যাও পাখি
পৃ্ষ্ঠা 0১ থেকে ২০
পৃষ্ঠা:০১
। এক।
সোমেন জানে, প্রেমের মূলেও আছে ভিটামিন।ব্যাপারটা সে টের পেল শনিবার সকালে, বৈচী স্টেশন থেকে আড়াই মাইল উত্তরে গোবিন্দপুর গাঁয়ে বহেরুর কিচেন গার্ডেনে বসে। কিচেন গার্ডেন বললে অবশ্য কিছুই বলা হয় না। বহেরু তার বিশাল পরিবারের সবজিটা এই ক্ষেতে ফলিয়ে নেয়। আড়েদিযে ক্ষেতটা চার-পাঁচ বিঘে হেসেখেলে হবে। বহেরু আদ্যিকালের চাষা নয়, কেমিক্যাল সার, ইনসেকটিসাইডসের সব বৃত্তান্ত জানে। জানে ব্যাঙ্কের সুদের হার, রাইটার্স বিল্ডিংস বা বি-ডি-ও অফিসে গিয়ে মুখচোরা জোড়হাত চাষার মতো ঈশ্বর ভরসায় বসে থাকে না চোটেপাটে কথা বলে কাজ আদায় করে আসে। বহেরু যে উন্নতি করেছে তা তার এই সবজিক্ষেতের উন্নত সতেজ সবুজ রং সংকেতে জানিয়ে দিচ্ছে। একটু দূরেই চলছে পাঁচ-ঘোড়ার পাম্পসেট। ডিজেলের গন্ধ আর ফটফট শব্দ। বছরে বার-দুই সে ভাড়া করে ট্র্যাক্টর। বহেরুর পরিবারের নামে বা বেনামে কত জমি আছে তার হিসেব সোমেন জানে না। আন্দাজ করে দেড় দুশো বিয়ে হবে। অনেক আগে যখন এখানে আসত সোমেন তখন অত বাড়বাড়ন্ত দেখেনি। মাঠের ধান উঠে গেছে। পড়ে আছে ন্যাড়া মাথায় সদ্য গজান চুলের মতো কাঁটা কাঁটা ধানের গোড়া। তবু সেই ক্ষেত সারা সকাল ধরে দেখিয়েছে তাকে বহেরু। দু-চার জায়গায় আগুনের চিহ্ন পড়ে আছে মাটিতে। এ জায়গায় আখের চাষ হয়। বহেরু মোটা সুতির একটা ভাগলপুরী চাদর গায়ে, পরনে ধুতি আর পায়ে বাটা কোম্পানির মজবুত একজোড়া থাকি রঙের হকিবুট পরে ঘুরে ঘুরে তাকে খানিকটা জমিজিরেত দেখাল।একবার দাঁড়িয়ে পড়ে সখেদে একটা ঢেলা বুটের ডগায় উলটে দিয়ে বলল-মাটির কি আর নিজের দুধ আছে। -কি বল বহেরু? সোমেন জিজ্ঞেস করল। -মাটির নিজের রস হল মায়ের বুকের দুধের মতো। কেমিক্যাল সার হচ্ছে গুঁড়ো দুধ, সেই নকল দুধ মায়ের বুকে ভরে দেওয়া। ছেলেবেলা যেমন স্বাদ পেতেন সবজিতে, এখন আর পান? সোমেন মুশকিলে পড়ে যায়। শাকসবজির স্বাদ নিয়ে সে মাথা ঘামায় না, পাতে দিলে সে মটর শাকের সঙ্গে খেসারির শাকের তফাত বুঝতে পারে না। চুপ করে রইল। -এ মাটি হচ্ছে এখন ওষুধের জোরে বেঁচে থাকা রুগি। নিজের জোর বল নেই। ওষুধ না পড়লে বছর-বিয়োনী বাঁজা বনে যাবে। খালধার পর্যন্ত যেতে যেতে রোদ চড়ে গেল। বহেরু ভাগলপুরী চাদরখানা খুলে ফেলল গা থেকে। গায়ে একটা ফতুয়া। সত্তরের কাছাকাছি বয়েস কে বলবে? হাতে বুকে ঢিলে চামড়ার তলা থেকে ডিম-ডিম পেশি পিছলোচ্ছে। গর্দানখানা ভাল খাঁড়া দিয়েও এক কোপে নামানো যাবে না, এত নিরেট। চুলে পাক ধরেছে কিন্তু চোখ দুখানা এখনও রোদে ঝিকোয়।
পৃষ্ঠা:০২
বিশাল লম্বা বহেরু। চাদরণানা খুলে মাটির বাঁধের ওপর যখন দু-পা ফাঁক করে দাঁড়াল তখনই অস্পষ্টভাবে সোমেন ভিটামিনের কার্যকারিতা বুঝতে পেরেছিল। চালুতে দাঁড়িয়ে সোমেন দেখে বাঁধের ওপরে শীতের ফিরোজা আকাশের গায়ে বিশাল স্তম্ভের মতো উঠে গেছে বহেরুর শরীর। এখানে রোদে বাতাসেও ভিটামিন ভেসে বেড়ায় নাকি? সেই সঙ্গে ক্যালসিয়াম, কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিনও? কতকাল ধরে বহের প্রায় একরকমের আছে। নিমের দাঁতনে মাজা স্টেনলেস স্টিলের মতো শক্ত দাঁত দেখিয়ে হেসে বহেরু হাত তুলে খালধারে একটা অনির্দিষ্ট এলাকা দেখিয়ে বলল-এই হচ্ছে আপনাদের জমি, একলপ্তে পাঁচ বিঘে। পোট্রক উজিয়ে গেলে আরও এক নিয়ে আছে আপনাদের, সে কিন্তু অনাবাদি, মরা জমি। ঠাকরাকে বলবেন, সে জমিতে চাষ দিতে এখনও দু-তিন বর্ষা লাগবে।গতকাল তাড়াতাড়ি কিট ব্যাগ গুছিয়ে দুপুরের বর্ধমান লোকাল ধরেছে সোমেন। তাড়াহুড়োয় ভুলভ্রান্তি হয়। আজ সকালে দেখে টুথব্রাশ আনেনি। বহেরুর ছেলে শক্ত দেখে নিমন্ডাল কেটে দিয়েছিল, সকালে সেটা আধঘণ্টা চিবিয়ে মাড়ি ছড়ে গেছে, মুখে বিদঘুটে স্বাদ। বহেরুর সত্তর বছরের পুরনো আসল দাঁতগুলোর দিকে চেয়ে সোমেন মুগ্ধ হয়ে গেল। ক্লোরোফিলের কাজ।কাল রাতে তার সম্মানে বহেরু মুরগি মেরেছিল। এরা ব্রাহ্মণের পাতে নিজেদের হাতের রান্না দেয় না। সোমেনকে নিজে বেঁধে নিতে হয়েছে। খুব তেল-ঘি-রসুন-পেঁয়াজ-লংকা দিয়েছিল বটে, কিন্তু তেমন কথায়নি বলে মাংসটা জমেনি তেমন। খিদের মুখে একপেট সেই ঝোলভাত খেয়েছে। এগারো ঘন্টা পর আজ সকালে সেই মাংসের একটা ঢেকুর উঠল। সোমেন হাতের পাতায় চোখের রোদ আড়াল করে ধু-ধু মাঠ ময়দাদন দেখে। ফেরার পথে সোমেন জিজ্ঞেস করল-বাবা এখানে এসে করে কী?বহেরু সামনে হাঁটছে। লাঠিয়াল চেহারা। কাঁবে চাদর ফেলা। উত্তুরে বাতাস দিচ্ছে টেনে। রোদ ফুঁড়ে বাতাসের কামড় বসে যাচ্ছে শরীরে। বহেরুর ভ্রূক্ষেপ নেই। লং ক্লথের ফতুয়ার আড়ালে চওড়া কাঁধ। অহংকারী চেহারা। খুলনা জেলার গাঁয়ে সে ছিল কখনও কামলা, কখনও ডাকাত, কখনও দাঙ্গাবাজ, আবার কিছু কিছু ভাগের চাষও করত, শীতের নদীতে মাছ ধরতে যেত, আবার সোমেনদের দেশের বাড়িতে ঘরামি বা মুনিশও খেটে গেছে। দেশ ভাগাভাগির সময়ে সে একটা সুযোগ নেয়। যশোর আর খুলনার রাস্তায় ঘরছাড়া মানুষদের ওপর হামলা করে সে কিছু কাঁচা পয়সার মুখ দেখে। শোনা যায়, নিজের দলের গোটা চারেক লোককে কেটে সে ভাগীদার কমিয়ে ফেলে। গোবিন্দপুরে এসে এক মুসলমান চাষির সঙ্গে দেশের জমি বদলাবার অছিলায় তাকে উচ্ছেদ করে জমির দখল নেয়। তারপর এই উন্নতি। সেই উন্নতিটাই কঠিন এবং সহজ শরীরের অহংকারে ফুটে উঠেছে এখন। মুখটা না ফিরিয়েই জবাব দিল বহেরু কী আর করবেন। বুড়ো মানুষ। এমনভাবে ‘বুড়োমানুষ’ কথাটা বলল যেন বা সে নিজে তেমন বুড়োমানুষ নয়। একটু ভেবেচিন্তে সাবধানে বলে-সারাদিন পুঁথুপত্রই নাড়াচাড়া করেন, খুড়োমশাইয়ের কাছে সাঁঝ সকাল খোলের বোল তোলেন, কচি-কাঁচাগুলোকে সেখাপড়াও করান একটু-আধটু, রোগেভোগে ওষুধপত্র দেন। মাঝে মাকে বহি চাপলে এধার ওধার চলে যান। যেমন এখন গেছেন। -কোথায় গেছে কিছু বলে যায়নি। বাহেরু মাথা নাড়ল কথাবার্তা তো বলেন না বেশি। বলাকওয়ার ধারও ধারেন না।
পৃষ্ঠা:০৩
আমরা ভাবলাম বুঝি কলকাতাতেই গেলেন, ঠাকরুন আর ছানাপোনাকে দেখা দিয়ে আসবেন। গেছেন তো মোটে চারদিন।-না বহেক, একমাস হয় আমরা কোনও খবরবার্তা পাইনি! বহেরু দুশ্চিন্তাহীন গলায় বলে আছেন কোথাও। উদাসী মানুষ। যেদিন মন হবে ফিরে আসবেনখন। ভাববেন না। বহেরুর কথাটায় একটু তাচ্ছিল্যের ভাব আছে। বাবার প্রতি নয়, তার প্রতি বা তাদের প্রতি। যেন বা বাবা কোথায় আছে তা জেনেও বলার ঢাড় নেই বহেরা। বহেরু কি বুঝে গেছে যে বাবার খোঁজে সোমেনদের আর সত্যিই দরকার নেই? খোঁজখবর করাটা বাহুল্য মাত্র? মাঠটা পার হয়ে এল তারা। বড় রাস্তাটা অন্তত পঁচিশ ত্রিশ বছরের পুরনো, পাথরকুচির রাস্তা। কোনওকালে বোধ হয় মেরামত হয়নি, গোরুর গাড়ির চাকায় আর গত বর্ষার জলে চষা জমির মতো এবড়ো-খেবড়ো হয়ে আছে, তারই পাশে একা দাঁড়িয়ে আছে বহেরুর খামারবাড়ি। আশেপাশে আর গাঁ-ঘর নেই। গোবিন্দপুরের বসত আরও কিছু উত্তরে। বহেরুর খামারবাড়িতে আটচালা, চারচালা, দোচালা মিশিয়ে দশ-বারোখানা ঘর। আর আছে গোশালা, ঘানিঘর, ঢেঁকিঘর, কাঠের মাচানের ওপর জাল দেওয়া একটা হাস মুরগির পোলট্রিও। প্রায় স্বয়ম্ভর ব্যবস্থা। জামাকাপড় আর শৌখিন জিনিসপত্র ছাড়া কহেরুদের প্রায় কিছুই কিনতে হয় না। বাড়ির হাতায় পা দিয়ে বহেরু হাক তুলে উত্তর দিকটা দেখিয়ে বলল-ওই গোবিন্দপুরের লোকগুলো খচ্চর। আমি এখানে নিজের মতো একখানা গাঁ করব। কহেক গी। চোখ দুটো আবার রোদে ঝিকলো। সট্রার কথা নয়, বহেরু হয়তো বা পারে। সে ভাগচাষি বা বরগাদার নয়। সে নিজস্ব জোতের মালিক, পয়সায় সোমেনদের কেনাবেচা করার মতো ধনী। তবু যে সে সোমেনদের জমি চষে দেয়, ফসলের দাম দেয়, সে তার দয়া। একসময়ে সে সোমেনদের বাপ-দাদুর নুন খেয়েছে। বাড়ির চাকরবাকরের মতো ছিল। দান উলটে গেছে এখন। সোমেনের বাবা বেধে হয় এখন বহেরুরই একজন কর্মচারী মাত্র, বাচ্চাদের পড়ায়, তার অর্থ প্রাইভেট টিউটর, হিসেবনিকেশও বোধ হয় কিছু করে দেয়। তার মানে, বাবা এখন বহেরুর ম্যানেজার কিংবা নায়েব। এ পর্যন্ত যখন বহেরু পেরেছে, নিজের নামে একখানা গাঁয়ের প্রতিষ্ঠা করতেও পারবে। জাতিগুষ্টি মিলিয়ে বহেরুর পরিবারেই প্রায় এক গাঁ লোকজন। উঠোন থেষ্টে খোলের শব্দ আসছে। কাল সন্ধেবেলাও শুনেছিল খোলের শব্দ, আবার খুব ভোরে। বহেরুর নব্বই বছর বয়সি জ্ঞাতি খুড়ো দিগম্বরের ওই এক শখ। এ বাড়িতে বোধ হয় ওই লোকটিই স্বার্থশূন্য এক বাতিক নিয়ে আছে। ক্ষেতখামার, বিষয়-আশয় বোঝে না। বোঝে কেবল খোলের শব্দ। তাতেই মাতাল হয়ে আছে। ভোররাতে সোমেন ঘুম ভেঙে প্রথমে বিরক্ত হয়েছিল। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে কাত হয়ে শুয়ে কানে বালিশ চাপা দিয়ে শব্দটা আটকাবার চেষ্টা করল কিছুক্ষণ। কিন্তু দূরাগত মেষের গুরু গুরু ধ্বনির মতো শব্দটা খুব সহজেই তার বুকে ঘা মারতে থাকে। চারদিকের নিস্তব্ধতার মধ্যে ওই শব্দটা যেন ওই নিস্তব্ধতারই একটা স্পষ্ট রূপ। বাজনার কিছুই জানে না সোমেন। কিন্তু ক্রমে ওই শব্দ তাকে কিছুক্ষণের জন্য অন্য সব শব্দের প্রতি বধির করে দিল। না-টানা সিগারেটের ছাই
পৃষ্ঠা:০৪
লম্বা হয়ে ঝুলে থাকে। সে অনুভব করে তার হৃৎপিণ্ডের স্বাভাবিক ডুবড়াব শব্দ আস্তে আস্তে বদলে যায়। বহেরুর বুড়ো খুড়োর আঙুলের টোকায় টোকায় নাচে তার আনন্দিত হৃৎপিণ্ড। সকালে উঠেই সে তাই প্রথমে বুড়ো লোকটাকে খুঁজে বের করে। -বড় ভাল বাজান তো আপনি। ঘোলাটে ছোট ছোট দুই চোখ, বেঁটেখাটো চেহারা এ বয়সেও মজবুত, আঙুলগুলোর ডগায় কড়া, ঝুপুস এক নোংরা তুলোর কম্বল মুড়ি দিয়ে রোদে বসেছিল মহানিম গাছটার তলায়। হাতে কাঁসার গ্রাসে চা। সোমেনের কথা শুনে কেঁপে ওঠে বুড়ো, হাতের চা চলকে যায়। বলে-আমি? আপনিই তো বাজালেন। বুড়ো থরথরিয়ে কেঁপে উঠে দাড়াতে চেষ্টা করে। হাত বাড়িয়ে সোমেনের হাত দুটো সাপটে ধরে ককিয়ে ওঠে-আমি না বাবু, আমি না। গুরু বাজাইছে। মাঝেমইধ্যে গুরু ভর করে শরীলে কথার টান শুনে বোঝা যায় দিগম্বর ঢাকা বা ওদিককার পূব দেশের লোক। যশোর বা খুলনার নয়। তবু কেন যে তাকে জ্ঞাতি বা খুড়ো বলে চালাচ্ছে বহেরু তা কে জানে। সোমেন শুনেছে, বহেরু নানা জায়গার সব গুণী, কিস্তৃত বা অস্বাভাবিক লোক এনে তার নিজের কাছে রাখে। এটাই ওর বাতিক। কী পরিষ্কার টনটনে আওয়াজে ওই খোল বাজছে এখন। কী একটা কথা ফুটি-ফুটি হয়ে উঠছে। ঠিক বোঝা যায় না। আবার বোঝাও যায়। বহেরুর বিশাল সংসারের নানা বিষয়কর্মের শব্দ উঠছে। কুয়োয় বালতি ফেলার শব্দ, পাম্পসেটের আওয়াজ, শিশুদের চিৎকার, বাসনের শব্দ। কিন্তু সব শব্দের ওপরে খোলের আওয়াজ বধির করে দিচ্ছে পৃথিবীকে। হলুদ কুঞ্জলতায় ছেয়ে আছে কটিাঝোপের বেড়া। সোনা রঙে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। তার পাশে বহেরু দাঁড়িয়ে উৎকর্ণ হয়ে শোনে একটু। তারপর হঠাৎ ফিরে বলে-খুড়োমশাইয়ের খোল কি বলছে বুঝছেন? সোমেন অবাক হয়ে বলে-না তো। -ভাল করে শুনুন। সোমেন শোনে। বলছে বটুেও ঠিক বোঝা যায় না। বহেরুর বিষয়ী চোখ দুটেঈহঠাৎ একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায়। তাতে একটা বৈরাগ্যও এসে যায় বুঝি। মাথা নেরেস্টলে-ঘুঘু তাড়া, ঘুঘু তাড়া, ঘুঘু তাড়া.. হাসে বহেরু। কিন্তু সোমেন আবাক হয়ে শোনে। সত্যিই পরিষ্কার ভাষাটা বুঝতে পারে সে। শুধু তাড়া ঘুঘু তাড়া ঘুঘু তাড়া… আবার পালটে যায় বোল। বহেরু হাঁটতে হাঁটিতে বলে এখন বলছে চিড়ে আন, চিড়ে আন, চিড়ে আন…. পরমুহূর্তেই আবার পালটে যায় বোল। বাত্মায় গোলে বহেরুর গুঁড়ো আর একটা কী কথা বলে যেতে থাকে। বহেরু হাঁটতে ইটিতে ধূধুল লতায় অন্ধকার গুঁড়িপথ ধরে বলে–এবার বলছে মাবিজুখি, মাখিজুবি, মাধিজুখি দু-তিনটে সমের শব্দ ওঠে। খোল বোল পালটাচ্ছে।
পৃষ্ঠা:০৫
বহেরু খাস ছেড়ে বলে, শুনুন, বলছে-দে দই, দে দই, দে দই… সোমেন দাঁড়িয়ে পড়ে। তারপর হাঁটে আবার। খোল ততক্ষণে ফিরে ধরেছে প্রথম বোল। ঘুঘু তাড়া ঘুঘু তাড়া ঘুঘু তাড়া…. একটু হতাশায় ম্লান হাসি হেসে বহেরু মাথা নেড়ে বলে সারাদিনই শুনবেন ওই আওয়াজ। যান আপনি বিশ্রাম করেন। মটরশাকের ক্ষেতে সাদা ফুল প্রজাপতির মতো আলগোছে ফুটে আছে। বহেরু যখন ক্ষেতটা পার হচ্ছে, তখন গাছগুলি শুড় বাড়িয়ে তাকে স্পর্শ করতে চাইছে, এই দৃশ্যটা দাঁড়িয়ে দেখল সোমেন। বিশ্রাম করার কিছু ছিল না। বহেরু বয়স্ক লোক, তার ওপর দেশের মানুষ। সিগারেটটা এতক্ষণ ইচ্ছে করেই খায়নি সে। একটা সিগারেট খাবে বলে ঘরে ঢুকল। বাবার ঘর। এই ঘরটায় রাত কাটিয়েছে সোমেন। বড় কষ্ট গেছে। সরগাছের বেড়ার ওপর মাটি লেপা, ওপরে টিনের চাল। সারা রাত ফাঁক-ফোকর দিয়ে বাতাস ঢুকেছে, আর শব্দ উঠেছে টিনের চালে। একধারে বাঁশের মাচানে বিছানা। গদির বদলে চটের ভিতরে গড় ভরে গদি বানানো হয়েছে, তার ওপর শতরঞ্জি আর পাতলা তোশকের বিছানা। গায়ে দেওয়ার জন্য একটা মোটা কাঁথা। একটা শক্ত বালিশ। একটা হলদি কাঠের সেলফে কিছু কাচের জার, শিশি, বোতল। কৃষি বিজ্ঞানের কয়েকটা বই। একটা ছোট টেবিল, লোহার চেয়ার। দুটো ঝাঁপের জানালা খুলে আলো হাওয়ার রাস্তা করে দেওয়া হয়েছে। তবু ঘরটা আবছা। দীর্ঘ বৃষ্টির দিনে যেমন ঘরের আসবাবে, বিছানায় একটা সোঁদা গন্ধ জমে ওঠে, এ ঘরে তেমনই এক গন্ধ। মাটির মেঝেয় ইঁদুরের গর্ত, বাঁশের খুঁটির নীচে ঘুণপোকায় কাটা বাঁশের গুঁড়ো। উইয়ের লাইন গেছে কাঠের তক্তার পাটাতন পর্যন্ত। বাবার বউল-গুলা খড়ম জোড়া আর একটা পিতলের গাছ মাচানের নীচে। তার পাশে বড় একটা টিনের, আর একটা চামড়ার সু্যুটকেশ। দুটোই বিবর্ণ। মশারিটা চালি করে রেখে গেছে কে, ঘরটা ঝ্যাঁটপাটও দিয়েছে, কিন্তু বিছুমাত্র উজ্জ্বলতা ফোটেনি। এই ঘরে তার বাবা থাকে। দিনের পর দিন। এবং প্রায় অকারণে। ভাবতে, বহুকাল বাদে বাবার জন্য একটু করুণা বোধ করে সোমেন। চেয়ারটায় বসতেই টিনের চেয়ারের জনকনে ঠান্ডা শরীরের নানা জায়গায় ছ্যাকা দেয়। তবু বসে থাকে সোমেন। একটা সিগারেট ধরায়। গত এক মাসে বাবাকে বুটো চিঠি দেওয়া হয়েছে। একটারও জবাব পায়নি। বাবা চিঠি দেবে না, এ তাদের জামাই ছিল। কিছু লোক থাকে যারা ঘর-জ্বালানি কিন্তু পর-ভুলানি। নিষ্পর লোকেরা নাম শুনলে কপালে জোড়হাত ঠেকিয়ে বলে সাক্ষাৎ দেবতা। অমন পরোপকারী মানুষ হয় না। কিন্তু ঘরের লোক জানে, ওরকম খেয়ালি, নিষ্ঠুর, স্বার্থপর মানুষ আর নেই। এরকমই একজন ঘরজ্বালানি লোক হচ্ছে বাবা, যাকে বাড়ির লোক বাদে আর সবাই সম্মান করে। পরোপকারী। হবেও বা। বাবার খুব বেশি রহস্য জানা নেই সোমেনের। সে মার কাছে শুনেছে, ভরা যৌবনে স্ত্রীকে রাতে-বিরেতে পাড়াপড়শির ভরসায় ফেলে রেখে বাবা যাত্রা-থিয়েটারে যেত। যাত্রা-থিয়েটারে পার্টও করত না, দেখতেও যেত না। যেত, স্টেজ বাঁধতে যাত্রাদলের সুখসুবিধের ব্যবস্থা করতে। ফুটবল খেলতে না জানলেও গাঁয়ের ম্যাচ-এ বাবা ছিল প্রধান জোগাড়ে মানুষ। গ্রাম দেশে প্রথা আছে, গোলপোস্টের পিছনে একজন কোনও নিষ্কর্মাকে গোলজাজ হিসেবে বসিয়ে দেওয়ার। বাবার কোনও
পৃষ্ঠা:০৬
যোগ্যতা ছিল না বলে ‘গোলজাজ’ হত বরাবর। এরকম কোনওখানে কিছু একটা হচ্ছে। জানলেই সেখানে ছুটে যেত মহা ব্যস্ততায়, দরকার থাক না থাক, সামান্য যে কোনও দায়িত্ব নিয়ে সাংঘাতিক ডাক হাঁক পাড়ত। পাড়াপড়শিদের ফাইফরমাশ খাটত বিনয় বিধায়। আশপাশের বিশ গাঁয়ের লোকের কাছে ব্রজগোপাল ছিল অপরিহার্য লোক। ব্রিজ খেলার কারও পার্টনার না জুটলে ব্রজগোপাল তিনক্রোশ বর্ষার গেঁয়ো রাস্তা ঠেঙিয়ে যেত। খেলতে। পারত না তেমন, ভুলভাল ডাক দিত। পার্টনার রাগারাগি করলে অমায়িক হাসত। সবাই জানে, এমন নিরীহ লোক হয় না। কিন্তু বাড়িতে সে লোকের অন্য চেহারা। পুরুষ সিংহ যাকে বলে। সোমেনরা মার কাছে শুনেছে, বারোটা রাতে দেড়সের মাংস আর তিনজন উটকো অতিথি জুটিয়ে এনে মাকে দিয়ে সেই রাতেই বাধিয়ে ভোর রাতে খেয়ে বিছানায় গেছে। তিথি না মানা অতিথির জ্বালায় মা অতিষ্ঠ, বাড়ির লোকজন জ্বালাতন। সারা যৌবন বয়সটা বাবাকে রোজগার করতে কেউ দেখেনি। দাদুর জমিন্দিরেত আর সেরেস্তার চাকরির আয়ে সংসার চলত। নেশাভাঙ ছিল না বটে, কিন্তু বাড়ির জিনিসপত্র, এমনকী নিজের বিয়ের শাল, আংটি, ঘড়ি পরকে বিলিয়ে দিতে বাধেনি। সোমেনরা জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখেছে বাবা বাড়ি ফিরলেই মার সঙ্গে ঝগড়া লাগে। প্রথম প্রথম সে ঝগড়ার মধ্যে মান-অভিমান ছিল। মানভঞ্জনও তারা লুকিয়ে দেখে হেসে কুটিপাটি হয়েছে। বাবা মার পায়ে মাথা কুটেছে, আর মা খুশিয়ালি মুখে ভয়-পাওয়া-ভাব ফুটিয়ে বলছে, পায়ে হাত দিয়ে আমায় পাপের তলায় ফেলছ, আমি যে কৃষ্ট হয়ে মরব। কিন্তু ক্রমে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা দেখেছে ঝগড়ার রকম পালটাচ্ছে। তখন দাদু বেঁচে নেই, দেশ ভাগ হয়েছে। অপদার্থ বাবা কোনওখানে জমি দখল করতে পারল না। ভাড়াটে বাড়িতে সংসার পেতেছে। তবু ধাত পালটায়নি। দু-তিনরকমের চাকরি করেছে বাবা সে সময়ে। প্রথমে ভলান্টিয়ার, তারপর রেশনের দোকান, কাপড়ের ব্যাবসা। কোনওটাই সুঝিযে হয়নি। তবে প্রচুর লোকের সঙ্গে পরিচয় থাকার সূত্রে, সবশেষে বেশি বয়সে একটা সরকারি কেরানিগিরি জুটিয়ে নেয়। কিন্তু বার ছুট নেশা ছিল সমান। সোমেন মনে করতে পারে, তারা শিশু বয়সে দেখেছে দিনের পর দিন বাবা বাড়ি নেই। বনগাঁ থেকে কৃষ্ণনগর পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গার বাবা যেত উদ্বাস্তুদের তদারক করতে কিংবা কোনও মচ্ছবের ব্যবস্থায়, সংকীর্তনের দলে। রেক্সাওটাই কাজেয় কাজ নয়। বাড়িতে মা আর চারটি শিশু-সন্তান একা। তখন মা আর বাবার বাগডায় মান-অভিমান মরে যেতে লাগল। এল গালাগালি। না বলত শয়তান, বেইমান, বাবা বলত নিমকহারাম, ছোটলোক। তখন বাবা বাড়িতে না এলেই ছায়া ভাল থাকে। পরস্পরের প্রতি আক্রোশ দেখে তাদের মনে হত, মা-বাবার এবার মারামারি লাগবে। মারামারি লাগত না। কিন্তু বাবা আরও বারমুখে হয়ে যেতে লাগল। পশ্চিজনে বলত, ব্রজগোপালের মতো সচ্চরিত্র লোক হয় না, অমন নিরীহ আর মহৎ দেখা যায় না। সোমেনরাও সেটা অবিশ্বাস করত না। বাইরে লোকটা তাই ছিল। নেশাভাঙ বা মেয়েমানুষের দোষ নেই, বাগড়া কাজিয়া মেটায়, পাঁচজনের দায়ে-দফায় গিয়ে পড়ে। অমায়িক, মিষ্টভাষী, অক্রোবী। তাকে ভালবাসে না এমন লোক নেই। মা ছিল। একটিমাত্র মানুষ যার সংস্পর্শে এলেই বাবার চেহারা যেত পালটে। এবং ভাইস ভার্সা। বড় হয়ে তারা ভাই-বোনেরা বাবা-মায়ের স্থায়ী ঝগড়াটা মিটিয়ে দেবার অনেক চেষ্টা করেছে। বাবা কিকে মা আলাদাভাবে কেউই লোক খারাপ ছিল না। দাদা একবার মা-বাবাকে টাকা-পয়সা দিয়ে কুড়ো বয়সে লেট হানিমুন করতে পাঠালে পুরীতে। বিশ্বাস
পৃষ্ঠা:০৭
ছিল, সমুদ্রের বিশাল বিস্তারের সামনে, আর তীর্থের গুণে যদি দুজনের মধ্যে একটা টান জন্মায়। কিন্তু মা বাবা খড়গপুর পার হতে পারেনি। সেখান থেকে ফিরতি ট্রেনে দুই আলাদা কামরায় চড়ে দুজনে ফিরে এল। বাসায় ফিরল আলাদ্য ট্যাক্সিতে। কথা বন্ধ। বালা রিটিনবার করার পর অবস্থা উঠল চরমে। তখন বাবা কিছু বেশি সময় বাসায় থাকত। তখন ঝগড়াটা দাভাল, মা বাবাকে বলত, তুমি মরো, বাবা মাকে বলত-আমি মরলে বুঝবে, দুনিয়াটা হাতের মোয়া নয়। লজ্জার কথা এই, ততদিনে দাদার বউ এসেছে, তাদের ছেলেপুলে হয়েছে। দিদিদের শ্বশুরবাড়ির লোকেরা, জামাইরা আসাযাওয়া করে। তখন মা-বাবা দুজনেই ছেলেমেয়েদের নিজের নিজের দিকে সাক্ষী মানতে শুরু করেছে। বুড়ো বয়সের স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ায় সবচেয়ে বড় দরকার হয় সাবালক ছেলেমেয়েদের সমর্থন। মার পাল্লাই ছিল ভারী। বাবা অভিমানে বাড়ি ছাড়ল। বাবার বাড়ি ছাড়াটা তখন নিতান্তই প্রয়োজন। একথা সত্যি যে, একমাত্র দাদা ছাড়া বাবার প্রতি তাদের আর কোনও ভাইবোনেরই তেমন টান নেই। ছেলেবেলা থেকেই তারা মাকে জানে। বাবার সঙ্গ তারা কদাচিৎ পেয়েছে। কাজেই, বাবা বাড়ি ছাড়ায় কেউ তেমন দুঃখ পায়নি। দাদাও ন্য। বাবা লোকটা বাউন্ডুলে হলেও তার একটা খুব বড় শখ ছিল। জমি। দেশ গাঁয়ের লোবের জমির টান থাকেই। বাবার কিছু বেশি ছিল। মার গগুয়ের কিছু গয়না বেচে বহেরুর হাতে দিয়েছিল সেই দেশ ভাগাভাগির কিছু পরেই। বহেরু মার নামে ছ’বিখে চাষের জমি কিনেছিল। আর নিজের খামারবাড়ির পাশে একটু বাজুজমিও। সেই জমিটা তারের বেড়ায় ঘেরা হয়ে পড়ে আছে। রিটায়ারমেন্টের সময়ে বাবা প্রায়ই ছেলেমেয়েদের এবং মাকেও বলত গোবিন্দপুরে বাড়ি করে সকলে মিলে থাকার কথা। কিন্তু ততদিনে তার ছেলেরা কলকাতার জীবনের স্বাদ পেয়ে গেছে। কেউ এল না। বাবা গৃহত্যাগ করে এল একা। মাঝে মাঝে যায়। দু’মাসে ছ’মাসে একবার। চিঠিপত্র দেয় মাঝে মাঝে। দাদা কয়েকবার দেখা করে গেছে। কেউ এলে বাবা অভিমান করে রাগ করে বলে-কেন এসেছ? আমি বেশ আছি। সোমেন জানে, সংসারের প্রতি, পরিবারের প্রতি বাবার কোনও টান আর নেই। তারাও বাবার কথা ভাবে না বড় একটা। আর পাঁচজন নিম্পর লোকের মতো বাবাও একজন। কোনও টান ভালবাসা, দেখার ইচ্ছে কংনিীও বোধ করেনি সোমেন। গত পাঁচ-হ বছরের মধ্যে সে বাবাকে দেখেছে এক-আধবার। খুঁড়ো মতো, টান টান চেহারার একজন গ্রাম্য লোক, ঢোলহাতা পাঞ্জাবি আর যুক্তি পরা, সদর থেকে বউদি বা দাদার ছেলেমেয়ে, কিংবা ঝি-চাকরের কাছে বাছিত লোকের কুশল জিজ্ঞাসা করে চলে যাচ্ছে। ঘরে ঢুকত না, বাড়ির জলটলও খেত না-কিন্তু ফিরে আসবার সময় সিঁড়ি ভাঙত আস্তে আস্তে। দু-একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাত। জোরে গলা খাঁকারি দিত। এ দৃশ্য সোমেন নিজেই দেখেছে। কিন্তু কচালে বুড়োর সঙ্গে আগ বাড়িয়ে কথা বলার ইচ্ছে হয়নি। বলতে কী, বাবার চেহারাটা ভুলেও গেছে সোমেন। দেখা হলে হয়তো চট করে চিনতেই পারবে না। সোমেনের জামার বুকপকেটে বাবাকে লেখা মার একটা ছোট্ট চিরকুট আছে। তাতে লেখা-তোমার কাছে কোনওদিন কিছু চাইনি। আমাকেও কিছু দিলে নয় তুমি। তোমার ইন্সিওরেন্সের পলিসিটা পেকেছে। আমার ইচ্ছ্য, ওই দশ হাজার টাকায় এখানে একটু জমি কিনি, আমাকে না দাও, রণেনকে অন্তত দাও। ভাড়া বাড়িতে আর থাকতে ইদ্দ্য করে না। ইতি প্রণতা ননী।
পৃষ্ঠা:০৮
বোধ হয় বাবাকে লেখা মার এই প্রথম চিঠি। শেষ বয়সে। খোলা চিঠি, পড়তে কোনও বাধা নেই। আদর ভালবাসার কোনও কথা না থাক, তবু কেমন চমকে উঠতে হয় ‘প্রণতা, ননী’ কথাটা দেখে। ‘প্রণতা’ কথাটাকে বড় আন্তরিক বলে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় সোমেনের। এই চিরকুটটা বাবার হাতে দিতে সোমেনের বড় লজ্জা করবে। আবার একটু ভালও লাগবে। ভাল লাগবে ওই ‘প্রণতা ‘টুকুর জন্য। লজ্জা করবে টাকার প্রসঙ্গ আছে বলে। বাবা প্রভিডেন্ড ফান্ডের এক পয়সাও কাউকে দেয়নি। ইন্সিওরেন্সের টাকাটা কি দেবে? দাদাও আপত্তি করেছিল। কিন্তু মা শুাল না। বলল-আমাকে যখন ‘নমিনি’ করেছে তখন ও টাকা আমাদেরই প্রাপ, কোনওদিন তো কিছু দেয়নি। প্রভিডেন্ড ফান্ডের টাকাটা বহেরুই পাবে শেষ পর্যন্ত, তোরা বাপেরটা কিছু পাবি না। বাপের সবকিছু থেকে বঞ্চিত হবে কেন? ও পাগলের কাছ থেকে টাকা নিলেই মঙ্গল। নইলে পাঁচ ভূতে লুটে খাবে। তাই মার চিঠি নিয়ে আসা সোমেনের। টেবিলের ওপর কাগজপত্র পড়ে আছে, একটা স্বর্ণসিপুর যাওয়ার খল-মুড়ি, একটা দশবাতির ল্যাম্প, কিছু চিঠিপত্র, একটা সস্তা টাইমপিস টক টক বিকট শব্দ করে চলছে। চিঠিপত্রগুলো একটু ঘেঁটে দেখল সোমেন। কলকাতার কয়েকটা নার্সারির চিঠির সঙ্গে তাদের দেওয়া চিঠিও আছে। আর আছে আজেবাজে ক্যাটালগ, ক্যাশমেমো, কয়েকটা একসারসাইজ বুকের পৃষ্ঠায় সাঁটা কিছু গাছের পাতা, পাশে নামগোত্র লেখা। পুরনো মোটা একটা বাঁধানো খাতা। তার পাতা খুলে দেখল, প্রথম পৃষ্ঠায় বড় করে লেখা-ডায়েরি। তার পরের পৃষ্ঠায় লেখা-পতিত জমিটার ভেষজ লাগাইব। তার পরের পৃষ্ঠাগুলিতে পর পর কুলেখাড়া, ঘৃতকুমারী, কালমেঘ ও পুরাতন চালকুমড়ার গুণাগুণ। একটা পৃষ্ঠায় লেখা- ‘বুড়োনিমের শিকড় হইতে ন্যাবার ওষুধ হইতে পারে, ফকির সাহেব বলেছেন। তার পরেই লেখা–‘তাণ্ডবস্তোত্র জপ করিলে আজম। সারে।’ তার এক পৃষ্ঠায়-ইজরায়েলের এক জ্যোতিষী বলিয়াছেন অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবী শাসন করিবে কিছু শুক্রবসন পরিহিত, দণ্ডধারী যোগীপুরুষ।’ এরকম কথা সর্বত্র। বোঝা যায়, বাবা কৃষি, ডাক্তারি, জ্যোতিষী, অকাল্ট ইত্যাদি সব কিছুরই চর্চা করে। ছেলেমানুষি ডায়েরির কোনও একটা পৃষ্ঠায় চিঠিটা গুঁজে রাখবে বলে শেষদিকের পাতা ওসটাতেই সোমেন দেখে একটা প্রায় সাদা পৃষ্ঠা। ঠিক তার মাঝখানে গোটা অক্ষরে লেখা-ভগবান, উইটি যেন সুখে থাকে। খাতাটা বন্ধ করে চুপ কমে ভাবে একটু। ঘরভরতি একটি আবছায়ার চৌখুপি। সোঁদা গন্ধ। হঠাৎ ওই গছ। তার। ই অন্ধকারটা সোমেনকে চেপে ধরতে থাকে। দমফোট লাগে বাইরের প্রাদে এসে যে বুকভরে শ্বাস নেয়। কী সবুজ, কী ধারাল রং প্রকৃতির। কী নিস্তব্ধতা। দির্ণম্বরের খোলের আওয়াজ এখন আর নেই। দূরে পাম্পসেটটা অবিরল চলেছে। এইখানে মানুষেরা বেশ আছে। মটর শাকের ক্ষেত পার হতে হতে এই বোব লাভ করে সোমেন। বড় বড় শুঁটি ঝুলে আছে। একটা-দুটো তুলে দানা বের করে মুখে দেয় সে। মিষ্টি। ভুরভুরে বেলেমাটির একটা ক্ষেত তছনছ হয়ে আছে। আলু ছিল বোধ হয়, উঠে গেছে। মাচানের পর মাচান চলেছে, বুদুল, সিম, বিন। যেন বা কেউ শালিমারের সবুজ এনামেল রঙে গাঢ় পোঁচ দিয়ে গেছে চারধারে। হাতের মুঠোয় ধরা যায় না, বিশাল বড় গাঁদা ফুল
পৃষ্ঠা:০৯
জঙ্গলের মতো একটা জায়গাকে গাঢ় হলুদ করে রেখেছে। মহানিদের তলায় ঋসে আছে দিগম্বর। গাছের গুঁড়িতে ঠেস। নাবা বুকের দিকে স্কুলে পড়েছে। ঘুম। পাশে বশংবদ যোগ। রঙিন সুতোর জাল দিয়ে খোলের গয়ে জামা পরানো হয়েছে। লাল-সাদা পুঁতির গয়না খোলের গায়ে। কয়েকটা গাঁদা ফুল গোঁয়া আছে। দিগম্বরের নত মুখ থেকে সুতোর মতো লালা ঝুলে আছে। শীতের মিঠে রোদ পড়ে আছে গুয়ে। ঘুম থেকে উঠে আবার বাজাবে। শুধু তাড়া মুমু তাড়া, যুধু তাড়া। আমের বোল এসে গেছে। পোকামাকড় পেঁপে ধরেছে গাছটাকে। ঝনঝন শব্দ বাজছে। একটা গেন্ডালার নীচে একপাল বাচ্চা বসেছে বইখাতা শেলেট নিয়ে। বুড়োমতো একজন পড়াচ্ছে। পোড়োরা তাকে ছোট ছোট বেলের মতো মাথা ঘুরিয়ে দেখল। সোমেন জায়গাটা পার হয়ে আসে। কুলগাছের তলায় দুটো সাঁওতাল মেয়ে বসে আছে। আরগটায় ম ম করছে পাকা ফুলের গন্ধ। একটা মেয়ে মুখ থেকে একটা সানা বিচি কুরুক করে ছুঁড়ে দিল, আর একটা কুল মুখে পুরল। বহেরুর দ্বিতীয় পক্ষের মেজো মেয়েটাকে কাল রাতে একঝলক সেয়েছিল। তখন গায়ে ছিল একটা খন্দরের চাদর। গোপদা মুখ, শ্যামলা রং, বেশ লম্বা, এছাড়া বেশি কিছু বোঝা যায়নি। সৌন্দর্য ছিল তার চোখে। বিশাল চোখ, মণিদুটো এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত অনেক সময় নিয়ে ঢলে পড়ে। দশবাতির আলোয় চোখ থেকে এক বশা আগুন ঠিকরে এসেছিল সোমেনের হৃৎপিণ্ডে। সেই মেয়েটিকে এই সকালের রোদে আবার দেখা গেল। গায়ে চাদর নেই। সতেজ লাউডগার মতো লম্বাটে শরীর। একটা ঝুডি বয়ে এনে উপুড় করে দিন্দ সাঁওতান মেযেদুটোর একটার কোঁচড়ে। সোমেন দেখল, মরা ইনুর। মেয়েদের একজন সন্দিহান চোখ তুলে বলে বিষ দিয়ে মারোনি তো দিদি? মেয়েটি কপালের চুলের ওছি সরিয়ে অবহেলা আর অহংবারভরে বলল-বিদ দিয়ে মারব কেন? আছড়ে আছড়ে মেরেছি। এই কথা বলে সে চোখ তুলে সোমেনকে লক্ষ করে। কিন্তু তেমন ভ্রুক্ষেপ করে না। বহেরুর খামারবাড়িতে সর্বত্র ভিটামিনের কাজ দেখতে পায় সোমেন। লাউডগার মতো ওই মেয়েটির অস্তিত্বের ভিটামিনং কিছু কম নয়। এ যে বইেকর মেয়ে তা একনজরেই বোঝা যায়। চোখা নাক, দুরন্ধু স্ট্রেট, আর চোখ পুরেতে নিষ্ঠুরতা। জয়ন্ত ইঁদুর হাতে ধরে আছড়ে মারা ওর পক্ষে গুেড়া শক্ত নয়। সাঁওতাল মেয়েগুছো উঠে দাঁড়িয়েছিল। লম্বাদনের পেট-কৌচড়ে ইঁদুরের স্তূপ। সোমেন করেকণা গিয়ে চইয়েটাকে জিজ্ঞেস করল খাবে? অবাক চোখে অচেনা লোকের দিয়ে চায় মেয়েটি। খাড় নাঞ্চল। খাবে। -কীভাবে খাও? পুড়িয়ে। সাঁওতাল বলতে যেমন সুঠাম শরীর বোঝায় এ মেয়েটির তা নয়। একটু ঢিলে শরীর, বহু সন্তান ধারণের চিহ্ন, কংসের মেচেতা, আর ধুলোময়লা-বসা প্রস্তাব। প্রশ্ন শুনে দুখ-সাদা দতে দেখিয়ে হাসে। বলে-আংগে পুড়িয়ে নিই, তারপর কেটেকুটে বাঁদি, যেমন সবাই রাঁধে। দাড়াল না। কহেরুর বাগান এখানে শেষ, ঢালু একটা পায়ে হাঁটা-পথ মাঠে নেমে গেছে। সেইদিকে নেমে গেল দুজন। সোমেন মুখ ফিরিয়ে বহেরুর মেয়েকে দেখল। দাড়িয়ে আছে এখনও। ব্লাউজের হাতা ফেটে হাতের স্বাস্থ্য ফুটে আছে, ভগবগে শরীরে আট করে শাড়ি
পৃষ্ঠা:১০
জড়িয়েছে বলে ধারাল পরীর ছোবল তুলে আছে। পিছনে একটি কামিনী ঝোপের চালচিত্র, পায়ের কাছে কলাবতী ফুলের গাছ।
দুই
বহেরুর চার-পাঁচটা মেয়ের সব কজনারই বিয়ে হয়ে গেছে। তার মধ্যে দুজন গানীর ঘর করে, একজনের বর ঘরজামাই, আর দুটো মেয়েকে তাদের স্বামী নেয় না। এ সবই সোমেন জানে। এ মেয়েটা ফেরতদের একজন, বিন্দু। বহেরুর কাছ থেকে ধানের দাম বুঝে নিতে কয়েকবার এসেছে সোমেন। তখন এইসব মেয়েরা ছোট ছিল। ধুলোময়লা মাখা গেয়ে গরিব চেহারা। ভিটামিনের প্রভাবে লকলকিয়ে উঠেছে। সিথিতে সিঁদূর আছে এখনও। বাকি সিঁদুর, অস্পষ্ট। মেয়েটা সোমেনকে দেখে একটু ইতস্তত করে। সর্দি হয়েছে বোধ হয়, বাঁ হাতে একটা ন্যাকড়ায় বাঁধা কালোজিরের পুঁটুলি। সেটা তুলে বারকয় শুকল। অন্যদিকে চেয়ে বলে- আপনার চা হচ্ছে। ঘরে দিয়ে আসব।-খাবেন না? আপনার জন্যই হচ্ছে।-দিতে পারো।-অতদূর নিয়ে যেতে ঠান্ডা মেরে যাবে। আমাদের ঘরে আসুন না, বসবেন।সোমেন মাথা নাড়ে। একা ঘরে মন টেকে না। এদের ঘরে দু-দণ্ড বসা যেতে পারে। আগেও এসেছে সোদেন, গন্ধ বিশ্বেসের কাছে কত গল্প শুনেছে বসে। বহুকাল আর আসা নেই বলে একটু নতুন নতুন লাগে। বহেরুর তখন এত জাতিগুটি ছিল না। একা বোকা হেলে চাষা গোছের ছিল তব্দ। এখন তার উন্নতির সংকন ছড়িয়ে গেছে চারধারে। নিষ্কর্মী, ভবঘুরে আত্মীয়রা এসে জুটেছে। সংসার বেড়ে গেছে অনেক। বহেরও বোধ হয় তাই চায়। ভবিষ্যতের বহেরু গাঁয়ে থাকবে তারই রক্তের মানুষ সব।পুরো চত্বরটাই বহেরুর বসত, তবু তার মধ্যেও ঘের-বেড়া দিয়ে আলাল আলাদা বাড়ির মতো বন্দোবস্ত। কামিনী বোপ্তটা তীন হাতে ফেলে প্রন-সেদ্ধ-করার গন্ধে ভরা একখানা উঠোনে চলে আসে সেভেন মৈয়েটির পিছু পিছু। জিজ্ঞেস করে-গন্ধ বিশ্বেস নেই? মেয়েটি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়, চোখ ছোট করে বলে থাকে। তবে পাগলমানুষ।-কোথায় চোদ তার কাছে কত গল্প শুনেছি।মেয়েটা হমান এখনও গল্প বলে। সব আগডুম বাগডুম গল্প। ওই বসে আছে। হাত তুলে বড় উঠোনের একটা প্রান্ত দেখিয়ে দিল।কটকটে রোদে সাদা মাটির উঠোনটা ঝলসাচ্ছে। চাটাই পাতা, ধান শুকোচ্ছে অনেকটা জায়গা জুড়ে। তারই একপ্রান্তে বসে আছে বুড়ো-সুড়ো এক মানুষ। বহেরু গাঁয়ে মানুষের আয়ুর ফেন শেষ নেই। গন্ধ বিশ্বেস মরে গেছে বুঝি। যখন দাদা বা বাবার সঙ্গে এক-আধদিনের জন্য আসত সোমেন তখন সে হাফপ্যান্ট পরে, গন্ধ বুড়ো। এক সময়ে ডাকাবুকো শিকারি ছিল, সাহেবদের সঙ্গে বনে-জঙ্গ। যাবো পাহাড়, সিলেট, চাটগাঁ-কত জায়গায় ঘুরে ঘুরে ব্যাবসা করেে
পৃষ্ঠা:১১
গল্প করত দোমেনের কাছে। উসকে দেওয়ার দরকার হত না, নিজে থেকেই বলত। কবেকার কথা সব। সোমেনের মনে হত, বুঝি বা ইতিহাসের পাতা থেকে খসে পড়েছে গন্ধ। এখনও সেই লোকটা বসে কাক শালিক তাড়িয়ে বান বাঁচাচ্ছে। হাতে একটা তলতা বীশের লগি। আশপাশে গোটা চোন্দো পনেরো সাদা সাদা কেড়াল তুলোর পুঁটলির মতো পড়ে রোদ পোয়াচ্ছে। তিন-চারটে দিশি কুকুরও হয়েছে বেড়ালদের গা ঘেঁষে বসে। পাশে একটা শূন্য কলাই করা বাটি। মুভি গেয়েছিল বোধ হয়।নাম গন্ধ, পদবি বিশ্বাস। কিন্তু সবাই বরাবর ডেকে এসেছে ‘গন্ধ বিশ্বেস’ বলে, যেন বা নামটা ওর পদবিরই অঙ্গ। শোনা যায়, বুড়ো বায়সে একটা ঝুঁড়িকে বিয়ে করে এনেছিল। সে গন্ধর সঙ্গে থাকতে চাইত না। কারণ, গন্ধর বিছানায় বিড়ালের মুক, কুকুরের সোম, বালিশে নাল শুকিয়ে দুর্গন্ধ। কিন্তু বউয়ের মনঞ্চুরির জন্য কিছু ছায়ান-কাটান দেবে, এমন মানুষ গন্ধ নয়। বউ তাই এক রাতে সরানরি গিয়ে দেওর বহেরর দরজায় ধাক্কা দিল শুতে দাও দিকিনি বাপু। না ঘুমিয়ে গতর কালি হয়ে গেল। সেই থেকে সে হয়ে গেল বহেরুর দ্বিতীয় পক্ষ।ঝগড়া-কাজিয়া তেমন কিছু হয়নি। কোল-অন্ত প্রাণ গন্ধ, কুকুর তার ভাবী আদরের। বউ তাদের বেশি কিছু নয়। বিয়ে করলেই আবার একটা বড় হয়। কিন্তু গন্ধ বখেব্যয় যায়নি। একই সংসারে একটু আলাদা হয়ে থেকে গেছে। সেই বাউ-ই এখনও ভাত বেড়ে দেয়, বাতের ব্যথায় রসুন-তেল গরম করে দেয়, বকাঝকাও করে। গুনিকে বহেরুর সন্তান যারণ করে। কিন্তু সিঁদূর পরে গম্বর নামে।এরকম যে একটা গোলমেলে সম্পর্কের মধ্যে রয়েছে গন্ধ, তাকে দেখলে মনে হয় না। বৈরাগীর মতো বসে আছে। মুখময় বিজবিজে দাড়ি। ছানি কাঁটা হয়নি, দু-চোখে স্পষ্ট মুসুরির ডালের মতো ছানি দুটো দেখা যায়। শীতে কাহিল হয়ে একটা কাঁথা জড়িয়ে বসে, গায়ে বহু পুরনো মিলিটারি পুলওভার, নিম্নাঙ্গে ময়লা ধুতি। বৃতিতে ঢাকা আছে ফুটবলের সাইজের হাইড্রোসিল। চলাফেরায় ভারী কষ্ট তার। এই নিয়ে কত হাসাহাসি করেছে সোমেন।সামনে সাদনে বসতেই বেড়ালগুলো মিটমিটে চোখে একটু চেয়েই চোখের ফসফরাস। ঢেকে ফেলল। কুকুরগুলো একটু গরুর শব্দ করে শুয়ে-শুয়েই লেজ নাড়ে।-গন্ধ, চিনতে পারো।গন্ধ স্থবিরতা থেকে একটু জাগে। রোদ থেকে হাতের পাতায় চোখ আড়াল করে বলে কিছু দেখি শাহ আমি লেন্সেন, এজকর্তার ছেলে।-না। ছোট।হাসে গন্ধ। বুঝদারের হাসি। হাত তুলে একটন মাপ দেখিয়ে বলে-এইটুকুন ছিলেন।আসেন না তো! বাপের জন্য প্রাণ টানে না?
পৃষ্ঠা:১২
-আছে। খাবে?হাত বাড়ায় গন্ধ। সোমেন সিগারেট দেয়। দন্তহীন মুখে সিগারেট বসিয়ে বড় আগ্রহে টানে গন্ধ। কাশে।-কাশছ তো, যেয়ো না। সোমেন বলে। হাপির টান তুলে কাশে গন্ধ, চোখে জল এসে যায়। হাতের উলটো পিঠে চোখের জল মুছে বলে-গত কই তত আরাম। এ কাশি আরামের। কতকাল গাই না কেউ নেয় ন্য। সিগারেটের গোড়া লালায় ভিজে গেছে। খুঃ করে জিভ থেকে তামাকের আঁশ ছিটিয়ে গন্ধ চোখ বুজে টানে। ঝপাস করে ধানের ওপর নেমে আসে কাক। গন্ধ হাত তুলে তাড়ায়-হেই।-কেমন আছ গন্ধ? ভালই। বহেরু কষ্ট দেয় না।-চাটা কাটাও না কেন?-দেখার কিছু নাই। কাটায়ে হবেন কী। হাতাতে হাতায়ে সব বুঝতে পারি। বেলাও ঠাহর পাই, বুয়া দুষ্য। খামোখা কাটিায়ে হবেটা কী? খরচ।-কিং পরসায়ও কাটে। সোমেন বলে-ক্যাম্প করে কাটে।সিগারেটে প্রাণভরে টান মারে গন্ধ। কয়শে। বড় আরাম পায়।সামলে নিয়ে কলে- বহেরুর খুব বাড়বাড়ন্ত দেখলেন সব?হাতের গুণ। গাছ ওরে ভালবাসে। আমারে ভালবাসে কুত্তা বিড়াল।বহেরুর মেয়ে বিন্দু পেয়ালা-পিরিচে চা নিয়ে আসে। পিরিচে চা চলকে পড়েছিল, সেটুকু ঢেলে ফেলে দিয়ে পেয়ালা বসিয়ে যত্নে চা দিল। দুটো বিন্তুট।শব্দে ঠাহর পেয়ে গন্ধ চেয়ে বলে, বিন্দু নাকি? কী দিলি এজকর্তার ছেলেরে? চা?-কেন? তুমি খাবো?-খাই।রজকর্তার ছেলেকে এ রস বাওয়াবি না? -ও রস তো শীতে হিম হয়ে আছে, বেলে ঠান্ডা লাগবে না।-একটু অক্টোরে দে।-দেবো।বলে বিন্দু চলে যায়। আর আসে না।সোমেনের চা যখন শেষ হয়ে এসেছে প্রায়, তখন গন্ধ বলে, তলানি থাকলে একটু দিকেন। এঁটো খাবে? সব খাই।সংকোচের সঙ্গে কাপটা একটু চা সুকু এগিয়ে দেয় সোমেন। বড় শীত। গন্ধ কাপটর গালে চেপে ধরে তাপটা ঢোয়। আস্তে আস্তে ঢুকে টুকে খায়। বলে-বহেক কষ্ট দেয় না। এরা
পৃষ্ঠা:১৩
দেয়। মরণগুলি বক্কার। সব মাগি বজ্জাত। দেখে বলে কিছু দেয় না। উপোস থাকি।বলে নির্ধিষ্ট মনে চা যায় গন্ধ। অল্প একটু তলানি, টপ করে ফুরিয়ে যায়। গন্ধ আঙুল দিয়ে কাপের তলার তদানির চিনি গোঁজে। গাঁ ঘরের চা, চিনি একটু বেশিই দেয় ওরা। সবটা গলে না। গন্ধ আঙুলের ডগায় ভেজা চিনি ভুলে এনে আঙুল চোষে। একটা বেডাল নির্দ্বিধায় তার কোলে উঠে আসে, কাপটা শোঁকে। মুখ থেকে আঙুলটা বের করে বেড়ালের মুখে করে গন্ধ। বেড়ালটা দু-একবার চাটন দেয়। তারপর নির্জীব হয়ে কোলেই বসে ঘুমোয়।-রঙ্গকর্তার ঘেঁজে আলেন নাকি।হয়। কিন্তু বাবা তো নেই। গন্ধ চুপ করে থাকে একটু। মাঝে মাঝে মাথাটা বোধ হয় ঝিম মেরে যায়। ধানের ওপর শালিখের হুড়াহুড়ি শুনে হাত বাড়িয়ে লগিটা নেয়। বলে-হেঃ ই। তারপর বলে আসে যাবেন যে-কোনও দিন। রথকর্তার পায়ের নীচে সুপারি, আছেন ক’দিন?আজই চলে যাব। বাড়িতে ভাববে।বহেরুর কাণ্ডকারখানা দেখে যাবেন না। কত জমি জোত, ধান-পান, বিশ-তিরিশ মুনিশ খাটে। বহুত পয়সা বহেরুর।আনি।গন্ধ হাত বাড়িয়ে বলে-দেন একটা।গন্ধ হাসে, চোখ ছোট করে বলে-সাদা কাঠি।সোমেন বুঝতে পেরে একটা সিগারেট দেয়।গন্ধ সিগারেটটা নাকের কাছে নিয়ে কাঁচা সিগারেটের গন্ধ নেয়। হাত বাড়িয়ে বলে- দেশলাইটা রেখে যান, পরে বাব।সোমেন দেশলাই দিয়ে দেয়। খালি কাপটা নিয়ে বেড়ালের খেলা শুরু হয়ে গেছে। শক্ত ঝুনো উঠোনে টন্ডাস করে ক্যাপটা ঢলে পড়ে। গন্ধ মুখ তুলে বলে-ব্রজকর্তারে বুঝায়ে-সুঝায়ে নিয়ে যান বাড়ি। বুড়ো বৃছদে কখন কী হয়।সোমেন চুপ করে থাকে। মনে পড়েন ভগবান, উহারা যেন সুখে থাকে। গন্ধ নিচু গলায় বলে এখানে এই শালা পাজি। বহেরু ভাল। কষ্ট দিতে চায় না। কিন্তুমাগিগুলো-এগারো হাতে কবি নাই যার ওই গুলান খচ্চর। কত গল্প শেমীতে পদ্ধ গেছি সব ভুলে গেছ?গন্ধ ফোকলা মুখে হাসে হঠাৎ।-মনে থাকে না কিছু।মানুষের বুড়ো বয়সের কথা ভেবে ভারী একটু দুঃখ হয় সোমেনের। তার বাপ দাদা গন্ধ বিশ্বেদের কাঁধেচড়েছে। সেই আমান মানুষটা কেমন লাতন হয়ে বসে গেছে এখন।-রাই গন্ধ। বলে সোমেন ওঠে।পূবের মাঠ রবিশস্যের চাষ পড়ে গেছে। সেই চৈতি ফসলের জমি চৌরস করছে বহেরুর সোকতান। দিগন্ধরের বোলের শব্দ ওঠে হঠাৎ। পৃথিবীকে আনশ্চিত করে বয়ে যেতে থাকে
পৃষ্ঠা:১৪
শব্দ। গাছগাছালির ছায়ায় ছায়ায় রোদের চিকরি-মিকরি। বুনো গন্ধ, মাটির সুবাস। বেলায় বিন্দু এল তার রান্নার জোগাড় নিয়ে। ঘরের পাশেই বাবার ছোট্ট পাকশাল। কাঠের জ্বলে রান্না হয়। স্তূপ করে কাটা আছে কাঠ, পাঁকাঠি। কাঠের ছালে অনভ্যস্ত রান্না রাঁধতে কাল তার চোখ জ্বলে ফুলে গিয়েছিল। বিন্দুকে বলল-আজ তুমিই বেঁধে দিয়ে যাও। আমার ইচ্ছে করছে না। বিন্দু চোখ বড় করে বলে-আমি বাঁধব। কাকা তা হলে কেটে ফেলবে। কাকা। কাকা আবার কো কিছু মাথাটি নামিয়ে গীকোটির আগুনে কাঠের আল তুলতে তুলতে বলে-কে আবার। বহের বিশ্বেষ। ভারী অবাক হয় সোমেন। বহেরু ওর কাকা হয় কী করে? সবাই জানে, বিন্দুর মা বহেরুর দ্বিতীয় পক্ষ। বিন্দুও কি জানে না যে এই বুড়ো, অক্ষম গন্ধ বিশ্বেসের বিকৃত অঙ্গ থেকে ও জন্মায়নি? বিন্দু মুখ তুলে বলে-চাল ধুয়ে দিয়েছি, তরকারি মাছ সব কোটিন আছে, মশলা বেটে দিয়েছি, আমি সব দেখিয়ে দেব, বেঁধেবেড়ে নিন। -কলকাতায় হোটেলে রেস্টুরেন্টে আমরা বারো জাতের ছোঁয়া খাই। -সে কলকাতায়। এখানে নায়। অগত্যা উঠতে হয় সোমোকে। গনগনিয়ে আঁচ ওঠে। বড় তাপ, ধোঁয়া। বিন্দু এটা-ওটা এগিয়ে দেয়, উপদেশ দেয়, হাসেও। এত কাছাকাছি এমন ভগবগে মেয়ে থাকলে কোন পুরুষের না শরীর আনচান করে। সোমেনের কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়-করল না। বরং সে কেমন নিবু নিবু কোষ করে মেয়েটার সামনে। কেন যে। যে কি ওই প্রচন্ড শরীর, প্রচুর ভিটামিন, প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ক্লোরোফিলে ওরা অতিরিক্ত উগ্রতার জন্য? হতে পারে। অত যৌকন সোমেনের সহ্য হয় না। ওই উন্ন শরীরের সঙ্গে টোত্তর দেওয়ার মতো ভিটামিন তার নেই। মেয়েটা কিন্তু টোকর দিতেই চায়। ছলবল করে কাছে আসে, যেন বা ছুঁয়ে দেবে, ঘাড়ের ওপর দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলে, ফুলকপিস্টা আরও সাঁতসান, নইলে স্বাদ হবে না। তার খাস সোমেনের ঘাড়ে লাগে। সোমের হতে বসে, মেয়েটা অমনি জিভ কেটে বলে-টুয়ে দিচ্ছিলাম আর কী। তারপর হট্রাম। সোমেন নপুংসকের মতো ভাঁত বোধ করে মেয়েটির কাছে। বহেরুকে ও বারা ট্রাকে কেন তা কিছুতেই ভেবে পায় না। গা-টা একটু দিন দিন করে তার। নিজের হিভেঙ্গে ভিটামিনের শা tha প্রোটিনের, বা ওইরকম একটিন কিছুর অভাব সে। সে চিরকাল বোধ করে এসেছে। বহেরুর খামারবাড়িতে এই যৌকন বরসে সেটা তার কাছে আর একটু স্পষ্ট হয়। সোমেন একটু অনয়েছে, সতর্কভাবে জিজ্ঞেস করে-শ্বশুরবাড়ি কতদূর? মেয়েটার মুখভার পালটায় না, হাসিখুশি ভাবটা বজায় রেখেই বলে কাছেই। বর্ধমান। -যাও-টাও না। -কেন? বনে না।
পৃষ্ঠা:১৫
সোমেনের আর কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস হয় না।মেয়েটা নিজে থেকেই আবার বলে আমারই দোষ কিছু। আমার শ্বশুর-শাশুড়ি ননদ দেওর কেউ খারাপ না।তবে?-যে-মানুষটাকে নয়ে শ্বশুরবাড়ি সেই লোকটাকেই আমার পছন্দ নয়। এমনি মানুষটা মন্দ না, দেহতত্ত্বটড় গেয়ে বেড়ায়, এক বেচিমের কাছে নাম নিয়েছে। নিরীহ মানুষ। তবে তার কোনও সাধ আহ্লাদ নেই। মেড়া। সে আমার পা চাটত, এমন বাবুক ছিল।তবে।-সেই জনাই তো বনে না। আমি লাঠেল মানুষ পছন্দ করি।সাদা দাঁতে চূড়ান্ত একটা অর্থপূর্ণ হাসি হাসল। সোমেন ভিতরে ভিতরে ‘আরও মিইতে যায়। সে কীরকম? সোমেন জিজ্ঞেস করে। ধামসানো আদর সোহাগ যেমন করবে, তেমনি আবার দরকার মতো চুলের মুঠ করবে। বাঁ হাতের কালোজিরের পুটলিটা নাকের কাছে ধরে শ্বাস টানে বিষ্ণু। চোখে চোখ রাখে। সোমেন চোখটা সরিয়ে নেয়। মেয়েটা পুরুচাটা। বুকের ভিতরাটা ওর গুর করে ওঠে সোমেনের, অস্বস্তি লাগে। একবার ভেবেছিল, আজ রাতটা কাটিয়ে কাল ফিরে যাবে কলকাতায়। বাবার সঙ্গে যদি দেখাটা হয়ে যায়। কিন্তু মেয়েটাকে তার ভাল লাগছে না। রাতবিরেতে এসে যদি ঠেলে ভোলে। কিছু বিচিত্র নয়। বহেরুর মেয়ে, নিজের পছন্দমতো জিনিস দখল পেতেই শিখে থাকবে। মনে মনে ঠিক করে ফেলে সোমেন, আজ রাতেই ফিরবে। অটটার কিছু পরে বোধ হয় একটা শনিবারের স্পেশাল ট্রেন যায় হাওড়ায়। বিকেল পর্যন্ত বাবার জন্য দেখে ওই ট্রেনটা ধরতে সুবিধে। ভিটামিনের অভাব তাকে কতটা ভিতু করেছে তা ভাবতে ভাবতে নেয়েখেয়ে দুপুরে ঘুমংলা দোমেন।বিকেলে জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখাহুল, বলল চলে যাবেনা পোষা বেজি কাঁধে বহেরু এল সে সময়ে।একটা কথা বলি।-এজকর্তই এখানে থাকে থাক। অযত্ন হবে না।। এখানে বামুন মানুষ নেই। ব্রহ্মকর্তাকে তাই ছাড়তে চাই না। আরামেই আছে। সোমেন উত্তর দিল না। উত্তর জানা নেই।একগোছা টাকা হাতে ধরিয়ে দিল বহেরু। কলল কোমরে আন্ডারপ্যান্টে গুঁজে নেবেন। ঠাকরুনকে বলবেন এবার ধানের দর ভাল। আপনি না এলে মানি-অর্ডার করে দিতাম। আজ কী কাল।তিন-চাররকমের ডাল, কিছু আনাজপত্র, এক বোতল ঘনির তেল-এই সব গুছিয়ে দিয়ে যায় বিন্দু। ঋহেরুর লোক স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। বড় একটা চটের থলিতে ভরে দিয়েছে। বেশ ভারী, তবু বোধ হয় বওয়া যায়। হাত তুলে খলিব ওজনটা পরখ করছিল সোমেন, বিন্দু হেসে আঁচল চাপা দেয় মুখে। মেয়েটার সাহস বেড়েছে। কলস খুব মরুদ।
পৃষ্ঠা:১৬
সোমেন বোকা বনে যায় একটু। মনে পাল। ইচ্ছে হল, থেকে গেলেও হত আজ রাতে। সে এখনও তেমন করে মেয়েমানুষের গা ছোয়নি। পরক্ষণেই ভাবে, সে ধরেই নিচ্ছে কেন যে বিন্দু তার সঙ্গে আজ রাতেই একটা কিছু হেস্তনেস্ত করতে চায়। চা খেয়ে সে গেল বিন্দুর সঙ্গে ময়ূরের ঘর দেখতে। বহেরুর বড় শখ, একটা চিড়িয়াখানা করে তার বহেরু গাঁয়ে। আপাতত গোটকেয় পাখি, একটা ময়ূর, দুটো হনুমান নিয়ে ব্যাপারাটা শুরু হয়েছে। পরে আরও হবে। উত্তরের সবজিক্ষেতের শেষে বহেরুর সেই সাধের চিড়িয়াখানা। জালে ঘেরা হর, উপরে অ্য্যাসবেসীদের ছাউনি। কিছু দেখার নেই। ময়ূর ঝিমোচ্ছে, হনুমান দুটো বিরক্ত। বিচিত্র কয়েকটা পাখি ঠোঁটে নখে নিরর্থক জাল কাটার চেরা করছে। দু’মিনিটেই দেখা হয়ে যায়। বিন্দু চিড়িয়াখানার পিছনে একটা মখমলের মতো মাসজমি দেখিয়ে বলল-মন খারাপ হলে আমি এইখানে এসে বসে থাকি। ভারী নিরিবিলি জায়গা। কেউ টেরই পায় না। জায়গাটায় দু-চার পা হাঁটে দুজনে। সোমেন ভাবে, প্রেমের মূলেও আছে ভিটামিন। এই ডগবগে মেয়েটার কাছে এখন ইচ্ছে করলেই প্রেম নিদেন করা যায়। মেয়েটাও মুখিয়ে আছে। অবশ্য এখানে প্রেম বলতে শরীর ছাড়া কী। মেয়েটাও কথায় প্রেম বুঝঝার মতো মানুষ নয়। কিন্তু ভিটামিনের অভাবে সোমেন শরীরে জ্বর বোধ করে, ভয় পায়, নিজেকে অভিশাপ দেয়। হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে বিন্দুর মুখের দিকে চায়। মাধথার চুলে অ্যামিনো অ্যাসিডের কাজ। ঘন গহীন চুলে সূক্ষ্ম সিঁথি। মেটে সিঁদুরটুকু ঠিক আছে। গায়ে খদ্দরের হলুদ চাদর, পায়ে হাওয়াই। মুখের গোলভাবটুকুর মধ্যে বেড়ালের কমনীয়তা, এবং বেড়ালেরই হিংস্রতা ফুটে আছে। খর চোখ। সোমেন বলতে যাচ্ছিল-ধরো বিন্দু, যদি আজকের দিনটা থেকেই যাই। বিন্দু দূরের দিকে অকারণ তাকায় মাঝে মাঝে। এখনও তাকিয়ে ছিল। সোমেন কিছু বলার আগেই তার দিকে চেয়ে বিন্দু বলল রজকর্তা আসছে। -কই? বাঙা হয়ে জিজ্ঞেস করে সোমেন। টালিগঞ্জের জমিটা তাদের দরকার। বড্ড -বাই যে, মাঠের মাঝ দিয়েও
.॥ তিন।
একটা মানুষ বহেরুর চৈতালি ফসলের ক্ষেত্র ধরে আসছে। কাছে এলে তার মছরগতি এবং ক্লান্তি বোঝা যায়। কালচে আামি বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত, তাতে রঙিন আলো, একটু কুয়াশার ভাপ জমে ঝুলে আছে মাগার ওপরে। একটা বিস্তৃতি পিছনে ফেলে আসছে বলেই লোকটাকে ছোট দেখায়। গায়ে র্যাপার, ধুতি, হাতে একটা ক্যাম্বিসের ব্যাগ। গেঁয়ো হাটুরে মানুষ একটা। বাবা বলে মনে করতে কষ্টই হয়।সোমেন বলল-তোমার চোখ সাংঘাতিক। এতদূর থেকে চিনলে কী করে?-চিনব না কেন। নিজেদের লোক। এব চলন-বলন সবই চেনা।সোমেনের ভিতরে একটা ছ্যাকা লাগে। নিজেদের লোক। তবু, ঠিক রখাই, বাক আর
পৃষ্ঠা:১৭
তাদের লোক তো নয়।একটু সময় নিয়ে মাঠ পার হয়ে আসেন রজগোপাল। খামারে ঢোকার রাস্তা কিছু উত্তরে। সেই দিকে আড়ালে পড়ে যান।বিন্তু মুখ ফিরিয়ে বলে-যাহ, খবর দিই গে।বিন্দু চলে যাওয়ার পরও যাসজমিটায় কিছুক্ষণ একা একা সিগারেট টানে সোমেন। বাবা জামাকাপড় কালে ছিতু হোক, তারপর দেখা করবে। আসলে, তার একটু লজ্জ্যাও করছে। গত কয়েক বছর তারা চিঠিপত্র ছাড়া বাবার খবর নিতে কেউ আগ্রহ বোধ করেনি। বাবাই বরং কয়েকবার গেছে। এতকাল পরে সোমেন এসেছে বটে, কিন্তু সেও খবর নিতে নয়, স্বার্থসিদ্ধি করতে। টালিগঞ্জের জমির প্লটটার সমস্যা দেখা না দিলে সে কোনওদিনই এখানে আর আসত না বোধ হয়।সিগারেট শেষ করে আস্তে বীরে ঘরে আসতে আসতে শীতের বেলা ফুরিয়ে যায়। দরজায় দাঁড়িয়ে দেখে, প্রজগোপাল মেঝেয় উবু হয়ে বসে ল্যাম্প জ্বালাচ্ছেন।শব্দ পেয়ে ঘাড়টা ঘোরালেন। জ্বলন্ত ল্যাম্পটা রাখলেন টেবিলের উপর। কলদেন-বাবার চেহারাটা বোধ হয় আগের মতোই আছে। মুখে চোখে একটা মেদহীন রন্ধ ভাব। গালে কয়েকদিনের দাড়ি। গায়ের চামড়া রোদে পোড়া, তাহাভ। শীতটা চেপে পড়েছে বলে এর মধ্যেই মাথা কান ঢেকে একটা খয়েরি কফটার জড়িয়ে নিয়েছেন। সোমেনের চেয়ে বাবালম্বায় কিছু খাটেন। সোমেন একটা প্রণাম করল।-শরীর-উরীর ভাল। জিজেন করে সোমেন। লজ্জা করে।-আছে একরকম প্রেসারটা একটু উৎপাত করে। বাড়ির সবাই কেমন আছে?আছে ভালই।যেন বা দুই পরিচিত লোকের কথাবার্তা। মাঝখানে একটু দূরত্ব কাঁটা কোপের বেড়ার মতো।-আজই চলে যাবে?সোমেন মুখ নামিয়ে বলে-আজই। নইলে সবাই ভাববে।থাকতে বলছি না। যাওয়ার হর্বি খাবে। নদে বাবা খানিকটা বিহুল চোখে সোমেনের নিকে চেয়ে থাকেন। সব পুরুংখ্যাই বোধ হয় একটা পুত্রমূনা থাকে। বাবার চোখে এখন সেই রকমই একটা জলুন। পূর্বক্ষগেই নিবে গেল চোখ, বললেন-কিছু দরকারে এসেছিলে।-মা একটা চিদ্ধি দিয়েছে ওই ডায়েরিতে গোঁজা আছে।বাবা একটু তটস্থ হন। হাতড়ে চিঠিটা গোঁজেন। খুবই ব্যাগ ভাব। সোমেন এগিয়ে গিয়ে চিঠিটা ভায়েরির পাতা থেকে বের করে দেয়।গলা গাঁকারি দিতে দিতে বাবা চিঠিটা নিবিষ্টমনে পড়েন। ছোট্ট চিঠি, তবু অনেকক্ষন সময় লাগে। স্টেমেনের বুকে একটু চাপ কষ্ট হয়। চিঠিটাতে কাভাবে বাবা যা খুঁজছেন তা কি পাবেন? বিষয়ী কথা ছাড়া ওতে কিছু নেই। না, আছে, ‘প্রণতা ননী’-এই কথাটুকু আছে। ওইটুকু বাবা লক্ষ্য করবেন কি।চিঠিটা হাতে নিয়ে বাব্য টিনের চেয়ারে বসলেন। মুখের রেখার কোনও পরিবর্তন হল না।তেমন। মুখ তুলে বললেন-কলকাতায় বাড়ি করতে চাও?-মার খুব ইচ্ছে।
পৃষ্ঠা:১৮
দুহাতের পাতায় মুখখানা ঘষে নিলেন বাবা।-বাড়ি করার জমি তো এখানেই কেনা আছে।-এ জায়গা তো দূরে। কলকাতাতেই চাকরি-বাকরি সব।-চাকরি তো চিরকাল করবে না, কিন্তু বসতবাড়ি চিরকাল থাকে। বংশপরম্পরায় ভোগ করে লোক। চাকরির শেষে যখন নিরিবিলি হবে তখন বিশ্রাম নিতে বাড়িতে আসবে।সোমেন চুপ করে থাকে।বাবা আস্তে করে বললেন-বাড়ি তো কেবল ইট কাঠ নয়। মনের শাস্তি, দেহের বিশ্রাম-এসব নিয়ে বাড়ি। কলকাতায় কি সেসব হবে?সোমেন এ কথারও উত্তর খুঁজে পায় না।-কোথায় জমি দেখেছ?টালিগঞ্জে।কতটা?-দেড় দুই কাঠা হবে। আমি ঠিক জানি না। বড় জামাইবাবুর এক বন্ধুর জমি। সেই বন্ধু কানাডায় সেটল করেছে। সস্তায় ছেড়ে দিচ্ছে অমিটা।-সস্তা মানে কত?-হাজার দশেক হবে বোধ হয়।-কীরকম জমি?-কর্নার প্লট। দক্ষিণ-পূর্ব খোলা। বড় জামাইবাবুর বাড়ির পাশেই।বাবা বড় চোখ করে বললেন-অজিতের বাড়ির পাশে। সেখানে কেন বাড়ি করবে তোমরা? আত্মীয়দের কাছাকাছি থাকা ভাল না, বিশেষ করে মেয়ের শ্বশুরবাড়ির পাশে তো নয়ই। ও বুদ্ধি কার, তোমার মায়ের?-আপনার অমত থাকলে অবশ্য সোমেন কথাটা শেষ করে না।বাবা তার মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়েছিলেন। কথাটা সোমেন শেষ করল না দেখে বললেন-আমার মতামতের কি কোনও দাম তোমার মা দেকেন? তিনি যদি মনে করে থাকেন তবে আমার অমত থাকলেও এই জমি কিনবেনই। তবু অমতটা জানিয়ে রাখা ভাল বলে রাখলাম।-এত সস্তায় আর কোথাও পাওয়া যাবে না। । বড় জামাইবাবুই সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। বাবা চিন্তিতমুখে করলেন আমি টাকা না দিলেও ও অমি তোমরা কিনবেই। যার-কর্জ করা হলেও, এ. ভূমমি জানি। কিন্তু তা হলে এখানকার জমিটার কী হবে?-এটাও থাকুক।-তাই থাকে। পৃথিবীতে যত মানুষ বাড়ছে তত জমি নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ছে। দখল যার, আমি তার। বহেরু যতদিন আছে ততদিন চিন্তা নেই, সে আমাদের বাধ্যের লোক। কিন্তু চিরকাল তো সে থাকবে না। তার জ্ঞাতিগুড়ি অনেক, ছেলেপুলেরা সাবালক। তোমরা দখল না নিলে তারা ক্রমে সব এনভোচ করে নেবে। তখন? আমি যক্ষার মতো আগলে আছি জমিটা, তোমাদের জন্যই। দেখেছ জমিটা ভাল করে? পশ্চিম দিকে সবটা আমাদের। প্রায় দুই বিঘে।-দেখেছি। -পছন্দ নয়?
পৃষ্ঠা:১৯
-ভাগই তো। কিন্তু বড় দূরের জায়গা। বাবা মাথা নাড়লেন। বুঝলেন। একটা শ্বাস ফেললেন জোরে। তারপর আস্তে আস্তে বললেন-কলকাতাতেও পার্টিশানের পরে খানিকটা জমি ধরে রেখেছিলাম। জবর দখল। হাতে-পায়ে ধরে দেশের লোক নীলকান্ত সেখানে থাকতে চায়। দিয়েছিলাম থাকতে, সময়মতো জমি পেলে সে উঠে যাবে-এরকম কথা ছিল। কিন্তু যাদবপুরের ওই এলাকার আমি পাওয়া ভাগ্যের কথা। নীলকান্ত আর ছাড়ল না সেটা। আমি মামলা মকদ্দমা করিনি। কলকাতায় আমার কোনও লোভ নেই। জানি তো, ও শহরটা শিগগিরই শেষ হয়ে আসছে। একটু বিস্মিত হয়ে সোমেন বলে-কেন? -ও শহর শেষ হবেই। অত বাড়িঘর নিয়ে হয় একদিন ডুবে যাবে মাটির মধ্যে, নয়তো মহামারী লাগবে, না হয় ভূমিকম্প। একটা কিছু হবেই। যার বুদ্ধি আছে সে ওখানে থাকে সোমেন মুখ লুকিয়ে হাসে একটু। এতক্ষণ বেশ ছিলেন বাবা, এইবার ভিতরকার চাপা পাগলামিটা ঠেলা দিয়ে উঠছে। -তুমি বিশ্বাস করো নাহ –কলকাতায় একটা অপঘাত যে হবেই। আমি যতদিন ছিলাম ততদিন আমার ওই একটা টেনশন ছিল। এত লোক, এত বাড়ি-ঘর, এত অশান্তি আর পাপ-এ ঠিক সইবে না। মানুষের নিঃশ্বাসে বাতাস বিষাক্ত। ডিফর্মড, ইমমক্সাল একটা জায়গা। ওখানে চিরকাল বাস করার কথা ভাবতেই আমার ভয় করত। নিশুতরাতে ঘুম ভেঙে গেলে শুনতাম, মার্টির নীচে থেকে যেন একটা গুড় গুড় শব্দ উঠে আসছে। কীসের শব্দ? -কী করে বলব? মনে হত। পাতালের জল বুঝি ক্ষয় করে দিচ্ছে শহরের ভিত। যেন ভোগবর্তী বয়ে যাচ্ছে। সোমেন চুপ করে থাকে। বাবা মুখ নিচু করে আত্মগত, চ মোটে বেড় দুই কাঠা জমিয় উমা ডুবে থাকেন একটুক্ষণ। তারপর মুখ তুলে বলেন- -হ্যাঁ। -ইচ্ছে করলে শাকপাতা কি দুটো কলাগাছও লাগাতে পারবে না। বাক্সের মতো সব ঘর হবে, গাদাগাদি করে থাকলে, সেটাই পছন্দ তা হলে? -মায়ের ইচ্ছে, বাড়িওয়ালারা বড্ড ঝামেলা করছে। -কেন? -ছেলেরা বিয়েটিয়ে করেছে, গুনের ঘর দরকার। বার বার তাগাদা দেয়, নতুন বাসাও পাওয়া যায় না সুবিধে মতো। মা বলে, কষ্ট করে একটু নিজেদের ব্যবস্থা করে নেওয়া যায়, জমিটা যখন সস্তায় পাওয়া যাচ্ছে- -টাকা না দিলেও তো তোমরা জমিটা কিনবেই। সোমেন উত্তর দেয় না। বাবা উৎসুক চোখে চেয়ে থাকেন। তারপর বললেন-সময় থাকতে যদি ও জায়গা ছেড়ে পালিয়ে আসতে পারতে তবে
পৃষ্ঠা:২০
ভাল হত। একদিন সেখবে কলকাতায় দিন-দুপুরে শেয়াল ডাকছে, মড়ার মাখা পড়ে আছে এখানে দেখানে, জনমনুষ্য কেউ থাকবে না। একটু ভেবে দেখ। আপনি মাকে যা লেবার লিখে দিন। -এসব কথা চিত্রিতে লেখার নয়, তোমার মাকে মুখের সামনে কিছু বলাও মুশকিল। গুণা সবসময়ে একটাই ভাব ‘এই পেয়েছি ঝগড়ার গোড়া, আর যাব না বালি-ওতরপাড়া।” -তবে আমি মাকে গিয়ে কী বলব? এই প্রথম কাব্য একটু হাসলেন। বললেন-তোমরা তবু কিছুতেই এদিকে চলে আসবে না-আমার কোনও মত নেই। -তোমরা বড় হয়েছে, মত নেই কেন? এই বয়সে নিজস্ব মতামত তৈরি না হলে আর কবে হবে? তোমাদের যদি এদিকে থাকার মত হয় তবে তোমার মায়েরও হবে। মেয়েরা স্বামীর বিরুদ্ধে যত শক্ত হয়েই বাড়াক না কেন, ছেলের বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস পায় না। ওখ্যান মেয়েরা বড় কাবু। সোমেন কথাটার সত্যতা বুঝতে পারে। জীবন থেকেই মানুষ কিছু সহজ দার্শনিকতা লাভ করে। বাবার কথাটা মিথ্যে নয়। সে একটু স্মিত হাসল। বাহু একটু শ্বাস ফেলে বললেন-বুঝেছি। রণেনই চায় কলকাতায় বাড়ি ঢোকঃ তোমারও হয়তো তাই ইচ্ছে। বলে বাবা আবার একটু হেসে মাথা তোড়ে বলেন- তোমাদের চেহারায় কলকাতার ছাপ বড় স্পষ্ট। তোমরা আর দেশ গাঁয়ে থাকতে পারবে না। আমার ইচ্ছে করে তোমাদের জন্য কলকাতা থেকে দূরে একটা নকল কলকাতা তৈরি করে দিই। তা হলেও হয়তো বাঁচাতে পারতুম তেমোদের। বাজ উঠে দাঁড়ালেন। জিজ্ঞেস করলেন-ক’টার গাড়িতে যাবে। -যেটা পাই। রাত আটটার গাড়িটা পরে ঘড়ি দেখে বলদেন-রাত আটটার পর শনিবার গাড়ি খুব র্যংকা যায়। দিনকাল ভাল নয়, অত রাতের গাড়িতে যাবে কেন? যেতে হলে একটু আলি যাও। ভাল হয়, আজ রাতটা কাটিয়ে কাল সকালে গেলে। দেরি হলে মা ভাববে। আমার অজই ফেরার কথা। বাবা চিন্তিতভাবে বললেন-সাড়ে প্রকটন বাজে, এখন রওনা হলেও রাত আটটার আগে গাড়ি পাবে না। -কিছু হবে না। ঠিক আরেকবার। বাবা আবার ব্যস্তুঙ্গেনা’ গাচু-গামছা নিয়ে বৌলাওলা বড়মের শব্দ তুলে দরজার কাছে যেতে যেতে কন্ঠেন তোমাদের জন্য আমিও কিছু কম চিন্তা করি না, বুঝলে? বাবা খড়মের শব্দ তুলে বাইরে বেরিয়ে যান। কুয়েতলার দিকেই যান বুঝি। অনুরে জদের শব্দ হয়। দশবাতির ল্যাম্প এর নীচে খাতাটা পড়ে আছে, তারই একটা পৃষ্ঠায় লেখা আছে-ভগবান, উহারা যেন সুখে থাকে। কথাটা ভুলতে পারছে না সোমেন। বার বারই মনে পড়ে। কেমন যেন অস্থির লাগে। বাবা ঘরে নেই, সেই ফাঁকে বিন্দু এল। নিশেব্দে। খানিকটা চুপি চুপি ভাব ছিল আসায়। একটু আগে যেমন পোশাক ছিল, তেমন আর নেই। একটু সেজেছে বুঝি। দশবাতির আলোয় ভাল বোঝা যায় না, তবু মনে হয়, চোখে কাজস টেনেছে, কপালে সবুজ টিপ, গায়ে
পৃ্ষ্ঠা ২১ থেকে ৪০
পৃষ্ঠা:২১
একটা রঙিন উলের শোল। একটু অবাক হয় সোমেন, স্টোলটা দেখে। তারপর ভাবে, কহেরু তো আর সত্যিই সাধারণ চসো নয়, তার মেয়েরা ফ্যাশন করতে বাবা কী।গলা নিচু করে বিন্দু বলে-জিনিসপত্র গুছিয়ে দেব?-গোছানোর কিছু নেই।-আজ থাকবেন না।-ব্রক্তকর্তার সঙ্গে সব কথা হয়ে গেল?সোমেন একটু হাসে, স্লান হাসি।বিন্দু গঙ্গাটাবিষন্ন করে বলে রজকর্তা একা একা পড়ে থাকে। আগে রমেনবাবু আসত,আজকাল কেউ আসে না।সোমেন নীরবে শুনে যায়। কথা বলে না।-খেয়ে যাবেন না।কী খাব?-ভাত।না, দেরি হয়ে যাবে।-মাঝে মাঝে আসবেন।সোমেন চোখ তোলে। বিন্দু চেয়ে আছে। চোখে পিপাসা।সোমেন বলে-কেন?প্রজকর্তাকে দেখতে। আবার কেন? বলে হাসে।সোমেন চোখ নামিয়ে নয়। বুকটার মন্ডে কী একটা মাতামাতি করে। বিন্দু দু-লা এগিয়ে এসে বলে রজকর্তার খুব অসুন করেছিল। সোমেন চমকে উঠেবংল-কী অসুখ?বুকের। হার্টেন।কেউ জানায়নি তো।-বাবা ভয়ে আনায়নি, যদি আপনার ব্রজকর্তাকে নিয়ে যান এখান থেকে। বাবা এঁকে ছাড়তে চায় না।অবস্থা বুব-হয়েছিল। বৈটরে ঐপাতাল, তারপর বর্তমানেও নিয়ে। র যেতে হয়েছিল ভাজারদেখাতে।-সোমেট্রেপ করে থাকে।-মাঝে মাকে আসবেন। আপনাদের জন্য ভেবে ভেবে হুড়োমানুষের বুক ঝাঁঝরা।একটা খাস ফেলে সোমেন বলে আচ্ছা, আসর।-আসবেন কিন্তু।-রিকশা পাওয়া যাবে না বিন্দু। আমি এবার রওনা হই।- রিকশা আনতে লোক চলে গেছে গোবিন্দপুর। এসে যাবে যখন-তখন।পড়মের শব্দটা বহিবে শুনেই কিছু পালিয়ে গেল।বাবা ঘরে আসেন। নিঃশব্দে জামা কাপড় ছাড়েন। কোণের খড়িতে আলগা হলদে রঙেরশুদ্ধবন্ত্র আছে, সেটা পরে নিয়ে খুঁটা গায়ে জড়নে। খালি গা, ধপধণ করছে পৈতেখানা।
পৃষ্ঠা:২২
-কিছু দেয়েছ-টেয়েছ?-খেয়েছি।-কোনও অসুবিধে হয়নি তো?-না। বহেরু খুব যত্ন করেছে।-বিছানাপত্র ভাল ন্যা, রাতে কষ্ট হয়েছিল নিশ্চয়ই?-তেমন কিছু না। আপনার কি অসুখ হয়েছিল?-শুনলাম হাসপাতাল পর্যন্ত যেতে হয়েছিল। আমাদের জানাননি কেন?বাবা গম্ভীর মুখে বলেন-তোমাদের জানাব কেন? কলকাতায় ভাল আছ, এত দূরে টেনে এনে কষ্ট দেওয়া।-কই কীসের?-কইই তো। অভিমান করে বাসা বলেন। তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে বলেন-বেশ আছি, অসুখ-উসুখ কিছু নেই। এরা আত্মীয়ের চেয়ে বেশি দেখাশোনা করে। তা ছাড়া, আমিও খাড়া আছি এখনও, ধসে যাইনি।-আমি বরং মাঝে মাঝে আসব।-কী দরকার। বলে বাবা একটা তিক্ত উত্তর দিতে গিয়েও থেমে যান। বোধ হয় সদ্যযৌবনপ্রাপ্ত তাঁর ছোট ছেলেটির মুখের সুকুমার ডৌলটুকু দশবাতির আলোয় হঠাৎ তাঁর বড় ভাল লাগে। যখন সংসার ছেড়ে এসেছিলেন তখন ছেলেটা পালটে গেছে। সেই পরিবর্তনটুকু বোধ হয় তরে ভাল লাগে। পুত্রভূধ্য টের পম বক্ষ জুড়ে। গলাটা হঠাৎ নরাম হয়ে আসে। বলেন-এস। ইচ্ছে হলে এস।সোমেন এই অভিমান দেখে স্মিত হাসে।বাবা জিজ্ঞেস করেন-চাকরিবাকরি করছ?-না। এখনও পাইনি। চেষ্টা করছি। ব্যাঙ্ক অব হরোদায় একটা হতে পারে।-ডাল।সোমেন একটু ইতস্তত করে। কথাটা বলতে বলেনি। তবু তার বলতে ইচ্ছে তাকে কেউ করে।-বাবা, কিছুদিনের আমাদের কাছে।বাবা একটু অবাক হনু ইতোমাদের কাছে?বাবা একটু ইেিসন। বলেন- বরং তুমি চাকরিবাকরি পেয়ে আলাদা বাস-টাসা করলে ডেকো। যাব।-আপনি যে আমাদের কাছে থাকেন না সেটা বড় খারাপ দেখায়।-থাকলে আরও খারাপ দেখাবে। বাসায় কাক-শালিক বসতে পারবে না অশান্তির চোটে। সব দিক ভেবেই আনি চলে এসেছি। যখন আমি আসি তখন তুমি নাবালক ছিলে, তাই তোমার কথা ওঠে না। কিন্তু রণেন আমাকে আটকাতে পারত। সে আটকায়নি।বাবা গলা খাঁকারি দেন। মুখে চোখে রক্তোচ্ছাস এসে যায় বুঝি। বাবা গলাটা প্রাণপণে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টাকরে বলেন সায়ংকালটা পার হয়ে যাচ্ছে। আমি একটু জপে বসি। তোমার সময় হলে চলে যেও।
পৃষ্ঠা:২৩
সোমেন ঘাড় নাড়ল। উঠে প্রণাম করে নিল।বিছানায় কম্বলের আসন পেতে বাবা গায়ের খুঁটিটায় মাথা মুখ ঢেকে শিরদাঁড়া সোজা করে বসেন। সোমেন চেয়ে থাকে। কঠের হওয়ার কত চেষ্টা করে লোকটা। পারেনা। ঢাকা শরীরটা একটু একটু কাপে। শীতে, না নিবন্ধ ব্রন্দনে?সেই প্রথম যৌবনকালের অভিমান আর ভাঙেনি। অভিমানে অভিমানে নষ্ট হয়ে গেছে ভালবাসা। কেউ কাউকে বইতে পারে না, সইতে পারে না। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সেই অভিমানই হয়েছে আরও কঠিন। যত দিন গেছে তত তা আরও কঠিন হয়েছে। বুকের গভীরে চৈত্রের কুয়োর তলানি জলের মতো কিছু ভালবাসা এখনও পড়ে আছে হয়তো। কিন্তু ওই দুস্তর অভিমান পার হয়ে সেইটুকু স্পর্শ করবে কে? নদীনালা না, রখেন না সোমেন না। ওই অভিমানটুকুই ব্রজগোপালের অস্তিত্ব বোধ হয়। তার সঙ্গে নিরন্তর চলে অপেক্ষা আর অপেক্ষা। এই কঠিন পাথরের অভিমান ভাঙবার জন্য কেউ আসুক, সবাই আসুক।মৃতু। ছাড়া ব্রজগোপালের এই বৃথা অভিমান থেকে মুক্তি নেই। এই কথা ভেবে রিকশায় বসে উত্তুরে বাভাসে কেঁপে ওঠে সোমেন। পাশে-বসা মুনিশ লোকটা একটা বিড়ি করায়। রাতের ট্রেনটা এল। ইলেকট্রিক ট্রেন ন্যা। কয়লার ইঞ্জিন, কাঠের বগি। আগাপাশতলা গাড়িটা ফাঁকা। দু-একটা কামরায় দু চারজন আছে। বেশির ভাগ কামরাই জনশূন্য। বাহাবছির সময় নেই বলে সামনের কামরাতেই মুনিশ লোকটা ব্যাগট্যাগ সুদ্ধু তুলে দেয়সোমেনকে।সোমেন গাড়ি ছাড়লে টের পায় তার কামরাটায় সে একদম একা।
চার।
ফাঁকা গাড়ির কামরায় সোমেনের একা বড় ভয়-ভয় করে। কোমরে আন্ডারওয়্যারের দড়ির খোপে কয়েকশো টাকা রয়েছে, কহেরুর দেওয়া। দাদা বিয়েতে নতুন ঘড়ি পেয়ে তার পুরনো ঘড়িটা দিয়ে দিয়েছে সোমেনকো’ পুরনো হলেও ভাল ঘড়ি, টিসো। সেই ঘড়িটা সোমেনের কবজিতে বাঁধা। বউদির বড্ড ভুলো মন, গানের সময়ে সাবান মাখতে অসুবিধে। হয় বলে আংটি গুলে রাখে। শ্রাগপর প্রায়দিনই ভুলে ফেলে আসে বাথরুমে। কতবার বাড়ির লোক পেয়ে বেকই জয়েছে। সোমেন কয়েকবার আংটি লুকিয়ে রেখে সিনেমার বা সিগারেটের পৃষ্টমাকাদায় করেছে। অবশেষে বউদি জ্বালাতন হয়ে একদিন বলে-ও আংটি হাতে রাখা মানে হাতি গেষার খরচ। রোজ হারাবে আর রোজ তোমার কাছ থেকে বন্ধকি জিনিস হাড়াতে হবে। তার চেয়ে ওটা তুমিই আঙুলে পরে থাকো। তাই পরে সোমেন। বউদির মধ্যের আঙুলের আংটি তার কড়ে আঙুলে হয়।ঘড়ি আংটি দুটোই খুলে পকেটে রাখল সোমেন। দরজা লুটোর লক লাগাতে দিয়ে দেখল, ছিটকিনি ভাঙা। গেইন দুই টিমটিমে আলো জ্বলছে, মাঝে মাঝে উসকে উঠছে আলো, আবার নিতু-নিবু হয়ে যাচ্ছে। ফাঁকা, রহস্যময়, ভৌতিক কামরা। শনিবার রাতের ট্রেন ফাঁকা যায়, বাবা বলেছিলেন। কিন্তু এতটা ফাঁকা, সোমেন ভাবতে পারেনি। আশপাশের কামরাতেও লোক নেই, সোমেন বেচা স্টেশনে গাড়িতে উঠবার সময়ে লক্ষ করেছে, লোক
পৃষ্ঠা:২৪
থাকলেও অবশ্য লাভ ছিল না। ডাকাতি অরাভরতি কামরাতেও হয়। সে সাবধানে কোমরে হাত দিয়ে ফোলা জায়গাটা দেখল। বহেরুর দেওয়া টাকা, একবার ভাবল, পরের স্টেশনে নেমে কামরা পালটে নেবে। কিছু বৈচিটাগ্রাম স্টেশনে গাড়ি থামলে দরজা খুলে নামতে গিয়েও সে দমে যায়। এমন ফাঁকা, শূন্য হাহাকার স্টেশন সে কদাচিৎ দেখেছে। দীর্ঘ গ্র্যাটফর্মে জনমানুষের চিহ্নও নেই, শুধু শীতের বাতাস বয়ে যাচ্ছে। অনেক দূরে স্টেশন-ঘরটা ঝিম মেরে আছে আধো অন্ধকারে। কুয়াশায় আবছা। খোলা মাঠে জমে আছে অন্ধকার, ঘুমন্ত, নির্জীব। সোমেন নামবার সময়ও পেল না। ট্রেন ছেড়ে দিল। প্ল্যাটফর্মটা পার হওয়ার সময় সে কেবল একজন বুড়ো কুলিগোছের লোককে দেখল রেলের কম্বুলে কোট গায়ে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একা একটা মানুষ, পিছনে প্ল্যাটফর্মের বিশাল নির্জনতা। সোমেন তৃষিতের মতো লোকাকে দেখল। মানুষ যে মানুষের কত আপন তা ওই একা লোকটাকে দেখে সোমেন বুঝতে পারে হঠাৎ।একটু কাঁপা বুক আর দুশ্চিন্তা নিয়ে সে দরজা থেকে ফিরে এসে বেঞ্চে বসে। কামরা বদলেও লাভ যখন নেই, লোকভরতি কামরাতেও যখন ডাকাতি হয়, আর তাকে যখন এই ট্রেনে ফিরতেই হবে তখন আর কী করার আছে?পুরনো আমলের গাড়ি। বয়সের জীর্ণতা দেখা যাচ্ছে চারধারে। বছের ওপর বিবর্ণ বং দিয়ে কামরাটার প্রিটিশ আমলের জরার চিহ্ন ঢাকা পড়েনি। চলার সময়ে একটা ক্লান্ডির ক্যাচকাচ শব্দ তুলছে। অ্যালার্মের শেকল দুলে দুলে টংটন্ডাস শব্দ তোলে। বাতি নিতু-নিখু হয়ে আসে, আবার হালে। পরের স্টেশনও পার হয়ে গেল গাড়ি। লোকজনের কোনও শব্দ হল না। ফাঁকা ট্রেন একটা বাঁশি দিয়ে আবার ছাড়ল।সোমেন বসে থাকে। মনে মনে প্রার্থনা করে, পরের স্টেশনে যেন দু-চারজন লোক ওঠে কামরায়। এন্ড ফাঁকা দে সহ্য করতে পারে না। ভিড়ের কামরা কত বিরক্তিকর, ফাঁকা কামরাও কী অসহ্য। মানুষ যে কোন অবস্থায় সুখী হয়!চিনেবাদাম, কমলার খোসা পড়ে আছে। দোমড়ানো ঠোঙা, সিগারেট আর বিড়ির টুকরো, দেশলাইয়ের বাক্স ইত্যাদিতে পরিপূর্ণ মেঝেটা দেখলে হঠাৎ ভয় করে। কত মানুষ হিয়া, তারা কেউ নেই। এ কথাটা হঠাৎ চমকে ওঠে বুকের মধ্যে। কলকাতার ভিড়-ভাট্টিময় গা-ঘেঁষা মানুষকে মানুষ কত অপছন্দ করে। আবার কখনও এরকম নির্জনতায় মানুষের বুকে মানুষের জনাই পিপাসা ক্ষেত্রে উঠে। সোমেন একটা সিগারেট ধরায়। জানালার ফাঁক ফোঁকর দিয়ে বাতাসু ভাসে, ছিটকিনিহীন দরজা বাতাসের দমকায় দড়াম করে খুলে আবার ধীরে ধীরে আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। ভুতুড়ে বাতিগুলো জ্বলে আর নেবে। একটা বহুজউটি বাঁয়ার শব্দের মতো শব্দ তুলে পার হয় গাড়ি। সোমেনের বড্ড শীত করতে থাকে। দাঁতে দাঁতে শব্দ হয়। কোটের কলারটা সে তুলে দেয়, জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকে। অন্যমনস্ক হওয়ার জন্য সে সুন্দর কিছু একটা ভাবতে চেষ্টা করে। আর ট্রেনটা অবিরল ‘দিনকাল ভাল নয়, দিনকাল ভাল নয়’, শব্দ তুলে ছুটতে থাকে।চোখ বুঝে এখন একটা বাক্য ভাবছিল সোমেন ভগবান, উহারা যেন সুখে থাকে। কখন, কোন একাকীত্ব বা সহায়তার সময়ে বাবা ওই কথাটা তাঁর ডায়েরির পাতায় লিখে রেখেছিলেন কে জানে। সোমেনের আর কিছু মনে পড়ে না, কেবল ওই বাক্য মনে পড়ে। বাবার জন্য একটু কষ্ট হয়। তাঁর অভিমান যে কত কঠিন হয়ে গেছে তা বাবাও জানেন না। আয়ুর সময় আর বেশি দিন নয়, ততদিন উদ্গ্রীব অপেক্ষা করবে বারা। কেমন ব্যস্তসমস্ত
পৃষ্ঠা:২৫
হয়ে মার চিরকুটটুকু পড়ছিল বাবা। হায়, তার মধ্যে বেশি কিছু ছিল না, ছিল ‘প্রণতা ননী’। কিন্তু ওই প্রণামটুকু বাবা কি নিয়েছে। নেবে কী করে? চিঠির মঞ্চে বড় স্বার্থপর কথা ছিল যে। দশ হাজার টাকা নিজের ছেলেদের বাড়ি করবার জন্য চেয়ে নেওয়া, প্রণামটুকু তার নধ্যেই হারিয়ে গেছে। ওটা শব্দমাত্র, আর কিছু নয়। সোমেন জানে।সোমেদের বড় ইচ্ছে করে, কাব্যকে আবার ফিরিয়ে আনতে। তা হয় না যদিও। ফিরে এলে আবার কাক-শালিক তাড়ানো ঝগড়া হবে। সে ভারী অশান্তি। বাবা বলেছিলেন, সোমেনের আলাদা বাসা হলে আসবেন। আলাদা বাসার কল্প সোমেন কল্পনা করতে পারে না। মা আর দাদাকে ছেড়ে আলাদা বাসা করে থাকবে তা কি হয়।বাবার কথা ভাবতে ভাবতে তার কলকাতার কথা মনে হয়। কলকাতার ওপর বাবার ভারী রাগ। কলকাতা সম্বন্ধে বাবার মতামত শুনলে হাসি পায়া ঠিকই। কিন্তু সোমেনের মাঝে মাঝে মানে হয়, কলকাতার যেন আর কিছু হওয়ার নেই। তার বুকে যতটুকু জায়গা ছিল তার চেয়ে ঢের বেশি মানুষজন আর ইমারত ঠেসে দিচ্ছে চারপাশ থেকে। এ ভার সে আর বইতে পারছে না। রাস্তায় রাস্তায় আজকাল হোর্ডিং লাগিয়ে বিজ্ঞাপন দেয়-কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে। কিংবা ক্যালকাটা ইজ ফর এভার, কিপ ক্যালকাটা ব্রিন…ইত্যাদি। পাশে আঁকা রক্তবর্ণ গোলাপের ছবি। কিন্তু তার মনে হয়, কলকাতার যতটুকু হওয়ার তা হয়ে গেছে। এখন কেবল অপটিমাম প্রেসারে টান টান টেনশনের ওপর রয়েছে কলকাতা। চারবারে কী একটা যেন ছিঁড়বে, ভাঙবে, তখন হুড়মুড় করে নগরপতনের ভয়াবহ শব্দ উঠবে। কলকাতার প্রতিটি লোকই ঝোল হয় কোনও না কোনও বিহুল মুহূর্তে এই কথা ভাবে। কী সেটা তা বোঝা যায় না, অনুভব করা যায়।আবার একটা নির্জন স্টেশন এল, চলে গেল। শীতের বাতাসে গা শিরশির কর বাঁশি দিয়ে গাড়িটা নড়ে ওঠে। বুড়ো শরীরের জীর্ণতার শব্দ তুলে চলে। সোমেন সুন্দর কিছু ভাবতে চেষ্টা করে। সুন্দর কিছু মনে পড়ে না। এক হতে পারে বাড়ি গিয়ে সে দেখবে ব্যায় অব বরোবার চিঠিটর এসেছে। পরীক্ষা ভাল দিয়েছিল, প্যানেলের উঁচুর দিকেই তার নাম থাকার কথা। চিঠিটা যদি আসে।ভাবতেই কেমন একটা আনন্দের বন্ধুহুড়ানি ওঠে বুকে, আর সেই সঙ্গে রিখিয়ার মুখ মনে পড়বেই, পাভলভের থিয়োরিতে কুকুরের ঘটনার মতো, কন্ডিশন রিফ্লেকস। কিন্তু ভেবেদেখলে তার চাকরির সঙ্গে রিপ্তিবাকে কিছুতেই এক সূতোতে বাঁধা যায় না। এ এক রকমের স্বপ্ন দেখা সোমেনেন্ডা, বেইশ বছর বয়সে এখনকার ছেলেরা আর এরকম স্বপ্না দেখে না। সোমেন বালিগঞ্জ স্বারকুলার রোডে বিখিয়াদের বাড়িটা গায় সময়েই মনশ্চক্ষে দেখে। একদম হালবিদ কায়ার বাড়ি, যার ডিজাইনটায় অনেকগুলো অসমান কিউবিক প্রকোষ্ঠ।দোতলার বারান্দায় অ্যালুমিনিয়ামের রেলিং। সবুজ খানিকটা জমির ওপর বাড়িটা বিদেশের গন্ধ মেখে দাঁড়িয়ে। ঘরে ঘরে অদ্ভুত সব গন্ধ। মাকে বলেছিল-তুমি সঙ্গে চলো। মা রাজি হয়নি। বলেছিল, আমার বড় লজ্জা করে। তুই একা যা। সোমেন তবু চাপাচাপি করেছিল-তোমার ছেলেবেলার সই, তারা কাছে লজ্জা কী? মা বিষন্ন মুখে বলেছে-সংসারের কী অবস্থা, দেখিস তো। মনের এসব অশান্তি নিয়ে কোথাও যেতে ইচ্ছেই করে না। ছেলেবেলার সই, তোর বাবার কথা জিজ্ঞেস করলে বলব কী? কোন কথায় কোন কথা উঠে পড়ে, আমি আবার সাজিয়ে বানিয়ে দুটো মিথ্যে কথা বললে তাল রাখতে পারি না। সব গোলমাল হয়ে যায়, তার ওপর এ চেহারা শৈলী কি আর
পৃষ্ঠা:২৬
চিনবে, দেখে আঁতকে উঠবে হয়তো। কী যে এক ঢল চুল ছিল আমার, রংটাও ছিল ফুটফুটে। চেহারা দেখেই সংসারের অশান্তি বুঝে ফেলবে। তুই একা যা। আমার খুব বন্ধু ছিল শৈলী। তোকে আদর-টাদর করবে। সংসারের কথ্য যদি জিজ্ঞেস-টিডোস করে তো রেখেঢেকে বলিস। সেই যাওয়া, পরেটে একটন চিঠি ছিল মায়ের দেওয়া, তাতে দেখা শৈলী, এই আমার ছোট ছেলে, সোমেন, তোর কাছে পাঠালুম। ওর যাতে একটা চাকরি বাকরি হয় দেখিস…।দোতলার ঘরে মার সেই শৈলী শুরে আছে। পিয়ানোর রিডের মতো চমৎকার সিড়ি কেয়ে উঠে দোতলার ঘরটিতে ঢুকে দূশটির দেখে থমকে গিয়েছিল সোমেন। পড়ন্ত বেলার আলো থেকে বাঁচানোর জন্য শ্যাওলা রঙের শেড টানা ছিল জানালায়, একটা মস্ত নিশ্চু ইংলিশ খাটের উপর উনি শুয়ে, বুক পর্যন্ত টানা একটা পাতলা লেপ। চেহারাটা রোগজীর্ণ, সাদা, রেগা। উঠে বসতে বসতে বললেন-কোন নদী, বগুড়ার ননী? তুমি তার ছেলে?ওমা! ঘরটায় তেমন কিছু ছিল না। শেষ থেকে একটা সহজে আভা ছড়িয়ে আছে আলোর মতোই। পরিষ্কার সাসা শ্বেতপাথরের মতো মেঝে। শিয়রের করছে একটা ট্রলি, তাতে ওষুধের শিশি, কাটাসের গুণে স্বচ্ছ জল, ভাঁজ করা ন্যাপকিন। একধারে একটা সানা রেফ্রিজারেটার, ছোট্ট। একান ড্রেসিং টেবিল। বালিশের পাশে কয়েকটা বই, একটন মহার্ঘ চশমা। একটা বই খোলা এবং উপুড় করা।-বোসো বাবা। তোমরা কলকাতায় থাকো। কেথোয়? বলে উনি ঝুঁকে বসলেন, কোলের ওপর হাত। ঢাকুরিয়া শুনে চোখ বড় বড় করে বললেন, এত কাছে। তবু ননী একদিনও এন না? সেই খুলনায় থাকতে চিঠি দিত মাঝে মাঝে। কতকাল তাকে দেখি না। খুব বুড়ো হয়ে যায়নি তো ননী। আমি যেমন হয়ে গেছি?সোমেন অস্বস্তির হাসি হেসেছিল। মা-ও বুড়ো হয়ে গেছে ঠিকই। বয়স তো আছেই, আর আছে সংসারের কত তাপ, ব্যথা বেদনা। সেসব কে বোঝে।অত বড়লোক, তবু শৈলীমাসির কোনও দেমাক দেখেনি সোমেন, বরা বললেন- কতকাল ধরে রোগে পড়ে আছি। সায়ে না। বড় মানুষজন দেখতে ইচ্ছে করে, কিন্তু এই রোগা-ভোগার কাছে কে এসে বসে এপ্রকবে। ননী এলে কত খুশি হতাম, তবু ননীর বদলে তুমি তো এসেছ। তোমার মুনুদীদা ননীর মতো, মাতৃমূণী ছেলেরা সুখী হয়।এ সময়ে রিখিয়া এল। রোধ হয় ইস্কুলের উঁচু বা কলেজের নিচুর দিকে পড়ে। কিশোরী, চঞ্চল, সদ্য শান্তি হয়েছে। ইস্কুল বা কলেজ থেকে ফিরল বের হয়, মুখখানায় রোদ-লাগা লালচে আভাড়াঈল্যে চুলের জট ছাড়াতে ছাড়াতে হবে এল, মায়ের বিছানার কাছে এসে অন্যমনে উঠে আসা অলগা চুল আরুলে জড়িয়ে চোখের সামনে তুলে ধরে বলে-ইস, রোজ কতটা করে চুল উঠে যাচ্ছে।শৈলীমাসির মুখথানার রেখাগুলি নরম হয়ে গেল, বললেন এই আমার একটামাত্র মেয়ে রিবিয়া। আমি ডাকি রিখি, গুর বাপ ডাকে রাধু। তোমার ভাল নাম কি বললে, সোবেন্দ্রনাথ?সোমেন মাথা নাড়ে।শৈলীমাসি হেসে বলেন-পুরনো আমলের নাম। আজকাল আর নামের মাঝখানে নাঘ-টাথ কেউ লেখে না। সোজা নাম-টাম লেখে। এখন দেখি ভাবনামের মতো সব ছোট
পৃষ্ঠা:২৭
ছোট নামের রেওয়াজ। সেদিন এক বারোয়ারি পুজোর স্যুভেনির দিয়ে খেল, মেম্বারদের নামের মধ্যে দেখি কত মিন্টু ঘোষ, পল্টু রায়, বাবলু সান্যাল বলতে বলতে মুখ তুলে মেয়ের দিকে চেয়ে বলেন-তাই না রিখি?রিখিয়া উত্তর না দিয়ে মুখ টিপে অর্থপূর্ণ হাসে। হাসতেই থাকে। বোঝা যায় নামের ব্যাপারটা নিয়ে এ বাড়িতে একটা রসিকতা চালু আছে।রিশিয়া বলল-রিশিয়া নামটা বিচ্ছিরি।শৈলীনাসি হাসেন, সোমেন বলেন-রিখিয়ার বড় মামার ছিল বিদঘুটে পোিেটর ব্যামো, কত ডাক্তার-বদ্যি করেও সারে না, সেজর গেল সাঁওতাল পরগনার রিখিয়াতে হাওয়া বদলাতে। সেখানে সারল, ফিরে এসে দেখে ভাগনি হয়েছে, তাই নাম রাখল রিখিয়া, বলল-শৈলী, তোর মেয়ের যা নাম রাখলাম দেখিস, রোগবালাই সব রুখে দিলাম।বলে সন্ধেহে মেয়ের দিকে কয়েক পলক চেয়ে থেকে মুখ সরিয়ে একটা শ্বাস ফেলে বলেন-বলতে নেই, শরীর নিয়ে রিধি আমাকে একটুও জ্বালায়নি, আমি তো কবে থেকে রোগ-বালাই নিয়ে পড়ে আছি, রিখি শিশুবেলায় যদি ভূগত তো ওকে দেখত কে? বঞ্চ লক্ষ্মী ছিল রিখির সেই বয়স থেকেই। রিগি, সোমেনকে কিছু খেতে দিবি না? ফ্রিজিডেয়ারে সন্দেশ আছে, দে। এ ঘরে নায়, পাশের ঘরে নিয়ে যাস। রুণির ঘরে যেতে নেই। সোমেন কয়েক পলকের বেশি বিখিযাকে তখন দেখেনি। খুব সুন্দরী নয়, তবু হালকা পলকা শরীরে একটা তেলতেলে লাবণ্য পিছলে যাচ্ছে। শ্যামলা রং, মুখখানায় সংসারের টানাপোড়েনের স্থাপ পড়েনি বলে ভারী কমনীয়। একটু দুষ্টু ভাব আছে, আছে বেশি হাসার রোগ। একটু জেদ-এর ভাবও নেই কি। তবু সব মিলিয়ে রিখিয়া বড় জীবন্ত।শৈলীমাসি বলেন-রিখি আমার চুলের গোছ বরে বলে-মা, তোমার এখনও কত চুল। আমি তখন ননীর কথা ভাবি। ইস্কুলে ননীর নাম ছিল চুলঅলা ননীবালা, দিদিমণিরা পর্যন্ত ওর যৌগ্য খুলে চুলের গোছ দেখত। আমরা কত হিংসে করতাম। দড়িফড়া দিয়ে কতবার চুল কত লম্বা বা মেপে দেখেছি, ভারী লক্ষ্মী ছিল ননী, আমরা যতবার ওর চুল মাপতাম ততবার চুপটি করে দাঁড়াত, হাসত, কখনও আপত্তি করত না। দাঁড়াও, তোমাকে একটা জিনিস দেখাই। রিখি, আমার অ্যালবামই। দে তো অ্যালবাম এলে শৈলীমাসি সোমোপে কাছে ডাকলেন। একটা পাতার গ্রুপ ছবি। হলদে হয়ে গেছে প্রায়। তিন সারি মোটা দাঁড়িয়ে এক সারি, চেয়ারে বসে এক সাগি, মাটিতে এক সারি। কারও হাতে এমন্ত্রবিস্তারির ফ্রেম-সেলাই করছে, কারও বা হাতে কুরুশকাঠি, চেয়ারে বস্য দুজনই মেয়ের সামনে সেলাই মেশিন। প্রায় পঁচিশ-ত্রিশজন মেয়ে ছবিতে রয়েছে।শৈলীমাসি বলেন-ইস্কুলে হাতের কাজের ক্লাসে তোলা ছবি। এর মধ্যে ননী কে বলো তো।সোমেন মুখ টিপে হাসল। বী ধারে সেলাই মেশিনের পিছনে মা বসে আছে। রোগা, খুব এক চল চুল, নতমুখে, বড় হাতার ব্লাউজ, শাড়ির আঁচল ব্লাউজের কাঁবে পিন করা। এক নজরেই চেনা যায়। তবু বড় অবাক লাগে। তাদের বাড়িতে মার ওই বয়সের কোনও ছবি নেই। কিশোরী মাকে কখনও দেখেনি সোমেন। দেখে অবাক মানে। এই ছিল আমার মা।শৈলীমাসি মুখের দিকে চেয়েছিল সকৌতুকে। সোমেন আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলে- এই তো আমার মা।
পৃষ্ঠা:২৮
-ও বাবা। নিজের মাকে চিনতে দেখি একটুও ভুল হয়নি। এখন বলো তো, আমি কেমন জন। ভারী মুশকিলে পড়ে যায় সোমেন। মুহূর্তেই ত্রিশজন মেয়ের ছবি একাকার হয়ে যেতে থাকে। শৈলীমাসির মুখটা কিছুতেই খুঁজে পায় না। তখন টের পায় তার কাঁধে সুগন্ধী এলোচুলের একটা গুছি এসে স্পর্শ করেছে। পরিষ্কার শরীরের সতেজ স্বাস ফেলে রিখিয়া ঝুঁকে পড়ে বনধের ওপর দিয়ে, আঙুল বাড়িয়ে বলে-এই তো আমার মা।সোমেন দেখে, শৈলীমাসিই তো। নীচের সারিতে এমব্রয়ডারির কাঠের ফ্রেম হাতে বসে। ঢলচলে শরীর, আহ্লাদী মুখ।শৈলীমাসি বুক পর্যন্ত লেপটা টেনে আবার আধশোয়া হয়ে বলেন-চিনবে কী করে? তখন তো এমন হইনি। তুই শুকে খাবার দিলি না রিখি। সে. ভুলে যাবি পরে। কতদিন পর ননীর খবর পেলাম। বড় দেখতে ইচ্ছে করে। কে কে আছে তোমাদের সংসারে, বলো তো সব, শুনি। ক’ভাই-বোন তোমরা?সোমেন সতর্ক হয়ে যায়। বাবাকে নিয়েই তাদের যত ভয়। সংসারের কথা একটুআধটু বলল সোমেন। তার দাদা রগেন্দ্রনাথ ফুড ইনস্পেকটর, দুই দিদির বিয়ে হয়ে গেছে, সে ছোট, বাবা রিটায়ার করে জমিজমা দেখছেন।শৈলীমাসি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে ননীকে আসতে বেরানো। খুব ভাল লাগবে। আমার ছেলেটা কতকাল ধরে বিলেতে পড়ে আছে। আসে না। আসবেও না লিখেছে। ওখানেই বিয়ে করবে। মেয়েটাই সঙ্গল। কিন্তু মেয়ে তো নিজের না, পরের ঘরে যাবে। আমার মাত্র দুটি। ননীকে বোলো যা দেখে গেলে। -বলব। -রিখি, ওকে খাবার দে। তুমি ওর সঙ্গে যাও সোমেন, যাওয়ার সময় আমাকে বলে যেও। আমি একটু ঘুমোই। শৈলীমাসি পাশ ফিরে শুলে সোমেন রিখিয়ার পিছু নিয়ে পাশের ঘরটায় আসে। বসার ঘর। গভীর সব গদিওলা সোফা, একধারে বুক-কেস কালো কাঠের। চার রঙের চারটে দেয়ালে তেলতেলে পালিশ। বুক-হেসের ওপর একটা আসাহি পেনট্যাক্স ক্যামেরা হেলাফেলায় পড়ে আছে।কোথা থেকে এই সুন্দর বড়লোকি ঘরের কোন কোনা থেকে একটা কুকুর উঠে এল। দিশি কুকুর। তার হাঁটাটুকুর ঔয্যে যেন আত্মবিশ্বাস নেই। এই ঘরে একটা দিশি হলদে কুবুরা দেখবে। এমনটা খালু করেনি সোমেন। সে এসে রিখিয়ার গা ঘেঁাঁয়ে দাঁড়িয়ে মুখটা তোলে। রিখিয়া ঝুঁকে একটু আদর করে শুকে। মুখ ফিরিয়ে সোমেনকে বলে-বসুন। সোমেন খুব অবাক হয়ে কুকুরটাকে দেখছিল। প্রথমে লক্ষ করেনি। এখন দেখল,কুকুরটা অন্ধ। সোমেন এমন দৃশ্য কখনও দেখেনি। সন্দেশ আনতে যিখিয়ার অনেক সময় লাগল। কুকুরটাকে আদর করল অনেকক্ষণ। তারপর প্লেট ভরতি ঠান্ডা সাদ্য সন্দেশ সামনের সেন্টার টেবিলে রেখে বলল-আমার ভাল নামটাও বিচ্ছিরি। কী সেটা? অপরাজিতা। কিন্তু ওই নামে কেউ ডাকে না। রিখিয়া বেশ নাম।
পৃষ্ঠা:২৯
-ছাই, জায়গার নামে মানুষের নাম বুঝি ভাল?-আমার নামও ভাল নয়। আমার ছোড়দির নাম বুড়ি এইভাবে কথা শুরু হয়েছিল। ঠান্ডা, হিম সন্দেশের ডেলা সোমেনের গলা দিয়ে নামছিল। না। মেজের ওপর বার্পেট নেই, সোফার সামনে মস্ত মস্ত লাল নীল উলের নরম পাপোশ। পা রাখলে ডুবে যায়। তারাই একটাতে রিখিয়ার পায়ের কাছে অদ্ধ কুকুরটা শুয়ে আছে।-কুকুরটা চোখে দেখে না। না। অন্ধ। কী করে হল?-জানি না তো, আমরা ওকে এরকমই পেয়েছিলাম। তখন গড়পারের বাড়িতে থাকতাম আমরা। বেশ গরিব ছিলাম। সে সময়ে এটা কোথা থেকে এসে জুটল। রয়ে গেল। এখন বুড়ো হয়ে গেছে।ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারে।-একটু একটু অভ্যাস আছে, তবে প্রায়ই এখানে-ওখানে ধাকা খায়।’তুমি’ না ‘আপনি’ কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না সোনেন। অন্ধ কুকুরটা থেকে চোখ তুলে সে আবার বুক-কেসের ওপর আসাহি পেনট্যাক্স ক্যামেরাটা দেখে। কী চকচকে, ককবাকে ক্যামেরাটা। মস্ত লেন্স। নিষ্প্রাণ একটি চোখ মেলে চেয়ে আছে সোমেনের দিকে। ঠিক যেন পাহারা দিচ্ছে। বার বার ওই অন্ধ কুকুর থেকে ক্যামেরার একটিমাত্র নিষ্প্রাণ চোখ পর্যন্ত দেখছিল সোমেন। সন্দেশের ডেলাটা গলা দিয়ে নামতে চাইছে না। জল খেতে গিয়ে বিষম খেন। ওই হেলাফেলায় পড়ে থাকা দামি আমেরা তার সঙ্গে দিশি কুকুরটা কেমন যেন বেমানান। ঘরের মধ্যে ওই দুটি জিনিসই সবচেয়ে বেশি লক্ষ করছিল সোমেন।রিখিয়কেও কি দক্ষ করেনি? করেছে। তবে তার তেমন কোনও দুর্বলতা নেই মেয়েলো সম্পর্কে। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়ে কত মেয়ের সঙ্গে তার তুই-তোকারি সম্পর্ক ছিল, আড্ডা দিয়েছে লন-এ বা রেস্টুরেন্টে, ফাঁকা ক্লাসঘরেও। তাই বুক কাঁপছিল না সোমেনের। কিন্তু সেই অপরাহ্নকালে বদবার ঘরে রিখিয়াকে দেখতে তার ভাল লেগেছিল বড়। লাল কার্পেটের ওপর পা রেখে রিখিয়া বসে। একটু ঝুঁকে কুকুরটাকে আদর করছে। বড় মহার্থ মনে হয়েছিল তাকে। পাহায় ক্যামেরার চোখ। একটু ভয় ভয় করেছিল সোমেনের। রিখিয়া বলে-আপনি টিম পরীক্ষা দেননি? (1)না।কেন? -কী হবে পড়ে। চাকরি করা বরং ভাল।- চাকরি। বঙ্গে সকৌতুকে রিখিয়া চেয়ে থাকে। ভাবখানা-ইস, এইটুকু ছেলের আছর চাকরি।পকেটের চিঠিটা পকেটাই রয়ে গেল সোমেনের। দেওয়া হল না শৈলীমাসিকে। মুখে সে পরিচয় দিয়েছিল-আমি ননীবালার ছেলে, আপনার সই ননীবালা। বাস ওইটুকুর জোরেই ওরা গ্রহণ করেছিল তাকে। প্রমাণপত্র চায়নি। চিঠিটা হাতে দিতে বড় লজ্জা করেছি সোমেনের। যখন শৈলীমাসির কাছে বিদায় নিয়ে আসে তখনও বুকপকেটের চিঠিটার কথা মনে
পৃষ্ঠা:৩০
হয়েছিল। শৈলীনাসি বলেন–আবার এসো। ননীকে আসতে বোলো। আমি তো কোথাও যেতে পারি না।আসব মাসিমা। বলেছিল সেকেন।চমৎকার সিড়িটা বেয়ে নেমে আসার সময়ে হঠাৎ শুনল রিণিয়ার স্বর আবার আসবেন।মুখ তুলে দেখে, রিখিয়া রেলিং বরে ঝুঁকে দোতলা থেকে চেয়ে আছে। তার চলে যাওয়া দেখছে।সোমেন ঘাড়ে নাড়ল। আসবে। মনে মনে বলল-তোমার কাছেও আসব রিখিয়া। একা তোমার কাছেই। এ তো স্পষ্টই বোঝা যায় যে একরিন সুসময়ে তোমার সঙ্গেই আমার ভালবাসা হবে।সেই অন্ধ কুকুর, সেই আসাহি পেনট্যাক্স ক্যামেরা বড় মনে পড়ে সোমেনের। ব্যান্ড অফ বরোদার চাকরির কথা মনে হলে বিখিয়ার কথা কেন যে মনে পড়বেই!গাড়িলি চলেছে তো চলেছেই। একটু ঢিমে গতি, নড়বড় করা শরীরের শব্দ। পাঁচটা স্টেশন গেল। কেউ উঠল না, নামল না। সোমেনের কোমরে গোঁজা টাকা, পকেটে আংটি, ঘড়ি, দিনকলে ভাল ন্যা, দিনকাল ভাল নয়, বলতে বলতে ট্রেনটা ছুটছে।একটু ঢুলুনি এসেছিল বুঝি। বেকের ওপর পা তুলে, ছারপোকার কামড় খেতে খেতে ও ঘুমিয়ে পড়েছিল। সেই ফাঁকে ট্রেনটা থেমেছিল কোথাও। হঠাৎ আবার চলতেই ঝাঁকুনিতে জেগে যায় সোমেন। এবং চমকে দেখতে পায়, সামনে চারটে ছেলে দাঁড়িয়ে। চারজোড়া চোখ তার মুখের ওপর স্থির।
পাঁচ
যে চারজন সোমেনাকে দেখছিল তাদের একজনের নাম মেকো।চারজনের একজন মেকোকে বলে এমকো, প্যাসেঞ্জার।-গ্রহি বে। মেকোর উত্তর-ও ধারটায় বসি খাওয়া হয়ে গেছে। বাবুর বাবার মাইরি এত বড়রা কে এক৫ববলে-মেকো, মনে দুখ লিস না। তোর কপালটা খারাপ মেধ্যে লস্ত্য, কালো, পরনে নোংরা প্যান্ট, গায়ে একইটা মেয়েদের বন্দরের নকশাদার চাদর। মুখটা সরু, ভাঙা। সোমেনকে একবার স্থির, কৃর দৃষ্টিতে দেখে নিয়ে বলল না পাণ্ডু, দুখ কীসের? তোমরা তো চুপকি মেরে ঢুকে খেয়ে এলে, আমার বেলায় হায়ামি বাবুর বাবা ঠিক আটকে দিল।চারছন কামরার অন্য দিকে গিয়ে বসে। সোমেনের বয়সিই হবে। জামা প্যান্ট ময়লা, ফরসা কিংবা কালো, লয়া কিংবা বেঁটে চারজনকে কিন্তু গড়পড়তা একই রকম রেখায়। মেকো এক ঠোঙা চিনাবাদাম বের করে বেঞ্চে নিজের পাশে রেখে বলে বাবু বলেছিল বাট ওর বাপটা হারামি আছে। একজন বলে-বহুত হায়ামি। বাবু আমাকেও বুধবারে বসেছিল, ভা বোনের বিয়েতে
পৃষ্ঠা:৩১
আসতে পারলে একটা দিনেমা দেখাবে। আমি তো যেখানে বিয়েবাড়ি দেশি ঠিক ঢুকে যাই, আর এ তো বন্ধুর বোনের বিয়ে। বাবু তখনই বলল-শুয়োরের বাচ্চা, আমার বাগকে তো চেনো না। বলেছে আমার কোনও বন্ধু ঢুকলে যাও যরে বের করে দেবে। আমিও বললাম, ঠিক আছে দেখে নেব।-তোকে কী বলল?-কী কাবে। প্যান্ডেলের গেট আটকে দাঁড়িয়েছিল উটকো লোক যদি ঢুকে যায় তো আটকাবে। আমাকে কেবল জিজ্ঞেস করাল-তুমি কোথেকে আসছ। বুদ্ধি করে বলে দিলাম, ছেলের তরফের। সন্দেহ করেছিল বটে, কিন্তু আটিকায়নি।মেকো বেঁটে একজনকে জিজ্ঞেস করে, তোর তো শালা নেমন্তন্নই ছিল।যাকে জিজ্ঞেস করা সেই হাই তুলে বলে-নেমন্তন্ন মানে। পুরো ফ্যামিলি কার্ড। আমাকেও আটকে ছিল, বাবার নাম বলতেই ছেড়ে দিল। প্রেজেন্টেশনের প্যাকেট ফ্যাকেট হাতে না থাকলে সন্দেহ করবেই। তুইও আবার মেজাজ নিলি।মেকো ঠ্যাটো ছড়িয়ে বলল-দূর বে গান্ডু, মেজাজ নেব না তো কি ওর ইয়ে শুয়ে জল খার। খপ করে হাতটা চেপে ধরল যে। বলল-তোমাকে তো চেনা-চেনা লাগছে, তুমি বাবুর বন্ধু না? তখন আমি গুটি নিয়ে বললাম-হ্যা বন্ধু তো কী হয়েছে। তখন বলে-কে নেমন্তন্ন করেছে তোমাকে? আমি তখন গরম খেয়ে বললাম- নেমন্তন্ন আপনি করেননি, বাবু করেছে। হারামিটা তখন বলে-বাবু তার কোনও বন্ধুকে নেমন্তন্ন করেনি, করলে তার হাড গুড়ো করে দেব। দেখি নেমস্তক্রের কার্ড। দে একটা ফ্যাসাদ মাইরি। আরও গরম খেতে যাচ্ছিলাম, লোকজন জুটিয়ে ঠিক একটা ভণ্ডুল করতাম, সে সময়ে বাবু এসে দূর থেকে চোখ টিপে সরে পড়তে বলল। নইলে চতুর্থজন সিগারেট ধরাল। বলল-আমাকে কিছু জিজ্ঞেসই করেনি। বহিরে একটু দাড়িয়ে রইলাম। স্যুট করে ঢুকে গেলাম এক সময়ে।মেকো বলে বাবুকে ঝাড়ব একদিন। এত বিয়েবাড়ি ‘রেড’ করলাম, সন্দেহ করলেও ভদ্রলোকেরা বেশি কিছু বলে না, কিন্তু এরকম যচাই পাটি কখনও দেখিনি।মেকো দ্রুত চিনেবাদামের খোসা তার দিকে চেয়ে হাসে। মেবেন হাসে না।চতুর্থজন বলে-মেজাজটা নিলে ঠিক ছেড়ে দিত তোকে।মেকো তাকে একেটা জরিণ মারল। অগ্রচমকা। বলল বেশ করেছি মেজাজ নিয়েছি।লাথি খেয়ে ভূতুগীজন বলে-তাতে লাভ কী হল? ভরপেট হাওয়া।তিনজন জটস।দ্বিতীয়জন বলে অসেল কথাটা কী জানিস মেকো, তোর ড্রেসটা আজ সব মাটি করেছে। বিয়েবাড়ি ভদ্রলোকের জায়গা। আমাদের রাস্তা-ঘাটে দেখে তো বাবুর বাবা, ছোটোলোকের মতোদেখকে। তুই যদি একটু মেক-আপ নিয়ে যেতিস-খচাস না কেলো। ছোট ভাইটাকে বললাম পুলওভারটা রেখে যাস, এক জায়গায় যাব, বিকেলে দেখি সেটা নেই। মেজাজটা সেই থেকে বিল্য হয়ে আছে।তৃতীয়জন হঠাৎ বলে–মেকো, তোকে একটা জিনিস দিতে পারি।-কী? নিস্পৃহ মেকো জিজ্ঞেস করে।তৃতীয়জন তার প্যান্টের পকেট থেকে একটা ডেলা বের করে আনে।
পৃষ্ঠা:৩২
বে? মেকো চোখ ছোট করে জিজ্ঞেস করে।ফ্রাই। হাতহিন্তু করে একটা সরিয়েছিলাম।-বার জন্য। -বার জন্য আবার। এমনি।মেকো জোর হেসে ওঠে-সুখ্যকে দিতিস? আলু। সবই খ্যা-খ্যা করে হাসতে থাকে।মেকো আর তার সঙ্গীদের পুরো গল্পটা শোনা হল না। ব্যান্ডেলে ওরা নেমে গেল। সোমেন পকেটে হাত দিয়ে দেখল তার ঘড়ি আংটি, কোমরে উকেন। কিছু বিশ্বাস নেই। এখনও অনেকটা পথ।হাওড়ায় যখন গাড়ি ঢুকল তখন স্টেশন ফাঁকা। রেল পুলিশ স্টেশনের চত্তর থেকে ভবঘুরেদের সরিয়ে দিচ্ছে, তবু এমন ভাল শোওয়ার জায়গ্য পেয়ে কিছু লোক এধার-ওধার পড়ে আছে চাদরমুড়ি দিয়ে শবদেহের মতো। শীতের রাত দশটার পরই ঝিমিয়ে গেছে শহর। কয়েকজন মাত্র লোক নিয়ে স্টিমারের মতো প্রকাণ্ড পাঁচ নম্বর বাসটা ছেড়ে যাচ্ছিল, সোমেন দৌড়ে গিয়ে ধরল। হাওড়ার পোল পেরিয়ে শহর ভেদ করে যেতে যেতে কিছুতেই যেন বিশ্বাস হয় না, একটু আগেই নে বহেরুর খামারবাড়িতে ছিল।রাত এগারোটায় বাড়ি ফিরে এল সোমেন। সবাই তার অপেক্ষায় জেগে বসে আছে। কেউ খায়নি। যেতে বসলে পর মা জিজ্ঞেস করে-কী বলল রে? দেবে? কী জানি। স্পষ্ট কথা বলে নই। মা শ্বাস ফেলে বলে দেবে না। আমি জানতাম।দাদা বিরক্ত মুখ তুলে বলে-জানতে যদি তবে আগ বাড়িয়ে চেয়ে পাঠালে কেন? আমি তো বারণই করেছিলাম। -বুড়ো হয়েছে, এবন যদি মতিগতি পালটে থাকে-সেই আশায়। দাদা ভাত মাখতে মাখতে বলেয়ে লোকটার কোনওকালে মন বলে বস্তু ছিল না তার কাছ থেকে কিছু আশা করা বৃথা। তুমি কোন আড়েদে যে চিঠিটাতে আমার নাম করে চাইলে। তোমার কি ধারণা, আমার নাম করে চাইলে বাবা গলে যাবে। তোকে তো ভালবাসত খুবই সংসারে একমাত্র তোর দিকেই টান ছিল। ওসব বাইরের টার মায়া। দত্যিকারের ভালবাসা নয়..। বলতে বলতে দ্বারা গার্ল হয়ে ওঠে রাগে, অপমানে। মা দুঃখ কৃত্তে পলে অজিত বলছিল জমিটা আর ধরে রাখা যাবে না, ভাল ভাল দর দিচ্ছে লোক। শুর বন্ধুও দাদাকে দিয়ে গত সপ্তাহে চিঠি দিয়েছে। বেচে দিক গে। দাদা প্রচন্ড রাগের গলায় বলে। মা অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। ফদার রাগকে এ বাড়ির সবাই ভয় পায়। দীর্ঘকাল হয় দাদার রোজগারে সংসার চলছে। সাইত্রিশ বছর বয়সে দানা সংসারের পরিপূর্ণ অভিভাবক। মা হঠাৎ নিজত্ততা ভেঙে বলে-তুই একটু দেখ না। দাদা অবাক চোখ তুলে বলে-কী দেখব! -একবার যা, তোর মুখ দেখলে যদি মায়া হয়। দাদা স্থির দৃষ্টিতে মার মুখের দিকে চাইল। মাও তক্ষুনি কথটার ভুল বুঝতে পারে।
পৃষ্ঠা:৩৩
চোখ সরিয়ে নিয়ে প্রসঙ্গ পালটে বলে না হলে দেখ যেমন করে পারিন, বারদোর করেও যদি রাখা যায়। আমার একখানা গড়না থাকলেও আজ খুলে দিলাম। কিন্তু ওই রাক্ষস তো সবই খেয়েছে। দাদা কোনও উত্তর দেয় না, খাওয়াদা শেষে উঠে যায়। সোমেন আর মা এক যঘারে দুটো চৌকিতে শোয়। মশারি ফেলা হয়ে গেছে, সোমেন শোওয়ার আগে সিগারেট খাচ্ছিল। মার সামনেই খায়। মা তার মশারির মধ্যে বসে মশা খুঁজল কিছুক্ষণ। চুলের জট ছাড়াল বসে। অরপর এক সময়ে বলল-কেমন সব দেখে এলি। কীসের কথা বলছ? বাবার কথা। -ভালই তো। -বহেক মোটে চারশো টাকা পাঠাল, ধানের দয় কি এবার কম। -বলা তো দর ভালই। যা দিল নিয়ে এলাম। -তুই তো ওরকমই, বাপের মতো ন্যালাক্ষ্যাপা। হিসেব বুঝে আসতে হয়। বহেরু কি সোজা লোক। তোর বাপের প্রভিডেন্ট ফান্ডের আর হাতের-পাতের রা ছিল তা দিয়ে নাকি জমি-টমি কিনিয়েছে। শেষে সব ও নিজেই ভোগ করবে। সোমেন একটু বিরক্ত হয়ে বলে-লোকটাকেই যখন ছেড়ে দিয়েছ তখন তার টাকার হিসেব দিয়ে কী হবে। মা চুপ করে যায়। কিন্তু বেশিক্ষণ নিজেকে সামলাতে পারে না, বলে আমার দুঃখ তোরা তার কিছু পেলি না। দশভূতে দুটে খাচ্ছে। -খাক গে। আমার ওসব দরকার নেই। -ঠিক ঠিক কী বললে বল তো? একবার তো বললাম। -আবার বল। গতিয়ে দেখি, কথ্যার মধ্যে কোনও ফাঁক রেখেছে কিনা। -কলকাতায় আমরা বাডি করি বাজান না। গোবিন্দপুরে গেলে বাড়ি করার টাকা দেসে। চাকরি-বাকরি ছেড়ে যাবে কী করে। তুই বুঝিয়ে সুকিয়ে আসতে পারলি না? সোমেন নীছর উত্তেজনায় আর একটা সিগারেট ধরাস।-কিরে? মা জিজ্ঞেস করে আবার।-বাবার বয়স কত না।-কেন?-বলো না।-সে হিসেব কি জানি? সে আমলে ব্যাস-উৎস নিয়ে তো কেউ হিসেব বড় একটা করত ন্য। মনে হয় পঁয়ষট্টি হবে। আমারই তো বোধ হয় ঘাট-টাট। কী জানি, ঠিক জানি না।-এই বয়সে একটা লোক অতদূরে একা পড়ে আছে। সে কেমন আছে তা একবারও জিজ্ঞেস করলে না?
পৃষ্ঠা:৩৪
-মা একটু অবাক হয়ে বলে-জিজ্ঞেস করলাম তো। তুই তো বললি ভালই। কেন, কিছু হয়েছে নাকি? বলতে বলতে মা উদ্বেগে মশারি তুলে বেরিয়ে আসে। মার চুল এখনও সব শেষ হয়ে যায়নি। এলো চুলের ঢলটি এখনও পিছনে কালো প্রপাতের মতো ঝরে পড়ছে। সেই কালোর মধ্যে রোগা সাদা মুখখানা, তাতে বিস্ফারিত চোখ দেখে সোমেনের মায়া হয়। মাথা নেড়ে বলল-কিছু হয়নি।-তবে ওসব কী বলছিস। ভাঁড়াস না। ঠিক করে বল।সোমেন হাসতে চেষ্টা করে। ঠিক ফোটে না হাসিটা। তার মনের মধ্যে একটা কথা বিষে আছে-ভগবান, উহারা যেন সুখে থাকে। কোন অসতর্ক মুহূর্তে নাকি মৃত্যুচিন্তায় নিজের ওই আর্তস্বর ডায়েরিতে লিখে রেখেছে বাবা! মা চেয়ে আছে। সোমেন বলে-ভেব না, ভালই আছে। টাকার কথাটা বেশি বলতে আমার লজ্জা করেছিল। গত পাঁচবছর আমরা কেউ বাবার খোঁজ নিতে যাইনি। মার মুখে যেন জল শুকিয়ে যায়। শুকনো মুখে টাকরায় জিভ লাগার শব্দ হয় একটা। মা বলে-গেলে কি খুশি হত নাকি। রণেন যখন যেত-টেত তখন তো উলটে রাগ করেছে। রণেনের অপমান হয় না! ছেলে এখন বড় হয়েছে, ছেলেমেয়ের বাবা তার সঙ্গে কথা বলতে বাপকেও সাবধান হতে হয়। সে লোকটা কী তেমন বাপ। চিরকাল… মা হাপরহাটি খুলে বলতে যাচ্ছিল। সোমেন বাধা দিয়ে বলে থাকগে। ওসব শুনে শুনে তো মুখস্থ হয়ে গেছে। মা রাগ করে বলে–আজ হঠাৎ তার দিকে টানছিস কেন? সে তোর জন্য কী করেছে? কিছু করেননি। সোমেন তা জানে। কেবল দশবাতির আলোয় মুখ তুলে বাবা একবার তাঁর কনিষ্ঠ ছেলেটির সুকুমার মুখশ্রী বড় ক্ষুধাভরে দেখেছিলেন। কী পিপাসা ছিল সেই চোখে!সোমেন হঠাৎ হালকা গলায় বলে-তোমরা মিস্টার অ্যান্ড মিসেস এবার একটা ফয়সালা করে নাও না।-কীসের ফয়সালা? সময় ০৫৬ -তুমি কি শুভদৃষ্টির করে চেয়েছিলে বাবার দিকে? অন্য সময়ে । মা হালকাভাবেই নেয় এসব কথা। এখন উদাস গলায় বলে-কে। সোহা চোখে ছেয়েয়ই তা সেই আনে। কাকেমা একটু চুপ্ত করে ভাবে। তারপর বলে-আমি তো সবই করেছি। ঘরদোর আগলে, ছেলেমেয়ে মানুষ করে, কোনওটাতেই তো ফাঁক রাখিনি। এখনও আমিই আছি সংসারে। কিন্তু তাকে বাউন্ডুলে হতে হয়েছে। কর্মফল কার ফলল? সে যদি ভালমানুষই হবে, তবে কেন এই সংসারের খরে পা দিতে সাহস পায় না? কেন ছেলেরা মেয়েরা জামাইরা তাকে বিষচক্ষে দেখে? সোমেন মাথা নেড়ে গম্ভীর হয়ে বলে-তোমার বড় গুমোর হয়েছে ননীবালা! -গুমোর। কীসের গুমোর রে পাজি ছেলে? -ছেলেমেয়েরা তোমাকে ভালবাসে, বাপকে বাসে না, তার গুমোর। -গুমোর থাকলে আছে। মায়েদের তো ওই একটাই অহংকারের জায়গা। তাকে ভাল
পৃষ্ঠা:৩৫
বলার জন্য বাইরের লোক আছে, আমাকে তো বাইরের লোকে জানে না, তোরা জানিসা আমিও তোদের জানি। সে বলুক তো বুকে হাত দিয়ে ছেলেমেয়েদের জন্য কী করেছে। সোমেন সিগারেটটা পিয়ে নিবিয়ে মশারির মধ্যে ঢুকে গিয়ে বলে বাদ দাও। রাত বারোটা বাজে। মা তবু গুনগুন করতে থাকে-একদিনে তুই এমন কী চিনে এলি লোকটাকে। আমরা সারাজীবন জ্বলেপুড়ে গেলাম- -আঃ। আলোটা নেবাও তো। মা আলো নিবিয়ে দেয়, অন্ধকারেও কথা বলে আমার বাচ্চারা জন্ম থেকে মাকে জানে, বাপ ছিল অতিথিসজ্জনের মতো। আজও তাই আছে। স্বার্থপর বারমুখো, পাগল একটা।সোমেন ধমকায়, বকবক করো না তো। অনেক ধকল গেছে- মা চুপ করে যায়। গলা এক পরদা নামিয়ে গুনাগুন স্বরে বলে, আরজন্মে আর মেয়ে হয়ে জন্মাব ভেবেছিস? মেয়েজন্ম এবারই ঘুচিয়ে গেলাম। আর না। কী পাপ, কী পাপ। ব্যাঙ্ক অফ বরোদা একদম মৌনীবাবা হয়ে আছে। চিঠিপত্র কিছু আসছে না। দিন যায়, সোমেন ভাবে চাকরিটা বোধ হয় হল না। ওদের অফিসে গিয়ে খোঁজ নিতে ভয়-ভয় করে। ইদানীং যে কয়েকটা পরীক্ষা বা ইন্টারভিউ দিয়েছিল তার মধ্যে ব্যাঙ্ক অফ বরোদাই ছিল হট ফেবারিট। যদি না হয় তবে কী যে হবে। অণিমার সঙ্গে ইউনিভার্সিটির লন-এ অনেক বসেছে সোমেন। মেয়েটা বড় বুদ্ধিমতী। অনেক মেয়ের সঙ্গে আড্ডা দিয়েও, অণিমার সঙ্গে আলাদা বসতে ভাল লাগত। চোখ্য চেহারা, ভারী চশমা চোখে। দাঁত চমৎকার। মুখটা একটু ভাড়া আর লম্বা বটে, কিন্তু ফরসা রঙে, আর প্রচুর পড়াশুনো করার ফলে একরকমের গাম্ভীর্য এসে গিয়েছিল বলে এর চেহারাটা ভালই লাগে সকলের। সোমেনের ভাল লাগা কিছু বেশি ছিল। অণিমাও তাকে পছন্দ করেছে বরাবর। সেবার বউদির সঙ্গে মার ঝগড়াটা খুর ভূরমে উঠেছিল। বরাবরই ছিল ঝগড়া। মার একটা বিচ্ছিরি স্বভাব আছে, সংসার থেকে জিনিস সরানো। তেমন কোনও কাজে লাগে না, তবু মা একটু চিনি কী আটা, নিজৎ একটু বাসনপত্র, ছেঁড়া ন্যাকড়াই হল কখনও, যা পাবে সব সরিয়ে লুকিয়ে রাখে। ভূত্র উপর আড়াই ঘরের ফ্ল্যাট বাড়ির যে ঘরখানায় মা আর সোমেন থাকে, সেটা প্রায় সুমুরেই তালাবন্ধ করে রাখে মা। এই স্বার্থপরতা বউদি প্রথন থেকেই সহ্য করতে পারত নাদ প্রায় সময়েই বলত-ছেলেমেয়েগুলো জায়গা বাসা পায় না, এমনিতেই জায়গা কম, তার ওপর আকার একখানা ঘর তালাবন্ধ। মা আবার সে কথার জবাব দিত- আমি বাপু নিজের হাতে ঘর পরিষ্কার করি, ছেলেপুলে নোংরা করলে, তোমরা তো সব পাটের বিবি, মুখ ফিরিয়ে থাকবে। সারাদিন খেটেখুটে রাতে একটু পরিষ্কার বিছানা পাব না। তা হবে না। এইভাবেই ক্রমে ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে দুই যুযুৎসব তৈরি হচ্ছিল। কারণটা কিছুই না, তবু ওই ঘরখানার অধিকারবোধ নিয়ে দুপক্ষের লড়াই। এই ঝগড়ায় বরাবর দাদা এসে মিটমাট করেছে, সোমেন বাড়ি ফিরে মাকে ধমকেছে। আবার পরদিন সব ঠিকও হয়ে গেছে। কিন্তু সেবার ঝগড়াটা এতই চরমে উঠল যে, মা একটা বাটি ছুঁড়ে মেরেছিল বউদিকে।
পৃষ্ঠা:৩৬
বউদির বদলে সেটা তার কোলের বাচ্চার হাঁটুতে লাগে। বউদি বাচ্চা ফেলে তেছে এসেছিল মাকে মারতে। রি স্মাটকায়।দাদা সেই প্রথম ঝগড়ার মিটমাট করার চেষ্টা করল না। অফিস থেকে ফিরে আসার পর বউদি পাশের ঘরে দাদার কাছে চেঁচিয়ে কেঁদে মার নামে নালিশ করল। অনেক রাত পর্যন্ত অশান্তি। অন্য ঘরে মা তখন ভয় পেয়ে কাঁদছে। সোমেন মাকে ধমকায়নি পর্যন্ত সেদিন। চুপ করে নিজের বিছানায় শুয়েছিল। সেই রাতে বউদি বা মার কারও ওপর তেমন নয়, কিন্তু দাদার ওপর কেমন একটু অবিশ্বাস এসেছিল বার। ছেলেবেলা থেকে যেমন সে দেখে এসেছে, মা-অন্ত প্রাণ দাদাকে, সেই দাদা যেন বা আর নেই। দাদার বিয়ের আগে পর্যন্ত তারা কত সুখী ছিল, এই কথা আলাদা থাকবে। সে রাতে সে মার পক্ষই যে সমর্থন করেছিল তা নয়। সে কেবল ভেবেছিল সংসারটার শান্তি বাঁচাতে ননীবালাকে আলাদা করা দরকার। দাদার রোজগারে যখন সংসার চলে তখন বউদির প্রাপ্য সম্মান তাকে নিতেই হবে। মা পুরঅন্ধ, অধিকারবোধ প্রবল, মা জানে রণেন তারই আছে সবটুকু। কাউকে কিছু না জানিয়ে সে ইউনিভার্সিটি যাওয়া বন্ধ করে পড়াশুনো আস্তে আস্তে ছেড়ে দেয়। পড়াশুনোর ক্ষতি হয় বলে দাদা তাকে টিউশনি করতে দেয়নি কক্ষাও। ক্রমে সে টিউশনিও খুঁজতে থাকে। সে সময়ে অণিমার সঙ্গে দেখা একতিন। চাকরির আপ্লিকেশনের জন্য ক্যারেকটার সার্টিফিকেট আনতে গিয়েছিল ইউনিভার্সিটিতে, দেখে অণিমা একা জলের ধারে ঘাসে বসে আছে রোদ্দুরে। কোলে খোলা বই। ওকে একা দেখে একটু কষ্ট হল সোমেনের। পাশে তার থাকার কথা এ-সময়ে। কত কথা হত তাদের। চুপ করে থাকাটাও একরকমের পূর্ণই ছিল। সৌটা ভালবাসা নয়, বোধ হয় বন্ধুত্বই হবে। তাকে দেখে চমকাল না অণিমা। আন্তরিক মুখখানা তুলে বলল-ভাবছিলাম, তোমার খোঁজ নিতে যাব। অসুখ-বিসুখ করেছিল? -না। পড়া ছেড়ে দিচ্ছি।অনিমা মৃদু হেসে বলে ছেড়ে দেওয়াই উচিত। একে কি পড়াশুনো বলে। -আমি ছাড়ছি পেটের বান্ধায়া।-তাই নাকি? চাকরি পেয়েছঃ এ -কোথায় চাকরি। টিউশনিই পাচ্ছি না সুবিধা মতো অণিমা আন্তরিক উদ্বেগাদ সঙ্গে বলে-তোমার খুব দরকার টিউশনির? খুব। – এতদিন কী করে চালাচ্ছিলে? -দাদা দিত। দিত কেন, এখনও দেয়। আমার নিতে ইচ্ছে করে না। এম-এ পাশের কোনও ভবিষ্যৎ নেই, খামোখা খরচাহমাদ মাইনে দিইনি। অশিমা অকপাটে জিজ্ঞেস করল-তোমার কেউ বার্ডেন নেই তো? -না, কেন। -ভাবছিলাম, একশো টাকার একটা টিউশনি হলে তোমার চলে কি না। -তোমার হাতে আছে? – আছে: যদি প্রেস্টিজে না লাগে করতে পারো। প্রেস্টিজের কী ব্যাপার টিউশনিতে?
পৃষ্ঠা:৩৭
-আমার ভাইকে পড়াবে?অদিমার ভাইকে কেন পড়াতে পারবে না, তার কোনও যুক্তিসিদ্ধ কারণ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। অণিমা তো বন্ধু, একই ক্লাসে পড়ে। ওর ভাইকে পড়ালে বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর সামাভাবটা নষ্ট হয়ে যাবে-শুধু এইটুকু খারাপ লেগেছিল সোমেনের। কিন্তু অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে হেসে সে বলল-গড়াব না কেন?অণিমা নিশ্চিন্ত হয়ে বলে তাহলে কাল থেকেই যেয়ো। ভাইটা সেন্ট লরেন্স-এ পড়ে। ক্লাস সিক্স। ইংরেজিতে বড্ড কাঁচা, ক্লাস ফলো করতে পারে না। স্কুল থেকে চিঠি দিয়েছে, পরের পরীক্ষায় ইংরেজিতে ভাল ফল না করলে নীচের ক্লাসে নামিয়ে দেবে। আমরা তাই একজন ভাল টিউটর খুঁজছি।-আমি রাজি। সেই থেকে সোমেন পড়ায় অণিমার ভাইকে। কিন্তু আশ্চর্য, এ ক’মাসের মধ্যে একদিনও ওদের বাড়িতে অণিমার সঙ্গে দেখা হয়নি। বোধ হয় লজ্জায় অণিমাই সামনে আসে না। সোমেনকে গুরা মাইনে দিয়ে রেখেছে, এটা বোধ হয় অণিমার কাছে সাধারণ ব্যাপার নয়। সোমেনও খোঁজ করে না। যতদিন টিউশনি না করত ততদিন সহজে দেখা হত বরং। এখন অণিমার বাড়িতে রোজ আসে বলে অণিমা রবিঠাকুরের সেই সোনার হরিণ হয়ে গেল বুঝি। পালিয়ে বেড়ায়, দৃষ্টি এড়ায়।কিন্তু টিউশনি করে কিছু লাভ হয়নি। মাকে নিয়ে আলাদা বাসা করার সাময়িক চিন্তা সে ছেড়েও দিয়েছে। সংসারের সবটাই তো কেবল কুরুক্ষেত্র নয়, সেখানে আছে একটা অদৃশ্য নিউক্লিয়াস, অণু-পরমাণু সব মানুষ কেন্দ্রাভিগ আকর্ষণে একটা টিননক্ষেত্র তৈরি করে নেয়। তাই সংসারের প্রতিদিনবার ভাঙচুরগুলো অলক্ষ্যে এক সারাহকর এসে কিছু কিছু মেরামত করে দিয়ে যায়, ঠুকে ঠুকে যেন বা বাসনপত্রের টোল-পড়া জায়গা তুলে দিয়ে যায়, জোড়া দেয় ফাটা-ভাঙা বাসন। সবটা মেরামত হয় না অবশ্য। নিখুঁতভাবে জোড়া লাগে না। তবুও অদৃশ্য নিউক্লিয়াস টানক্ষেত্রের ধর্ম রক্ষা করে চলে। তাই আবার মা আর বউদি ভাগাভাগি করে সংসারের কাজ করে এখনও। এ ছেলে রাখে তো ও রান্না করে। সোমেন তাই আর আলাদা বাসা করার কথা ভাবে না। কেবল বাবার কথা ভাবলেই সংসারের টানক্ষেত্রনির দুর্বলতা ধরা পড়ে। বাবা যে সত্যিই টুরিষ্টক্ষেত্রটা ছেড়ে গেছে তাও মনে হয় না আবার। সেই কথাটা বিষে থাকে সোমেনের মানে ভগবান, উহারা যেন সুখে থাকে। টিউশনিটা তাই আর ভচ লাগে না সোমেনের। খামোখা। চাকরিটা পেলে বরং হয়।টিউশনিটা ছাড়লে আল্লিমাও সহজভাবে কথা বলতে পারে আবার। বড্ড আবেগপ্রবণ মেয়ে।আবার মাসের প্রধমৈ একশোটা টাকা পাওয়ার অভ্যাসই বা কেমন করে ছাড়ে সোমেন। সন্ধ্যাবেলা সোমেন গাব্বুকে পড়িয়ে বেরোচ্ছে, হঠাৎ দেখে, অন্যমনে মাথা নিচু করে অণিমা অন্য দরজা দিয়ে বাসা থেকে বেরোচ্ছে। তেমনই আছে অণিমা। ভারী চশমার আড়ালে চোখ, পরনে ছাপা শাড়ি, গায়ে টোল, হাতে ব্যাগ, পায়ে চপ্পল। মুখে কোনও প্রসাধন কখনও মাখে না, চুল রুক্ষ।-এই যে বস, কী খবর?অণিমা চমকাল না। অশিমা কখনও চমকায় না। অণিমা কখনও চমকাবে না। আচমকা বোমা পড়লেও না। ওর এই স্বভাব। গম্ভীর মুখখানা তুলে চমৎকার মুখে হাসল-কী খবর। ছাত্র কীরকম পড়ছে।
পৃষ্ঠা:৩৮
ভালই। টার্মের ইনক্রিমেন্ট দেরে নাকি?-ইনক্রিমেন্ট। ভারি অপ্রতিভ গলায় বলে অণিমা। তেমনি ঠাট্টার স্বরে সোমেন বলে-ইনক্রিমেন্ট না দিলে ঘেরাও করব।এবা কি কাউকে ঘেরাও করা যায়? চোখ নাচিয়ে সোমেন বলে-যায় না?-কীভাবে শুনিসোমেন শব্দহীন হাসি হেসে বলে-যায়। একজনের দুটো হাতে একদিন ঠিকই ঘেরাও হবে তুমি। জানোনা? অণিমা মাথা নেড়ে বয়ো-না তো। কে সো ধরো, যদি বলি….
ছয়
অণিমা মুখ তুলে হাসে। হাসিটা দুষ্টুমিতে ভরা। অণিমা বলল থাক, বেলো না।-বলব না। সোমেন বিস্ময়ের ভান করে-তা হলে কথানি কি টের পেয়ে গেছ?-না তো। তবে শুনতে চাইছি না।সোমেন দীর্ঘশ্বাস হেডে বলে-গরিব হওয়ার ওই একটা দোষ। বড়লোকের মেয়েরা পাতা দিতে চায় না।আইে। তোমাকে আমি পাস্তা দিইনি?-বিয়েছ? তা হলে শোনোই না কথাটা। ধরো, যদি বলি–চুপ করব? যদি তোমাদের বাড়ি থেকে ফেরার পথে আজ আমার একটা অ্যাকসিডেন্ট হয় তা হলে কিন্তু কথাটা না বলাই থেকে যাবে। সারাজীবন তুমি ভাববে, সোমেন কী একটা বলতে চেয়েছিলবিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে সৃষ্টিীর হেসে ফেলে অণিমা। বলে গরিবের ছেলের অনেক দোষ। তার মধ্যে মৃত্যু-দ্বীয়ে রোমান্টিসিজম একটা।অণিমাদের বাগানে হইচাকরি ফুল ফুটেছে। বারান্দার ফ্লুরোসেন্ট আলোতে অজয় ভৌতিক ফুল দেখা হয়েছে। আসল রং বোঝা যায় না রাতে, কেমন আলোর তৈরি ফুল সব আধো-অন্ধকার শাঁখানে নিস্তব্ধ হয়ে ফুটে আছে। সোমেন চলে যাবে বলে বারান্দার বুযাপ সিড়ি বেয়ে নেমে এল। বলগ-গুলি। বলা হল না কিন্তু।-না হোক। শোনো, কোথায় যাচ্ছ?-গড়িয়াহাটা।-হাতে কোনও কাজ নেই তো।-কী কাজ থাকবে। সারাদিন নৈকষ্যি বেকার। গড়িয়াহাটায় বুকস্টলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটু লিটল ম্যাগাজিন দেখব, তারপর বাসায় ফিরব।অশিমার বাইরে যাকর সাজ। সোমেনের পিছু পিছু নেমে আসতে আসতে বলল- একটা জায়গায় আমার সঙ্গে যাবে?
পৃষ্ঠা:৩৯
সোমেন দাঁড়য়ে। হেসে বলে-যেতে পারি, যদি কথাট শোনো- অণিমা মাথা ঝাকিয়ে বলে-কথাটা আর একদিন বললে হয় না। যেদিন বেশ টসটাদ উঠবে, ফুল-টুল ফুটবে, দূরে কোথাও যাব আমরা। সেদিন বোলো বাপু! -সময় কিন্তু বয়ে যাচ্ছে। -থাকগে। এখন আমাকে পৌঁছে দাও। এবং একা ট্যাক্সি চড়তে ভয় করে। -তাই বলো। নইলে কি আর আমাকে সঙ্গে নিতে। অণিমা কথা বলে না। কুটি করে। প্রশস্ত পথটি ধরে ওরা বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের দিকে আস্তে আস্তে হাঁটে। সোমেন সিগারেট ববিয়ে নিয়ে বলে-অত রাতে কোথায় যাচ্ছ একা। অণিমা বলে-একা তো যাচ্ছি না। আমাকে না পেলে তো যেতে। অণিমা হেসে বলে-তাই যদি যাব তবে গাওস্তুত পড়না ঘরের পাশের ঘরটার বলে ঘন্টাখানেক মশা তাডালাম কেন? বুঝলে মশাই, ঠিক তকে তকে ছিলাম কবন তোমার পড়ানো শেষ হবে। সোমেন বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে পড়ে বলে-তাই বুঝি। তবে কী কথাটা তুমিই বলতে চাও অণিমা। তাই অপেক্ষা করেছিলে ট্যাক্সিতে যেতে যেতে বলবে। নাকি কোথাও দূরের কোনও মাঠে পৌঁছে গিয়ে বলবে। অণিমা ভয় পাওয়ার ভান করে বলে-না, না, আজ নয়। আজ অন্য জায়গায় যাচ্ছি। সোমেন স্নান মূখে ছাঁটতে হাঁটতে বলে-কলকাতায় কত লোকের কত জায়গা আছে যাওয়ার। -তোমার তাই বুঝি। সোমেন মাথা নাড়ে। আস্তে আস্তে আপন মনে বলে-ধরো, পার্ক স্ট্রিটের হোটেলে নাচ-গান হল্লোড় হয়, বড় রেস্টুরেন্টে হয় বিউটি কন্টেস্ট, কেনেস ক্লাবে জগ শো, সাউখ ক্লাবে টেনিস, গোপন আড্ডার নেশাভাঙ। সব জায়গায় যেতে ইচ্ছে করে। একটা খাস ফেলে বলে এমন গঙ্গার ঘাটেও যাইনা, জাহাজ দেখলে মন খারাপ হয়ে যায়। কোনওদিন বিদেশে যাব না, এই সত্যি কথাটা রউই মনে পড়ে। -আস্থ্য হিচকালুনে ছেলে রে বাবা! আর কী বই ইচ্ছে করে তোমার, একটা লিস্ট করে দিও তো। খেয়াল রাবন্তী এই তো ইচ্ছে করছে একটা কথা বলি। হরো, যদি বলিদু’হাতে বন্তি চাপা দিয়ে অণিমা হেসে ওঠে-ওটা থাক। -বললেই তো ফুরিয়ে গেলঃ থাক না। -সময় চলে যাচ্ছে। -যাকগে। তুমি ট্যাক্সি গতে তো। এই রাস্তায় ট্যাক্সি বড় কম। সন্ধে সাতটাও বাজেনি। অলিগঞ্জ সার্কুলার রোড এর মধ্যেই জনহীন, পরিত্যক্ত। হড়হড় করে কেবল কয়েকটা গাড়ি ওয়াশ-এর গুণির মতো মিলিয়ে যাচ্ছে। খোমেন রাস্তার দু’ধার দেখে হাই তুলে আড়মোড়া ভেঙে বলে-প্রাইভেট টিউটর হওয়ার কি গেরো রে বাক।
পৃষ্ঠা:৪০
কী হল?-ঢাকরি বজায় রাখতে কত ওভার টাইম খাটতে হচ্ছে।-ইস। কী যে অসহ্য হয়ে যাচ্ছ না দিনকে-দিন।-সেই জন্যই তো বলছিলাম, আরও অসহ্য হয়ে ওঠার আগেই কথাটা বলে ফেলার একটা চান্স দাও। এমন ফাঁকা রাস্তা, নিঝুম শীতের বাক, লোড শেডিং থাকলে চাঁদও দেখা যেত ঠিক। বরো, যদি বলি-ওই যে ট্যাক্সি সোমেন। ধরো, দৌড়ে যাও…সোমেন দৌডোল, এবং চটির একটা স্লাপ ছিড়ে ট্যাক্সিটা ধরতে পারল। অবশ আর কেউ ট্যাক্সি ধরার জন্য ওত পেতে ছিল না। যতদূর দেখা যায় রাস্তাটিন অতিশয় নির্জন।ট্যাক্সিতে সোমেন একটা সিগারেট ফ্যাল। হাঁফাচ্ছিল একটু। দুঃখিত স্বরে বলে-সব মুক্তি ঘরেআসে, সব গুটি ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন- -কী বলে রে পাগলা। অণিমার হাসি গুলকায়।-রাস্তায় এত রাতে মুক্তি নেই একটাও। তোমার ট্যাক্সি খরতে গিয়ে চটিটা বিয়েছে মাইরি।অণিমা শ্বাস ফলে বলে-কী যে কাণ্ড করো না।-তুমি দৌড়োতে বললে যে। না দৌড়োলে যদি চাকরিটা খাও।-ইচ্ছে করেই তো বললাম, নইলে তুমি বোকার মতো কথাটা বলে ফেলতে যেঃসোমেন সবিস্ময়ে বলে-কোন কথাটা?-যেটা বলতে চাইমিলে।-কী বলতে চাইছিলাম বলো তো।-কই যে। ধরো, যদি বলি-সোমেন বিরসমুখে বলে-থাকগে। বোলো না।-বলব না-বান। দিন বোলো। সোমেন সিগারেটে টান দিয়ে বলে যেদিন ফুলটুল ফুটবে।চাঁদ-টাঁদ উঠবে, লোড শেডিং থাকবে, দুরে কোথাও গিয়ে দুজনেই হেসে গড়ায়। পাঞ্জাবি ট্যাক্সিভ্যালা ঘাড় না ঘূকিয়েই একটা অস্ফুট শব্দে রাস্তা জানতে চায়। অণিমা হাসি না খারিরেই বলে-সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ।অণিমা তার খোঁশা হিন্দুকে ধরল, গা ঢাকা দিল, গাড়ির কাচটা তুলে দিল ভাল করে। বলল-শোন, কথাটা একজন বলে ফেলেছে।-কোন কধুটি সোমেন উদাসভাবে জিজ্ঞেস করে।-ও। সোমেন তেমনি নিরাসক্ত। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড পেরিয়ে লোয়ার সার্কুলার রোড ধরে ছুটছে গাড়ি। ডাইনে মোড় নিল একটা। কী চমৎকার সব মস্ত মস্ত ফ্লাটবাড়ি নিঝুম, অ্যারিস্টোক্র্যাট আর নরম সব আলোয় রঙে রঙিন। মুগ্ধ হয়ে যেখে সোমেন।-সত্যি বলছি। অণিমা বলল।-কে বলেছে কথাটা।ম্যাক্স।সোমেন একটু অবাক হয়ে বলে-কে বললে?
পৃ্ষ্ঠা ৪১ থেকে ৬০
পৃষ্ঠা:৪১
ম্যাজ।সে কে?-একজন অস্ট্রেলিয়ান সাহেব।-তাকে কোথায় পেলে।-পেয়ে গেলাম। একটা সেমিনারে আলাগ। দেখন থেকেই পিছু নেয় কলকাতার গলিযুক্তি দেখবে, বাঙাল বান্না খাবে, সেভার আর তবলা শিখবে। কিছুতেই ছাড়ে না। তাই তার গাইড হয়ে সঙ্গে নিয়ে কিছুদিন ঘুরলাম, নেমন্তন্ন করে খাওয়ালম, গানের ইস্কুলে নিয়ে গেলাম। সেই থেকে কী যে হয়ে গেল গুর।সোমেন চোখ মিট মিট করে ট্যাক্সির মধ্যেকার অন্ধকারে আবছা অণিমার মুখের দিকে চায়-বলেছে।-তোমার গা ছুঁয়ে বলছি। তিন-চারদিন আগে ভর সঙ্গে তারাপীঠ গিয়েছিলাম। মন্ত শ্বশান সেব্যনে, গাঁজার আভা। মাক্স গাঁজা খেতে গেল, আমি শ্যামলের সঙ্গে এধার-ওয় ঘুরে দেখছিলান। ম্যাক্স ঘন্টাখানেক গাঁজা টাঁজা টেনে এসে সোজা আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসল কথাটা শেষ না করে ট্যাক্সির ভিতরকার অন্ধকারে অশিমা ভারী রহস্যময়ী হয়ে বসে থাকে। নোমেন বিরসমুখে বলে তারাপীঠ জায়গাটাই খারাপ। অরে কক্ষনত যেও না- তাশিমা মুখ ফিরিয়ে নিবিষ্টমনে বাইরের দিকে চেয়ে ছিল। স্তিমিত গলায় করুল- কলকাতায় কত সুন্দর সুন্দর বাড়ি অণিমা। আমাদের যদি একটা বাড়ি হয়, আর ব্যাঙ্ক অফ বরোদার চাকরিটা তা হলে একদিন চলো তোমার সঙ্গে তারাপীঠে যাই।-ওমা। কেন?-তারাপীঠে না গেলে তুমি শুনবে না কথাটা।-কোন কথা!-সেই যে। ধরো, যদি বলি–বোলো না, বোলো না-বলতে বলতে অণিমা হাসতে থাকেন সোমেন তেমনি স্তিমিত গলায় বলে-কতদিন ধরে বলতে চেষ্টা করাছি। একবার জাপীঠে না গেলে চিনে রেস্টুরেন্টটার দিনকাল শেষ হয়ে গেছে। তবু বহুকালের পুরনো নিংমমাফিক আজও একজন বারবুড়ো অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে গালে বা ওই জাতীয় কোনধু একটা তারের যন্ত্র বাজায় মিনমিন করে। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের দ্রুতগামী অটোমোবিলের শব্দে কিছু, শোনা যায় না। লোকটা তবু প্রাণপণে বাজায়।বই পারে শেষ কেনিনটায় ঢুকে সোমেন অবাক হয়। ইউনিভার্সিটি ছাড়ার পর যাদের কোনওদিনই আর দেখবে না বলে ভেবেছিল তাদের কয়েকজন বসে আছে। একবারে অপালা আর পূর্বা। অন্যধারে অধ্যাপক অনিল রায়, শ্যামল আর একজন নীলচোখো, সোনালি চুলো, গোঁফদাড়িও। অল্প বয়সি সাহেব। তার পরনে খদ্দরের গেরুয়া পাঞ্জাবি, তার ওপর কালো জহর কোট। সাহেব কী বলছিল, অপালা আর পূর্ণ্য তার ইংরেজি কিছুমাত্র না বুঝে হেসে কুটিগুটি। মুখ বুলেই পূবা লাফিয়ে ওঠে-সোমেন। কী রোগা হয়ে গেছিস। রোজ ভোর কথা
পৃষ্ঠা:৪২
ভাবি। মাইরি!-আমিও। সোমেন নিরুত্তাপ গলায় বলে।অপ্যলা বড় বড় চোখ করে চেয়েই হেসে ফেলে-সোমেন, তুই বেশ মোটা-সোটা হয়েছিস তো।তুইও।ওরা সরে বসে জায়গা করে দেয়। অণিমা আর সোমেন বসে। বসেই টের পায়, উলটোদিকে তিন-তিনটে আধো মাতাল চেয়ে আছে।অধ্যাপক অনিল রায় বলেন-আগন্তুকটি কে অণিমা-সোমেন স্যার।-আমারও তাই মনে হচ্ছিল। মুখটা চেনা-চেনা।শ্যামল সাহেবের কাঁধের ওপর থেকে হাতটা সরিয়ে সোজা হয়ে বলে- সোমেন, তোর সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে। রিগার্ডিং-বলে ভুলে যায়। হাতটা অসহায়ের মতো উলটে দিয়ে বলে-যাকগে।সাহেব প্রোটোকদের তোয়াক্কা না করে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে-ম্যার।সোমেন হাতখানা হরে নিয়ে বলে-সোমেন।হাতটা নয়ম, একটু ঘেমো। অটিলান্টিক নীল চোখ দুটোয় কিছু ভিতু ভাব, খরগোশের মতো, হাসিটি লাজুক। পেটরোগা বাঙালির মতোই চেহারা, কেবল রং-টা ফরসা। সোমেন হাতটা ছেড়ে দিল এবং সাবধানে নিজের হাতের চেটো প্যান্টে মুছে ফেলল।পূর্বা ফিসফিস করে বলে-হা ভয় করছিল, তখন থেকে তিনটে মাতাল নিয়ে বলে।আছি। তোরা কেন দেরি করলি।সোমেন টের পায় তার পাঁজরে কনুইয়ের খোঁচা দিয়ে অণিমা কী একটা ইঙ্গিত করল। পরমুহূর্তেই অণিমা গলা নামিয়ে পূর্বাকে বলে-দেরি হবে না। বিকেলের মধ্যেই সাক্ষী সাবুদ জোগাড় করে রেজিস্ট্রারের কাছে যেতেই তো বেলা হয়ে গেল। সইচই করে এই দুজনে আসছি।পূর্বা ভীষণ অবাক হলে বলে-কী বলছিস যা তা।নাইরি।-সোমোকে?-আর কাকে?কী বলছে হেঃ।।অপালা তার লহিমজুসের গেলাস সরিয়ে রেখে রেখে মুখ পূর্বা অসহযেই মতো বলে-করা রেজিস্ট্রি করে এল, জানিস। কিন বদমাশ বলত?-কে? কারা। ভারী অবাক হয় অপালা। অণিমা আর সোমেন।-মাইরি। অপালার বড় চোখ বিশালতর হয়।পূর্বা কাঁদোকাঁদো মুখে বলে-এ মা! শেষ পর্যন্ত সোমেনকে।অণিমা ভারী চশমায় বেশ গম্ভীর মন খারাপ গলায় বলে সেই কবে থেকে হালাচ্ছে। বিয়ে করো, বিয়ে করো, ধৈর্য থাকে। আজ তাই ঝামেলা মিটিয়ে দিলাম।অপপ্তল্য বড় বড় চোখ করে, নিশ্বাস চেপে শুনেটুনে হঠাৎ বলে গুল।। ওদের দেখে
পৃষ্ঠা:৪৩
মোটেই বোঝা যাচ্ছে না বিয়ে করেছে। এই নাটকটায় নিজের ভূমিকা বুঝতে একটু সময় নিয়েছিল সোমেন। এবার হঠাৎ গা-কাড়া দিয়ে মুখ নিচু করে অপালার দিকে চেয়ে বলে-তোমার বুঝে কাজ নেই সোনা। তুমি তো পুতুল। পুতুলের সব বুঝতে নেই।-মারর এক খামড়।অনিল রায় হঠাৎ ওপাশ থেকে বসলেন কী হয়েছে মেয়েরা। রাগারাগি কীসের?পূর্বা তোমনি কাঁদো কাঁদো গলায় বলে-দেখুন স্যার, ওরা দুজন বিয়ে করে এল।-সোমেন আর অশিমা।-অ্যা। আমি যেন অন্যরকম শুনেছিলাম। দাঁড়াও, দাঁড়াও, খুব মাতাল হয়ে গেলাম নাকি।অপালা গলা তুলে গলে-মোটেই নিয়ে করেনি স্যার। সোমেনকে দেখুন, তিনদিন বাড়ি কামায়নি, চোর-চোর চেহারা, ময়লা জামাকাপড়, ও মোটেই বিয়ে করেনি অণিমাকে।অনিল রায় হাত তুলে অপালাকে থামান, গম্ভীর গলায় বলেন ইজ ইট ফ্যাই অণিমা।তোমার মুখ থেকে শুনি। অণিমা ভীষণ লাজুক মুখভাব করে স্টেমেনের দিকে তাকায়-লক্ষ্মীটি, স্যারকে বলে দাওনা।সোমেন তার খোঁচা খোঁচা দাড়ি চূলকে মাথাটাথা নিচু করে বলে-তুমিই বলো। একদিন পূর্বার সঙ্গে উজ্জ্বলায় ম্যাটিনিতে সিনেমা দেখে ফিরছিল সোমেন। কালীঘাট স্টপে ভিড়ের পাঁচ নম্বরে উঠতে গিয়ে সোমেন উঠল, পূর্বা উঠতে পারেনি। পূর্বার হাতব্যাগের ভিতরে ছোট্ট প্যাসা রাখার ব্যাগে পাঁচটা টাকা ছিল, বাসের পাদানিতে সাফ হাতের কেউ সেটা তুলে নিয়েছিল। বাস ছেড়ে দিলে ভিতর থেকে সোমেন শুনেছিল, পূর্বা সর্বনাশের গলার চেচাচ্ছে-সোমেন। সোমেন। ব্যাপারটা কিছুই না, পরের বাসে পূর্বা আসতে পারত, পয়লা না থাকলেও অসুবিধে ছিল না, কন্ডাকটরকে বললেই হত। কিন্তু পূর্বা থাবড়ে-টাবড়ে, দুঃখে কান্নাকাটি শুরু করে, বাসস্টপে কয়েকজন লেকও জুটে গিয়েছিল ওর চারপাশে। সোমেন রাসবিহারী বাসস্ট্যপূর্ণ নেমে ফিরে এসে পূর্বাকে ঘিরে ভিড়, ঘুনগুন করে কাঁদছে পূর্বা, বলছে–আমার বৃন্ধু চলে গেছে, কী যে হবে। এমা। আমার টাকাও নেই, তুলে নিয়েছে। কী বিশ্বিরি। বুদ্ধেটকিটা লোক ওকে একটা টাকা অফার করতেই পূর্বা বেঁঝে ওঠে-আমি কারও কাছে টাকা নেব না। তারপরেই আবার ঠোঁট কাঁপিয়ে চোখভরা জল রুমালে মুছে দিশাহারাভাবে বলতে থাকে-কী যে সব বিচ্ছিরি কাও না। যা তা। সোমেন যখন ভিড় ঠেলে গিয়ে ওর হাতটা ধরুল তখন পূর্বার মুখে-চোখে সে কী আনন্দের রক্তিমাভা, যেন বাচ্চা মেয়ে মেলার ভিড়ে বাবাকে হারিয়ে ফেলেছিল, এইমাত্র ফিরে পেল। এই হচ্ছে পূর্বা। যেখানে দুশ্চিন্তার কিছু নেই, সেখানেও ওর দুশ্চিন্ত।। যেখানে কাঁদবার মতো কিছু ঘটেনি সেখানেও ও কেঁদে ফেলে। আড়চোখে সোমেন দেখে পূর্বার মুখ লাল, ঠোঁট কাঁপছে, চোখের পাতা ফেলছে ফনঘন এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে। সোমেন ভারী ভয় পেয়ে যায়। পূর্বা ঘনক্ষন খাস ফেলে বলে-সার, বন্ধুকে কেউ বিয়ে করে? সেটা ট্রেচারি নয়। বলেই সোমেনের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে লজ্জা করে না। কী বিচ্ছিরি সব কাণ্ড করিস না।
পৃষ্ঠা:৪৪
সোমেন অবাক হয়ে বলে-কেন, আজমি পাত্র খারাপ? পূর্বা তাড়াতাড়ি মাথা নেড়ে বলে-দে কথা বলছি নাকি। কিন্তু অণিমা তোকে বর বলে ভাববে কী করে। তুই-ই বা কী করে ভাবনি যে-ইস ভাবতেই গা কেমন করে। অনিল রায় ভারী অবাক হয়ে পূর্বার কাণ্ডকারখানা দেখে বলেন-বন্ধুকে বিয়ে করতে নেই? কেন বলো তো -সোমেনকে কখনও স্বামী বলে ভাবতে পারবে অণিমা? কেন পারবে না? -আপনি বুঝতে পারছেন না স্যার। স্বামী মানে তো বড় বড় মানুষ, যাকে তদারক্তি করতে হয়। সোমেনন তো সমবয়সি, কেবল ইয়ারকি করে বেড়ায়, ও স্বামী হবে কী করে? অনিল রায় তাঁর ছাত্রণজীবনে মস্ত আধুনিক মানুষ ছিলেন। শোনা যায় প্রেসিডেন্সিতে পড়ার সময়ে বংদার চকবা-বকরা জামা, দাঁড় ক্ষ্যাপানো উৎকট রঙের প্যান্ট পরতেন, হিপ পকেটে থাকত মাউথ-অর্গান, করিডোরে মাউখ-অর্গান বাজিয়ে বিলেত্তি নাচ নাচতেন। অধ্যাপকরা চটে গিয়েছিলেন। তবু বি-এ আর এম-এ-তে ফার্স্ট হতে আটকায়নি। আমেরিকায় ডক্টরেট করেন। এখনও এই উত্তর চল্লিশে প্রায় একই রকম আছেন অনিল রায়। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে এখনও লনে বসে আছেন দেন। সিগারেট বিলেন। গাছে কাউবয় রঙিন শার্ট, বড় জুলপি, ফাঁপানো চুল, নিম্নাঙ্গে নিশ্চিত বেলবটমও আছে, টেবিলে পা ঢাকা রয়েছে বলে বোঝা যাচ্ছে না। একটা খাস ফেঝে বললেন আমাদের আমলে ক্লাসমেটকে বিয়ে করাটাই ফ্যাশন ছিল। ইন ফ্যাক্ট আমিও ইনভলভড ছিলাম। তোমাদের আমগটা কি খুব বেশি পালটে গেছে? -না স্যার, মোটেই পালটায়নি। সোমেন হেসে ওঠে পালটালে আমি আর অণিমা কেমন করে করলাম। করেছিস। অপালা হাত বাড়িয়ে বলে-দেখি সার্টিফিকেট। -ওর হাতব্যাগে আছে। উদাস গরায় বলে সোমেন। তারপর সিগারেটের ধোঁয়ার আড়ালে আত্মগোপন করার চেষ্টা করে। আর তক্ষুনি দেখতে পায়া, ধোঁয়ার ভিতর দিয়ে উলটোদিকে একজোড়া নীল ফসফরাস ফুলছে। ম্যাক্স। এতক্ষণ ম্যাক্সকে হিসেবের মধ্যেই বরেনি সোমেন। ও কি সত্যিই প্রোপোজ করেছিল অণিমাকে। করে থাকলে অণিমার এ কী রকম ব্যবহার। লাজুক, ভিতু, প্রেউরেনা চেহারার কোনও সাহেব এর আগে দেখেনি সোমেন। ম্যাক্সকে দেখে (তর্ষিকির হয়। ওর মুখে, কপালে রগ দেখা যাচ্ছে। শুষ্ক নেশার চিহ্ন। গাল বসা, চুল সুন্ত্র? শুধু চোখ দুখানার নীল আগুন জ্বলছে। কিছু বুঝতে পারছে, কিছু আন্দাজ করছে। এটবিন ঘ্যাটিন হালকা কথায় খিলখিল করছে, বাতাসে ইয়ারকি, তবু সে সব ছাপিয়ে একটা উনোপোড়েনও কি নেই। -অপালা অণিমার হাতব্যাগ কেড়ে নিয়ে ইটিকে দেখে বলে-না সার, নেই। অনিল রায় লম্বা চুলে আঙুল চালিয়ে উত্তেজিতভাবে বলেন-ইয়ারকি। ইয়ারকি। মাই গড়, তোমরা মোটেই বিয়ে করোনি। এমন ইয়ারকি তোমরা কোথা থেকে শিখলে। পূর্বা হঠাৎ ভীষণ হাসতে থাকে। যোমেদের দিকে চায়। ভারী আদুরে স্বরে বলে–তুই যা পাজি না সোমেন। এমন চমকে দিয়েছিলি। অনিমা অসহ্যর মুখ করে বলেছিল স্যার, বোধ হয় ট্যাক্সিতে পড়ে-ফড়ে গেছে, ভাড়া দেওয়ার সময়-
পৃষ্ঠা:৪৫
-ফের? অপালা ধমক দেয়।- অণিমা, তুই আমার জায়গায় বোস, সোমেনের সঙ্গে আমার কথ্য আছে। এই বলে পূর্ব জায়গা বদল করে নেয়া। বেয়ারা বিষারের জগ রেখে গিয়েছিল। সোমেন ফেনাটা ফুঁ দিয়ে চুমুক দিতে যাচ্ছে, পূর্ব কানের কাছে মুখ এনে বলল-বেশি খাস না সোমেন, পায়ে পড়ি। কেন?আমি তোর সঙ্গে ফিরব যে। গড়িয়ায় দিকে যাওয়ার আর কেউ নেই। মাতালের সঙ্গে ফেরার চেয়ে একা ফেরা ভাল। খাস না।-আচ্ছা। তোর কাছে টাকা আছে?-গোটা সারেক। কেন?-ট্যাক্তি নিম। চাঁটিটা ছিঁড়ে গেছে, হাঁটতে পারছিনা।-গড়িয়া পর্যন্ত ট্যান্তি। কত উঠবে জানিস? তা দিয়ে একজোড়া নতুন চটি হয়।অপালা চাপা ধমক দিয়ে বলে তোর সঙ্গে ফিরবে কেন? আজ বিয়ের দিন, সেমেন ওর বউয়ের সঙ্গে ফিরবে।চিলি-চিকেন আর এক চামচ ফ্রায়েড রাইস মুখে তুলেছিল সোমেন। একটু বিষম খেন। বউ কথাটা তার ভিতরে হঠাৎ বিদ্যুতের মতো খেলে যার অলক্ষ্যে ঝিকিয়ে ওঠে একটা আসাহী পেনট্যাক্স ক্যামেরার নিষ্প্রাণ চোখ। গবর শব্দ করে জেগে ওঠে একটা অদ্ধ কুকুর। হঠাৎ এতক্ষণ বাবে একটা নিরুদ্ধ লজ্জায় সোমোনের মুখ লাল হয়ে যায়।
সাত
বিকেলের দিকে হাওড়ায় এসে নামলেন রজগোপাল। ক্যাম্বিসের ব্যাগে কিছু তরিতরকারি, একটু খেজুর গুড়, আমসত্ত, কিছু গাছ-গাছল, ফকির সাহেবের দেওয়া বাতের ওষুধ। স্টেশনের চত্বরে নেমে ভাবি রিশ্রী লাগছে তাঁর। কলকাতার বুঝঙাপা ভিষ, গরমি ভাব, গাড়িঘোড়া, যতবার আসেন-তৃষ্টবারই আরও বেশি খারাপ লাগে। যেই পান না,বিশাহারা লাগে। এই বিপজ্জনক শইরে এখনও কিছু নির্বের বাস করছে, প্রতিদিন কিন্তু নির্বোধ আসছে বাস করতে। মানুষের নিয়তিই টেনে আনছে তাদের। তাঁর ছেলেরা এই শহরে বাড়ি করবো একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন এজগোশাল। সংসারে অনেকদিন হয় তিনি বাতিল মানুষ। রিটে কথা বা মতামতের কোনও মূল্য আর ওদের কাছে পাওয়া যাবে না। তবু ছেলেদের মুখের কাছে বিষের বাটি ধরতেই তিনি এসেছেন। বাড়ির জন্য দশ হাজার টাকা দিয়ে দেবেন। একেনারে পর হয়ে যাওয়ার ক্ষণকাল আগে, মৃত্যুর আগমুহূর্তেও যেন ওরা অন্তত একবার তাঁর দিকে আকর্ষণ বোধ করে। পুত্র-ক্ষুধা বড় মারাত্মক। সন্তানের বড় মায়া। বাসে একটা জানালার বারের সিড পেয়েছিলেন ব্রজগোপাল। খর চোখে চেয়ে কলকাতার দৃশ্যাবলি দেখতে থাকেন। বড়বাজার, ব্রাবোর্ন রোড, ডালহৌসি হয়ে ময়দান। এইটুকু রাস্তা জুড়ে বাণিজ্য আর বাণিজ্য। মানুষের লোভ-কালসার শেষ নেই। ময়দান থেকে বাকি রাস্তাটা চোখ বুজে কেবল ভাবেন আর ভাবেন। স্ত্রী আজ কেমন ব্যবহার করবে কে জানে? বোধ হয় ভাল ব্যবহার কিছু আশা করা যায় না। তদে টাকার খাতির সর্বত্র। হয়তো
পৃষ্ঠা:৪৬
বসিয়ে চা জলখাবার খাওয়াতেও পারে। ভেবে একটু হাসেন প্রজগোপাল। কিশোর বয়সে বিয়ে হয়েছিল তাঁদের। নৌকোয় যে বহু দূরের রাস্তা। কত রোমাঞ্চ কত কল্পনা। আজও ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়। সেই কিশোর বয়স ফিরে পেতে ইচ্ছে করে। যদি পান রজগোপাল, যদি এখনও কিশোর রত্নগোপানকে কেউ জিজ্ঞেস করে, পৃথিবীর এত মেয়ের মধে কাকে বই করতে চাও, তবে ব্রজগোপাল এখনও অম্লানবদনে বলবেন-ননীবালা। নদীবানার প্রতি তাঁর ভালবাসার এখনও যেন শেষ নেই। মুখখানার দিকে এখন আর ভাল করে তাকানো হয় না বটে, কিন্তু তাকালে এখনও সেই কিশোরকালের প্রণয়ের চিহ্নগুলি দেখতে পান যেন। আধো-ঢাকা কপাল, পিছনে অন্ধকারের মতো চুলের রাশি, থুতনির খাঁজে যাদের মুক্তাবিন্দু। স্ত্রী শব্দটাই কী মারাত্মক। এই শব্দের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অভ্যাস, আলয়, বিশ্রাম, শান্তি। প্রজগোপাল তা পাননি। তবু এখনও যদি তাঁকে কেউ প্রেমভিক্ষা করতে পাঠায়, তিনি এসে দাঁড়াবেন ননীবালার দরজায়। কেন দাঁড়াবেন তা কেউ জানে না। সংস্কার। রাস্তা ফুরিয়ে যায়। শীতের বেলাশেষে যোধপুর পার্কের পিছনে সূর্যাস্ত ঘটছে। ঢাকুরিয়ার প্রকাণ্ড জলাভূমিটায় কত কচুরিপানা, ঠিক মাঠের মতো দেখাচ্ছে। যোধপুরের ফাঁকা জমিগুলো ভরতি হয়ে যাচ্ছে ক্রমে। বাড়ি আর বাড়ি। পায়ের নীচে ভারবাহী কলকাতার নিঃশব্দ আর্তনাদ শোনেন প্রজগোপাল। ওই জলাভূমিটাও ক্রমে গ্রাস করে নেবে মানুষের সর্বগ্রাসী বসত। ঢাকুরিয়ার বাড়ির দোতলায় কুষ্টিত পায়ে উঠে এসে কড়া নাড়েন তিনি। খুবই সংকোচের সঙ্গে। যেন বা বেড়াতে এসেছেন, কর্তা বাড়ি নেই শুনলে ফিরে যাবেন। এ বাসার তিনি আয় কেউ নন। যত বাতই হোক অজেই তাঁকে ফিরে যেতে হবে। রপেনের বউ দরজা খোলে। ভারি খর ঝগড়াটে চেহারা, তবু সুন্দরী। হাঁটু ধরে একন ছেলে বায়না করছে। নাতি। সন্ধ্যা হয়েছে, তবু এখনও আলো জ্বালানো হয়নি বলে জায়গাটা অন্ধকার। কলেনের বউ দরজা খুলে বলে-কে? প্রজগোপাল গলা খাঁকারি দিয়ে বলেন-আমি ব্রজগোপাল। বউটি ঘোমটা টানার প্রয়োজন বোধ করে না। বলে। সুইচ টিপে আলো জ্বালে। প্রজাগোপাল যবে যাবেন কিনা না পেরে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বলেন-রখেন বাড়ি মেই। না এখনও কৈক্রেনি -আর -মা আচ্ছে আপনি ঘরে আসুন। -থাক, এইখান থেকেই বরং কথা বলে চলে যাই। বউটি গলায় যথেষ্ট ধার তুলে বলে-আপনি রোজ রোজ দরজায় দাঁড়িয়ে কথা বলে যান, পাঁচজন তাতে কী ভাবে। ঘরে আসুন। ছেলেটাকে কোলে নিয়ে ভিতরে সরে যায় বীণা। ব্রজগোপাল নিজের হৃৎস্পন্দন অকস্মাৎ টের পেতে থাকেন। বহুকাল বাদে ওদের ঘরদোরে ঢুকতে ইচ্ছে করে। ওরা কেমন যে আছে। সামনের ঘরটা ঠিক ঘর নয়। একটুখানি প্যাসেজ। কলঘর রান্নাঘর আর শোওয়ার ঘরের দরজা চারদিকে। মাঝখানে বেতের চেয়ার আর টেবিল পেতে বসার ব্যবস্থা। তারই একবারে
পৃষ্ঠা:৪৭
খাওয়া-দাওয়া হয়। বউটি ঘরের বাতি জ্বালল। আগে ঘাট পাওয়ারের বালব জ্বলত, এখন জুরেসেন্ট কতি। ঘরদোরের চেহলাও আগের মতো নেই। বেতের চেয়ারগুলো রং করা হয়েছে, তাতে ডানলোপিলোর কুশন পাতা। একটা ককঝাতে নতুন সোফা-কাম-বেড। এলধারে একটা মস্ত বড় রেডিয়োগ্রাম, তার ওপর ফুলদানি। দেয়ালে কাঠের চৌখুপিতে কেউনগরের পুতুল, বাঁকুড়ার খোড়া, রান্নাঘরের খোলা দরজা দিয়ে একটা গ্যাস সিলিন্ডার দেখা যাচ্ছে। নিজের অবস্থাকে প্রাণপণে অতিক্রম করার চেষ্টা করছে এরা। রণেন খুবটুষ খায় না তো এখন। ফুড ইনস্পেকটরের ঘুষের ক্ষেত্র অঢেল। ইচ্ছে করলেই রণেন অবস্থা ফিরিয়ে ফেলতে পারে। কিন্তু অকণ্ঠ সৎ মানুষ এজগোপালের রক্তের ধাত খানিকটা আছে বলে রণেন এই সেদিনও ঘুটুষ গেত না। এখন কি খায়? অবস্থার ফেরে পড়ে, বউ আর মায়ের গরজায়। বড় অস্বস্তি বোধ করেন রজগোপাল। যদি ঘুষ না খাস তবে কেন নিজের অবস্থার চেয়ে ভাল থাকার চেষ্টা করিস? না কি পাঁচজনকে দেখাতে চাস যে তোরা ঠিক মধ্যবিত্ত নোস।শ্রীশ্য ভিতরের ঘর থেকে ঘুরে এসে বলল-বসুন, মা আসছেন।প্রথগোপল মাথা নাড়লেন। বীণর কোলের ছেলেটির দিকে ইঙ্গিত করে বললেন-স্ত্রী নাম রেখেছ ওর?-কৌশিক। থাকনাম টুবাই। -বছর বয়স হল, না? – দু-বছর তিন মাস। মুখখানা বণ্যের মতোই। বউটি ছেলেকে আদর করে মাড়ে মুখ ডুবিয়ে বলে-ছোনা একটা। সজ্জায় রহুগোপাল মুখ ফিরিয়ে নেন। মা বাবা শ্বশুর-শাশুড়ির সামনে নিজের ছেলেকে আদর করা বড় লজ্জার ব্যাপার ছিল একসময়ে। এবা কিছু জানে না, মানেও না। ব্রজগোপাল হটাৎ প্রশ্ন করেন রণেনের কি প্রোমোশন হয়েছে?-না। হওয়ার কথা চলছে, কিন্তু কীসব যেন গগুপ্তেল।-এসব কবে হল?কাদের কথা বলছেন?-এই যে সব জিনিসপত্রণ-কিজিবন্দিতে?-বোধ হয়। তাইম ঠিক জানি না।ব্রজগোপাল ছঈিলেন। জানো না, তা কি হয়? সোফা কাম বেড, রেডিয়োগ্রাম কিল্পে গ্যাসের উনুন কেনার মানুষ রণেন তো নয়। সে চিঢালা মানুষ, শখ-শৌখিনতার ধার ধারে না। এসব মানুষ কেনে স্ত্রীবুদ্ধিতে, স্ত্রীরই তাগিদে। মেয়েছেলের মতো এমন বিপজ্জনক প্রাণী আর নেই। সাধুকে চোর, সরলকে কুটিল বানানোর হাত তাদের খুব সাফ। সম্ভবত, রণো এখন ঘুষ যাচ্ছে। সংসারটাও বড়, হয়তো সামলাতে পারে না।বসুন, চা করে আনি। বীণা বলে।ব্রজগোপাল হাত তুলে বলেন-না, চা আমি খাই না।-ওমা। আগে তো খুব খেতেন।ছেড়ে দিয়েছি।
পৃষ্ঠা:৪৮
-বাবারটানার কিছু দিই। অভিমান, পুরনো অভিমানটাই বুকে ফেনিয়ে ওঠে আবার। প্রজগোপাল মাথা নেড়ে বললেন-না। মনে ভাবলেন, এরা জিজ্ঞেস করে কেন। জিজ্ঞেস করলে কেউ কি বলে,ব্রজগোপাল বলদেন করং তোমার শাশুড়িকে ঢেকে দাও। ফিরে যাওয়ার গাড়ি আটটায়। দেরি হলে ওয়া ভাববে।ইশ্য অবাক হয়ে বলে কারা?-যাদের আশ্রয়ে আছি। আত্মীয়ের অধিক।কথাটা বলার দরকার ছিল না। তবু বললেন রজগোপাল। বীনা খারাপ ব্যবহার কিছু করছে না, কিন্তু একধরনের ভক্রতাসূচক দূরত্ব বজায় রাখছে যা তিনি ঠিক সহ্য করতে পারেন না। বোঝাই যাচ্ছে, ননীবালারও এখানে সুখে থাকার কথা নয়।বীণা মুখটা গম্ভীর করে থাকল।এজগোপাদ সঙ্গে সঙ্গে নিজের ভুলটা ধরতে পারেন। কিন্তু কথাটা ফেরাবেন কী করে। তাই সহোতাড়ি নাতির দিকে হাত বাড়িয়ে বলেন-এস দাদা।বীনা ছেলেকে ছেড়ে দিয়ে বলে দানুর কাছে যাও।ছেলেটি দু-পা এগিয়েও আসে। একদম কাছে আসে না। ব্রজগোপাল তবু হাত দুটে বাড়িয়েই থাকেন। বলেন খুব দুষ্টু হয়েছে।খুব। সেইজন্যই তো স্কুলে দিয়ে দিলাম।খুব অবাক হয়ে রজগোপাল বলেন-স্কুলে দিলে। দু-বছর মাত্র ব্যাস বললে না। বাঁশ্য হেসে বলে-দু-বছর তিন মাস। আজকাল ওর বয়সে সবাই স্কুলে যায়।-বলো কী। আমরা প্রথম স্কুলে যাই সাত আট বছর বয়সে, তাও খুব কন্নাকাটি করতাম।-এখনকার ছেলেরা তো স্কুলে যাওয়ার জন্য অস্থির।-কীরকম ইস্কুল?-নার্সারি। ইংলিশ মিডিয়াম।-ও। সে তো অনেক পয়সা নাছৌ-কুড়ি টাকা মাইনে, বাদ পরশে তার ওপর আজ এটা কাল সেটা লেগেই আছে। নাসে পঞ্চাশ ঢাকার ধাক্কা। বিবা হন। কিন্তু মুখে নির্বিকার ভান্টী বজায় রেখে বলেন-বড়ড়কেও কি ইংলিশ মিডিয়ামে দিয়েছ? মেয়েটাকেও?-হা একই স্কুলে।-তা হলে সংসারের দেড়শো টাকা মাসে বেরিয়ে যাচ্ছে।-হ্যা। একটু কষ্ট করছি, ছেলেমেয়েগুলো যদি মানুষ হয়।ক্রজগোপাল দীর্ঘশ্বাস চাপলেন। রণোর যা বেতন তাতে এত বড় সংসার চালিয়ে কষ্ট করেও বাড়তি দেড়শো টাকা বাচ্চাদের জন্য খরচ করা সম্ভব নয়। তবে কি রখো উপরি নিচ্ছে আজকাল। বুকের মধ্যে ভারী একটা কষ্ট হতে থাকে তাঁর। এ সংসারে কেউই প্রজগোপালকে অনুসরণ করল না। তিনি সৎ ছিলেন, এবং সৎ-অসতের ব্যাপারে তাঁর কোনও দ্বন্দ্ব ছিল না। ছেলের ভিতরে অন্তত সেইটুকু থাকলে তাঁর অহংকার থাকত।
পৃষ্ঠা:৪৯
তিনি প্রসঙ্গ পালটে বললেন-বড়জন কোথায়?-কে, বুবাই। সে খেলতে গেছে।-পড়াশুনোর কেমন হয়েছে। -ভাল, ফার্স্ট হয়। মাস্টারমশাইরা আন্টিরা মনোজিৎ বলতে অস্থির।-মনোজিৎ। ভারী অবাক হলেন প্রজগোপাল। বড় নাতির নাম তিনিই রেখেছিলেন সুপ্রসন্ন। তিনি যখন চলে যান রাখনও এ নামই বহাল ছিল। সদ্য লিখতে শিখেছিল নাতিটি, একসারসাইজ বুক আর বইয়ের ওপরে উচ্চা হাতে অতি কষ্টে লিখত সুগ্রসন্ন লাহিড়ি। প্রজগোপাল নিস্তেজ গদ্যয় বলেন-নামটা কি বদলানো হয়েছে।বীণা একটু লজ্জা পায়া, বলে-দেকেলে নাম বলে পালটে রাখা হয়েছে। ওর গন্ধুদের সব আধুনিক নাম, ও তাই ভাল নামের জন্য বায়না করত।-ও। একটু চুপ করে থেকে বলেন-মনোজিৎ বেশ নান। ভাল। মেয়েটারও কি নতুন নাম রেখেছ? -না, ওর সেই পুরনো নামই আছে। তবে ডাকনাম অনেক। কেউ ডাকে শানু, কেউ বেলকুড়ি, কেউ বুড়ি।ভিতরের যবে ননীবলা পরনের নোংরা শাড়িটা ছেড়ে ধীরে আস্তে একটা ভাল পাড়ি পরলেন। জারির ধাক্কা দেওয়া লাল পাড়। বেখেয়ালেই পরছিলেন। পরার পর মনে হল লাল পেড়ে শাড়ি বড় পছন্দ ছিল মানুষটার।শাড়ি পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চিরুনিটা হাতে নিলেন। সিন্থিতে সিঁদুরের খা। আজকাল সব সিদূরেই ভেজাল। প্রসি বিয়ের দিন সকালে বাদি বিছনায় ব্রজগোপাল যে বিদুয়ের স্তূপ ঢেলে দিয়েছিলেন সিখি ভরে, তার কিছু আজও অবশিষ্ট আছে, গোপন কৌটোয় যত্নে তুলে রেখেছেন নদীনালা। ওই সিঁদুর একটু একটু করে রূপণের মতো অন্য সিঁদুরের সঙ্গে মিশিয়ে আজও পরেন তিনি। নিয়ম। এখনকার সিঁদুর সে আমলের মতো নয়, সিঁথি চুলকে ঘা হয়ে যায়, তাই সচরাচর খুব সামান্য একটু সিদূর ছোঁয়ান আজকাল। বী ভেবে আজ ডগয়গে করে সিঁদুর পরলুেন। চুলের ঘট পছন্দ করতেন না ব্রজগোপাল। মাথার তেলের দাম বড্ড বেড়ে গেছে দুর্নীবালার একরাশি চুলে তেল দিতে সিকি শিশি তেল শেষ হয়ে যায়। রখেনের মুধু চেথে আজকাল তালুতে একটু ভেল চেপে ননীবালা মান সারেন। তাই তেলহীন চুঞ্জে আটা আর জট। চিকনি চালাতে নিয়ে একাটা খাস ফেললেন। এই বিপুল চুলের মেনি তার বোঝার মতো লাগে।সাজগোজ কি একটু বেশি হয়ে গেল? বীণা বোধ হয় শাশুড়ির এই প্রসাধন দেখে মুচকি হাসবে। মেয়েরাই মেয়েদের সবচেয়ে বড় শত্রু। সব লক্ষ করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। শ্বশুরবাড়িতেই তিনি শিখেছিলেন যে দানী শুশুর ভাসুরের সামনে যেতে হলে পরিস্থর হয়ে যেতে হয়। অবশ্য রজগোপালের ব্যবহারে সেসব শিক্ষা তিনি ভুলেও দিয়েছিলেন। আজ সেই পুরনো নিয়মটা রক্ষা করার জন্য তাঁর আগ্রহ হয়। তিন-চারবছর তিনি স্বামীর মুখশ্রী দেখেননি, তার আগেও বছর দুই এক আধপলক দেখেছেন। আজ তাঁকে ওই দোকটার সামনে যেতে হবে, মেজাজ ঠিক রাখতে হবে, মিষ্টি কথায় বোঝাতে হবে, টালিগঞ্জের আমিন কেনা তাদের একান্ত জ্যাকারা। ছেলেদের ব্রজগোপাল তো কিছুই দিলেন না, এটুকু অন্তত ছেলেদের জন্য ভিক্ষা করে নিতেই হবে তাঁকে। শরীর পরিচ্ছন্ন থাকলে মনটাও শান্ত রাখা
পৃষ্ঠা:৫০
যাবে। ব্রজগোপালেরও হয়তো তাঁকে দেখামাত্র গ্যাঁক করে উঠতে ইচ্ছে করবে না। সজগ্যেজ করতে বেশ একটু বেশি সময় নিলেন ননীবালা। তাঁর হাত-পা যেন বশে নেই। প্রেসারটা বোধহয় ইদানীং কেড়েছে, বুকে যণ বপ হাতীর পা গড়ছে। মাথায় ঘোমটা সযত্নে টেনে ননীবালা ধীরপায়ে বাইরের ঘরের পরদা সরিয়ে চৌকাঠে দাঁড়ালেন। বাইরের মানুষের মতোই বসে আছেন ব্রজগোপাল। খয়েরি চাদর গায়ে, আধময়লা বুতি, পায়ে ক্যাম্বিসের জুতো, বুলায় ধূসর চেহারা। ননীবালার দিকে চেয়েই মুখটা ফিরিয়ে নিলেন। ননীবালা আজকাল বীণাকে কোনও কাজের কথা বলতে ভয় পান। সংসার খরচের টাকা আজকাল বীণার কাছেই থাকে। খরচ নিয়ে মিটিমিটি বাঁষত বলে ব্যবস্থাটা ননীগালাই করেছেন। সংসারের কর্তৃত্বও সেই সঙ্গেই চলে গেছে। বীণা এখন ওপরওয়ালা। সচরানা মনীবালা তাকে কাজের কথা বলেন না। কিন্তু এখন অনুচ্চ কর্তৃত্বের সুরে বললেন-বউমা চায়ের জ্বল চাপাও। ও-বেদার রুটি করা আছে, একটু দিয়ে ভেজে দাও।বীণা বাধ্য মেয়ের মতো ওঠে। দেখে ননীওলয় খুশি হল। রজগোপাল এদের সংসারে ননীবালার অবস্থাটা যেন টের না পান।বাঁলর কাছে এসে বলে-উনি কিছু খাবেন না, আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম।ননীবালা সুর নামিয়ে বলেন-ওসব কি জিজ্ঞেস করতে হয়। সামনে ধরে দেবে। এস-জন বোয়ো যান তো নয়। যাও।বীণ চলে গেলে নাতি কোলে ননীবালা সোফা-কাম-বেডের একধারটায় বসেন।বলেন- ওদিককার খবর-টবর সব ভাল।-ওই একরকম। রজগোপাল অন্যদিকে চেয়ে বলেন।ননীবালা বেশি কথাটথা জানেন না, দ্বিতীয় কথাতেই সরাসরি প্রশ্ন করলেন-কী ঠিক করলে?জমিার কিনবেই তুমি।ননীবালা খাস ফেলে বললেন আমি জমি দিয়ে কী করব। জমি তো আমার জন্য।চাইছি না। ওদের জন্য। আমি আর ক’দিন?-এই হল।-খুব সস্তায় পাওয়া তছে। বিয়ের বছর জানি, সেই সব ব্যবস্থা করে দেবে। তাকে শুনেছি। কিন্তু কথ্য তো তা নয়। রণো ওরা সব এখনকার বাসিন্দা হয়ে গেলে গোবিন্দপুরে থাকযুদ্ধকে?যেই চাবুক ওরা থাকবে না। গ্রামে-গঞ্জে থাকার ধাত তো ওদের নয়।রজগোপাল উত্তর দেন না।নদীবালা শান্ত গলায় বলেন-আমার ওপর রাগ আছে তো থাক। ছেলেরা তো কোনও দোষ করেনি বাপের কাছে। রণোর একার ওপর এত বড় সংসার, দশ-বিশ হাজার এক ভাকে বের করে দেবার ক্ষমতা নেই। তুমি একটু ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখ।ব্রজগোপাল আস্তে করে বললেন-সব্ছলতার মধ্যেই তোমরা আছ, দেখতে পাচ্ছি। নতুন নতুন সব জিনিসপত্র কেনা হচ্ছে, নিজের অবস্থাকে ডিয়িয়ে পাঁচজনের কাছে সচ্ছলতা দেখানো।-ওমা। গরিবের সংসারেও দিনে দিনে টুকানিক করে কত জিনিস জমে যায় দেখাতে
পৃষ্ঠা:৫১
দেখতে। গত পঁচ-সাত বছর ধরে কত কষ্টে এইসব করেছে একে একে। তাও তো তেমন শৌখিন জিনিস না, সংসারের যা লাগে তাই। ছেলেদের সংসারের শ্রী দেখতে ইচ্ছে করে না?রজগোপাল ভ্রকুট করে বললেন-কিন্তু এত টাকা অসছে কোথেকে। রণোর যা মাইনে তাতে তো এসব হওয়ার কথা নয়। টাকার দাম কমছে বই ব্যড়ছে না। যুটুষ গাছে নাকি!-সেনাকন ছেলে নয়। তবে কেউ হয়তো খাতির-টাতির করে সস্তায় কোনও জিনিস ধরে দেয়। সে তো আর দোষের নয়।উদাস গলায় ব্রজগোপাল বলেন-তাই হবে। আমার সেসব না জানলেও চলবে।ননীবাল। মাথা ঠান্ডা রেখে বলেন একটা বয়সের পর ছেলেদের হাঁড়ির খবর নেওয়া ঠিক নয়। ওরা বড় হয়েছে, দায়িত্ব নিয়েছে, ওদের ভাগমন্দ ওদের বুঝতে দাও।-আমি তো সব কিছু থেকেই বুরে আছি, তবে আর আমাকে সাবধান করা কেন। ফুটুষ যদি নেয় তো নিক, আমার কী। শুধু সমাজের একজন মানুষ হিসেবে অন্য এক মানুষকে বিচার করছি।ননীবালা চঞ্চল হয়ে বলেন-রণো হয়তো এক্ষুনি চলে আসবে। এ সব কথা তার কাছে ভুলো না।প্রজগোপাল ভ্রু কুঁচকে সরাসরি স্ত্রীর দিকে তাকান। অল্প কঠিন স্বরে বলেন ছেলের প্রতি তোমার এত টান, তবু তাকে অত ভয় কেন? তাকে যদি শাসন করা দরকার হয় তবে তা করাই উচিত।-না না, তার দরকার নেই। রণ্যে ওসব কিছু করে না।-ভাল, জেনে গেলাম।-রথোকে কী বলব জামিটার কথা।-কিমুক।কিনবে?-হ্যা তো বলছি।-ভাল মনে বলছ, না মনে রাল্ দুইইখ?-তাতে কী দরকার। টাকুটী আমি দেব। কর্তব্য হিসেবে।-রগো বড় অভিমন্ত্রী এবলে, এরকম কথা শুনলে টাকা নেবে না।রজগোপাল বিশ্বঞ্চ হয়ে বলেন-তবে কীরকম কথাবার্তা বলতে হবে?-বিরক্ত হয়ো না। ছেলের মুখ চেয়ে খুশি মনে দাও। অনাদর অভ্রান্তার দান যে নেয় যে খুশি হয়ে নেয়ামা।ব্রজগোপাল চুপ করে থাকেন। চোখে একটু উদাস ভাব। হঠাৎ বলেন-রাণো খুব সহ ছিল। ফুড ইনস্পেকটরের চাকরিতে অনেক উপরি। সে সব লোভে কখনও পা দেয়নি।তোমায় অত সন্দেহেয় কী? ঘরে দুটো বাড়ত্তি জিনিস দেখেই কি লোকটাকে বিচার যায়। আমার বড় দুশ্চিত্তঃ হয়। দুশ্চিন্তা কীসের?-যারা ঘুষ নেয় তারা কখনও প্রকৃত অদ্ধা পায় না, কেবল যাতির পাল্লা।
পৃষ্ঠা:৫২
-প্রভা ধুয়ে জল খাবে। মা, ভাই, সংসার পালছে পুষছে, সে বড় কম কথা নাকি। আজকাল ক’টা ছেলে এই বয়সে এত দায়িত্ব ঘাড় পেতে নেয়? যার দায়িত্ব নেওয়ার কথা সেই নিল না কোনওদিন। রণোকে কেন অশ্রদ্ধা করবে লোকে? ব্রজগোপাল ননীবালার দিকে তাকালেন। মধ্য যৌবনে স্ত্রীর প্রতি যে হিংস্র প্রণ তাঁর দেখা যেত এখনও সেরকমই এক রাগে বুড়ো বয়সের দীপ্তিহীন চোখও একটু ঝলসে ওঠে। অথচ একথাও ঠিক, স্ত্রী ছাড়া অন্য কারও প্রতি কখনও এমন তীর রাগ তিনি অনুভব করেননি। তার অর্থ কি এই যে, স্ত্রীর প্রতিই তিনি সবচেয়ে বেশি অধিকার সচেতন?বীণা বুদ্ধিমতী। রান্নাঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু ওপাশে কান পেতে আছে হয়তো। তাই ননীবালা ব্রজগোপালের চোখ দেখে ভয় পেয়ে গেলেন। যদি লোকটা তেড়েফুড়ে কিছু বলে তো বউমার কাছে অপমান। বললেন ভয় পেয়ো না। রণো তেমন কিছু করেনি। শাত হলেও তোমারই ছেলে তো।-আমার ছেলেই শুধু নয়। তোমার যাতও তো কিছু তার মধ্যে আছে। তা ছাড়া আছে পারিপার্শ্বিকের প্রভাব, চারদিকের লোভ আর আকর্ষণ। মানুষ খুব মরিয়া না হলে এমন অবস্থায় সৎ থাকতে পারে না।ননীবালা স্বামীকে চটাতে চাইলেন না। উত্তরে বলতে পারতেন সৎ হয়ে কী ঘচু হবে। তা না বলে বললেন-তুমি হাতমুখ ধুয়ে নাও। খেয়ে বিশ্রাম করো।-ওসব দরকার নেই। রশোকে বোলো টাবদ আমি দেব। এল-আই-সিতে গিয়ে যেন ও একটু খোঁজখবর করে। দরকার মতো আমাকে খবর দিলেই আমি এসে সইটই করে টাকা তুলে দিয়ে যাব।-সব ব্যবস্থা অজিতই করছে। বসবে না?না। আর্টনার কাছাকাছি সময়ে গাড়ি আছে। তাড়াতাড়ি না উঠলে গাড়িটা ধরতে পারব না। -একটু বোসো, জলখাবারটুকু খেয়ে যাও, তা করতে হয়তো রণো এসে পড়বে।রজগোপাল খাওয়ার জন্য ব্যস্ত নন। কিন্তু এই সংসারের মাঝখানে আর একটু বসে বিশ্রাম নিতে তাঁর বড় সাধ হচ্ছিল। দূর এক একাকী নির্জন ঘরে ফিরে যেতেই তো হবে।বললেন-সোমেন বাড়িতে নেই?-না। এ সময়ে কি ডাঁশা চেন্ডেরা ঘরে থাকে?ব্রজগোপাল সেটা জান্তে ছোট ছেলেটি যখন বয়ঃসন্ধিতে পা দিয়েছে তখন তিনি বাড়ি ছেড়েছেন। চেহারায় বাউচুর হয়ে ছেলেটি এখন অন্যরকম হয়ে গেছে। তীক্ষ্ণ, বুদ্ধিমান এবং সুশ্রী মুখখানা স্বামী একবার দেখবার জন্য তাঁর বড় সাধ হচ্ছিল। জিজ্ঞেস করলেন-কখন ফেরে। -তার কিছু ঠিক নেই।-কী করেটরে আজকাল। স্বভাবটভাব কেমন।ননীবালা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বসেন-কাজকর্ম না থাকলে কী আর ভাল থাকে। এম. এ. পরীক্ষাটা দিল না, ব্যাঙ্কে একটা চাকরি পাওয়ার কথা হচ্ছিল তো তারও চিঠি এসেছে,চাকরি এখন হবে না।জলখাবারের প্লেট আর চা নিয়ে বীণা আসে। ঘরে ঢোকার আগে গলা খাঁকারি দেয়। ব্রজগোপাল জলবাবারের মেটটা ছুঁলেন মাত্র, চায়ে গোটা দুই চুমুক সিলেন। তারপর অন্যমনস্কভাবে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন-চাল।
পৃষ্ঠা:৫৩
কিছু বলার নেই ননীবালার। কেবল বললেন-শরীরটরীর কেমন।-ভাল, বেশ ভাল।-আর একটু বসলেই রণ্যে এসে পড়ত।-দেখা করার জন্য তাড়া কী? হবে এখন।-দুর্গা দুর্গা। ননীবালা বলেন।ব্রজগোপাল দরজার কাছ বরাবর গিয়ে ফিরে প্রশ্ন করলেন বাড়িটা কার নামে হবে?-রণোর ইচ্ছে আমার নামে হোক। আমি বলি দুই ছেলের নামে হলেই ভাস। তুমি কীবলো?-আমি কী বলব? যেটা তোমাদের খুশি।রাস্তায় এসে ব্রজগোপাল ইতস্তত তাকালেন। আরও শ্রীহীন, নোংরা বুলোটে হয়ে গেছে, কলকাতা। রাস্তায় জঞ্জালের স্তূপ জমে আছে। স্টেশন রোডে এই শীতেও কোথা থেকে জল আমে কাদা হয়ে আছে এখনও। ঘর-ছাড়া ছেলেরা জটলা করছে। যতদূর সতর্ক চোখে সম্ভব দেখলেন ব্রজগোপাল, সোমেনকে দেখা যায় কিনা কোথাও। নেই, থাকার কথাও নয়।কলকাতায় বেড়েছে কেবল দোকান। এত ঢোকান, কেনে কে, তা ব্রজগোপাল ভেবে পান না। তবু ঠিকই সওদা কোকেনা চলে। মানুষকে লোভী করে তুলবার কত আয়োজন চারদিকে।একটা ট্যাক্সি উলটোদিক থেকে এসে তাঁকে পেরিয়ে গেল। থামল। ব্রজগোপাল যাড় ঘুরিয়ে দেখলেন, বাসার সামনেই থেমেছে। একটু দাঁড়ালেন। রণো না? রণোই। ঘাড় নিচু করে নেমে এল, হাতে বোধ হয় একটা দুধের কৌটো, দু-একটা পাকেট গোছের, একটা ফোলিও ব্যাগ। চশমা নিয়েছে আজকাল। বেশ মোটা হয়ে গেছে। সোয়েটারের ওপর দিয়ে পেস্টটা বেশ ঠেলে বেরিয়ে আসছে, গালটাল পুরন্ত। চিনতে তবু অসুবিধে হয় না। ছেলে তো। মোটা হয়ে যাওয়ায় এই বয়সেই বেশ বয়স্ক দেখায়।কয়েকটা মুহূর্ত তিনি দাঁড়ালেন, ট্যাক্সিতে চড়ার অবস্থা রণ্যের নয়। তবু কী করে ট্যাক্সি চড়ে ওং দিব্যি নির্লিপ্ত মুখে ভাড়া গুনে দিয়ে খুচরো ফেরত নিচ্ছে। ট্যাক্সির মিটার টুংটাং করে ঘুরে গেল। বোঝা যায় হামেশা ট্যাক্সিতে চড়ার অভ্যাস আছে। নামা থেকে ভাড়া দেওয়া অবধি ঘটনাটুকুর মধ্যে একটু। অভ্যন্ত অবহেলার ভাব।রণ্যে বাড়িতে ঢুকে গেলে ইজগোপালের খেয়াল হয়, ছেলে এক্ষুনি শুনবে যে ধাবা এসেছিল, এইমাত্র বেরিয়েওগেছে। ফলে হয়তো বাপের সঙ্গে দেখা করতে তড়িঘড়ি নেমে আসবে। ভেবে বুজাগোপাল দ্রুত হাঁটতে থাকেন। তাঁর অভ্যাসের পক্ষে খুবই দ্রুত। জোরে ইসি তাঁর বাধ্য বড় রাস্তা পর্যন্ত এসেই ব্রজগোপাল বুঝতে পারবেন, কাজটা ঠিক হয়নি। বুকে প্রাণপাণি ডানা ঝাপটাচ্ছে।খাসবায়ু উৎকট রকমের কমে আসছে। এ সময়টায় তাঁর আজকাল হপির টান ওঠে। দু-ভার কদম হেঁটে রজগোপাল ব্রিজের পিলারের কাছে উবু হয়ে বসে পড়েন। ভগবান। এ যাত্রা সামলাতে দাও। এক বিশাল সমুদ্র যেন ক্লান্ত সাঁতারুকে বড় নয় ছয় করে। রজগোপাল বসে নিবিষ্টমনে শ্বাস টানতে চেষ্টা করেন। একবার এ সময়ে সোমোটার মুখখানা যদি দেখে যেতে পারতেন। ওই ছেলেটির প্রতি বড় মায়া। লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড়ে কোথায় হারিয়ে আছে ছেলেটা। এ বরসে কবে কখন প্রাণপাখি ছেড়ে যায় দেহের খাঁচা। আয় সোমেন আছ।
পৃষ্ঠা:৫৪
আট
কলকাতার ময়দানে প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দিচ্ছেন। রেডিয়োতে বিলে হচ্ছে। সন্ধেবেলা। প্রধানমন্ত্রী তাঁর স্বভাবসিদ্ধ আন্তরিকতার সুরে বার বার জাতিকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, আরও ত্যাগ, আরও কষ্ট স্বীকার, আরও ধৈর্যের জন্য জনগণকে প্রস্তুত হতে হবে। ভারতের চতুদিকে কয়েকটি দেশ মিত্রভাণাপন্ন নয়। যে কোনও সময়ে আমরা আক্রান্ত হতে পারি। বন্ধুগণ, আমরা যুদ্ধ চাই না, কিন্তু যুদ্ধে যদি আমাদের নামানো হয় তবে আমরা আদর্শের জন্য, অস্তিত্বের জন্য, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে চূর্ণ করার জন্য।…. অজিত রেডিয়োটা বন্ধ করে দেয়। রেডিয়োর পাশে পোষা বেড়ালের মতো বেতের গোল চেয়ারে পা গা ঢাকা দিয়ে বসে আছে শীলা। তার মুখশ্রী চমৎকার, রং একটু চাপা, ইদানীং সুখের কিছু মেদ জমছে গায়ে। ভূতে রঙের টল দিয়ে একটা সোয়েটার বুনছিল, একটা ঘর গুনতে ভুল হয়েছে, মাথা নিচু করে দেখছিল ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে। রেডিয়োটা বন্ধ। হয়ে যেতেই চমকে উঠে বলে-এই যায়, কী হল। -বন্ধ করে দিলাম। তুমি তো শুনছ না। অজিত শান্ত গলায় বলে। শুনছি না কে বলল? তুমি বন্ধ করে দিলে তাই বলে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা: ভারি বিস্ময়ভরে বলে শীলা। -তোমার কি ধারণা, প্রধনমন্ত্রীর গলার স্বরে ঘরদোর পবিত্র হবে? কেউ যখন শুনছি। না তখন খামোখা ব্যাটারি নষ্ট করে লাভ কী। আজকাল ব্যাটারির লনজিভিটি অনেক কমে গেছে, যদি যুদ্ধ হয় তো নেকট বাজেটে দামও বাড়বে। ভারী বিশ্রী স্বভাব তোমার। ভাল কথা সহ্যই করতে পারো না। কত লোক আজকের মিটিং অ্যাটেন্ড করছে জানো? খামোখা করছে। ফেরার সময়ে অধিকাংশ লোকই ট্রামে বাসে উঠতে পারবে না। লক্ষ্য রাস্তা হেঁটে মরবে সবাই, আর তা করতেই ভাল ভাল কথা যা শুনছে সব ভুলে যাবে। ইউনিয়ন করতে করতে তোমার মনটাই হয়ে গেছে বাঁকা। যেহেতু পিএম বলছে সেইজন্যই তার সব খারাপ। শুনছিলঞ্জ চাশ, দাও আবার রেডিয়োটা। -থাক। তার চেয়ে এস একটু প্রেমট্রেম করা যাক। যুদ্ধযুদ্ধ লাগলে কবে যে। কী হবে। -আহা, সারাদিনের ঐ সময় দেখা হয় সেটুকু সময়ও তো আমার দিকে তাকাও না। এখন প্রধানমন্ত্রীর ইমপ্যান্ট বক্তৃতার সময়ে গ্রেম উথলে উঠল। দাও না রেডিয়োটা, একটা ঘ্যা পড়ে গেছে, তুলতে পারছি না। দাও না গো- অজিত রেডিয়োটা আস্তে করে ছেড়ে দেয়। রোডিজের টেবিল থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর রনসন গ্যাস লাইটারটা তুলে নিয়ে বারান্দায় আসে। টালিগঞ্জের এ পাড়াটাকে খাটালের পাড়াও বলা যায়। বারান্দায় দাঁড়ালেই গোচোন, শুকনো গোবর আর গরুর গায়ের গন্ধ এসে ধাক্কা দেয় নাকে। অভ্যাস হয়ে গেছে এখন। কিম এক সন্ধ্যা নেমে আসছে মাঠে ময়দানে। অয় কুয়াশা, কৌতিক আলো জ্বলছে অন্ধকারে। কুয়াশার ভিতরে পাগির ডিমের মতো। একাও এ-সিকটায় ফাঁকা জমি দেখা যায়। অবশ্য ক্রমেই ফাঁকা জায়গা তবে যাচ্ছে, নিত্য নতুন ভিত পরুন হয়, বাঁশের ভারা ওঠে, তার সঙ্গে উঠতে থাকে ইটের গাঁথনি। লোহার মিল শীতে চনচনে হয়ে আছে।
পৃষ্ঠা:৫৫
গ্রিলের সঙ্গেই প্রায় গাল ঠেকিয়ে দাঁড়ায় অজিত। ঘরের ভিতর থেকে প্রধানমন্ত্রীর গলার স্বর আসছে, চারদিক থেকে প্রধানমন্ত্রীর গলার স্বর আসছে। সব বাড়িতে রেডিয়ো খোলা। কর্তা গিন্নি, চাকর-বাকর, খাটালগুয়ালর সবাই শুনছে, নির্বাচকমণ্ডলী, জনগণ। কাঁচা রাস্তাটা বা ধারে কিছুদূরে গিয়ে বাঁক নিয়েছে। বাঁকের মুখেই একটা বাতিস্তম। হলুদ আলো নতমুন হয়ে দাঁড়িয়ে। ওই জমিটা লক্ষ্মণের। গতকালও একটা এয়ারোগ্রাম এসেছে লক্ষ্মণের। কানাডা থেকে ওরা স্বামী-স্ত্রী বেড়াতে বেরিয়েছে স্টেটসে। বড় শীত, খুব ফুর্তি। লক্ষ্মণ আর ফিরবে না। ইমিগ্রান্ট ভিসা পেয়ে গেছে। ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ার লক্ষ্মণ কোনও দিনই খাটাল-ভরা এই এলাকায় বাড়ি করতে আসবে না। তার জমিটা বায়না করেছে রলেন। দু-একবছরের মধ্যেই ওখানে এক কি দেড়তলা দীন একটি বাড়ি উঠবে। শীলার খুব আনন্দ, বাপের বাড়ি উঠে আসছে কাছে। রুনসন গ্যাসলাইসরটার আগুন কেমন লেলিহান হয়ে লাফিয়ে ওঠে। চাকা ঘুরিয়ে দিলেই আবার কমে যায়। গ্যাসের সিলিন্ডার শেষ হয়ে এসেছে। লক্ষণ আবার পাঠাবে, লিখেছে। কিন্তু লক্ষ্মণ আর ফিরবে না। বন্ধুর অন্য শখ করে কাছাকাছি জমি কিনেছিল। যখনই কিনেছিল তখনই বোধ হয় লজ্বাণ জানত যে সে সুখের পাখি হয়ে উড়ে গেছে। ফিরবে না। তবু অজিতকে খুশি করতেই কিনেছিল বোধ হয়। মেরেকেটে গৌনে দু-কাঠা জমি হবে। বেশি দামও নয়। লক্ষ্মণের কিছু যায় আসে না যদি অজিত খুব কম দামেও জমিটা ছেড়ে দেয়। লক্ষ্মণ বহু টাকা মাইনে পায়। কানাডায় বাড়িও করেছে। খাটালে ভরা, বন্ধুহীন এদ্যকার অজিত পড়ে আছে একা। একাই। অজিত বড় একা। ঘর থেকে প্রধানমন্ত্রীর গলার ওপরে গলা তুলে শীলা ডাকে-শুনছো, ঠান্ডা লাগিও না। বারান্দায় এখন কী? ঘরে এস। অজিত উত্তর দিস না। কিং সাইজ ডানহিল সিগারেটের সুন্দর গন্ধটি ফুসফুস ভবে টেনে নিল। পাঁচ প্যাকেট পরিয়েছিল লক্ষ্মণ। আর মাত্র আড়াই প্যাকেট আছে। কৃপণের মতো খায় অজিত। একটুও যৌয়া নষ্ট করতে ইচ্ছে করে না। ফুরোলে আবার পাঠাবে। কত কী পাঠায় লক্ষ্মণ। কিন্তু সে নিজে ফিরবে না। দূরের স্বাম্পপ্তেস্টের আংলা কুরাশার একটা ধাঁধার মতো জ্বলছে। মাকড়সার জালেক্-মূতো সেই ভৌভিক আলোয় লক্ষ্মণের শূন্য জমিটা দেখা যায়। শীতে কিছু ছেলে কৌলিকেটে ব্যাডমিন্টন খেলে, বর্ষায় আগাছা জন্মায়। কোনওদিন লক্ষ্মণ ফিরবে, বাড়িকাতি করবে, এই আশায় এতকাল জমিটা ধরে রেখেছিল অজিত। শীলার তাগাদাহ শাশুড়িই আর রগেনের আগ্রহে ছেড়ে দিতে হল। ধরে রেখেও লাভ ছিল না অবিশ্যি পৃথিবী ঠিক এক পুকুরের মতো, মাছের মতো মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে কোথায় কোঞ্জো বৃথা ছিপ ফেলে বসে থাকা, কোন দূরে হারিয়ে যাওয়া মাছটিকে ধরে আনবে কাছে, এমন সাধা কী। লক্ষ্মণের পায়ে থাকত একটা বর্ণহীন গুলোটে চপ্পল, একটু খাটো ধুতি, গায়ে একটা ফুলহাতা শার্ট-যার হাতে বোতাম খসে যাওয়ার পর হাতীর কানের মতো লটপটি করত। শীত-গ্রীষ্মে ওই ছিল তার মার্কামারা পোশাকে। কখনও কারও সঙ্গে ঝগড়া করত না লক্ষ্মণ তর্কাতরিতে যেত না, কাউকে কখনও অবহেলা করেনি। বিশাল এক যৌথ পরিবারে মানুষ, মা-বাবা বর্জিত কাকা-জ্যাঠার সংসারে তার অনাদর ছিল না হয়তো। কিন্তু সে পরিবারের আদর জানাবার দাবাই ছিল কম। কাকা পলিটিকস করর-তৎকালীন সি পি আইয়ের নিয়াতকর্মী। জ্যাঠা দোকান দিয়েছিল। বাসায় পড়ার ঘর ছিল না। বইপত্র ছিল না, শোওয়ায়
পৃষ্ঠা:৫৬
জায়গারও কিছু ঠিক ছিল না। লক্ষ্মণের বাসায় গিয়ে দৃশ্যটা নিজের চোখে রেখেছে অজিত। লক্ষ্মণের তাই বেশি আপন ছিল ঘরের যাইরের জগৎ। সকলেই ভালবাসত লক্ষ্মণকে। সেবার প্রথম আই এস সি ক্লাসে বিজ্ঞান পড়তে গিয়ে অজিত বস্তুবিশ্বেনা অনুময় অস্তিত্বের বিষয়ে জানতে গিয়ে ভারী অবাক হয়। বিজ্ঞান, ত্রিকোণমিতি বা অঙ্কের বই খুলে বসে নে এক অবাক বিস্ময়ভরা তন্দ্বজ্ঞানের মুখোমুখি হত। বিশ্বের সব কিছুর অস্তিত্বের স্বরূপ বিশ্লেষণ জানতে গিয়ে তার বহুকালের পুরনো সব যারা ভেঙে যাচ্ছিল। বহু ছেলেই আই এস সি পড়ে, তাদের কারও এসব মনেই হয় না। কিন্তু অজিতের ভিতরে চাপা বিবাদরোগ বীজাণুর মতো ওত পেতে দিল। বিজ্ঞান পড়তে গিয়েই সেই বীজাণুর আক্রমণ টের পায়। সারাদিন বসে ভাবত এই যে আমি, আমি কতগুলি অণুর সমষ্টি মাত্র? একদিন ঠাট্টা করে কেমিষ্টির অধ্যাপক ক্লাসে কললেন মানুষকে পুড়িয়ে ফেললে খানিকটা কার্বন পড়ে থাকে,খানিকটা জল হয়ে উড়ে যায়। আমাদের এত আদরের শরীরের ওই হচ্ছে পরিণতি। জল আর কার্বন নিয়ে খুবই ভাবতে শুরু করেছিল অজিত। খেতে পারত না, রাতে ঘুমও কমে যেতে থাকে। মাথা ভরা ওলট পালট বিজ্ঞানের তত্ত্বজ্ঞান। বস্তুবিশ্বের গঠন, অঙ্কের কাল্পনিক সংখ্যা এবং অসীম চিহ্নের ব্যবহার তাকে মনে মনে ভয়ংকর উত্তেজিত এবং বিষাদগ্রস্ত করে তুলত। ইনফিনিটি শব্দটা নিয়ে ভাবতে বসে সে কেবলই অসীমতার ধারণা করতে গিয়ে মাথা চেপে ধরত ভয়ে। পাগল হয়ে যাব না তো। অবস্থা কাঠিকে কলাও যায় না। একা সওয়াও যায় না। সব ছেলেরা যখন রসায়নের ক্লাসে বস্তুত মলিকিউলার ভ্যালেন্সি বুঝছে। তখন অর্জিত নিউক্লিয়াস আর তার চারধারে ঘূর্ণমান পরমাণুকণার ধারণা করাতে নিয়ে ভারী অন্যমনস্ক হয়ে যেত। বুঝতে পারত অন্যান্য ছেলেদের মতো সে স্বাভাবিক নয়। যে একা,সে আলাদা। তার মতো চিন্তা বা দুশ্চিন্তা অন্য কারও নেই। ঠিক সেই সময়ে একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে লম্বাগকে সঙ্গী পায়। সেন্ট্রাল ক্যালকাটা কলেজ থেকে ওয়েলেসলি হয়ে হেঁটে কালীঘাট ফিরবে লক্ষ্মণ। কারণ তার পয়সা নেই। অজিত বলল-চলো তোমার ট্রাকভাড়া আমি দেব। লক্ষ্মণ রাজি হল তবু বলল-পরে উঠব, মরদান পর্যন্ত হাঁটিগুলো। এ সময়ে ফাঁকা জায়গায় হাঁটতে বেশ লাগে। সেই থেকে বন্ধুত্ব। সারা রাস্তা কত কথা বলে গেন লক্ষ্মণ। অজিত ভাল শ্রোতা পেয়ে মনোহরদান কড়াগের কাছে খাসে মুখোমুখি বসে তার বিজ্ঞান বিষয়ক বিপদের কথা বাস্তু করলে লক্ষ্মণ তার হাত চেপে ধরে চেঁচিয়ে উঠল- মাইরি, আমারও ওরকম হয়। আকাশের কথা’ নামে একটা বই পড়ে আমার মাথা গোলমাল হয়ে যাওয়ার যোগেন্দ্রচ। মনে হচ্ছে সেই কথাটাই ঠিক, মানুষ হচ্ছে জন্মান্ধ, তাকে একটা অন্ধকার ঘরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে একটা কালো বেড়ালকে খুঁজে বের করতে হবে। আমার কাকা একবার শলেছিলেন সৃষ্টির আদি রহস্য জানাবার চেষ্টা করা মাতা। বদি তা কেউ করতে দূটা তবে সেই অন্ধকার যরে ঢোকার আগে সে যেন তার বোধবুদ্ধি রেখে যায়,নইলে পাগল হয়ে যাবে। তার মতো আর একজনও আছে যে কিনা বিজ্ঞানের কত্বজ্ঞান নিয়ে মাথা ঘামায় এই কথা জেনে কী ক্রোমহর্ষনায় আনন্দ হয়েছিল অদিতের। আজও পায়ে।কাঁটা দেয়। মজ্জাগত বিষাদরোগ যদিও কোনওদিনই ছাড়েনি অজিতকে, তবু ওই বন্ধুত্ব তার মনে একটা হাওয়া-বাতাসের জানালা খুলে দিল। বড় অকপট, বন্ধুবৎসল ছেলে লক্ষ্মণ। মন-খারাপ হলেই অজিত চলে যেত এর কাছে। নাক্কণ তার চিরাচরিত পোশাকে যেরিয়ে আসত। রাস্তায় হটিও দুজনে, কয়েক পয়সায় উনেব্যসাম কিনে নিত। পাক বা লেকের ধারে
পৃষ্ঠা:৫৭
বদত্ত বিয়ে। সেই বয়সের তুলনায় কিছু বেশি পড়াশুনো ছিল লক্ষ্মণের। বিবেকানন্দের বই ইংরেজিতে পড়েছে, নাড়াচাড়া করেছে কিছু রাজনীতির বই, সবচেয়ে বেশি ছিল ভার পত্রিকা পড়ার অভ্যাস-পৃথিবীর কোথায় কী ঘটছে, কীভাবে ঘটছে, কেন-সে সব ছিল তার নখদর্পণে। তার কাছে খুব একটা মানসিক আশ্রয় পেয়েছিল অজিত। ওই ভাবেই তারা বড় হয়। আই এসসি থেকে বি এসসি। তারপরও সন্ধন পড়ল এম টেক। অনার্স ছিল না বলে অজিত লেখাপড়া ছাড়ে। বরাতজোরে এক ছোট্ট জীবনবিমা কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে যায়। লাক্ষ্মণ এম টেক-এ ভাল রেজাল্ট করে কিছুদিন চাকরি করল এখানে-সেখানে, একটা প্রফেসারিও করল কিছুদিন। বলত-অজিত, এখানে বড় কুপমন্ডুকের জীবন। পাসপোর্ট করছি, দেখি কী হয়। পাসপোর্ট করেও রিনিউ করাতে হল লক্ষ্মণকে। পারসেজ মানির সংকুলান হত না। ভিসা গচে যেত। অজিতের ছোট্ট কোম্পানি রাষ্ট্রায়ত হয়ে মাইনে-টাইনে বাড়তে লাগল। কাজ কমল। বউ এল ঘরে। এবং বউয়ের সঙ্গে মা-বাবার বনিবনার অভাব ঘটাতে অজিত ভবানীপুরের বাসা ছেড়ে আলাদা হয়ে উঠে এল টালিগঞ্জের কাছে। একটু বেশি বয়সেই লক্ষ্মণ গেল কানাডায়। বড় একা হয়ে গেল অজিত। ঘরে বউ, তবু একা। মেয়েরা যে পুরুষের গভীরতার বন্ধু ন্যয় সে সত্য অজিতের চেয়ে বেশি কে জানে। আজ যদি আবার সেই বিবাদরোগ ফিরে আসে তবে অজিত আনে, নিঃসঙ্গতার কাছে ছাড়া যরে তায় কেউ নেই যাকে বলবে তত্ত্বকথা। কত যেগ্রামের গল্প লেখা হয়, একটা মেয়েকে নিয়ে কত টানাপোড়েন, কত দ্বন্দ্ব কত আশা-নিরাশা, ব্যর্থতা ও মিলন, হায়, নারী গ্রোম তবু জীবনের কতটুকু মাত্র জুড়ে আছে। মেয়েদের সাধ্য কী স্পর্শ করে ধীমান পুরুষের গভীর নিঃসঙ্গতা! মেয়েমানুষের প্রতি প্রেম তাই ফুরিয়ে যায়, জুড়িয়ে যায়। কিন্তু দূরের লক্ষ্মণের জন্য অজিতের পিপাসা ঠিক জেগে থাকে। বন্ধুর মতো বন্ধু শেলে পৃথিবীর কত বিশ্বঙ্গতার অর্থ হয়ে যায় আনন্দ। অব্জিতের ছেলেপুলে হল না। সরকার খেপে খেপে মাইনে বাড়িয়ে গেল। আগে ইউনিয়ন করত, শীলা বকে বকে ছাড়াল ইউনিয়ন। বছরখানেক আগে প্রোমোশন পেরে সেকশন ইনচার্জ হয়ে গেল অজিত। শীলাও একটা গার্লস স্কুলে চাকরি করছে। দুজনের রোজগার। ফলে হাতে টাকা জমে গেল কিছু। সহ্মণকে লিখল কাছাকাছি দুটো প্লটে জমি গাছে, লক্ষ্মণের জন্য একটা কিনবে মুক্তি। দুই বস্তুতে পাশাপাশি থাকবে সারাজীকন। তত্বজ্ঞানী সহৃদয় বস্তু আর রঙ। চিঠি পেয়েই লক্ষ্মণ টাকা পাঠিয়েছিল জমি কিনবার জন্য। জালের মতো ভৌতিক আলোটি সম্মাণের জমির ওপর ময়লা জলের মতো গঞ্জে জীছে। ব্যাডমিন্টন কোর্টের আশে-পাশে কাঁটাকোপ। বর্ষকালে পাগল। ঢেঁকি, ভাঁট অছে আগাছায় ছেয়ে যায়। সম্মান জার্মান এক মহিসাকে বিয়ে করেছে, পেয়েছে ইমিগ্রান্ট ভিসা, জমিটা বেচে দিতে লিখেছে। প্রধানমন্ত্রীর বিষ্ণু-গম্ভীর কন্ঠস্বর ক্রমে উঁচুগ্রামে উঠছে। সেতারের কাসাব মতো। এবার থামবে। যেষেক কলবে-এতক্ষণ তিনভালে প্রথমে বিলম্বিত এবং পরে দ্রুত রাগ শোনালেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইত্যাদি। অজিতের বিদেশি সিগারেট শেষ হয়ে আসে। ফিল্টারটায় আগুন বরেছে, পোড়া একটা গন্ধ পাওয়া যায়। সেটা ফেলে দিয়ে আর একটা গরায় অলিত। রনসন গ্যাসলাইটারটতে চাকা ঘুরিয়ে হঠাৎ প্রায় অনফুট উঁচু একটা শিখা তৈরি করে। নিবিয়ে দেয়। পদ্মণ কোনওদিনই ফিরাবে না।
পৃষ্ঠা:৫৮
শীতের নির্জন রাস্তা দিয়ে কুয়াশায় ডুবন্ত একটা ছায়ার মতো মানুষ আসছে। সামনে এসে চিন্তামগ্ন মুখটা তুলল। অন্ধকার বারান্দায় সম্ভবত সিগারেটের আগুন দেখে জিজ্ঞেস করে-অজিত নাকি। আরে রদেন। -খবর আছে। -ভিতরে এস বলছি। অজিত মন্থর পায়ে ভিতরে আসে। ঘর ভরতি প্রধানমন্ত্রীর কন্ঠস্বর। শীলা বেচনা অংশটুকু তুলে আলোর ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নকশাটা দেখছে। অজিত দরজা খুলে এক বিপর্যস্ত রশ্চেনকে দেখতে পায়। আজকাল রণেন একটু মোটাসোটা হয়েছে। ভুড়ি বেড়ে যাওয়ায় এবং টাক পড়ছে বলে একটু বয়স্ক দেখায়। তবু আজকাল আগের তুলনায় অনেক বেশি রংসার, বাহারি পোশাক পরে সে। আজও পরনে নেভি ব্লু রঙের একটা সুট, গন্ময় টাই, কোটের তলায় দুধসাদা জামা। চুল বিন্যস্ত, দাড়িও কামানো। তবু বিপর্যয়ের চিহ্ন ফুটে আছে তার মুখে-চোখে। হা-ক্লান্ত এবং হতাশ্য মাখানো মুখ।শীলা মুখ তুলেই হাতের বোনাটা রেখে দিল। বলল-কী রে দাদা?সেই মুহূর্তেই প্রধানমন্ত্রী বলে উঠলেন-জয় হিন্দ। এবং জনতা তার প্রতিধ্বনি করল।শীলা নিজেই রেডিয়েটা বন্ধ করে দেয় এবার। উৎকণ্ঠায় রণেনের দিকে চেয়ে থাকে। রগেন চেয়ারে বসে একটু এলিয়ে হাতের ফোলিও ব্যাগটিন মেঝেয় রেখে হাতের চেটোয় মুখটা ঘষে নেয়। বলে-একটু চা কর তো।করছি। কী হয়েছে-গ্রহের ফের। বলে রণেন অজিতের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করে-এল অহি সি-তে চেকটায় খোঁজ নিয়েছিলে। অজিত তার বিদেশি সিগারেটটার ফিল্টার পুড়িয়ে ফেলেছে আবার। সেসর আশট্রেতে গুঁজে বলে নিয়েছি। কাল-পরশুই ইস্যু হওয়ার কথা।-কিন্তু বাবা আসতে পারছেন না। বহেরু লিখেছে বাবার শরীর ভাল নেই। বলবরতা থেকে ফিরে গিয়েই অসুস্থ। বাবাকে ছাই-চেক তো ওরা আর কাউকে দেবে না।না।-ব্যাপারটা এত দূর ম্যাটিঞ্জর করেও খুলে গেল।অজিত জ কুঁচতে বৃন্যে শ্বশুরমশাইয়ের কী হয়েছে?-জানি না। বট্রেক ভেঙে তো কিছু দেখেনি। লিখেছে, বুকে ব্যথা। তা থেকে বিচ্ছু। আন্দাজ করা দৃষ্টব নায়। এদিকে আমি সিমেন্টের পারমিট বের করেছি। লোহালকড়ও পেয়ে যাচ্ছি সস্তায়। টাকা আয়ডভান্স করা হয়েছে। এত দূর। এগিয়ে আবার বসে থাকতে হবে। চেক-এর ভ্যাসিডিটি কতদিন থাকে। তিন মাস।এরকমই।শীলার মুখটা গ্লান হয়ে গিয়েছিল। বসল তুই একবার গিয়ে দেখে আয় না। রাখেন একটু চড়া গলায় বলে-যাব বললেই যাওয়া যায়। তোর বউদির বোধ হয় একটা মিসহ্যাপ হয়ে গেল।
পৃষ্ঠা:৫৯
-কনসিভ করেছিল। তিন মাস। কাল থেকে ব্লিডিং–ইস। কী করে হল? পড়ৌড়ে যায়নি তো।- না। কিছু বলেনি সেরকম। আজ নার্সিং হোমে ভরতি করে দিতে হল। এক সঙ্গে এত ঝামেলা যে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছি। জলের মতো কিছু টাকা বেরিয়ে যাবে।কেউ কথা বলল না। রণেনই আবার বলে-অজিত, জমিটার ব্যাপারে তুমি কি আর সময় দিতে পারো না।অজিত উত্তর নেই নাঃ হাতের কনসন লাইটারটার দিকে চেয়ে থাকে। শীলা উৎকণ্ঠিত মুখ তুলে স্বামীকে দেখে।-পারো না? রখেন আবার প্রশ্ন করে।অজিত । কুঁচকে বিপরীত দেয়ালে কাঠের চৌখুপিতে রাখা হরেক পুতুলগুলো দেখে। প্রধানমন্ত্রী চুপ করেছেন। দূর থেকে সম্ভবত পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর কন্ঠস্বর আসতে থাকে। অজিত একণীং শ্বাস ছেড়ে বলে মুশকিল হল, লক্ষ্মণের এক পিসেমশাই প্লটটার ব্যাপারে জানেন। লক্ষ্মণও লিখেছিল যেন তার পিসেমশাইকে প্লটটা আমি বিক্রি করে দিই। উনি আট হাজার টাকা অফার দিয়েছিলেন। আমি লক্ষ্মণকে লিখি যে জমি অলরেডি বাজনা হয়ে গেছে, কয়েক দিনের মধ্যেই রেজিস্ট্রি হয়ে যাবে। এদিকে সেই পিসেমশাই এখনও খোঁজখবর রাখছেন যদি বাই চান্দ পার্টি পিছিয়ে যায়, তবে উনিই কিনবেন। ব্যাপারী বুলিয়ে রাখা খুবই দৃষ্টিকটু হবে। লক্ষ্মণ কোনও প্রশ্ন তুলবে না, কিন্তু মনে মনে অবাক হবে।তার খুবই ইচ্ছে ছিল পিসেমশাইকে প্লটটা বিক্রি করি। শীলা ভ্রূ কুঁচকে বলে-তোমার তো খুব বন্ধু সে। তাকে একটু বুঝিয়ে লিখে দাও না।বোঝাবার কী আছে। সে তো তাগাদা দেয়নি। তাগাদা যা আমারই। তা ছাড়া ওই পিসেমশাই ভদ্রলোক রিটায়ার করে সামান্য কিছু টাকা পেয়েছেন। কলকাতায় ওই ঢাকায়। জমি পাওয়া যে কী মুশকিল, তাই ভদ্রলোক খুব আশায় আশায় এসেছিলেন লক্ষ্মণের জমিটার জন্য। তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছি জমি বিক্রি হয়ে গেছে বলে। লক্ষ্মণকে আমি এখন কী লিখব?-একটু সময় চাও।অজিত অদ্ভূত চোখে শীলাকে দেখো বলে-চাইব কেন? সে তো আমায় সময় বেঁধে দেয়নি। জমি বিক্রির টাকারও তার দরকার নেই। টাকাটা তার অ্যাকাউন্টে কলকাতার এক ব্যাঙ্কে জমা পড়বে। প্রবলেমতো সেখানে নয়।1? তুমি চুপচাপ থাকো জমির ব্যাপারে। বাবা সুস্থ না হয়ে এলে তো রেজিষ্ট্রি হবে না।রণেন স্লামমুখে বলে-শোনো অজিত, বাবা বুড়ো হয়েছেন, তাঁর অসুখকে বিশ্বাস নেই, গুরুতর কিছু হলে-বলে একটু চুপ করে থাকে রমেন। শীলা তার মুখের দিকে চেয়ে আছে, অজিতও। রখেন চোখটা নামায়, বলে কাজেই তাঁর ভরসায় থাকাটা এবং তোমাকেও অসুবিধেয় ফেলারি ঠিক নয়। আমি অন্য একটা ব্যাপার ভাবছি।-বলো। অজিত নিস্পৃহ গলায় বলে।–ধরো যনি টাকাটা আমিই জোগাড় করে দিই তা হলে কেমন হয়।অজিত একটু বিস্মিত হয়ে বলে-তুমি নেবে? তা হলে এতদিন ওষ্ণদ্যানের ভরসায় ছিলে কেন।
পৃষ্ঠা:৬০
-সেটা মার আইডিয়া। মার ধারণা বাবার টাকা বারোভূতে লুটে খাবে, তাই কবার কিছু টাকা ছেলেদের জন্য আদায় করে দিতে চেয়েছিল মা। সেটা যখন আপাতত হচ্ছে না তখন জমিটা কেন হাতছাড়া হয়। বীণার সঙ্গে আমি পরমর্শ করেছি, সে তার কিছু গয়না দেবে, আমিও প্রভিডেন্ড ফান্ড থেকে লেন নিচ্ছি, আরও কিছু জোগাড় করেছি। সব মিলিয়ে জমির বামটা হয়ে যাবে। শীলা তার বড় বড় চোখ পরিপূর্ণ মেলে রণেনকে দেখছিল। হঠাৎ বলল-জমিটং তা হলে কার নামে কেনা হবে?রগেন তৎক্ষণাৎ চোখ সরিয়ে নেয়। বলে-সেটা এখনও ঠিক করিনি। তবে, মার ইচ্ছে, আমার নামে হোক।-তোর কী মত? রণেন একটু ইতস্তত করে বলে বীপার গয়নার অংশটাই বড়। মেজর টাকাটা ও-ই দিচ্ছে যখন, প্লটটা তখন ওর নামেই কেনা হোক। নইলে ওর বাপের বাড়ির লোকেদের চোখে খ্যাপারটা ভাল দেখাবে না। শীলা একটা নিঃশ্বাস ফেলে উঠে ব্যয়। কনে মুখ তোলে।-অদিত।-আমি দিন-সাতেকের মধ্যেই পেমেন্ট করব।ভাল।-তা হলে উঠি।-বোসো। শীলা তোমার চা করতে গেল।রণেন বসে। কিন্তু তার মুখচোখে একটা রক্তণভা ফুটে থাকে। সে যে স্বস্তি বোধ করছে না, তা বোকা যায়। অজিত চেয়ে থাকে। একসময়ে রণেনও তার বন্ধু ছিল, বেশি বয়সের বন্ধু। সেই সূত্রেই ওর বোনের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল অজিতের। কিন্তু লক্ষ্মণ যেমন বন্ধু তেমন বন্ধু রণেন নয়। এখন ওর দিকে চেয়ে একটু মায়া হয় অভিভের। রাতে শুয়ে শীলা কাল- আনছ। কউদির না। আমি অনেক ভাবলাম সারা সন্ধ্যা। কী ভাবলে-দাদা নানং চুর্তৈারা ইচ্ছে করেই বউদির নামে প্লটটা কিনছে। -বিলুক না। -তুমি কিছু বোঝো না। বউদির নামে বাড়ি হলে সেখানে সোমেন বা মার দাবি-দাওয়া থাকে না। আমরাও সেখানে বাপের বাড়ি বলে মাঞ্চ উচু করে যেতে পারব না। তুমি শুকে বেজো না। অজিত সামান্য উম্মার সঙ্গে বদে সেন রখেন থাকতে-থাকতেই বলতে পারতে। ওকে কথা দিয়ে দিলাম, তা ছাড়া ও বউয়ের গয়নাটিংনয়ে বেচেছে বলল। -হাই। বউদি ময়না বেচতে দেওযার লোক কিনা। তা ছাড়া সবাই জানে দামা দু’হাতে
পৃ্ষ্ঠা ৬১ থেকে ৮০
পৃষ্ঠা:৬১
পথসা রোজগার করছে। বিয়ের পর থেকেই ও যথেষ্ট পালটে গেছে। তোলা ঘুষ পায়। দশ-বিশ হাজার টাকার অন্য শুকে বউদির গয়না বেচতে হবে না। যদি বেচে তো সে লোক দেখানোর জন্য। অর্জিত অন্ধকারে একটু হাসল। বলল-আমার কাছে সবই সমান। পিসেমশাই বিলুক,কী রণেনের বউ বিনুক, কী শাশুড়িই কিনুভ-তমোর কিছু যায় আসে না।শীলা ঝংকার দিয়ে বলে-কিন্তু আমার যায় ভাসে। তুমি দাদাকে বেচতে পারবে না।-তা হলে কী করব?-আমি কিনব। শীলা বলে।-তুমি। তুমি কিনে কী করবে?-ফেলে রাখন। যেদিন বাবা টাকা দিতে পারবেন সেদিন ছেড়ে দেব্য-তা হয় না-কেন।-বড্ড দৃষ্টিকটু দেখায়। নলাক্ষণ কী ভাববে? তা ছাড়া রণেন আর তার বউও চটে যাবে, মুখ দেখাদেখি বন্ধ করে দেবে।শীলা চুপ করে থাকে। ভাবে। বলে-তাহলে সন্ধণবাবুর পিসেমশাইকেই বিক্রি করে।একটু স্তন থেকে অজিত বলে-রণেন কি তোমার শত্রু। সে কিনলেও জমিটা তোমার। বাপের বাড়ির হাতেই থাকল।শীলাএকটু খাস ফেলে বলে পুরুষমানুষ তুমি, তোমাদের মন একরকম। মেয়েদের মনই কেবল কু-ডাক ডাকে।রণেনকে অত অবিশ্বাস কেন সংসারটা তো এতকাল সে-ই টানছে। টানবেও। ছেলে হিসেবে রণেন তার সব কর্তব্যই করেছে। তোমার বাবা যখন টাকা তুলতে আসতে পারছেন না, অনিশ্চিত অবস্থায় জমিটা হাতছাড়া না করে রণেন যদি কেনেই তো তাতে দোষ কী। বউয়ের নামে কিনলেও দেনা নেই। নিজের বাড়ি বলে সে যে মা-ভাইকে বের করে দেবে, এমন তো মনে হয় না।নীলা চুপ করে থাকে। কিছু বলার ভাতো যুক্তি খুঁজে পায় না বোধ হয়। এক সময়ে বলে-বাবার সে কেন এসময়ে অমুষ করল। চলো না একদিন বাবাকে দেখে আসি।তোমার জন্য আমাকে সফন্দ করেন না, জানোই তো।কাকেই বা করেন। ঋবার ভালবাসা আমরাই পাইনি, যা একটু দাদা পেয়েছে। মার শ্রীকনটা যে কীনতে শঢিল।অনেকক্ষন বাদ থাকে শীলা। তারপর অজিত টের পায়, শীলা ফুঁপিয়ে কঁদেছে।ভীষণ অসহায় বোধ করে অব্দিত। কান্নাকাটি তার সহ্য হয় না। উঠে একব্যতে শীলাকে নিজের দিকে পশে ফেরাবার চেষ্টা করতে করতে বলে-আচ্ছা বোকা তো। কাঁদো কেন? না হয় যার শ্বশুরমশাইকে দেখতে, রণেনকেও না হয় ত্রুটিটা না কেলাম।শীলা তবু কাঁদে। সাধাসাধি করে করে ক্লান্ত হয়ে গেল অর্জিত। ঘুমও হবে না। অগত্য উঠে একটা ডানহিল ধরায়।সেই শব্দে শীলা হঠাৎ ফোঁপানি বন্ধ করে বলে তুমি চলে গেলে কেন? ভিতরে এস। -যাচ্ছি। সিগারেটটা খেয়ে নিই।
পৃষ্ঠা:৬২
-না। সিগারেট নেযাও।-আঃ, একটু অপেক্ষা করো না।-না, এক্ষুনি ভিতরে এস।অল্পিত খাস ফেলে বলে-কখন যে কী মনে হয় তোমার। একখানা হাত টেনে নেয় বুকের ওপর। অজিত আন্দাজে বালিশের তোয়ালে তুলে শীলার চোখ-মুখ মুছে দেয়। বলে-কেন কাঁদলে। বাবার জন্য, নাকি রণেন জমি বউয়ের নামে কিনছে বলে।-ওসব কারণ নয়।-তবে?নীলা চুপ করে থেকে বলে-আমি একটা জিনিস টের পাই আজকাল।-তুমি আমাকে ভালবাস না।
॥ নয় ]
খুব ভোরেই ঘুম ভাঙল রগেনের। বিছানা আজ যংকা। শুধু বড় ছেলেটা একধারে কেৎরে লেপের তলায় শুয়ে আছে। মেয়ে আর ছোট ছেলে তাদের ঠাকুমার কোল কাড়াকাড়ি করে শুয়েছে, ওঘরে। বড় ছেলেটার মাথায় একটোকা চুল, মন্ত্র মাথাটা জেগে আছে লেপের ওপরে, মুখ নাক ঢাকা। রীনা আজ পাঁচদিন নার্সিং হোমে।বুবাইয়ের মুখ থেকে লেপটা সাবধানে সরিয়ে দিল রগেন। ভারী হালকা আর দুতফুরে আছে মনন। সকাল থেকেই যে গগাম্ভীর্য তাকে চেপে ধরে সেটা কদিন হল একদম নেই। বীণ্য নার্সিং হোমে যাবার পর থেকেই নেই। অন্যদিন লেপ ছেড়ে উঠতে কষ্ট হয়। আজ হল না। শিস দেওয়া তার আসে না। ছেলেবেলা থেকে অনেক চেষ্টা করে দেখেছে, গেট খুঁচোল করে নানা কায়দায় বাতাস ছেড়েছে, বড় জোর একান দুই কুই আওয়াজ তুলতে পারে। তবু মন খুশি থাকলে রণেন আড়ালে শিস দেয়। অর্থাৎ ওই আওয়াজটা বের করে। আওয়াজটা রেখে যায় মাত্র।একটানা হয় না, বাতাসটা বেরিয়ে যাওয়ার পথে মাঝে মাঝে। একটু কুই। শব্দ তুলে তার মান উঠে গায়ে হাতগুলা এবটা উলিকটের গেঞ্জি পরল, লুঙ্গিটা গেছে এক কাকভোরে রণেন পরতে পরতে ড্রেসিং-টেক্সিমার সামনে এসে দাঁড়াল। নিজেকে দেখে ভার খুব বেশি পছন্দ হল না। পেটটা বেশ চরয়ে গেছে, গলায় চর্বির গোটাকয়েক থাক। গাল দুটোও কি বেশ ভারী নয়। ঘুরিয়ে-কিরিয়ে নিজেকে দেখল সে। হাত ভাঁজ করে বাইসেপ টিপে দেখল গেঞ্জির ওপর দিয়েহী না, তেমন শক্ত হয় না আজকাল। অর্থাৎ অপরিহার্য মেদ জমছেই। লোকে বলে তার বাক্তিত্ব নেই। ব্যাপারটা সে ঠিক বোঝে না। চিরকালই সে কিছু ঢিলা-ঢালা বশি আলগা মানুষ, একটু আয়েশি; টিপটপ থাকা তার আসে না। অনেক মানুষ যেমন কন্দ- টেপা পুতুলের মতো ঘুম থেকে উঠে চট জলদি হাতে নিখুঁত দাড়ি কামিয়ে, দাঁত মেজে, স্নান সেরে, এক্সিকিউটিভ-টি সেজে, রেক-ফাস্ট টেবিলে গিয়ে বসে তার সেরকম হবেও না কোনওদিন। ফুক্ত-ইনস্পেকটরের বেলা এগারোটার পরে বেরোলেও ক্ষতি নেই, অঢেল
পৃষ্ঠা:৬৩
আউটডোরে ঘোরা আছে তারপর। কিন্তু বীণা সেরকম পছন্দ করে না। বীণা যে কী চায়। কিন্তু বীণা আপাতত নার্সিং হোমে। পেটের বাচ্চাটিন নষ্ট হয়ে গেল। তা যাক। রখেন সেটা নিয়ে খুব একটা ভাবে না। আপাতত সে ব্যক্তিত্ব কথাটা নিয়ে ভাবছিল। তার ব্যক্তিত্ব নেই এটা একটা চাউর ব্যাপার। আচায় সে তার ব্যক্তিত্বটা একটু খুঁটিয়ে দেখছিল। প্রথমে সে ছোট চোখে চাইল, তারপর বিস্ফারিত চোদে একবার মুখটা তোল্লা গভীর করল, একবার ছটাকী একটু হাসির বিজলি খেলিয়ে দেখল। বাঁধার এবং ডানবার থেকে দেখে অতঃপর সে ছোট হাত-আয়নাটা বড় আয়নার মুখে মুখে ফেলে নিজের সঠিক চেহারান লক্ষ করে। আয়নার উলটো ছ্যায় পড়ে আর একটা আয়নার সেই উলটো ছায়াটাকে উলটে নিয়ে নিজের প্রকৃত চেহারাটা দেখা যায়। কিন্তু দেখেটেখে খুব একটা প্রভাবিত হয় না সে। কিংবদন্তীর খানিকটা সত্যিই। চর্বিগুলা তুখো গাল দুটো আর ছোট চোখে কি ব্যক্তিত্ব ফোটানো যায়। কিন্তু চার্চিলের ছিল, বিবেকানন্দের ছিল। সুনিয়ার বিস্তর মোটালেটিং মানুষের এখনও বৃক্তিত্ব আছে। কিন্তু সে যখন রোগা ছিল তখনও ছিল না, সে যখন মোটা হয়েছে তখনও নেই।নেই, কিন্তু তাতে বৈর্য হারায় না সে। নিরিবিলিতে এবং একখানা আয়না হাতের কাছে পেলে সে নিজের দিকে চেয়ে বিস্তর গোঁজে। এবং নিজেকে বিরুণ ধমকধামকও দেয়। কিন্তু লোকের সামনে সে গর্মীর মানুষ, কথা বম, ভারী দায়িত্বশীল কাজের মানুষ।সোমেন বা মা কেউ এখনও ওঠেনি। শিস দেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টাটা চালাতে চালাতে সে দাঁতটিতে মেজে নিল, ইসবগুলের ভূষি খানিকটা জলে নেড়ে খেল। মোজা এবং একজোড়া ন্যাকড়ার জুতো পরে বেরিয়ে পড়ল। রোজই সে খানিক সকালে বেড়ায় আজকাল। বীণা তার মেদ কমানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। দরজা ভেজিয়ে শিস দেওয়ার চেষ্টার অবিরল খাদবায়ুর উদ্ভট শব্দটা করতে করতে দে নিচতলার সদর খুলে রাস্তায় পড়ল। ধারেকাছে পার্ক নেই। হাঁটতে হাঁটতে চলে এল যোধপুর পার্কে। ঝিলের ধারে অনেকটা ফাঁকা জমি পড়ে আছে। শোনা যাচ্ছে, একদিন এখানে পার্ক হবে। ফাঁকা জায়গায় পড়েই দ্রুতপায়ে চক্কর দিতে থাকে সে। লক্ষ করে, সে আজ বড্ড সকালেই চলে এসেছে। কাছেপিঠে কেউ নেই। শুধু দূরে দু চারজন খাটালগুলা সেটা হাতে ফাঁকা বিলপুড়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক কাজে। যে দ্রুত চারদিক দেখে নিয়ে লুঙ্গির কেচে নিয়ে ফটাস করে মালকোঁচার মতো এঁটে নিষ। প্রকাণ্ড উরুত দুটো বেরিয়ে পড়েছে, উঁচু হয়ে আছে দাবনা। একটু লজ্জার ভরে ভেড়ে ফেলে পাঁই পাঁই দৌড়োতে দাগল সে। মেদান ঝরাতেই হবে। শরীর বা মজুন একটা গভীর পরিবর্তন দরকার। রণেনের ঠিক রুপেন হয়ে থাকতে ইচ্ছে করে না। বাগিছ নিজের সব ভেঙেচুরে ফেলে হয়ে যেতে ইচ্ছে করে ত্রিম ফিগারের একজন আইকিউটিভ, কিংবা পারসেনালিটিঅলা ডাইরেকটর, কিংবা হেভি ফাঁটের একজন ডিপার্টমেন্টাল সেক্রেটারি। যাহোক কিছু একটা। শুধু ফুড ইনস্পেকটর রণেন লাহিড়ি বাদে।ধু-চক্কর দূরতেই জিব বেরিয়ে গেল। শুকনো টাকরায় লেগে জিরান টকাস শব্দ করে। দু-চারজন বুড়োগুড়ো মানুষ রাস্তায় হাঁটছে, চেয়ে দেখছে তাকে, রণেন দাঁড়িয়ে লুসি নামায়। প্রচণ্ড হামনতে হাঁফাতে বুকে হাত চেপে হৃৎপিণ্ডকে সামাল দেয়-এ’ বাবা র’।যতদূর সম্ভব গম্ভীর হয়ে বাসায় ঢুকল সে। বাচ্চাগুলো এখনও ওঠেনি। মা নার্সিং হোমে বলে ঠাকুমার প্রশ্রয় পায় বড্ড বেশি। বীণা থাকলে ঠিক এই শীতভোরে তুলে দিত, ঠকঠকিয়ে শীতে কাপতে কাঁপতে বাতটাত মেজে সেগুলো পড়তে বসত এতক্ষণে। দেখে
পৃষ্ঠা:৬৪
ভারী কষ্ট হয় রগেনের। কাদিন ঘুমিয়ে দিক। বাচ্চাবেলায় শীতভোরের লেপঘুম যে নী আরামের! আহা, ঘুমোক। সোমেন রান্নাঘরের চৌকাঠে বদে হাই তুলছে। চা ওর প্রাণ। মা কাঁচলে চেপে চায়ের কেটলি নামান গ্যাস উনুন থেকে। রণেন সাধারণত নিজের ঘরে বসে চা খায়, এম। রাজঘরের দরজায় বসে চা-খাওয়া যে কী মৌজের তা বীণার রাজত্বে সে টেরই পায় না। সংসারের কর্তা সকলের সঙ্গে মেঝেয় বসে দুইহাট চা খাবে, বী গন্ধ রবে-তাতে ওজন কমে যায়। আজকাল বীণা নেই। সোমেনের পাশেই মেঝের ওপর থপাস করে বসে সে। আরামের একটা শব্দ তোলে-ওঃ ও। মাজাটায় একটা গ্যাং টের পায়। বুড়ো হাতে দৌড়টা ঠিক হজম হয়নি। সোমেন উটস্থ হয়ে দরে জায়গা দেয়। না কলকা ছাপের খদ্দরের চাদরের মোডক থেকে মাথা বের করে তাকে দেখে। সম্পূর্ণ ব্যক্তিত্বহীন একগাদ হাসে রসেন। বলে-মেরে দিলাম একটা দৌড়।সোমেন হা করে তাকায়। মা বলে-তী বলছিস। কাকে মারলি।রমেন ভারী আমুদে গলায় বলে-যোধপুর পার্কে বেড়াতে যাই তো রোজ, আজ দেখলাম ফাঁকা, কেউ নেই। লুঙ্গিটা কেঁয়ে নিয়ে মারলাম দৌড়। মাজাটা গেছে। ওঃ।-ইস! ওসব দৌড়ঝাপ কি তোর সয়। মা দুঃখের গলায় বলে-তোর হচ্ছে আদুরে ধত।- ওই আদর দিয়ে দিয়েই তো খেয়েছ। এই বয়সে পোয়াতির মতো ছুঁড়ি, নাভুগোগাল বড়গোপাল চেহারা। চা দাও তো।মা একটা শ্বাস ফেলে বলে-আদর আরে দিতে পারি কই? বউয়ের হাতে দিয়েছি, সে বা দিয়ে যা করে। আমাদের কি আর আদর দেওয়ার ক্ষমতা আছে।কী কথর কী উত্তর। তবু গায়ে মাখে না রণেন। প্রায় চোদ্দো বছরের ছোট ভাইটার দিকে চায়। তারই ভাই, তবু চেহারার প্রায় বিপরীত। লম্বা, রোগাটে, চোখা বুদ্ধিমানের চেহারা। অল্প বয়স, দাড়িফাড়িও ঠিকমতো কামায় না, নইলে ঠিকই বোঝা যায় যে ব্যক্তিত্বের চেহারা।রলেন হঠাৎ বলে-বসে না থেকে আহি এ এসটা দিয়ে সে না।সেমেন অবাক হয়ে বলে আই এ এস। আমি।রগেন মাথা নাড়ে। বলে অভকাদ যেন সেথায় ট্রেনিং দেয়।-ইউনিভার্সিটিতে।-ভরতি হয়ে যা। আমি ইঞ্চেৎ দেব। নিশ্চিত গলায় বলে রাখেন।সোমেন সামানা হচ্ছে বাল-বিকাফাকার জন্য নয়। আমার ইচ্ছে করে না।-কেন, ইচ্ছে করে না কেন?-ওসব জুয়ার হবে না। খামোখা চেষ্টা।-দরখ না দেগে যেতে পাবে। বলে খুব ভরসার হাসি হাসে রক্ষেন। বহুকাল এমন সহয়াভাবে কথাবার্তা হয়নি তিনজনে। বীলা নার্সিং হোমে যাওয়ার পর থেকে হচ্ছে। ভাইয়ের দিকে একটু চেয়ে থাকে রণেন। ওই রকম তেইশ চব্বিশ বছর বয়সে তারও কি সোমেনের মতো চেহারা ছিল? অবিকল না হলেও ওরকমই অনেকটা ছিল সে। বহেরণা খামারবাড়িতে সে যেওটের তখন। নয়নতারার সঙ্গে তখন তার একটা সম্পর্ক ছিল।মনে পড়তেই ফুচুক যুদ্বুক একটু হেসে ফেদল সে, আপনমনেই। ব্যক্তিত্বের অভাব। হাসিটা চাপা উচিত ছিল। গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করে বলল বহেরুর ওখানে কাকে কাকে
পৃষ্ঠা:৬৫
দেখলি?সোমেন বলে-কাকে দেখব? হাজারনি লোক, কাউকে আলাদা করে দেখার উপায় কী? তবে গন্ধ বিশ্বেস, দিগম্বর বিরক্ত হরে রণেন বলে-ওরা নয়।-তবে?বহেরুর ছেলেপুলেদের কাকে দেখলি?-চারটে ছেলের সঙ্গে আলাপ হল, আরও সব আছে। একটা মেয়েকে দেখলাম-বিন্দু, ডিভোর্সড।-ডিভোর্সড আবার কী! ওরা ওইরকম, ছেড়ে চলে আসে, আবার বিয়েফিয়েও করে। আইনটাইন মানে না। আমি যখন যেতাম তখন নালতারা নামে একজন ছিল, সেও ওইরকম-সোমেন মাথা নেড়ে বলে-হ্যা হয়, আছে একজন। আলাপ হয়নি। দূর থেকে আমাকে খুব দেখছিল।রখেন আপনমনে হাসে। বহুকাল আগের কয়েকটা দিন মনে পড়ে। নয়নতারা খুব জমিয়েছিল তার সঙ্গে। বেশি কিছু নয় অবশ্য। এই একটু জড়িয়ে উড়িয়ে গরা। দু-চারটে চুমু, আনাড়ির কাজ সব। তবু তোলা যায় না। সে সবের জন্য সে তার পৈতেয় পাওয়া একটা আংটি খুলে নিয়ে এসেছিল নয়নতারাকে। বড়ি এসে একটা ছিনতাইয়ের গল্প বলেছিল। মা অনেকদিন আংটিটার কথা দুঃখ করে বলেছে। আংটিটা তার নামের দুটো আলা অক্ষর মিনা করা ছিল–আর এল। আংটিটা কি আজও আছে নয়নতারার আঙুলে, বা বাজে। ভারী বিহ্বল লাগছিল ভাবতে।সুখের স্বপ্নটা ভেতে হঠাৎ চমকে ওঠে রখেন। ভারী ভয়-ভয় করে হঠাৎ। আংটিটা কি এখনও রেখেছে নয়নতারা। সর্বনাশ ওই আংটি দিয়ে যে এখনও অনেক কিছু প্রমাণ করা যায়। রণেন মনে মনে নিজেকে সান্ত্বন দিয়ে বলতে থাকে অবশ্য, বেশি কিছু নয়, বেশি কিছু নয়। সবই আনাড়ির কাজ, ছেলেমানুষি ইত্যয়নি।চায়ের সুঘ্রাণ এবং তাদের তিনজনের এই কাছাকাছি বসে থাকা বেশ ভাল লাগছিল রণেনের। বলল সোমেন, কাল তুই রবৎ নার্সিং হোমে যাস, বউদিকে দেখে আসিস। আমি বরং বদল একবার বাবাকে দেখতে বাই।সোমেন বলল তোমার সাওয়ার কী দরকার? আমিই বরং-না, না। কার বৃত্রিপদ্য গাছে। আমিই যাব’ঋন। অনেককাল যাই না। বাবাকে দেখে আদি, বহেকটাও পঞ্চশড করছে- মা বলে (রটিমাকে আর কদিন রাখবি ওখানে।-আছে থাক না। রদেন অন্যমনস্কভাবে বলে-বেশ তো আছে। বলেই নিজের ভুল বুঝতে পেরে কথা উলটে বলে ডাক্তার ঠিক এখনই ছাড়তে চাইছে না। মা একটু অনুযোগ করে-তোনের সর্বটাতেই বাড়াবাড়ি। ঘাট বলতে ডাক্তার। ছট বলতে নার্সিং হোম। মেয়েরাও কেমনধারা হয়ে গেল, সজ্ঞান অবস্থায় একটা পরপুরুষ ডাক্তার মেয়েদের শরীরে হাত দেবে এ কেমন কথা! পেটে বাচ্চা এলে দশবার চেক-আপ, লজ্জা হায়া কোথায় যে গেল। তুই নিয়ে আয় তো, কিছু হবে না। সোমেন এসব শুনে উঠে পড়ে। রগেন হাসে। বলে-ভাক্তাবই ছাড়তে চাইছে না যে।
পৃষ্ঠা:৬৬
-কেন। স্রাব বন্ধ হয়ে গেছে, অপারেশনও যখন দরকার নেই, তখন আর গুচ্ছের ঢাকা শুনবি কেন?-অপারেশন। বলে একটু চোখ বড় করে চায় রখেন। বলে-একটা মাইনর অপারেশন দরকার ছিল বটে।-তা না হয় সেটাই করিয়ে আন।-পাগল হয়েছ। ওখানকার ভান্ডার হচ্ছে সাহা। এমনিতে ডাক্তার ভাগই। কিন্তু দিনরাত কেবল খাওয়ার গল্প। অমন ইলিশ-ভাক্ত লোক দুটো নেই। আমাকে প্রায়ই বলে– পদ্মার ইলিশ। ও আর উনুনে চড়াতে হয় না, একটু তেল-সরষেবাটা মেখে বগলে চেগে রাখুন, বগলের ভাগেই সেদ্ধ হয়ে যাবে-এত নরম সুখী মাছ। বলতে বলতে বুঝলে না, ডাক্তারের চোখ দুখানা স্রেফ কবির চোষ হয়ে গেল। উদাস, অন্যমনস্ক। হাত থেকে স্টেথেসকোপের চাকরিটা পড়ে গেল ঠকাস করে, চশমা খুলে বুঝি চোখের জলও মুছল। সেই থেকে অপারেশনের নামে আমি ভয় পাই। রুগির শরীরে ছুরি বসিয়ে যদি লোকটার হঠাৎ ইলিশের কথা মনে পড়ে, যদি ওরকম অন্যমনস্ত আর উদাস হয়ে যায়, তা হলে তোমার বউমার কী হবে।সোমেন যেতে যেতেও শেটুকু শুনে হেসে ফেয়ে। মা স্মিতমুখ ফিরিয়ে নেয়।বেলায় অফিস কেরুনোর সময়ে রণেনের মাজার ব্যথাটা যেমন খচাং কাল একবার জুতোর ফিতে বাঁধার সময়ে, তেমনি তার মনেও একটা খচাং খিচ ধরল হঠাৎ। সে যে বউয়ের নামে জমিটা কিনতে চেয়েছে এটা মা জানে না তো। নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য সে বেরোবার মুখে জিজ্ঞেস করল-ওরা কেউ এসেছিল নাকি না?-কারা?শীলা, কিংবা অজিত।মা বিরক্তির শ্বাস ফেলে বলে আসবে কী। সেখানেও আদেখলাপনার চূড়ান্ত।-কেন?-মেয়ের নাকি পেটে বাচ্চা এসেছে। ডাওণর বলেছে পাঁচ মাস পর্যন্ত নড়চড়া বারণ। আমাই ডানলোপিলোর কুশন কিনে তিনরাত মেয়েকে শুয়ে থাকার কড়া আইন করেছে। পাশের বাড়িতে ফোন করে জামাই জানিয়ে দিয়েছে, মেয়ে এখন আসবে না।-ওঃ। বলে রসেন নিশ্চিন্তমনে বেরোয়। পাঁচ মাসের জন্য নিশ্চিন্ত।কিন্তু বাসরাস্তার দিকে ছটিতে ইটিতে তার হঠাৎ মনে পড়ে নিশ্চিন্ত। দূর বোকা। নিশ্চিন্ত কাসের। শাস্ত্রে ঘটনাটো মাও তো যেতে পারে ওদের বাড়িতে।সমস্যাটা ভেবে সে একটু থমকায়। তারপরই আবার দার্শনিক হয়ে যায়। জানবেই তো, একদিন তো জড়াবেই।যেমন সুন্দরভাবে দিনটা শুরু হয়েছিল সেভাবে শেষ হল না।কলকাতায় আজকাল ব্যাঙের ছাতার মতে। নার্সিং হোম গজিয়ে উঠেছে। দোকানঘরের ওপরে, কারখানার পাশে, অফিসবাড়িতে সর্বত্রই নার্সিং হোম। ভাল ব্যাবসা। বীণকে যে নার্সিং হোমে ভরতি করেছে রণেন সেটাও একটা এরকমই জায়গা। মধ্য কলকাতার জরাজীর্ণ বাড়িতে ঝকঝকে সাইনবোর্ড লাগানো। নীচের তলায় সামনের দিকে কাপড়ের দোকান, পিছনের দিকে এক আমুদে অবাঙালি পরিবারের বাস, দোতলায় নার্সিং হোম,
পৃষ্ঠা:৬৭
তিনতলায় বোধ হয় কোনও পাইকারের গুদাম। নীচের তলায় সবসময়েই হয় রেডিয়ো, নয়তো স্টিরিও কিংবা পিয়ানো অ্যাকোর্ডিয়ান রেওয়াজের শব্দ হচ্ছে। ওপরতলায় কুলীদের মালপত্র সরানোর শব্দ। সামনের রাস্তাতেও কোনও নৈঃশব্দ্য নেই। ট্রাম এইখানে বংক নেয় বলে প্রচণ্ড কচকোচ শব্দ তোলে। লরির হর্ন শোনা যায়। শীতের শুকনো বাতাসে পোড়া ডিজেল, ধুলো আর আবর্জনার গন্ধ আসে অবিরল। তবু নার্সিং হোম।রক্ত বন্ধ হয়েছে। বীণাকে একটু ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে, তবু সামলে উঠেছে অনেকটা। রণেনকে দেখে একটু কর্কশ স্বরে বলল-টুবাইকে আজও আনলে না?রণেনের মেজাজ ভাল নেই। ভিতরে নানারকমের অস্থিরতা। তবু মাথা ঠান্ডা রেখে বলল-কেমন করে আনব? আমি সোজা অফিস থেকে আসছি।অফিস থেকে আসছি, অফিস থেকে আসছি-রোজ এক কথা। বীণা মুখ ঘুরিয়ে নিল।ট্রামবাসের অবস্থা তো জানোই। বাসায় ফিরে টুবাইকে নিয়ে আসতে আসতে ভিজিটিং আওয়ার্স শেষ হয়ে যেত।বাঁদা ঝেঁঝে ওঠে-ভিজিটিং আওয়ার্স না হাতি। সারাদিন রাজ্যের লোক আসছে যাচ্ছে। পরশু এক ছুঁড়ি ভরতি হয়েছে, তার কাছে সারাদিনই দু-তিনটি ছোড়া আসছে, ফুল, ক্যাডবেরি, সিনেমার কাগজ দিয়ে যাচ্ছে, গুজগুজ ফুসফুস করছে তারা আসছে কী করে? আর তোমার অফিসটাই বা কোন জেলখানা? সারাদিন তো টো-টো করে বেড়ানোই তোমার চাকরি। একটু আগে বেরিয়ে টুবাইকে নিয়ে আসতে পারলে না?এরকম ভাষাতেই বীণা আজকাল কথা বলে। রখেন চুপ করে থাকে। আসলে রাগটা তার সোমেন আর মার ওপর গিয়ে পড়ে। পরশু থেকেই সোমেনকে বলছে বুবাই, টুবাই আর শানুকে নিয়ে একবার নার্সিং হোমে তাদের মাকে দেখিয়ে যেতে। ট্যাক্সি ভাড়াও কবুল করা ছিল। সোমেন, তেমন উৎসাহ দেখায়নি। মাও আপত্তি করেছে-মোটে তো তিনদিন হল গেছে, এর মধ্যে ছেলেমেয়েদের জন্য হেদিয়ে পড়ার কী। গুদের তো মায়ের জন্য কিছু আটকাচ্ছে না।তা ঠিক। বীপাকে ছাড়াও ছেলেমেয়েদের কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। মা যক্ষীপুড়ির মতো সংসারের সব কিছু আগলে রেখেছে।রাণেন চুপ করে ছিল। বীণ মুর্ষ ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করে-ডাক্তার কী বলল?-আরও কয়েকদিন ভূইঞ্জনে রাখতে বলছে।-আরও কয়েক দিন রাখতে বলার মানে জানো? টাকা মারার ধান্ধা। আমি থাকব না।তুমি ট্যাক্সি অবৌ, আনি আজই চলে যাব।-ডাক্তারের অমতে কি যাওয়া ঠিক হবে?-হবে। আমি ভাল আছি। ছেলেমেয়ে না দেখে আমি থাকতে পারি না। এখানকার অবাদ্য খাবারও মুখে দিতে পারি না, দু’দিন প্রায় উপোস যাচ্ছে। তুমি ট্যাক্সি ডাকো।-ব্লিডিংটা মোটে কালই বন্ধ হয়েছে, দুটো দিন থেকে যাও।-না। বলে বীণা মাগা নাড়ল। তারপর অভিমানভরে বলল আমার তো এমন কেউ আপনজন নেই যে বাড়ি থেকে রান্না করা খাবার দিয়ে যাবে রোজ। এখানে সকলের বাড়ি থেকে ভাত আসে, আমাকেই কেবল এদের হাতের অখাদ্য রান্না খেতে হচ্ছে। রদেন একটা শ্বাস ফেলে বলে-পরশু নিয়ে যাব। কথা দিচ্ছি।
পৃষ্ঠা:৬৮
বীণ্য অবাক হয়ে বলে-পরশু? মাধ্য যারাপ। এই নরকে আর এক রাতও নয়। তুমি আমাকে এখানে রেখে কী করে নিশ্চিন্ত আছো? সুস্থ মানুষ এখানে অসুস্থ হয়ে পড়ে। আনি আজই চলে যাবে। মলিন মুখে ওঠে।ইলিশের কবি ভাক্তার সায়া পাঁইগুই করল বটে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছেড়েও দিল। ট্যাক্সিতে ওঠার পর, বীদার যেটুকু অসুস্থতা ছিল সেটুকুও ঝরে গেল। দিব্যি এলিয়ে বসে বাইরের দিকে চেয়ে রইল একটুক্ষণ, মুধ না ঘুরিয়েই বলল-অজিতবাবুর সঙ্গে কথা বলেছ? বলেছি।কী বলছে?-কী আবার। ও তো বাজিই।শীলা কী বলল। কী বলবে?-জনিটা আমার নামে কিনতে চাও শুনে কিছু বলল না।-না। তবে আমি কাল এককার বাবার কাছে যাব। বীশা মুখ চবিতে ঘুরিয়ে প্রশ্ন করে-কেন?-বাবার শরীর খারাপ, একবার দেখে আসি।৬। বলে মুখ ফিরিয়ে নিল বীণা। তারপর একটু চুপ করে থেকে গলা আর একটু মৃদু, এবং আর একটু কঠিন করে বলল-শীলার কথায় হঠাৎ হুট করে বাবার কাছে যাওয়ার কথা বগলে কেন।শুণেন এত সাংসারিক বুদ্ধি যাবে না। তর্কও তেমন আসে না তার। একটা খাম ছেড়ে বলল-বাবা যদি কলকাতায় আসতে পারেন তবে জমিটা বাবার টাকাতেই কেনা হবে, মার নামে।-তাই বাবাকে দেখতে যাচ্ছ।বীনা তার চোখে চোখ রেখে তেমনি কঠিন গলায় ওলে সেজন্যই আমাকে আরও দু-দিন নার্সিং হোমে ফেলে রাখতে চেক্সেরছিলে, যাতে। কাছে গেছ? আমি জানতে না পারি যে তুমি ঋবার কথাটো ঠিক। বীণার বুন্ডির রবীশংসাই করতে হয়। তবু রণেন এবটু রেগে গেল। বলল- কেন, তোমাকে ৬৪রিয়ে গুলি নাকি। বাবার কাছে খাওয়াটা কি দোষের কিছু?তবে যা খুশি করো, কিন্তু আমার কাছে লুকচ্ছ কেন? রণেন উত্তেজিত হয়। মুখে কিছু বলতে পারে না, কিন্তু চঞ্চল হাতে একটা সিগারেট ধরায়। বীও চেয়ে আছে মুখের দিকে, জবাব চাইছে। রণেন গাল্যা ঝেড়ে বলে-লুকোইনি। জমিটা মার নামে কেনা হবে বলে ঠিক হয়েছিল, এখন হঠাৎ তোমার নামে কেনা হলে খারাপ দেখায়।-খারাপ লাগবে কেন? বাবা কলকাতায় আসতে পারছেন না, অজিতবাবুও জমি বিক্রির
পৃষ্ঠা:৬৯
জন্য সময় দিচ্ছেন না। সেক্ষেত্রে জনিস আমি তোমার টাকা দিয়ে কিনে নিতে বলেছি। রাতে দোষের কী? আর তোমার টাকা দিয়ে যদি কেনা হয় তবে মার নামে বেনা হবে কেন? যদি আমার নামে নাও কেনো, তুমি নিজের নামে কিনবে।-তাতে মা খুশি হবে না। মা চেয়েছিল, আমাদের দুই ভাইয়ের নামে কেনা হোক, তামি বলেছিলান, মার নামে কেনা হোক।-সে হত যদি শ্বশুরমশাই টাকা দিতেন। তিনি যদি না দেন তবে অমন সত্তার সুন্দর জমি তো হাতছাড়া করা যায় না।-মার ইচ্ছে দুই ভাইয়ের অংশীদারি থাক।বীণা অতান্ত বিদ্যুৎগর্ভ একটু হেসে বলে-তার মানে মা তোমাকে বিশ্বাস করেন না। তাঁর ধারণা, সোমেনকে তুমি আলাদা করে দেবে।রণেন সেটা জানে। তাই উত্তর দেয় না।বীণা বলল–একটা কথা বলি। যদি শ্বশুরমশাই শেষ পর্যন্ত টাকা দেন আর জমিটা যদি মা কিংবা তোমাদের দুই ভাইয়ের নামেই কেনা হয়, তা হলেই ব্য বাড়ি করার টাকা দিচ্ছে কে? ওই দশ হাজারে জমির দাম দিয়ে যা থাকবে তাতে তো ভিতটাও গাঁথা হবে না। যেমন-তেমন বাড়ি করতেও ত্রিশ-চল্লিশ হাজার টাকার বাকা। জমি যদি মায়ের নামে হয় বাড়িও তাঁর নামেই হবে, ভাগীদার তোমরা দুই ভাই। বাড়ির টাকার অর্ধেক তা হলে হয় মার দেওয়া উঠত, নইলে দেওয়া উচিত সোমেনের। তারা কি দেবে।-কোথেকে দেবে?-তা হলে তোমাকেই দিতে হয়। তুমি যদি বাড়ি তৈরির পুরো খরচ দাও তা হলেও পুরোটর কোনওদিন ভোগ করতে পারবে না। অর্ধেক দাবি সোমেনের। তা হলে ওই ভাগের জমিতে তুমি বাড়ি করার খরচ নেবে কেন?রধেন মুক্তিটা বোঝে। কিন্তু মানতে চায় না। তার মাথায়, এবার বৃদ্ধিতে কেবলই একটা কথা খেলা করে যে, এই যুক্তিতে একটা মস্ত বড় অন্যায় রয়ে গেছে। কিন্তু সেটা ঠিক ধরতে ঋরে না রদেন। কিছু বলতেও পারে না। কিন্তু ছটফট করে। বীণা আর কয়েকদিন নার্সিংহোমে থাকলে সে ঠিকই অন্যায়টা বুঝতে পারত। বাড়িতে ঢুকবার আগে রাখেন তার হুইকর গাড়ীর্দের মুখোশটা মুখে এঁটে দিল। আবার।
দশ
মাক্সি থেকে নেমে কথা একবারও পিছু ফিরে ন না চেয়ে বাসার সদরে ঢুকল এবং সিয়ি বেয়ে উঠবার চেষ্টা করতে লাগল। একটু থেমে থেমে, রেলিঙে ভর রেখে, খুব ধীরে ধীরে উঠছিল সে। পিছনে রখেন, তার এক হাতে ফোলিও ব্যাগ, অন্য হাতে প্লাস্টিকের ঝোলায় বীণর জিনিসপত্র। দুটো ব্যাগ একহাতে নিয়ে অন্যহাতটা বাড়িয়ে বীণার হাত ধরল যে, সাহায্য করতে চেষ্টা করল। বইশা হাতটা থাকিয়ে তির ওরে বলে আং, ছাড়ো। লাগছে। লাগার মতো ভোরে ধরেনি রণেন, তবু অপ্রস্তুত হয়ে ছেড়ে দিয়ে বলে-একা উঠতে পারবে? কষ্ট হচ্ছে তো।-হোক। অনেক উপকার করেছ, আর করতে হবে না। বীণা বলে।
পৃষ্ঠা:৭০
টায়ক্সিতে শেষ দিকে তাদের কথাবার্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বীণা চুপচাপ বাইরের দিকে চেয়ে বসেছিল। রণেনকে দরকার মতো উপেক্ষা করার একটা নিজস্ব ভঙ্গি আছে বীদার। মুখটায় একটু দুঃখী ভাব করে ছলছলে চোখে অন্যদিকে চেয়ে থাকে। মনে হয় বুঝি অভিমান। তা নয়। তখন সেই অভিমান ভাঙতে গেলেই অনর্থ ঘটে। ভঙ্গিটা দেখেই রণেন মনে মনে বিপদের গন্ধ পেয়েছিল তখনই। থেমে থেমে অনেকক্ষণ ধরে সিঁড়ি ভাঙে বীণা। মাঝে মাঝে কাতর ব্যথা-বেদনার শব্দ করে-উঃ বাবা। রণেন ধৈর্য ধরে পিছনে অপেক্ষা করে। বীশাকে ধরে তুলবে তার উপায় নেই। ছুঁতে গেলেই ও নির্দয় অপমান করবে। দরজা খুলে ননীবালা অবাক হয়ে বলেন-চলে এলে। বীণা উত্তর দিল না। দরজার চৌকাঠে হাতের ভর রেখে দাঁড়াল একটু। ননীবালা সরে গিয়ে বলেন-ঘরে এস। বাচ্চারা ঠাকুমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। টুবাই মাকে দেখে ভারী খুশি হয়ে ‘মা’ বলে চিৎকার করে দু’কদম এগিয়ে গিয়েছিল, ননীবালা তাকে টেনে রেখে বলেন-ফুঁস না, অশৌচ। তারপর রখেনের দিকে চেয়ে বলেন বউমাকে ঘরে নিয়ে আয়। আমি গরম জল করে দিচ্ছি, তুই স্নান করে ফেলিস।বীণা কোনও কথা না বলে তার ঘরে চলে গেল, তার ঠাস করে ভিতর থেকে বন্ধ করে দিল দরজা। অপ্রস্তুত অবস্থা। ননীবালা অপমানটা হজম করতে পারছিলেন না। ছেলের দিকে চেয়ে বলেন-কি জানি বাবা, আমরা তো এ অবস্থায় আঁতুড়-অশৌচ দুই-ই মানি। এতে রাগের কথা কী হল?রখেন ব্যাগটাাগ বাইরের ঘরের টেবিলেই রাখে। জামাকাপড় ছাড়তে পারে না, কারণ ঘরের দরজা বন্ধ। অগত্যা একটা গামস্থ্য জড়িয়ে সোফা-কাম-বেডটার ওপর বসে থাকে। ননীবালা চা করতে করতে রান্নাঘর থেকে ডেকে বলেন-বউমাকে জিজ্ঞেস কর তো চা খাবে নাকি।রখেন অবশ্য সে চেষ্টা করে না। তখন বুবাই উদ্যোগী হয়ে গিয়ে দরজায় ধাক্কা দেয়- মা, ও মা, চা খাবে। ঠানু জিজ্ঞেস করছে। মা, ও মা, খাবে? খাবে না?বাচ্চাদের যা স্বভাব, মা দরজা খুলছে না, মা দরজা খুলছে না, কাজেই বুবাই ক্রমান্বয়ে দরজা ধাক্কায়, আর ডাকে। তার সঙ্গে জুটে যায় টুবাই আর শানুও। তিনজনে তুলকালাম করাঘাত করে দরজায়। তাৰুজবে ডাকে। টুবাই দৌড়ে এসে বাপকে বড় বড় চোখ করে বলে যায়-দরজা খুলছে না মী অজ্ঞান হয়ে গেছে। গত লক্ষ্মীপুজোয় সারাদিন উপোসের পর ভোগ-টোগ রেখে পিত্ত আর অম্বলে কাহিল হয়ে ননীবালা অজ্ঞান হয়ে যান। সেই অভিজ্ঞতা থেকে টুবাইরের ধারণা, কেউ বন্ধ ঘর থেকে সাড়া না দিলে, বা ঘুমন্ত অবস্থা থেকে সহজে চোখ না মেললে সে নিশ্চয়ই অজ্ঞান হয়ে গেছে।তিনজনের ওই ধাক্কাধাক্কি আর ডাকাডাকির বাড়াবাড়ি দেখে ননীবালা উঠে এসে ধমকানও রকম করিস না, মেজাজ ভাল নেই, উঠে আবার মারধর করবে।ঠিক তখনই বীণা দরজা খোলে। ক্লান্ত চেহারা, দরজাটা ধরে দাঁড়িয়ে, ডান হাতে পাখার ডাঁটটা তুলে এলোপাথাড়ি কয়েক ঘা কসায় বাচ্চাগুলোর মাথায়, গায়ে, শ্বাসের সঙ্গে চাপা চিৎকারে বলে-যাঃ যাঃ, আপদ কোথাকার। জন্মে কখনও শুনিনি পাঁচ মাসের আগে বাচ্চা নষ্ট হলে কেউ আঁতুড় বা অশৌচ মানে। আমার বেলা যত নিয়ম। যাঃ যাহ, খুবি না আমাকে,
পৃষ্ঠা:৭১
ধারেকাছেও আসবি না। বীণার মূর্তি দেখে ননীবালার কথা জোগায় না। রণেন চায়ের কাপে চোখ রেখে বাসে থাকে। বীণা দরজাটা বন্ধ করতে যাচ্ছিল, তখন ননীবালা বললেন-তা আমি কি জানি ক’মাস। আমাকে কি তোমরা কিছু বলো।বীখ্য তীর চোখে বলে-পাঁচ মাসে পঞ্চামৃত হলে আপনি তা জানতে পারতেন না? কচি খুকি তো নন। ঢের বয়স হয়েছে।রঙেন বুঝতে পারে, মা একটা ভুল করেছে কোথাও। এ সব মেয়েলি ব্যাপার তার মাথার ঢোকে না, কিন্তু এটুকু বুঝতে পারে হয় ননীবালা ভুল করে কিংবা ইচ্ছে করেই আঁতুড় আর অশৌচের কথাটা তুলেছেন। সম্ভবত ননীবালার ধারণা ছিল যে, বীণা একালের মেয়ে, এত সব খুঁটিনাটি সে জানে না। কিন্তু ইচ্ছে না ভুল তার বিচার হবে কী করে? সংসারের কর সত্য কথা কোনওদিনই জানা যায় না। ননীবালা এক পরদা গলা নামিয়ে বলেন-অশৌচ না মানলেও হাসপাতালের ছোয়াটোয়া তো মানবে। না কি তাতেও দোষ।তীর কণ্ঠে বীণ্য উত্তর দেয় দোষ কিনা তা আপনিই জানেন! আমার বেলায় হাজার। দোষ, হাজার নিয়মনিষ্ঠা। কিন্তু কারো দরদ তো দেখি না। নার্সিং হোমে বুবাইয়ের বাপ ছাড়া কেউ একদিন উকি দিয়েও দেখে আসেনি, এক বেলা কেউ ঘরের ভাত পৌঁছে দিয়ে আসেনি ! আর দুর্বল শরীরে ঘরে পা দিতে না দিতেই আচার-বিচার শুরু হয়ে গেল।রণেন এইটুকু শুনেছিল। চায়ের কাপ রেখে সে দ্রুত বাথরুমে গিয়ে ঢুকে পড়ে। নদীবানা গরম জল করে দেওয়ার সময় পাননি, কাজেই শীতে হিম হয়ে থানা জল তুলে রণেন তার উত্তপ্ত মাথায় ঢালতে থাকে। স্নানের দরকার ছিল না। জলের শব্দে ঝগড়ার শব্দটা ডুবিয়ে দিল কেবল।ননীবালা অবশ্য পিছিয়ে গিয়েছিলেন। ঝগড়াটা তাই বেশি দূর গড়ায়নি। জানটান করে এসে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে রণেন দেখে, বীণা মূখ ফিরিয়ে শুয়ে আছে, বুকের কাছে টুবাহ। টুবাই ছোট, তার অপমান জ্ঞান নেই, কিন্তু বড় দুজন মার খেয়ে ঠাকুমার ঘরে ঢুকে গেছে, সেখান থেকেই তাদের গলার শুভ পাওয়া যাচ্ছিল।চুল পাট করতে করতে রণেন ক্রয় ব্যক্তিত্বের ঘাটতিগুলা মুখখানা দেখছিল। কিছু কক্তিত্ব যদি এই মুখশ্রীতে থাকৃত তবে এই সংসারটাকে আঙুলের ডগার সঞ্চালনে শাসন করতে পারত সে। বাপের বৃঢ় ছেলে বোকা হয়- এটা একটা প্রচলিত কথা। তার নিজের ক্ষেত্রে কথাটার ব্যবচ্ছ জয়নি। সে বোকাই। এবং বোকা বলেই ব্যক্তিত্বহীন। এ সবই বুঝতে। পারে রণেন। রঞ্জগোপালের উপেক্ষিত সংসারটি সে টানছে আজ বহুদিন। কিনা প্রশ্নে এবং কিনা দ্বিধায়। মা-বাপ-ভাই মিলে এ সংসার তো তারই নিজস্ব সংসার ছিল এতকাল। শুধু সংসার নয়, এ ছিল তার অস্তিত্ব, তার বেঁচে থাকা। মায়ের জন্য মঠ-মন্দির গাড়ি-বাড়ি সবই সে করে দিতে চেয়েছিল মনে মনে, এতকাল। কোনও দ্বিধা ছিল না, সংশর হল না। সকলে কলত রণেনের মতো এমন মাতৃভক্তি দেখা যায় না। সেই ভক্তিটা এখন আর তেমন টের পায় না রণেন। সংসার টানতে আজকাল তার কষ্ট হয়। কত ব্যয়কে মনে হয় অপব্যয়। বাবার টাকায় মায়ের নামে কেনা জমিতে নিজের টাকায় বাড়ি করা যে কত বড় মূর্ণতা তা অনায়াসে বুঝতে পারছে। তাই বীণার পরামর্শে চোরের মতো সে গিয়েছিল অজিতের কাছে, জমিটা বীণার নামে বেনার জন্য। সেই গ্লানিটাও তাকে চেপে ধরে। ব্যক্তিত্বহীনদের
পৃষ্ঠা:৭২
এই রকমই সব হয়। ভাল বা মদের বোধ নষ্ট হয়ে যায়। কী যে করবে, কী যে কয় উচিত তা সে ভেবে পায় না। অনেকক্ষণ বে-খেয়ালে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে সে। তার পুরনো স্বভাব। যায়না পেলে প্রায়ই তার কহাজ্ঞান থাকে না। বিরক্ত হবে বীণা বলল-আলোটা নিবিয়ে দাও, চোখে লাগছে। অপ্রস্তুত হয়ে সে আলো নেবায়, আর অন্ধকারে বীণার বাঁকা গলার স্বরটা আসে- দিনরাত মুখ দেখা, তাও যদি দেখার মতো মুখ হত। এ সবই উপেক্ষা করতে পারে রখেন। তার স্বভাব শাস্ত্র, রেগে গেলেও সহজে চঞ্চাশ পায় না তবে রাগ। কথা কম বলে। সে বীণাকে অন্ধকারে শুয়ে থাকতে দিয়ে বাইরের ধরের সোফা কান-বেডটায় একটু কেতরে বসে থাকে। রেডিরোটা চালিয়ে দেয়। খবর হচ্ছে। একটা যুদ্ধ টুদ্ধ লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা। চারদিকে টেনশন, কিন্তু দেশের খবর রকে বিন্দুমাত্র চিন্তাষিত করে না। সে নিজেকে নিয়ে ভাবে। ভাবতে ভাবতে ঘুম-ভাব এসে যায়, রেডিয়োটা চলতেই থাকে। হঠাৎ চমকে উঠে শোনে পুরুষ-হাতে রেডিয়োটা বন্ধ করে দিল বীণা। ঝাঁক-গলায় বলে-এই কপাল কুষ্টিটা খুলে রেখে ঘুমস্থ্যে কেন? ব্যাটারি নষ্ট হয় না। বদেন চোখ চায়। বীণ্যর ক্লান্তির ভাবটা কি কেটে গেল। ঘরের আসবাবপত্র টেনে টেনে সরাচ্ছে আর আপনমনে করছে-কদিন ছিলাম না, নোংরার হদ্দ হয়ে আছে ঘররের। স্কুল-কালি-বুলো, বিছানাপত্র ও হয়ে আছে বলতে বলতে আবার ও ঘরে যায়, আদনা ইটিকে জামা-কাপড় ছুঁড়ে ফেলে মেঝেয়-আন্ডারওয়্যার, গেঞ্জি কী কালেকুেরি হয়ে আছে। আমাকে আবার আচার-বিচার শেখাতে আসে সব। নোংরার হন্দ, বস্তিগুড়িতে গিয়ে থাকা উচিত। বখেন বুঝতে পাবে, এসব কথা শোনানোর জন্যই তাকে জাগিয়ে নিয়েছে বীলা। এখন সে যুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে। সহজে ছাড়বে না। বিষয় মনে রদেন বসে শোনে, বীল্য ও-মরে ছেলেমেয়েদের ডেকে নিয়ে বলছে-কী সব চেহারা হয়েছে এ কদিনে। গার না নাকি তোরা। হাড় জিরজির করছে। কনুইতে ময়লা, ঘাড়ে ময়লা, চোখে পিচুটি, নতে খ্যাতগা কেউ এএসব দেখে না নাকি। এই শীতে গায়ে গরম জামাও কেউ পরায়নি। ননীবালা গ্যাসের উনুনের সামনে বুকে আছেন নিশ্চুপে। কিন্তু সেটা তাঁর পরাজয় মেনে নেওয়া মনে করলে ভুল হবে। মনে মনে তিনিও তৈরি হচ্ছেন, লেগে যাবে। রখেন উঠে বসল এবং দীপার উদ্দেশ্নে একটা দুর্বল ধমক দিয়ে বলল-আঃ কী হচ্ছে। চুপ করে শুােইয়ে থাকো না বীণা প্রায় হারিয়ে আসে-কেন চুপ করে থাকব? এই ঘর-সংসারে আমি কি ফ্যালনা। আমার কলার কথা কিছু থকতে পারে না। -এই দুর্বল শরীরে অভ চেঁচিও না। ডাক্তার তোমার ওঠা-ছাঁটা বেশি বারণ করেছেন। -থাক, অত দরদে কাজ নেই। মুখের দরদ অনেক দেখা আছে। এইভাবে শুরু হয়েছিল। ননীবালা কেন যেন উত্তর দিচ্ছেন নাং চুচাপ আছেন। বীণা গনগন করে যেতে লাচলে একা একা। দু-চার ঘা বাচ্চাদের মারধরও করল শোওয়ার ঘরে। বোঝা যায়, সে নদীবালকে উত্তেজিত করে ঝগড়ায় নামাতে চাইছে। একটা হেস্ত-নেপ্ত করাই তার উদ্দেশ্য। ক্রমে ক্রমে তার কথাবার্তায় মরিয়া ভাব ফুটে উঠতে লাগল, রাখেন
পৃষ্ঠা:৭৩
শুনতে পায় শোওয়ার ঘরের ভেজানো দরজার ওপাশে বীণ্য চাপ্য গলা। বলছে-পাগলের গুছি। দ-পড়া কপাল না হলে কারও এরকম শ্বশুরব্যতি হয়।বহুকাল আগে রদেনের একবার কড়া খাতের টাইফয়েড হয়েছিল। তখন টাইফয়েডের চিকিৎসা ছিল না। গ্রামে-গঞ্জে ডাক্তার-কবিরাজও ছিল না সুবিধের। প্রায় বাহান্ন বিনে তার জ্বর কমেছিল বটে, কিন্তু কিছুকাল তার বিকারের অবস্থা হয়েছিল। জ্বরের পরও প্রায় মাস তিনেক সে মস্তিকবিকারে ভুগেছে। লোকে বলে টাইফয়েডের পর ওই পাগলামির সময়ে সে মা-বাপকে চিনতে পারত না, নিজের বাড়ি কোথায় বলতে পারত না। সেই পাগলামি সেরে যাওয়ার পর রগেন খুব ঠান্ডা আর ভালমানুষ হয়ে যায়। কিন্তু সে যে একদা পাল হয়ে গিয়েছিল এই ঘটনাটা সে কোনওদিনই ভুলতে পারে না। মাঝে মাঝে তার মনে হয় পাগলামিটা ছাই চাপা হয়ে আছে তার অভ্যন্তরে। সেই কারণেই কেব হ্যা আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে চেয়ে আজও এই বয়সেও সে নানা অঙ্গভঙ্গি করে, ব্যক্তিত্ব পেঁৗন্ডে, ফাঁকা মাঠ পেলে ছেলেমানুষের মতো দু-চক্রর দৌড়ে নেয়, কিংবা একাবোকা অবস্থায় সে এরকম অনেক কিছুই করে। ‘পাগল’ কথাটা শুনলেই বরাবর একটু চমকে ওঠে। তার বুকের ভিতরে একটা ভয় যেন হনুমানের মতো এ-ভালে ও-ডালে লাফিয়ে বেড়ায়।সে উঠে শোওয়ার ঘরের দরজার কাছে গিয়ে বলল-শোনো, এত অশান্তি কোরো না। যদি বাড়াবাড়ি করো, তা হলে আমি বেরিয়ে যাব। বীলা টুবাইকে হাত-মুখ ধুইয়ে এনে গরম পোশাক পরাচ্ছিল ইটু গেড়ে বসে। মুখ না ফিরিয়েই বদে-তুমি বেরিয়ে যাবে বলে ভয় দেখাচ্ছ কাকে? তুমি কবে ঘরে থাকো, কতক্ষণই বা থাকো? ঘরের কোনও খবর কি তোমার কানে যায়? যেতে হয় যাও, আমাকে চোখ রাঙাতে এস না। আমি আর ও-সব গ্রহা করি না। অগত্যা বেরিয়েই গেল রনে। শীতের রাস্তায় রাস্তায় খানিক ইটল। মাঘাটটা গরম। মোড়ে দাড়িয়ে সিগারেট খেল। দু-চারজন চেনা পাড়ায় লোকের সঙ্গে কথাবার্তা বলল। সোমেন তার আড্ডা সেরে ফিরছিল। বাও হয়েছে। রণেনকে রাস্তায় দেখে সিগারেট লুকিয়ে নতমুখে পেরিয়ে যাচ্ছিল, রণেন তাকে ডাকল। এত রাত করে ফেরে, একটু শাসন করা দরকয়ে। দিনকাল ভাল নয়। এভ রাত করে ফিরিদ কেন? বেকের চিন্তা হয় না? সোমেন তার কমনীয় সুন্দর মুগঞ্জে স্কুলে হাসল। হাসিটি ভুবন-ভোলানো। রখেন শাসন করতে গিয়ে মুগ্ধ হয়ে যাজু। পোমেন বলে একটা পিকনিকে যাব কাল, তমা সব জোগাড়যন্ত্র করছিলাম, এষ্ট্র দেরি হয়ে গেল।বদেন গলার্থালোরি দেয়। ভাইসকে সে কোনওদিনই কড়া কথা বলতে পারে না। কড্ড মায়াবী। আ্যকলিকার এই ব্যাদের ছেলেদের যেমন ডোন্টপরোরা ভাব তেমন নয়। তাই রাখেন বলে ৬। গায়ে গরম জামা নেই কেন। ওই পাতলা সোয়েটারে কি শীত মানে? একটা পুল-ওভার কিনে দিল।-তেমন শীত কই? আমার তো ঠান্ডা লাগেই না।-পিকনিকে বাইরে যাচ্ছিস তো? সেখানে শীত লাগবে। বরং আমার কোটটা নিয়ে-তোমারও তো কাল বাইরে যাওয়ার কথা। কোট তোমারও তো লাগবে।বাইরে যাওয়ার কথা। তাই তো। গোলমালে খেয়াল ছিল না। বাণার কাছে কাল তার
পৃষ্ঠা:৭৪
একবার যাওয়া উচিত। ওই অভিশপ্ত জমিটার হাত থেকে তো রেহাই নেই।রগেন অন্যমনস্ক হয়ে গেল। বলল-ধূ, অচ্ছা যা।গোলমালা বাঁধল রাত্রে।খাওয়া-দাওয়ার পর দরজা দিয়েছে তারা। রণেন দেখল যীশা কাগজ জ্বেলে ঘরের মেঝেয় একবাটি দুধ গরম করছে।৬ কী করছ? রখেন জিজ্ঞেস করে।বীশা উত্তর দিল-দেখতেই পাচ্ছ।-ঘরে কাগজ জ্বালছ কেন, রান্নাঘর থাকতে।রান্নাঘরে আমি যাব না, কারও শুচিবাইরে লাগতে পারে।-মাকে কললে মা নিজেই গরম করে দিত। কী করবে দুধ দিয়ে এত রাতে?বীনা উত্তর দিল না। দুধ গরম করে ঘুমন্ত টুবাইকে টেনেহিঁচড়ে আমল বিছানা থেকে। টুবাই ঘুমের মধ্যেকাঁদে, হাত পা ছোড়ে। তাকে গোটকেয় চড়-কাপড় দিয়ে, গলায় আঁচল চেপে ঝিনুকে দুধ খাওয়াতে থাকে বীমা।একটু অবাক হয় রগেন। একটু আগে টুবাই দূব-ভাত খেয়ে ঘুনিয়েছে। এখনই আবার খাওয়ার কথা নয়। বলন একটু আগেই তো পেলো, এখন আবার খাওয়ানোর কী দরকার? কঁচা ঘুম ভাগিয়ে কষ্ট দেওয়া শুধু শুধু।বীণা হঠাৎ দু’খানা ঝকঝকে চোখের ছোবা মারে রণেনকে। একটু ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলে-কেন, টুবাই বেশি খাচ্ছে বলে চোখে লাগছে নাকি? লাগলে অমন চোখ কানা করে রাখো!রুণেন চুপ করে থাকে। বীণা নিজেই বলে-বাচ্চাদের খাওয়াই, এটাকে সকলেরই চোখ কেন যে কটকট করে।রগেন একটু উত্তপ্ত হয়ে বলে-একে খাওয়ানো বলে না। এ হচ্ছে রোমার ব্যাক্তিক। অত গাওয়া কি সহ্য হবে?বীণা খুব অবাক চোখ তুলে বলে-দু’ঝিনুক দুধ বাচ্চারা খাবে না? এ কদিন ভাল করে দুধ গেছে নাকি পেটে? তোমরা পাগল নাকি। ‘অত খাওয়া’ বলতে তুমি কী বোঝাতে চাও?-বলছি, পেটে অত সইবে।-সে আমি বুঝণ। পেটে কূ সয় না সয় তা আমি মা হয়ে জানি না। তুমি জানবে? -তোমার মাথায় ছিটপী।-তা হবে। সংশ্লিগৈর সঙ্গে থাকলে লোকে পাগলই হয়।রগেন খাস, ফলে চুপ করে থাকে। কিন্তু বীদার আক্রোশ তাতে কমে না। সে বলে- পাগলের গুড়ি। যেমন পাগল ছিল বাপ, বাউন্ডুলে হয়ে বেরিয়ে গেছে, তেমনি ছেলেহঠাৎ সেই পুরনো ক্ষতে হাত পড়ে। ঠান্ডা, ভালমানুষ রণেন একটা ঝাঁকুনি খেয়ে জেগে ওঠে যেন। হঠাৎ চেঁচিয়ে বলে-চুপ করো বলছি।বীণা চমকে ওঠে। টুবাই বিষম খায়। দুধ গড়িয়ে নামে গাল বেয়ে। বীণা তার শান্তস্বভাব, উত্তাপহীন স্বামিটিকে হঠাৎ উত্তেজিত হতে দেখে একটু অবাক হয়। তাকায়। এবং তৎক্ষণাৎ বুঝতে পেরে যায় সে তার স্বামীর একটি অতিশয় দূর্বলতার স্থান খুঁজে পেয়েছে।
পৃষ্ঠা:৭৫
এতকাল এই দুর্বলতার কথা তার জানা ছিল না। মানুষ আর একটা মানুষের কত কিছু জানতে পারে না, কাছাকাছি থেকেও। মেয়েদের নিষ্ঠুরতার বুঝি শেষ নেই। যে মুহূর্তে বীণা বুঝতে পারে যে ‘পাগল’ কথাটাই রদেনকে উত্তেজিত করেছে সেই মুহূর্তেই সে দূর্বল জায়গটার প্রবল নাড়া দিতে থাকে। এবং খেলাটা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। বীদা বলে কেন, চুপ করব কেন? তোমাদের মধ্যে পাগলামির বীজ নেই? তোমার বাবাকে লোকে পাগল বলে না? তোমারও ছেলেবেলায় অসুখের পর একবার পাগলামি দেখা দেয়নি? আমি কি ভুল বলছি? বা সঠ্যি তা বলব না কেন?ঠান্ডা এবং শান্তস্বভাবের রণেনের ভিতরে সেই হনুমানের হাঁচোড় পাঁচোয় তার ভিতরটাকে নয়-ছয় করে দেয়, রাগে চিন্তাশক্তি সুপ্ত হয়ে যায়। সে বুঝতে পারে বীণা তাকে পাগল করে দিতে চাইছে। তার মনে নিভৃতে লুকিয়ে রাখা বড় গোপন ও লজ্জার স্থানটিতে এই প্রথম হানা দেয় মানুষ। সে মাথা চেপে ধরে। সে আর একবার চেঁচায়, কিন্তু কোনও কথা ফোটে না, একটা ভাস্তব আওয়াজ বেরিয়ে আসে। এবং সেই মুহূর্তে তার মনের যাবতীয় মানবিক চিন্তাশক্তি লুপ্ত হয়ে যায়।বীণা তার দিকে আঙুল তুলে বসে-তুমি পাগল নও। আগে এসব জানলে তোমার সঙ্গে বাবা আমার বিয়ে দিত? পাগলের বংশে কেউ জেনেশুনে মেয়ে দেয়।রণেন মশারি সরিয়ে বিছানার ধারে বসে সিগারেট খাচ্ছিল। সিগারেটটা পড়ে গেল। শূন্য এবং ভয়ার্ত চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে রগেন। এখন থেকে এই মেয়েমানুষটার চেয়ে বড় শত্রু তার আর কেউ নেই। ওই ভঙ্গি থেকেই সে হঠাৎ পা বাড়িয়ে লাথিটা ক্যল বীণার বুকে। টুবাই ছিটকে গিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে উঠে বসে। বীশা পড়ে দিয়ে ফের উঠতে যাচ্ছিল। রদেন ঝুঁকে তার চুলের মুঠি চেপে ধরে তাকে হেঁচড়ে তোলে, অস্ফুট গলার বলে- হারামজাদি, আমাকে জামাই পেয়ে তোর চোদ্দোপুরুষ উদ্ধার হয়ে গেছে বলতে বলতে সে তার ডান হাতে গোটাকায় প্রচণ্ড চড় মারে বীলার গালে। দেয়লের কাছে নিয়ে মাথা ঠুকে দেয়, মুখ ধবে দেয় দেয়ালে, আর বলে পাগল। পাগল। বল, বল, পাঠান। পাগল…বদ্ধ দরজায় তখন প্রবল ধাকা দিয়ে বাইরে থেকে সোমেন চিৎকার করছে-দালা, দ্বারা, কী করছ কী। দাদা, দরজা খোলো। দায়ের চিৎকারও কানে আসে রণেনের।মা বলে- সর্বনাশ করিস না, ওরে সর্বনাশ করিস না।ছেলেমেয়েরা ঘুম ভেন্তে, প্রধমটায় চিৎকার করে উঠেছিল। রলেন তার ক্ষরণ চোখে কাদের দিকে চাইতেই প্রাবা নিখর হয়ে গেল।অনেকক্ষনও এদে দরজা খুলেছিল রণেন। তখন বীণা মেঝেয় পড়ে আছে বটে, কিন্তু জান হারায়নি। কেবল বড় বড় খাস টানছিল। সোমেন গিয়ে বউদিকে ওঠানা, মা ধরে অনেকে। রণেন ননীবালার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে সোফায় বসে। সিগারেট ধরায়। জীবনে সম্পূর্ণ এক নতুন অভিজ্ঞতায় তার মনটা তখন অস্পষ্ট। আচ্ছা। এই প্রথম সে মেয়েছেলের গায়ে হাত তুলল। খবে সে আর ফানি। সোমেন আর মা যা করার করেছিল রাতে। সম্পূর্ণ ভূতগ্রস্তের মতো সোফায় বসে রইস রগেন। ননীবালা এসে এক সময়ে বললেন-ঘরে যা বলো। রণেন মাথা নাড়ল। সোমেন মাকে টেনে নিয়ে গেল যরে।
পৃষ্ঠা:৭৬
সারা রাত পরিতাক্ত এবং আচ্ছন্ন রণেন বসে রইল সোফায়। মশার কামড খেল, টের পেল না তেমন। সিগারেট খেল অনেক। মাথার ভিতর দিয়ে কত চিন্তার মুণি বয়ে গেল।মা বাবার কত ঝগড়া হয়েছে, কত আকথা বুকথা না বলেছে বাবাকে। বাবা কোনওদিন হাত তোলেননি। স্ত্রীলোকের জন্য একটা আলাদা সম্মানবোধ ব্রজগোপালের বরাবর। এখনকার দিনে যখন আর ট্রামেবাসে পুরুষরা মেয়েদের বসার জায়গা ছেড়ে দেয় না, লেডিস সিটে জায়গা না থাকলে মেয়েরা যখন দাঁড়িয়েই যায় তক্ষাও প্রজগোপাল নিজের সিটটি ছেড়ে দেন। স্ত্রীলোকরা দাঁড়িয়ে থাকবেন আর আমি পুরুষ হয়ে বসে থাকব-বাবার পৌরুষে সেটা আজও লাগে। এখনও অনাত্মীয়া, অপরিচিতা মেয়েছেলের মুদের দিকে ব্রজগোপাল তাকান না, স্পর্শ বাঁচিয়ে চলেন, অধিকাংশ মেয়েকেই সঙ্গোধন করেন ‘মা’ বলে।রথেদের মন বিস্ততা আর আত্মগ্লানিতে ভরে যায়। সারা রাত ধরে সে কত কী ভাবে। ভোরবেলা কেউ জেগে ওঠার আগেই সে পোশাক পরে বেরিয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ এলোমেলো ঘুরে বেড়ায়। গড়ের মাঠের কাছে ট্রাম থেকে নেমে কুয়াশার আচ্ছন্ন মাঠঘাটেনা সবুজ সৌন্দর্য দেখে। দেখাতে দেখতে এক সময়ে বহেরুর খামারবাড়িটার কথা মনে পড়ে যায়। নির্বাসিত, বৃদ্ধ হাজাগোপালকে মনশ্চক্ষে সে দেখতে পায়। নাতিদীর্য সঞ্চরিত্র একজন বাতিল মানুষ। হঠাৎ বাকার জন্য একটা আকুলতা বোধ করে সে।বিদে পেয়েছিল। রেস্টুরেন্টে খেয়ে, সেলুনে দাড়ি কামিয়ে নিয়ে একটু কেনায় দে হাওড়ায় গিয়ে ট্রেন ধরে।
এগারো
বর্ধমানের বাজারে বহেরু একজন ভবঘুরে চেহারার লোকের সঙ্গে কথা বলছিল। ডাল শস্যবীজের পাইকার পরান সাহাব চেনা লোক। রোগা, কালো, লিকলিকে চেহারা, গালে আর খুতনিতে খামচা-খামচা কয়েক গাছা লোমের মতো দাড়ি মাকুন্দই বলা যায়। দুটো গর্ত চোখে ভিতৃভাব। এক চালান মাল গন্ত করে পরান সাহা তার দোকানঘরের বাইরে বলে বেঁাঁচা নেড়ে হাওয়া যাচ্ছে-মোটা মানুহে শীতেও ঘাম হয়। সেখান থেকেই চেঁচিয়ে বলে- নিয়ে গিয়েই দেখ না। চোর ছ্যাঁগেছে নী, দোখের মধ্যে কোনও এওঠাই থাকতে পারে না। চোখে চোখে রেখো। তুমি প্রতির কথা বলেছিলে, ভাই আটকে রেখেছি।বহেরু মাখ্য নাড়ল। পরান সাহা তার পুরনো খদ্দের। কাজেই খারাপ লোক দেবে না। কিন্তু প্রত্নকর্তার সঙ্গে পরামর্শ নাকরে কথা দেয় কী করে? বলল রঙ বালু, আমি টপ করে ঘুরে আসছি। কৌলিও না কেন।লোকটা সঙ্গে ধরে বলল-গদি নেন আপনার কাছে থাকব। বর্ধমানের বাজার ভাল, শানা-মাকু সর এখান থেকেই কিনে নিলে হয়।-রাখো বাপু, আগে কর্তার মতামত দেখি। শান্য মাকু কিনতে হবে না, আমার তাঁতঘরআছে।-ও। লোকটা বিস্ময়ন্তরে বলে তা কর্তা কে?-ব্রাহ্মণ। আমার ব্রাহ্মণ। কথান অহংকারের সঙ্গে বলে বহেরু।-আমি দাঁড়িয়ে রইলাম তবে!
পৃষ্ঠা:৭৭
-থাকো, বিডিটিড়ি দাও, আমি এসে যাচ্ছি। লোকটা তক্ষন হঠাৎ আপনমনে বলে- বড় খিদে পেয়েছিল। চাড্ডি মুড়িটুড়ি-সে কথায় কান না দিয়ে বহেরু বাজারের ভিড় ভেঙে এগোয়। মশলাপট্টি পার হয়ে বড় রাস্তা ধরে খানিক এগোলে ঘড়ির দোকান। রজকর্তা বসে আছে ঠায় একটা পিঠ-উঁচু চেয়ারে।কর্তা, হল। ব্রজগোপাল যহেরুর দিকে চেয়ে মাথা নাড়েন। হয়নি। বহেরু একটু হাসল। বলল-৬ ঘড়ি তো ক্রোন্দোবার সারাই হয়েছে, যন্ত্রপাতি আর কি কিছু আছে? ফেলে দ্যান।রজগোপাল বিমর্ষভাবে বলেন-পুরনো জিনিস, মায়া পড়ে গেছে। বড় ছেলে প্রথম চাকরি পেয়ে দিয়েছিল, তা চোদ্দো পনেরো বছরের বেশি ছাড়া কম না।-একটু কথা ছিল, আবডালে আসেন।ব্রজগোপাল নেমে আসেনা কী বলবি?-একটা তাঁতি পেরেছি। দুশো সুতোর কাপড় বুনতে পারে।ব্রজগোপাল অবাক হয়ে বলেন-দুশো সুতো? সে তো শৌখিন ব্যাপার। তোর সে কাপড় কী দরকার।বহেরুর বড়সড় শরীরটা একটু ঝুঁকে পড়ে আত্মাদে, একটু মৌজের হাসি হেসে বলে- দুশো সুতোর কাপড় বোনা যার-তার কর্ম নয়। ও কাপড় পরলে টেনাই পাওয়া যাবে না যে কিছু পরে আছি। মনে হবে ন্যাটো আছি।প্রজগোপাল বড় চোখে চেয়ে বলেন-ও কাপড় পরে রাজা-জমিদার, তুই চাবিবাসি মানুষ, ও পরে কি তারাম পাবি?-দেখি কীরকম করে। পাঁচজনকে দেখানোও যাবে। আশেপাশে ঘরে কেউ তো বোনে না। একটা গুণী লোক, আটকে রাখি। কি বলেন।-নিবি তো নে। তবে দেখেশুনে নিস, একপেট ভাতের জন্য বহু হায়রে নিধর্মী গুণী সেজে ঘুরে বেড়ায়। রজগোপালের মুখে অবশ্য কোনও উৎসাহ দেখা যায় না। বহেরু উৎসাহে বলে-তো নিই? পরান সাহার চেনা লোক।-কত লোক তো আনলি। সেই যে সুন্দরবনের এক রাইচাষা এল আনারসের ক্ষেত। করতে, তারপর চৌপরদিনপড়ে ঘুমতো। সেরকম না হয়। -হলে বের করে দেব। একটু ধ্বনি আছে অবিশ্যি, মাঝেমধ্যে পালিয়ে যায়। তবে হাতটান নেই। পরান সাহা তুে িউলমিন রইল। আপনি আসুন না, দেখবেন। যদি মত দেন তো কথা পাকা করে বেি রজগোপাল ক্রিজে হয়ে বলেন দাঁড়া, ঘড়ির মেরামতিটা হোক। চোখের আড়াল হলেই ওরা যন্ত্রপাতি সরিয়ে ফেলে। ঘড়ি বলে জিনিস। বহেক জাওরিয়ে হাসে-পুরনো যন্ত্র, ও নিয়ে কী করবে? -তুই বড় বুঝিস। সব সারাইকর ঘড়ির পার্টস চুরি করে। বহেরু বোবে বড় কর্তাকে। এখন নড়ান যাবে না। আগাগোড়া মেরামতির সময়টা উনি ঠায় বসে থাকবেন অপলক চেয়ে। বড় সাবধানী লোক। দোকানদার পুরনো চেনা লোক, ব্রজগোপালের টেবিল-গড়িটা না হোক বার ছয়-সাত সারিয়ে দিয়েছে। কুড়োদুড়ো লোক, হাত কাঁপে, মাথ্য নড়ে, তাই দোকানে বড় একাস বন্দের হয় না। লোকটা ব্রজগোপালকে উদ্দেশ করে চেঁচিয়ে বলল রজদা, এ হবে না।
পৃষ্ঠা:৭৮
ব্রজগোপাল চমকে দোকানে উঠে যান। ঝুঁকে খড়িয়ায় ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে বলেন- হবে না?বুড়ো লোকটা ঝাড়নে হাত মুছতে মুছতে মাথা নাড়ে না, এর জান শেষ হয়ে গেছে। জং-সং লেগে একাজার। এ কারিন গুলল কী করে সেইটাই ভারী বিস্ময়ের কথা।-আর একটু নেড়েচেড়ে দেখুন না, বহু বছর ধরে সঙ্গে রয়েছে, বাতিল করতে নারা সারানো যায়। তবে তাতে নতুন কেনার খরচ। তেমন ভাল চলাকেও না। হতাশ হয়ে রজগোপাল গড়িটা হাতে নিয়ে বলেন-বড় ছেলে দিয়েছিল।-নতুন একটা কিনে নিন।-দূর। রজগোপাল ‘নতুন’ শব্দটা সহ্য করতে পারেন না বোধ হয়। বলেন-পুরনো আমলের জিনিসের মতো জিনিস হয়।রত্নগোপাল চাদরের তলায় ঘড়িটা নিয়ে নেমে আসেন। ইটিতে চাটতে বলেন-লোকটা বুড়ো মেরে গেছে রে বহেরু, ও-পাশে একটা দোকান দেখেছি, চল তো দেখিয়ে যাই। বলেকি না চলবে না।আবার ঘড়ির বোকানে বসবেন। তবে আর কোকাকে দেখতে যাওয়া হবে না। আমারও মালপত্র কেনার আছে। টাইম কট্য হল?হাতে গড়ি, তবু টাইম কটা হল তা দেখার উপায় নেই। ভারী রেগে গিয়ে ব্রজগোপালবলেন-কী করে বলি।টাইম জানতে বহেরু একজন চলতি ভদ্রলোককে দেখে এগিয়ে যায়। পিছিয়ে আবার প্রজগোপালের পাশটি ধরে বলে-আজ আর হবে না। জেলখানার ফটক বন্ধ হয়ে যাবে যেতে যেতে।শীতের বেলা ফুরিয়ে যাচ্ছে। বাজারের ভিড়ে পায়ে পায়ে ধুলো উড়ছে। রাঙা ধুলো। একটা জলহীন শুকনো কতাস বয়ে যাচ্ছে। ভিড়ের মধ্যে শীতটা টের পাওয়া যাচ্ছে না, ফাঁকায় পড়লে আজ ঠান্ডা কামড়াবে খুব। বুড়ো হাড়ে শীতটা আজকাল লাগে। রজগোপাল খড়িটা একবার ঝাঁকিয়ে কানে লাজন। কোনও শক্ষ না পেয়ে বলেন নষ্ট হবে না। তোর রাজ্যের সব লোকের ঘন্টায় ঘন্টায় সময় আনা চাই, যেন অফিস টাইম সবার। উত্তরের শেয়ার দিকটা ফাঁক করে বাদ্যকদের ঘরে থেকে। আমিন না থাকলে ঘড়ির অ্যালার্মবাজিয়ে মজা মারে। বহেক গভীরভাবে। বাঁ। হাওয়াল পাওয়ালগুলান বড় খচ্চর হয়েছে। সবকটাকে কানে ধরে ওঠাবন করাব। গুনী লোকটি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে পরান সাহ্যর দোকানের সামনে, আকাশমুখো চেয়ে। পরনে লুঙ্গি, গায়ে গেঞ্জির ওপর পড়ে পাওয়া একটা ছেঁড়া সোয়েটার। পেটটা খাল হয়ে পড়ে আছে, কতকাল বুঝি পেটপুরে খায়ানি। পেটের খোঁদলটাকে আরও ভিতর ঢুকিয়ে শীতে কুঁজো হয়ে লোকটা আকাশের দিকে চেয়েছিল। বহের সামনে দাঁড়াতেও গানিকক্ষণ যেন চিনতে পারল না, তারপর সম্বিৎ পেয়ে শুকনো ঠোঁটে বড় বড় দাঁতগুলো ঢাকার চেষ্টা করল। -কী? লোকটা বলে।-বুশ্যে সুতোর কাপড়? পরলে মনে হলে কিছু পরি নাই, ন্যাংটা আছি।
পৃষ্ঠা:৭৯
লোকটা ঘাড় নাড়ল। বলল- আমাদের বহু পুরুষে বুনে আসছি। ইদানীং সব গোলমাল হয়ে গেল। দাদন না পেয়ে শামার বাবা তাঁত বেচে দেয়। সে শখানেক ইতিশাষ। আমি তো শেষ অবদি বিষ্ণুপুর গিয়েলাম রেশমের কাজ শিখতে। ওরা শেখাতে গা করে না। সেই থেকে ঘুরে ঘুরে বেড়াই। তাঁত আর দাদন পেলে এখনও-বহেফ বাধা দিয়ে বলে–মালপত্র সব পাবে। এখন কিছুদিন পেটিভাতে কাজ করো তো বাপু। তোমার কাজ তো দেখি।লোকটা রাজি। বহেক রথগোপালকে দেখিয়ে বলে-ইনি ব্রাহ্মণ। একটা নমো ঠুকে দাও, শুভকাজে রাখণের পায়ের ধুলো-দোকটা কথাটা ধরতে পারে না, যেন না পায়ের ধুলো নেওয়ার অভ্যাস নেই। সে তেমনি খুব আপনমনে বলে-বড্ড খিদে পেয়েছিল। চাড্ডি মুড়িট্রডি হলে-ব্রজগোপাল বলেন থাক থাক। লোকটাকে দেখে তাঁর মনে হয় লোকটার আত্মবিশ্বাস নেই। তবে তাঁতের কথায় তার চোখ দুখানা যেমন কলসে উঠল, তাতে বোঝা যায় ওই একটা ব্যাপার সালই, জানে। বহেরকে বলেন-যা, ওকে কিছু মিষ্টিটিটি বাইয়ে অনা, পের্টিটা খাল হয়ে আছে।বহেরু মিষ্টি বা শৌখিন খাবারে বিশ্বাসী নয়। সে ভাতে বিশ্বাসী। চারকেলা সে নিজে ভাত মারে। ভাত ছাড়া সে কিছু ভাবতে পারে না। নহেরু হাসল মিষ্টির কর্ম নয়। রামহবিদার হোটেল থেকে পেট চুক্তিতে ভাত খাইয়ে আনি। অতটা রাস্তা যাবে।-তুই যা। আমি পরানের গদিতে আছি। বলে ব্রজগোপাল ঘড়িটা আবার কানে তোলেন রামহরি লোকটাকে দেখেই বেগড়বইি করতে থাকে। বলে-না বাপু, পেট চুক্তিতে হবে বহেক ঝেকে বলে-হবে না মানে? তোমার এখানে তো সবাই তাই খায় -সবাই না। লোক বুঝে আমাদের আলাদা আলাদা চুক্তি। রামহরি লোকটার দিকে আর এক ঝলক চেয়ে বলে- এ বাপু গাঁ ঘরের লোক, তাল ওপর উপোসী, দেকেই মনে হয়। আমরা লোক চিনি। পাইস সিস্টেমে খেতে পারে, যত ভাত তত পয়সা।গহেক রেগে উঠতে গিয়ে গ্রাসে বলে বর্ধমানের লোকের মুখে কী কথা। এ জেলা হচ্ছে লক্ষ্মীর বাথান, তুমি ঐখানের লোক হয়ে দুমুঠো ভাতের মায়া করালে। তো খাওয়াও তোমার পাহস দিয়েছেন কুছ পরোয়া নেহি। লোকটন গুণী বুঝলে রামহবিদা, দুশো সুতোর রামহরি উইতে কৌতূহল দেখায় না। বেগ টিপে বেচারা ডাকে। লোকটি কিছু যেতে পারল না। মরা পেট, তার ওপর তার খাওয়া নিয়ে এক গবেষণা শুনে লখনও হয়ে থাকবে। লোকটা আঁচাতে উঠে গেল। সে সময়ে পাণ্ডুয়ার দিয়ের কারবারি গন্ধবণিক হরিপদ চা খেতে ঢুকে বলে বহের যে। দু-চারটে কথা হয়। হরিপদ বলে-আমাদের হয়টে সেদিন এক বামন বীরা এসেছিল, একুনে আড়াই ফুট উঁচু হবে। এত ছোট বামন বীর দেখিনি। সঙ্গে সঙ্গে বহেরু কৌতূহল দেখায় কর্তটুকু বললে? আড়াই ফুট। ভাতে কতটা উঁচু
পৃষ্ঠা:৮০
হরিপদ মেঝে থেকে বোধ হয় হ-ইঞ্চি উঁচু একটা মাপ দেখায় হাত দিয়ে। বহেরু বলে- আরে বাপ্স। লোকটাকে পাওয়া যায়। দুই হাটবারে এসেছিল। আবারও আসবে। যা ভিড় লেগে গেল দেখতে। দাড়িগোঁফ আছে বিশ্বাস হয় না না-দেখলে। তোমার বেঁয়ে নেবে নাকি? বহেরু মাথা নাড়ল নিলে হয়। সামনের হাটবারে যাবখন। কিম্ভুত মানুষের বড় শখা আমার। ঠিক মাপ বলছ? বামন বীর আবার একটু লম্বাটে হয়ে গেলে তেমন কিম্ভুত থাকে না।হরিপদ চোখ বড় করে বলে-ঠিক মাপ মানে। শ্রীমন্তর দরজিঘরে গজফিতে দিয়ে মাপা হয়নি নাকি। তা নামন বীর নিয়ে কি পালবে পুষবে?-ওই একরকম। বলে বহেরু, একটু হাসে।-তুমি বাগ নিজেই কিস্তৃত আছো।তাঁতি লোকটা লুঙ্গিতে হাতমুখ মুছে দাঁড়িয়ে আছে তখন থেকে। বহেক উঠে পড়ল। খাবারের পয়সা দিতে দিতে মুখ ঘুরিয়ে হরিপদকে আবার মনে করিয়ে দিল-সামনের হাটবারে যাচ্ছি।রাস্তায় এসে পিছু-পিছু আসা লোকটার দিকে একবার ফিরে চেয়ে কী ভেবে বহেক বলে রাতেরবেলা আবার খেওখন। এ শালারা ব্যাবসাদার, লোকের পেট বোঝে না।লোকটা এতটুকুন হয়ে বলে-আমি রেশি খাই না। ঘুরে ঘুরে বেড়াই, খাওয়ার বেশি বায়নাকা থাকলে চলে?বহেরু একটু শ্বাস ফেলে বলে-কিন্তু দুশো সুতোর কাপড় বুনতে হবে-মনে থাকে যেন। আমার ইজ্জত রেখো।পরানের গদিতে ব্রজগোপাল ক্যাশবাক্সের পিছনে বসে নির্বিষ্টমনে তখনও ঘড়িটা ঝাঁকাচ্ছেন। মাঝে মাঝে কানে তুলে শব্দটা শুনবার চেষ্টা করছেন। কহেরুকে দেখতে পেয়ে বললেন-ঘরে থাকতে যাও বা একটু-আধটু চলছিল, এ ব্যাটিন খুলেটুলে একেবারে বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। একটুও টকটক শব্দ শুনছি না। পার্টস ফার্টস খুলে নিয়েছে নির্ঘাত।বহেরু হাসে। তার বলতে ইচ্ছে করে-নতুন ঘড়ি আপনাকে একটা কিনে দেব, ওটা ফেলে দ্যান। তা দিতেও পারে বাইক। এবয় ফসলে ভাল টাকা এসেছে। ঘেরপুলিশকে মাঠে কিছু ফসল দিতে হয়েছে। তা হলেও যে আর কতটুকু। ব্রাহ্মণকে একটা ঘড়ি দান করতে আটকায় নাই কিন্তু রজগোপালকে সেকথা বলতে সাহস পায় না বহেরু ডাকাত। ব্রজকর্তা কখনভূ করিও থেকে কিছু নেন না। ওই নষ্ট গড়িটা ধরে বসে থাকবেন, ঝাঁকাকেন, দুঃখ করকেন, কিন্তু অনাত্মীয় কারও কাছ থেকে নতুন একটা ঘড়ি নেবেন না হাত পেতে।এজন্যেই লোকটাকে বড় ভালবাসে বহেরু।রজগোপাল মুখ তুলে বলেন-সায়ংকালটা পার হয়ে গেল রে। আর কত দেরি করবি।আমার আহ্নিক হল না।-এই আসি। বলে বহেরু বেরিয়ে যায়।দোকানপাট সেরে গাড়ি ধরবার জন্য স্টেশনে যখন তিনজন পৌঁছাল তখন চারবার অন্ধকার হয়ে গেছে। গাড়ি ছাড়তেই নৌড়ঝাঁপ করা শরীরে যে ঘাম জমেছিল তা শিরশিরিয়ে ওঠে শীতের বাতাসে। বুড়ো হাড়ে শীত বড় লাগে। এজগোপাল কানমুখ ঢেকে
পৃ্ষ্ঠা ৮১ থেকে ১০০
পৃষ্ঠা:৮১
বসেন। বহেক একটু আবডালে গিয়ে পকেট থেকে ছোট কলকে আর গাঁজা বের করে। তাঁতি লোকটা রজগোপালের গায়ে ঢলে ঢলে পড়ে ভাতঘুমে। বহেরু গাঁজাটা উপভোগ করে। গাড়িতে লোকজন আছে, দেখছে তাকে গাঁজা খেতে।কিন্তু তার দিকে চেয়ে কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না। বহেরু সেটা জানে। নিজেকে তাই মাঝেমধ্যে রাজা-জমিদারের মতো লাগে তার। সুখ এরেই কয়। কোকা গত তিন বছর জেলে পচছে, আরও বছর দুই যানি টানবে। ছেলেটাকে একবার চোখের দেখা দেখে আসবে ইচ্ছে ছিল। হল না। মাঝলা সন্তান ভাল হয় না বড় একটা, আর বড় ছেলে হয় বোকা। কোকা তার মেজো ছেলে। ছেলেবেলা থেকেই খারাপ, গোবিন্দপুর ইস্কুলের মাস্টাকরা মেরে মেরে হয়রান। তারপর ধরল ডন-বৈঠক, আমড়ায় যেত। পাহাড় সমান।শরীর নিয়ে বজ্জাতি করত। সেবার বেদরকারে খামোকা একটা ছোকরাকে কেটে ফেলল গালবারে। ছোকরাটা পার্টি করতে এসেছিল, একটু-আধটু বিষ ছড়িয়েছিল বটে, কিন্তু সে তেমন কিছু না। গাঁ ঘরে শহুরে কথা বুঝবার মতো বুঝদার কজন? তবু তার সঙ্গে কোকা কী একটা শত্রুতা তৈরি হল। ছোকরাকে পুলিশও ভাল চোখে দেখত না, নইলে কোকাকে আরও কোলাত কঠিন মামলায়। অল্পের ওপর দিয়ে বেঁচে গেছে কোকা। খুনটা ঠিক প্রমাণ হয়নি। শুধু জানা গেছে যে, খুনের দলে ছিল। কিন্তু নিজের ছেলেটাকে ঠিক বুঝতে পারে না বহেরু। ও শালা অনেকটা তার নিজের মতোই। দাগ আছে। কিন্তু হিসেবি-বুদ্ধি নেই।ছেলেটাকে ভালও বাসে কহেক, আবার একটু ভয়ও পায়। গত মাসে গিয়ে দেখা করেছে।শরীর মজবুত হয়েছে আরও, পাথরটাথর ভাঙে, যাঁতা ঘোরায়, ঘানি টানে। বিহু খারাপ নেই। বহেরুর তাই দুঃখ হয় না। তার আরও ছেলে আছে, এক-আধজন কম থাকলেও কিছু অভাব বোধ হয় না।বৈঁচাতে যখন নামল তারা তখন চারবারে বেশ রাত ঘনিয়ে এসেছে। দুজন মুনিশ হাজির ছিল স্টেশনে, সঙ্গে বহেরুর দুই ছেলে। তাদের সঙ্গে আর একজন লোকও দাঁড়িয়ে আছে, মোটাসোটা চেহারা, কোটস্ম্যান্ট পরা। রজগোপাল নামতেই লোকটা এগিয়ে এসে প্রণাম করে।আলো-আঁধারে ঠিক চিনতে পারেননি ব্রজগোপাল। ঠাহর করে দেখেই চমকে ওঠেন। বুকের ভিতরটা ধক ধক করে। বহেক্ট্রকে দেখে বলে-রণেনবাবু না?ব্রজগোপাল সর্বদাই দুঃসংবাদের অপেক্ষা করেন। বয়সটা ভাল না। ননীবালার বা তাঁর নিজের। গলাটা সাফ করে দিয়ে বলেন তুমি?রূণেদের গলার মুকুটটি ভারী মৃদু, বলে-দুপুরে এসেছি, তখন থেকে বসে আছি।-ও। তা পূরক্ত কী? খারাপ খবর নাকি।-না না। আপনার শরীর খারাপ খবর পেয়ে এলাম।-চিঠি দিয়ে আসতে পারতে, তা হলে আর যেতাম না বর্ধমান। আমিও দুপুরের দিকেই গেছি। কিছু বলবে?-কেমন আছেন এখন?-ভাল। একটু বুকে ব্যথা হয়। বোধ হয় হাঁটিটার জন্যই। তা এই বয়সে আদিব্যাধি তো হবেই। চিন্তা কী?-কলকাতা শীগগীর যাবেন-টাবেন না?-যাব-যাব তো রোজই করি। হচ্ছিল না। শরীরটার অনাই। দু-চারদিনের মধ্যেই যাব।
পৃষ্ঠা:৮২
-সেই জামিটার ব্যাপারে-ব্রজগোপাল থমকে যান। পুরনো অভিমানাই বুকের ব্যথার মতোই ঘনিয়ে ওঠে। এরা কেবল দশটি হাজার টাকা চায়, তার জন্যই এত যাওয়া-আসা, এত খোঁজখবর।এজগোশলে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে বলেন-জমিটা তোমরা কিনো। আমি কয়েকদিনের মঞ্চেই গিয়ে টাকা দিয়ে আসব।বড় ছেলের চেহারায় ঘরগৃহস্থালির ছাপ পড়ে গেছে। কচি-ভাইটি আর নেই। বরববই ছেলেটা মা-বাপ ন্যাওটা, শান্ত প্রকৃতির, আর একটু বোকাসোকা ছিল। এখনও প্রায় তাই আছে, কবে বোধ হয় এখন মা বাপের জায়গায় বউয়ের ন্যাওটা হয়ে পড়েছে।বহেরু এদিকে মালপত্র ভাগাভাগি করে মুনিশদের মাথায় তুলে দিয়েছে। টর্চ আর লম্বা লাঠি হাতে ছেলেরা দাঁড়িয়ে আছে। ব্রজগোপাল অদেশ করলে রওনা হতে পারে সবাই। বহেরু বুকদম এগিয়ে এসে বলে ওদের রওনা করে দিই কর্তা। আপনি ছেলের সঙ্গে কথা বলুন, আমি মাস্টারবাবুর সঙ্গে একটু কথা বলে আসি, তিমি পুরানা তেতুল চেয়েরেখেছিলেন। একসঙ্গে যাবদন।ব্রজগোপাল খাড় নাড়েন। প্লাটফর্মের ফাঁকা কংক্রিটের বেঞ্চে বসেন দুজন। শিশির ভিজে বেঁচে আছে সিমেন্ট। হাওয়া দিচ্ছে, খুব শীত। রণেন বলে আপনি বেশি দেরি করবেন না, ঠান্ডা পড়েছে, রওনা হয়ে পরুন।তুমি একা বসে থাকবে? আর কেষ হয় আধ ঘন্টার মধ্যে গাড়ি নেই।-তাতে কী। ঘোরাফেরা করা, তা করতেই সময় কেটে যাবে।-আচ্ছা যাচ্ছি। ছুটির দিনে-টিনে এদিকে চলেও আসতে পারো তো, কহেরুর থানারের দক্ষিণে একটা চমৎকার জায়গা আছে, বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে এসে চড়ুইভাতি করে যেতে পারে।রগেন একটু অবাক হয়। বাবা এসব কথ্য এতকাল বলেননি। বরং রণেন এলে বিরক্তি। প্রকাশ করেছেন। সে চুপ করে থাকে।রজগোপাল বলেন-কলকাতা শহর আর ইংরেজি স্কুলে কোনও শিক্ষা হয় না। বাচ্চা-কাচ্চাদের নানা জায়গায় নিয়ে যেতে হয়, লোকের সঙ্গে মিশতে দিতে হয়, নইলে মাথায় পাদ জমে যায়। রদেন বলে সালা সপ্তাহ না। ওই, একটা ছুটির দিনে আর বেরোতে ইচ্ছে করে ‘ছাড়েন। একটু চুপ থেকে বলেন আমার খরের বিশ্রামের চেয়ে বাইরের শ্রমটরি ভাল লাগত বরাবর। তোমার মা অবশ্য পছন্দ করতেন না। কিন্তু বাইরেটাই আত্মাকে উচিয়ে রেখেছে। রখেন মাথা নাড়ে। কথা খুঁজে পায় না। রজগোপাল বলেন-আমোর কথা বাদ দাও। আমার জীবনের দশা দেখে লোকে হাসে হয়তো। তবু বলি, মাঝেমধ্যে সংসার থেকে পালানো ভাল, নইলে সংসারের মাঝখানে সারাক্ষণ থাকলে কেবলই খিটিমিটি বাঁধে, সম্পর্কগুল্যে বিষ হয়ে যায়, একঘেয়েমি থেকে পরস্পরের প্রতি বিতৃষ্ণা আসে।কথাগুলো খুব গভীর থেকে উঠে আসছে মনে হয় রণেনের। এবং বাবার এই অতি সসধারণ কথাগুলো তার ভিতরে যেন ছ্যাকার মতো লাগে। আত্মসংবরণ রগেদের আসে না।
পৃষ্ঠা:৮৩
সে হঠাৎ বলে ওঠে সংসারে বড় অশান্তি। প্রজগোপাল মুখ ফিরিয়ে বলেন-বীরকম? রাখেন নিজেকে সংযত করে নেয়, বলোভসব শুনে আপনার দরকার নেই।রজগোপাল মাথা নাড়লেন। বোকেন। বলেন কলকাতা শহরটাকে লক্ষ কোরো। চারদিকে মানুষকে লোভনী দেখাচ্ছে, স্বার্থপর করে তুলছে। ও হরেছে মানুষ পচানোর জায়গা, সাধুকেও অসৎ করে ফেলে। সেই জন্যই আমি ভেবেছিলাম এদিকটায় বসত গড়ে তুলব-রণেন গভীর দীর্যাস ছাড়ে। তার খুব ইচ্ছে করে সংসারের বাতিল এই মানুষটির কাছে থেকে যেতে। কাল রাত থেকে এক প্রবল অস্থিরতা, ভয়ংকর এক পাপবোধ তাকে তাড়া করে ফিরছে। তার বলতে ইচ্ছে করে-তাই হোক বানা, এইখানেই বসত গড়ে তুলি।কিন্তু বলে না। বহেরুর বিশাল শরীর চরাচর ঢেকে সামনে এসে দাঁড়ায়। হেসে সে বলে- আধ ঘণ্টার মধ্যেই কলকাতার গাড়ি আছে।রগেন মুখ তুলে বলে-বাবা, আপনি রওনা হয়ে পড়ুন। খুব ঠান্ডা।এজগোপাল গা করেন না, বলেন তুমি একা বসে থাকবে। আমিও থাকি, দেখতে দেখতে আর ঘন্টা কেটে যাবে।-না, আপনি উঠুন। রদেন জোর করে।অগত্যা ব্রজগোপাল ওঠেন।ভরা প্ল্যাটফর্মের গেট পর্যন্ত এগিয়ে যায়। ব্রজগোপাল সেখান থেকে পিছু ফিরে চান। কুরাশা আর ঝুঁককো আঁধারে কিছু দেখতে পান না বোধ হয় ভাল করে। তবু অন্ধকারে চেয়ে থাকেন।বহেক ডাক দিয়ে বলে-কর্তা, বিশকা নিয়ে নেব নাকি।প্রজগোপাল বলেন-না রে, ও-সব বাবুগিরির কী দরকার। চল। হেঁটে মেয়ে দিই। দীর্ঘ রাস্তা হাঁটতে ইটিতে বহেরু বলে-কর্তা, এক বামন বীরের খবর পেয়েছি। আর একটা লোক আছে গুসকরায়, তার দুহাতে চোদ্দোটি আঙুল। ছ আঙুলে অনেকে আছে, ও সাত আঙুলে। ছনক্ষর আঙুল থেকে নাকি আবার একটা অতুন বেরিয়েছে। আশ্চর্য ব্যাপার। এনে ফেলব দুজনকে বহেরু গাঁয়ে।অন্য সময় হলে রজগোপাল তাকে তার বাতিকের জন্য ধমকাতেন, এখন শুধু অন্যমনে দিলেন। তিনি বহেরুর কর্ণ কেন-সংসারে বড় অশান্তি। শুনতেই পাননি। ছেলেনি হঠাৎ ওই কথা বলল একটা ‘ই’এক ফাঁকা প্লাটফর্মের ঠান্ড। বেঞ্চটায় বসে আছে রমেন। সিগারেট খায়। মনটা বড় অস্থির। কারুহু রাতে সে বীণাকে মেরেছে খুব। এই প্রথম সে এই কাজ করুন। হাত দুখানা আবছায়ায় চোঁখের সামনে তুলে ধরে সে। দেখে। গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটা। মেয়েয়মানুষের গায়ে হাত তুলেছে। হায়। আয়মানিতে ভিতরটা সবে ওঠে। তার বাবা এথগোপাল এত অগড়া সত্ত্বেও কোনওদিন মার গায়ে হাত দেননি। এখনও ভিড়ের ট্রামে বাসে মেয়েছেলেকে সিট ছেড়ে দেন বাবা। মেয়েমানুষকে এখনও সম্মান করতে বাবা জানেদ। সে তবে এ কী করল।হলদে আলোয় উল্লসিত কুবাশার ভিতর দিয়ে ট্রেনটা আসছে। প্ল্যাটফর্ম ফাঁকা। রণেন
পৃষ্ঠা:৮৪
হঠাৎ সম্মোহিতের মতো উঠে দাঁড়ায়, তাই তো। এই গ্লানি থেকে এখনই মুক্তি পাওয়া যেতে পারে। সে উঠে ধীর পায়ে প্লাটফর্মের এরটায় চলে আসে। ঝুঁকে দাঁড়ায়। গাড়িটা আসছে। সব স্মৃতি ঝেড়ে ফেলে লাইনের ওপর চোখ বুজে লাফিয়ে পড়া। রশেন ঘোর লাগা চোখে গাড়িট দেখে। লাফানোর জন্য পা তোলে।
। বারো
প্ল্যাটফর্মের লোকজন দেখতে পায়, রেলগাড়ির আলোয় একটা মোটামতো বোকা লোক লাইনের ওপর ঝুঁকে বোধ হয় পানের লিক ফেলতে, কী নাক বাড়তে, কী থুতু ফেলতে দাঁড়িয়েছে। তারা চেঁচিয়ে ওঠে-গাড়ি আসছে, গাড়ি আসছে, ও মশাই সময় মতোই রগেন পিছিয়ে দাঁড়ায়। ভারী বিরক্ত হয়। পৃথিবীতে এর লোক বেড়ে গেছে যে কারও চোখের আড়ালে কিছু করার উপায় নেই। তার ধারণা হল, লোকগুলো না ডাকলে সে ঠিকই অন্তিম নাফটা দিতে পারায়।গাড়ি এলে রাগন উঠে পড়ে। বেশ ভিড়। সপ্তগ্রাহ্যন্তে এরা মফঃস্বলের বাড়িতে গিয়েছিল কিংবা কেড়াতে, তারা সোমবার থেকে ফের কলকাতার জোয়াল ঠেলতে ফিরছে। গাড়ির মেঝেয় থিক থিক করছে আধবুড়ি আর কচিকাঁচা নাএন্টিটি সব ভারতীয়। কোঁচকায়, পেটিলায়, কোমরে, গেঁজেয় বর্ধমানের সন্তা চাল রয়েছে, কলকাতার দানি বাজারে ছাড়বে। তাদের কটি-নাটি চিৎকারে কামরা গরম। তিনজন বসতে পারে এমন সিটে একটা ঠেলাঠেলি করে রলেন বসে পড়ে। নোটা শরীর, ঠিক মুৎ পায় না বসে। কিন্তু তিনজনের জায়গায় চারজনের বদার নিয়ম আছে বলে কেউ আপত্তিও করে না। ঢেউ খেলানো কাঠের সিট। দুটো সিটের জোড়ের অংশটা উঁচু হয়ে আছে, পাছায় কুটছে। তবু সেই অবস্থাতেও হা-ক্লান্ত রণেন বাষে বসে চুলতে থাকে। নজনতারা আজ বড় যত্ন করেছে। কতকাল পরে দেখা। বামুনের পাতে এরা রেঁষে ভাত দেয় না বটে, কিন্তু কাছে বসে যত্ন করে খাওয়ানো, দেখাশুনো করা-সে বড় কম নাকি!নয়নতারা তার মুখ-চোখ দেখে, আর হাবভাব লক্ষ করে প্রথমেই বলে দিয়েছিল- বউদির সঙ্গে ঝগড়া করে এসেছে প্রেটানয়নতারার সঙ্গে যখন সে সফ ইয়েছিল এখন কোথায় ছিল বীণা। বহুকালের কথা সব। বহেরুর খামারবাড়িতে ভেটুইটেম বলতে গায়ে-হাত। সে সব না হচ্ছে সরু চালের ভাত যেমন পানসে মতো লংয়ে হাবীর মুখে তেমনি হয়। হয়েওছিল তাই, তা বলে কি নয়নতারা সে সব স্মৃতি বুকে কুদ্ধর বসে আছে? মোটেই না। ভুলে গেছে কবে। রণেনকে দেখে অবাক, খুশি সবই হয়েছিল, কিন্তু কোনও গুপ্ত স্মৃতির পাপবোধ ছিল না। পুকুরে আজ বেড়াজাল ফেলেছে সহেরুর লোকজন, মাছগুলো নাড়াচাড়া পড়বে। জাল তুলে হাজার মাহ তুলে আবার জাল ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছিল, নয়নতারা হাঁটুতের জলে নেমে গিয়ে বাছাই একটা রুই তুলে আনল প্রায় দু সেরি। উঠে এসে বলল এর পুরোন আজ না খাইয়ে ছাড়ব না।খুব খাইয়েছে। ও-বেলা মুড়ো সুদ্ধ বারোখানা টুকরো গেছে পেটে। এ-বেলাও সাঁও লাগার পরই আবার গরম ভাত, মাছের ঝাল আর দুধ খেতে হয়েছে। ঘুম তো আসবেই। ঘুমোতে ঘুমোতে স্বপ্নও আসে। নয়নতারার। বীণার কাছে যেমন বাঁধা-পড়া জীবন, বহেকর
পৃষ্ঠা:৮৫
খামারে নয়নতারার কাছে তেমন নয়। বীরাকম হাওয়া-বাতাস, খোলা-মেলার মতো সম্পর্ক গড়ে তুলতে জেনেছিল নয়নতারা। সেই জনাই কি ওর স্বামীটা ওকে নিতে পারল না শেষ পর্যন্ত। তা বলে নয়নতারকে কেউ আবার যেন দুঃখী বলে না ভাবে। ও সব দুঃখ-টাখ তার আসে না। আজ দুপুরে মাথার কাছে বসে মুগুরি কাটছিল। জাতিটা ভারী শৌখিন। রুপোর মতো। রণেন হাত বাড়িয়ে জাঁতিটা টেনে নিয়ে বলন-কী জিনিস দিয়ে তৈরি বলো তো। এমন দেখিনি।নয়নতারার একটা হাসি-রোগ আছে। মুখে আঁচল চেপে বলল-এখনও মানুষটার দোষ যায়ানি দেখছি।শোওয়া অবস্থ্য থেকে ঘাড় স্কুলে রণেন বলে-স্ত্রী দোষ দেখলে।-বয়সের।-য়াঃ। রণেন বলল।-তবে জাতির নাম করে হাত ছুঁলেন যে বয়।রগেন বলে-ওকে ছেনিঃ বলে না। -বাবলকেও ছোঁয়া বলে না তো বাপু, ছোঁয়ার আবার আলাদা রকম আছে নাকি।-মনে পাপ না থাকলেই হল। রণেন বলে।নানতারা ছেনাল সন্দেহ নেই। কিন্তু বড় একটা শ্বাস ফেলে বলে মনের পাপের কথ্য বলছেন। সে বড় জটিল কথা।-জটিল দেন হবে?নয়নতারা মাথা নেড়ে বলে একটা পুরুষ আর একটা মেয়েমানুষ একটাই হলেই মনে পাপ আগে। এ প্রকৃতির নিয়ম।ঘরটা ছিল নয়নতারার। পাকা ঘর, ওপরে টিন। দক্ষিণের জানালা দিয়ে দক্ষিণাবনের সূর্যরশ্মি ঠ্যাং বাড়িরেছে। কেউ নয়নতারাকে কিছু বলতে সাহস পায় না, তাই তার বিছানাতেই এলিয়ে পড়েছিল বদেন। অবশ্য বাচ্চ। একটা পিউড়ি মেয়েকে কাছে রেখেছিল সে, নজচে আড়াল দিয়ে তামাক গাওয়ার জন্য। সে মেয়েটা খানিক কড়ি খেলে মোকেয় পড়ে ঘুমাচ্ছে। বালিশের অড়ে রোদের গন্ধ, নরম। লেপখানা যেন বা পালকের তৈরি। তার ওপর হাতের কাছে নয়ন নিজে। এমনতরো ছিলাস জীবনে কমই ভোগ করেছে রণেন। সেই চিন্তাহীন আরামের মধ্যে হঠাৎ একটা দুর্শিনিকতা ঢুকিয়ে দিল নয়নতারা। রণেন নাড়া খেয়ে বলে পাগ জাগে। সে কীবকুম?এতক্ষণ আপনি হায়েছ করছিল, হঠাৎ গলা নামিয়ে নয়নতারা বলে বলো তো, একটা বয়সের ছেলে আর একটা বয়সের মেয়ের বিকে যখন তাকায় তখনই সব সময়ে একটা কিছু পাপ ইচ্ছে জাতী কিনা? যেখানেই হোক, যক্ষাই হোক, চেনা বা অচেনা যা-ই হোক, হয় কিনা-এরকম? আমার তো মনে হয়, না হয়ে যায় নয়।ভাবী বিস্ময় বোধ করে রণেন শুয়ে থাকে। ভাবে। এবং আশ্চর্য হয়ে বোধ করে, ঠিক তাই। চোখে চোখে যৌনতার বীজ ছড়ায় বটে। নিজেকে দিয়েই সে বুঝতে পারে। যখন ভিড়ের মধ্যে, যগনই নিঃসঙ্গতায়, যখনই কখনও বয়সের মেয়ের দিকে চেয়েছে কক্ষাই মনে হয়নি কি-ওই ওটা হচ্ছে মেয়েছেলে। হাঁ হাঁ বাবা, মেয়েছেলে। আর মেয়েছেলের মানে কী? মানে তো একটাই পুরুষের কাছে মেয়েছেলের বা মানে হতে পারে। এই রকমই যৌনতার বীজাণুযুক্ত চোখ বটে আমাদের। এইজন্যই কী রামকৃষ্ণদেব বলেছেন মাতৃভাব
পৃষ্ঠা:৮৬
হৃদয়ে না এলে মেয়েদের ছাড়া নয়নতারার কাছে লজ্জাই বা কী? বলল-মাইরি, কেবল জাভিটার দিকেই চোখ ছিল আমার।নয়নতারা বিছানায় পড়ে-থাকা জাতিটা তুলে তার হাতে ফের বরিয়ে দিয়ে বলল-তা হলে জাঁতিটাই দেখ। ভাল জিনিস। মুরগিহাটা থেকে বাবা কিনে এনেছিল, স্টেনলেস ইস্টিলের। অনেক দাম।তখন জাঁতিটা ফেলে নয়নতারার হাত ধরতে কোনও বাধা হল না আর। তখন মনে মনে। রণেন বলন-মেয়েছেলে, হাঁ হাঁ বাবা মেয়েছেলে। মেয়েছেলের মানে তো একটাই হয় পুরুষের কাছে।চোখে চোখ রেখে নয়নতারা বলে-ঠিক বলিনি?-ঠিকই বলেছ। ভেবেটেবে দেখলাম, জীবনের কোনও মানেই হয় না।এক-আধটা যা মানে করা যায় তার একটা হচ্ছে টাকা, অন্যটা মেয়েছেলে।নয়নতারা ফের আপনি-আজ্ঞেয় ফিরে গেল। বলল আমি মোটেই সে-কথা বলিনি আপনাকে।বলোনি?না, বেন বলব? টাকা আর দেয়েছেলে ছাড়া জীবনে আর কিছু থাকে না নাকি? সে আবার কীরকম? কত কিছু আছে।-আমি তো খুঁজে পাই না।নয়নতাক্স হাসল, বলল আপনি আচ্ছা একটা লোক। অনেক ভেবেচিন্তে একটা কঠিন কথা বের করেছিলাম মাথা থেকে, সেটা জল করে দিলেন। জটিল কথা অত সহজে বোঝা যায় না।নয়নতারারও বয়স হল, রণেনের চেয়ে বড়জোর এক-দুবছরের ছোট হতে পারে। বহেরুর প্রথম পক্ষের মেয়ে। গাঁ ঘরের তুলনায় ফরসা, মুখটায় সর্বদা একটা হাসি মাখানো সহৃদয় ভাব, সকলের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করে, রাগ নেই। সেই ব্যবহারটাই আবার প্রেম-ট্রেম বলে ভুল করে লোকে। চোখ দু’খানা বড়, নাক টাক, ঠোঁটের কায়দা সব মিলিয়ে একরকম চটক আছে। বুদ্ধি বোধ হয়বেশি রাখে না, হাসিখুশি মেয়েদের বুদ্ধি কম হবেই, কিন্তু এক-অর্ধেটা কথা বলে বড় মারাত্মক। যেমন এই পাপ-ইচ্ছের কথাটা।বিকেল পর্যন্ত নয়নতারার হাতখানা মাঝে মাঝে ধরে রইল রণেন। হাতটা থেমে গেল, গলে গেল, কিছু সুমুদরী নয়নতারা তা ফেরত নিল না। ভাগ্যিস শীতের বিকেল কিছু তাড়াতাড়ি আসো অবশ্য রণেন হাতের বেশি এগোবার উৎসাহও পাচ্ছিল না। মেয়েমানুষ কথাটা তার মধ্যে মাঝে মাঝে বজ্রাঘাত করছিল তখন। মেয়েমানুষের গায়ে কাল রাতে জীবনে প্রথম হাত তুলেছিল রণেন। এ পাপ কি স্বালন হওয়ার?নয়নতারা মুখের ওপর একটু ঝুঁকে বলে-বাবা একটা মানুষের চিড়িয়াখানা বানাচ্ছে, শুনেছেন?-সে কীরকম? বিষন্ন রণেন জিজ্ঞেস করে।-সে চিড়িয়াখানায় থাকবে অদ্ভুত সব মানুষ। খুব বেঁটে, খুব লম্বা, খুব সুন্দর, গুব কুচ্ছিৎ, হিজড়েও থাকবে। আরও থাকবে নানারকম। সাহেব থেকে সাঁওতাল। যত আজব মানুষ হতে পারে সব এনে জড়ো করবে। যদি বলেন তো বাবাকে আপনার কথা বলে দিই।
পৃষ্ঠা:৮৭
বাবা ঠিক চিড়িয়াখানায় ভরতি করে নেবে আপনাকে।হাতটা তখন ছেড়ে দিল রণেন।নয়নতারা তখন দুঃখের গলায় বলে-আপনি পালটে গেছেন।-একটু মোটা হয়ে গেছি বলে বলছ?তাই হবে বোধ হয়। একটা সময়ে আপনি খুব ভিতু ছিলেন, মেয়েমানুষকে বড় ভয় ছিল আপনার।রণেন সনিঃশ্বাসে বলে-এখনআছে।নয়নতারা হাসে, বলে-সে মেয়েমানুষের ভয় নয়, এ বয়সের পুরুষ ডরায় কেবলবউকে, মেয়েমানুষকে নয়। আবার চমকায় রণেন। ঠিক কথা, হক কথা। বলে-তুমি বেড়ে কথা বলছ আজ।নয়নতারা জাঁতিটা কের তুলে নিয়ে বলল-তখন আমাকে বড় ভয় ছিল আপনার, আজ আর নেই।-সেটা ভাল, না খারাপ?খারাপ।-ভয়ডর থাকাই ভাল।বউ কি মেয়েমানুষ নয়? তাকে তো ভরাই ঠিকই।-নূর! বউ বিয়ের পর আর মেয়েমানুষ থাকে নাকি? পাশবালিশ হয়ে যায়।কথাটা কতদূর অশ্লীল ওসত্য তা চোখ কপালে তুলে ভাবে রণেন। তারপর বলে-শুধু পাশবালিশ?সে কথার উত্তরে নয়নতারা বলে- তা নয় অবশ্য, রাতের পাশবালিশ আর দিনের দারোগা পুলিশ।তারপর সে কী হাসি হেসেছিল সে। সারাটা দিনে কাল রাতের পাপবোধ অনেকটাই ধুয়ে মুছে দিয়েছিল। আংটিটা চাইবে বলে ভেবে রেখেছিল রণেন, তা আর চাইতে ভুলে গেল। নয়নতারা বলে আমাদেরও একটু একটু ভয় খাওয়া ভাল।-কেন?-স্বামী নেয় না বলে, আমাকে ও আমাকে সবাই কুমড়োলতা ভাবে, মাচান দিতে চায়। সে সব লোক আমার ভাল লাগে না। আমি লতানে গাছ নই, লতার মতো দেখতে বে বিষ-দাঁত আছে। জীব তাই।-তোমার উনে পাপ। রখেন চোখ বুজে বলেছিল।-হবে। যাই, ঠাকুরদা ডাকছে।-কে ডাকছে বললে? রণেন চোখ খুলে জিজ্ঞেস করে। -ঠাকুরদা, দিগম্বর। খোল-কপালে লোক।রণেন অবাক হয়ে বলে খোল কপালে লোক কথাটার মানে কী?নয়নতারা তার বিশুদ্ধ দীতে হেসে বলে-কোন যৌবন বয়সে ঠাকুরদার কপালে কেবল ফুটেছিল ওই খোলটা, আর কিছু নাই। লোকে বলে গণেশের কলা-বউ যেমন, ঠাকুরবার খোলও তেমনি।
পৃষ্ঠা:৮৮
বুঝলাম, তা ভাকল কোথায়, শুনতে পেলাম না তো-খোলের আওয়াজ হচ্ছে, শুনছেন।রণেন কান পেতে শোনে। আগেও শুনেছে, দিগম্বরের থোল কথা কর। এখনও কইছে। নয়নতারা বলে খিদের বোল তুলছে ঠাকুরদা। চিড়ে আন, চিড়ে আন, দে দই, দে দই। আমরা সব বুঝতে পারি। এই বাজনার জন্যই বাবা তার গুড়োকে আটকে রেখেছে এতকাল।-কহেরু আবার এ-সবেরও সমবাদার না কি?-তা নয়। মানুষের চিড়িয়াখানার কথা বলছিলাম যে আপনাকে? তাতে সব রকম মানুষ লাগে যে।নয়নতারা উঠে গেলে ভারী একা লেগেছিল রণেনের। উঠে ঘুরে ঘুরে বহেরুর খামারবাড়ি দেখছিল। দেখে দিগম্বর পুকুরের ঘাটলায় বসে আছে, হাতে বড় কাঁসার গ্লাসে চা, চায়ের ওপর মুড়ির স্তূপ ঢেলে দিয়েছে, আর সেই মুড়ির তলা দিয়ে সুচুক সুচুক টেনে দিচ্ছে চা। চায়ে সিঁটনো মুড়ি চিবচ্ছে আরামে। চারদিকের দুনিয়া সম্পর্কে কোনও বোধই নেই।একা একা ঘুরেছিল রণেন। বহেরুর খামার থেকে কয়েক কদম তফাতে তাদের জন্য বাপ্রদমি কিনে রেখেছিলেন বাবা। সেই জমি খুব সাবধানে ও যত্নে তারকাঁটা দিয়ে ঘিরেছে, জায়গা মতো আম-কাঁঠাল নিম্ন-নারকোল গাছ লাগিয়ে রেখেছে এ-সব গাছ বাড়তে সময় নেয়। তাই আগেভাগে লাগিয়ে রেখেছেন বাবা। যখন ছেলেরা বসত করতে আসবে, তখন যেন ফসল দেয়। তারকাঁটার গায়ে গায়ে অমরি গাছ-এ গাছ জীবাণু মারে। সামনের দিকে শীতের গাঁদা ফুটে আছে। একটা কুয়ো কাটা ছিল। এখনও সেটা মজে যায়নি। রখেন কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে কুয়োর ধারে দাঁড়াল। বড় কুয়ো। গভীরে কিছু জল অছে। বোধ হয় জলটা ব্যবহার হয়, এখনও আবর্জনা পড়েনি। ঝুঁকে দেখতে দেখতে মনে হল, ভিতরের জলে মাছ ফুট কাটছে। শীতের গভীর কুয়োয় রশেনের ছায়া, তার পিছনের ধূসর শীতের আকাশের ছায়া। রণেনের তখন একার বজ্রাঘাতের মতো ‘মেয়েমানুষ’ কথাটা মনে হয়েছিল। আর লাফিয়ে পড়তে ইচ্ছে হয়েছিল কুয়োর জলে। বড় শীত, তাই পারেনি।কিন্তু একথা ঠিক, আজ বার-বারই তার মরতে ইচ্ছে হয়েছে। মেয়েমানুষের সম্মান যে রাখতে জানে না, তার মরাই উচিত। কোটা ভাবতে ভাবতেই সে পিছু ফিরে ভূত দেখতে পায়। খুব লম্বা অপ্রাকৃত রকমের একটা লোক বেড়া ডিঙিয়ে জমির মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে বাঁশের একু্যুৎ লাঠি, তাতে ভর দিয়ে কুঁজো হয়ে না দাঁড়ালে আরও লম্বা ঠেকত। তার দিকে দেয়ে দাঁড়িয়েছিল, মুখে কথা নেই। তবে চোখের ভাষায় কথা কিছু ছিলই। চমকে স্ট্রিটঠও সামলে গেল রণেন। কারণ, বহেরু যে মানুষের চিড়িয়াগানা বানাচ্ছে একথাটা ভোলেনি সে। এই অস্বাভাবিক লম্বা লোকটা বহেরুর সেই চিড়িয়াখানারই একজন কেউ হবে। পিটুইটারি গ্লান্ডের দোষেই এরকমটা হয়ে থাকবে, লম্বায় অন্তত সাত ফুটের কাছাকাছি। চেহারা দেখে মনে হয় সাঁওতাল। তবে ভারী অসুস্থ, জীর্ণ চেহারা, শরীরের দৈর্ঘ্যকে দাঁড় করিয়ে রাখার ক্ষমতা নেই। লোকটা দ্রুত এসেছিল বোধ হয়, হাঁফাচ্ছে। রদেন লক্ষ করে, কাটাতারের ওপাশে বহেরুর জ্ঞাতিগুষ্টির রাজ্যের ছেলেমেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের হাতে চিল, চোখেমুখে শয়তানি মাখানো। লোকটাকে তাড়া করেছিল বোধ হয়, রণেনকে দেখে একটু থমকে গেছে। লোকটা হাত তুলে ডাকে, বাবু।
পৃষ্ঠা:৮৯
রণেন একটু এগোতেই লোকটা হাত তুলে ছেলেগুলোকে দেখিয়ে বলে, মারে। রমেন ছেলেগুলোকে একটু তাড়া করে যা, যা।ছেলেগুলো অল্প একটু দূরে সরে যায়। লম্বা লোকটা ঘাসে বসে হাঁফায়। সভয়ে চেয়ে থাকে ছেলেদের দিকে। কাঁটাতারের বেড়া ফাঁক করে আবার সাবধানে বেরিয়ে আসে। একটু দূরে এসেই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পায়, ছেলেগুলো কাঁটাতারের বেড়ার কাছে ঘেঁবে গিয়ে লোকটার দিকে ঢিল ছুঁড়ছে। লোকটা কুয়োর আড়ালে সরে গেল। তারপর সেও ঢিল কুড়িয়ে উলটে ছুঁড়তে থাকে। লোকটাকে ছেলেগুলোর হাত থেকে বাঁচানোর কোনও ইচ্ছেই বোধ করে না সে। পৃথিবীতে যে যার মতো বেঁচে থাকার লড়াই করুক। তার কী?এখন রেলগাড়ির সিটের জোড়ের ওপর অস্বস্তির সঙ্গে বসে ঢুলতে ভুলতে পুরো ক্যাপারটাকেই অবাস্তব মনে হতে থাকে তার। দেখে লম্বা লোকটা কুয়োর মধ্যে ঝুঁকে দীর্ঘ হাতে বিষ মেশাচ্ছে তাদের পানীয় জলে। চিৎকার করে উঠতে গিয়ে সে জেগে যায়। মেশায় যদি বিষ, মেশাগগে। তারা কোনওকালে ওই জল থেতে আসবে না তো। তারা কলকাতাতেই পার্মানেন্ট হয়ে গেল। টালিগঞ্জের বাড়িটা যদি হয়। ভারী ফাঁদে পড়ে গেছে রণেন। সিমেন্ট আর লোহালক্কড়ের জন্য আগাম দিয়েছে। বাড়িটা তাকেই করতে হবে। জমি হবে হয় মার নামে, নয়তো দু-ভাইয়ের নামে। বীণার কঠিন মুখখানা মনে পড়ে যায় তৎক্ষণাৎ। বজ্রাঘাত হয় বুকে। কাল রাতে সে বীণাকে মেরেছে। একে মেয়েমানুষ, তার ওপর রোগা শরীর। কী করে বাসায় ফিরে সে বীণার মুখোমুখি হবে। এক বিছানায় শোবেই বা কী করে, ফের কথাটথাই বা বলা যাবে কি কোনওদিন? হয়তো ফিরে গিয়ে দেখবে বীণা তার কাগাঁয়ের বাপের বাড়িতেই চলে গেছে। আর হয়তো আসবে না।… না যদি আসে তবে কি খুব মন্দ হয়? যদি চিরকালের মতো বীণা ছেড়ে চলে যায় তবে কি খুব খারাপ হবে রণেনেয়? হবে একটু অসুবিধে, বিয়ের পরের অভ্যেসগুলো যাবে কোথায়? তবু বোধ হয় মা-ভাই নিয়ে এরকম ব্যক্তিত্বহীন আনন্দের জীবনও আবার ফিরে পাবে রণেন। তখন মাঝে মাকে নয়নতারার কাছে আসবে। অটুড়ি পুরুষের মতো। লম্বা লোকটার কথা আবার ভাবে রণেন নয়নতারার কথা, রীত বীণ্ডর কথা… বাবার কথা সব মিলেমিশে একটা তালগোল স্বপ্ন হয়ে যেতে থাকে। এত কেষ্টনগরের দিকপূর্বক দুটো লোক বসেছে সামনের সিটে। ও দিকের লোক কথার গুস্তান। সারাক্ষ ব্রঙ্গরস করছিল। গাড়িটা হঠাৎ বেমক্কা থেমে যেতে তাদের একজন। অন্যজনকে ঠিক বীরভূম বা বাঁকুড়া জেলার কথা নকল করে বলে-গাড়িটা কোথায় থামা করাল রে?অন্যজন বলে-এ হচ্ছে হালুয়া ইস্টিশান।-সে কীরকম?-হাওড়াও নয়, লিলুয়াও নয়, মাঝামাঝি। হাওড়ার হা আর লিলুয়ার লুয়া নিলে যা হয়। ও হচ্ছে বাবা কার শেড। রাজধানী এক্সপ্রেসও হাওড়ায় ঢোকার আগে এখানে থামে। হালুয়া ইস্টিশানে।রণেন চমকে ওঠে। কার শেড। তার মানে হাওড়া এসে গেল প্রায়। একটু পরে সে বাসায় পৌঁছবে।
পৃষ্ঠা:৯০
খুব ভয়ে রণেন বাসায় ঢুকল। ভারি লজ্জা করছিল তার। মা দরজা খুলে সরে যায়। ছেলেমেয়েরা তাদের ঠাকুমার ঘরে হল্লাচিল্লা করছে। তার ঘর অন্ধকার। বীনা ঘরেই বিছানায় শুয়ে আছে, আন্দাজ করে সে। বাতি না ছেলে জামাকাপড় হাতে নিঃশব্দে। লুঙ্গিটা আলনার অভ্যস্ত জায়গা থেকে টেনে পরে নেয়। খবরের কাগজটা নিয়ে বসে বাইরের ঘরের সোফায়। কাগজ তরা যুদ্ধ লাগতে পারে, এই আশঙ্কা, দুর্দিনের সংকেত। সে সব পড়ে না রগেন। চোখ চেয়ে বসে থাকে।সোমেন ফেরেনি। বলে গেছে, ফিরতে রাত হবে। রুতে খাবে না। বীণার আর বাচ্চাদের খাওয়া হয়ে গেছে। রণেন খেয়ে এসেছে। ননীবালা খাননি। ঘটনাটা কতদূর গুরুতর হয়েছে তা এখনও বুঝতে পারে না রণেন, ছেলেমেয়েরা কাছে ঘেঁষছে না, না কথাটথা বলছে না। ভারি বিয়্যা বোধ করে সে।বড় ছেলেমেয়ে দুটো ঠাকুমার কাছে শোয় এখনও, তাদের মা হাসপাতালে যাবার পর থেকেই। শুধু টুবাই শোয় বীণার কাছে। বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়ার পরও রণেন অনেকক্ষণ বসে থাকে বাইরের ঘরে। তারপর এক সময়ে দ্বিধা-স্বন্দ্ব-সংশয় নিয়ে উঠে আসে। বিছানার মশারি তুলে ভিতরে ঢুকে শুয়ে থাকে চুপচাপ। বীণার গায়ে দেখ, লেপের অর্ধাংশ রণেনের প্রাপ্য। কিন্তু লেপটা টেনে নিতে তার সাহস হয় না। বিনা লেগে শুয়ে থাকে সে। বীণার গা থেকে একটা সুন্দর পাউডার বা সেন্টের গন্ধ আসে।হঠাৎ তাকে চমকে দিয়ে বীণা নড়েচড়ে ওঠে। পাশও ফেরে বুঝি। এবং হঠাৎ লেপটা তুলে তার গা ঢেকে দেয় বীণা। রপেনের বুকখানা মুচড়ে ওঠে হঠাৎ। কান্না আসে চোখ ভরে। বুক ভরে। সে পাশ ফেরে।বীণা।উত্তর নেই।-ক্ষমা করো। রণেন বলে।তারপর আঁকড়ে ধরে বীণ্যকে। প্রথমটায় শরীর একটু কঠিন করে রাগে বীদা। তারপর কেঁপে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। শরীরাটা হঠাৎ নরম হয়ে যায়।
। তেরো।
সোমেন ভেবুের পীড়িটা ধরতে পারেনি। অনেক রাত পর্যন্ত বলে বউদিকে নিয়ে ঝামেলা গেছে। তারপর শুয়ে শুয়ে গভীর রাত অবধি জেগে থেকেছে সে। টের পেয়েছে মাও ঘুমোয়নি। বাইরের ঘরে বসে মশা তাড়াচ্ছে। সে এক অসহনীয় অবস্থা। দাদা যে কেন বউদিকে মারল, কী করেই বা মারতে পারল, তা অনেক রাত অবধি ভেবে ভেবে তার মাথা গরম হয়েছে।এ পাশ ও পাশ করতে করতে মা এক সময়ে বলল-তোর দাদার কাছে একবার যা না।-কেন? ক্লান্ত সোমেন জিজ্ঞেস করেছে-কী করছে দেখে আয়। ঝোঁকের মাথায় কী একটা করে ফেলল, এখন যদি আবার। লজ্জায় ঘেন্নায় বেরিয়ে যায়–যাকগে। সোমেন রেগে উত্তর দিয়েছে-যাওয়াই উচিত। ভদ্রলোকের মতো দেখাবে
পৃষ্ঠা:৯১
লোকের কাছে, আর ছোটলোকের মতো সব কাণ্ড করবে।মা নিঃশ্বাস ফেলে বলল-মানুষ রেগে গেলে কত অনর্থ করে। তখন কি আর মানুষ মানুষের মতো থাকে। বউমার বড্ড মুখ হয়েছে আজকাল, বিকেলে বাড়িতে পা দেওয়া থেকে ইস্তক কী না বলছে।সোমেন হবে। সিগারেট ধরিয়ে বলল-তোমাদের জ্বালায় আমাকে একদিন বাড়ি হাড়তেমা চুপ করেছিল। সোমেন বাথরুম সাওয়ার নাম করে উঠে গিয়ে দাদাকে অবশ্য দেখেও এসেছে দুবার। সোফার ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে, মাতালের মতো। ডাকেনি সোমেন। থাক পড়ে। মশা কামড়ে থাক। বউদির অবশ্য তেমন কিছু লাগেনি। দুর্বল শরীর বলে আর ঘটনার বিস্ময়করতায় বোধ হয় কেমন হয়ে গিয়েছিল। গালে অবশ্য আঙুলের দাগ দগদগে হয়ে ফুটেছিল, কয়েক গুস্থি চুল ছিঁড়ে গেছে। কিন্তু দাদার ওপর এই প্রথম একটা তীব্র ঘৃণা মেশানো রাগ অনুভবও করে সোমেন। হতে পারে, দাদাকে দিনের পর দিন গোপনে উত্তেজিত ও বিরক্ত করেছে বউদি, তবু দাদা কেন অমানুষ হয়ে যাবে:এই সব কারণেই সকালে উঠতে দেরি হয়ে গেল। বেরোবার সময়ে দেখে সদর দরজা ভেজানো রয়েছে, দাদা নেই। বুকটা একটু কেঁপে উঠেছিল তার। দাদা বড় ভাবপ্রবণ ছেলে, রাগীও। অনুতাপে লজ্জার যদি দুম করে নিজের ওপর প্রতিযোশ নিতে গিয়ে ভালমন্দ কিছু একটা করে ফেলে?কিন্তু ভাববার সময় ছিল না। শিয়ালদা থেকে ব্যারাকপুরের গাড়ি ছাড়তে তখন আর কুড়ি মিনিট বাকি। ঢাকুরিয়া স্টেশনে এসে তাকে অপেক্ষা করতে হল কিছুক্ষণ শিয়ালদার গাড়ির জন্য। দেরি হয়ে গেল। কথা ছিল ভোরের গাড়িতে হাঁড়ি কড়াই নিয়ে সে আর শ্যামল গিয়ে গঙ্গার ধারে একটা পিকনিকের জায়গা খুঁজে বের করবে, তারপর স্টেশনে এসে নটার গাড়ি দেখবে। পূর্বা, অপালা, আর সব দূরের বন্ধুরা ওই গাড়িতে আসবে, তাদের নিয়ে যাবে জায়গা মতো। সেটা হল না। শ্যামল নিশ্চয়ই গাল দিচ্ছে সোমেনকে। কুয়াশা আর শীতের ভিতর দিয়ে ইলেকট্রিক ট্রেন তাকে কখন যে ব্যারাকপুরে এনে ফেলল তা অন্যমনস্ক সোমেন টেরও ফেলে না। নেমে ঘড়ি দেখল, নটা বাজতে আর অল্পই দেরি। মন ভাল হিল না বলে তার মেধাল হয়নি যে এই গাড়িটাতেই ওরাও আসতে পারে। সে আপন মনে নানা কথা ভয়েতে ভাবতে সেস্টশনের গেট পেরিয়ে বাইরে পা দিতে যাচ্ছে, তখন পেছন থেকে। ও মা! সোমেন, আমাদের নিতে এসে ফিরে যাচ্ছিস যে সোমেনেয় তখন শেয়াল হয়। সিরে পূর্বাকে। দেখে এবটু হাসে। পূর্বা চোখ বড় বড় করে তাকে দেখে, বলে কোথায় চলে যাচ্ছিলি আমাদের না নিয়ে? সোমেন বলে-ওরা কোথায়?ওই তো! দেখিয়ে দেয় পূর্বা। একটু পিছনে অণিমা, অপালা, ম্যাক্স, অনিল রায়- সবাইকেই দেখা যায়। ওরা গেটের কাছে এগিয়ে আসে। অপালা তাকে দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে বলে-যা খিদে পেয়েছে না রে। ব্রেকফাস্ট রেডি আছে তো।সোমেন সিগারেট ধরাল। মানুষের স্রোত বেরিয়ে আসছে। সে সেই প্রোতের মুখে থেকে একটু সরে দাঁড়ায়। অপেক্ষা করে। অপালা বোধ হয় হাতব্যাগে টিবিট খুঁজছে। পাচ্ছে না। ভ্রু কুঁচকে অধৈর্য হাতে হটিকাচ্ছে, তোলপাড় করছে ব্যাগ। পাচ্ছে না। বেড়ার ওপাশে
পৃষ্ঠা:৯২
দলটা একটু সরে দাঁড়িয়েছে লোকজনকে পথ দেওয়ার জন্য। পূর্বার মুখর কাঁদো কাঁদো হয়ে গেছে, সে বলল-ভাল লাগে না। কী যে সব কাণ্ড করিস না।অপালা বলে-আহা, কাও আবার কী? ব্যাগ খুলে টিকিটগুদের ভিতরে ফেলে। দিয়েছিলাম, বেশ মনে আছে।অনিল রায় পাইপ খাওয়ার অভয়দ করছেন। সেটা ধরাতে বরাতে বেশ নিরুদ্বেগ রসিক গলায় বলেন-ভিতরেই ফেলেছিলে তো। না কি ব্যাগটা খুলতে ভুলে গিয়ে টিকিটগুদের বাইরে ফেলে দিয়েছ।-না স্যার, স্পষ্ট মনে আছে। বাস অকারণে হাসে অপালা। অণিমাও। কারো কোনও উদ্বেগ দেখা যায় না।কেবল পূর্বার চোখ ছলছল করে ইস্ কী ইনসাল্ট স্যার। কী বিচ্ছিরি কাণ্ড। এই সোমেন চলে যাস না।সোমেন দুপা এগিয়ে যায়, বলে-কী হল, টিকিট পাচ্ছিস না?-নারে। অপালার ঋ কুঁচকে আসে, চোখ ছোট আর তীক্ষ্ণ হয়। ব্যাগটা ভুলে কাত করেভিতরে খোঁজে।সোমেন নিরুদ্বেগ গলায় বলে-কী আর করবি, মামাকে বলেকয়ে চলে আয়।অপালা চোখ তুলে অবাক হয়ে বলে-মামা। মামা আবার কে।সোমেন চোখের ইশারায় টিকিট চেকারকে দেখিয়ে দেয়। অপালা আর অণিমা অমনি ইয়ানাকির গন্ধ পেয়ে টিকিটট্রেকারের মুখের দিকে চেয়ে হাসতে থাকে। অনিল রায় গমকে দেন কী হচ্ছে কী?-স্যার, সোমেন বলছে ইনি নাকি আমাদের মামা, ছি-ডি-এ লাইনে সবাই চেকারকে মামা বলে। কেন বলে খোদায় মালুন। অল্পবয়সি চেকারটি গা ছেড়ে দাঁড়িয়েছিল। এখন হঠাৎ সোজা হল। একবার বিরতির একটু দৃষ্টিক্ষেপ করে সোমেনের দিকে। ততক্ষণে পূর্ণা রুমালে চোখ মুছছে। অনিল রায় বললেন- কোথাও বোধ হয় পড়েউড়ে গেছে তাহলে। দেন উই হ্যাভ টু গেদি ফেয়ার। বলতে বলতে হিপ পকেটের ওয়ালেটে হাত দেন।তৎক্ষনাৎ টিকিট খুঁজে পায় অপাল চেঁচিয়ে বলে মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল। পেয়েছি সাার, ব্যাগের লাইনিজের ওরা বেরিয়ে আসে। ‘রায় বলেন-স্পটটা কি খুব দূরে সোমেন।-আনো নাই অর্থাক হল অমিল রায়।না সাথি, আমিও এই গাড়িতে এলাম।অণিমা কাছেই ছিল, বলল-সে কী? তোমার তো শ্যামলের সঙ্গে আসার কথা।-আসিনি।পূর্বা বলে-এ মা। কী হবে তা হলে?অপালা রেগে গিয়ে বলে-ঠিক জানি, একটা ভন্ডুল হবেই। এখন গঙ্গার ঘাটিমর ঢ্যাঙস চ্যাঙ্কস করে শ্যামলকে খোঁজো,ততক্ষণে নাড়িভুঁড়ি হজম হয়ে যাবে।অনিল রায় নিরুদ্বেগ গলায় বললেন- তাতে কী। ব্যারাকপুর তো আর নিউইয়র্ক নয়। ঠিক খুঁজে পাওয়া যাবে। ব্যারাকপুরের গঙ্গার ঘাটে আমি অনেক এসেছি এক সময়ে। চেনা
পৃষ্ঠা:৯৩
জায়গা।ঋপালা বাতাস শুঁকে বলে স্যার, জিলিপির গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। সবাই জিলিপির গন্ধ পায়। গন্ধে গন্ধে তারা দোকানের দিকে এগিয়ে গেল। মুহূর্তেই সকালের শান্ত দোকানঘরটা সচকিত হয়ে ওঠে কলকাতার হাউড়ে ছেলেমেয়ের কলকলানো কথার শব্দে। জিলিপির পাহাড় ধংসে পড়তে থাকে।সকাল নটাতেও বোস ফোটেনি। কুয়াশায় আবছা গঙ্গার ধার বড় নিস্তক। এ অঞ্চলটায় বাগানদেরা বারি একের পর এক। লোকজন নেই। পাহাড়ি জায়গার মতো কুয়াশায় হিম হয়ে আছে এক প্রাচীন নিওবারা। বাগানের মধ্যে কেবল মাধ্য উঁচু করে আছে কিছু মানুষের চেহারা। সত্যিকারের মানুষ নয়, পাথরের মূর্তি। কলকাতার রাস্তাঘাটে এক সময়ে যেসব সাহেবদের স্ট্যাচু ছিল তা তুলে এনে রাখা হয়েছে।অনিল রায় পাইপের ভাঁটি তুলে ম্যারকে দেখান, ইংরেজিতে বলেন ওই হচ্ছে সত্যিকারের ব্রিটিশ আয়চার। আউট্রামের মূর্তিটা এখন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে রেখে দিয়েছে। সে মূর্তি ভোল্ট যায় না। টুপি পড়ে গেছে, আউট্রাম ঘোড়ার পিঠ থেকে ঘুরে দেখছে এমন ডাইনামিক স্ট্যাচু খুব কম দেখা যায়। জীবন্ত পাথর। পার্ক গ্লিটে ওর পেডেস্টলে এখন গান্ধীর মূর্তি বসানো আছে সেটাও মন্দ নয়। কিন্তু তার গ্র্যাঞ্জারই কুয়াশার ভিতরে দেখা যায় আরও কয়েকজন পাথরের মানুষকে। প্রিটিশ আমলের কলকাতার সব স্মৃতি। অনিল রায়ের বোধ হয় সেই সব মূর্তি দেখে যৌবন বয়সের কলকাতার কথা মনে পড়ে যায়। তিনি ম্যাক্সের কাঁধে হাত রেখে একটু পিছিয়ে চলতে থাকেন। এবং একটি ব্যর্থ প্রেমের গল্পই বলতে থাকেন বোধ হয়।অন্যমনস্ত সোমেন এগিয়ে হাঁটছিল। পিছনে মেয়েরা। পূর্বা একটু এগিয়ে এসে বলে-কী কান্ড করলি বল তো।-এখন যদি শ্যামলকে খুঁজে না পুষ্ট আমরা। সোমেন কথাটায় কান না দিয়ে বলে পূর্বী, ভোদের বাড়ির ওপরতলায় একটা এক ঘরের ফ্লাট খালি আছে খুলছিল না।-হ্যাঁ। রথরুম বিল্ডন নিয়ে কমপ্লিট ফ্ল্যাট, বড় ঘর, চারধার খোলা। কেন?আমাকে মারতে দিবি?অণিমা এগিয়ে আসে কী বলছে রে পাজিটা?পূর্বা ঘাড় না ঘুরিয়ে বলে আমাদের বাড়িতে থাকতে চাইছে।থাকবে মানে? ঘরজামাই হয়ে নাকি? বলে হাসে অণিমা।পূর্বা ভীষণ লজ্জা পেয়ে বলে বাং। আমাদের তিনতলার ফ্ল্যাটটার কথা বলছে, তোরাযা মুখ পলকা না।অপাল, অণিমার ফেস্ট ধরে টেনে বলে-অরজামাই হবে কিরে, ও তোর বর ন্য? সেই যে বিয়ে করে এলি সেদিন, ভুলে গেছিস?সোমেন ‘আঃ’ বলে ধমক দেয়। তারপর পূর্বাকে বলে-সত্যিই আমার বড় দরকার।
পৃষ্ঠা:৯৪
একমাস আমাকে থাকতে দিবি।অপালা বড় বড় চোখে চেয়ে বলে-বাড়ির সঙ্গে ঝগড়া করেছিস? না কি কোনও পরীক্ষা-ফরীক্ষা নিবি। সোমেন বলে তা দিয়ে তোর কী দরকার? আমি তো পূর্বার কাছে ঘরটা ভাড়া চাইছি। মাগনা নয়।অপালা উত্তর দেয় তোকে দেবে কেন? পূর্বা ওটা একরুন প্রসপেকটিভ ব্যাচেলরকে ভাড়া দেবে, সব ঠিক হয়ে আছে। আই-এ এস বা ইঞ্জিনিয়ার। ডাক্তার যদিও আমি দুচোখে দেখতে পারি না, তবু তাও চলবে। তোকে দেবে কেন? বেকার, এম এ’র মতো সোজা পরীক্ষাটাও পাশ করিসনি। তোকে দিয়ে পূর্বার ভবিষ্যৎ কী? বরং ধারকর্জ দিতে দিতে ফতুর হতে হবে।কথাটা পূর্বার লাগে, গম্ভীর মুখখানা ফিরিয়ে বলে-কেন, ব্যাচেলারকে ভাড়া দেব কেন, আমার বুঝি বর জুটছে না।অপালা ধমক দিয়ে বলে-কোথায় জুটছে? ধুমসি হয়ে যাচ্ছিস।-তোরই বা কোন বর জুটছে শুনি।সোমেন বিরক্ত হয়ে বলে রোদের কারো ফুটবে না। এত ইয়ারবাজ হলে কারো বর জোটে। ছেলেপক্ষ যদি দেখতে আসে তো তাদের সঙ্গেও তেরো ইয়ারকি দিবি, পার্টি কেটে যাবে।মাইরি, মাইরি। অপালা লাফিরে উঠে বলে-আমাকে একটা পার্টি দেখতে এসেছিল কিছুদিন আগে, পাত্রের জ্যাঠামশাই আর একজন ভগ্নীপতি। আমি খুব সিরিয়াস হয়ে গিয়ে বদলাম। কিন্তু মাইরি জ্যাঠামশাইটা যা বটিকুল না, দেখেই হাসি এসে যাচ্ছিল, অনেক কষ্টে হাসি চেপেচুপে বসে রয়েছি। হঠাৎ শুনি টক-৪ ফাঁক-ফ একটা শব্দ। প্রথমে বুঝতে পারিনি শব্দটা কোথা থেকে আসছে। এদিক ওদিক চাইছি। পাত্রপক্ষকে খাবার-টাবার দেওয়া হয়েছে, তারা খাচ্ছিল আর আমার দিকে মাঝে মাঝে দেখছিল। হঠাৎ টের পেলাম, শব্দটা জ্যাঠামশাইয়ের নাক থেকে আসছে। যখনই খাবার মুখে দেয় লোকটা তখনই মুখবন্ধ অবস্থায় নাক দিয়ে শব্দটা হয়। নাকে পলিপাস থাকলে ও-রকম হয় অনেকের, মুখ দিয়ে শ্বাস টানে, কিন্তু মুখ বন্ধ করলেই জিন্না আমি মাইরি, আর চাপতে পারলাম। না, ফুচুক ঢুকুক করে হেসে ফেললাম। অণিমা জোরে হেসে ঋছে বলে-সত্যি।-মাইরি। কয়েদিন পর ওরা রিগ্রেট লেটার দিল। বাবার সে কী বকা আমাকে-কিন্তু কী করব বল তো?গঙ্গার উন্মুক্ত বিস্তারের সামনে এসে পড়তেই কনকন করে ওঠে ঠান্ডা বাতাস। সোমেন বলে তোদের কারও জুটবে না, আমি বলে দিচ্ছি।-ঠিক বলেছিস। অপালা দুঃখের গলায় বলে-কেবল আমাদের মধ্যে অণিমটাই যা লাকি। ওর জুটে গেল বোধ হয়।-কে? সোমেন অবাক হয়ে বলে।-দুজন তো দেখতে পাচ্ছি। তুই আর ম্যাক্স। ন্যায় তো রোজ প্রোপোজ করছে, একটু আগে গাড়িতেও করছিল। অপালা বলে।-যাঃ। অণিমা নক্কার ভাণ করে আজ করেনি।
পৃষ্ঠা:৯৫
-এই মিথ্যুক, তোরা যে ও-পাশের সিটে গিয়ে আলাদা হয়ে বসলি, তখন স্পষ্ট দেখলাম ম্যাক্স, তোকে কী বলল, আর তুই খুব মিষ্টি হেসে মাথা নিচু করলি।-না, না, সে অন্য কথা।-কী কথা শুনি? অপালা চোখ পাকায়।বলছিল কলকাতায় বলার দাম নাকি বড্ড বেশি। ও কলা ছাড়া থাকতে পারে না।-মাইরি। আমি বলেছি, সস্তায় ওকে কলা কিনে দেব।’মিন্টুক, মিথ্যুক’ বলে অপালা হাসতে থাকে। শীতের নদীর ধারটা বড় নিস্তক, জলের শব্দ নেই। ওরা ঢালু বেয়ে নামতে নামতেই দেখতে পেল, ডান ধারে একটু গাছপালার জড়াজড়ি, তার ওধারে দু-চারজন লোক। উনুনের ধোঁয়া উঠছে।ভারী খুশি হয়ে পূর্বা চেঁচায়-ওই যে।দূর থেকে তাদের দেখেই শ্যামল রূগারাগি করতে থাকে। কিন্তু কেউ চটে না। কারণ, শামেল চমৎকার ব্রেকফাস্ট সাজিয়ে রেখেছে, কটি-মাখন, ডিমসেও, কলা, চায়ের জল ফুটছে ইটের উনুনে। রান্নার দুজন দোক এনেছে শ্যামল, আর একজন নিরীহ চেহারার বন্ধু। বলেছিল বটে, একজন বন্ধুকে আনবে, তাহলে এ-ই। সোমেন লক্ষ করে, লোকটার চেহারা নাদুসনুদুস, মুখে ভালমানুষি আব বোকামি, পরনে খুব দামি সু্যুট, হাতে এক ঠোঙা আঙুর। শ্যামল যথেষ্ট মিহি ও মিষ্টি গলায় পরিচয় করিয়ে দেয়। লোকটার নাম মিহির বোস। শ্যামলের স্কুলফ্রেন্ড, চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। বড় ফার্মে চাকরি করে। পরিচয়ের পর হাতজোড় করে রেখেই অপালার দিকে চেয়ে বলে-সবাই বুঝি আপনারা এম-এ দিয়েছেন।তার চেহারার ভালমানুষি আর বোকা ভাব সবাই লক্ষ করেছে। অপানার মুখে হাসি। খেলে গেল বিদ্যুতের মতো। একটু চাপা গলায় বলে-দূর শালা, তা দিয়ে তোর কী হবে। বলেই নিপাট ভালমানুষের মতো গলা তুলে বলে-হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন তো।মিহির বোস পরিষ্কার আগের কথাটা শুনতে পেয়েছে, বুঝতে পেরে সোমেন বিরক্ত হয়ে অন্যদিকে মুখ যেকয়। কিন্তু মিহির বোষ্ট্র বনলেও রাগ করে না, বলে-ভারী সুন্দর স্পষ্ট কিন্তু এন। সারাদিন এই জায়গাটায় আপনাদের সঙ্গে কাটাতে পারব ভাবতেই ভাল লাগছে।হরি-হরি। চাপা গলায় অধিমা শ্বাস ফেলে বলে।-কী বললেন। মিহির একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।অণিমা অমায়িক হেসে বলে কিছু না, হরিব নামঅপালা হু-হু করে হাসছে। শ্যামল গাছতলায় শতরঞ্চি পাতছে, কী একটু আন্দাজ করে ধমক দিল-এই, বী হচ্ছে? আয় না তোরা, বোস এসে।অপালা হাসি চাপতে চাপতেই চাপা গলায় বলে-এই মিহির, বোস, বোস। তারপর গলা তুলে বলে-আয় রে সবাই বসি।খতমত খাওয়া মিহির বোস হাসতে চেষ্টা করে। অপালার দিক থেকে চোখ সরিয়ে অশিমার দিকে চায়। অণিমা সঙ্গে সঙ্গে এ দুটো নাচাতে থাকে। অপ্রস্তুত মিহির বোস চোখ সরিয়ে নেয়। অপালা, অণিমা আর পূর্বা গ্য টেপাটেপি করে হাসতেই থাকে।শতরক্ষিতে বসে অপালা খুব দুঃখের গলায় মিহির বোসকে বলে-বাড়ি ফিরে গিয়ে আজ আপনি নিশ্চয়ই আমাদের খুব নিন্দে করকেন?
পৃষ্ঠা:৯৬
ভালমানুষ মিহির বোস তটস্থ হয়ে বলে-না, না, সে কী।অপালা মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলে-করবে না রে অণি?-হ্যাঁ করবে রে অপা। জানেন মিহিরবাবু, আমরা না খুব খারাপ। অণিমা মুখখানা চুন করে বলে।-না, না। মিহির শোস ঠিক এই পায় না।অপালা হাতজোড় করে বলে-আমরা সত্যিই ভীষণ খারাপ। সেইজন্য কেউ আমাদের ভালবাসে না, না রে পূর্বা পূর্বা মাথা নাড়ে। আঁচিলে হাসি চাপতে গিয়ে কাশতে থাকে। -আমাদের তাই বিয়েও হবে না। অণিমা করুণ স্বরে বলে। অপালা তাকে একটা ঝাপটা মেরে বলেনা, না জানেন, আমাদের মধ্যে একমাত্র এই অণিমারই হবে। হত না কিন্তু। ভাগ্যিস লোকটা বাংলা তেমন জানে না। এই যে গঙ্গার ধারে উলেকুলো সাহেবটা দাঁড়িয়ে আছে আমাদের স্যারের সঙ্গে ওর সঙ্গে অণিমার ভাব। সাহেব বলেই করছে, ব্যঙালি হলে কিছুতেই- অধিমা উৎকণ্ঠিতভাবে বলে ও বাংল্য শিখে গেছে অনেকটা। তাই আর একদম প্রোপোজ করছে না আজকাল। আপনার হাতে ওটা কীসের ঠোঙা মিহিরবাবু? মিহির বোস এতক্ষণে কথা খুঁজে পেয়ে বঙ্গল-আঙুর। তারপর শ্বাস ফেলে বলে- খাবেন? অপালা হাত বাড়িয়ে সেডাটা নিঃসংকোচে নিয়ে নেব। বলে-পেটুক ভাববেন না তো? -না, না। বলে হঠাৎ মিহির বোস খুব হাসতে থাকে। সবাই তার দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে মিহির বোস বলে আমার খুব ভাল লাগছে। বলে চকচকে চোখে সে অপালার দিকে চেয়ে থাকে। অণিমা খাস ফেলে বলে তোরও ব্যবস্থা হয়ে গেল অপ্য। পাইপ মুখে অনিল রায়, আর চোখে নীলচে ফসফরাস নিয়ে রোগা সাহেব এগিয়ে আসে। অনিল রার বলেন কী হচ্ছে। পূর্ণা এতক্ষণে একটা রসিকতা করে ম্যাড্রিমণি স্যার।-ম্যাটিনি। অনিল বায় রাক হন। -না স্যার, ম্যাট্রিওগিরই সবাই এত জোরে হাসে, কেউ কিছু বুঝতে পারে না। ম্যাক্স কথা বলে খুব কম। কদিন দাড়ি কামায়নি, সাদা দাড়িগোঁফে মুখটা আচ্ছন্ন। সবুজ পাঞ্জাবির ওপর জহরকোট, নীচে পায়জামা, উলোঝুলো চুল, নয়লাক্ষ্যাপার মতো দেখাচ্ছে। সোমেনের পাশে এসে বসে পড়ল। সোমেন দুঃখ করে বলল-তুমি পুরো ভেতো বনে গেছ সাহেব। ম্যাক্স হাসল। দীন এবং মলিন একরকম হাসি। বাংলা বোঝে আজকাল। বলল-এ, ই, ঠিক কথা। -এবার গরমকালে তোমাকে বাঁদিপোতার গামছা পরিয়ে আম আর কাঁঠাল খাওয়াব। আমার গ্যান্ডফাদার আর ফাদার ওইভাবে খেত। কনুই পর্যন্ত রস গড়াবে, আর চেটে চেটে খাবে।
পৃষ্ঠা:৯৭
অপালা হাসতে হাসতে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলে যাা। গরমকাল পর্যন্ত ও থাকবে নাকি। সেদিন ফেয়ারওয়েল দেওয়া হল, দেখলি না? ও চলে যাচ্ছে।-যাচ্ছে কোথায়। কবে থেকে তো শুনছি যাবে-যাবে।-যাবে। অণিমা আজও পাকা কথা দেয়নি যে।অশিমা ফের লজ্জার ভাগ করে বলে-ও প্রোপোজ করে না আজকাল, মাইরি। বাংলা শিখে যাওয়ার পর থেকে
চৈদ্ধ
এদের দঙ্গলে সোমেন বড় একটা আসে না। ভাল লাগে না। একসঙ্গে পড়ত, কিন্তু এখন ওরা এগিয়ে রইল, সোমেন পড়া ছেড়ে দিয়েছে। পিকনিকেও আসত না, কিন্তু কাল গাবুর পড়ার ঘরে এসে অশিমা খুব ধরুল-আমরা চার-চারটে মেয়ে যাচ্ছি, পুরুষ মোটে তিনজন-ম্যাক্স, অনিল রায় আর শ্যামলের কে এক বন্ধু। তাই ব্যালান্স অফ পাওয়ার থাকছে না। তুমি চলো সোমেন। সোমেন অবাক হয়ে বলেছে কেন, শ্যামল যাবে না? অণিমা অবাক হয়ে বলে শ্যামলকে ধরেই তো চারজন মেয়ে। সোমেন হেসে ফেলে বলেছে-তাই বন্দ্রে।কথাটা নিদেত্ত নয়। মেয়েদের সঙ্গ ছাড়া শ্যামল কখনও থাকতে পারে না। পুরুষ বন্ধু শ্যামলের আছে কি নেই। থাকলেও তাদের সঙ্গ ও খুব পছন্দ করে না বোধ হয়। আশ্চর্যের বিষয়, মেয়েদের সঙ্গে মিশে ওর গলার স্বর আজকাল মিহি হয়ে গেছে। মিষ্টি করে হাসে, চোখের চাউনিতে কটাক্ষ দেখা যায়। অণিমা একটা শ্বাস ফেলে বলেছিল-জানো না তো. শ্যামল আজকাল পুরুষ মানুষ দেখলে বুক ঢাকার চেষ্টা করে।সোমেনের মন ভাল নেই। কাল রাতে দাদার কান্ডটা সারাক্ষণ মনে পড়ছে। মাঝে মাঝে শীতে কেঁপে উঠছে সে। এতকাল সংসারের ভিতরের গণ্ডগোলটা এমনভাবে তাকে স্পশ করেনি। দাদা এত নীচে নেমে যায়নি তৃপ্তনও। বড়দি মাকে ইনল্যান্ডে একটা চিঠি দিয়েছে, দাদা নাকি টালিগঞ্জের জমিটা বউদির নামে কিনবার চেষ্টা করছে। কেনে ঝিনুক, সোমেনের কিছু যায় আসে না। কিন্তু সেটা দাদা, মা বা সোমেনকে জানাতে পারত। জানায়নি। এটা নিয়েও হয়তো কথা ভুমিয়েনা। সংসারে আর একটা অশান্তি লেগে যাবে। পিকনিকে এসে সোমেনের তাই মান ভাল নেই।একা একা একটু ঘুরবে বলে দঙ্গল ছেড়ে বেরোচ্ছিল, এ সময়ে অণিমা সঙ্গ যরে বলে- কোথায় যাচ্ছ?-বসে থেকে কী হবে। আমার আজ ইয়ারকি ভাল লাগছে না। তোমরা মিহির বোসকে। যা বাঁদরুনাচ নাচাচ্ছ।-বা রে, আমাদের দোষটা কা? লোকটা অত বোকা কেন?সোমেন ক্ষীণ হাসে, বলে-অবশ্য লোকটারও খুব খারাপ লাগছে না। বোধ হয় অপালার প্রেমে পড়ে গেছে। -পড়েছেই তো। তোমার মতো হার্টিলেস নাকি। সোমেন একটা চিল কুড়িয়ে দুরের একটা ল্যাম্পপোস্টের দিকে ছুঁড়ল। লাগন না।
পৃষ্ঠা:৯৮
বলল-অণিমা, তুমি এবার একটা প্রেমে পড়ে যাও, নয়তো বাড়ি থেকে পছন্দ-করা ছেলেকে বিয়ে করে ফেল।-কেন?এমন সুন্দর বয়সটা পেরিয়ে যাচ্ছেখিলখিল করে ইয়ারকির হাসি হাসে অগিমা, বলে-ভীষণ ফ্রাস্টেটেডরা ওই সব কথা বলে। নিজের হচ্ছে না, তাই অন্যকে উপদেশ দেওয়া।-পুরুষের বয়স আর মেয়েদের বয়স কি এক? বলে আর একবার ল্যাম্পপোস্টটা লক্ষ্য করে ঢিল ছোঁড়ে সে। লাগে না।অণিমা হাত ধরে হঠাৎ তাকে থামিয়ে বলে-ব্যস, আর এগিয়ো না, এখান থেকেই ল্যাম্পপোস্টটায় লাগাও দেখি, ক’বারে পারো দেখব।সোমেন দাঁড়ায়। একটু হেসে ঢিল কুড়িয়ে নেয়। ছোঁড়ে। অনেক দূর দিয়ে সেটা চলে যায়। অণিমা তখন মুখ ফিরিয়ে বলে সোমেন, তোমার ঢিল ছোঁড়া দেখেই বোঝা যায় আজ তোমার মন খারাপ।-না না, কে বলল?ঢিলাটা ল্যাম্পপোস্টে লাগাতে বললাম কেন জানো? ওটা একটা সাইকোলজিক্যাল টেস্ট। খুব গম্ভীরমুখে অণিমা বলে।সোমেন জানে, এটা ইয়ারকি। তবু বলে ঠিক আছে, দাঁড়াও লাগাচ্ছি। একটার পর একটা ঢিল ছুঁড়ল সোমেন। একটাও লাগল না। অনেক দূর দূর দিয়ে চলেগেল। অণিমা হাসে, বলে-আর ছুঁড়ে কাজ নেই, আমার যা বোঝার তা বোঝা হয়ে গেছে।এখন চলো তো, কফি হচ্ছে।সোমেন একটা সিগারেট করায়, চারপাশে চেয়ে দেখে। কুয়াশা এখনও কাটেনি, তবু এই বেলা সাড়ে দশটায় ভোরের সূর্যের মতো এক রক্তিম কুয়াশায় ঢাকা সূর্য গঙ্গার জলে কী অপরূপ আলো ঝরিয়ে দিয়েছে। শ্রীরামপুর এখনও আবহা, তবু এক বিমূর্ত ছবির মতো ফুটে উঠছে নদীর ওপারে। জলে নৌকা, শীতের শান্ত নদীতে চিত্রার্পিত হয়ে আছে। এ পরে ব্রিটিশ আমলের গন্ধমাখা নির্জনতা, বাংলোবাড়ি, ভাঙা পাড়। শ্রীরামপুরের পশ্চাৎপট নিয়ে অশিমা দাঁড়িয়ে। অণিমার মুখশ্রীর হোর্থীও কোনও বড় রকমের খুঁত নেই। ভোরের আলোয় তাকে ভালই দেখাচ্ছে। একটু হাসিমুখ, চোখে করুনা। সোমেন মাথা নেড়ে বলে-তুমি ঠিকই ধরেছ, মন-কেন সেরাদের এ-কিছু না। ফুলে সোমেন ফিল কুড়িয়ে নেয়। আবার ছোঁড়ে।অশিমা বলে-আজ লাগবে না। যতই চেষ্টা করো।–লাগবে।–অত সোজা নয় মশাই।আচ্ছা দাঁড়াও, দেখাচ্ছি।তারপর আরও অনেকগুলো ঢিল ছোঁড়ে সোমেন। এক-আধটা খুব কাছ দিয়ে যায়। কিন্তু লাগে না। অণিমা বলে-ইস, আর একটু হলে লেগে গিয়েছিল।-লাগবে, দাঁড়াও না।আবার ছোঁড়ে সোমেন। যত মনঃসংযোগ করে ততই ল্যাম্পপোস্টটা আরও দূরের বস্তু,
পৃষ্ঠা:৯৯
অলীক কল্পনা, ছায়াশরীর হয়ে যায়। ডিল লাগবার বাস্তব টং শব্দটিন শোনা যায় না। -অমন ডেসপারেটভাবে ছুঁড়ো না। অণিমা সাবধান করে দেয়-কার গায়ে লাগবে। হতাশ হয়ে সোমেন বলে এক-একদিন এ-রকম হয়। সেদিন যে কাজেই হাত দাও সব পণ্ড হবে। এক-একটা দুষ্টু দিন আসেনা। অণিমা হাসে, বলে তুমি যতক্ষণ ল্যাম্পপোস্টটাকে ভুলে না যাবে ততক্ষণ ঢিল লাগবে -লাগবে না? দেখি।শ্যামল দূর থেকে তাদের নাম ধরে ডাকছে। অণিমা সাড়া দিয়ে সোমেনকে বলে- চলো, চলো, কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।সোমেন মাথা নেড়ে বলে না, যতক্ষণ না লাগাতে পারি ততক্ষণ যাচ্ছি না।-আচ্ছা পাগল। ছেলেমানুষ একটা।সোমেন হেসে আরও কয়েকটা ঢিল কুড়িয়ে বাঁ হাতে জড়ো করে।-লক্ষভেদ করে কোন দ্রৌপদীকে পাবে বাবা। ঠান্ডা কফি আমি দু-চোখে দেখতে পারি না-বলে অণিমাচলে যায় রাগ করে।সোমেন একা নিরর্থক ল্যাম্পপোস্টে ঢিল লাগানোর গেলাটা খেলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত লক্ষ্যও স্থির থাকে না। কত কথা ভাবে, আর আন্দাজে ক্লান্ত হাতে ঢিল ছোঁড়ে। অনভ্যাসে হাত ব্যগিয়ে ওঠে, শীতের বাতাসে নিষ্পলক চোখে জল আসে। তবু আক্রোশে, হতাশায় ঢিল ছুঁড়তে থাকে সোমেন। ফ্রাস্টেশন। তাই হবে।টং করে অবশেষে একটা ঢিল লাগল। সোমেন একা একা হাসল। সফলতার একটা ক্ষীণ আনন্দ টের পায় সে. এত তুচ্ছ ব্যাপার থেকেও। পরমুহূর্তেই ভাবে, কত নিরর্থক। হাত ব্যথা করছে, ক্লান্তি লাগছে। তারপর একা সোমেন বহুদূর পর্যন্ত হেঁটে চলে গেল।একটু দূরে একটা গাছের তলায় অনিল রায় হুইস্কির বোতল খুলে বসেছেন, তাঁর সামনে গেলাস হাতে ম্যাক্স আর মিহির বোস। শ্যামল রান্নার তদারকিতে ব্যস্ত, তার কোমরে গামছা, পূর্বা তার গোজ কুচিয়ে সিস্ট্রেট গাছের ডালে একটা খাটো দোলনা বেঁধে দুলছে অপালা। অণিমার হাতে বই, হাঁটু বুকে গাছতলায় বসে আছে।-কী করছিলি এতক্ষণে একটা ধমক দেয় অপালা।সোমেন বলে ভেবেছিস। কোথাকার, দোলনা ছিঁড়লে বুঝবি মজা। এখনও বয়স বসে আছে-তোর ঢিল ছুঁড়বার বয়স থাকলে আমারও দোলনার বয়স আছে।অণিমা মুখ তুলে গম্ভীর গলায় বলে শোনো।- শেষ পর্যন্ত তুমি ল্যাম্পপোস্টটায় ঢিল লাগিয়েছিলে?-কবারে?-খেয়াল করিনি। কেন?-ভাবছিলাম। জানিস অপা, সোমেনের খুব ডিটারমিনেশন, ও দেখিস, উন্নতি করবে।
পৃষ্ঠা:১০০
-কীসে বুঝলি? অপালা দোলনা থেকে নেমে কাছে আসতে আসতে বলে। -ঢিল ছোঁড়া দেখে। অপালা শ্বাস ছেড়ে বলে-ঠিকই, ও খুব বীর। অণিমা কিছুর মতো মুখ করে বলে-না, না, ওকে এতকাল যা ভেবেছিল ও কিন্তু তা নয়। চিলটা লাগানো খুব শক্ত ছিল, ও কিন্তু পেয়েছে। সোমেন রেগে গিয়ে বলে-তুমিই তো ঢিলটা লাগাতে বললে। অণিমা হঠাৎ চোখ বড় করে তাকায়। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে সোমেনের দিকে, তারপর যেন সম্মোহন থেকে জেগে উঠতে উঠতে বলে তুমি সেজন্যই অত সিরিয়াস হয়ে গেলে? না হয় আমার মুখ থেকে একটা কথা বেরিয়েই গেছে। বলে আবার বিহ্বল চোখে চেয়ে থাকে অণিমা। আস্তে করে বলে-ভেবেও সুখ যে একজনের কাছে আমার কথার এত দাম। সোমেন। তুমি কী তবে-বলে থেমে চেয়ে খাকে অণিমা। সোমেন মাথা নাড়ে। বড় বড় চোখে অণিমার দিকে তাকায়। আস্তে করে গাঢ় স্বরে বলে-তবে আজ বলি? অশিমা মাথা নেড়ে কানে হতে চাপা দেয়, ভয়ার্ত গলায় বলে-না, না, এখন নয়। যেদিন ফুল-টুল ফুটবে, চাঁদ-চাঁদ উঠবে, লোডশেডিং থাকবে, সেদিন দূরে কোথাও গিয়ে- অপালা ব্যাপারটা দেখে খুব ঘাবড়ে গিয়েছিল। এতক্ষণে হঠাৎ শ্বাস ছেড়ে বলল- মাইরি, পারিস তোরা। কিন্তু ও কথাটা কী। সোমেন কী বলতে চাইছিল, আর তুই-ই বা চাঁদ ফুল-লোডশেডিং কী বললি ও-সব? ও একটা গোপন কথা। অণিমা বলে। আমার সঙ্গে কেউ গোপন কথা বলে না, মাইরি। অপালা দুঃখের গলায় বলল-বলবি না, এই সোমেন? কিরে? -ওটা কেবল আমার আর অণিমার একটা ডায়লগ। তুই বুঝবি না। সিক্রেট। -ইস, সিক্রেট। মারব খায়ড়। বল শিগগির। -এই সোমেন। অপালা রেগে সোমেনের হাত ঘর্মিচে ধরে। অন্য হাতে একটা থাপ্পড় কযায় পিঠে। সোমেন বলে-ইস, হাহেরী জোর। একদম ব্যাটাছেলে। -বলবি না। -তোর বিকুে এই না, না, বুঝলি। সোমেন বলে-হলেও বর ফেরত দিয়ে যাবে। এমন ব্যাটাছেলে মার্কিন দেয়ে জন্মে দেখিনি।-ছেলেগুলো মেনিমুখো হলে আমাদের ব্যাটাছেলে হতেই হয়। সোমেন একটু দূরে দাঁড়িয়ে বলে- সেজন্যই ছেলে আর মেয়েতে ফ্রি মিক্সিং ভাল নয়। দুপক্ষেই ভেজাল মিশে যায়।অশিমা গম্ভীর হয়ে বলে-সেই জনাই বুঝি তুমি আমাদের সঙ্গে সহজে মিশতে চাও না সোমেন। ছোঁয়াচ বাঁচাচ্ছ?-বটেই তো। আমার বউ হবে একটা আস্ত মেয়েমানুষ, তার মধ্যে ব্যাটাছেলের যেমন ভেজাল চলবে না, তেমনি আমার মধ্যে মেয়েছেলের ভেজাল থাকলে সে-ই বা খুশি হবে কেন?
পৃ্ষ্ঠা ১০১ থেকে ১২০
পৃষ্ঠা:১০১
-ইস। অপালা ঠোঁট গুলটিনয়-বউ। কোন বউ তোর জন্য ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে আছে। তোদের জেনারেশন বিয়ে হবে ভেবেছিস? বউ। মারব গাল্লড়। -তুই ঠিক পূর্বার মতো হয়ে যাচ্ছিস। আমার বউয়ের কথা শুনে তোর চটবার কী? সোমেন দু-পর পিছিয়ে গিয়ে বলে-আমার একটা বউ হতে নেই। ভিখিরিরও আর কিছু না হোক একটা বউ হয়। -কিন্তু তোর হবে না। বলে অপাল্য আঙুল তুলে তেড়ে আসে-তোর কিছুতেই হবে সোমেন তেমনি তটস্থ ভাব দেখিয়ে পিছিয়ে গিয়ে বলে-কিন্তু প্রায় হয়ে গেছে যে। অপালা থমকে গিয়ে হ। কুঁচকে তাকায়, বলে-কো সোমেন তখন গালগলা চুলকোয়, চোখমুখ বিকৃত করে নানারকম, তারপর হঠাৎ বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলে-দেখছিও তো কবো না, লম্বা ঘুষি মারেগা, হা রে মনোপাগলা- -ও কিরে? অপালা চেঁচিয়ে হেসে ওঠে। – মনোপাগলা নামে একটা পাগল আসত আমাদের বাড়িতে। সে বলত। অণিমা আর একটা কপট শ্বাস ফেলে বলে-তুই বুঝিসনি অপা। -কী বুঝিনি। -সোমেন প্রেমে পড়েছে। কিন্তু তার কথা আমাদের কাছে বলবে না। ওই ছড়াটার মধ্যে সেটাই বলে দিল। দেখেছে, বলবে না। না, সোমেন। –মাইরি। অপালা চোখ বড় করে বলে-পড়েছিস? -কেমন দেখতে রে? -দেখছিও তো করো না।-আবার? সোমেন সিগারেট ধরায়, বলে-কী করে বলি কেমন দেখতে। তাকে এখনও ঠিক চোখে দেখিনি, তবে বাশি শুনেছি। বল না। বল না। সোমেন অণিমার দিকে তাকায়, রেৎি গাঢ় স্বরে বলে-এই অনি, বলে দাও না সোনা। আর লুকিয়ে রেখে লাভ কী অণিমা ইয়ারকিটো প্রফেট নেয়।। লাজুক নতমুখে বলে-যাং, আমার ভারী লজ্জা করে। বলে অণিমা আঙুল কামড়ায়। ধুস! অপলা ভারী হতাশ হয়ে বলে- সেই পুরনো ইয়ারকি। যা ফাজিল হয়েছিস না তোরা। সোমেন, বলবি না তো। -দেখছিও তো কবো না-সোমেন সুর দিয়ে বলে-লম্বা ধুষি মারেগা, হা রে মনোপাগলা- ভেদ হয় না, কিছুতেই ভেদ হয় না বলে অপালা হঠাৎ দু-পা এগিয়ে এসে সোমেনের সোয়েটারটা বুকের কাছে খিমচে ধরে বলে-বলবি না? বল শিগগির। সোমেন বলে-হাড় ছাড়, মোটে একটাই সোয়েটার আমার, বেকার মানুষ। -বল তা হলে।
পৃষ্ঠা:১০২
-বলছি বলছি পূর্বা। সোয়েটারটা মুঠো করে মোচড়ায় অপালা-বদ শিগগির ঠিক করে। -বলতেই হবে? -হিড়লাম কিন্তু।-তুই।অপালা একটা ধাক্কা দিয়ে ঘন শ্বাস ফেলে বলে-ইস, সাহস কত।পিকনিক থেকে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেল। বসে গিয়েছিল, রাতে খাবে না। তার কারণ, এ বাড়িতে অন্নগ্রহণ করতে তার অরুচি।জামাকাপড় ছেড়ে অনেকটা ঠান্ডা জল খেয়ে শুয়ে পড়তে যাচ্ছিল সে। ননীবালা এসে বলেন-দুটো ভাত খাবি না?-রাতে না খেলে হাতি শুকিয়ে যায়, যা হোক দুটো খা।সোমেন একটু রেগে গিয়ে বলে-না, খিদে নেই। খাওয়া নিয়ে ঘ্যান ঘ্যান করো না তো, ভাল লাগে না।ননীবালা হাল ছাড়েন না। মুখে কিছু না বলে পান অর প্রকবার কৌটো খুলে বসেন। বলেন কখন থেকে ভাত তরকারি গরম করে বসে আছি। গরম কি থাকে। শীতকাল, টপ করে জুড়িয়ে যায়।-তুমি খাওনি?ননীবালা ছেলের চোখের দিকে চেয়ে একটু তাচ্ছিলোর মতো করে বলেন-বাব। তাড়াকী? তুইও দুটো মুখে দিতিস।সোমেন একটা শ্বাস ছেড়ে বলে-সহজে ছাড়বে না, না বুফি?-ছেলেরা না খেলে না যে বড় জব্দ হয়ে যায়।-দাদা ফিরেছে?-ই। কখন শুয়ে পড়েছে। একটু আগে শুনছিলাম ও-ঘরে কথাবার্তা চলছে। ভাব হয়ে গেছে বুঝি।-আবার ওদের দরজায় কান পেতেছিলে। সোমেন মার দিকে কটমট করে তাকায়। ননীবালা বিরসমুখে বলে তুই কেবল আমার কান পাতা দেখিস। কান পাতব কেন?জোরেই বলছিল, শুনেছিই।সোমেন হতাশ হয়ে বলে-তোমাকে নিয়ে পারি না। যত গণ্ডগোলের মূলে তুমি ঠিক থাকবে। গ্রেমে আর ছেলের বউ ঘরে কী বলে না বলে তা শুনতে তোমার লজ্জা করে না? ননীবালা অন্য সময় হলে এ কথায় রেগে যেতেন। কিন্তু এখন তাঁকে খুনই ভীতু আর হতাশ দেখাচ্ছিল। বললেন-সংসারের সব কি তুই বুঝিস। ছেলেদের ভালমন্দের জন্য মাকে অনেক অন্যায় করতে হয়। লজ্জা-ফেলা যাকলে চলে না।সোমেন স্থির দৃষ্টিতে ননীবালার চোখের দিকে চেয়ে বলে-তার মানে তুমি আড়ি পেতে ওদের কথা শুনেছ।তুই দুটি খেয়ে আমাকে ছেড়ে দে তো। শীতের রাত, অও অনেক বেজে গেছে। বলে সোজা পানটা মুখে না দিয়ে রেখে দেন নদীযালা। ছেলের দিকে চেয়ে বলেন-চল।
পৃষ্ঠা:১০৩
সোমেন কথা বলে না। কিন্তু খেতে যায়। কয়েক দিন হল, রান্নাঘরের এক ধারে টেবিল পাতা হয়েছে। টেবিলটা ভালই। শঠারেক খরচ করে বাদা বানাল। ওপরে কালচে রঙের সানমাইকা লাগানো, পায়ায় পেতলের শু। চেয়াকগুলোও চমৎকার। রান্নাঘরটা বেশ বড়, তবু টেবিল চেয়ার পাতার পর আর বেশি জায়গা নেই। নদীবকলা টেবিলে খান না, তাঁর এঁটো বাবিক। টেবিলে খেলে সর্বস্ব এঁটো হয়। সোমেন টেবিলে খেতে বসলে মা তার পায়ের কাছটিতে একটা ছোট্ট কাঁসার বাটিতে নিজের জন্য একটু ভাত আর মাছের ঝোল নিয়ে বসেন। ভাল করে খেতে পারেন না। অনিচ্ছায় মুখে গ্রাস তুলে অনেকক্ষণ ধরে চিবোন। সোমেন জিজ্ঞেস করে চার কোনও হাঙ্গামা হয়নি তো? -না, কী হবে। আমে দুধে মিশে গেছে বাঝা। আঁটিটা পড়ে আছে। সোমেন চাপা ধমক দিয়ে বলে-বেন, তাতে তোমার গা জ্বালা করছে? ওদের মিলমিশ হলে তোমার ক্ষতিটা কী হল? -ক্ষতিব কথা বলেছি? মিলমিশ হয়েছে ভালই তো। -তবে বলছ কেন? ননীবালা চুপচাপ ভাতের মাস চিবোতে থাকেন। হঠাৎ বলেন-তোর চাকরিটা হল না কেন? -হল না, এমনিই। সোমেন বিরক্ত হয়ে গেল-কেন, আমার চাকরি দিয়ে কী হবে? -মাঝে মাঝে ভাবি, তোর একটা কিছু হলে বরং একটু আলাদা বাসা-ভাসা করলে হয়। সোমেন উঠে পড়ে। ননীবালা খুব সম্প্রতি পান আর জরদার নেশা ধরেছেন। শোওয়ার আগে পান না হলে আজকাল চলে না। পানের বালি নিয়ে বসতে যাবেন, জাঁতিটা মেঝেয় পড়ে শব্দ হল। সোমেন শুয়েছিল, বলল–আঃ। -জেগে আছিস। -না ঘুমোচ্ছি। বিরক্ত হয়ে। সোমেন খুদে। ননীবালা শ্বাস ফেদেন। সোমেন পাশ ফিরে বলে করে জাঁতিটার শব্দ করলে না। -না, পড়ে গেল। দ। আমাকে জাগিয়ে এখন ওদের নিন্দেমন্দ করতে বসবে তো। -সংসাছে পার্কতে হলে অমন উদোর মতো থাকবি কেন? সব জেনেবুঝে থাকতে হয়। -জেনেবুঝে আমার দরকার নেই। আমি ভীষণ টায়ার্ড, শুয়ে পড়ো, বিরক্ত কোরো না। ননীবালা কথা বলেন না। গান গেয়ে ভাবরে পিক ফেলেন। বাতি নিবিয়ে মশারির মধ্যে ঢুকে যান। কিন্তু নানারকম শ্বাসের শব্দ আসে। একবার অস্ফুট কন্ঠে বলেন-যা মশা। তারপর আবার যানিকক্ষণ চুপ থেকে সোমেন জেগে আছে কি না বুঝনার চেষ্টা করেন। আপন মনেই বলেন-জে বাচ্চা দুটোকে আমার বাছ থেকে নিয়ে গেল। ওরা যেতে চায়নি। আমার কাছে তো বড় একটা শুতে পার না। -বেশ করেছে, নিয়ে গেছে। সোমেন বালিশে কান চেপে রেখে বলে-ওদের বাচ্চা ওরা নিয়ে যাবে না কেন। তা ছাড়া তুমিই তো বলো যে ওরা তোমার ঘর নোংরা করে,
পৃষ্ঠা:১০৪
-কীসে বুঝলি? অপাদা দোলনা থেকে নেমে কাছে আসতে আসতে বলে।-ঢিল ছোঁড়া দেখে।অপালা শ্বাস ছেড়ে বলে-ঠিকই, ও খুব বীর।অণিমা বিছুর মতো মুখ করে বলে-না, না, ওকে এতকাল যা ভেবেছিল ও কিন্তু তা নয়। চিলটা লাগানো খুব শক্ত ছিল, ও কিন্তু পেয়েছে।সোমেন রেগে গিয়ে বলে তুমিই তো চিলটা লাগাতে বললে।অণিমা হঠাৎ চোখ বড় করে তাকায়। অনেকক্ষন তাকিয়ে থাকে সোমেনের দিকে,তারপর যেন সম্মোহন থেকে জেগে উঠতে উঠতে বলে তুমি সেজন্যই অত সিরিয়াস হয়ে গেলে? না হয় আমার মুখ থেকে একটা কথা বেরিয়েই গেছে। বলে আবার বিহ্বল চোখে চেয়ে থাকে অণিমা। আস্তে করে বলে- ভেবেও সুখ যে একজনের কাছে আমার কথার এত দাম। দোমেন। তুমি কী তবে বলে থেমে চেয়ে থাকে অশিমা।সোমেন মাথা নাড়ে। বড় বড় চোখে অণিমার দিকে তাকায়। আস্তে করে গাঢ় স্বরে বলে তবে আজ বনি।অণিমা নাথা নেডে কানে হাত চাপা দেয়, ভয়ার্ত গলায় বলে না, না, এখন নয়। যেদিন ফুল টুল ফুটবে, চাঁদ চাঁদ উঠবে, লোডশেডিং থকবে, সেদিন দূরে কোথাও গিয়ে অপাল্য ব্যাপারটা দেখে খুব ঘাবড়ে গিয়েছিল। এতক্ষণে হঠাৎ খাস ছেড়ে বলল- মাইরি, পারিস তোরা। কিন্তু ও কথাটা কী। সোমেন কী বলতে চাইছিল, আর তুই-ই বা চাঁদ ফুল লোডশেডিং কী বললি ও-সব। -ও একটা গোপন কথা। অণিমা বলে। -আমার সঙ্গে কেউ গোপন কথা বলে না, মাইরি। অপালা দুঃখের গলায় বলল-বলবি না, এই সোমেন? কিরে? -ওটা কেবল আমার আর অণিমার একটা ডায়লগ। তুই বুঝবি না। সিক্রেট। ইস, সিক্রেট। মারব থাপ্পড়। কল শিগগির। না। -এই সোমেন। অপালা রেগে সোমেনের হাত স্থার্মচে ধরে। অন্য হাতে একটা থাপ্পড় কথায় পিঠে। সোমেন বলে-ইস, হাতুে এই জোর। একদম ব্যাটাছেলে। -তোর বিয়ে হাব না, বুঝলি। সোমেন বলে-হলেও বর ফেরত দিয়ে যাবে। এমনক্যাটাছেলে মন্ত্রী মেয়ে জন্মে দেখিনি। -ছেলেগুলো মেনিমুখো হলে আমাদের ব্যানছেলে হতেই হয়। সোমেন একটু দূরে দাঁড়িয়ে বলে সেজনাই ছেলে আর মেয়েতে ফ্রি মিক্সিং ভাল নয়। দুপক্ষেই ভেজাল মিশে যায়। অণিমা গম্ভীর হয়ে বলে- সেই জন্যই বুঝি তুমি আমাদের সঙ্গে সহজে মিশতে চাও না সোমেন। ছোঁয়াট বাচাচ্ছ? -বটেই তো। আমার বউ হবে একটা আস্ত মেয়েমানুষ, তার মঞ্চে ব্যাটাছেলের যেমন ভেজাল চলবে না, তেমনি আমার মধ্যে মেয়েছেলের ভেজাল থাকলে সে-ই বা খুশি হবে। কেনা?
পৃষ্ঠা:১০৫
-ইস। অপালা ঠোঁট ওনটায় এট: কোন নট ভোর জন্য ঠ্যাং ছড়িয়ে বদে নাছে।তোদের জেনারেশন বিয়ে হবে ভেবেছিস। কষ্ট। মারব থাপ্পড়। -তুই ঠিক পূর্বার মতো হয়ে যাচ্ছিস। আমার বউয়ের কথা শুনে তোর চটবার কীং সোমেন দু-পা পিছিয়ে গিয়ে বলে-আমার একটা কউ হতে নেই? ভিখিরিরও আর কিছু না হোক একটা বউ হয়।কিন্তু তোর হবে না। বলে অপালা আঙুল তুলে ভেড়ে আদে-তোর বিছুতেই হবেসোমেন তেমনি তটস্থ ভাব দেখিয়ে পিছিয়ে গিয়ে বলে-কিন্তু প্রায় হয়ে গেছে সো অপালা থমকে গিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকায়, বলে-কে! সোমেন তখন গালগল্য চুলকোয়, চোসমুখ বিকৃত করে নানারকম, তারপর হঠাৎ বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলে-দেখছিও তো কবো না, লক্ষ্য ঘুষি মারেগা, হা রে মনোপাগলা- -ও কিরে? অপালা চেঁচিয়ে হেসে ওঠে। মনোপাগলা নামে একটা পাগল আসত আমাদের বাড়িতে। সে বলত। অণিমা আর একটা কপট শ্বাস ফেলে বলে-তুই বুঝিসনি অগা। কী বুঝিনি? -সোমেন প্রেমে পড়েছে। কিন্তু তার কথা আমাদের কাছে কলবে না। এই ছড়াটার মধ্যে সেটাই বলে দিল। দেখেছে, বলবে না। না, সোমেন। -মাইরি। অগালা চোখ বড় করে বলে পড়েছিস ? -কেমন দেখতে বো? -দেখছিও তো করো না।সোমেন সিগারেট ধরায়, বালে কী করে বলি কেমন দেখতে। তাকে এখনও ঠিক চোখে দেখিনি, তবে বাঁশি শুনেছি।বলনা বল না। সোমেন অনিমার দিকে তাকায়, মৎ আর লুকিয়ে রেখে লাভ কী। গড় পরে বলে-এই অনি, বলে দাও না সোনা। অণিমা ইয়াংকিটা লুফে লাজুক নতমুখে বলে-যাঃ, আমার ভারী লজ্জা করে। তুমিই বলো। বলে শ কামড়ায়। খুস: অঞ্চী ভারী হতাশ হয়ে তোরা। সোমেন, বলবি না তো? বলে-সেই পুরনো ইয়ারকি। যা ফাজিল হয়েছিস না-রেখছিও তো করো না সোমেন দূর দিয়ে বলে-লম্বা খুঁতি মারেগ, হা রে মনোপাগলা- ভেদ হয় না, কিছুতেই, ভেদ হয় না বলে অপালা হঠাৎ দুঃপর এগিয়ে এসে সোমেনের সোয়েটারটা বুকের কাছে বিমচে ধরে বলে-বলবি না। বল শিগগির। সোমেন বলে-ছাড় ছাড়, মোটে একটাই সোয়েটার আমার, বেকার মানুষ। -বল তা হলে।
পৃষ্ঠা:১০৬
-বলছি, বলছি, পূর্ব। সোরেনিরটা মুঠো করে মোচড়ায় অপালা বল শিগগির ঠিক করে। -জাতেই হবে?ছিলাম কিন্তু। তুই। অপালা একটা ধাক্কা দিয়ে ঘন শ্বাস ফেলে বলে-ইস, সাহস কত। পিকনিক থেকে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেল। বলে গিয়েছিল, রাতে খাবে না। তার কারণ, এ বাড়িতে অন্নগ্রহণ করতে ভার অরুচি। জামাকাপড় হেডে অনেকটা ঠান্ডা জল খেয়ে শুয়ে পড়তে যাচ্ছিল সে। ননীবালা এসে বলেন-দুটো ভাত খাবি না? -না। রাতে না গেলে হাতি শুকিয়ে যায়, যা হোক দুটো খা। সোমেন একটু রেগে গিয়ে বলে-না, খিদে নেই। খাওয়া নিয়ে ঘ্যান ঘ্যান করো না তো, ভাল লাগে না। ননীবালা হাল ছায়েন না। মুগে কিছু না বলে পান আর জরদার কৌটো খুলে বসেন। বলেন-কখন থেকে ভাত তরকারি গরম করে বসে আছি। গরম কি থাকে। শীতকাল, টপ করে জুড়িয়ে যায়। -তুমি যাওনি? ননীবালা ছেলের চোখের দিকে চেয়ে একটু তাচ্ছিল্যের মতো করে বলেন-খাব। তাড়া কী? তুইও দুটো মুখে দিতিস। সোমেন একান শ্বাস ছেড়ে বলে সহজে ছাড়বে না, না বুড়ি? -ছেলেরা না খেলে মা যে বড় রূপ হয়ে যায়। ফিরেছে।-ই। কখন শুয়ে পড়েছে। একটু আগে শুনছিলাম ও-ধরে কথাবার্তা চলছে। ভাব হয়ে গেছে বুঝি। অবার ওদের দরজায় কান চৈতেছিলে? সোমেন মার দিকে কটমট করে তাকায়। ননীবালা বিরসমুখে বন্দে তুই কেবল আমার কান-পাতা দেখিস। কান পাতব কেন?জোরেই বলছিল, গুি সোমেন হতাশ হয়ে বলে-তোমাকে নিয়ে পারি না। যত গণ্ডগুেলের মূলে তুমি ঠিক থাকবে। ছেলে আর ছেলের বউ ঘরে কী বলে না বলে তা শুনতে তোমার সজ্জা করে না? ননীবালর অন্য সময় হলে এ কথায় রেগে যেতেন। কিন্তু এখন তাঁকে পূর্ণই ভীতু আর হতাশ দেখাচ্ছিল। বলদেন-সংসারের সব কি তুই বুঝিস? ছেলেদের ভালমন্দের জন্য মাকে অনেক অন্যায় করতে হয়। লজ্জা-যেন্না থাকলে চলে না।সোমেন স্থির দৃষ্টিতে ননীবালার চোখের দিকে চেয়ে বালে-তার মানে তুমি আড়ি পেতে ওদের কথা শুনেছ। -তুই দুটি খেয়ে আমাকে হেডে দে তো। শীতের রাত, তাও অনেক বেজে গেছে। বলে সোজা পানটা মুখে না দিয়ে রেখে দেন ননীবাল্য। ছেলের দিকে চেয়ে বলেন-চল।
পৃষ্ঠা:১০৭
সোমেন কথা বলে না। কিন্তু খেতে যায়। কয়েক দিন হল, রান্নাঘরের এক ধারে টেবিল পাতা হয়েছে। টেবিলটা ভালই। শ’চারেক খরচ করে দাদা বানাল। ওপরে কালচে রঙের সানমাইকা লাগানো, পায়ায় পেতলের ৩। চেয়ারগুলোও চমৎকার। রান্নাঘরটা বেশ বড়, তবু টেবিল চেয়ার পাতার পর আর বেশি জায়গা নেই। ননীকান্ত টেবিলে খান না, তাঁর এঁটো বাতিক। টেবিলে খেলে সর্বস্ব এঁটো হয়। সোমেন টেবিলে খেতে বসলে মা তার পায়ের কাছটিতে একটা ছোট্ট কাঁসার বাটিতে নিজের জন্য একটু ভাত আর মাছের ঝোল নিয়ে বসেন। ভাল করে খেতে পারেন না। অনিস্থায় মুখে গ্রাস তুলে অনেকক্ষণ ধরে চিবোন।। সোমেন জিজ্ঞেস করে-আর কোনও হাঙ্গামা হয়নি তো? না, কী হবে। আমে দুধে মিশে গেছে বাবা। আইটিটা পড়ে আছে। সোমেন চাপা ধমক দিয়ে বলে কেন ভাতে তোমার গা জ্বালা করছে? ওদের মিলমিশ হলে তোমার ক্ষতিটা কী হল? ক্ষতির কথা বলেছি? মিলমিশ হয়েছে ভালই তো। -তবে বলছ কেন? ননীবালা চুপচাপ ভাতের গ্রাস চিবোতে থাকেন। হঠাৎ বলেন তোর চাকরিটিন হল না কেন? -হল না, এমনিই। সোমেন বিরক্ত হয়ে গেল-কেন, আমার চাকরি দিয়ে কী হবে? -মাঝে মাঝে ভাবি, তোর একটা কিছু হলে বরং একটু আলাদা বাসা টাসা করলে হয়। সোমেন উঠে পড়ে। ননীবালা খুব সম্প্রতি পান আর জরদার নেশা ধরেছেন। শোওয়ার আগে প্রান না হলে আজকাল চলে না। পানের বাটা নিয়ে কম্বতে যাবেন, জাতিটা মেঝেয় পড়ে শব্দ হল। সোমেন শুয়েছিল, বলল-অ্যা। জেগে আছিস? না ঘুমোচ্ছি। বিরক্ত হয়ে সোমেন বলে। ননীবালা শ্বাস ফেলেন। সোমেন পাশ দিরে বলে – করে জাতিটার শব্দ করলে না? না, পড়ে গেল। ও- সব চালাকি আছে- আনি। আমাকে জাগিয়ে এখন ওদের নিন্দেমন্দ করতে বসবে তো। -সংসারে থাকতে হলে অমন উদোর মতো থাকবি কেন? সব জেনেবুঝে থাকতে হয়। -জেনে বুঝে আমার দরকার নেই। আমি ভীষণ টায়ার্ড, শুয়ে পড়ো, বিরক্ত কোরো না। ননীবালা কথা বলেন না। পান খেয়ে ডাবরে পিক ফেলেন। বাতি নিবিয়ে মশারির মঞ্চে ঢুকে যান। কিন্তু নানারকম শ্বাসের শব্দ আসে। একবার অস্ফুট কণ্ঠে বলেন-যা মশা। তারপর আবার খানিকক্ষণ চুপ থেকে সোমেন জেগে আছে কি না বুঝবার চেষ্টা করেন। আপন মনেই কলেন-আজ বাচ্চা দুটোকে আমার কাছ থেকে নিয়ে গেল। ওরা যেতে চায়নি। আমার কাছে তো বড় একটা শুতে পায় না। -বেশ করেছে নিয়ে গেছে। সোমেন বালিশে কান চেপে রেখে বলে-গুদের আয়া ওরা নিয়ে যাবে না কেন? তা ছাড়া তুমিই তো বলো যে ওরা তোমার ঘর নোংরা করে,
পৃষ্ঠা:১০৮
গুদের পায়ের ধুলোবালিতে তোমার বিছানা কিচকিচ করে।-সে তো সত্যি। তোরা চারটে ছেলেমেয়ে বড় হওয়ার পর থেকে বাচ্চাকাচ্চা বড় একটা টানি না তো।-তা হলে আর দুখে কীসের?ননীবালা হঠাৎ একটু চড়া গলায় বলেন সব না শুনে অত রাগ-রাগ করাছিদ কেন।-শুনতে চাই না। ঘুমোও।ননীবালা নিইয়ে দিয়ে বলেন-ই। ঘুম কি আর ছট বলতেই আসে। আজ বাবুটা চড়ে গেছে। ঘুম আর হবে না।-তা হলে আমাকে ঘুমোতে বাও।-ওখানে কী কী খাওয়াল আজ? ননীবালা প্রসঙ্গ পালটান খুব কৌশলে।-রণোটা সারাদিন কোথায় কী খেল কে জানে। বহেরর ওখানে যাওয়ার কথা ছিল, সেখানেই গিয়েছিল বুঝতে পারলাম না। কথা বলতে সাহস পেলাম না। রাতে কিছু খেল না। মুখখানা শুকনো দেখাচ্ছিল। খায়নি বুঝি সারাদিন।-না খাওয়াই উচিত। যে বউয়ের গায়ে হাত তোলে তার আবার খাওয়া।-সেটা অন্যায় করে ফেলেছে ঠিকই, কিন্তু যথো তো অত রাগ করার ছেলে না। বউমা কিছু একটা অন্যায় বলেছে নিশ্চনাই।কাল বাড়িতে পা দেওয়ার পর থেকেই তো টিক-টিক করছিল।সেমেন বেঁকে উঠে বলে-যা খুশি করুক, তা কলে গায়ে হাত তুলবে।-বলছি তো সেটা অন্যায় করে ফেলেছে। মানুষ কি সব সময়ে নিজের বলে থাকে।-দাদার পক্ষ হয়ে একটাও কথা আর বলবে না তুমি।-কেন বলব না? রগোকে আমি এইটুকুবেলা থেকে বড় করেছি, ওর ধাত আমার চেয়ে ভাল কে জানে। ও ঠান্ডা মানুষ, ওকে রূগলে কেমনতর হয়ে যায়। সেই জন্যই ওকে কেউ কখনও শাসন করেনি। তবে দরকারও হত না, ও তেমন কিছু দুষ্টুমি করতই না। কদিন হল দেখছি ও যেন কেমনারা হয়ে যাচ্ছে। -যাচ্ছে যাক। তুমি ওদের মধ্যে বেশি নাক গলিয়ো না। ননীবালয় আবার একটু চুপ থেকে (মোনের মন বুঝাবার চেষ্টা করেন। তারপর বলেন-শীলার চিঠিটা গুস্তুলি তো। আমি কিছু মাথামুণ্ডু বুঝলাম না। কী বলতে চেয়েছে বল তো। একটু বুঝিয়ে দৌ -আঃ। বলে ভীল কিরত্তিতে সোমেন উঠে বসে। বলে-কিছুতেই ঘুমোতে দেবে না? -ঘুমোস। সন্ধীয়েগৈলা পর্যন্ত ঘুমোদ, না হয় ডাকব না। এখন একটু বুঝিয়ে বল তো। কলে ননীবাদ দৗেরি তুলে বাইরে বেরিয়ে বসেন। ঘর অন্ধকার হলেও বাইরের আলো আবছাভাবে ঘরে আসে। ননীবালার ছায়ামূতিটার দিকে আক্রোশয়রে একটু চেরে থাকে সোমেন। তারপর বলে-তুমি বড়দির চিঠিটন ঠিকই -যা বুঝেছি তা কি হতে পারে? -হবে না কেন। বাজ তো টাকা দিতে এলেন না। জমিটা হাতছাড়া হয়ে যাক-তাইচাও? -তাই কি বলেছি? কিন্তু লোকটা এল না কেন, কেমন তার বুকের ব্যথা, এটা তো তোরা
পৃষ্ঠা:১০৯
কু-ভাইদের একজন গিয়ে খোঁজ নিতে পারতিস।সোমেন বলে বাবা তোমার কেউ হয় না। ওহেরুর চিঠি পেয়ে তুমিও তো চলে যেতে পারতে।ননীবালা কথা খুঁজে পান না। তারপর অনেকক্ষণ বাদে খাঁনকণ্ঠে বলেন আমি তো চোখের বিষ। আমাকে দেখলে ব্যথা বেড়েই যাবে হয়তো।সোমেন বালিশে উত্তপ্ত মাঘাটা আবার রাখে। কথা বলে না। ননীবালাও কিছু বলেন না অনেকক্ষণ। তারপর ক্ষীণকণ্ঠে বলেন-তাই বলছিলাম, তোর যদি একটা চাকরি-বাকরি হত তা হলে আলাদা একটু বাসা টসো করে মায়ে-শোয়ে থাকতাম।বড় রাখ হয় সোমেনের। সে বলে-দাদার মতো লোকের সঙ্গে থাকতে পারছ না, দাদা কত ভালবাসে তোমাকে।-কী করব। দেখছিস তো! সব দোষ কি আমার?-তোমারই। তোমাকে নিয়ে আমি থাকতে পারব না।ননীবালা অন্ধ হয়ে থাকেন। হাতের রোজের কয়েকগাছা চুড়ির একটু শব্দ হয়। খাস ফেলেন। খুব বিষন্ন ক্ষীণ গলায় বলেন-জবাব দিলি?
। পনেরো।
বাসে ট্রামে আজকাল অজিত উঠতে পারে না। বড় কষ্ট হয়। অফিসের পরই তাই তার বাসায় ফেরা বড় একটা হয় না। এক সময়ে যখন ইউনিয়ন করত তখন প্রায়দিনই অফিসের পর ইউনিয়ানের কিছু না কিছু কাজ থাকত, নয়তো কো-পারেটিকের। এখন সে সব দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছে। ওভারটাইম থাকলে অফিসের পর সময়টা একরকম কাটে। নইলে বিকেলটাফাঁকা এবং শূন্য।অজিত যখন বেরোয় তার বহু আগেই অফিসের লোকজন চলে যেতে শুরু কর। সরকারি অফিস, তাই কেউ সময়টময় মানে না। অর্পিত যায় না, গিয়ে কী হবে। সাড়ে পাঁচটা ছটা পর্যন্ত কাজ করে সে সময় কাটার তারপরও বাসায় ফেরার নামে গায়ে জ্বর আসে। শীলা বেলা থাকতেই স্কুল । থেকে থোই, কিন্তু অজিত ফেরে না। কার কাছে ফিরবে? একটা বাচ্চাও যদি থাকত।মুশকিল হয়েছে এই য অফিসে তার বন্ধু টন্ধু বড় একটা নেই। যখন ইউনিয়ন করত।তখন বন্ধু ছিল সুদীর্ঘ ছিল। ইউনিয়ন ছেড়ে দিয়েছে বহুকাল, সেকশন ইনচার্জ হওয়ার পরআর কোনও স্বম্পর্কও রইল না। যাদের সঙ্গে এক সাথে কাজ করে তাদের সঙ্গে আজও ঠাট্টা মন্তরা বা আড্ডার সম্পর্ক আছে বটে, কিন্তু বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তারাও কেমন ভোঁতা হয়ে গেছে, সংসার-চিন্তায় কিছুটা বা আত্মকেন্দ্রিক। হাসি ঠাট্টা আজও হয় কিন্তু দেও জলের ওপর ভেসে থাকা বিচ্ছিন্ন কুটেনকাটার মতো, তাতে স্রোত নেই, টান নেই, গর্তীরতা নেই। কলকাতার ভিড় দিনে দিনে কোন অসম্ভাব্যতার দিকে যাচ্ছে তা ভেবে পায় না অজিত। শহরটায় আগাপাশতলা দেখলে মনে হয় না এত মানুষ অনির জায়গা এখানে আছে। তবু কী করে যেন ঠিক এঁটেও যায়। ট্রামে বাসে কুলন্ত মানুষ দেখে অজিত, রাস্তাঘাটে মানুষের শরীর আগেপিছু কেবলই ঠেলে, ধাক্কায়। বিরক্তি, রাগ, ভয় নিয়ে মানুষ চলেছে, ঘুরে মরছে,
পৃষ্ঠা:১১০
কোথাও পৌঁছোয় না শেষ পর্যন্ত। ভিড় একটু কম থাকলেও, এবং অফিসের পর বাসে ট্রামে ওঠা গেলেও অবশ্য অজিত বাসায় ফিরত না। ফিরে গিয়ে কী হবে? শীলা সন্ধে থেকে রেডিয়ো খুলে রাখে, উল বোনে, সিনেমার কাগজ দেখে। অজিত তাড়াতাড়ি ফিরলে অবশ্য খুশি হয়। কিন্তু সেটা কেবল বাড়িতে একনান লোক আসার জন্য যেটুকু খুশি তাই। কথা প্রায়ই বলার থাকে না। শীলা ঝির নিন্দে করতে থাকে, আশেপাশের বাড়ির নানা খবরাখবরের কথা বলে, বড়জোর স্কুলের গল্প করে। ওদের স্কুলে নতুন এক ছোকরা মাস্টার এসেছে, সে নাকি বোকা তাই তাকে নিয়ে অনেক কাণ্ড হয় স্কুলে। সেই সব গল্প বলে শীলা। অজিতের ছাই ওঠে। অবিদসের পর একা-একাই কিছুটা হাঁটে অজিত। কিন্তু হাঁটার মতো তেমন জায়গা নেই। ময়দানের অন্ধকারেও দুর্বত্তের মতো কিছু মানুষ মুখ লুকিয়ে চুপিসাড়ে ঘোরে পুলিশ নজর রাখে, ভাড়াটে মেয়েছেলেরা গা ঘেঁষে যায়। রেস্টুরেন্টে খুব বেশিক্ষণ একা বসে থাকা যায় না। আসলে এই চল্লিশের কাছাকাছি বয়সেও তার সেই বয়ঃসন্ধির সমযাকার পিপাসা জেগে আছে লক্ষ্মণের জন্য। লক্ষ্মণ আর কোনওদিনই ফিরবে না। একটা কভার ফাইল কিনে তার মধ্যে লক্ষ্মদের সব চিঠি জমিয়ে রাখে অজিত। অবস্যামতো সেইসব চিঠি খুলে পড়ে। পিপাসা তাতে বেড়েই যায়। অবশেষে খুব রাত হওয়ার আগেই অফুরণ সময় ফুরিয়ে না পেরে সে কাসার দিকেই ফেরে। মাঝে মাঝে ভবানীপুরে নেমে নিজেদের বাড়িতেও টু মারে। কিছুই আগের মতো নেই। ভাইপো-ভাইঝির কত বড় সব হয়ে গেল। মা এখন কত বুড়োটে মেয়ে গেছে। খুব ঢেকে, ভালবেসে কথা বলার কেউ নেই। দাদা-বউদি আলগা আলগা কথা বলে, চাকর চা খাবার দিয়ে যায়। ইদানীং অজিত ম্যাজিক দেখায় বলে ভাইপো-ভাইঝিরা ঘিরে ধরে। অন্যমনস্কভাবে কয়েকটা ম্যাজিক দেখায় সেঃ জমে না। অজিতকে তাই বাসায় ফিরতেই হয়। নিস্তব্ধ বাড়ি। শিশুর কন্ঠস্বর নেই। কেবল রেডিয়েটিং বাজে। বেজে যায়। কেউ শোনে না। শীলা দরজা খোলে। কথা বলে না। অজিত ঘরে ঢোকে। কথা বলে না। আবার বলেও। খাওয়ার টেবিলে বিছানায় শুয়ে এক একদিন কথা হয় অনেক। ডাক্তার মিত্রকে কম টাকা আজ পর্যন্ত টেলি অজিত। কম করেও তিন চার হাজার টাকা বেরিয়ে গেছে। একবার নার্সিং হোমে শীলার একটা অপারেশনও হয়েছে। শীলার কোনও তেমন মারাত্মক খুঁত না পেরে জাতীর মিত্র অজিতেরও কিছু চিকিৎসা করেছেন। তবু লাভ হয়নি। নীলার পেটে বাচ্চা আসেনি। -কী আক্ট হবে, ছেড়ে দাও। অজিত হতাশ হয়ে বলেছে। শীলা কেঁদেছে, বলেছে-তোমাকে জীবনের সবচেয়ে বড় জিনিসটাই দিতে পারলাম না। -নূর দূর। অজিত সান্ত্বনা দিয়েছে-বাচ্চাকাচ্চা হলে ঝামেলাও কম নাকি। হল হয়তো, বাঁচল না। তখন বাচ্চা না হওয়ার চেয়েও বেশি কষ্ট। ছেলেপুলে বড় করা কি সোজা কথা। এ কোনও সান্ত্বনার কথাই নয়। তবু আশ্চর্য যে শীলা সান্তনা পায়। মুখের দিকে চেয়ে থেকে হঠাৎ হেসে বলে যা বলেছ। ছেলেপুলে হওয়া মানেই তো
পৃষ্ঠা:১১১
সারাদিন দুশ্চিন্তা। বাড়িঘর নোংরা করবে, কাঁদবে, চেঁচাবে। অশান্তি বড় কম নাকি। এই পড়ে গেল, এই ছড়ে গেল, এই এটা ভাঙল, সেটা হিফল! অজিত মাথা নেড়ে বলে তবে? শীলা শ্বাস ছেড়ে আবার তার বেদনার কাঁটা তুলে নিয়ে বলে-বাচ্চাকাচ্চা তো নয়, যেন অভিশাপ। না গো? -এই বেশ আছি। শান্তিতে, নিরিবিলিতে। হট করে যেখানে খুশি যেতে পারি। দুশ্চিন্তা নেই, ঝঞ্জাট নেই। অজিত সায় দিয়ে যায়। এবং এইরকমভাবেই দুটি শিশুর মতো তারা পরস্পরকে স্তোক দিয়ে ভুলিয়ে রাখতে চষ্টা করে। পারেও।কিন্তু দুজনের মাঝখানে একটা পরদা নেমে আসে ধীরে। যবনিকার মতো। তাদের দাম্পত্য জীবন যেন এই মস্তযৌবনেই শেষ হয়ে আসে।অজিত প্রথম ম্যাজিক শেখে রাস্তায় এক ম্যাজিকমলার কাছে। তিনটে টাকা নিয়ে সে অজিতকে বল অ্যান্ড কাপ, দড়িকাটা আর একটা তাসের খেময় শিখিয়েছিল। সেই তিনটে খেলা দেখিয়ে অজিত চমকে দেয় শীলাকে।শীলা ভারী আবাক হয়ে বলেছিল ভারী ভাল খেদা তো। তুমি তো বেশ খেলা দেখাও।তারপর নানা সূত্রে সে সত্যিকারের ম্যাজিসিয়ানদের কাছে যাওয়া আসা শুরু করে। বেশ করেকটা স্টেজ ম্যাজিক শিখে যায়, টেবিল ম্যাজিক অনেকগুলো টপাটপ শিখে নেয়। ফলে অফিসে, পাড়ায় ম্যাজিসিয়ান হিসেবে লোক তাকে চিনে গেছে। সে পয়সার বেলা দেখায়, জ্বলন্ত সিগারেট লুকিয়ে ফেলে কোথায়, হাতের আঙুলের ফাঁকে শূন্য থেকে নিয়ে আসে পিংপং কল। একটা দুটো তিনটে। এখন তার ভাণ্ডারে ম্যাজিকের মজুদ বড় কম নয়। ম্যাজিকের দোকান ঘুরে, ম্যাজিসিয়ানদের কাছ থেকেও সে সাজসরঞ্জাম কিনেছিল অনেক। ঘন্টাখানেক স্টেজে দেখানোর মতো সাঁক তার আছে।মাঝেমতে রাত জেগে সে আয়নার সামনে বসে পানিং আর পাসিং অভ্যাস করে। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে অন্যমনে পকেটে হাত দিয়ে কয়েন কনজিওরিং অভ্যাস করে। ভাবে, মাজিকওয়ালা হয়ে গেলে কেমন হয়।শালা আজকাল মাঝে দুইয্য বলে-তুমি আমাকে ভালবাস না।বাসি। নিস্পৃহ উত্তর দেয় অরিত।হাইবায়োকীসে বুঝলে।শীলা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে সবচেয়ে চাওয়ার জিনিসটা তোমার, তাই দিতে পারলাম না। নিষ্ফলা গাছকে কে ভালবাসে বলো।-হবে। সময় যায়নি।-মিত্র বলেছে, হবে মিত্র এশিয়ার সবচেয়ে বড় গয়নোকলজিস্টদের একজন।-কবে আর হবে?–মিত্রের কথা ছাড়ো, ঘোকছে আর টাকা বের করে নিচ্ছে। ওর দ্বারা হবে না। আমারই
পৃষ্ঠা:১১২
কোথাও দোষ আছে।-না। কিছু দোষ নেই।-ঠিক বলছ?-বলছি।অবশেষে একদিন ঋতু বদ্ধ হয়ে যায় শীলার। বুক ধুকপুক করতে থাকে। একদিন দুদিন করে দিন যায়। শীলার চোখেমুখে একটা অপার্থিব আলো কোথা থেকে এসে পড়ে।শীলা বাল-বড় ভয় করে গো।-কেন।-কী জানি কী হয়। আমার এমনিতেই একটু লেট ছিল।-না, না, এ সে লেট নায়। তুমি শরীরের কোনও পরিবর্তন বুঝছ না?-একটু একটু কিন্তুসেটা মানসিক ব্যাপারও হতে পারে। না, না। কাল একবার ডাক্তারের কাছে যাব।মির দেখেটেখে পরদিন বলেন-মনে হচ্ছে প্রেগন্যান্সি। তবে ইউটেরস একটু বাঁকা হয়ে আছে। নড়াচড়া একদম করবেন না। নরম, খুব নরম বিছানায় দিনরাত শুয়ে থাকবেন।আজকাল তাই থাকে শীলা। অভিজত একটা চমৎকার রবারের গদি কিনে এনেছে। অনেকা টাকা দাম। স্কুল থেকে ছুটি নিয়েছে শীলা। অজিতওঅফিস কামাই করে পূর্ণ। বিছানার পাশে চেয়ার টেনে বসে থাকে। চোখেমুখে উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ।শীলা উপুড় হয়ে শুয়ে থাকে। নরম গদিতে সুখের শরীর ডুবিয়ে, মুখখানা অজিতের দিকে ফিরিয়ে অ্যাগা-জ্যাবা চোখে চেয়ে থাকে। মাঝেমধ্যে অর্থপূর্ণ হাসি হাসে, বলে-কীঅজিত বলেকী?-অফিস যাওনা যে বড়।ছুটি জমে গেছে অনেক, নিয়ে নিচ্ছি।-কেন শুনি। কোনগুদিন ছুটি নিতে দেখি না। অফিস তো তোমার প্রাণ।-প্রাণ-ট্রশ ন্যায়। কজে থাকে।-কাজ কী তা তো জানি।-ফিস খেলা, আড্ডা আর মায়িক।না, না, প্রোমোশনের পর থেকে আর ওসব হয় না।শীলা স্বামীর প্রতি গভীর ভালবাসায় একরকম সম্মোহিত হাসি হাসে, বলে বউয়ের গন্ধ শুকে এত বাড়িতে বসে থাকার কী?-গন্ধটা বেশ লাগছে আজকাল।-বউয়ের গন্ধ। না কি অন্য কিছু।বউয়ের গন্ধই।-বুঝি গো, বুঝি।-বউয়ের গন্ধ নয়। অন্য একজনের গন্ধ।অজিত নিঃশব্দে হাসে। একটু লম্বাটে মুখ অভিতের। গায়ের রং ফরসার দিকে, সামনের
পৃষ্ঠা:১১৩
দাঁত সামন্য বড়। তবু হাসলে তাকে ভারী ভাল দেখায়। মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে শীলা। স্বামীকে এত ভাল বহুকাল লাগেনা। নীলা একটা শ্বাস ফেলে বলে-বউ তো পরের মেয়ে, তার জন্য কোনও মানুষটারই বা দবদ উথলে ওঠে। আসল দরদ তো তোমার নিজের জন্য, নিজের রক্তের জন আসছে। তাই অত ছুটি নিয়ে বসে থাকা। বুঝি না বুঝি?-তোমার জন্য দরদ নেই, এটা বুঝে গেছ? কী যুদ্ধি তোমার।-ওসব বুঝতে বুদ্ধির দরকার হয় না। হাবাগোবাও ভালবাসাটা বোঝে।-হবে।শীলা মৃদু হাসতেই থাকে। বালিশে মুখ ঘষে, গদিটায় একটু দোলায় শরীর, ঠ্যাং নড়ে। অজিত সতর্ক হয়ে ধমক দেয়-আঃ। অত নড়ো কেন? আচ্ছা চঞ্চল মেয়ে যা হোক। শীলা গুরগুর করে হাসে, বলে কী দরদ।অজিত ভ্রু কুঁচকে চেয়ে থাকে।শীলা ফের বলে-কার জন্য গো, এত দরদ? এতদিন তো দেখিনি।- বারবার এক কথা। অব্জিত বিরক্তির ভান করে। কিন্তু তার ভিতরে একটা টলটলে আনন্দ। নিঃশব্দে যেমন কলের তলায় চৌবাচ্চা ভরে ওঠে জলে, উপচে পড়ে-ঠিক তেমনি এক অনুভূতি, গলার কাছে একটা আবেগের দলা ঠেলা মেরে ওঠে।শীলা একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলার শব্দ করে বলে-সে এখন পেটের মধ্যে একটুখানি বরফের দলা মাত্র, তবু তার কথা মনে করেই দামি গদি এল, কাজের মানুষ ছুটি নিয়ে বসে থাকল, চোয়াড়ে মুখটায় মাঝে মাঝে হাসিও ফুটছে আজকাল গোঁফের ফাঁক দিয়ে। কী ভাগ্যি আমাদের!-একটু চুপ করে থাকবে?শীলা নিঃশব্দে হাসে, চোখেমুখে বিকরিমিকরি দুষ্টুমি। একটু চুপ করে থাকে। তারপর বলে-পরের নেরের কপাল খুলল এতদিনে।শীলাকে প্রায়দিনই স্নান করতে দেয় না অজিত। ওঠা-হাঁটা প্রায় বন্ধ। এক-আধদিন শীলা বায়না করে-আর পারি না, শুয়ে থেকে থেকে কোমর করে গেল। স্নান না করে শরীর জ্বর-জ্বর। একটু স্নান করতে দাও না অজিত আপত্তি করে। শের অবধি আবার নিজেই সাবধানে ধরে তোলে শীলাকে। বাথরুমে নিয়ে গিয়ে বলে তিমি স্নান করব।-এ মা। লোকে কী বলবে?-রেণু রয়েছে না। ঝি হলে কী হয় সব জেকে।-ও বাচ্চা মেয়ে, কিছু বুঝবে না।-না গে, বোঝে।-বুঝুকগে, অত মাথ্য ঘামানোর সময় নেই। একা অথরুমে তুমি একটা কাও বাঁধবে, আমি জানি।বলে বাথরুমের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে দেয় অর্জিত। শীলা আতঙ্গে বলে-না, না, তারী বিশ্রী দেখার। বড্ড লজ্জা করে।অজিতও শোনে না। শীলা তখন অগতর চোখ বুজে দাঁড়িয়ে লজ্জার হাসে। অজিত তার
পৃষ্ঠা:১১৪
কাপড় হাড়িয়ে দেয়। একটু আদর করে। খুষ সন্দিগ্ধের মতো শালার পেটটা স্পর্শ করে বলে-এখনও তো কিছু বোঝা যাচ্ছে না। একদম ফ্ল্যাট বেলি। শীল্য চোখ বড় বড় করে বলে-ও বাবাং, কী তাড়া। একনই বী। পাঁচ-ছমাসের আগে কিছু বুঝি বোঝা যায়। অজিত বলে-কদিন হল যেন! -প্রায় দেড়মাস। অজিত শ্বাস ফেলে বলে-মাত্র। নীলা হাসতে থাকে, বলে তোমার বরুড়া কি মেল ট্রেনে আসবে। সবার যেমন করে আসে তেমনই আসবে। বুঝলে। অজিত বোঝে। যত্নে স্নান করিয়ে দেয় শীলাকে। ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে শীলার গায়ের জলে নিজেও স্নান করে। ঘরে এনে চুল আঁচড়ে দেয়। বিছানায় বসিয়ে চামচ দিয়ে নিজের হাতে ভাত খাইয়ে দেয়। একাই পাতে খায় দুজনে। শীলা ভাজা বা মাছের টুকরো তুলে দেয় অজিতের মুখে। দুজনে পরস্পরের দিকে চেয়ে অর্থপূর্ণ হাসে। বড সুখ। রাতে শীলা ঘুমোয়। অজিতের ঘুম বড় অনিশ্চিত। তার মায়ুর একটা গণ্ডগোল আছে মাঝে মাঝে সহজে ঘুম আসে না। মাথা গরম লাগে। অন্ধকারেই উঠে টেবিল থেকে হাতড়ে জনসন গাসলাইটারটা তুলে নেয়। সিগারেট ধরায়। দশ করে লাফিয়ে ওঠে চমৎকার নীলচে আগুনের শিখা। অমনি ল্যাদের কথ্য মনে পড়ে। সেই সহৃদয় আর বৃদ্ধির শ্রী মাখানের সকল সুখ। একটা ছবি পাঠিয়েছে লক্ষ্মণ। একটা প্রকাণ্ড স্ট্রিমলাইনড গাড়ি-খুব হালফ্যাশানের জিনিস, তার সামনে ওরা স্বামী স্ত্রী দাঁড়িয়ে আছে। বউটি ভালই দেখতে, তাতে বয়নটা একটু বেশি-ডাম্মদেরই কাজাকাছি হবে। আর খুব লম্বা-লক্ষ্মণের সমান। লক্ষ্মণকে চেনাই যায় না ছবিতে। মোটা গোঁফ রেখেছে, বড় জুলপি, চুলও ঘাড়ের কাছে নেমে এসেছে। পরনে চেক প্যান্ট, গায়ে কেটে, চোখে বোষ-চশমা। নানাচ্ছে না লক্ষ্মণকে। মুখে খুশির হাসি। লক্ষ্মণকে কি আর চেনা যাবে না। পুরনো লক্ষ্মণ কি হারিয়েই গেল চিরকালের মতো? এরপর নম্বাণের ছেলেমেয়েরা হবে, চাকরি আরও বড় হবে, কানাডায় শিরুডু থেড়ে যাবে ওর। দেশে ফেজ হবে না। এব। সন্ধ্যণের পর ওর বংশধররাও হজে যাইবে কানাডায় মানুষ। তারা বাংলায় কথা বলবে না, আচরণ করবে না বাঙালির মধ্যে তারাও হবে ভিনদেশি। কেবল বহুকাল আগে প্রবাসে ছিটকে আসা লক্ষ্মণের পদবিটুকু স্মৃতিচিহ্নের মতো লেগে থাকবে তাদের নামের সঙ্গে। এরকম মূছে যাতাই নিঃশেষ হয়ে যাওয়া একটা মানুষের পক্ষে কতখানি দুঃখের তা কি লক্ষ্মণ বোঝে নাই কলকাতার লক্ষ্মণ কেন অমন বিশ্বজনীন আর আন্তর্জাতিক হয়ে গেল। কোনও চিহ্ন রেখে গেল না স্বদেশে। বাজে চিন্তা। মাথা থেকে চিন্তাটা বের করে দেয় অজিত। দরজির আঙুলের মাথায় যে যাতুব টুপি পরানো থাকে হাত-সেলাই করার সময়ে, তাই দিয়ে নতুন একটা খেল্য শিখেছে অজিত। পাশের ঘরে আলের ছেলে আয়নার সামনে বসে খেলাটা অভ্যাস করতে থাকে সে। ডান হাতের আঙুল থেকে চোখের পলকে বাঁ হাতের আঙুলে নিয়ে যায় বিদ্যুৎগতিতে লুকিয়ে ফেলে হাতেক তেলোয়। আবার আঙুলে তুলে আনে। আঙুলের ডগায় ডগার মুহুর্মুহু দেখা দেয় টুপিটা। হারিয়ে যায়, আবার দেখা দেয়। দ্রুত হাতে আঙুলে বিভ্রম সৃষ্টি করে চলে
পৃষ্ঠা:১১৫
অজিত। বাচ্চাটা বড় হলে হাঁ করে দেখবে বাবার কাণ্ডকারখানা। ভাবতেই চকিত একটা অদ্ভুত হাসি খেলে যায় মুখে। ‘বলা’ শঙ্গাটা কী ভয়ংকর। কী সাপ্তঞ্জাতিক। দু-হাতের আঙুলে নৃত্যপর বাতুর টুপির দ্রুত ও মায়াবী বিলমটি তৈরি করতে করতে সে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে চেয়ে থাকে একটু। শীলা ডাকে-ওগো কোথায় গেলে? অজিত উঠে ও-ঘরে যায়-রী হল? কী করছ রাত জেগে? ম্যাজিক? -পাগলা। ঘুমোবে না।-ঘুম আসছে না। অজিত বলে। -কাছে এস। তোমাকে ছাড়া ভাল লাগে না। এসো শিগগির, ও ঘরের বাতিটা নিবিয়ে দিয়ে এস। অজিত তাই করে। বিছানায় এসে শীলা ঘন হয়ে লেগে থাকে গায়ের সঙ্গে। লেপের ভিতরে ওম, দুজনের শরীরের তাপ জমে ওঠে। কিছুক্ষণ ঝিম মেরে থাকে শীলা। আবার আলগা হয়ে উন্মুখ মুখবানা তুলে বলে-অনেক আদর করো। আর্জিত আবছায়ায় স্ত্রীর মুখখানা দেখে। তার খাস ঘন হয়ে আসে। দু-হাতে শীলার জলের মতো নরম শরীর চেপে ধরে। বাসে অদয়াথাকি। ঊসস। শীলা শব্দ করে। -আদর খেয়ে শখ আর মেটে না তোর বউ। শীলা করতলে চেপে করে তার মুখ, বলে কথা নয়। আদর। মুখটা সরিয়ে নিয়ে অজিত হাসে, কললে-আমি যে হাঁফিয়ে যাই। তুই যে বড় বেশি আদরথাকি। তুমি বুলে। -তুমি কচি যুক্তি। শীলা আদর যেতে যেতে বলে আমাদের সবকিছু মাপমতো। বয়স-টয়স সব।-মেড ফর ইচ আবার? উমম। রতিক্রিয়ার পর হাকুন তৃপ্ত ও ক্লান্ত তখন একটা সিগারেটের জন্য বুকটা বড় ফাঁকা লাগে অজিতের। বেধোতে যাচ্ছিল, শীল জামা টেনে ধরে কোথায় যাচ্ছ? সিগারেট। -আগে অ্যাক্টরুম। তারপর একটা সিগারেট। অজিতের সিগারেটের পিপাসা নিয়ে বসে থাকে। মেয়েদের এই বড় দোষ। স্বামীর কীসে ভাল হবে তা সময়মত্যে সঠিক বুঝতে পারে না, নিজের ধারণামতো ঢালায়। বিরক্তির সৃষ্টি করে। রতিক্রিয়ার পর এখন শীলার আকর্ষণ কিছুক্ষণের জন্য আর নেই। কেবল সিগারেটের জন্য বুকটা শূন্য। পিপাসা। তবু অজিত মশারির বাইরে গেল না। হাত বাড়িয়ে বিচানায় পাশের ছোট টেবিন থেকে জগ এনে জল খায়, শীলাকে খাওয়ায়। এক সময়ে আস্তে করে বলে-মাকে বলে আসব
পৃষ্ঠা:১১৬
কাঁথার্টথা সেলাই করতে। শীলা আঁতকে উঠে কলে-এখনই কেন? -বুড়ো মানুষ, এখন থেকে শুরু না করলে সময়মতো হবে না। -না, না। শীলা বলে-বাচ্চা হওয়ার আগে ওসব করতে নেই। -ওসব তুকতাক তুমি বুঝবে না। বেশি সাধ করালে যদি খারাপ কিছু হয়। দূর, যত সব মেয়েলি সংখার। -বাচ্চা হওয়ার আগে বাচার জন্য কিছু করা বারণ। ও সব করবে না। বেশি আদেখল্যপানা ভাল নয়। অজিত একটা শ্বাস ছেড়ে বলে-আচ্ছা।
ষোলো
অফিসে ফিস্ বেলা হয় রানিং জোকারে। তাস বাঁটার পর যে তাসটা চিত হয় তার পরের নম্বরটা হয় জোকার, টেকা পড়লে দুরি, দুরি পড়লে কিন। অজিতের কপাল ভাল। প্রতিযার সে ঠিক দুটো তিনটে জোকার পেয়ে যায়। প্রচণ্ড জেতে। প্রতি কার্ডে দশ পয়সা হিসেবে এক-একদিন আট দশ টাকা পর্যন্ত জিতে নেয়। মাঝখানে খেলত না, আবার ইদানীং খেলে অজিত। মনটা একরকম ফুর্তিতে থাকে আজকাল। মেশিন ডিপার্টমেন্টের কুমুদ বোস বয়স্ক লোক। চেহারাখানা বিশাল, এক সময়ে গোবরবাবুর আখড়ায় বিস্তর মাটি মেখেছে। চুলে কলপ-উলপ দিয়ে ফিনফিনে ধুতি-পাঞ্জাবি পরে বইদবাবুর মতো থাকে সব সময়ে। বুদ্ধি কিছুটা ভোঁতা কথায় ভরপুর আদিরস। হেরে মিয়ে প্রায় দিনই বাল ভাদুড়ি, তুমি তো শালা ম্যাজিসিয়ান। অজিত বলে তাতে কী?-ম্যাজিসিয়ান মানেই হচ্ছে শাফলার। অজিত হেসে বলে-একা আমিই তো প্রতিবার শাফল করছি না। সবাই করছে। •তর তমি শালা তুকতাক জায়োটিকই। নইলে রোজ জেতো কী করে। -কপাল। অজিত বাস্ কপাল না কচু। কুঞ্জি গজগজ করে বোস-মুফত বসে বসে অতগুলো টাকা মাইনে পিটছ, দোহাতা লিকই তাসে, তোমারটা খাবে কে হে? আর্ট। এতদিনে একটা ছেলেপুলে করতে পারছে না। সেটাও কপাল। – কপাল-টপাল নয়। ও সব করতে পুরুষকার চাই। তোমার সেটা নেই। কতবার তো বলেছি, যদি নিজে না পারো তো বউকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও। উলটোদিক থেকে অরুণ দত্ত ধমক দেয়-বোসদা, চুখ। বোস বলে-ও শালা দ্বিতবে কেন রোজ?গোপাল মুখার্জি দিগারেটসুদ্ধ ঠোঁটে বলে-ও রোজা সেকটি রেজার দিয়ে কপাল কামায়।
পৃষ্ঠা:১১৭
বোস থমথমে মুখ করে বলে-কামায়? তাই হবে। ও শালা সবই কামিয়ে ফেলেছেবোধ হয়। পুরুষকার টুকুষকার সব। একটা হাসি ওঠে।অজিত সিগারেটের ধোঁয়ার ভিতর দিয়ে চেয়ে বলে-বোসদা, এবার আপনাদেরদেখাব।-দেখাবে মানে।-দেখকেন। সময় হোক।কিছু বাঁধিয়েছ নাকি এতদিনে?অজিত উত্তর না দিয়ে হাসে।বোস খাস ছেড়ে বলে বুঝেছি। কিন্তু এতদিন লাগল? আমার পাঁচ-ছ’টা নেমে গেছে, গোপালের ক’টা বেন। তিনটে না? ছবছরের বিয়েতে ভাল প্রগ্রেস! অরুণ, তোর? তুই তো নিরুদ্ধবাবু, সেই শুথে একটা বানিয়ে বসে আছিস, পাঁচ বছরের মধ্যে আর মুখেভাতের নেমা পেলুম না। করিস কী তোরা, অ্যাঁ?-সরকারের বারণ আছে। অরুণ দত্ত জবাব দেয়।কী একটা অশ্লীল কথা বলতে যাচ্ছিল কেস, অভিত সিগারেট ধরিয়ে লাইটারটা বোসের মুখের কাছে ধরে কলল-ফের কোনও খারাপ কথা বেরোলে ছ্যাঁকা দিয়ে দেব। চুপ।লাইটারান পট করে কেড়ে নেয় বোস। নেড়েচেড়ে দেখে। বলে-মাইরি কী জিনিস যে বানায় সাহেবরা। আমি সিগারেট খেলে ঠিক এটা মেরে দিতুম।ভাস বাঁটা হয়েছে। সবাই হাতের তাস সাজাচ্ছে। চিতিয়ে পড়েছে টেকা, অর্থাৎ রানিং জোকার হচ্ছে দূরি। এবার অজিতের প্রথম টান। সে পড়কের তাসের দিকে হাত বাড়িয়েছে, ঠোঁটে সিগারেট, চোখ কোঁচকানো, মাথায় ভিতরকার যন্ত্র অটোমেশনের মতো হিসেব করে যাচ্ছে।একটা অচেনা ঘরে কে ডাকল-অজিত।অজিত উত্তর দিল-উ, কিন্তু ফিরে তাকাল না। ডাকটা তার ভিতরে পৌঁছয়নি। অরুণ দত্ত ঠেলা দিয়ে বলে-কে ডাকছে দ্যাখ।অজিত বিরক্ত হয়ে ফিরে তাকায়। টিফিনের সময় শেষ হয়ে এল। তাড়াতাড়ি করলে এখনও আরদুইরাউন্ড খেলা হকে প্ররে। এর মধ্যে কে আপদ জ্বালাতে এল!অজিতের ঠোঁটে সিগারেই, জোই ভাই ধোঁয়ায় চোখে জ্বালা, জল। কিছু দেখতে পায় না অজিত। দাড়ান ছরিয়ে প্রলাপলক আগন্তুকের দিকে চায়। নস্যি রঙের ব্যাপার গায়ে বুড়ো একটা লোক। গ্রাম্য চেহারা। লেকটা তার চোখে একটি বিস্ময়ভরে চেয়ে আছে।-বী দুই শিলিত জিজ্ঞেস করে।লোকটা তাঁর চোখে চোখ রেখে একটু স্তম্ভিতভাবে চেয়েই থাকে। তারপর গলাথাকারি দিয়ে বলে-আমার পলিসিটার ক্যাপারে এসেছিলাম। তুমি ব্যস্ত থাকলে…. অজিত হঠাৎ লোকটাকে চিনতে পারে। ব্রজগোপাল লাহিড়ি, তার শ্বশুর। সিগারেটটাটপ করে নামায় সে।-ওঃ। বলে শণ্যব্যস্তে উঠে পড়ে। আশেপাশে চেয়ার টেনে বসে যারা খেলা দেখছিল তাদের একজনের হাতে নিজের তাসন ধরিয়ে দিয়ে আদর ছেড়ে বেরিয়ে আসে। শ্বশুরমশাই এই অবস্থায় তাকে দেখে ফেলেছেন বলে অজিতের একটু লজ্জা করে।
পৃষ্ঠা:১১৮
অফিসে বসে তাসটাস খেলা এ লোক যে ভাল চোখে দেখে না, এ তো জানা কথাই। তার ওপর পরাসার খেলা। ভাগ্যিস নগদ পয়সার খেলা হয় না: খাতায় হিসেব লেখা থাকে, মাসের শেষে পেমেন্ট হয়। তবু অস্বস্তি বোধ করে অজিত। এ লোকটার সামনে সে বরাবর এক অনির্দিষ্ট কারণে অস্বস্তি বোধ করেছে।বহু সিন পর দেখা, একটা প্রণাম করা উচিত হবে কিনা ঠিক বুঝতে পারছিল না অজিত। অফিসের মধ্যে অবশ্য লজ্জাও করে। দূধারে সার বেঁধে আই-বি-এম মেশিনগুলি চলছে। অনুচ্চ মৃদু শব্দ, কিন্তু অনেকগুলো মেশিনের শব্দ একসঙ্গে হচ্ছে বলে ঘর ভরে আছে শব্দে। তসের মতো কার্ডগুলি রোনালের ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে অনায়াসে, পড়ছে বিভিন্ন খোপে। ঠিক তাদের মতোই মেশিনগুলি তাস শাফল করছে, বাঁটছে। টিফিনের সময়ে মেশিন চলে না। কিন্তু এখন কমিশনের সময় বলে চলছে। কিছু লোক কাজ এগিয়ে রাখে। বিস্ময়ভরে ব্রজগোপাল যন্ত্রগুলির দিকে চেয়ে থাকেন একটু। ব্রজগোপালের পিছনে একটু দূরে দাঁড়িয়ে রগেন। পরনে চমৎকার কাঠকয়লা রঙের সুটি, চওড়া মেরুন টাই, গালে পানের ঢিবি। হাঝগঙ্গারাম। শ্বশুরমশাইকে দূরে দাঁড় করিয়ে রেখে রণেনই এসে ডেকে নিয়ে পারত অজিতকে, তা হলে ঝর অজিতকে এই অবস্থায় দেখতেন ন্য উনি।রগেন এগিয়ে এসে বলে-অজিত, চেকটা?বিরক্তি চেপে অজিত বলে-ডিসচার্জ ফর্মটা জমা দিয়েছ কবে?-একমাস তো হবেই।অজিত চিন্তিতভাবে বলে এতদিনে ঢেক তো রেজিস্টার্ড পোস্টে চলে যাওয়ার কথা তোমাদের বাড়িতে।-যায়নি।অজিত একটু হেসে বলে সরকারের ধারা থেকে টাকা বের করার কিছু পেরাসনী তো আছেই। সাধারণত কর্ম জমা দেওয়ার মাস দুই তিন পর ক্রেক যায়। আমি বলে রেখেছিলাম, তাই তাড়াতাড়ি যাওয়ার কথা ছিল।ব্রজগোপাল আই-বি-এম মেশিনের কার্ড বিলির চমৎকার নিপুণতা লক্ষ করে মেশিন থেকে চোখ তুলে তাঁর বড় জামাইয়ের দিকে চেয়ে বললেন একটু খোঁজ নিও। কোনও জায়গায় আজকাল আর কাজকর্ম ভূমিতাড়ি হয় না।-আজই খোঁজ নিচ্ছি। হাতো আজকালের মধ্যেই চেক চলে যাবে। আপনি এখন কয়েকদিন কলকাতায় থেকে যান।ব্রজগোপাল, প্রার দিকে চেয়ে থাকেন একটু। তাঁর চোখের বিস্ময় ভাবান এখনও যায়নি। বললেন-অন্তমি তো কলকাতায় থাকতে পারব না। তবে যদি বলো তো আবার কাল-পরশু আসতে পারি।-অত ছোটাছুটির দরকার নেই। অজিত সহানুভূতির সঙ্গে বলে-রেজিস্ট্রি চিঠির খবর পেলে আপনি পরে এসে রিসিভ করে চেক ব্যাঙ্কে জমা দিলেই চলবে। রেজিস্ট্রি চিঠি পোস্ট অফিসে দিন-সাতেক ধরে রাখবে।ব্যাপারটা অত সহজ তা যেন বিশ্বাস হতে চায় না ব্রজগোপালের। বলেন-আ্যার কোনও সইসাবুদ বা সাক্ষির দরকার নেই তো?
পৃষ্ঠা:১১৯
ব্রজগোপাল রণেনের দিকে চেয়ে বললেন–তা হলে তো হয়েই গেল। চিঠি এলে তোমরা আমাকে খবর দিয়ে।বলে এজগোপাল দরজার দিকে এগোতে এগোতে বললেন-তোমরা সব ভাল আছপ্রশ্নটা অজিতকে করা। সে পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতে বলে-ভালই। আপনার শরীর খারাপ শুনেছিলাম।-শরীরমুখী চিন্তা কখনও করি না। কাজকর্ম নিয়ে থাকি, ভালই আছি।-বী একটা বুকের ব্যথার কথা শুনেছিলাম।-হয় বটে মাঝেমধ্যে একটা। দেরেও যায়। আবার গা ঝাড়া দিয়ে উঠি ক্ষেতখামার করি।-এই বয়সে একটু বিশ্রাম দরকার।-বিশ্রাম মানে তো শুয়ে বসে থাকা নয়। বিশ্রাম হচ্ছে এক বিশেষ রকমের তাম। কোনও কোনও কাজই আছে যা ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়।অর্জিত এ বাবদে আর কথা বলতে ভরদা পান না।সিড়ি বেয়ে ব্রহ্মগোপান লবিতে আসেন। রণেন বাধ্য ছেলের মতো এজগোপালের পায়ে পায়ে হাঁটছে। তার মুখে অন্যমনস্বতা, আর বিষাদ, লমিটার ব্যাপারে আর কোনও কথা বলতে আসেনি রণেন। কথা ছিল, ও বউয়ের নামে অমিটা কিনবে। এখনকার নামে যে লক্ষ্মণের জমিটা কেনা হবে তা সঠিক বুঝতে পারছে না অজিত।ব্রজগোপাল লবি পার হয়ে পেভমেন্টে নেমে দাঁড়াদেন। বললেন-অর্জিত, তুমি ফিরে যাও বরং। করতোর ক্ষতি হচ্ছে।কাজ বলতে ব্রজগোপাল কী বোঝাচ্ছেন তা বুঝতে পারে না অজিত। উনি তাকে তাস খেলতে দেখেছেন। বলা যায় না, কুরুদ বোসের দু-একটা রসিকতাও হয়তো কানে গিয়ে থাকবে। তাস খেলাটাকেই ‘কাজ’ বলে ঠাট্টা করছেন নাকি? অবশ্য ঠাট্টা করার লোক নন।অজিত বলে- না, ক্ষতি হবে না। এইটুকুতে কী আর ক্ষতি।-তবু তুমি তো ইনচার্জ। তুমি ফাঁকি দিলে কর্মচারীরাও ফাকিই শিখবে।অদ্বিত হেসে বলে-টিছিল শেখ খ্রিষ্ট এখনও কিছু বাকি আছে।অপ্রিত কবজির খড়িউজ, অগ্রঈচোখে দেখে নেয়। টিফিনের টাইমটা হড়কে গেল। শেষ কয়েকটা ডিল থেজ কেশী।। খুব জমেছিল আজ। শ্বশুরের দিকে চেয়ে বলল আমাদের বাসায় তো আমোনো।-দূরে গারি। সময় পাই না। দুর্গল অজুহাত দেন ব্রজগোপাল।-আপনার মেয়ে আপনার কথা খুব বলে।ই। বলে ব্রজগোপাল একটু অন্যমনস্ক হয়ে যান। ছেলেমেয়েরা তাঁর কথা বলে এটা যেন ঢঠক তার বিশ্বাস হতে চায় না।-একদিন যাব গোবিন্দপুরে। অজিত বলল।ব্রজগোপাল একটা শ্বাস ফেলে আমাইয়ের মুখের দিকে তাকাল। বিশ্বাস করেন না, তিনি কলকাতার লোকের মুখের কথা বিশ্বাস করেন না। তবু মাথা নেড়ে বললেন-যেয়ো। জায়গাটা ভালই লাগবে।
পৃষ্ঠা:১২০
একটু অন্যমনস্ক রইলেন রজগোপাল। পেভমেন্টে গা ঘেঁষে অচেনা লোকেরা হলে যাচ্ছে। হাজার লোকের ভিড়ে এক অদ্ভুত অন্যমনস্কতাবশত তিনি বললেন-শীলার মুটা স্কুলেই গেছি। কতকাল দেখি না। -আজই, তো যেতে পারেন বাসায়, শীলা ভীষণ খুশি হবে। ব্রজগোপাল জামাইয়ের মুখে মেয়ের নাম শুনে বোধ হয় একটু বিরক্ত হন। অজিত চক্ষ করে। ব্রজগোপাল বললেন-আগে প্রথা ছিল ছেলেপুলে না হলে মেয়ের বাড়িতে অব বাপ-মা যায় না। অজিত সামান্য হাসে। ছেলেপুলে না হলে-কথা লক্ষ্য করেই হাস্য। বলল ওসব শ্রো প্রাচীন সংস্কার। না মানলেই হল। ব্রজগোপাল মাথা নেড়ে বলেন সংঙ্গারটা ভাল না মন্দ তা না জেনে ভাঙতে আমর ইচ্ছে করে না। তার দরকারই বা কী। আমরা বুড়ো হয়েছি, সব জায়গায় যাওয়া সম্ভব না হতে পারে। তোমরা যেয়ো। বাব। রণেন একটু এগিয়ে রাস্তার ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল। একটন খালি ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে ব্রজগোপাল বিরক্তির স্বরে বললেন-ট্যাক্সি নিলে নাকি? -হ্যাঁ। রণেন কুষ্টিত ভাব দেখায়। -কেন? –এ সময়টায় বড্ড ভিড়। ট্রয়মে বাসে ওঠা যায় না। ভিড় হলেও তো লোকে যাচ্ছে অসেছে। আমাদের বাবুগিরির কী দরকার? ট্যাক্সিটা ছেড়ে যেতে অজিত সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাল। আজ টিফিন খায়নি। খিদে পেয়েছে। কিছু খাবে বলে ফুটপাথের হরেক টিফিনওয়ালাদের দিকে কয়েক কদম এগিয়ে। গিয়েছিল সে। হঠাৎ মনে পড়ে যায়, শীলা বলেছিল ভাল চকোলেট নিয়ে যেতে। আর কান আচার। আর চানাচুর। এই প্রথম শীলা এসব খেতে চাইছে। তার অর্থ, প্রেগন্যান্সির কোন গোলমাল নেই। ছোরার মারের মতো একনে বীট ও তাঁর আনন্দ বুক ফুঁড়ে দেয় হঠাৎ। এত তীব্র সেই আনন্দের অনুভূতি যে অতিতের খাসকই হতে থাকে, হাত পায়ে রিমঝিম করে একটা জিবি ছাড়ার মতো হতে প্রকো অজিত অবিভর সিঁড়ি ভেঙে উঠে যায়। আই-বি-এম মেশিনগুলি সঙ্গমকালীন সুখের শব্দ তুলে চলছে। মেশিনগুলির পাশ দিয়ে হালকা পায়ে চলে যায় অজিত। অফিসার সেনগুপ্তর টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। উ। বলে সেনগুপ্ত মুখটা তোলেন। হাসেন। আজ চলে যাচ্ছি। -কী একটা খবর শুনছি। কুমুদ বোল বলে গেল। বউমার নাকি-
পৃ্ষ্ঠা ১২১ থেকে ১৪০
পৃষ্ঠা:১২১
অজিত দাঁতে ঠোঁট কামড়ে বলে একদিন যোসটাকে ঠ্যাভাব সেনবা।-মুখটা খারাপ, নইলে লেকার খারাপ না। বলছিল–কী বলছিল?-বলছিল, ম্যাজিসিয়ানের সব বিফলে যাচ্ছিল, আসল মাজিবটা এতদিন দেখাতে পারছিল না। বউয়ের পেটে দুনিয়ার সবচেয়ে আশ্চর্য ম্যাজিকটা দেখাতে না পারলে নাকি সব বৃথা। বলে সেনগুপ্ত মোটা শরীরে দুলে দুলে হাসেন-সেটা এতদিনে দেখিয়েছেম্যাজিসিয়ান। -এখনও কিছু বলা যাচ্ছে না। সেনদা, অজ যাচ্ছি।-বাও। কিন্তু আমার পড়ার স্কুলে একটা চ্যারিটি শো দিতে হবে, মনে থাকে যেন।বিনাপয়সায়।-আমার তো টেবিল-ম্যাজিক। শো দিতে অপারেটাস লাগে।-ওসব শুনছি না। আমি কথা দিয়ে রেখেছি। ফান্ডের অভাবে স্কুলটা উঠে যাবে হে। আমি সেক্রেটারি হবে বসে বসে দেখব।-আশা।অজিত অফিস থেকে বেরোবার আছে আর একবার আই-বি-এম মেশিনগুলির সামনে দাঁড়ায়। কতকাল ধরে এই সব মেশিন সে ঘাঁটছে। একঘেয়ে সব শব্দ। কিন্তু আজ শব্দটা অন্য রকম শোনায়। রতিক্রিয়াকালে খাসবায়ুর মুখের শব্দ, দাঁত যথার শব্দ, চুম্বনের শব্দ- সব মিলেমিশে একটা তীর কম্পন উঠছে। অজিতের বুক এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করে একটা আনন্দ ছোরা মারে আবার। বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো শরীর চমকায়।প্রায় ছুটে বেরিয়ে আসে অর্জিত। ক্যাডবেরি কেনে, আচার কেনে, চানাচুর কেনে। গ্রান্ট। স্ট্রিট থৈকে কিছু না ভেবে একটা শাড়িও কিনে ফেলে হঠাৎ। টাকা উড়িয়ে দেয়।এই দুপুরের নির্জনে সে বাড়ি ফিরে কী দিদায়, কী কাতরতায় শীলাকে মিশিয়ে ফেলবে নিজের সঙ্গে।তীব্রতায় সে প্রবেশ করবে শীলার অভ্যন্তরে। শীলা ভীষণ ভীষণ- ভীষণ-সুখে, লজ্জায়, হাসিতে একাকার হয়ে যাবে তার সঙ্গে।শীপা হারিয়ে গিয়েছিল। কতকলে অজিতের জীবনে শীলা প্রায় ছিলই না। আবার হঠাৎ কবে শীলা পরিপূর্ণ বউ হয়ে গেল।বৈর্বহারা অজিত জোরে- বর্মতলা থেকে ট্যাক্সি ধরল। বদল-জোরে চালান ভাই।অস্থির।
। সতেরো
ঠিক দুকুরবেলা ভুতে মারে ঢেলা। সারাটির দিন যখন শীলা একা, তখনই ভুতে বরে তাকে। ভুতের ঢিল এসে পড়ে মাথার ভিতরের নিথরতাদ। সারাদিন শুয়ে আর বসে সময় কাটে না। দিনটা কেবলই লম্বা হতে থাকে। মাঝে মাঝে অদ্রিত অফিস কামাই করলে তবু এরকম কেটে যায় সময়। কিন্তু আদব ভালবাসা যখন শেষ হয় রতিক্রিয়ায়, তারপর ক্রান্তি আসে, কথা ফুরোয়, টান করে বাঁধা তরে হঠাৎ ঢিলে হয়ে বেদূর বাজতে থাকে। বহুদিন শীলা এমন ভালবাসা পায়নি অদিতের কাছ থেকে। আবার বহুকাল পরে সে নিজেও
পৃষ্ঠা:১২২
ভালবাসেনি এত অজিতকে। তবু দিনটা কাটতে চায় না। একা বা দুজন। একা থাকাটা আরও ভয়কের। এখন ইস্কুলে পরীক্ষার সময়। এ সময়ে দু-একটা বেশি ক্লাস নিতে হয়, কোচিং থাকে। মেয়েদের ইস্কুলের নিয়মে বড় কড়াকড়ি। সাড়ে চারটে পর্যন্ত সম ফেলার সময় থাকে না। কিন্তু সেই ব্যস্ততা শীলার বড় ভাল লাগে। নিজেকে ভারী গুরুত্বপূর্ণ মানুষ বলে মনে হয়। ফাঁকে ফাঁকে টিচার্স রুমের আজ্ঞাটি। খুব ব্যস্ততার মধ্যে দু-পাঁচ মিনিটের চুরি করা আড্ডা যা ঝলমলে করে নেয় মনটাকে। ইস্কুলের জন্য মনটা বড় উন্মুখ হয়ে থাকে শীলার। কলকাতার শীতের দুপুরের মাত্রা এমন সুন্দর সময় আর কি হয়। এমন দুপুরে ঘরে পড়ে খাবার মতো শাস্তি আর কী হতে পারে। নির্জনতা জিনিসটা কোনওদিনই সইতে পারে না সে। তার ভাল লাগে রাস্তাঘাট, মানুষজন, আলো ঝলমলে চারবার। ভাল লাগে ক্লাসভরতি ছাত্রী, টিচার্স কমের জমজমাট কথার শব্দ। আর ভাল লাণে কাজ। সংসারের কাজ তার দুচোখের বিষ। কোমাও কোনও মেয়ে থাকে যার সংসারে ঢুকে, মধুর মধ্যে যেমন মাছি আটকে যায়, তেমনি আটকে থাকে। যেমন মা। ঘরসংসারে অমন আকণ্ঠ ডুবে থাকা মানুষ কমই দেখেছে শীলা। সারা দুপুর মা জেগে থেকে টুকটাক কাজ করছে তো করছেই। কোনও কাজ না পেলে ঝিয়ের মেজে যাওয়া বাসনে কোন কোলে একটু ছাইয়ের দাগ লেগে আছে ব্লেড দিয়ে ঘষে ঘষে তাই তুলবে, আর আপনমনে বকতে থাকবে-ইস, কী নোংরা কাজ। বাপের জন্মে এমন নোংরা কাজ করতে কাউকে দেখিনি। সারা দুপুর রেশনের গম ঝাড়বে কুলোয়, ঢাল বাছবে, নইলে ফেরিঅদ্য ডেকে সংসারের জিনিস কিনবে দরদত্তর করে। ওরকম জীবনের কথা শীলা ভাবতেও পারে না। তার নিজের সংসারটা পড়ে থাকে বাচ্চা কিয়ের হাতে। ছাড়া শাড়িটাও শীলাকে ধুতে হয় না, রান্নাবান্না থেকে যাবতীয় কাজ করে দেয় ঝিটা। রান্নায় কখনও কখনও গোলমাল করে। ঘরদোর খুব পরিষ্কার রাখে না, কাজ ফাঁকি দিয়ে পড়ে ঘুমোয়, কিন্তু তবু সংসারটা চলে ঠিকই। কিছু তেমন অসুবিয়ে বোধ হয় না। অবশ্য এই ইস্কুল করা বা বাপের বাড়ি মাঝে মাঝে যাওয়া বা একটু দোকান পশ্যর করা-এ ছাড়া শীলাও কি ঘরবন্দি নয়? অজিতের বাইরে বেড়াতে যাওয়ার ধাতই নেই। বড় ঘরকুনো লোক। প্রচন্ড আলসে। সারাদিন ঘর আর বারান্দা করে, সিগারেট খেয়ে কাটিয়ে দেবে, ছুটির দিনে রাস্তাঘাটে এটিতেও চায় না, বলে-যা ভিড়, আর রাস্তাঘাটের যা বিচ্ছিরি অবস্থা। এই লোকটার সঙ্গে থেকে শীলার বেড়ানোর শখ-আহ্লাদ চুলোয় গেছে।যে যেমন চায় সে তেমন পায় না কখনও। যেমন তার ছোট বোন ইলা। ঠিক মায়ের স্বভাব পেয়েছে। ছেলেবেলা থেকেই ঘরের কোণে বসে একমনে বিভোর হয়ে পুতুল খেলত, ছাদে এর্যপ্তানী, সঙ্গী-সাথীর সঙ্গে খেলতে তেমন ভালবাসত না। বড় হয়ে মার সঙ্গে ঘুরঘুর করে ঘরের কাজ করত। বিছানা তোলা বা পাড়া, টুকটাক একটু রঙ্গা নামানো ছড়ানো, শুকনো কাপড় শুছিয়ে রাখা, ধোপার হিসেব, সংসারের হিসেব রাখা। বিয়ে হল একটা উজ্জ্বল স্মার্ট ছেলের সঙ্গে। মুম্বইতে চাকরি করে। হুল্লোড়বাজ ছেলে। এক জায়গায় বেশিদিন থাকতে ভাল লাগে না বলে কলকাতার সরকারি চাকরি ছেড়ে মুম্বইতে একটা বেসরকারি ফার্মে চাকরি নিয়ে চলে খেলা সেখানে খুব আউটডোরে যায়। দিল্লি মাল্লাব্জ করে প্রায়ই। সব সময়ে ঝুঁকি নিতে ভালবাসে। ঘরের জীবনের চেয়ে বাইরের জীবনটা ওর বড় প্রিয়। ইলাকে প্রায়ই ধমকায়, বলে রোজ রান্নাবান্নার কী দরকার? সপ্তাহে দু-তিন দিন হোটেলে খেলেই হয়।
পৃষ্ঠা:১২৩
অমল আর ইলা বছর তিনেক আগে একবার এসেছিল। তখনই অমল দুঃখ করে বলেছিল শীলাকে শীলদি, আপনার বোনটি একদম ইনডোর গেম।-কেন?-বেরোতেই চায় না মোটে। সারাদিন কেবল ঘর সাজাবে আর গুচ্ছের নাবার-দাবার তৈরি করবে। আমাদের মতো ছেলে ছোকরার কি ঘরে এসে বসে খুনসুটি তাল লাগে। কলুন। আমি ওকে প্রায়ই বলি, চলো দুজনে মিলে হিণি হয়ে যাই। শুনেই ও ভয় খায়।শীলা দীর্ঘশ্বাস চেপে হেসে বলেছে-আর আমার শিবঠাকুরটি হচ্ছে উলটো। ব্যোম বাবা ভোলানাথ হয়ে ঘরে অধিষ্ঠান করবেন। কলকাতা শহরের বারো আন্য জায়গাই এখনও চেনেন না। কেবল অফিসের পরে অজ্ঞোটি আছে, আর কোনও শন আহ্লাদ নেই। আমার যে বাইরে বেরোতে কী ভাল লাগে।অমল বড় মুখ-পলকা ছেলে, দায়িত্বজ্ঞান নিয়ে কথা বলে না। ফস করে বলে বসেছিল-ইস শীলাদি, ইলার বদলে আপনার সঙ্গে যদি আমার নিয়ে হত। নীলা মুখ লুকোতে পথ পায় না। বুকের মধ্যে গুরুগুরুনি উঠে গেল তখনই। সবশেষে।খুব হেসেছিল।ইলা ধমক দিয়ে বলল-দিদি পুরন্দন না। ও কী রকম কথা।অমল অবাক হয়ে বলে-ভাতে কী হল। সম্পর্ক ভো ঠাট্টারই।কথাটা ঘোরানোর জন্য শীলা বলে-ত। তুই-ই বা ওর সঙ্গে বেরোস না কেন?-আমি অত ঘুরতে পারি না। গড়ি ঘোলায় বেশিক্ষণ কাটাতে বিশ্রি লাগে। হোটেলে আমি বাল আনইজি ফিল করি। তা ছাড়া নতুন নতুন জায়গায় নিয়ে যাবে, সেখানে পা দিয়ে বিশ্রামটুকুও করতে দেবে না। চলো, সমুদ্রে স্নান করে আসি। চলো পাহাড়ে উঠি। আফগানি দেখে আসি চলো। আমার দমে কুল্যের নয়।তোমার লাইফ সোর্স কম। শীলাদিকে দেখো, চোখেমুখে আর শরীরে টগবগ করছে জীবনীশক্তি। শুনে শীলা হাসবে না কাঁদবে ভেবে পায় না। বলেই অমল শীলার দিকে কিবে বলে-জানেন শীলাদি, ঘুরব বেকার ফুর্তি করব বলে বাচ্চাকাচ্চা হতে দিইনি এতকাল। কোম্পানি থেকে ইয়োরোপের মার্কেট, যাচাই করতে পাঠাবে বলছে, ভাবছিলাম ইল্যর ভিষটাও করিয়ে দেনা। কিন্তু এই অগ্রসৈফ মার্কা মহিলাকে নিয়ে দিয়ে ঝামেলা ছাড়া কিছু হবে না, সাহেবসুবোর জায়গা আমি চোখের আড়াল হালেই হয়তো ভয়ে কাঁদতে বসবে।ইলা দুখ ঝামতে ব্যতি যেতে আমার বয়ে গেছে।অমল শীলার দিকেই চেয়ে ছিল, দুঃখ করে বলল-ভেবে দেগলাম, বাচ্চাকাচ্চা মানুষ করতেই ওর সৃষ্টি হয়েছে। তাই ভাবছি এবার মুম্বই ঘিরেই বাচ্চার ব্যবস্থা করে ফেলব।সে কী লজ্জা পেয়েছিল শীলা। অমলের সঙ্গে বেশিক্ষন কথা বলার ওই হচ্ছে মুশকিল। গনগনে অ্যাগ্রেসিভ চঞ্চল, প্রাণপ্রচুর্য ভরা ছেলে। কোনও কথাই কাতে মুখে আটকায় না। কিন্তু ওকে বেশিক্ষণ সহ্য করা যায় না। বুক জা গুর করে। দমকা বাতাসের মতো মনেরদরজা জানালার বিল নাড়িয়ে দিয়ে যায়।সংসারে ঠিক এরকমই হয়। যা চাওয়া যায় তার উলটোটি বরাতে জোটে।মনের ভিতরে কত পাপের বাসা। বলতে নেই, শীলার এক-এক সময়ে মনে হয়েছে, অমলের সঙ্গে তার বিয়ে হলে মন্দ হত না। দমকা বাতাসের সঙ্গে খড়কুটের মতো উড়ে বেড়াতে পারত। কলকাতা ছাড়া আর কোথায়ই বা তেমন গেয়ে শীলা। অনেক বলেকয়ে
পৃষ্ঠা:১২৪
একবার পুত্রী গিয়েছিল একবার দার্জিলিং আর কাছেপিঠে দু-একটটা জায়গায়। ইস্কুলের স্টাফ সবাই মিলে বছরে দুবছরে এক-আধবার ডায়মন্ডহারবার বা কল্যাণীতে গেছে পিকনিক করতে, একবার স্টিমার পার্টিতেও গিয়োছিল অজিতের অফিস স্টাফের সঙ্গে। কিন্তু বিশাল ব্যাপ্ত পৃথিবীতে এ তো চৌকাঠ পেরনোও নয়। আর ইয়োরোপ ওদিকে হাত বাড়িয়ে আছে ইলার দরজায়, ইলা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। গতবার ওর ছেলে হল, কলকাতা থেকে এর শ্বশুর গিয়ে ইলাকে আগলাচ্ছে। অমল গত সেপ্টেম্বরে চলে গেছে ইয়োরোগে। বড় কষ্ট হয় শীলার। ইলুটা বড্ড বোকা।ঘরবন্দি থাকা মানে একরকম মরে যাওয়া। সে তাই বিয়ের পরই চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ওঠে। তার শ্বশুরবাড়ি বড্ড সেকেলে, মেয়ে-বউদের চাকরি কেউ পছন্দ করে না। কিন্তু ওই বড় সংসারে জবরজং আটকে থাকার হাত থেকে মুক্তি পেতেই শীলা চাকরিটা জোগাড় করেছিল অতি কষ্টে। ওই চাকরিই তার শ্বশুরবাড়ির বদ্ধ সংসারে হাওয়া-বাতাসের কাজ করেছে। নইলে সে মনে মনে মরে থাকত এতদিনে। সেই চাকরি থেকেই শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে গণ্ডগোলের সূত্রপাত। কিন্তু চাকরি ছাড়েনি শীলা। তার জেদ বড় মারাত্মক।তার চাকরির টাকা জমে জমেই জমির দামটা হয়ে গেল, তার সঙ্গে অব্দিতের সঞ্চর, আর কিছু ধারকর্জকরে বাড়িটা উঠে গেল অনায়াসে। অজিতের একার রোজগার হলে হত নাকি এত সহজে। ভাই শীদার একটা চাপা অহংকার আছে বাড়িটা নিয়ে। একটা মস্ত অভাব ছিল, সন্তান। তাও বোধ হয় না, বলতে নেই। আগে হোক। কত দুষ্টু লোক নজর দেয়, বাণ মারে, ওষুধ করে।শরীরের ভিতরে একটা প্রাণ, একটা শরীর। এখনও হয়তো একটা রফের দলা মাত্র। সেই দলাটা শীলার শরীর শুষে নেয় ধীরে ধীরে, টেনে নেয়, অস্থি মজ্জা মাসে। কে এক রহস্যময় কারিগর তৈরি করে চলেছে এক আশ্চর্য পুতুল তার শরীরের ভিতরে। ভাবতেই গায়ে কাঁন দেয়, কুলপ্লাবী এক অসহ্য আনন্দের ঢেউ গলা পর্যন্ত উঠে এসে দন বন্ধ করে দেয়। ডাক্তার বার বার সাবধান করে দিয়েছে-নড়াচাড়া একদম বারণ, একটু দোষ আছে শরীরে। হঠাৎ দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। পাঁচ মাস ধৈর্য ধরে থাকতেই হবে। তচাপর তার তেমন ভয় নেই।কিন্তু পাঁচটা মাস কি শীলার কাছে কৃড়। এই সুন্দর শীতের দুপুর বয়ে যায় নিরর্থক। সে ঘরের বাইরে পা দিতে পারে না। উল কুটতে কুনতে চোখ ব্যথা করে, দুহাতের আঙুল অসাড় হয়ে আসে। সকালের খবরের কাগজটা কতবার যে উলাটপালটে পড়ে সে। মোটা মোটা গল্পের বই শেষ করে। দিনেদার মাসিক কাগজ উলটেপালটে দেখে। তবু সময় ফুরোয় না। বই পড়তে একনামূদ্ধে তালও লাগে না। কিন্তু শরীরের ভিতরে আর একটা শরীরের কথা ভেবে সয়ে তৃমওকী নাম হবে রে তোর, ও দুষ্টু ছেলে? খুব জ্বালাবি মাকে। নাম কামড়ে ধরবি, চুল টেনে গরবি, মাঝরাতে কেঁদে উঠে খুঁজবি মাকে? না, না, ভাবতে নেই। আগে হোক। ভালর ভালয় আগে আসুক কোলজুড়ে।… হতে গিয়ে খুব কষ্ট দিবি না তো মাকে? লক্ষ্মী সোনা ছেলে, কষ্ট হয় হোক আমার, তোর যেন ব্যথাটি না লাগে। কেমন ঝামরে আদর করাব। মুখে মুখ দিয়ে পড়ে থাকব সারাদিন। নিজের পেটে আগতো হাত দু’খানা রেখে শীলাশুয়ে থাকে। বুক ভরে যায়।কিন্তু তবু, ঠিও দুক্তরবেলা ভূতে মারে ঢেলা।এই শীতকালে দুপুবেই রোদে একটা বানি রং ধরে যায়। কোমল ঠান্ডা বাতাস দেয়
পৃষ্ঠা:১২৫
টেনে। গায়ে একটা স্টোল বা স্কার্ফ জড়িয়ে ধীরে রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে এখন বড় ভাল লাগে। শীত তার সবচেয়ে প্রিয় ঋতু। তার দিনে রাতে, তার কুয়াশায় ঢাকা মায়াবী আবহে তার ফুলে ও ফসলে একটা দারিদ্রা ঘুচে যাওয়া প্রাচুর্যের চেহারা আছে। আর থাকে রহস্য, ওম। পরীক্ষা শেষ হলে শীতকালে ইস্কুলের বারান্দায় কখনও কমলালেবুর খোসা ছাড়াতে। বাড়াতে নিষ্টি গন্ধে বুক ভরে ওঠে। খাতা দেখার ফাঁকে ফাঁকে আত্মা। মেয়েরা যখন কথা বলে তখন সবাই একসঙ্গে বলে, কেউ কারও কথা শোনে না। একজন তার ঝিয়ের গল্প শুরু করতেই অন্যজনও তার বিয়ের গল্প শুরু করে দেয়, একজন নিজের ভাইয়ের বিয়ের গল্প ফেঁদে বসতেই অন্যজন তার কথার মাঝখানেই নিজের ননদের প্রসঙ্গ এনে ফেলে। আর ঠিক কথার মাঝখানে তুচ্ছ কারণে সবাই কেবল হাসতে থাকে। এক-এক সময়ে মেয়েরা নিজেরাও ভাবে-ইস, আমরা কী সব ছোট্টখাট্ট বিষয় নিয়ে কথা বলি-ঝি, গয়না, শাড়ি, নিয়ে: ভাবে আবার বলেও আর কেবলই হাসতে থাকে। তুচ্ছ তুচ্ছ সব কারণে, বহুবার শোনা কথা আবার শুনে, কিকে পরস্পরের চোখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ হাসি পায় বলে কেবলই হেসে যায় তারা।শীতের দুপুরটার জন্য মন বড় ছটফট করে শীলার, ঘরে বসে থেকে থেকে সে কেবলই দেখে, দিন পুড়ে কালো হয়ে অন্ধকার নেমে আসছে। ইস্কুল ছুটি হয়ে গেল কোথায়, ছেলেদের হরা কানে আসে। মনটা একটা ছবিহীন শূনা চৌকো ফ্রেমের মধ্যে আটকে থাকে। সামান্য এই কারণে চোখে জল এসে যায়।তাই ঠিক বুকুরবেলা, ভূতে মারে চেলা।আজকাল অবশ্য অদিত মাঝে মাঝে তাড়াতাড়ি ফিরে আসে। কোনওদিন বা অফিস কামাইও করে। কিন্তু বদ্ধ নির্জীব পুরুষ। হঠাৎ উত্তেজনা বশত প্রচন্ড আদর করতে থাকে, হটিকে-মাটিকে একশা করে শীলাকে। এবং তারপর তারা পরস্পরের মধ্যে প্রবিষ্ট হয়। তারপরই অজিত অন্যরকম হয়ে যেতে থাকে। একটু বুঝি দূরের মানুষ হয়ে যায়। কথা বলে, আসরও করে, কিন্তু জোয়ারটা থাকে না। হাই তুলে আড়মোড়া ভেঙে, সিগারেট ধরিয়ে ছানে এরান্দায় যায়। কিংবা আপনমনে ম্যাজিকের সুটকেস খুলে সরঞ্জাম বের করে আনে। আপনমনে পাসিং আরা পাসিং অভ্যেস করে। করে কয়েন কনজিওরিং, কাপস অ্যান্ড কলসের খেলা অভ্যেস করতে থাকে। জু-চারটে স্কুল শোতেও আজকাল ম্যাজিক দেখায় অজিত। কিন্তু মাই করুক শীলা যে একট সেই একা। যেদিন অজিত থাকে না সেদিন শীলার বুকের ওপর সময়ের ভার হাত্রিয় পায়ের মতো চেগে থাকে। পাঁচ মাস: ওমা গো। ভাবাইযায় না।কখনও কখনও। আবার পেটের ওপর হাত দুখানা রাখে শীলা। কিছুই টের পাওয়া যায় না ওপর থেকৃেমতিবু শীলার হাত যেন ঠিক সেই রক্তের দলার ভিতরে অশ্রুত হৃৎস্পন্দন শুনতে পায়। সেই রক্তের পিন্ডের ভিতরে বান ডাকে, অন্তঃস্থল থেকে উঠে আসে স্পন্দন। শীলা টের পায়। ও ছেলে, কেমন হবে রে তোর মুখখানা? কার মতো। না, না, থাক, ভাবতে নেই। শীলা ফের হাত সরিয়ে নেয়।কিন্তু ঠিক নূকুরবেলা ভূতে মারে ঢেলা।ইস্কুলটা খুব বেশি দূরে নয়। বড় রাস্তা পর্যন্ত হেঁটে যেতে লাগে, অজিতের সাত মিনিট, শীলার দশ মিনিট। সেখান থেকে উলটোবাগের ট্রাম ধরলে ঠিক দুটো স্টপ। স্টপ থেকে মোটে তিন-চার মিনিটের রাস্তা। তবে গলিখুঁজি দিয়ে একটা শর্টকাট আছে। সে বাস্তনি ভাল
পৃষ্ঠা:১২৬
নয়, কিন্তু রিকশা যায়। এক-এক দিন শীলার খুব ইচ্ছে করে, অজিত বেরিয়ে গেলে, চুপি চুপি উঠে সামান্য একটু প্রসাধন করে বেরিয়ে পড়ে। রিকশাঅলাকে বলবে ভাই খুব ধীরে ধীরে যাবে। কারো আনা ভাড়ার জায়গায় আমি তোমাকে না হয় একটা টাকা দেব। গর্তটর্ত বাঁচিয়ে দেয়ে, যেন কাঁকুনি না লাগে।আবার তখন একটা ভয়ও করে।ডাক্তাররা যা বলে তার অবশ্য সব সত্যি হয় না। রুগিকে বেশি ভয় দেখিয়ে অনেক সময়েই গুরা একটা বাড়াবাড়ি চিকিৎসা চালায়। ডাক্তারদের সব কথা শুনতে নেই। অন্য কিছু হলে অবশ্য শুনতও না শীলা। কিন্তু সন্তান বলে কথা। বিয়ের পর এতকাল তারা দুজনে যার পদধ্বনির জন্য কান পেতে ছিল সেই রাজাধিরাজ আসছে। সোজা লোক তো নয় সে। দুষ্টু ছেলে, মাকে যে কী কষ্টে ফেলেছিস। তোর জন্য দ্যাখতো কেমন ঘরবন্দি আমি। হোক, তবু তোর যেন কিছু না হয়।কিন্তু ঠিক দুকুরবেলা ভূতে মায়ে ঢেলা। দুপুরবেলায় শীলা তার সেলাই রেখে একটা খাদ ফেলে উঠল। আজ একবার যাবে ইস্কুলে। কিছু হবে না। ডাক্তারদের সবতাতেই বাড়াবাড়ি।
। আঠারো।
ঠিক দুকুরবেলা ভূতে মারল ঢেলা।ভূতের সেলাগুলোই ঘরে টিকতে দিল না শীলাকে। অতিষ্ঠ। মাথার ভিতরে একটা পুকুরে যেন ঢিলের ঝড় বয়ে যায়। বিছানায় সর্বক্ষণ পেতে রাখা শরীরের খাঁজে গাঁজে কেবলই ধৈর্যহীনতার ভূতের ঢেলা এসে পড়ে টুপটাপ। শরীর এপাশ ফিরিয়ে শোয়, ওপাশ ফিরিয়ে শোয়। ভাল লাগে না, বই তুলে নেয় হাতে। সেখানেও টুপটাপ ভূতের ঢিল এসে যেন পড়তে থাকে, মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। রেকর্ড-প্লেয়ার একাই সম্প্রতি কেনা হয়েছে সময় কলিনোর জন্য। কিছুক্ষণ রেকর্ড শুনল সে, ইস্কুলে যাবে বলে উঠেও এইভাবে কিছুক্ষণ সময় কাটায় শীলা। যাবে না যাতে না করে। কিন্তু জানালার বাইরে ওই যে রোদে ধানিরং ধরে গেল, বাতাস মনু খাস ফেলে বয়ে যায় হাহাকারের মতো। বাইরের পৃথিবীর আলোর ইশারা হয়ে দক্ষিণের ভোলা দরজার কাছে চৌকো পাপোশের মতো পড়ে আছে। ওই রোদে চক্কল পায়ে কিছায় একবার একটুক্ষণের জন্য ঘুরে আসতে বড় ইচ্ছা করে। কী করবে শীলা। এতকাল এতদিন ধরে ঘরবন্দি থাকার অভ্যাস তো নেই।কাঁ রে ছেকুরী যেতে নিবি একবার মাকে। একটুক্ষণের জন্য? সোনা আমার, লক্ষ্মী আমার, আর যে পারি না রে। একটু যাব। লক্ষ্মী সোনা, ভয় দেখাস না। তোর জন্য সারাজীবন কত কষ্ট সহ্য করব দেখিস। একটুও বিরক্ত হব না, রাগ করব না। যেতে দিবি?বাবা আমার, ছেলে আমার…এ-ঘর গেল, ও-খর গেল শীলা, ঘড়িতে মোটে দেড়টা, এখনও লম্বা দুপুর পড়ে আছে। রেকর্ডে গান হচ্ছিল, কী গান তা শোনেওনি সে। রেকর্ড শেষ হয়ে ঘাস-স্ আওয়াজ হচ্ছে, সেটা বন্ধ করে দিল। তারপর যেন বা সম্মোহিতের মতোই বেখেয়ালে ড্রেসিং টেবিলেরসামনে দাঁড়াল সে। সামান্য একটু পাউডার, একটু লিপস্টিক ভূঁইয়ে নেয়। আলমারি থেকে
পৃষ্ঠা:১২৭
শাড়ি বের করে দ্রুত হাতে পরতে থাকে, মনে মনে সময়ের হিসেবটা করতে থাকে ঝাড়ের মতো। যদি চারটেতেও ফেরে অজিত তা হলেও আড়াই ঘণ্টা সময় হাতে থাকে। রিকশায় বড় জোর শর্টকাট করে গেলে পনেরো কুড়ি মিনিট লাগবে। যাতায়াতে চল্লিশ মিনিট বাদ দিলেও প্রায় দেড় পৌনে দুই ঘণ্টা সে ইস্কুলে থাকতে পারে। কাজকর্ম করবে না কিছু। কেবল একটু অভ্যাস বজায় রেখে আসরে। একটু কথা, একটু হাসি, একটু চেনা মুখ দেখা, চেনা ইস্কুলবাড়িটার একটা ধূলোটে মূহু গন্ধ আছে, সেই গন্ধটা একটু বুক ভরে নেওয়া। অজিত টের পেলে ভয়ংকর রাগ করবে, ককরে ভীষণ, সেই ভয়ে বুকটা একটু কেঁপে কেঁপে ওঠে। পুরুষ মানুষের সন্তানক্ষুধা বড় প্রবল। সন্তান মানে পুরুষের নিজেরই পূনর্জন্ম। অজিতের নির্বিরোধী জীবনে ওই একটি প্রবল তীর ব্যাপার আছে। শীলা তা টের পায় ভীষণ, তমা শরীরের এই বিপজ্জনক অবস্থায় সে যদিও বা দু-একটা বেচাল বেভুল কাজ করে ফেলে, হয়তো একটু জোরে ওঠে বা পাশ ফেরে, কিংবা হয়তো রান্নাঘরে যায় তরকারি পাড়তে কিন্তু অজিতের চোখে পড়লে আর বক্ষ্য থাকে না জোর করে আবার শুইয়ে দেবে, পাহারা দিয়ে বসে থাকবে। অজিতকে তাই বড় ভয়।দ্রুত একটা এককেণী বেঁধে নেয় শীলা, ঝি মেয়েটাকে ঘুম থেকে ডেকে বলে-ঘোরদোর দেখে রাখিস।-তুমি বেরোবে বউদি তোমার না যারুণ।এক্ষুনি আসব।-দাদাবাবু যদি চলে আসে!-বলিস, পাশের বাড়িতে একটু গেছি। একটা রিকশা ডেকে নিয়ে আয় তো।রিকশায় ওঠার সময়ে যেন অনেকদিন বাদে আকাশ আর পৃথিবীরখোলামেলা কোলটিতে এসে যায় শীলা। বী ভীষণ ভাল লাগে তার।-তাই রিকশাঙ্গলা, আস্তে বেয়ো, খুব আস্তে।-হ্যাঁ।রিকশা আস্তেই যায়। কখনও একটু জোর হলে শীলা সাবধান করে দেয়। রাস্তাটা খারাপ, এখানে-সেখানে গর্ত। একটু একটু টালু খায়। ওরে ছেলে, ভুল করলাম না তো। সর্বনাশ করিস না, তোর পায়ে পড়ি। না নাছিছি, তোর পাপ হবে, পায়ের কথা কেন বলতে গেলাম। চুপ করে থাকিস ছেলে, উটকেধরে চুপ থাকিস।দুহাতে দুপাশের হাতলু ধরে শক্ত হয়ে বসে থাকে সে। শরীরকে যতদূর সম্ভব আলগা করে রাখে সিট থেকুে শরীরের মধ্যে যে রাজার শরীর সে যেন থাকে ভগবান। শরীরেরমধ্যে যে দেবতা ফেন ছেড়ে না যায়।শরীরের গুঞ্জান আবল্যি টের পায় না শীলা। রিকশাটা একটু দুলে দুলে, ধীরে ধীরে রাস্তা পার হয়ে যায়। দূর থেকে ইস্কুলের বাড়িটা দেখতে পায়, শীলা, ইস্কুলের ছাদে শীতের সুর্য আটকে আছে।স্টাফ-নামটা ভাগ্যিস একতলায়। শীলা দুধাপ সিডি, বারান্দা পার হয়ে সংফরুমেআসতেই একটা চাপা আনন্দ আর অভ্যর্থনা ছুটে আসে।-জারে, শীলা।-শুনেছি, শুনেছি, মিষ্টি-টিস্টি খাওয়াও বাবা।
পৃষ্ঠা:১২৮
-বেশ সুন্দর হয়েছেন শীলাদি।এইরকম সব কথা। বহুকাল পরে সীক্ষ-রুমে পা দিয়ে একটা গভীর তৃপ্তি তাকে ধরে থাকে। নাকের পাটা ফুলে ফুলে ওঠে, চোখ ঝলমল করে। দাঁতে ঠোঁট চেপে একরকম হাসতে থাকে সে। লজ্জার হাসি। সে আর চিরকালের সেই একা শীলাটি নেই। তার শরীরের মধ্যে এখন অন্য একশরীর। হয়তো এক রাজার হয়তো এক দেবতার। অহংকার পাখির মতো তার দুকান ভরে ঢাকে।সে ঘুরে ঘুরে হেড-মিস্ট্রেসের সঙ্গে দেখা করে, ক্লার্কদের সঙ্গে কথা বলে, ছাত্রীদের সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটায়, স্টাফ-রুমে বসে আমল দেয়। কী ভাল যে লাগে তার। বারবার ঘড়ি দেখে। চারটের এখনও ঢের দেরি আছে।মীনাক্ষী বলে-শীল, সুভদ্রর মন খারাপ। দেখছিস না, কথা বলছে না।সুভদ্র মেয়েদের থেকে দূরে আলাদা চেয়ারে বসেছিল, এ স্কুলে ছেলে স্টাফ খুব অল্প। পণ্ডিতমশাই ছাড়া একজন পুরনো আমদের বি-এসসি আছে কেবল। সুভদ্র ঢুকেছিল কমিটির প্রেসিডেন্টের সুপারিশে, একজনের লিড ভেকাপিতে। খুবই সুন্দর দেখতে সুভদ্র। ফরনা টকটকে রং, লম্বা, একটু রোগা হলেও মুখশ্রী মায়াবী কিশোরের মতো। অল্প দাড়ি রাখে সে, মোটা গোঁফ, গায়ে খুব কমনামি কিন্তু সুন্দর রঙিন খন্দরের শার্ট পরে সে, ঊরিকটের গাঢ় রঙের প্যান্ট পরে। সুভদ্র একটু বোকা। কিন্তু আবার এও হতে পারে যে, জেকামির ভান করে। কারণ তার ধারাল মুখে, বা চোখের তীক্ষ্ণ চাউনিতে বোকামির লেশমাত্র নেই। তবু স্কুলের চটুল স্বভাবের শিক্ষিকাদের মধ্যে সুভদ্রর বোকামির গল্প চাউর আছে। সেটা সুভদ্র জানে, কিন্তু রাগ করে না। বরং হাসে।শীলার সঙ্গে সুভদ্রর পরিচয় কিছু গাঢ়। বলতে নেই, স্কুলে শীলার মতো সুন্দরী কমই আছে। একটু সুখের মেদ জমেছে সন্ধাতি, নইলে শীলার আর কোনও খুঁত নজরে পড়ে না, দিঘল চোখ দুখানায় এখনও অনেক কথার, ইঙ্গিতের রহস্যের খেলা দেখায় শীলা, সিখেয় সিদুর যাদের আছে তারা ছেলেদের সঙ্গে সহজেই প্রথম আলাপের সংকেয়টা কাটিয়ে উঠায়েত পাবে। এই সুন্দর কিশোরপ্রতিম চেহারার যুবকটির সঙ্গে আড্ডা দিতে বরাবরই ভাল লেগেছে শীলার। সে মায়া বোধ করেশীলা সুভদ্রকে ডেকে জিজ্ঞেস করে-সুভদ্র, কী হয়েছে। মন খারাপ কেন? -কে বলে মন খারাপু। দুভদ্র নিরুত্তাপ গলায় বলে।মীনাক্ষী চাপা গুলুরচোটো-শোভনাদি ফিরে আসছে, তাই সুভরর চাকরি থাকছে না। নীলা অবাক হয়েবলে- শোভনাদি ফিরে আসছে। সে কী। উনি তো বরের সঙ্গে মাত্রাজ গেলেন এই সেদিন। চাকরি বলে করবেন না।-সেইটেই তো গোলমাল হল। ওর বর আরও প্রমোশন পেয়ে কোম্পানির ডাইরেক্টর হয়ে কলকাতায় ফিরছেন। শোভনাদি জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারিতে জয়েন করবেন বলে চিঠি নিয়েছেন।শীলার মন খারাপ হয়ে যায়।মীনাক্ষী বলে-অবশ্য শুধু সে কারণেই যে সুভদ্রর মন খারাপ, তা নয়।-আর কী কারণ? শীলা ভিজেস করে।-সে তো তুই জানিসই বাবা।
পৃষ্ঠা:১২৯
-কী জানব।- আহা, তুই যে ছুটি নিয়ে ঘরে বসে রইলি, সুভদ্র বেকারা এখন কোন আকর্ষণে স্কুলে আসবে?শীলায় কনটান একটু লাল হয়ে ওঠে। আবার মুখে সে হাসেও। সুভদ্র দূর থেকে একবার এদিকে তাকিয়েই উঠে বারান্দায় চলে যায়।বয়স্কা মাধুরীদি ধমক দিয়ে বলেন-তোর ইতর রসিকতাগুলো একটু বন্ধ করবি মিনু। -আহা। কে না দেখতে পাচ্ছে বাবা, শীলা ছুটি নেওয়ার পর থেকেই সুভদ্র কেমন মন খারাপ করে ঘুরছে!মাধুরী হাসেন। অবিবাহিতা এবং বয়স্তা অলা মুখখানা গাড় গার্থীদে মেখে রাখেন। মেয়েদের প্রেগন্যান্সি তাঁর সহ্য হয় না। গর্ভবর্তী মেয়েদের দেখলে রাগ করেন। তবু শীলার পক্ষ হয়েবললেন-মীনাক্ষী, সব খেয়ই কিন্তু আগুনের ইঙ্গিত করে না।ঠাট্টা। কিন্তু শীলা একটু অগস্তি বোধ করে। সুভদ্র আর ঘরে আসে না। স্কুল চারটের অনেক আগেই ছুটি হয়ে গেল আজ। পরীক্ষার প্রিপ্যারেশনের জন্য মেয়েরা ছুটি চেয়ে অ্যামিকেশন করেছিল। শুধু উঁচু ক্লাসগুলোর কয়েকটায় ক্লাস চলছে।তিনটে নাগাদ শীলা বেরিয়ে আসে ফেরার জন্য। বেয়ারাকে রিকশা ডাকতে পাঠিয়েছিল। দীর্ঘ ারান্দার থামের আড়াল থেকে সুভদ্র বেরিয়ে এসে তাকে- শীলাদি।-বী খবর? পালিয়ে এলেন যে। কথাটা বলতে বলতেই শীলা হঠাৎ টের পায় তার বুকের মধ্যে কী একটা নড়ে গেল। একটা শ্বাস অর্ধেক কেটে গেল। সঙ্গে একটা শ্বাস কষ্ট। শরীরটা ভার লাগে। ভাল লাগছে না।-মীনার্থীটা বড্ড স্ট্রেট।-আপনার মন খারাপ কেন?সুভদ্র একটা শ্বাস ফেলে বলে-শীলাদি, একটা কথার জবাব দেকেন।-আপনি চাকরি করেন কেন?-কেন করব না?-সরকার থাকলে নিশ্চনাই করলেন। কিন্তু আপনার কি চাকরি কদরা খুব দরকার?শীসা ক্ষীণ হেসে বলে নট হলে করব কেন।সুভদ্র মাথা নেড়ে বলে আমি জানি আপনার হাজব্যান্ড হাজার টাকার ওপর মাইনে পান, কলকাতার আপনাদের নিজেদের ঝাড়ি, ফ্যামিলি মেম্বার মোটে দুজন। তবু কেন চাকরি করা দরকার বলুন তো।শীলা একটু শ্বাস ফেলে কপট গাম্ভীর্য এনে বলে-দরকার যার যার নিজের কাছে। কারও খাওয়া-পরার প্রবলেম, কারও সময়ের প্রবলেম, বরুন যদি বলি, আামার সময় কাটে না বলে চাকরি করি।সুভদ্র তার বোকামির মুখোশটা পরে নিয়ে একটু বোকা হাসি হাসে। বুদ্ধ চোখে চেয়ে বলে–শীলাদি, আপনি সত্যিই সত্যবাদী।-ঢাকবার চেষ্টা করেননি। কিন্তু আপনার মতো একজন ভাল চাকুরের বউ বা
পৃষ্ঠা:১৩০
শোভনাদির মতে। একজন ডাইরেক্টরের স্ত্রীয় কেবলমাত্র সময়ের প্রবলেমের জন্য কি চাকরি করা উচিত? অঢেল সময় যদি থাকে তো আপনারা মহিলা সমিতি করুন, গান শিখুন বা সিনেমা থিয়েটার দেখুন। চাকরি কেন?-কষ্ট করে লেখাপড়া শিখব, কিন্তু সেটা কাজে লাগাতে গেলেই কেন দোষ হবে?-তাতে যে আমার মতো বেকাররা মারা পড়ি। শোভনাদি কলকাতায় ফিরে আসছেন বলেই চাকরিনে অন্যর নেকেন, নইলে তার দরকার ছিল না। অথচ তিনি জয়েন না করলে একজন অভাবী লোকের উপকার হয়। এ-কথাটা আপনারা বোকেন না কেন।-কথাটা সত্যি হতে পারে, কিন্তু ওর যুক্তি নেই সুভদ্র।সুভদ্র মাথা নেড়ে বলে, আছে শীলাদি। যার স্বামী ভাল রোজগার করে সে চাকরি করলে সমাজে ইকনমির ব্যালান্স থাকে না। নকশানাইটরা বে কয়েকটি ভাল কাজ করতে চেয়েছিল তার মধ্যে একটি হল স্বামী-স্ত্রীর দ্বৈত রোজগার বন্ধ করাশীলা হাসল। বলল-সুভয়, আমার একটু দুঃখ হচ্ছে শোভনাদি ফিরে আসছে বলে।সুভদ্র জান হেসে বলে- আমি চলে যাচ্ছি বলে নয়?শীলার অকারণেই আবার কান মুখ লাল হয়ে ওঠে। বলে-সেজন্যও।ইস্কুল বাড়ি প্রায় ফকি।ে দুজন হাঁটতে হাঁটতে মাঠটুকু পার হয়ে গেট পেরিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। সুভদ্র একটা সস্তা সিগারেট ধরিয়ে বলে- আমার চাকরিটা খুব দরকার ছিল। শীলা একটা শ্বাস ফেলে বলে পেয়ে যাবেন। একটু খুঁজুন।সুভদ্রর সাহস আছে। হঠাৎ মুখনানা উদাস করে বলে-চাকরি হয়তো পেতেও পারি, কিন্তু সেখানে আপনার মতো বুদ্ধিমতী সহকর্মী কি পাওয় যাবে?শীলা চারবারে চেয়ে দেখে একটু। কেউ নেই, কেউ তাদের লক্ষ করছে না। করলেও দোষের কিছু নেই। সুভদ্র ইস্কুলে ঢোকার পর থেকে দিনের পর দিন শীলা আর সুভদ্র ইস্কুল থেকে একসঙ্গে বেরিয়ে গল্প করতে করতে গিয়ে ট্রাম গুরেছে। ছাড়াছাড়ি হয়েছে শীলার। নির্দিষ্ট স্টপে। আবার কখনও সুভদ্র নেমে বাড়ির দরজা পর্যন্ত এগিয়েও দিয়ে গেছে। আলোর শীলা কখনও বা সীপে না নেমে কেনাকেটা করার জন্য চলে গেছে সুভদ্রর সঙ্গেই এসপ্লানেডে বা গড়িয়াহাটা। কিন্তু শরীরের অন্য এক রাজাধিরাজের আগমনবার্তা পাওয়ার। পর থেকেই শাঁলা একটু অন্যরকম হয়ে গেছে। কারও কথাই বেশিক্ষণ ভাবতে পারে না, কেবল শরীরের ভিতরকার সেই শরীর এনে গড়ে। সুভদ্রকে। সে তাই তেমন করে ভেবেছে কিএ কয়দিন।শীলা মুচকি হেসে বলে শুধু বুদ্ধিমতী।-সুন্দরীও। সঙ্গে চঙ্গে জবাব দেয় সূভদ্র।শীলা মৃদু হয়ে? তাই স্তাবকতাটুকুর লোভ সে ছাড়ে কী করে?আজ আর হাঁটে না শীলা। রিকশা আসবে তাই দাঁড়িয়ে থাকে। সুভয় পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে খেতে বলে-সত্যি আপনাদের ছেড়ে চলে যেতে খুব কষ্ট হবে। চাকরিপাওয়া সোজা নয়।শীলা চুপ করে থাকে।সুভদ্র নিজেই বলে আবার আমি কোনওকালে পলিটিক্স করতাম না। কিন্তু এখন দেখছি পলিটিক্স করলেই আখেরে লাভ হয়।-কীরকম?
পৃষ্ঠা:১৩১
ভালতি জোটে, বা দলেসার লাইসেন্স পাওয়া যায়। ভাবছি, পলিটিক্সে নেমে যান কিনা।শীলা পাশ থেকে সুভজর মুখখানা দেখে। কী সুন্দর চেহারা! চাকরি দেওয়ার হাত থাকলে শীলা শুদ্ধমাত্র ওর চেহারা দেখেই একটা চাকরি দিয়ে দিত।এই মুগ্ধতাটুকু পিনের আগার মতো তীক্ষ্ণ হয়ে লাগে শীলার বুকে। সুভদ্র চলে গেলে স্কুলটা অনেক বিবর্ণ হয়ে যাবে তার কাছে। সে তবু একটু ঠাট্টা করে বলে বরং সিনেমায় নেমে পড়ুন।অ্যাঁ।-আপনাকে লুফে নেবে।সুভার হাসল, বলে-অত সোজা নয়। তবে যা পাই তাই করব। বিছুতেই আর আপত্তি নেই। আপনার যখন আমাদের রাস্তা অটিকে রাখবেনই, তখন আমাদের রাস্তা তৈরি করে নিতে হলে।-শুনুন, শোভনাদির সঙ্গে আমার তুলনা চলে না। আমার চাকরির টাকা সংসারে অনেক হেলপ করে। শোভনাদির তা ন্যা, উরটা নিতান্তই শখ।সুভদ্র হেসে বলে-আমার কিন্তু কারও ওপরেই রাগ নেই। যা আছে রা কেবলমাত্র অনুরাগ।-খুব মুখ হয়েছে দেখছি। বলে শীলা গাঢ় শ্বাস ফেলে মায়াবী যুবকটির মুখখানা দেখে। আপনার ঠিকানা জানি। কোনওদিন হুট করে চলে যাব। আপনার হাজব্যান্ডের সঙ্গেআলাপও করে আসব।-নিশ্চয়ই।-এখআইসির একটা এজেন্সি নিয়ে ভাবি।-আমি বলে রাখব। কবে আসবেন।-আসর যে কোনওদিন।রিকশা এল। শীলা খুব সুন্দর একটু হেসে উঠে বসল। সুভদ্র নিঃসংকোচে তার মুখের দিকে মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইল। চোখ সরাল না শীলা। রিকশা করেক পা এগোলে শীলা মুখ ঘুরিয়ে হাসিমুখে চেয়ে রইল।গোপান এই রকম তারা মাঝে মাঝেই চেয়ে থেকেছে পরস্পরের দিকে। যখনই তারা দুজন একা হয়েছে তখনই।পাপ! কে জানে? কিন্তু ওই এক্টকেম শিহরন, গোপনতা, রহস্য-যা না থাকলে বেঁচে আছে বলে মনে হয় না। শীলা যে কত ঝুঁকি নিয়ে আজ ইস্কুলে এসেছে তা কি পারে নাই সুততার অন্য বর্তমানের ভিতরে ব কত কী থাকে, ভাগ্যিস তা অন্যে জানতেসুভদ্রর কথভেলিতে ভাবতে রিকশাওয়ালাকে আস্তে চালানোর কথা বলতে ভুল হয়ে গিয়েছিল। ডিকশাটা পর পর দুটি ঝাঁকুনি খেল। আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে শীলা- আছে।তেমন কিছু টের পেল না শীলা। কেবল বাড়ির সামনে রিকশা থেকে নামার সময়ে হেঁট হতে তলপেটে একটা চিনচিনে ব্যথা টের পেল।
পৃষ্ঠা:১৩২
উনিশ
বাসের দেগলোয়া তিন-চারটে মার্কামারা ছেলে উঠেছে। হাতে বইখাতা, পরনে কারও কনারঅলা গেঞ্জি, কারও রচেভা সস্তা শার্ট। এই শীতেও গায়ে গরম জামা নেই। চোদ্দো-পনেরো বছর বয়স। দুজনের সিট তিনজন ঠেসে বসেছে। চেহারা দেখলেই বোঝা যায় গরিব ঘরের ছেলে, বাজে ইস্কুলে পড়ে, যে ইস্কুলে ইউনিফর্ম পরার বালাই নেই। কলকাতার বিস্তৃত বস্তি অঞ্চল থেকে এরকম চেহারার বহু ছেলে সস্তা বাজে ইস্কুলে লেখাপড়া শিখতে যায়।একটা ছেলে চেঁচিয়ে বলে-কিস, কিস, এই টুবু, একটা কিস দিবি?বলতে বলতে ছেলেটা তার পাশের ছেলেটার গলা জড়িয়ে ধরে সেঁটে চুমু খাওয়ার চেষ্টা করে।ছেলেটা মুখে হাত চাপা দিয়ে বলে-যঃ। পাবলিক রয়েছে। -তোর পাবলিকের ‘ইয়ে’ করি।জনম্বর বাসের লেতিলায় প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে পিছনে দাঁড়িয়ে সোমেন দৃশ্যটা দেখে। সাদা আর ঘন নীল ইউনিফর্ম পরা তিন চারজন মেয়ে বসে আছে ডান দিকের দু-তিনটে সিটে, ফরসা ফরসা, গোলগাল অবারালি মেয়ে করুন, হাতে ছোট সুটকেস, কাঁধে প্লাস্টিকের জলের বোতল ঝুলছে। সম্ভবত ইংলিশ মিডিয়াম ইস্কুলে পড়ে, ছেলেগুলো ওদের দিকে তাকারো ওই সব করে যাচ্ছে। ইংরেজি শব্দগুলো ওই কারণেই কলা।রাগে হাত-পা রি-রি করে সোমেনের। বামসুদ্ধ লোকের একজনও রুণে উঠলে পুরো দৃশ্যটা পালটে যায়। কিন্তু কেউ কোনও ‘রা’ কাড়ে না। বরং না শুনার ভান করে অন্যদিকে, চেয়ে থাকে।মেয়েগুলোর ফরসা মুখচোখ লাল হয়ে উঠেছে। বাচ্চা একটন মেয়ে হঠাৎ মুখ ফেরাতে সোমেন দেখল, মেয়েটার চোখে স্পষ্ট কছার চিহ্নঃ-হোয়াট ইজ ইয়োর নেম? অন্যদিকে চেয়ে একটন ছেলে জিজেস করে।বন্ধুদের একজন বলে-মাই নেম ইজ-বলে মুম্বইয়ের একজন ফিানস্টারের নাম করে। তাকে ধমকে দেয় প্রথম ছেলেটা, বিস্তি করে। তারপর আবার জিজ্ঞেস করতে থকে হোয়াট ইজ ইয়োর চট্টও হোয়াট ইজ ইয়োর নেম?মেয়েগুলো ভয়ে আত্মী হয়ে আছে।সোমেনের পিরান টাকে একজন ফিসফিস করে বালে কী সব ছেলে!ব্যস। অক্টেন্টনিও প্রতিবাদ হয় না। সোমেনের সামনে দু-চারজন দাঁড়িয়ে আছে। বাসের ঝাঁকুনিতে দৌউলায় দাঁড়িয়ে ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করছে। বাস রেক কথে, আবার চলে। এ-ওর গায়ে পাক্কা খায় আগে পিছে। টলে ঢলে পড়ে যেতে যেতে আবার দাঁড়ায়।বাসটা কোথায় এসেছে বোঝা যাচ্ছিল না ভিড়ের জন্য। ছেলেদের এককজন চেঁচিয়ে ওঠে-ওই যে, নিরোষের বিজ্ঞাপন। নিরোধ ব্যবহার করুন, পনেরো পয়সায় তিনটে…কোথায় এসেছে তা না বুঝেও সোমেন ভিড় ঠেলে নামতে থাকে। বেশিক্ষণ তার এসব সহ্য হয় না। হয়তো মাথা গরম হয়ে যাবে। কিন্তু কিছু করা যাবে না। কেবল নিজের ভিতরে এক অদ্ধ রাগ নেছে বেড়ে ফুঁসে উঠে নিজেকেই ছুবলে মারবে। সেই বিদও আবার হজম করতে হবে নিজেকেই। ক্লান্তি আসবে। আসবে ব্যর্থতার বোধ। কলকাতার নির্বিকার জনগণ
পৃষ্ঠা:১৩৩
সকলেই এই ক্লান্তিতে ও ব্যর্থতায় ভুগে জীর্ণ হয়ে যাচ্ছে না কি?নেমে সোমেন দেখে, সে খুব বেশি দূরে নামেনি। এখান থেকে বড়দির বাড়ি আর মোটে দুটো স্টপ। খোলা আলো-হাওয়ায়। এটুকু হেঁটে যেতে ভালই লাগবে। সে সিগারেট কিনে ধরায়। পৃথিবীর কোথাও কোনও শাস্তি নেই। না ঘরে, না কইরে। সোমেনের মাঝে মাঝে বড্ড মরে যেতে ইচ্ছে করে। কিংবা পালাতে ইচ্ছে করে নিদেশে। কিন্তু জানে, শেষ পর্যন্ত কোথাও যাওয়া হবে না। এই নোংরা শহরে কিংবা এই নিস্তেজ, ভাবলেশহীন দেশে তার জীবন শেষ হয়ে যাবে একদিন।অন্যমনস্কভাবে সোমেন হাঁটছিল। একটা ট্যাক্সি পাশ দিয়ে যেতে যেতে এগিয়েই থামল।মুখ বাড়িয়ে কে যেন ভারুল-শালাবাবু!জামাইবাবু। সোমেন তাড়াতাড়ি সিগারেট ফেলে দেয়। এগিয়ে গিয়ে বলে- আপনাদের বাড়িতেই যাচ্ছিলাম।উঠে পড়ো। বলে দরজা খুলে ধরে অজিত।সোমেন উঠলে অজিত সরে বলে বলে এতকাল পরে আমাদের মনে পড়ল।সোমেন একটু লাজুক হাসি হেসে বলে-কেন, আদি না নাকি?আসো? সে বোধ হয় সূক্ষ্ম শরীরে, আমাদের সাদামাটা চোখে দেখতে পাই না। — সময় পাই না।সময়। তোমার আবার সময়ের টানাটানি কবে থেকে? একটা তো মোটে টিউশনি করো শুনেছি। আর কী করো? প্রেম নয়তো? তা হলে অবশ্য সময়ের অভাব হওয়ারইনা, না। প্রেম-ট্রেম কোথায়? -লাস্ট বেধ হয় ভাইমেটায় এসেছিলে। তারপর টিকিটি দেখিনি।এবার খুব বেশি দেখবেন- -সে দেখব বক্ষননিজেদের বাড়ি করে উঠে আসবে। তার এখনও ঢের দেরি,শ্বশুরমশাই একটু আগে অফিসে এসেছিলেন তেকটার খোঁজ বনতে।-বাঝ এসেছেন-এসেছেন মানে। এতক্ষণে হয়মে চলেও গেছেন হাওড়ায়। বাসায় যাননি বোধ হয়?-কী জানি। আমি তো ব্যস্যায় ছিলাম না।তুমি ওর কাছে যাওটাও না?-খুব কম।-যেয়ো। সুসজ্জিটীর টান বড় টান। আমার তো এক্ষাও কিছু হয়নি, কিন্তু হওয়ার সম্ভাবনাদেখেই মনটা উসখুস করে।কোটের বাঁ দিকের পকেট থেকে ডানহিলের সুন্দর প্যাকোটা বের করে অদিত, আর কনসন ফাইটারটা।-কী সিগারেট জামাইবাবু। সোমেন জিজ্ঞেস করে বেশ প্যাকেটটা তো।-বিলিতি। একটা চলবে না কি?-না, না। লজ্জার হাসি হাসে সোমেন।-লজ্জার কী। যরিয়ে ফোলা একটা। গাও তো।-আপনার সামনে নয়।
পৃষ্ঠা:১৩৪
-এই যে ভাই, সামনের বাঁ দিকের রাস্তা। বলে ট্যাক্সিগুলাকে নির্দেশ দেয় অজিত। জানহিলের প্যাকেটটা সোমেনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে-শালাবাবুরা সামনে সিগারেট না খেলে ভগ্নীপতিদের বড় অসুবিধে। দরকার হলে শালাদের ঘাড় ভেঙে সিগারেট খেতে পারে না।-আমি আপনাকে আর কী খাওয়াব বলুন। বেকার শালার স্য কী। একটা চাকরি-বাকরি দিতেন যদি।-তোমার এক্ষুনি চাকরির কী হল? এম এ-টা দাও না।-ও হবে না।-একটা প্রফেসরি হয়তো জুটে যেত। নাও, ধরিয়ে ফেল।সোমেন লম্বা সিগারেট একটা টেনে নেয়। ধরায়। খুব লজ্জা করে তার।অজিত বলে-আরে জামাইবাবু আবার গুরুজন নাকি। ঠাট্টার সম্পর্ক, লজ্জার কিছু নেই।বাসার সামনে টাক্সি থেকে নামে দুজনে।কড়া নাড়তে বাচ্চা কিটা এসে ঘুমচোখে দরজা খোলে।-শীলা, দেখ কে এসেছে। বলে হাঁক ছাড়ে অব্দিত।বাচ্চা কিাঁটা ভয়ার্ত মুখে বলে-বউদি নেই।অজিত যেন বুঝতে পারে না কথাটা। একটু অবাক হয়ে বলে কী বলছিস?বউদি বেরিয়ে গেল একটু আগে। রিকশায়।-কোথায় গেছে।-পাশের বাড়িতে।-পাশের বাড়িতে রিকশা করে। ভারী অবাক হবে বলে অজিত-কোন বাসায়?-কি-মেয়েটা কাঁদো কাঁদো মুখে বলে ওই দিকের রাস্তা দিয়ে গেল। কোথায় তা জানি না। বলে গেছে পাশের বাড়িতে।অঙ্কিত একটুক্ষণ অস্তিত হয়ে বসে থাকে। মুখচোখ লাল হয়ে ওঠে রাগে, উত্তেজনায়। তারপর জুতোমোজা ছাড়ে, কেটি হ্যাজারে টাঙায়রহস্যটির করতে না পেরে সোমেন জিজ্ঞেস করে কী হল জামাইবাবু?অজিত গম্ভীর স্বরে বলে কিন্তু না।ঝিকে ডেকে চা করতে বিদে অজিত। কিছুক্ষণ মুখখানা বুহাতের পাতায় ঢেকে বসে থাকে। সামলে নেই দিীকেকে। মুখ তুলে বলে-তোমার দিদি আজকাল আমাকে লুকিয়েসোমেন হাসে-পালায়?-শুর একরী প্রেমিক আছে যে।-এর ইস্কুল। ইস্কুলটাই ওর সর্বস্ব। আমরা কিছু না। বুঝলে শালাবাবু, তোমার দিদি এবার একটা সর্বনাশ ঘটাবে। রিকশা করে গেছে, ঝাঁকুনিতে না পেটের বাচ্চাটা নষ্ট হবেএ সব কথায় সোমেনের একটু লজ্জা করে। ডানহিলা ঠোঁটে চেপে সে চমৎকার ধোঁয়াটা টানে। রিকশার ঝাঁকুনিতে গেটের বাচ্চা নষ্ট হয়ে যাবে- ব্যাপারটা তার বাড়াবাড়ি
পৃষ্ঠা:১৩৫
বলে মনে হয়।সোমেন একটুক্ষণ বসে থেকে তারপর হঠাৎ বলে-জামাইবাবু।-উ। অন্যমনস্ক অজিত উত্তর দেয়।-আমার একটা উপকার করবেন।উপকার! নিশ্চয়ই।-আমাকে কিছুদিন আপনার বাড়িতে থাকতে দিন।অজিত একটু অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকায়। বলে-থাকবে? সে তো আমার সৌভাগ্য। কিন্তু কেন?-এমনিই।-বাড়ির সঙ্গে ঝগড়া করোনি তো?-না, সেসব কিছু নয়।অজিত একটু অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকায়। বলে-থাকবে? সে তো আমার সৌভাগ্য। কিন্তু কেন?এমনিই।-বাড়ির সঙ্গে ঝগড়া করোনি তো?-না, সেসব কিছু নয়।অজিত একটু উদাস হয়ে বলে-কদিন আগে শাশুয়িয়েবলন এসেছিলেন। তিনি তোমার বড়দিকে বলে গেছেন, তোমাদের বাসায় কী সব অশান্তি চলছে।সোমেন মাথা নাতে।অজিত একটু হেসে তুমি বড় সেন্টিমেন্টাল হে শালাবাবু, সংসারে একটু-আধটু খটাগটি তো থাকবেই। আমি নিজে মা-বাগ-অত্ত-প্রাণ ছেলে ছিলাম, সেই আমাকেই আলানা হয়ে চলে আসতে হল। এখন তো তবু সংসারের কিছুই টের পাওনি, যখন বিয়ে করবে তখন বউ এসে রাত জেগে তোমাকে দুদিনে সংসারের সার সত্য সব শেখাতে থাকবে। তখন দেখবে মা-বাপ সম্পর্কে তোমার আজম্মের ধারণা পালটে যাচ্ছে, ভাই-দাদা, ভাইপো-ভাইঝি সকলেরই গুপ্ত খবর পেয়ে যাবে। বিয়ে করো, বুঝবে।-বিয়ে। বলে। ও একটু ঠাট্টার হাদি-কেন, বিয়ে নয় কেন?-আমাদের জেনারেশন বিয়েউটিয়ে বোধ হয়। উঠে যাবে।-ধৈর্য ধরো, ধৈর্য হয়ে রামো, বাব্যে বুক। বিয়েটাকে টারগেট করে যা করার করে যাও। তুমি যদি সংঠীশ্রীখাড়ো তবে তোমার মা দাদার কী অবস্থা হবে জানো?কী হবে ট্রামার জন্য কিছু ঠেকে থাকবে না।-থাকবে। তবে কিছুদিনের জন্য যদি আমার বাড়িতে এসে থাকো তো ভালই হয়। তোমার দিদিটিকে একটু পাহারা দিতে পারবে। চোখে চোখে না বাবলে ও ঠিক চুপি চুপি প্রায়ই পালিয়ে যাবে ওর প্রেমিকটির কাছে। ডাক্তারের কড়া নিষেধ। কবু ও শোনে না। আমি অবশ্য অন্য কোনওদিন ধরতে পারিনি। আজই হঠাৎ তাড়াতাড়ি এসে পড়েছি বলে বুঝতে পারছি।চা শেষ করে আর একটা ডানহিল অজিতের প্যাকেট থেকে নিয়ে ধরায় সোমেন। বাইরে একটা রিকশা আমে। শব্দ হয়।
পৃষ্ঠা:১৩৬
অজিত মুখখানা গম্ভীর করে বসে থাকে।সদর দরজা খোলাই ছিল। শীল্য ঘরে এসে একটু খতমত খেয়ে দাঁড়ায়। বলে-ওমা! কখন এলে? সোমেন, হটাৎ যে দিদিকে মনে পড়ল।সোমেন সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ে। হাসে। উত্তর দেয় না কেউ।শীলা জ কুঁচকে সোমেনের দিকে চেয়ে বলে-খুব যে উন্নতি দেখছি। গুরুজনদেরসামনে সিগারেট খাওয়া!-জামাইবাবু জোর খাওয়ালেন, কী করব।-কত আমাইবাবুর বাব্য শালা। আবার ধোঁয়া ছাড়ার কায়দা হচ্ছে।অজিত ভ্রু কুঁচকে নিজের হাতের দিকে চেয়েছিল।শীলা তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলে-এটা জরুরি কাজ ছিল, বুঝলে। রাগ করেছ নাকি।অজিত শ্বাস ফেলে মাত্র। উত্তর দেয় না।দাড়িয়ে থাকতে শীলার বোধ হয় কষ্ট হয়। মুখখানা সামান্য বিকৃত করে বলে-যা রাস্তাঘাট। এত হাঁফিয়ে পড়েছি।বলে সোফায় বসে শীলা। হাতের ব্যাগ মেঝেয় ফেলে রেখে ঝি-মেয়েটাকে ডেকে চা করতে বলে দেয়। কপাল থেকে চুলের কুচি সরাতে সরাতে বলে- সোমেন, রাতে খেয়েতবে যারি। আজ ফ্রায়েড রাইস করব, আর মুরগি।সোমেন হেসে বলে আগে বাড়ির আবহাওয়ানি স্বাভাবিক হোক, তবে বলতে পারি খাব কিনা। এখন তো বজ্রবিদ্যুৎ সহ ঝড়বৃষ্টির সম্ভাবনা দেখছি।-আহো। এরকম আমাদের ব্রোজ হয়। জামাইবাবুটিকে তো চেনো না। রাগের হোলসেলার।অজিত তীক্ষ্ণ চোখে শীলাকে একটু দেখে নেয়।-কী দেখছ? শীলা জিজ্ঞেস করে।অজিত নিস্পৃহ গলায় বলে-তোমার মুখ সাদা দেখাচ্ছে।-ও কিছু না। বোদে এলাম তো।-রোদে মুখ লাল হওয়ার কথা, শ্রীধ্য হবে কেন?-শীলা, আমাকে লুনিবুয়রোড নেই। তোমার কোনও শীলা হাসতে চেষ্টা করল। বিবর্ণ হাসি। চোখ দুটো একটু ঘোলাটে, মুখ সাদা, ঠোঁট দুটোরমধ্যে ফড়িংয়ের পথেনার মতো কী একটু কেঁপে গেল। বদল- না, কিছু নয়।অজিত একটু শ্বাস ফেলে বলে-না হলেই ভাল। তবু বলি, সামান্য ধৈর্য রাখতে পারলে ভাল করতে। একটা পেরেকের জন্য না একটা সাম্রাজ্য চলে যায়।শীলা একটুক্ষণ বসে থাকে। তারপর দীপ গলায় বলে তোমরা বোসো, আমি ও-ঘরে। গিয়ে একটু শুয়ে থাকি।শীলা ধীরে ধীরে উঠে ও-ঘরে চলে গেল। অজিত আর একটু ধৈর্য ধরে বসে থাকল সোমেনের মুখোমুখী। তারপর বলল- কেমো শালাবাবু, আমাদের দুজনের ভাগ্যটা কেমনতা দেখে আসি। এ যাত্রাটা যদি রক্ষা হয়। অজিত ও যবে গেল। সোমেন কসে থাকে একা। শুনতে পায় ভেজানো দরজার ওপাশ
পৃষ্ঠা:১৩৭
থেকে বড়দির ফোঁপানোর আওয়াজ আসছে। চাপা, আবেগপূর্ণ কথার শব্দ ভেসে আসে। একটা অস্ফুট চুম্বনের শব্দ আসে।গায়ে কাঁটা দেয় সোমেনের। অনেকদিন বাদে হঠাৎ আবার তার মনের মধ্যে ঝিকিয়ে ওঠে একটা আসাহি পেনটিনাক্স ক্যামেরার ঢাকনা-খোলা ঝকঝকে চোখ, গর-র শব্দে ডেকে ওঠে একটা অন্ধ কুকুর।
বিশ
সোমেন বসেছিল চুপচাপ বাইরের ঘরে। দু-আঙুলের ফাঁকে পুড়ে যাচ্ছে সিগারেট। শীতের শুকনো বাতাসে সিগারেট তাড়াতাড়ি পোড়ে। উৎকর্ণ হয়ে সোমেন বড়দির কান্নার কারণটা বুঝতে চেষ্টা করছিল। কান্না সে একদম সইতে পারে না। মন খারাপ হয়ে যায়, মনে হয় কী জানি সর্বনাশ ঘটে গেল।কান্না থেমে গেছে, অনুচ্চ স্বরে জামাইবাবু কী বোঝাচ্ছে দিদিকে। সোমেনের তাল লাগছে না, রোদ মরে শীতের বিপ্পা সন্ধ্যা ঘুমিয়ে আসে। শীতকালে সোমেনের একরকম ভালই লাগে, কিন্তু এই ঋতুটা বড় গুরুভার, মন্থর, রহস্যময়। ও ঘর থেকে আদরের নির্ল শব্দগুলো আসে ভেজানো দরজা ভেদ করে। লজ্জা করে সোমেনের। উঠে চলে যাবে, তাও হয় না। মনে মনে সে এ বাড়িতে বসবাস করার পরিকল্পর ত্যাগ করে।কী বিশাল এই কলকাতা শহর, তবু কোথাও নিরুপদ্রবে বাস করার একটু জায়গা নেই তার জন্য। পূর্বা বলেছে, তাদের তিন তলার এক-ঘরের ফ্ল্যামিং সোমেনকে দেওয়া যায় কি না তা তার বাবাকে জিজেস করবে। হয়তো রাজিও করাবে পূর্বা। কিন্তু নেওয়া কি সম্ভব হবে। মাসে মাসে একশো পঁচিশ টাকা ভাড়া অসেবে কোথেকে: চাকরিটা সম্বন্ধে এক নিশ্চিত ছিল সে যে রেলে ক্লার্কশিপের পরীক্ষাটা পর্যন্ত দেয়নি। দিলেই ভাল করত। রেলের ঢাকরি হলে ভালই হত। বদলির চাকরি, কলকাতা ছেড়ে দূরে দূরে থাকতে পারত।কাছের চাকরিটা কেন যে হল না। ভাবতেই বুকের মধ্যে একটা বাথার মতো যন্ত্রণা হয়। অলক্ষে একটা কুকুর গর-র শব্দ করে, একটা আসাহি পেনট্যাক্স করমেরার ঢাকনা-খোনর মস্ত লেন্স ঝিকিয়ে ওঠে। রিবিয় করেছিল-আবার আসবেন।সোমেন কথা দিয়েছিল মাজল। মনে মনে ভেবেছিল, একদিন সুসময়ে তার সঙ্গে বিখিয়ায় ভালবাসা হরে।বন্দী বার্থেনি সোমেন। রিখিয়া তাকে ভুলে গেছে এতদিনে। কত ঢালাক-চতুরা ছেচ্ছো চলাদিকে রয়েছে, একজন বিষন্ন যুবককে ভুলে যেতে বেশিক্ষণ লাগে কি? মাঝে মাদ্রক সোমেনও ভাবে, ভুলে যাবে। কিন্তু ভোলে না। কত মেয়ের সঙ্গেই তো মিশেছে সোপ্টেন, তবে কেন রিদিয়ার প্রতি এই অভিভৃতি। ইচ্ছে করলেই অভিভূতি বা অবসেশনটা কাটিয়ে উঠতে পারে সে। কিছু শক্ত নয়। কিন্তু কাটিয়ে দিতে মায়া লাগে। মাঝে মাঝে মনে পড়ুক, ক্ষতি কী।ভেজানো দরজা খুলে অজিত এসে সোফাটায় বসে। সিগারেট আর লাইটার তুলে নেয়। তার মুখ চিন্তাদিত, ঠোঁটে রক্তহীন ফ্যাকাশে ভাব। সোমেন চেয়ে থাকে।চোখে চোখ পড়তেই অজিত বলে-মেয়েরা কখনও কথা শোনে না। বুঝলে শালাবাবু।
পৃষ্ঠা:১৩৮
-এখনও কিছু বোঝা যাচ্ছে না। একটা পেইন হচ্ছে। বলে অজিত এক হাতে সিগারেট, অন্য হাতে চুলের ভিতরে আঙুল চালাতে চালাতে ধৈর্যহীন অস্থিরতার সঙ্গে বসে থাকে।-ডাক্তার ডাকুন না। সোমেন বলে।-কী লাভ? ডাক্তারের কোনও কথা কি শোনে। শুনলে এরকমটা হত ন্য। লিভ ইট, এস অন্য বিষয়ে কথা বলি।অজিতের মুখে চোখে একটা আশা ত্যাগের ভাব। তার সঙ্গে চাপা রাগ।সোমেন উঠে বলল-দাঁড়ান, দেখে আসি।সোমেন শোওয়ার ঘরে ঢুকতেই একটা হাহাকারে ভরা খাস ফেলে বিছানায় পাশ ফিরল শীলা।বড়দি।শীলা তার মস্ত চোখ দুখানা খুলে চেয়ে বলে-বাবি না সোমেন। রাতে খেয়ে যাবি।-তোর শরীর কেমন লাগছে?শীলার ঠোঁট দুটো কেঁপে যায়। সামলে বলে এখন ভাল। বোস।সোমেন বিছানায় বসে। শীলার শ্বাসে একটা মৃদু অ্যালকোহলের গন্ধ জড়ায়। বোধ হয় একটু রান্ডি খাইয়েছে অর্জিত।-জামাইবাবু খুব আপসেট। সোমেন বলে।শীলা উত্তর দিল না। ক্ষণকাল চোখ বুজে থেকে বলে-সারাদিন ঘরবন্দি থাকা যে কীঅসহ্য।-কোথায় গিয়েছিলি।-স্কুলে। কী যে হল তারপর। বলেই বোধ হয় ভাইকে লজ্জা পায় শীলা। বলে-ওসব কিছু না। কিছু হয়নি। তুই নাকি তোর জামাইবাবুকে বলেছিস যে আমাদের বাসায় কদিন থাকবি।সোমেন মাথা নাড়ে।শীলার মুখখানা অন্তর্নিহিত যন্ত্রণায় সামান্য বিকৃত হয়ে গেল। চোখ বুজে একটু গভীর করে শ্বাস নেয় সে। তারপর বলে বাসায় কাড়া করেছিস।বউদির সঙ্গে, না?ঝগড়া হয়নি। বাসায় আমার ভাল লাগছে না।শীলা মুগ্ধ জরিয়ে নিয়ে বলে-লাগার কথা নয়শীলা আবার চোখ বুজে যন্ত্রণাটা সহ্য করে, বলে-শোন, তোর ইচ্ছে করলে এসে থাক, যতদিন খুশি। সারাটা দিন যা একা লাগে আমার। আর কতদিন যে ঘর থেকে বেরনো হবে না। থাকরি সোমেন? থাক না। মাকে কতবার বলেছি আমার কাছে এসে কদিন থাকার জন্য। কিছুতেই রাজি হল না। ও সংসারে কী যে মধু। উঠতে বদতে বউদি খোঁটা দেবে, কথা শোনাবে, তবু পড়ে থাকবে ওখানে।-মারও দোষ আছে।শীলাধমক দিয়ে বলে- আহা! দোষ আবার কী। মুখে একটু-আধটু হয়তো বলে, কিন্তু
পৃষ্ঠা:১৩৯
মার মন সাদা। অমন শাশুড়ির সঙ্গে যে বনে খেতে পারে না. বলতে বলতে শীলা চোখ বোজে। যন্ত্রণা সহ্য করে।মেয়েরা মায়ের দোষ কমই দেখে ভাজের ব্যাপারে। সোমেন তা জানে। সোমেন উঠতে উঠতে বলে-শোন বড়দি, আজ আমার নেমঞ্চটা ক্যানসেল কর। তেরে শরীর ভাল না। শুয়ে থাক চুপচাপ।শীলা করুণ মুখ করে বলে-থাক না আর একটু।সোমেন ঘড়ি দেখে বলে টিউশনিটায় যেতে হবে। পরীক্ষার সময়। শীলা চোখ বুজে বদে-যাকে পড়াস তার দিদি তোর সঙ্গে পড়ত না। হ্যাঁ।-বেশি মিশরি-টিশবি না, বুঝলি। সোমেন হাসে। বলে-মিশি না।-খুব নাকি মেয়েদের সঙ্গে ঘুরিস আর আড্ডা দিস।-কে বলল- পাশের বাড়ির মাধনী তোকে বঙ্গ-সংস্কৃতিতে দেখেছে।-দেখেছে তাতে কী? ঘুরলে দোষ কী?শীলা বড় চোখে চেয়ে বলে-তুই তো হাঁদা ছেলে। কোন পেঁৗদি পেঁচির পাল্লায় পড়ে-নূর। ওরা সব বড়ঘরের মেয়ে, পাত্তাই দেয় না বেকারকে।-বেকার কি চিরকাল থাকবি নাকি। তোর মতো পার্টি আর চটপটে ছেলে কজন? দুম করে একটা ভালচাকরি পেয়ে যাবি।সোমেন হেসে ফেলে। বলে এই যে বললি হাঁয়।-হাঁদাই তো। মেয়েদের ব্যাপারে হাঁদা। বনে শীলা ভাইয়ের দিকে স্নিগ্ধ চোখে চেয়ে হাসে। বলে-তোর বিয়ে আমি নিজে পছন্দ করে দেব। আমাদের সংসারে একটা লক্ষ্মী বউ দরকার।-দিস। বলে সোমেন বাইরের ওয়ের দিকে পা বাড়ায়।-শোন। ওই আলমারির পাল্লাটা পুন্দে দেয়, মাঝখানের তাকে একটা প্যান্টের কাপড়।আছে না।কেন।শালা ধমক দিয়ে বল্য়োল না।সোমেন আলগা পাল্লাটা টেনে খোলে। বাদামির ওপর হালকা হাইকা ঢেক দেওয়া সুন্দর টেরিটরেরা পান্টি সেখে। দামি জিনিস।-এখানে নিয়ে আয়। শীলা বলে।সোমেন কাপড়টা নিয়ে কাছে আসে। শীলা ওর মুখের দিকে চেয়ে বলে-পছন্দ হয়?-হলেই বা।-তোর জামাইবাবুকে তার বন্ধু পাঠিয়েছে আমেরিকা থেকে। ওটা তোর জন্য রেখে দিয়েছে। নিয়ে যা।- যাঃ। ভারী লজ্জা পায় সোমেন।-পাকামি করবি না। আজকেই করাতে দিবি, দরজির খরচ আমি দিয়ে দেব।
পৃষ্ঠা:১৪০
-জামাইবাবুকে পাঠিয়েছে, আমি কেন নেব।.-তোর জামাইবাবু কত পরবে? প্রতি মাসেই এটা-ওটা রাজ্যের জিনিস পাঠাচ্ছে, প্যান্ট শাটি সিগারেট ঘড়ি ক্যামেরা কলম। আমার জন্য শাড়ির মাপে কাপড় পাঠিয়েছে এ পর্যন্ত গোটা দশেক। এক দিয়ে কী হবে। তুই নিয়ে যা। ভাল দরজিকে দিয়ে করাস। খবরের কাগজে মুড়ে নিয়ে যা। আর ওথর থেকে তোর জামাইবাবুকে একটু পাঠিয়ে দিস।আচ্ছা, বলে সোমেন বেরিয়ে আসে। হাতে ধরা মোলায়েম ঈযনুক কাপড়টা একটা আরামদায়ক আনন্দের মতো তার হাত ছুঁয়ে আছে। কিছু অপ্রতাশিতভাবে পেলে মনটা কেমন ভাল হয়ে যায়।বাইরের ঘরে আলো-আঁধারির মধ্যে সিগারেট জ্বলছে। অজিত মৃদু গলায় বলে- কাপড়টা পছন্দ হয়েছে তো শালাবাবু?-খুব। এমন সুন্দর জিনিসটন আমাকে দিয়ে দিলেন?তোমার জন্যই রেখেছিলাম। বলে সিগারেটের প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে করেকটা সিগারেটও নিয়ে যাও।-নানো-নাও হে নাও, ফ্রায়েড রাইস আর মুরগির মাংস খাওয়াতে পারলাম না, একটু কমপেনসেট করে দিই। পুরো প্যাকেটটাই নিয়ে যাও, গোটা আষ্টেক আছে।সোমেন প্যাকেটটা পকেটে পোরে। বলে আজ সারুণ বাণিজ্য হল।আবছায়ায় অজিত একটু হাসে। আলো-আঁধারিতে ওর মুখটা তরল হয়ে মিশে হারিয়ে যাচ্ছে। মুখখানা অস্পষ্ট একটা চিহ্নের মতো। সিগারেটের একবিন্দু লাল আগুনের পাশে ওর হাসিটা ভৌতিক দেখায়। মুখে স্বেদ ঝিকিয়ে ওঠে। ধার ছ্যাদায় চোখ দুটো অন্ধকার। লম্বা নাকটা তর্জনীর মতো উঁচু হয়ে আছে।শীলা পাশের ঘর থেকে ক্ষীণ গনায় ডাকে-গুয়ো।-যাচ্ছি। উত্তর দেয় অজিত, কিন্তু নড়ে না। সিগারেটটা ধীরে টান দেয়।-জামাইঝর, যাই।অজিত মাথা নাড়ে। তারপর বিষন্ন গুলায় বলে-দি ওয়ার ইজ লস্ট ফর এ নেইল।কী বলছেন?কত তুচ্ছ কারণে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটে গেল শালাবাবু।সোমেন উত্তর খুঁজে পাছা-প্রাঅজিত বলে আমেসির বয়স চল্লিশ, তোমার দিদিরও ত্রিশ-বত্রিশ। কত ধৈর্য, কত অপেক্ষা, কত কষ্টের পর এই ভরাডুবি। শায়বাবু, আজ বিকেল থেকে গোটা জীবনের রংটাই বোধ হই ফিকে হয়ে গেল।সিগারেটটা অ্যাসট্রের মধ্যে ছ্যাঁক করে ওঠে। অজির মুখ তুলে দাঁড়িয়ে-থাকা সোমেনের দিকে তাকায়। আলো-আঁধারিতে মুখখানা রোজের স্টান্ডুর মুখের মতো দেখায়। সন্তানের জন্য সমস্ত মুখখানায় কী বুভুক্ষা আর পিপাসা কাতরতা ফুটে আছে।সোমেন বিষন্ন গল্যর বলে ভাফার ডাকবেন না?-ডাকব। তবু দি ওয়ার ইজ লস্ট। মানুষের ক্ষমতা বড় সীমাবদ্ধ। এই অবস্থা থেকে কে আমাদের বাঁচাতে পারে। ডাক্তার যা করার তা করেছে। এখন আর কী করার আছে তার। আমি আজকাল নিয়তি বানি। ভাগ্যে নেই।
পৃ্ষ্ঠা ১৪১ থেকে ১৬০
পৃষ্ঠা:১৪১
-এ সব বোগাস। আপনি উঠুন তো, দিদির কাছে যান। ভেঙে পড়ার কিছু হয়নি। যাচ্ছি। বলে অজিত অন্ধকারে বসে রইল। উঠল না। কেবল হাত বাড়িয়ে হাতড়িয়ে সিগারেটের প্যাকেটটা খুঁদল। পেল না। সোমেন নিঃশব্দে পাবেউটা পকটে থেকে বের করে টেবিলে রেখে দিয়ে বেরিয়ে আসে। অজিত লক্ষ করল না।সন্তানের জন্য কুরুক্ষা কেমনতর তা পুরোপুরি বোঝে না সোমেন। কিন্তু একটু একটু টেনা পায়। গোবিন্দপুরে সে বাবার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে অমনি এক তীব্র অসহায় ক্ষুধাকে প্রত্যক্ষ করেছে ব্রজয়েপালের মুখে। সেই থেকে বাবার জন্য ক্ষীণ সুতোর টান সে টের পায়। যে খুড়িটা কেটে গিয়েছিল বলে ধরে নিয়েছে সে, আসলে তা কাটেনি। রক্তে রক্তে বুঝি টরেটক্য বেদে যায় ঠিকই। টান তেমন প্রবল নয়, কিন্তু মাঝে মাঝে মন বড় কেমন করে, মনে হয়-আহা বে, লোকটা। বড় একা হয়ে হা-ভাতের মতো চেয়ে আছে ছেলেদের দিকে। মায়া হয়।সিগারেটের দোকান থেকে একটা সপ্তা সিগারেট কিনে দড়ির আগুনে ধরিয়ে নেয় সোমেন। ইমেরাস্তার দিকে হাঁটতে থাকে। ভাবে, অশিমাদের বাড়ি থেকে বিখিতদের বাড়ি বেশি দূর নয় তো। তবে কেন সে একবারও শৈলীমাসি আর বিখিয়ার কাছে যায়নি এত দিন। আজ একবার গেলে হয়। পান্টের কাপড়টা অপ্রত্যাশিত পেয়ে গিয়ে মনটা হঠাৎ ভাল হয়ে গিয়েছিল, জামাইবাবুর শেষ কথাগুলোয় আবার মন খারাপ হয়ে গেছে। গারুদের বাড়িতে যাওয়ার পথে একবার ও-বাড়ি হয়ে যাবে। আনোয়ার শা রোড দিয়ে আজকাল বাস যায় ঢাকুরিয়া পর্যন্ত। সেই আশায় কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে সোমেন হাঁটতে থাকে। প্যান্টের কাপড়টা বাড়িতে রেখে, হাতমুখ শুয়ে, একটু ফরসা জামাকাপড় পরে বেরোবে। মা প্রায়ই জিজ্ঞেস করে-হ্যাঁরে, শৈলী চাকরির কথা কী বলল। সোমেন বেঁকে বলে চাকরি কি ছেলের হরতের মোয়া! আসলে সে মাকে বোঝাবে কী করে, যে বাড়িতে সে বর হয়ে যাবে সে-বাড়িয় দেওয়া চাকরি সে তো নিতে পাবে না। একবার উমেদার হয়ে গেলে আর কি রহস্য যাকে মানুষের? রিখিয়া কেন যে আজ মাথাটা দখল করে আছে, কে জানে। মাঝে-মধ্যে আপন মনে মৃদু হাসল সোমেন। মনে মনে বলল, আসব রিবিয়া। আসছি। হাঁটতেই হটিতেই বাড়ি পৌঁছে গেল সে। সিডি ভেঙে ওপরে উঠে ঘরে ঢুকেই একটু অবাক হল। সোফার ওপর ব্রজগোপাল বসে আছেন। পাশে একটা চেয়ারে দাদা, মা মোড়ায় বসে। বউদি এঁটো মায়ের চীপ নিয়ে যাচ্ছে। একটি অপরূপ অসহনীয় সুন্দর সংসারের দৃশ্য।
। একুশ
ঘরে ঢুকতেই তারদিকে তাকালেন ব্রজগোপাল। একটু বুঝি নড়ে উঠলেন। মুখখনায় কী একটা টান-বাঁধা উদ্বেগ ছিল সেটা সহজ হয়ে গেল। তাকিয়ে উৎসাহ-ভরে বললেন- ওমো। এ ঘর বাধায় নয়। তবু কেন নিজের ঘরে ছেলেকে ডাকছেন, এমনই শোনাল গলা। সোমেনের সঙ্গে মাঝখানে অনেকদিন দেখা হয়নি। সে এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করুন। বলল-
পৃষ্ঠা:১৪২
বড়জামাইবাবুর কাছে শুনলাম, আপনি এসেছেন, আবার চলেও গেছেন।রজগোপাল সরে বসে জায়গা করে দিলেন সোমেনের জন্য। সোমেন একটু সংকোচের সঙ্গে বাবার পাশে বসে। এজগোপাল বলেন-যাওয়ার কথাই ছিল। বহেরুর যে ছেলেটা জেলে ছিল সে মেয়াদের আগেই হঠাৎ ছাড়া পেয়েছে। দামাল ছেলে। বহেরু বাকে ভয় পায়। আজ তাই বাড়িতে আমার থাকার কথা। আমাকে কিছু মানে-গোগে, তাই বহেরুর ইচ্ছে ছিল এ সময়টায় থাকি। চলেই যাচ্ছিলাম, রণেন ধরে নিয়ে এল। এসে পড়ে ভাবলাম, একটু বসে যাই। তোমার সঙ্গে দেখা-টেখা হয় না, তো এই সুযোগে যদি এসে পড়েএ বাড়িতে বেশিক্ষণ বসে থাকার জন্য যেন ব্রজগোপাল বড় লজ্জা পেয়েছেন, এমনভাবে কৈফিয়াত দেন। ঘরে ঢুকবার মুহূর্তে যে সুখী সংসারের ছবিন দেখতে পেয়েছিল সোমেন তা কত ভঙ্গুর। নিকটতম আত্মীয় মানুষেরা নক্ষত্রের মতো পরস্পর থেকে বহু দূরে বসবাস। করছে।সোমেন হাসিমুখে বলে-আপনার শরীর কেমন আছে।-মন্দ কী। মাটির সঙ্গে যোগ রেখে চলি, ভালই থাকি। তোমার চাকরিটা হল না।না।এজগোপাল যেন খুশি হন শুনে। বলেন পরের গোলামি যে করতেই হবে তারও কিছু মানে নেই। চাকরির উদ্ধেশ্য তো ভাত-কাপড়, নাকি। তা সেটার বন্দোবস্ত করতে পারলেকোন আহাম্মক চাকরি-বাকরিতে যায়! এই মোদ্দা কথাটা তোমরা বোঝো না কেন। সোমেন অবাক হয়ে বলে-কীভাবে ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থা হবে প্রজগোপাল একবার ননীবালার দিকে চেয়ে নিলেন্স। ননীবালা একটু গম্ভীর, টুবাইটা কোলে আধশোয়া হয়ে কী একটা বায়না করছে। বিরক্ত হয়ে বললেন-বউমা, নিয়ে যাও তো একটু। কথা শুনতে দিচ্ছে না।রজগোপাল পনাখাঁকারি দেন। বলেন-দেশের অবস্থা তো দেযছই। চাকরির ভরসায় থাকাটা আর ঠিক নয়। এমন দিন আসতে পারে, যখন টাকার ক্রয়ক্ষমতা কিছু থাকবে না। তাই বলি, মাটির কাছে থাক। ফসল ফলানোর আনন্দও পাবে, ঘরে ভাতের জোর থাকবে।মরবে না।সোমেন একটু হাসে। সেই পুরনো কথ্য। এর কোনও উত্তর হয় না। মৃদু স্বরে বলে- চাকরির সিকিউরিটি বেশি, ঝামেলা প্রমা’ চাষবাদ বড় অনিশ্চিত।রজগোপাল রণেনের দিকে চেয়ে হেসে তাকে সাক্ষী মেনে বললেন-কথা শোনো। সবাই আজকাল বেশি সিন্ড্রিউয়িটি আর কম ঝামেলা খোঁজে। পাগল। চাকরির ঝামেলা কি কম। চাকরগিরি মানে তো মনিবকে খুশি করা। না কি?রপেন আত্ব সৌমেনের চোখাচোখি হয়।রজগোপাল বলেন- চাকরিরও একটা মর্যাল আছে। সেটা মেনে যদি চাকরি করতে যাও, তা হলে ঝামেলা কমে না। অন্নদাতা মনিবের দায় যদি ঘাড়ে করে না নিলে, যদি সৎভাবে তাকে খুশি না করলে তো তুমি খারাপ চাকর। তোমার বাড়িতে যে ঠিকে-ঝি কাজ করে যায় সে যদি ফাঁকিবাজ বা আলসে হয়, যদি চোর হয়, যদি মুখে মুখে কথার জনাব করে তো তুমি কি তাকে ভাল বলো? তেমনি যদি চাকরগিরিই করো তো যোলো আনা ভাল চাকর হতে হবে। ফাঁকিজুকি, চুরি-চামারি এ সব চলে না।এই বলে এঙ্গগোপাল রমেনের দিকে তাকান। রণেন যদিও তেমন বুদ্ধিমান নয়, তবু এই
পৃষ্ঠা:১৪৩
কথার জিতরে ইঙ্গিতের ইশারাটি সে বোধ হয় বুঝতে পারে। চোখের পাতা ফেলে নীচের দিকে তাকায়।বউমার হাতে টুবাইকে তুলে দিয়ে ননীবালা একটা খাস ফেললেন। বললেন- ঝি-চাকরের সঙ্গে কি ভদ্রলোকদের তুলনা হয়? ছোটলোকদের ভাত আলাদা। ওরা লেখাপড়া শিখেছে।–লেখাপড়ার কথা না বলাই ভাল। এত শিখেও বিচি দেখে ফল চিনতে পারে না। ননীবালার হঠাৎ সস্তানের প্রতি আদিম জৈব অধিকারবোধ বোধ হয় প্রবল হল। ঝংকার দিয়ে বললেন-ওদের চিনতে হবে না।রজগোপাল একটু উদাস গলায় বলেন-সব চাকরেরই একরকম ধাত। আমি কিছু তফাত দেখি না। যারা যারা চাকর তারা দেশময় কাজে ফাঁকি দিচ্ছে, চুরি করছে, ফাঁকতালে মাইনে বাড়ানোর ধান্দা করছে, কাজ বন্ধ করে বসে থাকছে। মনিবরা ধরা পড়েছে চোর দায়ে। এটা কেমন কথা? জমিদারের সেরেস্তায় আমার বাপ চাকরি করতেন, মনিবকে খুশি রাখতে তাঁর কালঘাম ছুটে যেত। আমি করতাম সরকারি চাকরি, তাও বুড়ো বয়সে। সেখানে দেখতাম মনির বলে যে কেউ আছে তা বোঝা যাচ্ছে না। তবু প্রাণপাত করেছি। কোথাও না কোথাও একজন মনিব তো আছে। কোথাও হয়তো ব্যক্তিবিশেষ, কোথাও প্রতিষ্ঠান, কোথাও বা দেশের মানুষ। খোরপোষের টাকা তো কারও না কারও তহবিল থেকেই আসছেই। সেটা খেটে শোধ না দিয়ে ভাত খাই কী করে। লজ্জা নেই।ননীবালা অসন্তোষের গলায় বলেন এসব ভাবতে গেলে গন্ধমাদন। সবই বেমনভাবেচাকরি করে ওরাও তাই করবেব্রজগোপালের আজকাল রাগ-টাগ কমে গেছে। হাসলেন। বললেন জানি। ময়না এমনিতে কত কথা বলে, কিন্তু বেড়ালে সে ট্যা-টাই। সংসার রগড়ালে কত বারজি ভেক ছেড়ে ‘জন’ খাটতে যায়। তোমার ছেলেরাও তাই হবে। তবু বলি, আমার ওই এক দোষ। বলে একটু খাস ছেড়ে সোমেনের দিকে তাকান রজগোপাল। বলেন আমার সঙ্গে কোনও কিছুর বনে না। বুঝলে? আমি যা বুঝি তাই বুঝি। বুড়ো হয়েছি বাবা, বেশি কথা বলে ফেলি।বাবার গলায় চোরা-অভিমানটা খুব গোপনে, কিন্তু তীক্ষ্ণভাবে আঘাত করে সোমেনকে। চোখের দৃষ্টিতে একটা অসহায় ভার, দুনিয়াজোড়া সবাই তাঁর প্রতিপক্ষ বুঝি। কাল না। দান গুলটাবে না, লড়াই ছেড়ে সরে যাওয়ার জন্যই বুঝি প্রস্তুত তিনি। বাণপ্রস্থও শুরু হয়েছে।সোমেন তাড়াতাছি প্রাপ না বাবা। আপনার কথাগুলো তো ভালই। প্রজগোপাল দুয়েক নীরব রইলেন। আস্তে করে বসলেন-হবে। আমি মনিব কগাটা বড়মানি। চাষবাস করতে গিয়ে দেখেছি অমন খেয়ালি মনিব আর হয় না। মাটির পিছনে যত খাটবে, যত তাকে পুষ্টি দেবে, সেক দেবে ভত ফসল ঘরে আসবে। সেখানে দাবি আমায় সেই, চুরি-জোচ্চুরি চলে না, ধর্মঘট না। সেখানে সার্ভিস মানে চাকরি নয়, সেবা। মানুষের এই বুঝটা সহজে হয় না। যে দেশের যত উন্নতি হয়েছে সে দেশের লোক তত মনিবকে মানে। সে চাকরিতেই হোক, আর স্বাদীন বৃত্তিতেই হোক। বেশি সিকিউরিটি আর কম ঝামেলা বলে কিছু নেই। দেশ কথাটাই এসেছে আদেশ থেকে। যে বৃত্তিতে থাকো তার আদেশ মানতেই হয়। যন্ড ঝামেলাই আসুক। ডিউটিফুল ইজ বিউটিফুল।ননীবালা চুপ করে ছিলেন এতক্ষণ। এখন বললেন-এসব কথা ওদের বলছ, কেন?
পৃষ্ঠা:১৪৪
তোমার ছেলেরা কি খারাপ?ব্রজগোপাল সন্ত্রস্ত হবে ছেলেদের মুখের দিকে একবার চেয়ে দেখলেন। অরপর যুব কুষ্ঠার সঙ্গে প্রসঙ্গ পালটে বললেন-তা বলিনি। চাকরি পাওয়াও সোজা নয়। আর চাকরি পেলেই বা কী। বাঁধা মাইনে, গণ্ডীবদ্ধ জীবন, মানুষ ছোট হতে থাকে।ননীবালা বাতাস এঁকে কী একটা বিপদের গন্ধ পান। হঠাৎ ছোবল তুলে বলেন-তো তুমি ওকে কী করতে বলো?রজগোপাল যেন আক্রমণটা আশা করছিলেন। একটু মিইয়ে যায় তাঁর গলা। বলেন- পেলে তো ঢাকরি করবেই। আমি তো ঠেকাতে পারব না। যতদিন না পাচ্ছে ততদিন আমার কাছে গিয়ে থাকতে পারে। যা আছে সব বুঝেসুঝে আসুক।ননীবালা কুটিল সন্দেহে চেয়ে থাকেন স্বামীর দিকে। গলায় সামান। যার এসে যায়।বলেন ও সেখানে যাবে কেন চাষাভূযোর সঙ্গে করতে। বহেররা লোকও ভাল না। চাষার ধাতও ওর নয় যে, জলে কাদায় জেবদে চাষ করতে শিখবে। ও সব বলে লাভ নেই।ননীযানার কথার ধরনেই একটা রুখেওঠার তাব্য যেন বা তাঁর সন্তানকে কেড়ে নিরে এসেছেন রজগোপাল। তিনি পাখা ঝাপটে আড়াল দিচ্ছেন পক্ষিণীর মতো।প্রজগোপাল রণেনের দিকে চেয়ে বলেন-তুমিও কি তাই বলো?রুণেন মুখটা তুলে বলে-আমার কথায় কী হবে? সোমেনের ইচ্ছে হলে যাবে। আমারআপত্তি নেই।তজগোপাল মাথা নাড়লেন। কিন্তু সোমেনের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করলেন না। ননীবালারদিকে চেয়ে বললেন-আমি বললেই কি আর ও যাবে? তোমার ভয় নেই। সংসারনযভাবে ভাল হয়ে গেছে সেভাবটাই থেকে যাবে। একদিকে আমি একা, অন্যদিকে তোমরা।ননীকানা কথাটার উত্তর দিলেন না।সোমেনের একটা কিছু করা দরকার। হাতে খবরের কাগজে মোড়া প্যান্টের কাপড়টা তখনও ধরা আছে। ঘরের ভারী আবহাওয়াটা হালকা করার জন্যই সে মোড়কটা খুলে মার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল-প্যান্টের কাপড়টা বড়দি দিল। লক্ষ্মণদা পাঠিয়েছে কানাড়াথেকে। -ওমা। বলে হাত বাড়িয়ে ননীন্দ্রন্ত্রকচাপরটা নিলেন-বা। কী সুন্দর রং-টা রে। তোকেবড় ভাল মানাবে। রণেন, দ্যাখ।রণেন আগ্রহে এগিয়ে ঝুঁকে দেখে। টুবাইকে ঘরে শুইয়ে রেখে বউদি ঘরে পা দিয়েইএগিয়ে এসে বলে গম, ফাইন। ইংরেজিটা বলেই শ্বশুরের কথা মনে পড়ায় একটু লজ্জা এই অন্যমনস্কতার ফাঁকে ব্রজগোপাল ধীরে ধীরে উঠলেন। একটা ক্যাগিদের ব্যাগসোফার কোন থেকে তুলে নিয়ে বললেন চলি।প্যান্টের কাপড়টা বউমার হাতে দিয়ে ননীবালা কষ্টে উঠে বললেন-যাবে?-যাই। রাত হয়ে যাচ্ছে।ননীবালা সোমেনের দিকে চেরে কললেন-তুইও বেরোবি।টিউশনিতে যাব।-তা হলে সঙ্গে যা। বাসে তুলে দিয়ে যাবি।
পৃষ্ঠা:১৪৫
রাস্তায় ব্রজগোপাল দু-কলন আগে হাঁটছেন। অন্যমনষ, ভারাক্রান্ত। পিছনে সোমেন। বাবার সঙ্গে বহুকাল হাঁটেনি সোমেন। এই স্টেশন রোডেই ছেলেবেলায় সে সকালে খালিপেটে বাবার সঙ্গে মাঝে মাঝে প্রাতঃভ্রমণে যেত। ফেরার সময় খিদে পেত না। ব্রজগোপাল তাকে ফেরার পথে মুড়ি আর বাতাসা কিনে দিতেন। আবছা মনে পড়ে। বাবার সঙ্গ সে খুব বেশি পায়নি।লচ্চির সামনে কয়েকজন ছেলেছোকরা জটলা করছিল। অদের পেরিয়ে যাওয়ার সময়েএকজন আর একজনকে একটা খিস্তি করল। একটু চমকে উঠল সোমেন। রাস্তাঘাটে আজকাল অনর্গল খিস্তি করনে আসে। বাপ দাদার সঙ্গে বেরোতে তাই লজ্জা করে। একা থাকলে এ সব কানে লাগে না।সে বাবাকে লক্ষ করজা। শুনতে পাননি তো! না। ব্রজগোপাল আজ একটু অন্যমনস্ক। সোমেন বলে-বাবা, কাগটা আমার হাতে দিন।উ। বলে ব্রজগোপাল মুখটা ঘুরিয়ে হাসলেন। বললেন-না, না, এ ভারী কিছু নয়। -নিনা।একটু লাজুকভাবে সংকুচিত রজগোপাল বললেন-ক্যাম্বিসের ব্যাগ, এ তোমার নিতে সড়া করবে। মচবায়াও না।সোমেন একটু হেসে ব্যাগটা প্রায় কেড়েই নেয়। ব্রজগোপাল বাদি হাতটা ব্যাপারের মধ্যে টেনে নেন। সোমেন টের পায়, বুড়োর মনটা ভাল নেই। ভরভরতি সংসারটা দুটো চোখে দেখে ফিরে যেতে হচ্ছে। সোমেনের মনটা কেমন করে। বলতে কী এই প্রথম বয়সকালে সে বাবাকে একটু একটু চিনছে।রজগোপাল দু-কদম পিছিয়ে তার পাশ বরে বললেন- আমি আজ তোমার জন্যই বসেছিলাম। ভাবলাম দেখ্যার করে যাই। নইলে সন্ধের গাড়িটা ধরতে পারতাম।সোমেন একটু বিস্মিত হয়ে বলে-কোনও দরকার ছিল বাবা?-না, না। তেমন কিছু নয়। এমনিই। ভাবলাম বসেটসেই তো আছো, অথ্য ওদিকেএক-আধবার যাও-টাও না।-হাতে একটা টিউশনি আছে।-সে তো সন্ধেবেলা একটুখানি। মাদবাকি মিনটা তো ফাঁকা। ছুটিয়াটার দিনও আছে।সোমেন উত্তর দেয় না।প্রজগোপাল বলেন-হিউশনিটা করছ করো। কিছু বাড়ি বাড়ি ঘুরে পড়ানো অনেকটা ফিরিঅলার কাজ। এইটি অভ্যাসগত করে ফেলো না।-পেয়েছি, তাই করছি। বলেই তো থাকি।-খারাপং বলছি না, ব্রজগোপান নিজেকে সামলে নেন। বলেন-কিন্তু তোমরা মাঝেমধ্যে ওদিকে গেলে জমিজমার একটা বুঝ-সময় হয়। ব্রজগোপাল আবার আস্তে করে বলেন-অবশ্য আমি তোমাদের টেনে নিতে চাইছি না। তোমার মায়ের সেটা বড় ভয়েব্যাপার। আমি বলছিলাম, বসেই যখন আছ তখন- কথটি। শেষ করতে পারে না প্রজগোপাল। গ্যর কী একটু আটকায় বোধ হয়।সোমেন বলে-একা আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে ওখানে।-না, না। একা বেশ আছি। বহুকালের অভ্যাস। কাউকেই দরকার হয় না তেমন। কিছু তোমার মায়ের সন্দেহ, আমি ছেলেদের কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি। পাগল। তাই কি হয়।
পৃষ্ঠা:১৪৬
হাঁটকে হটিতে ভাবা রিজের ভলার কাছে চলে আসে। একটা ট্রেন সা করে বেরিয়ে গেল। ব্রিজের ওপরে মহ্যভার নিয়ে চলে যাচ্ছে ডবলডেকার, বিমগুদো কাঁপে। ব্রজগোপাল একবার ওপরের ছুটজ বাড়িঘরের মতো বাসের দিকে তাকিয়ে দেখলেন। থেমে র্যাপারটা ভাল করে জড়িয়ে নিলেন গায়ে। বললেন-তোমার সঙ্গে দেখা করাটাই দরকার ছিল। ভাবছিলান, হয়তো আজও দেগ্য হবে না। হয়ে গেল।সোমেন বলল-কিছু দরকার থাকলে কলুন।দরকার। বলে ব্রজগোপাল সামান্য হাসেন-তেমন কিছু নয়। ছেলেকে যে বাপের কেন দরকার হয় তা বাবা না হলে কী বোকা যায়।ব্রজগোপাল একটু খাস ফেললেন। সোমেন সঙ্গে সঙ্গে হাঁটে। ফাঁকা থেকে ক্রমে ভিড় আর আলোর মধ্যে এসে পড়ে। বাসস্টপ আর দূরে নয়। প্রজগোপাল খুব আস্তে হাঁটেন। সামান্য রাস্তাটুকু যেন দীর্ঘ করে নেওয়ার জন্যই। বলেন রণে কদিন আগে হঠাৎ গিয়ে হাজির। স্টেশনে দেখা হল, ও তখন ফিরছে। নানা কথার মধ্যে হঠাৎ বলে যেদাল বাবা, সংসারে বড় অশান্তি। ভেঙে কিছু বলল না। সেই থেকে মনটা বড় খারাপ হয়ে আছে। চালা ছেলে, সহজে কিছু বলে না। কীসের অশান্তি তা তো আর আমার বুঝবার কথা নয়। আমি বাইরের মানুষ। কিন্তু শুনলে পরে মন ভাল লাগে না। কোমেন সতর্ক হয়ে গিয়ে বলে-ওসব কিছু নয়। একটু বোধ হয় মন কথাকথি হয়েছিল,মিটে গেছে। ব্রজগোপাল মাথা নাড়লেন। বুঝেছেন, বললেন তাই হবে। তোমার মা কী কথায় যেন আজই বলছিলেন, তুমি নাকি আলাদা বাসা খুঁজছ।মার মুখ বড় পলকা। কিছু চেপে ঢেকে রাখতে পারে না। মনে মনে বড় রাগ হল সোমেনের। মুখে বলল ও বাড়িতে জায়গা কম, লেখাপড়ার একটা ঘর দরকার। তাই ভাবছিলাম।ব্রজগোপাল বুঝদারের মতো বললেন一কিন্তু কথাটা যে বিশ্বাস করালেন না তাঁর নিস্পৃহতা থেকে বোঝা গেল। একটা খাস ফেললেন। এবং শ্বাসের সঙ্গে বললেন মানুষের সওয়া-বওয়া বড় কমে গেছে।-বাবা, আপনি গোলো নম্বর ররর উঠে পড়ুন।-তাই ভাল।স্ট্যান্ডে বাস দাঁড়িয়ে আছে। বসার জায়গা নেই। ব্রজগোপাল বাসে উঠে বস্ত ধরে দাঁড়ালেন। একা ব্রজগোপালই দাঁড়িয়ে আছেন, আর সবাই বসে। বাসের দরজা দিয়ে দৃশ্যটা দেখে সোমো একা দাঁড়িয়ে থাকা বাবাকে বড় অদ্ভুত দেখাচ্ছে। বলল-বাবা, আপনি নেমে আসুন। পরের বাসে থাকেন।- থাকগে, দেরি হয়ে যাবে।-দাঁড়িয়ে যেতে আপনার কষ্ট হবে।ব্রজগোপাল মাথা নেড়ে বললেন-না, কষ্ট বদ। পারব।সোমেন ছাড়ল না, উঠে গিয়ে বাঝার হাতের ব্যাগটা নিয়ে বলে-আসুন।প্রজগোপাল এই, আরটুকু বোব হয় উপভোগ করে একটু হাসলেন। এই ছেলেটা তাঁর বড় মায়াবী হয়েছে। নেমে এলেন। পরের যোলো নম্বর বাসটা ফাঁকা দাঁড়িয়ে আছে স্টার্টারকে জিজ্ঞেস করে নিয়ে সোমেন বাবাকে ফাঁকা অন্ধকার বাসটায় স্কুলে দেয়। অবশ্য
পৃষ্ঠা:১৪৭
একেবারে ফাঁকা নয়। অন্ধকারে দুটো একটা বিড়ি বা সিগারেটের আগুন শিসিয়ে ওঠে। ব্রজগোপাল বসলেন। বললেন আজকাল সব জায়গায় বড় ভিত-হ্যাঁ।-তবু মানুষ কত কম।কথাটার মধ্যে একটা নিহিত অর্থ আছে। সোমেন বুঝল। কিছু বলল না। ব্রজগোপাল জিজ্ঞেস করলেন-তুমি কোথায় যাবে।সোমেনের একটু বিপদ ঘটে। সে যাবে বালিগঞ্জ সারকুলার জেডে। গাবুকে পড়াতে। সেখানে এই বাসেও যাওয়া যায়। কিন্তু বাবার সঙ্গে আর বেশিক্ষণ থাকতে তার এরকম অনভ্যাসজনিত অনিচ্ছা হতে থাকে। একটাসিগারেটও খাওয়া দরকার। সে বলল-এই কাছেই যাবে।-তা হলে রওনা হয়ে পড়ো। আমার জন্য দেরি করার দরকার নেই।—বাচ্ছি। বলে একটু ইতস্তত করে বলে-আমাকে কেনেও দরকার হলে-ব্রজগোপাল অন্ধকারে একটু অবাক গলায় বললেন-দরকার। সে তেমন কিছু নয়। সোমেন প্রত্যাশা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
বাইশ
গোপাল মান্য নেড়ে বাজুক গলায় বললেন-তুমি ভেগো না। দরকারটা শাপ ছাড়াকেউ বোঝে না।কী দরকার বাবা?-তোমার গায়ের গন্ধটুকু আমার দরকার ছিল। আর কিছু নয়।ভাগচাষির কোর্ট থেকে বেরিয়ে ফেরার পথে একজায়গায় দাঁড়িয়ে গেল বহেরু। রাস্তার পর ঘেঁষে মাঠমতো জায়গায় খেলা জমেছে। রাজ্যের লোক ভিড় করে ঘিরে আছে, লাউডস্পিকার বাজছে। দু-ধারে দুটো মস্ত গাছে বিশ পঁচিশ ফুট উচুতে টানা দড়ি বাঁধা, দড়ির মাঝ বরাবর একটা মোটে হাঁড়ি স্কুলছে। হাঁড়ির গায়ে সুতোয় গাঁথা দশ টাকার নোট হাওয়ায় উড়ে উড়ে হাতছানি দিয়ে ডাকছে মানুষজনকে। কম নয়, এই দুর্দিনের বাজারে একশোটা টাকা। লাউডপ্লিকাবে হিন্দি গান থামিয়ে ঘোষণা হচ্ছে- বন্ধুগণ, এ হচ্ছে বুড়ির হাঁচি। হাঁড়ির গায়ে একশো টাকা গাঁথা আছে, যে ছুঁতে পারে তার। কিছু শক্ত নয়, খুব সোজা খেলা। সেখুন, সেন্টার আসছেন সিমলেগড়ের যুবক সংঘ।আবার হিঙ্গি গান শুরু হয়।রজগোপাল বিরক্ত হয়ে বলেন-দাঁড়ালি যে।বহের একটু হেসে লাজুকভাবে বলে-বলে র’ন একটু দেখে যাই।-তোর আর বয়স হল না।বহেরু গায়ের চাদরখানা খুলে ঝেড়ে ভাঁজ করে। কাঁধে ফেলে বলে দুনিয়ার হাজারো মজা। দেখে-টেখে যাই সব।-তো তুই দাঁড়া। আমি এগুতে থাকি, তুই চোটে হেঁটে আসিস।বহেরু তখন মজা দেখছে। একবার মাথা নাড়ল কেরল। দশজনের দল, চারজন খেল
পৃষ্ঠা:১৪৮
হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াল, তাদের কাঁধে ভর দিয়ে উঠল তিনজন। নীচের চারজন টলোমলো। তাদের মাঝখানের ফোকর দিয়ে সাবধানে আর দুজন উঠছে। কাঁধে পা রাখতেই নীচের চারজন ঠেলাঠেলি শুরু করে দেয়।লাউডস্পিকারে গগন থামিয়ে উৎসাহ দেওয়া হতে থাকে আপনারা পারবেন। চেষ্টা করুন, শক্ত হয়ে দাঁড়ান। বুড়ির হাঁড়ি আপনাদের নাগালের মধ্যেই এসে গেছে প্রায়। শক্ত হয়ে দাঁড়ান, ভাসা হারাবেন নালাউডস্পিকারে গান থামিয়ে এদের উৎসাহ দেওয়া হতে থাকে আপনারা পারকেন। চেষ্টা করুন, শক্ত হয়ে দাঁড়ান। বুড়ির হাঁড়ি আপনাদের নাগালের মধ্যেই এসে গেছে প্রায়। শত্রু হয়ে দাঁড়ান, ভরসা হারাকেন না…কিন্তু মানুষের স্তন্তটা ভেঙেই গেল। হুড়মুড় করে ওপরের থেকেয়ারা পড়ে গেল এ ওর ঘাড়ে। চারধারে একটা হাসির চিৎকার উঠল।-যা, পারল না। রজগোপাল বললেন।বহেরু মুগ্ধ হয়ে খেলাটা দেখছিল। ঘাড় ঘুরিয়ে ব্রজগোপালকে দেখে বলল-বাননি? -মজাটা মন্দ নয়, তাই পাঁড়িয়ে গেলাম।-ভারী মজা। র’ন, একটু দেখে যাই।লাউডস্পিকারে ঘোষণা হয় এধার বুড়ির হাঁড়ি কারা ছোঁবেন চলে আসুন। কোনও প্রবেশমূল্য নেই, দশজনের যেকোনও দল চলে আসুন। বুড়ির হাঁড়ি আপনাদের চোখের সামনে ঝুলছে, হাতের নাগালের মধ্যেই। পুরস্কার নগদ একশো টাকা নগদ একশো টাকাভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলি হতে থাকে। রোগা-রোগা কালে-কালো চাফিকসি যেছের কয়েকজন মাঠের মাঝখানে ফাঁকা জায়গাটায় গিয়ে দাঁড়ায়। উপোসী চেহারা, গায়ে জোর বাল নেই।লাউডস্পিকার বলতে থাকে এবার আসছেন বেলদার চাবিভাইরা। মনে হয়, এ-বছর এরাই বুড়ির হাঁড়ি জিতে নেবেন। এঁরা প্রস্তুত হচ্ছেন, আপনারাও এঁদের উৎসাহ দিতেপ্রস্তুত থাকুন।আবার হিন্দি গান বাজে।প্রজগোপাল বলেন-এরা কি পারয়েটবহেরু একটু হাসে-তাই গাত্রে) শরীলে আছে কী? ভাল করে দম নিতে পারে না। এদগোপাল গল ফেলে এলেন টাকা দেখে লোভ সামলাতে পারেনি। লোক হাসাকে নেমে গেছে।-সেইটেই hag মজা।রোগা, অবঁধুডো, মরকুটে চেহারার লোকগুলো হাঁড়ির নীচে দাঁড়াতেই চারদিকে হুল্লোড় পড়ে গেল। লোকগুলোও অপ্রতিভভাবে হাসে চারদিকে চেয়ে। তারা যে মজার পাত্র তা বুঝে গেছে। তবু চারটে লোক কাঁধে কবি ঠেকিয়ে দাঁড়ায়, তিনজন আঁকুপাঁকু করতে করতে কাথের ওপর দাঁড়ায়। ভারী বেসামাল অবস্থা, চারজনের পিঠে তিনজন দাঁড়াতেই নীচের চারজনের পিঠ বেঁকে যাচ্ছে। মাটির দিকে নেমে যাচ্ছে মাথা। তবু ঠেলাঠেলি করে তারা সামাল দেয়। এখনও বুড়ির হাঁড়ি অনেক উঁচুতে। মাঝখানে অনেকনৈ শূন্যতা। বাতাসে ফুরজুর করে ওড়ে সুতোয় বাঁধা দশঘানা নোট। বুড়ির হাঁড়ি দোল খাচ্ছে। চারজনের পিঠে তিনজন দাঁড়িয়ে একটুক্ষণ দম নেয়। তারপর আর দুজন উঠতে থাকে চারজনের মাজায় পা
পৃষ্ঠা:১৪৯
রেখে, পিঠ বেয়ে। ভারী কষ্টকর কসরত। তবু ধীরে ধীরে দূধার দিয়ে দুজন শেষ পর্যন্ত ওপরের তিনজনের কাঁধের ওপর গিয়ে খাড়া হয়। প্রবল চিৎকার ওঠে চারদিকে। লাউডস্পিকার বলতে থাকে-পেরেছেন, আপনারা পেরেছেন। আর নোটে একজন উঠে দাঁড়াতে পারলেই বুড়ির হাঁড়ি জিতে যাকেন। সাহস করুন, শক্ত হয়ে দাঁড়ান।রোগা, জীর্ণ মানুষের তৈরি স্তমটা অবিশ্বাস্যভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। পিঠগুলো বেঁকে যাচ্ছে, খাস পড়ছে হপর হপর। টলছে, তবু দাঁড়িয়ে আছে। বুড়ির হাঁড়ি আর মাত্র এক-মানুষ উঁচুতে। সর্বশেষ লোকটা হালকা-পলকা, অল্পবয়সি। জিব দিয়ে ঠোঁটটা একবার চেটে আস্তে পা তুলল নীচের চারজনের একজনের মাজায় ভর রেখে উঠল। হাত বাড়াল দ্বিতীয় স্তরটায় ওঠার জন্য। প্রচন্ড হাততালি দিয়ে উঠল লোকজন, চেঁচাল-বাহবা। সাবাস! লাউডস্পিকারে ঘোষক বলতে থাকে- পারবেন। নিশ্চয়ই পারবেন। উঠে পড়ুন।এত উৎসাহে আর চিৎকারেই বোধ হয় দিশাহারা হয়ে স্তম্ভটা হঠাৎ ভেঙে পড়ল। বুড়ির হাঁড়ির নীচে কালো, শ্রীর্ণ মানুষের শরীর দলা পাকিয়ে গেল।এজগোপাল খাস ছেড়ে বললেন দূর। আগেই ভেবেছিলাম। বহেরু, এবার চল। বহেরর যেতে অনিচ্ছা। বলল দেখে যাই। কেউ না কেউ তো পারবেই।-পারলে পারবে। তা বলে কতক্ষণ দাঁভাবি?বহেরু আস্তে করে বলে-আমার দল থাকলে একবার দেখতাম কর্তা। হাঁড়িটা বন্ধ উঁচুতে বেঁধেছে, কিন্তু পারা যায়। গা গতর থাকলে কিছু শক্ত কাজ নয়।রজগোপান বললেন-জেদ করলে সব পায়া যায়, লোভ করলেই কিছু হয় না। বহেক বলে-এ তামশরি আমাদের ওখানে একবার দিলে হয়।পরের দলটাও তিন থাক তৈরি করেছিল। শেষ লোকটাই পারল না। লোকজন চেঁচাচ্ছে। লাউডস্পিকার আশ্বাস দিয়ে বলছে কেউ না কেউ পারবেনই। এগিয়ে আসুন। হতাশ হকেন না। এ ফেলাটার মধ্যে রজথ্যেপান লোক দেখতে পান। বহেরু দেখে লড়াই। বুড়ির হাঁড়িগায়ে মালার মতে। পরানো নোটগুলোয় বাতাস এসে লাগে। মাটি থেকে হাঁড়ি, মাঝখানে নিশূন্য ফাঁকা জায়গাটা। সেটুকু জায়গার মাঝখানে কত কী খেলা করছে। খেলা, লোভ, লড়াই।গোটা ছয়েক দল পর পর চেষ্টা করল। পারল না। বহেরু উত্তেজিত হয়ে বলে-কেউ পারল না। অ্যাঁ। একটা দলে ঢুকে পড়ব নাকি কর্তা? এ বুড়ো কাঁধে এখনও যা জোর আছ-যুর। শিং ভেজে বাছুরের দলে ঢোকা। চল। পিরামিডের খেলা অভ্যাস করতে হয়। শুধু ভার বইতে পারলেই হল না, ভারসাম্য রাখা চাই। সে বড় শক্ত।বহেরু চমৎকার দাঁত দেখিয়ে হেসে বলে কথার কথা বলছিলাম আর কী। সব হা-ঘরে কোত্থেকে এসে জুটেছে টাকার গছে। এদের বন্দ্র নয়। তবে বড় ভাল খেলা, গোবিন্দপুরে একবার খেলাটা দেব। দুশো টাকা বেঁষে দেব, কে লড়বি লড়ে বা। সে মজা হবে।এই সময়ে ডাকাবুকো হোঁতকা চেহারার একটা দল এসে নীরবে হাঁড়ির নীচে দাঁড়াল। তাদের সর্দার যে ছোকরা তার শরীয় বিশাল। যেমন মাথায় উচু, তেমনি গুওড়া কবি। সে মাথা তুলে হাঁড়িটা একবার দেখে নিল। লাউডস্পিকারে ঘোবণা হতে থাকে-একবার বুড়ির হাড়ির দিকে হাত বাড়াবেন গোবিন্দপুরের পোঁড়ারপাড়া মিলন সমিতি ব্যায়ামাগারের
পৃষ্ঠা:১৫০
যুবকবৃন্দ। এবার আমরা বেশ বুঝতে পারছি যে নিলন সমিতি বুড়ির হাঁড়ি প্রতিযোগিতা থেকে খালি হাতে ফিরে যাবেন না।ঋহেক হাঁ হয়ে সর্দারকে দেখছিল। মুখ ফিরিয়ে বলল কর্তা, ওই কোকার দল এসে গেছে।-ওই দেখুন।বহেরুর মাঝের ছেলে, সদ্য জো ফেরত কোকা এখন কোমরে হাত দিয়ে চারবারে চেয়ে দেখছিল। তার শরীরটা অঢেল। ভগবান ঢেলে দিয়েছে অস্থি-মজ্জা-মাংস। চোগ দুখানা ভয়ংকর। রজগোপাল বহেরুকে বললেন-ডাকিস না। কী করে দেখি।বহেরু নীরবে মাথা নাড়ল। চারদিকে প্রচণ্ড হাততালি। চেহারা দেখেই মানুষ বুঝে গেছে, এরা পারনেওয়ালা লোক।বোকা দাঁড়াল নীচের থাকে। সেখানে চারজন সবচেয়ে মজবুত চেহারার ছোকরা। তাদের কাঁধে অনায়াসে নৈপুণ্যে উঠে গেল তিনজন। পা কাঁপল না, টলল না কেউ। মুহূর্ত পরে আর দুজন উঠে গেল তিজনের কাঁধে। সর্বশেষ একজন অনরের মতো চটুল হাত-পায়ে উঠে গেল ওপরে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বুড়ির হাঁড়িটা দুলিয়ে দিল হাত দিয়ে। হাততালিতে তখন ফেটে পড়ছে চারদিক, চেঁচানিতে কান পাতা দায়। ভিড় এতক্ষণ গোল হয়ে গিয়েছিল জায়গাটা, এখন হাঁড়ি-ছোঁওয়া হয়ে গেলে মাঠময় ছেলেপুলে লোকজন হুটোপাটলাগিয়েছে। এত সহজে, অনায়াসে ওরা হাঁড়িটা ফুল যে বিশ্বাসই হতে চায় না। ওদের হাঁড়ি ছোঁওয়া দেখে মনে হয় যে কেউ পারে।বহেক বলে-বৃদ্। এ তো দেখছি ফখবনে খেলা। আনাড়িগুলোই নাজেহাল হচ্ছিলব্রজগোপাল হেসে বলেন দূর বোকা। সহজ মনে হয় বলে কি সহজ। দক্ষতা জিনিস্টা এমনি, শক্ত কাজটাও এমনভাবে করে যেন পা লাগাচ্ছে না বলে মনে হয়।বহেরু ভারী খুশি। বুড়িয় হাঁড়িটা তার ছেলের দল ছুঁয়েছে। ভিড়ের দিকে খেনি-ওপড়ানো পোরব মতো যেগে ওহয়ে যেতে যেতে বহেরু বলে-গাঁড়ম, একবার কোকাকে দেখে আসি।রজগোপাল বিরক্ত হয়ে এরটা ধমক দেন-তোর দেখা করার কী। ছেলেছোকরারা এ-সময়ে নানারকম দুত্রিজনতা করণে এ সময়ে সেখানে ধাপ-নানা হাব্বির হলে কি খুশি হয়। চলে আয়।বহেরু অমুধে যায়। কথাটা বড় ঠিক। এইসব পরামর্শ ঠিক সময়মতো দেন বলেই এজকর্তাকে তার এতপ্রয়োজন।পিছিয়ে এসে বহের বলে যাব না?-কেন যাবি?-তা হলে চলুন বরং। বলে হটিতে হটিতে একটা হাস ফেলে সে। তারপর গলটিন নামিয়ে বলে-হাওয়ালটাকে কেমন বোঝেন।-কেমন আর। হাঁকভাবের মানুষ হবে, তোর মতোই।বহেরু দুঃখিতভাবে মাথা নাড়ে। বলে-কাই কি হয়? আমি বরাবর মানী লোকের মান দিই। ও. দেয় না। দিনেকঞ্চলে ও সবকিছু দখলে নেবে। দেখবেন।
পৃষ্ঠা:১৫১
হজগোপাল আস্তে করে বলেন-দেখার জন্য আমরা কেউ থাকব না। নেয় তো নেবে।আমাদের কী রে? আমানের ডংক্য বেজে গেছে। সংসার নিয়ে অত ভাবিস না। -ভাবা ঠিকও নয়। বুঝি। তবু মনান মানে না। কোকাটি। এই বয়সেই খুন-খারাপি করেফেলল। শুন-খারাপির কি বয়স আছে না কি। আজকাল কতটুকু কতটুকু সব ছেলে মানুষ মেরে বেড়ায়।বহেরুর মুখে একটু উদ্বেগ দেখা যায়। বলে-আমিও তো কাটলাম কাঁটা। সে-সব কর্মের দোষেই কি ছেলেটাও অমন হল। ওই একটাই একটু বেগোছ রকমের, অন্য কাঁটা তো দেখছেন, ভালই।ব্রজগোপাল অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়েন। মনের মধ্যে হঠাৎ একটা নিঃসঙ্গতা ঘনিয়ে আসে, মেঘলা দিনের মতো। ছোট ছেলেটাকে মনে পড়ে। মায়ের শ্রীই পেয়েছে ছেলেটা। লম্বা রোগাটে বুদ্ধিমান মুখশ্রী। সংসারের গাদ এখনও মনের মধ্যে কোনও তলানি ফেলেনি। ছেলেদের কাছে কিছুই চাওয়ার নেই রজগোপালের। তবু বুক জুড়ে একটা দুর্ভিক্ষের চাওয়া রয়েছে। ভুলেই গিয়েছিলেন, কেন যে দেখলেন মুখখানা।রজগোপাল অন্যমনস্কভাবে মাথা নেড়ে বলেন-ভাবিস না। যত মায়া করবি তত দুঃখ। বহেক তত্ত্বকথা বোঝে না। তবু সায় দিল। বলল জেলখানার মেয়াদটা বড় টল করেফুরিয়ে গেরা। আরও কিছুদিন ঘানি টানলে রস মজত। রজগোপাল অবাক হয়ে বলেন-কেন রে? কোকা তোর কোন পাকা ধানে মই দিল। দিব্যি ঘুরছে-টুরছে, ফুর্তি করে বেড়াচ্ছে, তোকে ও পায় কীসে।বহেক একটু লজ্জা পায়। অপ্রস্তুত চোখ দু’খানা রঙ্গকর্তার চোখ থেকে সরিয়ে নিয়ে বলে-পায় না অবশা। কিন্তু ওর বড় দাগ। কখন কী করে ফেলে বুঝে পাই না। ভয় লাগে। -ছেলেদের ভয় পেতে শুরু করেছিস, তার মানে তোর কয়েসে পেয়েছে।চিন্তিতভাবে গহরু আস্তে করে বলে-এর মতলব ভাল নয়। আপনার হাওয়ালরা যদি জমিটমি বুঝে না নেয় তো আমরা চোখ বুজলে ও সব হাতিয়ে নেবে। ভাবি সং ব্রাহ্মণের সম্পত্তি যেয়ে শেষমেশ নির্বংশ হয়ে যাবে না। তো। আপনাকে ও খুব মানে, কিন্তুছেলেটার।ব্রজগোপাল উদাস গলায় বা ‘হাতানোর দরকার কী। । তেমন বুঝলে আমি ওর নামেসব লেখাপড়া করে দেব। -তাই কি’নেড়ে বলেন-আমার ছেলেরা আসবে না কখনও। ওদের কলকাতায় গেয়েছে।বহেরু একটু আগ্রহভরে বলে-তার চেয়ে কেন বেচে দেন না কর্তা। আমি কিনে নেব। -বেচব। বলিস কী? মাটি হল মা’টি। রামকৃষ্ণদেবের কথা। মা কি বেচবার জিনিস। একসময়ে আমার ঠাকুর বলেছিলেন-বড় দুর্দিন আসছে, সব সোনা মাটি করে ফেল। সেই তখন হাতের পাত্রের যা ছিল, আর সোনাদানা বেচে মাটি কিনতে লাগলাম। সে মাটি বেচব কী বলে? ছেলেরা যদি না বোঝে না বুঝুক।বহেরু একটা শ্বাস কেসন মাত্র। তার প্রকান্ড শরীরটায় কোথায় একটা দুর্বলতা আরে ভয়ের পচন শুরু হয়েছে।
পৃষ্ঠা:১৫২
। তেইশ
এখানে দিন শুরু হয় সূর্য উঠবার অনেক আগে। ছুটঘুটে অন্বকার, চারদিকে ফ্যাকাসে কুয়াশার ভূত। কালো পাহাড়ের মতে। শীত জমে থাকে। শিশিরে মাটি ভিজে থাকে এমন, যেন বৃষ্টি হয়েছে। নিগম্বরের গোলের প্রথম বোলটি ফোটে, প্রজগোপালের বউলঅলা খড়মের শব্দটি পাওয়া যায়, আর তখনই বহেরণর বড় জামাই কালীপদর গান শোনা যায়- জাইগতে হবে, উইঠতে হবে, লাইগতে হবে কাজে…।ঘড়ির অ্যালার্ম আর বাজে না। তবু উঠতে কোনও অসুবিধে হয় না। ঘুম বড় একটা আসে না তো। এপাশ-ওপাশ করে রাত কাটে। হারিকেনের পলতে কমানো থাকে, ঘরে একটা পোজ কেরোসিনের গন্ধ জমে। টিনের চালের ওপর টুপটাপ শিশির খসে পড়ার শব্দ হয়। আসেপাশে শেয়াল ডাকে, হাঁসের ঘর থেকে ডানা আপটানোর শব্দ আসে, ঘুমের মধ্যে মুরগি ভুল করে ডেকে ওঠে হঠাৎ। নিশুতি রাতে দূরের শব্দ সব শোনা যায়। গন্ধ বিশ্বেসের বহুমুত্র রোগ। অন্ধ-প্রায় মানুষ বলে ঘরে মেটে-হাঁড়ি রাখা থাকে। ঘুম-চোখে ঠাহর না পেয়ে মাঝেমধ্যে হাঁড়ি উলটে ফেলে ঘর ভাসায়। সেই পেচ্ছাপ কাচতে গিয়ে বিন্দুর মা বেহনে বেলানয় বাপ-মা তুলে বকাঝকা করে বলে গন্ধ হাঁড়ি উলটে ফেলেই আর্তনাদ করে বেড়ালের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে চেয়ায়-হাই শালা মেকুর, হাই অয়-অ্যা-আর। এভাবে দে সাক্ষী ব্যাখার চেষ্টা করে। গোটা চারেক সড়াল বুকুর সারা রাত চেঁচিয়ে পাহারা দেয়। নমঃশুর বৃন্দাবন লাঠি ঠুকে চৌকি দিয়ে ফেরে। রজগোপাল প্রায় সারা রাত এসব শব্দ শোনেন। শরীরের তাপে বিছানাটা রেতে ওঠে। পাশ ফিরলেই একটা শীতভাব টের পান। আরাম লাগে। এ বয়সে শীরটা বেশ লাগার কথা। কিন্তু লাগে না। বোধ হয় রক্তের চাপ বেড়েছে। তাঁতি লোকটা এ ঘরে ঘুমোয়। ব্যবস্থাটা বহেরুর। সে বলে বুড়ো মানুষ একা খাবেন, কখন কী হয়ে পড়ে, একটা লোক ঘয়ে থাকা ভাল। ব্রজগোপাল বিরক্ত হয়ে বলেন-তোর ব্যয়সটা কি কম নাকি। বহেরু হাঁ হাঁ করে বলে-ভদ্রলোকের জান আর ছোটলোকের কান কি এক। তা ছাড়া আমার জন আছে, আপনারে দেখে কেন্দ্রা।কথাটা আজকাল লাগে। একটু ভরুও হয়। মৃত্যুভয় নয়, এ অন্য রকমের এক রয়। এখান থেকে কলকাতার দূরত্তন এইসৈব করে দেখেন, খবর পেলে মুখাগ্নি করতে সময়মতো ছেলেরাকেউ এসে পড়তে পারবে তো।-তাঁতি লোকটার মন্মরি নেই। চটের ভিতরে খড় ভরে একটা গদি বানিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেটার ওপর টিকা মাটিতে পড়ে থাকে। মাথা পর্যন্ত কাঁথায় ঢাকা, তবু ফাঁকফোকর দিয়ে মশা ঢুকুেমিড়ায়। ঘুমের মধ্যেই চটাস চটাস মায়ে। প্রায় রাতেই শোওয়ার সময় হারিকেনের টিপ মূলে কেরোসিন আধ কোষ তেলোয় ঢেলে সরষেতেলের মতো গায়ে মুখে মেখে নেয়। তবু ঠিক কামড়ায়। ক্রিমি আছে বোধ হয় ঘুমের মধ্যে দাঁত কড়মড় করে, স্বপ্নের মধ্যে কথা বলে। ব্রজগোপাল বিরক্ত হন। পাকা ঘুম ভীতির, ডাকলে সহজে ওঠে না। আর এক চিন্তা এজগোপালের, চৌকির তলায় সুটকেস আছে, টেবিলে খড়ি, দড়িতে কিছু জামাকাপড়, দামি একটা দশবাতির ল্যাম্প একটা কিছু তুলে নিয়ে মাঝরাতে তাঁতি সটকায় যদি? এমন কিছু মহামূল্যবান দ্রব্য নয়, চোরের লাভ হবে না, কিন্তু গেরস্তর তো ক্ষতি। তাই সতর্ক থাকেন প্রজগোপাল। লোখাকার সব উটকো লোকজন ধরে আনে বহেরু। এসব লোককে বিশ্বাস কী? এসব মিলেঝুলে আজকাল ঘুম কমে গেছে। বুড়ো বয়সে অবশ্য
পৃষ্ঠা:১৫৩
ঘুম কমে যায়। এ বয়সে শরীরের কল বড় আনমনা, নিজের ক্ষয়ক্ষতি আর পূরণ করে নিতে চায়না।নিশুত রাতে পৃথিবীটা মস্ত বড় হয়ে ওঠে। ব্রজগোপাল শুলেই টের পান, ঢারবারে ঘুম, নিস্তব্ধতার ভিতরে মনটা নানা কথা কয়ে ওঠে। সে সব কথা ঢেউ-ঢেউ হয়ে চলতে চলতে কোথায়া পৌঁছে যায়। আর ঠিক ওরকম সব ঢেউ যেন চারধার থেকে দূর-দূরান্ত পার হয়ে তাঁর দিকেও আসতে থাকে। যেমন নক্ষত্রের আলো, যেমন দূরদেশ থেকে আসা বাতাস, যেমন খঞ্জনা পাখি।মনের বড় শত্রু নেই। এমনিতে বেশ থাকে, হঠাৎ কু-তাক ডাকতে শুরু করে। কাজকর্মের মধ্যে থাকলে মনটা বেশ থাকে, কিন্তু একা হলেই মানুষ বোকা। রাতবিরেতে আজকাল ঘুম না হলে একটা ধন্দ ভাব চেপে ধরে ব্রজগোপালকে। বিষয়চিন্তা তাঁর অভ্যাস নয়। কিন্তু বহেরুর মাঝলা ছেলে কোকা জেল থেকে গলাস হওয়ার পর বিষয়-আশয়ের জন্য একটু উদ্বেগ হয়। ছেলেন এই সেদিনও ছোট্টটি ছিল, পায়ে শুয়ে ঘুরঘুর করে বেড়াত, ফাইফরনাস গাটত। রজগোপালের ঠাকুর পুজোর হাসাদ একটু বাতাসার কণা কটি হাতখানা পেতে ভক্তিভরে নিত। চোদ্দো-পনেরো বছর বয়স পর্যন্ত কিছু বোঝা যায়নি। তারপরই ভেড়া বাঁশের মতো নিজের ইচ্ছেয় ঝড়তে লাগল। এখনও তেইশ-চব্বিশ বয়স, তবু চোখে ইতরামি এসে গেছে। কাউকে বড় একটা মানে গোনে না। মাঝেমধ্যে প্রজগোপালের ঘরে এসে ‘বামুনজ্যাঠা’ বলে ডাক দিয়ে মেঝেয় বসে। কথাবার্তা করা। কিন্তু প্রজগোপাল বুঝতে পারেন, ছেলেটার মধ্যে জন্মসূত্রে কোনও দোষ আছে। এ ছেলে যেখানে থাকবে সেখানেই একটা সামাল সামাল পড়ে যাবে। হাতের পাতের টাকা দিয়ে নিজের নামে কিছু জমি কিনেছেন ব্রজগোপাল, স্ত্রীর নামে আছে ছ’বিয়ে, আর আছে বাস্তুত্তমি। ছেলেরা আসবে না এসব দেখতে। তাই কোকার দিকে তাকিয়ে একটু উদ্বেগ বোধ করেন। এই বয়সেই খুন-খারাপি করে ফেলেছে এবং সেজন্য কোনও পাপবোধও নেই। জেলখানা থেকে হাতি হয়ে ফিরেছে। কোকা যে-ছোকরাকে কেটেছিল তাকে চিনতেন রজগোপাল। দোমেনের মতোই বয়স, তেজি চেহারা। পুলিশের ভয়ে পালিয়ে এসে গোবিন্দপুরে এক আত্মীয়-বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। কিছু স্যাভাৎ গুটিয়ে মাঠে-ঘাটে ঘুরে বেড়াত। তার রগে ছিন জোতদারদের ওপরে। কিন্তু এয়ন বিষ্ণু করেনি যে পালটি নিতে হবে। তবু কোকা তাকে কেটে ফেলেছিল। মশা-মাছি মারজেও জীবহত্যা হয়, মানুষ মারলেও তাই। তবু মানুষ যখন মানুষ মারে তখন বোধ হরকেবি নিজের রক্তেই একটা বিরুদ্ধ ভাব ওঠে। তার নিজের গড়া আর একটা জীবকে মন্ডেলি কি তার ভিতরে একটা আর্থত্মীয়বধের অনুতাপ কাজ করে? নাকি সে. ফাঁসির রহি যাবজ্জীবনের মেয়াদ-এসব ভেবে দিশেহারা হয়? ঠিক জানেন না রহ্মগোপাল। তবে মনে আছে, সেদিন রাতে ফিরে কোকা পুকুরে ঝাঁপ খেয়ে দাপালপি করেছিল অনেকক্ষণ। যখন তাকে তুলে আনা হয় তখন দুচোখ ঘোলাটে দান, বেভুল সব বকছে। রাতে গা-গরম হয়ে জ্বর এল। বাহের লক্ষন দেখেই চিনেছিল, এজগোপালকে আড়ালে ডেকে বলেছিল-শুয়োরটা নিশ্চয়ই মানুষ খেয়েছে কর্তা। অজেরই দোষ। রাত না পোয়াতে বিড়াল পার করতে হবে।ভোর রাতে কোকাকে প্রথম ট্রেনে কলকাতায় রওনা করে দিয়ে আসতে গিয়েছিল বহেরু। কলকাতা মানুষের জঙ্গল, পালিয়ে ধাবার এমন ভাল জায়গা আর নেই। কিন্তু কোকা স্টেশনেই ধরা পড়ে। ধরা পড়বার পর ব্রজগোপাল গিয়েছিলেন দেখা করতে, উকিল সঙ্গে
পৃষ্ঠা:১৫৪
নিয়ে। ছেলেটাকে তখন দেখেছেন, শিবনেত্র হয়ে লাতন বেচারার মতো বাদে আছে। ঘন ঘন মাথা যোয়, চুল তখনও সম্পদপে ভেজা, মুখটা পাঁশুটে কেমনধারা যেন। অনেককাল রোগভোগের পর মানুষের এমন চেহারা হয়। ছেলেটা সোমেনের ব্যাসি একটা তাজা ছেলেকে কেটে ফেলেছে, ভাবলে ওর ওপর রাগ যেত্রা হওয়ার কথা। কিন্তু মুখ দেখলে তখন মায়া হত। রক্তয্যেপাল একটু মায়াভরে বলতেন-কেন কাজটর করতে গেলি রে নিক্যংশায় কোকা তখন দিশেহারার মতো চারদিকে চেয়ে গলা নামিয়ে বলত-কাঁধের ওপর বাঁড়িয়েছিল একা। স্যাভাৎ জুটিয়ে আমাদের ওপর মাতববরী করত খুব। পেঙ্গুতে লাগত, তাই রাগ ছিল। সেদিন একা দেখে মাথার ঠিক রাখতে পারিনি। এখন তো সবাই মানুষ-টানুষ মারে, কেউ কিছু বলে না। তাই ভাবলাম, একবার মেরেই দেখি না কী হয়। পালান, নেতাই গুরাও সব বললে-দে শালাকে চুপিয়ে। দিনকাল যারুপ বলে অন্তর সঙ্গে থাকত। হাতে অন্তর মনুষ্টাও এবং, মাথার কেমন গোলমাল হয়ে গেল। হবিড় ছেড়ে দৌড়ে যেয়ে চুপিয়ে দিলাম।ব্রজগোপাল আতঙ্কিত হয়ে বলেছেন-ওয়ে চুপ চুপ। ওসব কথা কোল না আর ভুলে যা। উকিলবাবু যা শেখাবেন সেই মতো বলবি।সন্দেহ ছিল, জেরার সময়ে মাখা ঠিক রাখতে পারবে কিনা। কারণ, দেখা করতে গেলেই খুব আগ্রহের সঙ্গে ঘটনাটার বিশদ বিবরণ দিতে শুরু করত কোকা। চোখ দুখানা বড় বড় হরে যেত, দম ফেলত ঘন ঘন। বলত মাইরি, মানুষ যে এমনভাবে মরে কে জানত। আ-অী করে একটা চিৎকার ছেড়ে ছেলেটা যখন পড়ে যায় তখন রক্তটা এসে গায়ে লাগল। কী গরম রক্ত রে বাবা। পড়ে হি-হি করে কাঁপছিল ছেলেটা। সে কী ভয়ংকর দৃশ্য। কোকাকে ভারী মুশকিল ছিল।তখন চুপ করানো প্রথম কমিন কিম হয়ে পড়ে থাক। কোটে জেরার সময়ে নানা উলটোপালটা জবাব দিয়েছিল। সুবিয়ে ছিল এই যে, যাকে মেরেছিল তার নামে পুলিশের হুলিয়া ছিল। সে নাকি ভারী ডাকাবুকো ছেলে, কলকাতায় পুলিশ মেরে এসেছে। ফলে, কোকা আর তার দলবলের বিরুদ্ধে পুলিশ কেসটা খুব সাজায়নি। উকিলও সুযোগ পেয়ে ‘আত্মরক্ষার জন্য হত্যা’ প্রমাণ করার চেষ্টা পায়। মোকদ্দমা ফেঁসে যাওয়ার মতো অবস্থা। শেষ পর্যন্ত অবশ্য কারভানের মেয়াদ হয়েছিল। তিনজন আগেই খালাস পেয়ে যায়। সবশেষে বালাস হল কোকা, মেয়াদশেষ হওয়ার অনেক আছি।এই মামলায় রাজধাষ্ঠী ছিল গোবিন্দপুরের মেদু ভাওর। সে মাতাল-ভাতাল মানুষ। বেলদা-র শুতিবৃষ্টি থেকে বাঁধ ধরে ফিরছিল। সে ঘটনাটা চোখের সামনে দেখতে পায়। সে অবশ্য লোকইনদের ঠিক চিনতে পারেনি। উলটোপালটা সেও বলেছিল সাক্ষী দিতে গিয়ে। তবু সবচেয়ে জোরদার সাক্ষী ছিল সে-ই।এ তল্লাটে মেনুর মতো ডাক্তার নেই। পুরনো আমলের এল এম এফ। সে রুগির মুখে ওষুধ বলে জল ঢেলে দিলেও রুগি চাঙ্গা হয়ে যেত-মানুষের এমন বিশ্বাস ছিল তার ওপর। বউ মরে গিয়ে ইস্তক সে ছোর মাতাল। ব্যঙ্গ-বিধব্য এক কেন তার সংসার সামলায়, মেঘু সকাল থেকেই ঢুকু টুকু শুরু করে দেয়। রোজগারপাতি বন্ধ হয়ে গেছে প্রায়, সংসার চলে না, করি দেখে যে পয়সা পায় তা গুঁড়িকে দিয়ে আসে। ইদানীং পাগলামিতে পেয়ে বসেছিল। এক মুসলমান বৃষ্টির সন্ধেবেলা এসে হাজির, সান্নিপাতিকে তার তখন যাদশা।
পৃষ্ঠা:১৫৫
মেঘুর আলমারিতে ওষুধের নামগন্ধও ছিল না তখন। রুগি হাতছাড়া হয়ে দেখে ইঞ্জেকশনের দাম নিয়ে উঠে ভিতর কাড়িতে গিয়ে গোয়ালঘরের খোড়ো চাদের লালচে জল সিয়িছে ভরে এনে ঠেলে দিয়েছিল রুগির শার্টটরে। এ ঘটনা দেখে ভয় পেয়ে বাস-বিধব্য বোন চেঁচামেচি শুরু করাতে মেঘু গাঁ ছেড়ে পালাল ক’দিনের জন্য। তার তখন ধর্মভয় নেই, দোকলজ্জাও না, কেবল ছিল জীবজন্তর মতো মারণরের ভয়। ফেরার অবস্থায় সে ভারী মজা করেছিল। বর্ধমানের এক বিখ্যাত তান্ত্রিকের নাম করে বহেরুকে চিঠি দিল একদিন। চিঠির ওপর সিঁদুরের ছাপ, লাল কালি দিয়ে ত্রিশূল অকা। তাতে লেখা ক্ষীরোগ্রাম খুশানেশ্বরী শ্রীশ্রী১০৮ কালীমাতার আদেশক্রমে লিখি, বৎস বহেরু, গোবিন্দপুরের শ্রীমান মেঘনার ভট্টচার্য আমার শিষ্যত্ব গ্রহণ করিয়া অতি অল্প দিনেই সর্বসাধনায় সিদ্ধিলাভ করিয়াছে। অতঃপর সে মেঘুতান্ত্রিক নামে লোকপ্রসিদ্ধ হইবে। তাহার আধার অতি উচ্চ। কীরোভ্রাম শ্মশানে নায়ের স্বপ্নাদেশক্রমে একটি মন্দির নির্মাণকল্পে সে অর্থ সংগ্রহে তোমার নিকট যাইতেছে। তাহাকে সাহায্য করিলে শ্মশানেশ্বরী মাতার সিদ্ধ বর লাভ করিবে। বিমুখ করিলে শ্রীশ্রীমাতার কোগে পড়িবে ইত্যাদি। হাতের লেখা মেঘু ডাক্তারের নিজেরই, চিনতে কারও অসুবিধে হয় না। চিঠির প্রায় সঙ্গে সঙ্গে রক্তাম্বর রুদ্রাক্ষে সিঁদুর ত্রিশুলে সেজে মেঘুতান্ত্রিক এসে হাজির। লোকে হেসে বাঁচে না। বহু লোককেই ওরকম চিঠি দিয়েছিল মেমুতান্ত্রিক। বাল বিষবারা খর-ঋণাভুটে হয়। মেথুর বোন আরও এক ডিগ্রি বেশি। সে মেদুর মালা রক্তাম্বর ছিড়েকুটে একশা করল। সেই থেকে মেথুর মাথা বড় সাফ, সাহসীও বটে। গায়ে একরকম ঘা নিয়ে শেওড়াফুলি থেকে একজন লোক এসেছিল, বহু চিকিৎসায় সারেনি। মেঘু তার ডান হাত থেকে রক্ত সিরিঞ্জে টেনে নিয়ে বাঁ হাতে ভরে দিয়েছিল। লোকটা আশ্চর্যের বিষয়, ভাল হয়ে গিয়েছিল কাতে।গোবিন্দপুরের যে কজন লোককে বহেক পছন্দ করে তার মধ্যে মেধু একজন। খামারবাড়িতে কারও অসুখ হলে মেথুই এসেছে বরাবর। ব্রজগোপালের সঙ্গে তবে ভাবসাব ছিল খুব। প্রায় বলত প্রথঠাকুর, দু-বেলা খাওয়ার পর চ্যাটকানো প্লেটে মধু খাকেন দু চামচ। মধুটা ছড়িয়ে নেবেন, আস্তে ধীরে থাকেন। যত স্যালিভা মিশরেমধুর সঙ্গে, তত ভাল।কত্তমতো খেয়ে দেখেছেন প্রজমেশিলি, উপকার হয়।একদিন বলেছিল-প্রন্সফুজুর। একটা মুষ্টিযোগ দিয়ে রাখি। পাতিলেবুতে মেয়াদ বাড়ে।আর নিরামিষে।কী কর? এমগোপাল জিজ্ঞেস করেছেন।-কুনি শীপদের মেয়াদ। সনজিভিটি।পুদিনা, সুপো আর ধনেপাতা আমলকি দিয়ে বেটে খেলে আর অন্য ভিটামিন সরকার হয় না। ক্ষ্যাপাটে ডাক্তারটি। এরকম হঠাৎ হঠাৎ বলত। অবার্থ সব কথা। কিছু কিছু ডায়েরিতে লিখে রেখেছেন রজগোপাল। ইচ্ছে ছিল ডাক্তারের পুরো জীবনটাই লিখবেন। কিন্তু মোদো-মাতালের কাজে তা হয়ে ওঠেনি। পয়সাকড়ি ফুরলে ডাক্তারটা পাগলের মতো হন্যে হয়ে যেত। কুমোরপাডার হবিচরণ এক সময়ে তাড়ি বানাত। পুলিশের রগড়ানিতে ছেড়ে নিয়ে একথান্য ওষুধের দোকান দিল। গাঁ-ঘরের দোকান, তাতে কলরেজি, হোমিওপ্যাথি, অ্যালোপাথি সবই কিছু কিছু জোথাড় করে রেখেছিল সে। মেঘু ডাফার একদিন মৌতাতের সময়ে বিছুটি-লাগা মানুষের মতো সেখানে হাজির। ভাড়ির কারবার যে
পৃষ্ঠা:১৫৬
আর নেই তা খেয়ালই করল না। চারপাশটা ক্ষ্যাপা চোখে দেখে নিয়ে ‘শিশিতে তাড়ি বেচিস?’ এই বলে তাক থেকে এলোপাতাড়ি গোত্র দুই বোতল তুলে নিয়ে ঢকঢক মেরে দিতে লাগল। হরিচরণ হাঁ-হাঁ করে এসে ধরতে না ধরতে আধবোতল অ্যালক্যালাইন মিকশ্চার সাফ। অন্য বোতলটা ছিল ফিনাইলের, সেটা হরিচরণ সময়মতো কেড়ে না নিলে মুশকিল ছিল। পয়সা না পেলে এমন সব কাও করত মেঘু।এই নেধু যখন রাজসাক্ষী হয় তখন ব্রজগোপাল বহেরুকে বলেছিলেন-গুকে হাতে রাখ।হাতে রাখা সোজা। মেঘুকে মদের পয়সাটা দিয়ে গেলেই চমৎকার। ঝামেলা বক্কাট নেই। বিষ্ণু বহেরু কেমন একবারা চোখে ব্রহ্মকর্তার দিকে চেয়ে বলেছিল দেখি।-দেখাদেখির কী? ব্রজগোপাল বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন- এ সময়টা আর তেসিয়ে নষ্ট করিস না। আগে থেকে টুইয়ে রাগ।কিন্তু কেমন যেন গা করেনি বহেরু। আলগা দিয়ে বলল-মাতাল চাতাল মনুষ, হাত করলেও কী বলতে কী বলে ফেলবে।কথাটা ঠিক, তবু বহেরনর হাবভাব বুব ভাল লাগেনি ব্রজগোপালের। সে ছেলের ব্যাপারে একটু গা-আলগা দিয়েছিল ফেন। মেথুকে হাত করার কোনও চেষ্টা করেনি। ব্রজগোপাল নিজেই থিয়ে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে এসেছিলেন মেবুকে। পাঁটা টাকা দিয়েছিলেন, যদিও মেঘুকে টাকা দেওয়া মানে পরোক্ষে শুঁড়িখানার ব্যবসাকে মদত দেওয়া। স্বভাববিরুদ্ধ কাজটা তবু করেছিলেন ব্রজগোপাল।মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই কোকা বেরিয়ে এসেছে। এতে বাপ হয়ে বহেরনা খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু তার মুখেচোখে একটা নিরানন্দ ভাব। আর, তারচেয়েও বড় একটা ব্যাপার দেখতে পান ব্রজগোপাল। বাহককে জীবনে ভয় পেতে দেখেননি তিনি। এখন মনে হয় বহেরুর চোখে একটু ভয় মেন সাপের মাথার মতো উকি মারছে।’ভাবতে ভাবতে এপাশ থেকে ওপাশ হন তিনি। কাঁথাটা গায়ে জড়ান। তাঁতি লোকটা কীএকটু কথা বলে ঘুমের মধ্যে হাসে। ব্রজগোপাল অন্ধকারে চেয়ে থাকেন। হারিকেনেরপলতেয় একবিন্দু নীলচে হলুদ আলো জ্বলছে। রজগোপাল চেয়ে থাকেন। গতকাল মেধু ডাক্তার মারা গেয়ে কাক। খালাস হয়েছে মোটে কদিন। মেঘুটা আবার রাজসাক্ষী ছিল। কা
। চবিবশ
সেদিন ভাগচাষির কোর্ট থেকে ফেরার পথে মেঘু ডাত্তারের সঙ্গে দেখা। বেলদানা বাজারে নাঁড়িয়ে মাতলামি করছে। লোকজন ঘিরে সাঁড়িয়ে মজা দেখছে। বেঁটেখাটো কালোপানা বুড়ো মানুষ, ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুল, গালে বিজ্ঞবিজে সাদা দাড়ি, কষে ফেনা, দুচোখে জলের ধারা। হাপুস কাঁদে মেঘু ডাক্তার। মাতালের যা স্বভাব, কোথাও কিছু না, হঠাৎ একটন পুরনো অনাত্মীয় দুঃখকে খুঁচিয়ে তোলে। মেঘু কাঁদছে তার বালবিগনা বোনের কথা মনে করে-আমার জনমদুখিনী বোনটা, আহা-হা, আমার বিশ্বনা কেনটার যে কী দুখে। আমি তার দাদা… হাঁ আলবত তার মায়ের পেটের দাদ্য। বলে হঠাৎ কালা ভুলে বড় বড়
পৃষ্ঠা:১৫৭
ঠিকরানো চোখে চারদিকে, চেয়ে দেখে মেঘু ভান্ডার। পরমুহূর্তে ক্যাঁ করে কেঁদে ফেলে ভাঙা গলায় বলতে থাকে-মায়ের পেটের দাদা। মরার খবর হলে রোনাই কাছে ডেকে বলেছিল হাত ধরে-দাদাগো, ব্যবস্থা তো কিছু করে যেতে পারলাম না, ওর কী হবে। সেই বোনটা আমার বাসন মেজে খায়, আর আমি শালা মাতাল…শালা মাতাল জুতো মার, জুতো মার আমাকে বলতে বলতে মেঘু এর-ওর তার পায়ের দিকে দু-হাত বাড়িয়ে তেড়ে যায় জুতো করতে।সাত সাত করে সবাই পা টেনে নিয়ে পালাতে থাকে। কেবল বরা পড়ে যায় রেলের রাতকানা কূলি হরশঙ্কর। তার হাতে শিশিতে একটু কেরোসিন, দোকান থেকে ফিরছিল, মজা দেখতে সাঁড়িয়ে গিয়েছিল। তার একখানা ঠ্যাভ সাপটে ধরেছে মেঘু, হাঁটু গেড়ে বদে মুখ তুলে বলে-দে শালা জুতো আমার মুখে। যে। দিবি না? পরাসা জুটলে হরশকর নিজেও টানে, তাই খুব সমবেদনার সঙ্গে কী যেন বোকাতে থাকে ভাষারকেগোবিন্দপুরের যে কজনকে একটু-আধটু পছন্দ করে বহেরু, তার মধ্যে মেঘু ডাক্তার একজন। বন্ডে দেখে দাঁড়িয়ে গেল। বলল-খেয়েই, ডাভারটা যাবে।ব্রজগোপাল বলেন-দেখবি না কি।ও আর দেখার কী! চলে চলুন।- রজগোপাল একটু ইতস্তত করে বলেন-কোথায় পড়েফড়ে থাকবে। হিম লেখে নারোগ ব্যায়।বহেরু বলে-পেটে ও থাকলে আর ঠান্ডা লাগে না।রজগোগাল একটা শ্বাস ফেলেন। বলেন গণ ছিল রে।বহেরু থমকে দাঁড়ায়। হঠাৎ কী মনে পড়তেই বলে-ডাক্তারটা বামুন হয়ে ছোটলোকেরপা ধরছে।রজগোপাল তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলেন মাতালের আবার বামুন।বহেরু সে কথায় কান না দিয়ে বলে আপনি এগেন কর্তা, আমি দেখেই যাই।রজগোপাল হাসলেন। বহেরনর ওই এক দুর্বলতা। বামুন দেখলে সে অন্যরকম হয়ে যায়। প্রজগোপাল মাথা নেড়ে বলেন-দ্যাখ। একটা রিকশার তুলে দিস বরং।লম্বা পায়ে এগিয়ে গিয়ে বহেক দুজকা টানে তুলে ফেলে ডাক্তারকে, বলে গুলো ডাক্তার:মেঘু কিছু। বুঝতে পারে না। কেবল ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে বলে, মারছিস? মার। বলে মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়ে অধোরে কাঁদে। মুখের লালা, নাকের জল মিশিয়ে কাঁদতে কাঁদতে।ভান্ডা গলায় বলে মরি আমাকে।-তোমার ইজ্জত নেই। বামুন হয়ে দোসাদের পা চেপে ধরলে কোন আফেলে? চলো তোমাকে গোচোনা গেলাব আজ।মেঘু সঙ্গে সঙ্গে কথা ভুলে ফোঁস করে ওঠে কেন শালা। আমাকে পেয়ের শ্রী। অ্যাঁ। ফের মাতলামি করবে না বলে দিচ্ছি। তোমাদের খাঁ হয়েছে এক নেশাখোরদের-আমি মাতাল। ভাবী অত্মক হয় মেঘু-আমি। অ্যাঁ!-তুমি আজ বিস্তর দিলেছ। এত বাও কী করে হে। এই বলে বহেরু ভাকে টানতে টানতে বটতলার দরকশার আড্ডায় নিয়ে যেতে থাকে। মেধু চেঁচাতে থাকে শালা, থোক
পৃষ্ঠা:১৫৮
দেখেছিস? দেখেছিস গোরু সারাদিন খালি খায় আর খায়? সকালে জাবনা, বিকেলে জাবনা, তার ওপর দিনমানাত্তর ঘাস ছিঁড়ছে আর খাচ্ছে। রাতেও শালা উগরে তুলে চিবোয়। গোবনা কখনও পেট ভরে, দেখেছিস? আমি হলুম মদের গোক…লোকজন খ্যাল খ্যাল করে হাসছে। ছোকরা একটা রিকশাঅলা ঘন্টি মারে। রিকশাটা এগিয়ে আসতেই মেনু তেড়িয়া হয়ে দাঁড়ায়-রিকশায় যাব কেন, আমি কি মাতাল শালা? বহু কাপ্তান দেখেছি শুভির গায়ের ঘাম চাটলে শালাদের নেশা হয়ে যায়। আমি কি তেক্ষা মাতাল নাকি। আমি হচ্ছি নদের গোরু, সারাদিন খাইয়ে যা, পেট ভরবে না। মেঘনাদ ভটচাষকে কেউ কখনও মাতাল দেখেনি। হটাও বিবশাবলে মেঘু কথে দাঁড়ায়। তারপর বহেক কিছু টানাটানি করতেই সটান শুয়ে পড়ে ফুল্যেয়। সে অবস্থ্য থেকে তাকে তোলা বড় সহজ হয় না।প্রজগোপাল সেই শেষবার দেখেছিলেন মেঘু ডাক্তারকে বাজারের বটতলায় ধুলোমুঠো ঘরে পড়ে আছে। মাতাল মানুষ। ইদানীং বোধবুদ্ধি খুব কমে যাচ্ছিল। কেমন ভ্যাবাগঙ্গারাদের মতো চোখের নজর, দুটো ঠোঁট সবসময়ে করবলার মতো ফাঁক হয়ে থাকত। চোখের নীচে গদির মতো মাংস উঁচু হয়ে থাকত। চোখে আলো নিবে গেছে। ভিতরে ভিতরে বাঁচার ইচ্ছেটাও মরে গিয়েছিল বোধ হয়।পরশু বুঝি পয়সার টান পড়ে। গোটা চারেক টাকার জোগাড় ছিল। দুপুরের দিকে বাল্যবিধবা বোন রিনটে টাকা কেড়ে নেয়। না নিয়েও উপায় ছিল না, দু-চারদিন কুদ্ধি-কলাই সেদ্ধ অথবা গমের খিচুড়ি খেয়ে বাচ্চাদের পেট ছেড়েছে। কিছু ভদ্রলোকী খাবার না জোটালেই নয়। মেঘু ডাক্তার বোনকে মুখোমুখি বড় ডায়। টাকাটা হাপিস হয়ে গেল দেখে নাকি সুস্থ মাথায় সদর দরজায় দাঁড়িয়ে চেঁচামেচি করেছিল-আমার মালের দাম ভেঙে গেল, একটা টাকায় শুঁটির মুখখানাও দেখা যায় না। এখন আমার শরীরটা যদি পড়ে যায় তো তোদের দেখবে কে শুনি?দায়িত্বশীল গেরস্তের মতো কথাবার্তা। মালের দামটা ভেঙে গেছে বলে যে আবার টপ করে জোগাড় করে নেবে সে সাধ্য মেঘুর ছিল না। তার গুডউইল নষ্ট হয়ে গেছে। এখন মেঘু মাতাল, আর মেঘু ডাক্তার দুটো মানুষ। মাতাল মেযূর জন্য ডাক্তার মেঘু নষ্ট হয়ে গেছে। মাতাল অবস্থায় কী করেছে নী করেছে ভেবে মেঘু ইদানীং বড় বিনয়ী হয়ে গিয়েছিল। যখন-তখন লোকেন্দ্র গা ধরত। তাতে শ্রদ্ধা আরও কমে যায়। ধারকর্জ দিয়ে দিয়ে লোকে হয়রান। বুলুসিরডিয়ে গেলেই ডাক্তারকে নিশি ডাকে। বহ্যজ্ঞান থাকে না, পাপ-পুণ্য ভাল মন্দরা এবাধ সুপ্ত হয়ে যায়। ধূর্তামিতে পায় তখন। সে সময়ে চেনা লোকতাকে দেখলেই গুরী ঢাকা দেয়। পরশু বিকেলে মেঘুকে যখন নিশিতে পেয়েছে, মালের দাম ভেঙে দিয়ে চূড়ান্ত দুঃখেমেঘুর চোখে জল, সে সময়ে গুটি গুটি একটি পাঁঠা নিজে হেঁটে এল হাঁড়িকাঠে গলা দিতে। সে একটু বোকাসোকা ঢাবি মানুষ, এক-আধবার মেঘুর চিকিৎসা করিয়ে থাকবে। ‘কল’ দিতে এসেছিল। গোবিন্দপুর থেকে আরও মাইলখানেক উত্তরে তাদের গাঁয়ে। মেঘু তক্ষুনি রাজি। রুগি দেখার পর নাকি পয়সা না দিয়ে চাষি-বউ গুচ্ছের ধান, কলাই, দুটো বিচে-কলার মোচা, এসব দিয়েছিল। কিন্তু মেদুর তখন হন্যে অবস্থা, ধান-কলাই মোচা দেখে আরও মাথা খারাপ হয়ে গেল। চাষির ঘরে ঢুকে শিশিবোতল হটকায়, ছিপি খুলে গন্ধ শোকে, আর বলে-তোয়া মাল খাস না। অ্যা। মাল খাস না তো চাষবাস করার তাগদ পাস
পৃষ্ঠা:১৫৯
কীসে? মাল না খেলে শরীরে রক্ত হয় তোদের কী করে, অ্যাঁ। নগদা তিন চারটে টাকা থাকে না তোদের কাছে কেমন গেরস্থালী করিস তোরা! নাম ডোবালি।ঠিক কী হয়েছিল তা বলা মুশকিল। তবে মেঘু ডাক্তার চলে আসার পর নাকি চায্য দেখতে পায় তার ঘরের একটা জিনিস খোয়া গেছে। তার বড় ছেলে বর্ধমানের কলেজে পড়ে, একটা সস্তার হাতঘড়ি শাষ করে কিনেছিল। দেয়ালে পেরেকে ঝোলানো ছিল। নেই। মেঘু চারশো বিশ ছিল বটে, কিন্তু কখনও লোকের ঘরে ঢুকে কিছু সরায়নি এ যাবৎ। বেলদার সেই ঘড়ি দশ টাকায় বেচে কোকার এক সান্ডাতের কাছে, তারপর তাদের সঙ্গে বসেই একনম্বর টেনেছে। কাল সকালে বহেরনা হেফাজতে। তারা কোকার স্যান্ডাতনের খুঁজে বেড়াচ্ছে। কোকার খোঁজেও এসেছিল। কিন্তু দলে ছিল না বলে ধরে নিয়ে যায়নি। পালান চোবাই গড়িটা কিনেছিল, সেটা বাড়িতে ফেলে রেখে বোকার মতো ফেরার হয়েছে। পুলিশ চোরাই ঘড়ির জন্য খুঁজছে, নাকি খুন সন্দেহ করছে, কিছু বলা যায় না। ঘড়িটড়ি সন্তা ব্যাপার নিয়ে তারা এত মাথা ঘামায় না। তবে কি খুন?ব্রজগোপাল ভেবে পান না। মোদোমাতাল অপদার্থটাকে মেরে লাভটা কী? বহেরু তবু কাল বিকেলের দিকে প্রদগোপালের কাছে এসে বলেছে-ডাক্তারটা রাজসাক্ষী ছিল বলখুন হল না তো কর্তা।ব্রজগোপাল অবাক হয়ে বলেন-খুন বুঝলি কীসে? এমনিতেই শরীরটা ঝাঁঝরা হয়ে ছিল, পট করে মরে যেত যে কোনও সময়ে।বহেরু বন্ধভাবে মাথা নেড়ে বলে-গ্যাঁজ উঠছিল যে মুখ দিয়ে।রজগোপাল বিরক্ত হয়ে বলেন-ওসব খেলে তো ওরবম হবেই।বহেরু হেসে বলেছিল-পুলিশ কিছু একটা গন্ধ পেয়েছে। কেলো শুড়ির দোকানে কাল নাকি মেঘুকে পালান ওরা শাসিয়েছে-তুমি রাজসাক্ষী দিয়ে আমাদের যানি ঘুরিয়েছ, তোমার গর্দান যাবে।ব্রজগোপালের তবু বিশ্বাস হয় না। শুঁড়িখানায় বসে কত মশামাছির মতো মানুষ রাজা-উজির মারে। তিনিবললেন- লাশ তো তুই দেখেছিস। বিছু টের পেলি?গহেরু মাথা নেড়ে বলল-না, শরীর দেখে কিছু বোঝা যায় না। তবে ডাক্তারটা মদের নেশায় মাথার ঠিক রাখতে পারত নাচেকেউ যদি সে সময়ে পোকামারার বিষ এগিয়ে দেয় তো তাই ঢকঢক ঢেলে দেবে প্রথায়ী এই বলে একটা শ্বাস ফেলে বহেরু বলল-বোকাসির জন্য ভারী চিন্তা হয়ব্রজগোপাল হিস্ট্রিক হয়ে বললেন-চিন্তা করিস না। ও তো দলে ছিল না। মাঠেঘাটে লাশ পাওয়য় ঢোল পুলিশ একটু নড়াচড়া করে। কাটাকুটি করে দেখবে। ওসব কিছু না।-তা পালান পালিয়েছে কেন। সেটাও তো দেখতে হবে।-দূর বোকা। ও পালিয়েছে ভয়ে। ঘরপোড়া গোরু, একবার পুলিশ স্কুলে আঠারো যা। তার ওপর চোরাই ঘড়িটা কিনেছে, ভয় থাকবে না?বহেরু বুঝল। তবু একটু সন্দেহ প্রকাশ করে বলে-খুন যদি নাও হয়ে থাকে মেঘু, তবু কিন্তু মনে লয় কোকার স্যাঙাতরা সব খালাস হয়ে এসেছে, শাসাজে-টাসাচ্ছে দেখে ডাক্তারটা ভয় খেয়ে মরে গেল না তো। তেমন তেমন ভয়-ভরের বাতাস লাগলে মানুষ সিটিয়ে মরে যায়।সেটাও রজগোপালের বিশ্বাস হয় না। মেঘু বাস্তব জগৎ সম্পর্কে খুব খেয়াল করত না
পৃষ্ঠা:১৬০
ইদানীং। এক-একটা বোধহীনতা মানুষকে পেরে বসে, যখন বেঁচে থাকা আর মরে যাওয়ার তফাত করতে পারে না। বউ মরে যাওয়ার পর থেকে পরশু ইস্তক মেঘু ডাক্তারের আম্মাহেব ছিল বলে মনে হয় না। ‘আমি আছি’ এমনতর হুঁশ থাকলে তবে তো ভয়ডর? কেরল নেশায় বাধা দিত বলে বালবিধবা বেনটাকে সমকে চলত। আর সুস্থ অবস্থায় মেঘু ডাক্তার ভয় যেত মাতাল মেঘুকে। করবার মেঘু এসে প্রজগোপালের পা চেপে বয়ে বলেছে-দাদা, কাল সাঁঝের ঘোরে শীতলাতলায় আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, অবিহিত কিছু বসে ফেলেছি হ্যাতো, সম্মান রাখতে পারিনি। মাতাল-টাতাল মানুষ, ক্ষমা ঘেন্না করে নেবেন। মেঘুর ভাই সমস্যা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, নিজের মধ্যে দুটো মানুষকে সামাল দেওয়া। একটার সঙ্গে অন্যটার দেখা হয় না। একটা জাগলে আনাটা ঘুমোয়। একটা ঘুমোয় তো অন্যটা জাগে। কতদিন মেধু তার বোনের পা চেপে ধরে উচিয়েছে-বেঁধে রাখ, বেঁধে রাখ আমাকে গোশালে। ঢেঁকিতে লটকে রেখে দে। তখন অন্য মেথুটা অশরীরী হয়ে এসে এই মেদুটাকে ইশারা-ইঙ্গিত করত ভূতের মতো। ছাইগাদায় দাঁড়িবে, থেব পচিদের ওপর উঠে, মাদার গাছের ডালে বসে দাঁত কেলিয়ে হাসত মেথুর কাণ্ড দেখে। নিঃশব্দে মেথুর কানে কানে বলত-দূর বাবু, রসের বানে দুনিয়া ভেসে যাচ্ছে, তুমি কেন গর শুকনো সন্নিসি হয়ি থাকবে? কোন কচুপোড়া হবে তাতে? এই দুনিয় তোমার জন্য কোন সুখ শান্তির বন্দোবস্ত রেখেছে শুনি। তাই যদি ভেবে থাকো তো থাকো ঝেনের পায়ে লটকে, কিন্তু কিছু হওয়ার না।। দুনিয়া এখন তোমার কাছে বাওয়া ডিম বাবা, এ থেকে আর কিছু বেরোবে না। তখন মেঘু উঠে চোর-চোখে চারদিকে চাইত। বোন সে চাউনি চিনত। ঘরের বাসন-কোসন বা দামি জিনিস সব তালাচাবি বন্ধ, পয়সা-কড়ি লুকনো। নিজেকে গালমন্দ করতে করতে মেঘু তখন খারাপ হওয়ার জন্য অন্য মেধুর হাত ধরে বেরিয়ে পড়ত।তাই ব্রজগোপাল ভাবেন মেদুর কাছে দুনিয়ার ঘটনাবলির কোনও অর্থ ছিল না। দু-দুটো মেজুর টানা-হ্যাঁচড়ায় সে তখন নিজের ঘায়ে কুকুর পাগল। সে যে রাজসাক্ষী হয়েছিল, এ ইশই ছিল না।তবু নানা চিন্তা এসে চেপে ধরে। পাপের এক হাওয়া-বাতাস এসে গেছে দুনিয়ায়। কিছু বিচিত্র ন্যায়। কোকা সেই ছোকরাকে খুন করার পর যেমন বলেছিল-আজকাল তো সবাই মানুষ মারে, কারও কিছু হয় না। কোকা কেবলমাত্র সেই কারণেই ছোকরাকে মেরে দেখেছিল কেমন লাগে। এমনু তুচ্ছ কৌতূহলে যদি মানুষ মারা যায় তা হলে বলতেই হয়,সবার ঘাড়ে ভূত চেপেছোটআবার এও মনেটে মৈথুটা এমনিতেই মরল। মল্লার সময় হয়েছিল, দুনিয়ার মেয়াদ শেষ হয়েছে। এখন কৈী-মুক্ত হয়ে বউয়ের পাশটিতে বসেছে কলজে ঠান্ডা করে, একটা বউয়ের জন্য যে একটা মানুষ এমন শোক-পাগল হতে পারে তা আর দেখেননি ব্রজগোপাল।গভীর রাতে তিনি একটা শ্বাস ফেলে পাশ ফিরলেন। গায়ের কাঁখাটা সরে গেল। ঠান্ডা ঢুকছে। হারিকেনের এককিন্তু নীল আগুন স্থির হয়ে আছে। নীলের ওপর একটু হলদে চুড়ো। ঘরময় কেরোসিনের গন্ধ। তাঁতি লোকটা ঘুমের মধ্যে একবার বলল ভাঁয়াও না…আ তারপর চুপ করে ঘুমোতে থাকে। ঘড়িটা বন্ধ, সময়টি। ঠিক বুঝতে পারেন না জেগোপাল। এমনি সময়ে গন্ধ বিশ্বেস হা-হা করে চেঁচিয়ে উঠল। আজও মুতের হাঁড়ি উলটে ফেলেছে। বহেরর বড়জামাইয়ের গলার স্বর আসে। গলায় সুরের নামগন্ধ নেই, তবু একরকম একঘেয়ে পাঁচালির মতো আবেগে গাইতে থাকে জাইগতে হবে, উইঠতে হবে,
পৃ্ষ্ঠা ১৬১ থেকে ১৮০
পৃষ্ঠা:১৬১
লাইগতে হবে কােতারপর হঠাৎ সমস্ত পৃথিবী চমকে উঠে চুপ করে যায়। দিগম্বরের খোলে প্রথম চাঁটিটি পড়ে গুম করে। তোপের আওয়াজের মতো ওই একটি লনিই সবাইকে জানিয়ে দেয়, শব্দে ভগবান আছেন। শব্দ নমস্য।নিঃশব্দে ব্রজগোপাল ওঠেন। বাইরে এখনও নিশুত বাতের মতো অন্ধকার। কুরাশায় আবছা হিম। বৃষ্টির মতো শিশিরে ভিজে আছে চারধার। তবু ভোরের অনেক আগেই এখানে দিন শুরু হয়। দিগহ্বরের আনন্দিত রেন শব্দে মাতাল হয়ে লহরায় ভাসিয়ে নিচ্ছে জগৎসংসার।হারিকেন হাতে, খড়মের শব্দ না করে ব্রজগোপাল পুকুরের ঘাটে পা দিয়ে একটু চমকে ওঠেন। পৈঠায় কে কেন বসে আছে, অন্ধকারে একা। এটা প্রজগোপালের নিজস্ব ঘাট। রাহ্মণের ঘাট কারও কোনও কাজ করার নিয়ম নেই। ব্রজগোপাল হারিকেনটা তুলে কালেন-কে?
পঁচিশ
গার্ড সাহেবের মতো লঞ্চন উঁচুতে তুলে ধরে ব্রজগোপাল ঠাহর করে দেখলেন। খেজুর গাছ ঠেছে, খোঁটা পুঁতে মজবুত ঘাট তৈরি করে দিয়েছে, বহেরু। সবাই বলে, বামুনকতায় ঘাট, এ ঘাটে আর কেউ বোয়া পাবলা করে না। অন্য মানুষ তাঁর খাটে বসে আছে দেখে প্রজগোপাল অসন্তুষ্ট হন। আচার-বিচার সহবত সব কমে আসছে নাকি।কুয়াশা আর লাঠনের হলুদ আলোয় রহস্যের মাখামাখি। লোকটা মুখ ফিরিয়ে কাগ নামুনজ্যাঠারজগোপালের চোখ আত্মকরা কমজোরি। লইনের আলো থেকে চোখ আড়াল করে ঠাহর পেলেন, কোন্স। তার কান মাথা ঢেকে একটা কমকটার জড়ানো, গায়ে চাদর। অলিসান চেহারা নিয়ে বসেছিল, এজন এজগোখালকে দেখে উঠে দাঁড়ায়। গালে লে একটা একটা। দাঁতনকাঠি গোঁজা।রজগোপাল একটু। হতে বলেন তীরে।কোকা নিঃশব্দে একটু আঁজেন। বলল রাতে একদম ঘুম হ হল ন্য। তাই উঠে সভায় একটু বসে আছি।রজগোপত্রে পশ্চম ছেড়ে লণ্ঠন হাতে জলের কাছে নামলেন। জল হিম হয়ে আছে। ঢবাক করে বড় মাছ ঘাঁই নেয়। রজগোপাল কানে গোঁজা দাঁতনটা ধুয়ে নিয়ে বলেন-কাঁচা বয়সে ঘুম আসবে না কেন। সারাদিন দ্যিপানা করে বেড়াস, ঢলে ঘুমনোর কথা।-মাগাটা গরম লাগে।-কেন রোমেঘুমুড়ো কাঁৎ করে মরে গেল, পুলিশ ডাক খোঁজ করতে লেগেছে। আবার না পেরুতে লাগে।ছেলেটা যে খুব স্বাভাবিক নেই, তা শ্রজগোপাল বাতাস শুকে বুঝতে পারলেন। অসম্ভব নয় যে ছোকরা সারা রাত ঘরে ছিল না। শোক হয় ভোর ভোর শুঁড়িখানা থেকে ফিরেছে।
পৃষ্ঠা:১৬২
তবে একেবারে কেহেড নয়।ব্রজগোপাল বললেন-বৃত্তান্তটা বই, কিছু খবর পেয়েছিস?-কে জানে। তবে বাবা কাল রাতে ডেকে বলল, তুই পালিয়ে যা।বহেক বলেছে? প্রজগোপাল অকক হন।হ্যাঁ। তাই ভাবছি, পালাব কোথায়।-পালাবি কেন। পালালে আরও লোকের সন্দেহ বাড়ে।-পালান পালিয়েছে, আরও সব গা ঢাকা দিয়ে আছে। আমার ওরকম ভাল লাগে না। এই তো অ্যাদ্দিন মেয়াদ বেটে এলাম। ঘরের ভাক পেটে পড়তে না পড়তেই আবার সবাই হুড়ো দিতে লেগেছে। বেড়াল কুকুর হয়ে গেলাম নাকি।ব্রজগোপাল সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিতে পারেন না। তাঁর ছোট ছেলেটারও এই বয়স। এই বয়সে অভিজ্ঞতার বা বোধবুদ্দির পাকা রং লাগে না। দাঁতনটার তিতকুটে খাদ মুখে ছড়িয়ে যেতে থাকে। একটু ভেবে প্রজগোপাল বলেন পুলিশের পাকা খাতায় নাম উঠিয়ে ফেললি। এখন তো একটু ভয়ে ভয়ে থাকতে হবেই।কোকা একটু অভিমানভরে বলে-বা করেছি তার তো সাজা হয়েই গেল। লাগি গুঁতো কিছু কম দিয়েছে নাকি। আমার বড়সড় শরীলটা দেখে ওদের আরও যেন মারধরের রোখ চাপত। তার ওপর বেগার দিয়ে তো পাপের শোব করেছি। কিন্তু তবু এখন এলাকায় কিছু জলমন্দ হলেই যদি পুলিশ পেছুতে লাগে তো বড় অক্কাটের কথা।ব্রজগোপাল মাথা নাড়লেন। বুঝেছেন। একটু তেতো হাসি হাসলেন, বললেন-পাপের শোধ কি মেয়াদ খেটে হয়। কত চোর-জোচ্চোর-খুনে জেল খাটছে, তারা সব জেলখানায় থেকে ভাল হয়ে যাচ্ছে নাকি। লাথি গুঁতো দেয়, আটকে রাখে, আর ভাবে যে খুব সাজ। হচ্ছে। মানুষ ওতে আরও ক্ষ্যাপাটে হয়ে যায়। কর্তারা সব সাজা দিয়ে খালাস, মানুষ শোকানোর দায় নেবে কে? নিজেকে নিয়েই ভেবে দ্যাখ, জেলখানায় তোর কোনও শিক্ষা হয়েছে। শোধরানোর চেষ্টা করেছে তোকে?মাথাটা নেডে গুম হয়ে থাকে কোকা। বোধ হয় জেলখানার স্মৃতি মনে আসে। মুখটায় একটু কঠিন ভাব ফোটে। বলে-তো প্রাশ্চিত্তির হয় কীসে? আর কী করা লাগাবে? ব্রজগোপাল বলেন—প্রায়শ্চিত্ত হলটিতে গমন। অত শক্ত কথা তুই বুঝবি না।কেকের প্রজগোপালের দিকে চেরে দাঁতনটা অন্যমনস্কভাবে চিবোয়। তারপর হঠাৎ বলে আমি সেই ছেলেহার গায়ে হাত না। দিনেও কিন্তু পুলিশ ওকে পেলে মেরে দিত।কাজটা গোপালুপুলিশ যে আইনসঙ্গত খুনি, এ সত্য কে না জানে বললেন তোর সে সব কথায় দরকার কী? তুই নিজের কথা মনে রাখলেই হল। একটা পাতক করে ফেলেছিস, এখন হাত শুয়ে ফ্যাল। আর কখনও ওসব দিকে মন দিস না। বেঁচে থাকাটা সকলেরই দরকার।দিগম্বরের খোল তার বোল পালটেছে। বুড়ো হাতে খোলের চামড়ায় এক ‘অলৌকিক ডেকে আনছে সে। কধ্বনি ওঠে, প্রতিধ্বনি হয়ে ফেরে, যতদূর যায় ততদূর বধির করে নেয় সব কিছুকে। কথার মাওখানে রজগোপাল উৎকর্ণ হয়ে শোনেন। তাঁর আজাচক্রের জপ, তাঁর গোপন বীজকধ্বনি যেন ওই শব্দের তালেতালে ধ্বনিত হয়।কোকা বলে বামুনজারা।
পৃষ্ঠা:১৬৩
ক্ষয়ক্ষান্ত ব্রজগোপাল একটা ‘ই’ দেন কেবল।আপনাকে একটা কথা করে জাগি-কী কথা।-আমি যদি এখান থেকে না পালাই তো বাবা ফের আমাকে ধরিয়ে দেবে।প্রজগোপাল কথাটা বুঝাতে পারলেন না। বললেন-কোখায় ধরিয়ে দেবে-পুলিশে।কোকা মুখখানা এমনধারা করল যেন কাউকে ভাঙাচ্ছে। বলল-বাবাই তো ধরিয়ে দিয়েছিল সেবার, যখন খুনটা হয়ে গেল হাত দিয়ে বলে কোক্য তার দুগ্ধনা অপরাধী হাত চাদরের তলা থেকে বের করে সামনে বাড়িয়ে দেখাল।-বহের ধরাবে কেন? তোর ঘত বিদঘুটে কথা।-তবে আর ক’লাম কী? খুনটা হয়ে যেতে মাথাটা গোলমাল হয়ে গেল। সে রাতে স্বরও এসেছিল খুব। বিকারের অবস্থা। চারদিকের কিছু গ্রহর পাচ্ছিলাম না। যেন ভূতে বরেছে। ভোর হতে বাবা ঠেলে তুলে দিল, একটা কম্বল চাপা দিয়ে বলল-ঢল। তখন কিছু বুঝতে পারছিলাম না। ভাবলাম, বাবা লাঠেল লোক আছে, ঠিক বাঁচিয়ে দেবে। কেবল ‘বাবা বাবা’ করছি। বাবা যেমন ভগবান। বাবা আর বড় বোনাই সঙ্গে নিয়ে সৌশনে খেল গাড়িতে তুলে দেবে। স্টেশনঘর থেকে দূরে গাছতলায় কেক্ষের ওপর বসিয়ে রেখে দিল, গাড়ির তখন দেরি আছে। বড়বোনাই আমার হাতখানা ধরে রেখে ঠাকুর দেবতার নাম করছে, বাবা গেল গাড়ির খোঁজখবর করতে কি টিকিট কাটতে কে জানে। স্টেশন একদম হা-হা শূন্য, জনমানুষ নেই। আমি কম্বলমুন্ডি নিয়ে বসে ভয়ে ভরে আর জ্বরের ঘোরে কাঁপছি। সময়ের জন ছিল না। কতক্ষণ পরে হঠাৎ আঁধার ফুঁড়ে দুটো পুলিশ এসে সামনে বাড়িয়ে গেল। বড়বোনাই তখন প্রিরমি যায় আর বি। আমিও কোনও কথা মনে করতে পারি না। পুলিশ নাম জিজ্ঞেস করল, নিজের নামটা পর্যন্ত তখন মনে আনতে পারছি না।হেজ কোথায় ছিল।কোকা তাচ্ছিল্যের ঠেটি উলটে বলে-কে জানে। কিন্তু পুলিশের একটু পরেই বলা হাজির হয়ে গেল। কী কথাবার্তা বলল পুলিশের সঙ্গে কিছু বুঝতে পারলাম না। আমাকে হরে নিয়ে গেল। পার বড়বোনাই আমাকে ইশারায় বলেছে, পুলিশ বাকাই ডাকিয়েছিল। ওই রাতে স্টেশনে আমি কে, বা কী কুভায় তা পুলিশ টের পায় কী করে। তখন অবশ্য কিছু টের পাইনি। পুলিশ যখন টেল টেনে নিচ্ছে তব্দও বাবাকে চেচয়ে ডাকিয়ে ঢাকাডাকি করছিলাম- ওবাবা, বাধা গেএজগোপাই ঐতিনটা ফেলে দিলেন। বুকের মধ্যে একটা ভাব খামচে ধরে। চিরকালের একটা বাপের বাস বুকের মধ্যে। সেখানে একটা কাঁথি পট করে বিষে যায়।মুখে রজগোপাল বললেন তখন কি আর তোর হুঁশ ছিল। জ্বরের ঘোরে, আর ভয়ে ভরে কী দেখতে কী দেখেছিস, ভুলভাল ভেবেছিস। কালীপদ কি আর মানুষের মতো মানুষনাকি। আবোলতাবোন বুঝিয়েছে।কোকার মুখে হাসি নেই। গম্ভীর মুখেই সে বলে–বাবা আমাকে দু-চোথে বিষ দেখে।পাখিরা এ-ওকে ডাকে। ক্রমে বড় গোলমাল বাধিয়ে তোলে চারদিকে। পূবের আকাশে ফ্যাকাশে বা লাগে। চারদিকে মানুষের, পাখির, জসুজানোয়ারের জেগে ওঠার শব্দ হয়।
পৃষ্ঠা:১৬৪
আর তখন বিখদরের খোল মিহি শব্দের গুঁড়ো ছড়ায়।রক্তগোপাল জলের কাছে উবু হয়ে গড় ভরতে থাকেন। জলভরার গুর গুর শব্দ হতে থাকে। পিছনে পৈঠায় কোকা দাড়িয়ে থাকে পাহাড়ের মতো নিশ্চল। কানে পৈতে জড়িয়ে প্রজগোপাল ঘাট ছেড়ে উঠে আসেন। একবার তাকান কোকার দিকে।কোতা হারিকেনটা তুলে কল ঘুরিয়ে নিবিয়ে দিয়ে বলে-আপনি মাঠের দিকে যান, আমি হারিকেন ঘরে রেখে আসছি।ব্রজগোপাল বললেন-মনটাই মানুষের শত্রু। কাজকর্ম নিয়ে লেগে থাকবি মনটা বেশ থাকবে।ব্রজগোপাল মাঠের দিকে হটতে থাকেন। কোকা সঙ্গে সঙ্গে আসতে আসতে বলে- খুনখারাপি বাবাও কিছু কম করেনি। তবে আমাকে ভয় পায় কেন?-ওসব তোর মাথাগরমের কথা।কোকা একটু চুপ করে থেকে হঠাৎ একটু হতাশার সুরে বলে বামুনজ্যাঠা, আমাকে কিন্তু মন্ত্রতন্ত্র দেন।বেন?-কিছু নিয়ে লেগে পড়ে থাকি। বলে কোকা হাসে।তখন আবার হঠাৎ ভুরভুরে মদের গন্ধ আসে ওর শ্বাস থেকে। ছেলেটা স্বাভাবিক নেই। ব্রজগোপাল শ্বাস ফেলে বললেন-মনকে যা ত্রাণ করে তাই মন্ত্র। কিছু তোরা কি ত্রাণ পেতে চাস?তাতিটা তাঁতিঘরে বসে সারাদিন শানা মাকু নিয়ে ফুটব্যাট করছে। সুতো ছিঁড়ে রাস করেছে। পেটের গৌদলটা এখনও টোপো হয়ে ফুলে ওঠেনি বটে, তবে বহেরুর ভাতের গুণে শরীর সেরেছে একটু। দেতো মুখে একটু অপ্রতিভ হাসি। বহেরু তাঁতঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বাঘের মতো গুরু শুধু চোখে কাওটা চেয়ে দেখে। বাঘের মতোই হাঁক ছাড়ে মাঝেমাঝে-হচ্ছে তো তাঁতির পো?তাঁতি তার দশ আঙুলে ছেঁড়া সুত্যে গোলা পাকাতে পাকাতে বলে-হয়ে যাবে।দুশো সুতোর কাপড় শুনে সরাই হাসে। বহের হাল ছাড়ে না। লেগে থাকে। এখনও চন্দ্র সূর্য ওঠে, সংসারের আনঠে-কানাচে ভগবান বাতাস ভর করে ঘুরে বেড়ান, মানুষ তাই এখনও পূরোর অপবার্থ বিয়েকরাজ হয়ে যায়নি। লোকটা যদি দুশো সুতোর কাপড় খুনে দেখাতে পারে তবে বৃষ্টহকর এই বিশ্বাসটা পাকা হয়। তাঁতির এলেমে আর কেউ বিশ্বাস করেনা. বহেরু করো ভাই সে মাঝে মাঝে বিড় বিড় করে বলে-পারবে, ভীতিটা পারবে। আজকাল প্রায় সারাদিনই বহেরু নানা কথা বিড় বিড় করে বকে। চে-ঠেছে লম্বা সাঁওতালটা কদিন পড়ে পড়ে ধুকছে।অতখানি লম্বা বলেই তাকে আদর করে ঠাঁই দিয়েছিল বহেক, দেখার মতো জিনিস। কিন্তু বক্স-রোগা লোকটা তার শরীরের ভার আর বইতে পারে না। লক্ষণ ভাল নব। মেঘু ডাক্তার ওষুধপত্র দিয়েছিল, কাজ হয়নি। লোকটা বোরের মধ্যে পড়ে আছে, খেতে চায় না, ওঠে না, হাঁটে না। চিড়িয়াখানার বার যেয়ে একখানা ঘর তুলে দিয়েছিল বহেক। মস্ত লম্বা ময়ান করে দিয়েছে। সেইখানে শুয়ে আছে লোকটা। দরজায় দাড়িয়ে বহেক তাকে দেখে। বুঝতে পারে লোকটার কাল হয়ে এল। শরীরের লম্বা
পৃষ্ঠা:১৬৫
কটামোখানা কালের মতো দেখাচ্ছে। ক্রোয়াল আর খুলির হাড় চামড়া ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে ক্রমে। এত বড় শরীরটা কোনও কাজে লাগাতে পারল না হতভাগা। প্রায় ভাগাড় থেকেই লোকটাকে টেনে এনেছিল সে। নলহাটি স্টেশনে কিনা টিকিটে গাড়িতে উঠে পড়েছিল। পেটে খাবার নেই, গাড়ির কামরায় পড়ে ঝুঁকছিল। সেই অবস্থার বর্ধমানে তাকে রেলের বাবুরা ঢেলে দিয়ে যায়। বহেরু সেখান থেকে নিয়ে আসে। তিন মাসও টিকল না। বহের একটা খাস ফেলে। কী একটু বিড় বিড় করে। তার চিড়িয়াখানার বাঁদরটা চুপ করে বসে ঠিক মনি্যির মতো পেট চুলকোয়। বহেরুকে দেখে একটা কৃক ছেড়ে ঝাঁপ খেয়ে আসে। দরজাটা তরে নিয়ে বাঁধা। বহেরু তার খুলে বাঁদরটাকে কাঁধে নেয়। মানুষজন আর জীবজন্তুর প্রতি ইদানীং একটা মায়া এসে যাচ্ছে। বাঁদরটা বহেরনা মাখা দু-হাতে ধরে কাঁধে ঠ্যাং বুলিয়ে শিশুর মতো বসে থাকে। মাঝে মাঝে নিজের থেকেই বাঁধ বদল করে অন্য কাঁষে চলে যানা। ভারী একটা আদুরে ভাব। বহেক বাঁদরটাকে খানিক আদর করে। গালে গাল ঘষে দেয়। একটা চিমসে গন্ধ হয়েছে গায়ে। বহেরু বাঁদরটার লোম উলটে পোকাটোকাখুঁজে দেখল গায়ে। নেই। চোখ পিট পিট করে জানোয়ারটা আদর খায়। মুখখানা উল্লুকেরমতো হলে কী হয়, কোথায় যেন একটু বাদুরে হাসি লুকিয়ে আছে, ভ্যান্ডানো মুখে। ‘খচ্চর’বলে গাল দেয় বহেরু। জাড়ের সময় প্রায় শেষ হয়ে এল। উত্তরে কইটাকোপের জঙ্গলে একটিও পাতা নেই। গাছের কঙ্কাল কাঁটা আর ডালপালা মেলে সুড়ঙ্গে হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকটায় শ্মশান দেবে বলে ঠিক করে রেখেছে, তাই চাষ দেয়নি। সাপখোপ আর শেয়ালের আড্ডা হয়ে আছে। বহেরগাঁয়ে এ পর্যন্ত মরেনি কেউ। তাই শ্মশানটা কাজে লাগেনি। কাকে দিয়ে বউনি হবে তা বহেরু ভেবে পায়নি। আজ একবার উদাস চোখে চেয়ে দেখল অঙ্গলটার দিকে। স্টওতাল লোকটা আর কদিনের মধ্যেই যাবোসন্ধের মুখে পশ্চিম দিকের অকোশে এক পৌঁচড়া সাদাটে কুয়াসা আলোটাকে ভন্ডুল করে দিয়েছে। দুনিয়াটা কেমন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। শুকনো মাঠঘাট থেকে একটা ধুলোটে হাওয়া উঠে চারপাশের রং মেরে দিল। আর সেই ফ্যাকাশে আলোয় কাঁটাঝোপের মধ্যিখানে একটা মেয়েছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বহেক। প্রথমে ভাবল কাঠকুটো কুড়োতে এসেছে কেউ। কত আসে। পরমুহূর্তেই কুঝতে পারে, মস্ত চুলের রাশি এলো করে দাঁড়িয়ে আছে কে এক এলোকেশী। পশ্চিয় দিকে মুখ ফেরানো। কয়েক কদম এগিয়ে বহেড় ভারী চমকে যায়। মেয়েছেলেটা লুইটো। বুক পর্যন্ত গাছপালায় আড়াল থাকায় এতক্ষণ ঠাহরহয়নি। অচেনা মানুষ নয় স্ক্য হলে কুকুরগুলো খ্যাঁকাত।-কোন শাদি যুক্ত? বলে দাঁত কড়মড় করে বহেরু। বাঁদরটাকে নিঃশব্দে ছেড়ে দিয়ে গায়ের চাদরটির কোমরে পৌঁচিয়ে নেয় সে। সত্তর বছরের ঋজু শরীরটায় রাখ মেন যৌবনকাল এনে দেয়। মড় মড়াৎ করে আগাস্থ্য ভেঙে বহেক ক্রোটেপটে এগোয়। একটা হাতের খাবা চুলের মুঠিটা ধরার জন্য উদ্যত হয়ে আছে।সাড়া পেয়ে মেয়েটা হেলা ভরে ফিরে তাকায়। আর তৎক্ষণাৎ ভেড়া হয়ে যায় বহেরু। এ যে তার মেয়ে, নয়নতারা!ঘোলাটে দু-খান্য চক্ষু। তাতে আজি আজি সোনানি আভা। কপালে মস্ত তেল-সিঁদুরের টিপ। মোটা দু-খানা ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। মানুষখেকো পেতনির মতো খোনাসুরে বলল-খবর্দার, বইছে আসবি না। আমি বাঁমুন জানিস।
পৃষ্ঠা:১৬৬
বহেরু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখে। ওপরে খোলা ময়লা একটা আকাশ, চারধারে কুয়াশার আস্তরণ পড়ে যাচ্ছে। আলো, রংমরা এক বিটকেল বেলা। কাঁটাঝোপের ফাঁকে আঁকাবাঁকা অন্ধকার। নয়নতারা ফিন-জগতের জিনপরির মতো দাঁড়িয়ে।বহেরু জিজ্ঞেস করে-কে তুই? নয়নতারা?-নয়নতারাকে খাঁব। আমি মেঘু ডাক্তার।বাগে মাথাটা হঠাৎ বাজপড়া তালগাছের ডগার মতো জ্বলে ওঠে। দুই লাফ দিয়ে এগিয়ে যায় এহেক হারামজাদি, দুই চটকানে তোর ভূত যদি না ভাগাই তো…-খবদর। বলে একটা বুকফাটা চিৎকার দেয় নয়নতারা। তারপর হঠাৎ উর্ধ্বশ্বাদে ছুটতে থাকে। যম নখের মতো কাঁটা ওঁত পেতে আছে চারধারে। কাঁটায় যেমন কাপড়। ফেঁসে যায় ফ্যাঁস করে, তেমন ছিড়ে ফেঁসে যাচ্ছে গায়ের চামড়া। বুক ছিড়ে হাপর হাপর স্বাদ। নয়নতারা তবু লঘু পায়ে দৌড়োর, চেঁচিয়ে বলে-ধরবি তো মেয়েটাকে শেষ করে ফেলব।বহেরু কাটিনগাছ চেনে। তার গায়ে পিরান, কোমরে চাদর, পরেনে ধুতি। কাঁটায় কাঁটায় সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যেতে থাকে। কাঁটা খিমচে নিচ্ছে চামড়া, মাংস। বহেরু দৃকপাত করে না। দাঁতের ভিতর দিয়ে কেবল একটা রণি সাপের শিসানীর শব্দ তুলে সে এগোয়।মাঝখানে কয়েকটা বুড়ো খেজুর গাছ। তার চারপাশে একটু খোলা জমি। ভাঙা ইট, পাথর আর সাপের গেলদ পড়ে আছে। একটা মজা ডোজ, তার গায়ে শেয়ালের গর্ত। মেঠো ছুঁচো কয়েকটা বৌড়ে গেল। আয়গাটা গহীন, বাইরের কিছু নজরে আসে না। নয়নতারা সেখানে পৌঁছে গেল প্রথমে।বহেরু গাছগাছালি ভেঙে সেখানটায় পা দিতে না দিতেই নয়নতারা আধখানা ইট তুলে। ছুঁড়ে মারে যহেরুরদিকে। চেঁচিয়ে বলে-তোঁকে নির্বংশ করব হারামজাদা।ইট লাগে না। কিন্তু তেকে উড়ে বেরিয়ে যায়। নয়নতারার গায়ে আলাদা শক্তি ভর করেছে। বহেক খমকে ঠাকুর-দেবতার নাম নেয়। তারপরই বেডালের মতো পায়ে কোলকুজো হয়ে, তীব্র চোখে চেয়ে এক্ষেতে থাকে।-গু খা, ও থা, ও খা, মড়া না, মন্তা না চিৎকার করতে থাকে নয়নতারা। দু-হাতে মাটি সামচে তুলে বুকে মাখে, থুথু ছিটেছে চারদিকে-হারামজাদি বন্ডী কাটছে। এই বলে বহেরু একখানা ইট তুলে নেয়। বিশাল হাতে আন্ত ইটটা উঁচু করে কি হর করে।
। ছাব্বীশ1
নয়নতারা চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে। শেষ বেলার রক্ত-আলো কুয়াশা আর মেঘ ছিঁড়ে তিরের মতো এসে বিধেছে ওর মুখে। দুটো পদ্মপাপড়ির মতো চোখ এখন কলসাচ্ছে। টাঙ্গির ফলার মতো। ন্যায়টা, ভয়ংকরী চামুন্ডা এলোচুল কালসাপের মতো দশ্য তুলে আছে ওর পিছনে।নয়নতার রক্তমাখা খুধু ছিটোয়। বলে-থুঃ খৃঃ…মর, মর সব মরে যা… ইট দন্ন ডানহাতখানা তুলে ধরে তাকিয়ে আছে বহেরু। মারবে। কিন্তু সে নিজেই টের
পৃষ্ঠা:১৬৭
পায়, তবে ভিতরে আগুনটা সেঁতিয়ে গেছে। সামনে ওই ন্যাওটা উদোম যুবর্তী, তার তেল্লি মেয়েটা ও ফেনা-বা বহেরুর কেউ নয়। দুনিয়াত্তর মানুষের পাপ বেনো বর্ষায় জলের মতো কুল ছাগিয়ে উঠেছে। এই কালসন্ধ্যায় বহেরুর মেয়ের শরীরে নেমে এসেছে কলকি-অবতার। নাকি মেথু। ঠিক বুঝতে পারে না বহেরু। তবে তার শরীর কেটে ইঁদুরেরমতো একটা ভয় ভিতরে ঢুকে গেছে ইদানীং। সেই ভয়ের ইদুরটা নড়াচড়া করে ভিতরে। নয়নতারা মুঠো করে ধুলো তুলে চারদিকে ছিটিয়ে দিতে থাকে। বলে-পূঃ, দুম…সব অন্ধকার হয়ে যা, সব শ্মশান হয়ে যা…অযাক ভাবটা আর নেই। তার বদলে শরীরে একটা ঘরগরানি উঠে আসে বহেরুর। শীতটা জোর লাগে। সে একবার তার বাছা গলায় ঢাক ছাড়ে-তারা। ভাল হবে না বলে দিচ্ছি।শুনে খলবল করে হেসে ওঠে নয়নতারা, বলে-শশ্মশান হয়ে যাবে, বুঝলি? সব বসে যাবে মাটির নীচে। প্রক্তবৃষ্টি হবে।ফ্যাকাশে বেলাটা যাই-বাই করেও দাঁড়িয়ে আছে। চারধারে পাতাঝরা গাছের কঙ্কাল দুর্ভিক্ষের মানুষের মতো রোগা হাত-পা ছড়িয়ে ঘিরে আছে। রং নেই, সৌন্দর্য নেই। একটাদাঁড়কাক ডাকছে খা-খা করে।বহেরু চোখের জল মুছে নিল। জীবনে তার চোখ বেয়ে জল নেমেছে বলে মনে পড়ে না। এই বোধ হয় প্রথম। পাথর থেকে জল বেরিয়ে একা। চারধারে বড় অলক্ষণ। বহেরু ধা গলায় ডাকল-মা। মাগো!নয়নতারা আকাশের দিকে দু হাত তুলে কাকে যেন ডাকতে থাকে-আয়! আয়!শরীর শিউরে ওঠে বহের। কোন পিশাচ, ভূতপ্রেত, কোন ভবিতব্যকে ডাকে মেয়েটা।নাকি মরণ ডাকছে প্রাণভরে।বহেরু আর ডাবল না। ইটটা তুলল ফেনা। তার প্রকাণ্ড হাত, হাতে অসুরের জোর। দু-পা এগিয়ে ‘মা’ বলে একটা হাঁফ ছেড়ে ইট-টা সই করে দিল সে।লাগল বাঁ ধারে স্তনের ওপরে। পাখি যেমন জোরালো গুতুল খেয়ে গুচুলের গতির সঙ্গে ছিটকে যায়, তেমনি নয়নতারাকে নিয়ে ফ্রুটটা ছিটকে গেল। ব্যথা বেদনার কোনও চিৎকার দিল না নয়নতারা। কেবল মাটিতে, ওড়ে। তার হাত পায়ের ঘাটানিতে ধুলোদূরে দাঁড়িকে রাতটাক হাব্যর্ক হয়ে বহেরু দৃশ্যটা দেখতে থাকে। ফাঁকা জায়গা দিয়ে একটা হলদে শেয়াল দেখতে গেল চোর-পায়ে। পিছনের শিমুল গাছে একটা বড় পাখি নামল স্তূপ করে। কিছুক্ষণ নীড়েচড়ে নয়নতারা স্থির হয়ে পড়ে থাকে। চারধারে বেঁটে হেঁটে আগাছা,ন্যাড়া জমি। এইখানে শান্তিবামের ভিটে ছিল একসময়। বংশটা মরে হেজে গেছে। জমিটার দক্ষিন অংশটা বহুকাল দখল করে আছে বহেরু। বাকিটা পড়ে আছে, দাবিদার নেই। সন্ধ্যা মুলিয়ে উঠছে চারধারে। প্রেতহায়া ঘনিয়ে আসে। কঙ্কালসার গাছের ফাঁকে ফাঁকে উকি দিচ্ছে শেয়ালের চোখ। মগন্ডাল থেকে নজর দিচ্ছে বড় কালো পাখি। শাড়িরামের পোড়ো ভিটেঅশরীরীরা হাওয়া বাতাসে ফিসফাস করে। বহেরু নয়নতারার ওপর ঝুঁকে পড়ে দেখে, মেয়েটা গলাটানা দিয়ে পড়ে আছে। গোরুর ঝিমুনিরোগ হলে এরকম পড়ে থাকে। শিবনের, মুখে গ্যাঁজলা। খাস বইছে, তবে
পৃষ্ঠা:১৬৮
কাঁপা কাঁপা দীর্ঘশ্বাসের মতো, ফোঁপানির মতো, হিক্কার মতো। ডানবাত হয়ে আছে। কহেক তাকে আস্তে উলটে চিৎ করে শেয়াল। নিজের যুবতী মেয়ের নগ্ন শরীরটা এতক্ষণ মানুষের মতো চেয়ে দেখেনি কহেক। রাগে অন্ধ হয়েছিল। এইবার দৃশ্যটা দেখে লজ্জায় চোখ বুজে জিভ কাটল। কোমর থেকে চাদরটা খুলে ঢাকা দিল শরীর। কপাল থেকে চুল সরিয়ে দিল যত্নে। আগেই মেয়েটা পড়ে গিয়েছিল কোথাও, ঠোঁটটা কেটে ফুলে আছে। রক্ত গড়াচ্ছে। চোখের জল মুছে, মুখের লালা জড়ানো ঠোঁটে একবার অস্ফুট ডাবল মা। মাগো।তারপর পাঁজাকোলে শরীরটা তুলে নিল সে।চারধারে বড় অলক্ষণ দেখা যাচ্ছে আজকাল। কলির শেষ হয়ে এল নাকি।পরের দিন। মেথুর মড়া পুলিশ ছেকে দিয়েছে। তার শরীরে বিষক্রিয়া পাওয়া যায়নি, চোট একটু-আধটু যা ছিল তা আলের ওপর থেকে পড়ে গিয়েও হতে পারে। অতিরিক্ত কড়া মদেই কমজোরি কলজেটা গেছে। পেটে বিদঘুটে আলসার হিল। হার্টের রোগ ছিল, কিডনি ভাল ছিল না। সব মিলেমূলে গ্রহদোষে খণ্ডে গেছে। শুদ্ধ মুক্ত মেঘু কি এখন অন্তরীক্ষে তার বউয়ের পাশটিতে গিয়ে বসেছে। কলজেটা কি এবার ঠান্ডা হয়েছে তার। বউ মরার শোকেই না অমন পাগল হয়েছিল মেঘু! মরার পর ক্ষ্যাপা লোকটার সব শান্তি হয়েছে কি।ব্রজগোপাল মেযূর উঠোনের মধ্যেখানে দাঁড়িয়ে এসব তাকেন। পাশে কালীপদ উবু হয়ে বসে হাতের পাতার আড়াল দিয়ে বিড়ি টানছে। গাঁয়ের ছেলেরা গেছে মেথুর মড়া আনতে। যখন-তখন এসে পড়বে।বারান্দায় ঠেসান দিয়ে মেয়ূর বাস-বিধবা বোনটা বসে আছে। মৃত্যু সংবাদ পেয়ে পাড়া-প্রতিবেশীরা কিছু এসেছিল। আজ মড়া আসবে শুনে দু-চারজন এসেছে। একটা কুপি জ্বলছে দাউ দাউ করে, তার আগুনে দু একজন ভূতুড়ে চেহারার সাদাটে বিধবাকে দেখা বার। ছেলেপুলেরা কেউ তেমন কর্তটি নয় মেঘুর, সবচেয়ে ছোট ছেলেটার বরসই হবে সাত-আট বছর। বড় আজানের যন্থর বাক্সে বয়স। গোবিন্দপুরের হাটে তাকে যখে-যাওয়া ছেলেদের সঙ্গে বিড়ি যেতে রজগোপাল নিজের চোখে দেখেছেন। কাপড় জড়িয়ে সেই ছেলেদুটো এখন শীতে ঠকঠকিয়ে কাঁপুড়ে ছাঁচতলায় দাঁড়িয়ে। দুটি মেয়ে মেধুর। অভাব দুঃখ কষ্টের মধ্যেও তাদের বাড় বিজেকির। আট দশ বছরের মধ্যেই দু-জনের বয়স হবে। মাথায় বেশ লম্বা, শরীরও ক্লিছু খারাপ না। ঘরের মধ্যে মাদুরে শুয়ে দু-জন কাঁদছিল। একবার উঠে এসে উঠোটেরি বরজা দিয়ে বাস্তাব দিকে দেখে আসছে।সবচেয়ে বেখি গৌরকটা লেগেছে বাল-বিধবা বোনটারই। ছেলেমেয়েগুলোর বয়স কম, এ বয়সের হেই গভীর হয় না, জলের দাগের মতো, বিস্মৃতির ভাপ এসে মুছে দেয়। কিন্তু বোনটার আলো নিবে গেছে। পৃথিবীটা এখন বিশাল, দিকহারা, অনিশ্চয়। কদিন এত কেঁদেছে যে আর কাঁদার মতো দম নেই। চুপ করে বসে আছে। ব্রজগোপাল কুড়িটা টাকা দিয়েছিলেন হাতে। দুটো দশ টাকার নোট এখনও দুমড়ে পড়ে আছে পাশে। আঁচলে বাঁধায় কথাও খেয়াল হয়নি।একজন বিধবা দাওয়ায় একটা ছোট্ট মাদুরের আসন পেতে কাছে এসে কাল- ঠাকুরমশাই, আপনি বসুন গিয়ে।ব্রজগোপাল মাখা নাড়লেন। বসবেন না। বিধবাটি বলে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন। ওদের আসতে দেরি আছে।
পৃষ্ঠা:১৬৯
শোবের বাড়িতে একটা অদ্ভুত হবি্যির ঘি ঘি গন্ধ ছড়িয়ে থাকে। এটা বহুবার লক্ষ করেছেন রজগোপাল। আর বাতাসে একটা মৃদু সুক্ষ্ম জীবাণু সংক্রমণের মতো অশুচিতারমেদুর ছেলেরা পিসির পাশে গিয়ে বদল খানিক। বড়জনকে ব্রজগোপাল বলতে শুনলেন ও পিসি, শ্মশানে আমাকে দিয়ে কী করবে? বাবার মুখে আমি আগুন দিতে পারব না।পিসি উত্তর দেয় না। মেয়ে দুজন হুড়মুড় করে উঠে আসে বাইরে। অস্ফুট বামনাম করে। শ্মশ্বন আর বাবার কথা শুনে ভয় পেয়েছে। বেঁচে থাকতে মানুষ আপন, মরে গেলেই ভূতকে ভয়।ব্রজগোপাল জরিপ করে দেখেন। মেথু এই ছেলেপুলে, বিধবা বোন, দুটো তক্তপোষ, ভাড়া বাড়ি, গোটা দুই অকেজো আলমারি এইসবই রেখে গেছে। এই দুর্দিনে মেদু ভঙ্কা মেরে চলে গেল। গেছে খারাপ না। ভোগেনি, কাউকে ভোগায়নি। পড়েছে, আর মরেছে। কিন্তু এ দৃশ্চাটা মেদু যদি দেখত। দাউ দাউ কুপির আগুন আবছায়া ভার রক্তের সন্তান, তার শোকাতাপা কেনটন কেমন শীতবাতাসে, সামনের দীর্ঘ অভাবগ্রস্ত ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে ভয়ে-ভাবনায় মোয়া বেঁধে বসে আছে মানুষের পিন্ডের মতো। মেধুটার আকেল ছিল না। এতকটা প্রাণীকে সে কখনও গ্রাহ্য করেনি। ভালবাসার বউ মরে গিয়ে ভগবান ভবিতব্য সব কিছুর ওপর ক্ষেপে গিয়ে একান্ন পরিবার লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেল।অবশ্য মানুষ তার সন্তান-সন্ততির জন্য কীই বা রেগে যেতে পারে। ব্রজগোপাল তাঁর মামাবাড়ির কথা মনে করেন। দাদামশাই তাঁর এগারোট সন্তানের জন্য যথেষ্ট রেখে গিয়েছিলেন। ঢাকা শহরে বাড়ি, বঙ্গলক্ষ্মীর শেয়ার, আইচাকি, বগুড়ার লোনব্যাঙ্কে টাকা, নগদ আর সোনাদানায় আরও লাখ দেড় দুই; সে আমলের টাকার নামে এখনকার আরও বেশি। বড় দুই মামা কয়েক বছরের মধ্যেই পুরো সম্পত্তিটা ফুঁকে দিল। বাপ মরার পর তাদের বড়লোকি চালচলন বেড়ে গিয়েছিল হাজার গুণ। মেজোজন রেলের চাকরি ছেড়ে বাপের টাকায় ব্যাবসা দিল। ব্যাবসার করাটাই ছিল খুব, পিছনে না ছিল নিষ্ঠা, না পরিশ্রম। অন্য মামা মাসিরা তখন নাবালক। বড় হয়ে তারা দেখে, চারদিকে দুঃখের সংসার। সেই যে ভাইয়ে ভাইয়ে বথেরা লেগে গেল হার্টশেষজীবনতক মেটেনি।প্রজগোপাল ডাকেন, মানুঘু কী রেখে যেতে পারে সন্তানের জন্য? এমনকী আছে যা নষ্ট পায় না, ঠকবাজে ঠকিয়ে চীতে পারে না, যা স্থায়ী হয় এবং কর্মের মতো ঘিরে রক্ষা করে মানুষের সন্তানলেকালীপদ স্তুবিয়ে বিড়ি খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়ায়। একটু কেশে বলে-ঠাকুরমশাই, এখন মেলা কইবেন নাকি?প্রজগোপাল চিন্তিত মুখে বলেন-দেরি যখন হচ্ছে তখন আর কতক্ষণ দাঁড়াব। চল। এই বলে টর্চটা একটু জ্বালেন রজগোপাল। অন্ধকারের মাধ্যে চারপাশটা একটু দেখে নেন। পৃথিবীটা ঘোর অন্ধকার হয়ে আসছে ক্রমে। ছেলেপুলের কথা বঞ্চ মনে পড়ে। ছোট মেয়েটা বহুকাল দেখেন না। মেয়োনি বড় বাপভক্ত ছিল।এ সব কথা মনে হলে পৃথিবীটা অন্ধকার লাগে। উচব্যতিটা হেলে অন্ধকারটা তাড়ানোর চেষ্টা করেন প্রজগোপাল। কেশে নিয়ে কমফর্টারটা খুলে আবার গলায় জড়িয়ে নেন। মেদুর কেন উঠে আসে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে মুখনি ঘোমটায় আড়াল করে কী সেন বলে। ওর গলা
পৃষ্ঠা:১৭০
ভেঙে বসে গেছে, আওয়াজ হচ্ছে না। ব্রজগোপাল দু-পা এগিয়ে বলেন-কিছু বলছ মা?মেথুর বোন মাথা নেড়ে কষ্টে স্বর বের করে বলে-দাবা কড় পাপী ছিল। আপনাকে কেবল দেবতার মতো দেখত। শ্রাদ্ধটা আপনি করকেন।-শ্রদ্ধ। রত্নগোপাল অবাক হন। ইতস্তত করে বলেন, ওসব তো আমি করিই না মা। আচ্ছা, দেখব। শরীর গতিক যদি ভাল বুঝি তো…-দাদার খুব ইচ্ছে ছিল কোনও সৎ ব্রাহ্মণ যাতে শ্রাদ্ধ করে। বউদি সতীলক্ষ্মী ছিল। তার কাছে পৌঁছুতে হলে পুষ্টি লাগে। দাদা বড় পাপী ছিল।পাপী ছিল। ছিল বই কী। ঠাকুরের একটা কথা আছে, রক্ষা থেকে যা পাতিত করে তাই পাপ। জীবনধর্মের বিরুদ্ধে চলা যদি পাপ হয় তো মেঘু পাগী নিশ্চয়ই। সঠিক ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকাটা ধর্ম বলো ধর্ম, পূণ্য বলো পুণ্য। রজগোপাল এই শোকের বাড়িতে দাঁড়িয়েও মনে মনে হাসেন। সৎ বিলের হাতে কি চাবিকাঠি আছে যে এ-পাড় থেকে কল টিপে ওপাড়ের আত্মাদের একের সঙ্গে অন্যকে মিলিয়ে দেবে? একটু দীর্ঘশ্বাসও ফেলেন ব্রজগোপাল। মেঘুটা তার বউকে সত্যি ভালবাসত। সবাই চায়, মরার পর মেঘু তার বউয়েরসঙ্গে মিলেদুলে থাক।ব্রজগোপাল আর কালীপদ গোবিন্দপুর ছেড়ে বরাবর খামারবাড়ির দিকে হাঁটা দেওয়ার। পর মাঝ রাস্তার হরিবংনি কানে আসে। উলটোদিক থেকে হারিকেন আসছে। সামনে মাচানের ওপর মেঘুর শরীরাটা। ব্রজগোপাল বাস্তা ছেড়ে দাঁড়ান। চোখের সামনে নিয়ে ভাসতে ভাসতে মেধু চলে যায়। কালীপদ জোড়হাত কপালে ঠেকায়। হারিকেন কোকারহাতে। সে একটু পিছিয়ে দাঁড়িয়ে লন্ঠন তুলে বলে-বামুনজাাঠা।-আমি শ্মশানে যাচ্ছি।-বা।ভক্ত করে মদের গন্ধ ভেসে আসে। ব্রজগোপাল উদ্বিগ্ন বোধ করেন।আবার হাঁটতে হটিতে কালীপদ পিছন থেকে হঠাৎ বলে, ঠাকুরমশাই, মেঘু ডাক্তারেগতিমুক্তি হল না তা হলে।-কেন?এই যে নয়নতারার ওপর জয় করল। সবাই কণাবলি করছে।রজগোপান বিরক্ত দণ্ড উত্তর দেন না। কালীপদটা কিছু বোজ। কেকা না হলে কেউ ঘরজামাই থাকো কামাই হয়েও বহেরুর বন্ধু জোক, একসঙ্গে বসে গাঁজাটাজা খয়। এখানেই গেছে পিছে।কালীপদ আবার বলে চুরির দায়টা ঘাড়ে নিয়েগেলে, তার ওপর অপঘাত।প্রজগোপাল একটা গম্ভীর ‘ছ’ দিয়ে হাঁটতে থাকেন।কালীপদ কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে। তারপর হঠাৎ গুণ গুণ করে গান ধরে-কে হে বট, বাঁশের দোলাতে চইড়ে যাইচ্ছ চইলে খুশান ঘাটে। তোমার পোটলপোটলি রইল পইয়ে, জুড়ি গাড়ি কে হকিাবেতুলসী গঙ্গাজলের ছিটে গায়ে দিয়ে ব্রজগোপাল ঘরে এসে ল্যাম্পটা স্থালেন। জামাকাপড় ছেড়ে শুয়ে পড়বেন। রাতে খই আর দুধ খান, আজ সেটাও যেতে ইচ্ছে করছে।
পৃষ্ঠা:১৭১
না। বাচ্চাকাচ্চা কাউকে ডেকে দুধটা দিয়ে দেবেন বলে উঠতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় আঁধার ফুঁড়ে বহেরু এসে দরজায় দাঁড়াল। উদ্ভ্রান্ত চেহারা। বলল-কর্তা।বহেরু মেঝের ওপর বসে মুখ তুলে বলে-কলিকাদের কি শেষ হয়ে আসছে? ব্রহ্মগোপাল বহেরুর দিকে চিন্তিতভাবে চেয়ে থাকেন। বহেরু বলে-যদি রক্তবৃষ্টি হয়। যদি পৃথিবী ভেবে যায় মাটির ভিতরে।
। সাতাশ।
অবশেষে একদিন দুপুরে কড়া নড়ে উঠল।বাঁশা ভিতরের ঘরে এ সময়টায় দরজা বন্ধ করে ঘুমোয়। ননীবালা খুটুর-খাটুর করে কাজকর্ম করেন। একটু শুয়ে চোখ বুজবেন তার উপায় নেই, ঝিম হয়ে পড়ে থাকলেই নানা অঘটনের চিন্তা আসে মাগায়। ঘুম বদি কাসে তো সেই সঙ্গে দুঃস্বপ্ন দেখা দেয়।কদিন হল শরীরটা ভাল না। মাঝে মাঝে মাথাটা পাক দেয়। প্রেসারটা বেড়েছে বোব হয়। পাড়ার চেনা ডাওণকের করছে সময়মতো গেলেই প্রেসার দেখে দেয়। অলিস্যিতে যাওয়া হয় না, এ বয়সে ভালমন্দ যদি কিছু হয়ে যায় তো হোক। তাতে তাঁর আক্ষেপ নেই। বেঁচে থাকা একরকমের শেষ হয়েছে। দেখতে না দেখতেই একটা জীবন কেমন শেষ হয়ে গেল। তেমন করে বিছু বুঝতেই পারলেন না ননীবাল্ড। এই তো সেদিনও শিশুটি ছিলেন, বগুড়ায় রেলস্টেশনের ধারে তাঁদের পাড়ার বাস্তায় ঘাটে খেলে বেড়িয়েছেন, ধারে-কাছের কথা তেমন মনে পড়ে না, কিন্তু শিশু বয়সের কথা মনে পড়ে ঠিকই। স্পাই, যেন বায়স্কোপের ছবি। বিন্দি, কাতু, শৈলী-সব মিলেমিশে সে এক শরিয় রাজ্য। বৃষ্টি পড়ত, শীতের কুয়াশা ঘিরে থাকত, রোদ উঠত-সবই কেমন অদ্ভুত গন্ধনাযা, নতুন বুক-কেমন-করা। সে আমলে মেয়েদের লেখাপড়ার চাপ ছিল না। কেবল সারাদিন শিশু ভাই বা বোন টানতে হত। সে তেমন খারাপ লাগত না। নাজিরের কটূচিস্তায় ঘুষা করে বসিয়ে রেখে চুলে আলগা হাতে বড় খোঁপা বেঁধে এক্কা-দোকার কোর্টে অপিয়ে পড়া তারপর কিছু মনে থাকত না। ঘামে ভিজে যেত অঙ্গ, গারে ধুলোবালি নেঙ্গিত, নাকের পাটা ফুলে ফুলে উঠত দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাসে, তবু খেলার কী যে নেশা ছিলা জনদিন দেড় বছরের বোকা ভাইটা বারান্দা থেকে গড়িয়ে পড়ে কপাল কাটাল, মা মেরেছিল খুব চিরুনি দিয়ে। এখনও যেন কনুইয়ের হাড়ে ব্যথাটা চিনচিন করে। মনে হই, এই তো সেদিনের কথা সব। শৈলী নাকি বুড়ো হয়ে গেছে! হায়রে। কতটুকু ছিল শৈলী। ঢলঢলে চেহারা, ফরসা ঠোঁটদুটো একটু বোকাটে ভাবে ফাঁক হয়ে থাকত সব সময়ে, সামনের দাঁতে একটা ফাঁক ছিল মাঝখানটিতে। সাহেবি সব নাম ছিল ওদের। চার বোন ছিল মাইথনী, মেয়রা, পিকলি আর বিউটি, দুই ভাই ছিল শচীন আর বুয়া। শৈলীর ইস্কুলের নাম ছিল বিউটি। বিলিতি ফ্রক পরত, বিলিতি সাবান মাখত, বিলিতি বিস্কুট খেত, ওদের বাড়িতে আসত সব সাহেব মেম। জজের বাড়ি, না হবেই বা কেন। যে কোনও মেয়ের সঙ্গে শৈলীরা মিশত না। কেবল ননীবালার চুল দেখে ইস্কুলে সেধে ভাব করেছিল শৈলী। সেই ভার থেকে সই। এসব কি গতজন্মের কথা। নৌকোর মতো দেখতে ককরকে পালিশওয়ালা একটা ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে শৈলী আর পিকলি তাঁদের বাড়িতে এসে
পৃষ্ঠা:১৭২
কতবার একটা বেলাই কাটিয়ে গেছে হয়তো। আবার ননীবালাও গেছেন। ভারী চুপচাপ বাড়িটা ছিল গুদের, সে বাড়িতে কুকুর কুকুর। পর্যন্ত গম্ভীর।। । জজ নাকি হাসে না। তা হবে। শৈলীর বাবাকে কখনও হাসতে দেখেননি ননীবালা। কিন্তু সেই জজসাহেবও একবার ননীবালার খোলা চুল দেখে বলেছিলেন-বাঃ, এ তো অরণ্য। মনে আছে। সব স্পষ্ট মনে আছে, গলার স্বরটা পর্যন্ত কানে বাজে এখনও। সেই স্বপ্নের ছেলেবেলা থেকে এক হ্যাঁচকা টানে কোনও অচেনা, অকূল পাথারে রওনা হলেন একদিন। তখনও তাঁর শরীরটুকু ঘিরে শিশুদাই গন্ধ, ভাল করে ভাবতে শেখেননি, বুঝতে শেখেননি। খুলনা থেকে বর এল, টোপর পরে। সে কি ভয়াবহ হুলুধ্বনি, শঙ্খনাদ! বুকের ভিতরে ভূমিকম্প, ভেঙে পড়ছে পুতুলের ঘর, ফাটল ধরে গেল এক্কা-দোকায় কোর্টে, ছিঁড়ে গেল জন্মাবধি মা-বাপের ভাই-বোনের শক্ত বাঁধন। যেন রশি ছিড়ে স্টিমার পড়ল দরিয়ায়। অচেনা একদল লোক লুটেরার মতো ঘিরে নিয়ে চলল তাঁকে, আঁচল বাঁধা একটা অচেনা লোকের আঁচলে, কত কান্নাই কেঁদেছিলেন ননীবালা। সে কান্না যেন ফুরোবার নয়। হিকার মতো উঠতে লাগল অবশেষে। ব্রজগোপাল চোরের মতো অপরাধী চোখে চেয়ে দেখছিলেন তাঁকে গোপনে। অবশেষে ননীবালা ভারী অবাক হয়ে দেখেছিলেন, তাঁর অচেনা স্বামীটি উচুনির প্রান্ত দিয়ে লুকিয়ে চোখের জল মুহছে। সেই দেখে খানিকটা ধাতস্থ হয়েছিলেন। ননীবালা, যা হোক একেবারে পাষণ্ডের হাতে পড়েননি। মনটা নরম-সরম আছে। ফুলশয্যার রাতে কথাটা উঠতে ব্রজগোপাল প্রথমে স্বীকার করেননি, পরে অনেক ঝুলোবুলি করলে লাজুক মুখে বলেছিলেন—কী জানো, কারা দেখলে আমার কান্না পায়। কথাটা ঠিক নয়। ননীবালা জানেন, ব্রজগোপাল কান্না দেখে কাঁদেননি। নদীবালার জন্যই কেঁদেছিলেন। এসব কি বহুদিনের কথা।আজকাল বড় ভুল হয়ে যায়। নাতি-নাতনির নাম ঠিকঠাক মনে থাকে না। সোমেনকে শতবার রণো বলে ডাকেন, চাবির গোছা কোথায় রেখেছেন মনে থাকে না। তবু শিশুবেলার কথা কেন স্পষ্ট মনে থাকে।একেই কি বুড়োবয়েস বলে!আজকাল একা থাকলে এই বুড়োবয়সটাই জ্বালায়। তাই দুপুরে ঘুমান না বড় একটা। শরীর খারাপ থাকলে পড়ে থাকেন বৃটুেটু, কিন্তু বড় শাস্তি। ক্ষণে ক্ষণে উঠে জল খান, পান মুখে দেন, বেলা ঠাহর করেন জানাছটি দাঁড়িয়ে। ছেলেপুলেরা ইস্কুল থেকে ফেরে দুপুরে। বীণার কড়া নিয়ম, বেলায় হেঁটে বাচ্চারা ঘুমোবে, যাতে সন্ধেবেলায় পড়ার সময়ে কারও দুলুনি না পায়। সবাই বুর্ভেদ্য বলে নিঃকুম বাড়িটা ফাঁকা আর বড় হয়ে যায়।এমনি এক দুষ্টুকে কড়া নড়ল। কত কেউ আসতে পারে। ননীবালা ঝিমুনি ভেঙে উঠে বসতেই পেটে অম্বলের চাকা নড়ে উঠল। বুকটা ধড়াস ধড়াস করে।কে? বলে উঠে এলেন কষ্টে।বাইরে থেকে সাড়া এল-পিওন। রেজিস্ট্রি চিঠি আছে।ব্রজগোপালের টাকা এল বোধ হয়। বুকটা খামচে ওঠে হঠাৎ। আনন্দে না দুঃখে ঠিক বুঝতে পারেন নাতিনি। দরজা খুলে অল্পবয়সি পিওনকে বললেন-কার চিঠি?ব্রজগোপাল লাহিড়ি। –উনি তো নেই এখানে, দূরে থাকেন। আমি সই করে নিলে হবে? উনি আমার স্বামী।পিওন একটু ভাবে। তারপর একরকম অনিচ্ছের সঙ্গে বলে-নিন। উত্তেজনায় কলম খুঁজতে ঘরে ঢুকে খুঁজে পান না ননীবালা। ভীতকণ্ঠে বলেন দাঁড়াও
পৃষ্ঠা:১৭৩
বাবা, কলম উলম খুঁজে পাচ্ছি না, একটু দাঁড়াও।পিওন হেসে বলে-কলম নিন না, আমার কাছেই রয়েছে।পিওন ছেলেটব সই করার জায়গা দেখিয়ে দেয়, ননীবাল্য গোটা গোটা বাংলা হরফে দস্তগৎ করার চেষ্টা করেন। অক্ষরগুলো কেঁপে যাচ্ছে, জ্যাকড়া হয়ে যাচ্ছে। এই প্রথম একসঙ্গে অনেকগুলো উটকো এল হাতে। ব্রজগোপালের টাকা। বিশ্বাস হতে চায় না।পিওন ছেলেটা চিঠি দিয়ে ক্ষণকাল বোধ হয় বকশিশের অন্য অপেক্ষা করে। তারপর চলে যায়। ননীবালা দরজা বন্ধ করে নিজের ঘরে আসেন। শরীরটা বড় খারাপ করেছে আজ। বুকটা বশ মানছে না। বুকের ধুকধুকুনিটা যেন হঠাৎ একটু থেমে আবার হঠাৎ আছয়ে পড়ছে বুকের ভিতর।অনেক টাকা। অনেক। খামটা খুলে চেকটার দিকে চেয়ে থাকেন। টানা হাতের লেখাটা বুঝতে পারেন না। একটা খোপের মধ্যে সংখ্যাটা লেখা। দশ হাজারের চেয়ে অনেক বেশি। একটা বাড়ি উঠে যাবে না এতে? খুশি হবে না সবাই?বোধ হয় হবে। তবু বুকের ভিতরটা কী একরকম যেন লাগে। এতকাল এই টাকা ক’টার পথ চেয়ে বসেছিলেন ননীবালা। টাকা তুলে এজগোপাল তাঁর হাতে দেবেন তিনি ছেলেদের হাতে। জমিটা রেজিস্ট্রি হবে। ছেলেদের আর ছেলের বউয়ের কাছে ননীবালার মুখরক্ষা হবে। এই সংসারে তিনি আর একটু জোরের সঙ্গে ভাবের সঙ্গে থাকতে পারবেন।কিন্তু তাই কি হয়। হয় না। বীণা খুশি হবে না, রণোটাও কি খুশি হবে।ননীবালা ডকটা পিকদানির নীচে চাপা রেখে শুলেন একটু। শরীর ভাল না, মন ভাল না। চোখে হঠাৎ জল আসে কেন যে। মনে হয়, সংসারে কেউই আসলে করেও নয়, এই যে একা দুপুরে মন-খারাপ হয়ে পড়ে থাকা, দিনের পর দিন, কাছের কেউ থাকলে এ দশঃ হবে কেন তাঁর। কেন এমন ভার লাগে দিন। সময়ের ঢাকা যোরেই না ফেন।একেই কি বুড়োবয়েস বলে।ঢেকটা আর একবারও হাতে নিলেন না তিনি। পিকদানির নীচে সেটা চাপা রইল। জানালা দিয়ে হাওয়া আসছে, তাতে যণাকর করে পাখা নেড়ে ঢেকান জানান নিতে লাগল সে আছে। ননীবালা একটু বেশি সমছ বৃবে কাঁদলেন আজ। ঘুম হল না। ঠিকে কি। নাড়তে চোখ মুছে উঠলেন। ne ১সন্ধেবেলা রণেন এলে আছে দুপুরে এসেছে। ডেকে ঢেকটা হাতে নিলেন ননীবালা, কেবল বললেন-রাশেন খুশি হকে এ/এ ই এমনটাই আশা করেছিলেন তিনি। কিন্তু রণেন খুশি হল, চেকটা টেবিলে চাপ নিলয়া রেখে, জুতো মোজা খুলতে খুলতে সত্যিকারের খুশি হয়ে বলে এসেছে। যাক, বাঁচা গেল। কালই অজিতকে খবর দেব। লক্ষ্মণের কোন পিসেমশাই খুব ঘুরঘুর করছেন জমির জন্যননীবালা কথা বললেন না, শরীরটা বশ নেই। এ-বেলা বীণা রান্নাঘর সামলাচ্ছে, তিনি ছুটি নিয়েছেন। বীণা কৌতুহল দেখাল না। রক্সাঘরেই বসে রইল। তার এই চুপ করে থাকা, ওই পা-আলগা ভাব দেখে মনে মনে বড় কাহিল লাগে ননীবালার। শ্বশুরের টাকায় তারকোনও আগ্রহ নেই। আহাও করে না। গা ঘেঁসে ক্ষুদে নাতিটা দাঁড়িয়ে আছে। বলল-ঠদু, মশা কামড়াচ্ছে। কোলে নাও। তাকে কোলে নিলেন নদীবালা। আঁচলে পা ঢেকে শিশু-শরীরটায় গায়ের ওম দিতে
পৃষ্ঠা:১৭৪
দিতে মনটা হালকা হল। সংসারে এই বিষ্ণুগুলোকে ভগবান পাঠিয়ে দেন মানুষের মনের ধুলোময়লা ভাসিয়ে নিতেই বোধ হয়।সোমেন আজকাল অনেক রাতে ফেরে। কোলের ছেসেন বাঁ করে ভিন্ন্মানুষ হয়ে উঠেছে আজকাল। কথা বলেই না। কারও সঙ্গেই না। কেবল ভাইপো-ভাইঝির সঙ্গে একটু-আধটু। ননীবালা জানেন, ও অন্য জায়গায় বাসা খুঁজছে। শীলার বাড়িতে গিয়ে একদিন জানতে পেরেছেন। কাউকে বলেননি কিছু। কিন্তুবুঝাতে অসুবিধে হয় না যে, তাঁর আঁচলে বাঁধ ছেলেটা এ সংসার থেকে বার হতে চাইছে।সেদিন ব্রজগোপাল এসেছিলেন, যাওয়ার সময়ে সোমেন গেল সঙ্গে। টিউশনি সেরে রাতে ফিরে এসে সেকী চোটপাট ননীবালাকে-তুমি কেন বাবাকে বলেছ যে আমি আলাদা বাসা খুঁজছি। তুমি জানলে কোথেকে?এনীবালা ভয় পেয়ে বলেন-আমাকে শীলা বলেছে তুই নাকি ওদের বাসায় কদিন থাকতেচেয়েছিস।-তার মানে কি বাসা খোঁজা! দিদির বাড়িতে ভাই গিয়ে থাকলে ভিন্ন বাসা হয় নাকি। -না হয় ভুল বুঝেছি, রাগিস কেন?রাগব না। বাবাকে সংসারের সব কেলেঙ্কারি জানানোর দরকার কী। বাবার না জানলেও চলতননীবালা একটু কঠিন হওয়ার চেষ্টা করে বলেন-তাকে জানাব না কেন? সে কি তোদের পর?রাগী ছেলেটা ফুঁসে উঠে বলে তখন-পর কি না সেকথা জিজ্ঞেস করতে তোমার লজ্জা হয় না?এ কথার উত্তরে কিছু বলার নেই, ছেলেরা বড় হলে আলাদা বোধ বুদ্ধি হয়। মায়ের শেখানো কথা তোতা পাখির মতো বলেছে এক সময়ে এই ছেলেই। এখন সংসারের নানা দাঁড়ে বসে নানা কথা শিখেছে। বোধ হয়, ক্যাম্পের ওই দূরে দূরে থাকা ছেলেটার ভাল লাগে না। বোধ হয় ছেলেটা বাপের জন্য খোঁড়ে মনে মনে আর সেজন্য দায়ী করে রেখেছে ননীবালা আর রণেনকে। neতবু সেজন্য ছেলেটার ওপর রাগ হয় না ননীবালার। বরং আলাদা একটা গভীর মায়া জন্মায়। সে লোল্টাকে উদ্ভাবাসার কেউ তো নেই আর। ছেলেমেয়েরা পর, বউ চোখের বিষ। যদি এই ছেমেচার টান থাকে তবে ব্রজগোপালের ওইটুকুই আছে। ছেলের ভিতর দিয়ে তার বার্গের প্রতি একরকম আবছা কী যেন ভাব টের পান নদীবালা। বোধ হয়। বুড়োবয়সের জন্যই।একেই কি বুড়োবরেস বলে।আজ ননীবালা রাতে শোওয়ার সময়ে একটু সেধে কথা বলেন ছেলেটার সঙ্গে। বলেন-হ্যাঁরে, চাকরির কিছু হল না।-কী হবে।-শৈলীর কাছে আর একবার গেলি না। মুখচোরা ছেলে, নিজে না পারিস আমাকে একদিন নিয়ে যাস। কতকাল দেখি না।-গিয়েছিলাম আর একদিন। সোমেন নরম গলায় বলে।
পৃষ্ঠা:১৭৫
-গিয়েছিলি? কী বলল?সোমেন বড্ড সিগারেট থায় আজকাল। একটার আগুন থেকে আর একটা ধরিয়ে নিয়ে বলল-বলার অবস্থা নয়।-কেন?-ওরা খুব ব্যস্ত।-কীসে ব্যস্ত? শৈলীর শরীর খারাপ নাকি।-না, শুনলাম মেয়ের বিয়ের ঠিকঠাক হচ্ছে। তাই নিয়ে ব্যস্ত। বলে সিগারেটটা পুরো না খেয়ে ফেলে দেয়সোমেন।
অঠাশ
ননীবালা অবাক হয়ে বলেন-ও মা। সে তো গুয়ের গ্যালো মেয়ে শুনেছি। ওইটুকু মেয়ের বিয়ে দেবে!কেমন নিরাসক্ত গলায় সোমেন বলে ওইটুকু আবার কী। তোমার কত বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিলননীবালা শ্বাস ফেলে বলেন-সে তখন জ্ঞানবুদ্ধি হয়নি। কিন্তু আমাদের আমলে যা হব তা কি আজকাল হয়। তারওপর বড়লোকের মেয়ে, আদুরে, এত তাড়াতাড়ি তাকে বিদায়করবে কেন শৈলী। -সে তোমার শৈলীই জানে।এই শলে সোমেন আবার সিগারেটের জন্য হাত বাড়ায়।ননীবালা বলেন এক্ষুনি তো খেলি? বুকটা শেষ করবি নাকি। ওসব বেশি খেলে কী যেন সব রোগ বালাই হয়, লোকে বলে।-কিছু হবে না। এই বলে অস্থির হাতে আবার দেশলাই জ্বালে সোমেন।ইলছে না। এই নীলো ছেলের হয়ে একটু গোলমালের গন্ধ পর। কী কেন হিসেবে না।সময়ের একটু ফাঁক রাজেন ননীবালা, তারপর খাস্তে করে জিজ্ঞেস করেন-হ্যাঁ রে, শৈলীর মেয়ে দেখতে-হ কেন? কেমন?- -এমনিই tha করাছি, শৈলী দেখতে বেশ ছিল, একটু হাবা মতন ছিল অবিশ্যি।কালো-চোখমুখ ?-ভালই। আলগা চটক আছে। -তোর সঙ্গে কথাটথা বলল না?-বলবে না কেন? এ কী তোমাদের আমলের মেয়ে পুরুষের সম্পর্ক নাকিননীবালা বললেন-তা নয়। বলছিলাম, বড়লোকের মেয়ে বলে দেমাক নেই তো। -থাকলেই বা, কে পরোয়া করে।
পৃষ্ঠা:১৭৬
এটা উত্তর নয়। রাগ। ননীবালা বুঝলেন। একটু ছায়া মনের মধ্যে খেলা করে গেল। বুড়ো বয়সে সব মনে পড়ে। ছেলেবেলায় তিনি কতবার শৈলীর পুতুলের সঙ্গে নিজের পুতুলের কিয়ে দিয়েছেন। এখন যদি বুড়োবয়সে পুতুল খেলার ইচ্ছে হয়? ভাবতেই একটু খাস বেরিয়ে যায় বুক থেকে। তাই কি হয়। শৈলীরা কত বড়লোক। জজের বাড়িতে করেছে, বিয়েও হয়েছে আর এক মস্ত বড় ঘরে। সুখ ছাড়া আর কিছু কি করা জানে। নদীবালার ঘরে কী আছে? ওই তো হেলে, চেহারাটি কেমন রোগার মধ্যে তিরতিরে সুন্দর। বলতে নেই। পূঃ পূঃ। অমন সুন্দর ছেলেটা তাঁর সারাদিন ছন্নছাড়ার মতো ঘোরে। কোন বাড়িতে বুঝি একটু পড়ায়। ব্যাস। এ ছাড়া কোনও কাজ নেই। এই ছেলে কবে দাঁড়াবে, কবে তার বিয়ের কথা ভাববেন তা বুঝতে পারেন না তিনি। ব