ছড়ায় ছড়ায় বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
কবিতা: ০১ থেকে ৫৭
মণীন্দ্র রায়
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
মনের মধ্যে আবেগ জমলে
- সইত না আর তর্ সে,
তারিখ দিয়ে লিখত বীরেন
দুঃখ এবং হর্ষে।
সেসব লেখার ছন্দে-মিলে
দীপ্ত সুখে বক্ষে নিলে
বুঝতে পারি বইছে কেমন
কাল বোশেখীর ঝড় সে।
কবিতা:০২
চিত্ত ঘোষ
চোখে রাগ মুখে হাসি
চোখে রাগ মুখে হাসি
ছিল এক সন্ন্যাসী
মস্তকে নেই জটা
হৃদয়ের মন্ত্রটা
হয়ে গেল গম্ভীরা
যেন মেঘ ডম্বরু।
হৃদয়ের খুব কাছে
সে-দরাজ গান বাজে
আকাশের চূড়া থেকে
বিচ্যুৎ জ্বালে মেঘে সেই মেঘ
পর্বতই গলে হয়ে গেল নদী।
কবিতা:০৩
রাণা বসু
একটি প্রিয় নাম
স্পষ্ট কথা লিখতে যিনি
করতেন না দ্বিধা
ফন্দি-ফিকির জানতেন
না চলতেন পথ সিধা,
না ছিল জামা-কাপড়ের বাহার
দিনে-রাতে স্বল্প আহার,
দশের ভালোয় হাত মেলাতেন
এমন কবি কে?
-বীরেন চাটুজ্জে।
একটি প্রিয় নাম:
বীরেন চাটুজ্জে দু-হাত
দিয়ে সরিয়ে আঁধার আলো
দেখাতেন তিনি। আমরা তাঁকে চিনি,
পথ হাঁটছেন চোখে পড়লেই
আপন হতেন যিনি ।
কবিতা:০৪
মনোরমা সিংহরায়
উলুখড়
ছড়া লিখতে উলুখড়
এতোই ছিলেন দড় কাব্য
ছাড়া, ছড়াই তাঁকে করে তুলছে বড়।
উলুখড়কে বলো আমরা ভুলবো
কেমন করে, ভেবে তাঁকে
বাংলা মায়ের অশ্রু পড়ে ঝরে।
উঙ্গখড়-বীরেন্দ্র
চট্টোপাধ্যায়ের ছদ্মনাম।
কবিতা:০৫
ধীরেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্মরণে
এক হাতে তার কুঠার ছিল
আরেক হাতে ফুল
আঘাত ক’রে কখনো
বা ধরিয়ে দিত ভুল
কখনো বা আলিঙ্গনে
হৃদয় খুলে ধরে
বিশ্বাসে আর ভালোবাসায়
দিয়েছে বুক ভ’রে
মিথ্যা মানুষ সত্য মানুষ হু’স
পেয়েছে ফিরে
প্রীতির জালে সবাইকে
সে রেখেছিল ঘিরে।
আমরা তারই কথায় বারে
বারেই জেগে উঠি আনন্দে আর ব্যাথায়
কবিতা:০৬
শংকরানন্দ মুখোপাধ্যায়
কবিকে চিঠি
(রবীন্দ্র পুরস্কার প্রাপ্তিতে)
সব সময়ে একাই লড়েন
বীরেন্দ্র চট্টো নেই ক তাঁর
ঢাক দামামা পোষাক খট্টো মট্রো
উস্কো-চুলে ঝাল চানাচুর
ফুচকা-মুড়ি খাদ্য হুইস্কি-বিয়ার
নাই জানলেন কবির মধ্যে আছা
পুরস্কারের জগৎ থেকে
কুপা করলেন মা ষষ্ঠী
সবাই যখন বুড়িয়ে গেল
তিনি তখন বাষট্টি
এই তরুণকে ছ্যাখরে
তোরা এই তরুণের হার্ড।
অপরিসীম মনের ধনে কেমন সে ধনাঢ্য
কবিতা:০৭
অমরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
ছড়া
দু’জন ছিলেন ঢাকুরিয়ায়-
শিল্পী সীতেশ রায়,
অন্য জনের নাম কবি
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়…
রাম লক্ষ্মণ কোথায় গেলেন?
ভরত অযোধ্যায়;
তাঁরা আছেন থাকবেন কর্মে
প্রেমে পবিত্রতায়,
তোমার অপেক্ষায়।
কবিতা:০৮
কৃষ্ণানন্দ দে
ক্ষতিপুরণ
আকাশে আজও ভাতের
গন্ধ ঝুপড়ি ঘিরে জীবনমরণ,
থামলো হঠাৎ বুকের স্পন্দ
কবির সংঘে রক্তক্ষরণ।
মাটির শিকড় হাত পা মেলে
দাঁড়ায় জীবন-সন্ধ্যাকূলে,
ভোরের আলোয় শপথ
ভাসে নতুন পাতার বইটি খুলে।
রইলো এখন হিসাব খাতায় সব
দেওয়া আজ চাওয়ার হাতে,
বুকজ্বলা এই বিয়োগ ফলে
দীপক রাগের মন্ত্রণাতে।
কবিতা:০৯
সাধনা মুখোপাধ্যায়
যজ্ঞের ঘোড়া
দুরন্ত জীবনের মিছিলে মিছিলে
তুমি শুধু অফুরন্ত ছিলে ট্রাম
থামে বাস থামে ক’লকাতা হয়
শিহরিতা তুমি শুধু লিখে যাও
রাণর জন্মে বেঁচে থাকবার
এক অমোঘ কবিতা
মুখে যদি রক্ত ওঠে পৃথিবী
ঘুরছে তবু আরও ঘুরবেই
আমার যজ্ঞের ঘোড়া
অশ্বমেধের বেঁধে যদি
রাখি তবে রাখব
তোমার খু’টিতেই
কবিতা:১০
মলয়শঙ্কর দাশগুপ্ত
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
বলতেন সোজা চলতেন সোজা
ছিল নাকো ঢাকাঢাকি যা কিছু
মলিন ছুড়ে ফেলেছেন
ছিল নাকো রাখারাখি।
বুক ভরা তাঁর ছিল ভালোবাসা
শুধু মানুষেরই জন্মা,
কবির দু’ চোখে প্রেরণা
মানুষ মনুষ্যত্ব ধন্য।
কবিতা:১১
বিপুল চক্রবর্তী
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে মনে রেখে
১. কেউ বলে ফুল তাকে কেউ বলে ফুল্ল্কি
কোনোটাই ভুল কি?
বলুক তা গুণীজন, বলবে বিপুল কি।
২. কেউ বলে ফুল তাকে কেউ বলে ফুল্কি-
আমি নেই ও ভীড়ে নদী ঠিক কি রকম,
জানে তার কুল কি? যেতে চাই গভীরে।
কবিতা:১২
অনিল বস্তু
বীরেনদা
শঠের মুখে চুনকালি,
নাম ধ’রে সব দেয় গালি,
লোকটা বোধহয় নকশালী,
তরুনকে দেয় হাততালি!
হাসেন বসে বীরেনদা
কবিরা কি কাকের ছা?
ছৌ
চোখের জল মুখোশ বেয়ে
গড়ায় মঞ্চ ভ’রে বসে আছেন
পুরুলিয়ার ছৌ,
কোমর বেঁধে ভাষণ দিয়ে মণি
-মুক্তো ছড়ায়, কত শ্রমের চাক
ভেঙ্গে আজ ভালুকে খায় মৌ।
স্পষ্ট মুখে সুখ-দুঃখের খেলা
নিতেন তাদের বুকের ভিতর
বীরেন চাটুজ্জে, স্মরণ সভায়
আজ মুখোশের মেলা ধূপ-ধূনা
দেয় সাড়ম্বরে আজকে ঠেকায় কে?
কবিতা:১৩
ধীমান দাশগুপ্ত
তাঁর মনুষ্যত্ব
জল থেকে তুলে নিয়ে
পাতা ও-জলেই ভাসিয়েছো তা।
তাঁর মনে জল ছিল কাছে
সে-জলে গন্ধ লেগে আছে!
তাঁর কাব্যজগৎ
শঙ্কর কি ভিখিরি পার্বতীর
দোরগোড়ায় ভিক্ষাচ্ছলে
দাঁড়ান তিনি বিশ্বজনের বুক জুড়ায়।
কবিতা:১৪
মতি মুখোপাধ্যায়
রাজেন্দ্রাণী (তামার কবিতা
জেনে ছিলে অন্ন প্রাণ অম্ল-ই সবিতা,
বায়ুভুক ব্যক্তিগত লেখোনি কবিতা।
উজ্জল সত্যের সূর্য কে পারে সহিতে?
সদরে দিয়েছো টোকা যাওনি গলিতে।
দেড়লাখী ফ্ল্যাট নয় ছিল যা গোপন,
কয়েক হাজার বীজ মাটিতে রোপণ।
রাজবাড়ি যায় নি সে হয়নি পতিতা,
তবু সে-ই রাজেন্দ্রাণী তোমার কবিতা।
কবিতা:১৫
প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্মরণীয়েমু
লখীন্দর, আর ক্লান্ত ওফেলিয়া তুমিই
যেন তোড়ায় বেঁধেছিলে- ভাতের গন্ধ
বাতাস জুড়ে, উড়ছে পাখি নীলে।
মানুষ কেন কেঁদে ওঠে কেন বা
কারায় তুমি তোমার মতন ক’রে
বুঝতে চেয়েছিলে- যখন নিলে বিদায়
তখনো তোমার অনুরাগী তোমার
কবিতাকে শাণ দিয়ে বা প্রাণ দিয়ে নেয়,
চায় অখণ্ড সত্তাকে।
কবিতা:১৬
পবিত্র সরকার
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
বুকে জ্বলত আগুন,
চোখের পাতায় থাকত জল,
লড়াই করার অস্ত্র-
সে ওই কলমটি সম্বল।
ঝলসে উঠত ওই কলমের ফলা,
তারই আগুন ছোয় গিয়ে তার গলা,
কখন করে অঙ্গার তাঁর প্রশ্বাস,
ফুসফুস; নপুংসকের মেলায়
সে এক আগ্নেয় পৌরুষ-
ছিলেন তিনি-বীরেন চট্টোপাধ্যায়।
মৃত্যু কি আর তাঁর স্মৃতিতে হাত দেয়?
কবিতা:১৭
পবিত্র মুখোপাধ্যায়
সেই কবি
টুপটাপ ঝুপঝাপ বৃষ্টি;
তোমাদের পড়েছে কি দৃষ্টি?
রুখু চুলে ঝোলা কাঁধে কবি
আর আমাদের মধ্যে কবিতা
ও গদ্যে কাঁধে হাত রেখে হাঁটছেন না
ভালোবাসা ছিলো যতো,
ঘেন্না ততোখানি ছিলো তাঁর!
শত্রু- মানুষের যারা এই সমাজে
কি কথায় কি কাজে
তিনি তাঁর দুশমণ;
আজ তাঁর
ঝোলা আর ছেঁড়া চটি ফেলে
রেখে নির্ভার খুশমন কোথাও
আছেন তিনি লুকিয়ে, ডাকলেই
আসবেন, খুকৃষ্ণ কাশবেন,
সিগারেটে দিয়ে টান
বলবেন-পদ্ম এই নিন।
সেই দিন
নেই আর! কোথাও
গেছেন না কি ভ্রমণে?
হয়তো, নয়তো রয়েছেন
আমাদেরই মধ্যে গছ্যে ও পছ্যে
কবিতা:১৮
বিনয় মজুমদার
বীরেন চট্টোপাধ্যায়
যাত্রা কোম্পানী নট্ট বাদ
ছ্যায় কবিকে বীরেন চট্টোপাধ্যায়।
কাংরাপানি আমি হে শূলপানি
দ্যাখ ভবীকে ভুলবে না দেখি যে
বীরেনের বইতে ভরেছে র্যাক।
কবিতা:১৯
মণিভূষণ ভট্টাচার্য
নির্মান
মরা নদীখাতে জ্যোৎস্না নেমেছে,
অর্ধেক চাঁদ একা, চোখে ঘুম নেই,
স্বপ্নও নেই, গতিহীন বিস্ময়,
চারদিক ঘিরে নেমে আসে
শুধু রাত্রির রূপরেখা- আকাশে
জমেছে হালকা কুয়াশা, নিরন্ন লোকালয়।
প্রান্তর-ভরা আয়োজন ছিলো হালকা চন্দ্রালোকে
– পাহাড়ের উচু শিখরে জ্বলছে প্রৌঢ় বৃহস্পতি,
জোনাকির দল জ্বলে আর নেবে গূঢ় অজ্ঞাত শোকে-
রাতের উপোষে পাশাপাশি জাগে পাড়াগাঁর দম্পতি।
মজানদী ভরা বালি বুকে নিয়ে শুয়ে আছে সারারাত,
পাথরে পাথরে গতির ছন্দ পাহাড়ের কাছে শেখা,
উল্কা ঝরানো রাত্রির নিচে বিছাৎসম্পাত-
নিজের রূপেই পুড়ে গেছে আজ মধ্যরাত্রি একা।
দূর থেকে দূরে জলের শব্দ, ভেসে আসে খুব ক্ষীণ,
আর কেউ নয়, মানুষই চেয়েছে সুগভীর লোকহিত,-
পাল তোলা ঢেউ নদীটির বুকে নেচে যাবে সারাদিন,
শহীদের হাড়ে সূচিত সময় গড়া হবে নিশ্চিত।
কবিতা:২০
সামসুল হক
বীরেনদ।
আটাশে জুন ডাবের জলে
ভিজিয়েছিলুম তোমার গলা
সমুদ্রকে ঢাললে কেন তখন
আমার চোখের তলায়
বাইরে কোথাও যাবার আগে
আমাকে ঠিক লিখতে চিঠি
এগারো জুলাই তারিখে হঠাৎ
কেন ভাঙলে রীতি
এবার থেকে আচ্ছা জব্দে
রাখবো আমার বুকের মধ্যে।
কবিতা:২১
জগন্নাথ বিশ্বাস
দুটি ছড়া
১
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কবিতার একটা অধ্যায়,
সময়ের একটা অংশ,
রক্তবীজের এক বংশ,
কার সাধ্য তাকে বাদ ছ্যায়।
২
বীরেনদাকে মনে হতো মুক্ত স্বাধীন বীর,
কাঁধে ঝোলা মিছিল মিটিং সর্বদা অস্থির।
তখন সবাই ঠিক চেনেনি,
আজকে এসো ঠিক জেনেনিই
কেমন মাপের মানুষ ছিলেন চট্টো বীরেনদির
কবিতা:২২
বাসুদেব দেব
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
ঐ যে বীরেন চাটুজ্জে মশাল
জ্বেলে অন্ধকারে একলা
পথে কি খুঁজছেন?
আত্মসুখী ঘুমের দেশে ডাক
শোনা যায় ‘জাগুন জাগুন’
স্তূপীকৃত ছাইয়ের মধ্যে
ফু দিয়ে কে জ্বালে আগুন
চান নি খেতাব পদ পদবী
হাড়-হাভাতে বামন রাজ্যে
উচু মাথা এক সে
কবি বীরেন্দ্রনাথ চাটুজ্জে
ক্ষুধার্ত ঐ শব্দগুলো
কেউ ভিখিরি কেউ বা
শুলো তাদের রণদীক্ষা
দিয়ে রক্তহাতে কে যুঝছেন?
কবিতা:২৩
দেবী প্রসাদ
বন্দ্যোপাধ্যায় বীরেনদ।
এই তো গমক গলায় সাড়া তুলে,
চলার পথে দরাজ দুয়োর খুলে
ছিলেন বীরেনদা।
পদ্ম বেঁধে-কোথাও সুবাস তোড়া,
কোথাও তাতে রাগের আগুন
পোড়া দিলেন বীরেনদা।
বন্ধু বলে সবার মুঠোয় মুঠো বাঁধতে,
যেন মুখ ভরে সুখ কুটো উড়ছে বীরেনদা-র।
শহর-গাঁয়ে যে পথ হাঁটেন,
ভিড় বান ডেকে যায়-ঢেউ
ছাপিয়ে শির উচ্চে বীরেনদা-র ।
কবিতা:২৪
বিনোদ বেরা
কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্মরণে
শ্রেষ্ঠ তিনি জ্যেষ্ঠ তিনি
এই পৃথিবী তাই গোটা রাজ্য
-কিন্তু সিংহাসনে লোভ ছিল
না একফোঁটা।
প্রভুত্ব তাঁর ঘৃণ্য ছিল বন্ধুত্বতে
আস্থা পথছিল তাঁর জনবহুল
বিজন ছিল রাস্তা।
কবিতা:২৫
সমীর রায়
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্মরণে
আমার ঘরে আলোর অভাব
তোমার ঘরে তাও টিন বাজিয়ে
মেহের আলি বলে, তফাৎ যাও!
আমার ঘরে আলোর অভাব
কোথায় যাব মা?
শব্দ প্রদীপ জ্বলছে ঘরে,
নেইতো বীরেনদা!
কবিতা:২৬
মোহিনীমোহন গঙ্গোপাধ্যায়
কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
কবির কবি তাঁর কবিতায়
চাবুক ওঠে নেচে-
সর্বহারার শিকল ছেঁড়ার
গান যে ওঠে বেজে।
ফুলের ভেতর আগুন
ছোটে আগুনে ফোটে ফুল-
তাঁর কবিতায় নদী
নাচায় তরঙ্গে দুইকূল।
ভুখা মানুষ শুথা মানুষ
গাইছে বাঁচার গান-
তাঁর কবিতায় গর্জে
ওঠে হাজার মেসিনগান
কবিতা:২৭
ভবানীপ্রসাদ মজুমদার
গণকবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
কবিতারা কথা বলে হাসে-কাঁদে
গায় বারোমাস কবিতার মাঠ ফুড়ে
উকি মারে লতাপাতা ঘাস!
কবিতার বাগানেতে খেলা করে
দুধ-সাদা কাশ কবিতার কুঁড়ে
ঘরে তবু কারা করে পরিহাস?
কবিতারা মাঝে মাঝে বিলকুল
বল্লায় সাজ প্রতিবাদে প্রতিরোধে
ভুলে যায় সব ভয় লাজ! কবিতাও
যুদ্ধ করে, শত্রুর বিরুদ্ধে হানে বাজ
কবিতারা মরে মারে,
একথা তো প্রমাণিত আজ !!
মানুষের কবি তিনি থাকতেন
পাশে সুখে-দুখে মানুষের বিপদেতে
মাথা তুলে দাঁড়াতেন রুখে! অমলিন
হাসিখানি আটকানো থাকতোই মুখে
গণকবি বীরেনদা চিরকাল থাকবেন বুকে !!
কবিতা:২৮
সাগর চক্রবর্তী
ছড়ার মধ্যে তাঁকে
তিনি এখন দূরে বহুদূরে
হাতটা আমার হাওয়ার
রাজ্য ঘুরে ধুকতে ধুকতে
যেই নেমেছে, বই পাতায়
পাতায় তিনি আছেন;
দূরে গেছেন কই।
কবিতা:২৯
অমল চক্রবর্তী
লোকটা
তিনি ছিলেন নেহাতই এক
লোকটা বাড়তি শুধু অসাধারণ
চোখটা নইলে যেমন তেমন
সিধে পোষাকে তিনি ছিলেন
এক্কেবারেই লোকটা
চোখটা নিয়েই লোকটা ছিলেন
ব্যস্ত দেখার নেশায় তুচ্ছ ছিল
রেস্ত ভেতর থেকে নতুন করে
দেখাতে দেখতে দেখতে হতেন কেমন মস্ত
কাঁধের ঝোলায় থাকত কেবল
পছা ঐ নিয়ে কম হয়নি তো
হাড়হদ্দ তবুও হার মানেন নি
কক্ষনো পদ্য নিয়েই জেদী ছিলেন বড্ড।
এত্ত টুকুন ফুসফুসে কী ঝড়টাই বুনে
গেলেন সেটা তো নয় ঠাট্টাই আমরা
কি তার খানিকটুকু পারবো না কি
শুধুই চালাবো বাড়ফাট্টাই
কবিতা:৩০
হিমাংশু জানা
আমার কাছে
যে যা খুশি বলুক
তাঁকে বাম বা ডাইন বর্গীয়,
দিতেন না লাই ছলাকলায়
দরাজ মন আর দরাজ গলায়
ছিলেন তিনি আমার কাছে
তুলনাহীন, স্বর্গীয়।
কবিতা:৩১
রবীন শুর
তিনি
‘অন্যরকম ছিলেন তিনি।
পছদ্মবেচ! চাঁদনিচকে
ছিল না তার ফড়ের বিকিকিনি!
যা ভাবতেন তাই লিখতেন,
অঙ্ককষা ভিজে বেড়াল
জোঁকের মুখে শুন ছড়াতেন।
যে টেনেছে নিজের কোলে ঝোল,
কবিতা তার বাঘা তেঁতুল- জব্দ বুনো ওল!
কবিতা:৩২
জীবন গঙ্গোপাধ্যায়
ঋণ
শিশুদের ভালোবাসতেন তিনি
তাই ছিল তাঁর উদ্বেগ।
মুখোশেরা যত বিষ ঢেলে যায়
-সেই ঋণ কারা শুধবে?
কবিতা:৩৩
অমিতাভ দাস
মানুষ বীরেন চাটুজ্জে
মানুষ ছিলেন বড়ো মাপের,
মানুষ মহাকাব্য লিখেছিলেন
সারাজীবন হৃদয় ছিলো নাব্য;
চোখের জলে ভাববো
অমানবিক ঘোর তমশায়
সারাজীবন ক্ষুব্ধ,
লড়তে লড়তে চিরবিদায়
আলোর জন্যে যুদ্ধ;
মানুষ শুচিশুদ্ধ ॥
কবিতা:৩৪
পান্নালাল মল্লিক
বীরেনদা
১
সেদিন কবি ছিলেন বলেই
মুখ ছিল মুখর হয়েই
শোষণ তোষণ ভাবতে গেলেই
শাসন ছিল মুখের উপর কৃপাণ
ছিল অকৃপণ।
২
সেদিন কবি ছিলেন বলেই।
সুখ ছিল বুকের মাঝে দুঃখ
ছিল আন বাড়ী কলম ছিল ঠোঁট কাটা।
দেশ জুড়ে নেতার লেজুড়
খাবলা কাটে তত্ত ভাতে,
ভাত নেই ভাতের গন্ধে
ঘুরছে মান য হরদম দিল্লী
থেকে দমদম।
কবিতা:৩৫
মৃণাল চক্রবর্তী
বুকের মাঝে
আছেন তিনি বুকের
মাঝে আছেন স্থলে
জলে আঁধার ঘরে তাঁর
কবিতা লক্ষ পিদিম জ্বালে।
কবিতা:৩৬
জয়ন্তী চট্টোপাধ্যায়
বীরেনদার জন্যে
খবর আসে খবর আসে
কতরকম কি এমন
খবর এমন সময়
ভাবতে পারি নি।
হারায় কত হারায়
কি সব হারায় কত
কি হারিয়ে গিয়ে কেউ
তো এমন হৃদয় খোঁড়েন নি।
হারিয়ে গ্যাছেন আছেন তবু
মনের আকাশে আপনাকে
ছুই আপনাকে পাই গভীর বিশ্বাসে।
কবিতা:৩৭
জয়ন্তী চট্টোপাধ্যায়
তিনি নেই
সময়কে ভারী করে
ঘন অন্ধকার মানুষের
মুখর মুখে চাপিয়েছে পা-
কেন বা পিছনে চাই মিছিমিছি!
মুখর হতেন যিনি তিনি নেই?
না।
কবিতা:৩৮
নরেশচন্দ্র দাস
অতুলনীয়
দৃষ্টি কাড়ে সৃষ্টি তোমার
আঁধার ঘরে অগ্নিকণা
মানবতার প্রতীক তুমি
তুমিই তোমার ঠিক তুলনা।
কবিতা:৩৯
কাজল চক্রবর্তী
তিনি
সব ছবি তাঁর একে একে
খোলসা হলো ছবি তো
নয় মুখোসগুলো
যেই তিনি সেই মুখোশ-
কথা লিখতে গেলেন
ব্যাধি তাঁকে বুকের
ভেতর টেনে নিলো
নিজেই তিনি ছবি হলেন।
কবিতা:৪০
রত্নাংশু বর্গী
বীরেনদা যা বলেছেন
কেউ প্রেমে পড়ে আর
কেউ প্রেম করে একটা
হল সৃষ্টি আর একটা
নির্মান-বুঝলি শ্রীমান?
সত্যি কথা বলিস নিজের
কথাই বলিস চলিস মাটির
পথে শিকড়মুখী রথে।
কবিতা:৪১
সুখেন বিশ্বাস
শ্রদ্ধাস্পদেষু বীরেনদাকে
বুভুক্ষু ঐ মানুষগুলোর
যন্ত্রণাটা কিসের-
ভাবনাটাকে ভাবলে
একাই কাল কেউটের বিষের।
কাব্যে শেষে আঁকলে বসে-
আঘাত করা চাই, থাকতে
তুমি শিখল না কেউ
বিধছে বুকে তাই।
কবিতা:৪২
অতীন্দ্র মজুমদার
তুড়তুড়ির জন্য
তুড়তুড়ি রে, তুড়তুড়ি-
যে আসে তোর কাছে রে
তোর ছই গালে দেয় চুমকুড়ি
তুড়তুড়ি রে, তুডুতুড়ি।
চুমকুড়িতে তাতায় তোকে
মাতায় তোকে রাত্রিদিন,
তাতের চোটে পি. এফ
থেকে দরাজ হাতে করিস ঋণ।
ডাকিস সভা, বসাস মেলা,
স্পষ্ট ভাষায় উচ্চারণ,
তোর পিঠেতেই হেলান দিয়ে
সভাপতির সম্ভাষণ হায় রে কলি,
কারে বলি, সভার শেষে তুড়তুড়ি,
অন্য সবাই খাচ্ছে পায়েস,
তোর ভাতেতেই নেই লবন ॥
কবিতা:৪৩
নির্মল বসাক
বীরেনদা
মানুষ ছিলেন কথার
দামের এবং রক্ত
এবং ঘামের থোরাই
কেয়ার ট্র্যাফিক
জ্যামের ভীড়টি
ঠেলে ঠিক সময়ে
ইষ্টিশনে দিতেন পা
হাস্যমুখে উচ্চকিত
সে লোকটিই বীরেনদা
কবিতা:৪৪
মুকুলদেব ঠাকুর
বীরেনদা
এই যে কবি অমল,
নীরব, পবিত্র-
এই যে ছবি সরলতায় অনন্ত:
এর কাছে কি অর্থ কোন পরীক্ষা?
বাঁধনহারা, অলৌকিক এ, দুরন্ত।
কবিতা:৪৫
মুকুলদেব ঠাকুর
দেখেছিলাম তাঁকেই আমি
দেখেছিলাম তাঁকেই আমি
বইমেলাতে তরুণকবির
কাঁধের ওপর নির্ভরতায়
চাপিয়ে বয়স মেতেছিলেন
সেই খেলাতে: যাতে প্রাণের
উন্মাদনা আগুন ছড়ায়।
দেখেছিলাম তাঁকেই আমি
অনুষ্ঠানে- সব মানুষের
শেষে যিনি আসন খুঁজে
বসেই মুখর হোতেন মুখের
গল্পে-গানে এবং অনুভবের
দৃশ্যে দু’চোখ বুজে।
আজকে তিনি জেগে আছেন
সবার মনে, একটি বছর আগে
পেলেন অমল চিতা:
পরিব্রাজক দুই পা আজো
অন্বেষণে, মায়ার চোখে ঘুরে
বেড়ায় কবির পিতা।
দেখেছিলাম তাঁকেই আমি
ঢাকুরিয়ায়: উচ্চকিত কণ্ঠে
প্রতিবাদের ভাষায়।
কবিতা:৪৬
অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
বীরেন্দ্র
যাঁর
নীরেন্দ্র
বুকের ভেতর তিনি আমাদের
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
সে-নীর মানে
চোখের জল
দুঃখ যখন
জগদ্দল
তখন তিনি
হাস্যমুখে
নিলেন সবার দায়।
কষ্ট করার ক্ষেমেন্দ্র এই না
হ’লে বীরেন্দ্র
কবিতা:৪৭
অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
দিনে-রাতে
দিন চলে যায়
দিনের মতো
রাত টুকটুক করে।
ঠিক তখনি ‘রানর জন্য’
কাব্য মনে পড়ে।
রাত সরে যায় রাতের
মতো সূর্য যখন ওঠে ঠিক
তখনি ‘গ্রহচ্যুত’র কাব্য
মনে ফোটে।
কবিতা:৪৮
প্রশান্ত ভট্টাচার্য
তোমার জন্মদিন
তোমার,
প্রতিদিন জন্মদিন প্রতিদিন জাগা
প্রতিদিন প্রতীক্ষায় পথ চেয়ে থাকা।
প্রতিদিন জন্মদিন, ঘরে নয়,
পথে মিছিলের পতাকায় স্বপ্ন যায় ব্রতে!
প্রতিদিন জন্মদিন, মৃত্যু পেরিয়ে মৃত্যু
পেরিয়ে যাও সামনে এগিয়ে!
(আজ) আবার আরম্ভ এক,
নতুন লড়াই প্রতিদিন জন্মদিন,
প্রতিদিন তাই!
কবিতা:৪৯
পুলকেন্দু সিংহ
কবিকে
যেখানে শাসন, যেখানে শোষণ
যেখানে ক্ষুধার যন্ত্রণা।
সেখানে তোমার শাণিত
কবিতা এনেছে বাঁচার মন্ত্রণা।
যে কবি মিশেছে মিছিলের সাথে
কবিতার স্বাদ ঘামে ভেজা
যে কবি আমায় ছাড়েনি কখনো
যে কবি হয়নি কর্তাভজা।
বকেয়া পাওনা মিলেছে কিছুটা
কবির ধার কি মেটানো যায়
মহা উৎরাই
সামনে লড়াই এই গৌরবে প্রেরণা পাই।
কবিতা:৫০
ব্রত চক্রবর্তী
একটা দুটো বীরেন চট্টো
পদ্য যত খোলামেলা মানুষটা নয়
তেমন, দরজা বন্ধ জানলা খোলা
অনেক দেখি এমন।
কবি ভালো, মানুষ ভালো,
দু-দিকেতে দারুন;
সংখ্যা এদের নেহাৎ-ই
কম যত পারেন খুঁজুন।
একটা দুটো বীরেন চট্টো
হাজার খুঁজলে মেলে,
সদর অন্দর সব দেখা
যায় চৌকাঠে দাঁড়ালে॥
কবিতা:৫১
নিখিল তরফদার
তোঁমার স্মরণে
তোমার কথা পড়লে মনে
আজ আমাদের চোখের কোণে
জলের ধারা করে গো চিচিক্।
তোমার কীর্তি ছড়িয়ে আছে দেশটা জুড়ে।
সবার কাছে অমর হয়ে থাকবে তুমি ঠিক।
কবিতা:৫২
বাসুদেব কুণ্ডু
প্রিয় কবিকে
উচ্চশির শালপ্রাংশু,
নীল আকাশের পূর্ণ অংশু।
দীপ্ত তেজ মহীয়ান,
জনদরদী-মহাপ্রাণ।
শূণ্য বুকের পূর্ণ আশা
মূক মানুষের মুখের ভাষা।
নিঃস্বজনের আত্মজন,
সবলের দুঃশাসন।
পরাজিত তাই হবেই ইন্দ্র,
প্রণমি তোমারে কবি বীরেন্দ্র
কবিতা:৫৩
সত্যনারায়ণ মজুমদার
সে
শরীর জোড়া ক্ষয়ের
রোগ বুকে নিয়ে তীব্র
ক্রোধ তাঁর যজ্ঞের
ঘোড়া যায় দুরন্ত স্পর্ধায়।
কবিতা:৫৪
দ্বিজেন আচার্য
ইষ্টিশনে দাঁড়িয়ে আছি
কাদের বাড়ির পান-সুপারী
খেতে গেলি ইষ্টিকুটুম
কোন্ দেশেতে পাড়ি দিল
কু-ঝিক্ ঝিক্ রেলের গাড়ি?
কথন যে তুই ফিরবি বাড়ি-
ইষ্টিশনে দাঁড়িয়ে আছি
কবিতা:৫৫
অমলেন্দু বিশ্বাস
বীরেনদার জন্য এপিটাফ
দড়ি ছিড়ে পালিয়ে গ্যালো
কাছের মানুষ একটু আগুন
জমা রেখে অনাথ শিশুর।
এক চিলতে মেঘের ফাঁকে
তোমার আত্মগোপন এভাবে
গেলে হাসতে হাসতে কাঁদিয়ে মন।
ভয় নেইতো আগুন আছে বুকের
কাছে হাত সেঁকে নাও সে
যে আছে আশে পাশে।
কবিতা:৫৬
সুশান্ত বিশ্বাস
কবির জন্য ছড়া
টুপ টুপ টুপ, চোখের পানি
দাউদ মিয়ার ভাত জোটেনি।
মেঘুমালের অপু্যিরা সেবার
খরায় পড়ল মারা। শ্যাম
হাজরার ঘর যদি নাই বস্তি
হটান রাজা মশাই। দেশটা
নামেই প্রগতিশীল ভেতরে
তার টিউবাররুসিক্।
এ-সব কথা রাজনীতি
নয় জবাব দেবে জনগণই।
বলতে পারেন স্পর্ধা বুকে
যিনি ছিলেন সবার দুখে।
কবিতা:৫৭
শক্তিপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
তুমি আছে। লক্ষ বুকে
বুকের মধ্যে আগুন
আর লাল পলাশের ফাগুন,
দুয়ের মেল বন্ধন ক’রলে তুমি কবি।
অন্ধকারে জাগিয়ে
তোলো দ্বিপ্রহেরর রবি।
রক্তে তুলে বৈশাখী ঝড়
যখন গেলে চলে, তখন দেখি,
তুমি আছো লক্ষবুকে,
দুরন্ত মিছিলে।