Skip to content

জলিল সাহেবের আবেদন

পৃ্ষ্ঠা ০১ থেকে ১০

পৃষ্ঠা:০১

জলিল সাহেবের পিটিশন

হুমায়ুন আহমেদ

তিনি হাসি মুখে বললেন, “আমি দু’জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার বাবা। সেভেন্টি ওয়ানে আমার দু’টি ছেলে মারা গেছে।” আমি অবাক হয়ে তাকালাম। ভদ্রলোকের চেহারা বিশেষত্বহীন। বয়স প্রায় ষাটের কোঠায়। সে তুলনায় বেশ শক্ত সমর্থ। বসেছেন মেরুদন্ড সোজা করে। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। চশমা টশমা নেই। তার মানে চোখে ভালই দেখতে পান। আমি বললাম আমার কাছে কি ব্যাপার? ভদ্রলোক যেভাবে বসে ছিলেন সে ভাবেই বসে রইলেন। সহজ সুরে বললেন, “একজনের ডেডবডি পেয়েছিলাম। মালিবাগে কবর দিয়েছি। আমার ছোট মেয়ের বাড়ি আছে মালিবাগে।” : তাই নাকি? : জি মালিবাগ চৌধুরীপাড়া। : আমার কাছে কেন এসেছেন? : গল্পগুজব করতে আসলাম। নতুন এসেছেন এ পাড়ায়। খোঁজ খবর করা দরকার। আপনি আমার প্রতিবেশী। ভদ্রলোক হাসি মুখে বসে রইলেন। আমার সন্দেহ হল তিনি হয়তো সত্যি সত্যি হাসছেন না। তার মুখের ফাটাটাই হাসি হাসি। ভদ্রলোক শান্ত স্বরে বললেন “আমি আপনার পাশের গলিতেই থাকি।” : তাই নাকি? : জ্বি। ১৩/২, বাসার সামনে একটা নারিকেল গাছ আছে দেখেছেন তো?

পৃষ্ঠা:০২

আমি দেখিনি। তবু মাথা নাড়লাম। ভদ্রলোকের চরিত্র স্পষ্ট হতে শুরকরেছে। সম্ভবত অবসর জীবন যাপন করেছেন। কিছুই করার দরকার নেই। সময় কাটানোটাই বোধহয় তার এখন সমস্যা। যার জন্য ছুটির দিনে প্রতিবেশী খুজঁতে হয়।: আমার নাম আবদুল জলিল।আমি নিজের নাম বলতে গেলাম। ভদ্রলোক বলতে দিলেন না! উঁচু গলায় বললেন, “চিনি আপনাকে চিনি।”: চা খাবেন? চায়ের কথা বলি?: জ্বি না। আমি চা খাই না। চা সিগারেট কিছুই খাই না। নেশার মধ্যে পান খাই। : পান তো দিতে পারব না এখানে কেউ পান খায় না। : পান আমার সঙ্গেই থাকে। ভদ্রলোক কাঁধের ঝোলাতে হাত ঢুকিয়ে পানের কৌটা বার করলেন। বেশ বাহারী কৌটা। টিফিন কেরিয়ারের মতো তিন চারটা আলাদা বাটি আছে। আমি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস গোপন করলাম। ভদ্রলোক লম্বা পরিকল্পনা নিয়ে এসেছেন। সারা সকালটাই হয়তো এখানে কাটাবেন। দুঃখ কষ্টের গল্প অন্যকে শোনাতে সবাই খুব পছন্দ করে। ভদ্রলোক একটু ঝুকে এসে বললেন, “প্রফেসার সাহেব আপনি একটা পান খাবেন?” : জ্বি না। : পান কিন্তু শরীরের জন্য ভাল। পিত্ত ঠান্ডা রাখে। যারা পান খায় তাদের পিত্তের দোষ হয় না।: তাই নাকি? : জ্বি। পানের রস আর মধু হল গিয়ে বাতের খুব বড় ওষুধ। আমি ঘড়ি দেখলাম। সাড়ে দশটা। আজ ইউনিভার্সিটি নেই। থাকলে সুবিধা হতো। বলা যেত, “কিছু মনে করবেন না এগারটার সময় একটা ক্লাশ আছে আপনি অন্য আরেক দিন সময় হাতে নিয়ে আসুন।” ছুটির দিনে এরকম কিছু বলা যায় না। ভদ্রলোক তার পানের কৌটা খুলে নানান রকম মশলা বের করলেন। প্রতিটি শুঁকে শুঁকে দেখলেন। পান বানালেন অত্যন্ত যত্নে। যিনি পান বানানোর মতো ভুছ ব্যাপারে এতটা সময় নষ্ট করেন তিনি যে আজ দুপুরের আগে নড়বেন না তাতে কোন সন্দেহ নেই।

পৃষ্ঠা:০৩

কিন্তু আশ্চর্য ভদ্রলোক পান মুখে দিয়েই উঠে দাঁড়ালেন। হাসি মুখে বললেন, “যাই, আমি অনেকটা সময় নষ্ট করলাম।” বিশ্ময় সামলে আমি আন্তরিকভাবেই বললাম, “বসুন, এত তাড়া কিসের?” তিনি বললেন না আমি তাকে সিড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম। ফেরার পথে দেখি বাড়িওয়ালা বারান্দায় ভ্রূ কুচকে দাড়িয়ে আছেন। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, “প্রফেসর সাহেবকে ধরেছে বুঝি? সিগনেচার করেছেন?” : কি সিগনেচার?: জলিল সাহেবের পিটিশনে সিগনেচার করেননি?: পিটিশনটা কিসের?: আমাকে বলতে হবে না। নিজেই টের পাবেন। হাড় ভাজা করে দিবে। কোন প্রশয় দিবেন না। অস্পষ্ট একটা অস্বস্তি নিয়ে ঘরে ফিরলাম। নতুন পাড়ায় আসার অনেক বিরক্তিকর ব্যাপার আছে। নতুন নতুন মানুষদের সাথে পরিচিত হতে হয়। সে পরিচয় অনেক সময়ই সুখকর হয় না। তবে জলিল সাহেব প্রসঙ্গে ভয়টা বোধহয় অমলক। এরপর তার সঙ্গে দুবার দেখা হল। বেশ সহজ স্বাভাবিক মানুষ। একবার দেখা গ্রীন ফার্মেসীর সামনে। তিনি হাসিমুখে এগিয়ে এলেন। প্রফেসার সাহেব না? ভাল আছেন?: জ্বি ভাল। আপনি ভালো আছেন? কই আরতো আসলেন না? : সময় পাই না। খুব ব্যস্ত। পিটিশনটার ব্যাপারে। আমি আর কথা বাড়ালাম না। ক্লাশের দোহাই দিয়ে রিকশায় উঠে পড়লাম। দ্বিতীয়বার দেখা হলো নিউ মার্কেটের একটা নিউজ স্ট্যান্ডের সামনে। দেখি তিনি উবু হযে বসে একটির পর একটি পত্রিকা দ্রুত পড়ে শেষ করছেন। হকার ছেলেটি ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকে দেখছে।: কি জলিল সাহেব কি পড়ছেন এত মন দিয়ে? জলিল সাহেব আমার দিকে তাকালেন। মনে হয় ঠিক চিনতে পারছেন না। তাঁর চোখে চশমা। : চশমা নিয়েছেন নাকি? : জ্বি। সন্ধ্যা হলে মাথা ধরে। প্লাস পাওয়ার। ভাল আছেন প্রফেসার সাহেব? : জ্বি ভালো যাব একদিন আপনার বাসায়। পিটিশানটা দেখাবো আপনাকে।। চৌদ্দ হাজার তিনশ সিগনেচার জোগাড় হয়েছে। : কিসের পিটিশান?

পৃষ্ঠা:০৪

:পড়লেই বুঝবেন। আপনারা জ্ঞানী গুনী মানুষ আপনাদের বুঝতে কষ্ট হবে না। আমার ধারনা ছিল সরকারের কাছে কোন সাহায্য টাহায্য চেয়ে পিটিশান করা হয়েছে। সেখানে চৌদ্দ হাজার সিগনেচারের ব্যাপারটা বুঝা গেলো না। আমি নিজে থেকেও কোন আগ্রহ দেখালাম না। জগতে অসুস্থ্য মানুষের সংখ্যা কম নয়। সিগনেচার সংগ্রহ যদি কারো নেশা হয় তা নিয়ে আমার উদ্বিগ্ন হবার কোন কারন নেই। কিন্তু উদ্বিগ্ন হতে হলো। জলিল সাহেব এক সন্ধ্যায় তার চৌদ্দ হাজার তিনশ সিগনেচারের ফাইল পত্র নিয়ে আমার বাসায় উপস্থিত হলেন। হাসি হাসি মুখে বললেন, “ভালো করে পড়েন প্রফেসার সাহেব।” আমি পড়লাম। পিটিশানের বিষয় বস্তু হচেছ দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে দশ লাখ উহুদী মারা গিয়েছিল। সেই অপরাধে অপরাধীদের প্রত্যেকের বিচার করা হয়েছে এবং এখোনো হচেছ। কিন্তু এ দেশের ত্রিশ লক্ষ মানুষ মেরে অপরাধীরা কি করে পার পেয়ে গেলো? কেন এ নিয়ে আজ কেউ কোন কথা ভলছে না। জলিল সাহেব তার দীর্ঘ পিটিশানে সরকারের কাছে আবেদন করেছেন যেন এদের বিচার করা হয়। আমি ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম তিনি শান্ত স্বরে বললেন, “আমার দুটি ছেলে মারা গেছে, সেই জন্যই যে আমি এটা করছি তা ঠিক না। আমার ছেলে মারা গেছে যুদ্ধে। ওদের মৃতর জন্য অঅমি কোন বিচার চাই না। আমি বিচার চাই তাদের জন্য যাদের ওরা ঘর থেকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলেছে। আমার কথা বুঝতে পারছেন?” : পারছি। : জানি পারবেন। আপনে জ্ঞানী গুনী মানুষ। অনেকেই পারে না। বুঝলেন ভাই অনেকে মানবতার দোহাই দেয়। বলে বাদ দেন। ক্ষমা করে দেন। ক্ষমা এত সস্তা? এ্যা বলেন সস্তা? আমি কিছু বললাম না। জলিল সাহেব পানের কৌটা বের করে পান সাজাতে বসলেন। শান্ত স্বরে বললেন, “আপনি কি মনে করেছেন আমি ছেড়ে দিব? ছাড়ব না। আমার দুই ছেলে ফাইট দিয়েছে। আমিও দিব। মৃত্যু পর্যন্ত ফাইট দেব।

পৃষ্ঠা:০৫

দরকার হলে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের সিগনেচার জোগাড় করব। ত্রিশ লক্ষ লোক মরে গেল আর কেউ কোন শব্দ করল না? আমরা মানুষ না অন্য কিছু বলেন দেখি?” আমি সিগনেচার ফাইল উল্টে দেখতে লাগলাম। খুব গোছানো কাজ কর্ম। সিগনেচারের পাশে বর্তমান ঠিকানা ও স্থায়ী ঠিকানা। স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত আত্মীয় স্বজনের নাম ঠিকানা। : অনেকেই মনে করে আমার মাথা ঠিক নাই। এক পত্রিকা অফিসে গিযেছিলাম সম্পাদক সাহেব দেখাই করলেন না। ছোকরা মতো একটা ছেলে বলল, “কেন পুরানো কাসুন্দি ঘাটছেন? বাদ দেন ভাই।” আমি তার দাদার বয়সী লোক আর আমকে বলে ভাই।: আপনি কি বললেন?: আমি বললাম, “তুমি চাও না এদের বিচার হোক? ছেলেটি কিছু বলে না। সরাসরি না বলারও সাহস নাই। অথচ এই ছেলেরা কতো সাহসের সাথে যুদ্ধ করেছে। করে নাই?”: জ্বি করেছে। : আপনার বাড়িওয়ালার কথাই ধরেন। তার এক শালাকে ঘর থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলেছে। অথচ এই লোক সিগনেচার করেনি। ত্রিশ লক্ষ লোক মরে গেল কোন বিচার হল না। মনে হলেই বুকের মধ্যে চিন চিন করে ব্যথা হয়। আমি অত্যন্ত অস্বস্তি নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ভদ্রলোক দ্বিতীয় একটি পান মুখে পুরে বললেন, “সরকারী লোকজনদের সাথে দেখা করেছি। তারা আমি কি বলতে চাই সেটাই ভালো করে শুনতে চায় না। একজন আমাকে বলে, আপনি একটা পরিত্যক্ত বারি জন্য দরখাস্ত করেন। আপনার দুটি ছেলে মারা গেছে বাড়ি পাওয়ার হক আছে আপনার।” : আপনি কি বললেন? : আমি আবার বলব কি? বাড়ির জন্য পিটিশন করেছি নাকি? বাড়ি দিয়ে আমি করবটা কি? আমার দুই ছেলের জীবন কি এতো সস্তা? একটা বাড়ি দিয়ে দাম দিতে চায়? কতো বড় স্পর্ধা চিন্তা করেন। আমি চাই একটা বিচার হবে। একটা বিচার চাই। আর কিছুই না। সভ্য সমাজের নিয়মমতো বিচার হবে। বুঝলেন? : জি বুঝলাম। : আপনারা জ্ঞানীগুনী মানুষ আপনাদের বুঝাতে কষ্ট হয় না। অন্যরা কেউ বুঝতে চায় না। একেকটা সিগনেচারের জন্য তিনবার করে যেতে হয়। তাতে অসুবিধা নাই। আমি ছাড়বার লোক না?

পৃষ্ঠা:০৬

আমার সিগনেচার নিয়ে ভদ্রলোক চলে গেলেন। তারপর অনেকদিন তার সাথে দেখা হল না। একটা কৌতহল জেগে রইল। রাস্তাঘাটে দেখা হলে জিজ্ঞেস করেছি কি ভাই কতো দর কি করলেন? : চালিয়ে যাচিছ প্রফেসার সাহেব। দোয়া রাখবেন।: লোকজন দস্তখত দিচেছতো? : সবাই দেয় না। ভয় পায়। : কিসের ভয়?: ভয়ের কি কোন মা-বাপ আছে? ভয় পাওয়া যাদের স্বভাব তারা ভয় পাবেই। বুঝলেন না আমি আছি লেগে। আদালতে হাজির করে ছাড়ব। কি বলেন প্রফেসার সাব?: তাতো ঠিকই। :ডিস্টিক্টে ভাগ করে ফেলছি। এখন সব ডিস্টিক্টে যাব। কষ্ট হবে উপায়তো নাই। আপনি কি বলেন? : ভালোই তো। তাছাড়া শুধু দস্তখত জোগাড় করলেও হবে না। কেইস চালানোর মতো এভিডেন্স থাকতে হবে। বিনা কারনে নিরাপরাধ লোক জন ধরে ধরে মেরেছে এটা প্রমান করতে হবে না। ওরা ঘাগু ঘাগু সব ল’ইয়ার দিবে। দিবে না? : তাতো দিবেই।: আপনার জানা মতে কো ভালো লইয়ার আছে? : আমি খোঁজ করব। :তাতো করবেনই। আপনি তো অন্ধ না। অন্যায়টা বুঝতে পারছেন। বেশির ভাগ লোকই পারে না। মুর্খের দেশ। অনেকদিন আর ঝলিল সাহেবের দেখা পাই নাই। হয়তো সত্যি সত্যি জেলায় জেলায় ঘুরে বেড়াতে শুরকরেছেন। বগলে ভারী ভারী ফাইল। দস্তখতের সংখ্যা হয়তো বাড়ছে। বারো হাজার থেকে পনেরো হাজার। পনেরো থেকে বিশ। এমনকি

পৃষ্ঠা:০৭

সত্যি সত্যি হতে পারে যে চল্লিশ হাজার পঞ্চাশ লাখ দস্তখত জোগাড় করে ফেলবেন তিনি। পঞ্চাশ লক্ষ লোকের দাবী অত্যন্ত জোরালো দাবী। বর্ষার শুরুতে খবর পেলাম জলিল সাহেব অসুখে পড়েেেছন। হাঁপানি সেই সঙ্গে রিউমেটিক ফিবার। বাড়িওয়ালা বললেন, “পাগল মানুষ। শরীরের যত্ন তো আর কোনদিন করেন নাই। এ যাত্রা টিকবে না।” : বলেন কি? : হ্যাঁ গ্রীন ফার্মেসীর ডাক্তার সাহেব বললেন। আমি নিজেও গিয়েছিলাম দেখতে। : অবস্থা কি বেশী খারাপ? : বর্ষাটা টিকে কিনা… : বলেন কি? : খুবই খারাপ অবস্থা। বর্ষাটা অবশ্যি টিকে গেলেন। ফাইলপত্র বগলেদিয়ে ঘুরতে বেরুলেন। আমার সঙ্গে দেখা হলো দুপুরে। অমি চিনতেই পারি না এমন অবস্থা। তিনি এগিয়ে এলেন, “প্রফেসার সাহেব না?” : আরে কি ব্যাপার ভাই? একি অবস্থা আপনার। : বাঁচব না বেশী দিন। : না বাঁচলে চলবে? এত বড় একটা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছেন। : ঐটার জন্য টিকে আছি। : সিগনেচার কত দূর জোগাড় হয়েছে? : পনেরো হাজার। মাসে তিন চারশর বেশী পারি না। বয়স হয়েছে তো। তবে ছাড়বার লোক না আমি। : না ছাড়বেন কেন?  কাঠগড়ায় দাঁড় করাবো শালাদের। ইহুদীরা পেরেছে আমার পারব না কেন? কি বলেন? : তাতো ঠিকই। :ত্রিশ লাখ লোক মেরেছে বুঝলেন একটা দুইটা না। বাংলাদেশের মাসুষ সস্তা না? মজা টের পাইয়ে দেব।

পৃষ্ঠা:০৮

আজিমপুরের ঐ পাড়ায় আমি প্রায় দুই বছর কাটালাম। এই দু বছরে জলিল সাহেবের সাথে মুটামুটি ঘনিষ্টতা হলো। মাঝে মাঝে যেতাম তার বাসায়। ভদ্রলোকের নিজের বাড়ি। দোতালাটা ভাড়া দিয়েছেন। ভাড়ার টাকায় সংসার চলে। স্ত্রী নেই। বড় ছেলের বউ তার সঙ্গে থাকে। ফুটফুটে দুটি মেয়ে আছে সেই বউটির। যমজ মেয়ে বোধকরি। খুব হাসি খুশি। ভালোই লাগে ও বাড়িতে গেলে। বউটি খুবই যত্ন করে। পিটিশন সম্পর্কে বচচা দুটির ধারনাও দেখলাম খুব স্পষ্ট। একটি মেয়ে গম্ভভীর গয়ে আমাকে বললো, “দাদার খাতা লেখা শেষ হলে যারা আমার বাবাকে মেরেছে তাদের বিচার হবে।” এইটুকু মেয়ে এত সব বোঝার কথা নয়। জলির সাহেব নিশ্চয়ই ব্যাপারটা ওদের বুঝিয়ে বলেছেন। ও পাড়া ছেড়ে চলে যাবার পরও মাঝে মধ্যে যেতাম। তারপর ধীরে ধীরে যোগাযোগ কমে গেল। এক সময় দীর্ঘ দিনের জন্য দেশের বাইরে চলে গেলাম। যাবার আগে দেখা করতে গিয়েছি। শুনলাম তিনি ফরিদপুরে গিয়েছেন সিগনেচার যোগাড় করতে। কবে ফেরৎ আসবেন কেউ বলতে পারে না। তার ছেলের বউ অনেক দুঃখ করল। দুঃখ করার সঙ্গত কারণ আছে। একমাত্র পুরুষ যদি ঘর- সংসার ছেড়ে দেয় তাহলে জীবন দুঃসহ হয়ে ওঠে। বাইরে থাকলে দেশের জন্য অন্য রকম একটা মমতা হয়। সেই কারনেই বোধ হয় জলিল সাহেবের কথা মনে পড়তে লাগল। মনে হত ঠিকই তো ত্রিশ লক্ষ লোক হত্যা করে পার পেয়ে যাওয়া উচিত নয়। জলিল সাহেব যা করেছেন ঠিকই করেছেন। এটা মধ্য যুগ না। এ যগে এত বড় অন্যায় সহ্য করা যায় না।

পৃষ্ঠা:০৯

উইকেন্ডগুলিতে বাঙালীরা এস জড়ো হতো আমার বাসায়। কিছু আন্ডার গ্র্যাজুয়েট ছেলে, মুরহেড স্টেট ইউনিভার্সিটির অংকের প্রফেসার আফসার উদ্দিন সাহেব। সবাই একমত জলিল সাহেবের প্রজেক্টে সাহায্য করতে হবে। বাংলাদেশের জনগনের পক্ষ হতে প্রয়োজন হলে আন্তর্জাতিক আদালতে মামরা দায়ের করা হবে। বিদেশী পত্রিকায় জনমতেরজন্য লেখালেখি করা হবে। আমেরিকার ফার্গো শহরে আমরা এক সন্ধ্যাবেলায় ‘আব্দুল জলিল সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করে ফেললাম। আমি তার আহ্বায়ক। আফসার উদ্দিন সাহেব সভাপতি। বিদেশে বসে দেশের কথা ভাবতে বড় ভালো লাগে। সব সময় ইচছা করে একটা কিছু করি। দেশে ফিরলাম ছয় বছর পর। ঢাকা শহর অনেকখকানি বদলে গেলেও জলিল সাহেবের বাড়ির চেহারা বদলায়নি। সেই ভাঙ্গা পলেস্তারা উঠা বাড়ি। সেই নারিকেল গাছ। কড়া নাড়তেই চৌদ্দ পনেরো বছরের ভারী মিষ্টি একটা মেয়ে দরজা খুলে দিলো। অবাক হয়ে তাকালো আমার দিকে। তুমি কি জলিল সাহেবের নাতনী? : জ্বি : তিনি বাড়ি আছেন? : না, দাদু তো মারা গেছে দু বছর আগে।  ও। আমি তোমার দাদুর বন্ধু। : আসুন ভেতরে বসে বসুন। আমি বসলাম কিছুক্ষন। মেয়েটির মায়ের সাথে কথা বলার ইচছা ছিল। ভদ্রমহিলা বাসায় ছিলেন না। কখন ফিরবেন তারো ঠিক নেই। উঠে আসবার সময় জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার দাদু যে মানুষের সিগনেচার জোগাড় করতেন সেই সব আছে?”

পৃষ্ঠা:১০

জ্বি আছে। কেন? : তোমার দাদু যে কাজটা শুরু করেছিলেন সেটা শেষ করা উচিত তাই না? মেয়েটি খুব অবাক হলো। আমি হাসি মুখে বললাম, “আমি আবার আসবো কেমন?” : জ্বি আচছা। মেয়েটি গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসে নরম গলায় বলে, “দাদু বলেছিলেন একদিন কেউ না কেউ এই ফাইল নিতে আসবে।” আর যাওয়া হলো না। উৎসাহ মরে গেল। দেশের এখন নানান রকম সমস্যা। যেখানে সেখানে বোম ফোটে। মুখ বন্ধ করে থাকতে হয়। এর মধ্যে পুরানো সমস্যা টেনে আনতে ইচেছ করে না। আমি জলিল সাহেব নই। আমাকে ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হয়। মীরপুরে একটা পরিত্যক্ত বাড়ি কেনার জন্য নানান ধরনের লোকজনদের সাথে কথা বলতে হয়। জলিল সাহেবের মতো বত্রিশ হাজার দরখাস্তের ফাইল নিয়ে রাস্তায় বেরুনোর আমার সময় কোথায়? জলিল সাহেবের নাতনীটি হয়তো অপেক্ষা করে আমার জন্য। দাদুর পিটিশনের ফাইলটি ধলো ঝেড়ে ঠিকঠাক করে রাখে। এই বয়েসী মেয়েরা মানুষের কথা খুব বিশ্বাস করে।

Home
E-Show
Live TV
Namaz
Blood
Job