শেষ চিঠি - আয়েশা ফয়েজ (০১)
পৃষ্ঠা ১ থেকে ১৫
পৃষ্ঠা:০১
ভূমিকা: আমাদের বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ মারা যাবার পর আমাদের মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। সব সময় অস্থির থাকতেন। কী করলে একটু ভালো থাকবেন, আমরা ভেবে পেতাম না। হঠাৎ একদিন দেখি একটি ছোট রুলটানা খাতায় গুটি গুটি করে মা কী যেন লিখছেন। সবাই খুবই অবাক হলাম। এ রকম মানসিক অবস্থায় মাকী লিখছেন? মাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, ‘আমি তোদের দাদাভাই (হুমায়ূন আহমেদ) এর সাথে কথা বলি।’ মা লিখে লিখে তার আদরের ছেলের সাথে প্রতিদিন কথা বলতেন। আমরাও সান্ত্বনা পেতাম, মা মনের কথাগুলো লিখে কষ্টটা কিছুটা হলেও দূরে সরিয়ে রাখতে পারছেন।
আমরা এটাকে বই হিসেবে প্রকাশ করব কি না সেটা নিয়েও অনেক চিন্তাভাবনা করেছি, একজনের ব্যক্তিগত দুঃখের কথা প্রকাশ করা উচিত হবে কি না, সেটা নিয়ে আমাদের একটুখানি দ্বিধা ছিল। কিন্তু পাণ্ডুলিপির একেবারে শেষে মা একটি বক্স করে আমার মেয়ে অপলা হায়দারকে লিখেছিলেন-‘অমি নানু, তুমি লেখাটা ভালো করে একটু দেখে দিও।’ সেটি দেখে বুঝতে পেরেছিলাম তিনি এটা প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। তা ছাড়া এখানে বিস্ময়কর, প্রায় অলৌকিক কিছু তথ্য আছে, আমরা চাইছিলাম সেটা ছাপার অক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকুক। আমার মেয়ে অমি দেশের বাইরে চলে যাওয়ায় তার পক্ষে কিছু করা সম্ভব হয়নি। তবে তার নানু তাকে এত বড় দায়িত্ব দেয়ায় সে খুবই গর্বিত লে। আমি একটু একটু করে আমার মায়ের
পৃষ্ঠা:০২
এলোমেলো হাতের লেখা পুনর্লিখন করেছি। মা এর আগেও একটি বই লিখেছেন ‘জীবন যে রকম’। সেখানে নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো গুছিয়ে ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এ বইয়ে কোনো ধারাবাহিকতা নেই। মায়ের যে মনের অবস্থা সম্ভবত তার পক্ষে ধারাবাহিকতা রক্ষা করে লেখার ক্ষমতাও ছিল না। যখন যেটা যেভাবে মনে হয়েছে সেভাবে লিখে গেছেন। (পরিশিষ্ট ১) বর্তমানের কথা লিখতে লিখতে মুহূর্তেই অতীতে চলে যাচ্ছেন। আবার অতীতের কথা লিখতে লিখতে একেবারে সাম্প্রতিক ঘটনা বর্ণনা করেছেন। একই বিষয় একাধিকবার লিখে রেখেছেন। কোনো একজন মানুষের নাম ধরে লিখেছেন যে মানুষটিকে পাঠকের চেনার উপায় নেই। বাক্যের ভেতর শব্দ বাদ পড়ে গেছে, শব্দের ভেতর অক্ষর বাদ পড়ে গেছে। আমরা নানাভাবে চেষ্টা করে সেগুলো ঠিক করে মা যেভাবে লিখেছেন মোটামুটি সেভাবেই রেখে দিয়েছি। মাঝেমধ্যে শুধু বানান কিংবা বাক্য গঠন করতে হয়েছে যেন পাঠকের পড়ে বুঝতে সমস্যা না হয়।
এই বইতে মা অনেকের কথা বলেছেন। যাদেরকে ভালোবেসেছেন, স্নেহ করেছেন, হৃদয়ের উদারতায় তাদের কথা বলেছেন, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। কয়েকজন প্রকাশক, তাদের মা কিংবা স্ত্রীরা আমাদের মায়ের খুব কাছের মানুষ ছিলেন। তাদেরকে মা খুব ভালোবাসতেন, তারাও আমার মাকে খুব সম্মান করত। কিন্তু হুমায়ুন আহমেদ মারা যাবার পর তাদের কাছে আমার মায়ের প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছিল। হুমায়ূন আহমেদ আর নতুন পাণ্ডুলিপি দিতে পারবে না, সে নেই তাকে খুশি করার জন্যে তার মাকেও খুশি রাখার প্রয়োজন নেই। বরং তাকে অপমান করে অন্য কাউকে খুশি করতে পারলে তাদের জন্যে সেটাই মঙ্গল। আমার সামনে তারা যেভাবে আমার মায়ের অসম্মান ছিল তার একটি প্রসঙ্গ এখানে উল্লেখ করে।
পৃষ্ঠা:০৩
মা প্রায়ই হুমায়ূন আহমেদের দুই ছেলে নিষাদ-নিনিতকে দেখার জন্যে খুব ব্যাকুল হতেন। হুমায়ুন আহমেদ মারা যাবার কয়েক দিন পরই মায়ের অনুরোধে একদিন মাকে নিয়ে বাচ্চা দুটিকে দেখার জন্য ‘দখিন হাওয়া’য় যাই, সেটাই ছিল শেষ যাওয়া। সেখানে কথা প্রসঙ্গে আমেরিকায় হুমায়ূন আহমেদের চেয়ার থেকে পড়ে যাবার ঘটনাটি আসে। আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়, আমি এসব বিশ্বাস করি কি না? তথ্য জানা কিংবা অজানা থাকতে পারে কিন্তু সেটি বিশ্বাস করা বা না করার কিছু নেই। একটি সত্যি ঘটনা অবিশ্বাস করলেই সেটি ‘নাই’ হয়ে যায় না, আবার যে ঘটনাটি ঘটে নাই সেটা বিশ্বাস করলেই সেটা ঘটে যায় না। হুমায়ুন আহমেদকে হাসপাতালে ভর্তি করার সময় চেয়ার থেকে পড়ে যাবার ঘটনাটি ডাক্তারদের বলা হয়েছিল, সেটি হাসপাতালের কাগজপত্রে উল্লেখ আছে (পরিশিষ্ট ২) কাজেই সেটা বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাস করার প্রশ্নটি কেন আসছে? এটি তো ইচ্ছাকৃত ছিল না, এটি ছিল একটা দুর্ঘটনা। বরং ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা অস্বীকার করা হলেই সবাই কিছু একটা সন্দেহ করতে থাকে। আমি এরকম কিছু একটা বলার পর আমাকে একজন প্রকাশকের স্ত্রী বললেন, ‘আপনি আমেরিকায় গিয়ে চেয়ারটা ধরে বসে থাকেননি কেন?’ শুধু তাই নয়, পরিবেশটি যখন অত্যন্ত অপমানজনক হয়ে উঠল, আমি তখন আমার মাকে নিয়ে চলে আসতে চাইছিলাম কিন্তু তারা মাকে উঠতে দিচ্ছিল না। প্রতিবার ওঠার সময় জোর করে ধরে আমার দুর্বল, অসুস্থ এবং বৃদ্ধা মাকে টেনে বসিয়ে দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে তাকে আক্রমণ করে যাচ্ছিল, যে ভাষায় তাঁর সাথে কথা বলেছিল সেটা আমার পক্ষে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। আমার মা তাদের সবার সম্পর্কে এ বইয়ে স্নেহার্দ্র কথা লিখে গেছেন, তার সাথে ভূমিকায় এই একটি-দুটি সত্যি কথা লেখা থাকলে ক্ষতি কী?
পৃষ্ঠা:০৪
বইটির পাণ্ডুলিপি তৈরি হবার পর মায়ের একজন খুব প্রিয় এবং প্রতিষ্ঠিত প্রকাশককে আমরা বইটি প্রকাশের দায়িত্ব দিই। আমাদের ধারণা ছিল, মায়ের বই প্রকাশ করতে পেরে তিনি খুব আনন্দিত হবেন। কিন্তু আমাদেরকে বিস্মিত করে তিনি পাণ্ডুলিপি ফেরত দিলেন। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে জানালেন তাঁর পক্ষে এটি প্রকাশ করা সম্ভব না। শেষ পর্যন্ত বইটি প্রকাশিত হচ্ছে, তাম্রলিপির স্বত্বাধিকারী তারিকুল ইসলাম রনি আগ্রহ নিয়ে বইটি প্রকাশ করেছে। বইটির সার্বিক দেখাশোনা ও সম্পাদনায় আমাকে সাহায্য করেছে আমার ছোট ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। সবাইকে মহান একুশের শুভেচ্ছা। সুফিয়া হায়দার।
পৃষ্ঠা:০৫
আমার এত আদরের বাচ্চাটি আমাকে ছেড়ে তুমি কোথায় গেলে? বাবা, তোমার কি একবারও মনে হয় নাই যে তোমার একটা দুঃখী মা আছে, একটা সুন্দর দেশ আছে, তোমার ভাই-বোনগুলো তোমার আশায় দেশে অপেক্ষা করছে। দেশের মানুষ তোমাকে কী-ই না ভালোবাসে! তোমার ফুলের মতো বাচ্চাগুলোকে রেখে চলে যেতে তোমার কষ্ট হয় নাই? আমি বুকভরা আশা নিয়ে বসেছিলাম যে তুমি আবার ফিরে আসবে। আল্লাহ্ তোমাকে এত কষ্ট দিয়েছে, এখন নিশ্চয়ই তোমাকে দিয়ে এমন কোনো কাজ করাবে যা আমরা চিন্তাই করতে পারি না। এত দীর্ঘদিন থেকে তোমরা বাইরে। কী কষ্ট! আহা কী কষ্ট! একদিকে মা, অন্যদিকে ছেলে, মাঝখানে একটা পৃথিবী, এর থেকে বড় কষ্ট বুঝি আর কিছু নাই। এক-একসময় মনটা বড় অস্থির হয়ে পড়ত। কারো সাথে তখন সেটা নিয়ে কথা বললে আমাকে বোঝাত, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ হাসপাতালে বড় বড় সব ডাক্তার চিকিৎসা করছে। তা ছাড়া আপনার ছেলের ভাগ্য খুব ভালো, দেখবেন একদম সুস্থ হয়ে ফিরে আসবে। এ রকম কথা শুনলে মনটা শান্ত হতো। কিন্তু যেদিন তুমি আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে যাবে সেদিন দেখি আমি কিছুতেই শান্তি পাই না। কী যে কষ্ট হচ্ছে-তখন আমি ইকবালকে ফোন করলাম। সে বলল, “চিন্তা করবেন না। দাদা ভাই ভালোই আছে। আমার মতো।” শোনার পরও মনটা ভালো হয় না। ছটফট করি।
পৃষ্ঠা:০৬
একটু পরেই বউমা ফোন করল, তার গলাটা শুনে আমার মনটা একটু শান্ত হলো। তাকে সব বিস্তারিত বলতে বললাম। বউমা বলল, “আম্মা, দাদা ভাইয়ের হার্টফেল করছে।” তারপর ব্লাড প্রেসারের কী সব সংখ্যা বলছে আমি আর কিছু শুনতে পারি না। আমি কোনোমতে ফোনটা শাহীনের হাতে দিলাম, মনে হলো শরীরটা বুঝি অবশ হয়ে যাচ্ছে। অন্য সময় অস্থির লাগে, মনে হয় সারা গা থেকে গরম ভাপের মতো কিছু বের হয়ে যাচ্ছে, এখন মনে হলো আমার শরীর থেকে হিমশীতল কিছু একটা বের হয়ে যাচ্ছে। আমার জ্ঞান আছে, আমি বুঝতে পারছি, বাবা, এই হচ্ছে তোমার চিরবিদায়। বারডেমে আমি যখন কফিন খুলে তোমার মুখের সাথে আমার মুখটা লাগিয়েছিলাম, তখন আবার আমি সেই আগের হিমশীতল ভাবটা অনুভব করেছিলাম।
বাবা, মৃত্যুর জন্যে কতকাল থেকে আমি অপেক্ষা করে আছি। মৃত্যুর পর তোমার আব্বার সাথে দেখা হলে বলব তোমার হিসাব সব ঠিক আছে। তোমার গণনা আমি এখন বিশ্বাস করি। তুমি যা যা বলেছিলে আল্লাহ সব করেছে, শুধু তুমি দেখো নাই। আমার আর বলা হলো না। বাবা, তোমার কেমন লেগেছে পৃথিবী ছেড়ে যেতে? তোমার একটা লেখায় এ রকম ছিল, আড্ডাটা ঘুরে বেড়াচ্ছে। আসলেই কি তাই? তোমার কি খুব কষ্ট হয়েছিল? তুমি বলতে আল্লাহ্ তোমাকে সাজা দিতে পারবে না। মৃত্যুর পর মনকির-নাকির আসলে তুমি প্রথম তাদের বলবে, তোমরা একটু অপেক্ষা করো। আমি আগে একটু বিশ্রাম করি, আমার এখানে আসতে কষ্ট হয়েছে। তারপর তুমি আল্লাহকে বলবে, আল্লাহ্ তুমি আমাকে সাজা দিতে পারবে না, কারণ আমি তো নিজে থেকে পৃথিবীতে আসবে নাই। তুমি আমাকে পাঠিয়েছ। এখন তুমি
পৃষ্ঠা:০৭
আমাকে কেন সাজা দিবে? সত্যি কি বলতে পেরেছ? তোমার আব্বার সাথে কি দেখা হয়েছে? তুমি যখন ছোট ছিলে তখন সে তোমাকে “বাচ্চুনী বড় ব্যাটা” বলে ডাকত, সে কি তার বাচ্চুনী বড় ব্যাটা হুমায়ূনকে দেখে চিনতে পারল? আহা-সব যদি জানতে পারতাম! বাবা, তুমি কি খুব হাসছ? তোমার আম্মা বই লিখছে তাই? না বাবা, আমি মোটেও বই লিখছি না। তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করে, তোমার কথা শুনতে ইচ্ছা করে। তাই এই সব করি। আমার সত্যিকারের হুমায়ূন হারিয়ে গেছে, কিন্তু আমার আত্মার সাথে জড়িত যে হুমায়ূন সে আছে, সে থাকবে। তার সাথে মনে মনে কথা বলার চেষ্টা করি। সময়টা তখন কেটে যায়। তোমার আঁকা ছবি দেখে সবাই খুব অবাক হয়। সবাই বলে, এত প্রতিভা ছিল একটা মানুষের! তোমার যে রকম অনেক আঁকা ছবি আছে, আমারও সে রকম একটা ছবি ছিল, তুমি আমার সেই ছবিটা নষ্ট করে দিলে। আমার ছবিটা এ রকম
মনে করো, আমি মারা গেলাম। হয় হাসপাতালে না-হয় বাসায়। সংবাদটা পেয়ে তুমি কী করবে জানো? প্রথমেই তুমি বলবে এক কাপ চা। চা খেতে খেতে বলবে, দীর্ঘদিন পর একটা কষ্টের জীবনের অবসান হলো। তারপর তুমি হয়তো লিখতে বসবে কিন্তু লিখতে পারবে না। তখন তুমি উঠে দেখবে কে কী করছে, দেখবে মেয়েরা কাঁদছে। বউরা কাঁদছে। তুমি নিজেও হয়তো একটু কাঁদবে। তোমার তখন মনে পড়বে তুমি সব সময় আমাকে বলতে, “আপনি বেঁচে থাকতে থাকতেই আপনার কুলখানিটা করে ফেলি, আপনি দেখে যান।” আমি বলতাম, “করে ফেলো। তোমার যা খুশি।” তুমি হা হা করে হাসতে, হেসে বলতে, আপনি মারা গেলে -আমি কিন্তু কাঁদা না। আশি বছরের বৃদ্ধা মা, তার মৃত্যুতে
পৃষ্ঠা:০৮
কাঁদার কী আছে?” আমি বলতাম, “ঠিক আছে, কিন্তু আমার লাশটাকে কিন্তু বারডেমে ফেলে রেখো না। যেটাই করতে চাও তাড়াতাড়ি করে ফেলো।” ততক্ষণে নিশ্চয়ই সিলেট থেকে ইকবালও এসে হাজির হয়ে যাবে। আমার কবর খোদা শুরু হবে, তোমার যে রকম স্বভাব সে অনুযায়ী একটা সিগারেট মুখে দিয়ে এ মাথা থেকে ও মাথায় হাঁটবে। আমাকে কবরে নামানো হবে, ইকবাল মাথার দিক ধরবে, শাহীন পায়ের দিক। দুজনে যদি না পারে তাহলে নূরুন্নবীরাও হয়তো সাহায্য করবে। তারপর সবাই হাত তুলে আল্লাহ্র কাছে দোয়া করবে। নাতিরা ঘোরাঘুরি করবে, মুখ শুকনো করে বলবে, “এটা দুঃখের জায়গা, এখানে হাসাহাসি করা যাবে না।” একটু পরে নিজেরাই সেটা ভুলে কোনো কিছু নিয়ে হেসে কুটি কুটি হবে।
কবর দেয়া শেষ হলে সবাইকে নিয়ে বাসায় এসে ভাই- বোনদের বলবে, “দীর্ঘ জীবন শেষ করে সময়ের মৃত্যু। এই মৃত্যুর জন্যে কাঁদা ঠিক না। মনে কর আম্মা বেঁচে আছেন। আম্মা না হয়ে আমাদের কারো কিছু হলে আম্মা কি কষ্ট পেতেন! কাজেই কেঁদে- টেদে লাভ নেই। তার চেয়ে চল সবাই মিলে কোথাও থেকে ঘুরে আসি। তোরা ঠিক কর কোথায় যাওয়া যায়। আমি নিয়ে যাব।” কেমন ছবিটা? সুন্দর না? আমি মনে মনে এই ছবিটা ঠিক করে রেখেছিলাম। তুমি আমার এই ছবিটা নষ্ট করে দিলে। এই ছবিটা আর কোনো দিন সত্যি হতে পারবে না। বাবা, এখন তোমার এই দুঃখী মা’টা বসে ভাবে, আমার মাসুম নাতি দুটো কাকে দেখবে? তাদের এত আদরের বাবাটা কোথায় চলে গেল? কেন হঠাৎ করে ‘নাই’ হয়ে গেল? আমি তো দিন-রাত হাত উঠিয়ে আল্লাহ্র কাছে দোয়া করেছি, বলেছি, খোদা তুমি অন্তত এই মাসুম দুটি বাচ্চার জন্যে তাদের বাবাকে বাঁচিয়ে রেখো। ওদেরকে
পৃষ্ঠা:০৯
তুমি খুশি হয়ে দিয়েছ, এখন তুমি ওদের কষ্ট দিয়ো না। মায়ের দোয়া নাকি আল্লাহ্ কবুল করে। মানুষের মুখে এই কথা শুনেছি। সবাই এই কথা বলে। আমি বাবা জেনে-শুনে তো কোনো ভুল করি নাই। আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য যত খতম আছে সব পড়েছি। নিজে পড়ে আবার মনে হয় কে জানে কোথাও কী ভুল হয়েছে? তখন আবার মৌলবি দিয়ে পড়িয়েছি। প্রথম দিন থেকে ছদকা দিয়েছি। ছাগল দিয়েছি, গরু দিয়েছি, মুরগি তো প্রায়ই দিতাম। সাতটা সুস্থ- সবল মুরগি দিয়েছি একসাথে। শুনেছি একসাথে সাতটা সদকা দিলে আল্লাহ্ দয়া করেন। আমি মনে হয় সত্যিকারের মা হতে পারিনি। যদি হতে পারতাম তাহলে হাসপাতালও ঠিক থাকত, ডাক্তারও ঠিক থাকত। দোয়া-কালামও সব ঠিক হতো। আমার শুধুই ভুল। তোমার যখন শেষ অপারেশন হচ্ছে তখন আমি এক বৈঠকে ১০৪ রাকাত নামাজ আদায় করেছি। ওয়াক্তের নামাজ পড়তেই আমার কোমর ব্যথা হয়ে যেত কিন্তু এত রাকাত নামাজ পড়লাম কিছুই হয়নি। তখন মনটা খুশিতে ভরে গিয়েছিল, মনে হয়েছে আল্লাহ্ নিশ্চয়ই আমার দোয়া কবুল করেছেন।
মাজহার সব সময়ে তোমার সাথে ছিল। তার সংসার, দুটি বাচ্চা, ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছু ফেলে রেখে তোমার সাথে ছিল। তার এই চেষ্টার কৃতজ্ঞতা শোধ করার ক্ষমতা আমার নাই, মহান আল্লাহ্ তার প্রতিদান নিশ্চয়ই একদিন তাকে দিবেন। মাজহারের স্ত্রী স্বর্ণাও অসাধারণ একটি মেয়ে। যখনই আমি তাকে ফোন করেছি তখনই যখন যা খবর ছিল সব আমাকে দিয়েছে। আমার ধারণা ছিল এত দরদি একটা মেয়ে তার দোয়া আল্লাহ্ নিশ্চয়ই কবুল করবেন। প্রতীকের মাও কত কী যে করেছে, দোয়া-দরুদ খতম নিজে
পৃষ্ঠা:১০
পড়েছে, মাওলানাদের দিয়ে পড়িয়েছে। যখন সে দোয়া-দরুদ পড়েছে তখন আমাকেও পড়তে দিয়েছে। আমি ভাবতাম তার দোয়া আল্লাহ্ বিফল হতে দেবেন না। আমার ধারণা ছিল, আমি মা, আমার তো স্বার্থ আছে। আমার ছেলের এত নাম, এত সম্মান আমি তো তার ভাগ পাই। তাদের তো কোনো স্বার্থ নেই, তাদের পুরোপুরি নিঃস্বার্থ দোয়া আল্লাহ্ নিশ্চয়ই কবুল করবেন। মাজহারের মাও তোমাকে কী গভীরভাবে স্নেহ করেন। সারাক্ষণ আল্লাহ্র এবাদত নিয়েই আছেন, এই মহিলা যখন হাত উঠিয়ে দোয়া করবেন আল্লাহ্ তাকেও ফেরাতে পারবেন না। শুধু যে এঁরা আছেন তা তো নয়, সারা দেশের লক্ষ-কোটি মানুষ তোমার জন্য দোয়া করছে-এই লক্ষ-কোটি মানুষের মাঝে কি একটা মানুষও পবিত্র নেই? নিষ্পাপ নেই? তাদের কোনো একজনের দোয়া কবুল করে কি আল্লাহ্ আমার সন্তানটিকে সুস্থ করে ফিরিয়ে দেবেন না?
কিন্তু তুমি আর ফিরে এলে না। আচ্ছা বাবা, তোমার আব্বার সাথে কি তোমার দেখা হয়েছে? সে কি তার ‘বাচ্চুনী বড় বেটা হুমায়ূন কে দেখে চিনতে পেরেছে? সে কি তোমাকে দেখে খুশি হয়েছে? তোমার কি তোমার নানুর সাথে দেখা হয়েছে? আমি অসুস্থ ছিলাম বলে তোমার নানু মায়ের মমতায় বুকের দুধ দিয়ে তোমাকে পেলেছেন। আমার বাবা তোমাকে দেখতেন আর সবসময় বলতেন, খবরদার ওকে কেউ কিছু বলবে না, ওর যা খুশি হয় করুক। ওর ভাগ্যের কারণে ওর মা বেঁচে আছে। তোমার ভাগ্যের কারণে আমি যদি আজ বেঁচে না থাকতাম তাহলে এই পৃথিবীতে এখন আমি কি এত কষ্ট পেতাম? আমার অবস্থা দেখো, তোমার আব্বা গেল, আমার বাবা গেলেন, একজন
পৃষ্ঠা:১১
একজন করে তিনজন ভাই গেল, আমি বেঁচেই রইলাম। কী জন্যে বেঁচে রইলাম? আমার ছেলে এত জ্ঞানী-গুণী হবে, এত বই লিখবে, ছবি বানাবে, নাটক বানাবে, আমি সব দেখব-সেই জন্যে। আমার মতো এমন একজন নাদান মানুষের জন্য অপেক্ষা করেছে কত বড় সম্মান, কেননা আমি হুমায়ূনের মা। তুমি চলে যাবার পর, আমি একদিন ইকবালকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “ইকবাল, আমি কি এখনো হুমায়ূনের মা?” ইকবাল উত্তর দিল, “আমিও হুমায়ূনের ভাই।” এত মূল্যবান ছেলেটা কী করে এত সহজে হারিয়ে যায়? তারপরও তার মা কেমন করে বেঁচে থাকে? সুস্থ-সবল, একবার অজ্ঞান পর্যন্ত হয় না। আমি এই সব ভেবে কোনো কূল-কিনারা পাই না, কী করব আমি, বলো তুমি?
তোমার দাদা, দাদু, চাচাদের সাথে দেখা হয়? আমার খুব ইচ্ছে হয় যেন তোমাকে স্বপ্নে দেখি আর এই কথাগুলো জিজ্ঞেস করি। দেশ স্বাধীন হবার পর আমার মামাকে একদিন স্বপ্নে দেখেছিলাম। মামা কথা বলল না, আমি হাত ধরে রেখেছি, বলছি কথা না বললে ছাড়ব না। আমি জিজ্ঞেস করছি, “আপনাদের কী অবস্থা? কেমন আছেন? আপনাদের একজনের সাথে আরেকজনের দেখা হয়?” মামা বললেন, “আমাদের যার যে রকম কর্মফল সে সে রকম আছি। মাঝে মাঝে অন্যদের সাথে দেখা হয়।” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “বাবা কোথায় আছেন?” মামা বললেন, “ভাই সাহেব আমাদের অনেক উপরে আছেন।” আমি স্বপ্নের মাঝে জিজ্ঞেস করলাম, “আমাদের বাড়ির মেয়েদের ভিতর কে বেশি ধার্মিক? কে বেশি পবিত্র?”
পৃষ্ঠা:১২
আমি ভেবেছিলাম, আমার মায়ের কথা বলবেন। কিন্তু আমার এক চাচির কথা বললেন। সামাজিক মতে সেই চাচিকে খুব ভালো কেউ বলে না। বিয়ের পর নামাজ শিখেছেন। কোরআন শরিফ পড়া শিখেছেন। সেগুলো খুব নিয়মমতো পালন করেছেন। সূরা আর রহমান আর সূরা ইয়াসিন তার মুখস্থ ছিল। বয়স হওয়ার পর একসময় চোখেও দেখেন না, কানেও শুনেন না কিন্তু কখনো আল্লাহকে ডেকে বলেন না, “আল্লাহ্, তুমি আমাকে নাও।” আমার মনে হয় আল্লাহ যাকে যে অবস্থায় রেখেছে সে অবস্থা নীরবে মেনে নেয়াটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় কথা। এ ব্যাপারে তোমার কী মত সেটা আমি আর কোনো দিন জানব না। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, বাবা, তুমি কি আমার উপর রাগ করে গিয়েছ? তোমাকে একবারও স্বপ্নে দেখি না কেন? আমি যদি তোমার ওপর কোনো অন্যায় করে থাকি সেটা না জেনে করেছি। না বুঝে করেছি। তুমি আমার উপর রাগ করে থেকো না বাবা। তোমার অপারেশনটা আমার খুব ভয় লাগত। শাওনকে বলেছিও সেই কথা। সে আমাকে বুঝিয়েছে যে অপারেশনই একমাত্র শেষ চিকিৎসা। এটা করতেই হবে। দ্বিতীয় অপারেশন হবার পর খবর পেয়েছি, দু’দিনের দিন স্বপ্ন দেখি তুমি পড়ে গেছ। অজ্ঞান হয়ে গেছ। আমি দু’হাত পেতে ধরে আছি আর ‘মাজহার মাজহার’ বলে চিৎকার করছি। তখন আমার ঘুম ভেঙে গেল, দেখি আমার হাতগুলো ঠিক সেভাবেই আছে, যেন তোমাকে ধরে রেখেছি।
পৃষ্ঠা:১৩
শাওন আর তার মা সেঁজুতি-সবার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তারা তোমার কাছে ছিল। তুমি যখন অসুস্থ তখন তোমার সেবা-যত্ন করেছে। আমার খুব ইচ্ছা করত তোমার কাছে যেতে। সবাই আমাকে ভয় দেখাত। বলত, আমি গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে আরো বিপদ হবে। স্বর্ণা” এসে আমাকে বোঝাত তুমি নাকি আমাকে যেতে নিষেধ করেছ। ভিসা পাওয়াও নাকি কঠিন। প্রায়ই কমলকে জিজ্ঞেস করি, কিন্তু কিছু হয় না। এখন আর কোনো ভিসা লাগবে না। আমি বেঁচে থেকেও আমার অসুস্থ ছেলেটিকে গায়ে হাত দিয়ে দেখলাম না। কী খায় দেখলাম না। কেমো নিয়ে অসুস্থ শরীরে কীভাবে চলাফেরা করে, কিছুই দেখলাম না। অন্য সবাই দেখল। সেবা করল, যত্ন করল।
কেমন ছিলে বাবা তুমি? তোমার কি কখনো মনে হয়েছে যে আমার মা আমার পাশে আসুক। একটু আমার গায়ে হাত দিয়ে দেখুক আমি কেমন আছি। আমার বাচ্চা দুটিকে আমার মা একটু আদর করুক, আমি একটু দেখি। তোমার কি মনে হতো? তুমি তোমার নিনিতকে রোজ রাতে আমার কাছে দিয়ে যেতে। আমি তাকে বুকের কাছে নিয়ে শাস্তিতে ঘুমাতাম। নিষাদও তার দাদির জন্য পাগল ছিল। এখন জানি না কী করবে। তুমি যদি কখনো এসে বলতে, “এটা আমার ঘর” সে তোমাকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে বলত, “না! এটা আমার দাদির ঘর।” এই শিশু বাচ্চারা বাবা হারানোর এত বড় কষ্ট নিয়ে না-জানি কী করছে। কে জানে কোন পরিবেশে বড় হবে। হয়তো একদিন বলবে, “তার
পৃষ্ঠা:১৪
দাদি একজন বাজে মানুষ, তার জন্যে জাকাতের কাপড় পাঠায়।”” আর তার আদরের দাদি হয়তো হারিয়ে যাবে। আমি যদি শুধু বাচ্চাগুলোকে কাছে পেতাম, আমার ভালো লাগত, বুকটা ভরে যেত। আত্মাটা শান্তি পেত। নিষাদ বলত, “দাদি কেন এত দুষ্টু? আমার হাতে গোসল করতে চায় না।” সব তোমার শেখানো কথা। আহা! এই আদরের বাবাকে তারা আর কোনো দিন জানতে পারবে না। তারা জানবে বাবা মানে শুধুই ছবি। আহা! কী কষ্ট! কী কষ্ট! নোভাদের সাথে তোমার সম্পর্কের মাঝে একটা বড় দেয়াল উঠে গিয়েছিল। অভিমানে তারা খুব কষ্ট পেয়েছে, তুমি পেয়েছ আরো বেশি কষ্ট। বাবা, ভুলটা কিন্তু বেশি ছিল তোমার। তুমিও সেটা জানতে কিন্তু তোমার কিছু করার ছিল না। নোভা, তার ভাই- বোনেরা যদি যাওয়া-আসা করত তোমার নূতন সংসারে অশান্তি হতো। তোমার কাউকে কিছু বলার উপায় ছিল না। কষ্ট নিয়ে তুমি বেঁচে ছিলে আর আমি ছিলাম নীরব দর্শক। কিছু যে একটা করব সে বুদ্ধি তো আমার নাই।
রাশেদ চলে যাওয়ার পর নুহাশ তোমার খুব আদরের সন্তান ছিল। তাকেও তুমি কাছে পাও নাই। সেও তার এত প্রিয় বাবাকে পায় নাই। দুনিয়াটাতে অনেক বড় বড় দুঃখ, যখন সেগুলো কারো ঘাড়ে এসে পড়ে তখন আর কিছু করা যায় না। যেমন মনে করো মনির কথা, পরিবেশটা দেখেই সে অনুমান করেছে তুমি পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছ। সে তখন এসে এমনভাবে আমাকে
পৃষ্ঠা:১৫
জড়িয়ে ধরেছে, যেন সে আমাকে তার ছোট বুকের মাঝে ঢুকিয়ে আমার সব কষ্ট দূর করে দেবে। আমি তো তার মনের কথা বুঝতে পারি নাই, তুমি হয়তো বুঝতে পারতে। এমন একটা দুঃখী মেয়ে, সেও কত কষ্ট পায়। আর পাবে না-ই বা কেন? তুমি যদি এত কষ্ট পেয়ে দুনিয়া থেকে চলে যেতে পারো, যাকে শুধু সারা দেশের নয়, সারা পৃথিবীর বাঙালিরা ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে, সে যদি এত কষ্ট পায়, অন্যেরা তাহলে কেন পাবে না?
আল্লাহ্ বলেছেন, দশজন মানুষ যদি একজনকে ভালো মানুষ বলে তাহলে আল্লাহ্ তাকে মাফ করে দেবেন। আর কোটি কোটি মানুষ যাকে এত ভালোবাসে সে কেন এত কষ্ট পেয়ে গেল? আমার চোখের সামনে ভাসে যেন একটা জীবন্ত মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। কেমন না-জানি লেগেছিল তোমার বাবা। আমার এত আদরের বাচ্চাটা এত কষ্ট পেয়ে গেল? আমার চোখে এখন শুধু এসবই ভাসে। প্লেনে করে তোমাকে নিয়ে এলো, লাখ লাখ মানুষ তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে, কান্নায় ভেঙে পড়ছে। শহীদ মিনারের রাস্তা খালি করে আমাকে ধরে ধরে নিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে দেখলাম, ফুল দিয়ে তোমাকে ঢেকে রেখেছে। উপর থেকে তুমি কি দেখতে পেয়েছিলে তোমার জন্য তোমার দেশের মানুষের কত দরদ? তারপর শুরু হলো কোথায় তোমার কবর হবে সেই বিতর্ক। প্রথমে শুনলাম শাওন নিউ ইয়র্কে বলেছে কোথায় কবর হবে সেটি নিয়ে তুমি কিছু বলে যাও নাই, তাই দেশে গিয়ে পারিবারিক আলোচনা করে সেটি ঠিক করা হবে। এই আলোচনাটি অনেকেই শুনেছেন, তার মাঝে একজন অ্যাম্বাসেডরের স্ত্রী। শাওনের কথাগুলো রেকর্ড করতে চাইলে শাওনের মা বাধা দিলেন, রেকর্ড
পৃষ্ঠা ১৬ থেকে ৩০
পৃষ্ঠা:১৬
করা হলো না। প্লেনে করে যখন তোমাকে নিয়ে আসছে তখন দুবাই থেকে আবার আমাদের সাথে যোগাযোগ হলো। তখন মাজহার জানাল শাওনের মায়ের ইচ্ছা নুহাশ পল্লীতে সমাধি হবে। ঢাকায় এসে শহীদ মিনারে শাওন বলল, তার সাথে কথা হয়েছে তুমি নাকি বলেছ তোমাকে নুহাশ পল্লীতে কবর দিতে, না-হলে তোমার ভয় করবে। তুমি নাকি জানতে তুমি মারা গেলে তোমার লাশ নিয়ে টানাটানি হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। বাবা, তুমি যদি বলে থাকো তাহলে এভাবে বলা ঠিক হয় নাই। তোমার ভাই-বোন কখনোই তোমার কথার অবাধ্য হবে না। তুমি তো জানো তারা তাদের বড় ভাইকে বাবার সম্মান দিয়েছে, আরো দিবে। তুমি যখন জীবিত ছিলে, কিংবা যখন মারা গিয়েছ দেশের মানুষ সব সময়েই তোমাকে শ্রদ্ধা করেছে, ভালোবেসেছে। তুমি নাকি বলেছ তুমি বুদ্ধিজীবীদের কবরস্থান পছন্দ করো না কিন্তু তুমি নিজেই তো বুদ্ধিজীবী। তুমি নাকি বলেছ তুমি বনানী কবরস্থানও পছন্দ করো না, তুমি যেখানে যাচ্ছ সেখানে তো তুমি ইলেকশান করবে না, গানের জলসাও করবে না। আর যাই হোক তোমার শেষ কথাটি তো এক রকম হবে, এটি তিন রকম হলো কেন?
শাওন আমাকে বলেছে, জীবনে তো কিছু করতে পারলেন না, শেষ সময়ে কিছু করেন, অর্থাৎ নুহাশ পল্লীতে যেন তোমার কবরের ব্যবস্থা করে দিই। জীবিত অবস্থায় যে বিরাশি বছরে কিছু করতে পারল না, সেই অপদার্থ মানুষ শেষ সময়ে কী করবে? বাবা, তবে একটা খুব সত্যি কথা-তুমি যদি আমাকে বলেও যেতে যে আমার কবর হবে নুহাশ পল্লীতে, আমি কিন্তু তোমার কথা রক্ষা করতে পারতাম না। আমি সবার সামনে বলতাম, আমার ছেলে আমাকে
পৃষ্ঠা:১৭
বলেছে নুহাশ পল্লীর কথা, তবে আমার ইচ্ছা দেশের মানুষ যে শ্রদ্ধা-ভক্তি তাকে দেখিয়েছে তারা যেখানে তাকে কবর দিতে চায়, তারা যেটা ভালো মনে করে সেটাই হোক। আর আমি ধর্মভীরু মানুষ। সুযোগ-সুবিধা থাকলেই একজনকে একা একা কবর দিয়ে রাখতে হয় না, আত্মা কষ্ট পায়। তোমার আগে অনেক রকম পাগলামি চিন্তাভাবনা ছিল, তুমি বলতে পিরোজপুর থেকে তুমি তোমার আব্বার কবর এখানে তুলে নিয়ে আসবে, আমাকেও পাশাপাশি কবর দেবে ইত্যাদি ইত্যাদি। পরে আবার শুনেছি তুমি বলেছ নুহাশ পল্লীকে তুমি কবরস্থানও বানাতে চাও না আবার শান্তি নিকেতনও বানাতে চাও না; নুহাশ পল্লী যে রকম আছে সে রকম নুহাশ পল্লী থাকবে। তুমি বলতে তোমার ছেলেমেয়েদের বলে যাবে কেউ যেন এটা কখনো বিক্রি করে না, এটা যে রকম আছে সেভাবেই থাকবে। শেষবার নিউ ইয়র্ক ফিরে যাবার আগে তুমি সাংবাদিকদেরও তাই বলেছিলে, সে রকম রেকর্ডিংও আছে, আমি অন্তত তাই জানতাম।
অথচ যখন তোমাকে কবর দেয়ার সময় হলো তখন কোথায় কবর হবে সেটি নিয়ে কত রকম তর্ক-বিতর্ক। একসময়ে শুনতে পেলাম এটা কোর্টে মামলা করে নিষ্পত্তি করা হবে, যত দিন মামলার রায় না হবে তত দিন ডেড বডি বারডেমে থাকবে। তোমার ছেলে-মেয়েরা তাদের বাবাকে আর কষ্ট দিতে চায় নাই
পৃষ্ঠা:১৮
আসলে এই ব্যাপারটির পুরো দায়িত্ব ছিল তোমার ছেলে- মেয়েদের, অন্য কারো মতামতের কোনো দাম নেই, এমনকি স্ত্রীর মতামতেরও কোনো দাম নেই। এর মাঝে নিউ ইয়র্ক থেকে জাতিসংঘে বাংলাদেশের অ্যাম্বাসেডর আবুল মোমেন দেশে এসেছিলেন, আমার সাথে সেদিন দেখা করতে এলেন। আসলে আমার মতো নগণ্য একজন মানুষের সাথে তো দেখা করতে আসেননি, তিনি এসেছিলেন হুমায়ূন আহমেদের মায়ের সাথে দেখা করতে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করছিলাম, “হুমায়ূনের ডেড বডি আসতে এত দেরি হলো কেন?” তিনি বললেন, “টিকিটের সমস্যা হয়েছিল, সেটার সমাধান করতেই দেরি হয়েছিল।” আমি জিজ্ঞেস করছিলাম, “হুমায়ূন চেয়ার থেকে পড়ে গিয়েছিল এ রকম একটা কথা শোনা যায়, সে সম্পর্কে আপনি কি কিছু জানেন?” তিনি বললেন, “তার বাসায় আমার এক বন্ধুই চেয়ার থেকে পড়ে গিয়েছিল, তখন তহুরা আলী বলেছিলেন, হুমায়ূন সাহেবও ঠিক এভাবে চেয়ার থেকে পড়ে গিয়েছিল।” আমি বললাম, “শুধু কি একটা চেয়ারের পা একটু সরে গিয়েছিল নাকি সত্যি সত্যি পড়ে গিয়েছিল?” অ্যাম্বাসেডর সাহেব বললেন, “হুমায়ূন সাহেব একেবারে লম্বা হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। মাথায় লাগলে ক্ষতি হতো।”
তারপরই জানতে পারলাম অপারেশনের পর বাসায় গিয়ে তুমি চেয়ার থেকে পড়ে গিয়েছিলে। তখনই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়নি। সারাদিন গেল, রাত গেল, তোমার ব্যথা শুরু হলো, প্রচণ্ড ব্যথা, তুমি ব্যস্ত হয়ে পড়লে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবার জন্যে। মাজহার তখন তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল।
পৃষ্ঠা:১৯
যেহেতু তারাও জানে না কেন এমন হয়েছে, পড়ে গিয়ে নাকি অন্য কোনোভাবে-তাদের সাথে সাথে ভাক্তারদের সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত ছিল। তাদের কাছে নাকি জরুরি ফোন নাম্বারটা ছিল না। পরে বিশ্বজিৎ সাহার কাছ থেকে ফোন নম্বর নিয়ে যোগাযোগ করে। যেখানে পরে অপারেশন হয়, সেখানে তাদেরকে পড়ে যাওয়ার কথাটা বলা হয়নি, শাওন নাকি হাসপাতালে হাজিরও ছিল না। ইকবাল গিয়ে দেখে সিরিয়াস অবস্থা। সে অবশ্যি আমাকে ফোনে বলেছে, “ভালো আছে। বড় হাসপাতাল, বড় ডাক্তার, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।” মাজহারও টিভিতে সাক্ষাৎকারে বলেছে, “… মরণাপন্ন অবস্থার খবর সব ভুল। বিশ্বাস করবেন না কেউ। স্যার ভালো আছেন।”
অথচ তখন জীবন্ত মানুষটার নাকে নল, গলায় নল, চারদিকে যন্ত্রপাতি লাগিয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। জীবনের শেষসময়টায় কথাও বলতে পারে নাই। খাওয়া-খাদ্য পর্যন্ত ডাক্তারি মতে টিউব দিয়ে দিয়েছে। বাবা আমার, তুমি কী কষ্ট করে চিরবিদায় নিয়েছ। আমি সবকিছু শুনে শুনে এখন সব সময় কল্পনায় দেখি তোমার অসহায় চেহারাটা। এক সেকেন্ডের জন্যে ভুলতে পারি না। শান্তি পাই না। তোমার এই অসহায় চেহারাটা যদি সরে যেত, আমি শান্তি পেতাম। আমার ভাঙা ঘরে পূর্ণিমার চাঁদ কেমন করে থাকবে? তাই এত কষ্ট সহ্য করে চলে গেছ। আমি কী আশা নিয়ে বসেছিলাম! পৃথিবীর সেরা হাসপাতালে সেরা ডাক্তারের চিকিৎসা, দেশের কোটি কোটি মানুষের দোয়া-এতকিছু কি বৃথা যেতে পারে! বুকভরা আশা নিয়ে বসেছিলাম। কত ছদকা দিয়েছি, কত খতম পড়েছি বাবা তোমার জন্য। কিছু হলো না বাবা, কিছু হলো না।
পৃষ্ঠা:২০
একাত্তরে পাকিস্তান মিলিটারিরা তোমার আব্বাকে মেরে নদীতে ডেড বডি ফেলে দিয়েছিল, তোমার বাবা তিন দিন পানিতে ভেসে ছিল। তুমিও তিন দিন ঘুরে বেড়িয়েছ। তোমার আব্বার সাথে দেখা হয়েছে? সে তার বাচ্চুনী বড় বেটার সাথে দেখা করেছে? তোমাকে চিনতে পেরেছে? তুমি কি চিনেছিলে তোমার এত আদরের দুঃখী বাবাকে? জানি না আমি কবে জানব তোমাদের এই জগৎটার কথা। বাবা মানিক আমার, তুমি কি কষ্টে আছ নাকি আরামে আছ? তুমি কি আমার ওপর অভিমান করে গিয়েছ? একদিনও তোমাকে স্বপ্নে দেখলাম না। কত আশা করে ঘুমাই রাতে আমার বাচ্চাটাকে একটু দেখব। দেখা হয় না বাবা। আমি যদি কোনো ভুল করে থাকি আমার ওপর রাগ পুষে রেখো না বাবা, আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো।
গতকাল নুহাশ পল্লী গিয়েছিলাম। কত মানুষ যে আসছে চিন্তা করা যায় না। আমার যে বাবাটাকে মানুষ এত ভালোবাসে আল্লাহ্ তাকে কেমন করে এভাবে উঠিয়ে নিল? তোমার কষ্ট হয় নাই? যে নুহাশ পল্লীতে তোমার সাথে যেতাম, কী আনন্দ হতো, কী খুশি হতাম, এত বড় জায়গা যে দেখলেই মন ভরে যেত, সেই জায়গায় এখন সবাই কাঁদতে কাঁদতে গেলাম। আবার কাঁদতে কাঁদতে ফিরে এলাম। চার-পাঁচজন কোরআনে হাফিজ এসেছিলেন কোরআন খতম করে কবর জিয়ারত করতে। শুধু হাফিজ নয়, মৌলবি, মুন্সি, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান কেউ বাকি নেই। সবাই তোমাকে এত ভালোবাসে। কী জাদু তুমি জানতে বাবা? তোমার জন্মের পর একটা খুশির বন্যায় ভেসে গেছি। আমাদের পূর্বপুরুষের আমলে যত মালী, তেলী, ধোপা, নাপিত থাকত পরিবারে কোনো সন্তান হলে তারা এসে নাচ-গান করে বকশিস নিত। তোমার জন্মের সয়লাও তাই হলো।
পৃষ্ঠা:২১
আমার শাশুড়ি আমাকে বলতেন, “বউমা, ছেলের মুখের দিকে তাকিও না, মা-বাবার নজর লাগে। ফয়জুর রহমান তো কথা শুনবে না-তারপরও তুমি ওকে নিষেধ করবে।” আমার মেজ চাচা-শ্বশুর একদিন বেশকিছু কাগজপত্র হাতে করে নিয়ে এসে বলেছেন, “ভাই সাহেব, আমাদের বংশে সবসময় প্রথম সন্তান পুত্র-সন্তান হয় বারো প্রজন্ম থেকে হচ্ছে। হুমায়ূন হচ্ছে বারো নম্বর। এই পরিবারের এটাই বিশেষত্ব।” তোমার বেলা থেকে সেটি শেষ, তোমার প্রথম সন্তান কন্যা- সন্তান, নোভা। নোভার জন্মের আগে ভাই-বোন সবাই মিলে মিটিং করত, বাচ্চাটা যদি কালো হয় তখন কী হবে? আমি বলতাম, কী হবে? সবাই তখন বলবে মেয়েটা তার দাদির মতো হয়েছে।
নিষাদের জন্মের পর একদিন তুমি আমাকে বললে, “আম্মা, সবাই বলছে নিষাদ দাদির রং পেয়েছে।” আমি অবাক হয়ে বললাম, “সেকি! জীবনভর শুনলাম কালো বউ। আজ আমি হঠাৎ নিষাদের মতো ধবধবে ফর্সা কেমন করে হলাম?” তুমি হেসে বললে, “আপনাকে হাসপাতালে রেখে রেখে ফর্সা করে ফেলেছি।” নিষাদের জন্মের পর একদিন আমাকে বললে, “টিংকু বাচ্চাটা মানুষ করবে? সবাই তো বাচ্চাকে মানুষ করতে পারে না।” আজ এসব কথা মনে পড়ে আর ইচ্ছে করে আমার আদরের বাচ্চাটা চলে আসুক, একটু দেখি সে কেমন আছে তার জগতে। তোমার বাবার সাথে তোমার বিচিত্র স্বভাবের কথা নিয়ে আলাপ করতাম। বলতাম, “তোমার ছেলেটা সারাদিন কোথায় কোথায় ঘুরে?”
পৃষ্ঠা:২২
তোমার বাবা বলত, “জানো, প্রমথনাথ বিশীও এমন ঘুরে বেড়াত বিখ্যাত একজন লেখক। তোমার ছেলে নিশ্চয়ই বিখ্যাত লেখক হবে।” আবার বলতাম, “দেখো, আজ সারাদিন চিৎকার করছে বাসার গাছের কাঁঠালগুলো পেড়ে ফেলি না কেন? ছোট থাকতে পেড়ে ফেললেই তো লিচু হয়ে যাবে।” তোমার বাবা শুনত আর হা হা করে হাসত, “বলতো, তোমার ছেলের কত বুদ্ধি!” এত দিন পর সব কথা মনেও নাই। সিলেটে একবার দুর্ভিক্ষের অবস্থা, লঙ্গরখানা খোলা হয়েছে। সেই লঙ্গরখানায় তুমি প্রায়ই খেতে যেতে। একদিন শেফুকেও নিয়ে গেছ। দুজন মাটিতে কলাপাতা পেতে খেতে বসেছ, তখন একজন পুলিশ দেখে চিনে ফেলেছে, দৌড়ে এসে বাসায় খবর দিল। আমি কম বুদ্ধির মানুষ, শুনে খুব রাগ করেছি আর তোমার আব্বা শুনে হা হা করে হাসছে। বলছে, “কী হয়েছে তাতে? যারা খাচ্ছে ওরাও তো আমাদের মতো মানুষ।”
আমি জানতে চেয়েছি, লঙ্গরখানায় খেতে ইচ্ছা হলো কেন? তুমি বললে, কলাপাতায় যখন খিচুড়িটা ঢেলে দেয় তখন সেটা কেমন জানি ছড়িয়ে যায়, দেখতে বেশ লাগে। তা ছাড়া জিনিসটা খেতেও অনেক ভালো। তোমার আব্বা বলল, “দেখেছ, সবাই খায়, কিন্তু খিচুড়ি ছড়িয়ে যাবার মাঝে যে একটা আর্ট আছে সেইটা তোমার ছেলে ছাড়া আর কেউ বুঝে না। সব সময় মাথায় রাখো, তুমি একজন বিখ্যাত ছেলের মা হবে।” তখন কুমিল্লায় থাকি। বিশাল দোতলা বাসা, পাশে বিশাল পুকুর, আশপাশে সুনেকগুলো ছোট ছোট ঘর, তার একটিতে হাঁস-
পৃষ্ঠা:২৩
মুরগি থাকে। এগুলো আমি বেশ আগ্রহ করে পালি, রোজ ভোরবেলা গিয়ে দেখি ডিম পেড়েছে কি না। তুমি তখন ঢাকা কলেজে পড়, একবার ছুটিতে বাসায় এসেছ। তখন হঠাৎ একদিন ভোরে গিয়ে দেখি সবগুলো হাঁস ডিম পেড়েছে। আমি তো মহাখুশি। সবাইকে ডেকে ডেকে বলছি, দেখো, সবগুলো হাঁস ডিম দিয়েছে। তোমার বাবা শুধু মুচকি মুচকি হাসে। একসময় তোমাকে ডাকল, “বাবা শুনতো।” তুমি ভয়ে ভয়ে কাছে গেলে, বাবাকে মনে হয় একটু ভয়ও পেতে। ভাবছিলে বুঝি বকা দেবে। বাবা বকা দিল না, বলল, “ধুর, বোকা ছেলে! ডিম যখন রাখবিই দুই-একটা পচা ডিম রেখে দিতে পারলি না?” তারপর হা হা করে সে কী হাসি।
শিখু সবসময় আমাকে বলে আমি নাকি মহা বোকা-আগেও ছিলাম, এখনো আছি। আমার মনে হয় সে ভুল বলেনি, আসলেও তাই। আমার মনে আছে, বহুদিন আগে তুমি তখন ছোট, একবার মোহনগঞ্জ গিয়েছি। মা শবে বরাতের রোজা রাখবেন। সেটা শুনে তুমি বললে তুমিও রাখবে। তুমি যেহেতু রাখবে তাই বাড়ির সবাই ঠিক করল তারাও রোজা রাখবে। রীতিমতো হুলস্থুল কাণ্ড! হইচই করে রান্না করা হলো, সবাই মিলে সেহরি খাওয়া হলো। যেহেতু তুমি রোজা রেখেছ তাই ইফতারির বিশাল আয়োজন, সবাই মিলে ইফতারি তৈরি করছে। বেলা তিনটার মতো বাজে, তখন তুমি রেগেমেগে আমার কাছে এসেছ। এসে আমাকে বললে, “আপনি আমাকে কেন রোজা রাখতে দিলেন?” আমি অবাক হয়ে বললাম, “ওমা! তুমিই তো রোজা রাখতে চাইলে!” তুমি আরো রেগে বললে, “আমি চাইলেই আপনি রাখতে দিবেন কেন?”
পৃষ্ঠা:২৪
আমি বললাম, “আচ্ছা ঠিক আছে, আমার ভুল হয়েছে। এখন রোজা ভেঙে ফেলো।” তুমি বললে, “না। রেখেছি যখন এখন কেন ভাঙব?” আমার এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, চিকিৎসার জন্যে ঢাকা ছিল, সিঙ্গাপুর ছিল, অথচ তুমি গেলে আমেরিকায়। আমি কেন তোমাকে যেতে দিলাম? তুমি কি সেই ছোটবেলার মতো আমাকে বলতে চেয়েছিলে, “আমি না-হয় যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আপনি কেন আমাকে যেতে দিলেন?”
কত কথা মনে হয়। বারো-তেরো বছর বয়স তোমার। ক্লাস এইটে বৃত্তি পরীক্ষা দেবে। সে সময় হঠাৎ করে তোমার চিকেন পক্স হয়ে গেল। তোমার আব্বা তোমার স্কুলে গিয়ে সিক বেডে পরীক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করার জন্য বলেছিল, স্কুলের মাস্টার বিরক্ত হয়ে তোমার আব্বাকে বলেছিল, “আপনার ছেলের জন্যে আমাদের এত কিছু করার ব্যবস্থা করতে হবে কেন? আপনার ছেলে কি নদীয়ার চাঁদ নাকি?” তোমার আব্বা বলেছিল, “হ্যাঁ, আমার ছেলে নদীয়ার চাঁদ।” তুমি সত্যিই যখন নদীয়ার চাঁদ হয়েছিলে, তোমার আব্বা সেটা দেখে যেতে পারে নাই।
আমি বাবা তোমাকে কত কষ্ট দিয়েছি। তোমার বাড়িতে একটা স্কুল করবে বলে তোমাকে কত বড় ঝামেলার মাঝে ফেলে দিয়েছিলাম, তুমি কিন্তু তারপরও আমার কথা রেখেছ। আমি তোমাকে বলেছিলাম, তোমার বাবা সেই ক্লাস টু থেকে অন্য মানুষের বাড়িতে জায়গির থেকে পড়াশোনা করেছে। আল্লাহ্ তোমাকে ক্ষমতা দিয়েছেন, তুমি এখানে একটা তৈরি করে এই এলাকার বাচ্চাদের।
পৃষ্ঠা:২৫
তোমার বাড়ি কুতুবপুরের মানুষ খুবই রসিক, স্কুলের কথা শুনে বলেছে, “হুমায়ূন আহমেদ স্কুল দেবে? কোথায়? মাথায়?” হুমায়ূন আহমেদ স্কুল মাথায় দেয় নাই, মাটিতেই দিয়েছে। প্রথমে ৫ লাখ টাকার জমি কিনেছে, প্রথমে একটা শহীদ মিনার তৈরি করে স্কুল আরম্ভ করেছে। সত্তর-আশি লাখ টাকা খরচ করে একদিন সত্যি সত্যি স্কুল তৈরি হলো। ঢাকা থেকে লোকজন স্কুলের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে গিয়ে অবাক হয়ে গেছে। তোমাকে বলেছে, “এই গণ্ডগ্রামে আপনি করেছেন কী?” সেই স্কুল চালু হলো, পাশে প্রাইমারি স্কুলের জমি আছে ঘর নাই। সেখানে ঘর করার জন্য তুমি দশ হাজার টাকা দিলে।
একবার তোমার স্কুলে গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সংবর্ধনা হলো। সেই সংবর্ধনায় কে কোন চেয়ারে বসবে সেটা নিয়ে বিশাল উত্তেজনা। নানা ধরনের কষাকষি। আমি ভেবেছিলাম তোমার নিজের বাড়ি, নিজের এলাকা, নিজেদের বাচ্চাকাচ্চারা স্কুলে পড়বে, সেখানে টাকা পয়সা দিয়ে না হোক অন্যভাবে সবাই সহযোগিতা করবে। হলো তার উল্টো, খবর পেলাম গ্রামবাসী মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এই স্কুল বন্ধ করে দিতে হবে। সবাই মিলে স্কুলে তালা দিয়ে দেবে। খবরটি যখন আমার কানে এসেছে আমি রেগে আগুন। গ্রামে খবর পাঠালাম, “ঠিক আছে তোমরা তালা দাও। আমি ওসিকে বলব সবগুলোকে অ্যারেস্ট করতে। শুধু যে অ্যারেস্ট করবে তা নয়, স্কুলটি হুমায়ূন আহমেদ অন্য সবার মতো নিজের বাবা কিংবা মায়ের নামে দেয়নি, সকল শহীদদের স্মরণে শহীদ স্মৃতি বিদ্যালয় নামে দিয়েছে
পৃষ্ঠা:২৬
আমি হুমায়ূনকে বলে রাখব এমন ব্যবস্থা করতে যেন কেউ জেল থেকে বের হতে না পারে।” আমার হুমকিতে কাজ হলো, কেউ আর তালা লাগানোর সাহস করল না। অনেক পর বাবা তোমাকে এইসব কথা বলেছি। আমি তোমাকে এটাও বলেছিলাম যে বাবা সবাই দান নিতে পারে না। আমি ভুল করে তোমাকে এই যন্ত্রণার মাঝে ফেলে দিয়েছিলাম। তুমি আমার কথা উড়িয়ে দিলে। বললে, “মানুষ তো ভুল করবেই। ফেরেশতা হলে হয়তো ভুল হতো না।” স্কুল চালু হলে তোমার একজন জার্মান বন্ধু দশটি ছেলেমেয়ের স্কলারশিপ দিল। তুমি স্কুলের খোঁজখবর নিতে। প্রতি ঈদে তুমি স্কুলে শিক্ষকদের কাপড় দিতে, পরে শুনতে পেলাম শিক্ষকদের এই কাপড় পছন্দ না। শার্ট তাদের গায়ে লাগে না। এই শার্ট খয়রাতি শার্ট, এক সেলাইয়ের শার্ট। তারা দরজি দিয়ে নূতন করে শার্ট তৈরি করবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কত যে যন্ত্রণা তার আর শেষ নেই।
শুধু স্কুল দিয়েই শেষ নয়, তুমি গ্রামের রাস্তা করে দিয়েছ। ইলেকট্রিসিটির ব্যবস্থা করে দিয়েছ, পোস্ট অফিস তৈরি করে দিয়েছ সেখানে আবার তিনজনের চাকরি হয়েছে, পোস্টমাস্টার, পিয়ন আর রানার। মসজিদটা ভেঙে গিয়েছিল, নূতন করে তৈরি করে দিয়েছ। দাদা-দাদির কবর বাঁধাই করে দিয়েছ। একসময় কুতুবপুরের পরিচয় হতো পাশের গ্রামটি দিয়ে, সবাই বলত কলসহাটির পাশের গ্রাম। এখন গ্রামটির পরিচয় তোমার নাম দিয়ে, সবাই বলে হুমায়ূন আহমেদের কুতুবপুর। তোমার বাবা বেঁচে থাকলে কী যে খুশি হতো। তার নিজের গ্রামের জন্য খুব দরদ ছিল। কী তার কপাল, সেই গ্রামে তার কবর ও হতে পারল না-এটাকেই নিম্ফামার
পৃষ্ঠা:২৭
একবার ইকবাল আমেরিকা থেকে দেশে এসেছে, তখন সবাইকে নিয়ে তুমি সেন্ট মার্টিনস বেড়াতে গেলে। জায়গাটা তোমার খুব পছন্দ হয়ে গেল, তুমি সেখানে বাড়ি তৈরি করলে। কবি-সাহিত্যিকেরা সেখানে বেড়াতে যাবে, ঘরের বারান্দায় বসে সমুদ্র দেখবে, গল্প, কবিতা, উপন্যাস লিখবে! এই একটা ছোট জীবনে তুমি কত কী করেছ! দখিন হাওয়ার বাড়িটা তৈরি করেছ, নুহাশ পল্লীটাও তৈরি করেছ।
তুমি যখন এস এস সি পাস করলে তখন আমাদের পরিচিত সবারই প্রথমবার পরীক্ষায় ফেল করাই একটা রীতি ছিল! প্রথমবার ফেল করার পর অভিভাবকেরা মাথা নেড়ে বলত, “বাবারে বাবা! এত বড় একটা পরীক্ষা, প্রথমবার ফেল তো হবেই।” সেই সময়ে তুমি রাজশাহী বোর্ডে সেকেন্ড হয়ে পাস করলে। আমাদের সবার কী আনন্দ! সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেয়েছিলেন তোমার দাদা। তাঁর আনন্দ দেখে গ্রামের মানুষ অবাক হয়ে জানতে চাইত, “এত আনন্দ কিসের জন্যে? কোনো রকম গুপ্তধন পেয়েছেন নাকি?” তোমার দাদা হাসতেন আর বলতেন, “হ্যাঁ। পেয়েছি। এটা এমন একটা ধন, যেটা কোনো দিন শেষ হবে না। শুকুর আলহামদুলিল্লাহ্।”
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের নামকরণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে এমন অবস্থা হলো যে বিশ্ববিদ্যালয়টাই বন্ধ হয়ে গেল। তখন তুমি ঠিক করলে ২৬ মার্চ তুমি সিলেট যাবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বসে অনশন করবে। তোমার সাথে অনশন করার জন্যে শুধু যে আমরা সবাই রেডি তা নয়, দেখা গেল সারাদেশের মানুষ রেডি। নির্দিষ্ট দিনে সবাই হইচই করে রওনা দিলাম-ট্রেনে অনেক মানুষ, শুধু তাই নয়, ট্রেন যেখানেই থামে সেখানেই মানুষ উঠে ট্রেন ভর্তি হয়ে গেল। ট্রেনে সবাই কথাবার্তা
পৃষ্ঠা:২৮
বলছে, তুমি চুপ করে আছ। একসময়ে আমার কাছে এসে বসে রইলে। এই সময় কোনো একজন এসে আমাকে বলল, “নুহাশ পল্লীর সুন্দর ছনের ঘরটা কারা যেন পুড়িয়ে দিয়েছে। ঘরের ভেতরকার জিনিসপত্র বেশি উদ্ধার করা যায়নি।” আমি তাকে বললাম, “চুপচাপ থাকো। এখন এমনিতেই একটা ঝামেলা নিয়ে যাচ্ছ, তার মাঝে নূতন এই ঝামেলার কথা হুমায়ূনকে বলে লাভ নেই।”
শেখ হাসিনার সরকার তখন খুব ভালো দায়িত্ব পালন করেছিল। হুমায়ূন আহমেদের যেন কোনো ক্ষতি না হয় সে রকম ব্যবস্থা নেবার নির্দেশ দেয়া ছিল। সরকার সেই দায়িত্ব খুব ভালোভাবে পালন করেছিল। জামায়াত-শিবির অনেক রকম বাধা দেয়ার চেষ্টা করলেও তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। দিনশেষে অনশন ভাঙার সময় অনেকে এসেছিল-আমার অবশ্যি অনশন ভাঙতে হয়নি, আমি সেদিন রোজা রেখেছিলাম। মনে আছে, তুমি হেসে হেসে সবাইকে বলছিলে, আমার এই বিচিত্র একটি অভ্যাস আছে। সুযোগ পেলেই রোজা রেখে ফেলা। সিলেট থেকে ফিরে এসে নুহাশ পল্লীতে ছনের ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়ার ঘটনাটি তুমি জানতে পারলে। আমাকে বললে, “আমাকে বলেননি কেন? আমাকে এতই দুর্বল ভাবেন?” আসলেই সে এত দুর্বল না, আমি যা সহ্য করতে পারি সে পারে তার চেয়ে অনেক বেশি। শম্পার বিয়ে ঠিক হয়েছে। তুমি বললে, “বিয়েতে যা যা করা দরকার সবকিছু করেন। ওদের মনে যেন কোনো কষ্ট না থাকে।”
পৃষ্ঠা:২৯
শম্পার বিয়ের পর অনেক দিন পার হয়েছে, তার বাচ্চা হবে। তোমার বাসার কাছে ক্লিনিক। আমাদের সবার খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা তোমার বাসায়। বউমা এই সবের দায়িত্ব খুব ভালোভাবে নিতে পারে কারো কোনো ঝামেলা নেই। মাঝেমধ্যে তুমি ক্লিনিকে গেলে রীতিমতো হইচই পড়ে যেত, “স্যার আসছে! স্যার আসছে!” সেই মানুষ কীভাবে হারিয়ে যায়? বাবা তুমি কোথায়? কেমন আছ? আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে, কোনো দিনই জানা হবে না।
শম্পার ছোটবোন টুম্পার বিয়েও একদিন খুব সুন্দরভাবে হয়ে গেল। একদিন আমার কাছে খবর এসেছে তার একটি মেয়ে হয়েছে। তুমি ঘুমিয়েছিলে, সন্ধ্যাবেলা ঘুম থেকে ওঠার পর আমি তোমাকে খবরটা দিলাম। শুনে তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করলে, “কখন যাবেন?” আমি বললাম, “আমি এখন কেমন করে যাব। নূতন বাচ্চার জন্যে কিছু কেনাকাটা করি তারপর যাব।” তুমি বললে, “না, না, এখনই যান। সবাইকে নিয়ে ঘুরে আসুন। কেনাকাটা পরে হবে। এখন যখন যাবেন সবাই কী খুশি হবে। সবাইকে যার যার বাসা থেকে তুলে এই রাতেই যাবেন।”
তোমার কথামতো সবাইকে যার যার বাসা থেকে তুলে রওনা দিলাম। গভীর রাতে ময়মনসিংহ পৌঁছেছি, আমাদের দেখে সবাই কী খুশি! কী খুশি! গিয়ে দেখি কী চমৎকার একটি বাচ্চা। আমাদের পরিবারের সবাই দেখতে মোটামুটি ভালো, এই বাচ্চাটি যেন তার ভেতরেও আলাদাভাবে সুন্দর। আমরা সবাই অবাক হয়ে দেখছি আর গল্প করছি। গল্প করতে করতে একসময়ে রাত কেটে ভোর হয়ে এলো।
পৃষ্ঠা:৩০
সেই টুম্পা তিন বছর পর তার ফুলের মতো বাচ্চাটিকে নিয়ে বাসচাপায় মারা গেল। কী কষ্ট। আহারে, কী কষ্ট! আবার সবাই মিলে গেলাম তাকে চিরদিনের জন্য বিদায় দিতে। একবার মাহবুব এসে বলল, “একটা বোন সম্মেলন হবে। কাছের বোন দূরের বোন মিলে আপনারা সব বোনেরা একত্র হবেন। সবাই চাঁদা দিবে তারপর হেভি একটা খাওয়া-দাওয়া হবে। সবাই রেডি হয়ে আছে, এখন আপনি রাজি হলেই শুরু করে দেয়া যায়।” তুমি শুনে বললে, “না না, চাঁদা কী জন্যে দেবে! আপনি সবার বড় বোন, সব দায়িত্ব আপনার। হিসেব করেন আপনারা কতজন বোন, সবার জন্যে শাড়ি কিনেন। কত বাজেট হয়েছে আমাকে বলেন।” তোমার উদ্যোগে সেই বোন মেলা হলো, যেসব বোনদের সাথে বহুদিন যোগাযোগ নেই সবাই চলে এলো। ভাইয়েরা আমাদের ঘটা করে খাওয়াল।
বোন মেলার পর বাড়ির সব বউদের অভিমান, তারা বলল, বোন মেলা হয়, আর আমরা তো পরের বাড়ির মেয়ে, আমাদের কিছু হয় না। তুমি শুনে বললে, সত্যিই তো! বোন মেলা যদি হতে পারে তাহলে বউ মেলা কেন হবে না? অবশ্যই বউ মেলা হবে এবারে! বাবা, এক জীবনে তুমি যে কত কিছু করে গেলে। বাবা, মনে হয় অনেক বেশি করে ফেলেছ, তাই চলে গেলে এত তাড়াতাড়ি। যখন আমার মা মারা গেলেন তখন ঢাকায় হরতাল। তার মাঝে মায়ের লাশ নিয়ে সবাই বাড়িতে গেলাম। হিন্দু-মুসলমান সবাই এসে ভেঙে পড়ল মা’কে শেষবার একনজর দেখার জন্য। তুমি
পৃষ্ঠা ৩১ থেকে ৪৫
পৃষ্ঠা:৩১
বললে, “বেঁচে থাকতে সারাজীবন পর্দা করেছেন, এখন মারা গেছেন, তাকে দেখতে দেয়া কি ঠিক হবে?” পরে যখন ব্যাকুল মানুষদের দেখলে তখন বললে, “না, মানুষের এত ভালোবাসা, এত শ্রদ্ধা- এটাকে সম্মান করতে হবে।” সবাই তখন আমার মা’কে একনজর দেখে গেল। মনে আছে যখন ফজলু মারা গেল তুমি আমাকে নিয়ে গিয়েছিলে কবর দেবার জন্য। লাশকে কবরে নামানোর সময় তুমিও কবরে নেমে গিয়েছিলে, আমি জানি তুমি নিশ্চয়ই ভয় পেয়েছিলে কবরে নামতে। যখন রাশেদ মারা গেল তখন তুমি বলেছিলে বাবার কাঁধে পুত্রের লাশ খুব ভারী। বাবা, মায়ের বুকে পুত্রের লাশ কেমন? নবীজির সময়ের একটা গল্প শুনেছিলাম, একজন লোক একটা ছাগল জবাই করে দেখে ছাগলের কলজেটায় একটা ছিদ্র। লোকটা নবীজিকে জিজ্ঞেস করল, “এমন কেন হলো?” নবীজি বললেন, “ছাগলটির একটা বাচ্চা মারা গেছে। বাচ্চার কষ্টে তার কলজেতে ছিদ্র হয়ে গেছে।” একটা পশু যদি সন্তানের জন্যে এত কষ্ট পায় তাহলে মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব, তাদের কষ্ট কত বেশি? খোদা, তোমার এই সুন্দর পৃথিবীতে সৌন্দর্যের জন্যে মানুষ সৃষ্টি করেছ, তাদের তুমি কেন এত কষ্ট দিলে? বাবা, তোমার বাদশাহ নামদার বইটাতে আছে, সম্রাট-পুত্র হুমায়ুনের অসুখ। তার চিকিৎসক বলেছেন, অসুখ সারাতে হলে বড় কিছু দান করতে হবে। হুমায়ুনের বাবা সম্রাট
পৃষ্ঠা:৩২
আমি অতি সামান্য মানুষ, তবু আশা করেছিলাম আল্লাহ্ আমাকে আমার সন্তানের মা তৈরি করেছেন, আমি যদি আমার নিজেকে উৎসর্গ করি, তাহলে কি আমার ছেলেটা সুস্থ হয়ে ফিরে আসবে না? এই আশা বুকে বেঁধে কতবার খোদার কাছে নিজেকে উৎসর্গ করেছি কিন্তু আমার ছেলেটা আর সুস্থ হয়ে ফিরে এলো না। আমার কাছে ফিরে আসতেও তো পারত। যাই হোক, খোদা, তোমার ইচ্ছা। একটা প্রবাদ আছে, বাদশাহ এবাদত করলে বাদশাহি খানা আসে আর ভিখিরি এবাদত করলে ভিখিরির খানা আসে। তাই বোধ হয় সত্যি, সম্রাট বাবর তার সন্তানের জন্যে নিজের জীবন দিতে পারে- আমি ক্ষুদ্র মানুষ, আমি চাইলেও পারি না। আমার ভেতরে শুধু একটা সান্ত্বনা, খোদার অনেক বড় নেয়ামত, তোমার পাশে সব সময় হৃদয়বান মানুষেরা ছিল। বাবা, খুব ছোট থাকতে তুমি একবার আমার একটা ঘড়ি ভেঙে রেখে দিয়েছিলে। আমি ভেবেছিলাম ঘড়িটা এমনিতেই বুঝি নষ্ট হয়ে গেছে। তুমি যে ভেঙেছিলে আমি জানতাম না। দুই বৎসর আগে তুমি আমেরিকা থেকে একটা ঘড়ি এনে আমাকে দিয়ে বললে, “এই যে এটা আপনার ঘড়ি।” আমি অবাক হয়ে দেখলাম ঘড়িটা আমার সেই নষ্ট হয়ে যাওয়া ঘড়িটার মতো! তুমি বললে, না, ঘড়িটা নষ্ট হয়নি, তুমি ভেঙে ফেলেছিলে! আমি বললাম, “তোমাকে তো কেউ কখনো শাসন করেনি। যদি কেউ শুনত তুমি একটা ঘড়ি ভেঙে ফেলেছ, তাহলে সবাই নিশ্চয়ই বলত, তুমি দেখতে চাইছ ঘড়িটার ভেতর কী আছে? দেখতে চাইছ ঘড়িটা কেমন করে চলে। তাহলে তুমি কেন এটা গোপন করেছিলে?” তুমি বললে, “ছোট ছিলাম তাই বুঝিনি। কে স্থানি বলতে ইচ্ছাকরেনি।” আমম
পৃষ্ঠা:৩৩
রাতে কত আশা নিয়ে শুতে যাই যে তোমাকে স্বপ্ন দেখব, দেখি না। গত কোরবানি ঈদে স্বপন বিরাট দুটো খাসি নিয়ে এসে বলল তার একটা দাদা (হুমায়ূন আহমেদের) নামে কোরবানি দিবে। আমি বললাম, “তোমাকে দিতে হবে না। আমিই দেব।” সে তার মতো করে আমাকে বলল, “আমরা তো কথা বলতে পারি না, অন্যদের মতো হাত উঠিয়ে দোয়াও করতে পারি না। তাই কোরবানিটা আমি দিব, তাহলে দাদা নিশ্চয়ই সুস্থ হয়ে যাবে।” এ রকম কত যে ঘটনা আছে আমি লিখে শেষ করতে পারব না। তুমি চলে যাবার পর কত যে শোকবার্তা এসেছে তার হিসাব নেই, আমি যতই দেখি ততই অবাক হই। আমার এত মূল্যবান ছেলেটা এত তাড়াতাড়ি হারিয়ে গেল?
তুমি যখন কিশোরী মোহন পাঠশালায় ভর্তি হও তখন তোমার একজন বন্ধু জুটেছিল, অস্বাভাবিক খাটো এবং শরীরের তুলনায় মাথাটা বড়, তাই তাকে ডাকতে মাথা বড় শংকর! তুমি তোমার বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে, সাথে শংকর থাকত। তখন মনে হয় ছেলেটা ক্লাস টুতে পড়ে। একদিন তুমি এসে বললে, শংকর বলেছে সে যদি পরীক্ষায় ফার্স্ট হয় তাহলে তার বাবা তাকে একটা ফুটবল কিনে দিবে। শুনে তুমি শংকরকে ফার্স্ট করানোর জন্যে লেগে গেলে। বাসায় দেরি করে আসতে, জিজ্ঞেস করতাম, “কিরে এতক্ষণ কোথায় ছিলি?” তুমি বলতে, “শংকরকে পড়াচ্ছি।” মাঝে মাঝে শংকরকে পড়ানোর জন্যে বাসাতেও নিয়ে আসতে। শংকরের বাবা- মাও খুশি, তাদের ছেলে এত মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। পরীক্ষার সময় এলো, সবাই পরীক্ষা দিল। যেদিন পরীক্ষার রেজাল্ট দিবে,
পৃষ্ঠা:৩৪
তুমি খুব আশা নিয়ে স্কুলে গিয়েছ। ফিরে এসেছ মুখ কালো করে, তোমার খুবই মেজাজ খারাপ। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে?” তুমি শংকরের কথা বললে, “গাধাটা খারাপ করেছে।” আমি ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কী করেছ?” তুমি মহাবিরক্ত হয়ে বললে, “ফার্স্ট হয়েছি।” এই হলো হুমায়ূন আহমেদ। গোয়ারেখা, কলাখালি, বাবলা সব জায়গাতেই দরদি মানুষ পেয়েছি। গোয়ারেখার হুজুরের ছোট বউ অন্ধ মানুষ, তোমার চলে যাবার খবর পেয়ে আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যে ফোন করেছে। আল্লাহ্, আমি তো কারো জন্য কিছু করতে পারি না, তুমি সবার জন্যে ভালো করো। ডাক্তার মনোয়ারের স্ত্রী কী ভালো মানুষই না ছিলেন, আল্লাহ্ তুমি তাদের ভালো করো। আলমগীর (প্রকাশক) তার মায়ের জন্যে যা করত আমার জন্যে তাই করেছে। তুমি যখন আমেরিকায় তখন আমার জন্যে ডাক্তার আনা, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া, সবই সে করেছে। আমি কী খাব, কী খেতে পছন্দ করি-সব দিকে তাদের নজর। এসবের প্রতিদান দেওয়ার ক্ষমতা আমার নাই, আল্লাহ্ তুমি তাদের সেই প্রতিদানটি দিয়ো। একবার ভাবলাম জোবেদার বাড়ি যাব। তুমি শুনে যাওয়ার সব ব্যবস্থা করে দিলে। আমি গিয়ে ঘুরে এলাম। এই অল্প একটি জীবনে তুমি কত কী করে গেলে, এখন ঘুরে ঘুরে শুধু সেই কথাগুলো মনে পড়ে।
পৃষ্ঠা:৩৫
এবারে তুমি ঢাকায় এসে বললে, “আমি আমেরিকায় স্বপ্নে দেখেছি চ্যালেঞ্জার এসে বলছে, স্যার, চিকিৎসার জন্যে আমাকে তো আমেরিকা পাঠালেন না।” আমি বললাম, “এটি তোমার স্বপ্ন নয়। আমেরিকা গিয়ে তোমার মনে হয়েছে, তুমি ভালো হয়ে যাবে। তখন তোমার মনে হয়েছে চ্যালেঞ্জারকে আমেরিকা পাঠালে সেও হয়তো ভালো হয়ে যেত। এগুলো তোমার বিবেকের কথা।” আমার কথা শুনে তুমি হেসে বললে, “আপনি তো ভালোই ব্যাখ্যা দিলেন।” নুহাশ পল্লীতে একদিন খুব সুন্দর বৃষ্টি হয়েছে। তুমি আমাকে বললে, “আম্মা, জানেন কেন বৃষ্টি হয়েছে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কেন?” তুমি বললে, “আজ সন্ধেবেলা আমি আল্লাহকে ডেকে বললাম, আল্লাহ্, আমি এতদূর থেকে এসেছি একটু বৃষ্টির জন্যে আর একটু বৃষ্টি নেই। আল্লাহ্ তাই আজকে বৃষ্টি দিয়েছে।” এ রকম কত যে তোমার কথা আছে তার কোনো সীমা নেই।
একসময় তুমি কোনো গন্ধ পেতে না। একটা লেবু পাতা নাকের কাছে নিয়েও তুমি তার গন্ধ পাও না। তখন তুমি দুঃখ করে বললে, “আল্লাহ্, তোমার পৃথিবীতে এ রকম সুন্দর একটা জিনিস আছে কিন্তু আমি সেটা থেকে বঞ্চিত।” তখন তোমার কেন জানি মনে হয়েছে আল্লাহ্ তোমার কথা শুনেছেন, তোমাকে গন্ধ পাবার ক্ষমতাটা আবার ফিরিয়ে দেবেন। কয়েক দিন পর একজন পোলাও রান্না করে এনে তোমাকে বলেছে, “বস, দেখেন কী সুন্দর পোলাওয়ের গন্ধ বের হয়েছে। আপনাকে আমি এই পোলাও খাওয়াব।” তুমি বললে, “আমি তো কোনো গন্ধ পাই না।” মানুষটি আর কোনো কথা না বলে চলে গেল। পরের দিন সে একজন ডাক্তার নিয়ে এলো। তার চিকিৎসা তুমি শেষ পর্যন্ত আবার গন্ধ পাবার ক্ষমতা ফিরে পেলে।
পৃষ্ঠা:৩৬
আমাকে তুমি একদিন হেসে হেসে বলছ, “আমি যদি এমনি এমনিই গন্ধ পাবার ক্ষমতাটা ফিরে পেতাম তাহলে ভাবতাম আমি নিশ্চয়ই পীর হয়ে গেছি। যেটাই চাই সেটাই হয়ে যায়। আল্লাহ্ তাই এই ব্যবস্থা করেছেন, যদিও আমার দোয়াটা প্রথম দিনেই কবুল করে নিয়েছেন।” তোমাকে নিয়ে এ রকম কত যে কথা, কত যে বিচিত্র ঘটনা! একবার হাসপাতালে অসুস্থ আমি, আমার সাথে একটা মেয়ে। হঠাৎ রাতে আমার পুরো শরীর অবশ হয়ে এসেছে, আমি কোনো কথা বলতে পারছি না। আমার তখনো জ্ঞান আছে, পাশে শাহীন দাঁড়িয়ে আছে, আমি তার হাতের ওপর আঙুল দিয়ে লিখলাম, “আমি কথা বলতে পারছি না। আমার শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে।” শাহীন বলল, “আমি এক্ষুনি দাদা ভাইকে ফোন করছি।” নে তোমাকে ফোন করল, ফোন পেয়ে তুমি এলে, জিজ্ঞেস করলে, “আম্মা, কেমন আছেন?”
কী আশ্চর্য, আমি হঠাৎ করে আবার কথা বলতে পারলাম, শুধু তা-ই না, শরীরের অবশ ভাবটাও কেটে গেল। আমার সবসময়েই মনে হতো তোমার উপর আল্লাহ্র দেয়া একটা আলাদা শক্তি ছিল। যেমন শোভার বিয়েতে আমি যেতে চাইলাম, তুমি বললে, “আপনি যাবেন না, অসুস্থ হয়ে যাবেন।” বাবা-মা নেই মেয়েটির, সবকিছুতেই আমি হাজির থাকি আর বিয়েতে যদি না যাই মেয়েটা কষ্ট পাবে। আমি তাই চলে গেলাম, এবং ঠিকই অসুস্থ হয়ে পড়লাম। বিয়ে রেখে আমার ভাইয়েরা অসুস্থ আমাকে ঢাকার
পৃষ্ঠা:৩৭
হাসপাতালে নিয়ে আসে। তোমরা সবাই ল্যাব এইডে হাজির ছিলে, আমাকে যখন অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামাচ্ছে তখন শুনলাম তুমি আমার ছোট ভাইকে বলছ, “মামা! আমরা তো জানতাম এই অ্যাম্বুলেন্সে করে মরা মানুষ আনে, তুমি জীবিত মানুষকে নিয়ে এসেছ!” ইমার্জেন্সিতে শুয়ে আমি শুনছি তোমার কথা, শুনে সবাই হাসতে শুরু করেছে।
দীর্ঘদিন হাসপাতালে থেকে শেষ পর্যন্ত আমি বাসায় এসেছি। তুমি আমার জন্যে একজন নার্স নিয়ে এলে ঠিক সময়ে আমাকে ওষুধপথ্য খাওয়ানোর জন্যে। সবাই আমাকে দেখতে এসেছে, তোমার যেহেতু সবকিছু নিয়ে ঠাট্টা করার অভ্যাস তাই আমার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের বললে, “সবাই শোনো কী হয়েছে। আম্মার যখন জ্ঞান হয়েছে তখন আম্মা ভাবছেন মারা গিয়ে বেহেশতে চলে এসেছেন। নার্সদের জিজ্ঞেস করলেন, এটা কি বেহেশত? তারা বলল, হ্যাঁ! আম্মা তখন নার্সদের বললেন, দাও দেখি একটা আঙুর আমি পরীক্ষা করে দেখি। নার্সেরা আম্মাকে একটা আঙুর দিল, আম্মা মুখে দিয়ে দেখেন আঙুর ভয়ানক টক। বললেন, ধুর, এটা তো টক! এটা বেহেশত না-” এমনভাবে তুমি বলতে যে শুনে মনে হতো আসলেই বুঝি তাই ঘটেছে! এখন বসে বসে ভাবি আর অবাক হই, মনে হয় এত সুন্দর একটা জীবন ছিল আমার। তুমি চলে যাবার পর মনে হলো হঠাৎ করে বুঝি আমি রাজার মা হয়ে গেছি। দেশের যত গণ্যমান্য মানুষ, যত কবি-সাহিত্যিক- লেখক, যত মন্ত্রী, রাজনৈতিক নেতা, যত বড় বড় মানুষ, যাদের কখনো আমার বাসায় আসার কথা না, তারা সবাই আমার বাসায় ভিড় করে এসেছে। আমার ঘর ভরে গেছে। রাজার মা তো আমি হতে চাই নাই। কে
পৃষ্ঠা:৩৮
কী যে আমি রাত-দিন লিখে যাচ্ছি আমি জানি না। আমি যখন লিখি তখন মনে হয় আমি তোমার সাথে কথা বলছি। আমি কি আসলে পাগল হয়ে যাচ্ছি? মোহনগঞ্জে ইলেকট্রিসিটি আসায় তুমি খুব বিরক্ত হয়েছিলে। তুমি বলতে তোমার নানাবাড়িটি একটা রহস্যময় বাড়ি। বাড়ির পিছনে পূর্বপুরুষদের কবরস্থান। এক পাশে মসজিদ, প্রায় পাঁচশ বছরের পুরানো। বাড়ির সামনে নদী, নদীর নাম শিয়ালজানী। নদীতে শেখবাড়ির ঘাট। সেই নদীতে সবসময় নৌকা যাচ্ছে। বাংলা ঘরের বারান্দায় বসে তুমি দেখতে, কী অপূর্ব লাগত। সন্ধ্যা হলে ছেলের দল হ্যারিকেন জ্বালিয়ে পড়তে বসত, গানের মতো সুর করে সবাই পড়ত।
বাড়ির পাশে হিন্দুবাড়ি, পূজা-পার্বণে তারা ঢোল বাজাত। মসজিদের সামনে এসে আবার ঢোল বাজানো বন্ধ করে দিত। সবকিছু কী রহস্যময়। শীতের সময় তুমি নানার সাথে পাখি শিকার করতে যেতে, সেই সব কত বিচিত্র স্মৃতি। এই রহস্যময় বাড়িটা তোমাকে নাকি লেখক করে তুলেছিল। ইলেকট্রিসিটি এসে তোমার সবকিছু নষ্ট করে দিল। রাতে আর আলো-আঁধারিতে খেলা নেই, তার বদলে কটকটে আলো! বাবা, এখন কি তোমার মনে পড়ে সেইসব কথা? জানি না তোমার জগৎটা এখন কেমন। কেমন করে জানব সেটাও জানি না। তোমার ছেলেমেয়েরা যে তোমাকে কী ভালোবাসে তুমি সেটা বোঝো নাই। তোমাদের মাঝখানে অভিমানের একটা দেয়াল উঠে সব বন্ধ করে ফেলেছিল। বড় বউমা হজে যাচ্ছে, তুমি কি সেটা জানো? সেটা বুঝতে পারছ?
পৃষ্ঠা:৩৯
আরো একটা কথা তোমাকে বলা হয়নি। তুমি শর্মি আর নোভাকে যে গান শিখিয়েছিলে, শর্মি এখন জার্মানিতে তার মেয়েকে সেই গান শিখিয়েছে। বাঙালিরা তোমাকে স্মরণ করে সেখানে যে অনুষ্ঠান করেছিল, সেখানে শর্মির মেয়ে এহা সেই গান শুনিয়েছে। তুমি সারাটি জীবন মানুষকে শুধু আনন্দ দিয়েছ, তাহলে তুমি কেন দুনিয়া থেকে কষ্ট পেয়ে গেলে? আমি সারাক্ষণ শুধু আল্লাহ্ আল্লাহ্ করলাম, তাহলে আল্লাহ তুমি কেন আমার দোয়া কবুল করলে না! তাহলে আমি কি সত্যিকারের মা হতে পারি নাই? কোথায় যেন কী আছে যেটা বুঝতে পারি না, শুধু কষ্ট পাই।
কবি নজরুল ইসলামের নাকি একটি ছেলে মারা গিয়েছিল, তখন তিনি কবিতা লিখেছিলেন, ঘুমিয়ে আছে শান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি। আল্লাহ তুমি মহান, তুমি অসীম, অনন্ত, মানুষ অতি তুচ্ছ সামান্য একটা প্রাণী, তারা কী এমন পাপ করতে পারে যে তুমি তাদের মাফ না করে সাজা দাও? দয়া করো, মাফ করে দাও, তুমি না রহমানুর রহিম। সব বুলবুলিকে শান্তি দাও। ঘুমাতে দাও। আর আমার মতো দুঃখী মাদের ধৈর্য দাও। শান্তি দাও। শক্তি দাও। জানো বাবা, ইকবাল আমাকে একটা প্যাকেটে করে টাকা দিয়ে গেছে, গাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়ে গেছে, বলেছে যখন ইচ্ছা আমি যেন নুহাশ পল্লী যাই। কী হবে গিয়ে? তুমি তো আর বলবে না, “আম্মা এসেছেন। নিষাদ তোমার দাদা এসেছেন!” সেও তো তখন আর দৌড়ে আসবে না। এইটুকু একটা বাচ্চা কী করে সইবে এই কষ্ট? আল্লাহ্ তোমাকে কত অনুরোধ করেছি আমাকে ক্যান্সারটা দাও। দিয়ে আন্য মালাও। এই পুতুলের মতো মাসুম
পৃষ্ঠা:৪০
বাচ্চাগুলো দেখুক, জানুক তাদের কী চমৎকার একটা বাবা আছে। দেশের মানুষ তাকে কত ভালোবাসে। কত তার বই, ছবি, নাটক আরো কত কী আছে। তুমি ওদের কেমন করে এত কষ্ট দিলে! তোমার তো কোনো কিছুর অভাব ছিল না, তাহলে তুমি কেমন করে তোমার সন্তানদের পিতৃহীন করে গেলে? মনিটা তার নিজের ভাষায় আমাকে বলে, “দাদা তুমি ফিরে আসো, তুমি নাই আমরা কষ্ট পাচ্ছি!” মনি সবসময় আমার কাছাকাছি থাকে, কীভাবে আমাকে সান্ত্বনা দেবে তাই ভাবে। আমার মাথায় পানি দিচ্ছে, তেল দিচ্ছে। একটু পর পর দুধ আনছে, আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে। সবাই আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যে ব্যস্ত। আমি খুব ভালো থাকতে চেষ্টা করি, তবু কেন সবাই এত পেরেশান থাকে?
শাহীনকে তুমি সরি কেন বলেছ? তুমি জানো না তোমার উপর তোমার ভাই-বোনদের পুরোপুরি বিশ্বাস ছিল? সে তো জানত যদি এমন সময় আসত যে সে আর পারছে না, তাহলে তুমি তখন তার পাশে এসে দাঁড়াবে? আমি তো একটুও বুঝি নাই যে তুমি চলে যাবে, কত কথা বলার ছিল তোমার সাথে, কত কথা শোনার ছিল তোমার কাছ থেকে। নোভা, শীলা, বিপাশা, নুহাশ তোমাকে যে কত ভালোবাসে নিশ্চয়ই এখন তুমি তোমার জগৎ থেকে সেটা বুঝতে পাচ্ছ। বাবা, আমার জীবনের শেষ ছবিটা দেখবে? তুমি চলে যাওয়ার পর কল্পনায় আমি যেটা দেখি? ছবিটা এ রকম, তুমি আগে চলে গেলে, তোমার ভাই-বোনেরাও তোমাকে অনুসরণ করবে। তারাও আমাকে রেখে আস্তে আস্তে চলে যাবে। শুধু আমি একা পড়ে থাকব। সারাদিন সিছানায় একা একা পড়ে থাকব, আশেপাশে কেউ
পৃষ্ঠা:৪১
নেই। মাঝে মাঝে পাড়া-প্রতিবেশী দেখতে আসবে। তারা আমাকে দেখবে আর বলবে, “আল্লাহ, তুমি আর কত কষ্ট দেবে? এবারে মাফ করে দাও!” আর আমার কঙ্কালটা বিছানায় পড়ে থাকবে আর আমি আমার নিষ্ঠুর পৃথিবীটার দিকে তাকিয়ে থাকব। এই ছবিটা আমি দেখতে চাই না, কিন্তু কেন জানি মাথা থেকে সরাতে পারি না। ছবিটা কেমন বাবা? ১৯৯২ সালে তুমি আমাকে হজ করতে পাঠিয়েছিলে। হজে যেতে কারো সাথে যেতে হয় একা যাওয়া যায় না। সেই পরিবারটির তোমার সাথে ভাই-বোনের সম্পর্ক ছিল। তোমার কাছে বড় বোন আর দুলাভাইয়ের মতো ছিল, আমি তাদেরকে মেয়ে আর মেয়ে-জামাই হিসেবে দেখি। সেইভাবে তাদের শাশুড়ি হয়ে হজে গেলাম। ঢাকা থেকে বাংলাদেশ বিমানের প্লেনে উঠেছি, প্লেন যখনআকাশে উঠেছে তখন এয়ার হোস্টেস ট্রলিতে করে চা, কফি, জুস এইসব নিয়ে এলো। আমার পাশে বসেছে আমার পাতানো মেয়ে, তার নামও আয়শা (আয়শা নোমান)। সে হঠাৎ করে এয়ার হোস্টেসকে বলে উঠল, “আপনি কাকে চা দিচ্ছেন জানেন? ইনি হচ্ছেন হুমায়ূন আহমেদের মা।” এয়ার হোস্টেস মেয়েটি খুব অবাক হলো, মাথা নেড়ে বলল, “আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।” যখন শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস হলো তখন আরম্ভ হলো প্রশ্ন, কখন লিখে, কীভাবে লিখে, কত বয়স থেকে লিখে, কতগুলো বই লিখেছে-এ রকম হাজারো প্রশ্ন! আমি প্রশ্নের উত্তর দিলাম, মেয়েটি অধীর আগ্রহ নিয়ে শুনে গেল-আমার তখন কী যে ভালো লেগেছে সেটা আর বোঝাতে পারব না। এভাবে আমি কতবার কত জায়গায় গিয়েছি-আশ্চর্যের ব্যাপার কীভাবে কীভাবে জানি সবাই জেনে গেছে আমি হুমায়ূন আহমেদের
পৃষ্ঠা:৪২
মা। আর সেটা জেনে গেলে সেই একই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমাকে বারবার দিতে হয়েছে। হজে যাবার সময় পান-সুপারি আর জর্দা নিয়ে রওনা দিয়েছিলাম কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর নিতে পারিনি, কারণ কাস্টমসে রেখে দিয়েছিল। অন্যেরা দেখলাম ঠিকই নিয়ে যেতে পেরেছে। তারা কীভাবে কীভাবে জানি লুকিয়ে নিয়ে গেছে। অন্য সবার কাছে পান- সুপারি আছে, আমার নেই। দুদিন পর একটা ছেলে কৌটায় করে পান, সুপারি, চুন আর জর্দা দিয়ে গেল। হুমায়ূনের মা হিসেবেই দিয়েছে কিন্তু আমার সাথে দেখা করেনি। ছেলেটা কে এখনো আমি সেটা জানি না, ব্যাপারটা এখনো আমার কাছে রহস্যময়।
আমি যাদের সাথে হজে গিয়েছি মক্কায় তাদের এক আত্মীয়ের বাসায় আমায় দাওয়াত ছিল। হজের পর আমি তাদের বাসায় গিয়েছি গিয়ে দেখি সেখানে বিস্ময়ের পর বিস্ময় অপেক্ষা করছে। আমি ঘরে ঢোকার সাথে সাথে টেলিভিশনে হুমায়ূনের নাটক আরম্ভ হয়ে গেল! বাসায় বিশাল লাইব্রেরি, সেখানে হুমায়ূন আহমেদের প্রত্যেকটা বই আছে। মানুষ যে তাকে কী ভালোবাসে সেটি নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস হয় না। দেখি আর আমার মনটা ভরে যায়। আহা রে! ছেলেটা আমার কেমন আছে? শান্তিতে আছে তো? একবার আমি ইকবালের কাছে আমেরিকা গিয়েছি। বৌমা (ইয়াসমিন হক) আমার জন্যে একটা রঙিন শাড়ি কিনেছিল, ফেরার সময় সে আমাকে সেটা পরে যেতে অনুরোধ করল। সে আমাকে বোঝাল, আমি সবসময়েই তো সাদা শাড়ি পরি, একবার রঙিন শাড়ি পরলে কী এমন ক্ষতি-বৃদ্ধি হবে? তার কথা শুনে আমি রঙিন শাড়ি পরেই দেশে মিি
পৃষ্ঠা:৪৩
আমি যেদিন দেশে ফিরব তুমি সব ভাই-বোনকে বললে, “তোরা সবাই আজ আমার বাসায় আয়। অনেক দিন আম্মা দেশে নেই, আজকে যখন আসছেন তখন সবাই মিলে একসাথে থাকলেভালো লাগবে।” তোমার কথা শুনে সবাই বাসায় চলে এলো। তুমি এয়ারপোর্টে গেলে আমাকে নিয়ে আসার জন্যে। আমি প্লেন থেকে নেমে দেখি কেউ নেই। খুবই অবাক হচ্ছি। ভাবছি এত দিন পর দেশে ফিরলাম, ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি সবার এয়ারপোর্টে থাকার কথা, কেউ নেই কেন? এখন আমি কী করি? বাসায় যাই কেমন করে?
শেষ পর্যন্ত নিজের পরিচয় দিয়ে অনেক কষ্ট করে এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়েছি। যারা আমাকে বের হতে সাহায্য করেছে তাদেরকে একটু বকশিস না দিলে কেমন হয়? তাই তাদের ৫ ডলার বকশিস দিয়ে স্কুটারে করে বাসায় এসেছি। তুমি তখন শহীদুল্লাহ হলের হাউজ টিউটর। বাসায় এসে দেখি কোনো একটা গোলমাল হয়েছে, তাই গেটে তালা। স্কুটারওয়ালাকে রাস্তায় রেখে আমি এসে গেইট খুলে বাসায় এসেছি। আমাকে দেখে সবাই কী অবাক, চিৎকার-চেঁচামেচি, হইচই শুরু হয়ে গেল! আমি শুনলাম তুমি তোমার তিন মেয়ে নিয়ে এয়ারপোর্টে গিয়েছ আমাকে আনতে। এর মধ্যে এয়ারপোর্ট থেকে তোমার ফোন এলো, তুমি বলছ প্লেন ল্যান্ড করেছে কিন্তু সেখানে প্যাসেঞ্জারদের মাঝে আমাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বড় বৌমা (গুলতেকিন খান) জানে ততক্ষণে আমি পৌঁছে গেছি কিন্তু সে সেটা তোমাকে জানাল না, বলল, “আম্মা না এলে কী আর করবে? বাসায় এসো, আমেরিকায় ইকবাল ভাইকে ফোন করে খোঁজখবর নেয়া মা
পৃষ্ঠা:৪৪
আমি আসব বলে তুমি বিশাল একটা মাছ কিনে এনেছ। আমি যখন সেই মাছ কাটতে বসেছি তখন তুমি এয়ারপোর্ট থেকে ফিরে এসেছ। আমাকে দেখে কী অবাক হয়ে গেলে, বললে, “কী আশ্চর্য! আপনি কোথা থেকে এসেছেন? আমি সারা এয়ারপোর্ট খুঁজে আপনাকে পেলাম না?” বড় বৌমা বলল, “ইয়াসমিন রঙিন শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে-তাই তুমি খুঁজে পাওনি।” তুমি বললে, “তাই তো বলি আপনি কোথায় গেলেন? ইয়াসমিনের কাওটা দেখেছেন?” বড় বৌমা বলল, “তুমি নিজের মাকে খুঁজে পাচ্ছ না আর দোষটা হয়ে গেল ইয়াসমিনের? মানুষ কি শুধু একটা শাড়ি দেখবে, শাড়ি পরে আছে যে মানুষটা তার চেহারার দিকে তাকাবে না?”
সবাই মিলে তখন তোমাকে নিয়ে হাসাহাসি করতে লাগল। তুমি তোমার জীবনে কত বিচিত্র সব ঘটনার ভেতর দিয়ে গিয়েছ, আর সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হচ্ছে, সবকিছুতেই তুমি জয়ী হয়েছ। কোনো একটা বইয়ে তুমি লিখেছিলে, জজরা আজকাল ঘুষ খায়। সাথে সাথে জজরা তোমার বিরুদ্ধে মামলা করে দিল। আমরা তখন ভয় পেয়ে গেলাম, বিশেষ করে ভয় পেলাম আমি নিজে। ইকবাল তখন আমেরিকা থেকে বারবার ফোন করে আমাকে বলছে, “দাদা ভাই (হুমায়ূন আহমেদ) নরম মানুষ, আপনি যদি সরি বলতে বলেন সে বলে ফেলবে। কিছুতেই যেন সরি না বলে।” আমি বললাম, “যদি অ্যারেস্ট হয়ে যায় তখন?” ইকবাল বলে, “কী আর হবে? কতজনই তো অ্যারেস্ট হচ্ছে জেলে যাচ্ছে। আদল জেলখানার অভিজ্ঞতার ওপর
পৃষ্ঠা:৪৫
আরেকটা বই লিখে ফেলবে। দেশের মানুষ জেলখানার আরেকটা জগৎ সম্পর্কে জানতে পারবে। আমার মনে হয় না তাকে অ্যারেস্ট করবে। তবুও আপনি সাবধান।” কাজেই তুমি যখনই অ্যাডভোকেটের কাছে যাও, আমিও সাথে সাথে যাই। শুনি অন্য অ্যাডভোকেটরা বিরক্ত হয়ে বলছে, “তারা আর কাজ পায় না। এখন ঠ্যালা সামলাক।”এদিকে প্রকাশকেরা লাখ টাকার পোস্টার ছাপিয়ে রেখেছে, যদি তোমাকে অ্যারেস্ট করে তাহলে সাথে সাথে পোস্টারে পোস্টারে কোর্ট এলাকা ঢেকে দিবে। আরো মজা হয়েছে তখন, দৈনিক পত্রিকায় খবর এসেছে নেত্রকোনার এক মহিলা জজ এর মাঝে ঘুষ খেয়ে ধরা পড়েছে। জজদের করা কেস তারা নিজেরাই এক দিনের মাঝে শেষ করে দিল। তারপর কেস করল পিরোজপুরের এক অ্যাডভোকেট। তোমার “জোছনা ও জননীর গল্প” বইয়ে ছিল “ফজলু”র কথা। সেই বইয়ে ফজলুকে নকশাল বলা হয়েছে। সে তিন কোটি টাকার মানহানির কেস করল। অন্য আরেকজন অ্যাডভোকেট তোমার সাথে দেখা করে বলল, তুমি যদি কিছু টাকা দাও তাহলে সে চেষ্টা করে দেখবে কেসটা তুলিয়ে নেয়া যায় কি না। তুমি বললে, “আমার তিন কোটি টাকা আছে, কেস চলুক।”
অ্যাডভোকেট বেচারা মুখ শুকনো করে চলে যেতে প্রস্তুত হলো কিন্তু দেখা গেল তার ফিরে যাবার ভাড়ার টাকা নেই। মাজহার তাকে যাতায়াতের ভাড়া দিয়ে বিদায় করল।আমার এত সৌভাগ্যবান ছেলে তুমি, জীবনের শেষ সময়টিতে কেন এমন হলো? তোমার নিজের নুহাশ পল্লী ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়া জায়গা ছিল, মোহাম্মদপুরে জায়গা ছিল, সেন্ট মার্টিনে বাড়ি
পৃষ্ঠা ৪৬ থেকে ৬০
পৃষ্ঠা:৪৬
ছিল, ধানমন্ডিতে বাসা ছিল, বসুন্ধরায় জায়গা কেনা ছিল, তাহলে তোমার ডেথ সার্টিফিকেটে কেন তোমার নিজের কোনো একটি জায়গার নাম না লিখে “গুলশান” লেখা হলো? যে নুহাশ পল্লী নিয়ে পরে এত হইচই, সেই নুহাশ পল্লী তখন কোথায় ছিল? তোমার এত কিছু ছিল কিন্তু যখন পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়ার সময় হলো তখন হঠাৎ করে কেন পুরোপুরি নিঃস্ব মানুষ হয়ে শূন্য হাতে বিদায় নিতে হলো?তুমি বেলভিউ হাসপাতালে দিনের পর দিন কিছু খেতে পারো নাই, তোমার শরীরটুকু কেটে একটা কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখেছে, যন্ত্র দিয়ে তোমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, এই কষ্ট নিয়ে আমি না-জানি কত দিন, কত মাস, কত বছর বেঁচে থাকব। আমার জীবনটা এত জটিল কেন? এই জীবন নিয়ে আমাকে আর কতকাল বেঁচে থাকতে হবে?
শুনলাম শাওন তার সাক্ষাৎকারে অনেক কিছু বলেছে। যে কথাটা নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে সেটি হলো, তার বাবা নাকি হুমায়ূনকে দশবার কিনে ফেলতে পারবে। হুমায়ূন নিজেই নাকি এই কথা বলেছে! বলতেই পারে, তার কারণ একাত্তরে মিলিটারির গুলি খেয়ে তার নিজের বাবা যখন মারা গিয়েছে তখন সে তার নিজের ছেলেমেয়ের জন্যে দশটি টাকা বা পায়ের নিচে এক টুকরো মাটি রেখে যায়নি। শ্বশুরের এত ক্ষমতা দেখে আমার ছেলে দশবার কিনে ফেলার মতো একটা কথা যদি বলেও থাকে, তারপরেও কোনো স্ত্রী এভাবে একটা কথা বলে তার স্বামীকে ছোট করতে পারে, আমার জানা ছিল না। দেশের মানুষের যে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা দেখেছি আমার মনে হয় না হুমায়ূনকে এভাবে ছোট করা দেশের মানুষ পছন্দ করছে। কারণ হুমায়ূনের কী আছে, কী
পৃষ্ঠা:৪৭
নেই, তার পরিবারের কী ছিল, কী নেই, হুমায়ূন তো সবকিছুই নিজের কলম দিয়ে লিখে গেছে। তার মাঝে লুকানো-ছাপানো, রাখঢাক কিছু নেই। তার লেখার ভাষা ছিল সহজ। নিজেকে প্রকাশও করেছে তেমনি সহজে। তার কী আছে কী নেই সে সবকিছু নিজেই প্রকাশ করে গিয়েছে।তোমাকে বলে-কয়ে কেউ কিছু করতে পারেনি। তোমার নাটকে বাকের ভাইকে বাঁচানোর জন্যে কত কথা, কত মিছিল, কত আন্দোলন কিন্তু কিছুতেই তোমাকে টলানো গেল না। নাটকের টুনিকে নিয়েও কিছু কথা আমাকেও অনেকে অনুরোধ করেছে তোমাকে বলার জন্যে। আমিও তোমাকে বলেছি, তুমি আমার কথা শুনে শুধু মিটিমিটি হসো। এই হাসির অর্থ আমি বুঝি, তুমি আমার কথা রাখবে না!
আমি নির্মলেন্দু গুণকে বললাম, “বাবা, তোমরা একটু বুঝিয়ে বলো না, টুনিকে যেন না মারে! আমার মেয়েটার জন্যে মায়া লাগছে।”নির্মলেন্দু গুণ আমার হয়ে তোমার কাছে অনুরোধ করেছে কিন্তু তুমি তোমার মত পাল্টাও নাই। নাটক শেষ হলে বলেছ, “আমাদের গরিব দেশে যদি দেখানো হয় অনেক টাকা থাকলে একজন বেঁচে যায় তাহলে মানুষের একটা ভুল ধারণা হবে। যাদের টাকা নেই তারা ভাববে, আহা আমার যদি টাকা থাকত তাহলে আমার সন্তানটা ভালো চিকিৎসা করে বেঁচে যেত। জীবন আর মৃত্যু অন্যজিনিস এটা টাকা দিয়ে হয় না।”তাই বাবা আমি আমার জীবনেও সেই একই ব্যাপার দেখলাম। এখন আমি সারাদিন বসে ভাবি তোমার যদি এত ক্ষমতা না থাকত, তুমি যদি চিকিৎসার জন্যে বিদেশে না গিয়ে
পৃষ্ঠা:৪৮
দেশে থাকতে তাহলে কী হতো? দেশে এখন মাঝে মাঝে ক্যান্সারের রোগীরা আমার কাছে আসে-এরা ওষুধের চিকিৎসায় বেঁচে আছে। এরা সুস্থ না কিন্তু বেঁচে আছে। তুমিও যদি শুধু বেঁচে থাকতে? তুমি তো এক বছর আগে আমাকে ঢাকায় রেখে নিউ ইয়র্ক চলে গেলে। তুমি তো আর সাধারণ একজন মায়ের সাধারণ ছেলে না-তুমি সাধারণ মায়ের অসাধারণ ছেলে। সিঙ্গাপুরে অসুখ ধরা পড়েছে। সেখানে চিকিৎসা না করিয়ে পৃথিবীর সেরা হাসপাতালে চিকিৎসা করাবে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। শুনে আমি নিশ্চিন্ত হয়েছি, আমার ছেলেটার ভালো চিকিৎসা হবে, সুস্থ হয়ে আমার কাছে ফিরে আসবে। আমার একটিবারও মনে হয়নি তুমি চলে যাবে।
গত রাতে আমি স্বপ্ন দেখি যে আমি খুব কাঁদছি আর বলছি, তোমার বাবাও চলে গেল, তুমিও চলে গেলে, আমি এই বাচ্চাগুলো নিয়ে কোথায় যাব? কী করব?সেদিন বেশ রাতে একটি মেয়ে তার মা’কে নিয়ে বাসায় এসেছে। এসে বলছে, “এই বাসাতে নাকি কাউকে ঢুকতে দেয়া হয় না, ধানমন্ডিতে দেয়া হয়। আমাদের আপনার সাথে একটু কথা ছিল।”আমার বাসায় সবসময়েই মানুষজন আসা-যাওয়া করছে, বললাম, “কী কথা, বলো।”মেয়েটি বলল, “আমাদের বই পড়তে শিখিয়েছেন স্যার। আমাদের বাসায় তার বই ছাড়া আর কোনো বই নাই। আমরা দুই বোন, বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। আমি চতুর্থ বর্ষে পড়ি, স্যার, যখন বারডেমেরলা মি স্বপ্নে দেখি স্যার বলছেন,
পৃষ্ঠা:৪৯
আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, আমাকে তাড়াতাড়ি কবর দাও। আমার শরীর নীল হয়ে যাচ্ছে। আমি চাদরটা উঠিয়ে দেখি সত্যি সত্যি স্যারের শরীরটা নীল হয়ে আছে। এই কথাটা আপনাকে বলার ইচ্ছা ছিল।”মৃত্যুর পর তোমার বাবার দেহটি তিন-চার দিন নদীতে ভেসে বেড়িয়েছিল, তোমাকেও তো তোমার বাবার মতোই ঘুরে বেড়াতে হয়েছিল। তোমার কি খুব কষ্ট হয়েছিল? আমি এটা কোনো দিন জানতে পারব না। তুমি একটা বই লিখেছিলে, তার মধ্যে একটা লাশের কথা ছিল। লাশটা ছিল কিন্তু আত্মাটা ঘুরে বেড়াচ্ছে-এগুলো যখন ভাবি তখন আমার খুব কষ্ট হয়। আমি কোনো দিন জানতে পারব না। আমার যে কী কষ্ট হয় এগুলো ভাবতে, কিন্তু না ভেবেও পারি না। কত দিন থেকে আমার পরকাল সম্পর্কে জানতে ইচ্ছা করে কিন্তু সেই পরকাল তো আর আসে না।
আমার বই পড়ার খুব নেশা ছিল। তখন ভারত থেকে বই আনতে হতো, নূতন পাকিস্তান হয়েছে, ভারত থেকে কিছু আনা নিষেধ। তোমার বাবা নীতিমান মানুষ, তাই বাসায় বই আনা যায় না। আমার আগ্রহ দেখে শেষে রাজি হয়েছিল, পরে নিজেই খুব আগ্রহ করে বই আনত। আমার ছেলে লেখক হবার পর আমার আর কোনো দিন বই পড়তে অসুবিধে হয়নি। অন্য সবার বইয়ের সাথে সাথে তোমার বইও পড়তাম। নূতন বই বের হতে দেরি হলে পুরানোগুলোই পড়তাম। কোনো অসুবিধে হতো না। এখন বসে বসে ভাবি, কীভাবে এটা সম্ভব হয়েছিল, আমার মতো সাধারণ একজন মানুষের ঘরে এ রকম অসাধারণ একজন ছেলে আমার?
পৃষ্ঠা:৫০
তোমার এই একটা জীবনে তুমি কত কী করলে। বই লেখালেখি, ছবি বানানো, সবাইকে নিয়ে দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়ানো, ভাই-বোনদের বিয়ে দেয়া, বাড়ি বানানো, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা, আরো কত কী। একজন বলেছিল, জীবনের চেয়ে কর্ম বেশি হয়ে গেছে, তাই তোমাকে এত তাড়াতাড়ি চলে যেতে হয়েছে। একেক সময় মনে হয়, তাই বোধ হয় ঠিক। আমি ভেবে পাই না, পুতুলের মতো মাসুম দুটো বাচ্চা রেখে একজন বাবাকে চলে যেতে হয়? মায়ের দোয়া কাজে লাগে। আমি মনে হয় সত্যিকারের মা হতে পারিনি, তাই আমার দোয়া কাজে লাগেনি। ছদকা দিলে কাজ হয়, এই খতম পড়লে কাজ হয়, ওই খতম পড়লে কাজ হয়-আমি কোনোটাই তো বাকি রাখিনি কিন্তু কিছুই তো হলো না। আমার পুরো জীবনটা কী শুধু ভুলে ভুলেই কেটে গেল, কিছুই কি করতে পারলাম না? কি এমন ভুল করেছি সেটাও তো খুঁজে পাই না। আগে যখন মনটা অশান্ত হয়ে যেত তখন আল্লাহকে ডাকলে শাস্তি পেতাম, এখন তাও পাই না। বাকি জীবন কেমন করে কাটাব তাও জানি না। আমাদের মতো হতভাগ্যদের দীর্ঘ আয়ু হয়। বগুড়ার বাবলুর মায়ের কথা মনে আছে?
বইমেলা আসছে। নতুন বইয়ের আশায় সবাই ব্যস্ত। নূতন বই বের হলেই তুমি আমার কাছে আর অন্য সবার কাছে পাঠিয়ে দিতে। এই দিনগুলো আর কখনো ফিরে আসবে না। সুন্দর পৃথিবীটা এখন কেমন জানি লাগে। শুধু মনে হয় এখন কোথায় যাব? কী করব? না-জানি এখন আর কে কখন আমাকে ছেড়ে যায়। সামনে দীর্ঘ একটা সময়, সেটি কীভাবে শেষ হবে?
পৃষ্ঠা:৫১
তোমাকে জিজ্ঞেস করতাম, “আমি যখন মারা যাব তখন আমাকে কবর দিয়ে আসার পর হঠাৎ যদি কবরের ভেতর আমার জ্ঞান ফিরে আসে তখন আমি কী করব?”তুমি বলতে, “আপনি চিন্তা করবেন না। সাথে একটা মোবাইল ফোন দিয়ে দেব!”আমি অবশ্যি ভাবতাম, সত্যি যদি তাই হয় তাহলে আমি চোখ বন্ধ করে একমনে আল্লাহ্ আল্লাহ্ করতে থাকব। এখন তাও ভাবতে পারি না। ঠিকভাবে চলাফেরাও করতে পারি না। বেশির ভাগ সময় শুয়ে থাকি। বই পড়তেও ইচ্ছা করে না। আমি আমার যে ছেলেমেয়ের সাথে থাকি তাদের মনের শান্তির জন্যে আমার আরো অনেক ভালো থাকা দরকার। চেষ্টা করি কিন্তু তারা কতটুকু শান্তি পায় জানি না। আমি তাদের ভালো রাখতে চাই, হাসি-খুশি রাখতে চাই, কতটুকু পেরেছি জানি না। কারো কারো জন্যে জীবন বড় অসহায়, জীবন বড় কঠিন, বড় নিষ্ঠুর।
বাবা, ইকবাল তোমাকে বলেছিল, “দাদা ভাই তুমি এমন একজন মানুষ যে তোমার অসুখ হলে দেশের প্রেসিডেন্ট এসে তোমাকে দেখে যান। তোমার তুলনায় ভাবি খুবই অসহায়, তার কেউ নাই। আমি ভাবির পাশে থাকি?” তুমি বলেছিলে, “ঠিক আছে। তুই তোর ভাবির পাশে থাকিস।”ইকবালের সাথে তোমার এই কথাটা তুমি কিন্তু কোনো দিন আমাকে জানাওনি। আমি ইকবালের উপর খুশি ছিলাম তার ভাবির পাশে থাকার জন্যে। আবার মনে মনে কষ্টও পেতাম, কেন সে তোমার থেকে দূরে চলে গেল। বড় ভাইয়ের উপর কখনো কি এত রাগ দেখানো যায়? ইকবালকে কোনো দিন কিছু বলি নাই, তোমাকেও কিছু বলি নাই। পরে আমি এটা জেনেছি।
পৃষ্ঠা:৫২
৫ অক্টোবর তোমার লীলাবতীর উপর লেখা পড়লাম। সন্তানের মৃত্যুর মতো কষ্ট বাবা-মায়ের কাছে আর কিছু নাই। সন্তানের আগমনের প্রকাশভঙ্গি একেকজনের কাছে একেক রকম। কেউ সুন্দর করে প্রকাশ করতে পারে, কেউ পারে না। ভেবে কষ্ট হয় লীলাবতীর চিকিৎসা করার মতো সময়ই পাওয়া যায় নাই।রাশেদের জন্ম কী যে আনন্দ নিয়ে এসেছিল! তাকে ধরে রাখার জন্যে চিন্তাও করেছিলে, ভাগ্যে ছিল না। রাশেদ আমাদের ছেড়ে চলে গেল। জন্মের পর তার অসুখ ধরা পড়ার পর ড. তালুকদারকে ডেকে আনা হলো। তিনি খুব বড় শিশু ডাক্তার। ডা. তালুকদার আমাকে বললেন, “আমাদের প্রথম কি করা উচিত জানেন? দুই রাকাত নফল নামাজ পড়া।” আমি বললাম, “পড়েছি।”তিনি বললেন, “তারপর একটা ছদকা দেয়া।”
আমি বললাম, “দিয়েছি।”তিনি বললেন, “তারপর একজন ভালো ডাক্তার ডাকা।”আমি বললাম, “আমি জানি আপনি খুব ভালো ডাক্তার, তাইআপনাকে ডেকেছি!”তারপর চিকিৎসা আরম্ভ হলো। প্রথমে বললেন, বাচ্চার বেঁচে থাকার আশা আশি ভাগ। তারপর বললেন ষাট ভাগ। তারপরে তো বিদায়। ডাক্তার বলেছিলেন বাচ্চার মা বাচ্চার হাত ধরে বসে থাকুক। বউমার সিজারিয়ান হয়েছিল, তাই তার ডাক্তার বউমাকে আসতে দিবে না। শেষের দিকে অল্প কিছুক্ষণের জন্যে তাকে বাচ্চার কাছে আনা হয়েছিল। বাচ্চা আমাদের সাথে থাকল না, চলে গেল। কী কষ্ট- আহা কী কষ্ট!
পৃষ্ঠা:৫৩
রাশেদকে হাসপাতাল থেকে বাসায় নিয়ে আসার সময় শাহীনের কোল থেকে নিয়ে আমি শেষবারের মতো তার মুখের সাথে মুখ লাগিয়ে তাকে তার মায়ের বুকে তুলে দিলাম। তারপর শাহীন আবার তাকে কোলে নিয়ে সবার সাথে বাসায় ফিরে এলো। কত ধরনের কষ্ট যে আমার ভাগ্যে ছিল। বাবা, একটা ব্যাপার আমার খুব অবাক লাগে। তুমি যখন বেঁচে ছিলে আমি দীর্ঘদিন তোমার সাথে ছিলাম। তুমি একা ঘুমাতে ভয় পেতে, তাই আমি তোমার সাথে ঘুমাতাম। এই কথাটা তুমি কখনো কাউকে বলোনি, আমি বুঝতে পারি বড় হয়ে যাওয়া একজন মানুষের ঘরে তার মা ঘুমায়, সেটি হয়তো সবাইকে বলে বেড়ানো কোনো কাজের কথা না। কিন্তু তুমি যেহেতু লেখক, তুমি এটা বললে কোনো ক্ষতি-বৃদ্ধি হতো বলে আমার মনে হয় না।
আরো একটা কথা, কালের কন্ঠে তুমি লিখেছ তোমার ভাই- বোন, তোমার মা সবাই মিলে তোমাকে নিয়ে মিটিং করেছে খবর পেয়ে তুমি আমাকে সেটা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছ। আমি বলেছি, হ্যাঁ আমি মিটিং করব। পরে আর করা হয়নি। এই কথাগুলো তুমি বেঁচে থাকতেই বের হওয়া উচিত ছিল, তাহলে তোমাকে জিজ্ঞেস করতাম, কেন তুমি এই কথাগুলো লিখলে? তোমার ভাই-বোন তো কেউ তোমাকে অসম্মান করে কথা বলে না। এটা তোমাদের পরিবারের ধারা। তোমার ছোট ভাই-বোন তো তোমাকে বাবার সম্মান দিয়েছে। কথায় বলে, লেখকেরা নাকি ঝড়-বৃষ্টির রাতে জোছনা রাতের কথা কল্পনা করতে পারে-এখানেও
পৃষ্ঠা:৫৪
নিশ্চয়ই তাই হয়েছে-এই বিষয়গুলো তুমি কল্পনা করেছ! কল্পনা হিসেবে থাকলেই ভালো হতো, প্রকাশ হওয়াটা ঠিক হয় নাই।তুমি যখন ঠিক করলে বউমার সাথে ছাড়াছাড়ি করে ফেলবে, আমি তখন খুব কাতর গলায় তোমাকে বললাম, “বাবা, এই কাজটা করা খুব খারাপ। খুব একটা লজ্জার ব্যাপার হবে। এটা হয় না। তোমার এতগুলো বড় বড় ছেলেমেয়ে-খুব একটা অন্যায় কাজ হবে। খুব ভুল হবে।”যখন তোমাকে আমি এই কথাগুলো বলি তখন তোমার সাথে চ্যালেঞ্জারও ছিল। তুমি আমার কথা শুনে বলেছিলে, “আপনি বরং একটা কাগজে লিখে দেন, আমি আপনার ছেলে না।”তোমার কথা শুনে আমি বুঝেছিলাম তোমার জীবনে আমার প্রয়োজন শেষ হয়ে গেছে।
তখন তোমরা নাটক নিয়ে ব্যস্ত। সপ্তাহে তিন-চার দিন বাইরে থাকতে। বেড়াতে যেতে। মাঝে মাঝে আমি একা তোমার বাসায় থাকতাম, কাউকে সেটা বলতে আমার লজ্জা করত। এমনিতেই আমার ভয় কম, অসুবিধা হতো না। তুমি বলতে, “আপনাকে আমার সাথে থাকতে হবে না, আপনি চলে যান। এখানে কোনো অসুবিধে নেই।” আমি নিজেই বুঝতাম আশপাশের সবাই তোমার যত্ন নিত। বন্ধুবান্ধব, নাটকের শিল্পীরা সবাই আসছে। তোমার সাথে আমার থাকাটা একটা ঝামেলার মতোই হয়ে গিয়েছিল, তাই তোমাকে একা রেখে আমি চলে গেলাম।তবে এই কথাটি ঠিক, তোমার দ্বিতীয় বিয়েটি আমি বা আমার অন্য ছেলেমেয়েরা কেউই পছন্দ করে নাই। তুমি সুখী হয়েছ, খুশি হয়েছ, এটাই বড় কথা। আমরা কী ভেবেছি, কীকরেছি তাতে কিছু আসে যায় নাই।
পৃষ্ঠা:৫৫
বাবা, তুমি কি আমার উপর অভিমান করে গিয়েছ? তোমাকে ভালো করে একদিন স্বপ্নেও দেখি না। যদি তোমার মনে কোনো কষ্ট দিয়ে থাকি ভুল করে দিয়েছি, না জেনে দিয়েছি। রাগ করো না বাবা। তোমার জন্যে আমার কত কষ্ট। সারাজীবন কত কী করলে। হজ করানো, হার্ট অপারেশন, দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়ানো, স্কুল তৈরি করা, ল্যাব এইডে সবসময় আমার জন্যে একটা কেবিন রেডি রাখা। আমার সেবা করার জন্যে বাসায় একজন আয়া থাকার পরও একজন নার্স রেখে দেয়া। তুমি কী করো নাই আমার জন্যে? গ্রামের বাড়ি থেকে লোকজন এসে কী মজাই না পেত। এই একটা জীবনে, তুমি কত কী করলে বাবা?
পৃষ্ঠা:৫৬
আমার ছেলেটা আকাশের মতো বড় একটা ইচ্ছা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিল। কত ভালোবাসা আর স্নেহ-মমতা ছিল সবার জন্যে। তার মেয়েদের কী আদর ছিল। আমি পল্লবী থাকতাম বেশির ভাগ সময়, মেয়েরা মাঝে মাঝে আসত এখানে থাকার জন্যে। রাত একটা- দুটোয় তুমি গাড়ি পাঠাতে, মেয়েদের ছাড়া তোমার ঘুম আসছে না। বাচ্চারা মন খারাপ করে যেত।আমি যখন তোমার বাসায় থাকতাম সবাই আমার সাথে ঘুমাত। রাতে এসে এসে তুমি বারবার মশারি ঠিক করে গুঁজে দিতে। আমি বলতাম, “কী করিস? ঘুমাতে যা।”
তুমি বলতে, “মেয়েদের মশা কামড়াবে। আপনার শক্ত চামড়া, আপনার কাছে মশা আসবে না। মেয়েদেরকেই মশা কামড়াবে।”তোমার বাচ্চারাও বাবার বই না পড়ে ঘুমাতে পারত না। তুমিও বাচ্চাদের ছাড়া ঘুমাতে পারবে না। বিপাশা বলত, “ড্যাডি, তুমি তো আমাকে ছাড়া ঘুমাতে পারো না-এই শিশিটা নিয়ে যাও, এর মাঝে আমার গন্ধ ভরে দিয়েছি।” তোমার সেই বাচ্চা মেয়েটি মা হয়েছে। তারই প্রথম পুত্রসন্তান আর সবারই কন্যাসন্তান।তোমার তিন মেয়ের পর রাশেদ এসেছিল, সবাই কী খুশি, মনে হয় সবচেয়ে বেশি খুশি আমি। মাত্র দুই দিন পৃথিবীতে থেকে সে চলে গেল। আহা কী কষ্ট! একেকবার একেকটা কষ্ট আসে, মনে হয় এর চেয়ে বেশি কষ্ট বুঝি আর হতে পারবে না, তারপরও সেই কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকি।
পৃষ্ঠা:৫৭
তারপর বউমা যখন নুহাশকে নিয়ে সন্তানসম্ভবা তখন আমি বউমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছি। ডাক্তার দেখে বলল, “ছেলে হবে।” আমার তখন মনে হলো, আহা কী সুন্দর এই পৃথিবীটা! সত্যি সত্যি একদিন তার জন্ম হলো সিজারিয়ান করে। এবারে শিশুদের ডাক্তার আগে থেকে এনে রাখা হয়েছে। দুই-তিন দিন পর তার জন্ডিস ধরা পড়েছে, বাবা তখন কাউকে নুহাশকে ছুঁতে দেয় না। নিজে সর্বক্ষণ বাচ্চাটাকে নিয়ে থাকত। আমাকে বলত, “আপনার বয়স হয়েছে। আপনি পারবেন না।”আমি শুধু তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে তার খুশিটা দেখতাম। সেই নুহাশ যখন বড় হলো সবসময় তাকে সাথে সাথে রাখত। ঈদের নামাজে যাওয়া, বাজারে যাওয়া, কোনো জায়গায় বেড়াতে যাওয়া সবসময় সাথে নুহাশ। গাজীপুরের জায়গা কিনে তার নাম দিল নুহাশ পল্লী।
সেদিন নুহাশের একটা লেখা পড়লাম, সে তার নিজের ভেতর কত বড় একটা কষ্ট লুকিয়ে রেখেছে। আমি জানি নুহাশের বুকের মাঝে যে কষ্ট, তার বাবার বুকের ভেতর কষ্ট ছিল আরো অনেক বেশি। শেষবার যখন অল্প কয়দিনের জন্যে দেশে এসেছে তখন সারাক্ষণ শুধু ছটফট করেছে, নুহাশ কেন আসে না? আমি একজন গাধা মা, বলতেও পারি না হয়তো আসছে, ঢুকতে পারছে না। নুহাশকে বলা হলো না, তোমরা এই দুঃখী বাবাটাকে ক্ষমা করে দিয়ো। বিশ্বাস করো, সারাজীবন সে সবাইকে শুধু আনন্দ দিয়ে নিজে শুধু কষ্ট নিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। তুমি তো তবু তোমার এ রকম একটি অসাধারণ বাবার স্মৃতিটুকু মনে রাখতে পারবে কিন্তু তোমার যে আরো দুজন ছোট ভাই আছে, তারা কিন্তু তাদের বাবার স্মৃতিটুকুও মনে রাখতে পারবে না।
পৃষ্ঠা:৫৮
হুমায়ূন যখন দেশে এসেছে, চিকিৎসার জন্যে নিউ ইয়র্ক ফিরে যাবার সময় মনি তার সাথে ছবি তুলতে চাইল। হুমায়ূন বলল, “ভাবছে আমি মরে যাব। আরে, আমি বাংলাদেশে জন্মেছি, বিদেশে মরব কেন? আমি সুস্থ হয়ে আবার ফিরে আসছি।” তারপরও মাজহার মনির সাথে তোমার ছবি তুলে দিল। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ হাসপাতালের শ্রেষ্ঠ ডাক্তার অপারেশন করল, বলল, তুমি ক্যান্সারমুক্ত। সাত দিন পর হেঁটে গাড়িতে উঠে বাসায় ফিরে এলে। দুই দিন পর এমন কী হলো যে ডাক্তারদের আরো দুইবার অপারেশন করতে হলো, শেষ পর্যন্ত মারা যেতে হলো।শুনতে পেলাম সে নাকি বলে গেছে নুহাশ পল্লীতে তার ‘সমাধি’ হবে, শুধু তা-ই নয়, সেখানে কী লেখা থাকবে সেটাও বলে গেছে।
আমি প্রতিদিন ফোন করে তুমি কেমন আছ সেটা জানার জন্যে শাওন আর মাজহারকে বিরক্ত করেছি, তুমি কোনো দিন ফোন ধরো নাই। একবার তো বলতে পারতে, আম্মা শরীরটা ভালো না। আমি শুনে কিছু করতে পারতাম না কিন্তু তবুও তো তোমার মুখ থেকে জানতে পারতাম। শেষের দিকে খারাপ খবর আসতে শুরু করল, যখনই সে রকম খবর আসত তখনই আমি ফোন করতাম।
তবে তুমিই সবচেয়ে ভালো বলেছিলে, কোন সূরায় নাকি বলা আছে, মহান আল্লাহ বলেছেন, আমি সব মানুষের গলায় হারের মতো তার ভাগ্যটা ঝুলিয়ে দিয়েছি। আমার হারটা মনে হয় অনেক ভারী। তার ভার আর বইতে পারছি না। আমার আয়ুটাও বড় বেশি, আমি সেটাও আর টানতে পারছি না। জানি না কবে শেষ হবে, তোমাদের জগৎটা দেখার জন্যে আমি কত দিন থেকে অপেক্ষা করছি। কবে না-জানি সেটা দেখতে পারব, এগতের কষ্ট আমি আর সইতে পারছিলমার বর্ত
পৃষ্ঠা:৫৯
তুমি এবারে এসে সব টিভিতে সাক্ষাৎকার দিয়েছ। নুহাশ পল্লী সম্পর্কে বারবার বলেছ এটা যে রকম আছে সে রকমই থাকবে। বুঝতে পারছিলাম তুমি মৃত্যু নিয়ে, মৃত্যু হলে কোথায় কবর হবে সেটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছিলে। জীবনে এই প্রথমবার এবং এই শেষবার তোমার কোনো একটা মতামতে আমার কিছু বলার ছিল না। আমাদের ছোট সুখ-দুঃখের জীবনে আমার সাথে সবসময় সবকিছু নিয়ে কথা হতো। আমি সবসময় তোমার মত মেনে নিতাম, আমার এত বুদ্ধিমান একজন ছেলে, তার মতের বাইরে যাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। তুমি চলে যাবার পর একদিন নুহাশ পল্লীতে গিয়ে দেখি সেখানে শ্বেতপাথরের বিরাট বড় একটা সমাধি। সমাধিটা এত বড় যে আমি হাত দিয়ে কবরটা ছুঁতে পারি না। আমি শাওনকে বললাম, “দেখো এটা বেশি বড় হয়ে গেছে, আমি হাত দিয়ে কবরটা ছুঁতে পারছি না। সমাধিটা একটু ছোট করো।”
সে বলল করবে। কিন্তু আর ছোট করে নাই। কত বড় বড় শিল্পী আর আর্কিটেক্ট মিলে এটা করেছে, তারা কি আর সাধারণ একজন মা তার ছেলের কবরটা একবার ছুঁয়ে দেখতে পারছে না সেই কারণে কবরটা ছোট করবে? আমি যখনই সমাধিটা দেখি তখনই আমার বুকটা কেমন জানি ব্যথা করে। আমার মনে হয় আমার বাচ্চাটা বুঝি কষ্ট পাচ্ছে। জানি আমার কথার মাঝে কোনো যুক্তি নেই, তবু আমার কষ্ট হয়। সম্রাট হুমায়ুনের সমাধি কেমন হবে সেটা কল্পনা করার ক্ষমতা আমার নাই। কিন্তু আমার হুমায়ূনের সমাধিটা কেমন হবে সে রকম একটা কল্পনা আমার ছিল। সমান মাটির মাঝে কবরটা একটুখানি উঁচু আর পুরো জায়গাটা সবুজ ঘাস দিয়ে গালিচার মতো ঢাকা। আমি কাছে বসে কবরটা হাত দিয়ে ছুঁয়ে বসে থাকতাম আর বলতাম, আমার
পৃষ্ঠা:৬০
বাবাটা ঘুমিয়ে আছে। আমার আদরের মানিক শান্ত হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে। এখন দূরে দাঁড়িয়ে থাকি, এত টাকা খরচ করে এত বিশাল একটা সমাধি তৈরি হয়েছে। সে তো এখন আর আমার মতো সাধারণ মানুষের সন্তান নয়, সে এখন বিশাল পরিবেশে চলে গেছে, তার সমাধিটিও সে রকমই হতে হবে। থাকো বাবা, শাস্তিতে ঘুমিয়ে থাকো। মহান আল্লাহ্ যেন তোমাকে শান্তিতে রাখেন। মায়ের দোয়া নাকি মহান আল্লাহ্ কবুল করেন, তাই যেন সত্যি হয়।
তোমার শেষ কবিতায় তুমি লিখেছিলে লিলুয়া হাওয়া নাচে- কবিতার শেষ লাইনটা লেখার জন্যে কাগজ নেই, তুমি ছটফট করছ। আমি আমার সাদা শাড়ির আঁচলটা বিছায়ে দিলাম, তুমি সেখানে লিখে রাখলে। এখন আমি লিখতে বসেছি। লিখে যাচ্ছি, শুধু তোমাকে লিখে যাচ্ছি। আহা রে! যদি এটা সত্যি হতো আসলেই তোমাকে আমি লিখতে পারতাম, তাহলে এই পৃথিবীতে আমার তো এর চাইতে বড় কিছু চাওয়ার ছিল না। আহা! কেন এটা সত্যি হয় না? বেঁচে থাকা বড় কষ্ট বাবা। বড় কষ্ট।