ঝিলাম নদির তির
পৃষ্ঠা ০১ থেকে ১০
পৃষ্ঠা:০১
ঝিলম নদীর তীর
হিমালয়ের বরফ গলে গলে হয়েছে নদী। পাহাড়ের গা বেয়ে, পাইনের বন পেরিয়ে, আঁকাবাঁকা পথে সে নদী নেমে এসেছে নীচু মাটিতে। মৌরী ক্ষেতের ধার দিয়ে, উইলো ঝাড়ের কাছ দিয়ে চলে গিয়েছে শহরের বুক চিরে। কাঠের ঘর-বাড়িতে ঢাকা দু’পাশের তীর; মধ্যিখানে ধীরে বয়ে যাচ্ছে জলধারা। অন্ধকারে দূর থেকে দেখায় যেন কনে বউ-এর মাথায় দু’পাশের কালো চুলের মাঝখানে একটানা সরু সিঁথিটি। ছোট্ট নামটি তার; সহজ ও মিষ্টি। ঝিলম। সকালবেলা সোনালী রোদের আভা ঠিকরে পড়ে তার বুকে। সন্ধ্যাবেলা দোলে তারা-ভরা আকাশের ছায়া। ঝিলম ঝিলমিল করে দিন-রাত। নদীর কোল ঘেঁষেই উঠেছে দুধের মতো ধবধবে, শ্বেত পাথরে গড়া মস্ত রাজপুরী। দুয়ারে তার সেপাই। সিঁড়িতে তার সান্ত্রী। দেউড়িতে সঙ্গীন উচিয়ে কুচকাওয়াজ করে উর্দিপরা পাহারাওয়ালার দল। পুরানো আমলে এটাই ছিল রাজাদের খাশমহল। বুড়ো মহারাজা জীবন কাটিয়ে গিয়েছেন এখানেই। নতুন রাজার চাল-চলন আলাদা। স্ত্রী পুত্র দাস দাসী নিয়ে তিনি উঠে গিয়েছেন দূরে পাহাড়ের গায়ে বিলাতী ধরনে তৈরি নূতন বাড়িতে। সেখানে সেজের বদলে জ্বলে বিজলী বাতি, হাতিশালের বদলে আছে মোটর গ্যারেজ। সেকেলে বাজবাড়ি একালে হয়েছে সরকারী আপিস। তকমা-আটা কর্মচারীরা সেখানে বসে মহারাজার নামে প্রজা শাসন অর্থাৎ প্রজা শোষণ করে। শুধু বছরে দু’দিন রাজ-দরবার বসে মাঝের গোল হল ঘরটিতে। তখন চতুর্দোলায় চেপে রাজা আসেন। পুরানো রাজমহলের সাবেকি জাঁক-জমক আবার জেগে ওঠে। আগে সাজে লোক, পিছে সাজে লস্কর। ডাইনে বাজে বাঁশি, বায়ে বাজে মৃদঙ্গ। দশহরার দববার দেশের সবচেয়ে বড় পার্বণ, বছরের সবচেয়ে সেরা সমারোহ।মুক্তাব ঝালব আঁটা জড়োয়া চাঁদোয়ার নীচে কিংখাবে মোড়া গজদন্তের সিংহাসন। তাতে বসেছেন রাজা। মহারাজ শ্রীহরি সিং। কাশ্মীরের প্রজাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। সামনে পায়ের কাছে খোলা তলোয়ার হাতে প্রতিহারী। পিছনে মাথার কাছে ছাতাহাতে ছত্রধর। দু’পাশে চামর দুলিয়ে হাওযা দিচ্ছে আটজন কিঙ্কর কিঙ্করী। রুপোর পিলসুজের মাথায় জ্বলছে সোনার প্রদীপ; জয়পুরী পাথবেব ধূপদানিতে পুড়ছে কস্তুরী ধূপ। জমকালো পোশাকে পাত্র-মিত্র ও অমাত্যরা বসেছেন প্রথম সারিতে। তার পিছনে গণ্যমান্য লোকদের আসন পড়েছে যার যার মর্যাদা বুঝে। ফুলের শোভাষ, জরির সাজে, নানা রঙের আলোর মেলায় ঝলমল করছে সভা-ঘর। কিন্তু এত ধূমধামের মধ্যেও মহারাজাকে কেমন মনমরা দেখাচ্ছে যেন। তাঁর মুখে কেন নেই হাসি? চোখে কেন নেই খুশি-খুশি ভাব? সত্যি, মহারাজা হরি সিং-এর মনে একটুও সুখ নেই। মাস দুই হলো এদেশ থেকে ইংরেজ সরকার চলে গিয়েছে। যাবার বেলায় দেশকে দু’ভাগ করে এক ভাগ দিয়ে গিয়েছে একদল মুসলমানের হাতে। হিন্দুদের সঙ্গে তাদের মহা আড়ি। এক সঙ্গে এক রাজত্বে বাস করতেও তাবা রাজী নয। ভারতবর্ষ থেকে কেটে নেওয়া এই মুসলমানী দেশের নাম হয়েছে, পাকিস্তান। ইংরেজ আমলের আরও যে-সব দেশীয় রাজা ছিলেন, ইংরেজ যেতে না যেতেই তাঁরা প্রায় সবাই নিজ নিজ রাজ্যের সীমানার মিল দেখে ভাগ হওয়া দেশের এ-দিকে কিংবাও-দিকে যোগ দিয়েছে। জয়পুর, গোয়ালিয়র, কুচবিহার ইত্যাদি মিশেছে ভারতবর্ষে। ভাওয়ালপুর ও কালাত মিশেছে পাকিস্তানে। কাশ্মীব এখনও আছে দোটানায়। কাশ্মীরের সীমানার যোগ রয়েছে দু’দেশেরই সঙ্গে। পশ্চিমে প্রায় পঁচিশ মাইল ধরে আছে পাকিস্তান। আবার পূর্ব-দক্ষিণে তার সীমানা মিলেছে ভারতবর্ষে। কাশ্মীর কোন্ দেশে যোগ দেবে? মহারাজ। মন ঠিক করতে পাবেন না। অনেক ভেবে শেষটায় তিনি বললেন, এখন
পৃষ্ঠা:০২
কোনো দেশেই যোগ দিচ্ছি না। যেমন আছি তেমনি থাকি। পরের ভাবনা পরে হবে।” মহারাজা যাই ভাবুন, দেখা গেল, পরের আশায় বসে থাকতে অপরেরা রাজী নয়। ভারতবর্ষের নেতারা কিছু বললেন না ঘটে। ৩-দিকে পাকিস্তানের কর্তাদের তো সবুর সয় না। তাঁরা চান কাশ্মীর তক্ষুণি তাদের দখলে আসুক। কাশ্মীরের মহারাজা হিন্দু। ডোগরা রাজপুত। রাজ্যের প্রজারা বেশীর ভাগ মুসলমান। পাকিস্তানের বড় নেতারা মাথা নেড়ে বললেন, “এ অসহ্য।” বাবু যত কন, পারিষদগণ কহে তার শত গুণ। ক্ষুদে নেতারা ঘুষি বাগিয়ে হুঙ্কার দিলেন, “লড়কে লেঙ্গে-” যেই কথা সেই কাজ। প্রথমে শুরু হলো অভাব অনটনের চাপ দেওয়া। হাতে না মেরে ভাতে মারার ফন্দি। কাশ্মীর পাহাড়ী রাজ্য। চাষবাসের দেশ। ক্ষেতে ধান আর বাগানে ফল, এই হলো সেখানকার মোটামুটি ফসল। অন্য সব জিনিস তাকে আনতে হয় বাইরে থেকে। লাহোর বা রাওলপিন্ডির পথে চালান আসত এতকাল। পাকিস্তান বন্ধ করে দিলে তা’। তখন পেট্রোলের অভাবে কাশ্মীরের পথে মোটর বাস অচল হলো, কাগজের অভাবে স্কুল কলেজে লেখাপড়া বন্ধ, চিনির অভাবে ময়রার দোকানে সন্দেশের থালা পড়ে রইল খালি। রাজ্যে রোগী পায় না ওষুধ, শিশু পায় না পথ্য। নেহাত গরীব যে দিনমজুর, একটু নুন না মেলাতে তারও মুখে ভাত রোচে না।এ তো শুধু আরম্ভ। যেমন ফাঁসীর আগে হাজত, মারের আগে ধমকানি। সেপ্টেম্বর মাসের গোড়া থেকে শুরু হলো জবরদস্তি হামলা। রোজই সীমানার ও-পার থেকে পাকিস্তানীরা দল বেঁধে কাশ্মীরের গ্রামে ঢুকে লুঠতরাজ করতে লাগল। গত চার দিনে অবস্থা আরও সঙ্গীন হয়েছে। খবর এসেছে, যুদ্ধের সৈন্যদের মতো হাজার হাজার হানাদার কাশ্মীর রাজ্য আক্রমণ করেছে। ভিন্ন ভিন্ন শত্রু রাজ্যের নানা জায়গায় সীমানা পাঁর হয়ে গ্রামের পর গ্রাম দখল করেছে। সব চেয়ে বড় দলটা এগিয়ে আসছে মোটর লরী চেপে ডোমেলের পথে রাজধানী শ্রীনগরের দিকে। সে-দলে আছে হাজারখানেক উত্তব-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের উপজাতি, কয়েক শ’ পাঠান আফ্রিদি, আর অগুনতি মুসলীম লীগের ভলান্টিয়ার, নিজেদের তারা বলে, “মুসলীম ন্যাশন্যাল গার্ড।” দেশীয় রাজ্যগুলি এতকাল আপদে বিপদে নির্ভর করেছে ব্রিটিশ সরকারের উপর। তাদের নিজেদের সৈন্য যা’ ছিল, সে শুধু নামকাওয়াস্তে। কাশ্মীরের সৈন্য-সংখ্যা সামান্য। তারও আবাব অর্ধেক ছিল মুসলমান। শত্রুরা হানা দিতেই তারা দল ছেড়ে সবে পড়লো। বাধা দেওয়া দূরে থাক, “আল্লাহো আকবর” বলে তারা হানাদারদেরই দলে ভিড়ে গেল। কথায় বলে, যার খায় পরে তারই দাড়ি উপাড়ে। এই নিমকহারামেরাও হানাদারদেব রাস্তা দেখিয়ে আনতে লাগল রাজধানীর দিকে। মহারাজা উত্তলা হবেন না তো হবে কে? দশহরার দিনে রাজা দরবারে না বসলেই নয়। একশ’ বছর ধরে চলে আসছে এ নিয়ম: মহারাজা গোলাব সিং-এর আমল থেকে। পিতা-পিতামহদের সে নিযম তো ভাঙা চলে না। তাই এবারেও সভা ডাকতে হয়েছে। দরবারে কুল-পুরোহিত মন্ত্র পড়লেন। ভাট গান বেঁধে রাজার মহিমা শোনাল। মনের উদ্বেগ চেপে রেখে রাজা কাউকে দিলেন সনদ: কাউকে দিলেন শিরোপা। সভাসদেরা একের পর একে রাজার পায়ের কাছে রাখল প্রণামী। কেউ পাঁচ মোহর, কেউ বা দুই, যার যেমন হার বাঁধা আছে বাপ-ঠাকুর্দার আমল থেকে। জমিদার জায়গিরদারেরা কেউ দিল আসমানী রঙের কঙ্কা পাড় পশমী জমিয়ার, কেউ দিল ঝুড়ি-ভর্তি সুগন্ধ মৃগনাভী, কেউ বা দিল গিলগিটের নামকরা নীল গাই-এর শিং। হঠাৎ ব্যস্ত-সমস্তভাবে শহর কোটাল এসে ঢুকল দরবারে। চুপি চুপি কী যেন বলল নগরপালকে। নগরপাল আঁতকে উঠে ফিসফিস করলেন তার উপরওয়ালার কানে। উপরওয়ালা অমনি কানে কানে বললেন তাঁরও উপরওয়ালকে। তিনি গোপনে জানালেন মন্ত্রীকে, মন্ত্রী ভয়ে
পৃষ্ঠা:০৩
ভয়ে শোনালেন দেওয়ানকে। দেওয়ান মুখ কালো করে উঠে গিয়ে রাজাকে দিলেন দুঃসংবাদ। শুনে মহারাজ হরি সিং-এর মুখে কথা সরলো না খানিকক্ষণ। তারপর হঠাৎ আসন ছেড়ে উঠে দেওয়ানকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেলেন বাইরে। এবার আর চতুর্দোলা নয়। শাপলা শব্দে মোটর হাঁকিয়ে দিলেন নতুন রাজবাড়ির দিকে। সভাসদেরা সবাই অবাক। এ ওর মুখের দিকে তাকায়। ব্যাপার কী? একটু পরেই জানতে পারা গেল, ব্যাপার গুরুতর। মন্দ খবর বাতাসের আগে ছোটে। শোনা গেল, ব্রিগেডিয়র রাজেন্দ্র সিংজী যুদ্ধে নিহত হয়েছেন। কী সর্বনাশ। রাজেন্দ্র সিং ছিলেন মহারাজার প্রধান সেনাপতি। যেমন বীর, তেমনি সাহসী। তাঁর উপরেই মহারাজার যা’ কিছু ভরসা। কাশ্মীরের হিন্দুসৈন্য তখনও শ’দেড়েক বাকি ছিল। তাদের নিয়ে রাজেন্দ্র সিং এগিয়ে গিয়েছিলেন দুশমনদের রুখতে। হানাদারেরা তখন শ্রীনগর থেকে পঁয়ষট্টি মাইল দূরে উরি অবধি এসেছে। সেখানে ঐ অল্প ক’টি মাত্র সৈন্য নিয়ে রাজেন্দ্র সিং পাকিস্তানীদের বাধা দিলেন। প্রাণের মায়া ছেড়ে লড়তে লাগলেন তিনি। লড়তে লাগল তাঁর সৈন্যরা। হানাদারেরা সংখ্যায় প্রায় দশ গুণেরও বেশী। অসাধারণ বীরত্বে রাজেন্দ্র সিং তাদের ঠেকিয়ে রাখলেন উরিতে পুরা দুটি দিন। তারপর নিজ সৈন্যদের সঙ্গে নিজেও মারা পড়লেন যুদ্ধে। দেড়শ’ জন দেড় হাজারের বিরুদ্ধে লড়তে পারে কতক্ষণ। রাজদরবার থেকে মুখে মুখে খবর ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেল, পথে লোক চলে না, ঘরে ঘরে মেয়ে-পুরুষ সবাই ভয়ে জড়সড়। কী জানি কী হবে আজ রাতটুকু পোহালে। কিন্তু ততক্ষণও সময় পেলো না তারা। রাত তখন দশটার কাছাকাছি। হঠাৎ শহরের সমস্ত আলো নিবে গেল। বিজলী আলোর কারখানাটা মহুরায়। পাহাড়ী ঝরনার জল ধরে জলবিদ্যুৎ তৈরি হয় সেখানে। থামের মাথায় তারের মধ্য দিয়ে সে-বিদ্যুৎ আসে দূর দূরান্তের শহরে। হানাদারেরা মহুরায় পৌঁছে কারখানার যন্ত্রপাতি ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। মহুরা? সে-তো রাজধানী থেকে মাত্র পঞ্চাশ মাইল। চমকে উঠলো সবাই। তবে শ্রীনগরের আর বাকি রইল কত? পিচ-বাঁধানো চওড়া সড়ক গিয়েছে মহুরার গা দিয়ে। সে-পথে মোটর লরী বোঝাই হানাদারদের শ্রীনগরে এসে পৌঁছতে কতক্ষণ লাগবে। তবে আর কিসের ভরসা। সেই রাত্রিতেই শহর থেকে প্রাণের ভয়ে লোক পালাতে শুরু করল। মোটবে, লরীতে টাকায়, গরুর গাড়িতে, সাইকেল-এ বা ঘোড়ার পিঠে চেপে ছুটল নানা দিকে। যাদের কিছুই জুটল না, তারাও স্ত্রী-পুত্রের হাত ধরে পায়ে হেঁটে রওনা হলো নিরাপদ জায়গার ধোঁজে। রাজবাড়িতে হরি সিং দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে জিজ্ঞাসা করলেন, “দেওয়ান, এখন” উপায় ?” দেওয়ান হাত জোড় করে বললেন, “মহারাজ, উপায় একমাত্র ‘ভারত সরকার। তাঁদের সাহায্য চান। এক বছর আগে পণ্ডিত নেহরুকে রাজো ঢুকতে দেননি, কয়েদ করেছিলেন। সে কথা রাজার মনে ছিল। সেই নেহরু এখন ভারত সরকারের কর্তা। রাজা চিন্তিত মুখে বললেন, “তাঁরা কি সাড়া দেবেন?” দেওয়ান উত্তর করলেন, “হুজুর, আর্তকে রক্ষা করা মানুষের ধর্ম। তা যদি না করেন তবে তাঁরা কেমন মহৎ। অত্যাচারীকে বাধা দেওয়া ন্যায়ের বিধান তা’ যদি না মানেন, তবে তাঁরা কিসের শাসক। আপনি আবেদন করুন, আর দেরিতে সর্বনাশ হবে।” তখন সেই অন্ধকার রাজপুরীর খাসকামরায় লণ্ঠনের আলোতে বসে কাশ্মীরের শেষ মহারাজা হরি সিং নিজ হাতে পত্র রচনা করলেন। করুণ প্রার্থনা জানালেন ভারতের নতুন সরকারের কাছে। লিখলেন,-“এক্ষুণি সৈন্য-সামন্ত পাঠিয়ে কাশ্মীরকে রক্ষা করুন। দোহাই, তার চল্লিশ লক্ষ লোককে বাঁচান। সে-দিন তারিখটা ছিল ২৫শে অক্টোবর, ইংরেজী ১৯৪৭ সাল।
পৃষ্ঠা:০৪
দুই
নয়াদিল্লীতে মহারাজার তার পেয়ে প্রধান মন্ত্রী নেহরু ভাবেন, কী করা যায়? সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল সহকারী প্রধানমন্ত্রী। তিনি এবং অন্যান্য মন্ত্রীরা বললেন, তাড়াতাড়ি সৈন্য পাঠাতে হবে কাশ্মীরে হানাদারদের ঠেকাতে। লর্ড মাউন্টব্যাটেন তখন বড়লাট। তাঁর খুবই আপত্তি। তবে তিনি এখন নিয়মতান্ত্রিক গভর্নর জেনারেল, নিজের মত খাটাতে পারেন না, শুধু উপদেশ দিতে পারেন। বললেন, “পাকিস্তানও যদি সরাসরি সৈন্য পাঠায় হানাদারদের পক্ষে, তবে?” ডাকা হলো সেনাপতি ও সৈন্যদের কর্তাদের। তাঁরা সবাই ইংরেজ। এসে গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বললেন, কাশ্মীরে ভারতীয় সৈন্য পাঠানো বিপদের কথা। মন্ত্রিসভা জোর দিয়ে বললেন, বিপদের ভয়ে মহাবাজকে সাহায্য না দেওয়া কাপুরুষতা। পাকিস্তানীরা জোর করে দখল করবে কাশ্মীর, এ কখনই হতে দেওয়া যায় না। সে-কথা ঠিক। কিন্তু কাশ্মীর তো ভারতবর্ষে তখনও যোগ দেয়নি। আইন মানসে গেলে কাশ্মীরকে রক্ষা করা তো ভারত সরকারের দায় নয়। মহারাজা হরি সিং সে-কথা জানতে পেরে পর দিনই দলিল সই করে পুরোপুরি ভারতবর্ষে যোগ দিলেন। তখন ভারত সরকার তাঁদের সেনাপতিকে হুকুম দিলেন কাশ্মীরে সৈন্য পাঠাতে। দিল্লী থেকে কাশ্মীরে যাওয়ার একটি মাত্র রাস্তা। অনেক পাহাড়-পর্বত ডিঙিয়ে, নদী-নালা পার হয়ে, বন-জঙ্গলের ভিতর দিয়ে সে-পথ। প্রায় তিনশ’ মাইল। তারও এখানে ভাঙা, ওখানে মেরামতি। কোথাও এত খাড়া উঁচু যে, গাড়ি চলা দার, কোথাও বা এত ভীষণ সরু যে, পাশাপাশি হাঁটা কঠিন। সে-পথ ধরে গেলে নুন আনতেই পাস্তা ফুরোবে। ভারতীয় সৈন্য কাশ্মীরে পৌঁছবার আগেই হানাদারেরা তা’ পুরোপুরি দখল করে নেবে। তাই আকাশ পথে বিমানে সৈন্য পাঠানো ছাড়া অন্য গতি নেই। দিল্লীর ছাউনিতে তখন যথেষ্ট সৈন্য নেই। বারো মাইল দূরে গুরগাঁয়ে শিখ রেজিমেন্টের এক ব্যাটেলিয়ন সৈন্য ছিল। হুকুম পেয়ে রাত্রির অন্ধকারে তাদের কিছু এসে পৌঁছল পালমের বিমানঘাঁটিতে। তাড়াতাড়ি কোনো মতে সেখানে গোলা বারুদ পোশাক পরিচ্ছদ দেওয়া হলো তাদের। সাতাশে অক্টোবর ভোরবেলা প্রভাতী তাবাটি যখন সবে অস্ত গিয়েছে, দূরে খোলা মাঠের শেষে পুবের আকাশে দেখা দিয়েছে একটুখানি আবছা আলোর আভা, তখন বিমানবহরের তিন তিনখানা ডাকোটা বিমানের পাখা এক সঙ্গে গর্জন করে উঠল। শিখ সৈন্যদের দিয়ে নিমেষে আকাশ-পথে রওনা হলো শ্রীনগরের দিকে। স্বাধীন ভারতের এই প্রথম যুদ্ধযাত্রা। সৈন্য তো রওনা হয়ে গেল। কিন্তু তারা শ্রীনগরে নামতে পারবে তো? সেখানকার বিমানঘাঁটিটি এরই মধ্যে হানাদারেরা দখল করে বসেনি তো? দিল্লীর সদর দপ্তরে সবার মনেই সেই ভাবনা। বেতার টেলিফোনের ঘরে যন্ত্রপাতি নিয়ে বসে আছে লোক। হেডফোন কানে লাগিয়ে অপেক্ষা করছে খবর দেয়া-নেয়ার কর্মচারীরা। আধঘন্টা পর পর বড়কর্তারা ধোঁজ নিচ্ছেন, খবর এসেছে কি? না, আসেনি। ন’টা বেজে গেল। তখনও খবর এল না। সাড়ে নটা বাজলো। বাজলো দশটা। কোনো খবর নেই। দশটা পনের, কুড়ি, পঁচিশ ঘড়ির কাঁটাটা এগিয়ে যাচ্ছে মিনিটে মিনিটে। মিনিট তো নয়, মনে হয় যেন এক একটা যুগ। কারো মুখে কথা নেই, খরে নেই শব্দটি। একটা পিন পড়লেও বুঝি আওয়াজ শোনা যাবে। উদ্বেগে সবার যেন দম আটকে আসছে। এত দেরি হচ্ছে কেন? তবে কি? সাড়ে দশটা, দশটা একত্রিশ, হঠাৎ বেতার যন্ত্রের বোর্ডে আলো জ্বলে উঠলো। “হ্যালো, হ্যালো দিল্লী, হ্যালো, দিস ইজ শ্রীনগর কলিং, হ্যালো।” খবর এসেছে। ডাকোটা তিনটি নিরাপদে বিমানধাটিতে নেমেছে। প্রথম ভারতীয় সেনাবাহিনী পৌঁচেছে
পৃষ্ঠা:০৫
কাশ্মীরে। হুররে! স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে দপ্তরের উপরওয়ালারা বললেন, “থ্যাঙ্ক গড়।”
তিন
যে শিখ সৈন্যরা আকাশ-পথে শ্রীনগরে পৌঁছল তাদের নেতা ছিলেন লেফটেনেন্ট কর্নেল দেওয়ান রণজিৎ রায়। নামের শেষটা বাঙালীর মতো। তাই না? আসলে তিনি পাঞ্জাবী। লম্বায় প্রায় ছ’ফুট, ছত্রিশ ইঞ্চি বুকের ছাতি, হাতেব কব্জি দুটি লোহার বাঁটের মতো শক্ত এবং চওড়া। দেখে মনে হয়, হ্যাঁ, লড়াই করার যোগ্য একখানা চেহারা বটে! কথা ছিল, তিনি তাঁর ঐ অল্প ক’জন সৈন্য নিয়ে বিমানঘাঁটিটা শুধু আগলে থাকবেন। যথেষ্ট সৈন্য আর গোলা বারুদ না পাওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ নয়। বিমানঘাঁটিতে কাশ্মীরের অবস্থা শুনে এবং দেখে কর্নেল বায়-এর তো চক্ষুস্থির। শত্রু রাজধানী শ্রীনগরের কাছে বারমূলা শহর দখল করেছে। আর খানিকটা এগিয়ে এলেই পাহাড়ী এলাকা পার হয়ে গ্রামে, মাঠে ছড়িয়ে পড়ে চারদিক থেকে শ্রীনগরকে ঘিরে ফেলতে পারবে। তাই তো। এখন করা কি? হানাদারেরা সংখ্যায় কত, কোন পথে আসছে, কী তাদের সাজ-সরঞ্জাম, সমস্তই অজানা। না জেনে-শুনে শ’খানেক সৈন্য নিয়ে শত্রুর সঙ্গে লড়তে যাওয়ার বিপদ অনেকখানি। অথচ আরও সৈন্য আর অস্ত্র-শস্ত্র এসে পৌঁছনোর অপেক্ষায় থাকলে শ্রীনগবের আশা শেষ। কঠিন সমস্যায় পড়লেন কর্নেল রায়। বসে ধীরে-সুস্থে ভাববারই বা সময় কোথায়? এক মিনিট দেরি মানে হয় তো শত্রুকে এক গঞ্জ এগোতে দেওয়া। চটপট ঠিক করে ফেললেন কর্নেল বায়। দিল্লীর হুকুম যাই থাক, এই মুহূর্তে হানাদারদের ঠেকাতে না গেলে সবই হবে খতম। তিনি সৈন্যদের নিয়ে তৈরি হলেন। আর এক সমস্যা দেখা দিল। সৈন্যরা যাবে কী কবে? সঙ্গে না আছে মিলিটারী লরী, না আছে জীপ, না আছে অন্য কোনো রকমের গাড়ি বা ঘোড়া। শ্রীনগবের রাস্তায় যে মোটর বাসগুলি যাত্রী বা মান বইতো, খুঁজে পেতে তারই কয়েকটা যোগাড় হলো কোনো মতে। তাই নিয়ে কর্নেল রায় আব তাঁর সৈন্যরা রওনা হলেন। বারমূলাব মাইল দুই পুবে আছে একটা ছোট পাহাড়। তার একপাশ দিয়ে চলে গিয়েছে শ্রীনগরের পাকা সড়ক। দু’শ’ গজ দূবে বইছে ঝিলম নদী। সেই পাহাড়ের চূড়ায় ঘাটি করলেন কর্নেল রায়। হানাদারেরা ঐ সড়কে এগিয়ে আসতেই হুকুম দিলেন-“ফাযার।” শিখদের বন্দুকগুলি একসঙ্গে গর্জে উঠলো-গুড়ুম, শুড়ুম, গুড়ুম।! উরি থেকে এই অবধি হানাদারেরা বিনা বাধায় এগিয়ে আসছিল। আচমকা গুলী খেয়ে প্রথমে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল। যারা সামনে ছিল তাবা ঝড়ে উপড়েফেলা কলাগাছের মতো ধপাস করে পড়ে পড়ে মরতে লাগল রাস্তার দু’পাশে। পিছনের লোকগুলি দিশেহারা হয়ে এদিকে ওদিকে ছিটকে পড়ল। শেষে কিছুটা সামলে নিয়ে হানাদারেরাও পাল্টা আক্রমণ করল। একটু পরেই কর্নেল রায় বুঝলেন, যা’ শোনা গিয়েছে তা’ সত্যি নয়। দিল্লীতে অনেকে ভেবেছে, হানাদার মানে হলো একদল গুণ্ডা। দা, কাটারি, বর্শা, বল্লম, বোমা, পটকা ও গাদা বন্দুক নিয়ে লুঠতরাজ করতে এসেছে বুঝি। মোটেই তা’ নয়। এরা আজকালকার লড়াই-এর ফিকিরফন্দি সব জানে। ইউনিট, সাব-ইউনিট অর্থাৎ আলাদা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে যুদ্ধ চালাবার কায়দা কৌশল শিখেছে এরা। ক্যাপ্টেন, মেজর, কর্নেল এমনি সব শিক্ষিত কমান্ডার হচ্ছে দলের সর্দার। ব্রেনগান, স্টেনগান, হাল্কা ও মাঝারি মেশিনগান, হ্যান্ড গ্রেনেড, ট্যাঙ্কমারা রাইফেল আরও সব বিলাতী হাতিয়ার আছে তাদের হাতে। লাল ‘পাগড়ি বা সঙ্গীন উচনো দেখলেই ভয়ে পালিয়ে যাবে, এ-সব দৈত্য নয় তেমন।
পৃষ্ঠা:০৬
শিখ সৈন্যরা সংখ্যায় হানাদারদের কাছে নগণ্য। তবে পাহাড়ের মাথায় ঘাঁটি করার মস্ত একটা সুবিধা আছে। আডালে লুকিয়ে গুলী ছোঁড়া যায়। সেই সুযোগ নিয়ে তারা বিপক্ষ দলকে ঘায়েল করতে লাগল। অবিরাম যুদ্ধ চলল কয়েক ঘন্টা। সূর্য অস্ত গিয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। কর্নেল রায় লক্ষা করলেন পাহাডের অনাদিক দিয়ে হানাদারদের একটা দল গুটিগুটি এগিয়ে আসছে। সর্বনাশ। শক্ত দু’দিক দিয়ে ঘিরে ফেললে শিখ সৈনা যে একটিও জ্যান্ত রইবে না। তিনি বুঝলেন, তক্ষুণি সৈন্যদের অন্য জায়গায় সরিয়ে নিতে না পারলে রক্ষা নেই। হুকুম দিলেন তাদের পিছু হটতে। বড় হাবিলদার পায়ে পায়ে ঠোক্কর দিয়ে ডান হাতে স্যালুট করে জিজ্ঞাসা করল, “হুজুর, আপ। আপনি?” কর্নেল একটু হেসে বললেন, গুলী চালিয়ে দুশমনদের কেউ আটকে না রাখলে তারা পিছু নেবে। তাই সব শেষে যাবেন তিনি। নিজের সৈন্যদলেব শেষ লোকটিও নিরাপদে পার না হওয়া পর্যন্ত অধিনায়ককে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নড়তে নেই। এই হলো তাঁর মত। তিনি নিজে হাতে মেশিনগানের ঘোড়া টিপতে লাগলেন খট খট খট খট খট্। শিখ সৈন্যরা ধীরে ধীরে পিছনে সরতে লাগল। হানাদারেবা অবশ্য চুপ করে বসে নেই। তাদের বন্দুক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলী এসে পড়তে লাগল কর্নেল রায় আর তাঁর সেনাদলের চার পাশে। কিছু শিখ পড়ল মারা, কয়েকজন হলো জখম। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বাকি সৈনা হানাদারদের এড়িয়ে নিরাপদ জায়গায় পৌছল। সবার শেষে উঠে দাঁড়ালেন কর্নেল রায়। সেই মুহূর্তে অন্ধকার থেকে একটা গুলী এসে লাগল তাঁর কপালে। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন তিনি। বীর রণজিৎ রায় বীরের মতোই যুদ্ধ করতে করতে মারা গেলেন যুদ্ধক্ষেত্রে। বছর তের আগে দেরাদুনের মিলিটারী কলেজ থেকে পাশ করে সেকেন্ড লেফটেনেন্ট হয়ে রণজিৎ রায় ঢুকেছিলেন সেনাদলে। গত মহাযুদ্ধের সময় বর্মার জঙ্গলে জাপানীদের সঙ্গে লড়ে খুব নাম করেছিলেন। তাড়াতাড়ি প্রমোশন পেয়েছেন। উন্নতির ধাপে ধাপে হয়েছেন লেফটেনেন্ট থেকে ক্যাপ্টেন, ক্যাপ্টেন থেকে মেজর, মেজর থেকে লেফটেনান্ট কর্নেল। আরও ওপরে উঠবার আগেই মাত্র চৌত্রিশ বছর বয়সে জীবন শেষ হলো তাঁর। সব পাপড়িগুলি মেলার আগেই যেন শুকিয়ে গেল ফুলটি। পাক ধরার আগেই যেন বোঁটা থেকে খসে পড়ল গাছের কচি ফল। সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনার আলো-ছায়া ঘেরা এই মর্তভূমি থেকে অকালে বিদায় নিলেন কর্নেল রায়। কিন্তু বাঁচিয়ে গেলেন শ্রীনগরকে। রক্ষা করলেন কাশ্মীর রাজ্যকে। নিরাপদ করলেন লক্ষ লক্ষ নরনারীকে। শিখ সৈন্যদের আক্রমণে হানাদারেরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছিল। সে-দিন আয় এগিয়ে আসার সাধ্য ছিল না তাদের। মরেও অমর হয়ে রইলেন কর্নেল রায় আর তার সঙ্গীরা। বারমূলার পথে আজ যারা যাতায়াত করে তাদের চোখে পড়ে রাস্তার ধারে ছোট পাহাড়টির গায়ের কাছে একটি স্মৃতিফলক। একটি কাঠের বোর্ডে। তাতে ইংরেজীতে লেখা “ভারতের সেই সব বীর শিখ সৈন্যদের কথা চিরকাল মনে থাকবে, যারা কাশ্মীরের স্বাধীনতা রক্ষায় ১৯৪৭ সালের ২৭শে অক্টোবর প্রথম এইখানে হানাদারদের রুখতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছে।” কাশ্মীরে আরও আছে একটি ছোট্ট স্মৃতিস্তম্ভ। পাথরের মনুমেন্ট। তার চারদিক কাঠের রেলিং দিয়ে ঘেরা। ইংরেজীতে কী লেখা আছে তা না পড়লেও চলে। কারণ লেখাপড়া শেখেনি এমন যে অজ পাড়াগাঁয়ের চাষী সে-ও জানে, এই স্মৃতিস্তডটি কার জন্যে। মাথা নীচু করে হাত কপালে ঠেকিয়ে বলে, ‘কর্নীল রায় বাবর থে। ওয়ে ওহি যে জিহানে হামকো বচায়া।”
চার
করাচী প্রাসাদ কুটে, হোখা বারবার বানপাজাদার তন্দ্রা যেতেছে টুটে।
পৃষ্ঠা:০৭
আসলে কিন্তু করাচী নয়, র্যাবটাবাদ এবং তন্দ্রা নয়, স্বপ্ন। পাকিস্তানের শাহেনশা জনাব জিন্নার বহুকালের স্বপ্ন। স্বপ্নরাজ্য কাশ্মীর। এতদিনে আসছে বুঝি তাঁর অধীনে। ‘বুঝি’ আর কেন। একেবারে নিশ্চিত। হাতের মুঠিতে বললেই হয়। হাজার হাজার হানাদারদের দেওয়া। হয়েছে হরেকরকম হাতিয়ার। দেওয়া হয়েছে অসংখ্য মোটর লরী, ট্রাক ও গ্যালন গ্যালন পেট্রোল। তারা এরই মধ্যে পৌঁছে গিয়েছে পার্টানে। সেখান থেকে এগিয়ে যাবে শ্রীনগর। যেন রিষড়া থেকে কোন্নগর, বেহালা থেকে ডালহৌসী স্কোয়ার। নয়া বাদশাহ তাই চলে এসেছেন করাচী থেকে য্যাবটাবাদ। এগিয়ে এসে অপেক্ষা করছেন মাঝ পথে। সামনেই ইসলামের সব চেয়ে বড় পরব। রমজানের রোজার শেষে ঈদ। সেই পুণ্য দিনে হজরত মহম্মদের নাম স্মরণ করে বিজয়গর্বে শ্রীনগরে প্রবেশ করবেন পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহৎ ইসলাম রাষ্ট্র পাকিস্তানের জনক কার্যেদ-এ-আজম মহম্মদ আলী জিন্না। হজরতবাল মসজিদের জমায়েতে প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে পড়বেন নামাজ। কিন্তু হঠাৎ এ কী খবর। হানাদারদের পথে পড়েছে কাঁটা? শ্রীনগরের কাছে তাদের বাধা দিয়েছে ভারতীয় সৈনাদল? এ যে ঘাটের কাছে নৌকাডুবি, ল্যান্ডিং-এর মুখে এয়ার-ক্র্যাশ। বিশ্বাস হতে চায় না যেন। দুর্গম পাহাড় পর্বত ডিঙিয়ে কোনোখান থেকে কোনো সাহায্য এসে পৌঁছবার আগেই মহারাজের সিপাই বরকন্দাজ হবে নিকাশ, লোক লস্কর হবে নিশ্চিহ্ন, অনায়াসে পাকিস্তানী নিশান উড়বে শ্রীনগরের সরকারি দপ্তরখানার চূড়াতে এই ছিল পাকিস্তানের ধারণা। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আকাশপথে ভারতীয় ফৌজ এসে নামবে কাশ্মীরে, রুখবে হানাদারদের এমন সম্ভাবনা ছিল পাকিস্তানী কর্তাদের গোণাগুণতির বাইরে। এত বড় আশাভঙ্গ জিন্নার জীবনে এর আগে আর ঘটেনি। তাঁর ক্রোধের আর সীমা পরিসীমা রইল না। পাঞ্জাব-গভর্নরের মিলিটারী সেক্রেটারীকে ডেকে বললেন-“প্রধান সেনাপতি জেনারেল গ্র্যাসীকে টেলিফোন করো এই মুহূর্তে। আমার হুকুম। এই দণ্ডে পাকিস্তানের সমস্ত সৈন্য নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করুক কাশ্মীরে।” শুনে সেনাপতির চক্ষুস্থির। এ কী অদ্ভুত আদেশ। ব্রিটিশ আমলের ইংরেজ কর্মচারীরা প্রায় সবাই ভারতবর্ষের শত্রু। ভারতে ইংরেজ প্রভুত্বের অবসান ঘটিয়েছে ভারতীয় কংগ্রেস। সেই কংগ্রেস যাতে ধ্বংস হয় তাতেই তাঁদের আনন্দ। কিন্তু আর যাই হোক, তাঁদেরও কাণ্ডজ্ঞান আছে। তাঁরা জানেন, পিছনে থেকে অস্ত্র-শস্ত্র, সাজ-সরঞ্জাম ও বুদ্ধি-ব্যবস্থা দিয়ে হানাদারদের সাহায্য করা এক, প্রকাশ্যে যুদ্ধে নামা আর। বেগতিক দেখে গ্র্যাসী সবিনয়ে বললেন,- “ইওর এক্সেলেন্সী, আমি তো অকিনলেকের অধীন। তাঁর মারফতে আদেশ না পেলে করি কী? কথাটা ঠিক। দেশ বিভাগের সময় দু’পক্ষের সম্মতি নিয়ে দু’ দেশেরই সামরিক সর্বাধিনায়ক হয়েছেন অকিনলেক। ভাবত ও পাকিস্তানের দুই পৃথক কমান্ডার-ইন-চীফ লেফটেনেন্ট জেনারেল সার রব লকহার্ট ও ডগলাস গ্র্যাসী। তাঁদের উপরে এক যুক্ত সুগ্রীম কমান্ডার,-ফিল্ড- মার্শাল সার ক্লড অকিনলেক। খবর পেয়ে অকিনলেক তাড়াতাড়ি বিমানযোগে গেলেন লাহোরে। জিন্নাকে বললেন, কাশ্মীয়ে পাকিস্তানের সৈন্য পাঠানো মানেই, ভারতবর্ষের সঙ্গে যুদ্ধ। তাতে সর্বনাশ। জিন্নার যুক্তি, হিন্দুস্থানের ফৌজ এসেছে কাশ্মীরে হিন্দু মহারাজার পক্ষে। কাজেই পাকিস্তানের সৈন্য যাবে সেখানকার মুসলমানদের সাহায্যে। অকিনলেক বললেন, “কাশ্মীর দলিল সহি করে যোগ দিয়েছে ভারতবর্ষে। সুতরাং কাশ্মীর এখন ভারতবর্ষেরই অংশ, তাফে রক্ষা করা ভারত সরকারেরই দায়িত্ব। সেখানে ভারতীয় সৈন্য লড়তে যাওয়া সম্পূর্ণ আইনসঙ্গত।” “দলিল? সে তো মিথ্যে বাহানা। স্রেফ জোচ্চুরি। কাশ্মীরের ভারতে যোগ দেওয়া একটা সাজানো কারসাজি।” গর্জে উঠলেন জিয়া সাহেব।
পৃষ্ঠা:০৮
অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে শেষকালে অফিনলেক ঠাণ্ডা করলেন জিয়াকে। কাশ্মীরে পাকিস্তানী সৈন্য পাঠাবার হুকুম রদ করলেন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল, অকিনলেকেরই পরামর্শে চিঠি লিখলেন মাউন্টব্যাটেনকে। তিনি ও নেহরু আসুন লাহোরে। তাঁরা তিনজনে আলাপ আলোচনা করে একটা মীমাংসা করবেন কাশ্মীর সমস্যার। নরম চিঠি পাঠালেন দিল্লীতে। খবরের কাগজে দিলেন এক গরম বিবৃতি। ‘ভারতভুক্তি’র ধাপ্পা দিয়ে ভারত সরকার কাশ্মীর দখল করেছে। পাকিস্তান তা’ কোনো দিন মেনে নেবে না। হিন্দুস্থানী বন্দুকের জোরে সেখানকার মুসলমানদের দাবিয়ে রাখা চলবে না, চলবে না। দিল্লীতে মন্ত্রিসভার সদস্যরা শক্ত হলেন। চিঠি পেয়ে বললেন, “সমস্যা। কিসের সমস্যা? কাশ্মীরে হামলা। যারা হানাদারদের পাঠিয়েছে তাবা তাদের ফিরিয়ে নিলেই তা’ মিটে যায়। তার জন্যে আলাপের দরকার কি? আলোচনারই বা অবকাশ কোনখানে ?” মাউন্টব্যাটেন অবশ্য আপসের জন্যে ব্যগ্র। যে-ভাবেই হোক। তিনি চান, জিন্নার নিমন্ত্রণ রাখতে। মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে কেউ কেউ ব্যঙ্গ করে বললেন, “হ্যা, নিমন্ত্রণই বটে। ধরনটা যে বড়ই চেনা চেনা ঠেকছে। নেহরুর অবশ্য ছাতা নেই, জিন্নারও নেই আধটুকরো গোঁফ, তবুও মিউনিক পর্বের সঙ্গে ব্যাপারটা মিলে যাচ্ছে না কি। গদেসবার্গ আর লাহোর, এ-দু’-এর তফাত তো শুধু নামে।” এ-কথার জবার দেওয়া কঠিন। অবশেষে অনেক যুক্তিতর্কের পর ঠিক হলো নেহরু নয়, একা মাউন্টব্যাটেন যাবেন লাহোবে। পাঞ্জাবের লাটপ্রাসাদে দুই গভর্নর জেনারেলের সাক্ষাৎ। নমস্কার ও কুশল বিনিময়ের পরে জিয়া বললেন, “ভারত সরকার যে কাশ্মীরে সৈন্য পাঠাতে যাচ্ছে পাকিস্তানকে তা’ সময় মতো জানানোই হয়নি।” মাউন্টব্যাটেন বললেন, “সে কী কথা? মন্ত্রীদের যে-সভায় বিমানে সৈন্য পাঠাবার সিদ্ধান্ত হয়, সে-সভা থেকে বেরিয়ে নেহরু প্রথমেই যা’ করেছেন, তা’ হচ্ছে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকৎ আলীকে টেলিগ্রাম। জিন্না তখন অন্য কথা পাড়লেন। সোজা প্রশ্ন করলেন, “পবরাজ্যে ভারত সরকার সৈনা পাঠায় কোন সাহসে ?” মাউন্টব্যাটেন জবাব দিলেন, “ইনস্ট্রুমেন্টস অব হ্যাকসান, ‘ভারতভুক্তি’র অধিকারে।” ভিচ্ছা গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘ভারতভুক্তি সে তো নিছক ছল।” মাউন্টব্যাটেন বললেন, “না, পুরোপুরি সত্য।” জিন্না ব্যঙ্গ করে বললেন, “ওঃ কাশ্মীরের পঁচিশ লক্ষ মুসলমান দরখাস্ত করেছে বুঝি ভারত সরকারের কাছে?” মাউন্টব্যাটেন বললেন, “আইনে তার দরকার হয় না। মহারাজ স্বয়ং দস্তখত করেছেন দলিলে।” জিরা বললেন, “মহারাজা? তিনি সহি করার কে? কোন্ দেশীয় রাজ্য ভারতবর্ষে আর কোন রাজ্য পাকিস্তানে যোগ দেবে তা’ ঠিক করার একমাত্র মালিক হলো সেখানকার জনগণ।” মাউন্টব্যাটেন নীরবে একটু শুধু মুচকি হাসলেন। মনে মনে বোধহয় বললেন, সে কী কথা, মিস্টার জিয়া, এই কিছুদিন আগে জুনাগড়ের বেলায় আপনারাই তো বলেছিলেন যে, যোগদানের ব্যাপারে নবাবের ইচ্ছাই হলো আইনগত শেষ কথা। জিন্নাও বোধহয় বুঝলেন মাউন্টব্যাটেনের হাসির অর্থ। কড়া সুরে বললেন, “কাশ্মীরের ‘ভারতভুক্তি’ আমরা কোনো কালেই মানবো না। তার পিছনে আছে বল প্রয়োগ, গায়ের জোর।” মাউন্টব্যাটেন শান্তভাবে বললেন, “খুব খাঁটি কথা। সে-বল প্রয়োগ করেছে হানাদারেরা। গায়ের জোর খাটিয়েছে আক্রমণকারীরা। তার দায়িত্ব পাকিস্তানের।” ঘুরে ফিরে ঐ একই উক্তি ও একই যুক্তি। একই অভিযোগ এবং একই উত্তর।
পৃষ্ঠা:০৯
এমনি করে কেবল কথা কাটাকাটি চললো দুই গভর্নর জেনারেলের মধ্যে। অবশেষে জিয়া বললেন, “আচ্ছা, আসুন একটা মিটমাট করা যাক। দু’পক্ষই অবিলম্বে একই সঙ্গে কাশ্মীর থেকে চলে আসুক।” মাউন্টব্যাটেন বললেন, “ভারতবর্ষ তাদের সৈন্য ফিরিয়ে আনবে কাশ্মীর থেকে, সে না হয় বোঝা গেল। কিন্তু হানাদারদের ফেরাবে কে?” জিয়া বললেন, “আপনি ভারতীয় সৈন্য ফিরিয়ে আনলেই, হানাদারদের হামলা থামাবার ব্যবস্থা আমি করবো।” বটে। তবে যে এতদিন পাকিস্তান বলে আসছে, কাশ্মীর আক্রমণ সীমান্তের উপজাতীয়দের কাজ। হানাদারদের উপরে পাকিস্তানের কোনো হাত নেই। সেটা তা’ হলে শুধু বাইরে প্রচারের জন্য। ভিতরে আসল কথাটা স্বীকার করতে তেমন আপত্তি নেই। আলোচনা শেষ হলো। তর্কের শেষ হলো না। মীমাংসা হলো না সমস্যার। দুই নবগঠিত রাষ্ট্রের বিরোধ বইল অবিদূরিত।
পাঁচ
মাউন্টব্যাটের ও জিয়া একে অন্যের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। আন্তরিক হৃদ্যতায় নয়, মৌখিক ভদ্রতায়। এবার কাশ্মীর যুদ্ধের সেনাপতি হয়ে এলেন একজন বাঙালী। ব্রিগেডিয়ার এল পি সেন। লাবণ্যপ্রসাদ বা ললিতপ্রসন্ন নয় কিন্তু। লাওনেল প্রতীপ সেন। নামটা পুরোপুরি স্বদেশী নয়, তার কারণ লাওনেল প্রতীপের জন্মও স্বদেশে নয়। তাঁর বাবা ছিলেন ব্রহ্মদেশের এক নামকরা ব্যারিস্টব। লাওনেল জন্মেছেন রেঙ্গুনে। পড়াশুনা করেছেন সেখানকার সাহেবী কনভেন্টে। বিলাতের স্যাণ্ডহার্স্ট থেকে যুদ্ধবিদ্যা শিখে ভারতীয় সেনাবিভাগে অফিসার হয়েছেন গত মহাযুদ্ধের কয়েকবছর আগে।ডিস্টিংগুইসড সার্ভিস অর্ডার সেনাদলের খুব উঁচু খেতাব। খুব বীরত্ব না দেখালে মেলে না। গত যুদ্ধে ব্রিগেডিয়ার সেন ছিলেন দশ নম্বর বালুচ রেজিমেন্টের সেনানায়ক। বর্মায় কংগ-এর জঙ্গলে জাপানীদেব নির্মূল করে তিনি সেই সেরা খেতাব পেয়েছিলেন। শ্রীনগর এসে ব্রিগেডিয়ার সেন দেখেন, শত্রু চায় রাজধানীকে দু’দিক দিয়ে ঘিবে ফেলতে। একদল হানা দিচ্ছে সমুখ থেকে। আসছে বারমূলা হয়ে পিচ-বাঁধানো পথে। মোটর লরীর মাথায় চাঁদ-তারা মার্কা সবুজ ঝাণ্ডা উড়িয়ে। আর একদল আক্রমণ করছে বাঁ পাশ থেকে। তারা আসছে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে গাঁয়ের পথ বেয়ে। দুটো জোরালো জঙ্গীদল। যেন সাঁড়াশির মুখে দু’পাটি ধারালো দাঁত। দু’পাশ থেকে শহরটাকে চেপে ধরবে শক্ত কামড়ে। চিবিয়ে গিলে ফেলবে ধীরে ধীরে। ব্রিগেডিয়র সেন বুঝলেন, প্রথমে চাই দিন কয়েকের সময়। আপাতত চাই হানাদারদের কিছু দিন ঠেকিয়ে রাখা। তাড়িয়ে দেওয়ার কথা হবে পরে। সবার আগে হলো শ্রীনগরের বিমানঘাঁটিটি। শহরের মাইল আটেক বাইরে এই বিমানঘাঁটিটিই এখন কাশ্মীরের সঙ্গে ভারতের একমাত্র যোগাযোগ। ঘরের যেমন দোর, নদীর যেমন ঘাট। হাত ছাড়া হলে যাওয়া-আসারই আর পথ রইবে না। আকাশ-পথে গাড়োয়ালী সৈন্যদের এক রেজিমেন্ট এসে পৌঁছেছিল শ্রীনগরে। তাদেরই একদলকে মোতায়েন করলেন ব্রিগেডিয়র সেন বিমানঘাটির পাহারায়। বন্দুক কাঁধে নিয়ে তারা টহল দিতে লাগলো সর্বক্ষণ। পাশ না দেখালে ঢুকতে দেয় না জনপ্রাণীকে। কেউ কাছে ঘেঁষেছে কি অমনি বাজখাই আওয়াজে হাঁক দিয়ে শুধোয়, হ-কুম-দার-? শুনে পিলে চমকে ওঠে সবার।
পৃষ্ঠা:১০
দিন কাটে তো, রাত কাটে না। ভোর হওয়ার আগেই হানাদারদের আনাগোনা শুরু হয় বাদগামে। গ্রামটা বিমানঘাঁটি থেকে আধ মাইল দূর। চেঁচালে গলা শোনা যায়। আগুন জ্বালালে ধোয়া দেখা যায়। এত কাছে।যুদ্ধ বেধে গেল। একেবারে হাতাহাতি লড়াই। একদিকে পাকিস্তানী হানাদার, অন্যদিকে গাড়োয়ালী সৈন্য। কণ্ঠ আকড়ি’ ধরিল পাকড়ি’ দুই জনা দুই জনে। শত্রুদলে প্রায় সাতশ’। তাক্স হ্যান্ড গ্রেনেড আর ব্রেনগান নিয়ে আক্রমণ করছে। গাড়োয়ালীরা সংখ্যায় তার অর্ধেক। তার চালাচ্ছে রাইফেল। চার ঘন্টা ধরে চলল তুমুল হানাহানি। গোলার ধোঁয়ায় আকাশ হলো কালি, গুলীর শব্দে কানে লাগলো তালা। নিহত আর আহতদের রক্ত ঝরে’ জমিন হলো রাঙা। হানাদারেরা মরীয়া হয়ে সমুদ্রের ঢেউ-এর মতো জোরে বার বার ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগলো গাড়োয়ালীদের উপরে। তীরে যা-খাওয়া ঢেউ-এর মতোই বারবার ফিরে যেতে হলো তাদের। গাড়োয়ালীদের একচুল হটাতে পারল না তাদের জায়গা থেকে। খবর পেয়ে ব্রিগেডিয়র সেন শ্রীনগর থেকে তাড়াতাড়ি আরও সৈনা আর অস্ত্রশস্ত্র পাঠিয়ে দিলেন । ততক্ষণে হানাদারেরা হাঁপিয়ে উঠেছে । নতুন সৈন্যদের মহড়া নেওয়ার সাধ্যি নেই। নিমেষের মধ্যে শ’ দুই হানাদার গেল মারা। বেগতিক দেখে তারা পালিয়ে যেতে লাগল। বিমানঘাঁটিটির আর কোনো আশঙ্কা রইল না। বাদগামের জয়লাভ গাড়োয়ালীদের এক মস্ত বড় কীর্তি। কিন্তু এই যুদ্ধে তাদের সেনানায়ক মেজর সোমনাথ শর্মা নিহত হলেন। সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে নিজ সৈনাদের’ তিনি পরিচালনা করছিলেন। যুদ্ধ জয়ের আনন্দ অনেকখানি মলিন হয়ে গেল তাঁর শোকে। শোকে কাতর হয়ে বসে থাকার উপায় থাকে না সেনাপতিদের। রোগীর মৃত্যুতে উতলা ইলে ডাক্তার চিকিৎসা করবে কখন? ব্রিগেডিয়র সেনও মন দিলেন কাশ্মীরের রক্ষা ব্যবস্থায়। খোলা মাঠে তাঁবু খাটিয়ে তৈরি হলো সৈন্যদের ব্যারাক, বালির বস্তা সাজিয়ে অস্ত্রাগার। দেবদারু গাছের গুড়ি খাড়া করে টেলিফোনের তার খাটানো হলো এ-দপ্তর থেকে ও-দপ্তরে। সৈন্য। বেশী সৈন্য। আরও বেশী সৈন্য চাই কাশ্মীরে। পাঠাতে হবে আকাশপথে। পাঠাতে হবে অবিলম্বে। কিন্তু এত বিমান মিলবে কোথায়? তাই তো। দিল্লীতে যুদ্ধ দপ্তরের বড় কর্তারা ভেবে কুল পান না। হঠাৎ খেয়াল হলো। অনেকগুলি বেসামরিক বিমান কোম্পানী রয়েছে যে দেশে। তারা কলকাতা, বোম্বাই, দিল্লী, গৌহাটি প্রভৃতি বড় বড় শহর থেকে আকাশ-পথে যাত্রী আর মাল আনা-নেওয়া করে প্রত্যহ। একুনে তাদের প্রায় শ’ খানেক বিমান আছে। বেশীর ভাগই ডাকোটা। সরকারী হুকুমে রাতারাতি সবগুলি বিমান জড়ো করা হলো নয়াদিল্লীতে। পালাম আর সফদরজঙ্গ-এই দু’টি বিমানঘাঁটি থেকে সেগুলি খেয়া নৌকার মতো ঘণ্টায় ঘণ্টায় সৈন্য আর লড়াই-এর সাজ-সরঞ্জাম নিয়ে-আসা-যাওয়া করতে লাগল শ্রীনগরে। পাইলট, রেডিও অফিসার, গ্রাউন্ড এঞ্জিনীয়র, ক্রু, কারনাই বিশ্রাম নেই এতটুকু। ভোর হতে না হতেই শুরু হয় বিমানগুলির আকাশে ওড়ার পালা। সন্ধ্যায় একে একে ফিরে আসে মাটিতে। দিন শেষ হয় বটে, কাজ শেষ হয় না। তক্ষুণি আরা হয় আবার পরের দিনের উদ্যোগ আয়োজন। সারারাত কুলীয়া মাথায় বয়ে বোঝাই করে মাল, কর্মচারীরা ফর্দ করে জিনিসপত্রের। ফিটার মিস্ত্রীরা তেল ন্যাকড়া দিয়ে ঘষা-মাজা করে বিমানের কলকব্জা, ইঞ্জিন প্রপেলর ইত্যাদি। নাওয়া-খাওয়ার সময় থাকে না অনেকের। মেলে না দু’দণ্ড নিশ্চিন্ত আরামে ঘুমিয়ে নেওয়ার ফুরসত। দিনের পর দিন বিমান কর্মচারীদের এমন হাসিমুখে একটানা কাজ করার ক্ষমতা দেখে সবাই অবাক হয়। প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বলে, “মানুষ তো নয় এরা। এক একটি ফল।” কলের মতোই নিখুঁত নিয়মে চলতে লাগল সরবরাহের কাজ। বিমানপথে শ্রীনগর পৌঁছতে লাগল বাক্স-বন্দী বোমা, বন্দুক, বস্তা-বোঝাই রসদ। দলে দলে আসতে লাগল সৈন্য সামন্তেরা।
পৃষ্ঠা ১১ থেকে ২০
পৃষ্ঠা:১১
হেমন্তের শেষে হিমালয়ের কোলে মানস সরোবর থেকে যেমন সমতল ভূমিতে উড়ে আসে সারস, তিতির আর হংস-মিথুনের ঝাঁক। রোগের মতো উৎসাহটাও ছোঁয়াচে । একজনকে দেখলে আর একজনের বুক উঁচু হয়ে ওঠে। বিমানবাহিনীর লোকেরা যদি এত যোগ্যতা দেখাতে পারে তবে সাঁজোয়াবাহিনীর লোকেরা পিছনে পড়ে থাকবে নাকি? কখনও নয়। তারা উপরওয়ালাদের কাছে প্রার্থনা জানাল, হুকুম পেলে এক ডিভিসন আরমার্ড কার তক্ষুণি রওনা হতে পারে কাশ্মীরে। আরমার্ড কারগুলি কামান বসানো মোটর গাড়ি। চারিদিকে মোটা লোহার পাতে ঘেরা। যেমন তাদের কামানের দূর পাল্লা, তেমন তাদের দ্রুতগতি। শত্রু ছত্রভঙ্গ হয় তাদের দাপটে। কিন্তু যে-পথে সৈন্য চলা দায়, সে-পথে আরমার্ড কার যাবে কেমন করে? ঘন জঙ্গলে আটকে যাবে হয়তো উপরের ছাদ। পাথরে পিছলে যাবে নীচের চাকা। কামানের ভারে গুঁড়িয়ে যাবে নদী নালার উপরে হাল্কা কাঠের যতো সাকো। তখন স্যাপার্স আর মাইনার্স দলের লোকেরা এগিয়ে এসে বলল, তারা থাকবে সাঁজোয়া গাড়ির সামনে। আগেভাগে গাছ কেটে বন সাফ করবে, পাহাড় কেটে পথ। “এম- ই- এস”-এর লোকেরা সব এঞ্জিনীয়র। তারাই বা কম যাবে কেন? সেলাম করে জানাল, তার বাঁধবে খাদেব ধার, গড়বে নতুন শক্ত পুল। বাস। আর কথা কী? সেই রাত্রে দিল্লী থেকে বওনা হলো তারা। পাঠানকোর্টের মাঠ ছাড়িয়ে, পীর পঞ্জলের চূড়া ডিঙিয়ে, বানিহালের সুড়ঙ্গ-পথ ঘর্থর শব্দে পেরিয়ে একদিন সকালবেলা শ্রীনগবে এসে পৌঁছল ছোট একটি সাঁজোয়াবাহিনী। লাইনবন্দী আরমার্ড কার। দেখে শহরের ছেলে বুড়ো সবাব বুকে এল বল, মনে জাগলো আশা, মুখে ফুটলো হাসি। রাস্তাব দু’পাশে দাঁড়িয়ে তাবা মুহুর্মুহুঃ জযধ্বনি করতে লাগলো। “ভারত মাতা-কী জয়!” “জয়, পণ্ডিতজী-কী।”
ছয়
অক্টোবর মাসের বাকি দিন ক’টা শেষ হয়ে গেল। এল নভেম্বব। শীতের আমেজ দেখা দিল কাশ্মীরে। হবি পর্বতের গায়ে লাগল কুয়াশার প্রলেপ। নাশিমবাগে নারের পাতা হলো পীতাভ। পথের ধারে ফল ঝবা আনবোটের শাখাগুলি শুনা। ডাল হ্রদের জলে পানকৌড়িদের ডুব-সাঁতারেব খেলাও হয়েছে সাঙ্গ। তীরে ডানা মেলে বসে কুঁড়ে বাদশা’ব মতো তারা এখন শুধু বোদ পোহায় সারা দুপুব। সে-দিন শুক্রবার। ৭ই নভেম্বর। বাত তখনও শেষ হয়নি। ব্রিগেডিয়ক সেন হুকুম-দিলেন, “ফরোয়ার্ড মার্চ:” গত ক’দিন ধরে ব্রিগেডিয়র সেন এবং তার সহযোগীরা মিলে আক্রমণের তোড়জোড় সম্পূর্ণ করেছেন। শ্রীনগরের আশেপাশে কেবলই ছোট ছোট পাহাড়। তার আড়ালে কোনখানে জড়ো হয়েছে শত্রুদল। বন-বাদাড়ের মাঝে কোথায় আছে পথ, কোথায় আছে খাদ, তার খবর যোগাড় করেছেন গোপনে। মাইল মেপে এঁকেছেন রাস্তা-ঘাটের নক্সা। এতদিন ভারতীয় সৈন্যদের ছিল আত্মরক্ষার লড়াই। এবার এসেছে আক্রমণের পালা। পাটান থেকে শ্রীনগরের পথে হানাদারদের আস্তানায বেশীর ভাগ তখনও ঘুমে বেঘোর। দু’চার জন মাত্র আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসেছে। এমন সময়, “হারে রে রে রে।” হানাদারদের সর্দার তখনও বিছানায়। এ ক’দিনের লুটের আনন্দে তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা যেমন মশগুল; জয়লাভের আশায় তিনি নিজেও তেমনি ‘খোশ মেজাজ। বাদগামের যুদ্ধের পরে এ পর্যন্ত ভারতীয় সৈন্যদের আর কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায়নি। বিনা বাধায়-ই হানাদারেরা ক্রমশঃ এগিয়ে এসেছে বারমূলা থেকে পাটান। পাটান থেকে
পৃষ্ঠা:১২
সেলাটং। শ্রীনগর শহরের প্রায় দোরগোড়ায়। এখন রাজধানী শ্রীনগর তাদের নাগালে। ঠিক যেন গাছের নীচু ডালে ঝুলছে লাল টুকটুকে পাকা আপেলটি। শুধু হাত বাড়িয়ে তুলে নেওয়ার অপেক্ষা। অনেক রাত জেগে সদার তাই ইরার-দোস্ত নিয়ে আমোদ ফুর্তি করেন। কখনও মনের সুখে গোঁফে লাগান চাড়া। কখনও বা গন্ধ-ভরা রুমাল হাতে নিয়ে সহস্রবার দাড়িতে দেন ঝাড়া। শেষ রাত্রির দিকে সর্দারের ঘুমটা জাঁকিয়ে এসেছিল। স্বপ্ন দেখছিলেন। যেন শ্রীনগর দখল করে মহারাজকে কোতল করেছেন। মহারাণীকে করেছেন বাদী। তাকিয়া ঠেস দিয়ে সোনার গড়গড়ায় রুপোর নলে অম্বুরি তামাকের ধোঁয়া খাচ্ছেন আরামে। হঠাৎ শোনেন ‘হারে রে রে ভারতীয় বাহিনী আক্রমণ করেছে ভীষণ বেগে। চমকে উঠে বসে বললেন, “অ্যা, যুদ্ধ? সে কী?” চোখ রগড়ে চারদিকে তাকিয়ে শেষটায় হাঁক দিলেন, ‘বন্দুক লাও।” লাও তো বটে। কিন্তু আনে কে? হট্টগোলের মধ্যে হানাদারেরা কেউ খুঁজছে হাতিয়ার, কেউ যুঁজছে পোশাক কেউ বা দিশেহারা হয়ে অনর্থক ছুটোছুটি করতে গিয়ে নিজেদের মধ্যেই কপালে খেল ঠোকর, মায়ায় গেল চোট। ব্যাপারটা ভালো করে বুঝতে পারার আগেই কচুকাটা হয়ে গেল অনেকে। ব্রিগেডিয়র সেন আগেভাগে একদল সৈনাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন উত্তরে, আর একদলকে দক্ষিণে। মাঝখানে ছিল মূল পদাতিক বাহিনী। ত্রিভুজের তিনটি বাহর মতো তিন দল সৈনা একসঙ্গে আক্রমণ করল হানাদারদের। তিনদিক দিয়ে ঘেরাও হয়ে লড়াই করা চলে কতক্ষণ? কয়েক ঘন্টার মধ্যেই হানাদারেরা কাবু হয়ে পড়ল। তার উপরে। এ কী, মেশিনগানের আওয়াজ শোনায় যেন। হানাদারেরা অবাক হয়ে এদিকে ওদিকে তাকায়। ওমা, তাই তো। এ যে সাঁজোয়া গাড়ি। সর্বনাশ!! ঘর্থর শব্দে ছুটে আসছে পথের ধুলো উড়িয়ে, কামানের ধোয়া ছড়িয়ে। গুলী ছুড়ছে যেন শিলাবৃষ্টি। ‘ইয়া আল্লা” বলে হানাদারেরা তখন দিল সোজা চম্পট। দৌড়, দৌড়, ঠোঁচা দৌড়। কমান্ডার দেখলেন মহা বিপদ। দলের লোকেরা এভাবে পালাতে শুরু করলে যুদ্ধ করবেন কাকে নিয়ে? তিনি তাদের ফেরাবার চেষ্টা করলেন। বললেন, “ভাইজান, তোমরা পিছু হটছ কেন? মনে হিম্মৎ রাখ, হিন্দুস্থানী কাফেরগুলি এখুনি ঘায়েল হবে। একটু পরেই শ্রীনগর আমাদের কব্জায়। জিহাদ হাসিল কর” কে শোনে কার কথা। হানাদারেরা বলে, ‘আরে রাখো মিঞা, তোমার শ্রীনগর। আপনি বাঁচলে বাপের নাম। জান যায়, তায় জিহাদ।” তাড়াতাড়ি পালাতে লাগল তারা যার যে দিকে দু’চোখ যায়। কিন্তু যেদিকে সেদিকে যাওয়ার কি জো আছে। ভারতীয় সৈন্যরা আছে যে তিন দিকেই। খোলা একমাত্র পিছনের পথ। যে পথে হানাদারেরা হানা দিয়েছিল শ্রীনগরের পানে। উল্টে সে পথেই ঊর্ধ্বশ্বাসে পিছু হটল তারা। পিছনে মরে পড়ে রইল তাদের শ’তিনেক সঙ্গী। কিছু রেখে গেল লুঠের মাল, কিছু ফেলে গেল যুদ্ধের সাজ-সরঞ্জাম। প্রাণের মায়ায় ছোটা,-বড় বিষম ছোটা। পড়ি তো-মরি করে ছুটতে ছুটতে হানাদারেরা সেলটিং থেকে পালালো পাটানে। পাটান থেকে বারমূলায়। উল্লাসে ভারতীয় বাহিনী পিছনে ধাওয়া করল তাদের। কিন্তু শহরে যাত্রীচলার মোটর বাসগুলি কত আর জোরে চলতে পারে। তবুও সৈনাদলের ড্রাইভারেরা চেষ্টা করল প্রাণদণ। গাড়ির এক্সিলারেটরটা ডান পায়ে চেপে ধরল পুরোপুরি। স্পিডোমিটারের কাঁটাটা, চল্লিশ থেকে লাফিয়ে উঠল পঞ্চাশে। পঞ্চাশ থেকে পঞ্চান্ন। সৈন্য বোঝাই বাসের জানলা খড়খড়িগুলি কাঁপতে লাগলো সশব্দে। স্টিয়ারিংটা ধরতে হলো শক্ত মুঠোয়। “চালাও, চালাও জোরসে।” হাঁকতে লাগল ভারতীয় সৈন্যদলের সেনানায়ক। ঐ যে দেখা
পৃষ্ঠা:১৩
যাচ্ছে, পালাচ্ছে দুশমনেরা। আর একটু এগোলেই গরে ফেলা যাবে তাদের। “জোরে, আরও জোরে চালাও ড্রাইভার, আউর জোরসে।” পঞ্চার, সাতান্ত্র- স্পিডোমিটারের কাঁটা উঠছে। ঘাট, বাষট্টি-আর একটু, আরও–! ঘট খট খটট-ঘটাং। বেগ কমে ধীরে ধীরে গাড়ি ঠায় থেমে গেল। কী ব্যাপার। মোটরের ইঞ্জিন বিগড়েছে বুঝি? ড্রাইভার হ্যান্ডল ঘুরিয়ে স্টার্ট দিতে চেষ্টা করল। টানল চোক। বনেট খুলে পরীক্ষা করলো যন্ত্রপাতি। না। পেট্রোল ফুরিয়েছে গাড়ির। এক ফোটা তেল নেই পেট্রোল ট্যাঙ্কে।
সাত
বারমুলা থেকে হানাদারেরা পালিয়ে গেল দূরে। গাছ না উপড়ে বড় থামে না ঝড়, গাঁ না মজিয়ে নড়ে না মড়ক। লুঠতরাজ খুন-খারাপি না কবে দস্যুদলই বা বিদায় হয়েছে কবে কোন দেশে। হানাদারেরা গেল। কিন্তু যাবার আগে তাদের হাতের ছাপ রেখে গেল বাবমূলার আষ্টেপৃষ্ঠে। হাতের ছাপ তো নয়, নখের দাগ। সে দাগ বহু শোকের অশ্রু দিয়ে ভেজা, বহু লোকের রক্ত দিয়ে লাল। হানাদারেরা বাবমূলায় চড়াও হয়েছিল, দিনে-দুপুবে। পুরুষেরা তখন যে যার কাজে বাইরে। হাটে গলেছে বেচাকেনা, মাঠে চলেছে নিড়েন। কাছারিতে চোখে চশমা এঁটে মুন্সীরা লিখছে উর্দু বয়ানে দশধাবার আরজি। মাদ্রাসার বুড়ো মৌলভী সাহেব শান দাড়িতে হাত বুলিয়ে কিশোর ছাত্রদের শেখাচ্ছেন আলীফ, বে, তে. সে। শহব দখল করে দস্যুল দলে-বেদলে ছড়িয়ে পড়ল নানা দিকে। যেন পাকা ফসলের ক্ষেতে আচমকা নেমে এল বাশি রাশি পঙ্গপাল। সব ধ্বংস করে দিল দু’দণ্ডে। প্রথম পর্যায়ে লুঠ। বাক্স ভেঙে নিল টাকাকড়ি। সিন্ধুক ভেঙে সোনাদানা। মেয়েদের গা থেকে ছিনিয়ে নিল গয়না। তাঁতি বউ হারাল গলার হাঁসুলি, নাপিতবউ-এব গেল হাতের বাজুবন্ধ। অতি দরিদ্রের ঘবে আর কিছু না পেয়ে দস্যুবা হেঁশেল থেকে টেনে নিয়ে গেল পিতল কাসার বাসনপত্র। সন্ধ্যাবেলা ধানের গোলায় আর তিসিব আড়তে আগুন ধরিয়ে দিয়ে করল উল্লাস। রঙ্গ কবে একে অন্যকে বলল, বড়ি আচ্ছি রোশনাই হো রহী হৈ, বাঃ, খুব উজ্জ্বল আলো হচ্ছে তো। লুণ্ঠন আব হনন। যমজ ভাই-এর মতো চলে পিঠোপিঠি। হিন্দু আর শিখ সামনে পেলে আর রক্ষে নেই। হানাদারেরা নিমেষে তাদের হত্যা করতে লাগল পৈশাচিক উল্লাসে। যুবক, বৃদ্ধ, নারী, পুরুষ, কোনো বাছবিচার রইল না আর কোনোখানে। স্ত্রীর চোখের সামনে কত স্বামীর মাথা পড়ল কাটা। মায়ের কোলে কত শিশুর বুকে বিধলো গুলী। কোপে জঙ্গলে লুকিয়ে যারা কোনো মতে প্রাণ বাঁচালো তাদেরও সবার দেহ অক্ষত রইল না। কাশ্মীর আক্রমণকে পাকিস্তান বরাবর বলছে-ধর্মযুদ্ধ। কাশ্মীরের প্রজারা বেশীর ভাগ মুসলমান। মহাবাজ হিন্দু। তিনি নাকি কেবলই মুসলিম নির্যাতন করেন। তাই উপজাতীয় মুসলমানেরা ক্ষেপে গিয়ে কাশ্মীরে চড়াও হয়েছে, তাদের স্বধর্মীদের ত্রাণ করতে। এ তো যেমন- তেমন লড়াই নয়, এ জিহাদ। ওক তো হানাদার নয়, ওরা মুজাহিদ। বলেছেন পাকিস্তানের কর্তারা। মুজাহিদেরা কিন্তু মুসলমানকেও রেহাই দিল না বারমূলায়। ত্রাণ করণের বদলে প্রাণ হরণ হলো সেখানে। মুসলমান যাদেব ধন বা প্রাণ গেল তাদের মধ্যে নাম না-জানা ছিল অনেকে। নামজাল ছিলেন অবশ্য মকবুল শেরোয়ানী। শেরোয়ানী বারমূলার গণামানা নেতা। তাঁর কথা সবার মুখে মুখে, তার খ্যাতি রটেছে পথে-ঘাটে। লোকেরু রোগে-শোকে তিনি তাই এর মত দরদী, বিপদে-আপদে তিনি সখার মতো
পৃষ্ঠা:১৪
সহায়। সারা শহরে তাঁর সুনাম ধরে না। কিন্তু তাঁর উপরে পাকিস্তানীদের রাগ ছিল অনেক দিনের এবং অনেকখানি। পাকিস্তানের যিনি শাহানশা বাদশা, সেই কায়েদে আজম জিন্নাকে একবার বড়ই অপদস্থ করেছিলেন মকবুল শেরোয়ানী। কয়েক বছর আগে জনাব জিন্না এসেছিলেন কাশ্মীরে। বারমূলাব এক সভায় বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। বললেন, ‘কাশ্মীরী মুসলমানেরা সব এক হোক, তাদের এক আল্লা এক কলেমা, এক দল।” শেরোয়ানী ছিলেন সে সভায একজন শ্রোতা। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “ঠিক কথা। এক হোক, তবে শুধু মুসলমান নয়-এক হোক হিন্দু, মুসলমান, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্বণি, খ্রীস্টান। এক হোক কাশ্মীরের সমস্ত জনগণ।” জিন্না রেগে বললেন, “হিন্দুরা কাফের, মুসলমানের শত্রু।”মকবুল শেরোয়ানী উত্তর দিলেন, “হিন্দুরা মানুষ, মুসলমানেব ভাই।” রাগে জিন্না সাহেবের চক্ষু রক্তবর্ণ। মুখে যোগাল না কথা। বার্নিশ করা জুতো যশ মণ করে ক্রুদ্ধ পদক্ষেপে সভা ছেড়ে চলে গেলেন সেই মুহূর্তে। ফুলের মালা রইল পড়ে। জয়ধ্বনি রইল বাকী। সেই পুরানো কাহিনী মনে ছিল পাকিস্তানীদের। তার শোধ তুলল এতদিনে। হানাদারেবা শেরোয়ানীকে বেঁধে নিয়ে গিয়ে হাজির করল তাদের সর্দারের সামনে। বলল, “সেলাম কব।” শেরোয়ানী নির্ভীক। হেসে বললেন, “গুরুজনের চরণ ছাড়া করিনে কালে প্রণিপাত।” স্পর্ধা বটে। বোধে ফুলতে থাকে সর্দারের অনুচরেবা।মনের ক্রোধ চেপে রেখে সর্দার বললেন, “আমরা কাশ্মীর জয় করেছি। শ্রীনগব দখল করব দু’-এক দিনে। আমাদের দলে যোগ দাও। সাহায্য কব।” শেরোয়ানী জবাব দিলেন, “আক্রমণকারীকে বাধা দেওয়া কাশ্মীরের প্রত্যেকটি মানুষের কর্তব্য। তোমরা দস্যু তোমরা নিপাত যাও।” শুনে সবাই গর্জে ওঠে। কেউ হাঁকে গর্দান লাও, কেউ চড়াতে চাষ শুলে। আর কেউ বা চোখ লাল করে বলে, হেঁটোয় কণ্টক দাও, উপবে কণ্টক ডালকুত্তাদের মাঝে কবহু বণ্টক। সর্পব হুকুম দিলেন, “হাটের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে প্রথমে গুণে গুণে লাগাও দু’শ’ কোডা। দিঠে পাঁচশ’ পয়জাব। কমবক্রের তাতেও শিক্ষা না হলে, গুলী করে মাথার খুলি উড়িয়ে দাও। সবার সামনে।” তখন শেবোযানীর হাতে উঠল হাতকডি, পায়ে পড়ল রেডি। কোমবে দড়ি বেঁধে টানতে টানতে জল্লাদেরা নিযে গেল চৌরাস্তার মোডে। বধ্যভূমিতে। সেখানে হানাদাবেবা এসে ভিড জমাল মজা দেখার আশায়। শেরোয়ানী অবিচলিত। শপাং শপাং শব্দে পিত্রে পড়তে লাগল চাবুক। একের পর এক। কতগুলি লাগল বুঝে, মুখে, চোখে। কেটে গিযে, বক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগল সর্বাঙ্গে। সর্দারের লোকেবা ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলল, “এখনও বাঁচাব সময় আছে, আমাদের দলে যোগ দিতে রাজী থাক তো বল, বল-পাকিস্তান জিন্দাবাদ।” মকবুল শেরোয়ানীব চেঁচিয়ে কথা বলার শক্তি নেই, চেতনা পাচ্ছে লোপ, জিব আসছে জড়িয়ে। তবুও কোন মতে অতি ক্ষীণকণ্ঠে উচ্চারণ করলেন, “কাশ্মীর জিন্দাবাদ, মেবী পিয়ারী কাশ্মীর-কাশ্মীর বেঁচে থাক, আমার সাধের কাশ্মীর।” পর মুহূর্তে তিন দিক থেকে তিনটে বন্দুক এক সঙ্গে গর্জে উঠল তাব মাথা তাক করে। হানাদারেবা উল্লাসে হর্ষধ্বনি করে বলল-অবাধ্যের এই সমুচিত শান্তি। অন্য লোকেবা দেখে শিখুক। দেখে শেখার লোক আর বড় বাকী ছিল না। হানাদারেরা মেরে কেটে প্রায় সাবাড় করে এনেছিল সব।
পৃষ্ঠা:১৫
কিন্তু ঠেকে শিখতে হলো আরও কয়েকজনকে। তারা কাশ্মীরী নয়, বিদেশী। খ্রীস্টান মিশনারীদের এক আশ্রম ছিল বারমূলায়। “প্রেজেন্টেশান কনভেন্ট তার নাম। অনেক কাল আগের কথা। এক ইংরেজ মহিলা এসেছিলেন কাশ্মীরে। রোমান ক্যাথলিক সিস্টার। চিরকুমারী, সন্ন্যাসিনী। কাশ্মীরে চাষী মজুরদের দুঃখদুর্দশা দেখে তার হৃদয় কাতর হলো করুণায়। স্থির করলেন, সেইখানে দরিদ্রের সেবায় জীবন কাটিয়ে দেবেন তিনি। স্বদেশ, সমাজ ও স্বজন পড়ে রইল পিছনে। নিজের ইচ্ছায় মাথায় তুলে নিলেন সহস্র যোজন দূরে এক অপরিচিত দেশের দুঃস্থ জনগণের দুঃখ মোচনের ভার। নিজের অতি সামান্য সম্বল নিয়ে স্থাপন কবলেন এক আশ্রম। এই প্রেজেন্টেশান কনভেন্ট। তাব আয়তন ক্ষুদ্র, আয়োজন সামান্য। কিন্তু আন্তরিকতা কম নয়। তারপরে বহু বছর গিয়েছে কেটে। বহু ধর্মপ্রাণ দানশীল বিদেশীর দানে ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠেছে সেই কনভেন্ট। ক্ষুদ্র অন্তর থেকে দিনে দিনে যেমন গড়ে ওঠে বিরাট মহীবৃহ। শাখা-প্রশাখায় বিস্তৃত, পুষ্প-পল্লবে সমৃদ্ধ। আজ প্রেজেন্টেশান কনভেন্টে আছে হাসপাতাল। সেখানে প্রত্যহ শত শত অসুস্থেরা পায় ওষুধ। আছে বিদ্যালয়। সেখানে দরিদ্র ছেলেমেয়েবা নেয় পাঠ। আছে নারী শিল্পাগার। সেখানে অন্যথ্য স্ত্রীলোকেবা শেখে তাঁত চালনা, উল বোনা, সেলাই ও অন্যান্য কারুকাজ। সেদিনের সেই পুণ্যশীলা প্রতিষ্ঠাত্রী গিয়েছেন পরলোকে। তিনি নেই। কিন্তু আছে তাঁর কাজ, বয়েছে তাঁর আদর্শ। সে কাজ হাতে নিয়েছেন, সে আদর্শ সফল করেছেন নানা দেশ থেকে আগত নবীন সন্ন্যাসিনীবা। নতুন একদল সিস্টার। কেউ ফরাসী, কেউ জার্মান, কেউ বা ইটালীয়ান। ঠাদের জাতি আলাদা, ভাষা পৃথক, কিন্তু লক্ষ্য এক। সে লক্ষ্য পরোপকার। হানাদারেরা বাবমূলায় আসছে শুনে কনভেন্টের অনেকেই ভীত হলো। মাদার সুপিরিয়র কনভেন্টের প্রধান কর্মী। তিনি আশ্বাস দিয়ে বললেন “আসে আসুক। আমরা রোগীর শুশ্রুষা কবি, আর্তের সেবা করি, দীন দরিদ্র নিয়ে আমাদের কাজ। কারো সঙ্গে কোনো বিরোধ নেই আমাদের। আমাদের ভয় কিসের ?” হায়। তিনি জানতেন না যে, যারা লুঠ করে তাদের বীতি আলাদা। সাধুর তারা শত্রু, ভালোর তাবা যম। তাদের বিরোধ জগতের সমস্ত সভ্য ও শিক্ষিত নরনারীর সঙ্গে। মাদার সুপিরিষরের ভুল ভাঙতে বিলম্ব হলো না। বেলা তখন পাঁচটা। পীর পঞ্জালের মাথায় শাদা ববফের গায়ে লেগেছে পড়ন্ত বোদের আধ-গোলাপী রঙ। বাগানে সবুজ ঘাসের উপর পপলার গাছগুলিব ৬য়া পড়েছে দীঘ। আলখাল্লার মতো লম্বা ময়লা পিরান গায়ে, চাপা টুপি মাথায় ক্লান্ত গুজবালেবা মেষের পাল নিয়ে কাঁচা মকাই চিবোতে চিবোতে ফিরছে ঘরে। কনভেন্টের স্কুলে ছুটির ঘন্টা বেজেছে অনেকক্ষণ। ছাত্র-ছাত্রীবা চলে গিযেছে যে যার বাড়িতে। হাসপাতালে রোগীরা শুয়ে আছে বিছানায়। এমন সময় হঠাৎ শোনা গেল কোলাহল হৈ-হুল্লোড়ে একদল হানা দিল কনভেন্টে। কনভেন্টের অতিথিশালায় ছিলেন কয়েকজন বিদেশী। কেউ নতুন এসেছেন বেড়াতে, কেউ বা আছেন অনেক দিন। তাদের মধ্যে ছিলেন এক বৃদ্ধ ইংরেজ। লেফটেনেন্ট কর্ণেল ভি ও টি ডাইকস। আগে কাজ করতেন ভারতীয় সেনা বিভাগে, পেন্সনের পর বয়ে গিয়েছেন এদেশে। সস্ত্রীক বসবাস করছেন এই কনভেন্টে। বাতে প্রায় পঙ্গু। তবুও সাধ্যমতো হিসাবপত্র লেখাব কাজকর্ম করে সিস্টারদের সাহায্য করেন মাঝে মাঝে। বিপদের সময এই বৃদ্ধই বন্দুক হাতে এগিয়ে গেলেন সামনে। রুখতে চাইলেন দস্যুদের কনভেন্টের বাইরে। কিন্তু বার্ধক্যে ডাইকসের শরীর বলহীন। চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ। বাতে আড়ষ্ট হাত বন্দুক তাক করার আগেই হানাদারদের গুলিতে প্রাণ হারালেন তিনি। ভয়ে ও উদ্বেগে স্বামীর সঙ্গে ঠিক তাঁর পিছনেই ছিলেন স্ত্রী মিসেস ডাইকস। একটি ভীক খরগোশের ছানার উপরে এক পাল হিংস্র জম্ভব মতো তাঁর উপরে ঝাপিয়ে পড়ল হানাদারদের
পৃষ্ঠা:১৬
দল। শুধু একবার বুঝি একটি আর্তনাদ শোনা গেল। পর মুহূর্তেই আক্রমণকারীদের উদ্দাম আস্ফালন ও উন্মত্ত কোলাহলে চাপা পড়ে গেল সে কাতর স্বর। দু’দিন পরে মিসেস ডাইকসের নগ্ন মৃতদেহটা খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল একটা গভীর কূপের মধ্যে। মৃত মহিলার গায়ের জামা কাপড়টুকু পর্যন্ত নিতে বাকী রাখেনি তাঁর হত্যাকারীরা। কনভেন্ট থেকে প্রচুর ধনদৌলত বস্তা বোঝাই করে নিয়ে যাবে-এই আশা ছিল দস্যুদের। নিবাশ হলো। আশ্রম শোভার জন্য নয়, দেবার জন্যে। সেখানে না থাকে মণি-মুক্তার ছড়াছড়ি, না আছে হীরা-জহরতের জাঁকজমক। অগত্যা দেয়ালের ঘড়ি, আলনার জামা কাপড় আর জানলাব পর্দা নিয়েই হানাদারেরা কাড়াকাড়ি করতে লাগল। লুঠের মাল যতই হলো কম, লুরনকারীদের ততই বাড়ল রোষ। জিনিসপত্র ভেঙে গায়ের ঝাল ঝাড়তে লাগল। ঘরের টেবিল, চেয়ার, আলমারি, দেরাজ, পেয়ালা, পিরিচ, শার্লি, কপাট করল চৌচির। তাদের অস্ত্রের আঘাতে বাগানের পাশে সমাধিস্থানে শ্বেত পাথরের ক্রশ চিহ্নগুলি পর্যন্ত হলো চূর্ণবিচূর্ণ। এতেও শান্ত হলো না ক্রোধ। বরং খুন চেপে গেল মাখায়। কনভেন্টের বিদেশী সন্ন্যাসিনী মেয়েদের ন’জনকে সঙ্গীনের পাহারায় এনে এক সারিতে দাঁড় করাল উঠনে। ন’জন হানাদার বন্দুক উচিয়ে তাক করল তাদের কপালে। শুধু গুলী ছোড়ার অপেক্ষা। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে দূরু দুরু বুকে চোখ বুজে ভগবানের নাম স্মরণ করলেন সন্ন্যাসিনীরা। কিন্তু রাখে খ্রীস্ট মারে কে? আসন্ন মৃত্যুর হাত থেকে নাটি পরোপকারী সন্ন্যাসিনীদের রক্ষা করলেন অদৃশ্য থেকে নিশ্চয়ই ভগবান, কিন্তু প্রকাশ্যে একটি অতি ক্ষুদ্র জিনিস। সন্ন্যাসিনীদের মধ্যে একজনের মুখের একটি দাঁত ছিল সোনা-ধাঁধানো। সেটা চোখে পড়তেই এক জল্লাদ বন্দুক ফেলে দিয়ে ছুটল সেটা দখল করার লোভে। কিন্তু লুঠের নজব তো একা তারই তীক্ষ্ম নয়, তার অন্য সাঙাতরাও কিছু চোখ বুজে ছিল না। কাজেই সোনার লোভে নিজেদের মধ্যেই বাঁধল কলহ। প্রথমে গালাগালি। শেষে হাতাহাতি। হট্টগোলের মধ্যে হানাদারদের এক কর্তা এসে হাজির। তার কাণ্ডজ্ঞান আছে। কাশ্মীরী মেয়ে পুরুষ হত্যা করা এক, ঘুরোপীয় সন্ন্যাসিনীদের গুলী করায আর-সেটুকু তিনি বোঝেন। তাই শেষ মুহূর্তে অভাবনীয় রূপে প্রাণ রক্ষা হলো তাদের। হানাদারদের আর এক দল ততক্ষণ ব্যস্ত ছিল কনভেন্টের অন্য এক অংশে। তারা চড়াও হলো হাসপাতালে। যা’ সামনে পেল তাই করল খানখান। যাকে হাতে পেল তাকেই করল আহত বা নিহত। বন্দুকের বাটের ঘায়ে টুকরো টুকরো করল দামী এক্স-রে যন্ত্রপাতি। শিশি বোতল দিল উড়িয়ে, ওষুধপত্র গেল গড়িয়ে, ক্ষত-বিক্ষত হলো অসহায় অসুস্থ নরনারী। মারা গেল একজন নার্স, আয়ু শেষ হলো দু’জন রোগীর। প্রাণ দিলেন একটি পুণ্যবর্তী মহিলা। সিস্টার টেরেসেলীন। কনভেন্টের সহকারী মাদার সুপিরিয়র। সুদূর য়ুরোপের স্পেন দেশ থেকে এসেছিলেন বারমূলায় পরহিতের ব্রত দিয়ে। কনভেন্টের উপাসনা স্থানটি পাছে হানাদারদের আক্রমণে অপবিত্র হয়, এই আশঙ্কায় প্রহরীর মতো তিনি একা দাঁড়িয়ে ছিলেন মন্দিরের দুয়ারে। গুলী এসে বিগুল তার বুকে। সেদিন বারমূলায় দস্যুদের আঘাতে ছিন্ন হলো একটি কোমল লতার মূল। সেদিন জনসেবার বেদীতে নিবল একটি স্নিগ্ধ দীপের শিখা। সেদিন শুভ্র পাষাণ ফলকে পড়িল রক্ত লিখা।
আট
শ্রীনগর থেকে পেট্রোল জোগাত করে অবশেষে বারমুলায় এসে পৌঁছল ভারতীয় সৈন্যদল। সূর্য তখন অস্ত গিয়েছে। ধাঁরে ধীরে সন্ধ্যার অন্ধকার নামছে খনিয়ে।
পৃষ্ঠা:১৭
নিঝুম নিস্তব্ধ নগর। অনেক যা খেয়ে অসহ্য বাথায় অজ্ঞান হয়ে যাওয়া মানুষের মতো যেন পড়ে আছে ক্ষতবিক্ষত বারমূলা। অসাড় অচৈতন্য। তার পথগুলি জনহীন, ঘর-দোর শূন্য। রাস্তার ধারে, বাড়ির উঠনে ছড়িয়ে আছে মৃতদেহ। সেখানে শকুনি গৃধিনীদের চলছে ফলার, শেয়াল কুকুরে বেধেছে মারামারি। হায়, বারমূলা ছিল শহর, বারমূলা হয়েছে শ্মশান। পরদিন সকালবেলাই ব্রিগেডিয়র সেনের সৈন্যদল আবার বেরিয়ে পড়ল হানাদারদের সন্ধানে। কিন্তু তাদের কি আর নাগাল পাওয়া যায়। তাবা ততক্ষণে সবে পড়েছে অনেক দূরে। পালাবার সময় রাস্তাঘাট নষ্ট করে রেখে গিয়েছে যাতে ভারতীয় সৈনাদল সহজে পিছু ধাওয়া করতে না পারে। পথের মাঝখানে ফেলে রেখে গিযেছে বিরাট গাছের গুডি। কোথাও বা পাশের পাহাড় থেকে গড়িয়ে দিয়েছে মস্ত পাথরের চাঁই। সে সব না সবিয়ে এগোতে পারে না জীপ বা মোটর বাস। তার উপরে আবার পেট্রোল ফুবিযে যায় মাঝে মাঝে। শ্রীনগর থেকে নতুন পেট্রোল এসে না পৌঁছানো পর্যন্ত বসে থাকতে হয় নিরুপায়। এমনি করে ভারতীয় সৈনারা এসে পৌঁছল রামপুর। যে-পথে লাগে কয়েক ঘণ্টা, সে-পথে লাগলো কয়েক দিন। শ্রীনগরে যারা আছে তাবা আশা ও আশঙ্কায় দুলছে অঃসহ। কী হয়, কী হয়। সেলাটং ছিল ঘরের কোণায়। কানের কাছে গোলাগুলিব আওয়াজ শোনা গিয়েছে। লোকের মুখে খবর পাওয়া গিয়েছে। এখন শত্রুকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে দুরে। সেখানকার হারজিতের সঠিক সংবাদ জানে না কেউ। থেকে থেকে গুজব রটেছে নানা রকম। তার কোনটা সত্যি, কোনটা মিথ্যে হদিশ পাওয়া ভাল। সকালে শোনা গেল, ভারতীয় সৈনা, হানাদাবদের ঘায়েল করেছে। শুনে লোকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। পরক্ষণেই শোনা যায় তার উল্টো। ভারতীয় সৈনাদের নির্মূল করে হানাদাবেরা নাকি আবার এগিয়ে আসছে শ্রীনগরের পথে। তখন ভয়ে সবার মুখ শুকিয়ে যায়। বুক কবে দুরু দুরু। বাক্স-বিছানা বেধে পালাবাব উদ্যোগ করবে কিনা ভাবে এমনি করে দিন কেটে যায়। হঠাৎ এক সন্ধ্যেবেলা শ্রীনগরের বিজলী আলোগুলি ঝলমলিয়ে উঠলো। ছেলে, বুড়ো, মেযে, পুরুষ সবাই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে খানিকক্ষণ। প্রথমে লাগে অবাক, পব মুহূর্তেই জাগে আনন্দ। য্যা, মধুবা। তাহলে মালায় পৌঁছে গিলেছে ভাবতীয় সৈনাদল। হানাদারদেব দিয়েছে হটিষে? খুশিতে এ ওকে জড়িয়ে ধরে বলে, “মহবা, মন্থরা এসেছে আমাদের দখলে।” হ্যাঁ। বামপুর থেকে মন্ত্রনায় এসে পৌঁছেছে ব্রিগেডিযর সেনের সৈনাদল আজকাল সেনাবাহিনীর সঙ্গে থাকে জন কয়েক এস্ক্রিনীয়র। তারা যুদ্ধ কবেন না, কিন্তু যুদ্ধের সাচ-সবস্ক্রাম নিখুত বাখেন। জোড়াতালি দিয়ে অচল কলকব্জা সচল করতে ধারা ওস্তাদ। জীপ, গর্বী, মোটর, ট্যাঙ্ক মেরামতিতে তাদের জুড়ি নেই। জলবিদ্যুতের যন্ত্রপাতি তাদের কাছে নতুন হলেও একেবারে অসাধ্য নয়। দিন কয়েকের চেষ্টায় ভাঙ। টুকরোগুলো জুড়ে তাঁবা বিদ্যুৎ কারখানার ডাইনামোটা চালু করে দিলেন। আলো জ্বলে উঠল রাজধানীতে। শুধু পথে বা ঘরে নয়, লোকের মনেও।
নয়
মহুরা থেকে উরির পথের দু’ধারে উচু পাহাড় আর ঘন বন। সেখানে লুকিয়ে থেকে শত্রু আচমকা আক্রমণ করতে পারে যে কোন মুহূর্তে। তাই প্রারতীয় সৈন্যদলকে এবার এগোতে হবে সাবধানে। খবরদারীর জন্য সহায়তা নিতে হয বিমান বাহিনীর। শ্রীনগরের বিমানঘাটিটি ক্ষুদ্র। মহারাজ তৈল করেছিলেন তার নিজের বিমান চলাচলের জন্য। সে-বিমান মৌখীন প্রমোদ-ভ্রমণের বাহন আকালে ছোট, ৩০০নে কম। তাই বিমানঘাটির
পৃষ্ঠা:১৮
রানওয়ে যেমন সরু, ফ্লাইং কন্ট্রোল, বাতাসের গতি ও আবহাওয়ার হালচাল জেনে নেওয়ার যন্ত্রপাতি তেমনি। সাধারণ। বড় বিমান চলাচলের ব্যবস্থা ছিল না সেখানে। ভারতীয় বিমানবাহিনীর বড় কর্তারা তখন প্রায় সবাই ইংরেজ। তাঁরা দিল্লী থেকে এসে বিমানঘাঁটি পরিদর্শন করলেন। বিশেষজ্ঞ যত ছোট, মেজ, সেজ ও বড় সাহেব তাঁরা দিন দুই ধরে তার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, খুরিধি প্রভৃতি পরীক্ষা করলেন। ফিতা ফেলে মাপলেন, খড়ি দিয়ে দাগলেন, খাতা-পেন্সিল নিয়ে করলেন ভগ্নাংশ, দশমিক ও বর্গফলের রাশি রাশি অঙ্ক। তারপরে এক দিস্তা কাগজে নোট লিখে বললেন-অসম্ভব। শ্রীনগর বিমানঘাঁটিতে জঙ্গী বিমানের ওঠা-নামা চলে না। বিশেষজ্ঞদের মত, সে তো না মেনে উপায় নেই। অগত্যা পালম থেকেই বিমান বাহিনীর বিমানগুলিকে উড়ে আসতে হয় কাশ্মীরে। তাতে অসুবিধা অনেক। বিমানে পেট্রোল নেওয়ার জায়গা অল্প। যেতে আসতেই বেশীর ভাগ পেট্রোল ফুরিয়ে যায়। দিন কয়েক পরেই কিন্তু সমস্যার সুরাহা হয়ে গেল এক আশ্চর্যজনক ঘটনায়। পাহাড় পর্বতের আড়ালে, ঝোপ-জঙ্গলের মধ্যে যুদ্ধের এলাকাটা আকাশ থেকে চিনতে যাতে অযথা বিলম্ব না ঘটে সে জানো একটা বিশেষ ব্যবস্থা ছিল। দিল্লীর সদর দপ্তর থেকে খর পেলেই কাশ্মীরে ভারতীয় সৈনাদল খড়কুটো জড়ো করে আগুন জ্বেলে রাখতো তাদের ছাউনির কিনারে। বিমানগুলি সেই আগুন দেখে সহজেই তাদের লক্ষ্যস্থল বুঝতে পারতো। সেদিন সকালবেলা পালম থেকে দু’খানা স্পিটফায়ার বিমান নিয়ে রওনা হলো বিমানবাহিনীর দু’জন তরুণ পাইলট। উড়ে এল পাটানে। নীচে তাকিয়ে দেখল, কোথাও কোনখানে আগুনের চিহ্নমাত্র নেই। বেতারে খবর পাঠাতে ভুল করেছে বেতারবার্তার অপারেটার। তাই ব্রিগেডিয়র সেনের দপ্তর আগে-ভাগে জানতে পায়নি বিমানগুলির দিল্লী থেকে রওনা হওয়ার সংবাদ। তাই তো. এখন কী করা যায়? ফিরে যেতে হবে দিল্লীতে। তাছাড়া আর উপায় কী? পাইলটেরা ভাবে, মিছিমিছি এতখানি পেট্রোল নষ্ট হবে, কোনো কাজ না করে ফিরে যাবো, সে কেমন কথা। তার চাইতে। মিনিট দুই ভেবে নিয়ে এক পাইলট বেতাব টেলিফোনে অন্য পাইলটকে জিজ্ঞাসা করে, “শ্রীনগর বিমানধাটিতে নেমে একবার খোঁজ নিলে হয় না ?” দ্বিতীয় জন জবাবে বলে, ‘তা হয়, কিন্তু বড় সাহেবরা যে বলেন,-স্পিটফায়ার নামতে পারে না সেখানে।” “সাহেবরা যাই বলুন আমি কিন্তু আমার বিমান নিয়ে ঠিক নামতে পারি ঐ রানওযেব উপবে।” বলল প্রথম পাইলট। “দ্বিতীয় জন বলে, “আমিও।” “তবে এস, জয় হিন্দ বলে নামা যাক শ্রীনগবে।” যেই কথা সেই কাজ, রেডী? ওয়ান, টু, স্ত্রী, ডাউন। হুশ, হু-উ-শ। একের পর এক, দুটি স্পিটফাযার বিমানঘাটির কর্তৃপক্ষ ও ফ্লাইং কন্ট্রোলের কর্মচারীদের সত্ত্বাক করে দিয়ে নির্বিঘ্নে নেমে পড়ল শ্রীনগরের ছোট রানওয়ের উপর। ভুলের ফলেই ফলল সফল। বিমানঘাটি থেকে পাইলটের। ম্যাপের উপর লাল পেন্সিলের দাগ দিয়ে নিল লড়াই-এব সাঁমানা। আবার উঠল আকাশে। শত্রুপক্ষের মাথার উপর গুলিবৃষ্টি কবে সন্ধ্যার আগেই ফিবে গেল দিল্লীতে। বিমান শাস্ত্রের বিধানে যা’ ছিল এতকাল অসম্ভব, তাই সম্ভব করল অসম সাহসিক দুটি ভাবতীয একণ। তাদের গর্বে ভবে উঠল তাদের সহকর্মীদের বুক। তাদের বীরত্বে উজ্জ্বল হলো সমস্ত ভাবতবাসীর মুখ পরদিন শ্রীনগর বিমানঘাঁটিতে নতুন দপ্তল গোলা হলো ভাবতীয় বিমানবাহিনীর। দিল্লী থেকে এসে পৌঁছল অনেকগুলি স্পিপ্টফাযান। সেই সঙ্গে এল. হ. ফিটার, মেকানিক, গ্রাউণ্ড এঙিনায়ক, পাইলট অফিসার ইত্যাদি বিমান হলেন কমচারী দল তাদের মালপত্র, যন্ত্রপাতি, সাজ-সরঞ্জাম। অধিনায়ক হয়ে এলেন গ্রুপ ক্যাপটেন মেহের সিং, ডি এস ও। বিমান বাহিনীর সহায়তাষ ব্রিগেওিসণ সেনের সেনাদল মহরা থেকে রওনা হলো হানাদারদের
পৃষ্ঠা:১৯
সন্ধানে। আশেপাশের ঝোপ-জঙ্গলে ছোটখাটো শত্রুদল যা’ লুকিয়ে ছিল, তারা সাবাড় হয়ে গেল ভারতীয় সৈনাদের বন্দুকের গুলিতে। কিন্তু আসল বড় দলটা তখনও অনেক দূরে। তাকে ধরতে হলে জোরে পিছু ধাওয়া করতে হবে। কিছু দূর এগোতেই দেল্লা গেল সামনে গভীর ও চওড়া বিরাট এক নালা। তাতে পাহাড়ের ঝরনা থেকে স্রোত বয়ে যাচ্ছে তাঁর বেগে। গাড়ি পার হওয়ার উপায় নেই। পাথরে বাঁধানো শক্ত পুলটিকে হানাদাবেরা বারুদ জ্বালিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে অনেক আগেই। ডাক পড়ল এঞ্জিনীয়বদের। তারা বললেন, নতুন করে সেতু গড়তে চাই ভারী ভারী মাল-মশলা, তা’ এখন দুর্ঘট। আর চাই যথেষ্ট সময়। তার এখন অভাব। কোনো কিছুতেই হাল ছাড়াব পাত্র নন ব্রিগেডিয়র সেন। বললেন, “গাড়ি জীপ, ট্রাক, লরী, থাক পড়ে এখানে। শত্রুর পিছু ধাওয়া করতে হবে পায়ে হেঁটে। দখল করতে হবে উরি যেমন করে হোক। সৈনাবা সেলাম করে বলল, ‘জো হুকুম।” পায়ে হেঁটেই তারা তাড়া করল হানাদারদের। বীর দর্পে দখল করল উরি। চৌদ্দই নভেম্বর তিন সপ্তাহ আগে হানাদারদের রুখতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন ব্রিগেডিয়র রাজেন্দ্র সিং ঠিক সেইখানেই উঁচু এক মঞ্চের উপর ব্রিগেডিয়র এল পি. সেন সর্বপ্রথম উত্তোলন করলেন অশোক চক্র আকা গেরুয়া, সাদা ও সবুজ রঙের নিশান। স্বাধীন ভারতের ত্রিবর্ণ জাতীয় পতাকা। সবার কণ্ঠে উঠল উচ্চ রব, ‘জয় হিন্দ “স্বাধীন ভারতের জয়ধ্বনি। সৈনাদলের ব্যান্ডে বাজতে লাগল, “জন গণ মন অধিনায়ক। স্বাধীন ভারতের জাতীয় সঙ্গীত। উরিতে সে সঙ্গীত এই প্রথম শোনা গেল।
দশ
উরির জয়ধ্বনি মিলিয়ে যাওয়ার আগেই কিন্তু এল নতুন দুঃসংবাদ। জম্মু থেকে। জম্মু আর লাডাক, দুই দিকে দুই পৃথক প্রদেশ, মাঝখানে তার কাশ্মীর, এই তিন নিয়ে মহারাজ হরি সিং-এর রাজা। জম্মুর প্রায় গায়েই পশ্চিম পাকিস্তানের বড় বড় শহর আর সেনানিবাস, শেয়ালকোট, ওয়াজিরাবাদ ও মারি। সেখান থেকে হানালরেরা করেছে আক্রমণ। এরই মধ্যে দখল করে নিয়েছে অনেকখানি এলাকা। খুন, লুঠ আর জখমের তো কথাই নেই। কাশ্মীর প্রদেশে আক্রমণকারীরা সবাই ছিল বাইবের লোক। তাদের ঠেকানো সহজ। জম্মুতে দস্যুদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে কিছু স্থানীয় মুসলমান। তারা ঘরের শত্রু বিভীষণ। সব চেয়ে মারাত্মক। সর্দার ইব্রাহিম ধা তাদের নেতা। জম্মুতে মহারাজ হরি সিং-এর অধীনে পুঞ্চে ছিলেন এক মস্ত জায়গীরদার। তাঁর উপাধি রাজা। রাজার মতোই তাঁর প্রতাপ। রাজার মতোই তাঁর দান ও দাক্ষিণ্য। ইব্রাহিম এই রাজারই প্রজা। ছাত্রকালে সে ছিল মেধাবী। খুশি হয়ে পুঞ্চের রাজা নিলেন তার লেখাপড়ার ভার। স্কুল থেকে কলেজ। কলেজ থেকে বিলাত। রাজার অর্থে ব্যারিস্টর হয়ে ইব্রাহিম ফিরে এল জম্মুতে। সেখানে শিক্ষিত মুসলমানের সংখ্যা নগণ্য। দু’দিনেই তাদের নেতা হয়ে বসল নতুন ব্যারিস্টার। ততদিনে পাঞ্জাবে মুসলীম লীগের প্রসার জমে উঠেছে। সাম্প্রদায়িক ঝড়ো হাওয়ায় হিন্দু-বিদ্বেষের পাল তুলে দিয়ে তারা ভাসিয়েছে দুই জাতিতত্বের তরণী। তাই দেখে চতুর ইব্রাহিমের মাথায় গজাল দুর্বৃদ্ধি। আরও অনেক সুযোগ-সন্ধানীর মতো সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে চেপে বসল সে নৌকায়। যে রাজার টাকায় হয়েছে মানুষ তাঁরই বিরুদ্ধে শুরু করল ষড়যন্ত্র। কুৎসিত কৃতঘ্নতার এমন নির্লজ্জ দৃষ্টান্ত অতি অল্পই আছে ইতিহাসে। দুরাত্মার যেমন ছল, দুষ্কর্মেরও তেমনি সহযোগীর অভাব হয় না কোনোদিনই। ইব্রাহিমেরও জুটল দোসর। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী। আব্দুল কৈয়ায়ুম খান। তাঁর
পৃষ্ঠা:২০
বর্ণ-বিবর্তনের কাহিনীও কম চমকপ্রদ নয়। গোড়াতে কৈয়ায়ুম ছিলেন জাতীয়তাবাদী মুসলমান দিল্লীতে কেন্দ্রীয় আইনসভার প্রথম সারিতে কংগ্রেসী দলপতি ভুলাভাই দেশাই-এর পাশেই ছিল তাঁর আসন। তখন ইংরেজের সমালোচনা করতেন কঠোর ভাষায়। সাম্প্রদায়িকতাকে বলতেন বিষ। দেশনেতাদের য়্যালবামে থাকতো তাঁর ছবি। স্বদেশী সভা সমিতিতে শোনা যেত তাঁর ভাষণ। হঠাৎ একদিন তাঁর মতি হলো বদল, গতি হলো বিপরীত। যোগ দিলেন মুসলীম লীগে। রাতারাতি কংগ্রেসকে গাল দিতে লাগলেন এলোপাতাড়ি। গান্ধীকে বললেন, ভণ্ড। নেহরুকে-গোঁয়ার। আর প্যাটেল? সে তো সাক্ষাৎ শয়তান, মুসলমানদের পয়লা নম্বর দুশমন। কংগ্রেসের নেতারা তখন সবাই আমোদনগরে আগা খানের বাড়িতে বন্দী। তাঁরা পুরানো সহকর্মীর কীর্তি দেখে অবাক হয়ে ভাবেন, এ কী অঘটন।কথায় বলে,, জ্ঞাতি শত্রু বড় শত্রু, ভাই শত্রু মহাকাল। দলত্যাগীরাই হয় কালাপাহাড়। ভারতবর্ষের প্রতি আব্দুল কৈয়ায়ুম খানের রাগটাই যেন সব চেয়ে প্রচণ্ড। কাশ্মীর আক্রমণের পরিকল্পনা হয়েছে পেশোয়াবে, মূল পরিচালনাও সেখান থেকেই। সব কিছুরই পিছনে ছিল কৈয়ায়ুমের হাত। সদার ইব্রাহিম খান যোগাযোগ রাখল তাঁর সঙ্গে। অস্ত্র-শস্ত্র যোগাড় করে করল বিদ্রোহ। বলল, “রাজা, মহারাজা মানিনে। আমরা নতুন সরকার গড়েছি। তার নাম, আজাদ কাশ্মীর।” মীরপুর, পুঞ্চ, নৌশেরা ও রাজৌরীতে ছিল মহারাজ হরি সিং-এর ছাউনি। কিন্তু সেগুলিতে সৈন্য সংখ্যা যেমন অল্প, অস্ত্র-শস্ত্রও তেমনি অপ্রচুর। তার উপরে সেখানে ভিড় করেছে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা বহু হিন্দু ও শিখ শরণার্থী। অগণিত আহত ক্লান্ত ও সর্বস্বান্ত নরনারী। তাদের ক্ষুধার অন্ন আর বাসের ব্যবস্থাই দুরূহ। হানাদারেরা চার দিক থেকে ঘিরে ফেলল এই ঘাঁটিগুলিকে। খবর পেয়ে ভারত সরকার সৈন্য পাঠালেন পুঞ্চের পথে। কিন্তু পথ বলি তাকে কী মুখে? গহন ঘন বনের মাঝে এঁকে-বেঁকে গিয়েছে কোনোমতে পায়ে চলার সরু রেখাটি। তাই বেয়ে আট হাজার ফুট উঁচু হাজি পীরের গিরিবর্জ্য পার হয়ে বহু কষ্টে পুঞ্চের ছাউনিতে এসে ‘পৌঁছলেন ব্রিগেডিয়র প্রিতম সিং ও তাঁর এক ব্যাটেলিয়ন সৈন্য। সেখানে সমস্যা খাদ্য। ওৎ-পাতা বাঘের মতো সহস্র সহস্র হানাদার ঘিরে বসে আছে শহরের সর্বদিক। সাধ্য কী যে তাদের এড়িয়ে বাইরে থেকে আসবে চাল ডাল তেল বা নুন। ভিতরে গৃহস্থদের গোলায় আর পাটোয়ারীদের আড়তে শস্য যা’ ছিল তা’ এসেছে ফুরিয়ে। বাইরে থেকে খাদ্য আমদানীর এক মাত্র উপায় বিমান। কিন্তু বিমান নামবে কোথায়। ছাউনিতে সৈন্য যারা আছে তারা হানাদাবদের দূরে ঠেকিয়ে রাখতেই হিমশিম। বিমান অবতরণের রানওয়ে গড়বে কখন? প্রিতম সিং ভেবে কুল পান না। পুঞ্চে শরণার্থীদের মধ্যে ছিল এক হিন্দু ছুতোব। একদিন সে এসে হাজির হলো প্রিতম সিং-এর দপ্তরে। ব্রিগেডিয়র সাহেবের সঙ্গে দেখা করবে। আরদালী চাপরাসীরা প্রথমে হাঁকিয়ে দিতে চায়। শেষটায় অনেক বিনতি মিনতিতে মন নরম হলো তাদের। নিয়ে গেল প্রিতম সিং-এর সামনে। বৃদ্ধ সেলাম করে বলল, “হুজুর আমাকে কাজে লাগান।” ব্রিগেডিয়র জিজ্ঞাসা করেন, “তুমি বুড়ো মানুষ, কী কাজ করবে। বুড়ো উত্তর দেয়, “হাওয়াই জাহাজের জমি তৈরী করব।” প্রিতম সিং অবাক হয়ে বলেন, “রানওয়ে। তুমি তার কী জান?” বুড়ো বলে, “হুজুর কিছুই জানিনে, শুধু খাটতে জানি। আপনার এঞ্জিনীয়রেরা বানাবে নক্সা,রাজমিস্ত্রীরা গাঁথবে ইট। আমি মোট বয়ে যোগাবো মাটি, জল, চুন, সুরকী ও সিমেন্ট।” প্রিতম সিং-এর সন্দেহ ঘোচে না। বলেন, “সে কী কথা। তোমার এই অশক্ত শরীরে সে পরিশ্রম সইবে কেন ?”
পৃষ্ঠা ২১ থেকে ৩০
পৃষ্ঠা:২১
ছুতোরের চোখের কোণে জল দেখা দিল। দু’হাত কপালে ঠেকিয়ে বলল, “মালিক, এই শক্ত হাড়গুলি অনেক সয়েছে। আমার জোয়ান দুই ছেলে মরেছে দাঙ্গাকারীদের হাতে, একমাত্র মেয়ে হয়েছে নিখোঁজ। রুমা স্ত্রীর হাত ধরে রাত্রির অন্ধকারে পায়ে হেঁটে এসেছি পাঁচ ক্রোশের পথ। আর ক’টা দিন বাঁচব? কোন সুখেই বাচব। মরার আগে যদি বিমানধাটি তৈরীর কাজে কিন্তু মদত দিতে পারি তবে জানব আমার জিন্দগী সফল।”বৃদ্ধকে কিছুতেই নিরস্ত করা গেল না।পরদিন ভোরবেলা অনেক লোকের হট্টগোলে ঘুম ভাঙল প্রিতম সিং-এর। জানালায় তাকিয়ে দেখেন, প্রায় হাজার দুই শরণার্থী। যুবক, বৃদ্ধ, স্ত্রী, পুরুষ। ব্যাপার কী? সকই, রানওয়ে তৈরীর কাজে লাগতে চায়। বলে, “বুড়ো ছুতোর যদি পারে মোট বইতে, আমরা কি এতই অধম।” অদমা উৎসাহে কাজ শুরু হয়ে গেল রানওয়ের। কোপ-ঝাড় কেটে জমি হলো সাফ, দুরমুশ পিটিয়ে মাটি হলো পরু। ইট চুন সুরকী ঢেলে জাযগা হলো বিমান অবতরণের। রুগ্ন ও অশক্ত যারা, তারাও সাহায্য করল নানা ভাবে। সমর্থ লোকেবা কাজে চলে গেলে তারা কেউ আগলাল পড়শীদের ঘর সংসার, কেউ সামলাল তাদের ছেলেমেয়ে। এক মাসের কাজ সারা হলো এক সপ্তাহে। পুঞ্চের অবরুদ্ধ অধিবাসীদের জন্যে মাকাশপথে আসতে লাগল নিত্যকার খাদ্যসামগ্রী। হানাদারেরা ভেবেছিল, অনাহারের চাপে ছাউনির লোকেরা হার মানবে দু’দিনেই। তার আর সম্ভাবনা বইল না। অনেক শলা-পরামর্শের পর তারা তখন নিয়ে এল বড় এক বিলাতী কামান। ডিন পয়েন্ট সাত হাউইটজার। পাহাড়ের উপর থেকে গোলা ফেলতে লাগল ঠিক একেবারে রানওয়ের উপ৩। বাধ্য হয়েই বিমান অবতরণ বন্ধ হলো সেখানে। খাদ্যাভাব দেখা দিল শহরে। রেশনের মাপ কমিয়ে দিয়ে চলে কিছু কাল। সেনাবাহিনীর লোকেরা নিজে কম খেয়ে শিশুদের খাবার যোগাল আরও কিছু দিন। তার পর।প্রিতম সিং তার সিগন্যালারদের ডেকে বললেন, ‘এ অসহ্য। পাহাড়ের উপরে শত্রুপক্ষের কামানটাকে ঠাণ্ডা না করলেই নয়। বেতাবে খবধ পাঠাও সদর দপ্তরে। গোটা কয়েক দূর পাল্লার কামান পৌঁছে দিক এই ছাউনিতে। বাকী ভার আমাদের।” খবর পাঠানো যত সহজ, কামান পাঠানো তত নয়। তবুও সদর দপ্তরের কর্তারা বললেন, “চেষ্টা করতে দোষ কী? পঁচিশ পউেত্তার গোটা কয়েক কামান, গোলা বারুদ আর জনকয়েক গোলন্দাজ নিয়ে একদিন দুপুর বেলা রওনা হলো বিমান বাহিনীর তিনখানা ডাকোটা। এয়ার কমোর মেহের সিং তখন কাশ্মীরে বিমান বাহিনীর কর্তা। তিনি ভাবলেন, এমন বিপজ্জনক কাজে পাইলটদের একা ছেড়ে দেওয়া ঠিক নয়। জেনারেল স্কুলবস্তু সিং সেখানে সেনাবাহিনীর অধিকর্তা। তিনিও সঙ্গ নিতে চান। দু’জনে চেপে বসলেন একখান হাওয়ার্ড বিমানে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চারখানা বিমান এসে পৌঁছল পুঞ্চে। প্রথম ডাকোটাখানা যেই নামতে যাবে মাটিতে অমনি পাহাড় থেকে হানাদারদের ঢাউইটজারটা গর্জে উঠল গুড় ম-গুড়ুম শব্দে। বাজ পড়ার আওয়াজে একটা বড় গোলা ফেটে পড়ল ডাকোটার গা ঘেঁষে। বুঝি এক চুলের জন্য বেঁচে গেল ডাকোটার ডান দিকের ডানাটা। মেহের সিং বুঝলেন, চেষ্টা নিরর্থক। এ ক্ষেত্রে বিমান-অবতরণ আত্মহত্যারই সামিল। বেতারে হুকুম দিলেন। সব বিমানগুলি ফিরে গেল সদর দপ্তরে। পুঞ্চের ছাউনিতে শরণার্থীরা হতাশচিত্তে ফেলল দীর্ঘ নিঃশ্বাস। পাহাড়ের উপরে হানাদারদের ঘাঁটিতে উঠল হর্ষধফধ্বনি। মেহের সিং-এর মাথায় ফন্দি খেলে অনেক। সন্ধ্যেবেলা তার বাছাবাছা পাইলটদের ডেকে বললেন, “বন্ধুগণ, যে কাজ শুধু বলে হয় না, সে কাজ হয় কৌশলে। শত্রুর চোখে ধুলো দিয়ে কাজ হাসিল করতে হবে আমাদের।” তিনি খুলে বলেন তাঁর মতলব। শুনে পাইলটরা সবাই মহাখুশি। তারা বয়সে তরুণ, নতুনত্বের নামে মেতে ওঠে, বিপদের ঝুঁকিতে হয় আরও বেশী বেপরোয়া। পুঞ্চে সন্ধ্যা হয়েছে অনেকক্ষণ। শুক্লপক্ষের পঞ্চমীর আধখানা চাঁদ উঠেছে আকাশে। আধেক আলো, আধেক ছায়া আবছা কুয়াশার মতো ঘিরে রয়েছে দূরে শালবনের সারি আর শালিধানের
পৃষ্ঠা:২২
ক্ষেত। জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে লেগেছে নিঝুম নীরবতার রেশ, ঘুম জড়িয়ে এসেছে বুঝি বনলক্ষ্মীর স্নিগ্ধ আনত দুটি নয়নের শ্যামল আখিপল্লবে।অকস্মাৎ সেই নিস্তব্ধতার বুক চিরে ভেসে এল মেঘ গর্জন। না, মেঘ নয়, বিমান। ভারতীয় বিমানবাহিনীর খান কুড়ি বিমান এসে পৌঁছল পুঞ্চের আকাশে। তার প্রথমটিতে পাইলট স্বয়ং মেহের সিং। হানাদারদের গোলন্দাজরা তাড়াতাড়ি গোলাবারুদ বোঝাই করল কামানে। কিন্তু এ কী? বিমানগুলি কেবলই চক্রাকারে ঘুরছে আকাশে। মাটিতে নামছে না তো। হানাদারেরা ভেবে পায় না এর অর্থ। স্পষ্ট দেখা যায় না সবগুলি, গুণে বোঝা যায় না তাদের সংখ্যা। এই দেখা-অদেখা আর বোঝা-না-বোঝার সুযোগে আধা-আলো আধা-অন্ধকারের আড়ালে হঠাৎ হুশ করে নেমে পড়ল একখানা ডাকোটা। প্রিতম সিং-এর লোকেরা আগেই তৈরী হয়ে ছিল বিমানঘাটির ভিতরে। তারা চক্ষের পলকে হাতে হাতে নামিয়ে ফেলল বিমান থেকে মাল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই বিমানটি আকাশে উড়ে গিয়ে চক্রাকারে ঘুরতে লাগল অন্যান্য বিমানগুলির সঙ্গে। বাকী বিমানগুলির ঘোরা-ফেরা আর পাখার গর্জনে দূর থেকে ব্যাপারটা কারো চোখে পড়ল না। এক, দুই, তিন। একে একে ডাকোটাগুলি নামল মাটিতে। একে একে সাজ-সরঞ্জাম খালাস করে দিল শত্রুর অলক্ষে। একে একে ঝাঁকেব পাখির মতো আবার উড়ে মিশে গেল দলে। আধ ঘন্টার মধ্যে তাঁর বিমান বাহিনী নিয়ে মেহেব সিং বিজয গর্বে ফিরে গেলেন তাঁর সদর আস্তানায়। পাহাড়ের উপর হানাদারেরাও মহাখুশি। হিন্দুস্তানের হাওযাই জাহাজগুলি নামতেই সাহস করল না পুঞ্চে। কাফেরগুলি ভয় পেয়েছে খুব। বিলকুল ডরকে মারে ভাগ গয়া, হাঃ হাঃ হাঃ। তাদের হাসি অবশ্য বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। পরদিন ভোর হতে না হতেই শুরু হলো পূঞ্চের ছাউনি থেকে পঁচিশ পাউন্ডারের গোলা বর্ষণ। যেমন তার পাল্লা, তেমন তার আওয়াজ, আর তেমনি তার তেজ। হানাদারেরা তখন কামান বন্দুক সাজ-সরঞ্জাম ফেলে প্রাণ নিয়ে পালাবার পথ পায় না।
এগারো
পুঞ্চ রক্ষা পেল, কিন্তু উদ্ধার হলো না। দুর্গ শক্ত হলো, মুক্ত হলো না। হানাদারেরা আগের ভাগেই দখল করে বসেছিল নৌশেরাও তার আশেপাশের গ্রাম। ঘাঁটি করেছিল পাহাড়ের মাথায়। সেগুলি পুঞ্চের সেতুমুখ। সেখান থেকে তাদের হটাতে না পারলে পুঞ্চ উদ্ধার করা কঠিন। কঠিন কাজের জন্য চাই কঠিন পণ। সেই পণ ছিল ব্রিগেডিয়র ওসমানের। পঞ্চাশ নম্বর প্যারা ব্রিগেডের অধিনায়ক হয়ে তিনি এসেছিলেন ঝানগড়ে। সেটা নৌশেরারই কাছাকাছি। হানাদারেরা সেখানে মর্টার ও মেশিনগান নিয়ে আক্রমণ করেছে প্রবল বেগে। ভারতীয় সৈন্যরা তাঁদের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারছে না। উত্তর প্রদেশের আজমগড় জেলায় ওসমানের পৈতৃক বাস। বেনারসে হরিশ্চন্দ্র কলেজ থেকে ম্যাট্রিক ও এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি-এ পাশ করে যান বিলাতে। যুদ্ধবিদ্যা শিখতে। স্যান্ডহার্স্টের তিনিই শেষ ভারতীয় শিক্ষার্থী। অতি তরুণ বয়সেই ওসমানের স্বভাবে ছিল অস্বাভাবিক দৃঢ়তা। এক জাতীয় লোহা আছে যা’ ভাঙা যায় কিন্তু বাকানো যায় না। তার সঙ্গে বুঝি ওসমানের মিল ছিল। আর ছিল তাঁর দেশাত্মবোধ। সজাগ এবং সুতীক্ষ্ম। সাম্প্রদায়িকতাবাদী এক মুসলমান নেতা বিলাতে এক ভোজ- সভায় বসেছিলেন ওসমানের ঠিক ডাইনে। নাম শুনে অত্যন্ত অন্তরঙ্গতার সুরে বললেন, “ও, আপনি জাতিতে মুসলমান। আমিও তাই। বড়ই সুখের”
পৃষ্ঠা:২৩
বাধা দিয়ে ওসমান বললেন, “আমি জাতিতে ভারতীয়। হ্যাঁ, ধর্মের কথা যদি জিজ্ঞাসা করেন তো বলবো, ইসলাম।” নেতা সাহেবের মুখের আধখানা কথা রইল মুখে। সমুখের প্লেটে খাবারও আর তেমন রুচিকর বোধ হলো না। ভারত বিভাগের সময় ওসমান ছিলেন পশ্চিম পাঞ্জাবের মূলতানে। সাম্প্রদায়িক নৃশংসতার বহু দৃশ্য দেখেছিলেন স্বচক্ষে। বহু বিপন্ন শিখ ও হিন্দুকে রক্ষা করেছেন স্বহস্তে। বুঝি তারই প্রভাব পড়েছিল তাঁর পরবর্তী জীবনে। গান্ধী-হত্যার পরদিন থেকে ওসমান মাছ-মাংস ছেড়ে দিয়ে হয়েছিলেন নিরামিষাশী। ব্রিগেডিয়র ওসমান যে-দিন ঝানগড়ে সৈন্যদলের অধিনায়ক হয়ে এলেন, তার দু’দিন পরেই ঘটল ভারতীয় বাহিনীর পরাজয়। তাদের পিছনে হটে আসতে হলো কয়েক মাইল। অন্য কেউ হয় তো মুষড়ে পড়তো এই প্রাথমিক বিফলতায়। ওসমানের বাড়ল জেদ। ভবিষ্যতে পাল্টা আক্রমণের উদ্যোগ আয়োজন করতে লাগলেন। কঠোর পরিশ্রমে ভরে তুললেন গোলাগুলি আর বসদের ভাণ্ডার। গড়ে তুললেন স্থানীয় বালকদের নিয়ে এক অসামরিক স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। নিখুঁত করলেন খবর আনা-নেওয়ার সিগন্যালিং ব্যবস্থা। নিজ সহকর্মী ও সেনাবাহিনীকে দিলেন আশা ও আশ্বাস। তাদের মনে জাগিয়ে তুললেন প্রত্যয় ও প্রতিজ্ঞা।প্রথমে ওসমান হানাদারদের হাত থেকে কেড়ে নিলেন কোর্ট। সামান্য একটি পাহাড়ী গ্রাম। কিন্তু অসামান্য তার সামবিক গুরুত্ব। নৌশেরা, ঝানগড, বাজৌরী ও পুঞ্চের সড়কগুলি মিলেছে এসে ঐখানে। কোর্টের পরেই দখল করলে, নৌশেবা।হানাদারদের সদর ঘাঁটিতে সবাই প্রমাদ গণল। বড় কর্তারা চটে মটে কোটের সর্দারকে করলেন বরখাস্ত, নৌশেবার সেনাপতিকে কবলেন কয়েদ। নতুন অধিনায়কের অধীনে হাজার হাজার সৈন্য-সামন্ত দিয়ে পাঠালেন যুদ্ধে। হুকুম করলো, আবার দখল করা চাই হারানো এলাকাগুলি। যে হেরে পালিয়ে আসবে তার যাবে গদনি। হয় নৌশেরা, নয় তো শির। মরীয়া হয়ে হানাদারেরা নিশুতি রাতে আক্রমণ কবল নৌশেবা। দক্ষিণ, পূব আর উত্তর-তিন দিক থেকে তিন তিনটে বাহিনী। সব মিলিয়ে প্রায় হাজাব পনেরো হানাদার। সঙ্গে তাদের বিলাতী রাইফেল, মাঝারি ও হাল্কা মেশিনগান, মটার ও গ্রেনেড। আধুনিক সামরিক পদ্ধতিতে আক্রমণের রকম দেখে বুঝতে কষ্ট হয় না, যুদ্ধের আসল পরিচালক কারা, কারা আছে কাশ্মীর হামলার পিছনে। প্যারা ব্রিগেডের সৈন্যদল বিপুল বিক্রমে বাধা দিল এই বিশাল শত্রুতরঙ্গ। হানাদারদের লক্ষ্য, যে কবেই হোক আবার দখল করবে নৌশেরা। ভারতীয় বাহিনীর পণ, যে করেই হোক বক্ষা করবে নৌশেরা। কাশ্মীবের সংঘর্ষে এমন কঠোব ও এমন ভীষণ যুদ্ধ আর ঘটেনি। দু’ দলই করেছে জান কবুল। যেন দংশনক্ষত শ্যেন বিহঙ্গ যুঝে ভুজঙ্গ সনে। ব্রিগেডিয়র ওসমান নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে নিজের সেনাদলকে দিতে লাগলেন নির্দেশ। যেখানে দেখেন বিপদের একটুখানি আভাস, সেখানেই যান তিনি। রাত শেষ হলো। যুদ্ধ শেষ হলো না। কাটল দুপুর। তবু যুদ্ধের বিরাম নেই। বেলা গড়িয়ে গিয়ে অপরাহ্ণের ক্লান্ত সূর্য নামলো পটে। তখনও চললো হানাহানি। হানাদারদের শক্তি শৌর্যে নয সংখ্যায়। একজনকে নিকাশ করলে থাকে আরও এগারো জন। এই সংখ্যার জোরেই তারা ভারতীয় বাহিনীকে করল বিপন্ন। পঞ্চাশ গজের মধ্যে এগিয়ে এল। ক্রমশঃ কাছে। কাছের চাইতেও কাছে। আরও বেশী কাছে। ব্রিগেডিয়র ওসমান গোড়াতেই বুঝেছিলেন, শত্রুসংখ্যা অগুণতি। তাঁর নিজের বাহিনীর চতুর্গুণ। তিনি সাহায্য চেয়ে পাঠিয়েছিলেন পিছনের ঘাঁটিতে। তিনি যুদ্ধ পরিচালনা করেন আয় মুহূর্ত গোণেন। কতক্ষণে এসে পৌঁছবে নতুন সৈন্যদল? ততক্ষণ যুঝতে পারবে তো তাঁর নিজের বাহিনী? রুখতে পারবে তো দুশমনকে। বারে বারে ঘড়ি দেখছেন ওসমান। ঘড়ির কাঁটার সঙ্গেই পাল্লা তাঁর আর তাঁর সেনাবাহিনীর।
পৃষ্ঠা:২৪
কাঁটা যত এগিয়ে যাচ্ছে তত বাড়ছে আশঙ্কা, তত কমছে জয়লাভের আশ্বাস। অবশেষে শত্রুসৈন্য এসে পড়ল আরও নিকটে। একেবারে ঘাড়ের উপরে। ওসমান অধীর হয়ে তাকাচ্ছেন ডাইনে, ‘বাঁয়ে, পিছনে। সৈন্য, আরও সৈনা চাই এই মুহূর্তে। কিন্তু কোথায় পাবেন সৈন্য? দেখলেন ছাউনির কারখানা ঘরে এঞ্জিনীয়রেরা করছে যন্ত্রপাতি মেরামত। হাক দিয়ে বললেন ব্রিগেড়িয়র, “যেখানে যে আছো বন্দুক নিয়ে চলে এসো সমুখের সারিতে। কোনোমতে ঠেকিয়ে রাখ শত্রুকে।” যাঁরা এস্ক্রিনীয়র ছিলেন তাঁরা হাতুড়ি ফেলে হাতে তুলে নিলেন হাতিয়ার, সরবরাহ বিভাগের কর্মীদের কাজ রসদ যোগানো। তারা থাকে আসল যুদ্ধক্ষেত্রের অনেক পিছনে। তাঁদেরও নামতে হলো যুদ্ধে। ব্রিগেডিয়র ঘূর্ণির মতো ঘুরছেন তাঁবুতে তাঁবুতে। যাকে সামনে পান তাকেই যুদ্ধে পাঠান। “তুমি কে? রাঁধুনি। এখন রান্না থাক পড়ে। লড়াই কর। তুমি। মশালচি। কৃচ পরোয়া নেই, হানাদারদের রোখো।” যে লোকটা চিরকাল হিসাবের খাতা লেখে, খড়ি রেখে খাড়া ধরতে হলো তাকেও। “সৎ স্ত্রী আকাল।” পিছন থেকে শোনা গেল বহু কণ্ঠে শিখদের রণ-হুঙ্কার। নূতন সৈনাদল এসে পৌঁছেছে এতক্ষণে। ইস, আর একটুখানি, বুঝি পাঁচ মিনিট দেরি হলেই শেষ হয়ে যেত সব। নির্মূল হয়ে যেত ওসমানের সৈন্যদল। ফাঁড়া কেটে গেল যেন। যেন প্রায় কানের উপব দিয়ে গেল কোপ। নতুন সৈন্যদলের সঙ্গে সঙ্গেই এল ভারতীয় বিমান বাহিনীর খানকয়েক বোমারু বিমান। মাটিতে শিখ-সৈন্যের আক্রমণ আর আকাশে বোমারু বিমানের গুলিবর্ষণ। এ দু’ এর সামনে। হানাদারেরা টিকে থাকবে কতক্ষণ? সহস্র সহস্র হানাদারদের মৃতদেহ পড়ে রইল মাঠে, পথে, পাহাড়ের গায়ে, যেখানে দেখানে। ভারতীয় সৈন্যদের জয়ধ্বনিতে ক্ষণে ক্ষণে সচকিত হলো দূর ও নিকটের গিরিকন্দব। নৌশেরার যুদ্ধ হলো সারা। যে-পথ দিয়ে শত্রু এসেছিল, সে-পথ দিয়ে ফিরল নাকো তারা। শুরু হলো নতুন অভিযান। নৌশেরা থেকে ঝানগড়। পথে পড়ল গায়কোর্টের বন। শত্রুর চক্ষু এড়াতে ভারতীয বাহিনীকে এগোতে হলো অতি সাবধানে। ঝোপ জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে। কখনও দৌড়ে, কখনও হেঁটে, কখনও হামাগুড়ি দিয়ে, কখনও বা কেবল বুকে চলে। সৈন্যদল নিয়ে ওসমান পৌঁছলেন পৃথল পাহাড়ের সানুতে। শিকার-সন্ধানী নেকড়ে বাঘের মতো গোপনে। নিঃশব্দ পদসঞ্চারে। সবাই লুকিয়ে রইলেন বড় গাছের আড়ালে আবডালে। হানাদারেরা অনেক দিন থেকেই ঘাঁটি গড়েছিল এই পাহাড়ে। উঁচু চূড়ার উপর বসিয়েছিল হাল্কা ও মাঝারি মেশিনগান। কাঁটা তারের বেড়া দিয়ে ঘিরেছিল চার পাশ। যেখান দিয়ে পাহাড়ের ওঠার পথ, সেখানে ছিল সঙ্গীনধারী কড়া পাহারা। পশ্চিমে আকাশে প্রদোষের ক্ষীণ আলো যখন গেল মিলিয়ে, শিশু গাছের মাথায় নামলো প্রথম অন্ধকার, শেয়ালকাটার বনে ঝিঝি পোকারা সমস্বরে ধরলো তান, তখন আচম্বিতে একজন ভারতীয় সেপাই একটা গাছের ডাল থেকে লাফিয়ে পড়ল প্রথম পাহারাওয়ালার ঘাড়ে। শক্ত মুঠিতে গলা টিপে নিমেষে সাবাড় করলো তাকে। টুশব্দটি করার অবকাশ পেলে না বেচারা। দ্বিতীয় প্রহরী ছিল খানিকটা দূরে। আর একজন সৈন্য গুটিগুটি এসে তাকে পিছন থেকে পিঠে বসিয়ে দিল ঝকঝকে ধারালো ছুরি। সামান্য একটু গোঙানি শব্দ শোনা গেল। তার পরেই সব নীরব, নিশ্চল। আল্লার নাম নেওয়ারও সময় মিললো না হতভাগার। বাকী সৈনারা সব তখন আড়াল থেকে বেরিয়ে এল সামনে। যেন আলামিনের প্রদীপ ঘর্ষণে পাষাণের বুক চিরে দেখা দিল দৈত্যদল। হানাদারেরা এমন অকস্মাৎ আক্রমণের জন্যে মোটেই তৈরী ছিল না। কিছুক্ষণ বাধা দিয়েই দেখালো পিঠ। ভারতীয় বাহিনী ঘাঁটি দখল করে দেখে, অস্ত্রশস্ত্রের তো কথাই নেই, জামা, জুতো ফেলে গিয়েছে অনেকে। রসুই ঘরে পড়ে আছে নিস্তা দিস্তা গরম চাপাটি, গামলা-ভরা সুরুয়া আর
পৃষ্ঠা:২৫
ডেকচি-জরা বকরীর গোস্ত। আহা রে। বাছারা পালাবার তাড়ায় খাবারগুলি মুখে দেওয়ার সময় পায়নি এতটুকু। ঝানগড়ের ঝান্ডাচকে আবার উঠতে লাগল ভারতীয় নিশান। গ্যাসের আলো জ্বেলে সেই রাত্রিতে সেখানে হলো সমুদয় বাহিনীর পংক্তি ভোজন। নাচ, গান, হৈ-হল্লা-বিজয়ের আনন্দোৎসব। ঠিক দু’মাস পঁচিল দিন পরে ব্রিগেডিয়র ওসমানের ঘরে প্রথম বিছানা হলো খাটিয়ার উপরে। রাজপুত প্রতাপ সিং-এর মতো তিনিও প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যতদিন ঝানগড় উদ্ধার না হবে শত্রুর হাত থেকে, ততদিন ঘুমোবেন মেঝেতে। নৌশেরা ও ঝানগড় যেন দেউড়ির দুই গম্বুজ, দরজার দুই পার্টি। হাতছাড়া হওয়ায় প্রতিপক্ষ পড়ল বিপাকে। পাকিস্তান থেকে রসদ, অস্ত্র শাস্ত্র ও সৈন্য সরবরাহের রাস্তাগুলি পড়ল ভারতীয় কামানের পাল্লায়। হলো ভারতীয় গোলন্দাজদের সহজ নিশানা। রঙের টেক্কার মতো ঝানগড়ের ছাউনি যার হাতে, তারই হবে জিৎ। তাই দূর থেকে হানাদারেরা মাঝে মাঝে বোমাবর্ষণ করতে লাগল ঝানগড়ের উপরে। জুলাই মাসের আরস্ত। সেদিন চার তারিখ। রাত্রিবেলা কানগড়ে শুরু হলো শত্রুর বোমাবৃষ্টি। পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ, ঈশান, অগ্নি, নৈঋত কোনো দিকেই রইল না ফাঁক। দুম, দাম, দড়াম। মুহুর্মুহুঃ বোমা পড়তে লাগল ভারতীয় ছাউনির উপর। কালীপূজার রাত্রিতে শতশত উড়ন তুবডি আর হাউই বাক্তির মতো আকাশের বুকে খেলছে শুধু আগুনের হস্তা। সকল সঙ্কটে নিজ সৈন্যের পাশে এসে দাঁড়ান ব্রিগেডিয়র ওসমান। সেদিনও সেই অগ্নিবৃষ্টির মধ্যে তিনি আসা যাওয়া করেছিলেন এক বাস্কার থেকে অন্য বাকারে। খোঁজ খবর নিচ্ছিলেন সবাকার। এমন সময় একটা বোমা ফেটে পড়ল তাঁর সামনে। একেবারে গায়ে বললেই হয়। ছাউনীর ডাক্তার ও শুশ্রুষাকারীর দল করল-প্রাণপণ চেষ্টা। কিন্তু তারা তো ওষুধ দিতে পারেন। প্রাণ দিতে পারেন না। রাত্রিশেষে আকাশের তারাগুলি যখন একে একে গেল নিবে, চাঁদ ঢাকা পড়ল পাহাড়ের আড়ালে, তখন ভোরের স্নিগ্ধ মৃদু বাতাসে মিশে গেল ব্রিগেডিয়র-ওসমানের শেষ নিঃশ্বাস। ঝানগড়ের ছাউনিতে কঠিন সৈনিকেরও চোখ হলো ছলোছল। খবর পেয়ে পাকিস্তানে উঠল আনন্দরোল। পেশোয়ারে হানাদারদের শিবিরে হলো দীপালী। পুষ্পস্তবকে সাজিয়ে বীরের মৃতদেহ বিমানযোগে নিয়ে আসা হলো নয়া দিল্লীতে। সেখানে হিন্দু, শিখ, খ্রীস্টান, পারসিক ও মুসলমানেরা শ্রদ্ধাভরে ফুল ছড়িয়ে দিল শবাধারে। জাতীয় পতাকায় ঢেকে কামানের গাড়িতে হলো পূর্ণ সামরিক সম্মানে শবযাত্রা। শবানুগমন করলেন স্থল, নৌ ও বিমানবাহিনীর তিন সর্বাধিক্ষ্য ও অন্যান্য সেনানায়ক, মন্ত্রিসভার সমুদয় সদস্য ও প্রধানমন্ত্রী নেহরু। পথের দু’ধারে নতমস্তকে দাঁড়িয়ে বইল সকল সম্প্রদায়ের সহস্র সহস্র নরনারী। স্বাধীন ভারতে এর আগে গান্ধীজির শবযারা ছাড়া আর কারো মৃত্যুতে সিল্লীতে পড়েনি এমন সর্বজনীন বিষাদের ছায়া। ঘটেনি এমন বাষ্ট্রীয় শ্রদ্ধানিবেদন।
বারো
ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল ভারতীয় বাহিনীর জয়রথ। তার ঢাকার তলায় পিষে চূর্ণ বিচূর্ণ হলো হানাদারদের অভিলাষ, পাকিস্তানের সাধ এবং ষড়যন্ত্র। মুক্ত হলো কাশ্মীর উপত্যকা ও জম্মুর বহু শত্রুকবলিত অঞ্চল। গায়ের জোরে কাশ্মীর দখলের পরিকল্পনা হলো বিফল। শ্রীনগরের রাজভবনে পাকিস্তানী নিশান তোলার স্বপ্ন আর সফল হলো না। ক্রমে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এল কাশ্মীরে। ব্যবসা-বাণিজ্য আবার চলতে লাগল হাটে বাজারে। আগের মতো স্কুল-কলেজে বসলো ক্লাশ, আপিস আদালতে শুরু হলো কাজকর্ম। ধীরে, ধীরে আসতে লাগ’ল বাইরে থেকে দেশ-ভ্রমণকারীর দল। গুলমার্গের গালিচার মতো নরম সবুজ ঘাসের চত্বরে দেখা দিল ক্যাডির কাঁবে গলফের ব্যাগ চাপিয়ে পুরু টুইডের গ্লাস-ফোর্স-পরা গ্রৌঢ়ের দল। বরফ-জমা পাহাড়ের গা বেয়ে ‘শী’ করার উদ্দেশ্যে টাট্টু ঘোড়ার পিঠে চেপে
পৃষ্ঠা:২৬
খিলনমার্গের পথে রওনা হলো দুঃসাহসী তরুণ-তরুণীরা। ঝিলমের বুকে হাউসবোটগুলির বন্ধ ঝাঁপি খুলতে লাগল একে একে। শিকারায় কাঠের কারুকাজ, কাগজমণ্ডের সৌখীন কৌটা, আর বুটিদার শালের সওদা সাজিয়ে ফিরিওয়ালার দল ফিরতে লাগল বিদেশী যাত্রীদের দুয়ারে দুয়ারে। রাজধানীর বিপদ কাটল। কিন্তু রাজার দিন ফুরিয়ে এল রাজত্বের। মহারাজা হরি সিং-এর সিংহাসনে পড়ল টান।
তেরো
রূপকথার রাজপুত্র রাজা হয়, মন্ত্রীপুত্র-সচিব, সওদাগরের ছেলে সপ্ত ডিভায সওদা সাজিযে সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে যায় বাণিজ্যে। কাশ্মীরের অধিপতি হরি সিং কিন্তু রাজার পুত্র নয়, ভ্রাতুষ্পুত্র। বুড়ো মহাবাজ প্রতাপ সিং ছিলেন হরি সিং-এর জ্যাঠামশাই। নিজের ছেলে ছিল না। ভাইপোকে তিনি রাজত্ব দিয়ে গেলেন মরার পূর্ব মুহূর্তে। অনেকেই অবাক হয়েছিল। অবাক হওয়ারই কথা। হরি সিং-এর বাপ অমর সিং ছিলেন মহাবাজ প্রতাপ সিং-এর আপন সহোদর। শৈশবে এক মায়ের বুকের দুধ খেয়েছেন, একসঙ্গে করেছেন খেলা, সন্ধ্যাবেলায় একই আইমার কাছে ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমীর গল্প শুনে ঘুমিয়ে পড়েছেন পাশাপাশি পালঙ্কে। কৈশোরে এক শিক্ষকের কাছে নিয়েছেন পাঠ, যৌবনে একত্র গিয়েছেন মৃগয়ায়। কিন্তু বড় হয়ে তিনিই হলেন বৈরী। সিংহাসনের লোভে ভাই-এর বিরুদ্ধে দাঁড়াল ভাই। প্রতাপ সিংকে সবিয়ে নিজে রাজা হওয়ার চক্রান্ত করলেন অমর সিং। সে-কাহিনী জানতে হলে তাকাতে হবে অনেক পিছনে, একবার চোখ বুলিয়ে নিতে হবে পুরানো ইতিহাসের হুলো-জমা পাতায। সে প্রায় একশ বছর আগের কথা। পাঞ্জাবকেশরী বণজিৎ সিং তখন শিখ সাম্রাজ্যের অধীশ্বর। তার সৈন্যদলে ছিল এক তরুণ সেনানায়ক। ডোগরা রাজপুত গোলাব সিং। যেমন বীর তেমনি চতুর। খুশি হয়ে মহারাজ রণজিৎ সিং তাঁকে দান করলেন জন্ম প্রদেশ। সেনাপতি গোলাব সিং হলেন রাজা গোলাব সিং। ধীরে ধীরে বাড়তে আগল জম্মু রাজ্যের সীমানা। গোলাব সিং যোগ করলেন বালটিস্থান, জয় করলেন লাডাক। তাঁর তলোয়ার আর বুদ্ধি, দুই-ই সমান ধারালো। তাব বুঝতে দেবি হলো না যে, মোগলরাজ্যের দিন ফুরিয়েছে, আশা নেই শিখ সাম্রাজ্যের, ভবিষ্যৎ ভারতবর্ষের একচ্ছত্র অধিপতি হবে ইংরেজ। ততদিনে রণজিৎ সিং-এব মৃত্যু ঘটেছে লাহোরে। উদ্যোগী পুরুষকে সুযোগ দেন লক্ষ্মী, বুদ্ধিমানেরই সহায় হয় ভাগ্য। সীমান্ত যুদ্ধে বিরত হয়ে ইংরেজ সাহায্য চাইল গোলাব সিং-এর কাছে। রাজা ইংরেজ সৈন্যদলকে অকাতবে দিলেন অর্থ, দিলেন আহার, দিলেন আশ্রয়। চার বছর পর ইংরেজ শিখ সৈন্য পরাজিত করে লাহোর দখল করল। অমৃতসরের সন্ধিসূত্রে দু’কোটি টাকা দিয়ে রাজা গোলাব সিং পেলেন জম্মুর পাশাপাশি সমুদয় পাহাড়ী এলাকা। তার সীমানা সিন্ধু নদের পূব দিক থেকে রাবি নদীর পশ্চিম তীর অবধি বিস্তৃত। তার মধ্যে আছে কাশ্মীর আর গিলগিট। গোলাব সিং নতুন রাজ্যের অধিকার পেলেন কিন্তু দখল পেলেন না। কাশ্মীরের শাসনকর্তা শেখ ইমামুদ্দিন কাউকে কাছেই ঘেঁষতে দেয় না। অবশেষে জম্মু থেকে রওনা হলো সৈনাদল। যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে ইমামুদ্দিন মানল হার। কাশ্মীরের সিংহাসনে বসলেন মহারাজা গোলাব সিং। গোলাব সিং-এর মৃত্যুর পরে রাজা হলেন তাঁর পুত্র রণবীর সিং। বাপের ধারা বজায় রাখল ছেলে। বহুভাবে সাহায্য করলেন ইংরেজকে। সিপাহী বিদ্রোহের সময় সৈন্য পাঠিয়ে রক্ষা করলেন অনেক ইংরেজ প্রাণ। কিন্তু দুদিনের বন্ধুকে সুদিনে মনে রাখা ইংরেজের স্বভাব নয়। বিপদ কেটে যেতেই ইংরেজ স্কুলে গেল ভোগরা রাজবংশের উপকার। ততদিনে বড়লাট ও অন্যান্য ইংরেজ বড়কর্তারা জানতে পেরেছেন কাশ্মীরের সামরিক গুরুত্ব। বুঝেছেন, আফগান ও চীন এবং জারের রাশিয়াকে রুখতে
পৃষ্ঠা:২৭
হলে গিলগিটে রাখা চাই ইংরেজ খাঁটি। কাশ্মীর হাতছাড়া করে নিজের হাতে নিজেদের স্বার্থ হানি করেছেন, একথা ভেবে তাঁদের আপসোসের আর শেষ রইল না। তখন শুরু হল নানা কূটকৌশল। নানা ছলে ইংরেজ কর্তৃত্ব বহাল করতে চাইল কাশ্মীরে। রণবীর সিং-এর বড় ছেলে প্রতাপ সিং নেহাতই নিরীহ মানুষ। রাজা হয়েও জপ, তপ, পুজো-অর্চনা নিয়েই সময় কাটান বেশী। সুযোগ পেয়ে ইংরেজ কাশ্মীরে বসালেন এক রেসিডেন্সী, মানে-নিজেদের এক খবরদারি-আপিস। তার কর্তা হয়ে এলেন স্যার অলিভার সেন্ট জন-কাশ্মীরের প্রথম রেসিডেন্ট। কথামালার উট জানতো, জানালা দিয়ে একবার নাক গলাতে পারলে আস্তে আস্তে গোটা ঘরটা দখল করতে দেরি হয় না। সে কৌশল ইংরেজ রেসিডেন্টের অজানা ছিল না। বিশেষ করে বেসিডেন্ট প্লৌডেন লোকটা ছিল যেমন খল, তেমনি ধড়িবাজ। সে মহারাজের দরবারের কাউকে দেখাল লোভ, কাউকে দেখাল ভয়। দু’হাতে ঘুষ দিয়ে একে একে হাত করল কর্মচারীদের অনেককে। মহারাজার রাজস্বমন্ত্রী গোপনে যোগ দিল প্লৌডেনের দলে। একদিন সকালবেলা মহারাজ প্রতাপ সিং আহ্নিকে বসেছেন। এমন সময় ছোট ভাই অমর সিং এসে বললেন, “দাদা, বাইরে এস। জরুরী কথা আছে।” পুজোর আসনে বসে কথা বলা চলে না। মহারাজ ইসারা করে বোঝালেন, আহ্নিক শেষ হতে তখনও কিছু বাকি। অমর সিং চড়া মেজাজে বললেন, “নিকুচি করেছে তোমার আহ্নিক। পারো তো, আগে রাজা সামলাও, পরে করো পুজো-পার্বণ। নিজের মাথা ধাঁচাতে পারলে ঠাকুর দেবতার মাথায় গঙ্গাজল ঢেলো ঘটি ঘটি।” মহারাজ ব্যস্ত হয়ে ঠাকুর দালানের ভিতর থেকে বেরিষে এলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, “ব্যাপার কী?” অমব সিং বললেন, “এখানে নয়। চল শোবার ঘবে। সাবধানে সমস্ত দোব জানলা বন্ধ করে চুপি চুপি অমর সিং দিলেন সংবাদ। নিদারুণ দুঃসংবাদ। ইংরেজ রেসিডেন্টের হাতে ধরা পড়েছে অনেকগুলি গুপ্ত চিঠি। সমস্তই মহারাজ প্রতাপ সিং-এর নিজের হাতে লেখা। বাশিয়ার সঙ্গে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছেন তিনি। রেসিডেন্ট প্লৌডেনকেও গোপনে হত্যা করার চেষ্টায় আছেন মহারাজ।শুনে মহাবাজের দুই চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। বললেন, “এ শুধু মিথ্যে অপবাদ দিয়ে আমাকে বাজ্যচ্যুত কবার চক্রান্ত।” অমর সিং বললেন, ‘চক্রান্ত?” মহাবাজ বললেন, “হ্যা, তাই, আর সে চক্রান্তে আছ তুমি। ছোট ভাই-র দুই হাত ধরে মহাবাজ কাতবভাবে অনুনয় করলেন, “ভাই তুমি কাশ্মীরেব গদিতে বসতে চাও, আমি জানি। কিন্তু এমন অধর্ম ভগবান সইবেন না, এমন কাজ করো না।” অমব সিং আমতা আমতা করে বললেন, “আমি-ইযে-চক্রান্ত-সে কি কথ্য-মানে- ঠাব মুখে আব কথা যোগাল না। তাড়াতাড়ি সবে পড়লেন মহারাজার সুমুখ থেকে। মহাবা: এব বুঝতে বাকী বইলো না যে, বেসিডেন্ট গ্লোডেন ও ভাই অমর সিং মিলে তার চারদিক থেকে জাল পেতেছে বিষম ফাঁদ। কিন্তু কি করে পরিত্রাণ পাবেন ভেবে না ।পেয়ে ফাঁদে আটকে-পড়া শিকাবের মতোই তিনি অসহায়ভাবে শুধু ছটফট করতে লাগলেন। অবশেষে মহাবাগীকে বললেন, নিজের ভাই যখন শত্রু হযেছে তাব, তখন পবিত্রাণের চেষ্টায় আব কী ফল অদৃষ্টে যা আছে তাই হোক। সেদিন থেকে অগ্র চুল আাগ করলেন প্রতাপ সি বেসিডেন্ট তৈবা করল এক ‘ইবসাদ’। এতে লেখা, মহারাজ প্রঃপ সিঃ স্বেচ্ছায় সিংহাসন আাগ করছেন। বাহন সুশাসনের জন্য ৩০৫৩ সন্ত্রনমেন্ট যেন ব্যবস্থা করেন অবিলম্বে মহাবাজ প্রথমে অস্বীকার করলেন সেই ‘চ’২০০ সাতকিন্তু অমন সিং ভয় দেখাতে লেন অবিরত। বেশষকালে তিন দিন উপবাসে ক্লান্ত আদর দেহে নিরুপায় প্রতাপ সিং দিলেন
পৃষ্ঠা:২৮
দস্তখত। নিজ হাতে স্বাক্ষর করলেন নিজের বরখাস্ত পরোয়ানায়।রাজ্য শাসনের ভার নিল এক নতুন মন্ত্রণা পরিষদ। সে পরিষদের সভাপতি হিসাবে তার প্রকাশ্য প্রধান হলেন রাজা অমর সিং। অপ্রকাশ্য কর্তা রইলেন অবশ্য রেসিডেন্ট প্লৌড়েন। গিলগিটে দুর্গ তৈরী হলো ইংরেজের। তাতে কামান, বন্দুক নিয়ে জাঁকিয়ে বসলো ব্রিটিশ রেজিমেন্ট, গোরা সৈন্যদল। নিজের রাজ্যে নিজ রাজপ্রাসাদে এক কোণে প্রায় বন্দী হয়ে রইলেন অক্ষম, অসহায়, গদিচ্যুত মহারাজ। প্রতাপহীন প্রতাপ সিং। নিরাশায় নিরানন্দে, তাঁর দিনগুলি মনে হয় দীর্ঘ। মাসের বুঝি শেষ নেই, বছর যেন সংখ্যাহীন, অনাদি অনন্ত। অবশেষে মরীয়া হয়ে মহারাজ নিজ হাতে এক চিঠি লিখলেন বড়লাট লর্ড ল্যান্সডাউনের কাছে। সে পত্রের ভাষা অনিপুণ, রচনা অপটু, কিন্তু ভাব সরল ও সুস্পষ্ট। তিনি বললেন, রাশিয়াব সঙ্গে ষড়যন্ত্রের কথা আগাগোড়া মিথো। রেসিডেন্ট যে চিঠিগুলি দেখিয়েছেন, সেগুলি সমস্তই জাল। হয় মহারাজকে তার নিজের সিংহাসন ফিরিয়ে দেওয়া হোক, নয় তো বুকের মাঝখানে গুলী করে তাঁকে হত্যা করা হোক। এমন অপমানিত লাঞ্ছিত জীবন, আর তিনি সইতে পারছেন না। হঠাৎ একদিন কলকাতার এক খবরের কাগজে বেরুলো এক সরকারী দলিলের হুবহু নকল। তাতে প্রকাশ হয়ে গেল কাশ্মীরে ইংরেজের কীর্তিকাহিনী, রেসিডেন্ট প্লৌডেনের কারসাজি। পার্লামেন্টে উঠল তরঙ্গ। উদারনৈতিক সদস্য চালর্স ব্র্যাডলো মহারাজের পক্ষ নিলেন। উইলিয়ম ডিগবী ছিলেন সেকালের একজন ন্যায়নিষ্ঠ ইংরেজ। তিনি মহারাজার প্রতি অবিচারের নিন্দা করলেন জোরালো ভাষায়। অগত্যা ভারত সরকার মহারাজকে তাঁর শাসনভার ফিরিয়ে দিলেন। পনেরো বছর পরে আবার কাশ্মীরের সিংহাসনে বসলেন মহারাজ প্রতাপ সিং। তারপরে আরও কুড়ি বছর বেঁচেছিলেন তিনি। তাঁর আগেই অমর সিং মারা গেলেন। যুবক হরি সিং হলেন মহারাজের মন্ত্রিসভার একজন সদস্য। প্রতাপ সিং-এর পাটরাণী বললেন, “পুষ্যিপুত্র নেব আমি। আর যাই হোক, বিশ্বাসঘাতক অমর সিং-এর ছেলেকে বসতে দেব না সিংহাসনে।” প্রতাপ সিং কিন্তু চুপ করে থাকেন। তাঁর মনের কথা কেউ জানতে পায় না। ক্রমে মহারাজের চুলে ধরল পাক, চোখে পড়ল ছানি। বায়ু, পিত্ত, কফ কুপিত হয়ে বাধল বিষ্ণুম ব্যাধি। শয্যা নিলেন তিনি। রাজবৈদ্য এসে নাড়ী দেখেন দুবেলা, চরক ও সুশ্রুতের শ্লোক আউড়ে বড়ি ব্যবস্থা করেন নানা রঙের, ত্রিফলার জল আর মধু দিয়ে মেড়ে খাওয়ানো হয় প্রহরে প্রহরে। বৃথা। মহারাজের রোগের উপশম হয় না। প্রতাপ সিং বুঝলেন, তাঁর অন্তিমকাল আসন্ন। পাত্র মিত্র, সভাসদদের ডাকলেন কাছে। ভ্রাতুস্পুত্র হরি সিং-এর মাথায় হাত রেখে বললেন, “সবাই জেনে রাখো এই আমার উত্তরাধিকারী, জম্মু ও কাশ্মীরের ভাবী অধীশ্বর।” মহারাণী ছিলেন পাশে। তিনি ডুকরে কেঁদে উঠলেন, “হায়, কি করলে মহারাজ? শেষকালে অমর সিং-এর ছেলেকেই দিলে রাজ্যভার।” সে প্রশ্নের জবাব মিললো না। প্রতাপ সিং ততক্ষণে চোখ বুজেছেন। সে চোখ আর খোলেননি। সিংহাসনে বসে মহারাজ হরি সিং প্রথমে মন দিলেন প্রজার কল্যাণে। রাজ্যের বড় চাকরিগুলি যাতে বিদেশাবা না দখল করে সেজন্য করলেন আইন, কর্মচারীরা যাতে কাজে ফাঁকি না দেয় সেদিকে রাখলেন কড়া নজর। গ্রামে গ্রামে ঘুরে স্বচক্ষে দেখতে লাগলেন চাষী মজুরদের অবস্থা। কিলমে বান এলে শিকারা নিয়ে নিজে উদ্ধার করতে লাগলেন বন্যার এলাকা থেকে বিপন্ন নরনারীর দল। বিলাতে গোলটেবিল বৈঠকে বক্তৃতা দিলেন, ভারতবর্ষের শাসন কর্তৃত্ব দেওয়া উচিত ভারতীয়দেবই হাতে। একজন দেশীয় রাজার মুখে এমন কথা এর আগে কেউ কখনও ইংরেজ গভর্নমেন্ট খুঁশি হলেন না। কাশ্মীরে পুরোপুরি ইংরেজ কর্তৃত্ব না থাকায় তাঁরা তুষ্ট
পৃষ্ঠা:২৯
ছিলেন না। এখন রুষ্ট হলেন। কাশ্মীরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করলেন তাঁরা। উপায় ছিল সহরু। কাশ্মীরের প্রজারা অজ্ঞ মুসলমান। তাদের সাম্পরুলয়িক বৃদ্ধি। উস্কে দিতে কতক্ষণ। ওয়েকফিল্ড নামে এক ইংরেজ ছিল মহারাজ হরি সিং-এর মন্ত্রী। তারই মারফতে মুসলমানদের ক্ষেপিয়ে তোলা হলো কাশ্মীর ও জম্মুতে। রাজ্যের বাইরে থেকে সে অসন্তোষের আগুনে যোগান হলো প্রচুর ইন্ধন। মুসলমানদের নির্যাতন করছে হিন্দু মহারাজ আর তার হিন্দু কর্মচারীরা, এই বলে চেঁচাতে লাগল পাঞ্জাবের অর্থর এবং আহম্মদীয়া দলের নামজাদা সাম্প্রদায়িক মুষলমানেরা আর তাদের দলের উর্দু খবরের কাগজগুলি। লাহোরের দৈনিক শিয়াশৎ পত্রিকা খোলাখুলি কাশ্মীরী মুসলমানদের কাছে জানাল আবেদন, আল্লার নামে, শপথ নিয়ে তারা জান কবুল করুক। ইসলামের মান রাখতে তারা কোতল করুক দুশমনদের, সাবাড় করুক বিধর্মী সরকার। পত্রিকার হাজার হাজার সংখ্যা রোজ বিনামূলো হলো বিতরণ শ্রীনগর, সপুব, বিজবিহায়া ও অন্যান্য শহরে। গুপ্তচর পুস্তিকা “কাশ্মীর মজলুস” আর “মকতবি কাশ্মীর” ছড়িয়ে পড়ল হাটে বাজারে, মজলিসে, মসজিদে। সুদুর পাড়াগায়ের মক্তব মাদ্রাসার মুসলীম ছাত্রমহলে। আসতে লাগল অসংখ্য, কখনও ডাকে, কখনও বা হাতে হাতে। যেগুলির ছাপার কালি লাল, লেখার ভাষা হিংস্র। পড়লে নেহাত শান্ত মানুষেরও রক্ত তেতে ওঠে, মাথায় চাপে খুন। রাজ্যের ভিতরে আন্দোলনের নেতা হলেন এক তরুণ শিক্ষিত মুসলমান। তাঁর নাম-শেখ মহম্মদ আবদুল্লা।
চৈদ্দ
কাশ্মীরের এক সাধাবণ গৃহস্থ ঘরে জন্ম হয়েছে শেখ আবদুল্লার। তাঁর বাপ তৈরী করতেন পশমী শাল। মা রান্না করতেন, ঘর নিকোতেন, বিকালে হাটে বেচার জন্যে উদুখলে কুটতেন শালীধানের চিড়া । স্কুলের পাঠ সাঙ্গ হলে আবদুল্লা কলেজে পড়তে যান লাহোরে । সেখান থেকে আলীগড়। ভারতবর্ষে হিন্দু মুসলমান বিরোধের বীজ বুনেছে ইংরেজ। তার জমি তৈরী হয়েছে আলীগড়ে। আলীগড় মুসলীম কলেজের সাহেব অধ্যক্ষ মিস্টার বেক আর থিওডর মরিসন সে মাটিতে যুগিয়েছেন সার ও জল। যত্নে বাড়িয়ে তুলেছেন সাম্প্রদায়িক হিংসার চারা গাছ। সরকারী উৎসাহ আর উস্কানির আলো হাওয়ায় শাখা প্রশাখা মেলে পরে সে হয়ে দাঁড়িয়েছে বিরাট বিষবৃক্ষ। সর্বাঙ্গে তার কাঁটা। সে গাছের ছায়াতে বসে থেকে যে নিয়েছে পাঠ, সেখানকার ঘাসের উপর যে চলেছে পথ, সেখানকার বাতাস থেকে যে নিয়েছে নিঃশ্বাস সে কি হবে সাক্ষাৎ প্রেমাবতার? মরুর দেশে ফুটবে কি নাগকেশরের ফুল। আলীগড়ের ছাত্র শেখ আবদুল্লা যে কাশ্মীরে ফিরে মুসলমানদের ক্ষেপিয়ে তুলবেন হিন্দু বিদ্বেষে তাতে আর আশ্চর্য কী? তিনি প্রথমে ফতেকদলে স্থাপন করলেন এক মুসলীম পাঠাগার। সেখানে রোজ সন্ধ্যায় যে সব তরুণ পড়তে আসত তাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে লাগলেন গভর্নমেন্টের বিরুদ্ধে অসন্তোষ। শ্রীনগরের শাহহামদানের মসজিদে জুম্মার নামাজে বড় জমায়েত হয়। তাতে দিতে লাগলেন উত্তেজক বক্তৃতা। অজ্ঞ মুসলীম জনসাধারণ মোল্লাদের কথায় ওঠে বসে। চতুর আবদুল্লা শ্রীনগরের প্রধান মীরওয়েজ মৌলানা ইউসুফ শাহকে দলে টানলেন। তাঁর ফতোয়া হাতে নিয়েগ্রামে গ্রামে গড়ে তুললেন নিজ সমর্থকের সংঘ। কাশ্মীরের রাজকর্মচারীদের মধ্যেও অনেকে ছিল বুদ্ধিহীন। তাদের হঠকারিতায় মুসলীম জনগণের বিক্ষোভ ক্রমেই বেড়ে চলল। এই সময়ে হরি সিং-এর ঘটল মতিভ্রম। খ্রীস্টানেরা বললেন, ভগবান যাকে মারতে চান, আগে- ভাগে তার বুদ্ধি দেন গুলিয়ে। মহারাজ রাজ্যশাসনের বদলে মাতলেন প্রমোদ ভ্রমণে। রাজকার্য গেল চুলোয়, প্রজাহিত্বের কথা তোলা রইল শিকায়। আজ লন্ডন, কাল প্যারিস, পরশু রিভিয়ারায় কাটে তাঁর দিন। সেখানে তাঁর কীর্তি-কলাপ মাঝে মাঝে প্রায় কেলেঙ্কারির কোঠায় গিয়ে ঠেকে।
পৃষ্ঠা:৩০
বিদেশে বিলাস ব্যসনের সহজ ছিদ্রপথে দ্রুত শূন্য হয়ে আসে রাজকোষের সুবর্ণ ঝারিটি। তলানি সামান্য যেটুকু থাকে সেটুকুও লাগে আমলা গোমস্তার ভোগে। তখন তারা টাকার তাগিদে দরিদ্র প্রজার গলায় ট্যাক্সের ফাঁসে আরও কষে লাগান টান। ফল ফলতেও দেরী হলো না। অতি সামানা ঘটনাকে উপলক্ষ করেই ঘটলো বিপর্যয়। বারুদের স্তূপে একটি ক্ষুদ্র স্ফুলিঙ্গই তো বৃহৎ বিস্ফোরণের পক্ষে যথেষ্ট। ইংরেজী উনিশ শ একত্রিশ সাল। মে মাসের মাঝামাঝি। জম্মুর পুলিশ ব্যারাকে সেদিন একজন মুসলমান পুলিশ কাজে হাজির হয়নি। তার উপরওয়ালা, লাভরাম হিন্দু। কাশ্মীরী পন্ডিত। তিনি এসে দেখেন, লোকটা বিছানায় শুয়ে দিব্যি আরামে ঘুমোচ্ছে। শাসন করতে গেলে সে উল্টে লাভরামকেই গাল-মন্দ শুরু করল। রাগে লাভরাম পুলিশের বিছানাটা টান মেরে ফেলে দিলেন ঘরের মেঝেতে। বালিশের তলায় ছিল পবিত্র কোরানশরীফের কয়েকটি পৃষ্ঠা, তা ছিটকে পড়ল মাটিতে। কী। এত বড় স্পর্ধা। কাফেরের হাতে কোরানের হতাদর। বিধর্মী করে ইসলামের অপমান? ফতেকদলের পাঠাগারে গর্জে উঠল শেখ আবদুল্লা আর তার সমস্ত দলবল। জম্মু ও কাশ্মীরে যেখানে যত মুসলমান ছিল তাদের সবার কানে শৌছে দিল তারা এই খবর। ধূমায়িত অসন্তোষের অগ্নিতে পড়ল ঘৃতাহুতি। গভর্নমেন্ট বুঝলেন ব্যাপার গুরুতর। তাঁর মন্ত্রিসভার এক সদস্যকে দিলেন তদন্তের ভার। সাক্ষ্য প্রমাণে বোঝা গেল লাভরামের দোষ নেই। বিছানার ভিতরে যে ছিল ধর্মগ্রন্থ তা তার জানা ছিল না। তবুও মুসলীম সম্প্রদায়কে খুশি করতে লাভরামকে দেওয়া হলো চাকরি থেকে অবসব। অবাধ্যতার অপরাধে অবশ্য মুসলীম পুলিশটিকে করা হলো বরখাস্ত। মুসলীম জনমত শান্ত হলো না। শেখ আবদুল্লা এক সভা ডাকলেন শ্রীনগরে খান কোয়াইমুল্লাব চত্বরে। সেখানে হাজার হাজার উত্তেজিত মুসলমানের কাছে হিন্দু মহারাজ, তার হিন্দু কর্মচারী ও ‘হিন্দু প্রজাদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে বক্তৃতা দিল এক পাঠান। নাম আবদুল কাদের। লোকটা এক ইংরেজের রাধুনি বাবুচী। মনিবের সঙ্গে সদ্য এসেছে শ্রীনগরে। গভর্নমেন্ট সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তাব করলেন। তেরোই জুলাই শ্রীনগর সেন্ট্রাল জেলে আবদুল কাদেরের বিচারের দিন। সকাল থেকেই জেলের দরজায় জড়ো হতে লাগল জনতা। দলে দলে মুসলমান ছোট বড় শোভাযাত্রায় পৌছল এসে নানা অঞ্চল থেকে। তারা চেঁচাতে লাগলো, আবদুল কাদের শহিদ। তাদের মুহুর্মুহঃ হুক্কাবে কাঁপতে লাগল জেলখানার দরজা জানলা অবশেষে বাধভাঙা জলস্রোতের মতো বিক্ষোভকারীর দল ঢুকে পড়ল জেলের আঙিনায়। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আর তার সহকর্মীরাও চরাম নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিলেন। জনতাকে বুঝিয়ে শান্ত করার কিছুমাত্র চেষ্টা না করেই করলেন গুলীবর্ষণ। নিহত হলো জন দশেক, আহত ততোধিক। কোথাও আর কোনো মাত্রা রইল না। মৃতদেহ নিয়ে মিছিল করে বিপুল জনতা রওনা হলো গোরস্থানে। দশ হাজার ক্রুদ্ধ মুসলমানের শোভাযাত্রার প্রথম সারিতে ছিলেন পাঠাগারের নেতারা। তাদের হাতে আহতনের বক্তমাখা জামা কাপড়ে তৈরী বৃহৎ পতাকা। মুখে মহারাজার বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক ধ্বনি। শোভাযাত্রা তো নয় যেন আগ্নেয়গিরি থেকে নির্গত তপ্ত লাভার স্রোত। প্রধান রাজপথ দিয়ে জনস্রোত এসে পৌঁছলো মহারাজগঞ্জের বাজারে। সেটা রাজধানীর সবচেয়ে বড় ব্যবসায় অঞ্চল। মুহূর্তে উত্তেজিত জনতা ঝাঁপিয়ে পড়ল পথচারী হিন্দু স্ত্রী পুরুষের উপর। শ্রীনগরে শুরু হলো ভয়াবহ দাঙ্গা। দেখতে দেখতে হাঙ্গামা ছড়িয়ে পড়ল বিচরনগ এবং শহরের আরও অন্যান্য এলাকার। হিন্দু দোকান পসার হলো লুট, হিন্দু বাড়ি-ঘর হলো পুড়ে ছাই। তিনজন হলো খুন, একশ’ তেষট্টি জন জখম। দাঙ্গাকাব্যধ্য খানা করল তছনছ, টেলিফোনের লাইন কণল খানখান। ওয়েকফিল্ড তখন কাশ্মীরেব দেওয়ান। দাঙ্গার সময়ে তিনি হলেন নিখোজ। ক্রিং ক্রিং শব্দে মুহুর্মুহঃ টেলিফোন বাকছে তাঁর বাংলোতে। ভয়ার্ত হিন্দুরা জানাচ্ছেন ধন, প্রাণ, মর্যাদা রক্ষার
পৃষ্ঠা:৩১
কাতর আবেদন। পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট, সরকারী কর্মচারীরা চাইছে নির্দেশ। ওয়েকফিল্ডের বেয়ারা টেলিফোন ধরে কেবলি’ বলছে, “সাহেব কোঠিমে নেহি হৈ।” কখন ফিরে আসবে। তা সে জানে না, “নেহি মালুম।” শেষটায় ছাউনি থেকে মহারাজার সৈন্যদল এসে গুলী করে থামালো দাঙ্গাহাঙ্গামা, শান্তি ফিরিয়ে আনলো শহরে। গভীর রাত্রে দেওয়ান দিলেন দেখা। যেন আকাশ থেকে পড়লেন। “হ্যাঁ, দাঙ্গা হয়েছে না কি? কী আস্পর্ধা। বদমাশদের শায়েস্তা করছি এখুনি। ডাকাত ব্যাটাদের আগে পাঠাবো জেলে, ফাঁসিতে লটকাবো তারপব।” বলতে লাগলেন ওয়েকফিল্ড। আসল ব্যাপার বুঝতে বাকী রইল না মহারাজের। তিনি আবদুল্লা ‘আর তার সঙ্গীদের গ্রেপ্তার করে আটক করলেন হরি পর্বতের গারদে। ওরেকফিল্ডকে করলেন বরখাস্ত ‘তাড়িয়ে দিলেন অপদার্থ অকর্মণ্য অনেক কর্মচারীকে। শক্ত হাতে দমন করলেন সাম্প্রদায়িক আন্দোলন। রাজ্যে বিশৃঙ্খলার অজুহাতে মহারাজকে সরিয়ে কাশ্মীরের কর্তৃত্ব হাতে নেওয়ার যে চক্রান্ত ছিল ইংরেজের, তা সফল হলো না। পনেরো কয়েক বছর পরের কথা। শেষ আবদুল্লা গিয়েছিলেন পেশোয়ারে। সেখানে দেখেন এক বিরাট জনসভা। প্রায় লক্ষাধিক শ্রোতা। দীর্ঘদেহ পাঠানরা অধীর আগ্রহে শুনছে বক্তৃতা। কৌতূহলে আবদুল্লা এগিয়ে গেলেন কাছে। মঞ্চের উপরে শুভ্র খন্দরের টুপি মাথায় বক্তা নাতিদীর্ঘ ঋজুদেহ, উন্নতনাসা গৌরকান্তি পুরুষ। ললাটে বুদ্ধির দীপ্তি, চক্ষে সাহসের বহ্নি, চিবুকে কাঠিন্যের ইঙ্গিত। কণ্ঠে তীব্রতা নেই অথচ দৃঢ়তা আছে। যেন ঝকঝকে ইস্পাতের তলোয়ার। ব্যক্তিটি কে? বক্তা আর কেউ নন-কংগ্রেস-নেতা পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু। সভা শেষ হলে শ্রোতারা জয়ধ্বনি করতে করতে নেহরকে ভক্তের মতো ঘিরে ধরলো চারদিকে। শেখ আবদুল্লা অবাক হালেন। তাই তো, হিন্দু নেহক মুসলমান পাঠানদের এমন মন জয় করলেন কেমন করে? কী তাঁর কৌশল? কোথায় তাঁর আকর্ষণ। গেলেন নেহরুর কাছে। একবার নয়, দু’বার নয়, অনেকবার অনেক কথা বললেন। অনেক কথা শুনলেন। জানতে পারলেন ভারতে জাতীয় সংগ্রামের ইতিহাস, কংগ্রেস আন্দোলনের ধারা। আবদুল্লা নেহেরুকে জানালেন কাশ্মীরে মুসলীম চাষী মজুরদের দুঃখ-দুর্দশা। হিন্দু মহারাজ তাদের শোষণ করছেন। নেহরু বললেন, চাষীরা গরীব বলেই দুঃস্থ, মুসলমান বলে নয়। সরকার হৃদয়হীন, তার কারণ এ নয় যে তাঁরা হিন্দু বা ডোগরা, তার কারণ তাঁরা স্বৈরাচারী। আবদুল্লার চোখ খুলল। পেশোয়ার থেকে ফেরার পথে আরও একটি ঘটনা ঘটল। কাশ্মীরের এক আপেল বাগানের মধ্য দিয়ে আসছিলেন আবদুল্লা। বাগানের মালিক এক ধনী মুসলমান। নিজে দাঁড়িয়ে ফল পাড়াচ্ছিলেন। মজুরেরা হিন্দু। গাছের কোনোখানে একটি ফলও যাতে রয়ে না যায় সেদিকে মালিকের কড়া দৃষ্টি। তাঁর তাড়ায় মজুরেরা ক্রমশঃ নীচের ডাল থেকে উঠছিল উঁচু ডালে। মানুষের ভারে গাছের শাখাগুলি এমন ঝুঁকে পড়ছে যে, আবদুল্লার ভয় হলো, কখন বুঝি বা-কড়ড়-কড়াৎ-বুঝি বা’ নয়, সত্যি সত্যিই একটা গাছের সরু আগ-ডাল ভেঙে পড়ল মাটিতে। বছর কুড়ি বয়সের একটি মজুর ধপাস শব্দে হলো ধরাশায়ী। হা হা করে মালিক ছুটে এলেন। বসিয়ে দিলেন শপাং শপাং করে কয়েক ঘা বেত। মরার
পৃষ্ঠা:৩২
উপর খাঁড়ার ঘা। গর্জন করতে লাগলেন। উল্লুক কোথাকার, গাছের একটা ফলন্ত ডাল ভেঙে ফেললে। হায় হায়, কত টাকা লোকসান হলো। হতভাগার মজুরি কেটে নিতে হবে সবটা। তাতেই বা ক্ষতিপূরণ হবে কতটুকু? ইত্যাদি ইত্যাদি। আবদুল্লা ও আর পাঁচজন মিলে কোনো মতে মাটি থেকে তুললেন আহত অচৈতন্য মজুরকে। নিয়ে যাওয়া হলো তার বাড়িতে। সেখানে আরদুল্লা দেখলেন, ঠিক একই দুঃখ, কষ্ট, একই অভাব অনটন যা এতকাল দেখেছেন মুসলীম শাল কারিগরদের বাড়িতে। নেহরুর কথা মনে পড়ল, জনগণের যে দুর্দশা তার মূলে ধর্ম নয়, অর্থ। বদলে গেল শেখ আবদুল্লার দৃষ্টিভঙ্গি, বদলে গেল তাঁর মত। বদলে গেলেন তিনি নিজে। যেন তাঁর নবজন্মলাভ। সেবার শহরে কী নিয়ে যেন হিন্দু-মুসলমানে বাধলো এক বিতর্ক। তর্ক থেকে কলহ। কলহ থেকে ক্রোধ। তার পরেই দুই পক্ষে ইটপাটকেল ছোড়াছুড়ি। হিন্দুদের বিপদ বেশী। সংখ্যায় তারা নগণ্য। এক ঘর হিন্দুবাড়ি ঘিরে বাস করে দশ ঘর মুসলমান। ঝিলমের দু’নম্বর পুলের পাশে একটি ছোট হিন্দু মেয়ে জ্বরে মরে পড়ে ছিল। দু’দিন। তার সৎকারের উপায় নেই। ভয়ে হিন্দুরা ঘরের বাইরে বেরোয় না। নিজেদের হাটবাজারে যাওয়া বন্ধ। শব নিয়ে শ্মশানে যাবে কে? মড়া পোড়াতে গিয়ে নিজেরা মারা পড়বে না কি? প্রাণহীন মেয়ে কোলে নিয়ে মা কেঁদে বুক ভাসাচ্ছেন রাত্রি দিন। শুনতে পেয়ে শেখ আবদুল্লা গেলেন সেই বাড়িতে। দু’হাতে তুলে নিয়ে এলেন ছোট্ট মেয়েটির মৃতদেহ। ঝিলমের স্রোতে নিজ হাতে শিকারা বেয়ে নিয়ে চললেন শ্মশানে। নদীর দুই তীরে শত শত মুসলমান চলল শিকারার পিছনে। তারা ধিক্কার দিতে লাগল, “ছিঃ ছিঃ, কাফেরের মড়া পোড়াতে যাচ্ছে আবদুল্লা। শেষ কালে শেখ হলো কাভোগ।” কাভোগ মানে ডোম। আবদুল্লা চেঁচিয়ে জবাব দিলেন, “ধেৎ, মড়ার কী কোনো জাত থাকে রে, বোকার দল?” সেই থেকে শেখ আবদুল্লা হলেন এক নতুন মানুষ। সকল সম্প্রদায়ের লোক নিয়ে তিনি গড়লেন নতুন সমিতি। মুসলীম কনফারেন্স ভেঙে হলো ন্যাশন্যাল কনফারেন্স। বৃদ্ধ শিখ সর্দার বুধ সিং তার সভাপতি, তরুণ ব্রাহ্মণ প্রেমনাথ বাজাজ তার কর্মকর্তা, মুসলমান শেখ মহম্মদ আবদুল্লা তার অধিনায়ক। জনগণকে নিয়ে কাশ্মীরে শুরু হলো গণ-আন্দোলন। এতকাল যিনি ছিলেন মুসলীম নেতা এখন তিনি হলেন গণনায়ক। হিন্দু মুসলমান এক সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে জয়ধানি করল তার “শের-ই-কাশ্মীর জিন্দাবাদ।” কাশ্মীরের ঘরে ঘরে সহস্র সহস্র অজ্ঞ, অন্ধ ও অসহায় নরনারীর কাছে তিনি আনলেন নবীন অরুণালোক। রঞ্চিত, লাঞ্ছিতকে তিনি দিলেন অভয় ও আশ্বাস। দিলেন বর্তমানের মন্ত্র ও ভবিষ্যতের স্বপ্ন। মৃতের দেশে তিনি নব ভাব-গঙ্গার ভগীরথ।
ষোলো
কুক্ষণে মহারাজ হরি সিং-এর প্রধান মন্ত্রী হলেন রামচন্দ্র কাক। কাশ্মীরী পণ্ডিত। লোকটা সুচতুর। গোড়াতে শ্রীনগরের প্রতাপ সিং কলেজে লাইব্রেরীর কেরানী ছিলেন কুড়ি টাকা বেতনে। সেখানে থেকে ধীরে ধীরে হয়েছেন সরকারী দপ্তরের নানা বিভাগের কর্তা, আইন সভার সভ্য, মন্ত্রিসভার সদস্য, সবশেষে দেওয়ান। রাজকার্যে তাঁর কড়া দৃষ্টি ছিল, কিন্তু রাজনীতিতে দূরদৃষ্টি ছিল না। কংপ্লেসকে তিনি করলেন মহারাজের শত্রু। তারই হুকুমে কাশ্মীর রাজ্যে গ্রেপ্তার হলেন পণ্ডিত নেহরু চিককালের মতো বিরোধ ঘটে রইল কাশ্মীরের মহারাজ আর ভারতবর্ষের ভাবী প্রধানমন্ত্রী মধ্যে। দুর্ভাগ্য আর গরুর গাড়ি, আসে যখন ভিড় করে আসে। শ্রীনগরের পথে একদিন দেখা দিল এক সন্ন্যাসী। স্বামী সম্বদেব। কেউ বলে তাঁর বয়স দু’শ’ বছর কেউ বলে পাঁচশ’। হিমালয়ের
পৃষ্ঠা:৩৩
গুহায় বসে তপস্যা করেছেন এতদিন। ভক্তরা রটনা করল স্বামীজী সিদ্ধপুরুষ। ভূত, ভবিষ্যৎ কিছু নেই তাঁর অজানা। শুধু মুখের দিকে তাকিয়ে বলে দিতে পারেন মানুষের পূর্বজন্মের অজ্ঞাত ইতিহাস, আর পর জন্মের আগাম কাহিনী। ক্রমে তাঁর খ্যাতি পৌঁছল মহারাজারও কানে। স্বামীজীর ডাক পড়ল রাজপ্রাসাদে। সেখানে সন্তদেব দেবতার মতোই আসন পাকা করে বসলেন দু’দিনে। সন্ন্যাসী মহারাজকে বললেন, “ইংরেজ চলে যাচ্ছে ভারতবর্ষ ছেড়ে। তোমার ললাটে দেখছি রাজ্য ক্ষেত্রের সুস্পষ্ট সামুদ্রিক লিখন। ইংরেজী ‘এল’ অক্ষরের মতো। কোন শব্দের আদ্যে আছে ‘এল’? লাহোর এবং লাভাক। কুছ ফিকির নেই, মহারাজ, হনুমানজী কি কৃপাসে লাহোর থেকে লাডাক রাজা হবে তোমার।” গুরুজীর অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাস হলো হরি সিং-এর সেদিন থেকে হরি সিং-এর কাল হলো দুই, কাক আর সন্তদেব। যেন জ্বরের সঙ্গে বিসূচিকা, ঝড়ের সঙ্গে বজ্রপাত। মন্ত্রী দেয় দুর্বৃদ্ধি, গুরু দেয় দুরাশা। সর্বনাশের পথে দ্রুত এগিয়ে চলেন মহারাজ। অন্য সব দেশীয় রাজারা যখন একে একে যোগ দিচ্ছেন ভারত সরকারের সঙ্গে, তখন তিনি স্বপ্ন দেখেন ভারতবর্ষ আর পাকিস্তানের মাঝখানে এক বিস্তীর্ণ স্বাধীন সাম্রাজ্যের। লাহোর থেকে লাডাক। ইংরেজী ‘এল’ আছে তাঁর ললাটে। হুঃ, সে কি আর অমনি। নদীর জোয়ারের মতো সংসারে সুযোগ আর সময়ও বসে থাকে না কারো জন্যে। মহাকালের কাছে মহারাজারও খাতির নেই। দিন আর মাস বয়ে গেল হেলায়। স্বপ্নভঙ্গে হরি সিং যখন চোখ মেললেন, রাজধানীও তখন যায় যায়, রাজাপাট টলমল। অগত্যা প্রাণের দায়ে পাকিস্তানী হানাদার ঠেকাতে ধরনা দিতে হলো ভারত সরকারেরই কাছে। প্রধানমন্ত্রী নেহরু বললেন, সৈন্য তিনি পাঠাবেন। কিন্তু মহারাজের পিছনে চাই জনমতের সমর্থন। আগের কালের রাজারা তাঁদের আপন খেয়ালে রাজ্য চালাতেন। রেগে কারো নিতেন শির, কাউকে চড়াতেন শূলে। খুশিতে কাউকে দিতেন ধন-দৌলত, কাউকে বানাতেন সভাসদ। রাজকন্যাসহ অর্ধেক রাজত্ব দান করতেন ইচ্ছামতো। তখন প্রজা শুধু চোখ বুজে খাজনা যোগাত, মুখ বুজে দুঃখ সইত। পাইক পেয়াদার পকেট পুরিয়ে খালি পেটে ভাঙা গলায় চেঁচিয়ে বলতো, “রাজোশ্ববো জগদীশ্বরো বা।” সেদিন আর নেই। প্রজা ফেলবে কড়ি, বাড়া মাখবে তেল এ রীতি একালে অচল। এখন দেশের লোক চায় দেশ শাসনের ভাব। রাজাকে রাজ্য চালাতে হয় প্রজাব পরামর্শ শুনে। নেহরু বললেন, জননেতাকে দিতে হবে কাশ্মীরের জনশাসনের ভার। তথাস্তু। আবদুল্লা হলেন কাশ্মীর শাসন বাবস্থাব সাময়িক অধিকর্তা, হেড অব ্যাডমিনিস্ট্রেশান। রাজ্য সরকারের মাথা হয়েই কিন্তু আবদুল্লার মাথা গেল ঘুরে। আসলে আবদুল্লা লোকটার নিজস্ব কোনো মত নেই। যখন যার বুদ্ধি নেন, তখন তারই কথা বলেন, যার সাথে থাকেন তারই পথে চলেন। সঙ্গদোষ কড় দোষ। তার উপবে আছে আবার ক্ষমতার স্বাদ। লোভী বালকের ভোজন স্পৃহাব মতো তা কেবলই বাড়তে থাকে। আবদুল্লার আশপাশে আবার এসে জুটল কয়েকটি কুব ও স্বার্থপর মুসলমান। তারা রাত্রিদিন ঘিরে থাকে তাঁকে। দুধের বাটির চারপাশে যেমন ভঙন করে মাছি। দুষ্ট সরস্বতীর মতো তারা কেবলই দৃষ্টবুদ্ধি দিল অষ্টপ্রহর। দেখতে দেখতে আবদুল্লার মন আর মতি দুই-ই আবার হলো প্রাপ্তিতে আচ্ছন্ন ও স্বার্থবোধে মলিন। জাতীয়তাবাদের উন্নত শীর্ষ থেকে ধাপে ধাপে গড়িয়ে পড়লেন সাম্প্রদায়িকতার অতল গহ্বরে। জলেভেজা পুতুলের মতো তার রং ধুয়ে মুছে বেরিয়ে পড়ল ভিতরের কাদামাটির ডেলা। রূপ ঘুচে গিযে দেখা দিল স্বরূপ। আবদুল্লার রাগ ছিল হরি সিং-এর উপরে ষোল আনা। মহারাজ যে তাঁকে জেলে পুরেছিলেন, সেকথা ভুলতে পারেননি তিনি কোনো দিন। কিন্তু কথামালার উটের গল্প জানা ছিল তাঁরও। দড়িতে একবারেই ছেঁচকা টান দিলে তা’ ছিঁড়ে যাওয়ার আশঙ্কা। তাই আস্তে আস্তে জাল গুটিয়ে
পৃষ্ঠা:৩৪
আনলেন তিনি। এগোলেন ধীরে ধীরে, যাপে ধাপে। আবদুল্লা প্রথমে চাইলেন কাশ্মীরে পুরোপুরি এক মন্ত্রীসভা। হরি সিং হবেন ক্ষমতাহীন নিয়মতান্ত্রিক মহারাজ। যেমন ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে আছে রাজ্যপাল। কাজের জন্য নয়, সাজের জন্য। নৈবেদ্যের চূড়ায় যেমন সন্দেশ, ধোপার উপরে যেমন গোলাপ ‘ফুল। ভারত সরকারের অনুগ্রহে শেখ মহম্মদ আবদুল্লা হলেন কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী। কাটল কিছু কাল। হরি সিং-এর প্রতাপ নেই, কিন্তু প্রভাব আছে। সরকারী কর্মচারীরা তখনও মহারাজকেই মনে করে রাজ্যের মালিক। নিরক্ষর চাষী মজুরেরা পুরান অভ্যাসে তখনও বিপদে দেয় মহারাজের দোহাই, আমোদে আহ্লাদে মহারাজের গায় জয়। সেটা প্রধান মন্ত্রীর পছন্দ নয়। ততক্ষণে ভারতীয় সৈন্যদল হানাদারদের তাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে দূরে। আবদুল্লা ভাবলেন, এই সময়। তিনি তাঁর ধনুকে দিলেন টঙ্কার। তৃণ থেকে বের করলেন দারুণ অগ্নিবাণ। হরি সিং-এর কপাল গেল পুড়ে। ভারত সরকারের কাছে পত্র দিলেন আবদুল্লা, রাজ্যের জনগণ চায় না হরি সিংকে। সিংহাসন ছাড়তে হবে তাঁকে। সে কী কথা? শুনে চমকে ওঠেন মহারাজ। ছুটে আসেন দিল্লীতে। সেখানে তাঁর সহায় কে? গেলেন নেহরুর কাছে। হায়, তিনি হরি সিং-এর বন্ধু নন। শেখ আবদুল্লার উপরেই তাঁর অটুট বিশ্বাস। রাজতন্ত্রের চাইতে গণতন্ত্রে তাঁর আস্থা বেশী। তাঁর কাছে মহারাজের অনুনয় নিষ্ফল। অবশেষে একটা মাসোহারা নিয়ে গদি ছেড়ে দেওয়া ছাড়া গতি রইল না আর। তরুণ যুবরাজ করণ সিং হলেন রিজেন্ট-অর্থাৎ পিতার অবর্তমানে কাশ্মীরের রাজ্যধর। তাঁর বয়স তখনও আঠারো পার হয় নি। রাজপুত্র না হয়েও রাজা হয়েছিলেন হরি সিং। রাজা হয়েও রাজ্য হারালেন তিনি। ইংরেজী ‘এল’ অক্ষরটা আছে আরও একটা ইংরেজী শব্দের গোড়ায়। সেটা ‘লস্ট’। গুরু সন্তদেবের তা’ জানা ছিল না। শিষ্য হরি সিং-এর তা’ মনে ছিল না। মূর্খ হরি সিং। রাজ্যহারা হরি সিং গেলেন বন্ধে। নিরালা নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করতে লাগলেন সেখানে। ঘরের জানালা দিয়ে দেখা যায় অদূরে সমুদ্র তীর। বেলাভূমিতে কেবলই আছাড় খেয়ে পড়ছে ফণাতোলা সাপের মতো অসংখ্য সাগর তরঙ্গ। ঢেউ-এর পরে ঢেউ। বিরামহীন, সংখ্যাহীন। দিনের পর দিন কর্মহীন হরি সিং তাকিয়ে থাকেন তার দিকে। মাঝে মাঝে নিজের অজান্তেই মন উধাও হয়ে যায় দূর দূরান্তের দেশে। সেখানে পাহাড়ের মাথায় সোনালী রৌদ্রে ঝলমল করছে রূপালী বরফের আস্তরণ, চার-চেনারীর, পাতায় বইছে ঝিরঝিরে হাওয়া, ঝিলমের স্রোতে হরতনের টেক্কার মতো বৈঠা নিয়ে মাঝিরা বাইছে ঝালরআটা রঙিন শিকাবা, আমীরাকদলের পুলের কিনারায় লাঠি হাতে নিঃস্ব দুঃখীর দল ‘মিস্কিন’, ‘মিস্কিন’, বলে, হাত বাড়িয়ে মাগছে ভিখ। সে দেশ থেকে চিরকালের মতো বিদায় হয়েছেন হরি সিং। সেখানে কোনোদিন আর ঘটবে না তাঁর পদক্ষেপ। মন্দমতি, ভ্রষ্টনীড়, ভাগ্যহত হরি সিং।