গায়ের গন্ধ
পৃষ্ঠা ১ থেকে ৩
পৃষ্ঠা-০১
গায়ের গন্ধ
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
ই যে, ওই হল আঁচল! সবসময়ে আঁচল ১৫ বরে থাকত বলে মা এই নাম রেখেছিল।””বটে! তা বাপু, তুমি আঁচলের বৃত্তান্ত জানলে কী করে?””আছে, কানে আসে কি না, বাতাসে কত ফিসফাস ঘুরে বেড়ায় তা জানেন?””আমার কানে তো আসে না বাপু?””আপনার উঁচু কান, মোটর, ক্যানেস্তারা, হাতুড়ি আর লোহালকড়ের শব্দ ছাড়া আর কিছু কি আপনার কানে যায়?””কেন, শেতলাপুজোয় মাইক বাজে, চৌপথীতে ভোটের বক্তৃতা হয় সেসব কি আমার কানে আসে “তা আসে, আবার বেরিয়েও যায়। কোনও কিছু গায়ে মাখেন নাকি আপনি? আপনার গ্যায়ে শুধু তেলকালি, অথচ বাতাসে একসময়ে এন্ড ফিসফাস শুনেছিলাম, আপনি নাকি এমএসসি পাশ! দেখলে তো পে তায় হয় না।””ফিসফাসে বিশ্বাস করো কেন? আমি মিস্তিরি মানুষ, খেটেপিটে দুটো ডালভাতের জোগাড় করি, এটাই আসল কথা।””দেখুন ভোলাদা, মিস্তিরি আমরাও। তাই বলে দুনিয়া ভুলে দিনরাত গাড়ির কলকবজার মধ্যে ডুবে থাকতে হবে নাকি? আমাদের গাঁয়ের ফটিকটাদ পালাগান নিয়ে মজে থাকত। দিনরাত পালা ছাড়া কথা নেই। কিংবা ধরুন দিশেরপাড়ার নস্করবাবু, সকাল থেকে রাত আবধি ওস্তাদি গানের কালোয়াতি করে যাচ্ছেন। তার একটা মানে বুঝি, ওসবের মধ্যে একটা আলাদা রসকষ আছে। কিন্তু গাড়ির কলকবজায় কোন মধু ঘাপটি মেরে আছে একটু বুঝিয়ে বলবেন?””কেন বাপু, গেল হপ্তাতেই তো কি যেন একটা বাংলা সিনেমা দেখে এলুম কোথায়।””সিনেমা দেখুন ছাই না দেখুন ওতে কিছু আসে যায় না, কিন্তু একটু চোখ তুলে চারদিকটা দেখবেন তো। এখন কোথায় আছেন, বেলা ক’টা বাজে, খিদে-তেষ্টা পেয়েছে কি না এসবও যদি স্কুলে মেরে দেন তাহলে আপনার সম্পর্কে অন্যরকম ভাবতে হয়।””সে আবার কিরকম শুনি?””কিছু মনে করবেন না দাদা, লোকে আড়ালে বলে ভোলাটা পাগলা আছে।কী মুশকিল, একটা কাজ মন দিয়ে করতে গেলে লোকে তো একটু ওরকম হতেই পারে। আমাদের অঙ্কের স্যর হরিহরবাবুরও তো খাওয়াদাওয়ার ঠিক থাকত না।” “সেইটেই তো বললুম, পালাগান, কালোয়াতি কিংবা অঙ্ক তো শাস্ত্র, কিন্তু অটোমোবিলটা কোন হিসেবে তার সঙ্গে পাল্লা টানে?” “কেন, গাড়িই বা কি এমন খারাপ জিনিস। মানছি, আপনার মতো গাড়ির মেকানিক কমই আছে। আড়ালে আমরা বলাবলিও করি, ভোলাদার মতো গাড়ির হাঁচিকাশি বুঝতে পারার মতো বিদ্যে আমাদের নেই। তা বলে গ্যারেজের বাইরের দিকে একটু চোখ তুলে তাকাতে নেই?” “আহা, আজ তুমি বড্ড চটে আছ্যে। আচ্ছা, ওই আঁচল মেয়েটাকে নিয়েই বথেরা তো?” “আপনি তো আচ্ছা লোক ভোলাদা। ব্যাপারটা বখেরা হতে যাবে কেন? বখেরা মানে হল কক্কটি বা ঝামেলা। আপনার কি তাই মনে হচ্ছে।” “বাপু হে, সারা জন্ম মাত্র তিন মহিলার সঙ্গে আমার সম্পর্ক। মকুমা, মা আর দিদি। তিনজনেই থান্ডার। মকুমা তো চেলা কাঠ দিয়ে পেটাত, মায়ের অস্ত্র ছিল হাত পাখার বাঁট, কখনও গরম খুপ্তি। আর দিদি? ছয় বছরের বড় হওয়ার সুবাদে মাঝে মধ্যেই চুলের মুঠি ধরে উত্তম মধ্যম দিত। দিদির বিয়ে হয়ে গেছে, মা আর ঠাকুমার বুড়ো বয়সে দাপট কমে গেছে। তা বলে আমার আতঙ্কটা তো আর যায়নি। মেয়েমানুষকে বড্ড ভয় পাই বাপু। তাই বখেরা কথাটা মুখে এল।””এটা কথা হল না সাদা। মাসিমাকে বাস্তার বললেই তো হবে না। এই তো সেদিন চায়ের সঙ্গে টিচেভাজা খাওয়ালেন, মাতৃনিন্দা মহাপাপ।” “ওটা নিন্দে হবে কেন? মায়ের শাসন ছিল বলেই আমি বখে যাইনি। কথাটা ওভাবে বলা নয়,মা-মকুমার অসুখ করলে আমি অন্ধকার দেখি।” “এটাকেও বখে যাওয়াই বলে, বয়স কত হল তার হিসেব আছে?””বয়স নিয়ে ভেবে কী হবে। বেঁচে থাকলেই বয়সের
পৃষ্ঠা-০২
মিটার চড়তে থাকে।””বুড়োবয়সে দেখবে কে আপনাকে?””কেন, এই যে এতগুলো ছেলেকে হাতে ধরে কাজ শিখিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলুম, ওরাই দেখবে। না দেখলে বৃদ্ধাবাস আছে।” “বলি কি দাদা, বউ যেমন তেমন হোক, ঝগভুটে বা খান্ডারনি, সব বউই কিন্তু স্বামীটাকে আগলে রাখেন। দু-চারটে অন্যরকম আছে বটে, কিন্তু বেশিরভাগ মেয়েই নিজের মানুষটার কদর দেয়। ছেলেপুলেও তত আপন হয় না, যতটা বউ হয়।””তোমার আজ হল কী বলো তো হরিপদ? আমার মাথাটা খেতে এসেছো নাকি?” “না দাদা, ভালর জন্যই বলা। আপনি যে দুনিয়াটার দিকে মোটেই তাকান না। একটু কোথাও বেড়াতে যান না, সিনেমা-থিয়েটার গানবাজনার শখ নেই, শুধু কলকবজা নিয়ে পড়ে আছেন? রসকষ যে শুকিয়ে যাচ্ছে ভোলাদাদা? ছুপা রুস্তম হয়েই জীবনটা কাটিয়ে দেবেন?” “রুস্তম মস্ত বীর। আমার তো বুকের পাটাই “বিদ্যেকে অত তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করবেন না দাদা। মাধ্যমিক পাশ করার ধাক্কায় আমার মৃগী রোগের মতো হয়েছিল। থেকে থেকে কাঁপুনি উঠত, ঘন ঘন জলতেষ্টা আর পেচ্ছাপ পেত, খাওয়ায় অরুচি, অনিদ্রা,বদহজম। মাধ্যমিকের গুঁতোতেই যদি এতটা হয় তাহলে এম এ-র গুঁতোয় আরও না জানি কী কী হত। বাপ রে। তা দিদিমণিটার কী নাম যেন? জয়তী বোধ হয়! তা দিদিমণিটা আপনাকে বলছিল বটে, নবাঙ্কুর তুমি গ্যারাজ চালাচ্ছো! এ যে ভাবা যায়না! কত ভাল ছাত্র ছিলে তুমি, ফিজিক্সেফার্স্ট ক্লাস। দিদিমণির বরটা প্রথম প্রথমআপনাকে তুমি তুমি করে বলছিল মনেআছে? বৃত্তান্ত শুনে একেবারে নুতুপুতু হয়েকেমন আপনি আজ্ঞে করতে লাগল। সবমনে আছে আমার।””আজ ভাল জ্বালা হল হে হরিপদ, বলি মতলবটা কী তোমার?””সেটা আর খোলসা করতে দিচ্ছেন কই?””ওই তো, কী যেন একটা বলছিলে!””হ্যাঁ বলছিলাম, ওর নাম আঁচল।”ফর্সাপানা দিদিমণি গাড়ি সারাতে এসে না পড়লে আপনার পেটে যে এত বিদ্যে তাও কি জানতে পারতুম?দেননি ভগবান। তবে বেড়াতে যাই না কে বলল? এই তো গত বছর মা আর ঠাকুমাকে কাশী বিশ্বনাথ দেখিয়ে আনলাম।””সেটা তিন বছর আগে। আমার হিসেব আছে।””তা হবে। আর দিদির বাড়িতেও ঘুরে এলুম বেঙ্গালুরু থেকে।””সেও গতবার, তাও দিদি বিস্তর কাকুতিমিনতি করায়।””ও-ই যথেষ্ট, আমি না থাকলে গ্যারেজটা কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। ঠিকমতো কাজকর্ম হয় না। লোকে নালিশ করে।””গ্যারাজ আর গ্যারাজ। বলি একসময়ে যে ফুটবল খেলতেন, ক্লাবের থিয়েটারে পাট করতেন, তবলা শিখেছিলেন সব কিবিশ্বস্মরণ হয়ে গেল?””দূর দূর, অল্পবয়সে ও সব কে না করে বলো তো।””সেদিন সেই ফর্সাপানা দিদিমণি গাড়ি সারাতে হট করে এসে না পড়লে আপনার পেটে যে এত বিদ্যে তাও কি আমরা জানতে পারতুম?”ছাই বিদ্যে, কত ছেলেমেয়ে এম এ, বিএ পাশ করে ফ্যা ফ্যা করে বেকার ঘুরে। বেড়াচ্ছে দেখছো না। বিদ্যে দিয়ে কী হয়?”তাতে কী হল?” “ওই তো আপনার দোষ। আপনার কিছুতেই কিছু হয় না। কিন্তু আঁচল রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে চারদিকের লোক তাকায়।””দেশে কি নিষ্কর্মা লোকের অভাব? যা চোখে পড়ে তাই হাঁ করে দেখে। কেউ কেউ দেখবে দেয়ালে সাঁটা পুরোনো পোস্টারটাও হাঁ করে দেখছে।””তাও দেখে। আবার দেখার মতো জিনিস হলে তাও দেখে। রাস্তায় শুধু পুরোনো পোস্টার ছাড়া কি কিছু দেখার থাকে না?””বুঝলুম, আঁচল বোধহয় একজন দেখনসই মেয়ে।””শকুরের মুখে ছাই দিয়ে তাই এই গ্যারাজের সুমুখের পথ দিয়েই নিত্যি। যাতায়াত।” “””আঁচলের বাবার একখানা পুরোনো ওমনি গাড়ি ছিল। প্রায় ঝুরঝুরে অবস্থা। টেকো পরেশ হিসেবি লোক। গাড়িটাকে ছিবড়ে করে ছেড়েছিল। তারপর আপনাকে এসে ধরে পড়েছিল, ভোলাবাবু, গাড়িটা সামনের জানুয়ারি পর্যন্ত চালু থাকার ব্যবস্থা করে দিন। আমার একটা লাইফ পলিসি ততদিনে ম্যাচিওর করবে, তখন নতুন গাড়ি কিনব।” তাতে কী হল?””ওই তো আপনার দোষ। আপনার কিছুতেই কিছু হয় না। কিন্তু আঁচল রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে চারদিকের লোক তাকায়।””দেশে কি নিষ্কর্মা লোকের অভাব? যা চোখে পড়ে তাই হাঁ করে দেখে। কেউ কেউ দেখবে দেয়ালে সাঁটা পুরোনো পোস্টারটাও হাঁ করে দেখছে।””তাও দেখে। আবার দেখার মতো জিনিস হলে তাও দেখে। রাস্তায় শুধু পুরোনো পোস্টার ছাড়া কি কিছু দেখার থাকে না?””বুঝলুম, আঁচল বোধহয় একজন দেখনসই মেয়ে।””শকুরের মুখে ছাই দিয়ে তাই এই গ্যারাজের সুমুখের পথ দিয়েই নিত্যি। যাতায়াত।” “””আঁচলের বাবার একখানা পুরোনো ওমনি গাড়ি ছিল। প্রায় ঝুরঝুরে অবস্থা। টেকো পরেশ হিসেবি লোক। গাড়িটাকে ছিবড়ে করে ছেড়েছিল। তারপর আপনাকে এসে ধরে পড়েছিল, ভোলাবাবু, গাড়িটা সামনের জানুয়ারি পর্যন্ত চালু থাকার ব্যবস্থা করে দিন। আমার একটা লাইফ পলিসি ততদিনে ম্যাচিওর করবে, তখন নতুন গাড়ি কিনব।””ও হ্যাঁ। পরেশনাথ ঘোষ তো?” “হ্যাঁ, আর আপনারা মিত্তির।” “তুমি জ্বালালে হে হরিপদ। ঘোষ মিত্তিরের প্রসঙ্গ উঠাও কেন?” “ওঠে দাদা, ওঠে। পরেশবাবুদের বাড়িতেও উঠেছে।” “সে বাড়িতেই বা উঠছে কেন?” “সেখানেই তো রহস্য। পরেশ ঘোষের বউ ধ্রুবতারাকে চেনেন?” “না। আমার কি চেনার কথা?” “না চিনলেও ক্ষতি নেই। তবে তিনি আপনাকে চিনে ফেলেছেন। উনি জয়তী দিদিমণির পিসি।” “এ যে বেশ জটিল ব্যাপার দেখছি।” “রামচন্দ্রের সেতুবন্ধনে কাঠবেড়ালিরও নাকি কন্ট্রিবিউশন ছিল। আমারও একটু আছে। আমি জানিয়ে দিয়েছি, নবাঙ্কুর মিত্তিরের গ্যারাজ থেকে মাসে দেড় থেকে দু লাখ টাকা আয় হয়।” “একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না? হল নাকি? কিন্তু আমার হিসেবে কোনও গন্ডগোল নেই দাদা।””তুমি আমাকে যে বিপদে ফেলেছো তা বলার নয়। এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার একমাত্র উপায় হল, পালিয়ে যাওয়া।””তবে পালান। গ্যারাজ থেকে একটু তফাত হলে আপনার মনটা একটু বরং নরম হবে। ব্যাগপত্তর গুছিয়ে নিন। আমি নিজে সঙ্গে দিয়ে আপনাকে হাওড়া বা শিয়ালদা স্টেশন কিংবা দমদম এয়ারপোর্টে পৌঁছে। দেব।””ঠাট্টা করছি না হরিপদ। আমার একটা গোপন অসুবিধে আছে।” “কী সেটা?” “ঠিক বলার মতো নয়। লজ্জা এবং ঘেন্নার কথা। আর সেই জন্যই আমি সর্বদা মরমে মরে থাকি।” “ভোলাদা, আমাদের মরমে মরে থাকার কারণের কি অভাব আছে?” “ঠাট্টা নয় হরিপদ। শুনলে অবশ্য তোমার হয়তো হাসিই পাবে। তুচ্ছ বলেও মনে হতে পারে। কিন্তু আমার কাছে ব্যাপারটা মোটেই উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়।” “আর একটু খোলসা হলে হয় না? এত ভ্যানতাড়ার কী আছে?” “ছেলেবেলার ইস্কুলের বন্ধুরা আমার পাশে বসতে চাইত না। বলত, তোর গায়ে বিচ্ছিরি গন্ধ। ব্যাপারটা একদিনের নয়। ভাল করে সাবান মেখে স্নান করে গেছি। তবু বন্ধুরা গন্ধ পেত। গ্রীষ্মকালেই বেশি হত এটা। সেই থেকে আমি ভারী লজ্জায় পড়ে যাই। মাকেও এসে বলেছি। কিন্তু মা উড়িয়ে দিত। দূর, কোথায় তোর গায়ে গন্ধ? ওসব হিংসে করে খ্যাপানোর জন্য বলে। তা যে নয় তা আমি হাড়ে হাড়ে জানতুম।
পৃষ্ঠা-০৩
“”গায়ের গন্ধ। আপনি যে হাসালেন দাদা? পুরুষ মানুষ খেটেপিটে খায়। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মেহনত করে, তাদের গায়ে গন্ধ না হওয়াই তো আশ্চর্যের।” “তুমি যে গন্ধের কথা বলছো এ তা নয়। ক্লাস সেভেনে যখন পড়ি তখন অপালা নামে একটা নতুন মেয়ে এসে ভর্তি হল ক্লাসে। ভারী ভাল দেখতে। আড়ে আড়ে আমার দিকে চাইত। আমি তখন নিজের গায়ের গন্ধের জন্য মেয়েদের থেকে দূরে দূরে থাকি। কারও পাশে বসি না, মিশিও না মেয়েদের সঙ্গে। ভারী লজ্জা হয় নিজের জন্য “বুঝলুম, তা অপালা কী করল? “সে একদিন টিফিন পিরিয়ডে আমগাছের তলায় আমাকে পাকড়াও করল। অ্যাই, তুমি ওরকম আনসোশাল কেন? আমি তোমার সঙ্গে ভাব করতে চাই। আমি ঘাবড়ে গেলাম, ভ্যাবলা নই, আনস্মার্টও নই। কিন্তু নিজেকে নিয়ে বিপন্ন।” “ভাব হল?” “একটু হল। কয়েকটা দিন। বোধহয় সেটা ফেব্রুয়ারি-মার্চ হবে। তারপরই একদিন হাফ ছুটির পর ক্লাসে ফাঁকা ঘরে বসে গল্প করছি। দেখি অপালা রুমালে নাক চেপে ওষুধও দিয়েছিল বটে, কিন্তু পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিল, গায়ের দুর্গন্ধ ব্যাপারটা সিস্টেমের ডিফেক্ট। অনেকটাই জেনেটিক। কেউ কেউ বডি স্প্রে ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছিল।” “আমার যে এক গাল মাছি দাদা। গায়ের গন্ধ নিয়ে যে এমন গন্ধমাদন সমস্যা হতে পারে তা তো আমি একশো বছর ধরে বসে বসে ভাবলেও মাথায় আসত না।” “ওই যে বললাম, যার হয় তার হয়। কত রকমের আজব আতঙ্ক আছে তা ভাবলে অবাক হতে হয়। আমারও তাই শেষ তাবলি মনে হতে লাগল, বোধহয় পাপী টাপীদের এরকম দুর্গন্ধ বেরোয় গা দিয়ে। নিজেকে পাপী ভাবতে ভাবতে আর একরকমের পাগলামি এল মাথায়। ঠিক করে ফেললাম এরকম দুর্গন্ধ নিয়ে ভদ্রসমাজে মেলামেশার মানেই হয় না। বরং খেটে-খাওয়া মানুষদের সমাজে আমি ততটা বেমানান নই। কারণ গতরে যারা খাটে তাদের গন্ধ-উদ্ধ নিয়ে তেমন মাথাব্যথা নেই।” “শুধু গায়ের গন্ধের কথা ভেবেই কি ভদ্রসমাজ ত্যাগ করলেন ভোলাদা?” “ঠিক তাই। ভেবেছিলাম পিএইচডি করে কলেজটলেজে পড়াবো, রণে ভঙ্গ দিয়ে টিফিন পিরিয়ডে আমগাছের তলায় আমাকে পাকড়াও করল। অ্যাই, তুমি ওরকম আনসোশাল কেন? আছে। একটু বাদে কথার মাঝখানেই বলল, ‘আমার গাড়ি বোধহয় এসে গেছে। আজ আসি।'” “ইয়ে তো আজিব সি বাত হ্যায় দাদা।” এমনও তো হতে পারে যে, অপালার সদি হয়ে নাক সুড়সুড় করছিল, কিংবা বড় বাইরে পেয়েছিল।” “সে তুমি যাই বলো, গায়ের বোটকা গন্ধ নিয়ে আমি দিন দিন একা আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিলাম। লোকজন বিশেষ করে মহিলাদের কাছে যেতে ভয় করে। খুব সাবধানে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে যথাসম্ভব দূরত্ব রেখে চলি। ব্যাপারটা আমার মনের রোগেই দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল।” “গায়ের গন্ধ। শুধু গায়ের গন্ধ কি এত সিরিয়াস কিছু হতে পারে?” “ঠিক কথা। কিন্তু যার হয়, তার হয়। আর আমার অবসেশনটা এমনই দাঁড়িয়ে গিয়েছিল যে, আমি ডাক্তারের কাছে গিয়ে ধর্না দিয়েছিলাম। প্রথমে ডার্মাটোলজিস্ট, তারপর এন্ডোক্রিনোলজিস্ট, জেনারেল ফিজিশিয়ান, কেউ কিছু করতে পারেনি। নানারকম টেস্ট করে ছেড়ে দিয়েছিল।পিলু মিস্তিরির গ্যারাজে কাজে লেগে গেলাম। পিলু তো ভয়ে মরে। আমার হাতে পায়ে ধরে কাকুতি মিনতি করতে লাগল। বাবু, এসব আপনাদের কাজ নয়। এসব ছোটলোকি কারবার আপনার পোষাবে না। মা আর ঠাকুমার কানেও কথাটা গিয়েছিল। মা একদিন শলার ঝাঁটা দিয়ে মেরে বাড়ি থেকেই বের করে দিল। দিদি শুনে বলল, ‘বেশ হয়েছে।’ আর ঠাকুমা নাকি শনি ঠাকুরকে সিন্নি চড়িয়েছিল। কিন্তু আমি খুব খুশি, মনে হল সমাজে আমি আমার সঠিক অবস্থানের জায়গা খুঁজে পেয়েছি। মাঘাটা পরিষ্কার, বিজ্ঞানের পাঠ আছে। কাজে মন ছিল। সুতরাং মোটরগাড়ির সব গোপন খবর দেখে নিতে আমার মোটে সময়ই লাগল না। পিলু মিস্তিরি অবধি সেলাম করত।””গায়ের গন্ধের জন্য এতটা অধঃপতন। কোন হিসেবে অধঃপতন বুঝিয়ে বলবে? হিসেব করে দেখেছি প্রফেসারি করে যা রোজগার হত আমি তার থেকে বহুগুণ বেশি কামাই।” “কিন্তু প্রেস্টিজ। তেলকালি মেখে থাকেনবলে বাবুলোকরা এসে তো আপনি করেও বলে না।” “তবেই বোঝো, দোষটা মানুষের নয়, তেলকালির। ভাল জামাকাপড় পরে মাঞ্জা মারলেই লোকে ফের আপনি-আজ্ঞে করবে। ওই জন্যই লোকের ওপর আমার কোনও ভরসা নেই। লোক না পোক।” “বুঝলুম। কিন্তু আসল কথাটা হল, সেই গন্ধ ব্যাটা এখন কোথায়? আপনার গা ঘেঁষে এতকাল কাজ করছি, আজ অবধি তো সেই বিটকেল, বোটকা গন্ধটার হদিশ পেলুম না? সে ব্যাটা কোথায় গায়েব হয়ে আছে বের করে দেখান দিকি।” “তোমরা পাবে না হে। ওইটেই তো আমার স্ট্র্যাটেজি। ডিজেল পেট্রল মবিল আর কেমিকালে গন্ধটা আড়াল হয়েছে মাত্র।” “চালাকি ছাতুন দাদা, বুলাদিদের বাড়িতে শুটকি বান্না হলে সেই গন্ধ কি গ্যারেজে মারমার করে ঢোকে না? ইঁদুর পচলে গন্ধ পাই, ভ্যাট পরিষ্কার না হলে গন্ধ পাই, ছাতিম ফুটলে গন্ধ পাই, আর আপনার গন্ধটাই শুধু গায়েব হয়ে থাকবে?” “তুমি চাইছো কী বলো তো?” “আঁচলের কী হবে?” “কে আঁচল?” “ফের কথা ঘোরাচ্ছেন? পরেশের মেয়ে” আঁচল, সে আপনাকে ছাড়া বে বসবে না।”কেন “বোধহয় গন্ধটা পছন্দ হয়েছে।”চালাকি ছাড়ো হরিপদ। কাটা গায়ে আর নুনের ছিটে দিও না। নিজেকে নিয়ে আমার লজ্জা-ঘেন্নার শেষ নেই। তার ওপর একটা মেয়েকে টেনে এনে কষ্টে ফেলা।””আঁচলকে আপনার মায়েরও খুব পছন্দ। তবে উনি নাকি বলেছেন, ‘ওই ছোটলোকটাকে কেন বিয়ে করবে মা? বরং একজন ভদ্রলোক দেখে বিয়ে করো।”” “ঠিক কথাই তো বলেছে!” “কিন্তু আঁচল মানছে কই?” “বুঝিয়ে বললে মানবে।” “তাহলে একটা কাজ করুন, গায়ের গন্ধটা আঁচলকে একবার শুকিয়ে দিন।” “ইয়াকি কোরো না হরিপদ। এসব শুনে আমার ভাল লাগছে না।” “আপনি কি নিজের গায়ের গন্ধ পান?” “পাই বইকি?” “তাহলে নিজের সঙ্গে থাকেন কী করে? “ওটা কোনও কথা হল?” “হল, নিজের ভাল মন্দ যা আছে তা নিয়ে পালাব কোথায় বলুন তো। আমাদের কি পালানোর জো আছে?”