Skip to content

হুমায়ূন আহমেদে এর ওল্ড ফুলস ক্লাব - শহিদ হোসেন খোকন

পৃষ্ঠা ০১ থেকে ১০

পৃষ্ঠা:০১

শিল্প-সাহিত্যের সঙ্গে জড়িত মানুষের জন্যে আড্ডা একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। ইউরোপ-আমেরিকার কথা থাক, পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের আড্ডা নিয়ে প্রচুর গল্প আছে। হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন ভীষণ আড্ডাবাজ মানুষ। রাত ৮টা থেকে ১১টা পর্যন্ত তাঁর দখিন হাওয়ার ফ্ল্যাটে নিয়মিত আড্ডা হত। হুমায়ূন আহমেদ সে আড্ডার একটা নামও দিয়েছিলেন ‘ওল্ড ফুলস ক্লাব’। আমি ছোটগল্প লিখি। ভাবলাম, স্যারের সঙ্গে অবি নিয়ে কিছু লিখি। স্যারকে একদিন এ খারাপ না, শুরু কর। আমার শুরু এবং, আগাতেই শেষ কোনোটাই মজার সব অভিজ্ঞতা বললেন-আইডিয়া স্যার দেখে যেতে পারেন নি। ওন্ড ফুলস ক্লাবের আড্ডা, কিন্তু স্যার নিজেই লিখেছেন…. চলন্তিকা ডিকশনারিতে জন্ম অর্থ দেয়া হয়েছে- ‘কুলোকের মিলনস্থান’। আমার ‘দখিন হাও কিসের বাসায় প্রায়ই আড্ডা বসে। অর্থাৎ কিছু কুলোক একত্রিত হন। আওতায় প্রধান ব্যক্তিকে বলে। আড্ডাধারী। আমি সেই জন। বাকিদের পরিচয় দিচ্ছি। শাওন। (তার বাড়িতেই আড্ডা বসছে, সে যাবে কোথায়?) আলমগীর রহমান। (অবসর এবং প্রতীক প্রকাশনীর মালিক। আমার নিচতলায় থাকেন।) আর্কিটেক্ট করিম। (তিনি আগে ‘দখিন হাওয়া’তেই থাকতেন, এখন বিতাড়িত।)

পৃষ্ঠা:০২

মাজহারুল ইসলাম। (অন্যদিন পত্রিকার সম্পাদক-প্রকাশক, অন্যপ্রকাশ এবং অন্যমেলার স্বত্বাধিকারী। আমার পাশের ফ্ল্যাটেই থাকেন।) কমল বাবু। (নাম কমল বাবু হলেও ইনি মুসলমান। মাজহারুল ইসলামের পার্টনার। শখের অভিনেতা। যে ক’টি নাটকে উপস্থিত তার প্রতিটি ডায়লগ মুখস্থ। কবিতা আবৃত্তির মতো তিনি ডায়লগ বলে আনন্দ পান।) এঁরা আড্ডার স্থায়ী পাখি। সব সময় থাকেন। বেশ কিছু অতিথি পাখিও আছেন। এঁরা হঠাৎ হঠাৎ আসেন। যেমন চ্যালেঞ্জার, মাসুদ আখন্দ। কিছু আছেন নিমন্ত্রিত পাখি। নিমন্ত্রণ করলে এঁরা আসেন। অনিমন্ত্রিতভাবে কখনোই উপস্থিত হন না। যেমন, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, শফি আহমেদ, আর্কিটেক্ট রবিউল হুসাইন, জুয়েল আইচ, সালেহ চৌধুরী… প্রয়োজনের পাখিও আছে। তাঁদের উপস্থিতি দেখলেই বুঝা যায় কোনোকিছুর প্রয়োজন হয়েছে। যেমন, অভিয় আমাদের এই আড্ডার একটা নামও। আসাদুজ্জামান নূর। ওল্ড ফুলস ক্লাব ‘বৃদ্ধ বোকা সংঘ’। আমি সিঙ্গাপুরি-খোকন এবছু উইংয়ের সদস্য। আমাকে যেতে হত। সারা দিন স্যারের ওন্ড ফুলস ক্লারে নি-নাসির ওল্ড ফুলস ক্লাবের প্রবাসী কাজে বছরে চার-পাঁচ বার বাংলাদেশে সেরে সন্ধ্যা হলেই ছুটে যেতাম হুমায়ূন আড্ডায় রাত ৮টা থেকে ১১টা পর্যন্ত চুটিয়ে আড্ডা দিয়ে ফুরফুরে মন নিয়ে বাসায় ফিরতাম। আড্ডাশেষে কাউকেই তিনি ডিনার না করিয়ে ছাড়তেন না। অন্যদিনের সম্পাদক মাজহারুল ইসলামের নেটওয়ার্ক বিশ্বব্যাপী। তার মোবাইলে রাজ্যের মানুষের নাম এবং প্রায় সবার নামই একাধিক। যেমন- খোকন আছে ৪টা: খোকন-নিউইয়র্ক, খোকন-রাশিয়া, খোকন-ড্রাইভার এবং খোকন-সিঙ্গাপুর, ভবিষ্যতে আরো খোকন নিশ্চয়ই যোগ হবে। মোবাইলে কথা বলার বিশ্বরেকর্ড করার যদি কোনো ইভেন্ট থাকে মাজহারুল ইসলাম সে ইভেন্টে চ্যাম্পিয়ন হবে এবং গিনেস বুকে তার নাম উঠে যাবে এটা আমি বাজি ধরে বলতে পারি। তাকে এক চান্সে ফোনে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার… আমি যখনই তাকে ফোন করেছি ওপাশ থেকে

পৃষ্ঠা:০৩

নারীকণ্ঠে বলছে ‘কাঙ্ক্ষিত নাম্বারটি বর্তমানে ব্যস্ত আছে কিছুক্ষণ পর আবার ডায়াল করুন।’ আমার কথা বিশ্বাস না হলে পাঠক ট্রাই করে দেখতে পারেন। আসলে ক্লাব-ট্রাব কিছু না, সবাই জড়ো হত আডড্ডার লোভে। হুমায়ূন আহমেদ কেবলমাত্র একজন ব্যক্তি ছিলেন না, তিনি ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। নানা রকমের কর্মযজ্ঞ নিয়ে তিনি মেতে থাকতেন, সেই যজ্ঞে নানা কুশীলব- গ্রহ-উপগ্রহের প্রয়োজন। কুশীলবদের কাছে তিনি হলেন সূর্যের মতো…গ্রহ- উপগ্রহগুলো তাঁকে ঘিরে আবর্তিত হত। তাঁর মতো আড্ডাধারী লোক ছিল বিরল। আড্ডায় মজার সব অভিজ্ঞতার ঝুলি খুলে বসতেন… একের পর এক গল্প বলে যেতেন। তাঁর দেখা হাজারো পাত্র-পাত্রীর সমাবেশ থাকত সে গল্পে। আমরা সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতাম। তাঁর সেন্স অব হিউমারের কোনো গুনবনা হয় না। যে কোনো পরিবেশ-পরিস্থিতিতে মানুষের সুখ-দুঃখ নিয়ে এক বিরল ক্ষমতাধর মানুষ ছিলেন তিনি। রসিকতা করার একটি উদাহরণ দিচ্ছি-আজ.মটিক্যাল ১০ বছর আগে তাঁর হার্টের বাইপাস অপারেশন হবে সিঙ্গা মাউন্ট এলিজাবেথ হসপিটালে, অপারেশন থিয়েটারে যাবার ডাক্তার ফিলিপ কো তাঁকে জিজ্ঞেস করছেন-মি. হুমায়ূন ইউ নার্ভাস… ঘেমেটেমে যাচ্ছ, বিষয় কী! প্রিয় কারো সঙ্গে কথা বলতে লিউ কিংবা কিছু খেতে ইচ্ছে করছে? হুমায়ূন আহমেদ স্নান হেসে বললেন-বাইপাস অপারেশনের সারভাইবেল রেট কেমন? ফিলিপ কো বলেন ৯৯%। স্যার বললেন-দুর্ভাগ্যক্রমে আমি যদি ওই ১%-এর দলে পড়ি তা হলে তো এই পৃথিবীতে ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা নাই, কি বল? বিদেশে ডাক্তাররা সব সময় হাসিহাসি মুখ করে থাকে, এমনকি রুগিকে তার আসন্ন মৃত্যুসংবাদটাও তারা মুখে আর্টিফিসিয়াল হাসি ফুটিয়ে গড়গড় করে বলে যায়। স্যারের কথায় ফিলিপ কো থতমত খেয়ে গেল। মিহি গলায় সে বলে-বেছে বেছে তুমিই যে ১%-এর দলে পড়বে তার কোনো গ্যারান্টি নেই।

পৃষ্ঠা:০৪

হুমায়ূন আহমেদ মিসির আলির মতো পাল্টা যুক্তি দিয়ে বলেন- আমি যে ১০০ পারসেন্ট সারভাইব করব তারও তো কোনো গ্যারান্টি দিতে পারছ না। একটু আগে তোমার নার্স এসে বন্ডপেপারে আমার সই নিয়ে গেছে যাতে লেখা আছে উপরওয়ালা আমাকে ডেকে নিলে তোমাদের কোনো দায়দায়িত্ব নেই! ফিলিপ কো ভাবল-অপারেশন থিয়েটার বুক করা হয়ে গেছে, অ্যাসোসিয়েট ডাক্তাররা সবাই ছুরিতে শান দিয়ে বসে আছে, এ মুহূর্তে পেশেন্ট গণ্ডগোল পাকালে বিপদ, পেশেন্ট আবার একা নয়, তার সঙ্গে আছে তার মা…দু-জনেরই বাইপাস অপারেশন। সুতরাং অনেক টাকার মামলা। এই মামলা হাতছাড়া হলে বিপদ। ডা. ফিলিপ কো মিহি গলায় বলে- হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ নাউ? ফিলিপ কো’কে ধরাশায়ী হতে দেখে এবার তিনি আসল কথাটা পাড়েন-ডা. কো দেখ, এই নশ্বর পৃথিবীতে ম্যাব্রিক্রয়াম ৭০-৮০ বছর ঘটং ঘটং করে আমরা অজানা এক জগতে চলে। জগৎ সম্পর্কে আমাদের ধারণা বড্ড সীমিত। সেখানে অনেক জানা যায়, সিগারেট পাওয়া যাবে দি ইচ্ছে হয়েছে একসঙ্গে দুটি সিগারেট তার পর তোমরা কাটাছেঁড়া শান্তি আর পুরষ্কারের কথা ইশানা যায় নি…এ মুহূর্তে আমার টনে আমি অপারেশন থিয়েটারে ঢুকি, ফিলিপ কো’র ঘাম বললেন-মি. হুমায়ূন লিমার জ্বর ছাড়ার মতো অবস্থা। হাসিমুখে তিনি কেমিস্ট্রির ওপর নর্থ ডাকোটা থেকে তুমি পিএইচ, ডি, করেছ, সিগারেট নিয়ে তোমাকে জ্ঞান দেয়াটা অশোভন… নো প্রবলেম টেক ইওর টাইম… স্মোক অ্যান্ড কাম টু দ্য অপারেশন থিয়েটার… দ্বিতীয় উদাহরণ: মাঝখানে একবার স্যার অসুস্থ হলেন। তাঁকে সিকদার হসপিটালে ভর্তি করানো হল। নো ভিজিটর অ্যালাউড, ওল্ড ফুলস ক্লাবের সব সদস্যরা বেশ চিন্তিত। হাসির মতো চিন্তারোগও ছোঁয়াচে। স্যারের প্রকাশক, ভক্ত এবং মিডিয়ার লোকজন আরো বেশি চিন্তিত হয়ে পড়ল। চ্যানেলের ক্যামেরাগুলো হাসপাতালের আশপাশে ঘোরাঘুরি করে, স্যারের পরিচিত কাউকে হাসপাতাল থেকে বেরুতে দেখলেই ক্যামেরা তাকে জেঁকে ধরছে… স্যারকে কেমন দেখলেন, খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করছে কি না, পেসাব-পায়খানা ক্লিয়ার কি না ইত্যাদি।

পৃষ্ঠা:০৫

অবসর প্রকাশনা সংস্থার আলমগীর রহমান হাসপাতাল থেকে বেরুচ্ছেন স্যার কাঁচা আমের শরবত খেতে চেয়েছিলেন। তখনো আমের সিজন শুরু হয় নি, আলমগীর রহমান নিউমার্কেট থেকে গুলশান বাজার পর্যন্ত খোঁজাখুঁজি করে কাঁচা আম জোগাড় করেছেন। তাঁর সিক্রেট রেসেপি দিয়ে প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে শরবত বানানো হয়েছে। হসপিটালের বাইরে বেরুতেই চ্যানেলের সাংবাদিক প্রশ্ন করছে- স্যারকে কেমন দেখলেন? এ যাত্রা টিকবে তো! প্রশ্ন শুনে আলমগীর রহমানের মাথায় রাগ উঠে গেল। সারা দিন কাঁচা আম খোঁজাখুঁজি করে তিনি যথেষ্ট টায়ার্ড। এর মধ্যে প্রশ্ন-এ যাত্রা টিকবে তো! আলমগীর সাহেব বলেন-আমি কেমনে কই! আমি কি আজরাইল সাহেবের দুলাভাই না ভায়রা ভাই? স্যার, আমার একটা প্রশ্ন-উনি নাকি কোমাত্র। গেছেন, এ কথা কি সত্যি? দাঁড়ি-কমার বিষয় আমার জানা নাই, না। একটু আগে হুমায়ূন কাঁচা আমের স্যার, এখন তো প্রুফ রিডারের চাকরি করি খাইছে। আমের সি কাঁচা আম কোথায় পেলেন? কাঁচা আম কই পাইলাম এইটা কি আপনাকে বলতে হবে? আমি কি আপনার চাকরি করি? আঙ্কেল, আপনি যাচ্ছেন! আমি রাগলে আপনার কোনো সমস্যা আছে, আপনার কাছ থেইকা পারমিশন নিয়া আমাকে রাগারাগি করতে হবে? ক্যামেরা সরান। আমার চোখে সমস্যা আছে।… কী সমস্যা আপনার চোখে? আপনেরে বইলা লাভ কী, আপনে কি চোখের ডাক্তার? আরে ক্যামেরা সরান… নিকুচি করি আপনের ক্যামেরার… পরদিন সকালে হুমায়ূন আহমেদ হসপিটালে সকালের নাস্তা শেষে খবরের কাগজ পড়ছেন। একটা সিগারেট ধরাতে পারলে ভালো হত, গত চার দিন ধরে তিনি স্মোক করতে পারছেন না। হুমায়ূন আহমেদের ধারণা সবাই মিলে তাঁর সঙ্গে এক ধরনের শত্রুতা শুরু করেছে, তিন বেলা সুপের মতো অখাদ্য তাঁকে

পৃষ্ঠা:০৬

গিলতে হচ্ছে। মাছ-মাংসের বালাই নেই। সবচেয়ে বড় অপরাধ হল তাঁকে স্মোক করতে দেয়া হচ্ছে না, সিগারেটের প্যাকেট এবং দেশলাই সরিয়ে নেয়া হয়েছে। কাজটা করেছে শাওন, আজ থেকে শাওনের সাথে কথাবার্তা বন্ধ। আশার কথা হল, কাল রাতে আর্কিটেক্ট করিম এসেছিল। করিমের কাছ থেকে পাঁচটি সিগারেট এবং দেশলাই তিনি একরকম জোর করে রেখে দিয়েছেন। করিমকে বলেছেন-করিম আমি বোধ হয় মারা যাচ্ছি, সবাই মিলে ষড়যন্ত্র করছে আমাকে মেরে ফেলার, বড় আফসোস নিয়ে আমাকে চলে যেতে হচ্ছে। হুমায়ুন, তুমি কী বলছ এসব… আমরা সবাই তোমার পাশে আছি! সবাই পাশে আছে জানি, কিন্তু সিগারেট তো নেই! আমার ইচ্ছা- অনিচ্ছার কোনো দাম নেই কারো কাছে… আফসোস! হুমায়ূন আহমেদ ভাবছেন হাসপাতাল ছাড়া পাবার পর করিমকে এক কার্টন সিগারেট গিফ্ট করে ইবে। এখন সমস্যা হল কেবিনের ভেতরে কী করে সিগারেট ধুর যেতে পারে কোনো হেল্প করতে পারে। যায়! নার্সটাকে বলে দেখা স্যার নার্সকে ডেকে বললে ফেলেছি…কী নাম তোমার? অপর্ণা…অপর্ণা সাহা তোমাদের সবাইকে বেশ যন্ত্রণায় বাঃ বেশ করবে? নাম অপর্ণা তুমি কি কাইন্ডলি আমাকে একটু হেল্প অবশ্যই… বলুন স্যার আমাকে কী করতে হবে? তুমি কি আমার বেডের নিচে একটু চেক করে দেখবে ওখানে কেউ লুকিয়ে আছে কি না। অপর্ণা মুহূর্তেই ভয়ে আধমরা…খুব সন্তর্পণে সে বেডের নিচে উঁকি দিয়ে দেখে সেখানে কেউ নেই… থাকার কথাও না। হুমায়ূন আহমেদকে তাঁর আত্মীয়স্বজনের বাইরে অন্য কেউ এসে যাতে ডিস্টার্ব না করে সে জন্যে এক্সট্রা সিকিউরিটির ব্যবস্থা করা হয়েছে। অপর্ণা বলে-কই কেউ তো নেই স্যার… আপনার রুমের বাইরে সিকিউরিটি আছে আর আমি তো সারাক্ষণই ছিলাম… অচেনা কাউকেই আপনার কেবিনে আমরা আসতে দিচ্ছি না।

পৃষ্ঠা:০৭

সত্যি বলছ কেউ নেই? জি স্যার… কেউ নেই! না, মানে গত ক’দিন ধরে আজরাইল সাহেব ঘোরাঘুরি করছেন, আমি ভাবলাম উনি আবার খাটের তলায় ঘাপটি মেরে আছেন কি না… অপর্ণা খিলখিল করে হেসে ওঠে, নার্সদের জোরে হাসতে নেই কিন্তু অপর্ণা হাসি আটকে রাখতে পারছে না। মেয়েটির সেন্স অব হিউমার ভালো। হুমায়ূন আহমেদ বললেন-শোন অপর্ণা, আজরাইল সাহেব যেহেতু নেই তা হলে আমি এক কাজ করি একটা সিগারেট ধরাই তুমি বাইরে থাকো…দেখ কেউ যেন আমার কেবিনে না আসে। স্যারের কথা শুনে অপর্ণা এবার সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে যায়। হাসপাতালের কেবিনে বসে হার্টের রুগি স্মোক করতে চায় এমন অভূতপূর্ব আবদারের কথা কেউ কখনো শোনে নি, পূর্বে হিসেবে তার একটা রেস্পন্সিবিলিটি আছে, এজন্যে তার চাকরি পাগল মানুষটিকে আটকানোর সাধ্য তাবু তা আদায় করে নেন। মিসির আলির। একটা শিশুর মতো মনে হচ্ছে। ইল যেতে পারে! কিন্তু এই উনি বুঝি এমনই যা চান বুদ্ধিমান মানুষটিকে এখন ঠিক

পৃষ্ঠা:০৮

যদি কখনো ঢাকায় গিয়ে শুনেছি স্যার বিদেশে কিংবা ঢাকার বাইরে গেছেন তখন আমার খুব মন খারাপ হত, সন্ধ্যাগুলো নিরানন্দে কাটে। স্যারের সান্নিধ্য আমাকে চুম্বকের মতো টানত। কখনো তাঁকে চমকে দেবার জন্যে আগেভাগে কিছু না জানিয়ে হাজির হয়েছি তাঁর আস্তানায়। এমনি এক ঘটনার কথা বলা যায়-স্যার গেছেন সিলেটের গহীন অরণ্য লাউয়াছড়ায় ‘আমার আছে জল’ ছবির শুটিং করতে। মাজহার ভাই বললেন- স্যার নেই সন্ধ্যাগুলো একেবারেই শুটিং স্পটে? স্যার দেখলে খুশি হবেন। কাটছে, যাবেন নাকি মাজহার ভাই সারপ্রাইজ দিতে ভুলে গেছেন নিউইয়র্কে ‘চন্দ্রকথা’ ছবির শ্র ক্লাবের কোনো সদস্য না থাকায় প্রহসন। একবার হুমায়ূন স্যার কাঁর আনতে। সঙ্গে ওল্ড ফুলস অথৈ জলে পড়েছেন। অপরিচিত মানুষের সান্নিধ্যে স্যার দ্রুত ওঠেন ।। উদ্যোক্তারা স্যারকে রেখেছেন রেডিসন হোটেলে। সকালে শিতার জন্যে রুম সার্ভিসে কল দিয়েছেন। নাস্তার কুপন নেই, নিজেষ্ঠ পয়সা খরচ করে নাস্তা খাবেন। রুম সার্ভিস থেকে বলা হল-বাংলাদেশের গেস্টদের যে সব রুম দেয়া হয়েছে সেখানে রুম- সার্ভিস নেই। হুমায়ূন আহমেদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার অবস্থা, তিনি ক্ষুধা সহ্য করতে পারেন না। এ সময় দরজায় কে যেন কলিংবেল বাজাচ্ছে, স্যার বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলে দেখেন-একগাদা নাস্তা দিয়ে মাজহার দরজায় দাঁড়িয়ে আছে সাথে স্বাধীন খসরু আর মাসুম রহমান…

পৃষ্ঠা:০৯

মাজহার ভাই যখন বললেন-চলুন সিলেটে গিয়ে স্যারকে সারপ্রাইজ দিই! আমি আনন্দে নেচে উঠলাম… স্যারের সঙ্গে দেখা হবার মানে হল ‘আনন্দের ফোয়ারার জলে স্নান’। ঠিক হল আমি, মাজহার ভাই আর কমল পরদিন সকল ১০টায় তার গাড়িতে করে রওয়ানা হব… লাউয়াছড়া শহর থেকে অনেক দূরে, রাস্তা ফাঁকা থাকলে সন্ধ্যা নাগাদ পৌঁছনো যাবে। গাড়ির পেছনে প্রচুর খাবারদাবার নিয়ে আমরা পরদিন রওয়ানা হলাম। গাড়ি হাইওয়েতে উঠতেই মাজহার ভাই ড্রাইভিং সিটে বসে বললেন- ড্রাইভার যেভাবে চালাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে আমাদের পৌঁছতে মিডনাইট হয়ে যাবে। সন্ধ্যা নাগাদ পৌঁছতে না পারলে পুরো ট্যুরটাই মাটি হবে। ভাববেন না আমি আনাড়ি চালক, তবে সেফটির কথা চিন্তা করে বলছি সিট-বেল্ট বেঁধে নিন। কারণ সিলেট রোডে প্রচুর অ্যাক্সিডেন্ট অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের গাড়ি খালে পড়ে। ক’দিন আগে প্রাক্তন মাজহার ভাই ঝড়ের বেগে গাড়ি কথা ভেবে ভয়ে সিঁটিয়ে আছি। এত প্রাণ হারালেন। বেচারা বৃদ্ধ ঘুরেছেন তবু রাজনীতি থেকে। ইন, আমি সাইফুর রহমানের ধীয়ান রাজনীতিবিদ পানিতে পড়ে কেথেটার লাগিয়ে দেশ-দেশান্তরে নেন নি। বাংলাদেশে যাঁরা করেন তাঁদের বোধহয় রিটায়ারমেন্টের কোনো ব্যাপার নেই। প্রজরাইল সাহেব এসে টুটি চেপে না ধরা পর্যন্ত তাঁদের চেঁচামেচি বন্ধ হয় না। আমৃত্যু রাজনীতি করার বাসনা এঁরা কোনো দিন ছাড়তে পারেন না। পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট দু-বার নির্বাচিত হতে পারেন। তারপর আড়ালে চলে যান। পড়াশোনা, সবজি বাগান, টুকিটাকি কিছু সামাজিক কাজকর্ম আর ওম্ শান্তি ওম্ শান্তি ভাব নিয়ে তাঁদের সময় কাটে। আসলে মানুষ একটা পর্যায়ে এসে গৃহী না হলে জীবনের কোনো ব্যালান্স থাকে না। শীতের দিনে পাঁচটা বাজতেই সন্ধ্যা, কুয়াশার চাদরে ঢাকতে শুরু করেছে চারপাশ। মাজহার ভাই বোঁ বোঁ করে গাড়ি চালাচ্ছেন আর দুমিনিট পরপর কমলকে ধমকাচ্ছেন নাক ডাকা বন্ধ করার জন্যে। বিকট স্বরে নাক ডাকার জন্যে কমলের বেশ নাম-ডাক আছে।

পৃষ্ঠা:১০

বাসররাতের ঘটনা: কমল নববধূকে বলছে-বিয়েশাদি মহাঝামেলার ব্যাপার। বাসায় বাসায় দাওয়াত কর, বাজার কর, প্যান্ডেল খাটাও তারপর গায়ে হলুদ-বরযাত্রা-বৌভাত। এত ঝামেলা করে বিয়ে করার কোনো মানে হয় না, তার চেয়ে কোর্ট ম্যারেজ করা ভালো। দু-চার জায়গায় সই করে দিলেই হল… বিয়ের ঝামেলায় চার রাত ধরে আমার কোনো ঘুম নাই, আমি একটু ঘুমিয়ে নেই। কমলের সেই ঘুম ভেঙেছে সকাল ১১টায়। ঘুম থেকে উঠে দেখে নববধূ সেই সাজপোশাকেই খাটের ওপর বসে আছে, তার চোখ জবা ফুলের মতো লাল। কমল বলে-ঘটনা কী! তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন, চোখে কী হয়েছে? নববধূ বলছে-তোমার সাথে সংসার করা যাবে না, নাক-ডাকা লোক আমার দু-চক্ষের বিষ। সারা রাত নাক ডাকার শক্তে র শধু আামি এক ফোঁটা ঘুমাতে পারি নি। সারা জীবন এরকম টর্চার সহ্য কর পক্ষে সম্ভব না… বাঙালি নারীরা ধরিত্রীর মতো সর্বংসূর্য কমলের স্ত্রী এখন দু’সন্তানের। জননী। কমলের নাক-ডাকা নিয়ে অন্তচকানো অভিযোগ নেই। কমলকে নাক ডাকতে দেখলে কেবল মাজহাব হাঙ্গামা করে। বন-বাদাড় চা-বাগান পেকি সন্ধ্যা নাগাদ আমরা লাউয়াছড়ার গহীন অরণ্যে প্রবেশ করলাম। ভাই আগে একবার এসেছিলেন, এখানকার রাস্তা তাঁর খানিকটা পরিচিত, বাকিটা লোকজন ডেকে জিজ্ঞেস করে নিচ্ছেন। আমাদের ডেস্টিনেশন লাউয়াছড়ার ডাকবাংলো, স্যার তাঁর সিনেমার পুরো ইউনিট নিয়ে সেখানে আছেন। লাউয়াছড়া বাংলাদেশের অন্যতম রিজার্ভ ফরেস্ট, এর আয়তন ১২৫০ হেক্টর। ১৬৭ ধরনের গাছ রয়েছে এখানে, দৈত্যাকৃতির বিশাল সব রেইন ফরেস্ট দেখলে গা ছমছম করে। নানা বিচিত্র প্রজাতির পাখির বসবাস রয়েছে, এ বন পক্ষীপ্রেমীদের জন্যে এটা স্বর্গোদ্যান। ২৪৬ রকমের পাখি দেখা যায় এখানে। আর রয়েছে ৩০ প্রজাতির বন্যপ্রাণী। সম্ভবত পৃথিবীতে এটাই একমাত্র জায়গা যেখানে উল্লুকের বসবাস। স্যার বললেন, উল্লুকদের পারিবারিক বন্ধন এবং গোষ্ঠীপ্রীতি অনেকটা মানুষের মতোই। তাদের নাকি প্রায়ই সভা-টভা এবং ঝগড়াঝাঁটি করতে

পৃষ্ঠা ১০ থেকে ২০

পৃষ্ঠা:১১

দেখা যায়। ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া উল্লুক সমাজের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। উল্লুকরা তাদের স্বভাবের এই দিকটা বাংলাদেশের পলিটিক্যাল ভায়রনমেন্ট থেকে পেয়েছে কি না এটা একটা গবেষণার ব্যাপার। মাজহার ভাইয়ের সময়জ্ঞান অসাধারণ। আমরা ঠিক সময়টিতে এসে পৌছেছি। সারা দিন শুটিং করে একটু রেস্ট নিয়ে ডাকবাংলোর বারান্দায় ছবির পাত্র-পাত্রীদের নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ সদ্য সান্ধ্য আড্ডায় বসেছেন। দূর থেকে হাসির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে, স্যার সম্ভবত মজার কোনো অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন। এ সময় আমাদের গাড়ির হেড-লাইট দেখে সবাই উসখুস করে উঠল। ভাবটা এরকম-এ অসময়ে প্যান্ট-শার্ট পরা কোন উল্লুকের দল এল! সারপ্রাইজ দেবার জন্যে আগে থেকে আমাদের আসার ব্যাপারটা কাউকে জানানো হয় নি। আমাদের দেখে স্যার সত্যিই বিস্মিত হলেন! শুধুমাত্র আড্ডা দেবার জন্যে তিন ছোকরা দু এসেছে এ ব্যাপারটায় তিনি যথেষ্ট থেকে গাড়ি চালিয়ে চলে পুলকিত ছিলেন। ছবির নায়িকা লাক্স সুন্দরী মীমেক কেবল মুখ ভার করে আছেন। মেয়ের প্রথম ছবি মনে নানা অি সারা দিন শুটিংয়ে দৌড়ঝাঁপ করে মেয়ের চেয়ে নিজেই ক্লান্ত হব হয়ে উড়েছেন ঘুমাবার উপায় নেই, পরিচা ন। চোখ ভেঙে আসছে ঘুমে কিন্তু ‘হুমায়ূন আহমেদ একের পর এক নানা গল্প ফেঁদে চলেছেন। । এ সমষ্টি উঠে যাওয়াটা ঠিক না। মীমের শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না, বৃষ্টিভেজা এক গানের দৃশ্যে মীমকে চার বার ভিজতে হয়েছে। কোনো দৃশ্যই পরিচালকের মনঃপূত হচ্ছে না… যন্ত্রণার একশেষ। পরিচালক বোধহয় তাঁর মনের কথা টের পেয়ে গেছেন। হুমায়ূন আহমেদ মীমের মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন-শুনুন, আপনার মেয়েকে নিয়ে কোনো চিন্তা করবেন না। তার অভিনয় ভালো, সে দাঁড়িয়ে যাবে, এই ছবি রিলিজ হওয়ামাত্র ছটকু আহমেদ (ঢালিউডের পরিচালক) আপনার বাড়ি গিয়ে বলবে আমার ‘পাগল মন’ ছবিতে আপনার মেয়ের কাস্টিং ফাইনাল, এই নিন ফাইল, মেয়েকে বলুন সই করতে… জাহিদ টিপ্পনী কেটে বলে-হুমায়ূন ভাই, ছটকু আহমেদটা কে, আপনার আত্মীয়স্বজন নাকি?

পৃষ্ঠা:১২

আরে ছটকু আহমেদ কে আমি চিনি নাকি ঘোড়ার ডিম? নামের পাশে আহমেদ থাকলেই ভেবো না সব আমার আত্মীয়স্বজন। এফডিসিতে অন্তত ডজনখানেক পরিচালক পাবে যাঁদের নামের শেষে ‘আহমেদ’ আছে। ছটকু আহমেদ, ঝন্টু আহমেদ… একটা স্টোরি শোন-আমার ‘আগুনের পরশমণি’র মহরতের ডেট ফাইনাল করব, এ সময় সহকারী পরিচালক তারা চৌধুরী এসে মাথা চুলকে বলে-স্যার আপনাকে একটা পরীক্ষা দিতে হবে, পরিচালক সমিতি আপনার একটা ভাইভা পরীক্ষা নেবে। আপনি পরিচালক হবার যোগ্য কি না তা পরীক্ষা করে দেখবে…….আমি বললাম, খাইছে আমারে…’আগুনের পরশমণি’র চিত্রনাট্য, কলাকুশলী, পাত্র-পাত্রী সব ঠিকঠাক হয়ে আছে। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে টাকাপয়সার জোগাড় হয়েছে। ইউনিভার্সিটি থেকে ছুটি নেয়া হয়ে গেছে, এখন পরিচালক সমিতি যদি সব আটকে দেয় তো ছবির বারোটা বাজবে। পরিচালক সমিতি আমার কাছে। তমান দৈত্য হয়ে দেখা দিল… পরীক্ষার চিন্তায় আমার কলিজা শুকি গেল……অবশেষে নির্ধারিত দিনে তিন ইয়া মুকাদ্দেমু’ বলে বুকে ফুঁ দিয়ে পরীক্ষার হলে ঢুকলাম। ভেতরে আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম, সর্বনাশ! গোটা বিশেক পরিচারক্ষ শম্ভীর মুখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তাঁদের সবার সামনে খাততিলম। আমি যেন ফিজিক্সের ভাইভা পরীক্ষা দিতে এসেছি, এ, দেয়া হবে। তাঁদের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হল পরীক্ষাশেরে মার্ক আমি একটা গবেট মার্কা ছাত্র, তাঁরা যেন বলতে চাইছেন-ব্যাটা ফাজিল, টিভি নাটক নিয়া ছিলি টিভি নিয়াই থাক, ছবি বানানোর স্পর্ধা তোকে কে দিল, এটা কি ছেলের হাতের মোয়া? আমাকে প্রথম প্রশ্ন করা হল-পরিচালক বলতে আমি কী বুঝি, পরিচালকের প্রধান কাজ কী? আমি বললাম-ছবির পরিচালকের মূল কাজ হল ক্রিকেট খেলার আম্পায়ারের মতো মাথায় সাদা টুপি পরে সবাইকে ধমকাধমকি করা আর উঠতি নায়িকাদের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করা… হুমায়ূন আহমেদের কথা শুনে আমরা সবাই খুব হাসছি কিন্তু মীমের মা গম্ভীর। স্যার তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললেন… আপনার মেয়ের জন্যে দু’একটা টিপস্ দিচ্ছি-বাংলা ছবির নায়িকা হতে গেলে শরীর-স্বাস্থ্য ভালো হওয়া

পৃষ্ঠা:১৩

চাই, নয়তো পরিচালকের নজরে পড়া মুশকিল। অবশ্য একবার নায়িকার খাতায় নাম উঠে গেলে আর কোনো সমস্যা নেই। বুড়ি না হওয়া পর্যন্ত একের পর এক অফার আসতে থাকবে, বুড়ি হলেও সমস্যা নেই। তখন উঠতি নায়িকাদের মা, খালা কিংবা শাশুড়ির চরিত্রে অভিনয় করবে… …শুনুন, বাংলা ছবির নায়িকাদের তুলনায় আপনার মেয়ে যথেষ্ট স্কিনি, তবে তার জন্যে সুসংবাদ হল…এফডিসিতে নায়িকাদের জন্যে খাবারদাবারের বিশেষ ব্যবস্থা আছে। তাদের জন্য সুগন্ধি পোলাও চালের ভাত আসবে, অন্যেরা খাবে গণভাত। নায়িকা পাবে বড় মাছ, চিংড়ি ভুনা, খাসির ভুনা, মুরগির রেজালা আর অন্যেরা খাবে ভর্তা-ভাজি… …বাংলা ছবির নায়িকারা যে এত মোটা হয় তার কারণ কী জানেন? কারণ হল এফডিসির খাওয়াদাওয়া; যে কোনো চিকন-চাকন নায়িকা ছবির শুটিং করতে করতে এফডিসির খাবার খেয়ে স্ত্রির ফুলে-ফেঁপে গোলআলু হয়ে যাবে এতে রিলিজ হবে তখন নায়িকার সাইজ হবে। চিন্তার কোনো কারণ নাই, কারণ ওর। মাসের মাথায় মাশাল্লা ‘সন্দেহ নাই ছবি যখন বিস্তা! মেয়েকে নিয়ে আপনার কিগুলো প্লাস পয়েন্ট আছে… ১. সে ক্যামেরা ফ্রি। ২. সে ধমক ৩. সে ফ্রি (ধমক কাজ করতে পারে)। ভালো অনুকরণে প্রতে পারে। অনেকক্ষণ পর স্যার। কী কারণ? মা মুখ খুললেন-চিন্তার একটা কারণ আছে সবার সামনে বলা ঠিক হবে না, পরে আপনাকে বুঝিয়ে বলব। ঠিক হবে না কেন? এরা সবাই আমার আপন লোক, আমার ইউনিটে যারা কাজ করে সবাই আমার আপন। কোনো সমস্যা নাই, নির্ভয়ে বলেন। মানে আমরা তো আসলে হিন্দু। মীমের ভালো নাম হচ্ছে বিদ্যা সিনহা সাহা। তাই নাকি? মীম নাম শুনে আমি তো ভেবেছি সে মুসলমান, আলিফ লাম মীম থেকে তার নাম মীম। যাই হোক বিদ্যা সিনহা নামটা চেঞ্জ করলেন কেন?

পৃষ্ঠা:১৪

লাক্স-চ্যানেল আই সুন্দরী প্রতিযোগিতার সময় চ্যানেল আই এবং আমরা অনেক কায়দা করে তার আসল নামটা গোপন রেখেছি। হিন্দু জানলে তো কেউ তাকে ভোট দেবে না! আপনি কি সবাইকে এই সব কথা বলে বেড়াচ্ছেন? সবাইকে বলি না স্যার, যারা আপন শুধু তাদের বলি। শুনুন, সবাইকে আপন মনে করলেও জাহিদ সম্পর্কে সাবধান থাকবেন। সাবধান কেন? কারণ জাহিদ সন্ধ্যার পর তার নায়িকাদের আকাশের তারাগুলো চেনাতে চায়। সপ্তর্ষিমণ্ডল, সন্ধ্যাতারা এসব। সুযোগ পেলে নায়িকার মাকেও দেখায়। আপনাকে কি জাহিদ তারা দেখিয়েছে এর মধ্যে? জাহিদ হুমায়ূন আহমেদের কথা শুনে হা হা করে হাসছে। আর মীমের মা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। তাঁকে বেশ নার্সা স্যার মীমের মায়ের নার্ভাসনেস ।নার্গুন্তে দেখায়। কাটানোর ম্য বলেন—আপনার সঙ্গে রসিকতা করলাম, আসলে বেশিরভাগ শির্বিত মানুষই রসিকতা বোঝে না।

পৃষ্ঠা:১৫

২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাস, এ বছর বইমেলায় হুমায়ূন আহমেদের বিখ্যাত উপন্যাস ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ বের হয়েছে। স্যার বেশ খোশমেজাজে আছেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এটি তাঁর বড় মাপের কাজ। প্রায় প্রতি সন্ধ্যাতেই দখিন হাওয়ায় জমজমাট আড্ডা হচ্ছে। বিখ্যাত সব লোকজনের আগমনে মুখরিত দখিন হাওয়া। আড্ডার সময় স্যার সোফায় না বসে মেঝেতে আসন গেড়ে বসেন, বাধ্য হয়ে অন্যদেরও মেঝেতে বসতে হয়। ওল্ড ফুল মেঝেতে বসা নিয়ে অবশ্য কারো কোনো প্রকাশনা সংস্থার আলমগীর রহমান করেন। ফুর্বর ক্লাবের এটাই নিয়ম। শ্রেনি নেই, কেবল অবসর বিশাল বপু নিয়ে হাঁসফাঁস হুমায়ূন আহমেদ একের স্টাইল আছে-গল্পের করেন। পরকী গল্প বলে যান, গল্প বলার তাঁর নিজস্ব জাপারটাকে তিনি বেশ রসিয়ে উপস্থাপন শ্রোতারা সবাইে সবাই যুদ্ধ হয়ে স্যারের গল্প শোনে! গল্পগুলো বেশিরভাগই ‘জোছনা ও জননীর’। …তো কী হল! একাত্তরে যে যে-ভাবে পারে নিজের জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করছে। লোকজন ঢাকা ছাড়ছে-কেউ যাচ্ছে গ্রামে, কেউ ইন্ডিয়ায়। হিন্দুরা আছে সবচেয়ে বিপদের মধ্যে। যম এবং আজরাইল দুজনই তাদের ধাওয়া করছে। পাকিস্তানি মিলিটারির সাথে যোগ হয়েছে রাজাকার। মিলিটারির হাত থেকে বাঁচা গেলেও রাজাকারের হাত থেকে নিস্তার নেই। শাঁখারীবাজারে কোনো হিন্দু প্রাণ নিয়ে পালাতে পারে নি… কিন্তু ডেইলি

পৃষ্ঠা:১৬

পিপলস্ পত্রিকার সাব-এডিটর নির্মলেন্দু গুণের কোনো টেনশন নাই। উনি যম এবং আজরাইল দুজনকেই ফাঁকি দিয়ে ঢাকা শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন! কে একজন বলল-এটা কীভাবে সম্ভব! হুমায়ূন আহমেদ বললেন-কারণ, যম এবং আজরাইল দুজনই দাড়িওয়ালা মানুষকে সমীহ করে, নির্মলেন্দু গুণের দাড়ি ‘৭১ সালে বেশ কাজে লেগে গেল। বায়তুল মোকাররম থেকে সুরমা আর আতর কেনা হয়েছে, আতর-সুরমা-পাঞ্জাবি-দাড়িতে গুণকে দেখায় তরুণ সুফিদের মতো। সময় সুযোগ পেলেই তিনি হাঁটাহাঁটি করে শহরের অবস্থা দেখে আসেন। কে একজন গুণকে বলল- দাদা আপনার এরকম ফ্রিলি ঘোরাঘুরি করা ঠিক না, কখন ধরা খেয়ে যান! গুণ বলেন- আরে ধরা খাব কেন! দাড়ি ও লাগিয়ে ঘুরি, সমস্যা কী? সমস্যা আছে দাদা। এখন দাড়ি বলেন আর মুসলমান বলেন সবাই এ পাঞ্জাবি-সুরমা-আতর পার পাওয়া যাচ্ছে না, হিন্দু • দলিটারির ভয়ে দাড়ি রাখছে। গুণ আছে। গুণ’দা আপনি কবি মানুষ লেমা মুখস্থ করা কঠিন কোনো কাজ না। হিন্দু-মুসলমান এমনকি য়ের বৌদ্ধরা পর্যন্ত কলেমা মুখস্থ করে বসে আছে। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়… পাকিস্তানি মিলিটারি কাউকেই বিশ্বাস করছে না। তারা এখন পায়জামা-লুঙ্গি খুলে পরীক্ষা করে দেখছে মুসলমান না হিন্দু। বাঁচার একটাই উপায়। পালিয়ে আপনার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহে চলে যান। আর ঢাকা শহরে থাকতে চাইলে খৎনা করা ছাড়া বাঁচার কোনো উপায় নাই। বলুন কোনটা চান? বলেন-সমস্যা নাই, কলেমাও এ কথা শুনে নির্মলেন্দু গুণ ঘাবড়ে গেলেন, সমস্যার এদিকটা তাঁর মাথায় আসে নি… হুমায়ূন আহমেদের গল্প শুনে সবাই হা হা করে হাসছে। গল্পের মাঝখানে হাসির জায়গাগুলোতে তিনি হাসবার জন্যে ইচ্ছে করেই একটু পজ দেন। সবাই উৎসুক গল্পের শেষ অংশটা কী? স্বাধীন খসরু বলে-তারপর কী হল স্যার… গুণ’দা কী ঠিক করলেন?

পৃষ্ঠা:১৭

…গুণ ভেবে দেখল-এ বয়সে খৎনার ঝামেলায় যাওয়া ঠিক হবে না, ট্রেনে কিংবা বাসে যাওয়াও ঝামেলা। পাকিস্তানি মিলিটারি আর রাজাকাররা নানা জায়গায় চেকপোস্ট বসিয়েছে। তারা বাস-ট্রেন থেকে লোকজন নামিয়ে খৎনা করা আছে কি না পরীক্ষা করে দেখছে। গুণ ঠিক করল লম্বা হাঁটা দিয়ে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ যাবে…..হাইকোর্টের মাজারের কাছ দিয়ে যাচ্ছেন, দেখলেন ওখানে বাঙালিদের লম্বা লাইন। ঘটনা কী জানার জন্যে কাছে যেতেই দেখেন-পাকিস্তানি মিলিটারি বেসামরিক লোকজনের কাছ থেকে অস্ত্র জমা নিচ্ছে। যেসব বাঙালির লাইসেন্স করা অস্ত্র আছে তারা সেগুলো জমা দিচ্ছে। সবার মধ্যেই এক ধরনের অপরাধী ভাব যেন লাইসেন্স করা অস্ত্র রেখে তারা বড় কোনো অপরাধ করে ফেলেছে। এক মিলিটারি অফিসার নির্মলেন্দু গুণের কাছে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করেন-তোমহারা বন্দুক কাহা হ্যায়? গুণ উর্দুতে বলছে-বন্দুক তো নাহি হ্যায়। -ফির ইধার কিউ আয়া? -এ্যায়সি দেখতা হ্যায় আদমি। -তোম স্রেফ -জি জনাব। ইএ দেখনেকে ইধার বন্দুক জমা দিতা হ্যায়। আয়া? মিলিটারি অফিসার হিয়াসে, ভাগো। মিলিটারি গিয়ে বলে আরে উদ্বু কা পাঠে ভাগো হাত দিয়ে মাছি তাড়াবার মতো ভঙ্গি করল। নির্মলেন্দু গুণ হাঁটা ধরলেন। হাঁটতে হাঁটতেই ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ… নির্মলেন্দু গুণের আরেকটা স্টোরি শোন-আমি তখন মুহসীন হলে থাকি। আমার ঠিক উপরতলার রুমে থাকত মনিরুজ্জামান, সে হিস্টরির ছাত্র। তার রুমে চা বানানোর আয়োজন ছিল, সে কোথেকে যেন হিটার- কেটলি-কাপ-পিরিচ এসব জোগাড় করেছে। চায়ের আয়োজন হলেই মনিরুজ্জামান আমাকে ডাকত। আমারও তখন খুব ঘন ঘন চা খাওয়ার অভ্যাস। আমি সাধারণত চা খেতে যেতাম নীলক্ষেত রেললাইনের পশ্চিম পাশে। কখনো একা, কখনো আনিস সাবেতকে সঙ্গে নিয়ে। ছাইপাশের চেয়ে ‘চা’ অনেক ভালো ড্রিঙ্কস। তাই মনিরুজ্জামান ডাকলে আমি না গিয়ে পারতাম না। চা খেতে খেতে খানিকটা আড্ডাও হত। মাঝে

পৃষ্ঠা:১৮

মাঝে মনিরুজ্জামানের ওখানে নির্মলেন্দু গুণকে দেখি। গুণ কখনো কখনো রাতে থেকে যেত। গুণেরও আমার মতো চায়ের নেশা, গুণের নেশা বোধ হয় আরো মারাত্মক……এক রাতে গুণ থেকে গেল মনিরুজ্জামানের রুমে। সকালে কিছুতেই তাঁর ঘুম ভাঙে না। মনে হয় চায়ের নেশায় সে বুঁদ হয়ে ঘুমাচ্ছে, চা খেলে সবার ঘুম কেটে যায় কিন্তু গুণ চা খেয়ে নেশাচ্ছন্ন। মনিরুজ্জামান ক্যান্টিনে নাস্তা খেয়ে ক্লাসে চলে গেল। যাবার আগে গুণের জন্যে রুমে নাস্তা পাঠিয়ে দিল। সন্ধ্যায় মনিরুজ্জামান হলে ফিরে এসে দেখে তার রুমের অবস্থা শোচনীয়! সারা রুমে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বই-খাতা-লুঙ্গি-গামছা-চাপাতা, সব মিলিয়ে লণ্ডভণ্ড অবস্থা। রুমের ওপর দিয়ে যেন একটা ঝড় বয়ে গেছে। স্বাধীন জিজ্ঞেস করে-শোচনীয় কেন? ঘটনা শোন-গুণের ঘুম ভাঙল বারোটায় খাওয়ার পর তাঁর পেয়ে গেল চায়ের নেশা। ঘুম থেকে উঠে নাস্তা কোনো সমস্যা না, মনিরুজ্জামানের রুমে চা-চিনি-দুধ সবকিছুতে মজুদ। কেবল হিটার জ্বালিয়ে কেটলিতে গরম পানি বসিয়ে দিলেই কেটলি পাওয়া যাচ্ছে না। গুণ রুে দেখল কিন্তু কোথাও কেটলি মেজাজ খারাপ হল । সে তারপর কী হল? সহিটার জ্বালানোর পর দেখা গেল সম্ভাব্য জায়গায় তন্নতন্ন করে খুঁজে এদিকে হিটার তেতে উঠেছে, গুণেরও ল-চা না খেয়ে এই রুম থেকে যাবে না… …গুণের পণ হল ধনুকভাঙা পণ। তাঁর চোখ আটকে গেল বাথরুমের অ্যালুমিনিয়ামের বদনাটার দিকে। অ্যালুমিনিয়ামকে অ্যালুমিনিয়াম বলে চেনার উপায় নেই। দীর্ঘদিন ঘষা-মাজা না করায় বদনাটা দেখায় তামার মতো, ভেতরে আবার শেওলা ধরা। নির্মলেন্দু গুণ সেই বদনার পেছনে লেগে গেল। তারপর যথারীতি সে বদনায় চা বানিয়ে খেল। এক কাপ নয়, পরপর দু’কাপ। এক কাপে তাঁর তৃষ্ণা মেটে নি। মনিরুজ্জামান কিছুতেই বুঝতে পারছে না এ অবস্থা কেমন করে হল! এনএসএফের পাণ্ডারা এসে কোনো কারণে রুম সার্চ করে যায় নি তো। পাঁচপাণ্ডু গলায় সাপ পেঁচিয়ে ঘোরাঘুরি করে। ওদের পক্ষে কিছুই অসম্ভব না। হঠাৎ মনিরুজ্জামানের চোখ আটকে গেল বাথরুমের বদনাটার দিকে। হাতে

পৃষ্ঠা:১৯

নিয়ে দেখে ভেতরে চা-পাতা, তখন বুঝতে বাকি রইল না আসলে কী ঘটেছে-গুণ কেটলি না পেয়ে বদনায় চা বানিয়ে খেয়েছে। পাশের রুমের কবির সকালে চা বানানোর জন্যে মনিরুজ্জামানের কেটলিটা ধার নিয়েছিল। এ জন্যেই গুণকে বদনা দিয়ে চা-বানানোর কাজ সারতে হয়েছে। ভালোই হয়েছে, গুণের কল্যাণে বদনাটা চকচকে হয়ে গেছে। মনিরুজ্জামান ঠিক করল আবার বদনায় শেওলা জমলে গুণকে খবর দিতে হবে। আড্ডাশেষে হুমায়ূন আহমেদ বললেন-খাওয়াদাওয়া শেষ করে রাতে আমার এখানে থেকে যাও, কাল সকালে আমার সাথে নুহাশ পল্লী যাবে। তুমি তো বোধহয় নুহাশ পল্লী যাও নি কখনো! নুহাশ পল্লীতে যাবার আমন্ত্রণ পেয়ে আমি আনন্দে লাফিয়ে উঠি। নুহাশ পল্লীর অনেক গল্প শোনা হয়েছে-জোছনার গল্প, সাপ-ভূতের গল্প। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বেলাল চৌধুরী, মতিউর রহমান, ট্রে সিনেমারও শুটিং স্পট। মনজুরুল ইসলামের মতো বিখ্যাত মানুষেরা সেখানে আনন্দে নেকে হঠন। আবার ওটা নাটক- আমি এক বাক্যে রাজি হয়ে গেলুমে তবে একটা সমস্যা দেখা দিল- আমি উঠেছি আমার এক কাজিন চিনি আর্মি অফিসার, ভেতরে ওখানে। আমি ওদের বাসকে কলগেজ রেখে সরাসরি দখিন হাওয়ায় এসেছি। থাকে ক্যান্টনমেন্টের আমার লাগেজ জামাকাপড় সব ওদের ওরা আমার জন্যে জেগে বসে থাকবে। রাতটা বরং ওখানেই থাকা ভালো। স্যারকে সমস্যার কথা বলতেই তিনি বললেন-‘ঠিক আছে, সকাল সকাল চলে এসো।’ তারপর তাঁর সদ্য প্রকাশিত উপন্যাস ‘জোছনা ও জননীর গল্প’র একটা কপি ধরিয়ে দিলেন। ৫০০ পাতার উপন্যাস, বেশ ওজনদার। গত দু’দিন বইমেলায় ঘুরে অনেকগুলো বই কিনেছি। ওজন নিয়ে এবারো এয়ারপোর্টে সমস্যায় পড়তে হবে। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারিতে বইমেলায় এসে একগাদা বই কিনি। আবার মাজহার আর আলমগীর ভাই তাঁদের প্রকাশনীর সদ্য প্রকাশিত সবগুলো নতুন বই দিয়ে দেন। আরো টুকিটাকি জিনিসপত্র মিলিয়ে ওজন হয়ে দাঁড়ায় ৩০-৩৫ কেজি। এয়ারলাইন্স বেশ ঝামেলা করে। ২৫ কেজির বেশি তারা কিছুতেই ছাড়তে চায় না।

পৃষ্ঠা:২০

8

রাতে ক্যান্টনমেন্টে দিদার ভাইয়ের বাসায় পৌঁছে দেখি পরিস্থিতি থমথমে। আমি যখন দুপুরে এয়ারপোর্ট থেকে ওনার বাসায় পৌঁছাই তখন তিনি বলেছিলেন-তোমার ভাবি দু’দিনের জন্যে মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়ি বেড়াতে গেছে, রাতেই চলে আসবে। কিন্তু এখন বলছেন ভিন্ন কথা-গত এক বছর ধরে তাঁরা স্বামী-স্ত্রী নাকি আলাদা বসবাস করছেন। তাঁদের দুটি ছেলেমেয়ে, ছেলেটি বড় বয়স ৮ বছর। সে তার বাবার সঙ্গে ঢাকায় থাকে। আর ৬ বছরের মেয়েটিকে নিয়ে ভাবি নারায়ণগঞ্জে তাঁর বাবার বাড়িতে থাকছেন। দিদার ভাইয়ের স্ত্রীর নাম সখি। খুবই প্রসিখুশি ধরনের মহিলা। দেখতেও সুশ্রী, স্মার্ট। ওঁদের বিয়ে বুঝতে হবে তাঁদের সমস্যাটা ছেলু ওঁদের বাসায় উঠেছিলাম।। হয়েছি দশ বছর। এতগুলো বছর ৫ আলাদা থাকতে শুরু করে তা হলে নয়। গত বছরও বইমেলার সময় মধ্যে বেশ মধুর সম্পর্ক ছিল! কিন্তু তাই জিনের আমার চোখে পড়ে নি! ভেতরের এত ছেলেমেয়ে দুটোর করা ভেবে আমার বেশ মনখারাপ হল। বাবা-মায়ের সংঘাতে ওরাও জড়িয়ে গেছে। ভাই-বোনের খুনসুটি-ভালবাসার জগৎ থেকে ওরা বঞ্চিত হচ্ছে। দিদার ভাই আমাকে ধরলেন-শোন, সখি খুব জেদি মেয়ে। একবার কোনো ব্যাপারে ‘না’ বললে তাকে দিয়ে ‘হ্যাঁ’ করানো মুশকিল। আমাদের ব্যাপারটা মীমাংসার জন্যে দুই পরিবারের মধ্যে অনেকবার মিটিং-সিটিং হয়েছে। কিন্তু সখি তার সিদ্ধান্তে অনড়। তোমাকে যেহেতু সে খুব মানে, আর

পৃষ্ঠা ২১ থেকে ৩

পৃষ্ঠা:২১

আইনি ডিভোর্স যেহেতু এখনো হয় নি, তাই বাচ্চাদের কথা ভেবে তুমি একটু দেখ, যদি সখিকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে একটা সমঝোতায় নিয়ে আসতে পার। আমার আমেরিকার অ্যাম্বাসাডরের কথা মনে পড়ে গেল-বাংলাদেশের দুই রাজনৈতিক দলের ঝগড়া-বিরোধ মীমাংসার জন্যে উনি মাঝে মধ্যে চায়ের দাওয়াত দেন। আমি বেশ আনন্দের সঙ্গেই দায়িত্ব নিতে রাজি হলাম। তখন অনেক রাত। সখি ভাবিকে ফোন করে সকালে ক্যান্টনমেন্টের বাসায় আসতে বললাম। উনি কিছুতেই আসবেন না। আমি বললাম-আপনি আমার চায়ের দাওয়াতে না এলে আমেরিকার অ্যাম্বাসাডরের মান থাকে না। ভাবি হাসলেন। মনে হল বরফ গলতে শুরু করেছে। আমি অ্যাম্বাসাডরের প্রতিভার সবটুকুই ঢেলে দিলাম। কাজ হল, উনি আসতে রাজি হলেন। সখি ভাবি দশটার মধ্যেই চলে এলেন। আজ ছুটির দিন থাকায় রাস্তাঘাট নাকি বেশ ফাঁকা ছিল, কোনো ট্রাফিক জ্যামে পুর থেকে ক্যান্টনমেন্টে আসতে সময় লেগেছে খুঁত হয় নি। নারায়ণগঞ্জ এক ঘণ্টা। এসেই নাস্তার জোগাড়যন্ত্রে লেগে গেছেন। চা খেতে খেতে মিরা মিটিং শুরু করলাম। মিটিংয়ের শুরুতেই দুজনে পুরে অমীমাংসিত বিষয় নিয়ে আবার মহাসমারোহে ঝগড়া শুরু করলে ছেলেটা ভয়ার্ত চোখে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে বাবা-মায়ের ঝগড়া দ্রুত চা খেতে গিয়ে আমি জিভ পুড়িয়ে ফেললাম। ঝগড়াঝাঁটি ছেলেবেলা থেকেই এড়িয়ে চলি, ভয় পাই। এখন মনে হচ্ছে, মতো দুর্বল লোকের জন্যে অ্যাম্বাসাডরের প্রক্সি আমায় দিতে যাওয়া ঠিক হয় নি। একটু পরেই স্বাধীন খসরুর ফোন-নুহাশ পল্লীতে যাবার জন্যে সবাই প্রস্তুত। ধানমণ্ডির দখিন হাওয়ায় স্যারসহ সবাই আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। এই পরিবারটির কথা ভাবতে ভাবতে আমি নুহাশ পল্লীতে যাবার ব্যাপারটা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। যে গ্যাঁড়াকলে পড়েছি! এর থেকে উদ্ধার পাওয়া সহজ না। এদের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে অনেকদিন ঝগড়াঝাঁটি না হওয়ায় বরং তাঁরা আপসেট ছিলেন, আজ একটা সুযোগ তৈরি করে দেয়াতে তাঁরা বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছেন। বক্সিং গ্লাভস এনে দিলে মারামারিও লেগে যেতে পারে। আমি দ্রুত ভাবতে থাকলাম কী করা যায়? এদেরকে মিটিংয়ে বসিয়ে আমি মাঝপথে চলে যেতে পারি না। ভাবি বেচারা সেই নারায়ণগঞ্জ থেকে

পৃষ্ঠা:২২

এসেছেন। আবার এদিকে নুহাশ পল্লীতে যাবার জন্যেও আমি খুব এক্সাইটেড। আমার উপস্থিত বুদ্ধি খুব কম। হঠাৎ করে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি না, মাথা কাজ করে না। ফাঁকা ফাঁকা লাগে। স্বাধীনকে বললাম-তোমরা এগিয়ে যাও, আমার আসতে একটু দেরি হবে। আর স্যারের থেকে পারমিশন নাও আমার কাজিন আর তাঁর ওয়াইফও নুহাশ পল্লীতে আসতে চাচ্ছেন, কোনো সমস্যা আছে কি না। ফোনের ও-প্রান্ত থেকে স্যার বললেন-কোনো সমস্যা নাই। ঢাকায় যদি তোমার কোনো গার্লফ্রেন্ড থাকে ইচ্ছে করলে তাকেও নিয়ে আসতে পার। আর্কিটেক্ট করিম আমাদের সঙ্গে যাচ্ছে। দলে কোনো নারী সদস্য না থাকায় বেচারা বেশ আপসেট। তাড়াতাড়ি আসবে, দিন ছোট, আমরা আবার সন্ধ্যায় ফিরব। হুমায়ূন আহমেদের বহু গল্প-উপন্যাসে আশি এ করিমকে পাওয়া যাবে বিশেষ করে তাদের সাঁতার এই চোখে পড়ার মতো। নারী টিনএজ মেয়েদের প্রিয় ‘করিম আঙ্কেল’ হিসেছে বিশ্বাবার ব্যাপারে করিম আঙ্কেলের পরই সেরে বিষয়ে তার দুর্বলতা কোনো রকম না রেখেই উপস্থাপিত হয়েছে ‘দেখা না দেখা’ ভ্রমণকাহিনীতে, করেন বলে মনে হয়।২০৮শেষ এম সাহেব নিজেও ব্যাপারটা এনজয় হুমায়ূন আহমেদের চানন নুহাশ পল্লীতে যাবার কথা শুনে দিদার ভাই আর সখি ভাবির ফাড়া থেমে গেল, যেন তারা একটা স্বপ্নের দেশে যাবেন। ভাবি মহা-উৎসাহে তৈরি হতে লেগে গেলেন। আমি ঘোষণা দিলাম-সময় মাত্র দশ মিনিট। এই দশ মিনিটের মধ্যে প্রস্তুত হওয়া চাই। আধঘণ্টা পর সখি ভাবি মিহি গলায় দিদার ভাইকে ডেকে বললেন-এই একটু ভেতরে আসো তো, শাড়ির ভাঁজটা ঠিক করতে হবে। দিদার ভাই সুড়সুড় করে শাড়ি ভাঁজ করার কাজে লেগে গেলেন। ছুটির দিন ট্যাক্সি পাওয়া মুশকিল। চোখের সামনে হুস-হাস করে ইয়েলো ক্যাবগুলো ছুটে যাচ্ছে, কিন্তু কোনোটাই খালি নেই। আবার কেউ কেউ দূরের রাস্তা বলে যেতে রাজি হচ্ছে না। দশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পর একটা ট্যাক্সি পাওয়া গেল। ড্রাইভার হুজুর টাইপ। বয়স ত্রিশের কোঠায়। মুখে লম্বা দাড়ি, মাথায় টুপি।

পৃষ্ঠা:২৩

ড্রাইভার আবার নুহাশ পল্লী চেনে না। তবে লোকমুখে শুনেছে ওখানে সিনেমা-নাটকের শুটিং হয়। নায়ক-নায়িকা ছাড়া অন্য কেউ ঢুকতে পারেন না। সম্ভবত কাছ থেকে নায়ক-নায়িকাদের দেখার লোভে ড্রাইভার আমাদের নিতে রাজি হয়েছে। আমাদের অভয় দিয়ে তিনি বললেন-উইঠা বসেন কোনো সমস্যা নাই। শুনছি জায়গাটা গাজীপুর ছাড়ায়া, শালবনের ভিতর দিয়া রাস্তা। মানুষ জিগাইয়া বাইর কইরা ফালামু। আরে কলম্বাস আমেরিকা খুঁইজা পাইছে আর আমি নুহাশ পল্লী খুঁইজা পামু না? ড্রাইভারের মুখে কলম্বাসের কথা শুনে আমি একটু অবাকই হই। গাড়ি টঙ্গী ব্রিজ ছাড়িয়ে ছুটে চলেছে গাজীপুরের দিকে। ভদ্রলোক মনে হচ্ছে বেশ মজা পাচ্ছেন। নতুন একটা জায়গা আবিষ্কারের নেশা তাকে পেয়ে বসেছে। টঙ্গী ব্রিজ পর্যন্ত সে চুপচাপ ছিল, এর পর তাকে কথায় পেয়ে বসেছে। আমাকে জিজ্ঞেস করে-ভাইজান একটা কথা জিতে আপনেরে খুব চিনা চিনা মনে হইতাছে, কই জিব্রাই, বেয়াদপি নিয়েন। মই কন দেহি। না। হুজুর টাইপ লোকজনের সঙ্গে গল্প ইহকাল-পরকাল, আখিরাত-পুলসির জিন-ভূত হেন বিষয় নেই এরা জান রাখে না। দূরপাল্লার এক্সপ্রেস চেনের মতো ঝিকিরঝিক আওয়াজ তুলে নন- স্টপ কথা বলে যাবে আর মে ফলাতে দু’মিনিটেই আমার মাথা ধরে যাবে। থাকবে। এই ঝিকিরঝিক আওয়াজে আমি ড্রাইভারের কথার জবাবে বললাম-আমাকে আপনি এর করলে আর থামতে চায় না, ওদের বিপজ্জনক। এরা কথা শুরু ভাণ্ডারও বিশাল-পীর-পয়গম্বর, আগে কোথাও দেখেন নি, আমিও আপনাকে কখনো দেখেছি বলে মনে হয় না। আমার কাটা কাটা উত্তরে ভদ্রলোক দমবার পাত্র নন। মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন-না ভাইজান, আপনে আমারে না দেখলেও আমি আপনারে দেখছি। আপনের এই বেশভূষা দেইখা পরথমেই আমার সন্দেহ হইছে আপনে রিয়াজ ভাই। সত্য কইরা কন ত আপনে রিয়াজ ভাই না? আমি আকাশ থেকে পড়লাম-রিয়াজ কে! আমি রিয়াজ হতে যাব কেন? না ভাইসাব, আমি ভুল করলেও আমার এই দুই চক্ষু ভুল করতে পারে না। নুহাশ পল্লীতে যাইবেন শুইনাই আমার মনটার মধ্যে একটা কামড় দিছে। ঐখানে সিনামার নায়ক-নায়িকা ছাড়া আর কারো যাওনের অনুমতি নাই।

পৃষ্ঠা:২৪

আমি হেসে বলি-আমরা কেউ এখানে সিনেমার লোক না। আমি দেশের বাইরে থাকি হুমায়ূন আহমেদ স্যারের আমন্ত্রণে ওখানে বেড়াতে যাচ্ছি। কন কী, হুমায়ূন আহমেদ সাব আপনেগো ইনভাইট করছে! ভাইজান আমারে আপনে ফাঁকি দিতে পারবেন না, আপনের সব ছবি আমার দেখা…ঐ যে শাবনূরের লগে ময়ূরপঙ্খী বইটা করলেন… শাবনূররে বাঁচাইতে গিয়া আপনের পায়ের মধ্যে গুল্লি লাগল…ড্রাইভারের মজার কথা শুনে আমি হা হা করে হেসে উঠি। পেছনে ভাবিও হাসতে হাসতে ড্রাইভারের কথায় সায় দিয়ে বলে-আপনি ঠিকই ধরেছেন, উনিই রিয়াজ সাহেব, সানগ্লাস পরাতে একটু অন্যরকম লাগছে। সখি ভাবির কথা শুনে ড্রাইভার কষে ব্রেক করল, আর একটু হলেই গাড়ি খাদে পড়ে যায়! আমি রেগে গিয়ে বলি-সামনে কিছু নেই কিন্তু আপনি হঠাৎ করে ব্রেক চাপলেন কেন, ঘটনা কী? ড্রাইভার পান-খাওয়া কালচে দাঁতগুলো কিছু না। না, ভাইজান… আমার নিজের শত করে বললেন- ঘটনা ভাই আমার পাশে বসা! কী সৌভাগিতো বিশ্বাস হইতেছে না! রিয়াজ ঈমার… ভাইজান হাতখানা বাড়ায়া দেন, একটু হাত মিলাই! এর পরের ঘটনা ভয়াবহ হতে থাকলাম। যেমন। না পূর্ণিমা কার সঙ্গে আমার বেশি ঘনিষ্ঠতা এবং তাদের সঙ্গে কোশ্যে বাপন সম্পর্ক আছে কিন না, ড্রাইভার সাহেব সেটা যাচাই-বাছাই করে দেখতে চান। ট্রাইভারের নানা প্রশ্নবাণে আমি জর্জরিত লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে দেখি ড্রাইভারের উটকো সব প্রশ্নে ভাবি মুখ টিপে হাসছেন, হাসলে ভাবিকে আরো সুন্দর দেখায়। নুহাশ পল্লীতে যাব শুনে শাড়ি পাল্টেছেন। এত তাড়াহুড়োর মধ্যে আবার কোন এক ফাঁকে চোখে হালকা করে কাজলও এঁকেছেন। একটু কাজলের আঁচড়ে তাঁর রূপ খুলে গেছে বহুগুণ। দিদার ভাইয়ের মুখ গম্ভীর। সুযোগ পেলেই তিনি ভাবির সাথে পুরোনো হিসেবপত্র নিয়ে বসছেন। দীর্ঘদিনের ফাটল তিনি একদিনেই জোড়া লাগিয়ে ফেলতে চান। মাঝে মাঝে তাঁদের অসহিষ্ণুতা আমাদের কানে এসে লাগছে। তখন আমাকে বেশি বেশি করে রিয়াজের প্রক্সি দিতে হয় নয়তো হাটের

পৃষ্ঠা:২৫

লোকের কাছে রিয়াজের ভাই-ভাবির দুর্নাম রটে যাবে। হায় রিয়াজ, তোমার প্রক্সি দিতে গিয়ে এত বিড়ম্বনায় পড়তে হবে জানতাম না! আমি দশ বছর ধরে দেশের বাইরে থাকি বলে রিয়াজের একটা ছবিও দেখা হয় নি। রাজেন্দ্রপুরের শালবনের ভেতর দিয়ে গাড়ি চলছে, যেতে যেতে চোখে পড়ছে ক্লিষ্ট কিছু মানুষ গাছের শুকনো পাতা কুড়াচ্ছে। আমরা বড় রাস্তা থেকে বাঁ দিকে হোতাপাড়ার রাস্তায় ঢুকলাম। এটাই নুহাশ পল্লী যাবার রাস্তা, আশপাশের বাড়িগুলো ছবির মতো সুন্দর। ছায়াঘেরা বনানীর ভেতর ছোট ছোট বসতবাড়ি। শেষ দিকে সাত-আট মাইলের মতো মাটির রাস্তা। ইট-সুরকির বালাই নেই, রাস্তায় বড় বড় গর্ত। যে কোনো সময় গর্তে ঢাকা আটকে যাবার সমূহ সম্ভাবনা। এবড়োখেবড়ো রাস্তায় ঝাঁকুনিতে আমাদের হাড়-মাংস এক হবার জোগাড়! ড্রাইভার আমাদের অভয় দিয়ে বললেন। মনে দোয়া-দরুদ পড়েন লা ইলাহা ইল্লা জোয়ালে মিন। এরি ডার্ক ক্লাউড হ্যাজ এ।অবড়াইয়েন না স্যার, মনে সোবহানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজ লাইনিং। ঝাঁকুনিতে ভালোই হয়েছে। ফাটল ধরা দম্পতি জোড়া লা শুরু করেছে। দিদার ভাই সখি ভাবিকে এসে তরী ডোবার মতো অর্ধেক রাস্তা এসে আগলে ধরে বসে আছেন। গাড়ি পুরোপুরি থেমে গেট আমি ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম-ব্যাপার কী? ড্রাইভার মুখে ক্যাবলা হাসি ফুটিয়ে বললেন-এইটা সিএনজি গাড়ি স্যার, গ্যাসে চলে। গ্যাস মনে হয় শেষ দিকে, তেলেও লাল বাত্তি। এই জন্য ইঞ্জিনের শক্তি কইমা গেছে। ড্রাইভারের হাসি দেখে মনে হয় ইঞ্জিনের শক্তি কমে যাওয়ায় তিনি বেশ খুশি। আমি ভীত কণ্ঠে বলি-এখন উপায়? উপায় একখান আছে স্যার! বেয়াদপি নিয়েন না, সবারে গাড়ি থেইকা নামতে হবে। তারপর দিতে হবে ধাক্কা, সাথে হজরত আলীর নাম। হজরত আলীর নামের উপরে কিছু নাই, ওনার নামে বালা-মসিবত সব কাইটা যায়। আমরা যখন সব বালা-মসিবত কাটিয়ে নুহাশ পল্লীতে পৌঁছলাম তখন পুকুর থেকে মাছ ধরা হয়ে গেছে, সেগুলো রান্নার আয়োজন চলছে।

পৃষ্ঠা:২৬

আমাদের হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানালেন এ আনন্দ আশ্রমের পুরোহিত হুমায়ূন আহমেদ। তারপর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাতে লাগলেন তাঁর সাধের নুহাশ পল্লী। নানা রকম ফল-ফুল গাছের সমারোহ এখানে। গাছগুলোর সঙ্গে আমাদের এমনভাবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন যেন গাছের চোখ-কান-হাত-পা আছে, আত্মা আছে। বুঝলাম, গাছপালার সঙ্গে তাঁর একটা নিবিড় স্নেহের সম্পর্ক আছে। সেদিন স্যারের এক নতুন পরিচয় পেলাম। হুমায়ূন আহমেদ যে একতলার দালানটিতে থাকেন তার সামনেই একটা জাপানি বটগাছ, গাছটি দশ ফুট লম্বা হবে কিন্তু এখনই তার ঝুরি নেমে গেছে মাটিতে। শেষ প্রান্তে আছে একটা পুকুর, তাতে শান বাঁধানো ঘাট। স্যারের প্রায় সব কটি গ্রামের নাটকে এই ঘাটটিকে দেখা যাবে। পুকুরের পাশেই একটা উঠানওয়ালা বাড়ি। তাতে আছে কুঁড়েঘর, গোয়ালঘর এগুলো নাটকের সেট। অদূরেই আছে বাচ্চাদের আনন্দ দেবার জন্যে জুরাসিক পার্ক, তাতে কয়েকটা হরিণ হাতি বাঘ আর মূর্তি। হুমায়ূন আহমেদ বললেন-শিশুদের বাচ্চা কিনব বলে ঠিক করেছিলাম দেবার জন্যে একটা হাতির হাতিওয়ালা অন্যায্য দাম চায়, একটা বাচ্চা হাতির জন্যে দাম চারও চার লাখ টাকা। হাতি তো ডাল-ভাত খাবে না, হাতির খাবার হবে কেজির মতোই-দুধ ছাড়বার পর একটা ১২ বছরের হাতি প্রতিদিন ২৫০০ কেজি শাকসবজি খায় আর বিশ লিটার পানি। বছরে ধরো হাড়ির পেছনে খরচ হবে চার-পাঁচ লাখ টাকা, লস প্রজেক্ট। তবে নাটকের প্রয়োজনে হাতি ভাড়া করে আনা হয়। ঘোড়া আছে কয়েকটা, ঘোড়াগুলো খুব কাজে লাগে। ‘সবুজ ছায়া’ নাটকে হুমায়ূন ফরীদিকে দেখবে সে ঘোড়ায় চড়ে ভিক্ষা করে…স্যারের একতলা ফ্ল্যাটে যাবার পথে একটা বিশাল দাবার ঘরে আমার চোখ আটকে গেল। দুটো কিং সাইজের বেড জোড়া দিলে যে রকম সাইজ হবে এটা তেমন। একেকটা খুঁটির সাইজ হবে দু’ফিট। দাবা খেলা আমি মোটেও পছন্দ করি না, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে বসে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। এখন মনে হচ্ছে এরকম রাজসিক দাবার ঘরে দু’একটা গেম খেললে মন্দ লাগবে না। আরো কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ক্লান্ত হয়ে আমরা স্যারের ফ্ল্যাটে ঢুকলাম।

পৃষ্ঠা:২৭

ঢোকার মুখেই বরাবর দেয়ালটিতে তাঁর বাবা ফয়জুর রহমান সাহেবের একটা ছবি। ১৯৭১ সালে ফয়জুর রহমান ছিলেন পিরোজপুর জেলার পুলিশপ্রধান-এসডিপিও। ওয়‍্যারলেসে মেসেজ এসেছে ঢাকার পুলিশ সদর দপ্তর থেকে-দেশের সব জেলা পাকিস্তানি মিলিটারির দখলে আছে, সাব ডিভিশন এবং থানা পর্যায়েও আর্মি অতি দ্রুত অভিযান শুরু করবে। পুলিশ বাহিনীকে জানানো হচ্ছে তারা যেন সামরিক বাহিনীকে পূর্ণ সহযোগিতা করে। ফয়জুর রহমান সাহেব তা করেন নি। ট্রেজারির সব অস্ত্র-গোলাবারুদ তিনি তুলে দিয়েছিলেন স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। অকুতোভয় এই মানুষটিকে পাক আর্মি হত্যা করে। চারটি বেড রুম, বিশাল ডাইনিং আর কিচেন নিয়ে বেশ ছিমছাম থাকার ব্যবস্থা। ডাইনিং টেবিলগুলো জাপানি কায়দার, নিচু। কোনো চেয়ার নেই। মেঝেতে আসন গেড়ে বসতে। ত হয়। হুমায়ূন রুমেও একটা জাপানি কায়দার টেবিল। আসন গেড়ে বসলাম। আমাদের সঙ্গে করিম। বড় কোনো মানুষের মুখোমুনি মনে লজ্জিত হই। নুহাশ পল্লীতে সেই টেবিলের চারপাশে থাকেন সে আহমেদ যে দিয়েছে স্বাধীন আর আর্কিটেক্ট নিজের দৈন্যের জন্যে আমরা মনে ঢাকার পর থেকেই দিদার ভাই আর সখি ভাবি ভিন্ন মানুষ। দুজন। করেছেন, দিদার ভাই উনি ‘হাত ধরাধরি করে আমাদের সাথে ঘোরাঘুরি কানে কানে কী যেন বলছিলেন আর অমনি ভাবি হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ছিলেন… ওঁদের মধ্যে এ রকম সম্ভাব দেখে আমার খুব ভালো লাগছিল। মাছ ভাজা এসে গেছে। আমরা খেতে খেতে গল্প করছি। স্যার বললেন-পুকুর থেকে ধরা সরপুঁটি। সাবধান, এ মাছে খুব কাঁটা হয়, ভালো করে কাঁটা বেছে নিও। ছেলেদের গলায় কাঁটা আটকে গেলে ডাক্তার এজাজ আছে। আর মেয়েদের গলায় কাঁটা আটকে গেলে আছে আমাদের করিম। স্বাধীন বলে করিম চাচা তো ডাক্তার না, আর্কিটেক্ট। স্যার বলেন-আরে করিম হল শরৎচন্দ্রের মতো নারী-দরদী, নারীদের কোনো দুঃখ সে সহজভাবে নিতে পারে না। ধরো, এই ভদ্রলোক কী যেন নাম ভাই তোমার? ও দিদার… ধরো, দিদার পানিতে পড়ে গেছে, সে সাঁতার

পৃষ্ঠা:২৮

জানে না, পুকুরের পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে…এ সময় করিম কী করবে? সে দূরে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে বলবে-ব্যাটা দামড়া সাঁতার শিখস নাই ক্যান! আর যদি এই মেয়েটি পানিতে পড়ে যায় তা হলে করিম এক মুহূর্ত দেরি না করে পানিতে ঝাঁপ দেবে। তারপর কী যেন বলবে করিম? তুমি বল। করিম ভাই মহা-উৎসাহে বললেন-বলব, কন্যা সাঁতার শিখ নাই কেন? তুমি প্রতি শুক্রবারে এইখানে চলে আসবা, আমি এই পুকুরঘাটে তোমারে সাঁতার শেখাব। কোনো টাকাপয়সা লাগবে না, ফ্রি অব চার্জ। করিম ভাইয়ের কথা শুনে আমরা সবাই প্রাণ খুলে হাসছি। স্যারও বেশ মজা পাচ্ছেন। করিম ভাইকে উৎসাহ দিয়ে বললেন-করিম, ওদের তবলা শেখানোর স্টোরিটা বল। এক ইউরোপিয়ান মেয়েকে তুমি যে তবলা শেখালে…করিম ভাইয়ের তবলা শেখানোর গল্পটিও হাসতে আমাদের চোখে পানি চলে এসেছে। আসলে এ রকম মজা করে আমাদের চাইছিলেন। দিদার ভাই এবং ভাবির লেখী? রাজপুরুষ হুমায়ূন আহমেদের এক্সাইটেড ছিলেন যে মাঝে র। গল্প শুনে হাসতে ইনক পরে বুঝেছি-স্যার ঙ্গে সম্পর্কটা সহজ করতে তাঁরা রূপকথার বসে আছেন। সখি ভাবি এতই নিজের আঙুল টিপে পরীক্ষা করে দেখছিলেন এ দৃশ্য কতটায়ে দিদার ভাই সখি কে মাছের কাঁটা বেছে খাইয়ে দিচ্ছেন, স্যার মুগ্ধ হয়ে এ দৃশ্য দেখছেন। তিনি সখি ভাবিকে জিজ্ঞেস করলেন-মাছ ভাজা কেমন হয়েছে? দিদার ভাই বললেন-খুব ভালো হয়েছে স্যার। -তুমি তো আর খাচ্ছ না। খাচ্ছে তোমার বউ, ভালো-মন্দ তুমি বুঝবে কী করে! সখি ভাবি বললেন না স্যার, ওর মাছটা আগেই খেয়ে ফেলেছে, আমারটাই আমি খাচ্ছি। আমার কাঁটা বাছতে সমস্যা হয় বলে ও বেছে দিচ্ছে। স্যার ওদের উদ্দেশে বললেন-বাঃ তোমাদের এই টেকিং-কেয়ার, ভালবাসাবাসির দৃশ্য দেখে আমি সত্যি খুব আনন্দিত। ক’বছর হল তোমাদের বিয়ে হয়েছে?

পৃষ্ঠা:২৯

দিদার ভাই বললেন-দশ বছর। -ছেলেমেয়ে? -দুজন। এক ছেলে আর এক মেয়ে, স্যার!-বাঃ কী সুন্দর সুখের সংসার তোমাদের, শুনে খুবই খুশি হলাম। -জি স্যার, দোয়া করবেন। -দেখে বড় ভালো লাগল, বিয়ের দশ বছর পরেও তোমাদের ভালবাসাবাসি এত পোক্ত আছে। বউকে তুমি এখনো কাঁটা বেছে মাছ মুখে তুলে দিচ্ছ-এ দৃশ্য দেখে আমি মুগ্ধ, অনেকদিন এরকম সুন্দর দৃশ্য আমার চোখে পড়ে নি। স্যারের প্রশংসা শুনে দিদার ভাই সখি ভাবি দুজনেই আহ্লাদে গদগদ। স্যার একটু থেমে বললেন-বিয়ের দশ বছর পর স্বামী স্ত্রীকে কাঁটা বেছে মাছ খাইয়ে দিচ্ছে দৃশ্যটি বড়ই রোমান্টিক… বুই -ভেরি আনইউজুয়াল। বিয়ের দশ বছর পর ভালবাসা কাঁটা বেছে দেব পর্যায়ে থাকে না। ডাল মে কুচ কালা হ্যায়। স্যারের জানা একমাত্র হিন্দি শব্দ- ভাই আর সখি ভাবির মুখ শুকিয়ে। আহমেদের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা তা জানার কথা না আজ সকালেও ওরা জস্ট্রিতেন না ‘মে কুচ কালা হ্যায়’ শুনে দিদার । আমিও ভীষণ অবাক হলাম হুমায়ূন টেস্ট। ‘ডাল মে কুচ কালা’ থাকলেও ওনার এবং সখি ভাবি এখানে পুরোপুরি স্ট্রেঞ্জার। না নুহাশ পল্লীতে এসে মাছ ভাজা খাবেন। ওঁদের আচরণও আমার কাছে সুখি দম্পতির মতো স্বাভাবিক বলে মনে হয়েছে। সাইকোলজির কোন ফর্মুলায় ফেলে হুমায়ূন আহমেদ তাঁদের মধ্যকার নটঘটের ব্যাপারটা আঁচ করেছেন সেটা আমার কাছে এক রহস্য। আমি দেখলাম-হুমায়ূন আহমেদ নয়, আমাদের সামনে যেন বসে আছেন মিসির আলি। মিসির আলি তাঁর বুদ্ধিমত্তা আর লজিক দিয়ে অনেক জটিল সমস্যার সমাধানের পথ বাতলে দেন। মিসির আলিকে এত কাছে পেয়ে দিদার ভাই এবং সখি ভাবির সমস্যাটা চেপে যাওয়া ঠিক হবে না। আমি স্যারকে সব খুলে বললাম-গত এক বছর ধরে ওনারা দুজন দুই বাচ্চাকে নিয়ে আলাদা বসবাস করছেন এবং তাঁদের সম্পর্কটা ডিভোর্স পর্যন্ত গড়াবার উপক্রম…

পৃষ্ঠা:৩০

আমার কথা শুনে হুমায়ূন আহমেদ বললেন-আমি যা ভেবেছিলাম পরিস্থিতি দেখছি তার চেয়েও ভয়াবহ। বল দেখি কী তোমাদের সমস্যা? একান্ত ব্যক্তিগত বলে করিম ভাই আর স্বাধীন বাইরে চলে গেল। দিদার ভাই আর ভাবি আমাকে জোর করে আটকে রাখলেন। আমি বসে বসে মিসির আলির একটা জটিল সমস্যা সমাধানের প্রক্রিয়াটা দেখলাম। প্রায় ঘণ্টাখানেক আলোচনার পর হুমায়ূন আহমেদ ফাটলধরা দম্পতিকে জোড়া লাগানোর কয়েকটা টিপ্‌স্ বাতলে দিলেন। আর বললেন ফর দ্য সেক অব ইয়োর চিল্ড্রেন ডোন্ট ইভেন থিংক অ্যাবাউট ডিভোর্স…চারটা বেজে গেছে। বাবুর্চি এসে তাড়া দিচ্ছিল লাঞ্চের জন্যে। লাঞ্চ শেষ করে স্যার বিশ্রাম নিতে চলে গেলেন। স্বাধীনের চেনা এক পিকনিক পার্টি এসেছে, তারা আমাদের ধরে নিয়ে গেল ওদের গানবাজনার অনুষ্ঠানে। স্বাধীন লম্বা মতো একটা পরচুলা লাগিয়ে বাউলুম্যে লিডিং গায়ক, আমি আর করিম ভাই তার চেন শুরু করে দিল, সে আসর জমে গেল। ফাটলধরা দম্পতি হাতে হাত ধরে দেখে বেড়াচ্ছেন, দূর থেকে মনে হচ্ছে সদ্য প্রেমে পড়া কোনো যুক্তটি অনুষ্ঠান শেষ হতেই পিকনিকের ছেলেমেয়েরা স্বাধীনের অটোগ্রাফ আডড্ডায় কেটে গেল মহদিচ্ছ, ছবিও আমাদের টা তুলছে পালা করে। গানে- টা রঙিন বিকেল। ডিআমরা যখন প্রকৃতিতে সব পাখি ঘরে ফেরার মতো নিস্তব্ধতা। আমরা সবাই একটা মাইক্রোবাসে একসঙ্গে ঢাকায় ফিরছি। হুমায়ূন আহমেদ বসেছেন ড্রাইভারের পাশের সিটে। মিউজিক প্লেয়ারে বাজছে স্যারের লেখা গান- ও আমার উড়াল পঙ্খিরে যা যা তুই উড়াল দিয়া যা আমি থাকবো মাটির ঘরে আমার চোখে বৃষ্টি পড়ে তোর হইবে মেঘের উপরে বাসা… তখন বুঝি নি এই উড়াল পঙ্খিটা আমাদের আত্মা, আমাদের প্রাণ। দুঃখী লেখকের জীবনদেবতার কাছে এক ধরনের হাহাকার।

পৃষ্ঠা ৩১ থেকে ৪

পৃষ্ঠা:৩১

হুমায়ূন আহমেদের একটি অপছন্দের বিষয় ছিল ফোনে কথা বলা। তাঁর মুক্তি ছিল-যে মানুষটার সঙ্গে আমি কথা বলছি তার মুখ দেখা দরকার, বুঝতে হবে আমার কথাগুলো সে কীভাবে নিচ্ছে! জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর জন্যে পরিচিত কেউ ফোন করলেও তিনি শুকনো মুখে বলে যেতেন-কেমন আছেন ভাই, ভালো? জি আমি ভালো আছি…ভালো থাকবেন… সুখে থাকবেন…। ব্যস, এই হল তাঁর ফোনে কথা বলার অতি পরিচিত ভঙ্গি। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া স্যার কাউকে বিশে ফোন করতেন না। একদিন সন্ধ্যায় শাওন ভাবির ফোন-খোকন ভূতে কেমন আছেন? আপনার স্যার একটু কথা বলবেন…ওপাশ থেকে স্যারের গলা- বলে নিই। তুমি নিশ্চয়ই কথা শুনেছ… সম্ভবত টিউবী রিমুভ কেন শোন, জরুরি কাজের কথা আগে কাছ থেকে চ্যালেঞ্জারের ব্রেন টিউমারের করতে সার্জারির দরকার হতে পারে। তুমি তাকে যতটুকু পার সাহায্য করবে। নিশ্চয়ই স্যার…গুড… চ্যালেঞ্জার হল বাংলাদেশের ওয়ান অব দ্য ফাইনেন্ট অ্যাক্টর্স। উড়ে যায় বকপক্ষীতে পাগলের ভূমিকায় ওর অভিনয় তো তুমি দেখেছ…এ রকম একজন অ্যাক্টরকে হারিয়ে যেতে দেয়া যায় না। সিঙ্গাপুরের চিকিৎসা করা খুবই ব্যয়বহুল। তবু আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করব, প্রয়োজনে প্রাইম মিনিস্টারকে ধরব…

পৃষ্ঠা:৩২

…শোন, মানুষের সবচেয়ে সেনসিটিভ জায়গা হল ব্রেন, হেড অফিসে গণ্ডগোল হলে মানুষ বাঁচে না। আমার ধারণা সার্জারি হলে চ্যালেঞ্জার বাঁচবে না, কিন্তু তাকে এ কথা বলা যাবে না। আমাদের চেষ্টা করতে দোষ কী? মেডিকেল সাইন্স এখন অনেক দূর এগিয়েছে। লিভার, কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট এখন ডাক্তারের কাছে ডালভাত। -আমি জানি তুমি খুব ব্যস্ত থাক। তবুও যতটুকু পার ওদের খোঁজখবর নেবে, এটা আমার অনুরোধ। আর আমি চ্যালেঞ্জারের চিকিৎসার জন্য ১০ লাখ টাকা দিতে চাচ্ছি, তুমি এর সমপরিমাণ ডলার তাকে দেবে। ওরা আজ রাতে রওয়ানা হচ্ছে। ডলারটা কাল সকালেই লাগবে, তুমি কি ওদের দিতে পারবে? আমি স্যারকে আশ্বস্ত করে বলি-কোনো সমস্যা নেই, কাল সকালেই পাবে। সকালে গ্ল্যানিগেলস হাসপাতালে গিয়ে টিমতি লি’র চেম্বারে চ্যালেঞ্জার ভাই আর বৃর্ণ সাথে আগে কখনো দেখা হয় নি, তবু মনে রো প্রোপ্তি নিওরোবিশেষজ্ঞ ভাই ববি বসে আছেন। আমার যেন অনেক দিনের চেনা। ওল্ড ফুলস ক্লাবের আড্ডায় চ্যালেঞ্জার প্রসঙ্গ এসেছে। মূলত নাটক দিয়েই তাঁকে চেনা উড়ে যায় বকপক্ষীতে পাগলের ভূমিকায় চ্যালেঞ্জার ভাইয়ের অভিনয় হলিউডের ‘রেইনম্যান’- অসাধারণ। তাঁর অভিনয় দেখলে আমার অস্কার পাওয়া অভিনেতা ডাস্টিন হফম্যানের কথা মনে পড়ে। রেইনম্য ডাস্টিনের অভিনয় দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই যে, তিনি আসলে একজন প্রতিবন্ধী নন।নির্দিষ্ট দিনে সার্জারি হয়ে গেল। ব্রেনে দুটো টিউমার ছিল। ডাক্তার একটিকে রিমুভ করতে পারলেন, অন্যটি পারেন নি। ওটা সরাতে গেলে জীবন সংশয়ের আশঙ্কা আছে বলে ডাক্তার সার্জারি করেন নি। টিউমারটি ছিল ক্যান্সারাস, নিয়মিত রে দিতে হবে যাতে ক্যান্সার সেলকে আটকে রাখা যায়। ভালো হতে অনেক সময় লাগবে বলে ভাবি একটা বাসা ভাড়া করলেন। রে দিয়েও অবস্থার তেমন উন্নতি হল না। দ্বিতীয় টিউমারটি বাড়তে শুরু করায় চ্যালেঞ্জার ভাইয়ের কথাবার্তা বন্ধ হয়ে গেল। অনেক কথা বলতে চান, কিন্তু বুঝিয়ে বলতে পারেন না বলে নিজের ওপর রাগ করেন। হুমায়ূন

পৃষ্ঠা:৩৩

আহমেদের বই নিয়ে ফ্ল্যাপের ছবির দিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকেন। চোখ বেয়ে টপ টপ করে পানি পড়ে। একদিন সকালে ভাবি আর চ্যালেঞ্জার ভাইয়ের ছোটভাই হন্তদন্ত হয়ে আমাদের অফিসে এসে হাজির। ব্যাপার কী জিজ্ঞেস করতেই ভাবি বললেন- সকালে সবাই যখন ঘুমিয়ে ছিল তখন চ্যালেঞ্জার কাউকে কিছু না বলে বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে। সাধারণত প্রতিদিন সকালে চ্যালেঞ্জার তাঁর ছোটভাইকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে বের হন। কিন্তু আজ সকালে একাই বেরিয়ে গেছেন। সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজাখুঁজি করার পর চ্যালেঞ্জারকে না পাওয়ায় ওঁরা বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছেন। দুশ্চিন্তা হবারই কথা-চ্যালেঞ্জার কোথাও হারিয়ে গেলে কাউকে বুঝিয়ে বলতে পারবেন না কী তাঁর পরিচয়, কোথায় থাকেন। তার ওপর আবার সকাল থেকে নাস্তা নেই, ওষুধ নেই। প্লেট-গ্লাস ছুড়ে মারেন। দু’দিন আগে নাকি খুবই চিফলেছেন। এরকম একজন মানুষ খুবই ব্যাপার। দরি হলে ইদানীং রাগে কারণে আছাড় মেরে টিভি দশ-বিভুঁইয়ে হারিয়ে গেলে আমরা প্রথমে পুলিশ স্টেশদে হাসপাতালগুলোতে খোঁজ 303 হাসপাতাল এবং আশপার কোনো হদিস লাম। এরকম ঘটনায় পুলিশ প্রথমেই ইলিশ আমাদের বসিয়ে রেখে সবগুলো পুলিশ স্টেশনে খোঁজ করল, কিন্তু কোথাও ঠিক হল চ্যালেঞ্জার ভাইয়ের চেহারার বর্ণনা দিয়ে এফএমের স্টেশনগুলোতে ঘোষণা দেয়া হবে, যদি কারো চোখে পড়ে থাকে। ঝর্ণা ভাবি ক্রমাগত কেঁদেই চলেছেন। বাসার আশপাশের অলিগলিতে তিনি সকাল থেকে হন্যে হয়ে খোঁজাখুঁজি করে ক্লান্ত। তাঁকে বাসায় রেখে আমরা আবার খুঁজতে বের হলাম। আমাদের সঙ্গে যোগ দিল এন্ড্রু নামে এক চাইনিজ ভদ্রলোক। এন্ড্রু চ্যালেঞ্জার ভাইয়ের পারিবারিক বন্ধু, সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাকালীন নানাভাবে তিনি তাঁদের সাহায্য করেছেন। আমরা এন্ড্রুর গাড়িতে করে বাসার আশপাশের গলিগুলোতে আবার খুঁজে দেখছি। তিনটার দিকে ভাবির ফোন-চিৎকার করে তিনি বলছেন, ‘চ্যালেঞ্জারকে দেখা যাচ্ছে, পাশের এক বাড়িতে চ্যালেঞ্জারকে দেখা যাচ্ছে।’

পৃষ্ঠা:৩৪

আসলে ঘটনা হল চ্যালেঞ্জার পথ ভুল করে পাশের এক কন্ডোতে ঢুকে গেছেন, সিকিউরিটি গলিয়ে তিনি কীভাবে যে বিশাল কন্ডোতে ঢুকলেন সেও এক বিস্ময়! সেখানকার টেনিস কোর্টের বেঞ্চিতে দুর্বল শরীর নিয়ে শুয়ে ছিলেন, কড়া রোদের তাপে ঘুম ভাঙতেই উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছিলেন আর বারবার পড়ে যাচ্ছিলেন। ভাবি তাঁর সাত তলার বাসা থেকে এ দৃশ্য দেখে ফোনে চিৎকার করে আমাদের ডাকছেন। সবাই মিলে দ্রুত কন্ডোতে ঢুকে চ্যালেঞ্জারকে উদ্ধার করা হল। আমি বহু মানুষের আবেগময় দৃশ্য দেখেছি কিন্তু চ্যালেঞ্জারকে খুঁজে পাবার পর পারিবারিক পুনর্মিলনের এমন চমৎকার দৃশ্য আর দেখি নি। হুমায়ূন আহমেদ বলতেন-চ্যালেঞ্জারের অশ্রু গ্ল্যান্ডে মনে হয় কোনো সমস্যা আছে, সে কারণে-অকারণে চোখ থেকে এক থেকে দেড় লিটার পানি ফেলতে পারে। স্যার বোধ হয় ঝর্ণা ভাবির কথা জানতেন না। দুজন মিলে দুই লিটার চোখের পানি ফেলল কান্নাকাটির পর্ব শেষ হতে চ্যালেঞ্জার লেঞ্জার এবং ঝর্ণা ভাবি আমার দিকে এমন অপরাধী চোখে তাকালেন, আমার বেশ মায়া নাটকের কথা মনে পড়ে গেল। জী মুহূর্তেই ‘উড়ে। মানুষকে নানাভাবে বিরক্ত করার পাটকে বাংলাদেশে যাবার গেছি। চ্যালেঞ্জার যায় বকপক্ষী’ পাগলরূপী চ্যালেঞ্জার গ্রামের কের অপরাধী মুখ করে তাকিয়ে থাকেন। দখিন হাওয়ায় ওল্ড ফুলস ক্লাবের আড্ডায় ভাই হারিয়ে গিয়েছিলেন ও বলে স্যার খুব বকাঝকা করলেন। কেন এরকম একটা মানুষকে আমরা ঠিকমতো দেখাশোনা করি নি। তারপর স্যার শুরু করলেন চ্যালেঞ্জার ভাইয়ের গল্প-শোন, আমরা চায়নায় একটা ট্যুরিস্ট বাসে উঠেছি গ্রেট ওয়াল দেখব। আমাদের দলে আছে শাওন, মাজহার, কমল আর চ্যালেঞ্জার দম্পতি। ট্যুরিস্ট বাস আমাদের নিয়ে গেল জেড এম্পোরিয়ামে, সেখানে কেনাকাটা শেষ করে আমরা আবার বাসে উঠলাম। ভাবলাম এবার বোধহয় গ্রেট ওয়াল দেখা যাবে। ঘন্টাখানেক চলার পর বাস এসে থামল আরেক দোকানে, সেখানে মুক্তার চাষ হয়। একজন মুক্তা বিশেষজ্ঞ মুক্তার ওপর নানারকম জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা করার পর বড় সাইজের একটা ঝিনুক তুলে আমাকেই প্রথম জিজ্ঞেস করল-বল এর ভেতর কয়টা মুক্তা? একটা ঝিনুকে একটাই মুক্তা থাকার কথা। আমি

পৃষ্ঠা:৩৫

বললাম একটা। সফরসঙ্গীরা আমাকে নানান বিষয়ে জ্ঞানী ভাবে। তারা মনে করল এটাই সঠিক উত্তর। সফরসঙ্গীদের মধ্যে শুধু চ্যালেঞ্জার বলল সতেরটা। তাঁর বোকামিতে আমরা সবাই যথেষ্ট বিরক্ত হলাম। ঝিনুক খোলা হল। ঝিনুক ভর্তি মুক্তা। মুক্তা গোনা হল এবং দেখা গেল মুক্তার সংখ্যা ১৭। আমি আমার এক জীবনে অনেক কাকতালীয় ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি। কিন্তু চ্যালেঞ্জারের এই কাকতালীয় ঘটনার ব্যাখ্যা আমি জানি না। স্যার আমাকে বললেন চ্যালেঞ্জারের এই চিকিৎসা, তাঁর হারিয়ে যাওয়া এবং নির্বাক হয়ে যাওয়া, এসব ঘটনা নিয়ে তুমি কিন্তু একটা ভালো গল্প লিখতে পার। আমি তোমাকে কিছু টিপস্ দিচ্ছি… গল্প নির্মাণ এবং লেখালেখির জন্যে স্যারের টিপসগুলো আমার জন্যে ছিল এক বড় পাওয়া। আড্ডার মধ্য দিয়ে গল্প নির্মাণের আরো জানতে পেরেছি। অনেক কিছু স্যারের কাছ থেকে একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা আগে স্যার আমাকে জিজ্ঞেস ফেস্টিভালে বাংলাদেশের ছবি প্রদর্শ হবে। একদিন আড্ডার -তোমাদের সিঙ্গাপুর ফিল্ম কেমন হল? আমি বললাম-ভালো হয় -ছবির গল্পটা কিন্তু টে মিসের উপন্যাস থেকে নেয়া। পরিচালকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল? -জি স্যার, দেখা হয়েছে। -পরিচালককে তোমার কোনো বই দাও নি? -দিয়েছি স্যার। -পড়ে কী বলল? -বলেছে কবিতাগুলো খুব ভালো হয়েছে। একে একে মাজহার, কমল, আলমগীর ভাই, এসআই টুটুল, প্রফেসর মনিরুজ্জামান, শেহেরী ভাই সবাই চলে এসেছেন, আড্ডা বেশ জমে উঠেছে। স্যার গল্প শুরু করলেন-একটা স্টোরি শোন খোকনকে নিয়ে। (আমি মনে মনে বললাম আজকে আমার খবর আছে) সিঙ্গাপুর ফিল্ম ফেস্টিভালে বাংলাদেশের এক বিখ্যাত পরিচালকের ছবি দেখাল। খোকন যাই হোক, ছবির

পৃষ্ঠা:৩৬

একে-তাকে ফোন করে, দিন-রাত খেটে, শো’র দিন প্রায় শ’দুয়েক লোক জড়ো করল। ছবিটি ওখানকার বোদ্ধা মহলে বেশ প্রশংসা কুড়াল। সেই পরিচালকের গৌরবে খোকনও বেশ আহ্লাদিত হল। পরিচালককে নানা জনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। সবাইকে পরিচালকের সঙ্গে ফটো তুলে দিচ্ছে। ভাবটা এমন যেন সে অ্যাসিস্ট্যান্ট ডাইরেক্টর। রাতে পরিচালককে ক্যান্ডেল লাইট ডিনার করাতে নিয়ে গেল সমুদ্রের ধারে সি ফুড সেন্টারে। সেখানে বড় বড় সব লবস্টার অর্ডার দেয়া হল, আড়াই কেজি ওজনের আলাক্সান হোয়াইট ক্র্যাব নেয়া হল একটা, যেটার দাম ৩৫০ ডলার। খোকন একটা দামি শ্যাম্পেন অর্ডার দেবে ভেবেছিল কিন্তু পরিচালকের পছন্দ জনি ওয়াকার। আমি বাধা দিয়ে বলতে চাইলাম না স্যার…শ্রীলঙ্কান ক্র্যাবের অত দাম না, আর জনি ওয়াকার…! স্যার আমাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়ে মাঝখানে কোনো কথা বলবা না, তোমার শুনব। তারপর কী হল মানুষ লেন-আরে রাখ, গল্পের ভিজানো কথা থাকলে আমরা পরে শোন তোম্বলটা জানই খোকন দরাজ দিলের ।। তার পকেটে ৪/৫টা ক্রেডি কার্ড থাকে, দু’চার হাজার ডলার তার কাছে হাতের ময়লা। পানাহার শেষে খোকন পরিচালকের হাতে চুপিচুপি একটা প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে পল-জনাব, এটা আমার লেখা একটি বই। অন্যপ্রকাশ থেকে মাজহারুল ইসলাম বের করেছেন। মাজহারের নামটা সে ইচ্ছে করেই বলল। কারণ অন্যপ্রকাশের মাজহার হাবিজাবি বই ছাপে না। পরিচালক বেশ আগ্রহ নিয়ে প্যাকেটটি খুলে বইটি নেড়েচেড়ে বলল, বাঃ নামটি তো বেশ চমৎকার-সন্ধ্যার মেঘমালা, কাভারটাও সুন্দর হয়েছে। কে করেছে? খোকন লাজুক ভঙ্গিতে বলে-ধ্রুব এষ। পরিচালক বললেন- বাঃ শুনেছি ধ্রুব এষ হুমায়ূন আহমেদ ছাড়া অন্য কোনো হেঁজিপেজি লেখকের প্রচ্ছদ করে না। তোমারটা করেছে, ভেরি গুড। বইটি আমি খুবই আগ্রহ নিয়ে পড়ব। খোকন বেশ আত্মশ্লাঘা অনুভব করে। একজন বড় মাপের পরিচালককে নিজের বই দিতে পেরেছে। একদিন দেখা যাবে পরিচালক তার নতুন ছবির শট নিচ্ছে-সেখানে নায়িকা সোফায় গা এলিয়ে বই পড়ছে, লং শটে

পৃষ্ঠা:৩৭

দেখানো হবে নায়িকার হাতে যে-বইটি ধরা তার নাম ‘সন্ধ্যার মেঘমালা’। আনন্দের আতিশয্যে তার রাতে ঠিকমতো ঘুম হল না।… স্যার একটু দম নেন। কমল জিজ্ঞেস করল-তারপর কী হল? …পরিচালক আরো চার দিন সেখানে ছিলেন। প্রতি রাতেই ভালো ভালো রেস্টুরেন্টে ডিনার খাওয়া হচ্ছে। নাৎসি-জার-কার্ল মার্কস-টলস্টয়, হাসিনা-খালেদা-জিয়া-শেখ মুজিব ইত্যাদি নানা বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে কিন্তু পরিচালক খোকনের বইটি নিয়ে কোনো কথা বলছেন না। সে প্রতিদিন আশায় বুক বেঁধে থাকে, আজকেই বুঝি-বা সেই শুভক্ষণ-পরিচালক নিশ্চয়ই বইটি নিয়ে আজ কিছু বলবেন। কিন্তু শুভক্ষণ আর আসে না। পরিচালক কালই চলে যাবেন। শেষে লজ্জার মাথা খেয়ে দুরুদুরু বক্ষে খোকন পরিচালককে জিজ্ঞেস করে-জনাব, আমার বইটা দেখার কি সুযোগ হাহোছিল? উনি অবাক দৃষ্টিতে খোকনের দিকে তাকিয়ে বললেন-কোন খোকন লাজুক হেসে বলে-সেই যেও যে আমার লেখা একটি বই দিলাম… – দিন ডিনার শেষে আপনাকে ও হ্যাঁ মনে পড়েছে…তোমুক্ত ০ খোকন মনে করিয়ে দেয় সন্ধ্যার দুইটা তো, কী যেন নাম… মেঘমালা… -হ্যাঁ হ্যাঁ মনে তোমার কাব্যগ্রন্থটি… প্রথম কবিতাটা তো অত্যন্ত উৎকৃষ্ট রচনা। এটার একটা মৌলিক বিষয় হল মেঘ-পাহাড়-সমুদ্রকে তুমি এক সমান্তরাল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখেছ। ম্যাক্সিমাম কবির লেখাতেই কিন্তু প্রকৃতির এসব চিত্র উঠে এসেছে আলাদাভাবে। কিন্তু তুমি বলেছ প্রকৃতিতে আলাদাভাবে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই, সবই একই সূত্রে গাঁথা। তোমার আর একটি কবিতা সম্ভবত ছ’ কি সাত নাম্বার কবিতাটা হবে, বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে লিখেছ। ওটার মধ্যে বেশ কিছু বকা ঢুকিয়েছ দেখলাম…এটা কখনো করবে না। শামসুর রাহমান ‘এই মাতোয়ালা রাইত’ কবিতাটা লিখেছেন, কিন্তু ওটা কি কখনো কাউকে আবৃত্তি করতে দেখেছো? কবিতাটা নিয়ে তাঁর নিজেরও অস্বস্তি ছিল। কবিতায় বকাঝকা আসলে নেয়া যায় না, সাহিত্যের সব শাখার মধ্যে সবচেয়ে উচ্চ মার্গের জিনিস হল কবিতা।…

পৃষ্ঠা:৩৮

…তবে তোমার শেষ কবিতাটার কথা না বললেই নয়। কবিতাটির শিরোনাম বোধহয় তোমার বইটির নামেই… সন্ধ্যার মেঘ এরকম কিছু একটা…সত্যি কথা কি অনেক দিন এরকম ভালো কবিতা পড়ি নি। তুমি অমিতাভ ঘোষের লেখা পড়েছ? উনি মূলত ইংরেজিতে লেখেন। তাঁর একটা বিখ্যাত উপন্যাস আছে দ্য শ্যাডো অব দ্য উইন্ড। তোমার কবিতাটায় সে উপন্যাসের ছায়া আছে। গল্প-উপন্যাস লেখাটা কঠিন কোনো ব্যাপার না, অনেকটা ডায়েরি লেখার মতো। কিন্তু কবিতা ভিন্ন জিনিস। কাব্যচর্চা একটা বিরাট সাধনার ব্যাপার। তোমার হাত ধরে কবিতা একটা নতুন যুগের ঠিকানা পাবে এই আমার আশাবাদ।… পরিচালকের প্রশংসা শুনে খোকনের চোখে পানি এসে গেল। আনন্দে নয় দুঃখে। সবাই উৎসুক হয়ে কারণ জানতে চায়, আর্দ্রী হল, খোকন পরিচালককে যে কেন? স্যার বলেন-চোখে পানি আসার কা বইটি দিয়েছিল সেটি ছিল গল্পের বই লেখে নি। মধ্যে দুঃখ আসবে মেনে সে কখনো এক লাইন কবিতা সবাই হা হা করে হাসছে।

পৃষ্ঠা:৩৯

সেপ্টেম্বর চার, ২০১১। মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতাল থেকে হাসানের ফোন পেলাম, ভয়ার্ত গলায় সে বলছে-ভাই তাড়াতাড়ি হাসপাতালে আসেন… আমি জিজ্ঞেস করি-ব্যাপার কী? স্যারের ব্লাড রিপোর্টে অ্যাবনর্মালিটি ধরা পড়েছে। এখন আবার সিটি স্ক্যান করাতে হবে। অ্যাবনর্মালিটি মানে কী? বুঝিয়ে বল। আপনি প্লিজ হাসপাতালে আসেন, তারপর বুঝিয়ে বলছি। হাসান সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাতে তালে চাকরি করে, বাঙালি ইন্টারপ্রেটর। গতকাল ওখানে স্যারের একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল কার্ডিওলজিস্ট ফিলিপ কো’র সঙ্গে, বছর আগে ফিলিপ কো হুমায়ূন আহমেদ আর তাঁর মায়ের সার্জারি করেছিলেন। । মাঝখানে স্যার একবার ফলোআপে এসেছিলেন তখন হার্টের অবস্থা বেশ ভালো ছিল, এখনো মন্দ নয়। । কিন্তু স্যারের টুলের সঙ্গে ব্লাড যাচ্ছে শুনে গতকাল ফিলিপ কো তাঁকে রক্ত পরীক্ষা করতে দিয়েছেন। আজ স্যার আর শাওন ভাবি রেজাল্ট আনতে গেছেন, সকালেই আমি তাঁদের হাসপাতালে নামিয়ে দিয়েছি। হাসান টেস্টের রেজাল্ট ফোনে জানাতে চাচ্ছে না। অজানা আশঙ্কায় আমার মন কেঁপে ওঠে। হুমায়ূন আহমেদের ডাক্তার-ভীতি বেশ প্রবল। কখনোই তিনি ডাক্তার দেখাতে চাইতেন না। ডাক্তারের নাম শুনলেই আঁতকে উঠতেন, শিশুদের যেমন ইনজেকশন-ভীতি ওনারও তেমন ডাক্তার-ভীতি।

পৃষ্ঠা:৪০

ঢাকায় গেলে তাঁকে অনেক বার বলেছি সিঙ্গাপুরে এসে একটা থরো চেকআপ করাতে, তিনি ব্যঙ্গ করে বলেছেন-‘আরে রাখ তোমার ডাক্তার… আই এম অলরাইট, তোমাদের সিঙ্গাপুরের ডাক্তারগুলি মহাবদ, গেলেই একগাদা টেস্ট-ফেস্ট ধরিয়ে দেয়, ব্যাটারা মানুষের গলা কাটার জন্যে সব সময় ছুরি শান দিয়ে বসে আছে। আমার আর আম্মার বিল করেছে এক লাখ ডলার…বদের বদ।’ হুমায়ূন আহমেদের কথার ওপর কথা বলে এমন সাধ্য কার! মানুষের জীবনটা বড়ই অনিশ্চিত! এই গতকাল পর্যন্ত স্যারের সঙ্গে আমাদের কী আনন্দঘন সময় কেটেছে… কাল সন্ধ্যায় আমরা স্যারের সৌজন্যে সমুদ্রের ধারে ইস্ট-কোন্ট পার্কে একটা বারবিকিউ পার্টির আয়োজন করেছিলাম। স্যারের পরিবার, শ্বশুর-শাশুড়ি আর এখানকার বাঙালি সোসাইটির কিছু বন্ধু-বান্ধব এসেছিলেন তাঁদের পরিবার-পরিজন নিয়ে। চিকেন, মাটন আর’ চিংড়ির পোড়া গন্ধে বাতাস সুস্থ করছিল। সবার সঙ্গে পরিচয়পর্ব শেষে স্যার প্রথমেন্ট বলেন তোমরা কি সবাই ইরানি মেয়ে বিয়ে করছ নাকি? আমি বললাম-না স্যার, সবাই। ঙালি! সব মেয়েদের মাথায় দেখছি। দশ বছর আগে তোমাদের স্ত্রীদেরতো এ রকম দেখি নি! ইমতো সিকিউর সোসাইটিতে বাস করে তোমাদের মেয়েরা আইয়ামে জাহেলিয়া যুগের হিজাব নিয়েছে। ডাইনে-বাঁয়ে যেখানেই তাকারি পাইপাসেই একটা বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছ! আমি সভয়ে বলি-স্যার চল্লিশ পেরুলেই প্রবাসী বাঙালি এক ধরনের আত্মপরিচয়ের সংকটে ভোগে, এ থেকেই কেউ-বা অতি ধার্মিক অথবা অতি বিদেশী বনে যাবার চেষ্টা করে। কথাটা খারাপ বল নি। আমার মেয়ে নোভা আমেরিকায় গেল পিএইচ. ডি. করতে, পড়াশুনা শেষ করে ফিরে এল হিজাব নিয়ে। মা হিজাবের ধারেকাছে নাই অথচ মেয়ে হিজাব নিয়ে বসে আছে। কী আর করা যাবে। যে যেভাবে স্বস্তি পায় পাক। খাবার মুখে দিয়ে স্যার বললেন-এ-তো দেখছি অতি অখাদ্য খাবার, ফার্মের মুরগি হল পৃথিবীর অতি অখাদ্যের একটি। আর কী আছে বল।

পৃষ্ঠা ৪১ থেকে ৫

পৃষ্ঠা:৪১

আমি সভয়ে বলি-স্যার আর আছে চিংড়ি, বিফ স্টেক। বিফ আনো, খেয়ে দেখি কী অবস্থা, পোড়া চিংড়িও আনো… একটা স্টোরি শোন-আমেরিকায় এক বাসায় গেছি দাওয়াত খেতে, গৃহকর্ত্রীর ওজন হবে মাশাল্লা দেড় শ কেজি। মাছ-মাংস-ভর্তা-ভাজি মিলিয়ে উনি নিজ হাতে ১৮ পদ রান্না করেছেন। চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল মহিলা সারা দিন বেশ খাটাখাটনি করেছেন। কিন্তু খেতে গিয়ে পড়লাম বিপদে, যেটাই মুখে দেই সেটাই দেখি অতি অখাদ্য। চিংড়ি মাছ রান্নার জন্যে কোনো প্রতিভার দরকার হয় না, সে চিংড়ি মাছও হয়েছে জঘন্য। এমন বাজে রান্না করার জন্যেও বিশেষ প্রতিভার দরকার। আমি কেবল ডিম ভুনা আর ডাল দিয়ে ভাত খেলাম, অতি সুস্বাদু রান্না। খাওয়া শেষ হলে মহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম-ডিম ভুনা আর ডালটা কে রান্না করেছে? মহিলা ভীত কণ্ঠে বললেন-আমার হাসছে করেছে, বাকিগুলো আমি করেছি। দু-টাই কেবল সে রান্না আপনার বাসায় কি প্রতিদিন আগ মহিলা আমতা-আমতা করে। হাসবেন্ড রান্নাবান্না করেন? অ্যাসিস্ট্যান্ট, সকালে বেরিয়ে ও এসে রান্নাবান্না করে। -জি স্যার, আমি একটা ক্লিনিকের হয়, ফিরি রাতে। বিকেলে অফিসশেষে আমি গম্ভীর হয়ে বললাম-আপনার হাসবেন্ডের রান্নার হাত ভালো, সে মজার মজার রান্না করে আপনার বারোটা বাজিয়েছে, রান্নার ব্যাপারে আপনার প্রতিভাকে উনি প্রায় জিরো পর্যায়ে এনে দাঁড় করিয়েছেন। আমার কথা শুনে ভদ্রমহিলার বেশ মনখারাপ হল। তাঁর মুখ দেখে আমারও খারাপ লাগল, মুখের ওপর এ রকম কথা বলাটা ঠিক হয় নি। আমি তাঁকে রান্নার একটা বই উপহার দিলাম। অনেক বছর পর আমেরিকা গিয়ে আবার তাঁর বাসায় গেলাম। এবার উল্টো দৃশ্য… স্যারের সঙ্গে নানা গল্প-আড্ডায় কাল সন্ধেটা আমাদের চমৎকার কেটেছে। কিন্তু হাসানের ফোন পেয়ে বেশ টেনশন লাগছে। কী এমন ব্যাপার যা ফোনে বলা যাচ্ছে না! স্যার কি জটিল কোনো ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছেন?

পৃষ্ঠা:৪২

আমি দ্রুত হাসপাতালে ছুটে গেলাম। পরিস্থিতি বেশ থমথমে। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছি না যদি খারাপ কোনো খবর শুনতে হয়। শাওন ভাবির চোখের পাতা ভেজা, ইতোমধ্যে নিশ্চয়ই অনেকবার কেঁদেছেন। আমরা কেউ কারো মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। সিটি স্ক্যানের রিপোর্ট এসে গেছে, সবাই ডাক্তারের চেম্বারে গেলাম। ডাক্তারের রুমে আমি, শাওন ভাবি, স্যার আর হাসান। এক্স রে আর সিটি স্ক্যানের ছবি দেখে ডাক্তার করুণ মুখ করে বলে যাচ্ছেন স্যারের ক্যান্সার এখন স্টেজ ফোর, এই মরণব্যাধি প্যানক্রিয়াস থেকে লিভারে ছড়িয়ে পড়েছে। দ্রুত চিকিৎসার উদ্যোগ না নিলে দুই থেকে ছ’মাসের মধ্যেই পেশেন্ট কলান্স করবে। শাওন ভাবির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা। যেন তাঁর পায়ের তলা থেকে দ্রুত মাটি সরে যাচ্ছে বুকের ভেতরে কান্নার ঝড়… নিজেকে তিনি সামলে রাখতে পারছে অবিশ্বাসের দোলা-সত্যিই কি তাঁর নির্বিকার! জা। আমার মনে বিশ্বাস- স্টেজ ফোর? কিন্তু স্যার আাইছে! আমার তো ঘণ্টা বেজে তাঁর প্রথম প্রতিক্রিয়া গেছে…দেশে গিয়ে আগাম পল্লীতে আট-দশটা গরু না নিজে উপস্থিত থেকে স্যা নির ব্যবস্থা করতে হয়, কী বল? নুহাশ দেব। গরুর মাংস আর ঘন মুগডাল থাকবে, হিঁকে দেখেশুনে খাওয়াব। মানুষ কুলখানি করে মৃত্যুর পরে…আহা, যে বেচারা মরে যায় সে তার আত্মীয়স্বজনকে দেখেশুনে খাওয়াতে পারে না! আমি মৃত্যুর আগেই কুলখানির ব্যবস্থা করব, রান্না থেকে খাওয়ানো অবধি সবকিছু নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তদারক করব… সাথে টক দইয়ের ব্যবস্থা রাখলে কেমন হয়? হজমে সুবিধা হবে… সিটি স্ক্যানের রেজাল্ট জানার জন্যে মাজহার ভাই বারবার ফোন দিচ্ছেন, কী করে তাকে এই দুঃসংবাদ দেব ভেবে পাচ্ছি না। এরকম ভয়াবহ দুঃসংবাদ শোনার মতো কারোরই মানসিক প্রস্তুতি নেই। ‘সত্যেরে লহ সহজে’ হুমায়ূন আহমেদ ক্যান্সারে আক্রান্ত, এরকম সত্য সহজভাবে নেয়া যায় না।

পৃষ্ঠা:৪৩
স্যার হঠাৎ কেমন চুপচাপহয়েগেছেন। আমিগাড়ি চালাচ্ছি, আমার হাত কাঁপছে।কেন এরকম হল? মানুষকে আনন্দ দেবার দায়িত্ব যিনি স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলেনিয়েছিলেন, তাঁকে কেন জরা স্পর্শ করবে? বিধাতা এত নিষ্ঠুর কেন? স্যার বললেন-এখনই বাসায় যাবার দরকার নেই, চল একটু নার্সারিতে ঘুরে আসি। টমসন রোডে প্রায় দুই কিলোমিটার জুড়ে অনেকগুলো নার্সারি আছে। এটি হুমায়ূন আহমেদের একটি প্রিয় জায়গা। যখনই তিনি সিঙ্গাপুরে এসেছেন দুটি জায়গায় তিনি অবশ্যই যাবেন। একটি হল বইয়ের দোকান, আরেকটি নার্সারি। বই আর গাছের প্রতি স্যারের ভীষণ আগ্রহ-শুধু আগ্রহ নয়, গাছপালার প্রতি এক ধরনের বিশেষ মমতা দেখেছি তাঁর। স্যার গতবার এসে বর্ডার বুক শপের মেম্বারও হয়েছেন। নুহাশ পল্লীর বাগানবিলাসে দুটো খুদে দস্যি। মধ্যে একটি ছেলের হাত ভেঙে গেছে, একটি। হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাপারটা সেটা একটা ভাস্কর্য। ওই ভাস্কর্যটির না আমরা তা খুঁজে দেখছি। নাম ওগুলো এখন আর তৈরি করছে গত বৈশাখে আমি লের ভাস্কর্য আছে-ওর ভাঙা হাত নিয়ে বাগানে কাছেপীড়াদায়ক,হোক না একই রকম কিছু পাওয়া যায় কি ছেলেদের ভাস্কর্যগুলো আর নেই, জি ওজনের একটা ভাস্কর্য নিয়ে গেছি নুহাশ পল্লীর জন্যে। স্যার বলেছে কিন্তু এটা নিয়ে বড্ড বিপদ! -তোমার এই স্বল্পবসনা নারীমূর্তিটি বেশ সুন্দর আমি জিজ্ঞেস করলাম-বিপদ কেন স্যার? আর বোলো না, ছেলেপেলে যারাই এখানে বেড়াতে আসে তারাই এই ভাস্কর্যটির সঙ্গেই ছবি তুলবে আর সুযোগ পেলেই গায়ে হাত দেবে। আরে গাধার গাধারা! গার্লফ্রেন্ড জোগাড় কর, তার হাত ধরে হাঁটাহাঁটি কর! তা না, মূর্তির গায়ে হাত দেবে! কেমন বেকুব চিন্তা করে দেখ! স্যার তিনটি গাছ পছন্দ করলেন, সবগুলোই ইনসেক্ট ইটার, পোকামাকড় খেয়ে বেঁচে থাকে। গাছগুলোর কোনোটার পাতা কিংবা ফুল হাঁ হয়ে থাকে-পোকামাকড় সেই হাঁ’র ভেতরে ঢোকামাত্রই গাছ তা খেয়ে ফেলে। এ কথা শুনে স্যার খুবই উৎসাহ দেখালেন। বললেনমশার উপদ্রব

পৃষ্ঠা:৪৪

কমাতে এ গাছ খুবই ইউজফুল, বাংলাদেশের প্রত্যেক বাড়িতে এ গাছ থাকা উচিত! গাছ অবশ্য তখন কেনা হয় নি, ছ’মাস পর স্যার যখন চিকিৎসার মাঝপথে কিছুদিনের জন্যে নিউইয়র্ক থেকে ঢাকায় ফিরে এলেন তখন তাঁকে একদিন ফোন করতেই আমাকে সে-গাছগুলোর কথা মনে করিয়ে দিলেন। আমি খুবই অবাক হয়েছিলাম তাঁর স্মৃতিশক্তি আর গাছের প্রতি আগ্রহ দেখে, আটটা কেমো থেরাপি নেবার পরও সেই গাছগুলোর কথা তিনি ভোলেন নি। সেই ইনসেক্ট ইটার গাছগুলো কি এখনো নুহাশ পল্লীর বাগানবিলাসে আছে? সকালে হাসপাতালে যাবার সময় নিনিতকে আমাদের বাসায় রেখে গিয়েছিলেন। স্যার বলেন-চল নিষাদকে নিয়ে তোমাদের বাসায় যাই, নিনিত নিশ্চয়ই কান্নাকাটি করছে। আমি ফোনে খবর নিয়েছি-নিনিত ভালোই কাছে, আমার মেয়ের সঙ্গে একগাদা খেলনা নিয়ে সে খেলতে বসেছে নিনিতকে ছেড়ে বেশিক্ষণ থাকতে পড়েন। মলে স্যার নিজেই নিষাদ- ওদের জন্যে অস্থির হয়ে আমার স্ত্রী রুমকীকে বললাম করবেন, তোমার আজ অগ্নিপত্র PO স্যারকে দেখে নিনিতে স্যার বাসায় আসবেন। রাতে ডিনার কে নিনিতকে খুশি। আমার কন্যার সাথে ইতোমধ্যে তার বেশ ভাব হয়েছে কিন্তু ব্যবৗকে দেখামাত্রই। সে বেশ চঞ্চল হয়ে উঠল, ভাব- ভালবাসা সব উধাও। স্যার নিনিতকে কোলে নিয়ে বললেন- আমার এই এক জীবনে অনেক তো পাওয়া হল, পরম করুণাময় আমার কোনো আশা- আকাঙ্ক্ষাই অপূর্ণ রাখেন নি। এখন এই অবুঝ শিশু দুটোর জন্যই আমাকে আরো কিছুদিন বাঁচতে হবে… স্যারের কথা শুনে শাওন ভাবির চোখ আবার ভিজে ওঠে। স্যার বললেন-মাজহারকে জানিয়েছ? আমি বললাম জি স্যার… -কখন জানালে? -আপনি যখন নিষাদকে আনতে অ্যাপার্টমেন্টে গিয়েছিলেন, তখন। -মাজহার শুনে কী বলল? কান্নাকাটি করেছে?

পৃষ্ঠা:৪৫

-এটা সবার জন্যেই একটা শকিং নিউজ স্যার। আরে শকিং নিউজ না ঘোড়ার ডিম, মাজহার কাঁদছে বইমেলায় বই পাবে না এই দুঃখে। সাহিত্যের ধারেকাছে সে নাই, সে বোঝে ব্যবসা… হিমু আর মিসির আলির টেনশনে সে এখন অস্থির।… আমি এম জাস্ট কিডিং, আমার সব রকম দুঃসময়ে মাজহার আমার পাশে ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে, সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছে সে। আমার কিছু হলেই মাজহার অস্থির হয়ে পড়ে… তোমার মনে আছে আমার আর আমার আম্মার বাইপাস সার্জারি হচ্ছে তোমাদের মাউন্ট এলিজাবেথ হসপিটালে? অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাবার আগে রাজ্যের আত্মীয়স্বজন এসে অন্য রোগীদের হাসিমুখে অভয় দিচ্ছে। আমাদের সাথে গুলতেকিন আর মাজহার ছাড়া কেউ নেই। এই বিদেশ-বিভুঁইয়ে দুই-দুইটা সার্জারির পেশেন্ট নিয়ে আছে সে। খাওয়ার ঠিক নেই, ঘুমের ঠিক নেই, টেনশনে জানিয়ে রাখি—আমি যদি ধরো হঠাৎ মারাতে দুটোকে দেখবে না…। এই মাজকে মাজহারকে একটু ফোন কর প্লিজকরা যাই কেউ এসে এই বাচ্চা এসে ওদের পাশে দাঁড়াবে। হ্যালো… মাজহার খবর শুনেছ… শোন, নুহাশ পল্লীতে একটা আগাম কুলখানির ব্যবস্থা । আট-দশটা নাদুসনুদুস গরু কিনে ফেল… গরু কেনার কমলকে দাও, সে ভালো বুঝবে। কোরবানির সময় সে ভালো গরু কেনে আর তুমি নিয়া আস সব বুড়া মার্কা গরু… গেছে… হি ইজ মোর দ্যান মাই ব্রাদার। কালো মুখ বেগুনি হয়ে মাকে একটা আগাম কথা মাজহার শোন, চিকিৎসা কিন্তু আমি সিঙ্গাপুরে করাবো না। ডাক্তারগুলো এখানে বেজায় বদ। সারাক্ষণ এদের মাথায় ঘুরছে টাকা বানানোর ধান্ধা। এদের দিয়ে সুচিকিৎসা হবে না… একটা স্টোরি শোন এখানকার পত্রিকায় এসেছে মাউন্ট এলিজাবেথের এক ডাক্তার ব্রুনাইয়ের সুলতানের কাজিনের ব্রেস্ট ক্যান্সারের চিকিৎসা করেছে। পাঁচ মাসে তার বিল আসছে ২৫ মিলিয়ন ডলার… ও মাই গড বোলো না। বল ‘ও আওয়ার গড’… গড তোমার একার না মাজহার। স্টোরি শেষ হয় নাই… ডাক্তারের একটা বিলের কথা শোন… ক্যান্সারের রুগি বাঁচার সম্ভাবনা নাই, সময় শেষ, ডাক্তার বলল- রুগি দেশে নিয়ে যাও ভালো-মন্দ যা খেতে চায় খেতে দাও… সেই মুমূর্ষু

পৃষ্ঠা:৪৬

রুগিকে ডাক্তার এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিতে এয়ারপোর্টে গেছে, সেদিন আর অন্য কোনো রুগি দেখা হয় নি। সেই এক দিনের জন্যে ডাক্তার চার্জ করছে চার লাখ ডলার! অন্য এক ডাক্তার চার লাখ ডলার ফি’র কথা শুনে কী বলেছে জান? বলেছে-চার লাখ ডলার নাকি বেশি হয়ে গেছে। তিন লাখ হলে ঠিক ছিল… দুইটাকেই চাবকানো দরকার কি না বলো?…তুমি আমেরিকায় খবর নাও ওদের ওখানে ক্যান্সারের চিকিৎসা ভালো… ….. খবর নিয়েছ? হাসপাতালের কী নাম আবার বলো… মেমোরিয়াল স্লোন কেটারিং… O. k. নিউইয়র্কে জলি আর আবেদীন আছে, ওদেরকে বলো একটা অ্যাপয়েন্টমেন্টের ব্যবস্থা করতে… আমরা পরশুদিন ঢাকা আসছি, ভিসার কোনো সমস্যা নেই, পাঁচ বছরের মাল্টিপল লাগানো আছে, তুমি দ্রুত টিকেটের ব্যবস্থা কর… রুমকী ভয়ে ভয়ে ডাইনিং টেবিলে খাবার নিনিতের দেখাশোনা করতে হয়েছে বলে আজ বিশেষ কিছু খাবারদাবারের ব্যাপারে খুবই খুঁতখুঁতে। N পারে নি। স্যার দিয়ে বলে দিতে পারেন মাছটা কি তাজা ছিল না মরা। খাবার বিলে কাঁচামরিচ, আচার, ঘি আর লবণ অবশ্যই থাকতে হবে। রুমকীর খাবারের মেনু ভাজা, চিংড়ি ভর্তা, বেগুন ও ARBO লেবুপাতা দিয়ে কাচকি মাছ, রুই মাছ কাম্পং চিকেন (মালয়েশিয়ার ঘরে-পালা মুরগি) আর বেশি করে লেপাতা দিয়ে ঘন ডাল। মুরগির মাংস প্রথমে সার্ভ করা হয় নি স্যার দেশী মুরগি ছাড়া খেতে পারেন না বলে। একটু পর স্যার বললেন-মাংস কোথায়? রুমকী ভয়ে ভয়ে মাংস বের করে দিল। স্যার বললেন, মাংসের চেহারা তো মাশাল্লা ভালো, দাও দেখি। আমি সভয়ে বললাম-স্যার এটা মালয়েশিয়ার দেশী মুরগি। আমাকে ধমক দিয়ে বললেন-আরে রাখ তোমার দেশী মুরগি, বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও দেশী মুরগি নাই, তবে মাংসটা ভালো। খাওয়া শেষ করে স্যার বললেন রুমকী, তোমার রান্নার হাত ভালো, তোমাকে ১০-এ ৮ দেয়া গেল, ২ নম্বর কাটা গেল কারণ ডালে লবণ সামান্য বেশি ছিল। আমাদের নবীজী কারো বাসায় দাওয়াত খেতে গেলে একটা

পৃষ্ঠা:৪৭

দোয়া পড়ে (…দোয়াটা মনে করতে পারছি না) বলতেন-‘তোমার ঘরে কোনোদিন যেন খাবারদাবারের অভাব না হয়’। আমি তোমার জন্য সেই দোয়াটা করছি, ডেজার্ট কী আছে বের কর। ডেজার্টের কথা শুনে রুমকীর মুখ শুকিয়ে গেল। ঘরে দই-মিষ্টি কিছুই নাই, কমপ্লিমেন্টে পাওয়া নাম্বার এখনই নিচে নেমে যাবে। রুমকীর সৌভাগ্য বলতে হয়! ফ্রিজ খুলে কয়েকটা ইয়োগার্ট পাওয়া গেল। দু’দিন পর স্যার বাংলাদেশে চলে গেলেন। সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা করাতে তিনি কিছুতেই রাজি হলেন না। সবাইকে নিয়ে এয়ারপোর্টে গেছি। বোর্ডিং পাস নেবার পর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতেই স্যার বুকে জড়িয়ে ধরলেন। ছোটবেলা থেকেই আমি পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত, অনেক দিন পর মনে হল আমি পিতৃস্নেহের আস্বাদ পেলাম, আরো মনে হল আমি বুঝি এই স্নেহের লোভেই বারবার ছুটে গেছি তাঁর কাছে। নি সেদিন, না একটু আশার কথা না ভালবাসার স্যার আপনি সুস্থ হয়ে যাবেন… ভালো হয়ে হ্বানো কথা বলতে পারি মনে মনে বলেছি- অবেন… চলে যাবার আগে স্যার বলার মাজহার স্লোন কেটারিং-এ যোগাযোগ করেছে, আমরা শীঘ্রই আমাকে দেখতে? চলে যাব, আসবে তো আমেরিকায় আমি ধরা গলায় বলল যাব স্যার… অবশ্যই যাব… বললো 

পৃষ্ঠা:৪৮

১৫ অক্টোবর ২০১১- স্যারকে দেখতে নিউইয়র্ক যাচ্ছি। সিঙ্গাপুর থেকে নিউইয়র্ক প্রায় ২৪ ঘণ্টা জার্নি। আমি নিয়েছি এমিরাটসের ফ্লাইট, দুবাইতে প্রায় ৩ ঘণ্টার যাত্রাবিরতি। এত সময় প্লেনে বসে থাকা এক ধরনের টর্চার, সবচেয়ে বড় সমস্যা হল ওয়াশরুম। ওয়াশরুমটা একটু পরিচ্ছন্ন একটু নির্ঝঞ্ঝাট না হলে স্বস্তি পাওয়া যায় না। দুবাইতে যাত্রাবিরতির সময় ওয়াশরুমে গিয়ে দেখি সবগুলো দরজার সামনে লম্বা লাইন। এ দৃশ্য দেখে আমার টয়লেট মাথায় উঠেছে। দুবাই থেকে প্লেনে উঠে আরেক ৩৮০ প্লেনের সিটগুলো খুবই ছোট সমস্য ইন্টারনেতে নিখোমুখি হলাম।  এয়ারবাস এলাইমেন্ট, যাওয়া-আসার পথটুকুও বেশ সরু। আমি পাশে একটি আসন বুক করেছি। প্লেনে উঠে দেখি আমার বিশের আর তার কন্যা বসে আছে শ্যাও দুই সিটে মোটামতো এক মহিলা মাশাল্লা মায়ের মতোই গোলআলু টাইপ। সিটগুলো ছোট বুঝে দুজনেই হাঁসফাঁস করছে। আমি জানালার পাড়া নির্ধারিত আসনে বসব, আমাকে জায়গা করে দিতে মা-মেয়ে দুজনকেই উঠতে হল। এই ওঠা-বসাটুকু করাতেই মনে হচ্ছে তাদের জান বেরিয়ে যাচ্ছে। সিটে বসার পর মনে হল একটা ভুল হয়েছে- আমার টয়লেটে ছোট কাজ করে আসা দরকার ছিল। এখন উঠতে গেলে মা- মেয়ে দুজনেই বিরক্ত হবেন, শুধু এখন কেন যতবার যাব ততবারই বিরক্ত হবেন। আমি হিসেব করে দেখলাম দুবাই থেকে নিউইয়র্ক ১৪ ঘণ্টা ২০ মিনিটের জার্নি। ১৪ ঘণ্টায় আমাকে পাঁচ বার উঠতে হবে। পাঁচ বার আলুর

পৃষ্ঠা:৪৯

বস্তা ঠেলে যাওয়া বিরাট অভদ্রতা, কেন যে আমি উইন্ডো সিট চুজ করলাম! অনাগত সমস্যার আশঙ্কায় আমি ঝিম মেরে বসে রইলাম। মা-মেয়ে দুজনের মনেও নিশ্চয়ই নানা আশঙ্কা দানা বেঁধেছে-পাশে যে লোকটা এসে বসল কে সে? দেখে মনে হচ্ছে লোক সুবিধার না, বাংলা ছবির ভিলেন ডিপজলের ভাই-ব্রাদার। ১৪ ঘণ্টা একটা লোক পাশে বসে থাকবে। প্রথমে মুখ খুললেন-আপনি কি বাঙালি? আমি বললাম-হ্যাঁ। -কলকাতার না বাংলাদেশের? আমি হাসিমুখে বলি-বাংলাদেশের। বাংলাদেশের বাঙালি শুনে মহিলা মনে হল তেমন খুশি হলেন না। আমি যে ডিপজলের ছোট ভাই এতে কোনো সন্দেহ বে কলকাতার দাদা হলে উত্তমকুস্তা আশ্বস্ত হতে পারতেন। কারণ দাদারা বংশধর, তাদের কথায় মিষ্টতা, আচরণে শিষ্টতা। কিন্তু আমি নারায়ণগঞ্জের বাঙাল, একনাগাড়ে বেশিক্ষণ খেয়েছি গিয়েছি বলতে আঞ্চলিক ভাষা চলে – ওনা। দু-চারটা বাক্য বলার পরই আছে-খাইলিছি… নিউইয়র্কে কে থাকে?। আমি বিনীতভাবে নিউইয়র্কে আমার আত্মীয়স্বজন কেউ থাকে না। আমি যাচ্ছি হুমায়ূন আহমেদ স্যারকে > দেখতে, তাঁর ওখানেই উঠব। -ও আচ্ছা, উনি তো শুনেছি জ্যামাইকাতে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন। আপনি কি ওনার আত্মীয়? -না, আত্মীয় নই। আমি তাঁর একজন ফ্যান বলতে পারেন… মহিলা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-আপনি ওনার আত্মীয়স্বজন কেউ না অথচ এত টাকা খরচ করে আমেরিকায় যাচ্ছেন শুধুমাত্র ওনাকে দেখতে! আপনি কি টিভিতে অভিনয় করেন? আপনাকে কোনো নাটকে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। মহিলা ধরে নিয়েছেন আমি হয় আদম ব্যাপারী নয়তো ড্রাগ চোরাচালানের সাথে জড়িত। এ দুই পেশার লোকেরা ফালতু কাজে টাকা ওড়ায়।

পৃষ্ঠা:৫০

আমি হেসে বলি না, আমি নাটকের লোক না, সিঙ্গাপুরে থাকি। স্যারের সাথে দীর্ঘদিনের চেনাশোনা। সিঙ্গাপুরে তাঁর ক্যান্সার ধরা পড়ার পর কথা দিয়েছিলাম আমেরিকায় চিকিৎসা করাতে গেলে তাঁকে দেখতে যাব। আমার উত্তরে মহিলার সন্দেহ কাটে না। তিনি আরো খুঁটিয়ে জানতে চান-আপনি কি বিবাহিত, বৌ-বাচ্চা কোথায় থাকে? আপনার কি সিঙ্গাপুরে পাসপোর্ট না বাংলাদেশের পাসপোর্ট? ভালো যন্ত্রণায় পড়া গেল, মহিলা প্রশ্নের পর প্রশ্ন করেই চলেছেন। তাঁর প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আমি হাঁপিয়ে উঠছি, মাথা ধরে যাচ্ছে। সিঙ্গাপুর থেকে আমার ফ্লাইট ছিল রাত দেড়টায়, সারা রাত জার্নি করে দুবাইতে এসে নিউইয়র্কগামী কানেকটিং ফ্লাইট ধরেছি। এখন একটু চোখ বুজে পড়ে থাকতে পারলে ভালো হত। কিন্তু মহিলার সেটা সম্ভব হচ্ছে না। মাঝে মাঝে প্রশ্নকর্তাকে প্রশ্ন করার শনা দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে থামিয়ে দেয়া যায়। এ যন্ত্রণার হাত প্রশ্ন করলাম-আপনারা কোথায় থা থেকে রেহাই পেতে আমি এবার পাল্টা আমরা থাকি মাসকাটে অ্যাঙ্গেসির কর্মকর্তা। কিছুলি মীগের হাজবেন্ড ওখানকার বাংলাদেশী মেয়ের বিয়ে হয়েছে। নিলয় পেশায় এয়ারক্রাফট ইঞ্জিনিয়ার কিউইয়র্ক এয়ারপোর্টেই চাকরি করে। মেয়েকে নিলয়ের হাতে তুলে দিতেই নিউইয়র্ক যাচ্ছি… মহিলার নিশ্চয়ই কথা বলার রোগ আছে। আমার এক প্রশ্নের উত্তরে উনি সাতটা আনসার দিয়েছেন। ক. মাসকাটে থাকেন, খ. হাজবেন্ড অ্যাম্বেসির কর্মকর্তা, গ. কিছুদিন আগে মেয়ের বিয়ে হয়েছে, ঘ. মেয়ের জামাইয়ের নাম নিলয়, ৫. নিলয় এয়ারক্রাফট ইঞ্জিনিয়ার, চ. এয়ারপোর্টে চাকরি করে, ছ. মেয়েকে নিলয়ের হাতে তুলে দিতে নিউইয়র্কে যাচ্ছে। যারা কথা কম বলে সাধারণত তারা অল্প কথায় উত্তর দেয়, বাড়তি কোনো কথার মধ্যে যায় না। কিন্তু এই মহিলা কথার ফুলঝুরি নিয়ে বসেছেন। ফুলঝুরি উপমাটা ঠিক হল না, বলা উচিত ‘কাঁটার ঝুড়ি’ এই ঝুড়ির নিচে চাপা পড়ে আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত। আমার পাল্টা প্রশ্ন করার ফর্মুলা এর ওপর খাটবে না, একে থামানোর কোনো উপায় আমার জানা নেই।

পৃষ্ঠা ৫১ থেকে ৬

পৃষ্ঠা:৫১

আমি শেষ চেষ্টা-হুমায়ূন আহমেদের মিসির আলির ফর্মুলা অ্যাপ্লাই করি। জিজ্ঞেস করি-নিলয় কি আপনার বোনের ছেলে? আমার এ প্রশ্নে মহিলা ঘাবড়ে গেলেন। একজন অপরিচিতের কাছ থেকে তিনি এরকম প্রশ্ন আশা করেন নি। শুধু মহিলা নয়, তাঁর মেয়েটিও বিস্মিত চোখে আমাকে দেখছে। সাধারণত মোটাসোটা মেয়েদের বুদ্ধিসুদ্ধি একটু কম হয় কিন্তু এ মেয়েটির চোখে-মুখে বুদ্ধিবৃত্তির ছাপ আছে। চোখগুলো সুন্দর এবং চোখের তারায় এক ধরনের দীপ্তি আছে যা বারবার তাকিয়ে দেখতে হয়। -আপনি কি নিলয়কে চেনেন? -না, আমি চিনি না। -তা হলে ও যে আমার বোনের ছেলে কী করে জানলেন? লোমামি বললাম এটা আমার অনুমান। কথার মধ্যে কিছুটা সিলেটি টান আছে। সাধারণত সিলেটের লোকওমীনিজ ও বাইরে ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিতে চায় না নিলয়, মেয়ে-জামাই বলেন নি। নিজ আত্মীয় বা গোত্রের আপনি প্রথমেই বলেছেন -ঠিক আছে আপনার যুক্তি। না হয়ে আমার হাজবেন্ডের । কিন্তু নিলয় আমার বোনের ছেলে ছেলেও তো হতে পারত! আমি হেসে বলিই সও হতে পারত, কিন্তু নিলয় নামটা বলার সময় আপনার চোখে-মু এক ধরনের স্নেহের আভাস ছিল। সাধারণত মেয়েরা স্বামীর আত্মীয়স্বজনের চেয়ে নিজ পরিবারের আত্মীয়স্বজনকে একটু বেশি আপন মনে করে, একটু বেশি আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়। মহিলা আমার যুক্তি মেনে নিলেন এবং আমার সঙ্গে কথাবার্তা বন্ধ করে দিলেন। কথা বন্ধ করার পেছনে যা কাজ করেছে তা হল-উনি ভেবেছেন আমি দেখতে খর্বাকৃতি হলেও বুদ্ধি-বিবেচনায় একজন উচ্চমার্গের লোক। বেশি বুদ্ধিমান লোকের সঙ্গে কথা বলতে গেলে মানুষ কিছুটা হীনম্মন্যতায় ভোগে, হীনম্মন্যতা নিয়ে বেশিক্ষণ নর্মাল কথাবার্তা চালানো যায় না। আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষই এই ভুলটা করে-আকাট মূর্খকে পণ্ডিত কিংবা বুজুর্গ লোক মনে করে, ঝাড়ফুঁক দেয়া লোককে মাথায় নিয়ে নাচে। হুমায়ূন আহমেদের মিসির আলি অতিশয় বুদ্ধিমান লোক। আমার

পৃষ্ঠা:৫২

বুদ্ধি-বিবেচনা বেশ নিম্ন পর্যায়ের। আমি কেবল মিসির আলির ধার করা একটা ফর্মুলায় ফেলে ব্যাপারটাকে বিশ্লেষণ করেছি। মহিলা মিসির আলির ফর্মুলাকে আমার বুদ্ধিমত্তা হিসেবে ধরে নিয়ে ধরাশায়ী হয়েছেন। যাগ গে, ভ্যাজরভ্যাজর বন্ধ হয়েছে এতেই আমি খুশি। প্লেন ছেড়ে দেবার পর আমি আবার ওয়াশরুমে যাবার পথে দেখি পেছন দিকে কয়েক সারি আসন খালি পড়ে আছে, আলুর বস্তা মাড়াবার ভয়ে আমি একটা দখল করে লম্বা হয়ে গেলাম। প্লেনে আমার কখনো ঘুম হয় না, চেষ্টা করাও বৃথা। কেবল ঝিম মেরে পড়ে থাকি। তন্দ্রার মধ্যে বেশ কিছু স্বপ্নদৃশ্য দেখলাম, সবই অর্থহীন। একটা দৃশ্যে দেখলাম হুমায়ূন স্যার কোনো এক অজ পাড়াগাঁয়ে টিনের দোচালা বাড়িতে একা থাকেন। ভোরে ঘুম থেকে উঠে তিনি নিজ হাতে উঠান ঝাড়ু দিচ্ছেন। পরে আছেন ডুরিসমেত থ্রি-কোয়াট্রন্ড প্যান্ট, খালি গা। আমি বাড়িতে ঢুকে তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করতে। মমতায়-আমার কথা মনে পড়ল? ঘরে বসাই। যেন এক পিতা তাঁর সন্তানকে চোখে জল। আমাকে গভীর তোমার জন্যে চায়ের পানি দূর করছেন। তন্দ্রার মধ্যে আমার প্লেন চলছে তো চলছেই, দু’চার ঘণ্টা পরপর খাবারদদে সোর যেন কোনো শেষ নেই। ক্যাবিন ক্রুরা সার্ভ করছে। আমি বই। সময় কাটাচ্ছি। মুভি দেখলাম আমি ভাতজ্ঞীর মুভি দেখে তেরা বাপ’। অমিতাভ বুড়ো মাস্তান। কিন্তু তাকে বুড্ডা বলা যাবে না। বুড্ডা বললেই উনি ক্ষেপে গিয়ে লোকজনের হাড়-মাংস এক করে বুঝিয়ে দেন উনি বুড়ো হন নি। পুরো মুভি জুড়ে মারামারি, গান আর প্রেম দিয়ে মেশানো ককটেল। অমিতাভজী বুড়ো বয়সে ভালোই মজা দেখাচ্ছেন। এরপর হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস ‘বাদশাহ নামদার’ পড়লাম, আগে একবার পড়েছি আবারো পড়লাম। স্যারের লেখায় এই এক জাদু-বারবার পড়েও মনে হয় নতুন কিছু পড়ছি, কত সহজ ভাষায় তিনি ইতিহাসকে তুলে এনেছেন! জোছনা ও জননীর গল্প, লীলাবতী আর মধ্যাহ্নের ধারাবাহিকতার ফসল-‘বাদশাহ নামদার’। স্বাধীনতা-উত্তর অস্থির সময় নিয়ে লেখা ‘দেয়াল’ হুমায়ূন আহমেদের ইতিহাসভিত্তিক লেখায় নতুন সংযোজন।

পৃষ্ঠা:৫৩

দেয়ালের কয়েকটি অধ্যায় পড়েছি। মনে হয়েছে এ হুমায়ূন আহমেদ অন্য কেউ, তিনি যেন পুরোনো বৃত্ত ভেঙে নতুন এক বৃত্ত রচনা করে চলেছেন। ‘বাদশাহ নামদার’ উপন্যাস নিয়ে ছোট একটা ঘটনা আছে। চন্দ্রনাথ ওট্টাচার্য আমার বন্ধু-স্থানীয়, কলকাতার লোক। সিঙ্গাপুরে একাডেমি অব ফাইন আর্টসের সেতারের শিক্ষক। ওঁর স্ত্রীও ক্লাসিক্যাল সিঙ্গার, আমার মেয়ে সজনি তাঁর কাছে গান শেখে। দুজনেই বেশ পড়ুয়া। ওঁদের সাথে শীর্ষেন্দু- সুনীল-সমরেশের লেখা নিয়ে কথা হয় মাঝে মধ্যে। কলকাতার লোকজন একটু নাক-উঁচু স্বভাবের। বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে ওঁদের জ্ঞান ভাসা-ভাসা, বাংলাদেশের কোনো লেখকের লেখাও পড়েন নি। আমার স্ত্রী যখন মেয়েকে গান শেখাতে নিয়ে যায় তখন সময় কাটানোর জন্যে বসে বসে বই পড়ে। একবার সে ভুল করে ‘বাদশাহ নামদার’ উপন্যাসটি ওদের বাসায় ফেলে আসে। চন্দ্রনাথ ঘ্রেইনিং টেবিলে সে বই দেখে পড়তে শুরু করে এবং শেষ না করা পরত মাঠার মতো লেগে থাকে। পরদিন সকালে চন্দ্রনাথ হন্তদন্ত হয়ে অভিভার অফিসে এসে হাজির। মুখ দেখে মনে হচ্ছে কোনো একটা ব্যাপান্ত পয়ে সে বেশ উত্তেজিত। বলে-দাদা, হুমায়ূন আহমেদের কী কী বই আছে আপনার কাছে? আমি কাল সারা রাত জেগে বাদশাহ নামদার’ পড়েছি। মাইরি বলছি দাদা, দু’বার রেখে দিতে চেয়েছি কিন্তু পারি নি, উনি তো জাদুকর দাদা…এই জাদুকরের বা আমি কেন আগে পাই নি… সুজাতা বলছিল আপনার সাথে ওঁর জানাশোনা আছে, উনি কখনো সিঙ্গাপুরে এলে আমাকে একটু দয়া করে খবর দেবেন, ওঁর পায়ের কাছে বসে আমি একদিন সেতার বাজিয়ে শোনাব… প্লেন চলছেই, ১৪ ঘণ্টাকে মনে হচ্ছে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। জানালার ব্লাইন্ড খুলে আকাশ দেখার চেষ্টা করলাম। ঘন কুয়াশা ছাড়া দেখার কিছুই নেই। মনে হয় আটলান্টিকের ওপর দিয়ে যাচ্ছে। আবার বই খুলে বসলাম- ‘আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই’ হুমায়ূন আহমেদের ছেলেবেলার ছোট ছোট সব ঘটনা নিয়ে লেখা। মজার সব ঘটনা-একটা ব্যাপার আমার কাছে খুব কাকতালীয় মনে হয়। হুমায়ূন আহমেদের বয়স তখন আট, ছোট বোন শেফু বাবার কাছে বায়না ধরেছে তার জন্মদিন পালন করতে হবে।

পৃষ্ঠা:৫৪

বাবা ফয়জুর রহমান সাহেবের তখন খুব আর্থিক অনটন চলছে। তারপরও আদুরে কন্যার আনন্দের কথা ভেবে তিনি রাজি হলেন। গান-বাজনা, খাওয়া- দাওয়ার পর্ব শেষ করে তিনি মেয়েকে খুব দামি এক সেট চিনেমাটির খেলনা কাপ-পিরিচ উপহার দেন। এত সুন্দর খেলনা দেখে শেফু খুব খুশি। আর তিন দিন পর ১৩ নভেম্বর, হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন। সেও বাবার কাছে বায়না ধরে তার জন্মদিন পালন করতে হবে-জন্মদিন মানেই গিফ্ট। হুমায়ূন আহমেদ খুবই এক্সাইটেড-কবে আসবে ১৩ নভেম্বর, তিন দিন যেন কাটতেই চায় না। গান-বাজনা আর পিঠা-পায়েস শেষে ফয়জুর রহমান নিজের লেখা একটা কবিতা ফ্রেমে বাঁধিয়ে দিয়েছেন। কবিতার প্রথম দুটি চরণ সাতটি বছর গেল পরপর আজিকে পড়েছ আটে/তব জন্মদিন নয়ত মলিন ভয়াল বিশ্বহাটে। তিনি ছেলেকে জিজ্ঞেস করছেন-কিরে উপহার পছন্দ হয়েছে? হুমায়ূন আহমেদ অনেক কষ্টে কান্না চেত্রে তোর মুখ দেখে মনে হচ্ছে উপহার, তোর কাছে সামান্য মনে হচ্ছে, এমন হবে না। বড় হবার চেষ্টা কর তোদের জন্যদিনের উৎসব কষ্টে লেন হ্যাঁ, হয়েছে। হয় নাই। এই উপহার এখন আসবে যখন আর সামান্য মনে ক বড়। যাতে সারা দেশের মানুষ ইরা-মা’র করতে নাচায় হয়। ‘জন্মদিন। মাজহার ভাই সেদিন ফোনে জানালেন-এবার ১৩ নভেম্বর ঢাকা আর নিউইয়র্ক দু’জায়গাতেই হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিনের অনুষ্ঠান করা হবে। আমি খুব অবাক হয়ে লক্ষ করলাম গত দশ বছর ধরে এই দিনটিকে উপলক্ষ করে আমি বাংলাদেশে যাচ্ছি। ১৩ নভেম্বর নিজের অজান্তেই আমার জীবনের একটা অংশ হয়ে গেছে। আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে কেন? এর কোনো উত্তর জানা নেই। হৃদয়ের কোথায় যেন এক ধরনের টান অনুভব করি। হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গ, ওল্ড ফুলস ক্লাবের আড্ডা চুম্বকের মতো আমাকে টানে। এরপর খুশবন্ত সিংয়ের লেখা ‘দিল্লী’ পড়ছি। বইটি স্যারের জন্যে। খুশবস্তের লেখা মন্দ না, প্রচুর হাস্যরস থাকে তাঁর লেখায়। ১৯৪৭-এর দাঙ্গার উপরে লেখা ‘ট্রেন টু পাকিস্তান’ চমৎকার একটি উপন্যাস। তাঁর ‘কম্পেনি অফ এ ওম্যান’ বেশ মজার এক জীবনী। সেখানে একটা মজার

পৃষ্ঠা:৫৫

ঘটনা আছে। ঘটনাটা এরকম-খুশবন্ত তখন ইংল্যান্ডে ভারতীয় দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি আর কৃষ্ণ মেনন হলেন হাইকমিশনার। কৃষ্ণ মেনন বিয়ে করেন নি। তাঁর কাজ হল নেহরুকে তোয়াজ করে খুশি রাখা আর নতুন নতুন বান্ধবী জুটিয়ে প্রেম করা। কাজের সব বোঝা তিনি চাপিয়ে দিতেন খুশবন্ত সিংকে। একদিন এক কাসকেট কোম্পানি (যারা মৃতদেহ সৎকার করে) এক সমস্যা নিয়ে ভারতীয় দূতাবাসে এল। সমস্যা হল-একজন ভারতীয় বৃদ্ধা মারা গেছেন। তিনি একাকী বসবাস করতেন, বন্ধু বা স্বজন কেউ নেই। মৃত্যুর আগে তিনি একটা চিঠি লিখে গেছেন-তাঁকে যেন মৃত্যুর পর শাড়ি পরিয়ে ভারতীয় প্রথায় সৎকার করা হয়। কাসকেটের লোকজন জানে না কীভাবে শাড়ি পরাতে হয়। তারা ভারতীয় দূতাবাসে এসেছে যদি এখানকার কেউ এ ব্যাপারে ওদের সাহায্য করতে পারে। তখন ভারতীয় দূতাবাসে কোনো নারী কর্ম কাসকেটের লোকদের পাঠানো হল ফার্স্ট সেরে খুশবন্ত সবকিছু শুনে বললেন-দেখো, সমাধান করতে পারব। একজন খুলতেই শিখেছি পরানোর হাইকমিশনার সাহেবকে ধর করতে পারবেন। কারণ, রিসেপশন থেকে খুশবন্ত সিংয়ের কাছে। সমস্যা মনে হয় না আমি হীনুষ হিসেবে আমি কেবল শাড়ি নেই। তোমরা বরং আমাদের হয়তো তোমাদের এ ব্যাপারে সাহায্য প্রচুর ব্রিটিশ বান্ধবী। কাসকেটের লোকণ্ঠ আর শাড়ি পরে না। বলল-ব্রিটিশ বান্ধবী দিয়ে কী হবে! ওরা তো খুশবন্ত সিংহ মুচকি হেসে বলেন-কৃষ্ণ মেনন প্রথম ডিনারেই তার বান্ধবীদের শাড়ি উপহার দেন এবং ডিনার শেষে তাদেরকে বাসায় নিয়ে এসে কীভাবে শাড়ি পরতে হয় সেটা তালিম দেন। উনার স্ত্রী! সৌভাগ্যক্রমে উনি এখনো বিয়ে করেন নি। তোমরা বরং তাঁকে গিয়ে ধরো, আমার মনে হয় উনি আগ্রহ নিয়ে তোমাদের সমস্যার সমাধান করে দেবেন! কাসকেট কোম্পানির লোকেরা হাইকমিশনার সাহেবের রুমে ঢুকে কড়া ধমক খেয়ে বেরিয়ে আসেন।

পৃষ্ঠা:৫৬

বিমান দেরিতে পৌঁছাল। মাজহার ভাই দুপুর থেকেই এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করছেন। কথা ছিল দুপুরে বাসায় গিয়ে একসঙ্গে সবাই মিলে লাঞ্চ করব কিন্তু ফ্লাইট ডিলের কারণে সেটা হয় নি। বেচারা মাজহার ভাই। দুপুরে না খেয়ে মুখ ছোট হয়ে গেছে। এয়ারপোর্টের খুব কাছেই স্যারের বাসা। জ্যামাইকার ভাড়া বাসায় স্যার তাঁর ষষ্ঠ সংসার সাজিয়েছেন। হইচই করে হাঁড়ি-পাতিল, বিছানা-বালিশ, টিভি-ফ্রিজ কেনা হয়েছে। দেশ থেকে তাঁর শাশুড়িও এসেছেন নিষাদ- নিনিতকে দেখভাল করার জন্যে। শাওন ভাবি স্যারকে নিয়ে হাসপাতালে দৌড়ঝাঁপ করেন। নিষাদ-নিনিতকে দেখার কেউ নেই, এজন্যেই ওনার শাশুড়িকে আসতে হয়েছে। প্রায় দু’মাস পর স্যারের সাথে দেখা হল । ইতোমধ্যে তাঁকে ছয়টা কেমো দেয়া হয়েছে। একটু রোগা হয়েছেন কিন্তু প্রাণচাঞ্চল্যে টগবগ করছেন। আমাকে বললেন-তুমি রুগি দেখ আসছ ভালো কথা। আমি খুব খুশি হয়েছি। জীবনে প্রথম মাটিতে পা রেখেছ, শুধু রুগি দেখলে তো চলবে না। আমেরিকায় কিছু দেখার আছে। আমরা ঠিক করেছি আটলান্টিক সিটিতে যাব। শাওন বাসের টিকেট আর হোটেল বুকিং করে ফেলেছে স্কোল সকাল-সকাল বেরিয়ে পড়তে হবে, খাওয়াদাওয়া করে শুয়ে কেওড়া, নয়তো জেট-ল্যাগ কাটবে না। গত দু’মাসে বাসা আর হাসপাতাল করে-করে স্যার আসলে হাঁপিয়ে উঠেছেন। তাঁর একটু ব্রেক দরকার। আমার মনে হল, স্যার একটু খোলা হাওয়ায় প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে চাইছেন। আমি আসায় বেড়াবার একটা উপলক্ষ তৈরি হয়েছে। রাতে ডিনারের মেনু হচ্ছে ব্রকলি সিদ্ধ, পাবদা মাছ, ডিম ভুনা, আর ডাল। রান্নাবান্নার বই ছাপাতে গিয়ে মাজহার ভাই রান্নায় ভালোই হাত পাকিয়েছেন। তিনি অন্যদিনের রান্নাঘর সাজিয়েছেন জ্যামাইকার এ বাসায়। তাঁকে হেল্প করছেন স্যারের শাশুড়ি তহুরা আলী। কেমো দেবার ফলে স্যারের খাবারের রুচি কমে গেছে। একই খাবার দু’বেলা খেতে পারেন না। মাজহার ভাইয়ের ডিনারের পর আমি আর চোখ খোলা রাখতে পারছি না।

পৃষ্ঠা:৫৭

আমার জায়গা হয়েছে মাজহার ভাইয়ের রুমে। একটা পোর্টেবল মেট্রেসে আমি লম্বা হয়ে গেলাম। কিন্তু জেট-ল্যাগ কাটাবার উপায় নেই, মাঝরাতে মাজহার ভাই ডেকে তুললেন। আমি ধড়মড় করে উঠে বসতেই উনি বললেন, আমার নাক-ডাকা নাকি কমলের চেয়েও ভয়ানক। হতে পারে, যে-ব্যক্তি নাক ডাকে সে কখনোই তা টের পায় না। আমি পজিশন চেঞ্জ করলাম। কিন্তু একবার ঘুম ভেঙে গেলে আবার তাকে জোড়া লাগানো মুশকিল। আমি এপাশ-ওপাশ করছি, কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হল মাজহার ভাইয়ের নাক-ডাকা। আমার মনে হল মাজহার ভাইয়ের নাক ডাকার শব্দ কমল এবং আমার চেয়েও এককাঠি ওপরে। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না, দরজা নক্ করার শব্দে ঘুম ভাঙল। স্যার মাজহার ভাইকে ডাকছেন, চায়ের পানি বসাতে হবে। স্যার ভোরে উঠে এক কাপ চা পান করেন, সাথে বিস্কিট। দরজা দুজন কি রাতে নাক-ডাকার কম্পিটিশন আওয়াজ রে বাবা! তোমাদের সাথে কমল। খুলছে স্যার বললেন-তোমরা নাকি! কী ফরফর যেনো হলে তো এই কাঠের বাড়ি নড়বড়ে হয়ে যাবে। আর যদি কোনেভেষির্ষ আলমগীরকে জুটাতে পার তা হলে প্রথম রাতেই দড়াম করে কড়ি ভেঙে পড়বে এতে কোনো সন্দেহ নাই।

পৃষ্ঠা:৫৮

১৭ অক্টোবর ২০১১। আমরা যাব আটলান্টিক সিটিতে। দুপুর ৩টায় নিউইয়র্কের ৮ এভিনু থেকে গ্রেহন্ডের বাস ছেড়ে যাবে। ব্রেকফাস্ট কাম লাঞ্চ সেরে দুই গাড়িতে ভাগাভাগি করে আমরা জ্যামাইকা থেকে বাস স্টেশনের উদ্দেশে রওয়ানা হলাম। হুমায়ূন আহমেদ, শাওন ভাবি, নিষাদ-নিনিত আর শাওন ভাবির মা উঠেছেন চ্যানেল আইয়ের নিউইয়র্ক সংবাদদাতা খোকনের গাড়িতে। আমি, মাজহার ভাই লিফট নিয়েছি গাজী কাশেমের গাড়িতে। নিউইয়র্কের আকাশে ঝকঝকে রোদ দেখে মার্কন্তির বললেন- আজকের দিনটা হবে খুবই শুভ দিন। অনেক দিন পরুে হচ্ছে। স্টেশনে পৌছে দেখা গেল উল্টোচির স্টেশনে পৌঁছানো মাত্র আমাদের চোখের সামনে নির্ধারিত বাস হে গেল। মাজহার ভাই লক্ষঝক্ষ করে ড্রাইভারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা। তা বৃনুভূতিস, কিন্তু কোনো লাভ হল না। আমাদের বেশ মনখারাপ হল। মাত্র ১ জন্যে আমরা বাস মিস করলাম। মাজহার ভাই আমেরিকাঈদের সময়জ্ঞান নিয়ে বেশ গালমন্দ করলেন। এক মিনিট কী এমন সম্ভয়! ওয়েট করলে ক্ষতি কী, আমেরিকানরা বদের হাড্ডি। শাওন ভাবি সহজে ছাড়বার পাত্রী নন। তিনি অফিসারের সঙ্গে কথা বললেন-আমাদের সঙ্গে বাচ্চা এবং সিনিয়র সিটিজেন আছে, আমরা সময়মতো বাস ধরতে পারি নি, এখন কী হবে? অফিসার বলল-কোনো সমস্যা নেই, আধ ঘণ্টা পর আরেকটা বাস ছেড়ে যাবে। তোমরা ইচ্ছে করলে ওটাতে যেতে পার। একবার টিকেট কাটলে তুমি নির্ধারিত ডেটে যে কোনো বাসেই যেতে পার।

পৃষ্ঠা:৫৯

মাজহার ভাই সুর পাল্টে বললেন-এ না হলে কি আর আমেরিকা! ওদের ব্যাপার-স্যাপারই আলাদা। অন্য দেশ হলে বলত-সময়মতো আস নি কেন, এখন নতুন টিকেট কিনে নিয়ে আস। আমেরিকা আসলেই মহান এক দেশ। আধ ঘণ্টা সময় পাওয়াতে ভালোই হয়েছে, লাঞ্চ করার সময় পাওয়া গেছে। টেনশন আমাদের ক্ষুধা বাড়িয়ে দিয়েছে। সবার জন্যে টুনা স্যান্ডউইচ নেয়া হল। মুখে দেবার আগেই এক ভিখারি এসে হাত পাতল। স্যার মাজহার ভাইকে দেখিয়ে বললেন মাজহার তোমার মহান দেশে দেখছি ভিক্ষুকও আছে, ভিক্ষুক বিদায় কর। বল, আল্লারওয়াস্তে মাফ কর। মাজহার ভাই ভিক্ষুককে টুনা স্যান্ডউইচ এগিয়ে দিল। আমেরিকান মিশুক মাজহার ভাইয়ের দিকে এমনভাবে কটমটিয়ে তাকাল যেন এরকম অপমান তাকে এ এ জীবনে আর কেউ করে নি। ভিক্ষুকটি চেঁচামেচি শুরু করল। রূপমানের প্রতিশোধ নিতে স্যার বললেন-মাজহার এ আমেরিকান ভিক্ষুকরা খাবার পাচ্ছে, কিছু ডলার দিয়ে তাড়া গংলাদেশ না। তোমার মহান ওরা চেনে ডলার। বাচ্চারা ভয় আপদ বিদায় কর। বাচ্চাদের চেয়ে মনে জিহার ভাই ভয় পেয়েছেন বেশি। তিনি দ্রুত একটা দশ ডলারের এেগিয়ে দিলেন। ভিক্ষুক ডলার হাতে নিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে সামনে এগিয়ে গেল। এর পর পুলিশ এসে মাজহার ভাইয়ের ঠিক পেছনে দাঁড়ানো একটা কালো মেয়েকে হ্যান্ডকাপ পরাতে লাগল। ভয়ে মাজহার ভাইয়ের কালো মুখ বেগুনি হয়ে গেল। একটু আগেই তিনি মেয়েটির সঙ্গে হেসে গল্প করছিলেন। পুলিশ অভয় দিয়ে বলল-ড্রাগ অ্যাবিউজার, নট টু ওরিস। মহান দেশের মহান অ্যাবিউজারদের পাল্লায় পড়ে আমরা অতিষ্ঠ। এখন বাসে উঠতে পারলে বেঁচে যাই। নির্দিষ্ট সময়ে বাস এসে গেল, আমরা বাসে উঠে বসলাম। নিউইয়র্ক থেকে নিউ জার্সি তিন ঘণ্টার জার্নি। হাইওয়ে দিয়ে পিপীলিকার মতো সারি সারি গাড়ি যাচ্ছে। বিশাল বিশাল সব গাড়ি। সেলুন কারের চেয়ে এমপিভি’র সংখ্যাই বেশি মনে হল। এ কারণেই তেলের জন্যে

পৃষ্ঠা:৬০

আমেরিকানরা মরিয়া। গণতন্ত্র রক্ষার নামে বেছে বেছে তারা তেল-অধ্যুষিত দেশগুলোতেই হামলা চালাচ্ছে। আমরা উঠব আটলান্টিক সিটির শো-বোট হোটেলে। শাওন ভাবি আগেই চারটা রুম বুক করে রেখেছেন। খরচ বাঁচাতে মাজহার ভাই আমার সাথে একই রুমে থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্যার বলেছেন-তোমাদের নাক-ডাকার ব্যাঘাত হোক এটা আমি চাই না। দু’জন দু’রুমে আরাম করে নাক ডেকে ঘুমাবে। নাক-ডাকার মধ্যে এক ধরনের নান্দনিক ব্যাপার আছে! শো-বোটে আমরা দু’রাত থাকব। স্যারের খাবারদাবার নিয়ে মাজহার ভাই বেশ চিন্তিত। হুমায়ূন আহমেদ বাইরের খাবার একেবারেই খেতে পারেন না। হোটেল-রেস্টুরেন্টের খাবার প্রায় সবই তাঁর কাছে অখাদ্য। নাসিম ভাই নামে এক বাঙালি ভদ্রলোকের সঙ্গে মাজহার ভাইয়ের কথা হয়ে আছে। উনি আটলান্টিক সিটিতেই থাকেন, স্যারের খাবারদাবারের দেখভাল করবেন। নির্ধারিত হোটেলে বাস থেকে বাঙালি যুবক দাঁড়িয়ে আছে, যুবকের। ব্যাপারটা চখি বেসবলের টুপি পরে এক মাসিম । স্যার আসবেন শুনে উনি দু’দিনের ছুটি নিয়েছেন। নাসিম, এখনই আমাদেরকে তাঁর বাসায় নিয়ে যেতে চান। আমরা যতই হোটেলে চেক-ইন করার পর যাব। উনি ততই বলেন-না, কতক্ষণ ধরে সবাই না’ তৈ হবে। খেয়েদেয়ে এসে বিশ্রাম করেন। আছে! শেষে স্যার বললেন-নাসিম, বাচ্চাদের ন্যাপি চেঞ্জ করতে হবে। আর টুনা স্যান্ডউইচ খেয়ে মাজহারের পেটের অবস্থাও সুবিধার না। আমরা বরং হোটেলে চেক-ইন করে ফ্রেশ হয়ে তোমার বাসায় যাই। আমাদের আধ ঘন্টার বেশি লাগবে না। নাসিম ভাইয়ের স্ত্রী পুরো ডাইনিং টেবিল খাবার দিয়ে ভরে ফেলেছেন, প্লেট রাখার জায়গা নেই। তাদের ব্যাকইয়ার্ডে চাষ করা ঢেঁড়স, কালো বেগুন আর করলা ভাজি করা হয়েছে। কচুর লতি রান্না করা হয়েছে চিংড়ি মাছ দিয়ে। ভর্তা হয়েছে তিন ধরনের-ছোট চিংড়ি, শুঁটকি, আর সরিষার তেল দিয়ে আলু ভর্তা। বিরিয়ানি তিন ধরনের-চিকেন, মাটন, ফিশ বিরিয়ানি। তারপর আছে কাবাব, রোস্ট আর ডাল।

পৃষ্ঠা ৬১ থেকে ৭২

পৃষ্ঠা:৬১
স্যার নাসিম ভাইয়ের স্ত্রীকে বললেন-মাই গুডনেস! এ তো দেখছি এলাহি ব্যাপার! এত খাবার কে খাবে! এসব করতে তোমাকে তো বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়েছে! খাবার শেষে মিষ্টি পান লাগবে, পানের ব্যবস্থা কি আছে? আমরা সবাই বেশ তৃপ্তি নিয়ে খেলাম, জার্নি করলে ক্ষুধা-তৃষ্ণা বেড়ে যায়। নাসিম ভাই ও তাঁর স্ত্রীর আতিথেয়তায় স্যার মুগ্ধ। তিনি বললেন- এই বিদেশ-বিভুঁইয়ে তোমরা আমাদের জন্যে এত ভালবাসা জড়ো করে রেখেছিলে এটা আমার ধারণাতে ছিল না। আমি তোমাদের জন্যে অন্তর থেকে দোয়া করছি-তোমার ছেলেমেয়েরা যেন দুধে-ভাতে থাকে। খাবার শেষ করতেই আমাদের মিষ্টি সুপারি আর চমন বাহার দিয়ে পান দেয়া হল। পান মাজহার ভাইয়ের কাছে বিষবৎ, আমাদের দেখাদেখি তিনিও পান নিলেন একটা না পরপর দুইটা। নাসিম থেকে সদ্য বেড়াতে এসেছেন, তিনি সঙ্গে করে পান সাজানোর অন্যান্য সরঞ্জামাদি নিয়ে হল, অনায়াসেই তা দিয়ে একটা মিনি য়ের শাশুড়ি বাংলাদেশ দু’মাসের পান-সুপারি এবং ছিন। পানের স্টক দেখে মনে খোলা যায়। রাতে হোটেলে ফিরে স্যার ক্যাসিনোর কথা শুনে মার শাওন ভাবি চোখ পাকিয়ে না। স্যার মাজহার ক্যাসিনোতে যাবে নাকি? ভাইয়ের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। লৈন নো, নেভার। কেউ ক্যাসিনোতে যাবে বললেন শোচনাসুম, (কোনো কিছুর জন্যে আবদার করতে হলে স্যার শাওন ভাবিকে এ নামে ডাকেন) আটলান্টিক সিটি হল ক্যাসিনোর শহর গরিবের লাস ভেগাস। ক্যাসিনো ছাড়া আর এ সিটিতে দেখার কিছু নেই। আটলান্টিক সিটিতে এলাম অথচ ক্যাসিনোতে যাব না-এটা কেমন কথা! তুমি আগেও এখানে এসেছ। শাওন ভাবি বললেন-আগের ট্রিপ ছিল অন্যরকম। তখন তুমি সুস্থ ছিলে। এখন তুমি একটা ট্রিটমেন্টের ভেতর দিয়ে যাচ্ছ। আমার কথা থাক, মাজহারের কথা চিন্তা কর! বেচারা তার ব্যবসাপাতি, বাচ্চাকাচ্চা ফেলে আমার কারণে আমেরিকায় পড়ে আছে। তার আর্থিক ক্ষতি সীমাহীন। তুমি তো জান মাজহারের ক্যাসিনো-ভাগ্য খুব ভালো। গতবার সে তাজমহলের ক্যাসিনোতে পরপর দু’বার জ্যাকপট পেয়েছে। ১৪

পৃষ্ঠা:৬২

হাজার ডলার প্রায় ১২ লাখ টাকা। মানুষের ভাগ্যের কথা বলা যায় না। এবার হয়তো দেখা গেল মাজহার ১২ লাখ ডলারের জ্যাকপট পেয়ে গেছে, প্রায় এক কোটি টাকা। রাতারাতি মাজহার কোটিপতি! স্যারের কথা শুনে মাজহার ভাই পারলে এখনই ক্যাসিনোতে ঢুকে যান। কিন্তু শাওন ভাবি বললেন-অনেক রাত হয়েছে। এখন সবাই ঘুমাবে। মাজহার, হুমায়ূন আহমেদ, আর আমি ভোঁতা মুখ করে ঘুমাতে গেলাম। আমি কখনো ক্যাসিনোতে যাই নি। ক্ষীণ আশা ছিল মাজহার ভাইয়ের কাছ থেকে তালিম নেব কী করে জ্যাকপট পেতে হয়। আমার সে আশা পূরণ হল না। আমি আর্লি রাইজার। সূর্যদেব আকাশে উঠে গেছেন আর আমি বিছানায় পড়ে আছি এটা কখনো হবে না। হয়তো সূর্যদেবকে সম্মান দেখানোর জন্যেই আমার বাড়ির ক্লকে এক ধরনের সেলফ-অ্যালার্ম তি ঠিক করে দিয়েছে। আমি ভোরে ঘুম থেকে উঠে সমুদ্রের পাড়ে বের হলাম। চারদিকে সব একেবারে সুনসান। রাত জুয়া খেলে এখন সবাই ঘুমে কাদা। বারোটার আগে কারো ঘুম ভেতবে না। ৪ কিলোমিটার জুড়ে আটলান্টিকের পাড়ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ওয়াছে প্রাসাদসম সব হোটেল কাম ক্যাসিনো। আমাদের পাশের ছাটেলটির নাম হচ্ছে তাজমহল, খুবই দৃষ্টিনন্দন। মুঘল টো আবহ আনার চেষ্টা করা হয়েছে। সেখানে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইলাম। যতদূর চোখ যায় কেবল অসীম জলরাশি। সমুদ্র এখানে বেশ শান্ত। ছোট ছোট ঢেউয়ের সারি এসে আছড়ে পড়ছে। রূপং আটলান্টিক সিটির আয়তন মাত্র ১১ স্কয়ার মাইলের কিছু বেশি এবং ৪০ হাজার লোকের বসবাস এখানে। ট্যুরিস্টনির্ভর অর্থনীতি প্রতি বছর ৩৪ মিলিয়ন ট্যুরিস্ট আসে বেড়াতে। আমার ধারণা ৯০% ট্যুরিস্ট ক্যাসিনোতে জুয়া খেলতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয় এবং ফিরে যাবার সময় তওবা করে যায় আটলান্টিক সিটিতে আর কখনো পা রাখবে না। কিন্তু বছর না ঘুরতেই আবার এখানে আসার জন্যে তারা ব্যাকুল হয়। রুমে ফেরার সময় লবিতে দেখি নাসিম ভাই এবং তাঁর স্ত্রী, হাতে একগাদা নাস্তার প্যাকেট। হোটেলের নাস্তা স্যার আদৌ খেতে পারেন কি না

পৃষ্ঠা:৬৩

ভেবে তাঁরা বাসায় নাস্তা তৈরি করে নিয়ে এসেছেন। আমার রুমে নাস্তা সাজিয়ে সবাইকে ডেকে তোলা হল। মজা করে নাস্তা খেতে খেতে প্ল্যান করা হচ্ছে আজকের দিনটা কী করে কাটানো যায়। সিদ্ধান্ত হল নাস্তাশেষে আমরা হোটেল থেকে বেরিয়ে বোর্ডওয়াকে বেড়াব। দুপুরে বিচের পাশে কোনো একটা রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করা হবে, তারপর বিকেলে শপিং। বাইরে লাঞ্চ করব শুনে নাসিম ভাই আর তাঁর স্ত্রী আঁতকে ওঠেন। দুপুর এবং রাতে দুবেলাই আমাদেরকে তাঁদের বাসায় খেতে হবে। তাঁরা কোনো কথা শুনবেন না। শেষে স্যার বললেন-নাসিম, পাগলামো কোরো না। আমি ছ’বছর আমেরিকায় ছিলাম। বাসার বাইরে খেয়ে আমি অভ্যস্ত। তা ছাড়া তোমরা সব কাজকর্ম ফেলে আমাদের কেবল রান্না করে খাওয়াবে, এটা কোনো কাজের কথা না। আজ থেকে তোমরা আমার। স্ট-দুপুর এবং রাতে আমাদের সাথে খাবে। এর অন্যথা হবে না স্যারের কথাই বহাল রইল। ঠিক বোর্ডওয়াকে হাঁটাহাঁটি করে ওখানেই ভালো কোনো রেস্টুরেন্টে। বিকেলে শপিং আর রাতে হোটেলের ডাইনিংয়ে ডিনার। স্য ক্লাসলে কাউকেই। কষ্ট দিতে চান না। বিদেশে সবকিছুই নিজেকে। ইয়। তিন বাচ্চা নিয়ে নাসিম ভাইয়ের স্ত্রী এমনিতেই ব্যস্ত। আমাদের হয় না। প্রতিদিন ঝামেলা পোহানোর কোনো মানে পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘতম বোর্ডংওয়াক হল আটলান্টিক সিটিতে। বোর্ডওয়াক জুড়ে প্রচুর ট্যুরিস্ট। ওয়েদারটাও বেশ ভালো, এখনো জাঁকিয়ে ঠাণ্ডা পড়ে নি। সিগালগুলোর কোনো ভয়ডর নেই। আমাদের পায়ে পায়ে ঘুরছে। সিগাল দেখে নিনিতের বেশ আনন্দ। সে সব সময় চুপচাপ থাকে কিন্তু এখন কিছুতেই সে স্টলারে বসে থাকতে চাচ্ছে না। সিগালগুলো ধরার জন্যে সে নামতে চায়। স্যার নিনিতকে স্টলার থেকে নামিয়ে দিতেই দু’ভাই পাখিদের নিয়ে সে কী হুটোপুটি! হুমায়ূন আহমেদ ঘোর-লাগা দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। আমরা সমুদ্রের পাড় ধরে ধীর পায়ে হাঁটছি। মাজহার ভাই নানা ভঙ্গিমায় আমাদের ছবি তুলছেন। আশ্চর্য হলেও সত্যি, স্যারের সঙ্গে আমার

পৃষ্ঠা:৬৪

কোনো ছবি নেই। কখনো তোলা হয় নি। অনেককে ছবি তুলে দিয়েছি, কিন্তু আমার কখনো ছবি তোলার ইচ্ছে হয় নি। হয়তো ভেবেছি, যাকে এত কাছ থেকে চিনি তাঁর সঙ্গে ছবি তোলার দরকার কী! আমি স্যারের সঙ্গে ছবি তুলতে দাঁড়িয়েছি, স্যার রসিকতা করে বললেন-বেশি করে ছবি তুলে রাখ, আমার তো চলে যাবার ঘণ্টা বাজছে। এরকম সুযোগ আর নাও পেতে পার। স্যারের কথা শুনে আমার বেশ মনখারাপ হল। শাওন ভাবি ধমকের সুরে বললেন-কেন এরকম ফালতু কথা বল! আর কখনো এরকম ফালতু কথা বলবে না। তুমি আমাদের ছেড়ে কোথাও যাচ্ছ না। আমরা তোমাকে কোথাও যেতে দেব না। আর তোমার ঘণ্টাওয়ালার দেখা পেলে ঢিল মেরে আমি মাথা ফাটিয়ে দেব।

পৃষ্ঠা:৬৫

আমরা আটলান্টিক সিটি থেকে নিউইয়র্কে ফিরছি, নাসিম ভাই আমাদের বাসে তুলে দিতে এসেছেন। আমরা কেউ প্রথমে তাঁকে চিনতেই পারি নি। এ দু’দিন তিনি ছিলেন ক্যাজুয়েল পোশাকে। লংস্লিভ টি-শার্ট, জিন্স আর মাথায় বেসবল টুপিতে তাঁকে দেখাত টগবগে যুবক। কিন্তু আজ অফিসে জয়েন করেছেন বলে স্যুট-টাই পরে একেবারে আমেরিকান সাহেব। মাথায় বিশাল টাক, চেনার কোনো উপায় নেই এটা আমাদের নাসিম ভাই। মূলত টাক ঢাকতেই তিনি বেসবল টুপি পরতেন। লোক। পুরোদস্তুর মধ্যবয়স্ক আস, স্যার বললেন-তোমার স্যুট-বুট। ‘তুমি’ করে বলতে সাহস হচ্ছে না। লাগে ১৫-২০ বছর। তুমি তোর বেলায় ভালোই কারিশমা এখানেই বিদায়। ইথায় মস্ত টাক দেখে তোমাকে থেকে বৃদ্ধ হতে মানুষের সময় ভিছি রাতারাতি বৃদ্ধ বনে গেছ। যাবার বৃদ্ধরা একটু কোলাকুলি করি। আমরা বাসে উঠছি নাসিম ভাইয়ের চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। অপেক্ষমাণ যাত্রীরা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে একজন মধ্যবয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে হু হু করে কাঁদছে। বাস ছেড়ে দিল, আমরা অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলতে পারলাম না। বাসায় পৌঁছতে সন্ধ্যা, বাচ্চারা ঘুমিয়ে কাদা। বাইরে ডিনার করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু স্যার বললেন, বাচ্চারা ঘুমাচ্ছে, খামাখ্য গাড়ি থামিয়ে কাজ নেই। পার্কিংয়ের ঝামেলা। এর চেয়ে এক কাজ কর, বাসায় গিয়ে ভাত চড়িয়ে দাও। আলু ভর্তা, ডিম ভাজি আর

পৃষ্ঠা:৬৬

ভাল দিয়ে গরম ভাত। ট্র্যাভেলিংয়ের পর এর চেয়ে উপাদেয় কোনো খাবার আর হয় না। পরদিন সকালে আমরা সবাই স্লোন কেটারিং হাসপাতালে যাচ্ছি। আজ স্যারের ব্লাড টেস্ট। আমাদের লিফট দিচ্ছেন গাজী কাশেম। কাশেম সাহেবের পরিচয় তিনি একসময় এখানে বাংলাদেশ অ্যাম্বেসির কর্মকর্তা ছিলেন। চাকরি ছেড়ে নানা কিছু করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সব ব্যবসাতেই ফেল মেরেছেন। দু’বছর হল রিয়েল এস্টেটের ব্যবসার সঙ্গে আছেন। গাজী কাশেম রিয়েল এস্টেট শুরু করার পরপরই আমেরিকার অর্থনীতিতে ভয়াবহ মন্দা শুরু হয়েছে। বাড়িঘরের দাম এখন ৫০-৭০% কমে গেছে। মানুষের হাতে টাকা নেই। নতুন বাড়ি কেনার কথা কেউ চিন্তা করছে না। গাজী কাশেমের ধারণা তিনি এ ব্যবসাতেও ফেল মারতে যাচ্ছেন। মাজহার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হবার পর একটা ব্যবসার কথা চিন্তা করছেন, সে পর থোড়ে কাশেম সাহেব নতুন আধুনিক জীবনযাপনে মানুষের টেনশন, জন্যে টাকওয়ালা মানুষের সংখ্যাও ব্যবসায় নেমে পড়ার এখনই কাম্পেটিটর বেড়ে যাবে। জোটানোইবেন ‘হল ‘হেয়ার ট্রিটমেন্ট’। বেড়ে গেছে। এই টেনশনের বিপড়ছে। চুল গজানোর ওষুধ নিয়ে সময়। নয়তো পরে অনেক এ ব্যবসা জমবে না, কারণ তাদের তিন বেলা খাদ্য বড় সমস্যা। বাংলাদেশ এবং সিঙ্গাপুরের মার্কেটটা তিনি ধরতে চাচ্ছেন, ওখানে প্রচুর কাঁচা টাকার ছড়াছড়ি। বাংলাদেশে তিনি পার্টনার করতে চাচ্ছেন মাজহার ভাইকে এবং সিঙ্গাপুরে আমাকে। কাশেম সাহেবের প্রথম এবং দ্বিতীয় ক্লায়েন্ট যথাক্রমে মাজহারুল ইসলাম এবং আমি। আমাদের দুজনের মাথায় চুল কম। আমাদেরকে তিনি ১৮০ ডলারের ওষুধ ধরিয়ে দিয়েছেন। তিন মাসের কোর্স, তিন মাসের মধ্যে আমাদের মাথায় শাহরুখ খানের মতো চুল উঠে যাবে এটা তিনি গ্যারান্টি দিচ্ছেন। বিফলে মূল্য ফেরত। ইস্ট রিভারের ওপর দিয়ে গাড়ি চলছে। কুইন্সবোরো ব্রিজ থেকে ম্যানহাটনের অপূর্ব স্কাইলাইন দেখে আমি মুগ্ধ। আমেরিকার ঐশ্বর্যের এক বড় নিদর্শন ম্যানহাটন। এই ঐশ্বর্যের ভিড়ে সুদূর প্রাচ্য দেশের একজন

পৃষ্ঠা:৬৭

লেখককে নিয়ে আমরা যাচ্ছি স্লোন কেটারিং হাসপাতালে। হুমায়ূন আহমেদের চোখে আমার মতো বিস্ময় নেই, তার বদলে আছে বিরক্তি। তিনি মাজহার ভাইকে বললেন মাজহার বাংলাদেশে ক্যান্সার রিসার্চ সেন্টারের ব্যাপারটা আমি কিন্তু ফাইনাল করে ফেলেছি। চিকিৎসার জন্যে এই বিদেশ-বিভুঁইয়ে অযথা কষ্ট করার কোনো মানে হয় না। তুমি চিন্তা করে দেখ সমস্ত কাজকর্ম, আত্মীয়স্বজন ফেলে হাজার হাজার মাইল দূরে আমরা কেন আসব? এখানে এসে বাড়ি ভাড়া করা, সংসার সাজানো কী পরিমাণ ঝামেলা তুমি ভেবেছ?… … আমার পরিকল্পনাটা শোন, তিনজন ভিক্ষুকের কাছ থেকে প্রথমে ক্যান্সার রিসার্চ সেন্টারের জন্যে অর্থ ভিক্ষা নেয়া হবে। এঁদের ছবি তুলবেন নাসির আলী মামুন। স্কেচ করবেন ও ইন্টারভিউ নেবেন মাসুক হেলাল। তারপর আমরা যাব বাংলাদেশের তিন ভিক্ষুকরা দান করেছে শুনে তাঁরা লজ্জায় ইচ্ছা।… ধর্ষ ধনী মানুষের কাছে। কী করেন আমার দেখার …শীর্ষ ধনীর পর আমরা যাব কাছে। তাঁরা কিছুই আমার ধারণা খালি হাতে আমাদের ফেরাবেন না। অনেকগুলো উপদেশ দেবেন। বেকানতে জানেন, দিতে জানেন না। তবে দেবেন না আমরা জানি। তাঁরা কেশ আমাদের অসদেশেরও প্রয়োজন আছে কি বলো? স করণিধ্যম তিন সংখ্যাটা কেন স্যার, তিনজন ভিক্ষুক, আমি জিজ্ঞেস করণ তিনজন ধনী আর তিন রাজনীতিবিদ? স্যার বললেন-শোন, পিথাগোরাসের মতে তিন হচ্ছে সবচেয়ে রহস্যময় সংখ্যা। এটি একটি প্রাইম নাম্বার। তিন হচ্ছে ত্রিকাল-অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল। তিন হল ট্রিনিটি। তিন মানে আমি, তুমি ও সে। ব্লাড দেবার পর আমরা সবাই মিলে নাস্তা সেরে লবিতে অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন ডাক্তার আমাদের ডাকবে। এখানে পেশেন্টরা সবাই প্রায় একা। শিশু ছাড়া কারো সঙ্গে কোনো এটেনডেন্স নেই। এখানকার চিকিৎসা সংস্কৃতি মনে হয় এরকমই যার যার রোগের বোঝা তাকেই বয়ে বেড়াতে হয়। আমরা তিনজন ঘিরে আছি হুমায়ূন আহমেদকে।

পৃষ্ঠা:৬৮

কিছুক্ষণ পর স্যারের ডাক পড়ল। আমরা ডা, স্টিফেন আর ভিচের রুমে গেলাম। স্যারকে দেখে খুবই আন্তরিক ভঙ্গিতে ডাক্তার ভিচ বললেন- হ্যালো মি. আহমেদ, ইউ আর ডুইং ভেরি ওয়েল। তোমার কেমো কাজ করতে শুরু করেছে। ব্লাড কাউন্ট নিচে নামছে। এটা খুবই সুখের খবর। তুমি কি শেষ পর্যন্ত সিগারেট ছাড়তে পেরেছ? স্যার বললেন-আমার ছোট ছেলেটির কথা ভেবে আমার ৩৭ বছরের বন্ধু সিগারেটকে আমি এক কথায় বিদায় দিয়েছি। বাঃ ভেরি গুড, তোমার খারাপ লাগে না? নাঃ বরং উল্টো, কাউকে সিগারেট টানতে দেখলে ভালো লাগে। আমাদের বাড়ির সামনে একটি ডেইলি গ্রসারি শপ আছে, সেখানে চা-কফি পাওয়া যায়। যখন কাউকে দেখি কফির মগ নিয়ে বাইরে এসে সিগারেট টানছে তখন খুবই ভালো লাগে। ভেরি গুড। সবাই পারে না। তুমি নিম্ন টোয়েনের সিগারেটের গল্পটা জান? স্যার বললেন হ্যাঁ আমেরিকান লেখক মার্ক জানি। মার্ক সিগারেট ছাড়া কঠিন ব্যাপার। না। মার্ক কোয়েন আমি তাদের আমি আবার সিগারেট ছেড়েছি’… ছাড়া কঠিন কিছুই। বলেছেন, ‘অনেকেই বলে কথা শুনে অবাক হই। সিগারেট স্যারের রসিকতায় বললেন, আমার একটা ভিচ হা হা করে হেসে ওঠেন। স্যার ভিচকে ছিল।বল কী তোমার প্রশ্ন? তোমরা থাকতে, স্লোন কেটারিং থাকতে স্টিভ জবস কেন মারা গেলেন? ডাক্তার ভিচের হাসি মিলিয়ে গেল। গম্ভীর মুখ করে তিনি বললেন- প্রথমত স্টিভ জবস আমাদের স্লোন কেটারিং-এ চিকিৎসা নেন নি। দুর্দান্ত মুডি মানুষ হিসেবে ক্যান্সারের শুরুতেই তিনি চিকিৎসা করান নি, অপারেশনেও রাজি হন নি। যখন রাজি হলেন তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাঁর অনকোলজিস্টরা অ্যাগ্রেসিভ ট্রিটমেন্টে গেছেন। তার ওপর জবসের পুরো লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হয়েছে। নানা রকম কমপ্লিকেশনও ছিল। আসলে ক্যান্সার ট্রিটমেন্ট হল ইনডিভিজুয়াল। প্রত্যেকের আলাদা রিয়েকশন এবং রেসপন্সের ওপর নির্ভর করে চিকিৎসা করতে হয়। আমার মনে হয় আমি তোমাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি।

পৃষ্ঠা:৬৯

স্যারের চিকিৎসার অগ্রগতি দেখে আমরা বেশ আনন্দিত। এ উপলক্ষে কাল আমরা ব্যাটারি পার্কে বেড়াতে যাবার পরিকল্পনা করলাম, সেখানে জম্পেশ আড্ডা ও ডিনার। স্যার বললেন, ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করেছে, ডিনারের বদলে লাঞ্চ করলে কেমন হয়? ডিনারের বদলে ঠিক হল, আমরা ব্যাটারি গার্ডের রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করব। তারপর পার্কে বেড়ানো। আমাদেরকে লিফট দেবেন গাজী কাশেম। হেয়ার ট্রিটমেন্ট প্রজেক্টটা তিনি হাতছাড়া করতে চাচ্ছেন না। পরদিন সকালে নাস্তা খেয়ে আমরা ব্যাটারি পার্কে বেড়াতে গেলাম। ওয়েদার খুবই মনোরম। গতকাল ডাক্তার স্টিফেন আর ভিচের কাছ থেকে আশার কথা শুনে স্যারের মনটা বেশ ঝলমলে। ছবি তোলার ব্যাপারে খুব উৎসাহ। আজ নিজ থেকেই নানা ভঙ্গিমায় অনেক ছবি তুলেছেন। মাজহার ভাই এবং আমাকে ডেকে অনেকগুলো ছবি বেড়াতে এলে ট্যুরিস্টদের মধ্যে যে ধরনের রকম উচ্ছ্বসিত। নে। আমেরিকায় প্রথম থাকে, স্যার আজ সে ট্যুরিস্টরা বোটে করে স্টাচু অব বললেন যাবে নাকি? প্রথম দেখবে না, তা তো হয় না। দেখতে যাচ্ছে। স্যার আমাকে ইকায় এলে অথচ স্টাচু অব লিবার্টি আমি মনে মনে বল আমার সামনে হুমায়ূন আহমেদ দাঁড়িয়ে আছেন, বাংলাদেশের অব লিবার্টির জীবন্ত প্রতিমূর্তি। তাঁকে ফেলে আমার সেই পাথরের স্টাচু দেখতে যাওয়ার কোনো মানে হয় না।

পৃষ্ঠা:৭০

১০

হুমায়ূন আহমেদ তাঁর জ্যামাইকার বাড়ির তিন তলায় এটিক রুমে বসে ছবি আঁকছেন। ছবিতে বিকেলের সোনা-রঙ আলো ফুটিয়ে তুলবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু সোনা-রঙ ঠিকমতো আসছে না। মেঘের রঙ হয়ে যাচ্ছে কালো। এর কারণ তিনি কিছুতেই ধরতে পারছেন না। জলরঙে কোনো সমস্যা নেই তো! রবীন্দ্রনাথের গান কি মনঃসংযোগ কেড়ে নিচ্ছে? আজ সকাল থেকে তাঁর মনে রবীন্দ্রনাথের একটা গান বেজে চলেছে- মেঘের পরে মেঘ জমেছে, আঁধার করে আমায় কেন বসিয়ে রাখ একা দ্বারের রবীন্দ্রনাথ কোথা থেকে পেয়েছিতোট এ ভাষা, ভাগ্যদেবতা কি তাঁকে দিয়ে এসব অখিয়ে সুর? অদৃশ্য কোনো নিয়েছেন? হুমায়ূন আহমেদের নিজের অভিজ্ঞতার কথা মনে গেল। গল্প-উপন্যাস লিখতে গিয়ে দেখা যায়, এক পর্যায়ে পাত্র-পাত্রীব্য নিয়তি য পাত্র-পাত্রীহীমিয়াতি তাঁর নিয়ন্ত্রণে থাকে না। কোনো অদৃশ্য নিয়ন্ত্রক যেন পাত্র-পাত্রীদের নিয়ন্ত্রণ করে! অনেক কিছুই তো করা হল এক জীবনে, আর কত? সেই নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার আর অচিনপুর দিয়ে শুরু। তারপর কতশত লেখা আর রাত্রি জাগরণ। টিভি নাটক লেখা, নাটক-সিনেমা বানানো। এতসব করতে গিয়ে ফ্যামিলিতে সময় দেয়া হয় নি। ছেলেমেয়েরা ক্রমশ দূরে সরে গেছে। তবুও জীবনের এই পড়ন্ত বিকেলে এসে মনে হয় জীবন এত ছোট কেন?

পৃষ্ঠা:৭১

আজকাল কোনো কিছুতেই একাগ্রভাবে মনঃসংযোগ করতে পারেন না হুমায়ূন আহমেদ। সকালে দেয়াল উপন্যাস নিয়ে বসেছেন, উপন্যাসের পটভূমি ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট। কিন্তু তিনি কিছুতেই ক্যান্টনমেন্টে ঢুকতে পারছেন না। তাঁর ভাবনা আটকে আছে নুহাশদের বাসায়। বড় অভিমানী ছেলে। ছেলেটার সঙ্গে ভালো করে কথাই হল না, চোখের আড়ালে বড় হল। ছোট ছোট চিন্তা-দৃশ্যপটে আজকাল মনটা আচ্ছন্ন থাকে। তখন লেখালেখি ফেলে ছবি আঁকতে ইচ্ছে করে। এটা ঠিক রাইটার্স ব্লক না, এক ধরনের বিষাদ। ক্যান্সার ধরা পড়ার পর থেকে তাঁর মন বিষাদে ছেয়ে আছে। কোনো কিছুতেই স্বস্তি আসছে না। আগে জানালার পাশে ম্যাল্ গাছটার দিকে তাকালে মনটা ভালো হয়ে যেত। কী সুন্দর পাতার রঙ, একটু বাতাস পেলেই তিরতির করে নাচে। কিন্তু ইদানীং ম্যাল্ গাছটার দিকে তাকালেই মন কারণে গাছ দ্রুত পত্রশূন্য হচ্ছে, তিনি যেন মধ্যে দেখতে পান। পুত্র নিষাদ এ ব্রণে হচ্ছে। আসন্ন শীতের ছায়াই ম্যাল্ গাছটার সেও এখানে বাবার সঙ্গে ছবি আমি একটা ক্যাসেল আঁকব, আমাকে সময় এটিক ঘরে আঁকবে। নিষাদ বাবাকে বলে- শিখিয়ে দাও। হুমায়ূন আহমেদ জিবে করলেন-ক্যাসেল দিয়ে কী হবে? -তোমার এই বাং আমার পছন্দ হয় নাই। আমি একটা বড় ভয়ঙ্কর ক্যাসেল হাউস বানাব (নিষাদ ভয়ংকর বলতে পারে না, সে বলে ভয়ঙ্কর)। এই বাড়িতে অনেক মানুষ আসে, সবাই তোমাকে ডিস্টার্ব করে। ক্যাসেল হাউসে কেউ আসতে পারবে না। ক্যাসপাররা বাড়ি পাহারা দেবে। -ক্যাসপার কারা বাবা? -ক্যাসপার চেন না? ওরা হল এক ধরনের ভূত, গাছে থাকে। তোমার কোনো বিপদ হলে ওরা তোমাকে বাঁচাবে। -আর তুমি? পুত্র নিষাদ বলে-আমি তো এখন ছোট বাবা, ছোটরা সব কাজ করতে পারে না। আমি শুধু এখন তোমাকে বাথরুমে নিয়ে যেতে পারব। তুমি

পৃষ্ঠা:৭২

কখনো একা বাথরুমে যাবে না। আমি তোমাকে হাত ধরে নিয়ে যাব। বাথরুম শেষ হওয়ার পর হাত ধরে নিয়ে আসব। হয়, আমি তোমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকব। ছোট আছে বাবা। যতক্ষণ বাথরুম শেষ না লজ্জা করতে নেই, ঠিক পুত্রের কথায় হুমায়ূন আহমেদের চেক পানি এসে গেল। বিদায়বেলায় কেন এত সুখের মতো ব্যথা! ব্যাক সাথে এত ছোট বয়সের স্মৃতি ওদের মনে থাকবে না। আরো কিছুদি হবেন!  যদি সময় পাওয়া যায়। বিধাতা কি সদয়

Home
E-Show
Live TV
Namaz
Blood
Job