ত্রাস
পৃষ্ঠা ১ থেকে ২০
পৃষ্ঠা-১
এক:- সেলুনে ঢোকার সময় পোস্টারটা দেখতে পেল সে। ব্যাটউইং দরজার একপাশে দেয়ালের সাথে সাঁটা, ইদানীং লাগানো হয়েছে। ল-অফিসের ওয়ান্টেড পোস্টারের মত হলদেটে বা মলিন নয় ওটা। বিষয়বস্তুও একটু ভিন্ন রকমের। থমকে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে, চোখ বুলাল লেখাগুলোয়। জেরেমি টাউন নামের শহরে একজন মার্শাল দরকার, বেতন আলোচনা সাপেক্ষ।
শহরটার কথা সে শুনেছে। মাত্র কয়েকদিন হলো ওটার জন্ম। পাহাড়ে সোনার সন্ধান পেয়েছিল খেয়ালী এক প্রসপেক্টর, সেই থেকে কয়েকদিনের মধ্যে গড়ে উঠেছে। চারপাশ থেকে লোকজন ছুটে গেছে ওখানে-কেউ সোনার আশায়, কেউ ব্যবসা করতে; তাদের সাথে খারাপ কিছু লোকও জুটেছে। এরকম খনি- শহরে খারাপ লোকেরাই জুড়ে বসে। সোনা এমন এক জিনিস যা মানুষের বিবেককে দমিয়ে রাখে-লোভ, ঈর্ষা আর অপরাধের জন্ম দেয়।
আরও শুনেছে স্যামুয়েল কিনকেড, কার্ট রক্স, শেইন থমসন সহ বেশ কয়েকজন কুখ্যাত লোক জেরেমি টাউনের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। ওরা সেখানে বসতি করতে বা সৎ উদ্দেশে যাচ্ছে না, অ্যারিজোনার এদিকের খবর যেসব লোক কিছু না কিছু রাখে তারা সবাই জানে এ সত্যটি। কিনকেড বা রক্সের মত লোকদের কাছ থেকে সততা বা ভদ্রতা আশা করা যায় না। যেটা ওদের পছন্দ হয় আপসে না পেলে কেড়ে নেয়, খুন করতেও পিছ-পা হয় না। যেখানেই আইনের হাত দুর্বল সেখানে জুড়ে বসে ওরা, জবরদখল আর লুঠপাট শেষে নতুন কোন শহর বা জনপদের উদ্দেশে ঘোড়া ছোটায়।
পোস্টারের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে দরজার দিকে এগোল সে। জেরেমি টাউনের কি হলো বা না-হলো তাতে কিছুই আসে-যায় না ওর। ব্যাটউইং দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ল আগন্তুক, অনুসন্ধানী দৃষ্টি চালাল সারা ঘরে। একপাশে দীর্ঘ বারের পেছনে দু’জন বারকীপকে দেখতে পেল। ছড়ানো-ছিটানো অনেকগুলো টেবিল-চেয়ার। দেয়ালের কোণে আয়না লাগানো, ইচ্ছে করলে সরাসরি না তাকিয়েও ঘরের যে কারও ওপর নজর রাখা যাবে। পাশে কাচের দেয়াল, লবিটা বার থেকে আলাদা করা। খাওয়ার ব্যবস্থা আছে ওখানে।
মাথা থেকে হ্যাট সরিয়ে চুলে আঙুল চালাল ও, বারের দিকে এগোল। লম্বা পথ পাড়ি দিয়েছে, সারা দিন চলার ফলে গলায় ধূলি আটকে খরখরে হয়ে আছে। চুপসে যাওয়া পেটের ব্যবস্থা করার আগে একটা ড্রিঙ্ক দরকার। গলাটা তাতে পরিষ্কার হবে। বারের সামনে টুলের সারির একটায় বসে হুইস্কির ফরমাশ দিল ও। ড্রিঙ্ক আসার পর চুমুক দিয়ে চারপাশে তাকাল আবার। একটা টেবিলে পোকার খেলা চলছে, কাছে দাঁড়িয়ে দেখছে দু’জন লোক। দুটো ভিন্ন টেবিলে
পৃষ্ঠা-২
বসে গলা ভেজাচ্ছে আরও পাঁচজন। ‘অনেক দূর থেকে এসেছ বোধহয়?’ হালকা সুরে জানতে চাইল এক বারকীপ। মৃদু নড করল সে। হুইস্কিতে আগ্রহ বেশি। ‘জেরেমি টাউনে যাচ্ছ নাকি?’ ‘তাই মনে হচ্ছে তোমার?’ ‘দক্ষিণ থেকে এসেছ তুমি। হয় এখানে থাকছ অথবা সামনে এগোবে। বিগ বে-র পর ট্রেইল তো একটাই, আর সেটা জেরেমি টাউনে গেছে।’ ‘আমি আরও দূরে যাব, পাহাড় ছাড়িয়ে।’ ‘ওদিকে বসতি আছে? কখনও শুনিনি তো!’ শেষ চুমুক দিয়ে বারের ওপর গ্লাস নামিয়ে রাখল আগন্তুক, পকেট থেকে খুচরো পয়সা বের করে বিল মেটাল। ‘নোটিশটা দেখেছ?’ উঠতে যাবে এ সময়ে জানতে চাইল বারকীপ। নড করল সে, চোখে প্রশ্ন ফুটে উঠেছে। ‘এ পর্যন্ত তিনজন মার্শাল নিয়োগ করেছে ওরা। দু’রাতের বেশি টিকতে পারেনি কেউ। থমসনের দলবল যেখানে আছে সেখানে কোন মার্শাল টিকে থাকে কেমন করে? নরক-গুলজার অবস্থা শহরটার। সন্ধ্যার পর হাঙ্গামা, গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। শুনলাম কিনকেডও রওনা দিয়েছে।’ ‘হয়তো।’ ‘তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে ওগুলো ভালই চালাতে পারো,’ পিস্তলের দিকে ইঙ্গিত করে বলল বারকীপ। ‘হয়তো ওখানে গেলে সমাদর পাবে।’ ‘আগ্রহ নেই,’ বলে দরজার দিকে এগোল আগন্তুক। পেছন থেকে ওকে দেখল বারকীপ, যুবকের নিস্পৃহ আচরণে অবাক হয়েছে। পশ্চিমে নতুন শহর যে কোন আগন্তুকের কাছে চ্যালেঞ্জ, ধাঁধা বিশেষ। বিগ বে থেকে জেরেমি টাউন তিন দিনের পথ, কিন্তু সব খবরই আসে এখানে। শহরটা সম্পর্কে দারুণ কৌতূহলী এখানকার সবাই, এমনকি বিগ বে-র বাসিন্দা নয় এমন লোকও। অথচ বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখায়নি আগন্তুক। দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া দীর্ঘ কাঠামোর দিকে তাকাল বারকীপ-সুঠাম পেশীবহুল শরীর, হাঁটার মধ্যে দৃঢ়তা প্রকাশ পাচ্ছে। সবার আগে অবশ্য উরুতে নিচু করে বাঁধা জোড়া পিস্তলের ওপর নজর পড়বে যে কারও। আলাদা দরজা দিয়ে আগন্তুককে লবিতে ঢুকতে দেখল সে। নির্লিপ্ত দেখাচ্ছে তাকে, কোন দিকেই তাকাচ্ছে না। ওঅশ বেসিনে হাত-মুখ ধুয়ে একটা টেবিলে বসে পড়ল, ওয়েট্রেস আসতে খাবারের ফরমাশ দিল। খাওয়ার দিকে ওর মনোযোগ দেখে বারকীপ ধারণা করল লোকটা বেশ ক্ষুধার্ত ছিল। আয়েশ করে খাচ্ছে সে। বাড়ি ফিরতে সবারই ভাল লাগে, ভাবছে আগন্তুক, তারও লাগছে। এবার অবশ্য দীর্ঘ সময় পর, প্রায় তিন বছর বাদে ফিরছে। শেষবার যখন এসেছিল, এই শহরটা ছিল একেবারে নতুন। কয়েকটা জীর্ণ শ্যাক, একটা সেলুন আর স্টোর ছিল শুরুতে। তিন বছরে বেশ বড় হয়ে উঠেছে বিগ বে। লোকের সমাগমও
পৃষ্ঠা-৩
ঘটেছে। টেবিলের ওপর ছাইদানিতে সিগারেট গুঁজে রাখার সময় দরজার দিকে ফিরে তাকাল সে, চল্লিশোর্ধ্ব এক লোক আর একটা মেয়ে ঢুকছে। পরনের কাপড়ে ধুলোর ছাপ, দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়ার কারণে চোখে মুখে ক্লান্তি। কিছুটা অধৈর্য দেখাচ্ছে লোকটিকে, চোখে অস্থির দৃষ্টি। হাত-মুখ ধুয়ে এসে বসল মেয়েটির উল্টোদিকে। তারপর ওয়েট্রেস কাছে যেতে খাবারের ফরমাশ দিল। মেয়েটির দিকে তাকাল আগন্তুক। দ্বিতীয়বার তাকানোর মত মেয়ে বটে! রূপ উপচে পড়ছে না তবে কমনীয় সৌন্দর্যের ক্ষুরণ ঘটেছে ওর মধ্যে। রঙজুলা মসৃণ ত্বক। লম্বা, আকর্ষণীয় ফিগার। বিষণ্ণ দেখাচ্ছে ওকে, হয়তো যাত্রার ক্লান্তির কারণে; কিংবা এতগুলো পুরুষের কৌতূহলী দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে পড়ায়, আয়ত নীল দুই চোখে অপ্রতিভ দৃষ্টি দেখে তাই মনে হলো আগন্তুকের। এ এলাকায় নতুন এসেছে ওরা, একরকম নিশ্চিত সে। হয়তো জেরেমি টাউনই ওদের গন্তব্য। ওয়েট্রেস পাশ দিয়ে যেতে আরেক কাপ কফির ফরমাশ দিল সে। কফি আসার পর চুমুক দিল, তারপর দরজায় চোখ পড়তে ক্ষীণ সতর্কতার ছাপ পড়ল ওর মুখে। যে লোকটা ঢুকছে তাকে চেনে, জেসি ওয়েন। লম্বা তাগড়া শরীর পাকানো দড়ির মতই মজবুত, পেশীবহুল। উরুর হোলস্টারে চকচকে বাঁটের জোড়া পিস্তল। লম্বা আঙুলগুলো সবসময় কোমরের কাছে থাকছে, এমনকি হাঁটার সময়েও। পিস্তলে দারুণ চালু জেসি ওয়েনের হাত, বিদ্যুৎ গতিতে ড্র করতে সক্ষম। নিশানাও নিপুণ। হাঁটার মধ্যে আত্মবিশ্বাস ঠিকরে পড়ছে। বেপরোয়া এবং উদ্ধত একটা ভাব আছে ওয়েনের মধ্যে, সহজে বোঝা যায় না। কাউকে পরোয়া করে না এ লোক। কারণও আছে। অ্যারিজোনার এ প্রান্তে প্রথম সারির বন্দুকবাজ হিসেবে তার খ্যাতি।
জেসি ওয়েন এখানে এসেছে কেন, প্রশ্নটা খোঁচাচ্ছে ওকে। জেরেমি টাউনে যাবে? এটাই স্বাভাবিক। চেহারা-সুরতে অবশ্য ওকে সাধারণ লোক বলে মনে হয়, কেউ ধরতে পারবে না বহু অপরাধের হোতা সে। সুদর্শন, বাকপটু; আচরণ আর পোশাকে ভদ্রলোক। স্বার্থ ছাড়া কোথাও যায় না সে, এবং এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি, ওয়েনকে যুবতী আর মাঝবয়সী লোকটার সঙ্গে যোগ দিতে দেখে ভাবল আগন্তুক। দেয়ালের আয়না থেকে চোখ সরিয়ে নিল ও। ওয়েন এদের কি ক্ষতি বা উপকার করল তাতে কিছুই আসে-যায় না ওর।
তবে এটা ঠিক, নিজের এলাকা ছেড়ে বহু দূর চলে এসেছে ওয়েন, এবং সচরাচর বড়সড় কোন লাভের আশায় থাকলে এতটা পথ পাড়ি দেয় সে। তাতে তোমার কি? নিজেকে শাসন করল আগন্তুক, শুধু শুধু অন্যের ব্যাপার নিয়ে ভাবছ। কারণটা নিজেই আবিষ্কার করল, আসলে বয়স্ক ভদ্রলোক আর ওই মেয়েটি যে ওয়েনের অসহায় শিকারে পরিণত হতে যাচ্ছে এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই ওর। হলফ করে বলতে পারবে এদের দুর্বলতার সুযোগ নেবে ওয়েন, হয়তো মেয়েটাকে পটিয়ে ফেলবে, কিংবা গোল্লায় যাক জেসি ওয়েন! লম্বা চুমুক দিয়ে কফি শেষ করল সে, তারপর বিল মিটিয়ে বেরিয়ে এল।
পৃষ্ঠা-৪
পোর্চে দাঁড়িয়ে চোখ কুঁচকে রাস্তার দিকে তাকাল ও। রৌদ্রোজ্জ্বল একটা দুপুর। দীর্ঘ রাস্তার কোথাও লোকজন দেখা যাচ্ছে না। রাস্তায় বেরিয়ে অযথা কে-ই বা গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদে সিদ্ধ হতে চায়! হিচিং রেইলে বাঁধা গ্রুলার দিকে এগোল আগন্তুক, লাগাম ছাড়িয়ে স্যাডলে চেপে বসল। হ্যাটের কার্নিস আরও নিচে নামিয়ে দিয়ে চোখ আর কপালকে রোদের আঁচ থেকে আড়াল করল সে, তারপর চওড়া বিধ্বস্ত রাস্তা ধরে পশ্চিমে এগোল। গুটি কয়েক দালান চোখে পড়ছে এদিকে, বেশিরভাগই আবাসিক বাড়ি। একটা গলির মুখে এসে পড়তে চোখে পড়ল ব্যাপারটা। অন্তত ছয়টা ওয়্যাগন দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার একপাশে, আশপাশে বেশ কিছু লোক দেখা যাচ্ছে, বাচ্চা আর মহিলাও আছে। অপেক্ষা করছে ওরা। হয়তো জেরেমি টাউনে যাচ্ছে এ দলটাও, ভাবল সে। ‘এই, ড্যান, দাঁড়াও!’ পেছন থেকে চেঁচাল কেউ। ঘোড়ার রাশ টানল ও, পেছনে ঘুরল।
বিশালদেহী এক লোক দৌড়ে আসছে। কাছে আসার পর দেখা গেল রীতিমত হাঁপাচ্ছে সে, নিঃশ্বাসের সাথে ওঠা-নামা করছে প্রশস্ত বুক। ঝকঝকে সাদা দাঁতের সবগুলো বেরিয়ে পড়ল হাসির সাথে। ‘কি খবর, ড্যান?’ নড করে ‘ভাল’ বোঝাতে চাইল আগন্তুক, নির্বিকার মুখে দেখল লোকটিকে। থলথলে মুখ, সর্বত্র চর্বির আধিক্য। লম্বায় ছয় ফুট হবে, চওড়ায়ও তেমনি। বিশালদেহী হ্যান্স কোবার্নকে চেনে সে। মন্টানার সোনা ব্যবসায়ী। হাসলে সুদর্শন দেখায় ওকে, ধূসর চোখ জোড়ায় বন্ধুত্বপূর্ণ চাহনি।
‘জেরেমিতে যাচ্ছি, বড়সড় একটা চালান আছে,’ নিজ থেকে বলল ব্যবসায়ী। ‘তোমাকে পেয়ে ভালই হলো। কে জানত যার খোঁজে দুনিয়া তোলপাড় করতে বাকি রেখেছি বিগ বে-তে এসে তাকেই পেয়ে যাব। আমার চিঠি পাওনি?’ মাথা নাড়ল ড্যান। ‘গত দু’মাস চলার মধ্যে আছি।’
‘অ। আর আমি কিনা ভেবেছি প্রস্তাবটা তোমার পছন্দ হয়নি।’ পায়ের ভর বদল করল সে। ‘এসো, আমার বাগিতে চলো, একসাথে পান করা যাক। বহু দিন পর দেখা হলো।’ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ড্যানকে দেখল সে, যুবকের মধ্যে কোন আগ্রহ আছে কিনা বোঝার চেষ্টা করছে। ‘তাছাড়া—আমরা বোধহয় ব্যবসা নিয়েও আলাপ করতে পারি, অন্তত আমার তাই ধারণা।’ ‘ওসব নিয়ে ভাবছি না আমি,’ নিস্পৃহ কণ্ঠে বলল ও। ‘রসো! না শুনেই খেপে যাচ্ছ কেন? আমি তো তোমাকে প্রস্তাব দেইনি এখনও। আগে তো আমার বাগিতে দশটা মিনিট কাটিয়ে যাও। মেরী আছে।’ ঘুরে উল্টোদিকে হাঁটতে শুরু করল সে। খানিক কি যেন ভাবল ড্যান, তারপর স্যাডল ত্যাগ করে ঘোড়ার লাগাম হাতে সোনা ব্যবসায়ীর পেছন পেছন এগোল। ষাট গজ দূরে প্রথম বাগিটাই হ্যান্স কোবার্নের। ওটার পেছনে এসে মিসেসকে ডাকল সে। পাটাতনে উঠে পর্দা সরিয়ে আহ্বান করল ড্যানকে। বাগির দেয়ালের আঙটার সঙ্গে ঘোড়াকে পিকেট করল ড্যান, তারপর ওপরে উঠে এল। ভেতরে অপরিসর জায়গা, কিন্তু তাতেই সংসার গুছিয়ে নিয়েছে ওরা।
পৃষ্ঠা-৫
দরকারী জিনিসপত্র সব গুছিয়ে রাখা, টুকিটাকি ছাড়াও একটা স্টোভ রয়েছে এক কোণে; মাঝখানে ছোট্ট একটা টেবিল, পাশে দুটো চেয়ার। মিসেস কোবার্নকে ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে টুপি খুলে নড করল ও। ক্ষীণ হাসল মহিলা, স্বামীর মতই স্বাস্থ্যবতী। হাসিখুশি। ‘অনেকদিন পর, তাই না, ড্যান?’ তোমাদের ওদিকে যাওয়া হয়নি ইদানীং,’ মাথা ঝাঁকিয়ে ব্যাখ্যা দিল সে। ‘ ‘আসলে ইচ্ছে হয়নি তোমার, চাপা স্বরে অভিযোগ করল মেরী কোবার্ন। কোণের অপরিসর জায়গায় থালা-বাটি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল, একটু পর দুটো থালায় আপেল-পাই পরিবেশন করল। ‘জেরেমিতে যাচ্ছ?’ জানতে চাইল ড্যান। চামচে করে অনেকটা পাই মুখে পুরেছে কোবার্ন, সেই অবস্থায় মাথা ঝাঁকাল। ঢোক গিলে খাবার চালান করে দিল পাকস্থলীতে, তারপর বলল, ‘চালানটা বেশ বড়সড়, প্রায় দুই লাখ ডলারের সোনা,’ থেমে হাতের চেটো দিয়ে মুখ মুছল সে, খেই ধরল এরপর: ‘আমার আশঙ্কা হচ্ছে হয়তো লুঠ করার চেষ্টা করবে কেউ। কাউন্টির সব খারাপ লোক গিয়ে জড়ো হয়েছে জেরেমি টাউনে—থমসন, কিনকেড, রক্স তো আছেই, শুনেছি নেইল ডেভিসও আস্তানা গেড়েছে শহরের আশপাশে। জানোই তো এমন সুযোগ কখনও ছাড়ে না ও। সেজন্যেই তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু উত্তর না পেয়ে ভাবলাম ইচ্ছে নেই তোমার।’ শূন্য থালা টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে সোনা ব্যবসায়ীর দিকে তাকাল ড্যান, আগ্রহের ছিটেফোঁটাও নেই ওর মুখে, একেবারেই নির্বিকার দেখাচ্ছে। ভেতরে ভেতরে দমে গেল হ্যান্স কোবার্ন, ভেবেছিল ওর বিপদের কথা শুনে কিছুটা হলেও নরম হবে সে। ‘টাকা ছড়ালে যোগ্য লোকের অভাব হয় না,’ দার্শনিক সুরে মন্তব্য করল ড্যান। ‘যোগ্য লোক? কিন্তু ড্যান, শুধু যোগ্য লোক হলে তো চলবে না, তাকে একইসঙ্গে বিশ্বস্তও হতে হবে। দুই লাখ ডলার চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। তোমার উত্তর না পেয়ে মন্টানা থেকে দু’জনকে ভাড়া করেছি, কিন্তু ওই যে বললাম, ওদের ওপর আস্থা বা বিশ্বাস কোনটাই রাখতে পারছি না।
‘তোমাকে পেলে নিশ্চিন্ত হতে পারতাম। ড্যানি লসন স্টেজগার্ডের দায়িত্বে থাকবে জানলে স্টেজ লুঠ করার আগে হাজারবার চিন্তা করবে রক্স বা কিনকেডরা। কিন্তু কি আর করা!’ অসহায় একটা ভঙ্গি করল সোনা ব্যবসায়ী, উঠে গিয়ে দেয়ালে ঝোলানো কাবার্ড থেকে হুইস্কির বোতল আর গ্লাস বের করল। পানীয় ঢেলে অফার করল লসনকে। ‘ব্যস্ত না থাকলে আমার কাজটা নিতে পারো, ড্যান। ফী নিয়ে তোমার সঙ্গে কখনও দু’কথা হয়নি আমার। যোগ্য লোকের কদর বুঝি আমি, সমাদরও করি।’ হুইস্কিতে চুমুক দিল ড্যানি লসন। ‘কিছুদিন হলো ছেড়ে দিয়েছি এসব, হ্যান্স। ঝামেলা বেশি এ কাজে।’
পৃষ্ঠা-৬
‘দুঃসংবাদ, অন্তত আমার জন্যে, বিরস মুখে মন্তব্য করল কোবার্ন। ‘জেরেমি টাউন তেতে আছে এখন। মেরীকে নিয়ে ওখানে যাওয়া বোধহয় ঠিক হচ্ছে না তোমার।’ ‘আমি এমনিতেই যেতাম। মেরী জেদ ধরল ও-ও আসবে, অগত্যা…’ কাঁধ উচিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকাল সে। ‘বরাবরই সাহস বেশি ওর। এমনকি আমার চেয়েও।’ ‘তবুও…শহরটার পরিস্থিতি ভাল নয়। এটা অবশ্য শোনা কথা।’ ‘বাদ দাও, যা হওয়ার হবে! তুমি যাচ্ছ কোথায়?’ ‘ওদিকেই।’ ‘তাহলে একসঙ্গেই যেতে পারি আমরা?’ ‘উঁহু, তোমাদের বোধহয় আরও দেরি হবে।’ ‘কাল সকালে রওনা দিচ্ছি আমরা। একদিন বিশ্রাম নেব এখানে।’ ‘ওরা কারা?’ বাইরের ওয়্যাগন সারির দিকে ইঙ্গিত করল লসন। ‘বিভিন্ন দিক থেকে এসেছে, বেশিরভাগই আনাড়ি লোক। কয়েকজন আছে পশ্চিমে একেবারে নতুন। সবাইকে গাইড করছে জেসি ওয়েন। আর লোক পেল না ওরা! স্বীকার করছি এরকম একটা রাইডের নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা আছে ওর, তবে ওকে বিশ্বাস করা কঠিন, এটাই হচ্ছে যত চিন্তার ব্যাপার।’ নীরবে হুইস্কিতে চুমুক দিল লসন । ‘লারকিন হাঁদাটা ওর যুবতী মেয়েকে নিয়ে এসেছে। বোকা আর কাকে বলে! এমন জায়গায় কেউ অমন সুন্দরী মেয়েকে নিয়ে যায়? সোনার স্বপ্নে বিভোর, জেরেমি টাউনে গিয়ে মাটি খুঁড়ে বস্তায় বস্তায় সোনা তুলবে! আরে বাবা, তোমার জন্যে কেউ বাকি রেখেছে কিছু? শহরের চৌহদ্দিতে যত জায়গা ছিল সবই ক্লেইম করে ফেলেছে লোকজন। জবরদখলের কয়েকটা ঘটনাও ঘটেছে। ব্যাটাকে বুড়ো আঙুল দেখাবে জেসি ওয়েন। এরই মধ্যে মেয়েটার পেছনে লেগেছে হারামজাদা।’ ‘যার সমস্যা তাকেই ভাবতে দাও,’ মৃদু অসন্তোষ প্রকাশ করল মেরী। ‘তোমার নিজেরই কম নেই এ মুহূর্তে।’ ‘ওদের জন্যে করুণা হচ্ছে। লারকিন আর ওর মেয়ে দু’জনেই পশ্চিমে নতুন। ওয়েন ওদের সর্বনাশ করে ছাড়লে একটুও অবাক হব না।’ ‘তুমি শুধু সমালোচনাই করছ, অভিযোগ করল মেরী। ‘পারলে ওদের সাহায্য করো, নইলে মুখ বন্ধ রাখো।’ ‘এদের সাথে ভিড়লে কিভাবে?’ প্রসঙ্গ পাল্টাল লসন। ‘ভেবে দেখলাম লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে, কখন কোন বিপদ আসে তার ঠিক আছে? সাথে লোকজন থাকলে মন্দ হয় না। এই দলটা তখন রেডরক থেকে রওনা দিচ্ছিল, ভিড়ে গেলাম ওদের সঙ্গে। এ জন্যে অবশ্য ওয়েনকে বিশ ডলার ফী দিতে হবে।’ মিসেস কোবার্নকে নড করে উঠে দাঁড়াল ড্যানি লসন, ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে এল বাইরে। প্রথমেই খেয়াল করল পেছনের ওয়্যাগনের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে দু’জন। নিরাসক্ত দৃষ্টিতে ওকে দেখল লোকগুলো, ওর পিস্তলের
পৃষ্ঠা-৭
ওপর নজর আটকে থাকল কয়েক সেকেন্ড, তারপর নিচু স্বরে নিজেদের মধ্যে গল্প জুড়ে দিল। ‘এরা?’ জানতে চাইল লসন। পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ব্যবসায়ী, আনমনে মাথা ঝাঁকাল। ‘বিশ্বাস করা যায় এমন লোক পাওয়া কঠিন, ড্যান।’ ‘তারমানে তুমি নিজেই ওদের বিশ্বাস করছ না?’ ‘একবিন্দুও না।’ ‘ওখানে কি প্রচুর সোনা পাওয়া গেছে?’ ‘বিস্তর। এতবড় খনির কথা আমি কখনও শুনিনি।’ ‘এবং ঝামেলাও বেশি হবে,’ মন্তব্য করল ও। ‘ দয়া করে প্রস্তাবটা ভেবে দেখবে ?’ অনুরোধ করল কোবার্ন। মাথায় টুপি চাপাল লসন, গ্রুলার বাঁধন খোলার সময় ফিরে তাকাল। সোনা ব্যবসায়ীর চোখে চোখ রেখে স্মিত হাসল, দেখা হওয়ার পর থেকে মানুষটাকে এই প্রথম হাসতে দেখছে হ্যান্স কোবার্ন। ‘তেমন কোন প্রস্তাব কি দিয়েছ আমাকে?’ ‘না, সরাসরি কোন প্রস্তাব দেইনি। তবে কাজটা কি, আর আমি কি চাই তুমি ঠিকই বুঝতে পেরেছ।’ ‘অন্য কেউ হলে সাফ না করে দিতাম, ওয়্যাগনের দরজায় এসে দাঁড়ানো মেরী কোবার্নের উদ্দেশে ক্ষীণ নড করল ও। ‘তবে তোমার কথা আলাদা। হয়তো ভেবে দেখব…তোমার চালান কবে রওনা দিচ্ছে?’ ‘পাঁচ দিন পর।’ ‘হয়তো জেরেমিতে দেখা হবে আবার,’ স্যাডলে চাপার সময় বলল লসন। হাঁটুর গুঁতোয় ঘোড়াকে এগোনোর নির্দেশ দিল। গলি ধরে এগোল গ্রুলাটা। পেছন থেকে তাকিয়ে থাকল স্বামী-স্ত্রী। মূল রাস্তায় উঠে ডানে মোড় নিতে আড়ালে পড়ে গেল ড্যানি লসনের অবয়ব। পাশ ফিরে ক্রুদের দিকে তাকাল ব্যবসায়ী। ‘লোকটা কে?’ জানতে চাইল এক ক্রু। ‘ওকে চেনার দরকার নেই তোমার,’ বিরক্ত স্বরে বলল হ্যান্স কোবার্ন। ‘নিজের চরকায় তেল দাও, বিল! আর এখানে বসে না থেকে ঘুরে-ফিরে খানিকটা খোঁজ-খবর নিলেও পারো। হয়তো পরে কাজে লাগতে পারে এমন কোন তথ্য পেয়ে যাবে।’
‘সেটা তোমাকে বলে দিতে হবে না,’ চাঁছাছোলা স্বরে উত্তর দিল বিল নামের ক্রু। ‘নিজের কাজ আমরা ভালই বুঝি। অযথা জ্ঞান দিতে এসো না। মি. কোবার্ন, জেরেমি টাউনে পৌঁছানোর পর আমাদের কাজ শুরু হবে। আপাতত আমরা বেকার। বুঝতে পারছ?’ ‘হয়তো তখন আর তোমাদের কাউকে প্রয়োজন হবে না আমার।’ ‘কি বললে?’ তীক্ষ্ণ স্বরে জানতে চাইল অন্যজন, অবাক হয়েছে। ‘তেমন কিছু না। বলেছি তোমাদের কাজ-কারবার পছন্দ হচ্ছে না আমার।
পৃষ্ঠা-৮
ঠিক করেছি জেরেমিতে গিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব। তখন হয়তো তোমাদের বিদায়ও করে দিতে পারি। তবে নিশ্চিন্ত থাকো, পাওনা ঠিকই পাবে।’ শীতল দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল বিল নিকোল। ‘এ কাজটা করতে পারবে না তুমি।’ ‘আমার যা ইচ্ছে করব, তোমাদের কি!’ ‘বেশ তো। চুক্তি অনুযায়ী টাকা পেলেই আমরা খুশি,’ বলল অন্যজন। ‘পাবে।’ বিল । ‘তুমি কি ওকে ভাড়া করার কথা ভাবছ নাকি?’ কৌতূহলী স্বরে জানতে চাইল ‘করলেই বা তোমার অসুবিধে কি?’ ‘আমাদের চেয়ে টাফ লোক নাকি, তোমার ভাব-চক্করে মনে হচ্ছে কেউকাটা কেউ?’ তাচ্ছিল্যের সাথে জানতে চাইল সে। ‘শুনে রাখো, বিল, ও হচ্ছে ড্যানি লসন। ভাল করে মাথায় ঢুকিয়ে নাও কথাটা-তোমার মত বিল নিকোলদের পাত্তা দেয় না ওই লোক।’ থমকে গেল বিল নিকোল, সতর্ক দৃষ্টি ফুটে উঠেছে চোখে। আনমনে একটা কাঁধ উঁচাল সে, তারপর সিগারেট ফেলে বুটের তলায় পিষল। ‘হতে পারে। তবে আগাম সবকিছু বলা যায় কি? কে বলতে পারে ওখানে মরতে যাচ্ছে না সে?’ প্রশ্নটা দ্বিধায় ফেলে দিল সোনা ব্যবসায়ীকে। কি যেন ভাবল সে, তারপর ক্ষীণ হাসল। ‘স্বপ্ন দেখছ নাকি, বিল? ওর মুখোমুখি দাঁড়াতে হলে আরও কয়েকজনের সাহায্য হয়তো দরকার পড়বে তোমার।’ ‘ কে জানে উল্টোটাও তো হতে পারে!’ নিকোলের উষ্মায় ভ্রূক্ষেপ করল না হ্যান্স কোবার্ন। ঘুরে ওয়্যাগনের ভেতরে ঢুকে পড়তে গিয়ে রাস্তায় চোখ পড়ল তার। দেখল ফিরে আসছে লারকিনরা, সঙ্গে জেসি ওয়েন। দাঁড়িয়ে থেকে ওদেরকে দেখল কোবার্ন। মেয়েটির পাশাপাশি হাঁটছে ওয়েন। সমানে মুখ চলছে তার।
‘তুমি বোধহয় ক্লান্ত, ম্যা’ম, ওয়্যাগনের কাছে আসতে বলল ওয়েন। ‘বিশ্রাম নাও। কোন দরকার হলে আমাকে একটা খবর দিয়ো শুধু, ঝটপট চলে আসব। তোমাদের সবাইকে জেরেমিতে পৌছে দেওয়ার দায়িত্ব যখন নিয়েছি, তখন নিশ্চিন্তে, আমার ওপর নির্ভর করতে পারো।’ ‘ধন্যবাদ, মি. ওয়েন,’ বলে ওয়্যাগনের ভেতর ঢুকে পড়ল মেয়েটি। নির্বিকার মুখে চারপাশে উৎসুক লোকদের দেখল জেসি ওয়েন, ক্ষণিকের জন্যে বিল নিকোল আর ওর সঙ্গীর ওপর থমকে গেল দৃষ্টি, তারপর দৃষ্টি ফিরিয়ে হ্যান্স কোবার্নের দিকে ফিরল। বিড়বিড় করে উইশ করল সে। ঘুরে ফিরতি পথে শহরের মূল অংশের দিকে এগোল। ভেতরে ঢুকে পর্দা নামিয়ে দিল হ্যান্স কোবার্ন। চুলোয় কি যেন বসিয়েছে মেরী। স্ত্রীর পাশে গিয়ে দাঁড়াল সে। ‘হারামজাদার ভাব দেখে মনে হচ্ছে দুনিয়াতে ওর চেয়ে ভদ্রলোক বুঝি আর দ্বিতীয়টি নেই,’ তপ্ত স্বরে অসন্তোষ প্রকাশ করল সোনা ব্যবসায়ী। ‘আরে, শয়তান, তোকে হাড়ে হাড়ে চিনি আমি।’
পৃষ্ঠা-৯
‘সবাইকে সতর্ক করা তোমার দায়িত্ব, হ্যান্স।’ ‘অন্তত একশো মাইল পাড়ি দিয়েছে ওরা, কোন ঝামেলা বা অঘটন ঘটেনি। সবার আস্থা অর্জন করেছে ওয়েন। ওর বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেলে আমাকে বিশ্বাস করবে না কেউ, ভাববে অযথাই ওর সমালোচনা করছি।’ ‘ড্যান কি কাজটা নেবে?’ ‘বোঝা যাচ্ছে না,’ চিন্তিত দেখাল কোবার্নকে। ‘ওর মতি-গতি বোঝা কঠিন। কি ভেবে যে কি করে বসে তার ঠিক নেই। ভাবছি জেরেমি টাউনে কেন যাচ্ছে ও। খুনে-বদমাশে ভর্তি হয়ে গেছে শহরটা। ওখানে ওর কোন কাজ থাকতে পারে না।’ কেন, ওয়্যাগনের লোকগুলো সবাই কি খারাপ?’ ‘ ‘আমি তা বোঝাতে চাইনি। ড্যানি লসন এমন এক মানুষ কিনকেড বা রক্সদের সাথে যার কখনও মিল খায় না। আলাদা পথের মানুষ ও। বরং ওই খুনী লোকগুলোর বিপক্ষেই ওকে ভাল মানায়। আরেকটা পক্ষ আমরা, নিরীহ কিছু উচ্চাকাঙ্ক্ষী লোক। এদের নিয়ে যত বিপদ, নিজেদের চামড়া বাঁচাতে জানি না, আর এ জন্যেই আমাদের ওপর চড়াও হওয়ার সুযোগ পেয়ে যায় কিনকেডরা।’ ‘ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে তুমি বোধহয় লারকিনদের কথা বোঝাতে চাইছ?’ ‘নিঃসন্দেহে।’ ‘বাদ দাও ওদের কথা। তোমার নিজের ঝামেলা কি কম?’ মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানাল সোনা ব্যবসায়ী। সোনার চালান, জেরেমি টাউনের ভবিষ্যৎ, নিজের ব্যবসা-দুশ্চিন্তার হাজারটা বিষয়! বিল নিকোল আর ওর সঙ্গীকে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করতে পারছে না, অথচ হাতের কাছে বিশ্বস্ত এবং যোগ্য তেমন কাউকে পায়নি। সোনার পরিমাণ বেশি হওয়ায় দুশ্চিন্তাও বেড়েছে ওর। নিরাপদে মন্টানায় পৌঁছবে তো সাপ্লাই, নাকি পথে লুঠ হয়ে যাবে? ড্যানি লসন গার্ডের দায়িত্বে থাকলে নিশ্চিন্ত বোধ করত ও। আগেও কোবার্নের হয়ে কাজ করেছে সে, ছোটখাট কিছু ঝামেলা হলেও প্রতিবারই গন্তব্যে পৌছেছে সাপ্লাই। বাগির বাইরে বেরিয়ে এল সে। সন্ধে পর্যন্ত কয়েকটা সেলুন আর বারে ঘোরাঘুরি করে কাটাল। লোকজনের কথা শুনে, আলাপ করে বোঝার চেষ্টা করল সাপ্লাইটা সম্পর্কে কি ভাবছে এরা। কিন্তু বিফল হতে হলো ওকে, সোনার চালান নয় বরং জেরেমি টাউনের ভবিষ্যৎ নিয়ে আগ্রহী সবাই। বাগিতে ফিরে এসে অবাক হলো ও, দেখল মেরীর সাথে আলাপ করছে লারকিনের মেয়েটা। স্বামীর সঙ্গে অতিথির পরিচয় করিয়ে দিল মেরী কোবার্ন। উঠে দাঁড়িয়ে নড করল জুলিয়া লারকিন, তারপর হাত বাড়িয়ে দিল সোনা ব্যবসায়ীর দিকে। ‘বোসো, প্লীজ, ম্যা’ম,’ অনুরোধ করল হ্যান্স কোবার্ন। ‘ধন্যবাদ।’ ‘একা থাকতে খারাপ লাগছিল ওর, স্বামীর উদ্দেশে ব্যাখ্যা দিল মেরী, তারপর জুলিয়ার দিকে ফিরল। ‘এখন থেকে যখন ইচ্ছে চলে আসবে, বুঝেছ,
পৃষ্ঠা-১০
জুলি?’ নড করল মেয়েটি,। ‘আমি এলে হয়তো তোমার কাজের ক্ষতি হবে।’ ‘নাহ্, তোমার সঙ্গ পেলে বরং ভালই লাগবে। হ্যান্স তো বেশিরভাগ সময় বাইরে থাকে। সময় কাটানো আমার জন্যেও সমস্যা।’ ‘পশ্চিমে এই প্রথম এসেছ তোমরা?’ জানতে চাইল কোবার্ন। ‘বাবা আগেও একবার এসেছিল। আমি কিন্তু একেবারে নতুন।’ ‘কেমন লাগছে? তোমাদের সনোরার পরিবেশ কিংবা জীবনযাত্রার চেয়ে এখানকার জীবন সম্পূর্ণ আলাদা।’ ‘অন্তত খারাপ লাগছে না,’ ক্লিষ্ট হেসে বলল জুলিয়া, ওর চোখের গভীরে দ্বিধা দেখে বোঝা গেল এ ব্যাপারে নিজেও নিশ্চিত নয়। ‘বিভিন্ন ধরনের মানুষ, এদের বোঝা কঠিন। সব জায়গায় রুক্ষতার ছোঁয়া। কিন্তু এর মধ্যেও কি যেন একটা আছে। পরিশ্রমী মানুষ দেখতে ভাল লাগে আমার।’ মেরী কফি পরিবেশন করতে কাপ তুলে নিয়ে চুমুক দিল ওরা। আরও দু’একটা সৌজন্যমূলক কথাবার্তা শেষে উঠে দাঁড়াল জুলিয়া, ধন্যবাদ জানাল দম্পতিকে। তারপর বাগি থেকে নেমে পড়ল। চলো, তোমাকে এগিয়ে দেই,’ বলে নেমে এল কোবার্ন। ‘ ‘মাত্র তো কয়েক গজ পথ। আমি একাই যেতে পারব।’ ‘নিশ্চয়ই পারবে। তবুও তোমাকে এগিয়ে দেয়া আমার কর্তব্য।’ মৃদু মাথা ঝাঁকাল মেয়েটা। ওয়্যাগন পেরিয়ে পরেরটার সামনে এসে থামল জুলিয়া। ‘ধন্যবাদ, মি. দুটো ,’ বলল ও। ‘ভেতরে এলে খুশি হব।’ কোবার্ন ‘অন্য কোন দিন।’ হেসে ফিরতি পথ ধরল সোনা ব্যবসায়ী। পরদিন সকালে জেরেমি টাউনের উদ্দেশে যাত্রা করল দলটা। একটা মাসট্যাঙে চড়ে গাইড করছে জেসি ওয়েন। রুক্ষ ট্রেইল ধরে এগিয়ে চলল ছয়টা ওয়্যাগন। ক্রমশ শ্লথ হয়ে এল গতি, চড়াই-উত্তাই পেরিয়ে এগোতে হচ্ছে। সামনে ধূসর প্রান্তরের বুক চিরে চলে গেছে ট্রেইল, সবুজের চিহ্ন তাতে কমই। দিগন্তের শেষ প্রান্তে আবছা ভাবে চোখে পড়ছে সুউচ্চ জারকান মাউন্টেন্সের অবয়ব। কাছে মনে হলেও যথেষ্ট দূরে ওটা। দিনের শেষে মাইল দশ এগোনোর পর যখন একটা শুকিয়ে যাওয়া ক্রীকের কাছে ক্যাম্প করল ক্লান্ত লোকগুলো, তখনও ওদের কাছে মনে হলো সারা দিনে একটুও এগোয়নি। জারকান পাহাড়শ্রেণীকে একই রকম লাগছে। আকারে হয়তো কিছুটা বড় দেখাচ্ছে এখন, কিন্তু খালি চোখে দেখে বোঝা কঠিন ঠিক কতটা দূরত্বে আছে। তবে এরা সবাই জানে পাহাড়ের কাছাকাছি তাদের গন্তব্য। জারকান মাউন্টেন্সের শুরুতেই গড়ে উঠেছে সোনার শহর জেরেমি টাউন। তবে হতাশ হলো না কেউ। ছয় দিন আগে যে স্বপ্ন বুকে নিয়ে মন্টানা থেকে যাত্রা শুরু করেছিল ওরা, তা বিলীন বা ম্লান হয়ে যায়নি; বরং আরও উজ্জ্বল হয়েছে, যেহেতু জানে দু’দিনের মধ্যে পৌঁছে যাবে স্বপ্নের শহরে। সেখানে যে কেউ ভাবেনি যে অনেক অনিশ্চয়তা এবং কঠিন সময় অপেক্ষা করছে, কেউ তা ভাবেনি। প্রতি রাতের মতো, মানুষ ঘুমিয়ে পড়ল তারার আকাশের দিকে বা ওয়াগনের ভিতরের গভীর অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে সোনা এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভেবে। কিন্তু কিছু লোকের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভিন্ন দৃষ্টি রয়েছে, তাদের মধ্যে জেসি ওয়েন একজন
পৃষ্ঠা-১১
দুই:- দুই দিন পরে, একটি রৌদ্রোজ্জ্বল বিকেলে, দলটি জেরেমি টাউনে পৌঁছেছিল। শহরটি পাহাড়ের উপর গড়ে উঠেছে। একদিকে নদীটি পাহাড় থেকে মাইলের পর মাইল উজান থেকে নেমে গেছে, উভয় তীরে জরাজীর্ণ খুপরি এবং তড়িঘড়ি করে কেবিন তৈরি করা হয়েছে। দাবি নদী ঘিরে। প্রথমত, ওয়াগনের যাত্রীরা কয়েকটি উইন্ডমিলকে কয়েক জনের মতো উঁচুতে দেখেছিলেন। লম্বা রাস্তার দুই পাশে ছোট ছোট দালান, কেবিন ও তাঁবুর লাইন। চুন-স্লারি ব্যবহার করা এড়িয়ে চলুন, আসলে কোনোটাই শক্তিশালী হয় না। এখানকার বাসিন্দারা জানেন যে জেরেমি টাউনের অস্তিত্বই অনিশ্চিত এবং প্রশ্নবিদ্ধ, কারণ প্রতিদিনই অনিশ্চয়তায় পূর্ণ; ঠিক সোনার মতো – কখন এবং কত সোনা দাবি করবে তা অনুমান করা অসম্ভব। তাই অল্প পরিশ্রমে দ্রুত বাড়ি তৈরি করা হয়। সর্বত্রই অযত্ন আর অবহেলার ছাপ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কয়েকটি ওয়াগন দেখা গেল, কেউ কেউ ভবন বা কেবিন তৈরির ঝামেলায় না গিয়ে অস্থায়ী দোকান-কাম-আবাসন হিসেবে ব্যবহার করছে। সব মিলিয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে এখানে অন্তত দুই শতাধিক মানুষের সমাগম দেখে বিস্মিত মানুষ। বিষয়টি তাদের একটু রাগান্বিত করেছে। এখানে এসে এমন ধার্মিক কাজ দেখার কথা কেউ ভাবেনি; আগে যারা এসেছে তাদের চোখে যে ঠান্ডা অভ্যর্থনা তারা দেখেছে, এবং কিছুটা অনিচ্ছার কথাও ভাবতে পারেনি তাদের। প্রথম ওয়াগন ট্রেইল ধূলিসাৎ করে সিড হ্যামারটনের জেনারেল স্টোরের সামনে থামার সময়, কৌতূহলী লোকের ভিড় চারপাশে জড়ো হয়েছিল। তারা কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষা করলো। জেসি ওয়েন, যিনি সবার সামনে ছিলেন, তার ক্লান্ত মুখে খুশির হাসি নিয়ে, স্যাডল ছেড়ে যেতে বিরক্ত করেননি, থেমে যাওয়া প্রথম ওয়াগনের পাশে এসে ঘোড়াটিকে থামিয়ে দেন। তারপর মুস্তাংয়ের মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে মোড় নিল, সে পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করল, একে একে সব ওয়াগন থেমে গেল। বাতাসে উড়ে যাওয়া ধুলোর অত্যাচার এড়াতে একপাশে সরে যান
পৃষ্ঠা-১২
এল ওয়েন। হ্যাট চালিয়ে উড়ন্ত ধুলো সরিয়ে দিল, তারপর পকেট থেকে দুমড়ানো একটা সিগার বের করল। সিগার ধরানোর ফাঁকে আড়চোখে একবার দেখে নিল কৌতূহলী জেরেমিবাসীদের। শেষ লোকটি নামা পর্যন্ত অপেক্ষা করল ওয়েন। ‘আমার সাথে এসো সবাই, জরুরী কথা আছে তোমাদের সঙ্গে। ওখানে,’ হাত উঁচিয়ে জেনারেল স্টোরের পাশের সেলুনটা দেখাল সে। ‘এই শহরে আমাদের সফল আগমন উপলক্ষে পান করব সবাই, আর…’ স্মিত হাসল সে। ‘আমাদের দেনা-পাওনা চুকিয়ে ফেলব।’ তাকে অনুসরণ করে এগোল কয়েকজন পুরুষ, ওয়েনের পেছন পেছন সেলুনে ঢুকে পড়ল।কামারের দোকানের পোর্চে দাঁড়িয়ে ছিল এক তরুণ আর বয়স্ক এক লোক। নিস্পৃহ দৃষ্টিতে এতক্ষণকার নাটক দেখছিল ওরা। অধৈর্য ভঙ্গিতে পায়ের ভর বদল করল তরুণ, সঙ্গীর দিকে ফিরে নিচু কণ্ঠে বিতৃষ্ণা প্রকাশ করল: ‘লোকটা কে, টিম? ভাব-চক্কর দেখে মনে হচ্ছে শহরটা যেন ওর!’ ‘জেসি ওয়েন,’ সংক্ষেপে জানাল টিম কার্টিস। ‘অ, মন্টানার সেই রকবাজ? বুঝলাম!’ উষ্মা প্রকাশ পেল তরুণের কণ্ঠে। ‘কিন্তু সঙ্গে এত লোক নিয়ে এসেছে কেন তা তো বুঝতে পারলাম না।’ ‘বেশি বোঝার চেষ্টা কোরো না, বব। জেসি ওয়েনের ব্যাপারে আগ্রহী না হলে আখেরে তোমারই লাভ হবে। মুখ বুজে দেখে যাও, নিজ থেকে কিছু জানতে চেয়ো না, ওর উদ্দেশ্য ঠিকই জেনে যাবে একসময়।’ কিন্তু এই লোকগুলো?’ ‘ ‘আর সবার মতই সোনার লোভে এসেছে ওরা।’ ওয়্যাগনের দিকে তাকিয়ে আছে রবার্ট অ্যালেন। জুলিয়া লারকিনকে দেখে চরম বিস্ময় বোধ করল, চোখ সরাতে পারছে না। ‘আরে, টিম! দেখো, একটা গোলাপও এসে জুটেছে দেখছি!’ চাপা স্বরে বলল সে। ‘বব, তোমার ছোঁকছোক করার অভ্যেসটা বাদ দাও তো!’ বিরক্ত হয়ে বলল কার্টিস। ‘নইলে শেষে পস্তাবে। ও হয়তো এমন কারও বউ বা মেয়ে যার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে তোমার বুক কেঁপে উঠবে।’ ‘সবকিছুতে খারাপ দিকটা আগে ভাবো তুমি,’ খানিকটা বিষণ্ণ সুরে অভিযোগ করল তরুণ। ‘এবং ভয় ধরিয়ে দেয়ার মত কথা বলো শুধু!’ ‘তোমার চেয়ে অনেক দেখেছি, বাছা। সামান্য একটা ভুল বা মুহূর্তের খেয়ালের জন্যে বহু লোককে মরতে দেখেছি আমি।’ ‘উফ, তোমার মাস্টারগিরি যে কবে বন্ধ হবে!” ‘নাক-কান বুজে শুনে নাও, তোমার এখন শেখার বয়স, বাছা।’ ‘আমি ভাবছি কিনকেড বা রক্সের কি প্রতিক্রিয়া হবে।’ ওয়্যাগনের আশপাশে অপেক্ষায় থাকা লোকজনকে দেখছে কার্টিস। তাদের ওপর থেকে চোখ না সরিয়ে অভ্যস্ত হাতে তামাক-কাগজ বের করে সিগারেট রোল করল, তারপর নখে দেয়াশলাইয়ের কাঠি ঘষে আগুন জ্বালাল। সিগারেট ধরিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ‘আমার তো মনে হয় খুশিই হবে ওরা।’
পৃষ্ঠা-১৩
‘কেন?’ ‘এখানে এমন লোকই চায় ওরা-নিরীহ, আনাড়ি এবং পশ্চিমে নতুন। জোর করতে গেলে বাধা দেওয়ার সাহস করবে না, কিংবা প্রতিরোধও করতে পারবে না। তাতে সহজ হয়ে যাবে ওদের কাজ।’ এদিকে সেলুনের ভেতরে, ততক্ষণে ছয়জন পুরুষের উদ্দেশে ছোটখাট একটা বক্তৃতা দিয়ে ফেলেছে জেসি ওয়েন। ‘আশা করি এখানে কোন ঝামেলায় জড়াবে না কেউ,’ শেষে উপসংহার টানল সে, ‘যার যার পছন্দ মত জায়গা বেছে নিয়ে ক্লেইম করতে পারো। তবে ভুলেও অন্যের ক্লেইমে যেয়ো না, কেউই সেটা পছন্দ করবে না। এখানে কিছু অর্জন করতে হলে তা শ্রম দিয়েই করতে হবে, এমনকি সোনা তোলার কাজটাও। নদীর কাছে গিয়ে দেখো, বেগার খাটছে ওরা। সারা দিনে হয়তো এক আউন্স সোনাও তুলতে পারেনি, কিন্তু পরদিন ঠিকই নতুন উদ্যমে শুরু করছে আবার। যাক্সে, এবার বিদায়ের পালা, আশা করি আমার পাওনা মেটাতে আপত্তি নেই কারও?’ থেমে হুইস্কিতে চুমুক দিল জেসি ওয়েন, গ্লাসের কিনারার ওপর দিয়ে সামনে দাঁড়ানো লোকগুলোকে নিরীখ করল।
‘একটা কথা, জেসি,’ উঠে দাঁড়াল মাঝবয়সী এক লোক। ‘তুমিই বলেছ এখানে আসার পর ভাগ্য ফিরে যাবে আমাদের, কারণ জেরেমি টাউনে প্রচুর সোনা আছে। কিন্তু এখানে এসে দেখতে পাচ্ছি আগেই ক্লেইমের দখল নিয়ে বসে আছে বহু লোক।’ ‘এমন কোন কথা কি সত্যিই বলেছি?’ সহাস্যে পাল্টা প্রশ্ন করল ওয়েন, সযত্নে বিরক্তি আর অসন্তোষ চেপে রেখেছে। ‘আমি তোমাদের স্বপ্ন দেখাইনি, বন্ধুরা, তোমরা নিজেরাই দেখেছ। আমি শুধু এখানে নিয়ে এসেছি তোমাদের। বিনিময়ে কিছু ডলার পাওনা হয়েছে আমার।’ লোকটির মুখে চাপা অসন্তোষ দেখে ব্যাখ্যা দিতে বাধ্য হলো সে। ‘দেখো, মি. ক্যামেরন, আমি বলেছি এখানে সোনার সন্ধান পাওয়া গেছে। খবরটা তোমরা আগেই পেয়েছ, কিন্তু নিশ্চিত হয়েছ আমার কথায়। সোনা কি এখানে নেই, তাহলে এতগুলো লোক পড়ে আছে কেন? সোনা তোলার দায়িত্ব নিশ্চয়ই আমাকে দাওনি?’ আনমনে মাথা নাড়ল ক্যামেরন, চাহনিতে অনিশ্চয়তা ঝরে পড়ছে। টেবিলের ওপর রাখা হুইস্কির গ্লাস তুলে চুমুক দিল সে। নিরাসক্ত দৃষ্টিতে বাইরে অপেক্ষমাণ সঙ্গীদের দেখল, তারপর পকেট থেকে টাকা বের করে টেবিলে রাখল। পাওনা টাকা বুঝে নিয়ে মাথায় হ্যাট চাপাল ওয়েন। ‘আশা করি আমাকে আর দরকার হবে না তোমাদের। তবুও, কয়েকটা দিন থাকব এখানে। প্রয়োজন হলে বারকীপের কাছে খোঁজ কোরো, খবর পেয়ে যাব আমি। তোমাদের সাফল্য কামনা করছি।’
সরার পানীয়ের দাম মিটিয়ে দৃঢ় পায়ে বেরিয়ে গেল জেসি ওয়েন। খানিকটা নিরাশ হয়ে বসে থাকল লোকগুলো, কেবল হ্যান্স কোবার্ন ছাড়া। কৌতূহলী চোখে অন্যদের দেখছে সে। কিছুটা হলেও হতোদ্যম হয়ে পড়েছে উচ্চাকাঙ্ক্ষী লোকগুলো। এদের অনেকেই আকাশ-পাতাল ভেবে এসেছে এতদিন, অথচ তিক্ত বাস্তব আঁচ করতে
পৃষ্ঠা-১৪
পারছে এখন। সবার আগে যে কাজটি তাদের করা উচিত, ভাবল হ্যান্স কোবার্ন, নিরাপদ একটা আশ্রয় খোঁজা উচিত; কিন্তু তা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না কেউ। অবশ্য কিছুক্ষণ পরই হতাশা কেটে যাবে, আশপাশে প্রচুর খালি জায়গা আছে, ক্লেইম করার পাশাপাশি নদীর তীরে যে কোন জায়গায় রাতটাও কাটিয়ে দিতে পারবে। যেমন কেটেছে গত কয়েকদিন। হুইস্কি শেষ করে উঠে দাঁড়াল সোনা ব্যবসায়ী। প্রচুর কাজ পড়ে আছে তার-জেফরি হ্যালার্ডকে খুঁজে বের করতে হবে, জরুরী কিছু আলাপ প্রথমেই সেরে ফেলা দরকার; হাতে সময় মাত্র দু’দিন। ক্রুদের থাকার ব্যবস্থা করতে হবে, এবং ড্যানি লসনের খোঁজ করতে হবে, হয়তো এখানেই আছে সে। আশা ছাড়তে রাজি নয় কোবার্ন। বেরিয়ে এসে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে সারা শহরের ওপর চোখ বুলাল ও। সর্বত্রঅযত্নের ছাপ, সবকিছুই বড় তাড়াহুড়োর সঙ্গে করা হচ্ছে। রাস্তার ওপাশে একটা স্টোরের দেয়াল দাঁড় করাচ্ছে বাপ-বেটা, খোলা দোকানে পসরা সাজিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে আরেকজন। পাবলিক স্টেবলে কেবল কয়েকটা খোলা স্ট্র চোখে পড়ল। ল-অফিসটা একেবারে শেষপ্রান্তে, মাটি আর ইটের আলগা একটা কাঠামো বলা উচিত। পাশে নামকাওয়াস্তে কোর্ট হাউস। নাহ্, জেরেমি টাউনের বয়স দুই মাস হয়েছে ঠিকই, ভাবল ও, কিন্তু একবিন্দু এগোয়নি শহরটা। শুরুতে যেমন
ছিল, তারচেয়ে খারাপ হয়েছে অবস্থা। পরিকল্পনা বা যত্নের ছাপ নেই কোথাও। রাস্তায় নেমে হ্যাটের ব্রিম আরও নামিয়ে দিল হ্যান্স কোবার্ন, চোখ কুঁচকে তাকাল ওয়্যাগন সারির দিকে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গল্প করছে নতুন আসা লোকগুলো, মাঝে মধ্যে ইতি-উতি তাকাচ্ছে। নিজের বাগির কাছে পৌঁছতে দেখল ওর দিকেই এগিয়ে ‘ আসছে পিট লারকিন। কোবার্ন, তুমি তো আগেও এখানে এসেছ?’ মাথা ঝাঁকাল সে, অপেক্ষায় থাকল। ‘তুমি কি উইলিয়াম লারকিনকে চেনো? এখানে একটা ক্লেইম আছে বিলের। ওর কাছেই এসেছি আমরা।’ ‘ঠিক বলতে পারব না, মাইনারদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ নেই আমার।’ কোবার্ন খেয়াল করল উত্তরটা অপ্রতিভ করে তুলেছে লারকিনকে। ‘তবে আমার অফিসে গেলে হয়তো খোঁজ পেতে পারো। মাইনারদের কাছ থেকে সোনা কেনে আমার কেরানি, ও হয়তো চিনতে পারে।’ ‘ধন্যবাদ।’ বাগির আসনে চড়ল কোবার্ন। চাবুক চালিয়ে ঘোড়া দুটোকে এগোতে বাধ্য করল, সকাল থেকে টানা ছুটেছে বলে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে পশুগুলো। পিছু পিছু আসছে লারকিনদের ওয়্যাগন। ধীরে ধীরে শহরে প্রবেশ করল ওরা। খানিক এগিয়ে মূল রাস্তা ছেড়ে পাশের গলিতে ঢুকল, বিশ গজ দূরে একটা দালানের সামনে এসে থামল। চাকার ঘর্ঘর শব্দ শুনে ভেতর থেকে বেরিয়ে এল শীর্ণদেহী এক লোক। টুপি খুলে হিচিং রেইলের প্রান্তে ঝুলিয়ে রাখল সে, তারপর দ্রুত এগিয়ে এল।
পৃষ্ঠা-১৫
‘কেমন চলছে এদিকে, টড?’ জানতে চাইল কোবার্ন, বাগি থেকে নেমে পড়েছে। ‘ভাল, মি, কোবার্ন।’ ‘সব ঠিকঠাক আছে তো?’ হেসে ওকে আশ্বস্ত করল টড মার্টিন। ‘ও পিট লারকিন,’ লারকিনকে দেখিয়ে বলল সোনা ব্যবসায়ী। ‘আর লারকিন, এ হচ্ছে আমার ম্যানেজার-টড মার্টিন।’ হাত মেলাল দু’জন। মেরী আর জুলিয়া সহ অফিসে এসে বসল ওরা। সামনের বড়সড় ঘরটা অফিস-রূম, পেছনের একটা কামরা নিজের কোয়ার্টার হিসেবে ব্যবহার করে মার্টিন; আরেকটা কামরা খালি পড়ে থাকে, তবে গোছানো। জেরেমি টাউনে এলে এখানেই থাকে হ্যান্স কোবার্ন। জুলিয়াকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল মেরী। ‘টড, তুমি বোধহয় সাহায্য করতে পারবে ওকে,’ গদি-মোড়া একটা চেয়ারে বসে বলল কোবার্ন। ‘উইলিয়াম লারকিন নামে কেউ ক্লেইম করেছে?’ ‘করেছে।’ লারকিনের চোখে এবার খুশি দেখা গেল। সশব্দে হাঁপ ছাড়ল সে, তারপর বসে পড়ল একটা চেয়ারে। ‘বলতে পারবে ঠিক কোথায় ওর ক্লেইম?’ ‘নদীর একেবারে শেষ মাথায়, জেফরি হ্যালার্ডের পর ওর ক্লেইমটাই সবচেয়ে বড়। সোনাও তুলছে প্রচুর।’
‘ধন্যবাদ। এবার বোধহয় যেতে পারি আমরা।’ উঠে দাঁড়াল পিট লারকিন। ‘বোসো, কফি খেয়ে যাও,’ আমন্ত্রণ জানাল সোনা ব্যবসায়ী। লারকিন দ্বিমত না করে বসে পড়ল চেয়ারে। কফির আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়ল টড মার্টিন। মিনিট বিশ পর বিদায় নিয়ে ওয়্যাগনে চড়ল বাপ-বেটি। গলি ধরে চলে এল শহরের শেষ মাথায়। খানিকটা খোলা জায়গার পর ঢালের শুরু হয়েছে কয়েকশো গজ দূরে। ওয়্যাগনের চাকা আর ঘোড়ার খুরের গভীর দাগ পড়েছে ধূলিধূসর ট্রেইলে। দূর থেকে মাইনিং এলাকার ওপর চোখ বুলাল পিট লারকিন। শ্যাকগুলোর ধারে-কাছে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। নদী বা পাহাড়ের কাছে ব্যস্ত সবাই, মাটি খুঁড়ছে অথবা নদীর তীরে লোহার তৈরি সূক্ষ্ম ছাঁকনি দিয়ে মাটি মেশানো সোনা ছেঁকে তুলছে। চালকের আসনে, বাপের পাশে বসেছে জুলিয়া। অবাক হয়ে লোকজনের ব্যস্ততা দেখছে ও। অযথা সময় নষ্ট করছে না কেউ, হয়তো উৎসুক হয়ে একনজর দেখছে ওদের, তারপরই নিজের কাজে মনোযোগ দিচ্ছে। অথচ তিনশো গঞ্জ দূরে শহরের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন-সেলুন বা বাড়ির পোর্চে দাঁড়িয়ে থেকে অলস সময় কাটাচ্ছে বেশিরভাগ লোক; ব্যস্ততা নেই সেখানে, নেই কোন প্রাণচাঞ্চল্য। কি যেন ভাবছে পিট লারকিন, হয়তো বহু বছর পর ভাইয়ের সাথে দেখা হওয়ার পর কেমন লাগবে, ছোট ভাইকে কেমন দেখবে তা-ই তার চিন্তার বিষয়। চারপাশে কৌতূহলী দৃষ্টি চালাচ্ছে সে, ধারণা করার চেষ্টা করছে ঠিক কোন্টা বিল
পৃষ্ঠা-১৬
লারকিনের ক্লেইম। ‘শেষপর্যন্ত আমরা এসেই পড়লাম, তাই না?’ হালকা সুরে বলল সে। আনমনে মাথা ঝাঁকাল জুলিয়া। বাপের অতিরিক্ত আগ্রহ পছন্দ করতে পারছে না, এমনকি পশ্চিমে আসার ব্যাপারটাও সহজে মেনে নিতে পারেনি। বিল লারকিন সম্পর্কে ধারণা নেই ওর, জানে না লোকটি কেমন। ছেলেবেলায় দেখেছিল, ওর যখন নয়-দশ বছর। মানুষটা বাউন্ডুলে ছিল বলে বাড়িতে খুব কমই থাকত, তার বেশিরভাগ সময় কেটেছে পশ্চিমে। মাঝে মধ্যে ফিরে যেত সনোরায়, দু’একদিন থেকে কাউকে কিছু না জানিয়ে হাওয়া হয়ে যেত আবার। ভাইয়ের ভবঘুরে স্বভাব পছন্দ করত না বিল লারকিন, এবং সেটা প্রকাশ করতেও দ্বিধা ছিল না তার। এ নিয়ে দু’ভাইয়ের মধ্যে ঝগড়ার পরিণতিতে অভিমান করে বাড়ি ছেড়েছিল বিল, আর ফিরে যায়নি। তারপর বহু দিন তার কোন সংবাদ পায়নি ওরা, কেবল মাসখানেক আগের চিঠিটা ছাড়া-হঠাৎ বড়লোক হয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছে সে, এবং পিটকে পশ্চিমে আসার অনুরোধ করেছে। চিঠি পেয়ে ভাইয়ের ওপর সমস্ত অভিমান এবং আত্মমর্যাদা, সবই ভুলে গিয়েছিল পিট লারকিন। পনেরো দিনের মধ্যে রওনা দেয় ওরা। জুলিয়ার ইচ্ছে ছিল না, তবু আসতে হলো। কারও দয়ায় বেঁচে থাকাকে ঘৃণা করে ও। সেজন্যে বাপের ওপর কিছুটা হলেও অসন্তুষ্ট। পিট লারকিনের আগ্রহ কোথায় ভাল করেই জানে ও, সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছে সে কেবল বড়লোক হওয়ার আশায়। ভাইয়ের অনুগ্রহে নিজের ভবিষ্যৎ গড়ে নেবে! ‘বিল খুব অবাক হবে,’ নীরবতা ভাঙল লারকিন। ‘কেন?’ ‘এই যে এতদিন পর আবার দেখা। কত বদলে গেছি আমরা সবাই, তোকে দেখেছে সেই ছোট্ট অবস্থায়।’ ‘এতে অবাক হওয়ার কি আছে!’ তর্ক করল না লারকিন। বাঁক ঘুরে দক্ষিণে এগোল ওয়্যাগন। টড মার্টিনের নির্দেশনা অনুযায়ী বিল লারকিনের ক্লেইম কাছাকাছি হওয়ার কথা। নদীর ধারে ছোট্ট একটা কেবিন দেখা যাচ্ছে। আশপাশে কেউ নেই, পাহাড়ের কোলে গজিয়ে ওঠা বুনো ঝোপের কাছে দাঁড়িয়ে আছে একটা ঘোড়া। কাঁটাতার দিয়ে বেষ্টিত সীমারেখার ভেতরে একটা সাইনবোর্ড, সেটার লেখা অনুযায়ী এই জমিতে বিল লারকিনের মালিকানা প্রকাশ পাচ্ছে। কাঁটাতারের ফাঁক গলে এগোল ওয়্যাগন। পঞ্চাশ গজ রাস্তা পেরিয়ে কেবিনের সামনে পৌছে গেল ওরা। নদীর পাড়ে দীর্ঘকায় এক লোককে দেখতে পেল পিট লারকিন। হাতে, কাপড়ের এখানে-সেখানে কাদা লেগে আছে। হ্যাটটা স্ট্র্যাপের সাহায্যে পিঠে ঝোলানো। ঘেমে সারা, গায়ের সাথে লেপ্টে আছে শার্ট। কোমরের হোলস্টারে পিস্তলের নল উঁকি দিচ্ছে। প্রথমে শীতল নিরুত্তাপ দৃষ্টিতে তাকালেও পরে আগন্তুকদের চিনতে পেরে প্রাণের সঞ্চার হলো লোকটার চোখে। হাসি-মুখে এগিয়ে এল সে।
পৃষ্ঠা-১৭
‘আরে, পিট যে!’ উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল সে। ‘সত্যি এসে পড়েছ তাহলে!’ লাফিয়ে ওয়্যাগন থেকে নামল পিট লারকিন, ভাইয়ের দিকে এগিয়ে গেল। হাত মিলিয়ে পরস্পরকে আলিঙ্গন করল ওরা। ‘এই বয়সেও দেখছি তাগড়া জোয়ানই রয়ে গেছ তুমি, বিল!’ স্মিত হেসে বলল বড় ভাই। ‘এখানে আরামে জীবন কাটানো যায় না, পিট। আসলে তেমন কোন সুযোগই নেই। যাকেই পাবে, দেখবে প্রচুর পরিশ্রম করছে।’ জুলিয়ার দিকে ফিরল সে এবার, অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে নিরীখ করলে ওকে; ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হয়ে গেল মুখ। ‘আরিব্বাস্, তুমি দেখছি পুরোপুরি লেডি হয়ে গেছ, জুলি!’ এগিয়ে এসে জুলিয়াকে ওয়্যাগন থেকে নামতে সাহায্য করল সে। তারপর আচমকা জড়িয়ে ধরল ওকে, সস্নেহে চুমো খেল কপালে। সরে গেলেও ওকে ছাড়ল না বিল লারকিন, দুই কাঁধ ধরে রেখে ফের খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করল, মিটিমিটি হাসি লেগে আছে ঠোঁটের কোণে; শেষে জুলিয়ার মুখে স্থির হলো দৃষ্টি। ‘বেশ লম্বাও হয়েছ দেখছি, আর—সুন্দরী!’ লজ্জা পেল জুলিয়া। ‘কেমন আছ তুমি?’ ‘দারুণ।’ ওকে ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে গেল বিল লারকিন, কাপড়ে লেগে থাকা কাদার দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ হাসল। ‘এ মুহূর্তে নিশ্চয়ই সঙের মত দেখাচ্ছে আমাকে? দাঁড়াও, এক মিনিট, ধুয়ে আসছি!’ নদীর দিকে এগোল সে, হাত-মুখ ধুয়ে ফিরে এল মিনিট কয়েক পর। ‘এসো, ভেতরে এসে বোসো,’ বলে কেবিনের দিকে এগোল। ঘণ্টাখানেক পর খেতে বসল ওরা। ‘জুলি এসেছে, এটা আমার জন্যে সুখবর,’ সহাস্যে বলল বিল লারকিন। ‘নিজের রান্না খেতে খেতে অরুচিতে ধরে গেছে। খাওয়ার ব্যাপারে এখন থেকে চিন্তা করতে হবে না আর।’ ‘তুমি এখানে এলে কিভাবে?’ জানতে চাইল বড় ভাই। ‘সে অনেক লম্বা গল্প, অবসরে একদিন বলা যাবে,’ কৌশলে এড়িয়ে গেল সে. চুরুট ধরিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকাল বড় ভাইয়ের দিকে, আড়চোখে পলকের জন্যে দেখল জুলিয়াকে। ‘ভাবছি তোমাদের এখানে এনে ভুল করলাম নাকি।’ ‘কেন?’ সবিস্ময়ে জানতে চাইল পিট। ‘একেকটা দিন যা হচ্ছে এখানে! মারপিট বা গোলাগুলি লেগেই থাকে।’ ‘তেমন কিছুই তো দেখলাম না।’ ‘দেখবে, সন্ধে হলেই টের পাবে।’ জেফরি হ্যালার্ডের ইদানীং প্রায়ই মনে হয় এখানে আসাটাই দারুণ ভুল হয়েছে। কিন্তু সোনা আবিষ্কার করার সময় ও কি ঘুণাক্ষরেও ভেবেছে যে হলদেটে উজ্জ্বল ধাতুটা শেষপর্যন্ত আসলে বহু লোকের সর্বনাশ ডেকে আনবে? পাহাড়ের কোলে নিজের ক্রেইমে, কেবিনের পোর্চে পায়চারি করছে সে। নিরাসক্ত দৃষ্টিতে ঢালের নিচে শহরের দিকে তাকাচ্ছে মাঝে মধ্যে। ক’দিন হলো? বড়জোর দুই মাস, ভাবছে হ্যালার্ড, অথচ কত দ্রুত বদলে গেছে সবকিছু। শুরুতে
পৃষ্ঠা-১৮
ওরা যখন এসেছিল, কিছুই ছিল না এখানে। সুনসান নীরবতা, নির্জন প্রেয়ারি, আকাশছোঁয়া জারকান মাউন্টেন্সের সুবিশাল অবয়ব আর পাহাড় থেকে উড়ে আসা শীতল বাতাসই ছিল ওদের প্রথম ক’দিনের সঙ্গী। তারপর একে একে আসতে শুরু করল সবাই। চোখের নিমেষে গড়ে উঠল শহরটা। লোকজন দেখে প্রথমে খুশি হয়েছিল ওরা, ভুলেও ভাবেনি শেষে এত ঝামেলা হবে। নতুন এক জীবনের স্বপ্ন দেখেছিল ওরা-জ্যার ক্লেটন, জো হারপার, জেরেমি শেভলিন আর সে। কিন্তু জেরেমি শেভলিন সেই স্বপ্নের দেখা পায়নি। জোন্স সিটি থেকে রওনা দেয়ার দ্বিতীয় দিনেই অমঙ্গলের সূচনা হয়েছিল, সাপ্লাই আনতে গিয়ে বিগ বে শহরের এক রকবাজের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে শেভলিন। চারজনের জায়গায় তিনজন হয়ে যায় তারা। বন্ধুর মৃত্যুর শোক কাটতে না কাটতে ঝামেলা শুরু হয়ে যায়। পিছু পিছু চলে এসেছে ধান্ধাবাজ কিছু লোক। ভাল লোকের চেয়ে খারাপ লোকই বেশি এসেছে। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা নেই কারও, পরোয়াও করছে না কেউ, শহরের বেশিরভাগ লোকের ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য। এ পর্যন্ত ছয়জন মার্শাল নিয়োগ করা হয়েছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। প্রতিদিনই দু’একটা খুন হচ্ছে। বেপরোয়া লোকগুলোকে আইন শেখাবে কে, সেই দৃঢ়তা কারও নেই। ওর বন্ধুদের মতে বিগ থমসন, কার্ট রক্স বা স্যামুয়েল কিনকেডের মত লোকদের আইনের পথ দেখিয়ে দিতে হয়, গায়ের জোরে অথবা পিস্তলের নলে সেটা শেখাতে হয়। জেফরি হ্যালার্ড তা মানতে রাজি নয়। ওর ধারণা কিছুদিনের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে যাবে এখানকার জীবনযাত্রা। খুন-জখমের ঘটনা কমে যাবে, ধীরে হলেও শান্ত হয়ে যাবে জেরেমি টাউন। ধারণাটা প্রায় হেসেই উড়িয়ে দিয়েছে জো হারপার। অন্যদের মত শহরের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত না হলেও সে-ও স্বীকার করে শুরুতেই জেরেমি টাউনের ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা একেবারে নাকচ করে দেওয়া যায় না। পশ্চিমের উঠতি অনেক শহর এভাবেই ধ্বংস হয়ে গেছে।. সন্ধের অন্ধকার তখন বিছিয়ে পড়ছে সমস্ত চরাচরে। আগুন জ্বেলে রান্নার আয়োজন করছে জ্যাক ক্রেটন, অন্যরা শুয়ে-বসে অলস সময় পার করছে। কেবিনের পোর্চে দাঁড়িয়ে ছিল জো হারপার। আবছা অন্ধকারে দূরে গাঢ় চারটে ছায়া দেখতে পেল সে। চোখ কুঁচকে ঘোড়সওয়ারদের চেনার চেষ্টা করল। সবার সামনে বিশালদেহী এক লোক, বলিহারি স্বাস্থ্য আর তোবড়ানো মেক্সিক্যান হ্যাটই চিনিয়ে দিচ্ছে ‘বিগ’ শেইন থমসনকে।
‘জেফ, জ্যাক!’ চাপা স্বরে বন্ধুদের ডাকল সে। ‘শহরের অতিথিরা এদিকে আসছে বোধহয়।’ কেবিনের দরজায় উকি দিল জ্যাক ক্লেটন। নির্বিকার মুখে আগুয়ান ঘোড়সওয়ারদের দেখল সে, অকথ্য খিস্তি করল। ‘হারামজাদারা এখানে কোন ঝামেলা করতে চাইলে বুলেট দিয়ে ওদের খায়েশ মিটিয়ে দেব!’ ‘ভেতরে থাকো তোমরা, শান্ত স্বরে বলল হারপার। হাতে একটা উইনচেস্টার ওর, এমন ভাবে ধরা যাতে প্রয়োজন পড়া মাত্র ব্যবহার করতে পারে। ‘আমিই ওদের সঙ্গে কথা বলব। রাইফেলে থমসনের বুক নিশানা করে
পৃষ্ঠা-১৯
রেখো। বেতাল কিছু করলে ব্যাটার বুক এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়ো।’ ‘এটা আমাদের ক্লেইম, ওর কিছু করার নেই এখানে!’ যুক্তি দেখাল হ্যালার্ড। ‘ওর হয়তো ভিন্ন মত থাকতে পারে,’ দলটার ওপর চোখ রেখে বলল হারপার। ওদের ক্লেইমে ঢুকে পড়েছে থমসনের বাহিনী। ধীরে ধীরে এগিয়ে এল ওরা। বিশ হাত দূরে এসে থামল। বাতাসে ওড়া ধুলো থিতিয়ে এল আস্তে আস্তে। ‘ব্যস, আর এগোতে হবে না!’ বিশালদেহীর ঘোড়া আগে বাড়তে শুরু করায় হাত উচিয়ে নিষেধ করল হারপার। ‘যথেষ্ট হয়েছে। কাউকে খুঁজছ, থমসন?’ তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকাল সে, কিন্তু স্থির জো হারপারের চাহনি। তা দেখে মুচকি হাসল শেইন থমসন, হারপারের হাতে রাইফেল দেখে ভুরু কোঁচকাল, এমন একটা ভঙ্গি করল যেন সত্যিই ভয় পেয়েছে। ‘ক্যাম্প করার জন্যে চমৎকার জায়গা, তাই না?’ গা ছেড়ে দেয়া অলস ভঙ্গিতে সঙ্গীদের উদ্দেশে জানতে চাইল সে। ‘নিউ টাউনের মত নোংরা বা বাজে জায়গা নয় এটা। কি বলো, বাছারা?’ সঙ্গে সঙ্গে সায় জানাল ওর তিন সঙ্গী। ‘এ জায়গার ক্লেইম করা হয়ে গেছে, থমসন।’ দৃঢ় স্বরে বলল জো হারপার। ‘বাহ্, তাতে কি! আমরা তো শুধু ক্যাম্প করার মত একটা জায়গা চাইছি।’ মাথা নাড়ল হারপার, সামান্য হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল ওর মুখে। ‘প্লেসভিলের কথা তুমি ভুলতে পারো, থমসন, কিন্তু আমি ভুলিনি। নিরীহ এক লোকের ক্রেইমে ক্যাম্প করার অনুমতি চেয়েছিলে তুমি। অনুমতিও পেয়েছিলে। অথচ পরদিন সকালে দেখা গেল সেই লোক নেই। তুমি বললে সবকিছু তোমার কাছে বেচে দিয়ে চলে গেছে সে।আমি সেখানে ছিলাম, থমসন, ওই লোকের কবর নিজ হাতে খুঁড়েছি।’ রেগে গেল থমসন। ‘এরকম বানানো গল্প যদি আরেকবার বলো তবে গুলি খাবে!’ ‘এইমাত্রই তো বললাম। কি করবে?’ এক পা পিছু হটে রাইফেলের হ্যামার টানল জো হারপার। ‘কেটে পড়ো, থমসন, ঈশ্বরের দোহাই, ট্রিগারে বেশিক্ষণ থাকলেই আমার আঙুল চুলকাতে শুরু করে!’ ‘আরে দূর! এত অস্থির হচ্ছ কেন?’ পরিস্থিতি নাজুক দেখে সুর পাল্টাল সে। ‘আমরা তো তোমাদের সঙ্গে আলাপ করতে এসেছি, শহরের পরিস্থিতি যা হয়েছে…’
‘তোমাকে এখানে ডাকেনি কেউ!’ চাঁছাছোলা স্বরে বাধা দিল হারপার। গা জ্বালানো হাসি থমসনের মুখে। ‘সবসময় ডাকা লাগে না। নিজের গরজে এসেছি আমি।’ ‘কি বলতে চাও? তাড়াতাড়ি বলে কেটে পড়ো।’ হেসে পকেটে হাত ঢোকাল থমসন। দুমড়ানো একটা সিগার বের করে সময় নিয়ে ধরাল, এই ফাঁকে কেবিন আর আশপাশে চোখ বুলিয়ে নিল। বোঝার চেষ্টা করল কেউ লুকিয়ে আছে কিনা। ‘জায়গাটা অনেক বড়, প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি সোনা তুলছ তোমরা,’ এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে হালকা চালে বলল সে।
পৃষ্ঠা-২০
‘তাতে তোমার কি? ‘অনেক কিছু। বিশাল একটা জায়গার দখল নিয়েছ অথচ আমরা কোন জায়গা পাচ্ছি না, এটা কি ঠিক হলো?’ ‘পেছনে, নদীর ওপারে, কাঁধের ওপর বুড়ো আঙুল ভুলে ইশারা করল হারপার। ‘অনেক জায়গা আছে ওখানে। ইচ্ছেমত বেছে নাও।’ ‘কিন্তু এটাই যে আমার পছন্দ।’ ‘তাই নাকি? কিন্তু কিছুই করার নেই তোমার, থমসন। আমাদের আগে এলে হয়তো জায়গাটা তোমারই হত।’
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল বিগ থমসন। সিগার ফুঁকছে। তারপর হাসল সে, স্যাডলে নড়েচড়ে বসল। ‘এক কাজ করা যাক, তোমাদের ক্লেইমের কিছু অংশ না হয় ছেড়ে দ্বাও আমাদের। ছোট একটা অংশ হলেই চলবে। বিনিময়ে ন্যায্য দাম দিতে রাজি আছি আমি।’ ‘রাজি নই আমি।’ তাকিয়ে থাকল শেইন থমসন, সামনে দাঁড়ানো লোকটির দৃঢ়তা বোঝার চেষ্টা করছে। ‘হয়তো ভুল করছ তুমি। পরে পস্তাবে এমন কোন সিদ্ধান্ত না নেওয়াই ভাল।’ ‘সে আমি বুঝব!’ অধৈর্য স্বরে বলে উঠল হারপার। ‘আর কিছু বলার আছে তোমার?’ ‘হয়তো একটা চুক্তিতে আসতে পারি আমরা। আমার লোকেরা,’ পেছনে আঙুল উঁচিয়ে অন্যদের দেখাল সে। ‘সোনা তোলায় সাহায্য করতে পারে তোমাদের। বিনিময়ে…’ ‘তোমার সাথে চুক্তি?’ স্মিত হেসে তাকে থামিয়ে দিল হারপার। ‘এরচেয়ে একটা কেউটের সাথে চুক্তি করাও অনেক ভাল।’ ‘ইচ্ছে করলেই ক্লেইমটা দখল করে নিতে পারি আমরা। খারাপ উদ্দেশ্য থাকলে প্রস্তাব নিয়ে আসতাম না!’‘হয়তো, তবে তোমার কথায় আস্থা রাখতে পারছি না। শোনো, থমসন, দুই মিনিট সময় দিলাম। ক্লেইম ছেড়ে কেটে পড়ো। সময় শেষ হলে সরাসরি তোমার বুক সই করে গুলি করব আমি।’ অবজ্ঞার হাসি দেখা গেল থমসনের মুখে। ‘বুঝে-শুনে বলছ তো?’ ‘তুমি কতটা বুঝেছ, থমসন, তোমার বুকের দিকে একটা রাইফেলের নল তাকিয়ে আছে, এটা যদি দেখতে পেতে নিশ্চয়ই হাসি মুখে কথা বলতে পারতে না এতক্ষণ?’ ‘হয়তো ধাপ্পা দিচ্ছ না.’ স্নান হলো না থমসনের হাসি, আড়চোখে কেবিনের দিকে তাকাল সে। ‘ঠিক আছে, এবার না হয় যাচ্ছি। কিন্তু আবার আসব আমরা। তখন…পরিস্থিতি যেভাবে পাল্টে যাচ্ছে, ভদ্র ভাষায় প্রস্তাব দেয়ার সুযোগ হয়তো পাওয়া যাবে না। মার্শালের অফিসটা কিন্তু খালি পড়ে আছে।’ ‘তাতে কি?’ ‘নতুন একজনকে নিয়োগ করছ না কেন? আচ্ছা, জেফরি হ্যালার্ড কি নেই
পৃষ্ঠা ২১ থেকে ৪০
পৃষ্ঠা-২১
এখানে? ওকে একটা পরামর্শ দিতাম! লুকাস শাটনকে মার্শাল বানিয়েছিল ও। আমার বিরুদ্ধে ড্র করতে চেয়েছিল সে…’ ‘ওকে খুন করেছ তুমি!’ টাকরায় জিভ ঠেকিয়ে দুঃখসূচক শব্দ করল থমসন। ‘বেচারা! একটু আনন্দ- ফুর্তি করছিলাম আমরা, আর ও কিনা বাধ সাধল। সামান্য কথা কাটাকাটি হতেই পিস্তলে হাত দিল। এ অবস্থায় কি করতে পারতাম আমি? যাক্সে, আমার প্রস্তাবটা ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখো, তোমাদের ক্রেইমের চতুর্থ অংশের জন্যে এক হাজার ডলার দেব।’
‘মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার! ওটার দাম মিলিয়ন ডলার।’ ‘হয়তো, হয়তো না। তাছাড়া, কাউকে যদি মারা পড়তে হয় তার কাছে এক হাজার আর মিলিয়ন ডলারের তফাৎ কি!’ জো হারপার কিছু বলার আগেই কেবিনের ভেতরে হ্যামার টানার গম্ভীর শব্দ শোনা গেল, অখণ্ড নীরবতায় বেশ জোরাল শোনাল শব্দটা। ‘যথেষ্ট হয়েছে, থমসন!’ জ্যাক ক্রেটনের অধৈর্য কণ্ঠ শুনতে পেল ওরা। ‘তোমার প্রস্তাব নিশ্চয়ই পেশ করা হয়েছে? বেশ, এবার মার্শালের কবরের পাশে আরেকটা কবর খোঁড়ার ব্যবস্থা করার আগেই চলে যাও এখান থেকে!’ শব্দ করে হাসল শেইন থমসন, টুপির কিনারা উচিয়ে নড করল, তারপর ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে ফিরতি পথ ধরল। তাকে অনুসরণ করল অন্যরা।
কেবিন থেকে বেরিয়ে বন্ধুর পাশে এসে দাঁড়াল হ্যালার্ড, চিন্তিত দেখাচ্ছে। ‘অবস্থা ভাল ঠেকছে না, জৌ,’ স্নান কণ্ঠে বলল শহর কমিটির চেয়ারম্যান। ‘লোকগুলোর সাহস দেখো, জবরদখল করার জন্যে এখানে চলে এসেছে!’ ‘এটাই স্বাভাবিক, জেফ। শহরে ওদের জন্যে কোন আকর্ষণ আর নেই এখন। লোভে পেয়েছে ওদের। অল্প কয়েক ডলারে খায়েশ মিটছে না। যে কোন একটা ক্লেইম দখল করতে পারলে অল্প সময়ে বড়লোক হয়ে যাবে।’ ‘সেটা যে সহজ হবে না তা নিশ্চয়ই টের পেয়েছে?’ খানিকটা সন্তুষ্টির সুর সাবেক স্কুল-মাস্টারের কণ্ঠে। ‘কিন্তু তোমার মত নিশ্চিন্ত হতে পারছি না আমি। থমসন আসলে নিজের ইচ্ছের কথা জানিয়ে গেল, গোলমাল করার জন্যে আসেনি। যখন আসবে ওকে ঠেকিয়ে রাখতে পারব কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে আমার।’
‘তোমার ধারণা ঠিক না-ও হতে পারে।’ ‘উঁহু,’ পকেট থেকে তামাক-কাগ্রজ বের করে সিগারেট রোল করল হারপার। ‘এই একটা ব্যাপারে তোমার ঘাটতি আছে, জেফ। এ লোকগুলোকে তুমি চেনো না। এদের সাথে কখনও চলাফেরা করোনি, তাই জানো না কতটা খারাপ হতে পারে ওরা। কিন্তু আমি চিনি, জানি ঠিক কি করতে পারে ওরা।’ ‘কি করবে?’ ‘আপাতত কিছুই করবে না থমসন। নিজের খায়েশের কথা জানিয়ে গেছে, অপেক্ষা করবে এখন। বোধহয় সোনার সাপ্লাইটা হাতানোর তালে আছে ও। ওটা হাত করতে পারলে ক্রেইমের কথা হয়তো ভুলেই যাবে। খনিতে বেগার খেটে
পৃষ্ঠা-২২
কামাই করার চেয়ে মুফতে দুই লাখ ডলারের সোনা, একেবারে তৈরি অবস্থায় পেয়ে যাচ্ছে, লোভনীয় নয়? এ তল্লাটে যত আউট-ল আছে সবাই জেনে গেছে এটার কথা, যে কারও লোভ হবে।’ ‘স্টেজে অন্তত দু’জন গার্ড থাকবে।’ ‘চারজনই বা থাকল! কিন্তু তাতে কি? অন্যদের কথা বাদ দিলাম, এক থমসনের দলেই লোকের অভাব নেই।’ ‘তুমি শুধু ভয় পাইয়ে দাও।’ ‘থমসন সুযোগ পেলেই তোমাকে খুন করবে, জো, শঙ্কা প্রকাশ করল ক্লেটন। ‘মার্শাল ছাড়া কিভাবে চলবে এখানে?’ চিন্তিত স্বরে প্রসঙ্গ বদলাল হ্যালার্ড। ‘আইনের লোক ছাড়া এতকিছু সামলানো যাবে না। হারপার গুলি খাক, আমাদের সবকিছু হাতছাড়া হয়ে যাক, তা তো হতে পারে না। হয়তো আমরাই সামলাতে পারব, কিন্তু মার্শাল থাকলে সুবিধা, সবকিছু আইন মাফিক হবে।’ উইনচেস্টারটা পায়ের কাছে রেখে চুরুট ধরাল হারপার, তারপর ক্ষীণ হাসল। ‘কোন মার্শালই পাব না আমরা। থমসন আর কিনকেড আছে এখানে-এ কথা শোনার পর নেহাত বোকা ছাড়া দায়িত্ব নেবে না কেউ। ওদের এখনও চিনতে পারোনি তুমি, জেফ। দেখেছ তো, কিভাবে শায়েস্তা করেছে শাটনকে?’ থমথমে হয়ে গেল হ্যালার্ডের মুখ। ‘এই শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার হুকুম দেব ওদের!’ ‘জেফ, ভুলেও ওই কাজ করতে যেয়ো না,’ বলল ক্লেটন। ‘মানছি যথেষ্ট সাহস আছে তোমার, কিন্তু সাহসে সবকিছু হয় না। ওদের মত দ্রুত নও তুমি, হাসতে হাসতেই তোমাকে খুন করে ফেলবে এদের যে কেউ।’ পলকহীন দৃষ্টিতে জ্যাক ক্লেটনকে দেখছে হ্যালার্ড, তলে তলে রাগ আর অসন্তোষে ফেটে পড়তে বাকি। ‘তাহলে ওদের মত দ্রুত কে?’ ‘কয়েকজন তো আছেই-শ্যানন, অ্যার্প, কোবিন উইন্সটন, হারডিন…’ হ্যালার্ডের রাগের কারণ বুঝতে পারছে হারপার, তবে হাসল না সে। ‘এবং ড্যানি লসন। ওকে ছাড়া ধারে-কাছে কাউকে পাওয়া যাবে না বোধহয়। শুনেছি এদিকেই এসেছে লসন। কেউ যদি পারে তো সে ড্যানি লসনই।’ ‘ও তাহলে আরেক বিগ থমসন!’ ‘না, ড্যানি লসন ওরকম নয়। জীবন বাজি রেখে বলতে পারি আমি। সত্যি কথা বলতে কি, কয়েকবার তাই করেছি।’
পৃষ্ঠা-২৩
তিন:- মাটির কিছু নমুনা সংগ্রহ করার জন্যে পাহাড়ে উঠে এসেছে হ্যালার্ড। ঘোড়ার খুরের শব্দে পেছন ফিরে অচেনা এক লোককে দেখতে পেল। লম্বায় ওর সমান হবে আগন্তুক, কিন্তু তুলনায় কাঁধ আর বুক অনেক চওড়া। কালো জীর্ণ একটা হ্যাট মাথায়, পরনে রঙজ্বলা শার্ট, তারওপর চামড়ার ভেস্ট; এবং উরুতে জোড়া হোলস্টার, পিস্তল দুটো যেন নিতান্ত হেলাফেলা করে রাখা। কাছাকাছি হওয়ার পর ওর দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসল আগন্তুক। ‘ভাগ্য কেমন যাচ্ছে আজ, পাওয়া গেল কিছু?’ হালকা সুরে জানতে চাইল সে। আগন্তুকের চোখে চোখ রাখল জেফরি হ্যালার্ড। ‘জেনে-শুনে এখানে ক্লেইম করেছি আমি। আজ না হলেও কাল নিশ্চই পাওয়া যাবে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন না হওয়ার কোন কারণ নেই, যেহেতু এখানে আমিই প্রথম এসেছি।’ ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকাল লোকটা। ‘হয়তো। তুমিই তাহলে জেফরি হ্যালার্ড?’
লোকটিকে ঠিক সহ্য করতে পারছে না হ্যালার্ড, প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস লক্ষ্য করছে আগন্তুকের মধ্যে, অথচ মুখে পাথুরে নির্লিপ্ততা। ‘হ্যাঁ, আমিই জেফরি হ্যালার্ড। কি করতে পারি তোমার জন্যে?’ ‘কিছু না,’ মাথা নাড়ল সে। ‘শহরটা দেখে কৌতূহল হলো। নতুন শহর দেখতে ভাল লাগে আমার, হিসেব করতে ইচ্ছে করে কত দিন টিকে থাকবে শহরটা।’ আচমকা আড়ষ্ট হয়ে গেল হ্যালার্ডের দেহ, সরু চোখে আগন্তুককে দেখল। দৃঢ় হয়ে গেছে চোয়ালের পেশী, পিঠ টানটান করে দাঁড়াল ও। ‘ভাল করে দেখে রাখো, স্ট্রেঞ্জার!’ কাটা কাটা স্বরে, অসম্ভব গাম্ভীর্যের সঙ্গে কথাগুলো বলল স্কুল মাস্টার। ‘এ শহর টিকে থাকবে!’ ‘হয়তো, হয়তো না,’ জেফরি হ্যালার্ডের উত্তেজনা উপেক্ষা করল সে। ‘আসলে সোনা-রূপা খুব আপেক্ষিক জিনিস। এই আসে তো এই যায়। শুধু সোনার খনি পাশে থাকলেই কোন শহর গড়ে ওঠে না। শহর গড়ে তোলার জন্যে আরও অনেক কিছু দরকার।’ ‘তাই নাকি? হয়তো, হয়তো না। সোনা ছাড়া আর যাই লাগুক, সবই আছে আমাদের।’ আগন্তুকের মুখে হাসি দেখে গা জ্বলে গেল হ্যালার্ডের। নিজেকে কি ভাবে এই লোকটা? রাগে কিছু বলতে গিয়েও নিজেকে নিবৃত্ত করে নিল ও। আর কিছু না বলে হ্যাটের কিনারায় আঙুল ছুঁয়ে সামান্য নড করল লোকটা, তারপর ঢাল বেয়ে নেমে গেল নিচে। ত্যক্ত মনে নিজের ক্লেইমে বন্ধুদের কাছে ফিরে এল হ্যালার্ড। অবাক হয়ে দেখল মিটিমিটি হাসছে জো হারপার, আয়েশ করে সিগার টানছে। ‘তাহলে দেখা হলো তোমাদের?’ হেসে জানতে চাইল সে। ‘কার সঙ্গে?’ ‘পরিচয় দেয়নি বুঝি? লসন।’ ‘ও ড্যানি লসন?’ থমকে গেল হ্যালার্ড, তারপর ক্ষীণ হাসল। ‘ওকে আমার পছন্দ হয়নি।’ ‘তাই? অবশ্য অনেকেই পছন্দ করে না ওকে। তাতে ওরও কিছু করার নেই।’ “হতে পারে,’ বলে আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না জেফরি হ্যালার্ড। ‘শহরে
পৃষ্ঠা-২৪
যাচ্ছি আমি, জো। হ্যান্স কোবার্ন, ফেল্টন আর আরও কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করব। দেখি, সিটি কাউন্সিল গঠনের ব্যাপারে কি বলে ওরা।’ শহরের ঠিক মাঝামাঝি ডিক ফেন্টনের পত্রিকা অফিল। সামনের কামরাটাকে অফিস হিসেবে ব্যবহার করে সে, পেছনের কামরায় মেশিন আর অন্যান্য জিনিসপত্র। অ্যাডোবির তৈরি দালানে এখনও চুনকাম করা হয়নি, আসলে সুযোগই পাচ্ছে না ফেল্টন। জেরেমি টাউনে প্রতিটা দিন বা রাতই রোমাঞ্চকর; খুন-জখম, মারপিট আর লুঠপাটের ঘটনার বর্ণনায় ঠাসা থাকে ওর পত্রিকা। নিজের চেয়ারে বসে প্রুফ দেখছিল ফেল্টন। এসময়ে সাধারণত কাজ থাকে না ওর। দুপুর থেকে পরের সংখ্যার জন্যে কাজ শুরু করে। পায়ের শব্দে মুখ তুলে তাকাল সাংবাদিক। পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই করছে বয়স, কিন্তু দেখে বোঝা যায় না। পরিশ্রমী সে, অকপট এবং সৎ। সহসা পেছনে গুলির শব্দে চমকে উঠল জেফরি হ্যালার্ড। ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল, রাস্তার ওপাশে চলে গেল দৃষ্টি। বড়সড় একটা সেলুনে জুয়ার আসর বসিয়েছে এক লোক, হট্টগোল আর মারামারি লেগেই থাকে ওখানে।
সাতসকালেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ব্যাটউইং দরজা ঠেলে প্রায় ছিটকে বেরিয়ে এল লোকটা, টলছে মৃদু মৃদু। হাঁটু ভেঙে মাটিতে পড়ে গেল সে। রক্তাক্ত শরীরে কষ্টে-সৃষ্টে উঠে দাঁড়াল একটু পর, সমানে খিস্তি করছে কারও উদ্দেশে। সেকেন্ড কয়েক পর যমদূতের মত ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল সে লোকটাকে, কখন সেলুন থেকে পিছু পিছু বেরিয়ে এসেছে টের পায়নি। বিশালদেহী, দয়া-মায়ার ছিটেফোঁটাও নেই নির্জীব নীল দুই চোখে; আছে কেবল শীতল নির্বিকার দৃষ্টি। শার্টের হাতা গোটানো লোকটার, সবল পেশী কিলবিল করছে বাহুতে। গুলি খাওয়া লোকটাকে যথেষ্ট সময় দিল সে। পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে থাকল, কোমরের কাছে স্থির হয়ে আছে ভয়াল দর্শন কোল্ট। তারপর, একেবারে শেষ মুহূর্তে মাথায় গুলি করে আহত লোকটাকে ফেলে দিল। দরজার দিকে পা বাড়াতে উদ্যত হয়েছিল হ্যালার্ড। কিন্তু কাঁধে বলিষ্ঠ একটা হাতের অস্তিত্ব অনুভব করল ও। হাতটা ডিক ফেল্টনের। ‘দেখো, বাছা, তুমি এখন কি ভাবছ জানি আমি, কিন্তু নাক গলিয়ো না ওখানে। স্রেফ মারা পড়বে।’ কাঁধ থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল হ্যালার্ড। ‘কিন্তু এটা তো
স্রেফ ঠাণ্ডা মাথায় খুন!’ ‘আস্তে কথা বলো!’ টেনে তাকে ভেতরে নিয়ে এল ফেল্টন। ‘কে বলল খুন? যে লোকটা মারা গেল তার হাতেও পিস্তল ছিল, সমান সুযোগ পেয়েছে সে। সুতরাং খুন নয় এটা, বরং সবাই বলবে ফেয়ার ডুয়েল। গুলিটা কে করল জানো?’ ‘কে?’ আপনা আপনিই প্রশ্নটা মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেল।‘আইক জেসাপ।’ ‘আইক জেসাপ! এখানে!?’ ‘কেন, এখানে আসা নিষেধ নাকি ওর? সোনা, হ্যালার্ড, সোনা টেনে এনেছে সবাইকে। জুয়াড়ী হিসেবে যেমন খ্যাতি, তেমনি পিস্তলেও চালু ওর হাত। যে
পৃষ্ঠা-২৫
লোকটা মারা গেল সে হয়তো তাস খেলতে গিয়ে জেসাপের চুরি ধরে ফেলেছিল, হয়তো প্রতিবাদও করেছে। কিন্তু পরিণতি তো নিজের চোখে দেখলে। জেসাপ আপাদমস্তক চোর, কিন্তু ক্টর মুখের ওপর কথাটা বলা যেমন কঠিন, তেমনি প্রমাণ করাও কঠিন।’ ‘কিন্তু…’ ‘বোসো, কফি তৈরি হচ্ছে,’ বাধা দিল ফেল্টন। অসন্তোষ চেপে রেখে একটা চেয়ারে বসল হ্যালার্ড। জেদ চাপছে ওর, কিন্তু ডিক ফেল্টনের মুখের ওপর রা করতে ইচ্ছে করছে না। মানুষটা রগচটা, এবং অভিজ্ঞও বটে। পশ্চিমের বহু জনপদে পা পড়েছে তার, জেরেমি টাউনের মত অন্তত দশটা শহর গড়ে উঠতে দেখেছে। সাবধানী মানুষ না হলে এতদিন টিকে থাকতে পারত না। হাত বাড়িয়ে টেবিলের ওপর থেকে প্রফটা টেনে নিল হ্যালার্ড। একটা পৃষ্ঠায় বড়বড় করে লেখা: গত চব্বিশ ঘণ্টায়…. জন নিহত। হ্যালার্ড কাগজটা লক্ষ্য করেছে দেখে স্মিত হাসল ফেল্টন, টেবিলে দুটো মগ নামিয়ে রাখল সে। ‘সংখ্যা কিন্তু বসাইনি এখনও, কারণ দিন শেষ হয়নি। আরও ক’জন যে মরবে কে জানে, রাতে হিসেব করে বসিয়ে দেব।’
মানুষের জীবনের মূল্য কত কম, জেরেমি টাউনে না এলে সেটা বোধহয় বোঝা সম্ভব হত না, আনমনে ভাবল হ্যালার্ড। ‘সচেতন এবং দায়িত্বশীল কিছু লোককে নিয়ে সিটি কাউন্সিল গঠন করতে চাইছি আমি,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে মূল প্রসঙ্গ তুলল ও। ‘ফেল্টন, তুমি কি যোগ দেবে?’ মাথা নাড়ল সে। ‘উঁহু, এ কাজের যোগ্য নই আমি। খবরের কাগজ বের করি, এটাই আমার কাজ। তবে তোমার ভুলগুলো শুধরে দিতে পারব, আর যখন ঠিক কাজটা করবে তোমাদের পাশে থাকব আমি।’ একটু থেমে কফিতে চুমুক দিল সাংবাদিক। ‘এই প্রেস ছিল অন্য এক লোকের, স্রেফ ভাগ্যের চক্করে আমার হাতে এসে পড়ে। লোকটার সঙ্গে আমার যখন পরিচয় হয় অজ্ঞাত আততায়ীর গুলিতে আহত হয়ে তখন মরতে বসেছে সে। কেউ ছিল না ওর। যথাযোগ্য মর্যাদায় কবর দেব-এই প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে আমাকে প্রেসটা দিয়ে যায় সেন অবশ্য ওর কাছে আরেকটা প্রতিজ্ঞাও করেছি-সত্যি কথা বলব, যাই ঘটুক না কেন, শুধু সত্যি কথাই বলব; এবং এতদিন ধরে, যেখানেই গেছি, তাই করেছি আমি।’ মাথা ঝাঁকাল হ্যালার্ড। ‘শুনে খুশি হলাম। যখনই মনে হবে ভুল হচ্ছে আমার, জানাতে দ্বিধা কোরো না।’ মিনিট কয়েক চুপ করে থাকল দু’জনেই। নীরবে কফির স্বাদ উপভোগ করছে। কিন্তু কফির স্বাদ তেতো মনে হচ্ছে হ্যালার্ডের, একটু আগে দেখা ঘটনাটা ভুলতে পারছে না। ‘এখানে আইন, শৃঙ্খলা দরকার,’ শেষে নীরবতা ভাঙল হ্যালার্ড। ‘এভাবে তো চলতে পারে না। কয়েকজনকে মার্শাল হিসেবে নিয়োগ দিয়েছি আমরা, কিন্তু জানোই তো, দুটো দিনের বেশি টিকতে পারেনি কেউ। কঠিন, সমর্থ কাউকে
পৃষ্ঠা-২৬
দরকার। তুমি কি কারও নাম প্রস্তাব করবে?’ ‘দুঃখিত, এবারও সাহায্য করতে পারছি না তোমাকে।’ ‘ড্যানি লসন নামে একজনের কথা শুনেছি আমি।’ ‘উঁহু, আমি চাই না এখানে আসুক সে।’ ‘চাও না! তাহলে যোগ্য নয় সে?’ ‘তা নয়। ড্যানি লসন লোক হিসেবে ভাল, আর পিস্তলে ওর চেয়ে চালু হাত এখন পর্যন্ত দেখিনি আমি, যদিও জীবনে বহু পিস্তলবাজ দেখেছি। স্নায়ুর জোর আছে ড্যানের, সবচেয়ে বড় কথা শুর আছে সূক্ষ্ম বিচার শক্তি, যেটা পশ্চিমের অনেক সেরা বন্দুকবাজের নেই।’ ‘তাহলে ওর ব্যাপারে আপত্তি করছ কেন?’
ক্ষণিকের জন্যে কি যেন ভাবল ডিক ফেল্টন। ‘লসন আমার কাছে ছেলের মত, বিপদে একবার আমাকে সাহায্য করেছিল ও। আমি চাই না, এ ধরনের কোন শহরের দায়িত্ব নিক ও। কারণ জেরেমি টাউনের মত শহরকে ঠাণ্ডা করতে হলে আগে গুলি চালিয়ে বেপরোয়া লোকগুলোকে থামাতে হবে। আমি চাই না আবারও গোলাগুলিতে জড়িয়ে পড়ক সে, এমনিতেই ওর শত্রুর অভাব নেই।’ তর্ক করার প্রবৃত্তি হলো না জেফরি হ্যালার্ডের, তেতো হয়ে গেছে মন। ‘কাঁটাতারের ব্যাপারটা কিন্তু অনেকেই পছন্দ করছে না,’ মনে করিয়ে দেয়ার সুরে বলল সাংবাদিক। মনে পড়ল হ্যালার্ডের। একদল লোক ভাড়া করে শহরের চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে ওরা, অবশ্য চারটা প্রবেশদ্বার রেখেছে। যাতায়াতের সুবিধের জন্যে দুটো রাস্তাও বানিয়েছে। ‘কেন?’ ‘এখনও কিছুই স্থির হয়নি, হ্যালার্ড। অনেকের ধারণা আগে-ভাগেই কাজটা করে বসেছ তুমি। এজন্যে তোমাকে ধন্যবাদ দেবে না কেউ। ঘেরা অবস্থায় থাকতে চায় না কেউ, এখানে যারা এসেছে বড়লোক হয়ে ফিরে যেতে চায়। তবে তোমার পক্ষে আছি আমি। গতকালের কাগজটা দেখেছ তো, এ নিয়ে একটা সম্পাদকীয় লিখেছি?’ মাথা ঝাঁকাল স্কুল মাস্টার। ‘ধন্যবাদ, ডিক।’ মিনিট দশ পর চিন্তিত মনে হ্যান্স কোবার্নের অফিসে ঢুকল ও। হিসাবপত্র দেখছিল টড মার্টিন, পদশব্দে কাগজ থেকে চোখ তুলে তাকাল। হ্যালার্ডকে দেখে হাসি ফুটল মুখে, উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়াল। ‘বোসো, মি. হ্যালার্ড। মি. কোবার্নকে খবর দিচ্ছি,’ বলে ভেতরে চলে গেল সে। খানিক পর উপস্থিত হলো হ্যান্স কোবার্ন। কফির ফরমাশ দিয়ে হ্যালার্ডের দিকে ফিরল সে, সিগার অফার করল। ‘তোমাদের শহরের খবর কি, বলো এবার।’ ‘ভাল না। খুনে-বদমাশে ভরে গেছে। সন্ধ্যার পরপরই নরক হয়ে ওঠে শহরটা।’ ‘এখানে আসলে কঠিন একজন লোক দরকার, যে শক্ত হাতে সামাল দিতে পারবে সবকিছু।’
পৃষ্ঠা-২৭
‘বেন হকিন্স চেষ্টা করেছিল, ও তো যথেষ্ট কঠিন লোক। কই, একটা রাতও টিকতে পারল না।’ ‘বেন হকিন্স ওদের কাছে নস্যি, প্রায় তাচ্ছিল্যের সুরে বলল সোনা ব্যবসায়ী। ‘তুমি বরং অন্য কারও কথা ভাবো, জেফ শ্যানন, অ্যার্প বা লসন…’ ‘ওরা তো খুনী ছাড়া আর কিছু নয়, মুখের কথার মত পিস্তলের গুলি চালাতে পছন্দ করে!’ ‘এরকম গোলমেলে শহর ঠাণ্ডা করার জন্যে এমন লোকই দরকার, জেফ। খোঁজ করে দেখো, কাউকে আশপাশে পাও কিনা।’ ‘না। জেনে-শুনে একজন খুনীকে ভাড়া করতে পারি না আমি!’ একগুঁয়ে স্বরে বলল হ্যালার্ড। ‘আমার ধারণা একসময় মত বদলাবে তুমি, তখন হয়তো দেরি হয়ে যাবে না।’ ‘হয়তো।’ ‘সাপ্লাইয়ের ব্যাপারে আলোচনা করা যাক, কফি আসতে চুমুক দিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টাল কোবার্ন। ‘সব তৈরি রেখেছ তো?’ মাথা ঝাঁকাল সে। ‘আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে সাপ্লাইটা আদৌ মন্টানায় পৌঁছবে কিনা। সোনার কথা জেনে গেছে সবাই, শয়তানগুলো ছিনিয়ে নিলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।’ ‘দু’জনকে ভাড়া করেছি আমি। কিন্তু ওই যে বললাম, শক্ত কিছু লোক দরকার, ওরা মোটেও তেমন নয়। নিশ্চিন্ত হতে পারছি না আমি। ড্যানি লসনের সাথে দেখা হলো বিগ বে-তে। ওকে কাজটা নিতে বললাম, কিন্তু আগ্রহ দেখায়নি সে।’ ‘ড্যানি লসন?’‘হ্যাঁ, এদিকেই এসেছে ও।’ ‘কেন?’ শ্রাগ করল কোবার্ন। ‘কি করে বলি ওর মনে কি আছে! তবে এটুকু নিশ্চিত জানি অন্য সবার মত এখানে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে আসেনি সে। সুবর্ণ একটা সুযোগ চলে এসেছে তোমার সামনে, জেফ, প্রস্তাব দিতে পারো ওকে।’ ‘না। ওর মত কাউকে আইনের লোক হিসেবে জেরেমি টাউনে দেখতে চাই না আমি। ওর আর শেইন থমসনের মধ্যে পার্থক্য কি!’
‘লিভারি সিটির ঘটনাটা ভেবে দেখো। খারাপ কিছু লোককে হটিয়ে দিয়ে শহরটা পরিষ্কার করেছিল ও, মাত্র দশ দিনে। জেরেমি টাউনের চেয়ে কোন অংশে খারাপ ছিল না ওখানকার অবস্থা।’‘দরকার হলে আমি নিজেই তারা পরব, তবু ওরকম কাউকে ডাকব না!’ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল কোবার্ন। বোঝার চেষ্টা করল মানুষটা বোকা কিনা, বা ঠিক কি ভাবছে সে। পুরোপুরি ভাল মানুষ, সৎ এবং প্রখর নীতি-জ্ঞান লোকটির, একজন স্কুল মাস্টারের পক্ষে এটাই স্বাভাবিক। খুন-জখমকে মনে- প্রাণে ঘৃণা করে। সমস্যাটা এখানেই। জেফরি হ্যালার্ডের ধারণা নেই যে
পৃষ্ঠা-২৮
অন্যায়কে দমাতে মাঝে মধ্যে পাল্টা আঘাতেরও দরকার হয়, শুধু নীতি-কথা বা উপদেশ যথেষ্ট নয়। ‘যাকগে, বাদ দাও ওসব,’ প্রসঙ্গ বদলাল কোবার্ন। ‘নতুন আসা লোকগুলো সম্পর্কে কি ভাবছ তুমি?’ ‘দেখেছি ওদের। যথেষ্ট জমি আছে আশপাশে, ইচ্ছে করলে যে কোন জায়গায় ক্লেইম করতে পারে ওরা।’
‘কিন্তু থমসন বা রক্সরা বোধহয় খুশি হবে।’ ‘কেন?’ ‘সন্ধ্যার পর মাইনাররা কোথায় যায়, জানো তুমি? সেলুনে গিয়ে দেদারছে পান করে ওরা, জুয়া খেলে। সারা দিন বেগার খেটে যে পরিমাণ সোনা তোলে, তার অর্ধেকই জুয়ার টেবিলে হেরে আসে। ধান্ধাবাজ এসব জুয়াড়ীদের তাড়াতে হবে, জেফ। নইলে শেষে দেখবে জুয়ার টেবিলে একে একে খুন হয়ে যাচ্ছে নিরীহ মাইনাররা।’ ‘কোন ভাবে কি সবাইকে মানা করা যায় না? জুয়া না খেললেই তো টাকা হারানোর আশঙ্কা থাকে না আর।’ ‘অন্তত ত্রিশজন ধান্ধাবাজ লোক আছে এখানে, জেফ, যারা রাতের অপেক্ষায় সারাটা দিন কাটিয়ে দেয়। তক্কে তক্কে থাকে ওরা, যে কোন উসিলা পেলে হামলে পড়ে মাইনারদের ওপর। গায়ে-পড়ে ঝামেলা বাধায়, মারামারি করে। নিজেদের মধ্যেও লাগালাগি আছে ওদের। মাইনাররা শহরে আসবেই, সারা দিন কাজ করার পর সন্ধেয় হুইস্কি না গিললে শান্তি পাবে না ওরা, তাছাড়া টাকার গরম দেখাতে সবারই ভাল লাগে।’ ‘কই, আমি তো যাই না।’
‘নিজের মত ভাবছ কেন সবাইকে? সবাই তো তোমার মত মাস্টার নয়।’ উঠে দাঁড়াল হ্যালার্ড। ‘তাহলে ওই কথাই থাকল। পরশু সকালে রওনা দেবে সাপ্লাই। রাতে আরেকবার আসব আমি।’ নিজের ক্রেইমে ফিরে এল জেফরি হ্যালার্ড। শহরের কথা মাথা থেকে সরাতে পারছে না। অন্যদের চেয়ে তার চিন্তাই বেশি, কারণও আছে। এখানে এসে তিন বন্ধু ঠিক করে হ্যালার্ডের পরামর্শ অনুযায়ী চলবে ওরা। কারণ সে শিক্ষিত, জ্ঞানী ও মর্যাদাবান লোক। পরবর্তীতে শহর কমিটির প্রধানও হয়ে যায় সে। এ জন্যেই শহরের যে কোন ব্যাপারে ওর মাথা-ব্যথা বেশি। তাছাড়া ও নিজেও মনমত একটা শহর গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছিল, স্বপ্নটা যে এত তাড়াতাড়ি ধূলিসাৎ হয়ে যাবে তা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি। ক্লেইমে কাজ করছিল অন্যরা, ওকে চিন্তিত দেখে হাতের গাঁইতি ফেলে এগিয়ে এল জো হারপার। পুরানো একটা ন্যাকড়ায় হাত মুছে কেবিনে গিয়ে ঢুকল সে, ফিরে এল হুইস্কির বোতল হাতে। ‘কথা হলো?’ দিল। মাথা ঝাঁকাল হ্যালার্ড, হারপার বোতল বাড়িয়ে ধরতে সেটা নিয়ে চুমুক ‘কি ঠিক করলে তোমরা?’
পৃষ্ঠা-২৯
‘দু’জন লোক ভাড়া করেছে কোবার্ন, তবে সে নিজেই ওদের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। ড্যানি লসনকে নাকি প্রস্তাব দিয়েছে, কিন্তু রাজি হয়নি লোকটা। ওর মতে লসনের মত কাউকে মার্শাল হিসেবে নিয়োগ দেয়া উচিত আমাদের।’ ‘লসন শহরে এসেছে নাকি?’ নিচু স্বরে শিস দিল জ্যাক ক্লেটন। ‘একটা দারুণ খবর!! ‘এত খুশির কি হলো?’ সন্দিহান চোখে ক্লেটনের দিকে তাকাল হ্যালার্ড। ‘নিশ্চয়ই আছে। তোমারও খুশি হওয়া উচিত, জেফ। কারণ ওর মত লোক আশপাশে থাকলে ঝামেলাবাজদের অনেকেই পিছিয়ে যাবে, খারাপ একটা কাজ করার আগে অন্তত কয়েকবার চিন্তা করবে। তবে আমি ভাবছি এখানে কেন এসেছে ও, কাজ ছাড়া কোথাও ঘুরে বেড়ানোর লোক নয় সে।’
‘ভাবতে থাকো,’ উষ্মা প্রকাশ করল হ্যালার্ড। ‘যদিও, আমার ধারণা, তাতে সময় নষ্ট ছাড়া আর কোন কাজ হবে না তোমার। সবাই এমন ভাবে ওর কথা বলছ যেন সত্যিই করিৎকর্মা লোক সে, জেরেমি টাউনে পা রাখলেই সব সমস্যা মিটে যাবে, কিনকেডের দল লেজ তুলে পালাবে?’ দুর্বোধ্য হাসি দেখা গেল জো হারপারের ঠোঁটে, তবে তর্ক করার প্রবৃত্তি হলো না বলে ক্রেইমের দিকে চলে গেল সে। হ্যালার্ডের পক্ষে এরকম চিন্তা করা খুবই স্বাভাবিক, ভাবছে ও, শান্তিপ্রিয় মানুষ সে এবং পিস্তলবাজি বা খুনোখুনি মনে- প্রাণে ঘৃণা করে। তার যুক্তিকে অস্বীকার করার উপায় নেই, অস্থির কোন শহরকে ঠাণ্ডা করতে গেলে পাইকারি হারে কিছু মানুষ খুন হবে, নিরীহ মানুষের মরার সম্ভাবনাও থাকবে। জেরেমি টাউনের ব্যাপারটাও ব্যতিক্রম নয়। বাধা পেলে বেপরোয়া হয়ে উঠবে কিনকেড বা রক্সদের মত লোকেরা। যাচ্ছেতাই ব্যাপার ঘটিয়ে বসবে, ওদের তোপের মুখে পড়বে সাধারণ ব্যবসায়ী বা নিরীহ মাইনাররা। আইনের লোক সবাইকে রক্ষা করতে পারবে না, এটাই স্বাভাবিক। জেফরি হ্যালার্ডের আপত্তি এখানেই, মেনে নিতে পারছে না অস্ত্রের জোর খাটিয়ে শহরটাকে জঞ্জালমুক্ত করবে কেউ। সবকিছুতে সোজা পথটি দেখতে পায় সে, তার ধারণায় নেই যে কিনকেডের মত মানুষদের বশে আনতে হলে পিস্তলের নল উঁচিয়ে বাধ্য করতে হয়। একমাত্র নিজের চেয়ে কঠিন মানুষের কাছেই নতি স্বীকার করবে ওরা।
কিন্তু হ্যালার্ডের আন্তরিকতায় কোন খাদ নেই। জেরেমি টাউনকে পরিকল্পিত একটা শহর হিসেবে গড়ে তুলতে চায় সে। একটা স্কুল, গির্জা, হাসপাতাল, অথর্বদের জন্যে আশ্রয়কেন্দ্র এসবের স্বপ্ন দেখে মানুষটা। তার প্রত্যাশা অযৌক্তিক কিছু নয়, এবং তা সম্ভবও। তবে সবার আগে এখানে শান্তি আসা দরকার। খারাপ মানুষগুলোকে তাড়াতে হবে, কিংবা ভাল আচরণ করতে বাধ্য করতে হবে। সেই কাজটি সবাই পারবে না, গুটি কয়েক লোকের মধ্যে ড্যানি লসন একজন। অরিগনের শুরুতেও ঠিক এমন ঘটেছিল, কিন্তু শক্ত হাতে শহরটা সাফ
পৃষ্ঠা-৩০
করেছে লসন। শান্তিপ্রিয় অনেকেই ওর রুদ্র মূর্তি পছন্দ করতে পারেনি, তবে অধিকাংশ অরিগনবাসী খুশি হয়েছিল। প্রয়োজন মানুষকে কঠিন, এমনকি নির্মম হতেও বাধ্য করে, এটাই হচ্ছে প্রকৃত সত্য। অরিগনের মত এখানেও একজন ‘ড্যানি লসনে’র দরকার, যে শক্ত হাতে সামাল দেবে বেপরোয়া লোকগুলোকে, শহরটায় শান্তি আনবে। জেফরি হ্যালার্ডকে একজন সম্পূর্ণ মানুষ ভাবে জো হারপার। জীবনে অনেক লোক দেখেছে হারপার, কিন্তু তাদের কেউই একচেটিয়া ভাবে ভাল নয়, ভাল- মন্দের মেশাল। পশ্চিমে জীবনযাত্রার যে ধরন তাতে কারও পক্ষেই পুরোপুরি ভাল হওয়া সম্ভব নয়। জেফরি হ্যালার্ডই তার দেখায় সমস্ত মানুষের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম। বন্ধুরা সেজন্যে সমীহ করে স্কুল মাস্টারকে। হয়তো ওর পেশাই ওকে এতটা ভাল মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছে।
একটা ব্যাপারে তিন ‘জে’ একমত। জেরেমি শেভলিনের নাম ওরা মুছে যেতে দেবে না। যে স্বপ্ন নিয়ে এ শহরের উদ্দেশে যাত্রা করেছিল, তা পূর্ণ করবে। হার পেশার চারজন লোক, নিখাদ বন্ধুত্ব ছিল ওদের। একজন এখন আর নেই তো কি হয়েছে, তার দায়িত্বটুকু ভাগাভাগি করে নিতে পারবে অন্যরা। অর্থের অভাব নেই, দরকার নিষ্ঠা আর আন্তরিকতা। যে কারও চেয়ে জেফরি হ্যালার্ডের জ্ঞান আর বিচক্ষণতা বেশি, তাই ওকেই শহর কমিটির চেয়ারম্যান বানিয়েছে। দায়িত্বটা ঠিকমত সামলাচ্ছে সে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। ব্যর্থতা শুধু এক জায়গায়-শহরের পরিস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই ওদের। সত্যি কথা বলতে কি, সন্ধের পর শহরে যায় না ওরা। জানে শহরের মানুষগুলো সুযোগের অপেক্ষায় থাকে, গায়ে পড়ে ঝগড়া বাধিয়ে কিংবা জোর করে সোনা কেড়ে নিতে জুড়ি নেই ওদের। তেমন কিছু না হলেও জুয়ার টেবিল তো আছেই, সস্তা চুরি ধরতে পারে না মাইনাররা। বেশিরভাগ লোকই হেরে আসে। কেউ কেউ মেয়েদের কাছে যায়, চড়া দামে মেয়েদের সঙ্গ লাভের সুযোগ পায়। এত কাছে শহরটা, অথচ মাইনারদের কাছে ওটা একটা ভিন্ন জগৎ। শহরের মানুষগুলো লোভী, বারকীপ থেকে হন্সল্যার পর্যন্ত। তক্কে তক্কে থাকে ওরা, কিভাবে মাইনারদের কাছ থেকে দুটো পেনি বেশি খসানো যায়! এক বোতল হুইস্কি যেখানে অন্য শহরে এক-দুই ডলারে পাওয়া যায়, এখানে তার দাম পাঁচ ডলার। প্রতিটি পণ্য বেশি দামে কিনতে হয়। মাইনাররাও খুব একটা রা করে না, কারণ ওদের প্রতিদিনের কামাইও কম নয়। একজন কাউহ্যান্ডের বেতন মাসে চল্লিশ ডলার, কিন্তু সারা দিন একই পরিশ্রম করে হয়তো তারচেয়ে বেশি দামের সোনা একদিনে তোলা সম্ভব। রোজগার বেশি বলে খরচের ব্যাপারেও উদার এরা। হুইস্কি গিলে নিজের সুপ্রসন্ন ভাগ্যকে উদ্যাপন করতে চায় বোধহয়। নইলে ঝামেলার আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও প্রতিদিন শহরে যেত না ওরা। ড্যানি লসনের চিন্তা ফিরে এল আবার। এখানে কি করছে সে? যাই করুক, ভাবল হারপার, ওর উপস্থিতি জেরেমি টাউনের জন্যে আশীর্বাদ হতে পারে। কোন ভাবে তাকে রাজি করাতে পারলে নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে। শ্যানন বা অ্যাপ… কেউই এতদূর আসবে না, হয়তো হাজার ডলার খরচ করলেও রাজি হবে না; কিংবা
পৃষ্ঠা-৩১
দেখা যাবে বহু দূরে আছে, এখানে পৌছতে পৌঁছতে যে সময় লাগবে ততদিনে শহরটা হয়তো ধ্বংসই হয়ে যাবে। অন্য কোন কাজেও ব্যস্ত থাকতে পারে ওরা। তাছাড়া যোগাযোগ করার সময় কোথায়? সোনার চালান ঠিকমত মন্টানায় পৌঁছায় কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ হচ্ছে ওর। লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে, যে কোন জায়গায় আক্রান্ত হতে পারে স্টেজ। সুযোগসন্ধানী লোকের অভাব নেই। হয়তো কয়েকটা দলের মোকাবিলা করতে হতে পারে স্টেজগার্ডদের। ট্রেইলে অচেনা তিন ঘোড়সওয়ারকে দেখতে পেয়ে যুগপৎ কৌতূহলী এবং সতর্ক হয়ে উঠল ও। শক্ত-সমর্থ গড়নের প্রথম লোকটা, স্যাডলে বসার ভঙ্গি স্বতঃস্ফূর্ত, আত্মবিশ্বাসী। পরনে নোংরা পোশাক। দাড়ি-গোঁফ কাটেনি কয়েকদিন। পেছনের দুই রাইডারের চেহারা হিংস্র এবং কর্কশ। দ্রুত কেবিনের কাছে চলে এল হারপার। দেখল পোর্চে এসে দাঁড়িয়েছে ওর দুই বন্ধু। সন্দিহান চোখে দেখছে আগন্তুকদের। ধীরে ধীরে এগিয়ে এল ওরা। ত্রিশ গজ দূরে এসে রাশ টেনে ঘোড়া থামাল। নীল চোখ জোড়ায় নির্বিকার চাহনি, সরাসরি জেফরি হ্যালার্ডের দিকে তাকাল প্রথমজন। ‘তুমিই হ্যালার্ড?’‘হ্যাঁ।’
‘শুনলাম তোমাদের একজন মার্শাল দরকার। আমি গ্যারি লোফার্ট, আর আমার দুই সহকারী স্যাম আর জো চাকুরিটা নিতে পারি। বেশ কিছু গরম শহর ঠাণ্ডা করার অভিজ্ঞতা আছে আমাদের। মাথা নাড়ল হ্যালার্ড, অর্থাৎ চাকুরিটা জুটছে না ওদের। ‘দাঁড়াও, জেফ,’ বাধা দিল ক্লেটন। তারপর গ্যারি লোফার্টের দিকে তাকাল। ‘কিভাবে ভাবছ শহরটা ঠিক রাখতে পারবে?’ ‘বলেছি না-অভিজ্ঞতা আছে? আমাকে দু’শো ডলার দিলেই চলবে, আর ওদের জন্যে একশো করে।’ ‘বেশি চাইছ,’ নিস্পৃহ কণ্ঠে মন্তব্য করল হারপার। ‘বেশি!’ অবাক হওয়ার ভান করল লোফার্ট। ‘হাজারটা সমস্যা এই শহরে। সেসব তো আমাদেরই সামাল দিতে হবে, নাকি? তাহলে বেশি চাইলাম কিভাবে?’ ‘বুঝলাম। বিগ থমসনের নাম শুনেছ কখনও?’ স্মিত হাসল লোফার্ট। ‘শুনেছি। বিগ থমসন তো আমাদের মতই মানুষ, তাই না? তাই যদি হয় তবে ওকেও সামলাতে পারব।’ ‘ঠিক আছে,’ আপসের সুরে বলল জেফরি হ্যালার্ড। ‘থমসন আর কিনকেডকে শহর থেকে তাড়াও আগে, তারপর চাকুরি নিশ্চিত হবে তোমাদের।’ অন্যদের দিকে তাকাল লোফার্ট। ‘আর সবারও কি একই মত?’ একে একে মাথা ঝাঁকাল হারপার আর ক্লেটন। হাত বাড়াল লোকটা। ‘মার্শালের ব্যাজটা দিচ্ছ? আমার অথরিটি তো প্রমাণ করতে হবে।’ ব্যাজ নিয়ে তৎক্ষণাৎ নিজের শার্টে এঁটে রাখল লোফার্ট, তারপর হাসতে হাসতে চলে গেল। জেরেমি টাউনের ইতিহাসে সপ্তম মার্শাল সে, অথচ শহরটার পত্তন হয়েছে মাত্র দুই মাস তিন দিন!
পৃষ্ঠা-৩২
চার:- কিছু কিছু ব্যাপার আছে ইচ্ছে করলেও এড়াতে পারে না ড্যানি লসন। অবচেতন মন প্রায়ই ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাড়া করে ওকে। জেরেমি টাউনের ব্যাপারেও তাই হচ্ছে এখন। জানে ওখানে কোন কাজ নেই, তবু চলে এসেছে। খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে জেনেও হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারে না-ওর দোষটা এখানেই-অন্তত যেখানে কিছুটা হলেও সাহায্য করতে পারে সে। জারকান মাউন্টেন্সের গভীর এক উপত্যকায় রাত কাটিয়েছে ও। সকালে নাস্তা শেষে দ্বিধান্বিত মনে জেরেমি টাউনের পথ ধরেছে। তবে, তার আগে, উঁচু এক পাহাড়ের চূড়া থেকে পুরো এলাকা জরিপ করেছে। দুই লাখ ডলারের সোনা, টোপটা যে কারও জন্যে এড়ানো কঠিন। নেইল ডেভিসের জন্যেও। সাধারণত বড়সড় কোন দান ছাড়ে না কুখ্যাত এই আউট-ল। লসন নিশ্চিত জানে সে-ও এসে উপস্থিত হয়েছে। তন্নতন্ন করে খুঁজেও তার ক্যাম্পের কোন নিশানা খুঁজে পেল না ও। কিন্তু হলফ করে বলতে পারবে আশপাশেই আছে সে। চোখ রাখছে শহরের ওপর। সাপ্লাইটা রওনা দিলে পিছু নেবে, তারপর মওকামত হামলা করবে। চড়াই বেয়ে ওপরে উঠে আসতে ঢালের নিচে উপত্যকায় তিনজন লোককে দেখতে পেল লসন। খানিকটা অবাক হলো জেসি ওয়েনের সাথে হ্যান্স কোবার্নের ভাড়া করা ক্রুদের দেখে। ঘোড়ার রাশ টেনে অ্যাসপেন ঝোপের আড়ালে সরে এল ও। স্যাডলে বসে থেকে চোখ রাখল লোকগুলোর ওপর, একটা মরা গাছের গুঁড়িতে বসে আছে জেসি ওয়েন, হাতে সিগার। কি যেন বলছে সে, মনোযোগ দিয়ে শুনছে অন্য দু’জন। এতদূর থেকে কেবল ঠোঁট নড়াই দেখতে পাচ্ছে লসন। কি যেন একটা জিজ্ঞেস করতে মাথা ঝাঁকাল ক্রুরা, তারপর যার যার ঘোড়ার দিকে এগোল। ওরা চলে যেতে সময় নিয়ে সিগার শেষ করল জেসি ওয়েন, বুটের তলায় পিষল গোড়াটা। তারপর উপত্যকার মুখে রাখা সোরেলের দিকে এগোল। স্যাডলে চড়ে আশপাশে তাকাল সন্দিহান দৃষ্টিতে, কিছুক্ষণের মধ্যে ট্রেইল ধরে হারিয়ে গেল সিডার সারির আড়ালে। খানিক অপেক্ষা করে নিচে নেমে এল লসন। স্যাডলে বসেই খুঁটিয়ে দেখল জায়গাটা। কোন চিহ্ন নেই, কেবল বুটের চাপে চটকে যাওয়া ঘাস দেখা যাচ্ছে। মাটিতে দাগ আঁকেনি কেউ। সিগারেটের গোড়া পড়ে রয়েছে গুটিকয়েক। ব্যস, এই হচ্ছে জেসি ওয়েনের সঙ্গে দুই স্টেজ গার্ডের গোপন সাক্ষাতের আলামত। এতে কিছুই বোঝার উপায় নেই। শহরের দিকে এগোল ও, ঘোড়াটাকে হাঁটিয়ে নিয়ে এগোচ্ছে। তাড়া নেই
পৃষ্ঠা-৩৩
ওর, তাছাড়া কয়েকটা চড়াই-উত্তাই পেরোলেই শহরে পৌঁছে যাবে। ছুটতে গেলে হয়তো ওর উপস্থিতি টের পেয়ে যাবে জেসি ওয়েন, গোপন এ সাক্ষাতের কথা যে আর কেউ জানে না সে-সম্পর্কে নিশ্চিত থাকুক লোকটা। জেরেমি টাউনের শেষ মাথায় যেখানে ঢালের শুরু, সেখান দিয়ে প্রবেশ করল ড্যানি লসন। ঢালের ওপর থেকে দেখে নিয়েছে শহরটা। শান্তই আছে, দিনের বেলায় যেমন থাকে। রাস্তায় লোকজন কম। সবে সকাল হয়েছে, বেশিরভাগ লোকই রাত জাগার পর ঘুমাচ্ছে এখন। গলি ধরে মূল রাস্তায় চলে এল ও। জেসি ওয়েন বা হ্যান্স কোবার্নের দুই ক্রুকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। সিড হ্যামারটনের জেনারেল স্টোরের সামনে চোখ পড়তে থমকে গেল লসন। খানিকটা অবাকও হলো। এ মুহূর্তে দারুণ বিব্রত দেখাচ্ছে জুলিয়া লারকিনকে। ওয়্যাগনের আসনে বসে ছিল মেয়েটি, একটা হাত ধরে টেনে ওকে ওয়্যাগন থেকে নামানোর চেষ্টা করছে এক লোক। ফুট-বোর্ডে ভর দিয়ে তা ঠেকানোর চেষ্টায় অস্থির মেয়েটা। আতঙ্ক ওর চোখে-মুখে। ওয়্যাগনের পাশে বিল লারকিনকে দেখতে পেল লসন, মুখ থুবড়ে পড়ে আছে ধূলিময় রাস্তায়। কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে আরও দু’জন। হাসছে ওরা, সঙ্গীর সঙ্গে মেয়েটির জবরদস্তি চুটিয়ে উপভোগ করছে। ঘোড়াটাকে নিয়ে ফুটপাতে উঠে এল লসন, দেয়ালের দিকে সরে গেল। পেছন থেকে কাউকে গুলি করার সুযোগ দিতে চায় না, যদিও ওর উপস্থিতি এখনও টের পায়নি কেউ। চকিত দৃষ্টিতে আশপাশে তাকাল ও, কামারের দোকানের পোর্চে দাঁড়িয়ে আছে এক যুবক আর মাঝবয়সী এক লোক। নিস্পৃহ দৃষ্টিতে ঘটনাটা দেখছে লোকটি, কিন্তু তরুণের মুখে রাগ ফুটে উঠেছে। পা বাড়াতে যেতে পাশ থেকে হাত বাড়িয়ে তাকে নিরস্ত করল লোকটি। ‘নিজেকে সামলে নাও, বাছা। ওদের সাথে পারবে না তুমি।’ তরুণ নিরস্ত হওয়ায় বোঝা গেল লোকটির কথায় যথেষ্ট গুরুত্ব দেয় সে। অসহায় দৃষ্টি ফুটে উঠল চোখে। অজান্তে পিস্তলের কাছাকাছি চলে গেছে হাত। ‘যথেষ্ট হয়েছে, ছেড়ে দাও ওকে,’ নিরুত্তাপ স্বরে নিজের উপস্থিতি ঘোষণা করল ড্যানি লসন। ঝট করে ঘুরল লোকটি, জুলিয়ার হাত ধরে ছিল যে। খানিকটা বিস্ময় ওর চোখে, কিন্তু নিমেষেই রাগ ফুটে উঠল সেখানে। ‘সাহস তো কম নয়, আয়াকে বাধা দিতে এসেছ! তোমার ঘাড়ে ক’টা মাথা আছে, স্ট্রেঞ্জার?’ লোকটাকে স্রেফ উপেক্ষা করল লসন, জুলিয়া লারকিনের উদ্দেশে ক্ষীণ নড করল। উত্তরে হাসার চেষ্টা করল জুলিয়া, কিন্তু প্রায় বিদঘুটে দেখাল হাসিটা। ‘হারামজাদার সাহস দেখো, কেমন চালবাজি করছে!’ তড়পে উঠল লোকটি। এবার যেন ওদের উপস্থিতি সম্পর্কে সচেতন হলো লসন, লোকটার দিকে ফিরল। খুঁটিয়ে দেখল তাকে: তাগড়া শরীর, চৌকো আকৃতির মুখ, চোখে শীতল দৃষ্টি। উরুর হোলস্টারে পিস্তলের চকচকে বাঁট উঁকি দিচ্ছে। জুলিয়ার হাত ছেড়ে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল সে, পা ফাঁক হয়ে আছে। ‘কাজটা তুমি ভাল করোনি, নিকোলাস গ্রীন। অন্য কোন শহর হলে এতক্ষণে
পৃষ্ঠা-৩৪
তোমাকে একটা কটনউডের কাছে নিয়ে যেত লোকজন। জেরেমি টাউনে…’ ‘আমার যা ইচ্ছে করব, তাতে তোমার কি?’ রুক্ষ, শীতল স্বরে ওকে বাধা দিল নিকোলাস গ্রীন। ‘কাউকে পরোয়া করি না আমি!’ অবজ্ঞা ফুটে উঠল দৃষ্টিতে, আড়চোখে সঙ্গীদের একবার দেখে নিল সে। ‘ওখান থেকে সরে এসো,’ শান্ত স্বরে নির্দেশ দিল লসন। ‘নিকুচি করি তোমার। এমন ভাব করছ যেন…’ শেষ করল না সে, রাগে কুৎসিত হয়ে গেছে মুখ; চোখে বেপরোয়া দৃষ্টি। টান টান হয়ে আছে শরীর। পিস্তল ছুঁইছুঁই করছে ডান হাত। ‘সাবধান, নিক!’ সতর্ক কন্ঠে বলল ওর এক সঙ্গী। ‘ও ড্যানি লসন।’ নিমেষে শিথিল হয়ে গেল গ্রীনের শরীর। যুগপৎ বিস্ময় আর ভয় ফুটে উঠল চাহনিতে, চেহারা দেখে মনে হলো তপ্ত লোহার ছ্যাকা খেয়েছে যেন। ধীরে ধীরে হোলস্টারের ওপর থেকে হাত সরিয়ে নিল সে। ‘ভাগো সবাই! বেঁচে থাকতে চাইলে এমন কাজ আর কোরো না।’ ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠল গ্রীনের মুখে, কিছুটা হলেও সামলে নিয়েছে নিজেকে। ‘হয়তো, লসন। তবে আজকের ব্যাপারটা সহজে ভুলছি না। মওকামত যদি একবার পাই, ঠিকই গেঁথে ফেলব তোমাকে।’ বলে আর দাঁড়াল না যে, সঙ্গীদের ইশারা করে কাছের সেলুনে গিয়ে ঢুকল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল জুলিয়া লারকিন, ছুটে নামল ওয়্যাগন থেকে। দৌড়ে গিয়ে চাচার পাশে বসে পড়ল। কামারের দোকানের পোর্চে দাঁড়ানো দু’জনের দিকে তাকাল লসন। বয়স্ক লোকটির ওপর স্থির হলো ওর দৃষ্টি। ‘দয়া করে সাহায্য করবে ওদের?’ মাথা ঝাঁকাল সে। ‘আমার নাম কার্টিস, টিম কার্টিস।’ ‘এক বালতি পানি নিয়ে এসো,’ লারকিনকে দেখিয়ে বলল লসন, ‘ওর জ্ঞান ফেরানোর ব্যবস্থা করো।’ কামারের দোকানে ঢুকে গেল লোকটা, ফিরে এল একটু পর। গামলা উপুড় করে পানি ঢালল বিল লারকিনের মুখে। খানিক পর জ্ঞান ফিরে পেয়ে উঠে বসল মাইনার। প্রবল ভাবে মাথা নাড়ল বার কয়েক, শূন্য দৃষ্টি চোখে। তারপর ঘটনা মনে পড়ে যেতে চমকে তাকাল পাশে বসা জুলিয়া আর কার্টিসের দিকে। আড়ষ্ট দেহে উঠে দাঁড়াল সে, রাস্তার এপাশে চোখ পড়তে গ্রুলার স্যাডলে একই ভঙ্গিতে মবসে থাকা ড্যানি লসনকে দেখতে পেল। বুঝতে পারল ঠিক কি ঘটেছে। ‘তারপর, ড্যানি লসন, আবার দেখা হয়ে গেল আমাদের, না?’ ক্লিষ্ট হেসে বলল লারকিন, চাহনিতে নীরব কৃতজ্ঞতা ঝরে পড়ছে। ‘দেখা যাচ্ছে সময়মত উপস্থিত হয়ে যাওয়ার অভ্যাসটা যায়নি তোমার!’ নড করল লসন, কিছু বলল না। নিকোলাস গ্রীন যে সেলুনে ঢুকেছে সেটার দিকে তাকাল। বলা যায় না রাইফেল হাতে জানালায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে সে, সুযোগসন্ধানী এসব লোককে ভাল করে চেনা আছে ওর। সামনাসামনি লড়ার সাহস না থাকলেও মওকা পেলে পিঠে গুলি করতে এতটুকু বাধবে না গ্রীনের। ওয়্যাগনে চড়ল লারকিনরা। স্যামুয়েল কার্টিসকে ধন্যবাদ জানিয়ে ওয়্যাগন
পৃষ্ঠা-৩৫
ঘুরিয়ে দক্ষিণে এগোল। ঘোড়া দাবড়ে পাশে চলে এল লসন। ‘কি এমন জরুরী কাজ পড়ল যে ওকে নিয়ে আসতে হলো তোমার?’ বিল লারকিনের উদ্দেশে জানতে চাইল ও। প্রশ্নটার উত্তর তখনই দিল না সে। ‘তোমাদের পরিচয় হয়নি বোধহয়। ও জুলিয়া, আমার ভাতিজি। আর এ হচ্ছে ভবঘুরে ড্যানি লসন। মানুষের উপকার করে বেড়ায়!’ হালকা চালে বলল বিল লারকিন, কণ্ঠে তামাশার সুর থাকলেও স্পষ্ট বোঝা গেল দু’জনের সম্পর্কটা অনেক গভীর এবং আন্তরিক। সিগার ধরিয়ে এবার লসনের প্রশ্নের উত্তর দিল সে। ‘হ্যাঁ, আসতে হলো ওর কারণেই। আমি একা মানুষ, কোন রকমে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু জুলি আসার পর বলল ঘরটাকে গোছাবে, কিছু জিনিস কেনার জন্যেই শহরে আসা। আমার সঙ্গে আসার জন্যে জেদ ধরল জুলিয়া। পিট আসতে চেয়েছিল, কিন্তু ও তো এখানে একেবারে নতুন। তাই আমিই এলাম। কিন্তু আমিও কিছু করতে পারলাম না। আরেকটু হলে সর্বনাশ ঘটতে যাচ্ছিল। ভেবে দেখো, কি রকম বেপরোয়া হয়ে গেছে ওরা। একটা মেয়ের সঙ্গে জোর করতেও বাধছে না!’
‘তোমাকে ওরা অজ্ঞান করল কিভাবে?’ ‘ভাবতেই পারিনি এতটা সাহস করবে ওরা। কেনাকাটা শেষে স্টোর থেকে বেরিয়ে এসে ওয়্যাগনে উঠতে যাব এসময় সামনে পথরোধ করল একজন, পেছন থেকে এল অন্যরা। কিছু বোঝার আগেই একটা ডিম তৈরি করে দিল মাথায়।’ হেসে ‘ডিম’টার ওপর আলতো হাত বুলাল সে। ‘শালারা, মেরেছেও বেশ জোরে!’ ‘আমি দুঃখিত,’ ম্লান স্বরে এই প্রথম মুখ খুলল জুলিয়া। ‘বুঝতেই পারিনি এমন কিছু হতে পারে।’ গলাটা ঝংকার তুলল লসনের কানে, ওর কাছে মনে হলো প্রিয় একটা বাদ্য শুনেছে। আরেকবার শোনার ইচ্ছে হলো, কিন্তু চুপ মেরে গেছে মেয়েটা। ‘তোমার কোন দোষ নেই, বাছা,’ প্রবোধ দিল বিল লারকিন। ‘তুমি তো নতুন। এখানে বহু বছর ধরে আছি আমি, অথচ পাত্তাই পেলাম না। আসলে কখন কি ঘটবে সেটা আগে থেকে বোঝা সম্ভব নয়, অন্তত জেরেমি টাউনের মত শহরে।’ শহর থেকে বেরিয়ে এল ওরা। নদী আর ক্লেইমের দিকে চলে যাওয়া ট্রেইল ধরে এগোল ওয়্যাগন। ‘কোবার্নের অফিসে যাব আমি,’ ঘোড়ার গতি কমিয়ে বলল লসন। ‘পরেও যেতে পারবে,’ বিরক্ত দেখাল বিল লারকিনকে। ‘আগে আমার ওখানে চলো। কিছুক্ষণ গল্প করি, এতদিন পর দেখা হলো!’ ‘কাজ শেষ করে আসব হয়তো।’ ‘হয়তো কি, অবশ্যই আসবে।’ জুলিয়ার উদ্দেশে নড করে ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিল লসন। ট্রেইল থেকে সরে এসে হ্যান্স কোবার্নের অফিসের দিকে এগোল। পোর্চে দুই ক্রুকে দেখতে পেল ও, মাত্র বেরিয়ে এসেছে। রেইলে বাঁধা ঘোড়ায় চড়ল লোকগুলো, লসনকে দেখে কৌতূহলী দৃষ্টিতে অকাল একজন।
পৃষ্ঠা-৩৬
‘ওকে দেখা ছাড়াও যথেষ্ট কাজ আছে আমাদের, টেড,’ তাড়া দিল অন্যজন। ‘নাও, চলো এবার!’ নির্বিকার মুখে স্যাডল ছাড়ল লসন, প্রায় উপেক্ষা করল দুই ক্রুকে। রেইলের সঙ্গে লাগাম বেঁধে ভেতরে ঢুকে পড়ল। না তাকিয়েও বুঝতে পারছে টেড নামের লোকটার দৃষ্টি আটকে আছে ওর পিঠে। ফাঁকা অফিস রূমে একটা চেয়ারে বসে সিগারেট রোল করল ও। একটু পর হ্যান্স কোবার্নকে দেখা গেল ওপাশের দরজায়। ওকে দেখে খুশি হয়ে উঠল সে। ‘আরে, ড্যান যে। সকালে উঠেই তোমার মুখ দেখছি। অথচ ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি আবার দেখা হবে!’ চেয়ারে বিশাল শরীর ছেড়ে দিয়ে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল সোনা ব্যবসায়ী। ‘হয়তো আমি যা চাই-সাপ্লাই পৌছে দেয়ার দায়িত্ব নেবে তুমি।’ ‘একটা দুঃসংবাদ আছে তোমার জন্যে।’ কিছু না বলে তাকিয়ে থাকল হ্যান্স কোবার্ন, গম্ভীর হয়ে গেছে মুখ। ‘জেসি ওয়েনের সঙ্গে আলাপ করতে দেখলাম তোমার ক্রুদের।’ নিচু স্বরে শিস বাজাল কোবার্ন, তারপর স্মিত হাসল। জেরেমি টাউনে আসার পথে একসঙ্গে রাইড করেছে ওরা, ওয়্যাগন যাত্রীদের পরস্পরের মধ্যে আলাপ হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ড্যানি লসনকে চেনে বলেই জানে তথ্যটার যথেষ্ট গুরুত্ব আছে। প্রকাশ করা দূরে থাক, না জেনে কাউকে সন্দেহ করার লোক নয় লসন। তারমানে, সত্যিই ডাল মে কুচ কালা হ্যায়-ওর আশঙ্কাই সত্যি হতে যাচ্ছে। তবে খুশি হওয়ার মত একটা ব্যাপারও আছে। ড্যানি লসন যখন নিজ থেকে খবরটা দিতে এসেছে, এর মানে একটাই: ওকে সাহায্য করতে চাইছে সে। ‘তারমানে—আমার আন্দাজ যদি মিথ্যে না হয়,’ খানিকটা প্রসন্ন সুরে বলল কোবার্ন। ‘সাপ্লাইয়ের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠেছ তুমি।’
সোনা ব্যবসায়ীর আগ্রহ দেখেও না দেখার ভান করল লসন। ‘মনে হচ্ছে খবরটা শুনে অবাক হওনি, অথচ তোমার ঘাবড়ে যাওয়ার কথা।’ ‘উঁহু, দু’জনের কাউকে গোনার মধ্যে ধরছি না আমি। ইচ্ছে করলেই পাওনা চুকিয়ে ছাঁটাই করে দিতে পারি। আমার মাথায় এখন অন্য চিন্তা-কিভাবে কাজটা তোমাকে গছানো যায়!’ মুখে কিছু বলল না লসন, এমনকি ক্ষীণ নডও করল না। ‘ওয়্যাগন চালাবে কে?’ রোল করা সিগারেট ধরিয়ে নিরুত্তাপ স্বরে জানতে চাইল। ‘টিম কার্টিস। সাথে এক তরুণ আছে।’ ‘ওদের বোধহয় বিশ্বাস করা যায়। আমার কাছে খারাপ মনে হয়নি।’ ‘ছেলেটা অবশ্য ছটফট করে খুব। তবে অভিজ্ঞ বা নিজের চেয়ে সেয়ানা লোককে সমীহ করে।’ টড মার্টিন কফি দিয়ে যেতে নীরব হয়ে গেল সোনা ব্যবসায়ী। ‘আরেকটা প্রস্তাব দিতে চাই তোমাকে, কফির মগ তুলে চুমুক দিল কোবার্ন, মগের কিনারার ওপর দিয়ে পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল লসনের দিকে। ‘এখানে তোমাকে দরকার আমাদের, ড্যান। তৎক্ষণাৎ মাথা নাড়ল লসন। কফির মগ তুলে চুমুক দিল।
পৃষ্ঠা-৩৭
হতাশ হলো না কোবার্ন। আনমনে শ্রাগ করল, কিছুটা হলেও নিশ্চিন্ত বোধ করছে। অন্তত সাপ্লাইয়ের ব্যাপারে তো রাজি করানো গেছে বেয়াড়া লোকটাকে! ‘যাকগে, তোমার ওপর জোর করব না। সোনা পৌঁছে দিতে রাজি হয়েছ, এতেই খুশি আমি। এক কাজ করা যাক—আগাম একটা ঘোষণা দিয়ে দেব নাকি? তুমি গার্ডের দায়িত্বে আছ জানলে অনেকেই স্টেজ লুঠ করার সাহস করবে না।’ চুপ করে থাকল লসন, মুখ দেখে মনে হচ্ছে আপত্তি নেই। কিন্তু সে জানে নেইল ডেভিস তাতে পিছিয়ে যাবে না, ঠিকই সুযোগের অপেক্ষায় থাকবে লোকটা। বুঝে-শুনে আক্রমণ করবে, বিন্দুমাত্র ঝুঁকি নেবে না। পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে না হলে হামলাই করবে না, কারণ বরাবর নিজের নিরাপত্তার কথা আগে ভাবে সে। ওয়্যাগন গার্ডের দায়িত্বে কে থাকল বা না-থাকল তাতে ওর পরিকল্পনায় রদবদল হবে না; স্রেফ সুযোগ খুঁজবে সে এবং পেলে নির্দ্বিধায় সেটা লুফে নেবে। ড্যানি লসন কেন, হিকক বা শ্যাননও যদি গার্ডের দায়িত্বে থাকে, পিছিয়ে যাবে না দুর্ধর্ষ এই আউট-ল।
জেসি ওয়েন আরেকজন। ওর দুই চ্যালা থাকবে সাপ্লাইয়ের সঙ্গে। বাড়তি এই সুবিধের কারণে, এবং দুই ক্রু সময়মত তৎপর হতে পারলে অনায়াসে স্টেজ লুঠ করতে পারবে সে। ‘তোমার ক্রুদের ছাঁটাই করার দরকার নেই, ভুলেও কিছু বোলো না। ওরা জানুক ওদের সম্পর্কে কিছুই জানি না আমরা।’ ‘বেশি ঝুঁকি নেওয়া হয়ে গেল না?’ ‘কিছুটা আছে, তবে সুবিধাও আছে। ওদের ওপর চোখ রাখব আমি। লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে, চার-পাঁচ দিনের যাত্রায় যে কোন জায়গায় আক্রান্ত হতে পারি আমরা। ওদের কাজ-কারবার দেখে আভাস পাব ঠিক কোথায় হামলা করতে পারে জেসি ওয়েন।’ যুক্তিটা অস্বীকার করা যাচ্ছে না। ‘ঠিক আছে, এ ব্যাপারে তুমিই সবচেয়ে অভিজ্ঞ লোক,’ হেসে সিগার ধরাল সোনা ব্যবসায়ী। তারপর হালকা সুরে যোগ করল, ‘মাথা গেলে তোমার যাবে, আমার তো নয়! আমার গেলে যাবে কেবল সোনা।’ ‘পুরানো চুক্তিতে কাজ করব না আমি,’ জানাল লসন। ‘সোনার দামের পাঁচ পার্সেন্ট বখরা আমার।’ ‘তুমি দেখছি এ শহরের ব্যবসায়ীদের মত হয়ে গেছ, ড্যান!’ কৃত্রিম অভিযোগের সুরে বলল কোবার্ন। ‘সুযোগ পেয়ে বেশ খসিয়ে নিচ্ছ আমাদের কাছ থেকে।’ ‘এর কমে আর কেউ তোমাকে নিশ্চয়তা দিতে পারবে না।’ ‘জানি, বাছা,’ হাত বাড়িয়ে দিল হ্যান্স কোবার্ন। ‘তাহলে ওই কথাই থাকল। কাল সকালে এখান থেকে রওনা দেবে স্টেজ। সাথে আমার ক্রুরাও থাকছে।’ মাথা ঝাঁকিয়ে উঠে দাঁড়াল লসন, সিগারেটের শেষাংশ গুঁজে রাখল ছাইদানিতে। মাথায় হ্যাট চাপিয়ে দরজার দিকে এগোল। ‘মেরীকে আমার শুভেচ্ছা জানিয়ো।’
পৃষ্ঠা-৩৮
বেরিয়ে এসে ঘোড়ায় চড়ল ও, তারপর শহর ছেড়ে পাহাড়ের দিকে এগোল। নদীর আনাচে-কানাচে কোন জায়গাই বাদ দেয়নি সোনা সন্ধানী লোকগুলো, যত্রতত্র ক্লেইম করেছে। সূর্য এখন ঠিক মাথার ওপর। রোদে পিঠ তাতাচ্ছে। শহরের প্রবেশ মুখে ‘জেরেমি টাউন’ সাইনবোর্ডটা দেখে ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল ওর ঠোট থেকে। ক্ষণিকের জন্যে থেমেছিল ও, তারপর আলতো স্পার দাবাল, হালকা নচালে এগোল গ্রুলাটা।
শহরটা এখন শান্ত। পাহাড়ের ওপর থেকে প্রায় পুরো শহরই চোখে পড়ছে, তড়িঘড়ি করে তৈরি দালান, লগ আর কাঠের তৈরি কাঠামো, ক্যান্টিনা, তাঁবু…সবকিছুতে অযত্নের ছাপ। তবে সময়ে সবই বদলে যাবে, যদি সময় পায় জেরেমি টাউন-যদি টিকে থাকে। সব শহরই কিছু কিছু সুবিধা উপহার দেয়। এখানকার সুবিধা হচ্ছে সোনা। কিন্তু সোনাতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই লসনের। পাহাড়ের ওপাশে সত্যিকার এক সোনার সন্ধান জানা আছে ওর নয়ন জুড়ানো তৃণভূমি, নির্মল ঝর্না আর আলো- ছায়ায় ঘেরা নির্জন এক উপত্যকায় স্বপ্নের মত সুন্দর একটা বাথান। সেটা ছেড়ে কেন হলুদ ধাতুর পেছনে ছুটবে, যেখানে লোভ আর ঈর্ষার আগুনে পোড়ার সম্ভাবনা ষোলো আনা? পত্রিকা অফিসের পোর্চে দাঁড়িয়ে আছে জেফরি হ্যালার্ড। পাশের জেনারেল স্টোরের ফুটপাতে বসে সিগারেট রোল করছে টিম কার্টিস। সময় নিয়ে কাজটা সারল সে, তারপর দক্ষ হাতে নখে কাঠি ঘষে আগুন জ্বালাল। কার্টিসের কথায় মনোযোগ সরে গেল হ্যালার্ডের, অপেক্ষাকৃত কমবয়েসী তরুণকে বলছে সে: ‘আজও পাহাড়ের ওদিকে দেখেছি ওকে। ভাবগতিক সুবিধের ঠেকছে না, বব। আসলে শহরের ওপর নজর রাখছে ডেভিসের দলবল। ও যদি সোনা লুঠ করার চেষ্টা না করে তাহলেই বরং অবাক হব আমি।’ লোকটাকে চিনতে পারল হ্যালার্ড। ভবঘুরে টাইপের, তবে স্টেজকোচ ড্রাইভার হিসেবে দক্ষ। উল্টোদিকে তাকাতে আইক জেসাপকে রাস্তায় দেখতে পেল। তার পাশেই ধূসর রঙের সুট পরা এক লোক, দু’হাত কোমরে রেখে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ল-অফিসের দিকে। ‘আইক, তাসগুলো এখনও তোমার কথামত চলছে তো?’ হালকা সুরে জানতে চাইল সে। ‘অবশ্যই, ওয়েন, তাস সবসময় আমার ইচ্ছেমত চলে। ওটাই আমার পেশা কিনা।’ কিছুক্ষণ নীরব থাকল দু’জনেই, তারপর একটা সিগার ধরাল জুয়াড়ী। ‘মিনিট কয়েক আগে একটা নোটিশ পেয়েছি।’ ‘নোটিশ!’ ‘মার্শালের অফিস থেকে এসেছে নোটিশটা। বলা হয়েছে-সব ধরনের জুয়ায় লাভের দশ-শতাংশ মার্শাল বা ডেপুটিদের কাছে জমা দিতে হবে।’
পৃষ্ঠা-৩৯
এ ধরনের নোটিশের কথা এই প্রথম শুনলাম।’ ‘ ‘আমিও। তবে শহরের সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে সব বাসিন্দাদেরই কিছু না কিছু দেয়া উচিত। আমারও আপত্তি নেই। কিন্তু হুকুম করে টাকা আদায়ের ব্যাপারটা পছন্দ হচ্ছে না।’ সামান্য মাথা ঝাঁকাল ওয়েন নামের লোকটা। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ঝুলছে, তাচ্ছিল্য আর বিদ্রূপ প্রকাশ পাচ্ছে। ‘তুমি বরং ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলো মার্শালের সঙ্গে।’ ‘উঁহু, তা করতে যাচ্ছি না আমি। টাকা আদায় করার জন্যে নিজেই আসবে সে। আমার কাছ থেকে যদি দশ পার্সেন্ট আদায় করতে পারে, তাহলে মনে করব সত্যিই সেটা ওর প্রাপ্য!’ বলে আর দাঁড়াল না আইক জেসাপ, উল্টো ঘুরে ঢুকে পড়ল নিজের সেলুনে।
অজানা এক অস্বস্তি বোধ করছে জেফরি হ্যালার্ড। বুঝতে পারছে না গ্যারি লোফার্ট আদৌ কতটা কাজ দেখাতে পারবে, মার্শাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বেপরোয়া লোকগুলোকে খুঁচিয়ে ত্যক্ত করছে না তো? চিন্তিত মনে হ্যান্স কোবার্নের অফিসে ঢুকল ও। নিজের টেবিলে বসে আছে সোনা ব্যবসায়ী। চোখে-মুখে উৎফুল্ল ভাব। ‘খবর আছে একটা, জেফ।’ হ্যালার্ডকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠল। ‘সাপ্লাইয়ের দায়িত্ব নিয়েছে লসন।’ ফাটা বেলুনের মত চুপসে গেল হ্যালার্ড, শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল কোবার্নের দিকে। একটা চেয়ারে বসে নিজেকে সামলে নিল সে, গম্ভীর হয়ে গেছে মুখ। ‘পাঁচ পার্সেন্ট মজুরি দাবি করেছে ও।’ ‘এত টাকা! এক হাজার খরচ করলে ওর মত ডজনখানেক লোক পাওয়া যাবে।’ ‘তা পাওয়া যাবে,’ স্বীকার করল কোবার্ন। ‘কিন্তু তাদের কেউই ড্যানি লসন হবে না। ওর মত নির্ভরযোগ্য বা বিশ্বস্তও হবে না।’ ‘যাক্সে, ওটা তোমার ব্যাপার,’ শ্রাগ করল স্কুল মাস্টার। ‘তোমার যাকে ইচ্ছে নেবে, আমার তাতে কিছু আসে-যায় না।’ শহরের অবস্থা কি?’ ‘ ‘ভাল…বেশ ভাল। গ্যারি লোফার্টকে মার্শাল হিসেবে নিয়োগ দিয়েছি আমরা। সঙ্গে দুই সহকারী আছে ওর।’ স্মিত হাসল কোবার্ন। ‘লোফার্ট কয়েক ধাপ এগিয়েছে বটে, তবে এবার ভুল শহর বেছে নিয়েছে। বেশিক্ষণ টিকতে পারবে না ও। লোক হিসেবেও তেমন সুবিধের নয়…’ ‘ওকে চেনো তুমি?’ ‘নিশ্চয়ই। ও আসলে চোর। জেরেমি টাউনের মত নতুন শহর খুঁজে বেড়ায়। মার্শালের ব্যাজ পেলেই জুয়াড়ীদের ওপর জমা-খরচ শুরু করে। তাদের বাগে আনতে পারলে তারপর ধরে ব্যবসায়ীদের। কেউ ওর সঙ্গে সহযোগিতা না করলে
পৃষ্ঠা-৪০
কোন না কোন দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় লোকটা। নশূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল হ্যালার্ড, বুঝতে পারছে ঠিকমত জেনে-শুনে লোক নিয়োগ না করে দারুণ বোকামি করেছে। গ্যারি লোফার্ট যদি থমসন আর কিনকেডকে হটিয়েও দেয়, নির্ঘাত শহরের নিরীহ লোকজনের ওপর চড়াও হয়ে বসবে। সে আরেক বিপদ! রাগ হলেও নিজেকে সামলে নিল হ্যালার্ড। ওদের ক্রেইমে থমসনের আগমনের ঘটনা জানাল। নীরবে পুরোটা শুনল সোনা ব্যবসায়ী। ‘হারপার হয়তো ঠিকই বলেছে, আবার আসবে থমসন। তবে ওর চেয়েও বেশি ঝামেলাবাজ লোক আছে এখানে। রক্স, কিনকেড ক’জনের নাম জানি আমরা!’ থেমে কি যেন ভাবল সে। ‘জেফ, তুমি অস্বীকার করলেও এটা সত্যি যে গ্যারি লোফার্টের চেয়ে অনেক বেশি কঠিন লোকের দরকার এখানে। লোফার্টের মত লোককে আমলই দেবে না কিনকেড। ধরো, শ্যাননকে আনালে তুমি, সে-ও যে গুরুত্ব পাবে তা নয়। এখানে জুড়ে বসেছে ওরা, বিশাল লাভের সম্ভাবনা সামনে। স্বয়ং শয়তান এলেও তাকে লড়াই করতে হবে। ওদের হারাতে পারলেই কেবল শান্তি আসবে জেরেমি টাউনে। ‘সকালে কি ঘটেছে, জানো? বিল লারকিন আর ওর ভাতিজিকে পেয়ে বসেছিল রক্সের তিনজন লোক। হঠাৎ করে সেখানে উপস্থিত হয় লসন। ওর সঙ্গে লাগার সাহস করেনি লোকগুলো। এমন লোকই দরকার আমাদের, যাকে ভয় পাবে ওরা, সমঝে চলবে।’ উঠে দাঁড়াল জেফরি হ্যালার্ড। ‘পিস্তল নাচিয়ে বেড়াবে সবার সামনে? যাতে নিরীহ মানুষ ওর ছায়াও না মাড়ায়, তাই না? কিনকেড বা রক্সের সাথে তাহলে ওর পার্থক্য কোথায়? আইনের লোকের চেহারা যদি এরকম ভয়ঙ্কর হয়, তাহলে শহরটা চলবে কি করে? বাচ্চা বা মহিলারা সেখানে যাবে কখনও?’ হাত উঁচিয়ে হার মানল সোনা ব্যবসায়ী। ‘আমার কথা ফিরিয়ে নিচ্ছি, জেফ। স্পষ্ট বুঝতে পারছি এক লাইনে চিন্তা করছি না আমরা।’ ‘শান্তিপূর্ণ একটা শহর গড়তে হলে সবার সহযোগিতা দরকার, ওদের বলব আমি। আমার কথা শুনবে নিশ্চয়ই, যুক্তি দিয়ে বোঝাব সবাইকে।’ ‘দয়া করে ও-কাজটি করতে যেয়ো না। তোমাকে নিয়ে মজা করবে ওরা। শোনো, জেফ, ওদের কাছে বাইবেলের বাণী যা, তোমার কথাও তা।’ বিব্রত দেখাল হ্যালার্ডকে। ‘আমি কি তাই বলতে যাব?’ ‘অস্থির হয়ে আছ তুমি, জেফ। ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখো, এমন একটা শহরের কথা বলতে পারবে যেখানে ভাল কথা শুনিয়ে খারাপ লোককে সৎ পথে আনা গেছে? ওটা কেবল গির্জায় সম্ভব, এবং তাতে মন্দ লোকগুলোর নিজেদের উপলব্ধিও দরকার। ওদের গির্জায় পাঠাবে কে? পাঠাতে পারলে না হয় ভাল কিছু কথা শোনানো যাবে। মিথ্যে আশা করে অযথা নিজের হতাশা বাড়াচ্ছ। গ্যারি লোফার্টকে চেষ্টা করতে দাও, দেখা যাক কি করতে পারে ও।’ থ মেরে কিছুক্ষণ বসে থাকল জেফরি হ্যালার্ড। তারপর উঠে দাঁড়াল। ‘তোমার পরামর্শের জন্যে ধন্যবাদ, হ্যান্স। একটা কথা, ড্যানি লসনকে মার্শাল
পৃষ্ঠা ৪১ থেকে ৬০
পৃষ্ঠা-৪১
হিসেবে নিয়োগ দেয়ার প্রস্তাব ছাড়া অন্য যে কোন বিষয়ে নিশ্চিন্তে পরামর্শ দিতে পারো আমাকে। ওর ব্যাপারে আমার ধারণা খুব পরিষ্কার। রক্সের লোকগুলো ওকে ভয় পেয়েছ কেন, জানো? কারণ সে একজন খুনী। ওদের চেয়ে কড়া মাল। নিজের বিপদ ঠিকই টের পেয়েছে ওরা, জানত টিকতে পারবে না লসনের সঙ্গে। এমন লোক যদি এখানকার আইন হয় তাহলে নিরীহ লোকেরা কখনও সুবিচার পাবে?’ কার্ট রক্স হিসেবী মানুষ। কোন কাজ করার আগে বরাবর সম্ভাবনা আর পরিণতির কথা আগে ভাবে সে। এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ভাল করেই জানে জেরেমি টাউনে বিপুল সম্ভাবনা আছে ওর। প্রচুর সোনা আছে এখানে, অন্যরা তুলবে…ও শুধু সেগুলো হাতিয়ে নেবে। ব্যস, কাজ বলতে এটুকুই। অবশ্য সেটাও সহজ হবে না, কিনকেড আর থমসন আছে। শেষপর্যন্ত হয়তো দেখা যাবে নিজেদের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে গেছে।
মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে আছে রক্সের। সকালে ঘুম থেকে উঠেই খবরটা পেয়েছে। নিকোলাস গ্রীনকে একচোট নিয়েছে তারপর। গাধা! মেয়েদের সাথে খারাপ আচরণ করা আর আগুন নিয়ে খেলা পশ্চিমে একই জিনিস। তা-ও যে সে মেয়ে নয়, পূব থেকে আসা সম্ভ্রান্ত একজন মহিলা। বাজারের মেয়ে হলেও একটা কথা ছিল। কার্ট রক্স নিজেও পিচ্ছিল পথের মানুষ, কিন্তু সারা জীবনে অন্তত এই একটা ব্যাপার সবসময় এড়িয়ে গেছে, ভদ্র ঘরের কোন মহিলার সাথে জোর করা দূরে থাক, কখনও দুর্ব্যবহারও করেনি। পশ্চিমের মানুষ এ ব্যাপারে বড় আপসহীন। একজন মহিলা বিপদে পড়লে পাশে এসে দাঁড়াতে দ্বিধা করে না। রক্স নিজে ওখানে থাকলে লসনের মতই শায়েস্তা করত গ্রীনকে, পিটিয়ে তক্তা বানাত হারামজাদাকে। কিছু কিছু জিনিস আছে ওদের জন্যে সত্যিই স্পর্শকাতর, মেয়েমানুষ তার একটি। এখানে মাইনাররা পরস্পরকে সাহায্য করে খুব কম, লোভ আর ঈর্ষাই তার কারণ। বারো কিসিমের এসব লোকই একাট্টা হয়ে যাবে যদি তাদের মেয়েছেলেদের অপমান করে শহরের কেউ। সে মাইনার হলেও ছাড় পাবে না। এটাই পশ্চিমের রীতি। গরুচোর বা ঘোড়াচোর ধরতে পারলে যেমন তৎক্ষণাৎ কোন গাছে লটকে দেয়, তেমনি কোন মহিলার অসম্মান করবে যে লোক ধরা পড়লে একই পরিণতি জুটবে তার কপালে। নির্বিঘ্নে এখানে কাজটা শেষ করতে চায় কার্ট রক্স। চায় না হন্যে হয়ে ওর পেছনে ছুটক খেপা লোকজন। এ জন্যেই আজকের ঘটনা পছন্দ হয়নি ওর। কিন্তু একটা ব্যাপার কাঁটার মত বিঁধে আছে মনে, ড্যানি লসন এখানে এসেছে কেন? মাইনাররা ভাড়া করে আনেনি তো? নাহ্, তেমন হলে ঠিকই খবর পেত। ড্যানি লসনের উপস্থিতি একটা হুমকির মত। কঠিন মানুষ সে, এরকম কয়েকটা শহর ঠাণ্ডা করেছে এর আগে। সকালে ঘটে যাওয়া ঘটনার পর টনক নড়েছে রক্সের। কিনকেডের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছে সেজন্যেই। আলাদা আলাদা ভাবে মোকাবিলা করার চেয়ে দল
পৃষ্ঠা-৪২
বেঁধে ড্যানি লসনকে শিকার করা সহজ হবে। হয়তো জেরেমি টাউনের ব্যাপারে আগ্রহ দেখাবে না দুর্ধর্ষ লোকটা, কিন্তু নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই। তাছাড়া, সাপ্লাইটা সম্পর্কেও আলোচনা করা দরকার। এত বড় একটা চালান চোখের সামনে দিয়ে চলে যাবে, অথচ ওরা কিছু করবে না তা কি করে হয়? জ্যাক চেম্বারল্যান্ডের সেলুনে ঢোকার মুখে সদ্য বেরিয়ে আসা লোকটিকে দেখে থমকে দাঁড়াল কার্ট রক্স। ড্যানি লসনকে চেনে সে। টিম কার্টিস আর বব নামের ছোকরার সঙ্গে বেরিয়ে আসছে। থমকে দাঁড়াল লসন, নিচু স্বরে কি যেন বলল দুই সঙ্গীকে। দ্রুত সরে পড়ল ওরা। একা হয়ে গেল সে। একপাশে সরে গিয়ে দেয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়াল লসন, রাস্তার দু’ধারে সতর্ক দৃষ্টি চালাল। তারপর সরাসরি দশ হাত দূরে দাঁড়ানো কার্ট রক্সের দিকে তাকাল। পরস্পরের ওজন জানে ওরা, কিন্তু এখানে পরিবেশ ও পরিস্থিতি দুটোই ভিন্ন। ক্ষীণ হেসে মাথা ঝাঁকাল লসন। ‘অনেকদিন পর, তাই না, রক্স?’ পকেট হাতড়ে একটা সিগার বের করল রক্স। উত্তরে ছোট্ট করে নড করল। ‘ভাবিনি তোমাকে এখানে দেখতে পাব।’ ‘কেন, এখানে কি আসতে মানা আছে?’ ‘তা নয়’ হেসে বলল রক্স, সময় নিয়ে সিগার ধরাল। ‘এখানকার ব্যাপারটা আলাদা, অ্যাবিলিনের মত নয়। জেরেমি টাউনে কিন্তু সুবিধে করতে পারবে না।’ ‘তাই?’ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল লসন, মাপছে দুর্বৃত্তকে। ‘হ্যাঁ। কিনকেড, ওয়েন, থমসন-প্রচুর বেপরোয়া লোক। ক’জনের সাথে কুলাবে?’ ‘অ্যাবিলিনেও তাই বলেছ, রক্স। শেষে যখন মুখোমুখি হলাম আমরা, পিস্তল বের করতে রাজি হলে না তুমি।’ ‘আমার হিসাবটা একটু অন্যরকম, সবার চেয়ে আলাদা, হেসে ব্যাখ্যা দিল রক্স। ‘জেদের বশে লড়ি না আমি, শুধু লাভ আছে যেখানে সেখানেই পাওয়া যায় আমাকে। তোমার সঙ্গে ডুয়েল লড়লে হয় তুমি, নইলে আমি মারা পড়তাম। তাতে কি লাভ হত আমার? ড্যানি লসন আমার হাতে মারা পড়বে এই স্বপ্ন আমি দেখি না।’ ‘বুঝতে পেরেছি, কোন ঝুঁকি নিতে নারাজ তুমি। যার সাথে ডুয়েলে জেতার সম্ভাবনা বেশি, কেবল তার সামনেই দাঁড়াও, তাই না?’
বিন্দুমাত্র অপ্রতিভ হলো না কার্ট রক্স। ‘ঠিক তাই,’ হেসে একমত হলো সে। ‘কারণ চেষ্টা করলে বহু দিন বেঁচে থাকা যায়।’ ঘাড়ের ওপর আঙুল উঁচিয়ে শহরের পেছনে বুটহিলটা দেখাল। ‘ওখানে শুয়ে থাকার চেয়ে আরও কিছু দিন বেঁচে থাকাই আমার কাছে বেশি আনন্দের। একটাই তো জীবন, সুতরাং এত ঝুঁকি নিয়ে লাভটা কি!’ ‘অদ্ভুত মানুষ তুমি, রক্স। চেলা-চামুণ্ডাকে দিয়ে আমার পায়ে কামড় বসাবে, কিন্তু সাহস করে নিজে কখনও সামনে আসবে না, এই তো?’ ‘ঠিক, খাঁটি কথা বলেছ। আমার মনের কথা।’
পৃষ্ঠা-৪৩
‘হয়তো তোমার ইচ্ছে পূরণ হবে না, এখানেই সামনাসামনি দাঁড়াব আমরা।’ ‘আমার সন্দেহ আছে, লসন।’ মৃদু নড করে এগোল ড্যানি লসন। রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছিল টিম কার্টিস আর রবার্ট অ্যালেন, বেকুব বনে গেছে কার্ট রক্সের সঙ্গে লসনকে এভাবে কথা বলতে দেখে। নার্ভ আছে বটে মানুষটার, নীরব বিস্ময়ের সঙ্গে ভাবল অ্যালেন, পাত্তাই দেয়নি রক্সকে, অথচ সেলুনের ভেতর ওর সাঙ্গপাঙ্গরা ছিল। যেন পুরানো দুই বন্ধুর দেখা হয়েছে বহু দিন পর, অকপটে রক্সের নীচতা তুলে ধরেছে! আপাত দৃষ্টিতে স্বাভাবিক কথাবার্তা হলেও যে কোন একজনের ধৈর্যচ্যুতি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল, তাহলেই নরক নেমে আসত এখানে, জানে অ্যালেন। ‘ও যদি ড্র করত?’ দ্রুত পা ফেলে লসনকে ধরে ফেলল অ্যালেন। ‘তুমি কি জানতে সেলুনে ওর দোস্তরা ছিল?’ মাথা ঝাঁকাল লসন। ‘সেই সাহস নেই ওর। জয় সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে ড্র করবে না রক্স-আর যদি না কোণঠাসা করা যায় ওকে। ও ঠিকই জানত শো- ডাউন হলে প্রথম গুলিটা ওকে করব আমি।’ পেছন থেকে তিনজনের দলটাকে দেখল রক্স, একসঙ্গে পান করার অর্থ কি? দু’য়ে দু’য়ে চার মেলাল সে, তারমানে সাপ্লাইয়ের দায়িত্ব নিয়েছে ড্যানি লসন। চিন্তার কথা, স্টেজ লুঠ করা সহজ হবে না যেখানে লসন থাকছে। সেলুনে গিয়ে কিনকেডের অপেক্ষায় থাকল রক্স। দু’পক্ষে একটা রফা হওয়ার কথা। বিগ থমসনও বাদ যায়নি, যদিও কিনকেড বা রক্স কেউই আমল দেয় না তাকে। শুধু উটকো ঝামেলা এড়ানোর জন্যেই তাকে দলে রাখা।
কোণের একটা টেবিলে বসেছে ও, অনুচরদের বিদায় করে দিয়েছে। ক্ষীণ আপত্তি করছিল গ্রীন, কিন্তু ওর কড়া চাহনি দেখে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। ডিক টেবর হুইস্কি দিয়ে যেতে চুমুক দিল রক্স, কাচের জানালা গলে তাকাল রাস্তার দিকে। ওপাশে নাপিতের দোকানের সামনে অপেক্ষা করছে গ্রীন, সাথে আরও চারজন। দু’জনে প্রায় একইসঙ্গে প্রবেশ করল ওরা। কিনকেড পেছন দরজা দিয়ে, আর থমসন সামনের দরজা দিয়ে। বুটের শব্দে ঘর কাঁপিয়ে এগিয়ে এল বিগ থমসন, নিতান্ত অবহেলার সাথে বাম হাতে একটা চেয়ার টেনে টেবিল থেকে কিছুটা দূরে সরে বসল। ভঙ্গিটা এমন যাতে প্রয়োজনে মুহূর্তের মধ্যে লাফ দিতে পারে বা অনায়াসে পিস্তল বের করতে পারে। আমুদে দৃষ্টিতে রক্সের দিকে তাকাল সে। বোঝা গেল নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবছে। কার্ট রক্স যখন ডেকে পাঠিয়েছে সেটা সম্ভব, ভাবল কিনকেড। রক্সের উল্টোদিকে বসার আগে পেছন ফিরে নিজের লোকদের সরে যেতে ইঙ্গিত করল কলোরাডোর আউট-ল। ‘ওদের বেরিয়ে যেতে বলো, কিনকেড,’ পরামর্শ দিল রক্স। ‘থমসন, তোমার লোকদেরও বলো।’ ‘কেন?’ সন্দিহান চোখে তাকাল থমসন, দৃষ্টিতে চ্যালেঞ্জ। ‘যত কম লোক আমাদের আলোচনা সম্পর্কে জানবে ততই ভাল নয় কি?
পৃষ্ঠা-৪৪
নিজের দলের ওপর আস্থা থাকতে পারে তোমাদের, কিন্তু আমার নেই। আমার ছেলেদের ওপর তোমাদের আস্থা আছে কি?’ ‘নেই, এমনকি তোমার ওপরও নেই,’ স্বীকার করল কিনকেড। ‘এখান থেকে যাওয়ার পর নিজের লোকদের যা ইচ্ছে বলতে পারো, তবে আমি তোমাদের জায়গায় হলে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কিছু বলতাম না।’ ‘যুক্তি আছে তোমার কথায়,’ নিস্পৃহ স্বরে বলল থমসন। ‘ধরো কাউকে হাতের মুঠোয় পেয়ে গেল মার্শাল বা মাইনারদের কেউ। নিজের পিঠ বাঁচানোর জন্যে নির্ঘাত সবকিছু বলে দেবে সে।’ সেই সম্ভাবনা কম হলেও সাবধান থাকা ভাল।’ ‘ হাত নেড়ে নিজের লোকদের বেরিয়ে যেতে বলল কিনকেড। একটু পর থমসনের সঙ্গীরাও বেরিয়ে গেল। ঘণ্টাখানেক পর সন্তুষ্ট হয়ে বেরিয়ে এল ওরা। শহরের পরিস্থিতি, ড্যানি লসন আর সোনার চালান সম্পর্কে বিস্তর আলোচনা করেছে। সিদ্ধান্ত নিয়েছে লসন ঝামেলা করলে তাকেও ছেড়ে দেবে না। তিন দলের মধ্যে যতটা সম্ভব সম্ভাব বজায় রেখে সহাবস্থান করবে শহরে, নিজেদের মধ্যে সংঘাত এড়িয়ে চলবে। কিন্তু সোনার চালানের ব্যাপারে কেউ কাউকে ছাড় দিতে বা সহযোগিতা করতে অনিচ্ছুক; যার যার নিজস্ব চেষ্টায় উদ্দেশ্য সফল করতে হবে। তবে সবার আগে, জমকাল অভ্যর্থনা দেবে জেরেমি টাউনের নতুন মার্শালকে। বিকেলে আবারও শহরে এল জেফরি হ্যালার্ড। কিন্তু খবর শুনে মোটেই সন্তুষ্ট হতে পারল না। ডিক ফেল্টনের অফিসে ঢুকে দেখল পত্রিকার পরের সংখ্যার কাজ করছে সে। ঘেমে সারা সাংবাদিক, টেবিলে বসে কফি গিলছে; চোখে-মুখে এক ধরনের প্রশান্তি, টানা খাটুনির পর কাজ শেষ করতে পারলে যে ধরনের প্রশান্তি অনুভব করে মানুষ। ‘খরর শুনেছ?’ টেবিলের ওপর রিপোর্টের খসড়া দেখিয়ে হালকা সুরে বলল সাংবাদিক। ‘এ শহর এখন নরক। শহরের শেষ মাথায় সেলুন খুলেছিল হ্যাংক মিচেল। দুপুরে ওকে খুন করেছে গ্যারি লোফার্ট। সেলুন থেকে মার্শালের পিছু পিছু বেরিয়ে এসেছিল মিচেল, কিন্তু লোফার্টের দুই স্যাঙাৎ তৈরি ছিল রাইফেল নিয়ে। কোন সুযোগই পায়নি মিচেল।’ ‘তারপর?’ ঢোক গিলে তথ্যগুলো হজম করার চেষ্টা করল হ্যালার্ড। ‘মিচেলকে মেরে ওরা ভাবল পুরো শহর ওদের আয়ত্তে চলে এসেছে। লাভের বখরা আদায় করতে আইক জেসাপের কাছে গিয়েছিল ডেপুটিরা। স্রেফ না বলে দিয়েছে জেসাপ, মুখের ওপর হেসেছে ওদের প্রস্তাব শুনে। খেপে গিয়ে পিস্তল বের করেছে দুই ডেপুটি। কিন্তু ওরা তো জেসাপের চেয়ে দ্রুত পিস্তল বের করতে পারে না! দু’জনেই মারা গেছে।’ ‘আর লোফার্ট?’ ‘কিনকেড আর রক্স ওকে ধরল বটে, কিন্তু পেটানোর কাজটা একাই করেছে
পৃষ্ঠা-৪৫
থমসন। অমন পিটুনি কখনও দেখিনি আমি, জেফ, দেখতেও চাই না। শেষে মার্শালের ব্যাজটা পাছায় গেঁথে দিয়ে ঘোড়ার ওপর শুইয়ে লোফার্টকে শহর থেকে তাড়িয়েছে ওরা।’থমথমে দেখাচ্ছে হ্যালার্ডের মুখ। লজ্জায় আর রাগে মরে যেতে ইচ্ছে করছে। ওর সিদ্ধান্ত আবারও ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কি করা যায় এখন? মিনিট ত্রিশের মধ্যে জেফরি হ্যালার্ডের কেবিনে জরুরী মীটিং-এ বসল ওরা। মাইনার আর শহরের লোকজন, সব মিলিয়ে দশজন। একেকজন একেক পরামর্শ , কেউ কারও মতামতে গুরুত্ব দিচ্ছে না। দিচ্ছে ‘লসনকে দরকার,’ দৃঢ় কণ্ঠে বলল বিল লারকিন। ‘এ মুহূর্তে কেবল ওর ওপরই আস্থা রাখা যায়।’ ‘লসন কেন? ও ছাড়া কি আর কেউ নেই?’ ‘না। ওর মত পিস্তলবাজ থাকতে পারে, কিন্তু ওর মত বিশ্বাসী এবং সাহসী পিস্তলবাজ আর নেই।’ ‘কিন্তু কেউ পিস্তলের মুখে শহর শান্ত রাখুক তা আমার পছন্দ নয়।’ ‘পছন্দ না হতে পারে, কিন্তু এছাড়া উপায়ও নেই,’ সোজাসাপ্টা বলল এক ব্যবসায়ী। ‘চোর-ডাকাত, খুনী, বদমাশ জোচ্চোরে ভরে গেছে এই শহর। ভাল কথা বললে স্রেফ হাসবে ওরা। তুমি আছ পাহাড়ের মাথায়। ওসব গণ্ডগোলের কিছুই এখানে আসে না। কিন্তু আমাদের থাকতে হবে শহরের মাঝখানে, ওসবের মধ্যে। নিরাপত্তা চাই আমরা, শান্তিতে ব্যবসা করতে চাই।’ তার কথার সত্যতা প্রমাণ করতেই যেন শহরের কোথাও গর্জে উঠল কয়েকটা পিস্তল। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল জেফরি হ্যালার্ড, থমথমে দেখাচ্ছে মুখটা। ‘ঠিক আছে, পারলে ড্যানি লসনকে নিয়ে এসো তোমরা, আমার আপত্তি নেই,’ তিক্ত স্বরে ঘোষণা দিল সে। কিন্তু প্রস্তাব নিয়ে যাবে কে? ঠিক হলো ফেল্টন যাবে হ্যালার্ডের সঙ্গে। অথচ সারা শহর খুঁজেও কোথাও পাওয়া গেল না ড্যানি লসনকে। স্রেফ হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে যেন সে!
পৃষ্ঠা-৪৬
পাঁচ:- সেদিনের দৈনিকে বড়বড় অক্ষরে প্রকাশিত হলো সংবাদটা:জেরেমি টাউন থেকে পঞ্চাশ হাজার ডলারের সোনার চালান যাচ্ছে মন্টানায়। আগামীকাল রেডরকের উদ্দেশে যাত্রা করবে এই শহরের প্রথম চালান। শটগান হাতে পাহারায় থাকবে ড্যানি লসন।
অপরিচিত এক ড্রিফটার খবরটা দেখেই চেঁচিয়ে উঠল: ‘দেখেছ, বোকার হদ্দ আর কাকে বলে! এসব খবর এভাবে প্রচার করে কেউ? এরা দেখছি নিজেরাই লুঠপাটের ব্যবস্থা করে দিয়েছে!’ পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল বয়স্ক এক লোক, মৃদু রহস্যময় হাসি দেখা গেল তার ঠোঁটে। ‘ঠিকই করেছে ওরা। ড্যানি লসনের নাম প্রচার করে আসলে সতর্ক করে দিচ্ছে সবাইকে। কারও সোনা লুঠ করার ইচ্ছে থাকলে ওই নামটা দেখে সাহস করবে না আর।’
পরদিন ভোরে জেরেমি টাউন ছাড়ল সোনাভরা স্টেজ। পত্রিকায় পঞ্চাশ হাজার লেখা হলেও আসলে সোনার পরিমাণ আরও বেশি, সঠিক হিসেবে দুই লক্ষ সাত হাজার ডলার হবে সব সোনার মূল্য। ইচ্ছে করেই সত্য চেপে গেছে হ্যান্স কোবার্ন, সোনা ব্যবসায়ীর ধারণা সঠিক তথ্য জানতে পারলে অতিমাত্রায় বেপরোয়া হয়ে উঠবে দুর্বৃত্তরা। প্রাপ্তির তুলনায় ঝুঁকির পরিমাণ বেশি হলে কেউ কেউ হয়তো নিরস্তও হতে পারে। ক্লান্তিকর যাত্রা। কোন যাত্রী নেই, যদি না হ্যান্স কোবার্নকে যাত্রী ধরা হয়। বেশিরভাগ সময় দুই ক্রুর সঙ্গে কোচের ভেতরে থাকছে সে। টিম কার্টিস আর রবার্ট অ্যালেন পালা করে চালাচ্ছে স্টেজ। পাশেই বসে আছে ড্যানি লসন, সামনের পথ বা আশপাশে চোখ রাখতে সুবিধে বলে সারাক্ষণ ওখানেই থাকছে। কোলে একটা উইনচেস্টার ওর, পায়ের কাছে পড়ে আছে ডাবল-ব্যারেল শটগান। কার্টিসের কোলে আরেকটা শটগান আছে। লোকটির সাথে এটা-সেটা নিয়ে গল্প করলেও সারাক্ষণ চারপাশে তীক্ষ্ণ নজর রাখছে লসন। সন্ধে পর্যন্ত মাইল বিশের মত এগোল ওরা। একটা উপত্যকায় ক্যাম্প করার পর রান্না করতে বসল কার্টিস। ক্লান্ত শরীরে ঘাসের ওপর বসে পড়ল অন্যরা। গরম কফি খানিকটা হলেও চাঙা করে তুলল ওদের। একটা সিগারেট ধরিয়ে কিছু দূরে সরে এল লসন, ক্যাম্পের পেছনে পাহাড়ে উঠে এল। ফিল্ড গ্লাস বের করে জরিপ করল সামনের ট্রেইল। পুরো এক ঘণ্টা চোখ রেখেও কোন আগুন বা ক্যাম্পের চিহ্ন চোখে পড়ল না। কিন্তু তাতে নিশ্চিন্ত হওয়ার উপায় নেই, লসন জানে স্টেজ লুঠ হওয়ার সম্ভাবনা ষোলো আনা। মন্টানা পর্যন্ত দীর্ঘ যাত্রার যে কোন জায়গায় আক্রান্ত হতে পারে ওরা। তবে ওর চিন্তা আপাতত বিগ বে পর্যন্ত, ওখানে পৌঁছতে পারলে বাকি পথ নিয়ে ভাববে। বিগ বে-র ট্রেইল স্মরণ করার চেষ্টা করল, আচমকা আক্রমণ করা যায় সম্ভাব্য এমন তিনটে জায়গা শনাক্ত করল মনে মনে। ঠিক মাইল দুই পরেই একটা। দুপুরের দিকে প্রথম জায়গাটা পেরিয়ে এসেছে ওরা।
উটকো ঝামেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে দুই ক্রু। ওদেরকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে, কারণ শেষপর্যন্ত বেঈমানি করবে ওরা, নিশ্চিত জানে লসন। দু’জনের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রেখেছে ও, কোবার্নকেও লেগে থাকার পরামর্শ দিয়েছে, আলাদা হতে দিচ্ছে না কাউকে। নিজের দায়িত্ব ভাল ভাবেই পালন করছে সোনা ব্যবসায়ী। টেড স্পিড আর বব অ্যালেনকে পাহারার দায়িত্ব দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল লসন। মাঝরাত পর্যন্ত ওদের পালা, তারপর কার্টিস আর টমের। শেষ রাতে হ্যান্স আর
পৃষ্ঠা-৪৭
ওর। ভোরে ফের পাহাড়ে উঠে এল ও। অনেকক্ষণ ধরে চোখ রাখল ট্রেইলের ওপর। নিভু নিভু একটা আগুনের কুণ্ড দেখে খুশি হলো এবার। আন্দাজ করল মাইল দুই দূরে আছে ক্যাম্পটা। নাস্তা শেষে নিজের ঘোড়ায় স্যাডল চাপাল লসন। ‘কি ব্যাপার, ড্যান, কোথাও যাচ্ছ নাকি?’ জানতে চাইল কোবার্ন। ‘আশপাশেই থাকব।’ স্টেজের ভেতরে ঢুকে অ্যামুনিশন বক্স থেকে বাড়তি কার্তুজ তুলে নিয়ে বেরিয়ে এল ও, ঘাড় ফিরিয়ে মেঝেয় পড়ে থাকা স্ট্রংবক্সটা দেখল, যথেষ্ট মজবুত জিনিসটা। আঙটায় বড়সড় দুটো তালা ঝুলছে। ওগুলো অবশ্য কোন ব্যাপারই নয়, যে কেউ ভেঙে ফেলতে পারবে। সূর্য যখন পুব আকাশে আড়মোড়া ভাঙছে ঠিক এসময়ে রওনা দিল দলটা। ‘বব?’ স্টেজে উঠতে যাচ্ছিল তরুণ, লসনের ডাকে ফিরে তাকাল। ‘কার্টিসের পাশে গিয়ে বোসো, গল্প না করে খেয়াল রেখো চারপাশে। শিগগিরই আক্রান্ত হতে পারি আমরা।’ ‘তুমি কোথায় যাচ্ছ?’ ‘আমার কথা ভাবতে হবে না, যা বলেছি ঠিকমত কোরো।’ ‘ঠিক আছে, ড্যান,’ মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দিল সে। আড়চোখে বিল নিকোল আর টেড স্পিডের দিকে তাকাল লসন। ভাবলেশহীন থাকার চেষ্টা করছে ওরা, কিন্তু আড়ষ্ট মুখ দেখে বোঝা গেল লসনের সিদ্ধান্তে অবাক হয়েছে। ‘তোমরা দু’জন,’ তাদেরকে বলল ও। ‘বসে বসে না ঝিমিয়ে চোখ-কান খোলা রাখো, মাইল দুইয়ের মধ্যে আছে ওরা। যে কোন সময়ে আক্রমণ করতে পারে।’ নিস্পৃহ ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল টেড, উত্তেজনা বা উদ্বেগের নমুনাও নেই তার মধ্যে। লসন নিঃসন্দেহ হয়ে গেল সামনের দলটার সঙ্গে জেসি ওয়েনের সম্পর্ক নেই, তেমন হলে এতক্ষণে উত্তেজনায় টগবগ করে ফোটার কথা দু’জনের। এরা সঙ্গে থাকায় অন্তত একটা লাভ হয়েছে, ভাবল ও, রক্স বা ডেভিসের দল স্টেজ আক্রমণ করলে সাহায্য করতে পারবে। শুরুতে স্টেজের পেছনে থাকল লসন, কিন্তু একটু পর পেছনে ফেলে এল লক্করঝক্কর মার্কা কনকর্ড কোচকে। মাইল খানেক এগিয়ে আচমকা ট্রেইল থেকে সরে এল। বিপজ্জনক জায়গাটার কথা মনে করার চেষ্টা করল-ক্লিফের পাশ দিয়ে এগিয়েছে ট্রেইল, খানা-খন্দে ভরা উপত্যকার পাশেই পঞ্চাশ ফুট নিচে খাদের তলায় গিয়ে মিশেছে খাড়া ঢাল। এরকম একটা জায়গা স্টেজের জন্যে সত্যিই বিপজ্জনক, এবং হামলা করার জন্যে যুৎসই; কারণ স্টেজ সামলাতে ব্যস্ত থাকবে ড্রাইভার। ক্লিফের দেয়ালে আড়াল নেওয়ার মত প্রচুর জায়গা রয়েছে। মনে মনে একটা পরিকল্পনা দাঁড় করাল লসন, তারপর জোর কদমে ঘোড়া ছোটাল। ঢালের আড়াল ধরে এগোচ্ছে, তাছাড়া মূল ট্রেইল এড়িয়ে যাচ্ছে বলে
পৃষ্ঠা-৪৮
কারও চোখে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। মিনিট ত্রিশ পর ক্লিফটা দেখতে পেল। ঘোড়ার গতি কমিয়ে প্রায় হাঁটার পর্যায়ে নিয়ে এল ও, চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে। ক্লিফের কাছাকাছি এসে স্যাডল ছাড়ল ও। জুনিপার ঝোপের আড়ালে ঘোড়া রেখে পায়ে হেঁটে এগোল। নিঃশব্দে উঠে এল পাহাড়ের চূড়ায়। সামনে আরও কয়েকটা পাহাড়, কোনটাই ষাট-সত্তর গজের বেশি উঁচু হবে না। ক্লিফের লাগোয়া পাহাড়ে চলে এল একসময়, সামনের খোলা জায়গায় সতর্ক দৃষ্টি চালাল। ক্লিফের সারি, নিচে রুক্ষ ট্রেইল আর পাহাড়ী খাদ স্পষ্ট চোখে পড়ছে। উল্টোদিকের পাহাড়ে বা আড়াল নেওয়ার মত যে কোন জায়গায় অনায়াসে নজর রাখতে পারবে।
ঢাল বেয়ে চূড়ায় উঠে এল ও, কিনারায় এসে শ্রান্ত শরীর গ্র্যানিটের ওপর বিছিয়ে দিল, পাশে রাখল রাইফেল। ক্যান্টিন থেকে এক ঢোক পানি গলায় ঢেলে ফিল্ড গ্লাস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল এবার, সূর্যকিরণ সম্পর্কে পুরোমাত্রায় সচেতন, জানে ফিল্ড গ্লাসে প্রতিফলিত আলো মুহূর্তে ওর অবস্থান প্রকাশ করে দিতে পারে। মিনিট বিশ লাগল লোকগুলোকে খুঁজে বের করতে। লোক তিনজন, কিন্তু সাতটা ঘোড়া দেখতে পেয়েছে। তারমানে অন্তত আরও চারজন আছে। খুঁজতে শুরু করল ও, মিনিট দশ পর দু’জনের অবস্থান জেনে গেল। বাকিরা ওর অজ্ঞাতে রয়ে গেছে। ধূমপানের ইচ্ছে হচ্ছে, কিন্তু ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে ইচ্ছেটা দমিয়ে রাখল লসন। পকেট থেকে এক মুঠি বুলেট বের করে পাশে মাটির ওপর রাখল। রাইফেল টেনে নেওয়ার সময় মনে মনে হিসাব কষল, বিশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাবে স্টেজ। ঢাল বেয়ে ওঠার সময় আক্রমণ করবে ওরা। ঢালের নিচে, চল্লিশ গজ দূরে স্টেজটাকে প্রথম দেখার পর তৈরি হয়ে যাবে প্রতিপক্ষ; এই ফাঁকে, মিনিট খানেকের মধ্যে ক্লিফের একেবারে কাছাকাছি পৌঁছে যাবে কোচ। সাকল্যে এই এক মিনিটই পাবে লসন, এরই মধ্যে কাজ সারতে হবে। লুকিয়ে থাকা লোকগুলোর অবস্থানের ওপর শেষবারের মত নজর বুলাল ও-চাতালের ওপর দু’জন, কিছুটা ডানে বোল্ডারের আড়ালে তিনজন। অন্য দু’জনকে খুঁজে পায়নি। তবে নিশ্চিত জানে আশপাশেই আছে। চাতালের লোকগুলোকে আগে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিল লসন, লাগাতে সুবিধা হবে। তাছাড়া অরক্ষিত আছে ওরা, মুহূর্তের ব্যবধানে দু’জনকেই নিকেশ করতে পারবে। বোল্ডারের কারণে কিছুটা হলেও আড়াল পেয়েছে অন্য তিনজন, সহজে ধরাশায়ী করা যাবে না ওদের। উল্টোটাও সত্যি, পাল্টা আক্রমণ করে সুবিধা করতে পারবে না ওর সঙ্গে। কিন্তু লসন ক্রমাগত গুলি করতে থাকলে আড়াল নিতে বাধ্য হবে ওরা, স্টেজের ওপর থেকে মনোযোগ সরে যাবে। কিন্তু
অন্য দু’জন? হয়তো এরাই আসল কাজ সেরে ফেলবে। ধীরে ধীরে সময় কাটছে। তন্নতন্ন করে ক্লিফ আর পাহাড়ের সারির আনাচে- কানাচে নজর বুলাল লসন। একবার মনে হলো চাতালের ওপাশে যে গুটিকয়েক গুল্ম জাতীয় গাছ জন্মেছে তার পেছনে বাদামী কিছু একটা চোখে পড়েছে, কিন্তু
পৃষ্ঠা-৪৯
নিশ্চিত হতে পারল না। অনেকক্ষণ চোখ রেখেও কিছু দেখতে পেল না। ধুমসে হুইস্কি গিলছে চাতালের লোক দুটো, মাঝে মধ্যেই হাত বদল হচ্ছে বোতলটা। দূরে স্টেজের হালকা শব্দ শোনা যেতে সতর্ক হয়ে গেল লোকগুলো, স্থির পড়ে আছে এখন। রাইফেল বাগিয়ে ধরেছে।নিশ্ছিদ্র একটা ফাঁদ পেতেছে ওরা। কিন্তু লসনের অবস্থান এবং সময়োচিত তৎপরতার কারণে ছকটা পাল্টে যেতে পারে। সবকিছু নির্ভর করবে ওর দক্ষতার ওপর। মাত্র কয়েক সেকেন্ড সময় পাবে, এরই মধ্যে ছোট করে দিতে হবে দলটাকে; শুধু তাহলেই স্টেজটা নির্বিঘ্নে ফাঁদ পেরিয়ে যেতে পারবে। ডানদিকের লোকটার কপালে নিশানা করল লসন। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতে হলো না, লোকগুলোর নড়াচড়ায় স্পষ্ট বোঝা গেল কাছে চলে এসেছে স্টেজ। চাকার ঘড়ঘড় আওয়াজ তো শুনতে পাচ্ছেই। মুখটা বিস্বাদ লাগছে ওর, জানে জুয়া খেলতে যাচ্ছে এবং সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। টিম কার্টিস আর বব অ্যালেনের ওপর কিছুটা হলেও নির্ভর করছে ওর সাফল্য, কার্টিসকে দক্ষ হাতে ঘোড়াগুলো সামাল দিতে হবে, আর অন্তত দু’একজনকে নিকেশ করতে হবে অ্যালেনের, নইলে… ট্রিগারে চেপে বসেছে ওর আঙুল, রাইফেলের ব্যারেল সেঁটে আছে কাঁধের সঙ্গে; মনোযোগ সামনের লোকগুলোর ওপর, স্টেজের কথা বেমালুম ভুলে গেছে। প্রথমবার ট্রিগার টেনেই উইনচেস্টারের নল খানিকটা সরিয়ে দ্বিতীয়জনের কপাল বরাবর গুলি করল লসন। ফলাফল দেখার সুযোগ বা ইচ্ছে কোনটাই হলো না ওর, দ্রুত পরপর কয়েকটা গুলি করল অন্য তিনজনের দিকে। অপ্রত্যাশিত আক্রমণে ভড়কে গেছে লোকগুলো, সে-সুযোগটাই নিল লসন। তৃতীয় লোকটা সামনের দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যেতে সংবিৎ ফিরল ওদের। যে পাহাড়ের ওপর অবস্থান নিয়েছে ও, সেদিকে তাকিয়ে ওকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করল। কিন্তু লসনের লাগাতার আক্রমণে পিছিয়ে গিয়ে আড়াল নিতে বাধ্য হলো দু’জনেই। নিশানা ছাড়াই গুলি করে যাচ্ছে ও, বোল্ডার না ঝোপে গিয়ে লাগল দেখছে না। চাইছে লোকগুলো আরও কিছুক্ষণ আড়ালে থাকক। আশপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে ওর সন্দিগ্ধ দৃষ্টি। জুনিপার ঝোপের কিনারে এক ঝলকের জন্যে বাদামী একটা কাপড় দেখেছিল একটু আগে, এবার অবশ্য এক লোককে দেখতে পেল। ট্রেইলের দিকে মনোযোগ লোকটার, ঢাল বেয়ে উঠে আসা স্টেজের কাউকে নিশানা করছে। সম্ভবত ড্রাইভারই তার টার্গেট। সঙ্গে সঙ্গে ট্রিগার টেনে দিল লসন। লোকটার বাহুতে বিধেছে গুলিটা, এক চুল নড়ে গেল নিশানা; আর তাতেই বেঁচে গেল টিম কার্টিস। ওর কপাল ঘেঁষে বেরিয়ে গেল বুলেট। সপাটে চাবুক হাঁকাল সে, তুমুল গতিতে ছুটতে শুরু করল ঘোড়াগুলো। পেছনেই দেখা গেল একটা সোরেলে চেপে ছুটে আসছে বব অ্যালেন। হাতে উদ্যত পিস্তল। ‘মেস্কিট ঝোপের কাছে আছে ওরা!’ চেঁচিয়ে তাকে জানাল লসন। গড়ান দিয়ে সরে এল ও, পাহাড়ের কিনারে এসে ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল। অপেক্ষায় ছিল ঘোড়াটা, ছোটার মধ্যেই লাফিয়ে স্যাডলে চাপল ও, তারপর স্পার
পৃষ্ঠা-৫০
দাবাতে ছুটতে শুরু করল ঘোড়াটা। বাঁক নিয়ে ট্রেইলে উঠে আসার সময় আরেকটু হলে স্যাডল থেকে পড়ে যাচ্ছিল, কোন রকমে সামলে নিল। চোখ তুলে সামনের দিকে তাকাল ও। বিপজ্জনক জায়গাটা পেরিয়ে গেছে স্টেজ, কোচের খোলা দরজায় দেখা যাচ্ছে হ্যান্স কোবার্নকে। দুই ক্রু জানালায় অবস্থান নিয়েছে। সমানে দুর্বৃত্তদের অবস্থান লক্ষ্য করে গুলি করছে ওরা। নির্দয় ভাবে স্পার দাবাল লসন, ঘোড়ার গতি বাড়াতে চাইছে। ওকে গুলি করার সুযোগ পেয়ে গেলে এক গুলিতে দফা-রফা হয়ে যাবে। স্বস্তির ব্যাপার ক্রুদের নিয়ে ওকে কাভার করছে কোবার্ন। সামনে অন্য কোন দল না থাকলেই হয়। ক্লিফের দেয়ালের সঙ্গে শরীর ছুঁইছুঁই করছে ঘোড়াটার, তুমুল গতিতে ছুটছে। স্যাডলের সাথে শরীর মিশিয়ে দিয়েছে লসন। স্টেজটাকে পেরিয়ে এসে হাঁপ ছাড়ল, কিন্তু গতি কমাল না। পাশ দিয়ে ক্লিফের দেয়াল চোখের নিমেষে সরে যাচ্ছে পেছনে, চোখ তুলে সামনে ট্রেইলের দিকে তাকাল ও। এঁকেবেঁকে এগিয়েছে ট্রেইল, একটু পরেই খোলা জায়গা। ছোটার মধ্যেই রাইফেল রেখে পিস্তল তুলে নিল ও। চোখ পরবর্তী বাঁকের মুখে। একটা ব্যাক-আপ টীম আশা করছে। পাশে রবার্ট অ্যালেনের প্রসন্ন মুখ দেখতে পেল এসময়, হাসছে সে। খোলা চুল বাতাসে উড়ছে। ‘দারুণ কাজে দিয়েছে তোমার বুদ্ধি!’ চেঁচিয়ে বলল সে। ‘পাত্তাই পায়নি ওরা।’ ‘সামনে হয়তো আরও দু’একজন আছে। সতর্ক থেকো।’ সহাস্যে মাথা ঝাঁকাল অ্যালেন, পাশাপাশি ঘোড়া ছোটাচ্ছে। বাঁক পেরিয়ে খোলা জায়গায় আসতে দেখা গেল লসনের আশঙ্কাই সত্যি। ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে আসছে তিন ঘোড়সওয়ার। কিছুটা আগেই উপস্থিত হয়ে গেছে স্টেজ, তাছাড়া পাশার ছক এভাবে পাল্টে যাবে আশা করেনি ওরা। লসন আর অ্যালেনকে দেখেই যার যার পিস্তল বা রাইফেলের দিকে হাত বাড়াল তিন দুর্বৃত্ত। পিস্তল তৈরিই ছিল, স্রেফ নিশানা করতে হলো লসনকে, সামনের লোকটার উদ্দেশে একটা বুলেট পাঠিয়ে দিল। বুক চেপে ধরে স্যাডলে হুমড়ি খেয়ে পড়ল লোকটা। অ্যালেনের গুলিতে স্যাডলচ্যুত হলো পাশেরজন। মাত্র একটা গুলি করার সুযোগ পেল অন্য লোকটা, তাড়াহুড়ো করায় ফস্কে গেল সেটা-লসনের তিন হাত দূরে পাহাড়ের শরীরে গিয়ে বিঁধল। ততক্ষণে লোকটার একেবারে সামনে পৌছে গেছে ওরা। পাঁচ হাত দূর থেকে লোকটার বুক বরাবর গুলি করল লসন, চোখে চোখে তাকিয়ে থাকল গুলি করার সময়। সমূহ বিপদ বুঝতে পেরে মরিয়া হয়ে উঠেছে লোকটা, শেষ মুহূর্তে মাথা নিচু করে ফেলল। কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারল না, প্রশস্ত কপাল গুড়িয়ে দিল ভারী বুলেট। ধূলিধূসর ট্রেইলে আছড়ে পড়ল তার দেহ, একটু পর চলন্ত স্টেজ মাড়িয়ে গেল তাকে।
দু’শো গজের মত এগিয়ে থামল লসন, পাশে এসে দাঁড়িয়েছে অ্যালেন। হাঁপাচ্ছে সে। তবে মুখের হাসি ম্লান হয়নি এতটুকু। ঘাড় ফিরিয়ে পেছনের ট্রেইলের দিকে তাকাল, স্টেজটা একটু আগে পেরিয়ে গেছে ওদের। দুর্বৃত্তদের
পৃষ্ঠা-৫১
কেউ পিছু নিয়ে থাকলে চড়াও হবে তার ওপর, কিন্তু মিনিট বিশ পরও উৎসাহী কোন রাইডারকে দেখা গেল না। ‘চলো হে, যাই এবার,’ স্মিত হেসে বলল অ্যালেন। ‘মনে হচ্ছে সবক’টাকে সাবাড় করে ফেলেছি! শেষ লোকটাকে চিনতে পেরেছ?’ মাথা নাড়ল লসন। ‘কিনকেডের এক চেলা। গতকাল জ্যাক চেম্বারল্যান্ডের সেলুনে দেখেছি ওকে।’ ঘোড়ার গতি বাড়িয়ে স্টেজটাকে ধরে ফেলল ওরা। গতি কমিয়ে এনেছে কার্টিস। বিপজ্জনক জায়গাটা পেরিয়ে আসার সময় সর্বোচ্চ গতি আদায় করেছে পশুগুলোর কাছ থেকে, গতি কমিয়ে পরিশ্রান্ত পশুগুলোকে খানিকটা বিশ্রাম দিচ্ছে এখন। পরদিন নির্বিঘ্নে বিগ বে-তে পৌঁছল ওরা। দুপুর তখন। লসনের নির্দেশে ল- অফিসের সামনে স্টেজ থামাল টিম কার্টিস। শহরের শুরুতে আলাদা হয়ে গেছে বব অ্যালেন, ল-অফিসের উল্টোদিকের বাড়ির সামনে অবস্থান নেবে। ফুটপাথে থাকল দুই ক্রু, আর শেরিফের অফিসে গিয়ে ঢুকল হ্যান্স কোবার্ন। জানালার কাছে থাকবে সে। ভেতরে গিয়ে শেরিফের সঙ্গে আলাপ করল লসন, ওর সঙ্গে বেরিয়ে এল দুই ডেপুটি, এরাও পাহারায় থাকবে। ‘যাই ঘটুক, এখান থেকে নড়বে না কেউ!’ নির্দেশ দিয়ে দক্ষিণে এগোল লসন।
‘কোথায় যাচ্ছ?’ সন্দিহান সুরে জানতে চাইল বিল নিকোল। ‘যা বলছি করো, নিকোল!’ হাঁটার মধ্যেই বলল ও। চাপা অসন্তোষ দেখা গেল যুবকের চোখে। ‘আমাদের এখানে খাটিয়ে মারবে, আর নিজে সেলুনে গিয়ে আয়েশ করে হুইস্কি গিলবে?’ ধীরে ধীরে তার দিকে ফিরল লসন, স্থির দৃষ্টিতে মাপল নিকোলকে। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকল ওরা, তারপর দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল লোকটা। ‘তোমার যদি তেষ্টা পেয়ে থাকে, না হয় তুমিই যাও, নিকোল। দশ মিনিটের ছুটি দেয়া হলো তোমাকে। কিন্তু দশ মিনিট পর ঠিক এখানে এসে দাঁড়াবে। আপাতত তোমার জায়গায় থাকছি আমি।’ ‘ভুলে যাও, কথাটা এমনিতেই বলেছি,’ আড়ষ্ট ভাবে হাসল নিকোল, কিন্তু বিদঘুটে দেখাল হাসিটা। ‘সত্যি কথা বলতে কি, আমারই হুইস্কির তেষ্টা পেয়েছে।’ ফিরে এসে তার সামনে দাঁড়াল লসন। ‘বেশ তো, এক পেগ গিলে এসো।’ কি যেন ভাবছে বিল নিকোল। ‘আরে, আমি তো এমনি এমনি বলেছি।’ ‘আমি কিন্তু তামাশা করছি না।’ চোখে চোখে তাকিয়ে থাকল সে, তারপর শ্রাগ করল। ‘ঠিক আছে, তুমি যখন আপত্তি করছ না। কিন্তু একা যেতে ইচ্ছে করছে না। টেডকে সঙ্গে নিয়ে যাব? একা একা ড্রিঙ্ক করে আয়েশ হয় না।’
পৃষ্ঠা-৫২
‘উঁহু, কোথাও যাচ্ছে না টেড। বরং আমিই যাব তোমার সঙ্গে।’ ‘তুমি!?’ ‘হ্যাঁ, আমি।’ ‘তুমি তো কাজে যাচ্ছিলে,’ এড়ানোর চেষ্টা করল বিল। ‘যাচ্ছিলাম, কিন্তু মনে হচ্ছে সেটা তোমার পছন্দ হয়নি। এখন আমার সাথেই যেতে হবে তোমার, বিল, এবং শেরিফের অফিসে যাচ্ছি আমরা। তুমিও, টেড।’ বিস্ময়ে বড়বড় হয়ে গেল দু’জনের চোখ। ‘এর মানে কি, ড্যান?’ ‘গেলেই বুঝতে পারবে।’ হাত তুলে ল-অফিসটা দেখাল লসন, আরেক হাতে পিস্তল চলে এসেছে। ‘নাও, অনেক আলাপ হয়েছে। এবার এগোও, নয়তো পায়ে গুলি করব। বব,’ তরুণকে বলল ও। ‘টেড ছোঁড়ার পিঠে পিস্তল চেপে ধরো তো, মনে হচ্ছে জোর করেই নিতে হবে ওদের। উঁহুঁ, কোন চালাকি করার চেষ্টা কোরো না।’ টেড স্পিডের চোখে চাঞ্চল্য দেখে দ্রুত বলল লসন, তারপর সপাটে তার নাকে পিস্তলের নল চালাল। ‘এগোও!’ ডান হাতে নাক চেপে ধরল সে, রক্ত ঝরতে শুরু করেছে। যুগপৎ ঘৃণা আর প্রতিহিংসা ফুটে উঠেছে চোখে। ইতোমধ্যে তার হোলস্টার খালি করে ফেলেছে লসন। পিঠে পিস্তলের নলের খোঁচা দিয়ে এগোতে বাধ্য করল তাকে। ঘাড় ফিরিয়ে বিল নিকোলের দিকে তাকাল, লোকটাকে প্রায় ঠেলে নিয়ে আসছে
অ্যালেন। হোলস্টারটা শূন্য। ভেতরে ঢুকল ওরা। জানালার কাছে একটা চেয়ারে বসে ছিল হ্যান্স কোবার্ন। হাতে রাইফেল। ‘মি. কোবার্ন, এর মানে কি?’ অসহিষ্ণু স্বরে জানতে চাইল টেড স্পিড। ‘তুমি নিশ্চয়ই ব্যাখ্যা করবে?’ ‘এতক্ষণেও বুঝতে পারোনি?’ স্মিত হাসি সোনা ব্যবসায়ীর মুখে। ‘বোঝার কি আছে আবার?’ ‘বুঝবে, একটু পরেই খোলসা হয়ে যাবে সব। শেরিফ, মেহমানদের সেলে ঢোকাও তো! কিছুক্ষণ ওদের সঙ্গে কথা বলবে ড্যান, দয়া করে এই সময়টা বাইরে থেকো তুমি। দশ মিনিট, বেশিক্ষণ লাগবে না ওর।’ চল্লিশোর্ধ্ব এক লোক, জেরি টাম্বলার হচ্ছে বিগ বে-র শেরিফ। ‘কোন একটা গোপন ব্যাপার আছে মনে হয়?’ হেসে জানতে চাইল সে, চুলোয় কফির পানি চড়িয়েছে মাত্র। এগিয়ে এসে ড্রয়ার থেকে চাবি বের করল, দু’জনকে আলাদা সেলে ঢোকানোর পর তালা আটকে দিল। সমানে খিস্তি করছে টেড, লসনের চোদ্দ গোষ্ঠি উদ্ধার করছে। ‘বব, নিজের জায়গায় চলে যাও। আমি ডাকার পর কফি খেয়ে যাবে। একজন একজন করে আসবে।’ ‘ওদের ব্যাপারটা কি?’ কিছুটা বিস্মিত দেখাচ্ছে তরুণকে। পরে ব্যাখ্যা করব, ঠিক আছে?’ ‘ ‘নিশ্চয়ই, ড্যান।’ মাথা ঝাঁকিয়ে বেরিয়ে গেল সে।
পৃষ্ঠা-৫৩
‘আমাদের হাতে সময় খুব কম, হ্যান্স,’ একটা চেয়ারে বসার সময় বলল লসন। ‘হয়তো এখানেই আক্রমণ করবে ওরা। শুনতে অসম্ভব মনে হলেও জেসি ওয়েনের পক্ষে সম্ভব এটা। ভাবছি টেডকে চেপে ধরব, দেখি মুখ খোলে কিনা।’ ‘একটু বেশি ঝুঁকি নিচ্ছ না? দু’জন লোক কমে যাচ্ছে। হয়তো আরও পরে গন্তব্যের কাছাকাছি হামলা করত ওরা।’ ‘ঝুঁকিটা নিতেই হবে, হ্যান্স। দুটো কেউটেকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে নেই আর। বাইরে থেকে অ্যাম্বুশ করে অন্যরা যতটুকু ক্ষতি করতে পারবে দলের ভেতর থেকে তারচেয়েও বেশি করতে পারবে ওরা। আমি নিশ্চিত হয় এখানে, নয়তো সামনে ট্রেইলের কোথাও আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেছে ওরা। তখনকার অবস্থা চিন্তা করে দেখো, কাকে সামলাব-জেসি ওয়েনকে না ওদের? তাছাড়া, নিজের পিঠের দিকে নজর রাখতে রাখতে এই দু’দিন বিরক্তি ধরে গেছে
আমার!’ নীরবে ব্যাপারটা মেনে নিল হ্যান্স কোবার্ন। সেলের দিকে এগোল লসন। বিষদৃষ্টিতে ওকে দেখছে দুই আসামী। আক্রোশে ফেটে পড়ছে যেন, পারলে এখনই খুন করে ফেলে ওকে। ‘টেড স্পিড?’ ‘গোল্লায় যাও তুমি, ড্যান!’ ‘শোনো, একটা সুযোগ দিচ্ছি তোমাদের। কয়েকটা তথ্য দরকার আমার, এবং তা জানানোর জন্যে খুব বেশি সময় পাবে না। দ্বিতীয়বার কিন্তু জিজ্ঞেস করব না।’ হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করে কক করল ও। ‘শেরিফ, তুমি বরং বাইরে চলে যাও। এখানে যা ঘটবে সবকিছু হয়তো পছন্দ হবে না তোমার।’ ‘কি করবে?’ জানতে চাইল জেরি টাম্বলার, কণ্ঠে অনুমোদনের সুর। ‘ফিরে এসেই দেখতে পাবে।’ ‘তাড়াহুড়োর কি আছে। আজকের দিনটা এখানে কাটিয়ে দাও, বিশ্রাম নেওয়া হবে, তাছাড়া সময় পেলে ওদের কাছ থেকে খবরও বের করা যাবে।’ ‘উঁহু, সময় নেই আমার হাতে।’ শ্রাগ করে কফি তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে। ‘তোমাদের পরিকল্পনা কি? কোথায় আক্রমণ করার বুদ্ধি করেছ?’ জানতে চাইল লসন। চুপ করে থাকল ওরা, চাপা আক্রোশ দেখা যাচ্ছে দু’জনের মুখে। পিস্তল তুলে টেড স্পিডের উরুসন্ধিতে নিশানা করল লসন। তা দেখে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল তস্কর, নিমেষে সমস্ত আক্রোশ বিদায় নিল মুখ থেকে, আতঙ্ক আর সন্দেহ দেখা যাচ্ছে সেখানে। ‘আরে, করছ কি! সত্যি গুলি করবে নাকি?’ ভয়ার্ত স্বরে জানতে চাইল সে। ‘খোদার কসম, জবাব না পেলে সত্যি তাই করব।’ শীতল কণ্ঠে বলল লসন। ‘তামাশা করছ?’ জানতে চাইল বিল নিকোল, হাসি হাসি মুখ। গুলি করল লসন, নিকোলের কোমরের পাশে দেয়ালে চল্টা উঠাল গুলিটা। বিস্ময়ে বড়বড় হয়ে গেল তার চোখ, আতঙ্কিত হয়ে পড়ল এবার। ‘টেড,
পৃষ্ঠা-৫৪
হারামজাদা দেখি সত্যি সত্যি গুলি করছে! শেরিফ, তুমি এটা সহ্য করছ কিভাবে?’ ‘চোপরাও, নিকোল। অনেক হয়েছে। আর এক মিনিট দেখব, তারপর আগে তোমাকে গুলি করব। আমার ধারণা, এরপর থেকে কোন মেয়ের কাছে যাওয়ার ইচ্ছে হবে না তোমার।’ ‘শেরিফ! শুনতে পাচ্ছ?’ মরিয়া হয়ে চিৎকার করল সে। গুলি করল লসন। বিল নিকোলের উরুতে গিয়ে বিধল এবার। থরথর করে কেঁপে উঠল সে, হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল মেঝেয়। সমানে হাত-পা কাঁপছে। ‘টেড, পাগল হয়ে গেছে ও! ওকে বলে দাও! আরে বাবা, নিজে বাঁচলে তো জেসি ওয়েন আমাদের সাহায্য করবে।’ ‘ঠিক বলেছ, বিল, ধন্যবাদ।’ পিস্তলের নল এবার টেডের দিকে ঘোরাল লসন। সাথে সাথে লাফালাফি শুরু করল টেড স্পিড, চোখে নিখাদ আতঙ্ক। ‘বলছি, বলছি! খোদার দোহাই, গুলি কোরো না!’ ‘আমার ধৈর্য খুব কম।’ পিস্তলের নল এক চুল সরাল না ও। এখানেই, রওনা দেয়ার সময়,’ দ্রুত আউড়ে গেল টেড। ‘ ‘শেরিফ! তালাটা খুলে দাও তো, ভেতরে ঢুকব আমি। দেখি কতক্ষণ মিথ্যে বলতে পারে ওরা। অবশ্য আগে হাত-পাগুলো ভেঙে নেব, তাহলে আর লাফালাফি করতে পারবে না। তারপর নিশ্চিন্তে ওদের জিনিসে গুলি করতে পারব।’
‘খোদার কসম, মিথ্যে বলিনি!’ মরিয়া হয়ে বলল স্পিড। ‘কি হলো, শেরিফ? তালা খুলতে বলেছি তোমাকে, কফি দিতে তো বলিনি!’ ঘামতে শুরু করেছে ওরা, আড়চোখে দেখল লসন। পিস্তল হোলস্টারে ঢুকিয়ে টেবিলের কাছে ফিরে এল ও, ভাবার জন্যে কয়েক মিনিট সময় দিয়েছে দুই কয়েদীকে। কফি শেষ করে ফিরে এল সেলের কাছে। তালা খুলতে সঙ্গে এসেছে শেরিফ। ‘না বাপু, তুমি মানুষটা যেন কেমন! অন্যদের মনে ভয় ধরিয়ে দিতে জানো বটে।’ চোখ তুলে দুই আসামীর দিকে তাকাল সে। ‘বাছারা, ভালয় ভালয় ওকে বলে দাও, দেরি করে লাভ কি! পরে আফসোস করার চেয়ে জানিয়ে দাও সব, সারা জীবন মেয়েদের দেখে আতঙ্কে দৌড় দেয়ার চেয়ে এটা কি ভাল নয়?’ ‘নরকে যাও, হতচ্ছাড়া শেরিফ!’ খেঁকিয়ে উঠল বিল নিকোল। ‘যাব, তার আগে দেখে নিই জিনিস হারিয়ে কেমন ছটফট করো তোমরা।’ ‘লারেডো ক্রসিংয়ে, ঘোড়া বদলের সময়।’ চিৎকার করে জানাল টেড। নিষ্পলক দৃষ্টিতে লোকটাকে দেখল লসন, তারপর ক্ষীণ মাথা ঝাঁকাল। ক’জন থাকবে?’ ‘ ‘চারজন।’ ‘ব্যাখ্যা করো।’ অসহায় দৃষ্টি ফুটে উঠল টেড স্পিডের চোখে। ট্রিগারে চেপে বসা লসনের
পৃষ্ঠা-৫৫
আঙুলের দিকে তাকিয়ে আছে পলকহীন দৃষ্টিতে। ক্ষণিকের জন্যে অসহায় দেখাল লোকটাকে, তারপর শ্রাগ করে বলতে শুরু করল। ‘বলছি! দোহাই লাগে, পিস্তলটা সরাও! ওহ্, কি বেয়াড়া লোকের পাল্লায় পড়েছি রে বাবা! তখনই বলেছিলাম, স্টেজ গার্ডের চাকুরি নেওয়ার দরকার কি?’ প্রায় ম্লান স্বরে স্বগতোক্তি করল সে। তারপর ঝট করে ফিরল পাশের সেলে বন্দী বিল নিকোলের দিকে। ‘তুমিই জোর করে ওয়েনকে রাজি করিয়েছ, বিল! এখন বোঝ ঠেলা!’ ‘জলদি, টেড!’ তাড়া দিল লসন। ‘ঘোড়া বদলানোর ফাঁকে খেতে বা ড্রিঙ্ক করতে যেতাম আমরা। কথা ছিল ফিরতে দেরি করব। ওখানে যে বড় সেলুন আছে, ওটার পাশের গলি থেকে বেরিয়ে এসে হামলা করবে ওরা। পেছনে থাকার কথা আমাদের। দুই দলের মধ্যে পড়ে..’ শেষ করল না সে, লসনের হাতের পিস্তলের দিকে চকিত দৃষ্টি হানল একবার। ‘বিশ্বাস করো, এক বর্ণও মিথ্যে বলিনি।’ মনে মনে পরিকল্পনাটার সম্ভাবনা যাচাই করে সন্তুষ্ট হলো লসন। ‘ওয়েন কোথায়?’ ‘বলেছিল বিগ বে-তে থাকবে, সুযোগ পেলে ওর সঙ্গে টোবির সেলুনে দেখা করতে বলেছে আমাদের। পরিকল্পনায় কোন রদবদল হলে এখানেই জানাত।’ পিস্তল হোলস্টারে ফেরত পাঠাল লসন, দেখল সশব্দে দম ছেড়ে হাঁপ ছাড়ল ওরা। ‘একটা শব্দও যদি মিথ্যে বলে থাকো, ফেরার সময় নিজ হাতে তোমাদের খুন করব আমি!’ শাসাল ও। ‘কিন্তু সেলুনে আমাদের না দেখলে হয়তো পরিকল্পনা পাল্টে ফেলবে ওয়েন,’ বলল টেড স্পিড। ঘুরে তার দিকে তাকাল লসন, হাসল। ‘ভাল কথা মনে করেছ, তেমন কোন কথা তোমাদের মধ্যে হয়েছে কি?’মাথা ঝাঁকাল সে।
‘শেরিফ, কফি দাও ওদের। আমার অনেক সময় আর শ্রম বাঁচিয়ে দিয়েছে ওরা।’ সশব্দে মেঝেতে থুথু ফেলল টেড। ‘কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারবে না তুমি, ড্যান,’ জেদী স্বরে বলল সে। ‘জেসি ওয়েন ঠিকই তোমাকে খুন করবে।’ ‘তাতে তোমার লাভ কি?’ চুপ করে থাকল সে, জবাব দিল না। ‘নতুন দু’জন লোক ভাড়া করব নাকি?’ লসন অফিসে ফিরে আসতে জানতে চাইল কোবার্ন। ‘দরকার নেই। বিশ্বস্ত লোক পাব না। তাছাড়া পরিকল্পনায় কিছু রদবদল করতে যাচ্ছি আমরা, ভাবছি লারেডো ক্রসিং পেরিয়ে দক্ষিণের ট্রেইল ধরব কিনা।’ থমকে গিয়ে ওকে দেখল সোনা ব্যবসায়ী। ‘মাথা ঠিক আছে তোমার? এত সোনা নিয়ে চল্লিশ মাইল দীর্ঘ মরুভূমি পাড়ি দেবে নাকি?’ ‘ঠিক সেটাই ভাবছি আমি। মরুভূমি পাড়ি দিয়ে লিয়ন সিটিতে গিয়ে ট্রেনে
পৃষ্ঠা-৫৬
সোনা তুলে দেব, ব্যস, পরদিন মন্টানায় পৌঁছে যাবে। কয়েকবার হামলার আশঙ্কা নিয়ে এ ট্রেইল ধরে আরও একশো মাইল পাড়ি দেয়ার ইচ্ছে নেই আমার।’ ‘কিন্তু এত সোনা নেবে কিভাবে? স্টেজ নিয়ে নিশ্চয়ই মরুভূমি পাড়ি দেয়ার কথা ভাবছ না? আর, প্রতিপক্ষ ঠিকই জেনে যাবে ওদের ফাঁকি দিয়েছি আমরা।’
‘তাহলে তুমিও স্বীকার করছ যে ওদের ফাঁকি দিতে পারব আমরা? তাজা ঘোড়ার সরবরাহ অবশ্য পাব না, কিন্তু যদি বাড়তি কয়েকটা ঘোড়া সঙ্গে নিই, দেড় দিনে চল্লিশ মাইল দূরত্ব ঠিকই পেরিয়ে যেতে পারব। সবচেয়ে বড় কথা, রুট বদলে মরুভূমিতে যাচ্ছি আমরা ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করবে না কেউ। তাছাড়া সাধারণ ট্রেইলের চেয়ে মরুভূমি অনেক বেশি নিরাপদ।’ ‘সত্যি মরুভূমি পাড়ি দেবে? আমি কিন্তু এর আগে যাইনি ওদিকে। ট্রেইল আর ওঅটর হোলগুলো চেনা না থাকলে কাজটা আত্মহত্যার মতই হবে।’ ‘নিশ্চিন্ত থাকো, হ্যান্স। কার্টিস এ ব্যাপারে ওস্তাদ লোক। বহুবার এই ট্রেইলে যাতায়াত করেছে ও।’ মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানাল ড্রাইভার। ‘কোথায় যাচ্ছ?’ লসনকে উঠতে দেখে জানতে চাইল। ‘লিয়ন সিটিতে টেলিগ্রাম করব। ওদের জানাতে হবে না?’ ঘণ্টাখানেক পর ল-অফিসে বসে লাঞ্চ করে নিল ওরা। ক্যাফে থেকে খাবার আনিয়েছে শেরিফ। ভরপেট কফি পান করে লারেডোর উদ্দেশে রওনা দিল ওরা। নির্বিঘ্নে বেরিয়ে এল বিগ বে থেকে, কোন সমস্যা হলো না। ভবিষ্যতের কথা ভাবছে লসন। মন্টানা যাওয়ার সহজ ট্রেইল ছেড়ে উল্টোদিকে এগোবে ওরা, এটা নিশ্চয়ই ধারণা করতে পারবে না দুর্বৃত্তরা। ট্রেইলে স্টেজকোচ না দেখে শেষে হয়তো সন্দিহান হয়ে উঠবে, ততক্ষণে অনেক দূর চলে যাবে কোচ। সবচেয়ে নিরাপদে সোনা পৌছানোর উপায় বোধহয় এটাই। সামনে ক’টা দল অপেক্ষা করছে কে জানে! ওয়েন, রক্স বা কিনকেডের দল। থমসনও নিশ্চয়ই বাকি থাকবে না। আর নেইল ডেভিস তো আছেই। এ লোকটিকে নিয়েই বেশি ভয় ওর। প্রতিপক্ষের দুর্বলতা আগে খুঁজে বের করে মোক্ষম সময়ে আক্রমণ করে ডেভিস, অথচ সুবিধা করতে না পারলে হামলাই করবে না। ওর স্বভাবই এরকম। অতিরিক্ত ঝুঁকি নিতে নারাজ সে, ঠিক রক্সের মতই। অ্যাবিলিনে ওর সাথে রক্সের প্রথম দেখা। পরস্পরকে পছন্দ করতে পারেনি ওরা। প্রথম পরিচয়ের তিক্ততা খুব কমই কাটে। ওদের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। কারণও আছে, দু’জনের পথ সম্পূর্ণ আলাদা। জীবন বাঁচাতে বা কর্তব্যের খাতিরে কার্ট রক্সের মত বহু মানুষের লাশ টপকে এতদূর এসেছে ড্যানি লসন। আর রক্স তেমনই একজন মানুষ যার নামে চার-পাঁচটা হুলিয়া আছে, কিন্তু বিপদ সম্পর্কে সচেতন সে, জানে লসনের সাথে লাগতে গেলে প্রাণের ঝুঁকি নিতে হবে। স্বার্থ ছাড়া ঝুঁকি নেওয়ার পক্ষপাতি নয় সে। তবে এ-ও ঠিক, ওর পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ালে তাকেও ছাড়তে রাজি নয় রক্স, সে যেই হোক। তেমন একটা মুহূর্ত হয়তো জেরেমি টাউন বা এ যাত্রায় তৈরি হতে পারে। কে বলতে পারে?
পৃষ্ঠা-৫৭
চারপাশে তীক্ষ্ণ নজর রাখছে লসন। বিগ বে থেকে অতিরিক্ত ছয়টা ঘোড়া নিয়েছে। হ্যান্স কোবার্ন তা পছন্দ করতে না পারলেও তর্ক করেনি। লসনের ধাত ভাল করে জানে সে। আগেও দেখেছে, প্রয়োজন ছাড়া আচমকা কিছু করে না ড্যানি লসন। মন্টানার ট্রেইলটা দুর্গম, কিন্তু মরুভূমি আরও কঠিন জায়গা। তবে বিপদ আর অবাঞ্ছিত হামলা এড়ানো যাবে তাতে। কিছু লোক হয়তো পিছু নেবে, কিন্তু স্টেজ লুঠ করতে হলে আগে ওদের সামনাসামনি হতে হবে। অ্যাম্বুশ করার আশঙ্কা থাকছে না, এটাই হচ্ছে বড় স্বস্তির বিষয়। একবার উৎরে গেছে বলে প্রতিবারই সেরকম হবে এমন আশা করা চরম বোকামি। তাছাড়া এখন দু’জন লোক কম।
দীর্ঘ চল্লিশ মাইল রুক্ষ মরুভূমি পাড়ি দিতে হবে, কিন্তু মন্টানার দুর্গম ট্রেইলের তুলনায় কাজটা সহজ, যেখানে কার্টিসের অভিজ্ঞতা থাকছে ওদের সাথে। স্টেজ নিয়ে ধীর-গতিতে এগোতে হবে জেনেও ঝুঁকিটা নিয়েছে লসন। কোন রকমে লারেডো ক্রসিং পেরোতে পারলেই হয়, তারপর ‘দক্ষিণে ঘোড়া ছোটাবে। পারলে পেছন থেকে অনুসরণ করে ওদের ধরুক দুর্বৃত্তরা! মরুভূমিতে আর যাই হোক, অসহায় অ্যাম্বুশের শিকার তো হতে হবে না। সমান-সমান সম্ভাবনা থাকবে সবার। লারেডো ক্রসিতে কি ধরনের অভ্যর্থনার আয়োজন করবে জেসি ওয়েন? বিগ বে থেকে টেলিগ্রাম করার ফাঁকে কয়েক জায়গায় ঢু মেরেছিল লসন, টোবির সেলুনেও গিয়েছিল, কিন্তু ওয়েনের দেখা পায়নি। লোকটা যদি সত্যিই বিগ বে-তে এসে থাকে, এতক্ষণে নিশ্চয়ই খবর পেয়ে গেছে যে ধরা পড়ে গেছে ওর ক্রুরা? এবার কি পরিকল্পনা করবে সে? বোঝার উপায় নেই। নিখাদ সতর্কতা আর নিজেদের দক্ষতাই ওদের সম্বল, সঙ্গে ভাগ্যের খানিকটা সহায়তা পেলে হয়তো লারেডোর ফাঁদটা এড়িয়ে যেতে পারবে। বিগ বে থেকে লারেডো ক্রসিং, ট্রেইলটা মোটামুটি সমতল। পথে অ্যাম্বুশ করার মত সুবিধাজনক জায়গা নেই বললেই চলে। তবুও হামলার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়নি লসন। জানে সঠিক জায়গা বেছে নেবে ওয়েন, সেজন্যে খোদ লারেডো ক্রসিং হচ্ছে আদর্শ জায়গা। মাত্র কয়েক ঘণ্টার পথ। সন্ধ্যার আগেই লারেডো ক্রসিঙের মাইল খানেকের মধ্যে পৌঁছে গেল ওরা। আচমকা বিরতি দিল লসন, ট্রেইল থেকে সরে গিয়ে জরিপ করল সামনের পথ। একেবারে খোলা জায়গা, ওদিক থেকে কেউ এলে আগে-ভাগেই টের পাবে। কফির আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়ল টিম কার্টিস। লসনের নির্দেশে স্ট্রং বক্স খুলে সব সোনা চারটা স্যাডল ব্যাগে ঢোকাল কোবার্ন আর অ্যালেন। চার ব্যাগে অনায়াসে জায়গা হয়ে গেল। বিগ বে থেকে কেনা চারটে ঘোড়ার পিঠে চাপাল ব্যাগগুলো। কাজ শেষে ফের আগের মতই বাক্সে তালা আটকে রাখল ওরা, তবে কিছু বালি আর পাথর ভরে রেখেছে। ‘এখন থেকে স্যাডল ব্যাগে সোনা রাখব আমরা। বাধ্য হয়ে যদি কোচ ফেলে
পৃষ্ঠা-৫৮
যেতে হয়, তাহলে অন্তত সোনাগুলো হারাতে হবে না,’ অন্যদের প্রশ্নের উত্তরে ব্যাখ্যা করল লসন। ‘লারেডোয় পৌঁছে কি পরিস্থিতিতে পড়ব কে জানে, আগে থেকে সতর্ক থাকা ভাল। আর এখানেই সাপার করব আমরা।’ ‘কি!’ চমকে উঠল কার্টিস। ‘হ্যাঁ, লারেডোর খাওয়া আমাদের কপালে জুটবে না।’ ‘তারমানে,’ বিস্ময় কোবার্নের কণ্ঠে। ‘লারেডোয় থামব না আমরা?’ ‘না। ভাব দেখাব থামতে যাচ্ছি, তারপর হঠাৎ করেই ঘোড়া ছোটাব। স্টেজ সহ স্টেশনটা পেরোনোর চেষ্টা করব, কিন্তু অবস্থা খারাপ দেখলে কেট ফেলে রেখে যাব।’ ‘এজন্যেই ঘোড়া ভাড়া করেছ, সোনাগুলোও আলাদা করে ফেলেছ?’ হেসে জানতে চাইল কার্টিস। ‘লারেডো পেরিয়ে যাওয়ার সময় হয়তো সর্বোচ্চ গতিতে ছুটতে হতে পারে আমাদের। বিগ বে-তে থাকতেই মরুভূমি পাড়ি দেয়ার চিন্তা মাথায় এসেছিল। ভাবছিলাম কোন ভাবে ঘোড়া বদলের ব্যাপারটা এড়ানো যায় কিনা। ঘোড়া বদলাতে গেলে খামোকা কিছু মূল্যবান সময় নষ্ট হবে, তাছাড়া আমাদের আক্রমণ করার সুযোগ পেয়ে যাবে ওরা। তারচেয়ে এটাই কি ভাল হলো না? না থেমে সরাসরি স্টেশন পেরিয়ে যাব, কোচটা ফেলে গেলেও সোনা ঠিকই থাকবে আমাদের সঙ্গে। ‘কপাল ভাল থাকলে সবাই বেরিয়ে যেতে পারব, কিন্তু কেউ যদি পড়েই যায়, তাহলে অন্যদের দায়িত্ব হবে তার স্যাডল ব্যাগ নিয়ে কেটে পড়া।’ ‘আমার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চাপতে চাইছে, ড্যান, সহাস্যে বলল টিম কার্টিস। ‘চিন্তা করো, পুরো পঞ্চাশ হাজার ডলারের সোনা থাকবে আমার সঙ্গে, ইচ্ছে করলে অনায়াসে তোমাদের ফাঁকি দিয়ে কেটে পড়তে পারব। মরুভূমিটা আমার চেয়ে বেশি চেনো না তোমরা।’ ‘হতে পারে, তবে কিছু কিছু তো চিনি। যেখানেই যাও আমি তোমার পিছু নেব!’ পাল্টা হেসে উত্তর দিল লসন। ‘না হে, তোমাকে খেপানোর ঝুঁকি নিতে রাজি নই। দরকার নেই অত সোনার! পারিশ্রমিক হিসেবে দু’শো ডলার পাব, আমার জন্যে এই ঢের। নিশ্চিন্তে কাটিয়ে দিতে পারব কয়েক মাস।’ ‘ওগুলো শেষ হয়ে গেলে, আর যদি কোন কাজ না পাও, যোগাযোগ কোরো আমার সঙ্গে। তোমাকে একটা কাজ দিতে পারব বোধহয়, জেরেমি টাউনের কাছেই।’
‘তোমাদের বাথানে?’ ‘জানলে কিভাবে?’ ‘জেরেমির প্রায় সবাই জানে। তোমার বাবা শহরে এসেছিল একদিন। বাথানের কয়েকটা গরু চুরি করেছিল কিনকেডের দুই লোক, এদের পিছু নিয়ে ঠিক চলে এসেছে জ্যাক লসন। শহরের একেবারে শেষে যে দুটো কটনউড আছে তাতে ওদের ঝুলিয়ে দিল সে, সবার সামনে এবং চুরি করা গরুর পিঠে চাপিয়ে।
পৃষ্ঠা-৫৯
আহ্, দেখার মত হয়েছিল দৃশ্যটা! কিনকেড পর্যন্ত চুপ মেরে ছিল, কিচ্ছু করতে পারল না। ‘এরকম কোন ঘটনা আর বরদাস্ত করবে না, যাওয়ার সময় ঘোষণা দিয়ে গেল জ্যাকব লসন, এবং মাংসের দরকার হলে যেন গরু কিনতে ওর বাথানে যায় লোকজন। সাহস আছে মানুষটার, অন্তত বিশজন লোক ঘটনাটা দেখেছে, কিন্তু একটা আঙুল তোলার সাহস পায়নি কেউ, অথচ জ্যাকব লসনের সঙ্গে ছিল মাত্র তিনজন লোক।’ ‘এদের একজন ম্যাট হিগিন্স, তাই না?’ মাথা ঝাঁকাল কাটিস। ‘খোলা জানে কিভাবে এই দুর্ধর্ষ গানম্যানকে পটিয়েছে তোমার বাবা, কিন্তু জ্যাকব লসনের একান্ত বাধ্য মনে হয়েছে ওকে। সবার তো ধারণা ছিল তিন বছর আগে সত্যিই টুকসনে মারা গেছে হিগিন্স। পাহাড়ে ছিল বলেই বোধহয় ওর খোঁজ পায়নি কেউ।’ ‘ঘটনাটা আমার জানা নেই। এবার অনেকদিন পর বাড়ি ফিরে দেখলাম পরিবার সহ এখানে থাকছে সে।’ ‘তুমি কি সত্যিই বাথানে কাজ করার প্রস্তাব দিচ্ছ আমাকে?’ মাথা ঝাঁকাল লসন। ‘বব, তোমাকেও।’ কি যেন ভাবল কার্টিস। ‘মনে হচ্ছে কাজটা উপভোগ করব আমি। ম্যাট হিগিন্সের সঙ্গে কাজ করার আনন্দই আলাদা।’ সাপার শেষ করে কফি পান করল ওরা। নীরব হয়ে গেছে সবাই, গম্ভীর। কিছুক্ষণের মধ্যে লারেডো ক্রুসিঙের উদ্দেশে যাত্রা করবে। জানে না মাইল দুই দূরের নিঃসঙ্গ স্টেজ স্টেশনে কি চমক বা অভ্যর্থনা অপেক্ষা করছে, তবে অনেক অনিশ্চয়তা যে আছে সেটা নিশ্চিত জানে।
পৃষ্ঠা-৬০
ছয়:- ঘণ্টাখানেক পর লারেডো ক্রসিঙে প্রবেশ করল ওরা। দুটো সেলুন, একটা ক্যাফে, কামারের দোকান এবং আস্তাবল…সব মিলিয়ে চার-পাঁচটা বাড়ি। বড় সেলুনটা একাধারে ক্যাফে আর হোটেলের সেবা প্রদান করে। বাড়িটা দোতলা। ওপরে থাকার জন্যে কয়েকটা রূম; নিচে একপাশে লবি, অন্য দিকে বার। দরজা একটাই। রাস্তার ওপাশে কামারের দোকান, আস্তাবল এবং আরেকটা সেলুন। সব মিলিয়ে বড়জোর দশ কি পনেরোজন লোক থাকে এখানে। তবে মন্টানা থেকে বিগ বে পর্যন্ত স্টেজ যাত্রায় এদের বিরাট ভূমিকা আছে। চলার পথে এখানে বিশ্রাম নেয় যাত্রীরা, স্টেজের ঘোড়া বদল হয়। ঢোকার আগেই একটা কুকুর চিৎকার করে ওদের উপস্থিতি জানিয়ে দিল। তীর বেগে ছুটে এল চারপেয়ে জন্তুটা, সবার সামনে থাকা ড্যানি লসনের রোয়ানের কাছে এসে তীব্র স্বরে চেঁচাতে শুরু করল। অন্ধকারে জ্বলছে চোখ দুটো। অকস্মাৎ উৎপাতে থমকে দাঁড়িয়েছে রোয়ানটা, কিন্তু অস্থির ভঙ্গিতে আগু- পিছু করছে। আলতো স্পার দাবাল লসন, অনিচ্ছার সঙ্গে এগোল রোয়ান, কুকুরের কাছাকাছি হলো। স্টির্যাপ থেকে পা খসিয়ে কুকুরটার পাছায় ঝেড়ে লাথি হাঁকাল লসন। পাঁচ হাত দূরে ছিটকে পড়ল চারপেয়ে আপদ, কেঁউ কেউ করে অভিযোগ করল। কুকুরের মালিকের খোঁজে চারপাশে তাকাল ড্যানি লসন, কামারের দোকানের ভেতর একটা ছায়া দেখতে পেল। ছাদে ঝোলানো লণ্ঠনের স্নান আলো ঘরের কোণ পর্যন্ত পৌঁছায়নি, আবছা অন্ধকারে দেয়ালের সঙ্গে মিশে দাঁড়িয়েছে লোকটা। ‘কুত্তাটা সামলাও, মিস্টার! নয়তো পরেরবার কাছে এলে ওটাকে গুলি করব আমি!’ অধৈর্য স্বরে খেঁকিয়ে উঠল লসন। চুপ করে থাকল লোকটা, অনড় দাঁড়িয়ে আছে। নিজেকে সামলে নিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরিস্থিতি বোঝার প্রয়াস পেল লসন। এটা কোন ফাঁদ নয়তো? ‘হয়েছে, টব, আর এগোতে হবে না!’ কুকুরটা আবার এগোতে চড়া স্বরে ওটাকে নিরস্ত করল লোকটি। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল কুকুর, তারপর উল্টো ঘুরে মালিকের দিকে এগোল। ঘরের ভেতরে আবছা অন্ধকারে মিশে গেল, কিন্তু জ্বলজ্বলে চোখ জোড়া ঠিকই ওটার উপস্থিতি ঘোষণা করছে। ‘কোত্থেকে এসেছ তুমি, স্ট্রেঞ্জার?’ জানতে চাইল লোকটা। ‘তা জেনে তোমার কোন কাজটা হবে শুনি?’ বিরক্ত স্বরে বলল লসন। চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে ওর ‘শকুনে’ দৃষ্টি, বাড়ির কোণ আর দেয়ালের লাগোয়া চাপ চাপ অন্ধকারে গাঢ় কিছু কাঠামো খুঁজে পেতে চাইছে। পেছনে আবছা ভাবে ঘড়ঘড় শব্দ শোনা যাচ্ছে, মিনিট কয়েকের মধ্যে স্টেশনে ঢুকে পড়বে স্টেজ।
‘মনে হচ্ছে তোমার সঙ্গে আরও লোক আছে?’ নিস্পৃহ স্বরে জানতে চাইল কামার, যেন লসনের সঙ্গে লোক থাকা বা না-থাকায় কিছু যায়-আসে না তার, স্রেফ কৌতূহলের কারণে প্রশ্নটা করেছে। লণ্ঠনটা তুলে নিয়ে এগিয়ে এল সে, পোর্চে এসে ছাদ থেকে ঝুলন্ত আঙটায় ঝুলিয়ে দিল। অস্পষ্ট হলদেটে আলোয় মুখটা দেখা গেল এবার, বয়স্ক একজন লোক। মুখে কাটাকুটির দাগ, চোখে মাপা সতর্ক চাহনি। ‘লণ্ঠনটা সরিয়ে ফেলো, মিস্টার!’ শীতল কণ্ঠে নির্দেশ দিল ড্যানি। ‘কেন?’ ‘ওটা এখানে রাখারই বা দরকার কি?’ ‘আরে, চেহারা না দেখে কি কথা বলা যায় নাকি?’ হেসে বলল সে। ‘তাছাড়া স্টেজের ঘোড়া বদল করার সময় আলো না থাকলে কাজটা করব কিভাবে?’ উত্তরে পিস্তল কক্ করল ও। ‘যা বলছি করো, নইলে তোমার বুক ফুটো করব!’ লণ্ঠনের দিকে হাত বাড়াল লোকটি, ততক্ষণে লসনের পেছনে এসে পড়েছে স্টেজ। সহসা আস্তাবলের দরজায় দু’জনকে দেখতে পেল লসন, নিঃশব্দে বেরিয়ে
পৃষ্ঠা ৬১ থেকে ৮০
পৃষ্ঠা-৬১
এসেছে অন্ধকার ফুঁড়ে। চোখের কোণ দিয়ে হোটেলের দোতলায় একটা ছায়া দেখতে পেল ও। চতুর্থ লোকটাকে দেখল লণ্ঠনের উদ্দেশে গুলি করার সময়, এক্কেবারে সামনে-কামারের দোকানের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে বিশালদেহী। মাটিতে আছড়ে পড়ল লণ্ঠন, ধপ করে নিভে গেল সঙ্গে সঙ্গে। মুহুর্মুহু গর্জে উঠছে লসনের পিস্তল, কামারের উদ্দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে দ্বিতীয় গুলি। লণ্ঠনটা মাটিতে পড়ার আগেই লোকটার বুকে বিধল বুলেট। হুড়মুড় করে মেঝেয় আছড়ে পড়ল সে। শিথিল মুঠি থেকে খসে পড়ল পিস্তল, কোন ফাঁকে বের করেছে খোদা
মালুম। খার দাবাল লসন। লাফিয়ে আগে বাড়ল ওর রোয়ান। গুলি করতে সুবিধে হবে ভেবে হোটেলের দিকে ফিরেছে ও, ঘোরার সময় দেয়ালের কাছে দাঁড়ানো লোকটার উদ্দেশে গুলি করল। লোকটাও একইসঙ্গে গুলি করেছে। আস্তাবলের সামনে কমলা আগুন ওগরাচ্ছে দুটো পিস্তল। কানের পাশে বিচিত্র সুর তুলে ছুটে গেল তপ্ত সীসা, টের পেল লসন। মাথা নিচু করে ফেলেছে ও, নিশানা ছাড়াই গুলি করল হোটেলের লোকটার উদ্দেশে, ব্যস্ত রাখতে চাইছে তাকে। এই লোকটাই সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় তাকে বেধাতে পারল ও, দোতলা থেকে নিচে খসে পড়ল লাশটা।
চোখের নিমেষে কাছে চলে এসেছে আস্তাবলের সামনের লোকগুলো। পেছনে টিম কার্টিস আর অ্যালেনের অদ্ভুত চিৎকার শুনতে পাচ্ছে লসন, চেঁচিয়ে ঘোড়াগুলোকে উৎসাহ দিচ্ছে ওবা। খুরের দাপটে ধুলো উড়ছে, অস্পষ্ট হয়ে গেছে দৃষ্টিপথ। আন্দাজের ওপর ঝটপট দুটো গুলি করল ও, শূন্য সিলিন্ডারে হ্যামারের বাড়ি পড়তে দ্রুত বাম হাতে তুলে নিল অন্য পিস্তল। ছুটছে ওর রোয়ান, পিছু পিছু আসছে স্টেজটা। একপাশে আলাদা একটা ঘোড়ায় চড়েছে অ্যালেন, দু’হাতে উদ্যত পিস্তল থেকে সমানে গুলি করছে। ওর স্যাডল হর্নের সঙ্গে বাড়তি ঘোড়াগুলোর লাগাম বাঁধা। হ্যান্স কোবার্নও বসে নেই, কোচের পর্দা সরিয়ে রাইফেল থেকে সমানে গুলি করছে।
অ্যালেন আর কোবার্নের তোপের মুখে কিছু বোঝার আগেই ঝাঁঝরা হয়ে গেল আস্তাবলের সামনের লোকগুলো। হোটেলের পোর্চে ছুটে এসেছিল আরেকজন, নিশান। করার আগেই লসনের গুলিতে পটল ভুলল সে। ঘোড়ার গতি এতটুকু কমায়নি লসন, চোখের নিমেষে পেরিয়ে গেল স্টেশনটা, ওর পিছু নিয়ে নিরাপদে চলে এসেছে স্টেজ টানা অনেকক্ষণ ছুটল ওরা। তারপর খোলা একটা জায়গায় এসে গতি কমাল। ‘কার্টিস, তোমার খবর কি?’ জানতে চাইল লসন। সবচেয়ে কঠিন কাজটা ছিল তারই, স্টেজের আসন ছেড়ে ঘোড়ায় চড়তে হয়েছে সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে। কোচ ফেলে যেতে হলে টীম থেকে ঘোড়াটাকেও আলাদা করতে হত তার। ‘এক্কেবারে আগের মতই আছি, ড্যান, ড্রাইভারের কণ্ঠে উচ্ছ্বাস। ‘তবে সোনার মালিক বোধহয় গুলি খেয়েছে।’ ‘কোথায়, হ্যান্স?’
পৃষ্ঠা-৬২
‘আমার একটা কাঁধ অবশ করে দিয়েছে ব্যাটারা!’ বিরক্তি প্রকাশ করল সোনা ব্যবসায়ী। ‘খুব খারাপ নাকি?’ ‘জখম জখমই, খারাপ আর মন্দ কি! উফ, এরকম জানলে এই ট্রিপে আসি আমি! কি অলক্ষুণেই না পেয়েছিল!’ কাছে গিয়ে ক্ষতটা দেখল লসন। এক খাবলা মাংস তুলে নিয়ে গেছে বুলেট। রক্তক্ষরণ হচ্ছে। ব্যানডানার সাহায্যে ক্ষতটা চেপে ধরেছে সোনা ব্যবসায়ী। অনেকক্ষণ ধরে অ্যালেনের কোন সাড়া নেই দেখে এবার তার দিকে ফিরল লসন। আড়ষ্ট শরীরে বসে আছে সে স্যাডলে, ব্যথায় বিকৃত হয়ে গেছে মুখ। এক হাতে ডান উরু চেপে ধরেছে। ‘নাও, এবার এগোও। কারও আঘাতই এমন নয় যে এখনই শুশ্রূষা করতে হবে। কয়েক মাইল এগিয়ে নিই, মরুভূমিতে ঢুকে বিশ্রাম নেব আমরা।’ তর্ক করল না কেউ। আবার রওনা দিল ওরা। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে প্রকৃতি। দূরে ফ্যাকাসে আকাশের সঙ্গে মিশে গেছে রুক্ষ ট্রেইল। ধীরে ধীরে গাছপালা বা ঝোপ-ঝাড় কমতে শুরু করল। স্যাডলের ওপর ঘুরে পেছনে তাকাল লসন, অন্যরা পেরিয়ে গেল ওকে। সময় নিয়ে শোনার চেষ্টা করল, বুঝতে চাইছে কেউ অনুসরণ করছে কিনা। হয়তো ওদের খায়েশ মিটে গেছে। অন্তত চারজন লোক হারিয়েছে। আজকের রাতটা কাজে লাগানোর ইচ্ছে ওর। যতটা সম্ভব এগিয়ে যেতে চায়। সকালে হয়তো পিছু নেবে ওয়েনের দল, এই সময়ে যদি দশ মাইলও এগিয়ে থাকতে পারে তো ওদেরকে ধরার সম্ভাবনা একেবারেই কমে যাবে। কারণ তাজা ঘোড়া আছে সঙ্গে। বিগ বে ছেড়ে আসার পর স্টেজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ট্রেইল পাড়ি দিয়েছে ঘোড়াগুলো, সওয়ার না থাকায় ক্লান্ত হয়নি তেমন। চল্লিশ মাইল পথ, তবে সোজাসুজি যাওয়ার উপায় যেহেতু নেই সব মিলিয়ে ষাট মাইলের মত হবে। আশা করা যায় দু’দিন পর সকালের দিকে লিয়ন সিটিতে পৌছে যাবে।
একটু পর মরুভূমিতে ঢুকে পড়ল ওরা। স্যামুয়েল কার্টিস নেতৃত্ব দিচ্ছে এখন। ঘণ্টাখানেক এগিয়ে একটা ওঅটর হোলের কাছে থামল ওরা। দু’জনের ক্ষতের শুশ্রুষা ছাড়াও তেষ্টা মেটাল। পানির ক্যান্টিনগুলো ভরে নিল, ইচ্ছেমত পানি খেতে দিল ঘোড়াগুলোকে। মিনিট ত্রিশ বিশ্রাম নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করণ। চারপাশে কোথাও কোন ল্যান্ডমার্ক বা ট্রেইলের চিহ্নও দেখতে পাচ্ছে না লসন, বরং রাত বলে যেদিকে তাকাচ্ছে একইরকম লাগছে ওর কাছে। কিন্তু নির্বিকার দেখাচ্ছে কার্টিসকে, নিশ্চিন্তে এগোচ্ছে সে, একবারের জন্যেও থমকাল না বা থামল না। ভোরের দিকে একটা পানির উৎসের কাছে ক্যাম্প করল ওরা। নিজে পাহারার দায়িত্বে থেকে অন্যদের ঘুমানোর সুযোগ দিল লসন। পিছু নিয়ে আসছে না প্রতিপক্ষ, কিংবা আচমকা কেউ হামলাও করবে না, জানে ও; তারপরও ঝুঁকি
পৃষ্ঠা-৬৩
নিতে নারাজ। ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তে চাইছে শরীর, অনুভব করল লসন, সারা দিন লাগাতার ছুটতে হয়েছে। চোখের পাতা বুজে আসতে চাইছে। কফি খেতে পারলে ক্লান্তি কাটত। কিন্তু আগুন জ্বালানো ঠিক হবে না। রাতের বেলা দশ মাইল দূরের আগুনও অনায়াসে চোখে পড়ে। এক বেলা কফি না খেলে এমন কিছু যাবে- আসবে না। মরুভূমির আরও ভেতরে প্রবেশ করুক, কাল থেকে আগুন জ্বালানোর সুযোগ হবে। হঠাৎ করেই জেরেমি টাউনের কথা মনে পড়ল ওর। এখন কি ঘটছে সেখানে? বেপরোয়া লোকগুলো অবশ্য আপাতত সোনার চালান নিয়ে মাথা ঘামাবে-কিনকেড, রক্স বা থমসন…সবাই। এ ব্যাপারটা ঢুকে গেলে শহরের দিকে মনোযোগ দেবে ওরা। আচ্ছা, বিপদ আছে জেনেও এর মধ্যে নিজেকে কেন জড়িয়েছে ও? পারিশ্রমিক আর ঝুঁকির তুলনা স্রেফ অনর্থক মনে হচ্ছে। আসলে কাজটায় যে অনিশ্চয়তা, রোমাঞ্চ আছে তা টানে ওকে। সফল হলে সেটা উপভোগ করবে। জেরেমি টাউনে সেদিন কেন গিয়েছিল ও? ওই একই কারণে, অবচেতন মন টেনে এনেছে ওকে। মনের গোপন ইচ্ছে ছিল কাজটা নেওয়ার, হ্যান্স কোবার্ন আরেকবার প্রস্তাব দেওয়ার আগেই যেচে পড়ে কাজটা নিয়েছে। লারকিনদের ক্রেইমেও যাওয়া হয়নি। বিল লারকিন খেপে যাবে নিশ্চয়ই। এ লোকটির সাথে অনেকদিন থেকে জানাশোনা ওর। জুলিয়া লারকিন-মেয়েটা দারুণ সুন্দরী, জেরেমি টাউনের মত অশান্ত শহরে ঠিক মানায় না ওকে; বরং সল্ট লেক বা সনোরার মত বড় শহরে মানায়। নির্লিপ্ত একটা ভাব আছে মেয়েটির মধ্যে, দেখেছে লসন। ধন্যবাদ দেয়া দূরে থাক, বলতে গেলে সেদিন মুখই খোলেনি মেয়েটা। পশ্চিমে আসতে না আসতে কতটা বিতৃষ্ণা জমেছে ওর মনে?
জুলিয়া লারকিনের ধারণা বা চিন্তা-ভাবনায় ওর কিছু আসে-যায়, নাকি ওর ব্যাপারে আসে-যায় মেয়েটির? কোনটাই নয়। এখানে টিকতে পারবে না এ মেয়ে, ক’দিন পর নির্ঘাত সনোরায় ফিরে যাবে। বড় শহরের আরামদায়ক জীবন ছেড়ে কে পড়ে থাকতে চায় বিধ্বস্ত পশ্চিমে? কষে নিজেকে গাল দিল লসন, সামান্য একজন মেয়েমানুষকে নিয়ে ভাবছে সে! অথচ ভাবনার জন্যে অনেক বিষয় পড়ে আছে। সাপ্লাইটা ঠিকমত পৌছে দিতে না পারা পর্যন্ত ওর অস্থিরতা কাটবে না। পাহাড়ের চূড়া থেকে ফিল্ড গ্লাস দিয়ে স্টেজের ওপর নজর রাখছে এক লোক। অনেকক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে দেখল সে, তারপর নিশ্চিত হয়ে আয়নার সাহায্যে সঙ্কেত পাঠাল নেইল ডেভিসের কাছে। কাছাকাছি একটা রীজে আশ্রয় নিয়েছে আউট-ল নেতা, সঙ্গে আটজন দুর্বৃত্ত। ‘জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও সবাই,’ ত্যক্ত স্বরে বলল ডেভিস। ‘সম্ভব নয়, সরে যাচ্ছি আমরা।’
পৃষ্ঠা-৬৪
‘মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার, নেইল!?’ অসন্তোষ ঝরে পড়ল গ্যারি হর্নগ্রেনের কণ্ঠে। ‘পঞ্চাশ হাজার ডলার! এভাবে ছেড়ে দেব?’ ‘মরা মানুষের কাছে টাকার দাম নেই, গ্যারি,’ শীতল নিরুত্তাপ স্বরে বলল ডেভিস। ‘বলছি পরিস্থিতি আমাদের অনুকূলে নেই। সুতরাং এগোব না আমরা। তুমি যদি চাও তো যেতে পারো। কিন্তু মনে রেখো একা যেতে হবে তোমার। সফল বা ব্যর্থ যা-ই হও, ফিরে আসতে পারবে না আর।’ ইতস্তত করল হর্নগ্রেন। ‘কিন্তু আমি ঠিক ও-কথা বোঝাতে চাইনি, নেইল।’ ‘এমন লোভনীয় একটা দান ছেড়ে দিতে আমারও খারাপ লাগছে। কিন্তু ড্যানি লসনকে তো চিনি আমি। ও যদি মরেও, অন্তত কয়েকজনকে নিয়ে যাবে সঙ্গে। তাতে লাভটা কি হবে?’ ‘তাহলে কি করব আমরা?’ জানতে চাইল বিল ফস্টার। ‘যদ্দূর মনে হচ্ছে লিয়ন সিটিতে যাচ্ছে ওরা। ওখানেই যাব, লক্ষ্য রাখব স্টেজের ওপর। যদি পরিস্থিতি দেখে মনে হয় সুবিধে হবে, তাহলে চেষ্টা করব।’ রওনা দিল ওরা। সঙ্গে তাজা ঘোড়া, পথটাও সংক্ষিপ্ত। দেড় দিন পর, ঠিক সকালে পৌঁছে গেল লিয়ন সিটির কাছাকাছি। শহরের বাইরে একটা রীজের ওপর আশ্রয় নিল দলটা। তিনজনকে শহরে রেকি করতে পাঠাল ডেভিস, আলাদা আলাদা ভাবে শহরে ঢুকবে ওরা, সুবিধামত জায়গা বেছে নেবে। ‘চারজন,’ কিছুক্ষণ পরই রিপোর্ট করল হর্নগ্রেন। ‘কাউহ্যান্ড নয় ওরা, বাজি ধরে বলতে পারি আমাদের মতই ধান্ধায় আছে।’ ‘হুম!’ ফিল্ড গ্লাস নামিয়ে রেখে খানিকটা চিন্তিত সুরে বলল ডেভিস। ‘তাই তো দেখছি। কিন্তু কারা ওরা?’ ‘হয়তো কিনকেড বা রক্সের চেলা ?’ স্টেশন বিল্ডিংটা নিচু হলেও দীর্ঘ এবং যথেষ্ট চওড়া। পাশেই করালের সারি, এবং অন্য দিকে ইন্ডিয়ানদের আক্রমণে ভেঙে পড়া আগের দালানের ধ্বংসাবশেষ।
চারটে তরতাজা ঘোড়া রেইলে বাঁধা। মাত্র একজন লোক পাহারায় রয়েছে। তাকে চিনতে পারল নেইল ডেভিস। কার্ল ব্রেনেট। রহস্যময় এক লোক। অরিগন আর আইডাহোতে শেরিফের কাজ করেছে, কিন্তু ভাড়াটে বন্দুকবাজ হিসেবে বেশি পরিচিত। যে কেউ ভাড়া করতে পারে ওকে, টাকা হলেই হলো। আউট-ল নয়, কিন্তু ওর কাজের ধারাই সেরকম। হর্নগ্রেনের হাতে ফিল্ড গ্লাসটা ধরিয়ে দিল ডেভিস। ‘ব্রেনেটকে তো চিনলাম। দেখো অন্য কাউকে চিনতে পারো কিনা।’ দ্বিতীয় লোকটাকে চিনল গ্যারি হর্নগ্রেন। ছোটখাট, রোদপোড়া চেহারার লোকটার নাম এমিল নাচেজ। প্রায় বিড়ালের মত নিঃশব্দে চলাফেরা করে। ভাড়াটে বন্দুকবাজ, কখনও কখনও আউট-ল। তবে ধরা পড়েনি কখনও। বাকি দু’জনকে চিনতে পারল না কেউ। করালের পাশে চলে গেল একজন, বাকিরা স্টেশন বিল্ডিংয়ের ছায়ার আড়ালে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় থাকল, রাস্তা থেকে এদের কাউকেই দেখা যাবে না।
পৃষ্ঠা-৬৫
‘কি ঘটতে যাচ্ছে, নেইল, আঁচ করতে পারছ?’ ‘ওদের ভাবচক্কর দেখে মনে হচ্ছে লসনকে চেপে ধরতে যাচ্ছে।’ স্টেজের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে এখন, দূরের ট্রেইলে ধূলির ঝড় দেখা যাচ্ছে। ‘কি ঠিক করলে, ডেভিস?’ উৎসুক স্বরে জানতে চাইল বিল ফস্টার। ‘আমরা আছি নাকি নেই?’ ‘নেই,’ ঘোষণার সুরে বলল ডেভিস। ‘তবে এরা যদি সোনা ছিনিয়ে নেয়, তাহলে আছি। চোরের ওপর বাটপারি করব আমরা। লসনের চেয়ে এদেরকে সামলানো অনেক সহজ হবে আমাদের জন্যে।’ গ্যারি হর্নগ্রেনের পছন্দ হচ্ছে না আইডিয়াটা। কিন্তু চেপে গেল সে। নেইল ডেভিসের বিচক্ষণতার ওপর আস্থা রাখলে লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই, গত দশ বছরে তাই জেনেছে ওরা। সূর্য ওঠার আগেই রওনা দিল ওরা।
একঘেয়ে যাত্রা, তবু নিশ্চিন্ত বোধ করছে ড্যানি লসন, কারণ অ্যাম্বুশের আশঙ্কা আপাতত নেই। কেউ যদি পিছু নিয়েও থাকে ধরতে পারবে না ওদের। চিন্তা কেবল লিয়ন সিটিকে নিয়ে। সেখানে কারও থাকার সম্ভাবনা নেই, কিন্তু নেইল ডেভিসের ক্ষেত্রে শেষ কথা বলে কিছু নেই। হয়তো ঠিকই হাজির হয়ে যাবে সে। লোকটা যথেষ্ট বুদ্ধিমান, বিগ বে ট্রেইলে ওদেরকে না দেখে ঠিকই বুঝে নেবে গন্তব্য পাল্টে লিয়ন সিটির উদ্দেশে এগোচ্ছে ওরা। টানা দু’দিন বালির ওপর দিয়ে চলছে ওরা। সারা শরীর আর কাপড়ে ধুলোর পুরু আস্তর জমেছে। খটখটে হয়ে আছে গলা, তবে খাবার বা পানির অভাব বোধ করছে না এটাই হচ্ছে বড় স্বস্তি। কার্টিস তার কারিশমা ঠিকই দেখাচ্ছে, নিশ্চিন্তে এগোচ্ছে সে। পরদিন সকালে ঘোষণা করল দুপুরের আগেই পৌছে যাবে লিয়ন সিটিতে। ববের ক্ষতটা দ্রুত সেরে উঠছে, হাঁটতে পারছে সে। তবে স্যাডলে অথবা বেডরোলে কাটছে ওর সময়। নেহাত বাধ্য না হলে ওকে কাজ দিচ্ছে না লসন, প্রতিবার থামার পর দু’জনের ক্ষতের পরিচর্যা করছে। হ্যান্স কোবার্নের ক্ষতটা প্রায় শুকিয়ে এসেছে। তবে তার অভিযোগ বন্ধ হয়নি। সেসব যে মেকি, ঠিকই ধরতে পেরেছে লসন। সাফল্যের প্রায় শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে ওরা, লিয়ন সিটিতে গিয়ে সব সোনা ট্রেনে তুলে দিতে পারলেই নিশ্চিন্ত। সেটা সে-ও জানে, এবং চুটিয়ে উপভোগ করছে পরিস্থিতিটা। সেজন্যেই অযথা হাসছে সে, যে কোন কথার পিঠে রসাল মন্তব্য করছে। লিয়ন সিটিকে দেখে কখনও মনে হয় না ব্যস্ত বড়সড় একটা কাউ-টাউন। মরুভূমির একেবারে শেষ প্রান্তে অবস্থান হলেও ওপাশের সমতল ভূমিতে অ্যারিজোনার সেরা বাথানগুলো গড়ে উঠেছে। মন্টানার সঙ্গে সরাসরি ট্রেন যোগাযোগের বদৌলতে ছোট হলেও বেশ এগিয়ে গেছে শহরটা। দীর্ঘ রাস্তার দু’পাশে সারি সারি দালান, ধুলোর অত্যাচারে মলিন হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে হয়তো শ’খানেক লোকের বাস। ল-অফিসটা ঠিক মাঝখানে। শুরুতেই স্টেশন,
পৃষ্ঠা-৬৬
কয়েকটা বগি ইতস্তত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। পেছন দিক দিয়ে শহরে ঢুকল ওরা। করালের সামনের হিচ রেইলে বাঁধা চারটে ঘোড়া প্রথমেই দৃষ্টি কেড়ে নিল লসনের। সতর্কঘণ্টি বাজাচ্ছে মন। ‘স্টেজটা রাস্তার একপাশে রাখো, টিম, চাপা স্বরে নির্দেশ দিল ও। ‘এমন ভাবে রাখো যাতে প্রয়োজনে দ্রুত রাস্তায় উঠতে পারো। আমি যদি পড়েও যাই, তোমার প্রথম কাজ হবে এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া।’ কার্ল ব্রেনেটকে আলস্য ভরে করালের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল লসন। মৃদু হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল ওর ঠোঁটে। কিন্তু দৃঢ় হয়ে গেছে চোয়ালের পেশী। শটগান হাতে স্টেজ থেকে নামল ও। ‘হ্যালো, ব্রেনেট! অনেকদিন পর দেখা হলো তোমার সঙ্গে। আশা করিনি এখানে তোমাকে দেখতে পাব।’ লসনের চেয়ে অনেক বেশি অবাক হয়েছে কার্ল ব্রেনেট, তার কোন ধারণাই ছিল না স্বয়ং ড্যানি লসন থাকবে গার্ড হিসেবে। নিজেকে সামলে নিয়ে নিস্পৃহ দৃষ্টিতে তাকাল সে। ‘তোমার এক প্যাসেঞ্জারের খোঁজে এসেছি আমি।’ আমার প্যাসেঞ্জার তো একজন-হ্যান্স কোবার্ন।’ ‘ ‘তাহলে সে-ই।’ পেছনে নড়ে উঠল স্টেজ। কেউ হয়তো জায়গা বদল করেছে কিংবা মাটিতে নেমেছে। ‘যার খোঁজেই এসে থাকো, ব্রেনেট, কোন ঝামেলা চাই না আমি। প্যাসেঞ্জারদের নিরাপদে পৌঁছে দেওয়া আমার, দায়িত্ব।’ দু’পা এগোল ব্রেনেট। ঠিক পাশে এসে দাঁড়িয়েছে এমিল নাচেজ। সামান্য কাঁধ উঁচাল ব্রেনেট, যেন লসনকে উপেক্ষা না করে উপায় নেই; স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ‘হ্যান্স কোবার্ন কি ভেতরে আছে?’ নিরুত্তাপ স্বরে শেষে জানতে চাইল সে। স্টেজের দরজা খুলে নেমে এল কোবার্ন। ‘কি দরকার আমাকে?’ ‘তোমার কাছে কিছু কাগজ আছে। ওগুলো নিয়ে যাওয়ার জন্যে পাঠানো হয়েছে আমাদের।’ ‘ঠিকই ধরেছ, কিছু কাগজ আছে আমার কাছে। কিন্তু তাতে তোমার কি? কাগজগুলো আমার জিম্মায় আছে বৈকি, মালিক কিন্তু আমি নই, এমনকি তোমরাও নও।’ ‘তর্ক করতে আসিনি আমি, মি. কোবার্ন। কাগজগুলো নিয়ে যাওয়ার জন্যে পাঠানো হয়েছে আমাকে, ওগুলো নিয়েই তবে ফিরব।’ ‘এবং প্রয়োজনে জোর করে হলেও সেটা করব আমরা,’ উস্কানির স্বরে যোগ করল নাচেজ। ‘সুবিধাজনক অবস্থায় আছি আমরা। ঝামেলা এড়াতে চাইলে ভালয় ভালয় দিয়ে ফেলো।’ ‘তাই নাকি? কেন দেব তোমাদের? মন্টানার ভূমি বণ্টন অফিসে যাবে ওগুলো। অন্য কোথাও, আমি বলছি, অন্য কোথাও বা কারও হাতে যাবে না।’ এতক্ষণ আড়ালে ছিল দু’জন লোক, ব্রেনেট আর নাচেজের পেছনে এসে
পৃষ্ঠা-৬৭
দাঁড়িয়েছে এখন। আয়েশী ভঙ্গি ওদের আচরণে, কিন্তু তৈরি হয়ে আছে পিস্তল বের করার জন্যে। নেইল ডেভিস এদের না চিনলেও লসন ভাল করেই চেনে। এককথায় আউট-ল বলা যায়। এড কিনলে আর জিম ম্যাককয়। কোচ থেকে নেমে এল বব, এগোল কয়েক পা। ‘উঁহু, ঠিক বলোনি, নাচেজ। …ড্যান, ওরা যদি খেলতে চায়, তাহলে আমার ভাগে কিনলে আর ম্যাককয়কে ছেড়ে দাও।’ “হ্যান্স কোবার্ন শুধু যাত্রীই নয়, এই স্টেজের জিম্মাদারও। সুতরাং কোন ভাবেই ওকে ছেড়ে দিতে পারি না আমি, তোমাদের যেই পাঠাক।’ ‘এই স্টেজে তাহলে সোনা যাচ্ছে?’ হালকা চালে জানতে চাইল কার্ল ব্রেনেট। ‘স্বাভাবিক, আগেই বোঝা উচিত ছিল, নইলে শটগান হাতে পাহারায় থাকতে না তুমি। যাকগে, সোনার ব্যাপারে আগ্রহ নেই আমার। ডাকাতি করতে আসিনি আমরা। এমনকি হ্যান্স কোবার্নকেও চাই না, শুধু ওর সঙ্গের কাগজগুলো চাই।’ ‘দুঃখিত,’ প্রায় ঘোষণার সুরে বলল লসন। ‘আগেই বলেছি, যাত্রীদের সব দায়িত্ব আমার। অনেকক্ষণ হলো থেমেছি আমরা, ট্রেনে মাল তুলে দিতে হবে। মাল খালাস করেই ফিরতি পথে রওনা দেব। ব্রেনেট, আমার হাতের জিনিসটা দেখেছ তো, এক্সপ্রেস গান? ইচ্ছে করলে এটার সাহায্যে দুই টুকরো করে ফেলতে পারি তোমাকে। কেউ রক্ষা করতে পারবে না। ভাগ্যের জোরে যদি আমার শরীরে দু’একটা বুলেট ঢোকাতেও পারো, তাতেও লাভ হবে না, শেষ হয়ে যাবে তোমরা!’ চুপ করে থাকল কার্ল ব্রেনেট, মনে মনে হিসেব করছে। ‘আমাকে খুন করে যদি কাগজগুলো হাতে পাও, সোনা না ছুঁলেও স্টেজ ডাকাতির অভিযোগে আউট-ল হিসেবে চিহ্নিত হবে তোমরা। ব্যাপারটা এমনিতে চাপা পড়ে যাবে না।’ ইতস্তত করছে ব্রেনেট। বুঝতে পারছে এক বিন্দু মিথ্যে বলেনি লসন। তাছাড়া এটাও জানে শটগান হাতে কতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে দুর্ধর্ষ লোকটা। পরিস্থিতিটা নাজুক, আক্রমণাত্মক হওয়া বোকামি হবে। ‘ঠিক আছে, লসন,’ শেষে আপসের সুরে বলল ব্রেনেট। ‘মানছি আমাদের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থায় আছ তুমি। কিন্তু হ্যান্স কোবার্নের বিরুদ্ধে জোচ্চুরির অভিযোগ আছে, নিরীহ মাইনারদের ঠকিয়েছে সে। জেরেমি টাউনের…’ ‘প্রমাণ করতে পারবে?’ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বাধা দিল লসন। ‘জোর-জবরদস্তি না করে বরং আইনের সাহায্য নিচ্ছ না কেন? যাগে, ঢের হয়েছে, তোমরা চলে গেলে এবার খুশি হই।’ খরখরে স্বরে হেসে উঠল এমিল নাচেজ। ‘চলে যাব? কে চলে যাবে? কে কাকে সুবিধামত পেয়েছে? যে মুহূর্তে শটগানটা নামিয়ে রাখবে, সেই মুহূর্তে তোমাকে মাটিতে নোয়াব আমি, লসন!’ ‘ধরো তো এটা, বব,’ আচমকা শটগানটা ছুঁড়ে দিল লসন। হাত বাড়িয়ে জিনিসটা লুফে নিল তরুণ।
পৃষ্ঠা-৬৮
কার্ল ব্রেনেটের ওপর থেকে সরে গেল লসনের দৃষ্টি, নাচেজের রোদপোড়া মুখে স্থির হলো। ‘এবার ঠিক আছে তো, নাচেজ?’ শীতল স্বরে বলল ও। ‘আমার হাতে শটগান নেই এখন।’ চোখ দিয়ে নিজের সঙ্গে ড্যানি লসনের দূরত্ব মেপে নিল নাচেজ। সামনে দাঁড়িয়ে সেই লোক, ভাবছে সে, যাকে সবাই বলে সবচেয়ে শক্ত, সবচেয়ে দ্রুত। বেশ বেশ। হোলস্টারে ছোবল হানল এমিল নাচেজ, চোখের পলকে মুঠিতে উঠে এল ভয়ালদর্শন কোল্ট। সবাই দেখল সেটা। মাত্র একটা গুলির শব্দ হলো। পিস্তলে হাত রেখে নাচেজ ভেবেছিল-মেরে ফেলব, ড্যানি লসনকে মেরে ফেলব! এবং পরমুহূর্তে সে নিজেই মারা গেল। বাতাসে পান পাউডারের কটু গন্ধ। স্টেজের একটা ঘোড়া ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠেছিল, দক্ষ হাতে ওটাকে সামাল দিল টিম কার্টিস। ‘দুঃখিত, ব্রেনেট। উপায় ছিল না আমার,’ নিরুত্তাপ স্বরে বলল লসন।
মাথা নাড়ল সে, নিরাসক্ত কণ্ঠে বলল: ‘কিন্তু তুমি শটগানটা হাতছাড়া করে উস্কে দিয়েছ ওকে, নইলে মরতে হত না নাচেজকে।’ কয়েক মুহূর্ত নিশ্চুপ থাকল লসন, কঠিন চাহনিতে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিল গানম্যানকে। ‘হয়তো। কিন্তু এই চেয়েছিল ও। আনমনে শ্রাগ করল কার্ল ব্রেনেট, ঘোড়ায় চাপার আগে পলকের জন্যে নাচেজের স্থির দেহটা দেখল; দুঃখ, সহানুভূতি বা অনুশোচনা কিছুই নেই চাহনিতে-স্রেফ করুণা ঝরে পড়ছে। দেখাদেখি ম্যাককয় আর কিনলেও নিজেদের ঘোড়ায় চাপল। ‘লাশটা নিয়ে যাও। এবার যেন সচেতন হয়েছে ব্রেনেট, বিতৃষ্ণার সঙ্গে সঙ্গীর লাশটা দেখল, তারপর থোক্ করে থুথু ফেলল মাটিতে। ‘তুমি মেরেছ ওকে। পারলে তুমিই কবর দিয়ো।’ ধীরে ধীরে গলিতে ঢুকে পড়ল ঘোড়া তিনটে, একটু পর দূরে সরে গেল খুরের আওয়াজ। চেপে রাখা নিঃশ্বাস ছাড়ল হ্যান্স কোবার্ন। হাত বাড়িয়ে ববের কাছ থেকে শটগানটা ফিরিয়ে নিল লসন। ‘ফাস্ট…খুব ফাস্ট তুমি!’ বিড়বিড় করে বলল তরুণ। নিরুত্তর থাকল লসন। শটগান বগলে রেখে পিস্তলের সিলিন্ডারে দুটো নতুন কার্তুজ ভরল। ‘দুটো! দুটো কেন?’ ‘নাচেজের লাশ দেখলেই বুঝবে।’ বুট দিয়ে ঠেলে মৃতদেহটা উল্টে দিল বব। বুকে পাশাপাশি দুটো ফুটো তৈরি হয়েছে। এত দ্রুত গুলি দুটো বেরিয়েছে যে শব্দ শুনে মনে হয়েছিল একটাই গুলি ছুঁড়েছে লসন। সোনা ব্যবসায়ীর দিকে ফিরল লসন। ‘ব্যাপার কি, হ্যান্স? কিসের কাগজ চাইছিল ওরা?’
পৃষ্ঠা-৬৯
সশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। ‘কি আর! ক্রেইমের কাগজ। সরকারী ভাবে নথিভুক্ত করার জন্যে সবার কাগজ জমা করেছিল জেফরি হ্যালার্ড। মন্টানায় যাব শুনে আমার কাছে দিয়েছে সেগুলো, ভূমি বণ্টন অফিসে যাতে দাখিল করি।’ ভুরু কোঁচকাল লসন। ‘তাহলে থমসনই ভাড়া করেছে ব্রেনেটকে?’ ‘হয়তো। রক্স বা কিনকেডও হতে পারে। শয়তানগুলোর মাথায় ফন্দিটা এল কিভাবে? হয়তো কাগজগুলো ছিনিয়ে নিয়ে ক্লেইম থেকে মাইনারদের উৎখাত করার পরিকল্পনা ছিল ওদের।’ ‘কিংবা হতে পারে এটা উসিলা মাত্র। সোনাই বোধহয় ওদের লক্ষ্য ছিল,’ বাতলে দিল বব। ‘সুবিধে হবে না দেখে হাল ছেড়ে দিয়েছে।’ ‘মনে হয় না।’ স্টেশন অফিসের দিকে এগোল হ্যান্স কোবার্ন। বাইরে অপেক্ষায় থাকল অন্যরা। কোন রকম চাঞ্চল্য নেই লোকজনের মধ্যে, রাস্তায় একটা লাশ পড়ে আছে কিংবা একটা ডুয়েল হয়ে গেছে একটু আগে; কোনটাই গ্রাহ্য করছে না এরা। যার যার কাজে ব্যস্ত সবাই, বেশিরভাগই ট্রেনের যাত্রী, ট্রেনে উঠছে মালপত্র নিয়ে। ‘যেতে পারবে তো, বব?’ পাশে দাঁড়ানো অ্যালেনের উদ্দেশে জানতে চাইল লসন। স্টেশন দালানের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে ওরা, ঘোড়াগুলো কাছের রেইলে বাঁধা। যাব।’ ‘নিশ্চিন্ত থাকো, ড্যান। মাত্র কয়েক ঘণ্টার যাত্রা। এক ঘুমে মন্টানা পৌছে টিকেট নিয়ে কোবার্ন ফিরে আসতে শহরের দিকে এগোল ওরা। একটা ক্যাফেয় লাঞ্চ সেরে সব ঘোড়া আস্তাবলে রেখে ফের স্টেশনে ফিরে এল। ট্রেন ছাড়ার তখনও বেশ সময় বাকি। ‘এত সময় বসে থেকে করব কি?’ চাপা স্বরে অভিযোগ করল টিম কার্টিস। ‘কোন একটা সেলুনে গিয়ে এক রাউন্ড গিলে আসি?’ ‘যেতে পারো, কিন্তু দশ মিনিটের মধ্যে ফিরে আসবে।’ মাথা ঝাঁকিয়ে দ্রুত পায়ে মূল শহরের দিকে চলে গেল ড্রাইভার। স্টেশনে কাঠের তৈরি বেঞ্চি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, একটায় বসে পড়ল কোবার্ন আর বব। একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে লসন, চারপাশে সজাগ দৃষ্টি রাখছে। তপ্ত রোদ পিঠ তাতাচ্ছে এখন, কোটের দুটো বোতাম খুলে দিল ও।
টিম কার্টিস ফিরে আসতে ট্রেনের নির্দিষ্ট বগিতে উঠল ওরা। কোণের দুটো আসনে বসল কোবার্ন আর অ্যালেন। কার্টিস ওদের সঙ্গে বসতে চেয়েছিল, কিন্তু সাফ না করে দিয়েছে লসন। মাঝখানে আরও দুটো আসন রেখে একটু দূরে বসল সে। পরদিন দুপুরে মন্টানায় পৌছল ওরা। ট্রেন থেকে নামতেই ওদের অস্ত্র জমা নিল ডেপুটি শেরিফ। খানিক অস্বস্তি বোধ করলেও মেনে নিল কার্টিস। মন্টানায় এর আগে কখনও আসেনি সে। জানে না শহরে অস্ত্র বহন করা নিষিদ্ধ। কার্লি ব্রনসন এখানকার মার্শাল। দশজন ডেপুটি আছে ওর। বিশাল শহরটায় আইনের
পৃষ্ঠা-৭০
শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এদের দৃঢ়তার জন্যেই। ব্যাংকে সোনা জমা রেখে সেলুনে ঢুকল ওরা। জেরেমি টাউনের সোনার প্রথম সফল শিপমেন্ট উপলক্ষে পান করতে ইচ্ছুক হ্যান্স কোবার্ন। পুরো এক বোতল হুইস্কি একাই শেষ করে ফেলল টিম কার্টিস, বিনে পয়সায় পাচ্ছে যখন কম খেতে রাজি নয় সে। উদ্যাপন শেষে, পোর্চে বেরিয়ে আসতে দলটাকে দেখতে পেল ড্যানি লসন। সেলুনের ঠিক উল্টোদিকের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে নেইল ডেভিস। পাশে আরও দু’জন। প্রথমেই আউট-লর উরুর দিকে চলে গেল লসনের দৃষ্টি, হোলস্টার বা পিস্তল নেই দেখে স্বস্তি বোধ করল। ‘মানুষটা তুমি খুব চালাক, ড্যান,’ গম্ভীর সুরে বলল আউট-ল নেতা। দীর্ঘদেহী মানুষ সে, মুখে কাটাকুটির দাগ-বহু লড়াইয়ের সাক্ষ্য বহন করছে। নীল চোখ তার, ধূর্ত সতর্ক চাহনি সেখানে ‘ক’টা দিন বেগার খাটুনি গেল! মেলবি সিটির কাছে অপেক্ষা করছিলাম তোমাদের জন্যে, আসল ব্যাপার বুঝতে খানিক দেরি হয়ে গিয়েছিল। ওয়েনের লোকগুলোকে চেপে ধরেছ শুনেই আন্দাজ করা উচিত ছিল লিয়ন সিটিতে যাচ্ছ তোমরা। শর্টকাট পথে এসেও সুবিধা করা গেল না। তবে নাচেজের চালিয়াতি দেখতে মন্দ লাগেনি! ওকেই তো মাটিতে
নোয়ালে, নাকি?’ মৃদু নড করল লসন। ‘আশপাশেই ছিলে তুমি?’ ‘হ্যাঁ। ব্রেনেট কি চাচ্ছিল?’ পাশে দাঁড়ানো সঙ্গীদের অস্বস্তি টের পাচ্ছে লসন। বিষফোঁড়ার মত হঠাৎ উদয় হওয়া আউট-লর উপস্থিতি সহ্য করতে পারছে না কেউ। উসখুস করছে রবার্ট অ্যালেন, পায়ের ভর বদল করল সন্তর্পণে; কিন্তু একেবারে নির্বিকার দেখাচ্ছে টিম কার্টিসকে, জানে আসল কাজ সেরে ফেলেছে ওরা এবং যত ভয়ঙ্করই হোক, এখানে কিছুই করার নেই নেইল ডেভিসের। তবে অ্যালেনের মতই, অতটা নিশ্চিন্ত হতে পারছে না হ্যান্স কোবার্ন; উদ্বেগ আর অস্বস্তি বহু কষ্টে চেপে রেখেছে সে। ‘সম্ভবত থমসনই ভাড়া করেছিল ওকে,’ উত্তরে বলল লসন। আড়চোখে ডেভিসের দুই সঙ্গীকে দেখল একনজর। ‘জেরেমি টাউনের মাইনারদের কেইমের কাগজ ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল।’ নিচু স্বরে শিস বাজাল আউট-ল, স্মিত হাসছে। ‘আসার পথে রক্সের সাথে দেখা হলো। ওর চেহারা যদি দেখতে! ব্যাটা এখনও বসে আছে তোমার অপেক্ষায়।’ ‘একটা ড্রিঙ্ক কিনে দেই তোমাকে, নেইল?” কি যেন ভাবল নেইল ডেভিস, তারপর ক্ষীর্ণ হেসে মাথা ঝাঁকাল। ‘দাও। তোমার পয়সা যেভাবেই খরচ করো তাতে আমার কি?’ সঙ্গীদের দিকে তাকাল সে। ‘চলো হে, গলাটা ভিজিয়ে নেয়া যাক।’ ‘ড্যান?’ উসখুস করছে কোবার্ন। সোনা ব্যবসায়ীর দিকে ফিরল লসন। ‘বিশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাব,
পৃষ্ঠা-৭১
হ্যান্স। ওদেরকে নিয়ে চলে যাও তুমি।’ শ্রাগ করল সে, নীরব চাহনিতে বুঝিয়ে দিল ব্যাপারটা পছন্দ হয়নি, তবে তর্কও করল না। ‘আমি সঙ্গে থাকি?’ প্রস্তাব করল অ্যালেন। ‘ড্রিঙ্ক করবে আবার?’ ‘না।’ ‘তাহলে কোবার্নের সঙ্গে যাও, তোমাকে দরকার হবে ওর।’ শ্রাগ করে কার্টিসের পাশাপাশি এগোল সে। আগে আগে হাঁটছে হ্যান্স কোবার্ন। বিড়বিড় করে অসন্তোষ প্রকাশ করছে। ‘শহরে ঢুকলে কিভাবে?’ ভেতরে এসে একটা টেবিলে বসে জানতে চাইল লসন। ‘শহরে যা ভিড়, অন্যদের সঙ্গে মিশে থাকতে অসুবিধে হচ্ছে না। তবে ঝুঁকি এড়াতে অস্ত্র আনিনি সঙ্গে।’ ‘কোন ডেপুটির সামনে পড়োনি?’ মাথা নাড়ল সে, ওয়েট্রেস আসতে হুইস্কির ফরমাশ দিল। ‘চিনতে পারেনি আমাকে।’ হুইস্কি আসার পর নীরবে চুমুক দিল ওরা। ‘আসল খবরই বলা হয়নি! থমসন আর কিনকেড লোক ভাড়া করছে, বেয়াড়া লোক সব। আমার দলের দু’জনকে পটিয়ে ফেলেছে। ওয়েনকে নাকি লোক জোগাড়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। জানোই তো ওয়েন কতটা খারাপ। আরও শুনলাম জেরেমি টাউনের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে কোবিন উইনস্টন।’ খবরটা শুনে থমকে গেল লসন। কিংবদন্তীর এই বন্দুকবাজকে ভাল করে চেনে ও, পুরানো শত্রুতা আছে দু’জনের। দুর্ধর্ষ ফাস্টগান, কিন্তু কয়োটের মতই নীচ। চতুর, শঠ, শকুনের মত ধৈর্য ধরতে জানে, এবং লক্ষ্যভেদে নিপুণ। একবার কোন কিছুর পেছনে লাগলে সেটা করে ছাড়ে। পশ্চিমে ভাড়াটে খুনী হিসেবে পরিচিত কোবিন উইনস্টন। বহু লোককে খুন করেছে সে, ভাল-মন্দের বাছ-বিচার করে না। টাকা পেলেই খুশি। শিকারের ওপর নির্ভর করে ওর কাজের পদ্ধতি, সামনাসামনি লড়তে কুণ্ঠা বোধ করে না। কিন্তু আড়াল থেকে বা শিকারকে অসহায় অবস্থায় পেয়েই খুন করেছে বেশি। লোকটি এতই নীচ যে চোখের দিকে তাকিয়ে কপালে পিস্তলের নল ঠেকিয়েও মানুষ খুন করেছে। ‘তুমি জ্বানলে কিভাবে?’ মৃদু স্বরে জানতে চাইল লসন। ‘রক্স নিজ থেকেই খবরটা দিল। কিনকেড আর থমসনের সাথে রফা হয়েছে ওর। সবাই মিলে ভাড়া করেছে কোবিনকে। জানো তো আগাম টাকা নেয় সে? সুতরাং ওদের কিছু হয়ে গেলেও নিজের কাজ ঠিকই করবে কোবিন।’ ‘তুমি ভাবছ আমার জন্যেই আসছে সে?’ ‘আমি কিছুই ভাবছি না, ড্যান। আমার ভাবাভাবিতে কারও কিছু যায়-আসেও না। তবে এটুকু বুঝতে পারছি শেষপর্যন্ত জেরেমি টাউনের হাল ধরবে তুমি। এখন হয়তো তেমন কোন ইচ্ছে নেই তোমার, কিন্তু সময় হলে ঠিকই হাজির হয়ে
পৃষ্ঠা-৭২
যাবে ওখানে, কোন ব্যাজ বা কারও অনুমোদনের তোয়াক্কাও করবে না। আর রক্স বা কিনকেডরাই তোমার আসল শত্রু হয়ে দাঁড়াবে তখন, এবং সেই সঙ্গে কোবিন।’ জীবনে বহু কঠিন মানুষকে মোকাবিলা করেছে ড্যানি লসন, কিন্তু এদের কারও মত নয় কোবিন উইনস্টন। নিঃশব্দে, চুপিসারে কাছে আসবে লোকটা, হয়তো সবার অজান্তে কাজ সেরে চলে যাবে। দুশ্চিন্তার ব্যাপার এটাই, নইলে লড়তে ভয় পায় না সে। কোবিনের সামনে দাঁড়ানোর মত সাহস আছে ওর, বরং সে-ই ওর সামনে এসে দাঁড়াবে না কারণ তাতে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিতে হবে। পরিস্থিতিই ঠিক করে দেবে কি অবস্থায় ওকে পায় কোবিন, ভাবল লসন, অযথা দুশ্চিন্তা করে কোন লাভ নেই। সেলুন ছেড়ে স্টেশনের দিকে এগোল লসন। দূর থেকে দেখল ওর অপেক্ষায় ট্রেনের কাছে দাঁড়িয়ে আছে অন্যরা।
ওকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল কোবার্ন। ‘যাক্, এসেছ তাহলে! এবার নিশ্চই ফিরতি পথ ধরতে পারি আমরা? চলো হে, নেইল ডেভিসের সঙ্গে ওর অদ্ভুত সাক্ষাতের ফিরিস্তি শোনা যাক! খোদার কসম, জানতাম না অ্যারিজোনার সবচেয়ে কুখ্যাত আউট-লর সঙ্গে এত খাতির আছে ড্যানি লসনের! ভাগ্যিস, আগেই সব সোনা ব্যাংকে জমা করেছি, নইলে দু’জনকে খোশগল্প করতে দেখলে মাথা খারাপ হয়ে যেত আমার!’ হেসে ট্রেনে চড়ল লসন।
পৃষ্ঠা-৭৩
সাত:- জেরেমি টাউনে ফিরে এসে অনেকগুলো খবর পেল ড্যানি লসন। আরও এক লোককে শেরিফ নিয়োগ করেছিল শহর কমিটি, কিন্তু পরে দেখা গেল বেনি ডবিন নামের সেই লোক আসলে জেসি ওয়েনের সাগরেদ। তিন দিন পরই ডবিনকে বরখাস্ত করেছে শহর কমিটি। কাজটা সহজ হয়নি, জোর করে ব্যাজ কেড়ে নিতে হয়েছে, এবং তা করতে গিয়ে বাহুতে একটা গুলি লেগেছে জো হারপারের। একটা ক্লেইম জবরদখল করেছে শেইন থমসন, এবং বিশালদেহী এক ভবঘুরেকে পিটিয়ে শহর ছাড়া করেছে। আইক জেসাপের জুয়ার আড্ডায় খুন হয়েছে তিনজন। একই রাতে চুরি হয়েছে তিনটে স্টোরে, পিস্তলের মুখে এক দোকান থেকে ইচ্ছেমত রসদ সংগ্রহ করেছে কিনকেডের তিন চেলা। এছাড়া নিত্যকার হাঙ্গামা আর খুনোখুনি তো আছেই। গত ছয় দিনে সাতটা নতুন কবর খুঁড়তে হয়েছে বুটহিলে। কার্ট রক্সের সাথে লাগতে গিয়ে মারা গেছে একজন মাইনার। সন্ধ্যায় মীটিংয়ে বসবে শহর পরিচালনা কমিটি, শহরের সামগ্রিক পরিস্থিতির ওপর আলোচনা ছাড়াও শেরিফ নিয়োগ করা হবে। হ্যান্স কোবার্নের অফিস থেকে বেরিয়ে এসে গ্রুলায় চড়ল লসন। টড মার্টিনের জিম্মায় রেখে গিয়েছিল ঘোড়াটাকে। ও ফেরার পর স্টেবল থেকে ওটাকে নিয়ে এসেছে মার্টিন। ক্লান্তি লাগছে ওর, ক’দিন ধরে টানা ছোটার মধ্যে ছিল, তাছাড়া মানসিক ধকলও কম যায়নি। প্রিয় ঘোড়ার স্যাডলে চাপার পর কিছুটা হলেও স্বস্তি আর আনন্দ অনুভব করল লসন। বাথানে গিয়ে লম্বা একটা বিশ্রাম নেবে, ভাবছে ও, তারপর—তারপর কি? আবার বেরিয়ে পড়বে, নাকি নিরাপদ দূরত্বে থেকে জেরেমি টাউনের ধ্বংস হওয়া দেখবে? সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে নিজের ওপর বিরক্তি অনুভব করল ও।
পাহাড়ের দিকে তাকাল লসন। পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে সূর্য, কমে এসেছে রোদের তেজ; একটু পরেই পাহাড়ের আড়ালে ডুব দেবে। নদার ধারে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকে মাইনাররা, কিন্তু আজ প্রায় কেউই কাজ করছে না। সাড়া নেই, একেবারে নিশ্চুপ হয়ে আছে ক্লেইমগুলো। ধীর গতিতে শহর ছেড়ে ক্লেইমের দিকে এগোল লসন। নদী পেরিয়ে ওপাশের বিস্তীর্ণ উপত্যকায় গোপন ট্রেইল আছে, সেটা ধরে এগোলে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পাহাড়ের গভীরে ওদের বাথানে পৌঁছে যাবে। মাইল দুয়েক পথ, দুর্গম, কিন্তু বহুবার আসা-যাওয়া করেছে লসন। সময় আর পরিশ্রম কম বলে বারো মাইল ঘুরপথের চেয়ে এ ট্রেইলই পছন্দ ওর। বিল লারকিনের ক্লেইমের কাছে আসতে দূর থেকে কেবিনের পোর্চে জুলিয়া লারকিনকে দেখতে পেল ও। ওকেই দেখছে মেয়েটি। আঙুলে হ্যাটের কিনারা ছুঁয়ে নড করল লসন, ঘোড়ার গতি না কমিয়ে চলে যেতে উদ্যত হতে ওকে ডাকল জুলিয়া। খানিকটা দ্বিধার পর ফটক দিয়ে ক্রেইমের ভেতরে ঢুকল ও। ‘বাথানে যাচ্ছ?’ কাছে যেতে জানতে চাইল জুলিয়া। মাথা ঝাঁকাল ও, নীরবে নিরীখ করছে মেয়েটিকে। খানিক আগে গোসল করেছে বোধহয়। ঝরঝরে, সতেজ লাগছে ওকে। ভেজা চুল পড়ে আছে কাঁধের ওপর। অবাক হয়ে দেখল পশ্চিমের মেয়েদের মত সাধারণ পোশাক পরেছে জুলিয়া-ব্লাউজ, গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা ফ্রক। পোশাকটা মানিয়েছে ওকে, এবং আর দশটা মেয়ের সাথে ওর পার্থক্য কেবল অনাবিল সৌন্দর্যে। লসনের আবারও মনে হলো এখানে মানায় না জুলিয়া লারকিনকে, অন্তত জেরেমি টাউনের মত অস্থির এক মাইনিং টাউনে। ‘ভেতরে এসো, মি. লসন,’ আহ্বান করল মেয়েটি। খানিক দ্বিধা করল লসন। চারপাশে তাকাল, দু’ভাইয়ের কাউকে দেখা যাচ্ছে না। মেয়েটি বোধহয় একাই আছে। স্যাডল ছেড়ে রেইলের সঙ্গে লাগাম বাঁধল ও, তারপর কেবিনে ঢুকল। ভেতরের কামরায় চলে এল জুলিয়ার পিছু পিছু। খাবারের টেবিলে বসল ওরা। ‘মি. লসন, তোমাকে একটা ধন্যবাদও দেয়া হয়নি,’ বিস্কুট আর পাই পরিবেশন করার সময় বলল জুলিয়া।
পৃষ্ঠা-৭৪
‘এতক্ষণে ওটা পেয়ে গেছি আমি।’ ‘আমি তো দেইনি।’ ‘মুখে বলার দরকার পড়ে না সবসময়। এমনিতেই বোঝা যায়।’ ‘হয়তো,’ বলে শ্রাগ করল জুলিয়া, তারপর রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। দরজা দিয়ে চুলো আর কাছাকাছি একটা অংশ দেখা যাচ্ছে। পেছন থেকে মেয়েটির শারীরিক গড়ন, ফর্সা পিঠ চোখে পড়ল লসনের। নিজেকে শাসন করে চোখ ফিরিয়ে নিল ও। তামাক আর কাগজ বের করে সিগারেট রোল করল। ‘তোমার বাবা বা বিল কোথায়?’ মেয়েটি কফি নিয়ে ফিরে আসতে জানতে চাইল। ‘শহরে, ল-অফিসে মীটিং চলছে। সব মাইনাররা ওখানেই আছে।’ অজান্তে একটা ভুরু কোঁচকাল লসন’। ‘বাবার কাছে শুনলাম জুড ফস্টারের ক্লেইম দখল করে নিয়েছে থমসন,’ জানাল জুলিয়া। ‘এ ব্যাপারে কি করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করবে ওরা, একজন মার্শালও নাকি নিয়োগ করবে।’ ‘তোমার বোধহয় ভাল লাগছে না এখানে।’ ‘কেন?’ কপালে একটা ভুরু তুলে জানতে চাইল মেয়েটা, বিস্মিত। ‘তোমাকে দেখে তাই মনে হচ্ছে আমার। যে কোন শহরের শুরুর দিকটা সবসময় গোলমেলে হয়, খনি শহর হলে তো কথাই নেই; মহিলাদের জন্যে নিরাপদ হয়ে উঠতে কিছুটা হলেও সময় লাগে। জেরেমি টাউনের ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে। পশ্চিমে এসে শুরুতেই কঠিন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হচ্ছে তোমাকে, মিস্ লারকিন।’ ‘আমি একটা ভিন্ন পরিবেশে বড় হয়েছি, তাতেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। মানিয়ে নিতে একটু কষ্ট তো হবেই, তাই না?’ হেসে কফিতে চুমুক দিল জুলিয়া। ‘আচ্ছা, এখানে কি এরকমই চলতে থাকবে?’ ‘না। খুব বেশি হলে দু’মাস। খনিতে সোনা ফুরিয়ে গেলে বেশিরভাগ লোক কেটে পড়বে।’ ‘কেন?’ ‘সোনার কারণেই এ শহরের জন্ম। খনি না থাকলে খারাপ মানুষগুলো হয়তো আসতই না। পশ্চিমের যে কোন মাইনিং টাউনের শুরুটা সবসময়ই ঝামেলাপূর্ণ হয়, নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার জন্যে শহরে অরাজকতা সৃষ্টি করে ওরা- লুঠপাট বা জবরদখলে সুবিধে হয়। অথচ সোনা শেষ হয়ে গেলে নিমেষে কেটে পড়ে এসব ধান্ধাবাজ লোক।’ ‘বাকি যারা থাকে…নিরীহ লোকেরা?’ ‘হয়তো থাকবে। ধীরে ধীরে গড়ে উঠবে শহরটা। তবে সময় লাগবে, টেরিটরির এক প্রান্তে বলে লোকজন সাধারণত আসে না এদিকে। সব মিলিয়ে এ শহরের টিকে থাকার সম্ভাবনা কম। আবার খারাপ মানুষগুলোর কারণে সময়ের আগেই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে শহরটা।’ ‘কিভাবে?’ ‘ধরো এমন একটা সময় এল, যখন খারাপ লোকগুলো বেশ কিছু ক্লেইম
পৃষ্ঠা-৭৫
কেড়ে নিল; এদের ঠেকাতে গিয়ে প্রচুর লোক হতাহত হবে, তার বেশিরভাগ হবে নিরীহ মানুষ। ঝামেলা এড়াতে তখন চলে যাবে অন্যরা। শেষে নিজেদের মধ্যে লড়াই শুরু করবে খারাপ মানুষগুলো, স্বার্থ ফুরিয়ে গেলে একসময় এরাও চলে
যাবে, কিন্তু যাওয়ার আগে হয়তো পুড়িয়ে দেবে শহরটা। এরকম ঘটনা বহু উঠতি শহরের ভাগ্যে ঘটেছে।’ ‘কোন ভাবে কি ঠেকানো যায় না এসব?’ ‘দক্ষ হাতে যদি খারাপ লোকগুলোকে সামাল দেয়া যায়, প্রয়োজনে নিষ্ঠুর হতে হবে। কোন ভাবেই এদেরকে জুড়ে বসতে দেয়া যাবে না। তারপর হয়তো…’ ‘কিন্তু তেমন হলেও তো কিছু খুনোখুনি হবে।’ ‘হবে, তবে সেটা মহৎ উদ্দেশ্যে। ভাল কথা বলে খারাপ মানুষকে হটানো যায় না।’ ‘ওদের মনে ভয় ধরিয়ে দিতে হবে, যাতে শহর ছেড়ে পালায়, এই তো? সেদিন নিকোলাস গ্রীনকে তুমি যেমন পাইয়ে দিয়েছ।’ ‘ও কিন্তু শহর ছেড়ে পালায়নি। আর ঘটনাটা খুবই সামান্য ব্যাপার। একটা শহর পরিষ্কার করতে গেলে কতটা বিশৃঙ্খলা হতে পারে, কল্পনাও করতে পারবে না তুমি, ম্যা’ম। লুঠপাট, খুনোখুনি তো হবেই।* ‘সেদিনের ঘটনাকে সামান্য বলছ কেন? তুমি সাহস দেখিয়েছ বলেই আমাকে ওয়্যাগন থেকে নামাতে পারেনি ওরা, কিন্তু তুমি না থাকলে কি হত ভেবে দেখেছ?’ ‘ওটা স্রেফ বিচ্ছিন্ন একটা ঘটনা, অন্যদের কাছে এর কোন গুরুত্ব নেই। নিকোলাস গ্রীন পিছিয়ে গেছে বটে, কিন্তু সময়ে হয়তো দেখা যাবে কাউকেই পরোয়া করছে না সে-ঠাণ্ডা মাথায়ও খুন করা সম্ভব ওর পক্ষে। নিকোলাস গ্রীনের মত অন্তত বিশজন ভয়ঙ্কর লোক আছে এখানে। এরা বেপরোয়া হয়ে উঠলে নরক নেমে আসতে পারে জেরেমি টাউনে, মুহূর্তের মধ্যে ধ্বংস হয়ে যাবে শহরটা। ‘এরকম অশান্ত একটা শহর পরিষ্কার করতে হলে আসলে কয়েকজন দক্ষ কঠিন লোকের দরকার। যারা ওদের মতই কঠোর হতে পারবে, ঠাণ্ডা মাথায় খুন করতে পারবে। নিরীহ মানুষের কাছে হয়তো বাড়াবাড়ি’ মনে হতে পারে এসব,
কিন্তু এটাই সত্যি যে প্রয়োজনে নিষ্ঠুর না হলে শান্তিও আসে না।’ ‘বোধহয় বুঝতে পেরেছি,’ উজ্জ্বল দেখাল জুলিয়ার চোখ জোড়া, কিছুটা সমীহ মাখানো দৃষ্টিতে দেখছে লসনকে। অপ্রতিভ বোধ করছে লসন, দৃষ্টি নামিয়ে সিগারেট রোল করতে শুরু ‘বাথানে আর কে আছে তোমার?’ প্রসঙ্গ বদলাল জুলিয়া। করল। ‘বাবা-মা।’ ‘বাথানটা খুব সুন্দর?’ ‘তোমাকে কে বলেছে?’ ‘চাচা।’ ‘বিল একবার গিয়েছিল ওখানে।’
পৃষ্ঠা-৭৬
‘আমিও যাব একদিন। এখানে থাকতে বিরক্তি ধরে গেছে। সকাল হলেই সবাই বেরিয়ে পড়ে, সোনা তোলার নেশায় পেয়ে বসে ওদের। তারপর সন্ধে হলে শহরে চলে যায়, হুইস্কি গিলে পেট ভরে আসে। প্রতিদিন ওখানে গুলির শব্দ পাওয়া যায়। এভাবে চলতে থাকলে—আমার তো সন্দেহ হয় এখানে শেষপর্যন্ত বিশজন লোকও বেঁচে থাকে কিনা।’ ‘সেরকম কিছু হবে না। হয় তার আগেই শহরটা ধ্বংস হবে, নয়তো খারাপ মানুষগুলো কেটে পড়বে।’
‘প্রথম যখন পশ্চিমে এসেছি, মন্টানায় পা দিয়েই দুটো খুন হতে দেখলাম। একেবারে সামান্য কারণে। ঘটনাটাকে স্রেফ নিষ্ঠুরতা মনে হলো আমার। ধারণাটা অবশ্য পরে পাল্টে গেছে,’ স্মিত হাসল জুলিয়া। ‘সেদিন বুঝতে পারলাম সবার মধ্যে এই দুঢ়তা না থাকলে এখানে জীবনই অচল হয়ে পড়ত। প্রয়োজনে মানুষকে নিষ্ঠুরও হতে হয়, একটু আগে তাই তো লেছ? তোমার মধ্যে কি দেখেছে নিকোলাস গ্রীন, এভাবে দলবল সহ পিছিয়ে গেল সে? যার যার নিরাপত্তার ভার যখন শুধুই নিজের, জীবন বাঁচানোর তাগিদেই সবার জীবন রুক্ষ হয়ে উঠেছে, তাই না?’ নীরবে মাথা ঝাঁকাল লসন। ‘তোমরা কি একেবারে চলে এসেছ?’ ‘বাবা তাই চিন্তা করছে, কিন্তু’ খানিক দ্বিধা করল মেয়েটি, তারপর ক্ষীণ হাসল। ‘কারও অনুগ্রহে থাকা আমার ঠিক পছন্দ নয়, হোক না চাচা। সনোরায় একটা স্কুলে পড়াতাম আমি, পশ্চিমে আসার জন্যে বাবার আগ্রহ এতটাই ছিল যে মানা করতে পারলাম না। আমি হয়তো চলে যাব, যদি ভাল না লাগে…’ ‘জেফরি হ্যালার্ড এখানে একটা স্কুল খুলবে, ওখানে পড়াতে পারবে তুমি।’ ‘এখানে যদি মন টিকে যায় তো থাকব, কাজ করার ওপর সেটা নির্ভর করে না।’ ‘তারমানে—নিজের সম্পর্কে নিশ্চিত নও তুমি?’ ‘হ্যাঁ-ইচ্ছের বিরুদ্ধে এখানে এসেছি আমি। এখানে যে আমার জীবন খুব ভাল ভাবে, কাটবে না, এটুকু স্পষ্ট বুঝেছি। এই কেবিনের ভেতর পড়ে থেকে রান্না করা আর ঘর-দোর পরিষ্কার রাখা, এটা কোন কাজ হলো? উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই আমার, কিন্তু জীবন কাটানোর জন্যে একটা উপলক্ষ তো লাগে, তাই না? ওদের জন্যে সোনার মোহ আছে, আমার জন্যে কি আছে এখানে?’
‘আসলে পশ্চিম তোমার পছন্দ নয়।’ ‘অপছন্দ করি, তাও নয়। আসলে এখানে আমার কোন ভূমিকা নেই, শুধু ঘরকন্নার কাজ করছি, তা-ও বোধশূন্য কিছু মানুষের মধ্যে, যার মূলে আছে উত্তপ্ত অস্থির একটা শহর। এই পরিবেশে থাকি কিভাবে, যেখানে আমি পশ্চিমে একেবারেই নতুন? হয়তো অন্য কোথাও, আরও শান্তিপূর্ণ কোন জায়গায় অনায়াসে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারতাম! কিন্তু সত্যিই এখানে মন টিকছে না আমার।’ ‘ঠিকই বলেছ, ম্যা’ম।’ ‘তুমি হয়তো হতাশ হয়েছ। আমার কথায় বোধহয় পরোক্ষ ভাবে পশ্চিমকে খাটো করা হয়, অন্তত যেভাবে বলেছি কথাগুলো এখানকার কারও পছন্দ হওয়ার
পৃষ্ঠা-৭৭
কথা নয়।’ ‘অযথাই ভাবছ, ম্যা’ম। তোমার চিন্তা-ভাবনায় কারও কিছু আসে-যায় না, সুতরাং কারও তাতে আপত্তি করার প্রশ্নই আসে না।’ বাইরে ঘোড়ার খুরের শব্দ পেয়ে থেমে গেল লসন। চেয়ার ছেড়ে দ্রুত পোর্চে বেরিয়ে এল। বাইরে তখন গোধূলির আবছা আঁধার। কিন্তু দেখতে অসুবিধে হলো না ওর, শহরের দিক থেকে ক্রেইমের দিকে আসছে একদল লোক। অন্তত ছয়-সাতজন হবে। দুলকি চালে এগিয়ে আসছে ঘোড়াগুলো, রাইডারদের আচরণে কোন তাড়া নেই। ক্লেইমগুলো যে ওদের গন্তব্য, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই লসনের। ছুটে ঘোড়ার কাছে এল ও, স্যাডল ব্যাগ হাতড়ে ফিল্ড গ্লাস বের করে চোখের সামনে তুলে ধরল। নিমেষে কাছে চলে এল লোকগুলো, সবার সামনে বিশালদেহী লোকটাকে একনজর দেখেই চিনতে পারল-শেইন ‘বিগ’ থমসন। পেছনে আরও সাত ঘোড়সওয়ার। পেছনে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে জুলিয়া লারকিন, কৌতূহল আর শঙ্কায় কিছুটা হলেও উত্তেজিত দেখাচ্ছে ওকে। মেয়েটি পোর্চে পা রাখতে নিষেধ করল লসন। ‘ভেতরে থাকো, ম্যা’ম। বলা যায় না, হয়তো তোমাদের এখানেই আসছে ওরা।’ ‘কারা ওরা?’ একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকল মেয়েটা। ঘুরে ওর দিকে তাকাল লসন, দৃঢ়বদ্ধ চোয়াল আর চোখের সতর্ক দৃষ্টি চমকে দিল জুলিয়াকে। ‘ভেতরে চলে যাও, ম্যাম। বিল লারকিন আজ আরও একটা ভুল করেছে, তোমাকে একা রেখে যাওয়া উচিত হয়নি ওর।’ ‘ওরা কি গ্রীনের দল?’ নিচু স্বরে জানতে চাইল জুলিয়া। মনে মনে লসনের কথাটা উল্টে-পাল্টে দেখছে। ঠিকই বলেছে সে, তবে সৌভাগ্যের বিষয়: ভুলটা শোধরানোর জন্যে আবারও উপস্থিত হয়েছে সে। অন্তত ওর কোন উদ্বেগ লাগছে না, জানে নিশ্চিন্তে নির্ভর করা যায় মানুষটার ওপর। ‘না,’ বলে পিছিয়ে এল লসন। বাধ্য হয়ে পথ ছাড়তে হলো জুলিয়াকে। দরজা থেকে সরে দাঁড়াল, ও ভেতরে ঢুকতে দরজার কবাট ভিড়িয়ে দিল লসন। তারপর দু’পা এগিয়ে পোর্চের কিনারায় আঙটা দিয়ে ঝোলানো লণ্ঠনটা নিভিয়ে দিল। অপেক্ষায় থাকল এবার। বিল লারকিনের ক্লেইমের সামনে এসে থমকে দাঁড়াল লোকগুলো, ক্ষণিকের বিরতির পর আবার এগোল। পাশেই তিন ‘জে’-র ক্লেইম। ঘোড়সওয়ারদের গন্তব্য পরিষ্কার বোঝা গেল এবার, পুরানো খায়েশ মেটাতে এসেছে শেইন থমসন। মাইনাররা শহরে মী। টংয়ে বসেছে, এই ফাঁকে নিশ্চিন্তে দখল করে নিতে পারবে তিন ‘জে’-র ক্লেইম। বোকামি করেছে মাইনাররা। এখানে, যে কারও কেবিনে আলোচনা করতে পারত ওরা। মীটিং করার জন্যে জেরেমিতে যাওয়া লাগে না। শেইন থমসনের মত ধূর্ত, লোভী লোকেরা এমন সুযোগের জন্যে মুখিয়েই থাকে। খুব বেশি হলে একজন আছে কেবিনে, কিংবা কেউই নেই। অনায়াসে ক্রেইমের দখল নিতে পারবে ওরা, এবং ক্রেইমের দখল ফিরে পেতে বহু কাঠখড় পোড়াতে হবে জেফরি হ্যালার্ড বা ওর বন্ধুদের।
পৃষ্ঠা-৭৮
স্যাডল থেকে রাইফেল তুলে নিল লসন । ‘মিস্ লারকিন?’ ডাকল ও। ‘বলো!’ ভেতর থেকে উদ্বেগের সাথে সাড়া দিল মেয়েটা। ‘কোবার্নের অফিসে যেতে পারবে? ওকে বলবে হ্যালার্ডের, ক্লেইম দখল করতে এসেছে থমসন। মাইনারদেরকে যেন খবরটা দেয় সে।’ দরজা খুলে বেরিয়ে এল মেয়েটি। ওর সামনে এসে দাঁড়াল। ‘দুঃখিত, ম্যা’ম। অন্য কোন উপায় থাকলে তোমাকে। পাঠাতাম না। ধীরে ধীরে যেয়ো, তাড়াহুড়োর কিছু নেই,’ মেয়েটি পোর্ট ছেড়ে নেমে যেতে অনুরোধ করল লসন। ‘এদিকে মনোযোগ দেবে না ওরা। তাছাড়া অন্ধকারে তোমাকে দেখতেও পাবে না।’ মাথা ঝাঁকাল জুলিয়া, অন্ধকারে মিশে গেল ওর অবয়ব। এবার ছুটল লসন। নদীর কাছে এসে দক্ষিণে এগোল। চারপাশে চাপ চাপ অন্ধকার, তারওপর নদীর পাড় অসমতল। কিন্তু পরোয়া করছে না ও। আড়চোখে, ছোটার মধ্যেই ছুটন্ত ঘোড়সওয়ারদের দিকে তাকাল, তিন ‘জে’-র ক্রেইমের কাছাকাছি পৌছে গেছে প্রায়। ছোটার গতি বাড়াল ও। নিমেষে পেরিয়ে এল পঞ্চাশ গজ, বিল লারকিনের ক্রেইমের কাঁটাতারের বেড়া টপকে গেল লাফিয়ে। বিশ হাত দূরে ছোট একটা কেবিন, পাশে করাল আর স্ট্র। দুটো ঘোড়া আছে সেখানে। পোর্চে একটা লণ্ঠন জ্বলছে, কেবিনের ভেতর থেকে জানালা পথে চৌকো আলো এসে পড়েছে ওর সামনে। আলো এড়িয়ে কেবিনের পেছনে চলে এল লসন, জানালার কাছে সরে এসে ভেতরে উকি দিল। নেই কেউ। কিন্তু নড়াচড়ার শব্দ শুনতে পেয়েছে ও, দরজার কবাট খুলে পোর্চে বেরিয়ে গেছে কেউ। আচমকা পোর্চের বাতিটা নিভে গেল। হালকা পদশব্দ সরে যাচ্ছে, ফের কেবিনের ভেতরে ঢুকে পড়েছে লোকটা-বুঝতে পারল লসন-কিছুটা আড়ষ্ট পায়ে। দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে কেবিনের বাতিটাও নিভিয়ে দিল সে। করালের কাছে চলে এল লসন। খড় আর ঘোড়ার ঘামের কটু গন্ধ লাগছে নাকে। দেয়ালের সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে তাকাল ও। ততক্ষণে চলে এসেছে থমসনের দল। কেবিনের বিশ হাত দূরে থামল ঘোড়াগুলো, সার বেঁধে দাঁড়িয়েছে। খুরের আঘাতে বাতাসে ওড়া ধুলো দেখা যাচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু ধুলোর উৎকট গন্ধ আর ঝাঁঝ লাগছে নাকে-মুখে। ধীরে ধীরে ধুলোর মেঘ সরে যেতে স্পষ্ট হলো ওদের অবয়ব। ‘হয়েছে, আর এগিয়ো না, থমসন!’ কেবিনের ভেতর থেকে বলে উঠল জো হারপার। ‘আরে, জো দেখছি! কি ব্যাপার, খেপে যাচ্ছ কেন?’ ‘অনধিকার প্রবেশ করেছ তুমি, থমসন। তোমাকে মানা করেছিলাম কিন্তু দেখা যাচ্ছে ফের দলবল নিয়ে উপস্থিত হয়েছ।’ ‘কথা রাখতেই তো এসেছি!’ সহাস্যে বলল শেইন থমসন, আঙুল চালিয়ে হ্যাটটা ওপরে তুলে দিতে চাঁদের আলোয় স্পষ্ট হলো বিশাল মুখ। সেখানে ভয়-
পৃষ্ঠা-৭৯
ডরের লেশমাত্র নেই, বরং প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসে ফেটে পড়ছে মানুষটা। ‘ভাল মানুষের মত চলে যাও, থমসন। আর বলব না, খোদার কসম, এক পা এগোতে গুলি করব! আমার কি হলো তাতে মোটেই আমল দেব না। বুটহিলে যাতে তোমার জায়গা হয় সেটা নিশ্চিত করে তবেই মরব আমি!’ সন্দিহান চোখে তাকাল থমসন, মুখের হাসি ম্লান হয়নি। ‘চোপা তো ভালই চালাচ্ছে! কিন্তু অস্ত্রে সুবিধা করতে পারবে না এটা বোধহয় এখনও বুঝতে পারোনি। আরে, বোকার হদ্দ, আমি একা নই! সাথে আরও সাতজন আছে, দেখোনি ওদের?’ ‘না, ওদেরকে দেখছি না আমি। কেবল তোমার কপালের দিকেই আমার নজর!’ বাঁকা সুরে বলল জো হারপার, কিন্তু তামাশা নয় বরং হুমকি দিচ্ছে সে। ‘এই, হিউম, ওকে বের করে আনো তো। মনে হচ্ছে জোর করে কেবিন থেকে বের করতে হবে,’ কাছের লোকটির উদ্দেশে বলল থমসন। ‘এমন মাথামোটা লোক তো আর দেখিনি, এতগুলো সশস্ত্র লোক দেখেও নিজের বিপদ বুঝতে পারছে না।’
‘নিজের বিপদ কি তুমি বুঝতে পারছ, থমসন?’ চড়া স্বরে বলল জো হারপার, রাইফেল কক্ করল। ‘হ্যাঁ, মরার খায়েশ যদি তোমার হয়ে থাকে তো ওকে আরেক পা এগোতে বলো-তোমার কপাল গুঁড়ো করে দেই আমি!’ ‘হারপার, বামদিকের চারজনকে আমার ওপর ছেড়ে দাও,’ এবার নিজের উপস্থিতি ঘোষণা করল ড্যানি লসন। ‘খুব তড়পাচ্ছে ওরা। আশা করি বুলেট দিয়ে ওদেরকে শান্ত করতে পারব আমি।’ চমকে উঠল থমসন। সতর্ক দৃষ্টিতে করালের দিকে তাকাল, লসনের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করছে। ‘ওটা আবার কে?’ বিরক্তি প্রকাশ করল হিউম নামের লোকটি। ‘চিনলে না?’ হেসে উঠল হারপার, কণ্ঠে স্পষ্ট উচ্ছ্বাস। ‘ও হচ্ছে ড্যানি লসন, এবার চিনেছ নিশ্চয়ই?’ অস্পষ্ট আলো হলেও হিউমের ফ্যাকাসে চেহারায় স্পষ্ট হয়ে গেল এবার ঠিকই চিনতে পেরেছে সে। অস্বস্তি কাটাতে স্যাডলে নড়েচড়ে বসল আউট-ল। কেবিন আর করালের দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে অস্থির দৃষ্টি, একবার কেবিন তো পরমুহূর্তে করালের দিকে। ‘শেইন, মনে হচ্ছে ভুল সময়ে এসে পড়েছি আমরা,’ ফাঁকা কণ্ঠে বলল থমসনকে। ‘সুবিধা করা যাবে না ওদের সঙ্গে, যেখানে ড্যানি লসন নিজেই উপস্থিত।’ ‘থমসনের মনের কথাই বলেছে হিউম। আনমনে মাথা ঝাঁকাল থমসন, বিশাল কাঁধজোড়া দুলে উঠল। ‘ঠিক আছে, হারপার, এবারও তোমরাই জিতলে। কিন্তু মনে রেখো আবার আসব আমি।’ ‘তার আগেই জেরেমি টাউন থেকে তোমাকে তাড়াব আমরা!’ মুখিয়ে উঠল হারপার। ‘তোমরা গোবেচারা মাইনাররা?’ হেসে উঠল বিশালদেহী তস্কর, সতর্কতার সঙ্গে লাগাম তুলে নিল হাতে। ঘোড়া ঘুরিয়ে নিতে চেয়েও কি মনে করে করালের
পৃষ্ঠা-৮০
দিকে ফিরল। ‘সত্যিই তুমি ড্যানি লসন তো, নাকি ধাপ্পা দিচ্ছ? ঠিক আছে, আশা করি তোমার সাথেও দেখা হবে।’ ‘হবে, কিন্তু তোমার সেটা ভাল নাও লাগতে পারে,’ বলল লসন। ঘোঁৎ করে অস্পষ্ট একটা শব্দ করল সে, তারপর ঘোড়া ঘুরিয়ে স্পার দাবাল। ফিরতি পথে এগোল ঘোড়াটা। ওর পিছু নিল বাকিরা। খানিক অপেক্ষা করল লসন, তারপর দলটা বেশ দূরে যেতে বেরিয়ে এল করাল থেকে। ‘ধন্যবাদ, লসন,’ পেছন থেকে ওকে বলল হারপার। ঘুরে মাইনারের দিকে তাকাল ও, দেখল লণ্ঠন জ্বালাচ্ছে সে। আলো জ্বালিয়ে পোর্চ ছেড়ে নেমে এল, সামনে এসে হাত বাড়িয়ে দিল। ‘তুমি না এলে সত্যি ঝামেলায় পড়তাম। ঠিকই আমাকে কোণঠাসা করে ফেলত ওরা।’
‘যথেষ্ট সাহস দেখিয়েছ তুমি।’ ‘হয়তো, কিন্তু ক্লেইম রক্ষা করার জন্যে যথেষ্ট নয়, কিংবা থমসনের দলকে থামানোর জন্যেও। ভেতরে এসো।’ লারকিনের কেবিনের দিকে তাকাল ও, জুলিয়াকে খুঁজছে ওর চোখ। কিন্তু দেখতে পেল না। ‘ভেতরে যাও, জো। আমি এখুনি আসছি।’ ফিরতি পথ ধরল লসন। মেয়েটির কোন বিপদ হয়নি তো? নতুন এক পরিবেশে এসেছে মেয়েটা, অদ্ভুত এক পরিস্থিতিতে উচিত নয় এমন একটা কাজে পাঠিয়েছে জুলিয়াকে, কাজটা কি ঠিক হলো? কিন্তু এছাড়া কোন উপায়ও ছিল না। ওর উপস্থিতিতে আসল কাজ হয়ে গেছে, যে জন্যে মেয়েটিকে পাঠানো-মাইনারদের সাহায্য দরকার হয়নি। ঝামেলা এড়ানোর ইচ্ছেয় হোক কিংবা ভয় পেয়েই হোক, বাধ্য হয়ে পিছু হটেছে শেইন থমসন। কিন্তু মেয়েটা যদি সেদিনের মত কারও খপ্পরে পড়ে-নাহ্, তেমন সম্ভাবনা নেই। মাত্র তো কয়েকশো গজ পথ। হ্যান্স কোবার্নকে খবর দিয়েই চলে আসবে।,
কেবিনের কাছে আসতে ওদেরকে দেখতে পেল লসন। শহর থেকে বেরিয়ে এসেছে মাত্র, দ্রুত ক্লেইমের দিকে এগোচ্ছে জনা বিশেক লোক। উত্তেজিত, উদ্বিগ্ন কিছু মানুষ। দূরে হ্যান্স কোবার্নের অফিসের পোর্চে দু’জন মহিলার অস্পষ্ট অবয়ব দেখতে পেয়ে খানিকটা নিশ্চিন্ত হলো লসন। মেয়েটিকে কি এগিয়ে নিয়ে আসা উচিত? ভাবছে ও, এটুকু পথ আসা-যাওয়া করা এমন কোন ব্যাপার নয়। তবে ছোট হলেও কঠিন এক সময়ে ওর উপকার করেছে জুলিয়া, বিনিময়ে এ সৌজন্যটুকু বোধহয় পাওনা হয়েছে মেয়েটা। শহরের পথ ধরল ১। মিনিট পাঁচ পরে কোবার্নের অফিসে পৌছে গেল। ‘এবার আর সমস্যা নেই,’ হেসে জুলিয়ার উদ্দেশে বলল মহিলা। ‘ওর সাথে যেতে পারবে তুমি।’ লসনের দিকে ফিরল সে। ‘হ্যান্স গেছে তো গেছেই, ফেরার নাম নেই। ওর জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম আমরা। জুলিয়াকে একা পাঠাতে সাহস হচ্ছিল না।’ ‘ধন্যবাদ, ম্যা’ম।’ এগোল ওরা। ওদের সামনেই মাইনারদের দলটা, প্রায় পৌছে গেছে
পৃষ্ঠা ৮১ থেকে ১০০
পৃষ্ঠা-৮১
ক্রেইমের কাছে। ‘ওখানে বোধহয় কোন ঝামেলা হয়নি, তাই না?’ উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইল জুলিয়া। ‘এত সহজে চলে গেল লোকগুলো?’ ‘আবারও আসবে ওরা, সুযোগের অপেক্ষায় থাকবে।’ ‘এরকম টানা-পোড়নের মধ্যে ক’দিন থাকা যায়? একটা সুরাহা হওয়া উচিত নয় কি?’ ‘উচিত। কিন্তু মানুষগুলো বেপরোয়া। অন্যের জিনিস কেড়ে নিতে অভ্যস্ত ওরা, কোন যুক্তি বা উপদেশ মানবে না।’ কেবিনের কাছে পৌছে গেছে ওরা। ওদের সাড়া পেয়ে ভেতর থেকে বেরিয়ে এল বিল লারকিন, জুলিয়াকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কেবিনে ফিরে এসে ভাতিজিকে না দেখে দুশ্চিন্তা করছিল সে। ‘কোথায় গিয়েছিলে, জুলি?’ মেয়েটা মুখ খোলার আগেই সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করল লসন।
‘ওহ্, আমি কিনা ভেবেছি…’ নিজের ভাবনা প্রকাশ করল না সে, আনমনে একটা কাঁধ উঁচাল। ‘বেচারা এত বড় উপকার করল আমাদের, আর ওকে কিনা বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছ!’ সস্নেহে ভাতিজির মাথায় চাঁটি মারল সে, তারপর লসনের দিকে ফিরল। ‘ভেতরে এসো, ড্যান। কিছু কথা ছিল তোমার সঙ্গে। কফি খেতে খেতে আলাপ করা যাবে।’ দ্বিমত করল না লসন, বিল লারকিনের সঙ্গে টেবিলে এসে বসল। ‘শহরের খবর জানো?’ এভাবেই শুরু করল মাইনার। ‘না।’ ‘যে উদ্দেশে আজ মীটিং ডাকা হয়েছিল, একেবারে ভেস্তে গেছে সব,’ বলতে শুরু করল সে, রান্নাঘরে ব্যস্ত জুলিয়াকে দেখল একবার। ‘ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি মাইনাররা। মীটিং শেষ হওয়ার আগেই উপস্থিত হলো হ্যান্স কোবার্ন, জানাল যে থমসনের লোকেরা ক্রেইমে হানা দিয়েছে। শুনেই ছুটে এল সবাই। এরকম একটা ধাক্কা দরকার ছিল সবার। এখন বোধহয় আর অমত করবে না কেউ।’
নীরব থাকল লসন, ভাবছে। ‘জেফরি হ্যালার্ড ঠিক করেছে সেই মার্শাল হবে। অবশ্য ক’দিন আগে তোমাকে প্রস্তাব দেয়ার জন্যে রাজি হয়েছিল ও, কিন্তু সারা শহরে খুঁজেও তোমাকে পায়নি ফেল্টন আর হ্যালার্ড।’ এবার বিস্মিত হলো ও। হ্যালার্ড? উঁহু, আর যাই হোক একজন মার্শাল হিসেবে মানায় না তাকে। সততা বা সদিচ্ছা আছে মানুষটার, কিন্তু আসল জিনিসগুলোই নেই-অভিজ্ঞতা, দৃঢ়তা, দক্ষতা এবং সামর্থ্য। অস্থির একটা শহরের অসংখ্য বেপরোয়া লোককে সামলাতে পারবে না স্কুল মাস্টার, একটা দিনও টিকতে পারবে না। পিট লারকিনের মতই আনাড়ী সে। থমসন, রক্স বা কিনকেডকে আইন শেখাতে গেলে মুখের ওপর হাসবে ওরা, ঝামেলা করতে গেলে পিটিয়ে হ্যালার্ডের মার্শালগিরির খায়েশ মিটিয়ে দেবে, নয়তো স্রেফ একটা বুলেট ঢুকিয়ে দেবে বেচারার পেটে। ব্যস, খেল খতম। জেরেমি টাউনে এ পর্যন্ত
পৃষ্ঠা-৮২
যে ক’জন মার্শাল নিয়োগ করা হয়েছে, সামর্থ্যের বিচারে তাদের ধারে-কাছেও যেতে পারবে না হ্যালার্ড। চাইলেই সবকিছু হওয়া যায় না। ‘স্রেফ খুন হয়ে যাবে ও, তাই না?’ চিন্তিত স্বরে বলল বিল লারকিন, লসনের চিন্তার ধারা বুঝতে পেরেছে। ‘জেদের বশে কাজটা করছে ও। ওর জন্যে করুণাই হয় আমার। যোগ্য লোক পাচ্ছে না, আবার যাদের পাচ্ছে কেউই টিকতে পারছে না। এদিকে শহরের পরিস্থিতি দিনদিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। উপায় না দেখে হ্যালার্ড যে নিজেই চেষ্টা করবে, এতে বিস্ময়ের কি আছে! দায়িত্বের বোঝাও কারও কারও জন্যে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে, তাই না?’ এবারও নিরুত্তর থাকল লসন, সিগারেট রোল করছে।
‘হ্যালার্ডের ক্রেইমে আবারও বসবে ওরা। সিদ্ধান্ত নেবে কি, আসলে নিজেরাই একমত হতে পারছে না। আজকের ঘটনার পর হয়তো একটা সমঝোতায় পৌঁছতে পারবে।’ ‘হতে পারে। কিন্তু ক্লেইম রক্ষা করার চেয়ে শহরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা বোধহয় আরও জরুরী।’ তর্ক করল না বিল লারকিন, জানে ঠিকই বলেছে ড্যানি লসন। ক্রেইম দখল কিংবা মারামারির ঘটনা আসলে বিচ্ছিন্ন ব্যাপার, জেরেমি টাউনের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে বন্ধ হয়ে যাবে এসব। খারাপ মানুষগুলো না থাকলে ঝামেলা করবে কে? মাইনারদের একাট্টা হওয়া জরুরী হয়ে পড়েছে এখন, বিচ্ছিন্ন ভাবে আউট- লদের মোকাবিলা করতে পারবে না এরা, কিংবা শুধু নিজের ক্লেইম আঁকড়ে ধরে থাকলেও চলবে না। ভবিষ্যতে এরাই থাকবে এই শহরে, রক্স কিনকেড বা থমসনের মত লোকেরা স্বার্থ ফুরিয়ে গেলেই চলে যাবে। ‘তোমাকে নিস্পৃহ দেখতে ভাল লাগছে না আমার,’ স্পষ্ট অসন্তোষ প্রকাশ করল বিল লারকিন। ‘দুই মাইল দূরে তোমাদের বাথান, সবচেয়ে কাছের শহর এখন জেরেমি টাউন। তিন দিনের পথ পেরিয়ে বিগ বে-তে যাওয়ার চেয়ে এখানে আসা কি সুবিধের নয়? হয়তো তুমিও চাও শহরটা শেষপর্যন্ত টিকে যাক?’ ‘চাই,’ স্বীকার করল লসন। ‘কিন্তু সেজন্যে একটা টিনের তারা বুকে লাগিয়ে বেঘোরে মারা পড়তে হবে? নাহ্, বিল, কোন সম্ভাবনা দেখছি না আমি। এতগুলো বেপরোয়া লোকের সঙ্গে একা লড়াই করা যায় না।’ ‘সেদিনের কথা এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেছ, তিনজনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলে তুমি? কই, তখন তো এভাবে চিন্তা করোনি! কিংবা একটু আগের ঘটনাটা চিন্তা করো।’ লসন কিছু বলতে উদ্যত হতে একটা হাত তুলে থামিয়ে দিল সে। ‘উত্তরটা আমিই দিচ্ছি বলবে পরিস্থিতি তোমাকে বাধ্য করেছিল। বেশ তো, মানছি ঠিক তাই ঘটেছে। কিন্তু জোন্স সিটির ব্যাপারে কি বলবে? ওখানে কি বেপরোয়া লোক কম ছিল? সাহস করে তুমি এগিয়ে না গেলে শহরটা হয়তো ধ্বংসই হয়ে যেত।’
‘এখানে আমার কোন স্বার্থ নেই, বিল। তাছাড়া তোমাদের শহরটা ‘আমার পছন্দ নয়। থমসন বা কিনক্টেডরা এখানে না এলেও মাইনাররাই একসময়
পৃষ্ঠা-৮৩
নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়ি শুরু করত কোথাও সোনা পাওয়া গেলে শেষপর্যন্ত ঠিক এটাই ঘটে।’ ‘জোন্স সিটির বেলায় তোমার কি স্বার্থ ছিল?’ ‘কিছুটা তো ছিলই, তাছাড়া আমার মনে হয়েছিল একটা চেষ্টা করা যেতে পারে। ভাল কিছু লোকও সাহায্য করেছে আমাকে, প্রথমে না হলেও শেষে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল ওরা।’ ‘এখানে কি তেমন লোক নেই?’ ‘খুব কম। বেশিরভাগই স্বার্থপর, তোমরা মাইনাররাও। বেনি ডবিনের মত লোক এখানে আইনের কর্তৃত্ব করে, এটা একটা লজ্জার ব্যাপার। আসলে ঠিকমত একজন মার্শাল নিয়োগ করার যোগ্যতাও তোমাদের নেই। প্রয়োজনে এসব লোক যে আমাকে বিপদের মুখে ফেলবে না তা কে বলতে পারে? আমি নিশ্চিত, আজ পর্যন্ত যত মার্শাল নিয়োগ করেছ, ক্ষণিকের জন্যেও কাউকে সাহায্য করোনি তোমরা। একটা ব্যাজ দিয়েই খালাস, ভেবেছ তোমাদের দায়িত্ব শেষ।’ ‘হয়তো তোমার কথাই সত্যি, নীরব হয়ে গেল বিল লারকিন, পকেট থেকে সিগার বের করে ধরাল। ‘তবে আমার ধারণা কি, শুনবে?’ চোখ তুলে লসনকে নিস্পৃহ দৃষ্টিতে তাকাতে দেখে ভেতরে ভেতরে খানিকটা হতাশ হলো মাইনার, কিন্তু সযত্নে সেটা চেপে গেল। ‘এখন যতই আপত্তি করছ, ড্যান, আমার ধারণা শেষপর্যন্ত তুমিই এগিয়ে আসবে।’ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল লসন, বুঝতে অসুবিধে হলো না আসলে পরোক্ষ ভাবে ওকে প্রস্তাবটা দিয়ে ফেলেছে মাইনার। ‘একবারও নিজেদের কথা বলছ না,’ নিরুত্তাপ স্বরে বলল ও। ‘সত্যটাও এড়িয়ে যাচ্ছ। তোমাদের শহর এটা, তোমাদের নিজেদেরই এগিয়ে আসতে হবে।’ একটা ট্রে-তে কফি, আপেল-পাই আর বিস্কুট নিয়ে এল জুলিয়া। টেবিলে ট্রে নামিয়ে রেখে ফিরে গেল আবার। ‘তোমার পরিকল্পনাটা কি, ড্যান?’ চোখে প্রশ্ন ফুটে উঠল ওর।
‘এমনিতে বসে থাকার লোক নও তুমি। আমি নিশ্চিত এ শহরের ব্যাপারে তোমার আগ্রহ আছে, কিন্তু স্বীকার করছ না। আগ্রহ যদি না-ই থাকবে তো পড়ে আছ কেন? একটা শহর ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, আর তুমি দাঁড়িয়ে থেকে মজা দেখবে, এটা ঠিক বিশ্বাস হয় না আমার।’ চুপ করে থাকল লসন। ‘তুমি আসলে চাও, আমরা যেন তোমার হাতে-পায়ে ধরি, তাই না?’ ‘উঁহু, তোমাদের কাজ-কারবার পছন্দ হচ্ছে না আমার। পরস্পরকে সাহায্য করছ না কেউ। তোমরা বুঝতে পারছ না শহরে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা দরকার-কোন ছা-পোষা শেরিফের নয়, দরকার তোমাদের কর্তৃত্ব। কিন্তু কেবল নিজেদের
দুর্বলতাই প্রকাশ করছ তোমরা, রক্স বা কিনকেডরা সেই সুযোগ নিচ্ছে।’ ‘সেদিন জেফরি হ্যালার্ডকে বলেছ, নতুন শহর দেখলে নাকি হিসেব করো তুমি? জেরেমি টাউনের ব্যাপারে তোমার হিসেব কি বলে, ড্যান? টিকবে শহরটা,
পৃষ্ঠা-৮৪
নাকি গ্রে উডের মতই শেষ হয়ে যাবে?’ থমকে গেল লসন। ‘জানি না. বিল,’ শেষে নিচু স্বরে বলল ও। দেখল রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে জুলিয়া, চোখাচোখি হলো মেয়েটির সঙ্গে। নীরবে নড করল লসন, তারপর টেবিল থেকে নিজের হ্যাট তুলে নিয়ে দরজার দিকে এগোল। ‘ধন্যবাদ, বিল।’ ‘কিন্তু আমি জানি, ড্যান,’ পেছন থেকে বলল ক্ষুব্ধ মাইনার। ‘আমারও একটা হিসেব আছে-এই শহর টিকে যাবে!’
‘হয়তো,’ দরজার নবে হাত রেখে বলল লসন। ‘কিভাবে টিকবে, শুনলে না?’ ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল ড্যানি লসন। ‘শোনার আগ্রহ নেই আমার, দুঃখিত, বিল। শুভরাত্রি!’ বলে দরজা খুলে বাইরের অন্ধকারে বেরিয়ে গেল সে। ‘বন্ধুগণ, এই শহরে আসলে দরকার নাগরিক কমিটির-বিশ-পঁচিশজন শক্ত এবং সৎ মানুষ। নিজের জমির অধিকার রাখার জন্যে রুখে দাঁড়াবে ওরা। দরকার পড়লে গুলি করবে। প্রথমে আইনানুগ পথে চেষ্টা করব আমরা, ব্যর্থ হলে অস্ত্রের সাহায্য নেব। স্যামুয়েল কিনকেড, কার্ট রলের মত লোক পিস্তল-রাইফেল ছাড়া কিছু চেনে না। সুতরাং ওদের ঠেকাতে হলে কঠোর না হয়ে উপায় নেই।’ থেমে উপস্থিত ত্রিশ-চল্লিশজন লোকের দিকে তাকাল জো হারপার, বোঝার চেষ্টা করল কথাগুলো কতটা প্রভাবিত করেছে এদের।
‘আমার তা মনে হয় না, স্পষ্ট স্বরে দ্বিমত প্রকাশ করল হ্যালার্ড। ‘এ তো তোমারই শহর,’ প্রায় উপহাসের সুরে বলল বিল লারকিন। ‘তোমার যেমন পছন্দ, সেরকম মনে হতেই পারে। এক কাজ করো, মি, হ্যালার্ড, শেইন থমসনকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো কেন সে ভদ্র ব্যবহার করছে না। নিস্তল জমা দিয়ে ওকে একটা চাকুরি নিতে বলো।’ আহত বোধ করল জেফরি হ্যালার্ড, বিব্রত এবং কিছুটা হকচকিয়েও গেছে। মুখ খুলতে চেয়েছিল সে, কিন্তু তার আগেই বাধা দিল হ্যান্স কোবার্ন। ‘এ পর্যন্ত কতজন নিহত হয়েছে, ফেল্টন?’ জানতে চাইল সোনা ব্যবসায়ী। ‘আঠারো জন,’ জানাল, সাংবাদিক। ‘কতগুলো ডাকাতি বা লুঠের ঘটনা ঘটেছে?’ ‘অসংখ্য। গুনছে কে! অধিকাংশই তো রেকর্ড হয়নি।’ম ‘আর কোন খুন-জখম চাই না আমরা,’ জোর গলায় বলল হ্যালার্ড। ‘ভায়োলেন্স ছাড়া এখানে শান্তি স্থাপনের অন্য কোন উপায় আছে নিশ্চয়ই।’ ‘নেই। শেইন থমসন, কার্ট রক্স, স্যামুয়েল কিনকেড-না, এদেরকে থামানোর অন্য কোন উপায় নেই। ওরা অবশ্য ভায়োলেন্সে বিশ্বাসী নয় এমন লোকই পছন্দ করে, কারণ তাতে লুঠপাটে সুবিধে হয় ওদের।’ শোরগোল উঠল লোকগুলোর মধ্যে। একসঙ্গে মত প্রকাশ করতে শুরু করেছে সবাই।‘হ্যারি,’ শীর্ণদেহী এক লোকের উদ্দেশে জানতে চাইল জো হারপার। ‘কেউ
পৃষ্ঠা-৮৫
যদি তোমার ক্রেইম দখল করতে আসে, কি করবে তুমি?’ ‘লড়াই!’ ‘আমিও তাই করব!’ সঙ্গে সঙ্গে জানাল আরেকজন। ‘এই দেখো, হ্যালার্ড, তোমার কমিটির দু’জন লোক পাওয়া গেছে,’ প্রায় প্রসন্ন সুরে বলল বিল লারকিন। মোটাসোটা এক মাইনারের দিকে ফিরল সে। ‘তুমি কি করবে, ল্যাম্বার্ট?’ ‘উঁহু, এখানে থাকছি না আমি। এরকম বহু শহর জন্মাতে এবং শেষ হতে দেখেছি। অবস্থা খারাপ দেখলে শহর ছেড়ে চলে যাব। যে শহরের কোন ভবিষ্যৎ নেই সেখানে থাকব কেন!’ ‘লোগান?’
‘আমিও না। ঘাড়ে মাথা আমার একটাই!’ ‘আমি আছি,’ খানিকটা একগুঁয়ে স্বরে জানাল বিল ক্লাইড। ‘সবাই হয়তো বোকা বলবে আমাকে, কিন্তু কমিটিতে থাকছি আমি।’ ‘না,’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল হ্যালার্ড। ‘এসব কমিটির কোন দরকারই নেই!’ মাথা দোলাল হ্যান্স কোবার্ন। ‘আগেও বলেছি, এ শহর ঠাণ্ডা করার মত যোগ্য লোক আমাদের হাতের কাছে আছে। ড্যানি লসনের কথা বলছি আমি। জেফরি হ্যালার্ড বা অন্য কাউকে না জানিয়েই পরোক্ষ ভাবে একটা প্রস্তাব দিয়েছিলাম ওকে। কিন্তু সাফ না করে দিয়েছে সে। বলেছে: এ ধরনের কোন অফার দেয়া হয়নি ওকে, এবং পেলেও নেবে না। তো, বন্ধুগণ, একটু আগে ওর পাওনা মিটিয়ে দিয়েছি আমি। এতক্ষণে হয়তো শহর ছেড়ে চলে গেছে সে। যে লোকটা এ শহরের বিপদের সময় হাল ধরতে পারত, সেই চলে গেছে। ‘অবস্থা ভাল নয়, বিল। মন্টানা থেকে, ফিরে আসার সময় কিছু খবর পেয়েছি আমি। আরও লোক আসছে এখানে, এরা সত্যিকার অর্থেই দাঙ্গাবাজ। সময়ও বেশি নেই আমাদের হাতে।’ ‘ননসেন্স!’ বিরক্তি প্রকাশ করল হ্যালার্ড। ‘এ শহর আমার হাতে তৈরি…’ ‘এবং নিজের চোখে এর ধ্বংস দেখবে তুমি!’ ‘একটা কথা না বলে পারছি না, মি. হ্যালার্ড,’ নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ হলো অধৈর্য এক মাইনার। ‘আমার মনে হয় ড্যানি লসনকেই ধরা উচিত আমাদের। টাসকোসা আর রেডরকে শান্তি এনেছে লসন। মি. কোবার্ন ঠিকই বলেছে, ড্যানি লসনকেই দরকার আমাদের। শহরে শান্তি না এলে ব্যবসা বন্ধ করে চলে যেতে হবে, সবকিছু পুড়ে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার চেয়ে সামান্য ক্ষতি এমন কিছু নয়।’ কৃথাগুলো ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না হ্যালার্ডের, চোখ সরু করে তাকাল সে। ‘শহর ছেড়ে চলে যাবে? তুমি কি সিরিয়াস?’
‘সত্যি কথা বলতে কি, এদিকে নতুন তুমি, মি. হ্যালার্ড। অনেক কিছুই তোমার জানার বাকি। গ্রে উডের নাম শুনেছ?’ ‘না।’ ‘জেরেমি টাউনের মতই গ্রে উডের জন্ম। তবে গ্রে উডের সম্ভাবনা এই শহরের চেয়েও বেশি ছিল। সেখানেও একই অবস্থা। দাঙ্গাবাজরা দু’জন
পৃষ্ঠা-৮৬
মার্শালকে মেরে ফেলল, তারপর আর মার্শাল হওয়ার ঝুঁকি নিল না অন্য কেউ। কিছুদিনের মধ্যেই বখাটেদের শহর হয়ে গেল গ্রে উড, এবং শেষে সামান্য কারণে ধ্বংস হয়ে গেল শহরটা। ‘আসল গোলমাল কিন্তু আরম্ভ হয়েছিল একটা বারে, এবং সেটা শুরু করেছিল কার্ট রক্স। তারপরই দেখা গেল অবাধ লুঠপাট শুরু হয়ে গেছে-যে যা, পারছে কেড়ে নিচ্ছে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পুরো শহরে আগুন। ওখানে ছিলাম আমি, কোন রকমে পালিয়ে এসেছি।’ ‘তা লসনের ডাক পড়েনি সেখানে, এতই যদি যোগ্য আর করিৎকর্মা লোক হয়ে থাকে সে?’ ‘পড়েছিল,’ শান্ত কণ্ঠে জানাল মাইনার। ‘কিন্তু দেরিতে। ও যখন খবর পেয়ে পৌঁছায় তখন আর ওই শহরে রক্ষা করার মত কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। আমরাও বোধহয় দেরি করে সেই ভুল করতে যাচ্ছি।’ চুপ করে থাকল হ্যালার্ড। ভায়োলেন্স, গানফাইট কখনোই তার পছন্দ নয়। এ শহরে নিয়ম-কানুন প্রতিষ্ঠা করার অন্য কোন উপায় নিশ্চয়ই আছে। তবে সবচেয়ে বড় কথা ড্যানি লসনকে সে চায় না। কেন চায় না? একটু ভাবল সে। লোকটার নির্লিপ্ত চাহনি আর গা-ছাড়া ভাব ত্যক্ত করে তোলে ওকে, যদিও তাতে দোষের কিছু নেই, জানে হ্যালার্ড। ওর সন্দেহ এই নির্লিপ্ততা আসলে একটা খোলস, ভেতরে ভেতরে অস্বাভাবিক এক ক্ষমতার অধিকারী সে-ভীষণ একরোখা, নিষ্ঠুর এবং বেপরোয়া এক বন্দুকবাজ ড্যানি লসন-যে ক্ষমতা ওকে আর দশজন মানুষ থেকে আলাদা করে চিনিয়ে দেয়, বুঝিয়ে দেয় খেপে গেলে অদম্য হয়ে উঠতে সক্ষম সে। লাগামহীন আক্রোশ বা জেদ অন্যের জন্যে মঙ্গল বয়ে আনে কখনও? ‘কি ঠিক করলে, জেফ?’ হালকা সুরে জানতে চাইল জো হারপার। ‘আমি কি ওকে ভাড়া করব?’ ‘না,’ গম্ভীর স্বরে জানিয়ে দিল জেফরি হ্যালার্ড। ‘আমিই মার্শাল হব, এখন থেকে এ শহর আমিই চালাব।’ চোখ তুলে তাকাল সবাই, অবিশ্বাস সবার চোখে। ঠিক এসময় দূরে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পেল ওরা।
পৃষ্ঠা-৮৭
আট:- কোমরে হোলস্টার বাঁধার সময় খানিক দূরে বসে থাকা জো হারপারের দিকে তাকাল জেফরি হ্যালার্ড। বন্ধুর চোখে তীব্র অসন্তোষ দেখতে পেল সে, কিন্তু গ্রাহ্য করল না। আনমনে, অনেকটা দায়সারা ভাবে পিস্তল চেক করল সে, তারপর খাপের মধ্যে বসিয়ে দিল। এবার পকেট থেকে একটা রূপালী তারা বের করে বুকের কাছে, শার্টের পকেটের ওপর এঁটে দিল।’তোমার সাহসের তারিফ করছি, জেফ,’ বিরক্তি চেপে রাখার চেষ্টা করল না হারপার। পকেট থেকে দুমড়ানো একটা সিগার বের করে ধরাল। ‘কিন্তু কেবল বোকারাই এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তুমি বোকা নও জানি…’ অসহায় ভাবে একটা কাঁধ ঝাঁকাল সে। ‘তোমার মতলবটা কি, বলো তো?’ ‘না বোঝার তো কিছু নেই। আজ থেকে আমিই এ শহরের মার্শালের দায়িত্ব নিচ্ছি, এবং একটু পরেই টহলে বেরোব।’
স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল হারপার, যেন বুঝতে পারছে না ঠিক কি বলেছে হ্যালার্ড। কিন্তু এবারই প্রথম নয়, সকালে মীটিংয়ে ঘোষণা দিয়েছে সে। প্রথমবার শুনে যেমন অনুভূতি হয়েছিল, এখনও তাই মনে হচ্ছে হারপারের কাছে। বোকামি করছে মানুষটা। জেদ তাতিয়ে তুলেছে ওকে, নিজের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে একটুও ভাবছে না। ওর উদ্দেশ্য সৎ, মহৎও। কিন্তু শুধু সততা বা সাহস দিয়ে কিনকেড কিংবা থমসনদের মত মানুষকে দমিয়ে রাখা যায় না। সেজন্যে দৃঢ় মনোবলের পাশাপাশি দরকার অস্ত্রের দক্ষতা। যার কোনটাই জেফরি হ্যালার্ডের নেই।
এতদিন সে নিজে মার্শাল নিয়োগ করেছে, দু’দিনের বেশি টিকতে পারেনি কেউ। এবার নিজেকে বেছে নিয়েছে, এবং জো হারপারের ধারণা, আগের মার্শালদের পথই অনুসরণ করবে। সত্যি কথা বলতে গেলে, বন্ধুর জন্যে করুণা বোধ করছে ও। মানুষটা খাঁটি, কিন্তু প্রথমবারের মত যে সাহস বুকে নিয়ে কোমরে পিস্তল ঝুলিয়েছে সে, হয়তো কেবলই বেপরোয়া লোকগুলোকে উস্কে দেয়ার জন্যে। নির্ঘাত ওকে পিস্তলে হাত বাড়াতে বাধ্য করবে শয়তানগুলো। এখানেই জেফরি হ্যালার্ডের সীমাবদ্ধতা। সেটা সে নিজেও জানে বোধহয়। কিন্তু কারও যুক্তি মানছে না স্কুল মাস্টার। কাউকে যখন পাওয়া যায়নি, নিজের কাঁধে দায়িত্ব তুলে নিয়েছে।
‘হয়তো থমসনকে খুশি করতে যাচ্ছ তুমি,’ মৃদু কণ্ঠে মন্তব্য করল হারপার। ‘কেমন করে?’ সরু চোখে ওর দিকে তাকাল হ্যালার্ড, ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি। ‘দু’ব্যুর আমাদের ক্রেইমে এসেছিল ও, কিন্তু কোনবারই সুবিধা করতে পারেনি। এবার নিজের সীমানায় তোমাকে পেয়ে যাবে সে।’ ‘তোমার ধারণা ঠিক না-ও হতে পারে, হয়তো শহরে গোলমাল করবে না ও। এখানে এসেছিল ক্রেইমের দখল নিতে, শহরে তো ওরকম কোন ব্যাপার নেই।’ ‘নিজের পিঠের দিকে খেয়াল রেখো, জেফ হ্যালার্ড দরজার দিকে এগোতে পেছন থেকে বলল হারপার। মাথা ঝাঁকিয়ে বেরিয়ে গেল সে। পিছু নিয়ে এবার পোর্চে এসে দাঁড়াল জো হারপার, হ্যালার্ডের পিঠে সেঁটে আছে দৃষ্টি। দৃঢ় পায়ে শহরের দিকে হেঁটে যাচ্ছে সে। কোন রকম দ্বিধা বা জড়তা নেই। সকাল থেকেই অস্থিরতা অনুভব করছে ড্যানি লসন। মনটা পড়ে আছে জেরেমি
পৃষ্ঠা-৮৮
টাউনে। শহরের পরিস্থিতি শঙ্কিত করে তুলেছে ওকে। একবার গোলমাল শুরু হয়ে গেলে শেষে কি ঘটবে তা তো সে জানেই। সেই গোলমালেরও বেশি দেরি নেই। ছোটখাট কোন ডাকাতি বা সামান্য ভাঙচুরের মাধ্যমে শুরু হবে, এবং তার সমাপ্তি হবে শহরটার আগুনে ধ্বংস হওয়ার মধ্যে। অসুবিধে একটাই-যারা কাজটা করবে, নিজেদের সম্পত্তি ধ্বংস করবে না, বরং অন্যেরটা করবে। এ চিন্তাটা কোন ক্রমেই মাথা থেকে সরাতে পারছে না লসন। অভিজ্ঞতা থেকে জানে একমাত্র গোলাগুলি আর রক্তপাতের মাধ্যমে এই নৈরাজ্যের অবসান সম্ভব। কোন যুক্তিতর্ক চলবে না, তার ধার ধারবেও না কেউ। ঘুসির শক্তি আর জোরই হচ্ছে রক্স, কিনকেড বা থমসনের কাছে আইন। জেরেমি টাউনের সঙ্গে সম্পর্ক নেই ওর, কিন্তু তারপরও কি এক দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারছে না। গতরাতে বাথানের উদ্দেশে রওনা দিয়েও অর্ধেক পথ থেকে ফিরে এসেছে ও, তারপর নদীর ওপাড়ে উপত্যকায় রাত কাটিয়েছে। উপত্যকার শান্ত নিরুদ্বিগ্ন পরিবেশ, পাইনের সুবাস মাখা ঝিরঝিরে বাতাস কিংবা জোৎস্নালোকিত রাতও প্রশান্তি এনে দিতে পারেনি ওর মনে। শহর থেকে এক মাইল দূরে থাকলেও মনটা পড়ে ছিল জেরেমি টাউনে। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থেকেছে, কি এক উৎকণ্ঠায় কেটেছে মুহূর্তগুলো। একটা সিদ্ধান্তে পৌছানোর চেষ্টা করেছে।
জেরেমি টাউন ধ্বংস হয়ে গেলে কিছু যায়-আসে ওর? অবশ্যই। সরাসরি কোন লাভ-ক্ষতি নেই, কিন্তু এখানে কয়েকজন হিতাকাঙ্ক্ষী আছে ওর-কোবার্ন, লারকিন, জো হারপার কিংবা ডিক ফেল্টন…এদের কারও ক্ষতি দেখতে ভাল লাগবে না ওর। একটা শহরকে মরতে দেখার মধ্যেও কোন আনন্দ নেই। পাহাড়ের কোলে ছবির মৃত সুন্দর একটা শহর হিসেবে গড়ে উঠতে পারে জেরেমি টাউন-জেফরি হ্যালার্ডের স্বপ্ন সার্থক হতে দোষ কোথায়? একটা সুযোগ অন্তত পাওয়া উচিত মানুষটার।
সকালে নিজের অজান্তে জেরেমি টাউনের ট্রেইল ধরেছে ও। পাহাড়ের ওপর থেকে নজর রেখেছে শহরের ওপর। বিকেলে নদী পেরিয়ে চলে এসেছে বিল লারকিনের ক্রেইমে। দুই ভাই দারুণ ব্যস্ত মাইনিং-এ, জুলিয়া কফি তৈরি করছে। ‘আমাদের সবারই কিছু না কিছু দায়িত্ব আছে,’ জুলিয়া টেবিলে কফির ট্রে নামিয়ে রাখতে বলল ও। ‘আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সবার।’ স্মিত হাসল মেয়েটি, উজ্জ্বল দেখাচ্ছে আয়ত চোখ জোড়া। ‘তারমানে জেরেমি টাউনের দায়িত্ব নেওয়ার চিন্তা করছ তুমি?’ উত্তরে খানিকটা হলেও দ্বিধান্বিত দেখাল ওকে। ‘হ্যাঁ, আমার যে কি হয়! জানি এই শহর থেকে দূরে থাকা উচিত, কিন্তু পারছি না। জেফরি হ্যালার্ডের কথাই ধরো-আমাকে পছন্দ করে না ও। অবশ্য তাতে কিছুই যায়-আসে না আমার। কিন্তু ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়েছে মানুষটা, সে চায় শান্তি প্রতিষ্ঠিত হোক।’ কফি শেষ করে টেবিল ছাড়ল লসন, ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এল। তারপর ঘোড়ায় চড়ে শহরের দিকে এগোল। প্রথমেই জেফরি হ্যালার্ডের সঙ্গে দেখা হলো ওর। স্কুল মাস্টারের শার্টের বুকে একটা ব্যাজ সাঁটা। ‘সাহস আছে তোমার, মন্তব্য করল ও।
পৃষ্ঠা-৮৯
‘তুমি কি ভেবেছিলে ভীতু আমি?’ ‘তোমাদের প্রথম মার্শাল ম্যাকগিলও ভীতু ছিল না। যথেষ্ট সাহস ছিল ওর, ভাল মার্শাল হওয়ার ইচ্ছেও ছিল। কিছু কিছু শহর আছে তুমি যেভাবে চালাতে চাও সেভাবে চালাতে পারবে-পিস্তল ছাড়া, খুন-জখম ছাড়া। কিন্তু এখানে সেটা সম্ভব হবে না।’ ‘সে আমি দেখব!’ প্রায় অধৈর্য স্বরে বলল হ্যালার্ড, বিরক্তি বোধ করছে লসনের ওপর। স্মিত হাসল লসন। ‘ম্যাট লোগানের নাম শুনেছ?’ ‘কি হয়েছে ওর?’ ‘আসছে ও। বেশ কয়েকজন ভাড়াটে বন্দুকবাজ জোগাড় করেছে সে। কার্ট রক্স বা স্যামুয়েল কিনকেডের সঙ্গে কামড়াকামড়ি লেগে যাবে ওর। শেষপর্যন্ত কি যে ঘটবে কে জানে!’ মুখটা তেতো লাগছে জেফরি হ্যালার্ডের। ড্যানি লসনকে আপাদমস্তক অপছন্দ করে ও, কিন্তু তিক্ততার সঙ্গে অনুভব করছে এ লোকটার কিছু কিছু জ্ঞান ওর দারুণ প্রয়োজন এখন। ‘কি করব আমি?’ সরাসরি লসনের মুখের দিকে তাকাল ও। ‘মনে হয় না এই ব্যাজটা বাড়তি কোন কাজে আসবে, অন্তত যখন ওদের মুখোমুখি হব আমি।’ ‘তা হবে না। দেখো, হ্যালার্ড, জেদের বশে তুমি যে কাজটা নিয়েছ সেটা বিশেষজ্ঞের কাজ। সবাইকে দিয়ে এ কাজ হবে না। আমি যদি তোমার জায়গায় থাকতাম, তাহলে শটগান হাতে মুখোমুখি হতাম ওদের। স্পষ্ট জানিয়ে দিতাম আমার আইন। কেউ আইন ভাঙলে বা বেতাল করলে পেটাতাম তাকে। যদি পিস্তলের দিকে হাত বাড়াত; নির্দ্বিধায় গুলি করতাম।’ মাথা নাড়ল হ্যালার্ড। ‘আমি তা পারব না। আগে ওদের সঙ্গে কথা বলে দেখতে চাই। ওদের বলতে চাই, সবাই যদি একসঙ্গে থাকি, সবার মিলিত চেষ্টায় সুন্দর একটা শহর গড়তে পারব।’ স্মিত হাসল লসন। ‘কাকে বলবে এ কথা? কার্ট রক্স বা থমসনের কথাই ধরো-আইন চায় না ওরা। বাহুবল আর পিস্তলের দক্ষতাই ওদের কাছে আইন। যা ইচ্ছে তাই করতে পারে ওরা। এ শহর থাকল কি না-থাকল তাতে কি যায়- আসে ওদের? আখের গুছিয়ে নেওয়ার তালে আছে ওরা, ভদ্র ভাবে বললে কি চলে যাবে? নাকি তা হয় কখনও?’
‘তোমার বিশেষত্ব কোথায়?’ খানিক দ্বিধার পর প্রশ্নটা করে ফেলল হ্যালার্ড। ‘আমি যদি ওদের ঠাণ্ডা করতে না পারি তাহলে তুমি কিভাবে পারবে?’ ‘পারব যে তা কিন্তু বলিনি। চেষ্টা করে দেখব, হয়তো সম্ভব। কারণ ওদের মত একই সুরে জবাব দেব আমি, ওদের ওষুধই ফিরিয়ে দেব ওদের। আমার বাড়তি সুবিধে কাজটা আমার কাছে নতুন নয়। এটাও ওদের জন্যে দুশ্চিন্তার খোরাক, কারণ এই কাজে আগেও সফল হয়েছি আমি। ওদের কেউ কেউ আমার সেই সাফল্যও দেখেছে।’ মাথা নাড়ল হ্যালার্ড, জেদে দৃঢ় হয়ে গেছে চোয়াল। ‘না, থাক,’ একগুঁয়ে
পৃষ্ঠা-৯০
স্বরে ঘোষণা করল, ‘শুরু যখন করেছি, এর শেষ আমি দেখে ছাড়ব!’ জেফরি হ্যালার্ড আগে ল-অফিসে এল। শহরের প্রায় মাঝামাঝি ঘরটা, ছোট একটা কামরা, পাশে নামমাত্র সেল। সর্বত্র অযত্নের ছাপ। তাড়াহুড়ো করে তৈরি করা হয়েছে, আগের মার্শালদের কেউই ঘরটার যত্ন নেয়নি। সারা ঘরে ধুলো, নোংরা উচ্ছিষ্ট পড়ে আছে। বিরক্তি আর বিতৃষ্ণার সঙ্গে নিজের অফিস দেখল হ্যালার্ড, তারপর শ্রাগ করে কোণের স্টোভের দিকে এগোল। পানি চড়িয়ে দিয়ে টেবিলের ওপাশে চেয়ারে বসল। সেলুন আর বাড়িগুলো থেকে হৈ-হল্লার শব্দ ভেসে আসছে। এখন পর্যন্ত, কোন গোলমালের আভাস বা গুলির শব্দ শোনা যায়নি।
ড্রয়ার খুলে কয়েকটা পোস্টার বের করল সে। বিগ বে থেকে আনা হয়েছে। অযত্নে ধুলো জমেছে ওগুলোয়। সময় নিয়ে পোস্টারের চেহারাগুলো দেখল ও, মাত্র তিনজনকে চেনা মনে হচ্ছে। থমসন, রক্স আর ওর চেলা নিকোলাস গ্রীন। পুরানো ছবি, কিন্তু চেনা যায়। অন্য কাউকে চিনতে না পারলেও চেহারাগুলো মনের মধ্যে গেঁথে নিল হ্যালার্ড। বলা যায় না কাজে লেগে যেতে পারে। কেতলির পানি ফুটতে শুরু করতে চেয়ার ছাড়ল হ্যালার্ড। স্টোভের কাছে গিয়ে কফি তৈরি করল, তারপর মগভর্তি কফি নিয়ে ফিরে এসে আয়েশ করে বসল চেয়ারে। আজ রাতে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে। গোলমাল ছাড়াই পেরিয়ে গেছে দিনটা। কিন্তু একটু পরেই রাত নামবে। শূন্য দৃষ্টিতে শহরের রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকল হ্যালার্ড, এই প্রথম অনুভব করছে কি কঠিন দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে। বলতে গেলে একদম একা সে। জো হারপার বা জ্যাক ক্লেটন পাশে এসে দাঁড়াবে ঠিক, কিন্তু বিপক্ষে অনেক লোক। খানিকটা উদ্বেগ লাগছে ওর, অস্বীকার করতে পারবে না। এ ধরনের কাজ কখনও করেনি, তবুও বুঝতে পারছে কাজটা কঠিন। মীটিংয়ে জেদের বশে বলার সময় যতটা কঠিন মনে হয়েছিল, তারচেয়েও কঠিন। তবে পিছিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে বা মানসিকতা কোনটাই নেই ওর। যাই ঘটুক, শেষপর্যন্ত থাকবে সে। হয়তো বেপরোয়া লোকগুলোকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে পথে আনতে পারবে। দরজায় নক্ হলো। চোখ তুলে তাকাল হ্যালার্ড, লোকটাকে ঢুকতে দেখে রীতিমত বিস্মিত হলো। আর যেই হোক ড্যানি লসনকে দেখবে বলে আশা করেনি। ‘কফি হবে নাকি, মার্শাল?’ হালকা সুরে জানতে চাইল সে। ‘নিশ্চয়ই!’ ইঙ্গিতে একটা চেয়ার দেখিয়ে দিল হ্যালার্ড, উঠে স্টোভের কাছে গেল ও। একটা মগে কফি ঢেলে পরিবেশন করল লসনকে। ‘আচ্ছা, আজ রাতে কি ঘটতে পারে বলে তোঁমার ধারণা? একটু পরেই টহল দিতে বেরোব আমি।’ ‘ছ’জোড়া চোখ আর বারো জোড়া হাত দরকার হবে তোমার,’ স্মিত হেসে বলল লসন। ‘সাবধান, ফাঁদ থাকবে অনেক, পিস্তল লড়াইয়ে যেতে তোমাকে উস্কানি দেবে কেউ কেউ। গলি পেরোনোর সময় সতর্ক থেকো, ছাদের দিকেও
পৃষ্ঠা-৯১
নজর রাখবে। শেইন থমসন, কার্ট রক্স বা ওদের যে কেউ তোমার সঙ্গে লড়াই বাধাতে পারে, জড়িয়ে পড়ো না। আর তাস খেলায় যদি লড়াই বাধে, ভুলেও গ্রাহ্য কোরো না, যতটা সম্ভব জুয়ার হল থেকে দূরে গ্লেকো। নিজের পেছন দিকে লক্ষ্য রাখবে সবসময়। কখনও দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে ভেব না তোমার পেছন দিকটা নিরাপদ, ফর্টি-ফাইভ কার্তুজ ছ’ইঞ্চি কাঠ অনায়াসে ভেদ করতে পারে; অথচ এখানকার দেয়ালগুলো এক ইঞ্চির বেশি পুরু নয়। দ্রুত চলাফেরা করবে তুমি, এক জায়গায় বেশিক্ষণ থেমে থেকো না। কি করতে হবে সবাইকে স্পষ্ট বলে দেবে। কেউ যদি অবাধ্য হয় গুলি করবে তাকে।’ ওই কাজটা আমাকে দিয়ে হবে না।’ ‘ ‘তাহলে ধরে নাও আজ রাতেই খুন হয়ে গেছ তুমি।’ বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে লসনের দিকে তাকাল নতুন মার্শাল। ‘এ শহরে কতজন খারাপ লোক আছে বলে মনে হয়?’ ‘পাঁচ-ছয়জন খুব খারাপ। ডজন খানেক বেশ খারাপ। তবে শহর পরিষ্কার করতে হলে অন্তত ষাট-সত্তরজনকে সরাতে হবে।’
‘এত!’ ‘হ্যাঁ, তবে নিরাশ হওয়ার কিছু নেই। এখন হয়তো সরাসরি তোমার পক্ষ নিচ্ছে না কেউ, সাধারণ লোকজন কিন্তু শান্তি আর স্থিতিই চায়। যাদের কথা বললাম ওদের মধ্যে মাত্র কয়েকজন সত্যিই ভয়ঙ্কর, যেমন: থমসন, রক্স বা কিনকেড…’ ‘আইক জেসাপ।’ ‘ওর কাছ থেকে দূরে থেকো। আপাদমস্তক খুনী ও, কিন্তু নিজে কখনও ঝামেলা পাকায় না’। বেআইনী কিছুও করে না। পিস্তলের মুখে যদি ওকে সরাতে চাও তাহলে ভুল করবে, কারণ কাজটা সত্যিই কঠিন। সত্যি কথা বলতে কি, আইক জেসাপের মত লোক এ ধরনের শহরে বেশিদিন থাকে না। কিছু টাকা কামাই হলে এমনিতেই চলে যাবে ও। ওর ধাতটাই এমন।’ মাথা ঝাঁকাল হ্যালার্ড। ‘তবে প্রথমদিন হিসেবে শান্তির কথাই শোনাব ওদের। বলব ইচ্ছে করলে, পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে সুন্দর একটা শহর গড়তে পারব আমরা।’ ‘হ্যালার্ড, বাঘকে ভেড়ার পালের সঙ্গে শান্ত ভাবে ঘুরে বেড়ানোর অনুরোধ করার মত অবাস্তব কথা বলছ। তুমি যা বলবে সেটা ওদের স্বভাবের বাইরে। তবুও চেষ্টা করে দেখতে পারো।’ ‘সঙ্গে বন্দুক নেব না আমি, যুক্তি দিয়ে ওদের বোঝাব।’ কফি শেষ করার ফাঁকে নীরবে হ্যালার্ডকে দেখল লসন। বুঝতে পারছে একে উপদেশ দিয়ে লাভ হবে না, স্রেফ আরেকটা বোকামি করতে যাচ্ছে সে-নিরস্ত্র অবস্থায় টহলে বেরিয়ে বরং আরও বিপদে পড়বে, পাত্তাই দেবে না কেউ তাকে। হ্যালার্ডকে ধন্যবাদ জানিয়ে ল-অফিস থেকে বেরিয়ে এল ও। দূরে কামারের দোকানের সামনে টিম কার্টিস আর রবার্ট অ্যালেনকে দেখতে পেল। কাজ শেষ হয়ে গেলেও এখনও শহর ছেড়ে যায়নি ওরা। হয়তো লসনের মতই স্রেফ
পৃষ্ঠা-৯২
কৌতূহল আটকে রেখেছে ওদের-জেরেমি টাউনের ভাগ্যে শেষপর্যন্ত কি ঘটে! পাহাড়ের দিকে তাকাল, লসন, বিল লারকিনের ক্লেইমের দিকে চলে গেল দৃষ্টি। জুলিয়া লারকিনের কথা মনে পড়ল। কিন্তু এমন তো কখনও হয়নি। উঁহু, তোমার কথা পরে ভাবব! বিস্ময় গোপন করে নিজেকে শাসন করল ও। হ্যালার্ডকে মাত্র অর্ধেকটা প্রভাবিত করা গেছে। ওকে যতই অপছন্দ করুক স্কুল মাস্টার, কিন্তু উল্টো তাকে অপছন্দ করতে পারছে না লসন। জেরেমি টাউন যদি টিকে যায়, সৎ নীতিবান লোক হিসেবে নিশ্চয়ই নাম করবে সে। এখনও এ শহরে কোন সৌন্দর্য নেই। কোন গাছ নেই, ফুল নেই, আছে শুধু ক্যাকটাস। মাত্র দুটো দালান রঙ করা হয়েছে। প্রাণহীন রুক্ষ একটা শহর। এ ধরনের শহর কখনও ভাল লাগে না লসনের। কিন্তু তবু, গড়ে উঠেছে তো। ধ্বংস তারচেয়েও বেশি অপছন্দ ওর। এখনও একটা সম্ভাবনা আছে এ শহরের, সেই সম্ভাবনাই টানছে ওকে। ল-অফিসের পোর্চে দাঁড়িয়ে পুরো শহরে নজর বুলাল জেফরি হ্যালার্ড। রাস্তায় লোকজন কম। আশপাশের বাড়ি থেকে জানালা পথে ছিটকে আসা চৌকো আলো পড়েছে ক্ষত-বিক্ষত রাস্তায়। হুল্লোড় চলছে সব সেলুনে। কাছের বাড়ি থেকে মেয়েলি কন্ঠের হাসির শব্দ শোনা গেল। বাড়ি আর দোকানের অন্ধকার কোণগুলো তীক্ষ্ণ চোখে জরিপ করল হ্যালার্ড, বোঝার চেষ্টা করল ওখানে কেউ আছে কিনা। কাউকে চোখে পড়ল না। হয়তো নতুন মার্শালের ওপর নজর রাখার চেয়ে ফুর্তি করাতেই আগ্রহ বেশি ওদের। বিকেল থেকে অন্যান্য দিনের তুলনায় চুপচাপ পুরো এলাকা। খনি শ্রমিকরা সন্ধেয় হৈ-হল্লা করে, আজ তাও নেই। অমঙ্গলের পূর্বাভাস? শেষপর্যন্ত মত বদলে সঙ্গে পিস্তল নিয়েছে জেফরি হ্যালার্ড। টহলে বেরোনোর আগে জানালার কাছে এসে বাইরে তাকিয়েছে কয়েকবার, কিন্তু ড্যানি লসনের ছায়াও দেখতে পায়নি। স্রেফ অদৃশ্য হয়ে গেছে লোকটা! আশপাশেই থাকবে জো হারপার, জানে হ্যালার্ড। বন্ধুকে নিরস্ত করার চেষ্টা করেছে ও, কিন্তু মানেনি হারপার। সঙ্গে শটগান নিয়েছে সে। ‘কি দরকার, জো, তোমাকে শটগান হাতে পাশে দেখলে একটা সুযোগ পেয়ে যাবে ওরা,’ সতর্ক করেছে জ্যাক ক্লেটন। ‘হয়তো শেষপর্যন্ত দু’জনেই মারা পড়বে।’ ‘হয়তো পড়ব,’ উত্তরে বলেছে হারপার। ‘কিন্তু ও আমার পার্টনার। এখানে একসঙ্গে এসেছি, পার্টনার বলতে সব ক্ষেত্রেই পার্টনার হওয়া বুঝি আমি।’ ‘ঠিক আছে, তোমার যেমন ইচ্ছে। তবে সাবধান। মনে রেখো, ওরা কিন্তু জানে হ্যালার্ডের আশপাশে তুমিও থাকছ।’ হ্যালার্ড বা হারপার ড্যানি লসনের খোঁজ না পেলেও ঠিকই নিজের কাজ করে যাচ্ছে সে। জানে এমন পরিস্থিতিতে কি করতে হবে। যুৎসই একটা জায়গা বেছে নিয়েছে ও, আপাতত সেখানেই আছে। সন্ধের পরপরই রাস্তাগুলো ফাঁকা হয়ে গেছে আজ, বলতে গেলে কেউই নেই। সুতরাং রাস্তায় যখন পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল, লসন বুঝল টহলে নেমে গেছে নতুন মার্শাল। কিছু দূরে একটা
পৃষ্ঠা-৯৩
সিগারের আগুন চোখে পড়ল ওর। সিগন্যাল? ঠিক উল্টোদিকে জেনারেল স্টোরের দরজায় অলস ভাবে দাঁড়িয়ে আছে জাড ভেন্ট্রি।
চোখ কুঁচকে তাকাল লসন, অন্ধকারে দৃষ্টি সয়ে এসেছে। কয়েক মুহূর্ত পর সিগারঅলাকে চিনতে পারল, ক্রেম ব্রেস।ল-অফিস থেকে রাস্তা ধরে এগিয়ে আসছে একটা ছায়া। দৃঢ়তা নেই চলায়, মানুষটা দ্বিধান্বিত-স্পষ্ট বুঝতে পারল লসন-টনটনে অহমিকা বা আত্মবিশ্বাস কোনটাই নেই এখন। জেদ শক্তি যুগিয়েছিল তাকে, কিন্তু নিরেট বাস্তবের তিক্ত উপলব্ধিতে মুহূর্তের মধ্যে উবে গেছে সব।
অন্ধকারে গা মিশিয়ে এগোল ও, গলি ধরে চলে এল মূল রাস্তায়, সিড হ্যামারটনের জেনারেল স্টোরের দেয়ালের সঙ্গে মিশে থাকল। ফিড স্টেবলের পাশের গলির মুখে দেখা যাচ্ছে নিকোলাস গ্রীনকে, এমন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেন কিছুই জানে না।
প্রতিপক্ষ কি ধরনের পরিকল্পনা করেছে, এখনও আঁচ করতে পারেনি লসন। এমনও হতে পারে নিজেদের মধ্যে ফাঁকা গোলাগুলি করবে, আর সেই গুলি থামাতে গিয়ে দুই দলের মাঝখানে পড়ে ঝাঁঝরা হয়ে যাবে জেফরি হ্যালার্ড। তখন কাউকেই দোষ দেয়া যাবে না।
তেমন কিছুই কি ঘটবে? ফিড স্টেবলের উল্টোদিকে সিড হ্যামারটনের জেনারেল স্টোর। পাশে ‘গ্রে উড’ সেলুন, জেফরি হ্যালার্ড ওটার সামনে পৌঁছতে অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে এল একটা ছায়া। লোকটা বিশালদেহী, চলার সময় স্পারের ঝুনঝুন শব্দ সেলুন থেকে বেরিয়ে আসা পিয়ানোর আওয়াজ ছাপিয়ে উঠছে। পোর্চের একটা পোস্টে হেলান দিয়ে দাঁড়াল সে.। ডান হাতের চুরুট ঠোঁটে ছোঁয়াল, তারপর নখে দেয়াশলাইয়ের কাঠি ঘণে আগুন ধয়াল সেই আগুনে দৃঢ় কঠিন মুখটা দেখল মার্শাল, নিকোলাস গ্রীন
প্রায় তখনই অন্যদেরও দেখতে পেল হ্যালার্ড। অন্যমনস্ক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শীর্ণদেই, ক্রেম ব্রেস, মনোযোগ দিচ্ছে না এদিকে, ভান করছে আসলে। জাড ডেন্ট্রি একটু দূরে, ভারও যেন খেয়াল নেই এদিকে। পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে আরেকরুন, স্পষ্ট টের পেল. জেফরি হ্যালার্ড। সুন্নতো একান কাল, মনে হলো ওয় নিষ্ঠুর বেপরোয়া লোক গ্রীন, অথচ এমন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে বেন ভাজা গাংটিও উল্টে থেতে জানে না। পাশের দালান থেকে বেরিয়ে এল দু’জন, দেয়ালের সঙ্গে আয়েশ করে হেলান দিয়ে দাঁড়াল হ্যালার্ডের পেছনে। ‘হ্যার্জো, মার্শাল!’ আচমক। বলে উঠল নিকোলাস গ্রীন ‘তাহলে জেরেমি টাউনে আইন প্রতিষ্ঠ’ করতে যাচ্ছে তুমি?’
‘যাচ্ছি’ শান্ত স্বরে বলল হ্যালার্ড। ‘কারণ তার সময় হয়েছে।’ ‘বাহু, শুনে খুশি হলাম। সচেতন নাগরিক তুমি। আমরা কিন্তু জানি কিভাবে সচেতন নাগরিকের প্রশংসা করতে হয়। কি বলো, ছেলেরা, জানি না?’
পৃষ্ঠা-৯৪
উত্তর দিল না কেউ। ‘ড্রিঙ্ক করবে নাকি, মার্শাল? তেষ্টা পেয়েছে?’ হেসে জানতে চাইল সে। একসঙ্গে ড্রিঙ্ক করে উপলক্ষটা উদ্যাপন করা যাক…’ ‘ ‘নাহ্। তোমরা চালাও, ডিউটির সময় ড্রিঙ্ক করি না আমি।’ ‘চলো, একসাথে পান করব সবাই, সহজ সুরে প্রস্তাব করল সে। ‘প্রথমদিন টহলে বেরিয়েছ। এক রাউন্ড ড্রিঙ্ক করলে এমন কিছু যাবে-আসবে না, মি. হ্যালার্ড। এমন কোন ল-ম্যানের কথা আমি শুনিনি যারা টহলে বেরিয়ে পান করে না।’ ‘ইচ্ছে নেই।’ ‘ভাল কথা বলছ না তুমি, মার্শাল, অভিযোগের সুরে বলল গ্রীন। ‘নাকি আমার সাথে ড্রিঙ্ক করতে খারাপ লাগবে তোমার? হয়তো আমরা অত উঁচু দরের
লোক নই, তেমন কোন সহায়-সম্পত্তিও নেই আমাদের কিন্তু আমরা ভাল লোক। আশা করছি আমাদের সঙ্গে ড্রিঙ্ক করবে তুমি। না হয় এক চুমুকই দেবে।’ ‘দুঃখিত,’ কঠিন গলায় বলল হ্যালার্ড। ‘বলেছি তো ডিউটির সময় ড্রিঙ্ক করি না আমি। কাল আমার সঙ্গে দেখা কোরো তোঁমরা। একটা বোতল কিনে দেব তোমাদের। এখন যাচ্ছি, কাজ আছে আমার।’
‘দাঁড়াও।’ পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে, স্পষ্ট, টের পেল হ্যালার্ড। নিকোলাস গ্রীনের দিকে তাকাল ও। রাস্তার ওপাশে দাঁড়ানো ক্রেম ব্রেস এগিয়ে আসছে এখন, পিছু নিয়েছে জাড ভেন্ট্রি। অদূরে এক দালানের পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা ড্যানি লসন বুঝতে পারল কি চলছে মার্শালের মনে-কি করব আমি-কিন্তু চিন্তা-ভাবনার সময় নেই হাতে। ইতোমধ্যে দেরি হয়ে গেছে, হ্যালার্ডের এক্ষুণি সরে পড়া উচিত ‘তুমি নিশ্চয়ই এড়িয়ে যাবে না আমাদের?’ বিদ্রূপ আর তাচ্ছিল্য গ্রীনের কণ্ঠে। ‘তোমার সঙ্গ তো কখনও পাইনি আমরা, একবার পেয়েছি যখন সহজে ছাড়তে রাজি নই।’
‘আমার মনে হয় সবার সঙ্গে ড্রিঙ্ক করাই উচিত তোমার, মার্শাল,’ হ্যালার্ডের কাঁধে একটা হাত রাখল ক্রেম ব্রেস। ‘সেটাই ভাল দেখাবে।’ এক ঝটকায় হাতটা সরিয়ে দিল হ্যালার্ড। ‘আহ্-হা, তুমি দেখছি খুব স্পর্শকাতর! নিজেকে আমাদের জন্যে কি যথেষ্ট ভাবো তুমি, মি. হ্যালার্ড?’ ‘যথেষ্ট হয়েছে।’ কঠিন স্বরে বলল মার্শাল। ‘সরে যাও সবাই!’ হেসে উঠল একজন। ‘মার্শাল ঠিকই বলেছে, নিক। চলো, যাওয়া যাক। এ শহরে একজন ভাল মার্শাল দরকার। ও যোগ্য।’ ‘তুমি চলে যাও, আমি দেখছি,’ নিরুত্তাপ স্বরে সঙ্গীর উদ্দেশে বলল নিকোলাস গ্রীন। ‘বোঝা যাচ্ছে আমাদের মত লোক পছন্দ নয় ওর। কিন্তু একটা ব্যাপার কি জানো, আমিও কাউকে ড্রিঙ্ক অফার করে হতাশ হইনি কখনও।
পৃষ্ঠা-৯৫
সুতরাং তুমি আমার সাথে ড্রিঙ্ক করছ, মার্শাল!’ ‘ঝামেলা কোরো না, গ্রীন। অযথাই বিরক্ত করছ আমাকে। নিজের কাজে যাও।’ ‘কখন তোমাকে বিরক্ত করলাম!’ বিস্মিত দেখাল তাকে। তারপর হেসে উঠল চড়া স্বরে।। ‘যাকগে, চলে এসো মার্শাল। এই শেষবার বলছি। আমার সাথে ড্রিঙ্ক করলে তোমার ব্যাজের, অপমান হবে না। নাকি হবে?’ জেফরি হ্যালার্ড অস্বীকার করুক, তাই চায় লোকটি। তর্কটা তাহলে আরও এগিয়ে নিতে পারে গ্রীন, এবং একটা মওকা পেয়ে যাবে। ঠিক কি বলবে ভেবে পেল না হ্যালার্ড, আনমনে কাঁধ উঁচাল। কষ্ট করে নিজেকে’ ভাবলেশহীন রাখার চেষ্টা করছে, কিন্তু প্রায় অসহায় বোধ করছে। চকিতে পেছনে পায়ের শব্দ পেল, হ্যালার্ডের মনে হলো অন্তত তিনজন লোক ফিড স্টেবলের পাশের গলি থেকে
বেরিয়ে এসেছে। ‘কি ঠিক করলে, যাবে?’ ফের জানতে চাইল গ্রীন, হাসছে। ‘না!’ ‘উইলি,’ হ্যালার্ডের পেছনে কারও উদ্দেশে বলল সে। ‘ওকে জোর করে নিয়ে এসো তো। আমাদের মত লোকের সাথে ড্রিঙ্ক করতে নাকি ওর রুচিতে বাধছে। সেলুনে নিয়ে চলো, দেখি কয়েক ঢোক পান করার পর ওর মত বদলায় কিনা।’ পেছনে পায়ের শব্দ পেল জেফরি হ্যালার্ড, অন্তত তিনজন, ধারণা করল। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। ঘুরে তাকানোর ইচ্ছে বহু কষ্টে দমন করল সে। সরাসরি তাকাল গ্রীনের উদ্ধত চোখে। প্রচ্ছন্ন কৌতুক লোকটির চাহনিতে, মার্শালের বেসামাল অবস্থা চুটিয়ে উপভোগ করছে। হ্যালার্ড অনুভব করল গলা শুকিয়ে আসছে ওর, বুক ধড়ফড় করছে। সাহস দেখাতে গেলে নিজেই বিপদে পড়বে, এটুকু বোঝার ক্ষমতা আছে ওর। অথচ লোকগুলো সেটাই চায়, একটা ছুঁতোয় ওর ওপর হামলে পড়তে চাইছে। জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভেজাল ও, ঢোক গিলল। তারপর নিকোলাস গ্রীনের দিকে তাকাল। ‘তোমার মতলবটা কি, গ্রীন? আমাকে খারাপ কিছু করতে বাধ্য কোরো না।’
‘খারাপ কিছু, সেটা আবার কি?’ হেসে উঠল সে, কোমরের কাছে চলে গেছে হাত। ‘তুমি একটা আস্ত বেকুব, হ্যালার্ড! মার্শাল হতে যোগ্যতা লাগে, কিন্তু এটুকু বোঝার মত বুদ্ধিও নেই তোমার। আনাড়ী একজন লোক যদি কোমরে পিস্তল ঝোলায় তাকে দেখে করুণা হয় সবার, তোমার প্রতি আমারও তাই হচ্ছে এখন। তবে একটা কথা কি জানো, পিস্তল হাতে থাকলে আনাড়ী লোকও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। সুতরাং,’ হেসে উইলির দিকে তাকাল ও। ‘কই, নিয়ে এসো আমাদের মার্শালকে! একসাথে পান করার ফাঁকে পরিচয়টা হয়ে যাক।’ হ্যালার্ড টের পেল ওর হোলস্টার থেকে পিস্তল তুলে নিয়েছে কেউ। ‘এবার ভদ্রলোকের মত এগোও, মার্শাল!’ পেছন থেকে সিক্সগানের নলের খোঁচায় তাগাদা দিল উইলি। অসহায় বোধ করছে হ্যালার্ড। বুঝে উঠতে পারছে না ঠিক কি করা উচিত।
পৃষ্ঠা-৯৬
অনুভব করল কঠিন এক পরিস্থিতিতে পড়েছে। আড়চোখে সিড হ্যামারটনের স্টোরের দিকে তাকাল, দাঁড়িয়ে থেকে তামাশা দেখছে দুই ভবঘুরে। চাপা আনন্দ ওদের চোখে-মুখে, যেন দারুণ মজার কোন ব্যাপার ঘটছে এখানে। ‘ভয় পাচ্ছ নাকি, মার্শাল?’ ফোড়ন কাটল গ্রীন, তারপর ঘুরে এগোল সেলুনের দিকে। ‘নিয়ে এসো তো ওকে, আমাদের সাথে পান না করে যাবে কোথায়! আজ হুইস্কিতে ওর পেট ভরে দেব।’ ‘কোথাও যাচ্ছ না তুমি, গ্রীন।’ শীতল একটা কণ্ঠ শোনা গেল রাস্তার ওপাশে। ‘অন্তত মার্শালকে নিয়ে!’
ঝট করে ঘুরল নিকোলাস গ্রীন, ছোবল মেরেছে হোলস্টারে। আতঙ্ক নিয়ে দেখল হ্যালার্ড, পিস্তলটা উঠে আসছে বিদ্যুৎ বেগে। গলার শব্দে প্রতিপক্ষের অবস্থান আঁচ করে নিয়েছে গ্রীন। চরকির মত আধপাক ঘুরল সে, রাস্তার উল্টোদিকে তাকাল। ফিড স্টেবলের পাশের গলিতে চাপ চাপ অন্ধকার। ওখানে কিছুই দেখতে না পেয়ে খানিকটা বিহ্বল হয়ে পড়ল গ্রীন। হাতের পিস্তল উঁচিয়ে ধরে থাকল। ‘ঠিক চিনতে পেরেছি তোমাকে, ড্যানি লসন!’ তপ্ত আক্রোশে তড়পে উঠল সে। ‘সামনে এসো, লসন! সাহস দেখাও, বাছা!’ অন্ধকারের মধ্যে একটা ছায়া নড়ে উঠল। তা দেখে গুলি চালাল গ্রীন, আগুনের স্ফুলিঙ্গ দেখা গেল ওদিকে। বুকে গুলির তীব্র ধাক্কায় টলে উঠল ওর শরীর। দড়াম করে আছড়ে পড়ল পোর্চের ওপর। এদিকে ওর তিন সঙ্গীও পিস্তল বের করে ফেলেছে। মুহুর্মুহু গুলির শব্দে মুখর হয়ে উঠল জায়গাটা। গান পাউডারের কটু গন্ধে ভারী হয়ে এল বাতাস। স্থবির’ দাঁড়িয়ে আছে হ্যালার্ড, কি করবে বুঝতে পারছে না। পাশে তাকিয়ে দেখল ধুলোর মধ্যে নিথর পড়ে আছে গ্রীনের দুই সঙ্গী। পেট চেপে ধরে ককাচ্ছে অন্যজন। সীমাহীন অবিশ্বাসের সাথে লাশগুলো দেখল ও, ঢোক গিলে শুকনো মুখ আর গলা ভেজানোর চেষ্টা করল। তারপর পাশ ফিরে কিছুটা পেছনে, রাস্তার উল্টোদিকে তাকাল। নিকষ অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে ড্যানি লসন, তবে বাড়ির ছায়া পড়েছে ওর ওপর, এবং পেছনে নিরেট দেয়ালের গাঢ় পটভূমিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না ওকে। সতর্ক পায়ে দুই কদম পাশে সরে গেল সে, প্রায় নিঃশব্দে। চারপাশে চোখ বুলিয়ে প্যান্টের পকেট হাতড়ে বুলেট বের করল, একেবারেই নির্বিকার, নিরুদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে ওকে। পিস্তল রিলোড করার ফাঁকে আড়চোখে একবার দেখে নিল হ্যালার্ডকে। ‘লিও ব্র্যাক, ছাদ থেকে নেমে এসো,’ আবারও চেঁচাল ড্যানি লসন। ‘আমাকে ছাদে উঠতে বাধ্য কোরো না। রাইফেলটা আগে নিচে ফেলে দাও।’ শুধুমাত্র জনি বিয়ান্দাই রয়ে গেছে অন্ধকারে’। ‘তুমি ব্লাফ দেবে, আর শুনেই চলে যাব আমরা, লসন?’ বিদ্রূপের স্বরে জানতে চাইল সে। নিরুত্তর থাকল লসন, মুখটা দৃঢ় হয়ে গেছে। অন্ধকারে কমলা আগুন ওগরাল ওর হাতের পিস্তল। ধূলিময় রাস্তায় লুটিয়ে পড়ল জনি বিয়ান্দা। কষ্টেসৃষ্টে উঠে
পৃষ্ঠা-৯৭
দাঁড়ানোর চেষ্টা করল সে, কিন্তু পারল না। উল্টোদিকের বাড়ির ছাদে উঠে দাঁড়াল এক লোক, হাতের রাইফেল ছুঁড়ে দিল সে। সেকেন্ড খানেক পর রাস্তায় পড়ল রাইফেলটা। এর ঠিক দুই মিনিট পর রাস্তায় দেখা গেল লিও ব্র্যাককে, আলোয় এসে দাঁড়িয়েছে সে। চোখে খুনের নেশা, ধীরে ধীরে এগোল সে। পড়ে থাকা রাইফেলটা পাঁচ হাত দূরে। ‘আমার বন্ধুকে মেরেছ তুমি!’ বিষাদ বা শোক কোনটাই নেই লিও ব্র্যাকের স্বরে, স্রেফ প্রতিহিংসা ঝরে পড়ছে কণ্ঠে। ‘এ জন্যে তোমাকে খুন করব আমি, লসন!’ ‘বেশ তো! যাও, রাস্তা থেকে রাইফেলটা তুলে নাও। যাচ্ছ না কেন, লিও? রাইফেল তোলো!’ ‘সত্যি-সত্যি বলছি, তোমাকে খুন করব আমি।’ ‘বলছি তো। রাইফেল ওঠাও, লিও। নইলে যেখানে দাঁড়িয়ে আছ সেখানেই গুলি করে ফেলে দেব তোমাকে।’ কিন্তু ইতস্তত করছে লিও ব্র্যাক। পরমুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়ে রাইফেল তুলে নিল। ভেবেছিল গুলি করবে লসন, কিন্তু তেমন কিছুই ঘটল না। রাইফেল হাতে উঠে দাঁড়াল সে, বেপরোয়া হয়ে উঠেছে পুরোপুরি।
দেয়ালের সঙ্গে ঠেস দিয়ে রাখা রাইফেলটা আলতো হাতে তুলে নিল লসন, কোমরের কাছে ধরে রেখে ধীর পদক্ষেপে রাস্তার আলোকিত অংশে এসে দাঁড়াল। ‘আমাকে খুন করতে চাও, লিও? এই তো, তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছি, সুযোগ পেয়েছ তুমি। গুলি করো!’ দু’চোখে অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে থাকল লিও ব্র্যাক। কোমরের কাছে ধরে আছে রাইফেলটা। লসনের রাইফেলও একই অবস্থানে, তবে নিচু হয়ে আছে ওটার নল। অজান্তে ঘাম জমতে শুরু করেছে মন্টানার গানম্যানের কপালে। সুযোগ, ড্যানি লসনকে শেষ করে দেয়ার এই হচ্ছে সুবর্ণ সুযোগ! ‘কি হলো, লিও? এই না বললে খুন করবে আমাকে, ভুলে গেছ নাকি? গুলি করো, নইলে আবার রাইফেল ফেলে দাও, এবং কাল সূর্য ওঠার আগেই এ শহর ছাড়বে, নইলে দেখামাত্র তোমাকে গুলি করব আমি।’
ধীরে ধীরে রাইফেল তুলছে ব্র্যাক, ভেতরে ভেতরে যেন ভূমিকম্পের তাড়নায় অস্থির বোধ করছে। ড্যানি লসনের দিকে তাকাল সে, মানুষটার মুখে মজা পাওয়ার হাসি দেখে গা জ্বলে উঠল ওর। আরও ইঞ্চি দুয়েক উঠাতে হবে রাইফেলটা, তারপর…। কিন্তু হঠাৎ থরথর করে কেঁপে উঠল সে, রাইফেলটা পড়ে গেল শিথিল মুঠি থেকে। অজান্তে মুখ নিচু করে ফেলল। শেষ হয়ে গেছে সে। আজ রাতেই শহর ছেড়ে চলে যাবে। ধীরে ধীরে পিছিয়ে গেল লিও ব্র্যাক, রক্তশূন্য দেখাচ্ছে মুখটা। আচমকা ঘুরে দাঁড়াল সে, তারপর ছুটে হারিয়ে গেল গলির অন্ধকারে। চারপাশে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি চালাল লসন, অন্ধকার গলি আর বাড়ির ছায়াগুলো যেন ভেদ করে গেল ওর শ্যেনদৃষ্টি। শেষে, নিশ্চিন্ত হয়ে রাস্তায় ফিরে এল ওর নজর। পড়ে থাকা লাশগুলো দেখে অজান্তে দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তারপর রাইফেলটা হাত
পৃষ্ঠা-৯৮
বদল করে ফিরল জেফরি হ্যালার্ডের দিকে। ‘ওখান থেকে সরে এসো, হ্যালার্ড,’ মৃদু স্বরে বলল ও, ‘তারাটা খুলে সোজা ক্রেইমে ফিরে যাও।’ মাথা নাড়ল স্কুল শিক্ষক, পুরো শরীরই যেন জমে গেছে। ‘ও ঠিকই বলেছে, জেফ, ফিড স্টেবলের দিক থেকে ভেসে এল জো হারপারের কণ্ঠ। ‘ওদের বেয়াড়াপনার উপযুক্ত জবাব তোমার কাছে নেই, কথাটা অপ্রিয় হলেও সত্যি।’ ‘সত্যি কথা বলতে কি, এই চাকুরিটা চাইনি আমি, কিন্তু পরিস্থিতিই বাধ্য করেছে আমাকে। জেফরি হ্যালার্ডের মত ভাল মানুষ ওই অবস্থায় পড়ক, তাও আমি চাই না। ইচ্ছে করলে ব্যাজটা দিতে পারো আমাকে,’ হোলস্টারে পিস্তল ঢোকানোর সময় বলল লসন। ‘এখন থেকে এই শহর আমিই চালাব। যতদিন জেরেমি টাউন পরিষ্কার না হচ্ছে, ততদিন ওই ব্যাজ আমার পকেটে থাকবে।’ ‘এতক্ষণে একটা কাজের কথা বলেছ, লসন!’ উৎফুল্ল স্বরে বলল জো হারপার। ‘ডেপুটির দরকার হবে তোমার, ড্যান,’ হালকা সুরে বলল সাংবাদিক, গলি থেকে বেরিয়ে এসেছে হারপারের পিছু পিছু। ‘না, দরকার নেই।’
উইলির ভূপতিত দেহের কাছে গিয়ে দাঁড়াল হ্যালার্ড। নিজের পিস্তল উদ্ধার করে স্খলিত পায়ে এগোল ল-অফিসের দিকে। কারও দিকে তাকাল না সে, সরাসরি ভেতরে ঢুকে চুলোয় কফির পানি চড়াল। চেয়ারে বসতে দেখল লসন আর হারপার ঢুকছে। ‘ধন্যবাদ তোমাকে, লসন।’ ‘এটা তোমার রাস্তা নয়, হ্যালার্ড। ওরা খারাপ মানুষ, ভাল কথা বলে ওদের সঙ্গে পাত্তা পাবে না কেউ। ওদেরকে বশে রাখতে হলে ওদের মন্ত্রই ওদেরকে ফেরত দিতে হবে। তুমি সেটা পারবে না।’ ‘হয়তো ঠিকই বলেছ তুমি,’ মৃদু স্বরে বলল হ্যালার্ড, তবে কণ্ঠে সন্দেহ প্রকাশ পেল না। আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বসে থাকল চেয়ারে, কোন ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করল না। স্টোভের দিকে এগোল জো হারপার। সারা ঘরে ধুলোর আস্তর দেখে বিড়বিড় করে বিরক্তি প্রকাশ করল। হারপার কফির আয়োজন করছে, এই ফাঁকে ড্রয়ার থেকে একগাদা পোস্টার বের করে টেবিলে রাখল লসন। তবে দেখার আগ্রহ নেই ওর। রক্স, কিনকেড, থমসন…দু’একজন বাদে প্রায় সবারই চেহারা আছে কোন না কোন পোস্টারে, জানে ও; আর এদের প্রত্যেককেই চেনা আছে ওর-জেসি ওয়েনের মত যারা ওয়ান্টেড নয়, তাদেরও। অযথা সময় নষ্ট করার কোন মানে হয় না। ‘কিভাবে এগোবে, ভেবেছ কিছু?’ কেতলিতে কফির গুঁড়ো ছিটিয়ে দেয়ার সময় জানতে চাইল হারপার। ‘ঠিক করিনি এখনও।’ ‘মার্শালগিরি তোমার খুব সুখে কাটবে এ কথা বলতে পারছি না। এখানে
পৃষ্ঠা-৯৯
খারাপ লোকের সংখ্যাই বেশি।’ আনমনে মাথা ঝাঁকাল লসন। মোটামুটি নতুন দেখে একটা পোস্টার তুলে নিয়ে উল্টোপিঠে বিজ্ঞপ্তি লিখতে শুরু করল। কয়েকটা লেখার পর কফিতে চুমুক দিল। ‘ঠিক কি করতে চাইছ তুমি?’ পোস্টারের’ লেখায় চোখ বুলিয়ে কৌতূহলী স্বরে জানতে চাইল হারপার। ‘নিশ্চয়ই আশা করছ না বললেই শহর ছেড়ে চলে যাবে ওরা?’ ‘তা যাবে না। কেউ কেউ তো আমলই দেবে না, বরং রীতিমত বিদ্রোহ করে বসবে। শুরুতে খানিকটা ঝামেলা হবে। তবে কয়েকজনকে কোণঠাসা করতে পারলে পরের কাজটুকু সহজ হয়ে যাবে। হয় শান্তিতে থাকবে, নয়তো শহর ছাড়বে ওরা।’ ‘প্রার্থনা করছি যেন ওদের মাথায় শুভ বুদ্ধির উদয় হয়।’
পৃষ্ঠা-১০০
নয়:- ঠিক দুই ঘণ্টা পর জ্যাক চেম্বারল্যান্ডের সেলুনের দেয়ালে প্রথম নোটিশটা টানাল ড্যানি লসন।চোর ডাকাত, খুনী এবং জোচ্চোর জুয়াড়ীদের একটা তালিকা দেয়া হলো নিচে। এদের কাউকে জেরেমি টাউনের প্রয়োজন নেই। অচিরেই শহর ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে এদের, নইলে দেখা মাত্র গুলি করা হবে।
পরদিন, সকালে জিম কেলি যখন নোটিশটা দেখছিল, পেছন থেকে একজন তার সঙ্গীকে বলল: ‘চলো হে, এবার মানে মানে কেটে পড়ি!’ ‘কি ব্যাপার, ভয় পেয়েছ নাকি?’ সন্দিহান সুরে জানতে চাইল কেলি। ‘পেয়েছি বৈকি। ড্যানি লসন কিভাবে শহর পরিষ্কার করে, তুমি তো জানো না, আমি জানি। সেজন্যেই কেটে পড়ছি। তালিকার প্রত্যেককে খুঁজে বের করবে ও, প্রথমে হয়তো মনে করিয়ে দেবে নির্দেশটা। কিন্তু কেউ যদি বেতাল কিছু করে, কিংবা যদি ওর কথা না শোনে-স্রেফ নরক নামিয়ে আনবে সে। নির্দিষ্ট সময় পেরোনোর পর কাউকে ছাড় দেবে না ও, কোন অজুহাতও শুনবে না। ওর ধাতটাই এমন। একজনের পর একজনকে ধরবে।’
সকাল থেকেই সারা শহরে চক্কর মারছে ড্যানি লসন। চোখে সতর্ক দৃষ্টি, কান খাড়া। প্রতিটি ইঞ্চি মেপে নিচ্ছে মনে মনে। পথে সাংবাদিকের সঙ্গে দেখা হলো ওর। ‘কেমন চলছে, ডিক?’
পৃষ্ঠা ১০১ থেকে ১২০
পৃষ্ঠা-১০১
‘ভাল। তুমি যখন দায়িত্ব নিয়েছ, সবকিছু তখন ভাল ভাবে চলা উচিত।’ ‘সমস্যায় পড়লে আমাকে খবর দিয়ো।’ ‘ধন্যবাদ, ড্যান। তবে আমার সমস্যা আমিই সামলাতে চেষ্টা করব।’ পত্রিকা অফিসের কিছু দূরে পাশের এক গলিতে ডানা সুলিভানের ঘর। মেয়েটা সুন্দরী এবং আকর্ষণীয় ছিল একসময়। এখন পড়তির দিকে ওর শরীর। ‘তোমার বিরুদ্ধে আউট-লদের সহযোগিতা করার কিছু অভিযোগ আছে, ডানা। তোমাকে সরে পড়তে হবে।’ নির্বিকার মুখে তাকিয়ে থাকল মেয়েটা, তারপর ক্ষীণ হাসল। ‘কিন্তু এ শহরের অনেকেই যে চায় থাকি আমি, সেক্ষেত্রে তুমি কি করবে, লসন?’ ‘তালিকায় ওদেরও নাম আছে, ডানা, সবাই এ শহর ছাড়বে ওরা।’‘থমসন তোমাকে মেরে ফেলবে, লসন।’‘হতে পারে। থমসনেরও নাম আছে তালিকায়।’বলে আর দাঁড়াল না লসন। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ঘুরতে শুরু করল। জ্যাক চেম্বারল্যান্ডের সেলুনে ঢুকল ও এবার। বৈধ-অবৈধ সব উপায়ে মাইনারদের ঠকিয়ে দু’হাতে পয়সা কামাচ্ছে লোকটা, এমনকি ব্যবসায়ী বা ভবঘুরেরাও রেহাই পাচ্ছে না। সারা জেরেমি টাউনে সবচেয়ে চড়া দামের হুইস্কি বিক্রি হয় এখানে, পোকার টেবিলে নিয়মিত জোচ্চুরি হয়। একপাশে ড্যান্স হল তৈরি করেছে চেম্বারল্যান্ড, মন্টানা থেকে তিনটে মেয়েকে আনিয়েছে। রক্স, কিনকেড আর থমসনের সঙ্গে বিশেষ খাতির আছে লোকটার।‘তালিকাটা পড়ে দেখো,’ জ্যাক চেম্বারল্যান্ডকে বলল লসন। ‘সম্ভবত তোমার নামও আছে।’দাঁত কেলিয়ে হাসল চেম্বারল্যান্ড। ‘থাকুক কিন্তু অপেক্ষা করব বলে ঠিক করেছি আমি। যতক্ষণ না থমসন তোমার দফা রফা করছে, ততক্ষণ পর্যন্ত থাকছি আমি।’‘বেশ, অপেক্ষা করো। কিন্তু আগেই বলে রাখছি, থমসনকে পিটিয়ে শেষ করার পর তোমার মুখ আর দেখতে চাই না। দেখলে তোমারও একই অবস্থা করে ছাড়ব।’পেছনে উচ্চস্বরে হেসে উঠল চেম্বারল্যান্ড, কিন্তু ভ্রূক্ষেপ করল না লসন। বাইরে এসে রাস্তায় নামল। দেখল জিম কেলির সঙ্গে কথা বলছে আরও দু’জন। হঠাৎ করেই পেছনে চেনা একটা কণ্ঠ শুনতে পেল ও।
আইক জেসাপ।ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল লসন। ঠিক রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে বিশালদেহী জুয়াড়ী, ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। পথচলা লোকজন দাঁড়িয়ে গেছে, কৌতূহল শেষে কি ঘটবে।আঙুল তুলে নোটিশটা দেখাল জেসাপ। ‘আমার নাম তালিকায় দেখছি না যে, লসন? ব্যাপার কি?’ ‘কারণ তুমি ভদ্রলোক, জেসাপ। তাসে তোমার হাত অসম্ভব রকম ভাল, কিন্তু এই অহঙ্কার বিসর্জন দাওনি তুমি, খেলায় চুরি করোনি কখনও।’
পৃষ্ঠা-১০২
মুখটা পাথরের মতই নির্বিকার, বোঝা গেল না লসনের কথায় কি প্রতিক্রিয়া হয়েছে, কিন্তু আইক জেসাপ যখন কথা বলল সামান্য বিস্ময় ফুটে উঠল স্বরে। ‘তুমি আমাকে ভদ্রলোক বলেছ, ড্যান?” ‘তুমি কি তা নও, জেসাপ? পাঁচ-ছয় বছর ধরে চিনি তোমাকে। আমার জানা মতে এ সময়ে অন্য কিছুই করোনি তুমি। তাস খেলেছ কিন্তু চুরি করোনি। যাও, নিশ্চিন্তে তোমার ব্যবসা চালাও, তবে নিতান্ত বাধ্য না হলে কাউকে গুলি কোরো না।কথা শেষ করে এক মুহূর্তও দাঁড়াল না লসন।স্থির দৃষ্টিতে পেছন থেকে নতুন মার্শালকে দেখল আইক জেসাপ, ভুরু কুঁচকে গেছে। ধীরে ধীরে সিধে হলো ভুরু, স্মিত হাসি ফুটল জুয়াড়ীর নিষ্ঠুর ঠোঁটের কোণে। ঝটিতি ঘুরেই নিজের সেলুনে ঢুকে পড়ল সে।জুয়াড়ীরা অপেক্ষা করছিল ওর জন্যে। একসঙ্গে চোখ তুলে তাকাল সবাই। ‘মার্শালের সঙ্গে কি কথা হলো, নিশ্চয়ই শুনেছ তোমরা?’ নিরুত্তাপ স্বরে বলল জেসাপ। ‘বুঝতেই পারছ কি করা যাবে, আর কি করা যাবে না। যদি এরপরও খেলতে বসে কেউ দুই নম্বরী করতে চাও, তাহলে আমার কাছে জবাবদিহি করতে হবে তাকে। বুঝেছ? জুয়া চলবে এখানে, কিন্তু ফেয়ার হবে খেলাটা। একটা টেবিলের পেছন থেকে উঠে দাঁড়াল ম্যানেন ব্লেজ নামের এক লোক। ‘এই আসর ছেড়ে চলে যাচ্ছি আমি, নিজেই একটা আসর বসাব। আর নিজের ইচ্ছেমত চালাব সেটা।’
চেষ্টা করে দেখতে পারো।’
‘ ‘আর ড্যানি লসন সম্পর্কে বলছি। ওর নামই শুধু শুনেছি, কিন্তু ওর গুলিতে মরেছে এমন কারও কবর দেখিনি আমি।’ স্মিত হাসল আইক জেসাপ ‘দেখবে, ব্রেজ, নিশ্চয়ই দেখবে।’ পিস্তলে আদুরে চাপড় মারল ব্লেজ। ‘দেখাচ্ছি তোমাদের! নিকুচি করি ড্যানি লসনের, সে কে যে তার কথা শুনতে হবে?’ দ্রুত বেরিয়ে গেল সে। সিও হ্যামারটনের জেনারেল স্টোরের পোর্চে জিম কেলির সঙ্গে কথা বলছিল লসন, কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছে কয়েকজন।
রাস্তার মাঝখানে এসে চেচাল রেজ। ‘ড্যানি লসন?’ ফিরল লসন, সরু চোখে দেখল ব্লেজকে। নির্বিকার মুখ দেখে কিছুই বোঝার উপায় নেই। ধীর পায়ে পোর্ট ছেড়ে রাস্তায় নেমে এল ও। তোমার নির্দেশ আমি মানি না, লসন!’ ‘বেশ।’ ‘তুমি এই শহরের কেউ না!’ ‘তো?’ ‘নিজে এই শহর থেকে বেরিয়ে যাবে, নাকি জোর খাটাতে হবে?’ ‘জোর খাটাতে হবে। চেষ্টা করে দেখতে পারো!’ স্মিত হাসল লসন, ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি।
পৃষ্ঠা-১০৩
‘ঈশ্বরের নাম নাও, লসন,’ বিদ্যুৎ-খেলে গেল ব্রেজের হাতে, চোখের পলকে হাতের তালুয় চলে এল জোড়া পিস্তল এবং পরমুহূর্তে রাস্তায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল সে। দু’চোখে অবিশ্বাস। হতে পারে না, এ হতেই পারে না, এত দ্রুত ড্র করতে পারে না কেউ! মৃদু মাথা নাড়ল সে, তারপর চিরদিনের মত ধূলিময় রাস্তায় শুয়ে পড়ল। হোলস্টারে পিস্তল ভরে রাখল ড্যানি লসন। তারপর রাস্তার অন্যদিকে সরে গেল টিম কার্টিস আর রবার্ট অ্যালেনের সঙ্গে। সেলুনের ভেতরে এক ওয়েটারকে ডাকল আইক জেসাপ, বহু কষ্টে হাসি সামলে রেখেছে। ‘বিগবী, কাউকে দিয়ে একটা কবর খোঁড়ো তো, আর কবরের পাশে একটা ফলকে লিখে দিয়ো: এ লোক ড্যানি লসনের বিরুদ্ধে পিস্তল বের করেছিল।’ ‘এবার কি করবে, ড্যান?’ এগোতে এগোতে জানতে চাইল কার্টিস। ‘বড় মাছটাই ধরব এখন। থমসন। প্রথমে তালিকাটা পড়াব ওকে। চূড়ান্ত ফয়সালার আগে ওর সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই।’ আগে ল-অফিসে এল লসন, ডাবল-ব্যারেল শটগানটা তুলে নিল। বেরিয়েম এসে শেইন থমসনের কেবিনের উদ্দেশে এগোল। শহরের একেবারে শেষে থমসনের ডেরা। ছোট্ট কেবিন। একটাই দরজা, কোন জানালা নেই। দরজার কাছে পৌঁছে এক পা পিছিয়ে এল লসন। তারপর গায়ের জোরে লাথি হাঁকাল কবাটের ওপর। লাথি সহ্য করতে পারল না দরজা, হাট হয়ে সরে গেল পাল্লা দুটো। কোমরের কাছে শটগান ধরে রেখে ভেতরে ঢুকে পড়ল ও। বিছানায় শুয়ে ছিল শেইন থমসন, চোখ পিটপিট করছে। পাশেই শুয়ে আছে বেনি ডবিন। কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে খানিকটা উঁচু হলো সে: হতবাক, অবিশ্বাস্য ঘটনায় বিস্ফারিত হয়ে গেছে চোখ জোড়া। ‘উঠে বসো, থমসন জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও। সময় হয়েছে। ‘কি হচ্ছে এসবঃ’ এর্জে উঠল শেইন থমসন, লসনের শার্টের ওপর ব্যাজটা এতক্ষণে চোখে পড়ল তার ‘আচ্ছা এই তাহলে ব্যাপার! আমি তো এজন্যেই অপেক্ষা করছিলাম। খুব দ্রুত কাজ ফরল লসন। শটগানটা প্রয়োজন পড়লেই ব্যবহার করতে পারবে, এমন ভাবে হাতে রেখে এক হাতে খামচে ধরল থমসনের শার্ট, তারপর হ্যাঁচকা টানে তাকে তুলে আনল বিছানা থেকে। মেঝেয় আছড়ে ফেলল। মুহূর্তের জন্যে হকচকিয়ে গেল খিশালদেহী, তারপর উঠে দাঁড়াল। ‘এসো, থমসন, বাইরে এসো,’ আউট-লর পেটের দিকে শটগান তাক করে বলল লসন। ‘কোথায়?’ ‘রাস্তায়। তুমিও এসো, ডবিন। ভুলেও অন্য কিছু করার চিন্তা কোরো না, এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেব তাহলে।’ কঠিন চোখে তাকাল থমসন, বুনো আক্রোশ দেখা যাচ্ছে চাহনিতে। ‘একটা
পৃষ্ঠা-১০৪
সুযোগ দাও আমাকে, তারপর দেখব কে কাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে!’ ‘ম্যানেন ব্লেজও তাই ভেবেছিল।’ ‘রেজ!’ থমকে গেল থমসন, ঘনিষ্ঠ বন্ধু সে ওর। ‘মারা গেছে ও।’ ‘এসবই তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম আমি, শেইন,’ বলল বেনি ডবিন। ‘কিন্তু যে পরিমাণ গিলেছ, আমার কথা শোনার সময় কোথায়! কাল রাতে নিকোলাস গ্রীনকেও খুন করেছে ও।’
মুহূর্ত কয়েক নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকল শেইন থমসন। তারপর ভারী পা ফেলে কেবিনের বাইরে চলে এল। পেছনে বেনি ডবিন। বাইরে তখন ডজন দুয়েক লোক জটলা বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে, তামাশা দেখছে। রাস্তার মাঝখানে দুই বন্দীকে হাঁটিয়ে নিয়ে এল লসন। চারপাশে ভিড় ক্রমশ বাড়ছে। ‘সরে গিয়ে জায়গা দেবে এদের, তালিকাটা দেখুক ওরা?’ জনতার উদ্দেশে বলল লসন। খেয়াল করল ভিড়ের মধ্যে জেফরি হ্যালার্ড, কার্টিস আর ডিক ফেল্টনও রয়েছে। একজনের হাতে রাইফেল, দু’জনের হাতে শটগান। ‘খুব বাহাদুরি দেখাচ্ছ, না? শটগান হাতে নিরস্ত্র লোকের সঙ্গে?’ গানবেল্ট খুলে ফেলল লসন, পিস্তল সহ জোড়া হোলস্টার ডিক ফেল্টনের হাতে তুলে দিল। ‘লক্ষ্য রেখো যাতে কেউ আমাদের মধ্যে নাক গলাতে না পারে। থমসন খুব গর্ব করে বেড়ায়, ও নাকি দু’হাতে যে কোন লোককে ভেঙে- চুরে দিতে পারে। হয়তো ঠিকই বলে।’ ‘ঠিকই বলে। বাজি ধরতে পারো।’ স্মিত হাসল লসন। ‘কিন্তু আমিও নাছোড়বান্দা মানুষ, কোন কিছু পরখ না করে সিদ্ধান্ত নিই না!’ ঘুরে দাঁড়িয়ে বিশালদেহী তস্করের দিকে ফিরল ও। বুনো আক্রোশে জ্বলজ্বল করছে থমসনের চোখ, আয়েশী ভঙ্গিতে এগিয়ে এল সে; লোকটার চোখের গভীরে তাকিয়ে মনের ভাবনা স্পষ্ট পড়তে পারল লসন-থমসন ভাবছে দারুণ উপভোগ্য একট! মুহূর্ত পড়ে আছে সামনে! দুর্বৃত্তের চলাফেরা স্বতঃস্ফূর্ত, ক্ষিপ্র। বুনো উল্লাসে দু’বাহু ঝাঁকাল সে, কিলবিল করে উঠল পুরুষ্টু পেশী; ভঙ্গিটায় স্পষ্ট বোঝা গেল পেশাদার লড়িয়ে সে, বহুবার আসুরিক শক্তি নিয়ে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে, কৌশল বা মগজ না খাটাক, স্রেফ গায়ের জোরেই যে কাউকে টলিয়ে দিতে সক্ষম। প্রথম আঘাতটা লসনই করল। ঝটিতি ডান হাত চালাল ও। ঘুসিটা গিয়ে পড়ল শেইন থমসনের মুখে। কেঁপে উঠল বিশালদেহ। যতটা অবাক হয়েছে, তারচেয়ে যেন ব্যথাই বেশি পেয়েছে সে। হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে ঠোঁটের রক্ত মুছল, স্থির দৃষ্টিতে তাকাল ওর দিকে। তারপর দু’হাত বাড়িয়ে ঝুঁকে এল। থমসন ভেবেছিল সরে যাবে লসন, কিন্তু উল্টো দু’বাহুর ফাঁকে ঢুকে পড়েছে ও। পরপর দুটো জবর ঘুসি হাঁকাল পেটে। পরমুহূর্তে একটা আপারকাট খেয়ে টলে উঠল থমসন। খালি হাতের মারপিটে বহু দিন ধরে অভ্যস্ত থমসন। ঘুসি সে আগেও খেয়েছে, আক্রোশ আর জেদ দিয়ে কিভাবে সেগুলো হজম করতে হয় সে-ও ভাল
পৃষ্ঠা-১০৫
জানা আছে তার। মাথা নিচু করে এগোল এবার। লসন হামলা চালাতে পাল্টা আঘাত করল, পিছু হটতে বাধ্য করল মার্শালকে। সুযোগ পেয়ে বিপুল বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ল থমসন। ঘুসির চোটে শরীর কেঁপে উঠল লসনের। কিন্তু পড়ে যাওয়ার আগে থমসনের থুতনিতে প্রচণ্ড ঘুসি হাঁকাল। ব্যথায় কুঁকড়ে গেল বিশালদেহী গানম্যানের দেহ।
কিছুটা নিরাপদ দূরত্বে থেকে পরস্পরকে নিরীখ করতে থাকল ওরা, ফোঁসফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলছে। আয়েশী ভঙ্গিটা চলে গেছে থমসনের, বুঝতে পারছে মুখে যতই বড়াই করুক লসনকে সহজে কাবু করা যাবে না। মার্শালের ঘুসিগুলো তাতিয়ে তুলেছে ওকে, শীতল আক্রোশ অনুভব করছে দুর্বৃত্ত। ‘আমি তোমাকে মেরে ফেলব, লসন! চিরদিনের মত শেষ করে ফেলব!’ ‘বেশ তো! চেষ্টা করে দেখো।’ নিঃশ্বাস নেওয়ার ফাঁকে বলল লসন। কিছুটা হলেও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে থমসন। বিশাল দেহে অসুরের মত শক্তি, নিজের সামর্থ্য এবং সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন। স্রেফ ঘুসি চালিয়ে এর আগে একজনকে খুন করেছে সে। জানে লসনকে একবার বাগে পেলেই হলো, কাজ সারতে বেশিক্ষণ লাগবে না। চারপাশে লোকজনের ভিড় ক্রমশ বাড়ছে। বিগ থমসনকে হালকা ভাবে নিয়েছিল, হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে লসন। জানত খালি হাতে ভাল লড়িয়ে দুর্বৃত্ত, আশা করেছিল শক্ত লড়াই হবে। কিন্তু লোকটার গায়ে এমন দানবীয় শক্তি থাকবে কিংবা এত ক্ষিপ্রতা আশা করেনি। সতর্ক ভঙ্গিতে বৃত্তাকারে ঘুরছে ওরা। চাইছে আগে অন্যজন আক্রমণ করুক। ড্যানি লসন নিজেও শক্ত কাঠামোর মানুষ, অবশ্য থমসনের চেয়ে অন্তত ষাট পাউন্ড কম ওজন ওর। খালি হাতে লড়াই করার অভিজ্ঞতা আছে। এতদিন জানত বিশাল দেহ থাকলে লড়তে হয় কম, কারণ শারীরিক সুবিধের কারণে অন্যরা সাধারণত এদের এড়িয়ে চলে; কিন্তু ছোট শরীরের লোকদের আত্মরক্ষার খাতিরে খালি হাতে মারপিট করতে হয় বেশি; সুতরাং তুলনামূলক ভাবে এরাই বেশি কৌশল জানে। কিন্তু বিশালদেহী শেইন থমসনের ক্ষেত্রে কথাটা খাটে না। শরীরটাই কেবল বিশাল নয় ওর, বরং লড়াইয়ের খুঁটিনাটি সব কৌশলই জানা আছে। হঠাৎ থেমে এক পা পিছিয়ে এল লসন, তারপর আগে বেড়ে ঘুসি হাঁকাল থমসনের পেটে। অভিজ্ঞতা থেকে ও জানে চিবুক বা চোয়ালে ঘুসি খেলে সহ্য করতে পারে অধিকাংশ মানুষ, কিন্তু পেটে ক্রমাগত ঘুসি খেলে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে খুব কম লোক।
ঘুসি মেরেই সরে এল ও। এবার ভান করল থমসন, পড়ে যাচ্ছে যেন, আধচক্কর ঘুরেই ঝটিতি ডান হাত চালাল। বাতাস কাটার শব্দ হলো, কিন্তু মাথা নিচু করে সময়মত সরে যেতে সমর্থ হলো লসন, সরে যাওয়ার ফাঁকে বাম হাত চালাল। থমসনের পাঁজরে ওর হাতটা ছুঁয়ে গেল কি গেল না, চোখ বড়বড় হয়ে গেল বিশালদেহীর, সশব্দে দম নিল সে। এই সুযোগে এগিয়ে এল লসন। ক্রমাগত কয়েকটা ঘুসি হাঁকাল থমসনের মুখে। নুয়ে পড়তে পড়তে ওর কোমর
পৃষ্ঠা-১০৬
জাপটে ধরল তস্কর। বিশাল দুই বাহু দিয়ে চাপ দিচ্ছে। অসহ্য ব্যথায় চোখে অন্ধকার দেখল লসন, দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা হজম করার চেষ্টা করল। থমসনের দু’হাতে শরীরের ওজন ছেড়ে দিয়ে মাটি থেকে পা তুলে দিল ও, তারপর জোড়া পায়ে লাথি হাঁকাল লোকটার হাঁটুতে। হুড়মুড় করে মাটিতে পড়ল দু’জনেই। সাঁড়াশি বন্ধন থেকে মুক্তি পেয়েই লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল ড্যানি লসন, হাপরের মত ওঠা-নামা করছে বুক। উঠে দাঁড়ানোর সময় হাঁটু দিয়ে থমসনের মুখে আঘাত করেছে ও। থোক্ করে থুথু ফেলল সে, রক্তমাখা একটা দাঁত পড়ল ধূলিময় মাটিতে। ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে গেছে দুর্বৃত্ত, বুনো আক্রোশে ছুটে এল। এক বিন্দু সরল না লসন। নাগালের মধ্যে আসা মাত্র যেন পাঁচ টনী ট্রাককে থামাল পরপর দুটো ঘুসি হাঁকিয়ে। থমসন একরকম গ্রাহ্যই করল না মারগুলো। দু’হাত দিয়ে গায়ের জোরে ধাক্কা মারল লসনের বুকে। ভারসাম্য হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেল লসন। দ্রুত ওর বুকের ওপর বুট তুলে দিল থমসন, চাপ দিল। দু’হাতে বুট সহ পা-টা ধরে মোচড় দিল লসন, অস্ফুট স্বরে ককিয়ে উঠল বিশালদেহী, তারপর হুড়মুড় করে আছড়ে পড়ল মাটিতে। দু’জনেই লাফিয়ে উঠে সিধে হলো। পাজরে একটা ঘুসি খেল লসন, যেন ছুরির আঘাত। থমসনের চওড়া নাক আরও চওড়া করে দিল ও দুই ঘুসিতে, গলগল করে রক্ত বেরোতে শুরু করল। সরে গেল ওরা, বড়বড় নিঃশ্বাস ফেলছে। মুখ বিকৃত হয়ে গেছে থমসনের, সারা মুখে রক্তের ছোপ, প্রায় আধবোজা হয়ে গেছে একটা চোখ, কিন্তু অন্য চোখে-স্পষ্ট দেখতে পেল লসন-খুনের নেশা ফুটে উঠেছে। মরিয়া হয়ে উঠেছে দুর্বৃত্ত, এখন আর কৌশল বা লড়াইয়ের নিয়মের ধার ধারবে না। ওকে হাতের মুঠোয় পাওয়া মাত্র চূড়ান্ত আঘাত হানবে-বুকে চেপে ধরে একটা চাপে ভেঙে ফেলতে চাইবে ওর পাজর।
পরস্পরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে কৌশল বদল করল লসন। থমসনের একটা হাত ধরে ফেলল আচমকা, তারপর নিজের শরীর নিয়ে এল বিশাল দেহের কাছে; কাঁধের ওপর তুলে নিল থমসনের বগল, মাটিতে দুই পা-র ভর রেখে গায়ের জোরে ছুঁড়ে ফেলল তাকে। উড়ে গিয়ে রাস্তার ওপর আছড়ে পড়ল শেইন থমসন। নিশ্চল পড়ে থাকল, প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছে; কিছুটা হলেও হকচকিয়ে গেছে, বিশ্বাস করতে পারছে না ভরাডুবি হতে যাচ্ছে তার।
তাকে আর উঠতে দিল না লসন। কষ্টেসৃষ্টে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে বিশালদেহী, ঠিক তখনই চূড়ান্ত আঘাত করল। পরপর তিনটে ঘুসি মেরে থমসনের মুখ বিকৃত করে দিল। তারপর দুর্বৃত্তের বুকের কাছে শার্ট খামচে ধরে দাঁড় করাল তাকে, সামান্য বিরতির পর আরও কয়েকটা ওজনদার ঘুসি হাঁকাল মুখে। এমন ভাবে সরে এল লসন যেন জানে এরপর কি হবে। সত্যিই তাই হলো। রক্তাক্ত শরীরটা হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল, বালির ওপর মুখ থুবড়ে পড়ল শেইন
পৃষ্ঠা-১০৭
থমসন। স্থির, নিশ্চল পড়ে থাকল। একটু দূরে সরে গিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে তাকাল লসন, দ্রুত শ্বাস ফেলছে। হাপরের মত ওঠা-নামা করছে প্রশস্ত বুক, ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসছে নিঃশ্বাস। চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি চালাল ও, জানে যে কেউ এই সুযোগে পিস্তলের দিকে হাত বাড়াতে পারে। কিছুক্ষণ বাদে, সাংবাদিকের কাছ থেকে হোলস্টার নিয়ে উরুতে ঝোলাল ও, বিড়বিড় করে ধন্যবাদ জানাল। তারপর পানির ট্যাঙ্কের কাছে গিয়ে হাত-মুখ ধুলো। টের পেল মুখ আর হাতের ক্ষতগুলো জ্বালা করছে, কিন্তু গ্রাহ্য করল না।
কার্টিসের কাছ থেকে শটগানটা নিল ও, তারপর বিমূঢ় বেনি ডবিনের দিকে ফিরল। ‘ওকে সরিয়ে নাও এখান থেকে। সকাল হওয়ার আগেই শহর ছাড়বে, ডবিন! তোমাদের দু’জনের কাউকে যেন এই শহরে আর না দেখি। কথা দিচ্ছি-পরেরবার কিন্তু এত সহজে ছেড়ে দেব না।’ নীরবে মাথা ঝাঁকাল ডবিন, বিস্ময় কাটেনি তার এখনও। বিশ্বাসই করতে পারছে না অজেয় শেইন থমসনের পতন হয়েছে। লোকজনের ভিড় এতটুকু কমেনি। তাদের দিকে ফিরল ড্যানি লসন। ‘দয়া করে প্রত্যেকে নোটিশটা পড়ো। যার যার নাম আছে, তাদের কাউকে দরকার নেই আমাদের। যে যাবে না তাকে গুলি খেতে হবে। এ শহর পরিষ্কার করতে চাই আমি, একদম পরিষ্কার।’
কথা শেষ করে আর দাঁড়াল না ও। সরাসরি ল-অফিসে এসে একটা চেয়ারে ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিল। চোখ বুজে পড়ে থাকল কিছুক্ষণ। একটু পর খেয়াল করল একা নয় ও, কার্টিস চলে এসেছে। ‘আঘাত কেমন?’ জানতে চাইল সে। ‘থমসন ঘুসি মারতে জানে বটে!’ এবার কি শেষ হবে সবকিছু?” ‘ ‘না,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল লসন। ‘সবে তো শুরু হলো। এখন থেকে বন্দুক ব্যবহার করতে হবে। থমসনকে পিটিয়েছি শুনে মোটেও ক্ষান্ত হবে না রক্স বা কিনকেড।’ চুলোয় কেতলি চাপাল কার্টিস, পানি ফুটিয়ে লসনের ক্ষতের পরিচর্যা শুরু করল। ‘কিনকেড বা রক্সকে দেখেছ নাকি?’ জানতে চাইল লসন। ‘না। লাপাত্তা হয়ে গেছে ওরা।’ রবার্ট অ্যালেন আর জেফরি হ্যালার্ড এল একটু পর। ‘বব, আমার হয়ে রাস্তায় কিছুক্ষণ নজর রাখতে পারবে?’ ‘তারচেয়ে বরং একটা চক্কর দিয়ে আসি। কাউকে না কাউকে পেয়ে যাব, যার কাছে কিছু খবর পেতে পারি। কিনকেডের দলের অনেককেই চিনি আমি।’ বিল লারকিন এল এবার। তার কাছ থেকে জানা গেল ইতোমধ্যে শহর ছেড়ে চলে গেছে ষোলোজন। এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল হ্যালার্ড। এবার বোধহয় মুখ খোলার সিদ্ধান্ত
পৃষ্ঠা-১০৮
নিয়েছে। ‘ড্যান, তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। নিজেই নিজেকে বোকা বানিয়েছি আমি এতদিন।’ ‘কিন্তু চেষ্টা করেছ তুমি। তুমি ভদ্রলোক, হ্যালার্ড, কিন্তু ভদ্রতা ওদের ব্যবসা নয়। ভদ্রতা হচ্ছে ওদের কাছে দুর্বলতা, এবং একইসঙ্গে সুযোগও। এতদিন সভ্য এলাকায় বাস করেছ তুমি, এ অঞ্চল তো তা নয়।’ হাতের মুঠি খুলে-বন্ধ করে আঙুলের আড়ষ্টতা কাটাতে চাইছে লসন। ‘দেখলে তো, আমি আসলে ওদেরই একজন, নেকড়ের আক্রমণ ঠেকাতে আমিও নেকড়ে হতে পারি?’ ‘ধন্যবাদ, ড্যান।’ কথা শেষ করে আর দাঁড়াল না হ্যালার্ড। বাইরে এসে জো হারপারকে বলল, ‘ওর আঙুলগুলো দেখেছ তো, থেঁতলে গেছে? প্রয়োজন পড়লে কিভাবে পিস্তল চালাবে, কে জানে! তবে, জানো কি, চোখে না দেখলে আমি বিশ্বাসই করতাম না ওভাবে শেইন থমসনকে পেটাতে পারে কেউ!’কফির আয়োজন করেছে কার্টিস। কিছুক্ষণ পরই ফিরে এল বব অ্যালেন। ‘কি খবর পেলে?’ কফিতে চুমুক দিয়ে জানতে চাইল লসন। ‘জ্যাক চেম্বারল্যান্ড এখনও শহর ছাড়েনি। কে জানে, হয়তো তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছে সে! মার্শালের পক্ষ থেকে জামাই আদর না পেলে বোধহয় শহর ছাড়ার ব্যাপারে মত হবে না ওর।’ ‘আর কিছু?’ ‘শহরের ঠিক বাইরে দলবল সহ অবস্থান নিয়েছে কিনকেড। রক্সের নির্দেশের অপেক্ষায় আছে হয়তো। এদিকে এক লোককে ভাড়া করার জন্যে বিগ বে-তে লোক পাঠিয়েছে রক্স, ওখানে গিয়ে টেলিগ্রাম করবে লোকটা।’ ‘কাকে আনার জন্যে?’ ‘আমি যেমন জানি, তুমিও জানো, ড্যান। আশপাশে মাত্র একজন লোকই আছে যে পিস্তল হাতে তোমার মুখোমুখি দাঁড়ানোর হিম্মত রাখে।’ আনমনে মাথা নাড়ল লসন। জানে ও। লোকটা আর কেউ নয়। কোবিন উইন্সটন।
পৃষ্ঠা-১০৯
দশ:- খবর আনতে আবার বেরিয়ে গিয়েছিল রবার্ট অ্যালেন। কিছুক্ষণ পরই ফিরে এল সে, জানাল তালিকায় নাম আছে এমন বাইশজন পুরুষ আর পাঁচজন নারী শহর ছেড়ে চলে গেছে। তবে জমজমাট ব্যবসা ছেড়ে এক চুল নড়েনি জ্যাক চেম্বারল্যান্ড। ‘ওরা তোমার জন্যে অপেক্ষায় আছে, ড্যান,’ বলল কার্টিস। ‘এটা যে একটা ফাঁদ নিশ্চিত জানি আমি। তোমার হয়ে বরং আমিই যাই। রাইফেল ভাল চালাই আমি, তাছাড়া আমাকে আশা করছে না ওরা।’ মাথা নাড়ল লসন। ‘তা হয় না, টিম। ধন্যবাদ তোমাকে। এ আমার কাজ, আমিই করব।’ প্রায় আধ-ঘণ্টা লাগল তৈরি হতে। সারা শরীরে ব্যথা, আড়ষ্ট পেশী আর সন্ধিগুলো নড়তে চাইছে না। একটু নড়াচড়া করলেই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে লসন। হাতের আঙুলগুলো নাড়াচাড়া করল ও, আড়ষ্ট রয়ে গেছে এখনও। সামনে অনেক দায়িত্ব পড়ে রয়েছে-এ ভাবনাই খানিকটা সুস্থ করে তুলল ওকে।
এক ফাঁকে জো হারপার এসে জানাল লুকিয়ে আবার শহরে ঢুকেছে বেনি ডবিন আর শেইন থমসন। চেম্বারল্যান্ডের বারে গিয়ে ঢুকেছে। শুনেই খেপে গেল লসন। বাড়তি কার্তুজ আর শটগান নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ও। পোর্চে বেরিয়ে আসতে দেখল দূরে জেনারেল স্টোরের পাশের গলিতে সেঁধিয়ে গেল একজন, ল- অফিসের ওপর নজর রাখছিল নিশ্চয়ই। ব্যাপারটা গ্রাহ্য করল না লসন। হাঁটতে হাঁটতে ডিক ফেল্টনের অফিসের সামনে এসে দাঁড়াল ও, সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলল কিছুক্ষণ। শেষে শহরের একমাত্র রেস্তোরা ‘ব্লু লেগুন’-এ ঢুকে পড়ল। জানালার পাশে একটা টেবিল দখল করে কফির ফরমাশ দিল। জেরেমি টাউনের দীর্ঘ মূল রাস্তা আর বেশ কিছু বাড়ি চোখে পড়ছে এখান থেকে। টিম কার্টিসকে দেখতে পেল ও, জ্যাক চেম্বারল্যান্ডের সেলুন থেকে বেরিয়ে আসছে। রাস্তায় কিছুক্ষণ পায়চারি করল সে, তারপর আবারও ঢুকে পড়ল সেলুনে। স্মিত হাসল লসন। তাড়া নেই ওর, অপেক্ষা করুক থমসনরা। কফিটা বেশ ভাল, উপভোগ করছে ও। নিজেকে ক্রমশ সুস্থ মনে হচ্ছে। থমসন, ডবিন এবং রক্স, তিনজন ভয়ঙ্কর লোক, লুকিয়ে অপেক্ষা করছে ওর জন্যে। জ্যাক চেম্বারল্যান্ডও ভয়ঙ্কর, তবে লসন জানে জয়ের ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে পিস্তলে হাত দেয় না সে। কোরি মার্টিন আছে যখন, তখন এলি থমাসও থাকবে। তবে কিনকেড আর ওর চেলা জেস হার্কার নাও থাকতে পারে। হয়তো পুরোটাই জানে তারা, কিন্তু এটা যেহেতু ওদের ব্যাপার নয় সেহেতু দূরে থাকবে ওরা। আরেক কাপ কফির অর্ডার দিল লসন।
সেলুনের সামনে আরেকজনকে দেখা যাচ্ছে এখন। লোকটাকে চিনতে পারল লসন-মাইক অ্যান্ডারস। নির্দিষ্ট কোন পেশা নেই তার। কখনও ছিঁচকে চোর, কখনও রাসলার, আবার জুয়ার টেবিলে ধান্ধাবাজ হিসেবেও দেখা গেছে তাকে। লসন বুঝতে পারল ওর ওপর নজর রাখার জন্যে পাঠানো হয়েছে লোকটাকে। এদিক-ওদিক তাকাল অ্যান্ডারস, হোটেলের দিকে এগিয়ে আসছে। সতর্ক, মাপা দৃষ্টি চোখে। লসনকে হোটেলের ভেতরে দেখে থমকে দাঁড়াল মুহূর্তের জন্যে, তারপর এমন ভাব করল যেন দৈখতেই পায়নি। নিতান্ত খামখেয়ালিপনার সঙ্গে ভেতরে ঢুকল সে, লসনের তিন-চার টেবিল দূরে বসল। কফি আর পাইয়ের ফরমাশ দিল চড়া গলায়।
পৃষ্ঠা-১১০
মিনিট পাঁচ পরেই ঢুকল হ্যান্স কোবার্ন। হাসি হাসি মুখ সোনা ব্যবসায়ীর। লসনের উল্টোদিকের চেয়ারে বসল সে, তবে আড়চোখে দেখে নিয়েছে মাইক অ্যান্ডারসকে। ‘কফিটা চমৎকার। দারুণ লাগছে, হালকা সুরে বলল লসন। ‘শহরের দায়িত্ব নেওয়ার পর এই প্রথম স্বস্তি বোধ করছি আমি।’ খানিকটা ঝুঁকে এসে নিচু কণ্ঠে যোগ করল, ভান করল যেন কাউকে শুনতে দিতে চায় না। ‘এবার নিশ্চিন্তে আক্রমণ করতে পারব। রাস্তার ওপাশে আমাদের ছেলেরা তৈরি আছে তো?’বুঝে নিল সোনা ব্যবসায়ী। ‘হ্যাঁ। তৈরি সবাই।’ ‘বেশ, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল! যাক্সে, সোনা কেমন তুলছ তোমরা?’ ‘ভালই।’বিভিন্ন বিষয়ে কিছুক্ষণ কথা বলল ওরা। ‘কার্ল ব্রেনেট এসেছে,’ এক ফাঁকে জানাল কোবার্ন। ‘বিশালদেহী আরও এক লোক এসেছে শহরে, মুখে লম্বা একটা দাগ ওর। বলল তোমার কাছে এসেছে। পাহাড়ের একটা বাথানে নাকি থাকে ওরা।’ এবার সত্যিই স্বস্তি বোধ করল লসন। ভুল হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই, এ নিশ্চয়ই ম্যাট হিগিন্স। ওদের ফোরম্যান। পিস্তলে দারুণ চালু, বিশ্বস্ত এবং লড়াকু লোক। নিশ্চয়ই বাবা পাঠিয়েছে ওকে, অনমনে ভাবল লসন। কফি শেষ করে উঠে পড়ল অ্যান্ডারস। কি এক তাড়ায় পেয়েছে যেন তাকে, দ্রুত বেরিয়ে গেল। হোটেলের পেছন দরজা দিয়ে বেরোল লসন। দ্রুর্ত পায়ে এগোচ্ছে। খোলা জায়গায় আবর্জনা আর উচ্ছিষ্ট পড়ে আছে। বিভিন্ন দালানের পেছন দিক দিয়ে ও যখন জ্যাক চেম্বারল্যান্ডের সেলুন ‘ব্লু মাউন্টেন’-এর পেছন দরজায় পৌঁছল সবে তখন সামনের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকেছে মাইক অ্যান্ডারস। ‘ও তো বসে বসে আয়েশ করে কফি খাচ্ছে,’ অ্যান্ডারসের কণ্ঠ শুনতে পেল লসন। ‘তবে ওর বোধহয় একটা পরিকল্পনা আছে। শুনলাম কার্ল ব্রেনেট আর ম্যাট হিগিন্স এসেছে শহরে।’ ‘মানে?’ খেঁকিয়ে উঠল চেম্বারল্যান্ড। ‘কয়েকজন নাকি সশস্ত্র অবস্থায় অপেক্ষা করছে নাস্তার ওপাশে। কার্ল ব্রেনেটকে তো চেনোই অ্যারিজেংলার বিখ্যাত গানফাইটার। আর হিগিন্সের কথা আগেও শুনেছি আমি, বহু দিন ধরে লাপাত্তা ছিল ও। এতদিন বোধহয় পাহাড়ে লুকিয়ে ছিল।’ ‘ম্যাট হিগিন্স?’ সন্দিহান সুরে বলল ডবিন। ‘একসময় আউট-ল ছিল হারামজাদা। এখন বোধহয় পাহাড়ের ওপাশে যে বাথানটা আছে, ওখানে কাজ করে। ঝামেলা, জ্যাক, হিগিন্স কঠিন লোক। অরিগনে একবার…’ ‘লসন কি পরিকল্পনা করেছে বুঝতে পেরেছ?’ জিজ্ঞেস করল রক্স, প্রায় উপেক্ষা করল ডবিনকে, হিগিন্সের দুঃসাহসিকতার ফিরিস্তি দেয়ার সুযোগ দিল না। জানালার পাশ থেকে উকি দিল লসন। দু’জনকে দেখা যাচ্ছে। এদেরকে
পৃষ্ঠা-১১১
আত্মসমর্পণ করতে বলে লাভ নেই, মরে গেলেও তা করবে না কেউ। সুতরাং লড়াই ছাড়া বিকল্প নেই। ঝটিকা আক্রমণ করতে হবে, নইলে এতগুলো দক্ষ লোকের বিরুদ্ধে টিকতে পারবে না ও। অ্যান্ডারস উত্তর দেয়ার আগেই সবাইকে চমকে দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল লসন। দরজা খোলার শব্দে মুখ তুলে তাকাল সবাই। স্মিত হাসি লসনের ঠোঁটে। ‘আমার পরিকল্পনা হচ্ছে’ বলেই বেনি ডবিনের উদ্দেশে প্রথম গুলিটা করল ও, কারণ ডবিন গুলি খেয়ে পড়লে থমসনের ওপর পড়বে, তাতে লক্ষ্য স্থির করতে অসুবিধে হবে বিশালদেহী গানম্যানের। ডবিনের পেট বরাবর গুলি করল ও, শটগানের দ্বিতীয় গুলিতে ফেলে দিল কার্ট রক্সকে। পরমুহূর্তে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল লসন, যাতে টার্গেট হিসেবে অন্যদের কাছে নিজে ছোট হয়ে যায়। আঙুলগুলো আড়ষ্ট হয়ে আছে এখনও, তবু সহজেই হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করে ফেলল। থমসনের প্রথম গুলি এক চুলের জন্যে মিস্ করেছে ওকে, ধীরে সুস্থে এবার বিশালদেহীর পেট বরাবর একটা গুলি পাঠিয়ে দিল লসন। মেঝেয় শুয়ে পড়েছে অ্যান্ডারস। ‘আমার কাছে পিস্তল নেই!’ সমানে চেঁচাচ্ছে সে। কথাটা বিশ্বাস করল লসন, কারণ বিশ্বাস করতে ভাল লাগছে ওর, তাহলে অন্তত একজনকে নিয়ে ভাবতে হবে না। জ্যাক চেম্বারল্যান্ডের উদ্দেশে গুলি করল ও এবার, কিন্তু অবচেতন মন যেন সতর্ক করে দিয়েছে সেলুন-মালিককে; শেষ মুহূর্তে বিপদ বুঝতে পেরে বারের পেছনে বসে পড়েছে সে।
মুহূর্তের মধ্যে হোলস্টারে পিস্তল ভরে রেখে শটগানে নতুন কার্তুজ লোড করল লসন। বহুবার এ কাজ করেছে ও, সেজন্যে সময় লাগল কম। শটগানে গুলি ভরে উঠে দাঁড়াল এবার, চারপাশে শ্যেনদৃষ্টি চালাল। কোন সুযোগই পায়নি বেনি ডবিন। কিন্তু রক্স আরেকটু হলে ফেলে দিয়েছিল ওকে। প্রায় একইসঙ্গে গুলি করেছে ওরা, তবে লসন খানিকটা আগে করেছে বলেই রক্ষা পেল। বাহুতে একটা জোরাল টান অনুভব করল ও, দেখল হাঁটু ভেঙে মেঝেয় পড়ে যাচ্ছে কার্ট রক্স। ব্যথায় কুঁকড়ে গেছে মুখ, কিন্তু তারপরও পিস্তল তোলার চেষ্টা করছে। মারা যায়নি থমসনও। চোখের পলকে একপাশে সরে গেল সে, হাতে উদ্যত পিস্তল। চুলচেরা হিসেব করার উপায় নেই, কিংবা নিশানা করারও সময় নেই এখন। চোখের পলকে গুলি করল লসন। সামান্য নড়ে যাওয়ায় বুকে না লেগে থমসনের গলায় লাগল গোলা। মুহূর্তে একটা গর্ত হয়ে গেল, চোখে অবিশ্বাস নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল বিশালদেহী, তারপর দড়াম করে আছড়ে পড়ল কাঠের মেঝেয়। এবার কার্ট রক্সের দিকে মনোযোগ দিল লসন। সুযোগ একটা সে ইতোমধ্যে পেয়েছে বটে, কিন্তু তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে মিস করেছে। কপালে ত্রিনয়নের সৃষ্টি হতে হাঁটু ভেঙে মেঝেয় পড়ে গেল সে। আর উঠল না। তিন পা এগিয়ে কোরি মার্টিনের হাতের নাগাল থেকে পিস্তলটা লাথি মেরে সরিয়ে দিল লসন। শটগানের নল চেপে ধরল তার গলায়। এক মুহূর্ত পরস্পরের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল ওরা। ট্রিগারে সামান্য চাপ পড়লেই শেষ হয়ে যাবে
পৃষ্ঠা-১১২
মার্টিন। কিন্তু আত্মসমর্পণের কোন চিহ্নই নেই লোকটার মুখে। ‘অপেক্ষা করছ কেন, লসন?’ চেঁচিয়ে উঠল সে। ‘গুলি করো! মৃত্যু পাওনা হয়েছে আমার।’ ‘না,’ মার্টিনের ভাঙা ডান হাতের দিকে ইঙ্গিত করল লসন। ‘গানম্যান হিসেবে কোন দিন আর দাঁড়াতে পারবে না তুমি। এ শহর থেকে চলে যাও, মার্টিন, অন্য কোথাও গিয়ে ভাল মানুষ হওয়ার চেষ্টা করো। তবে নামটা বদলে নিয়ো আর এমন ভাব কোরো যেন পিস্তলের নামই শোনোনি কোন দিন।’ জ্যাক চেম্বারল্যান্ডের দিকে ফিরল ও এবার, যদিও পুরো সময়টাই চোখের কোণ দিয়ে লক্ষ্য রেখেছে তার দিকে। কাউন্টারে দু’হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে সে, চোখে-মুখে আতঙ্ক। বোঝাতে চাইছে লড়াইয়ে ছিল না, এবং এ লড়াইয়ের কিছুই জানে না। দু’পা এগিয়ে সেলুন মালিকের মুখোমুখি হলো লসন। ‘চলে যাওয়ার একটা সুযোগ দিয়েছিলাম তোমাকে, জ্যাক। সুযোগটা নাওনি তুমি।’ ‘বোকামি হয়ে গেছে, ড্যান।’ ‘সত্যিই বোকা তুমি!’ শটগান তুলল লসন, তারপর সজোরে বাঁটটা নামিয়ে আনল জ্যাক চেম্বারল্যান্ডের মুখে। তাল হারিয়ে পিছিয়ে গেল বার-মালিক, টলছে মৃদু মৃদু, মুখের একপাশ থেকে রক্ত ঝরতে শুরু করেছে। আঙুল তুলে দরজাটা দেখাল লসন। ‘রাস্তাটা দেখা যাচ্ছে, জ্যাক। জলদি কেটে পড়ো। আমার মত বদলে যাওয়ার আগেই চলে যাও শহর ছেড়ে।’ ‘আমার মালপত্র-জিনিসপত্র গোছাতে হবে।’ ‘গতকাল তোমাকে সেই সুযোগ দিতাম। কিন্তু আজ দেব না। জলদি!’ সামান্য দ্বিধা করল সেলুন-মালিক, কিন্তু লসনের চোখের দিকে তাকাতে সমস্ত সংশয় মুহূর্তে দূর হয়ে গেল। দরজা দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে গেল সে। মাথা নিচু করে হাঁটছে, কিন্তু মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে তলে তলে অসন্তোষ আর প্রতিহিংসায় জ্বলছে। ‘ওকে এভাবে চলে যেতে দিলে?’ দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে টিম কার্টিস। ‘হ্যাঁ, যদি এবার শিক্ষা হয়।’ ততক্ষণে মোটামুটি ভিড় জমে গেছে। সেই ভিড়ের সুযোগে সটকে পড়ছিল মাইক অ্যান্ডারস। তাকে থামাল লসন। ‘ভুল পথে পা বাড়িয়েছ তুমি, মাইক। এ পথ তোমার নয়। আরেকটু হলে মারা পড়তে আজ।’ ‘হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হচ্ছে।’ বারের ওপর থেকে চাবির গোছা তুলে নিয়ে তার দিকে ছুঁড়ে দিল লসন। ‘একটা কাজ দিচ্ছি তোমাকে। থমসন, রক্স আর ডবিনকে কবর দেবে, ফলক লাগাবে কিন্তু। সবার কবরেই ফলক থাকা উচিত। ফিরে এসে লকার খুলবে, যা পাবে সবই তোমার। তারপর কেটে পড়বে এখান থেকে, ভুলেও এদিকে এসো না আর।’ ইতস্তত করছে সে। ‘পয়সা নেব?’ ‘নেবে। জ্যাকের অধিকাংশ টাকাই চুরির। ওই টাকা দিয়ে নতুন পোশাক
পৃষ্ঠা-১১৩
কিনবে আর ভদ্র ভাবে বাঁচার চেষ্টা করবে।’ ক্লান্ত বোধ করছে লসন। লাশ তিনটে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে মাইক অ্যান্ডারস। ইতোমধ্যে একজন সহকারী জুটে গেছে ওর। ভিড় কমে যাচ্ছে। শটগান আর পিস্তল রিলোড করে সেলুন থেকে বেরিয়ে এল লসন। অনুভব করছে আবার অসাড় হয়ে যাচ্ছে আঙুলগুলো, বিশ্রাম চাইছে শরীর, কিন্তু সচেতন একটা স্পৃহা কাজ করছে এখনও। কিনকেড-জেসি ওয়েন-এলি থমাসের মত ডজন খানেক হিংস্র মানুষ রয়ে গেছে এখনও। সে কি খুন করতে ভালবাসে? কফিতে চুমুক দিতে দিতে ভাবছে ড্যানি লসন। ভালবাসে কি? না। অ্যান্ডারস আর চেম্বারল্যান্ডকেও মেরে ফেলতে পারত। অ্যান্ডারস ছেলেটা হয়তো তত খারাপ নয়, সঙ্গ দোষে বখে গেছে। ভাল হওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে এখনও। সেজন্যেই ছেড়ে দিয়েছে তাকে। কিন্তু চেম্বারল্যান্ডকে ছাড়ল কেন? সে তো চোর আর খুনী। পশ্চিমে নতুন আসা বহু লোকের সর্বনাশ করেছে, এ ধরনের শহরে সবসময়ই দেখা যায় তাকে। আর আছে সীমান্তে অবৈধ ব্যবসা। তাহলে কেন চেম্বারল্যান্ডকে খুন করল না? আসলে খুন করতে অপছন্দ করে সে। কিন্তু ওর গুলিতে যারা মারা গেছে, তাদের জন্যে কি কখনও দুঃখ বোধ করেছে কিংবা অনুশোচনা হয়েছে? হ্যাঁ, অ্যান্ডারসের মত মাথা গরম অবুঝ ছেলেরা খুন হলে দুঃখ পায় লসন, মনে হয় শুধু পরিস্থিতির শিকার হয়ে মারা গেল এরা। কিন্তু বিগ থমসন, বেনি ডবিন কিংবা কার্ট রক্সের মত লোকের জন্যে বিন্দুমাত্র দুঃখ নেই ওর। এরা বয়স্ক, অভিজ্ঞ, জেনে-শুনেই ঝামেলা পাকায়। মানুষের সর্বনাশ করে আনন্দ পায় ওরা। একমাত্র মরে গেলেই এদের গুণ্ডামি শেষ হয়। ভাল লাগে না, মনে মনে স্বগতোক্তি করল লসন, ভাল লাগে না এসব! কিন্তু দায়িত্ব বা কর্তব্য থেকে এক চুল সরে আসার উপায় নেই। কে কি ভাবল, কিংবা কি বলল তাতে কিছুই আসে-যায় না ওর। পরিস্থিতির বিচারে কি করা উচিত, নিশ্চিত জানে লসন, এবং তাই করবে। এক চুল টলাতে পারবে না কেউ। আর হয়তো দু’তিনটে দিন, ভাবল সে, তারপরই সবকিছুর নিষ্পত্তি হবে। প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে ওর। তখন কি করবে? পাহাড়ের কোলে নয়ন জুড়ানো একটা বাথান ভেসে উঠল ওর মানসপটে, আলো-ছায়ায় ঘেরা এক উপত্যকা…গভীর প্রশান্তি নিয়ে একটা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে ও, পাশেই অপূর্ব সুন্দরী এক নারী। মনে মনে একচোট হাসল লসন। অদ্ভুত ধারণাটা ইদানীং শাখা গজাচ্ছে মনের গভীরে, অথচ ক’দিন আগেও এ, ধরনের চিন্তা আসেনি মাথায়। কেঁটিয়ে চিন্তাটা তাড়িয়ে দিল লসন। কল্পনার ফানুস ওড়ানোর সময় নয় এটা, সামনে কঠিন সময়। কিনকেড আর জেসি ওয়েন রয়ে গেছে এখনও। সহজ পাত্র নয় এরা।
পৃষ্ঠা-১১৪
জেসি ওয়েনের ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না লসন। আসলে কি চাইছে লোকটা? জেরেমি টাউনে পড়ে আছে কেন? সরাসরি কিছু করেনি সে, স্রেফ পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে যেন। তালিকায় রাখা যায়নি তাকে, কারণ এখানে আসার পর এমন কিছুই করেনি যে ওকে দোষারোপ করা যাবে। বরং কিছু কিছু মানুষের উপকারই করেছে সে। অথচ লসন নিশ্চিত জানে লাভের আশা ছাড়া এক দণ্ড এখানে থাকার কথা নয় লোকটার। কার্ল ব্রেনেটকে হয়তো সে-ই ভাড়া করেছে। একবার ব্যর্থ হয়ে হাল ছেড়ে দেয়ার কথা নয় তার, কে জানে হয়তো আরেকটা সোনার চালানের অপেক্ষায় আছে! ‘কি ব্যাপার, মার্শাল, শুধু কফি খেলেই চলবে?’ পরিচিত কণ্ঠে সংবিৎ ফিরে পেল লসন। ‘কাউন্টির সবচেয়ে গরম শহর জেরেমি টাউন, অথচ এখানকার মার্শাল দেখছি দিব্যি কফি গিলে খুনে-বদমাশদের তাড়াচ্ছে!’ চোখ তুলে তাকাল লসন। কার্ল ব্রেনেট।
স্মিত হাসছে ব্রেনেট, এগিয়ে এসে টেবিলের সামনে দাঁড়াল। লসন ইঙ্গিত করতে উল্টোদিকের একটা চেয়ার দখল করল। ‘মনে হচ্ছে হুট করে এখানে চলে এসে ভুল করিনি,’ নিজ থেকেই মুখ খুলল সে। ‘আর কিছু না হোক তোমার কাজকর্ম দেখে মজা তো পেয়েছি। আহ্, যেভাবে পেটালে থমসনকে! সাহস আছে তোমার, ড্যান, চেম্বারল্যান্ডের সেলুনে যেভাবে হানা দিলে…’ ‘এখানে এসেছ কেন?’ মগে কফি ঢালার সময় বাধা দিয়ে জানতে চাইল লসন। থমকে গেল ব্রেনেট, ধীরে ধীরে গম্ভীর হয়ে গেল মুখটা। ‘চাকুরি গেছে আমার, লিয়ন সিটিতে আমার কাজ-কারবার পছন্দ হয়নি বদের। হাতে কাজ না থাকায় ভাবলাম এখানে এলে হয়তো একটা পেয়ে যাব।’‘ওরা নিজেরা নেমে পড়লেই পারে!’ মৃদু হাসল ব্রেনেট। ‘শুনেছি বেশ কিছু মারদাঙ্গা লোক জোগাড় করেছে কিনকেড। জেসি ওয়েন যোগ দিয়েছে ওর সঙ্গে। ওর চেলা এলি থমাসকে চেনো তো? এগারোটা খুন করেছে ও। ওদের মতে আমি কম হিংস্র, তাই চায় না আমাকে। থমাসের মত লোক দরকার ওদের।’ ব্রেনেটকে কফি পরিবেশন করল লসন। ‘তোমার আসল উদ্দেশ্যটা কি, বলো তো?’ ‘কাজ খুঁজছি।’ ‘শহরের বাইরে, বাথানের কাজ করবে?’ ‘ইচ্ছে আছে, কিন্তু এ মুহূর্তে জেরেমি টাউন ছাড়ছি না,’ কফিতে চুমুক দিয়ে চিন্তিত স্বরে বলল ব্রেনেট, মনে মনে লসনের প্রস্তাবটা বিবেচনা করছে। ‘তাহলে সব মজা মিস্ হয়ে যাবে। পরে না হয় প্রস্তাবটা ভেবে দেখব।’ সিগারেট রোল করে ব্রেনেটকে অফার করল লসন, তারপর স্থির দৃষ্টিতে নিরীখ করল গানম্যানকে। ‘যে উদ্দেশ্য নিয়েই এসে থাকো, কার্ল, আমার পথে য়েন তোমাকে দেখতে না পাই। ভাল মানুষ হিসেবে যদি থাকতে চাও, আপত্তি নেই আমার, কিন্তু…
পৃষ্ঠা-১১৫
‘আরে, খেপে যাচ্ছ কেন! ঝামেলা করতে এখানে আসিনি আমি। বরং পারলে তোমাকে সাহায্য করতে চাই।’ ‘কেন?’ খানিক দ্বিধা করল ব্রেনেট, আনমনে সিগারেট ফুঁকছে। দৃষ্টি লেগে আছে ওপাশের দেয়ালে। ‘আমার মত মানুষদের ন্যায়-অন্যায় বোধ কম, ড্যান। আগ- পাছ ভেবে কাজ করিনি কখনও, যখন যা মনে ধরেছে তাই করেছি। কিন্তু ইদানীং মনে হচ্ছে সত্যিই বোধহয় ধার কমে গেছে আমার। একটা বয়স হলে সবাই বোধহয় শ্লথ হয়ে পড়ে। পিস্তলের কথা বোঝাচ্ছি। আচ্ছা, ড্যান, কখনও কি ভেবেছ কিভাবে মারা যাবে তুমি?’ প্রশ্নটা থমকে দিল লসনকে, স্থির দৃষ্টিতে গানম্যানের দিকে তাকিয়ে থাকল। ও উত্তর দেয়ার আগেই খেই ধরল ব্রেনেট। ‘ভাবোনি, তাই না? কিন্তু আমি জানি, পিস্তলবাজ পিস্তলের গুলিতেই মরে। হাজারটা উদাহরণ দেয়া যাবে। এটাই পশ্চিমের রীতি, চাইলেও এড়াতে পারব না আমরা। কিন্তু ইদানীং আমার মনে হচ্ছে অন্তত চেষ্টা তো করতে পারি। ভাবছি সবকিছু ছেড়ে দিয়ে সাধারণ একটা জীবন বেছে নেব কিনা।’ ‘বেশ তো।’ ‘জীবনের সমস্ত সঞ্চয় নিয়ে এসেছি আমি। ভাবছি একটা স্টোর খুলব। জেফরি হ্যালার্ডের কাছ থেকে অনুমতিও পেয়েছি।’ ‘অনুমতি ছাড়াই শুরু করতে পারো। এমন কোন নিয়ম করেনি হ্যালার্ড। ইচ্ছেমত ব্যবসা শুরু করতে পারে যে কেউ, কেবল ঝামেলা না করলেই হলো।’ ‘কিন্তু আমি ভাবছি আরও ক’দিন পরে শুরু করব। ঝামেলাটা শেষ হোক, শহরটা শান্ত হলে…’ কথাটা শেষ করল না সে, লসনের মত সেও যেন এই শহরে টিকে থাকার সম্ভাবনা সম্পর্কে সন্দিহান। তবে আশান্বিত নিশ্চয়ই, নইলে এখানে থিতু হওয়ার চিন্তা করত না। জানালা দিয়ে বাইরের রাস্তায় চোখ বুলাল লসন, সন্ধে হয়ে এসেছে প্রায়। শহরের পশ্চিমে পাহাড়ের পেছনে ডুব দিচ্ছে সূর্য, পাহাড়ের বিপরীতে উজ্জ্বল আভা তৈরি হয়েছে দিগন্তে। আরেকটা ঘটনামুখর রাতের শুরু, আনমনে ভাবল ও, কে জানে কাল সূর্যোদয় দেখার সৌভাগ্য হবে না কার! উঠে দাঁড়িয়ে মাথায় হ্যাট চাপাল ব্রেনেট। ‘ব্লু লেগুনের ধারে-কাছে পাবে আমাকে, ড্যান। দরকার পড়লে জানাতে দ্বিধা কোরো না। আমার পক্ষে যতটা সম্ভব…কেন এখানে এসেছি, তোমার প্রশ্নের আরেকটা উত্তর আছে কিন্তু। সবারই অহঙ্কার থাকে, সেটা শেষ হয়ে গেলে তার অস্তিত্বই থাকে না। কিনকেড আমাকে ঘুণাক্ষরেও জানায়নি কাগজ বলতে আসলে কিছু নিরীহ মানুষের ক্লেইমের দলিল হাত করতে হবে। স্টেজে গার্ড হিসেবে তুমি থাকছ, সেটাও বলেনি। বোঝ তাহলে অবস্থা, স্রেফ আমাকে খুন হওয়ার জন্যে পাঠিয়েছিল ও! ভাগ্যিস পিস্তলে হাত দেইনি, নইলে নাচেজের মতই অবস্থা হত আমার। মজুরি তো দেয়ইনি, উল্টো ভীতু বলে গালাগাল করেছে আমাকে,’ থেমে জানালা দিয়ে শহরের দিকে তাকাল গানম্যান, প্রতিজ্ঞায় দৃঢ় হয়ে গেছে চোয়াল দুটো। ‘সুযোগ পেলে সেই
পৃষ্ঠা-১১৬
অপমানের শোধ আমি নেব!’ আনমনে নড করল লসন। হঠাৎ করেই সিদ্ধান্তটা নিল। প্রয়োজনে পাশে পাবে একে, নিশ্চিত জানে ও, মিথ্যে বড়াই করেনি কার্ল ব্রেনেট। এখনই তার সাহায্য নিতে অসুবিধে কি? ‘আমার ডেপুটি হবে নাকি, কার্ল?’ আচমকা শুধাল ও। চলে যেতে উদ্যত হয়েছিল ব্রেনেট, ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল। স্পষ্ট অবিশ্বাস তার চোখে, তারপর মুহূর্তে উজ্জ্বল হয়ে গেল মুখ। ‘কাজটা অবশ্য আগেও করেছি, কিন্তু ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি তোমার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাব, ড্যান। তুমি আমাকে যোগ্যতার চেয়ে বেশি সম্মান দিচ্ছ! শহরের লোকেরা আপত্তি জানে সবাই।’ করতে পারে, আমার কুখ্যাতি সম্পর্কে কম-বেশি ‘করবে না, কারণ আমার ইচ্ছেমত এই শহর চলবে-এই চুক্তি করেই কাজটা নিয়েছি। যাকে ইচ্ছে ডেপুটি বানাতে পারি। তাছাড়া কিনকেডকে এক হাত নেওয়ার সুযোগটা হারানো কি ঠিক হবে?’ স্মিত হেসে হাত বাড়িয়ে দিল ব্রেনেট। ‘এখন মনে হচ্ছে জেরেমি টাউনে এসে মোটেও ভুল করিনি।’ আরেকপ্রস্থ কফি পান করল ওরা, তারপর শহরের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করল কিছুক্ষণ। ঠিক করল টহল দিতে বেরোবে, বিপদে পড়লে কিভাবে অন্যকে জানাবে সেটা ঠিক করে নিল। ব্যাজ ছাড়াই বেরিয়ে গেল ব্রেনেট। তার ঠিক পরপরই বেরোল লসন। বিভিন্ন জায়গায় থামল, সতর্ক চোখে লক্ষ্য করছে সবকিছু। হাঁটতে হাঁটতে সরু গলি ধরে শহরের একেবারে শেষে চলে এল, সামনেই বিশাল একটা বাড়ি। বাতি জ্বলছে না কোন কামরায়। কিন্তু আবছা অন্ধকারে মূল দরজায় একটা মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেল লসন। সিগারেট টানছে, মেয়েটা। উল্টোদিকের বাড়ি থেকে ছিটকে আসা আলোয় মেয়েটির পরনের সিল্কের পোশাক ঝিলিক মারছে। মেয়েটিকে চেনে লসন। থামল ও। ‘হ্যালো, জেনি। কেমন আছ?’ হ্যালো, ড্যান। ভাল। তুমি?’ ‘ ‘ভাল। তোমার পুরুষ মানুষটা কি আশপাশে আছে?’ মুহূর্তের জন্যে দ্বিধা করল মেয়েটা, কালো চোখে সংশয় ফুটে উঠেছে। ‘না, তালিকায় নাম ছিল ওর। তোমার জন্যেই ওকে চলে যেতে হয়েছে।’
‘দুঃখিত, জেনি। কিন্তু তুমি তো জানোই ওর স্বভাব-চরিত্র কেমন।’ ‘জানি আমি!’ তিক্ত স্বরে বলল জেনিফার লয়েড। ‘তাহলে ওকে ছেড়ে দিচ্ছ না কেন? হয়তো ওর জন্যেই একদিন বড় কোন সমস্যায় পড়ে যাবে তুমি। ‘জানি, হয়তো তাই হবে,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিগারেটে শেষ টান দিল জেনি, তারপর পায়ের কাছে ফেলে জুতোর তলায় পিষল। ‘কিন্তু ওকে ভালবাসি আমি। ভালবাসা ব্যাপারটা কি তুমি বোঝ, ড্যান?’ চুপ করে থাকল লসন, কিছুটা হলেও বিব্রত বোধ করছে। সত্যিই কি কোন
পৃষ্ঠা-১১৭
ধারণা আছে ওর এ ব্যাপারে? চিন্তাটা তখনই থামিয়ে দিল লসন, একসময় বলল: ‘হয়তো বুঝি, জেনি। কিন্তু আমার কথা হচ্ছে, ভাল যখন বাসোই তাহলে ওকে ভাল করার চেষ্টা করছ না কেন?’ ‘চেষ্টা করছি, ড্যান।’ ‘তুমি খুব ভাল মেয়ে, জেনি। চারটে শহরে তোমাকে দেখেছি।’ ‘পাঁচটা। লিডভিলেও ছিলাম আমি।’
‘ঠিক আছে, পাঁচটা। এবং সব জায়গায় তুমি খুব শান্তিপ্রিয় ছিলে, অন্যের মঙ্গল চেয়েছ সবসময়। মনে আছে, ব্রনসনভিলে যখন কলেরা লেগেছিল, আক্রান্তদের ফেলে চলে গিয়েছিল সবাই? তুমি কিন্তু রয়ে গিয়েছিলে।’ ‘এছাড়া আর কি করতে পারতাম আমি।’ রাইফেল হাত বদল করল লসন। ‘কিন্তু সবাই তোমার মত উচিত কাজটা করেনি। ঠিক আছে, জেনি। আপাতত বিদায়। পরে দেখা হবে আবার।’। বড় রাস্তায় ফিরে এল লসন। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থেকে সতর্ক দৃষ্টি চালাল পুরো শহরে। আজ রাতে একেবারেই শান্ত হয়ে আছে জেরেমি টাউন। সেলুন আর জুয়ার আড্ডাগুলো প্রায় ফাঁকা। কাল সকাল থেকে আবার ব্যস্ত হয়ে উঠবে শহরটা কিন্তু তখন সে নাও থাকতে পারে-কার্ল ব্রেনেটই সব ঝুট-ঝামেলা সসামাল দিতে পারবে। আর মাত্র একটা কাজ বাকি আছে। কিনকেড আর জেসি ওয়েনকে থামাতে হবে। ঘোড়ার তীক্ষ্ণ চিহি শব্দে সংবিৎ ফিরে পেল লসন, সমস্ত চিন্তা মুহূর্তে উধাও হয়ে গেল। পাশ ফিরতেই গলি ধরে ছুটে আসতে দেখল একটা বাকবোর্ডকে, প্রাণপণে ছুটছে ঘোড়াগুলো। পঞ্চাশ গজ পেছনে গাঢ় কিছু কাঠামো দেখতে পেল লসন, চোখ কুঁচকে তাকাল ও, অন্তত বিশজন ঘোড়সওয়ার। বাকবোর্ডটাকে তাড়া করছে এরা। গলি ধরে সরাসরি বড় রাস্তার দিকে ছুটে আসছে বাকবোর্ড, বাঁক পেরোনোর সময় এক দিকে হেলে পড়ল, সজোরে ধাক্কা খেল কোনার বাড়ির দেয়ালে। হুড়মুড় করে কাত হয়ে পড়ে গেল ওটা, রাস্তায় ছিটকে পড়ল এক যাত্রী। একজন? না…দু’জন যাত্রী। উঠে বসার চেষ্টা করছে পড়ে যাওয়া লোকটা। তাকে চিনতে পারল লসন-হ্যান্স কোবার্ন। অন্যজন…মেরী কোবার্ন। কোন নরকে গিয়েছিল ওরা? দু’পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে সোনা ব্যবসায়ী। পরমুহূর্তে লসনকে দেখতে পেল, অস্ফুট স্বরে চেঁচিয়ে উঠল: ‘ওহ্, ড্যান। এখানে আছ তুমি!’ ততক্ষণে এসে পড়েছে পেছনের দলটা। সবার সামনে স্যামুয়েল কিনকেড। মোটা পাকানো একটা দড়ি ঘোরাচ্ছে সে। কোবার্ন উঠে বসার চেষ্টা করতে দড়ির ফাঁস দিয়ে আটকে ফেলল তাকে। হ্যাঁচকা টানে সোনা ব্যবসায়ীকে ফেলে দিল রাস্তায়। এ অবস্থায় টেনে নিয়ে যাবে। ‘স্যামুয়েল কিনকেড, থামো তুমি!’ চিৎকার করল লসন। ‘নরকে যাও তুমি, লসন!’ গর্জে উঠল কিনকেড, চলে এসেছে বড় রাস্তায়,
পৃষ্ঠা-১১৮
পিছু পিছু এগিয়ে আসছে অন্যরা। বুনো জন্তুর মত ঝাঁপিয়ে পড়ল লসন, বুঝতে পারছে আসলে সোনা ব্যবসায়ী নয়, ও-ই তাদের টার্গেট। হয়তো এই উসিলায় জড়সুদ্ধ উপড়ে ফেলতে চাইছে-ব্রেনেট, হিগিন্স কাউকেই ছাড়বে না। কিন্তু সবার আগে ওকে শেষ করতে চাইছে। অন্ধকার থেকে গুলি ছুঁড়ল লসন। ঘোড়ার স্যাডল থেকে ছিটকে পড়ল একজন। ইতোমধ্যে উঠে দাঁড়িয়েছে হ্যান্স কোবার্ন, কিন্তু হোলস্টার থেকে পড়ে গেছে ওর পিস্তল। ‘হ্যান্স!’ চেঁচাল লসন। ঝটিতি ওর দিকে ফিরল সে। তখনই নিজের বাড়তি পিস্তলটা ছুঁড়ে দিল লসন। শূন্যে সেটা লুফে নিল সোনা ব্যবসায়ী, এবং হাতের মুঠিতে আসা মাত্র গুলি করতে শুরু করল। স্যাডলশূন্য হলো এক ঘোড়সওয়ার। একই সময়ে গুলি করেছে লসন, কিন্তু স্যাডলের একপাশে হেলে পড়েছে স্যামুয়েল কিনকেড, গুলিটা তাকে স্পর্শ করল না। কিনকেডের গুণ্ডাবাহিনী চলে এসেছে মূল রাস্তায়, সমানে গুলি ছুঁড়ছে। মুহুর্মুহু গুলির শব্দ আর গানপাউডারের কটু গন্ধে ভারী হয়ে গেল বাতাস। গুলির পাশাপাশি দড়ির ফাঁসও ব্যবহার করছে ওরা। পিস্তলের গুলি শেষ হতে রাইফেলের দিকে হাত বাড়াল লসন। কিন্তু পজিশনে আনার আগেই একটা ফাঁস কেড়ে নিল রাইফেলটা। আরেক ঘোড়সওয়ার পাশ দিয়ে ছুটে যাওয়ার সময় প্রচণ্ড জোরে ল্যাসো দিয়ে আঘাত করল ওর মুখে। কয়েক মুহূর্তের জন্যে অন্ধ হয়ে গেল লসন। ধুলো উড়ছে সর্বত্র। চোখ পিটপিট করে দৃষ্টি পরিষ্কার করার প্রয়াস পেল ও, এক হাতে অন্ধের মত পিস্তলে গুলি ভরছে। কিন্তু ল্যাসোর ফাঁস ছুটে এসে পিস্তলটা কেড়ে নিল এবার। এক ঘোড়সওয়ার লাথি মেরে ধূলিময় রাস্তায় ফেলে দিল ওকে। কয়েক গজ এগিয়ে ঘোড়া ঘুরিয়ে নিল সে, তারপর ছুটে এল ফিরতি পথে, যাওয়ার সময় মাড়িয়ে যাবে লসনকে।
‘এমন মজা পাইনি বহু দিন!’ খরখরে কন্ঠে উল্লাস প্রকাশ করল স্যামুয়েল কিনকেড। ‘দেখো দেখি, আজ শুধু সোনা ব্যবসায়ী নয়, জেরেমি টাউনের টাফ মার্শালকেও ঘায়েল করতে যাচ্ছি আমরা! মজাটা টের পাচ্ছ, লসন? তোমার খেল খতম, আজই শেষ হয়ে যাবে তুমি!’
চোখ ফিরিয়ে লোকটাকে খুঁজল লসন, দেখা যাচ্ছে না কিনকেডকে। ছুটন্ত ঘোড়সওয়ারকে এড়াতে আন্দাজের ওপর একপাশে সরে গেল ও। বাড়ির দেয়ালের সঙ্গে মিশিয়ে দিল শরীর। সরার পথে ভাগ্যক্রমে পেয়ে গেল নিজের পিস্তল। দ্রুত হাতে সিলিন্ডারে বুলেট ঢোকাল ও, চোখ তুলে দেখল দালানের কোণ থেকে গর্জে উঠেছে একটা রাইফেল। ওর দিকে ছুটে আসা ঘোড়সওয়ার ছিটকে পড়ল স্যাডল থেকে। পড়ার পর আর উঠল না।
গুলিটা করেছে জেনি লয়েড।
পরমুহূর্তে আরেকজনকে রাস্তায় দেখতে পেল লসন। আইক জেসাপ!
পৃষ্ঠা-১১৯
দু’হাতের দুই পিস্তল সমানে আগুন ওগরাচ্ছে। একটু কাত হয়ে দাঁড়িয়ে গুলি ছুঁড়ছে সে, প্রত্যেকটা গুলি প্রায় নির্ভুল নিশানায় আঘাত হানছে। উঠে দাঁড়াল লসন। কিন্তু বাম দিকটা খেয়াল করেনি ও, তাড়াহুড়োয় সুযোগ হয়নি, দড়ির ফাঁস আবারও মাটিতে ফেলে দিল ওকে। এলি থমাস। লসন দেখল হাসছে সে, হাতের শটগান ধরে রেখেছে ওর মুখ বরাবর। হাসা উচিত হয়নি লোকটার, দেরি না করে গুলি করা উচিত ছিল। ওই সময়টুকুই যথেষ্ট লসনের জন্যে, এক লহমায় গুলি করল ও। একইসঙ্গে ঝাঁপ দিয়েছে একপাশে। চোখের সামনে গুঁড়িয়ে গেল এলি থমাসের মুখ, য়েন রক্তমাখা একটা মুখোশ পরেছে। শেষ মুহূর্তে গর্জে উঠেছিল তার হাতের শটগান, লসনের পাশে মাটি কেঁপে উঠল। ধুলোয় ঢাকা পড়ল ওর মুখ। দাঁড়াতে চেষ্টা করল ও, টের পেল সারা শরীর কাঁপছে। চোখ তুলে দেখল ওর দিকে তাকিয়ে আছে কিনকেডের আরেক শিষ্য মরগান কেইন। মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে তরুণের, চোখ বিস্ফারিত। হাতের পিস্তল না তুলেই গর্জে উঠল লসন, ‘পালাও, গাধা! মেরে ফেলব নইলে!’ পিছু হটল কেইন, তারপর ঘুরে দৌড়াতে শুরু করল। রাস্তার নিচু দিকে সরে গেছে স্যামুয়েল কিনকেডের দল, সেখান থেকে আবার ছুটে এসে আক্রমণ করার তোড়জোড় করছে। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না লসন, সারা শরীর ভেঙে পড়তে চাইছে। চোখের কোণে রক্ত, শার্ট ভিজে গেছে। একটা কাঁধ অবশ হয়ে গেছে, শক্তি পাচ্ছে না হাতে। কিন্তু অদম্য মনোবল আর জেদই টিকিয়ে রেখেছে ওকে। ওর ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে আছে জেনিফার লয়েড। একটু দূরে অবস্থান নিয়েছে ম্যাট হিগিন্স, নির্বিকার সুখে অপেক্ষায় আছে। তার পাশেই আইক জেসাপ আর ডিক ফেল্টন। হালাও, জো হারপার, বিল লারকিন কিংবা জ্যাক ক্রেটনও চলে এসেছে, ঝাপসা দৃষ্টিতে সবাইকে দেখতে পেল লসন।এগিয়ে আসছে ঘোড়সওয়াররা। এদিকে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে ওরা, যেন কারও নির্দেশের অপেক্ষায় আছে। কিন্তু কাজের সময় নির্দেশ দিতে হলো না, এমনকি কেউ তার ধারও ধারল না কিনকেডের দল রেঞ্জের মধ্যে আসা মাত্র গুলি ছুড়তে শুল্ম করস সবাই। একের পর এক স্যাডল থেকে খসে পড়ছে লাশ। পিস্তলের গর্জন, মানুষের বীভৎস আর্তনাদ আর ঘোড়ার আতঙ্কিত চিৎকারে মুখর হয়ে উঠল জায়গাটা। আবার পড়ে গেল লসন। এদিকে পালিয়ে গেছে কিনকেডের দল, তবে অধিকাংশই পড়ে আছে লাশ হয়ে। প্রাণপণ চেষ্টায় উঠে দাঁড়াল লান। দ্বিগুণ ক্লান্তি লাগছে এখন। নিজেকে আচ্ছন্ন মনে হচ্ছে ওর, কোন কিছুরই পরোয়া করতে ইচ্ছে করছে না। অবচেতন মন বলছে কাছের বাড়ির জানালায় আছে কেউ, কিংবা বাড়িটার পাশের গলিতে—আবারও গুলি করবে লোকটা, ওর অসহায় অবস্থার সুযোগ নিচ্ছে– তীব্র ব্যথা অনুভব করছে ও বাহুতে, অসাড় হয়ে গেছে একটা পা। বুঝতে
পৃষ্ঠা-১২০
পারছে গুলি লেগেছে শরীরের একাধিক জায়গায়। ধীরে ধীরে পাশ ফিরল ও, বাড়িটার জানালায় দৃষ্টি চালাল। আবছা আলোয় অস্পষ্ট একটা মুখ দেখতে পেল। পিস্তল তুলতে চাইল ও, কিন্তু এক বিন্দু শক্তি নেই দেহে। ক্লান্তি, রাজ্যের অবসাদ শরীরে। হুড়মুড় করে রাস্তায় পড়ে গেল ও, এবার আর উঠতে পারল না। জ্ঞান হারানোর আগে টের পেল পাশ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে কেউ, ঝাপসা দৃষ্টিতে আইক জেসাপের অস্পষ্ট অবয়ব দেখতে পেল ও। দ্রুত, প্রায় নিঃশব্দে ত্রিশ গজ দূরত্ব পেরিয়ে গেল জেসাপ। গলি ধরে ঢুকে পড়ল বাড়িটায়। কোথায় যেতে হবে জানা আছে ওর। খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ল ও। করিডর ধরে চলে এল নির্দিষ্ট কামরায়। ভেজানো পাল্লা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল, নিঃশব্দে। অন্ধকার কামরাটা, কিন্তু মানুষের নিঃশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে জেসাপ। মুহূর্তের জন্যে দ্বিধা করল ও, অন্ধকারে চোখ সয়ে আসতে জানালার পাশে দীর্ঘ একটা কাঠামো চোখে পড়ল। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল লোকটা। হাত বাড়িয়ে জানালার পর্দা টেনে দিল সে, তারপর সরে এল কামরার ভেতরের দিকে। ‘আলোটা জ্বালো, ওয়েন,’ মৃদু, প্রায় নির্লিপ্ত স্বরে বলল জেসাপ। থমকে দাঁড়াল লোকটা, হোলস্টারে ‘ছোবল হেনেছিল সে, শেষ মুহূর্তে জেসাপের কণ্ঠ চিনতে পেরে নিজেকে নিবৃত্ত করে নিল। ‘তুমি না রাস্তায় ছিলে? এখানে এলে কখন?’ আড়ষ্ট স্বরে জানতে চাইল জেসি ওয়েন।
‘আলোটা জ্বালো!’ আবারও বলল জেসাপ। শ্রাগ করল ওয়েন। পকেট হাতড়ে দেয়াশলাই বের করে জ্বালাল সে, কোণের টেবিলে রাখা লণ্ঠন ধরাল। সতর্ক দৃষ্টিতে তার প্রতিটা নড়াচড়া খেয়াল করল জেসাপ, হোলস্টারের ওপর পড়ে আছে ওর একটা হাত। ‘তো?’ জুয়াড়ীর দিকে ফিরল ওয়েন, চোঁখে সতর্ক চাহনি। ‘তুমি একটা জঘন্য লোক, ওয়েন, কেউ কি বলেছে কথাটা? শুনেছি চালু পিস্তলবাজ হিসেবে বড়াই করতে পছন্দ করো, অথচ সামনাসামনি লড়ার মুরোদ নেই তোমার! তুমি আসলে কিনকেড বা থমসনের চেয়েও অধম!’ পাথরের মত নির্লিপ্ত হয়ে গেছে ওয়েনের মুখ, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বন্ধুর দিকে। ‘বাইরের মানুষগুলোকে দেখেছ, ওয়েন? নিতান্ত নিরীহ মানুষ ওরা। কিন্তু মরবে জেনেও রুখে দাঁড়িয়েছে বেপরোয়া শত্রুর বিরুদ্ধে। ওরা একটা স্বপ্ন দেখছে-চাইছে এই শহরটা টিকে যাক। ড্যানি লসন ওদেরকে সেই স্বপ্ন দেখিয়েছে। অথচ তুমি তাকেই সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছ! লসনের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে যদি, না হয় তোমাকে সত্যিকার পুরুষ মানুষ বলা যেত, কিন্তু…’ ‘ পথ ছাড়ো আমার!’ শীতল স্বরে বাধা দিল ওয়েন। ওয়েনের চোখে চোখ রেখে ক্ষীণ হাসল জুয়াড়ী। ‘আজকে একটা জুয়া খেলতে এসেছি আমি, ওয়েন, অন্যরকম জুয়া। এই কামরা থেকে হয় তুমি, নয়তো আমি বেরোব।’
পৃষ্ঠা ১২১ থেকে ১৩২
পৃষ্ঠা-১২১
‘নিকুচি করি তোমার জুয়ার! ভেবেছ তোমাকে হারানোর ক্ষমতা নেই আমার? বড় বাড় বেড়েছে তোমার, জেসাপ, ভেবেছ সাধারণ মাইনারদের মত আমাকেও সামাল দিতে পারবে?’ বাঁকা হাসি ওয়েনের ঠোঁটের কোণে, তিরতির করে কাঁপছে কপালের পাশে একটা শিরা। হোলস্টারের ওপর লেপ্টে আছে দুই তালু। সিদ্ধান্ত টা নিয়েই ফেলেছে, নাচার সে-বন্ধুর লাশ টপকেই বেরিয়ে যেতে হবে। ‘যে কোন একজন! রাজি তুমি?’ হালকা চালে প্রশ্নটা করল জেসাপ, সিগার ধরিয়েছে এই মাত্র।
‘যেভাবে চাও তুমি! স্বীকার করছি তাসে তোমার হাত সত্যিই ভাল। এতটাই যে সবাই বলে তাস নাকি তোমার ইচ্ছেমত চলে। কিন্তু পিস্তল? পিস্তল কি কারও কথা শোনে বা ইচ্ছের কথা বোঝে, যখন সামনে এরচেয়েও সেয়ানে পিস্তলবাজ দাঁড়িয়ে থাকে?’ ‘আমারটা বোঝে।’ ‘তাহলে দেখাও!’ বিদ্যুৎ খেলে গেল ওয়েনের হাতে, চোখের নিমেষে মুঠিতে উঠে এল জোড়া পিস্তল।মাত্র দুটো গুলির শব্দ হলো। এর ঠিক দুই মিনিট পর বাড়িটা থেকে বেরিয়ে এল আইক জেসাপ। পরদিন বুটহিলে কবর দেয়া হলো জেসি ওয়েনকে। তার কবরের ফলকে লেখা থাকল:
জেসি ওয়েন (? – ১৮৮১) পিস্তলে আইক জেসাপের দক্ষতা নিয়ে বাজি ধরেছিল সে। বন্ধুর সন্দেহ নিরসন করতে খুব বেশি দেরি করেনি জেসাপ।
পৃষ্ঠা-১২২
এগারো:- ড্যানি লসনের মনে হলো কয়েক মুহূর্ত পরেই চোখ খুলেছে। দৃষ্টি পরিষ্কার হতে দেখল শহরের একমাত্র রেস্টুরেন্টের মেঝেয় শুয়ে আছে। দরজায় রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে আছে আইক জেসাপ, দুই জানালায় অবস্থান নিয়েছে ম্যাট হিগিন্স আর কার্ল ব্রেনেট। কারও কোলে মাথা ওর। চোখ তুলে দেখল লসন। জুলিয়া লারকিন! নীল আয়ত চোখে রাজ্যের উদ্বেগ আর শঙ্কা। ঠিক পাশেই মেরী কোবার্ন। একটা কেচির সাহায্যে ওর রক্তমাখা শার্ট কাটতে শুরু করেছে জেনিফার লয়েড। ফেল্টন, হারপার, হ্যালার্ড…সবাই আছে কামরায়। ‘বাইরের কি অবস্থা, বলো তো,’ ক্লান্ত স্বরে জানতে চাইল ও। ‘শান্ত এখন,’ উত্তর দিল ফেল্টন। ‘মনে হচ্ছে চুকে গেছে সবকিছু। তবে কে যেন গুলি করেছিল জেসি ওয়েনকে। মারা গেছে ও।’ দৃষ্টি নামিয়ে নিজের দিকে তাকাল লসন। ওর শরীর থেকে রক্ত মুছতে শুরু করেছে জেনি, কাঁধে বুলেটের ক্ষতটা নিজেই দেখতে পেল ও। ‘আঘাত কতটা গুরুতর আমার?’ ‘চারটে গুলি ঢুকেছে তোমার শরীরে। প্রচুর রক্ত হারিয়েছ।’ চোখ বন্ধ করল লসন। শরীরে কোন ব্যথা অনুভব করছে না এখন, তবে অসাড় হয়ে গেছে বাম বাহু। সাড়া নেই হাতে। ক্লান্তি আর আড়ষ্টতায় পেয়ে বসেছে মুখ আর হাতের আঙুলগুলোকে। জেনি এসব কাজে অভিজ্ঞ ডাক্তারের মতই দক্ষ, জানে ও। ঘরের ভেতরে শ্বাস-প্রশ্বাস আর মৃদু চলাফেরার শব্দ ছাড়া আর কোন আওয়াজ নেই। ওর শরীরে বুলেট খুঁজছে জেনি, টের পেল লসন। ব্যথা, রাজ্যের ব্যথা অনুভব করছে এখন। বাইরে, রাস্তায় অপরিচিত একটা কণ্ঠ শোনা গেল। ‘তোমরা ভেতরে আছ যারা, তাদের বলছি। কিনকেডের লাশ নিয়ে যেতে এসেছি আমরা। খোদার কসম, আর কোন উদ্দেশ্য নেই আমাদের।’
‘নিয়ে যাও,’ উত্তর দিল ফেল্টন। ‘তবে এর পরপরই শহর ছাড়বে। তোমাদের কাউকে এখানে প্রয়োজন নেই আমাদের।’ ‘কথা বলছে কে? ড্যানি লসন কি ওখানে নেই?’ ‘বাইরে আছে ও, তোমাদের খুঁজছে,’ চেঁচাল ব্রেনেট। ‘সুতরাং সময় থাকতে কেটে পড়ো।’ নিচু স্বরে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করল ওরা, তারপর আগের লোকটাই মুখ খুলল। ‘ঝামেলা আর চাই না আমরা। কিনকেড নেই যখন, আমাদের কাজও শেষ। ফিরে যাচ্ছি আমরা। তোমরাও লসনকে ফিরিয়ে নাও।’ মৃদু হাসি খেলে গেল জেফরি হ্যালার্ডের ঠোঁটের কোণে। অষুধটা বড় তেতো, আনমনে ভাবল স্কুল মাস্টার, অথচ একেই কিনা অবজ্ঞা করেছে সে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেল; আবার চুপচাপ হয়ে গেল চারদিক। কোথাও ডেকে উঠল দুটো মোরগ। ‘কেউ কি একটা বাকবোর্ড জোগাড় করবে, ওকে কেবিনে নিয়ে যাব আমি?’ জরুরী কণ্ঠে বলল জুলিয়া লারকিন, বরাবরের মতই কণ্ঠটা সুরেলা ঝংকার সৃষ্টি করল প্রায় অচেতন ড্যানি লসনের কানে। আচমকা নড়ে উঠল লসনের দেহ, জ্ঞান হারাল সে। কিন্তু জেনি তখন আনন্দে চেঁচিয়ে উঠেছে। ‘পেয়েছি! শেষ বুলেটটাও বের করে ফেলেছি।’ ‘হয়তো বাথানেই ফিরে যাওয়া উচিত ওর,’ মৃদু স্বরে আপত্তি করল ম্যাট হিগিন্স। ‘ওর মা বলেছে জোর করে হলেও যেন ধরে নিয়ে যাই ওকে। ড্যানকে অপছন্দ করে এমন লোকের সংখ্যা এখনও কম নয় এ শহরে। ‘কিভাবে ওকে নেবে তুমি, ম্যাট হিগিন্স?’ তীক্ষ্ণ স্বরে প্রতিবাদ করল জুলিয়া লারকিন। ‘এই শরীরে পাহাড় পেরোতে পারবে ও? ঠিক আছে, নিশ্চয়ই যাবে ও, কিন্তু আগে সুস্থ হোক। মিসেস লসনকে বোলো জুলিয়া লারকিন নিজে পৌছে দেবে ওঁর ছেলেকে।’
পৃষ্ঠা-১২৩
‘জ্বী, ম্যা’ম!’ ম্লান স্বরে বলল হিগিন্স, দৃষ্টি নিচু হয়ে গেছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সন্তুষ্ট, এবার বোধহয় সঠিক লাগাম পড়তে যাচ্ছে ড্যানি লসনের গলায়, আনমনে ভাবল সে। মা-লসন নিশ্চয়ই দারুণ খুশি হবে। এখনই ছুটে গিয়ে খবরটা দিতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু নিজেকে সামলে নিল সে। আগে লসনের বিপদের আশঙ্কা কাটুক, তারপর নিশ্চিত খবর নিয়ে বাথানে যাবে। ড্যানির আহত হওয়ার খবর পেয়ে নিশ্চয়ই বসে থাকবে না মহিলা, নিজেই ছুটে আসবে। পরদিন সকালে আবার চোখ মেলল লসন। জানালার পাশে শুয়ে আছে ও। পাশের এক চেয়ারে ঘুমিয়ে আছে জুলিয়া লারকিন, ক্লান্তি মেয়েটার মুখে। হাঁটুর ওপর শটগান রেখে দরজার কাছে বসে আছে ম্যাট হিগিন্স। উঠে বসার চেষ্টা করল লসন। কিন্তু একমণ ভারী মনে হচ্ছে মাথাটা। শঙ্কিত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল হিগিন্স। ‘উঁহু, ওঠার চেষ্টা কোরো না, বাছা। মেয়েটার ঘুমও ভাঙিয়ো না। প্রায় সারা রাত জেগেছে বেচারী।’ ‘এদিকের কি অবস্থা?’ ‘কিনকেড, এলি থমাস, ওয়েন-কেউ বেঁচে নেই। মারাত্মক আহত হয়েছে মরগান কেইন, তবে এ যাত্রা বোধহয় বেঁচে যাবে। গুলি খেয়েছে আরও কয়েকজন। তবে সবাই তো ভাড়াটে, কিনকেড বেঁচে নেই শুনেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে ওরা, টাকা দেবে কে? অন্যরা, যারা তখনও শহরে ছিল, কাল রাতের ঘটনার পর আর থাকবে না নিশ্চয়ই। তুমি পেরেছ, ড্যান, শহরটা পরিষ্কার করেছ!’ নিরুত্তর থাকল লসন। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। না, তেমন সুন্দর নয় বাইরের দিকটা। রাস্তাটা কোনমতে তৈরি, শহরটাও তেমনি। তবে আজ থেকে বিশ বছর পর কেউ যদি দেখে তখন হয়তো মনোরম একটা শহর দেখতে পাবে। লোকটা হয়তো কল্পনাও করতে পারবে না প্রথম দিকে কি অবস্থা ছিল এই শহরের, কত রক্তপাতের বিনিময়ে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এখানে, আর অল্পের জন্যে মরতে বসেছিল শহরটা! ‘ম্যাট,’ শেষে মৃদু স্বরে বলল লসন। ‘এ শহরটা মোটেও সুন্দর নয়।’ ‘প্রথম অবস্থায় কোন শহরই সুন্দর থাকে না, বাছা। তবে একদিক থেকে
বিবেচনা করলে কালকের তুলনায় আজকে কিন্তু শহরটা অনেক সুন্দর।’ ‘তোমাদের জন্যে ভালই হলো। এখন থেকে হুইস্কি পান করতে চাইলে এখানে চলে আসতে পারবে।’ ‘হয়তো। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, তিন বছর ধরে কাজ করছি তোমাদের বাথানে, কিন্তু ধারে-কাছে কোন শহর ছাড়াই দিব্যি চলে গেছে আমাদের। কখনও অভাব বোধ করিনি। শহর মানেই ঝামেলা, অন্তত আমার জন্যে।’ এক এক করে এল সবাই। লসনকে দেখে যাচ্ছে। প্রায় জোর করে জুলিয়াকে তাড়িয়েছে হিগিন্স, বিশ্রাম নিতে বাধ্য করেছে। ক্লান্তি এখনও দূর হয়নি, লসনের শরীর থেকে। কিন্তু কথা বলতে ভাল লাগছে ওর। শহর সম্পর্কে শুনল ও। গোলমাল পাকাতে পারে, এমন কেউ আর নেই এখন। দুপুরের দিকে খবর এল তখন পর্যন্ত কোন ঝামেলা হয়নি। তালিকায় নাম
পৃষ্ঠা-১২৪
ছিল, এমন একটা লোকও নেই আর। শুনে ক্লান্তি যেন আরও বেড়ে গেল ওর, চোখ বুজল লসন। আবার যখন চোখ খুলল, তখন প্রায় রাত। একটা একটা করে জ্বলে উঠছে শহরের আলো। চোখ ফিরিয়ে পাহাড়ের দিকে তাকাল ও, আবছা ভাবে চোখে পড়ছে বিশাল কাঠামো। ওই পাহাড়ের বুকে শান্তি আছে, আছে আলো-ছায়ায় ঘেরা শান্তিপূর্ণ বসতির হাতছানি। কিন্তু সেখানে বরাবরই নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে হয়েছে ওর। কিসের যেন অভাব বোধ করেছে। টান টান উত্তেজনা, রোমাঞ্চ আর অজানাকে জানার তীব্র ইচ্ছে ঘরছাড়া করেছে ওকে। কিন্তু এটাই ওর ঠিকানা, কোন একদিন ওখানেই স্থির হতে হবে। আজীবন তো এভাবে চলবে না। তাছাড়া…কার্ল ব্রেনেটের মতই স্বাভাবিক মৃত্যু চায় লসন, পিস্তলের গুলিতে মরতে চায় না। একটা স্থায়ী, শান্তিপূর্ণ জীবন কামনা করে ও। কিন্তু তারও আগে চাই… ‘কেমন লাগছে আজ, ড্যান?’ মৃদু কণ্ঠে জানতে চাইল জুলিয়া লারকিন, এইমাত্র কামরায় প্রবেশ করেছে। ঝরঝরে সতেজ দেখাচ্ছে ওকে, এবং কমনীয়। কাঙ্ক্ষিত এক নারী। ‘ভাল। কিন্তু শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে না। তোমাদের জন্যে ঝামেলা করছি কেবল। হিগিন্স আমাকে বাথানে নিয়ে গেলেই পারত।’
‘এ নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না, ড্যানি লসন! ওসব আমার ওপর ছেড়ে দাও।’ টেবিলে ট্রে নামিয়ে রাখল মেয়েটি, তারপর কৃত্রিম অভিযোগ নিয়ে দেখল ওকে। ‘খুব কাণ্ডজ্ঞান দেখাচ্ছ, কিন্তু খুনে একটা শহরে এসে মার্শালের দায়িত্ব নেয়ার সময় কোথায় ছিল এসব? এত বিপদের মুখে পড়তে যাচ্ছ, মা-কে বলে এসেছ? কাজটা ভাল করোনি তুমি।’ বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকাল লসন। ‘কিন্তু-তুমি এসব জানলে কি করে? নিশ্চয়ই ম্যাট বলেছে?’ ‘উঁহু, ম্যাট বলেনি। যার অভিযোগ তার মুখেই শুনেছি আমি।’ ‘তারমানে–মা এসেছিল?’ হ্যাঁ।’ চিন্তাগুলো জট পাকিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ, মেলাতে পারছে না লসন। ‘চলে গেছে?’ ‘হ্যাঁ। হিগিন্স পৌঁছে দিতে গেছে ওঁকে। দু’জন কাউহ্যান্ড রেখে গেছে সে, ওর ধারণা এখনও বিপদ কাটেনি তোমার। পাহারায় থাকা উচিত কারও।’ ‘তাই? খুব ভাল মানুষ ও। শহরের কি অবস্থা?’ ‘এ নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। তোমার কাজ হচ্ছে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠা।’ ‘শহরের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করার জন্যে কাউকে নিয়োগ করেছে ওরা?’ ‘আপাতত কার্ল ব্রেনেট দায়িত্ব নিয়েছে। ও বলছে তুমি সুস্থ হওয়ার পর এ নিয়ে আলাপ করবে তোমার সঙ্গে।’
পৃষ্ঠা-১২৫
‘ভাল। এরকমই চেয়েছিলাম আমি।’ জোর করে ওকে সুপ আর পাই খাওয়াল জুলিয়া। নীরবে কেটে গেল সময়। খানিকটা হলেও নিজেকে সুস্থ মনে হচ্ছে লসনের। কিন্তু কিছুটা হলেও বিব্রত বোধ করছে, অযথাই লারকিনদের জন্যে ঝামেলা করছে ও। ‘বিল বা পিট কোথায়?” ‘সোনা তুলছে। অন্য দিকে মনোযোগ দেয়ার সময় কোথায়!’ ‘ওহ্, প্রচুর উঠছে তাহলে!’ উদাস দৃষ্টিতে জানালা দিয়ে তাকাল ও। ‘আমি শুধু শুধু তোমাদের সমস্যা করছি…’ ‘বাজে কথা বোলো না, ড্যান!’ ‘পিস্তল কোথায় আমার?’ হঠাৎ জিজ্ঞেস করল ও। ‘তোমার পাশেই,’ আঙুল তুলে দেখাল মেয়েটি। ‘ওগুলো রেখে গেছে কার্ল ব্রেনেট। মজার ব্যাপার হচ্ছে হ্যান্স কোবার্নও অতিরিক্ত পিস্তলটা পাঠিয়ে দিয়েছে। তুমি কল্পনাও করতে পারবে না, ড্যান, সেদিন তোমার কাছ থেকে পিস্তল পেয়ে কি যে খুশি হয়েছিল ও। কোবার্ন আসলে আশ্চর্য এক মানুষ। আর আমার ধারণা সেদিন যেভাবে বাঁচিয়েছ ওকে, সেভাবে বোধহয় সাহায্য করোনি কখনও। পিস্তল ছুঁড়ে দেওয়ার ঘটনাটা বারবার বলছে সে, মাথা থেকে এ ব্যাপারটা সরাতে পারছে না।’
A ক্ষীণ হাসল লসন। ‘পিস্তল দরকার ছিল ওর তখন। আমার কাছে ছিল, দিয়েছি। এর মধ্যে তেমন কোন ব্যাপার তো নেই।’ মাথা দোলাল মেয়েটি, তারপর শ্রাগ করল। ‘যে যেভাবে দেখে, টেবিলের ওপর থেকে পিস্তলটা তুলে নিয়ে লসনের হাতে ধরিয়ে দিল ও। ‘এটা কিন্তু গুলিতে ভরা, কোবার্ন বলেছে তুমি নাকি ভরা পিস্তলই পছন্দ করো।’ ‘তা বটে। খালি পিস্তলের কি দাম!’ পাশে বসে থাকল জুলিয়া। নীরব উষ্ণ কামরায় ওর ছন্দময় নিঃশ্বাস স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে লসন। ‘তুমি বোধহয় বদলে গেছ,’ অস্ফুট স্বরে বলল ও শেষে। ‘কি রকম?’ ভুরু কুঁচকে জানতে চাইল মেয়েটি। ‘মনে হচ্ছে পশ্চিমে নতুন আসোনি, যেন এখানকার পুরানো বাসিন্দা। অথচ গত কয়েকদিন ভয়ঙ্কর কিছু ঘটনা আর অসংখ্য মৃত্যু দেখতে হয়েছে তোমাকে।’ ‘সয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, আমি বুঝতে পেরেছি পরিস্থিতির দাবিতেই ঘটেছে এসব। বুনো একটা দেশ, কিছু কিছু মানুষও হয়তো খারাপ, কিন্তু এও ঠিক ভাল মানুষও আছে এখানে। প্রথমে কিছুটা খারাপ লাগলেও এখন আর লাগছে না। এই শহরটাকেও ভাল লাগছে। প্রাণের সঞ্চার হয়েছে এখানে, এবং তুমিই তা দিয়েছ, ড্যান।’ ‘বাড়িয়ে বলছ তুমি। কি এমন করেছি আমি! অন্য যে কেউ এসব করত।’ ‘কিন্তু এত ঝুঁকি নিয়ে বেপরোয়া লোকগুলোর মুখোমুখি দাঁড়াত? কই, তোমার আগে তো কেউ সাহস করেনি!’ ‘জেফরি হ্যালার্ড করেছে।’ ‘কিন্তু সবারই সামর্থ্যের সীমা আছে, সেটা পেরিয়ে গেলেই ছন্দপতন হয়।
পৃষ্ঠা-১২৬
ঝামেলাও তৈরি হয়।’ জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল লসন। খানিক দ্বিধা করল ও, তারপর বলেই ফেলল কথাটা। ‘জেফরি হ্যালার্ড মানুষটা ভাল। ওর কথা ভেবে দেখতে পারো তুমি, ম্যা’ম, একদিন এ অঞ্চলের খুব নামকরা লোক হবে ও।’ ‘তাই?’ ভ্রুকুটি করল জুলিয়া লারকিন। ‘কিন্তু তুমি কি জানো আমার শরীরে আইরিশ রক্ত বইছে? আমার সমস্যা কি জানো, শান্ত নির্ঝঞ্জাট পুরুষ পছন্দ করি না আমি। আমার পছন্দ জেদী, একরোখা বুনো পুরুষ,’ ক্ষণিকের জন্যে থামল ও, তারপর স্মিত হেসে যোগ করল, ‘তোমার মত।’ অজান্তে আভা ছড়াল মেয়েটির মুখে, দ্রুত যোগ করল: ‘তবে ঠিক করেছি এখানে আর থাকব না।’ ‘কেন? পুবে ফিরে যাবে?’ রহস্যময় হাসি দেখা গেল মেয়েটির ঠোঁটের কোণে। গভীর মমতা আর আবেগে লসনের চুলে হাত বুলাল ও। ‘পরে বলব একদিন। লক্ষ্মী ছেলের মত শুয়ে থাকো এখন, তোমার জন্যে কফি তৈরি করে আনছি।’ ‘আলোটা নিভিয়ে দাও।’ পিস্তলটা চাদরের নিচে, কোমরের পাশে রাখল লসন। পিস্তল ছাড়া নিজেকে অসহায় মনে হয় ওর। এই যেমন এখন মনে হচ্ছে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া কোন অঙ্গ শরীরে জোড়া লেগে গেছে আবার। রান্নাঘর থেকে মৃদু শব্দ আসছে। বাইরের রাস্তায় কখনও কখনও পদশব্দ শোনা যাচ্ছে। শহর থেকে সেলুন আর ড্যান্স হলের বাদ্য ভেসে আসছে, তবে অন্যদিনের মত চড়া নয়। ঘুমিয়ে পড়ল লসন। এবং মিনিট কয়েক পরেই ঘুম ভাঙল, মনে হলো ওর, কারণ কফি নিয়ে এখনও ফেরেনি জুলিয়া। খুব আলতো পায়ের শব্দ শুনতে পেল লসন। সন্তর্পণে পোর্চে যেন পা রেখেছে কেউ। কান পাতল ও। শুনতে কি ভুল হলো? কারও পায়ের শব্দ? এমন মৃদু এবং সতর্ক! রাস্তায় দৌড়াচ্ছে কে যেন। তারপরই গম্ভীর একটা শব্দ শোনা গেল, মনে হলো মেঝেয় ভারী কিছু পড়েছে। অস্ফুট স্বরে গুঙিয়ে উঠল কেউ, এলোমেলো পায়ের শব্দ শোনা গেল আবার, আগের চেয়ে জোরাল। হঠাৎ ফিসফিস করে উঠল কেউ: ‘ড্যান, সাবধান! সাবধান, ড্যান!’ ফিসফিস করে কি বলছে লোকটা? ঘুম পাচ্ছে ওর। কিছুই বুঝতে পারছে না লসন। জুলিয়া এত দেরি করছে কেন? ও কি স্বপ্ন দেখছে? তখনই আবার পাশ থেকে কেউ বলে উঠল যেন: ‘ড্যান, কোবিন এসে গেছে…কোবিন উইন্সটন…’ আচমকা স্তব্ধ হয়ে গেল কণ্ঠটা। অন্ধকার ঘরে টান টান হয়ে গেল লসনের দেহ। সামান্য শব্দ হলো দরজার কাছে। ডানদিকে খানিকটা কাত হলো ও, অবচেতন মন সতর্ক করতে চাইছে ওকে; কেবলই মনে হচ্ছে বিপদ আছে সামনে। দরজাটা ওর মাথার কাছে, একটু পেছনে-সেখানেই বিপদ! বামদিক থেকে পিস্তলটা ডানদিকে নিল লসন। ডান হাতের মুঠিতে শক্ত করে
পৃষ্ঠা-১২৭
ধরে রাখল। জুলিয়া কোথায়? অবশ্য মনে মনে প্রার্থনা করছে মেয়েটি যেন এখন রান্নাঘরেই থাকে। কিন্তু ওকে সতর্ক করল কে? জানে না, বুঝতে পারছে না লসন। চুপচাপ অপেক্ষা করল ও। মুখের ভেতরটা শুকিয়ে আসছে, বৃষ্টিতে ভেজা বেড়ালের বাচ্চার মতই দুর্বল মনে হচ্ছে নিজেকে। যেন প্রয়োজনে মাথাও কাত করতে পারবে না। গাঢ় একটা ছায়া দেখা গেল কামরায়। দীর্ঘদেহী লোকটা, ডান হাতটা অপেক্ষাকৃত লম্বা দেখাচ্ছে। তারমানে হাতে পিস্তল আছে। ‘হ্যালো, ড্যান!’ বিজয়ের আনন্দ ছায়ামূর্তির স্বরে। ‘হ্যালো, কোবিন,’ বলল লসন, শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে নিল জিভ দিয়ে, চোখ পিটপিট করে তাকাল লোকটার দিকে। ‘ভাবিনি সত্যিই আসবে তুমি, কারণ কিনকেড কিন্তু মারা গেছে।’ ‘আমাকে অগ্রিম দিয়েছে ও। তুমি তো জানোই আমার কাজের ধরন। পুরো টাকা আগাম না পেলে কোন কাজে হাত দেই না। তাছাড়া তোমাকে মেরে ফেলতে খুব ভাল লাগবে আমার। কখনোই তোমাকে পছন্দ হয়নি কিনা।’ ‘নিশ্চয়ই। আমাকে পছন্দ করার কোন কারণ নেই তোমার। বরং অপছন্দ করাই স্বাভাবিক, কারণ তুমি ভাল করেই জানো তোমার চেয়ে ভাল পিস্তল চালাই আমি।’ খরখরে স্বরে হাসল কোবিন উইন্সটন, বিকৃত শোনাল কন্ঠ। কৌতুক বা রসবোধ কোনটাই নেই কণ্ঠে। ‘তুমি? আমার চেয়ে ভাল চালাও? কে জানে, ড্যান, সেই ফয়সালা হলে তো! কারণ একটু পরেই তোমাকে খুন করব আমি। ‘সত্যি কথা বলতে কি,’ বলে চলল সে। ‘এভাবেই যে ব্যাপারটার নিষ্পত্তি হচ্ছে তাতে খুশি আমি। তুমি শুয়ে আছ, অসহায়-আহা, কি যে ভাল লাগছে আমার!’ ‘বড় বেশি কথা বলো তুমি, কোবিন! এবং টালবাহানা করতে পছন্দ করো। খুব সহজেই সিদ্ধান্তে পৌঁছে, যাও। তোমাকে বোকা বানাতে চাই না আমি, কোবিন। কিন্তু তুমি কি জানো, সঙ্গে পিস্তল আছে আমার?’ ‘বাহ্, ড্যান, বাহ্! এখনও ধাপ্পা দেওয়ার বুদ্ধি হারাওনি দেখছি!’ ‘বেশ, মানছি, আমার সঙ্গে পিস্তল নেই। তা, তোমার অতিরিক্তটা ধার দাও না আমাকে? দেবে? ধার দাও-সমান লড়াই হোক। নাকি ভয় পাচ্ছ?’ হেসে উঠল কোবিন উইন্সটন। বাইরের দরজায় কারও শব্দ পাওয়া গেল, দুর্বল হাতে দরজার নব ঘুরাচ্ছে কেউ। ঠায় দাঁড়িয়ে আছে উইন্সটন, দরজার দিকে চলে গেছে দৃষ্টি, পিস্তলের নল ঘুরে গেছে সেদিকে। উল্টোদিকে, রান্নাঘরের দিকের দরজায় দেখা গেল জুলিয়াকে। ‘ড্যান, ঘুমাচ্ছ নাকি? কফি এনেছি। অপেক্ষা করো, আগে আলো জ্বালি।’ শব্দ শুনেই পাঁই করে উল্টো ঘুরল কোবিন উইন্সটন, এবং পরমুহূর্তে ভুল বুঝতে পারল। একটা মেয়ে মাত্র। পিস্তলের নল ফিরিয়ে আনছিল সে, এবং ঠিক তখনই তাকে গুলি করল লসন।
পৃষ্ঠা-১২৮
ঝামেলাও তৈরি হয়।’ জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল লসন। খানিক দ্বিধা করল ও, তারপর বলেই ফেলল কথাটা। ‘জেফরি হ্যালার্ড মানুষটা ভাল। ওর কথা ভেবে দেখতে পারো তুমি, ম্যা’ম, একদিন এ অঞ্চলের খুব নামকরা লোক হবে ও।’ ‘তাই?’ ভ্রুকুটি করল জুলিয়া লারকিন। ‘কিন্তু তুমি কি জানো আমার শরীরে আইরিশ রক্ত বইছে? আমার সমস্যা কি জানো, শান্ত নির্ঝঞ্জাট পুরুষ পছন্দ করি না আমি। আমার পছন্দ জেদী, একরোখা বুনো পুরুষ, ক্ষণিকের জন্যে থামল ও, তারপর স্মিত হেসে যোগ করল, ‘তোমার মত।’ অজান্তে আভা ছড়াল মেয়েটির মুখে, দ্রুত যোগ করল: ‘তবে ঠিক করেছি এখানে আর থাকব না।’ ‘কেন? পুবে ফিরে যাবে?’ রহস্যময় হাসি দেখা গেল মেয়েটির ঠোঁটের কোণে। গভীর মমতা আর আবেগে লসনের চুলে হাত বুলাল ও। ‘পরে বলব একদিন। লক্ষ্মী ছেলের মত শুয়ে থাকো এখন, তোমার জন্যে কফি তৈরি করে আনছি।’ ‘আলোটা নিভিয়ে দাও।’ পিস্তলটা চাদরের নিচে, কোমরের পাশে রাখল লসন। পিস্তল ছাড়া নিজেকে অসহায় মনে হয় ওর। এই যেমন এখন মনে হচ্ছে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া কোন অঙ্গ শরীরে জোড়া লেগে গেছে আবার।
রান্নাঘর থেকে মৃদু শব্দ আসছে। বাইরের রাস্তায় কখনও কখনও পদশব্দ শোনা যাচ্ছে। শহর থেকে সেলুন আর ড্যান্স হলের বাদ্য ভেসে আসছে, তবে অন্যদিনের মত চড়া নয়। ঘুমিয়ে পড়ল লসন। এবং মিনিট কয়েক পরেই ঘুম ভাঙল, মনে হলো ওর, কারণ কফি নিয়ে এখনও ফেরেনি জুলিয়া। খুব আলতো পায়ের শব্দ শুনতে পেল লসন। সন্তর্পণে পোর্চে যেন পা রেখেছে কেউ। কান পাতল ও। শুনতে কি ভুল হলো? কারও পায়ের শব্দ? এমন মৃদু এবং সতর্ক! রাস্তায় দৌড়াচ্ছে কে যেন। তারপরই গম্ভীর একটা শব্দ শোনা গেল, মনে হলো মেঝেয় ভারী কিছু পড়েছে। অস্ফুট স্বরে গুঙিয়ে উঠল কেউ, এলোমেলো পায়ের শব্দ শোনা গেল আবার, আগের চেয়ে জোরাল। হঠাৎ ফিসফিস করে উঠল কেউ: ‘ড্যান, সাবধান! সাবধান, ড্যান!’ ফিসফিস করে কি বলছে লোকটা? ঘুম পাচ্ছে ওর। কিছুই বুঝতে পারছে না লসন। জুলিয়া এত দেরি করছে কেন? ও কি স্বপ্ন দেখছে? তখনই আবার পাশ থেকে কেউ বলে উঠল যেন: ‘ড্যান, কোবিন এসে গেছে…কোবিন উইন্সটন…’ আচমকা স্তব্ধ হয়ে গেল কণ্ঠটা। অন্ধকার ঘরে টান টান হয়ে গেল লসনের দেহ। সামান্য শব্দ হলো দরজার কাছে। ডানদিকে খানিকটা কাত হলো ও, অবচেতন মন সতর্ক করতে চাইছে ওকে; কেবলই মনে হচ্ছে বিপদ আছে সামনে। দরজাটা ওর মাথার কাছে, একটু পেছনে-সেখানেই বিপদ! বামদিক থেকে পিস্তলটা ডানদিকে নিল লসন। ডান হাতের মুঠিতে শক্ত করে
পৃষ্ঠা-১২৯
ধরে রাখল। জুলিয়া কোথায়? অবশ্য মনে মনে প্রার্থনা করছে মেয়েটি যেন এখন রান্নাঘরেই থাকে। কিন্তু ওকে সতর্ক করল কে? জানে না, বুঝতে পারছে না লসন। চুপচাপ অপেক্ষা করল ও। মুখের ভেতরটা শুকিয়ে আসছে, বৃষ্টিতে ভেজা বেড়ালের বাচ্চার মতই দুর্বল মনে হচ্ছে নিজেকে। যেন প্রয়োজনে মাথাও কাত করতে পারবে না। গাঢ় একটা ছায়া দেখা গেল কামরায়। দীর্ঘদেহী লোকটা, ডান হাতটা অপেক্ষাকৃত লম্বা দেখাচ্ছে। তারমানে হাতে পিস্তল আছে। ‘হ্যালো, ড্যান!’ বিজয়ের আনন্দ ছায়ামূর্তির স্বরে। ‘হ্যালো, কোবিন,’ বলল লসন, শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে নিল জিভ দিয়ে, চোখ পিটপিট করে তাকাল লোকটার দিকে। ‘ভাবিনি সত্যিই আসবে তুমি, কারণ কিনকেড কিন্তু মারা গেছে।’ ‘আমাকে অগ্রিম দিয়েছে ও। তুমি তো জানোই আমার কাজের ধরন। পুরো টাকা আগাম না পেলে কোন কাজে হাত দেই না। তাছাড়া তোমাকে মেরে ফেলতে খুব ভাল লাগবে আমার। কখনোই তোমাকে পছন্দ হয়নি কিনা।’ ‘নিশ্চয়ই। আমাকে পছন্দ করার কোন কারণ নেই তোমার। বরং অপছন্দ করাই স্বাভাবিক, কারণ তুমি ভাল করেই জানো তোমার চেয়ে ভাল পিস্তল চালাই আমি।’ খরখরে স্বরে হাসল কোবিন উইন্সটন, বিকৃত শোনাল কন্ঠ। কৌতুক বা রসবোধ কোনটাই নেই কণ্ঠে। ‘তুমি? আমার চেয়ে ভাল চালাও? কে জানে, ড্যান, সেই ফয়সালা হলে তো! কারণ একটু পরেই তোমাকে খুন করব আমি। ‘সত্যি কথা বলতে কি,’ বলে চলল সে। ‘এভাবেই যে ব্যাপারটার নিষ্পত্তি ইচ্ছে তাতে খুশি আমি। তুমি শুয়ে আছ, অসহায়-আহা, কি যে ভাল লাগছে আমার!’ ‘বড় বেশি কথা বলো তুমি, কোবিন! এবং টালবাহানা করতে পছন্দ করো। খুব সহজেই সিদ্ধান্তে পৌছে, যাও। তোমাকে বোকা বানাতে চাই না আমি, কোবিন। কিন্তু তুমি কি জানো, সঙ্গে পিস্তল আছে আমার?’ ‘বাহ্, ড্যান, বাহ্! এখনও ধাপ্পা দেওয়ার বুদ্ধি হারাওনি দেখছি!’ ‘বেশ, মানছি, আমার সঙ্গে পিস্তল নেই। তা, তোমার অতিরিক্তটা ধার দাও না আমাকে? দেবে? ধার দাও-সমান লড়াই হোক। নাকি ভয় পাচ্ছ?’ হেসে উঠল কোবিন উইন্সটন। বাইরের দরজায় কারও শব্দ পাওয়া গেল, দুর্বল হাতে দরজার নব ঘুরাচ্ছে কেউ। ঠায় দাঁড়িয়ে আছে উইন্সটন, দরজার দিকে চলে গেছে দৃষ্টি, পিস্তলের নল ঘুরে গেছে সেদিকে। উল্টোদিকে, রান্নাঘরের দিকের দরজায় দেখা গেল জুলিয়াকে। ‘ড্যান, ঘুমাচ্ছ নাকি? কফি এনেছি। অপেক্ষা করো, আগে আলো জ্বালি।’ শব্দ শুনেই পাঁই করে উল্টো ঘুরল কোবিন উইন্সটন, এবং পরমুহূর্তে ভুল বুঝতে পারল। একটা মেয়ে মাত্র। পিস্তলের নল ফিরিয়ে আনছিল সে, এবং ঠিক তখনই তাকে গুলি করল লসন।
পৃষ্ঠা-১৩০
গুলিটা বোধহয় লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে বিছানার অন্য পাশে সরে গেল লসন। উইন্সটনের গুলিটা এসে বিধল বিছানায়, একটু আগে যেখানে ছিল ও। আবারও গুলি করল লসন। কিছুটা সামনের দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে নিষ্ঠুর গানম্যান। এবার ডানদিকে হেলে পড়ল দেহটা, কিন্তু দীর্ঘ শরীরে মোচড় তুলে সিধে হলো সে, তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল বিছানায়, লসনের পাশে। ‘মি. উইন্সটন?’ অস্বাভাবিক শান্ত কন্ঠে বলে উঠল জুলিয়া। ‘তোমার যদি আপত্তি না থাকে তো একসঙ্গে কফি খেতে পারি আমরা।’ এমন পরিস্থিতিতে অদ্ভুত প্রস্তাবটা থমকে দিল তাকে, তবে ক্ষণিকের জন্যে। মানুষ হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল সে, শান্ত স্বরের ভদ্র প্রস্তাবটা তাকে হতভম্ব করে দিয়েছে। সেই মুহূর্তটা কাজে লাগাল ড্যানি লসন। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল কোবিন উইন্সটনকে। পরমুহূর্তে পরস্পরকে গুলি করল ওরা। ধাক্কার কারণে বেসামাল অবস্থায় ছিল উইন্সটন, গুলিটা তাই লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। লসনেরটাও। কিন্তু কিছুটা হলেও সময় পেয়েছে ও, এদিকে পিস্তল ঘুরাচ্ছে উইন্সটন। দু’হাতে পিস্তল আঁকড়ে ধরল লসন, দাঁতে দাঁত চেপে ট্রিগার টানল। জানে এবার ব্যর্থ হলে আর কোন সুযোগই পাবে না। অথচ শরীর ভেঙে আসতে চাইছে, জোর পাচ্ছে না আঙুলে। পিস্তলটা এক চুল ওপরে তুলল ও। সবই ঘটল সেকেন্ড দুয়েকের মধ্যে। একবার, দুবার, তিনবার গুলি করল ও। শূন্য সিলিন্ডারে হ্যামারের বাড়ি পড়তে সংবিৎ ফিরল ওর, হাত থেকে ছেড়ে দিল পিস্তলটা। ক্লান্তিতে নিজেও লুটিয়ে পড়েছে বিছানায়। জ্ঞান হারানোর আগে শুনতে পেল কাঁদছে মেয়েটা। বাইরে হৈচৈ শুনে জ্ঞান ফিরে পেল লসন। দৌড়ে আসছে লোকজন। দরজায় সবেগে আঘাত করল কেউ। দরজা ভেঙে গেল একসময়। হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল কয়েকজন। উঠে দাঁড়িয়েছে জুলিয়া, ছুটে এসে চেপে ধরল লসনের শিথিল হাত। ‘ড্যান, ওহ, ড্যান! সুস্থ আছ তুমি, বলো, ড্যান!’ ‘কি হয়েছে,’ বাইরে বিল লারকিনের ভরাট কন্ঠ শোনা গেল। ‘কি হয়েছে এখানে?’ ঠিক কি হচ্ছে বুঝতে পারছে না লসন। ‘কোবিন উইন্সটন এসেছে,’ কেউ যেন বহু দূর থেকে বলল, ‘ড্যানের ওপর চড়াও হয়েছিল সে, কিন্তু নিজেই মারা গেছে শেষে।’ ‘লসনদের এই কাউহ্যান্ড পড়ে আছে কেন?’ এবার চোখ মেলে তাকাল লসন। ‘আমাকে সতর্ক করতে চেয়েছিল ও। সফলও হয়েছিল। ঘুমের মধ্যে ছিলাম আমি। কিন্তু উইন্সটন বোধহয় ছাড়েনি ওকে। ও কি বাঁচবে?’ কেউ সেই প্রশ্নের উত্তর দিল না, কিংবা উত্তর শোনার আগেই জ্ঞান হারাল লসন। পুরো এক সপ্তাহ বিশ্রাম নিল ও। বেশিরভাগ সময় ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। অনেক
পৃষ্ঠা-১৩১
মানুষ এল-গেল, নানা কথা বলল ওর সঙ্গে। উত্তর দিল, কিন্তু সবই ঘটেছে ঘোরের মধ্যে। সপ্তাহ খানেক পর উঠে দাঁড়াতে সক্ষম হলো লসন। হ্যাঁ, এখন শক্তি পাচ্ছে শরীরে। বাইরে সূর্যের আলোয় এসে দাঁড়াল ও। আহা, কি চমৎকার রোদ! জেরেমি টাউন তখন ব্যস্ত। নতুন জেনারেল স্টোর, হোটেল, রেস্তোরাঁ গড়ে উঠছে। একটু পরেই ডিক ফেল্টনকে নিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করতে এল জেফরি হ্যালার্ড। ‘এখন কেমন আছ, ড্যান?’ জিজ্ঞেস করল সাংবাদিক। ‘ভাল। হ্যালার্ড, শুনলাম তুমি নাকি স্কুল খুলতে যাচ্ছ?’ একটু হাসল সে। ‘হ্যাঁ, স্কুলের ব্যবস্থা তো করতেই হয়। একটা হাসপাতালও। জুলিয়া লারকিনকে প্রস্তাব দিয়েছিলাম, ইচ্ছে করলে স্কুলে পড়াতে পারে ও। কিন্তু মিস লারকিন বলল এখানে নাকি থাকবে না।’ আনমনে মাথা নাড়ল লসন, ক’দিন আগের স্মৃতি মনে পড়ল। ওকেও তাই বলেছে জুলিয়া-পুবে যাবে না, কিন্তু এখানেও থাকবে না। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল হ্যালার্ড। ‘একটা কথা বলব, ড্যান?’ ‘বলো।’ ‘জানি তোমাকে এ কথা বলার প্রয়োজন আসলে নেই। তাছাড়া আমি যে কথা বলব সেটা শোনার জন্যে এসব করোনি তুমি।তবুও, ধন্যবাদ তোমাকে, ড্যান, আন্তরিক ধন্যবাদ। তোমার কারণেই টিকে গেল জেরেমি টাউন!’ ক্ষীণ হাসল লসন। ‘এবার নিশ্চয়ই সুন্দর শান্তিপূর্ণ শহর হিসেবে গড়ে উঠবে জেরেমি টাউন।’ ‘হ্যাঁ,’ হ্যালার্ডের কণ্ঠে আত্মবিশ্বাস। ‘তাই হবে, ড্যান।’ এক এক করে এল অন্যরা-জো হারপার, কার্টিস, অ্যালেন, ব্রেনেট এবং আরও অনেকে। আবার চলেও গেল সবাই। একা হয়ে পড়ল লসন। কিছুটা অস্থির বোধ করছে ও, নিঃসঙ্গ এবং অসহায় মনে হচ্ছে নিজেকে। ওর পাশে এসে বসল জুলিয়া লারকিন। মিষ্টি রহস্যময় হাসি মেয়েটির ঠোঁটে। ‘কাল তোমাদের বাথানে যাব আমি, তোমাকে সঙ্গে নিয়ে।’ ‘আজই যাচ্ছি না কেন?’ ‘এত তাড়া কিসের?’ ‘এখানে আর ভাল লাগছে না।’ ‘কেন?’ ভুরু কোঁচকাল জুলিয়া, কিন্তু মুখে স্মিত হাসি। ‘হয়তো এখানে আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে, তাই। জেরেমি টাউনে আর কিছুই করার নেই আমার।’ ‘কিন্তু অন্য কোথাও নিশ্চয়ই তোমার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি?’ ‘কোথায়?’ ‘জানো না?’ চোখ বড় বড় করে তাকাল জুলিয়া। ‘কেন, তোমাদের বাথানে? তোমার বাবা-মা অপেক্ষা করছে তোমার জন্যে।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল লসন। ‘ওরা সবসময়ই চেয়েছে আমি যেন ধারে-কাছে
পৃষ্ঠা-১৩২
থাকি, কিন্তু…’ ‘ঘুরে বেড়িয়েছ তুমি,’ কথাটা শেষ করল জুলিয়া, তারপর সঙ্গে একটা প্রশ্ন জুড়ে দিল, ‘কিসের জন্যে?’ ‘জানি না।’ ‘কিন্তু আমি জানি।’ ‘জানো!?’ ‘হ্যাঁ।’ ‘কিসের জন্যে?’ ‘অতি প্রিয়, মনের মত একটা জিনিস খুঁজেছ-তোমার অবচেতন মন খুঁজেছে।’ ওহ্, আমি নিজে জানি না অথচ…’ ‘ আলতো হাতে ওর একটা বাহু স্পর্শ করল জুলিয়া লারকিন। ‘ঘুমের ঘোরে, যখন অসুস্থ ছিলে তুমি—সবই বলে দিয়েছ আমাকে। স্বপ্নটা নাকি আবিষ্কার করেছ এই সেদিন—আমাকে দেখার পর, সত্যি, ড্যান?’ বিব্রত বোধ করছে লসন, পারলে সরে যায় মেয়েটির কাছ থেকে। চুরি করে যেন ধরা পড়ে গেছে। কিন্তু অভয়ের চাহনি মেয়েটির নীল দুই চোখে, সেখানে কি এক অস্থিরতা-তাগাদা দিচ্ছে ওকে। ‘হ্যাঁ,’ স্বীকার করল ও। ‘কিন্তু তোমাকে বলা দূরে থাক, নিজের কাছেই স্বীকার করতে চাইনি আমি। আমি একজন কঠিন মানুষ, জুলিয়া, হয়তো যে কোন দিন স্যাডলে মৃতদেহ নিয়ে বাড়ি ফিরে আসবে আমার ঘোড়াটা।’ ‘ওরকম বোলো না, আমি জানি তেমন কিছুই ঘটবে না।’ রুদ্ধ স্বরে বলল জুলিয়া লারকিন। ‘বিশ্বাস করো, তেমন কিছু ঘটতে দেব না আমি!’ বিহ্বল চোখে মেয়েটির দিকে তাকাল লসন, লজ্জায় লাল হয়ে গেছে জুলিয়ার মুখ। দৃষ্টি নিচু। হাত তুলে জুলিয়ার কাঁধে রাখল ও, অন্য হাতে জোর করে নিজের দিকে ফেরাল অপূর্ব সুন্দর মুখটা। ‘ঘোষণাটা কি আজই দেব?’ মিল, অধীর স্বরে জানতে চাইল লসন। ওর কাঁধে মাথা রাখল জুলিয়া, দৃষ্টি সরিয়ে নিল। ‘কিন্তু ড্যান-আমি যে এখানকার কিছুই জানি না! পুবের একটা মেয়ে হয়ে…’ ‘আসল কাজটাই সেরে ফেলেছ,’ বাধা দিল লসন। ‘পশ্চিমের একজন পুরুষকে পছন্দ করেছ, এবং আমি যদি ভুল করে না থাকি, ছবির মত সুন্দর একটা বাথানে ভবিষ্যতের দিনগুলো কাটানোর স্বপ্ন দেখেছ! দেখলে, নিজের স্বপ্নের কথা বলোনি তুমি, কিন্তু ঠিক জেনে গেছি আমি?’ ‘মেয়েরা কি মুখ ফুটে সব কথা বলতে পারে?’ ‘ঘোষণাটা দেব তো?’ ‘দাও।’ ‘কবে?’ ‘আজই, ড্যান। এক্ষুণি! তারপর তোমাদের বাথানে যাব আমরা।’