নবি (সঃ) এর আশ্বচার্য ঘটনা (৩)
পৃষ্ঠা ০১ থেকে ১০
পৃষ্ঠা:০১
দেখতে পাচ্ছেন? উত্তর হলঃ হাঁ। খাদিজা (রাঃ) বললেন: আপনি আমার কোলে এসে যান। রসূলুল্লাহ (সাঃ) তাই করলেন। খাদিজা (রাঃ) জিজ্ঞাসা করলেন: আপনি এখন তাঁকে দেখতে পাচ্ছেন? উত্তর হল: হাঁ। খাদিজা (রাঃ) আপন মাথা খুলে দিলেন এবং ওড়না সরিয়ে ফেললেন। রসূলুল্লাহ (সাঃ) কোলেই উপবিষ্ট ছিলেন। খাদিজা (রাঃ) প্রশ্ন করলেন: আপনি এখন তাঁকে দেখতে পাচ্ছেন? তিনি বললেনঃ না। খাদিজা বললেন, ইনি শয়তান নন; বরং ফেরেশতা। আপনি দৃঢ়পদ থাকুন এবং সুসংবাদ নিন। এসব কথোপকথনের মাধ্যমেই হযরত খাদিজা (রাঃ) ঈমান আনলেন এবং সাক্ষ্য দিলেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে, তা সত্য। আবু নয়ীম ও বায়হাকী ইবনে ইসহাক থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তিনি বলেনঃ আমি এই হাদীসটি আবদুল হাসানের সামনে বর্ণনা করলে তিনি বললেন:আমি হাদীসটি ফাতেমা বিনতে হুসাইন (রাঃ)-এর কাছে শুনেছি। তিনি হযরত খাদিজা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেছিলেন। কিন্তু তাতে তিনি খাদিজার (রাঃ)-এই কথাগুলোও বর্ণনা করেছেন যে, আমি রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে আমার কামিজের ভিতরে দাখিল করলে জিবরাঈল চলে গেলেন। এ রেওয়ায়েতটি তিবরানীও আওসাতে উদ্ধৃত করেছেন।ইসমাঈল ইবনে হাকীম, ওমর ইবনে আবদুল আজিজ, আবু বকর ইবনে আবদুর রহমান ইবনে হারেছ ও উম্মে ছালামাহ্ কর্তৃক হযরত খাদিজা (রাঃ) থেকে উপরোক্তরূপ হাদীস বর্ণিত আছে।বায়হাকী ও আবু নয়ীম আবু মায়সারা আমর ইবনে শোরাহবিল থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) হযরত খাদিজা (রাঃ)-কে বললেন: আমি যখন নির্জনে থাকি তখন একটি আওয়াজ শুনি, যাতে ভীষণ ভয় পেয়ে যাই। হযরত খাদিজা (রাঃ) বললেনঃ: আল্লাহর পানাহ্! আল্লাহ আপনাকে অপদস্ত করবেন না। আপনি আমানতদার। আত্মীয়দের সাথে সদয় ব্যবহার করেন এবং বিশুদ্ধ কথা বলেন।আবু বকর (রাঃ) এলে তাঁকেও একথা জানানো হলে তিনি বললেন: আপনি নবী করীমকে (সাঃ) সঙ্গে নিয়ে ওয়ারাকার কাছে যান। সেমতে তারা উভয়েই ওয়ারাকার কাছে গেলেন। হুযুর (সাঃ) ওয়ারাকাকে বললেন: আমি যখন নির্জনে থাকি, তখন পিছন দিকে “ইয়া মোহাম্মদ! ইয়া মোহাম্মদ”!! আওয়াজ শুনতে পাই। তখন আমি দৌড়াতে থাকি। ওয়ারাকা বললেন: আপনি এরূপ করবেন না; বরং আপনার কাছে কেউ এলে আপনি দুঢ়পদ থাকুন এবং তাঁর কথা শুনুন। এরপর আমার কাছে এসে খবর দিন। এ কথাবার্তার পর যখন রসূলুল্লাহ (সাঃ) নির্জনে গেলেন, তখন কেউ তাঁকে “ইয়া মোহাম্মদ” বলে ডাকল এবং বলল:وَرَسُولُهُ أَشْهَدُ অতঃপর বললঃ পড়ুন-بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ – الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ ……. وَلَاالضَّالِّينَ এরপর বললঃ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ বলুন। রসূলুল্লাহ (সাঃ) এ ঘটনা সম্পর্কে ওয়ারাকাকে অবহিত করলেন। ওয়ারাকা বললেন:সুসংবাদ নিন! আমি সাক্ষ্য দেই যে, আপনি সেই নবী, যাঁর আগমনের সুসংবাদ ঈসা (আঃ) দিয়েছেন। মূসা (আঃ)-এর জিবরাঈল আপনার কাছে আগমন করেছেন। আপনি নবী, আপনাকে সত্বরই জেহাদের নির্দেশ দেয়া হবে। তখন আমি বর্তমান থাকলে আপনার সঙ্গে অবশ্যই জেহাদে শরীক হব। ওয়ারাকার ইন্তিকালের পর নবী করীম (সাঃ) বললেনঃ আমি ওয়ারাকাকে রেশমী বস্ত্র পরিহিত অবস্থায় দেখেছি। কারণ, সে আমার প্রতি ঈমান এনেছিল এবং আমাকে সত্য বলে মেনে নিয়েছিল। বায়হাকী ও আবু নয়ীম আবূ মায়সারা থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, নবী করীম (সাঃ) যখন বাইরে যেতেন, তখন শুনতে পেতেন যে, কেউ তাঁকে “ইয়া মোহাম্মদ” বলে ডাকছে। তিনি এ বিষয়টি হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর গোচরীভূত করেন, যিনি ছিলেন তাঁর বহু পুরানা বন্ধু। আবু নয়ীম ফযলের সনদ সহকারে বুরায়দা (রাঃ) থেকেও এমনিভাবে রেওয়ায়েত করেছেন। আবু নয়ীম আবদুল্লাহ ইবনে শাদ্দাদ থেকে বর্ণনা করেন যে, ওয়ারাকা হযরত খাদিজা (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন: তোমার স্বামী তাকে সবুজ পোশাকে দেখেছেন কি? তিনি বললেন: হাঁ। ওয়ারাকা বললেন, তোমার স্বামী নবী। তিনি উম্মতের তরফ থেকে বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হবেন।আবূ নয়ীম ওরওয়া থেকে এবং তিনি হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, হযরত খাদিজা (রাঃ) ওয়ারাকার সাথে এ বিষয়ে আলোচনা করলে তিনি বললেনঃ যে ভূখণ্ডে মূর্তি পূজা করা হয়, যেখানে জিবরাঈলের আলোচনা করা শোভনীয় নয়। তিনি আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর নবীগণের মধ্যে বিশ্বস্ত দূত। তুমি
পৃষ্ঠা:০২
তোমার স্বামীকে সেই স্থানে নিয়ে যাও, যেখানে তিনি এই দৃশ্য দেখেছেন। তিনি যখন জিবরাঈলকে দেখবেন, তখন তুমি আপন মস্তক খুলে দিয়ো। আল্লাহর প্রেরিত দূত হলে নবী করীম (সাঃ) তাঁকে দেখতে পাবেন না; অর্থাৎ জিবরাঈল প্রস্থান করবেন।হযরত খাদিজা (রাঃ) ওয়ারাকার নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করলেন। তিনি নিজেই বর্ণনা করেন, যখন আমি মাথা খুললাম, তখন জিবরাঈল উধাও হয়ে গেলেন এবং রসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে দেখতে পেলেন না। খাদিজা (রাঃ) ফিরে এসে এ ঘটনা ওয়ারাকাকে বললে তিনি বললেন: নবী করীম (সাঃ)-এর কাছে জিবরাঈলই আগমন করেন। এরপর ওয়ারাকা দাওয়াত-প্রকাশের অপেক্ষা করতে থাকেন।তায়ালেসী হারেছ ইবনে আবী উসামা এবং আবু নয়ীম হযরত আয়শা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেছেন যে, নবী করীম (সাঃ) মান্নত করেন যে, তিনি এবং হযরত খাদিজা (রাঃ) একমাস হেরা গিরি গুহায় এ’তেকাফ করবেন। এই মান্নত রমযানুল মোবারকে পড়ে। তিনি এক রাত বাইরে বের হলে “আসসালামু আলাইকা” শুনতে পেলেন। তিনি বলেনঃ আমি মনে করলাম হয়তো কোন জিন সালাম করেছে। আমি দ্রুত খাদিজার কাছে এলাম। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন: কি হল? আমি তাকে ঘটনা বললাম। তিনি বললেন: সুসংবাদ নিন। সালাম মঙ্গলের বাক্য। এরপর আমি পুনরায় বের হলে হঠাৎ জিবরাঈলকে আকাশের দিগন্তে দেখলাম। তাঁর একবাহু পূর্বে এবং অপর বাহু পশ্চিমে ছিল। আমি ভয় পেলাম এবং দ্রুত ফিরে এসে দেখি জিবারাঈল দরজার মাঝখানে আছেন। তিনি আমার সাথে কথা বললে আমার ভয়ভীতি দূর হয়ে গেল। এরপর তিনি এক স্থানে আমার সাথে দেখা করার ওয়াদা দিলেন। আমি সেখানে উপস্থিত হলাম। কিন্তু তিনি আসতে বিলম্ব করলেন। আমি ফিরে যেতে উদ্যত হলেই অকস্মাৎ জিবরাঈল ও মিকাঈলকে আকাশের কিনারা বেষ্টন করে থাকতে দেখলাম। জিবরাঈল নিচে নেমে এলেন এবং মিকাঈল আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যস্থলে রয়ে গেলেন। জিবরাঈল আমাকে ধরে চিৎ করে শুইয়ে দিলেন। এরপর তিনি আমার কলবের স্থানটি চিরে ফেললেন এবং কলব বের করে তা থেকে একটি বস্তু বের করলেন। অতঃপর কলবকে স্বর্ণের প্লেটে যমযমের পানি দ্বারা ধৌত করলেন এবং স্বস্থানে রেখে ক্ষতস্থান সংশোধন করে দিলেন এবং আমাকে ধনুকের মত ঝুঁকিয়ে পিঠে মোহর লাগিয়ে দিলেন। আমি মোহর লাগার প্রভাব অন্তরে অনুভব করলাম। এরপর আমার গ্রীবা ধরলেন। আমি কান্নার জন্যে উঁচু আওয়াজ বের করলাম। জিবরাঈল আমাকে বললেনঃ পড়ুন। এর আগে আমি কখনও কোন কিতাব পড়িনি। তাই পড়তে পারলাম না। তিনি আবার বললেনঃ পড়ুন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম: কি اقرأ باسمِ رَبِّكَ الَّذِي করলেন। এরপর আমাকে এক ব্যক্তির সাথে ওজন করলেন। আমি ভারী হলাম। এরপর দ্বিতীয় ব্যক্তির সাথে ওজন করলে আমিই ভারী হলাম। এরপর একশ’ ব্যক্তির সাথে আমাকে ওজন করলেন। এখানেও আমি ভারী হলাম। মিকাঈল বললেন: কা’বার প্রভুর কসম। তাঁর উম্মত তাঁর অনুসরণ করবে। রসূলে করীম (সাঃ) বললেন : পথিমধ্যে যত বৃক্ষ ও পাথর ছিল, সকলেই আমাকে আসসালামু আলাইকা ইয়া রসূলাল্লাহ বলেছে। ইমাম আহমদ, ইবনে সা’দ ও আবূ নয়ীম হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, হযরত খাদিজা (রাঃ) ওয়ারাকা ইবনে নওফেলের সাথে এ সম্পর্কে কথা বললে তিনি বললেনঃ ইনি জিবরাঈল। মুসার (আঃ) নিকট যিনি আসতেন। যদি তিনি নবীরূপে আবির্ভূত হন এবং আমি তখন জীবিত থাকি, তবে সর্ব প্রকারে তাঁকে শক্তি ও সাহায্য যোগাব। আবূ নয়ীম মুতামার ইবনে সোলায়মান থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, জিবরাঈল (আঃ) নবী করীম (সাঃ) কে ধরে একটি ফরশে বসালেন, যাতে মোতি ও ইয়াকৃত জড়ানো ছিল। অতঃপর জিবরাঈল বললেনঃ পড়ুন- اقرأ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ – خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍ أَقْرأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ الَّذِي عَلَّمَ يَا الْقَلَمِ عَلَّمَ الْإِنْسَانِ مَا لَمْ يَعْلَمُতিনি আরও বললেন: আপনি কোন প্রকার ভয় করবেন না। আপনি আল্লাহর রসূল। রসুলুল্লাহ (সাঃ) যখন জিবরাঈলের কাছ থেকে ফিরে আসছিলেন, তখন পথিমধ্যে প্রতিটি বৃক্ষ ও পাথর সিজদায় অবনত হয়ে “আসসালামু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ” বলছিল। ফলে তাঁর মন প্রশান্ত হয়ে গেল এবং তিনি আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামত পূর্ণমাত্রায় অনুধাবন করতে পারলেন। তিবরানী ও আবু নয়ীম হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, ওয়ারাকা ইবনে নওফেল হুযুর (সাঃ)-কে প্রশ্ন করেন: জিবরাঈল আপনার কাছে কোন অবয়বে আসেন। তিনি বললেনঃ তিনি আকাশ থেকে আমার কাছে আসেন। তখন তাঁর উভয় বাহু থাকে মোতির এবং তালু সবুজ। ইবনে রিস্তা কিতাবুল মোছারেফে যুহরী থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) হেরা গুহায় ছিলেন, এমতাবস্থায় এক ফেরেশতা তাঁর কাছে রেশমী কিংখাবের বস্ত্র নিয়ে আসে, যাতে আরবী আয়াতগুলো লিখিত ছিল। হরফে প্রথমবারের এত অবতীর্ণ
পৃষ্ঠা:০৩
ওবায়দ ইবনে ওমায়র কিতাবুল মাছাহেফে বর্ণনা করেন, জিবরাঈল রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে একটি বস্তু নিয়ে আসেন এবং বলেনঃ পড়ুন। তিনি বললেন: আমি পড়ুয়া নই। জিবরাঈল বললেন: পড়ুন إقرأ باشيم ريك ইবনে সা’দ হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন হুযুর (সাঃ) আজইয়াদ নামক স্থানে ছিলেন। হঠাৎ তিনি এক ফেরেশতাকে দেখলেন। সে আকাশের কিনারে পায়ের উপর পা রেখে তাঁকে আওয়াজ দিচ্ছিল: মোহাম্মদ! আমি জিবরাঈল। এটা দেখে হুযুর (সাঃ) ঘাবড়ে গেলেন। তিনি আকাশের দিকে মাথা তুললেই জিবরাঈলকে দেখতে পেতেন। তিনি দ্রুতবেগে হযরত খাদিজার (রাঃ) কাছে এলেন এবং ঘটনা বর্ণনা করে বললেন: আল্লাহর কসম, মূর্তি ও অতীন্দ্রিয়বাদীরা আমার কাছে যতটুকু ঘৃণিত, ততটুকু অন্য কোন বস্তু নয়। আমি নিজের সম্পর্কে অতীন্দ্রিয়বাদী হওয়ার আশংকা করছি। খাদিজা (রাঃ) বললেনঃ কখনও নয়। এটা অসম্ভব। আপনি এমন কথা মুখে আনবেন না। আল্লাহ আপনার সাথে এরূপ করবেন না। আপনি আত্মীয়দের সাথে সদয় ব্যবহার করেন, সত্য কথা বলেন এবং আমানত ফিরিয়ে দেন। আপনার চরিত্র মহান। এরপর খাদিজা (রাঃ) ওয়ারাকা ইবনে নওফেলের কাছে গেলেন। ওয়ারাকার কাছে এটা তাঁর প্রথমবার যাওয়া। তিনি ওয়ারাকাকে সকল ঘটনা বললে তিনি বললেন: আল্লাহর কসম, তিনি সত্যবাদী। এটা নবুওয়তের সূচনা। তাঁর কাছে জিবরাঈল আসেন। তুমি তাঁকে মঙ্গল ছাড়া অন্যকিছু চিন্তা না করতে বল। ইবনে সা’দ হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, হেরা গুহায় প্রথমবার ওহী নাযিল হওয়ার পর বেশ কিছুদিন পর্যন্ত জিবরাঈল (আঃ)-এর সাথে হুযুর (সাঃ)-এর সাক্ষাৎ হয়নি। এতে তিনি খুব দুঃখিত ও চিন্তিত হয়ে পড়েন। এমন কি তিনি কখনও খবীর পাহাড়ে এবং কখনও হেরা পাহাড়ে যাতায়াত করতে থাকেন। তিনি কখনও নিজেকে পাহাড় থেকে নিচে ফেলে দেয়ার সংকল্প নিয়েও যেতেন। একদিন যখন তিনি এমনি সংকল্প নিয়ে পাহাড়ে যাচ্ছিলেন, তখন হঠাৎ আকাশ থেকে একটি আওয়াজ শুনলেন। তিনি মাথা তুলতেই দেখলেন যে, জিবরাঈল (আঃ) আকাশ ও পৃথিবীর মাঝখানে একটি কুরসীতে চারজানু হয়ে উপবিষ্ট আছেন এবং বলছেন: হে মোহাম্মদ। আপনি নিশ্চিতরূপেই আল্লাহর রসূল এবং আমি জিবরাঈল। একথা শুনে রসূলুল্লাহ (সাঃ) চলে এলেন। তাঁর চক্ষু শীতল হল এবং অন্তর আশ্বস্ত হল। এরপর থেকে পরপর ওহী আসতে থাকে। হাকেম ইবনে ইসহাক থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আবদুল মালেক ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আবু সুফিয়ান অত্যন্ত স্মরণশক্তির অধিকারী ছিলেন। তিনি বর্ণনা করেন-হযরত খাদিজা (রাঃ) রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রতি ওহী নাযিল হওয়ার ব্যাপারে ওয়ারাকা ইবনে নওফেলের সাথে আলোচনা করতেন। এ প্রসঙ্গে ওয়ারাকা ইবনে নওফেল নিম্নোক্ত কবিতা রচনা করেন: : আকস্মিক ঘটনাবলী ও বিধিলিপির অবস্থা হচ্ছে? আল্লাহ যে বিষয়ের নির্দেশ, দেন, তা অপরিবর্তনীয়। খাদিজা আমাকে ডাকে, যাতে আমি বলি। খাদিজার অদৃশ্য বিষয়াবলীর কোন খবর নেই। খাদিজা আমার কাছে নবী (সাঃ) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে আসে, যাতে আমি শেষ যুগে যা হবে, সে সম্পর্কে তাকে অবহিত করি। খাদিজা আমাকে এমন বিষয়ে অবহিত করেছে, যা আমি প্রাচীন কাল থেকে শুনে আসছি। তা এই যে, মোহাম্মদ (সাঃ)-এর কাছে জিবরাঈল আগমন করেন এবং সংবাদ দেন যে, হুযুর (সাঃ)-কে মানব জাতির প্রতি প্রেরণ করা হয়েছে। আমি বললামঃ তুমি যা আশা করছ, আল্লাহতায়ালা, তা তোমার জন্যে পূর্ণ করবেন। অতএব আশা রাখ এবং অপেক্ষা কর। খাদিজা হুযুর (সাঃ)-কে আমার কাছে প্রেরণ করেছে, যাতে আমি তাকে তাঁর স্বপ্ন ও জাগরণের বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করি। সেমতে তিনি আমার কাছে এসে এমন বিশ্বয়কর কথা বর্ণনা করলেন, যা শুনে শরীর শিউরে উঠে। তা এইঃ আমি আল্লাহর বিশ্বস্ত ফেরেশতা জিবরাঈলকে দেখেছি। তিনি ভয়াবহ আকৃতি ধারণ করে আমার সামনে আসেন। এরপর জিবরাঈল থেমে রইলেন এবং আমি ঘাবড়ে গেলাম সেই বৃক্ষের কারণে, যা আমার চলার পথে পড়ত এবং আমাকে সালাম করত। আমি মোহাম্মদ (সাঃ)-কে বললাম: আমার ধারণা আপনি অতি সত্বর প্রেরিত হবেন এবং অবতীর্ণ সূরাসমূহ তেলাওয়াত করবেন। আমার জানও এ ধারণার সত্যায়ন করে। আমি আপনার খেদমতে উৎসাহের সাথেই উপস্থিত হব, যদি আপনি জেহাদ ঘোষণার মাধ্যমে কাফেরদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেন। তায়ালেসী, তিরমিযী ও বায়হাকী হযরত জাবের ইবনে সামুরাহ (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন: মক্কায় একটি পাথর আছে। যে রাতে আমি নবুওয়তে ভূষিত হই, সে রাতে সে আমাকে সালাম করেছিল। আমি সেটির কাছ দিয়ে গমন করলে বিলক্ষণ চিনতে পারি।
পৃষ্ঠা:০৪
মুসলিম এ রেওয়ায়েতই এভাবে বর্ণনা করেছেন: আমি মক্কার সেই পাথরটিকে চিহ্নিত করতে পারি, যে নবুওয়তপ্রাপ্তির পূর্বে আমাকে সালাম করত। আমি এখনও তাকে চিনি। তিবরানী, আবূ নয়ীম ও বায়হাকী হযরত আলী (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তিনি বলেন: আমরা রসুলুল্লাহর (সাঃ) সাথে যখন মক্কায় ছিলাম, তখন একদিন তিনি আমাদেরকে সঙ্গে নিয়ে শহরের একদিকে চলে গেলেন। তাঁর সামনে যে-কোন বৃক্ষ, টীলা ও পাথর পড়ত, সে-ই তাঁকে “আসসালামু আলাইকা ইয়া রসূলাল্লাহ” বলত। আমি তা শুনতাম। তিরমিযী এ রেওয়ায়েতটিকে হাসান এবং হাকেম ছহীহ্ বলেছেন। বাযযার ও আবূ নয়ীম হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন: যখন আল্লাহ তায়ালা আমার কাছে ওহী প্রেরণ করলেন, তখন আমি যে পাথর ও বৃক্ষের কাছে দিয়ে যেতাম, সে-ই আমাকে “আসসালামু আলাইকা ইয়া রসূলাল্লাহ” বলত। ইবনে সা’দ ও আবু নয়ীম বাররাহ্ বিনতে আঁবী তাজরাত থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, যে সময় আল্লাহ তায়ালা হুযুর (সাঃ)-কে নবুওয়ত ও কারামতে ভূষিত করলেন, তখন থেকে তিনি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার জন্য এত দূরে চলে যেতেন, যেখান থেকে কোন গৃহ তাঁর দৃষ্টিগোচর হত না। তিনি গিরিপথে এবং মরুভূমির নিম্ন এলাকায় পৌঁছে যেতেন। তিনি যে বৃক্ষ ও পাথরের কাছ দিয়ে যেতেন, সেটিই তাঁকে “আসসালামু আলাইকা ইয়া রসূলাল্লাহ” বলত। তিনি ডানে বামে ও পশ্চাতে তাকাতেন; কিন্তু কোন জনমানব দৃষ্টিগোচর হত না। আবূ নয়ীম কর্তৃক অন্য তরিকায় বর্ণিত এ রেওয়ায়েতের শেষ ভাগে আছে, হুযূর (সাঃ) “ওয়া আলাইকুমস্ সালাম” বলে জবাব দিতেন। জিবরাঈল (আঃ) তাঁকে সালাম শিক্ষা দিয়েছিলেন।ইবনে সা’দ ও বায়হাকী ইবরাহীম ইবনে মোহাম্মদ ইবনে তালহা ইবনে ওবায়দুল্লাহ থেকে বর্ণনা করেন যে, ইবরাহীম ইবনে মোহাম্মদ বলেন: আমি (তালহা) একবার বুছরার বাজারে গেলাম। হঠাৎ শুনতে পেলাম এক সন্ন্যাসী তার উপাসনালয়ে বসে বলছিল: এই আগন্তুকদেরকে জিজ্ঞাসা কর তাদের মধ্যে হেরেমের অধিবাসী কেউ আছে কিনা? তালহা বলেন: আমি বললামঃ আমি হেরেমবাসী। সন্ন্যাসী জিজ্ঞাসা করল? আহমদ আত্মপ্রকাশ করেছেন কি? আমি বললামঃ কোন আহমদ? সে বলল: ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিব। তাঁর আত্মপ্রকাশের মাস এটাই। তিনি সর্বশেষ নবী। তাঁর আত্মপ্রকাশের স্থান হচ্ছে হেরেমে এবং হিজরতের স্থান খর্জুর শোভিত প্রস্তরময় লবণাক্ত ভূমি। তাঁর প্রতি ঈমান আনায় তোমাদের অগ্রগামী হওয়া উচিত। তালহা বলেনঃ সন্ন্যাসীর কথা আমার অন্তরে স্থান করে নিল। আমি দ্রুতগতিতে মক্কায় পৌঁছলাম এবং মানুষের কাছে জিজ্ঞাসা করলাম, নতুন কিছু ঘটেছে কিনা? তারা বলল: হাঁ, মোহাম্মদ ইবনে আবুদুল্লাহ নবুওয়ত পাওয়ার কথা বলছেন। আবু বকর ইবনে আবু কোহাফা তাঁর অনুসরণ করছেন। আমি সেখান থেকে বের হয়ে আবু বকর (রাঃ)-এর কাছে এলাম এবং সন্ন্যাসীর কথাবার্তা সম্পর্কে তাকে অবহিত করলাম। তিনি রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে এসব কথা জানালে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। অতঃপর আমিও ইসলাম গ্রহণ করে ধন্য হলাম। নওফেল ইবনে আদভিয়া হযরত আবু বকর ও তালহা উভয়কে ধরে এক রশিতে বেঁধে ছিল। এজন্যে তাঁদেরকে “কুরায়নাইন” (দুই সহচর) নামে অভিহিত করা হয়। আবূ নয়ীম ইকরামা থেকে এবং তিনি হযরত আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, হযরত আব্বাস বলেন: আমি বাণিজ্য উপলক্ষে সেই কাফেলার সঙ্গে এয়ামন গেলাম, যাদের মধ্যে আবু সুফিয়ান ইবনে হরবও ছিলেন। সেখানে হানযালাহ ইবনে আবু সুফিয়ানের চিঠি পৌছল এই মর্মে যে, মোহাম্মদ (সাঃ) ঘোষণা করছেন যে, তিনি আল্লাহতায়ালার রসূল ও তাঁর প্রতি আহবান কারী। এ সংবাদটি সমগ্র এয়ামনেও ছড়িয়ে পড়ল। আমাদের কাছে জনৈক ইহুদী আলেম এসে বলল: যিনি নবুওয়ত দাবী করেছেন, আমি জানতে পারলাম তোমাদের মধ্যে তাঁর একজন চাচা রয়েছেন। হযরত আব্বাস বলেনঃ আমি বললাম, হাঁ, আমিই তাঁর চাচা। ইহুদী আলেম বলল: আমি আপনাকে কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করছি-আপনার ভাতিজার মধ্যে যৌবনের চপলতা কিংবা জ্ঞানবুদ্ধির অভাব আছে কি? হযরত আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ আমি জবাব দিলাম, আবদুল মুত্তালিবের আল্লাহর কসম, কোনটিই নেই। তিনি কখনও মিথ্যা বলেন নি, বিশ্বাসঘাতকতা করেন নি। তিনি কোরায়শদের মধ্যে “আমীন” উপাধিতে ভূষিত আছেন। ইহুদী আলেম জিজ্ঞাসা করল: তিনি কি স্বহস্তে লিখেন? আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ এই প্রশ্ন শুনে আমার ধারণা হল যে, হুযুর (সাঃ)-এর জন্যে স্বহস্তে লিখা বোধ হয় ভাল হবে। তাই আমি ইচ্ছা করলাম যে বলি, জ্বী “হা, তিনি স্বহস্তে লিখেন। কিন্তু আবু সুফিয়ান তা খণ্ডন করবে-এই ভয়ে আমি সত্য কথাই বললাম এবং জবাব দিলাম- না, তিনি স্বহস্তে লিখেন না। একথা শুনে ইহুদী আপন জায়গা থেকে লাফিয়ে উঠল এবং স্বীয় চাদর ছেড়ে একথা বলতে বলতে চলে গেল। ইহুদীদের সর্বনাশ হয়েছে, ইহুদীদেরকে হত্যা করা হয়েছে। আব্বাস (রাঃ) বলেন: আমরা আমাদের অবস্থান স্থলে ফিরে এলে আব সুফিয়ান বললেনঃ আবুল ফয়ল। তোমার ভাতিজাকে ইহুদীরা ৩য় করে। আমি
পৃষ্ঠা:০৫
বললাম: তুমিও তো দেখলে। এখন বল তোমার কি ইচ্ছা? মোহাম্মদ (সাঃ)-এর প্রতি ঈমান আন। যদি তাঁর দাবী সত্য হয়, তবে সত্যের প্রতি অগ্রগামীদের একজন হবে। আর মিথ্যা হলে তুমি একা নও; বরং তোমার সাথে তারাও থাকবে, যারা তোমার সমকক্ষ। তাদের যা পরিণাম হবে, তোমারও তাই হবে।আবু সুফিয়ান বললেনঃ আমি কুফায় অশ্বারোহী দলকে না দেখা পর্যন্ত তাঁর প্রতি ঈমান আনব না।আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেনঃ আমি আবু সুফিয়ানকে বললাম: তুমি কি বল? সে বললঃ ব্যস, আর জিজ্ঞেস করো না। এমনিতেই মুখ দিয়ে একটি কথা বের হয়ে পড়েছে। আমি জানি আল্লাহ অশ্বারোহী দলকে কুফায় আত্মপ্রকাশ করতে। দিবেন না।আব্বাস (রাঃ) বলেন: রসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন মক্কা জয় করলেন, তখন আমরা অশ্বারোহী দলকে কুফা থেকে আত্মপ্রকাশ করতে দেখেছি। আমি আবু সুফিয়ানকে বললাম: তুমি কি বলেছিলে মনে পড়ে? আবু সুফিয়ান বললেন: হাঁ, আল্লাহর কসম, এখন আমি সেই বিষয়টিই স্মরণ করছি।আবু নয়ীম মোয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আবু সুফিয়ান (রাঃ) বলেছেন-আমি এবং উমাইয়া ইবনে আবু ছত উভয়েই বাণিজ্য ব্যপদেশে সিরিয়া গিয়েছিলাম। সেখানে পৌঁছে উমাইয়া বলল ও চল, আমরা একজন খৃষ্টান আলেমের সাথে দেখা করি। কিতাব সম্পর্কে তিনি অগাধ জ্ঞানের অধিকারী। আমরা তাকে কিছু প্রশ্ন করব। আবু সুফিয়ান বর্ণনা করেন: আমি উমাইয়াকে বললাম: এই আলেমকে কোন প্রশ্ন করার প্রয়োজন আমার নেই। শেষ পর্যন্ত উমাইয়া একাই গেল এবং ফিরে এল। সে বর্ণনা করল। আমি সেই আলেমের কাছে গিয়ে তাকে অনেক প্রশ্ন করেছি। আমি তাকে বলেছি যে, প্রতীক্ষিত নবী সম্পর্কে আপনি যা জানেন বলুন। খৃষ্টান আলেম বললেনঃ সেই নবী একজন আরব হবেন। আমি বললামঃ কোন্ আরব? তিনি বললেন: আরবরা যে বায়তুল্লাহর হজ্ব করে, তিনি সেই বায়তুল্লাহর অধিবাসীদের একজন হবেন। তিনি কোরায়শ বংশোদ্ভূত হবেন। আমি বললামঃ তাঁর কিছু গুণাবলী বর্ণণা করুন। তিনি বললেনঃ তিনি একজন যুবক। তিনি যখন প্রৌঢ়ত্বের সীমায় পৌঁছাবেন, তখন তাঁর নবুওয়ত প্রকাশ পাবে। তিনি জুলুম-নিপীড়ন ও হারাম বিষয়াদি থেকে দূরে থাকবেন, আত্মীয়ের সাথে সদয় ব্যবহার করবেন, অন্যকেও এরূপ করতে বলবেন। তিনি মাতাপিতা উভয় দিক দিয়ে সম্ভ্রান্ত হবেন। তাঁর গোত্র মধ্যবিত্ত হবে, তাঁর অধিকাংশ সৈন্য হবে ফেরেশতা। আমি জিজ্ঞাসা করলামঃ তাঁর আগমনের চিহ্ন কি হবে? তিনি বললেন: হযরত ঈসা (আঃ)-এর ইন্তিকালের পর সিরিয়ায়। ত্রিশটি ভূমিকম্প হয়েছে। প্রতিটি ভূমিকম্প ছিল এক মহাবিপদ। কেবল একটি ভূমিকম্প বাকী রয়ে গেছে। তাতেও মানুষের প্রভূত দুঃখ-দুর্দশা হবে। আবু সুফিয়ান বর্ণনা করেন, উমাইয়ার কাছে এসব কথা শুনে আমি বললামঃ আল্লাহর কসম, এসব কথা সত্য নয়। উমাইয়া বলল: আমি যার কসম খাই, তার কসম, এটা বাস্তবিক সত্য। আবু সুফিয়ান বর্ণনা করেন। এরপর আমরা সিরিয়া থেকে স্বদেশ অভিমুখে রওয়ানা হলাম। পথিমধ্যে হঠাৎ শুনতে পেলাম এক অশ্বারোহী আমাদের পশ্চাতে বলছে-তোমাদের চলে আসার পরে সিরিয়ায় এক প্রলয়ংকরী ভূমিকম্প হয়েছে। এতে অনেক মানুষ নিহত হয়েছে এবং অনেক মানুষ ব্যাপক দূর্ঘটনায় পতিত হয়েছে। আবু সুফিয়ান বর্ণনা করেন, উমাইয়া আমার সামনে এল এবং বললঃ এখন খৃষ্টান আলেমের উক্তি সম্পর্কে তোমার মত কি? আমি বললামঃ আল্লাহর কসম, তার কথা ঠিক। এরপর আমি মক্কায় এলাম এবং পণ্য-সামগ্রী বিক্রয় করলাম। এরপর আমি বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে এয়ামন রওয়ানা হলাম। এয়ামনে পাঁচ মাস অবস্থান করার পর মক্কায় ফিরে এলাম। মানুষ আমার কাছে এসে সালাম করত এবং তাদের প্রদত্ত পুঁজি সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করত। এরপর নবী করীম (সাঃ) আমার কাছে এসে সালাম করলেন। তিনি আমাকে সফরের অবস্থা এবং অবস্থানস্থল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। কিন্তু নিজের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসা না করেই উঠে দাঁড়ালেন।আবূ সুফিয়ান বলেন: আমি হিন্দাকে বললাম, আল্লাহর কসম, আমি আশ্চর্য বোধ করি যে, কোরায়শ গোত্রের প্রতিটি ব্যক্তির পুঁজি আমার কাছে রয়েছে। তারা এসে নিজেদের হিসাব সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। কিন্তু মোহাম্মদ (সাঃ) এ সফরে যে পুঁজি বিনিয়োগ করেছিলেন সে সম্পর্কে কোন জিজ্ঞাসাই করেননি।হিন্দা বললঃ তুমি তাঁর শান সম্পর্কে অবগত নও। তিনি তো আল্লাহর রসূল হওয়ার ধারণা পোষণ করেন।আবু সুফিয়ান বলেন: তখন খৃষ্টান আলেমের কথা আমার মনে পড়ে গেল। আমি হিন্দাকে বললাম: তাঁর এই দাবী সম্পর্কে তিনিই ভাল বলতে পারেন। হিন্দা বলল: তিনি তো একথাই বলেন যে, তিনি আল্লাহর রসুল। হযরত আমীর মোয়াবিয়া (রাঃ) পিতা আবু সুফিয়ান থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তিনি (আবু সুফিয়ান) বর্ণনা করেছেন, আমরা গাজা অথবা ইলিয়ায় ছিলাম, উমাইয়া ইবনে ছলত আমাকে বলল: আবু সুফিয়ান। ওতবা ইবনে রবিয়ার হাল
পৃষ্ঠা:০৬
হকিকত বর্ণনা কর। আমি বললামঃ বরং তুমি বর্ণনা কর। উমাইয়া বললঃ প্রতব্য উভয় তরফ থেকে সম্ভ্রান্ত। সে জুলুম-নিপীড়ন ও হারাম বিষয়াদি থেকে দূরে থাকে। আমি বললাম তাই সে ভদ্র ও সচ্চরিত্র। উমাইয়া বলল: তুমি কি ওতবাকে দোষারোপ করছ? আমি বললাম : তুমি ভুল বলছ; বরং বয়স যতই বাড়ে, ভদ্রতা ততই বাড়ে। উমাইয়া বলল: তুমি কথাবার্তায় তড়িঘড়ি করো না। আমি বলছি-আমি কিতাবে পাই যে, একজন নবী হবেন এবং তিনি আমাদের এই হাররার মধ্য থেকে হবেন। আমার ধারণা ছিল যে, তিনি আবদে মানাফ থেকে হবেন। আবদে মানাফের মধ্যে গভীর দৃষ্টিপাত করে দেখলাম যে, ওতবা ছাড়া অন্য কারও মধ্যে নবী হওয়ার যোগ্যতা নেই। কিন্তু তুমি যখন ওতবার বয়স বৃদ্ধির কথা আমাকে বললে, তখন আমি বুঝলাম যে, ওতবা সেই সম্ভাব্য নবী নয়। কেননা, বয়স চল্লিশ বছর পার হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তাঁর প্রতি ওহী নাযিল হয়নি।আবু সুফিয়ান বলেনঃ আমি যখন সফর থেকে ফিরে এলাম, তখন মোহাম্মদ (সাঃ)-এর প্রতি ওহী নাযিল শুরু হয়েছে বলে শুলাম। আমি সওদাগরদের একটি দলের সাথে আবার ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম এবং উমাইয়ার কাছ দিয়ে গেলাম। আমি বিদ্রূপের ভঙ্গিতে তাকে বললাম: উমাইয়া। যে নবীর কথা তুমি বলতে, তিনি আত্মপ্রকাশ করেছেন। উমাইয়া বলল তিনি সত্য নবী। তুমি তাঁর অনুসরণ কর। বিশ্বাস রাখ আমিও তোমার সাথে তাঁর অনুসরণ করব। আবু সুফিয়ান। যদি তুমি তাঁর বিরোধিতা কর, তবে একদিন ছাগলের বাচ্চার ন্যায় বাঁধা অবস্থায় তাঁর কাছে নীত হবে। তিনি তোমার সম্পর্কে যা ইচ্ছা ফয়সালা করবেন।হারেছ ইবনে উসামা স্বীয় মসনদে ইকরামা ইবনে খালেদ থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, নবী করীম (সাঃ)-এর আবির্ভাবের সময় কিছু লোক সমুদ্রে এক নৌকায় সওয়ার হয়। প্রতিকূল বায়ু তাদেরকে এক অজানা সামুদ্রিক দ্বীপে নিয়ে যায়। তারা সেই দ্বীপে এক ব্যক্তিকে পায়। সে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করল। তোমরা কে? তারা বলল: আমরা কোরায়শী। প্রশ্ন হলঃ কোরায়শী কারা? তারা বলল। হেরেমের অধিবাসী এবং তৎসঙ্গে পরিচিতিমূলক কিছু বর্ণনা দিল। সে বলল: না তোমরা হেরেমের অধিবাসী, না আমরা। পরে দেখা গেল যে, লোকটি জুরহাম গোত্রের একজন। সে বললঃ তোমরা জান কি উৎকৃষ্ট ঘোড়ার নাম “জিয়াদ” কেন হল? কারণ আমাদের ঘোড়া অত্যন্ত দ্রুতগামী।এরপর কোরায়শীরা বলল: আমাদের মধ্যে একব্যক্তি নবুওয়ত দাবী করে। একথা শুনে সে বললঃ তোমরা এই নবীর অনুসরণ কর। আমি ভাল অবস্থায় নাই, তা না হলে আমিও তোমাদের সাথে এই নবীর কাছে পৌছে যেতাম।ইবনে আসাকির আবদুর রহমান ইবনে হুমায়দের দাদা হুমায়দ ইবনে আবদুর রহমান থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তিনি বলেন- আমি হুযুর (সাঃ)-এরআবির্ভাবের এক বছর পূর্বে এয়ামন গেলাম এবং আসকালান ইবনে আওয়াকেন হেমইয়ারীর কাছে অবস্থান করলাম। আসকালান ছিলেন অত্যাধিক বয়োঃবৃদ্ধ ব্যক্তি। এর আগে আমি যখনই এয়ামন যেতাম, তাঁর কাছেই অবস্থান করতাম। তিনি সর্বদাই আমাকে মক্কা, বায়তুল্লাহ এবং যমযম সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতেন। তিনি আরও জিজ্ঞাসা করতেন যে, তোমাদের মধ্যে কেউ আত্মপ্রকাশ করেছে কি? তাঁর জন্যে একটি খবর আছে। তাঁর কাছে একটি কিতাব আছে। তোমাদের মধ্যে কেউ কি তোমাদের বর্তমান ধর্মের বিরোধিতা করেছে? আমি তাকে বলতাম- না, এখন পর্যন্ত এমন কোন বিষয় প্রকাশ পায়নি।এবার যখন আমি তাঁর কাছে এলাম, তখন তিনি খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন এবং শ্রবণশক্তিও হ্রাসপাচ্ছিল। আমি তাঁর কাছে অবতরণ করলে তাঁর পুত্র ও পৌত্ররা সমবেত হল। তারা আমাকে তাঁর অবস্থা সম্পর্কে অবগত করল। তিনি নিজে চোখের উপর একটি পট্টি বাঁধলেন এবং বালিশে হেলান দিয়ে বসলেন। অতঃপর বললেন: কোরায়শী ভাই! আমার কাছে তোমার বংশপরিচয় বর্ণনা কর। আমি বললাম: আমি আবদুর রহমান ইবনে আওফ হবনে আবদে মানাফ ইবনে হারেছ ইবনে যুহরা। তিনি বললেন: যুহরার ভাই ছিল। এই বংশ পরিচয় যথেষ্ট। আমি কি তোমাকে এমন সুসংবাদ দিয়ে আনন্দিত করব না, যা তোমার জন্যে এই বাণিজ্য অপেক্ষা উত্তম?আমি বললাম: অবশ্যই সুসংবাদ দিন। তিনি বললেন: আমি তোমাকে একটি বিস্ময়কর বিষয় সম্পর্কে অবহিত করছি। একটি কাম্য বস্তুর সুসংবাদ দিচ্ছি। তা এই যে, আল্লাহ তায়ালা গত মাসে তোমাদের গোত্রে একজন নবী প্রেরণ করেছেন, তাঁর উপর কিতাব নাযিল করেছেন এবং তাঁর জন্যে ছোয়াব নির্ধারিত করেছেন। তিনি প্রতিমার পূজা করতে নিষেধ করেন এবং বাতিলকে প্রতিহত করেন।আবদুর রহমান বর্ণনা করেন: আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম যে, এই নবী কাদের মধ্য থেকে আবির্ভূত হয়েছেন? তিনি বললেনঃ তিনি অন্য কোন গোত্র থেকে নয়-বনী-হাশেম গোত্র থেকে। তোমরা হলে তাঁর মাতুল গোষ্ঠি। আবদুর রহমান, এখানে বেশীদিন থেকো না, তাড়াতাড়ি ফিরে যাও। সেখানে যেয়ে তাঁকে সাহায্য কর এবং তাঁর সত্যায়ন কর। তাঁর খেদমতে আমার এই কবিতাগুলো পেশ করবে। আমি আল্লাহর অস্তিত্বের সাক্ষ্য দেই, যিনি সুউচ্চ এবং রাতের অন্ধকার ও ভোরের আলো প্রকাশ করেন। তিনি গৌরব ও বীরত্বে কোরায়শ বংশীয়। হে সেই মহোত্তম ব্যক্তির সন্তান। যাঁর যবেহের বিনিময়ে ফিদিয়া দেয়া হয়েছে।
পৃষ্ঠা:০৭
তাঁকে প্রেরণ করা হয়েছে। তিনি সত্যের দিকে আহ্বান করেন এবং ন্যায় ও কল্যাণের পথ প্রদর্শন করেন। আমি আল্লাহর অস্তিত্বের সাক্ষ্য দেই, যিনি মুসা (আঃ)-এর প্রতিপালক।তিনি বাতহায় প্রেরিত হয়েছেন। আপনি আল্লাহর দরবারে আমার জন্যে সুপারিশ করুন। আল্লাহ মানুষকে সাফল্যের দিকে আহবান করেন।আবদুর রহমান বর্ণনা করেন: আমি এই কবিতাগুলো মুখস্থ করে নিলাম। অতঃপর সেখানে আমার প্রয়োজন দ্রুত সমাধা করে মক্কায় ফিরে এলাম। আমি হযরত আবূ বকর (রাঃ)-এর সাথে দেখা করে এ ঘটনা সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করলাম। তিনি বললেন: আল্লাহতায়ালা মোহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ (সাঃ)-কে মানব জাতির প্রতি রসূল করে প্রেরণ করেছেন। তুমি তাঁর কাছে যাও। আবদুর রহমান বলেন: আমি হুযুর (সাঃ)-এর খেদমতে উপস্থিত হলাম। তিনি তখন হযরত খাদিজা (রাঃ)-এর গৃহে ছিলেন। আমাকে দেখে মুচকি হেসে বললেন : বল, কি খবর? আমি একজন চরিত্রবান ব্যক্তির মুখমণ্ডল দেখছি। আমি তার জন্যে কল্যাণের আশা রাখি, যাকে তুমি পিছনে ছেড়ে এসেছ। আনি আরয করলামঃ হে মোহাম্মদ। কার কথা বলছেন। হুযুর (সাঃ) এরশাদ করলেন: তুমি আমার কাছে কোন আমানত নিয়ে এসেছ এবং কেউ তোমাকে পয়গাম দিয়ে প্রেরণ করেছে। বল, সেই পয়গাম কি? আমি বৃদ্ধ হেমইয়ারীর কবিতা সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করলাম এবং ইসলাম গ্রহণ করে ধন্য হলাম। অতঃপর রসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করলেন: হেমইয়ারী ভাই বিশেষ শ্রেণীর মুমিন। অতঃপর বললেন: পরওয়ারদেগার! অনেক মানুষ আমার প্রতি ঈমান এনেছে, অথচ তারা আমাকে দেখেনি। অনেক মানুষ আমার সত্যায়ন করেছে; অথচ তারা আমার কাছে হাযির হয়নি। এরা আমার সত্যিকার ভাই। অতীন্দ্রিয়বাদীদের কথা ও গায়েবী আওয়াজ ইমাম বোখারী হযরত ওমর ফারুক (রাঃ)-এর বাচনিক রেওয়ায়েত করেন যে, তার কাছ দিয়ে জনৈক সুশ্রী ব্যক্তি গমন করলে তিনি তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন। লোকটি বললঃ আমি মূর্খতাযুগে আরবের অতীন্দ্রিয়বাদী ছিলাম। হযরত ওমর (রাঃ) তাকে প্রশ্ন করলেনঃ তোমার নারী জিন তোমার কাছে যেসব খরব নিয়ে আসত, সেগুলোর মধ্যে সর্বাধিক আশ্চর্যজনক খবর কোনটি ছিল? সে বলল। একদিন আমি যখন বাজারে ছিলাম, তখন সেই নারী জিন আমার কাছে এল। তার আগমনে আমি যে কি পরিমাণ খাড়বে গেলাম, তা আমিই জানি। সে এসে এই কবিতা পাঠ করলঃ : তুমি জিন ও তাদের অবচেতন অবস্থা দেখনি। তাদের নৈরাশ্য দেখনি। উট ও উটের গদির সাথে জিনদের সংযুক্ত হওয়া দেখনি। হযরত ওমর (রাঃ) বললেন: তুমি ঠিক বলেছ। আমিও আরবের মাবুদদের কাছে এক রাত অতিবাহিত করেছিলাম। গভীর রাতে এক ব্যক্তি একটি বাছুর নিয়ে এল এবং যবেহ করল। বাছুরের ভিতরে কেউ এমন জোরে চীৎকার করল যে, আমি কখনও এমন চীৎকার শুনিনি। চীৎকারকারী বলছিল: ইয়া জলীহু, এ বিষয়টি মুক্তিদাতা, সেই ব্যক্তি উপদেশ দাতা, সে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলে; অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই। এটা শুনে সকলেই হতবাক হয়ে গেল এবং লাফিয়ে উঠে সেখান থেকে পলায়ন করল। আমি মনে মনে বললামঃ আমি এর পরিণতি না দেখে যাব না। এরপর দ্বিতীয়বার ও তৃতীয় বার তোমনিভাবে আওয়াজ করল। আমি সেখান থেকে চলে এলাম। এই ঘটনার কয়েকদিন পরই রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নবুওয়ত লাভের। খবর শুনা গেল। ইবনে সা’দ ও বায়হাকী মোজাহিদ থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, বনী গেফার গোত্র এমর্মে একটি বাস্তুর মান্নত করে যে, তাদের কোন এক প্রতিমার কাছে নৈকট্য লাভের জন্যে বাছুরটি যবেহ করবে। হঠাৎ সেই বাছুরটি এই বলে চীৎকার। করতে থাকে- يا الذريع أمر نجيح صالح يصبح لسان فصيح يدعو بمكة ان لا اله الا الله এই চীৎকার শুনে তারা বায়ুর যবেহ না করে চলে গেল। ইতিমধ্যেই নবী করীম (সাঃ) প্রেরিত হয়ে গেলেন। ইমাম আহমদ ও বায়হাকী মোজাহিদ থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তিনি বলেনঃ আমাদের জনৈক বৃদ্ধ ব্যক্তি বলেছেন-আমি আমার পরিবারের একটি গাভী পালছিলাম। হঠাৎ আমি তার পেট থেকে এই আওয়াজ শুনতে পেলাম। بالذرية قول فصيح رجل يصيح أن لا اله الا الله মক্কায় পৌছে দেখলাম যে, নবী করীম (সাঃ) প্রেরিত হয়ে গেছেন।
পৃষ্ঠা:০৮
বারা ইবনে আযেব থেকে বর্ণিত বায়হাকীর রেওয়ায়েতে আছে যে, ওমর ফারুক (রাঃ) সওয়াদ ইবনে কাবেরকে বললেন: তুমি তোমার ইসলাম গ্রহণের সূচনা বর্ণনা কর। সওয়াদ বললেনঃ এক জিন আমার সহচর ছিল। একদিন যখন আমি নিদ্রিত ছিলাম, সেই জিন হঠাৎ আমার কাছে এসে বলল: উঠ এবং বুঝ। লুয়ই ইবনে গালেবের বংশধর থেকে একজন রসূল প্রেরিত হয়েছেন। এরপর সে এই কবিতা পাঠ করলঃ: আমি জিন, তাদের নাপাক লোক এবং উটের পিঠে তাদের গদি বাঁধার কারণে আশ্চার্যান্বিত হই।জিনরা মক্কার দিকে ধাবিত হচ্ছে। তারা হেদায়েত অন্বেষী। তাদের মধ্যে যারা মুমিন, তারা নাপাক জিনদের মত নয়।হাশেমের অধস্তন এই পুরুষের দিকে মনোযোগী হও এবং হাশেমের মর্যাদার প্রতি দৃষ্টি তুলে দেখ।সওয়াদ বর্ণনা করেন-সে আমাকে জাগ্রত করল এবং সতর্ক করে বললঃ হে সওয়াদ। আল্লাহতায়ালা একজন নবী প্রেরণ করেছেন। তুমি তাঁর কাছে গেলে হেদায়েত পাবে। দ্বিতীয় রাতেও সে আমার কাছে এল এবং আমাকে জাগ্রত করে এই কবিতা পাঠ করল: আমি জিন, তাদের অন্বেষণ এবং যারা উটের পিঠে গদি বাঁধে, তাদের আচরনে আশ্চর্যান্বিত হই। তারা মক্কা অভিমুখে আসছে। তারা হোদায়েতের অন্বেষী। জিনদের মধ্যে যারা সত্যবাদী, তারা মিথ্যুকদের মত নয়।বনী হাশেমের মনোনীত ব্যক্তিত্বের দিকে চল। অগ্রবর্তী জিনরা পরবর্তীদের মত নয়। তৃতীয় রাতে সে এসে আমাকে জাগ্রত করল এবং এই কবিতা আবৃত্তি করলঃ : আমি জিন ও তাদের বীরত্বের কারণে আশ্চর্য হই আরও এ কারণে যে, তারা উটের পিঠে হাওদা বাঁধে। মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হচ্ছে হেদায়েতের আকাঙ্ক্ষায়। দুষ্ট জিন পছন্দনীয় জিনদের অনুরূপ নয়। সওয়াদ বর্ণনা করেন-আমি যখন দেখলাম যে, এই জিন এক রাতের পর দ্বিতীয় এবং তৃতীয় রাতেও আমাকে এ বিষয়ের প্রতিই আকৃষ্ট করছে, তখন আমার মনে ইসলামের প্রতি আকর্ষণ স্থান করে নিল। আমি হুযুর (সাঃ)-এর খেদমতে উপস্থিত হলাম। তিনি আমাকে দেখে মারহাবা বললেন এবং এরশাদ করলেনঃ হে সওয়াদ ইবনে কাবের। আমি জানি তোমাকে কিসে টেনে এনেছে। আমি আরয করলাম। ইয়া রসূলাল্লাহ! আমি কিছু কবিতা রচনা করেছি। আপনি সেগুলো শুনুন। অতঃপর আমি আবৃত্তি করলাম। : আমার কাছে নিদ্রাবস্থায় রাতের পর রাতে এক সুশ্রী ব্যক্তি আগমন করল। আমি যে বিষয়ে তাকে পরীক্ষা করেছি, তা মিথ্যা নয়। সে তিন রাত পর্যন্ত এসেছে। প্রতিরাতেই সে বলেছে যে, তোমার কাছে লুওয়া ইবনে গালেবের বংশধর থেকে একজন রসূল এসেছেন। আমি সফর করতে প্রস্তুত হলাম। দ্রুতগামী বড় মুখবিশিষ্ট উন্ত্রী প্রান্তরের পর প্রান্তর অতিক্রম করার পর আমাকে আপনার কাছে পৌছিয়েছে। আমি সাক্ষ্য দেই যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন প্রতিপালক নেই। আপনি প্রত্যেক অদৃশ্য বিষয়ে বিশ্বস্ত।শাফায়াতের দিক দিয়ে আপনি অন্যান্য পয়গাম্বর অপেক্ষা অধিক নৈকট্যশীল। হে পবিত্র ও মহান ব্যক্তি বর্গের সন্তান! হে সৃষ্টির সেরা, আপনার কাছে আগত বিষয় সম্পর্কে আমাদেরকে আদেশ করুন যদিও তাতে এমন শ্রম ও কঠোরতা থাকে, যা মানুষকে বৃদ্ধ করে দেয়। আপনি সেই দিন যেন আমার শাফায়াত করুন, যেদিন আপনি ছাড়া কোন শাফায়াতকারী সওয়াদ ইবনে কাবেরকে অবমুক্ত করতে পারবে না। ইমাম সুয়ূতী বর্ণনা করেন: এই হাদীসটি একাধিক তরিকায় বর্ণিত আছে। যেমন ইবনে শাহীন ‘সাহাবা’ গ্রন্থে ফযল ইবনে ঈসা কারশীর তরিকায় আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) থেকে বিস্তারিত ঘটনা উদ্ধৃত করেছেন যে, সওয়াদ ইবনে কাবের হুযুর (সাঃ)-এর খেদমতে উপস্থিত হয়েছেন। হাসান ইবনে সুফিয়ান স্বীয় মসনদে হুসাইন ইবনে আম্মারার তরিকায় বর্ণনা করেছেন যে, সওয়াদ হযরত ওমর ফারুক (রাঃ)-এর কাছে এসেছেন। এরপর বিস্তারিত ঘটনা উল্লেখ করেছেন। বোখারী স্বীয় ইতিহাস গ্রন্থে এবং বগভী ও তিবরানী এবাদ ইবনে আবদুস ছামাদের তরিকায় সায়ীদ ইবনে জুবায়র (রাঃ) থেকে সওয়াদের বিস্তারিত রেওয়ায়েত উদ্ধৃত করেছেন। হাসান ইবনে সুফিয়ান, আবু ইয়ালা, হাকেম, বায়হাকী ও তিবরানী ওছমান ইবনে আবদুর রহমানের মাধ্যমে মোহাম্মদ ইবনে কা’ব কুরশী (রাঃ) থেকে দীর্ঘ রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন। এ ছাড়া এ রেওয়ায়েতটি ইবনে আবী খায়ছামা ওরুয়ানী স্বীয় মসনদে এবং খারায়েতী আবূ জা’ফর বাকের (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন। বায়হাকী হেশাম ইবনে মোহাম্মদ কলবী থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তিনি বলেন: বনী তায় গোত্রের একজন শায়খ আমার কাছে বর্ণনা করেছেন যে, মাযান
পৃষ্ঠা:০৯
খবর মদীনায় আসে জনৈকা মহিলার এক অনুগত জিন মারফত। জিনটি একদিন পাখীর আকৃতি ধারণ করে তার প্রাচীরে বসে গেল। মহিলা তাকে বলল: নিচে এস, সে বললঃ না। কারণ, মক্কায় এক নবী প্রেরিত হয়েছেন। তিনি আমাদেরকে কুকর্ম করতে নিষেধ করেছেন এবং আমাদের জন্যে যিনা হারাম করেছেন।তায়ী আখানে অবস্থান করে পারিবারিক প্রতিমার সেবা করত। তার নিজের “নাজেষ” নামক একটি প্রতিমা ছিল। মাযান বলেন: আমি একদিন একটি জন্তু যবেহ করলে প্রতিমার মুখ থেকে আওয়াজ শুনলাম; মাযান। আমার কাছে এস, আমার কাছে এস!! তুমি এমন কথা শুনবে, যা গোপন থাকার নয়। বুঝে নাও ইনি প্রেরিত রসূল। তিনি আল্লাহর তরফ থেকে সত্য এনেছেন। তুমি এই নবীর প্রতি ঈমান আন, যাতে অগ্নি স্ফুলিঙ্গের তাপ থেকে রক্ষা পাও। এই অগ্নির ইন্ধন। পাথর। মাধান বলেন: আমি মনে মনে বললাম: ভারী আশ্চর্যের বিষয়। অতঃপর কিছুদিন পরে আমি একটি জন্তু যবেহ করলাম। এবার পূর্বের তুলনায় বেশি ও অধিক স্পষ্ট আওয়াজ শুনলাম। প্রতিমা বলছিল: মাযান, শুন। তুমি আনন্দিত হবে। কল্যাণ বিকাশ লাভ করেছে এবং অনিষ্ট আত্মগোপন করেছে। তেহামা থেকে মহান আল্লাহর ধর্মসহ একজন নবী প্রেরিত হয়েছেন। পাথর দিয়ে গড়া প্রতিমা ছেড়ে দাও এবং দোযখের তাপ থেকে নিরাপত্তা অর্জন কর। একথা শুনে আমি মনে মনে বললাম, ভারী আশ্চর্যের কথা। নিশ্চয় এটা আমার কাম্য বস্তুই হবে। এরপর আমাদের কাছে হেজাজ থেকে একব্যক্তি আগমন করল। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম: তোমাদের ওখানকার খবর কি? সে বলল: তেহামায় এক ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটেছে। তার কাছে যেই আসে, তাকেই সে বলে-তুমি আল্লাহর দিকে আহ্বানকারীর কথা মেনে নাও। তাঁর নাম আহমদ। আমি মনে মনে বললামঃ আল্লাহর কসম, এটা সেই খবর, যা আমি শুনেছি। এরপর আমি সফর করে রসূলে আকরাম (সাঃ)-এর খেদমতে হাযির হলাম। তিনি আমার কাছে ইসলামের স্বরূপ বর্ণনা করলেন। আমি ইসলাম কবুল করলাম। আমি আরয করলাম: ইয়া রসূলাল্লাহ। আমি গানবাজনা, নারী ও মদের প্রতি ভীষণভাবে আসক্ত। দুর্ভিক্ষ আমাদের উপর প্রাধান্য বিস্তার করে রেখেছে। ধনসম্পদ বিনষ্ট হয়েছে এবং নারী-পুরুষ ও শিশুরা অস্থি কংকালসার হয়ে পড়েছে। আমার কোন পুত্র সন্তান নেই। আপনি আল্লাহতায়ালার কাছে দোয়া করুন। তিনি যেন আমার বিপদাপদ দূর করেন, বৃষ্টিবর্ষণ করেন এবং আমাকে পুত্র সন্তান দান করেন। রসূলে করীম (সাঃ) দোয়া করলেন- ইলাহী। তাকে গান বাজনার বিনিময়ে কোরআন পাকের তেলাওয়াত এবং হারামের বিনিময়ে হালাল দান কর। তাকে বৃষ্টি দিয়ে উপকৃত কর এবং পুত্রসন্তান দান কর। মাযান বর্ণনা করেন- আল্লাহ তায়ালা আমার সমস্ত কষ্ট দূর করে দিলেন। আম্মান সবুজ ও শস্যশ্যামল হয়ে গেল। আমি চারজন আদর্শ মহিলাকে বিয়ে করলাম এবং আল্লাহ আমাকে হাইয়ান ইবনে মাযান দান করলেন।ইবনে সা’দ আহমদ, তিবরানী, বায়হাকী ও আবু নয়ীম হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, নবী করীম (সাঃ) সম্পর্কে সর্বপ্রথম এ রেওয়ায়েতটি ইবনে সা’দ ও বায়হাকী অন্য তরিকায় আলী ইবনে হুসায়ন (রাঃ) থেকে মুরছালও উদ্ধৃত করেছেন। আবূ নয়ীম আরতাত ইবনে মুনযির থেকে রেওয়ায়েত করেছেন যে, তিনি যমরাহ্ থেকে শুনেছেন মদীনার এক নারীর সাথে এক জিনের দৈহিক সম্পর্ক ছিল। জিন একবার উধাও হয়ে গেল এবং অনেক দিন পর্যন্ত তার কাছে এলোনা। এরপর সেই জিন এক ছিদ্রের মধ্য থেকে আত্মপ্রকাশ করল। মহিলা তাকে বললঃ ছিদ্রের মধ্য থেকে আসার অভ্যাস তোমার ছিল না। এখন এলে কেন? জিন বললঃ মক্কায় এক নবী আত্মপ্রকাশ করেছেন। তিনি যে পয়গাম নিয়ে এসেছেন, তা আমি শুনেছি। তিনি যিনা হারাম করেছেন। তাই আজ তোমাকে শেষ ছালাম জানাতে এসেছি। আবু নয়ীমের রেওয়ায়েতে হযরত ওছমান ইবনে আফফান (রাঃ) বলেনঃ হুযুর (সাঃ)-এর নবুওয়ত লাভের পূর্বে আমরা একটি কাফেলার সাথে সিরিয়া গিয়েছিলাম। আমরা সিরিয়ার দ্বারপ্রান্তে থাকতেই এক অতীন্দ্রিয়বাদিনী আমাদের কাছে এসে বলল: আমার অনুগত জিন আমার কাছে এসে দরজায় দাঁড়িয়ে গেল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম: তুমি ভিতরে আসবে না? সে বলল: পথ নেই। আহমদ (সাঃ) আত্মপ্রকাশ করেছেন। তিনি এমন আদেশ এনেছেন, যা সহ্যের বাইরে। একথা বলে অতীন্দ্রিয়বাদিনী চলে গেল। হযরত ওছমান (রাঃ) বলেনঃ আমি মক্কায় ফিরে এসে দেখি নবী করীম (সাঃ) সত্যিই আত্মপ্রকাশ করেছেন এবং মানুষকে আল্লাহর দিকে আহবান করছেন। ইবনে শাহীন, ইবনে মান্দাহ ও আলমায়ানী যথাক্রমে আছছাহাবা, “দালায়েলু-নবুওয়ত” ও “আল-জলীম” গ্রন্থে ইবনে সুবরাহ থেকে রেওয়ায়েত করেছেন যে, তিনি বলেন: আমি হযরত যুবাব ইবনে হারেছ (রাঃ)-এর মুখে শুনেছি যে, ইবনে দাফশার একটি সুশ্রী জিন ছিল। যে কোন ঘটনা ঘটত, সে যুবাবকে অবহিত করত। একদিন সে এসে যুবাবকে কোন বিষয়ে অবহিত করল। এরপর তাকে লক্ষ্য করে বলল: যুবাব। অত্যন্ত আশ্চর্যজনক একটি কথা শুন। মোহাম্মদ (সাঃ)-কে কিতাবসহ প্রেরণ করা হয়েছে। তিনি মক্কায় মানুষকে দাওয়াত দিচ্ছেন; কিন্তু তারা দাওয়াত কবুল করছে না। এর কিছুদিন পরেই আমি রসুলুল্লাহ (সাঃ) সম্পর্কে শুনে ইসলাম গ্রহণ করে ধন্য হলাম।
পৃষ্ঠা:১০
ওমর ইবনে শাবাহ্-জামূহ ইবনে ওছমান গেফারী থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তিনি বলেন: মূর্খতা যুগে একদিন আমরা গৃহে অবস্থানকালে হঠাৎ গভীর রাতে এক চীৎকারকারীর আওয়াজ শুনলাম। সে কিছু সমরসঙ্গীত ও আবৃত্তি করল। দ্বিতীয় ও তৃতীয় রাতেও এমনি শুনা গেল। এর কিছুদিন পরেই রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আবির্ভাবের সংবাদ পাওয়া গেল। ইবনে সা’দ ও ইবনে আসাকির এয়াযিদ ইবনে রোমানী থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, হযরত ওছমান ও হযরত তালহা (রাঃ) উভয়েই রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। হযরত ওছমান (রাঃ) আরষ করলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ। আমি এই মাত্র সিরিয়া থেকে এসেছি। আমরা মায়ান ও সরকার মধ্যবর্তী এক স্থানে নিদ্রিতাবস্থায় ছিলাম। হঠাৎ এক ঘোষক ঘোষণা করল : নিদ্রামপুরা। জাগ্রত হয়ে যাও। আহম্মদ (সাঃ) মক্কায় আত্মপ্রকাশ করেছেন। আমরা মক্কায় পৌঁছে লোকমুখে আপনার কথা শুনলাম। ইবনে সা’দ, আবু নয়ীম ও ইবনে আসাকির সুফিয়ান হুয়ালী থেকে বর্ণনা করেন-আমরা এক কাফেলার সঙ্গে সিরিয়া গেলাম। যারকা ও মায়ানের মধ্যস্থলে পৌছে আমরা রাতের বেলায় সেখানে অবস্থান করলাম। হঠাৎ আমরা এক ঘোড় সওয়ারের আওয়াজ শুনলাম: হে নিদ্রামপুরা। জাগ্রত হয়ে যাও। এটা নিদ্রার সময় নয়। আহমদ (সাঃ) আত্মপ্রকাশ করেছেন। জিনদেরকে শোচনীয়ভাবে হাঁকিয়ে দেয়া হয়েছে।একথা শুনে আমরা সকলেই ভীত হয়ে গেলাম। আমরা সকলেই ছিলাম যুবক ও শক্তিশালী। একথা শুনে আমরা যখন গৃহাভিমুখে ফিরে আসছিলাম, তখন সকলের মুখে একই কথা ছিল। তা এই যে, মক্কায় কোরায়শ বংশীয় এক নই আত্মপ্রকাশ করেছেন, যাঁর নাম আহমদ। কোরায়শরা তাঁর ব্যাপারে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে। আবু নয়ীম এয়াকুব ইবনে এয়াযিদ থেকে বর্ণনা করেন যে, হযরত ওমর ফারুক (রাঃ)-এর সম্মুখ দিয়ে এক ব্যক্তি গমন করলে তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন। ও নিয়া। তুমি তো অতীন্দ্রিয়বাদী। তোমার সঙ্গিনী জিনের সাথে তোমার সম্পর্ক কবে থেকে? সে বলল: আমার ইসলাম গ্রহণের পূর্বে সে। আমার কাছে এসে বলতে লাগলঃبا سلام يا سلام الحق المبين والخير الدائم وغير حلمالنائم الله اكبرউপস্থিত লোকদের মধ্যে একজন বললঃ আমিরুল-মুমিনীন, এ ধঙ্গনের একটি ঘটনা আমি বর্ণনা করছি- একবার আমরা এক পরিষ্কার স্বচ্ছ বিজনভূমিতে সফর করছিলাম। এই জনশূন্য প্রান্তরে আমরা একটি আওয়াজ ছাড়া অন্য কিছু শুনতে পাচ্ছিলাম না। অকস্মাৎ আমরা সম্মুখ দিয়ে এক সওয়ারকে আসতে দেখলাম। সে বলছিলঃیا احمد یا احمد الله اعلی و امجد أتاك ما وعدك منالخير يا احمد এরপর সে চলে গেল। অতঃপর জনৈক আনছারী বলে উঠলেন: আমিরুল মুমিনীন। এই প্রকার একটি ঘটনা আমিও বর্ণনা করছি- আমি সিরিয়া গিয়েছিলাম। সেখানে এক জনশূন্য প্রান্তরে হঠাৎ শুনলাম গায়েব থেকে কেউ এই কবিতা পাঠ করছে : একটি নক্ষত্র উদিত হয়ে পূর্ব দিগন্ত ঊদ্ভাসিত করে দিয়েছে। সে মানুষকে বিনাশকারী অন্ধকার থেকে বের করে। তিনি রসূল। যে তাঁকে সত্য বলে বিশ্বাস করে, সে সফলতা লাভ করবে। আল্লাহ তায়ালা তাঁর ইসলামকে সুউচ্চ ও প্রতিষ্ঠিত করেছেন।” আবু নয়ীম হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, মক্কায় আবু কোবায়স পাহাড়ে এক জিন উচ্চস্বরে এই কবিতা পাঠ করলঃ : আল্লাহ তায়ালা কা’ব ইবনে ফেহরের মতামতকে লাঞ্ছিত করুন। এদের জ্ঞানবুদ্ধি কত দুর্বল। বনী-কা’বের ধর্ম তাদের পিতৃ-পুরুষগণকে সমর্থনকারীদের ধর্ম। তারা এতে তিরস্কৃত হয়। যখন তোমাদের বিরুদ্ধে ফয়ছালা করা হবে, তখন জিন এবং আদমের পুরুষরা তোমাদের সঙ্গে থাকবে। সত্বরই তুমি উদ্ভারোহীদেরকে দলে দলে ছুটে আসতে দেখবে। তারা বড় বড় শহরে লোকদেরকে হত্যা করবে। তোমাদের মধ্যে এমন কোন ভদ্র আছে কি, মার মন স্বাধীন এবং যার পিতৃ পুরুষেরা সম্ভ্রান্ত। সেই ভদ্র যেন এমন আঘাত করে, যা সম্ভাব্য সেই আযাব এবং দুঃখ-কই থেকে স্বস্তির কারণ হয়। ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ এই কবিতার খবর মক্কায় প্রচারিত হয়ে গেল। মুশরিকরা এই কবিতা একে অপরকে পড়ে শুনাত এবং বলত- এতে মুসলমানদেরই কুৎসা গাওয়া হয়েছে। বসূলে আকরাম (সাঃ) বললেনঃ এটা এক
পৃষ্ঠা ১১ থেকে ২০
পৃষ্ঠা:১১
শয়তানের রচিত কবিতা। সে প্রতিমার ভিতর থেকে মানুষের সাথে কথা বলে। এর নাম মুসয়ির। আল্লাহ তায়ালা একে লাঞ্ছিত করবেন। তিন দিন পর এক আওয়াজদাতা পাহাড়ে এই কবিতা পাঠ করলঃ: আমি মুসয়ির শয়তানকে হত্যা করেছি। কেননা, সে অবাধ্যতা ও অহংকার করেছে।: সে সত্যকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে এবং অবিশ্বাসীদের জন্য পথ আবিষ্কার করেছে। আমি এমন এক তরবারি দিয়ে তার জীবনাবসান ঘটিয়েছি, যা সত্তার ভিত্তিকে উপড়ে ফেলে এবং চূড়ান্ত করে দেয়। তাকে হত্যা করার কারণ এই যে, সে আমাদের পবিত্র নবীর শানে ধৃষ্টতা প্রদর্শন করেছে।এই কবিতা শুনে রসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেনঃ সে দৈত্য জাতীয় জিন। তার নাম সমহজ। আমি তার নাম রেখেছি আবদুল্লাহ। সে আমার প্রতি ঈমান এনেছে এবং আমাকে বলেছে যে, সে কয়েক দিন ধরেই মুসয়ির শয়তানকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল।ফাকেহী আখবারে-মক্কায় হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর হাদীসটি আমের ইবনে রবীয়া থেকে বর্ণনা করেন যে, ইসলামের প্রাথমিক যুগে আমরা যখন মক্কায় ছিলাম, তখন হঠাৎ কোন এক পাহাড়ে একটি আওয়াজ শুনা গেল, যাতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উত্তেজনা ছড়ানো হল। নবী করীম (সাঃ) বললেনঃ এটা শয়তানের আওয়াজ। যখনই কোন শয়তান কোন নবীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়েছে, তখনই আল্লাহ তায়ালা তাকে হত্যা করেছেন। তিনি আরও বললেনঃ আল্লাহ তায়ালা এই শয়তানকে সেই জিনের হাতে হত্যা করিয়েছেন, যার নাম “সমহজ”। আমি তার নাম রেখেছি আবদুল্লাহ। রাতের বেলায় সেই জায়গায় আমি একটি অজ্ঞাত আওয়াজ শুনেছি। সে এই কবিতা পাঠ করছিলঃ نحن قتلنا مسعرا لما طغى واستكبر واصغر الحق ومن المنكرا يشتمه نبيا المطهر আবু নয়ীম ও ফাকেহী “আখতারে মক্কা” গ্রন্থে হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলে আকরাম (সাঃ)-এর নবুওয়ত প্রকাশ লাভ করলে মুসয়ির নামক এক জিন আবূ কোবায়স পাহাড়ে এই কবিতা قبح الله رأی کعب بن فهر الأبيات কাফেররা বলাবলি করলঃ আমরা যথেষ্ট অবহেলা করেছি। শেষ পর্যন্ত জিন আমাদেরকে উৎসাহিত করছে। পরবর্তী রাতে সমহজ নামক জায়গায় দাঁড়িয়ে এই কবিতা পাঠ করলঃ এক জিন সেই: আমি এমন তরবারি দিয়ে তার ভবলীলা সাঙ্গ করেছি, যা বন্যার ন্যায় বিনাশকারী।যে বিদ্রোহ করতে চায়, আমরা তাকে পর্যুদস্ত করে দেই।আবু সায়ীদ “শরফুল মুস্তফা” গ্রন্থে জুনদুল ইবনে নয়লা থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আমি রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে আরয করলামঃ হুযূর। আমার এক বন্ধু জিন হঠাৎ আমার কাছে এসে বললঃ : সাবধান! ধর্মের বাতি এমন নবীর হাতে প্রজ্বলিত হয়েছে, যিনি, সত্যবাদী, ভদ্র ও বিশ্বস্ত। এমন উষ্ট্রীর পিঠে রওয়ানা হও, যে দ্রুতগামী ও সুঠাম, যে সমতল ও অসমতল উভয় প্রকার মাটিতে চলতে অভ্যন্ত।আমি ভীত হয়ে জাগ্রত হলাম এবং বললামঃ কি হয়েছে? সে বললঃ যিনি পৃথিবীকে সমতল করেছেন, ফরয নির্ধারণ করেছেন, তার অনুপম সত্তার কসম, মোহাম্মদ (সাঃ) ভূপৃষ্ঠের জন্যে প্রেরিত হয়েছেন। তিনি সম্মানিত স্থানে লালিত হয়েছেন এবং মদীনা অভিমুখে হিজরত করেছেন। এ কথাগুলো শুনে আমি রওয়ানা হলাম। হঠাৎ গায়েব থেকে এই কবিতা পাঠের আওয়াজ এলঃ: হে রসূলের দিকে গমনকারী উষ্ট্রারোহী। তুমি হেদায়াত ও সুপথের তওফীক প্রাপ্ত হয়েছে। ইবনে কলী-আদী ইবনে হাতেম (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন, তিনি বলেনঃ হারেছ ইবনে দাগনা নামক এক ব্যক্তি ছিল বনী-কলব গোত্রের খাদেম। একদিন আমি যখন আমার গৃহের আঙিনায় উপবিষ্ট ছিলাম, তখন অকস্মাৎ সে ভীত ও সন্ত্রস্ত অবস্থায় এসে বললঃ তোমার উট নিয়ে নাও। আমি বললামঃ উদ্বিগ্ন হচ্ছে কেন? সে বললঃ আমি জঙ্গলে ছিলাম। সেখানে এক বৃদ্ধ ব্যক্তি পাহাড়ের উপত্যকা থেকে নেমে আমার সামনে উপস্থিত হল। তার মাথা ছিল শকুনে মাথার মত। সে সেই জায়গা থেকে নামল, যেখানে ঈগল পাখিও পিছলে যায়। সে স্বস্থানে ঝুলছিল এবং সেখান থেকে সরছিল না। আমি যা দেখেছি, তাকে তার চেয়ে বেশি বুঝতে পারছি। সে বলল: ও হে হারেছ ইবনে দাগনা। তুমি মনের কুমন্ত্রণাকে স্থান দিয়ো না। নূরের এই আলো অগ্নি গ্রহণকারীর হাতে রয়েছে। তুমি সত্যের দিকে ঝুঁকে পড় এবং প্রবঞ্চনা করো না। হারেছ আরও বললঃ আমি আমার উটগুলোকে হাকিয়ে দূরে অন্য জায়গায় ঘাস খাওয়ার জন্যে ছেড়ে দিলাম এবং নিজে ঘুমিয়ে পড়লাম। হঠাৎ এক উষ্ট্রারোহী
পৃষ্ঠা:১২
এসে আমাকে পদাঘাত করল। আমি জাগ্রত হয়ে গেলাম। দেখি কি, সে সেই বৃদ্ধ ব্যক্তি। সে বললঃ হারেছ। আমার কথা শুন হেদায়াত পাবে। পথভ্রষ্ট ও হীতাহীত জ্ঞানশূন্য মানুষ হেদায়াতপ্রাপ্তের মত নয়। সততার পথ পরিহার করো না। জগতের সকল ধর্মই আহমদ (সাঃ)-এর ধর্ম আসার পর রহিত হয়ে গেছে।হাবেছ বর্ণনা করেন- আমি এই কবিতা শুনে অজ্ঞান হয়ে গেলাম। অনেকক্ষণ পরে জ্ঞান ফিরে এল। এভাবেই আল্লাহ আমার অন্তরকে ইসলামের জন্যে মনোনীত করেছেন। তিবরাক ও আবু নয়ীম আমর ইবনে মুররা জুহানী থেকে রেওয়ায়েত করেন, তিনি বলেনঃ আমি হজ্বের ইচ্ছায় রওয়ানা হলাম। মক্কায় আমি স্বপ্নে একটি নূর দেখলাম, যা কা’বা গৃহ থেকে ছড়িয়ে পড়ছিল। অবশেষে আমার সামনে মদীনার পাহাড় আলোকিত হয়ে গেল। আমি এই নূরের মধ্য থেকে একটি আওয়াজ শুনলাম। কেউ বলছিলঃ তমসা বিলীন হয়ে গেছে। নূর সমুন্নত হয়েছে। খাতেমুল আম্বিয়া প্রেরিত হয়ে গেছেন। অতঃপর এই নূর পুনরায় ফুটে উঠল। আমি এই নূরে হীরা ও মাদায়েনের শুভ্র রাজপ্রাসাদ দেখতে পেলাম। এরপর আমি এই নূরের মধ্য থেকে একটি আওয়াজ শুনলাম। কেউ বলছিলঃ ইসলাম আত্মপ্রকাশ করেছে এবং প্রতিমা ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। আত্মীয়তার সম্পর্ক সংযোজিত হয়েছে।আমি ভীত অবস্থায় জাগ্রত হলাম এবং স্বজনদের ডেকে বললাম: আল্লাহর কসম, কোরায়শদের এই গোত্রের মধ্যে নতুন কোন ঘটনা প্রকাশ পাবে। আমি স্বপ্নে যা দেখেছিলাম, তা তাদেরকে বললাম। অতঃপর যখন আমরা আমাদের বাড়ীঘরে পৌঁছলাম, তখন খবর এল যে, আহমদ নামের এক ব্যক্তি নবুওতপ্রাপ্ত হয়েছেন। অতঃপর আমি রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর খেদমতে উপস্থিত হলাম এবং স্বপ্নের বিষয়বস্তু বর্ণনা করলাম। তারপর ইসলাম গ্রহণ করে ধন্য হলাম।আমি আরয করলামঃ ইয়া রসূলাল্লাহ! আমাকে আমার গোত্রের কাছে প্রেরণ করুন। তিনি তাই করলেন। আমি এসে তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিলে একজন ছাড়া সকলেই মুসলমান হয়ে গেল। সেই এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলতে ما الامامية: হে আমর ইবনে মুররা। আল্লাহ তোমার জীবনকে তিক্ত বিষাক্ত করুন। তুমি আমাদের উপাস্যদেরকে ছেড়ে দিতে বল। তুমি তোমার পৈতৃক ধর্মের বিরোধিতাকরছ। এরপর সে এই কবিতা পাঠ করলঃ: আমর ইবনে মুররা এমন সব কথাবার্তা বলে, যা কোন যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তির কথা হতে পারে না। দীর্ঘকাল পর্যন্ত হলেও আমি তার কথা ও কর্মের প্রতি লক্ষ্য রাখব। যে সকল বয়োঃবন্ধ ব্যক্তি অতীত হয়ে গেছে, তাদেরকে বোকা ও নির্বোধ মনে করতে হবে? যে এটা করতে চায়, সে সফলকাম হবে না।” আমর ইবনে মুররা লোকটিকে বললঃ আমাদের উভয়ের মধ্যে যে মিথ্যাবাদী, আল্লাহ তার জীবন তিক্ত করে দিবেন। তার জিহবা অচল করবেন এবং তাকে অন্ধ করে দিবেন। আমর ইবনে মুররা বর্ণনা করেনঃ আল্লাহর কসম, মৃত্যুর পূর্বে লোকটির সকল দাঁত ঝরে পড়ল। সে কোন কিছু খেয়ে স্বাদ পেত না। পরিশেষে সে অন্ধ ও বধির হয়ে গেল। আবু নয়ীম, খারায়েতী ও ইবনে আসাকির ইবনে খরবুস মক্কী খাছয়ামী থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আরবরা হারামকে হালাল এবং হালালকে হারাম করে নিত। তারা প্রতিমার পূজা করত এবং প্রতিমার কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করত। এক রাতে আমরা এক প্রতিমার কাছে উপস্থিত হয়ে দোয়া ভিক্ষা করছিলাম। হঠাৎ একটি গায়েবী আওয়াজ শুনা গেলঃ তোমরা শরীরী হয়ে বিচারকে প্রতিমাদের সাথে সম্পৃক্ত কর। তোমরা নির্বোধ নও। ইনি সৃষ্টির সেরা নবী। এই নবী বিচারকদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা ন্যায়পরায়ণ। তিনি নূর ও ইসলাম প্রকাশ করেন। এই নবী মানুষকে প্রতিমা পূজা থেকে বিরত রাখেন এবং বালাদে-হারাম তথ্য সম্মানিত শহরে সত্য প্রচার করেন। রাবী বর্ণনা করেনঃ এই আওয়াজ শুনে আমরা ঘাবড়ে গেলাম এবং সেখান থেকে প্রস্থান করলাম। যখন এ সম্পর্কে মানুষের মধ্যে কথাবার্তা চলছিল, তখনই সংবাদ পাওয়া গেল যে, নবী করীম (সাঃ) মক্কায় আত্মপ্রকাশ করেছেন। এরপর যখন তিনি মদীনায় আগমন করলেন, তখন আমি তাঁর খেদমতে উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করলাম। ইবনে সা’দ বাযযার ও আবু নয়ীম হযরত জুবায়র ইবনে মুতয়িম (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন, তিনি বলেনঃ আমরা বোয়ানায় এক প্রতিমার কাছে বসা ছিলাম। আমরা উট যবেহ করেছিলাম। হঠাৎ আমরা উটের পেট থেকে এই আওয়াজ শুনতে পেলামঃ শুন, আশ্চর্যের কথা। ওহীর কারণে আকাশে শয়তানদের কান পেতে কথা চুরি করার সুযোগ খতম হয়ে গেছে। এখন জিনদের প্রতি অগ্নি স্ফুলিঙ্গ নিক্ষেপ করা হয়। সেই নবীর কারণে, যিনি মক্কায় আছেন এবং যাঁর নাম আহমদ। তাঁর হিজরত ভূমি ইয়াসরিব (মদীনা)। জুবায়র বর্ণনা করেনঃ এটা শুনে আমরা বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়লাম। ঠিক এসময়টিতেই রসুলুল্লাহ (সাঃ) আত্মপ্রকাশ করলেন। আবু নয়ীম হযরত তামীম দারী (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন তিনি বলেনঃ হুযুর (সাঃ)-এর আবির্ভাবের সময় আমি সিরিয়ায় ছিলাম। আমি এক কাজে বের
পৃষ্ঠা:১৩
হলে পথিমধ্যেই রাত হয়ে গেল। মনে মনে বললামঃ এই বিশাল জঙ্গলের নিকটে কিরূপে রাত কাটাব। একটি জায়গা বেছে নিয়ে শয়ন করার পর আমি অদৃশ্য থেকে কাউকে বলতে শুনলামঃ আল্লাহ তায়ালার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা কর। কেননা, আল্লাহর আযাব থেকে জিনরা বাঁচাতে পারে না। আমি বললাম, তোমাকে আল্লাহর কসম, বল কি বলতে চাও। সে বললঃ আল্লাহর প্রেরীত রসূল আবির্ভূত হয়েছেন। আমরা হাজুন নামক স্থানে তাঁর পিছনে নামায পড়েছি এবং আমরা মুসলমান হয়ে গেছি। জিনদের ধোঁকা প্রতারণা খতম হয়ে গেছে। এখন তাদের উদ্দেশ্যে আগুনের গোলা নিক্ষেপ করা হয়। তুমি রব্বুল আলামীনের রসূল মোহাম্মদ (সাঃ)-এর কাছে যাও এবং ইসলাম গ্রহণ কর। তামীম বর্ণনা করেনঃ সকালে উঠে আমি এক সন্ন্যাসীর কাছে গেলাম এবং তাকে ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করলাম। সে বললঃ জিনরা সঠিক কথা বলেছে। সেই নবী হেরেম থেকে যাহির হবেন এবং তাঁর হিজরত-ভূমি হেরেম হবে। তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ নবী। তুমি তাঁর কাছে যাও না কেন?আবু নয়ীমের রেওয়ায়েতে বুয়ায়লিদ যমিরী বলেনঃ আমরা এক মূর্তির কাছে বসা ছিলাম। হঠাৎ মূর্তির পেট থেকে একটি আওয়াজ শুনলাম। কেউ বলছিলঃ ওহীর কারণে আকাশে শয়তানদের কথা চুরি বন্ধ হয়ে গেছে। তাদের প্রতি এখন অগ্নিগোলা বর্ষিত হয়। একজন নবীর কারণে, যিনি মক্কায় আছেন। তাঁর নাম আহমদ এবং তাঁর হিজরত ভূমি ইয়াসরিব। তিনি নামায, রোযা, পুণ্যকাজ ও আত্মীয়তা বুজায় রাখার আদেশ দেন। এটা শুনে আমরা সেখান থেকে প্রস্থান করলাম এবং মানুষকে জিজ্ঞাস। করলাম। তারা বললঃ সেই নবীর নাম আহমদ, তিনি মক্কায় আত্মপ্রকাশ করেছেন। আবু নয়ীম, ইবনে জরীর, ইবনে যাকারিয়া ও ইবনুত্তাররাহ কিতাবুশ-শোয়ারা গ্রন্থে আব্বাস ইবনে মেরদাস থেকে রেওয়ায়েত করেছেন যে, তিনি নিজের ইসলাম গ্রহণের সূচনাকারী ঘটনা এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ আমার পিতার ইন্তিকালের সময় ঘনিয়ে এলে তিনি আমাকে যেমার নামীয় এক প্রতিমা সম্পর্কে ওছিয়ত করলেন। আমি সেই প্রতিমাটি নিজের গৃহে স্থাপন করলাম। আমি প্রত্যহ তার কাছে যেতাম। যখন রসূলুল্লাহ (সাঃ) আত্মপ্রকাশ করলেন, তখন রাতের বেলায় আমি সেই প্রতিমার ভিতর থেকে একটি আওয়াজ শুনলাম। সে বলছিলঃ “সুলায়মের সকল গোত্রকে বলে দাও যে, আনীস মরে গেছে এবং মসজিদবাসীরা আবাদ হয়ে গেছে।” যেমার প্রতিমা বরবাদ হয়ে গেছে। মোহাম্মদ (সাঃ)-এর প্রতি কিতাব নাযিল হওয়ার পূর্বে তার এবাদত করা হত।’ কোরায়শদের মধ্যকার এক ব্যক্তিত্ব ঈসা ইবনে মরিয়ম (আঃ)-এর পরে নবুওয়ত ও হেদায়াতের উত্তরাধিকার প্রাপ্ত হয়েছেন। তিনি খোদ সৎপথপ্রাপ্ত।আব্বাস বর্ণনা করেনঃ আমি এ ঘটনাটি মানুষের কাছে গোপন রাখলাম এবং কাউকে এ সম্পর্কে কিছু বললাম না। আহযাব যুদ্ধ থেকে যখন সকলেই ফিরে এল, তখন আমি যাতে-ইরকের আতীক নামক স্থানের আশেপাশে উট চরাচ্ছিলাম। হঠাৎ একটি আওয়াজ শুনলাম। মাথা তুলতেই দেখি, এক ব্যক্তি উট পাখির উভয় পাখায় সওয়ার অবস্থায় বলছেঃ সেটাই নূর, যা সোমবার ও মঙ্গলবারের রাতে গামছা উস্ত্রীওয়ালার সাথে বনী আখিল-ওনাকার গৃহসমূহে প্রকাশ পেয়েছে। অতঃপর আব্বাসের বাম দিক থেকে এক গায়েবী আওয়াজদাতা তাকে জবাব দিলঃ জিন ও তাদের স্বগোত্রীয়দেরকে সুসংবাদ দিয়ে দাও যে, সওয়ারী তার পিঠের গদি রেখে দিয়েছে এবং আকাশ তার রক্ষীদেরকে প্রকাশ করে দিয়েছে। আব্বাস বলেনঃ আমি ভয়ে লাফিয়ে উঠলাম এবং বুঝলাম যে, মোহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর রসূল। খারায়েতী, তিবরানী ও আবু নয়ীম অন্য সনদ সহকারে আব্বাস ইবনে মেরদাস থেকে বর্ণনা করেন যে, দ্বিপ্রহরের সময় আমি উটের পালের মধ্যে ঘুরাফিরা করছিলাম। এমন সময় তুলার মত সাদা একটি উটপাখি দৃষ্টিগোচর হল। তার উপরে সাদা শুভ্র বস্ত্র পরিহিত এক ব্যক্তি সওয়ার ছিল। সে বললঃ হে আব্বাস ইবনে মেরদাস। আকাশকে তার রক্ষীরা ঘিরে ফেলেছে। যুদ্ধ তার শ্বাস গিলে ফেলেছে এবং অশ্বরা তাদের গদি রেখে দিয়েছে। সৎকাজ নিয়ে আগমনকারী ব্যক্তি সোমবার ও মঙ্গলবারের রাতে জন্মগ্রহণ করেছে। সে কুহওয়া উস্ত্রীর মালিক। আব্বাস বলেনঃ আমি ভয়ে সেখান থেকে চলে এলাম এবং যেমার নামক এক প্রতিমার কাছে গেলাম। হঠাৎ শুনি কি, এক আওয়াজদাত্য তার মধ্য থেকে কবিতা পাঠ করছে।আবু নয়ীম আব্বাস ইবনে মেরদাস থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আমি দ্বিপ্রহরে এক বৃক্ষের নিচে বসা ছিলাম। হঠাৎ আমার সামনে একটি উটপাখি প্রকাশ পেল। তার উপর এক সাদা পোশাকধারী বেদুঈন সওয়ার ছিল। সে আমাকে বললঃ হে আব্বাস ইবনে মেরদাস, সরদারপুত্র। তুমি জিনদেরকে এবং তাদের নৈরাশ্যকে দেখনি? যুদ্ধ তার শ্বাস গিলে ফেলেছে এবং আকাশকে তার রক্ষীরা বন্ধ করে দিয়েছে। ইবনে মেরদাস বলেনঃ আমি সেখান থেকে ফিরে এলাম। অতঃপর মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকলাম। একদিন আমার চাচাত ভাই এসে বললঃ রসূলুল্লাহ (সাঃ) মানুষকে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেন, আর আপনি লুকিয়ে আছেন?
পৃষ্ঠা:১৪
ইবনে সাদ ও আবূ নয়ীম সায়ীদ ইবনে আমর হুয়ালী থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আমি প্রতিমার নামে একটি জন্তু বলীদান করেছিলাম। হঠাৎ তার মধ্য থেকে এই আওয়াজ শুনলামঃ আশ্চর্যের বিষয়। বনী-আবদুল মোত্তালিবের মধ্য থেকে একজন নবী আত্মপ্রকাশ করেছেন। তিনি যিনা ও প্রতিমার নামে বলীদান করা হারাম সাব্যস্ত করেন। আকাশসমূহে পাহারা বসেছে এবং জিনদের লক্ষ্য করে আগুনের গোলা নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। আমর বলেনঃ এ কথা শুনে আমরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়লাম। মক্কায় আমার পর হুযুর (সাঃ)-এর আত্মপ্রকাশ সম্পর্কে কোন খবরদাতা পাওয়া গেল না। আমরা হযরত আবূ বকর (রাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করলাম। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলামঃ মক্কায় আহমদ নামে কোন ব্যক্তি আত্মপ্রকাশ করেছেন কি, যিনি আল্লাহর দিকে আহবান করেন? তিনি জিজ্ঞাসা করলেনঃ ব্যাপার কি? আমি ঘটনা বর্ণনা করলে তিনি বললেনঃ হাঁ, মোহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ (সাঃ) আছেন তিনি আল্লাহর রসূল।ইবনে সা’দ ও আবু নয়ীম আবদুল্লাহ ইবনে যায়েদা ছযালী থেকে রেওয়ায়েত করেছেন যে, আমি এক প্রতিমার কাছে থাকাবস্থায় তার পেট থেকে আওয়াজ গুনলাম। সে বলছিলঃ জিনদের ধোঁকা ও প্রতারণার অবসান হয়েছে। আহমদ নামীয় নবীর কারণে আমাদের প্রতি আগুনের গোলা নিক্ষেপ করা হয়। এ কথা শুনে আমি সেখান থেকে চলে এলাম। এক ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে সে আমাকে হুযুর (সাঃ)-এর আত্মপ্রকাশের কথা বলল। ইবনে মান্দার রেওয়ায়েতে বকর ইবনে জবালা বলেনঃ আমরা নিজেদের এক প্রতিমার কাছে একটি জন্তু যবেহ করলে তার পেট থেকে হঠাৎ এই বাক্য শুন্য গেল। বকর ইবনে জবালা! তুমি মোহাম্মদ (সাঃ)-কে চিন। বায়হাকী ও ইবনে আসাকির হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে. এক ব্যক্তি রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে বললঃ ইয়া রসুলাল্লাহ। মূর্খতা যুগে একবার আমি একটি পলাতক উটের খোঁজে বের হলাম। ভোর বেলায় আমি এক গায়েবী ক্যাওয়াজদাতাকে বলতে শুনলামঃ ৪ অন্ধকার রাতে নিদ্রামগ্নরা, আল্লাহতায়ালা হেরেমে একজন নবী প্রেরণ করেছেন। তিনি বনী হাশেমের একজন সদস্য। তিনি অনেক অন্ধকারকে আলোকময় করেন। রাবী বলেনঃ আমি এদিক-ওদিক তাকালাম। কিন্তু কোন ব্যক্তি দৃষ্টিগোচর হল না। তখন আমি এই কবিতা পাঠ করলামঃ ঃ হে অন্ধকার দাতে আহবানকারী। মারহাবা, তুমি এমন কল্পনার কথ্য বলছ যা এসে গেছে। আল্লাহ তোমাকে হেদায়াত করুন। সুন্দরভাবে সেই বিষয় বর্ণনা কর, যার প্রতি তুমি আহবান কর। তাকে সুবর্ণ সুযোগ গণ্য করা হবে। রাবী বলেনঃ তৎক্ষণাৎ আমি তার গলা ছাফ করার শব্দ শুনলাম। সে বললঃ নূরদেদীপ্যমান হয়ে গেছে এবং মিথ্যা নাস্তানাবুদ হয়ে গেছে। আল্লাহ মোহাম্মদ (সাঃ)-কে কল্যাণসহ প্রেরণ করেছেন। এরপর সে এই কবিতা পাঠ করলঃ : আল্লাহর জন্যে প্রশংসা, যিনি সৃষ্টিকে উদ্দেশ্যহীনভাবে সৃষ্টি করেননি। তিনি আমাদের নবী আহমদ (সাঃ)-কে প্রেরণ করেছেন। প্রেরিতদের মধ্যে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ নবী। আল্লাহ তাঁর প্রতি রহমত নাযিল করুন যতদিন তাঁর জন্যে একটি দল হজ্ব করতে থাকে।রাবী বলেনঃ এরপর ভোরের আলো ফুটে উঠল এবং আমি আমার উট পেয়ে গেলাম। আবু ইয়াযীদ “শরফুল-মোস্তফা” গ্রন্থে জা’দ ইবনে কায়স মুরাদী থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেনঃ আমরা চার ব্যক্তি মূর্খতা যুগে হজ্বের উদ্দেশ্যে বের হলাম। এয়ামনের এক জঙ্গল দিয়ে গমন করার সময় রাত হয়ে গেল। আমরা একটি বড় উপত্যকায় আশ্রয় নিলাম। যখন রাত স্তব্ধ হয়ে গেল এবং আমার সঙ্গীরা নিদ্রার কোলে ঢলে পড়ল, অকস্মাৎ উপত্যকার এক দিক থেকে একটি আওয়াজ ভেসে এল। কেউ এই কবিতা পাঠ করছিলঃ : রাতে বিশ্রাম গ্রহণকারীরা! তোমরা যখন হাতীম ও যমযমের মাঝখানে অবস্থান কর, তখন পৌঁছিও আমাদের পক্ষ থেকে মোহাম্মদ (সাঃ)-কে সালাম। যেখানে তিনি যান এবং যেখানে যাওয়ার ইচ্ছা করেন আমাদের সালাম তাঁর সাথী হোক। তাঁকে বলে দাও, আমরা আপনার ধর্মের লোক। ঈসা (আঃ) আমাদেরকে তাই বলে গেছেন। আবূ সা’দ “শরফুল-মোস্তফা’ গ্রন্থে (দুর্বল সনদে) বর্ণনা করেছেন যে, জুনদুর ইবনে হুমায়লের কাছে কেউ এসে বললঃ জুনদু। মুসলমান হয়ে যাও। সেই আগুনের উত্তাপ থেকে মুক্ত থাকবে, যা প্রজ্বলিত করা হবে। তুমি সফলকাম হবে। জুনদুর বললঃ ইসলাম কি? সে বললঃ প্রতিমার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ এবং সর্বজ্ঞানী অধিপতির সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন। জুনদুর’ প্রশ্ন করলঃ এর উপায় কি? সে বললঃ আরব থেকে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের আত্মপ্রকাশ আসন্ন। তিনি সম্ভ্রান্ত। অখ্যাত নন। তিনি হেরেম থেকে আত্মপ্রকাশ করবেন এবং আরব ও অনারব তাঁর
পৃষ্ঠা:১৫
অনুগত হবে। জুনদুর’ তাঁর চাচাত ভাই রাফে ইবনে খেদাজকে এ সম্পর্কে অবহিত করল। অতঃপর তারা যখন সংবাদ পেল যে, রসুলুল্লাহ (সাঃ) মদীনায় হিজরত করেছেন, তখন তারা এসে ইসলাম গ্রহণ করল।
আবির্ভাবের সময় প্রতিমা উপুড় হয়ে পড়ে গেল
ইবনে ইসহাক ও আবু নয়ীম হযরত ওয়াহাব ইবনে মুনাব্বিহ থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, যখন আল্লাহ তায়ালা নবী করীম (সাঃ)-কে প্রেরণ করলেন, তখন কেসরা (পারস্য সম্রাট) সকাল বেলায় দেখলেন যে, তাঁর প্রাসাদের গম্বুজ ভূমিসাৎ হয়ে গেছে এবং দজলা নদীর স্রোতধারা প্রতিহত হয়ে গেছে। এসব ঘটনা দেখে তিনি অত্যন্ত চিন্তিত হলেন। তিনি অতিন্দ্রীয়বাদী, জ্যোতির্বিদ ও যাদুকরদেরকে দরবারে তলব করলেন এবং বললেনঃ এ সম্পর্কে চিন্তাভাবনা কর। তারা চিন্তা ভাবনা শুরু করলে তাদের উপর আকাশের চতুষ্পার্শ্ব রুদ্ধ করে দেয়া হল, পৃথিবী অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেল এবং তারা স্বীয় শাস্ত্রে ব্যর্থ ও অপমানিত হয়ে গেল। সে মতে কোন যাদুকরের যাদু, অতীন্দ্রিয়বাদীর কলাকৌশল এবং জ্যোতিষীর জ্যোতির্বিদ্যা কার্যকর রইল না।অপরদিকে খায়েব অন্ধকার রাতে এক টিলার উপর গমন করে এক বিদ্যুৎন্ধটা দেখতে পেল, যা হেজাযের দিক থেকে প্রকাশ পেয়ে পূর্ব দিগন্ত পর্যন্ত পৌঁছে গেল। সকাল বেলায় সে নিজের পায়ের নিচে তাকিয়ে একটি সবুজ সতেজ উদ্যান দেখতে পেল। এই অস্বাভাবিক ঘটনা সম্পর্কে সে মন্তব্য করল। আমি যা দেখতে। পাচ্ছি, তা সত্য হলে হেজায থেকে এক বাদশাহ আত্মপ্রকাশ করবেন, তাঁর প্রভাব দূর প্রাচ্যদেশ পর্যন্ত পৌঁছে যাবে।বিষয়টি নিয়ে অতীন্দ্রিয়বাদীরা যখন পরস্পরে আলোচনায় বসল, তখন একে অপরকে বললঃ তোমরা জান যে, তোমাদের ও তোমাদের শাস্ত্রের মধ্যে কি বস্তু অন্তরায় হয়েছে। সেই বস্তুটি হচ্ছেন সদ্য আবির্ভূত একজন নবী। তিনি এই দেশ দখল করে নিবেন এবং বাদশাহীর পরস্পরা ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিবেন। ওয়াকেদী ও আবু নয়ীম হযরত মোহাম্মদ ইবনে কাব থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তিনি বলেনঃ আমি ৮ হিজরীতে পারস্য রাজ্যের রাজধানী মাদায়েনে গেলাম। পারস্য সম্রাটের অতুলনীয় প্রাসাদ ও অট্টালিকারাজি দেখে আমি বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়লাম। সেখানকার জনৈক বৃদ্ধ ব্যক্তি আমাকে বললঃ পারস্য-রাজ সর্বপ্রথম যে অপ্রীতিকর বিষয় জানতে পারেন, তা ছিল এই যে, যে রাতে নবী করীম (সাঃ)-এর কাছে ওহী আগমন করে, সে রাতে তার প্রাসাদের গম্বুজ ভূমিস্যাৎ হয়ে যায় এবং দজলা নদীর স্রোতধারা বিঘ্নিত হয়।ওয়াকেদী ও আবূ নয়ীম হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, যখন নবী করীম (সাঃ) নবুওত প্রাপ্ত হলেন, তখন প্রত্যেক প্রতিমা উপুড় হয়ে গেল। শয়তানরা অভিশপ্ত ইবলীশকে এ সম্পর্কে অবহিত করলে সে বললঃ একজন নবী প্রেরিত হয়েছেন। তোমরা তাঁকে তালাশ কর। তারা বললঃ কোন নবী আমরা পাইনি। ইবলীশ বললঃ আমি তাঁকে তালাশ করছি। সে মতে ইবলীশ নবী করীম (সাঃ)-এর খোঁজে বের হল। সে মক্কায় তাঁকে পেল। অতঃপর সে শয়তানদের কাছে গিয়ে বলল: আমি এই নবীকে পেয়েছি। কিন্তু তাঁর সাথে জিবরাঈল রয়েছেন।আবু নয়ীম হুলিয়া গ্রন্থে মোজাহিদ থেকে রেওয়ায়েত করেছেন যে, ইবলীশ চারবার ফরিয়াদ ও আহাজারি করেছে প্রথমবার যখন সে অভিশপ্ত ও বিতাড়িত হয়। দ্বিতীয়বার যখন তাকে পৃথিবীতে নামিয়ে দেয়া হয়। তৃতীয়বার যখন রসূলে আকরাম (সাঃ) প্রেরিত হন এবং চতুর্থবার যখন সূরা ফাতিহা নাযিল করা হয়। নবী (সাঃ)-এর আবির্ভাবের কারণে আকাশের হেফাযত আল্লাহ তায়ালা জিনদের উক্তির আলোচনা প্রসঙ্গে বলেনঃوَإِنَّا لَمَعْنَا السَّمَاءَ فَوَجَدْنَاهَا مُلَنَتْ حَرْسًا شَدِيدًا وَنُهُبًا وَإِنَّا كُنَّا نَقْعُدُ مِنْهَا مَقَاعِدَ لِلسَّمْعِ فَمَنْ يَسْتَمِع الآنيَجِدُ لَهُ شِهَابًا رَهَدًا(জিনেরা পরস্পরে বলাবলি করেছিল) আমরা আকাশের তথ্য সংগ্রহ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমরা দেখলাম কঠোর প্রহরী ও উল্কাপিণ্ড দ্বারা আকাশ পরিপূর্ণ। পূর্বে আমরা আকাশের বিভিন্ন ঘাঁটিতে সংবাদ শুনার জন্যে বসতাম। কিন্তু এখন কেউ সংবাদ শুনতে চাইলে তার উপর নিক্ষেপের জন্যে প্রস্তুত জ্বলন্ত উল্কাপিণ্ডের সম্মুখীন হতে হয়। (সূরা জিন) ইমাম আহমদ ও বায়হাকী সায়ীদ ইবনে জুবায়রের তরিকায় হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, শয়তানরা আকাশের দিকে আরোহণ করত, ওহীর বিষয়বস্তু শুনত, অতঃপর পৃথিবীতে এসে শ্রুত বিষয়বস্তুর সাথে আরও সংযোজন করে মানুষের কাছে বর্ণনা করত। তাদের এ কর্মপন্থাই আবহমান কাল থেকে চলে আসছিল। অবশেষে আল্লাহতায়ালা নবী করীম (সাঃ)-কে প্রেরণ করলেন। তখন থেকে তাদের সে সব ঘাঁটিতে বসা নিষিদ্ধ ও বন্ধ করে দেয়া হল। শয়তানরা এ ঘটনা ইবলীশের কাছে বর্ণনা করলে সে বললঃ পৃথিবীতে কোন বিরাট
পৃষ্ঠা:১৬
ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। সে ঘটনাটি কি, তা তদন্ত করার জন্যে ইবলীস শয়তানদেরকে প্রেরণ করল। তারা এসে রসূলে করীম (সাঃ)-কে কোরআন তেলাওয়াতে রত দেখল। তারা বললঃ আল্লাহর কসম, এটাই সেই ঘটনা। ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেনঃ শয়তানদেরকে আগুনের গোলা দ্বারা হত্যা করা হয়। যখনই কোন তারকা মানুষের দৃষ্টি থেকে উধাও হয়ে যায়, তখনই বুঝতে হবে যে, তারকাটি শয়তানকে পেয়েছে এবং আঘাত করেছে। তারকা শয়তানের মুখমণ্ডল, পাঁজর ও হাত জ্বালিয়ে দেয়। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) রেওয়ায়েত করেন যে, আকাশে জিনদের প্রতিটি দলের বসার জন্যে জায়গা ছিল। তারা সেখান থেকে ওহীর বিষয়বস্তু শুনত এবং অতীন্দ্রিয়বাদীদের কাছে এসে বর্ণনা করত। আল্লাহ তায়ালা নবী করীম (সাঃ)-কে নবুওত দান করার পর শয়তানদেরকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দিলেন। যখন আরবের অতীন্দ্রিয়বাদীদের কাছে জিনদের তরফ থেকে সংবাদ আসা বন্ধ হয়ে গেল, তখন তারা বলতে লাগলঃ আকাশের জিন ধ্বংস হয়ে গেছে। এরপর তারা এই পন্থা অবলম্বন করল যে, উটওয়ালারা প্রতিদিন একটি উট, গরু ওয়ালারা প্রতিদিন একটি গরু এবং ছাগল ওয়ালারা প্রতিদিন একটি ছাগল বলী দিতে শুরু করল। ইবলীশ বললঃ পৃথিবীতে কোন বড় ঘটনা ঘটেছে। আমার কাছে প্রত্যেক জায়গার মাটি নিয়ে এস। তার চেলারা মাটি নিয়ে এল। সে প্রত্যেক জায়গার মাটির ঘ্রাণ নিল। মক্কার মাটির ঘ্রাণ নিয়ে সে বললঃ এখানেই ঘটনাটি ঘটেছে। সে দ্রুতগতিতে মক্কায় পৌঁছে দেখল যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) প্রেরিত হয়েছেন। বায়হাকী আওফীর সনদ সহকারে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেছেন যে, যেদিন রসূলুল্লাহ (সাঃ) নবুওয়তের ঘোষণা দিলেন, সেদিনই শয়তানদেরকে বাধা দেয়া হল এবং তাদের উদ্দেশ্যে জ্বলন্ত উল্কাপিণ্ড নিক্ষিপ্ত হল। ইবলীশ বললঃ কোন ভূখণ্ডে নবী প্রেরিত হয়েছেন তোমরা যেয়ে তালাশ কর। শয়তানরা ব্যর্থ হয়ে ফিরে এল। নবুওয়তের কোন চিহ্ন তারা পেল না। এরপর খোদ ইবলীশ মক্কায় এল। সে রসূলে করীম (সাঃ)-কে হেরা গিরিগুহা থেকে বের হয়ে আসতে দেখল। এরপর ইবলীস তার চেলাচামুণ্ডাদের মধ্যে ফিরে গেল এবং তাদেরকে অবহিত করল। ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেন হযরত ঈসা (আঃ) ও রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মাঝখানে যে অন্তর্বর্তীকাল ছিল, তাতে আকাশের হেফাযত করা হত। না। শয়তানরা আকাশের মাটিসমূহে কথাবার্তা শুনার জন্যে যেয়ে বসত। যখন আল্লাহতায়ালা নবী করীম (সাঃ)-কে প্রেরণ করলেন, তখন আকাশে কড়া পাহারা বসিয়ে দেয়া হল এবং শয়তানরা নিহত হতে লাগল। ওয়াকেদী ও আবু নয়ীম হযরত উবাই ইবনে কাব (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেছেন যে, হযরত ঈসা (আঃ)-কে আকাশে উত্তোলনের পর থেকে উল্কাপিণ্ড নিক্ষেপ করা হয়নি। নবী করীম (সাঃ)-এর নবুওয়তপ্রাপ্তির পর আবার উল্কাপিণ্ড নিক্ষেপ শুরু হয়। সে মতে কোরায়শদের কাছে এটা ছিল সম্পূর্ণ নতুন ব্যাপার, যা ইতিপূর্বে তারা কখনও দেখেনি। তারা নিজেদের জন্তুগুলো ছেড়ে দিতে ও গোলাম আযাদ করতে শুরু করল। তারা বুঝল যে, প্রলয়ের সময় এসে গেছে। হকীফ গোত্রও তাই করতে লাগল। আবদে ইয়ালীল এই সংবাদ পেয়ে বললঃ তড়িঘড়ি করো না; বরং যে তারকা নিক্ষেপ করা হয়, তার পরিচয় জানা গেলে তা মানুষের ধ্বংসের কারণ। আর যদি পরিচয় জানা না যায়, তবে তা এমন বিষয়ের কারণে, যা প্রকাশ পেয়েছে। এ কথা শুনে আরবরা গভীরভাবে লক্ষ্য করে দেখল যে, নিক্ষিপ্ত তারকাগুলো পরিচয়ের বাইরে। তারা আবদে ইয়ালীলকে এ সম্পর্কে অবহিত করলে তিনি বললেন। এটা একজন নবীর আবির্ভাবের সময়। এর কিছুদিন পরেই আবু সুফিয়ান ইবনে হরব তায়েফ আসে এবং সংবাদ দেয় যে, মোহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ আত্মপ্রকাশ করেছেন এবং তিনি প্রেরিত নবী হওয়ার দাবী করেন। এ সংবাদ শুনে আবদে ইয়ালীল বললেন: এ কারণেই তারকা নিক্ষিপ্ত হয়। ইবনে সা’দ এয়াকুব ইবনে ওতবা ইবনে মুগীরা থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তারকা নিক্ষেপের ঘটনা দেখে আরবে ছকীফ গোত্রের লোকজন সর্বপ্রথম ভীত সন্ত্রস্ত হয়। তারা আমর ইবনে উমাইয়ার কাছে যেয়ে বললঃ আপনি নতুন আত্মপ্রকাশ কারী বিষয়টি দেখেছেন কি? সে বললঃ হাঁ, আমি দেখেছি। তোমরা লক্ষ্য করে দেখ, যদি সেগুলো বড় বড় নক্ষত্র হয়, যদ্দ্বারা দিক ও পথ জানা যায় এবং গ্রীষ্ম ও শীত জানা যায়, তবে তাদের সেগুলোর হওয়া প্রলয় ও মানব জাতির ধ্বংসের আলামত। আর যদি সেগুলো প্রসিদ্ধ তারকা ছাড়া অন্য অখ্যাত তারকা হয়, তবে এটা আল্লাহতায়ালার ইচ্ছার অধীনে হয় এবং সেই ইচ্ছা হচ্ছে একজন নবীর আবির্ভাব, যিনি আরবে প্রেরিত হবেন। তাঁর কারণে এসব ঘটনা ঘটছে। খারায়েতী হাক্কায়েক গ্রন্থে এবং ইবনে আসাকির মেরদাস ইবনে কায়স থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তিনি বলেনঃ আমি রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে অতীন্দ্রিয়বাদ ও নবী করীমের (সাঃ) আত্মপ্রকাশের কারণে অতীন্দ্রিয়বাদীদের সংবাদ আদান-প্রদান বিচ্ছিন্ন হওয়া সম্পর্কে আলোচনা করলাম। আমি বললামঃ আমাদের এখানে খালছা নাম্নী এক বাঁদী ছিল। তার সম্পর্কে আমরা ভাল ছাড়া অন্য কিছু জানতাম না। যে আমাদের কাছে এসে বললঃ হে দওস গোত্রের লোকজন। তোমরা আমার মধ্যে ভাল ছাড়া অন্য কোন বিষয় জাননি। কিন্তু অন্য বিষয়ও আমার মধ্যে আছে। আমরা প্রশ্ন করলামঃ সে বিষয়টি কি? সে বললঃ আমি আমার ছাগল চরাচ্ছিলাম। হঠাৎ এক অন্ধকার এসে আমাকে ঘিরে ফেলল। আমি
পৃষ্ঠা:১৭
অনুভব করলাম যে, কোন এক অজ্ঞাত পুরুষ যেন আমাকে সম্ভোগ করছে। আমি গর্ভবতী হয়ে গেলাম। অতঃপর যখন প্রসবের সময় এল, তখন এমন এক ছেলে সন্তান ভূমিষ্ট হল, যার লম্বা ও ঝুলন্ত উভয় কান কুকুরের কানের মত ছিল। সেই ছেলে আমাদের মধ্যে বড় হয়ে একদিন অন্য ছেলেদের সাথে খেলাধুলা করছিল। হঠাৎ সে বঝম্প দিয়ে উঠল, পরিধেয় বস্ত্র খুলে দূরে নিক্ষেপ করল এবং উচ্চস্বরে হায় হায় বলল। অতঃপর সে করতে লাগলঃ আল্লাহর কসম, পাহাড়ের এই ঘাঁটির অপর পার্শ্বে অশ্বারোহী দল আছে এবং তাদের মধ্যে আছে এক সুশ্রী যুবক।এ কথা শুনে আমরা দৌড়ে সেখানে গেলাম এবং অশ্বারোহী দলকে বিতাড়িত করে তাদের মাল লুটে নিলাম। সেই ছেলেটি আমাদের কাছে যা বলত, তা অক্ষরে অক্ষরে সত্য হত। ইয়া রসূলাল্লাহ! যখন আপনার আবির্ভাবের সময় এল, তখন সে আমাদেরকে যে সব সংবাদ বলত, তা মিথ্যা হত। আমরা তাকে বললামঃ ব্যাপার কি, তুমি যা বল, সব মিথ্যা হয় কেন? ছেলেটি বললঃ আমি কিছুই জানি না। যে আমাকে সত্যবাদী করেছিল, সে-ই আমাকে মিথ্যাবাদী করেছে। তোমরা আমাকে তিনদিন পর্যন্ত গৃহবন্দী করে রাখ। এরপর আমার কাছে এস। আমরা তাই করলাম। তিনদিন পর এসে গৃহের দরজা খুললাম। দেখি কি, সেই বালক একটি অঙ্গারের মত পড়ে আছে। সে বললঃ হে দউস গোত্রের লোকজন। আকাশে পাহারা বসানো হয়েছে এবং সর্বশ্রেষ্ঠ পয়গাম্বর আত্মপ্রকাশ করেছেন। আমরা তাকে জিজ্ঞাসা করলামঃ কোথায় আত্মপ্রকাশ করেছেন? সে বললঃ মক্কায়। এখন আমি মৃত। তোমরা আমাকে এক পাহাড়ের চূড়ায় দাফন করে দিয়ো। আমি অগ্নি প্রজ্বলিত করব তোমরা যখন আমার অগ্নি প্রজ্বলিত করা দেখবে, তখন আমাকে তিনটি পাথর মারবে। প্রত্যেক পাথর মারার সময় “বিইসমিকা আল্লাহুম্মা” বলবে। এরপর আমার প্রজ্বলন বন্ধ হয়ে যাবে এবং আমি স্থির ও ঠাণ্ডা হয়ে যাব।আমরা তাই করলাম। এরপর আমরা নবীর আবির্ভাবের সংবাদের অপেক্ষা করতে লাগলাম। অবশেষে হাজীরা হজ্ব শেষে আমাদের কাছে এল এবং তারা রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আবির্ভাব সম্পর্কে আমাদেরকে অবহিত করল।ইবনে সা’দ ও আবু নয়ীম যুহরী থেকে রেওয়ায়েত করেছেন যে, ওহী মাঝপথে শ্রবণ করা হত। যখন ইসলাম এল, তখন জিনদেরকে এ কাজ থেকে বিরত রাখা হল। বনী-আসাদে সায়ীরা নাম্নী এক মহিলার একটি অনুগত জিন ছিল। ওহী শ্রবণের পথ রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার পর সেই জিন সায়ীরার কাছে এল এবং তার বক্ষ দেশে প্রবেশ করে চীৎকার করে বলতে লাগলঃ পারস্পরিক আলিঙ্গন মওকূফ হয়ে গেছে, তরবারি উত্তোলিত হয়ে গেছে এবং এমন বিষয় এসেছে, যা প্রতিহত করার সাধ্য কারও নেই। আহমদ (সাঃ) যিনা হারাম করেছেন। বায়হাকী যুহরী থেকে বর্ণনা করেছেন- আল্লাহতায়ালা শয়তানদেরকে আকাশের কথাবার্তা শ্রবণ থেকে নক্ষত্ররাজির মাধ্যমে বাধা প্রদান করেছেন। অতীন্দ্রিয়বাদ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এবং এর কোন অংশ এখন অবশিষ্ট নেই। ওয়াকেদী ও আবু নয়ীম নাফে’ ইবনে জুবায়র থেকে রেওয়ায়েত করেছেন। যে, হযরত ঈসার (আঃ) পর অন্তবর্তীকালে শয়তানরা আকাশের আলাপ আলোচনা শুনত এবং তাদের প্রতি উল্কাপিণ্ড নিক্ষেপ করা হত না। কিন্তু যখন নবী করীম (সাঃ) প্রেরিত হলেন, তখন তাদের প্রতি উল্কাপিণ্ড নিক্ষিপ্ত হতে লাগল।ওয়াকেদী ও আবু নয়ীম আতা থেকে এবং তিনি হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, শয়তানরা ওহীর কথাবার্তা শ্রবণ করত। যখন আল্লাহ তায়ালা রসূলুল্লাহ (সাঃ) কে প্রেরণ করলেন, তখন শয়তানরা বাধাপ্রাপ্ত হল। তারা ইবলীশের কাছে এ বিষয়ে অভিযোগ করলে সে বললঃ কোন বড় ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। সে আবু কোবায়স পাহাড়ে আরোহণ করে দেখল, রসুলুল্লাহ (সাঃ) মকামে-ইবরাহীমের পিছনে নামায পড়ছেন। ইবলীশ বললঃ আমি এখনি তাঁর খাড় মটকে দেয়ার জন্যে যাচ্ছি। এহেন মন্দ উদ্দেশ্য নিয়ে সে এল। তখন জিবরাঈল (আঃ) রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে ছিলেন। তিনি এই অভিশপ্তকে লাথি মেরে বহু দূরে নিক্ষেপ করলেন। ওয়াহেদী ও আবূ নয়ীম মোজাহিদ থেকেও একই ধরনের রেওয়ায়েত করেছেন। আবু নয়ীম হযরত আনাস ইবনে মালেক থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, যখন নবী করীম (সাঃ) প্রেরিত হলেন, তখন ইবলীশ তাঁকে প্রতারিত করতে এল। জিবরাঈল (আঃ) তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন এবং ইবলীশকে তাঁর স্কন্ধদেশ থেকে আলাদা করে জর্দান উপত্যকায় নিক্ষেপ করলেন। আবু শায়খ, তিবরানী ও আবু নয়ীম হযরত আনাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, নবী করীম (সাঃ) মক্কা মোকাররমায় সিজদারত ছিলেন। অভিশপ্ত ইবলীশ তাঁর ঘাড় পিষ্ট করে দেয়ার অভিপ্রায় নিয়ে অগ্রসর হল। জিবরাঈল (আঃ) এমন এক ফোঁক মারলেন যে, জর্দান না পৌঁছা পর্যন্ত তার পা কোথাও ঠেকল না।
কোরআনের মোজেযা
আল্লাহপাক এরশাদ করেনঃقُلْ لَئِينِ اجْتَمَعَتِ الْإِنْسُ وَالْجِنُّ عَلَى أَنْ تَأْتُوا بِمِثْلِ هَذَا الْقُرْآنِ لَا يَأْتُونَ بِمِثْلِهِ وَلَوْ كَانَ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ ظَهِيرًا
পৃষ্ঠা:১৮
হে নবী! বলে দিন, যদি মানব ও জিনজাতি সম্মিলিত হয়ে এই কোরআনের অনুরূপ কালাম আনার চেষ্টা করে, তবে তারা এর অনুরূপ কালাম আনতে পারবে না, যদিও একে অপরের সাহায্য করে। আল্লাহ তায়ালা আরোও বলেনঃوَإِن كُنتُمْ فِي رَيْبٍ مِّمَّا نَزَّلْنَا عَلَى عَبْدِنَا فَأْتُوا بِسُورَةٍ مِّنْ مثْلِهِ وَادْعُوا شُهَدَاءَ كُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِيْنِ فَإِنْ لَّمْ تفْعَلُوا وَلَن تَفْعَلُوا فَاتَّقُوا النار الآية: আমার বান্দার প্রতি অবতীর্ণ কালাম সম্পর্কে তোমাদের কোন সন্দেহ থাকলে এর অনুরূপ একটি সূরা নিয়ে আস এবং তোমাদের সকল শরীককে ডেকে নাও আল্লাহ ছাড়া; যদি তোমরা সত্যবাদী হও। এরপর যদি তোমরা না পার এবং কখনও পারবে না, তবে অগ্নিকে ভয় কর।আল্লাহ তায়ালা আরো বলে:فَلْيَأْتُوا بِحَدِيثٍ مِثْلِهِ إِنْ كَانُوا صَادِقِينَ তারা সত্যবাদী হলে কোরআনের অনুরূপ একটি আয়াতই নিয়ে আসুক।ইমাম বুখারী হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে রসূলে করীম (সাঃ)-এর এই উক্তি বর্ণনা করেন যে প্রত্যেক পয়গাম্বরকেই এমন বিষয় দেয়া হয়েছে, যার প্রতি মানুষ ঈমান আনবে। আমাকে যা দেয়া হয়েছে, তা হচ্ছে ওহী। এই ওহী আল্লাহ তায়ালা আমার কাছে প্রেরণ করেছেন। আমি আশা করি সকল পয়গাম্বর অপেক্ষা আমার অনুসারীর সংখ্যা অধিক হবে। আলেমগণ বলেন: এই হাদীসের উদ্দেশ্য এই যে, পয়গাম্বরগণের মোজেযাসমূহ তাঁদের জীবৎকাল সমাপ্ত হওয়ার সাথে সাথে সমাপ্ত হয়ে গেছে। এসকল মোজেযা কেবল তারাই প্রত্যক্ষ করেছেন, যারা পয়গাম্বরগণের আমলে বিদ্যমান ছিলেন। কিন্তু কোরআনুল করীমের-মোজেযা কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। কোরআন পাক স্বীয় বর্ণনাভঙ্গি, প্রাঞ্জলতা ও অদৃশ্য বিষয়ের সংবাদ দেয়ার ব্যাপারে অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন। এমন কোন কাল অতিক্রান্ত হয় না, যার মধ্যে কোরআন পাকের বর্ণিত সংবাদসমূহের মধ্যে কোন না কোন একটি ভবিষ্যদ্বাণী আত্মপ্রকাশ না করে। এসব বিষয় কোরআন পাকের বিশুদ্ধতা-দাবীর স্বপক্ষে প্রকৃষ্ট প্রমাণ। খাসায়েসুল কুবরা-১ম খণ্ড পরোক্ত হাদীসের এ উদ্দেশ্যও বর্ণনা করা হয়েছে যে, পূর্ববর্তী মোজেযাসমূহ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ছিল। চর্মচক্ষু দিয়ে সেগুলো প্রত্যক্ষ করা হত; যেমন হযরত ছালেহ্ (আঃ)-এর উন্ত্রী এবং হযরত মূসা (আঃ)-এর লাঠি। এর বিপরীতে কোরআনী মোজেযাসমূহ অন্তরঃচক্ষু দ্বারা প্রত্যক্ষ করা হয়। সুতরাং যারা অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা পরিচালিত হয়ে কোরআনের অনুসরণ করে তাদের সংখ্যা বেশি না হয়ে পারে না। কেননা, যে মোজেযা চর্মচক্ষু দিয়ে অবলোকন করা হয়, তা অবলোকনকারীর গতায়ু হয়ে যাওয়ার কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আর যে বিষয় জ্ঞানের চক্ষু দিয়ে প্রত্যক্ষ করা হয়, তা অবশিষ্ট থাকে। যারা প্রথম প্রত্যক্ষকারীদের পরে আসে, তারা সর্বদা তা প্রত্যক্ষ করতে থাকে।হাফেয ইবনে হজর বলেন: উপরোক্ত উভয় ব্যাখ্যার সম্মিলন এক বাক্যের মধ্যে সম্ভবপর। কেননা, উভয় উক্তির সারমর্ম একটি অপরটির পরিপন্থী নয়। হাকেম ও বায়হাকী ইকরামা থেকে এবং তিনি হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, ওলীদ ইবনে মুগীরা নবী করীম (সাঃ)-এর সামনে উপস্থিত হলে তিনি তার সামনে কোরআন পাক তেলাওয়াত করলেন। এতে তার অন্তর বিগলিত হল। আবু জহল এ সংবাদ অবগত হয়ে ওলীদের কাছে গেল এবং বললঃ চাচা! কোরায়শরা আপনার জন্যে ধনসম্পদ একত্রিত করতে চায়। ওলীদ বলল: কেন? আবূ জহল বলল: আপনাকে দেয়ার জন্যে। কেননা, আপনি মোহাম্মদের কাছে গিয়েছিলেন। তাঁর কাছে যা আছে, আপনি তা দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছেন। ওলীদ বললঃ কোরায়শরা জানে যে, আমি তাদের মধ্যে সর্বাধিক ধনী ব্যক্তি। আবু জহল বলল: আচ্ছা, মোহাম্মদ সম্পর্কে এমন কোন কথা বলুন, যদ্ধারা আপনার কওম বুঝতে পারে যে, আপনি তাঁর প্রতি বিশ্বাসী নন।ওলীদ জওয়াব দিল: আমি কি বলব? তোমাদের মধ্যে কেউ সমরসঙ্গীত ও স্মৃতিগাথায় আমার চেয়ে অধিক বিজ্ঞ নেই। মোহাম্মদ যা বলেন, কবিতার সাথে তার কোন মিল নেই। এতদসত্ত্বেও তাঁর বর্ণিত বাক্যসমূহে অসাধারণ মিষ্টতা, অপূর্ব সৌন্দর্য ও মুগ্ধকরতা আছে। তাঁর উক্তি সকল উক্তির সেরা এবং কোন উক্তি তাঁর উক্তির চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়। তাঁর উক্তি অন্য সকল মহৎবাণীকে আচ্ছন্ন করে দেয়। আবু জহল বলল: আপনার কওম আপনার প্রতি সন্তুষ্ট হবে না, যে পর্যন্ত আপনি মোহাম্মদ সম্পর্কে কোন মন্দ কথা না বলেন। ওলীদ বলল: আচ্ছা, আমাকে চিন্তা-ভাবনা করার সময় দাও। সেমতে চিন্তাভাবনার পর ওলীদ বলল: এটা তো সেই যাদু, যা আমরা একে অপরের কাছ থেকে বর্ণনা করি। এই ঘটনার পর নিম্নোক্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়ঃ- ذَرْنِي وَمَنْ خَلَقْتُ وَحِيدًا وَجَعَلْتُ لَهُ مَالًا مَعْدُودًا – وَبَنِينَ
পৃষ্ঠা:১৯
شُهُودًا – وَمَهَدْتُ لَهُ تَسْمِهِيدًا ثُمَّ يَطْمَعُ أَنْ أَزِيدَ كَلَّا إِنَّهُ كَانَ لِا تَانِنَا عَنبْدًا سَأَرْهِقَهُ صَعُبُودًا إِنَّهُ فَكَرَ وَقَدَّرَ فَقُتِلَ كَيْفَ قَدَرَ ثُمَّ قتِلَ كَيْفَ قَدرَ ثُمَّ نَظَرَ ثُمَّ عَبَسَ وَبَسَر ثُمَّ أَدْمَرَ وَاسْتَكْبَرَ فَقَالَ انْصَذَا سِحْرَ تُوثَرُ انْهَذَا إِلَّا قَوْلُ الْبَشَرِ سَاصْلِيْهِ سَفَر আমার হাতে ছেড়ে দাও তার জন্য যাকে আমি অসাধারণ করে সৃষ্টি করেছি। তাকে আমি দিয়েছি বিপুল ধন-সম্পদ এবং নিত্যসঙ্গী পুত্রগণ এবং তাকে দিয়েছি স্বচ্ছন্দ জীবনের প্রচুর উপকরণ। এরপরও সে কামনা করে যে, আমি তাকে আরও অধিক দেই। না, তা হবে না। সে আমার নিদর্শনসমূহের বিরুদ্ধাচরণে বদ্ধপরিকর। আমি তাকে ক্রমবর্ধমান শাস্তি দ্বারা আচ্ছন্ন করব। সে চিন্তা করল এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। অভিশপ্ত হোক সে, সে কেমন করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হল। সে আবার চেয়ে দেখল। অতঃপর সে ভ্রুকুঞ্চিত করল এবং মুখ বিকৃত করল। অতঃপর সে পিছিয়ে গেল এবং অহংকার করল এবং ঘোষণা করলঃ এটা তো লোক-পরম্পরায় প্রাপ্ত যাদু ছাড়া আর কিছু নয়। এটা মানুষেরই উক্তি। আমি তাকে নিক্ষেপ করব সর্বনিকৃষ্ট জাহান্নামে। ইবনে ইসহাক ও বায়হাকী ইকরামা থেকে এবং তিনি হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, ওলীদ ইবনে মুগীরা ও কোরায়শদের একটি দল সমবেত হল। ওলীদ ছিল তাদের মধ্যে সর্বাধিক প্রবীণ। হজ্জের দিনও আসন্ন ছিল। ওলীদ বলল: আরবের বিভিন্ন গোত্রের প্রতিনিধিত্বকারী লোকজন তোমাদের কাছে আসবে। তারা রসূলুল্লাহ (সাঃ) সম্পর্কে শুনেছে। সুতরাং এ ব্যাপারে তোমরা নিজেদের মধ্যে ঐকমত্য করে নাও। সবারই যেন এক কথা হয়। তোমাদের কারও কথা যেন অন্য কারও কথাকে খণ্ডন ও মিথ্যা প্রতিপন্ন না করে। সকলেই বললঃ আবদুশ-শামস। আপনিই আমাদের জন্যে একটি মত স্থির করে দেন, যার উপর আমরা সকলেই কায়েম থাকি। ওলীদ বললঃ না, তোমরাই বল। আমি শুনি তোমরা কি বল। তারা বললঃ আমরা তাঁকে অতীন্দ্রিয়বাদী বলব।ওলীদ বললঃ মোহাম্মদ অতীন্দ্রিয়বাদী নয়। আমি অতীন্দ্রিয়বাদীদেরকে দেখেছি। তার কথা তাদের বাঞ্ছারার সাথে কোন সম্পর্ক রাখে না। লোকেরা বলন : তা হলে আমরা উল্লাস বলব। ওলীন বললঃ সে উন্মাদ নয়। আমরা অনেক উন্মাদ দেখেছি, চিনেছি। উন্মাদ ক্রোধের তীব্রতা, মনের খটকা এবং জল্পনা কল্পনা দ্বারা তাড়িত হয়ে কথা বলে। তার কথা এরূপ নয়। কোরায়শরা বলল: আমরা কবি বলব। ওলীদ বলল, সে কবিও নয়। আমরা কবিতার সকল প্রকারই জানি। তার কথা কবিতার কোন প্রকারের মধ্যে পড়ে না। কোরায়শরা বলল, আমরা যাদুকর বলব। ওলীদ বলল, তার কথা যাদু নয়। আমরা যাদুকর ও তাদের যাদু দেখেছি। তারা কথা ফোঁকে এবং দম করে। তাদের যাদুর গ্রন্থি থাকে। কোরায়শরা বলল, হে আবু আবদে শামস আপনি কি বলেন? ওলীদ বলল, আল্লাহর কসম, মোহাম্মদের কালামে অদ্ভুত মিষ্টতা আছে। তাঁর কথার শিকড় ফলে পরিপূর্ণ এবং পাকা, তরতাজা ও ফলন্ত। তোমরা যা যা বললে, সবগুলোই বাতিল ও অসার প্রতিপন্ন হয়ে যাবে। বরং অধিকতর সমীচীন এই যে, তোমরা তাকে এমন যাদুকর বলবে, যে একজন মানুষ ও তার পিতা, ভাই, স্ত্রী এবং গোত্রের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করে দেয়। একথা শুনে সকলেই ওলীদের কাছ থেকে প্রস্থান করল। যখন হজ্বের মওসুম এল এবং চতুর্দিক থেকে মানুষ আসতে শুরু করল, তখন কোরায়েশরা আগন্তুকদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্যে রাস্তার মোড়ে মোড়ে বসে গেল। যে কেউ তাদের কাছ দিয়ে গমন করত, তাকেই রসূলে করীম (সাঃ)-থেকে সতর্ক থাকতে বলে দিত। সেমতে আল্লাহ তায়ালা ওলীদ সম্পর্কে উপরোক্ত আয়াত নাযিল করেন। ওলীদ আল্লাহ তায়ালার কালাম ও রসূলুল্লাহ (সাঃ)- সম্পর্কে মানুষের সাথে আলাপ-আলোচনা করত। তার কাছে যারা বসত, তারা তার কথার প্রশংসা করত। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা এ আয়াত নাযিল করেনঃ الَّذِينَ جَعَلُوا الْقُرْآنَ عِضِينَ فَوَرَبِّكَ لَنَسْتَلَتَهُمْ أَجْمَعِينَ- অর্থাৎ যারা কোরআনের বিভিন্ন বিষয়াবলীকে খন্ডন করেছে, আপনার প্রতিপালকের কসম, আমি অবশ্যই তাদেরকে জিজ্ঞাসা করব। রাবী বর্ণনা করেন, আরবের লোকেরা নবী করীম (সাঃ)-এর খবর নিয়ে হজ্ব থেকে আপন আপন বাড়িঘরে প্রত্যাবর্তন করল। এভাবে আরবের সকল শহরে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আলোচনা ছড়িয়ে পড়ল। আবু নয়ীম আউফী থেকে এবং তিনি হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, ওগীদ আবু বকর ছিদ্দীক (রাঃ)-এর কাছে কোরআন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে আসে। হযরত আবূ বকর (রাঃ) তাকে অবগত করলে সে কোরায়শদের কাছে গেল এবং বলল, ইবনে আবী কাবশা যে কথা বলে, তা খুবই আশ্চর্যজনক। আল্লাহর কসম, সেটা না কবিতা, না যাদু, না পাগলামীর মত প্রলাপোক্তি। নিশ্চিতরূপেই তার কথা খোদায়ী কালাম। আবু নয়মী সুন্দী, ছগীর, কলবী, আবু ছালেহ, হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, ওলীদ স্বগোত্রীয় লোকদেরকে বলল, কাল হজ্বে সব
পৃষ্ঠা:২০
মানুষ জমায়েত হবে। মোহাম্মদের কথা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। কাল সকলেই তোমাদেরকে তাঁর সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। তখন তোমরা কি জবাব দিবে। সকলেই বলল, আমরা বলে দিব সে পাগল। ক্রোধের তীব্রতায় কথা বলে। ওলীদ বলল, মানুষ তার কাছে যাবে এবং তার সাথে কথা বলবে। তারা যখন তাকে বুদ্ধিমান ও শালীন বাক্যালাপকারী রূপে পাবে, তখন তোমাদেরকে মিথ্যাবাদী বলবে। কোরায়শরা বলল, আমরা কবি বলব। ওলীদ বলল, আরবরা লোক-পরস্পরায় কবিতা বর্ণনা করে। মোহাম্মদের কালাম কবিতা নয়। তারা তোমাদেরকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করবে। কোরায়শরা বলল, আমরা বলে দিব যে, সে অতীন্দ্রিয়বাদী। ভবিষ্যতে সংঘটিতব্য বিষয়াদি বলে। ওলীদ বলল, আরবরা অতীন্দ্রিয়বাদীদের সাথে মেলামেশা করে। যখন তারা তার উক্তি শুনবে এবং অতীন্দ্রিয়বাদের অনুরূপ পাবে না, তখন তোমরা মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত হয়ে যাবে। ইবনে ইসহাক, বায়হাকী ও আবু নয়ীম ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেছেন যে, নম্বর ইবনে হারেছ কেলদাহ দাঁড়িয়ে বলল, কোরায়শ সম্প্রদায়, তোমাদের উপর এমন বিষয় নাযিল হয়েছে যে, এ ধরনের বিষয়ের তোমরা কখনও সম্মুখীন হওনি। মোহাম্মদ (সাঃ) তোমাদের মধ্যে অল্পবয়স্ক, অধিকতর পছন্দনীয়, অধিক সত্যবাদী এবং বিশ্বস্ততায় সকলের সেরা ছিল। অবশেষে তোমরা যখন তার কান ও মাথার মধ্যবর্তী স্থানে শুভ্রতা দেখলে তখন সে তোমাদের কাছে যা আনার এনেছে। তোমরা তাকে যাদুকর বলছ। আল্লাহর কসম, সে যাদুকর নয়। আমরা যাদুকর, তাদের যাদু ও গ্রন্থি দেখেছি। তোমরা তাকে অতীন্দ্রিয়বাদী বলেছ। অথচ সে তা নয়। আমরা অতীন্দ্রিয়বাদীদের অবস্থা দেখেছি। তাদের কথাবার্তা শুনেছি। তোমরা তাকে কবি বলেছ। সে কবি নয়। আমরা কবিতা বর্ণনা করেছি এবং সকল প্রকার কবিতা শুনেছি। তোমরা তাকে পাগল বলেছ। আল্লাহর কসম, সে পাগল নয়। আমরা পাগলামি দেখেছি। এটা পাগলের প্রলাপোক্তি নয়। হে কোরায়শ সম্প্রদায়। তোমরা নিজেদের সম্পর্কে চিন্তাভাবনা কর। তোমাদের উপর এক বিরাট বিষয় নেমে এসেছে। ইবনে আবী শায়বা, বায়হাকী ও আবূ নয়ীম হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আবু জহল ও কোরায়শ নেতৃবৃন্দ বলল, আমাদের মধ্যে মোহাম্মদের ব্যাপারটি ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের উচিত এমন ব্যক্তিকে তালাশ করা, যে যাদু, অতীন্দ্রিয়বাদ ও কবিতা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল। সে গিয়ে মোহাম্মদের সাথে কথা বলবে, এরপর আমাদের কাছে এসে বর্ণনা করবে। একথা শুনে ওতবা বলল, আমি কবিতা, অতীন্দ্রিয়বাদ ও যাদু সম্পর্কে যথেষ্ট আন রাখি। এমন কোন বিষয় থাকলে তা আমার কাছে গোপন থাকবে না। সেমতে ওতবা রসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে এল এবং বললঃ মোহাম্মদ। আপনি শ্রেষ্ঠ, না হাশেম? আপনি শ্রেষ্ঠ, না আবদুল মোত্তালিব। আপনি শ্রেষ্ঠ, না আবদুল্লাহ? রসূলুল্লাহ (সাঃ) ওতবাকে কোন জবাব দিলেন না। ওতবা বলল, আপনি আমাদের উপাস্যদেরকে মন্দ বলেন কেন এবং আমাদের বাপদাদাকে ভ্রান্ত সাব্যস্ত করেন কেন? যদি আপনি নেতৃত্ব চান, তবে আমরা আমাদের ঝাণ্ডা আপনার কাছ খাড়া করে দিব এবং আজীবন আপনি আমাদের নেতা থাকবেন। আর যদি আপনি বিবাহ করতে চান, তবে কোরায়শ বংশের যে সকল পরমাসুন্দরী ললনাকে আপনি বিয়ে করতে চাইবেন, তাদের মধ্য থেকে দশ জনকে আমরা আপনার বিবাহে সমর্পণ করব। আর যদি আপনি ধনসম্পদ পছন্দ করেন, তবে আমরা আপনার জন্যে অগাধ ধনরাশি একত্রিত করে দিব, যদ্দ্বারা আপনি এবং আপনার পরবর্তী বংশধররা পরম সখে জীবন যাপন করতে পারবে। রসূলে করীম (সাঃ) নিরুত্তর ছিলেন কোন কথা বলছিলেন না। যখন ওতবা তার বক্তব্য সমাপ্ত করল, তখন তিনি নিম্নোক্ত আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করলেনঃبسم الله الرحيم – حكمْ تَنْزِيلُ مِنَ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ كِتَابٌ فُصِّلَتْ آيَاتُهُ قُرَأَنَا عَرَبِيًّا لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ …. فَإِنْ أَعْرَضُوا فَقُلْ انْذَرْتُكُمْ صَاعِقَةٌ مِثْلَ صَاعِقَةِ عَادٍ وَ ثَمُودَ হা-মীম! দয়ালু, পরম করুণাময় আল্লাহর নামে। এটা দয়াময় পরম করুণাময়ের নিকট থেকে অবতীর্ণ। এটা এমন কিতাব যা অবতীর্ণ হয়েছে আরবী লেসারআনরূপে, বিশদভাবে বিবৃত হয়েছে এর আয়াতসমূহ জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্যে, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে। কিন্তু তাদের অধিকাংশই বিমুখ হয়েছে। সুতরাং তারা শুনবে না। তারা বলে, তুমি যার প্রতি আমাদেরকে আহবান করছ, সে বিষয়ে আমাদের অন্তর আবরনে আচ্ছাদিত, কর্ণে আছে বধিরতা এবং তোমার ও আমাদের মধ্যে আছে অন্তরাল। সুতরাং তুমি তোমার কাজ কর এবং আমরা আমাদের কাজ করি। বলুন, আমি তো তোমাদের মতই একজন মানুষ, আমার প্রতি ওহী নাযিল করা হয় যে, তোমাদের উপাস্য একমাত্র উপাস্য। অতএব তাঁরই পথ অবলম্বন কর এবং তাঁরই নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর। মুশরিকদের জন্যে দুর্ভোগ, যারা যাকাত দান করে না এবং পরকালে অবিশ্বাস করে। যারা বিশ্বাস করে এবং সৎকর্ম করে, তাদের জন্যে রয়েছে নিরবচ্ছিন্ন পুরষ্কার। বলুন, তোমরা কি তাঁকে অস্বীকার করবেই, যিনি পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন,
পৃষ্ঠা ২১ থেকে ৩০
পৃষ্ঠা:২১
দু’দিনে। তোমরা কি তাঁর সমকক্ষ দাঁড় করাতে চাও? তিনি বিশ্বজগতের প্রতিপালক। তিনি ভূপৃষ্টে অটল পর্বতমালা স্থাপন করেছেন, পৃথিবীতে রেখেছেন কল্যাণ এবং চারদিনের মধ্যে এতে ব্যবস্থা করেছেন খাদ্যের, সমানভাবে সকলের জন্যে যারা এর অনুসন্ধান করে। অতঃপর তিনি আকাশের দিকে মনোনিবেশ করলেন যা ছিল ধূম্রপুঞ্জ বিশেষ। অনন্তর তিনি তাকে ও পৃথিবীকে বললেন, তোমরা উভয়ে আমার আদেশ পালনের জন্যে প্রস্তুত হও ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায়। তারা বলল, আমরা তো আনুগত্যের সাথে প্রস্তুত আছি। অতঃপর তিনি আকাশমণ্ডলকে দু’দিনে সপ্তাকাশে পরিনত করলেন এবং প্রত্যেক আকাশের নিকট তার কর্তব্য ব্যক্ত করলেন। তিনি নিকটবর্তী আকাশকে সুশোভিত করলেন প্রদীপমালা দ্বারা এবং করলেন সুরক্ষিত। এসব পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞ আল্লাহ কর্তৃক সুবিন্যস্ত। এরপরও যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তাদেরকে বলে দিন, আমি তো তোমাদেরকে সতর্ক করেছি এক ধ্বংসকর শাস্তি সম্পর্কে, যেমন শাস্তির সম্মুখীন হয়েছিল আদ ও সামূদ সম্প্রদায়। (সূরা হামীম আস সিজদাহ এতটুকু শুনে ওতবা মুখ বন্ধ করল এবং রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে কসম দিয়ে তেলাওয়াত থেকে বিরত থাকতে বলল। এরপর সে সঙ্গীদের কাছে না গিয়ে নিজেকে আলাদা করে নিল। আবু জহল বলল, কোরায়শগণ। আমরা ওতবাকে দেখছিনা। মনে হয় সে মোহাম্মদের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। কোন প্রয়োজনের কারণে মোহাম্মদের খাদ্য তার পছন্দ হয়ে গেছে। চল, আমরা ওতবার কাছে যাই। সেমতে সকলেই শুভবার কাছে এল। আবু জহল বলল, ওতবা, তোমার সম্পর্কে আমাদের ধারণা এই যে, তুমি মোহাম্মদের দিকে ঝুঁকে পড়েছ এবং তাঁর কথা তোমার পছন্দ হয়েছে। যদি তুমি ধনসম্পদ চাও, তবে আমরা তোমার জন্যে এই পরিমাণ ধন-সম্পদ জমা করে দিব, যা তোমাকে মোহাম্মদের খাদ্যের প্রতি অমুখাপেক্ষী করে দিবে। একথা শুনে ওতবা ক্রুদ্ধ হয়ে গেল সে রসূলুল্লাহ (রাঃ)-এর সাথে কখনও কথা বলবে না বলে কসম খেল। অতঃপর বলল, তোমরা ভালরূপেই জান যে, কোরায়শদের মধ্যে আমি সর্বাধিক ধনসম্পদশালীদের একজন। কিন্তু আমি তাঁর কাছে গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে-এমন কথা দিয়ে জবাব দিলেন, আল্লাহর কসম, যা না যাদু, না কবিতা বা অতীন্দ্রিয়বাদ। তিনি এ কথাগুলো তেলাওয়াত করলেন। بسمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ – هُمْ تَنْزِيلُ مِنَ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ صَاعِفَةٌ مِثْلَ صَاعِقَةِ عَادٍ وَثَمُودَআমি আমার মুখ বন্ধ করে নিলাম এবং দয়া ভিক্ষা চাইলাম। তোমরা ভাল করেই জান যে, মোহাম্মদ যখন কোন কথা বলে, ভুল বলে না। আমি আশংকা করলাম যে, কোথাও তোমাদের উপর কোন আযাব নাযিল হয়ে যায়! বায়হাকী ও আবু নয়ীম মোহাম্মদ ইবনে কা’ব (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তিনি বলেন, আমাকে বলা হয়েছে যে, ওতবা ইবনে রবীয়া জনৈক কোরায়শীকে বলল, আমি মোহাম্মদের কাছে যাচ্ছি এবং অনেক বিষয় তাঁর সামনে পেশ করছি। সম্ভবতঃ সে কর্তক বিষয় মেনে নিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে স্বীয় কর্মতৎপরতা থেকে বিরত থাকবে। কোরায়শরা বলল, হে আবুল ওলীদ। তুমি অবশ্যই যাও এবং তার সাথে কথাবার্তা বল। রসূলে করীম (রাঃ) তখন মসজিদে ছিলেন। ওতবা তাঁর কাছে এসে বসে গেল। এরপর মোহাম্মদ ইবনে কা’ব পূর্বোল্লেখিত রেওয়ায়েতটি বর্ণনা করেছেন। কথাবার্তা শেষে রসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে বললেন, আবুল ওলীদ! তোমার কথা শেষ? সে বলল, হাঁ। রসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, এবার আমার কথা শুন। ওতবা বলল, বলুন। রসূলে করীম (সাঃ) সূরা হা-মীম তেলাওয়াত করলেন। তিনি পাঠ করতে থাকলেন এবং ওতবা হতভম্ব হয়ে চুপচাপ শুনতে থাকল। সে উভয় হাত পিছনে নিয়ে তাতে ভর দিয়ে বসল। রসুলুল্লাহ (সাঃ) সেজদার আয়াতে পৌঁছে সেজদা করলেন। অতঃপর ওতবাকে জিজ্ঞাসা করলেনঃ আবুল ওলীদ। শুনেছ? সে বলল: শুনেছি। তিনি বললেন: এ হচ্ছে তোমার প্রশ্ন সমূহের জবাব। এখন তোমার মনে যা চায়, কর। ওতবা ফিরে সঙ্গীদের কাছে গেল। তাদের একজন অপরজনকে বলল, আল্লাহর কসম, ওতবা যে মুখে গিয়েছিল, সে মুখে ফিরে আসেনি। ওতবা তাদের কাছে বসলে তারা জিজ্ঞাসা করল, কি খবর এনেছ? সে বলল, আল্লাহর কসম, আমি এমন কালাম শুনেছি, যা ইতিপূর্বে কখনও শুনিনি। এই কালাম না কবিতা, না যাদু এবং না অতীন্দ্রিয়বাদদের উক্তি। কোরায়শ সম্প্রদায়! তোমরা আমার আনুগত্য কর। আমাকে মোহাম্মদ ও তার মিশনের হাতে ছেড়ে দাও এবং তাঁকে একাগ্রমনে থাকতে দাও। যে কথা আমি তার কাছ থেকে শুনেছি, তার মাধ্যমে একটি বিরাট ঘটনা ঘটবে। যদি সে আরবের উপর প্রাধান্য বিস্তার করে, তবে তার দেশ তোমাদের দেশ হবে এবং তার সম্মান তোমাদের সম্মান হবে। এ কারণে তোমরা সৌভাগ্যশালী হয়ে যাবে। এ কথা শুনে উপস্থিত কোরায়শরা বলল, আবুল ওলীদ, সে তার আকর্ষণীয় বাক্যদ্বারা তোমার উপর যাদু করেছে। ওতবা বলল, তোমাদের জন্যে আমার অভিমত এটাই। এখন তোমাদের যা ভাল মনে হয় কর। বায়হাকী ও আবূ নয়ীম ইবনে ওমর (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, নবী করীম (রাঃ) সূরা হা-মীম তেলাওয়াত করলে ওতবা সঙ্গীদের কাছে এসে বলল, হে আমার সম্প্রদায়! আজ তোমরা আমার কথা অনুযায়ী কাজ কর। পরে আমার অবাধ্যতা করে নিয়ো। আল্লাহর কসম, আমি এমন কালাম শুনেছি, আমার কান
পৃষ্ঠা:২২
ইতিপূর্বে এমন কালাম কখনও শুনেনি। আমি বুঝতে পারিনি যে, তাকে কি জবাব দিব।ইবনে ইসহাক ও বায়হাকী যুহরী থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, আমাকে বলা হয়েছে যে, আবূ জহল, আবু সুফিয়ান ও আখনাস ইবনে শরীত্ব এক রাতে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছ থেকে কিছু শুনার উদ্দেশে বের হল। হুযুর (সাঃ) তখন আপন গৃহে নামায পড়ছিলেন। তারা তেলাওয়াত শুনার জন্যে আপন আপন জায়গায় বসে গেল। কে কোথায় বসেছে, পরস্পরে তা জানত না। ছোবহে ছাদেক উদিত হলে তারা আপন আপন জায়গা ত্যাগ করে চলে গেল। পথিমধ্যে তারা আবার একত্রিত হল। একজন অপরজনকে দেখে পরস্পরে তিরস্কার করে বলল, পুনরায় যেয়ো না। তোমাদের কোন নির্বোধ ব্যক্তি দেখে ফেললে তার মনে তোমাদের সম্পর্কে খটকা দেখা দিবে। এরপর তারা সকলেই ফিরে গেল। দ্বিতীয় রাত এলে তাদের প্রত্যেকেই আপন আপন জায়গায় পুনরায় গিয়ে বসে পড়ল এবং সারারাত তেলাওয়াত শুনল। সকাল হলে তারা আবার প্রস্থান করল এবং এক জায়গায় একত্রিত হল। এরপর আগের দিনের মত কথাবার্তা বলে নিজ নিজ গৃহে চলে গেল। তৃতীয় রাতেও তারা তেলাওয়াত শুনার জন্যে স্ব স্ব স্থানে ফিরে এল এবং সকাল পর্যন্ত তেলাওয়াত শুনল। অতঃপর পথিমধ্যে সকলেই একত্রিত হলে পরস্পরে বলল, আমরা মোহাম্মদের কালাম না শুনার ব্যাপারে একটি চুক্তি না করে এখান থেকে টলব না। সে মতে তারা এ বিষয়ে একটি চুক্তি সম্পাদন করল এবং আপন আপন গৃহে চলে গেল। আখনাস ইবনে শরীফ সকালে উঠে লাঠি হাতে গৃহ থেকে বের হল এবং আবু সুফিয়ানের গৃহে এসে তাকে বলল, আবু হানযালা। তুমি মোহাম্মদের মুখ থেকে যে কালাম শুনেছ, সে সম্পর্কে তোমার অভিমত ব্যক্ত কর। আবু সুফিয়ান বলল, আবু ছালাবা, আমি সেই সব বিষয় শুনেছি, যে গুলো এবং যেগুলোর উদ্দেশ্যও আমি জানি। আখনাস কসম খেয়ে বলল, আমি সেগুলো জানি। এরপর আখনাস আবু জহলের কাছে এল এবং তাকে জিজ্ঞাসা করল, আবুল হাকাম, মোহাম্মদের কাছ থেকে যে জিনিস তুমি শুনেছ, সে সম্পর্কে তোমার অভিমত কি? আবূ জহল বলল, আমি কি শুনেছি? আমাদের মধ্যে ও বনী-আবদে মানাফের মধ্যে পুরুষানুক্রমে চলছে মর্যাদার লড়াই। তারা মানুষকে খাদ্য। খাইয়েছে, আমরাও খাইয়েছি। তারা সওয়ারী দিয়েছে, আমরাও সওয়ারী দিয়েছি। তারা বখশিশ দিয়েছে, আমরাও দিয়েছি। অবশেষে তারা এবং আমরা একে অপরের সমকক্ষ ছিলাম। আমরা ও আবদে-মানাফ ঘোড়দৌড়ের দু’ঘোড়া ছিলাম এবং সমকক্ষতা দাবী করতাম। এখন তারা বলে, আমাদের মধ্যে নবী আছেন। তাঁর কাছে আকাশ থেকে, ওহী আসে। যদি এটা ঠিক হয়, তবে আল্লাহর কসম, আমরা কখনও তার প্রতি ঈমান আনব না এবং তাকে সত্য বলে স্বীকার করব না।বায়হাকী মুগীরা ইবনে শো’বা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তিনি বলেন, সর্বপ্রথম যেদিন আমি রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে চিনেছিলাম, সেদিন আমি এবং আবু জহল মক্কার এক গলি দিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে দেখা হল। হুযুর (সাঃ) আবূ জহলকে বললেন, আবুল হাকাম। আল্লাহ ও তাঁর রসূলের দিকে এস। আমি তোমাকে আল্লাহর দিকে আহবান করছি। আবু জহল জবাব দিল, মোহাম্মদ। আপনি কি আমাদের উপাস্যদেরকে মন্দ বলা থেকে বিরত হবেন না। আপনি চান যে, আমরা আপনার তবলীগ করার সাক্ষ্য দেই। চলুন, আমরা সাক্ষ্য দেই যে, আপনি তবলীগ করেছেন। আল্লাহর কসম, যদি আমি জানতে পারি যে, আপনি যা বলেন, তা সত্য, তবে আমি আপনার অনুসারী হয়ে যাব।এ কথা শুনে রসূলুল্লাহ (সাঃ) ফিরে এলেন। এরপর আবূ জহল আমাকে বলল, আল্লাহর কসম, আমি জানি যে, মোহাম্মদ সত্য বর্ণনা করে। কিন্তু আসল কথা এই যে, বনী-কুছাই বলে আমাদের মধ্যে দারোয়ানী আছে। আমরা বললাম, হাঁ, আছে। বনী-কুছাই বলে, আমাদের মধ্যে “দারুন্নদওয়াহ” (পরামর্শ মজলিস) আছে। আমরা বললাম, নিঃসন্দেহে আছে। বনী-কুছাই বলে আমাদের মধ্যে ঝাণ্ডা আছে। আমরা বললাম, হাঁ আছে। বনী-কুয়াই বলে, আমাদের মধ্যে “সেকায়া” (হাজী গণকে পানি পান করানোর দায়িত্ব) আছে। আমরা বললাম, অবশ্যই। বনী-কুছাই মানুষকে খানা খাইয়েছে। আমরাও খাইয়েছি। এভাবে যখন আমাদের ও তাদের জানু পরস্পরে ঘর্ষণ খেতে লাগল; অর্থাৎ আমরা তাদের সমকক্ষ হয়ে গেলাম, তখন তারা বলতে শুরু করেছে আমাদের মধ্যে নবী আবির্ভূত হয়েছেন। আল্লাহর কসম, আমি তাকে সত্য বলে স্বীকার করব না। মুসলিম হযরত আবু যর গেফারী (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তিনি বলেন, আমার ভাই আনীস মক্কায় আসে। ফিরে গিয়ে সে আমাকে বলল, আমি মক্কায় এক ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ করেছি। তিনি দাবী করেন যে, আল্লাহতায়ালা তাঁকে রসুল করে প্রেরণ করেছেন। আমি আনীসকে জিজ্ঞাসা করলাম, মানুষ তাঁর সম্পর্কে কি বলে, সে বলল, মানুষ তাকে কবি, যাদুকর ও অতীন্দ্রিয়বাদী বলে। আনীস নিজেও কবি ছিল। সে বলল, আমি অতীন্দ্রিয়বাদীদের কথা শুনেছি। এ ব্যক্তি যে কালাম বর্ণনা করে, তা অতীন্দ্রিয়বাদীদের মত নয়। আমি তাঁর কালামকে কাব্যিক ছন্দের সাথে পরিমাপ করেছি। আল্লাহর কসম, তাঁর কালাম কোন মাপেই কবিতা নয়। তিনি সত্যবাদী এবং মানুষ মিনু্যুক। আবু যর (রাঃ) বর্ণনা করেন আমি নিজেই মক্কায় পৌছলাম। সেখানে আমি ত্রিশ দিন ত্রিশ রাত্রি পর্যন্ত অবস্থান করলাম। আমার কাছে যমযমের পানি ছাড়া খাওয়ার কোন বস্তু ছিল না। আমি যমযমের পানি খেয়ে খেয়ে মোটা হয়ে গেলাম। এ কারণে আমার পেটের ত্বকে ভাঁজ পড়ে গেল। এ সময়ের মধ্যে আমি ক্ষুধার কারণে কোনরূপ দুর্বলতা অনুভব করিনি।
পৃষ্ঠা:২৩
আবূ নয়ীম যুহরী থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আসয়াদ ইবনে যুরারাহ্ ইয়াওমুল-আকাবার দিন হযরত আব্বাস (রাঃ)-কে বললেন, আমি নিকট ও দূর সকল আত্মীয়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছি। আমি সাক্ষ্য দেই যে, হুযুর (সাঃ) আল্লাহর রসূল। আল্লাহ তাঁকে প্রেরণ করেছেন। তিনি মিথ্যাবাদী নন। যে কালাম তিনি এনেছেন, তা মানুষের কালামের অনুরূপ নয়। আবু নয়ীম ইবনে ইসহাক থেকে এবং তিনি ইসহাক ইবনে ইয়াসার থেকে বন্ধু-সালামার এক ব্যক্তি থেকে বর্ণনা করেন যে, বন্-সালামাহর এক যুবক ইসলাম গ্রহণ করলে তার পিতা আমর ইবনে জমূহ তাকে বলল, তুমি সে ব্যক্তির কালাম শুনেছ। সে সম্পর্কে আমাকেও অবহিত কর। যুবক পিতার সামনে সূরা ফাতেহা পাঠ করল। আমর বলল, কি সুন্দর কালাম। সে জিজ্ঞাসা করল, তার সমস্ত কালাম এরূপই? পুত্র জওয়াব দিল, আব্বাজান, এর চেয়েও সুন্দর।ইবনে সা’দ শা’বী ও যুহরী থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, বনী সুলায়মের কায়স ইবনে নসীবা নামক এক ব্যক্তি রসূলুল্লাহ (সাঃ) এর খেদমতে এল এবং তাঁর কালাম শুনল। সে কিছু বিষয় জিজ্ঞাসাও করল। রসূলুল্লাহ (সাঃ) সেগুলোর জবাব দিলেন। সে মুসলমান হয়ে গেল। অতঃপর নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্যে ফিরে এসে তাদেরকে বলল, আমি রোমের খবর, পারস্যের কোমল কথাবার্তা, আরবের কবিতা, অতীন্দ্রিয়বাদ এবং হেমইয়ারের গালভরা বুলি শুনেছি। কিন্তু নবী করীম (সাঃ)-এর কালাম এদের কথাবার্তার মোটেই অনুরূপ নয়। তোমরা আমার কথা অনুযায়ী কাজ কর এবং নবী করীম (সাঃ) থেকে আপন অংশ অর্জন কর। সেমতে তারা মক্কা বিজয়ের বছরে এসে মুসলমান হয়ে যায়। তাদের সংখ্যা সাতশ’ এবং এক উক্তি অনুযায়ী এক হাজার ছিল।
কোরআনী মোজেযার প্রকারভেদ
সকল বুদ্ধিজীবীই এ বিষয়ে একমত যে, কোরআন পাক এমন একটি অপ্রতিদ্বন্দ্বী মোজেযা, যার মোকাবিলা করার দুঃসাহস কোন মানুষ রাখে না, যদিও এর মোকাবিলা করার ঘোষণা করা হয়েছে।كَلام وَإِنْ الله যদি মুশরিকদের কেউ আপনার আশ্রয়ে আসতে চায়, তবে তাকে আশ্রয় দিন, যাতে সে আল্লাহর কালাম শুনে।- যদি আল্লাহর কালাম শ্রবণ করা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির জন্যে জব্দকারী প্রমাণ না হত, তবে ধর্মীয় বিষয়াদি আল্লাহর কালাম শ্রবণ করার উপর নির্ভরশীল হত না এবং মোজেযা ছাড়া অন্য কিছু দ্বারা জব্দকারী প্রমাণ কায়েম করা সম্ভবপর হতো না। আল্লাহ পাক আরও এরশাদ করেন কাফেররা বলে, আপনার প্রতি আপনার প্রতিপালকের তরফ থেকে কোন বিশেষ নিদর্শন নাযিল হয় না কেন? আপনি বলে দিন, নিদর্শনাবলী নাযিল করা আল্লাহর কাজ। আমার কাজ কেবল খোলাখুলিভাবে সতর্ক করা। তাদের জন্যে এটা যথেষ্ট নয় কি যে, আমি আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি, যা তাদের সামনে পাঠ করা হয়? সেমতে আল্লাহ তায়ালা বলে দিয়েছেন যে, খোদায়ী কিতাব নিদর্শন সমূহের মধ্যে একটি মহানিদর্শন এবং পথপ্রদর্শনের কাজে যথেষ্ট। এ ছাড়া অন্য যে সকল মোজেযা রয়েছে এবং পয়গাম্বরগণের হাতে যে সকল মোজেযা প্রকাশ পেয়েছে, কোরআন পাক একা সে সবগুলোর স্থলাভিষিক্ত। নবী করীম (সাঃ) কোরআন করীমকে আরববাসীদের কাছে উপস্থাপন করেছেন; অথচ তারা নেহায়েত শুদ্ধভাষী ও সুবক্তা ছিল। তাদেরকে এই কিতাবের মোকাবিলা করা এবং এর অনুরূপ কিতাব রচনা করার চ্যালেঞ্জ দেয়া হয়েছে। এ জন্যে বছরের পর বছর তাদেরকে সময় দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারা এর অনুরূপ কিতাব রচনা করতে সক্ষম হয়নি। অথচ তারাই খোদায়ী কিতাবের নূর নির্বাপিত করতে এবং এর বিষয়বস্তু গোপন করতে চূড়ান্ত পর্যায়ে উৎসাহী ছিল। যদি তারা মোকাবিলা করার ক্ষমতা রাখত, তবে এর মোকাবিলা করে জব্দকারী প্রমাণের মূলোৎপাটন করে দিত। ইতিহাসে একথা বর্ণিত নেই যে, আরবদের কেউ কোরআনের মোকাবিলা করার সংকল্প করেছে। বরং তারা কখনও হঠকারিতা এবং কখনও ঠাট্টা-বিদ্রূপের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। আবার কখনও যাদু কখনও কবিতা বলেছে। কখনও কোরআনকে পৌরাণিক উপাখ্যান বলে দিয়েছে। তাদের এসব কর্মকাণ্ড হতভম্ব ও নিরুত্তর হওয়ারই পরিচায়ক ছিল। মোটকথা, তারা নিরুপায় হয়েই এ বিষয়ে সম্মত হয় যে, তরবারিকেই তাদের ঘাড়ের উপর বিচারক করা হোক, তাদের সন্তান ও স্ত্রী-কন্যাদেরকে বন্দী করা হোক এবং তাদের ধনসম্পদ লুণ্ঠন করা হোক। অথচ তাদের আত্মসম্মানবোধ ও জেদ ছিল অত্যন্ত তীব্র ও প্রখর। যদি খোদায়ী কিতাবের অনুরূপ কিতাব রচনা করা তাদের ক্ষমতার মধ্যে থাকত, তবে নিশ্চিতরূপেই তারা এ পথে অগ্রসর হত। কেনন।, এটা তাদের জন্যে সহজ ছিল।হাফেয ইবনে হজর বলেন, আল্লাহ তায়ালা নবী করীম (সাঃ)-কে প্রেরণ করলেন; অথচ আরবে বিপুল সংখ্যক কবি, বক্তা ও ভাষাবিদ ছিল। তাদের কাছে এ কাজের অনেক সাজসরঞ্জামও ছিল। নবী করীম (সাঃ) তাদের মধ্যে দূরের ও নিকটের ব্যক্তিবর্গকে মোকাবিলা করার জন্যে ডাক দিলেন। এরপর তাদেরকে যুদ্ধের মুখোমুখী করলেন। অথচ তাদের মধ্যে কবি ও বক্তার প্রাচুর্য ছিল। এটা
পৃষ্ঠা:২৪
ছিল আরবদের অক্ষমতার সুস্পষ্ট দলিল। কেন না, তাদের মধ্যে সাহস থাকলে তারা একটি সূরা কিংবা কিছু আয়াত মোকাবিলার জন্যে পেশ করতে পারত। এটা রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উক্তিকে বাচাল, ইসলামকে নস্যাৎ এবং তাঁর অনুসারীদেরকে বিচ্ছিন্ন করার কাজে অধিক দ্রুত কার্যকর হত। কিন্তু তারা তা না করে মোকাবিলা করার জন্যে নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিল, দেশ থেকে বহিষ্কৃত হল এবং প্রচুর অর্থ-সম্পদ বিনষ্ট করল।ইমাম সুয়ূতী বলেন, কোরআন পাক কোন্ কোন্ দিক দিয়ে মোজেযা, এ ব্যাপারে আলেমগণের বিভিন্ন উক্তি রয়েছে। আমি এসব উক্তি “কিতাবুল-এতকান”-এ উল্লেখ করেছি। এখানে সারসংক্ষেপ বর্ণনা করছি। তা এই যে, কোরআনের মোজেযা হওয়া বিভিন্ন দিক দিয়ে প্রমাণিত। এক, কোরআন করীমের অনুপম সংকলন, এর বাক্যাবলীর পারস্পরিক মিল, এর ভাষাগত বিশুদ্ধতা এবং এর অলংকার আরবের সুপণ্ডিত ভাষাবিদদের অভ্যাস থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। দুই, কোরআনুল করীমের অত্যাশ্চর্য আঙ্গিক এবং এর অভূতপূর্ব বর্ণনা পদ্ধতি প্রচলিত আরবী কালামের পদ্ধতি থেকে ভিন্ন। তিন, অদৃশ্য বিষয়াদির সংবাদ দেয়া, যে বিষয়ের অস্তিত্ব নেই, তার সম্পর্কে অবগত করা এবং যেভাবে অবগত করা হয়, তা তেমনিভাবে প্রমাণিত হওয়া। চার, পূর্ববর্তী উম্মত ও শরীয়ত সম্পর্কে অবগত করা। অথচ এসব সংবাদ কেউ জানত না। কেবল সে সকল ইহুদী আলেম জানত, যারা এ খবর হাছিল করার কাজে সমগ্র জীবন ব্যয় করে দিত। নবী করীম (সাঃ) এসব খবর ও পূর্ববর্তী ধর্মমতগুলোর অবস্থা সম্পূর্ণ বাস্তবানুগ পন্থায় বর্ণনা করতেন; অথচ তিনি ছিলেন উম্মী। লেখাপড়া জানতেন না। পাঁচ, কোরআন মানুষের, অন্তর্নিহিত গোপন তথ্য বর্ণনা করে; যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেনঃاد هَمَّتْ طَائِفَتَانِ مِنكُمْ أَنْ تَفْشَلَا : যখন তোমাদের দু’টি দল ভীরুতা প্রদর্শনের ইচ্ছা করল। وَيَقُولُونَ فِي أَنْفُسِهِمْ لَوْ لَا يُعَذِّبُنَا اللَّهُ بِمَا تَقُولُ : কাফেররা মনে মনে বলে আমাদের কুকথার কারণে আল্লাহ আমাদেরকে শান্তি দেন না কেন?এ ছাড়া আরও অনেক আয়াত রয়েছে, যেগুলোতে কাফের সম্প্রদায়কে অবগত করা হয়েছে যে, তারা এরূপ করতে সক্ষম হবে না। বাস্তবেও তাদের দ্বারা এরূপকাজ সংঘটিত হয়নি এবং তা করার ক্ষমতা অর্জিত হয়নি। উদাহরণতঃ ইহুদীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে ولن يتمنوه ابدا তারা কস্মিনকালেও মৃত্যু কামনা করবে না। ছয়, তীব্র প্রয়োজন সত্ত্বেও আরবদের কোরআনের মোকাবিলা বর্জন করা। ইতিপূর্বে এই প্রয়োজন বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে। সাত, যারা কোরআন পাক শ্রবণ করে, শ্রবণ করার সময় তাদের অন্তরে ভয় সৃষ্টি হওয়া এবং আতঙ্ক দেখা দেয়া। উদাহরণতঃ হযরত জুবায়র ইবনে মুতয়িম (রাঃ) এ অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিলেন। তিনি নবী করীম (সাঃ)-কে মাগরিবের নামাযে সূরা তোয়া-হা পাঠ করতে শুনেন।তিনি বলেন, যখন হুযুর (সাঃ( أَمْ خُلِفُوا مِنْ غَيْرِ کشی )না তারা কোন কিছু ছাড়াই সৃজিত হয়েছে?) পর্যন্ত পৌঁছলেন, তখন আমার অন্তর উড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। তিনি আরও বলেন, ইসলামের মাহাত্ম আমার মনে জন্মলাভ করার এটা ছিল প্রথম মুহূর্ত। আট, কোরআন পাকের তেলাওয়াতকারী এর তেলাওয়াতে বিষণ্ণবোধ করে না এবং শ্রবণকারীর কাছেও অপ্রিয় ঠেকে না। বরং কোরআনের প্রতি মনোযোগ তেলাওয়াতে মিষ্টতা সৃষ্টি করে। বার বার তেলাওয়াত করলে মহব্বত বৃদ্ধি পায়। অথচ কোরআন ছাড়া অন্য কালাম বার বার পাঠ করলে বিরক্তি জাগে। এ কারণেই নবী করীম (সাঃ) বলেন, কোরআন পাক বার বার পাঠ করলে পুরাতন হয় না। নয়, কোরআন পাক এমন একটি নিদর্শন, যা দুনিয়া যতদিন থাকবে, ততদিন পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকবে। আল্লাহ তায়ালা এর হেফাযতের দায়িত্ব নিয়েছেন। দশ, কোরআন করীম যে সকল জ্ঞান বিজ্ঞান ও তত্ত্ব নিজের মধ্যে সন্নিবেশিত করেছে, জগতের কোন কিতাব সেগুলো সন্নিবেশিত করেনি। এগার, কোরআন পাকে কঠোরতা ও মিষ্টতা গুণের সমন্বয় ঘটেছে। এ দুটি পরস্পরবিরোধী গুণ সাধারণতঃ মানুষের কালামে সমন্বিত হয় না। বার, কোরআন পাক সর্বশেষ কিতাব এবং অন্য সকল কিতাবের প্রতি অমুখাপেক্ষী। কোরআন ছাড়া অন্য সব প্রাচীন গ্রন্থ এমন বর্ণনার মুখাপেক্ষী, যাতে কোরআনের সাহায্য নিতে হয়; যেমন আল্লাহ পাক এরশাদ করেন-إِنَّ هَذَا الْقُرْآنَ يَقُصُّ عَلَى بَنِي إِسْرَائِيلَ أَكْثَرَ الَّذِي هُمْ فِيهِيَخْتَلِفُونَ
পৃষ্ঠা:২৫
: নিশ্চয় এ কোরআন বনী-ইসরাঈল যে সব বিষয়ে মতভেদ করে, সেগুলোর অধিকাংশ বর্ণনা করে। কাযী আয়ায (রাঃ) বলেন, কোরআনী মোজেযার প্রথমোক্ত চারটি কারণ নির্ভরযোগ্য। অবশিষ্টগুলো কোরআনী বৈশিষ্ট্যের অন্তর্ভুক্ত। তার একটি বৈশিষ্ট্য এই বাকী রয়েছে যে, কোরআন সাত আঞ্চলিক অভিধানের উপর ভিত্তি করে নাযিল হয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য কিতাব এই তিনটি বৈশিষ্ট্যে কোরআনের বিপরীত। গ্রন্থকার বলেন, প্রথম দুটি বৈশিষ্ট্য আমি “আল-এতকান” গ্রন্থে বিশদভাবে বর্ণনা করেছি। কোরআনের অন্যান্য বৈশিষ্ট্য সে সকল বৈশিষ্ট্যের অধীনে বর্ণনা করব, যেগুলোর কারণে নবী করীম (সাঃ) সকল পয়গাম্বরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন। কাযী আয়ায (রাঃ) বলেন, কোরআনের মোজেযা হওয়ার কারণসমূহ জানার পর পাঠকবর্গের কাছে একথা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, কোরআনী মোজেযার সংখ্যা হাজার, দু’হাজার এবং এর বেশীর মধ্যে সীমিত নয়। কেননা, রসূলুল্লাহ (সাঃ) আরববাসীদেরকে কোরআনের একটি সূরা আনতে বলেছেন। এতেই তারা অক্ষম হয়ে গেছে। আলেমগণ বলেন, সর্বাপেক্ষা ছোট সূরা হচ্ছে-انا أَعْطَيْنَاكَ .الكوث কোরআনের প্রতিটি আয়াত কিংবা কয়েকটি আয়াত তার সংখ্যা ও পরিমাণের দিক দিয়ে কোরআনের মোজেযা। গ্রন্থকার বর্ণনা করেন- সূরা কাওসারের শব্দাবলী গণনা করলে দশটির উপরে পাওয়া যাবে। আলেমগণ কোরআনের শব্দাবলী গণনা করেছেন। এর সংখা সাতাত্তর হাজার নয় শত চৌত্রিশ। এতে মোজেযার পরিমাণ সাত হাজার। এই সাত হাজারকে আটটি কারণে গুণ করলে ছাপান্ন হাজার মোজেযা হবে। প্রথমোক্ত দুটি কারণের দিক দিয়ে কোরআনী মোজেযা জানতে হলে আমার গ্রন্থ আলু-এতকান, ও আসরারুস্তানযীল والله ولي الذين آمنوا الخএকশ বিশ প্রকার মোজেযা চয়ন করেছি। এ আয়াতটি আমি আমার গ্রন্থে আলাদা বর্ণনা করেছি। ইমাম আহমদ ওকবা ইবনে আমের থেকে হুযুর (সাঃ)-এর এ উক্তি উদ্ধৃত করেছেন যে, কোরআন পাক চামড়ায় থাকলে আগুন সে চামড়াকে জ্বালাবে না। তিবরানী এ হাদীসটি সহল ইবনে সা’দ থেকে এভাবে বর্ণনা করেছেন সেই চামড়াকে অগ্নি স্পর্শ করবেনা। তিনি ইছমত ইবনে মালেক থেকে এভাবে বর্ণনা করেছেন যদি কোরআন পাক চামড়ায় লিপিবন্ধ করা হয়, তবে অগ্নি তাকে স্পর্শ করবে না। ইবনে আছীর “নেহায়াতুল-গরীব” গ্রন্থে বলেন, কোন কোন আলেম বলেছেন যে, এ মোজেযা বিশেষ করে হুযুর (সাঃ)-এর আমলে ছিল।
ওহী নাযিল হওয়ার সময় মোজেযার প্রকাশ
ইবনে আবী দাউদ কিতাবুল মাছাহেফে আবু জা’ফর থেকে রেওয়ায়েত করেছেন যে, জিবরাঈল (আঃ) যখন রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে বাক্যালাপ করতেন, তখন আবু বকর ছিদ্দীক (রাঃ) তা শুনতেন; কিন্তু জিবরাঈল (আঃ)-কে দেখতেন না। ইমাম আহমদ, তিরমিযী, নাসায়ী, হাকেম, বায়হাকী ও আবু নয়ীম হযরত ওমর ফারুক (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, যখন রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রতি ওহী নাযিল হত, তখন আমরা মৌমাছির আওয়াজের মত গুন গুন আওয়াজ শুনতে পেতাম। অন্য এক রেওযায়েতে আছে হুযুর (সাঃ)-এর নূরানী মুখমণ্ডলের কাছে মৌমাছির ভন ভন্ শব্দের মত শুনা যেত।বুখারী ও মুসলিমের রেওয়ায়েতে হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, হারেছ ইবনে হেশাম নবী করীম (সাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করল, আপনার প্রতি ওহী কিভাবে আসে? তিনি বললেন, কখনও ঘন্টার শব্দের মত আসে। এটা আমার জন্যে খুবই কঠিন হয়। এরপর আমা থেকে বিছিন্ন হয়ে যায়। এ সময় যা কিছু বলা হয়, সবই আমি স্মৃতিতে সংরক্ষিত করে নেই। আবার কখনও ফেরেশতা মানবাকৃতিতে আমার সামনে প্রকাশ পায় এবং আমার সাথে কথা বলে। সে যা কিছু বলে, আমি মুখস্থ করে নেই। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, কনকনে শীতের মধ্যে আমি হুযুর (সাঃ)-এর উপর ওহী নাযিল হতে দেখেছি। ওহী বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর তাঁর পবিত্র রূপাল ঘর্মাক্ত থাকত। ইবনে সা’দের রেওয়ায়েতে আবু সালামাহ্ বলেন, আমার কাছে একথা পৌঁছেছে যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, আমার কাছে দু’ভাবে ওহী আসে। এক, জিবরাঈল (আঃ) আমার কাছে ওহী আনেন এবং আমার দিকে তা ইলকা (নিক্ষেপ) করেন। যেমন কোন পুরুষ কোন পুরষের দিকে ইলকা করে। এরপর ওহী বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। দুই, ঘন্টার শব্দের মত আসে এবং আমার অন্তরে প্রথিত হয়ে যায়। এটা আমা থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না। মুসলিমের রেওয়ায়েতে হযরত ইবনে ছামেত (রাঃ) বলেন, রসুলে করীম (সাঃ)-এর উপর যখন ওহী নাযিল হত, তখন তিনি কাঠিন্য অনুভব করতেন। তাঁর পবিত্র মুখমণ্ডল বিবর্ণ হয়ে যেত। আবূ নয়ীমের রেওয়ায়েতে হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন যখন নবী করীম (সাঃ)-এর উপর ওহী নাযিল হত, তখন তিনি বোঝা অনুভব করতেন। আল্লাহ farmate Bra at إِنَّا سَلْقِي عَلَيْكَ قَوْلًا تَقِيلًا . ‘ইলকা’ করব।
পৃষ্ঠা:২৬
আবু নয়ীম হযরত যায়দ ইবনে ছাবেত (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, যখন রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উপর ওহী নাযিল হত, তখন কাঠিন্য অনুভূত হত এবং অপরদিকে শীতকালেও তাঁর কপালে মোতির মালার মত ঘর্ম টপকে পড়ত। তিবরানী যায়দ ইবনে ছাবেত (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আমি রসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর ওহী লিপিবদ্ধ করতাম। যখন তাঁর উপর ওহী নাযিল হত, তখন তিনি তীব্র শৈত্য অনুভব করতেন এবং তাঁর শরীর থেকে মোতির মত ঘাম টপকে পড়ত। এরপর এ অবস্থা দূর হয়ে যেত এবং আমি তাঁর তেলাওয়াত শুনে ওহী লিপিবদ্ধ করতাম। ওহী লেখা শেষ হওয়ার আগে কোরআন পাকের বোঝায় আমার পদযুগল ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হত। আমি মনে মনে বলতে থাকতাম যে, এ পা নিয়ে আমি সম্ভবতঃ আর কখনও হাঁটতে পারব না।ইমাম আহমদ হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, যখন নবী করীম (সাঃ)-এর উপর ওহী নাযিল হত, তখন ছাহাবায়ে কেরাম তাঁর ত্বকের পরিবর্তন দ্বারা তা বুঝে নিতেন। আবু নয়ীম হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, যখন নবী করীম (সাঃ)-এর উপর ওহী নাযিল হত, তখন তাঁর পবিত্র মুখমন্ডল ও শরীর বদলে যেত, ছাহাবায়ে কেরাম তাঁর সাথে কথা বলা থেকে বিরত থাকতেন। তখন কেউ তাঁর সাথে কথা বলত না। ইমাম আহমদ, তিবরানী ও আবু নয়ীম হযরত ইবনে ওমর (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন, তিনি বলেন, আমি আরয করলাম, ইয়া রসূলাল্লাহ! আপনি ওহীর তীব্রতা অনুভব করেন। তিনি বললেন, হাঁ, অনুভব করি এবং আওয়াজ শুনি। তখন আমি দৃঢ়তা অবলম্বন করি। যখনই আমার উপর ওহী নাযিল হয়, আমি অনুভব করি যেন আমার রুহ্ করয হয়ে যাবে। আবু নয়ীম কলতান ইবনে আছেম (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, ওহী নাযিল হওয়ার সময় রসূলুল্লাহর (সাঃ) দৃষ্টি ও চক্ষুদ্বয় উন্মীলিত থাকত। যা কিছু আল্লাহ তায়ালার তরফ থেকে আসত, তাঁর জন্যে তার কর্ণদ্বয় ও অন্তর একাগ্র থাকত। বুখারী, মুসলিম ও আবু নয়ীম ইয়ালা ইবনে উমাইয়া থেকে রেওয়ায়েত করেন, তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রতি এমতাবস্থায় তাকালাম, যখন তাঁর উপর ওহী নাযিল হচ্ছিল। তিনি উটের ন্যায় নাসিকাধ্বনি করছিলেন। তাঁর চক্ষুদ্বয় ও কপাল রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছিল। ইবনে সা’দ আবু আরদা দাওসী থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি রসূলে আকরাম (সাঃ)-এর উপর ওহী নাযিল হতে দেখেছি। তিনি উটের উপর সওয়ার ছিলেন। উট অস্থির হচ্ছিল এবং তার কব্জি ফুলে দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছিল। এমন কি, আমার মনে হল উটের কব্জি ভেঙ্গে যাবে। উট অধিকাংশ সময় বসে পড়ত এবং কখনও ওহীর বোঝার কারণে সে তার উভয় হাত পেরেগের মত লম্বালম্বিভাবে টেনে দিত। অবশেষে ওহীর অবস্থা দূর হয়ে গেল। তখন তাঁর শরীর থেকে মোতির মত ঘাম প্রবাহিত হচ্ছিল। ইমাম আহমদ ও বায়হাকী হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেছেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন উষ্ট্রীর উপর সওয়ার হতেন এবং যখন ওহী নাযিল হত, তখন উন্ত্রী ওহীর বোঝার কারণে গ্রীবা মাটিতে রেখে দিত। প্রচণ্ড শীতের দিনে যখন ওহী নাযিল হত, তখন তাঁর কপাল থেকে খাম প্রবাহিত হতে থাকত। ইবনে সা’দ হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, যখন হুযুর (সাঃ)-এর উপর ওহী নাযিল হত, তখন তিনি মাথা ঢেকে নিতেন এবং মুখমণ্ডলে পরিবর্তন দেখা দিত। তিনি সম্মুখবর্তী দাঁতে শৈত্য অনুভব করতেন। তিনি ঘর্মাক্ত হয়ে যেতেন। এমন কি, ঘাম মোতির মত প্রবাহিত হতে থাকত। আহমদ, তিবরানী ও বায়হাকী “শোয়াবুল-ঈমান” গ্রন্থে হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উপর ওহী নাযিল হওয়ার সময় তাঁর মাথাব্যথা হত। এজন্যে তিনি মাথায় মেহেন্দী ব্যবহার করতেন। ইবনে সা’দ ইকরামা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রতি যখন ওহী নাযিল হত,তখন কিছুক্ষণ পর্যন্ত তাঁর উপর অনুরূপ তন্দ্রাচ্ছন্নতা প্রবল হত। মুসলিম হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, হুযূর (সাঃ)-এ৯ ৬পর ওহী নাযিল হওয়ার সময় আমাদের কেউ দৃষ্টি তুলে তাঁর দিকে তাকাতে পারতনা যে পর্যন্ত ওহী পূর্ণ না হয়ে যেত।
নবী করীম (সাঃ) জিবরাঈল (আঃ)-কে আসল
আকৃতিতে দেখেছেন
ইমাম আহমদ, ইবনে আবী হাতেম ও আবুশ শায়খ হযরত ইবনে মসউদ (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) জিবরাঈল (আঃ)-কে তাঁর আসল আকৃতিতে দু’বার দেখেছেন। প্রথমবার তিনি নিজে জিবরাঈল (আঃ)-কে আসল আকৃতিতে দেখার আবদার করেছিলেন। সেমতে জিবরাঈল (আঃ) দিগন্তকে ঘিরে নেন। দ্বিতীয়বার মেরাজ রজনীতে তাঁকে আসল আকৃতিতে। দেখেন।ইমাম আহমদ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসুলুল্লাহ (সাঃ) যখন জিবরাঈলকে আসল আকৃতিতে দেখেন, তখন তাঁর ছয়’শটি বাছ ছিল।
পৃষ্ঠা:২৭
প্রত্যেক বাহু দিগন্তবিস্তৃত ছিল। তাঁর বাহু থেকে বিভিন্ন রঙ্গের মোতি, ইয়াকুত ইত্যাদি ঝরে পড়ছিল। তাঁর স্বরূপ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালাই জ্ঞাত আছেন।আহমদ ও তিবরানী হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, নবী করীম (সাঃ) জিবরাঈল (আঃ) কে আসল আকৃতিতে দেখার জন্যে বলেন। তিনি বললেন, আপনার প্রতিপালকের কাছে দোয়া করুন। সেমতে রসূলুল্লাহ (সাঃ) দোয়া করলে পূর্ব দিক থেকে কাল বর্ণ প্রকাশ পেয়ে তা উঁচু হয়ে ছড়াতে লাগল।বুখারী ও মুসলিম হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, জিবরাঈল (আঃ) যে আকৃতিতে সৃজিত হন, সে আসল আকৃতিতে রসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে দু’বারের বেশী কখনও দেখেননি। তিনি তাকে এমতাবস্থায় দেখেন, যখন তিনি আকাশ থেকে পৃথিবীতে অবতরণ করছিলেন। তাঁর বিশাল বপু আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যবর্তী অংশকে ঘিরে রেখেছিল। ইমাম আহমদ হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেছেন যে, নবী করীম (সাঃ) এরশাদ করেছেন আমি জিবরাঈলকে নীচে অবতরণ করতে দেখলাম। তাঁকে দিয়ে আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যবর্তী অংশ পূর্ণরূপে ভরে গেল। তার শরীরে সুন্দুসের পোশাক ছিল, যাতে মোতি ও ইয়াকুত কুলছিল। আবু শায়খ “আল-আসমত” গ্রন্থে হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, নবী করীম (সাঃ) জিবরাঈল (আঃ)-কে বললেন, আমি আপনাকে আপনার আসল আকৃতিতে দেখতে চাই। সেমতে জিবরাঈল (আঃ) তাঁর একটি বাহু প্রসারিত করলেন। সেটিই আকাশের দিস্তকে ঘিরে নিল। এমন কি, আকাশে কিছুই দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল না। আবু শায়খ হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আমি জিবরাঈল (আঃ)-কে দেখেছি। তাঁর মোতির ছয়শ’ বাহু ছিল। তিনি এ বাহুগুলোকে ময়ূরের পাখার মত বিস্তৃত করলেন। আবু শায়খ হযরত ইবনে মসউদ (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, হুযুর (সাঃ) জিবরাঈল (আঃ)-কে সবুজ মূল্যবান পোশাকে দেখেন। তিনি আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যস্থিত অংশকে ঘিরে রেখেছিলেন। আবু শায়খ ও ইবনে মরদুওয়াইহি হযরত ইবনে মসউদ (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, হুযুর (সাঃ) জিবরাঈল (আঃ)-কে এমতাবস্থায় দেখেছেন যে, তাঁর উভয় পা সিদরায় ঝুলন্ত রয়েছে এবং সিদরার সবুজ বনানীর উপর বৃষ্টির ফোঁটার মত মোতি ছিল। আবূ শায়খ হযরত শহর ইবনে ওবায়দ (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, নবী করীম (সাঃ) যখন আকাশে গমন করলেন, তখন জিবরাঈল (আঃ)-কে আসল আকৃতিত্বে দেখলেন। তাঁর বাহুতে যমরদ, মোতি ও ইয়াকুত ঝুলন্ত ছিল। হুযুর (সাঃ) বলেন, আমার মনে হল জিবরাঈল (আঃ)-এর চক্ষুদ্বয়ের মাঝখানে যে দূরত্ব ছিল, তা দিগন্তকে ঘিরে নিয়েছে। এর আগে জিবরাঈলকে আমি বিভিন্ন আকৃতিতে দেখেছি। অধিকাংশ সময় তাঁকে দেহইয়া কলবীর আকৃতিতে দেখতাম। কখনও তাঁকে এমনভাবে দেখতাম, যেমন কোন ব্যক্তি আপন সঙ্গীকে চালুনির পিছন থেকে দেখে।ইবনে সা’দ ও নাসায়ী ইবনে ওমর (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, জিবরাঈল (আঃ) নবী করীম (সাঃ)-এর কাছে দেহইয়া কলবীর আকৃতিতে আসতেন। তিবরানী হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, নবী করীম (সাঃ) বলেছেন- জিবরাঈল (আঃ) আমার কাছে দেহইয়া কলবীর আকৃতিতে আসতেন। রাবী বলেনঃ দেহইয়া সুশ্রী ও সুপুরুষ ছিলেন। আল-আজলবী “তারীখ’ গ্রন্থে আওয়াফা ইবনে হাকাম থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, সুন্দরতম ব্যক্তি সেই, যার আকৃতি ধারণ করে জিবরাঈল (আঃ) আগমন করেন।
আবির্ভাব ও হিজরতের মধ্যবর্তী সময়ে প্রকাশিত মোজেযা
ইবনে আবী শায়বা, আবু ইয়ালা, দারেমী ও বায়হাকী হযরত আ’মাশ, আবু সুফিয়ান ও আনাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, জিবরাঈল (আঃ) রসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে এলেন। তিনি তখন মক্কার বাইরে ছিলেন। মক্কাবাসীরা তাঁকে রক্তাক্ত করে দিয়েছিল। জিবরাঈল (আঃ) জিজ্ঞাসা করলেন, কি হয়েছে? তিনি বললেন, এরা আমাকে ক্ষতবিক্ষত করেছে, একথা বলেছে এবং এমন করেছে।জিবরাঈল বললেন, আপনি কোন নিদর্শন দেখতে চান? তিনি বললেন, হাঁ। জিবরাঈল বললেন, এ বৃক্ষটিকে ডাকুন। রসূলুল্লাহ (সাঃ) ডাকলেন। বৃক্ষ মাটি চিরে চলে এল এবং তাঁর সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল। জিবরাঈল (আঃ) বললেন, একে ফিরে যেতে আদেশ করুন। তিনি বৃক্ষকে বললেন, স্বস্থানে ফিরে যাও। বৃক্ষ স্বস্থানে ফিরে গেল। হুযুর (সাঃ) বললেন, ব্যস, এটা আমার জন্যে যথেষ্ট। বায়হাকী হযরত হাসান (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেছেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) মক্কার কোন এক ঘাঁটিতে চলে গেলেন। তিনি স্বজাতির মিথ্যারোপের কারণে যারপর নেই দুঃখিত ছিলেন। তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন, পরওয়ারদেগার, আমাকে এমন কিছু দেখান, যাতে আমার মন শান্ত হয় এবং এ দুঃখ ও বেদনা দূর হয়। আল্লাহ তায়ালা ওহী পাঠালেন যে, এসব বৃক্ষের শাখাসমূহের মধ্য থেকে যে
পৃষ্ঠা:২৮
শাখাকে আপনি নিজের দিকে ডাকতে চান, ডাকুন। তিনি একটি শাখাকে ডাক দিলেন। সে স্বস্থান থেকে আলাদা হয়ে মাটি চিরে চিরে হুযুর (সাঃ)-এর কাছে এসে গেল। তিনি তাকে বললেন, স্বস্থানে ফিরে যাও। শাখাটি আবার মাটি চিরে চিরে ফিরে গেল এবং পূর্ববৎ দাঁড়িয়ে গেল। হুযুর (সাঃ) আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা ও গুণকীর্তন করলেন। তাঁর অন্তর প্রশান্ত হয়ে গেল। তিনি ফিরে এলেন।ইবনে সা’দ, আবু ইয়ালা, বাযযার, বায়হাকী ও আবু নয়ীম হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, নবী করীম (সাঃ) স্বজাতির মিথ্যারোপের কারণে জুহন নামক স্থানে বিষণ্ণ অবস্থায় উপবিষ্ট ছিলেন। তিনি দোয়া করলেন, পরওয়ারদেগার, আজিকার দিনে আমাকে এমন কোন নিদর্শন দেখান যে, এর পরে কোন ব্যক্তি আমাকে মিথ্যারোপ করলে আমি তার পরওয়া না করি। তিনি আল্লাহর নির্দেশক্রমে উপত্যকার একদিক থেকে একটি বৃক্ষকে ডাক দিলেন। সে মাটি চিরে চিরে তাঁর সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল এবং তাকে সালাম করল। এরপর তিনি বৃক্ষকে ফিরে যাওয়ার আদেশ দিলেন। বৃক্ষ স্বস্থানে ফিরে গেল। তিনি বললেন, এরপর আমার গোত্র থেকে যে আমাকে মিথ্যারোপ করবে, আমি তার পরওয়া করব না। এ রেওয়ায়েতের সনদ হাসান।আবু নয়ীম হযরত জাবের (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেছেন যে, মুশরিকরা রসূলুল্লাহ (সাঃ) এর উপর নির্যাতন চালালে জিবরাঈল (আঃ) তাঁর কাছে এলেন এবং তাঁকে এক মরুভূমির প্রান্তে নিয়ে গেলেন। সেখানে অনেক বৃক্ষ ছিল। অতঃপর তাঁকে বললেন, আপনি যে বৃক্ষকে ডাকতে চান, ডাকুন। তিনি একটি বৃক্ষকে ডাক দিলেন। সে এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে গেল। জিবরাঈল (আঃ) বললেন, আপনি সত্যের উপর আছেন।
কমবয়সী ছাগলের দুধ বের করা
তায়ালেসী, ইবনে সাদ, ইবনে আবী শায়বা, বায়হাকী ও আবু নয়ীম ইবনে মসউদ (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তিনি বলেন, আমি প্রাপ্ত বয়স্কের কাছাকাছি ছিলাম এবং মক্কায় ওকবা ইবনে আবী মুয়ীতের ছাগল চরাতাম। নবী করীম (সাঃ) ও আবু বকর (রাঃ) মুশরিকদের কাছ থেকে পলায়ন করে আমার কাছে এলেন। উভয়েই আমাকে বললেন, হে বালক, তোমার কাছে দুধ আছে? আমাদেরকে পান করাবে কি? আমি বললাম, আমি তো আমানতদার। কিরূপে পান করাব। তারা বললেন, তোমার পালে এমন কম বয়সী ছাগল আছে কি, যার সাথে এখনও কোন নর মিথুন করেনি? আমি আরয করলাম, জী হাঁ, আছে। অতঃপর আমি তেমনি একটি ছাগী তাঁদের কাছে নিয়ে এলাম। হযরত আবু বকর (রাঃ) সেটি বাঁধলেন এবং রসূলে করীম (সাঃ) তার ওলানের বাঁট ধরে মর্দন করতে লাগলেন। অতঃপর দোয়া করলেন। ছাগীর ওলান দু’টি দুধে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। আবু বকর (রাঃ) একটি পাথর নিয়ে এলেন, যার মধ্যে গর্ত ছিল। হুযুর (সাঃ) এই পাথরে দুধ বের করলেন। অতঃপর তিনি এবং হযরত আবূ বকর উভয়েই পান করলেন। আমাকেও পান করালেন। এরপর তিনি ছাগীর ওলানটিকে কুঞ্চিত হতে বললেন। সেটি কুঞ্চিত হয়ে পূর্ববৎ হয়ে গেল।
হযরত খালেদ ইবনে সায়ীদ ইবনে আছ (রাঃ)-এর স্বপ্ন
ইবনে সা’দ ও বায়হাকী মোহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে ওছমান থেকে রেওয়ায়েত করেন, খালেদ ইবনে সায়ীদ ইবনে আছ পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। ভাইদের মধ্যে সর্বপ্রথম তিনিই ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর ইসলাম গ্রহণের সূচনা এভাবে হয়। তিনি স্বপ্নে দেখেন, তাঁকে দোযখের কিনারায় দাঁড় করানো হয়েছে। এরপর খালেদ দোযখের এত বিস্তৃতি বর্ণনা করলেন, যা আল্লাহ তায়ালাই জানেন। তিনি স্বপ্নে দেখলেন, তাঁর পিতা তাঁকে দোযখে নিক্ষেপ করছে এবং রসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর কোমরে ধরে রেখেছেন, যাতে দোযখে গড়ে না যান। খালেদ এ স্বপ্ন দেখে ভীত হয়ে পড়লেন এবং বললেন: আল্লাহর কসম, এ স্বপ্ন সত্য। অতঃপর তিনি হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর কাছে এসে স্বপ্ন বর্ণনা করলেন। তিনি বললেন: আমি তোমার হিত কামনা করি। ইনি আল্লাহর রসূল। তুমি তাঁর অনুসরণ কর। খালেদ হুযুর (সাঃ)-এর কাছে এলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন : আপনি কোন্ বিষয়ের প্রতি আহ্বান করেন? তিনি বললেনঃ লা শরীক এক আল্লাহর প্রতি। মোহাম্মদ তাঁর বান্দা ও রসূল। তিনি আরও বললেন: মানুষ পাথরের এবাদত করে, অথচ পাথর না শুনে, না দেখে, না কোন উপকার ও অপকার করতে পারে। পাথর এটাও জানে না যে, কে তাদের এবাদত করছে এবং কে করছে না। তুমি তাদের পূজা পরিত্যাগ কর। খালেদ তৎক্ষণাৎ মুসলমান হয়ে গেলেন। এ সংবাদ পেয়ে তাঁর পিতা তাঁকে ধরে নেয়ার জন্যে লোক পাঠাল, ধমকি দিল, প্রহার করল এবং বললঃ আমি তোর রুজি বন্ধ করে দিব। খালেদ বললেনঃ তুমি রুজি বন্ধ করে দিলে কোন ক্ষতি নেই। আল্লাহ তায়ালা আমাকে যে রুজি দিবেন, তা দিয়ে আমি আমার জীবন নির্বাহ করে নিব।ইবনে সা’দ সালেহ ইবনে কায়সান থেকে রেওয়ায়েত করেন, খালেদ ইবনে সায়ীদ বর্ণনা কবেন- হর (সাঃ)-এর আবির্ভাবের পূর্বে আমি স্বপ্নে একটি ঘন অন্ধকার ছায়া দেখলান, যা সমগ্র মক্কা নগরীকে ঘিরে রেখেছিল। এ অন্ধকারে না কোন পাহাড় দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল, না কোন নরম মাটি। এরপর আমি একটি নূর দেখলাম, যা প্রদীপের মত যমযম থেকে বের হল। নূরটি যতই উপরে যাচ্ছিল, ততই বড় হচ্ছিল এবং চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। অবশেষে নূরটি অনেক উঁচুতে পৌঁছে গেল। সর্বপ্রথম আমি যে বস্তুটি নূরোজ্জ্বল দেখলাম, সেটি ছিল বায়তুল্লাহ।
পৃষ্ঠা:২৯
এরপর নূরটি এত বিশাল আকার ধারণ করল যে, প্রত্যেক নরম মাটি ও পাহাড় তাতে দৃষ্টিগোচর হতে লাগল। অতঃপর সেই নূর আকাশে উত্থিত হল, অতঃপর মাটিতে অবতরন করল। ফলে মদীনার খর্জুর বাগান আমার দৃষ্টিতে আলোকময় হয়ে গেল। এ সব খর্জুর বৃক্ষে অর্ধপস্তু খেজুর ছিল। এ নূরের মধ্যে আমি কাউকে বলতে শুনলাম পবিত্র কলেমা পূর্ণ হয়েছে। এ উম্মত সৌভাগ্যশালী হয়েছে। উন্মীদের নবী আগমন করেছেন এবং কিতাব মেয়াদ পর্যন্ত পৌছে গেছে। এ জনপদবাসীরা নবীকে মিথ্যারোপ করেছে। তাদেরকে দুবার আযাব দেয়া হবে। তৃতীয়বার তারা তওবা করে নিবে। তিনটি আযাব বাকী রয়ে গেছে। দু’টি পূর্বে এবং একটি পশ্চিমে। খালেদ স্বপ্নের এ ঘটনা আপন ভ্রাতা আমর ইবনে সায়ীদের কাছে বর্ণনা করলে তিনি বললেন: তুমি অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছ। আমার মনে হয়, এটা বনী আবদুল মোত্তালিব থেকে প্রকাশ পাবে। কেননা, তুমি নূরকে যমযম থেকে উত্থিত হতে দেখেছ। এ হাদীসটি দারে কুতনী “আল-আমসাদ” গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন। ইবনে আসাকির, ওয়াকেদী, ইসমাঈল ইবনে ইবরাহীম, মুসা ইবনে ওকবা এবং উন্মে খালেদ বিনতে সায়ীদ ইবনে আছ থেকে বর্ণনা করেছেন। এর শেষ ভাগে আরও বলা হয়েছে- খালেদ বললেন: এটা সেই বিষয়, যে কারণে আল্লাহ আমাকে হেদায়াত করেছেন। উম্মে খালেদ বর্ণনা করেন, সর্বপ্রথম আমার পিতা ইসলাম গ্রহণ করেন। কেননা, তিনি আপন স্বপ্ন হুযুর (সাঃ)-এর কাছে বর্ণনা করেন। তিনি বললেন: খালেদ, আল্লাহর কসম, আমিই সেই নূর এবং আমি আল্লাহর রসূল। একথা শুনে খালেদ মুসলমান হয়ে গেলেন।
হযরত সা’দ ইবনে আবী ওয়াক্কাসের (রাঃ) স্বপ্ন
ইবনে আবিন্দুনিয়া ও ইবনে আসাকির হযরত সা’দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন, তিনি বলেনঃ আমি ইসলাম গ্রহণের তিন বছর পূর্বে স্বপ্নে দেখলাম, আমি যেন ভীষণ অন্ধকার বেষ্টিত হয়ে আছি। কিছুই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। হঠাৎ আমার সামনে একটি চাঁদ উজ্জ্বল হয়ে দেখা দিল। আমি এর পিছনে চললাম। আমি তাঁদেরকে দেখছিলাম, যাঁরা এই চাঁদের দিকে আমার অগ্রগামী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন যায়দ ইবনে হারেসা, হযরত আলী, আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) প্রমুখ। আমি যেন তাঁদেরকে জিজ্ঞাসা করছি আপনারা এদিকে কবে এলেন? তাঁরা বললেনঃ এই মাত্র এসেছি। এই স্বপ্ন দেখার পর আমি সংবাদ পেলাম, নবী করীম (সাঃ) গোপনে ইসলামের দিকে দাওয়াত দিচ্ছেন। আমি আজইয়াদের এক বাড়ীতে তাঁর সাথে দেখা করলাম এবং জিজ্ঞেস করলামঃ আপনি কোন বিষয়ের প্রতি দাওয়াত দেন? তিনি বললেন: তুমি এ বিষয়ের সাক্ষ্য দাও যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই এবং আমি (মুহাম্মদ) আল্লাহর রসূল। সঙ্গে সঙ্গে আমি এই সাক্ষ্য উচ্চারণ করলাম।
একটি সাধারণ পাত্রে চল্লিশ জনকে
তৃপ্তি সহকারে আহার করানো
ইবনে ইসহাক ও বায়হাকী হযরত আলী (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন, নবী ) وَأَنذِرْ عَشِيرَتَكَ الأقربين 0 – (11) পরিবার-পরিজন এবং নিকটতম আত্মীয়বর্গকে সতর্ক করুন।) আয়াতখানি অবতীর্ণ হলে নবী করীম (সাঃ) বললেনঃ হে আলী, ছাগলের একটি আস্ত রান এবং এক ছা’ খাদ্যশস্য নিয়ে তুমি খানা তৈরী কর। আর দুধের একটি বড় পেয়ালা প্রস্তুত রাখ। এরপর বনী আবদুল মোত্তালিবকে একত্রিত কর। হযরত আলী (রাঃ) বলেন : আমি তাঁর আদেশ মোতাবেক সব প্রস্তুত করলাম। বনী আবদুল মোত্তালিব সমবেত হল। তারা ছিল তখন কম-বেশী চল্লিশজন। তাদের মধ্যে তাঁর পিতৃব্য আবু তালেব, হামযা, আব্বাস এবং আবু লাহাবও ছিল। আমি খানার সেই পাত্রটি তাদের সামনে পেশ করলাগ। হুযুর (সাঃ) পেয়ালা থেকে গোশতের একটি লম্বা টুকরা নিলেন এবং দাঁতের সাহায্যে চিরে পেয়ালার চার পার্শ্বে রেখে দিলেন। অতঃপর বললেন: বিসমিল্লাহ, খেতে শুরু করুন। সকলেই খেয়ে তৃপ্ত হয়ে গেল। আমরা কেবল অঙ্গুলির চিহ্ন দেখতাম। খাদ্য এত কম ছিল যে, তাদের মধ্যে এক ব্যক্তি হলেও এতটুকু খেয়ে ফেলত। অতঃপর হুযুর (সাঃ) বললেনঃ আলী। এঁদেরকে দুধ পান করাও। আমি দুধের পেয়ালাটি তাদের কাছে নিয়ে গেলাম। তারা পেয়ালা থেকে দুধ পান করল। অবশেষে সকলেই তৃপ্ত হয়ে গেল। আল্লাহর কসম, তাদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি হলেও এই পরিমাণ দুধ একাই পান করতে পারত। রসুলুল্লাহ (সাঃ) যখন তাদের সাথে কথা বলতে চাইলেন, তখন আবু লাহাব অগ্রণী হয়ে বলল। তোমাদের এ লোকটি তোমাদের উপর জাদু করেছে। এরপর সকলেই সেখান থেকে প্রস্থান করল এবং হুযুর (সাঃ) তাঁর বক্তব্য পেশ করতে পারলেন না। পরের দিন তিনি বললেন: আলী, গতকালের মত আজও খানাপিনার ব্যবস্থা কর। আমি যথাবিহীত ব্যবস্থা করলাম এবং তাদেরকে হুযুর (সাঃ)-এর কাছে একত্রিত করলাম। তিনি আগের দিন যেমন করেছিলেন, আজও তেমনি করলেন। তারা সকলেই তৃপ্ত হয়ে আহার করল। অতঃপর তিনি বললেনঃ : হে বনী আবদুল মোত্তালিব। আরবের কোন যুবক তার গোত্রের কাছে আমার চেয়ে উৎকৃষ্ট ভোন বিষয় নিয়ে এসেছে বলে আমি জানি না। আমি তোমাদের কাছে দুনিয়া ও আখেরাতের বিষয় নিয়ে এসেছি।
পৃষ্ঠা:৩০
এ রেওয়ায়েতটি ইবনে ইসহাক, বায়হাকী এবং আবু নয়ীম ও ইবনে ইসহাক, আবদুল গাফফার ইবনে কাসেম, নেহাল ইবনে আমর এবং আবদুল্লাহ ইবনে হারেসের সনদ সহকারে বর্ণনা করেছেন। আ’মাশ, নেহাল ইবনে আমর, এবাদ ইবনে আবদুল্লাহ নাফে’ ও সালেম থেকে রেওয়ায়েত করেন, হযরত আলী (রাঃ) বলেনঃ হুযুর (সাঃ) হযরত খাদিজা (রাঃ)-কে আদেশ দিলেন এবং তিনি খানা তৈরী করলেন। অতঃপর তিনি বনী আবদুল মোত্তালিবকে একত্রিত করার জন্যে আমাকে বললেন। আমি চল্লিশ ব্যক্তিকে দাওয়াত করলাম। তারা সমবেত হলে হুযুর (সাঃ) আমাকে বললেন: খানা আন। আমি তাদের কাছে এই পরিমাণ ছরীদ নিয়ে এলাম, যা এক ব্যক্তি খেয়ে ফেলতে পারত, কিন্তু সকলেই এই খাদ্য খেয়ে তৃপ্ত হয়ে গেল। অতঃপর তিনি আমাকে বললেনঃ তাদেরকে দুধ পান করাও। আমি তাদেরকে এমন একপাত্র থেকে দুধ পান করালাম, যা এক ব্যক্তির জন্যে যথেষ্ট ছিল। কিন্তু তারা সকলেই এই দুধ পান করল এবং তৃপ্ত হয়ে গেল। আবু লাহাব সমবেত সকলকে উদ্দেশ করে বললঃ মোহাম্মদ তোমাদের উপর জাদু করেছে। একথা ওনে সকলেই চলে গেল। ফলে তিনি তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিতে পারলেন না। কয়েকদিন অতিবাহিত হলে হুযুর (সাঃ) পুনরায় তাদের জন্যে খানা প্রস্তুত করালেন এবং আমাকে আদেশ করলেন। আমি সকলকে একত্রিত করলাম। সকলের আহার শেষে হুযুর (সাঃ) তাদেরকে বললেনঃ আমি যে বাণী নিয়ে এসেছি, তাতে কে আমাকে সাহায্য করতে পারে? আমি আরজ করলামঃ ইয়া রসূলাল্লাহ, আমি সাহায্য করতে পারি। আমি উপস্থিত সকলের মধ্যে অল্প বয়স্ক ছিলাম। সকলেই চুপ করে রইল। অতঃপর তারা আবু তালেবকে বললঃ দেখুন আপনার পুত্র কি বলছে? আনু তালেব বললেনঃ তাঁকে বলতে দাও। তার চাচাত ভাই হিতকর বাজে কখনও ভুল করবে না।আৰু নয়ীম হযরত আলী (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেছেন, عشيرتك الأقربين আয়াপনি নাযিল হলে রসূলে করীম (সাঃ) নিজের وانذر পরিজনবর্গের চল্লিশ ব্যক্তিকে খানায় আমন্ত্রণ করলেন। তাঁদের প্রত্যেক ব্যক্তি বড় এক একটি পাত্র ভরা দুধ এবং একটি ছাগলের গোশত্ একাই খেয়ে ফেলতে পারত। কিন্তু হুযুর (সাঃ) তাদের সামনে ছাগলের একটি মাত্র রান পরিবেশন করলেন। সকলেই খেল এবং তৃপ্ত হল। এরপর আমি এক পিয়ালা দুধ আনলাম। সকলেই তা থেকে পান করল এবং তৃপ্ত হয়ে গেল।আবু লাহাব বলল: আজকের মত জাদু আমরা কখনও দেখিনি। অতঃপর বল্লুল্লাহ (সাঃ) বললেনঃ আলী, আজ যেমন তুমি খানা তৈরি করেছ, আগামীকালও তৈরি করবে। সেমতে পরের দিনও তারা সকলেই তেমনিভাবে খেল এবং পান করল। এরপর রসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদের সামনে নিজের বক্তব্য পেশ করলেন। আবু নয়ীম ও ইবনে ইসহাকের রেওয়ায়েতে বারা ইবনে আযেব বর্ণনা করেন, ( انْذِرْ عَشِيرَتَكَ الْأَقْرَبِينَ মোত্তালিবের বংশধরকে একত্রিত করলেন। তাঁদের সংখ্যা ছিল চল্লিশ। তাদের মধ্যে এমনও ছিল, যারা একটি আস্ত ছাগলের গোশ্ত খেয়ে ফেলত এবং বড় এক পেয়ালা দুধ পান করতে পারত। হুযুর (সাঃ) হযরত আলী (রাঃ)-কে ছাগলের রান আনতে বললেন। তিনি তা প্রস্তুত কবে হুযুর (সাঃ)-এর কাছে আনলেন। তিনি সেখান থেকে একটি টুকরা নিয়ে কিছু ভক্ষণ করলেন। এরপর অবশিষ্টাংশ পাত্রের চারপাশে রেখে বললেনঃ দশ দশ ব্যক্তি খাদ্যের কাছে আসবে। সেমতে দশ জন করে এসে খেয়ে চলে গেল। অতঃপর তিনি দুধের পেয়ালা আনতে বললেন এবং নিজে এক চুমুক পান করে তাঁদেরকে দিয়ে বললেন: বিসমিল্লাহ, পান করুন। সকলেই পান করে তৃপ্ত হয়ে গেল। আবু লাহাব বলল: এ ব্যক্তির মত জাদু তোমাদের উপর কেউ করেনি। আমার কথা শুনে পরের দিনও তিনি তাদেরকে এমনিভাবে খাদ্য ও দুধের দাওয়াত দিলেন। এরপর তাদের সাথে আলোচনার সূচনা করলেন।
মাটি থেকে পানি বের হওয়া
ইবনে সা’দ হযরত আমর ইবনে সায়ীদের রেওয়ায়োতে বর্ণনা করেছেন, আবু তালেব বললেনঃ আমি যুলমাজায নামক স্থানে আমার ভাতিজা (নবী করীম (সাঃ)-এর সাথে ছিলাম। একবার ভয়নাক পিপাসার্ত হয়ে আমি তাঁকে বললামঃ আমার খুব পিপাসা হয়েছে। এখানে পানি নেই। এখন কি করি আমি মনে করতাম, আফসোস করা ছাড়া তার কাছে কি আছে? আমার কথা শুনে তিনি উট থেকে নেমে পড়লেন। বললেন। চাচা, আপনার পিপাসা লেগেছে? আমি বললামঃ হ্যাঁ। এরপর তিনি পেছনে মাটির দিকে ঝুঁকলেন। হঠাৎ আমি পানি দেখতে পেলাম। তিনি বললেন: চাচা, পানি পান করুন। আমি পানি পান করলাম।
আবু তালেবের জন্য রোগ মুক্তির দোয়া করা
আবু নয়ীম ও বায়হাকী হযরত আনাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন, আবু তালেব একবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। হুযুর (সাঃ) তাঁকে দেখতে গেলেন। তিনি বললেন: ভাতিজা, তুমি যে পালনকর্তার এবাদত কর, তাঁর কাছে আমার রোগ মুক্তির জন্যে দোয়া কর। হুযুর (সাঃ) বললেনঃ আল্লাহ, আমার চাচাকে সুস্থতা দান কর।
পৃষ্ঠা ৩১ থেকে ৪৪
পৃষ্ঠা:৩১
আবু তালেব তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে গেলেন; যেন রশির বন্ধনমুক্ত হয়ে গেলেন। তিনি বললেন: ভাতিজা। তুমি যে রবের এবাদত কর, তিনি তোমার কথা মেনে নেন? হুযুর (সাঃ) বললেন: চাচা, আপনি আল্লাহ তায়ালার আনুগত্য করলে তিনি আপনার আবেদনও কবুল করবেন।
হুযুর (সাঃ)-এর মাধ্যমে আবু তালেবের বৃষ্টির জন্য দোয়া করা
ইবনে আসাকিরের ইতিহাস গ্রন্থে বর্ণিত রেওয়ায়েতে জালিমা ইবনে আরফাজা বলেনঃ একদা আমি মসজিদে-হারামে যেয়ে দেখি, কোরায়শরা বৃষ্টির জন্য দোয়া উদ্দেশ্যে সমবেত হয়েছে। তাদের কেউ বলছিল, লাত ও ওযযার শরণাপন্ন হওয়া যাক। আবার কেউ বলছিল, তৃতীয় প্রতিমা মানাতের কাছে প্রার্থনা করা হোক। তাদের মধ্য থেকে জনৈক প্রবীণ, সুশ্রী ও অভিজ্ঞ ব্যক্তি বললঃ এমন সর্বনাশা কথা বলছ কেন? তোমাদের মধ্যে ইবরাহীম (আঃ)-এর ও ঈসমাঈল (আঃ)-এর অধঃস্তন পুরুষ বর্তমান রয়েছেন। লোকেরা বললঃ আপনি কি আবু তালেবকে বুঝাচ্ছেন? সে বলল: হাঁ। সেমতে সকলেই তাঁর কাছে রওয়ানা হল। আমিও তাদের সঙ্গে ছিলাম। আমরা আবু তালেবের দরজায় যেয়ে কড়া নাড়লাম। এক সুশ্রী ব্যক্তি এলেন। তাঁর পরনে ছিল হলদে রঙের লুঙ্গি। সকলেই তাঁকে বলল। আবু তালেব! সর্বত্র দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষজন দুর্গত হয়ে পড়েছে। বৃষ্টির দোয়া করার জন্যে চলুন। আবু তালেব বললেন: সূর্য ঢলে পড়ার এবং বাতাস চলার অপেক্ষা কর। সূর্য ঢলে পড়লে আবু তালেব বের হলেন। তাঁর সঙ্গে ছিল সুশ্রী সমুজ্জ্বল ও অন্ধকারে চাঁদের মত এক বালক। তার চতুর্দিকে ছিল ছোট ছোট ছেলেমেয়ে। আবু তালেব বালককে ধরলেন এবং বায়তুল্লাহর দিকে পিঠ করলেন। বালক আবু তালেবের অঙ্গুলি ধরল। ছেলেমেয়েরা তার চতুর্দিকে ঝুঁকে পড়ল। তখন আকাশে একখণ্ড মেঘও ছিল না। দেখতে দেখতে এদিক ওদিক থেকে পানিবাহী মেঘ এসে জমা হল এবং বৃষ্টি বর্ষণ করতে লাগল। জঙ্গলসমূহে পানির স্রোত বয়ে গেল এবং নগর ও মরুভূমি সবুজ সতেজ হয়ে গেল। এ সম্পর্কেই আবু তালেব এই কবিতাটি রচনা করেছিলেন: “তিনি এমন পবিত্র সত্তা যে, মেঘমালা তার নূরোজ্জ্বল মুখমণ্ডলের বরকতে পানি প্রার্থনা করে। তিনি এতীমদের সাহায্যকারী এবং বিধবা নারীদের সতীত্ব। হাশেম পরিবারের ধ্বংসপ্রাপ্তরা তাঁকে ঘিরে থাকে এবং তারা তাঁর কাছ থেকে নেয়ামত ও ফযীলত আহরণ করে। তিনি ন্যায়বিচারের মানদণ্ড, যাতে যবদানা পরিমাণ কমতি হতে পারে না। তিনি সত্যতার ওজনকারী। এই ওজনে কোন কমতি হতে পারে না।”
হযরত হামযা (রাঃ)-এর জিবরাঈলকে দেখা:
ইবনে সা’দ ও বায়হাকী আম্মার ইবনে আবী আম্মার থেকে রেওয়ায়েত করেছেন, হযরত হামযা (রাঃ) আরজ করলেন: ইয়া রসুলাল্লাহ! আমি জিবরাঈল (আঃ)-কে আসল আকৃতিতে দেখতে চাই। হুযুর (সাঃ) বললেনঃ তাঁকে দেখার সাধ্য তোমার নেই। হযরত হামযা (রাঃ) বললেনঃ অবশ্যই আপনি তার সাথে আমাকে সাক্ষাৎ করান। তিনি বললেনঃ আচ্ছা, বস। হযরত হামযা বসে গেলেন। জিবরাঈল (আঃ) একটি কাঠের উপর অবতরণ করলেন, যাতে মুশরিকরা তওয়াফ করার সময় তাদের কাপড় ঝুলিয়ে রাখত। হুযুর (সাঃ) হামযাকে বললেন: দৃষ্টি তুলে তাকাও। তিনি ডাকালে জিবরাঈলের পদযুগল সবুজ যমরুদের ন্যায় দেখতে পেলেন। তিনি বেহুশ হয়ে পড়ে গেলেন। এ রেওয়ায়েতটি মুরসাল।
চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত করার মোজেযাঃ
আল্লাহ পাক এরশাদ করেন:اقتربتِ السَّاعَةُ وَانْشَقَّ الْقَمَرُ কিয়ামত নিকটবর্তী হয়েছে এবং চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হয়েছে।বোখারী ও মুসলিম হযরত আনাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন, মক্কাবাসীরা নবী করীম (সাঃ)-এর কাছে আবেদন করল তিনি যেন তাদেরকে কোন নিদর্শন দেখান। সেমতে তিনি তাদেরকে দু’বার চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হতে দেখালেন। বোখারী ও মুসলিম হযরত ইবনে মসউদ (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন, নবী করীম (সাঃ)-এর আমলে চাঁদের দুটি খণ্ড হয়ে যায়। হুযুর (সাঃ) তাদেরকে বললেন: সাক্ষী থাক। বোখারী ও মুসলিমের অপর এক রেওয়ায়েতে হযরত ইবনে মসউদ (রাঃ) বলেন: আমরা হুযুর (সাঃ)-এর সঙ্গে ছিলাম। চাঁদ খণ্ডিত হয়ে দু’ভাগ হয়ে যায়। একভাগ পাহাড়ের এদিকে ছিল এবং একভাগ ওদিকে। তিনি বললেনঃ তোমরা সাক্ষী থেকো। বোখারী ও মুসলিম ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন, হুযুর (সাঃ)-এর আমলে চাঁদ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এক ভাগ পাহাড়ের উপর থাকে এবং এক ভাগ পাহাড়ের ওদিকে। হুযুর (সাঃ) বললেন: সাক্ষী থাক। বায়হাকী ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন-আমি মক্কায় চাঁদকে বিভক্ত হয়ে দু’ভাগ হতে দেখেছি। চাঁদের এক ভাগ আবু কোবায়স পাহাড়ের
পৃষ্ঠা:৩২
উপরে ছিল এবং এক ভাগ সুয়ায়দার উপরে। মুশরিকরা এটা দেখে বলতে লাগল। চাঁদের উপর জাদু করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে এই আয়াত নাযিল হল:التربتِ السَّاعَةُ وَانْشَقَّ الْقَمَرُ বায়হাকী ও আবু নয়ীম হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন, মক্কায় চাঁদ খণ্ডিত হয়ে দু’ভাগ হয়ে গেল। এটা দেখে মক্কার কাফেররা বলতে লাগলঃ ইবনে আবী কাবশা (হুযুর সাঃ) তোমাদের উপর এ ধরনের আদুই করে। তোমরা মুসাফিরদেরকে জিজ্ঞাসা কর। যদি তারাও তোমাদের মত চাঁদকে দ্বিখণ্ডিত দেখে থাকে, তবে এটা সত্য। নতুবা এটা জাদু, যা তোমাদের চোখে করা হয়েছে। তারা মুসাফিরদেরকে জিজ্ঞেস করল, যারা চতুর্দিক থেকে আগমন করেছিল। তারা বলল: আমরা চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়া দেখেছি। বোখারী ও মুসলিম হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, হুযুর (সাঃ)-এর আমলে চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল। একখণ্ড পাহাড়ের সামনে ছিল এবং একখণ্ড পাহাড়ের পেছনে। বায়হাকী ও আবু নয়ীম জুবায়র ইবনে মুতয়িম থেকে রেওয়ায়েত করেন, তিনি বলেন: আমরা রসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর আমলে মক্কায় ছিলাম। চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। একখণ্ড এক পাহাড়ের উপর এবং এক খণ্ড অন্য পাহাড়ের উপর ছিল। মানুষ বলাবলি করতে লাগলঃ মোহাম্মদ আমাদের উপর জাদু করেছে। একথা শুনে এক ব্যক্তি বলল: তোমাদের উপর জাদু করলেও সকল মানুষের উপর তো জাদু করেনি। আবূ নয়ীম আতা, যাহহাক ও ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন, মুশরিকরা হুযুর (সাঃ)-এর কাছে সমবেত হয়ে বলল: যদি আপনি সত্য নবী হন, তবে আমাদের সামনে চাঁদকে দু’খণ্ড করে দিন। এক খণ্ড যেন আৰু কোবায়স পাহাড়ের উপর এবং অপর খণ্ড কুয়াইকায়ানের উপর থাকে। তখন ছিল পূর্ণিমার রাত। হুযুর (সাঃ) আল্লাহ তায়ালার কাছে তাদের দাবী পূরণ করার জন্যে দোয়া করলেন। সেমতে চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল। অর্ধেক আবূ কোবাভস পাহাড়ের উপর এবং অর্ধেক কুয়াইকায়ানের উপর রয়ে গেল। হুযুর (সাঃ) বললেন: সাক্ষী থাক। আবু নয়ীম যাহহাক থেকে বর্ণনা করেন, ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন: চাঁদ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। এক ভাগ সাফার উপর এবং এক ভাগ মারওয়ার উপর রইল। আছর থেকে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত যতটুকু সময়, ততটুকু সময় দ্বিখণ্ডিত রইল। সকলেই তা দেখছিল। এরপর অদৃশ্য হয়ে গেল। আলেমগণ বলেন ৪ এ ঘটনাটি এক বিরাট মোজেযা। পূর্ববর্তী পয়গম্বরগণের মোজেযাসমূহ এর সমতুল্য হতে পারে না। কেননা, এটা উর্ধ্ব জগতে প্রকাশ পেয়েছে, যা বিশ্বচরাচরের সকল প্রভাবের ঊর্ধ্বে। সেখানে কোন প্রকার কৌশল ও তদবীর করার জো নেই। এ কারণে চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হওয়ার ঘটনা দ্বারা অখণ্ডনীয় প্রমাণ ও দলীল প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।
মানুষের অনিষ্ট থেকে হেফাযতের ওয়াদা:
তিরমিযী, হাকেম, বায়হাকী ও আবু নয়ীম হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন, তিনি বলেনঃ হুযুর (সাঃ)-এর হেফাযতের জন্যে পাহারা দেয়া হত। অবশেষে এই আয়াত নাযিল হলঃوَاللَّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ আল্লাহ মানুষের অনিষ্ট থেকে আপনার হেফাযত করবেন। এরপর হুযুর (সাঃ) পাহারাদার সাহাবীগণকে বললেনঃ তোমরা চলে যাও। আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং আমার হেফাযত করবেন।আহমদ, তিবরানী ও আবু নয়ীমের রেওয়ায়েতে জা’দ্য বলেন: আমি হুযুর (সাঃ)-এর কাছে এলাম। তাঁর কাছে এক ব্যক্তিকে পাকড়াও করে আনা হল এবং বলা হলঃ এই নরাধম আপনাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে ঘুরাফিরা করছিল। হযরত নবী করীম (সাঃ) বললেন: মোটেই ভয় করো না। কেউ আমাকে হত্যা করতে চাইলেও আল্লাহ তায়ালা তাকে সে সুযোগ দিবেন না।
আবু জাহলের অনিষ্ট থেকে হেফাযত:
মুসলিম হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেছেন, আবু জাহল লোকজনকে জিজ্ঞাসা করলঃ মোহাম্মদ আপন মুখমণ্ডল তোমাদের সামনে মাটিতে রাখেন কি? (অর্থাৎ সেজদা করেন কি?) ওরা বলল: হাঁ। আবু জাহল বললঃ লাত ও ওযযার কসম, আমি তাঁকে এরূপ করতে দেখলে তাঁর গর্দান পদদলিত করব অথবা মুখমণ্ডল ধূলি ধূসরিত করে দেব। অতঃপর একদিন হুযুর (সাঃ) যখন নামাযে রত ছিলেন, তখন আবু জাহল তাঁর গর্দান পদদলিত করতে এল। সেখানে উপস্থিত লোকেরা দেখল, আবু জাহল হঠাৎ পেছনে সরে যাচ্ছে এবং উভয় হাত দিয়ে নিজেকে রক্ষা করতে চেষ্টা করছে। পরে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে সে বলল : আমার ও মোহাম্মদের মাঝখানে একটা ভয়াবহ দৃশ্য রয়েছে এবং কতগুলো অদৃশ্য হাত কার্যকর দেখতে পাচ্ছি। হুযুর (সাঃ) বললেনঃ সে আমার কাছে আসলে ফেরেশতা তার এক একটি অঙ্গ ছোঁ মেরে নিয়ে যেত। এব পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা এই আয়াত নাযিল করেন: كَلَّا إِنَّ الْإِنْسَانَ لَبَطْفى
পৃষ্ঠা:৩৩
ইবনে ইসহাক, বায়হাকী ও আবু নয়ীম হযরত ইবনে-আববাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেছেন, আবু জাহল বলল: হে কোরায়শ সম্প্রদায়। তোমরা দেখছ যে, মোহাম্মদ আমাদের ধর্মের দোষ বের করে, আমাদের পিতৃপুরুষকে মন্দ বলে, আমাদেরকে নির্বোধ সাব্যস্ত করে এবং আমাদের উপাস্যদেরকে গালি দেয়। আমি প্রতিজ্ঞা করছি-আগামীকাল তার জন্যে একটি পাথর নিয়ে বসব। যখন সে নামাযে বসবে, তখন এই পাথর দিয়ে তার মাথা পিষ্ট করে দেব। এরপর দেখি তার গোত্র বন্ধু আবদ মানাফ কি করতে পারে। সে মতে আবু জাহল সকালে উঠে একটি পাথর নিয়ে বসে রইল। নবী করীম (সাঃ) নামাযে দাঁড়ালেন। কোরায়শরা সকাল বেলায় আপন আপন মজলিসে বসে গেল। তারা আবু জাহলকে দেখছিল। যখন নবী করীম (সাঃ) সেজদায় গেলেন, তখন আবূ জহল পাথর নিয়ে তাঁর দিকে অগ্রসর হল। নিকটে পৌঁছলে হঠাৎ তার মুখের রঙ বিবর্ণ হয়ে গেল এবং সে ভীত বিহ্বল হয়ে গেল। সে পিছনে হটতে লাগল এবং পাথরটি হাত থেকে ফেলে দিল। কোরায়শরা দৌড়ে আবু জাহলের দিকে গেল এবং তাকে জিজ্ঞাস করলঃ কি হল? সে বলল: আমি যখন তার দিকে অগ্রসর হলাম, তখন একটি তাগড়া উট দেখলাম। খোদার কসম, এই উটের মাথা, ঘাড় এবং দাঁত যেমনটি দেখলাম, কোন উটের তেমনটি দেখিনি। এই উট আমাকে গিলে ফেলতে চেয়েছিল। হুযুর (সাঃ) বলেন: তিনি ছিলেন জিবরাঈল (আঃ)। আবু জাহল আমার কাছে এলে তিনি ওকে ধরে ফেলতেন।বোখারী হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন, একদিন আবু জাহল বলল: আমি মোহাম্মদকে বায়তুল্লাহর কাছে নামায পড়া অবস্থায় দেখলে তার গর্দান পদদলিত করব। হুযুর (সাঃ) তার এ সংকল্পের কথা জানতে পেরে বললেন: আবু জাহল এরূপ করলে ফেরেশতারা সর্বসমক্ষে ওকে ধরে ফেলবে।বাযযার, তিবরানী, হাকেম, বায়হাকী ও আবু নয়ীম হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন-একদিন মসজিদে আমার উপস্থিতিতে আবু জাহল বললঃ”মোহাম্মদকে সেজদায় দেখলে তার ঘাড় পদদলিত করার জন্য আমি সংকল্প গ্রহণ করলাম।” হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ আমি হুযুর (সাঃ)-এর কাছে যেয়ে আবু জাহলের কুমতলব সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করলাম। তিনি কিছুটা রাগান্বিত অবস্থায় গৃহ থেকে বের হয়ে মসজিদে এলেন এবং মসজিদের দরজা দিয়ে নির্ভয়ে প্রবেশ করতে লাগলেন। আমি প্রমাদ গনলাম। তিনি নামাযে সূরা ইকরা তেলাওয়াত শুরু আমি যা দেখছি, তুমি তা দেখছ না। খোদার কসম, আকাশের প্রান্ত আমাকে ঘিরে ফেলেছে। ইবনে ইসহাক, বায়হাকী ও আবূ নয়ীম আবদুল মালেক ইবনে আবু সুফিয়ান সকফী থেকে রেওয়ায়েত করেন, জনৈক বেদুঈন নিজের উট নিয়ে মক্কায় এল। আবু জাহল তার কাছ থেকে উট ক্রয় করল, কিন্তু মূল্য পরিশোধে টালবাহানা গুরু করল। বেদুঈন কেরায়শদের মজলিসে এসে বলল: আবূ জাহলের কাছ থেকে প্রাপ্য আদায়ে কে আমাকে সাহায্য করবে। আমি ভিনদেশী মুসাফির। আবু জাহল আমার প্রাপ্য আত্মসাৎ করেছে। কোরায়শরা বললঃ তুমি ঐ ব্যক্তির (অর্থাৎ হুযূর সাঃ) নিকট গিয়ে দেখ। হুযুর (সাঃ) তখন মসজিদের এক কোণে অবস্থান করছিলেন। কোরায়শদের কথায় বেদুঈন হুযুর (সাঃ)-এর কাছে এসে ঘটনা বর্ণনা করল। তিনি ঘটনা শুনে বেদুঈনকে সঙ্গে নিয়ে আবু জাহলের বাড়ীতে গেলেন এবং তার দরজার কড়া নাড়লেন। আবু জাহল বলল: কে? তিনি বললেনঃ আমি মোহাম্মদ। আবু জাহল তাঁর দিকে অগ্রসর হল, কিন্তু তার রঙ ক্রমশঃ বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছিল। তিনি আবু জাহলকে বললেনঃ এ ব্যক্তির পাওনা পরিশোধ করে দাও। আবু জাহল বলল: আচ্ছা। সে বাড়ীর ভিতরে গেল এবং পাওনা নিয়ে ফিরে এল। হুযুর (সাঃ) বেদুঈনের পাওনা বুঝে নিয়ে তাকে দিয়ে দিলেন, অতঃপর স্বস্থানে ফিরে এলেন। লোকেরা আবূ জাহলকে বলল: আবুল হাকাম, তোমার আচরণ বিস্ময়কর! আবু জাহল বললঃ তোমাদের মঙ্গল হোক। মোহাম্মদ যখন আমার দরজায় কড়া নাড়ল, তখন আমি হঠাৎ ভীত হয়ে পড়লাম। যখন তাঁর কাছে এলাম, তখন আমার মাথার উপর একটি তাগড়া উট দেখতে পেলাম। আমি এ উটের মত কোন উটের মাথার খুলি, গর্দান ও দাঁত দেখিনি। খোদার কসম, আমি তার কথামত কাজ না করলে উটটি আমাকে খেয়ে ফেলত। আবু নয়ীম সালাম ইবনে বাহেলী থেকে এবং তিনি আবু এয়াযীদ মদনী ও আবূ কোরয়া বাহেলী থেকে বর্ণনা করেন যে, আবু জাহলের কাছে এক ব্যক্তির পাওনা ছিল। সে তা শোধ করতে অস্বীকার করল। লোকেরা প্রাপককে বলল: আমরা কি তোমাকে এমন এক ব্যক্তির কথা বলব না, যে আবু জাহলের কাছ থেকে তোমার পাওনা আদায় করে দিতে পারে? লোকটি বললঃ অবশ্যই বল। করলেন। যখন إِنَّ الإِنْسَانَ لَيَطْغَى পর্যন্ত পৌছলেন, যা আবূ জাহলেরই অবস্থা, তখন একব্যক্তি আৰু জহলকে বলল: এই তো মোহাম্মদ। সে বলল: তারা বললঃ মোহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহর কাছে যাও। সে এল। তিনি লোকটিকে সঙ্গে নিয়ে আবূ জাহলের কাছে গেলেন এবং বললেনঃ এ লোকটির পাওনা দিয়ে দাও। আবু জাহল বলল: আচ্ছা। অতঃপর যে অন্দরে গেল এবং লোকটির প্রাপ্য দেরহাম নিয়ে এল। লোকেরা আবু জাহলকে জিজ্ঞাসা করলঃ তুমি
পৃষ্ঠা:৩৪
কি মোহাম্মদকে ভয় করলে? সে বলল: সেই সত্তার কসম, যার কব্জায় আমার প্রাণ, আমি তার সাথে সুতীক্ষ্ণ বর্শাধারী লোকজনকে দেখেছি। পাওনা শোধ না করলে তারা বর্ণা দিয়ে আমার পেট চিরে দিত।আওরা বিনতে হরবের দৃষ্টি থেকে হেফাযত আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন- হে নবী, যখন আপনি কোরআন তেলাওয়াত করেন, তখন আমি আপনার মধ্যে এবং অবিশ্বাসীদের মধ্যে অন্তরায় সৃষ্টি করে দেই। আল্লাহ পাক আরও বলেন:وَجَعَلْنَا مِنْ بَيْنِ أَيْدِيهِمْ صَدَارَ مِنْ خَلْفِهِمْ سَدًّا فَاغْشَيْنَا هُمْلَهُمْ لَا يُبْصِرُونَ -: আমি স্থাপন করেছি তাদের সম্মুখে একটি অন্তরাল এবং পশ্চাতে একটি অন্তরাল এবং তাদের দৃষ্টির উপর রেখেছি আবরণ। ফলে তারা দেখতে পায় না। (সূরা ইয়াসীন)আবু ইয়ালা, ইবনে আবী হাতেম, বায়হাকী ও আবূ নয়ীম হযরত আসমা বিনতে আবু বকর (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেছেন, সূরা তাব্বাত অবতীর্ণ হওয়ার পর আওরা বিনতে হরব উত্তেজিত অবস্থায় রওয়ানা হল। তার হাতে ছিল একটি পাথর। রসুলুল্লাহ (সাঃ) মসজিদে ছিলেন। হযরত আবু বকর (রাঃ)-ও তাঁর সঙ্গে ছিলেন। আওরাকে আসতে দেখে হযরত আবুবকর বললেন: ইয়া রসূলাল্লাহ, আওরা আসছে। আমার আশংকা হয় সে আপনাকে দেখে না ফেলে। হুযুর (সাঃ) এরশাদ করলেন, সে আমাকে দেখতে পাবে না। তিনি কোরআন পাঠ করে নিজের হেফাযত করে নিলেন। আওরা এসে আবু বকর (রাঃ)-এর কাছে দাঁড়িয়ে গেল। হুযুর (সাঃ)-কে দেখতে পেল না। সে আবু বকর (রাঃ)-কে বলল: আমি জানতে পেরেছি তোমার সঙ্গী আমার নিন্দাবাদ করেছে। আবু বকর বললেনঃ কা’বা গৃহের প্রভুর কসম, তিনি তোমার নিন্দাবাদ করেননি। বায়হাকী এ রেওয়ায়েতটি আসমা (রাঃ) থেকেও হুবহু এভাবেই বর্ণনা করেছেন। এতে এ কথাগুলোও আছে- হযরত আবু বকর (রাঃ) বললেন: আমার সঙ্গী কবি নন। কবিতা কি তিনি তাও জানেন না। হুযুর (সাঃ) আবু বকরকে বললেনঃ আওরাকে প্রশ্ন কর তোমার সঙ্গে আর কেউ দৃষ্টিগোচর হয় কি? সে আমাকে দেখে না। কারণ, আমার ও তার মধ্যে একটি অন্তরাল স্থাপন করা হয়েছে। আবু বকর (রাঃ) আওরাকে এ কথা জিজ্ঞেস করলে সে বলল: তুমি আমার সাথে উপহাস করছ। আমি অন্য কাউকে দেখি না। ইবনে আবী শায়বা ও আবূ নয়ীম হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন, সূরা তাব্বাত নাযিল হলে আবু জাহলের স্ত্রী এল। আবু বকর (রাঃ) আরজ করলেনঃ ইয়া রসূলাল্লাহ। আপনি তাঁর সম্মুখ থেকে সরে গেলে ভাল হত। এই মহিলা অত্যন্ত কটুভাষিনী। হুযুর (সাঃ) বললেনঃ আমার মধ্যে ও তার মধ্যে অন্তরাল হয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত স্ত্রীলোকটি তাঁকে দেখল না এবং আবু বকরকে বলল: তোমার সঙ্গী আমার নিন্দাবাদ করেছে। আবু বকর (রাঃ) বললেন : তিনি কবিতা বলেনও না, পড়েনও না। অতঃপর সে চলে গেল। হযরত আবু বকর (রাঃ) আরজ করলেনঃ ইয়া রসূলাল্লাহ। সে আপনাকে দেখেনি। তিনি বললেন: আমার ও তার মধ্যে একজন ফেরেশতা ছিল, সে আপন বাহু দ্বারা আমাকে ঢেকে রেখেছিল।
মখযুমীদের অনিষ্ট থেকে হেফাযত
বায়হাকী হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকেوَجَعَلْنَ مِنْ بَيْنِ أَيْدِيهِمْ سَدًّا: আয়াতের তফসীর প্রসঙ্গে রেওয়ায়েত করেন, বনী-মখযূমের কিছু সংখ্যক লোক হুযুর (সাঃ)-কে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিল। তাদের মধ্যে আবু জাহল এবং ওলীদ ইবনে মুগীরাও ছিল। নবী করীম (সাঃ) নামায পড়ছিলেন। এ হতভাগারা তাঁর কেরাত শুনতে পেল। তারা ওলীদকে হত্যাকার্য সম্পন্ন করতে প্রেরণ করল। ওলীদ সে স্থানে এল, যেখানে তিনি নামায পড়ছিলেন। সে তাঁর কেরাত শুনছিল, কিন্তু তাঁকে দেখছিল না। সে ফিরে গেল এবং সঙ্গীদেরকে ঘটনা বলল। তারা সকলেই নামায পড়ার জায়গায় এল। তারা কেরাতের আওয়াজ শুনে অগ্রসর হলে আওয়াজ তাদের পেছন থেকে আসছে বলে মনে হল। তারা সেদিকে গেল, কিন্তু আওয়াজ পেছন থেকে আসছে বলে মনে হল। এ অবস্থা দেখে তারা ব্যর্থ হয়ে ফিরে এল। এ সম্পর্কেই উপরোক্ত আয়াত নাযিল হয়। ইমাম বায়হাকী বলেন: ইকরিমা থেকে বর্ণিত রেওয়ায়েত এ ঘটনাটির সমর্থন করে। সুয়ূতী বলেন: এখানে ইবনে জরীরের তফসীর গ্রন্থে উল্লিখিত ইকরামার রেওয়ায়েতের দিকে ইশারা করা হয়েছে। রেওয়ায়েতটি এইঃ আবু জাহল বলল, আমি মোহাম্মদকে দেখলে এই করব সেই করব। এ পরিপ্রেক্ষিতে নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয় ৪ إِنَّا جَعَلْنَا فِي أَعْنَاقِهِمْ أَغْلَالًا فَهِيَ إِلَى الْأَذْقَانِ فَهُمْ مُقْمَحُونَ وَجَعَلْنَا مِنْ بَيْنِ أَيْدِيهِمْ سَدًّا وَمِنْ خَلْفِهِمْ سَدًّاالتَيْنَاهُمْ فَهُمْ لَا يُبْصِرُونَ .
পৃষ্ঠা:৩৫
আমি ওদের গলদেশে চিবুক পর্যন্ত বেড়ি পরিয়েছি। ফলে ওরা ঊর্ধ্বমুখী হয়ে গেছে। আমি ওদের সম্মুখে একটি অন্তরাল এবং পশ্চাতে একটি অন্তরাল স্থাপন করেছি। ফলে ওরা দেখতে পায় না। আবু নয়ীম ইকরিমা থেকে এবং তিনি ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন, হুযুর (সাঃ) মসজিদে হারামে সশব্দে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। কোরায়শরা তাঁর উপর নির্যাতন চালায় এবং তাঁকে ধরতে উদ্যত হয়। হঠাৎ তাদের হাত তাদের খাড়ে বেড়ি হয়ে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে তাদের দৃষ্টি শক্তিও চলে যায়। তারা কোন কিছু দেখত না। এ অবস্থায় তারা হুযুর (সাঃ)-এর খেদমতে হাযির হয়ে আরজ করে, আমরা আপনাকে আল্লাহর কসম দিচ্ছি। অতঃপর তিনি তাদের জন্যে দোয়া করেন। ফলে তাদের অন্ধত্ব দূর হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সূরা ইয়াসীন নাযিল হয়। আবু নয়ীম মুতামার ও সোলায়মান থেকে বর্ণনা করেন, জনৈক মখযুমী মন্দ উদ্দেশ্য রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর দিকে অগ্রসর হল। তার হাতে একটি পাথর ছিল। সে যখন নিকটে এল, তখন হুযুর (সাঃ) সেজদায় ছিলেন। সে হাত তুলল। সঙ্গে সঙ্গে তার হাত অবশ হয়ে গেল, হাত থেকে পাথর আলাদা করার শক্তি রইল না। সে সঙ্গীদের কাছে ফিরে এলে তারা বলল: তুমি কাপুরুষতা দেখিয়েছ। সে বলল : আমি কাপুরুষতা দেখাইনি। এই দেখ, পাথর আমার হাতেই আছে। আমি এটি আলাদা করতে পারি না। তারা অবাক হল। তারা পাথরে তার অঙ্গুলিগুলো অবশ পেল। অনেক চিকিৎসার পর পাথর অঙ্গুলি থেকে বিচ্ছিন্ন হল।
নযর ইবনে হারেসের অনিষ্ট থেকে হেফাযত
ওয়াকেসী ও আবু নয়ীম হযরত ওরওয়া ইবনে যুবায়র (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন, নযর ইবনে হারেস রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে কষ্ট দিত। একদিন গ্রীষ্মকালে তীব্র গরমের সময় দ্বিপ্রহরে হুযুর (সাঃ) প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার জন্যে যাচ্ছিলেন। তিনি সানিয়াতুল-হুজুনের নিম্নভাগ পর্যন্ত পৌঁছে গেলেন। এ কাজে দূরে চলে যাওয়াই তাঁর অভ্যাস ছিল। নযর তাঁকে দেখে মনে মনে বলল: এ মুহূর্তে তিনি যেমন নির্জনে আছেন, তাঁকে হত্যা করার জন্যে এমন সুযোগ কখনও পাওয়া যাবে না। সে হুযুর (সাঃ)-এর দিকে অগ্রসর হল; কিন্তু তৎক্ষণাৎ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে আপন গৃহে ফিরে গেল। পথিমধ্যে আবু জাহলের সাথে দেখা হলে সে বলল: কোথেকে আসছ? মষর বলল: আমি মোহাম্মদের পশ্চাদ্ধাবন করেছিলাম। আমার উদ্দেশ্য ছিল ওকে হত্যা করা। কারণ, সে একাকী ছিল। কিন্তু অকস্মাৎ আমি অনেকগুলো সিংহ দেখলাম। সেগুলো মুখ হা করে আমার দিকে এগিয়ে আসছিল। আমি তাঁত হয়ে ফিরে এসাম। আবু আহল বলল: এটাও তার একটা জাদু।
হাকামের অনিষ্ট থেকে হেফাযত
তিবরানী, ইবনে মান্দাহ ও আবু নয়ামের রেওয়ায়েতে হাকামের পৌত্রী বর্ণনা করেন, আমার দাদা হাকাম আমাকে বলেছেন-আমি তোমার কাছে একটি চাক্ষুষ ঘটনা বর্ণনা করছি- শুন। একদিন আমরা এ মর্মে চুক্তি করলাম যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে পাকড়াও করব। আমরা একটি ভয়ংকর শব্দ শুনতে পেলাম। মনে হল যেন তেহামার পাহাড়সমূহ চুরমার হয়ে গেছে। আমরা অজ্ঞান হয়ে গেলাম। হুযুর (সাঃ) নামায সমাপ্ত করে গৃহে ফিরে যাওয়া পর্যন্ত আমাদের কোন বোধশক্তিই ছিল না। পরবর্তী রাতে আমরা আবার পূর্ববৎ চুক্তি করলাম। হুযুর (সাঃ) মসজিদে আগমন করলে আমরা তাঁর দিকে অগ্রসর হলাম। দেখি কি, সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয় এসে পরস্পরে মিলিত হয়ে গেল এবং আমাদের ও হুযুর (সাঃ)-এর মধ্যে অন্তরাল হয়ে গেল। আল্লাহর কসম, আমাদের প্রচেষ্টা ফলদায়ক হয়নি। অবশেষে আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে ইসলামে প্রবেশের তৌফিক দিলেন।
কুস্তিতে রোকানা পাহলোয়ানকে ধরাশায়ী করা
বায়হাকী ইসহাক ইবনে ইয়া’মার থেকে রেওয়ায়েত করেন, রসুলুল্লাহ (সাঃ) খ্যাতনামা পাহলোয়ান রোকানা ইবনে আবদে এয়াযীদকে বললেন: মুসলমান হয়ে যাও। সে বললঃ যদি আমাকে বিশ্বাস করাতে পারেন, আপনি যা বলেন তা সত্য, তবে আমি মুসলমান হয়ে যাব। রোকানা অত্যন্ত সুঠামদেহী শক্তিশালী ব্যক্তি ছিল। হুযুর (সাঃ) বললেন, যদি আমি তোমাকে ধরাশায়ী করে দেই, তবে আমার কথা সত্য বলে মানবে? সে বলল: অবশ্যই। রসূলুল্লাহ (সাঃ) দাঁড়িয়ে গেলেন এবং কুস্তিতে তাকে ধরাশায়ী করে দিলেন। সে বলল: আবার লড়ুন। তিনি আবার লড়লেন এবং রোকানাকে ধরে মাটিতে ফেলে দিলেন। রোকানা একথা বলতে বলতে ফিরে গেল যে, এ ব্যক্তি জাদুকর। এমন জাদু আমি কখনও দেখিনি। মাটিতে পড়ার পর নিজের উপর আমার কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না।বায়হাকীর রেওয়ায়েতে রোকানা ইবনে আবদে এয়াযীদ বলেন : আমি এবং রসুলুল্লাহ (সাঃ) আবু তালেবের ছাগপালের মধ্যে ছিলাম। আমরা ছাগল চরাতাম। তিনি একদিন আমাকে বললেনঃ তুমি আমার সাথে কুস্তি লড়তে চাও? আমি জিজ্ঞেস করলামঃ আপনি আমার সাথে কুস্তি লড়বেন? তিনি বললেনঃ হাঁ। আমি জিজ্ঞেস করলাম: কোন্ শর্তে লড়বেন? তিনি বললেন: একটি ছাগলের শর্তে। সেমতে আমি তাঁর সাথে কুস্তি লড়লাম। তিনি আমাকে পরাজিত করলেন এবং
পৃষ্ঠা:৩৬
আমার কাছ থেকে একটি ছাগল নিয়ে নিলেন। অতঃপর তিনি বললেন: দ্বিতীয় বার লড়বে কি? আমি বললামঃ জি হাঁ। আমি আবার লড়লাম এবং তিনি আমাকে আবার হারিয়ে দিলেন। শর্ত অনুযায়ী আর একটি ছাগল নিয়ে নিলেন। কেউ আমাকে দেখে কি না, তা দেখার জন্যে আমি এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলাম। হুযুর (সাঃ) বললেনঃ তোমার কি হল?আমি বললামঃ রাখালদেরকে দেখছি। কোথাও তারা আমাকে দেখে না ফেলে! দেখলে তারা আর আমাকে ভয় করবে না। অথচ আমি আমার গোত্রের মধ্যে সর্বাধিক শক্তিশালী বলে খ্যাত। হুযুর (সাঃ) বললেনঃ তৃতীয় বার লড়বে? তুমি একটি ছাগল পাবে। আমি বললাম: হাঁ, লড়ব। তাঁর সাথে তৃতীয় বারের মতও লড়লাম। তিনি এবারও আমাকে পরাস্ত করলেন এবং একটি ছাগল নিয়ে নিলেন। আমি দুঃখিত ও অবসন্ন অবস্থায় বসে পড়লাম। হুযুর (সাঃ) বললেনঃ কি হল? আমি আরজ করলাম: আবদে এয়াযীদের কাছে যাচ্ছি। আমি তার তিনটি ছাগল হারালাম। আমি মনে করতাম, কোরায়শদের মধ্যে আমিই সর্বাধিক শক্তিশালী পাহলোয়ান। হুযুর (সাঃ) বললেন: চতুর্থ বারও লড়বে? আমি বললামঃ না। তিন বারের পর আর সাহস নেই। হুযুর (সাঃ) বললেনঃ তোমার সব ছাগল ফিরিয়ে দিব। সেমতে তিনি আমার ছাগলগুলো ফিরিয়ে দিলেন। কিছু দিন পরেই তাঁর নবুওয়তপ্রাপ্তির কথা প্রকাশ হয়ে পড়ল। আমি তাঁর খেদমতে এসে মুসলমান হয়ে গেলাম। আল্লাহ তায়ালা আমাকে যেসব বিষয়ের হেদায়াত দান করেছেন, তন্মধ্যে একটি ছিল আমার এই বোধোদয় যে, সেদিন তিনি আমাকে নিজ শক্তিবলে ধরাশায়ী করেননি; বরং অন্যের শক্তি দিয়েই আমাকে পরাজিত করেছিলেন। বায়হাকী ও আবু নয়ীম হযরত আবু ওমামা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন, বনী-হাশেমে রোকানা নামের এক ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ছিলেন অসাধারণ শক্তিশালী। কাউকে ধরলে মুহূর্তেই তার দফারফা করে ছাড়তে। সে আসম উপত্যকায় ছাগল চরাত। একদিন নবী করীম (সাঃ) সে উপত্যকায় গেলেন। সেখানে তাঁর রোকানার সাথে সাক্ষাৎ হল। তিনি ছিলেন একাকী। রোকানা তাঁকে বললঃ মোহাম্মদ! আপনিই সে ব্যক্তি, যে আমাদের উপাস্য লাত ও ওযযাকে মন্দ বলে এবং নিজের পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাবান উপাস্যের দিকে দাওয়াত দেয়? আপনার সাথে আমার আত্মীয়তার সম্পর্ক না থাকলে আজ আমি আপনাকে হত্যা করতাম এবং কোন কথাই শুনতাম না। আজ আপনার পরাক্রমশালী উপাস্যের কাছে কি দোয়া করবেন, যাতে আপনাকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করেন। আমি আপনার সামনে একটি প্রস্তাব রাখছি। আসুন আমরা কুস্তি লড়ি। আপনি-আমাকে পরাজিত করতে পারলে আমার পাল থেকে দশটি ছাগল পাবেন। আপনি নিজে সেগুলো পছন্দ করে নেবেন। হুযূর (সাঃ) বললেনঃ তুমি যদি তাই চাও, তবে আমি লড়তে প্রস্তুত আছি। এরপর মল্লযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। হুযুর (সাঃ) রোকানাকে পরাজিত করার জন্যে। আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করলেন এবং রোকানা লাত ও ওযযাকে ডাক দিল। হুযুর (সাঃ) রোকানাকে ধরাশায়ী করে তার বুকের উপর চেপে বসলেন। রোকানা বলল: আপনি আমার বুক থেকে উঠে যান। আপনি আমাকে পরাজিত করেননি; বরং আপনার সর্বশক্তিমান উপাস্য আমাকে ভূতলশায়ী করেছে। লাভ ও ওযযা আমাকে সাহায্য করেনি। আপনার পূর্বে কেউ আমার পিঠ মাটিতে ঠেকাতে পারেনি। এরপর রোকানা বলল: আবার লড়ুন। এবারও পরাজিত করলে আবারও দশটি ছাগল দেব। হুযুর (সাঃ) দ্বিতীয় বার রোকানাকে ধরলেন। প্রত্যেকেই পূর্ববৎ আপন আপন উপাস্যের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলেন। হুযুর (সাঃ) রোকানাকে মার্টিতে ফেলে দিয়ে তার বুকের উপর চেপে বসলেন। রোকানা বলল: আমার বুক থেকে উঠে পড়ুন। আপনি আমাকে পরাজিত করেননি; বরং আপনার মাবুদ আমাকে পরাজিত করেছে। লাত ও ওযযা আমাকে লাঞ্ছিত করেছেন। আপনার পূর্বে কেউ আমার পৃষ্ঠদেশ মাটিতে লাগাতে পারেনি। এরপর রোকানা তৃতীয় বার কুস্তি লড়ার প্রস্তাব দিল এবং অতিরিক্ত আরও দশটি ছাগল দেয়ার কথা বলল। হুযুর (সাঃ) তাঁকে তৃতীয় বারও ধরাশায়ী করে দিলেন। রোকানা আবারও পূর্ববৎ লাত ও ওযযার অসহযোগিতার কথা প্রকাশ করে বললঃ আপনি আমার পাল থেকে ত্রিশটি ছাগল বেছে নিন। হুযুর (সাঃ) বললেনঃ রোকানা! আমি ছাগল চাই না। আমি তোমাকে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছি। তুমি দোযখে যাও এটা আমি পছন্দ করি না। তুমি ইসলাম গ্রহণ করলে বেঁচে যাবে। রোকানা বলল: কোন নিদর্শন না দেখানো পর্যন্ত আমি ইসলাম গ্রহণ করব না। হুযুর (সাঃ) বললেনঃ আমি আল্লাহকে সাক্ষী করে বলছি- যদি আমি আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করি এবং তিনি তোমাকে কোন নিদর্শন দেখান, তবে তুমি ইসলাম কবুল করবে। রোকানা বললঃ অবশ্যই কবুল করব।
পৃষ্ঠা:৩৭
রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকটেই একটি কাঁটাযুক্ত বৃক্ষ ছিল। তিনি বৃক্ষের দিকে ইশারা করে বললেন: আল্লাহর হুকুমে এগিয়ে এস। তৎক্ষণাৎ বৃক্ষটি দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। অর্ধেক তার শাখা ও পাতাসহ এগিয়ে এসে হুযুর (সাঃ) ও রোকানার সামনে দাঁড়িয়ে গেল। রোকানা বলল: আপনি বিরাট নিদর্শন দেখিয়েছেন। এখন একে ফিরে যাওয়ার আদেশ দিন। হুযুর (সাঃ) বললেনঃ আল্লাহ সাক্ষী, যদি দোয়া করি এবং বৃক্ষ ঘুরে স্বস্থানে চলে যায়, তবে তুমি ইসলাম কবুল করবে। রোকানা বলল: অবশ্যই কবুল করব। রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর দোয়ায় বৃক্ষটি আপন শাখা ও পাতাসহ ফিরে গেল এবং অপর অংশের সাথে সংযুক্ত হয়ে গেল। হুযুর (সাঃ) বললেনঃ রোকানা, মুসলমান হয়ে যাও, বেঁচে যাবে। রোকানা বলল ও এ বিরাট নিদর্শন দেখার পর কোন বাধা নেই; কিন্তু আমি মনে করি শহরের মহিলারা বলাবলি করবে, আমি আপনার সামনে ভীত হয়ে পড়েছি। তাই আপনার ধর্ম কবুল করেছি। অথচ শহরের নারী শিশু নির্বিশেষে সকলেই জানে, আজ পর্যন্ত কেউ আমার পৃষ্ঠদেশ মাটিতে ঠেকাতে পারেনি এবং দিবারাত্রির কোন মুহূর্তেই আমি ভীত হইনি। আপনি আপনার ছাগলগুলো নিয়ে যান। হুযুর (সাঃ) বললেনঃ তুমি ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছ- এমতাবস্থায় ছাগলের আমার কোন প্রয়োজন নেই।রসূলুল্লাহ (সাঃ) ফিরে এলেন। পথিমধ্যে আবু বকর ও ওমর (রাঃ)-কে পেলেন, উভয়েই তাঁর খোঁজে বের হয়েছিলেন। কারণ, তাঁরা জানতে পেরেছিলেন, হুযুর (সাঃ) আসম উপত্যাকার দিকে গেছেন। এ উপত্যকায় হিংস্র স্বভাব রোকানার কর্তৃত্ব ছিল। তাই তাঁরা পেরেশান হয়ে প্রত্যেক টিলার উপর দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। অবশেষে হুযুর (সাঃ) সামনে এলে তাঁরা বললেনঃ হে আল্লাহর রসুল, আপনি একাকী এ উপত্যকার দিকে কিভাবে এলেন? আপনি জানেন, এটা রোকানার উপত্যকা। সে যেমন রক্তপিপাসু, তেমনি আপনার ব্যাপারে মিথ্যারোপে কঠোর।নবী করীম (সাঃ) তাঁদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন এবং বললেন: আল্লাহ তায়ালা কি আমার হেফাযত করবেন বলে ওয়াদা করেননি। অতঃপর তিনি তাঁদের কাছে রোকানার সম্পূর্ণ ঘটনা খুলে বললেন। তাঁরা শুনে আশ্চর্যান্বিত হলেন এবং আরজ করলেনঃ ইয়া রসুলাল্লাহ। আপনি রোকানাকে পরাস্ত করেছেন? সেই আল্লাহর কসম, যিনি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, আমাদের জানা নেই যে, কেউ কখনও রোকানাকে ধরাশায়ী করেছে।হুযুর (সাঃ) এরশাদ করলেন: আমি পরওয়াদেগারের কাছে দোয়া করেছি। তিনি রোকানার মোকাবিলায় আমাকে সাহায্য করেছেন। দশ জনের বেশী ফেরেশতা দ্বারা সাহায্য করেছেন এবং দশ জনের শক্তি আমাকে দান করেছেন।
ওসমান (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণের সময়কার মোজেযা
ইবনে আসাকির হযরত ওসমান (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন, তিনি বলেনঃ আমি ইসলাম-পূর্বকালে নারীদের প্রতি দারুণ আসক্ত ছিলাম। একদিন রাতের বেলায় কোরায়শদের একটি দলের সাথে কা’বা প্রাঙ্গণে উপবিষ্ট ছিলাম। হঠাৎ কেউ বলল: নবী করীম (সাঃ) স্বীয় কন্যা রোকাইয়ার বিবাহ ওতবা ইবনে আবী লাহাবের সাথে ঠিক করেছেন। রোকাইয়া এমন রূপসী ও গুণবতী ছিলেন যে, দর্শক মাত্রই আশ্চর্যান্বিত হয়ে যেত। এ খবর শুনে আমার খুব পরিতাপ হল, আমি এ ব্যাপারে অগ্রণী হলাম না কেন। কিছুক্ষণ পরেই আমি গৃহে পৌঁছে খালার কাছে গেলাম। তিনি অতীন্দ্রিয়বাদিনী ছিলেন। তিনি আমাকে দেখে বলতে লাগলেনঃ”সুসংবাদ হোক। লাগাতার তিন বার তোমার সম্মান করা হোক, আবার তিন বার এবং আরও তিন বার তোমার সম্মান করা হোক, যাতে দশের সংখ্যা পূর্ণ হয়ে যায়। তোমার কাছে কল্যাণ এসেছে এবং অনিষ্টথেকে তুমি বেঁচে থাক।” “খোদার কসম, এক রূপসী নারীর সাথে তোমার বিয়ে হবে। তুমিও কুমার এবং কুমারী স্ত্রীই তুমি পাবে।” “তুমি এক মহীয়ান ব্যক্তিত্বের কন্যাকে পেয়েছ।” হযরত ওসমান বলেন: খালার কথা শুনে আমি অবাক হলাম। তাঁকে জিজ্ঞেস করলামঃ তুমি কি বলছ? খালা বললঃ ওসমান, তুমি সুশ্রী ও সুভাষী। নবীর সাথে এর সম্পর্ক আছে। আল্লাহ সত্যসহ এ নবীকে পাঠিয়েছেন। তাঁর সাথে অবর্তীর্ণ কিতাব ও কোরআন আছে। তুমি এই নবীর অনুসরণ কর। এই প্রতিমা’ যেন প্রতারণা করে তোমাকে মেরে না ফেলে। আমি বললামঃ খালা, তুমি এমন বিষয় আলোচনা করছ, আমাদের শহরে যার আলোচনা হয়নি। তুমি. এর স্বরূপ বর্ণনা কর। খালা বললঃ মোহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ আল্লাহ তায়ালার রসূল। তিনি আল্লাহর অবতীর্ণ কিতাব এনেছেন। এর মাধ্যমে মানুষকে সত্যের দিকে আহবান করেন। তাঁর প্রদীপই প্রকৃত প্রদীপ। তাঁর ধর্মই সাফল্য। তাঁর আমল যুদ্ধ-বিগ্রহের। সমগ্র দেশ তাঁর অনুগত। যুদ্ধে কাফেররা, নিহত হলে, তরবারি উত্তোলিত হলে এবং বর্শা নিক্ষিপ্ত হলে হৈ হুল্লোড় করা উপকারী হবে না।হযরত ওসমান (রাঃ) বলেনঃ আমি একথা শুনে ফিরে এলাম। এ কথাবার্তা আমার মনে প্রভাব বিস্তার করে এবং আমি এ সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করতে লাগলাম। আমি হযরত আবু বকরের কাছে পূর্ব থেকেই যাওয়া-আসা করতাম। আমি তাঁর কাছে এলাম এবং খালার কাছে যা শুনেছিলাম, সে সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করলাম।
পৃষ্ঠা:৩৮
তিনি বললেন, ওছমান। তোমার মঙ্গল হোক। তুমি বুদ্ধিমান ব্যক্তি। সত্য ও মিথ্যা তোমার জানা থাকার কথা। আমাদের কওম ধাদের পূজা পাট করে, তাদের কোন স্বরূপ আছে কি? এরা প্রস্তরনির্মিত নয় কি? এদের না শ্রবণের ক্ষমতা আছে, না দেখার- না উপকার করার, না ক্ষতি করার। আমি বললাম, খোদার কসম, এই প্রতিমাদের অবস্থা তাই। হযরত আবু বকর (রাঃ) বললেন, ওছমান। তোমার খালা তোমাকে নির্ভুল কথা বলেছেন। ইনি মোহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ, আল্লাহর রসূল। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে রেসালতে ভূষিত করে মানুষের মঙ্গলের জন্য প্রেরণ করেছেন। তুমি কি হুযুরের কাছে যেতে এবং তাঁর কালাম শুনতে চাও? আমি বললাম, অবশ্যই। অতঃপর আমি হুযূর (সাঃ)-এর খেদমতে হাযির হলাম। তিনি বললেনঃ ওছমান। আল্লাহ তায়ালা তোমাকে জান্নাতের দিকে ডাকেন। তুমি ইসলাম কবুল কর। আমি আল্লাহর রসূল। আল্লাহ তায়ালা আমাকে তোমার এবং আপন সৃষ্টির কাছে হেদায়াতের জন্যে প্রেরণ করেছেন। হযরত ওছমান (রাঃ) বলেনঃ আমি হুযুর (সাঃ)-এর কথা শুনে আবেগ আপ্লুত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করলাম। কিছুদিন অতিবাহিত হতেই আমি হযরত রোকাইয়াকে (রাঃ) বিয়ে করলাম। এরপর মানুষ বলাবলি করত, ওছমান ও রোকাইয়া চমৎকার দম্পতি।
হযরত ওমর (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণের সময়কার মোজেযা
ইবনে সা’দ, আবু ইয়ালা, হাকেম ও বায়হাকী হয়রত আনাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, ওমর ফারুক নাঙ্গা তরবারি হাতে নিয়ে বের হলেন। পথিমধ্যে বনী-যুহরার এক ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ হল। সে জিজ্ঞাসা করলঃ ওমর। কোথায় যাচ্ছ? ওমর বললেনঃ মোহাম্মদকে হত্যা করতে যাচ্ছি। লোকটি বললঃ এরপর-বনী হাশেম ও বনী-যুহরার হাত থেকে কিরূপে রক্ষা পাবে? ওমর বললেনঃ আমার মনে হয় তুইও নিজের ধর্ম ছেড়ে ছাবী হয়ে গিয়েছিস।লোকটি বললঃ তোমাকে একটি অদ্ভুত খবর শুনাচ্ছি। তোমার বোন ও ভগ্নিপতি উভয়েই ছাবী হয়ে গেছে। তারা তোমাদের ধর্ম পরিত্যাগ করেছে। এ কথা শুনে ওমর ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে ধাবমান হলেন। প্রথমে বোনের বাড়ীতে গেলেন। তখন তাদের কাছে হযরত খাব্বাব (রাঃ) ছিলেন। তিনি ওমর ফ্লারুকের পদধ্বনি শুনে আত্মগোপন করলেন। ওমর বোন ও ভগ্নিপতিকে জিজ্ঞাসা করলেনঃ তোমরা মৃদু স্বরে কি পাঠ করছিলে, যা আমার কানে এল। তারা তখন সূরা তোয়াহা পাঠ করছিলেন। তারা বললেনঃ আমরা পরস্পর কথাবার্তা বলছিলাম অন্য কিছু নয়। ওমর বললেনঃ সম্ভবতঃ তোমরা ছাবী হয়ে গেছ। ভগ্নিপতি বললঃ যদি হক কথা তোমাদের ধর্ম ছাড়া অন্য ধর্মে থাকে, তবে কি করব?এ কথা শুনে ওমর ভগ্নিপতির উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন এবং খুব প্রহার করলেন। তার ভগিনী স্বামীকে বাঁচানোর জন্যে এগিয়ে এলেন, ওমর তাকে একটি ঘুষি মারলেন, ফলে তার মুখমণ্ডল রক্তাক্ত হয়ে গেল। বোনের মুখে রক্ত দেখে ওমরের রাগ কিছুটা প্রশমিত হলো। তিনি বোনকে লক্ষ্য করে বললেনঃ আচ্ছা, তোমরা যে কিতাব পাঠ করছিলে, সেটি আমাকে দাও, আমি পাঠ করে দেখি। ভগিনী বললেনঃ তুমি অপবিত্র। কেবল পবিত্র মানুষই এতে হাত লাগাতে পারে। উঠে ওযু কর। ওমর দাঁড়িয়ে ওযু করলেন। এরপর লিখিত পাতাটি হাতে নিয়ে সূরা তোয়াহা পড়া শুরু করলেন। পড়তে পড়তে তিনি এই আয়াতে পৌঁছুলেন। إنِّي أَنَا اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدْنِي وَأَقِمِ الصَّلُوةَ لِذِكْرِي নিশ্চয় আমি আল্লাহ। কোন উপাস্য নেই আমাকে ছাড়া। অতএব, একমাত্র আমারই এবাদত কর এবং আমাকে স্মরণ করার জন্যে নামায কায়েম কর। আয়াতখানি পাঠ করে তিনি বললেনঃ আমাকে মোহাম্মদের কাছে নিয়ে চল। হযরত খাব্বাব (রাঃ) হযরত ওমর (রাঃ)-এর এ কথা শুনে গোপন জায়গা থেকে বের হয়ে এলেন এবং বললেনঃ সুসংবাদ হোক, আমি আশা করি নবী করীম (সাঃ)-এর সেই দোয়া তোমার মধ্যেই প্রতিফলিত হয়েছে, যা তিনি গত বৃহস্পতিবার রাত্রে করেছিলেন। তিনি দোয়ায় বলেছিলেন- হে আল্লাহ! ওমর ইবনে খাত্তাব কিংবা আমর ইবনে হেশামের মাধ্যমে তুমি ইসলামকে শক্তি দান কর। অতঃপর ওমর ফারুক রওয়ানা হলেন এবং নবী করীম (সাঃ)-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করলেন। ইমাম আহমদ ওমর ফারুক (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তিনি বলেনঃ আমি রসূলে করীম (সাঃ)-এর বিরোধিতায় অত্যন্ত কঠোর ছিলাম। একদিন তীব্র গরমের মধ্যে মক্কার এক রাস্তা দিয়ে চলছিলাম। জনৈক কোরায়শীর সাথে দেখা হলে সে বললঃ কোথায় যাচ্ছ? আমি বললামঃ উপাস্য দেবদেবীকে একটু সাহায্য করতে চাই। সে বললঃ ইবনে খাত্তাব। আশ্চর্যের বিষয় তুমি মনে কর যে, তুমি তোমার উপাস্যদের সাহায্য করছ; কিন্তু তোমার ঘরেই ইসলাম ঢুকে পড়েছে। আমি জিজ্ঞাসা করলামঃ কি বলছ? সে বললঃ তোমার ভগিনী মুসলমান হয়ে। গেছে।ওমর বর্ণনা করেনঃ এ সংবাদ পেয়ে আমি ভগিনীর বাড়ীতে যেয়ে দরজায় কবর নাড়লাম। তখন রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিয়ম ছিল নিঃস্ব লোকদের মধ্যে একজন
পৃষ্ঠা:৩৯
কিংবা দু’জন মুসলমান হয়ে গেলে তিনি তাদেরকে বিত্তবান মুসলমানদের সাথে শরীক করে দিতেন। কপর্দকহীনরা তাদের সাথে খাবারে অংশগ্রহণ করতো। আমার ভগ্নিপতির সাথেও হুযুর (সাঃ) দু’ ব্যক্তিকে শরীক করে দিয়েছিলেন। আমি যখন দরজায় কড়া নাড়লাম, তখন ভিতর থেকে জিজ্ঞাসা করা হলঃ কে? আমি বললামঃ ওমর। তারা দ্রুত আত্মগোপন করল। তারা তখন একটি ছহীফা (পুস্তকের অংশ বিশেষ) পাঠ করছিল, যা তাদের সামনে রাখা ছিল। দ্রুত আত্মগোপন করতে গিয়ে তারা ছহীফাটি নিয়ে যেতে ভুলে গেল। আমার ভগিনী দরজা খোলার জন্যে এগিয়ে এল। আমি তাকে রাগান্বিত স্বরে জিজ্ঞেস করলাম, তুই নাকি ছাবিয়া হয়ে গেছিস? আমার হাতে’ যা ছিল, আমি তা দিয়েই তার মাথায় আঘাত করলাম। মাখা ফেটে দরদর করে রক্ত প্রবাহিত হতে লাগল। রক্ত দেখে সে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল এবং বললঃ ইবনে খাত্তাব। তোমার মনে যা চায়, কর। আমি তো নতুন ধর্মে দাখিল হয়ে গেছি। অতঃপর আমি গৃহের অভ্যন্তরে গেলাম এবং পালংকে বসে পড়লাম। গৃহের মাঝখানে রাখা ছহিফার উপর আমার দৃষ্টি পড়ল। আমি ভগিনীকে বললামঃ এটা কি? আমাকে দে। সে বললঃ তুমি এর যোগ্য নও। পবিত্রতা অর্জন কর না। পবিত্র মানুষ ছাড়া এই ছহিফা কেউ স্পর্শ করতে পারে না। আমি ছহিফাটি নেয়ার জন্যে পীড়াপীড়ি করতে লাগলাম। অবশেষে সে আমাকে দিয়ে দিল। আমি খুলতেই দেখি তাতে বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম লেখা আছে। আল্লাহ তায়ালার মহান নাম সমূহের মধ্যে একটি মাত্র নাম পাঠ করার সাথে সাথেই যেন আমার অন্তর মধ্যে কম্পন শুরু হয়ে গেল। আমি ছহীফাটি পড়তে লাগলাম। আমি ছহিফাটি রেখে দিলাম। দেখি তাতে লেখা আছে- سبعَ اللَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ আকাশ ও পৃথিবীস্থিত সব কিছু আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করে। যখন আমি আল্লাহর মধ্যে থেকে অন্য আর একটি নামে পৌঁছুলাম, তখন আবার ভীত হয়ে পড়লাম। অতঃপর আমি নিজেকে সামলে নিলাম এবং ছহিফা পাঠ করলাম। অবশেষে en أمَنُوا بِاللَّهِ وَرَسُوالِيمٍ )তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি ঈমান আন) পর্যন্ত পড়লাম, তখন বলে উঠলাম- আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মোহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহু। যারা গৃহমধ্যে আত্মগোপন করেছিল, তারা দৌড়ে আমার কাছে এল এবং তকবীর ফানি দিল। অতঃপর তারা বললঃ ইবনে খাত্তাব। সুসংবাদ হোক, হুযুর (সাঃ) সোমবারে এই দোয়া করেছিলেন:اللهُمَّ أَعِيدُ الْإِسْلَامَ بِعُمَرَ بْنِ الْخَطَابِ أَوْ بِعَشْرِو بْنِ هِشَامٍ হে আল্লাহা ওমর ইবনে খাত্তাব অথবা আমর ইবনে হেশাম দ্বারা ইসলামকে শক্তি দান কর। আমরা আশা করি হুযুর (সাঃ)-এর এই দোয়া তোমার জন্যই কবুল হয়ে গেছে। ইমাম আহমদ হযরত ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন- ইসলাম গ্রহণের পূর্বে আমি রসূলে করীম (সাঃ)-এর পিছনে লেগে থাকতাম। তিনি আমার আগে মসজিদে চলে গেলেন। আমি পিছনে যেয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। তিনি সূরা “আল হাক্কা” পড়তে শুরু করলেন। আমি কোরআনের শাব্দিক গাঁথুনি শুনে অবাক হলাম এবং কোরায়শদের মত মনে মনে বললামঃ খোদার কসম, তিনি কবি। তিনি এই আয়াত পাঠ করলেন।إِنَّهُ لَقَوْلُ رَسُولِ كَرِيم وَمَا هُوَ لِقَوْلِ شَاعِرٍ قَلِيلًا مَّا تُؤْمِنُونَ . নিশ্চয় এই কোরআন একজন সম্মানিত রসূলের মাধ্যমে প্রেরিত বাণী। এটা কবির উক্তি নয়। তোমরা অল্পই বিশ্বাস কর। আমি বললামঃ তিনি একজন অতীন্দ্রিয়বাদী। এ সময় তিনি এই আয়াত পাঠ করলেনঃولا لِقَوْلِ كَاهِينِ قَلِيلًا مَّا تَذَكَّرُونَ এটা কোন অতীন্দ্রিয়বাদীর কথাও নয়। তোমরা অল্পই অনুধাবন কর। এরপর আমার অন্তরের প্রতিটি কোণে ঈমান প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। ইবনে আবী শায়বা জাবের ইবনে আবদুল্লাহ থেকে এবং তিনি ওমর ফারুক (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন- রাতের বেলায় আমার ভগিনীর প্রসব বেদনা শুরু হলে আমি গৃহ থেকে বের হলাম এবং কা’বা গৃহে এলাম। হুযুর (সাঃ) আগমন করলেন এবং নামায পড়লেন। আমি এমন কিছু শুনলাম, যা পূর্বে শুনিনি। এরপর তিনি ফিরে যেতে লাগলেন। আমি তাঁর পিছনে পিছনে চলমান। তিনি আমাকে বললেনঃ ওমর, তুমি দিনরাত সবসময় আমার পিছনে লেগে থাক। ব্যাপার কি?আমি ভীত হয়ে পড়লাম। তিনি আমার জন্যে বদদোয়া না করেন। আমি তাড়াতাড়ি বললামঃ আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আদ্রা কা রসূলুল্লাহ। আবু নয়ীম হযরত ওমর ফারুক (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন- আমি আবু জহল ও শায়বা ইবনে রবীয়ার কাছে বসা ছিলাম। আবু জহল বললঃ হে কোরায়শ সম্প্রদায়। মোহাম্মদ তোমাদের প্রতিমাদেরকে মন্দ বলে এবং তোমাদেরকে নির্বোধ সাব্যস্ত করে। তাঁর ধারণা তোমাদের বাপদাদাদের মধ্যে যারা মারা গেছে, তারা দোযখে যাবে। শুনে রাখ, তোমাদের মধ্যে যে কেউ মোহাম্মদকে হত্যা করবে, তার জন্যে আমার নিকট রয়েছে কাল ও। লাল রঙের একশ’ উন্ত্রী এবং এক এবং এক হাজার
পৃষ্ঠা:৪০
ওকিয়া রৌপ্য। ওমর ফারুক বলেনঃ আমি তরবারি হাতে নিয়ে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে হত্যা করার উদ্দেশ্যে বের হলাম। পথিমধ্যে দেখলাম, কিছু লোক একটি বাচ্চুর যবেহ করছে। আমি সেখানে দাঁড়িয়ে তাদেরকে দেখতে লাগলাম। হঠাৎ শুনলাম এই বাছুরের ভিতর। থেকে কেউ বলছে-يال ذريع امرر ميح رجل يصيح بلسان فصيح يدعوا ليالشهادة أن لا إله إلا الله وأن محمدا رسول الله ওমর (রাঃ) বলেনঃ আমি এই আওয়াজ শুনে মনে করলাম, সে আমাকে শুনাতে চাচ্ছে। এরপর আমি এক ছাগলের কাছ দিয়ে গেলাম। শুনি কি, কেউ বলছে-“হে শরীরীগণ! তোমাদের মধ্যে ও নির্বোধদের মধ্যে কোন তফাৎ নেই। ভোমরা প্রতিমাদেরকে আদেশ দাতা বল। তোমরা সকলেই উটপাখীর মত নির্বোধ।””আমি আমার সম্মুখে যা দেখি, তোমরা তা দেখ না। সেটি হচ্ছে একটি সমুন্নত নূর, যা অন্ধকার দূর করে দেয়।””নূরটি দর্শকদের জন্যে তেহামা থেকে প্রকাশ পেয়েছে। সেই ইমাম কি মহান। আল্লাহর দরবারে তাঁর জন্যে পুণ্য আছে।”সেই ইমাম কুফরের পর ইসলাম, সৎকর্ম ও আত্মীয়তার মিলন এনেছেন।ওমর ফারুক (রাঃ) বর্ণনা করেন- আমি এটাই বুঝলাম যে, আমাকে শুনাতে চায়। এরপর আমি যেমার প্রতিমার কাছ দিয়ে গেলাম। হঠাৎ শুনলাম তার পেট থেকে কেউ বলছে “যেমার প্রতিমা পরিত্যক্ত হয়েছে; অথচ একদা তারই পূজা করা হত, সেই ছালাতের পর, যা নবীর সঙ্গে এসেছে।””ঈসা ইবনে মরিয়মের পর যে নবুওয়ত ও হেদায়েতের উত্তরাধিকারী হয়েছে, সে কোরায়শদের একজন। সে হেদায়াতপ্রাপ্ত যারা যেমার এবং তার মত প্রতিমার পূজা করত, তারা সত্ত্বরই বলবে, হায়। যেমার এবং তার মত প্রতিমার পূজা করা হত।”তড়িঘড়ি করো না। নিশ্চয়ই তুমি মুখে ও হাতে এই নবীর সাহায্য করবে।” ওমর (রাঃ) বলেনঃ আল্লাহর কসম, আমি এটাই বুঝলাম যে, কোন নেপথ্যচারীর ইচ্ছা কথাগুলো আমাকে শুনানো। অতঃপর আমি আমার ভগিনীর কাছে এলাম। দেখি কি, তার স্বামী এবং হযরত খাব্বাব (রাঃ) তার কাছে রয়েছে। হযরত খাব্বাব আমাকে বললেনঃ ওমর। মুসলমান হয়ে যাও। তোমার মঙ্গল হবে। আমি পানি চাইলাম এবং ওযু করলাম। অতঃপর সেখান থেকে হুযুর (সাঃ)-এর খেদমতে হাযির হলাম। তিনি আমাকে বললেনঃ তোমার পক্ষে আমার দোয়া কবুল হয়েছে। তুমি মুসলমান হয়ে যাও। সে মতে আমি মুসলমান হয়ে গেলাম। ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে আমি হলাম চল্লিশতম ব্যক্তি। সেই সময় এই আয়াত অবতীর্ণ হয়ঃيا أَيُّهَا النَّبِيُّ حَسْبُكَ اللَّهُ وَمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ হে নবী। আল্লাহ এবং আপনার মুমিন অনুসারীরা আপনার জন্যে যথেষ্ট। ইবনে ওমর (রাঃ) বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ (সাঃ) এ দোয়া করেছিলেনঃاللهُمَّ أَعِيرَ الْإِسْلَامَ بِعُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ أَوْ عَمْرِو بْنِ هِشَامٍহে আল্লাহ! ওমর ইবনে খাত্তাব অথবা আমর ইবনে হেশামের মাধ্যমে ইসলামকে শক্তিশালী কর।ইবনে সা’দ, আহমদ, ইবনে হাব্বান, বায়হাকী ও তিরমিধী এই হাদীসকে ছহীহ বলেছেন। বায়হাকী-এর মত খোদ হযরত ওমর ও হযরত আনাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত উদ্ধৃত করেছেন। ইবনে মাজাহ ও হাকেম হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, হুযূর (সাঃ) দোয়ায় আমর ইবনে হেশামের জায়গায় আবু জহল ইবনে হেশাম বলেছিলেন। তিবরানী ও হাকেম ইবনে মসউদ থেকেও এরূপ রেওয়ায়েত করেছেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবীর দোয়া হযরত ওমর (রাঃ)-এর পক্ষে কবুল করেন এবং তাঁর মাধ্যমে ইসলামের বিপুল খেদমত হয়।- ইবনে সা’দ ও হাকেম ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, যখন ওমর ফারুক ইসলাম গ্রহণ করলেন, তখন থেকে আমরা শক্তিশালী হয়ে গেলাম। ওমরের ইসলাম গ্রহণের আগ পর্যন্ত আমরা বায়তুল্লাহর নিকট প্রকাশ্যে নামায পড়তে পারতাম না। হাকেম হুযায়ফা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, ওমর ফারুকের আমলে ইসলামের অবস্থা ছিল যেমন কোন ব্যক্তি সামনে থেকে আসতে থাকে এবং ক্রমশঃ নিকটবর্তী হতে থাকে। তাঁর শাহাদতের পর অবস্থা এই দাঁড়ায়, যেমন কোন ব্যক্তি পিছন থেকে সরে যেতে থাকে এবং ক্রমশঃ দূরত্ব বাড়তে থাকে।
পৃষ্ঠা:৪১
ইবনে সা’দ ওছমান ইবনে আরকাম (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, হুযূর (সাঃ) এই দোয়া করেন-اللَّهُمَّ أَعِرُ الْإِسْلَامَ بِأَحَبِّ الرَّجُلَيْنِ إِلَيْكَ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ او عمرو بن هشام হে আল্লাহ। ওমর ইবনে খাত্তাব ও আমর ইবনে হেশামের মধ্যে যে তোমার অধিক প্রিয়, তার মাধ্যমে ইসলামকে শক্তিশালী কর। পরবর্তী সকালে ওমর ফারুক আসেন এবং মুসলমান হয়ে যান। ইবনে সা’দ হয়রত সোহায়েব ইবনে সিনান থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, ওমর ফারুকের ইসলাম গ্রহণের ফলে ইসলাম শক্তিশালী হয়ে যায়। প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দেয়া হত। আমরা রায়তুল্লাহর আশেপাশে বৃত্তাকারে বসতাম এবং তওয়াফ করতাম। কেউ আমাদের উপর নির্যাতন চালালে আমরা তার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য দাঁড়িয়ে যেতাম। ইবনে সা’দ যায়ীদ ইবনে মুসাইয়ির থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, হযরত ওমর (রাঃ) চল্লিশ জন পুরুষ ও দশজন নারীর পর মুসলমান হন। তাঁর মুসলমান হওয়ার সাথে সাথে ইসলাম মক্কায় প্রকাশ্য রূপ পরিগ্রহ করে। হাকেম ও ইবনে মাজাহ হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, হযরত ওমর (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করলে জিবরাইল (আঃ) আগমন করেন এবং বলেনঃ হে আল্লাহর রসূল। ওমর ফারুকের ইসলাম গ্রহণের কারণে আকাশের অধিবাসীরা আনন্দ করছে।
হযরত যেমাদের ইসলাম গ্রহণের দৃশ্য
ইমাম মুসলিম, আহমদ ও বায়হাকী ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেছেন যে, ইযদে-শানওয়া গোত্রের যেমাদ নামক একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি মক্কায় আসেন। তিনি পাগলামী, ভূতপ্রেত ইত্যাদি উপসর্গের ঝাড়ফুঁক করতেন। তিনি কাফেরদের কাছ থেকে শুনলেন যে, মোহাম্মদ (সাঃ) পাগল। যেমাদ মনে মনে বললেনঃ আমি তার চিকিৎসা করব। সম্ভবতঃ আল্লাহ আমার হাতে তাঁকে আরোগ্য দান করবেন। যেমাদ বর্ণনা করেন, আমি হুযুর (সাঃ)-এর খেদমতে হাযির হয়ে আরয করলামঃ আমি জিনদের কাছ থেকে পাগলদের জন্যে ঝাড়ফুঁক করি। আল্লাহ যাকে চান, আমার হাতে আরোগ্য দেন। নবী করীম (সাঃ) এ কথা শুনে নিম্নোক্ত কলেমা পাঠ করলেনঃ الْحَمْدُ لِللَّهِ نَحْمَدُهُ وَنَسْتَعِينُهُ وَتُؤْمِنُ بِهِ وَنَتَوَكَّلُ عَلَيْهِ وَنَعُودُ بِاللَّهِ مِنْ شُرُورِ أَنْفُسِنَا وَمِنْ سَيِّئَاتِ أَعْمَالِنَا مَنْ يَهْدِهِ اللَّهُ فَلَا مُضِلَّ لَهُ وَمَنْ يُضْلِلْهُ فَلَا هَادِيَ لَهُ وَأَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ وَأَشْهَدَانَ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ যেমাদ বললেনঃ এই কলেমাগুলো আবার পড়ুন। হুযুর (সাঃ) পুনরায় পাঠ করলেন। যেমাদ বললেনঃ আল্লাহর কসম, আমি অতীন্দ্রিয়বাদীদের কালাম, যাদুকরদের কথা এবং কবিদের কবিতা শুনেছি। কিন্তু এই কলেমার মত কলেমা কখনও শুনিনি। এই কলেমাগুলো তো অলংকার-সমুদ্রের অতল গভীরে পৌঁছে গেছে। আপনি হাত বাড়ান, আমি ইসলামে দীক্ষিত হব। অতঃপর তিনি হুযুর (সাঃ)-এর হাতে বয়াত করলেন।
আমর ইবনে আবদুল কায়সের ইসলাম গ্রহণ
ইবনে শাহীন কয়েকটি মাধ্যমে এবং মযীদা ইবনে মালেক আবদুল কায়েম গোত্রের এক দল লোক থেকে বর্ণনা করেছেন যে, আবদুল কায়েস গোত্রের আশাজ নামক এক ব্যক্তির এক সন্ন্যাসী বন্ধু ছিল। সে দারাইনে বসবাস করত। এক বছর আশাজ সন্ন্যাসীর সাথে মোলাকাত করলে সন্ন্যাসী তাকে বললঃ একজন নবী মক্কায় আত্মপ্রকাশ করবেন। তিনি হাদিয়া খাবেন এবং ছদকা খাবেন না। তাঁর স্কন্ধ দেশের মাখঝানে একটি আলামত থাকবে। তাঁর ধর্ম সকল ধর্মের উপর জয়ী হবে। এরপর সন্ন্যাসী মারা গেল। আশাজ তার ভাগ্নেয় আমর ইবনে আবদুল কায়েসকে এসব কথা বলল। ভাগ্নে হিজরতের বছর মক্কায় এসে মামার বর্ণিত চিহ্নসমূহ সঠিক পেয়ে মুসলমান হয়ে গেল। নবী করীম (সাঃ) তাকে সূরা ফাতেহা ও সূরা ইকরা শিক্ষা দিলেন এবং বললেনঃ তোমার মামাকে ইসলামের দাওয়াত দিও। সে মতে তিনি ফিরে এসে আশাজকে ইসলামের দাওয়াত দিলে সে-ও মুসলমান হয়ে গেল। সে দীর্ঘকাল পর্যন্ত নিজের ইসলামকে গোপন রাখল। অতঃপর ঘোল ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে মদীনায় পৌঁছল। যে রাতের সকালে তারা মদীনায় পৌঁছুল, সেই রাতেই রসূলুল্লাহ (সাঃ) গৃহের বাইরে এসে বললেনঃ পূর্ব দিক থেকে একটি কাফেলা আসবে। তারা ইসলামকে অপছন্দ করবে না। কাফেলার নেতার একটি বিশেষ নিদর্শন থাকবে। যথাসময়ই তারা এল। তাদের এই আগমন মক্কা বিজয়ের মাসে হয়েছিল।
পৃষ্ঠা:৪২
তোফায়ল ইবনে আমর দওসীর ইসলাম গ্রহণ
ইমাম বোখারী হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তোফায়ল ইবনে আমর দওসী রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর খেদমতে হাযির হয়ে আরয করলেনঃ ইয়া রসূলাল্লাহ! দওস গোত্র নাফরমানী করেছে। তারা ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে। আপনি তাদের জন্যে বদদোয়া করুন। হুযুর (সাঃ) কেবলামুখী হয়ে দোয়ার জন্যে হাত তুললেন এবং বললেনঃ পরওয়ারদেগার। দওসী গোত্রের লোকদেরকে হেদায়াত কর এবং এখানে পাঠিয়ে দাও।বায়হাকী ইবনে ইসহাক থেকে রেওয়ায়েত করেছেন, তোফায়ল ইবনে আমর দওসী বর্ণনা করেন যে, হুযুর (সাঃ)-এর মক্কায় অবস্থানকালে তিনি মক্কায় আসেন। কোরায়শরা তোফায়লের কাছে গেল। তিনি ভদ্র ও জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন। কোরায়শরা তাঁকে বললঃ তুমি আমাদের শহরে এসেছ। খুব ভাল কথা। কিন্তু এক ব্যক্তি থেকে সাবধান থাকবে। সে আমাদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করেছে এবং আমাদের ধর্মীয় ব্যাপারে বিশৃঙ্খলার বীজ বপন করেছে। তার কথাবার্তা যাদুর মত মুগ্ধ করে। সে পিতাপুত্র, স্বামী-স্ত্রী ও পুত্র-কন্যার মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে। আমরা যে বিপদে পতিত হয়েছি, তোমাদের ও তোমাদের কওমের মধ্যেও সেই বিপদের আশংকা করছি। তাই তুমি তার সাথে কথাবার্তা বলবে না এবং তার কোন কথা শুনবে না। তোফায়ল বলেনঃ কোরায়শরা এ বিষয়ের উপর খুব জোর দিতে থাকে এবং তাকীদ করতে থাকে। অবশেষে আমি সংকল্প করলাম যে, হুযুর (সাঃ)-এর কাছ থেকে কিছু শুনবও না এবং কোন কথাও বলব না। এমনকি মসজিদে যাওয়ার সময় আমি আমার কানে কাপড় ঢুকিয়ে নিতাম, যাতে তাঁর কোন কথা আমার কানে না পড়ে। আমি মসজিদে পৌঁছে দেখি কি, হুযুর (সাঃ) কাবাগৃহের নিকটে দাঁড়িয়ে নামায পড়ছেন। আমি তাঁর নিকটে যেয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। আল্লাহর অভিপ্রায় এটাই হল যে, আমি তাঁর কিছু কথা শুনি। শেষ পর্যন্ত পবিত্র কোরআনের অনুপম কালাম শুনলাম। আমি মনে মনে বললামঃ আমি বুদ্ধিমান ও কবি। এই ব্যক্তি যা বলেন, তা শুনা উচিত। যে কোন কথার ভাল-মন্দ ওজন করার ক্ষমতা আমার আছে। সুতরাং যদি তা গ্রহণযোগ্য কথা হয়, তবে তা মেনে নিব। আর অসুন্দর কথা হলে বর্জন করব; সুতরাং আমি সেখানেই রয়ে গেলাম। যখন হুযুর (সাঃ) গৃহাভিমুখে রওয়ানা হলেন, তখন আমি তাঁর পিছনে পিছনে চললাম। আমি তাঁকে বললামঃ আপনার কওম আমাকে এমন এমন বলেছে। আপনি নিজের ব্যাপারটি আমার সামনে বর্ণনা করুন। অতঃপর তিনি আমাকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন এবং আমর সামনে কোরআন তেলাওয়াত করলেন। আল্লাহর কসম, আমি কোরআন পাকের চেয়ে উৎকৃষ্ট কোন কালাম কখনও শুনিনি এবং ইসলামের চেয়ে অধিক ন্যায়ভিত্তিক ধর্ম পাইনি। আমি মুসলমান হয়ে গেলাম। আমি আরয করলামঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আমার কন্ডমের নেতা। সকলেই আমার কথা মানে। আমি কওমের কাছে ফিরে যাবো। তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিব। আপনি আল্লাহর কাছে দোয়া করুন, তিনি যেন আমার জন্যে এমন কোন নিদর্শন প্রকাশ করেন, যা কওমের মোকাবিলায় আমার সহায়ক হয়। সে মতে হুযুর (সাঃ) আমার জন্যে দোয়া করলেনঃএকটি নিদর্শন সৃষ্টি করে দাও। তোফায়ল বর্ণনা করেন- আমি আমার কওমের কাছে ফিরে এলাম। যখন কুসা নামক স্থানে পৌঁছুলাম, তখন আমর চক্ষুদ্বয়ের মাঝখান থেকে প্রদীপের ন্যায় একটি আলোক প্রকাশ পেল। আমি আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করলামঃ পরওয়ারদেগার। এই আলো আমার মুখমণ্ডল ছাড়া অন্যস্থানে স্থাপন কর। আমার আশংকা হয় যে, মানুষ আমাকে মুখ বিকৃতির অপবাদ দিবে। সে মতে আলোর প্রদীপটি আমার মুখমণ্ডল থেকে স্থানান্তরিত হয়ে আমার চাবুকের আগায় ঝুলন্ত মশালের মত হয়ে গেল। অতঃপর আমি কওমকে ইসলামের দাওয়াত দিলাম। তারা ইসলাম গ্রহণে বিলম্ব করল। আমি রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্লেদমতে হাযির হয়ে আরয করলামঃ দওস গোত্র আমার বিরুদ্ধে প্রবল হয়ে গেছে। আপনি তাদের জন্যে বদদোয়া করুন। তিনি বললেন:اللهم اهد دو হে আল্লাহ! দওসকে হেদায়াত কর। এরপর আমাকে বললেনঃ তুমি কওমের কাছে চলে যাও। নম্রতা সহকারে তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দাও। আমি ফিরে গেলাম। দওসের ভূখণ্ডে অবস্থান করে তাদেরকে দাওয়াত দিলাম। অবশেষে হুযুর (সাঃ) মদীনায় হিজরত করলেন। দওস গোত্রের মধ্যে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল, তাদের সত্তর কিংবা আশিটি পরিবার নিয়ে আমি খয়বরে পৌঁছুলাম। • আবুল ফরজ মাগালীতে লিখেনঃ আমার চাচা আমার কাছে হাযীল ইবনে আমরের মাধ্যমে আমর থেকে রেওয়ায়েত করেছেন এবং আবুল ফরজ অন্য সনদে মোহাম্মদ ইবনে হাসান থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বললেনঃ আমার চাচা আব্বাস ইবনে হেশামের মাধ্যমে হেশাম থেকে রেওয়ায়েত করেছেন যে, তোফায়েল ইবনে আমর দওসী মক্কায় পৌঁছালেন। কোরায়শরা তোফায়লকে নবী করীম (সাঃ)-এর কাছে পাঠাল এবং বললঃ এই ব্যক্তি ও তার আনীত বিষয়বস্তু এবং আমাদের মধ্যকার পরিস্থিতি সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা কর। তোফায়ল হুযূর (সাঃ)-এর কাছে এলেন। হুযুর (সাঃ) তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলে তিনি বললেনঃ আমি একজন কবি, আমি যা বলি আপনি তা শুনুন। হুযুর (সাঃ)
পৃষ্ঠা:৪৩
বললেনঃ আচ্ছা, পড়। তোফায়ল কয়েক লাইন কবিতা পড়লেন। হুযুর (সাঃ) বললেনঃ আমিও পাঠ করি, তুমি শুন। অতঃপর তিনি আউযুবিল্লাহ ও বিসমিল্লাহ পাঠ করে সূরা এখলাছ ও সূরা ফালাক তেলাওয়াত করলেন এবং তোফায়লকে পুনরায় ইসলামের দাওয়াত দিলেন। তোফায়ল কালবিলম্ব না করে মুসলমান হয়ে গেলেন এবং কওমের কাছে ফিরে গেলেন। তিনি যখন কওমের কাছে পৌঁছলেন, তখুন অন্ধকার রাত ছিল এবং বৃষ্টি পড়ছিল। পথের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না। হঠাৎ তাঁর চাবুক থেকে একটি আলোকরশ্মি নির্গত হল। এরপর কওমের কাছে পৌঁছলে তারা তাঁকে জড়িয়ে ধরল এবং চাবুক স্পর্শ করতে লাগল। আলোকরশ্মি তাদের অঙ্গুলির ফাঁক দিয়ে ছিটকে পড়ছিল। তোফারল আপন পিতামাতাকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। তাঁর পিতা মুসলমান হয়ে গেলেন। এরপর স্বজাতিকে দাওয়াত দিলেন। কিন্তু হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) ছাড়া অন্য কেউ ইসলাম কবুল করল না। বর্ণনা করেন যে, হযরত তোফায়লকে যিনুর (নূর-ওয়ালা) বলা হত। কারণ, তিনি যখন হুযুর (সাঃ)-এর খেদমতে আসেন, তখন বললেনঃ আমাকে আমার কওমের কাছে প্রেরণ করুন এবং কোন নিদর্শন দান করুন। হুযুর (সাঃ) দোয়া করলেন। ফলে তোফায়লের চক্ষুদ্বয়ের মাঝখান থেকে একটি নূর নির্গত হয়। তোফায়ল আরয করলেনঃ আমর আশংকা হয় যে, কওম আমাকে মুখ বিকৃতির অপবাদ দিবে। সে মতে সেই নূর তোফায়লের চাবুকে স্থানান্তরিত হয়ে গেল। এটা অন্ধকার রাতে প্রজ্বলিত হত। কিতাবুদ্দাগানীতে আবুল ফরজ আবু কলবী থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তোফায়ল মক্কায় এলে কোরায়শরা তাঁর সাথে হুযুর (সাঃ)-এর বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। তোফায়ল হুযুর (সাঃ)-এর কাছে আসেন এবং কিছু কবিতা শুনান। হুযুর (সাঃ) তাকে সূরা এখলাছ, ফালাক ও নাস তেলাওয়াত করে শুনান। শুনামাত্রই তোফায়ল মুসলমান হয়ে গেলেন। রাবী তাঁর চাবুকের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি পিতামাতাকে ইসলামের দাওয়াত দেন। পিতা মুসলমান হয়ে যান তবে মাতা ইসলাম কবুল করেনি। এরপর কওমকে ইসলামের দাওয়াত দেন। কওমও দাওয়াত অমান্য করল। তোফায়ল হুযুর (সাঃ)-এর কাছে এলেন এবং তাঁকে বিষয়টি অবগত করলেন। তিনি যখন হেদায়েতের দোয়া করলেন, তখন তোফায়ল বললেনঃ আমি এরূপ দোয়া পছন্দ করতাম না। হুযুর (সাঃ) বললেনঃ তোমার মত লোক তাদের মধ্যে অনেক আছে।হযরত ওছমান ইবনে মযউনের ইসলাম গ্রহণ ইমাম আহমদ ও ইবনে সা’দ হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, হুযুর (সাঃ) মক্কায় আপন গৃহ প্রাঙ্গণে উপবিষ্ট ছিলেন, এমন সময় ওছমান ইবনে মযউন তাঁর কাছ দিয়ে গমন করলেন এবং হুযুর (সাঃ)-কে দেখে মুচকি হাসলেন। হুযুর (সাঃ) বললেনঃ বসবে না? তিনি বললেনঃ আচ্ছা বসি। এরপর ওছমান বসলেন। তাঁর সাথে কথা বলার সময় হুযুর (সাঃ) একবার দৃষ্টি আকাশের দিকে উত্তোলন করলেন এবং কিছুক্ষণ পর্যন্ত দেখতে থাকলেন। এরপর দৃষ্টি নিচের দিকে আনতে শুরু করেন এবং শেষ পর্যন্ত মাটিতে নিজের ডান দিকে নিবন্ধ করলেন। তিনি ওছমানের দিক থেকে ঘুরে ডান দিকে হয়ে গেলেন। তিনি তখন মাথা নাড়ছিলেন, যেন কেউ তাঁকে কিছু বলছে এবং তিনি তা বুঝছেন। ওছমান এই দৃশ্য দেখছিলেন। যখন রসূলুল্লাহ (সাঃ) কথাবার্তা শেষ করলেন, তখন আবার পূর্ববৎ আকাশের দিকে দৃষ্টি উত্তেলন করলেন। তাঁর দৃষ্টি সেই ফেরেশতার দিকে ছিল। ফেরেশতা দৃষ্টির অন্তরালে চলে গেলে তিনি ওছমানের দিকে মুখ করে বসে গেলেন। ওছমান বললেনঃ এই মাত্র আপনি যে কাজ করলেন, আমি কখনও আপনাকে এরূপ কাজ করতে দেখিনি। হুযুর (সাঃ) জিজ্ঞাসা করলেনঃ তুমি আমাকে কি কাজ করতে দেখেছ? ওছমান তা. বললে হুযুর (সাঃ) বললেনঃ তুমি বুঝে গেছ? ওছমান বললেনঃ জী হাঁ, বুঝেছি। হুযুর (সাঃ) বললেনঃ আমার কাছে এই মাত্র জিবরাঈল (আঃ) এসেছিলেন। ওছমান জিজ্ঞাসা করলেনঃ জিবরাঈল কি বললেন? হুযূর জওয়াব দিলেনঃ জিবরাঈল বলেছেনঃإِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ وَابْتَاءِ ذِي الْقُرْبَى وَيَنْهَىتذكرون عَنِ নিশ্চয় আল্লাহ আদেশ দেন ন্যায় বিচার, অনুগ্রহ ও আত্মীয়দের প্রতি সৌজন্যমূলক আচরণ করার এবং নিষেধ করেন অশ্লীল, অনাচার ও বিদ্রোহ করতে। তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন, যাতে তোমরা স্মরণ কর। ওছমান বর্ণনা করেন, সে সময়েই ইসলাম আমার অন্তরে আসন গ্রহণ করে এবং আমি মোহাম্মদ (সাঃ)-কে ভালবাসতে থাকি।
জিনদের ইসলাম গ্রহণ
وانصرفنا إليك الآية আপনার কাছে কিছুসংখ্যক জিনকে প্রেরণ করলাম, যাতে তারা কোরআন শুনে।অন্যত্র আল্লাহ বলেনঃ
পৃষ্ঠা:৪৪
قُلْ أُوحِيَ إِلَى أَنَّهُ اسْتَمَعَ نَفَرٌ مِّنَ الْجِنِّ فَقَالُوا إِنَّا سَمِعْنَا قُرْآنًا عَجَبًا يَهْدِي إِلَى الرُّشْدِ فَأَمَنَّا بِهِ وَلَنْ تُشْرِكَ بِرَبِّنَا أَحَدًا বলুন, ওহীর মাধ্যমে আমি অবগত হয়েছি যে, জিনদের একটি দল কোরআন পাঠ শ্রবণ করেছে। অতঃপর তাদের সম্প্রদায়ের কাছে বলেছে, আমরা এক বিস্ময়কর কোরআন শ্রবণ করেছি, যা সঠিক পথ নির্দেশ করে। ফলে আমরা তাতে ঈমান এনেছি। আমরা কখনও আমাদের প্রতিপালকের সাথে কাউকে শরীক করব না। (সূরা জিন)ইমাম বোখারী ও মুসলিম হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেছেন যে, নবী করীম (সাঃ) সাহাবীগণকে সঙ্গে নিয়ে ওকাষের বাজারে গেলেন। তখনকার দিনে শয়তানদের আকাশে যাওয়া এবং সেখান থেকে খবরাদি সংগ্রহ করে আনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাদের উপর অগ্নিপিও নিক্ষেপ করা হত। শয়তানরা তাদের দলের মানুষদের কাছে গেল। তারা বললঃ ব্যাপার কি, এখন আকাশ থেকে খবরাদি আন না কেন? শয়তানরা বললঃ আমাদের আকাশে যাওয়া বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আমাদের উপর অগ্নিপিও নিক্ষিপ্ত হতে শুরু করেছে। মানুষরা বললঃ এর কারণ অবশ্যই কোন নতুন ঘটনা হবে। অতএব পৃথিবীর পূর্ব-পশ্চিমে ঘুরে ঘুরে দেখ কি কারণে তোমাদের আকাশে যাওয়া বন্ধ করে দেয়া হল। জিনেরা পৃথিবীর পূর্ব-পশ্চিমে অনুসন্ধান শুরু করল। যে দলটি মক্কার দিকে প্রেরিত হয়েছিল, সেটি হুযুর (সাঃ)-এর কাছ দিয়ে গমন করল। তিনি তখন নখলা নামক স্থানে সাহাবীগণকে, সঙ্গে নিয়ে ফজরের নামায পড়ছিলেন। তারা যখন কোরআন পাঠের আওয়াজ শুনল, তখন গভীর মনোযোগ সহকারে শুনতে লাগল। অতঃপর তাঁরা বললঃ আকাশের খবর আনা নিষিদ্ধ হওয়ার এটাই কারণ। হে আমাদের সম্প্রদায়। আমরা এক বিস্ময়কর কোরআন শ্রবণ করেছি, যা সঠিক পথ নির্দেশ করে। আমরা তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আমরা আল্লাহর সাথে কখনও কাউকে শরীক করব না।বোখারী ও মুসলিম মসরুক (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তিনি বলেনঃ আমি ইবনে মসউদ (রাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করলামঃ সে রাতে জিনরা কোরআন শ্রবণ করে, রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে তাদের সংবাদ কে দিল? হযরত ইবনে মসউদ (রাঃ) জবাব দিলেনঃ একটি বৃক্ষ এ সংবাদ দিয়েছিল।মুসলিম, আহমদ, তিরমিযীর রেওয়ায়েতে হযরত আলকামা বলেনঃ আমি ইবনে মসউদ (রাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করলামঃ জিন-রজনীতে আপনাদের মধ্যে থেকে কেউ কি রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সঙ্গে ছিলেন? তিনি জওয়াব দিলেনঃ আমাদের মধ্য থেকে কেউ তাঁর সাথে ছিল না। কিন্তু মক্কায় এক রাতে আমরা হুযূর (সাঃ)-কে কোথাও খুঁজে পেলাম না। আমরা বললামঃ নাউযুবিল্লাহ, কেউ কি তাঁকে প্রতারণা করে হত্যা করেছে, না কেউ তাঁকে কোথাও আটক করেছে। আমরা সকলেই ভীষণ উদ্বেগের রাত্রি অতিবাহিত করলাম। যখন সকাল হল, তখন দেখি কি, হুযুর (সাঃ) হেরা গুহার দিক থেকে চলে আসছেন। আমরা আমাদের উদ্বেগের কথা তাঁকে জানালাম। তিনি বললেনঃ আমার কাছে জিনদের পক্ষ থেকে এক আহবানকারী এসেছিল। তাই আমি তাদের কাছে চলে গিয়েছিলাম। আমি তাদের সামনে কোরআন তেলাওয়াত করেছি। এরপর হুযুর (সাঃ) আমাদিগকে সেদিকে নিয়ে গেলেন এবং জিনদের অগ্নি প্রজ্জ্বলনের চিহ্ন দেখালেন। আবু ওছমান খুযায়ীর রেওয়ায়েতে ইবনে মসউদ (রাঃ) বলেনঃ নবী করীম (সাঃ) মক্কায় অবস্থানকালে এক রাতে সাহাবায়ে-কেরামকে বললেনঃ তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি আজ রাতে জিনদের সাথে আলোচনায় উপস্থিত থাকতে চায়, সে যেন হাযির থাকেন। শেষ পর্যন্ত আমাকে ছাড়া আর কেউ হাযির রইল না। আমরা চললাম। মক্কার উপরিভাগে পৌঁছে নবী করীম (সাঃ) পা দিয়ে একটি রেখা টানলেন এবং আমাকে তার ভিতরে বসে থাকার আদেশ দিলেন। তিনি সম্মুখে অগ্রসর হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং কোরআন তেলাওয়াত শুরু করলেন। তাঁকে অনেক জিন এসে ঘিরে নিল। অবশেষে তারা আমার ও তাঁর মধ্যে অন্তরাল হয়ে গেল। আমি তাঁর কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছিলাম না। এরপর জিনরা চলে গেল এবং মেঘখণ্ডের মত আলাদা আলাদা হয়ে যেতে লাগল। অবশেষে তাদের একটি দল বাকী রয়ে গেল। হুযুর (সাঃ) ফজরের সময় তাদের সাথে আলাপ সমাপ্ত করলেন। অতঃপর আমার কাছে এসে বললেনঃ সেই দলটি কোথায় গেল? আমি বললাম, ঐ দেখা যায়। অতঃপর তিনি কিছু হাড্ডি ও গোবর নিয়ে তাদেরকে দিলেন। তিনি আমাদেরকে হাড্ডি ও গোবর দিয়ে এস্তেঞ্জা করতে নিষেধ করলেন। (কারণ, এগুলো জিনদের খোরাক।) বায়হাকী ও আবূ নয়ীম আলী ইবনে রুবী থেকে এবং তিনি ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন- আমরা হুযুর (সাঃ)-এর সঙ্গে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে তিনি বললেনঃ জিনদের দলটি পনের জনের তারা পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত। আজ রাতে তারা আমার কাছে আসবে। আমি তাদের সামনে কোরআন তেলাওয়াত করব। তিনি যে জায়গায় যাওয়ার ইচ্ছা করেছিলেন, আমি সেখানে তাঁর সঙ্গে গেলাম। তিনি একটি রেখা টেনে আমাকে তার ভিতরে বসিয়ে দিলেন এবং বললেনঃ এই রেখার বাইরে যাবে না। আমি সম্পূর্ণ রাত্রি এর ভিতরেt রইলাম। তিনি প্রত্যুষে আমার কাছে এলেন। আমি অবশ্যই সে জায়গাটি দেখব বলে সেখানে গেলাম এবং সত্তরটি উট বসার পরিমাণ জায়গা দেখতে পেলাম