Skip to content

স্বর্ণ তৃষা

পৃষ্ঠা ০১ থেকে ১০

পৃষ্ঠা -০১

এক

এমন নয় যে লোকটাকে সাবধান করা হয়নি; হয়েছিল এবং তাতে সন্দেহের অবকাশ ছিল না কোনও।’মিস্টার,’ কেন?’ ওকে বলেছিলাম, ‘চুরি করতে গিয়ে নিজের বিপদ ডেকে আনছ কিন্তু সংসারে থাকে এমন বেয়াড়া ধরনের কিছু লোক। একটা ভুলে তাদের শিক্ষা হয় না দুটো করা চাই। ওয়েস বিগলো সেই জাতের’ লোক। ফলে যা হবার তাই হলো, শহরের পশ্চিমে একটা গোরস্থান আছে, সেখানে ওকে কবর দিল ওরা। এই শহরে, যারা গান ফাইটে নিহত হয়, তাদের ওখানেই কবর দেবার রেওয়াজ।আর ওই এক ঘটনাতেই আমার নাম লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল। মন্দ লোক হিসেবে ওরিন ওসমানকে এখন উভালদে শহরের সবাই চেনে। মন্দ- লোক, অর্থাৎ যাদের সঙ্গে ঝামেলায় জড়ালে বিপদ হয়। ন্যায়ের পক্ষ নেয়ায় অমন অনেক ভাল ভাল লোক ‘মন্দ’ বলে পরিচিত। তবে ওই খেতাবের জন্যে আমি একটুও লালায়িত্ ছিলাম না, তাই ঠিক করলাম চলে যাব উভালদে ছেড়ে।আসলে বিগলো ছিল গোঁয়ার। আমার লিকলিকে স্বাস্থ্য দেখে ভেবেছিল তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবে। কিন্তু ও কীভাবে জানবে, অস্ত্রচালনায় আমার হাতেখড়ি, শৈশবে। আমাদের বংশে এটাই রীতি শরীরে এর ভার সইবার শক্তিটুকু হলেই রাইফেল দেয়া হয়। আমার জীবনের পয়লা শিকার একটা কৃগার। আমার বয়েস তখন পুরো নবছরও পোরেনি। কুগারটা আমাদের শুয়োরের খোঁয়াড়ে হানা দিয়েছিল। তেরোতে মারি একজন হিগিনসকে। বাবার দিকে সে রাইফেল তাক করেছিল। হিগিনসদের সাথে আমাদের তখন ঘোর লড়াই চলছে।আমরা মোট পাঁচ ভাই। আমি-ই সবার বড়। এরপর অ্যানজেল, ও’নীল, জো, এবং সবার ছোট বব। ছেলেবেলায় আমাদের যত আবদার ছিল বাবার কাছে। সব ধরনের অস্ত্রচালনা শিখিয়েছেন তিনি। তাঁর কাছেই কর্নিশ-স্টাইল কুস্তি, শিখেছি। বাবা এক-আধটু মুষ্ঠিযুদ্ধ জানতেন, তাও তালিম দিয়েছিলেন • আমাদের। এত যে আবদার, তবু সময়ে সময়ে ভীষণ কঠোর হতেন বাবা। গোলাবারুদের অপচয় একদম পছন্দ করতেন না। শিকারে গিয়ে কোনও গুলি ফসকালে আর রক্ষে ছিল না, কৈফিয়ত দিতে হত কেন ফসকাল।অস্ত্র নিয়ে তামাশা সইতে পারতেন না তিনি। যদি কখনও দেখতেন, আমরা কোনও অস্ত্র নিয়ে খেলা করছি, শরীরের হাড়মাংস সব একজায়গায়

পৃষ্ঠা -০২

করতেন। তবে আমাদের কারও কপালেই তেমন দুর্ভোগ হয়নি। বাবা বলতেন ‘অস্ত্র খেলার জিনিস নয়। তুই একে সম্মান করলে এও রক্ষা করবে তোকে কোনও কারণ ছাড়া কক্ষনো হাত দিবি না অস্ত্রে।’আমি বরাবর একলাটি। নতুন নতুন জায়গা দেখতে আমার ভাল লাগে। কৈশোরে ন্যাটশেষ ট্রেস ধরে চলে গিয়েছিলাম নিউ অরলিন্সে। এর কিছু দিন পর শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। এবং আমি তাতে যোগ দেই।ইউনিয়ন আর্মির হয়ে আমাকে লড়তে দেখে ভীষণ অবাক হয়েছিলেন জেনারেল গ্র্যান্ট। হবারই কথা। আমার বাড়ি টেনেসি। কনফেডারেটদের পক্ষে ওই রাজ্যটিও যোগ দিয়েছিল। অন্যগুলো: অ্যালাবামা, আরকান-স, ফ্লোরিডা, জর্জিয়া, লুইসিয়ানা, মিসিসিপি, নর্থ ক্যারোলাইনা, সাউথ ক্যারোলাইনা, টেক্সাস আর ভার্জিনিয়া।জেনারেলকে কী জবাব দিয়েছিলাম, আমার তা আজও মনে আছে। ‘এই দেশ গড়তে গিয়ে আমার বাপ-দাদারা জান পানি করেছেন আমি সেটা নষ্ট হতে দিতে পারি না, জেনারেল।’কথাটা এখনও সমান সত্য। দেশের ডাকে ওসমান পরিবারের প্রতিটা লোক লড়বে। প্রয়োজনে মরতেও কুণ্ঠিত হবে না। আমরা এমনিতে নিরীহ, কিন্তু কেউ সেধে লাগতে এলে পিছিয়ে যাই না।উভালদের বাইরে এক কাউ আউটফিটে যোগ দিলাম, আমি। টেক্সাসের উত্তর থেকে গরুর পাল নিয়ে যাত্রা করলাম মন্ট্যানার চারণভূমির দিকে। আমরা যাচ্ছি বোযম্যান ট্রেইল ধরে, প্রতিপদে শঙ্কার হাতছানি।বিপদকে জয় করে আমি আনন্দ পাই। তবু এই ভবঘুরে জীবন আর ভাল লাগছিল না, মাথা গোঁজবার মত ঠাঁই খুঁজছিলাম একটা। কাউ আউটফিটে যোগ দেবার পেছনে এটাও একটা কারণ: এখান থেকে যে-আয় হবে, ইচ্ছে আছে তা দিয়ে একটা কিছু গড়ব নিজের জন্যে।ক্রেষি উওম্যান পর্বতের উত্তরে তিনজন লোক এল আমাদের ক্যাম্পে গরু কিনতে। বস বেচতে রাজি হলেন না, তবু রয়ে গেল ওরা। আমার নাম শুনে একজন কাছে এল।’বিগলোকে তুমি মেরেছ?”হ্যাঁ।”ওর দুভাই বদলা নিতে এসেছে। মন্ট্যানায় আছে তুমি যেও না,’ পরামর্শ দিল সে।’আমি কারও সঙ্গে লাগতে চাই না,’ বললাম, ‘তবে বাধ্য করলে’ ‘আচ্ছা, মোরার পিস্তলবাজ, ও’নীল ওসমান তোমার কেউ হয়?’ জিজ্ঞেস করল আরেকজন।’ভাই। ও’নীল পিস্তলবাজ? কই, জানতাম না তো?’ ‘তা হলে আর বলছি কী,’ জবাব দিল প্রশ্নকর্তা। ‘ওখানে ওর দারুণ দাপট

পৃষ্ঠা -০৩

সব খুনে-বদমাশ তল্লাট ছেড়ে ভেগেছে।”হ্যাঁ, পিস্তলে অবশ্যি নীলের হাত বরাবরই পাকা আমাকেও হারিয়েছে দু-একবার।’গ্যালাটিন উপত্যকায় পৌঁছে আমরা মন্ট্যানার ঘেসো জমিতে গরু ছেড়ে দিলাম। আমাদের মালিকের নাম নেলসন ফস্টার। শহর থেকে ডাক নিয়ে ফিরলেন তিনি। ওতে আমারও একটা চিঠি ছিল, জীবনে ওই প্রথম পেলাম।যুদ্ধের সময় দেখতাম লোকে চিঠি পাচ্ছে, লিখছে। আমার কাছে কখনও আসত না বলে ব্যথা বাজত বুকে। তাই যখন ডাকের তলব পড়ত, বাবুর্চির সঙ্গে। গিয়ে গল্প জুড়তাম। তিনকূলে কেউ ছিল না লোকটার, টেক্সাসের অদূরে এক কিওয়া ওঅর পার্টির হাতে নিহত হয়েছিল।ওই চিঠিটা পেয়ে আমার সব কষ্ট যেন নিমেষে দূর হয়ে গেল। খামের ভেতর থেকে পুরু কাগজ বেরোল একখানা। নাকের কাছে তুলে কাগজের গন্ধ শুঁকলাম। ভাঁজ খুলতেই আমার চোখ স্থির হয়ে গেল। জড়ানো হস্তাক্ষর। মনে মনে বিষম খেলাম ছাপার অক্ষর যাও-বা পড়তে জানি, হাতের লেখা কিছুই বুঝি না।একটু দূরে দাঁড়িয়েছিলেন মি. ফস্টার। আমার অসুবিধে বোধ হয় বুঝতে পারলেন তিনি। ‘দাও, পড়ে দিচ্ছি,’ বললেন।• রাজ্যের লজ্জা ঘিরে ধরল আমায়। এত বড় হয়েছি, সাতাশ-আটাশ বয়েস, অথচ পড়তে জানি না। ইন্ডিয়ান ওঅর ট্রেইল আমার চোখ সহজে চিনতে পারে, কিন্তু পড়াশোনায় বলতে গেলে একরকম আনাড়ি।অ্যানজেল আর ও’নীল প্রত্যেকেই নিজের বাথান করেছে, চিঠি পড়ে মি. ফস্টার জানালেন। মা এখন মোরায়, নিউ মেক্সিকোতে। এক বনেদি স্প্যানিশ পরিবারে বিয়ে করেছে নীল। অ্যানজেল রাজনীতি করছে সমাজে ওর যথেষ্ট প্রতিপত্তি।আমার নিজের বলতে কী আছে? একটা জীর্ণ স্যাডল, চারটে পিস্তল, একটা উইনচেস্টার রাইফেল আর আমার পরনের এই কাপড়। হ্যাঁ, আরও একখানা জিনিস আছে বটে আরকান-স টুথপীক। এক ধরনের ছুরি, হাতাহাতি থেকে মাংস কাটা সবই চলে।’তোমার ভাইয়েরা মনে হচ্ছে বেশ উন্নতি করেছে, বসের কথায় আমার চমক ভাঙল। ‘এখন তোমার লেখাপড়া শেখা উচিত, ওরিন আমার বিশ্বাস, তুমি অনেক বড় হবে।’ওই চিঠি পেয়ে বাড়ির জন্যে আমার প্রাণ কেঁদে উঠল। আমি ঘোড়া কিনতে বেরোলাম। এক ইন্ডিয়ানের সাথে দেখা হলো পথে। দুটো অ্যাপালুসা ঘোড়া আছে ওর কাছে। আমার একটা ৩৬ ক্যালিবার পিস্তল পেলে ঘোড়াগুলো বেচে দেবে। শুরু হলো দরদাম। আমরা, টেনেসির লোকেরা, সেই ছেলে বয়েস থেকে ঘোড়া বেচাকেনা করে আসছি। একজন রেড ইন্ডিয়ানের সাধ্য কী আমাকে ঠকায়।

পৃষ্ঠা -০৪

দীর্ঘ একহারা গড়ন লোকটার। বিষাদভরা চেহারা। কিন্তু সবচেয়ে আকর্ষণীয় ওর শিকারী কুকুরের মত একজোড়া চোখ। মর্মভেদী দৃষ্টি, মনে হয় যেন অন্তস্তল অবধি দেখে নিচ্ছে। ওই চোখই বলে দেয় এ-লোক, আর যাই হোক, কাউকে ঠকাবে না। ওকে মনে ধরল আমার, ইচ্ছে হলো সঙ্গে যা কিছু আছে বিলিয়ে দেই।খেতে বসলাম ওকে নিয়ে। নানান কথা হলো আমাদের; পথঘাটের অবস্থা, ইন্ডিয়ান সমাজের দুর্গতি, আকাল কিন্তু ভুলেও বিক্রির প্রসঙ্গ তুললাম না। মা বলতেন, খাওয়ার সময় কারও মনে আঘাত দিবি না, গৃহস্থের অকল্যাণ হয়।সন্দেহ নেই, বেচারা বিপাকে পড়েই অমন সুন্দর ঘোড়াদুটো বেচতে চাইছে। ও-রকম জিনিস হাতছাড়া হলে কার না মন খারাপ হয়। আহার-শেষে আপসরফায় এলাম আমরা। একটা পিস্তল, দশটা কার্তুজ, একটা পুরোনো কম্বল আর এক বোতল হুইস্কির বিনিময়ে দুটো অ্যাপালুসা কিনে নিলাম।ইন্ডিয়ানের চাহিদা ছিল মাত্র একটা পিস্তল, এত কিছু দেবার পরও আমার মনে হলো জিত আমারই হয়েছে।এরপর আমি বাড়ির পথ ধরলাম। মাকে একটিবার দেখবার জন্যে আনচান করছে মন। এই পশ্চিমে, মেয়েছেলের ধূমপান অনেকেই পছন্দ করে না। তবু মায়ের মুখের সেই পুরোনো পাইপ, তামাকের কটু গন্ধ এ-সবের জন্যে হু-হু করে উঠছে আমার অন্তর। নড়বড়ে দোলনা চেয়ারটার ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ কত দিন শুনি না বাড়ের বয়েসে ওই শব্দ ছিল আমাদের কাছে পরম নির্ভরতার প্রতীক। বুঝতাম, বাড়িতে আছি।মা যেন আমাদের শতহাতে আগলাতেন। তাঁর ভাঁড়ার ছিল যেন সাক্ষাৎ প্রকৃতির ঝাঁপি। এত যে খরা, দুর্ভিক্ষ খাওয়ার টেবিলে বসলে সেটা-বোঝবার উপায় ছিল না। কী এক অদ্ভুত কায়দায় মুখরোচক সব খাবার আমাদের সামনে তুলে ধরতেন মা।নিউ মেক্সিকোর উদ্দেশে রওনা হলাম আমি। মন্ট্যানা থেকে ঘোড়ার পিঠে নিউ মেক্সিকো বেশ দূরপথ। তাই বলে দমলাম না। বাসায় সকলের সঙ্গে দেখা করে আবার বেরোব। সাতাশ প্লাস এমন কিছু বয়েস নয় চেষ্টা করলে এখনও গড়তে পারব নিজের ভবিষ্যৎ। শান্ত মনে যাচ্ছিলাম আমি, সোনা খোঁজা বা কোনও ঝঞ্ঝাটে জড়াবারঅভিলাষ আমার একটুও ছিল না।’ আমি জানি, এরা জোড় বেঁধে থাকে। সোনা দুষ্প্রাপ্য বস্তু, কেউ পেলে সেটা নিজের কাছে রাখতে গিয়ে তাকে বহু ঝামেলা পোয়াতে হয়।বুনো রুক্ষ ট্রেইলে এগোচ্ছি। চারিদিকে যোজনবিস্তৃত মরুভূমি, মাঝে মাঝে কাঁটা ঝোপ আর জংলা ঘাস। ইন্ডিয়ান ট্র্যাক চোখে পড়ছে, কিন্তুসুকৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছি। আর্মিতে থাকতেই আমার কানে এসেছিল, ভীষণ দুর্দিন যাচ্ছে

পৃষ্ঠা -০৫

ইন্ডিয়ানদের। ওদের কেউ কেউ, যেমন চেরোকীরা, ব্যবসায় নেমেও সুবিধে করতে পারছে না। তবে একটা বিষয়ে আমি নিশ্চিত, লড়াইয়ের সুযোগ কিংবা ঘোড়া চুরির মওকা পেলে ওরা আজও সেটা হাতছাড়া করবে না দরকার হলে কয়েক ক্রোশ পথ অনায়াসে পাড়ি দেবে।গৃহযুদ্ধের পরপর ডাকোটায় স্যু আর শাইয়েন গোত্রের বিরুদ্ধে লড়েছি আমি। এটা মিনেসোটায় লিটল ক্রো গণহত্যার পরের ঘটনা। তখন কয়েকবার ইন্ডিয়ানদের মোকাবেলা করেছিলাম। ওদেরকে আমি সমীহ করি।শামুকের গতিতে এগোচ্ছি। ভোরের বাতাসে হিমের পরশ, পাহাড়ে তুষারপাতের আভাস দিচ্ছে। তবে দিনের বেলাটা মোটামুটি ওম জড়ানো। রাতে আকাশ চলে যায় নক্ষত্রের দখলে।দুর্গম পাহাড়ী ট্রেইলে চলার আমেজই আলাদা। কদিনেই বেশ ঝরঝরে হয়ে উঠেছে আমার শরীর। রকি মাউন্টিনস পেরিয়ে, টিটন্স আর সাউথ পাসের দক্ষিণ হয়ে ব্রাউন্স হোলে পৌছুলাম।দূর্বা-মোড়া ঢাল। চারপাশে অ্যাসপেনের সারি। ঝরনার ধারে ক্যাম্প করলাম আমি। ঘুণাক্ষরেও টের পেলাম না সামনেই বিপদ।

দুই

পরদিন সকালে স্যাডলে চাপতেই ভৌতিক ট্রেইলটা চোখে পড়ল। অদূরে একটা লাল বেলে পাথরের দেয়াল। তাতে অসংখ্য ফাটল। ওরই একটায় রুপোলি স্ফটিক বসানো।বিপদসঙ্কুল এলাকায় যাদের চলাফেরা, সব সময় তারা সতর্ক থাকে। অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়লে সন্দিহান হয়ে ওঠে। নুয়ে-পড়া ঘাস, ভাঙা ডাল, ঝরনার কাদা-ঘোলা পানি অনায়াসে তার নজরে আসে।প্রকৃতির একটা সহজ স্বাভাবিক আটপৌরে ভঙ্গি আছে। জন্তু-জানোয়ার নিজেদের স্বচ্ছন্দে মানিয়ে নেয় এর সাথে। তারা বাসা বানায়, কিন্তু আশপাশের পরিবেশ তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। বীবর একমাত্র ব্যতিক্রম। তার বাসা জলে, সে গর্ত খুঁড়ে বাঁধ দেয়। এ ছাড়া আর কোনওরকম বিশৃঙ্খলা দেখা গেলে ধরে নেয়া চলে, ওটা কোনও মানুষের কাজ। এই বিজন প্রান্তে স্ফটিকটা যে আপনাআপনি ওখানে উঠে যায়নি তাতে আমার একটুও সন্দেহ নেই। নিশ্চয় বসিয়ে দিয়েছে কেউ। অথচ কাছেপিঠে লোকালয় তো দূরের কথা, গেল কদিনে একটা মানুষ চোখে পড়েনি আমার।সাউথ পাস সিটি বহুদূরে, ঘোড়ার পিঠে উত্তরে হপ্তাখানেকের পথ।পাথরটা হাতে নিয়ে পরখ করে, আবার আগের জায়গায় রেখে দিলাম।

পৃষ্ঠা -০৬

চারপাশে একটা গোল দাগ অনেকদিন একভাবে থাকার ফল। এ-রকম পাথরের সাহায্যে পথের হদিস দেয়া হয়, আমি জানি। ফিল্ড গ্লাস লাগালাম চোখে। বেশ খানিকটা দূরে আরেকটা স্ফটিক।কৌতূহল চাপতে পারলাম না আর, স্ফটিক নির্দেশিত ট্রেইল ধরে এগিয়ে গেলাম। কাজটা যারই হোক, লোকটা বুদ্ধিমান। রাতের আঁধারেও এই ট্রেইল চেনা যাবে সাদা স্ফটিকগুলোই বাতলে দেবে।চড়াই বেয়ে ক্রমশ ওপরে উঠে এলাম আমি। আরেকটু গেলেই পাহাড়ের শেষ। বহুদূর অবধি দেখা যায় এখান থেকে। কোনও মানুষের ট্র্যাক বা পুরনো ক্যাম্পফায়ারের চিহ্ন চোখে পড়ল না।ঘুরে সঙ্কীর্ণ একটা গিরিপথে ঢুকলাম। সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসেছে। গোধূলির লালা আভায় দাঁত বের করে হাসছে ক্যানিয়নের ন্যাড়া দেয়াল। এখানে-সেখানে তুষার জমাট বেঁধে আছে।প্রায় হাজার ফুট নীচে জঙ্গল। আসন্ন রাতের বাতাস হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছে। থমথমে পরিবেশ। অ্যাপালুসার খুরের শব্দ আর জিনের মৃদু খসখসই কেবল একটুখানি আভাস দিচ্ছে প্রাণের। ধীর গতিতে এগাচ্ছে ঘোড়াটা, কান খাড়া।সামনে, বাঁয়ে ছোট্ট একটা ডোবা। আধো-অন্ধকারে রুপোলি জল ভৌতিক মায়া বিস্তার করেছে। ছোট ছোট ঢেউ জেগেছে হাওয়ায়। গা ছমছম করে উঠল আমার, পাহাড়চূড়ায় এইধরনের ডোবায় অপদেবতারা বাস করে বলে শুনেছি।ইচ্ছে করছে নিজের কপাল চাপড়াই, কোন দুঃখে এলাম এই পথে। এটা বোধ হয় প্রাচীন কোনও ট্রেইল হবে। আমার বাবা একবার ডোলোরেস নদীর ধারে কাটিয়েছিলেন কিছু কাল। সেটা এখান থেকে আরেকটু দক্ষিণে। ফাদার এসকালেনতে সান্তা ফে থেকে ক্যালিফোর্নিয়া যান মিশন খুলতে। তিনিও এ- অঞ্চল পাড়ি দিয়েছিলেন, কিন্তু এত উচ্চতায় তাঁর আসবার প্রশ্নই ওঠে না।নেহাত দায়ে ঠেকেছিল, নইলে এমন জনমানবহীন এলাকায় বেড়াতে আসে না কেউ। নিশ্চয় কোনও অমূল্য রত্নের খোঁজ পেয়েছিল লোকটা, সোনাই হবে সম্ভবত। এতটা এসে শেষ না দেখেই চলে যেতে সায় দিচ্ছে না আমার মন। আবার সেই সঙ্গে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছে, আর এগিও না।সহসা ক্ষীণ শব্দে চমকে উঠল আমার ঘোড়া। নির্জন পথে চলতে গেলে ঘোড়ার ওপর আস্থা রাখতে হয়। মানুষের চেয়ে ওদের শ্রবণক্ষমতা প্রখর, সামান্যতম আওয়াজও কান এড়ায় না। তা ছাড়া এটা জাত অ্যাপালুসা, দুর্গম অঞ্চল পাড়ি দিতে এর জুড়ি নেই।বহুদূর থেকে ভেসে আসছে শব্দটা। নিবিড় বনে ঝড়ের শব্দের মতন। কাছে এগোতে আরও জোরাল হলো। বুঝতে পারলাম, ঝরনার জল গড়িয়ে পড়ছে। আরেকটা গিরিপথে ঢুকলাম আমরা। এটা আগেরটার চেয়েও সরু। গিরিপথের এক পাশে সেই ভূতুড়ে ডোবার পানি গড়িয়ে পড়ছে। জলকণায়

পৃষ্ঠা -০৭

আচ্ছন্ন পরিবেশ। একটা অস্পষ্ট ট্রেইল চলে গেছে ঝরনার ধার ঘেঁষে। ওই ট্রেইল যে অধিকাংশ সময় পানির তলায় থাকে সেটা বুঝতে কল্পনাশক্তি লাগে না।সাবধানে তাকালাম নীচের দিকে। জলপ্রপাতের গর্জনে কান পাতা দুষ্কর। ওই স্বল্প আলোতেও দেখলাম, দেয়ালের গায়ে জ্বল জ্বল করছে একটা স্ফটিক। এ-বার আর কোনও ভ্রূকুটি মানল না মন, ধীরে ধীরে নামতে শুরু করলাম- ঢাল বেয়ে। একবার পা হড়কালে রক্ষে নেই, সোজা হাজার ফুট নীচে কঠিন পাথরের ওপর গিয়ে পড়ব। পিছু হটার পথ বন্ধ, কোনও মাসটাংয়ের পক্ষেই তা সম্ভব নয়।যত নীচে নামছি, ততই পানির ছিটায় ঝাপসা হয়ে আসছে চোখ। ট্রেইলটা প্রায় মাইল তিনেক অনুসরণ করে একটা উপত্যকায় নেমে এলাম আমি। গাছপালার ঘনত্ব দেখে বুঝলাম হাজার ফুট পাড়ি দিয়েছি। সেই ঝরনাটা আমার ডানে একটা সঙ্কীর্ণ অথচ গভীর ক্যানিয়নে হারিয়ে গেছে। ক্যানিয়নের দেয়াল আগাছা আর ফার্নে পরিপূর্ণ। তবে ট্রেইলটা বাঁক নিয়েছে উপত্যকার দিকে।এখানে উপত্যকার প্রস্থ বড়জোর বিশ গজ, দুধারে খাড়া দেয়াল। কায়দা জানা থাকলে পায়ে হেঁটে একজন মানুষের পক্ষে ওঠা সম্ভব; কিন্তু কোনও ঘোড়া দুফুটও যেতে পারবে কি না সন্দেহ। পুবদিকে, ক্যানিয়নের দেয়ালে শেষ-সূর্যের আলো সামান্য ফুটে আছে এখনও।প্রায় দেড়শো গজ যাবার পর চওড়া হয়ে গেল উপত্যকাটা। দৈর্ঘ্যে-প্রন্থে মাইল তিনেক হবে। ঝরনা আছে একটা, পথে যেটার পাশ কাটিয়ে এসেছি তার সাথে এর যোগ আছে।সচরাচর পাহাড়ী এলাকায় যেমন থাকে, তেমনি চমৎকার ঘেসো’ জমি। ঝরনার কিনারে সার সার অ্যাসপেন, গুটিকতক বামনাকৃতি উইলোও রয়েছে। কয়েকটা হরিণ চরছে অদূরে। মানুষের সাড়া পেয়ে তাকাল। আমার মনে হলো, এখানে আসার আরও কোনও পথ আছে, তবে সেটা ঠিক কোথায় ধরতে পারলাম না। আমি এগিয়ে যেতে টুক করে পালিয়ে গেল হরিণগুলো।• পেছনের দড়িতে টান পড়ছে, আর এগোতে চাইছে না আমার প্যাক হর্স। 1 বেশ ঠাণ্ডা হাওয়া, তবু ঘামছি আমি। মন খুঁতখুঁত করছে। স্ক্যাবার্ড থেকে উইনচেস্টার তুলে নিলাম।রাশ আলগা করে চলার নির্দেশ দিলাম অ্যাপালুসাকে। সন্তর্পণে, হিসেব কষে পা ফেলছে ও। ময়াল সাপের মত এখানকার সব কিছু টানছে আমাকে। ছায়ার দীর্ঘ থাবা আরও প্রসারিত হয়েছে, পাহাড়ের মাথায় স্নান আলোয় দূরের আকাশকে দেখাচ্ছে খুব কাছের।এ-বার গুহাটা চোখে পড়ল আমার।আসলে ঝড়বাদলে পাথুরে দেয়াল ক্ষয়ে ওই গর্তের সৃষ্টি। তবু, কম করে হলেও আট-দশ ফুট গভীর। সামনে ঝোপঝাড়, বেশির ভাগ অ্যাসপেন,

পৃষ্ঠা -০৮

প্রবেশমুখ ঢেকে রেখেছে।নেমে একটা গাছের সাথে ঘোড়াদুটো বাঁধলাম আমি। পায়ে হেঁটেই যাব, ঝুঁকি নেয়া উচিত হবে না। কোনও ট্র্যাক নেই, দীর্ঘকাল কেউ মাড়ায়নি এ-পথ। সাধারণত পাহাড়ী কেবিন যেমন হয়, এটাও তেমনি। পাথর সাজিয়ে দেয়াল তোলা হয়েছে। ভেতরটা আগুনের ধোঁয়ায় কালো, বুঝলাম ওগুলো বহুদিনের পুরনো দাগ।একদিকের দেয়াল ধসা, ইতস্তত-ছড়ানো পাথর। শেষ-প্রান্তে একটা গাছের গুঁড়ি পড়ে আছে। মসৃণ, কুঠার দিয়ে কেটে ফেলা হয়েছে। বসার জন্যে ব্যবহৃত হত গুঁড়িটা, অনুমান করলাম। উলটোদিকে খাঁজ কাটা, কয়েক সারি। গুনে দেখলাম মোট একত্রিশটা সারি। দিনে একটা করে হলে অতগুলো খাঁজ কাটতে পাঁচমাস লাগবে। এ-রকম বিরান দেশে সময়টা একেবারে কম নয়। গুহার মেঝেতে বালুর স্তর। হোঁচট খেলাম একটা কিছুর সাথে। সামান্যহাতড়াতে একটা মরচে-পড়া বর্ম বেরিয়ে পড়ল। এককালে স্প্যানিশ যোদ্ধারা ব্যবহার করত এ-ধরনের বর্ম। স্প্যানিশদের সম্পর্কে আমার যা জ্ঞান, তার প্রায় সবটাই বাবার কাছে• জেনেছি। মাঝে-মধ্যে বাবা তাঁর যৌবনের কাহিনি শোনাতেন আমাদের। আমরা সান্তা ফের গল্প শুনেছি। বাবা কিছু দিন ছিলেন ওখানে। সান্তা ফে আবিষ্কৃত হবার বছর দশেক পর স্প্যানিশ ধর্মযাজকেরা প্লিমা উথরকে অবতরণ করেছিল। খনিজ পদার্থের লোভে বহু জায়গায় অনুসন্ধান চালিয়েছিল ওরা। আজ আর সে-সবের নথিপত্র নেই। এটাও হয়তো তেমনি একটা কিছু হবে।যে-ট্রেইল ধরে মোরায় যাচ্ছিলাম আমি, ছেলেবেলায় সেটার কথাও শুনেছি বাবার মুখে। মনট্যানার খনিশ্রমিকদের কাছে পরে আরও জেনেছি এ-ব্যাপারে। ওই পথে উতেদের সঙ্গে স্প্যানিশরা ব্যবসা-বাণিজ্য করত। ফাদার এসকালেনতে, এমনকী ক্যাপটেন জন স্মিথ যখন ভার্জিনিয়া উপকূল আবিষ্কার করেন, তারও বহু আগে থেকে ওই ট্রেইল ধরে উত্তরে গেছে বণিকেরা। কিন্তু তারা বিশেষ রেকর্ড ‘রেখে যায়নি। সতেরোশো পঁয়ষট্টি সালে রিভেরা এসেছিলেন, এ-দিকে, অবশ্যি ততদিনে এই অঞ্চলের খবর সবাই জেনে গিয়েছিল।গুহা থেকে বেরিয়ে আবার উপত্যকার ওপরে উঠতে লাগলাম আমি। ঘোড়াগুলো সঙ্গে আছে। আধ-মাইল যাবার পর পাহাড়ের ঢালে একটা সুড়ঙ্গ দেখতে পেলাম। আশপাশে পাথর ছড়ানো।সুড়ঙ্গের দেয়াল ঘেঁষে পাথরের পাঁজা। একটা তুলে নিলাম হাতে বেশ ওজন। ঠুকে ঠুকে মাটি ঝেড়ে ফেলতেই চকচক করে উঠল সোনা।প্রথমে বিস্ময়ে, তারপর আনন্দে-উত্তেজনায় শিউরে উঠলাম আমি। এগুলো এখন আমার, অথচ মাত্র কদিন আগেও আমি ছিলাম নিঃসম্বল।

পৃষ্ঠা -০৯

তিন

সোনাহাতে স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে রইলাম। এই জনমানবশূন্য প্রান্তরে এমন ঘটনা ঘটবে আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।আমরা বিত্তশালী নই। মূলত আমাদের চাহিদা জমি। আবাদী জমি। পারিবারিক বন্ধনকে আমরা অত্যন্ত মূল্য দেই। আপদে-বিপদে এক সঙ্গে রুখে দাঁড়াই সবাই।হিগিনসদের সাথে আমাদের দীর্ঘকাল লড়াই চলেছে। এতে আমাদের অনেকেই মারা গেছে। হিগিনস পরিবারের শেষ-সদস্য লং হিগিনসের মৃত্যুতে অবসান ঘটেছে এই শত্রুতার। ওকে মেরেছে আমার ছোট ভাই, ও’নীলওসমান। আমি তখন বাড়িতে ছিলাম না। তবে এ-মুহূর্তে আমার মাথায় অন্য চিন্তা চলছে। যে-কোনও কাজের আগে চিন্তাভাবনা করবার পরামর্শ দিতেন বাবা। এখন আমি তাই করছি।ভবিষ্যতে কী ঘটতে পারে, সে-ব্যাপারে পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার। আগে খনিতে আমার মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, তারপর সোনার খবর জানাব লোককে।সোনার আরেক নাম বিপদ। অনেকেই এর স্বপ্ন দেখে; কিন্তু যখন পায়, নিজের অজান্তেই বিপদে জড়িয়ে পড়ে। সোনা মানুষের স্বাভাবিক মনুষ্যত্ববোধ নষ্ট করে। লোভে উন্মত্ত হয়ে ওঠে সে, খুন করতেও দ্বিধা করে না। কাজেই, সাবধান থাকতে হবে আমায়। এখন আমি এমন এক জায়গায় আছি যেখানে আইনের শাসন বলতে কিছু নেই।.সোনা ভারি জিনিস। ইচ্ছে করলেই লুকিয়ে রাখা যায় না। এর যেন দুর্গন্ধ আছে, বাতাসে ছড়ায়।তা ছাড়া, খনি থেকে বের করবার ঝক্কি প্রচুর। আমার সাথে সরঞ্জাম নেই। ঠিক করলাম, অল্প কিছু সোনা সঙ্গে নিয়ে যাব। ওগুলো বিক্রি করে সরঞ্জাম কিনব। আমার স্যাডলব্যাগেই নেব। ঝুঁকি আছে, কিন্তু আমি নিরুপায়। ক্যাটল ড্রাইভে সামান্য যা আয় হয়েছিল, খাবার এবং টুকিটাকি জিনিস কিনতে খরচ হয়ে গেছে।ওই খনিতে আমার চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি সোনা আছে। ছোটখাটো একটা বাথান আর কিছু বই কেনার সামর্থ্য হলেই আমি খুশি। অশিক্ষা একটা অভিশাপের মত। পাহাড়ে সুযোগ-সুবিধার অভাবে আমার লেখাপড়া হয়ে ওঠেনি। কেবল কোনমতে নিজের নাম সই করতে পারি। তাও বাড়িতে এক বাবা আর নীল ছাড়া কারও সাধ্য ছিল না সেটা পড়ে। সেনাবাহিনীতে আমার

পৃষ্ঠা -১০

অফিসারদের ভেতরে মাত্র একজন এক-আধটু বুঝতেন। এ-নিয়ে আমাকে দুশ্চিন্তা করতে মানা করেছিলেন তিনি।’রাইফেলে তোমার যা টিপ’ অফিসারটি বলেছিলেন, ‘তাতে তোমার হাতের লেখা যত খারাপই হোক, কেউ কোনও প্রশ্ন করার সাহস পাবে না।’কিন্তু আমি নিজেকে প্রবোধ দিতে পারি না। আমার ভাবী বংশধরদের কাছে মুখ দেখাবে কী করে? তারা যখন জানবে তাদের বাবা মূর্খ, তখন কি শ্রদ্ধা থাকবে আমার প্রতি?বীর্যবান পুরুষ বলে ওসমানদের খ্যাতি আছে। তাই আর আত্মীয়স্বজন মিলিয়ে আমাদের পরিবারে পুরুষ মোট ঊনচল্লিশজন। বাবার দুবোন-পাঁচ ভাই এখনও বেঁচে। দেশের নানা জায়গায় ছড়িয়ে আছে তারা। অনেকেই উচ্চশিক্ষিত। ওদের সামনে আমি নেহাত নগণ্য। তবে সোনা পাওয়ায়, আমার বিশ্বাস, এখন অবস্থার হেরফের ঘটবে।শোবার আয়োজন করলাম। খসিয়ে নিলাম ঘোড়াদুটোর জিন। সুন্দর আবহাওয়া। বসন্তের মাঝামাঝি, গ্রীষ্ম সমাগত প্রায়। পাহাড় থেকে বরক্ষের দল বিদায় নিয়েছে, তবে মিলিয়ে যায়নি। এই রাজ্যে সেটা আশা করাও বোকামি, আবার কখন শুরু হবে কেউ এ-কথা বলতে পারে না আগাম।শহর থেকে সরঞ্জাম নিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরতে পারলে, হয়তো কিছু সোনা উদ্ধার করে তুষারপাতের আগেই চলে যেতে পারব। এখন আমি যেখানে আছি, বছরের নয় মাস সেখানে বরফ থাকা বিচিত্র নয়। সুতরাং, এখানে আটকা পড়লে ভয়ঙ্কর শীত পাড়ি দিতে হবে।আরও একটা চিন্তা কাঁটার মত বিধছে আমার মাথায়।বর্ষায় ওই গিরিপথ চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। ফলে, শীত-বর্ষা বাদ দিলে, হাতে থাকছে আর পঞ্চাশ-ষাটদিন। বড়-জোর ওই কটা দিন এখানে ঢোকা বা এখান থেকে বেরোনো যাবে। অবশ্যি আর কোনও রাস্তা যদি ঠেকে থাকে, সেটা ভিন্ন কথা।নিজেকে আমার ফাঁদে-পড়া ইঁদুরের মত মনে হচ্ছে। আগুনের কফির পাত্র চড়িয়ে পরিস্থিতি বিচার করতে বসলাম।ওয়েস বিগলোর ভাইয়েরা হয়তো ভাবছে, আমি তাদের ফাঁকি দিয়েছি। সে-ক্ষেত্রে ওরা পিছু নেবে। মোরার পথে নিজের ট্রেইল লুকোবার চেষ্টা করিনি। কথাটা মনে হতেই চমকে উঠলাম। বিগলোরা আমাকে খুঁজতে গিয়ে অ্যানজেল আর নীলের কাছে গিয়ে হাজির হোক, এটা আমি চাই না। এমনিতেই জাতিমামলায় আমাদের অনেক খেসারত দিতে হয়েছে। ওদেরকে বিপদে জড়াবার অধিকার আমার নেই।তবে বিগলোরা এই উপত্যকায় আসবে বলে মনে হয় না। ভূতুড়ে ট্রেইলে ওঠার পর থেকেই নিজের ট্রট্র্যাক ঢাকার ব্যাপারে সচেষ্ট হয়েছি আমি। দমকা বাতাসে অগ্নিশিখা কাঁপছে। মেঝেতে ছায়া পড়েছে স্প্যানিশ

পৃষ্ঠা ১১ থেকে ২০

পৃষ্ঠা -১১

বর্মটার। দেয়ালে ঠেস দিয়ে রেখেছি ওটা। আচ্ছা, অশরীরী আত্মারা কি এইরকম রাতে দেখা দেয়?কেন জানি না, কিন্তু আমার মন বলছে আড়াল থেকে সারাক্ষণ কেউ নজর রাখছে আমার ওপর। ঘোড়াগুলো ছটফট করছে। ঘুমোবার আগে ওদেরকে ভেতরে এনে আগুনের কাছাকাছি বেঁধে রাখলাম। সময় বিশেষে, পাহারাদারহিসেবে ঘোড়ার জুড়ি নেই। তা ছাড়া এ-মুহূর্তে এরাই আমার একমাত্র সহায়। ভোরে ঝরনায় মাছ ধরতে গেলাম আমি। বড়শি ফেলে কয়েকটা ট্রাউট ধরলাম। নাস্তা সারলাম আগুনে সেঁকে।একটা মোটা গাছের ডাল ভেঙে সেটার এক প্রান্ত চিরলাম। এ-বার ওই ফাঁকে একটা গোলাকার নুড়িপাথর বসিয়ে দিতেই তৈরি হয়ে গেল একটা চলনসই কুঠার। এরপর সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় গিয়ে কাজে হাত দিলাম। সন্ধ্যে নাগাদ একটা বিরাট আকরিক খসে এল দেয়াল থেকে। প্রায় তিনশো ভরি ওজন হবে।এখন গভীর রাত, কিন্তু আমার বিশ্রাম নেই। সাবধানে স্ফটিকটা ভেঙে কিছু সোনা বের করলাম। উঁচুমানের জিনিস, জুয়েলারি দোকানে পাওয়া যায় এমনটা।নির্জন পাইন সুরভিত রাত। ফটফট শব্দে পুড়ছে লাকড়ি। হিমেল বাতাসে জুড়িয়ে যাচ্ছে শরীর। অন্ধকারে ঝরনার ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করলাম আমি, তারপর গুহায় ফিরে একটা ধনুক বানাতে বসলাম।চেরোকী ইন্ডিয়ানদের মাঝে বড় হয়েছি’ আমরা, তীর-ধনুকের সাহায্যে শিকার করতে জানি। অবশ্যি এ ছাড়া আমাদের কোনও উপায়ও ছিল না পাহাড়ের গোলাবারুদের অভাব প্রচণ্ড।সুন্দর গন্ধ ছড়িয়েছে ধোঁয়ার, থেকে থেকে সশব্দে লাকড়ি ফাটছে, তখন লকলক করে উঠছে শিখা। সহসা ঘোড়াদুটো পেছনের পায়ে ভর রেখে সোজা হলো। চট করে অন্ধকারে গা ঢাকা দিলাম আমি, হাতে উইনচেস্টার প্রস্তুত।অনেকক্ষণ বসে রইলাম অনড়, কান সজাগ। ঘোড়াগুলোর শরীরে প্রতিফলিত হচ্ছে আগুন। বোধ হয় ভালুক কিংবা সিংহটিংহ হবে, অথচ ঘোড়ার আচরণ দেখে সেটা বিশ্বাস করতেও বাধছে।খানিকবাদে ফের আহারে মন দিল দুই অ্যাপালুসা। একটা কঞ্চির সাহায্যে কফির কেতলি কাছে টেনে নিলাম আমি, গরুর জার্কি মুখে পুরে চুষতে। লাগলাম।ভীষণ পরিশ্রান্ত লাগছে, ভারি হয়ে আসছে দুচোখের পাতা। বৃষ্টির শব্দে ঘুম. ভাঙল আমার। পুব আকাশে ভোরের পাণ্ডুর আলো ফুটেছে। অ্যাসপেন শাখায় বৃষ্টি পড়ছে ঝুপ ঝুপ ঝুপ… আতঙ্কে কাঁটা দিল আমার গায়ে ওই গিরিপথ পানিতে তলিয়ে গেলে হপ্তাখানেকের ভেতর বেরোতে পারব না এখান থেকে।মালপত্র গুছাতে শুরু করলাম তাড়াতাড়ি। আবার রওনা দেব টের পেয়ে

পৃষ্ঠা -১২

ঘোড়াদুটো হেষারবে আনন্দ প্রকাশ করল। আমার কাছে এখন তিন পাউন্ডের মত সোনা আছে, সরঞ্জাম কিনেও কিছু উদ্বৃত্ত থাকবে হাতে।বাইরে এসে যা দেখলাম তাতে আমার চোখ কপালে উঠল। সকালে নাস্তা করব বলে যে-মাছখানা গাছের ডালে ঝুলিয়ে রেখেছিলাম, সেটা নেই। কোনও ভোঁতা ব্লেড বা দাঁত দিয়ে ঝোলাবার দড়িটা কেটে ফেলেছে কেউ।তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম মাটির দিকে। গাছের তলায় কয়েকটা ক্ষুদে ট্র্যাক নজরে পড়ল। বেড়ালের নয়, মানুষের পায়ের ছাপ। মনে হয় কোনও শিশু বা কিশোরীর।ঘাড়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল আমার। এ-রকম জায়গায় মানুষ থাকে কী করে অথচ নিজের চোখকে অবিশ্বাস করতে পারছি না। অপদেবতারা মাছ খায়, এমন কথা আমি কস্মিনকালেও শুনিনি।যাত্রার মুখে বাধা পড়ায় খিঁচড়ে গেল আমার মেজাজ। খিদেয় পেট জ্বলছে,মাংস দরকার। কিন্তু গুলি ছুঁড়তে ভরসা পেলাম না। তীর মেরে একটা কচি হরিণ বধ করলাম, ছাল ছাড়িয়ে গুহায় নিয়ে এলাম মাংস। খানিকটা ফালি করে কেটে আগুনের ওপর শুকোতে দিলাম। তারপর নাস্তা সারলাম বড় এক টুকরো মাংস ঝলসে নিয়ে। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না, বাতাসের তোড়ে হঠাৎ জেগে গেলাম। আগুন নিভু নিভু, লাল হয়ে আছে কয়লাগুলো। গুটিসুটি মেরে আবার শোবার উদযোগ করছি, এমন সময় আমার মাসটাং ডেকে উঠল।কম্বলের ভেতর থেকে পাকাল মাছের মত বেরিয়ে এলাম আমি, রাইফেল কক করে লুকোলাম অন্ধকারে।’শান্ত হ, বেটা, কোনও ভয় নেই, ফিসফিসিয়ে বললাম ঘোড়াকে। বাইরে বাতাসের টানা শোঁ-শোঁ গর্জন, আর কোনও শব্দ নেই’। একটুবাদে আরেকটা নড়াচড়ার আওয়াজ ভেসে এল। দুনিয়ার কোনও ভালুক বা হরিণ ওভাবে হাঁটে, আমি বিশ্বাস করি না।ঘোঁৎ করে নাক ঝাড়ল আমার ঘোড়াটা, চি হি রব করল প্যাক হর্স। কয়লার স্নান আলোয় ওদের পা দেখতে পাচ্ছি, কাছেপিঠে কিছুই নড়ছে না। অথচ আমার বদ্ধমূল ধারণা, আঁধারে রয়েছে কেউ।ধীর লয়ে বয়ে চলে সময়। মিটিমিটি জ্বলছে কয়লা। দেয়ালে হেলান দিয়ে আমি ঝিমোচ্ছি, তবে সমস্ত পেশী টানটান।আর কোনও সাড়াশব্দ নেই।• অনেক আশার প্রতিশ্রুতি নিয়ে ভোর হলো। ঝড় থেমে গেছে। পাইন বনের শেষ-প্রান্তে, পাহাড়চূড়োয় হেসে উঠেছে সূর্য। একটু একটু করে আবীর ছড়িয়ে দিচ্ছে সারা আকাশে। বাতাসে হাত-পা খেলিয়ে শরীরের খিল ছাড়ালাম আমি। প্রথমেই চোখে পড়ল, গতরাতের শুকোতে-দেয়া মাংস গায়েব। আজ আর বিরক্ত হলাম না: লোকটা যেই হোক, অনাহারে আছে নইলে একটা অচেনা

পৃষ্ঠা -১৩

ক্যাম্পে হানা দেবার ঝুঁকি নিত না। বাইরে গিয়ে আরেকটা হরিণ মারলাম। ছাল ছাড়িয়ে ঝুলিয়ে দিলাম গাছের ডালে। তারপর নিশ্চিন্ত মনে ফিরতি পথ ধরলাম। আমি বেঁচে থাকতে অন্য কেউ কষ্ট পাবে অনাহারে এটা আমার কাম্য নয়।বর্ষণের ফলে রাস্তা পিচ্ছিল, বারকয়েক পড়তে পড়তে টাল সামলে নিলাম। অতিকষ্টে উঠে এলাম বেসিনে, নামতে শুরু করলাম ভূতুড়ে ডোবাটাকে পাশ কাটিয়ে। তবে এ-বার আগের ট্রেইল ধরে যাচ্ছি না, একটা খাড়া ঢাল বেছে নিয়েছি কেবল-মাত্র পাহাড়ী ভেড়ার পক্ষেই অমন পথে চলাফেরা সম্ভব।বাঁকের মাথায় এসে, পেছন ফিরে চুড়োর দিকে তাকালাম আমি। ‘তোমার জন্যে মাংস রেখে গেলাম খেও,’ বললাম চেঁচিয়ে। ‘আমি আবার আসব সোনা নিতে।’ –

চার

‘মেসার কিনারে এসে থামলাম আমি। অদূরে, নীচে শান্তভাবে বইছে মোরা নদী। পাশেই বাথান। আলো জ্বলছে একটা ঘরে। পরম স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লাম। ওই বাথানে আমার হৃদয় আছে, কারণ ওখানে আছে আমার মা, ছোট ভাইয়েরা।পেছনের ট্রেইল আরেকদফা দেখে শুরু করলাম নামতে। উইলো বন থেকে হিমের গন্ধ উঠে আসছে। দূরে লা কুয়েভা উপত্যকা, ফসলের মাঠ কুয়াশায় মোড়া।হেষারব করে উঠল একটা ঘোড়া, ঘেউ ঘেউ শুরু করেছে একটা কুকুর, তারপর আরও একটা। তবু কোনও দরজা খুলল না; যেমন জ্বলছিল বাতি, তেমনি জ্বলতে লাগল। শান্ত নিরুদ্বিগ্ন মনে এগিয়ে যাচ্ছি আমি, দৃষ্টি সজাগ। অন্ধকারে নিশ্চয়ই কেউ আমার ওপর নজর রাখছে। আমার মতবল না বুঝে বলবে না কিছু।স্যাডল থেকে নেমে সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠলাম। বিনা সাড়াশব্দে ভেতরে ঢুকলাম দরজা ঠেলে।রেড়ির বাতি জ্বলছে একটা টেবিলে। ও’নীল বসে আছে। মা এবং আরও এক রমণী রয়েছে। ওই মেয়েটি বোধ হয় নীলের স্ত্রী, ভাবলাম।চারজনের টেবিল, একটা আসন ফাঁকা। নীরবে দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছি আমি, মাথা ওপরের চৌকাঠ জুঁই-ছুঁই। আনন্দে জিভ সরছে না আমার, মনে হচ্ছে গলার কাছে একটা পুঁটুলি দলা পাকিয়ে আছে, চোখে জল। কেমন যেন অপ্রতিভ লাগছে, বাধো বাধো ঠেকছে এই ধূলিমলিন পোশাকে পরিপাটি ঘরে ঢুকতে।

পৃষ্ঠা -১৪

‘কেমন আছ, মা? নীল, আমার পেছনের লোকটাকে বন্দুক সরাতে বললি না?ও’নীল উঠে দাঁড়াল। ‘কে… ওরিন!”হ্যাঁ রে তোরা সবাই ভাল আছিস?’ বললাম আমি। তারপর ঘুরে নীলের স্ত্রীকে নড করলাম। ‘হাউডি, ম্যাম? আমি উইলিয়ম ওরিন ওসমান। তুমি নিশ্চয়ই রোসাবেলা নীলের বউ।’আমার হাতে ওর করতল রাখল রোসাবেলা, পায়ের পাতায় ভর দিয়ে চুমু খেলো গালে। লজ্জায় আমার কান ঝাঁ-ঝাঁ করে উঠল। ঘর-কাঁপানো হাসিতে ফেটে পড়ল নীল, তারপর আমার পেছন দিকে অন্ধকারে তাকিয়ে বলল, ‘চলে এসো, ক্যাপ। ও আমার বড় ভাই ওরিন।’আঁধার ফুঁড়ে বেরিয়ে এল ক্যাপ সয়‍্যার। কৃশকায়, মাঝবয়েসী লোক। পোড়-খাওয়া ধূসর একজোড়া চোখ। গোঁফগুলো পেকে সাদা। স্থির চোখে আমার সাথে দৃষ্টি বিনিময় করল সে। নীল বাড়িয়ে লেখেনি, স্বীকার করলাম মনে মনে, এই লোক শক্তপাল্লা এতটুকু বেচাল দেখলে এতক্ষণে আমার লাশ ফেলে দিত।ক্যাপ এগিয়ে এসে আমার সঙ্গে হাত মেলাল।রান্নাঘরের দিকে ঘাড় ফেরালেন মা। ‘হুয়ানা, আমার ছেলেকে খেতে দে।” আবার আমার চমক খাওয়ার পালা। নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছি । আমার মা চিরকাল স্বাবলম্বী, সেই তিনি কিনা ঝি রেখেছেন।না হুয়ানা দোআঁশলা মেয়ে। বাবা মেক্সিক্যান, মা ইন্ডিয়ান। দামী থালায় করে খাবার নিয়ে এল সে। আমাকে আড়ষ্টতা গ্রাস করল, বহুদিন হলো কোনও মেয়েছেলের সামনে খাইনি। ধুকপুক করছে বুক, পাছে শিষ্টতায় হানি ঘটে। ট্রেইল ক্যাম্পে খিদে পেলে মানুষ খায় আচার-আচরণ নিয়ে মাথা ঘামায় না।’আমি বারান্দায় বসে খেলে আপত্তি আছে?’ বললাম। ‘কেমন যেন লাগছে এখানে।’হাত ধরে আমাকে চেয়ারের কাছে নিয়ে গেল রোসাবেলা। ‘বসো, ওরিন খেতে খেতে তোমার গল্প শুনব।’রোসাবেলার অকপটতায় মুগ্ধ হলাম। চকিতে সোনার কথা মনে পড়ল। বাইরে থেকে থলেগুলো নিয়ে এসে রাখলাম টেবিলে। এক টুকরো স্বর্ণপিও বের করলাম ভেতর থেকে, স্ফটিকের গুঁড়ো লেগে আছে এখনও।• বিস্ময়ে সবার চোখ কপালে উঠে গেল। নীলকে আমার কোনও ব্যাপারে ঘাবড়াবার পাত্র বলে মনে হয়নি, অথচ সেও স্পষ্টত তাজ্জব হয়েছে।রান্নাঘর থেকে হাত-মুখ ধুয়ে এসে খেতে বসলাম আমি। সংক্ষেপে সব কিছু জানালাম ওদের।এ-বাড়ির চাকচিক্যে আমার বিস্ময় বাড়ছে ক্রমশ। তকতকে নিকানো মেঝে, মিসিসিপির স্টিমারে এমনটা দেখেছি। পারলারের অনেকটা দেখতে

পৃষ্ঠা -১৫

পাচ্ছি খোলা দরজা দিয়ে। মেহগনি কাঠের ভারি আসবাব, দেয়াল-জোড়া শেলফ, থরেথরে বই।মায়ের জন্যে এমন একটা বাড়ির স্বপ্ন সারাজীবন আমি কেবল দেখেই এসেছি। অ্যানজেল আর ও’নীলের জন্যে গর্বে আমার বুক ফুলে উঠল।সবাই খাওয়ায় মগ্ন, আমি উঠে পারলারে গেলাম। এ-ঘরেও একটা টিমটিমে রেড়ির বাতি জ্বলছে। উস্কে দিলাম সলতেটা। উবু হয়ে তৃষিত চোখে দেখছি বইগুলো। নামালাম একটা, আলতোভাবে উল্টালাম মলাট যাতে ময়লা লেগে না যায়। হাত দিয়ে বইটার ওজন বুঝতে চেষ্টা করলাম। বেশ ভারি, নিশ্চয়ই বহু মূল্যবান কথা লেখা আছে।একটা লাইনের ওপর হাত রাখলাম আমি। পড়তে চাইলাম, পারলাম না। অপরিচিত শব্দ সব। এক বাইবেল ছাড়া জীবনে আর কিছু পড়িনি আমি। এইবার হেঁটে হেঁটে বইগুলোর নাম পড়তে শুরু করলাম। প্রায় সবই আইনের বই। সাহিত্য ও দর্শনের ওপরেও কিছু আছে। ওগুলো পড়তে ইচ্ছে করছে আমার। একের পর এক বই ঘাঁটছি। মাঝে-মধ্যে পরিচিত শব্দ পাচ্ছি একটা- দুটো।চকিতে এইসব জায়গা ধরা পড়ছে আমার চোখে, রাইফেলের নলে সূর্যের প্রতিফলনের মত। হঠাৎ এক জায়গায় এসে থমকে গেলাম, ব্ল‍্যাকস্টোনের ওই বিশেষ অংশটি কেন আমার পছন্দ হলো বলতে পারব না। *…সমাজে সকলের অধিকার সমান। প্রত্যেকেরই উচিত অন্যের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে মূল্য দেয়া, তেমনি সমাজের সমষ্টিগত চাহিদার দিকেও লক্ষ রাখতে হবে। অর্থাৎ, সমাজ যেমন ব্যক্তির অধিকার রক্ষা করবে; তেমনি ব্যক্তিও সামাজিক নিয়মকানুন মেনে চলবে। এ ছাড়া দেশে আইনের শাসন আসবে না।’বোকার মত দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। সম্পূর্ণ অর্থ ধরতে না পারলেও কথাগুলো দারুণভাবে ঝাঁকুনি দিল আমার ভেতরটাকে। ঠিক করলাম, যেভাবে হোক এর অর্থ উদ্ধার করব।বইগুলো যথাস্থানে রেখে উঠে দাঁড়ালাম আমি, জরিপের দৃষ্টিতে তাকালাম চারপাশে। এই বাড়ির মালিক আমার মা, এবং ও’নীল আর অ্যানজেল। এখানে আমার কোনও অধিকার নেই। এটা ওদের পরিশ্রমের ফসল এবং মাকে সেটা দান করেছে ওরা।ও’নীল সেই রোগা পেটুক বালকটি আর নেই। এখন দীর্ঘকায় একহারা গড়ন। হাবভাবে স্বকীয়তার ছাপ। কালো বনাতের কোট আর সাদা শার্টে চমৎকার মানিয়েছে ওকে। মনে হচ্ছে পোশাকটি যেন ওর জন্যেই সৃষ্টি। এমনকী, অ্যানজেলের চাইতেও সুদর্শন দেখাচ্ছে।আমি আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ওদের তুলনায় নিজেকে আমার কদাকার বলে মনে হলো। অসম্ভব লম্বা, লিকলিকে স্বাস্থ্য, হাড্ডিসার মুখ। অনেকটা কুঠারের মত। গালের এক পাশে একটা পুরোনো ক্ষতচিহ্ন। আমার

পৃষ্ঠা -১৬

সমস্ত শরীরের মধ্যে একমাত্র কাঁধেই যা একটু মাংস তাও ঈষৎ ঝুলে-গড়া। পরনের এই জীর্ণ আর্মি শার্ট আর বিবর্ণ জিন্সে আমাকে নির্ঘাত কিম্ভুতকিমাকার দেখাচ্ছে।ছোট ভাইয়েরা আমার, সে-তুলনায়, অনেক বেশি স্মার্ট, বুদ্ধিমান এবং সম্ভাবনাময়। আমার সম্বল শুধু দুখানি হাত, আর আমার কষ্টসহিষ্ণু মেরুদণ্ড। এই দুহাতে অবলীলায় প্রায় সব কাজ করতে পারি। ঘোড়ায় চড়া, গরুর দেখাশোনা জানি। কিন্তু তাতে কি লাভ হয়েছে কোনও?আবার বইয়ের সেই কথাটা মনে পড়ল। মানুষের জীবন ওই ছকে বাঁধা, ওভাবেই তার উন্নতি। বইতে এ-সব কথা লেখা থাকে, আগে জানতাম না আমি।অ্যানজেল এসে পড়েছে ইতিমধ্যে। গিটার বাজিয়ে গান ধরেছে। অতীতের মত সরব হয়ে উঠেছে আমাদের বাসা। তবে সময় থেমে নেই, আমি জানি, ছোট ভাইয়েরা আমাকে ফেলে বহু, বহুদূর এগিয়ে গেছে। আর কদিন পর আমার আটাশ পুরবে এর সবটুকুই প্রায় রুক্ষ রূঢ় অভিজ্ঞতা তবে আমার এই মনোবলটুকু অন্তত রয়েছে যে, অ্যানজেল আর ও’নীল যখন পেরেছে আমিও পারব।সকাল হলেই খনিতে যাবার তোড়জোর শুরু করব। সোনা কেচে সরঞ্জাম কিনব প্রথমে। তারপর বেরিয়ে পড়ব। ঝটপট সারতে হবে সব কিছু, কারণ বিগলোরা চলে এলে পরিস্থিতি কোন দিকে গড়াবে, বলা মুশকিল। কিন্তু আমি যেমনটি ভেবেছিলাম, প্রথম পর্ব তার চেয়ে অনেক সহজে সমাধা হয়ে গেল।মোরার নিকটতম বিপণিকেন্দ্র লাস ভেগাস। আমি রওনা হলাম সেখানে। সঙ্গে ও’নীল আর ক্যাপ সয়্যার।’আমিও আসছি,’ বলল ক্যাপ। ‘সাথে লোক থাকলে তোমার সুবিধে হবে। ওই সোনা যেখানেই দেখাবে,  তোমার শত্রু বাড়বে’। সুযোগ পেলে মেরেও ফেলতে পারে।’,লাস ভেগাসের পথে নতুন একটা আইডিয়া খেলল আমার মাথায়। সেই ঝরনাটার উল্টোদিকে, কোনও এক উপত্যকায় ক্লেইম স্টেক করব। লোকে এর ফলে ভাববে সোনা ওখানেই পেয়েছি আসল জায়গায় তাদের চোখ পড়বে না।’বেশ তো,’ বারকয়েক চোখ পিটপিট করল ক্যাপ। ‘তুমি ফাইল করো, আমি নামকরণ করব। ওটার নাম হবে রেড হেরিং।’লাস ভেগাস ব্যাঙ্কে আমি যখন সোনা দেখালাম, ব্যাঙ্কারের চেহারা ঈষৎ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। ক্যাপের কথা সত্যি: লোকটার চোখে লোভের ছায়া স্পষ্ট।’কোথায় পেয়েছ?’ প্রশ্ন করল ব্যাঙ্কার। ‘মিস্টার,’ বললাম আমি, ‘কেনার ইচ্ছে থাকলে দাম বলো নইলে আমি

পৃষ্ঠা -১৭

আর কোথাও যাব।’ব্যাঙ্কার লোকটা ঢ্যাঙা; গায়ে-গতরে মাংস নেই বললেই চলে। কালো কুঁতকুঁতে চোখজোড়ায় বাজপাখির দৃষ্টি। শুকনো রোগাটে মুখ, ঝাঁটার মত গোঁফ। নিজের ঠোঁট চাটল সে, সরাসরি তাকাল আমার দিকে। ‘চুরিও তো-‘আমার দৃষ্টি কঠিন হয়ে উঠছে দেখে ব্যাঙ্কারের গলায় কাঁটা ফুটল। ঠিক সেই মুহূর্তে ও’নীল আর অ্যানজেল দোর ঠেলে ভেতরে ঢুকল। অ্যানজেল দরকারী কাজে আগেই শহরে এসেছিল, ব্যাঙ্কে আসবার পথে ওকে তুলে এনেছে ও’নীল।’প্রবলেম, ওরিন?”না।”ওহ্, অ্যানজেল!’ ব্যাঙ্কার একবার ও’নীলকে আরেকবার আমাকে দেখছে। চেহারার মিল চোখে পড়বার মত। ‘সোনা কিনছিলাম। তোমার ভাই?’ ঘাম দেখা দিয়েছে ব্যাঙ্কারের কপালে। ‘ওরিন, এর নাম জন টুথহিল।”কী সৌভাগ্য!’ মুখে শুকনো হাসি ফুটাবার প্রয়াস পেল ঝাঁটা-গোঁফ ওরফে টুথহিল। কিন্তু আমাদের চোখ যখন পরস্পর মিলিত হলো, আমার বুঝতে বাকি রইল না যে আমার কপালে ভোগান্তি আছে।’মন্ট্যানা থেকে কালই এসেছে আমার ভাই, অমায়িক সুরে বলল অ্যানজেল। ‘ওখানে ওর একটা খনি আছে।”ওকে দেখে কিন্তু মনে হয় কাউহ্যান্ড।”একসময় তাই ছিলাম ইচ্ছে আছে আগামীতে নিজেই একটা র‍্যাঞ্চ দেব।’এরপর আমরা ঘুরে ঘুরে কেনাকাটা করলাম। মাইনিংয়ের জন্যে যা যা লাগবে, শাবল, গাঁইতি, ছেনি সব কিনলাম। এমনিতে আমার সন্দেহবাতিক নেই, কিন্তু জানি সাবধান থাকা ভাল। তাই, সারাক্ষণ পেছনের দিকে খোলা রাখলাম একটা চোখ। একটুবাদে নিজেদের কাজে চলে গেল অ্যানজেল আর ও’নীল। আমারও বাজার সারা। ক্যাপ সয়্যারকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। অবশ্যি ওকে নিয়ে দুশ্চিন্তা না করলেও চলে। যৌবনে ক্যাপ অনেক অসাধ্য সাধন করেছে। কেউ।তার লেজ মাড়ালে নিজের বিপদই ডেকে আনবে শুধু।বেলা ডুবে গেছে। আস্তাবলে মালপত্র রেখে আমি রাস্তায় নামলাম। থেমে এক ঝলক তাকালাম পাহাড়ের দিকে, তারপর পেছনে। যা ভেবেছি, ফেউ লেগেছে।লোকটা বিগলোদের কেউ হবে, সন্দেহ হলো আমার। ঝটিতি বাঁক নিলাম একটা অন্ধকার গলিতে, হাঁটতে লাগলাম ধীরে ধীরে। পেছন থেকে ধুপধাপ শব্দ ভেসে আসছে। মৃদু হাসি ফুটে উঠল আমার মুখে লোকটা কোনওক্রমেই আমাকে হারাতে রাজি নয়। ছায়ায় মিশে দাঁড়িয়ে রইলাম।

পৃষ্ঠা -১৮

আচমকা সামনে আমাকে না দেখে হতভম্ব হয়ে গেল লোকটা। ঝট করে থমকে গেল, আর ঠিক তক্ষুণি ওকে আঘাত করলাম আমি।আমার মুঠি বিরাট, মজুরের মত শক্ত হাত। লোকটার চোয়ালে থ্যাচ করে জমে গেল। কুড়োল দিয়ে গাছের গুঁড়ি কাটার মত শোনাল।আড়াল থেকে আমাকে কেউ নজরে রাখবে এটা আমার মোটেও পছন্দ নয়। বাঁ-হাতে ওর কলার চেপে ধরে, টানতে টানতে স্যালুনে নিয়ে গেলাম। ওখানেই আমাদের সবার মিলিত হবার কথা।খদ্দেররা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকাল আমাদের দিকে। পশ্চিমের যে-কোনও শহরে এইরকম দৃশ্য দেখলে লোকে কৌতূহলী হয়ে ওঠে। বারের সামনে একটা টুলে জোর করে বসিয়ে দিলাম ফেউকে।’কেউ চেন একে?’ জিজ্ঞেস করলাম। ‘আমার পিছু নিয়েছিল। অন্ধকারে হামলা করেছিল আমাকে।”ওর নাম উইল বয়েড জুয়াড়ি।”ভুল তাসে বাজি ধরেছিল, বললাম আমি।বয়েডের বোধশক্তি ফিরে আসছিল, যখন টের পেল কোথায় আছে, সরে পড়বার চেষ্টা করল বার থেকে। কিন্তু আমি ওকে বজ্রমুঠিতে ধরে রইলাম। আরকান-স টুথপীকটা বের করলাম কোমরের বেল্ট থেকে, এইসব ক্ষেত্রে বেশ সুফল দেয় ওটা।’আমার পেছনে লাগা তোমার উচিত হয়নি,’ বললাম, ‘মনে হচ্ছে তোমার ওই গোঁফই যত নষ্টের গোড়া।’ কঠিন দৃষ্টিতে বয়েড তাকিয়ে আছে আমার দিকে। মওকা পেলে আমাকে খুন করতে দ্বিধা করবে না। এরা খুব বিপজ্জনক হয়, টাকার লোভে যে-কোনওকাজ করতে পারে। মনে করে, ওদের চেয়ে চালাক বুঝি পৃথিবীতে আর কেউ নেই। অথচ ব্যাপারটা আদৌ তা নয়। লোকটাকে টাইট দেবার সিদ্ধান্ত নিলাম। বাড়িয়ে ধরলাম ধারাল ছুরিটা। ‘নাও, তোমার গোঁফ কামিয়ে ফেল।’ ফ্যালফ্যাল করে তাকাল উইল বয়েড। বোধ হয় ভাবছে, আমি ঠাট্টা করছি। ‘আমার পিছু নিয়ে মারাত্মক ভুল করেছ তুমি,’ খেই ধরলাম আবার। ‘সুতরাং, বুঝতেই পারছ-‘ ভীষণ হয়ে উঠল আমার চেহারা।কম্পিত হাতে ছুরিটা নিল বয়েড। একটু দোনোমনো করল, পরমুহূর্তে আমার কথা কানে যেতে গোঁফে ঠেকাল।’মিস্টার, পাঁয়তারা করো না ভাল হবে না ফল,’ বললাম আমি। থরথরিয়ে কাঁপছে বয়েডের হাত, বিনা সাবান-পানিতে কামাতে শুরু করল গোঁফ। ঘরসুদ্ধ লোক ক্ষুর চালাবার শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে।দড়াম করে খুলে গেল স্যালুনের দরজা। বয়েডের চোখজোড়া জ্বলে উঠল ক্ষণিকের জন্যে। মুখ খুলতে গিয়েও সামলে নিল নিজেকে। স্যালুনের নবাগত মেহমান টুথহিল।

পৃষ্ঠা -১৯

‘এই যে!’ কর্তৃত্বের সুর ফুটল তার গলায়। ‘হচ্ছে কী এখানে?”গোঁফ কামাচ্ছে একজন,’ হালকা সুরে বললাম আমি। মুহূর্তের জন্যে চোখ সরিয়ে যোগ করলাম, ‘তুমিও কামাবে নাকি, টুথহিল?’ ঝাঁটা-গোঁথের চেহারা লাল হলো সামান্য। দম নিয়ে বলল, ‘লোকটা দোষ করে থাকলে, সে-জন্যে আইন আছে।”সহকর্মীকে জেলে পুরতে চাইছ!’ মর্মাহত হবার ভান করলাম। ‘তুমি তো, দেখছি, সাংঘাতিক লোক।’নীরবে অপমান। জম করল ব্যাঙ্কার। কেউ তাকে সমবেদনা জানাল না। আমার ধারণা, এই লো- ই আমার পেছনে লাগিয়েছিল বয়েডকে।বয়েডের গোঁফ কামানো হয়ে গেছে। কলমের মত দু-একটা রয়ে গেছে এখনও। কয়েক জায়গায় কেটে গিয়ে রক্ত পড়ছে।’যাও, মাফ করে দিলাম,’ দরাজ গলায় ঘোষণা করলাম আমি। ‘ভাগো এই শহর থেকে এক্ষুণি। ফের কখনও আমার আশপাশে দেখলে স্রেফ খুন করে ফেলব।’সূর্য ওঠার আগেই যে গোটা শহর এ-কাহিনি জেনে যাবে, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তবে ওদের মনোভাব জানবার সৌভাগ্য আমার হবে না কারণ আমি তখন মোরার পথে থাকব।বাথানে পৌঁছে মালপত্র গোছাতে শুরু করলাম। দাওয়ায় বসে নিবিষ্ট মনে • আমাকে লক্ষ করছিল ক্যাপ, হঠাৎ নীরবতা ভাঙল সে।’আপত্তি না থাকলে আমি যাব তোমার সঙ্গে। বাসায় চুপচাপ বসে থাকতে আর ভাল লাগছে না।’জবাব দেবার অবকাশ পেলাম না, উঠোনে একটা বাকবোর্ড ঢুকল।লাফিয়ে নীচে নামল অ্যানজেল। মুখে মেঘ জমেছে। সোজা আমার কাছে – হেঁটে এসে বলল, ‘লাস ভেগাসে এক লোক তোমার খোঁজ করছিল, ওরিন। ওর নাম বিগলো।’

পাঁচ

আঁধার থাকতে রওনা হয়েছি আমরা। আকাশে দু-একটা তারা তখনও জ্বলছিল মিটমিট করে। আমরা কয়ৌট ক্রীকের উজানে যাচ্ছি। পুরোভাগে ক্যাপ সয়‍্যার, তারপর ছটা প্যাক হর্স, এবং সবশেষে আমি। স্যাংগর দ্য ক্রিসটোস পাহাড়থেকে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে, নীচে কোথাও ডাকছে একটা কোয়েল। আমরা ইচ্ছে করেই ঘুরপথে যাচ্ছি। যাতে কারও চোখে পড়তে না হয়।

পৃষ্ঠা -২০

বাথানের লাগায়ো মোরা নদী, একটা সঙ্কীর্ণ গ্যাপের ভেতর দিয়ে সমভূমিতে গিয়ে পড়েছে। মোরার পাড় ধরে আমরা কয়ৌট ক্রীকের সঙ্গমে পৌছুলাম, তারপর ঘুরে লা কুয়েভা উপত্যকায় উঠলাম।গোলনড্রিনোস গ্রাম ঘুরে অচেতন। পাশ কাটিয়ে উত্তরে যাত্রা করলাম আমরা। ভোরের কনকনে হাওয়া হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছে। নর্মেঘ আকাশ, আলো ফুটছে সবে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ভয়াল পাহাড়ী খাঁর গুলো, ভেংচি কাটছে। আমাদের খুরের চাপে নুয়ে পড়ছে ঘাস। জিনের খসখস শব্দে ছমছমে ভাব। গোলনড্রিনোস গাঁয়ে ডাকছে একটা কৌতূহলী কুকুর।ক্যাপের পরনে ঘরে-বোনা পশমী কোট। স্যাডলে কুঁজো হয়ে বসে আছে সে। বাড়ি থেকে বেরিয়েছে সেই কোন সকালে, এ-পর্যন্ত একটিবারও পেছন ফিরে তাকায়নি।আমার মন ঘুরে-ফিরে বাড়িতে চলে যাচ্ছে। ভোর তিনটেয় বিছানা ছেড়েছি আমি। এখন গরমকাল, তবু পাহাড়ে ঠাণ্ডার প্রকোপ কমেনি এতটুকু। অথচ বাসার সবাই আমাকে এগিয়ে দিতে দোরগোড়া অবধি এসেছিল। অত ভোরেও নাস্তা খাইয়ে তবে ছেড়েছে রোসাবেলা। এই একটা ক্ষেত্রে ও’নীলের ভাগ্যে আমার হিংসে হচ্ছে রোসাবেলার মত মেয়েকে ও বউ হিসেবে পেয়েছে।নীল ঘুম থেকে উঠেই শেভ করে নিয়েছিল। মানুষ রোজ দাড়ি কামাবার মত ফুরসত পায় কোথেকে আমি ভেবে পাই না। তবে দাড়ি কামালে চেহারার জোলুস বাড়ে, এটা স্বীকার করতেই হয়। বুঝতে পারছি, কোনও মেয়ের সাথে গাঁটছড়া বাঁধার আগে আমাকে ভব্যতা শিখতে হবে।মায়ের বয়েস হয়েছে। তার ওপর বাতে একটা পা প্রায় পঙ্গু। তবু ছেলেকে বিদায় জানাতে উঠে পড়েছিলেন বিছানা থেকে।চলে আসবার আগমুহূর্তে মায়ের কপালে চুমু খেয়েছি আমি। তারপর তাকিয়েছি ঘরের চারদিকে। বেদনায় টনটন করে উঠেছে আমার বুক: মায়ের কোল ছেড়ে আবার বিপদের মুখে পা বাড়াচ্ছি। মা আমার জীবনে সুখের মুখ দেখেননি; আজ যা পেয়েছেন, তাও যে একটা বিরাট কিছু তা নয়, আবার একেবারে ফেলনাও নয়। সবচেয়ে বড় কথা মা এতে খুশি। ছেলেরা তাঁকে চোখে হারায়, তাঁর আরাম-আয়েসের, ব্যবস্থা করেছে। এবং সেই সঙ্গে ওরা নিজেরাও উন্নতি করেছে।কিন্তু আমি, ওরিন ওসমান? বংশের বড় ছেলে, এটুকুই যা আমার সম্মান- এ ছাড়া আপনার বলতে আমার কিছু নেই… কিচ্ছু না।আমরা যেখানে যাব, তার মূল রুট স্প্যানিশ ট্রেইল। কিন্তু ক্যাপের পরামর্শে উত্তরে স্যান লুই এবং পুরোনো ফোর্ট ম্যাসাচুসেটস হয়ে যাচ্ছি। এখন পথে যদি কেউ ওত পেতে থাকে, বসে থাকাই সার হবে বেচারার। সে-রাতে আমরা ব্ল‍্যাক লেক থেকে আধ-মাইল ভাটিতে একটা পাইন সনে ক্যাম্প করলাম।

পৃষ্ঠা ২১ থেকে ৩০

পৃষ্ঠা -২১

নিথর রাত। একঘেয়ে সুরে জাল বুনে চলেছে ঝিঝি পোকার দল। দূরে ডাকছে কয়েকটা কয়ৌট। খোলা প্রান্তরে তারই প্রতিধ্বনি। কাছেই, ঢালের ওপর দিকে কোনও এক ঝোপে পিঠ চুলকাচ্ছে একটা গ্রিজলি। তবে এই দুই অধম আদম সন্তানের প্রতি ওর একটুও মনোযোগ নেই বুড়ো মানুষের মত বিড়বিড় করছে আপনমনে।শুক্লপক্ষে একাদশীর চাঁদ উঠেছে আকাশে। গাছপালার ফাঁক দিয়ে হলুদ জ্যোৎস্না লুটিয়ে পড়েছে মাটিতে। সশব্দে লাকড়ি পুড়ছে। আমার চোখে ঘুম আসছে না, অপলক চেয়ে আছি সপ্তর্ষিমণ্ডলের দিকে।এ-জীবনে আমি কি নীড় বাঁধতে পারব?সোনার খোঁজ গোপন রাখা কঠিন।ভাল-মন্দ, সবল-দুর্বল সোনার গন্ধ পেলে সবাই মৌমাছির মত ভনভন শুরু করে।পরদিন সকালে ফের রওনা হলাম আমরা। অল্পক্ষণের মধ্যে অ্যানজেল ফায়ার মাউন্টিনের গোড়ায় পৌঁছুলাম। আমাদের বাঁয়ে ওল্ড টাওস পাস, পাহাড়- পর্বত ডিঙিয়ে সামনে চলে গেছে। আজ যাত্রার শুরু থেকেই ছটফট করছে ক্যাপ। উদ্বিগ্ন, বারবার তাকাচ্ছে পেছন দিকে।’আমরা যখন ঈল নেস্ট উপত্যকায় এলাম, তখন বেলা বেশ চড়ে গেছে। দীর্ঘ ঢালে পাইনের সারি। পাতায় পাতায় বাতাসের কানাকানি। কাইমারনে যাবার ট্রেইলটা আমাদের পুবে। দল ছেড়ে ও-দিকটা জরিপ করতে এগিয়েগেলাম আমি। জনাকয়েক অশ্বারোহীর ট্র্যাক রয়েছে। ওদের গন্তব্য উত্তরে এলিযাবেথ টাউন। ঘোড়ার রাশ টেনে পরিস্থিতি বিচার করতে বসলাম আমরা। দুভাবে ওখানে যাওয়া যায়: মোরেনো ক্রীক ধরে সোজাসুজি; অথবা কোম্যাঞ্চে ক্রীক অনুসরণকরে, একটা পাহাড়কে পাশ কাটিয়ে সামান্য ঘোরা পথে।আমি ঠিক করলাম সোজা পথেই যাব। কারণ, এতে করে আমাদের পেছনে সত্যি সত্যি কেউ যদি লেগেও থাকে, সে টের পাবে না যে আমরা বিপদের আঁচ, পেয়েছি। ক্যাপ সয়্যারও সায় জানাল। ঠিক হলো, আমরা শহরে গিয়ে খাওয়া- দাওয়া সারব। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলব, আইডাহোতে আমাদের ক্লেইম আছে সেখানেই যাচ্ছি।এলিযাবেথ টাউন এখনও একটা সাপ্লাই পয়েন্ট। আশপাশের পাহাড় থেকে মাইনাররা মাল কিনতে আসে। কিছু দাঙ্গাবাজ লোক আছে। কিছু দিন আগে খাসমহাল বরাদ্দকে কেন্দ্র করে যে-লড়াই হয়েছিল, এরা যোগ দিয়েছিল তাতে।মামলা মিটে গেছে, ওরা যায়নি। একটা পরিত্যক্ত কোরালে নিজেদের জিনিসপত্র উঠিয়ে রাখলাম আমরা। রাস্তায় অলসভাবে ঘুরঘুর করছিল এক মেক্সিক্যান ছোকরা। ওকে ডাকলাম

পৃষ্ঠা -২২

আমি। ছোকরার বেশভূষা দীন-হীন – একনজরেই বোঝা যায় গৃহযুদ্ধে এদের কপাল পুড়েছে।ওর হাতে কয়েকটা মুদ্রা গুঁজে দিয়ে বললাম, ‘দানাপানি আর মালিশের ব্যবস্থা করো আমরা খেয়ে আসছি।’সবচেয়ে কাছের পানশালায় ঢুকলাম আমরা। ফিসফিস করে ক্যাপ জানাল, এখানকার বারে এ-যাবৎ আট-দশজন লোক খুন হয়েছে। বিচিত্র নয়, চল্লিশ ফুট ঘরে বিশ ফুট বার। এই স্বল্প রেঞ্জে গুলি ফসকালে সেটা ভাগ্য বলতে হবে।’তবে রান্নাটা ভাল,’ বলল ক্যাপ। ‘পুবের এক বিখ্যাত হোটেলে এই বাবুর্চি একসময় রাঁধত। একজন লোককে খুন করায় পালাতে বাধ্য হয়েছে।’বারে চার-পাঁচজন খদ্দের বসে। কঠিন চেহারা সব। একজনের মুখে জেনারেল গ্র্যান্ট-মার্কা দাড়ি।’ওর নাম বেন হবস,’ নিচু গলায় জানাল ক্যাপ। ‘টেক্সাসে ওর নামে হুলিয়া আছে।’আমাদের টেবিলে এল বারটেন্ডার। ‘কী দেব?’ ক্যাপ সয়্যারের দিকে এক ঝলক তাকাল সে। ‘দেখি না যে বড়?”ব্যস্ত,’ বলল ক্যাপ। মাথা ঝাঁকিয়ে দেখাল আমাকে। ‘আইডাহোতে আমাদের একটা ক্লেইম আছে ওখানেই থাকতে হয় আজকাল।’ বারের দিকে ইশারা করল ক্যাপ। ‘বেনের সঙ্গে ওই সাদা চুলের’ ছেলেটা কে, স্যাম?’কাঁধ ঝাঁকাল স্যাম। ‘কিড নিউটন, ভবঘুরে… বোধ হয় মরার শখ হয়েছে।”সেই ঝিনুকের সুপ বানাও এখনও? থাকলে আমাকে দাও এক কাপ।’ ‘আমাকেও,’ বললাম আমি, ‘তবে দুকাপ। এবং সম্ভব হলে, খানিকটা মাংস।”একটু সবুর করতে হবে… মাংস চুলোয়।’বারটেন্ডার চলে যেতে ক্যাপ মুখ খুলল। ‘স্যাম গোলমাল করবে না। কারও সাতে-পাঁচে নেই পাক্কা ব্যবসায়ী। ঝামেলা চায় না।’কিড নিউটন কনুইয়ের ভর রাখল বারে। এক পা ব্রাস রেইলের ওপর তোলা, আংটার মত করে আঁকড়ে আছে গোড়ালি দিয়ে। দুটো পিস্তল কোমরে। পিস্তলবাজদের ঢঙে গানবেল্ট নামিয়ে পরা, হোলস্টারদুটো সেঁটে আছে দুই উরুর সাথে। বাজপাখির ঠোঁটের মত লম্বাটে চেহারা। তোবড়ানো চোয়াল। চোখজোড়া কোটর থেকে ঠেলে বেরিয়ে আছে, যেন এখুনি ছিটকে পড়বে। – একটা থেকে আরেকটার দূরত্ব কম। ঈষৎ বাঁকা ঠোঁট, যেন ভেংচি কাটছে সর্বক্ষণ।বেন হবসকে নিচু স্বরে কিছু বলল নিউটন। ‘ফরগেট ইট,’ জবাব দিল হবস। নীরবে ক্যাপের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করলাম আমি। ওর চোখে হুঁশিয়ারি, চেহারা নির্লিপ্ত।খানিক পর খাবার দিয়ে গেল বারটেন্ডার। ক্যাপের কথা যথার্থ, মুখে দিয়েই

পৃষ্ঠা -২৩

বুঝলাম। ‘লোকটার রান্না তো ভালই,’ বললাম আমি, ‘তা খুনটা করেছিল কীভাবে?”কেন খাবারে বিষ মিশিয়ে।’ ক্যাপের গালে ভাঁজ পড়ল।

ছয়

ভীষণ খিদে পেয়েছিল আমাদের, খাবারটাও সুস্বাদু, পেট পুরে খেলাম। পশ্চিমের আর সব সস্তা স্যালুনের মত এটাও সাদা-মাঠা। একটা লম্বা বার, সামনে কয়েকটা টুল পাতা। ঘরের চারপাশে ছড়ানো-ছিটানো খানকতক চেয়ার- টেবিল। বারের পেছনে, দেয়াল ঘেঁষে শেলফ। রকমারি বোতল সাজানো। পশ্চিমে চিত্তবিনোদনের সুযোগ নিতান্তই কম। দিনান্তে কাজ সেরে মানুষ তাই পানশালায় ভিড় জমায়। নানা ধরনের, নানান পেশার লোক আসে এখানে। খায়, গল্প করে, অবসর সময় কাটায়। এরা প্রত্যেকেই স্বাধীনচেতা লোক, ব্যক্তিত্ববোধ প্রবল। এমনিতে নিরীহ, কিন্তু আঁতে ঘা দিলে আর রক্ষে নেই। কিছু মন্দ-লোকও আছে এদের মাঝে। নিজেদের এরা কেউকেটা, কঠিন লোক বলে ভাবে। মনে করে, তারা তাদের খেয়াল-খুশি অনুযায়ী চলবে, এবং অন্যেরা নির্বিবাদে মেনে নেবে তা। কিন্তু একটিবারও তলিয়ে দেখে না,এইরকম আচরণ করতে গেলে যে-সব গুণ থাকা দরকার তাদের সেটা নেই।যেমন কিড নিউটন। ওর বয়েস এমন কিছু নয়, বড়জোর কুড়ি-একুশ হবে। এখানে ঢোকার পর থেকেই আমি দেখছি, ও বার-বার আড়চোখে তাকাচ্ছে আমাদের দিকে। দৃষ্টি দেখলেই এ-সব লোককে চিনতে পারি আমি, বুঝতে পারছি কিডের মাথায় দুর্বুদ্ধি চেপেছে। তবে বেন হবস সেটা পছন্দ করছে না।বেন হবস কঠিন লোক। কাউকে তা বলে দেবার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু, সঙ্গী নির্বাচনে ওর আরও সতর্ক হওয়া উচিত। ঝগড়টে লোকের সঙ্গে চললে, অনেক সময় নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গোলমালে জড়িয়ে পড়তে হয়।নিউটন চাইছে একটা রক্তারক্তি ঘটাতে। হয়তো ভেবেছে, কাউকে খুন করতে পারলে লোকে তাকে সমীহ করবে। আর এ-জন্যে সে আমাদের বেছে নিয়েছে। কারণ বারে আমরাই নবাগত আগন্তুক।কিন্তু এর বিপত্তির দিকটা ও জানে না। আমরা ওর অচেনা, সুতরাং আমাদের শক্তি সম্পর্কে ওর কোনও ধারণা নেই। ক্যাপ সয়্যার বৃদ্ধ হলেও সিংহের তেজ রাখে বাহুতে। দুদে মোঘ শিকারী, ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে অসংখ্য লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা আছে। কিড নিউটনের মত বহু ছেলেকে মারা যেতে দেখেছে সে।সম্ভবত আমিও দাগ কাটতে পারিনি ওর মনে। আমার হালকা-পাতলা গড়ন দেখে ভেবেছে সহজেই সামলানো যাবে। অথচ একটু খেয়াল করলেই দেখতে

পৃষ্ঠা -২৪

পেত, আমার পিস্তলের বাঁট বহু-ব্যবহারে চকচকে।কোনও ঝঞ্ঝাটে জড়িয়ে পড়া আমার ইচ্ছে নয়। এমনিতেই বিগলোকে খুন করে একটা বিপদ ঘাড়ে নিয়েছি।ক্যাপের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসল নিউটন। ‘ফরগেট ইট, আবার বলল হবস।’তোমার হয়েছেটা কী?’ বিরক্তি প্রকাশ করল কিড। ‘আমি খালি একটু মজা করব।’ বেন ওর কানে কানে বলল কিছু, কিন্তু কিড আমল দিল না।’এই যে, বুড়ো মিয়া। অমন হাভাতের মত খেও না বদ-হজম হবে।’ক্যাপ তার খাওয়া চালিয়ে গেল, মুখের পেশীতে সামান্য টান পড়ল কেবল। ধীরে ধীরে বাঁ-হাত নামালাম আমি, একটা পিস্তল বের করে রাখলাম টেবিলের ওপর। এ-বার আমার দিকে তাকাল কিড, বেন হবসের চোখজোড়া ঈষৎ ছোট হয়ে গেছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছে আমাকে।’ওটা দিয়ে কী হবে?’ জিজ্ঞেস করল কিড। অবাক হবার ভান করলাম আমি। ‘আমাকে বলছ?”হ্যাঁ, পিস্তল বের করলে যে বড়?”অ। বিপদ-আপদে কাজ দেয় সাপখোপের তো অভাব নেই।’ ‘কথাটা কি আমাকে বলছ?’ কিডের স্বরে ঝাঁঝ।’ছি-ছি, খোকা। তোমাকে কেন বলব।’ জিভ কাটলাম আমি। ইচ্ছে করেই খোকা শব্দটার ওপর একটু চাপ দিয়েছি। জানি, উঠতি বয়েসের তরুণদের খোকা বললে তারা চটে যায়।কিড নিউটন এই আচমকা খোকা সম্বোধনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। ঠান্ড করতে পারছে না, আমি তাকে ঠাট্টা করছি কিনা।’বাড়িতে তোমার মা আছেন নিশ্চয়ই,’ আবার বললাম আমি। ওর দিবে তাকালাম অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে, তারপর এক টুকরো রুটি মুখে পুরে চিবুতেলাগলাম। ওকে চিন্তাভাবনা করবার সুযোগ দিচ্ছি আমি, যখন বুঝলাম কিড কিং বলতে চাইছে, হাত নেড়ে থামিয়ে দিলাম।’তোমার খাওয়া হয়েছে, বাছা? না হয়ে থাকলে এসো – আমাদের সঙ্গে খাবে। গায়ে গরম জামা-কাপড় নেই দেখছি শীতে কষ্ট পাবে তো।’কিডের দিশেহারা অবস্থা, আবার লজ্জাও পাচ্ছে একটু একটু। সবাই মুখ টিপে হাসছে। নিশ্চয়ই ওর মন বলছে পিস্তল ওঠাও, অথচ একজন শুভাকাঙ্ক্ষীকে মারাটা শোভন দেখায় না। তাতে বরং ওরই ফেঁসে যাবার আশঙ্কা, একজন নিরীহ লোককে হত্যা করলে আইন ছাড়বে না তাকে। এ- ক্ষেত্রে পশ্চিমের লোকেরা নির্মম। তারা সব অপরাধ ক্ষমা করতে পারে। কিন্তু বিনা কারণে কেউ কাউকে খুন করলে হত্যাকারীকে দয়া দেখায় না। সকলে

পৃষ্ঠা -২৫

তার বিপক্ষে চলে যায়।’কই, বসো।’ আমি চেয়ার এগিয়ে দিলাম। ‘মনে হচ্ছে তুমি অনেকদিন বাড়ি ছাড়া, তোমার মা চিন্তা করছেন তোমার জন্যে।’ কিছু বলবার ইচ্ছে থাকলেও, কিডের মুখে কথা জোগাল না। আঁতিপাঁতিকরে লাগসই জবাব খুঁজছে সে, অবশেষে অতিকষ্টে বলল, ‘আমার খিদে নেই।’ ‘লজ্জা পাবার কী আছে, বাছা?’ সস্নেহে বললাম আমি। ‘আমাদের প্রচুর আছে। তা ছাড়া এই ক্যাপের কথাই ধরো,’ মাথা ঝাঁকিয়ে দেখালাম সয়্যারকে, ‘বহু দেশ ঘুরেছে ও। কোথাও না কোথাও নিশ্চয়ই তোমার মত ছেলে আছে ওর। তুমি খেলে ক্যাপেরও মন ভাল হবে।’শব্দ করে হেসে উঠল কেউ, কিডের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। ‘মানে?’ চেঁচাতে গিয়ে ফাটা বাঁশির মত চিরে গেল ওর গলা, মুখ সাদা, শরীরের সমস্ত রক্ত চোখে এসে জমা হয়েছে।’বারটেন্ডার,’ নির্লিপ্ত গলায় বললাম আমি, ‘এই ছেলেটিকে এক কাপ গরম সুপ দাও।’ উঠে পড়লাম চেয়ার ঠেলে, হোলস্টারে রাখলাম পিস্তলটা। ক্যাপও উঠে দাঁড়িয়েছিল, দরজার দিকে এগিয়ে গেল সে। আমি বারটেন্ডারের হাতে আমাদের পাওনা ছাড়াও একটা বাড়তি সিকি দিলাম। ‘এটা ওর সুপের দাম।’তারপর ঘুরে কিডের দিকে নরম চোখে তাকালাম, করমর্দনের ভঙ্গিতে বাড়িয়ে দিলাম একটা হাত। ‘চলি, বাছা। ন্যায়ের পথে থেকো সব সময়. তোমার মায়ের শিক্ষা ভুলো না।’প্রায় যন্ত্রচালিতের মত আমার হাতটা ধরল কিড, পরমুহূর্তে ছিটকে সরে গেল যেন বিছায় কামড়েছে।. দরজার কাছে গিয়ে আমি আবার তাকালাম ওর দিকে। আমার চোখ এমনিতেই বড়, এ-বার সেগুলো ভীষণ হয়ে উঠল। ‘বাছা, বেশি ঘোরাঘুরিকোরো না ঠাণ্ডা লাগবে।’ বলে পেছন ফিরে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে। রাস্তায় নেমে আমরা আস্তাবলের উদ্দেশে রওনা হলাম। ‘ক্লান্ত?’ প্রশ্ন’ করলাম ক্যাপকে।’নাহ,’ বলল সে। তারপর যোগ করল, ‘ওই ছেলেটিকে তুমি কিন্তু প্রকারান্তে বেজন্মা বলেছ।”ম্…তোমার ভাষাটা একটু কড়া হয়ে গেল, ক্যাপ। আমি পারতে কাউকে গাল দেই না।”তবু ব্যাপারটা আসলে তাই দাঁড়াচ্ছে। একঘর লোকের সামনে ওকে তুমি, বোকা বানিয়েছ।”নরম ব্যবহারে অনেক সময় কাজ দেয় রাগ পানি হয়ে যায়, হেসে জবাব দিলাম আমি।সে-রাতটা আমরা কোম্যাঞ্চে ক্রীকের জঙ্গলে অতিবাহিত করলাম। পরদিন সকালে অনেক বেলা করে উঠলাম ঘুম থেকে।

পৃষ্ঠা -২৬

ক্রীকের পানিতে হাত-মুখ ধুয়ে, গরুর জার্কি আর পাউরুটি সহযোগে নাস্তা সেরে ব্যাক ট্রেইল জরিপ করতে বসলাম।একঘেয়ে প্রথম ঘণ্টা কাটল, তারপর দেখলাম ছজন ঘোড়সওয়ার যাচ্ছে উত্তরে। অবশ্যি এতে আমাদের ঘাবড়াবার কোনও কারণ নেই, ওরা আমাদের পিছু নিয়ে থাকলেও ট্র্যাক দেখতে পাবে না। এখানে আসবার পথে আমরা ক্রীক পাড়ি দিয়েছি। এতক্ষণে পানির স্রোতে ট্র্যাক ধুয়ে-মুছে গেছে।দুপুর নাগাদ ফের স্যাডলে চাপলাম আমরা। উপত্যকার পুব ধার ঘেঁষে এগোলাম। এর ফলে গাছপালা, পাথরের পটভূমিতে সহজে আমাদের চেনা যাবে না। এই উপত্যকা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় নহাজার ফুট ওপরে। দিনে বাতাস এখানে শীতল, রাতে কনকনে।ওই অচেনা অশ্বারোহীদের ট্র্যাক মাড়িয়ে আমরা কসটিয়া ক্রীকের ট্রেইল ধরলাম। এখান থেকে ক্যানিয়নের চড়াই শুরু। কসটিয়া ক্রীকে অশ্বারোহীরা ডানে মোড় নিয়েছে। ক্যাপের পরামর্শে বাঁয়ে একটা প্রাচীন ইন্ডিয়ান ট্রেইল বেছে নিলাম আমি।আমরা যখন স্যান লুই শহরে পৌছুলাম তখন শেষ-বিকেল। সূর্য পাটে বসেছে। অন্তরাগে পশ্চিম আকাশ লাল। সেখানে দৈত্যাকার মেঘের বাড়ি-ঘর। পাখির কাকলিতে পরিবেশ মুখরিত, ওদের মাঝে ঘরে ফেরার তাড়া।স্যান লুই ছোট্ট সাজানো শহর। অধিবাসীরা সবাই স্প্যানিশ বংশোদ্ভূত। সহিসের কাছে মালপত্র রেখে মুদিখানার পানে এগিয়ে গেলাম আমি, ঠিক পেছনে ক্যাপ। মুদির নাম ডেভিড সালাযার। এই অঞ্চলের মানুষ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে আসে ওর কাছে। সংবাদের ঘাঁটিও বলা চলে দোকানটিকে। বহুকাল আগে গ্যালাওয়ে নামে এক লোক দোকানটা চালু করেছিল, পরে সালাযার কিনে নিয়েছে।এরা বন্ধুবৎসল শান্তিপ্রিয় লোক। এখানে আছে অনেকদিন হলো। খেটে- খাওয়া মানুষ। সৎ, বিশ্বস্ত। মাল কিনছি আমরা, হঠাৎ একটা মেয়েলি গলা ভেসে এল, ‘সিনর?’ক্যাপ আর আমি একাযোগে ঘুরে দাঁড়ালাম; মেয়েটির লক্ষ্য সয়‍্যার।নাতিদীর্ঘ গড়ন। ঢলঢলে কমনীয় চেহারা, দীর্ঘ কালো চুল সেই শ্রী বহুগুণ বাড়িয়ে তুলেছে।’বুয়েন্স ডায়াস, টিনা,’ মেয়েটিকে চিনতে পেরে ক্যাপ বলল। ‘বহুদিন পর, তাই না?’ আমার দিকে ঘুরল সে। ‘টিনা, এর নাম ওরিন’ ওসমান নীলের বড় ভাই।’ ‘হাউডি, সিনর?’ টিনার টানাটানা চোখে শ্রদ্ধা। ‘তোমার ভাইয়ের কাছে আমি ঋণী। আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে।”নীল ভাল ছেলে।”সি…তাই।’আমরা দাঁড়িয়ে গল্প করছি, এমন সময় এক মেক্সিক্যান যুবক এল।

পৃষ্ঠা -২৭

চাবুকের মত স্বাস্থ্য, উঁচু কপাল, চৌকো মুখ, গভীর কালো চোখ। লম্বায় ক্যাপসয়্যারের সমান, ওজনও প্রায় তাই হবে। ‘আমার স্বামী, এসতেবান মেন্ডোযা।’ স্প্যানিশ ভাষায় স্বামীর কাছে আমাদের পরিচয় দিল টিনা। সহাস্যে মেনডোযা হাত বাড়াল, দৃষ্টিতে বন্ধুসুলভ আমন্ত্রণ। তবে আমার বুঝতে অসুবিধে হলো না, সময়ে এই লোক কঠোর হতেও জানে।এসতেবান এককালে ভ্যাকুয়েরো ছিল। ভ্যাকুয়েরো মানে রক্ষী। ডাকসাইটে স্প্যানিশ জমিদারদের লাঠিয়াল। ডেল নর্তের পথে মালবাহী ওয়াগন আনা-নেয়া করেছে।’বি কেয়ারফুল,’ হুঁশিয়ার করে দিল সে। ‘স্যান জুয়ানসে গোলমাল চলছে। ক্লিন্ট স্টকটন আছে ওখানে সঙ্গে একদল আউট-ল।”আজকালের ভেতর অপরিচিত কাউকে দেখেছ?’ ক্যাপ প্রশ্ন করল।এসতেবানের মুখে চতুর হাসি ফুটে উঠল। ‘সি। কাল রাতে। ছয়জন। একজন দাড়িওয়ালা। আরেকজন’ ঝিকিয়ে উঠল এসতেবানের মুক্তোর মত এক সারি দাঁত ‘দুটো পিস্তল ছিল লোকটার কোমরে।”তুমি না ছজনের কথা বললে?”তাই। ওদের মধ্যে দুজন তোমার চেয়ে তাগড়া, সিনর ওসমান। সোনালি চুল, ছোট ছোট চোখ। বেশ চওড়া চোয়াল। আমার ধারণা, ওদের নেতা ওই দুজনের মধ্যে কেউ হবে।”চেনো?’ আমাকে প্রশ্ন করল ক্যাপ।’না, ক্যাপ।’ বললাম বটে, কিন্তু আমি তখন ভাবছিলাম বিগলোরা দেখতে কেমন।এসতেবানকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘নাম-ধাম জানো কিছু?”না, সিনর। বেশিক্ষণ থাকেনি ওরা নতুন কেউ এসেছিল কিনা তাই জানতে চেয়েছিল শুধু।’লোকগুলো নির্ঘাত ভেবেছে আমরা পেছনে আছি, কিংবা আর কোনও ট্রেইল ধরেছি। কিন্তু ওরা পিছু নিয়েছে কেন? ডেল নর্তের পর পশ্চিমের ট্রেইল পাহাড়ী এলাকার ভেতর দিয়ে গেছে, উলফ ক্রীক পাস পেরিয়ে। অত্যন্ত দুর্গম পথ খাড়া, সাপের মত আঁকাবাঁকা। ওখানে কেউ অ্যামবুশ করলে আমরা ফাঁদে আটকা পড়ব।নেভোযাদের বাসায় রাতের আহার করে আবার যাত্রা করলাম। ওদের সেবা-যত্নে আমি মুগ্ধ। প্রচুর সমাদর পেয়েছি স্বামী-স্ত্রী দুজনের কাছে। ওদের ছেলের মুখ দেখে আমি একটা গিনি উপহার দিয়েছি।ওই ছজন ঘোড়সওয়ারের চিন্তা অহরহ পীড়ন করছে আমাকে। অনুভব করছি, ক্যাপকেও ভাবিয়ে তুলেছে ব্যাপারটা। আমরা যে-পথে যাচ্ছি, সেখানে ইন্ডিয়ান উৎপাত খুব বেশি। মূলত উতে অঞ্চল, তবে কোম্যাঞ্চেরা খানিকটা দখল করে নিয়েছে। উতেদের আদিনিবাস ব্ল‍্যাক হিলস। স্যু ইন্ডিয়ানদের তাড়া

পৃষ্ঠা -২৮

খেয়ে দক্ষিণে চলে এসেছে। কিন্তু এখানেও শাস্তি পায়নি, কিওয়া গোত্রের সঙ্গে লড়াইতে জড়িয়ে পড়েছে। কিওয়াদের রক্তপিপাসার খ্যাতি আছে। শ্বেতাঙ্গরা ওদের হাতেই নিহত হয়েছে সবচেয়ে বেশি।উতে আর কোম্যাঞ্চে গোত্র গোড়ায় পরস্পর মিত্র ছিল। এদের শিরায় একই রক্ত বইছে শো-শোন। পরে বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যায়। শ্বেতাঙ্গরা আসবার আগে ইন্ডিয়ানরা অন্তর্কলহে লিপ্ত ছিল। এর ব্যতিক্রম ইরাকুই গোত্র। পুবে রোমান সাম্রাজ্যের চাইতেও এক বিশাল এলাকা জয় করে সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল এরা। বহুদিন অক্ষুণ্ণ ছিল সেই শাস্তি।আমরা রিও গ্র্যান্ডের উজানে উঠছি। চারিদিকে পাইন-সিডারের ঝোপ, সকালে সোনা-রোদে আরও সোনালি দেখায়। মৃদু হাওয়ায় যখন গাছের পাতা দোলে, আমার অন্তর হু-হু করে ওঠে। টেক্সাসে এই নদীর পাড়েই কোম্যাঞ্চে আর আউট-লদের বিরুদ্ধে আমি যুদ্ধ করেছি, মনে পড়ে সে-সব স্মৃতি।একে একে অনেকগুলো রাত পেরিয়ে গেল। আমাদের ক্যাম্পফায়ারের ‘ধোঁয়া মিতালি পাতায় তারার সাথে। আর কোনও ট্র্যাক দেখতে পাইনি। নিঃসঙ্গ তুষারধবল গিরিশৃঙ্গ অটল দাঁড়িয়ে রয়েছে সামনে।,ক্যাপ সয়‍্যার যেন আলাদা এক মানুষে পরিণত হয়েছে। আগের চেয়ে শান্ত, তবু মাঝে মাঝে রাত্রিতে ওকে এমন কথার নেশায় পেয়ে বসে যে আমি রীতিমত বিস্মিত হই। আমার মনেও পরিবর্তন এসেছে। রাতে, বাতাস দ্বখন অ্যাসপেন পাইন ও সিডারের গন্ধে ম-ম, হিম আর আগুনের ভাপে ভারি, আমি ব্ল‍্যাকস্টোন খুলে বসি।অবশেষে আমরা বিয়র ক্রীকের ভাটিতে ভ্যালেসাইটোষ ক্যানিয়নে পৌছুলাম। আমাদের পশ্চিমে স্যান জুয়ান রেঞ্জ গ্রেনাডিয়ার ও নিডল মাউন্টিন্সের গগনচুম্বী শৃঙ্গ। ক্যাম্প করলাম একটা ঝরনার ধারে। ওপরে, চুড়োর দিকে তাকাতে সেই ভৌতিক অনুভূতিটা আবার ফিরে এল আমার মাঝে। হরিণের মাংস ঝুলিয়ে রেখে এসেছিলাম গাছের ডালে কে খেয়েছে সেটা?ক্যাপ ক্রীকে নামল, হাতে একটা প্যান। সন্ধ্যের একটু আগে উঠে এল, প্যানটা ধুয়ে বসল আগুনের কাছে এসে।প্যানের গায়ে স্বর্ণকুচি লেগে রয়েছে। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম এ-জায়গার দখল নেব।

সাত

বিপদ মোকাবেলায় তৈরি হচ্ছি আমরা। আমাদের অনুসরণ করা হচ্ছে, দুদিন আগে বা পরে ঠিকই খুঁজে পাবে। তা

পৃষ্ঠা -২৯

ছাড়া উতেদের মতিগতি বোঝা ভার। এখানে আসবার পথে আমি চিন্তা করবার সময় পেয়েছি: সোনা যখন পাওয়া গেছে, মানুষ আসবেই। ফলে ঝামেলা একটা হবে। সাথে সাথে এও বুঝতে পারছি যে, ভাল কাজও হবে কিছু। যত ভাবছি, ততই আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাচ্ছে, সোনা অনুসন্ধানীর চেয়ে ব্যবসায়ীর লাভের অঙ্ক বেশি। স্বর্ণতৃষার ঝুঁকি আছে, এ-ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী অনেক নিরাপদ।আমরা যে-ঝরনার পাড়ে ক্যাম্প করেছি, তার উৎস পাহাড়ে। আমার বিশ্বাস, এই ঝরনা অনুসরণ করেই খনির সন্ধান পেয়েছিলাম আমি। ক্যাম্পটা ক্যানিয়নের ওপর দিকে একটা চাতাল মত জায়গায়। পেছনে এবং পুবে, দুরারোহ পাহাড়ী ঢাল। চারপাশে ছড়ানো-ছিটানো পনডেরোসা পাইন, ডগলাস ফারের ঝোপ।প্রথমে দড়ির সাহায্যে মরা গাছের গুঁড়ি টেনে আনলাম আমরা, গাছগাছালির ফাঁকে কেবিনের দেয়াল তুললাম সেগুলো দিয়ে। তারপর পাইনের খুঁটি পুঁতে কোরাল বানালাম। খুঁটিগুলোর মাথা বেঁধে দিলাম গাছের ডালপালার সাথে। কাজটা, সন্দেহ নেই, কঠিন তবে আমরা দুজনেই এ-ব্যাপারে যথেষ্ট অভিজ্ঞ বলে নির্বিঘ্নে সমাধা হলো সব কিছু।সন্ধ্যের দিকে চাতালের কিনারে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি। উত্তরে বিরাট খোলা প্রান্তর। ভ্যালেসাইটোস ক্যানিয়নে এতখানি, ফাঁকা জায়গা ইতিপূর্বে আমাদের চোখে পড়েনি। জায়গাটা আমাদের ক্যাম্প থেকে মাইলখানেক দূরে।’ওখানেই শহর হবে,’ বললাম আমি।মুখ থেকে পাইপ নামাল ক্যাপ। ‘শহর?”সোনা যখন আছে, ক্যাপ, মানুষ আসবে। আর মানুষ এলে, তার চাহিদাও আসবে। আমরা দোকান খুলে ওদের চাহিদা মেটাব।’ক্যাপ হাসল। ‘আবার যেন ভেবে বসো না, দোকানটা আমি-ই খুলব।’ ‘আমিও না, ক্যাপ। শহরটা কোথায় হবে ঠিক করে অপেক্ষা করব আমরাতুমি আর আমি। তারপর ভাল কোনও লোক পেলে, পাব আমি নিশ্চিত, তাকে বসিয়ে দেব কারবারে।”তোমরা খুব কাজের লোক,’ সপ্রশংস গলায় বলল ক্যাপ। ‘একবার পাহাড় ছেড়ে বেরোলে তুফান ছুটিয়ে দাও। শুধু একটা ব্যাপারে আমার খটকা রয়ে গেছে এখনও অ্যাদ্দিন তোমরা কীসের মায়ায় ছিলে ওখানে?’পরের কটা দিন উদয়াস্ত পরিশ্রম করলাম। প্রায় চারশো গজ লম্বা রাস্তায় ঘুরে ঘুরে তৈরি করলাম শহরের ছক। মুদিখানা, লিভারি স্ট্যাবল, হোটেল, বোর্ডিং হাউস এবং দুটো স্যালুন থাকবে। কামারশালায় একজন ধাতু পরীক্ষকের বসবার ব্যবস্থাও রইল।মুদিখান। যেখানে হবে, তক্তা কেটে নিয়ে গেলাম সেখানে। একটা সাইনবোর্ড বসিয়ে দিলাম রাস্তায়, লোকজন এলে বুঝতে পারবে কোথায় পাওয়া যাবে আমাদের। পাশাপাশি নিজেদের ক্লেইমেও কাজ করছি। দিনে দুপ্যান করে

পৃষ্ঠা -৩০

বালু ছাঁকছি। সোনার গুঁড়ো পেয়েছি আরও যদিও পরিমাণ খুব অল্প। আরও মজবুত করেছি কেল্লা। অবশ্যি বাইরে থেকে বোঝা যাবে না,আমরাও তা চাই না, তবে হামলা হলে মোটামুটি প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারব। আমাদের পড়শীদের প্রতি আমাদের কারোরই বিশেষ আস্থা নেই। শান্তির কথা পুবের লোকদের মুখে শোভা পায়। একটা সাজানো-গোছানো সমাজে বাস করে ওরা। ঝামেলা পোয়াতে হয় না, দাঙ্গা-ফ্যাসাদ বাধলে সামলাবার জন্যে পুলিস রয়েছে। পশ্চিমে ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে অন্যায় করা হচ্ছে, এ-কথা বলে ড্রইংরুমে কফির কাপে ঝড় তোলা ওদের পক্ষে সহজ। কারণ ওরা কখনও ইন্ডিয়ান হামলার শিকার হয়নি, লাল পিঁপড়ের ঢিপির সামনে পুড়িয়ে মারেনি ওদের কোনও বন্ধুকে। অন্তত আমার তাই মনে হয়।ব্যক্তিগতভাবে আমি ইন্ডিয়ানদের শ্রদ্ধা করি। ওদের জীবনযাত্রা আমাদের মত নয়। অনেকে ইন্ডিয়ানদের কিছু কিছু গুণের কথা বলে; এগুলোর স্বপ্নই কেবল দেখে এসেছে শ্বেতাঙ্গরা, অথচ ইন্ডিয়ানদের কাছে সে-সবের তেমন কদর নেই। প্রকৃতির সহজ নিয়মে ওগুলো অর্জন করেছে ওরা শেখার জন্যে কসরত করতে হয়নি। দয়ামায়া, অনুকম্পা বলে কিছু নেই ওদের।মানব স্বভাবের কথা বলতে গিয়ে বড় বড় দার্শনিকেরা যা বোঝান, আসলে তা স্বভাব নয়; মানুষের জীবনপ্রণালী তার সমাজ ব্যবস্থা। আমার ধারণা ক্রিশ্চান ভাবধারায় যারা মানুষ হয়েছে, নরহত্যাকে তারা পাপ বলে মনে করে। অথচ ইন্ডিয়ানদের বিশ্বাস এর সম্পূর্ণ বিপরীত। অপরিচিত লোক মানেই তার কাছে শত্রু। কেউ উপহার, উপঢৌকন দিলে মনে করে, ভয় পায় বলেই দিচ্ছে।ওরা যোদ্ধা জাত। লড়াই ওদের পেশা, আনন্দের সেরা মাধ্যম। আমাদের সমাজে সব ধরনের ক্রীড়াবিদের সম্মান আছে, কিন্তু ইন্ডিয়ানরা শ্রদ্ধা করে একমাত্র লড়াকু মানুষকে।নিঝুম পরিবেশ। ধোঁয়া উঠছে। থেকে থেকে কাঁপছে শিখা। বহুদূরে তারস্বরে চিৎকার করছে কয়েকটা কয়ৌট। চুপচাপ মাটিতে শুয়ে আকাশের তারা গুনছে ক্যাপ সয়্যার। এই লোকটির নিরাভরণ অথচ অগাধ জ্ঞানের সামনে শ্রদ্ধায় নুয়ে পড়তে ইচ্ছে করে আমার। পশ্চিমে ক্যাপ বহুদিন হলো আছে। এখানকার রীতি- নীতি, ভাবধারা মিশে আছে ওর অস্থিমজ্জায়। বাবার সঙ্গে ক্যাপের মিল খুঁজে পাই আমি। তেমনি সরল, সাদাসিধে অথচ সদাসতর্ক, সাহসী।ইন্ডিয়ানরা আগে তাদের শরীরের যত্ন নিত, ক্যাপের কাছেই জানলাম। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকত, স্নান করত নিয়মিত। শ্বেতাঙ্গরা এসে ওদের নিয়মকানুন উল্টে দিয়েছে। আকণ্ঠ সুরাপানের অভ্যাস আর দারিদ্র্যের কষাঘাতে তলিয়ে গেছে ওরা। তবে ওদের সম্পর্কে সভ্যজগতের যে-ধারণা, কোনও ইন্ডিয়ান যোদ্ধা তা জানলে রীতিমত লজ্জা পাবে। সে তার শক্তি নিয়ে গর্ব করে নিজের সমস্যা মোকাবেলার ক্ষমতা তার আছে।ক্রমে রাত গভীর হচ্ছে, ঘুমে বুজে আসছে আমার দুচোখের পাতা। শুধু

পৃষ্ঠা ৩১ থেকে ৪০

পৃষ্ঠা -৩১

একটি ভাবনাই আলোড়িত হচ্ছে মাথায়: পাহাড়ের ওপরে কী আছে? আমার মাংস চুরি করেছিল কে? রোববার। আমরা প্রথম গোলমালের আভাস পেলাম। ছুটির দিন, আমাদের ব্যস্ততা নেই। গুটিকতক এলক আর হরিণের চামড়া শুকোচ্ছে ক্যাপ। নাস্তা সেরে আমার অস্ত্রশস্ত্রে তেল দিয়েছি আমি, বড়শি ফেলে ঝরনায় মাছ ধরেছি কিছুক্ষণ, তারপর বসেছি। পড়তে উষ্ণ অলস দিন, ক্রীকের পানিতে রোদ্দূর ঝিলিক মারছে, মাঝে মাঝে দমকা হাওয়ায় মাথার ওপর কাঁপছে পাইন গাছ। আমার মন আজ বিক্ষিপ্ত, বইয়ের পাতা থেকে বারেবারে উধাও হয়ে যাচ্ছে ওপরের ওই উপত্যকায়। খনি থেকে সোনা আনতে হলে, তুষারপাত শুরু হবার আগেই ওখানে ঢোকার বিকল্পরাস্তা খুঁজে বের করতে হবে। ‘ওরিন…’নিচু স্বরে ডাক দিল ক্যাপ, আমি উঠে ওর কাছে গেলাম। গাছপালার ফাঁক দিয়ে দূরে তাকিয়ে আছে ও। চারজন ঘোড়সওয়ারকে দেখতে পাচ্ছি, টাউন সাইটে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এদিকে ঘুরল, আমি চোখে ফিল্ড গ্লাস লাগালাম। ওদের কাউকেই পরিচিত ঠেকল না। ধীরে-সুস্থে এগিয়ে আসছে এক লাইনে, সারির শেষ লোকটি তার পিস্তল পরখ করছে।ঝরনার ভাটিতে, পঞ্চাশ গজ বা তার কিছু বেশি হবে, রাশ টানল ওরা। আমাদের কোরাল আর আগুনের ধোঁয়া চোখে পড়েছে। পরক্ষণে এগিয়ে এল। আমার পরনে রঙ-জ্বলা নীল আর্মি শার্ট এবং জিন্স, মাথায় তোবড়ানো ইউ.এস. আর্মি ক্যাপ, কোমরে পিস্তল। ওদের আসতে দেখে উইনচেস্টারখানা তুলে নিলাম, তারপর ক্যাপকে সঙ্গে করে দাঁড়িয়ে রইলাম অভ্যর্থনা জানাতে।’কী চাই?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি। ‘এ-দিকে লোকজন বড় আসে না।’ ‘শহরের সাইনবোর্ডটা দেখে মনে হলো তোমরা চাও আসুক,’ বলল ওদের মধ্যে একজন। ‘তা এখানে শহর দিয়ে হবেটা কী?”স্যার,’ বললাম আমি, ‘এটা আমাদের সুবিধের জন্যে করেছি। কাজ কাম সারা হলে সন্ধ্যের পর ক্যাপ সয়্যার আর আমি শহরে যাব। অথচ কাছেপিঠে একটাও নেই, তাই ভাবলাম আমরা নিজেরাই কেন গড়ে নিই না। শহরের নকশা, কাঠ জোগাড় সব শেষ। ইলেকশনও করেছি।”ইলেকশন?”যেহেতু শহর, মেয়র চাই একজন। ক্যাপ মেয়র নির্বাচিত হয়েছে। ও আগে কোনও দিন মেয়র হয়নি, আর এই শহরেও মেয়র ছিল না কখনও। তাই ঠিক করলাম, একই সঙ্গে ওদের যাত্রা শুরু হোক।’কথা বলার পাশাপাশি ওদের ওপর নজর রাখছি আমি। একটা ঘোড়ায় পিচফর্ক মার্কা লাগানো। সওয়ারির বপুখানা বিশাল, চৌকো মুখ, ঘন সোনালি

পৃষ্ঠা -৩২

চুল। আমাকে জরিপ করছে সে, তালি-মারা ইউনিফর্মটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। দ্বিতীয়জন একটু কুঁজো মত কালো বর্তুল চোখ। তিন নম্বর অশ্বারোহীর পেটা শরীর, অমায়িক বন্ধুসুলভ চেহারা। চতুর্থজন মোটা, কুমড়োর মত মুখ গোমড়া চেহারা।’যুদ্ধ শেষ, অথচ ইউনিফর্ম ছাড়োনি,’ বলল বিশাল-বপু, ‘ওটা বুঝি তোমার খুব পছন্দ?”নতুন কেনার সামর্থ্য,’ বললাম আমি।ঘোড়া চালিয়ে ক্রীকের পাড়ে গেল কুমড়ো, তারপর পেছন ফিরে ডাকল, ‘কিচ, দেখে যাও!’,ওরা সবাই গেল ঝরনার ধারে, ক্যাপ আর আমি অনুসরণ করলাম। আমাদের শ্যাফটের দিকে তাকাল কিচ, অর্থাৎ বিশাল-বপু। ‘সোনা?’ বিস্ময়ের সুর ফুটল ওর গলায়। ‘এটা তো রূপার দেশ।”সামান্য কিছু গুঁড়ো পেয়েছি,’ বললাম আমি। ‘তবে আমরা হাল ছাড়িনি।’ আমাদের পাত্তা দিল না কুমড়ো। ‘কিচ,’ বলল সে, ‘এখানে দামী জিনিস পেয়েছে এরা। তাই শহর বানিয়েছে। খবর পেলেই লোকজন ছুটে আসবে পাগলের মত তখন খোদ শহরটাই একটা সোনার খনি হয়ে উঠবে।’ ‘কচু হবে,’ বলল ক্যাপ। ‘আমাদেরই খাটুনি পোষাচ্ছে না।’ ঘুরল সে। ‘যাই, আমি কফির জোগাড় করিগে, ওরিন।’ বলে আগুনের দিকে হাঁটতে শুরু করল।নামটা কানে যেতেই ঝট করে আমার দিকে ফিরল কিচ। ‘ওরিন? তুমি ওরিন ওসমান?”হ্যাঁ।’খিকখিক করে হাসল সে। ‘শিগগিরই তোমার কিছু সঙ্গী জুটবে। সিলভারটনে দুজন লোক তোমাকে খুঁজছিল।”এখানে এলেই পাবে।’ওরা বলল তুমি নাকি দারুণ ছুটতে পার।’ কিচের চোখে শয়তানি। ‘ওই – পোশাকে অবশ্যি অনেককে ছুটতে দেখেছি আমি।”সে তো এডওআর্ড লীর সারেন্ডার দেখতে,’ বললাম আমি। ‘তারপর থেকে সব ছোটাছুটি বন্ধ।’মুখ খুলতে নিয়েছিল কিচ, চোয়াল শক্ত হয়ে গেল, কানের লতি লাল। ‘বিগলোরা বলছে ওরা যতবার তোমার পিছু নিয়েছে, তুমি ল্যাজ তুলে খরগোশের মত পালিয়েছ,’ একটুবাদে বলল।ওরিন ওসমান, আপনমনে বললাম, এ-লোক তোমায় লড়াইতে নামাতে চাইছে। সাবধান খুব সাবধান। ‘আমাকে কেউ খুন করতে চাইলে,’ মুখে বললাম, ‘তাকে খাটতে হবে। আমার অত সময় নেই যে নষ্ট করব।’ ক্যাপ আগুনের কাছে কাঠের গাদার আড়ালে আছে, সেখানে ও কী করছে আমি ভালই জানি।

পৃষ্ঠা -৩৩

‘শোনো,’ কিচ কিছু বলবার আগেই আমি শুরু করলাম, ‘সিলভারটনে ফিরে গিয়ে তুমি বিগলোদের বলবে, আমি এখানে আছি। বলবে, ওদের ভাই তাস চুরি করেছিল বলে মারা গেছে। এরপরেও যদি ওদের লাগার শখ থাকে, যেন চলে আসে।’তারপর আরও ঠাণ্ডা গলায় যোগ করলাম, ‘কিচ, তুমি পালানোর কথা কী যেন বলছিলে? ওদের সঙ্গে তুমিও এসো-‘চমকে উঠল কিচ, রাগে কামড়ে ধরল ঠোঁট। কিন্তু কুমড়ো বাধা দিল। ‘চলো, চলো।’রওনা হলো ওরা। কেবল পেটা-শরীর দাঁড়িয়ে রইল। ‘মি. ওসমান,’ বলল সে, ‘আমি আবার আসব তোমার সাথে কথা আছে।”যখন খুশি’ বললাম আমি।আমাদের ক্লেইমে কাজ করছি আমরা, কিছু সোনা উদ্ধার করেছি, দোলনা বানিয়েছি একটা। ইতিমধ্যে আমাদের ক্যাম্পের পেছনে, পাহাড়ের খাড়া ঢালে একটা গোপন ট্রেইল খুঁজে পেয়েছি আমি, বোধ হয় এককালে পাহাড়ী ছাগল চলাচল করত। ওই ট্রেইল ধরে চাতালের প্রায় দুশো ফুট ওপরে গাছের গুঁড়ি, পাথর আর ডালপালা দিয়ে একটা রাইফেল-পিট তৈরি করেছি এখান থেকে দু-তিনজন লোক অনায়াসে আমাদের ক্যাম্পের চারদিক কভার করতে পারবে।পরের দিন, বারকয়েক ওঠানামা করে ট্রেইলটাকে সাফ করলাম ভালমত। এই সময় পাহাড়ের আরও ওপরে ওঠার একটা রাস্তা পেয়ে গেলাম। ‘ব্যাপার কী?’ সাপারের পর জিজ্ঞেস করল ক্যাপ।’একান্তই যদি পালাতে হয়,’ বললাম, ‘আমি চাই না পথে কোনও বাধা থাকুক।’আগুন পোয়াতে পোয়াতে ক্যাপ তাকাল আমার দিকে। ‘তা পাহাড়ে কবে যাচ্ছ?”তোমাকে বিপদের মুখে ফেলে রেখে?’ ‘বাদ দাও।’ বাতাসে হাত খেলাল ক্যাপ। ‘বিপদ আমার জীবনে নতুন কিছু নয়। তুমি যাও তবে বেশি দেরি কোরো না।’ওকে বললাম, এই ক্যাম্প থেকে খনিতে কোন পথে যেতে হবে আমি জানি না। তবে বুঝতে পারছি ওটার খুব কাছাকাছি রয়েছি।ক্যাপ বলল আমার বর্ণনা শুনে ওর মনে হয়েছে, আগের বার আমি কলামবাইন পাস পেরিয়ে, জনসন ক্রীকের পথে ভ্যালেসাইটোসে এসেছিলাম। ওটা এখন আমাদের দক্ষিণে, তাই আমি দক্ষিণে রওনা হলে হয়তো রাস্তা খুঁজে পাব।ক্যাপকে একা রেখে যেতে সায় দিচ্ছে না মন। জানি ও একটা পোড়- খাওয়া নেকড়ে, কিন্তু চারপাশে আমার শত্রুও নেহাত কম নয়। বিগলোরা তো আছেই, তার ওপর রয়েছে বেন হবস, কিড নিউটন। লাস ভেগাসে টুথহিল আর তার সেই জুয়াড়ি বন্ধুর কথা না হয় বাদই দিলাম। মনে হচ্ছে বিপদ তার

পৃষ্ঠা -৩৪

সবগুলো দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরেছে আমাকে।পক্ষান্তরে, ক্যাপের কাছে যথেষ্ট কার্তুজ আর মাংস আছে। ঝরনা থাকায় পানির অভাব হবে না। একেবারে বেকায়দায় না পড়লে, কয়েকজনকে ও একাই সামলাতে পারবে। তা ছাড়া, আমরা সে-রকম বিপদের আশঙ্কা করছি না।বাড়ির কথা মনে পড়ল আমার। রোসাবেলার সাথে সুখের সংসার পেতেছে ও’নীল। বেলা ওকে সত্যিই ভালবাসে। ওই রকম মেয়ে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আচ্ছা, আমার প্রেমিকা কেমন হবে? কথাটা ভাবতেই হাসি পেল। সজ্ঞানে কোনও মেয়ে আমার মত ছন্নছাড়ার প্রেমে পড়বে বলে মনে হয় না। বরং ঠিক এর উল্টোটি, সারাজীবন ব্যাচেলর রয়ে যাবার সম্ভাবনাই বেশি। খুব জোর একটা ঘোড়া হয়তো সাথী হবে।শুকনো কাঠ পোড়ার গন্ধ আসছে, পাইন বনের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে, আকাশে তারার শামিয়ানা। সহসা বাতাসে হা-হা করে উঠল অ্যাসপেন ঝোপ। গশ্চিমে নিডল মাউন্টিনসকে দেখাচ্ছে বিশাল তুষারমানবের মত।আচমকা উঠে বসলাম আমি। ‘ক্যাপ!’ বললাম ফিসফিস করে। ‘শুনতে পাচ্ছ?”পাচ্ছি।”কেউ কাঁদছে।’ আমি উঠে বুটজোড়া গলিয়ে দিলাম পায়ে। আওয়াজটা থেমে গেছে, উজানি বাতাসের সঙ্গে কোথাও থেকে ভেসে এসেছিল।বনের কিনারে হেঁটে গিয়ে কান পাতলাম আমরা, কিন্তু আর শুনতে পেলাম না। মুখের কাছে দুহাত চোঙের মত করে ধরলাম আমি, ঈষৎ গলা, চড়িয়ে বললাম, ‘ক্যাম্পে এসো! ওখানে একা থাকার দরকার নেই!”একা তুমি জানলে কীভাবে?’ মোলায়েম সুরে জিজ্ঞেস করল ক্যাপ। ‘এসো, ঘুমুবে। ভূত বিশ্বাস করো তুমি? সব বাতাসের চালাকি হুঁ।’আর কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে অনুসরণ করলাম ক্যাপকে, আগুনের কাছে।ফিরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। বহুক্ষণ চোখ খোলা রইল আমার, কিন্তু রাত বয়ে চলল মৌনভাবে।হয়তো ক্যাপের কথাই যথার্থ, সবই বাতাসের কারসাজি। তবু খুঁতখুঁতি গেল না।

আট

আমার বিশ্বাস, ব্যাপারটা আদৌ বাতাসের কারসাজি নয়। ওই পাহাড়গুলোতে কিছু একটা…বা কোনও মানুষ আছে…ভোরের আগেই আমি পাহাড়ে রওনা হলাম। যেখানে যাচ্ছি সেখানে

পৃষ্ঠা -৩৫

কোনও ট্রেইল নেই। দক্ষিণে আছে, কিন্তু আমি সরে গেছি। বনের ভেতর বেশ কিছুটা গিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে মোকাসিন পায়ে দিলাম। পিছিয়ে এসে মুছে ফেললাম ট্র্যাক, তারপর ফের স্যাডলে চেপে রওনা হলাম ওপর দিকে।ঘন পাইন বন। রাস্তা প্রায় নেই বললেই চলে। মাঝে মাঝে ডালপালার তলা দিয়ে যাবার সময় কুঁজো হচ্ছি। কখনও-বা হাঁটছি নরম পাইন পাতার ওপর দিয়ে, হাতে অ্যাপালুসার লাগাম।যে-গিরিপথে ঢুকেছিলাম গেলবার, তার কাছাকাছি কোথাও বেরোব বলে অনুমান করেছিলাম। বাস্তবিক তাই ঘটল। একটা খাঁজের মাথায় উঠে এলাম আমি, চারদিক দেখা যায় এখান থেকে।উত্তরে স্টর্ম কিং, বিশাল চুড়ো, বরফের ওপর উজ্জ্বল রোদের চোখ ধাঁধানো প্রতিফলন। সটান নীচে নেমে গেছে ভ্যালেসাইটোস ক্যানিয়ন। ডানে, যোজনবিস্তৃত রুক্ষ প্রান্তর। এ-রকম এবড়োখেবড়ো এলাকা জীবনে দেখিনি।ভূতুড়ে ডোবাটার উদ্দেশে এগিয়ে গেলাম। অবিকল আগের মতই আছে। পানিতে ডুবে গেছে ট্রেইল। আমি চলে আসবার পর বৃষ্টি হয়েছিল, ডোবার আয়তন একরখানেক বেড়েছে। নীচে যাবার ট্রেইলের অবস্থাও তথৈবচ। বরং এখানে পানি একটু বেশিই হবে, তবে ব্যবহারযোগ্য। নির্জন উপত্যকায় পৌঁছে মনে হলো আমি যেন নিজের বাড়িতে ফিরে এসেছি।যে-গাছে মাংস ঝুলিয়ে রেখে গিয়েছিলাম, সেখানে গেলাম প্রথমে। মাংস উধাও, একটা হাড়গোড় নেই, অথচ কোনও হিংস্র জন্তু নিয়ে থাকলে সেটাই স্বাভাবিক ছিল। ট্র্যাক নেই। পড়ে থাকলেও বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে-মুছে গেছে। এরপর খনিতে গিয়ে জরিপ করলাম চারদিক। যেমন রেখে গিয়েছিলামতেমনি আছে। ঘুরে-ফিরে দেখতে বেরোলাম উপত্যকাটা। উদ্দেশ্য, এখানে ঢোকার বিকল্প রাস্তা সন্ধান করব। দেখলাম, জলপ্রপাত থেকে যে-ঝরনার উৎপত্তি, আসলে সেটা উত্তর দিকে গেছে। তারপর পশ্চিমে একটা বাঁক নিয়ে সোজা নেমে গেছে ভ্যালেসাইটোসে। এ-বার বুঝতে পারলাম, ক্যাপ আর আমি যেখানে ক্যাম্প করেছি, সেটা আসলে অন্য একটা ঝরনা।আবছা একটা ট্রেইল, সম্ভবত প্রাচীন ইন্ডিয়ানদের, পুবে চলে গেছে। দূরে আরও কয়েকটা ডোবা নজরে পড়ল আমার। আশপাশ ভালমত দেখতে খাঁজের মাথায় উঠে এলাম। এই উপত্যকার উল্টোদিকে পাহাড়, তার পেছনে আরেকটা বিশাল উপত্যকা অনেক উঁচু। সেখানে একটা ঝরনা বয়ে যাচ্ছে উত্তরে।পাহাড়ের স্পিনারে গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে অল্পস্বল্প ঘাস। উপত্যকার নীচে তৃণভূমি। গ্রীষ্মে এই জায়গাটা চমৎকার রেঞ্জ হতে পারে, ভাবলাম।পরক্ষণে ও-সব চিন্তা ঝেটিয়ে বিদায় করলাম মাথা থেকে। এখন আমার প্রথম দায়িত্ব ভ্যালেসাইটোসে নামার নতুন ট্রেইল খোঁজা এবং সম্ভব হলে, আমার মাংস কে চুরি করেছিল তা জানা।

পৃষ্ঠা -৩৬

উত্তরে যাবার সময় শেষ সীমানার দিকে তাকালাম। মনে হলো বেরোনোর কোনও পথ নেই, কিন্তু আরেকটু এগোতে আবিষ্কার করলাম তীক্ষ্ণ মোড় নিয়ে একটা জঙ্গলের সামনে গিয়ে শেষ হয়েছে উপত্যকাটা। বাঁক আর জঙ্গলের মধ্যবর্তী এলাকা সরু করিডরের মত।এখানে ঝোপঝাড়ের গোড়ায় তাজা পায়ের ছাপ চোখে পড়ল। নেমে অনুসরণ করলাম অস্পষ্ট ছাপগুলো। দু-এক জায়গায় দুমড়ে আছে ঘাস। এর অর্থ, আজ ভোরে শিশির থাকা অবস্থায় মাড়ানো হয়েছে। হঠাৎ একটা ফাঁদ চোখে পড়ল। আশপাশে অসংখ্য পায়ের ছাপ, তবে রক্তের দাগ বা লোম-টোম নেই। বোঝাই যায়, ফাঁদে আটকা পড়েনি কেউ। গোড়ালিতে ভর রেখে বসলাম আমি, দেখলাম খুঁটিয়ে। চাতুর্যের ছাপ আছে: এ-রকম ফাঁদ আগে কখনও দেখিনি।গাছপালার পেছনে তৃণভূমিতে ঘোড়া হাঁটিয়ে নিয়ে গেলাম আমি। সূর্যমুখী ফুলে ছেয়ে আছে মাঠ। উজ্জ্বল হলুদ, হাওয়ায় নাচছে। ঢালের এখানে-সেখানে প্রিমরোজ। নীল দেবদারুর সংখ্যাই বেশি, অ্যাসপেন আছে দু-চারটে। ওপর দিকে, জঙ্গলের কিনারে, কাঁটাওয়ালা পাইন, দেখতে মোচার মত, বাতাসের সাথে অন্তহীন লড়াইতে বেঁটে হয়ে গেছে।দেখলাম, আমার সেই অজ্ঞাতনামা মানুষটি এক জায়গায় থেমে ভেষজ লতাগুল্ম সংগ্রহ করেছে মাটি থেকে, অন্যত্র ঝরনায় নেমে পানি খেয়েছে। হঠাৎ একখানে এসে শেষ হয়ে গেল ট্র্যাক। লোকটা এরপর একটা বিরাট পাথর- চাঁইয়ের ওপর উঠে পড়েছে। মোকাসিনের ঘষায় পাথরের গায়ে ঘাসের দাগ লেগেছে। বুঝলাম, ওই অজ্ঞাতনামা দেখতে পেয়েছে আমাকে।চাঁইয়ের মাথায় উঠে পেছনে তাকালাম আমি। স্পষ্ট দেখা যায় আমার ব্যাক ট্রেইল। গোটা এলাকা জরিপ করতে বসলাম ওখানে। আমার অনুমানে ভুল হয়ে না থাকলে, ওই লোক কাছে-পিঠে কোথাও আছে, নজর রাখছে আমার ওপর। আমিও তাই চাই; এতে অন্তত বোঝার সুযোগ পাবে যে আমার কোনও কুমতলব নেই।একটুবাদে ফিরে গেলাম ঘোড়ার কাছে। কচি ঘাস চিবোচ্ছে। একটা ক্ষীণ জলধারা পেরিয়ে পাহাড়ের চুড়োয় উঠে এলাম আমি। গুটিকতক ব্রিসল-কন পাইন, বাজ-পড়া গাছ’ আর নুড়িপাথর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে।আমার ডানে, সামান্য আগে, একটা ঝরন। উত্তরপুবদিকে পাহাড় বেয়ে নেমে গেছে। মনে হলো, এই গোলকধাঁধা থেকে বেরোবার আরেকটা রাস্তা পেয়ে গেছি।অ্যাপালুসাকে চলার নির্দেশ দিলাম। ও কান খাড়া করল। ঘোড়ার দৃষ্টি অনুসরণ করে নড়াচড়া চোখে পড়ল আমার। দূরবর্তী একটা ঢালে অ্যাসপেন ঝোপ, তার প্রান্তে কেউ বসেছিল, কিন্তু আমি দূরবীন তোলার আগেই পালিয়ে

পৃষ্ঠা -৩৭

পথে আরেক জায়গায় ট্র্যাক চোখে পড়ল গলা-বরফের পাশে কেউ হাঁটু গেড়ে বসেছিল, নিঃসন্দেহে পানি খেতে। গত দুঘণ্টায় তিনবার পানি খেয়েছে ওই লোক। আমার কাছে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক ঠেকল। এটা পাহাড়ী এলাকা, বাতাসে জলীয়বাষ্প প্রচুর। তা ছাড়া, আবহাওয়া তেমন গরম নয়।বিস্মিত মনে রওনা হলাম আবার। এবং ঠিক তখুনি পরিষ্কার চোখে পড়ল ট্র্যাকগুলো। লোকটা যেই হোক, সোজা কোনও গন্তব্যের দিকে এগোচ্ছে। তাড়া আছে ওর, ট্র্যাক লুকোনোর সময় পায়নি।আরেকটু যেতে মাটিতে আছাড় খাওয়ার চিহ্ন দেখতে পেলাম। অসুস্থ… ঘন ঘন পানি খাচ্ছে তার কারণ লোকটা জ্বরে ভুগছে। এবং সম্ভবত ওর সঙ্গে কেউ নেই।একা।হারিয়ে গেল ট্র্যাক। কয়েক মিনিট খোঁজাখুঁজি করেও কোনও ছাপ চোখে পড়ল না। এ-বার অনুমানের ভিত্তিতে এগোতে হবে, লোকটা পাথুরে রাজ্যে চলে গেছে।আঁধার ঘনিয়ে আসছে। রাতে এই পাহাড় থেকে নামা অসম্ভব। মাঝে মাঝে থামছি, কান খাড়া, ধোঁয়ার সন্ধানে তাকাচ্ছি ইতিউতি। লোকটা পাথর আর বাজ-পড়া গাছগাছালির আড়ালে গা ঢাকা দিয়েছে।দূরদিগন্তে ঘনীভূত হচ্ছে কালো মেঘ। বজ্রবৃষ্টি হলে নরকে পরিণত হবে -জায়গা। যে-কোনও উপায়ে আমাকে নেমে যেতে হবে তাড়াতাড়ি। ইতিপূর্বে বারদুয়েক পাহাড়ী এলাকায় ঝড়ের মুখে পড়েছি, তবে সেগুলো এত উঁচু ছিল না। বিজলি চমকাচ্ছে, চিরে দিচ্ছে আকাশটাকে। নীল শিখা দেখা যাচ্ছে মাঝে- মধ্যে।বোল্ডার তো নয় যেন একটা নরক। বড় বড় পাথরখণ্ড, চুরির ফলার মত ছুঁচোল। যেন সারি সারি ভাঙা মাঢ়ীর দাঁত, পোকায়-খাওয়া। সামনে একটা ক্যানিয়ন ঝুপ করে নেমে গেছে প্রায় পাঁচশো ফুট। বাঁয়ে ভ্রূর মত ট্রেইল।এই ন্যাড়া গ্রানিটের অরণ্য থেকে পালানোর জন্যে দিশেহারা হয়ে উঠলাম আমি, অন্য যে-কোনও জায়গা আমার কাছে এখন স্বর্গ। ট্রেইলের উদ্দেশে দ্রুত পা চালালাম। অ্যাপালুসার পেছনের পায়ের ধাক্কায় একটা পাথর গড়িয়ে পড়ল, তবু নামা বন্ধ করলাম না আমরা লাগাম ধরে নিয়ে যাচ্ছি ওকে।ট্রেইলের শেষ-মাথায় ঘেসো জমিতে পৌছে তাকালাম ওপর দিকে। মনে হলো একটা সরু নলের ভেতর দাঁড়িয়ে আছি, ওপরে কেবল কালো আকাশ।তৃণভূমির ও-পাশে চলে গেছে ট্রেইলটা, এখানে আবার দেখা পেলাম ট্র্যাকের। পিছু নিলাম আমি। মেঘ গুরুগুরু করছে। পাথরের ঢল নামার শব্দের মতন। হঠাৎ, সামনে একটা গুহা চোখে পড়ল। রাশ টেনে ডাকলাম চেঁচিয়ে সাড়া পেলাম না।অ্যাপাসাকে রেখে এগিয়ে গেলাম পিস্তলহাতে। গুহামুখের সামনে,

পৃষ্ঠা -৩৮

পাহাড়ের গায়ে একটা কারনিস আনুমানিক ত্রিশ গজ লম্বা, বারো গজ গভীর। লোকবসতির চিহ্ন আছে। আবার হাঁক দিলাম, ক্যানিয়নের নীচে প্রতিধ্বনি তুলে মিলিয়ে গেল আমার চিৎকার।তারপর সব কিছু নীরব নিথর। বড় বড় কয়েকফোঁটা বৃষ্টি পড়ল। আমি আস্তে আস্তে গুহামুখের কাছে সরে গেলাম।সঙ্কীর্ণ প্রবেশপথ, দেয়াল তুলে খানিকটা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। পাথরের তৈরি, চুন-সুরকির আস্তর নেই, একটার পর একটা সাজিয়ে তোলা। গুহার ভেতরে পা রাখলাম আমি।একটা পুরোনো লাগাম ঝুলছে দেয়ালে। খটখটে একটা স্যাডল ও রাইফেল পড়ে আছে এককোণে। ফায়ারপ্লেসে স্তূপীকৃত পোড়া কয়লা, বহু-ব্যবহারের ছাপ। দেয়াল ঘেঁষে খড়ের তোরকি, কম্বল আর ভালুকের চামড়ায় ঢাকা, একটা মেয়ে শুয়ে আছে তাতে। 1ম্যাচের কাঠি ধরালাম আমি, পরমুহূর্তে সারা শরীরে শিহরণ বয়ে গেল। মেয়েটা পূর্ণ যুবতী, ছোটখাটো গড়ন, অপূর্ব লাবণ্য চেহারায়। একমাথা ঘন দীর্ঘ মেহেদি রঙের চুল, ঘাড় বেয়ে জমা হয়েছে তোশকের ওপর। পরনে তালি-মারাপোশাক, পায়ে মোকাসিন। রক্ত গোলাপের মত দুই গাল। ওকে ডাকলাম আমি, কিন্তু জবাব পেলাম না। ঝুঁকে হাত রাখলাম কপালে- জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।ঠিক সেই মুহূর্তে শুরু হলো ঝড়ের দাপাদাপি।দৌড়ে গিয়ে বাইরে থেকে ঘোড়াটা নিয়ে এলাম ভেতরে। লাগোয়া আরেকটা গুহা রয়েছে। একসময় কোরাল ছিল।প্রবেশমুখের পাশেই লাকড়ির গাদা, কোরালে ঘোড়া রেখে এসে তুলে নিলাম কয়েকটা, আগুন ধরিয়ে পানি গরম দিলাম।এ-বার ভেতরটা আরও ভালমত দেখতে পাচ্ছি। আরেকটা কম্বল রয়েছে, ওটা দিয়ে ঢেকে দিলাম মেয়েটাকে। পরিস্কার বুঝলাম দুজন লোক বাস করত এখানে, যদিও এই মুহূর্তে মাত্র একজন রয়েছে। সম্ভবত অনেকদিন ধরেই একা আছে ও।রাইফেলটা পরিষ্কার, তবে চেম্বার ফাঁকা। অ্যামুনিশন নেই কোথাও। পাথরের ছুরি আছে একটা, বেশ ধারাল। বোধ হয় এই ছুরি দিয়েই সে-বার আমার মাংস কেটে নিয়েছিল।মনে হলো মেয়েটা এখানে বহুদিন যাবৎ আছে। নিশ্চয়ই ভাল খাবার পায়নি, ভীষণ রোগা শরীর।পানি ফুটছে শোঁ-শোঁ করে। একটা পাত্রে ঢেলে নিয়ে কফি বানালাম। জার্কি ছিল আমার কাছে, সুপ তৈরি করলাম খানিকটা।বাইরে বিজলি চমকাচ্ছে ঘন ঘন, দু-তিন মিনিট পরপর বাজ পড়ছে। বৃষ্টি হচ্ছে মুষলধারে, বিজলির আলোয় বৃষ্টি-ধোয়া পর্বতমালা দেখতে পাচ্ছি আমি।

পৃষ্ঠা -৩৯

নীচে আমাদের ক্যাম্পে একলা রয়েছে ক্যাপ। আর কদিন পরেই এ- এলাকা ভরে উঠবে বাজে লোকে। এই বৃষ্টিতে বন্ধ হয়ে যাবে জলপ্রপাতের কাছে ফেরার পথ, আর কোনও রাস্তা না থাকলে এখানে আটকা পড়ব আমি। অসুস্থ মেয়েটারও শুশ্রূষা করতে পারব না।যখন সুপ গরম হলো, মেয়েটাকে কোলে তুলে খাওয়ালাম কিছুটা। জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছে। বুঝতে পারছি, শরীরের শেষ শক্তিটুকু ব্যয় করে গুহায় পৌঁছেছে। অতিকষ্টে একটু একটু করে খাচ্ছে সুপ।কিছুক্ষণ বাদে আবার ঘুমিয়ে পড়ল ও।কামবারল্যান্ডের বাসায় থাকতে আমাদের চিকিৎসা আমরা নিজেরাই করতাম। কিন্তু এই ঝড়-বাদলে বাইরে থেকে ভেষজ লতাপাতা আনা সম্ভব নয়। আমার সামনে এখন একটাই উপায় খোলা আছে: সুপ খাইয়ে ওর শরীর চাঙা রাখা।সর্দি-গর্মি হয়ে থাকলে বাঁচোয়া, মনে মনে প্রার্থনা করলাম নিউমোনিয়া বা ও-রকম ভয়ঙ্কর কিছু যেন না হয়। ওর শরীর ভেঙে গেছে। বারবার একটা চিন্তা বিরক্ত করছে আমাকে এই বুনো জায়গায় মেয়েটা এল কীভাবে?নিঃসাড়ে ঘুমোচ্ছে ও। খুঁজতে খুঁজতে গুহার ভেতর একজোড়া বুট, আর কোট পেয়ে গেলাম আমি। দুটোই ব্যাটাছেলের। কোর্টটা চাপিয়ে দিলাম ওর গায়ে।বাইরে ঝড়ের বিরাম নেই। কড়াৎ শব্দে বাজ পড়ছে। প্রায় দুঘণ্টা বাদে ঘুম ভাঙল মেয়েটার, চোখ মেলে তাকাল চারপাশে, কার নাম ধরে যেন ডাকল। আরও খানিকটা সুপ দিলাম ওকে। শিশু যেভাবে মায়ের দুধ খায়, তেমনি করে খেলো। সারারাত আগুনের ধারে বসে রইলাম আমি। পাছে নিভে যায়, এবং ও জেগে উঠে ভয় পায়। ঝড় থেমে গেল ভোরে, মেঘের গর্জন হারিয়ে গেল দূরে। একটা বড়শি বানিয়ে আমি ঝরনায় গেলাম। মাছ পাবার সম্ভাবনা কম, ঝড়ে ঘোলা হয়ে গেছে পানি। তবু ছুঁড়ে দিলাম বড়শি। কিছুক্ষণ পর ট্রাউট পেলাম একটা, এবং আধ-ঘণ্টা বাদে আরেকটা।লালচুলো মেয়েটা ঘুমোচ্ছে শান্তিতে। মাছগুলো ধুয়ে ভাজা করলাম আমি। তারপর আগুনে কফি চড়িয়ে বাইরে এলাম।ঘুরতে ঘুরতে হাজির হলাম একটা কবরের কাছে। খোঁড়া হয়নি, পাহাড়ের ঢালে একটা চওড়া ফাটলের ভেতরে দেয়া হয়েছে। ফাটলের দুপ্রান্তে দুটো পাথর, মাঝখানে এক ধরনের কাদামাটি লেপা। শুকিয়ে শক্ত হয়ে গেছে। কবার ওপর নাম-তারিখ লেখা:হুয়ান রোমেরো১৭৯০-১৮৭৪গতবছর মারা গেছে লোকটা। এবং মেয়েটা প্রায় একবছর হলো এখানে একা রয়েছে। স্বাস্থ্য ভেঙে পড়াই স্বাভাবিক, এখনও বেঁচে আছে সেটাই বরং আশ্চর্য।

পৃষ্ঠা -৪০

হুয়ান রোমেরো চুরাশি বছর বয়েসে মারা গেছে। একটা যুবতী মেয়েকে নিয়ে পাহাড়ে ঘোরাঘুরির পক্ষে বয়েসটা বেমানান। নাম থেকে বুঝলাম লোকটা স্প্যানিশ ছিল। কিন্তু ওই মেয়েকে আমার সে-রকম মনে হচ্ছে না। তবে ওদের মাঝে স্বর্ণকেশী আছে বলে যখন শুনেছি, তখন লালচুলো থাকা বিচিত্র নয়।গুহায় ফিরে গিয়ে আমি তাকালাম রোগিণীর দিকে। শুয়ে আছে, দেখছে আমাকে। ‘মাংসের জন্যে ধন্যবাদ, প্রথম চোটেই বলল।ওর চোখজোড়া গাঢ় নীল।’ম্যাম,’ বললাম আমি, ‘আমার নাম ওরিন ওসমান। বন্ধুরা ডাকে ওরিন।’ ‘আমি ডুসিলা কেরি,’ বলল ও।

নয়

ফের ঘুমিয়ে পড়ল ড্রসিলা। আগুনে আরও কিছু খড়ি গুঁজে দিয়ে আমি বাইরে, গুহামুখে এসে বসলাম। এই প্রথম সুযোগ পেলাম চারপাশে তাকাবার। স্বর্ণ উপত্যকাটা নির্জন, তবে শান্তিপূর্ণ… এখানকার পরিবেশ ভয়াল। কালো কালো গিরিশৃঙ্গ ঘিরে আছে চারদিক, কোথাও কোথাও ভাঙাচোরা। প্রতিটা ফাটলের গোড়ায় পাথর, ছাল-বাকলহীন গাছের গুঁড়ির স্তূপ। ন্যাড়া শুকনো ডালপালা ছড়ানো-ছিটানো।, এবড়েখেবড়ো পাহাড়ী খাঁজগুলোকে মনে হচ্ছে যেন আদিম কঙ্কালের বাহু।উপত্যকা বেয়ে ঝালরের মত নেমে এসেছে ঝরনা, পথে ডোবার মত সৃষ্টি হয়েছে কয়েক জায়গায়, তারপর হারিয়ে গেছে গভীর গিরিসঙ্কটে। ক্যানিয়নের প্রান্তবর্তী গাছগুলো ঝড়বাদলের দাপটে কুঁজো, থেমে গেছেবাড়। স্বাস্থ্য আর টিকে থাকার শক্তি ‘ছাড়া এদেরকে কিছু দেয়নি মহাকাল। ভূমিধসে উপড়ে গেছে বহু অ্যাসপেন, গড়িয়ে চলে গেছে নীচে, সেখানে বোল্ডার-চাপা পড়েছে। পাহাড়ের গা থেকে খসে-পড়া চাঙর, নুড়িপাথর আশ্রয় নিয়েছে ক্যানিয়নের মেঝেতে। সমভূমি নেই, জমাট-বাঁধা তুষারের ওপর কিছু ঘাস আর শৈবাল জন্মেছে। পাথরগুলো সব রঙিন লাল, কালো, সবুজ হরেক রঙের ব্যাঙের ছাতা গজিয়েছে। শিলার ওপর সর ফেলে ফেলে উর্বর মাটি সৃষ্টি করছে ওরা। এভাবেই একদিন আরও লতাপাতা জন্ম নেবে ওই মাটিতে, শ্যামল হয়ে উঠবে প্রান্তর।ঝরনার পাড়ে বিবর্ণ আর্কটিক উইলোর ঝাড়। রোদের অভাবে কয়েক জায়গায় বরফ রয়ে গেছে এখনও।দুপুরের দিকে সূর্য উকি দিল পাহাড়ের ওপর, গরম হয়ে উঠল গুহামুখ। -নতুন করে বরফ গলা শুরু হলো, গোটাকয়েক পার্বত্য মেষকে ফিতের মত সরু

পৃষ্ঠা ৪১ থেকে ৫০

পৃষ্ঠা -৪১

একটা ট্রেইল ধরে নেমে যেতে দেখলাম আমি। উল্টোদিকের পাহাড়ে দেখা দিল একটা বিরাটাকার কালো বুড়ো ভালুক। অবজ্ঞার দৃষ্টিতে ভালুকটা একবার তাকাল আমার পানে, তারপর হাত-পা ছড়িয়ে রোদ পোয়াতে লাগল। আমিও বললাম না কিছু।শান্ত পরিবেশ, তবু স্বস্তি পাচ্ছি না আমি। জায়গাটা কেমন যেন ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে মনে। তা ছাড়া ক্যাপকে নিয়েও দুশ্চিন্তায় আছি। মাঝ-বিকেলে আবার জেগে উঠল ডু কেরি। আমি ভেতরে গিয়ে এক কাপ কফি দিলাম ওকে। আমার দিকে তাকাল ও। ‘দারুণ লাগছে প্রায় এক বছরের মধ্যে এর স্বাদ পাইনি।”একটা ব্যাপার কিছুতেই আমার মাথায় ঢুকছে না,’ বললাম, ‘তুমি এখানে এলে কেন? তুমি কি হুয়ান রোমেরোর সাথে এসেছিলে?”উনি আমার দাদু। আমি দাদুবাড়িতে মানুষ। দাদিমা মারা যাবার পর থেকে ওঁর মনেও মৃত্যুভয় ঢুকে যায়। খালি ভাবতে শুরু করেন তিনি মারা গেলে আমার কী হবে। দাদুর কাছে একটা ম্যাপ ছিল, স্যান জুয়ান পাহাড়ে সোনার খনির উল্লেখ ছিল তাতে। ওই ম্যাপটা আমাদের পারিবারিক সম্পত্তি পুরুষানুক্রমে দাদুর হাতে আসে। তো উনি সিদ্ধান্ত নিলেন, আমার জন্যে খুঁজে বের করবেন খনিটা। আমিও জেদ ধরলাম আসার জন্যে।’দাদু খুব সাহসী ছিলেন, ওরিন। কাউকে পরোয়া করতেন না। কিন্তু। ম্যাপের সঙ্কেত ধরতে না পারায় আমরা পথ হারিয়ে ফেললাম। গোলাবারুদ কমে এসেছিল। পাহাড়-ধসে মালপত্রের সঙ্গে হারিয়ে যায় কিছু কাঁধে চোট পেলেন দাদু। এই সময় ‘আমরা এখানে এলাম। তাঁর বিশ্বাস ছিল খনিটা ধারে-কাছেই হবে। এ- রকম মনে করার কারণ আমাকে কখনও বলেননি তিনি, তবে ম্যাপে উল্লেখ ছিল দুই পাহাড়ের মাঝামাঝি কোথাও হবে। একটা উত্তরে, সামান্য পশ্চিম ঘেঁষে অন্যটা সোজা পশ্চিমে। ‘আমাকে যতটুকু বলেছিলেন, ওই ধসে দাদু আসলে তার চেয়ে বেশি আহত হয়েছিলেন। আর সেরে ওঠেননি। ফুলে ঢোল হয়ে গিয়েছিল একটা কাঁধ, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতেন। চিন্তিত হয়ে পড়লেন আমাকে নিয়ে। সোনার আশা বাদ দিয়ে এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে যাবেন বলে ঠিক করলেন।’এরপর তিনি বিছানায় পড়েন… তুমি যে-বার প্রথম এসেছিলে এটা তখনকার কথা। খিদেয় কষ্ট পাচ্ছিলাম আমরা, তাই তোমার মাংস চুরি করেছিলাম আমি।”আমাকে জাগানো উচিত ছিল।”আ… আমি ভয় পেয়েছিলাম।”তারপর যখন ফিরে এসে দেখলে তোমার জন্যে মাংস রেখে গিয়েছি তখন নিশ্চয়ই ভুল ভেঙেছিল?’

পৃষ্ঠা -৪২

‘ওহ্, তখনকার মনের অবস্থা বলে বোঝাতে পারব না। আমি মাংস নিয়ে ফিরে আসার পরপরই দাদু মারা যান। অবশ্যি তার আগে তোমার কথা বলেছিলাম ওঁকে।”তারপর?”তোমার সাথে আমাকে চলে যেতে বলেছিলেন উনি। বলেছিলেন, তুমি আমাকে নিয়ে যাবে এখান থেকে, সাধারণত পুরুষেরা মেয়েদের কোনও ক্ষতি করে না।”কবরটা দেখে আমি ভেবেছিলাম উনি বোধ হয় আরও আগে মারা গেছেন।’ ‘তারিখের ব্যাপারে আমি শ্যঅর ছিলাম না। সময়জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম আমরা।’অনেক ঝড়ঝাপটা গেছে ওর ওপর দিয়ে, সুপ বানাতে বানাতে ভাবলাম আমি। এ-বার বড় এক টুকরো মাংস দিলাম ওতে।’এখানে উঠলে কীভাবে?”উত্তরের একটা রাস্তা ধরে বহু প্রাচীন ট্রেইল, ভীষণ খাড়া।’আবার সেই উত্তর দিক্। আমি পশ্চিম দিকে নামবার রাস্তা চাইছি। আমার ধারণা এ-মুহূর্তে ক্যাপ সয়্যারের কাছ থেকে আমরা খুব বেশি হলে এক মাইল দূরে আছি। কিন্তু এই এক মাইল বলতে গেলে প্রায় সটান নেমে গেছে। ডুসিলা কেরির পক্ষে এ-শরীরে নড়াচড়া অসম্ভব। ওকে ফেলে রেখে যাব না আমি, বিশেষ করে আমাকে যখন খুন করবে বলে অনেকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। ওর কথা কাউকে বলবার আগেই যদি আমি মরে যাই, তখন?সাবধানের মার নেই, আগাম সব কিছু জানিয়ে রাখলাম ওকে। ‘ভ্যালেসাইটোস ক্যানিয়নে আমাদের ক্যাম্প। আমার বন্ধু ক্যাপ সয়্যার আছে ওখানে। ক্যাম্পটা এখান থেকে পশ্চিমে। আমার কিছু হয়ে গেলে সোজা ওর কাছে চলে যেও। ও তোমাকে মোরায় আমার মায়ের কাছে নিয়ে যাবে।’ আর কদিন বিশ্রাম পেলে ড্র চলাফেরার উপযুক্ত হয়ে উঠবে। অসুখটা এমন কিছু নয়, দীর্ঘ অনাহারে স্বাস্থ্যহানি ঘটেছে।বাইরে গিয়ে আমি ক্যানিয়নের বিপরীত দিক চলে এলাম। অনেকক্ষণ ধরে জরিপ করলাম পেছনের পাহাড়টা, ধসের ফলে মাঝামাঝি জায়গায় ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। পায়ে হেঁটে চূড়ায় ওঠা সম্ভব বলে মনে হলো।সম্ভবত ঠিক এর ও-পাশে, নীচে, আমাদের ক্যাম্প। বহু চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিলাম, একবার দেখব চেষ্টা করে। ঝরনার ভাটিতে একটা গাছ চোখে পড়েছিল, তার ডাল ভেঙে নিয়ে পাথরে আঁচড় কেটে লিখলাম: এখুনি ফিরব। রাইফেলটা হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করলাম আমি।কেটে-ছড়ে যাচ্ছে হাত-পা, প্রতি তিনকদমে এক পা হড়কে পড়ছি, তবু নিরাশ হলাম না।অবশেষে একসময় উঠে এলাম ঢালের মাথায়। এখান থেকে শুরু হয়েছে

পৃষ্ঠা -৪৩

ফাটল, ওপরে তাকাতে আমার চোখ স্থির হয়ে গেল। ইচ্ছে হলো ফিরে যাই, কিন্তু কোনও কাজে হাত দিয়ে সেটা শেষ না করা আমার ধাতের বাইরে। ত্রিকোণ চিমনির মত ফাটল, নীচের দিকে সরু, ওপর দিকে চওড়া। চিমনির ওপরের ঢালটা দেখলে মনে হয় যে-কোনও মুহূর্তে ভেঙে পড়বে। তবে হিসেব করে এগোলে ওঠা একেবারে অসম্ভব নয়।রাইফেলটা ঝুলিয়ে নিলাম কাঁধে, হাতদুটো এখন মুক্ত থাকবে, তারপর চিমনি বেয়ে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে এলাম ঢালে। হাঁফিয়ে গেছি, দম নিতে থামলাম একটু, তাকালাম নীচের দিকে। মনে হলো পড়ে যাব মাথা ঘুরে, এত উঁচুতে উঠে এসেছি বুঝতেই পারিনি। ফিতের মত দেখাচ্ছে ক্রীকটাকে, গুহামুখকে মনে হচ্ছে বুঝি আঙুলের নখ। উপত্যকা থেকে দুহাজার ফুট ওপরে রয়েছি আমি। ঘাস খাচ্ছে আমার ঘোড়াটা, পিঁপড়ের মত দেখাচ্ছে ওকে।বেছে বেছে অপেক্ষাকৃত মজবুত পাথরে ভর দিয়ে রওনা হলাম চুড়োর উদ্দেশে। যখন পৌছুলাম, আমার সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে।ওপরে নিঃসীম মহাকাশ, মেঘ। আমার চারপাশে উলঙ্গ মসৃণ গ্রানিট, বরফ গলে যাওয়ায় কোথাও কোথাও ফোকর বেরিয়ে পড়েছে। কোনও গাছ বা লতাখাতার চিহ্নমাত্র নেই। চকচক করছে চুড়োর মেঝে, ঝোড়ো হাওয়া ঝেটিয়ে বিদেয় করেছে সমস্ত আবর্জনা। নির্মল পরিবেশ, ফুরফুরে হাওয়া বইছে। আমি হেঁটে কিনারে গিয়ে দাঁড়ালাম।দূরে ভ্যালেসাইটোস উপত্যকা। চুড়োর সামান্য নীচে থেকে বনভূমির শুরু। প্রথমে দুটো-একটা গাছ, বাজ পড়ে কালো অঙ্গার হয়ে আছে, তারপর নিবিড় জঙ্গল। ওই বনের মাঝে আমাদের ক্যাম্প ক্ষীণ ধোঁয়ার রেখা উঠছে।এখন আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সমভূমির হিসেবে ক্যাম্প আধমাইল দূরে রয়েছে। কিন্তু পাহাড়ের উচ্চতা এক মাইলের বেশি, ফলে প্রকৃত দূরত্ব আরও বেড়ে গেছে। দু-এক জায়গায় কোনও পথ নেই, একদম খাড়া, কীট- পতঙ্গ ছাড়া কারও পক্ষে নামা সম্ভব নয়। কেবল উত্তরের ঢাল ধরে মাইলখানেক যাওয়া যাবে। আমাদের টাউন সাইটে কর্মচাঞ্চল্যের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। কয়েক সারি ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠছে, দালানকোঠাও তৈরি হচ্ছে বলে মনে হলো। তবে এত দূর থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না সেটা।সন্ধ্যের মুখে ফিরে এলাম গুহায়। ড্র হাসল আমাকে দেখে।’ভয় পাচ্ছিলে?’টোল পড়ল ওর গালে। ‘ন-না… তুমি তো বলেই গেছ ফিরে আসবে।’আগের চেয়ে অনেক সুস্থ দেখাচ্ছে ওকে। রঙ ফিরে এসেছে মুখে, কফির জোগাড় করছে। আসার পথে আমি একটা শিঙওয়ালা মেষ শিকার করেছিলাম, আগুনে ঝলসে নিলাম ওটা। ভূরিভোজন সেরে গল্প করতে বসলাম আমরা দুজন। চাঁদ না ওঠা অবধি চলল সেই গল্প।

পৃষ্ঠা -৪৪

তারপর ও যখন ঘুমোতে গেল, গুহার দরজায় আসনপিঁড়ি হয়ে বসলাম আমি। চন্দ্রালোকে রুপোর চাদরের মত মনে হচ্ছে তুষারাবৃত পাহাড়ের গা। একসময় পশ্চিমে ঢলে পড়ল চাঁদ, হারিয়ে গেল অন্ধকার বনানীর আড়ালে।পাঁচদিন পর, ভোরবেলায় রওনা হলাম আমরা।উত্তর-উত্তরপুবদিকের ঝরনাটা পেরিয়ে একটা প্রাচীন ট্রেইল ধরলাম। এটার কথাই বলেছিল ড্রসিলা। ওদের মোটবাহী খচ্চর কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল ও দেখাল। তারপর জানাল ক্যানিয়নের দক্ষিণে আরেকটা দুরারোহ ট্রেইল আছে, ওটা দিয়ে যাওয়া যাবে আমাদের ক্যাম্পে।ভুসিলা বসে আছে স্যাডলে, আমি অ্যাপালুসার লাগাম টেনে নিয়ে যাচ্ছি। পাথর আর ঘন জঙ্গল ভেঙে অনেকক্ষণ পর নীচে পৌছুলাম আমরা। শহর থেকে ‘প্রায় আধ-মাইল দূরে এসে থামলাম।জনাচল্লিশেক লোক কাজ করছে, ব্যস্তসমস্ত ভাব, ঘরবাড়ি উঠছে। কিন্তু ক্যাপ সয়্যারের ছায়াও দেখতে পেলাম না কোথাও। ব্যাপারটা মোটেও পছন্দ হলো না আমার।ডুকে সাহায্য করলাম ঘোড়া থেকে নামতে। ‘বিশ্রাম নেব,’ বললাম আমি। ‘ক্যাম্পে যাব রাতে। ওই লোকগুলোকে সুবিধের বলে মনে হচ্ছে না।’ ওদের সঙ্গে লাগতে গিয়ে একটা অসুস্থ মেয়েকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে চাই না আমি।অন্ধকার নামল ধীরে ধীরে। ক্যাপের কথা চিন্তা করে আর বসে থাকতে মন সায় দিল না। কোলে করে ড্রসিলাকে চাপিয়ে দিলাম স্যাডলে, আমার উইনচেস্টার রাইফেল বের করে নিলাম স্ক্যাবার্ড থেকে।সামান্য পথ। ছোট্ট একফালি ঘেসো জমি আর উইলো ঝোপের পরেই আমাদের ক্যাম্প। থমথমে পরিবেশ, কেবল দু-তিনটে পেঁচা আমাদের মাথার ওপর ডানা ঝাপটাচ্ছে। একটুবাদে দূরে একটা নেকড়ে ডেকে উঠল এবং থামল। সূর্য ডুবে গেছে, রাত নামেনি পুরোপুরি।আমরা ডানে মোড় নিলাম। আমার পায়ে মোকাসিন, ঘাসে শব্দ হচ্ছে না হাঁটার। অ্যাপালুসাটা জাত ইন্ডিয়ান ঘোড়া, অবস্থা বুঝে সাবধানে এগোচ্ছে। হালকা ধোঁয়া চোখে পড়ছে গাছপালার ফাঁক দিয়ে, পাহাড় থেকে ভেসে আসছে মিষ্টি বাতাস।ক্যাপের অমঙ্গল আশঙ্কায় আমার মন ছটফট করছে। শহরের ওই লোকগুলোকে একটুও ভাল ঠেকেনি আমার। ওদের বিরুদ্ধে একা পেরে উঠবে না ক্যাপ। হয়তো সে আহত হয়েছে, মারা পড়াও বিচিত্র নয়। কসম খেলাম আমি, ক্যাপ সয়্যারের কোনও ক্ষতি হয়ে থাকলে ওদের নাম-নিশানা মুছে দেব পৃথিবী থেকে।হঠাৎ সামনের ঝোপ থেকে তিনজন লোক বেরিয়ে এল। পুরোভাগে কিচ। ‘তোমার অপেক্ষাই করছিলাম, ওসমান,’ বলে আমার দিকে পিস্তল তাক

পৃষ্ঠা -৪৫

করল সে। কিচ ভেবেছিল আমাকে সে বাগে পেয়েছে। কিন্তু আমার পায়ের সাথে সাঁটানো উইনচেস্টারখানা চোখে পড়েনি ওর। আলগোছে ডান হাতে ওটা ওপরে তুললাম আমি, বাঁ-হাতে চেপে ধরলাম ব্যারেল, গুলি করলাম মাজার কাছ থেকে। আমাকে লক্ষ্য করে পিস্তল নাচাচ্ছিল কিচ, ঠোঁটে কুৎসিত হাসি, আচমকা বুলেটের ধাক্কায় পিছিয়ে গেল দুকদম, এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গেছে পেট। একটুও না সরে দ্বিতীয়জনকে গুলি করলাম, ঘুরে মুখ থুবড়ে পড়ল সে।তৃতীয়জন দাঁড়িয়ে রইল অনড়, ফাটা বেলুনের মত চুপসে গেছে, মুখ ফ্যাকাসে, চোখ বিস্ফারিত। ‘গানবেল্ট ফেলে দাও!’ হুকুম করলাম। ‘কোনও চালাকি নয়!’সুবোধ ছেলের মত নির্দেশ পালন করল সে, পিছু হটল এক পা। ‘এবার বলো দেখি, চাঁদ, তোমার নাম কী?”অ্যা… অ্যাব ওয়ারেন,’ ভয়ে তোতলাতে লাগল লোকটা। ইতস্তত করল একটু, তারপর বলল, ‘কিচ এখনও মারা যায়নি… দেখব চেষ্টা করে বাঁচে কিনা?’ ‘তেড়িবেড়ি করলে আবার গুলি খাবে,’ জবাব দিলাম আমি। ‘ওকে সাহায্য করার ইচ্ছে থাকলে, মুখ খোলো। আমার পার্টনার কোথায়?’শরীরের ভর বদল করল ওয়ারেন। ‘তুমি নিজের ভাল চাও তো পালাও… অন্যরা এসে পড়ল বলে।”আসুক। কই আমার প্রশ্নের জবাব দিলে না?”দেব না। কসম-‘ইতিমধ্যে সরে গিয়েছিলাম ওর কাছে, উল্টোহাতে চড় কষালাম মুখে। বেশি জোরে মারিনি; কিন্তু আগেই বলেছি আমার থাবা বড়, কঠোর পরিশ্রমের ফলে লোহার মত শক্ত।হাঁটু ভাঁজ হয়ে গেল ওর, কলারে চেপে ধরে টেনে তুললাম। ‘জবাব দাও, নইলে স্রেফ খুন হয়ে যাবে।’স্নায়ুর চাপ আর সইতে পারল না ওয়ারেন, হড়হড় করে বলে গেল সব। ‘ওরা অ্যামবুশ করেছিল মারতে পারেনি আহত অবস্থায় পালিয়ে গেছে ও তবে তার আগে আমাদের দুজনকে মেরে গেছে এখন তোমাদের ক্যাম্পে আছে।”একা?”না…জো রাগার আছে সঙ্গে।’ ওয়ারেন দম নিল। ‘রাগার ওর পক্ষ নিয়েছে।’কিচ গোঙাচ্ছিল, আমি ওর কাছে গেলাম। ‘বলেছিলাম না, কিচ, আমি পালাব না।’ ঘুরলাম ওয়ারেনের দিকে। ‘নিয়ে যাও ওকে। যদি বেঁচে যায়, আর যেন পিস্তল ঝোলাতে না দেখি। তোমাকেও না। ইচ্ছে করলে থাকতে পারএখানে কিন্তু পিস্তল ঝোলালে মারা পড়বে।’ লাগামটা হাতে নিলাম আমি, তারপর যোগ করলাম, ‘ফিরে গিয়ে ওদের

পৃষ্ঠা -৪৬

বলবে, আমাদের সঙ্গে আপস করতে। আর যদি তা না চায়, তা হলে যেন চলে যায় না গেলে আমি-ই তাড়াব।”ওরা চল্লিশজন!’ বলল ওয়ারেন।’হোক। তোমার কাজ বলা।’ওদের অস্ত্রপাতি কুড়িয়ে নিয়ে ফের যাত্রা করলাম আমি। যখন ক্যাম্পে পৌছুলাম, ঘুটঘুটে আঁধার নেমেছে। আমাকে চ্যালেঞ্জ করল একজন। গলাটা পরিচিত ঠেকল, তবে ক্যাপ নয়।’আমি ওসমান,’ বললাম, ‘সঙ্গে একজন মহিলা আছে।’পিছিয়ে ড্রসিলার কাছে গিয়ে বললাম, ‘ম্যাম, ওই ঘটনার জন্যে আমি দুঃখিত কিন্তু কী করব বলো, এ ছাড়া উপায় তো ছিল না।’ও জবাব দিল না, ভয়ে ভয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘লেগেছে?’ ‘ন-না।’ওর স্বর কেমন যেন অচেনা শোনাল আমার কানে, তবে ওকে ঘোড়া থেকে না নামানো অবধি ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিলাম না ততখানি। আড়ষ্টভাবে নামল ড্রসিলা, একটিবারও তাকাল না আমার দিকে।আমাদের পাশে একজন লোক উদয় হলো। ‘ওসমান? আমি জো রাগার। মনে পড়ে? তোমার সাথে আলাপ আছে বলেছিলাম। ক্যাপের কাছ থেকে ওদের দূরে সরিয়ে রাখতে চেষ্টা করছি আমি।’চিনতে পারলাম রাগারকে। সেই পেটা-শরীর, কিচের সাথে এও এসেছিল। ওকে পাশ কাটিয়ে কেবিনে ঢুকলাম। কম্বলের ওপর শুয়ে আছে ক্যাপ। ভীষণ ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলাম আমি।’রাতে আমরা বাতি বিশেষ জ্বালাই না,’ বলল রাগার। ওরা এলোপাতাড়ি গুলি ছোঁড়ে।”নিভিয়ে দাও।’চুপচাপ কয়েকমিনিট বসে রইলাম আমি, মৃত্যুভয় হেঁকে ধরেছে। বৃদ্ধের অবস্থা ভাল মনে হচ্ছে না। আমাদের বন্ধুত্ব দীর্ঘদিনের নয়, তবু ওর মায়ায় জড়িয়ে গেছি আমি। ক্যাপ সত্যিকারের খাঁটি লোক। ‘ওকে অ্যামবুশ করেছিল… চার-পাঁচজনে মিলে। গুলি করে ফেলে দেয় স্যাডল থেকে, তারপর খুঁজতে শুরু করে। কিন্তু ক্যাপ বুদ্ধি হারায়নি, কাছে আসার সুযোগ দিয়েছে, তারপর যখন বুঝেছে লক্ষ্য ফসকাবে না নিকেশ করেছে দুটোকে। বাকি সব ভয়ে বেড়ালের মত লেজ গুটিয়ে ভেগেছে।”চোট কোথায়?’অল্পের জন্যে রক্ষা পেয়েছে ফুসফুস। ওপর দিকে লেগেছে, তবে প্রচুর রক্ত হারিয়েছে এখানে আসার আগে। পরদিন সকালে খবর পেয়েই আমি চলে এসেছি।’তারপর ওরা যখন ওকে খতম করতে আসছিল, আমি বাধা দিয়েছি

পৃষ্ঠা -৪৭

এগিয়ে গিয়ে। ক্যাপের অবস্থা যে এত খারাপ, ওরা সেটা জানে না তাই আর হামলা চালায়নি জানের ভয় প্রত্যেকেরই আছে।’বাইরে গিয়ে গাছতলায় দাঁড়ালাম। ওই বৃদ্ধ যদি মারা যায়, ওদের কাউকে আস্ত রাখব না আমি দরকার হলে এ-জন্যে সারা দেশ চষব।’এতক্ষণে নিশ্চয় কিচের হাল দেখতে পেয়েছে ওরা, জানে আমি ফিরে এসেছি। এ-সব লোকের স্বভাব আমি ভালই বুঝি। আজ রাতে মিটিং বসবে ওদের, পরবর্তী কর্মপন্থা ঠিক করবে কিন্তু রাতে সাহস করবে না আসতে। বিশেষ করে কিচের ঘটনার পর। সুতরাং, কোনও গোলমাল যদি হয়, তো কাল।তবে আমি তৈরি থাকব ওরা আজ এলেও কুছপরোয়া নেই। আমি যেচে কোনও ঝামেলা বাধাইনি, কিন্তু ওরা যখন বাধ্য করছে, তখন আর কী করা? ওরা যদি পাহাড়ের গোড়ায় এক সারি কবর দিয়ে এ-শহরের উদ্ধোধন করতে চায় তাই হবে।জো রাগার পেছনে এসে দাঁড়াল। ‘অ্যানজেল, ও’নীল ওদের খবর দেবো?”লাগবে না আমি একাই পারব।’ আটচল্লিশ ঘণ্টা সময় পাবে ওরা। তারপর আমি শহরে যাব।

দশ

ভোর। গুমট আকাশ, বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। কথাটা মনে হতেই আঁতকে উঠলাম; বৃষ্টি মানেই তুষারপাতের আশঙ্কা, সে-ক্ষেত্রে খনিতে যাবার পথ অন্তত বেশ কিছু দিনের জন্যে বন্ধ হয়ে যাবে।আমাদের ক্যাম্পের চারদিকে জঙ্গল। তার কিনারে গিয়ে তাকালাম শহরের পানে। অনেকগুলো তাঁবু পড়েছে, একটা দালান নির্মিত হয়েছে ইতিমধ্যে, আরও দুটোর কাজ চলছে।পাততাড়ি গুটানোর কোনও লক্ষণ দেখতে পেলাম না।আগুনের পাশে জোড়াসনে বসে আছে জো রাগার। হাতে একটা দীর্ঘ ফর্ক, ভেনিসন স্টিক বানাচ্ছে ওটা দিয়ে। ড্রসিলা সাহায্য করছে ওকে। আমার সাথে চোখাচোখি হতেই মুখ নামিয়ে নিল। ওর দৃষ্টিতে স্পষ্ট ভয়।এ-জন্যে ওকে দোষ দেই না। পাহাড়ে শাস্তিতে বাস করছিল ও, আচমকা গান ফাইট দেখে স্নায়ুতে চাপ পড়েছে। আমার ভূমিকাতে বোধ হয় আঘাত পেয়েছে ড্র। যে-সব লোক নির্ঝঞ্ঝাট জীবন যাপন করে, কঠিন লোকদের মোকাবেলার ব্যাপারে তাদের কোনও ধারণা নেই। তা ছাড়া, লড়াইতেই যখন

পৃষ্ঠা -৪৮

সমস্যার ফয়সালা করতে হবে, তখন ফালতু কথা খরচ করতে যাব কেন?শহরের ওই লোকগুলোকে হুঁশিয়ার করা হয়েছে, ভাবনাচিন্তার সময় দিয়েছি। ওদের ভেতর রুখে দাঁড়ানোর মত লোক অবশ্যই আছে; এরা হবে কঠিন একগুঁয়ে লোক। কিছু লোক থাকবে বাকপটু, এরা প্রথম কাতারের নেতৃত্ব মেনে নেবে। আরেক ধরনের মানুষ দেখা যায় এ-রকম আউটফিটে। এরা সুযোগসন্ধানী, সাহসী সবল লোকদের কাঁধে ভর করে আখের গুছায়। নেতা হবার মত যোগ্যতা নিশ্চয়ই এই আউটফিটে কারও না কারও আছে।আমার হুঁশিয়ারি ওদের ঐক্যে, কিছুটা হলেও চিড় ধরাবে। সুযোগ- সন্ধানীদের অনেকেই জড়াতে চাইবে না লড়াইতে, বাকপটুদের কেউ কেউ সেই ছুতোয় কেটে পড়বে।ক্যাপের অবস্থা সঙ্গিন। এমনিতেই ও রোগা-পাতলা মানুষ, শরীরে রক্ত কম এখন সেই মহামূল্যবান রক্ত হারিয়ে কাহিল হয়ে পড়েছে। চোখ-মুখ দেবে গেছে, পাঁজরের হাড় গোনা যাচ্ছে একটা-একটা করে। ওর দিকে তাকালে আমার ভয় করে। প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর একটা মানুষ অথচ তার ছিটেফোঁটাও দেখা যাচ্ছে না।’ড্র,’ বললাম আমি, ‘ওর একটু সেবাযত্ন করতে পারবে?”পারব ।”ড্র, কাল রাতের ঘটনার জন্যে তুমি কিছু মনে কোরো না ‘অ্যাম সরি।”ওদেরকে তুমি না মারলেও পারতে!”ওরা খারাপ লোক, ডু আমাকে খুন করতে এসেছিল।”বিশ্বাস করি না। ভয় দেখাচ্ছিল।”ডু, ভয় দেখানোর জন্যে কেউ পিস্তল নাচায় না। এমন অনেককে আমি দেখেছি, যারা এটা বিশ্বাস করেনি বলে শেষ পর্যন্ত নিজের প্রাণ দিয়ে মাশুল গুনেছে।’আমার কথা বোধ করি মনঃপূত হলো না ওর, নীরবে সরে গেল। চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলাম বুকে, আমাদের সম্পর্কে ফাটল ধরেছে। জীবনে এই প্রথম একটি মেয়ের প্রতি টান অনুভব করেছিলাম, সেও আমার হবে না। আমার কর্তব্যপালনের পর আরও অপছন্দ করবে। তবু সত্য সত্যই রয়ে যাবে: কোনও পুরুষই মেয়েলোকের ইচ্ছানুযায়ী নিজের জীবন গড়তে পারে না। মেয়েদেরও উচিত নয় এ-ব্যাপারে পুরুষদের প্রভাবিত করা। তাদের মাঝে দেয়া-নেয়া, বোঝাপড়া নিশ্চয় থাকবে, কিন্তু পুরুষ যখন জীবন-মৃত্যুর কঠিন সমস্যায় পড়ে, তখন তার নিয়মেই তাকে সেটা মোকাবেলা করতে দেয়া উচিত।এখানে গোলমালে জড়াতে আসিনি। ক্লেইম দাখিল করেছি আমরা, শহরপত্তনের জন্যে মাপজোক করেছি একটা জায়গা, এবং দালানকোঠা কোথায় হবে তা ঠিক করেছি। কাঠ কেটে নির্মাণের জন্যে তৈরি হচ্ছিলাম: এই সময় বাইরের কিছু লোক এসে জবরদখল ‘করতে চাইছে সেটা। ক্যাপকে গুলি করেছে

পৃষ্ঠা -৪৯

ওরা, এবং আমাকে খুন করবার চেষ্টা করেছে।নাস্তার সময় কথাবার্তা হলো না বিশেষ। খাওয়া সেরে আমি ব্ল‍্যাকস্টোনের বই নিয়ে একটা গাছের তলায় গিয়ে বসলাম, এখান থেকে শহরের ওপর নজর রাখতে পারব। লেখাপড়া ব্যাপারটা আমার জন্যে কঠিন, ধৈর্যের সঙ্গে চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। অচেনা অজানা শব্দ বাদ দিয়ে পড়ছি। তবে কিছুক্ষণ পাঠের পর অধিকাংশ অর্থ মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে উঠল।একঘণ্টা বাদে বইটা ক্যাম্পে নিয়ে রেখে দিলাম, তারপর একটা বেলচা হাতে করে পথ ধরলাম ক্রীকের।কঠিন শিলান্তর অবধি শ্যাফট খুঁড়ে ক্যাপ সেটা সাফ করতে শুরু করেছিল। আমি ওখানে নেমে আরেকটু চওড়া করলাম ওটা, তারপর কিছু নুড়িপাথর বের করে আনলাম। এ-বার ঝরনার কিনারে গিয়ে একটা প্যানে অখলাম পাথরগুলো, পানিতে ডুবিয়ে কচলাতে লাগলাম। সোনার কুচি পাওয়া গেল কিছু, তবে সেটা না ধরবার মতই।মাঝে মাঝে জঙ্গলের প্রান্তে গিয়ে দেখে আসছি চারপাশ। দুপুর হয়ে এল, তবু শহরে কোনও কাজকর্মের চিহ্ন চোখে পড়ল না। এর মানে, ওদের আলোচনা-সভা এখনও ভাঙেনি। ক্যাপের শ্বাস-প্রশ্বাস সহজ হয়ে আসছে। আমি যখন ক্যাম্পে ফিরে এলাম, ভুসিলা খাওয়াচ্ছে ওকে। আমাকে না দেখার ভান করল, আমিও খেতে বসলাম নীরবে।লড়াই বাধলে আমরা হয়তো ওদের ঠেকাতে পারব, কিন্তু এখান থেকে পালাতে হলে পাহাড়ে ওঠাই একমাত্র পথ। সে-ক্ষেত্রে একজন রোগীকে নিয়ে যে বেশি দূর যেতে পারব না, তা বলাই বাহুল্য।একটা কুড়াল নিয়ে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করতে গেলাম আমি। আরও কটা গুঁড়ি যোগ করলাম, এখানে-সেখানে আগাছা সাফ করলাম কিছু। এর ফলে আমাদের জ্বালানির পরিমাণ বাড়ল।জো রাগার চিন্তিত হয়ে পড়েছে, বুঝতে পারছি, তবে লোকটা ভিতু নয়। ‘আমাদের পক্ষ নিলে কেন, জো?’ জানতে চাইলাম।’আগে ওদের স্বভাব-চরিত্র বুঝতে পারিনি। তোমাদের দুজনকে আমার মনে ধরেছে। তা ছাড়া, ওই দোকানটা লিজ নিতে চাই আমি। ওহাইওতে একসময় একটা মুদিখানায় চাকরি করতাম, কিন্তু যখন বুঝলাম এতে আমার ভাগ্য খুলবে না, চলে এলাম ছেড়ে দিয়ে। খনিতেও কাজ করেছি কিছু দিন, তবে আমার লক্ষ্য দোকান করা।”জো, ওটা তা হলে তুমিই পেলে। আমরা চাই শহরটা বড় হোক, ওই দোকান তুমি নিলে খুশি হব।”থ্যাংকস, ওরিন।’শহরে কী ঘটছে জানতে পারছি না বলে দুশ্চিন্তা বোধ করছি। অথচ এটা আমার স্বভাব-বিরুদ্ধ, কখনও বেশি সিরিয়াস হতে পারি না। এ-কারণে অতীতে

পৃষ্ঠা -৫০

আমাকে অনেক ক্ষেত্রে ভুল বুঝেছে মানুষ, ভেবেছে আমি সমস্যা দেখলেই পাশ কাটাতে চাই। এখন আমার সমস্ত মনোযোগ ওই লোকগুলোর প্রতি। নিশ্চয়ই ওরা এখানে আসার জন্যে সাহস সঞ্চয় করছে আর সেটা জোগাচ্ছে মদ। শহরটা মাস্তানে ভরে উঠুক, এটা আমার কাম্য নয়। মানুষ যাতে খাটা-খাটুনির পর নিরাপদে সান্ধ্যভ্রমণে বেরোতে পারে, সে-ব্যবস্থাই করতে হবে আমাকে।প্রায় একশো ফুটি একটা দড়ি পেলাম আমাদের মালপত্র ঘেঁটে। জোয়ের কাছে আরও কিছুটা মিলল, এই দুটো একত্রে গিঁট বেঁধে আমি কেবিন থেকে ফিল্ড গ্লাসখানা নিয়ে এসে শহরটা জরিপ করলাম।চারটে তাঁবু রয়েছে একটা বড়, রেলরাস্তা আছে এমন শহরে স্টেশনের পাশে এ-রকম তাঁবুতে স্যালুন দেখতে পাওয়া যায়। আরগুলো ছোট ছোট। জিন-চড়ানো দুটো ঘোড়া চোখে পড়ল, পেছনে লটবহর… রাস্তায় ঘুরঘুর করছে ব-য়েকটা লোক।হঠাৎ একটা বিষয়ে আমার কৌতূহল জাগল। শহরে যদি চল্লিশজন লোকই থাকবে, তবে অন্যরা কোথায়?হাত বাড়িয়ে রাইফেল তুলে নিলাম, বনের প্রান্ত ধরে হাঁটতে হাঁটতে প্রতিটা রাস্তা দেখলাম খুঁটিয়ে। ক্যাপ আর জো একাই হটিয়ে দিয়েছিল ওদের, এখন আমি রয়েছি মনে হয় না এ অবস্থায় আবার হামলা চালাবে ওরা, তবু সাবধান থাকা ভাল।কথাটা মাথায় আসতেই চমকে উঠলাম: ক্যাপ সয়‍্যার অসুস্থ, ড্রসিলা কেরি মেয়েছেলে পরিস্থিতি আমাদের জন্যে নেহাত নাজুক। সুতরাং আক্রমণ আমাকেই করতে হরে।সন্ধ্যে নাগাদ জো রাগার পাহারার দায়িত্ব নিল, আমি ভেতরে গেলাম খেতে। ক্যাপ জেগেছিল, তাকাল আমার দিকে। ‘ওরিন, তোমাকেই সব কিছু সামলাতে হবে। আমি তো বিছানায়।”দুঃখ করো না, ক্যাপ। আমাদের ক্লেইম বজায় রাখতে গিয়ে তোমার এই দশা।’ ওর বিছানার পাশে বসলাম, হাতে ধরে সাহায্য করলাম কফি খেতে।’আজ রাতে ওদের হিসেব চুকানোর পালা।”বি কেয়ারফুল।”আমরা না গেলে, ওরাই আসবে। তুমি অসুস্থ, ড্র রয়েছে এখানে গোলাগুলি করা ঠিক হবে না।”ড্র মেয়েটা ভাল।”ওই উপত্যকাটা তুমি যদি দেখতে। ও কীভাবে ছিল, আমার ভাবতেই অবাক লাগে। খাওয়া-দাওয়া নেই, তার ওপর একা।’বেশ তরতাজা লাগছে ক্যাপকে। বিশ্রাম আর প্রচুর খাবার দরকার ওর, তা হলেই হৃতশক্তি ফিরে পাবে। এই দুঃসময়ে ড্র থাকায় আমাদের লাভ হয়েছে। ঘরে ঢুকল ড্র, একবাটি সুপ নিয়ে এসেছে ক্যাপের জন্যে, আপ্রাণ প্রয়াস

পৃষ্ঠা ৫১ থেকে ৬০

পৃষ্ঠা -৫১

পাচ্ছে আমার দিকে না তাকাবার। ও কী আশা করে আমার কাছে? পুতুলের মত দাঁড়িয়ে থেকে মরলো? স্বীকার করছি, হামলা আমিই চালিয়েছিলাম, কিন্তু কিচের দায়ভাগও কম নয় লুকোচুরি খেলার জন্যে ওভাবে কেউ ওত পাতে না ঝোপের ভেতর।ডুসিলা যেন অবিকল পুতুলটি। ছোট্ট, কৃশকায়, ঢলঢলে। ওর পরনের কাপড় ছেঁড়া, তবু আপাতত ওটাতেই চালাতে হবে। এখানকার ঝামেলা ঢুকলে সিলভারটন বা ডেল নর্তে গিয়ে কিনে আনবো কয়েক প্রস্থ।ওর চেহারাতেও ফিরে এসেছে সজীবতা, চুল আঁচড়ে চমৎকার পনিটেল বেঁধেছে। ফ্যাশন বইয়ের মলাটে এ-রকম মেয়ের ছবি দেখেছি আমি। সত্যিই, আবারও স্বীকার করলাম আপনমনে, ও সুন্দরী।’আসি, দেখা হবে,’ বলে উঠে দাঁড়ালাম। ‘সাবধানে থেকো।’ক্ষণিকের তরে একবার মনে হলো কথা বলি, কিন্তু কী বলব? আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছে ও, কথা বলতে চাইছে না, একবুক জ্বালা নিয়ে সরে এলাম। বনের প্রান্তে গিয়ে আকাশ পানে তাকালাম আমি, সবে দু-তিনটে তারা ফুটেছে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম একটা, মানুষ কত বোকাই না হয়।মেয়েটার আছেই-বা কী? রূপ-যৌবন, আর মাথাভর্তি লাল চুল…এই তুচ্ছ কারণে এত মন খারাপের কী আছে?আমার চিন্তাভাবনা সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে, ইচ্ছে করছে শহরে গিয়ে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেই। তবে এতে আমার জেতার সম্ভাবনা ক্ষীণ, অথচ জিততে আমাকে হবেই। জো বিশ্বস্ত লোক, কিন্তু বন্দুকবাজ নয়। এখন যদি ও’নীল আসতো।জানি, তা হবার নয়। বহুদূরে আছে ও’নীল, কয়েকদিনের পথ। সব কিছু এখন আমার একার ওপর নির্ভর করছে। কারও সাহায্য পেলে কী হত না হত ভেবে লাভ নেই, তার চেয়ে কাজটা এককভাবে করার পরিকল্পনা আঁটাই বরং বুদ্ধিমানের লক্ষণ।দড়িটা গুটিয়ে নিয়ে আমি স্যাডলে চাপলাম। ‘জো,’ বললাম রাগারকে, ‘তমি সতর্ক থেকো। ওরা আসতে পারে। সম্ভব হলে আমিও চলে আসব সঙ্গে সঙ্গে তবে যতক্ষণ না আসছি, ঠেকিয়ে রেখো।’আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ড্রসিলা, ওর মুখ আমি দেখতে পাচ্ছি না। কেবল যাবার সময় একটা হাত তুললাম ওকে লক্ষ্য করে। ‘দেখা হবে,’ বলে ধীরে ধীরে ঢাল বেয়ে ঝরনাবক্ষে নামলাম।হিমেল আবহাওয়া। বাতাস নেই। আনত মেঘে আঁকাশ কালো। পাইনের মিষ্টি সুবাস ভেসে আসছে: ধোঁয়া, রান্নার গন্ধে বুকের ব্যথাটা আবার মাথাচাড়া দিল। শহরের উপকণ্ঠে পৌছে রাশ টানলাম আমি, নেমে ঝরনার ধারে অ্যাপালুসাটা বাঁধলাম উইলো ঝোপের সাথে। হাত রাখলাম ওর কাঁধে।’অপেক্ষা কর, বেটা। দেরি করব না।’

পৃষ্ঠা -৫২

মুখে বললাম বটে, কিন্তু কথাটা কতটুকু সত্যি তা আমি নিজেও জানি না।ওদেরকে বাগে পেলে হয়তো কাজটা সহজ হয়ে যাবে আবার এর উলটোটি ঘটাও অসম্ভব নয়। ড্রসিলা আমার কোনও সাহায্যে আসছে না, কিচকে মেরেছি বলে ও আমার ওপর অসন্তুষ্ট।আমাদের সম্পর্ক আবার জোড়া লাগবে, এটা নিশ্চয় বলা যায় না। জুসিলা সুন্দরী, মনের মত জীবনসঙ্গী পেতে অসুবিধে হবে না তার। আমার চেহারা সুন্দর, এক মা ছাড়া কেউই বলেনি আজতক। তাও সেটা বলবার সময় মায়ের মুখেও সন্দেহের ছাপ ফুটে উঠত।আমি রোগা-পটকা, তালপাতার সেপাই বলা চলে। কেবল দুটো কাজ জানি: ট্র্যাক চেনা এবং গুলি ছোঁড়া। এ ছাড়া আমার একমাত্র সম্বল আমার পেশীবহুল কাঁধ, অনায়াসে প্রচুর ভার সইতে পারি।পড়াশুনোর কথা মনে হলে আগে আমার গায়ে জ্বর আসত। ব্ল‍্যাকস্টোনের বইটা তো রীতিমত ভাবিয়ে তুলেছিল। কুকুর যেমন হাড় ভেঙে মজ্জা খাওয়ার লোভে দিশেহারা হয়ে ওঠে, তেমনি। আমার ভাবনাজগতে এক অভূতপূর্ব আলোড়ন, সৃষ্টি করেছে বইটি।ভদ্রলোক অনেক মূল্যবান কথা বলেছেন, জীবনের একটা অর্থ খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর বক্তব্যে। কোনমতে যদি লেখাপড়াটা শিখতে পারি… অ্যানজেলের মত উকিল হব না, তবে…এখন ওসব স্বপ্ন দেখার সময় নয়। সন্তর্পণে এগিয়ে গেলাম শহরের দিকে। হাতে দড়ি, রাইফেল। মোকাসিন পায়ে নিঃসাড়ে চলাফেরা করছি। বড় তাঁবুর চারটে গাই রোপে দড়িটা পেঁচিয়ে, সংলগ্ন আরও দুটো ছোট তাঁবুতে জড়িয়ে ফেললাম আষ্টেপৃষ্ঠে। তারপর ফিরে এলাম ঘোড়ার কাছে, দড়ির মাথা পমেলের সাথে বেঁধে স্যাডলে চাপলাম।শহরটা যেন ঘুমিয়ে আছে। শুধু মাঝে মাঝে ভেসে আসছে হালকা কথাবার্তা, গ্লাসের টুংটাং আর তাস ফেটার আওয়াজ। মনে হলো এদের ভয় না পেলেও চলবে।দালানের পাশে ঘোড়াটা নিয়ে গেলাম আমি, স্যাডলের ওপর দাঁড়িয়ে উঠে পড়লাম ছাতে। পরনের শার্ট খুলে চিমনির ভেতরে ঢুকিয়ে দিলাম, তারপর সাবধানে পিছিয়ে এলাম কারনিসের কাছে। আবার যখন স্যাডল স্পর্শ করলাম, নরক ভেঙে পড়েছে ভেতরে। ধোঁয়ায় ভরে গেছে ঘর, চেঁচামেচি জুড়ে দিয়েছে লোকজন, কাশছে-খকখক করে।ঘুরে দাঁড়ালাম আমি, দড়ি চেপে ধরলাম শক্ত করে, কোম্যাঞ্চে ঢঙে পিলে-কাঁপানো চিৎকার দিলাম একটা, তারপর অ্যাপালুসার পেটে স্পারের খোঁচা দিলাম।চমকে উঠল ঘোড়াটা, সন্ত্রস্ত খরগোশের মত ছুটতে শুরু করল। হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল তাঁবুগুলো। পরমুহূর্তে আবার তেড়ে গেলাম, খুরের শব্দ পেয়ে

পৃষ্ঠা -৫৩

একদল লোক বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছিল তাঁবু থেকে, দড়িদড়ায় হোঁচট খেয়ে ফের লুটিয়ে পড়ল।ছেড়ে দিলাম দড়িটা, স্যাডল থেকে ঝুঁকে একটা তাঁবুর খুঁটি তুলে নিলাম। তারপর ওটা দিয়ে এলোপাতাড়ি আঘাত করলাম ওদের মাথায়।মুদিখানার বারান্দায় একজন লোক দাঁড়িয়েছিল, হোলস্টারে হাত বাড়াল সে। খুঁটিটা ওর মুখ বরাবর ছুঁড়ে দিয়ে বললাম, ‘ধরো।’লাফিয়ে ‘সরে যাবার চেষ্টা করল দোকানি, চৌকাঠে বেধে পড়ে গেল অর্ধেক ভেতরে, বাকিটা বারান্দায়।অন্ধকারে গা ঢাকা দিলাম আমি। ঢের তামাশা হয়েছে। ছোট দুটো তাঁবু ভেঙে গেছে, হুলস্থুল চলছে তলায়। বড় তাঁবুটা কাত হয়ে পড়েছে এক পাশে। ঝগড়া হচ্ছে ওখানে, একজন ধমকে উঠল, ‘না, আমার দান! টাকা রাখো!’ একটা গুলি হলো।বাবার উপদেশ মনে পড়ল আমার, পরিস্থিতি বিচার করতে বসলাম। কৌতুকের দৃষ্টিতে দেখছি ওদের কাণ্ডকারখানা।তুমুল বচসা শুরু হয়েছে ওদের মাঝে, বাপ-মা তুলে গালি দিচ্ছে একে অন্যকে। কারও মধ্যে এতটুকু ধৈর্যের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে না।বেশি টানাহেঁচড়ায় একটা তাঁবু মাটিতে সমান হয়ে গেল। ভাবলাম ওদের আলো দরকার, বাইরের আগুন থেকে একটা জ্বলন্ত খড়ি নিয়ে ছুঁড়ে দিলাম ওই তাঁবুর দিকে।আমাকে দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল একজন। চকিতে ঘুরেই সরে গেলাম ওখান থেকে। পেছনে শটগানের ভোঁতা আওয়াজ উঠল একটা। তারপর দাউদাউ করে জ্বলে উঠল তাঁবু, আরেকটু পিছাতে বাধ্য হলাম আমি।বিনা খাজনায় আমার শহরে ওরা তালুক গাড়তে চেয়েছিল। আমার বন্ধুকে গুলি করেছে, মারতে চেষ্টা করেছে আমাকে।বালিয়াড়ির কিনারে কোরাল। দড়ি পেঁচিয়ে টান দিলাম খুঁটি ধরে, লুটিয়ে পড়ল। দুড়দাড় শব্দে ছুটে পালাল ওদের ঘোড়াগুলো।এতক্ষণে কিছুটা শান্ত হলো আমার মন। সত্যি, মানুষের বিধ্বংসী ক্ষমতা অবহেলার মত নয়, সঙ্কল্প করলে সে একাই বহু কিছু গুঁড়িয়ে দিতে পারে যেমন আমি দিলাম।আংটার মত করে এক পায়ে আঁকড়ে ধরলাম স্যাডলহর্ন, অ্যাপালুসার কানের কাছে মুখ নামিয়ে সাবধান থাকতে বললাম ওকে, আদর জানালাম ঘাড়ে হাত বুলিয়ে, তারপর আকাশের দিকে তাকালাম।গান ধরলাম আমি। ‘হোয়েন আই ওঅকড আউট অন দ্য স্ট্রীটস অভ ল্যারেডো, হোয়েন আই’ কান ঘেঁষে শিস কেটে বেরিয়ে গেল একটা বুলেট। জোর কদমে ঘোড়া ছোটালাম। গানটা বোধ হয় পছন্দ হচ্ছে না কারও।

পৃষ্ঠা -৫৪

এগারো

মেঘের কোলে হালকা কমলা রঙের ছোঁয়া। কম্বলের তলা থেকে বেরিয়ে এলাম আমি। জো রাগার খুঁচিয়ে উসকে দিয়েছে আগুন। কফির পানি চড়িয়েছে।বুটজোড়া গলিয়ে নিলাম পায়ে, গান বেল্ট বেঁধে উঠে দাঁড়ালাম। গোলমালের আশঙ্কায় একরকম ধড়াচূড়া পরেই শুয়েছিলাম রাতে, পিস্তল ছিল শিথানের কাছে।ভেস্ট চাপিয়ে আরেকটা পিস্তল গুঁজলাম বেল্টের পেছনে। তারপর হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেলাম বনের কিনারে। ও, হ্যাঁ, হ্যাটও চাপিয়েছি মাথায় ভোরে বিছানা ছাড়ার পর একজন কাউবয়ের ওটাই প্রথম কাজ।ওরা সম্ভবত শহর থেকে তল্পিতল্পা গুটাচ্ছে।ড্রসিলা উঠে পড়েছে, সাত-সকালে কেশবিন্যাস সারা, ঝিকমিক করছে সূর্যকিরণে। আমাকে কফি এনে দিল।’শান্তি হয়েছে?’ বলল ও।’থ্যাংক ইউ, ম্যাম… শাস্তি? ম্, শান্তি কী এত সহজে আসে, অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। তবে যদি কাল রাতের কথা বলো হ্যাঁ, হয়েছে শান্তি।”আমি তোমাকে ভাল জানতাম।”শুনে সুখী হলাম – যদিও জানি না কোন ধরনের লোককে ভাল বলে। আমার কাছে এর সংজ্ঞা আলাদা প্রয়োজনের সময় যার ওপর নির্ভর করা যায় তাকেই ভাল বলি আমি।”মানুষ খুন করে সুখ পাও?”একটুও না, অন্তত পেশা হিসেবে। কিন্তু বিপদে জড়িয়ে পড়লে ভিন্ন কথা। এখানে শেরিফ নেই যে তার দরজায় যাব, অতএব নিজের বিচারবুদ্ধির ওপর নির্ভর করতে হয়।’অন্যের সুবিধে-অসুবিধের কথা যারা ভাবে না, নিজের খেয়াল-খুশিমত চলে তাদেরকে আমি একটুও পছন্দ করি না।’যারা যুক্তি মানে, তাদের সাথে আপসের কথা বলা যায়। কিন্তু যারা গায়ের জোর ছাড়া কিছুই বোঝে না তাদের সঙ্গে তর্ক করে কী লাভ? -‘জো রাগারের কথাই ধরো সৎ, বিবেচক। ক্যাপ সয়‍্যারও তাই। ওরা একটা কিছু গড়ার চেষ্টা করছে। আর অন্যেরা সেটা থেকে ফায়দা লোটার মতলবে আছে। এ-অবস্থায় আমি হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকব?”তাই বলে তুমি নিজের হাতে আইন তুলে নিতে পারো না।’ ‘পারি, ড্র, পারি। আমি যে-নিয়মে চলি, শত শত বছর ধরে মানুষ তা মেনে

পৃষ্ঠা -৫৫

আসছে। এ-ব্যাপারে পড়াশুনো করেছি আমি। মানুষ যখন কোনও সমাজে বাস করে, তখন কিছু সামাজিক বিধি নিষেধ মানতে হয় তাকে। ওইসব নিয়ম অমান্য করলে তার বিচার হয় আর যদি বারবার ভঙ্গ করে, তা হলে সে আউট-ল হয়ে যায়।’এখানে আইনকানুন বলতে কিছু নেই, নিজের শুভবুদ্ধিই মানুষের একমাত্র ভরসা। ফলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে তার অস্ত্র তাকে ব্যবহার করতে হয়।’জো রাগারকে দেখো। কিছু বাজে লোকের সঙ্গে এখানে এসেছিল সে। পরে আমাদের ঘোর দুর্দিনে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ও জানে, এ- জন্যে ওর মৃত্যুও হতে পারে।’আমি লেখাপড়া জানি না, সে-ঘাটতি পোষানোর চেষ্টা করছি। বইপত্র পড়ছি ইদানীং। মানুষ যখন থেকে এক সাথে বাস করতে আরম্ভ করেছে, তখন থেকেই সে অন্যের সুখ-দুঃখের ভাগীদার হয়েছে।’আমরা চাই এটা শান্তির শহর হোক। মেয়েরা যেন নিরাপদে বাজারে যেতে পারে, বাচ্চাদের নিশ্চিন্ত মনে স্কুলে পাঠাতে পারে অভিভাবকেরা। কিন্তু ওরা কী করছিল জানো? ওরা সেটা নষ্ট করতে চাইছিল।”এভাবে ভাবিনি আমি,’ বলল ড্রসিলা। এ-বার আমার মেজাজ সপ্তমে চড়ে গেল।’জানি, কেউই ভাবে না, ক্ষোভের সাথে বললাম আমি। ‘মানুষ একটিবার চিন্তা করে দেখে না, তারা আজ যে শান্তিপূর্ণ সমাজে বাস করছে, সেটা গড়তে গিয়ে প্রথমে যারা এসেছিল তাদের কত কষ্ট করতে হয়েছে। ‘তবে এই তোমাকে স্পষ্ট বলে রাখছি, ওই শহরে স্কুল, চার্চ, হাসপাতাল হবে। আমেরিকার ফ্ল্যাগ উড়বে ওখানে। এ-জন্যে যদি আমাকে রক্তের নদীতে গোসল করতে হয় করব।’ -আমার মনোভাব বোধ হয় পছন্দ হলো না ওর। আড়ষ্টভাবে সরে গেল, বুঝলাম বেফাঁস কথা বলে ফেলেছি। কফির স্বাদ তেতো ঠেকল মুখে। কোনমতে শেষ করলাম। একটুবাদে জো বেরিয়ে এসে পাহারার দায়িত্ব নিল, ভেতরে গিয়ে আটারুটি আর ভেনিসন সহযোগে নাস্তা খেতে বসলাম আমি।ক্যাপের অবস্থা উন্নতির দিকে। চোখজোড়া উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, পাণ্ডুর মুখে অনেকটা রঙ ফিরে এসেছে।’হ্যালো, ক্যাপ,’ বললাম আমি। ‘জানতাম, এত সহজে মরবে না তুমি। যখন মরবে, সঙ্গে দু-চারটেকে নিয়েই মরবে। ঢের আরাম করেছ, এ-বার ওঠো জো আর আমি হাঁফিয়ে উঠেছি তোমাকে ছাড়া।’ স্বর্গীয় হাসিতে উদ্ভাসিত হলো ক্যাপের চেহারা। ‘কেমন বুঝছ অবস্থা?’ ‘ভালই। মনে হচ্ছে এখন সোজা: আঙুলে ঘি উঠবে। আমি শহরে যাচ্ছি ওদের সাথে কথা বলতে। এই ফাঁকে আরেকটু দাওয়াই দেব।’

পৃষ্ঠা -৫৬

‘হুঁশিয়ার।”আমি সব সময়ে হুঁশিয়ার, ক্যাপ,’ বললাম, ‘যখন পালানোর দরকার মনে করি ঠিকই পালাই। এখন যাচ্ছি সামনাসামনি বোঝাপড়া করতে।”ইস, আমি যদি যেতে পারতাম…”থাক, তোমাকে আর বাহাদুরি করতে হবে না, যা করেছ এই ঢের। তা ছাড়া ওরাও যুক্তি মানবে বলে মনে হয়। আমার প্রস্তাবে রাজি হলে ভাল’ শ্রাগ করলাম, অসম্পূর্ণ রাখলাম কথা।ক্যাপ যা বোঝার বুঝে গেল। জিজ্ঞেস করল, ‘কতজন?”বেশি না, জনাচল্লিশেক হবে।’রাইফেলটা স্যাডলের ওপর আড়াআড়িভাবে রেখে, শহরে গেলাম। ওরা দেখতে পেয়েছিল আমি আসছি, কিন্তু কোনও চাঞ্চল্য প্রকাশ করল না। আমিও নির্লিপ্ত চেহারায় ওদের মুখোমুখি হলাম। মাত্র একজনকে চিনতে পারলাম কুমড়ো, কিচের সঙ্গে এসেছিল আমাদের ক্যাম্পে। খুরের শব্দ পেয়ে অ্যাব ওয়ারেন বেবিয়ে এল। পিস্তল ঝোলায়নি।’এই শহর আমাদের, শুরু করলাম আমি। ‘তোমরা এখানে অন্যায়ভাবে ঢুকেছ। আমাদের কাঠ চুরি করেছ, ক্যাপ এবং আমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছ। কাল রাতে নিশ্চয়ই কিছুটা টের পেয়েছ এর পরিণাম কী। আমি এখন এসেছি ফয়সালা করতে।’কিচের কাছে শুনে থাকবে, ক্যাপ এখানকার মেয়র যেহেতু ক্যাপ অসুস্থ, দুটো দায়িত্বই পালন করছি আমি। তোমাদেরকে ভদ্রলোকের মত থাকতে হবে। এতে যদি এক্ষুণি ভাগো। পরে কিন্তু আর মুখে কথা হবে না সব কিছু। আমি টাউন মার্শাল। এখানে থাকতে হলে কারও আপত্তি থাকে, আমার সিক্স-শূটারই করবে ‘আর ওই ঘর ছেড়ে দিতে হবে,’ ইঙ্গিতে দেখালাম দোকানটা, ‘ওখানে মুদিখানা হবে জো রাগার লিজ নিয়েছে ওটা।’মুখ খুলল কুমড়ো। ‘ওটা আমার, আমি বানিয়েছি।”কাঠ পেলে কোথায়?’আমতা আমতা করল সে, তারপর ফাটল। ‘তাতে কী? আমরা পড়ে পেয়েছি নিয়েছি-”ওগুলো আমাদের,’ কেড়ে নিলাম কুমড়োর মুখের কথা। ‘ওর দাম একহাজার ডলার। হয় চুকিয়ে দাও, নয়তো ভাগো।”আমিও ছাড়ব না পাই পাই করে শোধ তুলব!”দশ মিনিট সময় দিলাম তোমাকে, এর মধ্যে না গেলে ছুঁড়ে ফেলে দেব।’ এ-বার অন্যদের দিকে তাকালাম, এমন ভাব করলাম যেন কুমড়ো নেই ওখানে। সবাই কাঠখোট্টা কঠিন চেহারার মানুষ, তবে কিছু নিরীহ মুখ চোখে পড়ল।

পৃষ্ঠা -৫৭

‘আমাদের একটা স্যালুন লাগবে এখানে হোটেল, রেস্তোরাঁও চাই। তোমাদের কারও ইচ্ছে থাকলে বলো, আমরা সহযোগিতা করব।’নিঃসন্দেহে কুমড়োই ওদের নেতা। রেগে টং হয়ে গেছে সে, কিন্তু নিশ্চিত বুঝতে পারছে না কজন তার পাশে এসে দাঁড়াবে। ইতিমধ্যে কয়েকজন সটকে পড়েছে। কিচ ও তার সঙ্গী নিহত। অ্যাব ওয়ারেনের মুখে ঘটনাটা শুনেছে ওরা।হঠাৎ একজন হৃষ্টপুষ্ট লোক ভিড় ঠেলে এগিয়ে এল সামনে, মুখের দাড়ি- গোঁফের জঙ্গল। ‘আমি আগে বাবুর্চির কাজ করেছি। রেস্তোরাঁটা আমাকে দাও।’ ‘বেশ, দাড়ি ছেঁটে সাফ-সুতরো হও। একমাস সময় পাবে তুমি, এর মধ্যে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারলে ভাল, নইলে আমরা অন্য লোক দেখব।’এরপর মুখ খুলল এক ছোকরা। কৃশকায়, ফ্যাকাসে চেহারা, দেখে মনে হয় অল্পদিন হলো পশ্চিমে এসেছে। ‘আমি হোটেল ম্যানেজার ছিলাম পুবে, স্যালুনও চালাতে পারব।”ঠিক আছে।’ বাঁ-হাতে আমার শার্টের বুক পকেট থেকে একটা কাগজ বের করলাম। ‘প্ল্যান-প্রোগ্রাম সব লেখা আছে এতে। তোমরা দুজন পড়ে জায়গা পছন্দ করো। তারপর কাজে হাত দেবে। লটারিতে ঠিক হবে কে আগে বানাবে। অপরজন সাহায্য করবে তাকে।’এ-বার ফের কুমড়োর প্রতি মনোযোগ দিলাম। তাকালাম ওর দিকে। নিচু স্বরে ওর সাথে কথা বলছে একজন। শুনতে পেলাম কুমড়োকে সে বুচার বলে ডাকছে।’বুচার,’ ডাকলাম ওকে, ‘আর তিন মিনিট সময় আছে তোমার হাতে।’দ্যাখো, ভাল হবে না বলে’ ‘আমার ঘোড়া সোজা এগিয়ে গেল ওর দিকে। ‘একজন অসহায় বৃদ্ধকে তুমি আক্রমণ করেছিলে। তোমার লাভের জন্যে তুমি পারো না এমন কাজ নেই। তোমার মত লোকেরা সমাজের কোনও উপকারে আসে না।’আরেক কদম আগে বাড়ালাম ঘোড়াটা, দোকানের বারান্দায় উঠে পড়ল কসাই। সিঁড়ির গোড়া অবধি ওকে ধাওয়া করল অ্যাপালুসা। ‘ফিরে আসব আমি,’ ঘেউ ঘেউ করে উঠল বুচার। বিগলোরা এখনও সিলভারটনেই আছে।”এসো, তোমার জন্যেও একটা জায়গা রাখব আমরা,’ বললাম, ‘কিচের পাশেই।’অ্যাব ওয়ারেন রয়ে গেল। সকালেই বুচার চলে গেল শহর ছেড়ে, আরও পনেরোজন ওর সঙ্গী হলো। ন্যায়ের পথে কেউ থাকলে তাকে রোখার সাধ্য নেই কারও। কথাটা এক টেক্সাস রেঞ্জারের। আমার বন্ধু ছিল সে: ছিল বলছি এই জন্যে যে, আজ আর ও নেই এক অপারেশনে নিহত হয়েছে। জীবনে অনেক ভুল করেছি আমি, কিন্তু এ-বার ঠিক পথে আছি। আমাকে আমল না দিয়ে ওদের উপায় নেই। মারতে

পৃষ্ঠা -৫৮

চেষ্টা করবে, তবে সেটা সহজ হবে না আমার প্রাণ খুব শক্ত। সেই থেকে শুরু হলো লোক আসা। দ্বিতীয় হপ্তায় একজন অশ্বারোহী এল,তারপর দুটো ওয়াগন। ক্রীক-সংলগ্ন জায়গার দখল নেয়া হয়ে গেছে। প্রায় তিরিশটা ভেড়া নিয়ে এসেছে একজন, পাহাড়ের ধারে চরছে ওগুলো। জো রাগার দোকান খুলেছে, অ্যালিসন তার হোটেল। পরিত্যক্ত বড় তাঁবুটাই এখন হোটেল। এর আগে ওটা ছিল জুয়ার আড্ডা। ব্রিগসের রেস্তোরাঁ ভালই চলছে। সস্তা সাধারণ খাবার, তবে স্বাদু। গরুর মাংস আর মটরশুঁটি তো আছেই, পাশাপাশি ভালুকের মাংস, ভেনিসন আর এলক পাওয়া যায়।এ-পর্যন্ত বিগলোদের দেখা পাইনি আমরা, তবে নানান উড়ো খবর কানে আসছে। টম ও ইরার কথাই শুনছি বেশি। সিলভারটনে একটা স্টেজ লুটের ব্যাপারে ওদের সন্দেহ করা হচ্ছে। ডেনভার সিটিতে একজনকে খুন করেছে টম। লিডডিলে দাঙ্গা হয়েছে, তাতে অংশ নিয়েছিল। ইরা জুয়াড়ি, সিলভারটন এবং আশপাশের ধনী ক্যাম্পগুলোতে তাস খেলে সময় কাটায়।আমাকে খতম করবে বলে বড়াই করে বেড়াচ্ছে ওরা। একটু ফুরসত পেলেই নাকি ঠিকানা লাগিয়ে দেবে। আমার একটাই প্রার্থনা, সে-ফুরসত যেন ওদের জীবনে না আসে।এর মাঝে দুবার পাহাড়ে গেছি, ফিরেছি সোনা নিয়ে… শেষযাত্রায় দুটো খচ্চরবোঝাই।এসতেবান মেনডোযা আর টিনা এখানে চলে এসেছে। শহরে কেবিন বানিয়েছে একটা, পাহাড়ের লাগোয়া। সাপ্লাইয়ের কাজ ধরেছে এসতেবান, দুটো ওয়াগনে করে সিলভারটন রোডে মাল আনা-নেয়া করে।আমাদের ক্যাম্প থেকে শহরে, নিজের বাসায় উঠে গেছে ড্রসিলা কেরি। জো রাগারের দোকানে চাকরি করে ও। পোস্ট অফিস এবং ওয়েলস ফার্গো এক্সপ্রেসের কাজকর্ম একই সঙ্গে চলে ওখানে। কিচ আর তার সঙ্গীকে আমি খুন করার পর থেকে ড্রসিলা সেই যে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে, এখনও সহজ হতে পারেনি আমার সঙ্গে।ক্যাপ পুরোপুরি সেরে ওঠেনি, আস্তে আস্তে হাঁটাচলা করে। তাই এ- দিককার সব কিছু আমি একাই সারছি।সন্ধ্যেয় হাতের কাছে কোনও খবরকাগজ পেলে পড়ি। ব্ল‍্যাকস্টোন শেষের পথে। মাঝে-মধ্যে আমাদের ক্যাম্পে মুসাফির আসে, দু-চারদিন থেকে ফের চলে যায়। ওদের অনেকের সঙ্গে বই থাকে, আমি সেগুলো চেয়ে নিয়ে পড়ি। তবে আমার অধিকাংশ সময় কাটে কাজে।ঢালের ওপর দিকে আমাদের জন্যে তিন-কামরার বাড়ি বানিয়েছি। এর ঠিক পেছনেই পাহাড়ে ওঠার ট্রেইল, পাশে ঝরনা। শীত আসছে। আস্তাবলটা মজবুত করেছি আরও। কয়েক টন খড় কেটে এনেছি মাঠ থেকে। কোনও কোনও চূড়ায় তুষার জমতে শুরু করেছে, ইতিমধ্যে ভোরে কুয়াশা

পৃষ্ঠা -৫৯

পড়ছে, গামলার পানিতে বরফ ভাসতে দেখলাম একদিন।পুরোনো ব্যারিকেডটা তেমনি আছে, মেসার ঝোপঝাড় ছেঁটে ছোট করে রাখছি। চমৎকার ঘাস হচ্ছে ওখানে, আমাদের গবাদিপশু চরতে পারবে।শহরে আমার পরিচিত লোকের সংখ্যা বেশি নয়। ক্যাপের অবর্তমানে মেয়রের দায়িত্বে আছে জো রাগার। অ্যালিসন আর ব্রিগস বিশ্বস্ত লোক। বুচার ফিরে এসেছে, ছোটখাটো জুয়ার আড্ডা খুলেছে। প্রায় দুশো লোকের বাস শহরে। আশা করছি আরও বাড়বে।রঙ বদলাতে শুরু করেছে অ্যাসপেন, হলুদ হচ্ছে… মোটে কমাস হলো এসেছি, অথচ মনে হয় যেন কতকাল ধরে আমি আছি এখানে।এর মাঝে সামান্য গোলমাল দেখা দিয়েছিল। বুচারের আড্ডায় দুজন জুয়াড়ি পরস্পরকে খুন করেছে। পোকার টেবিলে ওদের বচসার উৎপত্তি। এক রাতে ক্যাপ এসে বসল আমার পাশে। ‘এভাবে বই পড়লে,’ বলল সে, ‘তোমার চোখ যাবে।”কী করব, ক্যাপ, লেখাপড়া শিখতে হবে।’, দেখছি, তোমার ওই ভাইদের পথ ধরেছ। ওরাও বই পাগলা।”তুমি ‘কেন ওরা তো নিজেদের অবস্থা যথেষ্ট ফিরিয়েছে।”এবং বিয়ে করেছে।’কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম আমি, তারপর মৃদু সুরে বললাম, ‘বিয়েতে দুজন মানুষ লাগে, ক্যাপ।”ডুসিলার কাছে গেছ ইদানীং?”জানোই তো যাইনি।”মেয়েটা সুন্দরী। এভাবে একা পড়ে থাকবে না বেশি দিন। শুনছি ইরা বিগলোর নজর পড়েছে ওর ওপর।”বিগলো? এসেছে ও?”দিনকয়েক আগে তুমি তখন পাহাড়ে। ঘণ্টাখানেক ছিল, তবে ওর মধ্যেই মোলাকাত করেছে ড্রসিলার সঙ্গে। ইরা বেশ সুদর্শন।’নীতিশাস্ত্র পড়ে বরফ বিশেষ কাটেনি, ভেতরে ভেতরে হিংসেয় জ্বলে-পুড়ে খাক হলাম। ডুসিলার পাশে বিগলোদের কেউ… দৃশ্যটা ভাবতেই বুড়ো ভালুকের মত নীচতা জাগল আমার মাঝে।সন্ধ্যেয় বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে আমি শহরের বাতি দেখি, তবে হরদম যাই না ওখানে। আবার পাহাড়ে যাবার সময় ঘনিয়ে এসেছে, চলতি মৌসুমে এটাই হবে শেষ যাত্রা। তুষারপাতের আগে আরও কিছু সোনা আনতে চাই। নতুন পথের হদিস মেলায় ঘোরা পথে যেতে হচ্ছে না, ফলে আমার সাফল্যের সম্ভাবনা পনেরো আনা। ‘কাল খনিতে যাব,’ বললাম ক্যাপকে। এক মুহূর্ত দাঁড়ালাম ওখানে। ‘জানো, ড্রসিলারও একটা অংশ পাওয়া উচিত। ওই খনি খুঁজতে গিয়েই ওর।

পৃষ্ঠা -৬০

দাদুর মৃত্যু হয়েছে। একটা ম্যাপ ছিল তাঁর কাছে। আমার ধারণা, খনিতে যে- বর্মটা পেয়েছিলাম, সেটা ওদেরই কোনও পূর্বপুরুষের হবে।”আমারও তাই মনে হচ্ছিল। দেখছিলাম, তুমি নিজে থেকেই বলো কি না আমার হ্যাট তুলে নিয়ে বললাম, ‘যাই, ওর সাথে আলাপ করে আসি।’ ‘হ্যাঁ, যাও,’ বলল ক্যাপ। ।’এমনিতেও যেতাম আমার নতুন জামাকাপড় কেনা দরকার।রওনা হব, হঠাৎ থমকে গেলাম। এসতেবান মেনডোযা দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে।’সিনর, ওরিন? জরুরি কথা আছে।’ঘরে ঢুকল সে। ‘কাজ সেরে সন্ধ্যের পর ওয়াগনে বসে আরাম করছিলাম আমি। হঠাৎ কিছু লোকের কথাবার্তা কানে এল। ওরা বলছিল, তোমার কাছে নাকি সোনা আছে। এই পাহাড়েই কোথাও হবে খনিটা।”কে? তোমাকে দেখতে পেয়েছে?”না, অন্ধকার ছিল। একজনের নাম টুথহিল… ওরা ওকে বেশ সম্মান করছিল। আরেকজন বয়েড।’ক্যাপ তাকাল আমার পানে। ‘সুদূর লাস ভেগাস থেকে!”অন্যরা?’কাঁধ ঝাঁকাল এসতেবান। ‘চিনি না। তবে তুমি আবার পাহাড়ে গেলে ওরা বোধ হয় পিছু নেবে।”থ্যাংকস, এসতেবান।’ও বিদায় নিল, ভাবতে বসলাম আমি। আরেকবার ওখানে যাওয়া খুবই জরুরি। শুধু যে বাথান কিনব বলে যতটা সম্ভব সোনা সরিয়ে ফেলতে চাইছি, তা নয়; খনিতে আমি যথেষ্ট পরিশ্রম করেছি, সহজে মাল বের করবার জন্যে ট্র্যাক পেতেছি। এখন আর কেউ ওটার সন্ধান পেলে, খাটুনিটুকু যাতে পুষিয়ে যায়, সে-ব্যবস্থা অন্তত করা দরকার। বুঝতে পারছি এই যাত্রায় ঝুঁকি আছে, তবু আমাকে সেটা নিতে হবে।ক্যাপের শরীর মোটামুটি, এসতেবান মাঝে মাঝে এসে খোঁজখবর নেবে। নিজেকে সামলাবার মত শক্তি ফিরে পেয়েছে ক্যাপ, তা ছাড়া শহরে ওর বন্ধুবান্ধব আছে।’ড্রসিলাকে দেখতে গেলে না?’ তাড়া দিল ক্যাপ। ‘রাত বাড়ছে।’ স্যাডলে চেপে রওনা হলাম শহরের উদ্দেশ্যে। ঝলমল করছে বাতিগুলো, আমার মনে শিহরণের ছোঁয়া।ভুসিলা…সহসা, ঝোপের ভেতর একটা ছায়া নড়ে উঠল, পাশ কাটানোর আগে এক মুহূর্ত দাঁড়ালাম আমি। একটা লোক, নজর রাখছে আমাদের ক্যাম্পের ওপর।এসতেবান মেনডোযার অনুমান নির্ভুল।

পৃষ্ঠা ৬১ থেকে ৭০

পৃষ্ঠা -৬১

বারো

রাত, তবু দোকানে বেশ ভিড়। হাত নেড়ে অভিবাদন জানাল জো। আরেকটা কাউন্টারে ড্রসিলা দাঁড়িয়ে। এক ঝলক তাকালাম সে-দিকে, নির্বিকার চেহারা,আমাকে দেখেছে কিনা বুঝলাম না। অধিকাংশ খদ্দের নতুন, কেবল দুটো পরিচিত মুখ চোখে পড়ল। ‘মি. ওসমান না?’টুথহিল ওরফে ঝাঁটা-গোঁফ। লোকটার যেমন অন্তর, তেমনি ওর চেহারা। তবে থাকে ফিটফাট, দামী পোশাক-পরিচ্ছদ।’কেমন আছ?’ জিজ্ঞেস করলাম। ‘এখানে যে? ব্যাংকের কী খবর?’ ‘ভাল।’আড়চোখে তাকালাম ড্রসিলার দিকে, হাত খালি, এগিয়ে গেলাম। ‘ড্রসিলা,’ বললাম, ‘আমার কিছু জামা কাপড় দরকার।’ক্ষণিকের জন্যে আমাদের চারচোখ এক হলো। ‘দিচ্ছি।’ফরমাশ দিলাম ওকে, অনুভব করছি অনতিদূরে-দাঁড়ানো টুথহিলের দৃষ্টি সেঁটে আছে আমাদের ওপর। গোটাচারেক শার্ট, জিনস, মোজা, এবং একটা শীপস্কিন কোট নিয়ে এল ড্রসিলা।’…আর দুবাক্স ৪৪ কার্তুজ, বললাম আমি।ঝট করে চোখ তুলল সে, ঈষৎ কঠিন হলো চেহারা। তারপর ঘুরে, অ্যামুনিশন শেলফ থেকে দুটো বাক্স এনে রাখল কাউনটারে। ‘ড্রসিলা,’ বললাম আমি, ‘তোমার সাথে কথা ছিল।”আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ বলে তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ,’ বলল ও, ‘এ ছাড়া আর-”ব্লু, ওই সোনাতে তোমার ভাগ আছে। তোমার দাদু খুঁজছিলেন ওটা, সম্ভবত তাঁর কোনও পূর্বপুরুষ প্রথম ওই খনির হদিস পেয়েছিলেন। সুতরাং, একটা ভাগ তুমি পাবে।”যা ভাল বোঝো তুমি। এত কথার কী দরকার।’ দাম নিয়ে আমাকে খুচরো ফেরত দিল ও।’ড্র,’ বললাম আবার, ‘ওদেরকে গুলি না করে আমার উপায় ছিল না।’ ‘তাই? তুমি একটা নিষ্ঠুর, অথচ আমি কত কিছুই না ভেবেছিলাম-‘মাঝপথে কথা থামিয়ে ডুসিলা সরে গেল। এক মুহূর্ত অপেক্ষা করলাম আমি।টুথহিল পাশে এসে দাঁড়াল। ‘ড্রসিলা কেরির সাথে তোমার আলাপ আছে

পৃষ্ঠা -৬২

জানতাম না তো, বলল সে।’তোমার খুব বাজে স্বভাব তো, আড়ি পাতো?’ তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলাম আমি। ‘দ্যাখো, টুথহিল, এই শেষবারের মত সাবধান করে দিচ্ছি, আমার পেছনে লাগতে এসো না। তুমি লোক সুবিধের নও, চোর। নিজের মঙ্গল চাও তো, মানে মানে কেটে পড়ো। আর, হ্যাঁ, ওই বয়েডকে নিয়ে যাবে। ওকে যেন আর না দেখি বুঝেছ? দেখলে কিন্তু তোমাদের দুজনের কপালেই খারাবি আছে।’ওকে পাশ কাটিয়ে রওনা হলাম দরজার উদ্দেশে। ‘কী ব্যাপার, ওরিন?’ কাউন্টার থেকে জানতে চাইল রাগার। ড্রসিলা সভয়ে দেখছে আমাকে। লাস ভেগাসের রাস্তায় উইল বয়েড আমাকে অনুসরণ করেছিল, টুথহিলের সঙ্গে ওর সম্পর্ক, বা আজ সন্ধ্যেয় এসতেবান কী বলেছে আমাকে সে-সব কিছুই ও জানে না। টুথহিলের হাবভাব দেখে বোঝার উপায় নেই লোকটা ভেতরে ভেতরে আস্ত শয়তান। স্বভাবতই ওর সাথে আমার দুর্ব্যবহারে ঘটনাটা ড্রসিলা ভাল চোখে দেখবে না।’কিচ্ছু না, জো,’ গলা নামালাম আমি। ‘টুথহিল আমার ক্লেইমের ব্যাপারে কৌতূহল প্রকাশ করছিল। ওর সাথে কিছু ভাড়াটে গুণ্ডা আছে। লাস ভেগাস থেকে আমার পিছু নিয়েছে।’ফিরতি পথে মন স্থির করলাম আমি। কাল ভোরের আগেই যাত্রা করব পাহাড়ে। এর ফলে সহজে কেউ আমার নাগাল পাবে না, বেশ কিছুটা এগিয়ে থাকব। তারপর সোনাসহ, দক্ষিণে মোরায়, বা আর কোথাও গিয়ে বাথান কিনব। ডুসিলার যা খুশি করুক, আমি আর মাথা ঘামাব না ওর ব্যাপারে।যতবার ওর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করছি, ততবার একটা না একটা দুর্ঘটনা ঘটছে দাগ পড়ছে আমার চরিত্রে। ওর চোখের সামনেই কিচকে খুন করেছিলাম।ক্যাপ হয়তো আমার চেহারা দেখেই গোলমাল আঁচ করে থাকবে, নীরবে নতমুখে বসে রইল। মালপত্র বিছানার ওপর ছুঁড়ে ফেললাম আমি। তারপর দুটো প্যাক স্যাডল বের করলাম। অ্যাপালুসা এবং দুটো প্যাক হর্স নিয়ে যাব। সাজপোশাকের তেমন প্রয়োজন নেই… বড়জোর দু-তিনদিন থাকব বাইরে।তবু সাবধান’ থাকা ভাল, তাই এক হপ্তা চলার মত খাবার, এবং আমার গান বেল্ট ছাড়াও আরও চার বাক্স ৪৪ কার্তুজ নিলাম সঙ্গে। যখন স্যাডলে চাপলাম, সূর্য উঠতে তখনও এক ঘণ্টা বাকি।’বি কেয়ারফুল;’ হুঁশিয়ার করল ক্যাপ।টুথহিলকে দেখলাম। সোনার গন্ধ পেয়েছে ব্যাটা। নির্ঘাত পিছু নেবে।’ পাহাড়ের দেয়াল ঘেঁষে উত্তরে রওনা হলাম আমি, গাছপালার আড়ালে আড়ালে যাচ্ছি। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, ভ্যাপসা গন্ধ বাতাসে।রক ক্রীক যেখানে ভ্যালেসাইটোসে ঢুকেছে, সেখানে পৌঁছে পানিতে

পৃষ্ঠা -৬৩

নামলাম, বাঁক ঘুরলাম দক্ষিণপুবদিকে। ভোরের আলো ফোটার আগেই ধুয়েমুছে যাবে ট্র্যাক।একটুবাদে একটা চালের মাথায় উঠে পেছনে তাকালাম আমি। মোটা তুলি দিয়ে আকাশে রঙ লেপছে সূর্য। দূর-নীচে, কয়েক মাইল পেছনে, নড়াচড়া চোখে পড়ল। রাইফেলের নলে সূর্যের প্রতিফলন ধরা পড়ল মুহূর্তের জন্যে।ওদেরকে সেধে খনির পথ দেখানোর কোনও অর্থ হয় না। বাঁয়ে মোড় নিয়ে একটা বিপজ্জনক খাঁজের মাথায় চড়লাম, মাঝে বারকয়েক ঘোড়া থেকে নেমে গিয়ে মুছে এলাম আমার ট্র্যাক, তারপর স্যাডলে চেপে পুবদিকে রওনা হলাম। প্রায় আধ-মাইল দূরে একটা ডোবা চোখে পড়ল, উপত্যকায় যেটা আছে তার চেয়ে বড়। জোরকদমে ছুটলাম ও-দিকে।ডোবার কিনারে ক‍্যাম্প করলাম রাতের মত, আগুন ধরালাম না।গাছের পাতায় বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভাঙল। উঠে পড়লাম ঝটপট। দ্রুত স্যাডলে চেপে সরে গেলাম ওখান থেকে। প্রায় ডজনখানেক ছোট ছোট খানাখন্দ পেরিয়ে উঠে এলাম একটা পাহাড়চুড়োয়। মাইলের পর মাইল আজন্ম রুক্ষ বিস্তার, মর্ত্যলোকে এমন ভয়ঙ্কর সুন্দর জায়গা বোধ করি আর একটিও নেই।তীব্র হুল ফোটাচ্ছে বৃষ্টির ছাঁট। নড়াচড়ার আভাস নেই কোথাও। স্বর্ণ- উপত্যকায় নেমে গেলাম আমি। যেমন রেখে গিয়েছিলাম তেমনি আছে খনিটা। তবে জলপ্রপাতের প্রান্তবর্তী ট্রেইল তলিয়ে গেছে দুফুট পানির তলায়। বৃষ্টিতে শিগগিরই চলাচলের অনুপযুক্ত হয়ে পড়বে। অন্য রুটে ফিরতে হবে আমাকে।খনিতে ঢুকলাম ঘোড়া বেঁধে, হাত দিলাম কাজে। সামান্য প্রয়াসেই। খুলে আসছে পাথর; পচা স্ফটিক, বুটের চাপে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। কেঁপে বৃষ্টি পড়ছে… বেশিক্ষণ এভাবে চললে, বরফ জমে যাবে।ড্রসিলা বা আর কারও ব্যাপারে ভাবার সময় নেই এখন… সোনা উদ্ধার করেই সরে পড়তে হবে। আবার যখন বাইরে এলাম, বৃষ্টি ছেড়ে গেছে, তবে আবহাওয়া কেমন যেন শুষ্ক লঘুভার। উদ্ধিগ্ন হয়ে উঠলাম, ঘোড়াগুলোও ছটফট করছে।উপত্যকার উল্টোদিকে ঘেসো জমিতে কয়েকটা হরিণ ও এলক চরছে। ঝড়ের পূর্বাভাস? সাধারণত ওরা সূর্যাস্তের সময় নেমে আসে। থমথমে গুমট পরিবেশ, চুড়োর কাছে মেঘ জমছে। ফের বৃষ্টি শুরু হলো, অনেকটা কুয়াশার মত।খনিতে ফিরে আরও একটা ঘণ্টা কঠিন পরিশ্রম করলাম। তারপর কফি বানালাম আগুন জ্বেলে। খিদেয় ঝিমঝিম করছে ‘মাথা, অথচ আবহাওয়ার কারণে দুদণ্ড বিশ্রাম নেব তার জো নেই। মনে হচ্ছে ফাঁদে আটকা পড়ে গেছি। আমার অস্থির বোধ করার পেছনে এটাও অন্যতম কারণ।বেলা ডুবে গেছে। আমার কাজে বিরাম নেই। খনির এই অংশটা যদি পকেট হয় তবে আশ্চর্য হব না। সে-ক্ষেত্রে তলদেশের স্ফটিক কঠিনতর হওয়াই

পৃষ্ঠা -৬৪

স্বাভাবিক। স্ফটিক ভাঙতে ঘানির প্রয়োজন পড়বে। পরিস্থিতি তেমন দাঁড়ালে বেকায়দায় পড়ে যাব ঘানির ব্যবহার আমি জানি না। আনাড়ি।রাতে গুহার কাছাকাছি সরিয়ে আনলাম ঘোড়াগুলো, অনেকটা ভেতরে গিয়ে আগুন ধরালাম, তারপর খানকতক যবের রুটি তৈরি করে খেয়ে শুয়ে পড়লাম।ঘুম ভেঙে গেল মাঝ-রাতে।ভয়ঙ্কর ঠাণ্ডা পড়েছে। এতটা শীত পড়বে আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। ঘোড়াগুলো জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে, ঘাড় নামানো। গুহার বাইরে পা রাখতেই স্তম্ভিত হয়ে গেলাম চারিদিকে শুধু বরফ আর বরফ।আকাশ ফুটো করে অবিশ্রাম তুষার পড়ছে, চিকচিক করছে চন্দ্রালোকে। গাছ-পালায়, পাহাড়-পর্বতে, ঘাসে চকচকে বরফ। উইলো শাখায় ঝুলছে ভাঙা কাচের টুকরোর মত।মনে হলো যেন এক মায়ালোকে এসে পড়েছি আমি অপূর্ব সুন্দর, অথচ মৃত্যু-ভয়াল।ওই বরফ থাকা অবস্থায় প্রতিটি ট্রেইল চলাচলের অনুপযুক্ত হয়ে পড়বে। ঘোড়া তো ছার, হাঁটতে গেলেও ভয় পাবে মানুষ। ড্রসিলা যে-পথে উপত্যকায় এসেছিল, সেটার কথা মনে পড়তেই আমার চুল দাঁড়িয়ে গেল।রোদ উঠলে গলে যাবে দ্রুত। কিন্তু এটা মৌসুমের শেষ… যদি আগে বরফ পড়ে? সামান্যতম চাপেই তুষারধসের আশঙ্কা আছে। ভেতরে গিয়ে বড় করে, আগুন ধরালাম, তারপর একটা ছালা হাতে বাইরে এসে গাঁ-মুহুতে শুরু করলাম ঘোড়াগুলোর। অসহায়ের মত অনড় দাঁড়িয়ে রইল ওরা, চোখে শঙ্কা। বুঝতে পারছে, আমি ওদের সাহায্য করতে চাইছি। এত ভয়ানক তুষার-ঝড় আগে কখনও দেখিনি, নেভাদার পগোনিপস-এর কাছে নস্যি। বরফের ভারে অসংখ্য ডালপালা ভেঙে গেছে। সাসা সাদা বরফ- ঝকঝক করছে আয়নার মত। খাবার…এ মূহূর্তে আমার ওটাই সবচেয়ে প্রয়োজনীয়। এই ঠাণ্ডায় শরীর গরম রাখতে নিত্যকার চেয়ে বেশি খাবার লাগবে। কতদিন থাকতে হবে বলা যাচ্ছে না এখন হয়তো সারা শীতকাল।সময় নষ্ট করা চলবে না। প্রতিপদে, এমনকী সমান জায়গাতেও, পা ভাঙার ঝুঁকি আছে। সব ট্রেইল অবরুদ্ধ, সোনা আমার কোনও কাজে আসছে না। এখন থেকে শুধু বাঁচার লড়াই।ভোর হতে ঘণ্টা দুয়েক দেরি আছে, কুঠার নিয়ে বাইরে গেলাম আমি, প্রমাণ মাপের দুটো গাছের গুঁড়ি কেটে আনলাম গুহায়। এর ফলে জ্বালানির মজুদ বাড়ল। স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে রয়েছে ঘোড়াগুলো, পিচ্ছিল মাটিতে নড়াচড়া করতে ভয় পাচ্ছে। বেলচার আঘাতে ভেঙে ফেললাম ওদের আশপাশের বরফ, খনি থেকে কয়েক বেলচা পাথর নিয়ে ছড়িয়ে দিলাম ওখানে।.

পৃষ্ঠা -৬৫

বনে গিয়ে বরফ খসিয়ে ফেললাম একটা গাছের গুঁড়ি থেকে, মোটা ডালপালা কেটে ফিরে এলাম গুহায়। চাঁদের আলো মুছে গেছে। আরও কিছু লাকড়ি গুঁজে দিলাম আগুনে, তারপর পরবর্তী কর্মপন্থা ভাবতে বসলাম। হাল ছাড়া চলবে না, খুঁজলে বেরোনোর রাস্তা হয়তো পেয়ে যেতে পারি একটা।সকালে উঠেই শিকারে যেতে হবে। ঠাণ্ডায় পচবে না মাংস। ভোর হলো। আকাশ মেঘে ঢাকা। বুঝলাম ঠাণ্ডা বাড়বে। হরিণের খোঁজে বেরোলাম। বরফের কিনারে সরে গেছে অ্যাপালুসা, ঘাসের সন্ধানে আঁচড়াচ্ছে খুর দিয়ে। এটা মনট্যানার ঘোড়া, এ-কাজে অভ্যস্ত।দুপুরের সামান্য আগে মাদি হরিণ পেলাম একটা। রাতে জাঁকিয়ে ঠাণ্ডা পড়ল। হরিণ কাটাকুটি হয়ে গিয়েছিল, মাংস ঝুলিয়ে দিলাম। সাবধানে ছাল ছাড়িয়েছি, চামড়া নষ্ট হতে দেইনি। এখানে যদি পুরো শীত কাটাতে হয়, এ-রকম চামড়া লাগবে আমার।বিপদের আশঙ্কায় ঘুমানোর সাহস পেলাম না রাতে, কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে রইলাম আগুনের পাশে। গুহামুখে দেয়াল তুলতে হবে। বাতাসের সঙ্গে ঠাণ্ডা ঢুকছে ওই পথে। পরদিন সকালেও মেঘ কাটল না, ধারাল বাতাস চলছে সাঁই- সাঁই, হাড় অবধি ঢুকে যাচ্ছে, ঈষৎ দুলছে তুষারাবৃত ডালপালা, কঙ্কালের হাতের মত বাড়ি খাচ্ছে পরস্পর। জমাট-বাঁধা ঘাসের দিকে তাকিয়ে মলিন মুখে ঘোড়াগুলো লেজ নাড়ছে। বরফের খোঁচায় ছড়ে গেছে ওদের ঠোঁট, মাথা নিচু করে ফিরে এল আমার কাছে। ঝরনার ভাটিতে ঘাসগুলো লম্বা, বরফ ভেঙে আমি কিছুটা কেটে এনে দিলাম।এভাবে চলতে পারে না। যেভাবেই হোক নীচে নামতে হবে আমাকে। সম্ভব হলে ঘোড়াগুলো নিয়ে যাব সঙ্গে। তবে বুঝতে পারছি তা হবার নয়… আমার অভাবে এই নির্জন উঁচু উপত্যকায় মৃত্যুই লেখা আছে ওদের কপালে। রাতে হরিণের মাংসের কাবাব বানিয়ে সাপার করলাম। বাইরে টানা তুষারপাত হচ্ছে। ভোরে যখন ঘুম ভাঙল তখনও থামেনি। পা মচকে মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছে একটা ঘোড়া। আমি গুলি করে মৃত্যুযন্ত্রণা থেকেই রেহাই দিলাম ওকে। পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনি তুলল সেই আওয়াজ।ঝিরিঝিরি তুষার পড়ছে, হাঁটতে হাঁটতে জলপ্রপাতের ধারে গেলাম। জমে গেছে ঝরনা, একটা বিশাল তুষারপিণ্ডে পরিণত হয়েছে জলপ্রপাত। পানি আরও বেড়েছে, ট্রেইলটা তলিয়ে গেছে কয়েক ফুট। ওই পথে বেরোনোর চিন্তা এককথায় অসম্ভব। ডুসিলা তার দাদুর সাথে একটা শীত এখানে কাটিয়েছিল। কীভাবে? ওদের গুহাটা আরও বড়, পুরু ছাউনি। পাথরচাঁইয়ের ভিড়ে পর্যাপ্ত জ্বালানি কাঠ আছে। ওই ট্রেইল বেয়ে ওখানে নামা কি সম্ভব হবে?

পৃষ্ঠা -৬৬

ক্যানিয়ন পর্যন্তই কি যেতে পারব? ব্রিসল-কন পাইন ঝোপটা অনেক উঁচুতে, বাতাস ওখানে পূর্ণবেগে বইছে, ঠাণ্ডাও বেশি হবে। দুরারোহ ঢালে ওই ট্রেইল, এতক্ষণে নিশ্চয়ই বরফের আস্তর জমে গেছে।ওটা হবে আমার শেষ অবলম্বন। আপাতত এখানে থেকেই দুর্যোগ পাড়ি দেবার চেষ্টা করতে হবে।কোদাল নিয়ে বাইরে গেলাম, আরও কিছুটা বরফ ভেঙে ন্যাড়া করে দিলাম ঘাস যাতে ঘোড়াগুলো লড়াইয়ের সুযোগটুকু অন্তত পায়। জমাট-বাঁধা ঘাস নিজেরে চেষ্টায় আয়ত্তে আনবার কায়দা ওরা জানে, কিন্তু বরফে ওদের ঠোঁট, জঙ্ঘাদেশ কেটে-ছড়ে গেছে।সহসা তড়াক করে মাথা তুলল অ্যাপালুসা, কান খাড়া করেছে।উইনচেস্টার বাগিয়ে ধরলাম আমি। বরফের চাদর ভেদ করে যতদূর দেখতে পাচ্ছি, কিছুই নড়ছে না। শোনার প্রয়াস পেলাম, চরাচর নিস্তব্ধ।খুউব সাবধানে ক্রীকের প্রান্তে উইলো ঝোপের কাছে এগিয়ে গেলাম, একগুচ্ছ লম্বা ডাল কেটে নিয়ে এলাম গুহায়।বাইরে গেলে আমার সাথে সর্বদা একগোছা চামড়ার ফিতে থাকে, অধিকাংশই শুয়োরের রগ, মার্কা লাগানোর সময় গবাদি পশুর পা বাঁধতে প্রয়োজন হয়। চারণভূমিতে প্রত্যেক কাউহ্যান্ডের কাছে এ-জিনিস থাকে খানিকটা। জরুরি অবস্থা মোকাবেলার জন্যে রাখে। ওগুলো ব্যবহার করব এখন।নড়াচড়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না ঘোড়াদুটোর মাঝে, সারাক্ষণ গুহার সামনে রয়েছে। পুরো সকাল এবং বিকেলের কিছু সময় স্ফটিক ভেঙে যতটা সম্ভব সোনা বের করে নিলাম।উইলো ডালগুলো যখন আবার নমনীয় হলো, ডিমের মত বাঁকালাম প্রতিটাকে। তারপর সেরা দুটো বেছে নিয়ে দুমাথা বাঁধলাম একত্রে। এ-বার কোনাকুনিভাবে চামড়ার ফিতে জড়াতেই তৈরি হয়ে গেল একজোড়া স্নো-শু।সন্ধ্যে ঘনাতে এখনও বাকি রয়েছে কিছুক্ষণ। জুতোজোড়া পরখ করতে বাইরে বেরোলাম, হাতে রাইফেল। আমার জীবনে স্নো-শৃ প্রস্তুত এই প্রথম নয়, ভালই কাজ দিচ্ছে। জলপ্রপাতের কাছে গিয়ে দেখলাম, বরফের পরিমাণ আরও বেড়েছে ইতিমধ্যে।ঘুরে ভুসিলার গুহার উদ্দেশে রওনা হলাম। মোচাকৃতি পাইন ঝোপের কাছাকাছি গিয়ে ফিরতি পথ ধরলাম, অন্ধকার নামার আগেই আস্তানায় পৌঁছুতে হবে। হঠাৎ একটা গুলির আওয়াজে কানে তালা লেগে গেল।বিস্ময়ে জমে গেলাম, বিষণ্ণ পর্বতমালায় প্রতিধ্বনি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। একসময় মিলিয়ে গেল শব্দ, তবু দাঁড়িয়ে রইলাম, ঠাণ্ডায় কাঁপছি মৃদু, অনন্ত আকাশ আর হিমরাজ্যে আমি একা, নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। গুলি…এখানে!

পৃষ্ঠা -৬৭

আওয়াজটা নীচের ক্যানিয়ন থেকে এসেছে। কেউ আছে ওখানে। ড্রসিলার গুহার কাছেপিঠে।এখানে? এই জায়গায়?

তেরো

আচমকা চিড় ধরেছে বরফচাইয়ে… তুষারের চাপে কোনও গাছের ডাল ভেঙে পড়েছে?… না। গুলিরই শব্দ স্পষ্ট, তীক্ষ্ণ, সন্দেহাতীত।ওরিন, বললাম’ আপনমনে, তু… তুমি একা নও।ওই গুহার কথা কে কে জানে? আমার জানামতে একমাত্র ডুসিলা। ক্যাপ ভাসাভাসা শুনেছে আমার কাছে। এমনকী সঠিক পথনির্দেশ জানলেও ওর পক্ষে ওঠা সম্ভব নয়, শরীর এখনও দুর্বল।ড্রসিলা? তাই-বা হয় কী করে? ওর আসবার কোনও কারণ নেই।বাকি থাকছে আমার অনুসরণকারীরা। ওরা উপত্যকায় ঢোকার কোনও রাস্তা খুঁজে পেয়েছে? অসম্ভব নয়।এখন আমি ক্যানিয়নের উদ্দেশে রওনা হলে, পৌছুতে পৌছুতে সম্পূর্ণ অন্ধকার হয়ে যাবে। এবং কিছুই দেখতে পাব না। অতএব, খনিতে ফিরে গিয়ে ভোরের অপেক্ষায় বসে থাকাই ভাল।একটা কথা নির্দ্বিধায় বলা চলে; ওই লোকগুলো যদি ক্যানিয়নে এসে থাকে, আমার মত ওরাও বরফে আটকা পড়েছে। এবং সেক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে ওদের অবস্থা আমার চেয়েও সঙ্গিন। এ-রকম পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমার সমান দক্ষ নয় ওরা।পাহাড়ে থাকতে করবার মত আমাদের কিছুই ছিল না; কিন্তু আমরা, ওসমানেরা, আর কিছু না হোক একটা ব্যাপারে পটু: জানি, এই গোলকধাঁধা থেকে কীভাবে উদ্ধার পেতে হয়। কৈশোরেই আমরা পাহাড়ের প্রতিটি ইঞ্চি চষে ফেলেছি। প্রায় সবাই বাড়ি ছেড়েছি ষোলো বছর বয়েসে।আমার গোটা জীবনটাই, বলতে গেলে, কঠোর পরিশ্রমের যোগফল। অধিকাংশ সময় কেটেছে যুদ্ধক্ষেত্রে, লড়াইতে। ক্ষুধাতৃষ্ণার সাথে সংগ্রাম করেছি বহুবার। এ-রকম পাহাড়ী এলাকায় আটকা পড়া আজ নতুন নয়। ফলে, আমি ঠিকই টিকে যাব। কিন্তু ওরা…?ক্যাম্পে ফিরে দেখালাম গুহার আশপাশে চরছে ঘোড়াগুলো। ভেতরে এনে দলাইমলাই করলাম ওদের। আমরা যে বিপদে পড়েছি, এটুকু বোঝার মত বুদ্ধি ওদের আছে। তবে যত্নআত্তি পেলে নিশ্চিন্ত বোধ করবে অনেকটা। আগুন ধরিয়ে পরনের শীপস্কিন কোট খুলে ফেললাম। তারপর ভেস্ট

পৃষ্ঠা -৬৮

খসিয়ে ফের গায়ে দিলাম ওটা। ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় বাইরে গেলে বাড়তি কাপড় পরা আমার অভ্যেস। তবে এ-সব ক্ষেত্রে সবর্দা লক্ষ রাখতে হয় শরীর যেন না ঘামে। চলাফেরা বন্ধ করলে কাপড়ের তলায় ওই ঘাম জমে বরফে পরিণত হবার আশঙ্কা থাকে।রান্না সেরে আগুনের পাশে ব্ল‍্যাকস্টোন খুলে বসলা”। মাঝে মাঝে খুঁচিয়ে উসকে দিচ্ছি শিখা।গত কমাস যাবৎ গভীর রাত অবধি বিছানায় জেগে কাটাচ্ছি আমি। নতুন যা পড়েছি তা নিয়ে ভাবি, চেষ্টা করি বইয়ের ভাষায় কথা বলতে। আসছে বসন্তের আগেই আমার বাচনভঙ্গি উন্নত হবে বলে আশা করছি।আবার তেমনি, অনেক সময় ড্রসিলা সম্পর্কে চিন্তা করি। মৃত্যুর দুয়ার থেকে ওকে ফিরিয়ে এনেছি আমি। ভেবেছিলাম ও-ই হবে আমার জীবনসঙ্গিনী। বহু দিবাস্বপ্ন দেখেছি ওকে ঘিরে।কিন্তু এখন আর ভাবার মত অবশিষ্ট নেই কিছু। সে-দিন রাতে দোকানে ও পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছে সেটা। কিচকে গুলি করবার সুযোগ দিলেই বোধ হয় ডুসিলা খুশি হত। তবে এ-নীতিতে আমি বিশ্বাসী নই। প্রেমঘটিত ব্যাপারে অনেক পুরুষের আত্মাহুতি দেবার কথা শুনেছি কিন্তু এটা আমার বিবেচনায় চরম নির্বুদ্ধিতা ছাড়া কিছুই নয়। মেয়েরা বাস্তববাদী। ওরা সরাসরি আঁটি ভেঙে শাঁসটি খেতে পছন্দ করে, কোনও মেয়েই তার পূর্বপ্রেমিককে মনে রাখে না। এটা তাদের কাছে বাজে কাজের শামিল। আসলে ভালবাসার জন্যে বাঁচতে হয়, মরতে নয়।মেয়েদের এ এক অদ্ভুত স্বভাব। প্রত্যাখ্যান করতে বাধে না, সহজে ভুলে যায়, অথচ তার প্রেমিক আর কাউকে নিয়ে নীড় বাঁধুক এটাও সে চায় না। বরং প্রেমের অনলে আত্মবলি দিলেই ওরা বেশি খুশি হয়।হু-হু হাওয়া আসছে গুহামুখ দিয়ে। শীত শীত করছে আমার। যতবার প্রতিজ্ঞা করছি ড্রসিলার কথা আর ভাবব না, ততই যেন পেয়ে বসছে ওর চিন্তা- আগের চেয়ে বেশি করে মনে পড়ছে। মানসপটে, ভাসছে ওর মুখ, মেহেদি রঙের চুল। অনুভব করছি আমার গলার ভেতরে একটা কান্না দলা পাকিয়ে আছে। ছি, নিজেকে আবার চোখ রাঙালাম আমি, ব্যাটাছেলের কাঁদতে নেই।খেতে বসলাম, ঢুকল না গলা দিয়ে। উঠে পড়লাম একটা নাড়াচাড়া করে। সকালের জন্যে তুলে রাখালাম খানিকটা। তারপর স্যাডলব্যাগে বইটা রেখে শুয়ে পড়লাম।সূর্য ওঠার ঘণ্টাখানেক আগে শয্যা ত্যাগ করলাম। নাস্তা খেয়ে ঘোড়াদুটোকে নিয়ে গেলাম ক্রীকের ধারে। কুঠারের সাহায্যে গর্ত খুঁড়ে পানি খাওয়ার ব্যবস্থা করলাম ওদের জন্যে। বরফ ভেঙে ঘাস ছড়িয়ে দিলাম, অবশ্যি চাহিদার তুলনায় অতি সামান্য। এরপর বেরিয়ে পড়লাম। পায়ে স্নো-শৃঃ পিঠে বোঝা, দড়িঃ হাতে

পৃষ্ঠা -৬৯

রাইফেল। ক্যানিয়নের ট্রেইলে যখন পৌছুলাম, তখন ভোরের আলো ফুটছে সবে।তুষারে ঢাকা ট্রেইল। এক জায়গায় ময়লা লেগে আছে, আছাড় খেয়েছিল কিছু।দেয়ালের সাথে সেঁটে সাবধানে নামতে শুরু করলাম আমি। যেখানে পারছি দেয়ালের ফাটল বা এবড়োখেবড়ো পাথর ধরে নজের ভারসাম্য রক্ষা করছি। ময়লা দাগটার কাছে পৌঁছে দেখলাম ইতিমধ্যে তুষারে ঢাকা পড়েছে অনেকটা। অর্থাৎ, গেল রাতের ঘটনা; এবং জিনিসটা যাই হোক না কেন গড়িয়ে ক্যানিয়নের ও-পাশে চলে গেছে। বুকে হেঁটে সরে গেলাম কিনারের দিকে। এখানে-সেখানে তুষারের স্তূপ জমা করেছে বাতাস, একটা সরু কারনিস সৃষ্টি হয়েছে। কোনও লোক ওখানে দাঁড়ালে নির্ঘাত ভেঙে পড়ে যাবে। সন্তর্পণে ঝুঁকে আমি নীচে উঁকি দিলাম। ডুসিলা।প্রায় বিশ ফুট নীচে একটা সঙ্কীর্ণ শৈলশিরার ওপর পড়ে আছে। সারা শরীর তুষারে মাখামাখি। মেঘ চিরে ক্ষীণ সূর্যালোক এসে পড়েছে। সেই আলোয় বরফের পটভূমিতে জ্বলজ্বল করছে ওর মেহেদি রঙের চুল।রাইফেলটা নামিয়ে রেখে তাকালাম আশপাশে। ব্রিসল-কন পাইনের একগোছা শেকড় চোখে পড়ল, পাহাড়ের গা ফেটে বেরিয়ে আছে। শেকড়ের সাথে দড়ি বেঁধে নেমে গেলাম ওর কাছে। পুরু বরফ জমেছে কারনিসে। দৈর্ঘ্য-প্রস্থে বড়জোর দশ ফুট।দুআঙুলে ওর পালস দেখলাম আমি, কান পাতলাম বুকে। না, এখনও বেঁচে আছে।পাঁজাকোলা করে জড়িয়ে ধরলাম ওকে, গালে কানে আমার মুখ ঘষে শরীর গরম করতে চেষ্টা করলাম।ওর দুবগলের নীচ দিয়ে শক্ত করে বোলাইন নট বাঁধলাম একটা। তারপর দড়ি বেয়ে উঠে গেলাম ওপরে। যখন আমার শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হলো, টেনে তুললাম।বেলা চড়ে গেছে। দিনের আলোয় এখন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে চারদিক। বোলাইন খুলে গুটিয়ে নিলাম দড়ি, ফিতে বাঁধলাম স্নো-শূর, তারপর ড্রসিলাকে কোলে করলাম। সুপুরির মত ফুলে আছে ওর কপাল, তবে, অনুমান করলাম, ঘন চুল আর তুষারের কারণে মারাত্মক চোট পায়নি।দুকদমও যাইনি, হঠাৎ একটা চিৎকার শুনতে পেলাম। পরক্ষণে একটা রাইফেলের গুলি হলো। পাঁই করে ঘুরলাম আমি। দূর নীচে ক্যানিয়নের ভেতর নড়াচড়া চোখে পড়ল, বরফের পটভূমিতে কয়েকটা কালো ফুটকির মত।কেঁপে উঠল ডুসিলা, চোখ মেলল। চকিতে যতটা সম্ভব পিছিয়ে গেলাম আমি, হেলান দিলাম দেয়ালের গায়ে। ড্রসিলা নেমে পড়ল কোল থেকে।

পৃষ্ঠা -৭০

রাইফেল। ক্যানিয়নের ট্রেইলে যখন পৌছুলাম, তখন ভোরের আলো ফুটছে সবে।তুষারে ঢাকা ট্রেইল। এক জায়গায় ময়লা লেগে আছে, আছাড় খেয়েছিল কিছু।দেয়ালের সাথে সেঁটে সাবধানে নামতে শুরু করলাম আমি। যেখানে পারছি দেয়ালের ফাটল বা এবড়োখেবড়ো পাথর ধরে নজের ভারসাম্য রক্ষা করছি। ময়লা দাগটার কাছে পৌঁছে দেখলাম ইতিমধ্যে তুষারে ঢাকা পড়েছে অনেকটা। অর্থাৎ, গেল রাতের ঘটনা; এবং জিনিসটা যাই হোক না কেন গড়িয়ে ক্যানিয়নের ও-পাশে চলে গেছে। বুকে হেঁটে সরে গেলাম কিনারের দিকে। এখানে-সেখানে তুষারের স্তূপ জমা করেছে বাতাস, একটা সরু কারনিস সৃষ্টি হয়েছে। কোনও লোক ওখানে দাঁড়ালে নির্ঘাত ভেঙে পড়ে যাবে। সন্তর্পণে ঝুঁকে আমি নীচে উঁকি দিলাম। ডুসিলা।প্রায় বিশ ফুট নীচে একটা সঙ্কীর্ণ শৈলশিরার ওপর পড়ে আছে। সারা শরীর তুষারে মাখামাখি। মেঘ চিরে ক্ষীণ সূর্যালোক এসে পড়েছে। সেই আলোয় বরফের পটভূমিতে জ্বলজ্বল করছে ওর মেহেদি রঙের চুল।রাইফেলটা নামিয়ে রেখে তাকালাম আশপাশে। ব্রিসল-কন পাইনের একগোছা শেকড় চোখে পড়ল, পাহাড়ের গা ফেটে বেরিয়ে আছে। শেকড়ের সাথে দড়ি বেঁধে নেমে গেলাম ওর কাছে। পুরু বরফ জমেছে কারনিসে। দৈর্ঘ্য-প্রস্থে বড়জোর দশ ফুট।দুআঙুলে ওর পালস দেখলাম আমি, কান পাতলাম বুকে। না, এখনও বেঁচে আছে।পাঁজাকোলা করে জড়িয়ে ধরলাম ওকে, গালে কানে আমার মুখ ঘষে শরীর গরম করতে চেষ্টা করলাম।ওর দুবগলের নীচ দিয়ে শক্ত করে বোলাইন নট বাঁধলাম একটা। তারপর দড়ি বেয়ে উঠে গেলাম ওপরে। যখন আমার শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হলো, টেনে তুললাম।বেলা চড়ে গেছে। দিনের আলোয় এখন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে চারদিক। বোলাইন খুলে গুটিয়ে নিলাম দড়ি, ফিতে বাঁধলাম স্নো-শূর, তারপর ড্রসিলাকে কোলে করলাম। সুপুরির মত ফুলে আছে ওর কপাল, তবে, অনুমান করলাম, ঘন চুল আর তুষারের কারণে মারাত্মক চোট পায়নি।দুকদমও যাইনি, হঠাৎ একটা চিৎকার শুনতে পেলাম। পরক্ষণে একটা রাইফেলের গুলি হলো। পাঁই করে ঘুরলাম আমি। দূর নীচে ক্যানিয়নের ভেতর নড়াচড়া চোখে পড়ল, বরফের পটভূমিতে কয়েকটা কালো ফুটকির মত।কেঁপে উঠল ডুসিলা, চোখ মেলল। চকিতে যতটা সম্ভব পিছিয়ে গেলাম আমি, হেলান দিলাম দেয়ালের গায়ে। ড্রসিলা নেমে পড়ল কোল থেকে।

পৃষ্ঠা ৭১ থেকে ৮০

পৃষ্ঠা -৭১

অবশেষে গুহায় পৌছুলাম আমরা। আগুন নিভে এসেছিল, মিটমিট করে জ্বলছিল কয়লা। নতুন করে ধরালাম আমি, তারপর কফির পানির জন্যে খানিকটা বরফ গলাতে শুরু করলাম একটা পাত্রে।আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে শরীর গরম করছিল ড্রসিলা। আমি-মাথা তুলতে চোখাচোখি হলো। ‘ওরিন, সব দোষ আমার, মাফ করে দাও।’শূন্যে হাত খেলিয়ে ওকে আশ্বস্ত করবার প্রয়াস পেলাম। ‘ভাগ্যটা আমারই খারাপ তোমার সামনে মারতে হয়েছিল। অথচ আর কোনও উপায়ও ছিল না- আমাকে খুন করতেই এসেছিল ওরা।’দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি, দৃষ্টি বাইরে নিবন্ধ। উজ্জ্বল আকাশ, আবহাওয়া কনকনে ঠাণ্ডা। টুথহিলদের টিকিটি দেখা যাচ্ছে না কোথাও।’পুবের লোকেরা,’ শুরু করলাম আবার, ‘এখনও ডুয়েল লড়ে। তবে তার। আগে সব নিয়মকানুন ঠিক করে নেয় ওরা। একটা অনুষ্ঠানের মত হয়ে ওঠে ব্যাপারটা। এখানে সে-সবের বালাই নেই। পরিচিত লোকের মাঝে ওগুলো করা সাজে, কিন্তু পশ্চিমে অধিকাংশই ভবঘুরে কেউ কাউকে চেনে না। ফলে কারও – সাথে ঝগড়া-ফ্যাসাদ হলে বোঝার উপায় থাকে না তার বিপক্ষ মানুষ হিসেবে কেমন ভাল না মন্দ। তাই ঝটপট পিস্তল চালাতে হয়।”জো আমাকে এ-কথাই বলছিল। আ… আমি কান দেইনি প্রথমে। ব্যাপারটাকে ভীষণ নিষ্ঠুর বলে মনে হয়েছিল।”আসলেও যে নিষ্ঠুর। কিন্তু কী করা? আমি চাই না যে কেউ আমার কবরে দাঁড়িয়ে বলুক: “লোকটা ভায়োলেন্সে বিশ্বাস করত না, ভাল ছিল, তাই মারা গেছে।””দম নিতে থামলাম আমি, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছি সামনে। ‘না, ডু আইন-শৃঙ্খলার প্রতি আমার শ্রদ্ধা আছে বলেই আমাকে বেঘোরে প্রাণ দিতে হবে, মুখ বুজে অন্যায় সইব, এতটা ভাল মানুষ আমি নই। কাজেই দরকার হলে আমি পিস্তল ব্যবহার করব।’বিপক্ষ দলের পাত্তা নেই এখনও। হয়তো ট্রেইলে বাধার সম্মুখীন হয়েছে, অনভ্যাসের দরুন চলতে কষ্ট হচ্ছে। আবার এর উল্টোটিও হতে পারে। কাছেপিঠেই কোথাও ঘাপটি মেরে আছে, অপেক্ষা করছে ইন্ডিয়ানদের মত, ঝোপ বুঝে কোপ মারবে। প্রতিকূল আবহাওয়া আমার জন্যে শাপে বর হয়েছে। খনির সামনে যে-সব ভাঙা স্ফটিক পড়েছিল, সেগুলো ঢাকা পড়ে গেছে বরফে, বোঝার জো নেই, এটাই স্বর্ণ-উপত্যকা।ব্ল‍্যাকস্টোনের বইখানা চোখে পড়তে ছুসিলা তুলে নিল ওটা। ‘পড়ছ?’ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল আমার দিকে।’হ্যাঁ। এই বইটা পড়লে মনে হয় মানুষ হয়ে জন্মেছি বলে আমাদের গর্ব করা উচিত। জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি একদম বদলে দেয়।”তুমি ওকালতি করবে?’

পৃষ্ঠা -৭২

‘না। মূর্খতাকে আমি অপরাধ বলে মনে করি। স্কুলে যাবার সুযোগ হয়নি, এগুলোর সাহায্যে এক-আধটু যা পারি শিখছি। একদিন’ অনুভব করলাম আমার কান আরক্ত হয়ে উঠেছে ‘আমার ছেলেপুলে হবে, স্কুলে যাবে ওরা। তাই চেষ্টা করছি, ওদের বাবার কারণে ওদেরকে কোথাও যেন অপ্রস্তুত হতে না হয়।”হবেই-বা কেন?’ দৃঢ় সুরে বলল ড্র। ‘তুমি ভাল লোক, সাহসী, তা ছাড়া-‘ ‘ওই যে আসছে ওরা?’ বলে কাঠের গাদার আড়ালে বসলাম আমি। ররফের ওপর ওদের বুটের মচমচ শব্দ শুনতে পাচ্ছি। পাঁচজন। টুথহিলকে প্রথম দর্শনেই চিনতে পারলাম, পাশের দুজন সম্ভবত ইরা ও টম বিগলো। উইল বয়েডকে পথশ্রমে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। ওর পেছনে বেন হবস। অনুপস্থিত একমাত্র কিড নিউটন, সেই সাদাচুলো তরুণ পিস্তলবাজ। আমার জিভে একটা ভাঙা ডাল, একদৃষ্টে দেখছি ওদের এগিয়ে আসা, হাতে উইনচেস্টার প্রস্তুত। বোকামির পরিচয় দিচ্ছে ওরা, এত কম দূরত্বে…’বাইরে এসো, ওসমান। কথা আছে!”আমি শুনতে পাচ্ছি।”এখানে এসো।”এত আরাম ছেড়ে?’নিজেদের মাঝে তর্ক জুড়ল ওরা। তারপর টুথহিল গুহার উদ্দেশে রওনা হলো, ওর পায়ের কাছে বরফে গুলি করলাম আমি। সভয়ে থমকে দাঁড়াল ঝাঁটা- গোঁফ, তাড়াহুড়োতে আরেকটু হলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল।’আমার চাইতে তোমাদের অসুবিধেই বরং বেশি, কথোপকথনের ভঙ্গিতে শুরু করলাম। ‘বরফে সব রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। এখান থেকে বেরোবে কীভাবে?”শোনো, ওসমান,’ বলল ঝাঁটা-গোঁফ, ‘আমরা জানি তুমি একটা সোনার খনির ওপর বসে আছ। এর একটা অংশ পেলেই আমরা খুশি। বোকামি করছ কেন? আমাদের সবার জন্যেই যথেষ্ট আছে।”কোন্ দুঃখে? তোমরা এই ঠাণ্ডায় শিগগিরই মারা পড়বে কেন ভাগাভাগি করব আমি?’একটু নড়েচড়ে বসলাম। ‘শোনো, টুথহিল, ব্যাপারটা আসলে তোমার মগজে এখনও ঢোকেনি। তোমরা ফাঁদে আটকা পড়েছ। পালানোর রাস্তা বন্ধ। গোটা শীত কাটাতে হবে এখানে। তা পাঁচ-ছমাসের খাবার এনেছ তো?”ওসমান, তুমি না বেরোলে,’ হুমকি দিল ঝাঁটা-গোঁফ, ‘আমরাই আসছি।’ ‘তখন আমি খুন করার জন্যেই গুলি চালাব, টুথহিল।’ ভয়ঙ্কর ঠাণ্ডা। পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাবে। আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে, বাতাসের বেগ বেড়েছে। তাপমাত্রা এখন কমপক্ষে হিমাঙ্কের দশ ডিগ্রি নীচে হবে। ঘণ্টাকয়েক পরে পঞ্চাশে নেমে যাওয়া অসম্ভব নয়।

পৃষ্ঠা -৭৩

‘বেন,’ চেঁচিয়ে ডাকলাম, ‘তুমি তো নতুন লোক নও। ওদের বলো দশ- এগারো হাজার ফুট ওপরে রাতে কেমন ঠাণ্ডা পড়ে। গোটা শীত পাড়ি দিতে হবে আমাদের তুমিও নিশ্চয় বুঝতে পারছ সেটা।’তোমাদের আশ্রয় লাগবে, জ্বালানি লাগবে, খাবার লাগবে। এত উচ্চতায় শিকার বেশি দিন মিলবে না, পশু-পাখি সব নীচে নেমে যাবে। চেষ্টা করলে এখনও হয়তো পারবে তাড়াতাড়ি পালাও।’জ্বালানি কাঠে গুহামুখের অর্ধেক ঢাকা পড়েছে। পাঁচ ফুট উঁচু গাদা। চমৎকার আড়াল সৃষ্টি করেছে, বাতাস তো ঠেকাচ্ছেই গুলিও ঢুকবে না সহজে। সুড়ঙ্গটা লম্বা, পেছনে ঈষৎ বাঁকা একজন লোক স্বচ্ছন্দে লুকিয়ে থাকতে পারে। চাপা স্বরে ওখানে চলে যেতে বললাম ড্রসিলাকে।পাথুরে দেয়াল রিফলেক্টর হিসেবে কাজ করছে, তাপ ঠিকরে গরম রাখছে গুহাটা। আরও তিনটে বাড়তি জিনিস আছে আমাদের কাছে গাঁইতি, বেলচা, আর কুঠার। তুষার-রাজ্যে টিকে থাকতে হলে ওগুলো অপরিহার্য। এ-ক্ষেত্রে আমাদের সুবিধে বেশি: ওরা এ-সবের সাহায্য পাচ্ছে না।এই খনি আমার আবিষ্কার। কেউ কেড়ে নিতে চাইলেই আমি তা দেব কেন?ওরা দুভাবে আমাদের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। গুহার ছাত ও দেয়াল তাক করে ব্যাপক গুলি বর্ষণ করবে। ফলে নরকে পরিণত হবে জায়গাটা। এই স্বল্প পরিসরে বেরোনোর জায়গা না পেয়ে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি শুরু করবে দিগ্‌ভ্রান্ত বুলেটগুলো। সামনে নরম কিছু পড়লে নিমেষে ভেদ করে বেরিয়ে যায় এ-ধরনের বুলেট।অথবা আমাদের ঘোড়াগুলো মেরে ফেলবে।টানেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ওরা, মেরে ফেললে আমাদের দৃষ্টিপথ ঢাকা পড়ে যাবে। এমনকী পালানোর রাস্তা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ওদের বাঁচার সম্ভাবনা একশো ভাগের এক ভাগ, তবু বাঁচাতে আপ্রাণ চেষ্টা করব আমি।ঢালের ওপরে কোথাও ঠাণ্ডায় একটা গাছের ডাল মট শব্দে ভাঙল। ভীষণ শান্ত পরিবেশ… ঝড়ের পূর্বাভাস?মাটিতে সজোরে পা ঠুকল বয়েড, গাল বকল বিড়বিড় করে। ও-ই দল ছাড়বে সবার আগে। দীর্ঘ পরিশ্রমের সাহস বা ধৈর্য কোনটাই ওর নেই। ওদের মধ্যে যেন হবসই শেষ পর্যন্ত টিকবে। হঠাৎ ওরা ঘুরে বনের পথে রওনা হলো। একজনকে খতম করা দরকার,ভাবলাম। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে, তিনটে বিশাল গাছের আড়ালে হারিয়ে গেল ওরা। ডালপালা ভাঙছে একটা ঝোপের ভেতর, আগুনের জোগাড়-যন্তর করছে। শুধু এক আগুনে কুলোবে না ওদের। আরও জিনিস লাগবে।’কিড কোথায়?ইজন ছিল ওরা… একজন আঘাত পেয়ে নীচে পড়ে আছে। ক্যানিয়নের

পৃষ্ঠা -৭৪

নীচের অংশ দুর্গম, বড় বড় পাথরচাঁই আর গাছের গুঁড়িতে ভর্তি। বরফে নিঃসন্দেহে সেটা আরও ভয়াল হয়ে উঠেছে।লাকড়ির পালায় আঘাত ‘হানল একটা বুলেট। পাহাড়ে প্রতিধ্বনি তুলল রাইফেলের আওয়াজ। উবু হয়ে পট থেকে কাপে কফি ঢেলে আরাম করে বসলাম আমি। আঙুলগুলো গরম রাখতে কাপটা নাড়াচ্ছি দুহাতের তালুর মাঝখানে। একপশলা গুলি উড়ে এল, প্রবেশপথের ওপরে বিঁধল একটা, ঝুরঝুর করে পাথরকুচি খসে পড়ল গাদার ওপর।’সরে থাকো, ড্র। অযথা নড়াচড়া কোরো না।”ওরিন? আমাদের কী হবে?”ডু, সত্যি বলছি আমি জানি না। আমরা একজনও যদি পালাতে পারি সেটা আমাদের ভাগ্য বলতে হবে।’কয়েকমিনিট অবিরাম গুলি চালিয়ে গেল ওরা। আমি চুপ করে বসে রইলাম। এক পর্যায়ে থামল গুলি, শুনতে পেলাম ওরা তর্ক করছে।ওরা কি বিশ্বাস করবে আমরা মারা গেছি? আমি তাই চাই মনে-প্রাণে। আমার নাম ধরে চেঁচিয়ে ডাকল টুথহিল, জবাব দিলাম না। আরও দুটো গুলি ছুটে এল। একটা টানেলের ছাতে বিঁধল, অন্যটা আঘাত করল ভেতরের দেয়ালে।আবার চিৎকার করল টুথহিল। আমি কফিপান শেষ করে, কাঠের পালার • ফাঁক দিয়ে বাইরে উঁকি দিলাম।আরেকটা গুলি। ক্রুদ্ধ ভোঁতা গর্জন তুলে গুহার পেছন দিকে চলে গেল বুলেটটা।জোর বচসা চলছে। গলা শোনা গেলেও কথা বোঝা যাচ্ছে না। ঝোপ সরিয়ে টম বিগলো উদয় হলো, হাতে পিস্তল, গুহার দিকে আসছে।কাছাকাছি এসে হাঁটার গতি কমাল সে, ঝুঁকির পরিণাম বুঝতে পারছে। থমকে দাঁড়াল বিগলো, পিস্তলের ট্রিগার টিপল একবার। পরীক্ষামূলক গুলি, আন্দাজ করতে চাইছে আমরা বেঁচে আছি কি না, প্রবেশপথের বাইরে দেয়ালে আঘাত হানল।দোনোমনো করছিল বিগলো, পরক্ষণে ঝেড়ে ফেলল সব দ্বিধা, দ্রুত পায়ে হাঁটা দিল গুহার উদ্দেশে। বারো কদম দূরে থাকতে মুখ খুললাম আমি, ‘অল রাইট, বিগলো। ড্রপ দ্য গান!’চমকে এক পা পিছু হটল সে, আস্তে আস্তে উঠে আসছে পিস্তলের মাযফল। ‘ড্রপ ইট!’ এ-বার রাইফেলের নল চোখে পড়ল ওর। এই ব্যবধানে একটা বাচ্চাছেলেও নিশানা ফুটো করতে পারবে। পিস্তল ফেলে দিল সে। ‘তোমার ভাই তাস চুরি করতে গিয়ে মারা পড়েছে। পিস্তল বের করতে নিষেধ করেছিলাম আমি ও শোনেনি।’

পৃষ্ঠা -৭৫

কোনও কথা বলল না টম বিগলো।’গান বেল্ট খোলো,’ আদেশ করলাম।নীরবে হুকুম তামিল করল সে।’বেশ’, তুমি এখন যাও। তবে যাবার আগে বলো দেখি, তোমরা খাওয়ার ব্যাপারে কী ভাবছ। রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। আমাদেরটা নিতে পারছ না, আর পারলেও তা দিয়ে বেশি হলে এক হপ্তা টিকবে।”আমরা ঠিকই ফিরে যাব।”বেন হবসকে জিজ্ঞেস করে দ্যাখো। অ্যাল প্যাকারের কথা জিজ্ঞেস করো।”সে আবার কে?”একদল লোকসহ শীতে পাহাড় পেরোনোর চেষ্টা করেছিল। খাবার ফুরিয়ে যায় ওদের। বাকি পাঁচজনের মাংস খেয়ে বেঁচেছিল সে। তুমি এর জন্যে তৈরি আছ তো, বিগলো?”আমাকে ভয় দেখিয়ে ফায়দা হবে না, ওসমান।”আচ্ছা, যাও মরোগে তা হলে।’ওরা একটা পিস্তল আর গোটা বিশেক কার্তুজ হারাল। রাতে আমাকে বাগে আনবার চেষ্টা করবে।’ড্র. তোমাদের সাথে প্যাক হর্স ছিল?’ প্রশ্ন করলাম।না,’ জবাব দিল ও। ‘কাজ সেরেই ফিরে যাওয়ার প্ল্যান ছিল ওদের।” তার মানে খাদ্যসঙ্কটে পড়তে যাচ্ছে, সুতরাং ওদের চটজলদি ব্যবস্থা নিতে হবে অবিলম্বে।বিগলো ঝোপের আড়ালে অদৃশ্য হয়েছে। আচমকা ওইদিকে পরপর তিনটে গুলি ছুঁড়লাম আমি, তারপর এক মুহূর্ত বিরতি দিয়ে, একটু নীচে আরেকবার।কাঁপতে কাঁপতে কয়েকটা লাকড়ি গুঁজে দিলাম আগুনে। ক্ষুধার্ত শিখা ধীরে। ধীরে গ্রাস করল ডালগুলো, তারপর একটা পিচ-পাইনের টুকরো পেয়ে লকলক করে উঠল। ছাতে বাড়ি খেলো একটা বুলেট, গোঁত্তা মেরে নেমে এসে লণ্ডভণ্ড করে দিল আগুন। জামা-কাপড় এবং বিছানা থেকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ঝেড়ে ফেললাম আমি। পরক্ষণে অগ্নিকুণ্ডের ঠিক সামনে আরেকটা বুলেট এসে পড়ল, তীক্ষ্ণ টান অনুভব করলাম জামার হাতায়।গাছপালার ফাঁক দিয়ে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ওদের আগুন। লক্ষ্য স্থির করলাম ঠাণ্ডা মেঝেতে শুয়ে, ঝোপের প্রান্তে একটা কালো কাঠামো দেখা যাচ্ছে।ক্ষণিকের জন্যে ঢিল দিলাম পেশীতে। একটা লম্বা নিশ্বাস নিয়ে, তর্জনী রাখলাম ট্রিগারে, আস্তে আস্তে বের করে দিলাম শ্বাস, তারপর আঙুল বাঁকা করলাম।

পৃষ্ঠা -৭৬

বীভৎস চিৎকার উঠল একটা… পরমুহূর্তে বমি করার আওয়াজ ভেসে এল কোনও পশু বা মানুষের গলা দিয়ে অমন ভয়ঙ্কর আওয়াজ বেরোয় আগে জানতাম না আমি।এক ঝাঁক বুলেট ছুটে এল। আরও চারটে গুলি ছুঁড়লাম আমি, আগুনের পেছনে চার ফুট জায়গা জুড়ে, তারপর এক সেকেন্ড থেমে আগুনের ঠিক ও- পাশে আর একটা।’ড্র,’ বললাম আমি, ‘রান্না চড়াও। ব্যাগে ময়দা আছে, মাংস নাও কিছুটা। অন্ধকার ঘনালেই আমরা পালাব।”পারব?”চেষ্টা করতে দোষ কী?’টুথহিলদের পরবর্তী পদক্ষেপ আঁচ করতে পারছি না বলে উৎকণ্ঠা বোধ করছি, তবে ঠাণ্ডাই ভাবিয়ে তুলেছে বেশি।যে করে হোক পালাতে হবে আমাদের। চেষ্টা করতে হবে এখনও বল আছে, এরপর তাও থাকবে না।পাহাড়ে শীত কাটানোর মত শরীরের অবস্থা নয় ডুসিলার। পর্যাপ্ত খাবার নেই আমাদের, প্রয়োজনীয় পোশাক এবং সরঞ্জামের অভাব রয়েছে। তবে, বাইরের ওদের অবস্থা এর চাইতে খারাপ। আমার গুলিতে লোকটা যদি মরে গিয়ে থাকে, খোদার দরবারে আমার জন্যে তার শোকর আদায় করা উচিত। ওর একটা মহাউপকার করেছি আমি… মেরে যাবতীয় যন্ত্রণা থেকে রেহাই দিয়েছি।গোলাগুলিতে ভয় পেয়ে ঘোড়াগুলো দূরে সরে গিয়েছিল, এখন ফিরে আসছে। কিন্তু আমাদের কাছে পৌছানোর আগেই পরপর দুটো গুলিতে মারা পড়ল। প্রথমে প্যাক হর্স, তারপর অ্যাপালুসা।বহুকাল পর এই প্রথম ঝেড়ে গাল দিলাম আমি। বাবা খিস্তিতে পটু ছিলেন না, আর মা তো এর ঘোর বিরুদ্ধে। তাই আমাদের কারও মুখ তেমন খারাপ নয়, কিন্তু এ-ক্ষেত্রে আমার সহ্যক্ষমতা ভেঙে গেল। ভাল জাতের ঘোড়া ছিল ওগুলো, তা ছাড়া ওরা কারও পাকা ধানে মই দেয়নি। তবে কেন ওদের খুন করা হলো বুঝতে পারছি। ওই লোকগুলো নিজেদের তীব্র খাদ্য সমস্যার কথা জানে… ঘোড়াদুটো ওদের মাংসের জোগান দেবে।রাত নামল। তারা ফুটছে আকাশে। হিমশীতল পানির মত হাওয়া আসছে পাহাড় ডিঙিয়ে। চাঁদ উঠেছে, তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি না, পাহাড়চুড়োয় ডানা মেলেছে জ্যোৎস্না। দুবার জঙ্গলের দিকে গুলি চালালাম, তারপর খেতে বসলাম ড্রসিলাকে নিয়ে। প্রচণ্ড টেনশনে মুখে বিশেষ কিছু রুচল না। উদ্বৃত্ত মাংসটুকু একটা থলেতে চালান করলাম আমি। অন্য পোঁটলায় রইল আমাদের – বিছানাপাটি আর গোলাবারুদ।.টম বিগলোর গান বেল্ট ও- পিস্তল কুড়িয়ে আনলাম একটা লম্বা খুঁটির

পৃষ্ঠা -৭৭

সাহায্যে। আগে ওটা দিয়ে মাছ ধরতাম আমি। ওর বেল্টের কার্তুজগুলো আমার বেল্টের শূন্যস্থান পূরণ করল। সিলিন্ডার উপুড় করে আমার তালুতে রাখলাম বুলেটগুলো, কুঠারের আঘাতে গুঁড়িয়ে দিলাম ফায়ারিং পিন।এ-বার আমার হ্যাভারস্যাকের দড়িতে লুপ বাঁধলাম একটা, ওখানে কুঠার ঝুলবে। মেঝেতে অসংখ্য ছোট বড় পাথর পড়েছিল, ওগুলোর তলায় চাপা দিলাম গাঁইতি আর বেলচা দুটো। ওরা হয়তো খুঁজে পাবে, তবু কাজটা যত কঠিন করে তোলা যায় সে-চেষ্টাই করলাম আমি। থেকে থেকে একটা-দুটো গুলি পেছনের দেয়াল বা লাকড়ির গাদায় এসে হোঁচট খাচ্ছে। লম্বা বিরতি দিয়ে পাল্টা জবাব দিচ্ছি আমি। এটা একটা কৌশল। অপেক্ষা করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে ওরা: আমাদের নীরবতায় চট করে ধরতে পারবে না আসল ঘটনা। বরফের পটভূমিতে ওদের কালো অবয়ব চোখে পড়বে, তবু অন্ধকারের সুযোগে ওরা নির্ঘাত আক্রমণ চালাবে। অবশ্যি উপত্যকার শেষ-প্রান্তে গিয়ে দেয়াল ঘেঁষে যদি আসে..’তৈরি থাকো,’ ফিসফিস করে বললাম ড্রসিলাকে। ‘ওরা বোধ হয় এখন একটা কিছু করবে, তারপর ভাগব আমরা।’ সন্তর্পণে বুকে, হেঁটে বাইরে এলাম আমি, মিশে গেলাম দেয়ালের সাথে।ডানে-বাঁয়ে দুদিকই দেখা যাচ্ছে এখন। সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়ল না প্রথমে… হঠাৎ ডালপালার সাথে কাপড়ের ঘষা খাওয়ার ক্ষীণ শব্দ কানে আসতে সচকিত হয়ে উঠলাম। ঝোপের কিনারে নড়ছে কী যেন, রাইফেল তুললাম আমি, তাক করে ট্রিগার টিপলাম। মুখ খিস্তি করল কেউ, ভারি কিছু পড়ল মাটিতে, পরক্ষণে আমার মুখের অনতিদূরে একটা বুলেট আঘাত হানল পাথরে। ঝপ করে বসে পড়লাম, আধ- কদম পিছিয়ে গেলাম টানেলের ভেতর। বাইরে অকথ্য ভাষায় গালির ঝড় চলছে, এলোপাতাড়ি গুলি হলো কয়েকটা। একটা বোঝা ঝুলিয়ে নিলাম পিঠে। ডুসিলা ইতিমধ্যেই ছোটটা তুলে নিয়েছে। অপেক্ষা করলাম এক মুহূর্ত। ঝোপের কাছে আগুনের ঝলক লক্ষ্য করে রাইফেল ছুঁড়লাম, তারপর আমরা নিঃসাড়ে হাওয়া হলাম।সুড়ঙ্গের আশপাশ গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা। দেয়াল ঘেঁষে দ্রুত পা চালাচ্ছি, যখন অনেকটা সরে এলাম সুড়ঙ্গ থেকে, বাঁক ঘুরে ঢুকে পড়লাম জঙ্গলে। ওরা যে-পথে উঠে এসেছে, সে-পথে নামব আমরা। তারপর উল্টোদিকের ত্রিভুজ চিমনি বেয়ে খাঁজের মাথায় চড়ব। ড্রসিলার পক্ষে দুরূহ হবে কাজটা। জঙ্গলে ঢুকে মন্থর করলাম চলার গতি, একলয়ে এগোচ্ছি। জমাট বাঁধাবরফ, মসৃণ ভূত্বক, স্নো-শূয়ের তাই প্রয়োজন নেই। ফেলে দিলাম জুতোজোড়া, ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে উঠেছিল। যতদিন ঠাণ্ডা আছে, জমাট থাকবে তুষার। কিন্তু এর নীচে রয়েছে শিলাবরফ, ঝড়ের

পৃষ্ঠা -৭৮

সময় পড়েছিল, গরমে ওগুলো যেই গলতে শুরু করবে, অমনি দেখা দেবে সত্যিকার বিপত্তি। চলাফেরা করা যাবে না। সামান্যতম চাপে মারাত্মক তুষারধস নামবে। এই ঠাণ্ডাকে তাই আমাদের জন্যে আশীর্বাদই বলতে হবে।একনাগাড়ে হাঁটংি। খানাতল্লাশির ব্যাপারে অতিউৎসাহ দেখাবে না কেউ, এমনকী আমরা পালিয়েছি এটা টের পেলেও নয়। পরে যখন ঢুকবে ওখানে, ওদের মূল লক্ষ্য থাকবে সোনা খোঁজা। সামনে যা ছিল আমি চেঁছে-মুছে নিয়েছি, বাকিটুকুর জন্যে খোঁড়াখুঁড়ি করতে হবে ওদের।মাঝে-মধ্যে থেমে বিশ্রামের সুযোগ দিচ্ছি ভুসিলাকে, এতে ওর পেশীর জড়তা কেটে যাচ্ছে, স্বাভাবিক হচ্ছে রক্ত চলাচল। কোনও নালিশ জানাচ্ছে না ও. মুখ বুজে কষ্ট সইছে।ট্রেইলে পৌছুলাম আমরা, চন্দ্রালোকে চকচক করছে ক্যানিয়নের দেয়াল। আমার হাত খামচে ধরল ড্রসিলা।’ওরিন? যেতেই হবে?”হ্যাঁ।’আলতোভাবে ট্রেইলে পা রাখলাম আমি। জমাট বরফে সহজতর হবে নামা। সাবধানে রওনা হলাম নীচের দিকে, যেন ডিমের খোসার ওপর দিয়ে হাঁটছি।দেহের অনাবৃত অংশে কামড় বসাচ্ছে বাতাস, টান পড়ছে পেশীতে। নীচের ক্যানিয়নকে মনে হচ্ছে এক বিশাল অন্ধকার গহ্বর, হাঁ করে আছে। জ্যোৎস্নায় খাঁজগুলোকে দেখাচ্ছে হিংস্র মাংসাশী জন্তুর দাঁতের মত। এমন দৃশ্য মানুষের জীবনে বারবার আসে না, শিরায় শিরায় রোমাঞ্চিত আমি, থমকে দাঁড়ালাম এক মিনিট। ডুসিলা ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে, দুহাত আমার কাঁধে।’এই দৃশ্য দেখলে মা খুব খুশি হতেন,’ বললাম। ‘সুন্দর জিনিস দেখতে ভালবাসেন তো।’কনকনে বাতাস ক্রমাগত দাঁত বসাচ্ছে, ক্ষতবিক্ষত হয়ে উঠেছে মুখ, যেন অজস্র সূচ ফোটানো হয়েছে। পায়ের চাপে চিড় ধরছে বরফে; প্রতিপদে শঙ্কা, জীবনমরণের ঝুঁকি।রাস্তাটা তিন ফুট প্রস্থ, কোথাও কোথাও বড়জোর চার ফুট। কিন্তু কিনারে বরফের কারনিস সৃষ্টি হওয়ায় বেশি চওড়া দেখাচ্ছে। খাড়া ঢাল, ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগোচ্ছি, পা ফেলছি মেপে, তারপর আস্তে আস্তে সম্পূর্ণ ভর চাপিয়ে আরেকটা পা তুলছি।ওপরে আকাশ উজ্জ্বল; অফুরান জ্যোৎস্নায় দিনের মত হাসছে শৈলমালা। বহু উঁচুতে একটা খাঁজের মাথায় দমকা তুষার-ঝড় উঠল, ক্ষণিকের জন্যে পাতলা পর্দায় ঢাকা পড়ে গেল আকাশ। আমার গন্তব্য ওই খাঁজ, সকাল নাগাদ ওখানে পৌঁছে যাব। ট্রেইলের ওপর দিকে, ক্যানিয়নের দেয়ালে ঝালরের মত হরফ ঝুলছে। ভয় করছে ভীষণ, সামান্যতম দুলুনিতে ধস নামতে পারে, সূর্য

পৃষ্ঠা -৭৯

উঠলে তো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে। মাঝপথে এসে আবার থামলাম আমরা, ড্রসিলা পাশে চলে এল।’রেডি,’ জিজ্ঞেস করলাম ওকে। ‘ওরা কিন্তু এক্ষুণি এসে পড়বে, ড্র।’ ‘কতক্ষণ হলো বেরিয়েছি?”তা দুঘণ্টা হবে…’ঝড়ের বেগে নীচে নেমে এলাম আমরা, হাঁটু কাঁপছে ঠকঠক করে, গুহার দিকে এগিয়ে গেলাম। ফরসা হবার আগেই ওরা টের পেয়ে যাবে আমরা নেই। আগুন নিভে গেলে ধরে ফেলবে সব কিছু, খ্যাপা কুকুরের মত তেড়ে আসবে আমাদের খোঁজে।গুহার কাছাকাছি আসতে ধোঁয়ার গন্ধ পেলাম নাকেও ঝট করে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি। কেউ আছে গুহায়।পা টিপে টিপে দোরগোড়ায় হাজির হলাম, হাতে উদ্যত রাইফেল। ভেতরে উঁকি দিয়েই জমে গেলাম মূর্তির মত, একটা ৪৪ মাযল্ তাকিয়ে আছে আমার পানে। গুহামুখের মত হাঁ করে আছে যমদূত সাক্ষাৎ মৃত্যুপুরীর মত কালো, অন্ধকার।’মিস্টার,’ বললাম, ‘পিস্তলটা নামাও না হলে আমি তোমাকে খুন করব।’

চোদ্দ

কিড নিউটন ধরে আছে পিস্তল সেই সাদাচুলো ছেলেটি, যাত্রার শুরুতে ওকে আমি গোলমাল থেকে তফাতে থাকবার পরামর্শ দিয়েছিলাম।চিত হয়ে শুয়ে আছে ও, মুমূর্ষু চেহারা, পিস্তলটা কাঁপছে হাতে। একটা কম্বল চাপানো গায়ে। স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, শোয়া থেকেই আগুন উস্কে দেবার চেষ্টা করছিল।’কী ব্যাপার, কিড?’ আমার দিকে পিস্তল তাক করে রইল সে। উইনচেস্টারের ট্রিগার সময়মত চিপতে পারব তো আমি? সে-চেষ্টা যে করতে না হয়, প্রার্থনা করলাম মনে মনে।’পা ভেঙে গেছে।”ওরা তোমাকে ফেলে চলে গেল? এটা কোনও মানুষের মত কাজ হলো, কিড?’ বুক ঢিপঢিপ করছে, তবু সাহসে ভর করে রাইফেলটা নামালাম। ‘কিড, পিস্তল সরাও তোমার জখম দেখব।”তুমি আমাকে সাহায্য করবে কোন দুঃখে, মুখে বলল বটে, কিন্তু ওর চেহারা জানান দিচ্ছে এই মুহূর্তে সাহায্য পেলে ও বর্তে যায়।

পৃষ্ঠা -৮০

‘অসুস্থ লোকের সাথে আমার শত্রুতা নেই’ হাসি ফুটিয়ে তুললাম মুখে- ‘তুমি সেরে ওঠো, তখন দেখা যাবে, কেমন! নাও, বাপু, এখন হাতটা সরাও,দেখি আমি কদ্দুর কী করতে পারি।’ ড্রসিলার উদ্দেশে বললাম, ‘তুমি পাহারায় থাকো।’ওর হাত থেকে পিস্তলটা নিয়ে, তুলে ফেললাম কম্বল। চটী বেঁধেছিল, ঢিলে হয়ে গেছে। বিশ্রীভাবে ফুলে উঠেছে হাঁটুর নীচে, একনজরেই ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে।উরুর কাছ থেকে চিরে ফেললাম ওর প্যান্ট, বুটখানা কেটে খসিয়ে নিলাম পা থেকে। একজোড়া দামী বুট বরবাদ হয়ে যাক এটা কোনও কাউহ্যান্ডই চায় না, কিন্তু এ ছাড়া উপায় নেই। মনে হলো হাঁটুর কয়েক ইঞ্চি নীচে হাড় ভেঙে গেছে। আগের চটীগুলো একদম আনাড়ি হাতের কাজ, নতুন করে কয়েকটা কেটে বেঁধে দিলাম।পানি ফোটালাম খানিকটা, গরম কাপড়ের সেঁক দিলাম। সত্যি বলতে কী, কতটুকু উপকার হবে এতে জানি না, তবে কিড অন্তত অনুভব করবে যে ওর যত্ন নেয়া হচ্ছে। নির্জন গুহায় একজন নিঃসঙ্গ মুমূর্ষু লোকের জন্যে এই অনুভূতিটনিকের মত কাজ দেয়।’নিজের চেষ্টায় এসেছ এখানে?”না, ওরা রেখে গেছে।”কিড, এইসব আজেবাজে লোকের সাথে থেকো না। ভাল কোনও দলে যোগ দাও।’কিছু লাকড়ি ভেঙে চাঙা করলাম আগুন। কেবল একটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়। কঠিন সমস্যায় পড়েছি। এমনিতেই আমরা, ডুসিলা আর আমি, বিপদের মধ্যে আছি, পালানোর চেষ্টা করছি ওই নারকীয় খাঁজ পেরিয়ে। তার ওপর এখন কাঁধে সওয়ার হয়েছে একজন পঙ্গু।লোকে হয়তো বলবে আমার এ-ব্যাপারে মাথা না ঘামালেও চলবে, আমার প্রধান দায়িত্ব ডুসিলাকে নিয়ে এখান থেকে পালানো। একটা দোদুল্যমান অবস্থায় ‘রয়েছি আমরা ব্যর্থতার দিকে পাল্লা বেশি ভারি। আমার মাল লুট করতে চায় এমন কিছু লোকের সাথে এসেছিল কিড, হয়তো মেরেও ফেলত। ইতিপূর্বে আরেকবার আমার সাথে লড়াই বাধাতে চেয়েছিল। ভবিষ্যতে কী হবে জানি না, হয়তো কেউ বাধ্য হয়ে খুন করবে ওকে।কিন্তু এখানে ফেলে গেলে ঠাণ্ডায় জমে মারা যাবে। কোনও সন্দেহ নেই এতে। ওই সোনালোভী হায়েনাগুলো একটা খড়কুটো এগিয়ে দিয়েও সাহায্য করবে না ওকে। কিড মরে গেলেই বরং ওদের লাভ একজন ভাগীদার কমে গেল।জঙ্গলের ধারে গেলাম কুঠারখানা তুলে নিয়ে। চাঁদ ডুবে গেছে, ভোর হলো বলে। একটু খোঁজাখুঁজির পর যা চাইছিলাম পেয়ে গেলাম অ্যাসপেন ঝাড়ে। দুটো মজবুত খুঁটি কেটে আনলাম। প্রায় আট ফুটি।

পৃষ্ঠা ৮১ থেকে ৯০

পৃষ্ঠা -৮১

ডালপালা ছেঁটে কুঠারের সাহায্যে ঘষে ঘষে মসৃণ করলাম একদিক। আমার কুঠারটা ধারাল, গাছ ছাঁটার কায়দা ভালই জানি। ছেলেবেলায় টেনেসিতে থাকতে বেড়ার খুঁটি কেটে হাত পাকিয়েছি। বড়শির ঢঙে গোড়াটা ঈষৎ বাঁকিয়ে দিলাম ওপর দিকে।ছোট ছোট কয়েক টুকরো কাঠ নিয়ে এলাম লাকড়ির পালা থেকে। চারটে করে মোট আটটা ফুটো করলাম খুঁটি দুটোতে, তারপর কাঠের টুকরোগুলো ঢুকিয়ে দিলাম ফাঁকের ভেতর।’কী বানাচ্ছ?”চুপচাপ শুয়ে থাকো। তোমাকে ঘাড়ে করা সম্ভব নয় – তাই টেগেন তৈরি করছি।”আমাকে বাঁচাতে চাও কেন?’ বিস্মিত হলো কিড। ‘ঠাণ্ডায় মরতে দিতে চাই না বলে, ঝাঁঝিয়ে উঠলাম আমি। ‘এখন চুপটি করে শুয়ে থাকো। আমরা যদি বেরোতে পারি, তুমিও আসছ আমাদের সাথে। তবে বেশি কিছু আশা কোরো না আমাদের চান্স খুব কম।’কয়েকমিনিট কথা জোগাল না কিড নিউটনের মুখে। চামড়ার ফিতে দিয়ে ক্রসপিসগুলো বেঁধে ফেললাম আমি। একসময় একটু নড়েচড়ে বসল কিড, ভাঙা পা মেলে দিল সামনে। ‘ওসমান, মেয়েটাকে নিয়ে তুমি বরং চলে যাও। না-না, অন্তর থেকেই বলছি। আমাকে বাঁচানোর দরকার নেই আমি তোমাকে মারব বলেই এসেছিলাম।”পারতে না, কিড। আমি পিস্তল চালাই ছবছর বয়েস থেকে।’ ‘তোমরা যাও। তোমার ওই শ্লেজের কাজ নয় ট্রেইলে বহন করে আমকে।’ ‘আমরা ট্রেইল ধরছি না, কিড।’ গোড়ালিতে ভর দিয়ে বসলাম। ‘বেঁচে থাকলে নাতিপুতির কাছে তুমি গল্প করতে পারবে, কোনও একদিন পাহাড় টপকেছ।’ফাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কিড। বোধগম্য হয়নি আমার প্ল্যান হবার কথাও নয়। সুস্থ মস্তিকে কোনও মানুষ ওই কাজ করবে না।ট্রেইল ধরেই পাহাড়ে এসেছিলাম আমরা, এখন সেগুলো বারো ফুট বরফের তলায় চাপা পড়েছে। তাই আমি ঠিক করেছি খাঁজ পেরিয়ে ও-পাশের খাড়া ঢাল বেয়ে সোজা ক্যাম্পে নেমে যাব।পাগলামি? ঠিক… কিন্তু আর উপায় কী?আমরা সবাই ঘোড়ায় চেপে এসেছিলাম, এখন সেভাবে ফেরা অসম্ভব। মানুষের ভার হয়তো-বা পারবে, ঘোড়া এবং সওয়ারির ওজন একত্রে চাপালে প্রলয় ঘটতে বাধ্য। আমাদের সাফল্যের সম্ভাবনা শতকরা এক, তবু ঝুঁকি নিতে হবে।

পৃষ্ঠা -৮২

ঘোড়ায় চেপে অচেনা জায়গায় যাওয়া, আর পায়ে হেঁটে ফেরা এক কথা দু-তিনগুণ সময় লাগবে। ওই লুটেরাগুলো ভেবেছিল এসেই কাজ হাসিল নয় করে ফিরে যাবে। কঠিন গাড্ডায় পড়েছে ওরা।’মানে?’ এ-বার বোধ হয় কিড আমার মতলব বুঝেছে, আতঙ্ক ফুটে উঠেছে চোখে।কাজ থামিয়ে উল্টোদিকের পাহাড়ের পানে ইশারা করলাম। ‘ওটা আরও উঁচু – টপকাব।’ওর চাউনি বলে দিচ্ছে আমাকে উন্মাদ ভাবছে ও। একলা একজন লোক কিনা চায় একটা মেয়ে আর একজন আহত লোককে নিয়ে পাহাড় টপকাতে।ভোরের মুখে রওনা হলাম আমরা। পুব আকাশে সবে আলো ফুটছে। নড়বড়ে স্লেজে দড়ি বেঁধে টানছি আমি। খাড়া টেইল্যাস, তবে বরফ থাকাতে ওঠা সহজ হচ্ছে, পাথর সরে যাচ্ছে না পায়ের তলায়। তবু, উঠতে ঘাম ছুটে গেল।ড্রসিলা আপাদমস্তক চিমনিটা দেখে ভয়-বিস্ফারিত চোখে ঘুরল আমার দিকে। ‘ওরিন,’ বলল ফিসফিস করে, ‘না।’বস্তুত আমি নিজেও শঙ্কিত। উঁচু পাহাড়, তায় ভাঙাচোরা, প্রতিপলে প্রাণ হারাবার আশঙ্কা। আড়াআড়িভাবে রাইফেলটা ঝুলিয়ে নিলাম কাঁধে, তারপর আমার বেল্টে একগোছা দড়ি বেঁয়ে ডাকলাম ডুসিলাকে।শুয়ে আছে কিড, স্নেজের সাথে শরীর বাঁধা, আমার পানে তাকাল। ‘আমাকে ফেলে যাচ্ছ, ওসমান? না-না, তোমাকে দুষছি না হলে তোমার একজোড়া ডানা লাগবে।’ ওখানে উঠতে টেগেনের মাথায় দড়ির একটা প্রান্ত বেঁধে আমি রওনা হলাম। প্রতিটা রানারের সাথে পেঁচিয়ে, সবশেষে ওপরের ক্রসপিসে বাঁধা হয়েছে দড়িটা। এর ফলে টেনে তোলার সময় সোজাভাবে ঝুলবে ওটা।যাত্রাপথে বরফের গায়ে টো-হোলড খুঁড়লাম কিছু, গতবার ব্যবহার করেছিলাম এমন দুটো চোখে পড়ল। চিমনির মাথায় ‘উঠে আসতে বললাম ডুসিলাকে।ও দেখতে ছোটখাটো মানুষটি হলে কী হবে অসম্ভব চটপটে, সাহসী। তরতর করে উঠে এল, আমার চেয়ে স্বচ্ছন্দে।বুড়ো গ্রন্থিলব্রিসল-কন সেই আগের জায়গায় অবিচল দাঁড়িয়ে, চিমনির অব্যবহিত ওপরে, পাহাড়ের গভীরে মেলে দিয়েছে শতসহস্র শেকড়। গাছের পেছনে গিয়ে গোড়ালিতে ভর রেখে বসলাম আমি, বাঁ-পা ঈষৎ সামনে বাড়ানো। তারপর আস্তে আস্তে গোটাতে শুরু করলাম দড়ি। আগেই বলেছি, আমি বড়মাপের মানুষ, কাঁধ আর বাহুতে পাকানো পেশী। কিন্তু কিডের ভার বইতে গিয়ে অনুভর করলাম কঠিন কাজে নেমেছি। ওকে টেনে তোলা কেবল এর একটা দিক মাত্র। পাথুরে দেয়াল থেকে

পৃষ্ঠা -৮৩

নিজের চেষ্টায় দূরে সরে থাকতে হবে ওকে, নয়তো টানাহেঁচড়ায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাবে শ্রীর। যেখানে সুবিধে পাচ্ছে কিড নিজেই উঠে আসছে, এ-ক্ষেত্রে হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরছে টো-হোলডগুলোকে।ডুসিলা আমার পাশে দাঁড়ানো, পাইনের গুঁড়িতে জড়িয়ে দিচ্ছে দড়ি। হাত ধরে গেছে আমার, তবু দাঁতে দাঁত চেপে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।কিছু সময়ের জন্যে অবসর দিলাম হাতকে। প্যাকবোর্ডে বাঁধা শিশুর মত শূন্যে ঝুলে রইল কিড। উপত্যকার ও-পাশে চোখ পড়তেই দেখলাম, ট্রেইল বেয়ে নামছে চারজন লাক। সিকি মাইলটাক দূরে রয়েছে। সারির শেষ ব্যক্তি খোঁড়াচ্ছে।রাইফেল তুলল একজন, একটা ভোঁতা আওয়াজ কানে এল আমাদের। বুলেটের কী হলো বলতে পারব না, তবে আমাদের ধারেকাছে কোথাও আসেনি। টার্গেট উঁচুতে থাকলে এ-রকম ক্যানিয়নে দূরত্ব হিসেব করা অসম্ভব।কালেভদ্রে ঝড়ে বক মরে, এই-যা। আমি নিজেও বহুবার ব্যর্থ হয়েছি। আবার মন দিলাম কাজে। ব্যথা করছে হাত, হাঁসফাঁস করছি নিশ্বাসেরজন্যে। পাহাড়চুড়োয় বাতাস হালকা, ফুসফুস খালি হয়ে যায়। অতিকষ্টে ফুট দুয়েক টেনে তুললাম ওকে, পরস্পর ঘষে গরম করে নিলাম দুহাতের তালু,তারপর ফের শুরু করলাম। কোনও দিকে তাকানোর অবসর নেই। এখন শুধুই টেনে তোলা। টানো, শ্বাস নাও, আবার টানো।ফাটলের এককোণে বেধে আটকে গেল টেগেনটা। ‘ড্র’ সোজা হয়ে বললাম, ‘আমি নীচে যাচ্ছি। তুমি যতটা পারো দড়ি গাছের সাথে জড়িয়ে ফেলো।”ওরিন?’ঘুরে তাকালাম ওর পানে। সরাসরি আমার চোখের দিকে চেয়ে আছে। ‘তুমি এই ঝামেলা পোয়াচ্ছ কেন? আমি দুর্ব্যবহার করেছিলাম বলে?’দিব্যি কেটে বলছি, একটিবারও এ-চিন্তা ঠাঁই পায়নি আমার মাথায়। ‘না,, ড্র। একটা কথা কী জানো, বিপদের সময় কোনও পুরুষই মেয়েলোকের কথামত চলে না। সে তার বিবেক-বুদ্ধি অনুযায়ী কাজ করে। ওই লোকটা একবার আমাকে খুন করতে চেয়েছিল। আমারও প্ল্যান ছিল ওকে হারাব।’সেটা এক জিনিস, কিন্তু এখন পরিস্থিতি একদম আলাদা। এখন ও একজন অসহায় মানুষ। আমি ওকে উদ্ধার করার পর হয়তো ও আবার আমাকে খুন করতে চাইবে। তখন আমিও তাই করব।’নেমে গেলাম ঢাল বেয়ে। একটা ফাটলের কোনায় আটকে গিয়েছিল শ্লেজটা, মুক্ত করলাম, তারপর কিডকে টেনে তুললাম খাঁজের মাথায়।এই পাহাড়ের নীচে রয়েছে ক্যাপ, আমাদের কেবিন: এবং ক্লেইম দূরের ওই গাছপালার আড়ালে নিভৃত শান্তি অথচ এখানে ঝোড়ো হাওয়ায় সোজা

পৃষ্ঠা -৮৪

হয়ে দাঁড়াতে পারছি না আমরা। সমস্ত চিন্তা দূর করে দিলাম মাথা থেকে: যেভাবেই হোক নামতে হবে আমাদের, এবং দ্রুত।ফের মেঘ করছে কালো কালো ঢাউস সব মেঘ। অর্থাৎ আরও তুষারপাত হবে। চলতি হপ্তা শেষ হবার আগেই ওই ক্যানিয়ন হয়তো বিশ ফুট বরফে ঢাকা পড়বে।আকাশ পথে ক্যাম্পের দূরত্ব আধ-মাইল, তবে পাঁচ হাজার ফুট নীচে। উত্তরে যে-ট্রেইলটা আবিষ্কার করেছিলাম আমি, সেটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। একবার জঙ্গলে পৌছুতে পারলে, বাকি পথটুকু পেরোতে পারব আমরা যদিও পরিশ্রম হবে অমানুষিক।এই পাহাড় প্রায় তেরো হাজার ফুট উঁচু, সগর্জনে বাতাস বইছে। ছোট ছোট নুড়িপাথর উড়িয়ে নিয়ে গেল, ঝিরঝিরে তুষার পড়ছে। হাওয়ার অনুকূলে রওনা হলাম আমরা, প্লেজটা টেনে আনছি। অবশেষে খাঁজ, ডিঙিয়ে নামলাম নীচে। ঠিক সেই মুহূর্তে বাতাস পড়ে এল।আমার মুখ ফেটে চৌচির, হাত অসাড়। দস্তানার ভেতর আঙুল নাড়াতে পারছি না, শক্ত হয়ে গেছে। কিড নড়তে পারছে না, ঠাণ্ডায় জমে যে-কোনও মুহূর্তে ওর মৃত্যু হতে পারে, আমার ভয় হলো।স্লেজটাকে সামনে রেখে অগ্রসর হলাম ঢাল বেয়ে। হঠাৎ পাহাড়ের এককোণ থেকে দমকা হাওয়া ছুটে এল; বৃক্ষপত্রের মত স্লেজসহ শূন্যে তুলে ফেলল আমাদের। পরক্ষণে নামিয়ে দিল আবার, দড়ি ছিঁড়ে গেল আমার হাত থেকে। দড়াম করে আছাড় খেলো স্লেজটা, ঝাঁকুনি লাগল কিডের ভাঙা পায়ে,ব্যথায় ককিয়ে উঠল।প্রথমে ডুসিলা নেমে গেল। পাথুরে মেঝেতে বুক ঠেকালাম আমি, ধীরে- সুস্থে নামিয়ে দিলাম কিডকে। ইতিমধ্যে আমি সময়জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি, খেয়াল করতে পারছি না শেষ কবে গরম অনুভব করেছিলাম।সামনে, নীচে একটা বিশাল বুড়ো গাছ শেকড় উপড়ে পড়ে আছে। বিরাট মাকড়সার মত ছড়িয়ে আছে গাছটা, মৃত্যুযন্ত্রণায় ধুকছে, কেঁপে কেঁপে উঠছে শেকড়গুলো। এর সামান্য নীচে ইতস্তত-ছড়ানো গাছ, বাতাসের অত্যাচারে অধিকাংশই ন্যাড়া, বেঁটে তারপর জঙ্গল। গাছের মাথাগুলো দেখতে পাচ্ছি আমরা; দূরে, বহুদূরে অমলধবল তুষার-রাজ্য। কোনও কোনও বাড়ি থেকে ক্ষীণ ধোঁয়ার রেখা উঠছে।বাড়ির কথা মনে পড়ল আমার। ভাসমান তুষারকণার পর্দায় দেখলাম, আগুন জ্বলছে ফায়ারপ্লেসে, দোলনা-চেয়ারে দুলছেন মা, মুখে জ্বলন্ত পাইপ, গিটার বাজিয়ে গান ধরেছে অ্যানজেল। হঠাৎ ঝোড়ো হাওয়ায় ছিঁড়ে গেল পর্দা: ড্রসিলা, আহত কিড আর বাতাসের সাঁই-সাঁই ঝাপটা ছাড়া কেউ নেই সঙ্গে।একসময় আমরা বনে ঢুকলাম। এ-বার আর অসুবিধে হচ্ছে না চলতে। কেবল এখানে-সেখানে সাবধানে ধরাধরি করে নামাচ্ছি স্লেজ। এক জায়গায়

পৃষ্ঠা -৮৫

পাথরে হোঁচট খেয়ে আরেকটু হলেই পড়ে যাচ্ছিল ভুসিলা, হাত বাড়িয়ে খপ করে ধরে ফেললাম। অবশ্যি আমি নিজেও সুস্থ বোধ করছি না, দুহাঁটু ঠকঠক বাড়ি খাচ্ছে ক্রমাগত।ক্যাম্পের ওপরে ছোট্ট যে-কেল্লাটা আমি বানিয়েছিলাম, অবশেষে সেখানে পৌছুলাম। ইতিমধ্যে দুবার আছাড় খেয়েছি আমি, ঠাণ্ডায় পরিশ্রমে এত নিস্তেজ বোধ করছি যে আমার মাথা কাজ করছে না। ড্রসিলার কাঁধে ভর রেখে দীর্ঘ পাইন বনের ভেতর দিয়ে বাসার দিকে যাত্রা করলাম। দড়ি-টানা স্লেজটা আসছে পেছন পেছন।গাছপালার গোড়ায় পুরু বরফ জমেছে। সুতোর মত ধোঁয়া উঠছে চিমনি দিয়ে, জানালায় আলো দেখা যাচ্ছে একটা। মনে হলো এই তো ভোর হচ্ছিল, এখন আবার রাত নামছে।সহসা, বরফের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে গেলাম আমি। অনুভব করলাম ওঠার চেষ্টা করছি… দুহাতের তালুতে ভর দিয়ে উঠছি একটু একটু করে। জানালার বাতিটা চোখে পড়ছে, হালকা কথাবার্তা কানে আসছে। টলতে টলতে দরজায় গেলাম, অনেক চেষ্টাতেও খুলতে পারছি না, ল্যাচের ওপর সাড়া দিচ্ছে না আমার আঙুল।আচমকা খুলে গেল কপাট, সিক্স-গান হাতে ক্যাপ দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে সতর্ক, প্রস্তুত।’ভয় নেই, ক্যাপ, আমি,’ শ্রান্ত অবসন্ন গলায় বললাম।জো রাগার ছিল, দুজনে মিলে চ্যাংদোলা করে কিড নিউটনকে নিয়ে গেল ঘরে। ড্রসিলা দুহাতে মুখ গুঁজে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল। ওর পাশে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসলাম আমি, সান্ত্বনাবাণী শোনাতে লাগলাম একহাতে জড়িয়ে ধরে। কিড নিউটন আমার হাত খামচে ধরল। ‘মাইরি,’ বলল সে, ‘আজ আমি একজন মরদ-”ঘুমোনোর চেষ্টা করো, কিড,’ বললাম। ‘জো ডাক্তার ডাকতে যাচ্ছে।”অথচ আমি কিনা নিজেকে আপনমনে বিড়বিড় করছিল কিড। ‘শাট আপ!’ ধমক দিলাম আমি। উঠে আগুনের কাছে গিয়ে মেলে ধরলাম হাত। ঠাণ্ডা ছেড়ে যেতেই লক্ষকোটি সূচ চঞ্চল হয়ে উঠল আমার আঙুলের ডগায়।’সত্যিকার মরদের কথা যদি বলো’ তাকালাম নিউটনের দিকে ‘মোরায় আমার যে-দুভাই আছে, ও’নীল আর অ্যানজেল, ওরা!’ ‘আমি বড় হবার চেষ্টাই করেছি, কিন্তু পারিনি।’বিছানার কিনারে বসে তাপ শুষে নিচ্ছি। প্রতিটি পেশীর খিল ছেড়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে, ফিরে পাচ্ছি সাড়া। ড্রসিলা আমার পাশে ঘুমিয়ে পড়েছে, দুগালে শুকনো অশ্রুর দাগ, চোখের কোলে কালি।’অনেক ঝড় গেছে তোমার ওপর দিয়ে,’ বলে নিউটনের দিকে তাকাল ক্যাপ। ‘ওকে বাঁচালে কেন?’

পৃষ্ঠা -৮৬

‘ওটাই ভাল বলে মনে হয়েছে, তাই।”কিন্তু ও তোমাকে খুন করতে চেয়েছিল!”হ্যাঁ… মনে মনে। আমার বিশ্বাস সেই থেকে ও ভাবনাচিন্তা করার সময় পেয়েছে।’মুখ থেকে পাইপ নামাল ক্যাপ সয়‍্যার, পটে কফি ঢালল।’এ-বার তা হলে তুমি একটু চিন্তাভাবনা করো,’ বলল সে। ‘আরেকজন বিগলো এসেছে শহরে তোমার খোঁজ করছে।’

পনেরো

বিছানায় শুয়ে থাকার বান্দা নই আমি। ভোরে ফের খাড়া হলাম, শরীরে বল ফিরে আসেনি। দারুণ খিদে পেয়েছে, তাই উঠে পড়েছি।ভুসিলা এখনও ঘুমোচ্ছে আরেকটা কামরায়। সস্ত্রীক বেড়াতে এসেছে জো রাগার। ওখাইওর পাট চুকিয়ে গতকাল এখানে পৌঁছেছে ওর স্ত্রী।’বিগলো লোকটা আমাকে বড্ড ভাবিয়ে তুলেছে,’ বলল রাগার। ‘গায়ে পড়ে ঝগড়া বাধাতে চাইছে।”লেসিং চেনো একধরনের ইঁদুর। সুমেরু অঞ্চলে দেখা যায়, ভীষণ নাছোড়বান্দা। একটা যে-দিকে যায়, আরগুলো হুড়মুড় করে তার পিছু নেয়, একবারও ভাবে না এতে তার মরণ হতে পারে। বিগলোদের আমার ওইরকম মনে হচ্ছে ওদের মধ্যে যেন প্রতিযোগিতা লেগে গেছে, কে কার আগে মরবে।”ওকে এত হালকাভাবে নিও না, ওরিন,’ রাগার হুঁশিয়ার করল। ‘ডেনভার সিটি আর টাসকোসায় এই সেদিন দুজন লোককে খুন করেছে ও। বেনসন, বিগলো ভাইদের মধ্যে সবার বড় এবং সবচেয়ে ডেঞ্জারাস।”নাম শুনেছি,’ বলল ক্যাপ। ‘তবে ভাই-ব্রাদার আছে জানতাম না।’ ‘অন্যদের খোঁজ করছে। ওরা পাহাড় থেকে ফিরে আসেনি। বেনসনের বিশ্বাস, তুমি খুন করেছ।”ফিরলেই বরং অবাক হব। না, আমি মারিনি। ওরা পাঁচজন ছিল। ডুসিলা থাকায় ঝুঁকিটা নেইনি।’আগুনের তাপে ঘর গরম। আরাম লাগছে আমার। একটুবাদে ফের সটান ঘুমিয়ে পড়লাম।যখন চোখ মেললাম, উনানে রান্না চাপিয়েছে ডুসিলা। উঠে বুট পরলাম আমি। ভাল করে কুলি করলাম বেসিনে, হাত-মুখ ধুলাম। পানির ছোঁয়ায় জুড়িয়ে গেল মুখ, গালে হাত বুলিয়ে বুঝলাম দাড়ি কামানো দরকার।

পৃষ্ঠা -৮৭

ক্যাপ বাইরে কোথাও গেছে। বাসায় আমরা দুজন একা। কিড হাসপাতালে, ডাক্তার নিয়ে গেছেন।ড্রসিলাকে চুলোর পাড়ে দেখে আমার ভারি ভাল লাগল। এই অবস্থায় দেখলে কে বলবে, মাত্র কাল সন্ধ্যেয় যমের দরজা থেকে বেঁচে ফিরে এসেছে ও। মেয়েদের এই গুণটি আমার মন কাড়ে: ঝামেলার মাঝেও, ওদের গিন্নিস্বভাব বদলায় না। সমবেদনা দিয়ে যে-মেয়ে পুরুষকে ধরে রাখতে পারে সে-ই বুদ্ধিমতী। পুরুষের ভালবাসা ঝরনার মত, অজস্রধারায় ছড়িয়ে পড়ে। মেয়েদের প্রেম বহতা নদী, সেই ঝরনা-ধারাকে সস্নেহে বুকে লালন করে। পুরুষের টান বাইরে, মেয়েদের আকর্ষণ ভেতরে। তাই মেয়েদের উচিত পুরুষকে প্রেমের বন্ধনে জড়ানো; সংসারের নাগপাশে নয়। আমার এ-শিক্ষা হয়েছে মায়ের কাছে, বাবার দুরন্তপনাকে একটুও খর্ব না করে ভালবাসার মায়ায় বেঁধেছিলেন তাঁকে। এতে মায়ের নারীত্ব যায়নি, বাবার পৌরুষেরও হানি ঘটেনি।ড্রসিলার এখনও বহু শিক্ষা বাকি। ও কী শিখবে?হঠাৎ চিন্তার সুতো ছিঁড়ে গেল। ডিনারে ডাকছে ড্রসিলা। আমার দাড়ি কামানো সারা, তৈরি হয়ে নিলাম।বাইরে ক্যাপের পদশব্দ, বারান্দায় বুট ঝেড়ে ঘরে ঢুকল।’বরফ পড়ছে,’ বলল সে। ‘তোমার কপাল ভাল, আর কিছুক্ষণ দেরি হলে হয়তো ফিরতে পারতে না।’ড্র এক কাপ ধূমায়িত কফি এনে দিল আমাকে, দুহাতের তালুতে ধরে ওই লোকগুলোর কথা ভাবতে লাগলাম। ওরা স্বেচ্ছায় নিজেদের পায়ে কুড়োল মেরেছে। লোকগুলো আমার শত্রু, তবু ওদের জন্যে দুঃখ হলো।এক চুমুক কফি খেয়ে ক্যাপ তাকাল আমার দিকে। ‘বেনসন বলছে তোমার নাকি সাহস নেই, ওর সাথে লড়তে ভয় পাচ্ছ।’সংসারটা বড় আজব জায়গা, কিছু লোক থাকে যারা জেনেশুনে আগুনে ঝাঁপ দেয়।জীবনের কাছে আমার চাওয়া খুব সামান্য: একটা ছোট্ট বাথান, কিছু গবাদি পশু, আর আবাদযোগ্য খানিকটা জমি। সহসা ড্রসিলার প্রতি চোখ পড়তে উপলব্ধি করলাম, না, কেবল এই নয় আরও কিছু চাই আমি।কথাটা কীভাবে পাড়ব বুঝতে পারছি না। দেবার মত আমার কিছু নেই, তাই বলতেও ভয় হচ্ছে। আমি এখন পুরোপুরি যুবক, সবে ঠিকমত পড়তে শিখছি, একটা খনি পেয়েছি তবে সেটা কত বড় জানি না। বস্তুত ওটাকে আমার একটা পকেট বলে মনে হয়েছে। সে-জন্যেই ঠিক করেছি বসন্তের শুরুতে মোরায়, ভাইদের কাছে চলে যাব।কথাটা জানালাম ক্যাপকে।’ও-সব তোমার না ভাবলেও চলবে,’ বলল সে। ‘ও’নীল আর অ্যানজেল

পৃষ্ঠা -৮৮

আসছে এখানে। বিল ক্যানাভানও আছে।’বিলের বাড়ি কামবারল্যান্ডেই। এককালে ওখানকার শেরিফ ছিল, আমাদের দূরসম্পর্কের আত্মীয়। অ্যানজেলকে রাজনীতিতে এনেছে ও-ই, তবে টেনেসির ছেলেরাও রাজনীতি পাগল।’কবে?”আজ রাত, বা কাল। তোমার বিপদের কথা শুনেই আসছে।’নিশ্চয়ই শহর হয়ে আসবে ওরা। ওখানে বিগলো রয়েছে। আমাকে চেনে না সে। আচমকা ওসমান নামটা শুনে গোলাগুলি বাধিয়ে বসা অসম্ভব নয়। তেমন ঘটলে অবশ্যি আমার চিন্তার কিছু নেই। ও’নীল একাই ওকেসামলাতে পারবে… পিস্তলে ওর হাত বিজলি-চমকের মত ক্ষিপ্র।কফিপান শেষে উঠে দাঁড়ালাম আমি। গান বেল্ট তুলে নিয়ে বাঁধলাম কোমরে। তারপর কোট আর হ্যাট হাতে নিয়ে বললাম, ‘শহরে যাচ্ছি।’ ‘এখানে গুমট লাগছে,’ বলল ক্যাপ সয়্যার, ‘আমিও আসছি।’উনোনের পাশ থেকে ঘাড় ফেরাল ড্রসিলা, হাতে একটা খুস্তি। ‘খেয়ে গেলে না? এত কষ্ট করে রাঁধলাম।”দেরি হবে না,’ বললাম আমি, ‘খাবারগুলো গরম রেখো, ড্র।’কোট পরে হ্যাট চাপালাম মাথায়। এতে পোষাবে না, কুনস্কিনের জ্যাকেট কিনতে হবে। ‘অবশ্যি,’ খেই ধরলাম, ‘তোমার রান্না আমার খাওয়া উচিত নয় অভ্যাস হয়ে যাবে।’সোজা আমার চোখের দিকে তাকিয়েছিল ও, মুহূর্তের জন্যে আরক্ত হলো চেহারা।’বিশেষ করে আমার মত বোকাকে কোনও মেয়ে যখন বিয়ে করবে না।’ ‘মেয়েদের তুমি খুব ভাল চেনো বলে মনে হচ্ছে, ওর গলায় ঝাঁঝ প্রকাশ পেল। ‘আজ পর্যন্ত কোনও বোকাকে দেখেছ যার বউ নেই?’সত্যি বলতি কী, দেখিনি।’গরম রেখো,’ বললাম আমি।বেনসন বিগলো সম্পর্কে একটা কথাও বলল না ডুসিলা। শুধু বলল, ‘দেরি কোরো না, ওরিন হাত পুড়িয়ে রেঁধেছি।’বাইরে যদিও ঠাণ্ডা, আমার আরাম লাগছে। কোরাল থেকে ঘোড়া বের করল ক্যাপ। স্যাডল চাপানোই ছিল, নীরবে রওনা হলাম আমরা। খদ্দের গিজগিজ করছে স্যালুনে। বারে একজন দীর্ঘদেহী লোক দাঁড়িয়ে। চওড়া, দৃঢ়বদ্ধ চোয়াল। একনজরে বোঝা যায় গায়ে প্রচণ্ড শক্তি ধরে এ-লোক। আঁচ করলাম, ও-ই বেনসন বিগলো। ওরিন ওসমান, আপনমনে বললাম আমি, একে হালকাভাবে নিও না জাত কেউটে।ঘুরে আমার দিকে তাকাল সে। এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম ওর পাশে। চোখের পলকে খালি হতে শুরু করল স্যালুন। আমি যখন বারে দাঁড়াই,

পৃষ্ঠা -৮৯

পঞ্চাশ-ষাটজন ছিল, আধ-মিনিট পর মোটে জনাছয়েক রইল। এরা নিরীহ কৌতূহলী দর্শক, কী ঘটে স্বচোখে দেখে গল্প করবে প্রিয়জনদের কাছে।তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাকে ওপর-নীচ জরিপ করল বিগলো। শান্ত নিরুদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে আমি চেয়ে রইলাম ওর পানে। একটুবাদে হাসি হাসি মুখ করে বললাম, ‘বিগলো, তোমার গোঁফটা তো দারুণ!”মানে?”না, এমনি বললাম ড্রিংকস চলবে?”কথা এড়াচ্ছ কেন? না, আমি পরেরটা খাই না!’এতক্ষণে ওর হুঁশ হলো, ভিড় পাতলা হয়ে গেছে। শক্ত হয়ে গেল বিগলোর চোয়াল, দুপাশের হাড় ঠেলে বেরোতে চাইছে, চোখ কোঁচকানো।বাইরে থেকে ঘোড়ার পদশব্দ ভেসে আসছে। এই আবহাওয়ায় জরুরি কাজ না থাকলে কেউ বেরোবে না বাড়ি ছেড়ে। অ্যানজেল আর ও’নীল বোধ হয় এসে পড়েছে, ভাবলাম।দুশো মাইল দূর থেকে ছুটে এসেছে আমার ওই দুভাই আমার বিপদের খবর পেয়েই এসেছে।’তুমিই ওরিন ওসমান?’ বিগলোর গলায় রুক্ষতা। ‘তোমার ভাইটা, ওই ওয়েস, তাসের কিসু জানত না। পিস্তলেও আনাড়ি,এত করে নিষেধ করলাম-”টম, ইরা ওরা কোথায়?”অপেক্ষা করো, শীত কাটুক, বসন্তে ওদের দেখা পাবে,’ বললাম আমি। ‘ওদেরও মাথায় ঘিলু বলতে কিছু ছিল না, এই বরফের মধ্যে কেউ যায়পাহাড়ে!”তুমি দেখেছ ওদের?”দুবার আক্রমণ করেছিল আমাকে। পারেনি, মাঝখান থেকে টম তার, পিস্তল খুইয়েছে।’চুপ করে আছে বিগলো, কপালে ভাঁজ পড়েছে।’শুনলাম তুমি আমাকে মারতে এসেছ?’ মৃদু সুরে প্রশ্ন করলাম।এখনও আমাকে বুঝে উঠতে পারেনি ও। আমার হাবভাবে বিন্দুমাত্র চাঞ্চল্য বা উৎকণ্ঠা প্রকাশ পায়নি। সচরাচর একজন পথচারীর সাথে মানুষ যেভাবে কথা বলে, তেমনি হালকা চালে আলাপ করছি।’তুমি এক কাজ করো, বিপলো, এখান থেকে চলে যাও। তোমার ভাইয়েরা নিজেদের দোষে মরেছে।’তোমার কথাই বোধ হয় ঠিক,’ বলল সে। ‘এসো, ড্রিংক করবে।’ হুস্ করে চেপে-রাখা নিশ্বাস ছাড়ল কেউ। মৃদু গুঞ্জন শুরু হয়েছে খদ্দেরদের মাঝে। চমকপ্রদ কিছু ঘটল না দেখে হতাশ হয়েছে ওরা। বারটেন্ডার দুটো গ্লাসে পানীয় ঢেলে দিল। আমি একচুমুকে শেষ করে

পৃষ্ঠা -৯০

আরেক গ্লাসের অর্ডার দিলাম। ওটা খেয়ে পিছিয়ে এলাম এক পা। ‘চলি, বিগলো দেখা হবে।’ঘুরে দরজার উদ্দেশে হাঁটা দিয়েছি, পেছন থেকে ডাক এল, ‘ওসমান?’ ফাঁকা ঘরে পিস্তল কক্ করার শব্দ জোরাল শোনাল। পাঁই করে ঘুরলাম আধপাক, ওর প্রথম বুলেটটা আমার কানের লতি ছুঁয়ে চলে গেল। ইতিমধ্যে আমার হাতে বেরিয়ে এসেছে পিস্তল, গুলি করলাম ওর পেটে। ছিটকে বারের গায়ে আছড়ে পড়ল সে। বাঁ-হাতে রেলিং ধরে পতন ঠেকাল। বাইরে ঘোড়া থামার শব্দে শুনতে পেলাম না গুলির আওয়াজ, আচমকা কোমরের কাছে তীব্র টান অনুভব করলাম আমি। ককিয়ে উঠলাম ব্যথায়, আবার গুলি করলাম ওকে। এখনও মরেনি ও….৪৪ হলে কী হবে, আসলে কোনও মানুষকে থামাতে সোজা তার মাথায় নয়তো হৃৎপিণ্ডে গুলি করতে হয়। বিশেষ করে লোকটা যদি উন্মাদ হয়। বিগলোর অবস্থা এখন তাই, খুনের নেশায় খ্যাপার মত জ্বলছে ওর চোখ। আহত গ্রিজলির মত দেখাচ্ছে।কয়েকমিনিট অনড় দাঁড়িয়ে রইল বিগলো, রক্তে ভেসে যাচ্ছে শার্ট-প্যান্ট, দুপায়ের মাঝখানে মেঝেতে টপটপ করে বড় বড় লাল ফোঁটা পড়ছে।অতিকষ্টে পিস্তল তুলল বিগলো, বাঁ-হাতে ধরেই আছে রেলিং, নিশানা স্থির করল আমার বুক বরাবর। ধীরে ধীরে কক্ করছে পিস্তল, আবার গুলি করলাম আমি। ওর ধাক্কায় বার কেঁপে উঠল। একটা বোতল উলটে গড়িয়ে চলে এল, ছলকে পড়ল খানিকটা হুইস্কি। হাত বাড়িয়ে বোতলটা তুলে নিল বিগলো, ঠোঁটে ঠেকিয়ে উপুড় করল গলায়, একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে আমার চোখের দিকে।বোতলটা নামিয়ে রাখল বিগলো। ‘ওটার দাম আমি দেব,’ বললাম। ‘আমারই ভুল,’ বলল সে। ‘ওদেরকে পেছন থেকে মারোনি তুমি।”শুধু ওয়েসকে… অন্যরা ঠাণ্ডায় শেষ হয়েছে।”তাই,’ বলে পেছন ফিরল বিগলো। বাইরে ছোটাছুটির আওয়াজ পাচ্ছি।দীর্ঘ একটা মিনিট পিস্তলহাতে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি, চোখ ওর পিঠের দিকে। তারপর ভাঁজ হতে শুরু করল ওর হাঁটু, আস্তে আস্তে পড়ে গেল, কেবল আঙুলগুলো খামচে ধরে রইল রেলিং, ঢিলে হয়ে গেল একসময়, মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল বেনসন মারা গেল বিগলো পরিবারের বড় ছেলে।ভুসির মেঝেতে পড়ে আছে বেনসন বিগলো। চোখের পাতা খোলা, দৃষ্টিছাতে নিবদ্ধ। দাড়ির এখানে-সেখানে ভুসি লেগে আছে।প্যান্টের নীচে ভেজা ভেজা ঠেকছে আমার, রক্ত নামছে গড়িয়ে। পিস্তলে টোটা ভরে খাপে তুলে রাখলাম, ক্যাপ এগিয়ে এল কাছে।’লেগেছে?’ জিজ্ঞেস করল।’মনে হচ্ছে,’ বলে টাল সামলালাম দেয়াল ধরে।ঠাস করে খুলে গেল ব্যাটউইং ডোর, নীল ঢুকল, পেছনে অ্যানজেল। দুজনেরই হাতে খাপমুক্ত পিস্তল।’চলো বাড়ি যাই,’ বললাম আমি, ‘খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।” বিগলোর দিকে তাকাল ওরা।’আর কেউ?’ জিজ্ঞেস করল নীল।’থাকলেও আর চান্স পাবে না, আমি নিজেই এবার আগে গুলি করব।’ ক্যাপ আমার শার্ট খুলল টেনে। ডান কোমরে একটা গর্ত থেকে চুইয়ে রক্ত পড়ছে। মারাত্মক জখম নয়, হাড় অবধি পৌঁছেনি। পকেট থেকে সিলকের রুমাল বের করে ক্ষতস্থানে চেপে দিল নীল।’আগে ডাক্তারের কাছে চলো,’ আপত্তি জানাল ক্যাপ।’বাসায় কল দাও। ড্রসিলা খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছে।’ কেবিনে ফিরে দেখলাম দরজার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে ডুসিলা। ‘এই বোকাটা বিয়ে করেনি এখনও,’ বললাম আমি।ডুসিলা ঘুরে তাকাল আমার দিকে। ‘করবে,’ বলল ও। খুন্তিটা নামিয়ে রেখে এগিয়ে এল, দুহাত সামনে বাড়ানো, চিকচিক করছে চোখের কোল। আমি টেনে নিলাম বুক উথালপাথাল। নিশ্বাস ভারি। ধীরে ধীরে নামছে ঠোঁট। ওদিকে, বাইরে আবার তুষারপাত শুরু হয়েছে।

Home
E-Show
Live TV
Namaz
Blood
Job