নবি (সঃ) এর আশ্বচার্য ঘটনা (1)
পৃষ্ঠা ১ থেকে ১০
পৃষ্ঠা:০১
রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সৃষ্টি ও নবুওয়ত সকল পয়গাম্বরের অগ্রে
আল্লাহ পাক এরশাদ করেছেন- وَاذْ أَخَذْنَا مِنَ النَّبِيِّينَ مِيثَاقَهُم স্মরণ কর যখন আমি নবীগণের কাছ থেকে তাদের অঙ্গীকার গ্রহণ করলাম। ইবনে আবী হাতেম স্বীয় তফসীর গ্রন্থে এবং আবু নায়ীম তাঁর “আদ্দালায়েল” গ্রন্থে উপরোক্ত আয়াতের তফসীর প্রসঙ্গে কাতাদাহ, হাসান ও আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর এই উক্তি উদ্ধৃত করেছেন- “আল্লাহ তায়ালা আমাকে সকল পয়গাম্বরের অগ্রে সৃষ্টি করেছেন এবং সকলের শেষে প্রেরণ করেছেন। এ কারণেই তিনি আমার কাছ থেকে অঙ্গীকারও সকলের অগ্রে নিয়েছেন। আবূ সহল কাত্তান স্বীয় ‘ইমামী’ গ্রন্থে সহল ইবনে সালেহ হামদানী থেকে রেওয়ায়েত করেছেন যে, তিনি আবু জাফর মোহাম্মদ ইবনে আলীকে জিজ্ঞাসা করলেন: নবী করীম (সাঃ) সকলের শেষে প্রেরিত হয়েও সকল পয়গাম্বরের অগ্রে কিরূপে হলেন? জবাবে আবু জাফর মোহাম্মদ ইবনে আলী বললেন: আল্লাহ তায়ালা যখন আদম (আঃ)-এর ঔরস থেকে তাঁর সমস্ত বংশধরকে সৃষ্টি করেন, তখন তাদের কাছ থেকে সাক্ষ্য নেন যে, আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই? জবাবে সকলের অগ্রে হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) বললেন: “بلی” )হ্যাঁ)। এ কারণেই তিনি সকল পয়গাম্বরের অগ্রে, যদিও তিনি প্রেরিত হয়েছেন সকলের শেষে। আহমদ, বোখারী (স্ব-স্ব ইতিহাস গ্রন্থে), তিবরানী, হাকেম ও আবু নায়ীম সাহাবী মায়সারাতুল ফজর (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন, তিনি জিজ্ঞাসা করলেন : ইয়া রসূলাল্লাহ! আপনি কখন নবী মনোনীত হয়েছেন? তিনি বললেন: যখন আদম (আঃ) আত্মা ও দেহের মধ্যবর্তী অবস্থায় ছিলেন। আহমদ, হাকেম ও বায়হাকী ইরবায ইবনে সারিয়া (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি রসূলুল্লাহ (সাঃ)কে এ কথা বলতে শুনেছেন: আমি আল্লাহ তায়ালার কাছে “উম্মুল কিতাবে” (লওহে মাহফুযে) তখন নবী ছিলাম, যখন আদম (আঃ) মৃত্তিকায় লুটোপুটি খাচ্ছিলেন। হাকেম, বায়হাকী ও আবু নায়ীম হযরত
পৃষ্ঠা:০২
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন- নবী করীম (সাঃ)কে জিজ্ঞাসা করা হল, আপনাকে কখন নবী নিযুক্ত করা হল? তিনি বললেনঃ তখন, যখন আদম (আঃ) জন্ম ও আত্মা ফুঁকার মধ্যবর্তী পর্যায়ে ছিলেন। আবু নায়ীম সালেজী থেকে রেওয়ায়েত করেন, হযরত ওমর (রাঃ) রসূলুল্লাহ (সাঃ) কে প্রশ্ন করেন: আপনি কখন নবী নিযুক্ত হয়েছেন? উত্তর হল: তখন, যখন আদম (আঃ) মৃত্তিকায় লুটোপুটি খাচ্ছিলেন।ইবনে সা’দ ইবনে আবুল জাদআ (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করলেন: আপনি কবে নবী মনোনীত হয়েছেন? তিনি বললেন : তখন, যখন আদম (আঃ) রুহ ও দেহের মাঝখানে ছিলেন। ইবনে সা’দ মুতরিফ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে শাখীর (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, এক ব্যক্তি রসূলুল্লাহ (সাঃ)কে প্রশ্ন করলঃ আপনি কবে নবী হিসাবে মনোনীত হয়েছেন? তিনি বললেন : আদম আঃ) যখন রুহ ও দেহের মাঝখানে ছিলেন, তখন আমার কাছ থেকে অঙ্গীকার নৈওয়া হয়। তিবরানী ও আবূ নায়ীম আবু মরিয়ম গামমানী থেকে রেওয়ায়েত করেন, তিনি বলেছেন- জনৈক বেদুঈন নবী করীম (সাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করলঃ আপনার নবুওয়তের পূর্বে কি কি ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল? তিনি বললেন: সকল পয়গাম্বরের ন্যায় আল্লাহ তায়ালা আমার কাছ থেকেও অঙ্গীকার নেন। ইবরাহীম (আঃ) আমার আগমনের জন্যে দোয়া করেন। ঈসা (আঃ) আমার আগমনের সুসংবাদ দেন। এছাড়া আমার জননী স্বপ্নে দেখেন, তাঁর পদযুগল থেকে একটি প্রদীপ প্রজ্বলিত হয়েছে, যার আলোকে সিরিয়ার রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত আলোকিত হয়ে গেছে।
জ্ঞাতব্য বিষয়
শায়খ তকীউদ্দীন সুবকী (রহঃ) স্বীয় গ্রন্থে আয়াতের لمُؤْيم ? وَلَتَنْصُرْنَهُ )তোমরা অবশ্যই তাঁর প্রতি ঈমান আনবে এবং তাঁর সাহায্যকরবে।) অংশের তফসীর প্রসঙ্গে বলেনঃ এই অংশে নবী করীম (সাঃ)-এর বিরাট মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে এবং ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, তিনি অতীত পয়গাম্বরগণের আমলে প্রেরিত হলে তাঁদেরও নবী হতেন। কেননা, তাঁর নবুওয়ত রেসালত সকল কাল ও সকল সৃষ্টিতে পরিবেষ্টিত এবং শামিল। এ কারণেই তিনি এরশাদ করেছেনঃ আমি সমগ্র সৃষ্টির জন্যে নবীরূপে প্রেরিত হয়েছি। এই “সমগ্র সৃষ্টি” বলতে কেবল ভবিষ্যৎ সৃষ্টিই নয়; বরং অতীত সৃষ্টিও শামিল আছে। এ জন্যেই তো তিনি বলেছেন- আমি তখনও নবী ছিলাম, যখন আদম (আঃ)-এর মৃত্তিকানির্মিত প্রতিকৃতি রুহ থেকে খালি ছিল।কোন কোন আলেম এই শেষোক্ত হাদীসের অর্থ এই বর্ণনা করেছেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) আল্লাহ তায়ালার জ্ঞানে তখনও নবী ছিলেন। আমরা বলি, এটা ঠিক নয়। কেননা, আল্লাহ তায়ালার জ্ঞান তো সকল বস্তু ও সকল ঘটনাতেই পরিবেষ্টিত। আদম সৃষ্টির প্রাক্কালে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নবুওয়তের বিশেষভাবে উল্লেখ করা কেবল খোদায়ী জ্ঞান বর্ণনা করার জন্যে নয়; বরং এ কথা বলা উদ্দেশ্য যে, তাঁর নবুওয়ত সে সময়েই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। এ কারণেই আদম (আঃ) চক্ষু খুলেই আরশে “মোহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ” লিখিত দেখতে পান। যদি এই অর্থ নেয়া হয় যে, রসুলুল্লাহ (সাঃ) আল্লাহ তায়ালার জ্ঞানে ভবিষ্যৎ নবী ছিলেন, তবে এটা কেবল তাঁর বৈশিষ্ট্য নয়; বরং সকল পয়গাম্বরই আল্লাহর জ্ঞান অনুযায়ী ভবিষ্যৎ নবী ছিলেন। এ থেকে জানা গেল, কেবল রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এরই বৈশিষ্ট্য ছিল যে, সকল পয়গাম্বরের পূর্বে তাঁকে নবুওয়তের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করা হয়। এরপর গুরুত্ব সহকারে এই বৈশিষ্ট্য ঘোষণা করা হয়েছে, যাতে তাঁর উম্মত তাঁর উচ্চ মর্যাদার সাথে পরিচিত হয়ে যায় এবং এটা উন্মতের জন্যে কল্যাণ ও বরকতের কারণ হয়।এখানে কেউ প্রশ্ন করতে পারে যে, নবুওয়ত একটি গুণ। তাই এই গুণে যিনি গুণান্বিত হবেন, তাঁর বিদ্যমান থাকা জরুরী। এছাড়া নবুওয়তের জন্যে চল্লিশ বছর বয়্যক্রম নির্ধারিত। এমতাবস্থায় রসূলুল্লাহ (সাঃ) প্রেরিত হওয়ার পূর্বেই কিরূপে নবী মনোনীত হয়ে গেলেন? তখন তো তিনি জন্মগ্রহণও করেননি এবং প্রেরিতও হননি।আমি বলি, আল্লাহ তায়ালা দেহ সৃষ্টি করার পূর্বে রুহ সৃষ্টি করেছেন। তাই উল্লিখিত হাদীসে ইশারা নবী করীম (সাঃ)-এর পবিত্র রুহ অথবা তাঁর হকীকত তথা স্বরূপের দিকে হতে পারে। আল্লাহ তায়ালা সকল স্বরূপ “আসল” তথা আদিকালে সৃষ্টি করে রেখেছেন। তিনি যখন ইচ্ছা করেন এ সকল স্বরূপের মধ্য থেকে কোন একটিকে অস্তিত্ব জগতে আনয়ন করেন। এ সব স্বরূপের সামগ্রিক উপলব্ধি করতে আমরা অক্ষম। কেবল আল্লাহ পাকই সমস্ত স্বরূপ সম্পর্কে ওয়াকিফহাল অথবা যাদেরকে তিনি আপন নূরের আলোকে স্বরূপ পর্যন্ত পৌঁছার সামর্থ্য দান করেছেন। নবী করীম (সাঃ)-এর পবিত্র স্বরূপ আদম সৃষ্টির পূর্বেই আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁকে নবুওয়তের গুণে ভূষিত করেছেন। তাই তিনি তখনই নবী হয়ে যান। আরশে তাঁর পবিত্র নাম লিখিত হয় এবং ফেরেশতাগণসহ সমগ্র সৃষ্টিকে আল্লাহর দরবারে তাঁর সুউচ্চ মর্যাদা সম্পর্কে জ্ঞাত করে দেয়া হয়, যদিও তিনি শারীরিক দিক দিয়ে আল্লাহ প্রদত্ত সমস্ত গুণ ও বৈশিষ্ট্যসহ এ দুনিয়ায় পরে আগমন করেন। আবির্ভাব, ধর্ম প্রচার এবং বাহ্যিক জগতে নবুওয়তের যোগ্য হওয়ার দিক দিয়ে তিনি নিঃসন্দেহে সকল পয়গাম্বরের পশ্চাতে; কিন্তু তাঁর পবিত্র স্বরূপ এবং কিতাব ও আদেশ দানের দিক দিয়ে তিনি আদম (আঃ)-এরও অগ্রে।
পৃষ্ঠা:০৩
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, বিশ্ব চরাচরে যা কিছু ঘটে, আল্লাহ তায়ালা সে সম্পর্কে আদিকাল থেকে জ্ঞাত। আমরা যৌক্তিক ও শরীয়তের প্রমাণাদি দ্বারা সে সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করি। আর সাধারণ মানুষ তখন জানতে পারে, যখন সেই ঘটনা বাহ্য জগতে সংঘটিত হয়ে যায়। উদাহরণতঃ নবী করীম (সাঃ)-এর নবুওয়ত সম্পর্কে সাধারণ মানুষ তখন জ্ঞাত হয়েছে, যখন তাঁর প্রতি কোরআন অবতরণ শুরু হয়েছে এবং জিবরাঈল (আঃ) তাঁর কাছে আসতে শুরু করেছেন। আল্লাহ তায়ালার যে সকল কর্ম কোন বিশেষ পাত্রে আল্লাহর কুদরত, ইচ্ছা ও ক্ষমতার চিহ্ন স্বরূপ হয়ে থাকে, কোরআন অবতরণ সেগুলোর মধ্যে একটি। এর দুটি স্তর রয়েছে। প্রথম স্তর সাধারণ মানুষের জন্যে প্রকাশ পায় এবং দ্বিতীয় স্তরে সেই পাত্রের জন্যে আল্লাহর এই কর্ম থেকে পূর্ণতা অর্জিত হয়ে যায়। যদিও মানুষ এই পূর্ণতা সম্পর্কে জানতে পারে না; বরং আমরা “খবরে-ছাদেক” তথা বিশুদ্ধ হাদীসের মাধ্যমে এই পূর্ণতা সম্পর্কে অবগত হই। নবী করীম (সাঃ) সমগ্র সৃষ্টির সেরা সৃষ্টি। তাই তিনি সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে সর্বাধিক পূর্ণতাপ্রাপ্ত এবং সর্বাধিক মনোনয়নযোগ্য। সহীহ হাদীসের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে, নবী করীম (সাঃ) কে নবুওয়তের পূর্ণতা ও মানবতার পূর্ণতার মর্যাদা হযরত আদম (আঃ) কে সৃষ্টি করার পূর্বেই দান করা হয়েছিল। আল্লাহ তায়ালা মানব সৃষ্টির পূর্বেই সকল নবীর পবিত্র আত্মাসমূহের কাছ থেকে তাঁর সম্পর্কে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন যে, তাঁরা সকলেই তার প্রতি ঈমান আনবে এবং তাঁকে সাহায্য করবে। উদ্দেশ্য, সকল নবী জেনে নিক যে, তিনি সকলের অগ্রে এবং সর্বশ্রেষ্ঠ। তিনি নবীগণের জন্যেও তেমনি নবী ও রসূল, যেমন সকল মানুষের জন্যে। তাই لَتُؤْمِنُنَّ بِ বাক্যাংশে কসমের ‘লাম’ অক্ষরটি দাখিল করা হয়েছে।
নবীগণের কাছ থেকে ঈমান ও সাহায্যের অঙ্গীকার নেয়া খেলাফতের জন্যে বয়াত নেয়ার অনুরূপ
এ অঙ্গীকার এমন, যেমন খলিফাগণের জন্যে বয়াত নেয়া। সম্ভবতঃ খলিফাগণের জন্যে বয়াত নেয়ার পদ্ধতিটি এ অঙ্গীকার থেকেই নেয়া হয়েছে। পরওয়ারদেগারের কাছে নবী করীম (সাঃ)-এর মাহাত্ম্য একটু অনুমান করুন। তিনি সকল নবীর নবী। সেমতে কেয়ামতের দিন সকল নবী তাঁরই পতাকাতলে সমবেত হবেন। শবে মে’রাজেও নবীগণ তাঁর এক্তেদা করে নামায আদায় করেছেন। যদি তিনি আদম, নূহ, ইবরাহীম, মূসা ও ঈসা (আঃ)-এর সময়কালে আগমন করতেন, তবে এই নবীগণের উপরও তাঁর অনুসরণ ও তাঁর প্রতি ঈমান আনা তেমনি জরুরী হত, যেমন তাঁদের উম্মতের উপরও হত। এ কারণেই আল্লাহ তায়ালা সকল নবীর কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছেন। তাই সকল পয়গাম্বরের জন্যে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নবুওয়ত ও রেসালত স্বীকার করে নেয়া অপরিহার্য। কেবল এই পয়গম্বারগণ এবং তাঁর সত্তার সমসাময়িক হওয়া বাকী ছিল। কিন্তু তাঁর শেষ যমানায় আগমন করার কারণে এই গুণগত দাবীতে কোন পরিবর্তন আসেনি। দু’টি বিষয় প্রণিধানযোগ্য- এক, কোন কাজ এ কারণে না হওয়া যে, সেই কাজের পাত্র উপস্থিত নেই। দুই, কর্তা সূচনাতে কাজের যোগ্যতাই রাখে না। রসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর নবুওয়তের প্রতি নবীগণের ঈমান ও তাঁকে সাহায্য এ কারণে অস্তিত্ব লাভ করেনি যে, তিনি এই নবীগণের সময়কালে উপস্থিতই ছিলেন না। যেন পাত্র উপস্থিত ছিল না যদিও তাঁর পবিত্র সত্তার দাবীদার ছিল। এ কারণেই বলা হয়েছে যে, যদি তিনি এই নবীগণের সময়কালে আগমন করতেন, তবে তাঁদের জন্যে তাঁর অনুসরণ অপরিহার্য হয়ে যেত। সেমতে শেষ যমানায় যখন হযরত ঈসা (আঃ) আগমন করবেন, তখন তিনি যথারীতি নবীও হবেন এবং রসূলুল্লাহ (সাঃ)- এর শরীয়তও জারি এবং প্রয়োগ করবেন। এ কথা বলা ঠিক হবে না যে, হযরত ঈসা (আঃ) যখন শেষ যমানায় আগমন করবেন, তখন তিনি নবী হবেন না; বরং রসূলে করীম (সাঃ)-এর উম্মত হবেন। অবশ্যই তিনি উন্নত হবেন; কিন্তু উন্মত হওয়া হযরত ঈসা (আঃ)-এর নবী হওয়ার বিপরীত নয়। যেমন পূর্বেই বর্ণিত হয়েছে যে, নবী করীম (সাঃ) পূর্ববর্তী নবীগণের আমলে প্রেরিত হলে তাঁদের উপর তাঁর অনুসরণ ওয়াজিব হত এবং তাঁরা যথারীতি নবীও থাকতেন। কেননা, রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নবুওয়ত সকল নবীর নবুওয়তকে শামিল ও পরিবেষ্টিত করে। তাঁদের শরীয়ত ও মৌলিক নীতিসমূহও রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর শরীয়তের সাথে সম্পর্কিত। কোথাও শাখাগত বিরোধ থাকলে তা বিশেষীকরণ কিংবা রহিতকরণের বিরোধ বৈ নয়। অথবা বলা যায় যে, বিশেষীকরণ ও রহিতকরণ কিছুই নেই; বরং যে সময় যে নবীর শরীয়ত এসেছে সে সময় তা যেন রসূলুল্লাহরই (সাঃ)-শরীয়ত ছিল এবং সেই যুগের চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যশীল ছিল। পক্ষান্তরে তিনি নিজে যে শরীয়ত নিয়ে আগমন করেছেন, তা তাঁর উম্মতের সাথে সামঞ্জস্যশীল। উপরোক্ত বর্ণনা দ্বারা দু’টি হাদীসের অর্থ বোধগম্য হয়ে গেছে। প্রথম হাদীস এইঃ “আমি সমগ্র মানব জাতির জন্যে নবীরূপে প্রেরিত হয়েছি।” এর অর্থ এরূপ মনে করা হত যে, তিনি পূর্ববর্তী সকল মানুষের জন্যে নবী। কিন্তু উপরোক্ত ব্যাখ্যা দ্বারা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, তিনি পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল মানুষের নবী। দ্বিতীয় হাদীস এইঃ “আমি তখন নবী ছিলাম, যখন আদম (আঃ) রুহ ও দেহের মাঝখানে ছিলেন।” এর অর্থ এরূপ ধারণা করা হত যে, এর উদ্দেশ্য আল্লাহর জ্ঞানে তিনি নবী ছিলেন। কিন্তু উপরোক্ত বর্ণনা দ্বারা জানা গেল যে, রসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর শেষ যমানায় প্রেরিত হওয়া মানবভার যোগ্যতার ভিত্তিতে হয়েছে। মানবতা যখন তাঁর বিধানাবলী অনুসরণ করার যোগ্য হয়েছে, তখন তিনি
পৃষ্ঠা:০৪
প্রেরিত হয়েছেন। পূর্বেই এই যোগ্যতা অস্তিত্ব লাভ করলে তিনি পূর্বেই প্রেরিত হয়ে যেতেন। সুতরাং পাত্রের সাথে মিল রেখে তিনি প্রেরিত হয়েছেন। মানুষ যখন তার পয়গাম শুনতে এবং তাঁর শরীয়ত অনুসরণ করতে সক্ষম হয়েছে, তখন তিনি প্রেরিত হয়েছেন। এটা এমন, যেমন কেউ তার কন্যার বিবাহের জন্যে কাউকে উকিল নিযুক্ত করে দেয়। এই নিযুক্ত করা এবং সেই ব্যক্তির উকিল হওয়া সঠিক পদক্ষেপ। কিন্তু এই দায়িত্ব তখনই পূর্ণ হবে, যখন কুফু তথা কন্যার উপযুক্ত বর পাওয়া যাবে এবং অন্যান্য জরুরী সরঞ্জামাদিও সংগৃহীত হবে। এ কারণে বিবাহে বিলম্ব হলে উকিলের ওকালতি বিঘ্নিত হবে না। (তকীউদ্দীন সুবকীর বক্তব্য সমাপ্ত হল।)
রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মোবারক নাম আল্লাহর নামের সাথে আরশে লিখিত আছে
হাকেম, বায়হাকী ও তিবরানী স্বীয় গ্রন্থ “আছছপীরে” এবং আবূ নায়ীম ও ইবনে আসাকির হযরত ওমর (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, নবী করীম (সাঃ) বলেছেন: হযরত আদম (আঃ)-এর প্রমাদ হয়ে গেলে তিনি আল্লাহর দরবারে আরজ করলেন- পরওয়ারদেগার। আপনি হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-এর উসিলায় আমার মাগফেরাত করে দেন। এতে আল্লাহ পাক এরশাদ করলেনঃ হে আদম। তুমি মোহাম্মদকে (সাঃ) চিনলে কি রূপে? আদম (আঃ) বললেনঃ যখন আপনি আমাকে আপনার পবিত্র হস্তে সৃষ্টি করে আমার মধ্যে রুহ ফুঁকে দিলেন, তখন আমি মাথা তুলে আরশের গায়ে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ” লিখিত দেখলাম। এ থেকে অনুধাবন করতে পারি যে, ইনিই আপনার সর্বাধিক প্রিয়। আল্লাহ তায়ালা বললেনঃ হে আদম! তুমি সত্য বলেছ। মোহাম্মদ না হলে আমি তোমাকেও সৃষ্টি করতাম না।” ইবনে আসাকির কা’বে আহবার থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আল্লাহ তায়ালা হযরত আদম (আঃ)-এর প্রতি পয়গাম্বরগণের সমসংখ্যক লাঠি নাযিল করেন। (খাসায়েসে কুবরার বিভিন্ন কপিতে এ ধরনের শব্দই রয়েছে। সম্ভবতঃ এখানে আরও কিছু বাক্য বাদ পড়েছে।) অতঃপর হযরত আদম (আঃ) আপন পুত্র হযরত শীছ (আঃ) কে সম্বোধন করে বললেন: প্রিয় বৎস! তুমি আমার পরে আমার খলিফা হবে। তুমি তাকওয়া (খোদাভীতি) অবলম্বন কর। তুমি যখনই আল্লাহর যিকির করবে, তার সাথে মোহাম্মদ (সাঃ)-এর নাম অবশ্যই উচ্চারণ করবে। কেননা, আমি তার নাম আরশের গায়ে তখন লিখিত দেখেছি, যখন আমি রুহ ও মৃত্তিকার মধ্যবর্তী অবস্থায় ছিলাম। এরপর আমি সমগ্র আকাশমণ্ডল পরিভ্রমণ করেছি। আমি নভোমণ্ডলে এমন কোন জায়গা দেখিনি, যেখানে হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-এর নাম লিখিত নেই। আমার পরওয়ারদেগার আমাকে জান্নাতে রেখেছেন। আমি জান্নাতে কোন প্রাসাদ ও বাতায়ন এমন দেখিনি, যাতে মোহাম্মদ (সাঃ)-এর নাম লিখিত নেই। আমি তাঁর নাম হুরদের বক্ষে, ফেরেশতাগণের চোখের পুত্তলীতে, ‘তুবা’র পত্ররাজিতে এবং সিদরাতুল-মুনতাহার পল্লবসমূহে লিখিত দেখেছি। তুমিও অধিক পরিমাণে তাঁর নাম স্মরণ করবে। কেননা, ফেরেশতারাও সর্বক্ষণ তাঁর পূত নাম স্মরণ করতে থাকে। ইবনে আদী ও ইবনে আসাকির হযরত আনাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন: যখন আমার মে’রাজ হয়, তখন আমি আরশের পায়ায় “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ” লিখিত দেখেছি। ইবনে আসাকির হযরত আলী (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলে করীম (সাঃ) এরশাদ করেছেনঃ যে রজনীতে আমার মে’রাজ হয়, সেই রজনীতে আমি আরশে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ” লিখিত দেখেছি। এর সাথে আবূ বকর সিদ্দীক, ওমর ফারুক ও ওছমান যুন্নুরাইন (রাঃ)-এর নামও লিখিত ছিল। আবু ইয়ালা, তিবরানী স্বীয় গ্রন্থ আওসাতে এবং ইবনে আসাকির ও হাসান ইবনে আরফা আপন প্রসিদ্ধ গ্রন্থ জুযে হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ আমি মে’রাজ রজনীতে যে আকাশেই গমন করেছি, সেখানেই “মোহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ” ও “আবূ বকর সিদ্দীক” লিখিত ছিল। বাযযায় আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ মে’রাজ রজনীতে তামি যে আকাশেই গমন করেছি, তথায় আমার নাম ‘মোহাম্মদ রসূলুল্লাহ’ লিখিত পেয়েছি। দারে-কুতনী স্বীয় “আফরাদ” গ্রন্থে এবং খতীব ও ইবনে আসাকির হযরত আবু দারদা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন: আমি আরশে একটি সবুজ কাপড়ে শুভ্র নূর দ্বারা “মোহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ”, “আবু বকর সিদ্দীক” এবং “ওমর ফারুক” লিখিত পেয়েছি। ইবনে আসাকির হযরত জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, রসূলে করীম (সাঃ) বলেছেন: জান্নাতের দরজায় “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ” লিখিত আছে। আবু নয়ীম স্বীয় গ্রন্থ ‘আল-হিলইয়া’য় হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন: জান্নাতের কোন পাতা এমন নেই, যাতে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ” লিখিত নেই। হাকেম ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আল্লাহ তায়ালা হযরত ঈসা (আঃ)-এর প্রতি ওহী পাঠালেন- হযরত মোহাম্মদের প্রতি ঈমান আন
পৃষ্ঠা:০৫
এবং তোমার উম্মতের যে ব্যক্তিই তাঁর সময়কাল পাবে, তাকে তাঁর প্রতি ঈমান আনতে আদেশ কর। কেননা, মোহাম্মদ না হলে আমি আদমকে সৃষ্টি করতাম না এবং জান্নাত ও দোযখও সৃষ্টি করতাম না। আমি আরশকে পানির পৃষ্ঠে সৃষ্টি করলাম। সে হেলতে দুলতে লাগল। এরপর যখন তাতে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ” লিখে দিলাম, তখন নিশ্চল হয়ে গেল। হাফেয যাহাবী (রহঃ) বলেন : এই রেওয়ায়েতের সনদে আমর ইবনে আউস রয়েছে। সে অজ্ঞাত।ইবনে আসাকির আনুষ যুবায়রের মধ্যস্থতায় হযরত জাবের (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, হযরত আদম (আঃ)-এর উভয় কাঁধের মাঝখানে “মোহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ খাতেমুন্নবীয়্যীন” লিখিত ছিল। বাযযায হযরত আবু যর (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, কোরআনে যে কানয (ধনভাণ্ডার)-এর উল্লেখ আছে, তা একটি স্বর্ণের ফালি, যাতে লিখিত আছে- “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম” আমি সেই ব্যক্তির জন্যে বিস্মিত, যে তকদীরে বিশ্বাস রাখে না। আমি সেই ব্যক্তির জন্যে বিস্মিত, যে জাহান্নামের কথা বলেও হাস্য করে। আমি সেই ব্যক্তির আচরণে অবাক, যে মৃত্যুকে স্বরণ করেও গাফেল থাকে। “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ”। এমনি ধরনের রেওয়ায়েত হযরত ওমর ও হযরত আলী (রাঃ) থেকেও বর্ণিত আছে, যা বায়হাকী বর্ণনা করেছেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকেও রেওয়ায়েত আছে, যা খারায়েজী “কামউল হিরছ” গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন। তিবরানী ওবাদা ইবনে সামেত (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেছেন- “হযরত দাউদ (আঃ)-এর আংটির মণিকাটি আকাশ থেকে প্রেরিত হয়েছিল। তিনি সেটিকে স্বীয় আংটিতে সংযুক্ত করে নেন। এতে ‘আমাকে ছাড়া কোন (সৃষ্টিকর্তা) নেই, মোহাম্মদ আমার বান্দা ও রসূল লিখিত ছিল।ইবনে আসাকির ও ইবনে ফিজার স্ব-স্ব ইতিহাস গ্রন্থে আবুল হাসান আলী ইবনে আবদুল্লাহ হাশেমী থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তিনি বলেন: আমি ভারতবর্ষের কোন এক এলাকায় পৌঁছে একটি কাল রঙের গোলাপ গাছ দেখলাম। এর বড় কাল ফুলের সুগন্ধি অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর ছিল। ফুলের গায়ে সাদ্য হরফে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মোহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ আবু বকর ছিদ্দীক, ওমর ফারুক” লিখিত ছিল। আমার সন্দেহ হল যে, সম্ভবতঃ এটা কারও কাজ হবে। তাই আমি একটি বন্ধ কলি খুলে দেখলাম। আশ্চর্যের বিষয়, তাতেও এরূপ লিখিত ছিল। এ ধরনের গোলাপ গাছ সেখানে প্রচুর পরিমাণে ছিল। কিন্তু সেই গ্রামের লোকেরা খোদাকে চিনত না। তারা পাথরের পূজা করত। হযরত আদম (আঃ)-এর আমলে এবং আকাশে আযানে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পবিত্র নাম আবু নয়ীম হিলইয়া গ্রন্থে এবং ইবনে আসাকির আতা থেকে, তিনি হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ হযরত আদম (আঃ) ভারতবর্ষে অবতরণ করেন। ১ অবতরণের পর বিমর্ষতা অনুভব করলে জিবরাঈল (আঃ) আগমন করেন এবং আযান দেন- আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (দু’বার), আশহাদু আন্না মোহাম্মাদার রসূলুল্লাহ (দু’বার)। আদম (আঃ) জিজ্ঞাসা করলেন: এই মোহাম্মদ কে? জিবরাঈল বললেনঃ ইনি আপনার
সন্তানদের মধ্যে সর্বশেষ নবী।
বাযযার হযরত আলী (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, যখন আল্লাহ তায়ালা তাঁর রসূল (সাঃ)কে আযান শিক্ষা দেয়ার ইচ্ছা করলেন, তখন জিবরাঈল (আঃ) বোরাকে চড়ে আগমন করলেন। তিনি নবী করীম (সাঃ)-কে বোরাকে সওয়ার করাতে চাইলে বোরাক ক্ষিপ্ত হয়ে ছুটাছুটি করতে লাগল। জিবরাঈল (আঃ) বললেন: থেমে যা। আল্লাহর কাছে মোহাম্মদ (সাঃ)-এর চেয়ে বেশী মনোনীত কোন বান্দা তোর উপর কখনও সওয়ার হয়নি। অতঃপর রসূলুল্লাহ (সাঃ) সওয়ার হয়ে গেলেন। যখন সেই পর্দা পর্যন্ত পৌঁছালেন, যা আল্লাহ তায়ালার মাঝখানে অন্তরায় ছিল, তখন এক ফেরেশতা আত্মপ্রকাশ করল। সে বলল: আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার। পর্দার পিছন থেকে আওয়াজ এল। আমার বান্দা ঠিকই বলেছে। আমিই সুমহান। ফেরেশতা বললঃ আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। পর্দার পিছন থেকে আওয়াজ এলঃ আমার বান্দা ঠিক বলেছে। আমি ছাড়া কোন মাবুদ নেই। ফেরেশতা বললঃ আশহাদু আন্না মোহাম্মাদার রসূনুল্লাহ। পর্দার পিছন থেকে আওয়াজ এল। আমার বান্দা ঠিক বলেছে। আমিই মোহাম্মদকে নবী করে প্রেরণ করেছি। ফেরেশতা বললঃ হাইয়া আলাচ্ছালাহ, হাইয়া আলাল ফালাহ, কাদ কামাতিছ-ছালাহ, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার। আবার আওয়াজ এল: আমার বান্দা ঠিক বলেছে। আমি ছাড়া কোন মাবুদ নেই।এরপর ফেরেশতা রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর হাত ধরে ইমামতির জন্যে অগ্রে বাড়িয়ে দিল। তিনি সমগ্র আকাশবাসীর ইমাম হলেন। তাদের মধ্যে হযরত আদম ও নূহ (আঃ)ও ছিলেন। এভাবে আল্লাহ তায়ালা রসূলে করীম (সাঃ)কে সমস্ত নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের সৃষ্টির উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করলেন। পদচিহ্ন মৌজুদ আয়ে
পৃষ্ঠা:০৬
হুযুর (সাঃ)-এর জন্যে নবীগণের কাছ থেকে ঈমানের অঙ্গীকার নেয়া আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন :وَإِذْ أَخَذَ اللَّهُ مِيثَاقَ السَّيِّينَ لَمَا أَتَيْتُكُمْ مِّنْ كِتَبٍ رَّحِكْمَةٍ ثُمَّ جَاءَ كُمْ رَسُولٌ مُّصَدِّقُ لِمَا مَعَكُمْ لِتُؤْمِنَنَّ بِهِ وَلَتَنْصُرُنَّهُ قَالَ أقررتُم وَأَخَذْتُمْ عَلَى ذَلِكُمْ اصْرِى قَالُوا أَقْرَرْنَا قَالَ فَاشْهَدُوا وَأَنَا مَعَكُمْ مِّنَ الشهدِينَ .: আর আল্লাহ যখন নবীগণের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিলেন যে, আমি যা কিছু তোমাদেরকে দান করেছি কিতাব ও জ্ঞান এবং অতঃপর তোমাদের নিকট কোন রসূল আসেন তোমাদের কিতাবের সত্যায়নের জন্যে, তখন সেই রসুলের প্রতি ঈমান আনবে এবং তাঁকে সাহায্য করবে। আল্লাহ বললেন: তোমরা কি এই শর্তে আমার প্রদত্ত অঙ্গীকার গ্রহণ করে নিয়েছ? তারা বলল: আমরা স্বীকার করছি। আল্লাহ বললেন: তাহলে এবার সাক্ষী থাক, আর আমিও তোমাদের সাথে সাক্ষী রইলাম। (সূরা আলে এমরান, আয়াত ৮১)এই আয়াত সম্পর্কে ইবনে আবী হাতেম সুদ্দী (রাহঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, আল্লাহ তায়ালা হযরত নূহ (আঃ)-এর পর যে কোন নবী প্রেরণ করেছেন, তাঁর কাছ থেকে এই মর্মে অঙ্গীকার নিয়েছেন যে, তিনি মোহাম্মদ (সাঃ)-এর প্রতি ঈমান আনবেন এবং তাঁর সাহায্য করবেন, যদি তিনি তাঁর যুগে আসেন। নতুবা আপন উম্মতের কাছ থেকে ঈমান আনা ও সাহায্য করার অঙ্গীকার নিবেন।ইবনে আসাকির কুরায়ব থেকে এবং তিনি ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন অবশেষে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত, সর্বশ্রেষ্ঠ কাল এবং সর্বশ্রেষ্ঠ সঙ্গীদের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করলেন এবং সর্বশ্রেষ্ঠ শহরে জন্মগ্রহণ করলেন। এরপর আল্লাহ তায়ালা যত দিন চেয়েছেন, তিনি ইবরাহীম (আঃ)-এর হেরেমে বসবাস করলেন। এরপর তিনি “হেরেমে-মোহাম্মদ” অর্থাৎ মদীনায় চলে এলেন। এভাবে তিনি যেন এক হেরেমে জন্মগ্রহণ করলেন এবং অন্য হেরেমের দিকে হিজরত করলেন।
রসূলুল্লাহ (সাঃ) সম্পর্কে হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর দোয়া
ইবনে জরীর স্বীয় তফসীরে আবুল আলিয়া থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, ইবরাহীম (আঃ) দোয়া করলেন: পরওয়ারদেগার। আমার সন্তানদের মধ্যে একজন রসূল প্রেরণ করো। আল্লাহর পক্ষ থেকে জবাব এল: তোমার দোয়া কবুল হয়েছে। এই রসূল শেষ যুগে আগমন করবেন। আহমদ, হাকেম ও বায়হাকী এরবায ইবনে সারিয়া থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন: “আমি আমার পিতা ইবরাহীমের দোয়া এবং ঈসার সুসংবাদ।” ইবনে আসাকির ওবাদা ইবনে সামেত (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলে করীম (সাঃ)-কে বলা হল: আপনি নিজের সম্পর্কে বলুন। তিনি বললেন: হ্যাঁ, আমি পিতা ইবরাহীমের দোয়া এবং আমার আগমনের সুসংবাদ সকলের শেষে ঈসা ইবনে মরিয়মও (আঃ) দিয়েছেন। ইবনে সা’দ জরীর থেকে এবং তিনি যাহহাক থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন: আমার আগমনের জন্যে আমার পিতা ইবরাহীম তখন দোয়া করেন, যখন তিনি বায়তুল্লাহর ভিত্তি স্থাপন করছিলেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁর দোয়া কবুল করে নেন।
আল্লাহ তায়ালা হযরত ইবরাহীম (আঃ) ও তাঁর সন্তানদেরকে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আগমন সম্পর্কে অবগত করে দিয়েছিলেন
ইবনে সা’দ হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন- হযরত ইবরাহীম (আঃ) যখন বিবি হাজেরার দেশত্যাগের আদেশ পান, তখন তাঁদেরকে বোরাকে সওয়ার করানো হয়। তাঁরা যখনই কোন উর্বর ও নরম ভূমি অতিক্রম করতেন, তখনই হযরত ইবরাহীম (আঃ) বলতেন: হে জিবরাঈল, এখানেই নেমে পড়ুন। জিবরাঈল (আঃ) অস্বীকার করতেন। অবশেষে মক্কা এসে গেলে জিবরাঈল (আঃ) বললেনঃ হে ইবরাহীম। এখানে অবতরণ করুন। ইবরাহীম (আঃ) বললেন : এখানে, এই ঘাস-পানিবিহীন প্রান্তরে? জিবরাঈল (আঃ) বললেন ও হ্যাঁ, এখানেই আপনার সন্তানদের মধ্যে উম্মী নবী আবির্ভূত হবেন। ইবনে সা’দ শা’বী থেকে আরও রেওয়ায়েত করেন যে, হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর সহিফায় বর্ণিত আছে, তাঁর অনেক সন্তান-সন্ততি হবে। অবশেষে তাঁর সন্তানদের মধ্যে উম্মী নবী ও খাতেমুন্নবীয়্যীন আসবেন। ইবনে সা’দ মোহাম্মদ ইবনে কা’ব থেকে আরও রেওয়ায়েত করেন- যখন হাজেরা আপন পুত্র ইসমাঈলকে নিয়ে রওয়ানা হলেন, তখন পথিমধ্যে এক ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ হল। সে বলল। হাজেরা, তোমার পুত্র অনেক গোত্র ও প্রজন্মের পিতা হবে। তারই বংশধরের মধ্যে হেরেমে বসবাসকারী নবী উম্মী পয়দা হবেন। ইবনে সাদ মোহাম্মদ ইবনে কা’ব থেকে আরও রেওয়ায়েত করেন- আল্লাহ তায়ালা হযরত ইয়াকুব (আঃ)-এর নিকট এ মর্মে ওহী পাঠান যে, আমি তোমার সন্তানদের মধ্যে এমন নবী প্রেরণ করব, যিনি খাতেমুন্নবীয়্যীন হবেন এবং যাঁর নাম হবে ‘আহমদ’। তাঁর উম্মতগণ বায়তুল মোকাদ্দাসের প্রাসাদরাজি পুনঃ নির্মাণ করবে।
পৃষ্ঠা:০৭
আল্লাহ তায়ালা হযরত মূসা (আঃ)-কে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আগমন সম্পর্কে অবহিত করেছেন আল্লাহ তায়ালা কোরআন পাকে এরশাদ করেন- যারা নবী উম্মীর অনুসরণ করে, তাঁরা তার আলোচনা তওরাত ও ইঞ্জিলে লিখিত দেখতে পায়। আরও এরশাদ হয়েছে-الْكُفَّارِ رُحَمَاء الله وَالَّذِينَ مَعَهُ عَلَى محمد رسول الـ بَيْنَهُمْ تَرَاهُمْ رَكَعًا سُجَّدًا يَبْتَغُونَ فَضْلًا مِّنَ اللَّهِ وَرِضْوَانًا يْمُهُمْ فِي وُجُوهِهِمْ مِنْ أَثَرِ السُّجُودِ ذَلِكَ مَثَلُهُمْ فِي التَّوْرَاةِ وَمَثَلُهُمْ فِي الْإِنْجِيلِ كَزَرْعٍ أَخْرَجَ شَطَاهُ فَازَرَهُ .: মোহাম্মদ আল্লাহর প্রেরিত রসূল; তাঁর সহচরগণ কাফেরদের প্রতি কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল। আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় তুমি তাদেরকে রুকু ও সেজদায় অবনত দেখবে। তাদের মুখমণ্ডলে সেজদার চিহ্ন থাকবে। তওরাতে তাদের বর্ণনা এরূপই এবং ইনজীলেও। তাদের দৃষ্টান্ত একটি চারাগাছ, যা থেকে নির্গত হয় কিশলয়। বোখারীর রেওয়ায়েতে আতা ইবনে ইয়াসার বলেন: আমি একবার আমর ইবনুল ‘আস (রাঃ)-এর সাথে দেখা করলাম এবং বললাম- রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর গুণ বর্ণনা করুন। তিনি বললেন: শুন। কোরআনে উল্লিখিত তাঁর কতক গুণের। উল্লেখ তওরাতেও আছে। তওরাতে আছ- হে নবী! আমি আপনাকে শাহেদ (সাক্ষ্যদাতা), মুবাশশির (সুসংবাদদাতা) এবং নযীর (সতর্ককারী) রূপে প্রেরণ করেছি। আপনি উন্মীদের আশ্রয়স্থল, আমার বান্দা ও রসূল। আমি আপনার নাম “মুতাওয়াক্কিল” (ভরসাকারী) রেখেছি। আপনি অসচ্চরিত্র ও কঠোর নন এবং বাজারেও ঘুরাফিরা করেন না। আপনি মন্দের জবাবে মন্দ করেন না; বরং মাফ করে দেন। আল্লাহ আপনাকে তুলে নিবেন না, যে পর্যন্ত আপনার জাতি পথভ্রষ্টতা মুক্ত না হয়ে যায় এবং তারা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” না বলে। আল্লাহ আপনার মাধ্যমে অন্ধ চক্ষুসমূহকে দৃষ্টিশক্তি, বধির কর্ণসমূহকে শ্রবণশক্তি, এবং পথভ্রান্ত অন্তরসমূহকে সৎপথের দিশা দান করবেন। ইবনে আসাকির “তারীখে দামেশক”-এ মোহাম্মদ ইবনে হামযা থেকে রেওয়ায়েত করেন এবং তিনি তাঁর পিতামহ আবদুল্লাহ ইবনে সালাম থেকে বর্ণনা করেন- যখন আমি নবী করীম (সাঃ)-এর আবির্ভাব সম্পর্কে জ্ঞাত হলাম, তখন তাঁর সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশে রওয়ানা হলাম। রসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাকে বললেনঃ তুমি ইয়াসরিব ভূখণ্ডের আলেম ইবনে সালাম। আমি তোমাকে কসম দিয়ে জিজ্ঞাসা করছি, তওরাতে আমার কোন উল্লেখ আছে কি? আমি বললামঃ প্রথমে আপনি আপনার প্রতিপালক সম্পর্কে বলুন। এ কথা শুনে তিনি কাঁপতে লাগলেন। জিবরাঈল তৎক্ষণাৎ আগমন করলেন এবং এই আয়াতগুলো তেলাওয়াত করলেনঃ বলুন, তিনি আল্লাহ এক। আল্লাহ সর্ব বিষয়ের নির্ভর। তিনি জনক নহেন এবং জাতকও নহেন এবং তাঁর সমতুল্য কেউই নেই। এই আয়াতগুলো শুনে আবদুল্লাহ ইবনে সালাম বললেন: আমি সাক্ষ্য দেই যে, আপনি আল্লাহর রসূল। নিশ্চয়ই আল্লাহ আপনাকে এবং আপনার ধর্মকে সকল ধর্মের উপর বিজয়ী করবেন। তওরাতে আপমার গুণ এভাবে উল্লিখিত আছেঃ হে নবী! আমি আপনাকে “শাহেদ”, “মুবাশশির” ও “নযীর “রূপে প্রেরণ করেছি। আপনি আমার বান্দা ও রসুল। আমি আপনার নাম “মুতাওয়াক্কিল” রেখেছি। আপনি না কটুভাষী, না কঠোর মেজাজী। আপনি বাজারে ঘুরাফিরা করেন না। আপনি মন্দের জওয়াবে মন্দ করেন না; বরং মাফ করে দেন। আল্লাহ আপনাকে তুলে নিবেন না, যে পর্যন্ত আপনার শিক্ষায় উম্মত সঠিক পথে চলতে না থাকে এবং তারা সকলে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ না বলে। আল্লাহ আপনার মাধ্যমে অন্ধ চক্ষুসমূহকে দৃষ্টিশক্তি, বধির কর্ণসমূহকে শ্রবণশক্তি এবং তালাযুক্ত অন্তরসমূহকে উন্মোচন করেন। (ইবনে আসাকির যায়দ ইবনে আসলাম থেকেও একই রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন।) দারেমী স্বীয় মসনদে এবং ইবনে আসাকির রেওয়ায়েত করেন, কা’ব উপরোক্ত রেওয়ায়েতে আরও সংযোজন করেছেন, “মোহাম্মদ রসূলুল্লাহ আমার মনোনীত বান্দা। তিনি বদমেযাজ ও কঠোর স্বভাব নন। বাজারেও ঘুরাফিরা করেন না। মন্দের জবাবে মন্দ আচরণ করেন না; বরং ক্ষমা ও মার্জনা করে দেন। তাঁর জন্মস্থান মক্কা এবং হিজরতের স্থান মদীনা। তাঁর রাজত্ব শামদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। তিনি আল্লাহর রসূল। তাঁর উম্মত আল্লাহর সর্বাধিক প্রশংসাকারী। তারা অভাব-অনটনেও হৃষ্টচিত্তে আল্লাহর প্রশংসা করে। তারা যখন কোন জায়গায় পৌঁছবে, তখন আল্লাহর প্রশংসা ও তাঁর মাহাত্ম্য বর্ণনা করবে। রৌদ্রের মাধ্যমে সময়ের অনুমান করবে এবং নামায সময়মত আদায় করবে। দেহের মাঝখানে লুঙ্গি বাঁধবে। তারা হাত, পা ধৌত করবে। রাত্রিকালে তাদের এমন শুনা যাবে, যেমন মৌমাছির ভন ভন শব্দ।” দারেমী, ইবনে সা’দ ও ইবনে আসাকির, আবু ফরওয়া থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তিনি ইবনে আব্বাস এবং ইবনে আব্বাস (রাঃ) কা’বে আহরারকে
পৃষ্ঠা:০৮
জিজ্ঞাসা করলেনঃ রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর শুণ তওরাতে কিভাবে উল্লেখিত হয়েছে? কা’ব বললেন: তওরাতে তিনি এভাবে আলোচিত হয়েছেন-“মোহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ মক্কায় জন্যগ্রহণ করবেন এবং মদীনায় হিজরত করবেন। তাঁর রাজত্ব মুলুকে শাম পর্যন্ত বিস্তৃত হবেন। তিনি বাজারে ঘুরাফিরাকারী হবেন না। মন্দের জবাবে মন্দ আচরণ করবেন না; বরং ক্ষমা ও মার্জনা করে দিবেন। তাঁর উম্মত আল্লাহর প্রভূত প্রশংসাকারী হবে। তারা প্রতিটি আনন্দের ক্ষেত্রে আল্লাহর প্রশংসা করবে এবং তাঁর মাহাত্ম্য বর্ণনা করবে। তারা আপন হাত, পা ধৌত করবে এবং কোমরে লুঙ্গি বাঁধবে। নামাযের জন্যে যুদ্ধের ন্যায় সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াবে। মসজিদ সমূহে তাদের দোয়া ও তেলাওয়াতের গুঞ্জন মৌমাছির ভনভন শব্দের মত শ্রুত হবে। তাদের দোয়া আকাশে-শুনা যাবে।” যুবায়র ইবনে বাক্কার “আখবারে-মদীনা” গ্রন্থে এবং আবূ নয়ীম হযরত ইবনে মসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন- আমার গুণ এরূপ: আহমদ, মুতাওয়াক্কিল। জন্মস্থান মক্কা। হিজরতভূমি মদীনা। না বদমেযাজ, না কঠোর স্বভাব। সদাচরণের প্রত্যুত্তরে সদাচরণ করেন এবং অসদাচরণের জবাবে অসদাচরণ করেন না। তাঁর উম্মত সর্বাবস্থায় আল্লাহর খুব গুণগান করে। তারা কোমরে লুঙ্গি বাঁধে। আপন হাত, পা ধৌত করে। তাদের ‘ইনজীল’ তাদের বক্ষে সংরক্ষিত। তারা নামাযের জন্যে জেহাদের ন্যায় সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়। তারা সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করে। তারা রাতের বেলায় সন্ন্যাসী এবং দিবাভাগে সিংহ হয়ে যায়।” ইবনে সা’দ, হাকেম, বায়হাকী ও আবূ নয়ীম হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, নবী করীম (সাঃ) সম্পর্কে ইনজীলে এভাবে উল্লেখ আছে- : তিনি না বদমেযাজ, না কঠোর স্বভাব। তিনি বাজারে ঘুরাফিরাও করেন না। মন্দের প্রতিদান মন্দ দিয়ে দেন না; বরং ক্ষমা ও মার্জনা করে দেন। বায়হাকী ও আবূ নয়ীম উম্মে দারদা থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তিনি কা’বকে জিজ্ঞাসা করলেনঃ তওরাতে নবী করীম (সাঃ)-এর উল্লেখ কিভাবে করা হয়েছে? কা’ব বললেন: তওরাতে তাঁর উল্লেখ এভাবে করা হয়েছে- ও তিনি আল্লাহর রসুল। তিনি না বদমেযাজ, না কঠোর স্বভাব, না বাজারে ঘুরাফিরা করেন। তাঁকে ধনভাণ্ডার দান করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা তাঁর মাধ্যমে অন্ধদেরকে সৃষ্টিশক্তি দান করবেন। বধির কর্ণসমূহকে শ্রবণ শক্তি দান করবেন এবং বিপথগামীদেরকে পথে আনবেন। অবশেষে সকলেই সাক্ষ্য দিবে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।” তিনি উৎপীড়িতদের সাহায্য করবেন এবং দুর্বলদের হেফাযত করবেন। আবু নয়ীম হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেছেন- হযরত মূসা (আঃ)-এর প্রতি তওরাত নাযিল হলে পর তিনি তাতে উম্মতে মোহাম্মদীর উল্লেখ দেখে বললেন: পরওয়ারদেগার! আমি তওরাতে এক উম্মতের উল্লেখ দেখতে পাচ্ছি, যারা সকলের শেষে আগমন করবে এবং প্রতিযোগিতায় সকলের অগ্রে চলে যাবে। আপনি তাদেরকে আমার উম্মত করে দিন। আল্লাহ বললেন: এরা আহমদের উম্মত। মূসা (আঃ) বললেনঃ পরওয়ারদেগার! তওরাতে এক উন্মতের উল্লেখ আছে, যারা আপনাকে ডাকবে এবং তাদের দোয়া কবুল হবে। তাদেরকে আমার উম্মত করে দিন। আল্লাহ তায়ালা বললেন: এরা তো আহমদের উম্মত। মূসা (আঃ) বললেন: পরওয়ারদেগার, তওরাতে এমন লোকদের কথা আছে, যাদের ‘ইনজীল’ তাদের বক্ষে সংরক্ষিত থাকবে। তারা সেটি মুখে মুখে তেলাওয়াত করকে। তাদেরকে আমার উম্মত করে দিন। আল্লাহ তায়ালা বললেন: এরাতো আহমদের উম্মত। মূসা (আঃ) বললেন: প্রভু, তওরাতে এমন লোকদের উল্লেখ আছে, যাদের জন্যে গনীমত তথা যুদ্ধলব্ধ সম্পদ হালাল। তাদেরকে আমার উম্মত করে দিন। আল্লাহ তায়ালা বললেনঃ এরা আহমদের উম্মত। মূসা (আঃ) বললেনঃ হে রব! তওরাতে এমন উম্মতের কথা আছে, যারা নিজেদেরই আত্মীয়-স্বজনকে খয়রাত দিবে এবং এ জন্যে তাদেরকে পুরস্কৃত করা হবে। এদেরকে আমার উম্মত করে দিন। আল্লাহ পাক বললেন: এরা তো আহমদের উম্মত। মুসা (আঃ) বললেনঃ পরওয়ারদেগার। তওরাতে তাদের উল্লেখ আছে, যারা সৎকাজ করার ইচ্ছা করলে এবং আনজাম না দিলেও তাদেরকে এক পুণ্যের সওয়াব দেয়া হবে, আর আনজাম দিলে দশ পুণ্যের সওয়াব দান করা হবে। তাদেরকেই আমার উম্মত করে দিন। আল্লাহ তায়ালা বললেনঃ এরাও আহমদের উম্মত। মূসা (আঃ) বললেনঃ প্রভু হে। তওরাতে এমন লোকদের কথা আছে, যারা কেবল পাপ কাজের ইচ্ছা করে তা আনজাম না দিলে তাদের কোন পাপ লেখা হবে না। আর যদি আনজামও দেয়, তবে কেবল একটি পাপই লেখা হবে। পরওয়ারদেগার। তাদেরকে আমার উম্মত করে দিন। আল্লাহ বললেন: এরাও আহমদের উম্মত। মূসা (আঃ) বললেনঃ হে রব। তওরাতে এমন লোকদের উল্লেখ আছে, যাদেরকে পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের সম্পর্কে জ্ঞান দান করা হবে এবং যারা পথভ্রষ্টতা মিটিয়ে দিবে ও মসীহ দাজ্জালকে হত্যা করবে। পরওয়ারদেগার, তাদেরকে আমার উম্মত করে দিন। আল্লাহ বললেনঃ এরাও আহমদের উম্মত হবে। অতঃপর মূসা (আঃ) বললেনঃ পরওয়ারদেগার! তাহলে আমাকেও আহমদের উম্মতের একজন করে দিন। এতে আল্লাহ তায়ালা মূসা (আঃ) কেও দু’টি স্বাতন্ত্র্য দান করলেন; বললেনঃ হে মূসা। আমি তোমাকে আমার পয়গাম (রেসালত) ও কালামের জন্যে বেছে নিয়েছি। অতএব, আমি যা দিচ্ছি, তা নাও এবং কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও। এ কথা শুনার পর হযরত মূসা (আঃ) আরজ করলেনঃ পরওয়ারদেগার। আমি রাযীদ
পৃষ্ঠা:০৯
আবু নয়ীম আবদুর রহমান মুয়াফেরী থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, কা’বে আহবার জনৈক ইহুদী আলেমকে ক্রন্দনরত দেখে জিজ্ঞাসা করলেনঃ ব্যাপার কি? আলেম বলল: কোন একটি কথা মনে পড়েছে। কা’ব বললেনঃ আমি তোমাকে আল্লাহর কসম দিয়ে বলছি, যদি আমি তোমার ক্রন্দনের কারণ বলে দেই তবে তুমি আমার প্রশ্নসমূহের সঠিক জবাব দিবে কি? সে বলল: হ্যাঁ, দিব। কা’ব বললেনঃ তোমাকে আল্লাহর কসম দিয়ে জিজ্ঞাসা করছি। মূসা (আঃ) তওরাত পাঠ করে পরওয়ারদেগারকে বললেন: পরওয়াদেগার! তওরাতে একটি শ্রেষ্ঠ উম্মতের উল্লেখ আছে, যারা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ দিবে এবং অসৎ কাজ করতে নিষেধ করবে। তারা অতীত ও সর্বশেষ কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান আনবে। পথভ্রষ্টদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। অবশেষে কানা দাজ্জালকেও হত্যা করবে। পরওয়ারদেগার। তাদেরকে আমার উম্মত করে দাও। আল্লাহ বললেনঃ এরা আহমদের উম্মত হবে। এ কথা শুনে ইহুদী আলেম বলল। হাঁ, এটা ঠিক। অতঃপর কা’ব বললেন: তোমাকে আল্লাহর কসম দিয়ে জিজ্ঞাসা করছি, আল্লাহর কিতাবে এ কথাও আছে কি যে, তওরাত পাঠ করার পর মুসা (আঃ) আল্লাহকে বললেনঃ হে রব, এই কিতাবে এমন লোকদের কথা আছে, যারা তোমার সর্বাধিক প্রশংসা করবে। সময়ের অনুবর্তিতা করবে, সংকল্পে দৃঢ় হবে। কোন কাজের ইচ্ছা করলে ইনশাআল্লাহ বলবে। হে রব! তাদেরকে আমার উম্মত করে দিন। আল্লাহ বললেন: এরা তো আহমদের উম্মত। এ প্রশ্ন শুনে ইহুদী আলেম বললঃ হ্যাঁ, ঐশী কিতাবে এরূপ আছে। কা’ব বললেনঃ আমি তোমাকে আল্লাহর কসম দিয়ে বলছি- কিতাবে এ কথা আছে কি যে, মূসা (আঃ) তওরাত পাঠ করার পর বললেন, হে আল্লাহ! তওরাতে এমন লোকদের উল্লেখ আছে, যারা উচ্চ ভূমিতে আরোহণ করার সময় আল্লাহর হামদ করবে। আর যখন কোন নিম্নভূমিতে অবতরণ করে, তখনও আল্লাহর হামদ করবে। মাটি তাদের জন্যে পবিত্র। সমগ্র ভূপৃষ্ঠ তাদের সেজদার স্থান। তারা ‘জানাবত’ থেকে পবিত্র থাকবে। পানি না পাওয়া গেলে মাটিও তাদের জন্যে পাক হওয়ার উপাদানরূপে গণ্য হবে। তাদের মুখমণ্ডল ওযুর কারণে ঝলমল করবে। হে রব! তাদেরকে আমার উম্মত করে দাও। আল্লাহ বললেন। এরাও আহমদের উম্মত। এ কথা শুনে ইহুদী আলেম বলল: এটাও ঠিক। কা’ব বললেনঃ তোমাকে কসম দিয়ে জিজ্ঞাসা করছি- তুমি কি ঐশী গ্রন্থে এ কথাও পাও যে, হযরত মূসা (আঃ) তওরাত পাঠ করে আরজ করলেন: প্রভু হে! এই কিতাবে এমন লোকদের উল্লেখ আছে, যাদের প্রতি তুমি রহমত করেছ। যারা দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও কিতাবের উত্তরাধিকার লাভ কর’ব! তুমি তাদেরকে মনোনীত করেছ। তাদের কেউ কেউ নিজের উপর জুলুম করবে। কেউ কেউ মধ্যবর্তী পথে চলবে এবং কেউ কেউ সৎ কাজের দিকে দ্রুত ধাবিত হবে। তবে তোমার রহমত। তাদের সকলের উপর সমভাবে বর্ষিত হবে। তাদেরকেই আমার উম্মত করে দাও। আল্লাহ বললেন: এরা তো আহমদের উম্মত। ইহুদী আলেম বললঃ হ্যাঁ, তাই। কা’ব বললেনঃ আমি তোমাকে কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করছি- হযরত মূসা (আঃ) তওরাত পাঠ করার পর আরজ করলেনঃ হে আল্লাহ। তোমার কিতাবে এমন লোকদের উল্লেখ দেখা যায়, যাদের কোরআন বুকের মধ্যে সংরক্ষিত থাকবে। তারা জান্নাতীদের অনুরূপ বস্ত্র পরিধান করবে। নামাযের সারি এমন বানাবে, যেমন ফেরেশতারা তোমার দরবারে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মসজিদসমূহে তাদের তেলাওয়াতের শব্দ মৌমাছির গুঞ্জনের মত শ্রুত হবে। তাদের কেউ জাহান্নামে যাবে না, যে পর্যন্ত সে পুণ্য কাজ থেকে এমনভাবে খালি না হয়, যেমন প্রস্তরখণ্ডের উপরিভাগ ঘাস থেকে খালি থাকে। হে আল্লাহ। তাদেরকে আমার উম্মত করে দাও। আল্লাহ বললেন, এরা তো আহমদের উম্মত। ইহুদী আলেম বলল, হ্যাঁ, এটাও সঠিক। আল্লাহ তাআলার জবাব শুনে মূসা (আঃ) বিস্মিত হলেন যে, আল্লাহ তায়ালা হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এবং তাঁর উম্মতকে কি পরিমাণ কল্যাণ ও সৌভাগ্য দান করেছেন। তিনি বললেন, হায়। আমি নিজেও যদি হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-এর উম্মত হতাম। এরপর আল্লাহ তাঁকে এই আয়াত ওহী করলেন, يمُوسَى إِنِّي اصْطَفَيْتُكَ عَلَى النَّاسِ بِرِلْتِي وَبِكَلَامِي . : হে মুসা (আঃ)। আমি তোমাকে আমার পয়গাম ও কালামের জন্যে মনোনীত করেছি। এতে মূসা (আঃ) খুশী হয়ে গেলেন। আবু নয়ীম সায়ীদ ইবনে আবী হেলাল থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) কা’বে আহবারকে বললেন: বলুন, অতীত ঐশী গ্রন্থসমূহে হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) ও তাঁর উম্মতের উল্লেখ কিভাবে করা হয়েছে? কা’ব বললেন: পূর্ববর্তী কিতাবে বলা হয়েছে যে, হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) ও তাঁর উম্মত আল্লাহ তায়ালার খুব প্রশংসা করবে। তারা প্রত্যেক ভাল-মন্দ বিষয়ে আল্লাহর তারীফ করবে। উচ্চভূমিতে আরোহণ করার সময় আল্লাহর মাহাত্ম্য ঘোষণা করবে এবং নিম্ন ভূমিতে অবতরণ করার সময় তাঁর পবিত্রতা পাঠ করবে। তাদের দোয়া আকাশ পর্যন্ত পৌছবে এবং তাদের নামাযের গুঞ্জন মৌমাছিদের শব্দের মত হবে। তারা নামাযে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়, যেমন ফেরেশতারা তাদের প্রতিপালকের। দরবারে দণ্ডায়মান হয়। যুদ্ধক্ষেত্রেও তারা নামাযের ন্যায় সারিবদ্ধ হবে। তারা
পৃষ্ঠা:১০
জেহাদের জন্যে বের হলে ফেরেশতারা তাদের অগ্রে ও পশ্চাতে বর্শা নিয়ে বের হবে। আল্লাহর পক্ষে বের হওয়ার সময় আল্লাহ তাদেরকে ছায়াদান করবেন, যেমন বাজপাখী তার বাসায় থাকে। (এ স্কুলে কা’ব ইশারার মাধ্যমে বাজের বাসায় পাখা বিস্তার করার দৃশ্য দেখিয়ে দেন।) তারা কোন কঠিন স্থানে পিছপা হয় না। এরূপ ক্ষেত্রে জিবরাঈল তাদের সাহায্যার্থে চলে আসেন। আবু নয়ীম হিলইয়া গ্রন্থে হযরত আনাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলে করীম (সাঃ) এরশাদ করেছেন- আল্লাহ তায়ালা হযরত মূসা (আঃ)-এর প্রতি ওহী পাঠালেন- যে ব্যক্তি আহমদকে অস্বীকার করবে, আমি তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব। মূসা (আঃ) জিজ্ঞাসা করলেন: আহমদ কে? আল্লাহ তায়ালা বললেন: আহমদ সেই ব্যক্তি, সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে যার চেয়ে উত্তম কেউ নেই। তার নাম নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টির পূর্বেই আমি আরশে লিখে দিয়েছিলাম। জান্নাতে কেউ দাখিল হবে না, যে পর্যন্ত সে নিজে এবং তাঁর সমস্ত উম্মত দাখিল না হয়ে যায়।হযরত মূসা (আঃ) জিজ্ঞাসা করলেন। তাঁর উম্মত কেমন? আল্লাহ বললেন : তারা আল্লাহর খুব হামদ করবে। প্রত্যেক উঁচু নীচু স্থানে আল্লাহর প্রশংসা করবে। শরীরের মাঝখানে লুঙ্গি বাঁধবে। ওষু করবে। দিনে রোযা রাখবে এবং রাতে এবাদত করবে। আমি তাদের নিম্নতম পর্যায়ের আমলও কবুল করে নিব। তাদেরকে কেবল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে জান্নাতে দাখিল করব। হযরত মূসা (আঃ) বললেনঃ আমাকে তাদের নবী করে দিন। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করলেন: তাদের নবী তাদের মধ্য থেকেই হবে। মূসা (আঃ) বললেনঃ তা হলে আমাকে সেই নবীর উম্মত করে দিন। আল্লাহ বললেন: সেই নবী পরবর্তীকালে আগমন করবেন। তবে তুমি জান্নাতে তাঁর সাথে থাকবে।” ইবনে আবী হাতেম ও আবু নয়ীম ওয়াহাব ইবনে মুনাব্বেহ থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আল্লাহ তায়ালা ইউশা নবীর কাছে ওহী পাঠালেন: আমি একজন নবী উন্মী প্রেরণ করব, যার মাধ্যমে বধির কর্ণসমূহকে, বন্দ অন্তরসমূহকে এবং অন্ধ চক্ষুসমূহকে উন্মোচন করব। সেই নবী মক্কায় জন্মগ্রহণ করবেন। মদীনায় হিজরত করবেন এবং তাঁর রাজত্ব শামদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। আমার এই বান্দার নাম মুতাওয়াক্কিল, মুস্তফা, মরফু, হাবীব, মাহবুব ও মুখতার হবে। মন্দের জবাবে মন্দ আচরণ করবে না; বরং মাফ করে দিবে। ঈমানদারদের প্রতি অত্যন্ত দয়াশীল হবে। জন্তুর পিঠে বোঝা দেখে এবং এতিমকে বিধবার কোলে দেখে অশ্রুসজল হয়ে যাবে। সে না বদস্বভাব হবে, না কঠোর মেযাজ। বাজারে ঘুরাফিরা করবে না। অশোভন ও অমার্জিত কথাবার্তা বলবে না। এতটুকু গম্ভীর যে, প্রদীপের পার্শ্ব দিয়ে চলে গেলে তার শিখা সামান্যও নড়বে না। বাঁশের উপর দিয়ে হাঁটলেও পায়ের শব্দ শুনা যাবে না। সে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী, প্রতিটি ভাল কাজের জন্যে প্রস্তুত, সচ্চরিত্রতায় ভূষিত, গাম্ভীর্য তাঁর পোশাক, সততা তাঁর ভূষণ, খোদাভীতি তাঁর বিবেক। প্রজ্ঞা তাঁর বুদ্ধিমত্তা। সত্যবাদিতা তাঁর মজ্জা। ক্ষমা ও অনুগ্রহ তাঁর চরিত্র, ন্যায়বিচার তাঁর স্বভাব, সত্যতা তাঁর শরীয়ত। হেদায়াত তাঁর পথ প্রদর্শক। ইসলাম তাঁর ধর্ম এবং আহমদ তাঁর নাম। আমি তাঁর মাধ্যমে পথভ্রষ্টদেরকে হেদায়েত এবং অজ্ঞদেরকে জ্ঞান দান করব। তাঁর মাধ্যমে অনুন্নতদেরকে উন্নত করব। অখ্যাতদেরকে সম্মান দান করব। দরিদ্রদেরকে প্রচুর ধন-সম্পদ দান করব। নিঃস্বদের ধনাঢ্য করব। বিচ্ছিন্নতার পর মিলন ঘটাব। ভিন্ন মতাবলম্বীদেরকে পরস্পরে মিলিত করব এবং তাঁর উম্মতকে সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত করব। তারা মানুষকে সৎকাজের আদেশ করবে এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখবে। আমার প্রতি এবং আমার তওহীদের প্রতি সাচ্চা ঈমান রাখবে। আমার সকল পয়গাম্বরের কিতাবে বিশ্বাস রাখবে। তারা সময়ের খেয়াল রাখবে। তারা সেসব লোকের অন্তর্ভুক্ত হবে যাদের অন্তর, মুখমণ্ডল ও রুহ আমার হয়ে গেছে। তাদেরকে মোবারকবাদ! আমি তাদেরকেই সেই মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করব যারা মসজিদে, মজলিসে, নিদ্রাস্থলে এবং ঠিকানায় সর্বদা আমার পরিত্রতা, প্রশংসা, মহত্ত্ব ও একত্ব বর্ণনা করবে। তারা নামাযে এমনভাবে সারিবদ্ধ হবে, যেমন ফেরেশতারা আমার আরশের চারপাশে সারিবদ্ধ হয়। তারা আমার দোস্ত ও আনসার। আমি তাদের খাতিরে আমার দুশমন মূর্তিপূজারীদের কাছ থেকে প্রতিশোধ নিব। তারা দাঁড়িয়ে, বসে, রুকু করে ও সেজদা করে নামায আদায় করবে। তাদের হাজারো লোক আমার খাতিরে জানমাল বিসর্জন দিতে বের হয়ে পড়বে এবং আমার পথে সারিবদ্ধ হয়ে লড়াই করবে। তাদের ধর্মগ্রন্থ সর্বশেষ, তাদের শরীয়ত সর্বশেষ এবং তাদের ধর্ম সর্বশেষ হবে। সুতরাং যে ব্যক্তি তাদের আমলে তাদের কিতাব, তাদের শরীয়ত এবং তাদের ধর্মে ঈমান আনবে না, আমার সাথে তার কোন সম্পর্ক থাকবে না এবং আমি তার তরফ থেকে মুক্ত। আমি তাদেরকে সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত করব। তারা কিয়ামতের দিন সকলের জন্যে সাক্ষ্যদাতা হবে। তারা যখন ক্রুদ্ধ হয়, তখন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলবে। কোন বিষয়ে তিক্ততা অনুভব করলে “আল্লাহু আকবার” বলবে। তাদের মধ্যে কোন কলহ সৃষ্টি হয়ে গেলে “সোবহানাল্লাহ” বলবে। তারা হাত মুখ ও পা ধৌত করে এবং লুঙ্গি মাঝখানে বাঁধবে। উঁচু স্থানে উঠার সময় “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” বলবে। আল্লাহর পথে প্রাণ উৎসর্গ করবে। তাদের ইঞ্জিল তাদের বক্ষে সংরক্ষিত থাকবে। তারা রাতে আবেদ, যাহেদ এবং দিনে সিংহের ন্যায় সংগ্রামী হবে। তাদের মুয়াযযিন শূন্য পরিমন্ডলে আহহ্বান ছড়িয়ে দেবে। তাদের তেলাওয়াতের গুঞ্জন মৌমাছির আওয়াজের মত হবে। সেই ব্যক্তি সফলকাম, যে তাদের সাথে থাকবে এবং তাদের শরীয়ত মেনে চলবে। এটা আমার পুরস্কার
পৃষ্ঠা ১১ থেকে ২০
পৃষ্ঠা:১১
আমি যাকে ইচ্ছা এই পুরস্কার দান করি। আমার পুরস্কারের বিস্তৃতির কোন পারাপার নেই।বায়হাকী হবরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন: ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, জারুন্দ ইবনে আবদুল্লাহ নবী করীম (সাঃ)-এর খেদমতে হাজির হয়ে ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং বললেন: সেই আল্লাহর কসম, যিনি আপনাকে নবী করে প্রেরণ করেছেন- আমি আপনার আলোচনা তওরাতে পেয়েছি এবং হযরত ঈসা (আঃ) আপনার আগমনের সুসংবাদ দিয়েছেন। আবু নয়ীম সায়ীদ ইবনে মুসাইয়িব (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) কা’ব আহবারকে জিজ্ঞাসা করলেন: আপনি নবী করীম (সাঃ) ও হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর আমলে ইসলাম গ্রহণ করলেন না কেন? এখন হযরত ওমর (রাঃ)-এর খেলাফতকালে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। কা’ব বললেন: আমার পিতা তওরাতের কিছু অংশ লেখে আমাকে দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন যে, ব্যস এটুকুই মেনে চলবে এবং এই আমলই অব্যাহত রাখবে। তিনি অবশিষ্ট তওরাত মোহরাবদ্ধ করে বললেন: এই মোহর ভেঙ্গে তওরাত পাঠ করার চেষ্টা করবে না। এরপর যখন ইসলাম সমগ্র কল্যাণ নিয়ে আগমন করল, তখন আমি ভাবলাম, আমার পিতা কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমার কাছ থেকে গোপন করেছেন? সেমতে আমি মোহর ভেঙ্গে দিলাম এবং তওরাতে হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-এর আলোচনা পেয়ে গেলাম। তাই আমি এখন মুসলমান হয়ে গেছি। আবু নয়ীম শহর ইবনে হাওশাবের বরাত দিয়ে বর্ণনা করেন যে, কা’ব বলেন: আমার পিতা তওরাতের বড় আলেম ছিলেন। তিনি আমার কাছে কখনও কোন কথা গোপন করেননি। অন্তিম সময় উপস্থিত হলে তিনি আমাকে ডেকে বললেনঃ আমি আমার জ্ঞানভাণ্ডার থেকে কোন কথা তোমার কাছে গোপন রাখিনি। হ্যাঁ, দু’টি পৃষ্ঠা আমি লুকিয়ে রেখেছিলাম, যার মধ্যে ভবিষ্যৎ নবীর আলোচনা ছিল। তাঁর আগমনের সময় সন্নিকটে। আমি দু’টি পৃষ্ঠার বিষয়বস্তু এজন্যে বলিনি, যাতে তুমি কোন মিথ্যা নবীর খপ্পরে না পড়ে যাও। আমি পৃষ্ঠা দু’টি এই তাকে রেখে উপরিভাগ লেপে দিয়েছি। তুমি এগুলো এখনই বের করবে না। কেননা, যদি আল্লাহ তোমার কল্যাণ চান এবং শেষ নবীর আবির্ভাব ঘটে, তবে তুমি তাঁর অনুসারী হয়ে যাবে। এরপর আমার পিতা মারা গেলেন এবং আমরা তাঁকে দাফন করে দিলাম। এখন আমার মধ্যে দু’টি পৃষ্ঠা দেখার আগ্রহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। সেমতে আমি এগুলো বের করলাম। তাতে এই বিষয়বস্তু ছিল: মোহাম্মদ আল্লাহর রসূল ও সর্বশেষ নবী। তাঁর পরে আর কোন নবী আগমন করবেন না। তাঁর জন্মস্থান মক্কা এবং হিজরতের স্থান মদীনা। তিনি না বদমেযাজ, না কঠোর, না বাজারে ঘুরাফিরা করবেন। তিনি মন্দের জবাবে মন্দ আচরণ করবেন না; বরং ক্ষমা ও মার্জনা করবেন। তাঁর উম্মত আল্লাহর অত্যধিক প্রশংসাকারী হবে। তারা সর্বাবস্থায় আল্লাহর গুণকীর্তন করবে। আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের নবীকে সর্বাবস্থায় মদদ করা হবে। তারা আপন লজ্জাস্থান ধৌত করবে। কোমরে লুঙ্গি পরিধান করবে। তাদের ‘ইনজীল’ তাদের বক্ষে সুরক্ষিত থাকবে। তারা পরস্পরে এমন সহানুভূতিশীল হবে, যেমন এক মায়ের সন্তান। এই উম্মত সর্বপ্রথম জান্নাতে প্রবেশ করবে। এই বিষয়বস্তু দেখার কিছুদিন পরেই আমি সংবাদ পেলাম যে, নবী করীম (সাঃ) আবির্ভূত হয়েছেন। কিন্তু আমি ইসলাম গ্রহণে বিলম্ব করলাম, যাতে উত্তমরূপে প্রমাণ পেয়ে যাই। ইতিমধ্যে নবী করীম (সাঃ)-এর ওফাত হয়ে গেল এবং তাঁর একজন খলিফা নিযুক্ত হলেন। তাঁর সেনাবাহিনী আমাদের এলাকায় পৌছল। আমি মনে মনে বললামঃ আমি এই ধর্মে দাখিল হব না, যে পর্যন্ত তাদের চালচলন না দেখে নেই। এমনিভাবে আমি ইসলাম গ্রহণ বিলম্বিত করতে লাগলাম। অবশেষে হযরত ওমর (রাঃ)-এর নিয়োজিত কর্মচারীরা এসে গেল। যখন আমি তাদের অঙ্গীকার পূরণের অবস্থা দেখলাম এবং শত্রুর মোকাবিলায় খোদায়ী সাহায্য প্রত্যক্ষ করলাম, তখন বুঝে নিলাম যে, আমি তাদেরই অপেক্ষায় ছিলাম। এক রাতে আমি গৃহের ছাদে কাউকে এই আয়াত তেলাওয়াত করতে শুনলাম- ايُّهَا الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَبَ آمِنُوا بِمَا نَزَّلْنَا مُصَدِّقًا لِمَا معكم مِّنْ قَبْلِ أَنْ نَطْمِسَ وُجُوهَا . হে ঐশী গ্রন্থের অধিকারীবৃন্দ। আমি যা নাযিল করেছি (অর্থাৎ কোরআন) তার প্রতি ঈমান আন। এটি তোমাদের কাছে যে কিতাব আছে, তার সত্যায়ন করে। (ঈমান আন) এমন হওয়ার আগেই যে, আমি চেহারাসমূহকে বিকৃত করে পশ্চাদ্দিকে ঘুরিয়ে দিব। (সূরা নিসা, আয়াত-৪৭) এই আয়াত শুনে আমি খুবই ভীত হয়ে পড়লাম। মনে হল যেন সকাল হওয়ার আগেই আল্লাহ তায়ালা আমার মুখমণ্ডল পশ্চাদ্দিকে ঘুরিয়ে দিবেন। সেমতে ভোর হওয়ার সাথে সাথে আমি মুসলমানদের অবস্থানের দিকে ধাবিত হলাম। এ রেওয়ায়েতটিই ইবনে আসাকির ওয়াইল, উপনে রাফে ও অন্য রাবীদের থেকেও বর্ণনা করেছেন। বায়হাকী ওয়াহাব ইবনে মুনাকেরহ থেকে রেওয়ায়েত করেন যে আল্লাহ Setti তায়ালা হযরত দাউদ (আঃ)-এর প্রতি ওহী পাঠালেন। হে দাউদ। তোমার পরে
পৃষ্ঠা:১২
একজন নবী আসবেন। তাঁর নাম হবে “আহমদ” ও “মোহাম্মদ”। আমি কখনও তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট হব না। তিনি কখনও আমার নাফরমানী করবেন না। আমি তাঁর আগে পিছের সমস্ত গোনাহ মাফ করে দিয়েছি। তাঁর উম্মত রহম প্রাপ্ত হবে। আমি এই উম্মতকে সেই সব নফল দিয়েছি, যা পয়গাম্বরগণকে দিয়েছি এবং সেই সব ফরয অর্পণ করেছি, যা পয়গাম্বরগণকে অর্পণ করেছি। কিয়ামতের দিন তারা পয়গাম্বরগণের মত নূর নিয়ে আমার কাছে আসবে। আমি তাদের উপর প্রত্যেক নামাযের জন্যে পবিত্রতা অর্জন করা ফরয করেছি। এটা পয়গাম্বরগণের জন্যেও জরুরী ছিল। আমি তাদেরকে জানাবাতের গোসল করার আদেশ দিয়েছি। পয়গাম্বরগণকেও তা দিয়েছিলাম। আমি তাদেরকে হজ্জ ও জেহাদ করারও আদেশ দিয়েছি, যেমন পয়গাম্বরগণকে দিয়েছিলাম। হে দাউদ। আমি মোহাম্মদ ও তাঁর উম্মতকে সকল উম্মতের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি। আমি তাদেরকে ছয়টি গুণ দান করেছি, যা অন্য কোন উম্মতকে দেইনি। আমি ভুল-ভ্রান্তির কারণে তাদেরকে ধৃত করব না। (হাদীসের অবশিষ্টাংশ পরে আসছে।) তিবরানী, বায়হাকী, আবু নয়ীম ও ইবনে আসাকির কালতান ইবনে আসেম (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আমরা নবী করীম (সাঃ)-এর কাছে উপবিষ্ট ছিলাম, এমন সময় এক ব্যক্তি আগমন করল। রসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে জিজ্ঞাসা করলেন: তুমি তওরাত পড়েছ? সে বলল: হ্যাঁ। আবার প্রশ্ন করলেন: ইঞ্জীলও পড়েছ? সে বলল: হ্যাঁ। অতঃপর রসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে কসম দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেনঃ তুমি তওরাত ও ইনজীলে আমার আলোচনা পেয়েছ? লোকটি বললঃ হ্যাঁ হুবহু আপনার অভ্যাস ও আপনার আপাদমস্তক অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। আমাদের ধারণা ছিল যে, এই শেষ নবী আমাদের মধ্য থেকে আবির্ভূত হবেন। আপনার আবির্ভাবের পর আমাদের আশংকা হয় যে, আপনিই হয়তো সেই নবী। কিন্তু অনেক চিন্তাভাবনার পর জানা গেল যে, আপনি সেই নবী নন। কেননা, আমাদের কিতাবে আছে যে, সেই নবীর সঙ্গে সত্তর হাজার উম্মত এমন থাকবে, যারা বিনা হিসাব-নিকাশে বেহশতে যাবে। আপনার সঙ্গে সামান্য সংখ্যক লোক রয়েছে। রসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেনঃ সেই আল্লাহর কসম, যাঁর কব্জায় আমার প্রাণ; আমিই সেই প্রতিশ্রুত নবী। বিনা হিসাবে যারা বেহেশতে যাবে, তারা আমারই উম্মত। আর তারা সত্তর হাজার কেন, সত্তার হাজারেরও অনেক বেশি হবে। তিবরানী, ইবনে হাব্বান, হাকেম, বায়হাকী ও আবূ নয়ীম আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, আল্লাহ তায়ালা যখন যায়দ ইবনে সা’নাকে হেদায়ত করার ইচ্ছা করলেন, তখন যায়দ ইবনে সা’না বলতে লাগল। নবুওয়তের সকল আলামতই আমি চিনে নিয়েছি; কেবল দু’টি আলামতই বাকী রয়েছে। এক, মূর্খতার উপর তাঁর সহনশীলতা ও গাম্ভীর্য প্রবল হবে এবং দুই, মূর্খতা যত বেশি প্রকাশ পাবে, তাঁর সহনশীলতা তত বেড়ে যাবে। সেমতে আমি রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সহনশীলতা ও গাম্ভীর্য পরীক্ষা করার জন্যে তাঁর খুব কাছাকাছি থাকতে শুরু করলাম। অতঃপর আমি তাঁর সাথে অগ্রিম খেজুর ক্রয়ের লেনদেন করলাম এবং মূল্য পরিশোধ করে দিলাম। খেজুর সমর্পণের তারিখ আমার দু’অথবা তিন দিন বাকী থাকতে আমি তাঁর কাছে যেয়ে তাঁর চাদর ধরে ফেললাম এবং কর্কশ ভাষায় বললামঃ হে মোহাম্মদ। আমার প্রাপ্য খেজুর পরিশোধ করবে না? তোমরা আব্দুল মুত্তালিবের পরিবার। দাবী পরিশোধে টালবাহানা করাই তোমাদের অভ্যাস, আমি পূর্বেই তা জানতাম। হযরত ওমর (রাঃ) ক্রুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং বললেনঃ হে আল্লাহর দুশমন। তুই আল্লাহর রসূল (সাঃ)-এর সাথে এভাবে কথা বলছিস? এক্ষণে আমার হাতে তলোয়ার থাকলে আমি তোর গর্দান উড়িয়ে দিতাম। এসময়ে রসূলুল্লাহ (সাঃ) হযরত ওমরের দিকে গাম্ভীর্যপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। অতঃপর মুচকি হেসে বললেনঃ হে ওমর। এ ব্যক্তি অন্য কোন আচরণের যোগ্য। তোমার উচিত আমাকে দাবী পরিশোধ করতে বলা এবং তাকে ভদ্রভাবে দাবী করতে বলা। যাও, তাকে তার দাবী মিটিয়ে দাও। তুমি যে তাকে ভয় দেখিয়েছ এবং ধমক দিয়েছ, এর বিনিময়ে বিশ ছা’ খেজুর অতিরিক্ত দিয়ে দাও। একথা শুনে আমি ওমর (রাঃ)-কে বললাম: হে ওমর। আমি নবুওয়তের সকল আলামতই পরীক্ষা করে চিনে নিয়েছিলাম; কেবল দু’টি আলামত বাকী ছিল। এক, তাঁর ধৈর্য ও সহনশীলতা মূর্খতার ঊর্ধ্বে থাকবে এবং দুই, মূর্খতার বৃদ্ধি সহনশীলতা বৃদ্ধির কারণ হবে। আজ আমি এ দু’টি আলামতও জেনে নিলাম। অতএব তুমি সাক্ষী থাক, আমি আল্লাহকে আমার রব, ইসলামকে ধর্ম এবং মুহম্মদ (সাঃ) নবীরূপে সন্তুষ্ট চিত্তে গ্রহণ করলাম। ইবনে সা’দে যুহরীর রেওয়ায়েতে আছে- জনৈক ইহুদী বলল: আমি তওরাতে উল্লিখিত রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সকল গুণই পরীক্ষা করলাম, ধৈর্য ও সহনশীলতা ছাড়া। সেমতে আমি খেজুর ক্রয় করার জন্যে তাঁকে অগ্রিম বিশ দীনার দিলাম। এরপর উপরে উল্লিখিত রেওয়াতে বর্ণিত হয়েছে। রেওয়ায়েতের শেষাংশে বলা হয়েছে- ইহুদী হযরত ওমর (রাঃ)-কে বললঃ হে ওমর। ইতিপূর্বে আমি তওরাতে উল্লিখিত সকল গুণই তাঁর মধ্যে পেয়েছি ধৈর্য ও সহনশীলতা ছাড়া। আজ আমি তাঁর সহনশীলতা পরীক্ষা করে তাই পেয়েছি, যা তওরাতে বর্ণিত হয়েছে। এরপর সেই ইহুদী ও তার পরিবারের সকলেই সানন্দে ইসলাম গ্রহণ করল। আবূ নযীম ইউসূফ ইবনে আবদুল্লাহ এবং তিনি পিতা আবদুল্লাহ ইবনে সালাম থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তিনি বলেছেন: আমি ঐশী গ্রন্থসমূহ পাঠ করেছি: মক্কায় একটি ঝান্স সমুন্নত হবে। এই ঝাণ্ডাবাহকের সাথে তাঁর আল্লাহ এবং তিনি te আল্লাহর সাথে থাকবেন। এরপর আল্লাহ তাঁকে সকল শহরের উপর বিজয় দান করবেন।
পৃষ্ঠা:১৩
ইবনে সা’দ ও ইবনে আসাকির মূসা ইবনে এয়াকুব যমরী থেকে রেওয়ায়েত করেন এবং তিনি গোছায়মার গোলাম থেকে বর্ণনা করেন যে, মরিসের খৃষ্টান সহল এতীম অবস্থায় আপন চাচার কাছে লালিত-পালিত হয়। সে বলে। একবার আমি ইনজীল পাঠ করতে শুরু করলাম। তাতে দু’টি পাতা পরস্পরে সংলগ্ন ও জড়ানো ছিল। আমি পাতাগুলো আলাদা করলে তাতে হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-এর গুণাবলী এভাবে বর্ণিত ছিল: তিনি না দীর্ঘদেহী, না খর্বাকৃতি। তাঁর উভয় কাঁধের মাঝখানে “মোহরে নবুওয়ত” থাকবে। তিনি অধিকাংশ সময় দু’পা খাড়া করে বসবেন। সদকা কবুল করবেন না। গাধা ও খচ্চরে আরোহণ করবেন। ছাগলের দুধ দোহন করবেন। তালিযুক্ত জামা পরিধান করবেন। এরূপ লোক অহংকারমুক্ত হয়ে থাকে। তিনি হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশধর এবং তাঁর নাম হবে আহমদ। আমি এ পর্যন্ত পড়ার পর আমার চাচা এসে গেলেন এবং আমার হাতে পাতা দু’টি দেখে আমাকে শাসিয়ে বললেন: তুমি এই পাতাগুলো খুললে কেন? আমি বললামঃ এতে আহমদ নবীর কথা আছে। তিনি বললেন: এই নবী এখনও আত্মপ্রকাশ করেননি।” বায়হাকী ওমর ইবনে হাকাম ইবনে রাফে’ ইবনে সিনানের মাধ্যমে বর্ণনা করেন- “আমাকে আমার চাচা ও পিতৃপুরুষেরা বলেছেন, তাদের কাছে একটি লিখিত বস্তু ছিল, যা মূর্খতা যুগ থেকে বংশ পরম্পরায় তাদের নিকট স্থানান্তরিত হয়ে আসছিল। অবশেষে ইসলামের আগমন ঘটল এবং নবী করীম (সাঃ) হিজরত করে মদীনায় আগমন করলেন। আমরা সেই লেখাটি নিয়ে তাঁর খেদমতে হাযির হলাম। তাতে লেখা ছিল ৪ “আল্লাহর নামে শুরু, যাঁর উক্তি সত্য। মিথ্যাবাদীদের উক্তি ধ্বংস ও বরবাদী ছাড়া কিছু নয়। শেষ যমনায় এক উম্মত আসবে, যারা স্ব স্ব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ধৌত করবে। তারা কোমরে পাজামা বাঁধবে। শত্রুদের পশ্চাদ্ধাবন সমুদ্রেও করবে। তাদের নামায এমন হবে যে, এই নামায নূহের সম্প্রদায়ে থাকলে তারা প্লাবনে ধ্বংস হত না। ‘আদ সম্প্রদায়ে থাকলে তারা ঝঞ্ঝাবায়ুতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত না এবং ছামূদ গোত্রে থাকলে তারা বিকট শব্দে ভূমিসাৎ হত না।” আমি এই লেখাটি পাঠ করে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে শুনালে তিনি বিশ্বয় প্রকাশ করলেন।ইবনে মানদাহ হযরত আনাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন: আল্লাহ তায়ালা আমাকে সমগ্র বিশ্বের জন্যে হেদায়াত ও রহমত করে প্রেরণ করেছেন। তিনি আমাকে এজন্যে প্রেরণ করেছেন, যাতে আমি সকল প্রকার বাদ্যযন্ত্র কেঁঙ্গে ফেলি। একথা শুনে আউস ইবনে সামআন বলতে লাগল: আল্লাহর কসম, যিনি আপনাকে রসূল করে প্রেরণ করেছেন- আমি তওরাতে এরূপই পাঠ করেছি। বায়হাকী ও আবু নয়ীম রেওয়ায়েত করেন যে, কা’বে আহবার (রাঃ) এক ব্যক্তিকে বলতে শুনলেন, আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, সমস্ত মানুষ হিসাব নিকাশের জন্যে হাশরের ময়দানে সমবেত হয়েছে। পয়গাম্বরগণকেও ডাকা হয়েছে। প্রত্যেক পয়গাম্বরের উম্মত তাঁদের সাথে রয়েছে। প্রত্যেক নবীর সঙ্গে দু’টি করে নূর ছিল এবং তাঁর অনুসারীদের সাথে একটি করে নূর ছিল। যখন নবী করীম (সাঃ) আগমন করলেন, তখন তাঁর এক একটি কেশ ও পবিত্র মুখমণ্ডল থেকে অজস্র ধারায় নূর বিচ্ছুরিত হচ্ছিল। ফলে সকলের দৃষ্টি তাঁর প্রতি নিবদ্ধ হয়ে গেল। তাঁর অনুসারীদের প্রত্যেকের সঙ্গে অন্য পয়গাম্বরগণের ন্যায় দু’টি করে নূর ছিল। এই নূরের সাহায্যে তাঁরা পথ চলছিল। কা’ব বলেনঃ আমি লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলাম: বাস্তবিকই তুমি এ স্বপ্ন দেখেছ? সে বলল: হ্যাঁ দেখেছি। কা’ব বললেনঃ সেই সত্তার কসম, যাঁর কবজায় আমার প্রাণ, আল্লাহর কিতাবে হযরত মোহাম্মদ, তাঁর উম্মত, নবীগণ এবং তাঁদের উন্মতের গুণাবলী এমনিভাবেই ব্যক্ত হয়েছে। মনে হয় লোকটি এসকল বিবরণ তওরাতে পাঠ করেছে। ইবনে আসাকির হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, পাঁচ জন নবীর আগমনের সুসংবাদ তাঁদের নবুওয়তপ্রাপ্তির পূর্বেই মানুষকে শুনিয়ে দেয়া হয়েছে। সেমতে ইসহাক ও ইয়াকুব (আঃ)-এর সুসংবাদ দিয়ে বলা হয়েছে- “আমি সুসংবাদ দিয়েছি ইসহাকের এবং ইসহাকের পরে ইয়াকুবের।” হযরত ইয়াহইয়া (আঃ)-এর সুসংবাদ দিতে গিয়ে বলা হয়েছে- “আল্লাহ আপনাকে ইয়াহইয়ার সুসংবাদ দিচ্ছেন।” হযরত ঈসা (আঃ) সম্পর্কে বলা হয়েছে- “আল্লাহ আপনাকে কলেমাতুল্লার সুসংবাদ দিচ্ছেন।” হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-এর সুসংবাদের ঘোষণা এভাবে করা হয়েছে- “আমি সুসংবাদদাতা আমার পরে আগমনকারী রসূলের, যাঁর নাম আহমদ।” আবূ নয়ীম হিলইয়া গ্রন্থে ওয়াহাব থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, বনী ইসরাঈলের এক ব্যক্তি দু’শ’ বছর পর্যন্ত আল্লাহর নাফরমানী করতে থাকে। তার মৃত্যু হলে লোকেরা তার মৃতদেহ আবর্জনার স্তূপে নিক্ষেপ করল। এতে আল্লাহ তায়ালা ওহী পাঠালেনঃ হে মূসা। এই ব্যক্তিকে বের করে তার জানাযার নামায পড়। মূসা (আঃ) আরজ করলেনঃ হে আল্লাহ! বনী-ইসরাঈল সাক্ষ্য দেয় ছে, ate লোকটি দু’শ’ বছর পর্যন্ত তোমার নাফরমানী করেছে। আল্লাহ ওহী পাঠালেন। হ্যাঁ তাই করেছে। কিন্তু সে যখন তওরাত খুলত এবং মোহাম্মদের নামের উপর তার
পৃষ্ঠা:১৪
দৃষ্টি পড়ত, তখন সেটিতে চুম্বন করত, তার উপর চোখ রাখত এবং তাঁর প্রতি দরূদ প্রেরণ করত। আমি তার এই এবাদত কবুল করে তার সমস্ত গোনাহ মাফ করে দিয়েছি। সত্তর জন হুরও তার বিবাহে দান করেছি। ইবনে সা’দ হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলে করীম (সাঃ) একবার মদীনার ইহুদীদের একটি পাঠাগারে গমন করলেন এবং তাদেরকে বললেন: তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বড় আলেম কে? তারা বলল: আবদুল্লাহ ইবনে ছুরিয়া। রসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে একান্তে নিয়ে গেলেন এবং বললেন: আমি তোমার ধর্মের কসম দিচ্ছি এবং সেসব নেয়ামতের কসম দিচ্ছি, যা আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে দান করেছেন; অর্থাৎ মান্না, সলওয়া ও মেঘমালার ছায়া দান-আমি যে আল্লাহর রসূল, একথা কি তুমি জান? ইবনে ছুরিয়া বললঃ হ্যাঁ, আমি জানি; বরং সমগ্র ইহুদী সম্প্রদায় জানে। কেননা, তওরাতে আপনার গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যসমূহ বর্ণিত আছে। কিন্তু এরা আপনার প্রতিহিংসাপরায়ণ। রসুলুল্লাহ (সাঃ) বললেনঃ তোমার বাধা কিসের? সে বলল: আমি আমার সম্প্রদায়ের বিরোধিতাকে ভয় করি। কিন্তু এদের ইসলাম গ্রহণ করারও সম্ভাবনা আছে। তখন আমার পক্ষেও ইসলাম কবুল করা সহজ হবে। আহমদ ও ইবনে সা’দ আবু ছখর ওকায়লী থেকে রেওয়ায়েত করেন- আমাকে জনৈক বেদুঈন বলেছে যে, একবার নবী করীম (সাঃ) এক ইহুদীর কাছ দিয়ে গমন করেন। তার পুত্র অসুস্থ ছিল এবং সে অসুস্থ পুত্রের কাছে বসে তওরাত পাঠ করছিল। রসুলুল্লাহ (সাঃ) তাকে বললেন: আমি তোমাকে আল্লাহর কসম দিয়ে জিজ্ঞাসা করছি- তওরাতে আমার গুণাবলী ও আবির্ভাবের বিষয় উল্লেখ আছে কি? ইহুদী মাথা নেড়ে অস্বীকার করল। কিন্তু তার পুত্র বললঃ আমি আল্লাহকে সাক্ষী করে বলছি, যিনি মূসা (আঃ)-এর প্রতি তওরাত নাযিল করেছেন-আমার পিতা আপনার গুণাবলী, আপনার সময়কাল ও আপনার আবির্ভাবের কথা তওরাতে উল্লিখিত দেখেছেন। আমি সাক্ষ্য দেই যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই এবং আপনি আল্লাহর রসূল। রসূলুল্লাহ (সাঃ) ইহুদীকে পুত্রের কাছ থেকে সরিয়ে দিলেন। এরপর পুত্রের মৃত্যু হয়ে গেলে হুযুর (সাঃ) তার জানাযার নামায় পড়ালেন। বায়হাকী এমনি ধরনের রেওয়ায়েত হযরত আনাস ও ইবনে মসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন। ইবনে সাদ কলবী থেকে, তিনি আবূ ছালেহ থেকে এবং তিনি হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, কোরায়শরা নযর, ইবনে হারেস ও ওকবা ইবনে আবী মুয়ীত প্রমুখকে মদীপায় ইহুদীদের কাছে রসূলুল্লাহ (সাঃ) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করার জন্যে প্রেরণ করল। মদীনাবাসীদের নিকট গিয়ে বলল: আমরা তোমাদের কাছে পরামর্শ করার জন্যে এসেছি। আমাদের এক পিতৃ-মাতৃহীন নগণ্য ব্যক্তি অনেক বড় কথা বলে। তার দাবী এই যে, সে আল্লাহর নবী। ইহুদীরা বললঃ তার কিছু গুণাগুণ বর্ণনা কর। তারা কিছু গুণাগুণ বর্ণনা করল। ইহুদীরা জিজ্ঞাসা করল। এখন পর্যন্ত কোন শ্রেণীর লোক তাঁর অনুসারী হয়েছে? তারা বলল: নিম্ন শ্রেণীর লোক। এতে একজন ইহনী আলেম হেসে বললঃ মনে হচ্ছে ইনিই সেই নবী, যাঁর গুণাবলী আমরা আমাদের কিতাবে পাই। তাঁর কওম তাঁর সর্বাধিক দুশমন হবে। আহমদ, বায়হাকী ও ইবনে আসাকির হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, নবী করীম (সাঃ)-এর কাছে জনৈক ইহুদীর কিছু দীনার পাওনা ছিল। সে তা দাবী করলে রসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেনঃ এক্ষণে আমার কাছে নেই। ইহুদী বলল। দীনার না দেওয়া পর্যন্ত আমি আপনাকে যেতে দিব না। তিনি বললেনঃ তাহলে আমি তোমার কাছে বসলাম। একথা বলে তিনি বসে পড়লেন। তিনি যোহর, আছর, মাগরিব, এশা এবং পরবর্তী দিনের ফজরের নামায সেখানেই পড়লেন। সাহাবায়ে কেরাম ইহুদীকে শাসালেন এবং রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে বললেনঃ হে আল্লাহর রসূল। এক ইহুদী আপনাকে আটকে রেখেছে? তিনি বললেন: আমার প্রতিপালক আমাকে কারও উপর জুলুম করতে মানা করেছেন। এমনিভাবে বেলা বেড়ে গেলে ইহুদী মুসলমান হয়ে গেল এবং নিজের অর্ধেক মাল আল্লাহর পথে দান করল। সে বলল: আল্লাহর কসম। আমি যা কিছু করেছি, কেবল তওরাতে বর্ণিত আপনার গুণাবলী পরীক্ষা করার জন্যেই করেছি। কেননা, তওরাতে আপনার সম্পর্কে বলা হয়েছে। ঃ মোহাম্মদ আল্লাহর বান্দা। তাঁর জনন্মস্থান মক্কা এবং হিজরতের স্থান মদীনা। তাঁর রাজত্ব শাম পর্যন্ত বিস্তৃত। তিনি না কঠোরভাষী, না কঠোর স্বভাব এবং না বাজারে ঘুরাফিরাকারী। তিনি মন্দ কাজ করেন না। মিথ্যা বলেন না। আবুশ শায়খ স্বীয় তফসীরে সায়ীদ ইবনে জুবায়র থেকে বর্ণনা করেন যে, সম্রাট নাজ্জাশীর কয়েকজন সহচর তাঁকে বলেছিলেন: আমাদেরকে সেই নবীর কাছে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হোক, যাঁর আলোচনা আমরা আমাদের কিতাবে পাই। সেমতে তারা নবী করীম (সাঃ)-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং ওহুদ যুদ্ধে যোগদান করেন। যুবায়র ইবনে বাক্কার কা’ব থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আল্লাহ তায়ালা হযরত মূসা (আঃ)-এর প্রতি যে কিতাব নাযিল করেন, তাতে মদীনাকে সম্বোধন করে বলা হয়েছে- হে তাইয়েবা, তাবা, মিসকীনা। ধনভাণ্ডার কবুল করো না; বরং স্বীয় পৃষ্ঠদেশ সকল শহরের পৃষ্ঠদেশের উর্ধ্বে তুলে ধর। যুবায়র ইবনে বাক্কার কাসেম ইবনে মোহাম্মদ থেকে বর্ণনা করেন যে, তওরাতে মদীনার চল্লিশটি নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
পৃষ্ঠা:১৫
রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আবির্ভাবের পূর্বে খৃষ্টান, ইহুদী আলেম ও সন্ন্যাসীদের ঘটনাবলী
হাকেম ও বায়হাকী হযরত সালমান ফারেসী (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, হযরত সালমান ফারেসী (রাঃ) তাঁর নিজের ইসলাম গ্রহণের ঘটনা বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেনঃ আমি রামহরমুযের একজন সাধারণ বালক ছিলাম। আমার পিতা কৃষক ছিলেন। আমাকে একজন ওস্তাদের কাছে কিছু শিক্ষা লাভ করার জন্য দেয়া হয়েছিল। পিতার মৃত্যুর পর আমি সেই ওস্তাদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করলাম। আমার বড় ভাই স্বনির্ভর ছিল, কিন্তু আমি একেবারে নিঃস্ব ছিলাম। ওস্তাদ যখন মজলিস ত্যাগ করতেন, তখন সকল শিষ্য সবক মুখস্থ করার জন্যে প্রস্থান করত। এদিকে ওস্তাদ গায়ে চাদর জড়িয়ে পাহাড়ে আরোহণ করতেন। ওস্তাদকে কয়েকবার এরূপ করতে দেখে আমি বললামঃ আমাকেও সঙ্গে করে পাহাড়ে নিয়ে যান। ওস্তাদ বললেনঃ তুমি ছেলে মানুষ। ভয় পেতে পার। আমি বললামঃ না, আমি ভয় পাব না। ওস্তাদ বললেন: এই পাহাড়ে কিছু লোক থাকে। তারা সর্বদা এবাদত, সাধনা এবং খোদার ধ্যানে মগ্ন থাকে। তারা বলে যে, আমরা অগ্নি ও প্রতিমার পূজা করি। অথচ এটা ঠিক নয়। আমি বললাম আমাকে তাদের কাছে নিয়ে চলুন। ওস্তাদ বললেনঃ আচ্ছাঃ আমি তাদের কাছ থেকে অনুমতি নিচ্ছি। শেষ পর্যন্ত অনুমতি দিলেন। আমি ওস্তাদের সাথে তাদের কাছে পৌঁছে গেলাম। তারা সাত অথবা ছয় জন ছিল। অধিক এবাদতের কারণে তারা অস্থিচর্মসার হয়ে গিয়েছিল। তারা দিনে রোযা রাখত এবং রাতভর নামায পড়ত। গাছের পাতা এবং যা কিছু পাওয়া যেত ভক্ষণ করে নিত। আমরা গিয়ে তাদের কাছে বসলে তারা আল্লাহর হামদ ও প্রশংসা বর্ণনা করল। অতীত পয়গাম্বরগণের কথা বলল। অবশেষে হযরত ঈসা (আঃ)-এর কথা বর্ণনা করত যে, তিনি পিতা ছাড়াই জন্মগ্রহণ করেছেন। আল্লাহ তাঁকে রসূল করেছেন এবং মৃতকে জীবিত করার, পাখী সৃষ্টি করার, অন্ধ, বোবা ও কুষ্ঠরোগীকে নিরাময় করার মোজেযা দান করেছেন। কিন্তু লোক তাঁকে মেনে নেয় এবং কিছু লোক অস্বীকার করে। তিনি বললেনঃ বৎসগণ। তোমাদের আল্লাহ আছেন। তোমাদেরকে পুনরুজ্জীবিত হতে হবে। তোমাদের সম্মুখে রয়েছে জান্নাত ও জাহান্নাম। এতদুভয়ের কোন একটিতে তোমাদের যেতে হবে। যারা অগ্নির পূজা করে, তারা কাফের ও পথভ্রষ্ট। আল্লাহ তাদের কাজে সন্তুষ্ট নন এবং তাদের কোন ধর্ম নেই। এসব কথাবার্তা শুনে আমরা চলে এলাম এবং পরের দিন আবার গেলাম। তারা পুনরায় এমনি ধরনের ভাল ভাল কথা বলল। শেষ পর্যন্ত আমি তাদের কাছেই রয়ে গেলাম। তারা বলল: সালমান। তুমি এখনও ছেলেমানুষ। আমরা যে পরিমাণ এবাদত করি, তুমি তা করতে পারবে না। তুমি কেবল নামায পড়বে আর ঘুমিয়ে পড়বে। এরপর পানাহার করবে।এরপর সমসাময়িক বাদশাহের কানে তাদের সংবাদ পৌঁছে গেল। বাদশাহ। তাদেরকে বহিষ্কারের নির্দেশ দিলে আমি বললামঃ আমি আপনাদেরকে ত্যাগ করতে পারব না। সেমতে আমিও তাদের সাথে রওয়ানা হয়ে গেলাম। অবশেষে আমরা মুসেলে পৌঁছে গেলাম। এখানকার লোকেরা আমাদের খুব সম্মান করল। একদিন এক ব্যক্তি গুহা থেকে বের হয়ে এল। সে এসে সালাম করতঃ আমার সঙ্গীদের কাছে বসে গেল। সঙ্গীরা তার প্রতি অত্যন্ত সম্মান প্রদর্শন করছিল। সে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করল: আপনারা কোথা থেকে এসেছেন। তারা সমুদয় ঘটনা বর্ণনা করল। এরপর সে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করল এবং সঙ্গীরা আমার সপ্রশংস পরিচয় প্রদান করল। এরপর আগন্তুক আল্লাহর হামদ ও প্রশংসা বর্ণনা করল এবং নবীগণের ইতিহাস তুলে ধরল। সবশেষে হযরত ঈসা (আঃ)-এর কথা আলোচনা করে উপদেশ দিল যে, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং ঈসা (আঃ)-এর শরীয়ত মেনে চল। আল্লাহর বিধি-বিধানের বিরুদ্ধাচরণ করো না। এই উপদেশদানের পর যখন সে গমনোদ্যত হল, তখন আমি বললামঃ আমি আপনার সঙ্গে যাব। সে বলল: বৎস! তুমি আমার সাথে থাকতে পারবে না। আমি কেবল রবিবারে এই গুহা থেকে বাইরে আসি। আমি বললামঃ যা-ই হোক, আমি আপনার সাথে থাকব। এই বলে আমি তার পিছনে পিছনে গুহায় পৌঁছে গেলাম। পরবর্তী রবিবার পর্যন্ত তিনি কিছুই খেলেন না এবং নিদ্রাও গেলেন না। কেবল রুকু ও সেজদায় পড়ে রইলেন। রবিবার এলে আমরা বাইরে বের হলাম। লোকজন সমবেত হয়ে গেল। তিনি পূর্বের ন্যায় উপদেশ দিতে শুরু করলেন। এরপর পুনরায় গুহায় ফিরে এলেন। আমিও তাঁর সঙ্গে এলাম। এভাবে সে প্রতি রবিবারে বাইরে বের হত এবং মানুষকে সদুপদেশ দিত। এক রবিবারে সে লোকজনকে বললঃ আমি অতিশয় বৃদ্ধ হয়ে গেছি। অস্থিতে প্রাণ নেই। অন্তিম সময় আসন্ন। দীর্ঘ দিন হয় বায়তুল-মোকাদ্দাসের যিয়ারত করিনি। এখন সেখানে যেতে চাই। একথা শুনেই আমি বললাম আমিও সঙ্গে যাব। এরপর আমরা বায়তুল মোকাদ্দাসে পৌঁছে গেলাম। সে ভিতরে যেয়ে নামায শুরু করে দিল। সে প্রায়ই আমাকে বলত, সালমান। আল্লাহ তায়ালা “আহমদ” নামে একজন রসূল পাঠাবেন। তিনি তেহামায় অর্থাৎ মক্কায় আবির্ভূত হবেন। তাঁর চিহ্ন এই যে, তিনি উপহার খাবেন, সদকা খাবেন না। তাঁর কাঁধের মাঝখানে নবুওয়তের মোহর থাকবে। তাঁর আত্মপ্রকাশের সময় সন্নিকটে। আমি তো এত বুড়ো হয়ে গেছি যে, তাঁর সময়কাল পাব বলে আশা করতে পারি না। যদি তুমি তাঁর সময়কাল পাও, তবে তাঁকে সত্য বলে বিশ্বাস করবে এবং তাঁর অনুসরণ করবে। আমি বললামঃ যদিও তিনি আপনার ধর্ম ত্যাগ করতে বলেন? সে বলল: হ্যাঁ যদিও তিনি আমার ধর্ম বর্জন করতে বলেন, তবুও তাঁর প্রতি ঈমান আনবে। এরপর তিনি বায়তুল মোকাদ্দাস te থেকে বের হলে শহরের বাইরে এসেই তিনি রহস্যময়ভাবে নিখোঁজ হয়ে খেললে
পৃষ্ঠা:১৬
আমি তাঁকে অনেক তালাশ করলাম কিন্তু সন্ধান করতে পারলাম না। এভাবে তালাশ করতে করতেই অবশেষে বনু কালবের একটি কাফেলার দেখা পাওয়া গেল। আমি তাদেরকেও জিজ্ঞাসা করলাম। আমার ভাষা শুনে তাদের এক ব্যক্তি আমাকে নিজের উটের পিঠে বসিয়ে নিল। সে আমাকে নিজের শহরে এনে এক মহিলার হাতে বিক্রয় করে দিল। সে আমাকে বাগানের কাজে নিযুক্ত করল। এভাবেই আমি মদীনায় উপনীত হলাম।রসূলুল্লাহ (সাঃ) মদীনায় আগমন করলে আমি বাগানের কিছু খেজুর নিয়ে তাঁর খেদমতে হাজির হলাম। তাঁর কাছে কিছু লোকজন উপবিষ্ট ছিল। আমি খেজুর’ সামনে রেখে দিলাম। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন: কিসের খেজুর? আমি বললামঃ সঙ্গকা। তিনি উপস্থিত লোকদেরকে বললেনঃ তোমরা খাও। তিনি নিজে খেলেন না। আমি কিছুক্ষণ সেখানে অবস্থান করে পুনরায় কিছু খেজুর নিয়ে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সামনে রেখে দিলাম। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন: কিসের খেজুর? আমি বললাম: হাদিয়া (উপহার)। অতঃপর তিনি বিসমিল্লাহ বলে নিজেও খেলেন এবং সঙ্গীদেরকেও খাওয়ালেন। আমি মনে মনে বললাম: একটি চিহ্ন তো সত্য প্রমাণিত হল। এরপর আমি ঘুরে তাঁর পশ্চাদ্দিকে এলাম। তিনি আমার মতলব ঠাহর করে গায়ের চাদর সরিয়ে দিলেন। আমি তাঁর বাম কাঁধে নবুওয়তের মোহর স্পষ্ট দেখতে পেলাম। এরপর আমি সামনে এসে বসলাম এবং কলেমা পাঠ করলাম- আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লালাহু ওয়া আন্নাকা রসূলুল্লাহ। ইবনে সাদ, বায়হাকী ও আবু নয়ীম ইবনে ইসহাক থেকে, তিনি আসেম ইবনে আমর থেকে, তিনি মাহমুদ ইবনে লবীদ থেকে এবং তিনি ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, হযরত সালমান ফারেসী বলেছেন। আমি পারস্যের এক সম্পন্ন কৃষকের সন্তান। আমার প্রতি আমার পিতার স্নেহ-মমতা এত গভীর ছিল যে, তিনি আমাকে কন্যাদের মত গৃহে অন্তরীণ করে রেখেছিলেন। অগ্নিপূজায় আমার অনুরাগ এত তীব্র ছিল যে, আমি সেই অগ্নিরই সেবাদাস হয়ে রইলাম, যা আমার পিতা প্রজ্বলিত করত। তাই বাইরের জগৎ সম্পর্কে আমার তেমন কোন খবরই ছিল না। একবার আমার পিতা আমাকে ডেকে বললেন: বৎস। ক্ষেত-খামারের কোন খবর নেই। এর খবর নেয়া জরুরী। তুমি চলে যাও এবং মজুরদেরকে কাজ বলে চলে এস। দেখ, দেরী করো না। তুমি দেরী করলে আমার সমস্ত চিন্তা তোমাতেই নিবন্ধ থাকবে। সেমতে আমি ক্ষেতের উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে গেলাম। পথিমধ্যে আমি খৃষ্টানদের একটি গির্জা পেলাম। তাদের শব্দ শুনে আমি একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম: এখানে কি হচ্ছে? সে বলল: খৃষ্টানরা নামায পড়ছে। আমি ভিতরে প্রবেশ করে দেখতে লাগলাম। দৃশ্যটি আমার কাছে খুব মনোরম মনে হল। আমি সূর্যাস্ত পর্যন্ত সেখানেই বসে রইলাম। এদিকে আমার পিতা আমার খোঁজে লোকজন পাঠিয়ে দিলেন। আমি তো ক্ষেতে যাইনি। সন্ধ্যায় গৃহে পৌঁছলে পিতা বললেন, কোথায় ছিলে? আমি বলেছিলাম না শীঘ্র চলে আসতে? আমি বললামঃ আমি খৃষ্টানদেরকে দেখেছি। তাদের নামায আমার খুব পছন্দ হয়েছে। ফলে অপলক নেত্রে তাদের উপাসনা প্রত্যক্ষ করেছি। পিতা বললেনঃ তোমার এবং তোমার বাপদাদার ধর্ম তাদের ধর্মের চেয়ে উত্তম। আমি বললাম, অসম্ভব। তাদের ধর্মই উত্তম। কারণ, তারা আল্লাহর এবাদত করে, তাঁকেই ডাকে এবং তাঁরই নামায পড়ে। আর আমরা সেই অগ্নির পূজা করি, যা নিজেরাই প্রজ্বলিত করি। যখন ছেড়ে দেই, তখন নির্বাপিত হয়ে যায়। আমার পিতা এসব কথাবার্তা শুনে ভীত হয়ে পড়লেন। তিনি আমার হাতে পায়ে শিকল পরিয়ে দিলেন। কিন্তু আমি গোপনে খৃষ্টানদেরকে লোক মারফত জিজ্ঞাসা করলাম যে, তোমাদের ধর্ম সম্পর্কে উচ্চতর জ্ঞান অর্জন করার উপায় কি? তারা বলল, তোমাকে শাম দেশে যেতে হবে। অতঃপর আমি তাদের কাছে পয়গাম পাঠালাম যে, শাম দেশের কোন কাফেলা আগমন করলে আমাকে যেন সংবাদ দেয়া হয়। কিছুদিন পর তাদের কাছে ব্যবসায়ীদের একটি কাফেলা আগমন করলে তারা আমাকে সংবাদ দিল। এরপর বাণিজ্যিক কাফেলা প্রয়োজনাদি শেষ করে ফিরে যাওয়ার উদ্যোগ নিলে খৃষ্টানরা আমার কাছে লোক পাঠিয়ে দিল। আমি শিকল খুলে কাফেলার সাথে রওয়ানা হয়ে গেলাম এবং বাইতুল মোকাদ্দাসে পৌছে গেলাম। সেখানে যেয়ে লোকজনকে জিজ্ঞাসা করলাম যে, এই ধর্মের সর্বাপেক্ষা বড় আলেম কে? লোকেরা বলল, গির্জার পাদ্রী। আমি তার কাছে গেলাম এবং বললাম, আমি আপনার সাথে গির্জায় থাকতে চাই, যাতে এবাদত ও শিক্ষা লাভ করতে পারি। পাদ্রীর সম্মতি পেয়ে আমি তার সাথে থাকতে লাগলাম। কিন্তু সেই পাদ্রী তেমন ভাল লোক ছিল না। সে মানুষকে দান-খয়রাতের উপদেশ দিত। মানুষ যখন টাকা পয়সা ও ধন সম্পদ তার কাছে আনত, তখন সে সেগুলো গরীবদেরকে দেয়ার পরিবর্তে নিজের কাছে রেখে দিত। তার এ কাজ আমি মোটেই পছন্দ করতে পারতাম না। কিছুদিন পর এই পাদ্রী মারা গেলে মানুষ তাকে সমাহিত করার জন্যে সমবেত হলে আমি তাদেরকে পাদ্রীর অন্যায়ভাবে ধনসম্পদ আহরণের কথা বলে দিলাম। লোকেরা বলল, এই অভিযোগের প্রমাণ কি? একথা শুনে আমি পাদ্রীর সমস্ত ধনভাণ্ডার বাইরে নিয়ে এলাম। এগুলো ছিল সোনা রূপায় ভর্তি সাতটি বৃহৎ মৃৎপাত্র। লোকেরা তার এই কাণ্ড দেখে বলতে লাগল, আমরা তাকে দাফন করব না। তারা পাদ্রীর মৃত দেহ একটি কাঠে ঝুলিয়ে প্রস্তর বর্ষণ করল। এরপর তারা একজনকে এনে পাদ্রী নিযুক্ত করল। আল্লাহর কসম, আমি তার মত উপাসনাকারী কাউকে দেখিনি। সে দিবারাত্র এবাদতে ডুবে থাকত। ফলে আমি তাকে অত্যধিক
পৃষ্ঠা:১৭
মহব্বত করতে লাগলাম। আমি সর্বক্ষণ তার সঙ্গে থাকতাম। অবশেষে যখন তার ওফাত নিকটবর্তী হল, তখন একদিন বললাম, এখন আপনার অন্তিম সময়। আপনার সাথে আমার ঘনিষ্ঠ ভালবাসার সম্পর্ক ছিল। এখন আপনিই বলে দিন আপনার পরে আমি কার কাছে যাব। পাদ্রী বললেন, মুসেলে এক ব্যক্তি আছে। তার কাছে চলে যাও। তাকেও আমার মতই পাবে। মোট কথা, এই পাদ্রীর ওফাতের পর আমি মুসেলে পৌঁছে গেলাম। এখানে নতুন পাদ্রীর সাথে সাক্ষাতের পর তাকেও পূর্বের পাদ্রীর ন্যায় অত্যন্ত এবাদতকারী ও সংসারত্যাগী পেলাম। আমি তাকে বললাম, অমুক পাদ্রী আমাকে আপনার কাছে থাকার জন্যে পাঠিয়েছে। এরপর আমি তার কাছে থাকতে লাগলাম। সবশেষে তারও ওফাত নিকটবর্তী হল। আমি তাকে বললাম, এখন আমি কার কাছে যাব? তিনি বললেন, বৎস। নসীবায়নে এক ব্যক্তি আছে। সেও আমাদের মতই। তার কাছে চলে যেয়ো। সেমতে আমি তার কাছে চলে গেলাম এবং বললাম, অমুক পাদ্রী আমাকে আপনার কাছে প্রেরণ করেছে। তিনি বললেন, বৎস, তুমি আমার কাছে থাক। আমি থাকতে লাগলাম। অবশেষে তারও অন্তিম সময় ঘনিয়ে এল। আমি বললাম, এখন আপনি আমাকে কার কাছে পাঠাবেন? তিনি বললেন, রোম দেশে ওমুরিয়া নামক স্থানে একজন পাদ্রী আছেন। তুমি তার কাছে চলে যেয়ো। তিনিও আমাদের মত। মোট কথা, তার মৃত্যুর পর আমি ওমুরিয়া পৌঁছে গেলাম। এই পাদ্রীকেও পূর্ববর্তী পাদ্রীদের ন্যায় এবাদতকারী ও সন্ন্যাসী পেলাম। তার কাছে থাকাকালে কিছু উপার্জন করে আমি কিছু সংখ্যক ছাগল ও গরুর মালিক হয়ে গেলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারও শেষ সময় উপস্থিত হলে আমি বললাম, আপনার শেষ সময় এসে গেছে। এখন আমি কার কাছে যাব? তিনি বললেন, প্রিয় বৎস! এখন এমন কোন লোক নেই, যার কাছে আমি তোমাকে পাঠাব। কিন্তু একজন নবীর আগমনের সময়কাল সন্নিকটে। তিনি হেরেমে আত্মপ্রকাশ করবেন এবং খর্জুরশোভিত লবণাক্ত ভূমিতে হিজরত করবেন। তাঁর নবুওয়তের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী থাকবে। স্কন্ধের মাঝখানে থাকবে নবুওয়তের মোহর। তিনি উপহার গ্রহণ করবেন, কিন্তু সদকা তথা দান খাবেন না। সম্ভব হলে তুমি সেখানে পৌছে যেয়ো। কারণ, তাঁর আবির্ভাবের সময়কাল খুব নিকটে এসে গেছে। এই পাদ্রীর ওফাতের অল্প কয়েকদিন পরেই বন্-কলবের কয়েকজন আরব ব্যবসায়ী সেখানে গমন করল। আমি তাদের সাথে দেখা করে বললাম, তোমরা আমাকে সঙ্গে করে আরব দেশে নিয়ে চল। এর বিনিময়ে আমি তোমাদেরকে আমার পশুপাল দিয়ে দিব। আমি তাদেরকে ছাগলগুলো দিয়ে দিলাম এবং তারা আমাকে সঙ্গে নিয়ে নিল। কিন্তু কুবা উপত্যকায় পৌঁছে কাফেলার লোকেরা আমার উপর জুলুম করল। তারা আমাকে এক ইহুদীর হাতে বিক্রয় করে দিল। আমি সেখানে খর্জুর বৃক্ষ দেখে অনুমান করলাম যে, এটাই সেই দেশ, যার সম্পর্কে পাদ্রী বলেছিল। এরপর বনু কুরায়যার এক ইহুদী কুবা উপত্যকায় আগমন করল। সে আমাকে ক্রয় করে মদীনায় নিয়ে এল। আল্লাহর কসম, মদীনাকে দেখার সাথে সাথে আমার চিনতে বাকী রইল না যে, এটাই আমার ঈন্দিত দেশ। আমি গোলামীর জীবন অতিবাহিত করতে লাগলাম। রসূলুল্লাহ (সাঃ) মক্কায় আবির্ভূত হলেন; কিন্তু আমি তা জানতে পারলাম না। অবশেষে তিনি হিজরত করে মদীনার অদূরে কুবা পল্লীতে পৌঁছে গেলেন। আমি মালিকের বাগানে কাজ করছিলাম। তার ভ্রাতুষ্পুত্র আমার কাছে এসে বলতে লাগল, বনী কায়লার সর্বনাশ হোক। মক্কা থেকে এক ব্যক্তি এসেছে। তারাসকলেই তার চারপাশে সমবেত হয়ে বলে বেড়াচ্ছে যে, সে নবী। একথা শুনামাত্রই আমার সর্বাঙ্গে কম্পন এসে গেল। আমি মালিকের উপর পড়ে যেতে লাগলাম। বললাম, এ কেমন সংবাদ। মালিক আমাকে একটি মুষি মেরে বলল, এতে তোর কি? তুই নিজের কাজ কর। আমি বললাম, না, না। আমার কিছু না। অতঃপর আমার মধ্যে এই সংবাদের সত্যাসত্য জানার আগ্রহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। আমি সেখান থেকে বের হলাম। পথিমধ্যে আমি আমার এক স্বদেশিনী মহিলাকে পেলাম। তার গোটা পরিবার ইসলামে দীক্ষিত ছিল। সে আমাকে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ঠিকানা বলে দিল। আমার কাছে কিছু খাদ্য সামগ্রী ছিল। সেগুলো নিয়ে কুবায় রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর খেদমতে হাযির হয়ে গেলাম। আমি আরজ করলাম, আমি জেনেছি আপনি একজন মহান ব্যক্তি এবং আপনার সাথে কিছু প্রবাসী লোক আছে। আমার কাছে কিছু সদকার খাদ্য সামগ্রী আছে। ভাবলাম, আপনারাই এর সর্বাধিক হকদার। তাই নিয়ে এসেছি। নিন, খান। নবী করীম (সাঃ) নিজের হাত গুটিয়ে রাখলেন এবং সাহাবীগণকে খেতে বললেন। আমি মনে মনে বললাম, এক চিহ্ন তো দেখা হল। আমি ফিরে এলাম। রসূলুল্লাহ (সাঃ) কুবা থেকে মদীনায় চলে এলেন। আমি আবার কিছু সঞ্চয় করে তাঁর খেদমতে উপস্থিত হলাম। আরজ করলাম, আমি দেখেছি যে, আপনি সদকা খান না। তাই এই হাদিয়া নিয়ে এসেছি। একথা শুনে তিনি নিজেও তা খেলেন এবং সাহাবীগণকেও খেতে বললেন। আমি মনে মনে বললাম, উভয় চিহ্ন দেখা হয়ে গেল। এরপর আমি রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে গেলাম। তিনি এক জানাযার সাথে হেঁটে যাচ্ছিলেন। তাঁর গায়ে দু’টি পশমী চাদর ছিল। আমি নবুওয়তের মোহর দেখার উদ্দেশ্যে ঘুরে তাঁর পিছনে এলাম। এতে তিনি বুঝে নিলেন যে আমি একটি কথিত চিহ্নের খোঁজ করছি। সম্ভবতঃ এটা বুঝতে গিয়েই তিনি পৃষ্ঠদেশ থেকে চাদর সরিয়ে নিলেন। আমি নবুওয়তের মোহর দেখতে পেলাম।
পৃষ্ঠা:১৮
আমি ক্রন্দন করছিলাম এবং মোহর চুম্বন করে যাচ্ছিলাম। রসুলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, সালমান। সামনে এস। আমি সামনে এসে বসে পড়লাম। তাঁর মনোবাঞ্ছণ ছিল যে, আমার ঘটনাবলী সাহাবীগণও শুনুন। সেমতে আমি আমার জীবনের সকল ঘটনা শুনালাম। রসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, সালমান। তুমি তোমার মালিকের সাথে মুকাতাবাতের চুক্তি সম্পাদন করে নাও। (অর্থাৎ শর্তাধীনে মুক্তি লাভের চুক্তি কর।) আমি মালিকের সাথে তিনশ’ খর্জুর বৃক্ষ রোপণ ও চল্লিশ ওকিয়া স্বর্ণের বিনিময়ে চুক্তি সম্পাদন করলাম। সাহাবীগণের প্রত্যেকেই আমাকে খর্জুর চারা দিলেন; কেউ ত্রিশটি, কেউ বিশটি এবং অন্যরা একটি করে দিলেন। নবী করীম (সাঃ) বললেন, এসব চারা রোপণের জন্যে মালিকের যমিনে গর্ত খনন কর। খননের পর চারা রোপণের জন্যে আমাকে খবর দিয়ো। আমি গর্ত খনন করলাম। এ কাজে সাহাবীগণ আমাকে সাহায্য করলেন। খনন সমাপ্ত হলে রসূলুল্লাহ (সাঃ) আগমন করলেন,। আমরা চারা তুলে তুলে তাঁর হাতে দিতে লাগলাম এবং তিনি সেগুলো গর্তে স্থাপন করতে লাগলেন। সেই আল্লাহর কসম, যিনি তাঁকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, এগুলোর মধ্যে একটি চারাও বিনষ্ট হল না। এরপর আমার যিম্মায় চল্লিশ ওকিয়া সোনা রয়ে গেল। রসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে কোন খনি থেকে কবুতরের ডিমসম স্বর্ণ এল। তিনি বললেন, সালমান। এই স্বর্ণ নিয়ে নাও এবং তোমার কাছে যে পাওনা রয়ে গেছে, এ থেকে মালিককে তা চুকিয়ে দাও। আমি আরজ করলাম, ইয়া রসূলাল্লাহ। এটা তো আমার ঋণ পরিশোধের জন্যে যথেষ্ট হবে না। তিনি বললেন, আল্লাহ তাআলা এ থেকেই পরিশোধ করে দিবেন। সেই আল্লাহর কসম, যার কবজায় আমার প্রাণ, আমি সেই স্বর্ণখণ্ড থেকে চল্লিশ ওকিয়া মালিককে শোধ করে দিলাম এবং সেই পরিমাণ আমার কাছেও রয়ে গেল।আবু নয়ীম আবু সালামা ইবনে আবদুর রহমান থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, সালমান (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, আমি রামহরমুযে জন্মগ্রহণ করেছিলাম এবং গ্রামের শিশুদের সাথে খেলাধুলা করতাম। সেখানে একটি পাহাড় ছিল, যাতে গুহাও ছিল। একদিন আমি একাই সেদিকে চলে গেলাম। গুহার ভিতর থেকে একজন দীর্ঘদেহী ব্যক্তি বের হয়ে এল। সে পশমী চাদর ও জুতা পরিহিত ছিল। সে আমাকে ইশারায় ডাকল। আমি তার নিকটে গেলে সে বলল: হে বালক, হযরত ঈসা (আঃ)কে জান? আমি জবাব দিলাম: আমি তো কখনও এ নামও শুনিনি।সে বলল: ঈসা (আঃ) আল্লাহর রসূল। যে ঈসা (আঃ)-এর প্রতি এবং তাঁর পরে আগমনকারী আহমদ (সাঃ)-এর প্রতি ঈমান আনবে, সে দুনিয়ার দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্ত হয়ে আখেরাতের অগণিত নেয়ামতে পৌঁছে যাবে। আমি দেখলাম যে, লোকটির মুখ থেকে দূরের জ্যোতি বের হচ্ছে। আমার মন তার কথায় আটকে গেল। সে আমাকে শিক্ষা দিল যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই। ঈসা ইবনে মরিয়ম (আঃ) আল্লাহর রসূল। তার পরে মোহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর রসুল। মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবন সত্য। সে আমারকে নামাযের পদ্ধতিও শিখিয়ে দিল এবং বলল: যখন তুমি নামাযে দাঁড়াবে এবং কেবলামুখী হয়ে যাবে, তখন তোমার চতুর্দিকে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করা হলেও এদিক ওদিক দেখবে না। ফরয নামাযে পিতামাতা ডাক দিলেও জবাব দিবে না। হাঁ, আল্লাহর রসূল তোমাকে ডাকলে ফরয নামাযও ছেড়ে দিবে। কেননা, রসূলের ডাক আল্লাহর পক্ষ থেকেই ডাকের নামান্তর হয়ে থাকে। অতঃপর সে বলল: যদি তুমি মোহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ (সাঃ)-কে পাও, তবে তাঁর প্রতি ঈমান আনবে এবং আমার সালাম বলবে। তিনি মক্কার পাহাড় থেকে আবির্ভূত হবেন। আমি বললামঃ তার কিছু বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করুন। সে বলল তিনি রহমতের নবী। তাঁর নাম মোহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ। তিনি মক্কার পাহাড় থেকে আবির্ভূত হবেন। উট, গাধা, ঘোড়া ও খচ্চরে আরোহণ করবেন। স্বাধীন ও গোলাম তাঁর দৃষ্টিতে সমান হবে। রহমত তাঁর অন্তরে ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে মিশ্রিত হয়ে থাকবে। তাঁর উভয় কাঁধের মাঝখানে কবুতরের ডিমের ন্যায় চিহ্ন থাকবে। সেটির অভ্যন্তর ভাগে লেখা থাকবে আল্লাহ এক। তাঁর কোন শরীক নেই। মোহাম্মদ আল্লাহর রসূল। আর বহির্ভাগে লেখা থাকবে- যথা ইচ্ছা যাও। তুমি সফল। তিনি হাদিয়া খাবেন; কিন্তু সদকা কবুল করবেন না। তিনি হিংসা ও বিদ্বেষপরায়ণ হবেন না। কোন যিম্মী ও মুসলমানের প্রতি অবিচার করবেন না।তিবরানী ও আবূ নয়ীম শুরাহবিল ইবনে সহল থেকে বর্ণনা করেন যে, সালমান ফারেসী (রাঃ) বলেছেন: যখন আমি ধর্মের খোঁজে বের হলাম, তখন সন্ন্যাসীদের কাছে পৌছলাম। তারা বলত, এ যুগে আরবভূমি থেকে একজন নবী আবির্ভূত হবেন। তাঁর কাঁধে নবুয়তের মোহর থাকবে। সেমতে আমি আরব দেশে পৌছলাম এবং নবী করীম (সাঃ)-এর আবির্ভাব ঘটল। সন্ন্যাসীরা যে সকল চিহ্ন বর্ণনা করেছিল, সেগুলো আমি স্বচক্ষে দেখে নিলাম। নবুওয়তের মোহরও দেখলাম। এরপর আমি সাক্ষ্য দিলাম যে, আল্লাহ এক এবং মোহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর রসূল।বায়হাকী ও আবু নয়ীম বুরায়দা থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, সালমান ফারেসী (রাঃ) এ শর্তে মুক্তি চুক্তি করেছিলেন যে, তিনি মালিকের জন্যে খর্জুরের চারা লাগাবেন এবং পূর্ণ এক বছর পর্যন্ত সেগুলোর দেখাশুনা করবেন। এ চুক্তির পর রসূলুল্লাহ (সাঃ) সমস্ত চারা আপন পবিত্র হাতে রোপণ করেন, একটি চারা ছাড়া। সেটি হযরত ওমর (রাঃ) রোপণ করেছিলেন। বছর পূর্ণ হওয়ার পর সকল চারাতেই ফল ধরল; কিন্তু হযরত ওমর (রাঃ)-এর রোপণ করা চারায় ফল ধরল না। রসূলুল্লাহ (সাঃ) জিজ্ঞাসা করলেনঃ এটি কে রোপণ করেছে? বলা হল ওমর। রসুলুল্লাহ (সাঃ) সেটি উপড়ে সেখানেই আপণ হাতে চারটি পুনরায় রোপন করলেন। তাতে সে বছরই ফল ধরল।ইবনে সা’দ ও আবু নয়ীম আবু ওছমান মহন্দী থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, সালমান ফারেসী (রাঃ) বলেছেন আমি মুক্তির জন্যে মালিকের সাথে এ শর্তে চুক্তি
পৃষ্ঠা:১৯
করেছিলাম যে, তার জন্যে পাঁচশ চারা রোপণ করব। সবগুলো গাছে যখন ফল ধরবে, তখন আমি মুক্ত হয়ে যাবো। এ চুক্তির পর রসূলুল্লাহ (সাঃ) আগমন করলেন এবং সমস্ত চারা নিজ হাতে রোপণ করলেন একটি ছাড়া, যেটি আমি। রোপণ করেছিলাম। তাঁর রোপণকরা সকল চারাই ফলন্ত হল; কিন্তু আমার রোপণ করা চারাটা ফলন্ত হল না। হাকেম ও বায়হাকী আবু তোফায়ল থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, সালমান ফারেসী (রাঃ) বলেছেন: নবী করীম (সাঃ) আমাকে এ পরিমাণ সোনা দিয়ে ছিলেন। এ সময় সালমান (রাঃ) বৃদ্ধাঙ্গলি ও শাহাদতের অঙ্গুলি মিলিয়ে স্বর্ণ পরিমাণে গোলাকৃতি দেখালেন। তিনি বলেনঃ এ স্বর্ণটুকু এক পাল্লায় এবং ওহুদ পাহাড় এক পাল্লায় রাখা হলে স্বর্ণের পাল্লা ভারী হয়ে যেত। অন্য এক রেওয়ায়েতে আহমদ ও বায়হাকী বর্ণনা করেন যে, সালমান (রাঃ) বলেছেন: নবী করীম (সাঃ) যখন আমাকে সোনা দিলেন এবং বললেন যে, এ দ্বারা মালিকের পাওনা চুকিয়ে দাও, তখন আমি আরধ করলাম: এর দ্বারা পাওনা পূর্ণ হবে কি রূপে? অতঃপর তিনি স্বর্ণখণ্ডটি মুখে লাগালেন এবং আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে বললেনঃ যাও, এটা নিয়ে যাও। আল্লাহ তায়ালা তোমার ঋণ শোধ করে দিবেন। সেমতে আমি মালিকের কাছে গেলাম এবং তা থেকে চল্লিশ ওকিয়া তাকে শোধ করে দিলাম। ইবনে ইসহাক, ইবনে সা’দ বায়হাকী ও আবূ নয়ীম রেওয়ায়েত করেন যে, আছেম ইবনে আমর ইবনে কাতাদাহ এক ব্যক্তি থেকে এবং সেই ব্যক্তি হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজীজ (রহঃ) থেকে শুনেছে যে, তিনি বলেনঃ আমাকে সালমান ফারেসী (রাঃ) বলেছেন যে, আসূরিয়ার পাদ্রীর মৃত্যু নিকটবর্তী হলে সে আমাকে বললঃ শামদেশে দু’টি খর্জুরপূর্ণ ভূমিতে পৌঁছে যাও। সেখানে প্রতি বছর এক ব্যক্তি এক খর্জুরপূর্ণ ভূমি থেকে বের হয়ে অন্য খর্জুরপূর্ণ ভূমির দিকে যায়। সে পথি মধ্যে রোগীদের জন্যে দোয়া করতে করতে যায়। ফলে রোগীরা আরোগ্য লাভ করে। সে ব্যক্তিকে ধর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবে, যে সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞাসা করছ। সেমতে আমি সেখানে গেলাম এবং এক বছর সেখানে অবস্থান করলাম। সে ব্যক্তি বাইরে এলে আমি তার বাহুতে হাত রেখে বললাম: আল্লাহ আপনার প্রতি রহম করুন ইবরাহীম (আঃ)-এর সনাতন ধর্ম কোনটি? সে বললঃ একজন নবীর আগমন আসন্ন। তিনি হেরেম থেকে আবির্ভূত হবেন এবং তিনিই সে সনাতন ধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করবেন। হযরত সালমান (রাঃ) এ ঘটনা নবী করীম (সাঃ)-এর কাছে ব্যক্ত করলে তিনি বললেনঃ হে সালমান। যদি বিশ্বাস কর, তবে তুমি হযরত ঈসা (আঃ)-কে দেখেছ। (সুহায়লী বলেন, এ হাদীসের সনদ বিচ্ছিন্ন এবং এক রাবী অজ্ঞাত।) ইবনে ইসহাক ও বায়হাকীর রেওয়ায়েতে আছেম ইবনে আমর ইবনে কাতাদাহ বলেনঃ আমাদের মুরুব্বীগণ আমাকে বলেছেন যে, আরববাসীদের মধ্যে কেউ রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর অবস্থা আমাদের চেয়ে বেশী জানে না। আমাদের সাথে কিতাবধারী ইহুদী সম্প্রদায় বাস করত। আমরা ছিলাম পৌত্তলিক। আমাদের কোন বিষয় ইহুদীদের খারাপ লাগলে তারা বলতঃ একজন নবীর আগমন আসন্ন। আমরা তাঁর অনুসরণ করব এবং তোমাদেরকে আদ ও সামুদ জনগোষ্ঠীর ন্যায় ধ্বংস করে দিব। কিন্তু যখন আল্লাহ তায়ালা নবী পাক (সাঃ)-কে প্রেরণ করলেন, তখন আমরা ঈমান আনলাম, আর তারা পূর্ববৎ কুফরে অটল রইল। এর প্রেক্ষাপটে কোরআনের এই আয়াত নাযিল হয়: وَكَانُوا مِنْ قَبْلُ يَسْتَفْتِحُونَ عَلَى الَّذِينَ كَفَرُوا: কিতাবধারীরা ইতিপূর্বে কাফেরদের বিরুদ্ধে বিজয় কামনা করত। বায়হাকী ও আবু নয়ীম আলী ইযদী থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, ইহুদীরা এ বলে দোয়া করত: হে আল্লাহ! এ (আখেরী) নবীকে আমাদের মধ্যে প্রেরণ কর, যাতে তিনি আমাদের মধ্যে ও অন্যদের মধ্যে ফয়ছালা করে দেন। হাকেম ও বায়হাকী হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, যখন আরবের গাতফান গোত্র ও খায়বরের ইহুদীদের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হল, তখন ইহুদীরা পরাজিত হলে এই মর্মে দোয়া করতে লাগলঃ হে আল্লাহ! আমরা তোমার কাছে প্রতিশ্রুত নবী-উম্মীর উছিলায় আবেদন করি যে, এ নবীকে আমাদের মধ্যে প্রেরণ কর এবং আমাদেরকে বিজয় দান কর। এরপর পুনরায় যুদ্ধ হলে গাতফান গোত্র হেরে গেল এবং ইহুদীরা বিজয়ী হল। কিন্তু নবী করীম (সাঃ) প্রেরিত হলে তারা যথারীতি কুফরিতে অটল রইল। তখন আল্লাহ তায়ালা উপরোক্ত আয়াত নাযিল করলেন। ইবনে ইসহাক, আহমদ, বুখারী, হাকেম, বায়হাকী, তিবরানী ও আবু নয়ীম মাহমুদ ইবনে লবীদ থেকে এবং তিনি সালাম ইবনে সালামাহ থেকে রেওয়ায়েত করেছেন যে, তিনি বলেছেনঃ আমাদের এলাকায় এক ইহুদী ছিল। এক বার সে বনী আবদে আশহালে মজলিসে আগমন করে বক্তৃতা দিতে লাগল। সে মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবন, কিয়ামত, জান্নাত, জাহান্নাম, হিসাব-নিকাশ ও দাড়িপাল্লা সম্পর্কে আলোচনা করল। পৌত্তলিক বনী আবদে আশহাল মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবনে বিশ্বাসী at ছিল না। তার আলোচনা শুনে তারা বললঃ এটা কিরূপে সম্ভবপর যে, মানুষ মৃত্যুর।। পর পুনরায় জীবিত হবে। আমল অনুযায়ী জান্নাত ও জাহান্নামে প্রবেশ করবে। ইহুদী বলল: হাঁ। সে কসম খেয়ে আরও বললঃ যদি তোমরা বিরাট অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করে
পৃষ্ঠা:২০
আমাকে তাতে নিক্ষেপ কর, অতঃপর আমার ভস্ম মাটিতে মিশ্রিত করে দাও, তবুও আমি কিয়ামতে জীবিত হয়ে যাব। লোকেরা বললঃ আচ্ছা, কোন নিদর্শন বর্ণনা কর। ইহুদী মক্কা ও এয়ামনের দিকে ইশারা করে বললঃ দেশের এ দিক থেকে একজন নবী আবির্ভূত হবেন। লোকেরা প্রশ্ন করল। এই নবী কবে আসবেন? উপস্থিত লোকদের মধ্যে আমি ছিলাম সর্বকনিষ্ঠ। ইহুদী আমার দিকে ইশারা করে বললঃ এ যুবক পূর্ণ বয়স প্রাপ্ত হলে অবশ্যই নবীর সাক্ষাত পাবে। এ ঘটনার কিছু দিন পরেই নবী করীম (সাঃ) প্রেরিত হয়ে গেলেন। সে ইহুদী তখনও জীবিত ছিল। আমরা ঈমান আনলাম; কিন্তু সে অবাধ্যতা ও প্রতিহিংসার কারণে কুফরেই অটল রইল। আমি তাকে বললামঃ তুমি তো এমন এমন বলতে। এখন ঈমান আন না কেন? ইহুদী বললঃ আমার সেই কথা এই নবীর সম্পর্কে ছিল না। বায়হাকী, তিবরানী, আবু নয়ীম খলিফা ইবনে সাওদাহ্ থেকে বর্ণনা করেন- আমি মোহাম্মদ ইবনে আদী ইবনে রবীয়াকে প্রশ্ন করলাম: মূর্খতা যুগে তোমার পিতা তোমার নাম ‘মোহাম্মদ’ রাখল কেন? সে বললঃ আমি আমার পিতাকে এ প্রশ্ন করলে তিনি বললেনঃ আমরা বনী-তামীমের চার ব্যক্তি সিরিয়ার সফরে রওয়ানা হই আমি, সুফিয়ান ইবনে মাজাশে, এয়াযিদ ইবনে ওমর এবং উসাতা ইবনে মালেক। সিরিয়া পৌঁছে আমরা একটি ছোট জলাশয়ের পাড়ে অবস্থান করলাম। সেখানে বৃক্ষ ছিল। এক সন্ন্যাসী এসে বললঃ তোমরা কে? আমরা বললামঃ আমরা আরবের মুযার গোত্রের লোক। সে বললঃ তোমাদের মধ্যে সত্বরই একজন নবী আত্মপ্রকাশ করবেন। তাড়াতাড়ি যাও এবং তাঁর কাছ থেকে হেদায়াত হাছিল কর। কেননা, তিনি সর্বশেষ নবী। আমরা বললামঃ তাঁর নাম কি ?সে বললঃ তাঁর নাম মোহাম্মদ। আমরা সফর থেকে গৃহে ফিরে এলে সকলেরই পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করল এবং সকলেই আপন আপন পুত্রের নাম” মোহাম্মদ” রেখেছিলাম। ইবনে সা’দ সায়ীদ ইবনে মুসাইয়িব থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আরবরা অতীন্দ্রিয়বাদী ও কিতাবধারীদের মুখ থেকে “মোহাম্মদ” নামের একজন নবীর আগমন সম্পর্কে প্রায়ই শুনত। যে-ই একথা শুনত, সে-ই নবুওয়তের আকাঙ্ক্ষায় স্বীয় পুত্রের নাম “মোহাম্মদ” রাখত। ইবনে সা’দ কাতাদাহ ইবনে সাকান ওরফী থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, বনু তামীমে এক ব্যক্তির নাম ছিল মোহাম্মদ ইবনে সুফিয়ান ইবনে জামাশে। কেননা, এক পাদ্রী তার পিতাকে বলেছিল যে, আবরদের মধ্যে মোহাম্মদ নামীয় একজন নবী পয়দা হবেন। তাই তার পিতা পুত্রের নাম মোহাম্মদ রেখে দেয়। বায়হাকী মারওয়ান ইবনে হাকাম থেকে, তিনি মোয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তার পিতা আবু সুফিয়ান বলেছেন- আমি এবং উমাইয়া ইবনে আবী সলত সিরিয়া গেলাম। সেখানে খৃষ্টানদের এক বস্তীদিয়ে যাওয়ার সময় তারা উমাইয়াকে দেখে অত্যন্ত সম্মান প্রদর্শন করল এবং তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে লাগল। উমাইয়া আমাকে বললঃ তুমিও চল। আমি বললামঃ না, আমি যাব না। অতঃপর উমাইয়া তাদের সাথে চলে গেল। ফিরে এসে আমাকে বললঃ তুমি আমার কাছ থেকে কিছু গোপন করছ। আমি বললামঃ হ্যাঁ। সে বললঃ পবিত্র গ্রন্থ সম্পর্কে জ্ঞানী এক ব্যক্তি আমাকে বলেছে যে, একজন নবী আবির্ভূত হবেন। আমি বললামঃ সম্ভবতঃ আমিই। জ্ঞানী ব্যক্তি বললঃ না, সে তোমাদের মধ্য থেকে নয়। সে মক্কাবাসীদের মধ্য থেকে হবে। আমি জিজ্ঞাসা করলামঃ তার বংশপরিচয় কি? সে বললঃ আপন সম্প্রদায়ের মধ্যবিত্ত লোকদের মধ্য থেকে হবে। তাঁর আত্মপ্রকাশের নিদর্শন এই যে, হযরত ঈসা (আঃ)-এর পর থেকে শামদেশে আশি বার ভূমিকম্প হয়েছে। আরও একবার ভূমিকম্প হবে। এতে শামবাসীদের প্রভূত বিপদ ও কষ্ট হবে। আমাদের দেশে ফিরে আসার পর এক অশ্বারোহী আগমন করল। আমরা জিজ্ঞাসা করলামঃ কোথেকে আগমন করছ? সে বলল: সিরিয়া থেকে। আমরা বললামঃ সেখানে কোন ঘটনা ঘটেছে? সে বলল: হ্যাঁ। সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছে। ফলে সে দেশত্রাসী বিপদ ও পেরেশানীতে পতিত আছে। আবু নয়ীম কা’ব ও ওয়াহাব ইবনে মুনাব্বেহ থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, সম্রাট বখতে নছর একটি ভয়াবহ স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু জাগ্রত হওয়ার পর ভুলে যান। তিনি যাদুকর ও অতীন্দ্রিয়বাদীদেরকে ডেকে বললেনঃ স্বপ্নটি দেখার পর আমি অত্যন্ত পেরেশান আছি। তারা বললঃ স্বপ্নটি আমাদেরকে শুনান। সম্রাট বললেনঃ স্বপ্নের বিবরণ আমি ভুলে গেছি। তারা বললঃ তা হলে আমরা কি বলতে পারি? বখতেনছর দানিয়ালকে তলব করে নিজের পেরেশানীর কথা বললেন। দানিয়াল বললঃ আপনি স্বপ্নে একটি বিশালকায় প্রতিমা দেখেছেন, যার পা মাটিতে এবং মস্তক আকাশে। এর উপরিভাগ স্বর্ণের মধ্যভাগ রৌপ্যের এবং নিম্নভাগ তামার। এর গোছা লোহার এবং পা মাটির। আপনি প্রতিমাটি দেখছেন এবং এর সৌন্দর্যে ও কারুকার্যে বিস্ময় প্রকাশ করছেন। এমন সময় আল্লাহ তায়ালা আকাশ থেকে একটি পাথর প্রতিমার মাথায় নিক্ষেপ করলেন। ফলে গোটা প্রতিমাটি ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেল। এর স্বর্ণ, রৌপ্য, তামা, লোহা ও মাটি পরস্পরে মিশ্রিত হয়ে গেল। আপনি ভাবতে লাগলেন, এখন সমগ্র মানব ও জিন মিলেও এর
পৃষ্ঠা ২১ থেকে ৩৭
পৃষ্ঠা:২১
অংশসমূহকে আলাদা করতে পারবে না। বায়ু প্রাবাহিত হলে এর সমস্ত কণা উড়ে যাবে। এরপর আকাশ থেকে যে পাথর এসেছিল, সেটি বড় হতে লাগল এবং চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল। ফলে সমগ্র পৃথিবী আচ্ছন্ন হয়ে গেল। পাথর ও আকাশ ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট রইল না। একথা শুনে বখতেনছর বললেনঃ হাঁ, আমি এ স্বপ্নই দেখেছি। এখন এর ব্যাখ্যা দাও। দানিয়াল বললঃ প্রতিমার অর্থ হচ্ছে বিশ্বের সমগ্র জাতি। আকাশ থেকে আগত পাথর হচ্ছে আল্লাহর দ্বীন, যা শেষ যমানায় ছড়িয়ে পড়বে। এ দ্বীন নিয়ে আরবদেশে একজন নবীয়ে উম্মী আবির্ভূত হবেন। আল্লাহ তায়ালা এ দ্বীনের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বের জাতিসমূহকে মিছমার করে দিবেন, যেমন প্রতিমা টুকরা টুকরা হয়ে গেছে। এ দ্বীনকে আল্লাহ তায়ালা সারা বিশ্বের উপর বিজয়ী করবেন, যেমন এ পাথর সারা পৃথিবীকে ছেয়ে ফেলেছে।ইবনে আসাকির “তারীখে-দামেস্ক” গ্রন্থে ঈসা ইবনে দাব থেকে রেওয়ায়েত করেছেন যে, আবু বকর ছিদ্দীক (রাঃ) বলেছেন আমি কা’বার আঙিনায় উপবিষ্ট ছিলাম। যায়দ ইবনে আমর ইবনে নুফায়লও সেখানেই বসা ছিল। এমন সময় উমাইয়া ইবনে আবীসলত সেখান দিয়ে গমন করছিল। সে বললঃ যে নবীর অপেক্ষা করা হচ্ছে, সে তোমাদের মধ্য থেকে হবে, না আমাদের মধ্য থেকে, না ফিলিস্তিনবাসীদের মধ্য থেকে? যায়দ ইবনে আমর বললঃ কোন নবী প্রেরিত হবে কি না, তা আমার জানা নেই। এ কথাবার্তা শুনে আমি ওয়ারাকা ইবনে নওফেলের কাছে গেলাম এবং তাঁকে সব কিছু শুনালাম। তিনি বললেনঃ হাঁ ভাতিজা! কিতাবধারীরা আমাদেরকে বলেছে যে, প্রতীক্ষিত নবী আরবদের মধ্যবিত্ত ধরনের একটি বংশের মধ্য থেকে হবেন। বংশের জ্ঞান আমার আছে। তোমাদের কওম আরবদের মধ্যে সম্ভ্রান্ত এবং মধ্যবিত্ত ধরনের বংশধর। আমি বললামঃ, চাচাজান, এ নবী কি বলবেন? ওয়ারাকা বললেন, তাই বলবেন, যা তাঁকে বলতে বলা হবে। কিন্তু তিনি নিজে যুলুম করবেন না এবং তাঁর উপরও যুলুম করা হবে না। হযরত আবু বকর (রাঃ) বলেন, যখন রসূলে করীম (সাঃ) আবির্ভূত হলেন, তখন আমি তাঁকে সত্য বলে বিশ্বাস করি এবং তাঁর প্রতি ঈমান আনি। তায়ালেসী, বায়হাকী ও আবুনয়ীম সায়ীদ ইবনে যায়দ ইবনে আমর ইবনে নুফায়ল থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, একবার সায়দ ইবনে আমর ইবনে নুফায়ল এবং ওয়ারাকা ইবনে নওফেল দ্বীনের খোঁজে বের হয়ে মুছেলের এক সন্ন্যাসীর কাছে পৌঁছে যায়। সন্ন্যাসী যায়দকে প্রশ্ন করল, কোথেকে এসেছ? যারদ বলল, ইবরাহীম (আঃ)-এর নির্মিত ইমারতের শহর থেকে।প্রশ্ন হল, উদ্দেশ্য কি? যায়দ বলল, দ্বীনের খোঁজে এসেছি। সন্ন্যাসী বলল, দেশে ফিরে যাও। তোমরা যে ধর্মের তালাশ করছ, তা খোদ তোমাদের ভূখন্ডে প্রকাশ পাবে। আবু ইয়ালা, বগভী, তিবরানী, হাকেম, বায়হাকী ও আবু নয়ীম উসাতা ইবনে যায়দ থেকে, তিনি যায়দ ইবনে হারেছা থেকে বর্ণনা করেন যে, যায়দ ইবনে আমর ইবনে নওফেলের সাথে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাক্ষাৎ হয়েছে। তিনি যায়দকে বললেন, চাচাজান, মানুষ আপনার দুশমন হয়ে গেল কেন? প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, উল্লেখিত ব্যক্তিগণ মূর্তিপূজার বিরুদ্ধাচরণের কারণে প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। যায়দ বলল, আল্লাহর কসম, আমার পক্ষ থেকে কিছু হয়নি। তবে আমি তাদেরকে প্রথভ্রষ্ট সনে করতাম। তাই আমি দ্বীনের তালাশে বের হয়ে পড়ি এবং দ্বীপের এক শায়খের কাছে পৌঁছে যাই। সে আমাকে বলল, তুমি কোন সম্প্রদায়ের লোক? আমি বললাম, বায়তুল্লাহর প্রতিবেশীদের একজন। সে বলল, তোমাদের দেশ থেকে একজন নবী প্রকাশ পাবেন। তাঁর নক্ষত্র উদিত হয়ে গেছে। ফিরে গিয়ে তাঁর প্রতি ঈমান আন। আমি ফিরে এলাম; কিন্তু কিছুই অনুভব করলাম না। যায়দ ইবনে হারেছা বলেন, নবী করীম (সাঃ)-এর সাথে সাক্ষাতের পূর্বেই যায়দ ইবনে আমরের ইন্তেকাল হয়ে যায়। ইবনে সাদ ও আবু নয়ীম আমের ইবনে রবিয়া থেকে বর্ণনা করেন যে, আমের বলেছেন- আমি যায়দ ইবনে আমর ইবনে নওফেলের সাথে সাক্ষাৎ করলাম। তখন সে মক্কা থেকে হেরা অভিমুখে যাচ্ছিল এবং তার ও তার কওমের মধ্যে কলহ সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। কেন না, যায়দ ইবনে আমর কওমের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিমাপূজা থেকে আলাদা থাকত। সাক্ষাতের পর যায়দ বলল, হে আমের। আমি আমার কওমের বিরুদ্ধাচরণ করে ইবরাহিমী দ্বীনের অনুসরণ করি। আমি একজন নবীর অপেক্ষায় আছি, যিনি হযরত ইসমাঈল (আঃ) ও আব্দুল মুত্তালিবের সন্তানদের মধ্য থেকে হবেন। তার নাম হবে আহমদ। আমি সম্ভবতঃ তাকে পাব না। আমি এই মুহূর্তে তার প্রতি ঈমান আনছি, তাকে সত্য বলে বিশ্বাস করছি এবং সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তিনি নবী। যদি তুমি অধিক দিন জীবিত থাক এবং এ নবীর সাথে সাক্ষাৎ পাও, তবে আমার পক্ষ থেকে তাঁকে সালাম বলবে। হে আমের, আমি তোমাকে তাঁর কিছু বৈশিষ্ট্যও বলে দিচ্ছি, যাতে তুমি সহজে চিনতে পার। তিনি না খর্বাকৃতি হবেন, না লম্বাটে। কেশ বেশী হবে না, কমও হবে না। তাঁর চক্ষুদ্বয় লালচে হবে। উভয় কাঁধের মাঝখানে নবুয়তের মোহর থাকবে। তাঁর নাম হবে আহমদ। এ শহর তাঁর জন্মস্থান ও নবুয়তের স্থান হবে। কিন্তু তাঁর কওম তাঁকে শহর থেকে বহিস্কার করবে। কেন না, তারা তাঁর দাওয়াত অপছন্দ করবে। অবশেষে তিনি মদীনায় হিজরত করবেন। সেখানে তিনি প্রাধান্য লাভ করবেন। তাঁর ব্যাপারে তুমি কখনও
পৃষ্ঠা:২২
প্ররোচিত হবে না। আমি ইবরাহিমী দ্বীনের তালাশে সমগ্র দেশ ঘুরেছি। যে ইহুদী, খ্রীষ্টান ও অগ্নিপূজারীকেই আমি জিজ্ঞেস করেছি, সে এসব বৈশিষ্ট্যই বলেছে, যা আমি বর্ণনা করলাম। তারা আরও বলেছে যে, এ নবী ছাড়া এখন আর কোন নবী অবশিষ্ট নেই। আমের বলেন, নবী করীম (সাঃ) নবুয়ত প্রাপ্ত হওয়ার পর আমি এসব কথা তাঁকে বললাম। তিনি তিন বার যায়দ ইবনে আমরের জন্যে রহমতের দোয়া করলেন। অতঃপর বললেন, আমি তাঁকে জান্নাতে আপন চাদর মাটিতে ছড়িয়ে চলতে দেখতে পাচ্ছি। ইবনে সা’দ শা’বী থেকে, তিনি আবদুর রহমান ইবনে যায়দ ইবনে খাত্তাব থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, যায়দ ইবনে আমর ইবনে নওফেল বলেছেন আমি সিরিয়ার এক সন্ন্যাসীর কাছে গেলাম এবং তাকে বললাম, আমি মূর্তিপূজা, ইহুদীবাদ ও খৃষ্টবাদ কিছুই পছন্দ করি না। সন্ন্যাসী বলল, তুমি আসলে ইবরাহিমী দ্বীনের তালাশে আছ। হে মক্কাবাসী ভাই। তুমি যে ধর্ম খুঁজে বেড়াচ্ছ, তা তো আজ নেই। তোমাদের নিজের শহরে সত্য প্রকাশ পাবে। তোমাদের কওমে এবং তোমাদের শহরেই সে একজন নবী ইবরাহিমী দ্বীন নিয়ে আগমন করবেন। তিনি আল্লাহর কাছে সর্বাধিক সম্মানিত বান্দা হবেন। আবু নয়ীম আবূ উমামা বাহেলী থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আমর ইবনে আবাস্য সালমা বর্ণনা করেছেন আমি মূর্খতা যুগে আমার কওমের বাতিল কর্মকাণ্ড ত্যাগ করেছিলাম। জনৈক কিতাবধারী ব্যক্তির সাথে আমার সাক্ষাৎ হলে আমি তাকে সর্বোত্তম ধর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। সে বলল, মক্কা থেকে এক ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটবে, তিনি নিজের কওমের প্রতিমাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবেন। তিনিই-ই সর্বোত্তম ধর্ম নিয়ে আগমন করবেন। তাঁকে পেলে তাঁর অনুসরণ করবে। এরপর আমি মক্কায় এলাম এবং লোকজনের কাছে জিজ্ঞাসা করলাম কোন ঘটনা ঘটেছে কি না? তারা বলল, না। এরপর আমি মক্কা থেকে আগমনকারী কাফেলার সাথে সাক্ষাৎ করে খোঁজ-খবর নিতে লাগলাম। তারা না মূচক জওয়াব দিতে থাকে। একবার এমনিভাবে পথিমধ্যে বসা ছিলাম। এমন সময় এক অশ্বারোহী আগমন করল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কোথেকে এসেছ? সে বলল, মক্কা থেকে। আমি বললাম, সেখানকার খবর কি? সে বলল, হাঁ, এক ব্যক্তি নিজের কওমের প্রতিমাদেরকে ত্যাগ করে অন্য এক খোদার দিকে দাওয়াত দেয়। আমি মনে মনে বললাম, এ সেই ব্যক্তি, যাকে আমি তালাশ করি। আমি তার কাছে গেলাম। কিন্তু তিনি তখন আত্মগোপন করার মত অবস্থায় ছিলেন। আমি তাঁকে প্রশ্ন করলাম, আপনি কে? তিনি বললেন, নবী। আমি বললাম, নবী কি? তিনি বললেন, রসূল। আমি জিজ্ঞেস কলাম, আপনাকে কে প্রেরণ করেছে? তিনি বললেন, আল্লাহ। আমি বললাম, কি পয়গাম দিয়েছেন। তিনি বললেন, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। প্রাণের হেফাযত করতে হবে। পথঘাট শান্তিপূর্ণ রাখতে হবে। প্রতিমাসমূহ ভেঙ্গে দিতে হবে। একমাত্র আল্লাহর এবাদত করতে হবে। তাঁর সাথে কাউকে শরীক করা যাবে না। আমি বললাম, আপনার আনিত পয়গাম কি চমৎকার। আমি আপনার প্রতি ঈমান আনলাম এবং আপনাকে সত্য বলে বিশ্বাস করলাম। আমি আপনার সাথে থাকতে পারি কি? আপনি কি বলেন? তিনি বললেন, তুমি মানুষের বিরোধিতা দেখতেই পাচ্ছ। আপাততঃ আপন পরিবারের মধ্যে যেয়েই থাক। যখন শুনবে যে, পরিস্থিতি আমার অনুকূলে এসে গেছে, তখন তুমি আমার অনুসরণ করো। সেমতে আমি যখন শুনলাম যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) মদীনায় হিজরত করেছেন, তখন আমি তাঁর কাছে পৌঁছে গেলাম। ইবনে সা’দ এ রেওয়ায়েতটি শহর ইবনে হাওশাব থেকে বর্ণনা করেছেন। আবু নয়ীম ও ইবনে আসাকির রেওয়ায়েত করেন যে, হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেছেন, সম্রাট বখতে নছরের পক্ষ থেকে ব্যাপক ধ্বংসলীলা আসার পর বনী ইসরাঈল এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়ে। তাদের কিভাবে মোহাম্মদ রসূল্লল্লাহ (সাঃ)-এর গুণাবলী বর্ণিত ছিল। একথাও ছিল যে, তিনি আরবের কোন খর্জুর বিশিষ্ট বস্তীতে আত্মপ্রকাশ করবেন। সেমতে বনী-ইসরাঈল যখন সিরিয়া থেকে রওয়ানা হল, তখন সিরিয়া ও ইয়ামনের মধ্যবর্তী প্রতিটি আরব বস্তী সম্পর্কে তারা ধারণা করত যে, এটা ইয়াসরিবের অনুরূপ। এরপর তাদের একটি দল সেখানে বসতি স্থাপন করত। তারা সকলেই হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ ও তাঁর অনুসরণ করার অপেক্ষায় ছিল। বনী-হারূনের যাদের কাছে তওরাত ছিল, তাদের একটি দল ইয়াসরিবে বসতি স্থাপন করে। তাদের বিশ্বাস ছিল যে, হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এখানেই আগমন করবেন। তারা আপন সন্তানদেরকে তাঁর অনুসরণে উদ্বুদ্ধ করত। কিন্তু তাদের সন্তানরা যখন রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সময়কাল পেল, তখন উত্তমরূপে চিনাজানা সত্ত্বেও কুফরের উপর অটল হয়ে রইল। আবু নয়ীম বর্ণনা করেন যে, হযরত হাসসান ইবনে ছাবেত (রাঃ) বলেছেন- সাত বছর বয়সে গৃহে অবস্থান কালে আমি যা কিছু দেখতাম, মনে রাখতাম এবং যা কিছু শুনতাম, স্মৃতির মণিকোঠায় সংরক্ষিত রাখতাম। একবার আমানের কাছে ছাবেত ইবনে যাহহাক নামক এক যুবক আগমন করল। সে বলতে লাগল যে, বনী কুরায়যার এক ইহুদী তার সাথে তর্ক করছিল এবং বলছিল একজন নবীর আগমন অত্যাসন্ন। তিনি এক কিতাব নিয়ে আসবেন, যা আমাদের কিতাবের অনুরূপ। তিনি তোমাদের সকলকে আদ জাতির ন্যায় ধ্বংস করে দিবে। হাসসান (রাঃ) বলেন, আমি যাদুর কারণে অনুভব করলাম যেন আমি একটি সুরম্য প্রাসাদের উপরে আছি।
পৃষ্ঠা:২৩
আমি একটি উচ্চকণ্ঠ শুনলাম। এক ইহুদী মদীনার সুউচ্চ ভূমিতে আরোহণ করেছে। তার কাছে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত আছে। মানুষ তার কাছে সমবেত হয়েছে এবং জিজ্ঞাসা করছে কি বলছ? ইহুদী বলল, আহমদের নক্ষত্র উদিত হয়ে গেছে।। কোন নবীর আগমন আসন্ন হলেই এ নক্ষত্র উদিত হয়। আহমদ ছাড়া কোন নবী এখন অবশিষ্ট নেই। মানুষ একথা শুনে হাসতে লাগল এবং বিশ্বয় প্রকাশ করতে লাগল। (হযরত হাসসান (রাঃ) একশ বিশ বছর বয়ঃক্রম পান। ষাট বছর মূর্খতা যুগে এবং ষাট বছর ইসলামোত্তর যুগে অতিবাহিত করেন।) ওয়াকেদী ও আবু নয়ীম হুয়ায়সা ইবনে সউদ থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমাদের মধ্যে যে সকল ইহুদী বাস করত, তারা প্রায়ই একজন নবীর কথা বলাবলি করত, যিনি মক্কায় প্রেরিত হবেন। তাঁর নাম হবে আহমদ। তিনিই হবেন সর্বশেষ নবী। তাদের কিতাবে তাঁর গুণাবলীও বর্ণিত আছে। হুয়ায়স্য বলেন, আমি শিশু ছিলাম; কিন্তু যা দেখতাম এবং শুনতাম, সবই মনে রাখতে পারতাম। একবার আমি বনী আব’দে-আশহালের দিক থেকে একটি চীৎকার গুনলাম। এতে আমার কওমের লোকেরা ঘাবড়ে গেল যে, কি জানি হল। পুনরায় চীৎকার শুনা গেল। আমরা এই আওয়াজ শুনলাম এবং বুঝতেও পারলাম। এক ব্যক্তি বলছিল হে মদীনাবাসীগণ, এই দেখ আহমদের নক্ষত্র। তিনি পয়দা হয়ে গেছেন। একথা শুনে আমরা বিস্মিত হলাম। এরপর দীর্ঘদিন অতিবাহিত হয়ে গেল। আমরা একথা ভুলেও গেলাম। আমার কওমের অনেকে মারা গেল এবং শিশু যুবকে পরিণত হল। আমি নিজেও যুৱক হয়ে গেলাম। এ সময় আমি আবার সেই আওয়াজ শুনলাম। বলা হচ্ছিল, হে মদীনাবসীগণ, মোহম্মদ আত্মপ্রকাশ করেছেন এবং নবুয়তও পেয়ে গেছেন। তাঁর কাছে জিবরাঈল (আঃ)-ও এসে গেছেন, যিনি হযরত মূসা (আঃ)-এর কাছে আসতেন। এর কিছু দিন পরেই মক্কা থেকে খবর এল যে, এক ব্যক্তি নবুয়ত দাবী করেছে। এরপর কিছু লোক ইসলাম গ্রহণ করল এবং কিছু পিছনে রয়ে গেল। আমি তখন ইসলাম গ্রহণ করলাম, যখন রসুলুল্লাহ (সাঃ) মদীনায় হিজরত করে এলেন। ইবনে সাদ ও আবু নয়ীম রেওয়ায়েত করেন যে, হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেন কুরায়যা, নুযায়র, ফদক ও খয়বরের ইহুদীরা রসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর আবির্ভাবের পূর্বে তাঁর গুণাবলী বর্ণনা করত। তারা তাঁর মদীনায় হিজরত করার কথাও বলত। তিনি যখন জন্মগ্রহণ করলেন, তখন ইহুদী আলেমরা বলতে লাগল, এ রাতে আহমদ জন্মগ্রহণ করেছেন এবং তাঁর নক্ষত্র উদিত হয়ে গেছে। যখন তিনি নবুয়ত লাভ করলেন, তখনও তারা বলতে লাগল, তিনি নবুয়ত পেয়ে গেছেন। সত্যিই ইহুদীরা তাঁকে উত্তমরূপে চিনত। তাঁকে স্বীকার করত এবং তাঁর গুণাবলী বর্ণনা করত। আবূ নয়ীম, ইবনে সা’দ ও ইবনে আসাকির বর্ণনা করেন যে, আবূ নহলা বলেছেন, বনী কুরায়যার ইহুদীরা রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আলোচনা তাদের গিভাবে পাঠ করত। সন্তানদের কাছে তাঁর গুণাবলী বর্ণনা করত। নাম বলত এবং একথাও বলত যে, তিনি মদীনায় হিজরত করবেন। কিন্তু যখন তিনি আগমন করলেন, তখন হিংসা করতে লাগল এবং তাঁকে অস্বীকার করল। আবূ নয়ীম রেওয়ায়েত করেন যে, আবু সায়ীদ খুদরী (রাঃ) বলেছেন, আমি আমার পিতা মালেক ইবনে সিনানের কাছে শুনেছি যে, একবার তিনি বনী আব’দে আশহালের কাছে গমন করেন কথাবার্তা বলার জন্যে। সেখানে তিনি ইউশা’ নামক এক ইহুদীকে বলতে শুনেন যে, একজন নবীর আগমন আসন্ন। তাঁর নাম আহমদ। তিনি হেরেম থেকে আত্মপ্রকাশ করবেন। কেউ তাঁকে প্রশ্ন করল, তাঁর বৈশিষ্ট্য কি? সে বলল, তিনি না খর্বাকৃতি হবেন, না লম্বাটে। তাঁর চক্ষুদ্বয় লালচে হবে। তিনি পাগড়ী পরবেন এবং গাধার পিঠে সওয়ার হবেন। তরবারি তাঁর ঝুঁটিতে থাকবে। তিনি এ শহরে হিজরত করবেন। আমি বিস্মিত হয়ে আপন কওম বনী-হাযরায় চলে এলাম। আমার কওমের এক ব্যক্তি বলল, কেবল ইউশাই এ কথা বলে না; বরং সমগ্র ইয়াসরিবের ইহুদীও তাই বলে। একথা শুনে আমি বদী-কুরায়যার একটি সমাবেশে এলাম। সেখানেও এ আলোচনাই চলছিল। যুবায়র ইবনে আতা বলছিল, সেই লাল নক্ষত্র উদিত হয়েছে, যা কেবল কোন নবীর আগমনেই উদিত হয়। এখন মোহাম্মদ ছাড়া কোন নবী অবশিষ্ট নেই। আবূ নয়ীম মাহমূদ ইবনে লবীদ থেকে এবং তিনি মোহাম্মদ ইবনে সালামাহ থেকে বর্ণনা করেন যে, বনী আবদে আশহালে এক ইউশা’ নামীয় ইহুদী ছিল। আমি যখন শিশু ছিলাম, তখন এ ইহুদী বলত একজন নবীর আগমন নিকটে। তিনি জনপদে প্রেরিত হবেন। একথা বলার সময় সে হাত দিয়ে মক্কার দিকে ইশারা করত। যে তাঁকে পায়, সে যেন তাঁকে সত্য বলে বিশ্বাস করে। যখন রসূলুল্লাহ (সাঃ) প্রেরিত হলেন, তখন আমরা ইসলাম গ্রহণ করলাম; কিন্তু সে অবাধ্যতা ও হিংসার বশবর্তী হয়ে ইসলাম গ্রহণ করল না। আবু নয়ীম আবদুল্লাহ ইবনে সালাম থেকে বর্ণনা করেন যে, সম্রাট তুব্বা রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সত্যায়ন না করা পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করেন নি। কেন না, ইয়াসরিবের ইহুদীরা তাঁর কাছে রসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর সংবাদ বর্ণনা করেছিল। ইবনে সা’দ ইকরামা থেকে, তিনি হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে এবং তিনি উবাই ইবনে কা’ব থেকে বর্ণনা করেন যে, তুব্ব। যখন সসৈন্যে মদীনায় আগমন করলেন, তখন কানাত উপত্যকায় অবস্থান গ্রহণ করলেন। তিনি ইহুদী আলেমদেরকে বলে পাঠালেন যে, আমি এ বস্তীকে উজাড় করে দিব। ইহুদীদের মধ্যে শামুন ছিল বড় আলেম। সে বললঃ
পৃষ্ঠা:২৪
হে মহান বাদশাহ। এ শহরে বনী-ইসমাঈলের নবী হিজরত করবেন, যিনি মক্কার জন্মগ্রহণ করবেন এবং যাঁর নাম হবে আহমদ। যে জায়গায় আপনি অবস্থান করছেন, সেখানে তাঁর সঙ্গী ও তাঁর শত্রুদের মধ্যে অনেক খুনখারাবী হবে। তুবব্বা বললেন, তাঁর সাথে যুদ্ধ কে করবে? শামুন জবাব দিল, তাঁর কওম তাঁর সাথে যুদ্ধ করবে। তুব্বা প্রশ্ন করলেন, তাঁর সমাধি কোথায় হবে? শামুন বলল, এ শহরেই। তুব্বা জিজ্ঞাসা করলেন, যুদ্ধে কে পরাজিত হবে? শামুন বলল, জয়-পরাজয় উভয়ই হবে। যে মাঠে আপনি আছেন, এখানে পরাজয় হবে এবং তাঁর সঙ্গীসাথী এত বেশী পরিমাণে নিহত হবে যে, যা অন্য কোথাও এমনটা হবে না। কিন্তু পরিণামে তিনিই বিজয়ী হবেন। তখন কেউ তাঁর মোকাবিলা করবে না। তুব্বা জিজ্ঞাসা করলেন, তাঁর গুণাবলী কি? শামুন বলল, তিনি না লম্বাটে হবেন, না খর্বাকৃতি। তাঁর চক্ষুদ্বয় লালচে হবে। তিনি গাধার পিঠে সওয়ার হবেন। পাগড়ী বাঁধবেন। তরবারি তার ঝুঁটিতে থাকবে। তিনি পরওয়া করবেন না যে, কার সাথে দেখা করছেন। ইবনে সা’দ আবদুল হামিদ ইবনে জাফর থেকে, তিনি আপন পিতা থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, যুবায়র ইবনে বাততা ইহুদীদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বড় আলেম ছিল। সে বলত, আমার পিতা আমার কাছ থেকে একটি কিতাব গোপন করেছিল। কিতাবটি যখন পাই, তখন তাতে আহমদ নবীর উল্লেখ ছিল, যিনি মক্কার আবির্ভূত হবেন এবং তাঁর এ গুণাবলী থাকবে। যুবায়র একথা তাঁর পিতার মৃত্যুর পর বর্ণনা করেছিল এবং তখন পর্যন্ত রসূলুল্লাহ (সাঃ) প্রেরিত হননি। অল্পদিন পরেই সে শুনল যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) মক্কায় আবির্ভূত হয়ে গেছেন। এ খবর শুনে সে নিজের হেফাজতে রাখা কিতাব থেকে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আলোচনা মিটিয়ে দিল এবং বলল, এ আলোচনা এ ব্যক্তি সম্পর্কে নয়। আবু নয়ীম সা’দ ইবনে ছাবেত থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, বনু কুরায়যা ও বনু নুযায়রের ইহুদী আলেমরা নবী করীম (সাঃ)-এর গুণাবলী বর্ণনা করত। লাল নক্ষত্র উদিত হলে তারা বলল, এটা নবীর জন্মের নক্ষত্র এবং তিনি আখেরী নবী। তাঁর নাম আহমদ এবং তিনি ইয়াসরিবের দিকে হিজরত করবেন। কিন্তু যখন নবী করীম (সাঃ) আগমন করলেন, তখন তারা তাঁর নবুয়ত অস্বীকার করল এবং হিংসায় জ্বলে উঠল। আবূ নয়ীমের রেওয়ায়েতে যিয়াদ ইবনে লবীদ বর্ণনা করেন যে, তিনি মদীনারা টিলাসমূহে এ আওয়াজ শুনতে পান- হে ইয়াসরিববাসীগণ। বনী-ইসরাঈলের মধন্ত্র থেকে নবুয়ত খতম হয়ে গেছে। এখন আখেরী নবী আহমদ পয়দা হবেন। তিনি ইয়াসরিবের দিকে হিজরত করবেন। ইবনে সা’দ ও আনু নয়ীম রেওয়ায়েত করেন যে, আম্মারা ইবনে খুযায়মা ইবনে ছাবেত আপন পিতার কাছ থেকে উদ্ধৃত করেছেন আবু আমের নামক জনৈক সন্ন্যাসী আউস ও খাযরাজের ইহুদীদের মধ্যে সর্বাধিক রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর গুণাবলী বর্ণনা করত। ইহুদীদের কাছে যেয়ে ধর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করত। ইহুদীর রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর গুণাবলী বর্ণনা করত এবং মদীনায় হিজরত করার কথাও বলত। এরপর সে তায়মার ইহুদীদের কাছে গেল। তারাও একথাই বলল। এরপরা আবু আমের সিরিয়ায় গেল। সেখানকার খৃষ্টানদেরকে জিজ্ঞাসা করলে তারাও রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করল এবং বলল যে, মদীনা হবে তাঁর হিজরত ভূমি। আবু আমের সিরিয়া থেকে ফিরে এসে বলতে লাগল যে, সে সনাতন ধর্মের অনুসারী। পশমী বস্ত্র পরিধান করল, সন্ন্যাসব্রত অবলম্বন করল এবং দাবী করল যে সে হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর ধর্ম অনুসরণ করে। কিন্তু রসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন মক্কায় নবুয়ত ঘোষণা করলেন, তখন সে মক্কায় আসেনি; বরং স্বীয় অবস্থায় অটল রইল। যখন নবী করীম (সাঃ) মদীনায় এলেন, তখন সে হিংসা ও কপটতার পদ্ধ অবলম্বন করল। সে রসূলুল্লাহ (সাঃ) এর কাছে এসে বলল, “আপনি কোন্ ধম নিয়ে প্রেরিত হয়েছেন?” রসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন,” সনাতন ধর্ম নিয়ে এসেছি।” সে বলল, “আপনি এতে মিশ্রণ করেছেন।” নবী করীম (সাঃ) বললেন, আমি তেন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও সুস্পষ্ট সনাতন ধর্ম নিয়ে এসেছি। ইহুদী ও খৃষ্টানরা তোমার কাছে আমার যেসব গুণ ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছিল, সেগুলোর কি ফল হল? আনু আমের বলল, আপনি সেই ব্যক্তি নন, যাঁর গুণাবলী তারা বর্ণনা করেছিল। রসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, তুমি মিথ্যাবাদী। সে বলল, আমি মিথ্যা বলি না। রসূলুল্লাহ (সাঃ বললেন, আল্লাহ তায়ালা মিথ্যাবাদীকে নিঃসঙ্গ ও ধিকৃত মৃত্যু দান করুন। সে বলল, আমিন। এরপর আবু আমের মক্কায় চলে এল এবং আপন ধর্ম ত্যাগ করে কোরায়শদেন পৌত্তলিক ধর্মে দীক্ষিত হয়ে গেল। আবু নয়ীম ইবনে ইসহাক থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, জাফর ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আবুল হাকীমও উপরোক্ত রেওয়ায়েতটি বর্ণনা করেছেন এবা তাতে আরও সংযোজন করেছেন যে, মক্কা বিজয়ের পর আবূ আমের তায়েফে চলে গেল। তায়েফের অধিবাসীরাও মুসলমান হয়ে গেলে সে সিরিয়া চলে গেল একক্স সেখানে নিঃসঙ্গ ও ধিকৃত অবস্থায় মারা গেল।
পৃষ্ঠা:২৫
আবু নয়ীম আবূ সালামা ইবনে আবদুর রহমান ইবনে আওফ থেকে বর্ণনা করেন যে, কা’ব ইবনে লুওয়াই ইবনে গালেব শুক্রবারে কওমের লোকদেরকে একত্রিত করে এ ভাষণ দিত-শুন এবং শিখ, অন্ধকার রাত, উজ্জ্বল দিন, দিগন্ত বিস্তৃত ভূমি, সুউচ্চ আকাশ, স্তম্ভসম পাহাড়, নিদর্শন বিশিষ্ট নক্ষত্রমালা, পূর্ববর্তী ও পরবর্তী নারী পুরষ সকলই ধ্বংস হয়ে যাবে। আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখ, বংশ সংরক্ষণ কর। ধন সম্পদ বৃদ্ধি কর। মৃত্যুর পর কেউ ফিরে এসেছে কি? কোন মৃত জীবিত হয়েছে কি? গৃহ তোমাদের সম্মুখে। তোমরা যেমন বল, তেমন নয়। হেরেমের সৌন্দর্য বৃদ্ধি কর এবং তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন কর। একে আঁকড়ে থাক। কেন না, এর সাথে এক মহাসংবাদ জড়িত আছে। এখান থেকে নবীর আবির্ভাব হবে। আমাদের উপর দিয়ে দিবারাত্রি লাগাতার অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছে। যে কোন সময় নবী মোহাম্মদ এসে যাবেন। তিনি সত্য সত্য খবর শুনাবেন। আল্লাহর কসম, আমার চক্ষু, কর্ণ ও হাত পা সুস্থ থাকলে আমি তাঁর সাহায্যার্থে উঠে দাঁড়াতাম। কা’ব ইবনে জুওইয়ের ওফাত রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আবির্ভাবের পাঁচ শ ষাট বছর পূর্বে হয়েছিল। আবু নয়ীম ও ইবনে ইসহাক যুহরী থেকে, তিনি সায়ীদ ইবনে মুসাইয়িব থেকে এবং তিনি ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, কায়স্ ইবনে সায়েদা ওকাযের মেলায় তার সম্প্রদায়ের সামনে বক্তৃতায় বলল- মক্কার দিক থেকে তোমাদের কাছে সত্য আসবে। শ্রোতারা প্রশ্ন করন, কোন প্রকার সত্য? সে বলল, এক ব্যক্তি উজ্জ্বল মুখমণ্ডল, কাল চক্ষু লুওয়াই ইবনে গালেবের সন্তানদের মধ্যে হবে, সে তোমাদেরকে অনন্ত জীবন ও অক্ষষ নেয়ামতের দিকে আহবান করবে। তোমরা তাঁর দাওয়াতে সাড়া দিয়ো। যদি আমি তাঁর আবির্ভাব পর্যন্ত জীবিত থাকতাম, তবে সর্বাগ্রে তাঁর দিকে ধাবিত হতাম। খারায়েতী ও ইবনে আসাকির জামে ইবনে জেরান ইবনে জামী ইবনে ওছমান ইবনে সিমাল ইবনে আবিল হিছন ইবনে সামাওয়াল ইবনে আদিয়া থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, যখন আউস ইবনে হারেছার মৃত্যু সন্নিকটবর্তী হল, তখন সে আপন পুত্র মালেককে কিছু উপদেশ দেওয়ার পর বলল, আল্লাহর একটি ডাক আসবে, যদ্ধারা সৎকর্মপরায়ণরা সাফল্য লাভ করবে। যখন গালেবের বংশধর থেকে মক্কায় যমযম ও হাজারে-আসওয়াদের মধ্যস্থলে এক ব্যক্তি প্রেরিত হবে, তখন তাঁর সাফল্যের জন্যে চেষ্টা করবে। হে বনী আমের। তাঁকে সাহায্য করলেই কামিয়াবী অর্জিত হবে। ইবনে সা’দ হারাম ইবনে ওছমান আনছারী থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আসআদ ইবনে যুরারাহ চল্লিশজন সঙ্গীসহ সিরিয়া থেকে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে আগমন করেন। তিনি স্বপ্নে দেখলেন যে, কোন আগন্তক তাঁকে বলছেন, হে আবু উমামা। মক্কায় একজন নবী আবির্ভূত হবেন। তুমি তাঁর অনুসরণ করো। তাঁর চিহ্ন এই যে, তুমি যখন মনযিলে অবতরণ করবে, তখন তোমার সকল সঙ্গী মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে মারা যাবে। তুমি বেঁচে যাবে এবং অমুক ব্যক্তির চক্ষু বিনষ্ট হয়ে যাবে। সে মতে সে যখন মন্সিলে অবতরণ করল, তখন সকলেই প্লেগ রোগে আক্রান্ত হল। আবু উমামা ছাড়া সকলেই মারা গেল এবং তার এক সঙ্গীর একটি চক্ষু নষ্ট হয়ে গেল। ইবনে আবিদ্দুনিয়া, বায়হাকী ও আবু নয়ীম শা’বী থেকে, তিনি জুহায়নার এক শায়খ থেকে বর্ণনা করেন যে, মূর্খতা যুগে এক ব্যক্তি ওমায়র ইবনে হাবীব অসুস্থ হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। আমরা তার মুখমন্ডল ঢেকে দিলাম এবং মনে করলাম যে, সে মারা যাবে। অবশেষে তার কবর খননের জন্যেও লোকজনকে বলে দিলাম। আমরা তার কাছেই বসা ছিলাম, এমতাবস্থায় হঠাৎ সে উঠে বসল এবং বলল, আমি এখন সেই জায়গায় গিয়েছিলাম, যেখানে বেহুঁশ হয়েছিলাম। আমাকে কেউ বলল, হোবল তোকে থিকৃত করুক। তোর কবর খনন করা হচ্ছে এবং তোর মা তোর জন্যে কাঁদতে বসবে। তুই কি চাস না যে, তোর স্কুলে “কছল” (এক ব্যক্তির নাম)-কে কবরে নিক্ষেপ করে তার উপর মাটি চাপা দিয়ে দেই? তুইকি প্রেরিত নবীর প্রতি ঈমান আনবি? পরওয়ারদেগারের শোকর করবি এবং শিরক ও গোমরাহী ছেড়ে দিবি? আমি বললাম, হাঁ। এরপর আমাকে ছেড়ে দেয়া হল। এদিকে আমরা কছলের কাছে যেয়ে দেখলাম যে, সে মৃত গড়ে আছে। তাকে ওমায়রের জন্য খননকৃত কবরে দাফন করা হল। ওমায়র জীবিত রইল এবং ইসলাম গ্রহণ করল। ইবনে আসাকির কা’ব থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, হযরত আবু বকর ছিদ্দীক (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণের কারণ ছিল ঐশী নির্দেশ। ঘটনা এই যে, হযরত আবু বকর (রাঃ) বাণিজ্যের উদ্দেশে সিরিয়া গমন করেন। সেখানে তিনি একটি স্বপ্ন দেখে বুহায়রা নামক সন্ন্যাসীর গোচরীভূত করেন। সে নিজ্ঞাসা করল, আপনি কোত্থেকে এসেছেন। তিনি বললেন মক্কা থেকে। প্রশ্ন হল, আপনি কোন গোত্রের। লোক? তিনি বললেন, কোরায়শ গোত্রের। প্রশ্ন হল, কি করেন? তিনি বললেন, ব্যবসা-বাণিজ্য। এ কথা শুনে সন্ন্যাসী বলল, আল্লাহ আপনার স্বপ্ন সত্য করে দেখাবেন। তিনি আপনার কওমে একজন নবী পাঠাবেন। আপনি তাঁর উধীর হবেন এবং তাঁর ওফাতের পর তাঁর খলিফা হবেন। হযরত আবু বকর (রাঃ) এ ঘটনাটি গোপন রাখলেন ।। রসূলুল্লাহ (সাঃ) আসিস্টর হলে তাঁর কাছে এলেন এবং বললেন, ইয়া মোহাম্মদ। আপনার কাছে আপনার দাবীর te
পৃষ্ঠা:২৬
স্বপক্ষে কোন দলীল আছে কি? রসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, আমার দলীল সেই স্বপ্ন, যা আপনি সিরিয়াতে দেখেছিলেন। একথা শুনে হযরত আবু বকর (রাঃ) তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, কপালে চুম্বন করলেন এবং বললেন, আমি সাক্ষ্য দেই যে, আপনি আল্লাহর রসুল। ইবনে আসাকির মোহাম্মদ ইবনে আবদুর রহমান বায়াসী থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি স্বীয় পিতার কাছ থেকে, পিতা তাঁর পিতার কাছ থেকে শুনেছেন যে, হযরত আবু বকর (রাঃ)-কে কেউ প্রশ্ন করল, ইসলামের পূর্বে আপনি কি হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-এর নবুয়তের কোন চিহ্ন দেখেছেন? তিনি বললেন, হাঁ, দেখেছি। শুধু আমি কেন, কোরায়শ-অকুরায়শ যে-ই হোক না কেন, প্রত্যেকের জন্যে আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবুওয়তের নিদর্শন স্পষ্ট করে দিয়েছেন। আমি মুর্খতা যুগে এক বৃক্ষের নীচে উপবিষ্ট ছিলাম। হঠাৎ সে বৃক্ষের শাখাগুলো আমার মাথার উপর ঝুঁকে পড়ল। আমি হতভম্ব হয়ে সেগুলোর দিকে তাকাতে শুরু করলে তৎক্ষণাৎ বৃক্ষ থেকে আওয়াজ এল, অমুক নবী অমুক সময়ে আত্মপ্রকাশ করবেন। তুমি সকলের মধ্যে সর্বাধিক সৌভাগ্যশালী হয়ে যাও।
অতীত কিতাব সমূহে ছাহাবায়ে কেরামের উল্লেখ:
ইবনে আবীহাতেম স্বীয় তফসীরগ্রন্থে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে উদ্ধৃত করেছেন যে, আল্লাহ তায়ালা তওরাত, যবুর এবং আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করার পূর্বে স্বীয় জ্ঞানে একথা বিধিবদ্ধ করে দেন যে, উম্মতে-মোহাম্মদীকে পৃথিবীর উত্তরাধিকারী করা হবে। আল্লাহ পাক এরশাদ করেন, إِنَّ الْأَرْضَ يَرِثُهَا عِبَادِيَ الصَّالِحُونَ . : নিশ্চয় আমার সৎকর্মপরায়ণ বান্দারা পৃথিবীর উত্তরাধিকারী হবে। ইবনে আবীহাতেম বর্ণনা করেন যে, হযরত আবুদ্দারদা (রাঃ) উপরোক্ত আয়াত তেলাওয়াত করার পর বললেন, আমরাই সৎকর্মপরায়ণ বান্দা। আমি বলছি আমি যবুরের এক কপিতে একশ পঞ্চাশটি সূরা দেখেছি। চতুর্থ সূরায় একথা ছিল হে দাউদ, শুন এবং সোলায়মানকে বলে দাও, মানুষকে যেন বলে দেয় যে, পৃথিবী আমার। আমি মোহাম্মদ (সাঃ) ও তাঁর উম্মতকে এই পৃথিবীর ওয়ারিস করব। ইবনে আসাকির ইবনে মসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, হযরত আবু বকর (রাঃ) বলেছেন আমি ইসলামের আগমনের পূর্বে ইয়ামন গিয়েছিলাম এবং জনৈক ইহুদী শায়খের গৃহে অবস্থান করেছিলাম। তার বয়স ছিল দশ বছর কম চার’শ বছর। তিনি অত্যন্ত সুপন্ডিত ছিলেন এবং প্রাচীন গ্রন্থসমূহ অধ্যয়ন করেছিলেন। তিনি আমাকে বলল, তুমি হেরেমের লোক না? আমি বললাম, জ্বী হাঁ। শায়খ প্রশ্ন করলেন, তুমি কোরায়শী? আমি বলাম, জ্বী হাঁ। তিনি জিজ্ঞাস করলেনঃ তুমি তায়মী? আমি জওয়াব দিলামঃ জ্বী হাঁ। তিনি বললেন, ব্যস একটি বিষয় রয়ে গেল। আমি বললাম, সেটি কি? তিনি বললেন, তোমার পেট খুলে দেখাও। আমি বললাম, কেন? শায়খ বললেন, আমি সত্য জ্ঞানে একথা পেয়েছি যে, হেরেমে একজন নবী প্রেরিত হবেন। তাঁর সাহায্যকারী হবে একজন যুবক ও একজন বৃদ্ধ। যুবক হবে অকুতোভয় প্রতিরক্ষাকারী। বৃদ্ধ দুর্বল ও শ্বেতকায় হবে। তার পেটে থাকবে তিল এবং বাম উরুতে একটি চিহ্ন থাকবে। আমাকে পেট দেখিয়ে দিলে তোমার ক্ষতি কি? আমি তোমার সকল গুণ দেখেছি। কেবল এটিই দেখা হয়নি। হযরত আবু বকর (রাঃ) বলেন, আমি পেট খুলে দিলাম। সে আমার পেটে কাল তিল দেখে বলল, কাবার প্রভুর কসম, তুমিই সেই ব্যক্তি। ইবনে আসাকির রেওয়ায়েত করেন যে, রবী, ইবনে আনাম বর্ণনা করেছেন- অতীত কিতাবসমূহে হযরত আবু বকর (রাঃ)-কে বৃষ্টির পানির সাথে তুলনা করা হয়েছে, যা যেখানেই পড়ে, উপকার করে। ইবনে আসাকির রেওয়ায়েত করেন যে, আবূ বকরাহ বলেছেন, আমি হযরত ওমর (রাঃ)-এর কাছে গেলাম। তখন তাঁর কাছে কিছু লোক বসে আহার করছিল। হযরত ওমর (রাঃ) পিছনে বসা এক ব্যক্তির দিকে চোখে ইশারা করে জিজ্ঞাস করলেন, তোমাদের কিতাবে তার সম্পর্কে কি লেখা আছে? আমি বললাম, ইনি নবীর খলিফা ও বন্ধু। দীনূয়রী ও ইবনে নাসাকির রেওয়ায়েত করেন যে, যায়দ ইবনে আসলাম বলেন, হযরত ওমর (রাঃ) আমাকে বলেছেন মূর্খতা যুগে আমি কোরায়শের কিছু লোকের সঙ্গে বাণিজ্যের উদ্দেশে সিরিয়া গিয়েছিলাম। কাফেলা মক্কায় প্রত্যাবর্তন শুরু করলে আমার একটি কাজ মনে পড়ে গেল। সঙ্গীদেরকে বললাম, তোমরা চলতে থাক। আমি তোমাদের সাথে মিলিত হব। আমি সিরিয়ার এক বাজারে ঘুরাফেরা করছিলাম, এমন সময় এক পাদ্রী এসে আমার ঘাড় চেপে ধরল। সে আমাকে গীর্জায় নিয়ে গেল। সেখানে মাটির একটি প্রকান্ড স্তূপ ছিল। সে আমাকে একটি কোদাল, একটি কুড়াল ও একটি ঝুড়ি এনে দিল এবং বলল, এই মাটি তুলে বাইরে নিয়ে যাও। আমি বসে ভাবতে লাগলাম যে, এ কিরূপে সরাব। দ্বিপ্রহরে পাদ্রী এল এবং বলল, মাটি সরাওনি কেন? এরপর সে আমায় ঘুষি মারল। আমিও কোদাল তুলে তার মাথায় আঘাত করলাম। ফলে মাথা কেটে গেল। সেখান থেকে বের হওয়ার পর আমি পথ ভুলে গেলাম। দিবারাত্রি চলতে লাগলাম।
পৃষ্ঠা:২৭
সকালে এক গীর্জার নিকটে পৌঁছলাম এবং ছায়ায় বসে পড়লাম। গীর্জা থেকে এক ব্যক্তি বের হয়ে এল এবং বলল, এখানে বসে আছ কেন? আমি বললাম, আমি পথ ভুলে গেছি। সে আমার জন্য খাদ্য নিয়ে এল এবং আমার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করতে লাগল। সে বলল, এ সময়ে আমি কিতাবের সর্ববৃহৎ আলেম। তুমিই আমাদেরকে গীর্জা থেকে বহিকার করে দিবে এবং এ শহর দখল করে নিবে। আমি বললাম তুমি আমার ব্যাপারে ভুল বুঝাবুঝিতে লিপ্ত আছ। সে বলল, আচ্ছা, তোমার নাম কি? আমি বললাম, ওমর ইবনে খাত্তাব। সে বলল, নিঃসন্দেহে তুমিই সেই ব্যক্তি। এ গীর্জা এবং এর ভিতরে যা আছে, সব তুমি আমার নামে লিখে দাও। আমি বললামঃ তুমি আমার সাথে সদয় আচরণ করেছ। এখন এটাকে মলীন করছ কেন? সে বললঃ ব্যস তুমি এটা লিখে দাও যে, এ গির্জার উপর তোমার কোন দখল নেই। তুমি প্রকৃতই সেই ব্যক্তি হলে আমার উদ্দেশ্য সফল হবে। নতুবা এতে তোমার কোন লোকসান নেই। আমি বললামঃ আচ্ছা আন। আমি তাকে লিখিত দিয়ে তাতে মোহর লাগিয়ে দিলাম। হযরত ওমর (রাঃ) তাঁর খেলাফতকালে যখন বাইতুল মোকাদ্দাসে যান, তখন সেই সন্ন্যাসী লিখিত দলীল নিয়ে উপস্থিত হয়। তিনি এতে খুব আশ্চর্য বোধ করেন। হযরত ওমর (রাঃ) সমস্ত ঘটনা আমাকে শুনান এবং বলেনঃ এই গির্জায় ওমর কিংবা ইবনে ওমরের কোন অংশ নেই। আবদুল্লাহ ইবনে আহমদ আবু ইসহাক থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আনু ওবায়দা বর্ণনা করেছেন নবী করীম (সাঃ)-এর যমানায় একবার হযরত ওমর (রাঃ) যখন নিজের ঘোড়া চালনা করছিলেন, তখন তাঁর ঊরু খুলে যায়। নাজরানের এক ব্যক্তি তাঁর উরুতে তিল দেখে বললঃ এ সে ব্যক্তি, যার সম্পর্কে আমাদের কিতাবে লেখা আছে যে, সে আমাদেরকে আমাদের গৃহ থেকে বহিষ্কার করবে। আবু নয়ীম শহর ইখন নাওশাব থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, কা’ব বর্ণনা করেছেন, হযরত ওমর (রাঃ) যখন বাইতুল মোকাদ্দাসে ছিলেন, তখন আমি তাঁকে বললামঃ অতীতের কিতাবসমূহে লেখা আছে যে, এ দেশ একজন সাধু ব্যক্তি জয় করবে। সে মুসলমানদের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং কাফেরদের প্রতি কঠোর হবে। তার মনে তাই থাকবে, যা মুখে থাকবে। তার কর্ম তার কথার সত্যায়ন করবে। ন্যায়ের ব্যাপারে আপন-পর তার দৃষ্টিতে সমান হবে। তার অনুসারী রাতে দরবেশ এবং দিনে সিংহের ন্যায় পরাক্রমশালী হবে। তারা পরস্পরে নম্র আচরণ করবে, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখবে এবং সৎকাজে একে অপরের চেয়ে অগ্রণী হবে। একথা শুনে হযরত ওমর (রাঃ) বললেনঃ তুমি যা বলছ, ঠিক? আমি বললামঃ আল্লাহর কসম, ঠিক। তিনি বললেনঃ আল্লাহ তায়ালার শোকর, যিনি আমাদেরকে ইযযত দিয়েছেন, সম্মান ও গৌরবে ভূষিত করেছেন এবং মোহাম্মদ (সাঃ)-এর মাধ্যমে আমাদের প্রতি রহম করেছেন। ইবনে আসাকির ওবায়দ ইবনে আদম, আবূ মরিয়ম ও আবূ শোয়ায়ব থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, হযরত ওমর যখন জাবিয়া নামক স্থানে ছিলেন, তখন খালিদ ইবনে ওলীদ (রাঃ) বায়তুল মোকাদ্দাস পৌঁছেন। লোকেরা তাঁকে জিজ্ঞাসা করলঃ আপনার নাম কি? তিনি বললেনঃ খালিদ ইবনে ওলীদ। তারা জিজ্ঞাসা করলঃ আপনাদের আমীরের নাম কি? তিনি বললেনঃ ওমর ইবনে খাত্তাব। তারা বললঃ তাঁর কিছু গুণাবলী বর্ণনা করুন। খালিদ ইবনে ওলীদ হযরত ওমর (রাঃ)-এর দেহাবয়ব বর্ণনা করলেন। তারা বললঃ বায়তুল মোকাদ্দাস আপনি জয় করবেন না, বরং ওমর জয় করবেন। কারণ, আমাদের কিতাবে লেখা আছে যে, বায়তুল মোকাদ্দাসের আগে সকল শহর জয় করবে। যে ব্যক্তি বায়তুল মোকাদ্দাস জয় করবে, তার এ গুণ হবে। দ্বিতীয়তঃ কায়সারিয়া বায়তুল-মোকাদ্দাসের আগে জয় হবে। যান, প্রথমে কায়সারিয়া জয় করুন। এরপর আপনাদের আমীরকে সঙ্গে নিয়ে আসুন। তিবরানী ও আবূ নয়ীম মুগীছ আওযায়ী থেকে বর্ণনা করেন যে, হযরত ওমর (রাঃ) কা’বে আহবারকে জিজ্ঞাসা করলেনঃ তওরাতে আমার কি গুণাবলী বর্ণিত আছে? তিনি বললেন: আপনার সম্পর্কে বলা হয়েছে একজন কঠোরহস্ত খলিফা, যে আল্লাহর ব্যাপারে কারও তিরস্কারে ভীত হবে না। এরপর এক খলিফা হবে, যাকে একটি যালেম দল শহীদ করবে। এরপর পরীক্ষার যুগ শুরু হয়ে যাবে। ইবনে আসাকির হযরত ওমর (রাঃ)-এর মুয়াযযিন আকরা থেকে বর্ণনা করেন যে, হযরত ওমর (রাঃ) এক পাদ্রীকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমাদের কিতাবে আমাদের সম্পর্কে কি লেখা আছে? সে বললঃ আপনার বৈশিষ্ট্য ও ক্রিয়াকর্মের উল্লেখ আছে ঠিকই; কিন্তু আপনার নাম নেই। হযরত ওমর (রাঃ) প্রশ্ন করলেনঃ আমার সম্পর্কে কি আছে? পাদ্রী বলল, ইস্পাত-কঠিন শিং। হযরত ওমর (রাঃ) বললেনঃ এর মানে? সে বললঃ এর মানে কঠোর খলিফা। হযরত ওমর (রাঃ) বললেনঃ আল্লাহু আকবার। এরপর আমার পরে কে? পাদ্রী বললঃ একজন সৎ ব্যক্তি, যে আত্মীয়দেরকে অগ্রাধিকার দিবে। হযরত ওমর (রাঃ) বললেনঃ আল্লাহ তায়ালা ইবনে আফফানের প্রতি রহম করুন। তারপরে কে হবে? উত্তর হলঃ তরবারির ঝংকার। খলিফা বললেনঃ এটা তো পরিতাপের কথা। পাদ্রী বললঃ আমিরুল-মুমিনীন, যদিও তিনি নিজে সৎলোক হবেন। কিন্তু তাঁর খেলাফতে রক্ত প্রবাহিত হবে এবং তরবারি কোষমুক্ত হবে।
পৃষ্ঠা:২৮
ইবনে আসাকির ইবনে সিরীন থেকে রেওয়ায়েত ফরেন যে, কা’বে আহবার হযরত ওমর (রাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করেন: আমিরুল-মুমিনীন, আপনি স্বপ্নে কিছু দেখেন? হযরত ওমর (রাঃ) অস্বীকার করলে কা’ব বললেন: আমি এমন ব্যক্তি সম্পর্কে ওয়াকিফহাল, যিনি উম্মতের মঙ্গলের ব্যাপারাদি স্বপ্নে দেখে থাকেন। ইবনে রাহওয়াইহি আবু আইউব আনছারীর মুক্ত ক্রীতদাস হাসান ইবনে আফলাহ থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আবদুল্লাহ ইবনে সালাম মিসরীয়দের বিদ্রোহের পূর্বে মদীনায় আসতেন এবং কোরায়শ নেতৃবৃন্দকে বলতেন- ওছমানকে হত্যা করো না। তারা বলতঃ আল্লাহর কসম, তাঁকে হত্যা করার কোন ইচ্ছা আমাদের নেই। একথা শুনে আশ্বস্ত হয়ে আবদুল্লাহ ইবনে সালাম চলে যেতেন এবং একথা বলতে বলতে যেতেন যে, তারা তাঁকে অবশ্যই হত্যা করবে। অতঃপর তিনি পুনরায় এলেন এবং বললেনঃ তোমরা তাকে হত্যা করো না। তিনি নিজেই চল্লিশ দিনের মধ্যে ইন্তেকাল করবেন। তারা আবার পূর্বের কথাই বলল যে, তাঁকে হত্যা করা হবে না। এরপর আবার এলেন এবং হত্যা না করার জন্যে অনুরোধ করে বললেনঃ ওছমান নিজেই চল্লিশ দিনের মধ্যে ইন্তেকাল করবেন। ইবনে সা’দ ও ইবনে আসাকির তাউস থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, হযরত ওছমান (রাঃ)-কে শহীদ করা হলে আবদুল্লাহ ইবনে সালামকে প্রশ্ন করা হলঃ আপনি তওরাতে হযরত ওছমান (রাঃ)-এর আলোচনা কিভাবে পেয়েছেন? তিনি বললেনঃ আমরা তাঁকে ঘাতক ও অবমাননাকারীদের আমীর রূপে পেয়েছি। ইবনে আসাকির মোহাম্মদ ইবনে ইউসুফ থেকে, তিনি নিজের সাদা থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আবদুল্লাহ ইবনে সালাম হযরত ওছমান (রাঃ)-এর কাছে এলে তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন: যুদ্ধ ও সন্ধি সম্পর্কে আপনার অভিমত কি? আবদুল্লাহ্ বললেন: সন্ধি উপযুক্ত। কিন্তু আমাদের কিতাবে আছে আপনি কিয়ামতের দিন ঘাতক ও অবমাননাকারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগকারী হবেন। ইবনে আসাকির এ সনদেই রেওয়ায়েত করেছেন যে, আবদুল্লাহ ইবনে সালাম মিসরীয়দেরকে বললেনঃ তোমরা ওছমানকে (রাঃ) হত্যা করো না। কেননা, এই যিলহজ্ব মাস শেষ হওয়ার আগেই তাঁর ইন্তেকাল হয়ে যাবে। আবুল কাসেম বগভী সায়ীদ ইবনে আবদুল আজীজ থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ওফাত হয়ে গেলে ইহুদী আলেম যীকুরুবাত হেমইয়ারীকে জিজ্ঞাসা করা হলঃ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পরে কে হবে? সে বলল: “আল-আমীন” (অর্থাৎ আবু বকর রাঃ)। জিজ্ঞাসা করা হলঃ তারপরে? সে বললঃ ইস্পাত কঠিন শিং (অর্থাৎ হযরত ওমর রাঃ) প্রশ্ন করা হলও তারপরে? সে বললঃ আযহার (অর্থাৎ ২খরত ওছমান রাঃ) প্রশ্ন করা হলঃ তারপরে? উত্তর হল: উজ্জ্বল মুখমণ্ডল (অর্থাৎ হযরত আলী রাঃ)। ইবনে রাহওয়াইহি ও তিবরানী আবদুল্লাহ ইবনে মুগাফফাল থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, হযরত আলী (রাঃ)-এর শাহাদাতের পর আবদুল্লাহ ইবনে সালাম আমাকে বললেন: চল্লিশ বছর পূর্ণ হয়ে গেছে। এখন সন্ধি হয়ে যাবে। ইবনে সা’দ আবু সালেহ থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, হযরত ওছমান (রাঃ)-এর “হুদী” (উট চালনার গান) গায়ক এই হুদী গাইতঃ তারপরে আলী আমীর হবেন। যুবায়রের সাথে তার মতবিরোধ হবে। কা’ব বলেনঃ উদ্দেশ্য মোয়াবিয়া। মোয়াবিয়াকে বলা হলে তিনি বললেনঃ হে আবু ইসহাক। এটা কি রূপে হতে পারে। এখানে তো মোহাম্মদ (সাঃ)-এর ছাহাবী আলী ও যুবায়র উদ্দেশ্য। আবু ইসহাক বললেনঃ না, আপনিই উদ্দেশ্য। দারেমী ও ইবনে রাহওয়াইহি আবু জরীর ইযদী থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আবদুল্লাহ ইবনে সালাম নবী করীম (সাঃ)-কে বললেনঃ আমরা অতীত কিতাবসমূহে কিয়ামতের দিন আপনাকে পরওয়ারদেগারের সামনে মুখমণ্ডল অপ্রসন্ন অবস্থায় দণ্ডায়মান দেখতে পাই, এ কারণে যে, আপনার পরে আপনার উম্মত নতুন নতুন বিষয় গড়ে নিয়েছে।তিবরানী ও বায়হাকী মোহাম্মদ ইবনে এয়াযিদ থেকে বর্ণনা করেন যে, কায়স ইবনে খারশাহ ও কা’বে আহবার এক সঙ্গে যাচ্ছিলেন। ছিফফীন নামক স্থানে পৌছে কা’ব থেমে গেলেন এবং গভীর দৃষ্টিপাত করার পর বললেনঃ এ স্থানে মুসলমানদের অনেক রক্ত প্রবাহিত হবে, যা পৃথিবীর কোন অংশে প্রবাহিত হবে না। কায়স বললেনঃ আপনি কিরূপে জানলেন? গায়েবের খবর তো আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। কা’ব বললেনঃ পৃথিবীর প্রতি অংশে যা কিছু হবে এবং যা কিছু আবিষ্কৃত হবে সব আল্লাহর অবতীর্ণ কিতাব তওরাতে উল্লেখিত আছে। হাকেম মুস্তাদরাক গ্রন্থে আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়র (যাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, মুখতারের খণ্ডিত শির আনা হলে আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়র (রাঃ) বললেনঃ কা’ব যা কিছু বর্ণনা করেছিলেন, আমি সবগুলোর সত্যতা পেয়ে গেছি- একটি ছাড়া। তা এই যে, এক ছকফী আমাকে হত্যা করবে। আ’মাশ বলেনঃ আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়র জানতেন না যে, হাজ্জাজ তার সম্পর্কে কি সংকল্প করে রেখেছিল। হাকেম মুস্তাদরাকে বর্ণনা করেন যে, আবদুল্লাহ ইবনে আমর বলেছেনঃ কিভাবে উল্লেখিত আছে যে, মোয়াবিয়ার বংশে এক ব্যক্তি রক্তপিপাসু হবে। ে মানুষের ধন-সম্পদকে বৈধ মনে করবে এবং বায়তুল্লাহ ভেঙ্গে দিবে। আমার
পৃষ্ঠা:২৯
সামনেই এরূপ হয়ে গেলে ভাল। নতুবা আমাকে স্মরণ করো। (বনু কোরায়সে বসবাসকারিনী বনু মুগীরার এক মহিলাকে সম্বোধন করে একথা বলা হয়েছিল।) হাজ্জাজ ও ইবনে যুবায়রের আমল আসার পর এই মহিলা বায়তুল্লাহর ভগ্নদশা দেখে বললঃ আল্লাহ, আবদুল্লাহ ইবনে আমরের প্রতি সদয় হোন। আবদুল্লাহ ইবনে আহমদ হেশাম ইবনে খালেদ থেকে রেওয়ায়েত করেছেন যে, তিনি বলেনঃ আমি তওরাতে পাঠ করেছি যে, আকাশ ও পৃথিবী ওমর ইবনে আবদুল আজীজের জন্যে চল্লিশ বছর পর্যন্ত ক্রন্দন করবে। মোহাম্মদ ইবনে ফুযালা জনৈক সন্ন্যাসীর এই উক্তি বর্ণনা করেন যে, ন্যায়পরায়ণ শাসকদের মধ্যে ওমর ইবনে আবদুল আজীজের মর্তবা এমন, যেমন পবিত্র মাসসমূহের মধ্যে রজব মাসের মর্তবা। ওলীদ ইবনে হেশাম বর্ণনা করেন, আমরা প্রবাসে এক জায়গায় অবস্থান করলে জনৈক সন্ন্যাসী বললঃ আমিরুল-মুমিনীন সোলায়মান ওফাত পেয়ে গেছেন। আমরা বললামঃ তারপরে কে খলিফা হবে? সে বলল: ওমর ইবনে আবদুল আজীজ। আমরা সিরিয়ায় পৌছলে একথা সত্য সাব্যস্ত হল। চার বছরপর আমরা আবার সেই জায়গায় অবস্থান করে সন্ন্যাসীকে বললাম: আপনার কথা সত্য ছিল। সে বললঃ এখন ওমর ইবনে আবদুল আজীজকে বিষ প্রদান করা হয়েছে। আমরা দেশে ফিরে এসে এখবরও সত্য পেলাম। ইবনে আসাকির মুগীরা ইবনে নোমান থেকে বর্ণনা করেন যে, বছরার এক ব্যক্তি বলেছে- আমি বায়তুল-মোকাদ্দাসের উদ্দেশে গমন করছিলাম, বৃষ্টি আমাকে এক গির্জায় আশ্রয় নিতে বাধ্য করল। গির্জার সন্ন্যাসী আমাকে বলল: আমাদের কিতাবে আছে যে, তোমাদের ধর্মাবলম্বীরা আসরায় (সিরিয়ার একটি স্থানের নাম) যুদ্ধ করবে। তারা হিসাব নিকাশ ও আযাবের উর্ধ্বে থাকবে। এ খবর শুনার কিছু দিন পরেই হাজার ইবনে আদী ও তার সঙ্গীরা আসরায় আসে এবং পরস্পরে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। বায়হাকী কা’বে আহবার থেকে বর্ণনা করেন যে, বন্ধু-আব্বাসের কালো পতাকা প্রকাশ পাবে। সিরিয়ায় তাদের হাতে অনেক যালেম নিহত হবে। কুলায়বী হাম্মাদ ইবনে সালামাহ থেকে, তিনি ইয়ালা ইবনে আতা থেকে এবং তিনি বুজায়র আবু ওবায়দ থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, কিতাবধারী সারাহ ইয়ারমুকী বর্ণনা করেছেন আমি কিতাবে পাই যে, এ উম্মতের নবীসহ বারজন শীর্ষ নেতা হবেন। তাদের সময়কাল পূর্ণ হয়ে গেলে উম্মত অবাধ্যতা ও বিদ্রোহ করতে শুরু করবে এবং তাদের শক্তি পরস্পরের মধ্যে রায় হরে।
নবী করীম (সাঃ)-এর আবির্ভাব সম্পর্কে
অতীন্দ্রিয়বাদীদের খবর
আবু নয়ীম ও ইবনে আসাকির ইসমাঈল ইবনে আইয়াশ থেকে, তিনি এয়াহইয়া ইবনে আমর শায়বানী থেকে এবং তিনি আবদুল্লাহ ইবনে দায়লামী থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, এক ব্যক্তি হযরত ইবনে আববাস (রাঃ)-এর কাছে এসে বললঃ আমি জানতে পারলাম, আপনি সাতীহ্ নামক এক অতীন্দ্রিয়বাদী সম্পর্কে বলেন যে, আল্লাহ তায়ালা সমগ্র মানব জাতির মধ্যে তার মত কাউকে সৃষ্টি করেননি। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বললেন: হাঁ, আল্লাহ তায়ালা সাতীহকে কসাইয়ের চাটাইয়ের উপর পড়ে থাকা মাংসপিণ্ডের মত করে সৃষ্টি করেছেন। সে যেখানে যেত, চাটাইসহই তুলে নেয়া হত। কেননা, তার মধ্যে না ছিল কোন হাড্ডি, না ছিল কোন গ্রন্থি। কেবল মাথার খুলি, ঘাড় ও হাতের তালু ছিল। তাকে পা থেকে ঘাড় পর্যন্ত কাপড়ের ন্যায় ভাঁজ করে নেয়া হত। জিহবা ব্যতীত শরীরের কোন অংশে স্পন্দন ছিল না। সে যখন মক্কায় আসার ইচ্ছা করল, তখন তাকে চাটাইসহ বহন করে আনা হল। কুছাইয়ের পুত্রদ্বয় আবদে শামস ও আবদে মানাফ, আহওয়াস ইবনে ফেহের এবং আকীল ইবনে আব্বাস কোরায়শ বংশের এই চার ব্যক্তি তার সাথে সাক্ষাৎ করতে এলে সে তাদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করল। তারা জবাবে নিজেদের বংশপরিচয় পরিবর্তন করে বললঃ আমরা জুমাহ পৌত্রের লোক। আপনার আগমনের সংবাদ শুনে সাক্ষাৎ করতে এসেছি। কেননা, আপনার সাথে সাক্ষাৎ করা আমাদের জন্যে অপরিহার্য ছিল। আকীল তাকে হিন্দী তলোয়ার ও রুশী বর্শা উপহার দিল। কিন্তু প্রথমে তারা এ দু’টি বস্তু বায়তুল্লাহর দরজায় রেখে দিল এটা পরীক্ষা করার জন্যে যে, সাতীহ্ এগুলো দেখে কি না? সাতীহ বললঃ আকীল, তোমার দু’টি হাত আমাকে দাও। আকীল নিজের হাত তার হাতে ধরিয়ে দিল। সাতীহ্ বললঃ সেই সত্তার কসম, যিনি গোপন বিষয়াদি জানেন, যিনি গোনাহ মার্জনাকারী, কসম সেই দায়িত্বের, যা পূর্ণ করা হয় এবং কসম কা’বা গৃহের তুমি আমার কাছে হিন্দী তলোয়ার ও রুশী বর্শা উপহার নিয়ে এসেছ। কোরায়শী নেতারা বললঃ হে সাতীহ , তুমি সত্য বলেছ। সাতীহ বলল: কসম লাতের ও রামধনুর, কসম অগ্রগামী নওজোয়ান অশ্বের এবং সেই অশ্বের, যার ললাটের শুভ্রতা এক দিকে ঝুঁকে আছে, কসম খর্জুর বৃক্ষের এবং কাঁচা পাকা খেজুরের কাক উড়ন্ত অবস্থায় সংবাদ দিয়েছে যে, তোমরা জুমাহ্ গোত্রের লোক নও। বরং বাতহা উপত্যকার অধিবাসী কোরায়শী তারা সকলে বলল: তুমি ঠিক বলেছ। আমরা মক্কার বাসিন্দা। তোমার জ্ঞান-গরিমার কথা শুনে তোমার সাথে সাক্ষাৎ করতে এসেছি। আমাদেরকে বল,
পৃষ্ঠা:৩০
আমাদের কালে এবং আমাদের পরবর্তীকালে কি কি ঘটনা সংঘটিত হবে? সাতীহ বললঃ এবার তোমরা সত্যকথা বলেছ। শুন যেসব বিষয় খোদা আমাকে ইলহাম করেছেন- হে আরবের লোক সকল! তোমরা বার্ধক্যে উপনীত হয়েছ। তোমাদের ও অনারবদের অন্তর্জানে এখন আর কোন তফাৎ নেই। তোমাদের মধ্যে কোন জ্ঞান-গরিমা ও বুদ্ধিমত্তা অবশিষ্ট নেই। তোমাদের বংশধর থেকে একটি দল সৃষ্টি হবে, যারা সকল প্রকার জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনুসন্ধানকারী হবে। তারা বাঁধ পর্যন্ত পৌছে যাবে, অনারবদেরকে হত্যা করবে এবং গনীমত হাসিল করবে। কোরায়শ নেতারা প্রশ্ন করলঃ হে সাতীহ, তারা কোন বংশের লোক হবে? সাতীহ্ বলল: কসম স্তঃবিশিষ্ট গৃহের, শান্তির ও সম্রাটের- তারা তোমাদেরই বংশধর থেকে হবে, যারা প্রতিমা চূর্ণ করে দিবে এবং শয়তানের এবাদত ছেড়ে এক রহমানের এবাদত করবে। খোদার ধর্ম প্রতিষ্ঠিত করবে এবং অন্ধদের অগ্রে চলে যাবে। কোরায়শরা বললঃ হে সাতীহ, তারা কোন ব্যক্তির পরিবার থেকে হবে? সাতীহ বলল: কসম সেই সত্তার, যিনি সেরা সম্ভ্রান্ত, যিনি কীট-পতঙ্গ গণনাকারী, যিনি টিলাসমূহকে কম্পমান করে এবং দুর্বলকে সবল করে তারা সংখ্যায় হাজার হাজার হবে এবং আবদে-শামস ও আবদে-মানাফের পরিবার থেকে হবে। তাদের পরস্পরে মতবিরোধও থাকবে। কোরায়শরা বললঃ হে সাতীহ, তাদের আরও কথা শুনাও এবং বল যে, তাদের অভ্যুদয় কবে হবে? সে বললঃ সেই সত্তার কসম, যিনি অনন্তকাল থাকবেন, যিনি সকল পরিণাম সম্পর্কে ওয়াকিফ- নবী হাদী এ শহরেই আত্মপ্রকাশ করবেন। তিনি মানুষকে সৎকর্মের প্রতি দাওয়াত দিবেন এবং ইয়াগুছ, নসর ও ছদদের এবাদত অস্বীকার করে এক খোদার এবাদত করবেন। এরপর আল্লাহ তাঁকে ওফাত দিবেন। সে সময় দুনিয়াতে তাঁর প্রশংসা কীর্তিত হবে এবং আকাশে তাঁর সাক্ষ্য দেওয়া হবে। তাঁর পরে ছিদ্দীক শাসনকর্তা হবেন। তিনি ঠিক ঠিক ফয়ছালা করবেন এবং মানুষের অধিকার আদায়ে কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি করবেন না। তার পরে সনাতন ধর্মের অনুসারী ও অত্যন্ত অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তি শাসনকর্তা হবেন। তিনি অতিথিপরায়ণ হবেন এবং সনাতন ধর্মকে সুপ্রতিষ্ঠিত করবেন। তার পরে এক লৌহবর্মধারী ও অভিজ্ঞ ব্যক্তি শাসক হবেন। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন দল ঐক্যবদ্ধ হবে এবং তাঁকে হত্যা করবে। তার পরে আসবে এক বিজয়ী শাসনকর্তা। তার আমলে সৈন্যদের সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে। তারপরে তার পুত্র শাসক হবে। সে ধনসম্পদ আত্মসাৎ করবে এবং সন্তানদের জন্যে সম্পদ জমা করবে। তার পরে অনেক রাজরাজড়া আসবে এবং অনেক রক্ত প্রবাহিত হবে। অবশেষে একজন দরবেশ প্রকৃতির লোক আসবেন এবং তাদেরকে পিষ্ট করে দিবেন। অতঃপর যালেম আবু জাফর শাসনকর্তা হবে। সে সত্যকে দূরে ঠেলে দিবে এবং অসত্যকে নিকটবর্তী করবে। বিভিন্ন দেশ জয় করবে। এরপর আসবে এক খর্বাকৃতি শাসক, যার কোমরে চিহ্ন থাকবে। সে অকস্মাৎ মৃত্যুমুখে পতিত হবে। এরপর আসবে এক প্রতারক শাসক, যে দেশকে কাঙ্গাল করে দিবে। এরপর তার ভাই আসবে এবং একই ধারায় রাজ্যশাসন করবে। ধনসম্পদ কুক্ষিগত করবে। এরপর এক প্রভৃত নেয়ামতশালী বীর পুরুষ শাসক হবে। তার আত্মীয় ও পরিবারের লোকজন তার কাছ থেকে রাজত্ব ছিনিয়ে নিবে এবং তাকে হত্যা করবে। এরপর সপ্তম শাসক এসে দেশকে বেকার ও সম্পদশূন্য করে দিবে। সে নিজের দেশে ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুরবে। তখন প্রত্যেক ব্যক্তি রাজত্বের অভিলাষী হবে। মীসান ও লেবাননের মাঝখানে দামেশকে নিযারী ও কাহতানী বংশের যোদ্ধারা সমবেত হবে এবং নিযারীরা কাহতানীদেরকে পিষ্ট করে দিবে। এয়ামন বিভক্ত হয়ে যাবে। চতুর্দিকে ছিন্ন তাঁবু, বিচ্ছিন্ন ঝাণ্ডা এবং পায়ে শিকল পরিহিত কয়েদী দৃষ্টিগোচর হবে। মিম্বর বরবাদ হয়ে যাবে। বিধবারা সতীত্ব হারাবে। গর্ভবতী নারীদের গর্ভপাত হবে। ভূমিকম্প আসবে। ওয়ায়েল খেলাফতের দাবীদার হবে। একারণে নিযারীরা ক্ষেপে যাবে। গোলাম ও ব্যভিচারী বেড়ে যাবে। ভাল লোক কুত্রাপি পাওয়া যাবে। মানুষ ক্ষুধায় মারা যাবে এবং দ্রব্যমূল্য গগনচুম্বী হবে। কোন এক ছফর মাসে সকল যালেমকে হত্যা করা হবে। এই সংবাদ ব্যাপক প্রচার লাভ করবে। এরপর তীরন্দাজ ও পদাতিক বাহিনী আসবে। তারা বর্শাবাহীদেরকে হত্যা করবে। মানুষকে বন্দী করবে। এরপর ধর্ম মিটে যাবে। পরিস্থিতি বদলে যাবে। সেতুসমূহ বিধ্বস্ত করা হবে এবং দ্বীপবাসীরা প্রবল হবে। এরপর দক্ষিণ থেকে সেনাবাহিনী আসবে। তারা ফাসেকদের মদদ করবে। এটা এমন এক সংকটময় যুগ হবে, যখন মানুষের লজ্জা-শরম বলতে কিছু অবশিষ্ট থাকবে না।কোরায়শ নেতারা বললঃ হে সাতীহ্, এরপর কি হবে?সে বলল: এরপর এয়ামন থেকে এক শুভ্র ব্যক্তি আসবে। সে আদন ও সানা-আর মধ্যবর্তী স্থান থেকে আত্মপ্রকাশ করবে। তার নাম হবে হাসান কিংবা হুসাইন। আল্লাহ তার মাধ্যমে সকল ফেতনা খতম করে দিবেন।ইবনে আসাকির ইবনে ইসহাক থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, বাদশাহ রবিয়াহ ইবনে নছর একটি ভয়াবহ স্বপ্ন দেখলেন। এর ব্যাখ্যার জন্যে তিনি দেশের সকশ ভবিষ্যদ্বক্তা, অতীন্দ্রিয়বাদী, যাদুকর ও জ্যোতিষীদেরকে দরবারে তলব করলেন এবং
পৃষ্ঠা:৩১
বললেনঃ আমি একটি ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেছি। তোমরা এর ব্যাখ্যা দাও। তারা বললঃ স্বপ্ন শুনান, যাতে ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। রবিয়াহ বললঃ স্বপ্ন শুনিয়ে দিলে এর ব্যাখ্যায় আমার মন সন্তুষ্ট হবে না। এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা সেই দিতে পারে, যে না শুনেই স্বপ্ন জেনে নেয়। এক ব্যক্তি বললঃ যদি বাদশাহের ইচ্ছা তাই হয়, তবে সাতীহ ও শককে তলব করা উচিত। এক্ষেত্রে তাদের চেয়ে বড় কোন বিজ্ঞ নেই। তারাই এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা বলতে পারবে। আসলেও তখনকার দিনে এ দু’জনের সমকক্ষ কোন অতীন্দ্রিয়বাদী ছিল না। প্থমে সাতীহকে দরবারে আনা হলো। বাদশাহ বললেনঃ হে সাতীহ! আমি একটি ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেছি। তুমি বল আমি কি দেখেছি? সতীহ বললঃ আপনি দেখেছেন যে, ঘোরকৃষ্ণ বর্ণের এক ব্যক্তি অন্ধকার ভেদ করে নির্গত হল এবং মক্কার ভূখন্ডে যেয়ে পতিত হল। সেখানে যত খুলিওয়ালা ছিল, সে সবাইকে গিলে ফেলল।বাদশাহ বলল: ঠিক বলেছ। এখন এর ব্যাখ্যা বল। সাতীহ বলল: অতঃপর কংকরময় মাঠের মধ্যে যত কাঁট আছে, আমি তাদের কসম খাচ্ছি। সেই কৃষ্ণকায় ব্যক্তি আপনার দেশ আবিসিনিয়ায় আসবে এবং আধীন থেকে জারাশ পর্যন্ত ভূখন্ডের অধিপতি হয়ে যাবে। বাদশাহ বললেন: এটা তো আমাদের জন্যে পীড়াদায়ক ও ক্রোধের কারণ। আচ্ছা বল, এ ঘটনা আমার আমলে হবে, না আমার গরে? সাতীহ বললঃ এ ঘটনা আপনার ষাট-সত্তর বছর পরে ঘটবে। বাদশাহ প্রশ্ন করলেন: তাদের রাজত্ব বাকী থাকবে, না খতম হয়ে যাবে? সাতীহ্ বললঃ সত্তর বছরের কিছু বেশি সময় পরে খতম হয়ে যাবে। তারা অন্তর্দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে পলায়ন করবে। বাদশাহ প্রশ্ন করলেনঃ তাদেরকে কে হত্যা করবে এবং কে বহিষ্কার করবে? সাতীহ বললেন: ইরাম যী ইয়াযন নামক এক ব্যক্তি আদন থেকে আত্মপ্রকাশ করবে এবং এয়ামনে কাউকে ছাড়বে না। বানশাহ বললেন: তার রাজত্ব কায়েম থাকবে, না খতম হয়ে যাবে? সাতীহ বললেনঃ সত্তর বছরের কিছু বেশি সময়ের মধ্যে খতম হয়ে যাবে। বাদশাহ প্রশ্ন করলেন: কে খতম করবে? সতীহ্ বললেন: একজন ধীশক্তি সম্পন্ন নবী আসবেন, যাঁর প্রতি ওহী নাযিল হবে। বাদশাহ জিজ্ঞাসা করলেন: এই নবী কোন পরিবার থেকে হবেন? সতীহ বললেন: এই নবী গালেব ইবনে ফেহের ইবনে মালিক ইবনে নযরের সন্তানদের মধ্য থেকে হবেন। তাঁর রাজত্ব শেষ যমানা পর্যন্ত কায়েম থাকবে। বাদশাহ বললেন : হে সাতীহ, যমানারও কোন শেষ আছে কি? সাহীহ বললেন : হ্যাঁ। সেটা এমন একদিন হবে, যখন আপনি এবং পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল মানুষকে সমবেত করা হবে। সেই দিনে সৎকর্মপরায়ণর। ভাগ্যশালী হবে এবং কুকর্মীরা ভাগ্যাহত হবে। বাদশাহ বললেনঃ হে সাতীহ, তুমি যা বললে, তা ঠিক? সাতীহ্ বললেন: আমি পশ্চিমাকাশের লাল আভা, অন্ধকার এবং প্রত্যুষের কসম খেয়ে বলছি- আমি যা বলেছি, তা ঠিক। এরপর বাদশাহ শককে ডেকে স্বপ্ন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন এবং সাতীহের বক্তব্য গোপন রাখলেন এটা দেখার জন্যে যে, উভয়ে একই কথা বলে, না ভিন্ন ভিন্ন। শক বলল: আপনি একটি কয়লাকে অন্ধকার ভেদ করে বেরিয়ে আসতে দেখেছেন। আপনি সেটি বাগানে রেখে দিলেন। সে সেখানকার সকল প্রাণীকে গিলে ফেলল। বাদশাহ প্রশ্ন করলঃ এর ব্যাখ্যা কি? শক বললঃ উভয়কাল ও পাথুরে ময়দানের মধ্যস্থলে যত মানুষ আছে, আমি তাদের কসম খেয়ে বলছি, আপনার দেশে কৃষ্ণকায়রা আগমন করবে। তারা সবার উপর প্রবল হয়ে যাবে এবং আবীন ও নাজরান পর্যন্ত এলাকার শাসনকর্তা হয়ে যাবে। বাদশাহ বললেন: এটা তো আমাদের জন্যে খুবই কষ্টদায়ক এবং ক্রোধ। উদ্দীপক। এ ঘটনা আমার আমলে হবে, না আমার পরে? শক বলল: না, অনেক কাল পরে হবে। এরপর এন প্রতাগশালী ব্যক্তি দেশবাসীকে মুক্তি দিবে এবং তাদেরকে লাঞ্ছিত করবে। বাদশাহ প্রশ্ন করলেনঃ এই প্রতাপশালী ব্যক্তি কে হবে? শক বললঃ সে যাইয়াযন পরিবারের এক সম্ভ্রান্ত যুবক হবে। বাদশাহ প্রশ্ন করলেনঃ তার রাজত্ব খতম হয়ে যাবে, না টিকে থাকবে? শক বললঃ তার রাজত্ব একজন নবী খতম করবেন, যিনি সত্য ও সুবিচার নিয়ে আগমন করবেন। তাঁর সম্প্রদায়ের মধ্যে ফয়ছালার দিন পর্যন্ত রাজত্ব থাকবে। বাদশাহ বললেন: ফয়ছালার দিন কি? শক বলল: এই দিনে বাদশাহদেরকে প্রতিদান দেওয়া হবে। নাকাশ থেকে ডাক আসবে, যা জীবিত মৃত সকলেই শুনবে এবং তারা মীকাতে সমবেত হয়ে যারা আল্লাহকে ভয় করে থাকবে, তারা সফলকাম হবে।
পৃষ্ঠা:৩২
ইবনে আসাকির বলেনঃ সাতীহ আরমের বন্যার সালে জন্মগ্রহণ করে এবং নবী করীম (সাঃ) যে সালে জন্মগ্রহণ করেন, সেই সালে মারা যায়। তার বয়স পাঁচশ’ বছর মতান্তরে তিন শ’ বছর হয়েছিল। আবূ মূসা মুনায়নী কলবী থেকে এবং তিনি আওয়ানা থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, একবার হযরত ওমর (রাঃ) মজলিসে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গকে জিজ্ঞাসা করলেনঃ তোমাদের কারও কাছে নবী করীম (সাঃ) সম্পর্কে মূর্খতাযুগের কোন খবর আছে কি? একথা শুনে একশ’ ষাট বছর বয়স্ক তোফায়েল ইবনে যায়দ হারেছী বললঃ হাঁ, আমিরুল-মুমিনীন, মামুন ইবনে মোয়াবিয়ার অতীন্দ্রিয়বাদিতা সম্পর্কে তো আপনি জানেনই—-। এরপর সে নবী করীম (সাঃ)-এর আগমনের আলোচনা পর্যন্ত একটি দীর্ঘ বর্ণনা শুনিয়ে দিল এবং মামুনের এই কবিতাও শুনাল- হায়, আমি যদি তাঁকে পেতাম। হায়, আমি যদি আগে দুনিয়াতে না আসতাম। তোফায়ল বলেনঃ আমরা যখন তেহামায় ছিলাম, তখন রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নবুয়ত প্রাপ্তির সংবাদ অবগত হই। আমি মনে মনে বললামঃ ইনিই সেই নবী, যাঁর ভবিষ্যদ্বাণী মামুন করেছিল। এরপর দিন অতিবাহিত হতে থাকে। অবশেষে আমি রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে এসে ইসলাম গ্রহণ করলাম। পবিত্র নাম পাথরে খোদিত পাওয়া গেছে ইবনে আসাকির হাসান থেকে এবং তিনি সোলায়মান থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, হযরত ওমর (রাঃ) একবার কা’বে আহবার কে বললেনঃ হে কা’ব, রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ফযীলত সম্পর্কে আপনার জন্মের পূর্বেকার কোন ঘটনা শুনান। কা’ব বললেনঃ অবশ্যই হে আমিরুল মুমিনীন, আমি কিতাবে পড়েছি হযরত ইবরাহীম খলিলুল্লাহ একটি পাথর পান, যাতে চারটি ছত্র লেখা ছিল। প্রথম ছত্র এইঃ আমি আল্লাহ। আমা ব্যতীত কোন মাবুদ নেই। আমার ইবাদত কর। দ্বিতীয় ছত্র এই: আমি আল্লাহ। আমা ব্যতীত কোন মাবুদ নেই। মোহাম্মদ আমার রসূল। যে তার প্রতি ঈমান আনবে এবং তাঁর অনুসরণ করবে, তাকে মোবারকবাদ! তৃতীয় ছত্র এইঃ আমিই আল্লাহ। আমা ব্যতীত কোন মাবুদ নেই। যে আমার উপর ভরসা করবে, সে মুক্তি পাবে।চতুর্থ ছত্র এই: আমিই আল্লাহ। আমা ব্যতীত কোন মাবুদ নেই। হেরেম আমার। কা’বা আমার গৃহ। যে আমার গৃহে প্রবেশ করবে, সে আমার আযাব থেকে নিরাপদ হয়ে যাবে।বুখারী ও বায়হাকী মোহাম্মদ ইবনে আসওয়াদ থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তার পিতা কোন জায়গার নীচে একটি লেখা পান। সেটি পড়ার জন্যে কোরায়শরা হেমইয়ার গোত্রের এক বাক্তিকে ডাকল। সে বললঃ এটি এমন এক দলিল, যা বলে দিলে তোমরা আমাকে হত্যা করবে। মোহাম্মদ ইবনে আসওয়াদের পিতা বলেনঃ এতে আমরা বুঝে নিলাম যে, এর মধ্যে হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-এর আলোচনা আছে। সেমতে আমরা দলিলটি লুকিয়ে ফেললাম। আবূ নয়ীম হারিশ ইবনে আবূ হারিশ থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তালহা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন- বায়তুল্লাহর প্রথম খনন কার্যে একটি নকশাযুক্ত পাথর পাওয়া যায়। সেটা পড়ার জন্যে এক ব্যক্তিকে ডাকা হল। তাতে লেখা ছিলঃ আমার মনোনীত বান্দা। সে মুতাওয়াক্কিল, মুনীব ও মুখতার। সে মক্কায় জন্মগ্রহণ করবে। সে বাঁকা পথকে সরল করবে। সে সাক্ষ্য দিবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই। তাঁর উম্মত খুব প্রশংসাকারী হবে। তারা প্রতিটি উচ্চভূমিতে আল্লাহর হামদ করবে। কোমরে লুঙ্গি বাঁধবে এবং হাত পা পবিত্র রাখবে। ইবনে আসাকির আবুত্তাইয়ের আবদুল মুনয়িম ইবনে গলবুন থেকে বর্ণনা করেন যে, যখন আমূরিয়া বিজিত হল তখন সেখানে এক গির্জার প্রাচীরে স্বর্ণাক্ষরে এই কথাগুলো লিখিত দেখা গেলঃ পরবর্তীদের মধ্যে মন্দ সেই ব্যক্তি, যে পূর্ববর্তীদেরকে মন্দ বলে। পূর্ববর্তীদের এক ব্যক্তি পরবর্তীদের হাজারো ব্যক্তির চেয়ে উত্তম। হে গুহাবাসী, তোমার সম্মান ও গৌরব অর্জিত হয়েছে। কেননা, খোদা তোমার প্রশংসা করেছেন। খোদা তাঁর নাযিল করা কিতাবে বলেন: দু’জনের দ্বিতীয়জন যখন তারা উভয়েই গুহায় ছিল। হে ওমর! তুমি শাসক নও-বাপ। হে ওছমান, তোমাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছে এবং তোমার কবর পর্যন্ত যিয়ারত করা হয়নি। হে আলী, তুমি ধার্মিকদের পথপ্রদর্শক, রসূলুল্লাহ (সাঃ) থেকে কাফেরদেরকে দূরে বিতাড়নকারী। সুতরাং যে গুহাবাসী, সে ধার্মিক, সে জনপদের আশ্রয়স্থল। যালেমের ভাল-মন্দ কাজ তাদের মধ্য থেকে কার মর্যাদা ক্ষুন্ন করতে পারে? রাবী বলেন, আমি পাদ্রীকে জিজ্ঞাসা করলাম, বার্ধ্যকের কারণে যার ভ্রূ চোখের উপর ঝুলে পড়েছিল: এই কথাগুলো কবে থেকে তোমাদের গির্জার প্রাচীরে লিখিত আছে? পাদ্রী বলল: আপনাদের নবীর নবুয়ত প্রাপ্তির দু’হাজার বছর পূর্ব থেকে। আবু মোহাম্মদ জওহরীর রেওয়ায়েত এয়াহইয়া ইবনে ইয়ামান বলেন, বনী সোলায়মের মসজিদের ইমাম আমাকে বলেছেন যে, তাঁর পূর্বপুরুষেরা রোমের te জেহাদে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেখানে তাঁরা এক গির্জায় লিখিত দেখতে পান:
পৃষ্ঠা:৩৩
যে সম্প্রদায় হুসাইনকে শহীদ করেছে, তারা কি কিয়ামতের দিন তাঁর নানার শাফায়াত আশা করতে পারে?তারা প্রশ্ন করলেন: এটা কোন সময়ের লেখা? জওয়াব হল: তোমাদের নবীর নবুয়ত প্রাপ্তির ছয়শ’ বছর পূর্বের লেখা।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বংশগত পবিত্রতা
ইবনে সা’দ ও ইবনে আসাকির হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেছেন, আমার বংশতালিকায় হযরত আদম (আঃ) থেকে শুধুই বিবাহ রয়েছে কোন ব্যভিচার নেই।তিরমিযী হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রাসূলে করীম (সাঃ) বলেছেন, আমার বংশে মূর্খতা যুগের কোন বিয়ে নেই। আমার বংশে সকল বিবাহ ইসলামী পদ্ধতির অনুরূপ হয়েছে। ইবনে সা’দ ও ইবনে আসাকির হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, আমার বংশে সকলেরই বিবাহ হয়েছে এবং কোন অপকর্ম হয়নি। ইবনে সা’দ ও ইবনে আবী শায়বা মোহাম্মদ ইবনে আলী ইবনে হুসাইন (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেছেন, আমার বংশে হযরত আদম (আঃ) থেকে নিয়ে সকলেরই বিবাহ আছে। কোথাও মূর্খতা যুগের বিয়ে নেই। আমার বংশ সর্বত্র পাক পবিত্র। ইবনে সা’দ ও ইবনে আসাকির কলবী থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, নবী করীম (সাঃ)-এর জন্যে ‘কাযা ও কদরে’ (আমার ভাগ্য লিখনে) ছয়শ’ বছর এমন লিখা হয়েছে যে, এতে কোথাও ব্যভিচার নেই এবং কোথাও মূর্খতা যুগের অপকর্ম নেই। আদনী, তিবরানী, আবু নয়ীম ও ইবনে আসাকির হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রাঃ) থেকে সর্ণনা করেন যে, নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, হযরত আদম (আঃ) থেকে নিয়ে পিতামাতা কর্তৃক আমার জন্ম পর্যন্ত আমার বংশে সকল জন্ম বিবাহের মাধ্যমে হয়েছে। কোথাও মূর্খতা যুগের কোন অপকর্ম নেই। আবু নয়ীম হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেছেন,আমার বংশে আমার পিতামাতা কখনও মূর্খতাসুলভ পদ্ধতিতে মিলিত হয়নি। আল্লাহ তায়ালা আমাকে সর্বদা পবিত্র উরস থেকে পবিত্র গর্ভাশয়ে স্থানান্তর করতে থাকেন। যেখানেই পরিবারে দু’টি শাখার উদ্ভব হয়েছে, সেখানেই আল্লাহ তাআলা আমাকে সর্বোত্তম শাখায় রেখে দিয়েছেন। ইবনে সা’দ কলবী থেকে, তিনি আবু ছালেহ থেকে এবং তিনি হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, নবী করীম (সাঃ) এরশাদ করেছেন, আরববাসীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হচ্ছে মুযার। মুযারের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হচ্ছে আবদে মানাফ। আবদে মানাফের সন্তানদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হচ্ছে বন্ হাশেম এবং বনু হাশেমের মধ্যে সর্বোত্তম হচ্ছে আবদুল মুত্তালিবের সন্তান-সন্ততি। আল্লাহ তাআলা হযরত আদম (আঃ) থেকে যেখানেই বংশ বিভক্ত করেছেন, আমাকে তাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ শাখায় রেখেছেন। আল্লাহ তায়ালা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বলেছেন,وَتَقَلْبَكَ فِي السَّاجِدِينَ . (সেজদাকারীদের মধ্যে আপনার স্থান পরিবর্তন) বাযযার, তিবরানী ও আবু নয়ীম ইকরামা থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) আল্লাহ তায়ালার উপরোক্ত উক্তির তফসীর প্রসঙ্গে বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা নবী করীম (সাঃ)-কে পয়গাম্বরগণের ঔরসে স্থানান্তর করতে থাকেন। অবশেষে মা আমেনা তাঁকে প্রসব করেন। বুখারী হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, আমি হযরত আদমের (আঃ)-পরে সর্বশ্রেষ্ঠ পরিবারে আসতে থাকি। সবশেষে সেই পরিবারে প্রেরিত হয়ে গেছি, যাতে এখন আছি। মুসলিম ওয়াছেলা ইবনে আসকা থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রাসুলে করীম (সাঃ) এরশাদ করেছেন, আল্লাহ তায়ালা হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর সন্তানদের মধ্য থেকে হযরত ইসমাঈল (আঃ) কে মনোনীত করেন। অতঃপর ইসমাঈল (আঃ)-এর সন্তানদের মধ্য থেকে কেনানাকে, কেনানার মধ্য থেকে কোরায়শকে, কোরায়শের মধ্য থেকে বনী-হাশেমকে এবং বনী-হাশেমের মধ্য থেকে আমাকে মনোনীত করেছেন। তিরমিযী রেওয়ায়েত করেন, এছাড়া বায়হাকী ও আবু নয়ীম হযরত আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা যখন আমাকে সৃষ্টি করেন, তখন সৃষ্টির সেরা করে সৃষ্টি করেন। তিনি যখন গোত্র সৃষ্টি করেন, তখন আমাকে সর্বশ্রেষ্ঠ গোত্রে সৃষ্টি করেন। যখন মানবাত্মা সৃষ্টি করেন, তখন আমাকে সর্বোত্তম মানবাত্মারূপে সৃষ্টি করেন। এরপর যখন পরিবার সৃষ্টি করেন, তখন আমাকে সর্বোৎকৃষ্ট পরিবারে পয়দা করেন। সুতরাং te আমি সর্বশ্রেষ্ঠ, পরিবারের দিক দিয়েও এবং মানবাত্মার দিক দিয়েও।
পৃষ্ঠা:৩৪
বায়হাকী, তিবরানী ও আবু নয়ীম হযরত ইবনে ওমর (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা যখন মখলুক সৃষ্টি করেন, তখন সমগ্র মখলুকের মধ্যে বনী-আদমকে মনোনীত করেন। বনী-আদমের মধ্যে আরবকে পছন্দ করেন। আরবের মধ্যে মুযারকে, মুযারের মধ্যে কোরায়শকে, কোরায়শের মধ্যে বনী হাশেমকে এবং বনী হাশেমের মধ্যে আমাকে বেছে নেন। এ জন্যেই আমি সর্বোত্তমের মধ্যে সর্বোত্তম। বায়হাকী, তিবরানী ও আবূনয়ীম হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা সমগ্র সৃষ্টিকে দু’ভাগে বিভক্ত করেছেন। আমাকে এতদুভয়ের সর্বোত্তম ভাগে রেখেছেন। এরপর উভয় ভাগকে তিন প্রকারে বিভক্ত করে আমাকে সর্বোত্তম এক প্রকারে রেখেছেন। এরপর প্রত্যেক প্রকারকে গোত্রে বিভক্ত করে আমাকে সর্বশ্রেষ্ঠ গোত্রে রেখেছেন। এরপর গোত্রকে পরিবারে বিভক্ত করে আমাকে সর্বোত্তম পরিবারে রেখেছেন। এ কারণেই আল্লাহ বলেন,إِنَّمَا يُرِيدُ اللهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ البَيْتِ وَيُظهركم تطهيرا হে নবী-পরিবার! আল্লাহ তো চান তোমাদের থেকে নাপাকী দূর করতে এবং তোমাদেরকে উত্তম রূপে পবিত্র করতে। বায়হাকী ও ইবনে আসাকির মালেক থেকে, তিনি যুহরী থেকে এবং তিনি হযরত আনাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রাসূলে করীম (সাঃ) এরশাদ করেছেন, যখনই মানুষের দু’টি দল হয়েছে, আল্লাহ আমাকে সর্বোত্তম দলে রেখেছেন। আমি পিতামাতা থেকে জন্মলাভ করেছি। আমার বংশে মূর্খতা যুগের কোন অনাচার ছিল না। আদম (আঃ) থেকে নিয়ে আমার পিতামাতা পর্যন্ত আমার বংশে সকলেই বিবাহের মাধ্যমে জন্মগ্রহণ করেছে। কোথাও ব্যতিচার নেই। আমি তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম এবং আমার পিতাও ছিলেন সর্বোত্তম।বায়হাকী মোহাম্মদ ইবনে আলী থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে আরবকে পছন্দ করেন, আরবে কেনানাকে, কেনান্যর মধ্যে কোরায়শকে, কোরায়শের মধ্যে বনী-হাশেমকে এবং বনী হাশেমের মধ্যে আমাকে পছন্দ করেছেন।বায়হাকী, তিবরানী ও ইবনে আসাকির হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন জিবরাঈল (আঃ) আমাকে বলেছেন, আমিপূর্ব পশ্চিম প্রদক্ষিণ করেছি; কিন্তু মোহাম্মদ (সাঃ)-এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ কাউকে পাইনি এবং বনী-হাশেমের চেয়ে উত্তমও পাইনি।ইবনে আসাকির হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেছেন, হযরত আদম (আঃ) থেকে নিয়ে এখন পর্যন্ত আমার বংশে কোথাও অপকর্ম নেই। সমস্ত জাতি প্রজন্ম পরস্পরায় আমার সম্পর্কে বিতর্ক করেছে। অবশেষে আমি দু’টি সর্বশ্রেষ্ঠ গোত্রে বনী হাশেম ও বনী যাহরায় পয়দা হয়ে গেছি। ইবনে মরদুওয়াইহি হযরত আনাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রাসূলে করীম (সাঃ) নিম্নোক্ত আয়াত তেলাওয়াত করলেন لَقَدْ جاء كُمْ رَسُولٌ مِناَنكُم )নিশ্চয় তোমাদের কাছে তোমাদের নিজেদের মধ্য থেকে একজন রাসূল আগমন করেছেন। )1( তিনি انْفُسِكُمْ -এর ফা অক্ষরে পেশের পরিবর্তে যবর যোগে তেলাওয়াত করলেন। যার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, তোমাদের মধ্যে তোমাদের উৎকৃষ্টতম ব্যক্তি রাসূল হয়ে এসেছেন। অতঃপর তিনি বললেন, আমি বংশমর্যাদায় উৎকৃষ্টতম। আদম (আঃ) থেকে নিয়ে এখন পর্যন্ত আমার বাপদাদাদের মধ্যে কোন অপকর্ম নেই; বরং সকলেই বিশুদ্ধ বিবাহের মাধ্যমে জন্মগ্রহণ করেছে। ইবনে আবী ওমর আদনী হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আদম সৃষ্টির দু’হাজার বছর পূর্বে কোরায়শ আল্লাহ তায়ালার সামনে একটি নূরের আকারে ছিল। এই নূর যখন তসবীহ পাঠ করত, তখন ফেরেশতারাও সঙ্গে তসবীহ পাঠ করত। আল্লাহ তায়ালা আদমকে সৃষ্টি করে এই নূর তাঁর ঔরসে রেখে দিলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, এরপর আল্লাহ আমাকে আদমের ঔরসে পৃথিবীতে নামালেন। এরপর নূহ (আঃ)-এর ঔরসে স্থানান্তর করলেন। এমনিভাবে আল্লাহ পাক আমাকে সম্মানিত বান্দাদের ঔরসে এবং পবিত্রাত্মা নারীদের গর্ভে স্থানান্তর করতে থাকেন। অবশেষে আমার পিতামাতা আমাকে জন্ম দিলেন। আমার পিতৃপুরুষদের মধ্যে কেউ কখনও ব্যভিচারের ভিত্তিতে সঙ্গম করেনি। এ হাদীসের অর্থে আরও একটি হাদীস আছে, যা তিবরানী ও হাকেম ঘুরায়ম ইবনে আউস থেকে রেওয়ায়েত করেছেন। ঘুরায়ম বর্ণনা করেন, যখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাবুক থেকে প্রত্যাবর্তন করছিলেন, তখন আমি তাঁর কাছে গেলাম। এ সময় হযরত আব্বাস (রাঃ) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি আপনার প্রশংসা করতে চাই। তিনি বললেন, বল, আল্লাহ তোমার মুখ সালামত রাখুন। সেমতে হযরত আব্বাস(রাঃ) বললেনঃ
পৃষ্ঠা:৩৫
এর আগে আপনি ছায়ায় দিনাতিপাত করতেন এবং এমন স্থানে (জান্নাতে) থাকতেন, যেখানে পাতা মিলিত করা হয়। (হযরত আদম (আঃ)-এর ঘটনায় প্রতি ইঙ্গিত।) অতঃপর আপনি দুনিয়াতে (আদমের ঔরসে) এলেন। তখন আপনি না মনুষ্য ছিলেন, না মাংসপিণ্ড, না জমাট রক্ত। আপনি সেই বীর্ষ, যা নৌকায় সওয়ার হয়েছে এবং নসর (প্রতিমা) ও নসর পূজারীদেরকে পানি গ্রাস করেছে। (হযরত নূহ (আঃ)-এর ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত।) আপনি এমনিভাবে ঔরস থেকে গর্ভাশয়ে স্থানান্তরিত হতে থাকেন এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী অতিবাহিত হয়েছে। যখন ইবরাহীম (আঃ) অগ্নিতে ঝাঁপ দেন, তখন আপনি তাঁর ঔরসে ছিলেন। এমতাবস্থায় অগ্নির কি সাধ্য ছিল যে, ইবরাহীম (আঃ) কে স্পর্শ করে? অবশেষে আপনার শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ আপনার মাহাত্ম্য খন্দকের উচ্চস্থালকে ঘিরে নিল, যার নীচে অন্যান্য পাহাড়ের মধ্যবর্তী অংশ আছে। আপনি যখন ভূমিষ্ঠ হলেন, তখন পৃথিবী আলোকময় হয়ে গেল এবং আপনার নূরে দিগন্ত উদ্ভাসিত হয়ে গেল। এখন আমরা এই নূর ও আলোর মধ্যে আছি। আমাদের সম্মুখে হেদায়াতের পথ উন্মুক্ত। বায়হাকী ও ইবনে আসাকির হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেছেন, যখন আল্লাহ তায়ালা হযরত আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করলেন, তখন তাঁকে তাঁর সন্তান-সন্ততি দেখালেন। হযরত আদম (আঃ) তাদের পারস্পরিক শ্রেষ্ঠত্ব নিরীক্ষা করতে থাকেন। অবশেষে তিনি একটি চমকদার নূর দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করলেনঃ পরওয়ার দেগার! এ কে? আল্লাহ তায়ালা বললেন, এ তোমার সন্তান আহমদ। সেই প্রথম এবং সেই শেষ। সেই সর্বপ্রথম শাফায়াত করবে। আবু নয়ীম এই হাদীস প্রসঙ্গে বলেন, এই শ্রেষ্ঠত্ব রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নবুয়তের দলীল। কেননা, নবুয়ত একাধারে রাজতন্ত্র ও শাসনতন্ত্র হয়ে থাকে। যদি রাজা সম্ভ্রান্ত ও মানুষের মধ্যে সাধক বিশিষ্ট হয়, তবে মানুষ তার সামনে বুঝুঁকে পড়ে এবং নির্দ্বিধায় আনুগত্য করে। এ কারণেই হিরাক্লিয়াস আবু সুফিয়ানকে প্রশ্ন করেছেন, তোমাদের মধ্যে তার বংশমর্যাদা কিরূপ? আবু সুফিয়ান বলল, তিনি উচ্চ বংশমর্যাদা সম্পন্ন। হিরাক্লিয়াস বলল: পয়গাম্বরগণ আপন সম্প্রদায়ের মধ্যে বংশ মর্যাদায় বিশিষ্টই হয়ে থাকেন।
হযরত আবদুল মুত্তালিবের স্বপ্ন
আবু নয়ীম আবু বকর ইবনে আবদুল্লাহ থেকে, তিনি স্বীয় পিতা থেকে এবং তিনি তাঁর পিতা থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আবু তালেব বলেছেন, আবদুল মুত্তালিব বর্ণনা করেছেন, এক রাতে বায়তুল্লায় নিদ্রিত অবস্থায় আমি একটি অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম। অতঃপর কোরায়শ বংশের এক অতীন্দ্রিয়বাদিনীর কাছে যেয়ে স্বপ্ন বর্ণনা করলাম। স্বপ্নটি ছিল এইঃ একটি বৃক্ষ উদ্গত হল। দেখতে দেখতে এর শাখা প্রশাখা আকাশচুম্বী হয়ে গেল এবং পূর্ব ও পশ্চিমে ছড়িয়ে পড়ল। অতঃপর এই বৃক্ষ থেকে একটি নূর নির্গত হল, যার আলো সূর্য অপেক্ষা সত্তর গুণ বেশি ছিল। সকল আরব অনারণ এর সামনে সেজদাবনত ছিল। নূরটি বড়ও হচ্ছিল এবং ছড়িয়েও যাচ্ছিল। এরপর নূরটি কখনও প্রকাশ পেত এবং কখনও গোপন হয়ে যেত। একদল কোরায়শ এই বৃক্ষ শাখার নিকটবর্তী হলে একজন সুদর্শন যুবক তাদের কোমর ভেঙ্গে দিত। আমিও বৃক্ষের শাখা ধরার চেষ্টা করলাম; কিন্তু ধরতে পারসাম না। আমি জিজ্ঞাসা করলামঃ এটা কার অংশ? উত্তর হল: এটা তাদের অংশ, যারা তোমার পূর্বে একে ধারণ করেছে। এই স্বপ্নের কারণে আমি ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে জেগে গেলাম। এই স্বপ্ন শুনে অতীন্দ্রিয়বাদিনীর মুখমণ্ডল বিবর্ণ হয়ে গেল। সে বলল: যদি তোমার এই স্বপ্ন সত্য হয়, তবে তোমার ঔরস থেকে এক ব্যক্তি জনন্মগ্রহণ করবে, যে পূর্ব ও পশ্চিমের অবিপতি হবে এবং সমস্ত মানুষ তার সামনে নত হয়ে যাবে। আবদুল মুত্তালিব আবু তালেবকে বললেন, সম্ভবত: তুমিই সেই শিশু। নবী করীম (সাঃ) প্রেরিত হয়ে গেলে আবু তালেব এই ঘটনা শুনাতেন এবং বলতেন: আল্লাহর কসম, সেই বৃক্ষ হচ্ছে আবুল কাসেম আমীন। তাকে বলা হত তা হলে আপনি তার প্রতি ঈমান আনেন না কেন? তিনি জওয়াব দিতেন। ভালমন্দের ভয় করি এবং লজ্জা লাগে।
মাতৃগর্ভে অবস্থানকালে যে সকল মোজেযা প্রকাশ পায়
হাকেম, বায়হাকী, তিবরানী ও আবু নয়ীম আবু আওয়ান থেকে, তিনি মেসওয়ার ইবনে মাখরামা থেকে, তিনি ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে এবং তিনি হযরত আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আবদুল মুত্তালিব বর্ণনা করেছেন, আমরা শীতকালীন সফরে এয়ামনে পৌঁছলাম। সেখানে আমি এক ইহুদী আলেমের কাছে গেলে এক কিতাবধারী আমাকে প্রশ্ন করলঃ তুমি কে? আমি বললামঃ আমি একজন কোরায়শী। সে জিজ্ঞাসা করল: কোরায়শের কোন। পরিবার থেকে? আমি বললামঃ আমি বন্-হাশেমের।
পৃষ্ঠা:৩৬
অতঃপর সে বলল: আমাকে অনুমতি দাও, আমি তোমার দেহ দেখব। আমি বললাম: হ্যাঁ, তবে গুপ্তস্থান ছাড়া। সেমতে সে আমার নাকের ছিদ্র দেখে বললঃ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তোমার এক হাতে রাজত্ব এবং অন্য হাতে নবুয়ত রয়েছে। আমার ধারণা ছিল যে, এই নবুয়ত ও রাজত্ব বন্নু-যুহরার মধ্যে হবে। এখন এটা কিরূপে হল? আমি বললামঃ আমি জানি না।কিতাবধারী বললঃ স্ত্রী আছে? আমি বললাম: এখন পর্যন্ত নেই। সে বলল: দেশে ফিরে বন্-যুহরায় বিয়ে করে নাও। এরপর আবদুল মুত্তালিব মক্কা প্রত্যাবর্তন করলেন এবং হালা বিনতে ওয়াহাব ইবনে আবদে মানাফকে বিয়ে করলেন। তাঁর গর্ভ থেকে হামযা ও ছফিয়্যা জন্মগ্রহণ করলেন। আবদুল মুত্তালিব আপন পুত্র আবদুল্লাহকে আমেনা বিনতে ওয়াহাবের সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ করে দিলেন। তাঁর গর্ত থেকে রাসূলে করীম (সাঃ) জন্মগ্রহণ করলেন। এতে কোরায়শরা বলতে লাগল: আবদুল্লাহ নিজের পিতার উপর বাজী নিয়ে গেল। এই হাদীসটি আবু নয়ীম হুমায়দ ইবনে আবদুর রহমান থেকে রেওয়ায়েত করেছেন এবং ইবনে সা’দ তাবাকাতে জাফর ইবনে আবদুর রহমান থেকে বর্ণনা করেছেন। তাতে আছে আবদুল মুত্তালিব বললেন: কিতাবধারী আমার নাকের চুল দেখে বলল। আমি নবুয়ত ও রাজত্ব দেখতে পাচ্ছি। তন্মধ্যে একটি বনু-যুহরায় হবে। এই রেওয়ায়েতের শেষভাগে আছে, আল্লাহ তায়ালা আবদুল মুত্তালিবের সন্তানদের মধ্যে নবুয়ত ও রাজত্ব উভয়ই অবধারিত করে দিয়েছেন।আবু নয়ীম সা’দ ইবনে আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পিতা আবদুল্লাহ নিজের কোন গৃহ নির্মাণ করছিলেন। ফলে তাঁর সর্বাঙ্গ ধূলি ধূসরিত ছিল। এই অবস্থায়ই তিনি এক মহিলা ইয়ালা আদভিয়ার কাছ দিয়ে গমন করলেন। ইয়ালা তাঁর চক্ষুদ্বয় দেখে কাম প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার জন্যে নিজের দিকে ডাকল। সে তাঁকে বললোঃ যদি তুমি আনার সাথে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন কর, তবে আমি তোমাকে একশ’ উট দিব। আবদুল্লাহ বললেনঃ গোসল করে শরীরের মাটি পরিস্কার করে আসি। একথা বলে তিনি স্ত্রী আমেনার কাছে চলে এলেন এবং সহবাস করলেন। এতে গর্ভ স্থির হল। এরপর আবদুল্লাহ আদভিয়ার কাছে যেয়ে বললঃ তুমি যে দাওয়াত দিয়েছিলে, সে সম্পর্কে কি মনে কর? ইয়াল। বললেনঃ না, এখন না। আবদুল্লাহ বললেন: কেন? সে বলল: যখন তুমি ইতিপূর্বে এসেছিলে, তখন তোমার কপালে নূর ছিল। আমেনা সেটি তোমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে।এক রেওয়ায়েতে এরূপ আছে- তুমি যে নূর নিয়ে গিয়েছিলে, তা ফিরিয়ে নিয়ে আসনি। তুমি আমেনার কাছে যেয়ে থাকলে নিশ্চয়ই তার গর্ভ থেকে এক বাদশাহ জন্মগ্রহণ করবে।আবূনয়ীম, খারায়েতী ও ইবনে আসাকির ‘মাতা’ থেকে, তিনি হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আবদুল মুত্তালিব পুত্র আবদুল্লাহর বিবাহের জন্যে বের হয়ে বাতহার জনৈকা ইহুদী অতিন্দ্রীয়বাদিনীর কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন, উদ্দেশ্য মহিলার নিকট থেকে কিছু পরামর্শ গ্রহণ। এই মহিলা অতীত কিতাবসমূহের সুপণ্ডিত ছিল। তার নাম ছিল ফাতেমা। সে আবদুল্লাহর মুখমণ্ডলে নবুওয়তের নূর দেখে বললঃ হে যুবক। তুমি আমার সাথে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন কর। আমি তোমাকে একশ’ উট দিব। আবদুল্লাহ বললেনঃ: হারাম কাজ করার চেয়ে মরে যাওয়া উত্তম। সম্মান ও ধর্ম উভয়ই রক্ষা করে তোমার আবদার রক্ষা কিরূপে সম্ভব। আবদুল্লাহ পিতার কাছে ফিরে এলেন এবং আমেনা বিনতে ওয়াহাবকে বিবাহ করলেন। তিন দিন তাঁর কাছে থাকার পর ফাতেমার কথা মনে পড়ল। সেখানে পৌঁছলে সে জিজ্ঞাসা করল কি হল? আবদুল্লাহ বললেন: আমার পিতা আমেনা বিনতে ওয়াহাবের সাথে আমার বিয়ে দিয়েছেন। আমি তিনদিন তার কাছে অবস্থান করেছি। এ কথা শুনে ফাতেমা বলল: আল্লাহর কসম, আমি কোন কুলটা নারী নই। আমি তোমার মুখমণ্ডলে যে নূর দেখেছিলাম, সেটি নিজের মধ্যে স্থানান্তরিত করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আল্লাহর অভিপ্রায় অন্যকিছুই ছিল। ফাতেমা আরও বললঃ “আমি একটি অত্যুজ্জ্বল মেঘ দেখেছি, যা থেকে বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা পড়ল। তমসার মধ্যে একটি নূর চমকে উঠল। সে চতুর্দশীর চাঁদের মত সমগ্র পরিবেশকে উজ্জ্বল করে দিল। আমি সেই নূরের আকাঙ্ক্ষা করলাম, যাতে এ নিয়ে গর্ব করতে পারি। কিন্তু প্রতিটি আকাঙ্ক্ষাই পূর্ণ হয় না। আল্লাহর কসম, বনী যোহরা গোত্রের সেই মেয়েটি তোমার কাছ থেকে যা ছিনিয়ে নিয়েছে, তুমি তার খবরও রাখ না।” সে আরও বললঃ হে বনী-হাশেম! আমেনা তোমাদের ভ্রাতার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। এখন তার বিবেক ও অন্তরে দ্বন্দু চলছে, যেমন প্রদীপ নির্বাপিত হওয়ার পর আপন তেলে নিমজ্জিত ছোট ছোট বাতি সৃষ্টি করে। মানুষ যে ধনৈশ্বর্য অর্জন করে, তা তার নিজেরই ইচ্ছার ফলশ্রুতি নয়, আর যা হারিয়ে ফেলে, তাও তার অবহেলার কারণে হারায় না। তুমি কোন বিষয় দাবী করলে সুন্দরভাবে করবে। কেননা, তোমার বাপদাদা al তোমার জন্যে যথেষ্ট হবে হয় বন্ধ হাত, না হয় উন্মুক্ত হাত।
পৃষ্ঠা:৩৭
আমেনা যখন আবদুল্লাহর কাছ থেকে অভিলাষ পূরণ করে নিল, তখন আমার দৃষ্টি তার দিক থেকে সরে গেল এবং আমার মুখ বন্ধ হয়ে গেল।এই হাদীসটি ইবনে সা’দ হেশাম ইবনে কলবী থেকে এবং তিনি ফাইয়ায ইবনে খাছআমী থেকেও রেওয়ায়েত করেন। সাথে এ কথাগুলোও আছে-আবদুল্লাহ ফাতেমার কাছে ফিরে এসে বললেন: সেই প্রস্তাবটি সম্পর্কে এখন তোমার কি ধারণা? ফাতেমা বলল: এক সময় আকর্ষণ ছিল; কিন্তু আজ আর নেই। তার এই জবাব আরবে প্রবাদ বাক্য হয়ে গেছে।’ ইবনে সা’দ ওয়াহাব ইবনে জরীর ইবনে হাযেম থেকে, তিনি স্বীয় পিতা থেকে এবং আবূ এয়াযীদ মদনী থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আমি জানতে পেরেছি, আবদুল্লাহ এক খাছআমী নারীর কাছ দিয়ে গমন করলে সে তাঁর কপাল থেকে আকাশ পর্যন্ত একটি নূর দেখতে পায়। এটা দেখে সে আবদুল্লাহকে বললঃ তুমি আমার সান্নিধ্যে আসবে? আবদুল্লাহ বললেন: হাঁ, কংকরগুলি ফেলে আসি। কংকর স্থানান্তর করার পর তিনি আমেনার সান্নিধ্যে চলে গেলেন। এরপর খাছআমী মহিলার কথা মনে পড়লে তার কাছে পৌছলেন। মহিলা বলল: অন্য কোন নারীর কাছে গিয়েছিলে? আবদুল্লাহ বললেন: হাঁ, আমার পত্নী আমেনার কাছে। সে বলল : তা হলে তোমার আর কোন প্রয়োজন নেই। তুমি যখন যাচ্ছিলে, তখন তোমার কপাল থেকে একটি নূর আকাশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এখন সেটা নেই। আমেনাকে এমর্মে জ্ঞাত করো যে সে ভূ-পৃষ্ঠের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকে গর্ভে ধারণ করেছে। ইবনে আসাকিরও এ হাদীসটি রেওয়ায়েত করেছেন।বায়হাকী, আবু নয়ীম ও ইবনে আসাকির ইকরামা থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেছেন- এক খাছআমী সুন্দরী মহিলা হজ্বের মওসুমে এখানে আসত। তার কাছে বিভিন্ন ধরনের আচার থাকত। সম্ভবতঃ সে এটা বিক্রয় করত। একবার সে আবদুল্লাহর কাছে এল। তাকে দেখে আবদুল্লাহর পছন্দ হল। মহিলা নিজেকে তার কাছে পেশ করলে আবদুল্লাহ বলল ও আমি আসছি। অতঃপর তিনি চলে গেলেন এবং স্ত্রী আমেনার সাথে সহবাস করলেন। ফলশ্রুতিতে নবী করীম (সাঃ)-এর গর্ভ হয়ে গেল। অতঃপর আবদুল্লাহ্ সেই মহিলার কাছে ফিরে এলে সে বলল: তুমি কে? আবদুল্লাহ বললেন : আমি সেই ব্যক্তি, যে তোমার কাছে আসার ওয়াদা করেছিল। মহিলা বলল: তুমি সেই ব্যক্তি নও। সেই ব্যক্তি হলে তোমার কপালের নূর অদৃশ্য হয়ে গেছে। এখন দৃষ্টি গোচর হচ্ছে না। বায়হাকী ও আবু নয়ীম ইবনে শিহাব থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আবদুল্লাহ অত্যন্ত সুশ্রী পুরুষ ছিলেন। একবার কয়েকজন কোরায়শী রমনীর কাছ দিয়ে গমন করলে তাদের একজন বললঃ তোমাদের মধ্যে কে এ যুবককে বিয়ে করে তার কপালের নূর আগলে নিবে? অতঃপর আমেনা তাকে বিয়ে করল এবং রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর গর্ভ সঞ্চার হল। ইবনে সা’দ ও ইবনে আসাকির ওরওয়া থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, ওয়ারাকা ইবনে নওফেলের ভগিনী কাতীলা জ্যোতির্বিদ ছিল। আবদুল্লাহ তার কাছ দিয়ে গেলে সে তাঁকে নিজের দিকে আহবান করল এবং আঁচল ধরে ফেলল। আবদুল্লাহ আবার আসব বলে সেখান থেকে চলে গেলেন। অতঃপর আমেনার কাছে যেয়ে সহবাস করলেন। ফলে নবী করীম (সাঃ) গর্ভে এলেন। অতঃপর পুনরায় কাতীলার কাছে যেয়ে তাকে অপেক্ষমাণ পেল। সে বলল: তুমি যা বলেছিলে, সে সম্পর্কে তোমার মত কি? কাতীলা বললঃ না। তুমি যখন গমন করছিলে, তখন তোমার কপালে একটি ঝলমলে নূর ছিল। এখন সেই নূর নেই। ইবনে সা’দ ও ইবনে আসাকির কলবী থেকে, তিনি আবু ছালেহ থেকে এবং তিনি হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়াতে করেন যে, যে মহিলা আবদুল্লাহর কাছে নিজেকে পেশ করেছিল, সে ছিল ওয়ারাকা ইবনে নওফেলের ভগিনী। ইবনে সা’দ ওয়াকেদী থেকে, তিনি আলী ইবনে এয়াযীদ থেকে, তিনি তাঁর পিতা থেকে এবং তিনি আপন ফুফু থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আমরা শুনতাম আমেনা গর্ভবতী অবস্থায় বলতেন-আমি গর্ভবর্তী, এ অনভূতি পর্যন্ত আমার হয় না। সাধারণতঃ মহিলারা মনের উপর যে বোঝা অনুভব করে, আমি তেমন করি না। কেবল হায়েয বন্ধ হয়ে যাওয়াই অনুভব করেছি, যা সাধারণতঃ বন্ধও হয় এবং আসেও। হায়েয বন্ধ হওয়ার পর একদিন যখন আমি জাগরণ ও নিদ্রার মধ্যবর্তী অবস্থায় ছিলাম, তখন আমার কাছে এক আগন্তুক এসে বলল: তুমি জান তোমার গর্ভে কে আছে? আমি বললাম: আমি জানি না। সে বলল: এই উন্মতের সরদার ও নবী তোমার গর্ভে রয়েছে। এটা ছিল সোমবার। এরপর প্রসবের সময় নিকটবর্তী হলে আগন্তুক আবার এল এবং বললঃ বল আমি প্রত্যেক হিংসাপরায়ণের অনিষ্ট থেকে তাকে এক আল্লাহর আশ্রয়ে দিচ্ছি। আমি কথাগুলো বলে গেলাম। পরে মহিলাদের কাছে এ ঘটনা ব্যক্ত করলে তারা বলল: ঘাড়ে ও বাহুতে লোহা পরিধান কর। আমি তাই করলাম। কিছুদিন পরেই লোহা ভেঙ্গে আলাদা হয়ে গেল। এরপর আমি আর লোহা পরিনি। নাবূ নয়ীম বুরায়দা ও ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন, যে, আমেনা স্বপ্নে দেখলেন যে, তাঁকে বলা হলঃ তুমি সমগ্র সৃষ্টির সেরা ও সারা বিশ্বের সরদারকে গর্ভে ধারণ করেছ। সে ভূমিষ্ঠ হয়ে গেলে তার নাম রাখরে আহমদ ও মোহাম্মদ এবং তার উপর এটি ঝুলিয়ে দিবে। আমেনা জাগ্রত হয়ে দেখলেন যে, সোনালী অক্ষরে লেখা একটি পৃষ্ঠা তাঁর কাছে রাখা আছে। তাতে