ফালি ফালি করে কাটা চাঁদ
পৃষ্ঠা ১ থেকে ১৫
পৃষ্ঠা-১
পবিত্র শাশ্বত জিনিশ যে তাকে চিরকাল রাখতে হবে অপরিবর্তিত রূপে। যাক না। জীবন বদলে। ঘটনাটি ঘটে; এটিই আমার জীবনের একমাত্র ঘটনা, যা ঘটে শুধুতে ঘটনা হিশেবে, বিশুদ্ধ ঘটনা হিশেবে, অন্য কিছু হিশেবে নয়।যে-অসরকারি ইউনিভার্সিটিটিতে পড়াই আমি, তার ছদ্বমার্কিন জ্ঞানচর্চায় ছলাকলার শেষ নেই, জ্ঞানের থেকে ছলাকলাই বেশি; তার অনন্ত ছলাকলার একটি হচ্ছে বছরে একবার দলে দলে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ঢাকার বাইরে- সিলেট বগুড়া রাঙ্গামাটি নেত্রকোণা দিনাজপুর বাংলাবান্ধা কুষ্টিয়া যশোর ঝিনাইদহ- যেতে হয়, সারতে হয় প্রবল এক পল্লীসংযোগপ্রকল্প, প্রশান্ত মহাসাগরের সুদূর দ্বীপপুঞ্জের মতো ছড়ানো পল্লীজীবনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হয় বহুরে সাড়ে চার লাখ টাকার সোনামণি হীরেমণি রাজপুত্রকন্যাদের, যারা মিনারেল ওয়াটার ছাড়া পুকুরের পানি দেখে নি ব’লে বিশ্বাস করে, পুকুরের পানিতে মাহ কীভাবে সাঁতার কাটে সেটা ভেবে চমকে ওঠে। এই সোনামণিদের আমি ভালোবাসি, ওদের একেকটিকে আমার আকাশ থেকে খ’সে পড়া তারার ছুলোকণা ধ’লে মনে হয়। পল্লীসংযোগে সবারই উৎসাহ প্রবল, জানুয়ারি ভ’রে উৎসব লেগে থাকে আমার অসরকারিতে, হৈহৈচৈচৈ দলে দলে পাজেরো ভ’রে দিকে দিকে ছোটো আর ফিরে আসো, একশেষ করো ক্যামেরা ভিডিও ল্যাপটপের; শিক্ষকরা, যারা এক সময় খটিতাম কোনো-না-কোনো এনজিওতে, তার আগে ডিশ মাজতাম নরওয়ে সুইডেন জার্মানি হল্যান্ডে, যাওয়ার জন্যে পাগল হয়ে থাকে, সাত দিন থলথলে ঢলঢলে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে বাইরে থাকার জন্যে মোটা টাকা ঢোকে পকেটে টাকার কোনো অভাব নেই, প্রজেক্ট করো আর টাকা নাও, আর ধনী মুখেল ব্ল্যাকেল বাঙা বাবাগুলোর রাজপুত্র রাজকন্যাগুলো এর জন্যে আরো উত্তেজিত হয়ে থাকে, তারা উত্তেজিত থাকে শারীরিকভাবেই, অঙ্গে অঙ্গে প্রত্যঙ্গে প্রত্যঙ্গে রক্রে রন্ধ্রে, বাইরে গিয়ে অনেকগুলো ড্যুরেন্স প্যান্থার রাজা কামসূত্র সেনসেশন সফলভাবে সংযোগ ক’রে ফিরে আসতে পারবে ব’লে। বনানী বারিধারায়, কালো কাচে ঢাকা পাজেরো টয়োটার ভেতরে সংযোগে তারা পূর্ণ পরিতৃপ্তি লাভ করে না।আমার অসরকারিটি একটি এনজিওই, ঝকঝকে চকচকে লেকচার সেমিস্টার ক্রেডিটের এনজিও, এটাকে আমি আমার দেহের প্রতিটি বন্ডের থেকেও ভালোবাসি, এটি মাস যেতে না যেতে আমাকে এতো টাকা দেয় যে এটাকে প্রকায়মনোবাক্যে ভালোবাসা ছাড়া উপায় নেই, এটা আমার দেহটি চাইলেও আমি অবলীলায় দান করতে পারি; আর এর কতো কর্মকাণ্ড, উৎসব, কতো পার্টি। এটি প্রতিবছর আরেকটি এনজিওর সাথে মিলেমিশে যাপন করে এই পল্লীসংযোগপ্রকল্প, পল্লী পল্লী পল্লী গান তারা গাইতে পছন্দ করে, যেহেতু ডোনাররা এটা খুব পছন্দ করে, পল্লীর সাথে পরিচয় না থাকলে বিশ্বের নাগরিক হওয়া সম্ভব নয়, সম্ভব নয় বিশ্বায়নও; এবং এ-বছর আমি ওই রাজপুত্র রাজকন্যাদের নিয়ে উঠি সিলেটের কমলগঞ্জের পাহাড়ের পর পাহাড়ের ওপর ছড়ানো একটি এনজিওর রেস্টহাউজে। আমার ভালো লাগে।
পৃষ্ঠা-২
পবিত্র শাশ্বত জিনিশ যে তাকে চিরকাল রাখতে হবে অপরিবর্তিত রূপে! যাক না জীবন বদলে। ঘটনাটি ঘটে; এটিই আমার জীবনের একমাত্র ঘটনা, যা ঘটে শুধু ঘটনা হিশেবে, বিশুদ্ধ ঘটনা হিশেবে, অন্য কিছু হিশেবে নয়।যে-অসরকারি ইউনিভার্সিটিটিতে পড়াই আমি, তার ছদ্মমার্কিন জ্ঞানচর্চায় ছলাকলার শেষ নেই, জ্ঞানের থেকে ছলাকলাই বেশি; তার অনন্ত ছলাকলার একটি হচ্ছে বছরে একব্যর দলে দলে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ঢাকার বাইরে- সিলেট বগুড়া রাঙ্গামাটি নেত্রকোণা দিনাজপুর বাংলাবান্ধা কুষ্টিয়া যশোর ঝিনাইদহ- যেতে হয়, সারতে হয় প্রবল এক পল্লীসংযোগপ্রকল্প, প্রশান্ত মহাসাগরের সুদূর দ্বীপপুঞ্জের মতো ছড়ানো পল্লীজীবনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হয় বছরে সাড়ে চার লাখ টাকার সোনামণি হীরেমণি রাজপুত্রকন্যাদের, যারা মিনারেল ওয়াটার ছাড়া পুকুরের পানি দেখে নি ব’লে বিশ্বাস করে, পুকুরের পানিতে মাছ কীভাবে সাঁতার কাটে সেটা তেবে চমকে ওঠে। এই সোনামণিদের আমি ভালোবাসি, ওদের একেকটিকে আমার আকাশ থেকে ব’সে পড়া তারার ধুলোকণা ব’লে মনে হয়। পল্লীসংযোগে সবারই উৎসাহ প্রবল, জানুয়ারি ভ’রে উৎসব লেগে থাকে আমার অসরকারিতে, হৈহৈচৈচৈ দলে দলে পাজেরো ভ’রে দিকে দিকে ছোটো আর ফিরে আসো, একশেষ করো ক্যামেরা ভিডিও ল্যাপটপের; শিক্ষকরা, যারা এক সময় খাটতাম কোনো-না-কোনো এনজিওতে, তার আগে ডিশ মাজতাম নরওয়ে সুইডেন জার্মানি হল্যান্ডে, যাওয়ার জন্যে পাগল হয়ে থাকে, সাত দিন থলথলে ঢলঢলে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে বাইরে থাকার জন্যে মোটা টাকা ঢোকে পকেটে টাকার কোনো অভাব নেই, প্রজেক্ট করো আর টাকা নাও, আর ধনী যুবেল ব্ল্যাকেল রাঙা বাবাগুলোর রাজপুত্র রাজকন্যাগুলো এর জন্যে আরো উত্তেজিত হয়ে থাকে, তারা উত্তেজিত থাকে শারীরিকভাবেই, অঙ্গে অঙ্গে প্রত্যঙ্গে প্রত্যঙ্গে রন্ধ্রে রন্ধে, বাইরে গিয়ে অনেকগুলো তারেক্স প্যান্থার রাজা কামসূত্র সেনসেশন সফলভাবে সংযোগ ক’রে ফিরে আসতে পারবে ব’লে। বনানী বারিধারায়, কালো কাচে ঢাকা পাজেরো টয়োটার ভেতরে সংযোগে তারা পূর্ণ পরিতৃপ্তি লাভ করে না। আমার অসরকারিটি একটি এনজিওই, ঝকককে চকচকে লেকচার সেমিস্টার ক্রেডিটের এনজিও, এটাকে আমি আমার দেহের প্রতিটি খণ্ডের থেকেও ভালোবাসি, এটি মাস যেতে না যেতে আমাকে এতো টাকা দেয় যে এটাকে শুকায়মনোবাক্যে ভালোবাসা ছাড়া উপায় নেই, এটা আমার দেহটি চাইলেও আমি অবলীলায় দান করতে পারি; আর এর কতো কর্মকাণ্ড, উৎসব, কতো পার্টি। -এটি প্রতিবছর আরেকটি এনজিওর সাথে মিলেমিশে যাপন করে এই পল্লীসংযোগপ্রকল্প, পল্লী পল্লী পল্লী গান তারা গাইতে পছন্দ করে, যেহেতু ডোনাররা এটা খুব পছন্দ করে, পল্লীর সাথে পরিচয় না থাকলে বিশ্বের নাগরিক হওয়া সম্ভব নয়, সম্ভব নয় বিশ্বায়নও; এবং এ-বছর আমি ওই রাজপুত্র রাজকন্যাদের নিয়ে উঠি সিলেটের কমলগঞ্জের পাহাড়ের পর পাহাড়ের ওপর ছড়ানো একটি এনজিওর রেস্টহাউজে। আমার ভালো লাগে।
পৃষ্ঠা-৩
এর আগে আমি কখনো সিলেটে আসি নি।আমি সমতলভূমির সমতল মেয়ে, নৃতত্ত্বে হনুলুলুর একটা তিন অক্ষরের ডিগ্রি থাকলেও আমি তো মেয়েই রয়ে গেছি আজো- আপাদমস্তক মেয়ে, বিশ্বটাকে আমি আজো পার্বত্য নয় বাঁকা নয় সমতলই মনে করি, মনের দিক দিয়েও আমি সমতলই; আমার ভেতরে ধানখেতের পর পাটখেত খালের পর নদী আর বিলের ভেতরে পুকুর দিঘি আছে, ধান পাট পুঁটিমাছ ট্যাংরা বোয়াল নলা ইলিশ গজার আছে, কোনো পাহাড়পর্বত টিলা নেই; যখন দু-পাশের পাহাড় পেরিয়ে আমাদের পাজেরোটি একটি পাহাড়ে উঠতে থাকে, আমি শিউরে উঠতে থাকি, পৃথিবীতে যেনো এর আগে কেউ পাহাড়ে ওঠে নি। একটা পাহাড় আমার ভেতরে তার সারা শরীর, হাত পা মাথা মুখ জিভ, নিয়ে ঢোকে। এটা পাহাড়, ছোটো হ’লেও পাহাড়, আমার মনে হ’তে থাকে; আমি একটা উল্লাস বোধ করতে থাকি। ঠিক হয়ে আছে আমি থাকবো পাহাড়ের ওপরের রেস্টহাউজে, সোনার টুকরোরা থাকবে এ-পাহাড়টি থেকে নেমে সামনের দুটি পাহাড়ের ভেতর দিয়ে গিয়ে একটি নিচু পাহাড়ের ওপরের আবাসিক গৃহগুলোতে। পাহাড়টিতে যখন ওঠে পাজেরোটি আমার ভেতরটা নিচের দিকে প’ড়ে যেতে চায়, যেমন ছোটোবেলায় দোলনায় ওঠার পর কেউ ধাক্কা দিলে নিচের দিকে প’ড়ে যেতো আমার ভেতরটা, তারপর দু-দিকে অজস্র গাছের অন্ধকারের ভেতর দিয়ে একটা চালু দিয়ে নামে আমাদের পাজেরোর পর পাজেরো, তখনও আমার ভেতরটা পেছনে প’ড়ে যেতে থাকে। আমার মনে হ’তে থাকে আমি একজন অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর না হয়ে পেছনের বালিকাটি হয়ে গেছি; আমার ভালো লাগে যে আমি চঞ্চল হ’তে পারি, দুলে উঠতে পারি, আমি ম’রে যাই নি।রাজপুত্র রাজকন্যাদের ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে আমি আসি আমার রেস্টহাউজে। রেস্টহাউজের কেয়ারটেকার কাম কুকটি অত্যন্ত চমৎকার, আমাকে দেখেই বুঝতেপারে যে সারাক্ষণ বাঙলার ভেতর ইংরেজি খুঁজেগুঁজে কথা বলতে হবে, বা সে আমার রাজপুত্র রাজকন্যাদের কথা শুনে, তাদের জিন্স আর বুকের উচ্চতা পাছার প্রসার আর পাজেরোর সাইজ দেখে, বুঝতে পেরেছে ইংরেজি গোঁজা ছাড়া উপায় নেই। বাঙালির মুখে ইংরেজি শুনতে আমার ভালো লাগে, এটা ওদের মায়ের বুলি হ’লেই ভালো হতো; আমি নিজে যখন বলি তখন বারবার আমাকে এ প্লাস প্লাস দিতে ইচ্ছে করে। পাহাড়ের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে রেস্টহাউজটি, আমার জন্যে রয়েছে সবচেয়ে পুবের ঘরটি, যেটি থেকে একসাথে দেখা যায় দক্ষিণ, পুব, আর উত্তর; আমি ঘরে ঢুকেই প্রকৃতির তিন দিকের আদরে আক্রমণে বিবশ হয়ে পড়ি, মনে হয় তিনটি পাহাড় তিন দিক থেকে উঠছে আমার ওপরে তিনটি পাহাড় তিন দিক থেকে টানছে আমাকে। এটা কোনো ধানখেতের সমতলতা নয়, বিলের জলসমষ্টি নয়; দেখতে পাই দক্ষিণে ঢালু হয়ে পাহাড় নিচের দিকে নেমে গেছে, এক কিলোমিটার দূরে বাঁকা হয়ে উঠেছে আরেকটি পাহাড়, পুবে অনেক দূরে আরেকটি পাহাড়, উত্তরে অজস্র গাছের ভেতর দিয়ে উঠেছে আরেকটি পাহাড়; জানালার জালের ভেতর দিয়ে ঠেলে
পৃষ্ঠা-৪
ঠেলে পাহাড় এসে ঢুকতে থাকে আমার ভেতরে। আমি চুপ ক’রে ব’সে থাকি, নিস্তব্ধতা সবুজ পাহাড় হয়ে আমাকে ঘিরে ধরে। অনেক বছর আমি এমন একলা হই নি, অনেক বছর আমি এমন একলা হওয়ার সুখ পাই নি।স্তব্ধ হয়ে ব’সে থাকি আমি, নৈঃশব্দ্য আমাকে অবিরল সবুজে ভ’রে দিতে থাকে, আমার মনে হ’তে থাকে আমার শরীর সবুজ হয়ে উঠছে, ভেতরের মাংস সবুজ হয়ে উঠছে, সবুজ হয়ে উঠছে রক্তনালির প্রবাহ।কেয়ারটেকার-কুক দরোজায় নক করলে আমি পৃথিবীতে ফিরে আসি। আমি বলি, কে? ভেতরে আসুন।সে বলে, ম্যাডাম, আপনের হট ওয়াটার লাগবে? আপনে বাথ নিবেন? আমি বলি, হ্যাঁ, গরম পানি হ’লে তো ভালোই হয়।সে বলে, আমি টাবে হট ওয়াটার দিতেছি, আপনে বাথ সেরে লন। আমি বলি, হ্যাঁ, দিন।সে বলে, বাথের পর কি টি খাবেন?আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, টি কি রুমে দিব, না ডাইনিংয়ে খাবেন?আমি বলি, গোশল করার পর আমি খাওয়ার ঘরে আসবো, তারপর চা বানালেই চলবে।সে বলে, টির সঙ্গে কী খাবেন?আমি বলি, এসেই বলবো।অ্যাটাচ্ড্ বাথরুম নেই, ঘর থেকে কয়েক পা ফেলেই একটি ছোটো চমৎকার বাথরুম, একটি বিশাল বালতিতে গরম পানি থেকে ধুয়ো উঠছে; আমি ভেতরে ঢুকে দরোজা বন্ধ করি, গরম পানিতে ঠাণ্ডা পানি মেশাই, সম্পূর্ণ নগ্ন হই, গোশল করতে থাকি। বাসায় হ’লে আমার অনেক সময় লাগতো, শরীরে মুখে বেশ কিছু প্রাকৃতিক জিনিশ মাখতাম, যাকে দেলোয়ার বলে হলুদ-মরিচ লাগানো, কখনো বলে পাঁচফোড়ন দেয়া, রান্ধনবাড়ন; সাবান আমার সহ্য হয় না, একটি বই নিয়ে গিয়ে বসতাম বাথরুমে, ঘণ্টাখানেক কেটে যেতো, এখানে অতোটা সময় দেয়া যাবে ব’লে আমার মনে হয় না; তবু ধীরেধীরেই আমি গোশল করি, আমার মনে হ’তে থাকে পৃথিবীতে আর কেউ নেই, ভেজা শরীরে বেবি ওয়েল মাখি, অনেকক্ষণ ব’সে থাকি বাথরুমের মেঝের ওপর।আমার অদ্ভুত লাগতে থাকে।চা খেতে ইচ্ছে করে। বাথরুমে এক কাপ চা পেলে বেশ হতো, টাটকা গরম লাল চা; বাসায় হ’লে এককাপ চা বানিয়ে নিয়ে, এককাপ গরম পানিতে এক চামচ পাতা আর আধ-চামচ চিনি ঢেলে, বসতাম বাথরুমে, বইয়ের পাতা উল্টোতে থকতাম, কখনো আয়নাটির সামনে দাঁড়িয়ে দেখতাম নগ্ন নিজেকে, স্তন দুটির লাল বৃত্ত, নাভির গভীরতা, জঘনের কোমল ভাস্কর্য নিজেকে দেখতে
পৃষ্ঠা-৫
আমার ভালো লাগে, দেখতে দেখতে নিজেকে আমার আপন মনে হয়, নগ্ন শরীর শুকোতে থাকতো, ইচ্ছে হ’লে আরেকটুকু বেবি ওয়েল মাখতাম, চা খেতে থাকতাম, উল্টোতে থাকতাম বইয়ের পাতা, দেলোয়ার হয়তো চিৎকার করতে থাকতো, তোমার রান্ধন হইলো?এখন কেউ চিৎকার করবে না, তবু আমি বেরিয়ে আসি বাথরুম থেকে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, চারদিকে কেউ নেই; জানালা দিয়ে দেখি কুয়াশা নামছে পাহাড়ের মতো, অন্য রকম হয়ে গেছে তিন দিকের পাহাড়, কুয়াশাজড়ানো পাহাড় এখন এগিয়ে আসছে আমাকে জড়িয়ে ধরার জন্যে; মনে হ’তে থাকে পাহাড়গুলো যদি তিন দিক থেকে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরতো, আমি সুখ পেতাম, আমার খুব সুখ পেতে ইচ্ছে করতে থাকে।ঘরে তালা দিয়ে আমি ডাইনিংরুমের দিকে হাঁটতে থাকি, বারান্দায় শেক্ষে শেব্দে বই সাজানো, মাতা মেরি ও তার পুত্রের মহিমার বই, ব্রাতার অলৌকিক গল্পের বই, দেখে আমার ওই বালকের জন্যে স্নেহভরা হাসি পায়- ত্রাতা, আহারে বিশ্বাস; যার যা ইচ্ছে বিশ্বাস করুক, এতে এ-মুহূর্তে আমার কিছু যায় আসে না; আমার সুখ লাগছে যে কেউ নেই চারপাশে, কোনো ত্রাতা নেই, শয়তান নেই, দেবদূত নেই, সাগ নেই, একটা পুরো রেস্টহাউজে একা আমি, এমন একলা হওয়ার সুখ আমি কখনো পাই নি, মনে পড়ে না শেষ কবে আমি একলা হয়েছিলাম।কখনো হয়েছিলাম? মনে পড়ে না, আমার প্রচণ্ড সুখ লাগতে থাকে।কুক বলে, ম্যাডাম, আমার নাম রামকৃষ্ণ।আমি তার নাম জিজ্ঞেস করি নি, সে হয়তো আমাকে সাহায্য করার জন্যে তার নামটি আগেই জানিয়ে দেয়, হয়তো নামটা এরপর আমার নানা কাজে লাগবে। কখনো আমি কারো নাম জিজ্ঞেস করি না, কিন্তু একবার শুনলে কখনো ভুলি না; নাম শোনার পর প্রতিটি মানুষকেই আমার গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়, নামই মানুষ। কিন্তু কখনো আমি কারো নাম জিজ্ঞেস করি না কেনো; কাউকেই কি প্রথম আমার গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না? শুধু তারা যখন বুঝিয়ে দেয় তাদের গুরুত্ব, শুধু তখনই বুঝতে পারি? রামকৃষ্ণ নামটা আমার ভেতরে কিছুক্ষণ ধ’রে অর্থহীনভাবে কাঁপে, আমি ওটাকে অর্থপূর্ণ ক’রে তুলতে চাই।আমি ধীরেধীরে এক টুকরো বাটারটোস্ট খাওয়ার চেষ্টা করি, ওটির ভেতর থেকে একটা পুরোনো গন্ধ বেরিয়ে এসে আমাকে থামিয়ে দেয়; রামকৃষ্ণ খুটখাট ক’রে কী যেনো করতে থাকে, আমি ভার দিকে তাকাই না। আমি বুঝতে পারি সে কিছু একটা শুনতে চায়, সে একটা নাম বলেছে, তার বিনিময়ে একটা কিছু শোনার তার অধিকার আছে।আমি বলি, রামকৃষ্ণ, আপনার নামটা খুব সুন্দর।রামকৃষ্ণ খুব খুশি হয়, বলে, ম্যাডাম, আপনে আমারে ‘আপনি’ বললেন। আমি বলি, অন্যরা বলে না?
পৃষ্ঠা-৬
রামকৃষ্ণ বলে, কেয়ারটেকার শোনার পর আপনি বলে, যখন দেখে আমি কুক, তখন তুমি বলে।আমি চা খেতে থাকি, মনে হয় রামকৃষ্ণ আরো কথা বলতে চায়; কিন্তু আমি কী বলবো তার সাথে, বা অনেক কিছুই ইচ্ছে করলে আমি বলতে পারি, বলতে ইচ্ছে করছে না। এই রেস্টহাউজের স্তব্ধতা আমাকে ঘিরে ধরেছে, রামকৃষ্ণ এখানে না থাকলেই আমি সম্পূর্ণ স্তব্ধতা পেতে পারতাম; কিন্তু রামকৃষ্ণ মনে হয় স্তব্ধতায় ক্লান্ত, সে চারদিকে কিছু শব্দের কলরব চায়।আমি কি রামকৃষ্ণের সাথে একটু নৃতত্ত্ব চর্চা করবো? একটু নাড়া দিলেই কি তার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসবে না নৃতাত্ত্বিক সোনার একটি-দুটো খণ্ড?আমি বলি, রামকৃষ্ণ, আপনি কোন কোন দেবতার পুজো করেন?এভাবে প্রশ্নটা করতে চাই নি, তার নামটা থেকে মনে করতে পারতাম সে হিন্দু, কিন্তু আমার একটু সন্দেহ ছিলো, তাই জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছিলো সে হিন্দু না খ্রিস্টান, কিন্তু সরাসরি এমন প্রশ্ন করা শোভন হবে না ব’লে মনে হয়, ধর্মানুভূতির প্রবল স্পর্শকাতরতার যুগে এটা বিপজ্জনকও হ’তে পারে, তাই আমি ঘুরিয়ে করি প্রশ্নটা, এতে চমৎকার সাড়া দেয় রামকৃষ্ণ।সে বলে, আমি কোনো দেবতার পূজা করি না, আমি হিন্দু না, ম্যাডাম, আমি খ্রিস্টান।আমি খুশি হই, চমৎকার একটি সোনার খণ্ড বেরিয়ে এসেছে; তবে একটি খণ্ডে চলবে না, আমার আরো কিছু সোনার খণ্ড সংগ্রহ করতে ইচ্ছে হয়।আমি জিজ্ঞেস করি, কে প্রথম খ্রিস্টান হয়েছিলেন, আপনার দাদা?সে বলে, আমিই প্রথম খ্রিস্টান হয়েছি, ম্যাডাম।একটু অবাক হই আমি; রামকৃষ্ণের বয়স চল্লিশের মতো হবে, সে খ্রিস্টান হয়ে থাকলে বেশি দিন আগে হয় নি, এবং তাকে একটা বড়ো সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিলো, খুব স্পষ্টভাবে সে বদল করেছিলো তার জীবন।আমি জিজ্ঞেস করি, কেনো খ্রিস্টান হলেন?সে বলে, আমার মাবাবা দাদাদাদী সবাই ছিলো চা বাগানের লেবার, লেবাররা মানুষ না, ম্যাডাম, তাদের মানুষ থাকতে দেয় না ম্যানেজাররা।তার কণ্ঠস্বরে ঘৃণা উপচে পড়তে থাকে।আমি বলি, কেনো মানুষ থাকতে দেয় না?সে বলে, কয়টা টাকার জন্যে দিনরাইত খাটতে হয় লেবারদের, আর ওই টাকা তারা মদ খেয়ে উড়িয়ে দেয়। মদ না খেয়ে উপায় নেই, ভাত না খেলেও চলে, কিন্তু মদ খেতেই হবে। আমার বাবা খালি মদ খেতো, আর আমরা ভাত খেতে পেতাম না। আর লেগে থাকে পুজা আর পুজা, আর ঘরে ঘরে কুষ্ঠ ঘরে ঘরে খাইসিস। এতো দেবতার পুজা করতে হতো, বুঝতে পারতাম না কোনটা কে? আমার বাবামা ছিলো ছোটলোক, আমি ছিলাম ছোটলোকের ছেলে,
পৃষ্ঠা-৭
আমাদের কোনো দাম ছিলো না, পুজার জন্যে আমরা টাকা দিতাম, কিন্তু মন্দিরে ঢুকতে পারতাম না। তাই ছোটবেলা থেকেই আমার আর ওই ধর্ম ভালো লাগতো না, লেবার হ’তে ইচ্ছে করতো না; মনে হতো পালিয়ে গিয়ে মানুষ হই।আমি বলি, খুব কষ্ট লাগতো আপনার?সে বলে, কষ্টের শেষ ছিলো না, ম্যাডাম। বাগানের ভিতর একটা ইস্কুল ছিলো, আমি সেই ইস্কলে যেতে শুরু করি, আমার মাবাবায় পাঠায় নাই, লেবারদের ছেলেমেয়েদের জন্যে ইস্কুল, বেশি কেউ যায় না, কিন্তু আমার যেতে ইচ্ছে করতো, ইস্কুলে গিয়েই শুধু আমার একটু শান্তি লাগতো।আমি জিজ্ঞেস করি, ইস্কুলটা খুব ভালো ছিলো?সে বলে, না, একদম ভালো ছিলো না, খালি ভালো ছিলো এক স্যার, স্যার ছিলো খ্রিস্টান, তারে দেখেই আমার ইচ্ছা হয়।
আমার চা খাওয়া হয়ে গেছে, রামকৃষ্ণের খনি থেকে আর সোনার খণ্ড তুলতে আমার ইচ্ছে হয় না, রামকৃষ্ণ ভালো আছে, চা বাগানে থেকে গেলে সে এমন মানুষ হয়ে উঠতো না; আমার স্তব্ধ হ’তে ইচ্ছে করে, আমি তাকে আর কোনো প্রশ্ন করি না, সেও থেমে যায়। ঘরে ফিরে কুয়াশার মতো পাহাড় আর পাহাড়ের মতো কুয়াশা দেখতে থাকি, আমি যেনো একা থাকার অসীমতা বোধ করি, এবং অনেক বছর পর ঝোঁপের একপাশে একঝাঁক জোনাকি দেখে আমি সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ হয়ে উঠি। জোনাকি উড়ছে, জোনাকি, এবং কুয়াশা, পাহাড়, আমি।পরদিন থেকে শুরু হয়ে যায় আমাদের পল্লীসংযোগপ্রকল্প।সংযোগের এলাকা কমলগঞ্জের বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের গ্রাম, ঘোড়ামারা; গ্রামটি দেখে শিউরে উঠি আমি, চঞ্চল হই না, স্নিগ্ধ হই, ওটি ওর নামের মতো নয়, বিষ্ণুপ্রিয়ার মতো; গুপুরিগাছের সারির পাশে আমগাছের ডালে যে-ঘুঘুটি ডাকছিলো, নিজেকে আমার মনে হয় সেই ঘুঘুটির ডাকের মতো সুখী ও অনন্ত। কতো বছর পর আমি ঘুঘুর ডাক শুনলাম, আহা, এখানে না এলে হয়তো আমার কখনো ঘুঘুর ডাক শোনা হতো না, মনেও পড়তো না যে মুঘু আছে পৃথিবীতে, আর ঘুঘু ডাকে। ওই দিকে মিষ্টি নদী ধলাই। আমার সোনামণি ছাত্রছাত্রীরা মেতে ওঠে গ্রাম দেখে, নদী দেখে; কিছু দেখে কোকাকোলার মতো উপচে পড়া একটু বেশি মেতে ওঠা ওদের স্বভাব, কিন্তু ওদের মুখ দেখে মনে হয় ওরা মেতে উঠেছে ভেতর থেকেই; সাথে সাথে মেতে ওঠে ওদের ল্যাপটপ, ক্যামেরা, ভিডিও। মণিপুরী বলতে এতোকাল আমার চোখের সামনে কেঁপে উঠতো নাচ, ওদের ঘরবাড়িগুলোকেও আমার সাহিংপরা স্থির নর্তকীর মতো মনে হয়, যেনো সূর্যের মুখের দিকে তাকিয়ে নেচে চলছে নিঃশব্দে। বাড়িগুলোর মুখ পুব দিকে, সূর্যের দিকে। আমরা মিশতে থাকি বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী নারী ও পুরুষের সাথে,পেতে থাকি টুকরো টুকরো তথ্য, মনে হয় প্রশান্ত মহাসাগরের কোনো দ্বীপেগিয়ে পৌঁচেছি, ভ’রে উঠছি। মিশছি আমরা লাহিং, ব্লাউজ, ইনাফিপরা নারীদেরসাথে, পাছাতিপরা পুরুষদের সাথে; বেশ লাগছে, খেরে দেখছি পান্তেই, উরুখই,
পৃষ্ঠা-৮
কলিখই, ভাজা নিমপাতা। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের দিকে দিকে নারী, তারাই বিষ্ণুপ্রিয়া, তারাই জমি তারাই ঘর; জমিতে ফসল ফলে উঠছে তাদের ছোঁয়ায় আর খামে; নারীরা চাষ করে না, চাষ পুরুষের কাজ, সব ধরনের চাষ, নারীদের কাজ ফসল বোনা, ফসল তোলা। বালাকাপানি উৎসবে ফসল কাটার জন্যে মেতে ওঠে নারীরা। ঘরে তাঁত থেকে শাড়ি ছড়িয়ে পড়ছে তাদেরই আঙুলের ছোঁয়ায়; আশিভাগ কাজ ক’রে চলছে তারা। কিন্তু? না, অধিকার নেই তাদের পিতার সম্পত্তিতে; স্বামীর সম্পত্তিতেও নেই। বেশ, বেশ; বিষ্ণুপ্রিয়া নারী, তুমি কাজ করো, রাসনৃত্যের মতো তুমি কাজ করো, কাজই তোমার শ্রেষ্ঠ নাচ, কিছু চেয়ো না। খিলকরানি। শব্দটা বেশ লাগলো আমার। বাসররাত, থিলকরানির আগে বরবধুকে একসাথে ঘুমোতে দেয় না তারা, উৎসব ক’রে তাদের ঘুমোতে দেয় একসাথে। একটি খুব ভেতরের সংবাদ নাড়া দিলো আমাকে; একটি বাচ্চা হওয়ার পর বিষ্ণুপ্রিয়া স্বামীস্ত্রীর এক বিছানায় শোয়া নিষেধ, ভিন্ন বিছানায় ভিন্ন ঘরে চ’লে যেতে হয়। পারে তারা? ভিন্ন বিছানা তৈরি হয়, কিন্তু বাকিটা পারে না। আমি কি পারতাম না একটি বিষ্ণুপ্রিয়া নারী হ’তে, যে মাঠে লাঙল চালাতো, ধান বুনতো, খেসারি তিল সরষে বুনতো, আবার ঘরে বুনতো লাহিং?পাঁচদিন হয়ে গেছে পল্লীসংযোগের, আরেক দিন বাকি, তার পরের দিন ভোরেই ঢাকা ফিরবো; সেদিন সন্ধ্যায় রেস্টহাউজে ফিরে আমি ধীরেধীরে উষ্ণস্নান নিই ঘন্টাদেড়েক ধ’রে, স্তব্ধতা আর নিঃশব্দতা উপভোগ করি শরীর জুড়ে, ঘরে ফিরে অনেকক্ষণ পাহাড় আর কুয়াশার সাথে সম্পর্ক করি; রামকৃষ্ণ দরোজায় নক করে ম্যাডাম, টি বানাবো? আমি তাকে পানি গরম করতে বলি। আমি ধীরেধীরে আশ্চর্য সুখে এক কাপ চায়ের জন্যে খাবার ঘরে যাই, মনে মনে চায়ের লাল রঙ দেখি, এবং সেখানেই দেখা হয় অদ্রলোকের সাথে। রামকৃষ্ণ ছাড়া এই প্রথম কাউকে দেখলাম রেস্টহাউজে। ভদ্রলোককে দেখেই আমার মনে হয় নিঃশব্দতা ভেঙে গেছে রেস্টহাউজের, চারদিকের সমস্ত পাহাড় ও কুয়াশার; আমি নিঃশব্দতার ভেঙে পড়ার প্রচণ্ড শব্দও শুনতে পাই। আমার কি খারাপ লাগে? আমার কি ভালো লাগে? আমি বুঝতে পারি না। খাবার টেবিলের একটি চেয়ারে ব’সে আছেন ভদ্রলোক, হয়তো চায়ের অপেক্ষায় আছেন; আমাকে দেখে প্রথম বিব্রত হন, তারপর কথা না ব’লে হাসেন, হাসিটাকে আমার কোলাহল ব’লে মনে হয়, আমিও মাথা নেড়ে হাসি, তারপর অন্য দিকে তাকাই, তাকাই রামকৃষ্ণের রান্নাঘরের দরোজার দিকে। আমি কি বসবো ভদ্রলোকের মুখোমুখি, ব’সে চুপচাপ বা হেসে হেসে চা খাবো? একটু বিব্রত বোধ করি আমিও; ভূখন দেখতে পাই দু-কাপ চা নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসছে রামকৃষ্ণ; তার হাত থেকে আমার চায়ের কাপটি নিয়ে চামচ দিয়ে চা নাড়তে নাড়তে আমি বেরোই খাবারঘর থেকে। খাবারঘর থেকে বেরোলেই ওয়েটিংরুমে সাজানো কয়েকটি সোফা, যেগুলোকে আমি দেখে আসছি পাঁচদিন ধ’রে, ইচ্ছে থাকলে একবারও বসি নি, বসার দরকার হয় নি, গিয়ে আমি একটিতে বসি। এভাবে বেরিয়ে এসে সোফায় বসতে আমার খারাপ লাগে, হঠাৎ দাদীর মুখ আর ঘোমটাটিকে মনে
পৃষ্ঠা-৯
পড়ে; কী হতো যদি বসতাম ভদ্রলোকের মুখোমুখি, চা খেতাম হেসে হেসে, কথা বলতে বলতে? আমার কোন অংশ দূষিত হতো, ছিঁড়ে পড়তো কোন অঙ্গ, প’চে যেতো কোন প্রত্যঙ্গ? আমি চা নাড়তে থাকি; একবার ইচ্ছে হয় উঠে গিয়ে ভদ্রলোকের মুখোমুখি বসি, বলি, আমি দুঃখিত।চায়ে চুমুক দিতে আমার ইচ্ছে করে না, মনে হয় চা তেতো হয়ে গেছে।দেখি ভদ্রলোক বেরিয়ে আসছেন তাঁর পেয়ালা হাতে, আমি একবার কেঁপে উঠি, ইচ্ছে হয় দাঁড়িয়ে বলি, আসুন।আমার কিছু বলতে হয় না, ভদ্রলোকই বলেন, আমাকে আপনি ছেড়ে এলেন ব’লে আমিই এলাম; কেউ আমাকে পরিত্যাগ করলে আমার খুব খারাপ লাগে।ভদ্রলোকের শব্দব্যবহারে আমি চমকে উঠে দাঁড়াই।আমি বলি, আসুন; কিন্তু পরিত্যাগ শব্দটা কি একটু বেশি অর্থপূর্ণ হয়ে গেলো না? আপনি বোধ হয় ছোটো ছোটো ঘটনাকে খুব বড়ো ঘটনা হিশেবে দেখেন।তিনি বলেন, সব ঘটনাকে নয়, শুধু ছেড়ে যাওয়ার ঘটনাগুলোকে; নৌকো ছেড়ে পেলে বিমান ছেড়ে গেলে গাড়ি ছেড়ে গেলে আমার কষ্ট হয়।তাঁর কথা শুনে আমার মজা লাগে, আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে কষ্টের ছাপ দেখার চেষ্টা করি; যাঁর এতো কষ্ট, তাঁর মুখে নিশ্চয়ই কষ্টের হাজার হাজার দাগ প’ড়ে গেছে, কিন্তু আমি কোনো দাগ দেখতে পাই না।আমি বলি, কেনো এতো কষ্ট হয়?তিনি বলেন, সম্ভবত মা আমাকে ছেলেবেলায় ছেড়ে গিয়েছিলো ব’লে। এবার আমার কষ্ট হয়, কিন্তু আমি কারো কষ্টকে সহানুভূতি দিয়ে চাপা দিতে পারি না, তাতে আমার মনে হয় আমি তার কষ্টকে অপমান করছি।আমি বলি, ছেলেবেলায় আপনার মা মারা গিয়েছিলেন বুঝি?তিনি বলেন, ম’রে গেলেও কষ্ট কম হতো, তখন মা আমারই থাকতো, কিন্তু মা আমাকে ছেড়ে গিয়েছিলো, বাবাকে ছেড়ে গিয়েছিলো।এ নিয়ে আর কথা বাড়ানো সম্ভব নয় আমার পক্ষে, আমি বলি, আসুন চা খাই, চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।আমরা চা খেতে থাকি, কথা বলতে থাকি, দূরে কুয়াশা নামতে থাকে, দক্ষিণের পাহাড়গুলো হয়তো অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে; এক সময় বুঝতে পারি আমি কথার পর কথা ব’লে চলেছি, অনর্গল, এতো কথা আমি অনেক বছর বলি নি, আমার ভেতর থেকে এতো কথা অনেক বছর বেরোয় নি, এতো কথাও তাহলে আমার ভেতরে ছিলো; এবং তিনিও বলছেন অনর্গল, তাঁর ভেতরেও কথার শেষ নেই। কী বলছি আমরা? খুবই নিরর্থক কথা, কিন্তু মনে হচ্ছে এমন গুরুত্বপূর্ণ কথা আর নেই, আমরা কখনো এতো অসাধারণ কথা আগে বলি নি, এখন সময় এসেছে সেই গুরুত্বপূর্ণ না-বলা কথাগুলো ব’লে ফেলার: সেই ছেলেবেলায় আষাঢ়ের বন্যায় আমাদের পুকুরে কীভাবে একজোড়া
পৃষ্ঠা-১০
নারকেল দিয়ে সাঁতার শিখেছিলাম, পানি ঢুকে গিয়েছিলো আমার নাকেমুখে, বাবা আমাকে কীভাবে বারবার ছুঁড়ে দিয়েছিলেন পানিতে, একবার আশ্বিনে বাবার সাথে বিলে গিয়ে শাপলা তুলেছিলাম, কচকচ ক’রে খেয়েছিলাম কাঁচা শাপলা, এক মাঘের সন্ধ্যায় আমাদের ছোটো খেজুরগাছে উঠে রস নামিয়ে এনে খেয়েছিলাম আমি আর আমার আপা, কেউ জানতে পারে নি, সে-সব রূপকথা আমার ভেতর থেকে ঝরনাধারার মতো বেরিয়ে আসছে, কখনো যা কাউকে বলি নি, তা আমি ব’লে চলছি ভদ্রলোককে; আর তিনি আমাকে ব’লে চলছেন তাঁর সাইকেল চালানো শেখার গল্প, বাজার থেকে ঘন্টায় চার আনা ভাড়ায় সাইকেল নিয়ে তিনি আর তাঁর বন্ধু সাইকেল চালানো শিখেছিলেন, সড়ক থেকে কীভাবে প’ড়ে গিয়েছিলেন শুকনো বরইকাঁটার পালার ওপর, ছিঁড়ে গিয়েছিলো গায়ের চামড়া, একবার সাইকেলের চেইনে জড়িয়ে প্রায় টুকরো হয়ে গিয়েছিলো বাঁ পায়ের একটা আঙুল, একবার মামাবাড়ি বেড়াতে গিয়ে দশ টাকা চুরি করেছিলেন মামাতো দুলাভাইয়ের পকেট থেকে, খুব হৈচৈ প’ড়ে গিয়েছিলো, বাড়ির সবাইকে সন্দেহ করা হয়েছিলো চোর ব’লে, শুধু তাঁকে ছাড়া, কেননা গুডবয় ব’লে তাঁর খুব নাম ছিলো, এইটে পড়ার সময় এক সন্ধ্যায় লুকিয়ে বিড়ি খেতে গিয়ে ধরা পড়েছিলেন বাবার কাছে, বাবা দেখেও তাঁকে দেখে নি, তিনি ব’লে চলছেন তাঁর অসামান। গল্প, আমি শুনে চলছি মন্ত্রমুগ্ধ। তিনি যা বলছিলেন, তার প্রভিটি টুকরোকেই আমার মনে হচ্ছিলো স্বপ্ন দিয়ে মোড়া, আমি যা বলছিলাম, তার প্রতিটিকেই তাঁর মনে হচ্ছিলো সোনার টুকরো।আমাদের চা একবার শেষ হ’লে আমরা আরেকবার চা বানাতে বলি রামকৃষ্ণকে, তারপর আরেকবার চা বানাতে বলি।বেশ রাত হয়ে গেছে খেয়াল করি নি, সময়ের কথা মনে পড়ে নি, মনে পড়ে যখন রামকৃষ্ণ এসে বলে, টেবিলে ডিনার দিবো?তিনি ঘড়ি দেখে বলেন, সাড়ে দশটা বেজে গেছে? এতো তাড়াতাড়ি? আমি হাসি; সাড়ে তিনটা বেজে গেলেও আমাদের মনে হতো, এতোতাড়াতাড়ি? খেতে আমাদের অনেক সময় লাগে- বাসায় তো আমি দুমদাম খেয়ে উঠি, ভাজির পর শাক নিই, মাছের একটা টুকরো নিতে না নিতেই মুরগির একটা রান নিই, দেলোয়ারও খেয়ে ওঠে ঝড়ের মতো, কিন্তু আজ; আমরা খাই কম, খাইই না, কথা বলি বেশি, খাদ্যের নয় কথার ক্ষুধায় পেয়েছে আমাদের; তাঁর ক্ষুধা মিটছে আমার কথার ভর্তায়, আমার ক্ষুধা মিটছে তাঁর কথার ভাজিতে; শুকনো মুরগির মাংসে আমরা কোনো স্বাদ পাই না, ভেটকির পেটিতে কোনো স্বাদ পাই না, ভাজিতে কোনো স্বাদ নেই; কিন্তু তিনি স্বাদ পান যখন আমি বলি মরিচ দিয়ে মেখে ভাজা পুঁটি মাছের কথা, আমি স্বাদ পাই যখন তিনি বলেন ইলশের ডিম ভাজার কথা। পাট শাক? অদ্ভুত, মধুর মতো। কচুর লতি?সাংঘাতিক, অমৃতের মতো। অমৃত কেমন? জানি না, পাট শাকের মতো, কচুর
পৃষ্ঠা-১১
লতির মতো, ধনেপাতার মতো। বোম্বাই মরিচ? আশ্চর্য সুগন্ধ, নাকের কাছে ধ’রে রাখতে ইচ্ছে করে। পেঁয়াজ ভর্তা? সরষের তেল দিয়ে? পান্তাভাতে? আহা, মধু। বেলেমাছের গুঁড়ো? ইশ, জিভে জল এসে যায়। টাকির পোনা? আহা, সেই কবে খেয়েছিলাম, যদি এই রাতে খেতে পেতাম।আমি বলি, আপনি জুয়োরের মাংস খেয়েছেন?তিনি লাফিয়ে ওঠেন, ই, অনেক, বেকন আমার খুব পছন্দ ছিলো, যখন বিলেতে ছিলাম, এখনো গেলে খাই।তাঁর কথায় আমি বিস্মিত হই না, একটু বীরত্বের প্রকাশ দেখতে পাই।আমি একটু হাসি, বলি, আমার হ্যাম পছন্দ।আমার কথায় তিনি একটু চমকে ওঠেন, চোখেমুখে একটা প্রশ্নের চিহ্ন দেখতে পাই।তিনি বলেন, কোথায় খেয়েছেন?আমি বলি, খেয়েছি।তাঁর আরেকটুকু জানতে ইচ্ছে করে আমি বুঝতে পারি, কিন্তু আরেকবার প্রশ্ন করতে তাঁর দ্বিধা হয়।আমি বলি, আপনার কী পছন্দ হুইস্কি, ওয়াইন, বিয়ার?আবার চমকে ওঠেন তিনি, বলেন, হুইস্কি, তবে বিয়ারও আমার খুব পছন্দ। আমি বলি, মাঝেমাঝেই খান?এবার তিনি বিব্রত বোধ করেন, কী বললে গ্রহণযোগ্য হবেন আমার কাছে একটু হিশেব করতে থাকেন মনে হয়, তারপর বলেন, কখনো কখনো খাই।আমি বলি, নিয়মিত খান না কেনো?তিনি বলেন, নিয়মিত খাওয়া কি ভালো?আমি বলি, কেনো ভালো নয়? কখনো কখনো খাওয়া যা ভালো নিয়মিত তা খাওয়া কি ভালো নয়?তিনি বলেন, আসলে আমি মাঝেমাঝেই খাই, তবে এটা শুনে আপনি আবার কী ভাবেন, তাই একটু কমিয়ে বলেছিলাম।আমি বলি, একটু-আধটু মিছে বলার অভ্যাস আছে তাহলে?তিনি লাফিয়ে ওঠেন, না, না, মিছে বলি নি, একটু ঘুরিয়ে বলেছি।আমি বলি, আপনার জানতে ইচ্ছে করে না আমি খাই কি না?তিনি বলেন, মেয়েরা তো সাধারণত খায় না।আমি বলি, আপনি তবলিগ করেন না কি? কাকরাইল মসজিদে যান তাহলে? না কি জামাতে ইসলাম? আপনার টুপিটা কোথায়? পকেটে? ওটা একতলা না দোতলা?আবার লাফিয়ে ওঠেন তিনি, আমাকে ভুল বুঝবেন না, মেয়েরা মদ খেলে আমি কিছু খারাপ মনে করি না, মদ তো ভালো জিনিশ।
পৃষ্ঠা-১২
আমি বলি, মদ? সেটা আবার কী? আমি চিনি হুইস্কি বিয়ার ওয়াইন ভদকা; মদ তো চিনি না।তিনি বলেন, হ্যাঁ, তাই তো, মদ বললে কেমন খারাপ লাগে, হুইস্কি বিয়ার ওয়াইন শ্যাম্পেন রাম বললে তো খারাপ লাগে না।আমাদের খাওয়া শেষ হয়, আমরা আবার চা নিয়ে গিয়ে সোফায় বসি।রামকৃষ্ণ বলে, আমি এখন বাসায় যাবো, আপনাদের আর কিছু লাগবে?তিনি বলেন, যাও, তবে তোমার চা-চিনি কোথায় একটু দেখিয়ে দিয়ে যাও, চুলোটাও দেখিয়ে দাও।তিনি উঠে গিয়ে সব কিছু দেখে আসেন, ইচ্ছে ক’রেই আমি যাই না; আমি জানি এমন পরিস্থিতিতে পুরুষেরা প্রচুর কাজে উৎসাহী হয়ে ওঠে, তাকে আমি কাজ করার সুযোগ দিই।চা খেতে খেতে তিনি বলেন, আমার নাম খালেদ, আমি ইঞ্জিনিয়ার।আমি হাসি আর বলি, নামপরিচয়ের কোনো দরকার ছিলো না; আপনার নামটি হয়তো আমার মনে থাকবে না।তিনি চমকে ওঠেন, বেশ আহতও বোধ করেন; একটি পুরুষের নাম মনে থাকবে না একটি নারীর, এটা তো অপরাধ।তিনি বলেন, আমার নামটা সুন্দর নয়, হয়তো আপনার মনে থাকবে না; আপনার নামটা আমার মনে থাকবে, আপনার নামটি কি বলবেন?আমি বলি, আমার নামটিও মনে রাখার মতো নয়, খুব বিচ্ছিরি একটা নাম। তিনি বলেন, পরিচয় হলো, অথচ আমরা আমাদের নাম জানবো না?আমি বলি, জানতে হবে কেনো? নামপরিচয় ছাড়া কি আমরা পাশাপাশি ব’সে চা খেতে পারি না, গল্প করতে পারি না?তিনি বলেন, তাহলে চলুন, একটু বাইরে হেঁটে আসি।বাইরে ঘন কুয়াশার ভেতরে গ’লে পড়ছে বয়ে চলছে চাঁদের আলোর ধারা, দূরে কুয়াশায় চাঁদের আলোতে ঘুমিয়ে আছে পাহাড়, আমাদের ঘিরে বড়ো বড়ো গাছ, আমরা দাঁড়িয়ে আছি যেখানে, সেটিও পাহাড়, পুবে সমতল জমির ওপর জ্যোৎস্নার ঢল নেমেছে, আরো দূরে পাহাড় ঘুমিয়ে আছে। আমি আবার স্তব্ধতা নিঃশব্দতা বোধ করি, ইচ্ছে হয় আমি হাঁটতে থাকি জ্যোৎস্নার ভেতর দিয়ে পাহাড়ের দিকে, একা একা গিয়ে উঠি পাহাড়ে, গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। আমার ওপর কুয়াশা ভাসুক, শিশির পড়ুক, একটা পাতার মতো আমি প’ড়ে থাকি পাহাড়ের ওপরে, আর আমাকে ভুলে যাক সবাই।তিনি বলেন, আপনি কিছু ভাবছেন।আমি বলি, ওই দূরের পাহাড় দেখে আপনার কী মনে হচ্ছে? তিনি বলেন, মনে হয় কিছুক্ষণ আগে ওকে কেউ ছেড়ে গেছে। আমি বলি, আপনি শুধু ছেড়ে যাওয়ার কথাই ভাবেন?
পৃষ্ঠা-১৩
তিনি বলেন, না, কাছে পাওয়ার কথাও ভাবি। আচ্ছা, আপনি বলুন পাহাড় দেখে আপনার কী মনে হচ্ছে?
আমি বলি, দেখে মনে হচ্ছে পাহাড়টা আমাকে জড়িয়ে ধরার জন্যে এগিয়ে আসছে, এপিয়ে এসে এসে জড়িয়ে ধরছে।তিনি বলেন, আপনার ইন্দ্রিয়গুলো সম্ভবত খুবই প্রবল।আমি বলি, না, এটা আমার মনে হচ্ছে, এতে আমার ইন্দ্রিয়গুলোর কোনো ভূমিকা নেই। সত্যিই পাহাড়টা এসে জড়িয়ে ধরলে আমি হয়তো ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেবো।ভদ্রলোক হঠাৎ আমার কাছ থেকে একটু দূরে সরে যান।আমরা রেস্টহাউজের পাহাড় থেকে নিচের দিকে নামতে থাকি, আমাদের মাথার ওপর বিশাল বিশাল গাছের ডাল থেকে ঝরতে থাকে চাঁদের আলো, শিশির, কুয়াশা বাতাসের মতো ধাক্কা দিয়ে যেতে থাকে।তিনি জিজ্ঞেস করেন, আপনার কি শীত লাগছে?আমি বলি, না।তিনি বলেন, এই রাতটি আমার চিরকাল মনে থাকবে।আমি বলি, আপনার স্মরণশক্তি হয়তো প্রবল।তিনি বলেন, আপনার মনে থাকবে না?আমি হাসি, বলি, হয়তো মনে থাকবে না।ভদ্রলোক বেশ আহত হন, বলেন, সত্যিই আপনার মনে থাকবে না, এমন একটা রাতের কথা আপনি ভুলে যাবেন? এই চাঁদ, কুয়াশা, পাহাড়… আপনি, আমি, রেস্টহাউজ, চা…আমি বলি, তাতে কিছু আসে যায় না; এ-রাতটি চমৎকার, খুবই মধুর, এই তো যথেষ্ট, এর সাথে চিরকালকে জড়ানো কি ঠিক হবে? আর রাত কি আমাদের বলছে যে আমাকে চিরকাল মনে রেখো, না রাখলে খুব কষ্ট পাবো, বা বলেছে মাঝরাতে বেড়ানো হে পুরুষ হে নারী, তোমাদের আমি মনে রাখবো?তিনি বলেন, কিছু কিছু ঘটনা কি চিরস্মরণীয় নয়?আমি হাসি, বলি, চিরকালের শেষে যেদিন পৌছোবো, সেদিন বাটা থেকে পান যেতে খেতে ব’সে ব’সে ভাববো কী কী মনে আছে, তাদের ধন্যবাদ জানাবো।তিনি বলেন, আপনি বিশ্বয়কর মানুষ।আমি হাসি, বলি, তার মানে বিস্ময়কর মেয়েমানুষ?তিনি বলেন, না, না, মেয়েমানুষ নন, মানুষ; আপনাকে বোঝা আমার পক্ষে সত্যিই কঠিন, আপনি সত্যিই বিস্ময়কর।আমি বলি, আপনি আর কোনো বিশ্বয়কর মানুষ দেখেন নি?তিনি বলেন, এমন দেখি নি, এতোটা দেখি নি, মনে হচ্ছে কখনো দেখি নি,
পৃষ্ঠা-১৪
আর দেখবো ব’লেও মনে হয় না।আমি বলি, আপনার কি লাফ দিয়ে শেষ সিদ্ধান্তে পৌঁছোনোর অভ্যাস আছে?তিনি বিব্রত হন, বলেন, না, আমি লাফ দিয়ে শেষ সিদ্ধান্তে পৌঁছি নি, অনেক ভেবেই বলেছি।তখন কুয়াশা জমাট বেঁধে নামে, আমরা একবার একজন হারিয়ে যাই অন্যের কাছে থেকে; এমন কুয়াশা কখনো দেখি নি।তিনি বলেন, আমরা কুয়াশায় হারিয়ে যাচ্ছি, আপনাকে দেখতে পাচ্ছি না।আমি বলি, আমি আছি, হারাচ্ছি না, আপনি হারিয়ে যাবেন না।তিনি বলেন, ম’রে গেলেও আমি হারিয়ে যাবো না, হারিয়ে গেলে আমি য’রে যাবো; এই রাতে আমি মরতে চাই না।আমি বলি, চলুন, ফিরে গিয়ে চা খাই।তিনি বলেন, আমার খুব ভয় হচ্ছে, যদিও খুব ইচ্ছে হচ্ছে, কী ক’রে আমার ইচ্ছেটাকে যে জানাই।আমি বলি, ভয় না ক’রে আপনার ইচ্ছেটা প্রকাশ করুন।তিনি বলেন, আমার ইচ্ছে করছে আপনার একটি হাত ধ’রে পাহাড়ে উঠি, চিরকালের জন্যে হাতধরাটিকে মনে রাখি।আমি হাসি, বলি, আপনি না হয়ে অন্য যে-কোনো পুরুষ এখন আমার পাশে থাকলে তারও মনে এ-ইচ্ছেটা জাগতো, কারো কারো ইচ্ছে জাগতো আমাকে জড়িয়ে ধরায়। বলুন ঠিক বলি নি?তিনি বলেন, আমাকে মাফ করুন, আপনার কথা শুনে আমার আর ইচ্ছেকরছে না, নিজেকে আমার খুব খারাপ মনে হচ্ছে।আমি বলি, না, আপনি খুব খারাপ নন, কী বলেন? আপনি এ-প্লাস পাবেন।তিনি বলেন, না, না, নিজেকে আমার এখন ইতর মনে হচ্ছে, যেনো আমিএকটা জঘন্য ইতর, সারাজীবন ইতরামো ক’রে এসেছি, মাতলামো ক’রে এসেছি, আর গলির মোড়ে মেয়ে দেখলেই ঠোঁট চেপে শিস দিয়েছি।আমি হাসি, বলি, আপনার এতোটা প্রায়শ্চিত্ত করার দরকার নেই, পুরুষমানুষ কি সব সময়ই একটু ইতর হয় না?ভদ্রলোক একবার কেঁপে ওঠেন, বলেন, হ্যাঁ, তাই, হয়তো তাই; পুরুষমানুষ, ওদের কথা আর বলবেন না, আমিও ওদের দলেরই।আমি হাসি, বলি, আচ্ছা, আপনি কখনো ধর্ষণ করেছেন?ভদ্রলোক লাফিয়ে ওঠেন, আপনি কী যে বলেন, আপনার মুখে কিছু আটকায় না, আপনি কি মনে করেন আমি ধর্ষণ করতে পারি?আমি বলি, আগে থেকেই আমি কিছু মনে ক’রে রাখি না।তিনি আমার থেকে বেশ দূরে স’রে যান, আমি বলি, অতো দূরে যাবেন না। আমরা রেস্টহাউজের দিকে উঠতে থাকি, তিনি আমার থেকে দূরে দূরে
পৃষ্ঠা-১৫
থেকে সাবধানে হাঁটতে থাকেন যেনো আমার শাড়ির আঁচলও গিয়ে তাঁর পুলওভারে না লাগে; আমার বেশ মজা লাগে।আমি বলি, এতো দূরে স’য়ে যাচ্ছেন কেনো, ধরুন, আমার হাত ধরুন।আমি বাঁ হাতটি তাঁর দিকে বাড়িয়ে দিই, তিনি ধরবেন কি ধরবেন না ভেবেভেবে সময় নেন, তারপর আমার হাতটি ডান হাতে ধ’রে হাঁটতে থাকেন। তাঁর হাতটি কাঁপতে থাকে।আমি বলি, আপনার ইচ্ছে পূর্ণ হলো? আমার আঙুলগুলো কেমন লাগছে?তিনি যেনো বিদ্যুতের কামড় খেয়ে আমার হাতটি ছেড়ে দেন, বলেন, না, না, এই হাত ধরা আর আগুন ধরা একই কথা; আমি ধ’রে রাখতে পারবো না।আমি বলি, কেনো, আমার হাতটি কি কোমল নয়?তিনি বলেন, কোমল, আগুনের মতো কোমল।আমি বাঁ হাত দিয়ে তাঁর ডান হাতটি ধ’রে রেস্টহাউজের দিকে উঠতে থাকি, ভদ্রলোক অবাক হয়ে তাকান আমার দিকে।আমি বলি, আপনার হাতটি একটু বেশি শক্ত, আপনি কি ইট ভাঙেন?তিনি চমকে ওঠেন, বলেন, এখন মনে হচ্ছে সারাজীবন ইট ভাঙলেই ভালো হতো; কাল থেকে ভাঙবো।আমি হাসি; বলি, এখন আমি যা চাইবো আপনি তা হ’তেই রাজি হবেন, মনে হবে আহা, আগে কেনো হলাম না; তাই না?তিনি বলেন, যেমন?আমি হাসি, বলি, আমি চাইলে এখন আপনি রাখাল হ’তে রাজি হবেন,রিকশাঅলা হ’তে রাজি হবেন, মাঝি হ’তে রাজি হবেন, জেলে হ’তে রাজি হবেন। ঠিক বলি নি?তিনি একটু সময় নেন, তারপর বলেন, তাই মনে হয়, আপনি বললে এখন আমি ওই পাহাড় থেকে মাটি কেটে আনতে পারি।আমি বলি, পাহাড় তো বেশ কাছে, ওই চাঁদ থেকে মাটি কেটে আনতে পারবেন না?তিনি বলেন, পারবো, হয়তো পারবো, অন্তত কোদাল নিয়ে রওনা হবো, জীবনে অন্তত একবার চাঁদের মাটি কেটে জীবন সার্থক করবো।আমি বলি, প্রচুর, প্রচুর মাটি কেটে আনবেন? তাই না?তিনি বলেন, হ্যাঁ, আপনার যতোটা লাগবে ততোটা কেটে আনবো। আমি বলি, আমার অনেক মাটি লাগবে।তিনি বলেন, বলুন, কতো ঘনফুট লাগবে, বলুন, এখনই গামছা প’রে ভানুগাছ বাজার থেকে চাঙ্গাড়ি কোদাল কিনে রওনা হই।ভদ্রলোক পাকা খেলোয়াড়, বেলতে জানেন, সম্ভবত অনেক খেলেছেন, আরো অনেক খেলবেন; আর আমার পাকা খেলোয়াড় পছন্দ।
পৃষ্ঠা ১৬ থেকে ৩০
পৃষ্ঠা-১৬
আমি বলি, তার দরকার নেই, চলুন ভেতরে গিয়ে চা খাই।দু-কাপ চা বানিয়ে আবার আমরা সোফায় বসি। বানাতে সময় লাগে না, লাগলেও সেটাকে আমাদের সময় মনে হয় না; তিনি পানি গরম করেন, আমি কাপে পানি ঢালি, তিনি চাপাতা দেন, আমি চিনি দিই, তিনি নাড়েন, আমি কাপ নিয়ে সোফার দিকে আসতে থাকি, তিনি আমার হাত থেকে কাপ দুটি নিয়ে সোফার সামনের টেবিলে রাখেন। একটু একটু খেতে থাকি আমরা, সময়ের অভাব নেই, একটি রাত প’ড়ে আছে সামনে। ব’সেই আমি আবার গভীর স্তব্ধতা নিঃশব্দতা বোধ করি। আমরা কোনো কথা বলি না, অনেক কথা বলা হয়েছে, মনে হচ্ছে এখন আমাদের ব’সে থেকে চা খাওয়ার সময় এসেছে।কুয়াশা দেখতে দেখতে আমি বলি, কটা বাজে?তিনি ঘড়ি দেখে বলেন, তিনটা।আমি বলি, আপনি ঘুমোতে যাবেন না?তিনি চমকে উঠে বলেন, যাবো। আপনি যাবেন না?আমি বলি, আজ না ঘুমোলে কেমন হয়?তিনি বলেন, বেশ হয়, অনেক রাত তো ঘুমিয়েছি, আজ না হয় না-ই ঘুমোলাম, জেগে থাকাও খুব সুখের।আমি বলি, গতরাতেও কি আপনার জেগে থাকার ইচ্ছে করেছিলো?তিনি বিব্রত হয়ে বলেন, না, কোনো কোনো রাতে জেগে থাকতে ইচ্ছে করে, রাতটা চিরকাল মনে থাকে।আমি বলি, আপনার চিরকাল ক-মাসে?তিনি বলেন, চিরকাল, অবিস্মরণীয় শব্দগুলো বলতে আমার ভালো লাগে।আমি আমার কাপটি নিয়ে উঠে দাঁড়াই, বলি, আসুন, আমার সঙ্গে আসুন, আমার ঘরে যাই।আমি জানি এটাই তিনি চেয়েছিলেন; এই রাতে আমার সঙ্গে চা খেতে খেতে কোন পুরুষ এটা না চাইতো? কোন অন্ধ, বধির, বিকলাঙ্গ?আমি হাঁটতে শুরু করি, ধীরেধীরে, আমার ভেতরে কে যেনো ব’লে ওঠে, কী এসে যায় যদি কিছু ঘটে, ঘটুক, কী এসে যায় কিছু ঘটলে।তিনি তাঁর কাপ নিয়ে আমার পেছনে হাঁটতে থাকেন; আমার ঘরের দরোজা খোলার জন্যে তাঁর হাতে আমার কাপটি সিই, চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে আস্তে চাপ দিতে দিতে নিজেকে বলি, কী এসে যায় যদি কিছু ঘটে, ঘটুক, কী এসে যায় কিছু ঘটলে; এবং দরোজাটা খুলে বলি, আসুন, ভেতরে আসুন।ঘরের ভেতরে পা দিই, পা দিতে দিতে নিজেকে বলি, কী এসে যায় যদি কিছু ঘটে, ঘটুক, কী এসে যায় কিছু ঘটলে।তাঁর মুখে অন্য একটা আলো পড়েছে দেখি, আলো থেকে ভিন্ন একটা আভা ঝিলিক দিচ্ছে, ঝিলিকটা এসে লাগছে আমার শরীরে। তিনি ভেতরে
পৃষ্ঠা-১৭
ঢোকেন, দরোজা বন্ধ করতে করতে একবার আমি নিজেকে বলি, কী এসে যায় যদি কিছু ঘটে, ঘটুক, কী এসে যায় কিছু ঘটলে।জানালার বাইরে জমাট কুয়াশার দুগ্ধ, পাহাড়গুলো দুধেল হয়ে উঠেছে। ভদ্রলোককে আমার অচেনা লাগে। তাঁর মুখটি কি একটু ছোটো হয়ে গেছে?একটু বেঁকে গেছে? একটু লম্বা হয়ে গেছে? অন্ত্রলোক কি আমার চেনা? তাঁকে কি আমি আগে কখনো দেখেছি?বিছানার পাশে শুধু একটি চেয়ার, আমি তাঁকে বলি, বসুন। কী এসে যায় যদি কিছু ঘটে, ঘটুক, কী এসে যায় কিছু ঘটলে।আমি বিছানার ওপর বসি, তাঁর দিকে তাকাই না, তাকালেও আমি হয়তো কিছু দেখতে পাবো না; শুধু একটি স্বর শুনতে পাই- কী এসে যায় যদি কিছু ঘটে, ঘটুক, কী এসে যায় কিছু ঘটলে।ভদ্রলোক আমার বাঁ হাতটি নিয়ে খেলা করতে থাকেন, আঙুল দেখেন, নখ নাড়েন, হাতটি নিয়ে তাঁর ঠোঁটে ছোঁয়ান, দু-হাতে ধ’রে রাখেন- বেশ খেলেন, তারপর তাঁর দুটি হাত আমার মুখের দিকে উঠে আসে; দু-হাতের ভেতরে আমার মুখটি নিয়ে আমার দুই চোখের ভেভরে তাকান ভদ্রলোক।মুখটি আমি চিনতে পারি না, মনে হয় না কখনো এ-মুখ দেখেছি, দেখতেও চাই না, চেনা হোক অচেনা হোক কিছুই এখন তাৎপর্যপূর্ণ নয় আমার কাছে।কী এসে যায় যদি কিছু ঘটে, ঘটুক, কী এসে যায় কিছু ঘটলে।আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসি, তাঁকে আমি চিনতে পারি না; তখন তাঁর ওষ্ঠ এগিয়ে আসে আমার ওষ্ঠের দিকে।ওষ্ঠ? এগিয়ে আসছে? আমার ওষ্ঠের দিকে? আসুক। কী এসে যায়। আমার ওষ্ঠে তাঁর ওষ্ঠ? কী এসে যায়? থাকুক।আমার গ্রীবায় তাঁর ওষ্ঠ? জিভ দিয়ে লেহন করছেন আমার গ্রীবা? কী এসে যায়? করুন।তাঁর হাত কাঁপছে আমাকে খুলতে? কাঁপতে থাকুক। তাঁর হাত মন্থন করছে আমাকে? করুক।তাঁর ওষ্ঠ লেহন করছে বৃন্ত? করুক। কী এসে যায়।এক সময় তিনি বলেন, বাতি নিভিয়ে দিই?আমি কি শব্দের জগতে আছি? শব্দও আমার অচেনা সনে হয়।আমি কথা বলি না, আলো আর অন্ধকার একই জিনিশ এখন আমার কাছে। আলো কী? অন্ধকার কী? বাতি কী? আমি কি এতোক্ষণ আলোতে ছিলাম? তাহলে কেনো এতো অন্ধকার লাগলো? তিনি আলো নিভিয়ে দেয়ার পর আমি কেনো আলো দেখতে পাচ্ছি?অন্ধকার না কি আলো, ও তিনি আমার পাশে, ওপরে, এপাশে, ওপাশে। তিনি যখন ঢুকতে থাকেন, আমার ভেতরে কে যেনো জেগে ওঠে, কথা
পৃষ্ঠা-১৮
বলতে শুরু কবে, আমি নিজেকে বলতে থাকি- এর পর জীবন আর আগের মতো থাকতে পারে না। জীবন বদলে দিচ্ছি আমি, বদলে যাচ্ছে জীবন। তিনি পরিশ্রম করতে থাকেন, কঠোর পরিশ্রমী মানুষ তিনি, আমাকে ভেঙে ফেলে আবার গড়ার চেষ্টা করতে থাকেন, আমাকে বাতাস জল আগুন মেঘ কুয়াশায় পরিণত করার সাধনা করতে থাকেন, আমি নিজেকে বলতে থাকি, এর পর জীবন আর আগের মতো থাকতে পারে না, জীবনকে আমি আগের মতো থাকতে দিতে পারি না। জীবন বদলে ফেলছি আমি? এইটুকুতেই জীবন বদলে ফেলতে হবে? এমন কী আর করছি? সূর্য গ্রহ নক্ষত্রপুঞ্জগুলোকে কি আমি আবর্জনারূপে ফেলে দিচ্ছি? কমলগঞ্জে পল্লীসংযোগে এসে না হয় একটি পুরুষের সাথে ঘুমোচ্ছি, তাতে এমন কী হচ্ছে? কোথায় পচছে আমার শরীর? শরীরের কোথায় ঘা হচ্ছে? কুন্ঠরোগ খ’সে খ’সে পড়ছে আমার কোন অঙ্গ? থকথকে হয়ে উঠছে কি আমার স্তন? নর্দমার স্রোত কি বয়ে যাচ্ছে আমার দুই বাহু দিয়ে? আমার মুখ কি ভ’রে যাচ্ছে দুর্গন্ধে? না তো। আমার মনে হয় এটি একটি ঘটনা, ঘটনামাত্র, তার বেশি কিছু নয়; আমি একটি ঘটনা ঘটাচ্ছি, ঘটাচ্ছি বিশুদ্ধভাবে; কোনো আবেগে নয়, পরিকল্পনায় নয়। তিনি খেটে চলছেন, বুঝতে পারি তিনি খাটায় দক্ষ, আমার একতিল জমিও চাষবাসের বাইরে রাখবেন না; কিন্তু আমি শুধু মজা পাচ্ছিলাম, ভাঙতে ভাঙতে গ’ড়ে উঠছিলাম, বলছিলাম, এর পর জীবন আর আগের মতো থাকতে পারে না। আমি কি ফিরে গিয়ে আমার আগের শয্যায় ঘুমোতে পারি, বালিশে মাথা রাখতে পারি? ঘুমোতে আমার ঘেন্না লাগবে না? আমি কি আর দেলোয়ারের নিচে আগের মতো প’ড়ে থাকতে পারি? প’ড়ে থাকতে আমার ঘেন্না লাগবে না? ভদ্রলোকের জন্যে আমার মনে আবেগ জন্মেছে? না, কোনো আবেগ তো দেখতে পাচ্ছি না, তাঁর মুখটিই মনে করতে পারছি না আমি, কেমন যেনো ভদ্রলোকের মুখটি? মনে হচ্ছে আমি তাঁকে একটি সুযোগ দিয়েছি, তিনি তার সদ্ব্যবহার ক’রে চলছেন, সদ্ব্যবহার করতে তিনি জানেন, এ-প্লাস প্লাস; মনে হচ্ছে আমি ক্ষুধার্ত একটি লোককে খাদ্য দিয়েছি, তিনি গোগ্রাসে খেয়ে চলছেন, পান ক’রে চলছেন; তার বেশি কিছু নয়। আমি বদলে দিচ্ছি জীবন, ভদ্রলোককে দিয়ে বদলে দিচ্ছি জীবন; এর পর জীবন আর আগের মতো থাকতে পারে না। জীবন বদলে যাওয়া কি খুব কঠিন হবে? হবে হয়তো; তাতে কী এসে যায়? ঠিক কি হলো জীবন বদলে দেয়া? কেনো, অঠিক কোথায়? জীবনকে একভাবে থাকতে হবে কেনো, জীবন কি খুব আহামরি চিরন্তন ব্যাপার যে তাকে গোবর দিয়ে লেপেপুছে উঠোনের মতো ঠিকঠাক ঝকঝকে রাখতে হবে? বদলাতে হ’লে ভেবেচিন্তে পরিকল্পনা ক’রে বদলাতে হবে? কেনো? ভদ্রলোক ভেঙেচুরে প’ড়ে গেছেন আমার পাশে, খুব পরিশ্রম করেছেন, থাকুন তিনি ঘুমিয়ে আমার পাশে, নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত; হয়তো জয়ী ভাবছেন নিজেকে, কমলগঞ্জে এসে এক সন্ধ্যায় তিনি একটা বিশাল জয় সম্পন্ন ক’রে ফেলেছেন, হয়তো সেটা ভেবে সুখ পাচ্ছেন, মনের ভেতরে খুঁড়ে খুঁড়ে তাকে অবিস্মরণীয় ক’রে রাখছেন; আর আমি ভাবছি, এর পর জীবন আর
পৃষ্ঠা-১৯
আগের মতো থাকতে পারে না।আমি কি একটু ঘুমোবো? রাত কতো বাকি? ইচ্ছে করলে ঘুমোতে পারি, ইচ্ছে করলে জেগে থাকতে পারি; আমি শুধু শুয়ে থাকি। শুয়ে থাকতে আমার খারাপ লাগে না, জীবনকে দেখে মনে মনে আমার হাসি পায়। আমি ভদ্রলোকের মুখটি মনে করার চেষ্টা করি, মনে পড়ে না; কারো মুখই আমার মনে পড়ে না। আমি মনে মনে বলি, জীবনকে আমি বদলে দিয়েছি।ভদ্রলোক আবার সক্রিয় হয়ে ওঠেন, তাঁর ক্লান্তি কেটে গেছে, বা তিনি যেএকটি সোনালি সুযোগ পেয়েছেন, সেটাকে সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে চান;অন্ধকারকে তিনি ব্যর্থ হয়ে যেতে দিতে পারেন না, এমন সুযোগ আর নাওআসতে পারে জীবনে। না কি তিনি চাচ্ছেন আমাকে আরো সুখী করতে? সুখেআমাকে ভরিয়ে দিতে, যাতে আমি রাতটিকে মনে রাখি। আমার কি ইচ্ছে হচ্ছে?না কি হচ্ছে না? আমি বুঝতে পারি না। আমি কি তাঁকে বাধা দেবো? ঠেলেসরিয়ে দেবো? তাহলে ভদ্রলোক কি আমাকে ধর্ষণ করবেন? ভয় পেয়ে চুপ ক’রেপ’ড়ে থাকবেন পাশে? হাঁটু গেড়ে কাতরভাবে প্রার্থনা করবেন?আমি তাঁকে বাধা দিই না, তিনি কাজ করতে থাকেন।তিনি বলেন, ভালো লাগছে?আমি কোনো কথা বলি না।তিনি হয়তো আমার থেকে একটা প্রশংসাপত্র আশা করছেন, সেটি পেলে আরো উদ্দীপ্ত হয়ে কাজ করতে পারবেন, কিন্তু এ-সময়ে আমি কথা বলতে পছন্দ করি না, কথা বলতেই পারি না, এ-সময়ে আমি প্রাচীন পাহাড়ের গভীরতম গুহার স্তব্ধতা চাই।ভদ্রলোক আবার খাটতে শুরু করেছেন, হয়তো আমাকে আরো অবিস্মরণীয় কিছু দেয়ার বাসনা জেগেছে তাঁর মনে, তিনি আমার বাহুর ভেতর দিয়ে গ্রীবার পাশ দিয়ে নাভির নিচ দিয়ে গিরিপথ উপত্যকা গুহার ভেতরে সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিয়ে কাজ করতে থাকেন, তাঁর জিভ অধীরভাবে কাজ করতে থাকে গভীর গহ্বরে; তিনি হয়তো ভাবছেন আমাকে জীবনের শ্রেষ্ঠ সুখটি দিচ্ছেন, যার কথা আমি কোনোদিন ভুলতে পারবো না; কিন্তু আমি নিজেকে বলতে থাকি, এর পর জীবন আর আগের মতো থাকতে পারে না। আমি আর আগের জীবনের মুখোমুখি দাঁড়াতো পারবো না, তার মুখোমুখি বসতে পারবো না; আগের জীবনকে বলতো পারবো না, এই শোনো। কেনো পারবো না? আমি জানি না; শুধু মনে হয় পারবো না। আমি কি অপরাধ করছি? না, আমার তা মনে হয় না। অপরাধ কেনো? কার ক্ষতি করছি আমি? চুক্তিভঙ্গ করছি আমি? আমার হাসি পায়। আমি কি একবার একটি ঠাপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলবো আমার জীবনের জন্যে? ভেতরে আমি কোনো দীর্ঘশ্বাস টের পাই না। হাহাকার ক’রে উঠবো আমার জীবনের নাম ধ’রে? কোনো হাহাকার আমি শুনতে পাই না। এবার ভদ্রলোক আরো শক্তি সপ্তাহ ক’রে কাজে নেমেছেন, তাঁর শিল্পকলার বাক্স খুলে ফেলেছেন,
পৃষ্ঠা-২০
একটির পর একটি শিল্প দেখাচ্ছেন, বেশ ভালো শিল্পী ভদ্রলোক, প্রতিভাবান; তাঁর ত্বক হয়তো আমার ত্বকের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছে, আগের বারের মতো তিনি আর উত্তেজিত চঞ্চল বিচলিত বিভ্রান্ত দ্বিধাগ্রস্ত নন, যেনো নিজের জমিতে কাজ করছেন, মন দিয়ে ঠিকমতো চাষ করছেন, লাঙল বিচলিত হয়ে ছুটছে না, যীর শান্তভাবে চযছেন, গাছের ছায়ায় মাঝেমাঝে বিশ্রাম নিচ্ছেন, আবার এসে লাঙল চালাচ্ছেন; আর আমি ভাবছি জীবনটাকে বদলে দিচ্ছি আমি, আমার খারাপ লাগে না ভালো লাগে না, শুধু বুঝতে পারি জীবনকে আমি আর আগের মতো থাকতে দিতে পারি না। ভদ্রলোকের জন্যে আমার করুণা হয়, তাঁর দিকে মনে মনে দুটো পয়সা ছুঁড়ে দিই; তিনি এতো পরিশ্রম করছেন আমাকে শ্রেষ্ঠতম পুলকটি দেয়ার জন্যে, আর আমি তাঁকে ভাবছি একটি যন্ত্র, যা দিয়ে আমি বদলে দিচ্ছি আমার জীবন।বীজ বোনা হয়ে গেলে তিনি এলিয়ে পড়েন, কোনো কথা বলেন না; হয়তো এখনই ঘুমিয়ে প’ড়ে নাক ডাকতে শুরু করবেন।আমি বলি, এবার কি ঘরে যাবেন?তিনি তাড়াতাড়ি উঠে পোশাক প’রে দরোজা খুলে বেরিয়ে যান।আমি গড়াই, মনে মনে হাসি, ভোর হয়ে এসেছে; আমার নতুন জীবনের প্রথম ভোর, আমি ভোরটির মুখ দেখার জন্যে বাইরে তাকাই।সুপ্রভাত, আমার নতুন জীবনের প্রথম ভোর, সুপ্রভাত।কমলগঞ্জের ঘোড়ামারায় আমাদের শেষ দিন; ছেলেমেয়েদের ল্যাপটপ, ভিডিও, ক্যামেরা মেতে ওঠে শেষবারের মতো; আমার মনে পড়ে গতরাতে কী যেনো ঘটেছিলো। কী ঘটেছিলো? একটি ঘটনা? আমি জীবনটাকে বদলে দিয়েছি? একরাতেই বদলে দিয়েছি জীবন? ঘোড়ামারার শুপুরিগাছগুলো আগের মতোই আছে, আগের মতোই খেতে কাজ করছে বিষ্ণুপ্রিয়া মেয়েরা, ঘরে ফিরে তারা আগের মতোই ডালের পর ডাল রাঁধছে, ঘুঘুটা ডাকছে, আমি শুধু বদলে দিয়েছি জীবন। আমার ভালো লাগে না, খারাপ লাগে না; আমি ছেলেমেয়েদের সাথে উল্লাসে ছবি তুলতে থাকি, ল্যাপটপে তথ্যের পর তথ্য ঢোকাতে থাকি, এবং এক সময় ভুলেই যাই যে আমি জীবন বদলে দিয়েছি। সন্ধ্যায় যখন আমাদের পাজেরো ঢোকে রেস্টহাউজের প্রাঙ্গণে, আমি পাজেরো থেকে নেমে ঢুকি রেস্টহাউজে, ঢুকেই দেখি ভদ্রলোক ব’সে আছেন সোফায়, তখনই আবার আমার মনে পড়ে জীবনকে আমি বদলে দিয়েছি।এটা আমার নতুন জীবনের প্রথম সন্ধ্যা; আমি বাইরে তাকিয়ে একবার সন্ধ্যার মুখটি দেখি।শুভসন্ধ্যা, আমার নতুন জীবনের প্রথম সন্ধ্যা।ভদ্রলোক এগিয়ে এসে বলেন, আপনার জন্যেই ব’সে আছি, চা খাবো ব’লে। আমি হাসি, বলি, আপনি চা খেতে খেতেই তো অপেক্ষা করতে পারতেন। তিনি বলেন, না, তা ভালো লাগতো না; আপনার জন্যে ব’সে থেকেই বেশি
পৃষ্ঠা-২১
ভালো লেগেছে।আমি বলি, তাহলে যে আরো একঘন্টা ব’সে থাকতে হবে। তিনি বলেন, তাও আমার ভালো লাগবে। আমি রামকৃষ্ণকে বাথরুমে গরম পানি দিতে বলি।গোশল করতে করতে আমি ভাবি আমি কি ব্যগ্র হয়ে আছি ভদ্রলোকের সাথে চা খাওয়ার জন্যে? চা? ভদ্রলোক? না, তেমন তো আমার মনে হয় না। চা খাওয়ার কথা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম, ভদ্রলোক মনে করিয়ে দেয়ায় আমার চা খাওয়ার তৃষ্ণা পেয়েছে। আমি ধীরেধীরে গোশল করি, নিজেকে দেখি, গায়ে বেবি অয়েল মাখি, শরীরটা আমার আগের মতোই আছে, শুধু নিচ দিকে একটু ব্যথা করছে; বাথরুম থেকে বেরিয়ে ঘরে আসি, বিছানার পাশের চেয়ারটিতে বসতে ইচ্ছে হয় আমার, বসার পরই ভালো লাগে কুয়াশা, আর কুয়াশার ভেতর দিয়ে পাহাড় দেখতে। কুয়াশা আমার ভেতরে ঝলমল করতে থাকে, পাহাড়গুলো ঝলমল করতে থাকে; ঘর থেকে বেরোতে আমার ইচ্ছে করে না। এই প্রথম সন্ধ্যাটি তো আগের সন্ধ্যাগুলোর মতোই চমৎকার, দূরের পাহাড়টি তো আগের মতোই চঞ্চল করছে আমাকে। তাহলে জীবনের বদল ঘটে নি? ব’সে থাকতে ভালো লাগছে আমার। চা খেতে হবে? খেতে ইচ্ছে করছে? করছে? কেট এক কাপ চা বানিয়ে আনলে বেশ হতো। না খেয়ে খুব খারাপ লাগছে? না তো। চা না খেলেও খারাপ লাগবে না।অনেকক্ষণ হয়তো কেটে গেছে, দরোজায় টোকার শব্দ শুনতে পাই।আমি কুয়াশা দেখতে থাকি, কারো কথা আমার মনে থাকে না। আমি গিয়ে দরোজা খুলি, দেখি ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। আমি বলি, চলুন, চা খেতে যাই।আমরা গিয়ে সোফায় বসি, রামকৃষ্ণ চা, বিস্কুট, চানাচুর, কেক নিয়ে আসে। এতো আয়োজন দেখে আমি হাসি।তিনি বলেন, আপনি বোধ হয় চা খাওয়ার কথা ভুলে গিয়েছিলেন। আমি বলি, আপনার নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হলো। তিনি বলেন, হ্যাঁ, হয়েছে, তবে চায়ের জন্যে নয়, আপনাকে না দেখে। আমি হাসি, বাহ্, আপনাকে তো এক সন্ধ্যায়ই রোগে ধ’রে ফেলেছে। তিনি বলেন, না, কোনো রোগে ধরে নি তো। আমি বলি, এই যে প্রেমে পড়া পড়া রোগটা দেখতে পাচ্ছি। তিনি বলেন, কেনো? আমার কথা আপনার সারাদিনে মনে পড়ে নি? আমি বলি, কাজ নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলাম, আপনার কথা মনে পড়ে নি।ভদ্রলোক খুব আহত হন, একটি আন্ত অগুলিঙ্গসম্পন্ন পুরুষমানুষ, যে আমার শরীরটি সারারাত চষেছে, আরোহণ করেছে আমার ওপর, যে প্রভু হয়ে উঠেছিলো আমার শরীরের, উল্টেপাল্টে যে উপভোগ করেছে আমার শরীরের
পৃষ্ঠা-২২
সমস্ত উচ্চতা নিম্নতা সমতলতা, তাকে কী ক’রে আমি ভুলে যেতে পারি? সে কি তেলেপোকা, পিঁপড়ে, বা কুকুরছানা যে ভুলে যাবো? খুবই অন্যায় করেছি আমি, বড়োই অপরাধ করেছি; আমার ক্ষমাপ্রার্থনা করা উচিত।আমি বলি, আমি ক্ষমা চাই।তিনি বিব্রত হয়ে বলেন, কেনো, কিসের জন্যে ক্ষমা?আমি বলি, এই যে আপনাকে ভুলে গিয়েছিলাম।তিনি বলেন, বলুন, সত্যিই ভুলে গিয়েছিলেন?আমি বলি, হ্যাঁ, সত্যিই।তিনি বলেন, কী ক’রে পারলেন? আমি তো পারি নি।আমি বলি, কেনো পারেন নি?তিনি বলেন, যাঁর সাথে এতো গভীরভাবে একটি রাত কাটালাম, তাঁকে কীক’রে ভুলি? আপনি কী ক’রে ভুলে রইলেন? আমি হাসি, বলি, আচ্ছা, আমি যদি সারারাত রামকৃষ্ণকে নিয়ে ঘুমোতাম, তাহলে কি আপনার মনে হয় তাকে আমি সারাদিন মনে রাখতাম?তিনি শিউরে ওঠেন, না, না, আপনি তা পারেন না, রামকৃষ্ণকে নিয়ে আপনিঘুমোতে পারেন না।আমি বলি, কেনো নয়?ভদ্রলোক কোনো উত্তর খুঁজে পান না, তিনি চারদিকে বিচলিতভাবে তাকাতে থাকেন, তাঁর পৃথিবী কাঁপছে; তারপর বলেন, আপনার একটা ডক্টরেট আছে, আপনি একটা ইউনিভার্সিটির অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, আপনি এটা পারেন না।আমি বলি, আপনার সাথে আমি ঘুমোলাম, এর সঙ্গে রামকৃষ্ণ বা মালি হরিদাস বা রিকশাঅলা কেরামতের সাথে ঘুমোনোর কী পার্থক্য? আমি তো পদের সাথে ঘুমোই নি, ঘুমিয়েছি মানুষের সাথে।তিনি এবার আর ব’সে থাকতে পারেন না, উঠে একবার খাবার ঘরে যান, বেরিয়ে দক্ষিণের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন, তারপর এসে বসেন। আমি বলি, আজ রাতটা আপনার খুব খারাপ কাটবে, সারারাত জেগে থাকতে হবে।তিনি বলেন, কেনো? আমি বলি, আপনি তো আর আজ আমার সঙ্গে ঘুমোবেন না, আপনার রুচিতে বাঁধবে।তিনি বলেন, আপনি বিস্ময়কর মানুষ, আপনার পায়ের নিচে ব’সে থাকতে পারলেও আমি সুখী হবো।আমি বলি, আপনি বাড়িয়ে বলছেন।তিনি বলেন, একা থাকলে কষ্টে থাকবো, এটা সত্যি।আমি বলি, শুয়ে শুয়ে ভাববেন আমি হয়তো রামকৃষ্ণের সাথে ঘুমোচ্ছি,
পৃষ্ঠা-২৩
তখন আপনার আর ঘুম আসবে না।ভিনি বলেন, আপনি এটা করবেন না, আমি জানি।আমি বলি, আপনি নিজেকে প্রবোধ দিচ্ছেন, নইলে আপনার কষ্টের সীমা থাকবে না।আমরা চা খাই, কথা বলি, রামকৃষ্ণ খাবার দিলে খাবার খাই, ভদ্রলোক রামকৃষ্ণকে বারবার দেখেন, তাঁর মুখে একটা যন্ত্রণা ভেসে ওঠে, আবার চা নিয়ে বসি আমরা। এবার কোনো কথা বলি না। আমাদের কথা কি আর নেই? এর মাঝেই ফুরিয়ে এসেছে? পরিচিত মানুষের সাথে বেশি কথা বলা যায় না? দেলোয়ারের সাথেও বেশি কথা হয় না অনেক বছর, কাজের কথা বেশি থাকে না, আর পরিচিতদের সাথে অকাজের কথা বলা যায় না। এক সন্ধ্যার পরিচয়েই আমাদের কথার অভাব ঘটছে? আমার একটি টুনটুনির মুখ মনে পড়ছে, যেটি টুনটুন ক’রে উড়তো আমাদের শাদা বেগুনগাছগুলোতে, ওই টুনটুনিটির কথা কি বলবো আমি ভদ্রলোককে, তিনি কি শুনে উল্লসিত হয়ে উঠবেন? ছোটোবেলায় বউয়াভাত খেতে আমার ভালো লাগতো, মরিচ বাঁটা দিয়ে, শুঁটকির ভর্তা দিয়ে, তা কি আমি বলবো ভদ্রলোককে; আমার কি ইচ্ছে করছে বলতে? না, বলতে তো ইচ্ছে করছে না। তিনি কি বলবেন কোনো গল্প, ইস্কুলে যাওয়ার পথে চিলের পা থেকে একটা ধবধবে শাদা শরপুঁটি খ’সে পড়েছিলো তাঁর সামনে, তিনি বইখাতা ফেলে পাগলের মতো জড়িয়ে ধরেছিলেন সেটি, দৌড়ে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে মায়ের হাতে দিয়ে আবার ছুটেছিলেন ইস্কুলে, ক্লাশে দেরি হয়ে গিয়েছিলো ব’লে হেডস্যার তাঁর কান ম’লে দিয়েছিলো, এমন কোনো গল্প শুনতে কি আমার ইচ্ছে করছে? না তো, ইচ্ছে করছে না। কালকে এ-গল্প শুনতে আমার খুবই ভালো লাগতো, আমি দেখতে পেতাম একটি বালক ডান হাতে ধবধবে শরপুঁটি, বাঁ কাঁধে একবোকা বই নিয়ে দৌড়োচ্ছে বাড়ির দিকে, আনন্দে ফেটে পড়ছে, আমিও ভ’রে উঠতাম সুখে। অথচ আজ? আমি বলি, আপনার আর কোনো গল্প নেই? বলুন, আপনার গল্প শুনি। তিনি বলেন, না, মনে হয় নেই; কোনো গল্পই আর বলার মতো মনে হচ্ছেএনা, যেটির কথাই ভাবছি সেটিকেই ময়লা নীরস লাগছে। আমি বলি, এক সন্ধ্যায়ই গল্পগুলো এমন নীরস হয়ে গেলো?তিনি বলেন, হ্যাঁ, কাল দ্বিধাহীনভাবে আপনাকে যা বলতে পারতাম, আজ পারছি না কেনো?আমি বলি, কাল হয়তো আপনার চোখে অনেক স্বপ্ন ছিলো, আজ নেই। তিনি বলেন, আপনার চোখেও তো ছিলো।আমরা একটু একটু চা খাই, কথা বলি না, পরিচিতরা বেশি কথা বলে না। পরিচিতদের কোনো গল্প থাকে না, পরিচিতরা গল্প বলে না।তিনি বলেন, চলুন, একটু হেঁটে আসি; পশ্চিমের পাহাড়টার মাথার ওপর একটি কুঁড়েঘর আছে, সেটি দেখতে আপনার খুব ভালো লাগবে।
পৃষ্ঠা-২৪
আমরা বেরিয়ে পড়ি। প্রথমে একটু উত্তর দিকে যেতে হয়, তিনি বেশ ভালোভাবেই চেনেন পথঘাট, তারপর পশ্চিমের পাহাড়ে যাওয়ার সরু পথ, আমাদের ওপর গাছের অন্ধকার আর চাঁদ ও কুয়াশার জ্যোৎস্না। দূর থেকেই পশ্চিমের পাহাড়ের ওপর জ্যোমায় কুয়াশায় ঘুমিয়ে থাকা কুঁড়েঘরটি দেখে আমি নিজেই যেনো ঘুমিয়ে পড়ি। দূরে পুবে পাহাড়, পশ্চিমে পাহাড়, উত্তরে পাহাড়, দক্ষিণে পাহাড়, মাঝখানে মুকুটের মতো এই পাহাড়, তার ওপর কুঁড়েঘর, জ্যোৎত্মা ও কুয়াশার মধ্যে ঘুমিয়ে আছে একটা শাদা বেড়াল। গাছের পাতা ঝিকমিক করছে, নিচে একটি সরোবর স্থির হয়ে আছে ভাঙা আয়নার টুকরোর মতো, ভদ্রলোককে দেখাচ্ছে গাছের ছায়ার মতো। আমরা কুঁড়েঘরটির কাছে এসে দাঁড়াই; জ্যোৎত্মা কুয়াশা পাহাড়ের ভেতর থেকে অপরূপ এক স্তব্ধতা আমার ভেতরে ঢুকতে থাকে।ভদ্রলোক আমার হাত ধরেন।আমি বলি, আমার একটু একা থাকতে ইচ্ছে করছে। তিনি বলেন, তাহলে আমি দূরে গিয়ে দাঁড়াই।আমি বলি, আপনি বরং রেস্টহাউজে ফিরে যান, আমি সারারাত এখানে ব’সে রাত্রি দেখি।তিনি বলেন, না, আপনি একা থাকতে পারবেন না, নানা ভয় আছে। আমি বলি, তাহলে কিছুক্ষণ একা থাকি?ভদ্রলোক বলেন, আমার কিন্তু একটুও একা থাকতে ইচ্ছে করছে না, তাছাড় আপনি কাল চ’লে যাবেন।আমার একা থাকতে ইচ্ছে করে, সম্পূর্ণ পরিপূর্ণ অখণ্ড একা, আমি একা হয়ে যাই। আমার সুখ লাগে, কুয়াশার মতো, চাঁদের আলোর মতো, পাহাড়ের অন্ধকারের মতো সুখ; একটি বড়ো পাখি উড়ে যাচ্ছে, দেখতে পাচ্ছি এবং দেখতে পাচ্ছি না, পাখিটাকে একখণ্ড জমাট কুয়াশা মনে হচ্ছে, আমি জ্যোৎস্নায় পাখিটির পেছনে পেছনে পাহাড়ের পর পাহাড় পেরিয়ে উড়ি, উড়তে উড়তে কোনো একটি গাছের ডালে বসি, আবার উড়ি; দূরে একঝোঁপ জোনাকি নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জ্বলছে, আমার সুখ লাগে, আমি জোনাকির মতো জ্বলি; চাঁদটা ঠাণ্ডা হয়ে আছে মাথার ওপরে, তার স্তব্ধতা নিঃশব্দতা আমাকে ভরিয়ে তোলে। আজ রাতটি যদি আমি এই কুঁড়েঘরে কাটিয়ে দিই? কেমন হয়? দিতে পারবো? ঘুম আসবে? ভয় পাবো? কোনো ভয় আছে? একা ব’সে থাকতে পারবো? এখন কতো রাত? আমি কি একা?ভদ্রলোক এসে বলেন, চলুন, এবার ফিরি, অনেক রাত হলো। আমি বলি, ফিরতে হবে? তিনি চমকে ওঠেন, ফিরতে হবে না? আমি বলি, কেনো ফিরতে হবে? তিনি বলেন, এখানে তো আমরা থাকতে আসি নি।
পৃষ্ঠা-২৫
আমি বলি, আপনার চা খেতে ইচ্ছে করছে?তিনি বলেন, চা, এতো রাতে? না তো।আমি বলি, গতরাত হ’লে আপনার চা খেতে ইচ্ছে করতো।আমি স্তব্ধতা শরীরে বয়ে হাঁটতে থাকি, কোনো কথা নয়, রেস্টহাউজে ঢুকে আমি হাঁটতে থাকি আমার ঘরের দিকে; ভদ্রলোক আসেন সাথে সাথে, আমি ঘরের দরোজা খুলে ফিরে তাঁর দিকে তাকাই।জীবনটা আমার বদলে গেছে, জীবন আর আমার আগের মতো নেই। আমি বলি, আসুন।তিনি আসার জন্যেই এসেছেন, তবু ধীরেধীরে ঘরে ঢোকেন। তাঁর ঘরে ঢোকাকে আমার কোনো ঘটনাই মনে হয় না; তাঁর ঢোকাও যা, না ঢোকাও তাহ; তাঁর কথা আমি ভাবি না, ঘরে ঢুকেই আমি এলিয়ে পড়ি বিছানায়।গতরাতে আমি বদলে দিয়েছি জীবন? একটি ঘটনা দিয়ে? এই ভদ্রলোককে দিয়ে? আজো? আজ তো আর জীবন বদলে দেয়ার মতো বড়ো কিছু ঘটবে না, ঘটবে তুচ্ছ পুনরাবৃত্তি। পুনরাবৃত্তি ঘটবে? ঘটুক। কী এসে যায়? ভদ্রলোক আলো নিভিয়ে উঠে আসেন বিছানায়, প্রথম একটু দূরে গড়ান, তারপর আমাকে টেনে নিয়ে আদর করতে থাকেন। জীবন তো বদলে গেছে গতকালই, আজ আর এমন কী ঘটবে? ভদ্রলোক হয়তো ভাবছেন তাঁর ছোঁয়ায় আমি শিউরে উঠছি, একবার ইচ্ছে হয় শিউরে উঠি, পারি না। জীবনের জন্যে আমার কষ্ট হচ্ছে? কই, না ভো। ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে আগের জীবনে? না তো। আমি ফিরে যেতে পারি? না তো। ফিরে গেলে আমার ভালো লাগবে? না তো। গতরাতে জীবন বদলে যাওয়ার কথা ভাবতে ভাবতেও আমার সুখ লাগছিলো এক ধরনের, আমি একটি ঘটনা ঘটাচ্ছি, আজ ভাও লাগছে না; মনে হচ্ছে রোববারের পর সোমবার, যা ঘটছে তা কোনো ঘটনা নয়; ভদ্রলোক একা খেলছেন, ভালোই খেলেন তিনি, ভালোই খেলতে শিখেছেন, আমার মনে হয় ভদ্রলোকও নিঃসঙ্গ বোধ করতে শুরু করেছেন, যদিও তিনি পরিশ্রম ক’রে চলছেন আমার শরীরটি নিয়ে। ভদ্রলোক সম্ভবত একটি বিশাল মাঠে একা খেলার নিঃসঙ্গতা বোধ করছেন, তবু খেলে যাচ্ছেন। ভদ্রলোকের জন্যে আমার মায়া হয়, এখন ইট ভাঙতে থাকলেও তিনি এতোটা একলা বোধ করতেন না। কিন্তু তিনি অবসর নেন না; খাটতে থাকেন, তাঁর হাতে মাত্র আধারাত্রি সময়, এ-সময়ে যতোটা পারেন তিনি তুলে নিতে চান। আমি হাসি। নিন, যতোটা পারুন নিন, আমার নিষেধ নেই। কী আর নিচ্ছেন এমন? আমার শরীরটাকে খেয়ে ফেলতে চাচ্ছেন, পারছেন না ব’লে আরো বড়ো হা করছেন, আমাকে সারাজীবনের শ্রেষ্ঠ সুখটি দিতে চাচ্ছেন। আমি হাসি। জীবন বদলে যাওয়ার কথা আমি ভাবতে চাই, তাও আমার ভাবতে ইচ্ছে করে না; ওটা আর এমন কী যে রাতের পর রাত ভাবতে হবে? একটি পুরুষ আমার ওপরে নিচে খেটে চলছে, খাটতে দিচ্ছি আমি, ভদ্রলোক দক্ষ ক্রীতদাস হ’তে পারতেন কোনো হেরেমে; তিনি এখন দৃঢ় হয়ে
পৃষ্ঠা-২৬
উঠেছেন, প্রবেশ করতে চান।আমি সম্ভবত একটু গড়িয়ে স’রে যাই, বলি, আজ থাক।অন্ত্রলোক হঠাৎ থমকে খেনে যান। তিনি কি এখন গলা চেপে ধরবেশ আমার? জোর করে ঢুকবেন ভেতরে?তিনি বলেন, একবার, শুধু একবার।আমি বলি, না, আজ থাক।তিনি কি আমার দু-পা চেপে ধ’রে ভেঙেচুরে ঢুকবেন? বলাৎকার? ধর্ষণ?তিনি বলেন, কী হয়েছে আপনার? আমি বলি, আপনি ঘরে যান।তিনি বলেন, আরো একটু থাকি? একবার।আমি বলি, আমার ভালো লাগছে না।ভদ্রলোক বেরিয়ে যান, আমি চোখ বন্ধ ক’রে হাত-পা ছড়িয়ে প’ড়ে থাকি। প’ড়ে থাকতে আমার ভালো লাগে, জানালার বাইরে কুয়াশা, ভেতরে ঢুকছে আলোর মতো, আমার ভালো লাগে। জীবনটা আমি বদলে দিয়েছি, জীবন আয় আমার আগের মতো নেই, এখন অন্য জীবন আমার। গড়াতে গড়াতে এক সময় আমি উঠে বসি, আলো দেখা দিচ্ছে আকাশে। আমার ভালো লাগে।ব্রেকফাস্ট করতে গিয়ে দেখি ভদ্রলোক কুঁকড়ে ব’সে আছেন খাবার ঘরে।আমি তাঁকে দেখে হাসি।তিনি বলেন, ঢাকা ফিরে দেখা করবো।আমি বলি, তার কী দরকার।আটটা, পাজেরো এসে গেছে, আমরা ঢাকার দিকে রওনা দিই। আমি সোজা হেঁটে পাজেরোতে উঠি, পেছনে তাকাই না; পাহাড় দিয়ে নামার সময় একবার পেছনে তাকিয়ে দেখি ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন রেস্টহাউজের বারান্দায়। তিনি কুঁকড়ে আছেন, তাঁকে ভাঙা দেখাচ্ছে।আমি এসেছিলাম এক জীবন নিয়ে, ফিরছি অন্য জীবন নিয়ে। আমি কি বদলে গেছি? কই, না তো; আমার সবই আগের মতো আছে, শুধু জীবনটা- আগের মতো নেই, ভাবতে আমার মজা লাগে। এতো সহজ জীবন বদলে দেয়া। জীবন তাহলে বিরাট কিছু নয়? তাকে বদলে দেয়া যায় সহজেই? আমি বাইরের দিকে তাকাই, দু-পাশের পাহাড়গুলোকে আমার প্রিয় মনে হয়, আমি বলতে থাকি, তোমাদের সাথে আবার কবে দেখা হবে জানি না, তোমাদের দেখে আমি সুখী হয়েছি, তোমরা থেকো, সুখে থেকো। ছেলেমেয়েরা কলকল করতে থাকে, আমিও মাঝেমাঝে মেতে উঠি ওদের সাথে; ভালো লাগছে যে আমি মাততে পারছি। তাহলে জীবন বদলে গেলে বিশেষ কিছু হয় না? সারা পথে আমি ভাবতে চাই যে আমার জীবনটা বদলে গেছে, আমি বদলে দিয়েছি জীবনটাকে, এটা ভেবে আমি সময়টা কাটাতে চাই, কিন্তু দেখি আমার মন তা ভাবতে চায়
পৃষ্ঠা-২৭
না, মগজের কাছে এটাকে এক একঘেয়ে ব্যাপার মনে হয়, মন আর মগজ দু-ই ক্লান্ত হয়ে ওঠে। আমি ভাবনাটাকে পথের পাশের খালে ছুঁড়ে ফেলে দিই; ফেলার সাথে সাথে দেখি একটি রঙিন মাছরাঙা ঝাঁপিয়ে পড়ছে জলে, গাড়িটা দ্রুত চলছে, তাই তার মুখের মাছটি দেখতে পাই না। মাছরাঙাটি কি মাছ পেলো, ভাবতে ভাবতে ঝলমল ক’রে ওঠে আমার রক্ত।দুপুরের পর ক্যাম্পাসে পৌঁছি আমরা; ছেলেমেয়েরা নেমে যায়। ড্রাইভার আমাকে বালার নামানোর অন্যে পাড়ি চালাতে শুরু করে।আমি বলি, ড্রাইভার, আমাদের রেস্টহাউজে চলো।সে একটু বিস্মিত হয়, বলে, বাসায় যাইবেন না, ম্যাডাম?আমি হাসি, বলি, না, রেস্টহাউজে চলো।রেস্টহাউজের দোতলায় একটি ঘর আমার পছন্দ হয়।কেয়ারটেকার বিস্মিত হয়, ম্যাডাম, আপনে রেস্টহাউজে থাকবেন?আমি বলি, হ্যাঁ।তিনি বলেন, কয় দিন থাকবেন, ম্যাডাম?আমি বলি, এক সপ্তাহ, হয়তো এক মাস, ঠিক জানি না। তিনি বলেন, বাসায় ফোন ক’রে জানাবো, ম্যাডাম?আমি বলি, না।কেয়ারটেকারের কাছে এটা গ্রহণযোগ্য মনে হয় না, তার একটা দায়িত্ব আছে; সে জানে আমার একটি বাসা আছে, বাসায় আমার একটি স্বামী আছে, এখন আমার বাসায়ই থাকা উচিত। আমি আমার মতো থাকতে পারি না; আমি কীভাবে থাকবো, কোথায় থাকবো, কেনো কোথায় থাকবো, সেটা ঠিক হয়ে আছে, আমার কাজ সেভাবে থাকা, তার বাইরে আমি যেতে পারি না। আমার একটু খারাপ লাগে। আমি জীবন বদলে দিয়েছি, এর পর আমাকে অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে, জবাবদিহি করতে হবে। ইচ্ছে করলেই আমি জীবন বদলেদিতে পারি না। জীবনটা শুধু আমার নয়, আমার জীবনটা অন্যদেরও।আমি নিজেকে বলি, প্রস্তুত হও, তৈরি হও।আমি উত্তর দিই, আমি প্রস্তুত, আমি তৈরি।আমি কি মাকে টেলিফোন ক’রে জানাবো আমি ঢাকায় ফিরেছি, আছি ইউনিভার্সিটির রেস্টহাউজে? মা কি হৈচৈ ক’রে উঠবেন না? জানতে চাইবেন না কেনো উঠেছি আমি রেস্টহাউজে আমার নিজের বাসা থাকতে? আমি এটা পারি না। আমার ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় থাকা উচিত, ঠিক জায়গায় ঠিকমতো ঠিক বালিশে ঠিক বিছানায় শোয়া উচিত। তার বাইরে আমি যেতে পারি না। দেলোয়ারকে ফোন করবো? বলবো রেস্টহাউজে উঠেছি? সে প্রথম এটাকে একটা জৌক মনে করবে (হয়তো), তারপর (হয়তো) চিৎকার করবে চ’লে আসো চ’লে আসো, তারপর (হয়তো) ছুটে আসবে। ছুটে আসবে? আমি ঠিক
পৃষ্ঠা-২৮
জানি না ছুটে আসবে কি না। আমার ডাকে কি সে আজকাল আগের মতো ছুটে আসতো? গত মাসে একবার আমি একটা কাজে আটকে প’ড়ে গিয়েছিলাম, তাকে ফোন করেছিলাম গাড়িটা নিয়ে এসে আমাকে একটু নিয়ে যেতে, ভেবেছিলাম উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠবে সে, কিন্তু সে বলেছিলো রাত দশটা আর এমন কী রাত, একটা বেবি নিয়ে যেনো আমি ফিরে যাই। আমার কথায় সে রেগেও যেতে পারে, বলতে পারে যেখানে ইচ্ছে সেখানে থাকো, তাতে তার কিছু যায় আসে না। তার কি মনে আছে আমি আজ ফিরবো? সে কি দিনের পর দিন হিশেব ক’রে চলেছে আমি কবে ফিরবো? আমার ফেরার ক-দিন ব্যকি আছে? আমার জন্যে ব্যাকুল হয়ে ছিলো সে? আমার কথা ভেবে কি সে তারিখ হিশেব করতে ভুল করেছে দু-একবার? পঁচিশ তারিখকে তার মনে হয়েছে সাতাশ, শনিবারকে মনে হয়েছে সোমবার? না কি দেলোয়ার এ-কটা দিন প্রবল স্বাধীনতা ভোগ করেছে, এবং আমার ফেরার কথা ভেবে ভার বোধ করছে? দেলোয়ারের জন্যে আমি অভাব বোধ করছি? মায়া হচ্ছে? হ্যাঁ, একটু অভাব বোধ করছি, একটু মায়া হচ্ছে, পাঁচটি বছর একসাথে ছিলাম; কিন্তু আমি কি আগের জীবনে ফিরে যেতে পারি? না। প্রশ্নটি আমার মাথায় ঘুরে ঘুরে আসে, প্রতিবারই ভেতর থেকে একটি উত্তর লাফিয়ে পরিষ্কারভাবে বেরিয়ে আসে- না।আমি আর ফিরে যেতে পারি না, জীবনকে আমি বদলে দিয়েছে।আমি গোশল করি, যেনো অনন্ত অবসর পেয়েছি, সময়ের আমার কোনো অভাব নেই, গোশল করতে করতে এক যুগ কেটে যায়, বেরিয়ে এসে একটি বই হাতে নিয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়ি।কেয়ারটেকার যখন দরোজায় নক ক’রে আমার ঘুম ভাঙায়, তখন দশটা। ম্যাডাম, আপনে খাবেন না?না।আপনের খাবার রেখে দিয়েছি।থাক।আপনের ঘরে দিয়া যাই?ना।সকালে ব্রেকফাস্ট করবেন?হ্যাঁ।সে খুব অবাক ও আহত হয়ে ফিরে যায়; আমি আবার ঘুমিয়ে পড়ি।খুব ঘুম পেয়েছে, অনন্ত অন্ধকারের মতো ঘুম আমাকে টেনে নিচ্ছে ভেতরে, মনে হয় অনেক বছর আমি ঘুমোই নি, ঘুমের ভেতরে অন্ধকারের ভেতরে ঢুকে আমি সুখ পাচ্ছি, ডুবে যাচ্ছি পুকুরের কালো জলের নিচে, ডুবতে ভালো লাগছে, আমার ভেতর থেকে আরেকটি আমি বেরিয়ে তাকিয়ে আছে অন্য আমিটির দিকে, দেখছে ডুবে-যাওয়া। আমার কি শরীর আছে? শরীরটাকে আমি অনুভব করতে পারি না, জলের সাথে সেটি মিশে গেছে, আমি একটি ছায়া হয়ে গেছি,
পৃষ্ঠা-২৯
ছায়া মিশে যাচ্ছে অন্ধকারের ভেতরে। আমি কি অনেক বছর ঘুমোই নি? এই প্রথম আমি আস্বাদ পেলাম ঘুমোনোর? আমি ঘুমিয়ে পড়ি।দু-দিন খুব ভালো লাগে যে কেউ আমার সংবাদ নেয় নি, পৃথিবীতে আমি একা আছি, একা থাকার সুখ যে এতো মধুর এটা আমার জানা ছিলো না, কমলগঞ্জেও আমি এমন একা ছিলাম না; মা সংবাদ নেয় নি, তার অনেক কাজ, আব্বা হয়তো ব্যস্ত, তিনি হয়তো ভুলেই গেছেন আমি ঢাকার বাইরে গিয়েছি; দেলোয়ার নেয় নি, সে হয়তো সুখে আছে, ব্যস্ত আছে তার ব্যবসা নিয়ে; আমার ডিরেক্টরও নেন নি, এটা তাঁর ভাবনার বিষয় নয়। অস্তিত্বহীন হয়ে থাকার সুখে ডুবে থাকি আমি দু-দিন, আমার মনে হ’তে থাকে আমি নেই, কেউ জানে না আমি নেই। আমি ক্লাশ নিতে আসি, পাঁচটা পর্যন্ত থাকি, গল্প করি, ক্লাশ নিই, পল্লীসংযোগের চাঞ্চল্য সম্পর্কে কথা বলি, রেস্টহাউজে ফিরে গিয়ে পড়াই, পড়ি, লিখি, জীবন সম্পর্কে কিছুই ভাবি না। আমার শরীরটা একটু ব্যথা করতে থাকে, অল্প অল্প, ভদ্রলোক ভালোভাবেই চযেছেন, বেশ ভারিও ছিলেন ভদ্রলোক, তাঁর ভারটা এখনো কাজ ক’রে চলছে আমার ওপর, ভেবে আমার হাসি পায়। ওই লোকটিকে ওপরে চড়তে দিয়ে কি আমি ভালো করেছি? কী দরকার ছিলো? আমি কি খুব আর্ত ছিলাম? আবেগ জেগেছিলো? না তো। সুখ পেয়েছি? না তো। মজা করতে চেয়েছিলাম? হয়তো। একটা অস্পষ্ট দাগ দেখতে পাই বাহুতে। ভদ্রলোক দাঁত বসিয়ে দিয়েছিলেন কোনো এক সময়, টের পাই নি? শরীরে দাগ আমি পছন্দ করি না। একটি ঘটনা আমি ঘটিয়েছি, জীবন বদলে দিয়েছি, আমার খারাপ লাগছে না। মনে হয় আমি ভালো আছি।দু-তিন দিন পর এক দুপুরে আমার ডিরেক্টর দৌড়ে দরোজা ঠেলে হাঁপাতে হাঁপাতে ঢোকেন আমার ঘরে, আমি বুঝতে পারি একটা কিছু ঘটেছে।হাঁপাতে হাঁপাতে বলেন, ডক্টর শিরিন, আপনি কি আপনার বাসায় থাকেন না? আমি ভাবতেই পারি না, আপনি বাসায় থাকেন না।আমি বলি, কেনো, কী হয়েছে বলুন তো?তিনি বলেন, আপনার হাজব্যান্ড ফোন করেছেন, তিনি জানতে চেয়েছেন আপনার গ্রুপ ফিরেছে কি না, এখনো আপনি ফেরেন নি কেনো?আমি বলি, আপনি কী বললেন?তিনি বলেন, চলুন, তাড়াতাড়ি চলুন, আপনার হাজব্যান্ড ফোন ধ’রে আছেন, তিনি আপনার সঙ্গে কথা বলবেন।আমি কি দেলোয়ারের ফোন ধরার জন্যে ডিরেক্টরের ঘরে যাবো? না গেলে কেমন হয়? কেমন দেখায়? তাহলে ডিরেক্টর নিজেই পাগল হয়ে যাবেন, তিনি আমাকে জানেন শুদ্ধতা, সুখ, প্রসন্নতা, আর জ্ঞানের নারীমূর্তি হিশেবে।আমি গিয়ে ফোন ধরি।আমি বলি, হ্যালো, তুমি কেমন আছো?দেলোয়ার বলে, আমি জানতে চাই তুমি দু-দিন আগে ঢাকায় ফিরেছো,
পৃষ্ঠা-৩০
অথচ এখনো বাসায় আসো নি কেনো?আমি বলি, তুমি কি আমার জন্যে উদ্বিগ্ন হয়ে আছো?দেলোয়ার বলে, আমি জানতে চাই তুমি বাসায় আসো নি কেনো?আমি একটু কষ্ট পাই, বলি, আসতে ইচ্ছে করে নি। দেলোয়ার বলে, ইচ্ছে করে নি? ইচ্ছে করবে না কেনো?আমি বলি, সত্যিই ইচ্ছে করে নি, এখন আরো করছে না।দেলোয়ার বলে, তুমি কোথায় উঠেছো, তোমাদের বাসায়?আমি বলি, না।দেলোয়ার বলে, তাহলে কোথায় উঠেছো?আমি বলি, ওঠার জায়গার তো অভাব নেই, উঠেছি একখানে।দেলোয়ার বলে, তুমি বাসায় আসবে কখন?আমি বলি, আসতে আমার ইচ্ছে করছে না।দেলোয়ার বলে, তুমি কি পাগল হয়ে গেছো? বাসায় আসতে ইচ্ছে করবে না কেনো? তোমার কী হয়েছে?আমি বলি, আসতে ইচ্ছে করছে না।দেলোয়ার কোনো কথা খুঁজে পায় না, আমি ফোন রেখে দিই।ডিরেক্টর বলেন, ভক্টর শিরিন, আমি ভাবতেই পারি না আপনি বাসায় যান নি। যান নি কেনো? কী হয়েছে আপনার? যাই ঘটুক, মেয়েলোকের বাসার বাইরে থাকা ঠিক নয়।আমি বলি, যেতে ইচ্ছে করে নি।তিনি হেসে ওঠেন, আমাদেরও তো মাঝেমাঝে বাসায় যেতে ইচ্ছে করে না, মনে হয় জঙ্গলে চ’লে যাই, তাই ব’লে কি ব্যসায় যাই না? মাঝেমাঝে একটু দেরি ক’রে ফিরি, কিন্তু বাসায় ঠিকই যাই।আমি হাসি, বলি, বাসায় ফেরেন কেনো?তিনি বলেন, তাহলে কোথায় যাবো, কোন দোজগে? মিসেস আজগর, মিসেস সানাউল্লা বা মিস ফারজানার সঙ্গে কয় সন্ধ্যা আড্ডা দেয়া যায়? এটা দেখি সেটা দেখি, শেষে দেখি বাসাই ভালো। যান, ডক্টর শিরিন, আজ তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে যান, আপনার হাজব্যান্ড পাগল হয়ে আছেন।আমি বলি, দেখি। ডিরেক্টর বলেন, আপনার হাজব্যান্ডের সঙ্গে কি গোলমাল হয়েছে? আমি বলি, না।তিনি বলেন, আপনার হাজব্যান্ড লাকি মানুষ, আপনার মতো ওয়াইফ পাওয়া লাকের ব্যাপার, তিনি পাগল হয়ে যাবেন। আমি বলি, আপনি বাড়িয়ে বলছেন।
পৃষ্ঠা ৩১ থেকে ৪৫
পৃষ্ঠা-৩১
আবার টেলিফোন বেজে ওঠে; টেলিফোন বেজে উঠলে আমি সাধারণত চমকে উঠি, কেউ আমাকে চাচ্ছে ভেবে শিউরে উঠি, ধরার জন্যে আমার হাত বরা হয়ে ওঠে, কিন্তু এবার ধরতে আমি কোনো সাড়া পাই না, যন্ত্রটি অনেকক্ষণ বাজে; আমি ধরছি না দেখে আমার ডিরেক্টর অস্থির হয়ে ওঠেন, বলেন, ধরুন, ধরুন, এইটা আপনারই ফোন, তাড়াতাড়ি ধরুন।আমি হাসি, বলি, এটা আপনার ঘর, আপনারই ধরা উচিত।তিনি ফোন ধ’রে বলেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আছেন, কথা বলুন।আমি হ্যালো বলতেই দেলোয়ার বলে, তুমি ফোন রেখে দিলে কেনো?আমি বলি, তুমি কথা খুঁজে পাচ্ছিলে না, ভাবলাম তোমার আর কথা নেই, তাই রেখে দিয়েছিলাম।দেলোয়ার বলে, দিস ইজ ভেরি ব্যান্ড, আমি ফোন করেছি, তুমি ফোন রেখে দিতে পারো না।আমি বলি, আর তো কথা ছিলো না।দেলোয়ার বলে, তুমি এখনি বাসায় চ’লে আসো, আমি বলছি তুমি এখনই বাসায় চ’লে আসো।তার কণ্ঠস্বর কর্কশ শোনায়, আমি বলি, তুমি তো জানো আমি আদেশ পছন্দ করি না, আদেশ শুনতে আমার ভালো লাগছে না।দেলোয়ার বলে, আমি অর্ডার দিচ্ছি না; একটা সামান্য বিজিনেসম্যান হয়ে আমি ইউনিভার্সিটির একজন প্রফেসারকে অর্ডার দিতে পারি না।শ্লেষটা আমার ভালো লাগে, তাহলে ওর মনে আছে আমার এ-পরিচয়টি।আমি বলি, তুমি সম্ভবত কোনো কমপ্লেক্সে ভুগছো।দেলোয়ার বলে, দেরি না ক’রে বাসায় চ’লে আসো।আমি বলি, আমার আসতে ইচ্ছে করছে না, ইচ্ছে করলে আমি আসবো।দেলোয়ার বলে, আমি এখনই গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি, ড্রাইভার যাচ্ছে, তুমি চালে আসো।আমি মনে মনে হাসি, দেলোয়ার পাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছে, ড্রাইভার আসছে আমাকে নিতে, আমার তো খুব খুশি হওয়ার কথা, ড্রাইভার আসছে।আমি বলি, গাড়ি পাঠাবে? আচ্ছা পাঠাও, তবে পাড়িটা এখানেই থাকবে, আমার একটু দরকার হবে।দেলোয়ার বলে, দরকার হবে, মানে?আমি বলি, গাড়িটা আমার কাছে থাকলে আমার একটু সুবিধা হবে,যাতায়াতে আমার বেশ অসুবিধা হচ্ছে।দেলোয়ার বলে, ওহ্, আমি ভুলে গিয়েছিলাম, গাড়িটা তোমার, গাড়িটা তুমিই কিনেছিলে; তোমার গাড়ি তুমি তো চাইবেই।আমি বলি, আমি কিনেছিলাম? তা ভুলেই গিয়েছিলাম; তবে সেজন্যে নয়,
পৃষ্ঠা-৩২
আমার একটা গাড়ি দরকার। রিক্সা বেবি ভালো লাগছে না।দেলোয়ার বলে, রিক্সা বেবির দরকার কী, গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি, তুমি চ’লে আসো; আর গাড়িটা তো তোমার, যদিও সবাই ভাবে আমার।আমি বলি, থাক, গাড়ি পাঠাতে হবে না।দেলোয়ার বলে, তুমি থেকো, আমি পাঁচটার দিকে আসছি।এতোক্ষণ কোনো কষ্ট পাচ্ছিলাম না, এবার একটু কষ্ট পাই, একটা ব্যথা ঝিলিক দেয়, পাঁচটা? এখন নয় কেনো? আমি হ’লে তো পাঁচটার জন্যে অপেক্ষা করতাম না, এখনই ছুটতাম; আমি যাকে চাই সে যদি না আসতে চাইতো, আমি তার কাছে ছুটে যেতাম, এক মিনিটও আমার সহ্য হতো না।আমার হাজব্যান্ড, মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন খান, নিতে আসবেন আমাকে, তিনি আমার জন্যে খুব উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন, তাঁর জন্যে আমার চার ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে, ভেবে আমার হাসি পায়। এই চার ঘণ্টা আমাকে তাঁর দরকার নেই, আমাকে চার ঘণ্টা পর পেলেও চলবে। কমলগঞ্জে জীবনটাকে বদলে না দিলে আমি আনন্দে হৈচৈ করতে করতে এরই মাঝে ফিরতাম, মনে হতো আমি কতো সুখে আছি, এতোদিন দূরে ছিলাম, অভাবে ছিলাম, ফিরে এ- জীবনকেই আমি জড়িয়ে ধরতাম। এই?আমি বলি, আসার দরকার নেই, আমি একটু একা থাকতে চাই।দেলোয়ার বলে, একা তো থেকেই এলে সাত আট দিন।কথা বলতে আমার ইচ্ছে করে না, আমি ফোন রেখে দিই।আজ আর কোনো ক্লাশ নেই, আমি বেরিয়ে পড়ি; রেস্টহাউজে আজ একটু তাড়াতাড়িই ফিরি, ফেরার সময় রাস্তার পাশে বিব্রত একটা গাছ দেখে আমি মুগ্ধ হই। আমার ভেতরটা কেঁপে ওঠে; গাছটি আমার চোখে পড়ে নি এতোদিন, কেনো পড়ে নি ভাবতে ভাবতে রেস্টহাউজে আমার ঘরে ফিরি। ঘরে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয় বেশ আছি এখানে, অনেকগুলো কাজ ক’মে গেছে, কিন্তু এখানে তো বেশি দিন থাকা যাবে না। একটা ফ্ল্যাট খুঁজতে হবে, ছোটো, একলা আমার জন্যে; পাবো তো? আব্বার বাসায় গিয়ে উঠতে পারি, সেখানে উঠতে চাই না; আমি জীবন বদলে দিয়েছি, সম্পূর্ণ নতুন জীবন চাই, আগের কোনো জীবনেই ফিরতে চাই না।শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিলাম, একা থাকতে ভালো লাগছিলো, মাঝেমাঝে মনে পড়ছিলো- কই, দেলোয়ার তো এলো না, মনে মনে হাসছিলাম, তাহলে কি আমি চাই সে আসুক? একবার মনে হচ্ছিলো, আসুক; আমাকে এতো সহজে ভুলে যাবে, একটু ডাকবেও না, একটু এলোমেলো হবে না, একটু কাঁদবে না, এটা ভাবতে একটু কষ্ট লাগছিলো; আবার মনে মনে বলছিলাম, না, তার আসার দরকার নেই। আমি জীবন বদলে দিয়েছে, আমার কোনো কষ্ট নেই।সন্ধ্যার দিকে দরোজা ঠেলে দেলোয়ার ঢোকে। আমি বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে বলি, এসো, বসো।
পৃষ্ঠা-৩৩
দেলোয়ারকে দেখলে আমি সাধারণত লাফিয়েই উঠি, উঠতে আমার ভালো লাগে, আর ও গৌরব বোধ করে।দেলোয়ার বলে, বসতে আসি নি, চলো আমার সাথে।আমি বলি, বসো, চা খাও।দেলোয়ার বলে, বসতে আর চা খেতে আসি নি, তাড়াতাড়ি চলো।আমি বলি, তোমাকে দেখতে বেশ দেখাচ্ছে, জামাটা নতুন।দেলোয়ার বলে, বাজে কথা রাখো, তাড়াতাড়ি চলো।আমি বয়কে দু-কাপ চা আনতে বলি।উত্তেজনায় কাঁপছে দেলোয়ার, আমি তার চোখে ক্রোধ আর ক্ষতির আভাস দেখতে পাই; ক্রোধটা আমার খারাপ লাগে না, কিন্তু তার চোখে ক্ষতির আভাস দেখে আমার খারাপ লাগে। তার নতুন জামাটা সুন্দর, এরই মাঝে তার একটি নতুন জামা কিনতে হয়েছে? আমার একটু খারাপ লাগে।আমি বলি, বসো।দেলোয়ার সোফায় বসতে বসতে বলে, তুমি কী ঢং শুরু করেছো আমি বুঝতে পারছি না, তাড়াতাড়ি চলো, আমার অসহ্য লাগছে।দেলোয়ারের দিকে চা বাড়িয়ে দিয়ে বলি, খাও, চা খাও।দেলোয়ার আমাকে জড়িয়ে ধ’রে চুমো খাওয়ার চেষ্টা করে, তার শরীরটা আমার অচেনা লাগে, কোনো শরীর ধরতে আমার ইচ্ছে করে না, আমি একটু দূরে সরে গিয়ে বলি, চুমো নয়, চা খাও।দেলোয়ার আমাকে শক্তভাবে ধ’রে রেখে বলে, চা নয়, চুমো খেতে চাই,অনেক দিন চুমো খাই না, শুই না।দেলোয়ারকে শারীরিকভাবে খুব উত্তেজিত মনে হয় না, তার ছোঁয়ায়, তার ঠোঁটে কামনা আছে ব’লে আমার মনে হয় না; কিন্তু সে কামনায় ভ’রে উঠেছে এমন একটা আবেগ আমার ভেতরে ঢুকোতে চায়; তার হয়তো মনে হয়েছে আর কোনো কিছুর কাছে ধরা না দিলেও আমি তার কামনার কাছে ধরা দেবো। কিন্তু তার ছোঁয়া আমার অচেনা মনে হয়, আমার শরীর কোনো ছোঁয়াই চায় না।আমি বলি, আমার ইচ্ছে করছে না, বসো, চা খাও।সে আমাকে ছেড়ে দিয়ে কাঁপতে থাকে, তার কম্পন আমাকে আলোড়িত করে না।দেলোয়ার বলে, কী হয়েছে তোমার? তুমি কি পাগল হয়ে গেছো? তোমার কি মাথা ঠিক নেই? মাথা খারাপ না হ’লে কেউ বাসা ছেড়ে রেস্টহাউজে থাকে?আমি বিছানায় ব’সে তাকে দেখি, তার জন্যে আমার মায়া হয়। এই লোকটি কোনো অপরাধ করে নি, আমি জীবন বদলে দিয়েছি, তার ফল ভোগ করছে সে, এটা সে কখনো ভাবতেও পারে নি। তার চোখে আমি উদ্বেগ, আর এক আসন্ন লোকসানের আতংক দেখতে পাই, দেখে আমার খারাপ লাগে।
পৃষ্ঠা-৩৪
আমি হাসি, বলি, আমাকে দেখে কি পাগল মনে হয়?আমি একটু বেশি মধুরভাবেই হেসে ফেলি হয়তো, তার চোখ আমার মুখের ওপর থমকে স্থির হয়ে থাকে; সে চা খায় না, সোফায় ব’সে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, আমাকে ভালোভাবে দেখে, কোনো কথা বলে না।সে হয়তো আমার মুখে কিছু পড়তে চায়; আর আমার মনে হয় দেলোয়ার লাভক্ষতির হিশেব কষছে। কী হিশেব করছে দেলোয়ার? আমাকে হারানোর ক্ষতির হিশেব? ৫০০,০০০? আমার শরীরটি হারানোর ক্ষতির হিশেব? ২০০, ০০০? আমি যে একটি চমৎকার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, সেটা হারানোর হিশেব? ১০০০,০০০? আমি যে তার ওয়াইফ, আমাকে দেখিয়ে সে যে গর্ব বোধ করে, সেটা হারানোর লোকসানের হিশেব? ৫০০,০০০? টাকাপয়সার হিশেব সে খুবই চমৎকার করতে পারে, এবং ক্ষতি সে একেবারেই পছন্দ করে না।আমি হাসি, বলি, কী, দেখলে তো? পাগল মনে হচ্ছে?দেলোয়ার বলে, আমি বুঝতে পারছি না তোমার কী হয়েছে? তুমি বাসায় যেতে চাচ্ছো না কেনো?আমি একটু খোঁচা দিতে চাই, বলি, আমি তো এসেছি কয়েক দিন হলো, তোমার আজ আমার কথা মনে পড়লো?দেলোয়ার বিব্রত হয়, বলে, মনে পড়েছে, আমার মনে হয়েছে তোমার আসতে দেরি হচ্ছে।আমি বলি, খবর নিয়েছিলে?দেলোয়ার আরো বিব্রত হয়, বলে, খবর নিই নি, মনে করেছি তুমিই খবর দেবে, তুমিই তো সাধারণত খবর নাও দাও।বেশ নিশ্চিন্তে ছিলো সে, আমিই তো খবর নিয়েছি দিয়েছি এতোদিন, দূরে বেড়াতে গেলে আমিই ট্রেনের টিকিট কিনে এনেছি, প্লেনের টিকিট কিনেছি, বাজারটাজার করেছি, কাজের মেয়েটা না থাকলে রান্নাটা, প্লেট মাজাটা, ফ্লোর ঝাঁট দেয়াটা আমিই করেছি। তখন আমার মনে পড়ে নি এসব আমিই করছি, এখন মনে পড়লো, বেশ অসুবিধা হবে লোকটির। দেলোয়ারকে আমার এখনো ভালোই লাগছে, সে কোনো অন্যায় করে নি, কিন্তু তাকে একটা কঠিন ফলভোগ করতে হচ্ছে, আমি জীবন বদলে দিয়েছি ব’লে।আমি বলি, তুমি যাও, আমার যেতে ইচ্ছে করছে না।দেলোয়ার বলে, আমাকে কি তোমার আর ভালো লাগে না?প্রশ্নটা আমাকে কপালে পাথরের টুকরো এসে লাপার মতো আহত করে। আমি ধ’রেই নিয়েছিলাম দেলোয়ারকে আমার ভালো লাগে, আর সে ধ’রেই নিয়েছিলো তাকে আমার ভালো না লেগে পারে না; তার প্রশ্নে আমার মনে পড়ে ভালো লাগা না লাগার কথা আমি কখনো ভাবিই নি। এটা কেমন ক’রে হলো? আমি কি তার হাসি পছন্দ করতাম, তার চুল পছন্দ করতাম? সে কি মধুরভাবে কথা বলতো? হঠাৎ চমক জ্বালিয়ে দিতো ভেতরে? সে কি বিশুদ্ধ চলতি বলতো,
পৃষ্ঠা-৩৫
এখন বলছে? না তো। তাকে আমার ভালো লাগতো?আমি হেসে বলি, নতুন শার্টে তোমাকে বেশ দেখাচ্ছে, আমার বেশ লাগছে তোমাকে। কটি শার্ট কিনেছো? না কি উপহার পেয়েছো? তোমাকে তো আমার ভালোই লাগে, এখনো লাগছে।দেলোয়ার বলে, তাহলে বাসায় যেতে চাচ্ছো না কেনো? আমি ভেবেছিলাম আমি আসার সাথে সাথে তুমি গাড়িতে উঠবে।আমি বলি, যেতে ইচ্ছে করছে না।দেলোয়ার বলে, তাহলে আমিও আজ এখানেই থাকবো।কথাটি কি সে আন্তরিকভাবে বললো? আমার মনে হয় না, সে আমাকে বিব্রত করার জন্যেই কথাটা বলেছে। আমি বলি, না, এখানে তুমি থাকতে পারো না, কারো সাথে ঘুমোতে আমারইচ্ছে করছে না। আমি একা ঘুমোতে চাই।দেলোয়ার বলে, কেনো পারি না? আমি কি তোমার হাজব্যান্ড নই, তুমি কি আমার ওয়াইফ নও? আমাকে থাকতে দেবে না কেনো? আমার সাথে ঘুমোনো কি কারো সাথে ঘুমোনো হলো?আমি বলি, আমি কিছুদিন একা থাকতে চাই। হাজব্যান্ড ওয়াইফ এসব কথা ভাবতে আমার ভালো লাগছে না। আমি একা ঘুমোতে চাই।দেলোয়ার বলে, হাজর্যান্ড ওয়াইফরা এক বিছানায়ই ঘুমোয়, আমি আমার ওয়াইফের সাথে ঘুমোতে চাই।আমি বলি, আমার কারো সাথে ঘুমোতে ইচ্ছে করছে না।দেলোয়ার উঠে আমাকে জড়িয়ে ধ’রে চুমো খেতে চায়; আমার মনে হয় এবার সে আমাকে বলাৎকার করবে। সে খুবই উত্তেজিত হয়ে আছে, কামনায় নয়, ক্রোধে; তার শরীর কাঁপছে খরখর ক’রে, সে আমার চুলগুলোও ধরেছে শক্তভাবে, গ্রীবায় তার হাত আমার কাছে শক্ত লাগছে।আমি বলি, এভাবে কেউ চুমো খায় না, রেইপ করে।দেলোয়ার বলে, ওয়াইফের সাথে ইন্টারকোর্স রেইপ নয়, তুমি আমার ওয়াইফ, আমি হাজব্যান্ড, আমি তোমার সাথে যে-কোনো সময় ফিজিকেল রিলেশন করতে পারি, আমার অধিকার আছে।আমি বলি, না, তুমি পারো না।দেলোয়ার বলে, বাসায় চলো।
আমি বলি, তুমি এতো উত্তেজিত হয়ে আছো কেনো? আমি চাচ্ছি একটু দূরে থাকতে, তা তুমি মেনে নিতে পারছো না কেনো? তুমি তো রিক্সাঅলা ট্রাকড্রাইভার নও।দেলোয়ার বলে, আমার সঙ্গে তোমাকে যেতেই হবে, এখনি যেতে হবে। আমি বলি, আমরা দুজন প্রাপ্তবয়স্ক দায়িত্বশীল মানুষ, আমরা একে অন্যের
পৃষ্ঠা-৩৬
ওপর জোর খাটাতে পারি না। আশা করি তুমি জোর খাটাবে না।দেলোয়ার বেশ অসহায় বোধ করে। যখনই তার মনে পড়ে আমার একটা তিন অক্ষরের হনুলুলু আছে, একটা অতিবেতনের প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি আছে, এটা সেটা ওটা আমি জানি, দরকার হ’লেই একটা পণ্ডিতের মতো আমি কথা বলতে পারি, দশটি বই থেকে নানা উদ্ধৃতি দিতে পারি, তখন সে অসহায় বোধ করে; সে নানা এয়ারপোর্ট ব্যাংকক দিল্লি নিউইয়র্ক পার্টি ওয়াইন ছাড়া অন্য বিষয়ে কথা বলতে স্বস্তি পায় না। এতোদিন তার এটা আমার বেশ পছন্দ ছিলো, এয়ারপোর্ট নিয়ে কথার বলার থেকে উৎকৃষ্ট কথা কী আছে।দেলোয়ারের বেরিয়ে যেতে বেশ রাত হয়, তার জন্যে আমার কষ্ট হয়, কিন্তু জীবনটাকে যে আমি বদলে দিয়েছি, সেজন্যে আমি কোনো কষ্ট পাই না। আমি যদি জীবন বদলে না দিতাম, সব কিছু ঠিকঠাক থাকতো, কমলগঞ্জ থেকে ফিরে সরাসরি বাসায় যেতাম, গিয়ে দেলোয়ারকে অফিসে ফোন করতাম আমি ফিরেছি, শুনে সে খুশি হতো, ফিরতে ফিরতে তার একটু রাত হয়ে যেতো বা হতো না, তাহলে আমি যে-জীবনের মধ্যে থাকতাম, সেটা কি এখনকার জীবনের থেকে বেশি চাঞ্চল্যকর হতো? বেশি আকর্ষণীয়? দিন দশেক আগেও আমার মনে এ-প্রশ্নটাই জাগে নি, এখন জাগছে।দেলোয়ার ফিরে গেছে, সে হয়তো সরাসরি আব্বার কাছে, মার কাছে যাবে,গিয়ে জানাবে আমি ঢাকায় ফিরেছি, কিন্তু বাসায় ফিরি নি, ফিরতে চাচ্ছি না। আব্বা আর মা শুনে চমকে উঠবেন, মার রক্তচাপটা বেড়ে যাবে, এখনই ছুটে আসতে পারেন আব্বা আর মা; নাও আসতে পারেন, তবে কাল যোগাযোগ হবেই। কাল একটা বড়ো গোলমালে পড়তে হবে আমাকে; তাঁরা বোঝাবেন, আমি বুঝবো না, এবং তাঁরা কিছুতেই বুঝে উঠবেন না কেন্যে আমি ফিরতে চাই না। বিস্ময় ও যন্ত্রণার মধ্যে থাকবেন তাঁরা, আমিও তাতে যন্ত্রণা পাবো; কিন্তু আমি তাঁদের বলতে পারবো না আমি জীবন বদলে দিয়েছি। দেলোয়ার চ’লে যাওয়ার পর আমি একটি বই পড়তে পড়তে নিজের সাথে মাঝেমাঝে আলাপ করতে থাকি, পড়ার ফাঁকে ফাঁকে আলাপ আর আলাপের ফাঁকে ফাঁকে পড়তে থাকি, এ-পদ্ধতিটা আমি ছোটোবেলা থেকেই ব্যবহার ক’রে আসছি, এতে আমার মাথাটা পরিচ্ছন্ন থাকে।দেলোয়ারকে ফিরিয়ে দেয়া কি ঠিক হলো?ঠিকই হয়েছে, তুমি জীবন বদলে দিয়েছো, এ ছাড়া তুমি আর কী করতে পারো?তুমি কি অপরাধ করেছো, অপরাধবোধে ভুগছো?না, অপরাধ করেছি মনে হয় না; পুরুষেরা তো এমন সব সময়ই করে।তুমি তো পুরুষ নও।তাতে কী হয়েছে?হয় নি? নানা জায়গায় ঘুমোলে পুরুষের গায়ে ময়লা লাগে না, নারীর গায়ে
পৃষ্ঠা-৩৭
ময়লা লাগে। পুরুষ ব্যবহার করে, নারী ব্যবহৃত হয়।আমার গায়েও কোনো ময়লা লাগে নি, আর ব্যবহার করা? আমিই ব্যবহারকরেছি অদ্রলোককে, ব্যবহৃত হই নি।কে বললো হও নি? ভদ্রলোকটিই তো চেপে পিষে ভেঙে চুরে ঢুকে বেরিয়ে ভিজিয়ে গলিয়ে ভোগ করলো তোমাকে।আমি তাঁকে ওইভাবে ব্যবহার করেছি, খাটিয়েছি।কিন্তু তুমি কি পুরুষটিকে ব্যবহার করতে গিয়ে ব্যবহৃত হও নি? সে তোমার ভেতরে ঝলকে ঝলকে যে-লালা ঢেলেছে, তাতে তুমি বিপদে পড়তে পারো; তুমি তো তার ভেতরে কিছু ঢালো নি, তার ভেতরে তুমি কোনো ছাপ রাখো নি।হ্যাঁ, এটা ওদের একটা সুবিধা, ওদের ব্যবহার করতে গেলে ব্যবহৃত হ’তে হয়, আমিও সেভাবে ব্যবহৃত হয়েছি। কিছু করার নেই।তুমি যা করেছো, তা তো কেউ জানে না, জানবে না। ফিরে যেতে অসুবিধা কোথায়?আমি তো জানি, এটাই আমার অসুবিধা।তোমার ভেতর কি পুরোনো নৈতিকতা কাজ ক’রে চলছে? সতীত্বটতিত্ব? না।তাহলে তুমি জীবনকে বদলে দিচ্ছো কেনো?আমার মনে হচ্ছে আমি যা করেছি, ভাতে আমি আগের জীবনে ফিরে যেতে পারি না, নিজের কাছে নিজেকে অসৎ মনে হবে।অনেক নারী তো এমন করে, সুখে সংসারও করে।তারা করুক, আমার আপত্তি নেই, আমি পারবো না।তুমি গোপনে যেখানেই শোও না কেনো, বিয়েটাকে তো ঠিক রাখতে হবে। কেনো ঠিক রাখতে হবে?রাখতে হবে না? সমাজ তো এই চায়, সব চলুক, বিয়েও চলুক। আমি তা মনে করি না।বিয়েকে কি তুমি কখনো গুরুত্বের সাথে নাও নি?মনেই পড়ে নি, বিয়ে করতে হয় করেছিলাম, একসাথে শুতে হয় শুয়েছিলাম, একসাথে থাকতে হয় থেকেছিলাম।বিয়ে কি এতো তুচ্ছ? এটাকে কি টিকিয়ে রাখতে হবে না? কখনো ভাবি নি।কষ্ট হবে না?যদি হয় তখন দেখবো। একা থাকবে? সেটাও পরে দেখবো।
পৃষ্ঠা-৩৮
আবার বিয়ে করবে?মনে হয় না। করতেও পারি নাও পারি। করার কী দরকার?আব্বার ডায়াবেটিস, মার রক্তচাপ, আমি তাঁদের দুজনেরই উদ্বিগ্ন বিষণ্ণ মুখ দেখতে পাই; তাঁরা রাতে ঘুমোতে পারবেন না, আমার কথা ভেবে ভেবে জেগে থাকবেন, আমার খারাপ লাগে। আমার জন্যে তাঁদের কষ্ট হোক, এটা আমি চাই না, কিন্তু রাতটি তাঁদের কষ্টে যাবে আমার জন্যে; ভোরে উঠেই আমি ফোন করি, ধরেন আব্বা; আমার ফোন পেয়ে তাঁর ওপর থেকে একটা বড়ো ভার নেমে যায়, আমি তাঁর গলার স্বরে বুঝতে পারি।আব্বা বলেন, ভোর কী হয়েছে রে শিরিন?আমি বলি, আব্বা, না, কিছু তো হয় নি।আব্বা বলেন, তাহলে তুই বাসা ছেড়ে রেস্টহাউজে থাকছিস কেনো? কাল মাঝরাতে দেলোয়ার এসেছিলো।আমি বলি, এজন্যেই এতো ভোরে ফোন করলাম, আপনি আর মা হয়তো চ’লে আসতে পারেন।আব্বা বলেন, হ্যাঁ, আমি ভোরেই উঠে গেছি, তোর মাও উঠেছে; দেলোয়ার এলেই আমরা তোর ওখানে আসবো।আমি বলি, আপনি আর মা এখানে আসবেন, আপনাদের কষ্ট হবে, এজন্যেই ফোন করলাম। আব্বা, আপনারা আসবেন না।আব্বা বলেন, ঠিক আছে, তুই রেস্টহাউজ থেকে বাসায় চ’লে যা।আমি বলি, না, আব্বা, আমি বাসায় যাবো না; কষ্ট ক’রে আপনারা আসবেন না। আমি কিছুক্ষণ পরই বেরিয়ে যাবো, সকালে আমার ক্লাশ আছে।আব্বা বলেন, তোর মা পাগল হয়ে আছে। আমি বলি, মা কি উঠেছে? তাহলে মাকে দিন।মা ফোন ধ’রে আর্তনাদ ক’রে ওঠে, অই শিরি, তর কী অইছে? তুই বাসা থুইয়া বাইরে থাকছ ক্যা? আমি তর লিগা হারারাইত ঘুমাইতে পারি নাই।আমি বলি, আমার কিছু অয় নাই, মা, আমার লিগা ভাইব্বো না, আমি ভাল আছি। তোমার রক্তচাপটা অহন কেমুন আছে?মা বলে, তর জামাই কাইল রাইতে কাইন্দা কাইট্টা গেলো, তুই বারিতেথাকছ না বইল্লা আমার হারারাইত ঘুম অয় নাই, চাপ বারছে মনে অয়। আমি বলি, অহন একটু ঘুমাইয়া লও; আর এইহানে আহনের কাম নাই, আমার নয়ডার সোম ক্যালাশ আছে।মা বলে, জামাইর লগে তর ঝগড়া অইছে নি?আমি বলি, ঝগড়া অইবো ক্যা?মা বলে, তাইলে তুই বারি থুইয়া বাইরে আছঢ় ক্যা? মাইয়ামাইনশের বাইরে থাকন ভাল না।
পৃষ্ঠা-৩৯
আমি বলি, এই লইয়া তুমি ভাইব্বো না, তোমার রক্তের চাপটা বাইর্যা যাইবো। তুমি অহন একটা ঘোম দেও।মা বলে, তুই তর বাসায় চইল্লা যাইচ, কতা দে, নাইলে আমি অহন আমু। আমি বলি, তোমার শরিল খারাপ, আহনের কাম নাই।মা বলে, কতা দে, নাইলে আমি আহুম।আমি বলি, তোমার আহনের কাম নাই, ক্যালাশের পর আমিই আহুম। মা বলে, তাইলে দুইফরে এইহানে খাইচ, তর জামাইরেও খাইতে কমু। আমি বলি, আইচ্ছা, খামুনে।দিন বিশেক হলো মাকে আব্বাকে দেখি না, নাসরিন সুমনটাকে দেখি না;ওদের দেখতে ইচ্ছে করছিলো, দু-এক দিনের মধ্যে যেতাম, কিন্তু এখন যেতেহচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ কাজে, একেবারে আমার জীবন নিয়ে। বাসায় গেলে ওদেরজন্যে কিছু-না-কিছু নিয়ে যেতে আমার সুখ লাগে, সুখটুখ লাগা আমি পছন্দকরি। দুপুরে অবশ্য সুমন নাসরিন একটাকেও পাবো না, ও দুটি আমার মতোই কলাভবন কার্জন হলের ঘূণপোকা, একবার গেলে আর ফিরতে চায় না; হয়তোযখন আমি ফিরে আসবো, বিকেলে বা সন্ধ্যায়, তখনো দেখা হবে না। ওরাআব্বা আর মার মতো চিন্তায় নেই, এখনো জানে না, জানলেও চিন্তাটিন্তা করবে না; বলবে, যেখানে থাকতে ইচ্ছে করে, সেখানেই থাক, নরকে ইচ্ছে করলে নরকেই থাক, স্বর্গেই যে থাকতে হবে, এটা কে বলেছে? ক্লাশ থেকে বেরিয়েআমি একটি বিপণিকেন্দ্রে গিয়ে এটা সেটা কিনি, ওদের জন্যে এবং আমার জন্যে, রেস্টহাউজে ফিরে বিশ্রাম নিই একটু, হাতমুখ ধুই, কাপড় বদলাই, এবং আয়নায় নিজের মুখ দেখে চমকে উঠি- মুখটি এতো সুন্দর দেখাচ্ছে আমার,মুখটি দেখার পর আমার হাতের দিকে তাকিয়ে, আঙুলগুলো দেখে, পিঠের ওপর ছড়ানো চুল দেখে আমি মুগ্ধ হই। লিপস্টিক মাখি না, তবু আমার ঠোঁট এমন উজ্জ্বল? আমি তাহলে বেশ আছি? যদি খারাপ থাকতাম, এগুলোতে ময়লা লাগতো না জং ধরতো না? জীবন বদলে দিলে তাহলে মানুষ খারাপ থাকে না?হঠাৎ একটা ভাষনা ঝিলিক দেয়, আমার এই মুখ এই হাভ এই শরীর দেখে দেলোয়ার কি একটু বেশি পাগল হয়ে উঠবে না? তার ভেতরে ক্ষতির যন্ত্রণাটা একটু বেশি কামড় দেবে না? হয়তো দেবে, কিন্তু আমি কী আর করতে পারি জীবন বদলে দেয়ার পর?দেলোয়ারের জন্যে আমার মায়া হয়, কোনো অপরাধ না ক’রে ও শাস্তি পাচ্ছে, ও জানতেও পারছে না কেনো শাস্তি পাচ্ছে, শাস্তিটা কতো বড়ো তাও ও জানে না; কিন্তু আমি তো কারণটা জানাতে পারি না।দুপুরে আমি গিয়ে যখন কলিংবেল বাজাই, দেলোয়ারই দরোজা খুলে দেয়। দেলোয়ারকে দেখে আমি একটুও কেঁপে উঠি না। আগে কি কেঁপে উঠতাম? আমি মনে করার চেষ্টা করি; না, কোনো কম্পনের ইতিহাস মনে পড়ে না, তাকে শুধু আমার একজন পরিচিত পুরুষ মনে হয়। আগে হ’লে হয়তো দেলোয়ার
পৃষ্ঠা-৪০
দরোজা খুলতো না, আমার কলিংবেল তাকে টানতো না; আজ টেনেছে। কেনো টেনেছে? ভেবে আমার হাসি পায়।আমি হাসি, বলি, ভালো আছো?দেলোয়ার কোনো কথা না ব’লে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।আমি ডাকি, মা, আব্বা, আমি এসেছি।মার গলার স্বর শুনি, আমি রান্ধনঘরে, শিরি, এইহানে আয়।হাতের জিনিশগুলো খাবারটেবিলের ওপর রেখে রান্নাঘরে গিয়ে দেখি মায় উৎসবের রান্নার আয়োজন করেছে।কাজের মেয়েটি বলে, আফা, আমার লিগা কি আনছেন?আমি বলি, তর রূপ খোলনের লিগা একটা লিপস্টিক আনছি।মেয়েটি বলে, হ, আফায় সব সোম আমার মনের কতা আগেই জাইন্যা যায়, আমি মনে মনে লিপিস্টিকই চাইতে আছিলাম।মেয়েটিকে আমি পছন্দ করি, অনেক বছর ধ’রে আছে; ওকে আমি একটু আধটু তোশামোদই করি, শস্তা শ্যাম্পু শস্তা লিপস্টিক সাবান, যা ওর স্বপ্নের বস্তু আমি মাঝেমাঝেই এনে দিই ওকে, শুধু মার কথা ভেবে। ও চ’লে গেলে মার কষ্টের শেষ থাকবে না, তাতে আমার কষ্টের শেষ থাকবে না।আমি মাকে বলি, তুমি দিহি দুনিয়ার সব কিছু রাইন্ধা হালাইছো।মাকে খুব খুশি মনে হয়, মা বলে, তপো একলগে খাওয়ামু, রানতে অইবো না? কতো দিন পর আইলি।আমি বলি, পোলাও কোর্মা রুইমাছ কইমাছ…মা বলে, তর কতাও ভুলি নাই, তিনচাইর পদের ভর্তাও বানাইছি।আমি বলি, সুমন নাসরিনের ফিরতে আইজও রাইত অইয়া যাইবো নি, মা? মা বলে, তুমি আইবা হুইন্যা গ্যাছে, আইজ কি তারা রাইত করতে পারবো? আইয়া পরলো বইল্যা।ওদের জন্যে আমার বুকটা কেঁপে ওঠে; আর তখনই ওরা হৈহৈ কলকল ক’রে বাসায় ঢোকে। আমি বলি, কি রে তরা যে আইজ এতো তরাতরি আইলি, প্রাইচ্যের অক্সফোডে কাডা রাইফেল শুরু অইয়া গ্যাছে নি? কেমুন বাজতে আছে? নাসরিন জড়িয়ে ধ’রে বলে, তুমি আইবা, আর আমরা পোড়ার ইনভার্সিটিতে মরনের লিখা থাকুম নি? দেহি কী কী আনছো আমার লিগা।আমি বলি, তর বয়ফ্রেইন্ডগুলির খবর কী? সগলে বাইচ্যা আছে তো? নাসরিন বলে, বয়ফ্রেইন্ড কই দেকলি? চাকরবাকররে তুই বয়ফ্রেইন্ড কচ? আমি বলি, তুই তো বেশ বদমাশ হয়ে উঠেছিস। তোর জিভে আমি রক্ত দেখতে পাচ্ছি।সুমন বলে, এমুন অ্যাকটা টিশাডের লিগা তরে ফোন করুম বইল্যা ভাবতে
পৃষ্ঠা-৪১
আছিলাম। তুই জানলি কেমুন কইর্যা?আমি বলি, আমার এনজিওতে পোলাগুলিরে ফিনতে দেহি।আব্বা এসে বলেন, আমার জন্যে কী এনেছিস, আমার জন্যে?একটি উৎসব শুরু হয়ে যায়, আমি এমন উৎসবে সুখ পাই, আমাকে নিয়ে ওরা যে মেতে ওঠে, এটা আমাকে সুখ দেয়, মনে মনে আমি চাইও, এবং তার আয়োজনও আমি করি। এই যে ছোটো ছোটো উপহার, এই যে বড়ো বড়ো প্রশংসা, এই যে দুপুরে ছুটে আসা সুমন নাসরিনের। কী যে সুখ।মা রান্নাঘর থেকে ডাকে, অই শিরি, রাজন অইয়া গেছে, টেবিলে খাওন দে।এটাও পছন্দ মার, সে রাঁধবে, কিন্তু বাড়বো আমি, টেবিলে খাবার সাজাবো আমি, সবাইকে খেতে ডাকবো আমি। এটা আমারও পছন্দ। আমি খাবার বাড়ি, কাজের মেয়েটা আর নাসরিনকে বলি টেবিলে খাবার সাজাতে, প্লেট দিতে; কয়েক মিনিটের মধ্যে টেবিল খাবারে সেজে ওঠে।আমি সবাইকে খেতে ডাকি। দেলোয়ার আর আব্বা ড্রয়িংরুমে।আমি গিয়ে বলি, আব্বা, খেতে আসুন; দেলোয়ারকে বলি, এসো, খেতে এসো।আব্বা তাড়াতাড়ি গিয়ে বসেন টেবিলে, দেলোয়ার ব’সে থাকে। আমি হেসে তার কাছে গিয়ে বলি, এসো, খেতে এসো।দেলোয়ার আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, ওর চোখ ভ’রে আছে ক্ষতির ভয়ে। আমি একটু বেশি মধুর হেসে মধুর কণ্ঠে বলি, মা তোমার জন্যে কতো কী রেঁধেছে, এসো, তাড়াতাড়ি এসো; অনেক দিন এমন খাও নি।আমার হাসিটা তখন কেনো একটু বেশি মধুর হলো, কণ্ঠটা কেনো একটু বেশি মধুর বাজলো? ইচ্ছে ক’রেই করেছিলাম আমি?দেলোয়ার উঠতে দেরি করে; আমি চোখে মুখে ঝিলিক ছড়িয়ে বলি, আহা, ওঠো, এসো, খেতে এসো, দেরি কোরো না।দেলোয়ার আমার একটি হাত ধ’রে দাঁড়ায়, আমি প্রথম হাতটা ছাড়িয়ে নিই না, তারপর আমার হাতটি নিজেই বেরিয়ে আসে ওর হাত থেকে।
মা ছাড়া সবাই খেতে বসেছে, আমিও।দেলোয়ারের পাতে খাবার তুলে দিতে দিতে, বড়ো কইমাছটা তুলে দিতে দিতে আমি বলি, আমি রান্নাঘরে ঢোকার সাথে সাথে মা আমাকে ব’লে দিয়েছে এই বড়ো কইমাছটা তোমার, অথচ এটা খেতে ইচ্ছে করছিলো আমার। দেলোয়ার বলে, তাহলে তুমিই নাও।আমি বলি, আমি এটা খেলে মা আমাকে জানে মেরে ফেলবে।মা বলে, আমার একটামাত্র জামাই, বড়ো মাছটাতো জামাইই খাইবো। শিরি, দে, জামাইরে আরেকটা কইমাছ দে।আমি বলি, দেখলে, তোমার জন্যে মার কতো টান?
পৃষ্ঠা-৪২
আমি আরেকটা কইমাছ তুলে দিই, দেলোয়ার আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।খেতে খেতে দেলোয়ার আমার দিকে তাকায়, যেনো সে বিয়ের জন্যে পাত্রী দেখতে এসেছে, সরাসরি তাকাতে পারছে না, মাথা নিচু ক’রে খেতে খেতে ফাঁক বুঝে একবার দেখছে, চোখ নামিয়ে নিচ্ছে, আবার দেখছে ফাঁক বুঝে। পাত্রের চোখ জ্বলজ্বল ক’রে উঠছে, পারলে এখনি কাজি ডেকে বিয়েটা সেরে বাসরঘরে ঢুকে পড়ে। আমার মজা লাগে, একটু কষ্টও লাগে; লোকটি এখনো আমার হাজব্যান্ড, আমরা টেবিলের এপাশে ওপাশে, আমি খাবার তুলে দিচ্ছি তাকে, তবু আমরা কতো দূরে, আমি জীবনটাকে বদলে দিয়েছি ব’লে। আমি কয়েকবার তার পাতে খাবার তুলে দিতেই সে খুশি হয়ে ওঠে, তার চোখের ভয়টা কেটে যায়, যেনো একটু পরেই সে আমাকে নিয়ে বাসায় ফিরবে।আমি বলি, নাসরিন, দেখ তো দেলোয়ারের জামাটা, কী চমৎকার না? ওকে খুব মানিয়েছে না?নাসরিন বলে, তুমি কিনে দিয়েছো, আর না মানিয়ে পারে?আমি বলি, না, এটা ও নিজেই কিনেছে, সুন্দর জিনিশ ও আমার থেকেও বেশি পছন্দ করতে পারে।মা বলে, ওই শিরি, আমাইর পাতে কোর্মা দে।আমি তাড়াতাড়ি যত্নের সাথে একটি আস্ত মুরগি তুলে দিই তার পাতে। দেলোয়ার বলে, করছো কী, করছো কী? আমি এভো খেতে পারবো না। আমি বলি, তাহলে ভেঙে আমাদেরও দাও।দেলোয়ার মুরগিটা ভেঙে অর্ধেকের বেশি আমার পাতে তুলে দেয়, তুলে দিতে তার সুখ লাগে; আমার মনে পড়ে কতো দিন সে আমার পাতে কিছু তুলে দেয় নি; দেয়ার তার দরকার পড়ে নি, আমিই তো তুলে দিয়েছি।নাসরিন বলে, দ্যাখো, দেলোয়ার ভাই আমাকে দেখলো না, মুরগিটা নিজের বউর পাতেই ভুলে দিলো, না দিলে যেনো বউ তাকে ছেড়ে যেতো।আমি বলি, তুই বড়োই ঈর্ষা করিস আমাকে।নাসরিন বলে, আমি ঈর্ষা করি দেলোয়ার ভাইকে।দেলোয়ার খুশি হয়ে বলে, কেনো ঈর্ষা করো আমাকে? আমার কী আছে? নাসরিন বলে, এমন বউ যার, তাকে তো সবাই ঈর্ষা করে। একটি বউ বাগিয়েছিলেন বটে আপনি, কেমন ক’রে পেরেছিলেন?নাসরিনের কথায় দেলোয়ার সুখী হলো? কষ্ট পেলো? গর্ব বোধ করলো? দেলোয়ার কি আসলেই কি একটি অসাধারণ বউ বাগিয়েছিলো? আমার মধ্যে কিছু কি অসাধারণ আছে? খেতে খেতে দেখি দেলোয়ারের মুখের চোখের ভয়টা কেটে যাচ্ছে, সে আত্মবিশ্বাস ফিরে পাচ্ছে, ভয়ের অন্ধকার কেটে গিয়ে সেখানে জয়ের আলো দেখা দিচ্ছে; সে পিছলে প’ড়ে যাচ্ছে কোনো উঁচু শিখর থেকে, এ-দাগটা ছিলো তার চোখেমুখে, খেতে খেতে মনে হচ্ছে- না, সে পড়ে নি, সে
পৃষ্ঠা-৪৩
আবার উঠছে শিখরের দিকে, উঠে পড়েছে, শিখরের ওপরে সে দাঁড়িয়ে পতাকা তুলে দিয়েছে। দেখে আমার কষ্ট হয়, সে জানে না আমি জীবন বদলে দিয়েছি। তাকে খুব হাসিখুশি দেখায়, যেমন দেখাতো পাঁচ-ছ বছর আগে, যখন তার সাথে আমার পরিচয় হচ্ছিলো; তারপর আমাকে পেয়ে যাওয়ার পর অনেক দিন তাকে এতোটা হাসিখুশিতে ভ’রে উঠতে দেখি নি। হাসিখুশির মধ্যে থাকার রাখার দায়িত্বটি আমিই পালন করেছি, যদিও সেটাকে আমার দায়িত্ব মনে হয় নি। দেলোয়ারের পাতে আমি মাঝেমাঝে খাবার তুলে দিতে থাকি, কোকের গ্লাশটা এগিয়ে দিই, আগের মতোই একটি-দুটি প্রশংসা করি। দেলোয়ার এসব আগের মতোই উপভোগ করতে থাকে; আগে অবশ্যি আমি তাকিয়ে দেখতাম না সে উপভোগ করছে কি না, আজ দেখি সে খুবই উপভোগ করছে, উপভোগ করতে করতে সে আগের মতোই আমার হাজব্যান্ড হয়ে উঠছে।খাওয়া শেষ হ’তে-না-হ’তে দেলোয়ার বলে, চলো, তাড়াতাড়ি, বাসায় চলো।আগেও এমন কথা সে বহুবার বলেছে, তার কথা শুনে আমার ভালো লেগেছে, আমিও আর দেরি করি নি, তার কথা শোনার সাথে সাথে হাসিমুখে তৈরি হয়েছি, যাকে আব্বাকে নাসরিন সুমনকে ব’লে রওনা দিয়েছি। আমি তখন অপেক্ষায় থাকতাম কখন দেলোয়ার বাসায় যাওয়ার কথা বলবে, আজো জানতাম সে কথাটি বলবে, কিন্তু আমি অপেক্ষায় ছিলাম না।আমি বলি, তুমি ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসো, আমি আসছি। দেলোয়ার খুশিতে ড্রয়িংরুমে যায়, সে হয়তো আমার কথার অর্থটি তার নিজের মতো ক’রে করেছে।মা একা পায়, আজো একা খেতে বসেছে; মাকে আমি খাবার বেড়ে দিই, খেতে খেতে মা জিজ্ঞেস করে, তর লগে জামাইর ঝগরা মিটা গ্যাছে তো?আমি বলি, কোনো ঝগরা অয় নাই, মা।মা বলে, যা অইবার অইছে, অহন তুই জামাইর লগে বাসায় যা।আমি বলি, না, মা।মা বলে, তুই তো কোনোদিন আমার কতা না হোনছ নাই। আর জামাইর লগে যাইবি না ক্যান, হে কী করছে?আমি বলি, কিছু করে নি, আমার যেতে ইচ্ছে করছে না।মা বলে, তুই তো কোনোদিন এমুন আছিলি না।আমি বলি, আমারে লইয়া চিন্তা কইরো না, তাইলে তোমার রক্তচাপটা বারবো।মা বলে, পুরুষপোলাগো লগে মাজেমইদ্যে ঝগরা অয়ই, হেই লিগা কি অন্য জায়গায় গিয়া ওটতে অইবো?দেলোয়ার একা ব’সে আছে ড্রয়িংরুমে, আমার একবার যাওয়া উচিত তার
পৃষ্ঠা-৪৪
সামনে, অতিথির কাছে যেমন যেতে হয়, মাও চায় আমি যাই; আমি ভেবেছিলাম সে একা হয়তো কষ্ট পাচ্ছে হয়তো বিষণ্ণ হয়ে আছে হয়তো আমার জন্যে উৎকণ্ঠিত অস্থির হয়ে আছে, গিয়ে দেখি সে খুব খুশিতে আছে, রিমোট কন্ট্রোল টিপে টিপে চ্যানেল থেকে চ্যানেলে যাচ্ছে, এক চ্যানেলে একটি আধন্যাংটো মেয়ে লাফিয়ে উঠলো, তার ওপরভাগ কোলাহল করতে লাগলো, মেয়েটিকে গেলার জন্যে সে থামলো, আমি এসেছি সেটা তার কাছে কোনো ঘটনা মনে হলো না। সে জানে মেয়েটি চ’লে যাবে, আমি থাকবো। দেলোয়ারের পাশে কয়েকটি ইংরেজি বাঙলা সাময়িকপত্র প’ড়ে আছে, সেগুলো সে ধরেও নিঃ শেষে অনেকগুলো উপন্যাস, প্রবন্ধসংকলন, কবিতার বই, অর্থনীতি রাজনীতি দর্শনের বই দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলোর দিকে সে তাকায়ও নি, তাকে কখনো আমি বই ছুঁতে দেখি নি। এতোদিন আমার খারাপ লাগে নি, ভালোই লেগেছে যে আমার হাজব্যান্ডটি মূর্ব, মাঝেমাঝে আমি তাকে জ্ঞান দিতে পারি এটা সেটা সম্পর্কে, কিন্তু আজ আমি ধাক্কা খেলাম।আমি বলি, চমৎকার নাচছে মেয়েটি।আমার কথার অর্থ বোকার আর দরকার নেই দেলোয়ারের, খাবার টেবিলে সে সব অর্থ বুঝে পেছে- আমি যাচ্ছি তার সাথে।দেলোয়ার বলে, হ্যাঁ, দারুণ নাচ; বোম্বাইর মেয়েগুলো দারুণ নাচে, আর ফিগারও দারুণ, দেখার মতো।এ-উচ্ছ্বাস আমি তার মুখে অনেক শুনেছি, তার চোখে লাল কামনা দেখেছি,তখন খারাপ লাগে নি, বরং উচ্ছ্বাসে আমিও যোগ দিয়ে বলেছি, কোমরগুলো দ্যাখো, বুকগুলো দ্যাখো, নিতম্বগুলো দ্যাখো, কীভাবে এমন কাঁপায়।আজ আমার ঘিনঘিনে লাগে।আমি বলি, তুমি নাচ দেখতে থাকো, আমার একটু কাজ আছে।আমার কি একটু অভিমান হলো? আমি জীবন বদলে দিয়েছি, দেলোয়ার এখন যা-ইচ্ছে করতে পারে, তাতে আমি দুঃখ পেতে আহত হ’তে পারি না, আমার স্বরেও যন্ত্রণা প্রকাশ পেতে পারে না। তবু আমি কেনো এভাবে কথা বললাম? আমার এটা বলা ঠিক হয় নি, নিজেকে আমি বলতে থাকি।দেলোয়ার বলে, চলো, তাড়াতাড়ি বাসায় চলো।আমি স্বাভাবিকতায় ফিরে আসি, সহজ সরলভাবে কথা বলি।আমি বলি, আমি তো যাচ্ছি না, তুমি যাও, আমাকে এক্ষুণি বেরোতে হবে, আমার বেশ কাজ আছে।দেলোয়ার বলে, বাসায় যাবে না কোথায় যাবে? কী কাজ?দেলোয়ারের কাছে আমার জবাবদিহি করতে হবে? তার প্রয়োজন আছে? আমি জীবন বদলে দিয়েছি, যেখানে ইচ্ছে যেতে পারি।আমি বলি, রেস্টহাউজে যাবো, আমার একটি লেখা শেষ করতে হবে।
পৃষ্ঠা-৪৫
লেখাটির কথা বলা কি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেলো না? নিজেকে কি একটু গুরুত্বপূর্ণ ক’রে তুলতে চেয়েছি আমি? আমি রেস্টহাউজে যাবো, এটাই কি যথেষ্ট নয়; সাথে কারণ দেখাতে হবে কেনো?দেলোয়ার বলে, রেস্টহাউজে না, আমার সঙ্গে তোমাকে বাসায় যেতে হবে; তুমি বেশি বাড়াবাড়ি করছো।আমি বলি, তুমি বসো, আমি যাচ্ছি।দেলোয়ার বলে, তাহলে একটা গোলমাল হয়ে যাবে।দেলোয়ার এতো তাড়াতাড়ি এতোটা উত্তেজিত হয়ে উঠবে আমি ভাবি নি; ভেবেছিলাম সে বোঝার চেষ্টা করবে আমাকে, কষ্ট পাবে, তখন আমিও কষ্ট পাবো, তার জন্যে আমার মন ভারি হয়ে উঠবে।আমি বলি, হয়তো হবে।দেলোয়ারের জন্যে আমার মায়াই ছিলো, তার জন্যে আমার একটু কষ্টই ছিলো, তাকে না জানিয়ে আমি জীবন বদলে দিয়েছি ব’লে তার জীবনটাও বদলে যাচ্ছে, তাতে আমার একটু যন্ত্রণাই ছিলো; কিন্তু এখন কি আমি দেলোয়ারের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠছি? দেলোয়ার কি হয়ে উঠছে আমার প্রতিপক্ষ? আমাদের আলাপগুলো হয়ে উঠছে কর্কশ? আমি তো কোমল থাকতেই চেয়েছিলাম; ভেবেছিলাম দেলোয়ারও কোমল থাকবে, আমি ওর কণ্ঠে বিষণ্ণতা চেয়েছিলাম, আমিও একটু কাতর হ’তে চেরেছিলাম।দেলোয়ার জোরে ডাকতে থাকে, সুমন, নাসরিন।ওরা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করে, তবু ওরা দুজনই দেলোয়ারের ডাকে ওদের ঘরথেকে বেরিয়ে আসে।দেলোয়ার বলে, দ্যাখো তো ও কী শুরু করেছে?দেলোয়ার এখন এতো অসহায়? অভিযোগ করছে ওদের কাছে? নাসরিন আমাকে জিজ্ঞেস করে, কী শুরু করেছো তুমি?আমি বলি, কিছুই তো শুরু করি নি।দেলোয়ার নাসরিনকে বলে, মাকে আর আব্বাকে একটু আসতে বলো, আমার একটু কথা আছে।আমি বলি, ব্যাপারটা আমার, এবং কিছুটা তোমার, এতে আব্বাকে আর মাকে আমি জড়াতে চাই না। এটা তাঁদের ব্যাপার নয়।দেলোয়ার বলে, না, এটা তাঁদেরও ব্যাপার।মা আসে, আব্বা আসেন; দেলোয়ার তাঁদের কাছে অভিযোগ জানাতে থাকে। মা আমাকে জড়িয়ে ধ’রে বলে, যা মা, তুই জামাইর লগে যা। আমি বলি, না, মা, আমি যাচ্ছি না।মা বলে, এইডা কেমুন কতা? জামাইর লগে যাবি না ক্যা? আমি বলি, মা, তুমি তা বুঝবে না।
পৃষ্ঠা ৪৬ থেকে ৬০
পৃষ্ঠা-৪৬
আব্বা কথা বলেন না, একবার আমার দিকে তাকিয়ে চুপ ক’রে থাকেন।দেলোয়ার বলে, যাবে না কেনো, আমি কী করেছি?মা বলে, ক, জামাই দোষ করলে অহনই মাপ চাইবো, ক, জামাই কী দোষ করছে তর কাছে?আমি বলি, না, কোনো দোষ করে নি।মা বলে, তাইলে যাবি না ক্যা?নাসরিন বলে, ওর ওপর জোর ক’রে কী হবে? ও যেতে চায় না, নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। পরে হয়তো নিজেই ও যাবে।আমি বলি, মা, এখন আমি বেরোবো, আমার একটু কাজ আছে।মা বলে, কাম থাকলে যাইচ, ভয় জামাইর লগে যা।আমি নাসরিনকে বলি, নাসরিন, তুই ওর সাথে যাস তো, আমার কাপড়চোপড় আর বইপত্রগুলো এনে রাখিস; কাপড়চোপড় বইপত্রইগুলো আমার দরকার।আমি মাকে আর আব্বাকে, দেলোয়ারকে ব’লে বেরিয়ে আসি, দেলোয়ার স্তব্ধ হয়ে ব’সে থাকে। আমি চেয়েছিলাম হাসিমুখে দেলোয়ারকে বিদায় দিতে, যেনো কিছু হয় নি, বন্ধুদের মধ্যে দেখা হয়েছে, দুপুরটা বেশ কেটেছে, ভালো খেয়েছি, গল্পগুজব করেছি, তারপর হাসিমুখে পরস্পরকে বিদায় জানিয়েছি, কিন্তু তা হলো না। দেলোয়ার আমার বন্ধু নয়? হাজব্যান্ড? তার অধিকার অনেক বেশি? মা খুব উদ্বিগ্ন, সংসার তার কাছে খুবই বড়ো ব্যাপার, সংসারে মা কোনো গোলমাল দেখতে চায় না; আকা সব সময়ই কম কথা বলেন, দেখে এসেছেন আমি সব সময় আমার মতোই কাজ ক’রে এসেছি, তাতে তাঁকে কখনোই – কোনো সমস্যায় পড়তে হয় নি, বরং তিনি যুক্ত থাকতে পেরেছেন অনাবশ্যক-উদ্বেগ থেকে। নাসরিন সুমন আমারই অন্য সত্তা, ওরা এ নিয়ে ভাববেও না, ওদের ভাবার অনেক কিছু আছে। আমি বেরিয়ে আসি, আমার সাথে সাথে ওরা নামে, হাসতে হাসতে নামে, আমি কেনো যাচ্ছি না দেলোয়ারের সাথে সে- – সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করে না, আমিও ওদের সাথে হাসতে হাসতে নামি।মজা করার জন্যে নাসরিনকে জিজ্ঞেস করি, কী রে তোর বয়ফ্রেইন্ডগুলোর মধ্যে কোনটি তোর বেশি ফেভার পাচ্ছে? কোনটিকে একটু আধটু চুল ছুঁতে
পৃষ্ঠা-৪৭
আমি বলি, এর চেয়ে তুই ওকেই বল না, এই মিয়া আমার লিগা মেলা থিকা অ্যাকটা চাইর আনা দামের কাকই কিন্যা আইন্যো তো।আমরা হাসাহাসি ক’রে বাসার বাইরে যাই, একটি বেবির জন্যে দাঁড়াই।সুমন বলে, ওর কথা তুই বিশ্বাস করিস না, ও আন্ত লায়ার, ও একজনকে জড়িয়ে ধ’রে হাঁটে বিকেলবেলা।আমি বলি, তোর খবর কী? মেয়েটেয়ে পটালি?সুমন বলে, আমার পটাতে হয় না, আমাকেই পটায়।আমি বলি, কটা?সুমন বলে, গোটা দশেক, তবে এগুলোকে আমি নেবো না।আমি বলি, কেনো এগুলোর কি গাল ভাঙা, দাঁত উঁচু?সুমন বলে, আমার ইচ্ছে আমেরিকায় অ্যাস্ট্রোফিজিক্সে পিএইচডি, সেখানে ইতালীয় জাপানি ফরাশি আমেরিকান ইন্ডিয়ান আইরিশ আফ্রিকান অ্যারাবিয়ান শো-খানেক পটানোর পর একটা কিছু।আমি বলি, শো-খানেক?সুমন হেসে বলে, তারও বেশি হ’তে পারে, অ্যাস্ট্রোনমিকাল নাম্বারস।বেবিতে উঠে আমি রেস্টহাউজের দিকে ফিরতে থাকি, বেবিটা লাফাতে লাফাতে চলতে থাকে, ফিরতে ফিরতে নাসরিন সুমন যেনো ঘিরে থাকে আমাকে, আর কিছু নয়। যে-কোনো কথা হাস্যপরিহাসের সাথে বলতে পারি আমরা, ছোটোবেলা থেকেই, কোনো কিছুতেই কোনো কিছু মনে করি না, এটা সুখী ক’রে রেখেছে আমাদের, যখন হাল্কা হ’তে চাই তখন হাল্কা কথামালা আমাদের বুক থেকে ময়নার স্বরের মতো ঝ’রে পড়ে। এটা এক আশ্চর্য সুখ, যা বাঁচিয়ে রাখে আমাদের। নাসরিন একটি ছেলেকে জড়িয়ে ধ’রে হাঁটে? আমার খুব ভালো লাগে। হাত ধ’রে হাঁটার এই তো সময়; এরপর হাতগুলো তো পাথর হয়ে যাবে, একটার সাথে আরেকটা লাগলে ঘর্ষণের শব্দ উঠবে। নাসরিন যাকে জড়িয়ে ধ’রে হাঁটে, তাকে কি সে চুমো খায়? এখনই কি ওরা ঘুমোতে শুরু করেছে? হয়তো, হয়তো নয়। কী এসে যায় ঘুমোলে আর না ঘুমোলে? সুমন কটি মেয়ের পাল্লায় পড়েছে? দশটি? বিশটি? পড়বেই তো, ওর যা রেজাল্ট আর চেহারা, টেইনে পড়ার সময়ই তো একটি মেয়ে পাগল হয়ে গিয়েছিলো। মেয়েটির চিঠি আমি দেখেছি, অজস্র চিঠি, চিঠি লেখার বয়স ওটি- তুমি আমার দেহ নাও, শুধু তোমাকেই দেবো আমার অনাঘ্রাত দেহ, আর কাউকে এই দেহ দেবো না। তুমিই এর ঘ্রাণ নেবে, ভোগ করবে আমার দেহ। দেহ ফুল? কী ফুল? বকুল? পদ্ম? শিউলি? গোলাপ? আমার শিউলিই পছন্দ। ঘ্রাণ নিলে ফুল অপবিত্র অশুদ্ধ ময়লা হয়ে যায়? ওই বয়সেই মেয়েটি তার দেহ নিয়ে পাগল হয়ে উঠেছিলো? হবেই তো, ওটাই তো দেহের বয়স, যখন বাতাসের ছোঁয়ায় গ’লে যেতে ফুটে উঠতে ইচ্ছে করে। আমার কী হয়েছিলো ওই বয়সে? হঠাৎ দেলোয়ারকে মনে পড়লো। এতোক্ষণ দেলোয়ারকে মনে পড়লো না
পৃষ্ঠা-৪৮
কেনো? মনে প’ড়ে ভালোই লাগলো; পাঁচ বছর ছিলাম, আর থাকবো না। কষ্ট লাগছে? আমি কি দেলোয়ারকে সহজেই ভুলে যাচ্ছি? যদি জীবন বদলে না দিতাম, এখন দেলোয়ারের সাথে বাসায় ফিরতাম; হয়তো আজ আসাই হতো না এখানে, বাসায়ই থাকতাম; দেলোয়ারকে ভুলতে যে আমার কষ্ট হচ্ছে না এতে আমার কষ্ট লাগে। কমলগঞ্জ যাওয়ার সময় আমি তো বাসায় ফেরার কথা ভেবেই পা বাড়িয়েছিলাম, তখন জানি নি জীবনটা বদলে যাবে; জীবনটা এখন বদলে গেছে, আমার আর কিছু করার নেই। দেলোয়ার কি একটু পরেই রেস্টহাউজে আসবে? আমি কি তা চাই? না, আমি চাই না।রেস্টহাউজে ফিরে আমি কেয়ারটেকারকে বলি, আমার বেশ কাজ আছে, ফোন এলে আমাকে দেবেন না, কেউ দেখা করতে এলে ঢুকতে দেবেন না।কেয়ারটেকার একটু বিব্রত হয়ে বলে, আইচ্ছা, ম্যাডাম।একটা গবেষণানিবন্ধের উপাত্ত আর তত্ত্ব টেবিলে আর মনে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলাম অনেক দিন ধ’রে, লিখে উঠতে পারছিলাম না, দক্ষিণ এশিয়া সম্পর্কে একটি ত্রৈমাসিকের সম্পাদক ই-মেইল ক’রে চলছিলেন হংকং থেকে, সিংগাপুরে ওঁর সাথে দেখা হয়েছিলো, কথা দেয়ার পরও লেখাটি পাঠাতে পারি নি, পুরুষ হ’লে এতোদিনে পাঠিয়ে দিতাম, হয়তো হংকং ঘোরার সুযোগও মিলে যেতো; আমার খারাপ লাগে। আমি লেখাটি লিখতে ব’সে যাই, ভাগ্য ভালো নোটটোটগুলো ইউনিভার্সিটিতে আমার ঘরেই রেখেছিলাম, নইলে বিপদ হতো, নারীদের নিয়েই লেখাটি; ধর্ম কীভাবে বাধা দিচ্ছে, মৌলবাদী রাজনীতি কীভাবে বাধা দিচ্ছে নারীর বিকাশে, মসজিদ মাদ্রাসা বোরখায় কীভাবে ঢেকে যাচ্ছে দেশ, উমরা হজ নামাজে কতোটা মেতে উঠেছে রাজনীতিবিদেরা, সে-সম্পর্কে লিখতে শুরু করি, লেখাটি এগোতো থাকে; লিখে সুখ পাই। একটু অসুবিধা হচ্ছে আইবিএমটা নেই, সব বই হাতের কাছে নেই; ওগুলোর জন্যে এখনই আমি লড়াইয়ে নামতে চাই না। ছ-মাস হলো কিছু লিখি নি, কিন্তু হু-মাসে মুরগির ৫০০ জোড়া রান ভেজেছি, ধনেপাতা বাটায় লবণ ঠিক হয়েছি কি না জিভ বের ক’রে পরখ করেছি, রোস্ট সুস্বাদু হয়েছে কি না দেখেছি, দেলোয়ারের জমাগুলো ঠিকমতো ধোয়া হয়েছে কি না দেখেছি, আমার লেখাটি হয় নি। রাতে লিখতে বসেছি, দেলোয়ারের দেহে কাম জেগেছে, আমাকে কম্পিউটার থেকে টেনে নিয়ে মেঝেতে বিছানায় শুইয়ে সে এটা সেটা করেছে, আমার ভালোই লেগেছে, পুলক না লাগলেও মনে করেছি মাল্টিপল পুলকে ভেঙে পড়েছি; আর লেখা হয় নি। পুলক? জিনিশটি কী দেলোয়ার জানে না; আমি তাকে বোঝাতে চাই নি। সে মনে করেছে আমার ওপরে চড়লেই আমি সুখে ভেসে যাই। আমি প্রশংসা করতে পছন্দ করি, সুখ পাই; কাজের মেয়েটিকে প্রশংসা করি, বুয়াটিকে প্রশংসা করি, আমার ডিরেক্টরকে প্রশংসা করি, ওরা ভালো থাকে; প্রশংসা করেছি দেলোয়ারকেও, বলেছি তার সঙ্গম অসাধারণ, তার ছোঁয়ায় আমি জলের মতো বইতে থাকি মোমের মতো গলতে থাকি। আমি যে বানিয়ে বলেছি, তা নয়; আমার বলতে ইচ্ছে করেছে, দেলোয়ার শুনে সুখ পায়, তাকে সুখী করতে ইচ্ছে
পৃষ্ঠা-৪৯
করেছে। শুনে দেলোয়ার সুখে ঘুমিয়েছে, আমি অনেক রাত ঘুমোতে পারি নি; ঘুমোতে পারি নি ব’লে আমি নিজেই অপরাধ বোধ করেছি।লেখা? লিখে কী হবে? গবেষণা? এমন কী দরকার? মাস শেষ হ’তে-না- হ’তে বেশ মোটা টাকাই তো সরাসরি জমা হয় গ্রিন্ডলেজে, এভো মোটা যে প্রত্যেক মাসে আমিই লজ্জা পাই, অনেকক্ষণ চোখ বন্ধ ক’রে থাকি, ব্যাপারটি গোপন ব’লে কারো সঙ্গে লজ্জা ভাগ ক’রে নিতে পারি না; তবে আমি, একটা মাইয়ামানুষ, বিখ্যাত হওয়ার এতো কী আছে? হাজব্যান্ড আছে, তার ইনকামও অত্যন্ত ভালো, যদিও বিস্ময়করভাবে দু-চার মাস পরপরই তার বড়ো দাগের টান পড়ে, বিব্রতভাবে আমাকে বলে, আমি চেক লিখে দিয়ে সুখ পাই; আর কী আছে চাওয়ার? লেখারই কী আছে? না হয় একটি তিন অক্ষর করেছি হনুলুলু থেকে, একটা সুযোগ পেয়েছিলাম ব’লে, তার অর্থ কি আমাকে সারাজীবনই জ্ঞানট্যান চর্চা করতে হবে? প্রাচ্যের অক্সফোর্ডেও তো অনেক তিন অক্ষর আছে; তারা কি লিখছে, লেখার দরকার বোধ করছে? তাদের দেখে আমার ভালো লাগে, তারা হাজব্যান্ডদের সুন্দর সুন্দর পাজেরো আর শীততাপনিয়ন্ত্রিততে উঠছে, পেট পাছা বক্ষ সমৃদ্ধ হচ্ছে তাদের, সুখ মাংস হয়ে ঝুলে ঝুলে পড়ছে চারদিকে। তাদের থেকে আমি বেশি কী? কয়েক মিনিট চিৎ কাৎ উপুর হওয়া, তারপর প’ড়ে থাকাই কি আমার প্রধান কাজ নয়? এই আমি একটি স্ত্রীলোক, যাই হই না কেনো, এই চমৎকার সমাজ, দেড় হাজার বছর আগের শ্রেষ্ঠ পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থার চোখে আমি তো একটা মাইয়ালোক। আমার নিবন্ধের থেকে দেলোয়ারের ব্যবসা অনেক গুরুত্বপূর্ণ; ওর ব্যবসার সাথে জড়িতরা আসছে দিল্লি নিউইয়র্ক থেকে, আমারও ভালো লেগেছে; পার্টিতে যেতে আমিও আনন্দ পেয়েছি, বুফেতে ঘুরে ঘুরে খাবার তুলতে আমি খুবই সুখ পাই। মগজটা এক আস্ত শয়তান; একবার ওকে ঘুমোতে দিলে ও আর জাগতে চায় না। লিখতে লিখতে মনে হয় কী যে অপচয় করেছি নিজেকে। আমি কতো দিনে ক্ষতি পোষাতে পারবো? কোনোদিন পারবো?একটি ফ্ল্যাট দরকার, এখানে বেশি দিন থাকতে পারি না।থাকতে আমার ভালোও লাগছে না, যদিও সব কিছুই এখানে ভালো; ছেড়ে দিতে হবে, সারাজীবন থাকতে পারলে খারাপ হতো না। কোথায় উঠবো? মার ওখানে? না। মা দেলোয়ার হয়ে চেপে থাকবে আমার ওপর দেলোয়ার আবার মাকে মা মা ব’লে ডেকে দু-পা ধ’রে সালাম করে আসতে যেতে, সকালে বিকেলে রাতে উত্তর দিতে দিতে চুপ ক’রে থাকতে থাকতে অসুস্থ হয়ে পড়বো। কারো আশ্রয়ে থাকতে চাই না; মার না, আব্বারও না, নিজের আশ্রয়ে নিজের মতো থাকতে চাই। সেটা কি আমি পারি না? বেশ পারি।একটা ছোটো ফ্ল্যাট, একরুমের; তা কি আছে ঢাকায়? একলা থাকতে হবে, কী পরিচয় দিয়ে ভাড়া নেবো? আমার পদের পরিচয়টা গ্রহণযোগ্য হবে অগ্রপশ্চাৎবিবেচক বাড়িঅলাদের কাছে, কিন্তু আরেকটা পরিচয় তারা জানতে
পৃষ্ঠা-৫০
চাইবে: বিবাহিত? ওরা বলবে বিবাহিতা? মেরিড? অবিবাহিত? আনমেরিড?বিবাহিত হ’লে হাজব্যান্ড কই? আমি তো এখনো বিবাহিত, অর্থাৎ বিবাহিতা, দেলোয়ারের সাথে সম্পর্ক এখনো চুকিয়ে দিই নি, দেলোয়ার আমাকে দাবি করতে পারে, যদিও আমি জীবন বদলে দিয়েছি। কয়েক দিন ধ’রে লিখতে থাকি, ক্লাশ নেয়ার জন্যে ইউনিভার্সিটিতে যেতে আসতে থাকি, ই-মেইলের খবর নিই কখনো কখনো, কারো সাথে দেখা করি না, ডিরেক্টরও পান না আমাকে; বেরোনোর সময়, ঢোকার সময়, কেয়ারটেকার জানায় তিন চারটি ফোন এসেছিলো, আমি তাকে বলি, ঠিক আছে, আমাকে দেয়ার দরকার নেই। লোকটি বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকে।দু-দিন পর নামার সময় দেখি গেইটে দাঁড়িয়ে আছে দেলোয়ার।দেখে চমকে উঠি, আমি হেসে বলি, তুমি?দেলোয়ার বলে, হ্যাঁ, ঘণ্টাখানেক ধ’রে দাঁড়িয়ে আছি তোমার জন্যে।আমি হাঁটতে থাকি, একটি বেবি ধরতে হবে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। আমি বলি, দাঁড়িয়ে থাকার কী দরকার ছিলো। না এলেই পারতে।দেলোয়ার বলে, তোমার ঘরে যেতে চেয়েছিলাম, কেয়ারটেকার ঢুকতে দিলো না, প্রতিদিনই তোমাকে ফোন করি, পাই না।দেলোয়ারকে একটু বিষণ্ণ মনে হয়, একটু ভেঙেছে মনে হয়; কিন্তু আমি কী করতে পারি, আমার কিছুই করার নেই।আমি বলি, আমি ওদের নিষেধ করেছি। দেলোয়ার বলে, তোমার সাথে কথা আছে।আমি বলি, তুমি কিছু মনে কোরো না, আমার ক্লাশ আছে, আমাকে এখুনি যেতে হবে, কথা বলার সময় নেই, ক্লাশের সময় হয়ে এসেছে।দেলোয়ার বলে, চলো, তোমাকে পৌছে দিই।আমি বলি, না, আমি একাই যেতে পারবো।দেলোয়ার বলে, তুমি যা করছো, তাতে ভালো হচ্ছে না।দেলোয়ার কর্কশ হয়ে উঠছে, শাসন করছে, আমার ভালো লাগে না। আমি বলি, তা আমি বুঝি।দেলোয়ার বলে, তুমি কেনো এমন করছো আমি বুঝতে পারছি না। আমি বলি, বোকার কি দরকার?একটি বেবি এসে থামে, আমি বেবিটি নিয়ে ক্যাম্পাসে পৌছি, দেড় ঘন্টা দেড় ঘণ্টা তিনঘন্টা ক্লাশ নিই, ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে দেখি দেলোয়ার ব’সে আছে। তাকে দেখে আমার ভালো লাগে না, খারাপও লাগে না; একা থাকতে পারলেই আমার ভালো লাগতো, তবু একটি লোক এসেছে আমার সাথে দেখা করতে, আমি উঠিয়ে দিতে পারি না। আমি হেসে বলি, কী, তুমি এখানে?
পৃষ্ঠা-৫১
দেলোয়ার একটা ভয়ের মধ্যে ছিলো, হয়তো আমি রেগে উঠবো, আমার হাসিটা তাকে স্বাভাবিক ক’রে তোলে।দেলোয়ার বলে, তোমার সাথে কথা বলতে এলাম।এমন সময় দরোজা ঠেলে ‘হেই ডক্টর শিরিন’ ব’লে ঢোকেন আমার ডিরেক্টর; তিনি দিনে অন্তত আধঘণ্টা আমার সাথে গল্প না করলে সুস্থ থাকেন না, বাসায় ফিরতে তাঁর সুস্বাদু লাগে না, জীবনটাকে তাঁর নিরর্থক লাগে।আমি হেসে বলি, আসুন।ডিরেক্টর দেলোয়ারকে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন, আফটার অল দেলোয়ার আমার হাজব্যান্ড, সাধারণত আসে না, তাকে দেখে উচ্ছ্বসিত হওয়া ডিরেক্টরের প্রশাসনিক দায়িত্ব; নইলে আমিও মাইন্ড করতে পারি। একটু ঈর্ষাও জড়িয়ে থাকে, দেলোয়ার আমার হাজব্যান্ড, সে নিশ্চয়ই পুরুষসিংহ, নইলে আমার মতো ওয়াইফ বাগালো কেমন ক’রে? ডিরেক্টর দেলোয়ারকে বলেন, কী টান, ব্যবসাবাণিজ্য ফেলে ওয়াইফকে দেখতে চ’লে এসেছেন, ভক্টর শিরিন একটি হাজব্যান্ড পেয়েছেন বটে, অবশ্যিএমন ওয়াইফের জন্যে ব্যবসাবাণিজ্য ফেলে রাখা যায়।দেলোয়ার বলে, হ্যাঁ, দেখতে ইচ্ছে করলো, চ’লে এলাম।ডিরেক্টর হাসতে হাসতে বলেন, তা তো আসবেনই, এমন ওয়াইফকে কতোক্ষণ না দেখে থাকা যায়।আমি বুয়াটিকে ডাকি, কফি আনতে বলি, তিনজনে কফি খাই। ডিরেক্টর চ’লে গেলে আমি হেসে হেসে দেলোয়ারকে বলি, কিছু মনে কোরো না, কফি ছাড়া আর কিছু খাওয়াতে পারলাম না।দেলোয়ার বলে, তোমার ডিরেক্টর প্রতিদিনই তোমার সাথে কফি খান? শুনে আমার খারাপ লাগে, আমি বলি, হ্যাঁ, খান।দেলোয়ার বলে, কোনোদিন তো বলো নি।আমি বলি, এটা জানার জন্যেই কি তুমি এতোদূর এসেছো? টেলিফোনেই জেনে নিতে পারতে কে কে আমার সাথে কফি খায়। তুমি কি আরো দেখতে চাও? তাহলে অন্যদেরও ফোন ক’রে আনি।দেলোয়ার বলে, চলো, আমার সাথে চলো।আমি বলি, তুমি তো জানো আমি যাবো না।দেলোয়ার বলে, তোমার সাথে কথা আছে।আমি বলি, কথা বলার অনেক সময় প’ড়ে আছে, পরে বলা যাবে, না বললেও কোনো ক্ষতি হবে না।দেলোয়ার বলে, না, আজই আমি বলতে চাই, কথা বলতেই হবে। আমি বলি, কেনো, কাল তুমি সিংগাপুর যাচ্ছো না কি? দেলোয়ার বলে, না, কতোদিন তোমাকে কাছে পাই না, একসাথে ঘুমোই না,
পৃষ্ঠা-৫২
আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।আমি হেসে হেসে বলি, দেখে তো মনে হচ্ছে না।দেলোয়ার বলে, চলো, বাসায় চলো।আমি বলি, তোমাকে একটি কথা বলি।দেলোয়ার বলে, বলো।আমি বলি, তুমি তো আমাকে চেনো?দেলোয়ার বলে, হ্যাঁ, চিনি।আমি বলি, তাহলে একই কথা বারবার বলো কেনো?দেলোয়ার বলে, আমি বুঝতে পারছি না তুমি এমন করছো কেনো? আমার কী দোষ? আমি তো কোনো দোষ কবি নি।আমি বলি, তোমার কোনো দোষ নেই।দেলোয়ার বলে, তাহলে কেনো?আমি বলি, দোষটা আমার।দেলোয়ার অনেকক্ষণ চুপ ক’রে থাকে, শেষে বলে, বাসায় না যাও, চলো, কোথাও একসাথে খাই।একসাথে কতো খেয়েছি আমরা, এক সময় রেস্তোরাঁয় রেস্তোরাঁয়, দুপুরে সন্ধ্যায়, তারপর নিজেদের ঘরে পাঁচ বছর, এখন দেলোয়ার একসাথে খেতে চার, মায়া লাগে ওর জন্যে, কষ্ট লাগে।আমি বলি, আজ না।দেলোয়ার বলে, তাহলে কাল চলো, একসাথে খাই কোনো রেস্তোরাঁয়। আমার একটু মায়া হয় আমার একটু দয়া হয়, ভেতরটা কেমন করে। আমি বলি, আচ্ছা।দেলোয়ার বলে, আমি দুপুরে এসে নিয়ে যাবো।
আমি বলি, আসতে হবে না, রেস্তোরার নাম আর সময় বলো, আমি নিজেই যাবো, তোমার আসতে হবে না।দেলোয়ার বলে, না, আমি এসে নিয়ে যেতে চাই।আমি বলি, তাহলে হয়তো খাওয়াটা হবে না।সে কিছু হারিয়ে ফেলছে এমন একটা বিমর্ষ আলো তার চোখে দেখা দেয়; সে হারাতে চায় না, বলে, আচ্ছা, তুমি নিজেই এসো।দেলোয়ারকে আমি একা বেরিয়ে যেতে দিতে পারি না, তাতে নিজেকেই অপমান করছি মনে হবে, তাকে আমি পাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিই, সে খুশিতে আমার সঙ্গে নামতে থাকে; সে নিজেই চালিয়ে এসেছে, তাকে গাড়ি চালিয়ে ফিরে যেতে দেখে আমার কষ্ট লাগে, কিন্তু আমি পেছনে ফিরে না তাকিয়ে ফিরে আসি; এসে দেখি আর কষ্ট লাগছে না। দেলোয়ারকে ছেড়ে থাকতে আমি এতো কম কষ্ট পাবো, এটা ভেবে আমার কষ্ট লাগে; সে কি আমার কাছে অসামান্য
পৃষ্ঠা-৫৩
মূল্যবান কেউ ছিলো না, যাকে হারিয়ে পথেপথে আমার পাগল হয়ে বেড়ানোর কথা ছিলো? যাকে হারিয়ে মানুষ পাগল হয় না সে কতোটুকু মূল্যবান? আমাকে হারিয়ে কি দেলোয়ার পাগল হবে? পাগল না হ’লে আমি কি কষ্ট পাবো না? পাবো। মনে হবে আমি এতো তুচ্ছ ছিলাম তার কাছে। আমি তার মগজের কোষ হয়ে উঠতে পারি নি। ঘরে ফিরে একটু পড়ি, তারপর পাঠাগারে যাই, নতুন কতকগুলো জর্নাল এসেছে, আমি দেখি নি, চাঞ্চল্যকর অভিনব নিবন্ধে ঠেসে আছে জর্নালগুলো; আমি নিবন্ধের পর নিবন্ধের ভেতর দিয়ে যেতে থাকি, সারাংশের পর সারাংশ প’ড়ে চমকে উঠতে থাকি, রচনাপঞ্জিতে নতুন নতুন রচনার নাম দেখে ব্যথিত ও চঞ্চল হয়ে উঠি, আমার জীবনকেই আমি ভুলে যাই। মনে পড়ে এক সময় আমি এই তো ছিলাম; পাঠাগারে ঢুকে ভুলে গেছি সব কিছু, সমাজসংসার, বইয়ের পাতাগুলোতে আমি দেখেছি আমাকে, তারপর একদিন এ-জগত থেকে দূরে স’রে গেছি। সমাজসংসারে। আবার কি আমি ফিরতে পারবো? আমার জীবনে? আমার ফিরতে ইচ্ছে করে।রেস্টহাউজে ফিরতে ফিরতে মনে পড়ে দেলোয়ারকে কথা দিয়েছি কাল দুপুরে এক রেস্তোরায় ভার সাথে আমি খেতে যাবো। খেতে কি যাবো? যাওয়া ঠিক হবে? কী হবে খেয়ে? পাঁচ বছর আগে আমরা অনেক খেয়েছি রেস্তোরাঁয়, খেতে খেতে এক ঘরে এক বিছানায় পরস্পরের শরীরে ঢুকে গেছি; তখন খাওয়ার একটি লক্ষ্য ছিলো, রেস্তোরাঁয় খাওয়াটা ছিলো বাসায় এক টেবিলে খাওয়া এক বিছানায় শোয়ার জন্যে নানা ছন্দে নাচ নানা সুরে গান। তখন পায়রা ছিলাম, নানাভাবে উড়েছি নানা সুরে বাকুমবাকুম করেছি পাখায় পাখা রেখেছি; এখন আর সেই স্বপ্ন নেই, এক বিছানায় আমি আর শুতে চাই না, অনেক শুয়েছি। কিন্তু তাকে কথা দিয়েছি, আমি যাবো, কথা দিয়ে আমি কথা না রাখতে পারি না। খেতে যাবো, এতে আমি কোনো শিহরণ বোধ করি না, পাঁচ বছর আগে করতাম, এখন যাবো কথা দিয়েছি ব’লে।আমার কি কোনো পুরুষ লাগবে না? একান্ত নিজস্ব একটি পুরুষ? যার বাহু আছে ওষ্ঠ আছে দাঁত আছে অণ্ডকোষ লিঙ্গ আছে? হয়তো লাগবে, পুরুষ ছাড়া আমি থাকতে পারবো না- হয়তো, থাকতে ভালো লাগবে না- হয়তো, পুরুষ আমি পছন্দ করি, বেশ পছন্দ করি, এই জন্তুটির সঙ্গ আমি পছন্দ করি; এই জন্তুটির পশম আমার পছন্দ, এর গায়ের ঘাম আমার পছন্দ; পুরুষকে আমার শয়তান মনে হয়, এও মনে হয় যে শয়তান হওয়ার জন্যেও প্রতিভা লাগে। প্রতিটি পুরুষের মধ্যেই আমি খুঁজে পেয়েছি একটি ক’রে শয়তান, মেফিস্তো, আবার প্রতিটির মধ্যেই আমি দেখেছি একেকটি ছোটোখাটো প্রতিভা; তাই ওরা আমাকে মুগ্ধ করে।এই প্রতিভাবান এই শয়তান পুরুষের বিরুদ্ধে একটি তীব্র প্রবন্ধ লিখেছিলাম অনেক আগে, বাঙলায়, অনেকটা রেগে অনেকটা মজা ক’রে, আমার নারী বন্ধুরা খুশিতে ফেটে পড়েছিলো (ফারজানা পর পর দুটো বিয়ে চুরমারের পর একা ছিলো, দিলরুবার বিয়েটা কুঁড়েঘরের মতো পুড়ে যাওয়ার পর বিয়েকে ঘেন্না
পৃষ্ঠা-৫৪
করতে করতে বিয়ে করেছিলো ওর থেকে তিরিশ বছর বড়ো এক জেনারেলকে, তাসনিম ঘুমোচ্ছিলো একটি বিবাহিত বৃদ্ধের সাথে, শাহনাজ ঘুমোচ্ছিলো জেগে থাকছিলো কখনো এর সাথে রেস্টহাউজে ওর সাথে পর্যটনে তার সাথে মোটেলে), যদিও তারা প্রত্যেকে ঘুরছিলো কোনো-না-কোনো পুরুষের চারদিকে শস্তা উপগ্রহের মতো; তারা যখন আমাকে পুরুষবিদ্বেষী ব’লে অভিনন্দন জানাচ্ছিলো, আমি তাদের বলি নি যে আমি পুরুষ পছন্দ করি। তাতে ওরা দুঃখ পেতো। ওই শয়তানগুলো সমুদ্র পাড়ি দিয়েছে, বুকে তলোয়ার বিধিয়েছে, খনিতে নেমেছে, খুন করেছে, খুন হয়েছে, আবার নারীর বন্দনা করেছে, নারী থেকে নারীতে ছুটেছে। শয়তান ও প্রতিভা; যা শয়তান নয় যা প্রতিভা নয়, তা আমার পছন্দ নয়। পুরুষের কাছে হয়তো আমাকে যেতে হবে- হয়তো, কিন্তু দেলোয়ারের কাছে? আমি পারবো না।ক-দিন হলো পুরুষের সাথে আমি ঘুমোই না?আমি হাসি, নিজেকে খোঁচা দিয়ে জিজ্ঞেস করি, ঘুমোনোর জন্যে কি ব্যা হয়ে উঠেছো, শিরিন আহমেদ?খারাপ কী, ঘুমোনো এমন কী খারাপ?তাহলে দেলোয়ার তো আছেই, বৈধ, কাবিনসম্মত, ঘুমোও না কেনো?না, ওর সাথে আর পারবো না।কেনো পারবে না?তা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।নিজেকে ইমমোরাল লাগবে?না, আমি তো ওই বস্তুতে বিশ্বাস করি না।পুরুষের অভাবে খারাপ লাগছে?তা তো একটু লাগছেই; আমি আছি আর অন্তত একটা পুরুষ ঘুরছে না আমাকে ঘিরে এটা আমার ভালো লাগে না।পুরুষ তো রাস্তায় কতো, তোমার চারপাশে কতো, লোহার দোকানে করাত কলে কতো পুরুষ গিজগিজ করছে।না. আমাকে যারা দখল করতে চায় সেগুলোকে আমার নেয়ার মতো মনেহয় না, আমার ভালো লাগে দখল করতে।দখল করবে কখন?আমার যখন ইচ্ছে করবে, যখন আমি ইন্সপায়ার্ড হবো।নিজেকে নিয়ে আমি মজ্য করতে থাকি, খোঁচাতে থাকি নিজেকে, এবং একটি বইয়ের পাতার পর পাতা প’ড়ে যেতে থাকি।দেলোয়ারের সাথে একটি রেস্তোরায় দুপুরে খেতে যেতে হবে, ওর কথা আছে শুনতে হবে, যদিও আমার শোনার কিছু নেই; আমি ক্লাশ নিয়ে ফিরে বিশ্রাম নিচ্ছি, অর্থাৎ চুপ ক’রে ব’সে আছি, এক ঘণ্টা সময় আছে যাওয়ার। ঠিক
পৃষ্ঠা-৫৫
সময়ে বেরোবো; ঠিক সময়ে পৌঁছোতে আমি পছন্দ করি, কাউকে বসিয়ে রাখতে নিজে গিয়ে ব’সে থাকতে আমি পছন্দ করি না।ডিরেক্টরের ঘরে আমার ফোন এসেছে, গিয়ে ফোন ধরি, বলি, হ্যালো।শুনতে পাই, ডক্টর শিরিন বলছেন, ডক্টর শিরিন?আমি বলি, হ্যাঁ, বলছি, আপনি কে বলছেন?গুনতে পাই, আমি আপনাকেই চাই, আমি খালেদ বলছি।আমি বলি, কে বলছেন?তিনি বলেন, আমি খালেদ বলছি, ওই যে কমলগঞ্জে দেখা হয়েছিলো।আমি বলি, ওহ্, ভালো আছেন?তিনি বলেন, হ্যাঁ, ভালো আছি, আপনি ভালো আছেন তো? আপনার কথাই ভাবছি সব সময়।আমি বলি, আপনি আমার নাম কোথায় পেলেন? ফোন কোথায় পেলেন?তিনি বলেন, আপনি না বললেও এসব পাওয়া কঠিন নয়, আমি সহজেই পেয়েছি। আপনার সাথে আমি দেখা করতে চাই।আমি বলি, তার তো কোনো দরকার নেই।তিনি বলেন, আমার দরকার আছে। আমি কি এখন একটু আদতে পারি।আমি বলি, না, আমার কাজ আছে, আমাকে এখুনিই বেরোতে হবে। ফোন করার জন্যে ধন্যবাদ, আচ্ছো, রাখি।তিনি বলেন, দয়া ক’রে রাখবেন না, একটু কথা বলি।আমি আবার বলি, রাখি।আমি রেখে দিই, আমার সময় নেই, বেরোতে হবে; দেলোয়ারকে কথা দিয়েছি, আমি ঠিক সময়ে পৌঁছোতে চাই।দেরি করি নি, ঠিক সময়েই দিয়ে আমি পৌছোই, পৌঁছে নিজেকে একটু প্রশংসা করি, বলি, শিরিন, গুড, তুমি পারবে; দেখি বাইরে দাঁড়িয়ে আছে দেলোয়ার, আমার বুকে একটু ধাক্কা লাগে। সত্যিই ধাক্কা লাগে? আমি ঠিক বুঝতে পারি না; না কি এক সময় যে ধাক্কা লাগতো, লাগলে আমি সুখী বোধ করতাম, তার “স্মৃতি আমি জাগিয়ে তুলেছি আমার ভেতরে? সেই কতো বছর আগে দেলোয়ার এভাবে দাঁড়াতো; প্রেমিক হিশেবে সে ভাগ্যবান ছিলো, তাকে বেশি দাঁড়িয়ে থাকতে হতো না, কী যেনো আমাকেই ঠেলে নিয়ে যেতো ঠিক সময়ের আগে, প্রেমিকা হিশেবে আমি বোধ হয় অদ্বিতীয়, ভালোবাসলে সারাক্ষণ ভালোবাসতেই চাই, তারপর কতো দিন এভাবে দাঁড়ায় নি, তাকে দাঁড়াতে হয় নি; অনিশ্চয়তা মানুষকে এভাবেই শুদ্ধ ক’রে তোলে। যখন অনিশ্চিত তখন আমরা হাজার হাজার বছর কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি, নিশ্চিত হ’লে কয়েক মুহূর্তে স্থির হয়ে দাঁড়াতে ক্লান্তি লাগে; দেলোয়ারকে দেখে মনে হয় সে আমার জন্যে হাজার বছর না হ’লেও ঘন্টাখানেক দাঁড়িয়ে থাকতে পারতো।
পৃষ্ঠা-৫৬
আমি ওকে দেখে হাসি, আমার হাসিটা পাঁচ বছর আগের হাসি হয়ে ওঠে না, ওর হাসিটাও না। সে এক সময় ছিলো যখন রেস্তোরাঁয় ঢুকতে চাঞ্চল্য লাগতো, দরোজায় দাঁড়ালেই একটা অদ্ভুত গন্ধ পেতাম, আমার আসতে একটু দেরি হ’লে আমিই অস্থির হয়ে উঠতাম, আজ দেখি তেমন লাগছে না, চঞ্চল হয়ে উঠি নি, গন্ধটাও বিভোর করছে না, দেরি হ’লেও অস্থির হতাম না, বুকে যে-ধাক্কাটি লাগলো সেটিও মৃদু। ধাক্কা কি লেগেছিলো? দেলোয়ারকে একটু অস্থির দেখাচ্ছে, অনেক দিন ওকে এমন অস্থির দেখি নি, পাঁচ বছর ওকে আমি স্থির থাকতে দেখেছি, চারপাশ স্থির ছিলো তাই দেলোয়ার স্থির ছিলো, এখন ভাঙন ধরেছে, একটু একটু ভাঙছে। আগে আমাদের রেস্তোরাঁয় ঢুকতে সময় লাগতো, বাইরটাকেই আমি উপভোগ করতে থাকতাম, সেলোয়ারও আমার সাথে উপভোগ করতো। আজ আর তেমন মনে হয় না, আমার ইচ্ছে করে নেমেই ভেতরে ঢুকে যেতে, যেনো আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক আছে, সময় হয়ে গেছে, গিয়েই আলোচ্যসূচি হাতে নিয়ে আলোচনা শুরু করতে হবে, আগের কিছু সিদ্ধান্ত কনফার্ম করতে হবে, এবং গ্রহণ করতে হবে নতুন কিছু সিদ্ধান্ত।আমি নেমেই বলি, বাহ, রেস্তোরাটি আগের থেকে অনেক সুন্দর হয়েছে। আমি বানিয়ে বলি নি, অনেক দিন পর রেস্তোরাঁটিকে দেখে আমার ভালো লাগে, তাকে আমার প্রশংসা করতে ইচ্ছে করে, মনে হয় আমার কথা শুনে রেস্তোরাঁটি খুশি হয়ে উঠবে যেমন আমি খুশি হয়ে উঠেছি।দেলোয়ার বলে, তুমিও আগের থেকে সুন্দর হয়েছো।দেলোয়ার কি বানিয়ে বললো? আমাকে একটু প্রশংসা ক’রে আমার ভেতরে সে ঢুকতে চায়? দেলোয়ারের মুখে অনেক দিন প্রশংসা শুনি নি, প্রশংসা করার কোনো দরকার হয় নি, আমিই তো তার প্রশংসা করেছি যখন তখন, তারপ্রশংসা শুনে আমার মজা লাগে।আমি হাঁটতে থাকি, তার দিকে ডাকিয়ে মধুরভাবে হাসি, বলি, তুমি মিছে কথা বলছো।দেলোয়ার বলে, না, সত্যি কথাই বলছি, তুমি অনেক সুন্দর হয়েছো। সত্যি বলছে? হয়তো। তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমি বলি, দূরে আছি ব’লে আমাকে তোমার সুন্দর মনে হচ্ছে। দেলোয়ার বলে, না, তুমি সত্যিই সুন্দর হয়েছো।দেলোয়ারের চোখে ক্ষুধা দেখতে পাচ্ছি সুন্দরের জন্যে? এই সুন্দরকে সে অনেক পান করেছে অনেক খেয়েছে; তখন এমন ক্ষুধা দেখি নি। তার ক্ষুধায় আমি তার চোখে অনেক সুন্দর হয়ে উঠেছি? দেলোয়ারকে আমার আগের থেকে সুন্দর মনে হচ্ছে না; তার কারণ কি তার জন্যে আমার ক্ষুধা নেই?আমি বলি, তাহলে আমার দূরে থাকাই ভালো, সুন্দর হ’তে আমার ভালো লাগে।আমি হটিতে থাকি, দেলোয়ার হাঁটে, আমরা ভেতরে ঢুকি।
পৃষ্ঠা-৫৭
আগে আমিই খুঁজে বের করতাম কোথায় বসলে আমাদের সুখ লাগবে সবচেয়ে বেশি, আজ আমি খুঁজি না, যে-কোনো টেবিলেই আমি আজ বসতে পারি, কোনো টেবিলেই আমি বেশি সুখ পাবো না, আর কোনো টেবিলেই পাবো না কম সুখ। আগে তো খেতে আসতাম না, কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার জন্যে আসতাম না; তখন আসতাম নিজেদের উপভোগ করার জন্যে। রেস্তোরাঁর ভেতরটাও সুন্দর হয়েছে আগের থেকে, চেয়ারটেবিলগুলো থেকে সৌন্দর্য ঝ’রে ক’রে পড়ছে, কিন্তু গুগুলোকে আমার আগের মতো প্রাণময় মনে হয় না; আগে আমি টেবিলের নিচ দিয়ে নদী বইতে দেখতাম, টেবিলে উড়তে দেখতাম প্রজাপতি, ঝাঁকেফাঁকে টিয়ে উড়ে যেতো টেবিল থেকে টেবিলে, তাদের ডানার শব্দ শুনতাম। দেলোয়ার ভেবেছিলো আমি বসার মতো একটি টেবিল খুঁজে বের করবো, আমি বের করছি না দেখে সে-ই একটি টেবিল খুঁজে বের করে, আমি ব’সে তার দিকে তাকাতে গিয়ে দূরে তাকিয়ে ফেলি, দেখি একটি পুরুষ আর একটি নারী স্তব্ধ হয়ে ব’সে আছে। তাদের হয়তো অনেক কথা ছিলো, কথা শেষ হয়ে গেছে; কিছুক্ষণ পর আমরা হয়তো ওভাবে ব’সে থাকবো।দেলোয়ার বলে, তুমিই অর্ডার দাও।আমি হেসে বলি, তুমি নিমন্ত্রণ ক’রে আনলে, অর্ডার তো তুমিই দেবে।দেলোয়ার বলে, তোমার কী খেতে ইচ্ছে করছে?আমি বলি, কিছুই না, আমি এসেছি কথা শুনতে।দেলোয়ার বলে, কী খাবে বলো।আমি বলি, তুমি বলো তো আমার কী খেতে পছন্দ?দেলোয়ার ভাবতে থাকে, আমার কী খেতে পছন্দ তার মনে পড়ে না; আমার কষ্ট লাগে আমি পাঁচ বছরে তার ভেতরে ঢুকতে পারি নি। কষ্ট লাগে? না, লাগে। না, আমি জীবন বদলে দিয়েছি, কষ্ট কেনো লাগবে? ওই দূরের টেবিলের লোকটি তো জানে না আমি পছন্দ করি কী খেতে, ভাতে কি আমার কষ্ট লাগবে?আমি বলি, তোমার কী খেতে পছন্দ আমি মুখস্থ বলতে পারি।দেলোয়ার বলে, মেয়েরা এসব পারে।
আমি বলি, তুমি বেশ প্রভুর মতো কথা বলছো।দেলোয়ার বিব্রত হয়, তার চোখে আবার মূল্যবান কিছু হারিয়ে ফেলার ভয়টা দেখা দেয়, এবং কাতর স্বরে বলে, আমার এভাবে কথা বলা ঠিক হয় নি। আমি বলি, না, না, ঠিকই আছে, তুমি সাধারণত এভাবেই কথা বলো। দেলোয়ার বলে, তুমি তখন এটা ধরিয়ে দাও নি। আমি বলি, হ্যাঁ, দিই নি, তখন এটা আমার চোখে ধরা পড়তো না।দেলোয়ার বলে, এখন ধরা পড়ছে কেনো?আমি বলি, এখন আমি তোমাকে দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি ব’লে।
পৃষ্ঠা-৫৮
দেলোয়ার প্রচুর খাবারের অর্ডার দিয়েছে, সেগুলো একটির পর একটি আসতে থাকে, কিন্তু আমি সুপের ভেতরেই ঘুরতে থাকি; এর বেশি আমার এগোতে ইচ্ছে করে না। আমি তো খেতে আসি নি, দেলোয়ারের অনুরোধে রেস্তোরাঁয় এসেছি, তার কিছু কথা আছে, আমাকে শুনতে হবে।দেলোয়ার বলে, তুমি তো কিছুই খাচ্ছো না।আমি বলি, এই তো খাচ্ছি।দেলোয়ার বলে, আমার সাথে আজ বাসায় চলো।আমি বলি, না।দেলোয়ার বলে, কেনো যাবে না?আমি বলি, আমার আর যেতে ইচ্ছে করে না।দেলোয়ার বলে, দ্যাখো, আমার খুব অসুবিধা হচ্ছে, আগামী সপ্তাহে দিল্লি যেতে হবে, তুমি ফিরছো না ব’লে তারিখটা ঠিক করতে পারছি না, ব্যবসার খুব ক্ষতি হচ্ছে।আমি বলি, কাজের মেয়েটির সাথে আলাপ ক’রে তারিখটা ঠিক ক’রে নিয়ো, ব্যবসার ক্ষতি করা ঠিক হবে না।দেলোয়ার বলে, আমি কাজের মেয়ের সাথে আলাপ করবো? তুমি আমাকেএমন ভাবতে পারো?আমি বলি, অসুবিধা কোথায়?দেলোয়ার বলে, তার মানে?আমি বলি, তুমি তো আমাকে কাজের মেয়েই মনে করছো।দেলোয়ার উত্তেজিত হয়ে বলে, আমি তোমাকে কাজের মেয়ে মনে করি? তোমার এটা মনে হয়?আমি বলি, উত্তেজিত হোয়ো না, তুমি কেনো, সব পুরুষই বউদের কাজের মেয়ে মনে করে, বউ না থাকলে তাদের অসুবিধা হয়, যেমন তোমার হচ্ছে।দেলোয়ার বলে, কিন্তু তুমি বাসায় যাবে না কেনো?আমি বলি, সেটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার।দেলোয়ার বলে, তুমি আমার ওয়াইফ, তোমার কোনো ব্যক্তিগত ব্যাপার থাকতে পারে না।আমি হাসি, বলি, তুমি এখনো মধ্যযুগে আছো।দেলোয়ার উত্তেজিত হয়ে ওঠে, রাখো তোমাদের আধুনিক যুগ।আমি আহত বোধ করি, কষ্ট লাগে দেলোয়ারের জন্যে, ওর জন্যে আমি মনের ভেতরে একটু শূন্যতা লালন ক’রে রাখতে চেয়েছিলাম, একটু ছোট্ট বিষণ্ণ জমি একটু ছোট্ট মেঘলা আকাশ, কিন্তু দেলোয়ার শূন্যতাটাকে টিকতে দিচ্ছে না। এই দেলোয়ারের সাথেই পাঁচটি বছর কাটিয়েছি আমি, একেই দিয়েছি আমার পাঁচটি বছর? শরীর? ওষ্ঠ? প্রেম? জীবন? একেই জড়িয়ে ধ’রে সুখে ভ’রে
পৃষ্ঠা-৫৯
গেছে মন? তখন চোখে এসব ধরা পড়ে নি আমি ঘোরের মধ্যে ছিলাম ব’লে; নিজেকে আমার ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করে যে আমি আমার জীবন বদলে দিয়েছি, বদলে দিয়েছি ব’লে অনেক কিছু দেখতে পাচ্ছি, যা আগে দেখতে পেতাম না। তার সাথে আমার আর কোনো কথাই বলতে ইচ্ছে করে না, রাগ করতেও ঘেন্না লাগে করুণা করতেও ঘেন্না লাগে।তবু আমি বলি, তুমি বর্বর হয়ে উঠছো, আমার এখানে বসতে ভালো লাগছে না, আমি উঠি।দেলোয়ার বলে, আমি বর্বর?আমি বলি, না, তুমি সুসভ্য; তুমি বসো, আমি উঠি।দেলোয়ার বলে, না, তুমি যাবে না, আমার কথা আছে।আমি বলি, তোমার কথা আমি রাখতে পারবো না।আমি উঠতে চাই, দাঁড়াই, দেলোয়ার আমার পা জড়িয়ে ধ’রে বলে, তুমি যেয়ো না, তোমাকে আমি ভালোবাসি।আমার হাসি পায়, আমার প্রেমিককে আমি কখনো আমার পদতলে দেখতে চাই নি।আমি বসি, বলি, তুমি নিজেকে এতো নিচে নামিও না।দেলোয়ার বলে, তাহলে আমি কী করবো?আমি বলি, প্রেমিক কখনো পা ধরে না, বুকে জড়িয়ে ধরে।আমি কথাটি বলি, কিন্তু দেলোয়ার যদি আমাকে এখন, আগামীকাল, পরশু, আগামী বছর, এবং তারপর বুকে জড়িয়ে ধরতে চায়, তাহলে আমি তার বাহুতে ধরা দিতে পারবো না, ওই বাহু আর বুককে আমার আর ধরা দেয়ার মতো স্থান মনে হয় না, তাকে আর প্রেমিক মনে হয় না। ওই দূরের টেবিলের লোকটি আমাকে জড়িয়ে ধ’রে চুমো খেতে চাইলে আমি যেমন তাকে ঠেলে ফেলে দেবো, ঠিক তেমনি ঠেলে ফেলে দেবো দেলোয়ারকে। দেলোয়ারকে আমার শয়তান মনে হয় না প্রতিভাবানও মনে হয় না, তুচ্ছ মনে হয়। স্বামী? হাজব্যান্ড? এসব হাস্যকর মনে হয় আমার কাছে; আমি চাইলে কি এমন অজস্র পুরুষের স্বামী হাজব্যান্ড হ’তে পারি না? পারি না শুধু আমি স্ত্রীলিঙ্গ ব’লে?অমি ধীরেধীরে বেরিয়ে আসি, দেলোয়ার ব’সে থাকে; বেরোনোর সময় সব কিছুকে আমার বিস্ময়কর লাগে। দেলোয়ারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক খারাপ ছিলো না, খুবই ভালো ছিলো, তা এমন খারাপ হয়ে উঠলো কেমন ক’রে? আমি জীবন বদলে দিয়েছি, কিন্তু তার সাথে সম্পর্ক খারাপ হোক আমি চাই নি, শুধু স’রে যেতে চেয়েছি, আর দেলোয়ার ধ’রে রাখতে চেয়ে কেমন ঘিনঘিনে ক’রে তুলছে সম্পর্ক। সম্পর্ক ছিন্ন হ’লেই সম্পর্ক খারাপ হ’তে হবে? এতোদিন আমাদের সুখের প্রেমের চমৎকার সম্পর্কের নিচে লুকিয়ে ছিলো সম্পর্কের এই রূপটি? ভালো সম্পর্কও বিশুদ্ধ নয়? কোনো সম্পর্কই বিশুদ্ধ নয়? এর নিচেও পাক থাকে? নাড়া পড়লে ওপরে উঠে আসে, এবং সব কিছুকে নোংরা ক’রে দেয়?
পৃষ্ঠা-৬০
দেলোয়ারকে আমার তাজ মনে হ’তে থাকে, যার ঠোঁটে আমি ঠোঁট রাখতে পারি না, যার সাথে আমি বিছানায় যেতে পারি না, যার সামনে আমি নগ্ন হ’তে পারি না, যাকে আমি আমার শরীর ছুঁতে দিতে পারি না। জীবন বদলে দিয়ে আমি ভালোই করেছি, বুঝতে পারছি জীবনকে, তার মুখ চিনতে পারছি। আমি রেস্টহাউজের দিকে ফিরতে থাকি, পাশের ঘরবাড়ি গাছপালাকে আমার ভালো লাগতে থাকে, কিন্তু জীবনকে আমার মনে হ’তে থাকে শোচনীয় অন্তঃসারশূনা, যার জন্যে মুহূর্তের জন্যেও হাহাকার করতে পারি না, চোখে একটুও জল জমতে দিতে পারি না।একটি ছোটো ফ্ল্যাট দরকার, রেস্টহাউজে থাকতে আর ভালো লাগছে না। খারাপ লাগছে? তাও নয়; তবে এখানে বেশি দিন থাকতে পারি না।কাউকে বলবো একটা ফ্ল্যাটের খোঁজ দিতে? বলা কি ঠিক হবে? বলার সাথে সাথে তারা একরাশ প্রশ্নের পর প্রশ্ন করবে না? খোঁজ দেয়ার থেকে খোঁজ নেয়াই কি হয়ে উঠবে না তাদের প্রধান কাজ? কেনো আমি ফ্ল্যাট চাই? ফ্ল্যাটের তী দরকার? আমার নিজেরই তো বাসা আছে। হাজব্যান্ডের সাথে গোলমাল চলছে? কেনো গোলমাল চলছে? কোনো নারী? কোনো পুরুষ? এমন একটু-আধটু হয়ই। তারা কি গোলমালটা মিটিয়ে দেবে? অজস্র উপদেশ ঝ’রে পড়বে তাদের ঠোঁট থেকে। আমি এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবো না, তাদের উপদেশ আর সহানুভূতি সহ্য করতে পারবো না। একটি ফ্ল্যাট কি খুঁজে নিতে পারি না আমি নিজেই? যদি পুংলিঙ্গ হুতাম, কী করতাম? নিজেই কি বেরিয়ে পড়তাম না ফ্ল্যাটের খোঁজে? স্ত্রীলিঙ্গ হয়েছি ব’লে সাহায্য চাইভে হবে অন্যদের? না, নিজেকেই খুঁজে নিতে হয় যেমন নিজের পথ, তেমনি নিজের ফ্ল্যাট আমার নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে।বেরিয়ে প’ড়ে দেখি ফ্ল্যাট পাওয়াও কঠিন নয়। বাক, একটি অযোগ্যতা থাকলেও তিনটি যোগ্যতা আমি অর্জন ক’রে রেখেছিলাম, দেখছি সেগুলো বেশ কাজ দিচ্ছে; আমি স্ত্রীলিঙ্গ, এটা আমার অসংশোধনীয় অযোগ্যতা, এর জন্যে ফ্ল্যাটের দরোজা সহজে খুলতে চায় নি, কয়েকবার বেশি টোকা দিতে হয়েছে, কলিংবেলের সুইচে একটু বেশি সময় আঙুল চেপে রাখতে হয়েছে; কিন্তু আমি একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, ওটার বুঝ নামডাক, লাখপতি কোটিপতিদের সোনামণিদের স্বর্গ ওটি, আমার একটি তিন অক্ষর আছে, আমি মাসে পনেরো হাজার দিতে পারি, ফ্ল্যাট পেতে কোনো অসুবিধা হয় না। কয়েকটি মধুর প্রশ্নের মধুরভাবে জবাব দিতে হয়, এই যা। আমি একা? হ্যা। হাজব্যান্ড? ছিলো। কোথায়? এই শহরেই। একটু গোলমাল চলছে? হাজব্যান্ড কি আসবে? না। একটু গোলমাল আছে আমার, তবে বাকি সবটাই আকর্ষণীয়, আমাকে ফ্ল্যাট ভাড়া দিতে দ্বিধা করে না বাড়িজলা; বরং আমাকে ফ্ল্যাট ভাড়া দেয়ার জন্যে সে একটু বেশিই আগ্রহী হয়ে ওঠে, তার স্ত্রীটিও। আমাকে কেউ পছন্দ করবে না, এটা হ’তে পারে না, আমি জানি, আমি গিয়ে যদি দাঁড়াই সামনে আমাকে পছন্দ করতেই হবে; শত্রুরাও আমাকে পছন্দ করে।
পৃষ্ঠা ৬১ থেকে ৭৫
পৃষ্ঠা-৬১
এজন্যে কি আমি সাধনা ক’রে আসি নি ব্রুকবেলা থেকেই? দু-একটি জিনিশ পেয়েছিলাম না খেটেই, খেয়ালি প্রকৃতির কাছে থেকেই; মুখটি সুন্দরই নিয়ে এসেছিলাম, অন্তত আমার নিজের কাছে সুন্দর লাগে, পথেঘাটে এখানেসেখানে জেনেছি একটি সুন্দর মুখ খুব দরকার, মানুষ সুন্দর মুখ খুব পছন্দ করে, তার মোহ আছে সুন্দরের জন্যে, ধন্যবাদ মাকে আব্বাকে, এটা যদি খারাপ হতো যদি আমার পছন্দ না হতো, তাহলে আমার দুঃখের শেষ থাকতো না, আমি সকালে বিকেলে মধ্যরাতে ম’রে যেতাম; বঙটাও খুব খারাপ নিয়ে আসি নি, না ধবধবে না মিশমিশে, ধন্যবাদ স্বেচ্ছাচারী প্রকৃতিকে, রঙপাগল বর্ণান্ধ এই কালচেটেদের দেশে আমার রঙটা যদি আমার মতো না হতো কষ্টে কষ্টে আমি পাগল হয়ে যেতাম। বদ্ধ পাগল, ডাস্টবিন থেকে মুরগির ঠ্যাং কুড়িয়ে খাওয়া হি হি ক’রে হাসা পাগলি। চমৎকার হতো। আর আমি কি মুগ্ধ করার মতো বাক্য কি শিখি নি, সরল বক্র সুগন্ধি রঙিন উড্ডীন বাক্য? গাধাকে কীভাবে সিংহের শিরোপা দিয়ে অনুপ্রাণিত উদ্দীপ্ত করতে হয়, থরথর ক’রে কাঁপাতে হয়, তা কি আমি জানি না; আবার সিংহকে কীভাবে গাধার মতো বশ মানাতে হয়, মরা গরুর মতো ভাগাড়ে ফেলে রাখতে হয়, তাও কি জানি না আমি? লাথি দিতেও কি শিখি নি, যদিও লাথি আমার বিশেষ দিতে হয় না, লাথি দিতে আমার খারাপই লাগে। আমি এটা শিখেছি, যেমন শিখেছিলাম গণিত বাঙলা ইংরেজি সমাজ। আমি কি প্রস্তুত হই নি? তার জন্যে আমি কি আমার রক্তকে খাটাই নি? তাহলে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিতে পারবো না কেনো?একলা একটি ফ্ল্যাট আমার। একটা মাইয়ামানুষ, যে নিজের জীবন বদলে দিয়েছে, যার কোনো পুরুষ নেই, তার নিজের একলা একটি ফ্ল্যাট। হোক না ভাড়া করা। কয়েক দিন ধ’রে ফ্ল্যাটটিকে আমি আমার মতো ক’রে সাজাই, ওটিকে আমার চরিত্র দিই, ওকে ডক্টর শিরিন ক’রে তুলি; খুব বেশি কিছু দরকার নেই, বেশি বস্তু আমি পছন্দ করি না, ফ্ল্যাটটিকে ভারি না ক’রে পাখির মতো লঘু ক’রে তুলি, যে আমাকে নিয়ে উড়বে। কয়েক দিনে সাজানো হয়ে গেলে আমি রেস্টহাউজ ছেড়ে ফ্ল্যাটে উঠি, কাউকে জানতে দিই না কোথায় যাচ্ছি, জানাতে ইচ্ছে করে না, কেয়ারটেকার শুধু এটুকু জানতে পারে আমি রেস্টহাউজ ছেড়ে দিচ্ছি। আমার ফ্ল্যাট, তাতে একলা আমি, এটা আমার, এটা আমার পৃথিবী, আর কারো নয়। আগে কখনো এমন মনে হয় নিঃ আমাদের বাড়িতে একটি ঘর হিলো আমার জন্যে ইস্কুলের সময় থেকেই, ওটা খুব স্বাভাবিক মনে হতো, ওটা তো থাকবেই, কিন্তু ফ্ল্যাট বা বাড়িটাকে নিজের মনে হয় নি, আমাদের মনে হয়েছে, দেলোয়ারের সাথে ছিলাম এক বড়ো ফ্ল্যাটে, তার অনেক কিছুই কিনেছিলাম আমি, ওটিকে সাজিয়েছিলাম আমি, কিন্তু ওটিকেও আমার মনে হতো না, মনে হতো দেলোয়ারের, দেলোয়ারও তাই মনে করতো, সবাই তা মনে করতো। তাতে আমার খারাপ লাগতো না, আমার নিজের কিছু থাকতে হবে, তখন এটা মনে হতো না। আমি ইচ্ছে করলে আমার সারা বিশ্ব ছেড়ে দিতে পারি, কিছুই আমি চাই না, সব দিয়ে দিতে পারি, আবার ইচ্ছে হ’লে
পৃষ্ঠা-৬২
একটি ধুলোকণাও ছাড়ি না, মুঠোতে শক্ত ক’রে ধ’রে রাখি যেনো ওটি সোনার টুকরো। তখন কি জগতটাকেই দেলোয়ারের মনে হতো না? দেলোয়ারের জগতে ছিলাম আমি। দেলোয়ারের জগতে সূর্য উঠতো, আমি সেই সূর্য থেকে আলো পেতাম; তার জগতে অন্ধকার নামতো, ওই অন্ধকারে আমি দেলোয়ারকে জড়িয়ে ধ’রে ঘুমোতাম। তখন আমার কোনো জগত ছিলো না। আমি আমার জগতটা দেলোয়ারকে উপহার দিয়ে দিয়েছিলাম, আর দেলোয়ার আমাকে থাকতে দিয়েছিলো তার জগতে, এতেই আমি সুখী ছিলাম। কিন্তু এই ভড়ো করা ফ্ল্যাটটিকে আমার নিজের মনে হয়, এটি আমি ভাড়া নিয়েছি, এটিকে সাজিয়ে তুলেছি আমি, এখানে থাকবো আমি, এবং মনে হয় আমার জগতটিকে আমি ফিরে পাচ্ছি। আমার জগতে এখন আমার সূর্য উঠবে, আমার জগতে এখন আমার অন্ধকার নামবে, আমি আবার হয়ে উঠবো আমি। অমি ঘুরে ঘুরে ফ্ল্যাটটিকে দেখি, বেডরুমের একপাশে আমার খাটটিকে ছোট্ট চরের মতো মনে হয়, ওটিতে একলা আমি ঘুমোবো; ওই পাশে পড়ার টেবিলচেয়ার দেখে মায়া লাগে, খাবারঘরের টেবিলটি আর চেয়ারগুলোকে, ছোট্ট শাদা ফ্রিজটিকে ছুঁত্তে দেখি, ড্রয়িংরুমের ছিমছাম সোফাগুলোকে আদর করি। আর কী কী লাগবে? লাগলে কিনে ফেলবো। আমার বইগুলো? পিসিটি? খুবই দরকার’ওগুলো। ওগুলোর জন্যে একটা ছোটো দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। দক্ষিণের বারান্দায় যাই, দিয়ে দেখি কাঁঠালগাছের ডালে টাওয়েলের মতো স্কুলে আছে করেক টুকরো নীল আকাশ, বাতাসে কাঁপছে।কয়েকদিন বেশ ব্যস্ততায় কেটেছে, আমার নিজের জন্যে ব্যস্ততা, ব্যস্ত থাকতে ভালো লেগেছে; ইউনিভার্সিটিতে গেছি, বেশিক্ষণ থাকি নি, ভাগ্য ভালো এ-সময়ে আমার ক্লাশ নেই, নতুন কোর্স শুরু হবে মাসখানেক পর, বাসায় দুবার ফোন করেছি, মায় একটু কাঁদাকাটা শুরু করতেই প্রবোধ দিতে দিতে রেখে দিয়েছি, বুকে একটু কুয়াশা জমেছে, আর সবটা সময়ই কেটেছে ফ্ল্যাট গোছাবার পেছনে। ছুটতে হয়েছে দোকানে দোকানে, আসবাবপত্রের, ফ্রিজের, ম্যাটের, এটার সেটার, খারাপ লাগে নি; সে-সব এনে তুলতে হয়েছে, বসাতে হয়েছে পছন্দমতো জায়খায়। একরাশ পুরুষকে খাটালাম; ওরা আমার থেকে নিম্নবর্ণের, তবু তো পুরুষ; মাঝেমাঝে ওদের পৌরুষ জেগে উঠছিলো, নিজেদের মতো কাজ করছিলো, আমি তা করতে দিই নি, আমি করিয়েছি যেভাবে আমি করাতে চাই। দেখেছি আমি পারি। পারবো না কেনো? কয়েকটি ফোন এসেছিলো, আমাকে পায় নি। ফ্ল্যাটে উঠে আমি দু-দিন অনেকটা হারিয়েই যাই, কেউ জানে না আমি কোথায় আছি, হারিয়ে যেতে আমার বেশ লাগে।একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছি, ফোন নেই, টিভি নেই, মাকেও ফোন করি নি, আমি তো শিশু নই যে মাকে না দেখে ডুকরে কেঁদে উঠবো আর মাও কাঁদতে থাকবে আমাকে দু-দিন না দেখে; একা একা পড়াই, পড়ি, রান্না করি, মিন্সমিট দিয়ে আলুসেদ্ধ খাই, ঘুমোই, একটির পর একটি মুখ মনে পড়ে, নিজেকে দেখি, দেখতে ভালো লাগে। পড়ি, লিখি, পড়তে পড়তে লিখতে লিখতে নিজের সাথে
পৃষ্ঠা-৬৩
কথা বলতে থাকি, একা থাকি না, দুজন হয়ে উঠি।এই জীবন তোমার কেমন লাগছে?বেশ তো, খুব খারাপ নয়, নট সো ব্যাজ।খারাণ না ভালো?অনেকখানি ভালো অনেকখানি খারাপ, তবে বেশ। জীবন এর চেয়ে এমন কী আহামরি জিনিশ হবে?উপভোগ করছো?হ্যাঁ, বেশ তো উপভোগ করছি, আমি সব কিছু উপভোগ করতে পারি।এই জীবনে তুমি সারাজীবন থাকতে পারবে?এই তো শুরু হলো, এখনই সারাজীবন নিয়ে ভাববো কেনো?জীবন কি একলা থাকার জন্যে?হ্যাঁ, না; একলাও থাকা চলে, আবার পালেপালেও থাকা চলে, এর কোনো নিয়ম নেই।তোমার কি একটু নিঃসঙ্গ লাগছে?হ্যা, একটু তো লাগছেই।এভাবে থাকতে পারবে?সেটা দেখা যাবে।ক-দিন তুমি এভাবে হারিয়ে থাকবে কাউকে না জানিয়ে?না তো, দু-চার দিন হারিয়ে থেকে দেখছি কেমন লাগে।ক-দিন হারিয়ে থাকবে? শুক্রবারই বেরোবো, নাসরিনকে সুমনকে দেখতে ইচ্ছে করছে, ওদের সাথেহৈচৈ করতে ইচ্ছে করছে, হয়তো আমি মানুষের সংস্পর্শ চাচ্ছি, মানুষের গন্ধ ও কন্ঠস্বরের স্বাদ চাচ্ছি, ঘরে মানুষের চলাফেরা দেখতে চাচ্ছি। ওদের একটা চমকও দিতে হবে। ওরা কি ভাবতে পারছে এর মাঝে আমি একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে ফেলেছি? সাজিয়েগুছিয়ে তুলেছি? এতোটা হয়তো ভাববে না, হয়তো আমার কথা ওরা ভাবছেই না।শুক্রবার সকালেই বাসায় গিয়ে উঠি, সবাইকে পেতে হবে, বিশেষ ক’রে নাসরিন আর সুমনকে; জানতাম আমাকে পেয়ে ওরা খলখল ক’রে উঠবে, বেশ কিছু দিন আমাকে দেখে নি; তাই হয়, ওরা আনন্দে খলখল ক’রে ওঠে, আমিও। এই সুখটুকু আমি চাই, এই সুখটুকু আমাকে আলো দেয়।দিয়েই বলি, দুপুরে আজ তোদের আমি খাওয়াবো।সুমন হৈ হৈ ক’রে ওঠে, চল্ চল্, এখনই চলু, বহুদিন চাইনিজ খাই নি। আমি হাসি, বলি, পাঁচতারায় হ’লে কেমন হয়?নাসরিন বলে, ওহ্ বাব্বা, পাঁচতারা? ওখানে আমি ভয় পাবো, ওখানে না কি গাররা যায়?
পৃষ্ঠা-৬৪
আমি হেসে বলি, গণ্ডারদের এতো ওয় পাস কেনো? ওগুলো নিয়েই ভো থাকতে হবে।নাসরিন বলে, না, আমি গত্তারদের সাথে থাকতে পারবো না।আমি বলি, থাকতে থাকতে দেখবি অভ্যাস হয়ে গেছে, ওরা যে গন্ডার তা আর বুঝতেই পারবি না।সুমন বলে, না, তারাটারার দরকার নেই, চাইনিজই খাবো, আমরা মিডক্লাস, চিকেন ফ্রাইড রাইস, থাই সুপ।আমি বলি, তোর গোটা দুই মোটাঘাটা গার্লফেন্ডকে নিয়ে নিবি না কি?সুমন বলে, তুই বললে শো-খানেককে এখনই ডাক দিই, দেখবি একেকটির সাইজ কী।নাসরিন বলে, আমিও দু-একটি পাগলছাগল ডাকবো না কি?আমি বলি, মাত্র দু-একটি? তোর ভাণ্ডার এমন শূন্য? ইউনিভার্সিটিতে জিনিয়াসের সংখ্যা কমে গেছে না কি?নাসরিন বলে, এখন মস্তানরাই জিনিয়াস, ওরা রিভলবার বুকের কাছে ধ’রে বলে আই লাভ ইউ, তারপর ঝোঁপের ভেতরে টেনে নিতে চায়।আমি বলি, খাওয়ার পর তোদের একটা চমক দেবো।নাসরিন বলে, কিসের চমক রে? তোর চমক তো আবার ঠাভার চমকের মতো হয়া।আমি বলি, তারচেয়েও বেশি।মা আমাকে ডাকে, অই শিরি, এই দিকে হুইন্যা যা।এই ভয়েই ছিলাম, মায় এখনই তার প্রিয় কাঁদাকাটাগুলো শুরু করবে; তার মেয়েটির জন্যে তার কষ্টের শেষ নেই।আমি গিয়ে বলি, মা, কেমুন আছো?মায় বলে, কেমুন আর থাকুম, তর লিগা চিন্তায় ঘুমাইতে পারি না।আমি বলি, চিন্তা কিয়ের মা?মায় বলে, জামাইর লগে তর অহনও মিলমিশ অয় নাই?আমি বলি, এইসব কতা তুমি ভাইলো না, এইডা কিছু না।মায় কলে, জামাই কাইলও ফোন করছিলো, ভর লিগা কষ্টে আছে, তুই জামাইর কেছে ফিরা যা।আমি বলি, না, যাইতে পারুম না, মা।মায় বলে, এইভা কেমুন কতা, জমাইর কেছে যাইতে পারবি না ক্যা? জামাই এমুন কি দোষ করছে? পুরুষপোলাগো আবার দোষ কী? মাইয়ামানুষ। আবার পুরুষপোলাগো ছাইরা দূরে থাকে নিঃআমি বলি, কোনো দোষ করে নাই।মায় বলে, হ, তুই শনিবার দুইকরে অইছিলি, বেদনায় আমার প্যাট ফাইয়া
পৃষ্ঠা-৬৫
গেছিলো, হেইদিনই বুজছিলাম তরে লইয়া আমার অনেক জ্বালা অইবো।একথাটি মা সব সময়ই বলে, আমি যখন একটু তার মতের বাইরে যাই, তখনই মা এই অভিযোগ তোলে, তুলে সুখ পায়। এটা মার আমাকে আদর করার ভাষা, এটা শুনতে আমি পছন্দ করি।আমি বলি, হেইডা তো আমার দোষ না, হেইডা মা তোমার দোষ, তোমার দোষেই আমি শনিবার অইছি।আমিও সব সময় এই উত্তরটিই দিই, তাতেও মা সুখ পায়।মায় বলে, তুই অগো লগে বয় পিয়া, আমি তর লিখা রান্দি।আমি বলি, আমি আইজ খামু না, অগো লইয়া চাইনিজে খামু।মায় বলে, হেইর দিগাই হেরা এত লাফাইতে আছে।আব্বার সাথে কথা বলি, আব্বা আমার জীবন সম্পর্কে কোনো কথা বলেন না, নিজের ক্লান্তির কথা বলেন; তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝি তিনি কিছু একটা শুনতে চান, কিন্তু আমি কিছু বলি না ব’লে আব্বা কিছু জানতে চান না। আব্বা কি আমাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন নন? হয়তো, তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি শান্ত উদ্বেগ দেখতে পাই, কিন্তু আব্বা মা নন।দুপুরের আগেই আমরা বেরিয়ে পড়ি, সুমন আর নাসরিনের প্রিয় চাইনিজে খাই, খেতে খেতে গল্প করি।নাসরিন বলে, তুমি আমাকে একটি দায়িত্ব দিয়েছিলে।এ-ভারটা আমার ভেতরে ছিলো, অনেকবার ভেবেছি ফোন ক’রে জিজ্ঞেস করি কী হলো, কিন্তু প্রশ্নটা আমার ভেতরে আটকে গেছে, আজো ভেতরে ঘোলা জলের মতো ঘুরছিলো, কিন্তু চেপে রাখছিলাম। এটা আমি ওকে কোনোদিন জিজ্ঞেস করতো পারবো না, আমাকে এটা এমনভাবে ভুলে থাকতে হবে যেনো কোনোদিন ওকে কিছু বলি নি। এর কথা নাসরিন না তুললেই বেঁচে যেতাম, কিন্তু আমার বাঁচা তো আমার হাতে নয়।আমি বলি, কী দায়িত্ব?বলতে গিয়ে গলায় আটকে যেতে চায়, তবু আমি শান্ত সহজভাবেই উচ্চারণ করি কথাটি, যেনো আমি কিছুই এর আনি না।নাসরিন বলে, তোমার শাড়ি বই পিসিটি আনার।একটু ধাক্কা লাগে ভেতরে, আমি বলি, ওহঃ তার কী হলো?নাসরিন বলে, দেলোয়ার ভাই ওগুলো দেন নি ব’লে আমি তোমাকে আর কিছু জানাই নি, জানাতে আমার খারাপ লাগছিলো।আমি বলি, দেয় নিঃনাসরিন বলে, দেলোয়ার ভাই বলেছেন ওগুলো নিয়ে কী হবে, তুমি তো শিগগির ওখানে ফিরে যাবে।ফিরে যাবো? তাই ওর মনে হয়? আমার মুখ দেখে ওর তা-ই মনে হয়েছে?
পৃষ্ঠা-৬৬
ওগুলো আটকে রেখে আমাকে ফেরাতে চায়? ও কি মনে করে ওই বস্তুগুলো আমাকে ওর কাছে নিয়ে যাবে? যদি যেতাম তাহলে তো যেতাম ওরই জন্যে, বস্তুগুলোর জন্যে নয়; এখন ওর কাছে ওর নিজের থেকে বস্তুগলো বড়ো হয়ে উঠেছে। আমার কষ্ট হয় দেলোয়ারের জন্যে।আমি বলি, আচ্ছা, এগুলো আমার লাগবে না।লাগবে না, কিন্তু আমার কষ্ট লাগে; ওগুলো আমার দরকার, ওগুলো খুবই লাগবে আমার, ওগুলো আমিই কিনেছিলাম, পছন্দ ক’রে ক’রে কিনেছিলাম, আবার ওগুলো কিনতে হবে, অনেকগুলো টাকা চ’লে যাবে। এখন তো আমাকে হিশেব ক’রে চলতে হবে, ব্যাংকের হিশেব আগে আমার মনে থাকতো না, কয়েক দিন ধ’রে আমি মনে মনে হিশের ক’রে চলছি, এখন থেকে সব সময়ই হিশেব করবো। ওগুলোর জন্যে আমার ভেতরে মায়াও জন্মেছে, একটি নতুন শাড়ি কিনলেই মনে পড়বে এমন একটি শাড়ি ছিলো আমার, সেটি আমি আর পরবো না, নতুন পিসি কিনলে কিবোর্ডে আঙুল চালাতে চালাতে মনে পড়বে আগেরটির মুখ; আর ওই বইগুলো? সবগুলোর নাম কি মনে আছে? অনেকগুলো বই ছিলো, যেগুলো কিনে শুধু সই ক’রে রেখে দিয়েছি, পড়বো পড়বো ক’রে পড়া হয় নি, সময় পাই নি, খোলাই হয় নি, অনেকগুলোর নামই ভুলে গেছি, ওগুলোর জন্যে আমার কষ্ট লাগে। একবার কেঁদে উঠতে ইচ্ছে করে। আমি জীবন বদলে দিয়েছি, অনেক কিছুর সঙ্গেই আমার সম্পর্ক বদলে যাচ্ছে, আমার বই আমার শাড়ি আমার কম্পিউটারের সাথেও আমার সম্পর্ক বদলে গেছে।নাসরিন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, একটি কথা তোমাকে জিজ্ঞেস করবো?আমি চেয়েছিলাম নাসরিন যেনো কিছু জিজ্ঞেস না করে, কিন্তু ও যদি জিজ্ঞেস করতে চায় আমি না করতে পারি না।আমি বলি, কর।নাসরিন বলে, তুমি আর ওখানে ফিরতে চাও না কেনো?আমি বলি, এমনিই।নাসরিন বলে, তোমাকে চিনি, এমনিই এতো বড়ো ঘটনা তুমি ঘটাবে না। আমি হেসে বলি, এটা এমন কী আর বড়ো ঘটনা? এতে কি চাঁদতারা খ’সে পড়ছে, দেশে ধন্যা দেখা দিচ্ছে?নাসরিন বলে, বড়ো ঘটনা নয়? তুমি জীবন বদলে দিচ্ছো, এটা অনেকের কাছে চাঁদ খ’সে-পড়ার থেকেও ভয়ঙ্কর।আমি বলি, তার মানে আমার জীবনের রূপটা স্থির হয়ে গিয়েছিলো? নাসরিন বলে সবাই তো তা-ই মনে করে, বিয়ে মানেই জীবন, বিয়ে টিকিয়ে রাখাই জীবন।আমি বলি, অর্থাৎ গত পাঁচ বছর ধ’রে যা চলছিলো, তা-ই আমার জীবন? আমাকে ওতেই থাকতে হবে?
পৃষ্ঠা-৬৭
নাসরিন বলে, সভিাই, একটা জীবনই সারাজীবন চালাতে হবে, ভাবলেই আমার অসুখ করে। কী ক’রে যে মানুষ পারে।আমি বলি, মা আর আব্বা তো একটা জীবনই কাটিয়ে গেলেন।নাসরিন বলে, মা আর আব্বার জীবন আমার বেশ লাগে, তাঁরা আমাদের মা আর আব্বা ব’লে, কিন্তু তাঁদের জীবন কোথায়? আমাদের বাদ দিলে তাঁদের জীবন কোথায়?সুমন বলে, খাওয়া তো হলো, কিন্তু তোমার চমকটা কোথায়? আমি বলি, চল, চমক দেখবি, চল।আমি বলি, কিন্তু এখন আর চমক দিতে আমার ইচ্ছে করে না, মনে হয় ওটা আর চমক নেই, ওটা নিতান্তই একটি ফ্ল্যাট দেখানো; তবু বেরিয়ে পড়ি, একটি বেবি নিই, বেবি ছুটতে থাকে, সুমন নাসরিন বারবার জিজ্ঞেস করতে থাকে, আমরা যাচ্ছি কোথায়, আমরা যাচ্ছি কোথায়, আমি বলতে থাকি, চমক দেখতে, চমক দেখতে। আমি যেনো উৎসাহিত করতে থাকি নিজেকে, যেনো সত্যিই আমি ওদের চমকে দিতে যাচ্ছি। আমার ইউনিভার্সিটির বেশ কাছেই একটি পাঁচতলা বাড়ির সামনে বেবি খামে, আমরা উঠে চারতলার পুব দিকের ফ্লাটের দরোজায় এসে দাঁড়াই, আমি দরোজা খুলি।সুমন বলে, আমরা কোথায় এলাম?ঢুকতে ঢুকতে আমি বলি, বল তো কোথায় এলাম?নাসরিন হৈচৈ ক’রে ওঠে, তুমি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছো না কি? ফ্ল্যাট নিয়েছো? আমি বলি, দ্যাখ তো কেমন লাগছে?সুমন বলে, দারুণ ফ্ল্যাট, দারুণ সাজিয়েছো, আমি এখানে থেকেই যাবো।যদি ওরা এখানে থেকে যেতো তাহলে আমি সুখী হতাম, কিন্তু আমি জানি ওরা থাকবে না; এটা আমার জীবন, আমার জীবনে ওরা কেনো থাকবে? আমি কি ওদের ডাকবো আমার জীবনে? কেনো ডাকবো?আমি বলি, কিন্তু এটাকে খালি খালি লাগছে না?সুমন বলে, খালি খালি মানে কী, এটা তো খালিই। তোমার বই কই, কম্পিউটার কই, ফোন কই, টিভি কই?আমি বলি, হয়ে যাবে।নাসরিন বলে, তুমি যেহেতু ফ্ল্যাট নিয়েছো, এসব অবশ্যই হয়ে যাবে; কিন্তু তোমার একা একা থাকতে খারাপ লাগবে না?আমি বলি; একা একা লাগলে রাস্তার রিক্সাওলাদের চায়ের দোকানে গিয়ে চা খেতে খেতে সিগারেট টানতে টানতে ওদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে আসবো।সুমন বলে, খুব চমৎকার হবে, ওরা তোমাকে ফ্রি চা খাওয়াবে।নাসরিন বলে, শুধু চা খাবে কেনো, অফটাইমে রিক্সা চালিয়ে পাঁচ দশটা টাকাও রোজগার করতে পারো।
পৃষ্ঠা-৬৮
আমি বলি, আমার কিন্তু মাঝেমাঝে রিক্সা চালাতে ইচ্ছে করে। নাসরিন বলে, রিক্সা কেনো, রাস্তার ধারে তুমি চিতই পিঠাও ভাজতে পারো। আমার ভালো লাগে ওর কথা শুনে; আমি রাস্তার ধারে চিতই পিঠা ভাজতে পারি? মাজায় শাড়ি শক্ত ক’রে বেঁধে ঝাঁট দিতে পারি রাস্তা? ভোরে উঠে টিফিন কেরিয়ার হাতে ফুটপাত দিয়ে ছুটতে পারি গার্মেন্টসে? এসব আমি ভেবে দেখেছি, মনে হয়েছে দরকার হ’লে এসব আমি পারতাম, যেমন পারি পড়াতে, পারি পার্টিতে পেস্ট্রি খেতে খেতে হাসতে। যদি আমি স্মাগলার হতাম, তাহলে চমৎকার স্মাগলিং করতাম, আমলা হ’লে ইচ্ছে করলে দেদার মুষ খেতাম, আবার ইচ্ছে হ’লে হতাম নিষ্কাম সাধু সন্ত।বিকেল ভ’রে আমরা বিছানায় আর মেঝেতে গড়াই, আড্ডা দিই, বারান্দায় গিয়ে টাওয়েলের মতো ঝোলানো আকাশ দেখি, আর আমার ভয় লাগতে থাকে ওরা চ’লে যাবে, আমি একা থাকবো, আমার একা একা লাগবে, কিন্তু আমি রাস্তায় রিক্সাঅলাদের সাথে গিয়ে চা খেতে খেতে সিগারেট টানতে পারবো না। টানতে পারলে বেশ হতো। যদি পকেটে হাত দিয়ে একা একা সিগারেট টানতে টানতে হাঁটতে পারতাম রাস্তায়, বা কোনো চায়ের দোকানে গিয়ে পিরিচে ঢেলে চা খেতে পারতাম, তাহলে ভার কেটে যেতো অনেকটা। তা আমি পারবো না; আমাকে বই নিয়ে গড়াতে হবে, মাঝেমাঝে ওদের হাসির শব্দ শুনে চমকে উঠে দেখবো ওরা নেই। ইচ্ছে করে ওদের বলি, তোরা যাস নে, কিন্তু ওদের আমি একথা বলতে পারবো না, ওরা ভাববে আমি খুব কষ্টে আছি।ওরা চ’লে যাওয়ার পর আমার জন্যে একটি ভয়ঙ্কর, হিংস্র, ভালুকের মতো রাত আসে, যা এই ক-দিন আসে নি; আমি সাথে সাথে প্রস্তুত হই এর মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্যে। এই ক-দিনও একলা ছিলাম, কিন্তু এমন একলা লাগে নি, ভালো লেগেছে, মনে হয়েছে নিজের রাজ্যে নিজে আছি; আজ ওরা আমার ভেতরে নিঃসঙ্গতা বুনে গেলো ওদের সঙ্গতাপূর্ণ রাজ্য থেকে হানা দিয়ে? আমার কি মনে হচ্ছে ওরা খুব ভালো আছে, আমি ভালো নেই, ওদের সব আছে, আমার কিছু নেই, তাই এমন নিঃসঙ্গ লাগছে নিজেকে? ওদের আর ডাকবো না? সঙ্গতাপূর্ণ জনভূমি থেকে কাউকে ডেকে আনবো না আমার রাজ্যকে সংক্রামিত করার জন্যে? জানতাম ওরা চ’লে যাওয়ার পরই আমি নিঃসঙ্গতায় কাতর হয়ে উঠবো, নিজেকে মনে হবে পরিত্যক্ত, একটি সোনালি মাছির মতো একা একা উড়তে থাকবো, তাই ওরা থাকতে থাকতেই তৈরি হ’তে থাকি আমি। কাতর হ’লে চলবে না, নিঃসঙ্গতায় অসুস্থ হ’লে চলবে না; আমাকে থাকতে হবে সব মানুষের থেকে সুস্থ। আমার জীবন শাসন করবে আমাকে, আর আমার জীবনকে শাসন করবো আমি। আমি ও আমার জীবন পরস্পরের প্রভু ও ভৃত্য।ওদের বেবিতে উঠিয়ে দিয়ে ঘরে ফিরে দেখি মেঝের ওপর একটি বই উপুড় হয়ে প’ড়ে আছে, বইটিকে আমার আরেকটা সত্তা ব’লে মনে হয়, যেনো আমিই উপুড় হয়ে আছি; বইটিকে আমি আদর ক’রে হাতে তুলে নিই, চুমো খাই,
পৃষ্ঠা-৬৯
মেঝের ওপর ব’সে গড়তে থাকি। এক পাতা পড়ার পর গুচ্ছগুচ্ছ পাতা উল্টিয়ে আরেক পাতার চোখ বুলোই, আবার গুচ্ছগুচ্ছ পাতা উল্টোই। পড়তে মন বসছে না? মনকে বলি, প্রিয় মন, অস্থির মন, তোমাকে বসতেই হবে বইয়ের পাতায়, স্থির হ’তেই হবে তোমাকে। মন বলে, তুমি বই রেখে বাথরুমে গিয়ে এক দুই তিন চার ঘণ্টা ধ’রে শাওয়ারের নিচে ব’সে থাকো, ঠাণ্ডা হও, ভেজা চুলের অন্ধকার মুখের ওপর বুকের ওপর ছড়িয়ে ব’সে ব’সে ভাবো, হাত বুলোও শরীর জুড়ে, তুমি পাগল হয়ে যাও। কিন্তু এটা কি আমি করবো? জীবনের অত্যাচার আমি মেনে নেবো? জীবন আমাকে পাগল ক’রে তুলতে চাইলেই আমি পাগল হবো? তার বদলে জীবনকেই আমি পাগল ক’রে তুলবো; বলবো, জীবন, আমার কথা শোনা, আমি যা করতে বলি, করো, অবাধ্য হোয়ো না। আমি নিজেকে বলতে থাকি, এতো একলা বোধ কোরো না, মেয়ে, লক্ষ্মী মেরে, তোমার সঙ্গে তো তুমি আছো, এতো একলা বোধ করার কিছু নেই, মানুষকে একলাই থাকতে হয়, দলে দলে থাকায় কোনো সুখ নেই। কিসের অভাব তোমাকে কাঁপাচ্ছে। তুমি কি অভাব বোধ করছো দেলোয়ারের? তার কাছে ফিরে যাবে? ফিরে যেতে পারবে? খুঁজে দেখি দেলোয়ারের জন্যে কোনো শূন্যতা নেই আমার মধ্যে; তাহলে কি কোনো পুরুষের অভাব বোধ করছো, এই রাতে তোমার কি একটি পুরুষ দরকার? জড়িয়ে ধরতে চাও একটি পুরুষকে? না, তাও না। আমার শরীর কোনো পুরুষ কামনা করছে না; কোনো পুরুষের ওঠ বা আঙুল বা প্রত্যঙ্গ চাচ্ছে না; আমার একলাহ্ উঠে আসছে আমার ভেতর থেকেই।ঘুম আসে না, দুটো বাজে, রাতটিকে মরুভূমি মনে হয়; আমি নিজেকে বলি- বেশ, ঘুম আসছে না বেশ হয়েছে, প্রতিরাতে ঘুম আসতেই হবে কেনো, কেনো জেগে থাকতে হবে না কোনো কোনো রাতে? রাত কি শুধু ঘুমোনোর জন্যে? জেগে থাকার জন্যে নয়? ঘুমোলেই মানুষ সুখে থাকে? না ঘুমিয়ে সুখে থাকা যায় না? সবাই ঘুমিয়েছে ব’লে তোমাকেও ঘুমোতে হবে? আর সবাই কি ঘুমিয়েছে? সুখে থাকতে হবে কেনো? সুখ কাকে বলে, ঘুমোনোকেই কি সুখ বলে? মানুষকে সুখী হ’তে কেনো? জন্তুরা সুখী হবে, সুখে থাকবে; মানুষ কেনো সুখে থাকবে? রান্নাঘরে গিয়ে আমি পানি গরম করি, বাষ্পের শব্দ শুনি মন দিয়ে, চা বানাই, কাপে বেশি ক’রে পাতা ছেড়ে দিয়ে গরম পানি ঢালি, চিনি দিই, কাপ নিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসি। কুয়াশা দেখি, এবং দেখি আকাশে গুচ্ছগুচ্ছে তারা জ্বলছে, আমি ওদের নাম জানি না, ওদের একটি একটি নাম দিতে থাকি। তুমি রোহিণী, তুমি মথা, তুমি শতভিষা, তুমি বিশাখা, তুমি আর্দ্রা, তুমি স্বাতী। তারাগুলোর নাম শুনেছিলাম অনেক আগে, কোনোদিন তারাগুলোকে নামের সাথে মিলিয়ে দেখার ইচ্ছে হয় নি, আকাশই কখনো দেখি নি, আজ রাতে এসব নাম আমার মগজে ঝিকিমিকি করতে থাকে, ওদের আমি একটি একটি নাম দিতে থাকি। ভারশর ভারাগুলো এলোমেলো হয়ে যেতে থাকে, মঘা লাফিয়ে যেতে থাকে বিশাখা রোহিণীর ওপর দিয়ে, ওগুলো অন্ধকার হয়ে উঠতে থাকে; আমি আকাশকে বাদ দিয়ে আমার ঘরে ঢুকি।
পৃষ্ঠা-৭০
সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস থাকলে বেশ হতো, আমি চেয়ারে ব’সে মনে মনে হাসতে থাকি, তাহলে একটির পর একটি সিগারেট টানতে পারতাম, অ্যাসট্রে উপচে পড়তো, কয়েকটি টানার পর আর টানতে ইচ্ছে করতো না, কিন্তু ধরাতে থাকতাম একটির পর একটি, অত্যাচার করে চলতান জীবনকে। কিন্তু আমার সে-সুযোগ নেই। বাসায় হুইস্কি বা ঠান্ডা বিয়ার থাকলেও বেশ হতো, চুষে চুষে গিলে দিলে পান করা যেতো, কয়েক গেলাশ গিলে খাটে মাথা মেঝেতে পা রেখে প’ড়ে থাকতে পারতাম। বিয়ার তো বেশ লাগে, হুইস্কিও। ঠিক ক’রে ফেলি কয়েক বোতল হুইস্কি রাখতে হবে, পাঁচ দশ ক্যান বিয়ার রাখতে হবে। আমার ইচ্ছে করে বাইরে গিয়ে হাঁটতে, কিন্তু আমি কি হটিতে পারি একা একা এ রাতে? আমার খুব ইচ্ছে করে বেরিয়ে পড়তে, দরোজার দিকে বারবার তাকাই, এবং আমি ঘরের ভেতরেই হাঁটতে থাকি। এটাই এখন আমার রাজগণ, শুধু এখানেই আমি একা হাঁটতে পারি।জীবন, তুমি আমাকে কষ্ট দিচ্ছো, তোমাকে আমি বদলে দিয়েছি বলে? কষ্টদাও, কিন্তু আমি হারবো না তোমার কাছে; তুমি প্রভু নও, আমি তোমার প্রভু, তোমাকে আমি শাসন করবো আমার মতো ক’রে। আমার মাথা টনটন করছে, চোখ কর্কশ হয়ে উঠেছে, উঠুক; আমি সহ্য করবো। জীবন, তুমি বলছো একটি টিভি থাকলে বেশ হতো, চ্যানেলের পর চ্যানেলে ছুটে জীবন থেকে পালিয়ে পালিয়ে রাত কাটিয়ে দিতে পারতাম; কিন্তু না, আমি পরোক্ষভাবে তোমাকে যাপন করতে চাই না, আমি তোমাকে যাপন করতে চাই সরাসরি, টিভির সাহায্য নিয়ে পালিয়ে পালিয়ে আমি বাঁচতে চাই না। আমার কোনো টিভি থাকবে না। তুমি বলছো একটা টেলিফোন থাকলে এখন কারো সাথে ভাগ ‘ক’রে নিতে পারতাম রাতটিকে; একটা টেলিফোন আমার দরকার, কিন্তু আজ যদি থাকতো, আমি সেটি ব্যবহার করতাম না। আমি তোমাকে সরাসরি শাসন করতে চাই, পরোক্ষভাবে নয়।ইচ্ছে করলে এর পর আমি ঘুমিয়ে পড়তে পারতাম; শেষরাতে একটু একটু ঘুম পেতে থাকে, রাতের কোমল ঘন ভার ঢুকতে থাকে মাথার ভেতরে, চারপাশে জমতে থাকে রাতের স্তব্ধ গন্ধ, তার আকাশের নিথরতা, কিন্তু আমি ঘুমোই না, দেখতে চাই সারারাত জেগে থাকতে কেমন লাগে, আমি একটি সম্পূর্ণ ঘুমহীন রাত চাই। একটি জীবন প’ড়ে আছে সামনে জয়ের জন্যে, আর একটি ছোটো রাতকে আমি জয় করতে পারবো না? রাত কি আমার থেকে শক্তিশালী, রাত কি আমার মতো বদ্ধপরিকর মানুষ? পাখির ডাকে আমি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই- এতো পাখি আছে জগতে, এতো পাখি এই শহরে, পাখিগুলোর জন্যে এই দুর্বৃত্ত দণ্ডিত শহরটিকে আমার ক্ষমা ক’রে দিতে ইচ্ছে করে; মেতে উঠেছে অনেকগুলো পাখি, আমি তাদের সবার নাম জানি না, একটির কণ্ঠ চিনতে পারি, সেটি নিশ্চয় দোয়েলমণি, ওটি অশেষ মত্ত, মনে হচ্ছে জাগিয়ে তুলবে সবাইকে, ওর ডাকে কেঁপে কেঁপে ভোর হচ্ছে। পুব দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠি আমি, পুব আকাশে ওটি কী দেখছি? একশো ওয়াট বালবের মতো জ্বলজ্বল ক’রে জ্বলছে তারাটি,
পৃষ্ঠা-৭১
ওর আলো এসে পড়ছে আমার মুখে? ওটি কী? শিউরে শিউরে উঠি আমি। এটিই কি শুকুতারা? শুত্রগ্রহ? গুকতারা? শুক্রগ্রহ? অনেক শুনেছি এর নাম, কল্পনায় অনেক দেখেছি, কিন্তু কোনোদিন দেখি নি, আজ কি আমি দেখলাম ওকে? আমার ভয়ঙ্কর রাত আমাকে উপহার দিলো একটি তারা? আমার বন্ধ শরীর ঝলমল ক’রে ওঠে, আমার রক্তের ভেতর দিয়ে ভোরের বাতাস বয়ে যায়। একটি ভারা জ্বলতে থাকে আমার ভেতরে।আমার ক্লাশ নেই, তবু ওদিন আমি একটু আগেই আগেই ইউনিভার্সিটিতে যাই; এবং বারান্দায় দেখা হয় আমার ডিরেক্টরের সাথে।তিনি থমকে দাঁড়িয়ে বলেন, ডক্টর শিরিন, আজ আপনাকে এতো ফ্রেশ দেখাচ্ছে!ভয় পাচ্ছিলাম তিনি হয়তো বলবেন আজ আমাকে এভো ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে কেনো? কেনো আমার চোখ লাল হয়ে ফেটে পড়ছে? আমার চোখের নিয়ে এতো কালি জমাট বেঁধেছে কেনো? এতোগুলো উত্তর আমি দিতে পারবো না, না পেরে আমার চোখের নিচে আরো কালি জমবে।আমি হেসে বলি, ভোরবেলা আপনার চোখ এখনো ফ্রেশ আছে ব’লে।তিনি বলেন, না, না, রসিকতা নয়, সত্যিই অদ্ভুত ফ্রেশ দেখাচ্ছে আপনাকে, দাঁড়ান, আপনাকে একটু দেখে নিই।আমার ভেতর দিয়ে এক ঝলক আনন্দ পাহাড়ি ঢলের মতো বয়ে যায়।আমি দাঁড়িয়ে বলি, এই দাঁড়ালাম, দেখুন।আমি যেভাবে দাঁড়িয়েছি তাতে আমি নিজেকে দেখতে পেলে নিজেই মুগ্ধ হতাম, অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকতাম, তারপর বিব্রত হতাম।তিনি বিব্রত হয়ে বলেন, এই জন্যেই আপনার সাথে কথা ব’লে সুখ পাই। আমি বলি, চলুন আমার ঘরে, চা খাবেন; প্রশংসার জন্যে এক কাপ চাআপনার পাওনা হয়েছে।
তিনি বলেন, চলুন, একটি ফ্রেশ মুখ দেখতে দেখতে এক কাপ চা খাই। আমরা আমার ঘরে আসি, কাজের মেয়েটিকে ডেকে গরম পানি আনাই, আমি দু-কাপ চা বানাই।ডিরেক্টরের দিকে এক কাপ চা এগিয়ে দিয়ে আমি বলি, আপনার প্রশংসা শুনতে আজ আমার ভালো লাগছে, আপনার যতোটা ইচ্ছে প্রশংসা করুন, আজ আমার প্রাণভরে প্রশংসা শুনতে ইচ্ছে করছে, ইংরেজি বাঙলা হিব্রু গ্রিক হটেনটট অ্যাস্কিমোতে আমাকে প্রশংসা করুন।তিনি বলেন, আপনার মুখ দেখে আমার প্রেমে প’ড়ে যেতে ইচ্ছে করছে। আমি হেসে বলি, সে তো আপনি অনেক দিন ধ’রেই পড়ছেন, আপনার পড়া দেখতে আমার ভালোই লাগে।তিনি বিব্রত হন, শেষে হেসে বলেন, হ্যাঁ, সেটা ঠিক, কিন্তু আপনার মতো
পৃষ্ঠা-৭২
আগুনের প্রেমে পড়ার সাহস আমার নেই।আগুন? সত্যি? মাটি নই? কাদা নই? ফুল নই? আগুন? বেশ। আমি বলি, প্রেমে পড়তে সাহস লাগে?তিনি বলেন, লাগে না? বউ আছে, ছেলেমেয়ে আছে, মানসম্মান আছে।আমি হেসে বলি, ওহ্, আপনি তো বিয়ের কথা বলছেন, প্রেমের কথা নয়।তিনি বলেন, জানেন ডক্টর শিরিন, মাঝেমাঝে ইচ্ছে করে জীবনটাকে বদলে ফেলি, শেষে আর সাহস হয় না।আমি জিজ্ঞেস করি, ভয়টা কিসের?তিনি বলেন, জীবনটা সত্যিই ভালো লাগছে না, ঘেন্না, লাগছে, তবে আরেকটা প্রথম থেকে শুরু ফরতে হবে ভাবলে ভয় লাগে, আধায় প্রাবনিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করতে পারবো না।আমি বলি, আপনার স্বর শুনে মনে হয় আপনি ম’রে গেছেন।তিনি বলেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই, শুধু আপনার সামনে বসলে একটু বেঁচে উঠি।একটু খোঁচা দিতে ইচ্ছে করে, আমি বলি, আপনার স্ত্রীর সামনে একথাটি বলতে পারতেন?মনে হয় আমার কথা শুনেই তিনি ভয় পাচ্ছেন, স্ত্রীর মুখোমুখি প’ড়ে যাচ্ছেন।তিনি বলেন, তার সামনে? তাহলে তো আমি বেঁচেই থাকতাম।এমন সময় তাঁর পিয়নটি ছুটে এসে বলে, স্যার, আপনার ফোন এসেছে।আমার ফোন শুনলে আমি ছুটে যেতাম, কিন্তু তাঁর চোখেমুখে আমি বিরক্তি দেখতে পাই, তিনি যেনো ফোন ধরতে চান না; হয়তো ফোনে কেউ তাঁকে কিন্ডারগার্টেনে যেতে আদেশ দেবে।তিনি বলেন, ফোনটা এই ঘরে নিয়ে এসো।আমার ইচ্ছে করছিলো ফোনটা আমার হোক, এই সকালে আমাকে কেউ মনে করুক, আমাকে চাক, সে যে-ই হোক, আমার বাইরের কেউ একটু আমার দরকার বোধ করুক, আমার কণ্ঠ শুনতে চাক। আমি ভেতরে ভেতরে কেঁপে কেঁপে বাইরের কারো কণ্ঠ শোনার জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠছিলাম, ফেটে পড়হিলাম, কিন্তু চেপে রাখছিলাম নিজেকে, যেনো ডিরেক্টর আমার ব্যাকুলতার একটি কণাও টের না পান।তিনি ফোন ধ’রে বলেন, ওই, আপনি ভষ্টর শিরিনকে চান; ধরুন, দিচ্ছি। আমি ব্যাকুল হয়ে উঠছিলাম, কিন্তু ডিরেক্টরের কথা শুনে ভেতরটা ধক ক’রে ওঠে, কে হ’তে পারে ভেবে শিউরে উঠি বিব্রত বোধ করি, আবার সুখ লাগে; ডিরেক্টরের দিকে তাকিয়ে আমি স্নানভাবে হাসি, যেনো আমার ফোন আসায় আমি লজ্জিত, এতো সকালে আমার ফোন আসা ঠিক হয় নি।
পৃষ্ঠা-৭৩
তিনি আমাকে ফোনটি দিয়ে বলেন, ডক্টর শিরিন, আপনার ফোন, আপনি কথা বলুন, আমি একটু বাইরে যাবো।ধন্যবাদ, এটাও আমি চেয়েছিলাম, এই ভোরবেলার প্রথম ফোন, ঘ্রাণ না নেয়া প্রথম বেলি ফুলের মতো, আমি কাউকে সামনে বসিয়ে রেখে কথা বলতে পারবো না, আমার ভেতর থেকে কথা বেরোবে না, ঘাম লেগে ফুল ময়লা হয়ে যাবে; ভেতর থেকে আমার ঠিক শব্দটি ঠিক ধ্বনিটি ঠিক অর্থটি বেরোবে না, আমি ভাববো এক কথা বেরিয়ে আসবে আরেক কথা, ভাবনা আর কথার গোলমালে আমি ভেঙে পড়বো।
তিনি বেরিয়ে যান কে হ’তে পারে কে হ’তে পারে ভাবতে ভাবতে আমি ফোন ধ’রে বলি, হ্যালো।শুনতে পাই এক প্রচণ্ড ঝড়ের দাপাদাপি, কালবোশেখি, হ্যালো, ডক্টর শিরিন আমি খালেদ বলছি, আমাকে কি আপনি চিনতে পারছেন? চিনতে পারছেন আমাকে? আমি খালেদ, সেই যে আমাদের দেখা হয়েছিলো কমলগঞ্জে, আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন?কমলগঞ্জ? সেটি কোথায়? কখন আমি গিয়েছিলাম সেখানে? আমি কিআসলেই গিয়েছিলাম?এই ভোরবেলা এতো ঝড়? আমি কি এই ফোন চেয়েছিলাম? এই ফোন আসাতে আমি কি বিরক্ত? আমি কি এই কন্ঠস্বর এই ঝড়ের প্রবাহ শুনে সুখ পাচ্ছি? এটা কি আমার ভেতরের কোনো অভাব পূরণ করছে?আমি কি চিনতে পারছি ভদ্রলোককে? তাঁর মুখটি কেমন? চুল কেমন? আঙুলগুলো কেমন? আমি কি চিনতে পারছি?আমি বলি, হ্যাঁ, পারছি, আপনি কেমন আছেন?হাহাকার শুনতে পাই, আমি ভালো নেই, জানেন আমি ভালো নেই।শুনে আমার ভালো লাগে; যদি বলতেন ভালো আছেন, তাহলে তাঁর সাথে কথা বলতে হয়তো আমার ইচ্ছে হতো না; যারা ভালো আছে, তাদের সাথে আমার কিসের সম্পর্ক? আমার সম্পর্ক হাহাকারের সাথে।আমি বলি, আমি তো ভেবেছিলাম আপনি ভালো আছেন, সুখে আছেন।তিনি বলেন, আপনি কী ক’রে ভাবতে পারলেন আমি ভালো থাকবো? এটা আপনি কী ক’রে ভাবডে পারলেন?তাঁর হাহাকার ঢেউয়ের মতো এসে আমার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে।
পৃষ্ঠা-৭৪
মতো, মধ্যরাতের মাতালের মতো খারাপ। মানুষকে কেনো শুধু ভালো থাকতে হবে সব সময়? কেনো তাকে সব সময় ঠিক সময়ে ঘুমোতে হবে? সব সময় ঠিক সময়ে জাগতে হবে? ঠিক মতো চুল ছাঁটাতে হবে? ঠিক মতো জুতো পরতে হবে? তার পোশাকের ভাঁজ কেনো ঠিক থাকতে হবে সব সময়? কেনো এলোমেলো হবে না।আমি হেসে বলি, ব্রেকফাস্ট করেছেন? তিনি বলেন, হ্যাঁ, করেছি। আমি বলি, চা খেয়েছেন? তিনি বলেন, হ্যাঁ, খেয়েছি। আমি বলি, শেভ করেছেন? তিনি বলে, হ্যাঁ, করেছি। আমি বলি, চুল ব্রাশ করেছেন? তিনি বলেন, হ্যাঁ, করেছি। আমি বলি, জুতোর ফিতে বেঁধেছেন? তিনি বলেন, হ্যাঁ, বেঁধেছি। আমি বলি, ঠিক সময়ে অফিসে পৌচেছেন? তিনি বলেন, হ্যাঁ, পৌঁচেছি। আমি হেসে বলি, তাহলে আপনি খারাপ আছেন কোথায়? সবই তো ঠিক আছে, খুবই তো চমৎকার আছেন।তিনি বলেন, না, এগুলো দিয়ে বোঝা যাবে না আমি কতোটা খারাপ আছি।আমি হাসি, কী দিয়ে বোঝা যাবে? তিনি বলেন, আমার ভেতরটা যদি দেখতেন, তাহলে বুঝতেন আমি কতোটা খারাপ আছি।আমি হেসে বলি, ওটা কি পড়া ব্যাঙের মতো হয়ে গেছে?তিনি বলেন, ভক্টর শিরিন, আমি কখনো এতো খারাপ থাকি নি। পচা ব্যাঙওআমার থেকে ভালো আছে।সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়ে ভদ্রলোক ভালো খেলোয়াড়, খেলতে জানেন।আমি বলি, সত্যি?তিনি বলেন, হ্যাঁ, কী যে খারাপ আছি।আমি জিজ্ঞেস করি, আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে?তিনি বলেন, আত্মহত্যা? সেটাকেও তুচ্ছ মনে হয়।আমি হেসে বলি, তাহলে ক’রে ফেলুন না একবার।তিনি বলেন, হয়তো করবো, তার আগে আপনার সাথে একটু দেখা করতে চাই, প্লিজ আমাকে একটু সময় দিন।
পৃষ্ঠা-৭৫
অদ্রলোক কি আঠারো তলার ছাদের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন? দাঁড়িয়ে খুব কাঁপছেন? ধরার মতো কিছু নেই? একটু বাতাসেই প’ড়ে যাবেন? তাঁর আর সময় নেই? তাই তিনি সময় মাগছেন আমার কাছে? আমার হাতে মহাকাল? অনন্ত সময়? দেবো? দিয়ে কী হবে? কাউকে আমার সময় দিতে ইচ্ছে করে না, কারো কাছে সময় চাইতেও ইচ্ছে করে না। প্রত্যেকের জীবন নিজের, দেখাশোনা করতে হবে নিজেকেই।
আমি বলি, আপনার নিশ্চয়ই অনেক কাজ আছে, এখন রাখি।তিনি বলেন, প্লিজ আপনি রেখে দেবেন না, আমার আর কোনো কাজ নেই, সব কাজ আমার নিরর্থক মনে হয়, আপনার সাথে আমার অনেক কথা আছে, প্লিজ ফোন রেখে দেবেন না।কাতর হাহাকার শুনতে পাই ওপার থেকে, আমার হাসি পায়, কষ্ট লাগে, ভালো লাগতে থাকে, এমন হাহাকার আমি কখনো শুনি নি, শুনলেও ভুলে গেছি, পদ্মার ঝড়ের মধ্যে নৌকো ডুবছে এমন মাঝির হাহাকার শুনি আমি, হাহাকার মধুর লাগে, মনে হয় সারাদিন হাহাকার শুনে যেতে পারবো।আমি ঠাপ্ত স্বরে বলি, বলুন।আমি ঠান্ডা করতে চাই নি আমার স্বরকে, কিন্তু ওটি নিজে নিজেই এমন শীতল হয়ে যায় যে আমার স্বর শুনে আমি নিজেই শীতল হয়ে যাই। আমি হ’লে আর কথা বলতাম না, ফোন রেখে দিয়ে স্তব্ধ হয়ে ব’সে থাকতাম।তিনি বলেন, ভয় হচ্ছে আপনি ফোন রেখে দেবেন, তাই ফোনে আমি সব কথা বলে উঠতে পারবো না।আমি হেসে বলি, ভয় না পেয়ে আপনার কথা বলুন।তিনি বলেন, আমি আপনার সাথে একটু দেখা করতে চাই, আপনার সাথে আমার অনেক কথা আছে।তাঁর কথা শুনতে আমার ভালো লাগে; আমার জন্যে কেউ হাহাকার করছে, অনেক দিন হাহাকার গুনি নি, আরো হাহাকার শুনতে আমার ইচ্ছে করে, আমি প্রবল নিবিড় অনন্ত বিষাদময় হাহাকার শুনতে চাই।হাহাকার কেনো আমার ভালো লাগে? কেনো মানুষ হাহাকার করে? আমি বলি, ফোনেই বলুন। তিনি বলেন, সেই থেকে অস্থির হয়ে আছি, আমার জীবন বদলে গেছে।চমকে উঠি আমি কথাটি শুনে, জীবন বদলে গেছে? প্রথম ভদ্রলোকের জন্যে আমার ভয় লাগে, যেভাবে হাহাকার করছেন তাতে মনে হচ্ছে তিনি পাতালে প’ড়ে গেছেন, সেখানে খুব অন্ধকার, তিনি কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না, আলো বুজছেন। পরে মনে হয়- বদলে গেছে, বেশ হয়েছে, জীবন এমন কী অক্ষয় অব্যয় অজর জিনিশ যে বদলাবে না? যদি বদলে গিয়ে থাকে, তাহলে বদলাক; সেখানে আরেকটি জীবন দেখা দেবে। আমার ভালো লাগে, এমন বড়ো কিছু তো হয় নি, একটি জীবন শুধু বদলে গেছে।
পৃষ্ঠা ৭৬ থেকে ৯০
পৃষ্ঠা-৭৬
আমার একটু মধুর পীড়ন করতে ইচ্ছে করে, মনে হয় নখগুলোতে একটু মধু মেখে হৃৎপিণ্ডের ভেতরে ঢুকিয়ে দিই।আমি বলি, কীভাবে বদলে গেলো?তিনি বলেন, আমি আর আগের জীবনে স্থির হ’তে পারছি না, আপনার সাথে আমার অনেক কথা আছে, প্লিজ আমাকে একটু সময় দিন।স্থির হ’তে পারছেন না? বেশ। তিনি স্থির হ’তে চান? আমি তাঁকে স্থিরতা দেবো? কেনো? অস্থির হওয়ার সময় তো তাঁর ভেবে দেখা উচিত ছিলো কিনি অস্থিরতা সহ্য করতে পারবেন কি না।আমি বলি, কেনো, অস্থির হওয়ার কী আছে?তিনি বলেন, অস্থির হবো না? আপনার সাথে দেখা হওয়ার পর কি আর স্থির থাকা সম্ভব? জীবন কি আগের মতো আর থাকতে পারে?আমার ভালো লাগে, ভদ্রলোক হয়তো বানিয়ে বলছেন, তবু তো আমার কথা ভেবে তাঁকে বানিয়ে বলতে হচ্ছে, ভালো লাগছে আমার। আমার সাথে দেখা হ’লে মনে অস্থিরতা জাগে? রক্তমাংস জীবন কেঁপে কেঁপে ওঠে?আমি বলি, জানেন, আমার সাথে প্রতিদিনই অনেকের দেখা হয়। তিনি বলেন, হ্যাঁ, তা জানি।আমি বলি, তাদের জীবন কি অস্থির হয়ে যায়, বদলে যায়?তিনি বলেন, আমার সাথে আপনার যেভাবে দেখা হয়েছে সেভাবে তাদের দেখা হ’লে তাদের জীবনও বদলে যেতো।যেভাবে দেখা হয়েছে। অন্যদের সাথে আমার সেভাবে দেখা হয় নি, তাঁর সাথেই শুধু আমার দেখা হয়েছে এমনভাবে যাতে জীবন বদলে যায়। দেখা হওয়ার নানা রূপ আছে, কোনো কোনো দেখা হওয়ায় কিছুই ঘটে না, আবার কোনো কোনো দেখা হওয়ায় জীবন বদলে যায়। আমার ভেতরে একটু মেঘ জ’মে ওঠে, আমার সারাদিন ধ’রে কথা বলতে ইচ্ছে করে, মনে হয় সারা দিনরাত হাহাকার শুনি; আমার সারা ভূমণ্ডলের হাহাকার শুনতে ইচ্ছে করে, আমি চাই সূর্যটা এসে পা মুড়ে ব’সে হাহাকার করুক আমার সামনে।আমি বলি, সব ঠিক হয়ে যাবে, এটা এমন কিছু নয়।তিনি বলেন, না, ঠিক হবে না।ঠিক হবে না? আমার হাসি পায়, আমি জানি সব ঠিক হয়ে যাবে।আমি বলি, আমার একটু কাজ আছে, এখন রাখি।তিনি বলেন, আমি আগামীকাল ফোন করবো।আমি কোনো কথা বলি না। আমার খারাপ লাগে যে আমি ফোন রাখতে চেয়েছি, আর তিনি তাতে রাজি হয়ে গেছেন। আমি না হয় রাখতে চেয়েছি, কিন্তু তিনি তাতে রাজি হবেন কেনো? ভাহলে তিনি খারাপ আছেন কোথায়? আমি যদি খারাপ থাকতাম, তাহলে ফোন রাখতে দিতাম না, অনন্তকাল ধ’রে আমার
পৃষ্ঠা-৭৭
হাহাকার শোনার জন্যে ধ’রে রাখতাম। আমি খারাপ আছি, আমি হাহাকার করতে চাই, আর তা কেউ শুনতে চাইবে না কেনো?তিনি বলেন, এই একটা দিন যে আমার কী ক’রে কাটবে!গুহ্, তাঁর একটি দিনের সমস্যা, মাত্র একটি দিনের ভার বহনের ক্লান্তি, একটি দিন কেটে গেলে তিনি ভারমুক্ত হয়ে আকাশে উড়বেন।আমার একটু পীড়ন করতে ইচ্ছে করে, আমি বলি, আপনার স্ত্রীকে নিয়ে কক্সবাজারে বেরিয়ে আসুন না, জীবনটা ভালো কেটে যাবে।তিনি আঘাত খেয়ে কাৎরে ওঠেন, বলেন, না, না, তা আর আমি পারি না, তাকে নিয়ে বেরোনোর কথাও আমি আর ভাবতে পারি না।আমি বলি, কেনো পারেন না?তিনি বলেন, আর সুখ পাবো না, নিজেকে ঘৃণা করতে ইচ্ছে হবে।আমি বলি, কেনো, তার কী অপরাধ?তিনি বলেন, আপনি আমাকে এভাবে কষ্ট দেবেন না। না, তার আর কী অপরাধ, অপরাধ সবই আমার।আমি বলি, আপনি কি মনে করছেন অপরাধ কিছুটা কি আমারও?তিনি বলেন, না, আপনার কোনো অপরাধ নেই, অপরাধ সবই আমার।আমি বলি, তাহলে চুপচাপ দওটা ভোগ করাই কি ভালো নয়?তিনি বলেন, তা-ই চেয়েছিলাম, কিন্তু পারছি না, শুধু আপনাকেই মনে পড়ে, আমাকে একটু সময় দিন, আপনার সাথে আমি দেখা করতে চাই।আমি ফোন রেখে দিই, রেখে দিয়ে আর ঘরে বসতে ইচ্ছে করে না; নিঃশব্দহাহাকার শুনতে শুনতে আমি পাঠাগারে যাই, বই খুঁজতে থাকি, শেজের ভেতর থেকে হাহাকার বেরিয়ে আসতে শুনি, শুনে আমার সুখ লাগে, শুনে আমার ঘেন্না লাখে। এখানে ব’সে আমি পড়তে পারবো না, আমি বই বাছি, একপাশে দেখি কয়েকটি রচনাবলি প’ড়ে আছে, আমি অবাক হই। বাঙলা সাহিত্য এখানে? এই ইংরেজি এনজিও অসরকারিতে বাঙলা? আমি শরৎ-রচনাবলিটি টেনে নিই, আমার উপন্যাস পড়তে ইচ্ছে করে, পুরোনো উপন্যাস, যেগুলো অনেক আগে প’ড়ে কেঁপে উঠেছিলাম। বইগুলো ইস্যু ক’রে বেরিয়ে পড়ি, বাসায় যেতে হবে, যেতে যেতে হাহাকার শুনতে থাকি, ভালো লাগে, ঘেন্না লাগে, আমার ঘুম পায়; বাসায় ঢুকে বই আর ব্যাগটা রেখে আমি বিছানায় এলিয়ে পড়ি।তাহলে আমি ঘুমোতেও পারি যেমন পারি জেগে থাকতে? ঘুমও আমার জেগে থাকাও আমার? ঘুম থেকে উঠে দেখি সন্ধ্যে হয়ে এসেছে, কিন্তু আমার মনে হয় ভোর হলো, মাকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে রুটি তৈরি হয়েছে কি না, ইস্কুলে যাবো। আমি কি মাকে ডাকবো? আমার ব্যাগ কোথায়? বই কোথায়? ভাড়াতাড়ি উঠে মাকে ডাকতে গিয়ে মনে পড়ে আমি আর ইস্কুলে পড়ি না, ব্যাগে বই নিয়ে আমাকে ইস্কুলে ছুটতে হবে না, আর এখন কোর নয়, সন্ধ্যা
পৃষ্ঠা-৭৮
হ’তে যাচ্ছে। ইস্কুলে যদি ছুটতে পারতাম খুব ভালো লাগতো, কিন্তু এখনো আমার খারাপ লাগছে না, খুবই ভালো লাগছে, হাল্কা মনে হচ্ছে নিজেকে; কিশোরীর মতো একটু দৌড়োদৌড়ি করি এ-ঘরে ও-ঘরে, শাড়ি ব্লাউজ সায়া বন্ধনি ছুঁড়ে ফেলে মেঝেতে দাঁড়িয়ে একটু নাচি, সেই কবে নাচতে শিখেছিলাম তার কয়েক কণা ঝিলিক দিয়ে ওঠে আমার শরীরে, দেখি আমার কোমর এখনো বেশ বাঁকে, এবং মনে পড়ে দুপুরে আমি কিছু খাই নি, কিন্তু ভাতের ক্ষুধা আমার পায় নি, পেয়েছে চায়ের ক্ষুধা, হ্যাঁ, তৃষ্ণা নয়, ক্ষুধা, আমি চা বানানোর জন্যে পানি বদাই চুলোর ওপর, আর হাহাকার শুনতে পাই। চা বানিয়ে মেঝের ওপর পদ্মাসনে ব’সে বিস্কুট চুবিয়ে চুবিয়ে চা খেতে থাকি, গলা বিস্কুট জিভ আর টাকরার মাঝখানে অনেকক্ষণ চেপে রাখতে রাখতে খাই, হাহাকার শোনার চেষ্টা করি, কেঁপে উঠি একটু, এবং আমার হাসি পায়- স্ত্রীকে আর ভালো লাগছে না ভদ্রলোকের, তাতে তিনি হয়তো আর স্বাদ পাচ্ছেন না, তাই হাহাকার।তাঁর জীবন বদলে গেছে? আমার জীবন বদলে গেছে- অন্নলোকের কথাটি হঠাৎ আমার মনে পড়ে, শোনার সময় এর অর্থ সবটা বুঝতে পারি নি, চায়ে বিস্কুট ভিজিয়ে খেতে খেতে অর্থটি স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে, ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে একটি ভয়ানক অর্থ। অর্থটি আমাকে রাগিয়ে তোলে, দুঃখ দেয়; আমরা কতো ভিন্ন কতো বিপরীত। তাঁর জীবন বদলে গেছে, তার মানে তিনি নিজে বদলে দেন নি, বদলে দিতে তিনি চান নি, যেনো নিজে নিজে তাঁর জীবন বদল করেছে নিজেকে, অর্থাৎ আমি বদলে দিয়েছি তাঁর জীবন; নইলে সেটা আগের মতো শান্ত শিষ্ট ভদ্র নম্র মধুর থাকতো; স্ত্রীকে নিয়ে বেড়াতে যেতেন, নিয়মিত পিল খাওয়ার কথা মনে করিয়ে দিতেন, শাড়ি কিনে আনতেন, ওই চমৎকার জীবনটা বদলে দিয়েছি আমি; তাই আমাকে নিতে হবে তাঁর জীবন বদলে যাওয়ার দায়ভার। তিনি জীবন বদলে দেন নি, তাঁর জীবনটা বদলে গেছে, বদলে দেয়ার কাজটি করেছি আমি, আমি অপরাধ করেছি।একটি সুবোধ বালকের সম্ভাবনাপূর্ণ জীবনটা নষ্ট ক’রে দিয়েছি আমি। আমার হাসি পায়, সুবোধ বালক।আহা, দশম শ্রেণীতে ফার্স্ট হয়ে উঠেছিলো বালকটি, বই ছাড়া আর কোনো দিকে তাকাতো না, নীল কাগজে একটা চিঠি ছুঁড়ে তাকে নষ্ট ক’রে দিয়েছে পাশের বাসার দুই মেয়েটি।ভাতে বদলে গেছে অমূল্য জীবনটা, ভীষণ ক্ষতি হয়ে গেছে বিশশতকের। আমার জীবনটা? আমি তো মনে করেছি আমিই বদলে দিয়েছি আমার জীবন, আমি না বদলালে কেউ আমার জীবন বদলে দিতে পারতো না; বদলে দিয়েছি ব’লে কারো কাছে হাহাকার করতে যাই নি, মনে করি নি আমার জীবন বদলে যাওয়ার দায়ভার বইতে দেবো অন্য কাউকে। আমার জীবন আমার, এর বদলও আমার, এর তারও আমার, এর ভালো থাকাও আমার, খারাপ থাকাও আমার; এর আজ ও আগামীকাল আমার, এর বোশেখ আমার জ্যৈষ্ঠ আমার।
পৃষ্ঠা-৭৯
আমার জীবন বদলে দিয়েছি আমি, ভাই আমার জীবন বদলে গেছে; তাঁর জীবনটা তিনি বদলান নি, বদলিয়েছে অন্য কেউ, যে বদলে দিয়েছে তার কাছে এখন তিনি অভিযোগ আর আবেদন নিয়ে হাজির হয়েছেন। সম্ভবত এখন তাঁকে উদ্ধার করতে হবে। আমি কেনো তাঁকে আমার সাথে ঘুমোতে দিলাম? আমি কি তাঁকে ঘুমোতে দিয়ে অপরাধ করি নি? তাতে যে তাঁর সুন্দর জীবনটা বদলে গেছে, নইলে এখন তিনি সুখে স্ত্রীর সাথে ঘুমোতে পারতেন। এখন হয়তো আর স্ত্রীকে চুমো খেতে ইচ্ছে করে না, জড়িয়ে ধ’রে আর আগের মতো সুখ পান না। আমি আর তাঁর হাহাকার শুনতে পাই না, কারো হাহাকার আমার শুনতে ইচ্ছে করে না; আমি আরেক কাপ চা বানাই, পদ্মাসনে ব’সে চা খেতে খেতে একটি নতুন লেখার কথা ভাবতে থাকি।পরদিন আমি বেশ দেরি ক’রে ইউনিভার্সিটিতে যাই; ক্লাশ নেই, শুধু একটু হাজিরা দেয়া, এতোগুলো টাকা দেয়, আর একটু আড্ডা দেয়া।দেরি ক’রে কেনো গেলাম? জানি না, হয়তো জানি। আমি কি এড়াতে চাই কাউকে? এড়ানোর কী আছে? ভদ্রলোক ফোন করবেন, হাহাকার করবেন, আমার শুনতে ইচ্ছে করবে না, ওগুলোকে শূন্যগর্ভ মনে হবে; আবার হয়তো ইচ্ছে করবে শুনি, দেখি করো রকমের হাহাকার আছে পৃথিবীতে। এটা আমি এড়াতে চাই? এড়িয়ে কী হবে? এটা আমি শুনতে চাই? শুনে কী হবে?গিয়েই শুনি ফোন এসেছিলো, দু-তিনবার, আমার ভয় হয় আবার আসবে, আবার মনে হয় আসুক না, কী হবে ফোন এলে? আসুক, বা না আসুক, তাতে আমার কিছু আসে যায় না; এর ওপর আমার কোনো হাত নেই। আমি ব’সে একটি বইয়ের পাতা উল্টোতে থাকি, ভেতরে ভেতরে বলতে থাকি- আসুক না, ফোন যদি আসেই, তাহলে এখনই আসুক না, দেরির কী দরকার।আমার দরোজায় নক হয়; আমি বলি, কাম ইন, প্লিজ।কে আসতে পারে? অভাবিত কেউ? নকটাকে চেনা আর অচেনা মনে হয়। দেখি দরোজা ঠেলে ঢুকছে দেলোয়ার।আমি হেসে উঠে দাঁড়াই, এটা আমার অভ্যাস, একটু চমকে একটু উচ্ছ্বসিত হয়েই বলি, তুমি?দেলোয়ারকে দেখে আমার ভালোই লাগে; আমি চাই নি সে আসুক, তবু সে এসেছে, বেশ, আসুক।দেলোয়ার বলে, হ্যাঁ, এলাম।যেনো এক পরিচিত এসেছে, বন্ধু এসেছে, তাকে দেখে আমার খুশি লাগছে, সেই খুশিটা আমার হাসিতে লেগে আছে; আমি বলি, বসো।দেলোয়ার বলে, তোমাকে ফোন ক’রে পাই না, রেস্টহাউজে গিয়ে শুনি তুমি সেখানে নেই।দেলোয়ারের কন্ঠ বলছে আমি অপরাধ করেছি, আমাকে যেমন সহজে পাওয়া শর্তসম্মত ছিলো, সেটা আমি ভঙ্গ করেছি।
পৃষ্ঠা-৮০
আমি ঠাক্স স্বরে বলি, হ্যাঁ, ওটা ছেড়ে দিয়েছি।দেলোয়ার বলে, তোমাকে নিয়ে যেতে এলাম।বাহ, আমি যেনো গোসা ক’রে ঠোঁট ফুলিয়ে বাপের বাড়ি চ’লে এসেছি, আমার স্মৃতির এতোদিন সময় হয় নি, ভেবেছিলেন আমি নিজেই একদিন তাঁর পায়ে ফিরে গিয়ে কেঁদেকেটে মাফ চাইবো, সেটা হচ্ছে না দেখে তিনি দয়া ক’রে তাঁর পরিবারকে নিতে এসেছেন; এবং আমাকে এখনই ঘোমটা মাথায় দিয়ে তাঁর পেছনে পেছনে হাঁটতে হবে।আমার ইচ্ছে করে একটু রেগে উঠি, কিন্তু আমি স্নিগ্ধ থাকি।আমি বলি, চা খাও।কাজের মেয়েটিকে ডেকে পানি আনাই, চা বানিয়ে এক কাপ দেলোয়ারের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে হেসে বলি, তুমি দেখতে বেশ সুন্দর হয়েছো।দেলোয়ারকে আমার সব সময় ভালোই লাগে, আজো লাগে; ওকে প্রশংসা করতেও আমার ভালো লাগে, দেলোয়ারও মনে করে প্রশংসা তার সব সময়ই প্রাপ্য, এবং আমারও এটা অভ্যাস হয়ে গেছে।সেলোয়ার চা খেতে গিয়ে পিরিচে চা ফেলে দেয় একটু, আমি টিস্যুলেশার দিয়ে পিরিচটি মুছে আবার চায়ের কাপটি এগিয়ে দিই তার দিকে। কেউ ময়লা পিরিচে কাপ রেখে চা খাচ্ছে দেখতে আমার ভালো লাগে না।দেলোয়ার বলে, আমি তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি।আমি বলি, বেশ করেছো।দেলোয়ার বলে, চলো আমার সাথে।আমি বলি, তুমি তো জানো আমি যাবো না।দেলোয়ার বলে, কেনো যাবে না? আমি হেসে বলি, এমনিই। দেলোয়ার বলে, তোমার ক্লাশ আছে?আমি বলি, না।দেলোয়ার বলে, তাহলে চলো, বাসায় যাই।আমি বলি, তুমি যাও।আমি চুপ ক’রে ব’সে থাকি, আমার কথা বলতে ইচ্ছে করে না; তার এই টানাটানি আমার ভালো লাগে না। দেলোয়ার কেনো বুঝতে পারছে না গেলে আমি যেতাম, উড়ে যেতাম, আমাকে টানতে হতো না?দেলোয়ার বলে, তুমি এখন কী করবে?আমি বলি, এখন যাবো।দেলোয়ার বলে, আমার সাথে চলো।আমি বলি, না।দেলোয়ার বলে, তাহলে আমি তোমার সাথে যাবো।
পৃষ্ঠা-৮১
এ-ভয়টা আমার ছিলো, আমি তার সাথে যেতে চাইবো না, সে আমার সাথে যেতে চাইতেও পারে; তখন আমি কী করবো? আমি সোজা নেমে গিয়ে একটি বেবি নেবো, একটু ঘুরে এপথ সেপথ দিয়ে যাবো, সে গাড়ি ক’রে পেছনে পেছনে আসতে আসতে এক সময় আমাকে হারিয়ে ফেলবে? কেমন লাগবে আমার? এই পালানো? এই অনুসরণ? ভালো লাগবে না। দেলোয়ারকে আমার ফ্ল্যাটে আমি নিতে চাই না? হয়তো তাই; তবে সে আসতেও পারে, ব’সে আমার সাথে চাও খেতে পারে, গল্পও করতে পারে; কিন্তু আর আগের মতো নয়। সে আসতে চাইবে হাজব্যান্ড হিশেবে, কিন্তু আমি যে জীবন বদলে দিয়েছি, আমি হাজব্যান্ড চাই না। আমি লুকোচুরি ক’রে থাকতে চাই না, পালিয়ে থাকতে চাই না, শুধু বদলানো জীবনে থাকতে চাই।
আমি বসা থেকে উঠতে উঠতে বলি, আমি যাচ্ছি। দেলোয়ার বলে, আমিও তোমার সাথে যাবো।আমি বলি, না।দেলোয়ার বলে, আমি যাবো।দেলোয়ার আমার সাথে সাথে পেছনে পেছনে নামে, আমি রাস্তায় এসে বেবির জন্যে দাঁড়াই।আমি বলি, তুমি যাও।দেলোয়ার বলে, আমি তোমার সাথে যাবো।দেলোয়ারের গাড়িটা দেখছি না, গাড়িটাকে, গাড়ির রঙটাকে একবার আমার দেখতে ইচ্ছে করে, আমি এদিক ওদিক তাকাই।জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে না, তবু জিজ্ঞেস করি, তোমার গাড়ি কই? দেলোয়ার বলে, গাড়িটা তো আমার নয়, তাই আনি নি; পরের গাড়িতেচড়তে ইচ্ছে করে না।আমি বলি, যার, তার কাছে পাঠিয়ে দিলেই পারো।আমি ভেবেছিলাম দেলোয়ার বলবে, দেবো; কিন্তু সে কোনো কথা বলে না। একটি বেবি এলে আমি হাত তুলে থামাই, বেবিতে উঠি; দেলোয়ারও ওঠারউপক্রম করে।আমি বলি, ভূমি উঠো না।দেলোয়ার বলে, না, আমি যাবোই। আমি বলি, জোর ক’রে যাওয়া কি তোমার ঠিক হবে? দেলোয়ার বলে, জোর ক’রেই যেতে হবে। একটি দৃশ্য হয়তো অভিনীত হবে আমার ইউনিভার্সিটির সামনের রাস্তায়, তাআমি চাই না।আমি বলি, আচ্ছা, চলো।এ কেমন যাত্রা, মনে হয় আমি এক অচেনা মানুষের পাশে ব’সে আছি, এমন
পৃষ্ঠা-৮২
অচেনা মানুষ, যার দিকে আমার তাকাতেও ইচ্ছে করছে না; অথচ আগে যখন আমরা একসাথে বেবিতে উঠতাম, আমাদের উল্লাস বেবির শব্দকেও ছাপিয়ে উঠতো। দেলোয়ার আমার একটি হাত টেনে নিতে চায় তার হাতের ভেতরে, আমার হাতটা নিজে নিজে স’রে আসে। সে আমার গ্রীবা টেনে চুমো খেতে চায়, সে জায়গাটি জানে, সে হয়তো ভেবেছে বেবির ভেতরেই আমি গ’লে গ’লে ওয়ে পড়বো, চোখ বুজে আসবে; আমি দূরে স’রে যাই।আমি বলি, তুমি না এলেই ভালো করতে।দেলোয়ার বলে, কেনো আসবো না?আমি বলি, দিন দিন তুমি আমার চোখে স্নান হয়ে উঠছো।দেলোয়ার বলে, তুমি কি কারো সাথে প্রেম করছো?আমার ঘেন্না লাগে, ইচ্ছে করে তাকে ঠেলে ফেলে দিই; তার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি একটি কুষ্ঠরোগীর মুখ দেখতে পাই।আমি বলি, করলে তোমাকে বলবো কেনো?দেলোয়ার বলে, শুনেছি এখানে লাভ আর লাভমেকিংই বেশি হয়।বেবি এসে বাড়ির সামনে থামে; আমি বলি, তুমি চ’লে যাও।দেলোয়ার বলে, না।আমার সাথে সাথে সে ওপরে ওঠে, ভেতরে ঢোকে; ঢুকেই আমাকে জড়িয়েধ’রে চুমো খেতে চায়, নগ্ন করতে চায়। এর জন্যে আমি প্রস্তুত ছিলাম, জানতাম সে আমাকে উপভোগ ক’রে অধিকার করতে চাইবে; সে আমার দুর্বলতাগুলো আর দুর্বল স্থানগুলো চেনে, পাঁচ বছর ধ’রে আমিই ওগুলো তাকে চিনিয়ে দিয়েছিলাম, আজ সেগুলো কাজে লাগাতে চাইবে।আমি ধাক্কা দিয়ে তাকে সরিয়ে দিয়ে বলি, দ্যাখো, তোমাকে আমি চুম্বন আলিঙ্গনের জন্যে নিয়ে আসি নি।তার মুখটি কি কোনো জন্ত্রর মুখের মতো দেখালো? আমি একবার চোখ বন্ধ ক’রে আবার তাকাই, মানুষের মুখ দেখতে চাই।দেলোয়ার বলে, তাহলে কাকে নিয়ে আসো?ঘেন্নায় আমি স্তব্ধ হয়ে যাই, বলি, তা তো তোমাকে আমি বলবো না।দেলোয়ার বলে, তুমি একটা নষ্ট মেয়েলোক।আমি বলি, তুমি যদি মনে করো, তাহলে তাই।দেলোয়ার বলে, এজন্যেই তুমি বাসা ভাড়া নিয়েছো।আমি বলি, তুমি ঠিক বুঝেছো।দেলোয়ার বলে, পুরুষের গায়ের গন্ধ ছাড়া তুমি সময় কাটাচ্ছো, তা কি তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে বলো? তোমাকে আমি চিনি না?আমি বলি, হ্যা, পুরুষ ছাড়া আমার চলে না; পেটিকোটের নিচে ডজনখানেক পুরুষ সব সময়ই আমি ঝুলিয়ে রাখি।
পৃষ্ঠা-৮৩
দেলোয়ারকে যদি খাড় ধ’রে বের ক’রে দিতে পারতাম! আমি তা পারি না, কাউকেই আমি কখনো খাড় ধ’রে বের ক’রে দিতে পারবো না; গাড় ধ’রে ওকে বের ক’রে দিতে আমার খুবই খারাপ লাগবে, ও আমার একদিন খুব কাছের ছিলো, ভেতরের ছিলো, আমার নগ্ন দেহ ও অজস্রবার উপভোগ করেছে, ওকে উপভোগ করতে দিয়ে সুখ পেয়েছি; আর ও আমার থেকে শক্তিমান, আমার লিঙ্গের এই দুর্বলভাটি আমার আছে, আমাকে সে ধর্ষণ করতে পারে।সে সারা ফ্ল্যাট ঘুরে দেখে এসে বলে, বেশ সাজিয়েছো, বেশ সুখেই আছো। আমি বলি, হ্যাঁ, আছি।দেলোয়ার বলে, সে কখন আসে?আমার আর ইতরামে সহ্য হয় না, তার সাথে ইভরামো করতেও ইচ্ছে করে না, নইলে বলতাম, এখনিই আসবে; মনে হয় নোংরা ক’রে ফেলছি নিজেকে, আমার ফ্ল্যাট ভ’রে আবর্জনা ছড়িয়ে পড়ছে, উপচে পড়ছে ফলমূত্র।আমি বলি, আমার খেতে হবে, চাইলে তুমিও খেতে পারো।দেলোয়ার বলে, হ্যাঁ, খাবো।খাওয়ার কিছুই নেই, দুপুরেও আমি জেলি মেখে টোস্ট করা দু-টুকরো পাউরুটি আর এক কাপ চা খাই, আজো ভাই আছে। কয়েক দিন ধ’রে এভাবেই চালাচ্ছি, ভালোই লাগছে, যখন খারাপ লাগবে পোলাও রান্না ক’রে ফেলবো। আমি টোস্টারে কয়েক টুকরো পাউরুটি সেকি, প্লেটে সাজিয়ে এনে খাবার টেবিলে বাখি; কুটানি জেলির বইয়মটি টেবিলেই রাখা ছিলো, ব’সে সেটি থেকে টোস্টে জেলি মাখি, কেটলি অন ক’রে দিই। একটি প্লেটে দেলোয়ারের জন্যে তিনটি টোস্ট, আমার প্লেটে দুটি টোস্ট। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলো, যা সে অনেক দিন দেখেছে, কিন্তু কখনো দেখে নি।আমি বলি, বসো, খাও।দেলোয়ার বলে, তুমি এই খেয়ে বেঁচে আছো না কি?আমি বলি, সুখে থাকলে বেশি খেতে হয় না।দেলোয়ার বলে, এর চেয়ে চলো বাইরে খেয়ে আসি।আমি বলি, তুমি আর কাউকে নিয়ে গিয়ে খাও।দেলোয়ার বলে, তুমি ভো অন্য কাউকে নিয়ে খাচ্ছো।আমি বলি, হ্যাঁ, খাচ্ছি।খেতে খেতে ভাবি আরেকটা আক্রমণ আসবে, দেলোয়ার অধিকার করতে চাইবে আমাকে, আমার দেহটিকে, ফেভাবে কয়তে চাইবে সেটা হবে বলাৎকার; আমি তা হ’তে দেবো না। দেলোয়ার খাচ্ছে, আমি মাঝেমাঝে তার মুখের দিকে তাকাই; তার মুখে ঝলকে ঝলকে তার আগের মুখটি দেখতে পাই আমি, সে- মুখটির জন্যে আমার মায়া হয়; আবার আরেকটি মুখ দেখি, যেটি মানুষের মুখ নয়, সেটি আমাকে অসুস্থ ক’রে তোলে।
পৃষ্ঠা-৮৪
তার দিকে চা এগিয়ে দিয়ে বলি, চা শেষ হ’লে তুমি চ’লে যাবে।হাত বাড়িয়ে সে আমার হাত ধ’রে বলে, আমি চুমো খেতে চাই।আমি হাত টেনে নিয়ে বলি, না।সে বলে, আমি ইন্টারকোর্স করতে চাই।আমি বলি, না।সে বলে, তাহলে আমি মেইডসার্ভেন্টটার সাথে করবো।আমি বলি, করো।সে বলে, এখন গিয়েই করবো।আমি বলি, কোরো।বলতে ইচ্ছে করে, এর মাঝে নিশ্চয়ই করেছে), একা পেয়ে মেয়েটিকে কি তুমি না ক’রে ছেড়েছো, কিন্তু বলি না; সে ক’রে থাকলে করুক, যতোবার ইচ্ছে, ভাতে আমার কী, আমি তো আর তার জীবনের মধ্যে নেই, সে তার জীবন নিয়ে যা ইচ্ছে করতে পারে, আমি বাধা দিতে পারি না, দুঃখ পেতে পারি না; আমি চাই সে এখন যাক, আমাকে মুক্তি দিক, আমি একা থাকতে চাই; তার সাথে আমি মারামারি করতে চাই না।আমি বলি, তুমি এখন যাও, হয়তো একদিন আমিই ডাকবো।সে বলে, না, তুমি ডাকবে না।আমি বলি, আমার অনুরোধ রাখো, তুমি যাও।সে বলে, কেনো? লোকটি কি এখন এসে পড়বে?আমি বলি, দা, আমিই তাঁর কাছে যাবো।আমি মারামারি করতে চাই নি, কিন্তু দেখতে পাই ওর কথায় আমার ভেতরে এক ডাকাত জেগে উঠছে, স্তব্ধ হিংস্রতা জাগছে মনে, লড়াই করার জন্যে তৈরি হয়ে উঠছি আমি।সে বলে, আমি তোমার দেরি করিয়ে দিচ্ছি?আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, একবার ইন্টারকোর্স করতে দাও।আমি বলি, না।সে বলে, আগে তো প্রতিরাতে করতাম।আমি বলি, হ্যাঁ, দিনেও করতাম।সে বলে, তাহলে এখন করতে দেবে না কেনো?আমি বলি, আমার আর ইচ্ছে করে না।সে বলে, তুমি লোকটির সাথে নিশ্চয়ই করো।আমি বলি, হ্যাঁ, করি।সে বলে, রেগুলারলি করো?
পৃষ্ঠা-৮৫
আমি বলি, হ্যাঁ, করি।সে কেঁপে ওঠে, বলে, সত্যিই করো?আমি বলি, সত্যি না মিথ্যে আমি বলবো না, এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।সে বলে, তাহলে চুমো খেতে দাও। লড়াই আর আমার ভালো লাগে না, আমি বলি, আচ্ছা, খাও। কী আসে যায় যদি সে একবার চুমো খায়? এমন তো সে কতোই খেয়েছে, কতোবার আমিই এগিয়ে গিয়ে খেয়েছি, তার সামনে কতোবার বিছিয়ে দিয়েছি নিজেকে, এখন চুমো খেলে আমার এমন কী এসে যায়? কী নাই হয়? মাঝরাতে কোনো বর্ষণকারী যদি ছুরি পিস্তল উঁচিয়ে আমাকে ধর্ষণ করতে চায়, পৌরাণিক সতীত্ব রক্ষার জন্যে প্রাণপণ লড়াই ক’রে আমি আমার দেহটিকে ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত হ’তে দেবো না, আমার দেহটিকে আমি ভালোবাসি, এর গায়ে একটু আঁচড় লাগলেও আমার কাঁদতে ইচ্ছে করে, আর নিহত হয়ে আমি কখনোই মহীয়সী সতীর উপাধি নেবো না; আমি আমার দেহটিকে তুলে দেবো। এটাও তেমনি, দেলোয়ার চুমো খেয়ে আমাকে অর্ধেক ধর্ষণ করতে চায়, বাধা দিলে সে আমাকে পূর্ণ ধর্ষণ করবে, আমার দুপুর বিকেল সন্ধ্যাটিকে নষ্ট ক’রে দেবে।দেলোয়ার এগিয়ে এসে আমাকে চেয়ার থেকে টেনে তুলে চুমো খায়া, আমি বাধা দিই না, আমি তাকে চুমো খাওয়ার অনুমতি দিয়েছি, সে চুমো খেতে পারে; কিন্তু আমি তো চাই নি, আমার ঠোঁট ঝামাপাথরের মতো খসখসে হয়ে ওঠে, শরীরটা শক্ত হয়ে ওঠে কংক্রিটের মতো দেয়ালের মতো, যদিও আমিই এক সময় তাকে চুমো খাওয়া শিখিয়েছিলাম আমার ঠোঁট জিভ বাড়িয়ে নিয়ে, শিখিয়েছিলাম অন্ধ হয়ে যেতে। আমি বিস্মিত হই, ভয় পাচ্ছিলাম সে হয়তো আমার স্পর্শকাতর জায়গাগুলোকে উত্তেজিত ক’রে তুলবে, পাগল ক’রে তুলবে আমার গ্রীবার লাল তিলটিকে, আমি হয়তো কেঁপে কেঁপে জ্ব’লে জ্ব’লে মোমের মতো গ’লে যাবো, ঝলকে ঝলকে আমার ভেতর থেকে তরুণ আগুন বেরোতে থাকবে। তার বদলে মনে হ’তে থাকে সে আমাকে পীড়ন করছে, আলিঙ্গনে আমার শরীরটিকে ভেঙে ফেলতে চাচ্ছে, আমার হাতগুলো খ’সে পড়লে ঠোঁট দুটি ছিঁড়ে পড়লে যেনো সে সুখী হয়। তার ভেতরে কী জেগে উঠেছে? কাম না ক্রোধ? আমি বুঝতে পারি না; না কি আমি যুঝতে পারি? তার বাহুপাশে আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, আমি নিজেকে টেনে সরিয়ে আনি।আমি বলি, হয়েছে, আর না।সে বলে, না, আরো।আমি ঠাণ্ডা স্বরে বলি, না, আর নয়। সে কেঁপে কেঁপে মেকের ওপর ব’সে পড়ে, তাকে অসুস্থ মনে হয়। আমি বলি, এবার যাও। সে বলে, আমার যেতে ইচ্ছে করছে না। আমি বলি, এখন যাও।
পৃষ্ঠা-৮৬
সে বলে, আমি প্রতিদিন আসবো।আমি বলি, না।সে বলে, তোমাকে ছেড়ে থাকতে আমার কষ্ট হয়।তার কথা শুনে আমারও কষ্ট হয়, তার মুখের দিকে তাকিয়ে তার আগের মুখটি দেখতে পাই।আমি স্নিগ্ধভাবে বলি, এখন যাও।দেলোয়ার বেরিয়ে যায়, দরোজা বন্ধ ক’রে এসে আমি বিছানায় এলিয়ে পড়ি; পীড়নে আমি বেশ ক্লান্ত, বাথা করছে গ্রীবা, কোমরে একটি নখ ব’সে গিয়েছিলো হয়তো, শরীরটা ভেঙে পড়ছে; তবু আমার মন কষ্ট পেতে থাকে তার। জন্যে। সে শূন্য হয়ে গেছে; একদিন তার সব পূর্ণ ছিলো, তখন সে দেবদূত ছিলো, এখন শূন্য হয়ে গেছে ব’লে শোচনীয় হয়ে উঠেছে সে। আমার কোনো কষ্ট নেই, তাকে হারিয়ে ফেলছি এই শূন্যতাবোধ আমার নেই; তার কষ্ট অনেক, আমাকে হারিয়ে ফেলার শূন্যতা তাকে পীড়ন করছে, নিজেকে সে পরিত্যক্ত ভাবছে, সব কিছু তার নিরর্থক লাগছে। একটি প্রশ্নর উত্তর খুঁজছে সে, পাচ্ছে না, পাচ্ছে না ব’লে আরো কষ্ট পাচ্ছে। কেনো আমি তাকে ছেড়ে দিচ্ছি? সে জানে না, আমি জানি। আমি জানি ব’লে আমার কষ্ট নেই, সে জানে না ব’লে তার অশেষ কষ্ট। আমি কারো সাথে ঘুমোচ্ছি? সে জানে না, আমি জানি। আমি জানি ব’লে আমার কোনো কষ্ট নেই, সে জানে না ব’লে তার অশেষ কষ্ট। তার খুব কষ্ট হচ্ছে, এতে আমার কষ্ট লাগে; কিন্তু আমার কিছুই করার নেই, আমি জীবন বদলে দিয়েছি।দেলোয়ার কি ফিরে গিয়ে কাজের মেয়েটির সাথে ঘুমোবে? সে কি ঘুমোনো শুরু ক’রে দিয়েছে? মেয়েটিকে তো সে পছন্দ করতো, মেয়েটির খলথলে শরীরের দিকে তাকে আমি তাকিয়ে থাকতে দেখেছি, যেমন সে তাকায় হিন্দি সিনেমার মেয়েগুলোর দিকে। ভুল স্তন উরু পাছা তার পছন্দ। সে কি ঘুমোয়? দুমোক, আমার কী। ঘুমোবে না কেনো? তার তো ঘুমোনো দরকার। ঘুমোক, সেটা আমার ভাবার বিষয় নয়, সে ঘুমোক। কিন্তু সে ঘুমোয় কি ঘুমোয় না, এটা আমি ভাবছি কেনো; আমার মাথায় এটা ঘুরছে কেনো? এটা কি আমার ঠিক হচ্ছে? সে যেখানে ইচ্ছে ঘুমোক।আমার খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছে, যে কারো সাথে, দেলোয়ারকে ছাড়া; আমার ডিরেক্টর, ওই ভদ্রলোক, গ্রিভলেজ ব্যাংকের ম্যানেজার, অলিম্পিয়ার সেলসবয়, ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে আমার স্যার, যিনি মৃদু হার্ট-অ্যাটাকে ভুগছেন, আমাকে দেখলেই ফোন নম্বর দিয়ে ফোন করতে বলেন, আমার সাথে তাঁর কথা আছে, এবং আমি চিনি না যাদের, এমন কি একটি রিক্সাঅলা পেলেও আমি মন ভ’রে কথা বলতাম। একটা ফোন থাকলে বেশ হভো, একটি ফোন শিগগির নিতে হবে, নইলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসবে। আমি কথা বলতে চাই, শুনতে চাই; কোনো কাজের নয়, অকাজের কথা, যার কেন্দ্র আমি। ডিরেক্টরের সাথে
পৃষ্ঠা-৮৭
কথা বলতে পারলে তাঁকে অনেকগুলো খোঁচা দিতাম, তিনি আমার স্তব করতে থাকতেন, ভালো লাগতো; ওই ভদ্রলোকের সাথে কথা বলতে পারলে হাহাকার শুনতাম, গুনতে আমার ভালো লাগতো, তাঁর ভেতরে আপিয়ে দিতাম আরেকটুকু হাহাকার; স্যারের সাথে কথা বলতে পারলে কী বলতাম জানি না, হয়তো শুধু শুনতাম, হয়তো তিনিও হাহাকার করতেন; আর একটা রিক্সাঅলার সাথে কথা বললে হয়তো তার বউকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্যে বেরিয়ে পড়তাম, নিয়ে যেতে আমার ভালো লাগতো।আমার খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছে, এলোমেলো অনেক কথা।তুমি এখন কাকে পাবে? নিজের সাথেই কথা বলো।নিজের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।তাহলে স্তব্ধ হয়ে যাও, বেনো পৃথিবীতে কথা নেই।তখন চোখ পড়ে আমার শরৎ-রচনাবলিটির ওপর, আমি দু-হাতে ওটি টেনে নিই, ভেতরে আঙুল ঢোকাতেই গৃহদাহটি খুলে আসে। আমি মৃদু হাসি, চমৎকার, ঠিক বই নিজেকে মেলে ধরেছে আমার সামনে।মনে পড়ে দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় লুকিয়ে লুকিয়ে এটি প’ড়ে পাগল হয়ে গিয়েছিলাম; অচলার জন্যে ভ’রে উঠেছিলাম কষ্টে, ওর হয়ে হাহাকার করেছিলাম কয়েক দিন ধ’রে, বারবার- আট নয় দশবার পড়েছিলাম।আজো অচলা আছে আমার বুকের ভেতরে।আজো দেখতে পাই ব্যথিত মহিম বেরিয়ে যাচ্ছে অচলাদের বাড়ি থেকে,অচলার বাবা তাকে বিদায় ক’রে দিয়েছে, তার পছন্দ এখন ধনী সুরেশকে। মনে পড়ে আমি মহিমের বিষণ্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, ইচ্ছে হয়েছিলো গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরি, আমার ক’রে রেখে দিই।একটি বেয়ারা দৌড়ে এসে তার হাতে এক টুকরো কাগজ দেয়, তাতে লেখা শুধু ‘অচলা’। ওই ঘটনায় কলমলিয়ে উঠেছিলাম। মহিম ফিরে গিয়ে দেখে ভেজা চোখ নিয়ে অচলা দাঁড়িয়ে আছে সিড়িতে।আমার বুক কাঁপছিলো, চোখ জলে ভরে উঠছিলো।অচলা নিজের আঙুল থেকে আংটি খুলে পরিয়ে দেয় মহিমের ডান হাতের আঙুলে, এবং ‘এইবার যা করবার তুমি করো’ ব’লে গড় হয়ে পায়ের কাছে একটি নমস্কার ক’রে ধীরে ধীরে চ’লে যায়।ঝলমল ক’রে উঠেছিলাম, আমার সব গাছে সব পাতায় ফুলে মেঘে ঢেউয়ে ভোরের আলো এসে পড়েছিলো।কাঁপছিলাম- আমি অচলা হ’লে কি পারতাম এমন করতে? পারতাম, পারতাম, পারবো, পারবো- আমায় মন বলতে থাকে।অনেক দিন পর উপন্যাস পড়ছি, পড়তে থাকি, ভালোই লাগতে থাকে; আমি কথা বলতে চেয়েছিলাম মুহম্মদ আহাম্মদ হরিদাস কানাইলাল যে কারো সাথে,
পৃষ্ঠা-৮৮
এবার কথা বলার ভালো লোক পেয়ে যাই, একেবারে শরৎবাবু; পড়তে থাকি, আর তাঁর সাথে কথা বলতে থাকি।মাঝেমাঝে তাঁকে ডেকে জিজ্ঞেস করি- শরৎবাবু, আপনি কি সব সময় সত্য কথা বলছেন? না কি দু-একটি মিছেও বলছেন?জিজ্ঞেস করি, মশাই, অচলা মহিম সুরেশকে কি আপনি নিজেই বুঝতে পারছেন? মাঝেমাঝে গোলমাল ক’রে ফেলছেন যে।পড়তে বেশি সময় লাগে না, ঘটনার উপন্যাস, বর্ণনার নয়, উপলব্ধির নয়, ঘটনার; দ্রুত এগোতে থাকি। পড়তে পড়তে, তিন চার ঘন্টা পর, পৌছি সেই ভয়ঙ্কর ঘটনায়, যার জন্যেশরৎবাবু প্রস্তুত করছিলেন পাঠকদের।আমি একটু উত্তেজিত হই, মন বলতে থাকে, দেখি তো শরৎবাবু কীভাবে বর্ণনা করেছেন অচলা-সুরেশের প্রথম শারীরিক সম্পর্ক?অচলা নিজে যেতে চায় নি সুরেশের ঘরে, রামবাবুর আবেদনে নিবেদনে মধ্যরাতে অচলা ঢুকছে সুরেশের শয়নমন্দিরে, সব পাঠক তাকিয়ে আছে সেদিকে, আমিও।তখন বাইরে মত্ত প্রকৃতি মাতলামো করছে, অন্ধকারে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, সারারাত এভাবেই মেতে থাকে প্রকৃতি।আমি একটু হেসে উঠি, জিজ্ঞেস করি, শরৎবাবু, ভেতরে কী হচ্ছে, শয্যায় কী হচ্ছে, তার সংবাদ তো দিলেন না। বুঝতে পারছি এর বেশি আপনি পারেন না, সমাজ মানবে না, সমাজকে মেনেই তো লিখতে হবে আপনাকে, তাহলেই তো থাকতে পারবেন জনপ্রিয়।আমি হেসে বলি, মশাই, উত্তেজনাটুকু ঠিকই তৈরি করেছেন, তারপর অন্ধকার, তারপর প্রতীকরূপক প্রকৃতির মাতলামো, বিদ্যুতের চমক। মশাই, ধর্ষণ করছে সুরেশ আর খেটে মরছে বাইরের প্রকৃতি।রামবাবু খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখেন বারান্দায় অচলা টেবিলে মাধ্য পেতে ব’সে আছে; তার মুখ মড়ার মতো শাদা, চোখের কোণে গাঢ় কালিমা, চোখের কোল বেয়ে অশ্রুধারা বইছে।মজা লাগে, আমি জিজেস করি, মশাই, অচলা কি জানতো না সুরেশের শয়নমন্দিরে ঢুকলে কী হবে? এর জন্যেই তো তাকে ভাগিয়ে এনেছে সুরেশ। মশাই, অচলা কি এর জন্যে একটু প্রস্তুত ছিলো না?সুরেশ তাকে ধর্ষণ করেছে? মেনে নিচ্ছি, তাই; আর অচলা তো বাসরঘরে ঢোকে নি যে সারারাত কাটিয়ে দেবে চুম্বনে, মিলনে, ভোর হওয়ার পরও জড়িয়ে ধ’রে থাকবে পুরুষটিকে।তাই ধর্ষিত হওয়ার পর তার বাইরে এসে ব’সে থাকারই কথা। আমি জিজ্ঞেস করি, শরৎবাবু, কবার অচলাকে ধর্ষণ করেছে সুরেশ? আপনি
পৃষ্ঠা-৮৯
কি ঠিকমতো জানেন? একবার? তা মনে হয় না, এতোদিন পর একবারে সে থামে নি, হয়তো দু-বার, হয়তো তিনবার।আমি পড়তে থাকি, কথা বলতে থাকি শরৎচন্দ্রের সাথে।আমি জিজ্ঞেস করি, শরৎবাবু, ওই ধর্ষণের রাতের পর অচলা কি আত্মহত্যা করেছিলো?শরৎবাবু বলেন, তাহলে তো জানাকামই।আমি জিজ্ঞেস করি, এরপর তো অচলা-সুরেশ একই শয়নমন্দিরে একই শয্যায় ঘুমোতো?শরৎবাবু বলেন, হ্যাঁ, তা তো আমি একবাক্যে বলেই দিয়েছি।আমি জিজ্ঞেস করি, শরৎবাবু, আপনি কি ঠিকমতো জানেন এর পর তারা ক-মাস এক শয্যায় ঘুমিয়েছে? এক মাস? দু-মাস?শরৎবাবু বলেন, ঠিক জানি না, তবে এক-দেড় মাস হবে।আমি জিজ্ঞেস করি, তারা কি ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিয়েছে ওই সময়টা? না কি রাতে দু-একবার মিলিত হয়েছে? চুমো খেয়েছে?শরৎবাবু বলেন, বুঝে নেবেন, সব কথা লেখা যায় না।আমি বলি, তার মানে তারা প্রতিরাতে প্রচুর চুমো খেয়েছে, এবং মিলিত হয়েছে। অচলা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলো সুরেশের সাথে চুম্বনে মিলনে। পরের রাতগুলোতে তো সে উঠে বারান্দায় টেবিলে মাথা রেখে ব’সে থাকতো না।আমি জিজ্ঞেস করি, মশাই, কথা বলছেন না কেনো?শরৎবাবু বলেন, হ্যাঁ, আপনি যা বলছেন, তা ঠিকই।আমি কয়েক পাতা উল্টিয়ে তাঁকে প’ড়ে শোনাই, বলি, আপনি লিখেছেন, গাড়িতে ক’রে অচলা আর সুরেশ যাচ্ছিলো রামবাবুর বাড়ি, তখন সুরেশ অচলার মাথাটা বুকের ওপর টানিয়া লইয়া ওষ্ঠাধর চুম্বন করিল।শরৎবাবু বলেন, হ্যাঁ, ঘটনা ঠিক।আমি বলি, মশাই, তারপরই আপনি লিখেছেন, অপমানে আজও অচলার মুখ রাঙা হইয়া উঠিল, ঠোঁট দুটি ঠিক তেমনি বিছার কামড়ের মত জ্বলিয়া উঠিল। শরৎবাবু বলেন, হ্যাঁ, তাই।আমি জিজ্ঞেস করি, আপনি কি সত্য কথা বলছেন, শরৎবাবু? না কি মিথ্যেকথা বলছেন? না কি কপটতা করছেন? না কি আপনি অচলাকে বুঝতে পারেন নি? বলুন শরৎবাবু, একমাস দেড়মাস ধ’রে অচলা-সুরেশ এক বিছানায় ঘুমিয়েছে, আলিঙ্গন চুম্বন সঙ্গম করেছে, তারপর যদি সুরেশ অচলাকে চুমো খায়, তাতে তার ঠোঁট বিছার কামড়ের মতো জ্ব’লে উঠতে পারে কি না? কেনো মিথ্যে কথা বললেন? কেনো কপটতা করলেন, বলুন শরৎবাবু।শরৎবাবুর দিকে তাকিয়ে আমি হাসতে থাকি, বলি, আপনি দুকূল বাঁচাতে চেয়েছেন, শরৎবাবু। চুমোর কথা ব’লে পাঠকদের একটু উত্তেজনা দিতে
পৃষ্ঠা-৯০
চেয়েছেন, আপনি জানতেন সেই সময়ে একটা চুমোতে ঘরঘর ক’রে কেঁপে উঠবে দুই বাঙলা, আবার বিছার কামড়ের কথা ব’লে সন্তুষ্ট রাখতে চেয়েছেন সমাজকে, নৈতিকতাকে। শরৎবাবু, বলুন, আপনি কি অপরাধ করেন নি?আমার কথা বলতে ইচ্ছে করেছিলো, পড়তে পড়তে কথা বলতে বলতে সময়টা আমার চমৎকার কেটে যায়। আমি ঘুমিয়ে পড়ি।খুব ভোরে ঘুম ভাঙে, শরীরটাকে কুয়াশার মতো হাল্কা লাগে, ভেসে বেড়াতে ইচ্ছে করে ধানখেতে, নদীর পারের কাশের ভেতরে, জ’মে থাকতে ইচ্ছে করে ছোটো কোনো পাহাড়ের পাশে। উঠে বিস্কুট খেতে খেতে চা বানাই, এক চুমুক লাল চা খেয়ে ঝলমল ক’রে উঠি, একটি বই টেনে নিয়ে এ-পাতার এক প্যারা ও-পাতার আধপ্যারা পড়ি; নিজেকে জিজ্ঞেস করি, কেমন আছো? খুব খারাপ আছো? চালাতে পারবে না এভাবে? না পারলে আবার জীবনটাকে বদলে নেবে, জীবনটা তোমার, একে তুমি বেভাবে ইচ্ছে বদলাতে পারো। একটি জিনিশ কি তুমি পাও নি? স্বাধীনতা? আগে এটা তোমার ছিলো?ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে নেমেই দেখি গেইটে দাঁড়িয়ে আছেন ভদ্রলোক; আমার খারাপ লাগে না, জানতাম একদিন এসেই পড়বেন, হাহাকারের একটি পরিণতি না দেখে তিনি হাহাকার থামাবেন না। কেউ খামায় না, আমি হ’লেও থামাতাম না। দেখে আমি হাসি, মজা লাগে আমার, একটি পুরুষ অফিস বউউউ ফেলে দাঁড়িয়ে আছেন আরেক প্রান্তরে, ভদ্রলোক কখনো ভাবতেও পারেন নি একদিন তাঁকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে জড়োসড়ো হয়ে, মুখে উদ্বেগের একটা স্থাপ দিয়ে। তাঁর দাঁড়ানোর ভঙ্গিটা বেশ বিব্রত, তিনি বুঝতে পারছেন না কীভাবেদাঁড়ালে স্বস্তি পাবেন।আমি বলি, আপনি এখানে?তিনি বলেন, হ্যাঁ, আপনার সাথে দেখা করতে এলাম।আমি বলি, চলুন।আমরা গিয়ে আমার ঘরে বলি; তাঁর দিকে তাকিয়ে আমি হাসি, যে হাসিটা দেখার জন্যে তিনি এসেছেন। উঠতে উঠতে ভাবছিলাম আমি কি মধুর হাসবো, না গম্ভীরভাবে তাকাবো? আমার মন বলতে থাকে গম্ভীর হ’তে হবে কেনো? অদ্রলোক এতোদূর এসেছেন, তুমি যদি একটু মধুর হাসো, তাহলে তোমার কী ক্ষতি? ভদ্রলোক তো তোমাকে জোর ক’রে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন না; আর হাসলে তুমি সুস্থ থাকো, তোমার হাসিই তো তোমাকে বাঁচিয়ে রাখে।আমি বলি, নিশ্চয়ই আপনি এতোদূর এক পেয়ালা চা খেতে এসেছেন? তিনি বলেন, হ্যাঁ, কতোদিন খাই না।আমি বলি, ওহ্, একটু স্মৃতি জেগে উঠেছে?তিনি বলেন, স্মৃতির ভেতরেই তো বাস করছি।গরম পানি আনাই, আমি চা বানাই, তিনি আমার চা বানানোর দিকে তাকিয়ে থাকেন; ইচ্ছে ক’রেই একটু বেশি সময় নিই, এ-দৃশ্যটা দেখতে ভদ্রলোকের
পৃষ্ঠা ৯১ থেকে ১০৫
পৃষ্ঠা-৯১
ভালো লাগছে, তিনি আমার আঙুলগুলোর দিকে তাকিয়ে আছেন, আমি একটু অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বেশি ক’রেই তাঁকে দেখার সুযোগ দিই, দেখতে চাচ্ছেন দেখুন; এটা আমার নিজের সাথে নিজের দুষ্টুমি, হয়তো নিজেকে একটু ভালো লাগার কিছুটা সুখী রাখার একটু সুস্থ থাকার পদ্ধতি। নিজেকে বলি, তোমার দীর্ঘ তন্বী আঙুলগুলো যদি কারো সুন্দর লাগে, তোমার নিজেরই তো লাগে, যদি একটু ঘোর লাগে তাঁর চোখে, যদি তাঁর দেখতে ইচ্ছে করে চোখ ভ’রে, তাহলে দাও না দেখতে, আর কিছু তো নয়- কয়েকটি আঙুল; দিনের শুরুতে তিনি একটু সৌন্দর্যের নড়াচড়া দেখতে চান, সব ফেলে এতোদূর ছুটে এসেছেন, দেখতে দাও, একটু ধন্য করো।কিন্তু আমার ভেতর থেকে যে-কথাটি বেরিয়ে আসে, সেটি আঙুলগুলোর মতো নয়; আমি বলি, আপনার স্ত্রী নিশ্চয়ই আপনার চা বানান?তিনি চমকে ওঠেন, মনে হয় আমি একটি অত্যন্ত কদর্য অসুন্দর অশ্লীল প্রশ্ন করেছি, যা এই সুন্দর পরিবেশে তিনি আশা করেন নি, আমার আঙুলগুলোর মতোই সুন্দর কিন্তু তিনি শুনতে চেয়েছিলেন, এই সুন্দর পবিত্র শুদ্ধ সকালবেলা তিনি স্ত্রীর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আলোচনা করার জন্যে আসেন নি। আমি পরিবেশ অপবিত্র ক’রে ফেলছি, নষ্ট ক’রে ফেলছি তাঁর মানসিক পরিবেশ।তিনি বিব্রত হন, কেঁপে ওঠেন, বলেন, হ্যাঁ, বানায়, হ্যাঁ, কখনো বানায়,মাঝেমাঝে, কাজের মেয়েটিই বেশি বানায়।তাঁর দম নিতে কষ্ট হচ্ছে? রক্তচাপ বেড়েছে? আমি তাঁর দিকে তাকাই, তাঁর চোখেমুখে দেখতে পাই তিনি চান এ-বিষয়ে যেনো আমি আর কোনো কথা না বলি, কিন্তু আমার বলতে ইচ্ছে করে। আমি দেখেছি পুরুষেরা খুব বিব্রত হয় স্ত্রীর প্রসঙ্গ উঠলে যখন তারা অন্য কোনো নারীর সাথে মধুর আলাপ ক’রে সুখী হ’তে চায়, পার্টিতে পার্টিতে আমি স্ত্রীদের সম্পর্কে আলোচনা ক’রে অনুরাগীদের ভিড় কমিয়েছি, আমার সেকথা মনে পড়ে।আমি বলি, তাঁর চা নিশ্চয়ই খুব ভালো হয়?কী বলবেন ভেবে পান না, শেষে বলেন, হ্যাঁ, না, হয় একরকম, পিরিচে চা প’ড়ে থাকে, চিনি কম হয়, মাঝেমাকে জঘন্য বেশি হয়; কাজের মেয়েটিই তার থেকে ভালো বানায়, কাজের মেয়েটির চা-ই আমি বেশি পছন্দ করি।ভদ্রলোকের শরীর থেমে উঠছে? একটু খামুক না।আমি বলি, তাঁর চা বানানোর দিকে আপনি নিশ্চয়ই মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকেন, তাঁর আঙুলের সৌন্দর্য দেখেন?ভদ্রলোক আরো বিব্রত হন, চোখ ফিরিয়ে নিয়ে টেবিলের ওপর অনেকটা ভেঙে পড়েন, বলেন, না, মনে হয় কখনো তাকাই নি।আমি হেসে বলি, কেনো ডাকান নি? তাঁর আঙুলগুলো কি গোন্দা গোন্দা? এমন সরু আর দীর্ঘ নয়, এভাবে নাচে না?তিনি বলেন, হ্যাঁ, না, তবে তাতে মুগ্ধ হওয়ার মতো কিছু দেখি নি, কখনো
পৃষ্ঠা-৯২
তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে নি, আঙুলগুলোই কখনো দেখি নি।আমি বলি, আমার আঙুলের দিকে যে তাকিয়ে রইলেন?তিনি বলেন, আপনার আঙুল আপনার হাত সুন্দর, এদিকে অনেক কাল তাকিয়ে থাকা যায়।আমি বলি, আমার সবই সুন্দর?তিনি বলেন, হ্যাঁ, সব।আমি বলি, এর আগে আপনি কখনো প্রেমে পড়েছিলেন?তিনি বলেন, না, না, এমন তীব্র প্রেমে কখনো পড়ি নি।আমি বলি, মৃদু?তিনি একটু লজ্জিত হয়ে বলেন, তারচেয়েও কম।আমি বলি, সাহসে কুলোয় নি?তিনি লজ্জা পান, বলেন, তখন বয়স কম ছিলো।আমি বলি, এখন বয়স হয়েছে?তিনি বলেন, বয়স না হ’লেও এবার সাহস করতাম।আমি বলি, আমি যদি আপনার স্ত্রী হতাম, তাহলে আমার আঙুলগুলোরসৌন্দর্য কি আপনার চোখে পড়তো?খুবই বিব্রত হয়ে তিনি বলেন, পড়তো, নিশ্চয়ই পড়তো।আমি বলি, না, পড়তো না; স্ত্রীর দিকে কেউ তাকায় না।তিনি বলেন, আপনার মতো স্ত্রীর দিকে না তাকিয়ে পারা যায় না।আমি বলি, জানেন?তিনি বলেন, কী?আমি বলি, পরস্ত্রীর আঙুল সব সময়ই সুন্দর, পরস্ত্রীর হাতের তালুতে সব সময়ই চন্দনের সুগন্ধ।ভদ্রলোক এবার সত্যিই ভেঙে পড়েন, আমার দিকে তাকানোর সাহসও পান না, তাকালেই যেনো একটা বজ্র ঝাঁপিয়ে পড়বে তাঁর ওপর; আমি অদ্রলোকেরদিকে তাকিয়ে থাকি, তাঁর ভগ্ন অবস্থা দেখতে আমার ভালো লাগে।আমি হেসে চা এগিয়ে দিয়ে বলি, চা খান।তিনি পেয়ালাটা টেনে নিয়ে চামচ দিয়ে চা নাড়তে থাকেন।আমি চুমুক দিতে দিতে বলি, চাটা বেশ হয়েছে, খেতে ভালো লাগবে, খান।তিনি বলেন, আপনার সব কিছুই মধুর।আমি বলি, আপনি বেশ বানিয়ে কথা বলতে পারেন।তিনি বলেন, না, বানিয়ে বলছি না। আমি বলি, এর আগে যে-বিষটুকু ঢাললাম, তাও মধুর?তিনি বলেন, না, ওটা বিষ নয়, ওটাও মধু।
পৃষ্ঠা-৯৩
ভদ্রলোক খেলতে জানেন, আবার বেলা শুরু করেছেন; এই বেলাটুকুতে আমার খারাপ লাগে না; আমি মনে মনে বলি, খেলোয়াড়, খেলো, আমি তোমার বেলা দেখতে চাই, দেখি তুমি কতোটুকু খেলতে পারো।আমি বলি, আপনি নিয়মিত মিথ্যে বলেন?তিনি ব’লে ওঠেন, না, না, আমি মিথ্যে বলি না।ভদ্রলোক একটি চমৎকার দিনের জন্যে আমার কাছে এসেছেন, তীর্থযাত্রার মতো, স্বপ্ন দেখছেন হয়তো আরো অনেক চমৎকার সুন্দর দিনের; ভদ্রলোককে আমার ভালোই লাগছে, অন্তত খারাপ লাগছে না, কিন্তু আমি তো তাঁকে নিয়ে কোনো স্বপ্ন দেখি নি। তিনি একবার অভাবিতকে পেয়েছিলেন, আমি দিয়েছিলাম, দিতে আমার ইচ্ছে করেছিলো, এখন তাঁর হয়তো ব্যাকুলতা জেগেছে অভাবিতকে চিরদিনের মতো বেঁধে রাখার।আমি অধ্যাপকের মতো একবার চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে তাঁর দিকে তাকাই, মনে হয় অদ্রলোক আমার প্রথম বর্ষের ছাত্রের মতো কাঁপছেন, আবার স্বপ্ন দেখছেন আমাকে জড়িয়ে ধ’রে ঘুমোনোর। তিনি সে-স্বপ্ন দেখতে পারেন, একদিন তিনি স্বপ্ন না দেখেই স্বপ্নের থেকে বেশি পেয়েছিলেন।আমি বলি, আপনার স্ত্রী কেমন আছেন?তিনি পাতাল থেকে একটু ওপরে উঠেছিলেন, আবার পাতালে প’ড়ে যান; আমি তাঁকে হাত ধ’রে তোলার কোনো আবেগ বোধ করি না। ভদ্রলোক পাতালে প’ড়ে যাচ্ছেন? পড়ুন। আমার কী? তাঁকে হাত ধ’রে টেনে তোলার কোনো দায়িত্ব তো আমি নিই নি।তিনি বলেন, হয়তো ভালো আছে, হয়তো ভালো নেই, আমি জানি না।আমি বলি, জানেন না কেনো?তিনি বলেন, জানতে আগ্রহ হয় না।আমি বলি, আপনি কি নিষ্ঠুর মানুষ?তিনি বলেন, না, নিষ্ঠুর হবো কেনো?আমি হেসে বলি, চা খাচ্ছেন না কেনো? চা খান।এটুকুতেই তিনি উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন, বলেন, খাচ্ছি।ভদ্রলোক অসুস্থ হয়ে পড়ছেন? আমার মনে হয় ভদ্রলোককে একটু সুস্থ ক’রে তোলা দরকার, তিনি এভোট। বিপজ্জনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হবেন, ভাবেন নিঃ ভেবেছিলেন মধুর আবেশে কেটে যাবে সময়টা, কিন্তু আমি তাঁকে বারবার অন্ধকারে ফেলে দিচ্ছি, পাভালে নামিয়ে দিচ্ছি। এটা করা হয়তো ঠিক হচ্ছে না,অতিথিকে সুখী করা আমার দায়িত্ব।আমি মধুরভাবে হেসে বলি, বলুন, কেনো এতোটা পথ ছুটে এলেন? তিনি একটু আলো দেখতে পান, বলেন, আপনাকে দেখতে। আমি হেসে বলি, শুনে ভালো লাগলো। কেমন লাগছে?
পৃষ্ঠা-৯৪
ঝলমল ক’রে উঠে তিনি বলেন, চোখ ভ’রে দেখতে ইচ্ছে করে।আমি বলি, কতোক্ষণ দেখলে চোখ ভরবে? তিনি চোখ নামিয়ে নেন, একথার পর কারো দিকে তাকিয়ে থাকা যায় না।আমি বলি, বললেন না তো কতোক্ষণ দেখলে চোখ ভরবে?তিনি বলেন, সারাজীবনেও নয়।আমি বলি, তাহলে তো রোজহাশরের দিনেও দেখতে হবে।তিনি বলেন, আপনার সাথে আমার অনেক কথা আছে। আমি বলি, বলুন।এতো সরাসরি তাঁর কথা জানতে চাইবো, একটুও আবেশ সৃষ্টি করবো না, ঘর ভ’রে ঘোলাটে মেঘ আর চাঁদের আলো ছড়াবো না, এটাও ভিনি আশা করেন নি; তাই আবার বিব্রত হয়ে ওঠেন তিনি।তিনি বলেন, কী ক’রে যে এখানে সব কথা বলি।আমার একটু মজা করার ইচ্ছে হয়, আমি হেসে বলি, চলুন তাহলে রমনা পার্কে কোনো ঝোপের আড়ালে গিয়ে বসি, আপনি বসবেন একটা খবরের কাগজের ওপর আমি ঘাসের ওপর।তিনি বেশ আহত হন, পার্কে দূরের কোনো পার্কে তিনি আমাকে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন হয়তো দেখতেন পরে, এমন কোনো পার্কে যেখানে কেউ দেখতে পাবে না, কিন্তু এর পর পার্কের কথা ভাবতেও পারবেন না।তিনি বলেন, না, না, পার্ক লাগবে না।আমি বলি, পার্কে ব’সেই মনের কথা শুনতে আমার ভালো লাগবে।তিনি বলেন, কেউ হয়তো দেখে ফেলবে।আমি বলি, দেখে ফেললে খুব অসুবিধা হবে?তিনি বলেন, হ্যাঁ, একটা কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।আমি বলি, কেলেঙ্কারিকে খুব ভয় পান?তিনি বলেন, হ্যাঁ, কিছুটা তো পাই-ই।আমি বলি, তাহলে চলুন আপনার বাসায় গিয়েই ব’সে চা খেতে খেতে শুনি, অনেকক্ষণ ধ’রে শোনা যাবে।তিনি আর্তনাদ ক’রে ওঠেন, না, না, আমার বাসায় না; সেখানে না।আমি হেসে বলি, কেনো নয়? আমি বলি, এগুলো কি খুব খারাপ কথা?তিনি বলেন, বাসায় একথা কী ক’রে বলি?তিনি বলেন, না, খারাপ কথা না।আমি বলি, আমার সাথে আপনার অনেক কথা আছে, সেগুলো নিশ্চয়ই খুব। গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলো আপনার বাসায় ব’সে শোনাই কি ভালো নয়?
পৃষ্ঠা-৯৫
তিনি বলেন, না, না, সেখানে হয় না।আমি বলি, কেনো? সেখানে আপনার স্ত্রী আছেন ব’লে?ভদ্রলোক কাঁপছেন, আমার দিকে তাকাতে পারছেন না, তিনি পাতালের দিকে পা বাড়িয়ে দিয়েছেন, পিছলে পড়ে যাবেন।তিনি বলেন, হ্যাঁ, সে আছে।আমি বলি, তাঁর সামনে কথাগুলো বলতে পারবেন না?তিনি বলেন, না, তার সামনে কী ক’রে বলি?আমি বলি, তাঁকে ভয় পান?তিনি বলেন, না, না, ভয়ের কী আছে?আমি বলি, আপনি সম্ভবত নিজেকে অপরাধী ভাবছেন, অপরাধবোধে ভুগছেন, তাই কথাগুলো আপনার স্ত্রীর সামনে বলতে পারবেন না।তিনি বলেন, হ্যাঁ, একটু অপরাধবোধ তো হচ্ছেই।আমি হেসে বলি, অপরাধীদের সাথে কথা বলতে আমার ভালো লাগে না।তিনি বলেন, না, আমি অপরাধী নই।আমি বলি, আমার যে মনে হচ্ছে।তিনি বলেন, না, আমি অপরাধী নই।আমি বলি, আপনি বরং আরেক কাপ চা খেয়ে আজ চ’লে যান, কোনোদিন যদি অপরাধবোধ কাটিয়ে উঠতে পারেন, আমার সাথে যোগাযোগ করবেন, তখন আপনার কথা শুনবো।ভদ্রলোক হাহাকার ক’রে ওঠেন, আমার কথা আজই আমাকে বলতে হষে,নইলে বাঁচবো না।আমি বলি, বাঁচবেন না?তিনি বলেন, তেমনই মনে হয়।আমি বলি, আপনার বয়স কতো, যদি কিছু মনে না করেন।তিনি বলেন, পঁয়তাল্লিশে পড়েছি।আমি হেসে বলি, আপনি কৈশোরে পা দিয়েছেন।ভদ্রলোকের জন্যে আমার কষ্ট হয়, ইচ্ছে হয় তাঁর চিবুক ধ’রে বলি, বালক,তুমি লোভী হয়ে উঠেছ্যে, ভুল পথে পা দিয়েছো, যাও, বাসায় গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বসো, গড়ের অঙ্কগুলো করো, উপপাদ্যগুলো আবার দেখো, পদ্যগুলো মুখস্থ করো, ভাবসম্প্রসারণ শেখো; যাও, স্ত্রীর সাথে ঘুমোও, তাকে গর্ভবতী করো, ফ্ল্যাট কেনো, জমি কেনো, উত্তেজনায় স্বপ্নে বাসনায় থেকো না। আমি মনে মনে হাসি, আমি জানি তিনি কী বাসনা নিয়ে এসেছেন।আমি কাজের মেয়েটিকে ডেকে আবার গরম পানি আনাই, চায়ের কাপ দুটি দুই, সুন্দর ক’রে মুছি, চা বানাই, বানাতে সময় নিই; দেখি তিনি আর আমার আঙুলের দিকে তাকাচ্ছেন না।
পৃষ্ঠা-৯৬
আমি হেসে বলি, কী হলো? আপনি যে আমার চা বানানো দেখছেন না? আমার আঙুলগুলোর রূপ দেখতে আপনার ইচ্ছে করছে না?তিনি বলেন, আমার সাহস হচ্ছে না।তাঁর দিকে চা এগিয়ে দিয়ে বলি, আচ্ছা, এবার আপনার কথা বলুন।তিনি বলেন, আমি আপনাকে ভালোবাসি।আমি বলি, তা আমি জানি, এটা নতুন কথা নয়।এমন নির্মম উত্তরও তিনি শুনতে চান নি, তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁর কথা শুনে আমি মাথা নিচু ক’রে ব’সে থাকবো, তিনি আমার হাত ধরবেন, তারপর উঠে আমাকে জড়িয়ে ধ’রে চুমো খাবেন; এবং আমিও বলবো ভালোবাসি। তিনি বেশ হতাশ হন; তাঁর কি একবার উঠে চ’লে যেতে ইচ্ছে করে?তিনি বলেন, আমার জীবনটা বদলে গেছে।আমি জিজ্ঞেস করি, কীভাবে?তিনি বলেন, সেই যে আমাদের দুই রাত, তার পর থেকে।আমি বলি, সেটা কি জীবন বদলানোর মতো বড়ো ঘটনা ছিলো?তিনি বলেন, এতো বড়ো ঘটনা আমার জীবনে আর ঘটে নি।আমি জিজ্ঞেস করি, এখন আমাকে কী করতে হবে?তিনি চুপ ক’রে থাকেন, আমার দিকে তাকিয়ে বিহ্বল হয়ে ওঠেন, নিজেকে গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন, আমি তাকিয়ে তাঁকে দেখি।তিনি বলেন, আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই।ভদ্রলোকের হাতে বেশি সময় নেই, সময় নষ্ট না ক’রে আসল কথাটি ব’লে ফেলেন তিনি; খুবই গভীর গুরুত্বপূর্ণ কথা, মনোযোগ দিয়ে আমার শোনা উচিত, কিন্তু শুনে আমার মজা লাগে, অদ্রলোক খুব বড়ো একটা ঝুঁকি নেয়ার জন্যে প্রত্রত; এখন দরকার আমার সহযোগিতা।আমি ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসি, হাসিটায় তিনি ভয় পান।আমি বলি, শুনে ভালো লাগলো, এখনো আমার জন্যে প্রস্তাব আসছে।তিনি বিব্রত হয়ে বলেন, আমি আপনাকে ভালোবাসি। আমি বলি, পয়গামটি ঘটক দিয়ে পাঠালেই ভালো হতো না?তিনি বলেন, পয়গাম নয়, আমি আপনাকে ভালোবাসি।আমি বলি, সেজন্যে বিয়ে করতে চান?তিনি বলেন, হ্যাঁ।আমি বলি, আমার একটি হাজব্যান্ড আছে জানেন?তিনি বলেন, জানি।আমি বলি, তাহলে কী ক’রে আপনাকে বিয়ে করি? এক সাথে দুটো স্বামী আমি মানলেও আপনাদের সমাজ মানবে না।
পৃষ্ঠা-৯৭
তিনি বলেন, না, না, দুটো স্বামী কেনো?না, দুটো স্বামী তিনি মেনে নিতে পারবেন না; আমাকে তাঁর একলা দরকার, অন্য কারো সাথে ভাগ ক’রে তিনি আমাকে উপভোগ করতে পারবেন না।আমি বলি, কেনো? তাতে অসুবিধা কী?তিনি বলেন, তা কী ক’রে হয়?আমি বলি, আমাকে ভাগাভাগি ক’রে পেতে খারাপ লাগবে?তিনি বলেন, আমি ওকথা ভাবতেই পারি না।আমি বলি, একবার ভেবে দেখার চেষ্টা করুন না। তিনি বলেন, না, না, এটা ভাবার মতো কথা না।আমি বলি, তাহলে আপনাকে কী ক’রে বিয়ে করি?তিনি বলেন, তার তো উপায় আছে।আমি বলি, ডিভোর্স?তিনি বলেন, হ্যাঁ।আমি বলি, ডিভোর্স জিনিশটা কী, তা আমার এক-আধবার ক’রে দেখতে ইচ্ছে করে; আর তা না হয় আমি করলাম, কিন্তু আপনি?তিনি বলেন, আমিও ডিভোর্স করবো।আমি বলি, এতোদিনের স্ত্রীকে ডিভোর্স করতে কষ্ট হবে না?তিনি বলেন, না, হবে না, আপনাকে পেলে।আমি বলি, আমি এমন কী মূল্যবান?তিনি বলেন, আপনার কী মূল্য তা আমি বুঝি, আপনি তো বুঝবেন না।আমি বলি, আপনার স্ত্রীকে না হয় ডিভোর্স করলেন; কিন্তু আপনার হয়তোদু-তিনটি সন্তান আছে।তিনি বলেন, হ্যাঁ, চারটি।আমি বলি, আপনি সন্তান বেশ পছন্দ করেন।তিনি বলেন, তা করি।আমি বলি, তাদের দুঃখে তো আপনার বুক ভেঙে যাবে?তিনি বলেন, একটু দুঃখ তো লাগবেই।আমি বলি, তাদের জন্যে কাঁদবেন?তিনি বলেন, এটা কি কাঁদার বয়স?আমি বলি, তাদের কী করবেন?তিনি বলেন, তা পরে দেখা যাবে।আমি বলি, আমার সন্তানদের কী হবে?তিনি বলেন, আমি জানি আপনার কোনো সন্তান নেই।বেশ এগিয়েছেন অদ্রলোক, আমার আরো মজা করতে ইচ্ছে করে, আমি
পৃষ্ঠা-৯৮
জিজ্ঞেস করি, আপনার স্ত্রীকে না ছাড়লে হয় না?তিনি একটু বিব্রত হন, আবার স্বস্তিও বোধ করেন।তিনি বলেন, হয়, যদি সে অনুমতি দেয়।আমি ভেতয়ে ভেতরে হো হো ক’রে হাসতে থাকি, কিন্তু জিজ্ঞেস করি, তাঁর অনুমতি আনতে পারবেন?তিনি বলেন, হয়তো পারবো, চাপ দিলেই অনুমতি দেবে।আমি বলি, চাপ দিলেই দেবে?তিনি বলেন, চাপ দিলে মেয়েলোক অনুমতি না দিয়ে পারে না।শুনে আমার বেশ লাগে, মেয়েলোকের পরিস্থিতি তাঁর বেশ জানা; বেশি কিছু নয়, একটু চাপ দিতে হবে, মেয়েলোক রাজি হয়ে যাবে, নইলে যাবে কোথায়, খাবে কী, পরবে কী? তার পায়ের নিচে তো মাটি নেই।আমি বলি, তিনি ছেলেমেয়ে নিয়ে এক বাসায় থাকবেন, আমরা আরেক বাসায়?তিনি বলেন, হ্যাঁ।আমার ইচ্ছে করে ভদ্রলোকের মুখে একটা লাথি দিই, আমার জুতো দুটোর দাগ তাঁর মুখে স্পষ্ট ক’রে দিই, তাঁর ওপর দিয়ে হেঁটে যাই, কিন্তু তা আমি পারি না, শুধু মজা করার ইচ্ছেটা প্রবল হয়ে ওঠে।আমি বলি, আজই বিয়েটা করলে কেমন হয়?তিনি চমকে ঝলমল ক’রে উঠে বলেন, আজ? তা কী ক’রে হবে? আপনার ডিভোর্স নিতে হবে না?আমি বলি, আপনি কি আমাকে সত্যিই ভালোবাসেন?তিনি বলেন, হ্যাঁ, সেই থেকে আপনার অভাবে আমি ম’রে যাচ্ছি।আমি বলি, সত্যি বলছেন?তিনি বলেন, হ্যাঁ; আপনাকে আমি ভালোবাসি।আমি বলি, স্ত্রীকে আর ভালো লাগছে না?তিনি মাথা নিচু ক’রে বলেন, না।আমি জিজ্ঞেস করি, কেনো লাগছে না?তিনি বলেন, আপনাকে ভালোবাসি ব’লে।আমি বলি, আমার সাথে দেখা না হ’লে তো তাঁকে ভালোই লাগতো?তিনি বলেন, না, সংসার করা আর কী।আমার ভেতরটা শক্ত হয়ে ওঠে, কিন্তু আমার মুখটি আমি মধুর হাসিতে ভ’রে রাখি, তাঁকে একটু ঘোলাটে ক’রে তুলতে ইচ্ছে হয়; ভদ্রলোক আমার মুখের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকেন।আমি বলি, সে-রাত দুটো আপনার মনে পড়ে?
পৃষ্ঠা-৯৯
তিনি বলেন, সব সময় মনে পড়ে।আমি বলি, কতো দিন হলো?তিনি বলেন, পনেরো-যোলো দিন।আমি জিজ্ঞেস করি, আপনি সত্যি আমাকে ভালোবাসেন?তিনি বলেন, হ্যাঁ, আমি বোঝাতে পারবো না কতোটা ভালোবাসি।আমি বলি, খুব কষ্টে আছেন?তিনি বলেন, হ্যাঁ, ভীষণ কষ্ট।আমি বলি, কিসের কই?তিনি বলেন, কাছে পেতে চাই, সব সময়।আমি বলি, স্ত্রীকে খুব খারাপ লাগছে?তিনি বলেন, হ্যাঁ।আমি বলি, তাঁকে নিয়ে থাকতে আর সুখ পাচ্ছেন না?তিনি বলেন, না।আমি ভদ্রলোকের স্ত্রীকে একবার দেখার চেষ্টা করি; তাঁকে কখনো দেখি নি, কিন্তু স্ত্রী তো আমি অনেক দেখেছি চার সন্তানের মা, পেট ঝুলে গেছে, বাহুতে মাংস, চামড়া খসখসে, লিপস্টিক মেখে মেখে ঠোঁটে শ্বেতি হয়ে গেছে, চোখে ঝিলিক নেই, কথায় সুগন্ধ নেই- ভদ্রলোকের আর ভালো লাগছে না।আমি বলি, আপনার স্ত্রী তো সুন্দরী?তিনি বলেন, এক সময় ছিলো।আমি বলি, এখন?তিনি বলেন, তাকাতে ইচ্ছে করে না।আমি বলি, একটু মোটা হয়ে গেছেন?
তিনি বলেন, একটু নয়, অনেকখানি।আমি বলি, চামড়া খসখসে হয়ে গেছে?তিনি বলেন, হ্যাঁ।আমি বলি, শরীরে গন্ধ?তিনি বলেন, কাছে যেতেও ইচ্ছে করে না।আমি বলি, সেন্ট কিনে দেন না?তিনি বলেন, দিই, ওগুলোতে আরো দুর্গন্ধ বাড়ে।আমি বলি, ঘেন্না লাগে?তিনি বলেন, হ্যাঁ।আমি বলি, তাঁর রান্না খান?কিনি বিব্রত হন, বলেন, হ্যাঁ, খাই।আমি বলি, তাঁর হাতের চা খান?
পৃষ্ঠা-১০০
তিনি আরো বিব্রত হন, বলেন, হ্যাঁ, খাই।আমি বলি, একই বিছানায় শোন তো?তিনি আরো বিব্রত হন, বলেন, হ্যাঁ, শুই।আমি বলি, শুতে ঘেন্না লাগে না?তিনি বলেন, শুতে হয়, শুই।আমি বলি, আমাকে ভালোবেসে তাঁর সাথে ঘুমোতে খারাপ লাগে না?তিনি বলেন, লাগে, তবু শুতে হয়।আমি বলি, অন্য কোনো ঘরে শুতে পারেন না?তিনি বলেন, সেটা কেমন দেখায়? স্ত্রী কী ভাববে।আমি বলি, আপনার স্ত্রীকে বলতে পারেন নি আপনি আরেকজনকে ভালোবাসেন, তাঁর সাথে আপনি আর ঘুমোতে পারবেন না?তিনি বলেন, একথা কি বলা যায়?আমি বলি, কেনো বলা যায় না?তিনি বলেন, না, বলা যায় না।আমি বলি, আপনি তো সত্য কথা বলতে পছন্দ করেন।তিনি বলেন, তারপরও বলা যায় না।আমি বলি, এর মাঝে স্ত্রীর সাথে সঙ্গম করেছেন তো?এতোটা তিনি আশা করেন নি, একটি মেয়েলোক একটি পুরুষকে এমন প্রশ্ন করবে তিনি ভাবতে পারেন নি, তিনি আহত হন, বিচলিত হন, বিব্রত হন, মাথা নিচু ক’রে ব’সে থাকেন।আমি বলি, বলুন, আমি কিছু মনে করবো না।।তিনি কেঁপে কেঁপে বলেন, হ্যাঁ, করেছি।আমি বলি, দশবারোবার?তিনি মাথা নিচু ক’রে চুপ ক’রে থাকেন।আমি বলি, বলুন, আমি কিছু মনে করবো না।তিনি বলেন, অতো নয়, পাঁচছয়বার।আমি হাসি; আমার হাসি দেখে তিনি একটু স্বস্তি পান, যেনো পাঁচছয়বারে আমি কিছু মনে করি নি, দশবারোবার হ’লেই আপত্তিকর মনে করতাম; একটি পুরুষ প্রেমে পড়তে পারে, আর প্রেমিকাকে না পাওয়া পর্যন্ত স্ত্রীর সাথে সঙ্গম করতে পারে, তার শরীর তো প্রেমের সংবাদ জানে না, এতে এমন কী অন্যায়।আমি বলি, প্রতিরাতেই তো করেছেন?তিনি বলেন, না।আমি বলি, কেনো করেন নি?তিনি বলেন, ইচ্ছে করে নি।
পৃষ্ঠা-১০১
আমি বলি, সুখ পেয়েছেন?তিনি বলেন, না, না, সুখ কি আর পাওয়া যায়?আমি বলি, কেনো পাওয়া যায় না?তিনি বলেন, আপনার সাখের পর আর কোথাও সুখ পাবো না।আমি বলি, তাহলে করলেন কেনো?তিনি বলেন, এক বিছানায় শুই তো।আমি বলি, আপনি না আমাকে ভালোবাসেন?তিনি বলেন, হ্যাঁ, ভালোবাসি।আমি বলি, তাহলে তাঁর সাথে কীভাবে সঙ্গম করলেন?ভদ্রলোক কাঁপতে থাকেন, তিনি ভেঙে পড়েন।আমি বলি, আমার মুখ ভাবতে ভাবতে তাঁর সাথে সঙ্গম করেছেন?ভদ্রলোক আমার দিকে তাকাতে পারেন না, কিন্তু আমি তাঁর দিকে সরাসরি তাকাই, হয়তো আমার একটি শুয়োর দেখতে ইচ্ছে হয়।আমি বলি, আপনি একজনকে ভালোবাসেন এবং আরেকজনের সাথে সঙ্গম করেন; বলুন তো আপনি কি মানুষ?আমি হেসে তাকাই তাঁর দিকে, বলি, নিজেকে আপনার ঘৃণা হয় না?ভদ্রলোক মাথা নিচু ক’রে ব’সে থাকেন, তাঁকে আমার লাথি মারতেও ঘেন্নাহয়; না, আমি লাথি মারতে পারি না, থুতু ছিটোতে পারি না, ওগুলো আমার অভ্যাসে নেই, একটি পশু কোথায় কখন কার সাথে ঘুমোলো, সঙ্গম করলো, বিষ্ঠা খেলো, মূত্র চাটলো, তাতে আমার কী।আমি বলি, আপনার চা খাওয়া তো শেষ হয়েছে?ভদ্রলোক কাঁপতে কাঁপতে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ান, মনে হয় প’ড়ে যাবেন; কিন্তু তিনি পুরুষ, পড়েন না, দরোজা টেনে বেরিয়ে যান।আমি কি তাঁর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবো তিনি কীভাবে বেরোচ্ছেন?দেখবো আমার ঘর থেকে একটি মানুষ না পণ্ড বেরোচ্ছে? আমার ইচ্ছে করে না, আমার ঘেন্না লাগে না, বাগ ধরে না।আমি হেসে একটি বই খুলে ধরি; এবং দেখতে পাই ভদ্রলোক এখনই ছুটে যাচ্ছেন বাসার দিকে, স্ত্রীকে রান্নাঘর থেকে টেনে এনে বিছানায় ফেলে তাঁর ওপর চড়ছেন, অদ্রমহিলা বিস্মিত হয়ে হাঁপাচ্ছেন।দু-দিন ধ’রে ভাবছিলাম, আগে কখনো ভাবতে হয় নি, এই প্রথম ভাবলাম।ঠিক তিরিশ দিনেই আমার ঘটনাটি ঘটে; তার তিন চার দিন আগে বোঁটাদুটো একটু মৃদু টনটন করে, কোমরে একটু কামড় লাগে, তলপেটে একরকম ঘণ্টাধ্বনি শুনি ওই অনুভূডিটিকে ঘণ্টার ধ্বনির মতোই মনে হয়, যেনো ঢংঢং ক’রে বেজে চলছে, মনে মনে শুনতে ভালো লাগে, তারপর দু-তিন সব কিছু মী নিরাক পড়ার মতো স্তব্ধ; এবং ভিরিশ দিনের দিন দেখা দেয়।
পৃষ্ঠা-১০২
এবার টনটন নেই, কামড় নেই, ঘণ্টাধ্বনি নেই, স্তব্ধতা নেই।বোঁটাদের জিজ্ঞেস করি, কি হে টনটন করছো না কেনো? কোমরকে জিজ্ঞেস করি, কি হে দাঁতগুলো গেলো কই? কামড় দিচ্ছে না কেনো? তলপেটকে আদর করতে করতে জিজ্ঞেস করি, ঘণ্টা বাজহে না কেনো, সময় কি হয় নি?স্তব্ধতাকে জিজ্ঞেস করি, তুমি কোথায়?শরীরকে জিজ্ঞেস করি, কিছু কি হয়ে গেছে? তোমার ভেতর একটা দুর্ঘটনা ঘ’টে গেছে? ঝামেলা বাঁধিয়ে বসেছো?তখন চক্রের কতো তারিখ ছিলো? পনেরো? যোলো? ভাই হবে; তাহলে হয়তো ঘ’টে গেছে অঘটনটি।যদি ঘ’টে যায়? প্রথম একটু ভয় লাগে, তারপর নিজেকে বলি, ভয় পাওয়ার কিছু নেই, মেয়ে, সময় এলে দেখা যাবে, উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।তিরিশ দিনের ভোরে ঘুমের ঘোরে মনে হয় ক্ষরণ হচ্ছে, তাড়াতাড়ি উঠে দেখার চেষ্টা করি, দেখি, কিছু নেই।আমি হাসি, ভয় পেয়ে গেছো? বলি, ভয় পাওয়ার কিছু নেই, ভাবারও কিছু নেই, চলতে থাকো।তিরিশ একত্রিশ বত্রিশ কেটে যায়; বুঝি যা ঘটার ঘ’টে গেছে।তুমি এখন একটি কারখানা; তোমার ভেতরে একটি মানুষ উৎপাদিত হচ্ছে,এখনো মানুষ হয়ে ওঠে নি, কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই হয়ে উঠবে।কী করবে তুমি? ভেজা ভেজা আবেগ জেগে উঠছে মা হওয়ার? মা হ’তে চাও তুমি? স্বর্ণের থেকে গরীরসী?একটা প্রাণী জন্মাচ্ছে তোমার ভেতরে, একটি দেহ জনাচ্ছে, বাপটি অবশ্য বৈধ নয়, এখন তুমি কী করবে?বৈধ নয়? তাতে কী আসে যায়? বৈধ কাকে বলে? কথা হচ্ছে তুমি একটি মানুষ জন্ম দিতে চাও কি না?আমি কোনো আবেগ বোধ করি না, কোনো মানুষ জন্ম দিয়ে ব্লাউজ খুলে বুকের দুধ খাওয়ানোর কোনো সাধ আমার ভেতরে খুঁজে পাই না। একটি মানবশিশুকে বুকে জড়িয়ে ধ’রে ছড়া গাইতে গাইতে ঘুমিয়ে পড়ার স্বপ্ন আমার চোখে দেখা দেয় না।তুমি অবশ্য বুঝতে পারছো কী ঘটছে তোমার ভেতরে, কিন্তু একটা পরীক্ষা করিয়ে দেখা দরকার নয়? এখনই পরীক্ষা করাবো? সময় নেবো কয়েক দিন? এতো তাড়াহুড়োর কী আছে? দিন দশেক সময় নিলে কেমন হয়?কিন্তু তিন চার দিন পরই দেখি কিছু করতে আমার ভালো লাগছে না, আমি ইউনিভার্সিটি থেকে সরাসরি যাই একটি ডায়াগনস্টিক কমপ্লেক্সে, পরীক্ষা করাই।বা ভেবেছিলাম, পজিটিভ।
পৃষ্ঠা-১০৩
বেবিতে ব’সে বাসায় ফেরার পথে আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করি, কেমন লাগছে তোমার? ঝামেলা মনে হচ্ছে? ভয় পাচ্ছো? বিরক্তি লাগছে? তোমার কি মনে হচ্ছে ওই দুই রাত ওসব না করলেও পারতে? মনে কি হচ্ছে একটা তুল ক’রে ফেলেছো? এখন তোমার অনুতাপ হচ্ছে?শুনতে পাই, ওই দুই রাত যা করেছি, তা আমার করতে ইচ্ছে করেছিলো, আমি ভুল করি নি, আমি সুখ পেয়েছি, কোনো অনুতাপ নেই। আমি জানতাম এটা ঘটতে পারে, আমি প্রস্তুতই ছিলাম।এখন? এখনও আমি প্রস্তুত।কীভাবে প্রস্তুত তুমি? রেখে দিতে চাও? না, তেমন কোনো নির্দেশ আমিপাচ্ছি না ভেতর থেকে। নির্দেশ পেলে রেখে দিতাম। রেখে দিতে পারতে? কেনো নয়? অবশ্যই পারতাম; কে আটকাতো?কী পরিচয়ে রাখতে? দেলোয়ারের? অবশ্যই নয়। ওই ভদ্রলোকের? তাও নয়। আমার পরিচয়ই কি যথেষ্ট নয়?একটা পুরুষের নাম তো দরকার। দরকার? তাহলে যে-কোনো একটি পুরুষের নাম দিয়ে দিতাম। শুধু নাম তো? একটা নাম দিতাম।শব্দটি যেনো কী? এমআর? করাতে হবে, আমি বেবিতে ব’সেই ঠিক করি। পথের পাশে মেরি স্টোপসের বিজ্ঞাপনগুলো একটির পর একটি পেরিয়ে যেতে থাকে বেবিটা; ওগুলো দেখতে আমার ভালো লাগে।বেবি থেকে নেমে আমি দৌড়ে দৌড়ে ফ্ল্যাটে উঠি, যেনো কিছু হয় নি, বা যা হয়েছে তা উল্লাসের, আমি যেমন চেয়েছিলাম, যেনো ফাইভে পরীক্ষা দিয়েছিলাম, পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে, আমি খুব ভালো করেছি, মাকে আর আব্বাকে জানানোর জন্যে তাড়াতাড়ি উঠছি, এর জন্যে ভাবনাচিন্তার কিছু নেই; এক দুপুরে গিয়ে ভেতরটা ধুয়েমুছে নিলেই চলবে, এমন কঠিন কিছু নয়; আধঘন্টা হয়তো চিৎ হয়ে পা দুটো ফাঁক ক’রে প’ড়ে থাকতে হবে, মেয়েলোকের এমন কতো চিৎ হ’তে হয়, ভেতরে একটি-দুটি যন্ত্রপাতি ঢুকবে, একটু ছিঁড়বে একটু কাৎরে উঠবো, তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে।খেয়ে এক পেয়ালা চা নিয়ে মেঝেতে বসেছি, কী ভেবে যেনো তলপেটের দিকে তাকিয়েছি, আর অমনি আমার ঘেন্না লাগে, শরীরটা ঘিনঘিন ক’রে ওঠে; আমার মনে হয় আমি দূষিত।চা খাচ্ছিলাম, পেয়ালাটি ঠোঁটের সামনে ধরেছিলাম, মনে হয় আমার ছোঁয়ায় পেয়ালাটি নোংরা হয়ে যাচ্ছে, লাল চা ঘোলা হয়ে যাচ্ছে, তাতে ময়লা জমছে, কিলবিল করছে ক্রিমি; দেখতে পাই আমার ভেতরে লোকটি একদলা ময়লা ঢুকিয়ে দিয়েছে, থকথকে ময়লার দলা সুড়ঙ্গ দিয়ে অন্ধ সাপের মতো এগোচ্ছে, বীজাণুগুলো পাল্লা দিয়ে ছুটে চলছে, আমার ভেতরটা থকথকে হয়ে উঠেছে। আমি একবার লাফিয়ে উঠি, আবর্জনার স্তূপ থেকে কোনো নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাই।
পৃষ্ঠা-১০৪
আমি চোখ বন্ধ করি, দেখতে পাই আমার জরায়ুতে একটা ফোড়া বেড়ে উঠছে, ময়লা থকথক করছে, পুঁজ জমাট বাঁধছে; ওই ময়লা ছড়িয়ে পড়ছে আমার রক্তে মাংসে সবখানে, ময়লা খাচ্ছে আমাকে।আমার ঘেন্না লাগে, ইচ্ছে করে দৌড়ে গিয়ে শাওয়ারের নিচে দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে থাকি।এই ময়লা আমাকে কতো দিন বইতে হবে? আজই কি ছুটে যাবো মেরি স্টোপসে? আজ গেলে হবে? না কি আরো বাড়তে দিতে হবে?আমি বিছানার দিকে তাকাই, ওটি কি থকথক করছে ময়লায়? আমি টেবিলে শেক্ষে বইগুলোর দিকে তাকাই। ওগুলো বই? থকথকে ময়লা? মেঝের ওপর দিয়ে ময়লা গড়িয়ে চলছে?আমার ঘেন্না লাগে, বমি আসে, গা ঘিনঘিন করে; আমি বারান্দার গিয়ে দাঁড়াই, আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে হয় থকথকে ময়লায় আকাশ ভ’রে আছে, আকাশ থেকে দলা দলা ফল গ’লে পড়ছে।আমি চোখ বন্ধ ক’রে ফেলি।দৌড়ে বাথরুমে যাই, বমি করার চেষ্টা করি; আমার বমি আসে না, ঘেন্নায় শরীরটা খুলিয়ে উঠতে থাকে।চোখ বন্ধ ক’রে আমি মেঝের ওপর ব’সে থাকি, দেখতে পাই আমার ভেতর দিয়ে ময়লা বয়ে চলছে, আমার ভেতরে ময়লা বাড়ছে, আমার ভেতরে জ’মে উঠছে মলের স্তূপ।আমার মুখে একরাশ খুঁতু এসে জমে।আর কতো দিন আমাকে বইতে হবে ঘিনঘিনে ময়লা? কতো দিন আর ঘিনঘিন করবে আমার ভেতরটা? আর কতো দিন আমি বইবো ওই লোকটির মল? আমি কাঁপতে থাকি, আমার আর একদিনও বইতে ইচ্ছে করছে না।চোখ বন্ধ ক’রে দুই হাঁটুর ভেতর মাথা গুঁজে আমি ব’সে থাকি, জমাট অন্ধকার ঘিরে ধরে আমাকে, আমি আলো খুঁজতে থাকি, অনেকক্ষণ পর একটু একটু আলোর ঝিকিমিকি দেখতে পাই; আমি নিজেকে বোঝাতে থাকি, তুমি এতো ঘিনঘিনে ভাবছো কেনো নিজেকে? তুমি তো জানো তুমি মেয়েমানুষ, মেয়েমানুষকে ময়লা বইতেই হয়; তুমি যদি পুরুষের সাথে যাও, তুমি দূষিত হবেই, পুরুষ তোমাকে দূষিত করবেই। তুমি যদি দূষিত হ’তে না চাও, পুরুষের সঙ্গে যাবে না। তুমি ভেঙে পোড়ো না, কয়েক দিনের মধ্যেই তুমি নিজেকে পরিষ্কার ক’রে নেবে, তোমার ভেতরে কোনো পুরুষের ময়লা থাকবে না। ময়লা তোমাকে পেরিয়ে যেতে হবে, এটা নিয়ে আর ভাববে না, কাল পরশু একবার মেরি স্টোপসে যাবে, দেখবে কখন তুমি ধুয়ে ফেলতে পারো নিজেকে। তুমি তো বোঝোই তোমার ভেতরে ময়লার বয়স উনিশ-বিশ দিনের বেশি নয়, এখন খুঁজেই পাওয়া যাবে না, ওটাকে বাড়তে দাও, তারপর ফেলে দেবে। এখন তুমি আর এর কথা ভাববে না; কে বলেছে তুমি দূষিত? তুমি দূষিত নও।
পৃষ্ঠা-১০৫
আমার ভেতর যে-বালিকাটি আছে, তাকে বোঝালে বোঝে।কোথায় দূষিত আমি? আমার আঙুলগুলো ঝলমল করছে, ওগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে, আমার হাতের তালু নিটোল, আমার ত্বক মসৃণ, কোনো রেখা পড়ে নি; আমার তলপেটে কোনো দাগ নেই, এটা খুলে পড়ে নি, একটি গভীর নাভির নিচে আমার তলপেট নিটোল, তারপর রেশমের মতো সবুজ ঘাসের মতো উর্ণাজাল, বোঁটা সুন্দর, তাদের ঘিরে আছে লালাভ জ্যোতিশ্চক্র, আমার মুখে নিগ্ধতা।কোথায় দুষিত আমি? আমি দূষিত নই।সন্ধ্যার পর এক কাপ চা নিয়ে লিখতে বসেছি, লেখাটা বেশ এগোচ্ছে, আমি ওসব ভুলে গেছি, কটা বাজে তাও ভুলে গেছি, শুনি কলিংবেল বাজছে। কটা বাজে? তাকিয়ে দেখি দশটা। আবার কলিংবেল বাজে। এই প্রথম আমার ফ্ল্যাটে কলিংবেল বাজলো; আমার ভালোই লাগে, কোনো একটি মানুষ এসেছে, সে যেই হোক, তার মুখ দেখতে পাবো, কথা বলতে পারবো।আমি দরোজা খুলে দেখি দেলোয়ার।দেলোয়ারকে কি দরোজা থেকে বিদায় ক’রে দেবো? আমার নিজেরই ভালো লাগবে না, মনে হবে একটি মানুষকে অপমান করেছি।
আমি বলি, এসো।ঢুকেই সে আমাকে জড়িয়ে ধরতে চায়; আমি বলি, না।তার মুখ থেকে একটা গন্ধ বেরিয়ে আসছে, গন্ধটা আমি চিনি, অনেক দিন পর পেলাম গন্ধটা, আগে আমার খারাপ লাগতো না, ভালোই লাগতো, আজ আমার একটু খারাপ লাগে; এবং একটু কাঁপছে দেলোয়ার।আমি বলি, পান করার পর অন্য কারো বাসায় যাওয়া ঠিক নয়।সে বলে, অন্য কারো নয়, আমি নিজের বাসায়ই এসেছি।আমি বলি, এটা তোমার বাসা নয়, আমার।সে বলে, চলো, বেডরুমে যাই।আমি বলি, তুমি বসতে চাইলে ড্রয়িংরুমেই বসতে হবে।আমি ড্রয়িংরুমের দিকে হাঁটতে থাকি, দেলোয়ার আমাকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করতে করতে ড্রয়িংরুমে ঢোকে।আমি বলি, তুমি ওখানে বসো।সে বলে, আমি তোমার পাশে বসতে চাই, জড়িয়ে ধরতে চাই, চুমো খেতে চাই।আমি বলি, আগে তুমি ওখানে বসো।দেলোয়ার বসতে বসতে বলে, আমি অফিসে ব’সে চার ক্যান বিয়ার খেয়েছি, এতে আমার কিছু হয় না, আমি মাতাল নই।আমি বলি, হ্যাঁ, তুমি মাতাল নও, কিন্তু তোমার বোধ হয় ক্ষুধা পেয়েছে,
পৃষ্ঠা ১০৬ থেকে ১২০
পৃষ্ঠা-১০৬
তুমি কি কিছু খাবে?সে বলে, না, আমি খেতে আসি নি, তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি। আমি বলি, তোমার বোধ হয় কিছু খেয়ে নেয়া দরকার।সে বলে, না, আমি খেতে আসি নি।আমি দুজনের সোফাটিতে বসেছি, দেলোয়ার বসেছে পাশের একজনের সোফাটিতে; তার কথা শুনে আমি একটু শক্ত হয়ে বসি।আমি বলি, তুমি জানো আমি যাবো না।সে বলে, কেনো যাবে না? তুমি আমার ওয়াইফ, তোমাকে যেতেই হবে।এ-প্রশ্ন ও দলিলটি নিয়ে আমি ভেবেছি। তার একটি দলিল আছে, দলিলটি তাকে অধিকার দিয়েছে, তাই আমাকে একটি উত্তর দিতে হবে, সেটা গ্রহণযোগ্য হ’তে হবে। আমার জীবনটা তো আমার নয়, এটা সমাজের রাষ্ট্রের সভ্যতার। উত্তরটি শুধু দেলোয়ারের কাছে দিলেই হবে না, দিতে হবে সবার কাছে, আমি সবার কাছে দায়বদ্ধ, সবাইকে ঠিকমতো বুঝিয়েসুজিয়ে সবাই রাজি হ’লেই শুধু আমি দেলোয়ারকে ছেড়ে দিতে পারি, নইলে পারি না।কতোজনকে যে বোঝাতে হবে? রিক্সাঅলাকে বোঝাতে হবে, পানের দোকানদারকে বোঝাতে হবে, মুদি দোকানদারকে বোঝাতে হবে? পিয়নটিকে, ডিরেক্টরকে, কাজের মেয়েটিকে, মসজিদকে বোঝাতে হবে? না বুঝিয়ে আমি কিছু করতে পারি না।উত্তরটি প্রথম কার কাছে দিতে হবে? দেলোয়ারের কাছে? দিলে সে কি মেনে নেবে? এর চেয়ে আমার, এবং দেলোয়ারের, জন্যে কি কোনো প্রশ্ন কোনো উত্তর ছাড়া দূরে স’রে যাওয়া ভালো নয়? আমার তাই মনে হয়েছে। কিন্তু দেলোয়ার দেখছি তা মেনে নিতে রাজি নয়। দেলোয়ারকে আমার খারাপ লাগে না, ভালোই লেগেছে এতোদিন, এখনো লাগে, আমি শুধু চেয়েছি আমার কাছে সৎ থাকতে; আমি জীবন বদলে দিয়েছি,তাই তার কাছে আমি যেতে পারি না, নিজেকে আমার অসৎ মনে হবে,সারাজীবন নিজেকে আমার ঘেন্না লাগবে। আমি ঘেন্নার মধ্যে থাকতে পারি না।আমি কি দেলোয়ারকে বলবো কেনো তার কাছে আমি যাবো না?সে কি তা মেনে নেবে? সহ্য করতে পারবে? পুরুষেরা কি এটা সহ্য করে? সে কি উত্তেজিত হয়ে উঠবে না, একটা বিকট কাণ্ড বাঁধাবে না? মিথ্যে কথা বলবো? আমি কি মিথ্যে কথা বলতে পারবো? কেনো মিথ্যে বলবো? না, আমাকে নিয়ে আমি মিথ্যে বলতে পারবো না; আমার জীবন নিয়ে আমি কেনো মিথ্যে বলবো? উত্তর দিলে আমাকে সত্য উত্তরই দিতে হবে।আমি বলি, শোনো, আমি তোমার স্ত্রী ছিলাম।সে বলে, তুমি আজো আমার ওয়াইফ। আমি বলি, তুমি কি বুঝতে পারছো না আমি আর ফিরে যেতে চাই না?
পৃষ্ঠা-১০৭
সে বলে, কেনো যেতে চাও না?আমি বলি, তা তুমি জানতে চেয়ো না।সে বলে, কেনো জানতে চাইবো না? আমি বলি, জেনে তো লাভ নেই।সে বলে, তুমি কি আমার থেকে ভালো কাউকে পেয়েছো?আমি বলি, না। সে বলে, তাহলে যাবে না কেনো?আমি বলি, এটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত, তোমাকে বলতে চাই না।সে বলে, আমাকে গুনতেই হবে।আমি বলি, শুনে কী হবে?সে বলে, আমাকে শুনতেই হবে।আমি বলি, শুনে তুমি সুখী হবে না।সে বলে, তবু আমি শুনতে চাই।আমি বলি, তোমার শোনার দরকার নেই।সে বলে, আছে।আমি বলি, তুমি এখন যাও।সে বলে, না শুনে আমি যাবো না।দেলোয়ার উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধ’রে চুমো খাওয়ার চেষ্টা করে, আমি তাকে দূরে ঠেলে দিই, যদিও কয়েক দিন ধ’রে আমি ক্ষুধা বোধ করছি, পুরুষের আঙুল ঠোঁট দাঁত প্রভৃতির জন্যে কামনা জেগে উঠছে, এই সময়টাতেই আমি তীব্র বাসনার মধ্যে থাকি, ভেঙে পড়তে গ’লে যেতে কেঁপে উঠতে ঘুমিয়ে পড়তে বেশি পন্দ করি, কিন্তু দেলোয়ারের স্পর্শ আমাকে কোনো তাপ দেয় না, আমি ঠাণ্ডা হয়ে উঠি, মনে হয় এমন আলিঙ্গন আমার শরীর চায় না।আমি বলি, এটা চুমো খাওয়ার সময় নয়। সে বলে, আমাকে বলতেই হবে কেনো তুমি যাবে না?বলতেই হবে? আমি বলতে চাই না, কিন্তু বলতেই যদি হয় সত্যটিই বলতে হবে, আমি ভাবতে থাকি, মিথ্যে আমি বলতে পারবো না।দেলোয়ারের সামনে আমার ব’সে থাকতে ইচ্ছে করে না, কিন্তু তাকে আমি বের ক’রে দিতে পারি না, আমি বললেও সে বেরোবে না।আমি বলি, আমি এখনো খাই নি, তুমি কি খাবে?সে বলে, তোমার সেই টোস্ট আর জ্যাম তো?আমি বলি, হ্যাঁ।আমি রান্নাঘরে যাই; টোস্ট সেঁকি, জ্যাম মাথি, কয়েক টুকরো মাংস ভাজি, চা বানাই, আমার সময়টা চমৎকার কাটতে থাকে, নিজেকে জিজ্ঞেস করতে
পৃষ্ঠা-১০৮
থাকি, আমি কি বলবো? একদিন তো বলতেই হবে, এখনই বলা ভালো, আমি আর দেলোয়ারের ভার বইতে পারছি না।একটি ট্রেতে ক’রে কয়েক টুকরো জ্যামমাখা টোস্ট, ভাজা মাংস, চা নিয়ে আমি ড্রয়িংরুমে ঢুকি। দেখি সে ঝিমোচ্ছে।আমি বলি, এই, টোস্ট খাবে?সে ঝিমোনো থেকে জেগে উঠে বলে, খাবো।আমি দু-টুকরো টোস্ট, মুরগি ভাজা, আর চা এগিয়ে দিই ওরে দিকে। ওর জন্যে আমার কষ্ট হয়, হয়তো ও এর মাঝে কাজের মেয়েটির বা আরো কারো সাথে ঘুমিয়েছে, মুমোক, তাতে আমার কী, কিন্তু একটা অভাব ওকে ভেঙে ফেলছে, আমার কষ্ট হয়; কিন্তু আমার কিছু করার নেই, আমি জীবন বদলে দিয়েছি, আমি তাকে জীবনের এই ঝিমোনো থেকে তুলে আনতে পারি না।আমি বলি, আরেক টুকরো মাংস নেবে?সে বলে, দাও।আমি আরেক চিলতে টোস্ট আর কয়েক টুকরো মাংস এগিয়ে দিই। সে খেতে খেতে বলে, আমি আজ তোমার সঙ্গে থাকবো।আমি বলি, না।সে বলে, আমার সঙ্গে শুতে তোমার ইচ্ছে করে না?আমি বলি, না।সে বলে, ওই লোকটি কি তোমার কাছে আসবে এখন?আমি বলি, ইতরামো কোরো না।সে বলে, তাহলে তুমি আমাকে ছেড়ে দিচ্ছো কেনো?আমি বলি, এটা আমার ব্যক্তিগত।সে বলে, না, ব্যক্তিগত নয়, আমাকে বলতেই হবে।আমার রক্ত ঝনঝন ক’রে বেজে ওঠে, ছিড়ে পড়তে চায় রগগুলো, মাখা টনটন ক’রে ওঠে। ওকে কি বলতেই হবে? আমার ব্যক্তিগত ব’লে কিছু নেই? দেলোয়ার আমার স্বামী ছিলো, এখনো আছে, অন্যের চোখে, তাই আমারব্যক্তিগত কিছু থাকবে না?আমি বলি, তোমার শুনে কী হবে?সে বলে, আমি শুনবো।আমি বলি, সহ্য করতে পারবে না।সে বলে, পারবো।আমি বলি, পারবে না।সে বলে, বলো, আমি পারবো।আমার ভেতরে আগুনের অজস্র স্ফুলিঙ্গ আমি টের পাই, কট ক’রে একসাথে
পৃষ্ঠা-১০৯
সেগুলো জ্ব’লে উঠছে, চারপাশের খড়কুটোয় গাছপালায় ঘরবাড়িতে আগুন ধ’রে যাচ্ছে, দাউদাউ ক’রে উঠছে; আমি বুঝতে পারি না কীভাবে এ-আগুন থামাবো।আমি বলি, তুমি কি সত্যিই সহ্য করতে পারবে? সে বলে, পারবো।আমি বলি, আমি প্রেগন্যান্ট।সে চমকে ওঠে, বলে, কী ক’রে হলো? আমি তো রাবার ইউজ করি।আমি বলি, হয়েছে।সে উত্তেজিত হয়ে বলে, কী ক’রে হলো? হ’তে পারে না।আমি বলি, সবাই রাবার ইউজ করে না।সে বলে, সবাই? সবাই কে?আমি চুপ ক’রে থাকি, তাকিয়ে দেখি দেলোয়ারকে; সে কাঁপছে, সে বিশ্বাস করতে পারছে না আমার ভেতরে একটা কিছু ঘটেছে, সে তো খুবই সাবধান, খুবই যত্নের সাথে সে প্যাকেট ছিঁড়ে ধীরেধীরে রাবার পরে, টেনে দেখে ভেতরে বাতাস আছে কি না, ফেটে যেতে পারে কি না, টেনে মূল পর্যন্ত নিয়ে আসে, পারলে সে ওটিকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতো।আমি বলি, এটা তোমার নয়।সে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে, তারপর বলে, আমার নয়?আমি বলি, না।ওর মুখটি খুব হিংস্র দেখায়, হয়তো এখনি লাফিয়ে পড়বে আমার ওপর, আমি একটু ভয় পাই, কিন্তু শক্তভাবে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি।সে বলে, সত্যিই আমার নয়?আমি বলি, না।সে বলে, তাহলে কার?আমি বলি, সেটা জেনে তোমার লাভ নেই।সে বলে, তবু আমাকে জানতে হবে।আমি বলি, তোমার জানার দরকার নেই।সে বলে, আছে।আমি বলি, আমি তোমাকে বলবো না।সে বলে, তোমাকে বলতেই হবে।দেলোয়ার ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ছে, স্তব্ধ হয়ে আছে, একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে ওর ভেতর দিয়ে, তার স্থাপ ওর চোখেমুখে দেখা যাচ্ছে; আমাকে আক্রমণ করার জন্যে ভেতরে ভেতরে সে উত্তেজিত হয়ে উঠেছে, কিন্তু উঠে আমাকে আক্রমণ করবে সে-শক্তিও পাচ্ছে না। ওর জন্যে আমার মায়া হয়, ইচ্ছে করে ওর ভেতরের ঝড়টা এক নিমেষে থামিয়ে দিই।
পৃষ্ঠা-১১০
সে বলে, ওটা কি তোমার ডিরক্টরের?আমি শীতলভাবে বলি, হ’তে পারে।সে বলে, না কি তোমার পিয়নের?আমি ঘলি, হ’ভে গারে।সে বলে, না কি রিক্সাঅলার?আমি বলি, হ’তে পারে।সে বলে, না কি পানঅলার?আমি বলি, হ’তে পারে।সে বলে, ওটা কার?আমি ঠাঙ্গভাবে বলি, এরা ছাড়াও দেশে আরো অনেক পুরুষ আছে।সে বলে, তুমি এই সবার সঙ্গে শোও?আমি বলি, অসুবিধা কী?দেলোয়ার কাঁপতে থাকে, একবার সে বিশ্বাস করতে চায়, আরেকবার তার বিশ্বাস হয় না; বিশ্বাস করলে সে মারা যাবে।সে বলে, বলো, তোমার ভেতরের জারজটা কার?আমি বলি, জারজ নয়।সে বলে, তাহলে ওটা কী?আমি বলি, ওটা একটা ভ্রণ।সে বলে, আমার না হ’লে ওটা জারজ হবে না?আমি বলি, না।সে বলে, আমার না হ’লে অবশ্যই ওটা জারজ।আমি বলি, হয়তো জারজ, তাতে কী?সে বলে, তাতে কিছু নয়?আমি বলি, না।দেলোয়ার উত্তেজিত আর ক্লান্ত; তার মুখে আমি একটি বিপর্যন্ত ভগ্ন অসহায়পুরুষকে দেখতে পাই, মনে হয় পুরুষ কখনো এর থেকে বেশি পরাজয়ের গ্লানিবোধ করে নি। পুরুষ রাজ্য ছেড়ে দিতে পারে, পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়তেপারে, কিন্তু তার মেয়েলোক আরেকটি পুরুষের সাথে ঘুমিয়েছে, এটা সহ্য করা সম্ভব নয় তার পক্ষে।সে বলে, ওটা কোন কুত্তারবাচ্চার?আমি বলি, তা তোমাকে আমি বলবো না।সে বলে, বলতেই হবে।আমি বলি, না।সে বলে, এজন্যেই তুমি আমাকে ছেড়ে যাচ্ছো?
পৃষ্ঠা-১১১
আমি বলি, হয়তো।সে বলে, কুত্তারবাচ্চাটা কে?আমি বলি, তা তোমার জানার দরকার নেই।সে বলে, কুত্তারবাচ্চাটা থাকে কোথায়?আমি বলি, এই শহরেই।সে বলে, কুত্তারবাচ্চাটা কি আমার থেকে হ্যান্ডসাম?আমি বলি, ভেবে দেখি নি।সে বলে, কুত্তারবাচ্চাটা কি আমার থেকে ধনী?আমি বলি, জানি না। আমি নিজেকে বলছিলাম, সহ্য করো, ঠাণ্ডা থাকো, স্থির থাকো, ধীর থাকো, এখন তোমার উত্তেজিত হওয়ার সময় নয়; কিন্তু দেখতে পাই আমার ভেতর বিষ জ’মে উঠছে, আমি সহ্য করতে পারছি না।সে বলে, কুত্তারবাচ্চাটার সাথে তুমি প্রত্যেক রাতেই থাকো? আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, কুত্তারবাচ্চাটা কি দিনেও আসে? আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, কুত্তারবাচ্চাটা আজ রাতেও আসবে? আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, কুত্তারবাচ্চাটা তোমার সঙ্গে সারারাত থাকে? আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, কুত্তারবাচ্চাটার বউ নেই?আমি বলি, হয়তো আছে।সে বলে, তুমি তাও জানো না?আমি বলি, জানার দরকার বোধ করি নি।সে বলে, তুমি যার-তার সাথে চিৎ হও?আমি বলি, হয়তো হই।দেলোয়ার ভেঙে পড়ছে, ক্রুদ্ধ হয়ে উঠছে, ওর চোখে অসুস্থ আগুন জ্বলছে; মনে হয় ও আমাকে ছিড়েফেড়ে ফেলবে, পুড়িয়ে ছাঁই ক’রে ফেলবে।আমি একটু ভয় পাই, উঠে ও আমার গলা চেপে ধরতে পারে, মুখে আঘাত ক’রে আমার মুখটিকে বিকৃত ক’রে দিতে পারে, আমাকে ভেঙেচুরে ফেলতে পারে, কিন্তু আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকি।দেলোয়ার অসুস্থ হয়ে পড়ছে ব’লে আমার মনে হয়।আমার ইচ্ছে হয় ওর হাত ধ’রে নিয়ে ওকে বিছানায় শুইয়ে দিই, কিন্তু ও শুতে চাইবে না, ওর চোখমুখ দেখে আমি বুঝতে পারি। ও কি আক্রমণ করবে?
পৃষ্ঠা-১১২
কীভাবে করবে? কতোটা করবে? খুন করবে? আমি কি আক্রমণের মুখ থেকে পালিয়ে যাবো? আমার পালাতে ইচ্ছে করে না।সে উঠে এসে আমাকে শক্ত ক’রে ধ’রে বলে, তুমি একটা প্রস্টিটিউট।তার আঙুল আমার দুই বাহুর ভেতর গেঁথে গেছে, আমি প্রচণ্ড যন্ত্রণা বোধ করি, কিন্তু সহ্য করার চেষ্টা করতে থাকি।আমি বলি, হ’তে পারি।সে বলে, এতোদিন আমি একটা প্রস্টিটিউটের সাথে থেকেছি?আমি বলি, প্রস্টিটিউট কেনো, তারচেয়ে বেশি।সে বলে, তুমি টানবাজারে গিয়ে নাম লেখাও।আমি বলি, লেখাবো।সে বলে, তোমাকে আমি রেইপ করবো।আমি বলি, করো।সে বলে, রেইপ করতে করতে তোমাকে আমি শেষ করবো।আমি বলি, করো।সে বলে, তোমার পেটেরটাকেও শেষ করবো।আমি বলি, করো।আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি।দেলোয়ার টেনে ছিঁড়তে থাকে আমার ব্লাউজ শাড়ি, ছিঁড়তে তার কষ্ট হয়, আমার শরীরে তীব্র চাপ পড়ে, চামড়া কেটে যাচ্ছে মনে হয়; আমি ব্রা পরি না, বহুদিন পর দেলোয়ার আমার স্তন দুটি দুলে উঠছে দেখে বিহ্বল হয়ে পড়ে, আমাকে টেনে নিয়ে মেঝের ওপর চিৎ ক’রে ফেলে। আমি বাধা দিই না; ও আমাকে ধর্ষণ করতে চায়, করুক। সে তার ট্রাউজার আর শার্ট খুলে ফেলে নগ্ন হয়ে আমার ওপর গড়িয়ে পড়ে; এবং প’ড়েই চায় আমার ভেতর ঢুকতে, ঢুকে আমাকে ছিন্নভিন্ন ক’রে ফেলবে, শেষ ক’রে ফেলবে, আমার যে-প্রত্যঙ্গটি তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে ধ্বংস ক’রে ফেলবে সেটিকে; সে খুব উত্তেজিত, কাঁপছে, সে বারবার চেষ্টা করতে থাকে, পেরে ওঠে না, কিছুতেই দুঢ় হ’তে পারে না। আমি চিৎ হয়ে প’ড়ে থাকি, মনে করতে থাকি এ শরীরটা আমার নয়, এটা নিতান্তই একটি শরীরমাত্র, আমার নয় অন্য কারো নয়, এটা একটি শরীর, দেলোয়ার সেটিকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করছে, পেরে উঠছে না।কিন্তু ধর্ষণ করতেই হবে তার, আমি মনে মনে বলি, করো, এতে আমার কিছু যায় আসে না, যতো পারো করো, অনন্তকাল ধ’রে করো।সে পেরে ওঠে না।কিন্তু তাকে পারতে হবে, ধর্ষণ করতে হবে আমাকে।সে আমাকে চুমো খেতে থাকে, আমি উত্তর মেরুর মতো প’ড়ে থাকি, এতো ঠান্ডা আমি হ’তে পারি, তা আমি কখনো ভাবতেও পারি নি, আগে যেমন সাড়া
পৃষ্ঠা-১১৩
দিতো আমার জিভ ঠোঁট চিবুক বাহু গ্রীবা পিঠ জংঘা সেগুলো সাড়া দেয় না, আমার ভয় হচ্ছিলো ওগুলো হয়তো সাড়া দিয়ে ফেলবে, কিন্তু ধর্ষণকারীর ছোঁয়ায় ওগুলো কেঁপে ওঠে না জ্ব’লে ওঠে না, ওগুলো ধর্ষিত হ’তে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে নি, সে আমার স্তন চুষতে তাকে, কামড় দিতে থাকে, আমাকে উল্টেপাল্টে চুমো খেতে থাকে, দুমড়েমুচড়ে ফেলতে থাকে, বারবার চেষ্টা করতে থাকে ভেতরে ঢুকতে। সে তার প্রত্যঙ্গটিকে দৃঢ় করার চেষ্টা করতে থাকে, সে চাচ্ছে ওটা একটা তলোয়ার হয়ে উঠুক, যা দিয়ে সে আমাকে টুকরো টুকরো ক’রে ফেলবে, কিন্তু সে দৃঢ় হ’তে পারছে না, ওটি সাড়া দিচ্ছে না, একটা প’চে যাওয়া মাংসের দলাকে সে ঠেলে ঠেলে আমার ভেতরে ঢুকোতে চেষ্টা করে, সেটি কিছুতেই ঢোকে না, ঘণ্টাখানেক ধ’রে সে আপ্রাণ পরিশ্রম করতে থাকে, আমি শীতলভাবে নিচে প’ড়ে থাকি।এক সময় সে আমার পাশে গড়িয়ে প’ড়ে কাঁদতে থাকে, আমি পারছি না, আমি পারছি না।সে কুঁকড়ে প’ড়ে থাকে, মনে হয় ম’রে গেছে, আর কোনোদিন জেগে উঠবে না; তার জন্যে আমার কষ্ট হয়, একবার পরলে ও সুস্থ হয়ে উঠতো।আমি বলি, তুমি কি আরেকবার চেষ্টা ক’রে দেখবে?সে বলে, না, আমি পারবো না।আমি বলি, আরেকবার দেখবে পারো কি না?সে বলে, না, আমি শেষ হয়ে গেছি।দেলোয়ার কুঁকড়ে প’ড়ে থাকে, এখন প’ড়ে থাকাই ভালো ওর জন্যে।আমি কাপড় পরি, পরতে আমার কষ্ট হয়, শরীরটা আমার ভেঙে গেছে, কিন্তু আমি শক্ত হওয়ার চেষ্টা করি।কাপড় প’রে তার পাশে গিয়ে ব’সে জিজ্ঞেস করি, তোমার কী হলো?সে মৃতের মতো প’ড়ে আছে, বলে, আমি আর কোনোদিন পারবো না।আমি বলি, শরীর খারাপ লাগছে?সে বলে, আমি শেষ হয়ে গেছি।আমি বলি, তুমি একটু অসুস্থ, ঠিক হয়ে যাবে।সে বলে, না, ঠিক হবে না।আমি এক গ্লাস পানি ওর হাতে দিয়ে বলি, পানি খাও।দেলোয়ার করুণভাবে আমার দিকে তাকিয়ে পানি খেতে থাকে।আমার শরীরটা ব্যথা করছে, ভেঙেচুরে পড়তে চাচ্ছে, শরীরকে বলি, এটাকিছু নয়, এটুকুতে কিছু হয় না, ভেঙে পোড়ো না, বেশি কিছু হয় নি, তুমি একটি ধর্ষণকারীর কবলে পড়েছিলে, কিন্তু সে পারে নি, সে তোমাকে ছিঁড়েফেড়ে ফেলতে পারতো, ভাঙতে চুরতে পারতো, তুমি সুস্থ থাকো, তোমার নাক ভেঙেযেতে পারতো, স্তন ছিঁড়েফেড়ে যেতে পারতো, তুমি সুস্থ থাকো।
পৃষ্ঠা-১১৪
আমার শরীরটা আমার মতোই, ঠিকভাবে বললে কথা শোনে বোঝালে বোঝে; আমি উঠে গিয়ে পানি গরম করি, দু-কাপ চা বানাই, ট্রেতে ক’রে চা আর বিস্কুট দিয়ে দেলোয়ারের পাশে রাখি।আমি বলি, এখন কেমন লাগছে?সে বলে, আমি নেই।আমি বলি, বিস্কুট খাও, চা খাও।সে মাথা নিচু ক’রে বিস্কুট আর চা খেতে থাকে, সে শিখিল হয়ে পড়েছে, তার আঙুল এক টুকরো বিস্কুটও ঠিকমতো ধরতে পারছে না; আমার দিকে সে তাকাতে পারছে না, পরাজয়ের যন্ত্রণায় সে ভেঙে পড়ছে।আমি বলি, কেমন আছো, একটু ভালো লাগছে?সে বলে, আমি আর কোনোদিন পারবো না।আমি বলি, ও নিয়ে ভেবো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।সে বলে, তুমি তো আমার থাকবে না?আমি বলি, না।সে বলে, এখন আমি কী করবো?আমি বলি, কাপড় পরো, বাসায় গিয়ে ঘুমোও, দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে।সে বলে, ওই লোকটি কি এখন আসবে?আমার রাগ ধরে, আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, তুমি লোকটিকে নিয়ে সারারাত ঘুমোবে?আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, ওই লোকটি খুব ভালো পারে?আমি বলি, হ্যাঁ।দেলোয়ার হুহু ক’রে কাঁদতে শুরু করে, তার শরীর কেঁপে কেঁপে ভেঙেপড়তে চায়, সে আমার দিকে তাকাতে পারে না।আমি তার দিকে ট্রাউজার এগিয়ে দিয়ে বলি, পরো। দেলোয়ার পরার চেষ্টা করে, পেরে ওঠে না; আমি টেনে টেনে তাকেট্রাউজার পরিয়ে দিই, বেল্ট এঁটে দিই; শার্টটা তার হাতে দিই, তার হাত কাঁপতে থাকে, আমি তাকে শার্ট পরিয়ে দিই।আমি বলি, এবার যাও।দেলোয়ার আমার দিকে তাকায় না, অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর দরোজার দিকে চুলে চুলে হাঁটতে থাকে, আমি দাঁড়িয়ে থাকি। তার সাথেদরোজা পর্যন্ত যেতে আমার ইচ্ছে করে না।শব্দ শুনি দেলোয়ার দরোজা খুলে বেরিয়ে গেলো, একবার ইচ্ছে করে গিয়ে তাকে হাত ধ’রে সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে দিই, সে সিঁড়িতে প’ড়ে যেতে পারে, দরোজায় গিয়ে দেখি সে নেই। দরোজা বন্ধ ক’রে এসে আমি বিছানায় শুয়ে
পৃষ্ঠা-১১৫
পড়ি, নিজেকে বলতে থাকি, তুমি কিছু মনে কোরো না, এটা এমন কিছু হয় নি, জীবন বদলে দেয়ার পর জীবনে কতো কিছু ঘটে, এর পর হয়তো আরো কতো কিছু ঘটবে, এতে তুমি কিছু মনে কোরো না, এসব মনে রেখো না।কিন্তু আমার শরীরটা কোঁকাতে থাকে, ফুলের টোকাও কখনো ওর গায়ে লাগে নি, আজ আমার প্রিয় শরীরটা দুমড়েমুচড়ে গেছে। আমার মাংসের প্রতিটি কণার ভেতর দিয়ে বিষের যন্ত্রণা বয়ে যাচ্ছে, কোষগুলো ছিঁড়েছিঁড়ে যাচ্ছে, ফেটে পড়ছে রগগুলো। একবার মনে হয় পাঁজরের মাঝখানের হাড়টি ভেঙে গেছে, ভয় পেয়ে আমি হাড়টি টিপেটিপে দেখি; না, ভাঙে নি, আমি স্বস্তির শ্বাস ফেলি; আবার মনে হয় নিচের হাড়টি ভেঙে গেছে, টিপে দেখি, না, ভাঙে নি, আমি গভীর ভয় থেকে ভেসে উঠি; আবার মনে হয় উরু দুটো খ’সে প’ড়ে গেছে, ও দুটো আমার কোমরের সাথে নেই, আমি ভয় পেয়ে উঠে দেখি ও দুটো আমার শরীরের সাথেই আছে; মনে হয় আমার স্তন দুটো ছিঁড়ে প’ড়ে গেছে, ওখানে কোনো স্তন নেই, আছে শূন্যতা, আমি শিউরে উঠে ও দুটোকে জড়িয়ে ধরি। আমার স্তনে কামড়ের দগদগে দাগ, পেটে দাগ, বাহুতে দাগ; দাগগুলোতে আগুনের কুণ্ড জ্বলছে। যন্ত্রণা হচ্ছে অথচ আমার কোনো দুঃখ লাগছে না; শরীর যন্ত্রণায় ভ’রে গেছে, কিন্তু আমার মনে কোনো কষ্ট নেই। আমি শুয়ে থাকতে পারছি না, মাংসের কূপেকূপে বিষ জ’মে গেছে। আমি উঠে পানি গরম করি, দু- বালতি গরম পানি নিয়ে বসি বাথরুমে; গরম পানি ঢালতে থাকি শরীরে, টাওয়েল ভিজিয়ে এখানে সেখানে চেপে ধরতে থাকি, আমার শরীর ঝিলিক দিতে থাকে, আমি বলতে থাকি, কিছু নয়, সব ঠিক হয়ে যাবে।পরদিন ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার জন্যে বেবিতে উঠেছি, অমনি আমার ময়লার টুকরোটিকে মনে পড়ে; আমি একবার হেসে উঠি, দেখি আমার ঘেন্না লাগছে না, ওটিকে আর ময়লা মনে হচ্ছে না।আমি ওর সাথে মনে মনে কথা বলতে থাকি।আমি বলি, অই প্রাণকণা, ছোট্ট রক্তবিন্দু, তোর কাছে ক্ষমা চাই, তোকে ঘেন্না করেছি ব’লে, তোকে ময়লা বলেছি ব’লে।এখন থেকে যতোদিন আছিস তোকে আর ময়লা বলবো না; তুই প্রাণকণা, তুই রক্তবিন্দু, তুই উল্লাস, তুই ঘাসফুল, তুই মৌমাছি।তোর মুখ দেখতে ইচ্ছে করে, কিন্তু প্রাণকণা, তোকে আমি দেখতে পাবো না, তোকে আমি দেখবো না।তোর কি দেখতে ইচ্ছে করে মাটি? ঘাস? মেঘ? লাল ফুল? পাখি? তোকে যদি আমি ঘাস দেখাতে পারতাম, চন্দ্রমল্লিকা দেখাতে পারতাম।তুই যদি হোতি একা আমার, তোকে চুমো খেতাম; কিন্তু তুই একা আমারনোস, তুই আরেকজনের ময়লা থেকে এসেছিস।ওই ময়লার প্রবাহকে আমি ঘেন্না করি, তুই তা বুঝবি না। আমাকে ক্ষমা করিস, তোকে আমি দেখতে পাবো না।
পৃষ্ঠা-১১৬
তোকে আমি মনে রাখবো, তোর মুখ আমার মনে পড়বে।আমি ওর সাথে কথা বলতে বলতে হাসতে থাকি, যেনো সত্যিই আমি কোনো শিশুর সাথে কথা বলছি, যে রঙিন দোলনায় দুলছে, হাসছে, আমার হাত যাকে বারবার দুলিয়ে দিচ্ছে।আমার ঘরে এসে বসতেই মেরি স্টোপসের কথা মনে পড়ে, আমি সারিসারি বিজ্ঞাপন দেখতে পাই পথের ধারে, দেখে সুখ পাই।আমি প্রাণকণাকে ডেকে বলি, অই তুই আমার সঙ্গে মেরি স্টোপসে যাবি?শুনতে পাই ও বলছে, যাবো, আমি যাবো।আমি বলি, কেনো যাবি?শুনতে পাই, আমাকে ধুয়ে ফেলতে যাবো।আমি বলি, খারাপ লাগবে না?শুনতে পাই, না, খারাপ লাগবে না।আমি বলি, কেনো?শুনতে পাই, তুমি তো আমাকে ঘেন্না করো।আমি বলি, আমি তোকে ঘেন্না করি?শুনতে পাই, হ্যাঁ।আমাকে যেতে হবে, দু-চার দিনের মধ্যেই যাবো, আমি কিছু বইতে চাই না আমার ভেতরে, না ময়লা, না প্রাণকণা, না রক্তবিন্দু, না ঘাসফুল।শরীরটা ব্যথায় বিষিয়ে উঠেছে, ভেঙে ভেঙে পড়ছে, কিছুই ভালো লাগছে না, ব’সে থাকতেও ইচ্ছে করছে না। এখন হাতে কোনো কাজ নেই, আমার নতুন কোসর্টা শুরু হ’তে আরো মাসখানেক বাকি, বইও খুলতে ভালো লাগছে না, ডিরেক্টরও বোধ হয় আসেন নি, এলে একবার হানা দিতেন। এখন কি কেউ আমার ঘরে আসতে পারে না? একটা টেলিফোন করতে পারে না? একা আমার ভালো লাগছে না। পাঠাগারে যাবো? দু-একটি নতুন বই নেবো? পড়তে ইচ্ছে করবে? মনে হয় ইচ্ছে করবে না, আমার কেমন যেনো লাগছে, আমি বুঝতে পারছি না। কোথায় যাবো আমি? কোথায় যেতে পারি আমি? মানুষ কতো দূর যেতে পারে? আমি পাঠাগারের দিকে হাঁটতে থাকি, ঢুকতেই দেখি ওপাশের টেবিলে একরাশ সংবাদপত্র প’ড়ে আছে। সংবাদপত্র পড়তে আমার একদম ভালো লাগে না, ওগুলো পড়লে আমি অসুস্থ বোধ করি, আমার ভেতরে দল বেঁধে রোগের পর রোগ দেখা দেয়, কিলবিল ক’রে আমার ভেতরে বীজাণু ঢুকতো থাকে; কিন্তু আজ ইচ্ছে হয় সংবাদপত্র নেড়েচেড়ে দেখতে।গোটা দুই সংবাদপত্র নিয়ে আমি টেবিলে গিয়ে বসি, একটার পাতা উল্টোতে থাকি, রাবিশের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি মনে হয়; না, এতো ময়লার ভেতর দিয়ে আমি যেতে পারবো না।পত্রিকাটি ছুঁড়ে রাখতো যাবো, তখন সংবাদটি চোখে পড়ে।
পৃষ্ঠা-১১৭
শিরোনামটি দেখে আমি একটু হাসি নিজের দিকে তাকিয়ে; বলি, তোমার খবর। জেনা, পেট, ফতোয়া, দোররা, মোল্লা। বেশ পুরোনো সংবাদ, বছরের পর বছর ধ’রে ঘটছে, আর ছাপা হচ্ছে।আয়েশা জেনা করেছে, একশো দোররা মারা হয়েছে আয়েশাকে। বাড়িবাড়ি কাজ ক’রে খেতো, কাজ করতে করতে পেট বানিয়ে বসেছে। পাঁচ বছর আগে স্বামী মারা গেছে, অথচ তার পাঁচমাসের পেট। পেটটা কে বানালো তার খবর নেই; আয়েশা জেনা করেছে, তাকে দোররা মারা হয়েছে।আয়েশা, তুমি কি কোনো রেস্টহাউজে ঘুমিয়েছিলে? চা খেতে খেতে গল্প করতে করতে তোমার ইচ্ছে হয়েছিলো? জীবন বদলে দিতে চেয়েছিলে তুমি?আয়েশা, তোমার আঙুলগুলোর রূপে ওই লোকটি কি পাগল হয়ে আছে?আয়েশা, তোমার একটি পেট আছে, সেটি ময়লায় ভ’রে গেছে; আমারও একটি আছে, সেটিতেও ময়লা জমেছে।পেট, সব দোষ পেটের, ওখানে একটু ময়লা ঢুকলে চারদিকে রাষ্ট্র হয়ে যায়; ওখানে ময়লা অবশ্যই ঢুকবে, তবে বৈধ ময়লা ঢুকতে হবে। কিন্তু পেট, এমন খানকি, বৈধ-অবৈধ বোঝে না, ময়লাকে রক্তের পিও পাকিয়ে বসে।ফতোয়া, দোররা, মোল্লা; বেশ ভালো, ইসলাম জেগে উঠছে, দোররা হয়ে পাথর হয়ে।আমি নিজের দিকে তাকাই, আমাকেও তো দোররা মারার কথা।আমি একটু হাসি, আমাকেও দোররা মারা হবে?কে মারবে? সমাজ? রাষ্ট্র? ধর্ম?আয়েশার জন্যে আমার কষ্ট হয়, আমার জন্যেও কষ্ট হয়, সমাজ রাষ্ট্র ধর্মের জন্যেও কষ্ট হয়।আমি যদি আয়েশা হতাম, একশো দোররা খেয়ে প’ড়ে থাকতাম, থুতু উড়ে আসতো আমার দিকে। আয়েশা যদি শিরিন হতো, সে ওই সংবাদ প’ড়ে নিজের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠতো।সমাজ ধর্ম বুড়ো থুথুরে বাঘ হয়ে উঠেছে, তার দাঁত নেই, পায়ে জোর নেই, লাফ দিতে পারে না, দৌড়োতে পারে না, ভাই আমাকে ধরতে পারছে না, আয়েশাকে ধরতে পেরেছে। আমি দৌড়োতে পারি, আয়েশা পারে না।সংবাদটি আমি পুরো পড়তে পারি না, পত্রিকাটি ঠেলে রেখে উঠে আসি। আমার অনেক কিছুই ইচ্ছে করতে থাকে; একবার ইচ্ছে হয় মাকে দেখে আসি, বেশ কয়েক দিন দেখি না, আমার জন্যে সে হয়তো পাগল হয়ে আছে, তার মেয়েটি তার মনের মতো হলো না, না, থাক; ইচ্ছে হয় দূরে কোনো গ্রামে চ’লে যাই, একা, অচেনা গ্রামে, গাড়িতে ক’রে নয়, একটি নৌকোয় ভাসতে ভাসতে দূরে চ’লে যাই, শুধু ভাসতেই থাকি, কোনো গ্রামের দরকার নেই, নদী আর আকাশ থাকলেই চলবে। আয়েশাকে দেখতে ইচ্ছে করে, ওর পেটটা
পৃষ্ঠা-১১৮
দেখতে ইচ্ছে করে; দোররা কেমন? মারলে কতোটা ব্যথা পাওয়া যায়? আমাকে মারলে আমি বাঁচবো? ন্যাংটো ক’রে মারে? পিঠে? পাছায়? ইসলাম কোথায় মারতে বলে? আবার আমার ইচ্ছে করে হুইস্কি খেতে, এক বোতল হুইস্কি যদি থাকতো, তাহলে বাসায় ব’সে পানি আর বরফ ছাড়া খেতাম। কড়া হুইস্কি খেতাম, বিশুদ্ধ হুইস্কিতে ঠোঁট দিলে আমি সোনালি আগুনে জ্ব’লে উঠি, আমার জ্ব’লে উঠতে ইচ্ছে করে। কোথায় পাবো, এখন আমি কোথায় পেতে পারি? ডিরেক্টরের কাছে কি পেতে পারি? ওঁর বাসায় আছে?আমি ডিরেক্টরের ঘরে যাই, আমাকে দেখে তিনি কলকল ক’রে ওঠেন; তাঁর এই কলকলটা শোনার আমার ইচ্ছে ছিলো।আমি গিয়েই বলি, আপনার কাছে হুইস্কি আছে? তিনি চমকে উঠে বলেন, কী বললেন? হুইস্কি? আমি বলি, হ্যাঁ, হুইস্কি। তিনি বলেন, কেনো? আমি বলি, আমার খেতে ইচ্ছে করছে। তিনি ভয় পেয়ে বলেন, আপনি হুইস্কি খাবেন? আমি বলি, হ্যাঁ, খাবো। তিনি বলেন, আপনি? আমি বলি, আপনি এতো অবাক হচ্ছেন কেনো? তিনি বলেন, আপনি হুইস্কি খান এটা আমি ভাবতে পারি নি। আমি বলি, আপনি তো খান? তিনি বলেন, হ্যাঁ, খাই। আমি বলি, আপনার বাসায় আছে? তিনি ভয় পেয়ে যান, বলেন, বাসায়? বলেন কী? বাসায় হুইস্কি রাখলে আমি বাসায় থাকতে পারবো?আমি বলি, তাহলে কোথায় রাখেন? তিনি বলেন, আপনি কি ভাবেন হুইস্কি আমি কিনে খাই? অতোটা সাহস আমার নেই; পার্টিটার্টিতে খাই, বাসায় ফেরার আগে গোটা দুই পান চিবোই, ওই রাতে মিসেসের সঙ্গে মেলামেশা করি না।আমি বলি, কোথায় আমি এক বোতল হুইস্কি কিনতে পারি? তিনি বলেন, স্কাইভিউতে পাওয়া যায় শুনেছি। আমি বলি, চলুন না আমার সাথে, এক বোতল হুইস্কি কিনবো। তিনি ভর পান, বলেন, না, না, ডক্টর শিরিন, আমি হুইস্কি কিনতে যেতে পারবো না, কেউ দেখে ফেলতে পারে। আমি জানতে চাই, দেখে ফেললে কী হবে? তিনি বলেন, বদনাম হয়ে যাবে।
পৃষ্ঠা-১১৯
আমি বলি, আমার বাসায় পানের নিমন্ত্রণ করলে কি আপনি আসবেন?তিনি খুশি হয়ে বলেন, আপনার ইনভাইটেশন তো রাখতেই হবে, অবশ্যই আসবো।আমি বলি, একদিন করবো, তবে আজ আমার এক বোতল স্কচ দরকার। তিনি বলেন, আপনি জৌক করছেন।আমি বেরিয়ে আসি তাঁর ঘর থেকে, ধীরেধীরে নিচে নামি, একটু ভাবি- না, আমি যেহেতু কিনতে চেয়েছি, আমাকে কিনতেই হবে; একটি বেবি নিয়ে গিয়ে পৌছি স্কাইভিউতে। গেইটে দাঁড়ানো পিয়নটিকে জিজ্ঞেস করি, বারটি কোন দিকে; সে চমকে ওঠে; একটু চমকে উঠবে আমি জানতাম, চমকে ওঠাটাই তো আমি চাই। একটি মাইয়ালোক বারে ঢুকবে, তাতে সব খাঁটি মুসলমান পুরুষের হয়ে ও একটু কেঁপে উঠবে না? ওর একটু দায়িত্ব আছে না? ও কী জবাব দেবে? তবে আমাকে বারটা দেখিয়ে দেয়াও ওর দায়িত্ব; লোকটি আমাকে বারে নিয়ে যায়, একটু সাড়া পড়ে, আমি একবার চারদিকে তাকাই, মাতালরাও আমাকে দেখে স্তব্ধ হয়ে উঠেছে দেখে আমার ভালো লাগে।আমি কাউন্টারে গিয়ে এক বোতল স্কচ হুইস্কি কিনতে চাই।আমার কাছে হুইস্কি বেচবে তো, না কি বলবে মাইয়ামানুষের কাছে তারাহুইস্কি বেচে না?আমার সোয়ামির অনুমতি আনতে হবে?কালো চকচকে জানালাদরোজার বোরকা প’রে আসতে হবে?না, তেমন কিছু নয়, দেশটিতে ইসলামপ্রচারের কাজটি সম্ভবত এখনোসম্পন্ন হয় নি, ইরান আফগানিস্থান থেকে আরো অনেক অলিআউলিয়া দরবেশ আসতে হবে, আরো অনেক হাজাম দরকার, চামড়া চিমটে দিয়ে শক্ত ক’রে টেনে বেশি ক’রে কাটতে হবে।একটি নতুন শব্দ শুনি, পার্সেল; শুনে আমার ভালো লাগে। কাউন্টারের লোকটি ক্লেইমোরের একটি পার্সেল খবরের কাগজে মুড়ে কালো পলিথিনে ভ’রে আমার হাতে দেয়; আমি ব্যাগে ঢুকিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে বেরিয়ে বেবিতে উঠি। পিয়নটি পেছনে পেছনে আসে, একটা বড়ো সালাম দেয়, আমি ওকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট দিই। লোকটি খুশি হয়ে আরেকটি সালাম দেয়।আমার বেশ লাগে, আমি নিজে হুইস্কি কিনতে পেরেছি।বিকেলে কলিংবেল বেজে ওঠে, আমি একটু অস্বস্তি বোধ করি; ছিদ্র দিয়ে তাকিয়ে দেখি মায় আর নাসরিন। আমি একটু চঞ্চল হয়ে উঠি, সাথেসাথে একটা যন্ত্রণা আমাকে ধাক্কা দেয়, যন্ত্রণাটা কাটিয়ে উঠতে আমার সময় লাগে।মাকে দেখে আমি সুখ পাই না।আমি দরোজা খুলে বলি, মা, তুমি?মায় বলে, হ, তরে দেকতে আইলাম, কতদিন ধইর্যা দেহি না।
পৃষ্ঠা-১২০
আমি বলি, আহ, আহ, ভিতরে আহ।মায় আমার বাসাটা ঘুরে দেখতে চায়, আমি তাকে নিয়ে এ-ঘরে ও-ঘরে বারান্দায় রান্নাঘরে ঘুরি, ফ্রিজ দেখাই, চুলো দেখাই, টোস্টার দেখাই, ওসব মায় দেখতে চায়, ওগুলো দেখতে মায় সব সময়ই সুখ পায়। যে-বাসায় দুটো ফ্রিজ আছে, সে-বাসায় দ্বিগুণ সুখ আছে ব’লে মায় মনে করে; যার সুখের সরল ধারণা আমার ভালো লাগে।নাসরিন বলে, দেকছো মা, বাসাটা কী সোন্দর?মায় বলে, হ, ও কি আর ভাল জিনিশ ছারা থাকতে পারে?নাসরিন বলে, তোমার এই মাইয়াডা পোলা অইলে ভাল অইতো।মায় বলে, মাইয়া অইয়াই জ্বালাইয়া মারতে আছে, আর পোলা অইলে ত রক্ষা আছিল না।আমি হেসে বলি, এইর মইদ্যে দুই চাইরডা খুন কইর্যা হালাইতাম। মায় বলে, হেইডা মিছা কতা না।আমি মাকে জিজ্ঞেস করি, মা, কী মনে কইর্যা আইলা? ফোন করলে তোআমিই যাইতাম।মায় বলে, আইলাম তর লগে কয়ডা নিরিবিলি কতা কইতে।আমি বলি, হোয়ার ঘরে লও, বিছনায় বইয়া কতা কই।মায় নাসরিনকে বলে, অই নাসরি, তুই ড্রয়িংঘরে বয়, আমি শিরির লগে কয়ডা কতা কই।মায় বিছানায় ব’সে কথা বলতেই পছন্দ করে; সে আমার বিছানায় উঠে বসে, আমি মেঝেতে বসি।আমি বলি, মা, তুমি কী খাইবা?মায় বলে, অহন কিছু খামু না, পরে খামুনে।আমি বলি, না, একটু কোক খাও।মায় বলে, তাইলে আন।আমি নাসরিনকে এক গেলাস কোক দিয়ে মার জন্যে এক গেলাস কোক এনে মার হাতে দিই।আমি বলি, অহন কও, কী কতা?মায় বলে, শিরি, তুই জামাইর কাছে ফিইর্যা যা, মাইয়ামানুষ অইয়া একলা থাকন ভাল না।আমি বলি, খারাপ কিয়ের, আমি তো ভালোই আছি।মায় বলে, মাইয়ামাইনষের একটা পুরুষপোলা লাগে, মাইয়ামানুষ যতই রাজাবাশশা অউক না ক্যান, পুরুষপোলা ছারা চলে না।আমি বলি, আমার চলবো।মায় বলে, মাইয়ামাইনষের বেশি ত্যাজ ভাল না, কতার আছে না পোলাব
পৃষ্ঠা ১২১ থেকে ১৩৫
পৃষ্ঠা-১২১
ত্যাজে বাশশা মাইয়ার ত্যাজে ব্যাশ্যা।আমি বলি, মা, হেই দিন আর নাই, ত্যাজ কইর্যা মাইয়ারাও আইজকাইল বাশশা অইতে পারে।মা আমার দিকে করুণ কোমলভাবে তাকিয়ে আছে, যেনো আমাকে জড়িয়ে ধ’রে শুয়ে বুকের দুধ খাওয়ানোর ইচ্ছে হচ্ছে তার, তার দুধ খেলে আমি সেরে উঠবো। মা কি আমার জন্যে কষ্ট পাচ্ছে? নিজের জন্যে কষ্ট পাচ্ছে? আমি বুঝতে পারি না। আমি কষ্ট পাচ্ছি মার জন্যে।মায় বলে, তুই কি আর জামাইর ঘরে যাবি না? আমি বলি, আমি যামু না, মা। মায় বলে, যাবি না ক্যা? আমি বলি, অ্যামনেই। মায় বলে, জামাই কোনো দোষ করছে? আমি বলি, না, হে কোনো দোষ করে নাই। মায় বলে, তাইলে যাবি না ক্যা? আমি বলি, আমার মন চায় না। মায় বলে, জামাই আইজ আমার কাছে গেছিল। আমি বলি, হেইডা আমি আগেই বুজছি। মায় বলে, হে অনেক কান্দাকাটি করলো। আমি বলি, অইডা কিছু না। আমি একটু চমকে উঠি, দেলোয়ার এটাও বলেছে মাকে? এটা না বললে তার চলতো না? না, মনে হয় চলতো না।মায় বলে, তুই না কি দোষ করছছ, জামাই আমারে কইল।আমি বলি, কী দোষ করছি?মায় বলে, কবিরা গুনা করছছ? আমি বলি, হেইডা আবার কী?মায় বলে, তুই না কি কোন ব্যাডার লগে হুইয়া প্যাড বানাইছছ?দেলোয়ার কিছুই বাকি রাখে নি; কয়েক ঘণ্টা আমি যেন্নাহীন কাটিয়েছিলাম, আবার ঘেন্নাটা ফিরে আসে।আমি বলি, হ। মায় বলে, এমুন কত মাইয়ালোক কত ব্যাডার লগে হোয়, হেইডা আবারকইতে গেলি ক্যা? আমি বলি, আমার মনে অইছিলো কওন উচিৎ, নাইলে নিজেরে আমার খারাপ মনে অইতো।মায় বলে, আরেক বেডার লগে ছলি, হেইডা খারাপ না?
পৃষ্ঠা-১২২
আমি বলি, আমার হইতে ইচ্ছা অইছিলো, হুইছি।মায় বলে, হুইছিলি হুইছিলি, তা কইতে গেলি ক্যা?আমি বলি, চোরামি করতে আমার ইচ্ছা অয় নাই।মায় বলে, জানছ না পুরুষপোলারা অন্য মাইয়ালোকের লগে হোয়, আর তাগো মাইয়ালোক অন্যের লগে হুইলে তাগো মাতায় আগুন ধইর্যা যায়।আমি বলি, হেইডা জানি বইল্যাই ত আমি আর যাইতে চাই নাই।মায় বলে, তারপরও জামাই তরে নিতে চায়, তরে লইয়া ঘর করতে চায়, কয় যা অওনের অইয়া গ্যাছে, অহনও তুই তার ঘরে যা।আমি বলি, হে আমারে দয়া করতে চায়?মায় বলে, না যাইয়া কি থাকতে পারবি?আমি বলি, আমি কি তারডা খাই না ফিন্দি যে যাইতে অইবো?মায় বলে, তুই সংসার করবি না?আমি বলি, অইডা লইয়া অহনও ভাবি নাই।মায় বলে, তর একটা পুরুষপোলা লাগবো না?আমি বলি, একটা ক্যান দশটা পুরুষপোলা লাগবো, হেইডা আমি দেহুম,তুমি আমারে লইয়া ভাইব্যো না, মা।মায় বলে, অহন তুই কী করবি? আমি বলি, তারে আমি ছাইর্যা দিমু।মায় বলে, কলঙ্ক অইবো না?আমি বলি, কলঙ্ক আবার কিয়ের?মায় বলে, তাইলে হেই ব্যাডারে বিয়া করবি নি? আমি বলি, না।মায় বলে, প্যাডেরচারে কী করবি?আমি বলি, এইয়া লইয়া তুমি ভাইব্যো না।মায় বলে, মাইনষে হুনলে কী কইবো?আমি বলি, হুনলে হুনুক।মায় বলে, তুই যা মনে করচ কর।আমি বলি, মা, আইজ থাইক্যা যাও।মায় বলে, না রে, থাকনের উপায় নাই।আমি বলি, তাইলে তুমি বহ, আমি রান্দি; আইজ আমার রান্দা তোমার খাইয়া যাইতে অইবো।মায় বলে, তুই কি রানতে পারবি? ল তর রান্দনের ঘরে, আমিই রান্দি, তরে একটু রাইন্দা খাওয়াই।ফ্রিজে কোটা কই, কোটা টাকি, কাচকির গুঁড়ো আছে, মিষ্টি কুমড়োর ফালি
পৃষ্ঠা-১২৩
লাউয়ের চণা ধনেপাতা আছে, মিটসেফে গুঁড়ো চিংড়ি আর পুঁটিমাছের শুঁটকি আছে; যায় আর আমি রান্না শুরু ক’রে দিই।রান্না করতে করতে মায় বলে, অই শিরি, সব কিছুই ও তুই গোছগাছ কইর্যা রাখলি, খালি বিয়াডা গুছাইয়া রাখলি না।আমি বলি, বিয়া এমুন কিছু ব্যাপার না, অইডা গুছাইয়া রাখনের জিনিশ না।মায় বলে, আমি যে গুছাইয়া রাখলাম।আমি বলি, মা, তোমার আর কিছু করনের আছিল না।মায় বলে, হ, আমাগ্যে ত হিগাইছিল রান্দনবারন আর পোলাপান পয়দা করনই মাইয়ালোকের কাম।আমি বলি, তোমাগো মিছা কতা হিগাইছিলো।মায় বলে, হ, মিছার মইদ্যেই অনমডা কাডাইয়া দিলাম।আমি বলি, তয় তোমার প্যাডে আমরা অইছি, হেইডা ভালই অইছে।মায় বলে, তর প্যাডেরডা রাইক্যা দিবি নি?আমি বলি, না।মায় বলে, তুই পোলাপান লবি না?আমি বলি, হেইডা পরে দেহুম।মার সব কিছু খুঁটেখুঁটে নেড়েচেড়ে দেখা অভ্যাস, জীবনকে সে আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে ধুয়ে মুছে দেখতে পছন্দ করে, একেকটি জিনিশ দেখা তার কাছে জীবনের একেকটি অংশকে সফল ক’রে তোলা; মায় একটা চামচ আধঘণ্টা ধ’রে ধুতে আর মুছতে পারে, কাপড়ে একটা দাগ এক ঘণ্টা ধ’রে ঘষতে পারে; খাওয়ার পর মা আমার ঘরের এটা সেটা নেড়ে দেখতে দেখতে আমার ব্যাগটা নাড়তে গিয়ে স্কচের বোতলটা দেখতে পায়। দেখে তার ভালো লাগে, মনে হয় জীবনের একটি নতুন খণ্ড সে দেখতে পেলো, যা আগে দেখে নি। মায় বোতলটা ব্যাগ থেকে ভুলে তার দিকে তাকিয়ে থাকে, বোতলটাকে মার ভালোই লাগছে, তলোয়ার দুটোর দিকে সে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে, নাসরিন আর আমি পেছনে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসি, খুব মন দিয়ে মায় ওটা দেখতে থাকে; তার বাসায়বোতলের অভাব নেই, কোক ফান্টা সেভেন আপে তার ফ্রিজ ভরাই থাকে, শুধু এরকম কোক সে আগে দেখে নি।মায় বলে, অই শিরি, এইডা কী কোক রে?নাসরিন খিলখিল হেসে বলে, মা, এইডা খুব দামি কোক।মায় বলে, কয় ট্যাকা দাম?নাসরিন হাসতে হাসতে বলে, দুই হাজার ট্যাকা।মায় চমকে ওঠে, কোক আবার দুই হাজার ট্যাকা অয় নি রে?নাসরিন বলে, অয়, তার থিকাও বেশি-অয়।আমি বলি, মা, এইডা মদ।
পৃষ্ঠা-১২৪
মায় তাড়াতাড়ি বোতলটি রেখে দিয়ে বলে, শিরি, মদ ত হারাম, তুই মদ খাছ নি?আমি বলি, ইচ্ছা অইলে খাই।মায় বলে, মদ খাইলে দোজগে যাইতে অইবো, আল্লারসুল কইছে মল হারাম, মদ খাইলে দোজগে যাইতে অইবো।আমি বলি, না, মা, দোজগে যাইতে অইবো না; দোজগ বইল্যা কিছু নাই।মায় বলে, নাই?আমি বলি, মা, ওইগুলি সব মিছা কতা।নাসরিন বলে, মা, একটু খাইয়া দেকবা নি? খাইতে খুব ভাল।আমি মার মুখের দিকে তাকাই, মার মুখে আমি দোজগের ভর দেখতে পাই না, মায় আগুনে পুড়ে যাচ্ছে না; তার মুখে বাসনার ছাপ দেখতে পাই। মার মধ্যে একটা পরখ ক’রে দেখার প্রবণতা আছে, যা সে দেখে নি তা একটু দেখে নিতে তার ইচ্ছে হয়, তা সে চেপে রাখে অনেক সময়, কিন্তু তার ভেতরে বাসনাটা কখনো মরে না।আমি হেসে বলি, মা একটু খাইবা?মায় ভয় পেতে পেতে বলে, দোজগে যামু না ত?আমি বলি, তোমার মাইয়া যুদি দোজগে যায়, তুমিও তার লগে যাইও, শুঁটকি রাইন্দা ইচার ভর্তা বানাইয়া খাইতে পারুম।মায় বলে, রঙটা সোন্দর দেহাইতে আছে, একটু খাইয়া দেহুম নি?মার চোখে বাসনা দেখতে পাই আমি, কিন্তু একটু পরেই বাসনাটা নিভে আসে তার চোখেমুখে।মায় বলে, থাউক, খাইয়া কাম নাই।আমি বলি, তাইলে থাউক।বেশ রাতেই যায় মায় আর নাসরিন, একটা চমৎকার দিন কাটে আমার, আমি প্রফুল্ল ও বিষাদ বোধ করি। আমার ইচ্ছে করছিলো মার সাথে চ’লে যেতে, ওদের সাথে কয়েক দিন থাকতে; তারপর মনে হয় আমি কি আমার জীবন বইতে পারছি না? ক্লান্ত হয়ে উঠেছি? ভেঙে পড়ছি? কেনো যেতে হবে ওদের সাথে? যদিও ওরা মা আর নাসরিন? মার জীবন মার, নাসরিনের জীবন নাসরিনের, আমার জীবন আমার। আমার জীবন কি ভারি হয়ে উঠেছে? আমি কিশুদের জীবনের আনন্দ চাই নিজের জীবনকে সুখী রাখতে? নিজেকে আমি বইতে পারছি না নিজে? আমি এটা হ’তে দিতে পারি না।আমি কি এখন একটু পান করবো? আমি বোতলটির দিকে তাকিয়ে থাকি।কেনো আমি তাকিয়ে আছি? পান করতে কি আমার দ্বিধা হচ্ছে?পান করা কি নিজেকে পানের হাতে তুলে দেয়া নয়? না, এখন আমি পান করবো না; যখন পান করা হবে বিশুদ্ধ পান করা, তখন
পৃষ্ঠা-১২৫
পান করবো, এখন নয়।আমি একটি বই খুলে ধরি; হাঁটতে হাঁটতে বইটি পড়তে থাকি, এক সময় আমার ঘুম পায়, আমি মেঝের ওপর ঘুমিয়ে পড়ি।ইউনিভার্সিটি যাওয়ার জন্যে তৈরি হয়েছি, সাড়ে দশটা বেজেছে, বেরোতে যাবো, মনে পড়ে আজ বন্ধ; আমি একটু ভয় পাই, তাহলে দিনটা কীভাবে কাটাবো?একটু ঘুরে আসবো বাইরে থেকে? পথে পথে হাঁটবো? মায়ের কাছে গিয়ে উঠবো? মা ভয় পেয়ে যাবে না? ভাববে না তার শনিবারের মেয়েটি কষ্টে আছে?দুটো কাজ আমার হাতে; মেরি স্টোপস, পরিষ্কার হয়ে আসতে হবে, আর দেলোয়ার, ছেড়ে দিতে হবে।পরিষ্কার হওয়া, ময়লা থেকে মুক্তি পাওয়া। পরিষ্কার? খুব কষ্ট পাবো? একটি বইয়ে পড়েছিলাম এটা এখন কোনো ব্যাপারই না, মাত্র কয়েক মিনিট শুষে নিয়ে আসবে ফোড়াটিকে। আমি মনে মনে ভাবতে থাকি শুষে নিয়ে আসবে ফোড়াটিকে, মাত্র কয়েক মিনিট।ছেড়ে দেয়ার কাগজপত্র? খুব ঝামেলা হবে? কতোটা ঝামেলা হবে? খুব বেশি হবে? হোক, পোহাতে হবে।দুটো কাজ হাতে, এ-সপ্তাহের মধ্যেই ক’রে ফেলতে হবে।আর দেরি করতে পারি না, পারলে আজই ক’রে ফেলতাম; কিন্তু কাজ, সময় নেয়, আমার হাতে নয়।ইউনিভার্সিটি যাওয়ার কাপড়চোপড় খুলে ফেলবো? থাক, কিছুক্ষণ এভাবেই থাকি, মনে হবে ইউনিভার্সিটি গেছি; কেউ হয়তো আসবে আমার ঘরে, হয়তো কোনো টেলিফোন পাবো, একবার পাঠাগারে যাবো। ভালোই লাগছে আমার বাসায় ইউনিভার্সিটির সাজে, ভালোই লাগছে।যাক, আজ আর রান্না করতে হবে না, কালও দরকার হবে না, মায় যা রান্না ক’রে গেছে, কয়েক দিন চ’লে যাবে। কালকের দিনটা ভালো কেটেছে, মায় এসেছিলো, নাসরিন এসেছিলো। কথা বলেছি, অনেক কথা।টেলিফোন আনতে হবে, দরকার; আনতে হবে, একটু দৌড়োদৌড়ি করতে হবে, আনতে হবে। বিচ্ছিন্ন হয়ে আছি, এতো বিচ্ছিন্ন থাকতে পারি না। টিভি? সাধারণত দেখি না, তবে কি একেবারে দেখি না? মাঝেমাঝে তো দেখতে ইচ্ছে হয়। যদি এখন একটা সুচিত্রা-উত্তম দেখতে পেতাম।গাড়ি। একটি তো ছিলো, না, ওটা আর আমার নয়; ওটা আমি চাইতে পারবো না। একটা গাড়ি কিনতে হবে, টাকা আছে? ধার করবো? ব্যাংক থেকে? আমার কতো আছে? কতো দিনে জমবে?মন দিয়ে কাজে নামতে হবে, নারী ও মৌলবাদ নিয়ে একটি বই লিখতে হবে, বাঙলায়, তারপর ইংরেজিতে; প্রতিদিন খাটতে হবে, অন্তত দশ ঘণ্টা,
পৃষ্ঠা-১২৬
সময় নষ্ট করা চলবে না।প্রচুর কাজ করতে হবে, প্রচুর পড়তে হবে লিখতে হবে, লেখা ছাড়া পড়া ছাড়া আর কোনো কাজ নেই, এর বাইরে যা সবই খণ্ডকালীন, সবই তুচ্ছ।এমন সময় কলিংবেল বেজে ওঠার শব্দ শুনি, একটা ধমকের মতো শব্দ, আক্রমণের মতো আওয়াজ। বাজার ধরনটা চেনা, আমার চেয়ার থেকে উঠতে ইচ্ছে করে না, গিয়ে দরোজা খুলতে ইচ্ছে করে না।আবার কলিংবেলের আক্রমণ, ধারাবাহিক, হিংস্র, অস্থির।দরোজার ছিদ্র দিয়ে দেখি দেলোয়ার; দেখার দরকার ছিলো না, তবু অন্য কিছু দেখার জন্যেই হয়তো তাকাই, দেখি। খুলবো? খুলে কী হবে? সময়টা নষ্ট হবে। বিরক্তি লাগবে। আমার দরোজা খুলতে ইচ্ছে করে না, তবু খুলি।আমি বলি, তুমি কি ভেতরে ঢুকবে?সে বলে, কেনো? সেই লোকটা এসেছে না কি?আমি একটু কোমল হওয়ার চেষ্টা করছিলাম, একটু দয়া করতে চাচ্ছিলাম, ভাবছিলাম এসেছে যেহেতু আসুক; কিন্তু তার কথা শুনে আমার ভেতরে একটা বাঘ ঘুম ভেঙে আগে।আমি বলি, কোন লোকটা?সে বলে, সেই কুত্তারবাচ্চাটা।আমার বাঘটার চোখ থেকে ঘুমের সমস্ত রেশ কেটে যেতে থাকে, চোখে ঘুমের বদলে আগুনের ফুলকি দেখা দিতে চায়।আমি বলি, হ্যাঁ, এসেছে।সে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ঢুকে বলে, তাকে আমি আজ দেখে নেবো।আমি বলি, আচ্ছা দেখো।দরোজা লাগিয়ে আমি ড্রয়িংরুমের দিকে হাঁটতে থাকি, ড্রয়িংরুমে আমার যেতে ইচ্ছে করে না, হাঁটতে ইচ্ছে করে না, তবু ওদিকেই যাই; দেলোয়ার আগে আগে ড্রয়িংরুমে ঢুকে দেখে কেউ নেই; সে আরো অস্থির উত্তেজিত হয়ে ওঠে, কাঁপতে থাকে, তার চোঁয়াল শক্ত হয়ে ওঠে।সে বলে, লোকটা কি তোমার বেডরুমে?আমি বলি, হ্যাঁ। আমার বাঘ জেগে উঠে চারদিক দেখছে, নখর ধার দিতে শুরু করেছে। দেলোয়ার দৌড়ে বেডরুমে যায়, আমি ড্রয়িংরুমে স্থির হয়ে ব’সে থাকি; সে হয়তো তাঁকে রান্নাঘরে, বারান্দায়, বাথরুমে, খাটের নিচে খোঁজে।এসে বলে, কই? লোকটা কই?আমি বলি, তুমি ওখানে বসো।দেলোয়ার বসতে বসতে বলে, লোকটা কই? আমি বলি, আছে।
পৃষ্ঠা-১২৭
সে বলে, তুমি আমার সাথে জৌক করছো?আমি বলি, না।দেলোয়ারকে খুব বিচলিত দেখায়, ঘেমে উঠছে মনে হয়; সে প্রাণপণে বিশ্বাস করতে চাচ্ছে লোকটি আসে নি, আবার লোকটি আসে নি, তাও বিশ্বাস করতে পারছে না; সে লোকটিকে চায় এবং চায় না।সে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, হয়তো সেখানে লোকটির ঠোঁটের দাগ লেগে আছে কি না, তা দেখার চেষ্টা করে; হয়তো দেখতে চায় আমার চোখের ভেতরে লোকটিকে দেখা যায় কি না। হয়তো সে আমার ঠোঁটে লোকটির ঠোঁট দেখে, আবার দেখে না; আমার গালে লোকটির ঠোঁটের দাগ দেখে, আবার দেখে না; আমার চোখে লোকটির মুখ দেখে, আবার দেখে না। সে অস্থির, জ্বলছে; আমি তার মাংস পোড়ার গন্ধ পাই।সে বলে, লোকটা এখনো আসে নি?আমি ঠাণ্ডা স্বরে বলি, তা তোমাকে আমি বলবো না।সে বলে, কেনো বলবে না?আমি বলি, আমার ব্যক্তিগত কথা তোমাকে কেনো বলবো?সে বলে, আজ তো বন্ধ; এতো সেজেগুঁজে আছো কেনো?আমি বলি, আছি।সে বলে, লোকটার জন্যে ব’সে আছো?আমি বলি, হ্যাঁ।দেলোয়ার ব’সে থাকতে পারছে না, কাঁপছে, জ্বলছে, পুড়ছে, ধুয়ো উঠছে, গন্ধ উঠছে, ছাই হচ্ছে; আমার ঠাণ্ডা স্বর হয়তো তার উত্তাপকে শীতল ক’রে দিচ্ছে মাঝেমাঝে। সে লোকটিকে চায় এবং চায় না; লোকটি তার ভেতরে ঢুকে গেছে, তার ভেতরে আগুন জ্বেলে চলছে, ওই আগুনে সে পুড়ে যাচ্ছে, যদিও সে চায় লোকটিকে ছাইয়ে পরিণত করতে।সে বলে, লোকটা এখন আসবে?আমি বলি, হয়তো আসবে।সে বলে, হয়তো কেনো, তুমি জানো না?আমি বলি, জানি।সে বলে, লোকটা আসবে?আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, তুমি তার জন্যে ব’সে আছো?আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, প্রতিদিন আসে?আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, তুমি লোকটার জন্যে এভাবেই অপেক্ষা করো?
পৃষ্ঠা-১২৮
আমি বলি, হ্যাঁ, ভালো লাগে।টের পাই আমার ভেতরের বাঘটি ধীরস্থিরভাবে তার কাজ করা শুরু করেছে, সে নিঃশব্দে জিভ দিয়ে রক্তপান করছে।সে বলে, লোকটার সাথে তুমি বাইরে যাবে?আমি বলি, ঘর থাকতে বাইরে যাবো কেনো?সে বলে, ঘরেই থাকবে?আমি বলি, তিনি চাইলে বাইরেও যেতে পারি।সে বলে, ওহ্, তুমি লোকটার কথায় চলছো?আমি বলি, তাঁর কথায় চলতে আমার ভালো লাগে।সে বলে, তুমি লোকটার সব কথা শোনো?আমি বলি, হ্যাঁ; শুনতে ভালো লাগে।কাঁপতে থাকে দেলোয়ার, তার শরীর স্থির হয়ে থাকতে ভুলে গেছে, পা দুটো ভুলে গেছে দাঁড়াতে।সে বলে, লোকটা কি আজ রাতে তোমার সাথে ছিলো?আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, সারারাত ছিলো?আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, লোকটা গতরাতেও তোমার সাথে ছিলো?আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, সারারাত ছিলো?আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, লোকটা প্রত্যেক রাতেই তোমার সাথে থাকে?আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, আজ রাতেও থাকবে?আমি বলি, আজ রাতে আমাদের শেরাটনে থাকার কথা।সে বলে, শেরাটনে?আমি বলি, একরাত সোনারগাঁয়েও ছিলাম।সে বলে, সোনারগাঁয়ে?আমি বলি, হ্যাঁ; আগে তো কখনো থাকি নি।সে বলে, প্রত্যেক রাতেই ইন্টারকোর্স করো?আমি বলি, হ্যাঁ।দেলোয়ার থরথর ক’রে কাঁপতে থাকে, তার ভেতরে বিস্ফোরণ ঘটে, সোফা থেকে লাফিয়ে উঠে সে আমার দিকে ছুটে আসতে চায়। আমি বলি, যা বলার ওখানে ব’সে বলো।
পৃষ্ঠা-১২৯
আমার কণ্ঠস্বরে দেলোয়ার থমকে দাঁড়ায়; একটু কি কেঁপে ওঠে? আমাকে সে ভয় পাচ্ছে? এই স্বর সে আশা করে নিং সে ধীরেধীরে বসে।আমি বলি, তুমি ভদ্রভাবে কথা বলতে চাইলে বসো, নইলে যেতে পারো; আমাকে বিরক্ত কোরো না।সে বলে, আমি ভদ্রভাবেই কথা বলতে চাই।আমি বলি, তাহলে বসো।আমার চা খেতে ইচ্ছে করছে; আমি উঠে গিয়ে চা বানাই, শুধুই চা, আর কিছু নয়; তারপর দু-কাপ চা নিয়ে ড্রয়িংরুমে আসি।এক কাপ তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলি, তুমি কি চা খাবে?সে বলে, তোমার চা খেতে আমার ঘেন্না হয়। আমি বলি, তাহলে খেয়ো না। সে বলে, লোকটার নাম কী? আমি বলি, খালেদ। সে বলে, লোকটা কী করে? আমি বলি, ইঞ্জিনিয়ার। সে বলে, আমার বিশ্বাস হয় না। আমি বলি, না হ’লে আমি কী করতে পারি? আমি বলি, ও দুটো দেখেছো? সে বলে, কী?সে বলে, তুমি একটা প্রস্টিটিউট, প্রস্টিটিউটের কথা কে বিশ্বাস করে?আমি বলি, আমার জুতো দুটো।দেলোয়ার একবার আমার জুতো দুটোর দিকে তাকায়, সে রেগে ওঠার চেষ্টাকরে, আবার নিজেকে স্থির করতে চায়।আমি বলি, ও দুটোর কথা মনে রেখে কথা বোলো।সে বলে, আসলেই লোকটার কী নাম?আমি বলি, শামসুল হক।সে বলে, একটু আগে যে বললে খালেদ?আমি বলি, প্রস্টিটিউটরা কখন কী বলে, ঠিক আছে?সে বলে, সত্যি ক’রে বলো লোকটার কী নাম?আমি বলি, খালেদ।সে বলে, তুমি মিথ্যে কথা বলছো।আমি বলি, হ্যাঁ, আমি মিথ্যে কথা বলছি।সে বলে, যা হওয়ার হয়ে গেছে, তুমি আমার সাথে চলো; আমি এই সবভুলে যাবো, কিছু মনে রাখবো না।
পৃষ্ঠা-১৩০
আমি বলি, তুমি এখন যাও।সে বলে, আমি যেতে আসি নি।আমি বলি, তাহলে তুমি থাকো, আমি যাচ্ছি।আমি একবার ওঠার উদ্যোগ নিই, কিন্তু উঠতে গিয়ে আর উঠতে ইচ্ছে করে না; নোংরামোকে ফ্ল্যাট জুড়ে ছড়িয়ে দিতে আমার ভালো লাগে না।সে বলে, আচ্ছা, কয়েকটি সত্য কথা আমাকে বলবে?আমি বলি, কী?সে বলে, ওই লোকটার সাথে তোমার আগে পরিচয় ছিলো?আমি বলি, না।সে বলে, তার সাথে তোমার কোথায় দেখা হয়?আমি বলি, কমলগঞ্জে।সে বলে, কমলগঞ্জের কোথায়?আমি বলি, রেস্টহাউজে।সে বলে, আমার বিশ্বাস হয় না, নিশ্চয়ই তোমাদের আগে পরিচয় ছিলো।আমি বলি, হ্যাঁ, ছিলো।আমার বাঘের খেলা দেখে আমি নিজেই বিস্মিত হই; আমি মনে মনে বলতে থাকি, খেলো, আমার বাঘ, পান করো।সে বলে, কোথায় পরিচয় হয়?আমি বলি, ঢাকায়ই।সে বলে, তাহলে যে বললে কমলগঞ্জে?আমি বলি, হ্যাঁ, কমলগঞ্জে।সে বলে, তুমি মিথ্যে কথা বলছো, তোমাদের আগে পরিচয় ছিলো।আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, তুমি একটা প্রস্টিটিউট।আমি বলি, আমার ওই জুতো দুটোর কথা ভুলে যেয়ো না। দেলোয়ার চমকে ওঠে, সে আমার ইতালীয় জুতো দুটোর দিকে অনেকক্ষণতাকিয়ে থাকে। ও কি জুতো দুটো মন দিয়ে দেখছে? জুতো দুটোর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হচ্ছে? মনে হয় জুতো দুটো ওর ভেতরে ঢুকে একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করছে।সে বলে, তুমি আমার সাথে চলো, আমি সব ভুলে যাবো।আমি বলি, তুমি যাও।সে বলে, না গেলে তোমাকে আমি রেইপ করবো।আমি বলি, কী দিয়ে করবে?সে বলে, মানে?
পৃষ্ঠা-১৩১
আমি বলি, নপুংসকেরা রেইপ করতে পারে না।দেলোয়ার বিব্রত বোধ করে, দূরের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকে; আমারদিকে, এমনকি তার নিজের দিকেও তাকাতে পারে না। ফিরে চিৎকার ক’রে বলে, এখনই দেখিয়ে দেবো আমি রেইপ করতে পারি কি না, আমি দেখিয়ে দেবো।ওই চিৎকার ফাটা আওয়াজের মতো শোনায়, আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে। হয় না, আমি হাসি।আমি বলি, আজ তোমাকে আমি সে-সুযোগ দেবো না।সে বলে, তুমি একটা খানকি।আমি বলি, জুতো দুটোর কথা মনে রেখো।দেলোয়ার লাফিয়ে উঠতে চায় বসা থেকে, সে কাঁপছে, এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, ভেঙে পড়ছে, আবার তার খুন করার ইচ্ছে জাগছে হয়তো, কিন্তু তাও পারবে ব’লে মনে হয় না।আমি বলি, ভদ্রভাবে ব’সে কথা বলো।সে বলে, আসলেই তোমাদের কমলগঞ্জে দেখা হয়?আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, ক-রাত তোমরা একসাথে শুয়েছো?আমি বলি, দু-রাত।সে বলে, দু-রাতই ইন্টারকোর্স করেছো?আমি বলি, না।সে বলে, তোমরা একসাথে শুয়েছো আর ইন্টারকোর্স করো নি, আমি বিশ্বাস করি না।আমি বলি, করেছি।সে বলে, ক-বার করেছো?আমি বলি, দু-বার।সে বলে, তুমি মিথ্যে কথা বলছো, তোমার মতো সুন্দরী মেয়েলোক পেয়ে সে দু-বারে ছেড়ে দেয় নি; তোমরা সারারাত করেছো।আমি বলি, হ্যাঁ, সারারাত।দেলোয়ার বসা থেকে উঠে আমার দিকে আসতে থাকে, তার চোখ জ্বলছে, তার হাতের আঙুল শক্ত হয়ে উঠেছে, আবার সে কাঁপছেও।আমি বলি, এদিকে আসবে না, ওখানে বসো।দেলোয়ার আবার গিয়ে বসে, বসতেই হয়তো চাচ্ছে ওর শরীর; আমার ইচ্ছে হয় ওকে ধ’রে বসাই, কিন্তু তা আর হবে না।সে বলে, লোকটার সাথে তোমার দেখা হয় কখন?
পৃষ্ঠা-১৩২
আমি বলি, এক সন্ধ্যায়।সে বলে, কোনখানে দেখা হয়?আমি বলি, ডাইনিং হলে।সে বলে, এক টেবিলে ব’সে তোমরা খেয়েছিলে?আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, খেতে খেতে লোকটা তোমাকে শোয়ার প্রস্তাব দিলো?আমি বলি, তিনি দেন নি।সে বলে, তাহলে কে দিলো?আমি বলি, আমি দিয়েছিলাম।সে লাফিয়ে ওঠে, বলে, তুমি প্রস্তাব দিয়েছিলে?আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, তুমি দিতে পারলে?আমি বলি, কেনো পারবো না?সে বলে, কী প্রস্তাব দিয়েছিলে?আমি বলি, খেতে খেতে বললাম, আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে, আপনি খুব আবেদনময়, আজ রাতে আমি আপনার সাথে শুবো।সে চিৎকার ক’রে ওঠে, তুমি একটা বেশ্যা, তুমি একটা খানকি, তুমি একটা প্রস্টিটিউট।দেলোয়ার লাফিয়ে উঠে আমার দিকে ছুটে আসে, আমি সাথে সাথে প্রস্তুত হই, আমি আজ তাকে সুযোগ দেবো না, ছেড়ে দেবো না; সে একটি চড় মারে, আমি স’রে গিয়ে অন্য জায়গায় বসি, তার চড় আমার গালে লাগে না; লাগলে আমার গালটি হয়তো ফেটে যেতো।আমি বলি, তুমি এখন বেরিয়ে যেতে পারো।সে ফিরে গিয়ে বসতে বসতে বলে, বেরিয়ে যেতে আমি আসি নি।আমি বলি, কী জন্যে এসেছো?সে বলে, তা তুমি দেখতে পাবে।আমি বলি, আমার জুতো দুটোর কথা মনে রেখো।দেলোয়ার কি একটু ক্লান্ত? ওর জন্যে কি আমার মায়া হচ্ছে? ওকে কি আমি এক গেলাস ঠাণ্ডা পানি এনে দেবো? বলবো তুমি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছো? তুমি বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম করো।সে বলে, যা করেছো তাতে আমি কিছু মনে করবো না, আমার সাথে চলো, আগের মতো থাকি।আমি বলি, তুমি যেতে পারো।সে বলে, তুমি ওই লোকটাকে বিয়ে করবে?
পৃষ্ঠা-১৩৩
আমি বলি, হয়তো করবো।সে লাফিয়ে উঠে বলে, তোমার বিয়ে করা আমি দেখিয়ে দেবো।আমি বলি, তুমি এখন যাও।সে বলে, কুত্তারবাচ্চাটার বউবাচ্চা নেই?আমি বলি, আছে।সে বলে, তাহলে বিয়ে করবে কীভাবে?আমি বলি, আমি তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী হয়ে থাকবো।সে বলে, তুমি লোকটির দ্বিতীয় স্ত্রী হবে?আমি বলি, ক্ষতি কী?সে বলে, লোকটা এতোই মহাপুরুষ যে তুমি তার দ্বিতীয় স্ত্রী হবে?আমি বলি, হ্যাঁ, তিনি মহাপুরুষ।সে বলে, তোমার চোখে লোকটিকে মহাপুরুষ মনে হয়?আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, তুমি লোকটার প্রেমে পড়েছো?আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, এক সন্ধ্যায়ই প্রেমে প’ড়ে গেলে?আমি বলি, প্রেমে পড়তে একশো বছর লাগে না।দেলোয়ার জ্বলছে, তার ভেতরে অজস্র কীট তাকে কামড়াচ্ছে; আর লোকটিকে এখনই দেখতে ইচ্ছে করছে দেলোয়ারের; সে দেখতে চায় লোকটি কতোটা সুপুরুষ, কোথায় লোকটি তার থেকে শ্রেষ্ঠ। দেলোয়ার দ্বিতীয় হয়ে পড়েছে, সে প্রথম ছিলো, এটা সে সহ্য করতে পারছে না। সে আর নায়ক নয়, দেলোয়ারের মনে হচ্ছে সে ভিলেন হয়ে উঠেছে, সে স্বর্গ থেকে প’ড়ে গেছে, সে আর ওই লোকটির মতো নায়ক হয়ে উঠতে পারবে না।সে বলে, লোকটি কি দেখতে আমার থেকে সুন্দর? আমি বলি, না।সে বলে, তাহলে যে বললে সে মহাপুরুষ?আমি বলি, মহাপুরুষ হ’তে হ’লে সিনেমার হিরো হ’তে হয় না।সে বলে, আসলেই লোকটা দেখতে কেমন?আমি বলি, সুন্দর।সে বলে, তাহলে যে বললে সুন্দর না।আমি বলি, তুমি দুঃখ পাবে ব’লে বলেছি।সে বলে, লোকটা কেমন সুন্দর?আমি বলি, প্রথম দেখায়ই শুতে ইচ্ছে করে।দেলোয়ার থরথর করে কাঁপতে থাকে, সে হয়তো মনে মনে লোকটিকে
পৃষ্ঠা-১৩৪
দেখতে পায়, যার সৌন্দর্যের কোনো তুলনা হয় না, যার সৌন্দর্যের কাছে সে ভিখিরির মতো হেরে গেছে। সে এখন ভিখিরি, সে মুঘল সাম্রাজ্যের মালিক হ’লেও পথে পথে ভিক্ষে ক’রে ফিরবে।সে বলে, লোকটা খুব সুন্দর?আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, লোকটার সব কিছু তোমার ভালো লাগে?আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, লোকটার কী তোমার ভালো লাগে? আমি বলি, তাঁর ঠোঁট আমার ভালো লাগে।সে বলে, আর?আমি বলি, তাঁর জিভ আমার ভালো লাগে।সে বলে, জিভ?আমি বলি, তাঁর নখ আমার ভালো লাগে।দেলোয়ার মাথা নিচু ক’রে ব’সে থাকে, আমার দিকে তাকাতে পারে না, সে হয়তো নিজের ওপর ঘেন্নায় ঘুলিয়ে উঠেছে।সে বলে, ডাইনিং হল থেকেই তোমরা শুতে চ’লে গেলে?আমি বলি, না।সে বলে, তাহলে কী করলে?আমি বলি, বললাম চলুন পাহাড়ে একটু বেরিয়ে আসি।সে বলে, তুমি বললে?আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, আমার কথা তোমার মনে পড়ে নি?আমি বলি, না।সে বলে, তখন রাত কয়টা?আমি বলি, সম্ভবত দশটা।সে বলে, তোমরা পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে গেলে?আমি বলি, আমরা হাত ধ’রে হাঁটতে হাঁটতে গেলাম।সে বলে, হাত ধ’রে হাঁটলে?আমি বলি, হাত ধ’রে হাঁটতে আমার ইচ্ছে করছিলো।সে বলে, কে আগে হাত ধরলো?আমি বলি, আমি।সে উত্তেজিত হয়, বলে, তুমি হাত ধরলে?আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, নিশ্চয়ই সেখানে লোকটা তোমাকে চুমো খেয়েছে?
পৃষ্ঠা-১৩৫
আমি বলি, তিনি খান নি।সে বলে, সে খায় নি?আমি বলি, না।সে বলে, তাহলে কে খেলো?আমি বলি, আমিই তাঁকে চুমো খেয়েছি।সে বলে, তুমি চুমো খেলে?আমি বলি, হ্যাঁ।দেলোয়ার লাফিয়ে উঠে আমাকে চড় মারার চেষ্টা করে, আমি দূরে স’রে যাই, আমি আক্রমণকারীর দিকে নিজের গাল পেতে দিতে পারি না।সে চিৎকার করে, তুমি একটা খানকি, তুমি একটা বেশ্যা।আমি বলি, তুমি এখন বেরিয়ে যাও।সে বলে, তোমাকে আমি পিষে ফেলবো।আমি বলি, পারলে পিখো।সে বলে, দেখো, কীভাবে পিষি। আমি বলি, দেখবো।সে বলে, খানকি।আমি বলি, আমার জুতো দুটোর কথা মনে রেখো।দেলোয়ার কি পাগল হয়ে গেছে? ওর চোখেমুখে আমি অসংখ্য উন্মাদের মুখ দেখতে পাই, একপাল উন্মাদ ওর চোখেমুখে কোলাহল করছে, কেউ খুন করতে চাচ্ছে, কেউ হো হো ক’রে হাসতে চাচ্ছে, কেউ পথে পথে আগুন লাগাতে চাচ্ছে সব ঘরবাড়িতে, কেউ কাঁদছে। সে আমার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে, কাঁপছে সে, টলছেও; আমি একবার ভয় পাই, কিন্তু ভয় পেলে আমার চলবে না। আমি উঠে একটু দূরে স’রে গিয়ে দাঁড়াই, সে ছুটে এসে চড় মারে, আমি আরো দূরে স’রে যাই, হাত দিয়ে ফেরাই, সে আবার চড় মারে। চড়টা লাগে আমার গাল জুড়ে, আমি উল্টে প’ড়ে যাই; আমার মনে হয় আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু না দেখলে আমার চলবে না, আমি হাত বাড়িয়ে একটি জুতো তুলে নিই। আমি উঠে দাঁড়াই, সে আবার চড় মারে, এবং আমি শক্ত ক’রে জুতো দিয়ে আঘাত করি, লাগে তার কপালে; মনে হচ্ছিলো আমি পারবো না, কিন্তু আমার জুতোর গোড়ালি শক্তভাবেই লাগে, সে চমকে ওঠে।আমি বলি, আর এগোবে না। সে বলে, আমি তোমাকে রেইপ করবো। আমি বলি, তা আমি দেবো না। সে বলে, দিতে হবে না, আমিই করবো। আমি বলি, তা দেবো না। আমি জানি আমি ওর সাথে পেরে উঠবো না, আমার লিঙ্গের তিরিশ লাখ
পৃষ্ঠা ১৩৬ থেকে ১৪৮
পৃষ্ঠা-১৩৬
বছরের দুর্বলতা আছে আমারও, কিন্তু আমার প্রিয় শরীরটি যদি ভেঙেচুরেও যায় আজ, তবু আমি তাকে আক্রমণকারীর কাছে সঁপে দেবো না। প্রিয় শরীর, তোমাকে আমি রক্ষা করবো, তোমাকে ছুঁয়ে বলছি ম’রে গেলেও তোমাকে আমি আজ কোনো ধর্ষণকারীর হাতে তুলে দেবো না। দেলোয়ার এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে, আমি তাকে ফেরাতে থাকি, এক সময় আর পারি না- আমার লিঙ্গের দুর্বলতা আমার শরীরে; সে আমার ডান হাত চেপে ধ’রে পেছনের দিকে আটকে রাখে, আমি বাঁহাত দিয়ে তাকে আঘাত করার চেষ্টা করি, পেরে উঠি না; সে আমার চুলগুলো ধ’রে টান দেয়, হায়রে আমার প্রিয় চুল, আমি উল্টে মেঝেতে প’ড়ে যাই, সে আমার বুকের ওপর চেপে বসে।আমি এক দলা থুতু ছিটিয়ে দিই তার মুখে; সে আমার গালে চড় মারে, আমি আরেক দলা থুতু ছিটিয়ে দিই তার মুখে; বুতু ছাড়া আমার আর কোনো অস্ত্র নেই।সে বলে, লোকটাকে যেভাবে চুমো খেয়েছিলে আমাকে সেভাবে চুমো খাও।আমি আরেক দলা থুতু ছিটোতে গিয়ে দেখি থুতু নেই।সে বলে, আমাকে চুমো খাও।আমি বলি, কোনোদিন না।সে বলে, খেতে হবে।আমি বলি, না।সে বলে, তোমার জিভ বের করো।আমি বলি, না।সে বলে, ঠোঁট দাও।আমি বলি, না।সে আমার গালে চড় মারে, আমার চোখ অন্ধকার হয়ে আসে; কিন্তু অন্ধকার হয়ে এলে আমার চলবে না, আমি চোখে আলো জ্বালিয়ে রাখি। আমার আলো চাই, শরীরে শক্তি চাই; আমি চাই আমার স্তন দুটি হয়ে উঠুক ধারালো পাথর,আঙুল হয়ে উঠুক তীক্ষ্ণ বর্শা, খুকু হয়ে উঠুক অবিরল বজ্রপাত। সে আমাকে চেপে ধ’রে বলে, লোকটার সাথে কমলগঞ্জে ক-রাত শুয়েছো? আমি বলি, সাত রাত।সে বলে, তাহলে যে বললে দু-রাত?আমি ধলি, না, সাত রাত।সে বলে, তাহলে দু-রাত বললে কেনো?আমি বলি, তুমি কষ্ট পাবে ব’লে।সে বলে, সত্যি ক’রে বলো ক-রাত?আমি বলি, সাত রাত।সে বলে, ক-বার ইন্টারকোর্স করেছো?
পৃষ্ঠা-১৩৭
আমি বলি, সারারাত ভ’রে।সে বলে, সাত রাতই সারারাত ভ’রে?আমি বলি, হ্যাঁ।দেলোয়ার কাঁপতে থাকে, মনে হয় সে প’ড়ে যাবে, তীব্র ভূমিকম্প হচ্ছে তার জগত জুড়ে, সে তার জগত নিয়ে ভেঙে পড়বে।সে বলে, তাহলে যে বললে দু-বার?আমি বলি, না, সারারাত ভ’রে।সে বলে, তাহলে দু-বার বললে কেনো?আমি বলি, তুমি কষ্ট পাবে ব’লে।সে বলে, সারারাতে ক-বার?আমি বলি, গুণে রাখি নি।সে বলে, দশবার?আমি বলি, দশবার কেউ পারে না।সে বলে, লোকটা খুব ভালো পারে?আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, লোকটা টায়ার্ড হয় না? আমি বলি, না।আমি বলি, এজন্যেই লোকটাকে তোমার পছন্দ?আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, লোকটার সাথে খুব সুখ পেয়েছো? আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, পুলকের পর পুলক হয়েছে?আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, লোকটার সাথে সারারাত কেমন কেটেছে?আমি বলি, সারারাত কেটে গেছে শরীরের রহস্য উদ্ঘাটন ক’রে ক’রে।সে বলে, রহস্য? তোমার শরীরে আরো রহস্য ছিলো?আমি বলি, ছিলো।সে বলে, কোথায় ছিলো?আমি বলি, তোমাকে তা কখনো জানাই নি।সে বলে, কেনো জানাও নি?আমি বলি, তোমাকে জানাতে ইচ্ছে করে নি।সে বলে, আমার সাথে সুখ পাও না?আমি বলি, পেতাম।সে বলে, এখন পাও না?
পৃষ্ঠা-১৩৮
আমি বলি, না।দেলোয়ার আবার আমার গালে চড় মারে, তার হাতটা আমার গালে আটকে থাকে অনেকক্ষণ; আমি আমার বাঁ পা টেনে এনে তাকে লাথি দিই, লাথিটা তার বুকে লাগে শক্তভাবেই। যে প’ড়ে যেতে থাকে, আমি ওঠার চেষ্টা করি; যে আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার ওপর, আমার চুলগুলো ধ’রে আমাকে চিৎ ক’রে চেপে ধরে মেকের ওপর।সে বলে, তোমাকে আমি রেইপ করবো।আমি বলি, পারবে না।সে কেঁপে ওঠে, তারও হয়তো মনে হয় সে পারবে না, আজ পারবে না, কোনোদিন পারবে না।সে বলে, পারবো।আমি বলি, কখনো পারবে না।সে আমাকে নগ্ন করার চেষ্টা করে, আমি বাধা দিই, তার হাত বারবার সরিয়ে দিতে থাকি, কিছুতেই আমি আজ নগ্ন হবো না, হে প্রিয় শরীর, কোনো ধর্ষণকারীর সামনে আমি তোমাকে নগ্ন করবো না, তোমার সৌন্দর্য ধর্ষণকারীর জন্যে নয়, তুমি শুধু প্রেমিকের ছোঁয়ায় ফুটতে পারো; সে টেনে আমার শাড়ি ব্লাউজ ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করে, পারে না, আমি আজ তার সামনে নগ্ন হবো না, সে আমাকে চেপে ধ’রে নিজে নগ্ন হ’তে থাকে।আমি বলি, ওতে লাভ নেই।সে বলে, কেনো?আমি বলি, তুমি পারবে না।সে বলে, কেনো?আমি বলি, নপুংসকেরা পারে না।সে কেঁপে উঠে বলে, দেখিয়ে দেবো আমি পারি কি না।আমি বলি, তুমি পারবে না।দেলোয়ার এবার চেষ্টা করতে থাকে উত্তেজিত হ’তে, শক্ত হ’তে, তার শিথিল শরীরকে দৃঢ় করতে; সে আমার ঠোঁটে চুমো খাওয়ার চেষ্টা করে, আমি খেতে দিই না, স্তনে চুমো খাওয়ার চেষ্টা করে, আমি দিই না; সে আমার শরীরে নিজেকে ঘষতে থাকে, আমি ঘষতে দিই না; সে চেষ্টা করতে থাকে, তাকেপারতেই হবে, কিন্তু পেরে ওঠে না।সে কিছুতেই দৃঢ় হ’তে পারছে না, তার জন্যে আমার কষ্ট হয়, কিন্তু আমি তাকে সাহায্য করতে পারি না, সে আমার সাহায্য আর পাবে না। সে নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে ওঠে; সে আমাকে এক হাত এক পা দিয়ে চেপে ধ’রে আরেক হাত দিয়ে নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করতে থাকে, পাগলের মতো নাড়তে থাকে তার প্রত্যঙ্গটি, ওটি সাড়া দেয় না, পচা মাংসের
পৃষ্ঠা-১৩৯
মতো দলা পাকিয়ে থাকে, তার মুখ বিকৃত হয়ে যেতে থাকে, সে শক্ত হ’তে পারে না, তার কপালে ঘাম জমছে দেখতে পাই, কিন্তু ওই ঘাম আমি মুছিয়ে দিতে পারি না, আর দেবো না।আমি বলি, আমাকে ছাড়ো।সে বলে, না।আমি বলি, তুমি কিছু পারবে না।সে বলে, পারবো।আমি বলি, নপুংসকেরা রেইপ করতে পারে না।সে বলে, পারবো।আমি বলি, রেইপ করতে হ’লে শিশু থাকতে হয়।দেলোয়ার আমাকে একটা চড় দেয়, আমার গালে তার আঙুলের দাগ ব’সে যার মনে হয়, সে আমার চুলগুলো টেনে ছিঁড়ে ফেলতে চায়; আমি তার মুখে একবার খামচি দিই, কয়েকটি নখ ব’সে যায়।সে বলে, কয়েকটি কথা বলবে।
আমি বলি, কী?সে বলে, তোমরা কি পুরো ন্যাকেড হয়ে ইন্টারকোর্স করেছিলে? আমি বলি, না।সে বলে, তুমি মিথ্যে কথা বলছো, ভোমরা নিশ্চয়ই পুরো ন্যাকেড হয়েছিলে।আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, তুমি কি নিজে ন্যাকেড হয়েছিলে?আমি বলি, না।সে বলে, লোকটা কি তোমাকে ন্যাকেড ফরেছিলো?আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, কীভাবে করেছিলো?আমি বলি, আমি চোখ বুজে শুয়ে ছিলাম, তিনি আমাকে নগ্ন করেছিলেন, ধীরেধীরে খুলেছিলেন।সে বলে, তারপর?আমি বলি, অনেকক্ষণ আমাকে দেখেছিলেন, আমর করেছিলেন, আমি চোখ বুজে শুয়ে ছিলাম, তিনি আমার সারা শরীরে চুমো খেয়েছিলেন।দেলোয়ার আমাকে একটা চড় দেয়, আমি তার গালে একটা চড় দিই, অনেকখানি থুতু ছিটিয়ে দিই।সে বলে, লোকটি তোমাকে দেখে কিছু বলেছিলো?আমি বলি, হ্যাঁ, বলেছিলেন।
পৃষ্ঠা-১৪০
সে বলে, কী বলেছিলো?আমি বলি, বলেছিলেন আপনার দেহখানি সুন্দর, এতো সুন্দর দেহ আমি দেখি নি।সে বলে, আর কী বলেছিলো?আমি বলি, বলেছিলেন আপনার স্তন দুটি সুন্দর, এতো সুন্দর স্তন আমি দেখি নি।সে বলে, আর কী বলেছিলো?আমি বলি, বলেছিলেন আপনার উরু সুন্দর।সে বলে, আর কী বলেছিলো?আমি বলি, বলেছিলেন আপনার নাভি সুন্দর।সে বলে, আর কী বলেছিলো?আমি বলি, বলেছিলেন আপনার বাগান সুন্দর।সে বলে, বাগান?আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, আর কী বলেছিলো?আমি বলি, বলেছিলেন আপনার বাগানের ঘাস আর ফুল সুন্দর।দেলোয়ার দু-হাতে আমার গলা চেপে ধরে, আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে; আমি তাকে আবার খামচি দিই, তার নাকে লাগে, সে আমার গলা থেকে হাত সরিয়ে নেয়।সে বলে, লোকটা নিজে ন্যাকেড হয়েছিলো?আমি বলি, না।সে বলে, তাহলে?আমি বলি, আমি তাঁকে নগ্ন করেছিলাম।সে বলে, তুমি নগ্ন করেছিলে?আমি বলি, হ্যাঁ।দেলোয়ার আমার গালে একটা চড় দেয়, আমি তার মুখে থুতু দিই।সে বলে, কীভাবে করেছিলে?আমি বলি, তা তোমাকে বলবো না।সে বলে, বলতে হবে।আমি বলি, সেভাবে তোমাকে কখনো নগ্ন করি নি।সে বলে, তোমরা আলো জ্বালিয়ে রেখেই ইন্টারকোর্স করেছিলে?আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, কেনো আলো জ্বালিয়ে রেখেছিলে?আমি বলি, তিনি আলো নেভাতে চেয়েছিলেন।
পৃষ্ঠা-১৪১
সে বলে, কেনো নেভালো না?আমি বলি, আমি আলো নেভাতে নিষেধ করি।সে বলে, কেনো?আমি বলি, আমি তখন তাঁকে দেখতে চেয়েছিলাম।দেলোয়ার আবার আমাকে চড় দেয়, আমি তাকে লাথি দিই, সে প’ড়ে যেতে যেতে আমার ওপর চেপে থাকে।আমি বলি, ওঠো, তুমি কিছু পারবে না।সে বলে, লোকটা প্রত্যেকবারই পেরেছিলো?আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, প্রত্যেকবার?আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, অনেকক্ষণ ধ’রে?আমি বলি, হ্যাঁ।দেলোয়ার ভেঙে পড়ছে, কাঁপতেও পারছে না, তার শরীর শিথিল হয়ে এসেছে; আমার করুণা লাগে তার জন্যে, কিন্তু আমার কিছু করার নেই, আমি চাই অকরুণ হয়ে উঠতে।সে বলে, তুমি লোকটাকে আদর করেছো?আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, কীভাবে করেছো?আমি বলি, তাঁর ঠোঁটে চুমো খেয়েছি।সে বলে, শুধু ঠোঁটে?আমি বলি, তাঁর বুকে পিঠে পায়ের পাতায় চুমো খেয়েছি।সে বলে, পায়ের পাতায়?আমি বলি, তার নখেও চুমো খেয়েছি।সে বলে, আমাকে চুমো খাও।আমি বলি, না।সে বলে, আমার বুকে চুমো খাও।আমি বলি, না।সে বলে, আমার ঠোঁটে চুমো খাও।আমি বলি, না।দেলোয়ার আমাকে চেপে ধরে, ভেঙে ফেলতে চায়; আমি তাকে হাঁটু দিয়ে গুঁড়ো দিয়ে ফেলে দিই। আমি ইঠতে চাই, পারি না; সে আমার আমাকে চেপে ধরে, দু-হাত ভেঙেফেলার মতো ক’রে আমাকে তার নিচে আটকে রাখে, আমি টানাটানি ক’রে হাত
পৃষ্ঠা-১৪২
সরিয়ে আনি, দেখি সে দুর্বল হয়ে পড়েছে।সে বলে, লোকটাকে তুমি বিয়ে করবে?আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, কখন?আমি বলি, আগামী সপ্তায়।সে বলে, আমি তোমাকে ছাড়বো না।আমি বলি, আমি তোমাকে ছেড়ে দেবো।সে বলে, খানকি, প্রস্টিটিউট, ঢোকেই আমি ছেড়ে দেবো।আমি বলি, দাও।সে বলে, তার আগে তোকে আমি দেখিয়ে দেবো।আমি অবাক হই, দেলোয়ার ‘তুই’তে নেমে এসেছে, আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে কার পাই, একটি লাশ আমাকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করছে।সে বলে, লোকটা এখনো যে এলো না?আমি বলি, আসবে।সে বলে, কখন আসবে?আমি বলি, তা তোমাকে বলবো কেনো?সে বলে, লোকটা যখন ইচ্ছে আসে?আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, তোমরা দিনেও ইন্টারকোর্স করো?আমি হঠাৎ আমার হাত টেনে নিয়ে তার মুখে একটা চড় দিই, চড়টা শক্তভাবেই লাগে; সে আমাকে আরো জোরে চেপে ধরে।সে বলে, বলো তোমরা দিনেও করো?আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, পুরো ন্যাকেড হয়ে?আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, কোথায় করো?আমি বলি, বিছানায়, মেঝেয়, বারান্দায়, বাথরুমে, কিচেনে।সে বলে, রান্না করতে করতেও করো?আমি বলি, হ্যাঁ, মশলার সুগন্ধে তিনি বেশি সুখ পান।মনে হচ্ছিলো দেলোয়ার আবার চড় দেবে, গলা চেপে ধরবে, আমিও তৈরিহ’তে থাকি; কিন্তু সে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।সে বলে, তুমি আগের থেকে সুন্দর হয়েছো।আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, ওই লোকটা একথা বলে?
পৃষ্ঠা-১৪৩
আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, লোকটা নিশ্চয়ই তোমার স্তনের প্রশংসা করে?আমি বলি, হ্যাঁ, আমার স্তন তিনি খুব পছন্দ করেন।সে বলে, স্তন পছন্দ করে?আমি বলি, সে এ-দুটো নিয়ে খেলে।সে বলে, খেলে?আমি বলি, পান করে।সে বলে, আমি পান করতে চাই।আমি বলি, না।দেলোয়ার খরখর ক’রে কেঁপে ওঠে; আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে কষ্ট পাই, কিন্তু আমার কিছু করার নেই।সে বলে, তোমার তলপেটের প্রশংসা করে?আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, তোমার উরুর প্রশংসা করে?আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, তোমার চুলের প্রশংসা করে?আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, লোকটা সব সময় তোমাকে চুমো খায়?আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, ঠোঁটে?আমি বলি, ঠোঁটে গালে বুকে নাভিতে উরুতে পিঠে পায়ে জংঘায় নিতম্বে গ্রীবায় বাহুমূলে বাগানে।সে বলে, সব জায়গায়?আমি বলি, হ্যাঁ।যে বলে, আমি চুমো খাবো।আমি বলি, না।সে বলে, আমি তোমার স্তন দেখবো।আমি বলি, না।সে বলে, আমি তোমাকে ন্যাকেড দেখবো।আমি বলি, না।সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, তার কোনো প্রত্যঙ্গ আর সজীব নেই, শিথিল হয়েপড়েছে তার সব কিছু; আমার মায়া হয়, কিন্তু মায়া করার কিছু আমার নেই।দেলোয়ার কি আমাকে ছাড়বে না? তার নিচ থেকে কখন উদ্ধার পাবো? সেআর কতোক্ষণ চেপে রাখবে আমাকে? আমার পানি খেতে ইচ্ছে করছে, চা
পৃষ্ঠা-১৪৪
খেতে ইচ্ছে করছে, আমার শরীর ব্যথায় ভ’রে গেছে।আমি বলি, আমাকে ছাড়ো।সে বলে, তাহলে আমার সাথে চলো।আমি বলি, কখনো না।সে বলে, ওই লোকটাকে নিয়ে তুমি এ-বাসায় থাকবে?আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, লোকটা তোমার খরচপাতি দেবে?আমি বলি, আমিই যথেষ্ট আয় করি।সে বলে, লোকটার তো বেশ মজা, সে শুধু তোমাকে উপভোগ করবে?আমি বলি, হ্যাঁ, তাতেই আমি সুখী।সে বলে, আমাকে নিয়ে তুমি সুখী নও?আমি বলি, না।সে বলে, লোকটা কি আসলেই তোমাকে বিয়ে করবে?আমি বলি, হয়তো করবে, হয়তো করবে না।সে বলে, করবে না কেনো?আমি বলি, তার সমস্যা আছে।সে বলে, কী সমস্যা?আমি বলি, তাঁর বউ আছে, বাচ্চা আছে।সে বলে, তুমি লোকটার মিস্ট্রেস হয়ে থাকবে?আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, মিস্ট্রেস হয়ে থাকতে তোমার ভালো লাগবে?আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, তোমার পেটেরটা?আমি বলি, রেখে দেবো।সে বলে, রেখে দেবে?আমি বলি, হ্যাঁ।সে আমাকে আবার চড় মারার চেষ্টা করে, আমি হাত ধ’রে ফেলি; শিথিলঅসার মৃত হাত, আমার শক্তি থাকলে ভেঙে ফেলতে পারতাম।সে বলে, তুমি আর আমাকে ভালোবাসো না?আমি বলি, না।সে বলে, ওই লোকটাকে ভালোবাসো?আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, তুমি লোকটার মিস্ট্রেস হয়ে থাকবে?আমি বলি, হ্যাঁ।
পৃষ্ঠা-১৪৫
সে বলে, তোমার ঘেন্না লাগবে না? আমি বলি, কেনো ঘেন্না লাগবে? সে বলে, মিস্ট্রেসও যা বেশ্যাও তাই। আমি বলি, আমি তাঁর বেশ্যা হয়েই থাকবো। সে বলে, তুমি তার বেশ্যা হয়ে থাকবে?আমি বলি, হ্যাঁ।সে ভেঙে পড়ছে, জয়ী হ’তে চেয়েছিলো, কিন্তু আমি তাকে জয়ী হ’তে দেবো না; আমি দিচে পিষে গেলেও থাকবো অপরাজিত।ব্যথায় কাতরে উঠছে আমার শরীর, পা থেকে মাথা পর্যন্ত বিষ ছড়িয়ে পড়ছে, গাল ফুলে উঠেছে, ঠোঁট কেটে গেছে, আমি জিভের নিচে রক্তের নোনা স্বাদ পাই। আমি মনে মনে বলি, ওটা কিছু নয়, আমি পরাজিত হ’তে চাই না, আমি জয়ী হ’তে চাই না, আমাকে চাই।আমি বলি, আমরা আবার বেড়াতে যাবো।সে বলে, লোকটাকে নিয়ে?আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, কোথায়?আমি বলি, কমলগঞ্জে।সে বলে, কেনো?আমি বলি, বলেছেন কমলগঞ্জে তিনি হানিমুনে যাবেন।সে বলে, হানিমুনের প্ল্যানও ক’রে ফেলেছো?আমি বলি, হ্যাঁ।সে বলে, খানকির আবার হানিমুন।আমি বলি, চাইলে তুমি দেখতে আসতে পারো।দেলোয়ার হঠাৎ উঠে আমাকে লাথি মারে, আমি গড়িয়ে গিয়ে দেয়ালেরপায়ে পড়ি, মাথাটা আমার দেয়ালে টু খায়; সে এসে আবার আমাকে তার নিচে। চেপে ধরে, আমার গলার দিকে তার হাত এগিয়ে আসতে থাকে।হাতের কাছেই আমার আরেকটি জুতো, আমি জুতোটি ধ’রে গোড়ালি দিয়ে শক্ত ক’রে তার মুখে আঘাত করি। সে কাতরে ওঠে।সে আমাকে তার নিচে চেপে ধ’রে মুখে হাত দিয়ে দেখে রক্ত। দেলোয়ারের রক্ত দেখে আমার ভালো লাগে, আমি শক্তি ফিরে পাই।আমি বলি, আমাকে ছাড়ো।সে বলে, না।আমি বলি, তুমি কি আমাকে খুন করতে চাও?সে বলে, জানি না।
পৃষ্ঠা-১৪৬
আমি বলি, খুন করতে পারো, তবু আমাকে পাবে না।সে বলে, আমি তোমাকে রেইপ করতে চাই।আমি বলি, পারবে না।সে বলে, পারবো, আমাকে পারতে হবে।আমি বলি, নপুংসকেরা পারে না। সে বলে, আমি তো আগে পারতাম।আমি বলি, আমি পারতে দিতাম।সে বলে, এখনো দাও।আমি বলি, আর কোনোদিন দেবো না।দেলোয়ার আবার শক্ত হওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। সে আমাকে চুমো খেতে চায়, আমি মুখ ফিরিয়ে নিই; সে আমার স্তনে চুমো খেতে চায়, আমি উল্টেন্ট তার মুখের কাছের থেকে আমার স্তন সরিয়ে নিই; সে আমাকে নগ্ন করতে চায়, আমি দিই না, বাধা দিই, সে আমাকে নগ্ন করতে পারে নাতার শক্ত হওয়া দরকার, সে নিজেকে ঘষতে থাকে আমার শরীরের সাথে, তার প্রত্যঙ্গটি সাড়া দেয় না, পচা মাংসের মতো প’ড়ে থাকে।আমার মায়া হয়, এটিকে একদিন আমি দণ্ডের মতো দৃঢ় আর স্বপ্নের মতো কোমল ক’রে তুলতাম, এটি মধ্যযুগের রাজার মতো মুকুট প’রে দেখা দিতো, আজ ওটি ধ্বংসস্তূপ। যা একদিন আমার প্রেরণায় কবি হয়ে উঠতো, তা এখন নর্দমার প’চে যাওয়া শুয়োরের লাশ। কিন্তু দেলোয়ার অদম্য, তাকে পারতে হবে, সে ঘ’ষে ঘ’যে ক্লান্ত; হাড দিয়ে সে প্রত্যঙ্গটিকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা ক’রে চলছে, প্রত্যঙ্গটি সাড়া দিচ্ছে না, বিকৃত হয়ে উঠছে তার মুখ, যন্ত্রণায় সেচিৎকার ক’রে উঠছে থেকে থেকে।আমি বলি, আমাকে ছাড়ো।সে বলে, না।সে বলে, তবু আমি ছাড়বো না।আমি খলি, দেখছো না তুমি পারবে না? আমি বলি, তুমি দেখছো না আমি কষ্ট পাচ্ছি? আমি বলি, তুমি কি আমাকে মেরে ফেলতে চাও?সে বলে, সুখ তো অনেক পেয়েছো।সে বলে, হ্যাঁ।আমি বলি, আমাকে মেরে তোমার কী লাভ?সে বলে, তোমাকে আমি আর কারো সাথে শুতে দেবো না।আমি বলি, কেনো?সে বলে, তোমার দেহ শুধু আমার।
পৃষ্ঠা-১৪৭
আমি বলি, এটা কারো নয়, আমার।সে বলে, তোমার জন আমি আর কাউকে দেখতে দেবো না।আমি বলি, আমি দেবো।সে বলে, তোমাকে আমি ছাড়া আর কেউ চুমো খেতে পারবে না। আমি বলি, খাবে।সে বলে, আমি ছাড়া কেউ তোমার সাথে ইন্টারকোর্স করতে পারবে না। আমি বলি, করবে।দেলোয়ার তার হাত আমার গলার দিকে এগিয়ে আনতে থাকে; কিন্তু আমি মরতে চাই না, আমি ঠেলে তার হাত সরিয়ে দিই।আমি যতোবারই তার হাত সরিয়ে দিই ততোবারই সে হাত আমার গলার দিকে এগিয়ে আনে; কিন্তু তার হাত অবশ হয়ে এসেছে, তার হাতও প্রত্যঙ্গটির মতো পচা মাংস হয়ে গেছে।আমি তার হাতকে আমার গলা চেপে ধরতে দিতে পারি না।আমি কী করবো? আমি মরতে চাই না। আমি আমার গলায় তার হাতের ফাঁস পরতে চাই না।সে আমার গলার দিকে একটু এগিয়ে আসতেই আমি দু-হাতে তার অণ্ডকোষ চেপে ধরি, সে চিৎকার ক’রে ওঠে।আমি তার অণ্ডকোষ চেপে ধ’রে থাকি; এ-দুটো আমার জীবন।সে চিৎকার ক’রে বলে, ছেড়ে দাও, আমি ম’রে যাচ্ছি।আমি আরো জোরে চেপে ধ’রে বলি, আমিও ম’রে যাচ্ছিলাম।আমি আরো জোরে চাপ দিই, আমার ইচ্ছে হয় ও দুটোকে ডিমের মতোভেঙে ফেলি, কিন্তু আমি ভাঙি না, সে চিৎকার ক’রে লুটিয়ে পড়ে।সে বলে, ছাড়ো, ম’রে যাচ্ছি।আমি বলি, ছাড়বো না, তুমি আমাকে মেরে ফেলছিলে।সে বলে, ছাড়ো, আমি চ’লে যাবো।আমি বলি, তোমাকে আমি বিশ্বাস করি না।
সে বলে, বিশ্বাস করোআমি বলি, না।সে কেঁদে কেঁদে বলে, আমাকে বিশ্বাস করো।আমি বলি, না।আমি কী করবো এখন? চেপে ভেঙে ফেলবো এ-দুটি? খুন করবো ওকে? খুন করতে আমার ইচ্ছে হয় না, আমার মায়া হয়। দেলোয়ার একদিনআমার সব ছিলো, আজ আমার কেউ নয়; ওর জন্যে আমার কষ্ট হয়, কিন্তু আমি অণ্ডকোষ ছেড়ে দিতে পারি না।
পৃষ্ঠা-১৪৮
আমি বলি, আমি চেপে ধ’রে আছি, তুমি তোমার শার্ট ট্রাউজার পরো। সে বলে, দাও।আমি পা দিয়ে তার দিকে শার্ট আর ট্রাউজার এগিয়ে দিই, জোরে চাপ দিই তার অণ্ডকোষে, চেপে রাখি; সে মেঝেতে শুয়ে শুয়ে আস্তে আস্তে শার্ট আর ট্রাউজার পরে; অনেক সময় লাগে।তার দিকে তাকিয়ে আমার কষ্ট হয়, আমার মায়া হয়; কিন্তু না, আমি মায়া করার জন্যে জন্যি নি, কষ্ট বোধ করার জন্যে জন্মি নি।সে বলে, ট্রাউজারের বোতাম লাগাতে পারছি না।আমি বলি, বাইরে গিয়ে লাগাবে।আমি ভার অণ্ডকোষ চেপে ধ’রে আছি, শক্ত ক’রেই ধ’রে আছি।আমি যদি, ওঠো, হাঁটো।আমি দু-হাত দিয়ে তার অণ্ডকোষ চেপে ধ’রে দরোজার দিকে হাঁটতে থাকি, সে আস্তে আস্তে হাঁটতে থাকে আমার সাথে।দরোজার কাছে এসে বলি, দরোজা খোলো।দেলোয়ার কাঁপতে কাঁপতে দরোজা খোলে, আমি জোরে একটা চাপ দিই;মেসে ব’সে পড়তে চায়।আমি বলি, আর এসো না।সে বলে, আচ্ছা।আমি বলি, তুমি কি আমাকে শেষ চুমো যেতে চাও?সে বলে, না।আমি জোরে তার অণ্ডকোষে চাপ দিয়ে তাকে সিঁড়িতে ঠেলে ফেলে দিই, সে নিচের দিকে গড়িয়ে পড়ে; আমি তাড়াতাড়ি দরোজা বন্ধ করি।ছিদ্র দিয়ে একবার তাকাই, দেখি দেলোয়ার নেমে যাচ্ছে।আমার চোখে একটু জল জমে, এক বিন্দু, দু-বিন্দু; আমি নিজেকে বলি, এটা কিছু নয়, জল, মুছে ফেললেই মুছে যাবে।