অমানুষ
পৃষ্ঠা ১ থেকে ১৫
পৃষ্ঠা-১
প্রস্তাবনা
স্কুল ছুটি হওয়া মাত্র বাচ্চা ছেলেটি ছুটে বেরিয়ে এল। তার বয়স ছ’-সাত-ভারি মিষ্টি চেহারা। বাইরে বৃষ্টি পড়ছিল। ছেলেটি তার সবুজ রঙের রেইনকোটের হুন্ড উঠিয়ে দৌড়াতে শুরু করল। উত্তর দিকের দু’নম্বর গেটে তাদের ড্রাইভার এঞ্জেলো গাড়ির দরজা খুলে অপেক্ষা করছিল। ছেলেটি উঠে বসতেই গাড়ি চলতে শুরু করল। এঞ্জেলো আজ অন্যদিনের চেয়েও দ্রুত চালাচ্ছে। এত তাড়া কিসের তার? ছেলেটি হঠাৎ দারুণ অবাক হল। যে গাড়ি চালাচ্ছে সে এঞ্জেলো নয়। ভয়-পাওয়া গলায় বলল, “তুমি কে?” লোকটি জবাব দিল না। ততক্ষণে হাইওয়েতে এসে পড়েছে। তেমন ট্রাফিক নেই, গাড়ি চলছে উল্কার মতো।ছেলেটির নাম পাপিনো মেচেটি। এইমাত্র তাকে অপহরণ করা হল। পোর্ট সিটি কার্সিকায় গত দু’মাসে এটি হচ্ছে চতুর্থ শিশু অপহরণ।মেয়েটির মধ্যে কিছু-একটা আছে যা পুরুষদের অভিভূত করে দেয়। রূপের বাইরে। অন্যকিছু।অসামান্য রূপসী মেয়েদেরকেও প্রায় সময়ই বেশ সাধারণ মনে হয়। এই মেয়েটি সেরকম নয়। এবং সে নিজেও তা জানে।মেয়েটির চোখ দুটি ছোট ছোট এবং বিশেষত্বহীন। গালের হাড় উঁচু হয়ে আছে ছোট্ট কপাল কিন্তু তবু কী অদ্ভুত দেখতে। কী মোহময়ী।তার পরনে সাধারণ কালো রঙের একটি লম্বা জামা। পিঠের অনেকখানি দেখা যাচ্ছে। দূর থেকে মনে হয় মেয়েটির গায়ের রং ঈষৎ নীলাভ। দেখলেই হাত দিয়ে ছুঁতে। ইচ্ছে করে।মেয়েটি প্রকাণ্ড জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দূরে তাকিয়ে ছিল। তাকে দেখে বোঝায়। উপায় নেই সে কিছু ভাবছে কি না। এইজাতীয় মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুই বোঝা যায় না। এদের চোখ সাধারণত ভাবলেশহীন হয়ে থাকে।’মামণি!’মেয়েটি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল অ্যানি এসে ঢুকেছে। অ্যানির পায়ে ঘাসের স্লিপার। চলাফেরা নিঃশব্দ।’অ্যানি।”কী মামণি?”তোমাকে বলেছি না ঘরে ঢুকতে হলে জিজ্ঞেস করে ঢুকবে?’অ্যানি লজ্জিত ভঙ্গিতে চোখ বড় বড় করে মা’র দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটি অবিকল মায়ের মতো দেখতে। শুধু চোখ দুটি আরো উজ্জ্বল, আরো গম্ভীর।’অ্যানি, তুমি এগারোয় পড়েছ, এখন তোমার অনেক কিছু শিখতে হবে, ঠিক না?”জি, মা।”এখানে আমি তোমার বাবার সঙ্গে থাকতে পারতাম। পারতাম না?”পারতে।”আমাদের অনেক ব্যাপার আছে যা তোমার দেখা বা শোনা উচিত নয়।’ অ্যানির গাল লাল হয়ে উঠল। সে মায়ের দিকে সরাসরি তাকাতে পারল না। ‘কিছু বলবার জন্যে এসেছিলে, অ্যানি?”ই।”বলে ফ্যালো।”মা, ঘরে বসে থাকতে আমার ভালো লাগছে না। বড্ড একা একা লাগে। আমি আবার স্কুলে যেতে চাই।’
পৃষ্ঠা-২
‘তুমি তো একা খাবছ না, মিস মারিয়াটা আছেন। আছেন না?’মিস মারিয়াটাকে আমার ভালো লাগে না। মা, আমি স্কুলে যেতে চাই।”বললেই তো যেতে পারছ না। তোমার নিরাপত্তার ব্যাপারে আমি নিশ্চিত না হয়ে তোমাকে স্কুলে পাঠাব না। যাও, এখন শুয়ে পড়োগে।’অ্যানি তবুও দাঁড়িয়ে রইল। রুদ বড্ড বিরক্ত হল। তার গলার স্বরে অবিশ্যি সেই। বিরক্তি প্রকাশ পেল না।’অ্যানি, তুমি আরকিছু বলবে?”‘আমি স্কুলে যেতে চাই মা।”সেকথা তো আমি একবার শুনেছি। আবার বলছ কেন? যাও ঘুমুতে যাও। একই কথা বারবার শুনতে ভালো লাগে না।অ্যানি নিঃশব্দে চলে গেল। রুন মেয়ের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটি নিশ্বাস ফেলল। তার মেয়েটি অসামান্য রূপসী হয়েছে। এরকম রূপবতীদের অনেকরকম ঝামেলার মধ্যে বড় হতে হয়। তার নিজের যখন মাত্র দশ বছর বয়স তখন তার মুখে রুমাল বেঁধে তাকে জোর করে…। না, এইসব নিয়ে তার এখন আর ভাবতে ভালোদেখল ভিকির গাড়ি এসে ঢুকছে।পুরুষমানুষ কেউ আছে কি না। রুন হাসিমুখে বলল, ‘আগেই এসে পড়লে যে?’লাগে না। স্কুল অল্প খানিকটা মার্টিনি ঢেলে গ্লাস হাতে করে সিঁড়ির কাছে আসতেই ভিকি ব্যবসার ব্যাপারে রোম গিয়েছিল। তার আরো দুদিন পরে ফেরার কথা। রুন অবিশ্যি মোটেই অবাক হল না। ভিকি প্রায়ই এরকম করে। অসময়ে এসে উপস্থিত হয়। রুনের বিষয়ে তার কিছু সন্দেহ আছে। অসময়ে এসে দেখতে চায় রুনের সঙ্গে’কাজ হয়নি তাই ফিরে এলাম।”ডিনার দিতে বলবা’ভিকি ক্লান্তস্বরে বলল, ‘খেয়ে এসেছি। ব্যবসার অবস্থা খুব খারাপ যাচ্ছে রুন।”মার্টিনি তৈরি করে দেব। অলিভ আছে।”দাও।’মার্টিনির প্লাসটি এক চুমুকে শেষ করল ভিকি। তার মানে সে কোনো-একটি বিষয়ে বিশেষভাবে চিন্তিত। ব্যবসা নিয়ে। কিন্তু ব্যবসা তো তার অনেকদিন থেকেই খারাপ যাচ্ছে। এটা তো নতুন কিছু নয়।’রুন।”শুনছি, বলো।”বসো। সামনের চেয়ারটাতে বসো। তোমার সঙ্গে ঠান্ডা মাথায় কিছু কথাবর্তা বলা দরকার। জরুরি।’রুন বসল না। আরেক গ্লাস মার্টিনি তৈরিকরে পাশে এসে দাঁড়াল। ভিকি গর্মীরস্বরে বলল, ‘তোমাকে খরচ কমাতে হবে, রুন। অনেকটাই কমাতে হবে।’রুন খিলখিল করে হেসে উঠল।’হাসির কথা না। এই পেইন্টিংটি আমি রোমে যাবার পর কিনেছ তুমি। ওর দাম।
পৃষ্ঠা-৩
‘খুব সস্তা। নয় লক্ষ লিরা।’ডিকির মুখ পলকের জন্যে ছাই হয়ে গেল।’নয় লক্ষ লীরা।’ই। কার আঁকা দেখবে, মেতিস। অদ্ভুত না? মোতিস এ-ছবি আর আঁকেনি। তোমার ভালো লাগছে না?’ভিকি বহু কষ্টে রাগ সামলাল। রেগে গেলে রুমের সঙ্গে তর্ক করা অসম্ভব। রুনকে বোঝাতে হবে। ঠাণ্ডা মাথায়, পরিষ্কার যুক্তি দিয়ে। ‘রুন দয়া করে একটা জিনিস বুঝতে চেষ্টা করো। আমার অবস্থা ভালো না। খারাপ। খুবই খারাপ।”কীরকম খারাপ?”এ-বছরও লোকসান দিয়েছি। এদিকে ব্যাংকের কাছে বিরাট বড় দেনা।”প্রায় এক কোটি লিরা।’রুন নিঃশব্দে হাসন। ভিকি ভেবে গেল না এই অবস্থায় এমন স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কেউ হাসে কী করে।’হাসছ কেন?”তোমার নার্ভাস অবস্থা দেখে।”বাস্তবকে বুঝতে শেখো, রুন। প্লিজ।’রুন হাসিমুখে সামনের চেয়ারটায় বসল। ‘এমন অবস্থা তোমার হল কেমন করে? তোমাদের এতদিনের সিদ্ধ ইন্ডাস্ট্রির হঠাৎ করে এমন ভগ্নদশা হল কেন?’ভিকি ক্লান্তস্বরে বলল, ‘আমাদের মেশিনপত্র সমস্তই পুরনো। আমাদের নতুন স্পিনিং মেশিন কিনতে হবে। “খরাটস” জাতীয় মেশিন। নতুন মেশিন না বসালে আমরা হংকং-এর চীনাদের সঙ্গে পারব না। ওরা এখন অর্ধেক খরচে চমৎকার সিল্কদিচ্ছে বাজারে।”কিনলেই হয় নতুন মেশিন।”টাকা পাব কোথায়? ব্যাংক থেকে লোন নিতে হবে। তার জন্যে গ্যারান্টি দরকার।সেজন্যেই বলছি খরচপত্র কমাও।”হংকং-এর চীনাদের জন্যে আমার জীবনযাত্রা বদলাতে হবে?”বদলাতে বলছি না, খরচপত্র কমাতে বলছি।’রুন উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করল। ভিকি দেখল সে ক্লসেটের কাছে দাঁড়িয়ে কাপড় খুলে ফেলছে। ভিকি চোখ ফেরাতে পারছে না। যত দিন যাচ্ছে রুনের বয়স কমছে। রুন হালকা সুরে বলল, ‘চলো, ঘুমুতে যাই।”বসো একটু। রাত বেশি হয়নি।’গারে কোনো কাপড় নেই অথচ কী সহজ ভঙ্গিতে রুন চলাফেরা করছে। ভিকি একটু চিন্তিত বোধ করল। কন তাকে মন্ত্রমুগ্ধ করতে চাইছে। নিশ্চয়ই কোনো-একটা কারণ আছে। কী হতে পারে সেটি? রুন একটি সিগারেট ধরিয়ে ভিকির সামনের চেয়ারটায় বসল। নরম স্বরে বলল, ‘অ্যানি স্কুলে যেতে চাইছে।’
পৃষ্ঠা-৪
‘যাক। যাওয়াই তো উচিত।’মেয়র্যানদের মেয়ের মতো ওকেও যদি কিডন্যাপ করে নিয়ে যায়, তখন?’ ‘ভিকি বিরক্ত হয়ে বলল, ‘মেয়র্যানরা হচ্ছে ইতালির সবচে ধনী পরিবার। ওদের মেয়েদের কিডন্যাপ করে দুকোটি লিরা মুক্তিপণ চাওয়া যেতে পারে। কিন্তু আমার কীরুন গম্ভীর স্বরে বলল, ‘তোমার যে কিছু নেই তা তো আর যারা কিডন্যাপ করে তারা জানে না। আমি নিজেও তো জানতাম না তোমার এই অবস্থা।’ভিকি একটি সিগারেট ধরাল। মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। রুনের সঙ্গে তর্ক করতে হলে মাথা শ্যস্ত রাখতে হয়। ভিকি ধীরস্বরে বলল, ‘রুন, যারা কিডন্যাপিং করছে তারা মাফিয়ার লোকজন, তা তো জান?”জানি।”মাফিয়ারা সমস্ত খোঁজখবর রাখে। কার কী অবস্থা তা তাদের অজানা নয়, বুঝতে পারছ? কাজেই তুমি নিশ্চিন্তে অ্যানিকে স্কুলে পাঠাতে পার।’রুন উঠে দাঁড়াল। কী চমৎকার একটি শরীর। কে বলবে এই মেয়েটির বয়স।চল্লিশ? সিলিঙের নরম আলো যেন ঠিকরে পড়ছে তার গায়ে। জলকন্যার মতো লাগছে। রুন গম্ভীর গলায় বলল, ‘সুইজারল্যান্ডে একটি চমৎকার স্কুল আছে। জেনেভার কাছে। অনেক ইতালিয়ান ছেলেমেয়ে সেখানে পড়ে। আমি অ্যানিকে সেই স্কুলে দিতে চাই। টেয়ারদের ছোট মেয়েটি ভরতি হয়েছে সেখানে। চমৎকার স্কুল।’ভিকি স্তম্ভিত হয়ে গেল। এসব কী বলছে সে। দীর্ঘ সময় চুপ থেকে বলল, ‘আসল জিনিসটাই তুমি বুঝতে পারছ না। আমরা টাকা নেই। মেয়েকে সুইজারল্যান্ডে রেখে পড়ানো আমায় সাধ্যের বাইরে। তা ছাড়া অ্যানিরও ভালো লাগবে না। এত দূরে সে একা একা থাকতে পারবে না।”একা একা থাকবে কেন? আমিও থাকব। একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করবজেনেভার কাছে। তুমি হপ্তায় হপ্তায় এসে দেখে যাবে। প্লেনে মাত্র একঘণ্টা লাগে।’ ‘এতক্ষণ আমি কী বলেছি তা তুমি বুঝতে চেষ্টা পর্যন্ত করনি রুন। টাকা কোথায় আমার?’রুন পা দোলাতে দোলাতে বলল, ‘এখানকার বাড়িটা বিক্রি করে ফ্যালো। এত সুন্দর বাড়ি, প্রচুর দাম পাবে। সেই টাকার অর্ধেক দিয়ে জেনেভায় একটা বাড়ি কেনাভিকি থেমে থেমে বলল, ‘আমার এই বাড়িটাও ব্যাংকের কাছে মর্টগেজও। আমার ধারণা ছিল তুমি তা জান।’রুন উত্তর দিল না। উঠে গিয়ে আরেকটা সিগারেট ধরাল। ভিকি বলল, ‘অ্যানিকে মিলানের স্কুলেই যেতে হবে। এই হচ্ছে শেষ কথা।”বেশ, সে যাবে মিলানের স্কুলে। ভূমি তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করো।”নিরাপত্তার ব্যবস্থা-তার মানে?”ওর একটা বডিগার্ড রেখে দাও। এখন তো সবারই আছে। নিখমুদের দু’মেয়ের জন্যেই বডিগার্ড আছে।’
পৃষ্ঠা-৫
‘রুন, তুমি কি জান কত খরচের ব্যাপার সেসব।”আমি জানি না। জানতে চাই না। তুমি যদি অ্যানির বডিগার্ডের ব্যবস্থা না কর তাহলে ওকে আমি সুইজারল্যান্ডে নিয়ে যাব।’ ‘রুন, বডিগার্ড রাখা মানেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করা। সবাই ভাববে, ওদের অনেক টাকাপয়সা।’রুন হাসিমুখে বলল, ‘ভাবলে অসুবিধে কী?”কুন প্লিজ একটা জিনিস দ্যাখো। হাজার হাজার ছেলেমেয়ে ইতালিতে স্কুলে যায় যাদের বাবা-মা আমাদের চেয়ে অনেক ধনী, কিন্তু তাদের ছেলেমেয়েদের জন্যে কোনো বডিগার্ড নেই।”না থাকুক। আমার কিছুই যায় আসে না। ওরা তো আর আমার ছেলেমেয়ে না।”আমার অসুবিযেটা তুমি দেখছ না। একটা বাড়তি খরচ। শুধুশুধু একটা ঝামেলা।’ রুন দৃঢ়স্বরে বলল, ‘আজকাল সব ছেলেমেয়ের জন্যে বডিগার্ড আছে। এরেভোসের আছে, টুরেয়ার আছে, এমনকি কেয়োলিনদের পর্যন্ত আছে।’ভিকি একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। ব্যাপারটা এতক্ষণে পরিষ্কার হয়েছে। বডিগার্ড একটি মর্যাদার মাপকাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দামি একটা গয়নার মতো। রুন ভিকির গলা জড়িয়ে ধরল, ‘তুমি একবার এতরার সঙ্গে কথা বলো। সে নিশ্চয়ই তোমার টাকাপয়সার ঝামেলা মেটাবার ব্যাপারে সাহায্য করবে। ও তো অনেককেই বুদ্ধি দেয়।’ডিকি উত্তর দিল না। রুনের এই দূরসম্পর্কের ভাইটিকে সে সহ্য করতে পারে না। তার ধারণা, রুনের সঙ্গে ঐ ভাইটির গোপন মেলামেশা আছে। এই ভাইটির কথা উঠলেই রুনের মধ্যে একটা গদগদ ভাব দেখা যায়। রুন আরেকবার বলল, ‘বুঝলে ডিকি, তুমি এভরার সঙ্গে কথা বলো। সে তোমাকে চমৎকার বুদ্ধি বাতলাবে।’রুন এসে ভিকির কোলে বসে পড়ল। গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আর গম্ভীর হয়ে থাকার দরকার নেই। হাসো এবার।’ভিকি হাসতে পারল না। টেনে টেনে বলল, ‘বডিগার্ডের ব্যাপারটি নিয়ে তুমি কি এতরার সঙ্গে কথা বলেছ?”উই।’ভিকির মনে ক্ষীণ একটা আশা হল। যদি এতরাকে দিয়ে রুনকে বোঝানো যায় তা হলে হয়তো কাজ হবে। এতরা যদি বলে বডিগার্ড রাখার ব্যাপারটি হাস্যকর তা হলে রুন নিশ্চয়ই শুনবে। ভিকি এটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল।অ্যানির ঘুম ভাঙল খুব ভোরে।সে একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে নিচে নেমে এল। কী আশ্চর্য, বাখানে বেতের চেয়ারে বাধা বসে আছেন। সে চেঁচিয়ে ডাকল, ‘বাবা।’
পৃষ্ঠা-৬
‘বীরে বেটি? এত সকালে ঘুম ভেঙেছে?”‘ভালো ঘুম হয়নি রাতে।”না। দুঃস্বপ্ন দেখেছি বাবা।”কী দেখেছিস?’ অ্যানি জবাব দিল না। ভিকি মেয়ের কোমর জড়িয়ে ধরে বলল, ‘দেখেছিস একটা প্রকাণ্ড দৈত্য তাড়া করছে। তা-ই না?’অ্যানি হাসল কিন্তু কোনো উত্তর দিল না। সে যে-দুঃস্বপ্ন দেখেছে সেরকম দুঃস্বপ্নের কথা কাউকে বলা যায় না। নিজের কাছে লুকিয়ে রাখতে হয়; সবচে প্রিয় যে- বান্ধবী তাকেও বলা যায় না।অ্যানির একটু মন-খারাপ হল। তার যত ব্যাস বাড়ছে ততই গোপন জিনিসের সংখ্যা বাড়ছে। যেমন এতরা চাচার কথাই ধরা যাক। ইদানীং একরা চাঙা তাকে দেখলেই আদর করার ছলে জড়িয়ে ধরেন। মুখে কী মিষ্টি মিষ্টি কথা, ‘আরে আমাদের অ্যানির মনটা খারাপ কেন? কী হয়েছে আমাদের অ্যানির?’অ্যানি পরিষ্কার বুঝতে পারে এ সবই হচ্ছে ভান। এতরা চাচাকে এখন আর একটুও ভালো লাগে না। সেদিন এসে মাকে বলল, ‘ওয়াল্ট ডিজনির একটা মুভি হচ্ছে, অ্যানিকে দেখিয়ে আনব বলে ভাবছি।’মা মহাখুশি। হাসতে হাসতে বলল, ‘বেশ হয়। বেচারি একা একা থাকে। নিয়ে যাও।’অ্যানি বলল, সে যাবে না। তার মুভি দেখতে ভালো লাগে না। শেষ পর্যন্ত অবিশ্যি যেতে হল। মায়ের অবাধ্য হওয়ার সাহস তার নেই।মুভিহল অন্ধকার হতেই এতরা চাচা তার কোমর জড়িয়ে ধরলেন। অ্যানি স্তম্ভিত হয়ে লক্ষ করল মাঝে মাঝে সেই হাত নিচে নেমে যাচ্ছে। এইসব কথা কাকে বলবে সে? মাকে? মা নিশ্চয়ই উলটো তার ওপর রাগ করবেন। কারণ এতরা চাচাকে মা খুব পছন্দ করেন। এটাও অ্যানির ভালো লাগে না। এতরা চাচা সময়ে অসময়ে আসে বাড়িতে। মা তাকে নিয়ে দক্ষিণের গেস্টহাউসে ঢলে যান। গেস্ট হাউসে গিয়ে দরজা বন্ধ করার কী মানে? এমন কী কথা তার সঙ্গে যা দরজা বন্ধ করে বলতে হয়?ভিকি দেখল অ্যানি গঞ্জীর হয়ে বসে আছে। সে হালকা স্বরে বলল, ‘আমার মামণি এত গম্ভীর কেন?’অ্যানি চাপাস্বরে বলল, ‘এখানে চুপচাপ বসে থাকতে আমার ভালো লাগছে না বাবা। আমি স্কুলে যেতে চাই।”খুব শিগগিরই যাবে মা।”কবে?”তোমার মা চাচ্ছেন তোমার জন্যে একজন বডিগার্ড রাখতে। এই ব্যাপারটি নিয়ে আমব্য চিন্তাভাবনা করছি। যদি না রাখলে চলে তা হলে তুমি এই হপ্তা থেকে যেতে পারবে। আর যদি রাখতে হয় তা হলে একটু দেরি হবে।’
পৃষ্ঠা-৭
অ্যানি মুখ উজ্জ্বল করে বলল, ‘বডিগার্ড রাখলে খুব মজা হবে বাবা।”মজা কিসের?”ঐ লোকটি কেমন বন্দুক-টন্দুক হাতে নিয়ে থাকবে। ভাবতেই আমার মজা লাগছে, বাবা।”মামণি, এর মধ্যে মজার কিছু নেই। সমস্ত ব্যাপারটি হাস্যকর। খুবই হাস্যকর।”আমার কাছে তো বেশ লাগছে বাবা।’ভিকি কিছু বলল না। অ্যানি বলল, ‘তুমি কি চা খাবে? চা আনব তোমার জন্যে?”চা বানাতে পার তুমি?”ই, খুব পারি।”বেশ তো, খাওয়া যাক এক কাপ চা।’অ্যানি হাসিমুখে রান্নাঘরের দিকে ছুটে গেল। ভিকির একটু মন-খারাপ হল। অ্যানি এখানে খুব নিঃসঙ্গ। ভিকি তাকে সময় দিতে পারে না। রুনও পারে না। মেয়েটির কোনো সঙ্গীসাথি নেই।’চা ভালো হয়েছে বাবা?”‘চমৎকার হয়েছে।”মনে হচ্ছে একটু বেশি কড়া হয়েছে।”আমার কড়া চা পছন্দ।’অ্যানি হাসিমুখে বলল, ‘আমি যদি বলতাম চা বেশি হালকা হয়েছে তা হলে তুমি বলতে আমার হালকা চা পছন্দ ঠিক না বাবা?’তা ঠিক।’ভিকি, অ্যানি দুজনেই গলা ছেড়ে হেসে উঠল।রেস্টুরেন্টটি ছোট কিন্তু শহরের নামী রেস্টুরেন্টগুলির মধ্যে এটি একটি। এরা ইতালি শহরে সবচে ভালো ‘প্রসকিউটু’ (কচি বাচ্চুরের গোশত) রান্না করে-এ ধরনের একটা কথা চালু আছে। ভিকি প্রসকিউটু পছন্দ করে না, কিন্তু তবু এখানে এসেছে। কারণ এ রেস্টুরেন্টটি এতয়ার খুব প্রিয়, সে প্রায় রোজই এখানে লাঞ্চ খেতে আসে।ডিকি যেশ খানিকক্ষণ বসে থাকবার পর এতরা এসে উপস্থিত। চমৎকার একটা নীল রঙের শার্টের উপর হালকা গোলাপি একটা টাই পরেছে এভরা। কে বলবে এই লোকটির বয়স চল্লিশের ওপর।’দেরি করে ফেললাম নাকি, ভিকি?”না, খুব দেরি না।”লাঞ্চের অর্ডার দিয়েছ?”এখনও দিইনি। কী খেতে চাও তুমি?’এতরা হাসিমুখে বলল, ‘আমরা বাঁধা মেনু ভিটেলো টনাটু, প্রসকিউটু এবং এক বোতল বারগুন্ডি।’বারগুন্ডির গ্লাসে চুমুক দিয়ে এভরা ফুর্তিবাজের ভঙ্গিতে বলল, ‘এখন বলো, তোমার সমস্যাটা কী?’
পৃষ্ঠা-৮
ভিকি ইতস্তত করতে লাগল। নিজের সমস্যা অন্যের কাছে বলতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু এতরার যত দোষই থাকুক, এর মাথাটা খুব পরিষ্কার। তা ছাড়া, ওর আলো ‘কানেকশন’ আছে। প্রচুর লোকজনের সঙ্গে ওর চেনাজানা।’কী ব্যাপার, চুপ করে আছ যে? বলো।”তুমি বোধহয় জান না আমার ব্যবসার অবস্থা খুব খারাপ যাচ্ছে।’ঠিক জানি না বললে ভুল হবে। তবে কতটা খারাপ তা জানি না।”বেশ খারাপ।”এত খারাপ হল কী করে?’ভিকি জবাব দিল না। এতরা বলল, ‘আমার কাছে ঠিক কী পরামর্শ তুমি চাও?”আমার যা দরকার তা হচ্ছে মোটা অঙ্কের কিছু টাকা।”মোটা অঙ্কের টাকা জোগাড় করা তোমার জন্যে কঠিন হবার কথা নয়। তোমার স্ত্রীর প্রচুর টাকা আছে।”আমি ওর কাছে হাত পাততে চাই না।”বুঝলাম। স্ত্রীর কাছে হাত না পাতাই ভালো, তাতে দাম কমে যায়।’এতরা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘তুমি ব্যাংকে চেষ্টা করেছ? তোমার যা নামডাক তাতে ব্যাংক থেকে সহজেই মোটা টাকা লোন পাবে। ভরাডুবি না হওয়া পর্যন্ত ব্যাংক তোমাকে টাকা দেবে। তুমিও সেটা জান, জান না?’ভিকি উত্তর দিল না। এতরা বলল, ‘তুমি কি চেষ্টা করেছ?”বিশেষভাবে করিনি।”তা হলে করো। টাকার সমস্যা কোনো সমস্য নয়। অন্তত তোমার জন্যে নয়। তুমি চাইলে আমি দুএকজন ব্যাংকারের সাথে কথা বলতে পারি। অবিশ্যি আমি তার কোনো প্রয়োজন দেখি না। তোমাকে সবাই চেনে।”আমাকে না। আমার বাবাকে চেনে।”একই কথা। তোমার বাবাকে চিনলেই ভোমাকে চেনা হয়। এখন বলো, তোমার আসল প্রবলেম কী? তোমার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে তোমার মনে আরোকিছু আছে।’ ভিকি আরেকটা বারগুন্ডির অর্ডার দিয়ে চুপ করে রইল। যেন ভাবছে সমস্যাটি বলা ঠিক হবে কি না।’চুপ করে আছ কেন, বলে ফ্যালো।’ভিকি দীর্ঘ সময় নিয়ে বডিগার্ডসংক্রান্ত সমস্যাটি বলল। এতরা হাসিহাসি মুখে শুনল। তার ভাব দেখে মনে হল, সে খুব মজা পাচ্ছে। ভিকি বলল, ‘এখন বলো, আমার কী করা উচিত।”একটা বডিগার্ড রাখো। এই একমাত্র সমাধান।’ভিকি বড্ড বিরক্ত হল। এতরা এই কথা বলবে তা সে ভাবেনি। তার ধারণা ছিল বাডিগার্ড রাখার হাস্যকর দিকটি এভরার চোখে পড়বে। এতরা একটি সিগারেট ধরিয়ে গম্ভীর হয়ে বলল, বডিগার্ডের ব্যাপারটি এখন রুনের একটি প্রেস্টিজের ব্যাপার হয়ে
পৃষ্ঠা-৯
দাঁড়িয়েছে। রুনকে আমি যতটুকু জানি তাতে মনে হচ্ছে বডিগার্ড না রাখা পর্যন্ত সে শান্ত হবে না। একজন বুদ্ধিমান স্বামীর প্রধান কাজ হচ্ছে স্ত্রীকে শান্ত রাখা।”কিন্তু এত টাকা আমি পাব কোথায়?”রীতিমতো প্রফেশনাল লোক রাখলে অনেক টাকা লাগবে, বলাই বাহুল্য। কিছু তোমার তো আর প্রথম সারির লোকের প্রয়োজন নেই, ঠিক না?”ঠিক।”কাজেই কোনোরকম একজন কাউকে কয়েক মাসের জন্যে রেখে দাও। রুন শাস্ত হলেই ছাড়িয়ে দাও, ব্যস ঢুকে গেল।”এরকম লোক কোথায় পাওয়া যায়।”এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করলেই পাওয়া যাবে। আমার ওপর ছেড়ে যাও। আমি জোগাড় করে দেব। আগামী হপ্তায় তুমি তোমার বডিগার্ড পাবে। ঠিক আছে?’ভিকি কিছু বলল না। এভরা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ‘আর কোনো সমস্যা আছে? থাকলে বলে ফ্যালো।”না, আরকিছু নেই।”তা হলে এই কথা রইল। সোমবার তুমি বডিগার্ড পাবে। এখন তা হলে উঠি। চমৎকার লাঞ্চের জন্যে ধন্যবাদ। আর শোনো ভিকি, তুমি মুখ এমন হাঁড়ির মতো করে রাখবে না। একটু হাসো। তোমাকে দেখে মনে হয় তুমি গভীর সমুদ্রে পড়েছ।’এতরা বেরিয়ে গেল। ভিকি নিজের মনে বলল, ‘আমি গভীর সমুদ্রেই পড়েছি। অতলান্তিক জলে।”এতরা তার কথা রাখল। হন্ডা শেষ হবার আগেই একজন বিদেশী মানুষ এসে হাজির।’তোমার সঙ্গে বন্দুক আছে?”হ্যাঁ।’দেখাতে পার?’লোকটি জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা ছোট রিভলভার বের করল। ভিকি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে রইল সেটার দিকে।’কী নাম এটির?”বেরেটা ৪৮।’ডিকি শিশুর মতো আগ্রহে লিভলবারটি হাতে তুলে নিল। কী সুন্দর। ছিমছাম।ছোট্ট একটি জিনিস।’এর লাইসেন্স আছে?”‘আছে।”এর মধ্যে কি গুলি ভরা আছে?”আছে।”তুমি এইজাতীয় রিভলভার আগে ব্যবহার করেছ?’ ‘করেছি।’
পৃষ্ঠা-১০
‘কী সর্বনাশ। তুমি আগে বলবে তো?’ভিকি সাবধানে রিভলভারটি নামিয়ে রাখল। শুকনো গলায় বলল, ‘তোমার কাগজপত্র কী আছে দেখি।’লোকটি কাগজপত্রের একটা চামড়া-বাঁধানো ফাইল নামিয়ে রাখল। ভিকি প্রথমবারের মতো পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল লোকটির দিকে।লোকটি ইতালিয়ান নয়। বিদেশী। গায়ের চামড়া কালো। পুরু ঠোঁট। বড় বড় চোখ। অদ্ভুত একধরনের কাঠিন্য আছে। কোথায় সে কাঠিন্যটি তা ধরা যাচ্ছে না। ভিকি নিচুস্বরে বলল, ‘তুমি কি কখনো মানুষ মেরেছ?”হ্যাঁ।’জিকির গা শিরশির করে উঠল।
‘কতজন মানুষ মেরেছ?”এর উত্তর জানা কি সত্যি প্রযোজনা”না-না, উত্তর না দিলেও হবে। এমনি জিজ্ঞেস করলাম।’ভিকি ফাইল খুলল।নাম: জামশেদ হোসেন।বয়স: ৫৫ভিকি অকেক্ষণ নামটির দিকে তাকিয়ে রইল। কী অদ্ভুত নাম!’তোমার দেশ কোথায়?”‘ফাইলে লেখা আছে। ফাইল খুললেই পাবে।”হ্যাঁ, লেখা আছে ফাইলে। পরিষ্কার সব লেখা। লোকটি কথাবার্তী বেশি বলতে চায়।না। এটা ভালো। বডিগার্ড এরকমই হওয়া উচিত। ভিকি পড়তে শুরু করল।জাতীয়তা: বাংলাদেশী।’সেটি আবার কোন দেশ?”ইডিয়া ও বার্মার মাঝামাঝি ছোট্ট একটা দেশ।”তোমার পাসপোর্ট আছে? ইতালিতে যে আছ তার কাগজপত্র আছে?”আছে।”কী ধরনের কাগজপত্র?’লোকটি গম্ভীর স্বরে বলল, ‘আমি ফ্রেঞ্চ লিজিওনে দীর্ঘদিন ছিলাম। তারপর কিছুদিন ছিলাম ইতালিয়ানদের সঙ্গে জিান্ডায়, আলজিয়ার্সে। আমার কাগজপত্র সেই সূত্রে পাওয়া।’ভিকি অবাক হয়ে বলল, ‘আলজিয়ার্সে কিসে ছিলে?”ফার্স্ট প্যারাট্রুপ রেজিমেন্টে।”বল কী। তুমি বাংলাদেশের লোক হয়ে লিজিওনে ঢুকলে কী করে?’ছিলে?’লোকটি জবাব দিল না। ভিকি বলল, ‘লিজিওনে ঢোকার আগে তুমি কোথায়
পৃষ্ঠা-১১
‘অনেক জায়গায় ছিলাম। আমি একজন ভাড়াটে সৈনিক, মিঃ ভিকি। যে পয়সা দিয়েছে আমি তার জন্যেই যুদ্ধ করেছি। আমি কোথায় ছিলাম, কী ছিলাম সেসব জিজ্ঞেস করার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। আমাকে যদি তোমার পছন্দ হয় তা হলে রাখতে পার। পছন্দ না হলে বিদেয় হব।’ভিকি অনেকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারল না। এতরা এই লোকটিকে পাঠিয়েছে। কিন্তু মনে হচ্ছে ঠিক লোক পাঠায়নি। অবস্থা যা তাতে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে এই লোক খাঁটি পেশাদার লোক।ভিকি নিঃশব্দে কাগজপত্র পড়তে লাগল।অসাধারণ লিজিওনারি হিসেবে তাকে পরপর দুবার অর্ডার অব ভেলর দেয়া হয়।ভিকি বড়ই অবাক হল। এতরা এই লোকটিকে পাঠানোর আগে আরো দুজনকে পাঠিয়েছিল। ভিকি তাদের সঙ্গে দুএকটি কথা বলেই বিদেয় করে দিয়েছে। সে দুজন রাস্তার গুন্ডা ছাড়া কিছুই না। কেউ জীবনে কখনো বন্দুক ধরেছে কি না সে সম্পর্কেও। সন্দেহ আছে। বডিগার্ড হিসেবে ওদের রাখলে রুন রেগে আগুন হত, বলাই বাহুল্য। কিন্তু এই লোকটি অদ্ভুত। ভিকি বলল, ‘তুমি কি কফি খাবে?”না।”খাও-না। খাও। ভালো কফি।’লোকটি চুপ করে রইল। ভিকি কফি আনতে বলে নিচুস্বরে জানাল, ‘তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। কিন্তু একটি কথার জবাব দাও। এত কম টাকায় তুমি কাজ করতে রাজি হচ্ছ কেন?’লোকটি কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, ‘মিঃ জিকি, আমি একজন অ্যালকোহলিক। বডিগার্ড হিসেবে আমার কোনোই মূল্য নেই এখন। বয়স হয়েছে। শরীর নষ্ট হয়ে গেছে।’ডিকি তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।’মিঃ এতরা আমাকে বলেছেন তোমার যেনতেন একজন লোক হলেই চলে। প্রফেশনাল লাগবে না।”তা টিক। আসলে আমার স্ত্রীর চাপে পড়েই একজন বডিগার্ড রাখতে হচ্ছে। আমার মেয়েকে কিডন্যাপ করার কোনো কারণ নেই। স্ত্রীদের চাপে পড়ে আমাদের অনেক কিছুই করতে হয়। ভালো কথা, তুমি কি বিবাহিত।”না।”ভালো, খুব ভালো।’লোকটি নিঃশব্দে কফি খেয়ে যাচ্ছে। ভিকি বলল, ‘ইয়ে, তুকি কি বড়রকমের অ্যালকোহলিক?”शा।”মাতাল হয়ে যাও?’
পৃষ্ঠা-১২
‘আরেকটি কথা তোমাকে বলা দরকার। এমন হতে পারে যে তিনমাস পর তোমাক আমার দরকার হবে না। এতরা নিশ্চয়ই তোমাকে বলেছে সেটা?”হ্যাঁ, বলেছে।”আরেকটি কথা। তোমাকে রাখব কি না সেটি নির্ভর করছে আমার স্ত্রীর ওপর। বুঝতেই পারছ, ওর জন্যেই তোমাকে রাখা।”বুঝতে পারছি।”চলো, আমার স্ত্রী সঙ্গে তোমার পরিচয় করিয়ে দিই। অবিশ্যি তোমাকে আমার। পছন্দ হয়েছে। বেশ পছন্দ হয়েছে। তোমার নামটি যেন কী?”জামশেদ। জামশেদ হোসেন।”অদ্ভুত নাম। এর অর্থ কী?”আমার জানা নাই।রুন অবাক হয়ে বিদেশী লোকটির দিকে তাকাল। লম্বা। রোগা। একটু যেন কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাথার চুল সাদা-কালো, খাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে। পরনে কালো রঙের একটি জ্যাকেট, জ্যাকেটের মাঝখানের বোতামটি নেই তবে জ্যাকেট এবং ট্রাইজার দুটিই বেশ পরিষ্কার। রুন কঠিন স্বরে বলল, ‘তুমি তো ইতালিয়ান নও।”না।’ভিকি বলল, ‘ইতালিয়ান না হলেও চমৎকার ইতালিয়ান বলতে পারে।” রুন বলল, ‘তোমর বয়সও অনেক বেশি।”হ্যাঁ, পঞ্চান্ন।’ভিকি হড়বড় করে বলল, ‘বয়স হলেও এই লাইনে সে একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি। কাগজপত্র দেখলেই বুঝবে। আজকাল এই লাইনে অভিজ্ঞ লোক পাওয়া খুব মুশকিল।’রুন বলল, ‘তোমার দেশ কোথায়?”‘বাংলাদেশ।”সেটি আবার কোথায়?”উত্তর দিল ভিকি, ‘বার্মা এবং ইন্ডিয়ার মাঝামাঝি একটি ছোট্ট দেশ। রুন, তুমি বরং মিঃ জামশেদের কাগজপত্রগুলো দ্যাখো।’রুন বলল, ‘তুমি কি আজ থেকে কাজে লাগতে পারবে?”দোতলার একটি ঘরে তুমি থাকবে। অ্যানিকে স্কুলে নিয়ে যাবে এবং ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। তোমার সঙ্গে বন্দুক আছে?'”আছে।”এসো, তোমাকে ঘর দেখিয়ে দিচ্ছি।’রুন বেরিয়ে গেল। জামশেদ গেল তার পিছুপিছু। ভিকি সোফায় বসে ঘামতে লাগল। রুন ফিরে এসে একটা ঝগড়া বাধাবে, জানা কথা। এসেই চিৎকার শুরু করবে, ‘এই বুড়ো হাবড়াকে কোথেকে ধরে এনেছ?’
পৃষ্ঠা-১৩
কিন্তু সেরকম কিছুই হল না। করুন ফিরে এসে শান্তস্ববে বলল, ‘লোকটিকে আমার পছন্দ হয়েছে। তবে…’ ‘তবে কী?”লোকটির দিকে তাকালে কেমন যেন অস্বস্তি লাগে।”বিদেশী লোক, তাই।”না, তা নয়। অন্য একধরনের অস্বস্তি। অস্বস্তি ঠিক না, ভয় বলতে পার।’ভিকি অবাক হয়ে বলল, ‘কী আশ্চর্য, ভয় লাগবে কেন?”জানি না কেন। শুধু মনে হচ্ছিল একটা পেশাদার খুনি। কত লোককে যে মেরেছে। জানে।’কে ভিকি চুপ করে রইল। রুন বসল, ‘লোকটির চোখ দেখেছ। পাথরের তৈরি বলে মনে হয়। ঠিক না?”আমি বুঝতে পারছি না কী বোঝাতে চাচ্ছ তুমি।”ওর মনে দয়ামারা রহম বলে কিছু নেই।”এরকম লোকই তো তুমি চেয়েছিলে, রুন।’ রুন চিন্তিত মুখে বলল, ‘তা অবিশ্যি ঠিক।’স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল ভিকি। বড় ঝামেলা ঢুকেছে। মাস দুএক পর বিদেয় দিলেই হবে। এই টাইপের লোকদের নিজের ঘরে রাখা ঠিক না। তা ছাড়া বিদেশী লোক। বিদেশীদের বিশ্বাস করতে নেই।”মিস মারিয়াটা, আমাদের ঘরে যে নতুন একজন মানুষ এসেছে তাকে তুমি দেখেছ?”না।”আমিও দেখিনি। সে কিন্তু বিদেশী, মিস মারিয়াটা।”তুমি পড়ায় মন দিচ্ছ না অ্যানি।”আজকে আমার পড়তে ইচ্ছে করছে না।”ইচ্ছা না করলেও পড়তে হবে।’অ্যানিকে অ্যালজেব্রার বই খুলতে হল। সে দুতিনটা অঙ্ক শেষ করেই বলল, ‘মিসমারিয়াটা, ঐ বিদেশী কিন্তু ভয়ংকর লোক। ফটফট গুলি করে মানুষ মারে।”মানুষ মারা যদি তার কাজ হয় তা হলে তো মারবেই। সবারই তার নিজের কাজ করতে হয়। ঠিক না?”হ্যাঁ ঠিক। ওর কাজ কিন্তু মানুষ মারা না। ওর কাজ হচ্ছে আমাকে দুষ্ট লোকের হাত থেকে রক্ষা করা। সেরকম কোনো লোক দেখলেই সে একেবারে শেষ করে দেবে। দ্রুম ক্রম।
পৃষ্ঠা-১৪
মিস মারিয়াটার মধ্যে কোনো উৎসাহ দেখা গেল না। সে আবার পড়াতে শুরু করল। অ্যানি ছাড়া পেল সন্ধ্যার আগে-আগে। এবং ছাড়া পাওয়ামাত্র ছুটে গেল দোতলায়। লোকটির ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। অনেকক্ষন দরজার পাশে। দাঁড়িয়েও অ্যানি কিছুই শুনল না। লোকটি অসময়ে ঘুমুচ্ছে নাকি? অ্যানি দরজায় টোকা দিতেই ভারী গলায় লোকটি কথা বলল, ‘কে?”আমি কি তোমার ঘরে আসতে পারি?’ খুট করে দরজা খুলে গেল।’আমার নাম অ্যানি।’কোনো উত্তর নেই। লোকটি তাকিয়ে আছে শুধু।’আমি কি তোমার ঘরে একটু বসতে পারি?’লোকটি দরজা থেকে সরে দাঁড়াল। অ্যানি হাসিমুখে বলল, ‘তোমাকে পেয়ে খুব ভালো লাগছে। আমার কথা বলার লোক নেই।’লোকটি ভারীস্বরে বলল, ‘বাচ্চাদের সঙ্গে আমি কথা বলতে পারি না। বাচ্চাদেরআমি পছন্দ করি না।’অ্যানি শুঞ্জিত হয়ে গেল। থেমে থেমে বলল, ‘আমি বাচ্চা নই। আমার এপ্রিল মাসে বারো হবে।’লোকটি কথা বলল না। অ্যানি বলল, ‘আমি যদি কিছুক্ষণ তোমার ঘরে বসি তা হলে কি তুমি বিরক্ত হবে?’অ্যানির চোখে প্রায় জল এসে পড়ছে। সে বহু কষ্টে নিজেকে সামলাল। লোকটি মৃদুস্বরে বলল, ‘একটি জিনিস তোমাকে বুঝতে হবে, অ্যানি। আমি নতুন কেনা কোনো খেলনা না। আমাকে রাখা হয়েছে তোমার নিরাপত্তার জন্যে, এইটুকুই আমি দেখব, এর বেশি না। যদি এ জিনিসটি পরিষ্কার বুঝতে পার তা হলে তা তোমার জন্যেও ভালোআমার জন্যেও ভালো।’
অ্যানি ধরাগলায় বলল, ‘তুমি কি আমাকে চলে যেতে বলছ?”হ্যাঁ।’অ্যানির চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। সে প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেল।কুন এসে ঢুকল তার কিছুক্ষণ পর। সে ইতস্তত করে বলল, ‘অ্যানি খুব কাঁদছে।’ লোকটি জবাব দিল না। রুন বলল, ‘আমার এই মেয়েটি খুব সেনসেটিভ, ওর সঙ্গে ভাব করতে হবে খুব ধীরে ধীরে। একবার ভাব হলেই বুঝবে খুব মিষ্টি মেয়ে ও।”মিসেস রুন, আমি তোমার মেয়ের সঙ্গে ভাব করতে আসিনি। ওসব আমি পারি না। আমার দ্বারা ওসব হয় না।”তোমরা যে-কাজের জন্যে আমাকে রেখেছে সে-কাজ আমি ঠিকমতো করতে চেষ্টা করব, এর বেশি আমার কাছে কিছু আশা করবে না।’
পৃষ্ঠা-১৫
রুন আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল, কিন্তু লোকটি আর কথা বলল না। কুন ভাবন এই বিদেশী লোকটিকে রাখা হয়তো ঠিক হয়নি।মিস মারিয়াটাও একই কথা বলল, ‘বিদেশীদের কখনো বিশ্বাস করতে নেই, মিসেস রুন।’মিস মারিয়াটার অবিশ্যি সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি। সে গলা খাদে নামিয়ে বলেই ফেলন, ‘কোনো একদিন হয়তো দেখা যাবে এই লোকই আপনাদের গুলি করে মেরে রেখে পালিয়েছে।’রুন বিরক্ত হয়ে বলেছে, ‘আমাদের মারবে কেন?”মিসেন রুন, ওদের কোনো কারণ-টারন লাগে না, ওরা হচ্ছে “বর্ন কিলার”। ওরা স্বাভাবিক মানুষ না, মিসেস রুন।’কথাটি একেবারে মিথ্যা নয়। ভাড়াটে সৈনিকরা অস্বাভাবিক মানুষ তা বলাই বাহুল্য। বন্য পশুর মতো জীবন কাটিয়ে হঠাৎ করে কেউ পোষ মানে না। এর পিছনে নিশ্চয়ই কোনো রহস্য আছে।’মিসেস রুন, লোকটাকে বিদেয় করে দিন।”দেখা যাবে কী করা যায়। আমার কাছে তেমন কিছু খারাপ মনে হচ্ছে না।”ভালোও তো মনে হচ্ছে না, ঠিক না?’রুনের মনে একটি কাঁটা বিঁধে রইল। অস্পষ্ট সন্দেহের একটি তীক্ষ্ণ কাঁটা।”হ্যালো, কন?”‘আমি এতরা।'”হ্যালো, এতরা।”‘নতুন বডিগার্ড কি কাজ শুরু করেছে?”হ্যাঁ, করেছে।”পছন্দ হয়েছে তোমার?”রুন জবাব দিল না। এতরা বলল ‘হ্যালো, জবাব দিচ্ছ না কেন?’রুন ইতস্তত করে বলল, ‘ভালোই তো।”অ্যানির পছন্দ হয়েছে?”‘পছন্দ হওয়াহওয়ির কী আছে? বডিগার্ডের সঙ্গে তার সম্পর্ক কী? স্কুলে নিয়ে যাবে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। বাস।’এতরা গলার স্বর একধাপ নামিয়ে ফেলল, ‘শোনো, একটা প্রবলেম হয়েছে।”কী প্রবলেম?”আমি এজেন্সিতে খোঁজ নিয়েছিলাম। আমার মনে হচ্ছে লোকটিকে রাখা ঠিক হবে’কেন?”ও একজন ডেজারাস লোক। আগে বুঝতে পারিনি।’
পৃষ্ঠা ১৬ থেকে ৩০
পৃষ্ঠা-১৬
রুন শান্তহরে বলল, ‘এরকম কাজের জন্যে তো ডেঞ্জারাস লোকই দরকার।”তা দরকার, তবু আমার মনে হচ্ছে একে ছাড়িয়ে দেয়া ভালো। আমি সন্ধ্যাবেলা এসে আলাপ করব। তুমি থাকছ তো?”হ্যাঁ, সেও থাকবে।’এতরার মনে হল রুন খানিকটা নিরাশ হল।’আচ্ছা, আমি আসব সন্ধ্যায়।’লাঞ্চের সময় রুন দেখল অ্যানি অস্বাভাবিক গম্ভীর। কিছুই মুখে দিচ্ছে না।’রান্না পছন্দ হচ্ছে না তোমার, অ্যানি?”পছন্দ হবে না কেন। বেশ ভালো রান্না।’তবে খাচ্ছ না কেন?”আমার ভালো লাগছে না।’রুম খানিক্ষণ চুপ থেকে বলল,’লোকটা কি তোমাকে কোনো কড়া কথা বলেছে?”ওর ঘর থেকে বের হয়ে তুমি খুব কাঁদছিলে, তাই জিজ্ঞেস করছি।”এমনি কাঁদছিলাম। ও আমাকে কোনো কড়া কথা বলেনি।’রুন অবাক হয়ে বলল, ‘লোকটিকে তোমার পছন্দ হয়েছে নাকি?”হ্যাঁ, পছন্দ হয়েছে।’অ্যানি স্পটম্বরে আবার বলল, ‘লোকটিকে আমার ভানুকের মতো লাগে মা। প্রকাণ্ড একটা বুড়ো ভালুক।”এই ভালোক কিন্তু তুলোভরা ভালুক না যে সারাদিন কোলে করে ঘুরে বেড়াবে।এই ভালোকের ধারালো নখ আছে।’অ্যানি খিলখিল করে হেসে ফেলল।’হাসছ কেন?”এমনি হাসছি।”কারণ ছাড়া হাসা এবং কারণ ছাড়া কান্না এসব মোটেই ভালো লক্ষণ না। কালথেকে তুমি রীতিমতো স্কুলে যেতে শুরু করবে। লোকটি নিয়ে যাবে এবং নিয়ে আসবে।এর সঙ্গে বেশি মিশতে চেষ্টা করবে না। এই লোকটি মেলামেশা বেশি পছন্দ করে না।”তুমি লোকটি লোকটি বলছ কেন মা? ওর একটি নাম আছে। জামশেদ। মিঃ জামশেদ বলবে।”ঐসব বিদেশী নাম আমার মুখে আসে না।”চেষ্টা করলেই আসবে। বলে। আমার সঙ্গে-জামশেদ।”বলেছি তো বিদেশী নাম আমি উচ্চারণ করতে পারি না।”মা, ওকে যদি আমি বুড়ো ভালুক বলি, তা হলে কি ও রাগ করবে?’৮৪৩’জানি না। তুমি বড্ড বাজে কথা বল।’
পৃষ্ঠা-১৭
‘মিস মারিয়াটা বলছিলেন, বুড়ো ভালুক নাকি ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ খুন করতে।পারে।”এরকম বলার কারণ কী?”মিস মারিয়াটার এরকম মনে হচ্ছে। আমার কিন্তু তা মনে হয় না মা।”মনে না হলেই ভালো।”আমার কাছে মনে হয়, বুড়ো ভালুক খুব একটা চমৎকার মানুষ।’রুন উঠে পড়ল। বসে থাকলেই অ্যানির বকবকানি শুনতে হবে। বড্ড বেশি কথা বলছে সে। মোটেই ভালো লক্ষণ নয়।গাড়ি চলছে থার্ড অ্যাভিনিউ দিয়ে।পেছনের সিটে অ্যানি বসে আছে। তার সঙ্গে দূরত্ব রেখে বসেছে জামশেদ। জামশেদ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে দুপাশের পথঘাট লক্ষ করছে। সুবিধাজনক জায়গাগুলি দেখবার চেষ্টা। যেসব জায়গায় হঠাৎ করে হামলা হতে পারে। অত্যন্ত ব্যস্ত রাস্তা। এখানে গাড়ির উপর হামলা চালানোর সম্ভাবনা খুবই কম। যদি কিডন্যাপিং-এর চেষ্টা হয় তবে তা হবে স্কুলের আশপাশে। ব্যস্ত রাস্তায় নয়। তবু রাস্তা সম্পর্কে একটা পরিষ্কার ধারণা থাকা প্রয়োজন।জামশেদ তার হাঁটুর উপর মেট্রোপলিটান ম্যাপটি বিছিয়ে দিল। লাল পেন্সিল দিয়ে দাগ দিতে লাগল থার্ড অ্যাভিনিউতে ক’টি এক্সিট আছে তার ওপর। পেট্রোল পাম্প ক’টি আছে তাও দেখতে হবে। বড় ভ্যানজাতীয় গাড়ি লুকিয়ে রাখার সবচেয়ে সহজ জায়গা হচ্ছে পেট্রোল পাম্প। নষ্ট হয়ে গেছে এই অজুহাতে প্রকাণ্ড একটা গাড়ি সেখানে দীর্ঘ সময় ফেলে রাখা যায়। এতে কারোর মনে কোনোরকম সন্দেহ জাগে না।স্কুল পর্যন্ত তিনটি পেট্রোল পাম্প দেখা গেল। জমশেদ ড্রাইভারের দিকে ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করল, ‘স্কুলে যাবার তো অনেকগুলি পথ আছে। তুমি কি সবসময় থার্ড অ্যাভিনিউ দিয়ে যাওঞ্জ'”হ্যাঁ। এই রাস্তায় ট্রাফিক কম।”এর পর থেকে কখনো পরপর দুদিন এক রাস্তায় যাবে না। আমাদের এমন ব্যবস্থা করতে হবে যেন কেউ আগে থেকে বুঝতে না পারে আমরা কোন রাস্তায় যাব।’ ‘ঠিক আছে। আমি একেক দিন একেক রাস্তায় যাব।’জামশেদ ইতস্তত করে বলল, ‘রওনা হবার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করবে কোন রাস্তা। আমি বলে দেব। তুমি কিছু ঠিক করবে না।’ড্রাইভারটি আহত স্বরে বলল, ‘আমি কুড়ি বছর ধরে এদের গাড়ি চালাচ্ছি। তুমি আমাকেও বিশ্বাস করছ না?”না। আমি কাউকে বিশ্বাস করি না।”যে কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না তার পৃথিবীতে বাস করা কষ্টকর। পৃথিবীতে বাস করতে হলে মানুষকে বিশ্বাস করতে হয়।’
পৃষ্ঠা-১৮
জমশেদ ছোট একটি নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘ঠিক আছে তোমার পছন্দের রাস্তাতেই যাবে।”ধন্যবাদ। তুমি আমাকে তা হলে বিশ্বাস করতে পারছ?”না। আমি তো বলেছি আমি কাউকে বিশ্বাস করি না।’সিসিলিয়ান ড্রাইভার অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে পড়ল।অ্যানি সারা পথে চুপচাপ বসে ছিল। একটা কথা জানবার জন্যে তার খুব ইচ্ছা করছিল। লোকটির হাতে এরকম একটা লম্বা কাটা দাগ কোথেকে হল? দুহাতেই গভীর দাগ। যেন কেউ একটা ধারালো কিছু দিয়ে কবজির নিচ থেকে দুটি হাত কেটে ফেলতে চেষ্টা করেছিল। অ্যানি শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেসই করে ফেলল, ‘মিঃ জামশেদ, আমি কি একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?’কোনো উত্তর নেই।’শুধু একটি কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।”করো।”তোমার হাতে কী হয়েছে?”আলজিয়ার্সে আমি একবার গ্রেফতার হয়েছিলাম, তখন হাত কেটে গিয়েছিল।’কারা তোমাকে গ্রেফতার করেছিল?’উত্তর নেই।’তারা কি তোমাকে মারধোর করেছিল?”হ্যাঁ, করেছিল।’অ্যানি ভয়ে ভয়ে হাত বাড়িয়ে জামশেদের হাতের কাটা দাগ স্পর্শ করল। জামশেদ কঠিন ভঙ্গিতে হাত সরিয়ে নিল। রুক্ষস্বরে বলল, ‘কেউ আমার গায়ে হাত রাখলে আমার ভালো লাগে না। আর কখনো গায়ে হাত দেবে না। আর শুধুশুধু প্রশ্ন করবে না। মনে রাখবে কথাটা। আমার এসব ভালো লাগে না।’অ্যানি জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। তার চোখ ছাপিয়ে জল আসছে। সে চায় না কেউ দেখে ফেলুক। কেউ দেখে ফেললে বড় লজ্জার ব্যাপার হবে।’শোনো অ্যানি, কাঁদবে না। কাঁদার মতো কিছু হয়নি। অকারণে কান্না আমি সহ্যকরতে পারি না।’অ্যানি ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, ‘তুমি কখনো কাঁন না?’উত্তর নেই।’যখন আমার মতো ছোট ছিলে তখনও কাঁদনি?জামশেদ থেমে থেমে বলল, ‘পৃথিবীটা খুব ভালো জায়গা নয়। অনেকরকমের দুঃখকষ্ট আছে পৃথিবীতে। এখানে ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে কেঁদে বুক ভাসালে হয় না। তুমি যখন বড় হবে তখন জানবে অনেক কুৎসিত ও কদর্য ব্যাপার হয় এখানে।’ অ্যানি ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, ‘তুমি আমাকে যত ছোট ভাবছ আমি তত ছোটনা। আমি অনেক কুৎসিত ব্যাপারের কথা জানি কিন্তু আমি কাউকে সেসব বলতে পারি না। আমার কোনো বন্ধু নেই।’
পৃষ্ঠা-১৯
দোতলার লবিতে বসে জামশেদ কফি খাচ্ছিল। মারিয়া নামের যে মেয়েটি কফি নিয়ে এসেছে সে কিছুক্ষণ গল্প জমাবার চেষ্টা করেছে কিন্তু তা সঙ্গত কারণেই জমেনি। আমশেদের সঙ্গে কখনো গল্প জমে না।জামশেদ চারদিক তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে দেখছিল। বাড়িটি সেরকম সুরক্ষিত নয়। চারদিকের দেয়াল নিচু। যে-কেউ অনায়াসে দেয়াল টপকাতে পারবে। তার ওপর কোলাপসেবল গেটটিতে বেশির ভাগ সময়ই তালা থাকে না। ভিকির সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলতে হবে। তিনটি জিনিস করা দরকার। দেয়াল কমপেক্ষ তিন ফুটের মতো বাড়াতে হবে এবং গেটে সর্বক্ষণ তালা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এবং একটি ভালো জাতের কুকুরের ব্যবস্থা করতে হবে।জামশেদ কফি খেতে যেতে ভাবল, শরীর যদি আগের মতো থাকত তা হলে। এসবের দরকার হত না। কিন্তু শরীর আগের মতো নেই, নষ্ট হয়ে গেছে। এখন একধরনের আলস্য বোধ হয়। দারুন ক্লান্তি লাগে। মাঝে মাঝে দেশে ফিরে যেতে ইচ্ছা করে। কেউ কি এখনও আছে যে তাকে চিনতে পারবে। এজাতীয় ভাবনা ইদানীং তার হয়। তখনই তাকে নেশা করতে হয়। সস্তা ধরনের নেশা, ঝাঁঝালো ব্ল্যাক নাইট কিংবা টক রাম। লিভার অতি দ্রুত পচিয়ে ফেলবার মহৌষধ। লিভারটি সুস্থ রেখেই-বা কী লাভ। জীবন ফুরিয়ে আসছে। ঘণ্টা বেজে গিয়েছে, কান পাতলে শোনা যায়। এ সময়ে কোনোকিছুর জন্যেই কোনো মমতা থাকে না।জমশেদ উঠে দাঁড়াল। মারিয়া সিড়ি দিয়ে নামছিল। সেখান থেকেই চেঁচিয়ে বলল, ‘কফিপটে আরো কফি আছে। খেতে চাইলে ঢেলে নাও।’ জামশেদ তার উত্তরে কিছু বলল না। সে নিজের ঘরে চলে এল। এ-ঘরের জানালাগুলো ছোট ছোট। অর্থাৎ ঘরটি ভৃত্যশ্রেণীর লোকদের জন্যে। ভাতে কিছুই যায় আসে না। ঘরটি প্রশস্ত এবং লাগোয়া বাথরুম আছে। বাথরুমটি ঝকঝকে পরিষ্কার। তা ছাড়া বুকশেলফ আছে একটি, প্রচুর ইংরেজি পেপারব্যাক সেখানে। বই পড়ার তার তেমন অভ্যেস নেই। তবু মাঝেমধ্যে চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।’তুমি হাততালি দেবে, মারিয়া। তোমার হাততালির সঙ্গে সঙ্গে আমি দৌড়াব। শব্দ করে হাততালি দেবে।’জামশেদ তাকিয়ে দেখল অ্যানি লনে দৌড়াতে শুরু করেছে। সিঁড়ির কাছে কোমরে হাত দিয়ে মারিয়া দাঁড়িয়ে আছে। জামশেদ অবাক হয়ে লক্ষ করল মেয়েটি বেশ ভালো দৌড়াচ্ছে। দেখে যতটা দুর্বল মনে হয় ততটা দুর্বল নয় সে। বেশ ভালোই ছুটছে। তবে স্টার্টিং হচ্ছে না। মেয়েটির রিফ্লেক্স অ্যাকশন ভালো না। অনেকখানি নষ্ট করছে শুরুতেই। জামশেদের হঠাৎ ইচ্ছে হল নিচে নেমে যেতে, আর ঠিক তক্ষুনি অ্যানি চেঁচিয়ে বলল, ‘মিঃ জামশেদ, আমি স্কুল স্পোর্টসে নাম দিয়েছি। ওয়ান হানড্রেড মিটার।’জামশেদ জানালার পাশ থেকে সরে এল। তার এখন সুটকেস খুলে কনিয়াকের বোতলটি বের করার ইচ্ছা হচ্ছে। প্রবল ইচ্ছা। জামশেদ ঘরের দরজা বন্ধ করে সুটকেস খুলল। নিচে অ্যানি খুব হৈচৈ করছে। চেঁচিয়ে বলছে, ‘মারিয়া, তোমাকেও দৌড়াতে
পৃষ্ঠা-২০
হবে আমার সঙ্গে। একা একা দৌড়াব নাকি? উঁহু, তা হচ্ছে না।’ মারিয়া স্প্যানিশ ভাষায় কী যেন বলল। তার উত্তরে অ্যানি পলা কাঁপিয়ে হাসতে লাগল। জামশেদের কাছে মনে হয় অ্যানি মেয়েটি বেশ ভালো।ভিকি একটা দুঃসংবাদ পেয়েছে।ওরিয়েন্ট মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ম্যানেজার টেলিফোন করে বলেছে এক কোটি লিরা ঋণ আপাতত দিতে পারছে না ওরা। তবে নতুন স্পিনিং মেশিন কেনা হলে সেই মেশিন বন্ধক রেখে কিছু দেয়া যেতে পারে।ভিকি আকাশ থেকে পড়ল। খবরটি অপ্রত্যাশিত। ওরিয়েন্ট মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ম্যানেজারের সঙ্গে খোলাখুলি কথা হয়েছিল। যোগাযোগ এতরার করে দেয়া। ম্যানেজার বলেছিল, ঋণ পাবার কোনো অসুবিধা হবে না। হঠাৎ করে এরকম হল কেন কে জানে।ভিকি কী করবে ভেবে পেল না। সিল্ক ইন্ডাস্ট্রি বিক্রি করে দেয়াই সবচেয়ে ভালো বুদ্ধি। সিনথেটিক কাপড়ের ব্যবসাতে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কিন্তু তার অন্যে যে সাহস দরকার সে সাহস ভিকির নেই। তাদের তিন পুরুষের ব্যবসা হচ্ছে সিদ্ধ নিয়ে। সিল্ক ছেড়ে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়। ডুবলেও সিল্কের মধ্যেই ডুবতে হবে।’হ্যালো, এতরা?”হ্যাঁ। কী ব্যাপার, এই সাতসকালে?”‘ওরিয়েন্ট মার্কেন্টাইল লোন দিচ্ছে না।”বল কী।”হ্যাঁ। আজকেই কথা হয়েছে।”কীজন্যে দিচ্ছে না কিছু বলেছে?”না।”আচ্ছা, আমি জিজ্ঞেস করে জানব।’তিকি ক্লান্ত স্বরে বলল, ‘এখন আমার কী করণীয় সেটা বলো।”বিদেশী ব্যাংকগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত। ওদের হার্ট অনেক বড়। ঋণ চাইলে এত ধানাইপানাই করে না। তুমি আমেরিকান এক্সপ্রেসের সঙ্গে যোগাযোগ করো। মিঃ অলিভার লরেন্স নামে এক ভদ্রলোক আছেন সেখানে। ওঁর সঙ্গে কথা বলো।’দেখি।”দেখাদেখির কিছু নেই। আজকেই যোগাযোগ করো। আচ্ছা, একটা কথা, মিলান শপিং মলে তোমার একটা ঘর আছে না?'”আছে।””সেটাও কি মর্টগেজড?’হ্যাঁ।”কোন ব্যাংক?”‘সিটি ব্যাংক।’
পৃষ্ঠা-২১
‘তোমার অবস্থা তো করুণ বলেই মনে হচ্ছে। যাক, ঘাবড়াবার কিছু নেই। একটা- কিছু হবেই। ব্যাংক ছাড়াও তো ঋণ দেবার লোক আছে।’ভিকি শঙ্কিত গলায় বলল, ‘আমি ব্যাংক ছাড়া বাইরের কোনো লোন নিতে চাই’না চাওয়াই উচিত। ইন্টারেস্টের রেট খুবই চড়া।”সেজন্যে না। মাফিয়াদের সঙ্গে জড়াতে চাই না।’এতরা খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘জলে নামলে কুমিরের সঙ্গে ভাব রাখাই ভালো।”এতরা, ভাব বেশি করতে চাই না।”আচ্ছা-আচ্ছা, ঠিক আছে। ভিকি।”শুনছি।”এই রোববারে বাচ্চাদের জন্যে একটা মেলা হচ্ছে। সার্কাস, ম্যাজিক-শো এইসব হবে, চিলড্রেন্স নাইট। একটা বড় জাহাজ ভাড়া করছে ওরা। জাহাজের মধ্যেই সব ব্যবস্থা। তুমি অ্যানি এবং রুন এদের নিয়ে ঘুরে আসো। মন ভালো থাকবে।”আমি এই ক’দিন কোথাও বেরুব না।”অ্যানির ভালো লাগত।”তুমি যেতে চাইলে অ্যানিকে নিয়ে যেতে পার। আমি কোথাও নড়ব না।’মিঃ অলিভার লরেন্স লোকটি অত্যন্ত মিষ্টভাষী। সে ভিকির ঋণের কাগজপত্র সব হাসিমুখে দেখল। কফি খাওয়াল। মিডল ইস্টের সমস্যা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করে শেষ পর্যায়ে বলল, ‘মিঃ ভিকি, ইতালিয়ানরা পারতপক্ষে বিদেশী ব্যাংকের কাছে লোন চায় না। এদিক দিয়ে তারা খুব জাতীয়তাবাদী। বিদেশী ব্যাংকের কাছে ওরা তখনই আসে যখন দেশী ব্যাংক ওদের ঋণ দেয় না। কথাটা কি ঠিক নয়?”হ্যাঁ, তা ঠিক।”আপনাকে স্থানীয় ব্যাংকগুলো লোন দিচ্ছে না কেন, মিঃ ভিকিং’ভিকি সরাসরি কোনো জবাব দিতে পারল না। লরেন্স অলিভার হাসিমুখে বলল, ‘আমার মনে হয় পিওর সিল্ক থেকে আপনার সরে আসা উচিত। পিওর সিল্কের বাজার ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে।’ভিকি চুপ করে রইল। লরেন্স অলিভার বলল, ‘আপনাদের যে পরিবারিক নামডাক আছে তার ওপর নির্ভর করেই আমরা আপনাকে লোন দিতে রাজি আছি, তবে আপনাকে পিওর সিল্ক থেকে সরে আসতে হবে।’ভিকি ক্লান্তস্বরে বলল, ‘তা সম্ভব নয়।”সম্ভব নয় কেন?”মিঃ লরেন্স, সিল্ক ব্যবসা আমাদের অনেক দিনের ব্যবসা। আমার দাদা ছিলেন রাস্তার ছোকরা। সিল্ক ব্যবসা করেই ডিনি কোটিপতি হয়েছিলেন। তিন-পুরুষের সেই ব্যবসা আমি নষ্ট করব তা হয় না।’
পৃষ্ঠা-২২
লরেন্স অলিভার মৃদু হাসল।’আপনি হাসছেন কেন?”হাসছি কারণ আপনি ব্যবসার জন্যে ফিট নন। আপনি সেন্টিমেন্টাল।”‘সেন্টিমেন্টাল হওয়া কি খুব দোষের?’ডিকি চুপ করে গেল।’আমি দুঃখিত যে কিছু করতে পারছি না। তবে আপনি যদি ব্যবসার ধারা বদলাতে চান তা হলে আমরা সঙ্গে দেখা করবেন। আমি নিশ্চয়ই সাহায্য করব।’ভিকি মৃদুস্বরে বলল, ‘তা সম্ভব নয়।’রুন ত্রিশ হাজার নিরা দিয়ে নতুন একটা ড্রেস কিনেছে। অনেকটা জাপানি কিমানোর মতো দেখতে। হালকা সবুজ রঙের ওপর নীল নকশা। ঘরে আনার পর তার মনে হল, ঘন সবুজের ওপর খন নীল নকশার যে ড্রেসটি ছিল সেটিও সন্ধ্যাবেলার জন্যে চমৎকার। রুন সেটাও কিনে আনল। একই ডিজাইনের উপর আরো দুটো ড্রেস ছিল। সে দুটোও কিনে ফেলবে কি না এই বিষয়ে সে ঠিক মনস্থির করতে পারল না। সবগুলি কিনে ফেলবার পেছনে সবচেয়ে বড় যুক্তি হচ্ছে তা হলে তাকে দেখে অন্য কেউ একই ডিজাইনের পোশাক সঙ্গে সঙ্গে কিনতে পারবে না। আর না কেনার পেছনে যুক্তি হচ্ছে ডিকি রাগ করবে।ভিকি অবিশ্যি রাগ করল না, ভাবলেশহীন চোখে তাকিলে দেখল। রুন হালকা গলায় বলল, ‘খরচ একটু বেশি পড়ে গেল, কিন্তু দ্যাখো-না, এত চমৎকার ডিজাইন রোজ রোজ পাওয়া যায় না। আর সবুজ রঙের গাম্ভীর্যটুকু দ্যাখো। চোখ ফেরানো যায় না। তুমি খুশি হয়েছ তো?”হ্যাঁ, হয়েছি।”না, ঠিক খুশি হওনি। একটু বাগ তোমার মধ্যে আছে। কিন্তু আমি ড্রেসটা গায়ে দিয়ে আসি, দেখবে কী অদ্ভুত লাগে। ভালো কথা, ঐ লোকটা তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। খুব নাকি জরুরি।”কোন লোকটা?”আমাদের বডিগার্ড। ওর নাম মনে থাকে না আমার।”কী চায় সে?”আমি জানি না। আমাকে কিছু বলেনি।”বেশ, ডাকো।’ভিকি মন দিয়ে ওর কথা শুনল। লোকটি ঘরের চারদিকের দেয়াল তিনফুট উঁচু করতে চায়, একটি কুকুর রাখতে চায়।’মিঃ ভিকি, তোমার বাড়ি খুবই অরক্ষিত। যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তবে তোমার বাড়িতেই ঘটবে।’
পৃষ্ঠা-২৩
‘জামশেদ, তুমি একটা কথা ভুলে যাচ্ছ। আমার মেয়েকে কেউ কিডন্যাপ করবে না। তোমাকে আমি রেখেছি শুধু আমার স্ত্রীকে খুশি করবার জন্যে। তুমি তার কাছে একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠার প্রতীক।”এই কথা তুমি কিন্তু আমাকে আগে বলনি।”এখন বললাম। এখন থেকে জেনে রাখো।”এখানে থাকতে তোমার কেমন লাগছে?”জামশেদ জবাব দিল না।ভিকি বলল, ‘অ্যানি অবিশ্যি খুব খুশি। তোমাকে ওর খুব পছন্দ হয়েছে।’জামশেদ অবাক হয়ে তাকাল। তাকে পছন্দ করবার তেমন কোনো কারণ নেই। বরং অপছন্দই হবার কথা।’তোমাকে ও কী বলে ডাকে জান? বুড়ো ভালুক।”বুড়ো ভালুক?”তোমাকে নাকি ওর বুড়ো ভালুকের মতো লাগে।”আমার মেয়েটিকে কেমন লাগে তোমার? চমৎকার না?”শিশুদের আমি ঠিক পছন্দ করি না, মিঃ ভিকি। ওদেরকে কখনোই ভালো লাগে’তা-ই বুঝি?'”হ্যাঁ।”পছন্দ না করার কারণ কী?”আছে হয়তো কোনো কারণ। আমি ঠিক জানি না। কারণ নিয়ে কখনো ভাবিনি।’मा।রুন দারুণ বিরক্ত হল।একজন লোক অগ্রহ করে নিতে চাইছে, কিন্তু মেয়ে যাবে না। এর মানে কী?কতরকমের মজার ব্যবস্থা আছে। সারারাত জেগে সার্কাস-টার্কাস দেখবে, তা না,অ্যানি মুখ গোঁজ করে আছে।’কেন যাবে না, অ্যানি?”আমার ভালো লাগে না।’ভালো না লাগার কী আছে এখানে?”বললাম তো আমার কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না।”সার্কাস দেখতে তোমার ভালো লাগে না?’
পৃষ্ঠা-২৪
অ্যানি চুপ।’পুতুলনাচ দেখতে ভালো লাগে না?’কোনো জবাব নেই।’তার ওপর প্যান্টোমাইম আছে।’অ্যানি টেনে টেনে বলল, ‘তুমি যদি যাও তা হলে আমি যাব।’রুন বিরক্ত স্বরে বলল, ‘আমি তোমার কোনো অজুহাত শুনতে চাই না। তুমি যাবে এবং হাসিমুখে যাবে। একটা লোক এত টাকা খরচ করে টিকিট এনেছে, না, সে যাবে না। দিনরাত ঘরে বসে থেকে এটা তোমার হয়েছে।”মা, আমি কোথাও যেতে চাই না।’ ‘এ ব্যাপারে আমি আর কথা বলতে চাই না। তুমি তোমার কাপড় গুছিয়ে রাখো। সন্ধ্যাবেলা এতরা চাচা তোমাকে তুলে নিয়ে যাবে।’অ্যানি তার বাবাকে গিয়ে ধরল, ‘বাবা, আমি ঐ জাহাজে যেতে চাই না।”কেন মা?”আমার ভালো লাগছে না।”শরীর খারাপ?”‘না, শরীর ঠিকই আছে?”তা হলে কি মন খারাপ?”মন-খারাপ হলে তো যাওয়াই উচিত। তা হলে মন ভালো হবে। তা ছাড়া বহু টাকা খরচ করে তোমার এতরা চাচা টিকিট কেটেছেন। সেটা দেখতে হবে না?”আমার একটুও ইচ্ছা করছে না বাবা।”ইচ্ছে না করলেও আমাদের অনেক কিছু করতে হয়। তুমি না গেলে তোমার মা খুব রাগ করবেন। তোমার মা রাগ করলে কী অবস্থা হয় তা তো তুমি জানোই। জানো না।’জানি।'”যাও মা, ঘুরে আসো। বেশ লাগবে তোমার। মনে হবে কেন যে আগে আসতে চাইনি।’রাত দশটার পর জামশেদ দরজা বন্ধ করে দেয়। আজকেও করে দিয়েছে। সুটকেস খোলা হয়েছে। হুইসকির পেটমোটা বোতল বের হয়েছে। বোতলের মুখ খোলবার আগেই দরজায় আলতো করে টোকা পড়ল।কোনো উত্তর নেই। জামশেদ বোতলটা ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলল।’কে?’কোনো উত্তর নেই। জামশেদ দরজা খুলে দেখে যাসের স্লিপার পায়ে দিয়ে অ্য দাঁড়িয়ে আছে শুকনোমুখে।
পৃষ্ঠা-২৫
‘কী ব্যাপার?”আমি তোমার সঙ্গে একটা কথা বলতে চাই।”কথাটা সকালে বললে হয় না?”না।”এসো, ভেতরে এসে বলো।’অ্যানি নিঃশব্দে ভেতরে এল। জামশেদ দেখল মেয়েটির চোখ ফোলা। নিশ্চয়ই দীর্ঘ সময় ধরে কাঁদছে।’কী বলবে বলো।”কাল সন্ধ্যায় এওরা চাচা আমাকে একটা জাহাজে নিয়ে যাবে। সেখানে সারারাত ধরে সার্কাস-টার্কাস হবে।’অ্যানি দম নেয়ার জন্যে থামল। জামশেদ কিছুই বলল না।’আমি সেখানে যেতে চাই না।”ঐ লোকটা ভালো না। আমি অনেক কিছু বুঝতে পারি। আমি আগের মতো ছোট না।’তুমি তোমার বাবা-মাকে বলেছ?”বলেছি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি?”তুমি কি বলেছ এতরা চাচা লোকটি খারাপ।’অ্যানি ফুঁপিয়ে উঠল। জামশেদ তারী গলায় বলল, ‘যাও, ঘুমুতে যাও। অনেক রাত হয়েছে। নাও, এই তোয়ালেটা দিয়ে চোখ মোছো।’অ্যানি চোখ মুহে শান্তস্বরে বলল, ‘শুভ রাত্রি, মিঃ জামশেদ।’শুভ রাত্রি।’এভরা এসে পড়ল পাঁচটার মধ্যেই। তার গায়ে চমৎকার একটা সার্জের কোট। পিঠে বাটিকের কাজ-করা চামড়ার একটা ব্যাগ।’অ্যানি, তৈরি তো?’রুন বলল, ‘হ্যাঁ, তৈরি হচ্ছে। আর ঝামেলার কথা বল কেন, হঠাৎ করে বলছিল সে যাবে না। তার নাকি ভালো লাগছে না।”‘কী আশ্চর্য, ভালো লাগছে না কেন? কোথায়, অ্যানি কোথায়?”সাজগোজ করছে।’যাচ্ছে তো এখন?”হ্যাঁ, যাচ্ছে।”যাক, তাও ভালো।’অ্যানি লাল রঙের একটি ম্যাক্সিজাতীয় ড্রেস পরেছে। ড্রেসটির জন্যেই হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক অ্যানিকে বেশ বড় বড় লাগছে। পনেরো-ষোলো বছরের
পৃষ্ঠা-২৬
তরুণীর মতো। রুন অবাক হয়ে বলল, ‘বাহ, চমৎকার লাগছে তো। গালে কি তুমি রুজ দিয়েছ, অ্যানি?”নাহ্।”রুজ ছাড়াই গাল এমন লাল দেখাচ্ছে। আশ্চর্য তো। এতরা, দ্যাখো, আমার মেয়েকে দ্যাখো। পরীর মতো লাগছে না?”ই, তা লাগছে। মেয়ে মায়ের মতোই হয়েছে।’গেটের পাশে জামশেদ দাঁড়িয়ে ছিল। এতয়া অ্যানিকে নিয়ে গেটের কাছে আসতেই সে বলল, ‘মিঃ এতরা, অ্যানিকে যে তুমি জাহাজে নিচ্ছ, সেখানকার নিরাপত্তার ব্যবস্থা সম্পর্কে আমি তো কিছু জানি না।”তোমার জানার কোনো দরকার আছে কি?”আছে। আমাকে বেতন দিয়ে রাখা হয়েছে অ্যানির নিরাপত্তার জন্যে। কাজেই অ্যানি যেখানে বাবে আমিও সেখানে যাব।’এতরা অঙ্কিত হয়ে গেল। বলে কী এই উজবুক।’আমি একে নিয়ে যাচ্ছি এটা কি যথেষ্ট নয়?”‘না মিঃ এতরা, মোটেই যথেষ্ট নয়। আমি সঙ্গে যাচ্ছি।’এতরা দেখল, লোকটির কালো চোখ পাথরের মতো কঠিন। এ যাবেই সঙ্গে, এতে ভুল নেই।জ্যানির ফ্যাকাশে ঠোঁটে যেন রক্ত ফিরে এসেছে। সে মনে হচ্ছে অন্যদিকে তাকিয়ে হাসি গোপন করতে চেষ্টা করছে।’তোমাকে সঙ্গে নেয়ার জন্য কোনো বাড়তি টিকিট নেই।”তা হলে আজ যাওয়াটা বাতিল করতে হবে।”আমার মনে হয় একটা ছোট ব্যাপারকে এখানে অনেক বড় করে দেখা হচ্ছে।”আমার তা মনে হয় না মিঃ এতরা।’এতরা তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকাল। জামশেদ শান্তস্বরে বলল, ‘চেটা করনে এখনওহয়তো আনো একটি টিকিট জোগাড় করা যেতে পারে।”এত সময় আমার নেই। আমি একজন ব্যস্ত মানুব।”তা হলে ধরং অন্য কোনোদিন হবে।’এতরা জবাব দিল না।ভিকি অনেক রাতে ঘুমুতে এসে দেখে রুন জেগে আছে। ব্যাপারটি অস্বাভাবিক। রুন এত রাত পর্যন্ত জাগে না। রাত জাগলে তার চোখের নিচে কালি পড়ে। এটি সে হতে দেয় না। শরীর ঠিক রাখবার জন্যে অনেক কঠিন নিয়ম মেনে চলে সে।ভিকি বলল, ‘কী ব্যাপার, এখনও জেগে আছ যে? দেড়টা বাজে।”তোমার জন্যে জেগে আছি।”কিছু হয়েছে নাকি?”ঐ লোকটার চাকরি নট করে দাও।’
পৃষ্ঠা-২৭
‘কার চাকরি নট করব?”জামশেদ না কী যেন নাম-অ্যানির বড়িপার্ড।”ব্যাপারটা কী?”অত্যন্ত অস্ত্র ব্যবহার করেছে সে।”কার সঙ্গে? তোমার সঙ্গে?”না, এতয়ার সঙ্গে। এতরা ভীষণ রেগে গেছে।’ঘটনাটা খুলে বলল রুন। ভিকি গম্ভীর হয়ে বলল, ‘এটা বলার জন্যেই তুমি এত রাত পর্যন্ত জেগে বসে আছে?’ ‘ঘটনাটা তোমার কাছে খুব সাধারণ মনে হচ্ছে। এতবড় অপমান করল সে এতরাকে। শেষ পর্যন্ত এতরা অ্যানিকে রেখে গেল।”এতরার অপমানিত বোধ করার তো কোনো কারণ নেই। লোকটি তার ডিউটি করেছে।”ডিউটি? কিসের ডিউটি?”অ্যানিয় নিরপত্তার দিকে লক্ষ রাখার ডিউটি। লক্ষ রাখা যাতে কেউ অ্যানিকে কিডন্যাপ না করে।’রুন রেগে গিয়ে বলল, ‘কে কিডন্যাপ করবে অ্যানিকে?”আমারও তো সেই প্রশ্নই ছিল। কিন্তু তখন তুমিই আমাকে অন্যরকম বুঝিয়েছ।”বেশ, আমি ভুল করেছি।”বডিগার্ডের ভূত তোমার ঘাড় থেকে নেমেছে?’রুন জবাব দিল না।’বডিগার্ডের আর তা হলে প্রয়োজন নেই?”খুব ভালো।”এখন বলো কবে তাড়াচ্ছ লোকটাকে?’খুব ‘বললেই তো আর হুট করে তাড়ানো যায় না। চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে হলে ভালো কারণ থাকতে হবে। নয়তো ইউনিয়নের আমেলায় পড়ব।”কিছু চাকরি দেবার সময় তো তুমি বলেছিলে টেম্পোরারি অ্যাপয়েন্টমেন্ট, বলনি?”হ্যাঁ, তা বলেছি। কিন্তু টেম্পোরারি অ্যাপয়েন্টমেন্টেও তিনমাস শেষ হবার আগেনোটিস দেয়া যায় না। তুমি এত ব্যস্ত হয়ে উঠলে কেন?”এতরা খুব রাগ করেছে।”একে তো এতরাই জোগাড় করে এনেছিল।”এতরা আমাকে বলেছে ঐ লোকটি না বিদেয় হওয়া পর্যন্ত সে এ-বাড়িতে আসবে ‘না আসুক। তার আসতেই হবে এমন কোনো কথা আছে?’না।”তার মানে? কী বোঝাতে চাচ্ছ তুমি?”কিছুই বোঝাতে চাচ্ছি না। ভোর হোক তখন দেখা যাবে। এখন ঘুমাও। অসংখ্য কামেলা আমার মাথায়। এইসব সামান্য ব্যাপার নিয়ে হৈচৈ করতে ভালো লাগছে না।’
পৃষ্ঠা-২৮
‘তোমার আবার কী ঝামেলা?”ব্যাংক থেকে লোন পাওয়া যাচ্ছে না।”একটা থেকে না পাওয়া গেলে অন্যটা থেকে পাওয়া যাবে।’ভিকি কথা না বাড়িয়ে ঘুমুতে গেল। রুন মাথার চুল আঁচড়াতে আচঁড়াতে বলল, ‘ঐ লোকটি মনে হল অ্যালকোহলিক। মারিয়া জানালা দিয়ে দেখেছে রাতের বেলা বোতল নিয়ে বসে ও।”একটুআধটু ড্রিংক তো সবাই করে।”তা করে, কিন্তু কেউ দরজা-টরজা লাগিয়ে করে না। আমি এ-বাড়িতে কোনো মাতালকে রাখব না।”সকাল হোক, আলাপ করে ঠিক করব কী করা যায়। এখন দয়া করে ঘুমুতে যাও।’টুক টুক করে টোকা পড়ছে দরজায়। জামশেদ ভারীস্বরে বলল, ‘কে?”আমি। আমি অ্যানি।”কী চাই?”আমি তোমাকে ধন্যবাদ দিতে এসেছি।”ঠিক আছে। এবার যাও।”আমি তোমার জন্য কয়েকটা গোলাপ ফুল এনেছিলাম।”স্কুল লাগবে না। তুমি যাও।অ্যানি তবুও দীর্ঘ সময় দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। মারিয়া কফির পেয়ালা হাতে বাইরে বেরিয়ে দেখল অ্যানি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাপারটা তার ভালো লাগল না। একটা ভয়ংকর লোকের দরজার সামনে ভোরবেলায় ফুল-হাতে দাঁড়িয়ে থাকাটা চট করে চোখে লাগে। ব্যাপারটা রুনকে বলতে হবে। মারিয়া ডাকল, ‘অ্যানি।”হ্যালো, মারিয়া।”কী করছ একা একা’কিছু করছি না।”ফুল কার জন্যে?’অ্যানি হাসিমুখে বলল, ‘বুড়ো ভালুকের জন্যে।”হঠাৎ ফুল কেন? কোনো বিশেষ কারণ আছে?”আছে। তোমাকে বলা যাবে না।’মারিয়ার জ কুঞ্চিত হন। ব্যাপারটা তার মোটেও ভালো লাগছে না।জামশেদকে একদিনের ছুটি দেয়া হয়েছে।তার ছুটির প্রয়োজন ছিল না তবু নিতে হল। ভিকি বারবার বলল, ‘ঘুরেটুরে আসো। সারাক্ষণ ঘরে বন্দি হয়ে থাকার দরকার নেই। অ্যানির স্কুল নেই, সে বাড়িতেই থাকবে।’
পৃষ্ঠা-২৯
জামশেদের যাবার তেমন জায়গা নেই। মিলান শহরটিকে সে খুব ভালো চেনে না। দশ বছর আগে এখানের অলিগলি চেনা ছিল। এখন আর নেই। দশ বছর খুব দীর্ঘ সময়, এই সময়ে খুব চেনা জিনিসও খুব অচেনা হয়ে যায়।রাস্তাঘাট বদলে গেছে। শহর অনেক পরিচ্ছন্ন হয়েছে। ডেলকা নদীর দুপাশে বস্তিজাতীয় যেসব ঘরবাড়ি ছিল তার কোনো চিহ্নও নেই। আকাশছোঁয়া দালান উঠেছে দুপাশে। প্রশস্ত ছয় লেনের রাস্তা। ঝলমলে নিওন আলো।সন্ধ্যার আগে জামশেদ একতলা একটা রেস্টুরেন্টের সামনে এসে দাঁড়াল। রেস্টুরেন্টটি শহরের উপকণ্ঠে একটি দরিদ্র অঞ্চলে। অল্প আলোর একটি বাতি জ্বলছে। সে-আলোতে রেস্টুরেন্টের নাম অস্পষ্টভাবে চোখে পড়ে ‘পিজা অ্যান্ড লাসানিয়া হাউস’। লেখাটি ইংরেজিতে।রেস্টুরেন্ট ফাঁকা। এক কোনায় একটি বুড়োমতো ভদ্রলোক ঝিমুচ্ছে। অন্য প্রান্তে একটি অল্পবয়েসী মেয়ে একা একা বসে আছে। মেয়েটি ঘনঘন ঘড়ি দেখছে। নিশ্চয়ই কারো জন্য অপেক্ষা করছে সে।কাউন্টারে অল্পবয়স্ক একটি ছোকরা বসে আছে। জামশেদ কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল, ‘আমি একজন আমেরিকানের খোঁজ করছি, তার নাম বেন ওয়াটসন।’ছেলেটি সন্দেহভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। থেমে থেমে বলল, ‘কীজন্যে খোঁজ করছেন?”ও আমার পরিচিত।”বেন এখানে নেই।”সে এখানে আছে। কখন আসবে সে?”‘জানি না।”আমি তার জন্যে অপেক্ষা করব।”ইচ্ছা হলে করুন।’জামশেদ একটি অন্ধকার কোনা বেছে নিল বসবার জন্যে। কাউন্টারের ছেলেটি এসে জিজ্ঞেস করল, ‘কিছু খাবে? ভালো পিজা আছে।”না।”কনিয়াক আছে। দেব?”দিতে পার।”লিরা আছে তো তোমার কাছে?”আছে।”এখানে আগে দাম দিতে হয়।”জমশেদ হাজার লিরার একটি নোট বের করল।’ছেলেটি নোট নিতে নিতে বলল, ‘বেন ওয়াটসনের সঙ্গে তোমার কী দরকার?’ ‘আছে একটা দরকার।’
পৃষ্ঠা-৩০
‘তুমি কি পুলিশের লোক?’नाজমশেদ লক্ষ করল মাস্তান ধরনের একটি ছেলে ঢুকেছে। ঠিকমতো দাঁড়াতেও পারছে না টলছে। ছেলেটি গিয়ে দাঁড়িয়েছে মেয়েটির টেবিলের সামনের। নিশ্চয়ই কোনো ঝামেলা বাধাতে চায়। জামশেদ কানখাড়া করল।’মিস, আমি কি তোমার টেবিলে বসতে পারি?”আমি একজনের জন্য অপেক্ষা করছি। তুমি দয়া করে অন্য টেবিলে বসো।”যার জন্যে অপেক্ষা করছ সে তো আসছে না।”আসবে।”যখন আসবে তখন ছেড়ে দেব।’জামশেদ লক্ষ করল মেয়েটির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে উঠছে। মেয়েটি উঠে দাঁড়াল।’উঠছ কেন?”আমি অন্য কোথাও বসব।”কেন, আমাকে পছন্দ হচ্ছে না?”পছন্দ অপছন্দে কথা না। আমি বাড়ি চলে যাব।”এখনই বাড়ি যাবে কেন? রাত তো মাত্র শুরু।’কাউন্টারের ছেলেটি বলল, ‘এ্যাই, ঝামেলা করবে না।”ঝামেলা?”এটা মাতলামির জায়গা না।”কী, তুই আমাকে মাতাল বললি?”মাতাল টাতাল বলিনি। যাও, অন্য কোথাও যাও।”এইখানে এই মেয়ের হাত ধরে বসে থাকষ, দেখি কোন শালা কী বলে।’লোকটি পকেট থেকে আধহাত লম্বা একটি ছোরা বের করল।
মেয়েটির মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল। বুড়ো ভয় পেয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। সে এইঝামেলায় থাকতে চায় না। কাউন্টারের ছেলেটিও ভয় পেয়েছে।জামশেদ উঠে এগিয়ে গেল। খুব ঠাণ্ডাস্বরে, বলল, মেয়েটিকে ছেড়ে দাও।”কেন? তুই ফুর্তি করতে চাস?”ওর হাত ছাড়ো।’মাতালটা হাত ছেড়ে দিল কিন্তু নিমিষেই বাঁ হাতে ছোরাটা তুলল। তোলার ভঙ্গিই বলে দিচ্ছে ছোরা সে অতীতে অনেকবার ব্যবহার করেছে। আজকেও করবে। কারণ মদের প্রভাবে তার বুদ্ধি ঘোলা হয়ে গেছে।জামশেদ দ্রুত ভাবতে চেষ্টা করল। ছোকরা লেফট হ্যান্ডার কি না তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। অনেক সময় প্রতিপক্ষকে ধোঁকায় ফেলবার জন্যে এই কাণ্ডটি করা হয়।আক্রমণের ঠিক আগের মূহূর্তে ছোরা চলে আসে ডান হাতে। জামশেদ একদৃষ্টে মাতালটির দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। অপেক্ষার মতো কষ্টকর কিছুই নেই। তা ছাড়া বয়সের জন্যে ইন্দ্রিয় আগের মতো সজাগ রাখা
পৃষ্ঠা ৩১ থেকে ৪৫
পৃষ্ঠা-৩১
যায় না। জামশেদের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমল। এগিয়ে আসছে, এখন ঝাঁপিয়ে পড়বে। যা ভাবা গিয়েছিল তা-ই, সে আর ডান হাতটিই ব্যবহার করবে। ধোঁকা দেবার উদ্দেশ্যেই বাঁ হাতে রেখেছে ছুরি। হাতবদল হবার আগমুহূর্তেই কিছু একটা করতে হবে।মেয়েটি কুলকুল করে ঘামছিল। সে দেখল, ছুরি-হাতে বাঘের মতো বয়স্ক লোকটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে মাতালটি। মেয়েটি চোখ বন্ধ করে ফেলল। চোখ মেলে যে-দৃশ্য দেখল তার জন্যে সে প্রস্তুত ছিল না। দেখল বয়স্ক লোকটি নিজের জায়গায় ফিরে যাচ্ছে। চার-পাঁচ ফুট দূরে চিত হয়ে পড়ে আছে মাতালটি। খুব সম্ভব তার নাক ভেঙে গেছে। গলগল করে রক্ত পড়ছে। সে দারুণ অবাক হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে বয়স্ক লোকটিকে।জামশেদ তার টেবিলে ফিরে আসতেই ছেলেটি দৌড়ে এল।’স্যার, ভালো কনিয়াক আছে, দেব?”‘টাকা লাগবে না।”না। আমি এখন উঠব।”স্যার, আপনি যদি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেন তা হলে বেনের সঙ্গে দেখা হবে। যেন ওয়াটসন একটার দিকে আসবে।’জামশেদ উঠে দাঁড়াল।’স্যার, একটু যদি বসেন।”না, এখন আমি যাব।”বেন ওয়াটসনকে আপনার কথা কী বলব?’কিছু বলতে হবে না।”আপনার নাম?”আমার নাম বলার কোনো প্রয়োজন নেই।”আপনি কি আবার আসবেন?”হ্যাঁ, আসতে পারি। না-ও আসতে পারি।’জামশেদ রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়েই মেয়েটিকে দেখতে পেল। সে খুব সম্ভব জামশেদের জন্যে অপেক্ষা করছিল। জামশেদকে বের হতে দেখেই দ্রুতপায়ে এগিয়ে এল। ‘আমি আপনাকে ধন্যবাদ দেবার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।”‘ধন্যবাদ দেবার কোনো প্রয়োজন নেই।”আমি কি আপনার নাম জানতে পারি?’জামশেদ সেকথার উত্তর না দিয়ে মৃদুস্বরে বলল, ‘মেয়েদের এত রাতে এক একা বাইরে থাকাটা ঠিক না।”আমি আমার এক বন্ধুর জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। আমার বন্ধু একজন পুলিশ অফিসার।’
পৃষ্ঠা-৩২
‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। শুভ রাত্রি।’শুভ রাত্রি।’রুন কখনো সকালে উঠতে পারে না।ন’টার সময় বেড-টি খেয়ে সে খবরের কাগজ পড়তে বসে। খেলাধূলা এবং আইন আদালত এই দুটি অংশ পড়তে পড়তে দশটা বেজে যায়। রোজই সে দাঁত ব্রাশ করতে যায় দশটার পর।আজ একটা বিচিত্র কারণে রুটিনের ব্যতিক্রম হল। শেষরাতের দিকে রুন একটি ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখল। যেন সে এবং অ্যানি সমুদ্রের ধারে বেড়াতে গিয়েছে। কিন্তু অ্যানির গায়ে কোনো কাপড় নেই। সে খুব বিরক্ত হয়ে বলছে, ‘এইসব কী অসভ্যতা, অ্যানি। ছি।’ঠিক তখন অ্যানি ভয়-পাওয়া স্বরে বলল, ‘মা, পালাও। ওরা আমাদের ধরতে আসছে।’রুন চমকে পিছনে ফিরে দেখল তিনটি বন্ধ উন্মাদ ছুটে আসছে তাদের দিকে। ওদের গায়েও কোনো কাপড় নেই। রুন দৌড়াতে শুরু করল। কিন্তু অ্যানি সেরকম দৌড়াতে পারছে না। পাগলগুলো শেষ পর্যন্ত অ্যানিকে ধরে ফেলল। রুন শুনল, অ্যানি প্রাণপণে চেচাচ্ছে, ‘জামশেদ আমাকে বাঁচাও।’রুন এই সময় জেগে উঠল। পরপর দুপেগ ব্রান্ডি খেয়ে বাইরে এসে দেখল ভোর হয়েছে। অ্যানি জগিং সুট পরে দৌড়াচ্ছে বাড়ির সামনের খোলা মাঠটায়। রুন একবার ভাবল অ্যানিকে ডাকে। কিন্তু ডাকল না। রেলিঙে ভর দিয়ে তাকিয়ে রইল, স্বপ্নের ঘোর তার তখনও কাটেনি। এখনও গা কাঁপছে।জন দেখল জামশেদ নিচে নেমে যাচ্ছে। হাত-ইশারা করে ডাকছে অ্যানিকে। কী যেন বলছে। উপর থেকে ঠিক শোনা যাচ্ছে না। রুন নিচে নেমে এল। জামশেদ ভারী গলায় উপদেশ দিচ্ছে অ্যানিকে।’তুমি ভালোই দৌড়াচ্ছ, কিন্তু শুরুটা ভালো হচ্ছে না। দৌড়ে শুরুটাই আসল। ঠিকসময় শুরু করতে হবে। সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ রাখতে হবে।’আঅ্যানি বলল, ‘তুমি কি আমাকে শেখাবে? আমি জানি আমি ভালো দৌড়াতে পারি, কিন্তু শুরুটা আমার সত্যি সত্যি খারাপ।’রুন দেখল জামশেদ গম্ভীর হয়ে আছে। এই লোকটি কি সহজ হতে জানে না? ‘আমাকে তুমি শেখাবে? প্লিজ।”হ্যাঁ, শেখাব। এসো আমার সঙ্গে।’
পৃষ্ঠা-৩৩
রুন লক্ষ করল অ্যানির সমস্ত চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। এসব মোটেই ভালো লক্ষণ নয়। মেয়েটি ক্রমে ক্রমেই অপরিচিত এই ভয়ংকর লোকটির দিকে ঝুঁকে পড়ছে।রুন ভিকিকে টেলিফোন করল দুপুরে। ভিকি টাকাপয়সার কী-একটা সুরাহা করবার জন্যে রোমে গিয়েছে। গতকালই ফেরার কথা ছিল, ফেরেনি।’হ্যালো, ভিকি?”হ্যাঁ। কী ব্যাপার?”‘গতকাল রাতে আমি একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছি।”তা-ই নাকি?'”হ্যাঁ। শোনো কী দেখলাম…’ভিকি ভ্রু কুঁচকে শুনতে লাগল। লং ডিসটেন্স কল। প্রচুর বিল উঠবে কিন্তু উপায় নেই, শুনতেই হবে। স্বপ্নের কথা ভিকিকে দশ মিনিট ধরে শুনতে হল। সবশেষে রুদ বলল, ‘আমার খুব ভয় লাগছে।”ভয়ের কিছু নেই। স্বপ্ন স্বপ্নই।”হোক স্বপ্ন। তুমি আজকেই চলে আসবে।”আমি আসতে পারছি না। টাকার কোনো ব্যবস্থা করতে পরিনি।”কবে আসবে?”দেখি।’টেলিফোন রেখে দেয়ার আগে ভিকি বলল, ‘বড্ড ঝামেলায় পড়ে গেছি। তুমি কিছু টাকার ব্যবস্থা করতে পার নাকি, রুন?”আমি, আমি কোথেকে করব?”তোমার তো অনেক গয়নাটয়না আছে।’রুন জবাব না দিয়ে টেলিফোন রেখে দিল। ডিকি ছোট্ট একটি নিশ্বাস ফেলল।রুন আজ কিছু কেনাকাটা করবে বলে ভেবে রেখেছিল। কিন্তু মত বদলালো।দুঃস্বপ্ন দেখার পর তার আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করছিল না। সে ঠিক করল আজ সারাদিন সে ঘরেই থাকবে। আজ রান্না করলে কেমন হয়? অনেক দিন কোনো রান্নাবান্না করা হয়নি। কিন্তু রান্না করার ইচ্ছাটা স্থায়ী হল না। রুদ টিভি খুলে টিভির সামনে বসে রইল। কিছুক্ষণ পর টিভি দেখতেও ভালো লাগল না। সমস্ত দিন ঘরে বসে থাকাটা এমন ক্লান্তির ব্যাপার তা তার জানা ছিল না। দুপুরের দিকে অতিষ্ঠ হয়ে সে এতরাকে টেলিফোন করল, ‘এতরা, তুমি কি সন্ধ্যার পর আসতে পার?”নিশ্চয়ই পারি। কী ব্যাপার?”ব্যাপার কিছু নয়, গল্পগুজব করা যাবে।”বাইরে কোথাও খেতে চাও? বনভিলে চমৎকার একটা রেস্টুরেন্ট আছে।’না, আজ আমি কোথাও বেরুব না ঠিক করেছি।’এতরা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘ভিকি ফেরেনি?”নাহ্।”কবে ফিরবে জান?’
পৃষ্ঠা-৩৪
‘আমি ঠিক জানি না। কাল ফিরতে পারে।”ভিকি তো শুনলাম দারুণ ঝামেলায় পড়েছে।”কী ঝামেলা?”ওর একটা সিল্ক কারখানা শুনলাম বন্ধ হয়ে গেছে।’রুন অবাক হয়ে বলল, ‘কই, আমি তো কিছু জানি না।”তোমাকে কিছু বলেনি?”আচ্ছা আমি এসে বলব।’রুনের একটু মন-খারাপ হল। ভিকি তা হলে সত্যি সত্যি বড়রকমের ঝামেলায় পড়েছে। তাকে সাহায্য করা উচিত। রুন ইচ্ছা করলেই তা পারে। মোটা অঙ্কের টাকা রুনের আছে। তার নিজস্ব টাকা। এবং টাকা যে আছে তা ভিকি নিজেও জানে না। রুনের বাবা বলে দিয়েছিল, ‘কিছু-কিছু জিনিস স্বামীদের জানাতে নেই। একটি হচ্ছে স্ত্রীদের ব্যাংক-ব্যালেন্স। তোমার টাকাটা হচ্ছে তোমার দুঃসময়ের জন্যে, ভিকির দুঃসময়ের জন্যে নয়।’রুন বলেছিল, ‘কিন্তু বাবা, ধরো, ভিকি একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়ল, তখন?”তখন তুমি ওকে ছেড়ে চলে আসবে।’বাবার কথা এখন মনে না রাখলেও চলবে। বাবা মারা গেছে, কাজেই খবরদারি করবার জন্যে ছুটে আসবে না। রুন তার ব্যাংকে টেলিফোন করল, ‘আমি মোটা অঙ্কের কিছু টাকা তুলতে চাই।”কতদিনের মধ্যে?”এক সপ্তাহ।”ক্যাশ হলে পারা যাবে না।”ক্যাশ নয়, ক্রসড চেক করে দিলে হবে। পারা যাবে?”কোন কারেন্সি?”ইতালিয়ান হলেই হবে। পারা যাবে?”যাবে। তবে আপনার একটা চিঠি লাগবে।”বেশ। চেক রেডি করে রাখুন।”আপনার ঠিকানায় পাঠাব?”না, শুধু রেডি করে রাখুন।রুন টাকার পরিমাণ এবং ক্রসড চেকের নাম বলল। ব্যাপারটা যে এত সহজে হবে তা তার ধারণা ছিল না। সুইস ব্যাংকগুলি খুব এফিসিয়েন্ট।এতরা এল রাত ন’টার দিকে। রুন হালকা গোলাপি একটা স্কার্ট পরে বসে ছিল লবিতে। এতরা হাসিমুখে বলল, ‘আমরা যত বুড়ো হচ্ছি তুমি ততই রূপসী হচ্ছ।’করুন তরল গলায় হাসল। এতরা রুনের কাঁধে হাত রাখল। কাঁধে সে হাত স্থায়ী হল না, নিচের দিকে নেমে আসতে লাগল। রুন কিছু বলল না। লবি অন্ধকার, কেউ কিছু দেখছে না। এতরা হালকা গলায় বলল, ‘ডিকি বেচারা মহাবিপদে পড়েছে।’
পৃষ্ঠা-৩৫
রুন বলল, ‘ঠিক কত টাকা হলে সে বিপদ থেকে মুক্তি পায়?”কেন জিজ্ঞেস করছ?”জানবার জন্যে।”সাময়িক মুক্তি না চিরকালের জন্যে মুক্তি?”চিরকালের জন্যে মুক্তি।”অনেক টাকার ব্যাপার। ওয়ান মিলিয়ন ইউ এস ডলার।”এত টাকা?”হ্যাঁ। সে ঝামেলাটা পাকিয়েছে বড় করেই।’এভরা রুনের জামার হুক খুলতে চেষ্টা করল। রুন তেমন বাধা দিল না। একবার শুধু অস্পষ্ট স্বরে বলল, ‘আহ কী করছ?”কিছুই করছি না, রুন।’ এতরা আবো এগিয়ে এল।রুন বলল, ‘ভিকি একটা অপদার্থ, তবু মনে হয় আমি ওকে পছন্দ করি।”তা হয়তো করো।”ইদানীং বেচারা ঘুমাতে পারছে না। আমি ওকে সাহায্য করতে চাই।’এতরা রুনের কথা ঠিক শুনতে পায়নি। সে জামার হুকটি খুলে ফেলেছে। জলপরীর মতো একটা অর্ধনগ্ন নারী পাশে থাকলে কথাবার্তায় মন দেয়া যায় না। এতরা সে-রাতটা এখানেই কাটাল।অ্যানিদের স্কুলে আজ বার্ষিক স্পোর্টস। অ্যানি তার বাবা এবং মা দুজনের জন্যে দুটি টিকিট এনেছে। ভিকি বলেছে সে যেতে পারবে না, তার প্রচুর ঝামেলা। রুন হ্যাঁ না কিছুই বলেনি। খুব সম্ভব সেও যাবে না। রোদে বসে থাকলে রুনের মাথা ধরে। তা হাড়া যেদিন স্পোর্টস ঠিক সেদিনই হোটেল শেরাটনে গোলাপ ফুলের প্রদর্শনী হচ্ছে। এই প্রদর্শনীটি অন্য প্রদর্শনীগুলোর চেয়ে আলাদা। চিত্রতারকাদের বাড়ির গোলাপ প্রদর্শনী। এতরা দুটি টিকিট জোগাড় করেছে। বাচ্চাকাচ্চাদের দৌড়-ঝাঁপ দেখার চেয়ে হোটেল শেরাটনে যাওয়া বহুগুণে শ্রেয়। কিন্তু সেন্টিমেন্টের ব্যাপার আছে। অ্যানির এই স্পোর্টস নিয়ে খুব আগ্রহ। দু-তিন মাস আগে থেকেই বলে রেখেছে, যেতেই হবে। এখন তাকে না বলাটাই এক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।কিন্তু রুন ঠিক করে ফেলল ব্যাপারটা ঝুলিয়ে না রেখে মিটিয়ে ফেলাই ভালো। রাতের খাবার টেবিলে কন্ন প্রসঙ্গটা তুলল, ‘অ্যানি, তোমার স্পোর্টস কবে?”‘সতেরো তারিখ। ভোমাকে তো বলেছি আগে।”তুমি কিসে কিসে আছ?’একশো মিটার দৌড়।’
পৃষ্ঠা-৩৬
‘আর কিছুতে না?”না। তুমি যাচ্ছ তো মা?’রুন ইতস্তত করে বলল, ‘খুব চেষ্টা করব আমি, কিন্তু…”অর্থাৎ যাচ্ছ না। আমি আগেই জানতাম যাবে না।”এর মানে কী? তুমি আগেই জানতে মানে?”মানে কিছু নেই। তোমরা কেউ যাবে না তা আমি আগেই জানতাম।’অ্যানি খালা সরিয়ে উঠে দাঁড়াল।’ডিনার শেষ করো অ্যানি।”আমার খিদে নেই।”অ্যানি, তোমার বয়স হচ্ছে। এখন তুমি আর ছেলেমানুষ নও। সবার সুবিধা- অসুবিধা তোমার বুঝতে পারা উচিত।’অ্যানি প্রবাব না দিয়ে ছুটে চলে গেল নিজের ঘরে। মারিয়া টেবিল থেকে খালা সরাতে সরাতে বলল, ‘অ্যানি এবার একশো মিটার স্পোর্টসে প্রাইজ পাবে।”তা-ই বুঝি?”হ্যাঁ, ম্যাডাম। এঐ লোকটি খুব ভালো শেখায়।’দৌড়ানোর মধ্যে আবার শেখানোর কী আছে?”তা জানি না, তবে লোকটি যত্ন করে শেখাচ্ছে।’রুদ গম্ভীর হয়ে গেল। মারিয়া হঠাৎ বলল, ‘লোকটি খুব খারাপ না ম্যাডাম।’খারাপ হবে কেন?”না, মানে লোকটি অ্যানিকে পছন্দ করে।’রুন চোখ তুলে তাকান। মারিয়া কফি ঢালতে ঢালতে বলল, ‘অ্যানির যে-রাতে জ্বর এল, সে-রাতে একবার সে আমাকে জিজ্ঞেস করেছেজ্বর কত?”ই। ওর কাছ থেকে তা আশা করা যায় না, ঠিক না ম্যাডাম?’জামশেদ সারা দুপুর একটা বই পড়তে চেষ্টা করছে, ‘দি ইয়েলো নাইট’। পড়া মোটেও আগাচ্ছে না। অভ্যেস না থাকলে যা হয়। বইটির কভারে লেখা আছে ‘এই সত্যি ভূতের গল্প কেউ যেন রাতে না পড়ে। যাদের ব্লাডপ্রেশার বা হার্টের অসুখ আছে তারা যেন ভুলেও এ-বই না পড়ে।’ জামশেদ বহু কষ্টে ধীরে ধীরে এগুচ্ছে এবং যতই এগুচ্ছে ততই তার মেজাজ খারাপ হচ্ছে। এমন সব আজগুবি জিনিসও লেখা হয় এবং লোকজন কিনে এনে পড়ে। একটি একুশ বছরের মেয়ের সঙ্গে প্রতিরাতে একটি পিশাচ এসে ঘুমায়। গাঁজাখুরিরও সীমা থাকা দরকার। জামশেদ বই বন্ধ করে বিরক্তমুখে বারান্দায় চলে এল। তার প্রচণ্ড তৃষ্ণা বোধ হচ্ছে। এমন তৃষ্ণা যা সময়-অসময় মানে না, হঠাৎ জেগে উঠে চেতনা আচ্ছন্ন করে ফেলে। কিন্তু এখন যদি দরজা বন্ধ করে বোতল খুলে বসে তা হলে আর নিজেকে সামলানো যাবে না। জামশেদ প্রাণপণে তৃষ্ণা ভুলে থাকতে চেষ্টা করল। ব্যস্ত থাকলে কাজ হবে হয়তো। সে নিচে নেমে এল। লনের এক প্রান্তে অ্যানি
পৃষ্ঠা-৩৭
বসে ছিল। তার বসায় ভঙ্গিটি অদ্ভুত-যেন কাঁদছে। এবং কান্না লুকানোর চেষ্টা করছে। জামশেদ একবার ভাবল তাকে ডাকবে না। তবু ডাকল এবং আশ্চর্য, ডাকল খুব নরম। স্বরে, ‘কী করছ, অ্যানি?”কিছু করছি না।”কাঁদছিলে নাকি?’অ্যানি তার জবাব না দিয়ে বলল, ‘তুমি কি কাল আমার স্পোর্টস দেখবে, না গাড়িতে বসে থাকবে?”লোকজনের ভিড় আমার পছন্দ হয় না। আমি গাড়িতে থাকব।’জামশেদের কথা শেষ হবার আগেই অ্যানি প্রায় ছুটে চলে গেল। সারা বিকেল এবং সারা সন্ধ্যা তার আর দেখা পাওয়া গেল না।রাত দশটায় জামশেদ রান্নাঘরে উঁকি দিল। মারিয়ার বিশ্বয়ের সীমা রইল না। জামশেদকে কখনো এখানে আসতে দেখা যায় না। সে অবাক হয়ে বলল, ‘কী, কফি খাবে? কফির জন্যে এসেছ?”না। অ্যানি কোথায়?”‘ঘুমুতে গেছে।'”ঘুমিয়ে পড়েছে?”‘না, এখনও ঘুমায়নি। জামি দুধ নিয়ে যাব। দুধ খেয়ে শোবে।”জেগে আছে তা হলে?”হ্যাঁ। কী ব্যাপার? কিছু বলবে অ্যানিকে?”তুমি অ্যানিকে বলবে যে আমি এর স্পোর্টস দেখতে যাব।’মারিয়া বলল, ‘আমি এক্ষুনি ওকে বলছি।”এক্ষুনি বলার দরকার নেই।’মারিয়া বলল, ‘আমি খুব খুশি হয়েছি যে তুমি যাচ্ছ। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুক।অ্যানি মেয়েটি খুব নিঃসঙ্গ।’জামশেদ জবাব দিল না, গম্ভীরমুখে উপরে উঠে এল।একশো মিটার দৌড় হচ্ছে তিন নম্বর ইভেন্ট। অ্যানি খুব নার্ভাস হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে প্রতিযোগী পাঁচজন। এদের মধ্যে নিন্তি নামের মেয়েটি হরিণের মতো দৌড়ায়। মাঠে নামবার আগে জামশেদ বলল, ‘যখন দৌড়াতে শুরু করবে তখন একটি জিনিসই শুধু খেয়াল রাখবে। সামনের লাল ফিতা। ঠিক আছে?”ঠিক আছে।”ভয় লাগছে?”হ্যাঁ। মনে হচ্ছে আমি হেরে যাব।”কাউকে তো হারতেই হবে।”আমার হারতে ভালো লাগে না।’
পৃষ্ঠা-৩৮
স্টার্টিং ফায়ার হতেই অ্যানি বিদ্যুতের মতো ছুটল। আদশেদ হাসল-চমৎকার স্ট্যুটিং। অপূর্ব!। অ্যানি নিমেষের মধ্যে প্রতিযোগীদের পেছনে ফেলে দিল। কিন্তু অঘটন ঘটল-অ্যানি ছমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। একটা হাহাকার উঠল দর্শকদের প্যাভিলিয়ন থেকে। অ্যানির আশাহত চোখের সামনে প্রতিযোগীরা ছুটে বেরিয়ে গেল। লাফিয়ে উঠল জামশেদ-‘উঠে দাঁড়াও, দৌড়াও। বোকা মেয়ে, দৌড়াও।’অ্যানি উঠে দাঁড়িয়েছে। জামশেদ তৃতীয়বার চেঁচাল, ‘দৌড়াও।’ অ্যানি ছুটতে শুরু করল। পৌঁছাল সবার শেষে।অ্যানি কাঁদতে কাঁদতে দর্শকদের প্যাভিলিয়নের দিকে আসছে। জামশেদ এগিয়ে গেল। একটি ছোট্ট শিশুর মতো অ্যানি আমশেদকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল।বাড়ি ফেরার পথে জামশেদ বলল, ‘আমি খুব খুশি হয়েছি যে পড়ে যাবার পরও তুমি উঠে দাঁড়িয়েছ এবং দৌড়াতে শুরু করেছ।”তাতে কিছুই যায় আসে না।”তাতে অনেক কিছুই যায় আসে, অ্যানি।’অ্যানি ফ্রকের হাতায় চোখ মুছল। জামশেদ বলল, ‘পৃথিবীতে বেশির ভাগ মানুষইহুমড়ি কেয়ে পড়ে যায়। খুব অল্প কিছু মানুষ উঠে দাঁড়াতে পারে।’ অ্যানি চাপাস্বরে বলল, ‘ওরা এসে পৌঁছায় সবার শেষে।”আপাতদৃষ্টিতে এরকম মনে হয়। সত্যিকার অর্থে ওরাই কিন্তু জয়ী।’অ্যানি জবাব দিল না। জামশেদ বলল, ‘সমুদ্রের দিকে যেতে চাও, অ্যানি? ওখানে বালির উপর বসে আইসক্রিম খাওয়া যেতে পারে। কী, চাও যেতে?”চাই।”এসো, আজকের দিনটি আমরা খুব ফুর্তি করে কাটাই। মিউজিয়ামে গেলে কেমন’মিউজিয়াম আমার ভালো লাগে না।”তা হলে চলো চিড়িয়াখানায় যাওয়া যাক। চিড়িয়াখানা ভালো লাগে?”লাগে।'”যাবে?’অ্যানি তাকিয়ে দেখল, বুড়ো ভালুতের পাথরের মতো চোখ দুটি কোন এক আশ্চর্য উপায়ে তরল হয়ে যেতে শুরু করেছে।ভিকি পরপর দুরাত ঘুমাতে পারেনি। এক সপ্তাহের মধ্যেই একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তাকে নিতে হবে। সিল্কের ব্যবসা গুটিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত। ভিন-পুরুষের একটা ব্যবসাগুটিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত হঠাৎ নেয়া যায় না। এর জন্যে অনিদ্রায় কাতর হতে হয়। কন দেখল, তিকি রাত ন’টার দিকে ড্রাইভারকে গাড়ি বের করে আনতে বলছে।’কোথায় যাচ্ছ?”একটা কাজে যাচ্ছি।’
পৃষ্ঠা-৩৯
‘টাকার জোগাড় করতে?”না। ওটা আয় জোগাড় হবে না।”আশা ছেড়ে দিয়েছ মনে হচ্ছে।’ডিকি জবাব দিল না। রুন বলল, ‘একটা কাজ করলে কেমন হয়? আমাকে ভালো একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাও-না।’ভিকি নিঃশব্দে টাইয়ের নট বাঁধতে লাগল।’কী, কথায় জবাব দিচ্ছ না যে? চলো-না সমুদ্রের ধারে যে একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্ট আছে সেখানে গিয়ে লবস্টার খেয়ে আসি।’ভিকি ক্লান্তস্বরে বলল, ‘রুন, তুমি বুঝতে পারছ না আমি একটা দারুণ সমস্যার। মধ্যে আছি। এমন হতে পারে যে চাইনিজ রেস্টুরেন্টে লবস্টার আর কোনোদিনই আমরা। খেতে পাব না।’রুল হাসিমুখে বলল, ‘কিন্তু এমন তো হতে পারে যে হঠাৎ করে তোমার সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল।”আমার বেলা হঠাৎ করে কিছু হয় না।”একেবারে আশা ছেড়ে দেয়া ঠিক না। চলো যাই।’ রুন ভিকির হাত ধরল।’প্লিজ, রুন। আমাকে বিরক্ত কোরো না। খুব খারাপ সময় যাচ্ছে।”সময় ভালোও তো হয়ে যেতে পারে। কথা শোনো আমার।’ভিকি কোনো কথা শুনল না। বিরক্তমুখে নিচে নেমে গেল। ভার বেশ মাথা ধরেছে। রুনের ন্যাকামি শুনতে এতটুকুও ভালো লাগছে না।এতরা চোখ কপালে তুলে বলল, ‘এ কী চেহারা হয়েছে তোমার?’ডিফির চেহারা সত্যি সত্যি খারাপ হয়েছে। বুড়োটে দেখাচ্ছে। চোয়াল স্কুলে পড়েছে। চোখের দৃষ্টিও নিষ্প্রভ। এতরা সরু গলায় বলল, ‘একেবারে ভেঙে পড়েছ মনে’তা ভেজেছি। সেটাই স্বাভাবিক নয় কি?”না। তোমার যা হচ্ছে তা খুব অস্বাভাবিক। তুমি কোনো সমাধানের দিকে না তাকিয়ে অন্যদিকে তাকাচ্ছ।”সামাধান কিছু নেই।’এভরা মিটিমিটি হাসল। হাসিমুখেই বলল, ‘চমৎকার একটা ডিনারের অর্ডার দাও। সেইসঙ্গে জামান কিছু হোয়াইট ওয়াইন আনতে বলো। তোমাকে সমাধান দিচ্ছি।’ভিকির কোনো ভাবান্তর হল না। সে সিগারেট ধরিয়ে ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে রইল। এতরা খানিকটা ঝুঁকে এসে বলল, ‘প্রথম শ্রেণীর সমাধান আছে আমার কাছে, ঠাণ্ডা মাথায় শুনতে হবে।”বলো, শুনি।”বলছি। তার আগে নার্ভগুলি ঠাণ্ডা করাবার জন্যে এক পশলা মার্টিনি হোক।মার্টিনি উইখ অলিভ।’
পৃষ্ঠা-৪০
এতরা হাতের ইশারায় ওয়েট্রেসকে ডাকল।’কী তোমার সমাধান?”বলছি। শর্ত হচ্ছে সবটা বলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তুমি কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না। প্রথমে কোনো সাড়াশব্দ না করে শুনবে। ঠিক আছে?”ঠিক আছে।”তা হলে শুরু করছি।’এতরা লম্বা একটা চুমুক দিল মার্টিনিতে। নিচুস্বরে বলতে শুরু করল, ‘তুমি নিশ্চয়ই জান, ইংল্যান্ডের একটা ইনস্যুরেন্স কোম্পানি অদ্ভুত অদ্ভুত সব ইনস্যুরেন্স পলিসি বিক্রি করে। জান তো?”‘আনি।”ওরা ইদানীং একটা নতুন ইনস্যুরেন্স পলিসি বিক্রি করতে শুরু করেছে। ধনী বাবা-মারা তাঁদের সন্তানদের নিরাপত্তা ইনস্যুরেন্স করছেন।”তা-ই নাকি? জানতাম না তো।”ইনস্যুরেন্স করবার পর যদি ইনস্যুর-করা ছেলেমেয়েরা কিডন্যাপ হয় তা হলে কিডন্যাপারদের দাবি অনুযায়ী সব টাকা ইনস্যুরেন্স কোম্পানি দিয়ে দেয়। বুঝতে পারছ?”পারছি।’এতয়া আরেকটি ডবল মার্টিনির অর্ডার দিয়ে বলল, ‘এতক্ষণ যা বললাম তা হচ্ছে। তোমার সমস্যার সমাধান।’তার মানে?”ব্যস্ত হয়ো না। বুঝিয়ে দিচ্ছি।’ভিকি তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এতরা সহজ ভঙ্গিতে বলতে লাগল, ‘তুমিঅ্যানির জন্যে ঐ একটি পলিসি কিনবে। এক মিলিয়ন ডলারের একটি পলিসি। তারপরকিছু দুষ্টলোক অ্যানিকে চুরি করে এক মিলিয়ন ডলার মুক্তিপণ দাবি করবে। ইনস্যুরেন্স কোম্পানি এক মিলিয়ন ডলার দেবে তা তো বুঝতেই পারছ। সেখান থেকে পাঁচ লাখ ডলার পাবে তুমি, আর বাকিটা যাবে কিডন্যাপের ব্যবস্থা যারা করবে তাদের হাতে।’ ভিকি নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল। এতরা হাসিমুখে বলল, ‘পরিকল্পনা দায়িত্বে যারা থাকবে তাজ সবাই খুব বিশ্বাসী। আমার নিজের লোক বলতে পার।’ভিকি কোনো জবাব দিল না।’অবিশ্যি ইনস্যুরেন্স কোম্পানির কিছু বিধিনিষেধ আছে। যেমন পলিসি বিক্রি করবার আগে ওদের দেখাতে হবে যে তুমি তোমার মেয়ের নিরাপত্তার যথাযথ ব্যবস্থা করেছ। যেমন, ওর জন্যে চব্বিশ ঘণ্টার বডিগার্ড আছে। বাড়িতে পাহারাদার কুকুর আছে। বুঝতে পারছ?’ভিকি কিছু বলল না, চুপচাপ বসে রইল। এতরা বলল, ‘ডিনারের অর্ডার নেয়া যাক, কী বল? এমন মনমরা হয়ে গেলে কেনা”তোমার সমাধানটি আমার পছন্দ হয়নি।’
পৃষ্ঠা-৪১
‘ভালো। পছন্দ যে হতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। আমরা নতুন সমাধানের কথা চিন্তা করব। তবে ভিকি, এতক্ষণ আমরা যে-কথাবার্তা বললাম তা যেন তৃতীয় কোনো প্রাণী জানতে না পারে।”জানবে না।”রুনকেও বলবে না।”এতরা, আমি আমার নিজস্ব ব্যাপারগুলোর কথা ঘরে বলে বেড়াই না।”৬৬। আর শোনো, যদি তোমার মনে হয় আমার পরিকল্পনাটি প্রথম শ্রেণীর তা হলে বিনা দ্বিধায় আমাকে জানাবে। বুঝতে পারছি অ্যানির নিরাপত্তার বিষয়েই তুমি বেশি চিন্তিত। অ্যানিকে আমি আমার নিজের মেয়ের মতোই দেখি, ওর নিরাপত্তার যথাযোগ্য ব্যবস্থা নেয়া হবে বলাই বাহুল্য।’ভিকি গড়ীয়মুখে ডিনারের অর্ডার দিল। ডিনার ছিল সাদামাটা কিন্তু ডিনারশেষে প্রচুর ড্রিংকসের ব্যবস্থা হল। এবং একসময় ভিকি বলল, ‘তুমি যে-পরিকল্পনার কথা বলছ তার পেছনে তোমার কী স্বার্থ?”‘আমার দুটি স্বার্থ। বন্ধুর উপকার হবে। তা ছাড়া, আমিও কিছু টাকা পাব। দশ হাজার ডলার। বিরাট কিছু নয়, তবে মন্দও নয়।’ভিকি হঠাৎ বলল, ‘আমি রাজি আছি।”ভালো। আমি জানতাম তুমি রাজি হবে।’ভিকি উত্তর দিল না।’কোনোরকম ঝামেলা ছাড়া এতবড় একটা দান একমাত্র জুয়ার টেবিলেই পাওয়া সম্ভব।’ এতয়া টেনে টেনে হাসতে লাগল। ‘আরেক রাউন্ড হবে?’ভিকি জবাব দিল না।’আরেক রাউন্ড হোক। ভিকি, তোমাকে খুব বিমর্ষ দেখাচ্ছে। ফুর্তির জন্যে কোথাও যেতে চাও? দুটি স্প্যানিশ মেয়ে আছে, আমার পরিচিত। অপূর্ব! এবং বিশেষ পারদর্শী।”ফুর্তির জন্যে আমি কখনো বাইরে যাই না।”ঠিক ঠিক। খুবই ঠিক।’এভরা হাতের ইশারায় ওয়েট্রেসকে ডাকল। সে মনে হল কিঞ্চিৎ নেশাগ্রস্ত।জমশেদের ঘরে মৃদু নক হল। অন্ধকার কাটেনি এখনও। এত ভোরে কে আসবে? জামশেদ ঘড়ি দেখল, ছ’টা বাজতে এখনও দশ মিনিট বাকি।’কে?”আমি। আমি আনি।’
পৃষ্ঠা-৪২
‘কী ব্যাপার?”আমি তোমাকে শুভ জন্মদিন জানাতে এসেছি।”কিসের শুভ জন্মদিন?’ জামশেদ বিরক্তমুখে গায়ে রোব জড়াল। দরজা খুলল অপ্রসন্ন মুখে।অ্যানি হাসিমুখে একটা প্যাকেট হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সে ক্ষীণস্বরে বলল, ‘ভেতরে আসব?”না।’অ্যানি ইতস্তত করতে লাগল। জামশেদ তারীখরে বলল, ‘আমার জন্মদিন কবে তা আমি কেন আমার বাবা-মাও জানেন না।”কিন্তু আমি যে তোমার কাগজপত্রে দেখলাম ৪ঠা জুলাই তোমার জন্মদিন। ‘একটা-কিছু লিখতে হয় সেজন্যেই লেখা। বুঝতে পারছ?”পারছি।”হাতে ওটা কী, জন্মদিনের উপহার।”ই।’ঠিক আছে, দাও।’অ্যানি মৃদুস্বরে বলল, ‘তোমার জন্মদিন কবে তা কেউ জানে না কেন?”অনেকগুলি ভাইবোন আমরা কার কবে জন্ম এসব নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় আমার মা-র ছিল না।”ক’জন ভাইবোন।’জামশেদের ও কুঞ্চিত হল। সে একবার ভাবল জবাব দেবে না। কিন্তু জবাব দিল। ‘নজন। দু’টি বোন।’তুমি ক’নম্বন?’ ‘চার। আরকিছু জিজ্ঞেস করবে?’অ্যানি হালকা স্বরে বলল, ‘জন্মদিনে এমন রাগি গলায় কথা বলছ কেন?”তোমাকে তো বলেছি আজ আমার জন্মদিন নয়।”তুমি তো জান না কবে সেটা। এমন তো হতে পারে আজই সেই দিন।”তাতে কিছু আসে যায় না।’অ্যানি অস্পষ্টভাবে হাসল।’কী এনেছি তোমার জন্যে খুলে দেখবে না?’জামশেদ প্যাকেট খুলে ফেলল।’এটা একটা ভিডিও গেম। তুমি তো একা একা থাকতে পছন্দ কর, সেজন্যে কিনেছি। একা একা খেলতে পারবে। কী করে খেলতে হয় আমি তোমাকে শিখিয়ে দেব।”ঠিক আছে।”তুমি হাতমুখ ধুয়ে আসো, আমি তোমাকে শিখিয়ে দিচ্ছি। আজকে আমি তোমার সঙ্গে ব্রেকফাস্ট করব।’
পৃষ্ঠা-৪৩
জামশেদ কিছু বলল না। অ্যানি হাসিমুখে বলল, ‘আমাদের দুজনের ব্রেকফাস্ট আজ এখানে দিয়ে যাবে। এবং তোমার জন্মদিন উপলক্ষে আজ খুব চমৎকার ব্রেকফাস্ট তৈরি। হচ্ছে।’জামশেদ হাতমুখ ধুতে গেল। বাথরুম থেকে বেরুতেই চোখে পড়ল ভিকি লনে একা একা হাঁটছে। এত ভোরে ভিকি কখনো ওঠে না। জামশেদের মনে হল, ভিকি যেন একটু বেশিরকম বিচলিত। আমশেদের সঙ্গে ভিকির একবার চোখাচোখি হল। ভিকি বাঁ হাত উঠিয়ে কী যেন বলল ঠিক বোঝা গেল না।সাত কোর্সের একটি স্প্যানিশ ব্রেকফাস্ট তার টেবিলে অত্যন্ত চমৎকারভাবে সাজানো। অ্যানি কফিপট থেকে কফি ঢালছে। জামশেদ ছোট একটা নিশ্বাস ফেলল।। অ্যানি বলল, ‘তুমি কিন্তু একবার বলনি, খ্যাত ইউ।”থ্যাঙ্ক ইউ।”এর মধ্যে একটা জিনিস আমার তৈরি। কোনটি বলতে পারবে?”তুমি রান্না করতে পার?”না। মারিয়া বলে দিয়েছে আমি রান্না করেছি।’জামশেদ কফির পেয়ালায় চুমুক দিল। অ্যানি আবার বলল, ‘আজ কিন্তু তুমি রাগ করতে পারবে না। আজ আমার সঙ্গে গল্প করতে হবে।”জামশেদ জবাব দিল না।অ্যানি একটু গম্ভীর হয়ে বলল, ‘আমি জানি তুমি আমাকে একটুও পছন্দ কর না। আমি এলেই বিরক্ত হও। তবু আজ আমি অনেকটা সময় তোমার ঘরে বসে থাকব।”ঠিক আছে।”এবং তোমাকে নিয়ে বিকেলে মলে শপিং করতে যাব। আমি বাবাকে বলে রেখেছি।’অ্যানির কথা শেষ হবার আগেই দরজায় ছায়া পড়ল। ভিকি এসে দাঁড়িয়েছে।’মিঃ জামশেদ, শুভ জন্মদিন।”জামশেদ শুকনো স্বরে বলল, ‘ধন্যবাদ।’অ্যানি তোমার জন্মদিন নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই হৈচৈ করছিল।’জামশেদ ঠাডাস্বরে বলল, ‘তুমি কি ভেতরে এসে আমাদের সঙ্গে এক কাপ কফি খাবে?’না ধন্যবাদ। আমি তোমার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।’নিশ্চয়ই।’জামশেদ ঘর থেকে বেরিয়ে এল। ভিকি বারান্দার এক প্রান্তে সরে গেল। সিগারেট ধরাল একটি। জামশেদের মনে হল, লোকটা বিশেষ চিন্তিত। সিগারেট ধরাবার সময় তার হাত কাঁপছিল। এর কারণ কী?’বলো কী বলবে।”না, তেমন কিছু নয়।’ভিকি অস্পষ্টভাবে হাসল। জামশেদ বলল, ‘তোমাকে চিন্তিত মনে হচ্ছে।
পৃষ্ঠা-৪৪
‘না, চিন্তিত না। চিন্তিত হবার কী আছে?’ভিকি রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছল। ফ্যাকাশেভাবে হেসে বলল, ‘এবার বেশ গরম পড়বে, কী বল?’জামশেদ জবাব দিল না। ডিকি ইতস্তত করে বলল, ‘তোমাকে একটি কথা বলতে চাই। ইয়ে, মানে, তেমন জরুরি কিছু নয়।”বলো।”ধরো যদি এমন পরিস্থিতি হয় যে তুমি দেখছ কেউ অ্যানিকে কিডন্যাপ করার চেষ্টা করছে, তখন আমার মনে হয় সবচেয়ে ভালো হবে তুমি যদি চুপচাপ থাক।”কেন?”না, মানে তুমি যদি গুলি করতে শুরু কর তা হলে বুলেট অ্যানির গায়ে লাগার সম্ভাবনা, ঠিক না?”আশঙ্কা যে একেবারে নেই তা নয়। তবে ভিকি, আমাকে রাখা হয়েছে অ্যানির নিরাপত্তার জন্যে, ঠিক না?”হ্যাঁ, তা ঠিক।”তুমি নিশ্চয়ই আশা কর না এরকম পরিস্থিতিতে আমি মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকব’না না, তা কেন? তা তো হতেই পারে না।’ভিকি আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলল। জামশেদ বলল, ‘তুমি কি কোনোকিছু নিয়ে চিন্তিত?”না না, চিন্তিত হব কেন?’ভিকি দুর্বলভাবে হাসল। জামশেদ ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারল না।ডিকি কিছু-একটা নিয়ে বিশেষভাবে চিন্তিত।রুনের চোখেও ব্যাপারটা ধরা পড়ল। সাধারণত এসব ছোটখাটো জিনিস তার চোখে পড়ে না। কিন্তু পরিবর্তনটি হঠাৎ এবং স্পষ্ট। চোখে না পড়ে উপায় নেই। তার ওপর ক’দিন আগে ভিকি দু’টি প্রকাণ্ড অ্যালসেশিয়ান কুকুর কিনে এসেছে। এর কারণ বোধগম্য নয়। ভিকি কুকুর পছন্দ করে না। হঠাৎ করে কুকুরের প্রতি তার এরকম প্রেমের কারণ কীঃ রুন কোনো ব্যাপার নিয়ে বেশিক্ষণ ভাবতে পারে না। তবু সে এ ব্যাপারটি নিয়ে অনেক চিন্তাভাবনা করল। ভিকিকে যে ঠিক ভালো না বাসলেও পছন্দ করে। স্বামী হিসেবে সে চমৎকার। এবং যতদূর মনে হয় মাঝে মাঝে জুয়ার টেবিলে বসা ছাড়া তার অন্য কোনো বদঅভ্যেস নেই।রুন বিকেলে একটু বিশেষ সাজসজ্জা করল। এ-জাতীয় পোশাকে কুমারী মেয়েদেরকেই ভালো লাগে। কিন্তু রুনকে এখনও কুমারী মেয়ে বলেই ভ্রম হয়। কন বড় একটি খাম হাতে নিয়ে ভিকির ঘরে উঁকি দিল।’হ্যালো, ভিকি।”হ্যালো।’
পৃষ্ঠা-৪৫
‘কী ব্যাপার, তুমি দেখি একেবারে মাছের মতো হয়ে গেছ।’ভিকি জবাব দিল না। রুন সামনের চেয়ারটিতে বসতে বসতে বলল, ‘খুব সম্ভব গতরাতে তোমার ঘুম হয়নি। চোখ লাল। ব্যাপারটা কী আমি জানতে চাই।”তেমন কিছু না।”বিজনেস নিয়ে চিন্তিত?’হ্যাঁ।’কোনো সুরাহা হয়নি?”না।”বুদ্ধিমান এতরা কোনো বুদ্ধি দিতে পারল না।’ভিকি ঈষৎ চমকাল। কিছু বলল না। রুন গম্ভীর গলায় বলল, ‘আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই।’ভিকি চোখ তুলে তাকাল।’আমি তোমাকে পঞ্চাশ হাজার ডলার দেব। কিন্তু একটি শর্ত আছে।’
‘কী শর্ত?”তুমি তোমার মুখে যে ভয়াবহ চিন্তার মুখোশ পরে আছে এটি পুড়িয়ে ফেলতে হবে।’ কথাটা বলে রুন বিলখিল করে হেসে উঠল। আর ঠিক তখন টেলিফোন এল। বালজাক অ্যাভিনিউর মোড়ে অ্যানিকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। ছোটখাটো একটা খও প্রলয় হয়ে গেছে সেখানে। প্রাথমিকড়াবে মনে করা হচ্ছে তিনজন মারা গেছে। সংখ্যাএর চেয়ে বেশিও হতে পারে।এক মিলিয়ন ডলার মুক্তিপণ চেয়ে প্রথম টেলিফোনটি এল রাত এগারোটায়।এগারোটা পঁচিশে সেন্ট্রাল হাসপাতাল থেকে টেলিফোন এল। জামশেদ নামের যে- দেহরক্ষীকে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছে তার অবস্থা সংকটাপন্ন। নিকট আত্মীয়স্বজনদের খবর দেয়া প্রয়োজন।অ্যানির অপহরণ সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে ‘লা বেলে’ পত্রিকায়। রিপোর্টটিতে একজন প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য আছে। মধ্যবয়স্ক এই স্কুল- শিক্ষকটি ঘটনার সময় কফিশপে কফি খাচ্ছিলেন। তাঁর চোখের সামনেই সমস্ত ব্যাপার ঘটল।তাঁর প্রতিবেদনটি ছিল এরকম:’আমি যেখানে কফি খাচ্ছিলাম, আইসক্রিম পার্লারটি ছিল তার সামনে। জুলাই মাসের গরমের জন্যেই খোলা উঠানে কফির টেবিল বসানো হয়েছিল। আমি আমার এক বান্ধবীর জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। ঘনঘন তাকাচ্ছিলাম রাস্তার দিকে।’চারটা ত্রিশ মিনিটে নীলরঙা একটি ছোট পনটিয়াক এসে আইসক্রিম পার্লারে থামল। গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল অত্যন্ত রূপসী একটি বালিকা। বালিকাটি কাউন্টারে আইসক্রিমের অর্ডার দিয়ে যখন অপেক্ষা করছিল তখন আমি লক্ষ করলাম একটি প্রকাণ্ড সবুজ রঙের ওপেল গাড়ি আইসক্রিম পার্লারের পশ্চিমদিকে থামল।’
পৃষ্ঠা ৪৬ থেকে ৬০
পৃষ্ঠা-৪৬
তিনটি লোক নেমে এল গাড়ি থেকে। দুজন ছুটে গেল মেয়েটির দিকে, তৃতীয়জন ফাঁকা আওয়াজ করতে লাগল। তার হাতে হালকা একটি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ছিল। গুলি ছুড়বার আগ পর্যন্ত আমি তা লক্ষ করিনি।’গুলির শব্দ আসামাত্র চারদিকে ছুটাছুটি শুরু হল। আমি নিজেও উঠে দাঁড়ালাম। কফিশপের মালিক চেঁচিয়ে বলল-সবাই মাটিতে শুয়ে পড়ুন। বিপদের সময় কারোর কিছু মনে থাকে না। আমারও থাকল না। আমি দৌড়ে খোলা রাস্তায় এসে পড়লাম। তখন বাচ্চা মেয়েটিকে দুজন ওপেল গাড়িটির দিকে টেনে নিচ্ছে এবং মেয়েটি চ্যাঁচাচ্ছে প্রাণপণে। যে-দুজন মেয়েটিকে টানছে তাদের একজন মেয়েটির গালে চড় কষাল। এই সময় স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র-হাতে তৃতীয় ব্যক্তিটিকে দেখালাম মাটিতে গড়িয়ে পড়েছে। আমি অবাক হয়ে দেখলাম কালো রঙের একটি মানুষ ওদের দিকে ছুটে যাচ্ছে। মানুষটির বাঁ হাতে একটি পিস্তল।’এই সময়ে সবুজ ওপেল গাড়িটি থেকে আরো দুজন লোক বন্দুক-হাতে লাফিয়ে নামল। কালো লোকটি ছুটন্ত অবস্থাতেই গুলি ছুড়ল। এরকম অব্যর্থ হাতের নিশানা কারো থাকতে পারে তা আমার জানা ছিল না। লোক দুটিকে নিমিষের মধ্যে লুটিয়ে পড়তে দেখলাম।’কালো লোকটি বুনো মোষের মতো ছুটছিল। হঠাৎ সে থমকে দাঁড়াল। সবুজ গাড়িটির দরজা খুলে লম্বা-চুলের একটা লোক কয়েক পশলা গুলি করল কালো লোকটিকে। আমি দেখলাম কাল্যে লোকটি উবু হয়ে পড়ে গিয়েছে।”না বেলে’ পত্রিকাটিতে দুটি ছবি ছাপা হয়েছে। একটি অ্যানির, অন্যটি জামশেদের। জামশেদ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে অসম্ভব সাহসী এই লোকটি মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করছে। সেন্ট্রাল হাসপাতালে তাকে রাখা হয়েছে কড়া পুলিশ নিরাপত্তায়। ডাক্তাররা ইতিমধ্যে দু’বার তার ফুসফুসে অস্ত্রোপচার করেছে। তৃতীয় দফা অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হতে পারে। সেন্ট্রাল হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের সচিব অন নান বলেছেন। জামশেদের সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। তবে সম্ভাব্য সকল চেষ্টা চলছে।অ্যানিয় ছবির নিচে তার একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে যে অ্যানি ভিকি হচ্ছে বিখ্যাত সিল্ক ব্যবসায়ী অ্যারন ভিকির নাতনি। তার বয়স বারো বছর এবং তার মুক্তির জন্যে এক মিলিয়ন ইউ এস ডলার মুক্তিপণ চাওয়া হয়েছে।অ্যানির যে-ছবিটি ছাপা হয়েছে সেটি তার গত জন্মদিনের ছবি। মাথায় হ্যাপি বার্থডে টুপি। মুখভরতি হাসি। ছবিটিতে অ্যানিকে দেবশিশুর মতো লাগছে।বেন ওয়াটসন খরবটি দুবার পড়ল। তার ভ্রূ কুঞ্চিত হল। ছবিটিতে যে কালোমতো লোকটিকে দেখা যাচ্ছে, সে যে ‘জামুস’ এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাদের ছাড়াছাড়ি হয় লিসবনে, প্রায় পনেরো বছর আগে। পনেরো বছর দীর্ঘ সময়। এই সময়ের মধ্যে পুরানো অনেকের সঙ্গেই দেখা হয়েছে, শুধু ‘জামস’-এর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।বেন ওয়াটসন ‘লাসানিয়া ও পিজা হাউজ” থেকে বেরুল রাত এগারোটায়। তার মুখ চিত্তাক্লিষ্ট ও বিষণ্ণ। জাস্ বড় ধরনের ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছে। তার পাশে দাঁড়ানো উচিত।
পৃষ্ঠা-৪৭
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বেন ওয়াটসনকে জানাল, রুগির অবস্থা ভালো নয় এবং যেহেতু রুগি ইনটেনসিভ কেয়ারে আছে সেহেতু দেখা হবে না। বেন ওয়াটসন সারারাত হাসপাতালের লাউঞ্জে বসে কাটাল। জামস বোধহয় এ-যাত্রা টিকবে না।ভোরবেলায় জানা গেল ফুসফুসে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। তৃতীয় অপারেশন হল ভোর সাতটায়।এক মিলিয়ন ইউ এস ডলার পৌঁছে দেয়া হয়েছে। ইনস্যুরেন্স কোম্পানি সুটকেস ভরতি করে দশ ডলারের নোটের বান্ডিল যথাসময়ে দেয়ায় কোনোরকম ঝামেলা হয়নি। সুটকেসভরতি ডলার এভরাকে দেয়া হয়েছে। এবং টাকা দেবার এক ঘন্টায় ভেতর ভিকি টেলিফোন পেয়েছে যে অ্যানিকে রাত ন’টার আগেই ফোরটিনথ অ্যাভিনিউর মোড়ে একটি কমলা রঙের সিতান গাড়ির (যার নম্বর এফ ২৩৪) পেছনের সিটে পাওয়া যাবে। ওরা টেলিফোনে অ্যানির গলাও শুনিয়েছে। অ্যানি বলেছে, সে ভালো আছে এবং কেউ তার সঙ্গে কোনো খারাপ ব্যবহার করেনি। অ্যানি জামশেদের কথাও জানতে চেয়েছে। জামশেদ এখনও বেঁচে আছে শুনে খুশি হয়েছে।ভিকি সন্ধ্যা থেকেই ফোরটিনথ অ্যাভিনিউর মোড়ে দাঁড়িয়ে ছিল। রাত এগারোটা বেজে গেল কারোর দেখা পাওয়া গেল না।সে বেশ কয়েকবার এতরাকে টেলিফোন করল। কেউ ফোন ধরল না। ভিকির বুক কাঁপতে লাগল। রাত যতই বাড়তে লাগল একধরনের শীতল ভীতি তাকে কুঁকড়ে দিতে লাগল। অ্যানি বেঁচে আছে তো? আদরের অ্যানি, ছোট্ট অ্যানি সোনা।’ঠিক ক’ঘণ্টা পার হয়েছে অ্যানির মনে নেই। সে মনে রাখার চেষ্টাও করেনি। চিন্তা করতে পারছে না। অনেক কিছুর মতো চিন্তা করবার শক্তিও নষ্ট হয়ে গেছে। কোনো স্মৃতি নেই মাথায়। শুধু মনে আছে বুড়ো ভালুক ডান হাতে পিস্তল নিয়ে দৈত্যের মতো ছুটে আসছিল। কী ভয়াবহ কিন্তু কী চমৎকার ছবি। একসময় ছবিটি নষ্ট হয়ে গেল। আমশেদ গড়িয়ে পড়ল মাটিতে।’এ্যাই মেয়ে, কিছু খাবে?’ ‘বলেছি তো আমি কিছু খাব না।”ঠিক আছে।’
পৃষ্ঠা-৪৮
অ্যামি বক্ষ করল লোক তিনটি তার সঙ্গে মোটামুটি শুদ্র ব্যবহার করছে। প্রথম তাকে নিয়ে গেছে শহরের বাইরে, একটা ছোট্ট একতলা বাড়িতে। সে-বাড়িতে বুড়োমতো একজন লোক বসে ছিল, অ্যানিকে দেখেই সে ফুঁসে উঠে বলল, ‘এর জন্যে আমার সেরা তিনটি মানুষ মারা গেছে?’অ্যানির সঙ্গের লোকটি তার উত্তরে বিদেশী ভাষায় বুড়োকে কী কী যেন সব বলল। অ্যানি কিছুই বুঝল না। অ্যানিরা সেখানে ঘণ্টাখানেক থেকে আবার রওনা হল। অ্যানিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল একটি বদ্ধ ওয়াগনে করে। কোথায় যাচ্ছে, অ্যানি কিছুই বুঝতে পারল না। অ্যানির সঙ্গে যে বেঁটেমতো লোকটি ছিল সে একসময় বলল, ‘তুমি ছাড়া পাবে শিগগিরিই। ভয়ের কিছু নেই।’অ্যানির ঠোঁট টেপ দিয়ে আটকানো, সে এর জবাবে কিছু বলতে পারন না। লোকটি থেমে থেমে বলল, ‘মেয়ে হিসেবে তুমি অভ্যন্ত লোভনীয় কিন্তু কড়া নির্দেশআছে, আমাদের কিছুই করবার নেই।’যাত্রাবিরতি হল একটি হোটেলজাতীয় স্থানে। অ্যানিকে বলা হল হাতমুখ ধুয়ে নিতে।অ্যানি মাথা নাড়ল। সে কিছুই করতে চায় না। হঠাৎ বেঁটে লোকটি এসে প্রকাণ্ড একটি চড় কষাল। অ্যানি হতভম্ব হয়ে গেল। সে নিঃশব্দে হাতমুখ ধুয়ে এল। বাথরুমে আয়নায় দেখল তার বাঁ গাল লাল হয়ে ফুলে উঠেছে।টয়লেট থেকে বেরুতেই বেঁটে লোকটা বলল, ‘এখন থেকে যা বলব শুনাব। নয়তো সেফটিপিন দিয়ে তোর চোখ গেলে দেব।’অ্যানি বহু কষ্টে কান্না সামলাল। এখান থেকেই ওরা অ্যানির বাবাকে টেলিফোন করল। এবং একসময় অ্যানিকে বলল বাবার সঙ্গে কথা বলতে।’মামণি, তুমি ভালো আছ?”হ্যাঁ।”ওরা তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছে না তো?’অ্যানি শুনল তার বাবা কাঁদতে শুরু করেছে। সে কোনোদিন তার বাবাকে কাঁদতে শোনেনি। তার বুক ব্যথা করতে লাগল। টেলিফোন কেড়ে নেয়া হল এই সময়। বেঁটে লোকটা বলল, ‘তোমাকে আমরা পাশের ঘরে রেখে যাব। চিৎকার চ্যাঁচামেচিতে কোনো লাভ হবে না-কেউ শুনতে পাবে না। তোমার হাত-পা অবিশ্যি বাঁধা থাকবে, বুঝতে পারছ?”পারছি।”তবে ভয়ের কিছু নেই। ঘণ্টা দুএকের মধ্যে তুমি ছাড়া পাবে। ঠিক আছে?”অ্যানি জবাব দিল না।’তুমি কি কিছু খাবে?”ভালো।’লোকগুলি উঠে দাঁড়াতেই অ্যানি বলল, ‘আমার সঙ্গে যে কালো রঙের একজন হিল, তাকে তোমার গুলি করেছ, সে কি বেঁচে আছে।’
পৃষ্ঠা-৪৯
‘জানি না।”এটা কোন জায়গা’তা দিয়ে তোমার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।”তোমরা কি আমাকে মেরে ফেলবে? আমার এক বন্ধুকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলেছিল।’লোকগুলি হেসে উঠল যেন খুব একটা মজার কথা।ডঃ জন নানের ধারণা ছিল না যে একরম গুরুতর আহত একজন মানুষ দেয়ে উঠতে পারে। তিনি বেন ওয়াটসনকে বললেন, ‘আপনার এই বন্ধুটির জীবনীশক্তি অসাধারণ। এবং আমার মনে হচ্ছে সে সেরে উঠবে।”ধন্যবাদ, ডাক্তার। সে কি আগের মতো চলাফেরা করতে পারবে?”তা বলা কঠিন।’
‘আমি কি ওর সঙ্গে কথা বলতে পারি?”আপনার বন্ধু কথা বলতে পারবে কি না জানি না। তবে আপনি দেখা করতে পারবেন।”হ্যালো, আম্স্। চিনতে পারছ?’জামশেদ উত্তর দিল না। তার চোখে অবিশ্যি কয়েকবার পলক পড়ল। ‘ডাক্তার বলছে তুমি সেরে উঠবে। তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছ?’জামশেদ মাথা নাড়াল।’খুব কষ্ট হচ্ছে।’জামশেদ চুপ করে রইল।’অবশ্য কষ্ট হলেও তুমি স্বীকার করবে না, তোমাকে আমার চিনতে বাকি নেই। হা হাহা।’নার্স এসে বেন ওয়াটসনকে সরিয়ে নিয়ে গেল। যাবার আগে সে ফুর্তিবাজের ভঙ্গিতে বলল, ‘আমি থাকব হাসপাতালের আশপাশেই, কোনো চিন্তা দেই।’জামশেদের ভাবলেশহীন মুখেও ক্ষীণ একটি হাসির রেখা দেখা গেল। জামশেদের জবানবন্দি নেবার জন্যে পুশিশের যে অল্পবয়স্ক অফিসারটি লাউল্লে বসে ছিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে অনেকবার চলে যেতে বলল। রুগির কথা বলার মতো অবস্থা নয়। গুলি লেগেছে দু-জায়গায়, ডান ফুসফুসের নিচের অংশে এবং তলপেটে। তলপেটের জগমটিই হয়েছে মারাত্মক। ভাগ্যক্রমে বুলেট ছিল বত্রিশ ক্যালিবারের। এর চেয়ে ভারী কিছু হলে আর দেখতে হত না। রুগি যে এখন পর্যন্ত স্কুলে আছে তার কারণ লোকটির অসাধারণ প্রাণশক্তি। কথা বলার মতো অবস্থা তার আদৌ হবে কি না কে জানে? কিন্তু পুলিশ অফিসারটি দিনে চার-পাঁচবার ফরে আসছে। ডাক্তার দেখা হবে না বলা সত্ত্বেও বসে থাকছে।তৃতীয় দিনে সে রুগির সঙ্গে কথাবার্তা বলার অনুমতি পেল। ডাকার জন নানা বারবার বললেন, ‘খুব কম কথায় সারবেন। মনে রাখবেন, লোকটি গুরুতর অসুস্থ।’ জামশেদ চোখ মেলে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল পুলিশ অফিসারটির দিকে।
পৃষ্ঠা-৫০
‘আজ কি একটু ভালো বোধ করছেন।’জামশেদ মাথা নাড়ল।’আপনি জানেন না, যে-তিনটে লোক মারা গেছে তাদের ধরবার জন্য পুলিশবাহিনী গত চার বছর ধরে চেষ্টা করছে। এরা মাফিয়াচক্রের সঙ্গে জড়িত। এই লোক তিনটির নামে গোটা দশেক খুনের মামলা আছে। এরা বন্দুক চালাতে দারুণ ওস্তাদ। অবিশ্যি আপনি নিজেও একজন ওস্তাদ।’জামশেদ স্নান হাসল। থেমে থেমে বলল, ‘ওরা আমার জনো প্রস্তুত ছিল না বলে এরকম হয়েছে। ওরা কোনো প্রতিরোধ আশা করেনি।”তা ঠিক। ওরা কল্পনা করেনি অব্যর্থ নিশানায় একজন-কেউ লাফিয়ে পড়বে।’ পুলিশ অফিসার হঠাৎ অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল। ‘আমার স্ত্রী আপনাকে চিনতে পেরেছে। আপনার ছবি হাপা হয়েছে পত্রিকায়। সেটা দেখে চিনল। একবার আপনি তাকে সাহায্য করেছিলেন আপনার কি মনে আছে?’জমশেদ কিছু মনে করতে পারল না।’একবার এক রেস্টুরেন্টে একটা মাতালের পাল্লায় পড়েছিল সে। আপনি তার। সাহায্যের জন্যে এগিয়ে এসেছিলেন।”মনে পড়েছে।”আমরা এই ঘটনার কিছুদিন পরই বিয়ে করি। আমার স্ত্রীর খুব ইচ্ছা ছিল বিয়েতে। আপনাকে নিমন্ত্রণ করার, কিন্তু আপনার ঠিকানা আমরা জানতাম না।’জামশেদ ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলল। পুলিশ অফিসার বলল, ‘আপনাকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করার আছে। কিন্তু এখন আর বিরক্ত করব না। শুধু এটুকু বলে যাচ্ছি যে আপনার নিরাপত্তার জন্যে ভালো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। দুজন সশস্ত্র পুলিশ আপনাকে পাহারা দিচ্ছে।’জামশেদ ক্লান্ত স্বরে বলল, ‘মেয়েটির খোঁজ পাওয়া গেছে?”না, এখনও পাওয়া যায়নি। মেয়ের বাবার বিশেষ অনুরোধে পুলিশ খোঁজখবর করছে না। আমরাও মেয়েটির নিরাপত্তার কথা ভেবে চুপ করে আছি।”টাকা দেয়া হয়েছে? আপনি কিছু জানেন।”আমার যতদূর মনে হচ্ছে টাকা দেয়া হয়েছে। তবে নিশ্চিতভাবে আমরা কিছু বলতে পারছি না। মেয়ের বাবা আমাদের পরিষ্কার কিছু বলছে না।’অ্যানির মনে হল হাত-পা বাঁধা অবস্থায় সে অনন্তকাল ধরে এখানে পড়ে আছে। সে মনে-মনে অনেকবার বলল- আমি কাঁদব না, কিছুতেই কাঁদব না।
পৃষ্ঠা-৫১
কিন্তু বারবার তার চোখ ভিজে উঠতে লাগল। রাত কত হয়েছে কে জানে। ঘরে কোনো ঘড়ি নেই, কোনোরকম সাড়াশব্দও আসছে না। নিশ্চয়ই জনমানবশূন্য কোনো জায়গা। বাড়িতে একা একা নিজের ঘরে ঘুমুতেও ভয় লাগত তার। মাঝরাতে যতবার ঘুম ভাঙত ততবার তাকত মারিয়া, মারিয়া। যতক্ষণ পর্যন্ত না মারিয়া সাড়া দিচ্ছে ততক্ষণ তার ঘুম আসত না। মনে হত নিশ্চয়ই খাটের নিচে ভূতটুত কিছু লুকিয়ে আছে।আশ্চর্য, সেরকম কোনো ভয় লাগছে না। লোকগুলো চলে যাবার পর বরং অনেক কম লাগছে। বেঁটে লোকটা সারাক্ষণ কীভাবে তাকাচ্ছিল ভার দিকে। বেশ কয়েকবার গায়ে হাত দিয়েছে। ভাবখান। এরকম যেন অজান্তে হয়েছে। একবার অ্যানি বলে ফেলল, ‘আপনার হাত সরিয়ে নিন।’বেঁটে লোকটা হাত সরিয়ে নিল, সঙ্গের দুজন হেসে উঠল হা হা করে। বেঁটে লোকটা তখন অভ্যন্ত কুৎসিত একটা কথা বলল। এমন কুৎসিত কথা কেউ বলতে পারে?পাশের ঘরে টেলিফোন বাজছে। কেউ ধরছে না। আবার বাজছে আবার বাজছে। চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল অ্যানি। অদ্ভুত একটি স্বপ্ন দেখল সে। যেন জামশেদ এসেছে এ-ঘরে। তার হাতে ভয়ালদর্শন একটি অস্ত্র। জমশেদ বলছে, “মামণি অ্যানি, তুমি শুধু একটি একটি করে মানুষ আমাকে চিনিয়ে দিবে। তারপর দ্যাখো আমি কী করি। আমি হচ্ছি জামশেদ। বন্ধুরা আমাকে কী ডাকে জন? বুড়ো ভালুক। আমি ভালুকের মতোই ভয়ংকর হা হা হা।”অ্যানির ঘুম ভেঙে গেল। অ্যানি অবাক হয়ে দেখল দরজা খুলে এভরা চাচা ঢুকছেন। এটাও কি স্বপ্ন? না, স্বপ্ন নয় তো। সত্যি সত্যি তো এতরা চাচা। অ্যানি দেখল এতরা চাচার হাসিহাসি মুখ। এতরা চাচা অ্যানির মুখের টেপ খুলে দিয়ে নরম গলায় বললেন, ‘কী, চিনতে পারছ তো?”অ্যানি ফুঁপিয়ে উঠল।’খুব ঝামেলা গেছে, না? ইস, হাতে দেখি দাগ বসে গেছে। কাঁদে না। দুষ্টু মেয়ে, কাঁদে না।’এভরা কাছে টেনে নিল অ্যানিকে। ‘ভয়ের আর কিছুই নেই। সব ঝামেলা মিটেছে।”আপনি কি আমাকে ফিরিয়ে নিতে এসেছেন?”তোমার কী মনে হয়?’অ্যানি এতবার কাঁধে মাথা রাখল।’ভোমাকে ছাড়িয়ে নিতেই এসেছি।’বলতে বলতে এতরা অ্যানির বুকে ভার বাঁ হাত রাখল। অ্যানি কয়েক মুহূর্ত কিছু বুঝতে পারল না। এতরা চাচা কি ডান হাতে তার জামার হুক খোলার চেষ্টা করছে?অ্যানি সরে যেতে চেষ্টা করল কিন্তু তার আগেই এতরা তাকে প্রায় নগ্ন করে ফেলল। অ্যানি বুঝতে পারছে একটা রোমশ হাত তার প্যান্টির ভেতর ঢুকে যাচ্ছে।
পৃষ্ঠা-৫২
প্যান্টি খুলে ফেলতে এতরাকে মোটেই বেগ পেতে হল না। সে নরম স্বরে বলল, ‘তোমাকে একটুও ব্যথ্যা দেব না। দেখবে ভালোই লাগবে তোমার।’অ্যানি চিৎকার বা কিছুই করল না। সে তার অসম্ভব সুন্দর নগ্ন শরীর নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। এতরা যখন টেনে তাকে তার কোলে বসাল তখন শুধু সে ফিসফিস করে তার মাকে ডাকতে লাগল।ভিকি টেলিফোনে প্রায় কেঁদে ফেলল। ‘হ্যালো এতরা, হ্যালো।”শুনছি।”কই ওরা তো আমার অ্যানিকে ছাড়ছে না।”এত অস্থির হচ্ছ কেন?”অস্থির হব না, কী বলছ তুমি।”শোনো ভিকি, মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে এখন। সমস্ত ব্যাপারটাই জট পাকিয়ে গেছে, বুঝতে পারছ না?’ ‘না-আমি বুঝতে পারছি না।”ঠিক আছে, তুমি ক্যাফে ইনে চলে আসো। টেলিফোনে সব বলা যায় ना।’অ্যানি বেঁচে আছে তো?’আরে তুমি বলছ কী এসব।’ভিকি এবার গলা ছেড়ে কাঁদতে শুরু করল।’হ্যালো ভিকি, তুমি চলে আসো ক্যাফে ইনে। আমি থাকব সেখানে। ভালো কথা,রুন কেমন আছে? সে নিশ্চয়ই খুব বিচলিত?”একে ট্রাংকুলাইজার দিয়ে রাখা হয়েছে।”ঠিক আছে, তুমি চলে এসো।’ক্যাফে ইন বেস্টিলা পোর্ট-লাগোয়া ছোট্ট একটি কফি শপ। সারাদিন কফি এবং পটেটো চিপস বিক্রি হয়। সন্ধ্যায় পর দু-তিন ঘণ্টার জন্যে ফ্রায়েড লবস্টার পাওয়া যায়। ভিড় হয় সন্ধ্যার পর। বসার জায়গা পাওয়া যায় না।ভিকি এসে দেখল, এতরা একটা ছোট কামরা রিজার্ভ করে তার জন্যে বসে আছে। এতরার মুখ চিন্তাক্লিষ্ট। ভিকি এসে বসল, কিন্তু দীর্ঘ সময় কোনো কথা বলতে পারল না। এতরা বলল, ‘কিছু খাবে। হট সস দিয়ে লবস্টার চলবে? মেক্সিকান রেসিপি। চমৎকার।ভিকি ঠাণ্ডা গলায় বলল, ‘আমার মেয়ে কোথায়?’ রেখেছি।”তুমি এমনভাবে জিজ্ঞেস করছ যাতে মনে হয় তোমার মেয়েকে আমি লুকিয়ে
পৃষ্ঠা-৫৩
‘তুমি জান না সে কোথায় আছে?”আমি কী করে জানব?”‘সে কোথায় আছে তার কিছুই জান না?”না। তবে তোমাকে বলেছি ওদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে।’ভিকি ক্লান্তস্বরে বলল, ‘আমি সমস্ত ব্যাপারটা পুলিশকে জানাতে চাই।”সেটা তোমার ইচ্ছা। একটা কথা আমার মনে হয় তুমি ভুলে যাচ্ছ, মূল পরিকল্পনাতে তুমিও আছ। পুলিশ তা ঠিক পছন্দ করবে না। এবং সবচেয়ে অপছন্দ করবে তোমার স্ত্রী রুন।’এতরা একটি সিগারেট ধরাল। আড়চোখে ভিকির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ধরো এখন যদি তোমার মেয়ের কিছু হয় পুলিশ সবার আগে ধরবে তোমাকে।'”আমার মেয়ের কিছু হয় মানে?”কথার কথা বলছি। কিছুই হবে না, মেয়ে ঘরে ফিরে আসবে। তুমি বৃথাই এতটা ভেঙে পড়ছ।”ভিকি চুপচাপ তাকিয়ে রইল।এতরা বলল, ‘মনে হচ্ছে মূল পরিকল্পনার একটু অদলবদল হয়েছে। ওদের তিনটা লোক মারা গেছে। বাছা-বাছা লোক। এটা ভো মূল পরিকল্পনায় ছিল না। ওদের দিকটা তো তোমাকে দেখতে হবে। সমস্ত ব্যাপারটা জট পাকিয়ে গেছে।’ভিকির চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল।’জিনিসটা যে এরকম দাঁড়াবে তা আমার ধারণার বাইরে ছিল। তোমার ঐ বেকুব বডিগার্ড যেভাবে গুলি ছুঁড়ছিল তাতে অ্যানির মারা পড়ার সম্ভাবনা ছিল সবচেয়ে বেশি। ভাগ্যক্রমে গুলি লাগেনি।’ভিকি উঠে দাঁড়াল।’কী ব্যাপার, যাচ্ছ নাকি?”‘ই।”বসো আরো খানিকক্ষন।”পুলিশের কাছে সব খুলে বলবে বলে ঠিক করেছ নাকি?”জামি কিছুই ঠিক করিনি।’ভিকি বাড়ি ফিরে গেল না। একা একা ঘুরে বেড়াল দীর্ঘ সময়। তারপর হঠাৎ কী মনে করে চলে গেল হাসপাতালে। অসময়ে তাকে হাসপাতালে ঢুকতে দেবার কথা নয়, কিন্তু আশ্চর্য, সে জামশেদের সঙ্গে দেখা করতে চায় শুনেই তাকে ঢুকবার পাশ দেয়ালবিতে যে-পুলিশ অফিসার বসে ছিল সে এগিয়ে এল, ‘আপনি নিশ্চয়ই তিকি?’ ‘হ্যাঁ।”আমশেদের সঙ্গে দেখা করবার জন্যে এসেছেন।’হ্যাঁ।’
পৃষ্ঠা-৫৪
‘তার আগে কি আমি আপনাকে দুএকটি কথা জিজ্ঞেস করতে পারি।”আমি খুব ক্লান্ত। আমি কোনো আলোচনায় এই মুহূর্তে যেতে চাই না।”ঠিক আছে, ঠিক আছে। পরে কথা বলব। আমি অ্যানি অপহরণের তদন্তকারী দলের একজন সদস্য।”যান, আপনি ভেতরে চলে যান। জামশেদ সতেরো নম্বর কেবিনে আছে। ভালোই আছে।”ধন্যবাদ।’ভিকি মৃদুস্বরে বলল, ‘এখন কি শরীর ভালো?’জামশেদ মাথা নাড়ল। ‘ভালো।”আমি আগেও একবার এসেছিলাম। তোমার তখন জ্ঞান ছিল না।’আমি জানি। আমি খবর পেয়েছি।”হাসপাতাল থেকে কবে ছাড়া পাবে?”আরো সপ্তাহখানেক লাগবে।”তারপর কী করবে কিছু ঠিক করেছ?’ডিকি চুপচাপ হয়ে গেল। জামশেদ তাকে নীরবে লক্ষ করতে লাগল। ভিকি একসময় বলল, ‘তোমার এখানে সিগারেট খাওয়া যেতে পারে? কেউ কোনো আপত্তি করবে না তো?”নাহ্।’ভিকি সিগারেট ধরাল। টানতে লাগল অপ্রকৃতিস্থের মতো। জামশেদ বলল, ‘তুমি মনে হচ্ছে এখনও কোনো খবর পাওনি।’
কিসের খবর?”তুমি বাড়ি ফিরে যাও।’কী হয়েছে?’জামশেদ বলল, ‘একটা খারাপ সংবাদ আছে তোমার জন্যে।’অ্যানি কি মারা গেছে।”কখন খবর পাওয়া গেল?”‘আধ ঘণ্টা আগে।’ভিকি উঠে দাঁড়াল। জামশেদ বলল, ‘অ্যানির ডেডবডি পাওয়া গেছে একটি গাড়িরলাগেজ কেবিন।”ভিকি, আমি একটি কথা তোমাকে বলতে চাই।”বলো।’
পৃষ্ঠা-৫৫
‘তোমার সঙ্গে কিছুদিন হয়তো আমার দেখা হবে না। আমি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে শরীর সাবাবার জন্যে অনেক দূরে কোথাও যাব। তারপর আবার ফিরে আসব।’ফিরে আসব প্রতিশোধ নেবার জন্যে। আবার আমাদের দেখা হবে।’ভিকির চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। জামশেদ তাকিয়ে রইল। তার চোখ পাথরের চোখের মতো। সে-চোখে ভালোবাসা, স্নেহ, মমতা এইজাতীয় অনভূতির কোনো ছায়া পড়ে না। সে মৃদুস্বরে দ্বিতীয়বার বলল, ‘আমি আবার ফিরে আসব।’রাত প্রায় দুটোর দিকে এতরার শোবার ঘরের টেলিফোন বেজে উঠল। এত রাতে অকাজে কেউ ফোন করে না, নিশ্চয়ই জরুরি কিছু। এতরা বিছানা ছেড়ে উঠে এল। সে প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিল। টেলিফোনের শব্দে জেগেছে।’হ্যালো, আমি এতরা, কাকে চান?”আপনাকেই চাই।”আপনি কে বলছেন?’ওপাশ থেকে সাড়া পাওয়া গেল না। কিন্তু গলার আওয়াজ শুনে মনে হয় বিদেশী কেউ। ভাঙা-ভাঙা ইতালিয়ান বলছে।’হ্যালো, কে আপনি?”আমি কে সেটা জানা কি খুব প্রয়োজন? তারচে বরং কীজন্যে টেলিফোন করেছি সেটা বলে ফেলি।”আমাকে কিছু বলতে হলে আগে আপনার পরিচয় দিতে হবে। রাতদুপুরে এভাবে মানুষের সঙ্গে কথা বলা যায় না। কে আপনি?’ওপাশের লোকটি সে-প্রশ্নের জবাব দিল না। অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলল, ‘বারো বছরের অ্যানি নামের কোনো মেয়েকে চেনেন?”আপনি কে?”বারো বছরের ঐ মেয়েটির খুব রহস্যময়ভাবে মৃত্যু হয়েছে।”কে আপনি।”আমি ঐ মেয়েটির একজন বন্ধু। আমার নাম জামশেদ। চিনতে পারছেন।’এতরা একবার ভাবল টেলিফোন নামিয়ে রাখে। কিন্তু তাতে লাভ হবে কি?লোকটি আবার টেলিফোন করবে।’রহস্যময় কিছু তো আমি জানি না। মেয়েটি মারা পড়েছে কিডন্যাপারদের হাতে। এবং আমি যতদূর জনি ওর মৃত্যুর জন্যে তুমি বহুলাংশে দায়ী। তুমি ছিলে মেয়েটার দেহরক্ষী। তুমি তাকে রক্ষা করতে পারনি। ঠিক না?’
পৃষ্ঠা-৫৬
‘ঠিক।”আজ তার মৃত্যুর পর বন্ধু সেজেছ? এবং রাতদুপুরে টেলিফোন করে আমাকে বিরক্ত করছ?”তা অবিশ্যি করছি। এবং করার একটি কারণ আছে।”কী কারণ?”কারণ হচ্ছে-আমার ধারণা মেয়েটির মৃত্যুর সঙ্গে তোমার যোগ আছে। হ্যালো, টেলিফোন রেখে দিচ্ছ নাকি?”না।”আমি তোমাকে এর জন্যে খানিকটা শান্তি দিতে চাই।”তুমি কোথেকে টেলিফোন করছ?”কেন, পুলিশে খবর দিতে চাও? সেটা মনে হয় খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। শোনো এতরা।”এতরা টেলিফোন নামিয়ে রাখল। লোকটা নিশ্চয়ই আবার টেলিফোন করবে। পুলিশকে বলা দরকার যাতে পুলিশ কলটি কোথেকে করা হচ্ছে তা ধরতে পারে। পাবলিক বুথ থেকে করা হলে ধরা যাবে না। তবে জানা যাবে কলটি কোন এরিয়া থেকে আসছে।এতরা নাম্বার ডায়াল করল তবে পুলিশের কাছে নয়। হাসপাতালে। সিটি হসপিটাল। ‘রিসিপশান, আমি একজন রুগি সম্পর্কে জানতে চাই। আমি খুবই উদ্বিগ্ন।”এক্ষুনি জেনে দিচ্ছি।”ওর নাম জামশেদ। বিদেশী।”বেড নাম্বার এবং কেবিন নাম্বার?’ ‘সেটি ঠিক বলতে পারছি না।”‘ঠিক আছে, ধরে থাকুন। ডিউটি রেজিস্টার দেখে বলছি।’এতরা টেলিফোন কাঁধে নিয়েই নিজের জন্যে একটি মার্টিনি বানাল। ওদের নাম খুঁজে বের করতে সময় লাগবে।’হ্যালো!”বলুন শুনছি।”আপনি যে-রুগির কথা জানতে চেয়েছেন সে তো ডিসচার্জ নিয়ে চলে গেছে।”ও, তা-ই বুঝি? কবে?”আজ সকালেই।”ধন্যবাদ। যাবার সময় কোনো ফরওয়ার্ডিং অ্যাড্রেস রেখে গেছে কি? চিঠিপত্র এলে যাতে ঐ ঠিকানায় পাঠানো যায়?”না, এরকম কিছু নেই।”আচ্ছা, ঠিক আছে। অসংখ্য ধন্যবাদ।’এতরা টেলিফোন রেখে দিল। ব্যাপারটা ক্যানটারেলাকে জানানো উচিত? ক্যানটারেলা মাঝারি ধরনের বস। মাঝারি ধরনের হলেও তার যোগাযোগ ভালো।
পৃষ্ঠা-৫৭
বিশেষ করে কিছুদিন ধরেই ডিকানডিয়ার সঙ্গে তার খুব ভালো সম্পর্ক যাচ্ছে। প্রথম দিকে এটাকে সবাই গুজব বলেই মনে করত কারণ ডিকানডিয়া মাঝারি ধরনের কারো সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করে না। কিন্তু এটা গুজব নয় সত্যি।এতরা ঘড়ি দেখল। দুটো ত্রিশ। রাত অনেক হয়েছে। তবু ক্যানটারেলাকে পাওয়া যাবে। রাত দুটো পর্যন্ত সে থাকে জুয়ার আড্ডায়। বাড়ি ফেবে তিনটায়, ঘুমুতে যায় চারটায়। ঘড়ি-ধরা কাজ। খানিক ইতস্তত করে টেলিফোন ডায়াল করল।’হ্যালো, কে?”আমি এতরা।”এতরা? এত রাতে কী ব্যাপার?’
‘একটা সমস্যা হয়েছে আমার।”সমস্যা? কী সমস্যা?’জামশেদ নামের ঐ লোকটি আমাকে টেলিফোনে ভয় দেখিয়েছে।”একটা মেয়েকে তুমি রেপ করে মেরে ফেলবে আর কেউ তোমাকে ভয়ও দেখাতে পারবে না?’এতরা শুকনো গলায় বলল, ‘ব্যাপারটা সেরকম না।”সেরকম না মানে?”এটা একটা অ্যাকসিডেন্ট।”তা-ই বুঝি?’ক্যানটারেলা উচ্চস্বরে হাসল। মদ খেয়ে টং হয়ে আছে নিশ্চয়ই। এতরা নিচুস্বরে বলল, ‘ভিকানজিয়া বলেছেন তিনি ব্যাপারটা সামলে দেবেন।”সামলানো তো হয়েছে। হয়নি। কোনো পুলিশ রিপোর্ট হয়নি। কেউ গ্রেফতার হয়নি। তোমার নাম পর্যন্ত কেউ জানে না। ঠিক কি না?”ই।’
‘তা হলে চিন্তা করছ কেন?”এঐ টেলিফোনটার জন্যে চিন্তা করছি।”শোনো, এখন থেকে চলাফেরা করবার সময় বডিগার্ড নিয়ে চলাফেরা করবে,ব্যস। দু-তিনজন লোক সাথে থাকলেই নিশ্চিন্ত।”আচ্ছা, তা-ই করব।”এতরা, একটা কথা।”বলুন।”বারো বছরের মেয়েটির সঙ্গে এঐ কর্ম করবার সময় তোমার কেমন লেগেছিল? অভিজ্ঞতাটা কি আনন্দদায়ক ছিল?’ক্যানটারেলা টেলিফোন ফাটিয়ে হাসতে লাগল যেন খুব একটা মজার কথা। এতরার ইচ্ছা করছিল টেলিফোন নামিয়ে রাখতে, কিন্তু তা করা যাবে না। এমন কিছুই করা যাবে না যা ক্যানটারেলাকে রাগিয়ে দিতে পারে।’হ্যালো, এতরা।’
পৃষ্ঠা-৫৮
‘বলুন।”আমরা খারাপ লোক সবাই জানে। কিন্তু তুমি একটা নিম্নশ্রেণীর অপরাধী। কেঁচোজাতীয়। বুঝতে পারছ?”পারছি।”একজন অপরাধী অন্য অপরাধীকে বাঁচিয়ে রাখে। এইজন্যই তোমাকে প্রোটেকশন দেয়া হয়েছে।”এইসব কথা কি টেলিফোনে বলা ঠিক হচ্ছে।”কেন, পুলিশ শুনে ফেলবে? টেলিফোন কানে নিয়ে বসে থাকা পুলিশের কাজ নয়। আর তা ছাড়া পুলিশের বড়কর্তা এবং ছোটকর্তাকে কী পরিমাণ টাকা আমরা দিই সে- সম্পর্কে তোমার ধারণা আছে?’না।’না থাকাই ভালো।’ক্যানটারেলা টেলিফোন নামিয়ে রাখল খট করে। বাকি রাতটা এতরার কাটল না- ঘুমিয়ে। পরপর চার গ্লাস রাম বেল এবং ভোরের দিকে বাথরুম বমি করে ভাসিয়ে দিল। দিনটি শুরু হচ্ছে খারাপভাবে।মঙ্গলবার হচ্ছে এতয়ার মাদারস ডে। প্রতি মঙ্গলবার মায়ের কাছে তাকে ঘন্টা তিনেক কাটাতে হয়। দুপুরের লাঞ্চ খেতে হয়। হাসিমুখে কথা বলতে হয়। এবং মায়ের কাছে প্রতিজ্ঞা করতে হয় এর পরের রোববার থেকে সে নিয়মিত চার্চে যাবে।এই মঙ্গলবারেও বুড়িকে দেখা গেল বাড়ির সামনে, বারান্দায় ছেলের জন্যে অপেক্ষা করছে। বুড়ির মুখ অত্যন্ত গীর।’এতরা, এত দেরি কেন আজকে?”বেশি দেরি তো নয় মা। আধঘণ্টা।”আধঘণ্টাও অনেক সময়। এগারোটার আগেই তোমার আসার কথা। এখন বাজে এগারোটা চল্লিশ।”মা, আমি খুব দুঃখিত। আর দেরি হবে না।”কফি বানিয়ে রেখেছিলাম। জুড়িয়ে পানি হয়ে গেছে বোধ করি।”কফি খাব না মা।”কেন? কফি খাবে না কেন? শরীর খারাপ নাকি? না, শরীর ঠিক নেই। কেমন শুকনো দেখাচ্ছে। দেখি, গায়ের টেম্পারেচার দেখি। এই তো জ্বরজ্বর মনে হচ্ছে।”জুর নয়। রোদের মধ্যে গাড়ি চালিয়ে এসেছি তাই গা-গরম লাগছে।”এতরা, তুমি মিথ্যা কথা বলে আমাকে ভোলাতে চেষ্টা করছ। এটা ঠিক না। চাদর দিচ্ছি শুয়ে পড়ো।”মা, তুমি শুধুশুধু ব্যস্ত হচ্ছ।”‘আমি মোটেই শুধুশুধু ব্যস্ত হচ্ছি না। তোমাকে যা করতে বলছি, করো। আমাকে রাগিও না।’
পৃষ্ঠা-৫৯
এতরাকে চাদর গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়তে হল। বুড়ি বড় এক পেয়ালা কফি হাতে নিয়ে তার সামনে চেয়ার টেনে বসল।’তুমি চার্চে যাওয়া শুরু করেছ?’এতরা জবাব দিল না।’এখনও শুরু করনি। ইদানীং তোমাকে নিয়ে একটা দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি। আমার মনে হয় তোমার চার্চে যাওয়া শুরু করা উচিত।”কী দুঃস্বপ্ন দেখেছ?”দেখলাম তুমি রাস্তা দিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছ। তোমার গায়ে কোনো কাপড় নেই। তোমাকে ভাড়া করছে একজন মানুষ। ওর হাতে প্রকাণ্ড একটা ভোজানি।”যে তাড়া করছে সে কেমন লোক?”স্বপ্নের ভেতর সবকিছু এত স্পষ্ট দেখা যায় না। আমি শুধু ভোজালিটা দেখলাম।”লোকটা কি বিদেশী? গায়ের রং কেমন?’বুড়ি ঠাণ্ডাস্বরে বলল, ‘এত উত্তেজিত হচ্ছ কেন? তোমার কি কোনো বিদেশীর সঙ্গে ঝামেলা হয়েছে?”না, ঝামেলা হবে কেন? কফি দাও।’বুড়ি কফি পারকুলেটর চালু করে তার ছেলেকে তীক্ষ্ণচোখে দেখতে লাগল। এতরা ঘামছে। চোখের দৃষ্টি অন্যরকম। নিশ্চয়ই কোনো ঝামেলায় জড়িয়েছে। এঞ্জেল ফসিলো লোকটি খর্বাকৃতির। চোখের মণি ঈষৎ সবুজ। দলের কাছে সে বিড়াল- ফসিলো নামে পরিচিত। বিড়ালের একটি গুণ তার আছে, সে অসম্ভব ধূর্ত। মাফিয়াদের মধ্যে নিম্নশ্রেণীর বুদ্ধিবৃত্তির লোকজনই বেশি। এরকম ধূর্তের সংখ্যা কম। বস ভিকানডিয়া তাকে একটু বিশেষ স্নেহের চোখে দেখেন এই একটিমাত্র কারণেই। বৃর্ত মানুষ সাধারণত সাহসী হয় না। ফসিলোও সাহসী নয়। ভাবে তার সাহসের একটা তান আছে। অকারণে মারপিট শুরু করে। কথা বলে অত্যন্ত উদ্ধত ভঙ্গিতে। যে-কোনো বিপজ্জনক কাজে আগ বাড়িয়ে যাওয়ার উৎসাহ দেখায়। সাহসের অভাব গোপন রাখবার যথাসাধ্য চেষ্টা করে।আজ এঞ্জেল ফসিলোকে খুব খুশি-খুশি দেখাচ্ছে। খুশির কারণ রহস্যাবৃত। বস ভিকানডিয়ার সঙ্গে আজ বিকেলে কিছু কথাবার্তা হয়েছে। টেলিফোনে নয়, মুখোমুখি। এটি ফসিলের খুশির কারণ হতে পারে। কারণ ভিকানডিয়া তার ভিলায় কাউকে ঢুকতে সেন না এবং মুখোমুখি কারো সঙ্গে কথা বলেন না। বসদের নানানরকম সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। নিজের লোকদেরও নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে রাখতে হয়। ভাগ্যবান
পৃষ্ঠা-৬০
কয়েকজনই শুধু অল্প সময়ের জন্যে তাঁর দেখা পায়। ফসিলো সম্ভবত ভাগ্যবানদের দলে।পড়তে শুরু করেছে। এটা খুশি হবার মতোই ঘটনা।এঞ্জেল ফসিলো শিস দিতে দিতে গাড়ি থেকে নামল। তার গাড়িটা ছোট। কালো। রঙের টু-সিটার ডজ। অন্য সবার মতো দরজা লক করল না। কারণ পাড়িচুরির মতো। অপরাধ যারা করে তারা সবাই ফসিলোর টু-সিটারটা ভালোভাবে চেনে। এতে তারা হাত দেবে না।ফসিলো গম্ভীর ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল। এটি একটি নতুন নাইট ক্লাব। মেক্সিকান এক ব্যবসায়ী এ-মাসেই চালু করেছেন এবং অল্পদিনের মধ্যেই জমিয়ে ফেলেছেন। প্রচুর। ভিড় হচ্ছে। এত অল্প সময়ে নাইট ক্লাবটি জমে যাওয়ার মূলে আছে দুটি মেক্সিকানা যুবতী। এরা প্রত্যেকেই অসম্ভব রূপসী। প্রতি রাতেই তিনটে শো করে। নাচের শো। চী নাচের পোশাক বিচিত্র। সমস্ত গা ঢাকা থাকে কিন্তু সবার বাঁ-স্তনটি থাকে নগ্ন। এইন বিচিত্র পোশাক সবার কাছে যথেষ্ট আকর্ষণীয় মনে হয়েছে।ফসিলোকে ঢুকতে দেখেই নাইট ক্লাবের ম্যানেজার হাসিমুখে এগিয়ে এল।’সিনোর ফসিলো যে। কী সৌভাগ্য। আসুন আসুন।’ফসিলো ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে লাগল। স্টেজ অন্ধকার হয়ে আসছে। নাচ শুরু হবে এখনই। ফসিলো মৃদুস্বরে বলল, ‘এক বুক দেখিয়েই শুনলাম পুরুষদের পাগল করে দেয়া হচ্ছে।”‘হ্যাঁ হ্যাঁ সিনোর, দুটো খুলে দিলে কি আর রহস্য থাকে? সব রহস্যই হচ্ছে অর্ধেকে। এখন বলেন, কী দিয়ে আপনার সেবা করতে পারি।”আমি কোথায় থাকি জানেন?”জানব না, কী বলেন। ফমি ভিলায়। ঠিক বলেছি তো?”ঠিক। ঐখানে আপনাদের নাচের মেয়েদের একজনকে আজ রাতে পাঠাবেন।”কিন্তু সিনোর, ওরা ঠিক ঐ ধরনের কাজ করে না। ওরা আসলে নাচতেই এসেছে।ভদ্র পরিবারের মেয়ে, সিনোর।”আপনার শো শেষ হয় ক’টায়?”এই ধরেন দুটায়, কোনো কোনো রাতে তিনটেও বেজে যায়।”ঠিক আছে, তিনটের পরই পাঠাবেন।’ফসিলো তার সবুজ চোখ দিয়ে অন্যরকম ভঙ্গিতে তাকাল ম্যানেজারের দিকে। ম্যানেজার সঙ্গে সঙ্গে বলল- ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। নিয়ম থাকেই ভাঙার জন্যে।এখন বলুন কোনটিকে পাঠাব। ভালোমতো দেখেশুনে বলুন।”দেখার সময় নেই আমার। যেটা সবচে রেগা সেটাকে পাঠাবেন। রোগা মেয়েই আমার পছন্দ।”কিছু পান করবেন না? খুব ভালো শেরি আছে।”‘নাহ্।”লক্ষ রাখবেন আমাদের দিকে, সিনোর, আপনাদের ভরসাতেই বিজনেস চালু করা। হে হে হে।’
পৃষ্ঠা ৬১ থেকে ৭৫
পৃষ্ঠা-৬১
ফসিলো বেরিয়ে এল। রাত প্রায় এগারোটা বাজে। বাড়ি ফেরার আগে ঘণ্টা দুই জুয়া খেলা যেতে পারে। ভাগ্য খুলতে শুরু করেছে কি না তা জুয়ার টেবিলে না-বসা পর্যন্ত বলা যাবে না। মিরান্ডার একটি ভালো জুয়ার আসর বসে।ফসিলো গাড়ির দরজা বন্ধ করে চাবির জন্যে পকেটে হাত দিতেই অনুভব করল, তার ঘাড়ের কাছে ধাতব কিছু-একটা লেগে আছে। কাঠ হয়ে বসে রইল ফসিলো।পেছন থেকে ভারী গলায় কেউ-একজন বলল, ‘যেভাবে বসে আছ ঠিক সেভাবেই বসে থাকো। এক চুলও নড়বে না।’ফসিলো নড়ল না। ঘাড়ের পেছনে রিভলভারের নন লেগে থাকলে এমনিতেই নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায়।’আমি যা বলব ঠিক তা-ই করবে। গাড়ি স্টার্ট দাও।’ ফসিলো গাড়ি স্টার্ট দিল। মিলানের বুলেভার দিকে এগিয়ে যাও। রোড নাম্বার ১২ দিয়ে এক্সিট নেবে। তোমার পেছনে যেটা ধরে আছি তার নাম বেয়েটা থার্টি টু।’ দেখতে দেখতে গাড়ি বারো নম্বর রোডে গিয়ে হাইওয়েতে এক্সিট নিল। ফসিলোমৃদুস্বরে বলল, ‘তুমি যা করছ তার ফলাফল সম্পর্কে তোমার ধারণা নেই সম্ভবত। তুমি বোধহয় জান না আমি কে?”তুমি এঞ্জেল ফসিলো। বন্ধুরা তোমাকে বিড়াল-ফলিলো বলে।’ফসিলোর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমল। হাত-পা কেমন যেন ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। ফসিলো বুঝতে পারছে না লোকটি কী চায়। উদ্দেশ্য কী? সে বসেছে এমনভাবে যে রিয়ার ভিউ মিররে তাকে ঠিক দেখা যাচ্ছে না। গলার স্বর শুনে মনে হচ্ছে বিদেশী। একটু টেনে কথা বলছে।’সেন্ট জেনিংসে এক্সিট নেবে।’ফসিলো সেন্ট জেনিংসে এক্সিট নিল। শেষ পর্যন্ত গাড়ি থামল পুরানো ধরনের একটি একতলা বাড়ির সামনে। কোথায় এসেছে ফসিলো মনে রাখতে চেষ্টা করছে। বাড়িটি হালকা হলুদ রঙের, টালির ছাদ। অনেকখানি জায়গা আছে সামনে। এসব খুঁটিনাটি লক্ষ করে লাভ কী? ফসিলোর মনে হল এ-বাড়ি থেকে সে আর ফিরে যেতে পারবে না। নাইট ক্লাবের মেয়েটা হয়তো তার বাড়িতে গিয়ে বসে থাকবে। রোগা একটি মেয়ে যার বয়স খুবই কম। হয়তো ষোলো-সতেরো। ফসিলো বলল, ‘তুমি কী চাও?লোকটি শীতল স্বরে বলল, ‘বিশেষ কিছু না। কয়েকটা প্রশ্ন করব।”এজেন কোনো প্রশ্নের জবাব দেয় না।”সেটা দেখা যাবে।”শুয়োরের বাচ্চাদের কী করে শায়েস্তা করতে হয় তাও আমরা জানি।”জানলে ভালোই।’কথা শেষ হবার আগেই ফসিলোর মাথায় প্রচণ্ড শব্দে রিভলভারের হাতল দিয়ে আঘাত করা হল। ব্যথা বোধ হবার আগেই ফসিলোর কাছে চারদিক অন্ধকার হয়ে। গেল।
পৃষ্ঠা-৬২
জ্ঞান হল অল্পক্ষণের মধ্যেই। চোখ মেলেই দেখল নাইলন কর্ড দিয়ে তাকে শক্ত করে বাঁধা হয়েছে চেয়ারের সঙ্গে। সামনেই একটি কাঠের টেবিল। টেবিলের উপর দুটি পেতলের আট ইঞ্চি সাইজ পেরেক এবং একটা হাতুড়ি। চেয়ারের উলটোদিকে যে বসে আছে ফসিলো তাকে চিনতে পারল। এই লোকটাকে সে আগে দেখেছে। বারো বছরের সেই মেয়েটির বডিগার্ড ছিল।’ফসিলো, আমাকে চিনতে পারছ?’ফসিলো জবাব দিল না।’নিশ্চয়ই আশা করনি তোমার সঙ্গে আমার আবার দেখা হবে?”কী চাও তুমি?'”বলেছি তো কয়েকটি প্রশ্ন করব।”সশ্ন জিজ্ঞেস করে কোনো লাভ নেই। এঞ্জেল ফসিলোর মুখ থেকে কেউ কিছু বার করতে পারে না।”চেষ্টা করতে দোষ নেই, কী বল?’ফসিলো জবাব দিল না। সে দ্রুত নিজের অবস্থা বুঝে নিতে চেষ্টা করছে। সামনে বসে থাকা লোকটা কথাবার্তা বলছে নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে। এমন একটা ব্যাপার ঘটছে কিন্তু তার মধ্যে কোনোরকম উত্তেজনা নেই।’ফসিলো, এই পেতলের পেরেকটি দেখতে পাচ্ছ? এই পেরেকটি এখন আমি তোমার হাতের তালুতে ঢুকিয়ে দেব। তারপর প্রশ্ন শুরু করব। একেকটা প্রশ্ন করবার পর দশ সেকেন্ড সময় দেব। দশ সেকেন্ডের মধ্যে উত্তর না পাওয়া গেলে একেকটি করে আঙুল কেটে ফেলব।’ফসিলো নিজের কানকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না। এইসব কি সত্যি সত্যি ঘটছে? নাকি কোনো দুঃস্বপ্ন? ফদিলো কিছু বুঝে ওঠার আগেই লোকটা তার বাঁ হাত টেবিলের ওপর টেনে এনে মুহূর্তের মধ্যে পেরেক বসিয়ে দিল। হাত গেঁথে গেল টেবিলের সঙ্গে। ফসিলো শুধু দেখল একটি হাতুড়ি দ্রুত নেমে আসছে। পরক্ষণেই অকল্পনীয় ব্যথা। যেন কেউ হ্যাঁচকা টান দিয়ে হাত ছিঁড়ে নিয়েছে। ফসিলো জ্ঞান হারাল।ফসিলোর জ্ঞান ফিরতে সময় লাগল। তার অবস্থা ঘোর-লাগা মানুষের মতো। এসব কি সত্যি সত্যি ঘটছে। হাত কি সত্যি সত্যি পেরেক দিয়ে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে টেবিলে? ফুলে-ওঠা হাত, উপরে জমে-থাকা চাপ-চাপ রক্ত দেখেও বিশ্বাস হতে চায় না। শুধু যখন একটু নড়াচড়াতেই অকল্পনীয় একটা ব্যথা সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ে তখনই মনে হয় এটি সত্যি সত্যি ঘটছে।সামনের টেবিলে বসে-থাকা লোকটা নির্বিকার ভঙ্গিতে সিগারেট টানছে যেন কিছুই হয়নি। লোকটির হাতে নোটবই আর কলম।’ফসিলো, তোমাকে এখন প্রশ্ন করতে শুরু করব। মনে রাখবে প্রশ্ন করার ঠিক দশ সেকেন্ডের মধ্যে উত্তর চাই। প্রথম প্রশ্ন, অ্যানিকে কিডন্যাপ করবার জন্যে কে পাঠিয়েছিল তোমাদের।”
পৃষ্ঠা-৬৩
‘বস ভিকানডিয়া।”তোমরা ক’জন ছিলে?”পাঁচজন। দুজনকে তুমি মেরে ফেলেছিলে।”যে-তিনজন বেঁচে আছে তাদের একজন তুমি। বাকি দুজন কে?”উইয়ি ও নিওরো।”ওদেরকে কোথায় গেলে পাওয়া যাবে?”ফসিলো চারটি ঠিকানা বলল। কখন গেলে ওদের পাওয়া যাবে তা বলল। ওদের সঙ্গে কীসব অস্ত্রশস্ত্র থাকে তাও বলল।’ঐমেয়েটিকে তুমি রেপ করেছিলে?’ফসিলো হ্যাসূচক মাথা নাড়ল।’ক’বার?’ফসিলো উত্তর দিল না।’বলো ক’বার।”বেশ কয়েকবার।”তোমার সঙ্গীরাও?”এরকম করার নির্দেশ ছিল তোমাদের ওপর?”‘না। আসলে সমস্ত ব্যাপারটাই এলোমেলো হয়ে গেছে। র্যানসমের টাকার ব্যাপারে কীসব ঝামেলা হয়েছে। মেয়েটাকে বেশ কিছুদিন রাখতে হল। এর মধ্যে একদিন এতরা ওকে রেপ করল। আমরা ভাবলাম একবার যখন হয়েই গেছে… তারওপর মেয়েটি ছিল অসম্ভব রূপসী।’ ‘মেয়েটির মৃত্যুর পর বস ভিকানডিয়া কী করল?”বস খুব রাগলেন।”শুধুই রাগলেন?”আমাদের প্রত্যেকের ত্রিশ হাজার লিরা করে পাওয়ার কথা। আমরা ওটা পাইনি।”বলো, এখন তোমার বসের কথা বলো।”কী জানতে চাও?”তুমি যা জান সব বলো। ভিকানডিয়াই কি এখন সবচে শক্তিশালী?”হ্যাঁ।’কারা কারা ওর ডানহাত?’ফসিলোর কথা জড়িয়ে যেতে শুরু করছে। হাতের ব্যথা ছড়িয়ে পড়ছে সারা শরীরে। ফসিলো বলল, ‘তুমি আমাকে নিয়ে কী করবে?”মেরে ফেলব।”কীভাবে মারবে?”তুমি আমার সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছ কাজেই তোমাকে সামান্য করুণা করব। কীভাবে তুমি মরতে চাও সেটা বলো। সেইভাবে ব্যবস্থা করব।’
পৃষ্ঠা-৬৪
ফসিলো কিছু বলতে পারল না। তার মুখ দিয়ে ফেনা বেরুতে লাগল। আরো কিছুক্ষণ পর বেরটা থার্টি টু থেকে একটি বুলেট ফসিলোর মাথার একটি বড় অংশ উড়িয়ে দিল।’হ্যালো, তুমি কে?”চিনতে পারছ না? আমার নাম জামশেদ।”কী চাও তুমি?”তোমাকে একটা খবর দিতে চাই। এঞ্জেল ফসিলোকে চেন?’এতরা জবাব দিল না।’ওকে মেরে ফেলা হয়েছে।”আমাকে এসব শোনাচ্ছ কেন?”ভাবলাম তোমার কাছে খবরটা ইন্টারেস্টিং মনে হতে পারে। তা ছাড়াও আমি আরেকটা জিনিস জানতে চাই। অ্যানির কিডন্যাপিং পরিকল্পনাটি কি তোমার?’এতরা টেলিফোন নামিয়ে রাখল। সে ভেবেছিল আবার রিং হবে। কিন্তু কেউ রিং করল না। শুধু দুপুরবেলা মায়ের টেলিফোন এল-‘এতরা, ঐ স্বপ্নটা আমি আবার দেখেছি।”কী স্বপ্ন?”ঐ যে তুমি একটা রাস্তা দিয়ে উলঙ্গ হয়ে দৌড়াচ্ছ। আর তোমার পেছনে পেছনে। একজন লোক ভোজালি নিয়ে ছুটি আসছে।”তুমি কি কোনো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছ?”না।”চার্চে যাবার কথা মনে আছে?”আছে, আছে।’এতরা টেলিফোন নামিয়ে রাখল।রিনালো পুলিশের হমিসাইডের লোক। অনেক ধরনের বিকৃত মৃতদেহ দেখে তার। অভ্যেস আছে। তবুও ফসিলোর লাশের সামনে সে ভ্রূ কুঁচকে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে রইল।
পৃষ্ঠা-৬৫
খুনটা করা হয়েছে অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায়। হাতের তালুতে পেরেক বসিয়ে দেবার ব্যাপারটি তাকে ভাবাচ্ছে। মাফিয়াদের দলগত বিরোধ শুরু হল? হলে মন্দ হয় না। নিজেরা নিজেরা বুনোখুনি করে মরুক। কিন্তু ব্যাপারটা সেরকম নাও হতে পারে। ফসিলের হাতে বসানো পেরেক দেখে মনে হয় কেউ তার কাছ থেকে কথা আদায় করতে চেয়েছে। কিন্তু ফসিলো এমন কোনো ব্যক্তি নয় যায় কাছে মূল্যবান খবর আছে। সে ভিকানডিয়ার একজন অনুগত্য ভৃত্য মাত্র।রিনালো নোটবই খুলে দুটো পয়েন্ট লিখে রাখল। এক, পেট্রোল পুলিশকে সতর্ক করে দিতে হবে। যদি এই খুনটা মাফিয়াদের দলগত বিরোধ থেকে হয়ে থাকে তা হলে অল্প সময়ের মধ্যে বেশকিছু খুনোখুনি হবে। দুই, ভিকানডিয়ার কাছে যত টেলিফোন এখন থেকে যাবে ও আসবে সবগুলি পরীক্ষা করে দেখতে হবে। এটা খুব জরুরি। দলের কেউ মারা পড়লে বসদের টেলিফোনের সংখ্যা খুব বেড়ে যায়। অধিকাংশ কলই হয় অর্থহীন ধরনের। তবু তার মধ্যেও অনেক খবরাখবর থাকে।রিনালো সন্ধ্যার দিকে ভিকানডিয়ার ভিলায় টেলিফোন করল। বিনালোকে জানানো হল ভিকানডিয়া ঘরে নেই। কোথায় আছে তাও জানা নেই। রিনালো বলল, ‘আমি হমিসাইডের একজন ইন্সপেক্টর, আমার নাম রিনালো।”ও। আপনি ধরুন, দেখি উনি আছেন কি না।’ভিকানভিয়ার মধুর গলা পাওয়া গেল সঙ্গে সঙ্গে।’কে বলছেন?”আমি রিনালো, হমিমাইড ইন্সপেক্টর।”বড় আনন্দিত হলাম। কিন্তু কী করতে পারি আপনার জন্যে?”ফসিলো মারা গেছে শুনেছেন।”কোন ফসিলো?'”এঞ্জেল ফসিলো।”মারা গেছে? আহা। মৃত্যু বড় কুৎসিত জিনিস, মিস্টার রিনালো।”তা ঠিক। খবরটা কি আপনি আমার কাছ থেকেই প্রথম শুনলেন, না আগেই শুনেছেন।”আগেই শুনেছি।”ভিকানডিয়া, আপনি কি এই ধরনের আরো মৃত্যুর আশঙ্কা করছেন?”মৃত্যু একটি বাজে ব্যাপার, মিস্টার রিনালো। কিন্তু আমরা সবাই মারা যাই। তা-ই নয় কি?”আপনি আমার কথায় জবাব দেননি। এই ধরনের আরো মৃত্যুর আশঙ্কা করছেন কি?’
‘আশা ও আশঙ্কা এই দুটো জিনিস নিয়েই তো আমরা সবাই বাঁচি।’রিনালো টেলিফোন নামিয়ে রাখল। এই ধরনের কথাবার্তা চালিয়ে যাওয়া মুশকিল। এদিক দিয়ে ক্যানটাবেলার কথাবার্তা সহজ স্বাভাবিক। বাড়তি দার্শনিকতা নেই। প্রশ্নের জবাব দিতে কোনোরকম দ্বিধা নেই।
পৃষ্ঠা-৬৬
‘ক্যানটারেলা, এই ধরনের হত্যাকাণ্ড কি আরো হবে?”মনে হয় না, মিঃ রিনালো। এটা দলগত কোনো বিরোধ নয়।”আপনি কি এই ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত।”মোটামুটিভাবে নিশ্চিত। বস ভিকানডিয়ার বয়স হয়েছে। তিনি এখন সবরকম বিরোধ এড়িয়ে চলেন।”কারো সঙ্গেই তার কোনো বিরোধ নেই বলতে চান?”বিরোধ নেই তা নয়, তবে যে-কটা বড় ফ্যামিলি এখন আছে তাদের সবার সঙ্গে। তাঁর সম্পর্ক ভালো।”তা হলে আপনার ধারণা এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বড় ফ্যামিলির স্বার্থ জড়িত নয়?”সেরকমই ধারণা। অবিশ্যি আমার ধারণা ভুলও হতে পারে।”আচ্ছা ঠিক আছে।”আরকিছু জিজ্ঞেস করবার নেই আপনার?”আপাতত না।”ভালো কথা, মেয়েমানুষের ব্যাপারে আপনার উৎসাহ আছে? আমার জানামতে কয়েকটি মেয়ে আছে, সঙ্গিনী হিসেবে ওদের তুলনা নেই। ভারতীয় মেয়ে। জানেন তো ভারতীয় মেয়েরা কেমন মধুর স্বভাবের হয়।”এইসব বিষয়ে আমার তেমন কোনো উৎসাহ নেই।”বলেন কী। পুলিশে চাকরি করলেই একেবারে শুকং কার্ডং হতে হবে এমন তো কোনো কারণ নেই। তা ছাড়া যেসব মেয়ের কথা বলছি ওরা লাইসেন্সড গার্লস।বেআইনি কোনো ব্যাপার নেই।’রিনালো টেলিফোন নামিয়ে রাখল। একজন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে এইজাতীয় কথাবার্তা বলার ব্যাপারে ওদের কোনো দ্বিধাসংকোচ নেই এটাই আশ্চর্য। তার চেয়েও বড় আশ্চর্য এদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ দাঁড় করানো যায় না। কেউ ওদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে না। প্রমাণ জোগাড় করা যাবে না। এরা আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরের একটি সম্প্রদায়ে পরিণত হয়ে পড়েছে।রিনালো ছোট্ট একটি নিশ্বাস ফেলল।মেয়েটির নাম নিমো। বয়স সতেরো টতেরো হবে কিন্তু দেখায় আরো কম। রাত দশটার মতো বাজে। এমন কিছু রাত নয়, কিন্তু চারদিক চুপচাপ হয়ে গেছে। অঞ্চলটি শহরের উপকণ্ঠে। লোকচলাচল কম। বাংলো প্যাটার্নের এই বাড়িটির চারদিকে উঁচু দেয়াল। দু’জন রক্ষী পাহারা দেয় পালা করে। এই বাড়িটির সঙ্গে বাইরের যোগাযোগ
পৃষ্ঠা-৬৭
নেই বললেই হয়। কিন্তু নিমোকে সে ব্যাপারে খুব একটা উদ্বিগ্ন মনে হয় না। এরকম বন্দিজীবন মনে হয় তার ভালোই লাগছে।খুটখুট করে টোকা পড়ল দরজায়।নিমো বলল, ‘কে?’ কোনো জবাব পাওয়া গেল না। উইয়ি এসে গেছে নাকি? উইয়ি সাধারণত রাত এগারোটার দিকে এসে বাকি রাতটা কাটায়। আজ একটু সকাল- সকাল এসে পড়ল নাকি? নিমো আবার বলল, ‘কে, উইয়ি?’ খুট খুট করে দুবার শব্দ হল কিন্তু কেউ জবাব দিল না। রক্ষীদের কেউ এসেছে কি? কিন্তু ওদের কি এত সাহস হবে? উইয়ির কঠিন আদেশ আছে যেন ওরা বাড়ির কম্পাউন্ডের ভেতর না ঢোকে। সে- আদেশ অমান্য করবার সাহস ওদের হবে না। কিন্তু মাঝে মাঝে সবারই কি একটু- আধটুআদেশ অমান্য করতে ইচ্ছে করে না। নিমোর তো সবসময়ই ইচ্ছে করে। আচ্ছা, রক্ষীদের কেউ যদি হয় তা হলে দরজা খোলামাত্র ভয়ানক অবাক হবে। ওরা নিশ্চয়ই স্বপ্নেও ভাবেনি সম্পূর্ণ নগ্নদেহের একটি মেয়ে দরজা খুলে দেবে। এরকম দৃশ্য শুধু স্বপ্নেই দেখা যায়। বাস্তবে দেখা যায় না। নিম্যে হাসিমুখে দরজা খুলে দিল।দরজার ওপাশে অপরিচিত একজন লোক রিভলভার উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নগ্নদেহের নিমোকে দেখে তার কোনো ভাবান্তর হল না। ভারী গলায় বলল, ‘অসময়ে তোমাকে বিরক্ত করছি। খুবই লজ্জিত। কোনোরকম চ্যাঁচামেচি করবে না।’নিমো কোনো শব্দ করল না। লোকটা ঘরে ঢুকে পড়ল।নিমো মৃদুস্বরে বলল, ‘তোমার নাম কী?”জামস। জামশেদ।”তুমি কী চাও? আমার সঙ্গে কোনো টাকাপয়সা নেই।”আমি টাকাপয়সার জন্যে আসিনি।”তা হলে কীজন্যে এসেছ? আমার সঙ্গে বিছানায় যাবার জন্যে।”না।’নিযো দেখল লোকটা তার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না।’তুমি ঢুকলে কীভাবে?’ঢুকতে খুব একটা অসুবিধে হয়নি।’নিমো দেখল লোকটার মুখে ছোট্ট একটা হাসি। এর মধ্যে হাসির কী আছে?’কী চাও তুমি?”তোমার কাছে উইয়ি নামের যে-লোকটি আসবে ওর মাথায় আমি বেরেটা থার্টি টুর তিনটি বুলেট ঢুকিয়ে দেব। সেজন্যেই এসেছি।”উইয়ি যে এখানে আসে তা তো তোমার জানার কথা নয়।’নিমো আবার লক্ষ করল, লোকটির মুখে হালকা একটু হাসি।’উইয়িকে মারতে চাও কেনা”ও বারো বছরের একটি মেয়েকে রেপ করে মেরে ফেরেছে। মেয়েটার নাম।অ্যানি।’
পৃষ্ঠা-৬৮
নিমোর মুখ সাদা হলে গেল। কী বলছে এই লোক? নিমো চাপায়রে বলল, ‘উইয়ি এরকম হতেই পারে না।’
‘তুমি কি উইয়ির স্ত্রী?”না। তবে আমরা শিগগিরই বিয়ে করব। তুমি হাসছ কেন? এর মধ্যে হাসির কী আছে?”তোমার মতো বেশ কয়েকটা মেয়ে আছে উইয়ির। ওদের সবাই হয়তো জানে উইয়ির সঙ্গে তাদের নিয়ে হবে।’নিমো জবাব দিল না। লোকটি একটা সিগারেট ধরাণ, আর ঠিক তখনই বাড়ির সামনে থামল বড় একটি গাড়ি। সিগারেট অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিল লোকটি।’এই মেয়ে, শোনো। তুমি সবসময় যেভাবে দরজা খোলো ঠিক সেইভাবেই খুলবে। খোলামাত্রই চেষ্টা করবে প্রথম সুযোগেই দূরে সরে যেতে।”আর যদি দূরে না সরি? যদি উইয়িকে জড়িয়ে ধরে থাকি?”তা হলে তোমাদের দুজনকে গুলি করব।’কী ঠাণ্ডা কণ্ঠস্বর। কোনো সন্দেহ নেই এই লোক দুজনকে মারতে তিলমাত্র বিধা করবে না। নিমো দেখল লোকটা দরজা বন্ধ করে বাঁদিকের ড্রেসিংটেবিলের কাছে সরে গেছে। উইয়ির ভারী পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। নিমোর ইচ্ছা হল প্রাণপণে চেঁচিয়ে উইয়িকে সাবধান করে। কিন্তু তার গলা দিয়ে কোনো স্বর বেরুল না। উইয়ি যখন দরজায় টোকা দিয়ে বলল, ‘কোথায় আমার ময়না পাখি, দেখন হাসি।’ তখন সে অন্যদিনের মতোই দরজা খুলে দিল। উইয়ি ঘরে ঢুকল নিমোকে জড়িয়ে ধরে। আর সেই সময় একটা ভারী গলার স্বর শোনা গেল, ‘ভালো আছ, উইয়ি? আমাকে চিনতে পারছ আশা করি?”উইয়ি নিমোকে ছেড়ে দিয়ে দ্রুত হাত ঢোকাল প্যান্টের পকেটে আর তখনই পরপর তিনবার গুলি হল।নিমো কিছু বুঝতে পারছে না। সবকিছু স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। সে দেখছে উইয়ির প্রকাও দেহটা খাটের পাশে কাত হয়ে পড়ে যাচ্ছে। বিদেশী লোকটা কী যেন বলছে ভাকে। কী বলছে? সবকিছু অস্পষ্ট ধোঁয়াটে।’এই মেয়ে তুমি কাপড় পরে নাও। পুলিশ আসবে এক্ষুনি। ওদের সামনে এরকম ন্যাংটো অবস্থায় বের হওয়া ঠিক হবে না।’লোকটা বাতি নিভিয়ে অন্ধকারে বের হয়ে গেল। খুব ছুটাছুটি হচ্ছে বাইরে। রক্ষী দুজন দৌড়ে আসছে সম্ভবত। উইয়ির গাড়িতেও যে একজন দেহরক্ষী সবসময় থাকে সেও ছুটে আসছে। নিমোর মনে হল সে এখন প্রচুর গোলাগুলি শুনবে। কিন্তু সেরকম। কিছুই শুনল না। সে কি জ্ঞান হারাচ্ছে? উইয়ির পড়ে-থাকা বিরাট শরীরের দিকে তাকিয়ে মুখ ভরতি করে বমি করল। গা গুলাচ্ছে। ঘরবাড়ি কেমন যেন দুলছে। নিমো দ্বিতীয়বার বমি করল।
পৃষ্ঠা-৬৯
রিনাদোর অফিসঘরটি ঠাণ্ডা। এয়ারকুলার আছে। তার ওপর একটি ফ্যান ঘুরছে। তবু নিমো থামতে লাগল।পুলিশি ব্যাপারে নিমোর কোন্যে পূর্বঅভিজ্ঞতা নেই। ভাসাভাসা একটি ধারণা যে পুলিশ অফিসাররা নির্দয় প্রকৃতির হয় এবং উলটোপালটা প্রশ্ন করে সহজেই ফাঁদে ফেলে দেয়। কিন্তু এই অফিসারের বয়স অল্প এবং সে প্রশ্ন করছে খুবই আন্তরিক ভঙ্গিতে। কফি খেতে দিয়েছে। কথা বলছে নরম গলায়, যদিও কথাগুলো শুনতে তার মোটেও ভালো লাগছে না।’তুমি কি একজন প্রোসটিটিউট।’জি না।”না বলছ কেন? তুমি তো থাকছিলে রক্ষিতার মতো। উইয়ির হাতে পড়বার আগেও অনেক পুরুষের সঙ্গে থেকেছ। থাকনি?’নিমো চুপ করে রইল।’তুমি কি জানতে উইয়ি পতিতাবৃত্তির একটা বড় অংশ পরিচালনা করে?”না।”উইয়ির সঙ্গে যেসব মেয়ে থাকে তারা পরে বিভিন্নরকম পতিতাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়ে বা পড়তে বাধ্য হয় এটা তুমি জানতে না?”জি না। উইয়ি আমাকে বিয়ে করবে বলেছিল।”তা কি তুমি এখনও বিশ্বাস কর?”আমার বিশ্বাস অবিশ্বাস উইয়ি বেঁচে থাকলে প্রমাণ হত। সেটা তো এখন প্রমাণ করবার কোনো পথ নেই।”যে-লোকটা উইয়িকে মারল সে একজন বিদেশী?”‘কী করে বুঝলে?”‘টেনে টেনে কথা বলছিল। তার চেহারাও বিদেশীদের মতো। নামটাও সেরকম।”সে তোমাকে তার নাম বলেছে?”ইয়া।”কী নাম?”আমার মনে নেই।”সে বলেছে অ্যানির মৃত্যুর জন্যে সে শাস্তি দিচ্ছে?”হ্যাঁ।”আচ্ছা, সে কি তার নাম জামশেদ বলেছে?”আমার মনে পড়ছে না।”লোকটার কোনো বৈশিষ্ট্য তোমার মনে পড়ে?’না।”লোকটি খুবই ঠাণ্ডা মাথায় সমস্ত ব্যাপারটা ঘটাল। সে এতটুকুও উত্তেজিত ছিল ‘গুলি করবার আগে লোকটি কোনো কথাবার্তা বলেছে?’
পৃষ্ঠা-৭০
‘বলেছে, কিন্তু আমার মনে নেই।”এইজাতীয় হত্যাকাণ্ড সে আরো করবে কি না তা বলেছে?”আমার মনে পড়ছে না।”কফি খাও। কফি ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।’নিমো কফিতে চুমুক না দিয়ে তার কপালের ঘাম মুছল।ভিকি খবরের কাগজের প্রথম পাতায় ছাপা খবরটার অর্থ ঠিক বুঝতে পারল না। তাকে দ্বিতীয়বার খরবটি পড়তে হল। শিরোনাম হচ্ছে ‘একক যুদ্ধ’। অসীম সাহসী একজন প্রৌঢ়, যার নাম জামশেদ, সে একাকী যুদ্ধ ঘোষণা করেছে এমন সব অপরাধীর বিরুদ্ধে, যাদেরকে পুলিশ কিছুই বলে না বা বলবার ক্ষমতা রাখে না। বেশ বড় খবর। সেখানে অ্যানির মৃত্যু-প্রসঙ্গ আছে। এবং ভয়ংকর দুজন অপরাধী যারা অল্প কিছুদিনের ভেতর মারা গেল তাদের কথাও আছে। নিমো নামের মেয়েটার ক্ষুদ্র একটি সাক্ষাৎকারও আছে।ডিকি দীর্ঘ সময় চুপচাপ বসে রইল চেয়ারে। আজ ছুটির দিন, রুনকে নিয়ে তার বে ল্যান্ডে যাবার কথা। সেখানে একটি ছোট্ট কটেজ ভাড়া নেয়া হয়েছে। কিন্তু ভিকির আর যেতে ইচ্ছে করছিল না। ইচ্ছে করছিল, রুনকে পাশে বসিয়ে অ্যানির পুরানো দিনের ছবিগুলি দেখে। কিংবা কবরখানায় গিয়ে অ্যানির ছোট্ট কবরটিতে কিছু ফুল দিয়ে আসে। ফুলের সঙ্গে থাকবে এই খবরের কাগজটি যেখানে অনাত্মীয় একটা বিদেশীর কথ্য আছে। যে ছোট্ট অ্যানির ভালোবাসার উত্তর দিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। ভিকির চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে লাগল। রুন ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে বলল, ‘কী হয়েছে?’ ‘এই খবরটা পড়ো।’রুন নিঃশব্দে পড়ল। তার চেহারা দেখে মনে হল না তার কোনো ভাবান্তর হয়েছে। ডিকি মৃদুকণ্ঠে বলল, ‘বে ল্যান্ডে যাবে আজ?”নাহ্।”কী করবে? সিমেট্রিতে যাবে।”নাহ্।’ বলেই অনেক দিন পর গভীর ভালোবাসায় রুন তার স্বামীকে জড়িয়ে ধরল। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, ‘আমার মেয়ে আর অন্ধকার কফিনে শুয়ে শুয়ে কাঁদবে না। অন্তত একজন তার ভালোবাসার সম্মান রেখেছে। আমার মামণির আজ খুব আনন্দের দিন।’রিনালো অফিসে এসেই শুনল তাকে ক’বার টেলিফোনে খোঁজ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে অফিসে পৌঁছামাত্রই যেন সে এই নাম্বারে যোগাযোগ করে। বিশেষ প্রয়োজন।
পৃষ্ঠা-৭১
রিনালো দেখল নাম্বারটা অপরিচিত। কে হতে পারে? ডায়াল ঘোরানো মাত্রই মুদ্ স্বর শোনা গেল, ‘ভিকানডিয়া বলছি।”আমি রিন্যালো, কী ব্যাপার?”আজকের খবরের কাগজ দেখেছেন, মিঃ রিনালো?”হ্যাঁ।”বিশেষ কোনো খবর আপনার চোখে পড়েছে কি?”‘কোনটির কথা বলছেন? লাওসের হাঙ্গামা।”না। লাওস নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। আপনি কি দেখেননি খবরের কাগজের লোকরা কীভাবে একজনকে হিরো বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছে।”জামশেদের কথা বলছেন?”হ্যাঁ।’দেখেছি। কিন্তু এ ব্যাপারে আমাকে টেলিফোন করবার কারণটা ঠিক ধরতে পারছি না।”আপনার কি মনে হয় না ব্যাপারটা নিয়েএকটু বেশি বাড়াবাড়ি করা হচ্ছে।”আপনি ভুল জায়গায় টেলিফোন করছেন। আমি খবরের কাগজের লোক নই।”মিঃ রিনালো, আমি ঠিক জায়গাতেই টেলিফোন করেছি।’তার মানে?”আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন কোনো কাগজেই এত বড় একটা হিরোর কোনো ছবি ছাপা হয়নি। এবং আমি যতদূর জানি পুলিশ বিভাগ ছবি ছাপাতে নিষেধ করেছে।”পুলিশ বিভাগের স্বার্থ?”লোকটা বিদেশী। ছবি ছাপা হলেই সে পরিচিত হয়ে পড়বে। দ্রুত ধরা পড়বে। আপনারা চান না সে ধরা পড়ুক।”আপনার এরকম অনুমানের কোনো ভিত্তি আছে কি?”কিছুটা আছে। আমরা ওর ছবি দিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে চেয়েছিলাম।পত্রিকাওয়ালারা সেটা ছাপতে রাজি নয়। অপরাধীকে ধরিয়ে দিন এই শিরোনামে বিজ্ঞাপন।”‘আপনারা এইজাতীয় বিজ্ঞাপন দিতে শুরু করেছেন?”বিজ্ঞাপনটা দেয়া হয়েছিল উদ্বিগ্ন জনসাধারণের নামে।”ও, তা-ই বুঝি?”হ্যাঁ, মিঃ রিনালো। আমরাও জনগণ। ট্যাক্স দিয়ে বাস করছি।”মিঃ ভিকানডিয়া!”বলুন।”আমার কেন জানি ধারণা হচ্ছে, এই একটা লোকের জন্যে আপনারা কিছুটা বিচলিত হয়েছেন।”মোটেই না। পত্রিকাওয়ালারা জিনিসটাকে একটা সেন্টিমেন্টালে রূপ দিতে চাচ্ছে, সেখানেই আমার আপত্তি।’
পৃষ্ঠা-৭২
‘লোকটা কিছু সহজ পাত্রও নয়, মিঃ ভিকানডিয়া।”আড়াল থেকে গুলি করার মধ্যে কোনো বাহাদুরি দেখি না।”বাহাদুরি দেখানোর তার কোনো ইচ্ছাও বোধহয় নেই। ভালো কথা, আপনি এখনও হয়তো খবর পাননি, নিওরোর মৃতদেহ পাওয়া গেছে।”কী বলছেন?”নিওরো, যে অ্যানির কিডন্যাপিং-এ অড়িত ছিল, তার ডেডবভি পাওয়া গেছে। বুলেটের সাইজ থেকে মনে হয় সেটা বেরেটা থার্টি টু জাতীয় অস্ত্র থেকে এসেছে।”কখন পাওয়া গেছে ডেডবডি।”অল্প কিছু আগে। ঘণ্টাখানেক হবে।’বস ভিকানডিয়া দীর্ঘ সময় রূপ থেকে বলল, ‘আপনাকে খুব খুশি মনে হচ্ছে।”পুলিশের লোক সহজে খুশি হয় না, অখুশিও হয় না।”‘জামশেদকে ধরবার কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে?”‘এসব পুলিশের ব্যাপার। ও নিয়ে কৌতূহল প্রকাশ না করাই ভালো।”আমার মনে হচ্ছে পুলিশ ওকে ধরবার কোনোরকম চেষ্টাই করছে না। করছে কি?’রিনালো শব্দ করে হাসল। জবাব দিল না।’হ্যালো রিনালো।’রিনালো টেলিফোন নামিয়ে রাখল।প্রতিটি প্রভাতী সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় নিওরোর মৃত্যুসংবাদ চাপা হল। ছবি ছাপা হল অ্যানির। অ্যানির হত্যাকাণ্ড ও মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা কীভাবে সাজা পাচ্ছে সে-বিবরণ লেখা হল। শুধুমাত্র জামশেদের কোনো ছবি নেই। তার চেহারার কোনো বিবরণও নেই। একটি পত্রিকায় পোস্ট এডিটরিয়েল লেখা হল জামশেদকে নিয়ে। সম্পাদক লিখলেন আমরা আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া কখনো সমর্থন করি না। যারা আইন নিজের হাতে নেয় তারা আমাদের কাছে অপরাধী। কিন্তু যখন দেখি বিচারের বাণী নীরবে কাঁদে, আইন অপরাধীদের স্পর্শ করে না তখন ব্যথিত হই। সে- সময় কোনো সাহসী মানুষ যদি আইন নিজের হাতে তুলে নেয় তখন ডাকে সমর্থন না করলেও একধরনের শ্রদ্ধা ও মমতা বোধ করি তার জন্যে। সেও অপরাধী। কিন্তু অপরাধী হলেও তাকে ঘৃণা করতে আমাদের বিবেক সায় দেয় না। আমরা আশা করছি আমাদের জীর্ণ পুলিশবাহিনী জামশেদের ঘটনা থেকে একটা বড় শিক্ষা গ্রহণ করবে। তাদের ভবিষ্যৎ কর্মধারা এরকম হবে যেন আমাদের অপরাধীদের ওপর আস্থা স্থাপন করতে না হয়।লা বেলে পত্রিকায় আরেকটি মজার খবর ছাপা হল। দুটি নাগরিক কমিটি বৈঠকে বসে ঠিক করেছে জামশেদের নিরাপত্তার ব্যাপারে তারা সবরকম সাহায্য দেবে। বৈঠকের শেষে তার জামশেদের জন্যে বিশেষ প্রার্থনার ব্যবস্থা করেছে।শহরে এখন অনেক গাড়ি দেখা যেতে লাগল যেগুলোর গায়ে নতুন ধরনের সব স্টিকার, ‘জামশেদ, আমরা আছি তোমার সাথে।’ ‘তুমি চালিয়ে যাও, জামশেদ।’ ‘এই গাড়িটিতে জামশেদের জন্যে একটি আসন আছে।’
পৃষ্ঠা-৭৩
সকাল থেকেই মেঘ করেছিল।দুপুরের দিকে ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করণ। এতরা একবার ভাবল আজ আর মা’র কাছে যাবে না। টেলিফোনে খোঁজ নেবে। এই ভাবনা অবিশ্যি বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। আজ মঙ্গলবার মা’র কাছে না গেলেই নয়। এতরা বিষক্তমুখে গাড়ি বের করতে বলল। দিনকাল এমন হয়েছে হুটহাট করে কোথাও যাওয়া যায় না। তিন- চারজন দেহরক্ষী সঙ্গে রাখতে হয়। গাড়িতে বসতে হয় মাথা নিচু করে। সবসময় একটা আতঙ্ক। এরকম অবস্থায় মানুষ থাকতে পারে? সবচেয়ে ভালো হয় মাসখানেকের জন্যে অন্য কোথাও চলে গেলে। এর মধ্যে নিশ্চয়ই সব ঝামেলা মিটে যাবে। একটিমাত্র মানুষ কী করে একরম একটা ঝামেলা সৃষ্টি করে কে জানে। খুবই বিরক্তিকর ব্যাপার। অবিশ্যি ক্যানটারেলা বলেছে তিন দিনের মাথায় লোকটিকে খুঁজে বের করা হবে। এবং জীবিত অবস্থায় চামড়া তুলে নিয়ে সমুদ্রের নোনা জলে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে রাখা হবে। ক্যানটারেলার কথায় বিশ্বাস করা যায়, এরা ফালতু কথা কম বলে।এতরা বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই নিচে থেকে একজন চেঁচিয়ে বলল, ‘স্যার, আমরা তিনজনই কি সঙ্গে যাব?”‘তা হলে কুকুর সামলাবার জন্যে কেউ থাকবে না। কুকুর দুটো কি চেইন দিয়ে আটকে রাখব।”রাখো। সবকিছুই আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন? নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করবে।’এতরা ভ্রূ কুঞ্চিত করল। যে-তিনজন দেহরক্ষী রাখা হয়েছে তাদের বৃদ্ধিবৃত্তি নিম্নস্তরের বলেই এতবার ধারণা। সারাক্ষণ কথাবার্তা বলছে। ফুর্তিবাজের ভঙ্গি। কোথায়ও যখন বের হয় এমন ভাব করে যেন পিকনিকে যাচ্ছে। ইডিয়েটস। এতরা ডারী গলায় বলল, ‘কুকুর বাঁধা হয়েছে।”জি স্যার।”ভালো করে বাঁধো। আর শোনো, দিনের বেলা এরা যেন বাঁধা থাকে। এদের ছাড়বে সন্ধ্যা সাতটার পর। বুঝতে পারছ।”খুব পারছি, স্যার।’এতরা বিষণ্ণ ভঙ্গিতে নিচে নেমে এল। কুকুর দুটো তাকে দেখামাত্র গোঁগোঁ শব্দে একটা রাগী আওয়াজ করল। এতরার ভ্রূ দ্বিতীয়বার কুঞ্চিত হল। এই কুকুর দুটোকে সে পছন্দ করে না। এদের শীতল চোখের দিকে তাকালেই এতরার কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসে। এরকম একটা ভয়াবহ জীবকে মানুষের বন্ধু নাম দেয়ার কী মানে? এতরা ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলল। সময়টা তার খারাপ যাচ্ছে। যেসব জিনিস সে পছন্দ করে না তার চারপাশেই এখন সেসব জিনিস। অটোম্যাটিক অস্ত্র-হাতে কয়েকজন নির্বোধ অথচ ভয়াবহ মানুষ। দুটো হিংস্র কুকুর যারা মনিরকে দেখে গোঁগোঁ শব্দে গর্জন করে। কোনো মানে হয়?
পৃষ্ঠা-৭৪
এতরার মা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। তার মুখ হাসিহাসি, এর মানে ঘরে কেউ লুকিয়ে নেই। তবু একটা ক্ষীণ সন্দেহ থেকে যায়। হয়তো সাবমেশিনগান হাতে জামশেদ নামের কুকুরটা ঘাপটি মেরে বসে আছে রান্নাঘরে। বিচিত্র কিছুই নয়। ওই কুকুরটার পক্ষে সবই সম্ভব। একরা ক্ষীণস্বরে বলল, ‘তোমরা দুজন গিয়ে ভালো করে খুঁজে দেখবে, কেউ কোথাও লুকিয়ে আছে কি না। তারপর গাড়িতে বসে না থেকে বাড়ির চারপাশে ঘুরবে। চোখকান খোলা রাখবে।”বৃষ্টি পড়ছে সিনোর।”পড়ক।’দুজন গভীরমুখে নেমে গেল। স্ত্রী বিরক্তিকর অবস্থা। স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা যায় না। সারাক্ষণ একটা দম-বন্ধ-করা আতঙ্ক। এরকম কিছুদিন চললে পাগল হয়ে যেতে হবে।এতরার মা ব্যাপারস্যাপার দেখে খুবই অবাক। ‘হচ্ছে কী এসব?”কিছুই হয়নি। একটু সাবধানে চলাফেরা করছি। এতে অবাক হবার কী আছে?”হঠাৎ করে এত সাবধানতারই-বা কী আছে?’এতরা জবাব দিল না। মুখ কালো করে বসে রইল।’আমার মনে হয় তোমার ওজনও কমেছে। দশ পাউন্ড ওজন কমেছে।”ওজন ঠিকই আছে।”মোটেই ঠিক নেই। আমি ওজনের যন্ত্র আনছি, মেপে দ্যাখ্যে।”থাক, মাপতে হবে না।”অবশ্যই হবে। কথার ওপর কথা বলবে না। যা বলছি করো।’
বুড়ি ওজনেয় যন্ত্র নিয়ে এল। দেখা গেল সত্যি আট পাউন্ড ওজন কম।’সাত দিনে আট পাউন্ড ওজন কমেছে, এর মানে কী?”কমেছে, আবার বাড়বে। এই নিয়ে এত হৈচৈ কেন?”ইদানীং তোমার কোনো শত্রু তৈরি হয়েছে কি?”নাহ্।”ঠিক করে বলো।”দুএকজন হয়তো আছে, সে তো সবারই থাকে। দুষ্ট লোকের অভাব আছে নাকি পৃথিবীতে।’ ‘তা ঠিক।’বুড়ি কফি তৈরি করতে লাগল। ক্রিম মেশাতে মেশাতে আড়চোখে দুএকবার তাকাল ছেলের দিকে। এতরার চোখে কেমন যেন দিশাহারা ভাব। বুড়ি কফির কাপ নামিয়ে রেখে বলল, ‘পৃথিবীতে ভালো লোকও আছে।”আছে নাকি?”হ্যাঁ। ঐ বিদেশী লোকটার কথাই ধরো।”কার কথা বলছ।”ঐ যে জামশেদ না কী যেন নাম।’
পৃষ্ঠা-৭৫
এতরা তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলল, ‘ও ভালো লোক সে-ধারণা তোমার হল কোত্থেকে?”সবাই তো বলছে।’সবাই মানে পত্রিকাওয়ালার বলছে। ওরা দিনকে রাত করতে পারে। একটা খুনি বদমাশফে স্বর্গীয় দূত বানিয়ে দেয়।”একটা বিদেশী লোক একা একা যুদ্ধ করছে এটা তোমার চোখে পড়ে না।’এতরা কফির কাপে চুমুক দিয়ে মুখ বিকৃত করল।’কী, কথা বলছ না যে?”মানুষ মারাটা কোনো স্বাগীয় দূতের কাজ না।”যাদের মারছে তারা কি মানুষ? তারা তো পশুরও অধম।’এতরা গভীর হয়ে গেল। বাইরে বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। বৃষ্টি দেখে মেজাজ আরো খারাপ হয়ে যাচ্ছে। বুড়ি বলল, ‘আরেক কাপ কফি দেব?”চিলি দিয়ে বিন রেঁধেছি, দুপুরে আমার সঙ্গে লাঞ্চ করবে।”উঁহু, আমার কাজ আছে।”এইরকম আবহাওয়ায় আবার কিসের কাজ? দুর্যোগের দিনে কাজ থাকে শুধু দুষ্ট ‘স্বর্গীয় দূতদের কোনো কাজ থাকে না?”তুমি মনে হয় কোনো কারণে লোকটার ওপর রেগে আছ?”না, রাগব কেন?”লোকটা স্বর্গীয় দূত হয়তো না, কিন্তু বিবল একজন মানুষ। চার্চে ওর জন্যে প্রার্থনা করা হয়েছে।”প্রার্থনা করা হয়েছে?”হ্যাঁ।’এতরা সরু চোখে তাকিয়ে রইল।’কী প্রার্থনা করা হয়েছে?”‘প্রার্থনা করা হয়েছে যাতে তার কোনো বিপদ-আপদ না হয়।”একজন ভয়ংকর খুনির নিরাপত্তার জন্যে আজকাল তা হলে গির্জায় প্রার্থনাও হয়? পবিত্র খ্রিস্টান ধর্মের প্রচুর উন্নতি হয়েছে দেখি।’বুড়ি কিছু বলল না। রান্নাঘবে চলে গেল। লাঞ্চ সেরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে তিনটে বেজে গেল। মেঘ কেটে আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে। আরামদায়ক শীতলতা চারদিকে। এরকম দিনে ঘুমুতে ইচ্ছা করে। কিন্তু ঘুমানো যাবে না। অনেক কাজ আছে। দেশের বাইরে চলে যাবার একটা ব্যবস্থা না করলেই নয়। এরকম আতঙ্কের সঙ্গে সহবাস করা যায় না। এর চেয়ে পাসপোর্ট নিয়ে এক্ষুনি কোনো ট্রাভেল এজেপিতে যাওয়া দরকার। যদি সম্ভব হয় তা হলে আজ বিকেলেই ইংল্যান্ড চলে যাওয়া যায়। এখানে আর কিছুদিন থাকলে সত্যি সত্যি পাগল হয়ে যেতে হবে।
পৃষ্ঠা ৭৬ থেকে ৯০
পৃষ্ঠা-৭৬
এতরা ঘরে ঢোকামাত্র তার সেক্রেটারি বলল, ‘স্যার, আপনাকে এক্ষুনি মিঃ ভিকির বাড়িতে যেতে হবে। খুব জরুরি।”ব্যাপার কী?”তা স্যার জানা যায়নি। মিসেস রুন্দ দুবার টেলিফোন করেছেন। শুধু বলেছেন খুব জরুরি।’এতবার প্রথমেই মনে হল এটা একটা ট্র্যাপ। কেউ রুনের মুখের ওপর পিস্তল ধরে। টেলিফোন করিয়েছে। সস্তা ধরনের ট্র্যাপ বলাই বাহুল্য। অবিশি একটা কিন্তু থেকে যায়। দিনেদুপুরে এরকম ফাঁদ পাতে না কেউ। ফাঁদ পাতা হয় অন্ধকারে। ‘কীরকম জরুরি তার কোনো আভাসও দেয়নি কেউ?”না স্যার।”ঠিক আছে, গাড়ি বের করতে বলো।”আরেকটি কথা স্যার।”বলো।”লয়েড ইনস্যুরেন্স থেকে দুজন লোক এসেছিলেন।”কী ব্যাপারে?”পরিষ্কার করে কিছু বলেননি। তবে আমার অনুমান মিঃ ভিকির মেয়ে অ্যানির নিরাপত্তা ইনস্যুরেন্স প্রসঙ্গে কিছু বলতে চান। তাঁরা আজ সন্ধ্যার পর আসবেন বলে গেছেন।”আমি সন্ধ্যার পর কারো সঙ্গে দেখা করি না। ওরা এলে ফিরে যেতে বলবে।”ঠিক আছে স্যার।’বেল টিপতেই রুন নিজে এসে দরজা খুলল। মনে হল সে এতক্ষণ এতরার জন্যেই অপেক্ষা করছিল। রুনের সাজসজ্জা সাধারণ তবু এতেই তাকে অপরূপ লাগছে। পারিবারিক চূড়ান্ত বিপর্যয়ের ছাপ কোথায়ও নেই। একটু রোগা হয়েছে তাতে তার বয়স যেন আরো কম লাগছে। এতরা হালকা গলায় বলল, ‘কেমন আছ রুন?”ভালো।”একটু মনে হয় ওয়েট লুজ করেছ।”তা করেছি।”ভিকি কেমন আছে?’ও ভালো নেই। ওর জন্যেই তোমাকে ডেকেছি।”কী হয়েছে ভিকির।”চলো, নিজেই দেখবে।’ভিকি বারান্দায় একটি রকিংচেয়ারে দোল খাচ্ছিল। তার হাতে নেভানো একটা চুরুট। এতরা বলল, ‘হ্যালো ভিকি।’ ভিকি তাকাল একবার, তাকিয়েই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। এতরা বলল, ‘শরীর ঠিক আছে তো, ডিকি?’ ডিকি কোনো উত্তর দিল না। তার দৃষ্টি অস্বাভাবিক স্থির। যেন এ-জগতের কোনোকিছুর সঙ্গে তার কোনো যোগ নেই।
পৃষ্ঠা-৭৭
রুন বলল, ‘অবস্থাটা বুঝতে পারছ?”পারছি। কবে থেকে এরকম হয়েছে?”গতরাত থেকে। হঠাৎ করেই অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে পড়েছে। কারো সঙ্গে কোনো কথাবার্তা নেই। কাল সারারাত ঘুমায়নি। যতবার আমার ঘুম ভেঙেছে আমি দেখেছি সে বারান্দায় রকিংচেয়ারে বসে আছে।”ডাক্তার দেখিয়েছ?”দেরি না করে ডাক্তার ডাকা উচিত।”আমি বড্ড ভয় পাচ্ছি এতরা।”ভয়ের কিছু নেই। ঠিক হয়ে যাবে।’রুন ক্লান্তস্বরে বলল, ‘একটার পর একটা আঘাতে ওর এরকম হয়েছে। ওর ব্যবসাটা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে, জান বোধহয়।”না, জানি না।”সব জলে গেছে। লিও স্ট্রিটের বাড়িটাও বিক্রি করতে হয়েছে। বাড়ি মর্টগেজড ছিল, টাকাপয়সাও তেমন পাওয়া যায়নি।’এতরা চুপ করে রইল। রুন বলল, ‘এসো ভেতরে গিয়ে বসি। কফি খাবে?”খেতে পারি।”তোমার নিজের স্বাস্থ্যও খুব খারাপ হয়েছে।’এতরা ক্ষীণস্বরে বলল, ‘নানান ঝামেলা যাচ্ছে।’তোমার আবার ঝামেলা কিসের?’এতরা চুপ করে গেল। রুন কফির কাপ নামিয়ে রেখে স্বাভাবিক স্বরে বলল, ‘আমার ধারণা ছিল ডিকির প্রতি আমার প্রেমট্রেম কিছুই নেই। ধারণাটা সত্যি নয়।ওকে আমি ভালোবাসি।”ভা-ই নাকি?”হ্যাঁ। অ্যানির মৃত্যুর পর ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়েছে। ঠিক এই মুহূর্তে দুটো লোককে আমি ভালোবাসি। একজন হচ্ছে ভিকি, অন্যজন হচ্ছে অ্যানির বিদেশী দেহরক্ষী।’এতরা কিছু বলল না। রুন থেমে থেমে বলল, ঐ বিদেশী মানুষটার প্রতি আমি খুব অবিচার করেছি। শেষের দিকে ওকে আমি মনেপ্রাণে ঘৃণা করেছি। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছি ওকে চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দিতে।”তা-ই নাকি?”হ্যাঁ।’এভরা একটা সিগারেট ধরিয়ে সরু গলায় বলল, ‘ঐ বিদেশীর সঙ্গে কি এখন তোমার কোনো যোগাযোগ আছে?”কখনো টেলিফোন করেও কিছু বলেনি তোমাকে?”
পৃষ্ঠা-৭৮
‘না। ওরা ভিন্ন ধরনের মানুষ এতরা। নিজের বিশ্বাসের জন্যে কাজ করে। কারো ধার ধারে না।’এতরা উঠে দাঁড়াল। গঞ্জীর গলায় বলল, ‘আমাকে জরুরি কাজে ইংল্যান্ডে যেতে হচ্ছে রুন। হপ্তাখানেকের মধ্যে আসব।’রুন কোনো জবাব দিল না। গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এল ঠিকই। কিন্তু আগের মতো যাবার আগে জড়িয়ে ধরে চুমু খাওয়ার কোনো আগ্রহ দেখাল না।রাত এগারোটা ত্রিশ মিনিটে খাই এয়ারলাইন্সের একটি বিমানে করে এভরা ইতালি ছেড়ে গেল।রাত বারোটার লেট নাইট বুলেটিনে জানানো হল, জামশেদ নামের বিদেশী দেহরক্ষীটিকে পুলিশ পোর্ট সিটির এক বাড়ি থেকে গ্রেফতার করেছে। বাড়িটা শহর থেকে প্রায় দেড়শো মাইল দূরে। ফ্রান্স সীমান্তে। ইতালি থেকে সে পালাতে চেয়েছিল কি না কে জানোবস ভিকানডিয়াকে রাত আটটার পর জাগাবার নিয়ম নেই। বছর তিনেক আগে যখন দুটো বড় পরিবারের ভেতর হঠাৎ করে যুদ্ধ বেধে গেল তখনই শুধু তাকে একবার রাত তিনটেয় ঘুম থেকে ডেকে তোলা হয়েছিল। ভিকানডিয়া জিজ্ঞেস করেছিল, সব মিলিয়ে এ-পক্ষের ক’জন মারা গেছে? উত্তর শুনে ঘুমুতে গিয়েছিল। ভঙ্গিটা এমন যেন কিছুই হয়নি।জামশেদের গ্রেফতার হবার খবর সে তুলনায় তেমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ খবর নয়। কিন্তু তবু কী মনে করে যেন তাকে জাগানো হল। ভিকানডিয়া খবর শুনে অত্যন্ত গভীর হয়ে পড়ল। এটিও তার স্বভাববিরুদ্ধ। ভিকানডিয়া কখনো গম্ভীর হয় না। তার বড় ছেলে এবং ছোট মেয়ের জামাই ক্যানটারেলা পরিবারের সাথে এক সংঘর্ষে নিহত হয়। সে-খবর পেয়েও ভিকানডিয়ার কোনো বাহ্যিক পরিবর্তন হয়নি। সহজ স্বরে বলেছিল–যে-মৃত্যু হঠাৎ করে আসে সে-মৃত্যুসংবাদ হচ্ছে সুসংবাদ। দীর্ঘদিন রোগ ভোগ করে মরে অভাগারা।হয়তো ডিকানডিয়ার বয়স হয়ে যাচ্ছে। বয়স হলেই মন দুর্বল হয়। তখন জামশেদের মতো প্রায় তুচ্ছ একজন মানুষের গ্রেফতারের সংবাদে মুখ অন্ধকার হয়।ভিকানডিয়া গরম এক কাপ কড়া কফি দিতে বলল। ক্যানটারেলাকে খবর দিতে বলল। বিশেষ জরুরি, যেন এখনিই চলে আসে।ক্যানটায়েলাকে পাওয়া গেল না। যে-কয়েকটি জুয়ার আড্ডায় তার যাতায়াত সেগুলোর কোনোটাতেই সে নেই। পতিতাপল্লীতে তাকে পাওয়ার কথা নয়। মেয়েদের
পৃষ্ঠা-৭৯
ব্যাপারে তার উৎসাহ নেই। দুষ্ট লোকের ধারণা ক্যানটারেল্য পুরুষত্বহীন। এরকম হাতির মতো জোয়ান একটি লোককে নিয়ে এজাতীয় অপধাদ কী করে রটে কে জানে! ভিকানডিয়া রাত দুটোয় আবার খোঁজ করল ক্যানটারেণাকে পাওয়া গেছে কি না। না, পাওয়া যায়নি। সবক’টা নাইট ক্লাবে দেখা হয়েছে। শহরের ভেতরের ব্রথেলগুলোতেও দেখা হচ্ছে। ভিকানডিয়া গম্ভীরমুখে বলল, ‘ফাজিনকে আসতে বলো।’ফাজিন ভিকানডিয়ার ভাইয়ের ছেলে। ডিকানডিয়ার মৃত্যুর পর এ পরিবারের অনেক দায়িত্ব ফাজিনের ওপর বর্তাবে। সেই হিসেবে ফজিনের গুরুত্ব অনেকখানি। ভিকানডিয়া এমন সব জিনিস নিয়ে ফাজিনের সঙ্গে কথা বলে যা কোনো মাফিয়া বস কখনো করে না। তা ছাড়া ফাজিন ভিকানডিয়ার বাড়ির একতলাতে থাকে। এটিও একটি অদ্ভুত ব্যাপার। কোনো বস পরিবারের কোনো গুরুত্বপূর্ণ সদস্যের সঙ্গে এক বাড়িতে থাকে না।ফাজিন ঘুমুচ্ছিল। সে হাতমুখ ধুয়ে কাপড় বদলাল। এত রাতে যখন তাকে ডেকে তোলা হয়েছে তখন নিশ্চয়ই জরুরি কিছু হয়েছে। হয়তো এক্ষুনি বেরুতে হবে। তৈরি হয়ে যাওয়াটাই ভালো।’চাচ্য আমাকে ডেকেছেন?’ই, বসো। জামেশেদ গ্রেফতার হয়েছে, শুনেছ?”জি।’এই প্রসঙ্গে তোমার মতামত কি?’ফাজিন বুঝাতে পারল না ঠিক কী জানতে চাচ্ছে ভিকানডিয়া। জমশেদ গ্রেফতারহয়েছে, এর আবার মতামত কী।’মনে হচ্ছে এ ব্যাপারে তোমার কোনো মতামত নেই?”আমি বুঝতে পারছি না আপনি কী জানতে চাচ্ছেন।”বুঝতে না পারার তো কিছুই নেই। আমি সহজ ইতালিয়ান ভাষাতেই প্রশ্ন করছি। নাকি মাতৃভাষা ভুলে গেছ?’ফাজিন চুপ করে রইল। ভিকানডিয়া গম্ভীর গলায় বলল, ‘সমস্ত ব্যাপারটাই যে বানানো, তুমি বুঝতে পারছ না?”বানানো?”তোমাকে যতটা বুদ্ধিমান আমি ভাবতাম তুমি ৩৩টা বুদ্ধিমান নও।’ফাজিন চোখ নামিয়ে নিল। ভিকানডিয়া একটা চুরুট ধরিয়ে শান্তস্বরে বলল,’সমস্ত ব্যাপারটাই পুলিশের একটা চাল। একটা বড়রকমের ধাপ্পাবাজি।”তা-ই কি?”হ্যাঁ, তা-ই।’ যে-লোকটিকে আমরা খুঁজে পাচ্ছি না, ইতালিয়ান পুলিশ ফট করে’এরকম একটা চাল দেবার পিছনে যুক্তিটি কী?’তাকে গ্রেফতার করে ফেলল? আমাদের পুলিশ এত কর্মদক্ষ কোনোকালেই ছিল না।’
পৃষ্ঠা-৮০
‘খুব সহজ যুক্তি। আমাদের বিভ্রান্ত করা। পুলিশের ভেতর কিছু-কিছু অর্বাচীন ছোকরা ঢুকে গেছে যারা আমাদের কেঁচোর মতো যেন্না করে। জামশেদকে গ্রেফতারের খবর এইসব ছোকরারা ছড়িয়েছে, যাতে আমরা অসতর্ক হই এবং আরো কয়েকজন যারা পড়ি। বুঝতে পারছ?”পারছি।”ওরা দেখাতে চায় যে মাফিয়ারা সর্বেসর্বা নয়। আমার মনে হয় ঐসব অর্বাচীন ছোকরাদের একটা শিক্ষা দেয়া দরকার।”কীরকম শিক্ষা দিতে চান?”ওদের মধ্যে রিনালো নামে এক ছোকরা আছে যে নিজেকে বিশেষ বুদ্ধিমান বলে মনে করে। তাকে নিশ্চনাই চেন?”হ্যাঁ, চিনি।”ওর দুটো মেয়ে আছে যমজ। ঐ দুটো মেয়ের একটাকে কাল দুপুরের আগেই মেয়ে ফেলবে এবং রিনালোকে টেলিফোন করে মিষ্টি গলায় বলবে ভবিষ্যতে যেন সে আরো সাবধানে কাজকর্ম করে। তাকে বলবে, সবাইকে সন্তুষ্ট রাখার ক্ষমতা একটা ভালো ক্ষমতা।’ফাজিন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘আপনি যা বলছেন তা করা হবে, কিন্তু তা করার আগে আমাদের বোধহয় নিশ্চিত হওয়া উচিত যে জামশেদের গ্রেফতারের ব্যাপারটা একটি ধাপ্পা। হয়তো সে সত্যি সত্যি গ্রেফতার হয়েছে।”সে গ্রেফতার হয়নি। আর না হলেও কিছু যায় আসে না। ঐ ছোকরাকে একটু শুড়কে দেয়া দরকার।”ঠিক আছে। আমি কি এখন উঠব?'”হ্যাঁ। রাতদুপুরে অকারণে আমার সামনে বসে থাকার কোনো কারণ দেখি না।’জমশেদকে রাখা হয়েছে কড়া পাহারায়। কিন্তু তাকে মোটেই ভয়াবহ মনে হচ্ছে না। বরং ফুর্তিবাজ ধরনের লোক বলেই মনে হচ্ছে। ক্রমাগত কফি খাচ্ছে, চুরুট টানছে। জিপসি মেয়েদের নিয়ে চমৎকার অশ্লীল রসিকতা করে সবাইকে হাসিয়েছে। কে বলবে এই সেই ভয়াবহ লোক। যে-অফিসার তাকে গ্রেফতার করেছে সে ক্রমেই চিন্তিত হতে শুরু করল। কোথাও ভুল হয়নি তো?ভুল হবার কথা অবিশ্যি নয়। সে গভীর রাতে একটি টেলিফোন পেয়ে দলবল নিয়ে ছুটে গেছে। ফোনকলটা ছিল সংক্ষিপ্ত ‘জামশেদ অমুক ঠিকানায় রাত কাটাবে। আপনারা ঘণ্টাখানেকের মধ্যে এলে তাকে ধরতে পারবেন।’ সে তখুনি নয়জনের একটি
পৃষ্ঠা-৮১
স্কোয়াড নিয়ে গিয়েছে। আর সত্যি আউটহাউসে একজনকে পাওয়া গেছে। কঙ্কল মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছিল। তাকে ডেকে তুলে জিজ্ঞেস করা হল: ‘কী নাম?’লোকটি বলল, ‘জামশেদ।”দেশ?”বাংলাদেশ।”তুমিই কি সেই বিখ্যাত জামশেদ?”বিখ্যাত কি না জানি না তবে আমিই সেই লোক।”তোমার সঙ্গে অস্ত্রটগ্র কী আছে?’আপাতত একটা বারো ইঞ্চি ড্যাগার ছাড়া কিছুই নেই।”তোমাকে গ্রেফতার করা হল।”ভালো কথা। এতে কি তোমার প্রমোশনের কোনো সুবিধা হবে?’গ্রেফতারের ঘটনাটা এক ঘণ্টার ভেতর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। পুলিশ কমিশনার বিশেষ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেবার জন্যে আদেশ দিলেন। পুলিশি তদন্ত সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত কোনো পত্রিকা, রেডিও বা টিভি ইন্টারভিউ যেন না দেয়া হয় সেরকম নির্দেশ দেয়া হল। তদন্তকারী অফিসার হিসেবে নিয়োগ করা হল হমিসাইড ইন্সপেক্টর রিনালো ও কিনসিকে। এদের পাঠানো হল পোর্ট সিটিতে।রিনালো এসে পৌঁছাল ভোর ছ’টায়। তার সঙ্গে জামশেদের কথাবার্তা হলএরকম-রিনালো তুমি জামশেদ?জামশেদ: হ্যাঁ।রিনালো: জামশেদ যখন হাসপাতালে ছিল তখন প্রায়ই তার সঙ্গে দেখা করতে যেতাম। তোমাকে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।জামশেদ: (নিশ্চুপ)।
রিনালো: এই কাজট কেন করেছ?’জামশেদ: (নিশ্চুপ)রিনানো তোমার নিজের বুদ্ধিতেই করেছ, না অন্য কারোর বুদ্ধিতে?জামশেদ: নিজের বুদ্ধিতে। আসল জামশেদকে সাহায্য করবার জন্যে করেছি।রিনালো তোমার ধারণা এতে ভার সাহায্য হবে?আামশেদ: হ্যাঁ, আমার তা-ই ধারণা।রিনাদো। তুমি একটি মহাবেকুন। তুমি যে কী পরিমাণ জটিলতার সৃষ্টি করেছ সে। সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা নেই।রিনালো মহা বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল। ঠিক তখনই এল টেলিফোন। মিহি সুরে একজন বলল, ভিকানডিয়া আপনাকে গভীর সমবেদনা জানাচ্ছেন। এবং আশ্য করছেন
পৃষ্ঠা-৮২
আপনি ভবিষ্যতে এমন কিছু করবেন না যাতে এজাতীয় দুঃখ আপনাকে আরো পেতে হয়।রিনালো কিছুই বুঝতে পারল না। তার যমজ মেয়েদের একটি মারা গেছে গাড়ির নিচে চাপা পড়ে, এই খবর তখনও তার কাছে এসে পৌঁছায়নি।ক্যানটারেণা কয়েক মুহূর্ত নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না। এটা কি স্বপ্ন? না চোখে ভুল দেখছে? সন্ধ্যা থেকে এ পর্যন্ত তিন-চার পেগ হুইসকি খেয়েছে শুধু। এতে তার কোনো নেশা হয় না। কিন্তু নেশা ছাড়া এরকম একটি দৃশ্য দেখা সম্ভব নয়। ক্যানটারেলা দেখল তার সোফায় একজন কে বসে আছে। ঘর অন্ধকার। তবু বোঝা যাচ্ছে লোকটার হাত খালি নয়। লোকটি বলল, ‘আমাকে চিনতে পারছ।”হ্যাঁ। তুমি কেমন আছ?”‘ভালো। তুমি ভালো আছ, ক্যানটারেলা?”ভালোই আছি। এ-জায়গার ঠিকানা কোথায় পেলে, জামশেদ?”বলছি। তার আগে তুমি পকেট থেকে তোমার ছোট্ট মিসিমার পিস্তলটা আমার পায়ের কাছে ফেলে দাও। অন্য কিছুই করতে চেষ্টা করবে না।’ক্যানটায়েলা পিস্তলটা বের করে ছুড়ে দিল। মৃদুস্বরে বলল, ‘তুমি ওস্তাদ লোক, জামশেদ। সাহসী ও বুদ্ধিমান। দুটো জিনিস একসঙ্গে হয় না। সাহসী লোকরা হয় বোকা। আমি বুদ্ধিমান, সে কারণেই আমার সাহস কম। তোমার যদি আপত্তি না থাকে তা হলে আমি এক পেগ হুইসকি খেতে চাই। আমার চিন্তা করার শক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।” ক্যানটাবেলা অনুমতির অপেক্ষা না করেই দক্ষিণের দেয়ালের দিকে এগিয়ে গেল। ছোট্ট একটি ঘরোয়া ধরনের বার আছে সেখানে।’জামশেদ, তুমিও কি একটু চেখে দেখবে?”মদ খাওয়া আমি ছেড়ে দিয়েছি।”এরকম একটা পরিস্থিতিতে খাওয়া উচিতও নয়। ভালো কথা, তুমি কি আমাকে মেরে ফেলবে? কথাবার্তা খোলাখুলি হওয়া প্রয়োজন।’জামশেদ ভারী গলায় বলল, ‘না, তেমোকে আমি মারব না।’আমিও তা-ই তাবছিলাম। তুমি অনেক খোঁজখবর নিয়েছ, কাজেই আমি নিশ্চিত ছিলাম অ্যানি অপহরণ এবং মৃত্যুর ব্যাপারে আমার ভূমিকার কথা তুমি জান।”আমি জানি।”কতটুকু জান?”
পৃষ্ঠা-৮৩
‘আমি জানি তুমি প্রথম থেকেই এর বিরোধিতা করেছ। অ্যানির মৃত্যুর খবর পেয়ে তুমি ছুটে গিয়েছিলে এতরাকে গুলি করে মারবার জন্যে। ভিকানডিয়া হস্তক্ষেপ না করলে এতয়া সেই রাতেই মরত।”হ্যাঁ, তুমি অনেক খবরই রাখ। তবে আমি নিজে এতরাকে মারবার জন্য যাইনি। লোক পাঠিয়েছিলাম। নিজের হাতে আমি মানুষ কখনো মারিনি। আমার সাহস কম।’ জামশেদ বলল, ‘আমি কয়েকটি জিনিস তোমার কাছ থেকে জানতে চাই।”আমার মনে হয় না আমি তোমাকে কিছু বলব।”বলবে। আমি জানি মানুষের কাছ থেকে কী করে কথা আদায় করতে হয়।”তোমার কায়দাটা কী?”খুব সহজ কায়দা, ক্যানটারেলা। আমি চুলের কাঁটা দিয়ে তোমার বাঁ চোখটি উপড়ে ফেলব। আমার ধারণা তা করবার আগেই তুমি কথা বলা শুরু করবে।”তা ঠিক। সত্যি কথা বলতে কি আমি এখুনি কথা বলতে চাই। কী জানতে চাও?”মূল পরিকল্পনাটি কার?”বস ভিকানভিয়ার। তবে পরিকল্পনাটা কার্যকর করেছে ফাজিন। এরা দুজনেই। ঘটনার মূল নায়ক। এতরা হচ্ছে খলনায়ক।”এখন বলো কীভাবে তিকানডিয়াকে হত্যা করা সম্ভব, কীভাবে তার কাছে যাওলা যায়?”বলছি। তার আগে তুমি কি দয়া করে বলবে এ-বাড়ির ঠিকানা কী করে পেলে? বস ভিকানডিয়া এবং তার লোকজন পর্যন্ত এ-বাড়ির ঠিকানা জানে না। আমি যখন পালিয়ে থাকতে চাই তখনই শুধু এ-বাড়িতে আসি।’ জামশেদ ভারী গলায় বলল, ‘আমাকে এ-শহরের অনেকেই এখন সাহায্য করতে চায়। অচেনা লোকজনের কাছ থেকেও এখন আমি খবরাখবর পাই।”তুমি খুবই ভাগ্যবান, জামশেদ। তবে আজ তোমার ভাগ্যটা খারাপ।’ক্যানটারেলার কথা শেষ হবার আগেই জামশেদ ছিটকে পড়ল মেঝেতে। কখন যে অন্ধকারে দুজন মানুষ সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসেছে জামশেদ কিছুই বুঝতে পারেনি। ক্যানটারেলা বদল, ‘ওকে ভালো করে বেঁধে ফ্যালো।’ঠিক আছে স্যার।”জ্ঞান আছে কি?”না, জ্ঞান নেই। নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে।”নিচের ঘরে নিয়ে বন্ধ করে রাখো। আর একজন ডাক্তার ডাকো।”ডাক্তার।”হ্যাঁ, ডাক্তার। কারণ আমি একজন ভদ্রলোক। আর একটি কথা, তোমার আসতেএত দেরি করলে কেন? আমি তো ঘরে মানুষ দেখেই বেল টিপলাম।”দেরি করিনি স্যার। আমরা সঙ্গে সঙ্গেই এসেছি, সুযোগের অপেক্ষা করছিলাম।’
পৃষ্ঠা-৮৪
‘ভালো। খুব ভালো। তোমরা ভালো পুরস্কার পাবে।’ক্যানটারেণা এগিয়ে গিয়ে খানিকটা নির্জলা হুইসকি ঢালল গলায়।জামশেদের জ্ঞান ফিরল ঘন্টাখানেকের মধ্যে। সে তাকাল চারদিকে। ছোট একটি ঘর। সে শুয়ে আছে বিছানায়। তার গায়ে একটি পরিষ্কার চাদর। মাথার কাছে চল্লিশ পাওয়ারের একটি বাল্ব জ্বলছে। পায়ের কাছে ছোট্ট একটি টেবিলে এক জগ পানি। শক্ত লোহার দরজা। ভারী দুটো তালা ঝুলছে সেখানে। এ-ঘর থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়। জামশেন কয়েকবার ডাকল ‘কেউ আছে এখানে?’ কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। জমশেদ ঢকঢক করে পুরো জগ পানি খেয়ে ঘুমুতে গেল। বড় ঘুম পাচ্ছে।ভিকানডিয়ার সঙ্গে ক্যানটাবেলার দেখা হয় পরদিন সকাল দশটার দিকে। ভিকানডিয়া গর্জে উঠল, ‘কোথায় ছিলে কাল সারারাত? সমস্ত শহর চষে ফেলা হয়েছে তোমার জনো।”ক্যানটারেলা চুপ করে রইল। ভিকানভিয়া বলল, ‘ঘটনা খুব দ্রুত ঘটছে, বুঝতে পারছ তো?”পারছি।”পুলিশ জানিয়েছে ওরা যে-লোকটাকে ধরেছে সে জামশেদ নয়।”ভোরবেলার খবরের কাগজে তা-ই পড়লাম।”এখন আমাদের কাজ কী বুঝতে পারছ? যেভাবেই হোক জামশেদকে ধরা।’ ক্যানটারেলা শান্তহরে বলল, ‘সে যদি এ-শহরে থাকে তা হলে ধরা পড়বেই।”তোমার ধারণা সে এ-শহরে নেই?”এই বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই।”শহর থেকে বেরুবার সব কটা পয়েন্টে আমাদের লোক থাকবে। এবং আমাদের আরেকটি কাজ করতে হবে। জামশেদের ছবি বড় করে ছাপিয়ে সমস্ত শহরময় ছড়িয়ে দিতে হবে।”ছবি পাওয়া গেছে?”হ্যাঁ, ছবি জোগাড় হয়েছে। ছবির নিচে লেখা থাকবে, ওকে ধরিয়ে দিন।’ ‘তাতে কোনো লাভ হবে না। এ-শহরের লোকজন ওকে ধরিয়ে দেবে না।’ ভিকানডিয়া সরু গলায় বলল, ‘তোমার বুদ্ধিবৃত্তির ওপর থেকে আমার আস্থা কমে যাচ্ছে। আমরা শুধু ছবিই ছাপাব না। ছবির সঙ্গে এ-ও লিখে দেব, একে ধরিয়ে দিতে
পৃষ্ঠা-৮৫
পারলে পঁচিশ হাজার ইউ এস ডলার পুরস্কার দেয়া হবে। পুরস্কারের টাকাটা আমরা একটা ব্যাংকে জমা করে দেব। তাও লেখা থাকবে।’কানটারেলা চুপ করে রইল। ভিকানভিয়া বলল, ‘তোমার ধারণা এতে কাজ হবে?”হতে পারে।”সন্দেহ থাকলে টাকার পরিমাণ বাড়িয়ে পঞ্চাশ হাজার ইউ এস ডলার করে দাও। টাকায় সবই হয়।”তা হয়।”আমি এই ঝামেলার দ্রুত নিষ্পত্তি দেখতে চাই।”আমরাও চাই, ভিকানডিয়া।’টুনটুন করে ডোরবেল বাজছে।এতরার ভ্রূ কুঞ্চিত হল। কে হতে পারে? রাত প্রায় নটা। রুম সার্ভিস হবে না নিশ্চয়ই। দরজার পিপ হোল দিয়ে যে-লোকটিকে দেখা যাচ্ছে, সে ব্রিটিশ। অত্যন্ত অল চেহারা। এ তার কাছে কী চায়?এতরা দরজা খুলতেই বাইরে দাঁড়ানো লোকটি বলল, ‘আপনাকে বিরক্ত করবার জন্যে আন্তরিক দুঃখিত।”কে আপনি?”বলছি। তার আগে ভেতরে এসে বসতে পারি কি?”আমার পক্ষে বেশি সময় দেয়া সম্ভব নয়। আমি আজ সকালেই ইংল্যান্ডে এসে শৌঁছেছি। অসম্ভব ক্লান্ত।”আজ সকালে এসেছেন কথা ঠিক নয়, মিঃ এতরা। আপনি এসেছেন পরশু। আমি ভেতরে আসতে পারি?”আসুন।’ভদ্রলোক ভেতরে এসেই বললেন, ‘আমি হচ্ছি লয়েডস ইনস্যুরেন্সের একজন তদন্তকারী অফিসার। আমার নাম রেমন্ড কিন।’এতরা কিছু বলল না। লোকটি অত্যন্ত সহজ ভঙ্গিতে সোফায় বসে হাসিমুখে বলল, ‘অ্যানি নামের একটি মেয়ের ইনস্যুরেন্স পলিসির ব্যাপারে আপনাকে দুএকটি কথা জিজ্ঞেস করব। অবিশ্যি আপনি যদি অনুমতি দেন।”আপনি কী করে জানলেন যে আমি এখানে আছি? আমার ঠিক এই মুহূর্তে এখানে থাকার কথা নয়।
পৃষ্ঠা-৮৬
‘মিঃ এতরা, এটা জানার জন্যে আমাদেরকে শার্লক হোমস হবার প্রয়োজন হয় না। আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবার জন্যে দুজন গিয়েছিলেন ইতালি। তাঁরা ট্রাভেল এজেন্টের মাধ্যমে জেনেছে আপনি ইংল্যান্ডের টিকিট কেটেছেন। আমি তাই এখানকার হোটেলগুলিতে খোঁজ করেছি। আপনি যদি অন্য কোনো নামে হোটেল রিজার্ভেশন করডেন, তা হলে অবিশ্যি আমার পক্ষে খুঁজে বের করা সম্ভব হত না।”আমি অন্য নামে সিট রিজার্ভ করব কেন?”কথার কথা বলছি মিঃ এতরা। অবিশ্যি ইচ্ছা থাকলেও আপনি তা পারতেন না।কারণ হোটেল সিট রিজার্ভেশনের সময় বিদেশী নাগরিকদের পাসপোর্ট দেখাতে হয়।’এতরা সিগারেট ধরান। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে।’মিঃ এতরা, এখন কি আমি দুএকটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?”না, এখন পারেন না। আমি খুবই ক্লান্ত। আপনাকে কাল আসতে হবে। রাত নটা আলোচনায় জন্যে ভালো সময় নয়।’রেমন্ড কিন সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। হাসিমুখে বলল, ‘আমি কাল সকালে আসব।বিরক্ত করবার জন্যে অত্যন্ত দুঃখিত।”দশটার পর আসবেন। আমি অনেক দেরি করে উঠি।”আমি আসব ঠিক সাড়ে দশটায়। ইতালি সম্পর্কে কিছু গল্পগুজবও করা যাবে।’ইতালি সম্পর্কে গল্পগুজব করার কিছু নেই।”থাকবে না কেন? আমি দুদিন আগের খরব জানি সেখানে জামশেদ নামের একটি লোক গ্রেফতার হয়েছে পুলিশের কাছে। এ নিয়ে ইতালিতে তুমুল উত্তেজনা।’এতরা চাপা স্বরে বলল, ‘জামশেদ গ্রেফতার হয়েছে?”হ্যাঁ, হয়েছে। আমরা জামশেদের ব্যাপারেও উৎসাহী। অ্যানির ইনস্যুরেন্সের বিষয়ে শুকেও দরকার। কাজেই আমরা ওর ব্যাপারে খোঁজ রাখার চেষ্টা করছি। মিঃ এতরা।’
‘বলুন।”আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আপনিও জামশেদের ব্যাপারে বেশ উৎসাহী।”না, আমি উৎসাহী নই। আমি উৎসাহী হব কীজন্যে?”ও, সরি। আমারই ভুল হয়েছে। আচ্ছা মিঃ এতরা, আমরা কাল ভোরে কথা বলব।”দশটার পর।’ঠিক সাড়ে দশটায় আমি আসব। গুড নাইট।’এভরা টেলিফোনে রুম সার্ভিসকে কফি দিতে বলল। তার দুমিনিট পরেই বলল কফি দেবার প্রয়োজন নেই। তার কিছুই ভালো লাগছে না। তার কেন জানি প্রচণ্ড ভয় করতে লাগল। ইংল্যান্ডে আসার পরিকল্পনাটি কাঁচা। তার উচিত ছিল দেশেই থাকা। দেশে নিরাপত্তার ব্যবস্থা আরো জোরদার করা যেত।এখন ফিরে গেলে কেমন হয়? কাল সকাল দশটার আগেই রওনা হয়ে গেলে মন্দ হয় না। ইনস্যুরেন্স কোম্পানির ঐ ছাগলটির সঙ্গে কোনো কথা বলার ইচ্ছে হচ্ছে না।
পৃষ্ঠা-৮৭
এতরা রাত তিনটায় হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে এল। ভোর সাড়ে চারটায় ফ্রান্সের কনকর্ডের একটি টিকিট পাওয়া গেছে। সেখান থেকে বাসে করে ইতালি চলে যাওয়া যাবে। ভালো লাগছে না, কিছুই ভালো লাগছে না।আমশেদ সমস্ত দিন শুয়ে রইল।প্রচণ্ড খিদে। কিন্তু কোনো খাবার নেই। এক জগ পানি ছিল তা শেষ হয়েছে অনেক আগেই। জামশেদের শুয়ে থাকা কিংবা বসে বসে বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আরকিছু করবার নেই। চুপচাপ বসে থাকার ব্যাপারটি খুবই বিরক্তিকর। জামশেদ ঘুমুতে চেষ্টা করছে। কিন্তু ঘুম আসছে না। আয়ু উত্তেজিত। সে মনে-মনে পরবর্তী পরিকল্পনা ঝালিয়ে নিতে গিয়ে বাধা পেল। পরবর্তী পরিকল্পনা করাও অর্থহীন। এখান থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না। অলৌকিক কোনো ব্যাপার বা সৌভাগা এসব জিনিসে জামশেদের বিশ্বাস নেই। কাজেই পরবর্তী কোনো পরিকল্পনা তৈরির আগে বরং মৃত্যুর জন্যে মানসিক প্রস্তুতি নেয়াই ভালো।কী হয় মৃত্যুর পর? মৃত্যুর ওপারেও কি কোনো জগৎ আছে। সুখী কোনো ভুবন। যেখানে কষ্ট নামক ব্যাপারটি নেই। ক্ষুধার কষ্ট নেই। গ্লানি ও বঞ্চনার কষ্ট নেই। আনন্দ ও উল্লাসের একটি অপরূপ ভূবন। ভাবতে ভাবতে জামশেদের ঘুম এসে গেল। অদ্ভুত একটি স্বপ্ন দেখল সে।যেন অ্যানি ছুটতে ছুটতে আসছে, তার বদ্ধ ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বলছে, ‘এই ভালুক, তুমি এখানে আটকা পড়ে আছ কেন?”বুদ্ধির দোষে আটকা পড়েছি।”এমন বোকা কেন তুমি?’অ্যানি মাথা দুলিয়ে খুব হাসতে লাগল। রিনরিনে মিষ্টি গলায় হাসি। ঘুম ভেঙে উঠে বসল জামশেদ।এখন ফি দিন না রাত বোঝার উপায় নেই। ঘরে সবসময় বাতি জ্বলছে। কোনোরকম শব্দটব্দও কানে এসে পৌঁছাচ্ছে না। ক্ষুধার তীব্রতাও ক্রমে ক্রমে মরে যাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে এই ঘরে সে আছে আটচল্লিশ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে। ত্রিশঘণ্টা পার হলে খিদে ময়ে যায়। শুধু তৃষ্ণা থাকে। তৃষ্ণাও কমে আসে পঞ্চাশ ঘন্টায়। না খেয়ে থাকার অভিজ্ঞতা জামশেদের আছে। একবার সে এবং বেন ওয়াটসন না খেয়ে সাত দিন ছিল। সে ছিল একটি ছেলেমানুষি ব্যাপার। বেন ওয়াটসন একদিন বলল, ‘জাস, একটা বাজি ধরলে কেমন হয়?”কিসের বাজি?’
পৃষ্ঠা-৮৮
‘না খেয়ে থাকায় বাজি। কে বেশি সময় থাকতে পারে।”কত টাকা বাজি?”পঞ্চাশ ইউ এস ডলার।”ঠিক আছে।’বেন ওয়াটসনের কাজই হচ্ছে বাজি ধরা। সবকিছুতেই সে একটা বাজি ধরে ফেলবে। এবং অবধারিতভাবে হারবে। না খেয়ে থাকার বাজিতেও তা-ই হল।ত্রিশ ঘণ্টার মাথায় ওয়াটসন পঞ্চাশ ডলারের নোট এনে মুখ কালো করে বলল, ‘আবার হারলাম। এসো এবার খানাপিনা করা যাক।’জামশেদ বলল, ‘তুমি খাওয়াদাওয়া করো। আমি দেখতে চাই না-খেয়ে কতদিন থাকা যায়।”আর দেখাদেখি কী, তুমি তো জিতবেই।”বাজি-টাজি না। পরীক্ষা করতে চাই, না-খেয়ে কতদিন থাকা যায়।’জামশেদ স্কুলে রইল সাতদিন পর্যন্ত। বেন ওয়াটসন চিন্তায় চিন্তায় অস্থির। সামান্য বাজি ধরা থেকে এ কী ঝামেলায় পড়া গেল। শেষমেশ পাঁচশো ডলার নিয়ে সাধাসাধি, যেন জামশেদ কিছু-একটা মুখে দেয়। ইস, কীসব দিন গিয়েছে।সে বিছানায় উঠে বসল। আবার শুয়ে পড়ল। উঠে বসা এবং শুয়ে থাকা এই দুটি মাত্র কাজ তার। প্রথম দিকে খানিক হাঁটাহাঁটি করা যেত, এখন আর যায় না। শোয়ামাত্রই ঝিমুনি এসে গেল জামশেদের। আর প্রায় তার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হল অ্যানি দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তার মুখ কেমন যেন বিষণ্ণ। কথা বলছে টেনে টেনে।’বুড়ো ভালুক।”খুব কষ্ট হচ্ছে?”তা হচ্ছে, অ্যানি।”মানুষের এত কষ্ট কেন বুড়ো ভালুক?”কী জানি অ্যানি।”আমি কারোর কষ্ট দেখতে পারি না। খুব কান্না পায়।’জামশেদের মনে হল অ্যানি কাঁদতে শুরু করেছে। সে হাত বাড়াল অ্যানিকে সান্ত্বনা দিতে, তখনই তন্দ্রা কেটে গেল। আবার সেই আপের ছোট্ট ঘর। চল্লিশ পাওয়ারের হলুদ একটা বাতি। জামশেদের পেটে পাক দিয়ে উঠল। বমি হবে বোধহয়। হয়, এরকম হয়। একটা সময় আসে যখন শরীর বিদ্রোহ করতে শুরু করে। চোখ কিছু দেখতে চায় না। পা চলতে চায় না। মস্তিষ্ক স্থবির হয়ে আসে। জামশেদ মেঝেতে বমি করল।বস ভিকানডিয়া ঠাণ্ডাস্বরে বলল, একটি লোক হাওয়া হয়ে যেতে পারে না। ফাজিন জবাব দিল না।
পৃষ্ঠা-৮৯
‘লোকটি নিশ্চয়ই কোনো মন্ত্রটন্ত্র জানে না। নাকি তোমরা বলতে চাও সে অলৌকিক ক্ষমতাধর কোনো মানুষ?”সে খুব সম্ভব ইতালিতে নেই। ইতালিতে এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে তাকে খোঁজা হয়নি। আমার ধারণা সে জীবিত নেই।”এরকম ধারণা হবার কারণ কী?”কোনো কারণ নেই, আমার মনে হচ্ছে এরকম।”‘কারণ ছাড়াই যারা বিভিন্ন জিনিস ভাবে ওরা ছাগল সম্প্রদায়ভুক্ত বলেই আমি মনে করি।’ফাজিন কিছু বলল না। ভিকানডিয়া তিক্তস্বরে বলল: ‘ওর বন্ধু ওয়াটসন কী বলছে?”ও কিছুই বলছে না।”বলাবার চেষ্টা করেছ?”হ্যাঁ করেছি। পেন্টাগল ইনজেকশন দিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। ও কিছু জানে না। জানলে বলত।”কী বলে সে।”সে বলে যে ওর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে জামশেদ ওর সঙ্গে দুরাত ছিল।”সেই দুরাত ওদের মধ্যে কী কথাবার্তা হয়েছে?”বিশেষ কোনো কথাবার্তা হয়নি। জামশেদ কথা বলে কম।’ভিকানডিয়া চুরুট ধরাল। ফাজিন বলল, ‘ওয়াটসনকে নিয়ে এখন কী করব?”আমাকে জিজ্ঞেস করছ? এইসব ছোট জিনিস নিয়ে কেন তোমরা আমাকে বিরক্ত কর? যদি দেখ ওকে ধরে রেখে আর কোনো লাভ নেই তা হলে আপন বিদেয় করো। বস্তায় ভরতি করে ফেলে দাও সমুদ্রে।’ভিকির অবস্থা খারাপ হয়েছে। খাওয়াদাওয়া বন্ধ। রাতে ঘুমুতে পারে না। সমস্ত রাত বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে থাকে। জন দিশাহারা হয়ে গেল। ডাক্তাররা তেমন কিছু ধরতে পারেন না। মানসিক অসুস্থতার কোনো লক্ষণ নেই। ডাক্তারদের সঙ্গে কথাবার্তা সহজ স্বাভাবিক মানুষের মতো। কিন্তু রুনের সঙ্গে কথা বলার সময় কথা জড়িয়ে যায়। একটি কথা শুরু করে অন্য একটি কথায় চলে যায়। রুন কয়েকবার চেষ্টা করেছে ভিকিকে নিয়ে সুইজারল্যান্ডের দিকে যেতে। বাইরে হয়তো অন্যরকম হবে। আবার হয়তো ভিকি আগের মতো হয়ে উঠবে।ভিকির ব্যবসা নষ্ট হয়ে গেছে তাতে কিছুই যায় আসে না। ব্যবসা আবার হবে। রুনের নিজের যথেষ্ট টাকা আছে। কোনোকিছু না করেই সে-টাকায় নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে। অবিশ্যি পুরুষমানুষ বসে থাকতে পারে না। পূরুষমানুষদের কিছু-একটা করতে হয়। কাজেই আবার যাতে ভিকি উঠে দাঁড়াতে পারে রুন সে-চেষ্টা করবে।
পৃষ্ঠা-৯০
রুন দেখল ভিকি উঠে আসছে। পা ফেলছে এলোমেলোভাবে। রুন এগিয়ে গিয়ে ভিকিকে ধরে ফেলল। ‘একটা অন্যায় করেছি, রুন। তোমাকে আজ সেটা বলতে চাই।’জন বলল, ‘অন্যায় করে থাকলে করেছ। আমরা সবাই কখনো-না-কখনো ভুল করি।”আমি যা করেছি সেটা তোমার শোনা দরকার।”আমি কিছুই শুনতে চাই না। আমি চাই তুমি আগের মতো হও।”রুন প্লিজ, আমার কথা শোনো।”না, কোনো কথা শুনতে চাই না আমি।’রুন ভিকিকে গভীর আবেগে জড়িয়ে ধরল। ছেলেমানুষের মতো চোঁচিয়ে কাঁদতে লাগল ভিকি।’জামশেদ তুমি বেঁচে আছ?’জামশেদ চোখ মেলল। পরিষ্কার কিছু দেখা যাচ্ছে না। সব যেন ঘোলাটে লাগছে।’আমি ক্যানটারেলা। তোমার জনো খাবার এনেছি। নাও, খাও। প্রথম খাও ফলের রস। তারপর দূখ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। শরীরে একটু শক্তি হোক আমি আবার আসব।’জামশেদ কথাবার্তাও ঠিক বুঝতে পারছে না। তবুও সে উঠে বসেত চেষ্টা করল। ‘নড়াচড়া করবে না, শুয়ে থাকো। আমি দুঃখিত যে তোমাকে ছ’দিন না-খেয়ে থাকতে হল। উপায় ছিল না। খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করতে গেলেই তোমাকে ওরা খুঁজে বের করে ফেলত। তবে আমি জানাতাম ছ’দিনে তোমার কিছুই হবে না।’ক্যানটারেলা কমলার রস জামশেদের মুখের কাছে ধরল। মৃদুস্বরে বলল, ‘একসঙ্গে বেশি খাবে না, অল্প কিছু মুখে দাও। তারপর কিছু সময় বিশ্রাম করো। আবার কিছু খাও। একজন ডাক্তার নিয়ে এসেছি, সে বোধহয় তোমার শিরা দিয়ে কিছু খাবারদাবার ঢোকাবে।’জামশেদের মনে হল ক্যানটারেলার পাশে যেন অ্যানি দাঁড়িয়ে আছে হাসিমুখে। সে যেন বলছে, ‘খাও, বুড়ো ভালুক, খাও। এমন বোকার মতো তাকিয়ে থেকো না।’জামশেদ গ্লাসে চুমুক দিল।’জামশেদ, এখন কি সুস্থ বোধ করছ?’জামশেদ চোখ মেলল। ক্যানটারেলা দাঁড়িয়ে আছে। জামশেদ বলল, ‘আজ কত তারিখ?”বায়ো। বারোই আগস্ট। তুমি কি এখন সুস্থ বোধ করছ?’ ‘করছি।’
পৃষ্ঠা ৯১ থেকে ৯৪
পৃষ্ঠা-৯১
‘ভালো, খুবই ভালো। আরো বিশ্রাম নাও, আমি পরে আসব।’আমার যথেষ্ট বিশ্রাম হয়েছে।”আরো হোক। একটু ব্রান্ডি খাবে। এতে স্নায়ু টানটান হয়ে ওঠে।”আমার আয়ু এমনিতেই টানটান।’ঠিক আছে, তা হলে ব্র্যান্ডি খেতে হবে না। বিশ্রাম নাও। ডাক্তার বলেছে দিন। দুয়েকের মধ্যে তুমি আগের ফর্মে ফিরে আসবে।’ জামশেদ ক্লান্তস্বরে বলল। ‘মনে হচ্ছে তুমি চাও, আমি দ্রুত আগের ফর্মে ফিরে আসি।’ ‘হ্যাঁ, আমি চাই। তোমাকে আমার দরকার আছে। আজ রাতে একবার আসব। তখন বলা যাবে কেন দরকার।’এতরা ইতালিতে ফিরে এসে হকচকিয়ে গেল। জামশেদ ধরা পড়েনি। শুধু তা-ই নয়, সে নাকি বাতাসে মিলিয়ে গেছে। ক্যানটারেলার সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়েছে। ক্যানটারেলার কথাবার্তাও অস্পষ্ট। কিংবা এতরা এখন আর আগের মতো চিন্তাভাবনা করতে পারে না বলেই সব কথাবার্তাই অস্পষ্ট মনে হয়। এদের দুজনের মধ্যে কথোপকথন ছিল এরকম-এতরা: তুমি তো বলেছিলে জিন দিনের ভেতর ওকে ধরবে, তারপর চামড়া খুলে সমুদ্রে ডুবিয়ে রাখবে।ক্যানটারেলা: বলেছিলাম নাকি?এতরা: হ্যাঁ।ক্যানটারেলা: লোকটি মন্ত্রটস্ত্র আনে। বিপদের সময় ফস করে অদৃশ্য হয়ে যায়।এতরা: কী বলছ এসব? ঠাট্টা করছ নাকি?ক্যানটারেলা ঠাট্টা? না, আমি ঠাট্টা-ফাট্টা করি না।এতরা: প্লিজ ক্যানটারেলা, ঠাট্টা-তামাশা সহ্য করার ক্ষমতা এখন আমার নেই।ক্যানটায়েলা না থাকারই কথা। কারণ তুমি সম্ভবত নেক্সট টার্গেট।এতরা: কী বলছ এসব?ক্যানটারেলা: ঠিকই বলছি।এতরা: তুমি পাগলের মতো প্রলাপ বকছ?ক্যানটারেলা হতে পারে। হওয়াই সম্ভব, হা হা হা।এতরা: হাসছ কীজন্যে? এর মধ্যে হাসির কী হয়েছে?ক্যানটারেলা একটা পুরনো জোক মনে করে হাসছি। শুনতে চাও? একবার একটা লোক নাপিতের দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করল (এই জায়গায় এতরা খট করে রিসিভার নামিয়ে রাখল)।পরপর দুরাত এতরার এক ফোঁটা ঘুম হল না। খুট করে কোনো শব্দ হতেই সে লাফিয়ে ওঠে। তার মনে সন্দেহ, গার্ডরা হয়তো পাহারা দেবার নাম করে ঘুমুচ্ছে। সে প্রতি দুঘণ্টা পরপর নিচে নেমে যায় খোঁজ নিতে। কোনো একটি কামরায় বেশিক্ষণ থাকতে পারে না।
পৃষ্ঠা-৯২
দ্বিতীয় রাতে কড়া এক ভোজ লিব্রিয়াম খেল। কিন্তু তাতেও কিছু হল না। শেষরাতের দিকে তন্দ্রার মতো হল। কিন্তু সে-তন্দ্রা বিভীষিকার তন্দ্রা, এতরা স্পষ্ট দেখল জামশেদ সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় এক হাতে একটি ধারালো তলোয়ার নিয়ে তার দিকে ছুটে আসছে। সে দৌড়াচ্ছে প্রাণপণে। দুজনের দূরত্ব ক্রমেই কমে আসছে। এতবার বুকের ভেতর হৃৎপিন্ডটা লাফাচ্ছে, যেন এক্ষুনি ফেটে চৌচির হবে।এতরা জেগে উঠে বিকট স্বরে কেঁদে উঠল আহ্, বেঁচে থাকা কী কষ্টের ব্যাপার।’জামশেদ, তুমি কি এখন পুরোপুরি সুস্থ।’হ্যাঁ।’পান্না পড়বে এক হাত। দেখতে চাই সুস্থ কি না।”নাহ।”ঠিক আছে। তোমার জন্যে ভালো চুরুট আনিয়ে রেখেছি। হাভানা চুরুট, নাও।’জামশেদ হাত বাড়িয়ে চুরুট নিল। শীতল স্বরে বলল, ‘ক্যানটারেলা, এখন বলো কী বলতে চাও।”বলছি। ‘তার আগে একটু মার্টিনি হলে কেমন হয়?”আমি এখন মদ খাই না।”ভালো। তোমার জন্যে কফি দিতে বলি?”বলো।’ক্যানটারেলা চুরুট ধরিয়ে হাসিমুখে বলল, ‘তোমাকে ছোট্ট একটা গল্প বলতে চাই, জমশেদ।”গল্পে আমার কোনো আগ্রহ নেই, মিঃ ক্যানটারেলা।’জামশেদ তাকিয়ে রইল। ক্যানটারেলা মৃদুস্বরে বলল, ‘আমি যখন খুব ছোট তখন ভিকানডিয়া পরিবারের সঙ্গে আমাদের পরিবারের একটা বড় ধরনের ঝামেলা শুরু হয়। মাফিয়া পরিবারগুলির ঝামেলার নিষ্পত্তি কীভাবে হয় তা হয়তো তুমি জন। এক পরিবারকে শেষ হয়ে যেতে হয়। আমাদেরও অবস্থা হল সেরকম। শেষ পর্যন্ত কোনো উপায় না দেখে আমার বাবা সন্ধির ব্যবস্থা করল। সন্ধির শর্তগুলির মধ্যে একটি হল- আমার মাকে যেতে হবে ভিকানডিয়ার ঘরে। রক্ষিতার মতো। আমার মা বিশেষ রূপসী ছিলেন। তিকানডিয়ার শুরু থেকেই মা’র প্রতি আগ্রহ ছিল। পারিবারিক বিরোধেরএটিও একটি কারণ। গল্পটি তোমার কেমন লাগছে, জামশেদ?’ জামশেদ জবাব দিল না। ক্যানটারেলা থেমে বলল: ‘আমার মা’র বেশিদিন দুঃখ ভোগ করতে হল না। অল্পদিন পরই তার মৃত্যু হল। আমরাও ধীরে ধীরে সব ভুলেযেতে শুরু করলাম। একসময় ভিকানডিয়া আমাকে স্নেহ করতে শুরু করলেন। পুরাতন। স্মৃতি কিছু আর মনে রইল না। ‘তারপর হঠাৎ একদিন তুমি এসে উদয় হলে। তোমার কাণ্ডকারখানা দেখে পুরানো সব কথাবার্তা আমার মনে পড়তে শুরু করল। বিশেষ করে মনে পড়তে লাগল আমার
পৃষ্ঠা-৯৩
মাকে। তিনি আমাকে কী ডাকতেন জান। তিনি ডাকতেন “ন্যাংটো বাধা” বলে। কীরকম অদ্ভুত নাম, দেখলে?’জামশেদ তাকিয়ে দেখল ক্যানটারেলার চোখ দিয়ে জল পড়ছে। ক্যানটারেলা ধরাগলায় বলল: ‘জমশেদ, আমার শরীরটা হাতির মতো। কিন্তু আমার সাহস নেই। আমি পৃথিবীর সবচে বলশালী কাপুরুষদের একজন। সেজন্যেই তোমাকে আমার প্রয়োজন।’ জামশেদের চুরুট নিতে গিয়েছিল। সে আবার চুরুট ধরাল। ক্যানটারেলা মৃদুস্বরে বলল: ‘ডিকানডিয়ার প্রাসাদে ঢোকার ব্যবস্থা আমি করে দেব। বেরুবার ব্যবস্থা করতে পারব না। এটা হচ্ছে ওয়ান ওয়ে জার্নি। তুমি ঢুকতে পারবে, বেরুতে পারবে না।’ জামশেদ শান্তস্বরে বলল: ‘বেরুতে না পারলেও ক্ষতি নেই।’
‘আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। রওনা হতে হবে আজ রাতেই। আজ রাত ন’টায় বিশেষ কারণে জিকানডিয়ার ঘরের সব বাতি হঠাৎ করে নিভে যাবে।’ জামশেদ কিছু বলল না। ক্যানটারেলা ঠাণ্ডা গলায় বলল, ‘তুমি যদি ফিরে না আসতে পার, তা হলে এভরার ব্যবস্থা আমি করব। তুমি এ ব্যাপারে কিছুমাত্র চিন্তা করবে না। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি।’ ‘ঠিক আছে।’ ‘জামশেদ, আরেকটি কথা। যদি তুমি ফিরে না আসতে পার তা হলে তোমার ডেডবডি কি দেশে ফেরত পাঠাবার ব্যবস্থা করব?’ ‘নাহ্।’ ‘কাউকে কিছু বলতে হবে?’ ‘সাহ।’ ‘কোনোকিছুই বলার নেই তোমার?’ জামশেদ মৃদুস্বরে বলল, ‘যদি সম্ভব হয় অ্যানির পাশে একটু জায়গা রাখবে। মেয়েটি বন্ড ভীতু। আমি পাহারায় থাকলে হয়তো শান্তিতে ঘুমুবে।’ ক্যানটারেলা তাকিয়ে রইল, কিছু বলল না। গভীর রাতে একরার ঘুম ভেঙে গেল। ঝনঝন করে টেলিফোন বাজছে। যেন ভয়াবহ কোনো খবর এসেছে টেলিফোনে। এভরা কাঁপা গলায় বলল, ‘হ্যালো।’ ‘এতরা, খবর শুনেছ?’ ‘কী খবর?’ ‘বস ভিকানডিয়াকে খুন করা হয়েছে। কে করেছে বুঝতে পারছ তো?’
পৃষ্ঠা-৯৪
‘কে? জামশেদ?'”ঠিক ধরেছ। তবে তোমার জন্যে একটি সুখবর আছে। জামশেদও মারা যাচ্ছে। খুব বেশি হলে ঘণ্টাখানেক টিকে থাকবে। আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?”পাচ্ছি।”একবার সিটি হাসপাতালে এসে দেখবে না কত লক্ষ লক্ষ মানুষ এসে জমা হয়েছে। এই বিদেশী মানুষটির খবর দিতে?”তুমি কে?”ইতালির সবচে বড় বড় ডাক্তাররা ছুটে এসেছেন। তিনটি আলাদা আলাদা মেডিক্যাল বোর্ড হয়েছে। এরকম মরায় সুখ আছে, তা-ই না?”তুমি কে?”আমাকে চিনতে পারছ না?”না। তুমি কি ক্যানটারেলা?’টেলিফোন লাইন কেটে গেল। আবার দুঘণ্টা পর ঝনঝন করে বেজে উঠল।’হ্যালো, এতরা?”হ্যাঁ।’সুসংবাদ, জামশেদ মারা গেছে।”তুমি কে?”আমি ওর প্রেতাত্মা। জামশেদের মতো লোকগুলি মরেও মরে না। দীর্ঘকাল বেঁচে থাকে। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছি।’এতয়া কাঁপা গলায় বলল, ‘তুমি ক্যানটারেলা?”না, আমি জামশেদ। আমি আসছি।’রাত চারটায় ছোট্ট একটি সাদা রঙের ওপেল গাড়ি এতরার বাসার সামনে থামল। ক্যানটারেলা নেমে এল গাড়ি থেকে। নিচের গার্ডরা কেউ তাকে আটকাল না। এভরা বারান্দায় বসে শুনল সিঁড়ি বেয়ে ভারী পায়ে কে যেন উঠে আসছে উপরে।ইস্টার্ন সিমেট্রিতে অ্যানি নামের মেয়ের কবরের পাশে একজন বিদেশীর কবর আছে। তার গায়ে চার লাইনের একটি ইতালিয়ান কবিতা যার অর্থ অনেকটা এরকম-‘এখানে একজন মানুষ ঘুমিয়ে আছে। তাকে শান্তিতে ঘুমুতে দাও।’ কবরটির পাশেই দুটি প্রকাণ্ড চেরিফুলের গাছ। বসন্তকালে কবরটি সাদা রঙের চেরিফুলে ঢাকা পড়ে থাকে। বড় চমৎকার লাগে দেখতে।