কুহু ও কেকা- সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
কবিতা-০১- দুই সুর
কোকিল-কালো কোকিল রচে সুরের ফুলে ফুলঝুরি,
বসন্তে সে ভুলায়ে আনে হাওয়ায় করি’ মন চুরি!
কুষ্ণটিকা-কুটিল নভে বুলায় তুলি রঙ্গিলা,
দোলায় তৃণ-বল্লরীতে মঞ্জু ফুল-মঞ্জরী!
বনের যত মনের কথা সেই জেনেছে অন্তরে,
কিশোর কিশলয়ের আশা তীরি সে সুরে সন্তরে!
শীতের গড়ে পাথর নড়ে-মুহুর্মুহু হয় ঢিলা,
মোচন হ’ল বন্দী যত মুকুল কুহু-মন্তরে!
সুখীর সুখী শিখী সে নাচে হেলয়ে গ্রীবা গৌরবে,
আওয়াজে তার কদম ফোটে, কানন ভরে সৌরভে;
কলাপ মেলি’ করে সে কেলি রৌদ্রে স্নেহ সঞ্চারি’,
‘এনায় ছায়া মোহন মায়া উচ্চকিত ঐ রবে।
14 হুপ্ত দেশে মুগ্ধ নাচে নয়ন যেখে অপিয়া,
– মেতুর নভে ধূমল ফণী বেড়ায় যবে দার্পয়া!
তমাল ‘পরে নৃত্য করে কুহক কেক। উচ্চারি’,
মুচ্ছি’ পড়ে সর্প শত সত্রশিখা তপিয়া!
বনের কুহু, বনের কেকা, কুহক-ভরা যুগ্ম-রাগ,
দেয় গো বাঁটি নিখিল মাঝে আনন্দেরি যজ্ঞভাগ!
অনাদি সুধা,-অনাদি সোম,-হয় না কেহ বঞ্চিত;
অনাদি সাম, অনাদি গুক পূর্ণ করে বিশ্ব-যাগ।
মনের কুহু,-মনের কেকা,-অনাদি তারো মুচ্ছ না,
গোপন তার প্রচার, তবু, তুচ্ছ না সে তুচ্ছ না।
গহন-গেহে নিভৃতে রহে নিখিল-হৃদি-সঞ্চিত,
মিলিয়া আছে উহারি মাঝে বরষা সাথে জ্যোৎসনা।
আপনি পড়ে ছন্দে ধরা আপনি তার উদ্বোধন,-
ক্রৌঞ্চী কাঁদে করুণ কুহু,-কবি সে-কেকা, ক্ষুব্ধ মন।
উলসি’ ওঠে গুপ্তক্টোরা স্বপ্ত নদী সুড়ঙ্গের,
কল্পলতা মুকুল মেলি’ বিতরে, চির গুপ্ত-ধন।
আদিম কুহু, আদিম কেকা, ধরিবে কেবা ছন্দে ‘সে,
– -জনম যার কামনী লোকে মনের হুগোপন দেশে;
ফুটায়ে ফুল, ছুটায়ে হাওয়া,
লুটায়ে ফণা ভুজঙ্গের মিল্লায়ে দু’হু গাহিবে মুহু-গাহিবে মহানন্দে সে।
ফুটিতে যাহা ঝরিয়া পড়ে, গাঁথিবে তারে সঙ্গীতে!
কামনা বুঝি কনক-ধুনী সুমেরু চূড়া লঙ্ঘিতে!
মানস-লীনা বাজে যে বীণা শিখিবে তারি মুচ্ছ না,
– প্রকাশ যার আকাশ-তটে অযুত শত ভঙ্গীতে।
হৃদয়ে মুহু কোকিল কুহু ময়ূর কেকা রব করে,
গহন প্রাণ কুহর মাঝে স্বপন-ঘেরা গহ্বরে!
ধেয়ানে দোঁহে আরতি করি’ ফুটাবে মেঘে জ্যোৎসনা স্মিরিতি সাথে পীরিতি,
আজি মন্ত্র-মধু মস্তরে।
কবিতা –০২-জ্যোৎস্না-মদিরা
চন্দ্র ঢালিছে তন্দ্রা নংনে,
মল্লিকা বনে ঢালিছে মারা;
ছায়ায় আর্দ্র আরে খানি আজ
আলো মাখা ফিকে হাল্কা ছায়া!
সুদূর-স্বপন-বিধুর প্রাণ,
উঠিছে মৃছল মধুর গান,
মৃদুল বাতাসে মর্ম্মর ভাষে উছসি’ উঠিছে বনের কায়া।
স্ফুরিত ফুলের উতলা গন্ধে,
গাহে অন্তর কত না ছন্দে,
আলোকে ছায়ায় প্রেমে সুষমায় ভুবনে বুলায় মদির মায়া!
কু?
বসন্তের প্রথম ঊষায় ফুলদলে জাগাবে বলিয়া বহিল দক্ষিণ বায়ু,
কে আজি সুধায় মুহুর্মুহু আনন্দে গলিয়া?-‘কু?’
মধু আলো,
মধুর বাতাস বুঝি তারে করেছে বিধ্বল,
ভুলে গেছে দ্বন্দ্ব’ দ্বিধাঁ, দুখের আভাস তাই সে সুধায় অবিরল ‘কু?’
সে যে আজ শমেলেছে গো পাখা,
দেখেছে গো সৌন্দর্য্য অপার,
হাওয়া তারে মাতায়েছে চূত-রেণু-মাথা,
তাই বুঝি পুছে বারম্বার-‘কু?’
বিধাতা করেছে তারে কালো,
– নীরব শিশিরে বরযায়,
তবু সে ফেলেছে বেসে জগতেরে ভালো
প্রেমোচ্ছাসে তাই সে সুধায় ‘কু?’
কবিতা-০৩- মদন-মহোৎসবে
বন উপবন আলো ক’রে অশোক ফুটে আছে,
অশোক ফুলের রূপটি ঠাকুর! চাইছি তোমার কাছে;
চোখের দাবী মিলে পরে তখন খোঁজে মন,
তাই তো প্রভু! সবার আগে রূপের আকিঞ্চন।
মল্লিকা ফুল হাসছে হরি’ হাওয়ার,
মগজ মন, মনোহরণ বিস্তাটি দাও-এ মোর নিবেদন;
মনের ক্ষুধা মিটিয়ে দিতে শক্তি যেন হয়,
– নইলে, শুধু রূপের আদর-হয় না সে অক্ষয়।
আমের মুকুল জাগছে আকুল ফলের আশা নিয়ে,
সফল কর আমায় ঠাকুর। প্রেমের পরশ দিয়ে।
প্রিয় আমার স্নেহের নীড়ে স্নিগ্ধ যেন রয়,
মনের মোহ ফুরিয়ে গেলেও প্রাণের পরিচয়।
গন্ধ-মধু-রূপ-সায়রে ভাসছে নীলোৎপল,
– নিখুৎ-নধর অটুট-আদর সোহাগ-শতদল;
রূপে, রীতে, মাধুরীতে অনি হ’তে চাই,
চোখের মনের প্রাণের ক্ষুধা মিটিয়ে যেন যাই।
মল্লিকা ফুল, আমের মুকুল, অশোক,
নীলোৎপলে, ঠাকুর তোমার চরণ পুজি,
পূজি নয়ন জলে। অরুণ অরবিন্দ সম তরুণ এ হৃদয়,-
তোমার বরে কামনা তার সফল যেন হয়।
কবিতা- ০৪-মধুমাসে
যে মাসেতে পুষ্পে মধু, মধু মধুকরের মুখে,
– হিয়া যখন চাওয়ার ক্লাগে
- হয়ু গো মদির অধীর সুখে;-
আঁশি আকুল অন্বেষণে ফিরছে যখন বনে বনে,-
মুহুর্মুহু কুহু স্বরে
তন্ত্রী দুলে উঠছে বুকে;
তখন তুমি দিলে দেখা অমনি
ফুলের বনে ফুলের রাণী রমণী!
অনি বিপুল সুখের ভরে আকুল আঁখি উঠল ভ’রে,
পুলক হাসি পাগল বাঁশী বিদায় দিল মৌন দুখে!
কবিতা- ০৫-গান
মুখখানি তার পদ্মকলি ভাশের
হাওয়ায় দোদুল্-হল্!
সুখের স্বপন,
বুকের সে ধন,
দুখের আপন সে বুলুল।
ভুবন-ভোলা নয়ন দু’টি..
খোঁজে না ছল, নেয়না
‘ ত্রুটি, ছুটির হাওয়া ছুটিয়ে দে দেয়,
আপন-ভোলা মধুর ভুল!
উড়ো পাখীর,
লাগল পরশ তাইতো রে মন গেল উড়ে,
কি এক হাওয়া জাগল সরস স্বপন-সুখের ভুবন জুড়ে!
তড়িৎ-ভরা মেঘের মতন হৃদয় জুড়ে জাগল চেতন,
দেবতা সে কোন্ ছদ্মবেশে করলতার কাম্য-ফুল!
কবিতা-০৬-চার্ব্বাক ও মঞ্জুভাষা
বনপথে চলেছে চার্সাক,
সূর্য্যতাপে স্পন্দিত সে বন;
ক্লান্ত আঁখি, চিন্তিত, নির্ব্বাক,
বিনা কাজে ফিরিছে ভুবন।
হ্রদের দক্ষিণ কূলে ভিড়ি’
শুামলেখা শোভিছে শৈবাল,
মরালীর পক্ষে চক্ষু রাখি’ আঁধি মুদে চলেছে মরাল।
তীরে তীরে-ধন সারি দিয়ে
দেবদারু গড়েছে প্রাচীর,
বনস্থলী-মধুচক্র ভরি
রশ্মি-মধু ঝরিছে মদির।
চলিয়াছে চার্বাক কিশোর,
ভ্রূকুঞ্চিত, দৃঢ় ওষ্ঠাধর;
শিশিরের পদ্মকলি সম রুদ্ধ
প্রাণে দ্বন্দ্ব নিরস্তর।
“আজি যদি মঞ্জুভাষা আসে এই পথ দিয়া,
চকিতে আঁচলখানি নেব তার পরশিয়া,
সে যদি জানিতে পারে!
সে যদি পালটি চায়!
মাগিয়া লইতে ক্ষমা আমি কি পারিব, হায়!
সে এলে অবশ তনু, কথা না জুয়ায় আর!
কত যেন অপরাধ,আঁখি নোয় বারবার!
সময় বহিয়া যায়, চলে যায় রূপসী,
রাখিয়া রূপের স্মৃতি ডুবে যায় সে শণী।
“কে বলে বিধাতা আছে,
হায়, বে বলে সে জগতের পিতা,
পিতা কবে সন্তানে কাঁদায়,-
ক্ষুধায় কাঁদিলে দেয় তিতা!
পিতা যদি সর্বশক্তিমান পুত্র কেন তাপের অধীন?
পিতা যদি দয়ার নিধান
পুত্র কেন কাঁদে চিরদিন?
নাহি-নাহি-নাহি হেন জন,
বিধি নাই- নাহিক বিধান।
কোন্ ধনী পিতার সংসারে
অনাহারে মরেছে সন্তান?
মোরা যে বিশ্বের পরমাণু
স্নেহ প্রেম মোদেরো প্রবল;
আর যেই ত্রিলোকের পিতা’
তারি প্রাণ পাষাণ-নিশ্চল?
দাসীপুত্র যারা জন্মদাস ভয়ে ভক্তি জানি তাহাদের,
আজন্ম যে হ’তেছে নিরাশ,
– সেও রত তোষামোদে ফের!
ধিক! ধিক! মরণের দাস! মুখে বল পুত্র অমৃতের!
ছিল দিন,
হাসি আসে এবে;
– নখে চিরি’ বক্ষ আপনার,
আমিও ক’রেছি লোহদান লৌহময় পায়ে দেবতার।
বালকের অধল হৃদয়ে
আমিও করেছি আরাধন,
জব কি প্রহলাদ বুঝি কভু
জানে নাই ভকতি তেমন।’
ফল তার?পদে পদে বাধা আাজনম,
বুঝি আমরণ! মরণের পরে কিবা আর?
নাহি-নাহি-নাহি কোনো জন।”
অকস্মাৎ চাহিল চার্ব্বাক পশ্চিমে
পড়েছে হেলে রবি,
রশ্মি-রসে ডুবু ডুবু বন,
আবিভূতা বনে বনদেবী!
মঞ্জুভাষা রূপে বনদেবী
শিরে ধরি’ পাষাণ কলস,
আসে ধীরে আশ্রম বাহিরে গতি ধীর,
মম্বর, অলস।
পর্ণরাশি-মর্ম্মর-মন্ত্রীর পদতলে মরিছে গুঞ্জরি’;
অযতনে কুস্তলে বহুলে লগ্ন তার নীবার মঞ্জরী।
লতিকার তত্ত্ব সে অলক, মঙ্গল-প্রদীপ আঁখি তার;
পরিপুর সংযত পুলকে কপোল সে পুষ্প মহুয়ার।
ওঠে, তার জাগ্রত কৌতুক,
অধরেতে সুপ্ত অভিমান:
বাহুলতা চন্দনের শাখা,
বর্ণ তার চন্দ্রিকা সমান।
চাহিয়া, সহসা বালা ডাকিল চার্জাকে
“ওগো! শোনো শোনো শুনিম্ন এনেছ তুমি মৃগ শিশু এক,
আছে কি এখনো ?”
মন-ভুলে চেয়েছিল মুখপানে তার বিস্ময়ে চার্বাক,
নীরব হইল বালা; কি দিবে উত্তর?
বিষম বিপাক।
কহে শেষে ক্ষীণ হেসে গদগদ বচন
“সুন্দর হরিণ,
চিত্রিত শরীর তার সোনার বরণ;-
যেয়ো একদিন! আজ যাবে?”
মুখ চেয়ে জিজ্ঞাসে চার্ব্বাক ভরসা ও ভয়ে;
মজুভাষা কহে “না, না, আজ?-আজ থাক!” আধেক বিস্ময়ে!
সহসা সংবরি আপনায়,
কহে বালা চাহি মুখপানে,
“শুনিম্ন মা-হারা মৃগ শিশু
মৃত মৃগী কিরাতের ব্যরে;
ইচ্ছা করে পালিতে তাহায়,
– শিশু সে যে মা-হারা হরিণ;
পড় তুমি, অবসর না থাকে তোমার,
– বলিলে পালিতে পারি আমি সারাদিন।
বল, আমি মা হ’ব তাহার।”
“তাই হোক্” কহিল চার্ব্বাক,
“আমার স্নেহের ধনে তব
স্নেহ-ধার দিয়ো তুমি।”
কহি যুবা হইল নির্ব্বাক।
কৌতুকে চাহিয়া মুখপানে
মঞ্জুভাষা মঞ্জুলীলাভরে
চলে গেল মরাল গমনে জল নিতে ক্রৌঞ্চ-সরোবরে।
আশার বাতাসে করি ভর ফিরে এল চার্লাক কুটীরে,
ভাষাহীন আশার আবেশে সুখভরে চুমে মৃগটিরে।
“ঠেকেছিল মনোতরী খান্ প্রাণ-নাশা সংশয়-চত্রায়,
ভাষাহীন আশা পেয়ে আজ হর্ষে ভেসে চলে পুনরায়।
যত কিছু ছিল বলিবার না বলিতে হ’ল যেন কণা বোঝা
-সোজা হ’ল মনে এনে, ধুয়ে গেল যক্ত মাটি মলা।
ছিল ঠেকে ‘মনোতরী স্থান,-
চলিল সে কাহারু ইঙ্গিতে?
কে গো তুমি ছজ্ঞেয় মহান্ ?
কে দেবতা এলে আশিষিতে?-
” এ আনন্দ কে দিলে আমায়?
– আশা-সুখে মন পরিপূর!
এতদিন চিনি নি তোমায়;
আজ বটে দয়ার ঠাকুর!”
রাত্রি এল; শয্যাতলে জাগিয়া চার্ব্বাক,
আশা-সুখে ধন্ত মানে জন্ম আপনার;
নিগুণ মহেশে যেই করিয়াছে হেলা,
আনন্দ-মূর্ত্তিতে হিয়া পূর্ণ আজি তার!
সেই একদিন শুধু জীবনে চার্ব্বাক নত হ’য়েছিল নিজে চরণে ধাতার;
প্রেমের কল্যাণে শুধু সেই একদিন,-
সে যে আনন্দের দিন,-দে যে প্রত্যাশার।
কবিতা- ০৭-সহজিয়া
ফুলেই যা’ দিলে ‘বে নাকো ক্ষতি অথচ আমার লাভ,
আমি চাই’ সেই সৌরভ, শুধু
অতনু অতল ভাব।
আমি চাই সেই দূর-হ’তে-পাওয়া আমি চাই মধু-মশ গুল্ হাওয়া,
অন্তরে চাই শুধু রূপসীর
অরূপ আবির্ভাব, যাহা দিলে তার ক্ষতি নাই, তবু আমার পরম লাভ।
বৃটে হ’তে ছি”ড়িতে না চাই দিতে নাহি চাই দুখ,
সহজ প্রেমের অমল আমোদে ভরিয়া উঠুক্ বুক!
ঘাঁটিতে না চাই দুনিয়ায় মাটি তারি মাঝে মিশে রয়েছে যা’ খাঁটি,
নিতে হ’বে সেই পরশ মণির চুম্বিত সৌনাটুকু,
কারো কোনো ক্ষতি হ’বে না, অথচ আমার ভরিবে বুক।
কবিতা-০৮- লীলার ছল
আমি যদি চাই, অবগুণ্ঠনে তুমি মুন্নুখানি ঢাব;
নয়ন ফিরালে, তবে, অনিমিথে কেন গো চাহিয়া থাক!
এমনি করিয়া চিরদিন কিগো!
জড়ায়ে রাখিবে মোরে?
তবু কাছাকাছি হবেনা?
আমার জীবন দিবে না ভ’রে?
নয়ন তোমার করে অনুনয়,
তুমি দূরে সরে থাক! লীলায় হেলায়
মেঘের মেলায় রঙীন্ স্বপন আঁক!
পুজা চাও তুমি হৃদয়-প্রাণের হায় গো পাষাণ-দেবী!
তবুও আমায় ধন্য হইতে দিবে না তোমায় সেবি’!
ফাগুন ফুরায় ফুল ঝরে যায়
ওগো কৌতুক রাখ,
হৃদয়ের পুরে
- পরিচিত সুরে
ডাক গো বারেক ডাক।
কবিতা- ০৯-অবগুন্ঠিতা
আমি
বসনে ঢুেকেছি মুখ দেখিতে তোমায়!
দূরে সরে যাই, বুকে আঁকিতে তোমায়!
তুমি অভিমান-ভরে ফিরে যেয়ো না,
নিরাশ নয়নে বঁধু তুমি চেয়ো না;
আমার ভুবন ভরি’ আছ দিবা-বিভাবরী,
আঁখির পুতলি! হেরি আঁখিতে তোমায়!
লব্ধ-দুর্লভ হে মম বাঞ্ছিত নিধি!
সাধনার ধন! নিঃসঙ্গ এ অন্তরের চির আকিঞ্চন!
করুণ-লোচনা! অন্ধ এ মন্দিরে তুমি উদার জোছনা।
মলিন খুলির কোলে লয়েছ গো ঠাঁই,
জোছনারি মত তবু জ্বঙ্গে মানি নাই!
অয়ি ইন্দুলেল্গা! অন্তরে পেয়েছি তোমা,
নহি’ আর একা।
নহি আর সমুদভ্রান্ত,
ক্ষুধিত নয়ানে,
ফিরি নাক’ দেখে দেশে নিষ্ফল সন্ধানে;
হে অমৃত-ধারা!
উঞ্জ কটাক্ষের ভিক্ষা হ’য়ে গেছে সারা।
এসেছ হৃদয়ে তুমি সহজ গৌরবে,
পূর্ণ করি’ দশ দিক মন্দার সৌরতে;
আমি মুগ্ধ চিতে ফিরেছি নীড়ের
কোলে তোমারি ইঙ্গিতে!
আপনি মগন হ’য়ে গেছি আপনাতে,
ভাবিতেছি নিশিদিন-কী আছে আমাতে!
যাহার সন্ধানে তুমি এসে ধরা দেছ?
হায়, কে তা’ জানে
সংসারের মাঝে ছিন্ন সন্ন্যাসী উদাস,
তুমি সঙ্গে নিয়ে এলে ফুলের নিশ্বাস,
আনিলে চেতনা, দুখের গদগদ সুখ, সুথের বেদনা!
ভেবেছিন্ন জগতের আামি নহি কেহ,
তুমি ভেঙে দিলে ভুল, দিলে তব স্নেহ,
মর্ম্ম পরশিলে,
রুদ্ধ উৎস খুলে গেল,
হে সুন্দরশীলে!
আজি মোর সর্ব্ব চিত্ত্ব সারা
ভমু ভরি আনন্দ অমৃত-ধারা ফিরিছে সঞ্চরি’!
নীরবে নিভৃতে আমাতে মিশেছ তুমি,
অয়ি অনিন্দিতে!
জীবনে এসেছ পূর্ণা!
রিক্তা তিথি-শেষে,
মানসী দিয়েছ দেখা মানুষের দেশে,
অয়ি স্বপ্ন সখী,
তোমারি মাধুরী আজ নিখিলে নিরখি’।
তুমি সে বালিকা যার চম্পক অঙ্গুলি লিখিত মেঘের স্তরে চঞ্চল বিজুলি!
যাহার লাগিয়া জাগিত গো তন্দ্রাতুর বালকের হিয়া।
শিয়রে সোনার কাঠি ঘুমাইতে তুমি,
মুক্ত দ্বারে রৌদ্র আর জ্যোৎস্না যেত চুমি’!
সাগরের তলে তুমি সে গাঁথিতে মালা মুকুতার ফলে।
তোমারি পরশ বহে বসন্ত বাতাস,
বর্ষা-জলোচ্ছাসে ছিল তোমারি নিশ্বাস!
মুচ্ছিত বৈশাখে ও লাবণ্য-মণি ছিল চম্পকের শাথে।
তুমি ছিলে অন্ধকারে কালোচুল খুলে;
চন্দ্রালোকে তোমারি অঞ্চল পড়ে হলে;
সন্ধ্যা সরোবরে গন্ধতৃণে গন্ধ রেখে তুমি যেতে স’রে!
স্বপ্নে ছিলে স্বর্গে ছিলে মগ্ন পারিজাতে, অতনু আভাস ছিলে,
ছিলে কল্পনাতে; আজ একেবারে মর্তে এলে মূর্ত্তি ধরে আমারি দুয়ারে!
মুগ্ধ মোরে ক’রেছ গো মুগ্ধ চোখে চাহি’,
– ধুয়ে মুছে দেছ গ্লানি, তাই সখী গাহি বন্দনা তোমারি,
তব প্রেমে মণিহার পরেছে ভিখারী।
কবিতা- ১০- প্রিয়-প্রদক্ষিণ
প্রিয়ার ও উঁহু অতনু সে কোন্ দেবতার মন্দির!
বন্ধনহীন মন উদাসীর আলয় সে শান্তির।
তাহারে ঘিরিয়া ঘুরিছে হৃদয় ঘুরিছে রাত্রিদিন,
উৎসুক সুখে কৌতুকে তারে করিছে প্রদক্ষিণ!
ফিরিছে হৃদয় কুন্তলে তার ফিরিছে কপোলে,
চোখে; অধরে, উরসে, চরণে পানিতে ফিরিছে তাম্র-নখে!
ফিরিছে আঙুলে, ফিরিছে জড়লে,
ফিরিছে ভুরুর তিলে, ফিরে অবিরাম,
কৌতূহলের অস্তু নাহিক মিলে।
ঘুরি গো যাত্রী দিবস রাত্রি
অনুপ দেউল ঘিরে।
নূতন প্রেমের নির্মূল-করা ‘নিম্নালি’ ধরি’ শিরে!
কত হাসি কত পুলক-অশ্রু কবি গো আবিষ্কার,
দৈব প্রসাদে খোলে দেউলের নূতন নূতন দ্বার!
নূতন প্রণয় নব পরিচয় নব রাগিণীর গীতি,
কত জনমের মূর্ছনা তাতে মুচ্ছিত কত স্মৃতি!
প্রিয়ার দিঠিতে ভোলামন আজ হয়েছে জাতিস্মর,
দৈব আলোকে ভ’রেছে দু’চোখ ভরেছে নীলাম্বর!
প্রিয়ার রূপের অন্ত নাহিরে নূতন সে ক্ষণে ক্ষণে,
ক্ষণে ক্ষণে তার শোভা নব নব হেরি বিশ্বদ মনে!
উদ্বেল তাই হৃদয়-পরাণ নাচিছে রাত্রি দিন;
নিবিড় পরশ আঁথি সনে করে প্রিয়ারে প্রদক্ষিণ!’
কবিতা-১১- তুমি ও আমি
তুমি আমি-আমরা দোঁহে যুক্ত ছিলাম আলিঙ্গনে ফুল-জনমে;
ছিলাম যখন পাড়ি-ঘেরা সিংহাসনে;
আমার ছিল সোনার রেণু, স্নিগ্ধ মধু তোমার হাসে,
তুমি ছিলে মধ্য-কেশর আমি তোমার ছিলাম পাশে।
হঠাৎ কি যে মর্জ্জি হ’ল,
হঠাৎ কেমন হ’ল মতি তফাৎ হয়ে গেলাম দোঁহে,
-বিমুখ পরস্পরের প্রতি! দীর্ঘ দিনের তপস্তাতে কায় মী হ’ল ছাড়াছাড়ি,
আমি ক্রমে হ’লাম পুরুষ, তুমি প্রিয়ে হ’লে নারী।
তফাৎ হয়েই ফুটুল আঁখি, দেখতে পেলাম পরস্পরে-
ভিতর থেকে টান পড়েছে, টবে নাকো থাক্লে স’রে;
‘নোল্’ দিয়ে তাই এগিয়ে এল্লাম, এগিয়ে হটে গেলাম পিছে,
মান অভিমান জাগল ধারল,মিলন বাধা বাড়ল মিছে।
আজ বিরহের দারুণ দায়ে পরস্পরে চাইছি মোরা,
– আজ বিধাতার বিড়ম্বনায় চেখের জলে ঝরছে ঝোরা;
আর মিলনের নেইক আশা মৌমাছিদের ঘটকালিতে,
ভাঙা এ মন জুড়তে এখন হচ্ছে নিতি জোড়-তালিতে।
তফাৎ হ’য়ে নেইক তৃপ্তি, ছ’ ঠাঁই হ’য়ে ছথ মেনেছি,
লাভের মধ্যে, হায় গো বিধি, হারিয়ে-পাওয়ার স্বাদ জেনেছি;
হারিয়ে-পাওয়া। গভীর সে সুখ!-প্রবল সে যে দুখের বাধায়!
বিচিত্র সে নূতন মিত্র!-এক সাথে সে হাসায় কাঁদায়!
ফুল জনমে অভেদ ছিলাম,-যুক্ত ছিলাম আলিঙ্গনে,
আজ আমাদের এই মিলনে সেই কথাটিই জাগছে মনে;
দূরে স’রে দুনিয়া ঘুরে আবার মিলন এই জনমে,
মুক্ত দোঁহার যুক্ত হৃদয় আজ বিধাতার পায়ে নমে।
কবিতা- ১২- অকারণ
শূন্য যখন গাভিনীর তীর,
পথে কেহ নাহি চলে,-
গড়ে নাক দাঁড় থোঁ তরণীর তিমির-মগন জল্যে
নীলাম্বরীর স্নাঞ্চল দিয়া সন্ধ্যা ত্বে দেয় দৃষ্টি রুধিয়া,,
গন্ধ তৃণের বিভোল গন্ধ বাতায়ের কোলে ঢলে;
করুণে মুরলী বাজে পরপারে, দীপ জ্বলে নিবে কিনারে কিনারে,
সুখ নীড়ে পাখী ঘুম-ভরা আঁখি স্বপনে কি যেন বলে; .
তখনি এ হিয়া উঠে উছসিয়া
নয়নে-অশ্রু ছলে।
যবে ঝর ঝরে বারিধারা ঝরে আর সব রহে চুপ-
তরু পুল্লবে সঞ্চিত জল
জলে পড়ে-টুপ টুপ,
যবে ঘুমন্ত কেতকীর শাখে জড়ায়ে নিভৃতে সুনিবিড়
পাকে গন্ধ-মগন কাল ভুজঙ্গ খুসিরা খসিয়া উঠে;
দাদুরীর ডাকে ভরি’ উঠে বন, দাপাটরা ফিরে দশ্য পবন,
নব কল্পস্ব যুথীর গন্ধ আকাশে, বাতাসে লুটে,-
তখনি এ হৈয়া উদ্ঠ উছসিন্ন নয়নে অশ্রু ফুড়ে!
প্রথম শরতে অম্বরে যবে মেঘ-ডম্বরু বাজে, –
যবে খরশাণ বিধাতার বাণ ঝলসে গগন মাঝে,-
কমল কলিকা শঙ্কিত মনে রহে নতমুখে মুদিত নয়নে,
তরুণ অরুণ কিরণ স্মরিয়া কুরিয়া ঝুরিয়া মরে,-
ব্যাকুল পরাণ খুঁজে আশ্রয়,
– খুঁজে সে শরণ চাহে সে অভয়,
– এ তিন ভুবনে আপনার জনে
খু’জি’ মরে সকাতরে,-
উছসি’ উঠিয়া বিরহী এ হিয়া নয়ন-সলিলে ভরে।
পউষের রাতে কঙ্কাল সম বিথারি’ রিক্ত শাখা,
কাঁদে যবে তরু ভিজিয়া শিশিরে ভস্ম-কুহেলি-মাখা,
কুকুর তুলে বুক্কন ধানি,
যুৎকার করে উলুক অমনি,.
উত্তর বায়ু শীতের প্রতাপ প্রচারে ভূমগুলে,,
দীর্ঘ যামিনী পোহায় জাগিয়া- তপ্ত হিয়ার পরশ মাগিয়া,
পরাণ ক্ষুণ্ণ নয়ন শুভ্য নিবিড় তিমির তলে,
– তখনি এ হিয়া উঠে উছলিয়া,
নয়নে মুকুতা ফলে।
এ কি বিধুরতা হায় রে বিরহী!
*কালে কালে নিতি নিতি!
এ কি রে দহন রহি’ রহি’ রহি’
একি অপরূপ গীতি!
এ কি মিছামিছি দুঃখের খেলা,
এ কি মিছামিছি আঁখিজল-ফেলা!
কোন্ বেদনার চির হাহাকার চিরদিন জাগে প্রাণে!
কোন্ খানে শুরু, কোথা উন্মেষ,
কোন/যুগে হায় হ’বে এর শেষ, ‘
কোন্ রাগিণীর ব্যথা ভরা রেশ
ধ্বন্তিছে সকল গানে! অকারণে হায়
অশ্রু গুঁড়ায় কোন্ সাগরের টানে!
পাল্কীর গান
পাল্কী চলে!
পাল্কী চলে! গগন-তলে আগুণ জলে!’
স্তব্ধ গাঁয়ে আদুল গায়ে যাচ্ছে কারা রৌদ্রে সারা!
ময়রা মুদি চক্ষু মুদি’
পাটায় ব’সে
ঢুলছে ক’পে!
দুধের চাচ্চি
শুষছে মাছি,
উড়ছে কতক
ভল্ ভনিয়ে।-
আছে কারা
হন হনিয়ে?
হাটের শেষে রুক্ষ
বেশে ঠিক্ দু’পুরে
ধায় হাটুরে!
কুকুর গুলো
শুক্ছে ধুলো,
– ধুকছে কেহ
ক্লান্ত দেহ।
ঢুক্ছে গরু
দোকান-ঘরে,
আমের গন্ধে
আমোদ করে!
পাল্কী চলে,
পাল্কী চলে- ছল্ল্কি
চালে নৃত্য তালে!
ছয় বেহারা,
– জোয়ান তারা,
– গ্রাম ছাড়িয়ে আগ বাড়িয়ে না মাঠে তামার টাটে!’
তপ্ত তামা,- যায় না থামা,
উঠছে আলে নামছে গাঢ়ায়,
– পাল্কী দোলে ঢেউয়ের নাড়ায়।
ঢেউয়ের দোলে অঙ্গ দোলে!
মেঠো জাহাজ সাম্পে বাড়ে,
一 ছয় বেহারার চরণ-দাঁড়ে।
কালা সবুজ কাজল খ’রে
পাটের ভূমী ঝিমায় দূরে!
ধানের জমী প্রায় সে নেড়া,
মাঠের বাটে. কাঁটার বেড়া!
‘সামাল্’ হেঁকে চল বেঁকে ছয় বেহারা,
– মদ তারা! জোর হাঁটুনি খাটুনি ভারি;
মাঠের শেষে তালের সারি।
তাকাই দূরে, শূন্যে ঘুরে চিল্ ফুকারে মাঠের পারে।
গরুর বাথান,
– গোয়াল্ল-থানা,
一 ওই গো! গাঁয়ের ওই সীমানা!’
বৈরাগী সে,
-কণ্ঠী বাঁধা,-
ঘরর কাথে লেপছে কাঁদা;
মট্কা থেকে চাষার ছেলে দেছে,
ডাগর চক্ষু মেলে!
– দিচ্ছে চালে পোয়াল গুছি; বৈরাগীটির
– মূর্ত্তি গুচি।
–পঞ্জাপতি হলুদ বরণ,-
শশার ফুলে রাখছে চরণ!
কার বহুড়ি বাসন য়াজে?
一 পুকুর ঘাটে ব্যস্ত কাজে;
এটো হাতেই হাতের পৌঁছায় গায়ের,
মাথার কাপ্পড় গোছায়!
পাল্কী দেখে আছে ছুটে ন্যাংটা থোকা,
– মাথায় পুটে!
পোড়োর আওয়াজ যাচ্ছে শোনা;
থোড়ো ঘরে চাঁদের কোণা।
পাঠশালাটি দোকান-ঘরে,
গুরু মশাই দোকান করে!
পোড়ো ভিটের পোতার পরে
শালিক নাচে,
ছাগী চরে।
গ্রামের শেষে
অশথ-তলে
বুনোর ডেরায়
চুল্লী জ্বলে;
টাকা কাঁচা
শাল-পাতাতে
উড়ছে ধোঁয়া
ফ্যান্সা ভাতে।
গ্রামের সীমা
ছাড়িয়ে, ফিরে
পাকী মাঠে না ধীরে;
আবার মাঠে,-
তামার টাটে,
– কেউ ছোটে,
কেউ কষ্টেছাঁটে;
3 মাঠের মাটি রৌদ্রে কাটে,
পাল্কী মাতে
আপন নাটে!
শঙ্খ চিলের সঙ্গে,
যেচে- পাল্লা দিয়ে
মেঘ চলেছে! তাতারসির
তপ্ত রসে বাতাস
সাঁতার দেয় হরষে!
গঙ্গা ফড়িং লাফিয়ে চলে;
বাঁধের দিকে সূর্য্য চলে।
পাল্কী চলে রে! অঙ্গ ঢলে রে!
আর দেরী কত? আরো কত দূর?
“আর দুর কি.গো? বুড়ো শিবপুর
ওই আমাদের;
ওই, হাটতলা,
ওরি পেচুখানে
ঘোষেদের গোলা।
পাল্কী চলে রে,
অঙ্গ টলে রে; সূর্য্য চলে,
পাল্কী চলে!
কবিতা- ১৩-মুগ্ধা
ওই রূপে মোর মন ভুলেছে,
ভরেছে মন মোহন রূপে!
জেগে তোমায় স্বপন দেখি,
তোমার রূপে যাচ্ছি ডুবে!
ওগো আমার দখিন হাওয়া!
ওগো আমার তমাল ছায়া!
ওগো শ্যামল শাঙনী মেঘ!
ওগো আমার গায়ক গুণী!
এই গিয়েছ কাছটি থেকে,
অসীম তোমার দক্ষিণতা,
তপ্ত জনের ঘুচাও ব্যথা;
স্বপ্নে তোমায় চায় যে যূথী,
ওগো আমার গানের পুথি!
ভাবছি ছুটে যাই এখুনি,
বাড়িয়ে-বলা নয় গো এ
নয় ভালবাসার-ভুল্-বকুনি;
হায় ৫গা বিধির এনি রিধান
মিলন-বেলাই অল্প-আয়ু,-
শীতের বেলার চেয়েও খাটো,
বইছে তবু দখিন বায়ু!
ফুল-জাগানো দখিন হাওয়া,
দিল্ জাগানো দক্ষিণতা;
মিলন-মেলা যায় ফুরায়ে,
ফুরায় না হায় মনের কথা।
দূরে কেন যায় গো লোক্কে,
আমি যে চাই, থাকৃতে কাছে,
আনাগোনা ফুরিয়ে দিয়ে কাছে
থাকায় দোষ কি আছে?
এসো কাছে প্রিয় আমার-
এস আমার জনম ভরি’;
একলা ঘরে ওগো! আমি
তোমার কথা স্মরণ করি।
আসতে তোমায় হবেই হবে-
অগৌণেতেই আস্তে হবে,-
জেগে ভাল ফেল্লে বেসে-স্বপ্নে ভাল বাস্তে হ’বে।
কবিতা-১৪-গ্রীষ্ম-চিত্র
বৈশাখের খরভাপে মুচ্ছাগত গ্রাম,
ফিরিছে মন্থর বায়ু পাতায় পাতায়;
মেতেছে আমের মাছি, পেকে ওঠে আম,
মেতেছে ছেলের দল পাড়ায় পাড়ায়।
সশব্দে বাঁশের নামে শির,-
শব্দ করি’ ওঠে পুনরায়;
শিশুদল আতঙ্কে অস্থির পথ ছাড়ি’ ছুটিয়া পালায়।
স্তব্ধ হ’য়ে সারা গ্রাম রহে ক্ষণকাল,
রৌদ্রের বিষম ঝাঁঝে শুক ডোবা ফাটে;
বাগানে পশিছে গাভী, ঘুমায় রাখাল,
বটের শীতল ছায়ে বেলা তার কাটে।
পাতা উড়ে ঠেকে গিয়া আলে,
কাক বয়ে দড়িতে কুয়ার’;
তন্দ্রা ফেরে মহাজের মহালে,
ঘরে ঘরে ‘ভেজানো দুয়ার।
কবিতা-১৫-সাড়ে চুয়াত্তর
দূর থেকে আজ ওগো তোমায় মনের কথা কই,
নূতন খবর নেই কিছু আজ মনের খবর বই।
ভাব ছি আমি কোথায় তুমি হায় সে কতদূর,
কোথায় সহর কল্কাতা আর কোথায় কুসুমপুর!
না জানি কি ভাবছ এখন করছ কিবা কাজ,
কার সাথে বা কইছ কথা? পরেছ কোন্ সাজ?
ইচ্ছা করে হাওয়ার ভরে তোমার কাছে যাই,
করছ যে কি পিছন থেকে লুকিয়ে দেখি তাই।
ইচ্ছা করে শুন্তে তোমার বচন সোহাগের,
ইচ্ছা করে-ইচ্ছা করে-ইচ্ছা করে চের!
ইচ্ছা করে কত কি যে-সাধ যে জাগে আজ,
– শাদার পরে কালি দিয়ে লিখতে সে পাই লাজ।
জ্বৰে যদি না পড় সে দিনের বেলায় আর তবে লিখি,
-লিতে সে লোভ হচ্ছে যে বারবার!
হচ্ছে সে লোভ,
কিন্তু, ওগো!-পড় না এর পর,
আমার চিঠির এইখানে আজ সাড়ে চুয়াত্তর;
এইখানে শেষ করতে হবে দিনের বেল্লার পাঠ,
রাতের পড়া রাত্রে হবে, ভাঙলে লোকের হাট।
বাকীটুকু শোত্রার বেলায় বন্ধ ক’রে ঘর
এক্লাস্কুলে দেখতে হ’বে রেখে শেষের পর;
সেই গোপ্লনে মনে মনে পোড়ো চিঠির শেষ,
নিদ-মহলে বন্ধু! আমার আর্জি হ’বে পেশ।
সেই গোপনের আবরণে, জানাই তোমার পায়
, একটি তোমার চুমার লাগি পরাণ কাঁদে,
হায়! দিয়ো দিয়ো একটি চুমা আমার চিঠির গায়,
প্রদীপ যদি হাসতে থাকে নিবিয়ে দিয়ো তায়।
দাও যদি সে পাবই আমি,
পাবই আমি টের,
হাওয়ার আগে হ’বে বিলি বার্তা হৃদয়ের।
আসবে স্বপন তোমার বেশে মুদলে আঁখির পাত,
কাটবে সারা রাত্রি সুখে বন্ধু! প্রিয়! নাথ!
দূর থেকে সুর লাগবে বীণায়, জাগবে গো অন্তর,
আমার চিঠির মাঝখানে তাই সাড়ে চুয়াত্তর।
কবিতা-১৬-গ্রীষ্মের শুর
হয়ে!
বসন্ত ফুরায়!
মুগ্ধ মধু মাধবের গান ফন্তু সম লুপ্ত আজি,
মুহ্যমান প্রাণ। অশোক নির্মাল্য-শেষ,
চম্পা আজি পাণ্ডু হাসি হাসে,
ক্লান্ত কণ্ঠে কোকিলের যেন মুহুর্মুহু কুহুধ্বনি নিবে নিবে আসে!
দিবসের হৈম জ্বালা দীপ্ত দিকে দিকে,
উজ্জ্বল-জাজ্জ্বল-অনিমিখ,
নিঃশ্বসিছে নিঃস্ব হাওয়া,
হুতাশে মুর্জিত দশদিক্! রৌদ্র আজি রুদ্র ছবি,
আকাশ পিঙ্গল, ফুকারিছে চাতক বিহ্বল,
– খিন্ন পিপাসায়; হায়!
হায়!
আনন্দ ধরায় নাহি আজ আনন্দের লেশ,
চতুদিকে ক্রুদ্ধ আঁখি, চারিদিকে ক্লেশ।
সংবর ও মূত্তি, ওগো একচক্র-রথের ঠাকুর!
অগ্নি-চক্ষু অশ্ব তব মুচ্ছি বুঝি পড়ে,
অরে সে ছুটাবে কত দূর?
সপ্ত সাগরের বারি সপ্ত অর্থে তব করিছে শোষণ তৃষ্ণাভরে,
তবু নাহি তৃপ্তি মানে, পিয়ে নদ, নদী,
সরোবরে পঙ্কিল পৰঞ্চল পিয়ে গোস্পদে ও কূপে,
গ্রুপে রস-তাও পিয়ে চুপে! তৃপ্তি নাহি পায়! হায়!
হায়! সান্ত্বনা কোথায়? রৌদ্রের সে রুদ্র আলিঙ্গনে
জগতের ধাত্রী ছায়া আছে উষ্মা-মনে;
আশাহত ক্ষুদ্ধ লোক, আকাশের পানে শুধু চায়,
ময়ূরের বর্হ সম ময়ূখের মালা বহিতেজে চৌদিকে বিছায়!
হর্ম্ম্যতলে, জলে, স্থলে, স্নিগ্ধ পুষ্পদলে আজ শুধু অগ্নি কণা ক্ষরে,
হাতে মাথে ধুনী আালি’ বসুন্ধরা কৃচ্ছ, ব্রত করে;
ওঠে না অনিন্দ্য চরু আমোঘ প্রসাদ,-
দেবতার মূর্ত আশীর্ব্বাদ,- দীর্ঘ দিন যায়, হায়!
হায়!!
হৃদয় শুকায়!
‘নাহি বল,
নাহিক সম্বুল,
অন্তরে আনন্দ নাই;
চক্ষে নাহি জল!
মূক হ’য়ে আছে মন,
দীর্ঘশ্বাসে অবস্থান গান,
বিশ্বত সুখের স্বাদ হৃদি অনুংলুক,
ধুক ধুক করে উধু প্রাণ।
কে করিবে অনুযোগ?
দেবতার কোপ,
কোথা বা করিবে অনুযোগ?
চারিদিকে নিরুৎসাহ,
চারিদিকে নিঃস্ব নিরুযোগ!
নাহি বাষ্প বিন্দু নভে,
বরযা সুদূর;
দগ্ধ দেশ তৃষায় আতুর,
ক্লান্ত চোখে চায়; হায়!
কবিতা-১৭-অন্তঃপুরিকা
আর যে আমার সইছে নারে সইছে না আর প্রাণে,
এমন ক’রে কতদিন আর কাটবে কে তা’ জানে!
দিন গুণে দিন ফুরায় নাকো নিমিষ গণি তাই,
বুকের ভিতর হাঁফিয়ে ওঠে, আঙ্গুল চোখে চাই।
যে থান্টিতে বস্তু সে জন বছি সেখায় গিয়ে,
দেখছি খুলে চিঠিটি তার ঘরে দুয়োর দিয়ে;-
বেশী আমি পাইনি ও গো পাইনি বেশী,
আর, পারে যাবার একটি কড়ি একটি চিঠি তার।
হাসিয়েছিল কোন কথাতে, হাচ্ছি/মনে ক’রে,
দেখতে হঠাৎ ‘ইচ্ছে হ’য়েচক্ষু এল ভ’রে।
শোবার ঘরে করাট এঁটে ছবিটি তার লিখি,
হয় না কিছু, সেইটি তবু নয়ন ভ’রে দেখি।
নানান কাজে ব্যস্ত থাকি, তবুও কেন ছাই,
মনটা ওঠে আকুল হ’য়ে, উদাস হ’য়ে যাই।
ডানা যদি দিতেন বিধি উড়ে যেতাম চ’লে,
সকল ব্যথা সইত, মাথা রাখতে পেলে কোলে।
সীতা সতী বুদ্ধিমতী, প্রণাম করি পায়,-
আজ বুঝেছি বনে কি সুখ,
কি দুখ অযোধ্যায়।
কবিতা-১৮-আনন্দ-দেবতার প্রতি
এস আমি প্রমোদ! পুলক! রভস হে!
মুছেছি অশ্রুধার; আজ মুকুল নহে তো অবশ হে!
তায় নীহার নাহিক আর।
আজ ধরণী আঁচলে আবর’ গো!
যত কালিকার ঝরা ফুল,
নদী
কাকলি-কুজনে কুহর’
গো গাহ গাহ কুলুকুল!
তবু পাথী নীহারে শিহরে ফুলদল!
নীবব পুনর্ব্বার !
নদী ভাসাইয়া আনে
অবিরল শুধু চিতার ভগ্নভার!
পরি’
আমি শ্মশানে বাসর রচিব গো শুষ্ক ফুলেরি হার,
নয়ন উপাড়ি রুধিব গো নয়নের বারিধার।
আমি
এই
রভস-দেবতা! বঁধুয়া হে! এস সথা একবার,
রাখিব রাখিব রুধিয়া হে। নয়নের বারিধার। তুমি আমি
এস
এই
কবিতা-১৯-দরদী
(বাউলের সুর)
মনের মরম কেউ বোঝে না!
(এরা) হালে কাঁদে, কাঁদলে হাসে!
(আহা) দরদ দিয়ে কেউ দেখে না
(ওগো) গরজ নিয়ে সবাই আসে।
(যেজন) হিয়ার হাসি কান্না বোঝে
(ওগো) ছিলাম আমি তারি খোঁজে,
(হায় রে) কার্টুল বেলা ভাঙল মেলা
(তবু) বসেই আছি আসার আশে।
বন্ধু! তোমায় বন্ধ বা কি?
আড়াল থেকেই মিলাই আঁখি
(আমি) প্রাণের খবর পাইনে চোখে
(শুধু) মুখ-চাওয়া সার দ্বারের পাশে।
(ওগো) মরমী কেউ মিল্ড যদি
(তবে.) বইত উজান জীবন-নদী-
(ওগো) নিরবধি সেই দরদীর (মোহন)
বাঁশীর সুরে প্রেমোল্লাসে!
(মালিনী ছন্দের অনুকরণে)
উড়ে চলে গেছে বুবুল,
শূন্যময় স্বর্ণ পিঞ্জর;
ফুরায়ে এসেছে ফাল্গুন,
যৌবনের জীর্ণ নির্ভর।
রাগিণী সে আজি মন্থর,
উৎসবের কুঞ্জ নির্জন;
ভেঙে দিবে বুঝি অন্তর ম
ঞ্জীরের ক্লিষ্ট নিকণ।
ফিরিবে কি হৃদি-বল্লভ পুষ্পহীন শুষ্ক কুঞ্জে?
জাগিবে কি ফিরে উৎসব খিন্ন এই পুষ্প পুঞ্জে?
ভাঙনে ভেঙেছে মন্দির কাঞ্চনের মূর্ত্তি চূর্ণ,
বেলা চলে গেছে সুন্ধির,
– লাঞ্ছনার পাত্র পূর্ণ।
1 কনক-ধূতুরা
কনক-ফুচুর!! কনক-ধুতুরা !
পরিপূর তুমি বিষে; ও তমু-পাত্রে
অতনু-সুষমা উপচি’ উঠিল কিসে?
তুমি অপরূপ ওগো রূপবতী! অপরূপ তব কথা!
মুকুলিত করি’ তুলিছ কেবলি মৃত্যু ও মাদকতা!
উথলি’ উঠিছে একটি বৃস্তে দুখের সঙ্গে সুখ,
মৃত্যু-অভেদ জীবন-নৃত্য!- মন করে, উৎসুক!
সোনার গেলাসে মুগ্ধ মদিরা!- কর্ণে কী কণা জপে!
ফেণগুঞ্জনে মত্তলোচনে মৃত্যুর হাসি সঁপে!
কনক-ধুতুরা !,
কনক-ধুতুরা! কিসে তুমি পরিপূর?
মুগ্ধ নয়নে আমি তোর পানে চেয়ে আছি তৃষাতুর।
কবিতা-২০-চাতকের কথা
হে সরসী! তুমি স্বচ্ছ শীতল,
– বলেছে আমায় অনেক পাখী;
হায়, আমিও তৃষিত,
তবু তোর পানে নারিনু নারিনু ফিরাতে আঁখি!
তুমি সুন্দর, তুমি সুবিপুল,
সুলভ তোমার অগাধ বারি,
মোর সমুখে রয়েছ নিশিদিনমান
তবু তো ও জল ছুইতে নারি! 4
তবু
নিয়ত আকাশে আশা এখ-চাওয়া,
নিত্য নিয়ত তৃষার জালা, তোর ‘পরে মোর ফিরিল না মন,
হায় গো রূপসী সরসীবালা!
ওগো বাঁধাজল! করি’ কোলাহল দর্দ রদল বন্দে তোরে,
হায় কাকের ভেকের তুমি আরাধ্যা
আমি তোরে সেবি কেমন ক’রে?
নিন্দা তোমায় করিনে গো আমি,-
নাই নাই মনে ঘৃণার কণা; খেলা-ছলে হেলা করিনে তোমায়,-
পাই নি তেমন কুমন্ত্রণা। হায়
তৃষ্ণা আমায় দিয়েছেন বিধি,- সে তৃষা ফটীক-জলের তৃষা,
ওগো শাস্তির আশা সুদুর আমার,- দহন আমার দিবস নিশা!
আমি
মেঘের রন্ধে করি আনাগোনা,
বিজলীতে অলি’ ফুকারি ‘ত্রাহি’!
তবু
উধাও-ধাওয়ার হায়াৎ-পাওয়ার চকিত-
চাওয়ার তুলনা নাহি।
ওগো
বিধাতা আমায় এমন করেছে,
一 দুষ্কর এতে করেছে ব্রতী;
তাই
পুষ্কর মেঘে মজে আছে মন,
নাই সে পুষ্করিণীর প্রতি।
হে সরসী! তুমি তারার আরসী,-
স্বচ্ছ অগাধ আরামে ভরা; আকাশে জলের রয়েছে যে দ্রোণী সেই চাতকের তৃষ্ণা-হরা।
তবু
কবিতা-২১-ঝোড়ো হাওয়ায়
ঝোড়ো হাওয়ায় রোল উঠেছে কোলাহলের সাথ! আকাশ জুড়ে অকালে ওই ঘনিয়ে আসে রাত!
আজকে যারা ফিরত ঘরে হারাল পথ পথের ‘
পরে ধুলায় আঁখি বন্ধ, হ’ল অন্ধ অকস্মাৎ।
ডাঙায় গাছের ডাল টুটিছে,
বিষম ডামাডোল, জলে নায়ের হাল ছুটিছে,
বোল্ রে হরি বোল!
তুর্ণ ছোটে ঘূর্ণি হাওয়া ফুরায় বুঝি পারে, যাওয়া;
পান্থ পার্থী পাল্টে পাখা নিল মাঠের কোল।
যোজন জুড়ে মেঘে মেঘে বজ্র-আকর্ষণ,
বহুক হাওয়া ক্ষুরের ধারে, -হ’বে সুবর্ষণ।
গম্ভীরা যে বুকের ‘পরে বসে আছে আড়ম্বরে,-
দন্তটা তার খর্ব্ব হ’বে,-এ তার নিদর্শন।
ঝোড়ো হাওয়ার রোল গুনে আজ মেতেছে পরাণ!
সাবধানী! তুই আজকে কারে করিস্
রে সাবধান মৃত্যু যে আজ চোখের আগে নাচে
মিলন-অনুরাগে, বাহুতে তার মিলিয়ে বাহু গাইতে হ’বে গান!
ঝড়ের তালে নাচবে ধূলি উড়িয়ে ধূসর কেশ।
রুদ্রজটা পড়বে ছিড়ে-জুড়িয়ে যাবে দেশ।
স্বর্গ হ’তে-গঙ্গা ঝ’রে’
দিবে ভুবন স্নিগ্ধ ক’রে;
কুম্ভীরের ওই জিহ্বা-তালুর ঘুচবে পিঙ্গ বেশ।
জানি আমি অপূর্ব্ব ওই রুদ্র গঙ্গাধর,
যেথাই দাহ শুদুঃসহ সেইখানে তার ভর।
দুখের আদি,-সুখের নিদান,-
তারি বরে দুঃখ-নিধান মরণ করে অমৃত দান,
শিব সে-ভয়ংকর!
ছুটুক না সে রুদ্র মরুৎ, নাই তো কোনো ভয়
,- চেতন-জড়ে না হয় হবে পাগড়ী-বিনিময়;
নিশ্বাসে যাঁর ঝঞ্ঝা ছোটে,-
প্রশ্বাসে প্রশান্তি ফোটে,-
তাঁর সুরে সুর মিলিয়ে মোরা মরণ করি জয়।
কবিতা-২২-বজ্র কামনা
হায় শূন্য জীবন নীরস হৃদয়
আর
নীরব দহনে দহে, লুপ্ত অশ্রু মরমের তলে ফন্তু-ধারায় বহে;
ওগো রুদ্র আকাশ্ব নিথর বাতাস অন্ধ’ হুতাশে ভরে,
আজ বরষণ-লোভে বিবশা ধরণী বজ্র কামনা করে!
হায় কুন্তীরক্ষের পিঙ্গল তালু- আকাশ পিঙ্গ ছবি,
তার জিহ্বার মত প্রান্তর ঢালু রৌদ্রে শুষিছে রবি;
হায় খাকী রঙে থাক হ’ল দুই আঁখি দুনিয়াটা গেল খ’রে,
তাই ঘন-বরষণ-লালসে ধরণী বজ্র কামনা করে!
আজ সুখ নাহি দেহে বিশ্রাম-গেছে স্বস্তি নাহিক প্রাণে,
যেন আঙার-ধানীর বাষ্প বিভোল্ খসিছে সকল খানে।
নাই
নাই ফুল ফুল, ফলে নি ফসল ধু ধুধু তেপান্তরে,
হায় ফলের লালসে বন্ধ্যা ধরণী বঙ্গ কামনা করে।
ওগো
হিল্ মিল্ কবে বহিবে সলিল ফেনমুখ ফণা তুলি’?
আর ঝিল্ মিল, কবে ছলিবে সহীরে তাজা অঙ্কুরগুলি?
ওগো খালি কোল কবে ভরিবে আবার- আর কত দিন’ পরে?
হায় সফলতা লাগি’ মৌনে ধরণী বজ্র কামনা করে।
ওগো বস্ত্রের রাজা অস্ত্র তোমার হান একবার বেগে,-
এই ক্ষীণ বাষ্পের দীন উচ্ছ্বাস পরিণত হোক্ মেঘে;
ওগো ঘনায়ে মিলায়ে কর সুনিবিড় তড়িত-জড়িত স্বরে,
আজ
বধ-ভয় ভুলি’ বন্ধ্যা ধরণী বজ্র-কামনা করে।
ওগো বজ্র-দেবতা বজ্র তো শুধু
ও
বধের যন্ত্র নয়; যে বন্ধ্যা-জনের সন্তাপ-হারী,- বন্ধন করে ক্ষয়;
ও
যে মিলন বঁটায় কাঞ্চন-ডোরে ধরণী ও অম্বরে
তাই
বন্ধ্যা ধরণী মরণ-দোসর বন্দ্র কামনা করে।
যক্ষের নিবেদন (মন্দাক্রান্তা ছন্দের অনুকরণে)
পিঙ্গল বিহ্বল ব্যথিত নভতল, কই গো কই মেঘ উদয় হও,
সন্ধ্যার তন্দ্রার মুরতি ধরি’ আজ মন্ত্র-মন্থর বচন কও;
সূর্য্যের রক্তিম নয়নে তুমি মেঘ। দাও হে কজ্জ্বল পাড়াও ঘুম,
বৃষ্টির চুম্বন বিথারি’ চলে যাও-অঙ্গে হর্ষের পড় ক ধূম।
বৃক্ষের গর্ভেই রয়েছে আজো যেই– আজ নিবাস যার গোপনলোক সেই সব পল্লব সহসা ফুটিবার হৃষ্ট চেষ্টায় কুসুম হোক; গ্রীষ্মের হোক্ শেষ,
ভরিয়া সানুদেশ স্নিগ্ধ গম্ভীর উঠুক্ তান,
যক্ষের দুঃখের করহে অবসান, যক্ষ-কাস্তার জুড়াও প্রাণ!
শৈলের পইঠায় দাঁড়ায়ে আজি হায় প্রাণ উধাও ধায় প্রিয়ার পাশ,
মুচ্ছার মস্তর ভরিছে চরাচর,
ছায় নিখিল কার আকুল শ্বাস! ভরপুর অশ্রুর বেদনা-ভারাতুর মৌন কোন স্থর বাজায় মন,
বক্ষের পঞ্জর কাঁপিছে কলেবর,
চক্ষে দুঃখের নীলাঞ্জন!
রাত্রির উৎসব জাগালে দিবসেই,
তাই তো তন্দ্রায় ভুবন ছায়,
রাত্রির গুণ সব দিনেরে দিলে দান,
তাই তো বিচ্ছেদ দ্বিগুণ, হায়;
ইন্দ্রের দক্ষিণ বাহু সে তুমি দেব!
পূজ্য! লক্ত মোর পূজার ফুল,
পুষ্কর বংশের চূড়া যে তুমি মেঘ!
বন্ধু! দৈবের ঘুচাও ভুল!
নিষ্ঠুর যক্ষেশ, নাহিক কপালেশ,
রাজ্যে আর” তাঁর বিচার নেই,
আজ্ঞার লঙ্ঘন করিল একে,
আর শাস্তি ভুঞ্জান্ দুজনকেই!
হায় মোর কান্তার না ছিল অপরাধ,
মিথ্যা সয় সেই কতই ক্লেশ,
দুর্ভর বিচ্ছেদ অবলা বুকে বয়,
পাংশু কুস্তল, মলিন বেশ।
বন্ধুর মুখ চাও, সখা হে সেথা যাও,
দুঃখ দুস্তর তরাও ভাই, কল্যাণ-সংবাদ কহিয়ো কানে তার,
হায়, বিলম্বের সময় নাই; বৃস্তের বন্ধন আশাতে বাঁচে মন,
হায় গো, বল্ তার কতই আর?
বিচ্ছেদ-গ্রীষ্মের তাপেতে সে শুকায়,
যাও হে দাও তায় সলিল-ধার।
নির্মূল হোক্ পথ, শুভ ও নিরাপদ,
দূর-মুহুর্গম নিকট হোক্, হ্রদ, নদ,
নির্ঝর, নগরী মনোহর,
সৌধ শুন্দর জুড়াক্ চোক্;
চঞ্চল খঞ্জন-নয়না নারীগণ বর্ষা-মঙ্গল করুক্ গান,
বর্ষার সৌরভ, বলাকা-কলরব,
নিত্য উৎসব ভরুক্ প্রাণ!
পুষ্পের তৃষ্ণার করহে অবসান,
হোক্ বিনিঃশেষ যুথীর ক্লেশ, বর্ষায়, হায় মেঘ!
প্রবাসে নাই শুখ,হায় গো নাই নাই সুখের লেশ;
যাও ভাই একবার মুছান্তে আঁখি তার,
প্রাণ বাঁচাও মেঘ! সম্বর হও, “বিদ্যুৎ-বিচ্ছেদ
জীবনে না ঘটুকু বন্ধু! বন্ধুর আশিষ লও।
কবিতা-২৩-দুর্দিনে
মলিন অ্যাঁচল চক্ষে চাপিয়া কে তুমি ভুবনে এলে,
- অসীম অকূল দুর্ভাবনার পাংশুল ছায়া মেলে!
হে নীরবচারী, বুঝিতে না পারি মুখে কেন নাহি ভাষ,
কোন্ অক্রর অতলে ডুবিয়া হিম হ’য়ে গেছে খাস?
ছিন্ন-বসন! রিক্ত-ভূষণ! গভীর-শ্বসন! ওরে! কেন গুমরিয়া উঠিস্ কাঁদিয়া?
কি বেদনা বল্ মোরে। বিহ্বল শুর ডাকে দন্দর, চাতক উড়িয়া বসে; মদালস তব মূরতি-সে কোন্ শোকের মাদক রসে।
সহসা শিহরি’ চীৎকার কেন করিলি,
রে উন্মাদ, রুদ্ধ ব্যথার রূঢ় তাড়নার এই কি আর্তনাদ!
ত্রাসে মুদে এল বিশ্বলোকের আয়ত চোখের পাতা,
আধা শাদা হ’য়ে গেল শঙ্কায় বিকচ নীপের মাথা!
অকালে দিনের আলোক হরিয়া কে এলে গো চুপে চুপে,
বিজুলির হাসি পাণ্ডুর করি’ দেখা দিলে ছায়ারূপে!
আঁচল তোমার তিতিয়া ভূতলে অশ্রু ঝরিয়া পড়ে,
বেদনায় তরু-বল্লরী বীথী এ পাশ ও পাশ নড়ে।
ওগো ছদ্দিন! কে পূজিল তোমা ভূ’ই-চাঁপা ফুল দিয়া !
চাঁদ-আঁকা পাখা দোলায় ময়ূর বিস্ময়াকুল হিয়া।
মুর্চ্চিত ধরা আঁখি মেলে,
তোরে পাইয়া ব্যথার ব্যথী,
খুলে গেল তার হাজার নেত্র,
ফুটিল হাজার যুথী!
ওগোঁ কাঁমচারী! সন্তাপহারী!
অন্তর তুমি জানো, বিষাদের
বেশে এসে দেখা দাও,
ব্যথিতে বক্ষে টানো;
অশ্রু ঘুচাতে, ব্যথিতের সাথে অশ্রু মিশাতে হয়,
তুমি তাহা জানো, বন্ধু পুরাণো! দুর্দিন সহৃদয়!
ওগো দেবতার অশ্রু-প্লাবন !
তোমার পাবন-ধারে মলিনতা তাপ ঘুচাও মহীর উর্ধ্বর কর তারে;
নীল পদ্মের মথিত নীলিমা ব্যথিত চক্ষে দাও,
ঘন চুম্বন দান কর, ওগো, বুকে নাও! বুকে নাও!
কবিতা-২৪-অভয়
মেঘ দেখে কেউ করিস্ নে ভয়,
আড়ালে তার সূর্য্য হাসে!
হারা শশীর হারা হাসি অন্ধকারেই ফিরে আসে!
দখিন হাওয়ার অমোঘ বরে রিক্ত শাখাই পুষ্পে ভরে,
সিক্ত যে প্রাণ অশ্রুধারায় প্রাণের প্রিয় তারি পাশে।
কবিতা-২৫-বর্ষা
ঐ দেখ গো আঙ্কে আবার পাগলি জেগেছে,
ছাই মাখা তার মাথার জটায় আকাশ ঢেকেছে!
মলিন হাতে ছুয়েছে সে ছুঁয়েছে সব ঠাঁই,
পাগল মেয়ের জালায় পরিচ্ছন্ন কিছুই নাই!
মাঠের পারে দাঁড়িয়েছিল ঈশান কোণেতে,-
বিশাল-শাখা পাতায়-ঢাকা শালের বনেতে;
হঠাৎ হেসে দৌড়ে এসে খেয়ালের ঝোঁকে,
ভিজিয়ে- দিলে ঘরমুখো ঐ পায়রা গুলোকে!
বজ্রহাতের হাততালি সে বাজিয়ে হেসে চায়, বুকের ভিতর রক্তধারা নাচিয়ে দিয়ে যায়; ভয় দেখিয়ে হাসে আবার ফিফিকিয়ে সে, আকাশ জুড়ে চিমিকিয়ে চিক্সিকিয়ে রে!
ময়ূর বলে ‘কে গো?’ এযে আকুল-করা রূপ! ভেকেরা কয় ‘নাই কোনো ভয়’, জগৎ রহে চুপ; পাগুলি হাসে আপন মনে পাগুলি কাঁদে হায়, চুমার মত চোখের ধারা পড়ছে ধরার গায়।
কোন্ মোহিনীর ওড় না সে আজ উড়িয়ে এনেছে, পূবে হাওয়ায় ঘুরিয়ে আমার অঙ্গে হেনেছে; চঙ্কে দেখি চক্ষে মুখে লেগেছে এক রাশ, ঘুম-পাড়ানো কেয়ার রেণু, কদম ফুলের বাস!
বাদল্ হাওয়ায় আজকে আমার পাগলি মেতেছে; ছিন্ন কাঁথা সূর্য্যশশীর সভায় পেতেছে! আপন মনে গান গাহে সে নাই কিছু দূষ্পাত, মুগ্ধ জগৎ, মৌন দিবা, সংজ্ঞাহারা রাত!
কবিতা-২৬-নাগ পঞ্চমী
হায়! প্রতি বৎসরে হাজার হাজার সোনার মানুষ নাগ-দংশনে মরে।
সেই নাগে মোরা পূজি! সর্গ-পূজার মন্ত্রের লাগি’
বেদ-সংহিতা খুঁজি! নাগ-পঞ্চমী করি! গ্রন্থিল বাঁকা হিস্তাল-শাখা ধরিতে আমরা ডরি।
দুধকলা দিই সাপে! পূজা খেয়ে খল দংশন করে!-মরি গো মনস্তাপে। জানিনে কিসে কি হয়,-
মৃত্যুরে পূজি’ অমরতা-লাভ, কিছু বিচিত্র নয়।
কবিতা-২৭-রামধনু
পুণ্য আখণ্ডল-ধনু মণ্ডিত কিরণে,
রম্য তুমি জলদের নীল শিলাপটে,
“ক্ষুরিত প্রহনে আর প্রশ্নোত রতনে রচিত ও তনুচ্ছদ;
ধূর্জটির জটে
ধূপছায়া শাটি-পরা জাহ্নবীর মত
মেধমাঝে মুর্তিখানি মনোজ্ঞ তোমার;
শ্যাম অঙ্গে রাখী সম শোভন সতত;
হর্ষ-কলতান বিশ্বে তোল বারম্বার!
ইন্দ্রধমু তুমি কিহে পুরাণ-বর্ণিত?
কিম্বা রামধনু নাম যথার্থ তোমার?
প্রজা-বৎসলের কর করি’
অলঙ্কত লভিছ কি আজো তুমি শ্রদ্ধা সবাকার?
রামধনু! রামরাজ্য অতীতে বিলীন,
তুমি তারি রম্য-স্মৃতি চির-অমলিন।
কবিতা-২৮-প্রাবৃটের গান
দাঁড়া গো তোরা ঘিরিয়া দাঁড়া নীরব নত নেত্রে,
দেবতা আজি জীবন-ধারা বরিষে মরুক্ষেত্রে!
শুনিস্ নে কি ঘর্ঘরিয়া চলেছে কে ও স্বর্গ দিয়া,
গগন-পথে বিপুল রথে হেলায়ে হেম বেত্রে!
আবৃত-করা প্রাবৃট এল মেলিয়া মেঘ-পক্ষ,
বিবশা ধরা বিতথ বেশ, খসিছে মুহু বক্ষ।
অজানা ভয়ে অচেনা সুখে কথাটি কারো নাহিক মুখে,
পাথার গেছে বচন হরি’ আঁথির থির লক্ষ্য!
বৃহৎ মুখে বৃংহিতে কি দিগ গজেরা গর্জে?
মিলাবে কিও অমরা ধরা আকাশ ভাঙি’ বঙ্গে?
ধরণী আছে প্রতীক্ষাতে অর্ঘ্য ধরি’ স্বিন্ন হাতে,
শুচিত স্বরভঙ্গ তার কেকার রবে বড় জে।
দাদুরি করে উলুধ্বনি, দেবতা নামে মর্তে,
উনার হ’ল সুরভি আজি ধূপেরি পরিবর্তে!
স্তব্ধ চলা, বন্ধ খেয়া, একাকী উকি স্তায় গো কেয়া,
জ্বালায়ে মণি জাগিছে ফণী ত্যজিয়া নিজ গর্ভে।
দেবতা নামে! পুলকে হের ছালোকে দোলে সিন্ধু!
রথের ধূলে মলিন হ’ল তপন তারা ইন্দু!
বাদল-বায়ে মন্ত্র পড়ি’
বাজায় কেও সাঁঝের ঘড়ি?- থাকিতে বেলা!
বিধান বিধি মানেনা একবিন্দু!
অন্ধ-করা অন্ধকারে নাহিরে নাহি রন্ধু!
বিরামহারা অধীর ধারা পাগল পারা ছন্দ।
হাজার-তারা সেতারখানি বলিছে কিও ডাগর বাণী!
তরল তারে উঠিছে ধ্বনি মেদুর মৃদু মন্দ!
দেবতা চুমে ধরার আঁথি অলক চুমে রুক্ষ!
এলারে পড়ে বাদল-মালা-রূপালি জরি সুক্ষ্ম!
চুমিয়া তনু কুসুমি’ তোলে, হরষ-দোলে পরাণ দোলে!
সেচন করে সফল করে মোচন করে দুঃখ।
দাঁড়াগো তোরা রারীর ডোরা বাঁধিয়া নে গো এস্তে;
দেবতা আসি’ আশিষ-ধারা বরিষে আজি মস্তে!
দেখিস্ নে কি নীলাম্বরে এসেছে করী-কুম্ভ-‘পরে,-
আহত চোখে বিজুলি লেখা, উশীর মাখা হস্তে।
কবিতা-২৯-নূতন মানুষ
ঝুলিয়ে দোলা দুলিয়ে দে!
দুনিয়াতে আজ নূতন মানুষ!-ভুলিয়ে নে রে ভুলিয়ে নে!
দুয়ার ‘পরে আমের মুকুল,- ঝুলিয়ে দে রে অশোক-বকুল,
দেব তা আসে শিশুর বেশে, হায় রে, স্নেহের দান সেধে!
ঝুলিয়ে দোলা ছলিয়ে দে!
নূতন আঁখির সোনার পাতায় সোহাগ-কাজল বুলিয়ে দে!
নূতন আওয়াজ কান্না কাঁদে! নূতন আঙুল আঙুল বাঁধে!
নূতন অধর পীযূষ পিয়ে নুতন মায়ার ফাঁদ ফেঁদে!
ঝুলিয়ে দোলা ছলিয়ে দে! নরম আঁচে সন্ত-দুধের ফেনার রাশি ফুলিয়ে দে!
প্রাচীন দোলার নুতন মালিক এসেছে ঐ ঐন্দ্রজালিক!
অরাজকের আপনি-রাজা রাখবে হৃদয়-মন বেঁধে!
ঝুলিয়ে দোলা দুলিয়ে দে! দোন্না ঘিরে কাঁকণ কারা বাজায় চামর চুলিয়ে রে!
মরণ-বাঁচন-মেলার মাঝে ওই রে শুভ শঙ্খ বাজে,
পুরাণো দীপ চায় গো হেসে, নূতন মানুষ চায় কেঁদে!
কবিতা-৩০-প্রথম হাসি
দোলার ঘরে গুছি গো আজ নূতন হাসির ধ্বনি!
ফুলঝুরিতে ফুল্কি হাসির রাশি!
রূপার মুন্ডুর জড়িয়ে হাতে বাজায় কে খঞ্জনী!
কাঁদুনে ওই শিল্পে কোথায় হাসি!
পিচকারীতে হালে কেরে গোলাপ-জলের ধারা?
– ঝারার পার্থী কুন্ন কি হাসির কথা?
বরফ-গলা ঝর্ণা যেন জাগল পাগল-পারা!
– স্বচ্ছ প্রাণে সরল চঞ্চলতা!
প্রথম হাসির পান সুপারি কে দিল ওর মুখে?
হাসির কাজল কে পরালে চোখে? হাচ্ছে থোকা!
হাচ্ছে একা! হাচ্ছে অতুল সুখে!
এমন হাসি কে শিখালে ওকে?
কলম্বরে হাচ্ছে। ওরে! হাচ্ছে আপন মনে!
– দেখন-হাসি পরীর হাসি দেখে। খুলেছে আজ হাসির কুলুপ কোন্ কুঠুরির কোণে,
– মাণিকে তাই আকাশ গেল ঢেকে!
আনন্দের এই পরম অল্প-প্রথম অন্ন-হাসি কোন্ দেবতা প্রসাদ দিল ওকে?
কাছনে আজ নূতন ক’রে জন্মেছে রে আসি’ জন্মেছে সে হরষ-হাসি-লোকে!
কবিতা-৩১-ভাদ্রশ্রী
টোপর পানায় ভল ডোবা নধর লতার নয়ান-জুলী,
পূজা-শেষের পুষ্পে পাতায় ঢাক্স যেন কুণ্ডগুলি।
তাজা আতার ক্ষীরের মত পূবে বাতাস লাগছে শীতল,
অতল দীঘির নি-তল জলে সাঁৎরে বেড়ায় কাংলা-চিতল।
ছাতিম গাছে দোন্না বেঁধে দুলছে কাদের মেয়েগুলি,
কেয়া-ফুলের রেণুর সাথে ইল্পে-গুঁড়ির কোলাকুলি;
আকাশ-পাড়ার শ্যাম-সায়রে যায় বলাকা জল সহিতে,
ঝিল্লি বাজায় ঝাঁঝর, উলু দেয় দাদুরী মন মোহিতে!
কল্কে ফুলের কুঞ্জবনে জছে আলো খাগেলাসে,
অভ্র-চিকণ টিলি জলের ঝলমলিয়ে যায় বাতাসে;
টোকার টোপর মাথায় দিয়ে নিড়েন হাতে কে ওই মাঠে?
গুড়-চালেতে মিলিয়ে কারা ছিটায় গায়ে জলের ছাটে?
নক্সী রাতে চাষার সাথে চষা-ভু’য়ের হচ্ছে বিয়ে,
হ’চ্ছে শুভদৃষ্টি বুঝি মেঘের চাদর আড়াল দিয়ে;
ক’নের মুখে মনের সুখে উঠছে ফুটে শ্যামল হাসি,
চাষার প্রাণে মধুর তানে উঠছে বেজে আশার বাঁশী!
বাঁশের বাঁশী বাজায় কে আজ?
কোন্ সে রাখাল মাঠের বাটে?
অগাধ ঘাসে দাঁড়িয়ে গাভী ঘাসের নধর অঙ্গ চাটে।
আজ দোপাটির বাহীর দেখে বিজলী হ’ল বেঙা-পিতল,
কেয়া ফুলের উড়িয়ে ধ্বজা পূবে বাতাস বইছে শীতল।
কবিতা-৩২-তখন ও এখন
(রুচিয়া)
তখন কেবল ভরিছে গগন নূতন মেঘে,
কদম-কোরক ছলিছে বাদল-বাতাস লেগে;
বনান্তরের আসিতেছে বাস মধুর মৃদু,
ছড়ায় বাতাস বরিষা-নারীর মুখের সীধু,-
তখন কাহার আঁচলে গোপন যুথীর মালা মধুর মধুর ছড়াইত বাস-কে সেই বালা?
বিপাশ হিয়ার বিনাইত ফাঁস অলক রাশে,
সুদূর সুদূর স্মৃতিখানি তার হিয়ায় ভাসে।
এখন বিভার মহামহিমার আকাশ ভরা,
শরৎ এখন করিছে শাসন বিপুল ধরা;
এখন তাহায় চেনা হ’বে দায় নূতন বেশে,
তরুণ কুমার কোলে আজি তার হাসায় হেসে
লুকাও লুকাও লালসা-বিলাস লুকাও স্বরা,
বাসর রাতির সাথীটি-সে আর না স্বায় ধরা;
এখন কমল মেলিতেছে দল সলিল মাঝে,
বিলোল চপল বিজুলি এখন লুকায় লাজে।
কিশোর প্রাণের কোথা সে ফেনিল প্রেমের পাঁতি,
কোথায় গো সেই নব বয়সের নূতন সাথী;
বিলাস-লীলায় দেখে না সে আর বারেক চাহি,
খেলার পুতুল কোথা পড়ে?-আজ খবর নাহি।
পুতুল পরাণ পেয়েছে গো তার সোহাগ পেয়ে,
নূতন আলোক প্রকাশিছে তাই আনন ছেয়ে!
নূতন দিনের মাঝে পুরাতন লুকায় হেসে,
নূতন দুয়ার দেউলে ফুটাও নিশির শেষে।
কবিতা-৩৩-“ওগো”
কিছু ব’লে ডাকিনেকো তারে,-
ডাতে হ’লে বলি কেবল ‘ওগো!’
ডাকি তারে হাজারো দরকারে জীবন-রণে সেই জেনারল টোগো!
সন্ধি এবং বিগ্রহেরি মাঝে মুহুর্মুহু চাই তারে সব কাজে;
ডাক্তে কিন্তু বাধছে সম্বোধনে,
– ডাতে গিয়ে এগিয়ে দেখি-
‘No Go’ লজ্জা কেমন জোগায় এসে মনে তাইতো তারে ডাকি সেরেফ ‘ওগো!’
ছলে ছুতায় ডাক্ছি সকাল থেকে ‘চাবিটা কই?
‘কাগজগুলো?-ওগো!’ ‘পানের ডিবে?
-কোথায় গেলে রেখে?’ হাঁক ডাকেতে ডাকাত আমি রোধো।
টান্তে সদাই চাই গো তারে প্রাণে শব্দ খুঁজে পাইনে অভিধানে,
– ভাষার পুঁজি শুল্ক একেবারে,
– টাঁকশালে তার হয় না নুতন যোগও;
মন-গড়া নাম চাইরে দিতে তারে,
শেষ-বরাবর কিন্তু বলি ‘ওগো!’
বন্দ্ব ভাবি ‘প্রিয়া’ ‘প্রাণেশ্বরী’ ছেড়ে দিয়ে ‘শুন্ছ?
‘ ‘ওগো!’ ‘হাগো’; বস্তে গিয়ে লজ্জাতে হায় মরি ও সম্বোধন ওদের মানায় নাকো।
ওসব যেন নেহাৎ থিয়েটারী যাত্রা-দলের গন্ধ ওতে ভারি,
‘ডিয়ার ‘টাও একটু ইয়ার-যে যা,
‘পিয়ারা’ সে করবে ওদের খাটো,
– এর তুলনায় ‘ওগো’ আমার খাসা,
যদিও, মানি-একটু ঈষৎ মাঠো।
ঈষৎ মাঠো এবং ঈষৎং মিঠে
এই আমাদের অনেক দিনের
‘ওগো’ চাষের ভাতে সঞ্চ ঘিয়ের ছিটে মন কাড়িবার মস্ত বড় Rogue ও!
ফুল-শেষে সেই ‘মুখে-মুখের’ ‘ওগো!’
রোগের শোকের দুঃখ-সুখের ‘ওগো!’
সব বয়সের সকল রসে ঘেরা,
– নয় সে মোটেই এক-পেশে একচোখো বাংলা
ভাষা সকল ভাষার সেরা স্নিগ্ধ মধুর ডাকের সেরা ‘ওগো’।
কবিতা-৩৪-কাশ ফুল
বরষার ঘন-যবনিকা খানি সহসা গিয়েছে খুলি’,
হেথা
ঘাসের সায়র ফেনিল করেছে কাশের মুকুলগুলি।
ওই
তুলি সমতুল শাদা কাশ ফুল আলো
ক’রে আছে ধূলি,
যেন
‘শারদ জোছনা অমল করিতে
ধরণী ধরেছে তুলি!
যেন
রাতারাতি সুধা-ধবলিত করি’ দিবে গো কাজল মেঘে,
গোপনে স্বপনে তুলি লাখে লাখ সহসা উঠেছে জেগে!
তাই
তারা
তারা
কিছু রাখিবে না পাংশু ধূসর কিছু রাখিবে না রুখু,
আকাশের চাঁদে বুলাইতে চায় আপনার রং টুকু!
তাই
বাতাসের বুকে বুলিছে ধরার বৃত-তুলি অঙ্গুলি,
জোছনায় রং ফলাইতে চায় কাশের ক্ষুদ্র তুলি!
ওগো
কবিতা-৩৫-জোনাকী
ওই
একটি ছ’টি পাতার পরে একটু’মৃদু আলো,
” দেখতে ভারি নূতন, ‘ওয়ে-
ও যে
কেমন লাগে ভালো!
আয় জোনাকী বুকটি ভ’রে একটু নিয়ে আলো,
আঁধার রাতি বাদল সাথী চাঁদের ভাতি কালো।
আজ
যেটুকু তোর দেবার আছে দিয়ে দে তুই আজ,
তারার মত নাই বা হ’ল,-
ও সে
তাতেই বা কি লাজ? ছোট?
সে তো ভালই আরো ছোট বলেই মান;
দুঃখীজনের ভিক্ষা মুঠি,
দানের সেরা দান!
ও বে
থাক্ না তারা তপন শশী থাক্ না যত আলো,
– তাদের মোরা করব পূজা, বাস্ত্র তোরেই ভালো।
কবিতা-৩৬-ফুল-সাঞি
মনে যে সব ইচ্ছা আছে
- পূরবে না সে তোমায় দিয়ে, তাইতে প্রিয়ে!
মন করেছি আরেকটিবার করব বিয়ে।
হাছ কিও? ভাছ মিছে?
মিথ্যা নয় গো মিথ্যা নয়;-
মন যা’ বলে শুনতে হবে,-
মনের নাম যে মহাশয়।
মন বলেছে ‘বিয়ে কর’
কাজেই হবে করতে বিয়ে;-
এবার কিন্তু ফুলের সঙ্গে,-
চছে না আর মানুষ নিয়ে;
মনের কথা মনই জানে;
লুকিয়ে কি ফল তোমার কাছে?
মন সে বড় কেও-কেটা নয়
মনের নিজের মর্জি আছে।
দন বলেছে বালে ভাল পুড়তে হবে এক চিতাতে;
মৃত্যু আমায় করলে দাবী- মরতে তুমি পারবে সাথে?
পারই যদি; তাতেই বা কি?
আইন তোমায় বাধ বে, প্রিয়ে!
কাজেই দেখ, যা’ বলেছি চল্বে নাকো তোমায় দিয়ে।
এবার বিয়ে ফুলের কুলে,.
জ্যোৎস্না-ধারায় অঙ্গ ধুয়ে,
হ’ক সে চাঁপা কিম্বা গোলাপ আপত্তি নেই বকুল জুয়ে।
আব-ঘরে কিশোর কুঁড়ি মনের গোপন পাঁজী দেখে,
বাঁদীর মত আনব বেছে বনের বান্দা-বার্জার থেকে।
সোহাগ দিয়ে রাখব ঘিরে, ঢাক্ব কভু প্রাণের নীড়ে,
ইচ্ছা হ’লে তুল্ব শিরে,
ইচ্ছা হ’লে ফেল্ম ছিঁড়ে।
মর্জি হ’লে হাজারটিকে পরব গলায় গেঁথে মালা,
ঝগড়াঝাঁটির নেইক শঙ্কা সতীন-
কাঁটার নেইক জ্বালা।
নেইক দ্বন্দ্ব দু’ইচ্ছাতে,-
নেইক লোকের নিন্দাভয়। -হাচ্ছ? হাস।
কিন্তু প্রিয়ে করব বিয়ে সুনিশ্চয়।
ফুল-সাঞি যে ফকির আছে ফুলকে তারা ভালবাসে,
তাদের ধারা ধরব এবার,- থাক্ক মগন ফুলের বাসে।
থাব্ব ডুবে অগাধ রূপে কুরূপ কাঁটা দেখব নাকো;
ফুল নিয়ে ঘর করব এবার তোমরা সবাই সুখে থাকো।
তার পরে দিন আসবে যখন মরতে আমি পারব সুখে,
ইতস্ততঃ করবে না ফুল থাতে একা শবের বুকে।
ফুল-সে আমার সঙ্গে যাবে- পুড়ব মোরা এক চিতাতে;
দেখিস্ তোরা দেখিস্ সবাই যেতে সে ঠিক্ পারবে সাথে।
ভেবেছিলাম প্রথম প্রিয়ে! তোমায় এসব বন্ধ নাকো,
লুকিয়ে ক’রে আস্ব বিয়ে লুকিয়ে হবে সাতটি পাকও।
কিন্তু ছাপা রইল না, হায়; মনের কথা-গোপন অতি- বেরিয়ে গেল কথার কথায়,
– কথায় বলে মন-না-মতি!
মনের ভিতর মর্জি আছেন নবাবী তাঁর অনেক রকম,
কবিতা-৩৭-ফুল-শির্ণি
(মুসলমান সাহিত্যিকবৃন্দের অভ্যর্থনার জন্ম বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষৎ-কর্তৃক
আহত সভায় কোজাগর পূর্ণিমায় পঠিত।)
গুগ গুলু আর গুলাবের বাস মিলাও ধূপের ঘুমে।
সত্যপীরের প্রচার প্রথমে, মোদেরি বঙ্গভূমে।
পূর্ণিমা রাতি। পূর্ণ করিয়া দাও গো হৃদয় প্রাণ;
সত্যপীরের হুকুমে মিলেছে হিন্দু মুসলমান!
পীর পুরাতন, নূর নারায়ণ,- সত্য সে সনাতন;
হিন্দু মুসলমানের মিলনে তিনি প্রসন্ন হ’ন।
তাঁরি ইশারায় মিলিয়াছি মোরা হৃদয়ে জ্যোৎস্না জ্বালি’;
তাঁহারি পূজায় সাজায়ে এনেছি ফুল-শির্ণির ডালি।
বাঙালীর কবি গাহিছে জগতে মহামিলনের গান,
বিফল নহে এ বাঙালী জনম বিফল নহে এ প্রান।
ভবিশ্বতের পানে মোরা চাই আশা-ভরা আহলাদে,
বিধাতার কাজ সাধিবে বাঙালী ধাতার আশ্বর্ব্বাদে।
বেতালের মুখে প্রশ্ন যে ছিল আমরা নিয়েছি কেড়ে,
জবাব দিয়েছি জগতের আগে ভাবনা ও ভয় ছেড়ে;
বাঁচিয়া গিয়েছি সত্যের লাগি’ সর্ব্ব করিয়া পণ,
সত্যে প্রণমি’ থেমেছে মনের অকারণ স্পন্দন।
সাধনা ফলেছে, প্রাণ পাওয়া গেছে জগৎ-প্রাণের হাটে,
সাগরের হাওয়া নিয়ে নিশ্বাসে গম্ভীরা নিশি কাটে;
শ্মশানের বুকে আমরা রোপণ করেছি পঞ্চবটী,
তাহারি ছায়ায় আমরা মিলার তের শতকোটি।
মণি অতুলন ছিল যে গোপন স্বজনের শতদলে,-
ভবিষ্যতের অমর সে বীজ আমাদেরি করতলে;
অতীতে যাহার হ’য়েছে সূচনা সে ঘটনা হবে হবে,
বিধাতার বরে ভরিবে ভুবন বাঙালীর গৌরবে।
প্রতিভায় তপে সে ঘটনা হবে, লাগিবে না তার বেশী,
লাগিবে না তাহে বাহুবল কিবা জাগিবে না দ্বেযান্বেবি;
‘মিলনের মহামন্ত্রে মানবে দীক্ষিত করি’ ধীরে- মুক্ত হইব
দেব-ঋণে মোরা মুক্তবেণীর তীরে।
মনের কথা বলে খুলে
টিটকারী সে করবে জখম।
লুপ্ত যুগের অস্থিগুলো গুপ্ত আছে মনের ভিতে,
– সভ্যতাঁর এই সৌধতলেই,-
বর্তমান এই শতাব্দীতে!
তাই মগজের পোড়ো কোঠায় অন্ধকারে ঘুরছে চাবী,
– বছে উঠে গঙ্গাযাত্রী;-
সহমরণ করছি দাবী!
বাঁচন এই যে সম্প্রতি মন মগন আছে ফুলের রূপে,
– নইলে কিষে ঘত বিপদ!-
বন্দ্ব তাহা তোমায় চুপে?-
মরণ-দায়ে গেছ বেঁচে;
পালাও প্রিয়ে প্রাণটা নিয়ে;
ফুল-সাঞিদের মতন আমি ফুলকে এবার করব বিয়ে!
কবিতা-৩৮-জবা
আমারে লইয়া খুলী হও তুমি ওগো দেবী শবাসনা!
আর খুঁ জিরোনা মানব-শোণিত আর তুমি থু জিয়োনা।
আর মানুষের হৃৎ-পিণ্ডটা নিয়োনা খড়ো ছিঁড়ে,
হাহাকার তুমি তুলোনা গো আর মুখের নিভৃত নীড়ে।
এই দেখ আমি উঠেছি ফুটিয়া উজলি’ পুষ্প-সভা,
– ব্যথিত ধরার হৃৎপিণ্ড গো!- আমি সে রক্তজবা।
তোমার চরণে নিবেদিত আমি আমি সে তোমার বলি,
- দৃষ্টি-ভোগের রাঙা খর্পরে রক্ত-কলিজা কলি।
আমারে লইয়া খুসী হও ওগো!
নম দেবী নম নম,
ধরার অর্ঘ্য করিয়া গ্রহণ ধরার শিশুরে ক্ষম।
কবিতা-৩৯-ছায়াচ্ছন্না
ছিন্ন ছায়া ঘনিয়ে এল ঘুমে নয়ন আলা,
ঘুমাক্ আহা ঘুমাক্ তবে বালা; হাওয়ার ভরে যায় পরীরা,
ঢেউয়ের ফণায় নিল হীরা, জড়িয়ে গেল ললাট ঘিরে
নিদকুসুমের মালা! ঘুমাক্ আহা ঘুমাক্ তবে বালা।
তোলে নি আজ বৈকালী ফুল,- ভরে নি আজ থালা,
ছায়ায় ছাওয়া রূপের রসের ডালা;
গন্ধ তৃণের গহন খাসে শিউলি কুঁড়ি ঝিমিয়ে আসে,
তন্দ্রা-ভারে পড়ল ভেরে। আঁধারে ডাল-পালা!
ঘুমাক্ আহা ঘুমাক্ তবে বালা।
শিয়রে থোও সোনার কাঠি সন্ধ্যা-মেঘে ঢালা,
খণ্ড চাঁদের দীপখানি হোক্ জ্বালা;
হাওয়ার মুখে নাই কোনো বোল,
– অশথ পাতায় দেয় না সে দোল,
আঁধার শুধু কোল ভরেছে,- হিমে শীতল-কালা!
ঘুমাক্ আহা ঘুমাক্ তবে
বালা!
শুনবে না সে আজ ঝিঝিদের রাত্রি ব্যাপী পালা, –
দেখবে না গো বনে জোনাক্- জ্বালা;
পর্দাথানি দাও গো টানি’ ঘুমিয়ে গেছে আলোর রাণী,
লুপ্ত-শিখা সোনার প্রদীপ মৃত্যু-ভুবন আলা;
ঘুমিয়ে গেছে ঘুমিয়ে গেছে বালা।
কবিতা-৪০-সৎকারান্তে
রেখে এলাম এক্লা-যাবার পথের মোড়ে; সেই কথাটি জানাই,
প্রভু! করজোড়ে! নেহাৎ শিশু নয় সেয়ানা,
অচেনা তার ষোল আনা,- ভয় যদি পায় নিয়ো তুলে অভয় ক্রোড়ে,
প্রভু আমার! এক্লা-চলা পথের মোড়ে।
তোমার পায়ে সঁপে দিয়ে-নির্ভাবনা; নইলে প্রভু!
সইত কভু যম-যাতনা? যম-নিয়মের ভৃত্য তোমার,-
চিতার শিখা অঙ্গুলি তার,- সেই আঙুলে নেয় সে চুনি’ রত্ন-কণা;
তোমার হাতে সঁপে সে হয় নির্ভাবনা!
সঁপে গেলাম প্রভু! তোমার চরণ-ছায়ে,
– মুক্ত হ’লাম তোমার দয়ায় সকল দায়ে;
ফিরিয়ে তোমার গচ্ছিত ধন হাল্কা হ’য়ে গেল জীবন,
মায়ের বুকের রত্ন দিলাম বিশ্ব-মায়ে, ওগো প্রভু!
সঁপে গেলাম তোমার পায়ে।
রেখে গেলাম তুমি-দোসর পথের মোড়ে,
সেই কথাটি জানাই তোমায় করজোড়ে;
জানি তুমি নেবেই কোলে,
তবু তোমায় যাচ্ছি বলে,-
বিশ্বমায়ে বল্ছি,-অবোধ, নিতে ওরে;
– দাঁড়িয়ে তোমার যম-জাঙালের বক্র মোড়ে।
কবিতা-৪১-ছিন্ন মুকুল
সব চেয়ে যে ছোটো পীড়ি খানি সেই খানি আর কেউ রাখে না পেতে,
ছোটো থালায় হয় নাকো ভাত বাড়া, জল ভরে না ছোট্টো গেলাসেতে;
বাড়ীর মধ্যে সব চেয়ে যে ছোটো খাবার বেলায় কেউ ডাকে না তাকে,
সব চেয়ে যে শৈষে এসেছিল তারি খাওয়া ঘুচেছে সব আগে।
সব চেয়ে যে অল্পে ছিল খুসী,-
খুসী ছিল ঘেঁষাঘেঁষির ঘরে, সেই গেছে, হায়,
হাওয়ার সঙ্গে মিশে দিয়ে গেছে জায়গা খালি ক’রে;
ছেড়ে গেছে, পুতুল, পুঁতির মালা,
ছেড়ে গেছে মায়ের কোলের দাবী,
ভয়-তরাসে ছিল যে সব চেয়ে সেই খুলেছে আঁধার ঘরের চাবী!
চলে গেছে এক্লা চুপে চুপে, দিনের আলো গেছে আঁধার ক’রে;
যাবার বেলা টের পেলে না কেহ। পারলে না কেউ রাখতে তারে ধ’রে।
চ’লে গেল,-পড়তে চোঁখের পাতা,- বিসর্জনের বাজনা শুনে বুঝি!
হারিয়ে গেল অজানাদের ভিড়ে, হারিয়ে গেল,-পেলাম না আর খুঁজি’।
হারিয়ে গেছে-হারিয়ে গেছে, ওরে।
হারিয়ে গেছে বোল্-বলা সেই বাণী,
হারিয়ে গেছে কচি সে মুখখানি দুধে-ধোয়া কচি দাঁতের হাসি।
আঁচল খুলে হঠাৎ স্রোতের জালে ভেসে গেছে শিউলি ফুলের রাশি,
ঢুকেছে হায় শ্মশান ঘরের মাঝে ঘর ছেড়ে তাই হৃদয় শ্মশান-বাসী।
সব চেয়ে যে ছোটো কাপড়গুলি সে গুলি কেউ দেয় না মেলে ছাদে,
যে শয্যাটি সবার চেয়ে ছোটো আজকে সেটি শূন্য পড়ে কাঁদে;
সব চেয়ে যে শেষে এসেছিল সেই গিয়েছে সবার আগে স’রে,
ছোট্ট যে জন ছিল রে সব চেয়ে সেই দিয়েছে সকল শুল্ক ক’রে।
কবিতা-৪২-ভুই চাঁপা।
দিনের আলোয় লা রে নীল তন্দ্রা-লেখা!
নিবিড় সুখে কী কৌতুকে বাজল কেকা!
রসিয়ে রবি-রশ্মি হোখা পূবে হাওয়ার বইল সোঁতা,-
আজ পাতাল-ঘরের নাগিনী ওই বাইরে একা!
কৌতূহলী কেকাধ্বনি মূর্ত্তি ধরে!-
ফুল সে দু’ই চাঁপা হ’য়ে মাটির ‘পরে! বিস্ময়েরি বোল্ বেজেছে,
– বিনা-ডালেই ফুল সেজেছে!-
ওই
লুপ্ত গাছের গোপন মূলে কী মস্তরে!
শাঁওল-বরণ শাওলাতে ছায় কোমল মাটি,
মাটির কোলে পাপড়ি মেলে ভূঁই চাঁপাটি!
মগন ছিল পাতাল-তলে জাগল সে আজ কিসের ছলে?
– ঠেল মাথার বৃষ্টিধারার রূপার কাঠি!
বুঝি
বেরিয়েছে তাই পাতাল-পুরীর রত্ন-কণা!
– লক্ষ-ফণা অনন্তেরি একটি ফণা!
আন্ জনমের নষ্ট মুকুল,
এই দিনের এই ফুটন্ত ফুল,- –
ওগো যুক্ত সে কোন্ গোপন স্বতায়-অদর্শনা!
দিনের আলোয় লাগছে আজি তন্দ্রা চোখে,
নিবিড় নীলে ডুবিয়ে নিল স্বপ্নলোকে!
পাতাল-পুরীর কুণ্ড হ’তে অমৃত কে বহায় স্রোতে!-
ওগো জন্ম-মরণ যুক্ত ক’রে ফুটুল ও কে!
আজকে থালি ফিরে-পাওয়ার বইছে হাওয়া!
নেই কিছু নেই চিরতরেই হারিয়ে-যাওয়া!
হারাণো ফুল ফুটছে ফিরে শাঁওল মাটির আঁচল ঘিরে!
ওই মূলের ঘরে মিল্ যে আছেই-যাবেই পাওয়া!
কবিতা-৪৩-ধূলি
জীবনের লীলাক্ষেত্র পুণ্য ধরাতল,
প্রতি ধূলিকণা তার পবিত্র নির্মূল।
মানবের হর্ষ, ব্যথা, মানবের প্রীতি,
মানবের আশা, ভয়, সাধনার স্মৃতি,
– স্পন্দিত করিছে তার প্রত্যেক অণুরে নিত্য নিশিদিনমান;
অবিশ্রাম সুরে উঠিছে গুঞ্জন গান অশ্রুত-মধুর –
অতীতের প্রতিধ্বনি বিশ্বত সুদূর!
এই যে পথের ধূলি উড়ায় বাতাস মহামানবের ইহা মৌন ইতিহাস; তীর্থময় মর্ত্যলোক;
প্রতি রেণু তার আনন্দ-গদগদ চির অশ্রু-পারাবার।
কবিতা-৪৪-মাটি
এই যে মাটি-এই যে মিঠা-এই যে চির-চমংকার,-
চরণে লীন এই যে মলিন-এই যে আধার নিরাধার,-
এই মাটি গো এই পৃথিবী-এই যে তৃণ-গুল্মময়,
তারার হাটে মাটির ভাঁটা, তাই বলে এ তুচ্ছ নয়।
মাটি তো নয়-জীবন-কাঠি,
কণায় কণায় জীবন তার,-
মাটির মাঝে প্রাণের খেলা,
মাটিই প্রাণের পারাবার! মাটি তো নয়-
মায়ামুকুর-একপিঠে তাঁর লীলার খেল,
আরেকটি দিক অন্ধ-অসাড়, রশ্মিঘাতে অনুজেল!
মাটিই আবার মরণ-কাঠি, মাটির কোলে উদয়-লয়,
যে মাটিতে ভাঁড় গড়ে রে তাতেই মানুষ মানুষ হয়!
মাটির মাঝে যা’ আছে গো সূর্য্যেও তার অধিক নেই,
তড়িৎ-স্থতার লাটাই মাটি, জীবন-ধারার আধার সেই!
কবিতা-৪৫-গঙ্গার প্রতি
সঞ্জীবিয়া উভতীর,
সঞ্চারিয়া শ্যাম-শস্ত-হাসি,
তরঙ্গে সঙ্গীত তুলি’ ছড়াইছ ফেন-পুষ্প-রাশি অয়ি সুরধুনী-ধারা!
অমোঘ তোমার আশীর্ব্বাদ! পালিছ সংসার তুমি লোকপাল-বিষ্ণুর-প্রসাদ!
রিক্ত ছিল মহী, তারে তব বর করিল উর্ধ্বর,
কৃতজ্ঞ মানব তাই কীর্তি তোর গাহে নিরন্তর;
যুগে যুগে ওঠে তাই তোরে ঘিরি’ বেদ-মন্ত্র-গাথা,
ব্রহ্ম-কমণ্ডলু-ধারা! সর্ব্বতীর্থময়ী তুমি মাতা!
তোরে ঘিরি’ উর্ধ্বরতা,
তোরে ঘিরি’ স্তব-উপাসনা,
তোরে ঘিরি’ চিতানল উদ্ধারের খসিছে কামনা;-
তীরে তীরে প্রেতভূমে; অয়ি রুদ্র-জটা-নিবাসিনী!
শবেরে করিছ শিব তুমি দেবী অশিব-নাশিনী।
অমল পরশ তোর, বড় স্নিগ্ধ মাগো তোর কোল,
অন্তকালে ক্লান্ত ভালে বুলাও গো অমৃত হিল্লোল।
কত জননীর নিধি সঞ্চিত রয়েছে ওই বুকে;
তোরে সঁপি পুত্রকল্লা, তোরি কোলে ঘুমাইবে সুখে
একদিন তারা সবে; দেহভার বহে প্রতীক্ষায়;
আত্মার মিলন স্বর্গে, তোর জলে কায়ে মিলে কায়,-
ভন্ম মিলে ভগ্ন সনে,-এ মিলন প্রত্যক্ষ সাকার!
যুগে যুগে আমাদের মিলনের তুমি মা আধার।
পর্ব্ব রচি’ তাই মোরা তোরি তীরে মিলি বারম্বার,
পরশি তোমারে-অয়ি পিতৃ-পুরুষের-ভস্মাধার!
চক্ষে হেরি শুদ্র দ্বিজ স্নকলের মিলিত সমাধি,
অয়ি গঙ্গা ভাগীরথী! ভারতের অন্ত, মধ্য, আদি!
কবিতা-৪৬-শোণ নদের প্রতি
সৈকত-শয্যার ‘পরে সুবিশাল বাহু যেন কার সূচনা করিয়া শুভ ‘দুরিয়া উঠিছে বারখার বলদৃপ্ত, কাঞ্চন-বরণ। হে হিরণ্য-বাহু নদ,- কোন্ দেবতার তুমি বাহু? কত ঋদ্ধ জনপদ,- কত গ্রাম, কত ক্ষেত্র-সম্পদে দিয়েছ তুমি ভরি’; দিয়েছ-দিতেছ আরো; নাহি জানি কত কাল ধরি’।
প্রাচীন পাটলিপুত্র-পোষ্য প্রতিপাল্য সে তোমার,- মৌর্য্যমণি চন্দ্রগুপ্ত গ্রীকরাণী অঙ্কে দিল যার,- মৌর্য্যবংশ স্থাপয়িতা; যে বংশের প্রতাপে মলিন সূর্য্যবংশ। ধৰ্ম্মাশোক যাহারে পালিল বহুদিন জগতের শ্রেষ্ঠ রাজা। ওগো শোণ! তোমারি শোণিতে পুষ্ট সে গোবিন্দসিংহ; -গুরু নামে খ্যাত অবনীতে।
ওগো শোণ! স্বর্ণবাহু! অতীতের মুকুটের সোনা! তোমার ও উন্মিজাল-গৌরবের স্বর্ণ-জরি-বোনা!
কবিতা-৪৭-বারাণসী
যাত্রীরা সবে বলিয়া উঠিল-‘দেখা যায় বারাণসী!’
চমকি চাহিলু,-স্বর্গ-সুষমা মর্ত্যে পড়েছে খসি’!
এ পারে সবুজ বড়ার ক্ষেত, ও পারে পুণ্যপুরী,
দেবের টোপর দেউলে দেউলে কাঁপিছে কিরণ-ঝুরি;
শারদ দিনের কনক-আলোকে কিবা ছবি ঝলমল,-
অযুত যুগের পূজা-উপচার, হেম-চম্পকদল!
আধ-চাঁদখানি রচনা করিয়া গঙ্গা রয়েছে মাঝে,
স্নেহ-সুশীতল হাওয়াটি লাগায় তপ্ত দিনের কাজে।
জয় জয় বারাণসী! হিন্দুর হৃদি-গগনের তুমি চির-উজ্জ্বল শশী।
অগ্নিহোত্রী মিলেছে হেথায় ব্রহ্মবিদের সাথে,
বেদের জ্যোৎস্না-নিশি মিশে গেছে উপনিষদের প্রাতে;
এই সেই কাশী ব্রহ্মদত্ত রাজা ছিল এইখানে,
খ্যাত যার নাম শাক্যমুনির জাতকে, গাথায়, গানে;-
যার রাজত্ব-সময়ে বুদ্ধ জন্মিল বারবার ন্যায়-ধর্ম্মের মর্য্যাদা প্রেমে করিতে সমুদ্ধার।
এই সেই কাশী-ভারতবাসীর হৃদয়ের রাজধানী,
এই বারাণসী জাগ্রত-চোখে স্বপন মিলায় আনি’!
এই পথ দিয়া ভীষ্ম গেছেন ভারত-ধুরন্ধর,-
-কাশী-নরেশের কন্তারা যবে হইল স্বয়ম্বর।
সত্য পালিতে হরিশ্চন্দ্র এই কাশীধামে, হায়,
পুত্র জায়ায় বিক্রয় করি’ বিকাইল আপনার।
তেজের মূর্ত্তি বিশ্বামিত্র সাধনায় করি’ জয়- হেথা লভিলেন তিনটি বিছা,
সৃষ্টি, পালন, লয়;
বিদ্ধায় যিনি জ্যোতির পুঞ্জ করিলেন সমাহার,
নূতন স্বর্গ করিলেন যিনি আপনি আবিষ্কার।
শুদ্ধোদনের স্নেহের দুলাল ত্যজিয়া সিংহাসন করুণা-ধৰ্ম্ম চেথায় প্রথম করিল প্রবর্তন।
এই বারাণসী কোশল দেবীর বিবাহের যৌতুক,
দেখিতেছি যেন বিম্বিসারের বিস্মিত স্মিতসুখ!
নৃপতি অশোকে দেখিতেছি চোখে বিহারের পইঠায়,
শ্রমণগণের আশীর্ব্বাচনে প্রাণ মন উথলায়!
সমুখে হাজার স্থপতি মিলিয়া গড়িছে বিরাট স্তুপ,
শত ভাস্কর রচে বুদ্ধের শত জনমের রূপ।
চিকণ চারু শিলার ললাটে লিখিছে শিল্পজীবী ধৰ্ম্মাশোকের মৈত্রীকরুণ অনুশাসনের লিপি!
মহাচীন হ’তে ভক্ত এসেছে মৃগদাব-সারনাথে,-
স্তপের গাত্র চিত্র করিছে স্বপ্ন সোনার পাতে।
জয়! জয়! জয় কাশী!
তুমি এসিয়ার হৃদয়-কেন্দ্র,-মূর্ত্ত ভকতি রাশি!
এই কাশীধামে ভক্ত তুলসী লিখেছেন রামকথা,
ভকতি যাঁহার অপ্রমত্ত প্রভুপদে সংযতা।
এই কাশীধামে জোলাদের ছেলে কবীর রচিল গান,
যাঁহার দোহায় মিলেছিল দুহু হিন্দু মুসলমান।
এই কাশীধামে বাঙালীর রাজা মরেছে প্রতাপরায়,
যার সাধনায় নবীন জীবন জেগেছিল বাংলায়।
মৃত্যু হেথায় অমৃতের সেতু, শব নাই-শুধু শিব!
মনে লয় মোর হেথা একদিন মিলিবে নিখিল জীব;
আত্মার সাথে হ’বে আত্মার নবীন আত্মীয়তা,
মিলন-ধর্মী মানুষ মিলিবে; এ নহে স্বপ্নকথা।
জয় কাশী! জয়! জয়! সারা জগতের ভকতি-কেন্দ্র হ’বে তুমি নিশ্চয়।
স্ফাটক শিলার বিপুল বিলাস মাত্র নহ তো তুমি,
আমি জানি তুমি আনন্দ-ধাম ছুঁয়ে আছ মরভূমি;
আমি জানি তুমি ঢাকিয়াছ হাসি ভ্রুকুটির মসীলেপে,
অমৃত-পাত্র লুকায়ে রেখেছ সময় হয়নি ভেবে;
তৃষিত জগত খুঁ জিতেছে পথ, ডেকে লও, বারাণসী!
পথিকের প্রীতে প্রদীপ জ্বালিয়া কেন আছ দূরে বসি’?
মধু-বিজ্ঞায় বিশ্বমানবে দীক্ষিত কর আজ, ঘুচাও বিরোধ,
দন্ত ও ক্রোধ, ক্ষতি, ক্ষোভ, ভয়, লাজ।
সার্থক হোক্ সকল মানব,
জয়ী হোক্ ভালবাসা,
সপ্তস্কারের পাষাণ-গুহায় পড়ুক কৰ্ম্মনাশা।
ব্যাসের প্রয়াস ব্যর্থ সে কভু হ’বেনাশে একেবারে
সবারেই দিতে হ’বে গো মুকতি এ বিপুল সংসারে।
তুমি কি কখনো করিতে পার গো শুচি অশুচির ভেদ?
তুমি যে জেনেছ চরাচর ব্যাপী চির জনমের বেদ।
স্তম্ব হইতে ব্রহ্ম অবধি অভেদ বলেছ তুমি,
– ভেদের গণ্ডী তুমি রাখিয়ো না, অয়ি বারাণসী ভূমি!
ঘোষণা করেছ আশ্রয়ে তব ক্ষুধিত রবে না কেহ;-
প্রাণের অন্ন দিবে না কি হায়? কেবলি পুষিবে দেহ?
দাও সুধা দাও, পরাণের ক্ষুধা চির-নিবৃত্ত হোক,
বিশ্বনাথের আকাশের তলে মিলুক সকল লোক।
অখিল জনের হৃদয়ে রাজ্য কর তুমি বিস্তার,
সকল নদীর সকল হৃদির হও তুমি পারাবার।
পর যে মন্ত্রে আপনার হয় সে মন্ত্র তুমি জানো,
বিমুখ বিরূপ জগত-জনেরে মুগ্ধ করিয়া আনো;
বিচিত্র মালা কর বিরচন নানা বরণের ফুলে,
অবিরোধে লোক সার্থক হোক পাশাপাশি মিলেফুলে;
দূর ভবিষ্য নিখিল বিশ্ব যে ধনের আশা করে-
তুমি বিতরিয়া দাও সে অমৃত জগত জনের করে।
জয়! বারাণসী জয়! অভেদ মন্ত্রে জয় কর তুমি জগতের সংশয়।
কবিতা-৪৮-হিমালয়াষ্টক
নম নম হিমালয়! গিরিরাজ-তুমি,
মানচিত্রের মসীর চিহ্ন নয়!
বর্ষা-মেঘের মত গম্ভীর!
দিগ বারণের বিপুল শরীর!
অবাধ বাতাস বাধ্য তোমার,
তোমারে সে করে ভয়।
নম নম হিমালয়!
নম নম গিরিরাজ! অযুত ঝোরার মুক্তা-ঝুরিতে উজ্জ্বল তব সাজ;
সূত্রবিহীন কুসুমের হার উল্লাসে শোভে উরসে তোমার;
মৃদু-পণিকা করিছে অঙ্গে পত্র-রচনা কাজ! নম নম গিরিরাজ!
নম মহামহীয়ান্! নতশিরে যত গিরি-সামন্ত সম্মান করে দান।
গুহার গূঢ়তা, ভৃগুর ভ্রুকুটি, তোমাতে রয়েছে পাশাপাশি ফুটি’,
ভীম অর্ব্বদ, ভীষণ তুষার গাহিছে প্রলয় গান! নম মহামহীয়ান্!
নম নম গিরিবর!
স্থির-তরঙ্গ-ভঙ্গিমাময় দ্বিতীয় রত্নাকর।
শিখরে শিখরে, শিলায় শিলায়,-
চপল-চমরী-পুচ্ছ-লীলায়,-
সাগর-ফেনের মত সাদা মেঘ নাচিছে নিরন্তর।
নম নম গিরিবর।
নম নম হিমবান্! মৌনে শুনিছ বিশ্ব-জনের দুঃখ-সুখের গান;
নিখিল জীবের মঙ্গল-ভার নিজ মস্তকে বহু অনিবার,
চির-অক্ষয় তুষার তোমার শত চুড়ে শোভমান;
নম নম হিমবান্।
নম নম ধরাধর!
নাগবেণী আর সরল শালেতে মণ্ডিত কলেবর;
মেঘ উত্তরী’, তুষার কিরীট, ছত্র আকাশ,
ধরা পাদপীঠ; তুমি লভিয়াছ মৃত্যু-ভুবনে চির-অমরতা-বর! নম নম ধরাধর।
প্রত্যুষে সে যে ফুটিয়া,
প্রদোষে নিঃশেষে লয় পায়,
সোনার কাহিনী স্মরিতে একটি পাপড়ি না রহে, হায়!
কে জানে কথন অপ্সরাগগ সে ফুল চয়ন করে,
সোনালি স্বপন লেগে যায় শুধু নরের নয়ন ‘পরে।
নিত্য প্রভাতে ফাগুয়া তোমার ওগো কাঞ্চন-গিরি!
দেব-হস্তের কুঙ্কুম ঝরে নিত্য তোমারে ঘিরি’!
সোনার অতসী সোনার কমলে নিত্যই ফুল-দোল!
নিত্যই রাস জ্যোৎস্না-বিলাস! হরষের হিল্লোল!
নিত্য আবার বিভূতি তোমার ঝরে গো জটিল শিরে,
কন্কনে হিম তুষার-প্রপাত সর্পের মত ফিরে!
দিনে তুমি যেন মূর্ত্ত জীবন
রজত-শুভ্র-কায়া,
নিশীথে তুমিই ভীষণ পাংশু
মহা-মরণের ছায়া;-
আঁধারের প্লটে যখন তোমার পাণ্ডু ললাট জাগে,
– ভয়-বিস্ফার নয়নে যথন তারাগণ চেয়ে থাকে!
তুমি উন্নত দেবতার মত, উদ্ধত তুমি নহ,
নিগূঢ় নীলের নিৰ্ম্মলতায় বিরাজিছ অহরহ।
দৃষ্টি আমার ধৌত করিছে রুচির তুষার তব,
হৃদয় ভরিছে হরষ-জোয়ার বিস্ময় নব নবু!
এ কি গো ভক্তি?-বুঝিতে পারি না; ভয় এ তো নয় নয়,
সকল-পরাণ-উথলানো এ যে সনাতন পরিচয়!
তোমার আড়ালে বাস করি মোরা তোমার ছায়ায় থাকি,
তোমাতে করেছে স্বর্গ রচনা মুগ্ধ মোদের আঁখি;
ভূলোকের হ’য়ে ছ্যুলোক-ক্লেড়েছ স্বর্লোক আছ তুমি’,
অমর-ধামের যাত্রার পথে দিব্য-শিবির তুমি!
নম নম নম কাঞ্চন-গিরি! তোমারে নমস্কার,
তুমি জানাতেছ অমৃতের স্বাদ অবনীতে অনিবার!
তোমার চরণে বসিয়া আজিকে তোমারি আশীর্ব্বাদে
সোনার কমল চয়ন করেছি সপ্ত ঋষির সাথে।
কবিতা-৪৯-মেঘলোকে
গিরি-গৃহে আজ প্রথম জাগিয়া আহা কি দেখিমু চোখে,
মর্ত্যলোকের মানুষ এসেছি জীবস্তে মেঘলোকে!
গিরির পিছনে গিরি উকি মারে চূড়ায় লঙ্ঘে চূড়া,
বিন্ধ্যের মত কত পাহাড়ের গর্ব্ব করিয়া গুড়া!
তারি মাঝে মাঝে এ কি গো বিরাজে? এ কি ছবি অদ্ভুত!-
গিরি-উপাধান সামুতে শয়ান কোন্ যক্ষের দূত?
চারি দিকে তার তল্পি যত সে ছড়ানো ইতস্তত,
পাশ মোড়া দিয়া ঘুমায় রৌদ্রে ক্লান্ত জনের মত!
কে জানে কাহার কি বারতা লয়ে চলেছে কাহার কাছে,
বসনের কোণে না জানি গোপনে কার চিঠিখানি আছে!
সে কি যাবে আজ অলকাপুরীতে ক্রৌঞ্চদুয়ার পথে?
তুষার ঘটার জটিল জটায় লঙ্ঘিয়া কোনো মতে?
কূপ, নদী, নদ, সমুদ্র, হ্রদ-
যার যাহা দেয় আছে,- সব রাজস্ব সংগ্রহ ক’রে,
পবনের পাছে পাছে-
সে কি আসিয়াছে গিরিরাজ-পদে করিতে সমর্পণ?
কিবা, তার শুধু কূটজ ফুলের জীবন বাঁচানো পণ!
রৌদ্র বাড়িল, নিদ্রা ছাড়িয়া উঠিল মেঘের দল,
শিখরে শিখরে চরণ রাখিয়া চলিয়াছে টলমল;
দেখিতে দেখিতে বিশা’য়ের এই পাষাণ-যজ্ঞশালে
. শত বরণের সহস্র মেঘ জুটিল অচির কালে!
চমরী-পুচ্ছ কটিতে কাহারো ময়ূর-পুচ্ছ শিরে,
ধূমল শ্বসন পরিরা কেহ বা দাঁড়াইল সভা ঘিরে!
সহসা কুহেলি পড়িল টুটিয়া, অমনি সে গরীয়ান্
উদিল বিপুল হৈম মুকুটে গিরিরাজ হিমবান!
গগন-গরাসী প্রলয়ের ঢেউ,- আদি প্লাবনের স্মৃতি,-
প্রাচীন দিনের পাগল ছন্দ,- উদ্বেল মহাগীতি,-
মহান্ মনের উচ্ছাস যেন সফল হ’য়েছে কাজে,-
আদি কল্পনা রেখেছে নিশানা সৃষ্টি-পুঁথির মাঝে!
নীল আকাশের প্রগাঢ় নীলিমা যেন গো সবলে চিরি’
ধরার পরশ ঠেলিয়া, গগন- ফু ড়িয়া উঠেছে গিরি!
একি মহিমার মহান্ বিকাশ!-
আকাশের পটে আঁকা,
ছ্যুলোকে দুলিছে স্বর্গের জ্যোতি স্বর্গের স্মৃতি মাথা!
নিখিল ধরার ঊর্দ্ধে বসিয়া শাসিছে পালিছে দেশ,
বজ্র টুটিছে, বিজুলী ছুটিছে, নাহি ভ্রূক্ষেপ-লেশ!
আজি দলে দলে গিরিসভাতলে মেঘ জুটিয়াছে যত,
প্রমথ-নাথেরে ঘিরিয়া ফিরিছে প্রমথ-দলের মত।
নীরবে চলেছে গিরি প্রধানের সভার কর্মচয়, সৃজন,
পালন-বহু আয়োজন ওই সভাতলে হয়; কোন্ ক্ষেতে কত বরষণ হবে,
– কোন্ মেঘ যাবে কোথা,- সকলের আগে হয় প্রচারিত ওইখানে সে বারতা;
শিখরে শিখরে তুষার-মুকুরে ঠিকরে কিরণ-জালা,
মুহূর্তে যায় দেশদেশাস্তে গিরির নিদেশ মালা!
বার্তা বহিয়া শূন্যের পথে মেঘ ওঠে একে একে,
রৌদ্র ছায়ার চিত্র বসনে নানা গিরি বন ঢেকে;
আমি চেয়ে থাকি অবাক নয়নে বসি’ পাথরের স্তুপে,
সৃষ্টিক্রিয়ার মাঝখানে যেন পশেছি একেলা চুপে!
হাজার নদের বন্তা-স্রোতের নিরিখ যেখানে রয়,
লক্ষ লোকের দুঃখ সুখের হয় যেথা নির্ণয়,-
মেঘেরা যেখানে দূর হ’তে শুধু বৃষ্টি মারে না ছুড়ে,
পাশাপাশি হাঁটে মানুষের সাথে,- পড়ে থাকে সানু জুড়ে;
কখনো দাঁড়ায় ভঙ্গী করিয়া কীর্তনিয়ার মত,-
কেহ মৃদঙ্গে করে মৃদু ধ্বনি, কেহ নর্তনে রত।
কখনো আবার মেঘের বাহিনী ধরে গো যোদ্ধ,
বেশ,- মৃত্যুতে যেন মর্ত্য-প্রেতের কলহ হয়নি শেষ!
কৌতুকে মিহি চাঁদের সূতার ওড়না ওড়ায় কেহ,
তারি ভারে তবু পলে পলে যেন ভাঙিয়া পড়িছে দেহ!
আমি বসে আছি এ সবার মাঝে এই দূর মেঘলোকে,
নিগূঢ় গোপন বিশ্ব-ব্যাপার নিরখি চৰ্ম্ম-চোখে!
স্বর্গের ছায়া মর্ত্যে পড়েছে,
শান্ত হ’য়েছে মন,
নয়নে লেগেছে ধ্যানের সুষমা-
দেবতার অঞ্জন;
চক্ষে দেখেছি দেবতার দেশ দূরে গেছে গ্লানি যত,
মেম্বেরও উর্দ্ধে করেছি ভ্রমণ গ্রহ-তারকার মত!
কবিতা-৫০-চূড়ামণি
ডুবেছে সকলি, তবু, শীর্ষ জেগে আছে, জেগে আছে হিমালয়;
সে তো কারো কাছে কোনোদিন ভ্রমেও হয়নি অবনত! শক,
হণ, মোগল, পাঠান কতশত আসিয়াছে মুক্তরোধ বন্যা সম,
তবু পারেনি ডুবাতে কেহ কোনোমতে কভু মহিমা-মণ্ডিত পুণ্য হিমালয় চূড়ে!
কোলাহল ক’রেছে কেবল ফিরে ঘুরে। পরাজয় স্বীকার করেনি হিমালয়।
তুষার-উষ্ণীষ তব কলঙ্কিত নয় চরণধূলায় কারো, ওগো পুণ্যভূমি!
সকল গ্লানির উর্দ্ধে বিরাজিছ তুমি,- লয়ে তব ব্রহ্মবিছা,
তপস্তার বল; জগতের চূড়ামণি অটল অচল!
কবিতা-৫১-“লরেল্”
প্রতীচ্য কবির চির সাধনার ধন তোরে আজি হেরি চক্ষে,
সরেল-পল্লব! রাজ্যবান রাজা হ’তে পূজ্য যেইজন লেই লভে লরেলের মুকুট দুলভ।
অন্ধকবি হোমরের ছিলি আঁখি তারা, দান্তের ‘প্রথমা প্রিয়া’ ছিলি সখি তুই;
তোরে পরশিয়া আজি আমি আত্মহারা,- ইচ্ছা করে হে শ্যামাঙ্গী। শিরে তোরে ইথু।
প্রকৃতির প্রাণ-দেওয়া প্রাচীন হাপরে গঠিত পল্লব তোর শ্যামল-কোমল,- রসের রসান্ করা;
কবি বিনা পরে অরসিকে রূপ তোর কি বুঝিবে? বল্!
চির-হরিতের গড়া তনু শুকুমার, চির-নবীনের শিরে আসন তোমার।
কবিতা-৫২-দার্জিলিঙের চিঠি বন্ধু,
আমি এখন বসে আছি সাত-শো-তলার ঘরে!
বাতাস হেথা মলিন বেশে পশিতে ভয় করে।
ফিরোজা রং আকাশ হেথা মেঘের কুচি তায়,
গরুড় যেন স্বর্গপথে পাখা ঝেড়ে যায়!
অন্ত রবির আভাস লাগে পূর্ণিমা চাঁদে,
শীর্ণ ঝোরা যক্ষ-নারীর দুঃখেতে কাঁদে!
তবু এখন নাই অলকা নাই সে যক্ষ আর,
মেঘের দৌত্য সমাপ্ত, হায়, কবির কল্পনার।
হঠাৎ এল কুষ্মাটকা হাওয়ায় চড়িয়া,
ঘুম-পাহাড়ের বুড়ী দিল মন্ত্র পড়িয়া!
কুহেলিকার কুহকে হায় সৃষ্টি ডুবিল,
ঝাপসা হ’ল কাছের মানুষ দৃষ্টি নিবিল।
ভন্মভূষণ ভোলানাথের অঙ্গ বিভৃতি বিশ্ব ‘
পরে ঝরে যেন বিশ্ব-বিস্তৃতি! সকল গ্লানি যায় ধুয়ে গো দৈব এই স্নানে,-
অরুণ আভা অঙ্গে জাগে আরাম পরাণে!
ক্ষণেক পরে আবার ভাঁটা পড়ে কুয়াসায়,
গুন্ম-ঘেরা পাহাড়গুলি আবার দেখা যায়;
নীল আলোকের আবছায়াতে নিল্লীন তরুচয়
, ‘কাঞ্চি’-মণির ছল্ দুলিয়ে হাল্কা হাওয়া বর্ষ!
মেঘ টুটে, ফের ফুটে ওঠে আকাশ-ভরা নীল,-
নীল নয়নের গভীর দিঠি যেথায় খোঁজে মিল;
শাস্তি হ্রদে সাঁতারি তার মিটে না আশা,
নীল নীড়ে হায় আঁখি-পাখীর আছে কি বাসা?
সাঁতার ভুলে মেঘ চলে আজ লস্করী চালে,
অন্ত রবির সোহাগ তাদের ওমর বাড়ালে!
মেঘের বুকে কিরণ-নারী পিচকারী হানে,
রামধনুকের রঙীন্ মায়া ছড়ায় বিমানে;
মেঘে মেঘে পান্না চুনীর লাবণ্য লাগে,
আচম্বিতে তুষার গিরি উন্নত জাগে!
দিব্য-লোকের যবনিকা গেল কি টুটি’?
অপ্সরীদের রঙ্গশালা উঠে কি ফুটি’?
গিরিরাজের গায় বী-টোপর ওই গো দেখা যায়,
স্বর্ণ-সারে সিঞ্চিত কি স্বর্গ-সুষমায়!
পায়ের কাছে মৌন আছে পাহাড় লাখে লাখ,
আকাশ-বেঁধা শুভ্র চূড়া করেছে নির্ব্বাক্!
নর-চরণ-চিছু কভু পড়ে নি হোথায়,
নাইক শব্দ, বিরাট, স্তব্ধ,
আপন মহিমার! সন্ধ্যা প্রভাত অঙ্গে তাহার আবীর ঢেলে যায়,
রুদ্ধগতি বিদ্যুতেরি দীপ্তি জাগে তায়! শিখায় শিখায় আরম্ভ
হয় রঙীন মহোৎসব, বিদূর ভূমে রত্ন-ফসল হয় বুঝি সম্ভব!
মর্ত্যে যদি আনাগোনা থাকে দেবতার- ওই
পাদপীঠ তবে তাঁদের চরণ রাখিবার।
ওই বরফের ক্ষেত্রে হলের আঁচড় পড়ে নাই,
ওই মুকুরে সূর্য্য, তারা, মুখ দেখে সবাই!
হোথায় মেঘের নাট্যশালা, রঙ্গ কুয়াসার,
হোথায় বাঁধা পরমায়ু গঙ্গা যমুনার!
ওইখানেতে তুষার-নদীর তরঙ্গ নিশ্চল,
রশ্মি-রেখার ঘাত-প্রতিঘাত চলছে অবিরল।
উচ্চ হতে উচ্চ ওষে মহামহত্তর, নিৰ্ম্মলতার
ওই নিকেতন অক্ষয়-ভাম্বর!
হয় তো কোথাই যক্ষপতির অলকানগর, হয়
তো হবে হোথাই শিবের কৈলাস-ভূধর; রজতগিরি
শঙ্করেরি অঙ্কোপরি, হায়, কিরণময়ী গৌরী বুঝি ওই গো মুরছায়!
হয় তো আদিবুদ্ধ হোথায় সুথাবতীর মাঝে অবলোকন করেন ভূলোক সাজি’
কিরণ সাজে! কিম্বা হোথা আছে প্রাচীন মানুস সরোবর,- স্বচ্ছশীতল আনন্দ
যার তরঙ্গ নিকর। কবিজনের বাঞ্ছা বুঝি হোথাই পরকাশ- সরস্বতীর শুভ্র
মুখের মধুর মৃছহাস!
লামার মুলুক লাসা কি ওই ঢাকা কুয়াসায়? বাংলা দেশের মানুষ যেথা
আজো পূজা পায়! এই বাঙালী পাহাড় ঠেলি’ উৎসাহ-শিখায় ঘুচিয়েছিল
নিবিড় তমঃ নিজের প্রতিভায়। এই পথেতে গেছেন তাঁরা দেখেছেন এই সব, এইখানে উঠেছে তাঁদের হর্ষ কলরব।
এনি ক’রে স্বর্ণ শৃঙ্গ বিপুল হিমালয়,-
আমার মত তাঁদের প্রাণেও জাগিয়েছে বিস্ময়।
দেশের লোকের সাড়া পেয়ে আজ কি তাঁহারা
চেয়ে আছেন মোদের পানে আপনাহারা?
চোখে পলক নাইক তাঁদের-পড়ে না ছায়া, মমতা কি
যায়নি তবু-ঘোচেনি মায়া? তাই বুঝি হায় ফিরে যেতে
ফিবে ফিরে চাই, কে য়েন, হায়, রইল পিছে,-কাহারে হারাই।
সন্ধ্যা এসে ডুবিয়ে দিল রঙীন চরাচর,
অনিচ্ছাতে রুদ্ধ হ’ল দৃষ্টি অতঃপর।
উঠল সেজ্বে সাঁঝের আলোয় দার্জিলিং পাহাড়,
ফুটুল যেন ভুবন-জোড়া গাঁদাফুলের ঝাড়!
কুজ্জটিকায় সাঁঝের আঁধার হ’ল দ্বিগুণ কালো
, অরুণ-ছটার ছাতা মাথায় হাসে গ্যাসের আলো।
তখন দুলার বন্ধ ক’রে বন্ধ ক’রে সাসি, অন্ধ-করা
অন্ধকারে স্বপন-মুখে ভাসি। ঘুমের বুড়ীর মন্ত্র-মোহ
অনি তখন খসে, চেনা মুখের ছবিগুলি ঘিরে ঘিরে বসে!
ঘোর নিশীথে দারুণ শীতে কষ্ট যথন পাই,
ইচ্ছা করে কৃচ্ছ-সাধন পাহাড় ছেড়ে যাই; শিক্ষা-শাসন হেথা;
সেথায় হরষ হিন্দোল, এযে কঠোর গুরু-গৃহ সে যে মায়ের কোল।
তাই নিশীথে ঘরের কথা জাগে সে সদাই,
মেঠো দেশের মিঠে হাওয়ায় গা মেলিতে চাই।
সংগোপনে শব্দ যোজন করি ছ’ চারিটি সশরীরে যেতে না পাই তাই তো পাঠাই চিঠি।
ভগ্ন স্বাস্থ্য কর্তে আস্ত পড়ছে ভেঙে মন, ডাক পিয়নের মূর্ত্তি ধেয়ান ক’রে সকল ক্ষণ;
তাই অনুরোধ মাঝে মাঝে পত্র যেন পাই, চিঠির ভেলায় প্রবাস-পাথার পার ক’রে নাও, ভাই!
কবিতা-৫৩-সিংহল
“(“Young Lochinvar” এর ছন্দে)
ওই
ওই
সিন্ধুর টিপ সিংহল দ্বীপ কাঞ্চনময় দেশ! চন্দন যার অঙ্গের বাস,
তাম্বুল-বন’কেশ! উত্তাল তাল-কুঞ্জের বায়-মন্থর নিশ্বাস!
উজ্জ্বল যার অব্শ্বর, আর উচ্ছল যার হাস!
যার
আর
শৈশব তার রাক্ষস আর যক্ষের বশ, হায়, আর যৌবন তার ‘
সিংহে’র বশ,সিংহল নাম যায়; বঙ্গের বীজ ্যগ্রোধ প্রায় প্রান্তর তার ছায়,
আজো বঙ্গের বীর ‘সিংহে’র নাম অস্তর তার গায়।
ওই
এই
ওই কাঠ
বঙ্গের শেষ কীর্ত্তির দেশ সৌরভময় ধাম! শক্কর যার বঝল-বাস,
সিংহল যার নাম। মন্দির সব গম্ভীর, তার বিস্তার ক্রোশ দেড়;
পুষ্কর-মেঘ পুষ্কণীর দশ ক্রোশ ঠিক বেড়।
যার
যার
ওই
হায়
ফাল্গুন আর দক্ষিণ বায়-সিংহল তার ঘর, লুদ্ধের প্রায় সিংহল ধায় বঙ্গের অন্তর;
সিংহল এই বঙ্গের, হায়, পণ্যের বন্দর, বঙ্গের বীর সিংহল-রাজ-কল্লার হয় বর।
ছিল
ওগো
ওই সিংহল দ্বীপ সুন্দর, শুাম;-নির্মূল তার রূপ,
তার কণ্ঠের হার ল’ঙ্গর ফুল, কপূর কেশ-ধূপ;
আর কাঞ্চন তায় গৌরব, আর মৌক্তিক তারু প্রাণ,
আর সম্বল তার বুদ্ধের নাম, সম্পদ নির্ব্বাণ।
কবিতা-৫৪-সিদ্ধিদাতা
(যবদ্বীপের একটি গণেশ মূর্ত্তির ছবি দেখিয়া)
একি তোমার মুর্ত্তি হেরি!-একি হেরি সিদ্ধিদাতা!
হাজার নর-মুক্ত ‘পরে ঠাকুর! তব আসন পাতা!
হাজার জীবন নষ্ট হ’লে-ব্যর্থ গেলে হাজার জন-
তবে তোমার হয় প্রতিষ্ঠা?-নির্ম্মিত হয় সিংহাসন?
তখন তুমি প্রসন্ন হও-তখনি হও আবির্ভাব?
– নইলে পরে ব্যর্থ আশা? নইলে সুদূর সিদ্ধিলাভ?
খুলে গেল দৃষ্টি এবার!-ঠাকুর! তোমায় নমস্কার!
হাড়ের স্তুপে সিদ্ধিদাতার আসন-পাতা! চমৎকার!
দুর্গমে কে যাত্রা ক’রে যবদ্বীপে করলে জয়!
কত বছর যুদ্ধ হ’ল কতই প্রাণের অপচয়!-
হিসাব তাহার নাইক কোথাও;
শিল্পী শুধু কল্পনাতে আভাসখানি রেখে গেছে কঙ্কালের ওই অঙ্কপাতে;
গড়ে গেছে পাথর কেটে মূর্তিখানি জীবস্ত,
শবাসনে সিদ্ধিদাতা,-শোকের দহন নিবন্ত।
নৃযুগুেরি স্তূপের পরে জাগল বিপুল জয়ের গাথা,
অভেদ হ’য়ে দিলেন দেখা সিদ্ধি সনে সিদ্ধিদাতা।
থর্ব্ব তুমি-স্কুল রকমের, সিদ্ধি-তুমি লম্বোদর;
তবু তোমায় চায় সকলে, তবু তুমিই মনোহর!
তোমার লাগি বিশ্বামিত্র পীড়া দিল নিখিল জীবে,
যাত্রী ছোটে তোমার লোভে মর্ত্যলোকে আর ত্রিদিবে;
কারো হঠাৎ নিছে বাতি, কারো মাথায় চক্র ঘোরে,
কেউ বা লভে জ্ঞানের ভাতি, কেউ বা পথেই যায় গো ম’রে!
সিদ্ধি লাগি’ কর্মী, জ্ঞানী ছুটছে কবি দিবস নিশা,
কেউ বা লভে স্বর্ণকণা, কেউ বা ধূলায় হারায় দিশা!
.শিখাও প্রভু! বিঘ্ন বিপদ ফেতে ঠেলে দুঃখ রাতে;
করতে শিখাও কৃষ্ণ সাধন নাম লিখিয়ে খরচ-থাতে,
মরতে শিখাও শুষ্ক মুখে, ফিরতে শিখাও শুল্ক হাতেই,
সত্যভানু প্রদীপ্ত যে নৃ-কপালের শুভ্রতাতেই।
পণ্ড পূজা ঠাকুর! তোমার ক্ষুদ্রচেতা বেনের ঘরে,-
উচ্ছলোভী মূষিকে সে সিদ্ধিদাতার বাহন করে!
তারা তোমায় চেনে না, হায়, চেনে নাক সিদ্ধিদাতা,
অভ্রভেদী নৃকঙ্কালে প্রভু! তোমার আসন পাতা।
কবিতা-৫৫-ওঙ্কার-ধাম
(Un Pelerin D’ Angkar পড়িয়া)
ওঙ্কার-ধাম! ওঙ্কার-ধাম।
চিত্ত-চমৎকার।
ক্লান্ত-কাম্বোজে কনকাস্তোজ হিন্দুর প্রতিভার!
তোরণে তাহার সপ্তশার্ষ সর্প সে ফণা ধরে,
পর্ব্বত সম বিপুল দেউল মিশরের যশ হরে।
যোজন ব্যাপিয়া পত্তন তার,
বিধিয়া নীলাম্বর পর্ব্বতজয়ী গর্ব্বে উঠেছে দেউল স্তরে স্তর।
ওস্বজে তার সোনার পদ্ম, চূড়ায় চতুর্ষু খ-
নীরব হাস্তে নিরখে চতুর- দিকের দুঃখ সুখ;-
বিরাট মুরতি, আরতি তাহার জাগায় ভকতি ভয়!
দেউল ঘিরিয়া মূর্তি-মেখলা,-
রামায়ণ শিলাময়!
রাক্ষস, রথ, হস্তী মহৎ, যুদ্ধের হুড়াহুড়ি,
সাগর মথন, দেব অগণন,
রয়েছে যোজন জুড়ি’!
প্রতি শিলা তার পেয়েছে আকার,
শিল্পীর সুপরশে, সারি সারি সারি বুদ্ধ
মুরতি মগন ধ্যানের রসে।
বিশ্ব হাজার একই দেবতার রেখেছে গো খুদে খুদে,-
নির্ব্বাক শিলা নীরবে ঘোষিছে,- দেবতা সর্ব্বভূতে!
শিল্পীর তপে হেথা অপ্সরা রয়েছে পাথর হ’য়ে-
হেম-মুখী প্রেম মদিরেক্ষণা-
বহুর সোহাগ স’য়ে।
যোজন জুড়িয়া রয়েছে পাষাণ- স্তম্ভের মহাবন,
জুনপদ দশলক্ষ লোকের
নামশেষ সে এখন!
নিবিড় বনের সবুজ আঁধার দিনে আছে দিক্ জুড়ে;
শল্প-শিব একা বিরাজিছে আজ চতুম্মু খের চূড়ে!
আধেক ভগ্ন ধূলায় মগ্ন আগুনে মূরতিগুলা, –
নাই লোক শুধু বাছড় পেচক,- পালক এবং ধূলা।
ওঙ্কার-ধাম! ওঙ্কার ধাম! নাই-কারো নাই সাড়া,
ঘন্টার মালা দুলিছে কেবল বাতাসে পাইয়া নাড়া।
ধ্বংসের দাড়া অশথ শিকড়
পাকড়ি’ ধরিছে আঁটি’; তার সাথে ধূলি আর বিস্তৃতি,
শিয়রে মরণ-কাঠি। ওঙ্কার-ধাম!
ওঙ্কার-ধাম! বিস্তৃত তুমি আজ,
জানেনা হিন্দু কীর্ত্তি আপন! হায় নিদারুণ লাজ!
কবিতা-৫৬-পদ্মার প্রতি
হে পদ্মা! প্রলয়ঙ্করী। হে ভীষণা!
ভৈরবী সুন্দরী! হে প্রগল্ভা!
হে প্রবলা! সমুদ্রের যোগ্য সহচরী তুমি শুধু;
নিবিড় আগ্রহ তার পার গো সহিতে একা তুমি;
সাগরের প্রিয়তমা অরি দুর্বিনীতে!
দিগন্ত-বিস্তৃত তব হাস্তের কল্লোল তারি মত চলিয়াছে তরঙ্গিয়া,
চিরদৃপ্ত, চির-অব্যাহত। দুর্ণমিত, অসংযত, গূঢ়চারী,
গহন-গম্ভীর, সীমাহীন অবজ্ঞায় ভাঙিয়া চলেছ উভতীর!
রুদ্র সমুদ্রের মত,
সমুদ্রেরি মত সমুদার তোমার বরদ হস্ত বিতরিছে ঐশ্বর্য্য-সম্ভার।
উর্ধ্বর করিছ মহী, বহিতেছ বাণিজ্যের তরী,
গ্রাসিয়া নগর গ্রাম হাসিতেছে দশদিক ভরি’!
অন্তহীন মূর্ছনায় আন্দোলিছ আকাশ সঙ্গীতে,-
ঝঙ্কারিয়া রুদ্রবীণা,-মিলাইছ ভৈরবে ললিতে!
প্রসন্ন কখনো তুমি, কভু তুমি একান্ত নিষ্ঠুর;
দুর্ব্বোণ, দুর্গম হায়, চিরদিন দুজ্ঞেয়-সুদুর!
শিশুকাল হ’তে তুমি উচ্ছ ঙ্খল,
দুরন্ত-দুর্ব্বার,; সগর রাজার
ভন্ম করিলে না স্পর্শ একবার!
স্বর্গ হ’তে অবতরি’ ধেয়ে চলে এলে এলোকেশে,
কিরাত-পুলিন্দ-পুণ্ড, অনাচারী অস্ত্যজের দেশে!
বিস্ময়ে বিহ্বল-চিত্ত ভগীরথ ভগ্ন-মনোরথ বৃথা বাজাইল শঙ্খ,
নিলে বেছে তুমি নিজ পথ; আর্য্যের নৈবেখ্য, বলি, তুচ্ছ করি’
হে বিদ্রোহী নদী! অনাহুত-অনার্য্যের ঘরে গিয়ে আছ সে অবধি!
সেই হ’তে আছ তুমি সমস্তার মত লোক মাঝে, ব্যাপৃত সহস্র
ভুজ বিপর্য্যয় প্রলয়ের কাজে!
দস্ত যবে মূর্ত্তি ধরি’ স্তম্ভ ও গুথজে দিন রাত অভ্রভেদী হ’য়ে ওঠে,
তুমি না দেখাও পক্ষপাত
তার প্রতি কোনোদিন; সিন্ধুসখী!
হে সাম্যবাদিনী! মূর্খে বলে কীর্তিনাশা,
হে কোপনা! কল্লোলনাদিনী!
ধনী দীনে একাসনে বসায়ে রেখেছ তব তীরে,
সতত সতর্ক তারা অনিশ্চিত পাতার কুটিরে;
না জানে সুপ্তির স্বাদ, জড়তার বারতা না জানে?
ভাঙনের মুখে বসি’ গাহে গান প্লাবনের তানে,
নাহিক বাস্তর মায়া,
মরিতে প্রস্তুত চিরদিনই! অয়ি স্বাতন্ত্র্যের ধারা!
অয়ি পদ্মা! অয়ি বিপ্লাবিনী!
কবিতা-৫৭-পাল্লা ঝোরা
তোমরা কি কেউ শুনবে নাগো পাগলা ঝোরার দুঃখ গাথা?
পাগল ব’লে কৰ্ব্বে হেলা? কর্দ্ধে হেলা মর্ম্মব্যথা?
জন্ম আমার হিম-উরসে, কুলে আমার তুল্য নাই,
সিন্ধুনদের সোদর আমি গঙ্গাদিদির পাগল ভাই।
বরফ-মরুর এক্লা জীবন ভাল আমার লাগত নারে,
লুকিয়ে উকি তাইতো দিতাম নীচের দিকে অন্ধকারে;
শুড় পুড়িয়ে গুড় গুড়িয়ে বেরিয়ে এসে কৌতূহলে গড়
গড়িয়ে গড়িয়ে গেলাম, ছড়িয়ে প’লাম শূন্যতলে।
পিছল পথে নাইক বাধা, পিছনে টান নাইক মোটে,
পাগলা ঝোরার পাগল নাটে নিত্য নূতন সঙ্গী জোটে!
লাফিয়ে প’ড়ে ধাপে ধাপে,
ঝাঁপিয়ে প’ড়ে উচ্চ হ’তে চড় চড়িয়ে পাহাড় ফেড়ে নৃত্য ক’রে মত্ত স্রোতে,-
তরল ধারায় উড়িয়ে ধূলি, জুড়িয়ে দিয়ে হাওয়ার জালা, ]
জটার ‘পরে জড়িয়ে নিয়ে বিনিসুতার রাস্নামালা;
একশো যুগের রনস্পতি,-বাকল-ঝাঁঝি সকল গায়,-
মড়মড়িয়ে উপড়ে ফেলে স্রোতের তালে নাচিয়ে তায়,-
গুহার তলে গুমরে কেঁদে, আলোয় হঠাৎ হেসে উঠে,
ঐরাবতের বৈরী হ’য়ে, কৃষ্ণমৃগের সঙ্গে ছুটে,
স্তব্ধ বিজন যোজন জুড়ে ঝঞ্ঝাঝড়ের শব্দ ক’রে,
অসাড় প্রাচীন জড় পাহাড়ের কানে মোহন মন্ত্র প’ড়ে,-
পরাণ ভ’রে নৃত্য ক’রে মত্ত ছিলাম স্বাধীন সুখে,
ছন্দ ছাড়া আজকে আমি যাচ্চি ম’রে মনের দুখে;
যাচ্চি ম’রে মনের দুখে পূর্ব্ব সুখে স্মরণ ক’রে;
কারির মুখে ঝরার মতন শীর্ণ ধারায় পড় ছি ঝ’রে।
চক্রী মানুষ চক্র ধ’রে ছিন্ন ক’রে আমার দেহ ছড়িয়ে দিলে দিগ্বিদিকে,
নাইক দয়া, নাইক স্নেহ। আমি ছিলাম আমার মতন,-
পাহাড়-কোলে নির্ব্বিবাদে, মানুষ ছিল কোন্ সুদূরে-সাধিনি বাদ তাদের সাথে;
তবুও শিকল পরিয়ে দিলে রাখলে আমায় বন্দীবেশে,
ক্ষুদ্র মানুষ স্বল্প-আয়ু, আমায় কিনা বাঁধলে শেষে!
কৌশলে সে, ফাঁদ ফেঁদেছে, পারিনে তায় ছিঁড়তে বলে,
শীর্ণ হ’য়ে যাচ্চি, ক্রমে, পড়ছি গ’লে অশ্রুজলে।
আগে আমায় চিন্ত যারা বন্ধে শোনো, ‘যায় না চেনা!’
বাজবে কবে প্রলয়-বিষাণ?-মুখে আমার উঠছে ফেনা!
বিকল পায়ের শিকলগুলো কতদিন সে থাব্বে আরো?
রুদ্রতালে নাত্ব কবে? তোমরা কেহ বন্ধে পার?
কবিতা-৫৮-শূদ্র
শুদ্র মহান্ গুরু গরীয়ান,
শূদ্র অতুল এ তিন লোকে,
শূদ্র রেখেছে সংসার, ওগো!
শূদ্রে দেখনা বক্র চোখে।
আদি দেবতার চরণের ধূলি শূদ্র,-
একথা শাস্ত্রে কহে, আদি দেবতার
পদরেণু-কণা সকল দেবতা মাথায় বহে।
বিধাতার পাদ-পদ্মের রেণু না করিবে শিরোধার্য্য কেবা?
কে সে দর্পিত-কে সে নাস্তিক- শূদ্রে বলে রে করিতে সেবা?
গঙ্গার ধারা যে পদে উপজে তাহে উপজিল শূদ্র জাতি,
পাবনী গঙ্গা, শূদ্র পাবন পরশ তাহার পুণ্য-সাথী।
শূদ্র শোধন করিছে ভুবন তাই তার ঠাঁই শ্রীপদমূলে
, আপনারে মানী মানিয়া সে কভু শিয়রে হরির বসে না ভুলে।
শুদ্ধ-সত্ত্ব পাবকের মত জগতের গ্লানি শূদ্র দহে;
মহামানবের গতি সে মূর্ত, শূদ্র কখনো ক্ষুদ্র নহে।
কবিতা-৫৯-মেথর
কে বলে তোমারে, বন্ধু, অস্পৃশু অশুচি?
শুচিতা ফিরিছে সদা তোমারি পিছনে;
তুমি আছ, গৃহবাসে তাই আছে রুচি,
নহিলে মানুষ বুঝি ফিরে যেত বনে।
শিশুজ্ঞানে সেবা তুমি করিতেছ সবে,
ঘুচাইছ রাত্রিদিন সর্ব্ব ক্লেদ গ্লানি!
ঘৃণার নাহিক কিছু স্নেহের মানবে,-
হে বন্ধু। তুমিই একা জেনেছ সে বাণী।
নির্বিচারে আবর্জনা বহ অহর্নিশ,
নির্বিকার সদা শুচি তুমি গঙ্গাজল।
নীলকণ্ঠ করেছেন পৃথ্বীরে নির্ব্বিষ;
আর তুমি? তুমি তারে করেছ নির্মূল।
এস বন্ধু, এস বীর, শক্তি দাও চিতে,-
কল্যাণের কর্ম্ম করি’ লাঞ্ছনা সহিতে।
কবিতা-৬০-পথের স্মৃতি
হাত পেতে বসেছে ভিখারী রাজপথে মৌন প্রত্যাশায়;
শাখা মেলি’ শীর্ণ তরু সারি শুন্যমনে আকাশে তাকায়।
লঘু মেঘ চলে যায় ভেসে,-
উপবাসী রহে শাখাদল;
শাদা মেঘ ভেসে গেল হেসে
পিপাসীরে দিল না সে জল!
ধোয়া ধুতি-রেশমী চাদর –
চলে গেল ফিরাইয়া মুখ;
অনুদার বিলাসী বাঁদর অভুক্তের বুঝিল না দুখ।
সহসা উড়ায়ে ধূলিজাল স্নান মেঘ এল বায়ুভরে,-
বজ্রকণ্ঠ মুরতি করাল,- সেই শেষে দিল স্নিগ্ধ ক’রে!
থামাইয়া থার্ড ক্লাশ, গাড়ী রুক্ষ মূর্ত্তি দুঃখী গাড়োয়ান গাড়ী
হতে নামি’ তাড়াতাড়ি গরীব গরীবে দিল দান!
শাদা মেঘ দেয় না রে জল,
স্নান মেঘ! আয় তোরা আয়,
রিক্ত শাথে হ’বে ফুল ফল বিন্দু বিন্দু তোদেরি দয়ায়।
কবিতা-৬১-দুর্ভিক্ষে
ক্ষিদের জরে যাচ্ছে মারা,
ক্ষিদেয় ঘুরে পড়ছে মরে।
উপর-ওলার মর্জি, বাবা,
একে একে যাচ্ছে সরে।
বিকিয়ে গেছে হালের বলদ,
ছধুলি গাই বিকিয়ে গেছে,
চালিয়েছিলাম ছ’ পাঁচটা দিন
কাঁসা পিতল সকল বেচে!
বিকিয়ে গেছে লক্ষ্মী মোহর জনার্দনের রূপার ছাতা,
ভিটার গ্রাহক নাইক গাঁয়ে,
তাই আজো সব গুঁজছে মাখা।
বিকিয়ে গেলাম পেটের দায়ে,
পেটের জ্বালা বিষম জালা,
কেড়ে থাবার দিন গিয়েছে,
কুড়িয়ে খাবার গেছে পালা;
কচি ছেলের খেইছি কেড়ে,
কান্নাতে কান দিইনি মোটে,
চোখে কানে যায় কি দেখা?
ক্ষিদেয় যখন ভিতর ঘোটে?
প্রথম প্রথম লুকিয়ে খেতাম,
চোরের মতন হেথা হোথা,
নিজের ক্ষিদেয় ভুতে হ’ত ছেলে মেয়ের ক্ষিদের কথা!
ঘাস পাতাতে চন্দ্বে ক’দিন? ক’দিন ওসব সইবে পেটে?
শুকিয়ে আছে ক্ষিদের নাড়ী, কারো নাড়ী দিচ্ছে কেটে।
ক্ষিদের জ্বালায় জোয়ান মেয়ে দেছে সেদিন গলায় দড়ি,
ক্ষিদের জরে কচি কাঁচা মরছে নিত্যি ঘড়ি ঘড়ি।
শুছে পড়ে শ্মশান-ভিটায়,-শুছে পড়ে সারি সারি,
সকল গুলোর মুক্তি হলে নির্ভাবনায় মর্ত্তে পারি।
একে একে হ’চ্ছে নীরব খড়ের শেষে কঠিন ছুঁয়ে,
হ’চ্ছে নীরব-যাচ্ছে ম’রে,-বুঝছি সবি শুয়ে শুয়ে।
বুঝতে পারছি-ওই অবধি-জান্তে পাচ্ছি মাত্র এই,
মুখে দেব জল ছ’ ফোঁটা-তেমন ধারাও শক্তি নেই।
মড়ার লোভে ঢুকবে কুকুর, ভাবুতে ওঠে শিউরে গাটা,-
জ্যান্তে পাছে খায় গো ছিঁড়ে, ভাবছি এখন সেই কথাটা।
চোখের আগে অন্কি ওড়ে, গারে মুখে বস্থে মাছি,
বুঝতেও ঠিক পারছি নাক-মরেছি না বেঁচেই আছি!
হায় ভগবান! মর্জি তোমার! হায় জগদীশ! তোমার খুসী!
রাখলে তুমি রাখতে পার, মারতে পার মারলে রুধি’,-
বাঘের ক্ষিদে মিটাও ঠাকুর, প্রাণ রাখ প্রাণহানি ক’রে;
মানুষ মরে ক্ষিদেয় জ’রে-হাত গুটিয়ে রইলে সরে!
কবিতা-৬২-সংশয়
গ্রহণ-দিনের গহন ছায়ায় গাহন করি’
গগনে উঠিছে শঙ্কার সুর ভুবন ভরি’!
রাহুর গরাসে হিরণ কিরণ হইল সারা,
হায় হায় করে আলোর পিয়াসী নয়ন তারা।
যে দিকে তাকাই কেবলি যে ছাই পড়িছে ঝরি’!
ক্লান্ত পরাণ, দিনমান শুধু ভাবিয়া মরি; ‘কি হ’বে গো’!
-কারে সুধাইব, হায়, পাই নে ভাবি’,
মধ্য সাগরে ছিদ্র তরণী যায় যে নাবি’!
স্থির-নিশ্চিত মৃত্যুর মত আসিছে ঘিরে,
নিশ্বাস হরি’ দৃষ্টি আবরি’ ঘন তিমিরে;
কোথা শাদা পাল? কই তরী তব? হে কাণ্ডারী!
লোনা জলে একি মিছে মিশে গেল নয়ন বারি।
কবিতা-৬৩-হাহাকার
দুর্ভিক্ষের ভিক্ষুকের মত কেঁদে কেঁদে ওঠে সে নিয়ত;
রোদন উত্তমে ‘অবসান, আছে শুধু বদন-ব্যাদান!
আছে বুকে বুভুক্ষার মত জগতের ক্ষুণ্ণ খেদ যত,
আছে শুধু যমের যন্ত্রণা প্রেতলোকে জাগাতে করুণা।
এ সংসার অন্ধ-কারাগার, কোনোদিকে মিলে না দুয়ার;
ক্ষুর প্রাণ, সংক্ষুব্ধ বেদনা, কেবল পিঞ্জরে আনাগোনা।
এ পিঞ্জর ভাঙ ভগবান, শোক তাপ হোক্ অবসান;
এ উৎকট রোদনের শেষ কর, কর, কর পরমেশ!
কবিতা-৬৪-শূন্যের পূর্ণতা
কৃষ্ণ হ’তে পাংশু হ’য়ে,
ক্ষুদ্র হ’তে ব্যাপ্তি ল’য়ে শকুন্তের ছায়া ক্রমে আলোকে মিলায়!
জিজ্ঞাসা সংশয়-শেষে,
দগ্ধ রিক্ত চিত্ত দেশে অনাসক্ত পূর্ণজ্ঞান বিহরে লীলায়!
কবিতা-৬৫-১৪ই জ্যৈষ্ঠ
(আমার পিতামহ স্বর্গীয় অক্ষয়কুমার দত্ত মহাশয়ের সাংবৎসরিক শ্রাদ্ধদিনে রচিত)
অনেক দেছেন যিনি মানবেরে অরূপণ করে,-
ধীশক্তির দাতা বলি’ মুখ্যভাবে ধ্যান তাঁর করে আমাদের এ ভারত;
প্রতিদিন প্রভাতে সন্ধ্যায় মুখরিত করি দিক শ্রেষ্ঠ সে দানের কথা গায়।
সেই শ্রেষ্ঠ বিভৃতিতে ছিলে তুমি ভূষিত ধীমান্!
জ্ঞানাঞ্জনে নেত্র মাজি’ বিশ্ব-বৃষ্ণ দেখিলে মহান্ !
বিজ্ঞানের তুর্য্যনাদে স্তব্ধ করি’ দিলে তুচ্ছ কথা,
সর্ব্ব সঙ্কীর্ণতা ত্যজি’ নিলে বরি’ বিশ্বজনীনতা;-
অন্ধ বিশ্বাসের বিষে জর্জরিত এ বঙ্গ-ভুবনে এনে দিলে জ্ঞানামৃত;
হ’লে গুরু চক্ষুরুন্মীলনে। সত্যের করিতে সেবা স্বার্থ, সুখ,
স্বাস্থ্য মিথ্যা সংস্কারের মোহ ক্ষয় করি’ দিলে তিলে তিলে।
অর্দ্ধ পথে থাম নাই সন্ধি করি’ অজ্ঞতার সনে,
সূর্য্যকান্ত মনি তুমি পরিপূর অপূর্ব্ব কিরণে।
(২)
আজি তব মৃত্যুদিনে, ওগো পূজা! ওগো পিতামহ !
এনেছি যে দীন অর্ঘ্য-তুমি সে প্রসন্ন মনে ।
বার্ষিকী এ শ্রাদ্ধে তব পিণ্ডভোজী ডাকিনি ব্রাহ্মণ,
জানি তাহে হইত না, ওগো জ্ঞানী! তোমার তর্পণ;
অন্তরের শ্রদ্ধা শুধু আমি আজি করি নিবেদন;
এই তো যথার্থ শ্রাদ্ধ-কীর্ত্তি-কথা স্মরণ কীৰ্ত্তন।
সত্য-দেবতার পদে আজ শুধু এই ভিক্ষা চাই,-
বুদ্ধেরে পুজিতে যেন রক্তধারে বেদী না ভাসাই;-
অবতার বলি’ মুখে, যেন, হায়, অজ্ঞতার ফলে রঘুবীরে না বসাই মংস্য,
কুর্মু, বরাহের দলে;
তব প্রিয় কর্ম্ম ত্যজি’ যেন তব তর্পণে না বসি’ বিস্তা তপ
বিবর্জ্জিয়া শুধু যেন কৌলীন্ত না ঘোষি’।
হে আদর্শ জ্ঞানযোগী। হে জিজ্ঞাসু তব
জিজ্ঞাসায় উদ্বোধিত চিত্ত মোর;
গরুড় সে জ্ঞান-পিপাসায়।
কবিতা-৬৬-শ্মশান-শয্যায় আচার্য্য হরিনাথ দে
আজ শ্মশানে বহ্ণিশিখা অভ্রভেদী তীব্র জ্বালা,
– আজ শ্মশানে পড়ছে ঝরে উল্কাতরল জালার মালা!
যাচ্ছে দেশের গর্ব্ব,-শ্মশান শুধু হ’চ্ছে আলা,
যাচ্ছে পুড়ে নূতন ক’রে সেকেন্দ্রিয়ার গ্রন্থশালা।
একটি চিতায় পুড়ছে আজি আচার্য্য আর পুড়ছে লামা,
প্রোফেসার আর পুড়ছে ফুর্তি, পুড়ছে শমস্-উল্-উলামা,
পুড়ছে ভট্ট সঙ্গে তারি মৌলবী সে যাচ্ছে পুড়ে,
ত্রিশটি ভাষার বাসাটি হায় ভন্ম হ’য়ে যাচ্ছে উড়ে
একত্রে আজ পুড়ছে যেন কোকিল, ‘কুকু’, বুন্ডুলেতে,
– দাবানলের একটি আঁচে নীড়ের পিঠে পক্ষ পেতে;
পড়ছে ভেঙে চোখের উপর বর্তমানের বাবিল্-চূড়া,
দানেশ-মন্দী তাজ সে দেশের অকালে আজ হচ্ছে ওড়া।
আজ শ্মশানে বঙ্গভূামর নির্বল উজ্জ্বল একটি তারা,
রইল শুধু নামের স্মৃতি রইল কেবল অশ্রুধারা;
নিবে গেল অমূল্য প্রাণ, নিবে গেল বহ্ণিশিখা,
বঙ্গ ভূমির ললাট ‘পরে রইল আঁকা ভষ্মটীকা।
সাগর তর্পণ বীর সিংহের সিংহশিশু! বিস্ফাসাগর।
বীর! উদ্বেলিত দয়ার সাগর, বীর্য্যে সুগম্ভীর!
সাগরে যে অগ্নি থাকে কল্পনা সে নয়,
তোমায় দেখে অবিশ্বাসীর হয়েছে প্রত্যয়।
নিঃস্ব হ’য়ে বিশ্বে এলে, দয়ার অবতার।
কোথাও তবু নোয়াও নি শির জীবনে একবার!
দয়ায় স্নেহে ক্ষুদ্র দেহে বিশাল পারাবার,
সৌম্য মূর্ত্তি তেজের ক্ষত্তি চিত্ত-চমৎকার!
নালে একা মাথায় নিয়ে মায়ের আশীর্ব্বাদ,
করলে পূরণ অনাথ অতুর অকিঞ্চনের সাধ;
অভাজনে অন্ন দিয়ে-বিজ্ঞা দিয়ে আর- অদৃষ্টেরে ব্যর্থ তুমি ফরলে বারম্বার।
বিশ বছরে তোমার অভাব পূরল নাকো, হায়,
বিশ বছরের পুরাণো শোক নূতন আজো প্রায়;
তাই তো আজি অশ্রুধারা ঝরে নিরন্তর।
কীর্ত্তি ঘন মুর্ত্তি তোমার জাগে প্রাণের ‘পর।
স্মরণ-চিত্র রাখতে পারি’ শক্তি তেমন নাই,
প্রাণ প্রতিষ্ঠা নাই যাতে সে মুরং নাহি চাই;
“মানুষ খুঁজি তোমার মত,-একটি তেমন লোক,-
স্মরণ-চিহ্ণ মূর্ত!-যে জন ভুলিয়ে দেবে শোক।
রিক্ত হাতে করবে যে জন যজ্ঞ বিশ্বজিৎ,-
রাত্রে স্বপন চিন্তা দিনে দেশের দশের হিত,-
বিঘ্ন বাধা তুচ্ছ ক’রে লক্ষ্য রেখে স্থির তোমার মতন ধন্ধ হ’বে,
চাই য়ে এমন বীর। তেমন মানুষ না পাই যদি খুঁজব তবে,
হায়, ধূলায় ধূসর বাঁকা চাট ছিল যা’ ওই পায়;
সেই যে চটি উচ্চে যাহা উঠত এক একবার শিক্ষা দিতে অহঙ্কতে শিষ্ট ব্যবহার।
সেই যে চটি-দেশী চাট-বুটের বাড়া ধন, খুঁজব তারে,
আম্ব তারে, এই আমাদের পণ;
সোনার পিড়েয় রাখব তারে,
থাকৃত্ব প্রতীক্ষায় আনন্দহীন বঙ্গভূমির ‘বিপুল নন্দিগায়।
রাখব তারে স্বদেশ প্রীতির নূতন ভিতের ‘পর,
নজর কারো লাগবে নাকো, অটুট হ’বে ঘর!
উচিয়ে মোরা রাখব তারে উচ্চে সবাকার,-
বিস্তাসাগর বিমুখ হ’ত-অমর্য্যাদায় যার।
শাস্ত্রে যারা শস্ত্র গড়ে হৃদয়-বিদারণ,
তর্ক যাদের অর্কফলার তুমুল আন্দোলন;
বিচার যাদের যুক্তিবিহীন অক্ষরে নির্ভর,
– সাগরের এই চটি তারা দেখুকু নিরন্তর।-
দেখুক, এবং স্মরণ করুক সব্যসাচীর রণ,-
স্মরণ করুক বিধবাদের দুঃখ-মোচন পণ;
স্মরণ করুক ‘পাণ্ডারূপী গুণ্ডাদিগের হার,
“বাপ্ মা বিনা দেবতা সাগর মানেই নাকো আর!”
*অদ্বিতীয় বিস্তাসাগর! মৃত্যু-বিজয় নাম,
ঐ নামে হায় লোভ করেছে অনেক ব্যর্থকাম;
নামের সঙ্গে যুক্ত আছে জীবন-ব্যাপী কাজ,
কাজ দেবে না? নামটি নেবে?-একি বিষম লাজ!
বাংলা দেশের দেশী মানুষ! বিস্তাসাগর বীর!
বীরসিংহের সিংহ শিশু! বীর্য্যে সুগম্ভীর!
সাগরে যে অগ্নি থাকে কল্পনা সে নয়,
চক্ষে দেখে অবিশ্বাসীর হ’য়েছে প্রত্যয়
কবিতা-৬৭-ঋষি টল্টয়
সঙ্কীর্ণ স্বার্থের ক্ষোভে ক্ষুন্ন ক্ষুব্ধ ছিল জগজন অন্ধকূপে বন্দী সম;
তুমি খুলে দিলে বাতায়ন, ওগো ঋষি কৃষিয়ার! মুক্ত রন্ধে স্বর্গের
বাতাস প্রবেশিল অন্ধকূপে; বিশ্ববাসী বাঁচিল নিশ্বাস
ফেলি; ওগো টস্ট্রয়!
বিনাশিলে তুমি মহাভয় মানবের;
প্রচারিলে পৃথ্বীতলে বিশ্বাসের জয়।
মহাবৈষম্যের মাঝে প্রচারিলে সাম্যের বারতা,
উচ্চারিলে, দ্রষ্টা! তুমি, মহামিলনের পূর্ব্বকথা।
বাণী তব মৃত্যুহীন মৃত্যুময় এ মর্তাভুবনে ওগো মৃত্যুঞ্জয় কবি।
হে মনীষি জাগে,আজি মনে সিদ্ধার্থের সুপ্ত স্মৃতি,
তোমার শুনিয়া কণ্ঠরব, সেই সুর,
সেই কথা; তারি মত-তারি মত সব।
সেই! সেই তপ! সেই মহামৈত্রীর বাখান!
বুদ্ধকল্প বিশ্বপ্রেমে বর্তমানে তুমি মহাপ্রাণ!
কবিতা-৬৮-কবি-প্রশস্তি
(ঋষি কবি শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহোদয়ের সংবর্দ্ধনা উপলক্ষে রচিত)
বাজাও তুমি সোনার বীণা হে’কবি! নব বঙ্গে; মাতাও তুমি,
কাঁদাও তুমি, হাসাও তুমি রঙ্গে!
তোমার গানে তোমার সুরে উঠিছে ধ্বনি ভুবন জুড়ে,
লক্ষ হিয়া গাহিয়া আজি উঠছে তব সঙ্গে।
কমলে তুমি জাগালে প্রাতে,
নিশীথে নিশিগন্ধা, পূর্ণা তিথি মিলালে আনি
‘ রিক্তা মাঝে নন্দা! যে ফুল ফোটে স্বর্গ
বায়ে আহরি’ দিলে প্রিয়ের পায়ে, মিলালে
আনি’ অনাদি বাণী নবীন মধুচ্ছন্দা!
জগৎ-কবি-সভায় মোরা তোমার করি গর্ব্ব,
বাঙালী আজি গানের রাজা, বাঙালী নহে খর্ব্ব।
দূর্ভ তব আসন-খানি অতুল বসি’ লইবে মানি’
হে গুণী তব প্রতিভা-গুণে জগৎ-কবি সর্ব্ব।
জীবন-ব্রতে পঞ্চাশতে পড়িল তব অঙ্ক,
বঙ্গ-গৃহ জুড়িয়া আজি ধ্বনিছে শুভ শঙ্খ;
পান্থ এসে পুষ্প-রথে পৌঁছিলে হে অর্দ্ধ পথে,-
সারথি তব শুভ্র-শুচি কীর্তি অকলঙ্ক।
অর্ধশত শরতে সোনা ঢেলেছ তুমি নিত্য,
অর্দ্ধশত মিলিলে হেন তবে সে পূরে চিত্ত;
সোনার তরী দিয়েছ ভরি’, তবুও আশা অনেক করি;
ভরিয়া ঝুলি ভিখারী সম ফিরিয়া চাহি বিত্ত।
‘চাতক! তুমি কত না মেঘে মেখেছ বারি-বিন্দু,
কত না ‘ধারে ভরিয়া তুমি তুলেছ চিত-সিন্ধু!
মরাল! তুমি মানস-সরে দিরেছ কত হরষ-ভরে,
চকোর তুমি এসেছ ছুয়ে গগন-ভালে ইন্দু।
বঙ্গ-বাণী-কুঞ্জে তুমি আনিলে শুত লগ্ন,
বাজালে বেণু মোহন তানে পরাণ হ’ল্ল মগ্ন।
বিষাণ যবে বাজালে, মরি, গলিয়া শিলা পড়িল ঝরি’
মিশিল স্রোতে বন্ধ ধারা, পাষাণ-কারা ভগ্ন।
গভীর তৰ প্রাণের প্রীতি, বিপুল তব যত্ন, দিশারি!
তুমি দেখাও দিশা, ডুবারি তোলো রত্ন।
যে তানে টলে শেষের ফণা পেয়েছ তুমি তাহারি কণা,
– অমৃত এনে দিয়েছে গ্রেনে, নহে সে নহে প্রত্ন।
অমৃত এনে দিয়েছে প্রাণে পরাণ-শোষী দুঃখ,
গৌণ যাহা না গণি’ তাহে চিনিয়া নিলে মুখ্য;
শোকের রাতে রহিলে ধ’রে হিরন্ময় মৃণাল ডোরে,
রুদ্রে নিলে বরণ ক’রে রসায়ে নিলে রুক্ষ।
রেখেছ তুমি দৈবী শিখা হৃদয়ে চির-দীপ্ত,
অবিশ্বাসে হতাশ্বাসে জগৎ যবে ক্ষিপ্ত;
মত্ততারে করেছ ঘৃণা- চাহনা তবু মুক্তি বিনা,
উজল মনোমুকুর তব হয়নি মসীলিপ্ত।
বাজাও রুবি! অলোক বীণা মধুর নব ছন্দে,
হৃদয়-শতদল সে তুমি ফুটাও সুধা গন্ধে;
যে ভাব ওঠে প্রাণের মাঝে তোমার গানে সকলি আছে,
তোমার নামে মেতেছে দেশ, মিলেছে মহানন্দে।
গহন মেঘে বিজলি সম উজলি’ আছ বঙ্গ,
মাতাও কহু কাঁদাও তুমি হাসাও করি’ রঙ্গ!
সূৰ্য্য সম উজলি’ ভূমি সপ্ত ঘোড়া ছুটাও তুমি,
তৃপ্ত হ’ল হৃদয়-প্রাণ লভিয়া তব সঙ্গ।
কবিতা-৬৯-র্অ্ঘ্য
(কবি-সম্বর্দ্ধনা উপলক্ষ্যে সাহিত্য-পরিষদের ছাত্র সভ্যদিগের পক্ষ হইতে প্রদত্ত)
নেতধাট মোরা পাই নাই খুজে, বিশ আড়া ধান আনিনি কবি।
এনেছি কেবল হৃদয়ের প্রীতি-
বিকচ কমল কোমল ছবি।
পরগণা লিখে সঁপিতে কবিকে কৃষ্ণচন্দ্র বঙ্গে নাহি,
আঁখিজলে শুধু করি’ অভিষেক চাহি।
দর্ভ আসনে বসাতে জীবনের বহু শূন্য প্রহর ভরিয়া তুলেছ বীণার তানে,
অন্ধ যামিনী হেসেছে পুলকে,-
যে হাসি হাসিতে অন্ধ জানে।
তোমার যোগ্য কি দিব অর্থা? কোথা পাব মোরা ভাবি গো তাই;-
জনক রাজার মত কোথা পাব হিরণ-শৃঙ্গ হাজার গাই!
ব্রহ্মবিদের তুমি বরেণ্য,-
কাব্য-লোকের লোচন রবি!
স্বর্গে বসিয়া আশিষিছে তোমা,
ব্রহ্মবাদিনী বাচক্রবী।
শ্রদ্ধার অক্ চন্দন আর
অনুরাগ-ধারা এনেছি মোরা,
তোমার যোগ্য নাহিক অর্ঘ্য,-
তবু লও প্রীতি রাখীর ডোরা।
কবিতা-৭০-নিবেদিতা
প্রস্থতি না হ’য়ে কোলে পেয়েছিল পুত্র যশোমতী;
তেমনি তোমারে পেয়ে হৃষ্ট হয়েছিল বঙ্গ অতি,-
বিদেশিনী নিবেদিতা। স্বাস্থ্য, সুখ, সম্পদ তেয়াগি’
দীন দেশে ছিলে দীন ভাবে; দুঃস্থ এ বঙ্গের লাগি’
সঁপেছিলে সর্ব্বধন,কায়, মন, বচন আপন,
ভাবের আবেশ ভরে, -করেছিলে আত্ম-নিবেদন।
ভালবেসে ভারতেরে কাছে এসেছিলে দূর হ’তে,
দিয়েছিলে স্নিগ্ধ ক’রে অনাবিল মমত্বের স্রোতে।
তপস্তার পুণ্য তেজে করেছিলে অসাধ্য-সাধন,
জ্বেলেছিলে স্বর্ণ দীপ অন্ধকারে;
নব উদ্বোধন করেছিলে জীর্ণ বিবমূলে মাতৃরূপা শকতির;-
স্মরিয়া সে সব কথা আজ শুধু চক্ষে বহে নীর।
এসেছিলে না ডাকিতে, অকালে চলিয়া গেলে,
হায়, চলে গেলে অল্প-আয়ু দুর্ভাগার সৌভাগ্যের প্রায়,-
দেহ রাখি’ শৈল মূলে,-শঙ্করের অঙ্কে মৃতা সতী;
ওগো দেবতার-দেওয়া ভগিনী মোদের পুণ্যবতী!
কবিতা-৭১-নফর কুণ্ডু
নফর নফর নয়,-এক মাত্র সেই তো মনিব নফরের দুনিয়ায়;
দীন হীন প্রতি জীবে শিব প্রত্যক্ষ ক’রেছে সেই।
নহিলে কি অস্পৃশ্ন মেথরে বিপন্ন দেখিয়া,
নিজ প্রাণ দিতে পারে অকাতরে দুঃস্থের উদ্ধার লাগি’?
পঙ্কে সে মানে নি অগৌরব; সে শুধু মানস-চক্ষে দেখেছে গো বিপন্ন মানব,
শুনেছে মনের কানে মুমূর্ষু জনের আত্তরব,-
অমনি গিয়েছে ভুলে পুত্র, জায়া, পিতা, মাতা,সব, গৃহ,
গৃহস্থালী-সুখ; বাষ্প-বিষ-বিহবল-গহ্বরে নেমেছে অকুতোভয়ে;
একটি সে জীবনের তরে।
একটি প্রাণের লাগি’ নিজ প্রাণ দেছে মহাপ্রাপ্ত।
স্বদেশী বিদেশী মিলি’ স্মরে আজি পুণ্য অবদান নিঃস্ব এই নফরের।
নফর আজিকে পুণ্যশ্লোক;
আলোকিছে মাতৃভূমি শুভ্র তার শুরুতি-আলোক।
কবিতা-৭২-দেশবন্ধু
(স্বর্গীয় রমেশচন্দ্র দত্তের অভ্যর্থনা উপলক্ষে সাহিত্য-পরিষদে গীত) বন্ধুর ভালে চন্দন-টীকা কণ্ঠে কমল-মালা, দেশ-বন্ধুর শুভ আগমনে হৃদি-মন্দির আলা! মাধবে মাধবী-কঙ্কণ বাঁধ বন্ধুর মণিবন্ধে, লোক-বন্ধুর গৌরব-গাথা গাঁথ মনোরম ছন্দে; বেদের সরস্বতী এসেছেন লইয়া বরণ-ডালা,- ইন্দু-কিরণ-নিন্দিত যাঁর মুকুট-রশ্মি-জ্বালা। বন্ধুর তরে তোরণ রচনা করেছে নূতন বর্ষ,- নবীন পুষ্পে নব কিশলয়ে; উথলে নবীন হর্ষ। বর্ষণ করে লাজ-অঞ্জলি কল্যাণন্ট পুরবালা,
জনবন্ধুর আগমন-পথে লক্ষ কুসুম ঢালা।
কবিতা-৭৩-জ্যোতির্মণ্ডল
যাঁহাদের পুঞ্জ তেজে দীপ্ত আজি বঙ্গের গগন,
বাঙালীর চিত্তপটে তাঁহাদের একত্র মিলন!
মণ্ডলের মধ্যে রবি মহিমায় করেন বিরাজ,
সৌর জগতের সত্য সাহিত্য-জগতে হের আজ হ’য়ে আছে সপ্রমাণ।
উর্দ্ধে তার নিস্পন্দ আলোক,-
যঙ্গ-যুগন্ধর রাজা আছেন রচিয়া ধ্রুব-লোক;
আর্ষ-লোক পার্শ্বে তার, তপঃ ক্লিষ্ট সপ্তর্ষি মণ্ডল,-
স্তব্ধ, শান্ত সুগম্ভীর পুরাতন জ্যোতিষ্কের দল,-
অক্ষয় সে জ্ঞানযোগী, কর্ম্মযোগী বিস্তার সাগর,-
দূরতার মন্দীভূত রশ্মি তবু স্পষ্ট সুগোচর।
রবির দক্ষিণভাগে বঙ্কিম বঙ্গের বৃহস্পতি;
বামে মধু শুক্রগ্রহ,
বিতরিল যেই শুভ্র জ্যোতি রবি উদয়েরও আগে।
শুল্কে শোভে নীহারিকা-সেতু, উল্কা আছে, গ্রহ আছে,
আছে তারা, আছে ধূমকেতু।
কবিতা-৭৪-বিশ্ববন্ধু
(বিঙ্গবন্ধু উইলিয়ম্ ট্রেডের মৃত্যু উপলক্ষে) গ্রহণ-বর্জিত শুচি সূৰ্য্য সম নিত্য নির্ণিমেষ নিয়ন্তার নেত্রবিভা পশেছিল ও তব পরাণে; তাই জান নাই শঙ্কা, তাই তুমি মান নাই ক্লেশ, বিবাদ, বিপদ, বিঘ্ন; টল নাই নিন্দা অপমানে।
হে তেজস্বী! অগ্নি-সত্ত্ব! হে তপস্বী!
স্বদেশ বিদেশ ভিন্ন নহে তব চোখে;
তোমার নাহিক আত্মপর; ঘোষণা ক’রেছ তুমি নিত্য সত্য;
চিত্ত স্বার্থ-লেশ- শুক্ত তব চিরদিন; ধৃতব্রত তুমি ঋতম্ভর।
“জাতির প্রতিষ্ঠা বাড়ে ন্তায়-নিষ্ঠ শুচি অনুষ্ঠানে”
এ তোমার মূলমন্ত্র,-এ তোমার প্রাণের সাধনা;
জয়-ডঙ্কা-নাদে তাই আতঙ্কিত হ’তে তুমি প্রাণে দুর্ব্বলের পীড়াভয়ে।
বিশ্ব-মানবের আরাধনা,-
সনাতন ্যায়-ধৰ্ম্ম, তুমি তার ছিলে পুরোহিত;-
কত অভিচার-মন্ত্র নষ্টবীর্য্য তব শঙ্খ রবে।
হে বিশ্বাসী! বিশ্ববন্ধু! ওগো কর্মী উদার-চরিত!
নিঃস্ব নির্জিতের পক্ষে একা তুমি যুঝেছ গৌরবে।
হে ধর্ম্মিষ্ঠ! আত্মনিষ্ঠ!
লভিয়াছ সমুদ্র-সমাধি অস্তে তুমি সমুদার!
মানুষের রাজ্যের বাহিরে; ঊর্দ্ধে শুধু নীলাকাশ-সীমাহীন,’
অনন্ত, অনাদি, নিম্নে লীলায়িত নীল উচ্ছ, সিত চন্দ্রমা-মিহিরে।
তোমার সমাধি ভঙ্গ করিবে না তরঙ্গ দুর্জয়,
আত্ম-প্রাণ-দানে তব আওত্রাণ ঘটেছে, সুক্ষণে;
কীর্তনীয় তব নাম; কীর্তি তব অমর অক্ষয়,
ক্ষাত্রধৰ্ম্ম মূর্ত তুমি, হে যশস্বী! জীবনে মরণে।
কবিতা-৭৫-চৌদ্দ প্রদীপ
চৌদ্দ প্রদীপে চৌদ্দ ভুবন উজল করি,
বিস্তৃত শত অমা-যামিনীর কাজল হরি;
পিতৃযানের অজানা আঁধারে আলোক জ্বালি,
আলোর রাখীতে বাঁধি গো অতীতে, ঘুচাই কালি!
মৃত্যু গহনে বিস্তৃত জনে স্মরণ করি,
স্মৃতি-লোকে সবে জাগাই পুলকে চিত্ত ভরি’।
কল্পনা দিয়ে করি গো স্বজন কল্প-লতা,-
অশ্রু-হিমানী জড়িত আকাশে অতীত-কথা!
চৌদ্দ প্রদীপে সপ্ত ঋযিরে স্মরণ করি,
ত্রিশঙ্কু আঙ্গ বিশ্বামিত্রে বরণ করি;
স্মরি অগস্ত্যে-ফেরে নি যে আর যাত্রা ক’রে,
স্মরি গো বুদ্ধে-জ্ঞানে প্রেমে যার ভূবন ভেরে;
স্মরি পরাশরে-তার রাক্ষস-সত্র-কথা,
স্মরি মৈত্রেয়ী অরুন্ধতীরে পতিব্রতা; ‘
বাল্মীকি আর কালিদাস কবি জাগিছে মনে,
দোলাইয়া শিখা নমিছে প্রদীপ দ্বৈপায়নে।
ভীষ্মের স্মৃতি উজলিছে দীপ হৃদয়-লোকে,
– সাবা ভারতের পিতামহ সেই অপুত্রকে।
জাগিছে ভরত সর্ব্বদমন ভারত-আদি,-
অশোক-প্রতাপ-পৃথ্বী-বিজয়সিংহ-সাথী!
জাগে বিক্রম অভিনব নব-রছে ধনী,
যবনী রাণীর বক্ষে জাগিছে মৌর্য্যমণি।
লুপ্ত দিনের বিস্তৃতি-লেপ ঘুচেছে কালো,
চৌদ্দ প্রদীপে আজিকে চৌদ্দ ভুবন আলো।
কোলাকুলি আজ তিমিরে দোলারে আলোর দোলা!
চৌদ্দ যুগের চৌদ্দ হাজার ঝরোখা খোলা!
এ পারে প্রদীপ উল্কা ওপারে উলসি’ ওঠে,
পিতৃযানের মাঝখানে আজ বার্তা ছোটে;
আনাগোনা আজ জানা যেন যায় আকাশ ‘পরে,
পিতৃগণের পদ-রেণু আজ আঁধারে করে!
আঁধার-পাথারে আকুল হৃদয় পেয়েছে ছাড়া,
চৌদ্দ, প্রদীপে চৌদ্দ ভুবনে জেগেছে সাড়া।
কবিতা-৭৬-বন্দরে
শাস্ত্র-শাসন রইল মাথায়,
তর্ক মিছে, ‘নেইক ফল;
বন্দরে ওই দাঁড়িয়ে জাহাজ,
বেরিয়ে পড় বন্ধুদল! বাজে কথায় কান দিয়োনা,
কান দিয়োনা ক্রন্দনে,
দুতে হ’বে সিন্ধু-দোলায় বিরাট বুকের স্পন্দনে।
সাগর-পথে যাত্রা-নিষেধ?-
লক্ষ্মীছাড়ার যুক্তি ও,
লক্ষ্মী আছেন সিন্ধুমাঝে-মুক্তাভরা গুক্তি ও;
ফিরব মোরা দশটা দিকে রত্নাকরের বুক চিরে,
রত্ন নেব, মুক্তা নেব, সঙ্গে নেব লক্ষ্মীরে।
বাণিজ্যে সে বসত করে সিন্ধুজলে জন্ম তার,
সাগর সেঁচে আনব তারে আন্য ঘরে পুনর্ব্বার;
আন্দ্ব ঘরে মাথায় ক’রে বিষ্মা মৃত-সঞ্জীবন,
শুক্র ঋষির চরণ-ধূলায় পরব মোরা জ্ঞানাঞ্জন।
দেবযানীরে রাখব খুসী ব্রহ্মচর্য্য ছাড়ব না,
আপনজনে স্কুল্ব না রে পরের আদর কাড়ব’না;
জালের কাঁঠি নিরেট পাঁটি, ছড়িয়ে পড়ে ছত্রাকার,-.
মিলে নিধি, জলের তলে থাবে না সে ছুড়িয়ে আর;-
ঘেঁষে ঘেঁষে ঘনিয়ে এসে মিলিয়ে দেবে সকল খুঁট,-
‘ইঙ্গ ঘড়াটি ধরবে আঁটি’ লাখ, আঙুলের লোহার মুঠ!
ছড়িয়ে গিয়ে জগৎমাঝে মিল্ক মোরা অন্তরে;
নূতন ক’রে পড়ব বাঁধা দেশের মায়া-মস্তরে।
পাজি পুঁথি রইল মাথায়, জ্ঞানের বাড়া নেইক বল,
যৌবনের এই শুভক্ষণে বেরিয়ে পড় বন্ধুদল।
হিন্দু যখন সিন্ধুপারে করলে দখল যবদ্বীপ
কোথায় তখন ভট্টপল্লী কোথায় ছিলেন নবদ্বীপ?
কোথায় ছিল জাতির তর্ক-অর্কফলার আন্দোলন-
যেদিন রুদ্র সমুদ্রেরে বিজয় দিল আলিঙ্গন?
মেক্সিকোতে হ’ল যেদিন মুঠ প্রতিষ্ঠা রামসীতার-
বিধান দিল কোন্ মনীষি?- খোঁজ রাখে কি পুরাণ তার?
উড়ুপ-যোগে দু’দিন আগে হিন্দু বেত সিন্ধু পার, মিশর,
পেরু, রোম, জাপানে ছুটন্ত নিয়ে পণ্যভার;
তাদের ধারা লুপ্ত হবে?
থাকবে শুধু পঞ্জিকা?
ধানের আবাদ উঠিয়ে দিয়ে ফসল হ’ল গঞ্জিকা?
করুক তবে সূক্ষ্ম বিচার শাস্ত্র নিয়ে পণ্ডিতে;
নিঃস্ব করুক না-ধানী গোময়-লিপ্ত গণ্ডীতে।
চলবে না কেউ মোদের নিয়ে?
-সাগরের তো চলছে জল;
পরের কথা ভাবব্ব পরে;
বেরিয়ে পড় বন্ধুদল।
কবিতা-৭৭-ছেলের দল
হল্লা ক’রে ছুটির পরে ওই যে যারা যাচ্ছে পথে,
হাকা হাসি হাসছে কেবল, ভাচ্ছে যেন আগা স্রোতে,-
কেউ বা শিষ্ট, কেউ বা চপল, কেউ বা উগ্র, কেউ বা মিঠে;
ওই আমাদের ছেলেরা সব,-ভাবনা যা’ সে’ ওদের পিঠে।
ওই আমাদের চোখের মণি, ওই আমাদের বুকের বল,-
ওই আমাদের অনর প্রদীপ, ওই আমাদের আশার স্থল,-
ওই আমাদের নিখাদ সোনা, ওই আমাদের পুণ্যফল,-
আদর্শে যে সত্য মানে-সে ওই মোদের ছেলের দল।
ওরাই ভাল বাস্তে জানে দরদ দিয়ে সরল প্রাণে,
প্রাণের হাসি হাতে জানে, খুলতে জানে মনের কল,-
ওই যে দুষ্ট, ওই যে চপল, ওই আমাদের ছেলের দল।
ওরাই রাখে আলিয়ে শিখা বিশ্ব-বিজ্ঞা-শিক্ষালয়ে,
অন্নহীনে অন্ন দিতে ভিক্ষা মাগে লক্ষ্মী হ’য়ে;
পুরাতনে শ্রদ্ধা রাখে নূতনেরও আদর জানে ওই আমাদের ছেলেরা সব,
-নেইক দ্বিধা ওস্কের প্রাণে;
ওই আমাদের ছেলেরা সব-খুচিয়ে অগৌরবের রব দেশ
দেশান্তে ছুটছে আজি আনতে দেশে জ্ঞান-বিভব;
মাকিনে আর জন্মনিতে পাচ্ছে তারা তপের ফল,
হিবাচীতে আগুন জেলে শিখছে ওরা কজাকল;
হোমের শিখা ওরাই জ্বালে, জ্ঞানের টীকা ওদের ভালে,
সকল দেশে সকল কালে উৎসাহ-তেজ অচঞ্চল,
ওই আমাদের আশার প্রদীপ, ওই আমাদের ছেলের দল।
মানুষ হ’য়ে ওরা সবাই অমানুষী শক্তি ধরে,
যুগের আগে এগিয়ে চলে, হাস্ত্যমুখে গর্বভরে;
প্রয়োজনের ওজন-মত আয়োজন সে কর্তে পারে,
ভগবানের আশীর্ব্বাদে বইতে গ্লারে সকল ভারে।
ওই আমাদের ছেলেরা সব,-ত্রুটি ওদের অনেক হয়,-
মাঝে মাঝে ভুল ঘটে ঢের, কারণ ওরা দেবতা নয়;
মাঝে মাঝে দাঁড়ায় বেঁকে নিন্দা শুনে অনর্গল,
প্রশংসাতেও হয় গো কাবু,-মনের মতন দেয় না ফল
তবু ওরাই আশার খনি,-
‘ সবার আগে ওদের গণি,
পদ্মকোষের বজ্রমণি ওরাই ধ্রুব সুমঙ্গল;
আলাদিনের মায়ার প্রদীপ ওই আমাদের ছেলের দল।
কবিতা-৭৮-কালোর আলো
কালোর বিভার পূর্ণ ভুবন;
কালোরে কে করিস্ ঘৃণা?
আকাশ-ভরা আলো বিফল কালো আঁখির আলো বিনা।
কালো ফণীর মাথায় মণি,
সোনার আধার আঁধার খনি;
বাসন্তী রং নয় সে পাখীর বসন্তের যে বাজায় বীণা;
কালোর গানে পুলক আনে, অসাড় বনে বয় দখিনা!
কালো মেঘের বৃষ্টিধারা তৃপ্তি সে দেয় তৃষ্ণা হরে,
কোমল হীরার কমল ফোটে কালো নিশির প্ল্যামসায়রে!
কালো অলির পরশ পেলে তবে মুকুল পাড়ি মেলে,-
তবে সে ফুল হয় গো সফল রোমাঞ্চিত বৃন্ত ‘পরে;
কালো মেঘের বাহুর তটে ইন্দ্রধনু বিরাজ করে।
সন্ন্যাসী শিব শ্মশান-বাসী,
সংয়ারী সে কালোর প্রেমে;
কালো মেয়ের কটাক্ষেরি ভয়ে অসুর আছে থেমে।
দৃপ্ত বলীর শীর্ষ’পরে কালোর চরণ বিরাজ করে,
পুণ্য-ধারা গঙ্গা হ’ল-সেও তো কালো চরণ ঘেমে;
দুর্ব্বাদলশ্যামের রূপে-রূপের বাজার গেছে নেমে।
প্রেমের মধুর ঢেউ উঠেছে কালিন্দীরি কালো জলে,
মোহন বাঁশীর মালিক যেজন তারেও লোকে কালোই বলে;
বৃন্দাবনের সেই যে কালো,- রূপে তাহার ভুবন আলো,
রাসের মধুর রসের লীলা, তাও সে কালে তমাল তলে;
নিবিড় কালো কালাপানির কালো জলেই মুক্তা ফলে।
কালো ব্যাসের রূপায় আজো বেঁচে আছে বেদের বাণী,
দ্বৈপায়ন-সেই কৃষ্ণ কবি-‘শ্রেষ্ঠ কবি তারেই মানি;
কালো বামুন চাণক্যেরে আঁটবে কে কূট-নীতির ফেরে?
কাল-অশোক জগৎ-প্রিয়, রাজার সেরা তাঁরে জানি;
হাক্সী কালো লোকক্সানেরে মানে আরব আর ইরাণী।
কালো জামের মতন মিঠে-কালোর দেশ এই জম্বুদ্বীপে
– কালোর আলো জ্বলছে আজো, আজো প্রদীপ যায়নি নিবে;
কালো চোখের গভীর দৃষ্টি কল্যাণেরি করছে সৃষ্টি,一
বিশ্ব-ললাট দীপ্ত-কালো রিষ্টিনাশা হোমের টিপে,
রক্ত চোখের ঠাণ্ডা কাজল-তৈরী সে এই স্নান প্রদীপে!
কালোর আলোর নেই তুলনা-কালোরে কী করিস্ ঘৃণা!
গগন-ভরা তারার মীনা বিফল-চোখের তারা বিনা;
কালো মেঘে জাগায় কেকা, চাঁদের বুকেও কৃষ্ণ-লেখা,
বাসন্তী রং নয় সে পাখীর বসন্তের যে বাজায় বীণা,
কালোর গানে জীবন আনে নিথর বনে বয় দখিনা!
কবিতা-৭৯-আমরা
মুক্তবেণীর গঙ্গা যেথায় মুক্তি বিতরে রঙ্গে আমরা বাঙালী বাস করি সেই তীর্থে-বরদ বঙ্গে;-
বাম হাতে যার কম্পার ফুল, ডাহিনে মধুক-মালা,
ভালে কাঞ্চন-শৃঙ্গ-মুকুট, কিরণে ভুবন আলা,
কোল-ভরা যার কনক ধান্য,
বুকভরা যার স্নেহ, চরণে পদ্ম,
অতসী অপরাজিতায় ভূষিত দেহ,”
সাগর যাহার বন্দনা রচে শর্ত তরঙ্গ ভঙ্গে,-
আমরা বাঙালী বাস করি সেই বাঞ্ছিত ভূমি বঙ্গে।
বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া আমরা বাঁচিয়া আছি,
আমরা হেলায় নাগেরে খেলাই, নাগেরি মাথায় নাচি।
আমাদের সেনা যুদ্ধ ক’রেছে সজ্জিত চতুরঙ্গে,
দশাননজয়ী রামচন্দ্রের প্রপিতামহের সঙ্গে।
আমাদের ছেলে বিজয়সিংহ লঙ্কা করিয়া জয় সিংহল নামে রেখে গেছে নিজ শৌর্য্যের পরিচয়। একহাতে মোরা মগেরে রুখেছি, মোগলেরে আর হাতে,
চাঁদ-প্রতাপের হুকুমে হঠিতে হয়েছে দিল্লীনাথে।
জ্ঞানের নিধান আদিবিদ্বান্ কপিল সান্ধ্যকার এই বাক্কার মাটিতে গাঁথিল সূত্রে হীরক-হার।
বাঙালী অতীশ লঙ্ঘিল গিরি তুষারে ভয়ঙ্কর,
জালিল জ্ঞানের দীপ তিব্বতে বাঙালী দীপঙ্কর।
কিশোর বয়সে পক্ষধরের পক্ষশাতন করি’ বাঙালীর ছেলে ফিরে এল দেশে যশের মুকুট পরি’। বাঙলার রবি জয়দেব কবি কান্ত কোমল পদে করেছে সুরভি সপ্তস্কৃতের কাঞ্চন-কোকনদে।
স্থপতি মোদের স্থাপনা করেছে ‘বরভূধরের’ ভিত্তি,
শ্যাম-কাম্বোজে ‘ওঙ্কার-ধাম’,-মোদেরি প্রাচীন কীর্ত্তি।
বেয়ানের ধনে মূর্ত্তি দিয়েছে আমাদের ভাস্কর বিপাল আর ধীমান,
যাদের নাম্। অবিনশ্বর। আমাদেরি কোন সুপটু পটুয়া লীলায়িত
তুলিকায় আমাদের পট অক্ষয় ক’রে রেখেছে অজস্তায়।
কীর্তনে আর বাউলের গানে আমরা দিয়েছি খুরি।
মনের গোপনে নিভৃত ভুবনে দ্বার ছিল যতগুলি।
মন্বন্তরে মরি নি আমরা মারী নিয়ে ঘর করি,
বাঁচিয়া গিয়েছি বিধির আশিষে অমৃতের টীকা পরি’।
দেবতারে মোরা আত্মীয় জানি, আকাশে প্রদীপ জ্বালি,
আমাদেরি এই কুটিরে দেখেছি মানুষের ঠাকুরালি;
ঘরের ছেলের চক্ষে দেখেছি বিশ্বভূপের ছায়া,
বাঙালীর হিয়া অমিয় মথিয়া নিমাই ধরেছে কায়া।
বীর সন্ন্যাসী বিবেকের বাণী ছুটেছে জগৎময়,-
বাঙালীর ছেলে ব্যাঘ্রে বৃষভে ঘটাবে সমন্বয়।
তপের প্রভাবে বাঙালী সাধক জড়ের পেয়েছে সাড়া,
আমাদের এই নবীন সাধনা শব-সাধনার বাড়া।
বিষম ধাতুর মিলন ঘটায়ে বাঙালী দিয়েছে বিয়া,
মোদের নব্য রসায়ন শুধু গরমিলে মিলাইয়া।