দারসে হাদীস -২য় খন্ড _হাঃপারভিন
পৃষ্ঠা ১ থেকে ১৫
পৃষ্ঠা:০১
দারস-১:কুরআন তিলাওয়াতের ফযীলত
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ (رض) أَنْ رَسُولَ اللَّهِ (صلعم) قَالَ : مَا اجْتَمَعَ قَوْمٌ فِي بَيْتٍ مِنْ بُيُوتِ اللهِ يَتْلُونَ كِتَابَ اللَّهِ وَيَتَدَارَسُوْنَهُ فِيمَا بَيْنَهُمْ إِلَّا نَزَلَتْ عَلَيْهِمُ السَّكِينَةُ وَغَشِيَتْهُمُ الرَّحْمَةُ، وَخَفْتُهُمُ الْمَلَائِكَةُ وَذَكَرَهُمُ اللَّهُ فِيمَنْ عِنْدَهُ. (مسلم، ابو داؤد) অর্থ : হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। রাসূল (সা) বলেছেন: আল্লাহর কোন ঘরে কোন একদল মানুষ সমবেত হয়ে যদি আল্লাহর কিতাব (কুরআন) অধ্যয়ন করে এবং অপরকে তা শেখায় তবে তাদের ওপর শান্তি অবতীর্ণ হয় ও রহমত দিয়ে তাদেরকে ঢেকে ফেলা হয়। ফিরেশতাগণ তাদেরকে ঘিরে রাখে এবং আল্লাহ তার নিকটবর্তী ফিরেশতাদের কাছে তাদের কথা উল্লেখ করেন। (সহীহ মুসলিম, আবু দাউদ)
শব্দার্থ:)عَنْ أَبِي هُرَيْرَةٌ (رض : হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত : أَنْ رَسُوْلَ اللهِ (صلعم) قَالَ : নিশ্চয়ই রাসূল (সা) বলেছেন। مَا اجْتَمَعَ قَوْمٌ : কোন একদল মানুষ সমবেত হয়ে। في بيت : ঘরের ! মধ্যে। مِنْ بُيُوتِ اللهِ : আল্লাহর কোন ঘরে। يَتْلُونَ كِتَابَ الله আল্লাহর কিতাব (কুরআন) অধ্যয়ন করে। وَيَتَدَارَسُوْنَهُ : এবং অপরকে তা শেখায়। إِلَّا نَزَلَتْ عَلَيْهِمُ : তবে তাদের ওপর অবতীর্ণ হয়। السكينة الرَّحْمَةُ : শান্তি ও রহমত দিয়ে তাদেরকে ঢেকে ফেলা হয়। وَخَفْتْهُمُ الْمَلَائِكَةُ:: ফিরেশতাগণ তাদেরকে ঘিরে রাখে। !: وَذَكَرَهُمُ اللَّهُ :
পৃষ্ঠা:০২
এবং আল্লাহ তাদের কথা উল্লেখ করেন। فيمن عنده: তাঁর নিকটবর্তীদের (ফিরেশতাদের) কাছে। গুরুত্বঃ মহান আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন মানুষের সঠিক পথ-নির্দেশনার জন্য যুগে যুগে নবী-রাসূলগণের নিকট যে সকল আসমানী কিতাব অবতীর্ণ করেছেন, তন্মধ্যে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানী কিতাব হলো আল- কুরআন। ইহা হচ্ছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের মূল উৎস। প্রতিদিন গভীর অভিনিবেশ সহকারে কুরআন অধ্যয়নের মাধ্যমে এর অন্তর্নিহিত বিষয়গুলো উপলব্ধি করে আল্লাহর হুকুমের সত্যতা মেনে নিয়ে আনুগত্যের শির নত করে দেয়াই মু’মিন জীবনের লক্ষ্য। এ কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য কুরআন তিলাওয়াতের গুরুত্ব অপরিসীম। যেহেতু সকল জ্ঞানের কেন্দ্র বিন্দু হচ্ছে কুরআন, সেহেতু নিয়মিত এ কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে বহুমুখী জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি করা যায়।জীবনকে সুন্দর ও সৌন্দর্যময় করে গড়ে তুলতে এবং ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি নিশ্চিত করতে কুরআনের শিক্ষা জীবনের সর্বক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করা একান্ত প্রয়োজন। এজন্য কুরআনকে বেশী বেশী অধ্যয়ন করে খোদায়ী বিধান সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করা অতীব জরুরী। তাই আলোচ্য হাদীস খানায় কুরআন অধ্যয়নের ফযীলতের কথা তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে কোন ঘরে মানুষ সমবেত হয়ে যদি আল্লাহর কিতাব (কুরআন) অধ্যয়ন করে এবং অপরকে তা শেখায় তবে তাদের ওপর শান্তি অবতীর্ণ হয় ও রহমত দিয়ে তাদেরকে ঢেকে ফেলা হয়। ফিরেশতাগণ তাদেরকে ঘিরে রাখে এবং আল্লাহ তার নিকটবর্তী ফিরেশতাদের কাছে তাদের কথা উল্লেখ করেন। গ্রন্থ পরিচিতিঃ সহীহ মুসলিম। এ গ্রন্থের প্রণেতা হলেন ইমাম মুসলিম (র)। যার পূর্ণ নাম আবুল হোসাইন। মুসলিম বিন হাজ্জাজ আল কুশাইরী আন-নিশাপুরী। তিনি খুরাসানের প্রসিদ্ধ শহর নিশাপুরে ২০৪ হিজরী ২৪শে রজব জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবকাল থেকেই তিনি হাদীস শিক্ষায় আত্মনিয়োগ করেন। ২১৮
পৃষ্ঠা:০৩
হিজরীতে ১৪ বছর বয়সে হাদীস সংগ্রহের জন্য তিনি হিজাজ, ইরাক, মিশর, বাগদাদ, সিরিয়া ইত্যাদি মুসলিম জাহানের ইল্ম শিক্ষার কেন্দ্রভূমিসমূহে ভ্রমণ করেন। তিনি সেকালের জ্ঞানসাগর ও যুগ শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ইমাম বুখারীর সান্নিধ্য লাভ করেন। ইমাম মুসলিম (র) সরাসরি ওস্তাদগণের কাছ থেকে শ্রুত তিন লক্ষ হাদীস হতে যাচাই-বাছাই করে (তাহযীবুল আসমা ১০ম খণ্ড) দীর্ঘ ১৫ বছর সাধনা ও গবেষণা করে এ। শ্রেষ্ঠ গ্রন্থখানি সংকলন করেন। এতে তাকরারসহ হাদীস সংখ্যা ১২,০০০। তাকরার বাদে হাদীস সংখ্যা ৪,০০০ মাত্র। (তাদরীবুর রাবী) সমসাময়িক মুহাদ্দিসগণ এ গ্রন্থকে বিশুদ্ধ ও অমূল্য সম্পদ বলে উল্লেখ করেছেন। আজ প্রায় বার শত বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও সহীহ্ মুসলিমের সমমানের কোন গ্রন্থ রচিত হয়নি। হাফেয মুসলিম ইবনে কুরতুবী (র) বলেনঃ لمْ يَضَعُ أَحَدٌ فِي الأَسْلَام مِثْل. “ইসলামে এরূপ আর একখানি গ্রন্থ আর কেউই রচনা করতে পারে নাই।” (মুকাদ্দামা, ফতহুল বারী, ২য় অধ্যায়) এ গ্রন্থের বিশুদ্ধতা প্রসঙ্গে ইমাম মুসলিম নিজেই মন্তব্য করেনঃ “মুহাদ্দিসগণ যদি দু’শত বৎসর পর্যন্তও হাদীস লিখতে থাকেন, তবুও তাদেরকে এ সনদযুক্ত বিশুদ্ধ হাদীসের উপর নির্ভর করতে হবে।” (আল-মুকাদ্দামা আলাল মুসলিম, নবুবী) ইনতিকাল: এই মহা-মনীষী ২৬১ হিজরী সনে ৫৭ বৎসর বয়সে নিশাপুরে ইনতিকাল করেন। (আল-হাদীসু ওয়াল মুহাদ্দীসুন ৩৫৭ পৃঃ) সুনানে আবু দাউদ সুনানে আবু দাউদ গ্রন্থখানা প্রণয়ন করেছেন জগত বিখ্যাত হাদীস বিশারদ সুলাইমান ইবনুল আশয়াস ইবনে ইসহাক আল আসাদী আসসিজিস্তানী। কান্দাহার ও চিশত-এর নিকট সীস্তান নামক স্থানে তিনি ২০২ হিজরীতে জন্ম গ্রহণ করেন। হাদীস শিক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি ইরাক, সিরিয়া, মিশর, খোরাসান পরিভ্রমণ করেন এবং সেখানকার মুহাদ্দিসগণের নিকট হতে
পৃষ্ঠা:০৪
হাদীস শ্রবণ ও সংগ্রহ করেন। হাদীসে তাঁর যে অসাধারণ জ্ঞান ও গভীর পারদর্শিতা ছিল, তা যুগের সকল মনীষীই উদাত্ত কণ্ঠে স্বীকার করেছেন এবং তাঁর তীক্ষ্ম স্মরণশক্তির প্রশংসা করেছেন। সে সঙ্গে তাঁর গভীর তাকওয়া ও পরহেজগারীর কথাও সর্বজন স্বীকৃতি লাভ করেছে। ইমাম হাফিজ আবু আবদুল্লাহ বলেছেন: “ইমাম আবু দাউদ নিরংকুশ ও অপ্রতিদ্বন্দ্বিভাবে তাঁর যুগের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ছিলেন।”তিনি ২৭৫ হিজরীতে বসরা নগরীতে ইনতিকাল করেন। ইমাম আবু দাউদ পাঁচ লক্ষ হাদীস থেকে বাছাই করে মাত্র ৪৮০০ হাদীস তাঁর সুনানের জন্য নির্বাচিত করেন। তিনি শুধু মাত্র আহকাম সম্পর্কিত হাদীসই সংকলন করেছেন। উল্লেখ্য যে, ইমাম আবু দাউদ তাঁর সুনানে এমন সব হাদীসই গুরুত্বসহকারে সংকলন করেছেন যেসব হাদীস দ্বারা বিভিন্ন ফিক্হী আহকামের বুনিয়াদ রেখেছেন। الله تعالى إِنَّهَا تَكْفِي الْمُجْتَهِد بَعْدَ كِتَابِ اللهِ : “একজন মুজতাহিদের পক্ষে ফিহের মাসয়ালা বের করার জন্য আল্লাহর কিতাব কুরআন মজিদের পরে এই সুনানে আবু দাউদ গ্রন্থই যথেষ্ট।” সংকলন সমাপ্ত করার পর তিনি গ্রন্থটি তাঁর হাদীসের উস্তাদ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের সম্মুখে উপস্থাপন করেন। ইমাম আহমদ এটিকে খুবই পছন্দ করেন এবং ইহা একখানা উত্তম হাদীস গ্রন্থ বলে প্রশংসা করেন। অতঃপর তা সর্বসাধারণের সম্মুখে উপস্থাপন করা হয়। আর আল্লাহ উহাকে এত বেশী জনপ্রিয়তা ও জনগণের নিকট মর্যাদা দান করেছেন, যা সিহাহ সিত্তার মধ্যে অপর কোন গ্রন্থই লাভ করতে পারেনি। রাবী পরিচিত: হযরত আবু হুরায়রা (রা)। উল্লেখিত হাদীসখানা হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। তাঁর নাম সম্পর্কে প্রায় ৩৫টি অভিমত পাওয়া যায়। বিশুদ্ধতম অভিমত হচ্ছে ইসলাম গ্রহণের পূর্বে তাঁর নাম ছিল- ১. আবদুশ শামছ, ২. আবদু আমর, ৩. আবদুল ওয্যা ইত্যাদি।
পৃষ্ঠা:০৫
ইসলাম গ্রহণ করার পর তাঁর নাম- ১. আবদুল্লাহ ইবনে সাখর ২. আবদুর রহমান ইবনে সাখর ৩. ওমায়ের ইবনে আমের। উপনামঃ আবু হুরায়রা। পিতার নাম: সাখর। মাতার নামঃ উস্মিয়া বিনতে সাফীহ অথবা মাইমুনা। আবু হুরায়রা নামে প্রসিদ্ধির কারণঃ আবু অর্থ-পিতা, হুরায়রা অর্থ- বিড়াল ছানা। এ হিসেবে আবু হুরায়রা অর্থ হয় বিড়ালের মালিক বা পিতা। একদা হযরত আবু হুরায়রা (রা) তাঁর জামার আস্তিনের নিচে একটি বিড়াল ছানা নিয়ে রাসুলের দরবারে হাজির হন। হঠাৎ বিড়ালটি সকলের সামনে বেরিয়ে পড়ে। তখন রাসূল (সা) রসিকতার সাথে বলে উঠলেন: “یا هريرة” “হে বিড়ালের পিতা? তখন থেকেই তিনি নিজের জন্য এ নামটি পছন্দ করে নেন এবং এ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। ইসলাম গ্রহণ: হযরত আবু হুরায়রা (রা) ৭ম হিজরী মোতাবেক ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে খায়বার যুদ্ধের পূর্বে ইসলামগ্রহণ করেন। প্রখ্যাত সাহাবী তুফায়িল বিন আমর আদ-দাওসীর হাতে ইসলামে দীক্ষিত হন। রাসূল (সা)-এর সাহচর্য তিনি ইসলাম গ্রহণের পর ইলম অর্জনের তীব্র আকাঙ্খা নিয়ে রাসূল (সা)-এর সাহচর্যে আসেন। রাসূল (সা) যখন যেদিকে যেতেন তিনিও সেদিকে যেতেন। এভাবে সার্বক্ষণিক সাহচর্য লাভ ও খেদমতের মাধ্যমে তিনি অধিক হাদীস চর্চার সৌভাগ্য লাভ করেন। রাসূল (সা)-এর দু’আ: হাদীস বর্ণনার প্রাথমিক অবস্থায় তিনি তাঁর স্মৃতিতে সব কিছু ধারণ করে রাখতে পারতেন না। রাসূল (সা)-কে একথা বলার পর তিনি তাকে তার ‘চাদর বিছিয়ে রাখার’ কথা বলেন, অতঃপর রাসূল (সা) তাতে দু’আ করলেন। এ বরকতের ধারায় তিনি এমন তীক্ষ্ণ মেধা ও স্মৃতি শক্তির অধিকারী হলেন যে, তিনি যা শুনতেন তা আর কোন দিন ভুলতেন না। হাদীসে তাঁর অবদানঃ হযরত আবু হুরায়রা (রা) হাদীসের প্রচার ও প্রসারে বিরাট অবদান রেখেছেন। তিনি সর্বাপেক্ষা অধিক সংখ্যক হাদীস
পৃষ্ঠা:০৬
বর্ণনা করেছেন। তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ৫৩৭৪টি। তন্মধ্যে বুখারী ও মুসলিম শরীফে ৮২২টি ও এককভাবে বুখারীতে ৪০৪টি এবং মুসলিম শরীফে ৪১৮টি হাদীস স্থান পেয়েছে। ইনতিকাল: হাদীসে নববীর এই মহান খাদেম ৭৮ বছর বয়সে মদীনার অদূরে ‘কাসবা’ নামক স্থানে ইনতিকাল করেন। ব্যাখ্যাঃ কুরআন তিলাওয়াতে রয়েছে অত্যধিক ফযীলত। কুরআন ও হাদীসের আলোকে নিম্নে তা উল্লেখ করা হল। ১. সর্বোত্তম ইবাদত: আল্লাহর নৈকট্য লাভ এবং ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তির জন্য মানুষ ফরয ইবাদতের পাশাপাশি নফল ইবাদত করে থাকে। এ সকল ইবাদতের মধ্যে কুরআন তিলাওয়াত হচ্ছে শ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম ইবাদত। এ প্রসঙ্গে মহানবী (সা) বলেনঃ أفضلُ الْعِبَادَةِ تِلَاوَةُ الْقُرْآنِ (مسلم) “ইবাদতসমূহের মধ্যে সর্বোত্তম ইবাদত হচ্ছে কুরআন তিলাওয়াত করা।” (মুসলিম) কুরআন তিলাওয়াত সম্পর্কে সাহাবাগণ ও ওলামায়ে কেরামগণের মতামত- قراءة القرآن أفضلُ مِنَ الذِّكْرِ بَعْدَ الْقَرَائِضِ. “ফরয ইবাদতের পর কুরআন তিলাওয়াত যাবতীয় যিকিরের চেয়ে উত্তম।” যে ব্যক্তি ইহার বিরোধিতা করে সে আল্লাহর নিকট অন্যায়কারী ও পাপী। অপর একটি হাদীসে রয়েছেঃ হযরত আবু যর (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা) বলেছেনঃ হে আবু যর, তুমি যদি আল্লাহর কিতাব থেকে একটা আয়াত শেখ, তবে সেটা তোমার জন্য একশো রাকাত (নফল) নামায পড়ার চেয়ে উত্তম। আর যদি তুমি ইসলামী জ্ঞানের একটা অধ্যায়ও মানুষকে শেখাও, তবে তা তোমার জন্য এক হাজার রাকাত নামায পড়ার চেয়েও উত্তম, চাই তদনুসারে আমল করা হোক বা না হোক। (ইবনে মাজাহ)
পৃষ্ঠা:০৭
২. আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম: পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করা আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম। কারণ, কুরআন এসেছে আল্লাহ তা’য়ালার পক্ষ থেকে। কাজেই তা তিলাওয়াতে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভ করাই স্বাভাবিক। হযরত আবু যর (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ রাসূল (সা) বলেছেন: “তোমরা আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য ঐ জিনিস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ আর কোন জিনিস পাবে না যা স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন থেকে বের হয়ে আসছে, অর্থাৎ কুরআন।” (হাকেম) ৩. আল্লাহর সাথে কথোপকথনঃ আল-কুরআনের পবিত্র আয়াতসমূহ আল্লাহর কালাম বা বাণী। কুরআন যেহেতু আল্লাহর বাণী সেহেতু ইহার প্রত্যেকটি শব্দ ও বাক্যে অলৌকিকত্ব ও আধ্যাত্মিকতা বিদ্যমান। বান্দা যখন একাগ্রচিত্তে এ কুরআন তিলাওয়াত করে তখন সে প্রকারান্তরে আল্লাহ পাকের সাথেই কথা বলে। রাসূল (সা) এ প্রসঙ্গে বলেনঃ “যদি কোন ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কথা বলতে চায়, তবে সে যেন বেশী বেশী করে কুরআন তিলাওয়াত করে।” তাই কুরআন তিলাওয়াতে মানুষের হৃদয়ে উহার প্রভাব প্রতিফলিত হয়। যেমন- আলোর সম্মুখে আসলে মানুষ আলোকিত হয়। কুরআন যেহেতু মানুষকে কল্যাণের পথে আহ্বান করেছে সেহেতু কুরআন তিলাওয়াত করলে মানুষের মন সে কল্যাণের দিকে ধাবিত হবেই নিঃসন্দেহে। কুরআন তিলাওয়াতে মু’মিনগণ যেমনি লাভ করেন প্রশান্তি তেমনিভাবে আল্লাহর ভয়ে হৃদয়ে কম্পন সৃষ্টি হয়। إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّهَ وَجِلَتْ قُلُوْبُهُمْ، وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيْمَانًا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ. আসলে তারাই মু’মিন, আল্লাহর কথা উচ্চারিত হলে যাদের মন ভীত বিহ্বল হয়ে কাপতে শুরু করে। আর যখন তাদের সামনে আল্লাহর আয়াত (কুরআন) পাঠ করা হয়, তখন তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং তাদের রবের উপর ভরসা করে। (সূরা আল-আনফালঃ ২)
পৃষ্ঠা:০৮
৪. পিতা-মাতার মর্যাদা বৃদ্ধিঃ কুরআন অধ্যয়ন করে যে ব্যক্তি কুরআনের উপর আমল করবেন কিয়ামতের দিন তার পিতা-মাতাকে উচ্চ মর্যাদায় সমাসীন করা হবে। এ প্রসঙ্গে রা (সা) বলেন: وَعَنْ سَهْلِ بْن مُعَادٍ (رض) أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ (صلعم) مَنْ قَرَأَ الْقُرْآنَ وَعَمِلَ بِهِ الْبِسَ وَالِدَاهُ تَاجًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ، صُومُ أَحْسَنُ مِنْ ضَوْءِ الشَّمْسِ فِي بُيُوتِ الدُّنْيَا، فَمَا ظَنُّكُمْ بِالَّذِي عَمِلَ بِهذا. (ابو داؤد) হযরত সাহল বিন মুয়ায (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা) বলেছেন: যে ব্যক্তি কুরআন পাঠ করেছে এবং তাতে যা আছে তার উপর আমল করেছে, তার পিতা-মাতাকে কিয়ামতের দিন এমন একটি টুপি পরানো হবে যার কিরণ সূর্যের কিরণ হতে উজ্জ্বল দেখাবে; এমতাবস্থায় সে ব্যক্তি সম্পর্কে তোমাদের কি ধারণা যে ব্যক্তি কুরআন পড়ে এবং তার হুকুম অনুযায়ী আমল করে।” (আবু দাউদ)
৫. অন্তরের মরিচা দূর করেঃ কুরআন তিলাওয়াত অন্তরের মরিচা দূর করে। তাই বেশী বেশী কুরআন তিলাওয়াত করা উচিত। ! وَعَنِ ابْنِ عُمَرَ (رض) قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ (صلعم) إِنْ هَذِهِ الْقُلُوبَ تَصْدًا كَمَا يَصْدَا الْحَدِيدُ إِذَا أَصَابَهُ الْمَاءُ قِيلَ يَا رَسُولَ اللَّهِ وَمَا
جالامُهَا قَالَ كَثْرَةُ ذِكْرِ الْمَوْتِ وَتِلاوَةُ القُرآن (بيهقى) হযরত ইবনে উমর (রা) বলেনঃ একদা রাসূল (সা) বলেছেন: এই অন্তরসমূহে মরিচা ধরে, যেভাবে লোহায় মরিচা ধরে যখন উহাতে পানি লাগে। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলোঃ হে আল্লাহর রাসূল (সা), উহার পরিশোধক কী? (উহার থেকে বাচার উপায় কী?) তিনি বললেনঃ বেশী বেশী মৃত্যুর কথা স্মরণ করা এবং কুরআন তিলাওয়াত করা। (বায়হাকী) ৬. ইহকালের জ্যোতি পরকালের সঞ্চয়ঃ পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতের মধ্যে ইহকালের জ্যোতি ও পরকালের সঞ্চয় নির্দিষ্ট রয়েছে। রাসূলের
পৃষ্ঠা:০৯
হাদীস থেকে জানা যায়, হযরত আবু যর (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন আমি বললাম: হে রাসূল (সা)! আমাকে উপদেশ দিন। তিনি বললেন: আল্লাহকে ভয় করা তোমাদের কর্তব্য। কেননা এটা ইসলামের মূল মন্ত্র। আমি বললাম: হে আল্লাহর রাসূল (সা)। আর একটা উপদেশ দিন। তিনি বললেন: তোমাদের কুরআন পড়া উচিত, কেননা কুরআন তোমাদের জন্য ইহকালের জ্যোতি ও পরকালের সঞ্চয়। (ইবনে হাব্বান) ৭. সুপারিশ করার অধিকার লাভঃ যে ব্যক্তি কুরআনের শিক্ষা লাভ করবে নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করবে ও কুরআন অনুযায়ী নিজের জীবন গঠন করবে সে ব্যক্তি কিয়ামতের দিন তার পরিবারের সদস্যদের জন্য সুপারিশ করার অধিকার লাভ করবে। রাসূল (সা)-এর বাণীঃ
وَعَنْ عَلِى (رض) قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ (صلعم) مَنْ قَرَءَ الْقُرْآنَ فَاسْتَظْهَرَهُ فَأَحَلَّ حَلالَهُ وَحَرَّمَ حَرَامَهُ ادْخَلَهُ اللَّهُ الْجَنَّةَ وَشَفْعَهُ فِي عَشَرَةِ مِّنْ أَهْلِ بَيْتِهِ كُلُّهُمْ قَدْ وَجَبَتْ لَهُمُ النَّارُ. (ابن ماجه) :হযরত আলী (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (সা) বলেছেন: যে ব্যক্তি কুরআন পড়েছে এবং মুখস্থ করেছে, অতঃপর এর হালালকে হালাল এবং হারামকে হারাম জেনে আমল করেছে, তাকে আল্লাহ তা’য়ালা জান্নাতে প্রবেশ করাবেন এবং তার পরিবারের এমন দশ ব্যক্তি সম্পর্কে তার সুপারিশ গ্রহণ করবেন যাদের দোযখবাসী হওয়া অবধারিত ছিল। (ইবনে মাজাহ)
৮. আল্লাহর নিকট মর্যাদাবান হওয়ার মাধ্যমঃ কুরআনের জ্ঞানই হচ্ছে প্রকৃত জ্ঞান। আর এ জ্ঞানের প্রচার ও প্রসারের মধ্যেই নিহিত আছে মানবতার প্রকৃত কল্যাণ। ইসলামের দৃষ্টিতে এই জ্ঞানের বাহক ও শিক্ষার্থীগণই হচ্ছে সর্বোত্তম মানুষ। এ প্রসঙ্গে রাসূল (সা) বলেনঃ
عنْ عُثْمَانَ عن النبي (صعلم) قَالَ: خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ. (بخاری، مسلم)
পৃষ্ঠা:১০
হযরত উসমান (রা) হতে বর্ণিত, নবী করীম (সা) এরশাদ করেছেনঃ তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই উত্তম যে নিজে কুরআন শিক্ষা করে এবং অপরকে শিক্ষা দেয়। (বুখারী-মুসলিম) পবিত্র কুরআন মহান আল্লাহর চিরন্তন ও শাশ্বত বাণী। ইহা উচ্চতর জ্ঞান বিজ্ঞানের অতল সমুদ্র এবং বিশ্ববাসীর জন্যে সঠিক পথ প্রদর্শণকারী। এ মহাগ্রন্থে রয়েছে মানব জীবনের সকল সমস্যার সমাধান। ইহকালীন জীবনের শান্তি ও পরকালীন জীবনের মুক্তি পেতে হলে অবশ্যই কুরআনের বিধান মেনে চলতে হবে। একথা সর্বজন স্বীকৃত যে, কুরআনের বিধান মেনে চলার জন্য প্রথমেই পবিত্র কুরআন শিখতে হবে এবং কুরআনের মর্ম গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। অতঃপর অপরকে কুরআন শিক্ষা দিতে হবে। মানুষ যাতে এ চিরসত্য ও বাস্তবতাকে গুরুত্ব দিয়ে কুরআন শিক্ষা করে এবং অপরকে শিক্ষা দেয় সেজন্যই রাসূলে পাক (সা) আলোচ্য হাদীসে কুরআনের শিক্ষার্থী ও শিক্ষাদানকারীকে অন্যসব শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের তুলনায় অধিক মর্যাদার অধিকারী বলে ঘোষণা করেছেন। অপর হাদীসে কুরআন পাঠের মর্যাদা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে: হযরত ইবনে উমার (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা) বলেছেন: তিন ব্যক্তি কিয়ামতের প্রাক্কালীন মহা আতংকে আতংকিত হবে না এবং তাদের কোন হিসাব দিতে হবে না, বরঞ্চ তারা সমস্ত সৃষ্টি জগতের হিসাব গ্রহণ শেষ হওয়া পর্যন্ত একটা মেস্কের পাহাড়ে থাকবে। (১) যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কুরআন পড়লো এবং জনগণের সম্মতি নিয়ে কুরআনের বিধান অনুযায়ী তাদের নেতৃত্ব করলো, (২) যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে মানুষকে নামাযের দিকে ডাকে এবং (৩) যে ব্যক্তি আল্লাহর হক ও বান্দার হক সুষ্ঠুভাবে পালন করে। (তাবরানী)
অন্য বর্ণনায় আছে, হযরত ইবনে উমার বলেছেন, এ হাদীসটি যদি আমি রাসূল (সা)-এর মুখ থেকে অন্ততঃ সাতবার না শুনতাম, তবে প্রচার করতাম না। (তারগীব ওয়াত-তারহীব ২য় খণ্ড: ১৪৭)
৯. অত্যধিক সওয়াব লাভের মাধ্যমঃ কুরআন যেহেতু আল্লাহ পাকের বাণী ইহার তিলাওয়াতে আল্লাহ পাক অধিক খুশি হন। তাই কুরআন অত্যধিক
পৃষ্ঠা:১১
তিলাওয়াত করা সওয়াব লাভের মাধ্যম। কুরআন তিলাওয়াতকারীকে এবং এর মর্ম উপলব্ধিকারীকে আল্লাহ তা’য়ালা অধিক সওয়াব দান করে থাকেন। এ প্রসঙ্গে রাসূল (সা) বলেনঃ
وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ (رض) قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللَّهِ (صلعم) مَنْ قَرَا حَرْفًا مِنْ كِتَابِ اللَّهِ فَلَهُ بِهِ حَسَنَةٌ وَالْحَسَنَةُ بَعَشْرِ امْثَالِهَا ، لَا أَقُولُ، الم حَرْفٌ، وَلكِنْ أَلِفٌ حَرْفٌ، وَلَامٌ حَرْفٌ، وَمِيمٌ حَرْفٌ (ترمذی) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাবের কোন একটি অক্ষর পাঠ করবে আল্লাহ তাকে এর পরিবর্তে একটি সওয়াব দান করবেন আর একটি সওয়াব দশ গুণ বৃদ্ধি পাবে। আমি বলি না যে, আলিফ-লাম-মীম একটি অক্ষর; বরং আলিফ একটি অক্ষর, লাম একটি অক্ষর ও মীম একটি অক্ষর। (তিরমিযী) অপর এক হাদীসে জানা যায় কুরআনের একটি আয়াত শিক্ষা করা একশো রাকাত নফল নামাযের চেয়ে উত্তম। ১০. জান্নাত পাওয়ার উত্তম মাধ্যমঃ যে ব্যক্তি কুরআন তিলাওয়াত ও মুখস্ত করেছে এবং যথাযথভাবে তার আমল করেছে তার জন্য রয়েছে বেহেশতের সুসংবাদ। এ প্রসঙ্গে রাসূল (সা) বলেনঃ “কিয়ামতের দিন কুরআন তিলাওয়াতকারীকে বলা হবে, কুরআন তিলাওয়াত করতে থাকো আর বেহেশতে প্রবেশ করতে থাকো।” অপর হাদীসে বলা হয়েছে:
وَعَنْ عَبْدِ اللهِ بن عَمروبن العاص (رض) قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللَّهِ (صلعم) يُقَالُ لِصَاحِب القرآن : اقرأ وَارْقَ، وَرَتِّلُ كَمَا كُنتَ تُرَتِّلُ فِي
الدُّنْيَا، فَإِنَّ مَنْزِلَكَ عِنْدَ آخِرِ آيَةٍ تَقْرَؤُهَا. (ترمذی) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা) বলেছেন: কুরআনের সাথীকে বলা হবে, তুমি পড়তে থাক, আর
পৃষ্ঠা:১২
উর্ধ্বে আরোহন করতে থাক। তুমি দুনিয়ায় যেভাবে তিলাওয়াত করতে। তুমি সর্বশেষ যে আয়াত পড়বে সেখানেই তোমার বাসস্থান। (তিরমিযী) ইমাম খাত্তাবী বলেন: সাহাবায়ে কেরামের বিভিন্ন বক্তব্য থেকে জানা যায়, বেহেশতের ভবনগুলোর যতো তলা পবিত্র কুরআনে ততো আয়াত রয়েছে (অর্থাৎ ৬৬৬৬ আয়াত)। কুরআনের পাঠককে বেহেশতে নিয়ে বলা হবে, তুমি যতো আয়াত পড়তে পার, বেহেশতের ততো তলা ওপরে উঠে যাও। যে ব্যক্তি সমস্ত কুরআন পড়তে পারবে, সে বেহেশতের সর্বোচ্চ তলায় পৌছে যাবে, আর যে তার অংশ বিশেষ পড়তে পারবে, সে সেই অংশ পরিমাণ উচ্চে আরোহণ করতে পারবে। মোট কথা, যেখানে পড়া শেষ সেখানে (ওপরে) চড়াও শেষ হবে। (আত-তারগীব ওয়াত-তারহীবঃ ২য় খণ্ড: ১৪৬) ১১. কিয়ামতের দিন সুপারিশ করবেঃ কুরআন কিয়ামতের দিন তিলাওয়াতকারীর জন্য সুপারিশ করবে। কাজেই বেশী বেশী করে কুরআন তিলাওয়াত করা কর্তব্য। এ প্রসঙ্গে মুসলিম শরীফের একটি হাদীসে উল্লেখ আছে যা হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত: افْضَلُ الْعِبَادَةِ تِلاوَةُ الْقُرْآنِ، إِقْرَمُوا الْقُرْآنَ فَإِنَّهُ يَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ شفيعا لأصحابه. (مسلم):”কুরআন তিলাওয়াত শ্রেষ্ঠ ইবাদত। তোমরা কুরআন তিলাওয়াত কর, কারণ কিয়ামতের দিন কুরআন পাঠকের জন্য সুপারিশ করবে।” (মুসলিম) অপর এক হাদীসে বলা হয়েছে: “কুরআন সুপারিশকারী, সুপারিশ করার অধিকার প্রাপ্ত, যারা তার বিরোধী তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগকারী এবং পূর্বতন কিতাবগুলো দ্বারা সমর্থিত। যে ব্যক্তি কুরআনের অনুসরণ করে, তাকে সে বেহেশতে নিয়ে যায়। আর যে ব্যক্তি তাকে অমান্য করে, তাকে সে দোজখে নিয়ে যায়। (ইবনে হাব্বান) ১২. অন্তরের ইচ্ছা পূরণ হয়ঃ কুরআন তিলাওয়াতকারীর অন্তরের ইচ্ছা আল্লাহ তা’য়ালার কাছে প্রার্থনা করার পূর্বেই পূর্ণ করে দেন। এ প্রসঙ্গে হাদীসে বলা হয়েছে:
পৃষ্ঠা:১৩
وَعَنْ أَبِي سَعِيدٍ (رض) قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ (صلعم) يَقُولُ الرَّبُّ تَبَارَكَ وتعالى : مَنْ شَغَلَهُ الْقُرْآنُ عَنْ مَسْأَلَتِي أَعْطَيْتُهُ أَفْضَلَ مَا أُعْطِي السَّائِلِينَ وَفَضْلُ كَلَامِ اللَّهِ عَلَى سَائِرِ الْكَلَامِ كَفَضْلِ اللَّهِ عَلَى خَلْقِهِ. (ترمذی) হযরত আবু সাঈদ (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা) বলেছেনঃ আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেনঃ যে ব্যক্তি কুরআন অধ্যয়নে নিয়োজিত থাকায় আমার নিকট কিছু চাওয়ার সময় পায় না তাকে আমি ঐ ব্যক্তির চেয়ে শ্রেষ্ঠ নি’য়ামত দান করবো যে আমার কাছে চায়। (কুরআন অধ্যয়নকারীর অন্তরের ইচ্ছাগুলো চাওয়া ছাড়াই পূরণ করে দেই) আল্লাহর সমগ্র সৃষ্টির ওপর আল্লাহর যেমন শ্রেষ্ঠত্ব তেমনি দুনিয়ার অন্যসব বাণীর ওপর আল্লাহর কুরআনের শ্রেষ্ঠত্ব।” (তিরমিযী)
মুসলিম শরীফের অপর এক হাদীসে আছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) বর্ণনা করেন, পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতের বরকতে বহুলোক উন্নতি লাভ করবে আর কুরআনের অবহেলার কারণে বহুলোক লাঞ্ছিত হবে।” (মুসলিম) ১৩. ফিরেশতাদের সমমর্যাদা দেয়া হবেঃ কুরআন তিলাওয়াতকারী ব্যক্তিবর্গ ফিরেশতাগণের সঙ্গী হবেন। মর্যাদার দিক দিয়ে তাদের সমতুল্য হবেন। এ প্রসঙ্গে রাসূলের বাণী: “হযরত আয়েশা (রা) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেছেন: কুরআনে অভিজ্ঞ ব্যক্তি ফিরেশতাগণের সাথে থাকবেন।” (বুখারী, মুসলিম) عَنْ عَائِشَةَ (رض) قَالَتْ : قَالَ رَسُولُ اللَّهِ (صلعم) : الْمَاهِرُ بِالْقُرْآنِ مَعَ السَّفَرَةِ الْكِرَامِ الْبَرَرَةِ، وَالَّذِي يَقْرَأُ الْقُرْآنَ وَيَتَتَعْتَعُ فِيْهِ وَهُوَ عَلَيْهِ شاق له أجران (متفق عليه):হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা) বলেছেন: কুরআন পাঠে দক্ষ ব্যক্তি সম্মানিত পুণ্যবান লেখক ফিরেশতাগণের সঙ্গী (মর্যাদার দিক
পৃষ্ঠা:১৪
দিয়ে তারা সম্মানিত ফিরেশতাগণের সমতুল্য) আর যে ব্যক্তি কুরআন তিলাওয়াত করতে গিয়ে মুখে আটকে যায়, বার বার ঠেকে যায় এবং উচ্চারণ করা বড়ই কঠিন বোধ করে তার জন্য দ্বিগুণ সওয়াব। শুধু তিলাওয়াত করার জন্য একগুণ আর কষ্ট করার জন্য আর একগুণ। (বুখারী, মুসলিম) ১৪. নেতৃত্ব লাভের অধিকারী হবেঃ হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন: রাসূল (সা) কোথাও একটি প্রতিনিধি দল পাঠাচ্ছিলেন। এই দলে বেশ কিছু সংখ্যক লোক ছিল। তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে জানতে চাইলেন, কার কাছে কতটুকু কুরআন (মুখস্থ) আছে। তাদের মধ্যে যারা অপেক্ষাকৃত কম বয়সী, তাদের একজনের কাছে এসে তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ ওহে অমুক, তোমার কাছে কতটুকু কুরআন আছে? সে বললো: অমুক অমুক অংশ এবং সূরা আল-বাকারা। রাসূল (সা) বললেনঃ তোমার কাছে সূরা আল-বাকারা আছে? সে বললোঃ জি হ্যাঁ। রাসূল (সা) বললেন তবে যাও, তুমি দলের আমীর। দলের ভেতরে যারা অপেক্ষাকৃত অভিজাত ও প্রভাবশালী তাদের একজন বললো: আমি সূরা আল-বাকারা শিখিনি শুধু এই ভয়ে যে, তা ধরে রাখতে পারবো না। (মুখস্থ রাখতে পারবো না) রাসূল (সা) বললেনঃ তোমরা কুরআন শিখ এবং তা পড়। কেননা কুরআন হচ্ছে সেই মেশক ভর্তি থলির মত, যার সুগন্ধি সর্বত্র ছড়িয়ে যায়। আর যে ব্যক্তি কুরআন শিখেছে, কিন্তু তা নিজের ভিতর রেখে শুয়ে থাকে (নিয়মিত না পড়ে, অলসভাবে সময় কাটায়) সে সেই থলির মত, যাকে মেশকের ওপর কেবল হেলান দিয়ে রাখা হয়। (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ ও ইবনে হাব্বান) ১৫. আচরণের পরিবর্তন ঘটে: যিনি নিয়মিত কুরআন অধ্যয়ন করবেন তার জীবনে সার্বিক পরিবর্তন আসবে, এটাই স্বাভাবিক। যিনি আল্লাহর কালামের ধারক-বাহক তার চরিত্রে নৈতিক পরিবর্তন সৃষ্টি হবে। এ প্রসঙ্গে রাসূলের হাদীস: হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা) হতে বর্ণিত। রাসূল (সা) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি নিয়মিত কুরআন অধ্যয়ন করে, সে তার দুই
পৃষ্ঠা:১৫
পাঁজরের মাজখানে নবুয়তকে ধারণ করে। কেবল এইটুকু কমতি থাকে যে, তার কাছে অহি আসে না। কুরআনে পারদর্শী ব্যক্তির পক্ষে এটা শোভনীয় নয় যে, যে ব্যক্তি তার প্রতি রাগান্বিত হবে, তার প্রতি সেও রাগান্বিত হবে এবং যে ব্যক্তি তার সাথে অশোভন ও মূর্খতাসুলভ আচরণ করবে, তার সাথে সেও মূর্খতাসুলভ আচরণ করবে। কেননা, তার ভেতরে তো আল্লাহরকালাম রয়েছে।” (হাকেম) ১৬. কুরআনহীন হৃদয় শূন্য ঘরের সমতুল্যঃ মানব জাতিকে জাহিলিয়াতের অন্ধকার হতে উদ্ধার করে হেদায়েতের রাজপথ দেখিয়েছে আল-কুরআন। এ দিক দিয়ে কুরআন হচ্ছে সর্বোত্তম হেদায়েতকারী গ্রন্থ। কাজেই এ কুরআন যার অন্তরে নেই সে হৃদয় শূন্য ঘরের সমতুল্য তাতে কোন সন্দেহ নেই। রাসূল (সা) বলেছেন: إِنَّ الَّذِينَ لَيْسَ فِي جَوْفِهِ شَيْءٌ مِنَ الْقُرْآنِ كَالْبَيْتِ الْخَرْبِ “যে হৃদয়ে আল-কুরআনের কোন জ্ঞান নেই সে হৃদয় শূন্য ঘরের সমতুল্য।” (তিরমিযী)
শিক্ষা ১. যেখানে কুরআনের চর্চা হয় সেখানে আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়। ২. ঐ স্থানে শান্তি অবতীর্ণ হয় ও রহমত দিয়ে ঢেকে ফেলা হয়। ৩. ফিরেশতাগণ তাদেরকে ঘিরে রাখেন। ৪. আল্লাহ তার নিকটবর্তী ফিরেশতাদের কাছে তাদের কথা উল্লেখ করেন। ৫. আমাদের বেশী বেশী কুরআন চর্চায় আত্মনিয়োগ করা উচিৎ।
পৃষ্ঠা ১৬ থেকে ৩০
পৃষ্ঠা:১৬
দারস-২: আল-কুরআনের বৈশিষ্ট্য
وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ ابْنِ مَسْعُودٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: إِنَّ هذا الْقُرْآنَ مَادُبَةُ اللَّهِ فَاقْبَلُوا مَادُبَتَهُ مَا اسْتَطَعْتُمْ إِنَّ هَذَا الْقُرْآنَ حَبْلُ اللَّهِ، وَالنُّوْرُ الْمُبِينُ، وَالشَّفَاءُ النَّافِعُ ، عِصْمَةٌ لِمَنْ تَمَسُّكَ بِهِ، وَنَجَاةٌ لِمَنِ اتَّبَعَهُ، لَا يَزِيعُ فَيُسْتَعْتَبُ ، وَلَا يَعْوَجُ فَيُقَوْمُ، وَلَا تَنْقَضِي عَجَائِبُهُ، وَلَا يَخْلُقُ مِنْ كَثْرَةِ الرد، اتْلُوهُ فَإِنَّ اللهَ يَأْجُرُكُمْ عَلَى تِلاوَتِهِ كُلِّ حَرْفٍ عَشْرَ حَسَنَاتٍ، أَمَا إِنِّي لَا أَقُولُ : الم حَرْفٌ، وَلَكِنْ أَلِفٌ حَرْفٌ وَلَامٌ
حرفٌ، وَمِيمٌ حَرْفٌ رَوَاهُ الْحَاكِمُ)
অর্থঃ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) হতে বর্ণিত। রাসূল (সা) বলেছেন: এই কুরআন হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে ভোজনের আয়োজন। সুতরাং তোমরা যতটা পার, তার ভোজনের আয়োজনকে গ্রহণ কর। এই কুরআন হচ্ছে আল্লাহর রজ্জু, সমুজ্জ্বল জ্যোতি, রোগ নিরাময়ের অব্যর্থ চিকিৎসা এবং যে একে ধারণ করে তার জন্য রক্ষক, যে এর অনুসরণ করে তার জন্য ত্রাণকর্তা। এ কুরআন কখন ভুল বলে না যে তাকে শুধরাতে হবে। কখন এঁকে-বেঁকে চলে না যে তাকে সোজা করে দিতে হবে। এর বিস্ময়ের কোন শেষ নেই এবং বহুবার পুনরাবৃত্তি করা সত্ত্বেও তা পুরানো হয় না। তোমরা কুরআন পাঠ কর, কেননা আল্লাহ তোমাদেরকে কুরআন পাঠের জন্য প্রতি অক্ষরে দশটা সওয়াব দেন। ভাল করে বুঝে নাও, আমি বলছি না আলিফ-লাম-মীম একটা অক্ষর; বরং আলিফ একটা অক্ষর, লাম একটা অক্ষর এবং মীম একটা অক্ষর। (হাকেম)
পৃষ্ঠা:১৭
শব্দার্থ:الْقُرْآنَ নিশ্চয়ই এই কুরআন হচ্ছে | مأدبة الله : আল্লাহর পক্ষ থেকে ভোজের আয়োজন। فَاقْبَلُوا مَادُبَتَه * সুতরাং তোমরা তাঁর ভোজের আয়োজন কবুল কর। ما اسْتَطَعْتُمْ : তোমাদের সাধ্যমত।الْقُرْآنَ : নিশ্চয়ই এই কুরআন হচ্ছে। حَبْلُ الله: আল্লাহর রজ্জুالْمُبِينُ : সমুজ্জ্বল জ্যোতি। والشَّفَاءُ النَّافِعُ : রোগ নিরাময়ের অব্যর্থ চিকিৎসা। عصمة لمن تمسك به : এবং যে একে ধারণ করে তার জন্য রক্ষক। ونجاة لِمَنِ اتَّبَعَة : যে এর অনুসরণ করে তার জন্য প্রাণকর্তা : لا يزيغ فيسْتَعْتَبُ : এ কুরআন কখনো ভুল বলে না যে তাকে শুধরাতে হবে। ولا يعوج فيقوم : কখনো এঁকে-বেঁকে চলে না যে তাকে সোজা করে দিতে হবে। وَلَا تَنْقضى عَجَاثِبُهُ : এর বিশ্বয়ের কোন শেষ নেই : ولا يَخْلُقُ مِنْ كَثْرَةِ الرد পুরানো হয় না। চাঁটা: তোমরা কুরআন পাঠ কর। فَإِنَّ কেননা আল্লাহ তোমাদেরকে সওয়াব দেন। على بلاوته: কুরআন পাঠের 1 کل حرفٍ عَشْرَ حَسَنَاتٍ: প্রতি অক্ষরে দশটা নেকি। ঢা: ভাল করে বুঝে নাও। نّى لَا أَقُولُ নিশ্চয়ই আমি বলছি না। الم )আলিফ-লাম-মীম) একটা অক্ষর। ولكن الفُ حَرْفٌ : বরং আলিফএকটা অক্ষর। ولام حرف : লাম একটা অক্ষর। وميم حَرْفٌ : এবং মীম একটা অক্ষর।
ব্যাখ্যাঃ আল-কুরআন হচ্ছে মুক্তির এক মাত্র পথ। আল-কুরআনের অনুসরণেই কেবল পথ হারা জাতি পথের দিশা পেতে পারে। কুরআন হচ্ছে মুত্তাকীদের জন্য হেদায়েত। মানুষ ভোজনের আয়োজন করে তার আত্মীয়-স্বজনকে যেমনি দাওয়াত দেয়ার ব্যবস্থা করেন; তেমনি আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দার জন্য ভোজনের আয়োজন করেছেন। আর এই কুরআন হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে ভোজনের আয়োজন। তাই
পৃষ্ঠা:১৮
বলা হচ্ছে তোমরা যতটা পার, তার ভোজনের আয়োজনকে গ্রহণ কর। অপর এক হাদীসে উল্লেখ আছে কুরআনের ধারক বাহকগণই হচ্ছে আল্লাহর আত্মীয়। ! وَعَنْ أَنَسِ (رض) قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللَّهِ (صلعم) : إِنَّ لِلَّهِ اهْلِينَ مِنَ النَّاسِ قَالُوا : مَنْ هُمْ يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ قَالَ : أَهْلُ الْقُرْآنِ هُمْ أَهْلُ اللَّهِ وخاصته (نسائی، ابن ماجه، حاکم) হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা) বলেছেন: মানুষের মধ্যে আল্লাহর কিছু আত্মীয়-স্বজন রয়েছে। লোকেরা জিজ্ঞেস করলোঃ হে আল্লাহর রাসূল, তারা কারা? তিনি বললেন: যারা কুরআনের ধারক- বাহক, তারাই আল্লাহর আত্মীয় ও আপনজন। (নাসায়ী, ইবনে মাজাহ ও হাকেম) এই কুরআন হচ্ছে আল্লাহর রজ্জু, যা অবলম্বনে মানুষ হিদায়েত লাভ করে আল্লাহর সান্নিধ্য পেতে পারে। কুরআন হচ্ছে সমুজ্জ্বল জ্যোতি, যা দ্বারা পথহারা মানুষ আলোর সন্ধান লাভ করে আলোকিত হতে পারে। কুরআন হচ্ছে রোগ নিরাময়ের অব্যর্থ চিকিৎসা, যা দ্বারা মানুষ ঈমানী, শারীরিক ও মানসিক রোগ থেকে মুক্তি পেতে পারে। যে কুরআন ধারণ করে তার জন্য কুরআন রক্ষকের ভূমিকা পালন করে থাকে। আর যে কুরআন অনুসরণ করে তার জন্য কুরআন ত্রাণকর্তা হিসাবে কাজ করে। কুরআনে কোন শোভা-সন্দেহ ও ভুল-ভ্রান্তি নেই তাই এ কুরআন কখনো ভুল বলে না যে তাকে শুধরাতে হবে। কুরআনে কোন বক্রতা নেই তাই এ কুরআন কখনো এঁকে-বেঁকে চলে না যে তাকে সোজা করে দিতে হবে। কুরআন এক অলৌকিক গ্রন্থ তাই এর বিস্ময়ের কোন শেষ নেই। কুরআন এক অভিনব কিতাব তাই এর অভিনবত্বের শেষ নেই বলেই বহুবার পুনরাবৃত্তি করা সত্ত্বেও তা পুরানো হয় না। তাই আল্লাহর নির্দেশ হচ্ছে তোমরা কুরআন পাঠ কর, কেননা আল্লাহ তোমাদেরকে কুরআন পাঠের জন্য প্রতি অক্ষরে দশটা সওয়াব দেন। ভাল করে বুঝে নাও, আমি বলছি না আলিফ- লাম-মীম একটা অক্ষর; বরং আলিফ একটা অক্ষর, লাম একটা অক্ষর এবং মীম একটা অক্ষর।
পৃষ্ঠা:১৯
কুরআন সকল মানুষের পথ নির্দেশ ও কল্যাণ নিশ্চিত করে। এ প্রসঙ্গে আল-কুরআনের ঘোষণা হচ্ছে: هذا بَيَانٌ لِّلنَّاسِ وَهُدًى وَمَوْعِظَةٌ لِّلْمُتَّقِينَ. “বস্তুতঃ এটা মানব জাতির জন্য সুস্পষ্ট সতর্কবাণী এবং আল্লাহকে যারা ভয় করে, তাদের জন্য এটা পথ নির্দেশ ও কল্যাণের উপদেশ।” (সূরা আলে-ইমরানঃ ১৩৮) وَانْزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ. “আমরা এ কিতাব তোমার প্রতি নাযিল করেছি, যেন তুমি মানব জাতির সামনে সে শিক্ষা-ধারার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করতে পার, যা তাদের (কল্যাণের) জন্য নাযিল করা হয়েছে এবং লোকেরা যেন চিন্তা-গবেষণা করে।” (সূরা আন-নাহলঃ ৪৪) হযরত আলী (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ রাসূল (সা)-কে বলতে শুনেছি যে, সাবধান থাক! অচিরেই ফিতনা বা অশান্তির সৃষ্টি হবে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, তা থেকে বাচার উপায় কি? তিনি বললেন, আল্লাহর কিতাব, যাতে তোমাদের পূর্ব পুরুষদের ঘটনা বিদ্যমান এবং ভবিষ্যত কালের খবরও বিদ্যমান। আর তাতে তোমাদের জন্য উপদেশাবলী ও আদেশ-নিষেধ রয়েছে, তা সত্য ও অসত্যের মধ্যে ফয়সালা দানকারী এবং তা উপহাসের বস্তু নয়। যে কেউ তাকে অহংকারপূর্বক পরিত্যাগ করে, আল্লাহ তাকে ধ্বংস করেন। আর যে ব্যক্তি তার হিদায়েত ছাড়া অন্য হিদায়েতের সন্ধান করে আল্লাহ তাকে পথ ভ্রষ্ট করেন। কুরআন আল্লাহর দৃঢ় রশি, যিকরুল হাকিম এবং সহজ ও সরল পথ, যা দ্বারা মানুষের অন্তকরণ কলুষিত হয় না এবং তা দ্বারা মানুষ সন্দেহে পতিত হয় না, ধোঁকা খায় না। তা দ্বারা আলেমগণ তৃপ্তি লাভ করে না (অধিক জ্ঞান লাভেও তৃপ্তি হয় না) বার বার তা পাঠ করলেও পুরানো হয় না, তার অভিনবত্বের শেষ হয় না। যখনই জ্বীন জাতি তা শুনল, তখনই সাথে সাথে তারা বলল: নিশ্চয় আমরা আশ্চর্য কুরআন শুনেছি, যা সৎ পথের দিকে লোকদেরকে ধাবিত করে। সুতরাং আমরা এর প্রতি ঈমান
পৃষ্ঠা:২০
এনেছি। যে ব্যক্তি কুরআন মোতাবেক কথা বলল, সে সত্যই বলল। যে তাতে আমল করল, সওয়াব প্রাপ্ত হল। যে কুরআন মোতাবেক হুকুম করল সে ন্যায় বিচার করল এবং যে ব্যক্তি কুরআনের দিকে মানুষকে ডাকবে, সে সৎ পথ প্রাপ্ত হবে। (তিরমিযী) গ্রন্থ পরিচিতি: হাকেম। মুহাদ্দিস হাকেম নিশাপুরী চতুর্থ হিজরী শতকের একজন শ্রেষ্ঠ হাদীসবিদ। তিনি প্রধানত ইমাম বুখারী ও মুসলিমের গ্রন্থ প্রণয়নের পর অবশিষ্ট সহীহ হাদীসসমূহ সংগ্রহ ও তার ভিত্তিতে স্বতন্ত্র একখানা গ্রন্থ প্রণয়ন করেন, যার নাম হচ্ছে ‘আল-মুস্তাদরাক’। ইহা সর্বজনবিদিত যে, ইমাম বুখারী ও মুসলিম যে দু’খানা হাদীস গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন ইলমে হাদীসের জগতে তাই সর্বাধিক সহীহ। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, সমস্ত সহীহ হাদীসই এই গ্রন্থদ্বয়ে সন্নিবেশিত হয়েছে, এর বাইরে আর কোন সহীহ হাদীস থেকে যায়নি। বস্তুত উক্ত গ্রন্থদ্বয়ের উল্লেখিত হাদীসসমূহ সহীহ, কিন্তু এগুলোর বাইরেও বহু হাদীস এমন রয়ে গেছে যা গ্রন্থদ্বয়ের অন্তর্ভুক্ত হাদীসসমূহের সমান পর্যায়ের সহীহ। উপরোক্ত ইমামদ্বয় কোন হাদীসকে সহীহ বলে গ্রহণ করার জন্য যে শর্ত আরোপ করেছিলেন এবং সহীহ হাদীস বেছে নেয়ার জন্য যে মানদণ্ড স্থাপন করেছিলেন সে শর্ত ও মানদণ্ডে উত্তীর্ণ অরো বহু হাদীস বাইরে থেকে গিয়েছিল। যা শুধু গ্রন্থদ্বয়ের আকার অসম্ভব রকমে বড় হয়ে যাওয়ার আশংকায় তাতে শামিল করা হয়নি। ইমাম হাকেম এ ধরনের হাদীসসমূহ অনুসন্ধান করে ও তুলা দন্ডে ওজন করে তার সমন্বয়ে ‘মুস্তাদরাক’ নামে আলোচ্য গ্রন্থখানি প্রণয়ন করেন। ইমাম হাকেম এতদ্ব্যতীত হাদীসে আরো কয়েকখানি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি ৪০৫ হিজরী সনে ইনতেকাল করেন। (হাদীস সংকলনের ইতিহাস) রাবী পরিচিতিঃ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) এর পিতার নামঃ মাসউদ। উপনাম: আবু আবদুর রহমান আল-হুযালী। বৈবাহিক জীবন: তিনি ছাকীফা গোত্রের আবদুল্লাহ ইবনে মু’য়াবিয়ার কন্যা যয়নবকে বিবাহ করেন। তাঁর তিন পুত্র ও এক কন্যা ছিল।
পৃষ্ঠা:২১
ইসলাম গ্রহণ: মহানবী (সা) দারুল আরকামে প্রবেশের পূর্বেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। (মুস্তাদরাকে হাকেম) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) নবুয়তের প্রাথমিক অবস্থায় ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তিনি নিজেই বলতেন আমি ৬ষ্ঠতম মুসলিম হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছি। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক তাঁকে ৩৩তম এবং সিয়ারে আলামুন নুবালা গ্রন্থে ১৭তম মুসলিম বলে উল্লেখ করেছেন। সাহচর্য লাভ: হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) সর্বদা রাসূলে করীম (সা)-এর খেদমতে নিয়োজিত থাকতেন ও সফর সঙ্গী হতেন। তিনি হুযূর (সা)-এর অযুর পানি, মিসওয়াক ও জুতা মোবারক বহন করতেন। হিজরত: ইসলাম গ্রহণের পর তিনি প্রকাশ্যভাবে মক্কায় কুরআন তিলাওয়াত শুরু করেন। ফলে তিনি কাফিরদের অত্যাচারের শিকার হন। এক পর্যায়ে কুরাইশদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মক্কা থেকে আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। রাসূল (সা) মদিনায় হিজরত করলে তিনি আবিসিনিয়া থেকে মদিনায় হিজরত করেন। জিহাদে যোগদান: তিনি সকল জিহাদে অংশগ্রহণ করে ইসলামের দুশমনদের সাথে প্রকাশ্যে মোকাবেলা করেন এবং বীরত্বের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হন। হুনায়েনের যুদ্ধে তিনি শত্রুর বিরুদ্ধে সাহসিকতার সাথে যুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনঃ ৬৪০ খ্রিঃ মোতাবেক ২০ হিজরী কুফায় কাজী নিযুক্ত হন। একই সাথে বাইতুল মাল, ধর্মীয় শিক্ষা ও মন্ত্রিত্বের দায়িত্বও পালন করেন। চারিত্রিক গুণাবলী: তিনি উন্নত চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। সততা, ন্যায়-নিষ্ঠা, দক্ষতা ও বিচক্ষণতার এক জীবন্ত আঁকর ছিলেন। তিনি জীবনের সকল ক্ষেত্রে চুপ থাকা ও পরামর্শের ক্ষেত্রে রাসূল (সা)-এর নীতি অনুসরণ করতেন।হাদীস বর্ণনায় তাঁর অবদান হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি রাসূল (সা)-এর সঙ্গী হওয়া ও খেদমত করার সুবাদে অনেক হাদীস বর্ণনা করার সুযোগ পেয়েছেন। রাসূল (সা) তাঁর অনেক
পৃষ্ঠা:২২
গোপন কথাও তাঁকে বলতেন। তাঁর থেকে চার খলিফাসহ অসংখ্য সাহাবী ও তাবেয়ী হাদীস বর্ণনা করেছেন। তিনি ছিলেন সাহাবীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ফকীহ। তাঁর বর্ণিত হাদীস সংখ্যা ৮৪৮টি। ৬৪ থেকে ৬৮টি হাদীস বুখারী শরীফে ও মুসলিম শরীফে যৌথভাবে বর্ণিত আছে। ইনতিকাল: তিনি ৩৩ হিজরীর ৯ই রমজান ৬০ বছর বয়সে মদিনায় ইনতিকাল করেন। হযরত ওসমান (রা) তাঁর জানাযার নামাযে ইমামতি করেন ও জান্নাতুল বাকীতে দাফন করেন। আল-কুরআনের বৈশিষ্ট্যসমূহ ১. সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানী কিতাবঃ পবিত্র কুরআন স্বয়ং আল্লাহ তা’আলার বাণী যা সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর ওপর নাযিল করা হয়েছে। কুরআন আসমানী কিতাবসমূহের সর্বশেষ কিতাব। এরপর কিয়ামত পর্যন্ত আর কোন কিতাব নাযিল করা হবে না। তাই কিয়ামত পর্যন্ত সকল সমস্যার সমাধান সম্বলিত আল-কুরআনই সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানী কিতাব। الر كِتَابٌ أَنْزَلْتُهُ إِلَيْكَ لِتُخْرِجَ النَّاسَ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ بِإِذْنِ رَبِّهِمْ إِلَى صِرَاطِ الْعَزِيزِ الْحَمِيدِ. “আলিফ-লাম-রা! এ কিতাব, যা আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি, যাতে আপনি বিশ্ব মানবতাকে তাদের প্রতিপালকের নির্দেশক্রমে অন্ধকারাছন্ন জীবন থেকে বের করে আনতে পারেন আলোকোজ্জ্বল মুক্তির রাজপথে। যিনি মহাপরাক্রমশালী, সপ্রসংশিত।” (সূরা আল-ইবরাহীম : ১)
২. চিরন্তন ও শাশ্বত গ্রন্থঃ আল-কুরআন নির্দিষ্ট জাতি, গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, দেশ বা কালকে কেন্দ্র করে নাযিল হয়নি; বরং ইহা সর্বকালের সমগ্র বিশ্ব মানবতার সর্বাত্মক হিদায়াতের সওগাত নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। তাই এটা চিরন্তন ও শাশ্বত বিশ্বজনীন গ্রন্থ। شهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِّنَ الهدى والفرقان.
পৃষ্ঠা:২৩
“রমযান এমন একটি মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কুরআন, যা মানুষের জন্যে হিদায়াত এবং সত্যপথযাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথনির্দেশ আর হক- বাতিলের মধ্যে পার্থক্যকারী দলিল।” (সূরা আল-বাকারা : ১৮৫) الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي انْزَلَ عَلَى عَبْدِهِ الْكِتَابَ وَلَمْ يَجْعَلْ لَهُ عِوَجًا. “সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই, যিনি তাঁর বান্দার প্রতি এ কিতাব অবতীর্ণ করেছেন, এতে তিনি বক্রতা তথা অপূর্ণতা রাখেননি।” (সূরা কাহাফঃ ১) ৩. রআন নির্ভুল ও অতীব বিশুদ্ধ গ্রন্থঃ আল্লাহর অবতীর্ণ জীবন বিধান আল্লাহর কুরআন নির্ভুল ও অতীব বিশুদ্ধ গ্রন্থ। এর মধ্যে কোন সন্দেহের লেশমাত্র নেই। পবিত্র কুরআনে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে: ذلِكَ الْكِتَابُ لَا رَيْبَ فِيهِ. “এটা এমন কিতাব, যাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই।” (সূরা আল-বাকারা: ২) إِنَّا أَنزَلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ لِلنَّاسِ بِالْحَقِّ. “আমি আপনার নিকট সত্যসহকারে কিতাব নাযিল করেছি মানুষের (হেদায়েতের) জন্যে।” (সূরা আয-যুমার: ৪১) কুরআন অপরিবর্তনীয় আসমানী কিতাব, এর পরিবর্তনের ক্ষমতা কারো নেই। وَاتْلُ مَا أُوحِيَ إِلَيْكَ مِنْ كِتَابِ رَبِّكَ لَا مُبَدِّلَ لِكَلِمَاتِهِ. “তোমার প্রভুর নিকট থেকে তোমার প্রতি যে অহী নাযিল করা হয়েছে, তা তিলাওয়াত কর। তার কথা পরিবর্তন করার ক্ষমতা কারো নেই।” (সূরা কাহাফ: ২৭) قُلْ مَا يَكُونُ لِي أَنْ أَبَدَّلَهُ مِنْ تِلْقَاءِ نَفْسِي إِنْ أَتَّبِعُ إِلَّا مَا يُوحَى إِلَى “আপনি বলে দিন যে, আমি নিজের পক্ষ থেকে এ কিতাব পরিবর্তন করার অধিকারী নই। আমি শুধু অহীর অনুসরণ করি, যা আমার প্রতি অবতীর্ণ হয়।” (সূরা ইউনুস: ১৫)
৪. কুরআন পরিপূর্ণ জীবন বিধান: মহাগ্রন্থ আল-কুরআন হচ্ছে সর্বশেষ
পৃষ্ঠা:২৪
পরিপূর্ণ জীবন বিধান। বর্তমান ও অনাগত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সব সমস্যার সমাধান হিসেবে ইহা অবতীর্ণ। এর পর আর কোন আসমানী কিতাব অবতীর্ণের প্রয়োজনীয়ত নই। কারণ, এ গ্রন্থে মানব জীবনের ইহকালীন ও পরকালীন সমস্ত বিষয় উল্লেখ রয়েছে: وَنَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ تِبْيَانًا لِكُلِّ شَيْءٍ “তোমার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি, যার মধ্যে সকল বিষয়ের বর্ণনা আছে।” (সূরা আন-নাহল: ৮৯) আর ইসলামকে পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে: اليوم اكمَلْتُ لَكُمْ بَيْنَكُمْ وَاتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا. “আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের জীবন ব্যবস্থাকে পরিপূর্ণ করে দিলাম। আমার নি’য়ামত রাজি তোমাদের উপর পরিপূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য জীবন ব্যবস্থারূপে ইসলামকে মনোনীত করলাম।” (সূরা আল-মায়িদা: ৩) ৫. চিরন্তন চ্যালেঞ্জের মুকাবিলায় উত্তীর্ণ গ্রন্থঃ আল-কুরআন চিরন্তন চ্যালেঞ্জের মুকাবিলায় উত্তীর্ণ গ্রন্থ। যখন এ গ্রন্থ হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর নিকট অবতীর্ণ হয় তখন আরবের লোকেরা কুরআনের ভাষার বিশুদ্ধতা, ভাষা অলংকার, রচনাশৈলী, বলিষ্ঠ যুক্তিধারা, অনুপম বিন্যাস ও ভাষার মাধুর্যে বিমোহিত হয়ে ইসলামের দিকে ধাবিত হতে শুরু করে। কিন্তু কতিপয় ইসলাম বিদ্বেষী কপট মুনাফিক জিদের বশবর্তী হয়ে একে কবিতা, যাদু বলে নানা অপবাদ রটাতে থাকে। আল্লাহ তা’আলা তাদের লক্ষ্য করে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেন, যদি সত্যি ইহা কোন মানুষের রচনা হয়ে থাকে তাহলে অনুরূপ একটি বাক্য রচনা করে দেখাও। وَإِن كُنتُمْ فِي رَيْبٍ مِّمَّا نَزَّلْنَا عَلَى عَبْدِنَا فَأْتُوا بِسُورَةٍ مِّنْ مِثْلِهِ، وَادْعُوا شُهَدَاءَكُمْ مِّنْ دُونِ اللَّهِ إِنْ كُنتُمْ صَدِقِينَ
পৃষ্ঠা:২৫
“আমি আমার বান্দার উপর যা অবতীর্ণ করেছি, তাতে তোমাদের কোন সন্দেহ থাকলে তোমরা তার অনুরূপ কোন সুরা রচনা করে আন। তবে আল্লাহ ছাড়া তোমাদের সকল সাহায্যকারীকে ডাক। তোমরা যদি সত্যবাদী হও।” (সূরা আল-বাকারা: ২৩) “বলুন, যদি এ কুরআনের মত কুরআন রচনার জন্য সমগ্র মানব ও জ্বিন জাতি সমবেত হয় এবং তারা পরস্পরকে সাহায্য করে, তবুও তারা এ কুরআনের মত উপস্থাপন করতে পারবে না।” (সূরা বনী ইসরাঈল: ৮৮) এই চ্যালেঞ্জ মুকাবেলায় সে যুগেই শুধু নয় বর্তমান বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের যুগেও কেউ সফল হয়নি। সকলেই এক বাক্যে পুরানো সে কথাই বলতে বাধ্য হচ্ছে : لَيْسَ هُدًا مِنْ كَلامِ الْبَشر “না-এটা কোন মানুষের বাণী নয়।” ঐতিহাসিক গীবন বলেনঃ Quran is a glorious testimony of the unity of God. “পবিত্র কুরআন আল্লাহ তা’য়ালার অদ্বিতীয় এক উজ্জ্বল নিদর্শন।” ৬. কুরআনের ভাষা ও গুণগত মানঃ আল-কুরআন এক অতুলনীয় অনুপম ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী গ্রন্থ। এর ভাব, ভাষা, অলংকার, উপমা, ছন্দ, রচনাশৈলী, বাক্যের অনুপম বিন্যাস সব কিছু মিলে এটি এক অতুলনীয় অভিনব সাহিত্য। এর তিলাওয়াতের প্রভাব এতই গভীর যে, এর দ্বারা সরাসরি আল্লাহর সাথে বান্দার হৃদয়ের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। আল্লাহর বাণী: “আল্লাহ অবতীর্ণ করেছেন উত্তম বাণী সম্বলিত গ্রন্থ, যা সুসামঞ্জস্য, যা পুনঃপুনঃ আবৃত্তি করা হয়। এতে যারা তার প্রভুকে ভয় করে তাদের শরীর রোমাঞ্চিত হয়। তারপর তাদের দেহ মন প্রশস্ত হয়ে আল্লাহর স্মরণে ঝুঁকে পড়ে, এটাই আল্লাহর পথ নির্দেশ। তিনি যাকে ইচ্ছে এর দ্বারা মুক্তির সন্ধান দেন, যাকে ইচ্ছে বিভ্রান্ত করেন, তার কোন পথ প্রদর্শক নেই।” (আল-যুমার: ২৩) ৭. মুক্তির একমাত্র পথ হচ্ছে আল-কুরআনঃ আল-কুরআন হচ্ছে মুক্তির একমাত্র পথ। আল-কুরআনের অনুসরণেই কেবল পথহারা জাতি পথের দিশা পেতে পারে। কুরআন হচ্ছে মুত্তাকীদের জন্য হিদায়াত।
পৃষ্ঠা:২৬
هذا بيان للنَّاسِ وَهُدًى وَمَوْعِظَةً لِّلْمُتَّقِينَ. “বস্তুতঃ এটা মানব জাতির জন্য সুস্পষ্ট সতর্কবাণী এবং আল্লাহকে যারা ভয় করে, তাদের জন্য এটা পথ নির্দেশ ও কল্যাণের উপদেশ।” (সূরা আলে-ইমরান: ১৩৮) وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ. “আমরা এ কিতাব তোমার প্রতি নাযিল করেছি, যেন তুমি মানব জাতির সামনে সে শিক্ষা-ধারার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করতে পার, যা তাদের (কল্যাণের) জন্য নাযিল করা হয়েছে। এবং লোকেরা যেন চিন্তা-গবেষণা করে।” (সূরা আন-নাহল: ৪৪) ৮. বিষয়বস্তুর ব্যাপকতা: পবিত্র কুরআন এমনই একখানা মাহাত্ম্যপূর্ণ গ্রন্থ যার ব্যাপরতা ও বিশালতা অধিক। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’য়ালা বলেনঃ كِتَبُ فُصِّلَتْ أَيْتُهُ قُرْآنًا عَرَبِيًّا لِّقَوْمٍ يَعْلَمُونَ بَشِيرًا وَنَذِيرًا. “এটা এমন এক গ্রন্থ, বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে এর আয়াতসমূহ আরবী ভাষায় কুরআনরূপে, যা জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী।” (সূরা হা-মীম-সিজদাহঃ ৩-৪) কুরআনের শব্দ, বাক্য ও বক্তব্য এতই ব্যাপক যে, তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে সহস্র সহস্র পৃষ্ঠা সম্বলিত তাফসীর গ্রন্থের সৃষ্টি হয়েছে। এর ব্যাপকতা সম্পর্কে ফরাসী মনীষী ডঃ মরিস বুকাইলি বলেছেনঃ “কুরআন বিজ্ঞানীদের জন্য একটি বিজ্ঞান-সংস্থা, ভাষাবিদদের জন্য একটি শব্দকোষ, বৈয়াকরণিকদের জন্য এক ব্যাকরণ গ্রন্থ, কবিদের জন্য একটি কাব্যগ্রন্থ এবং আইন বিধানের জন্য একটি বিশ্বকোষ।” (মুসলিম সংস্কৃতির ইতিহাস: ১০০) ৯. কুরআনের শ্রেষ্ঠত্বঃ আল-কুরআনের শ্রেষ্ঠত্ব ও বড়ত্ব এত ব্যাপক যে, ইহা যদি কোন পাহাড়ে অবতীর্ণ করা হতো তা হলে পাহাড়ও আল্লাহর ভয়ে ধ্বসে দীর্ণ-বিদীর্ণ হয়ে যেত; অথচ পাহাড়ের মানুষের মত চেতনা শক্তি নেই। কিন্তু আশরাফুল মাখলুকাত মানুষ চিন্তা-শক্তিসম্পন্ন জীব
পৃষ্ঠা:২৭
হয়েও আল-কুরআনের শ্রেষ্ঠত্ব অনুভব করে না এবং তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন নয়। لَوْ انْزَلْنَا هَذَا الْقُرْآنَ عَلَى جَبَل لِّرَأَيْتَهُ خَاشِعًا مُّتَصَدِّعًا مِّنْ خَشْيَةِ الله، وَتِلْكَ الْأَمْثَالُ نَضْرِبُهَا لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ. “আমরা যদি এ কুরআন কোন পাহাড়ে অবতীর্ণ করে দিতাম তাহলে তুমি দেখতে যে, তা আল্লাহর ভয়ে ধ্বসে যাচ্ছে ও দীর্ণ-বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। এ দৃষ্টান্ত এজন্য মানব জাতির সামনে পেশ করলাম যেন তারা চিন্তা-ভাবনা করতে পারে।” (সূরা আল-হাশর: ২১)
আল-কুরআনের বিধান অমান্য করার পরিণতি
وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ. “যারা আল্লাহর নাযিল করা বিধান মোতাবেক সমস্যার সমাধান করে না (বিচার ফয়সালা ও দেশ শাসন করে না) তারা কাফের।” (সূরা আল- মায়েদা: ৪৪) وَقَدْ أَنْزَلْنَا ايْتِ بَيِّنَتٍ ، وَلِلْكَفِرِينَ عَذَابٌ مُّهِينٌ. “আমরা স্পষ্ট বয়ান সম্বলিত আয়াতসমূহ নাযিল করেছি। অস্বীকারকারীদের জন্য অপমানকর আযাব।” (সূরা আল-মুজাদিলা: ৫) مَا آمَنَ بِالْقُرْآنِ مَنِ اسْتَحَلَ مَحَارِمَهُ. “কুরআনে বর্ণিত হারামকে যে হালাল মনে করে, সে কুরআনের প্রতি ঈমান গ্রহণকারী নয়।” (তিরমিযী) কুরআনের বিধান গোপন কারীর পরিণতিঃ “যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান সমূহ গোপন করে এবং সামান্য বৈষয়িক স্বার্থের জন্য তা বিসর্জন দেয়, তারা মূলতঃ নিজেদের পেট আগুন দ্বারা ভর্তি করে। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের সাথে কথা বলবেন না। তাদেরকে পবিত্র করবেন না। তাদের জন্য কঠিন পীড়াদায়ক শাস্তি রয়েছে।” (সূরা আল-বাকারা: ১৭৪)
পৃষ্ঠা:২৮
কুরআনের কিছু অংশ অমান্য করার শান্তি: যারা কুরআনের কিছু অংশ মানবে এবং কিছু অংশ অস্বীকার করবে তাদের কি শান্তি হবে তা পবিত্র কুরআনে এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে: افَتُؤْمِنُونَ بِبَعْضِ الْكِتَابِ وَ تَكْفُرُونَ بِبَعْضٍ فَمَا جَزَاءُ مَنْ يُفْعَلُ ذَالِكَ مِنكُم الأخرى فِي الْحَيَوةِ الدُّنْيَا وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يُرَدُّونَ إِلَى أَشَدَّ الْعَذَابِ. “তোমরা কি আল্লাহর কিতাবের কিছু অংশ বিশ্বাস কর (মান) আর কিছু অংশ অবিশ্বাস কর। জেনে রাখ, তোমাদের মধ্যে যারা এরূপ আচরণ করবে, তারা দুনিয়ার জীবনে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হতে থাকবে এবং পরকালে তাদেরকে কঠিন শাস্তির দিকে নিক্ষেপ করা হবে।” (সূরা আল- বাকারা: ৮৫)
শিক্ষা ১. কুরআনকে একমাত্র হিদায়াতের উৎস মনে করতে হবে। ২. কুরআন এক অলৌকিক গ্রন্থ তাই এর বিস্ময়ের কোন শেষ নেই। ৩. কুরআন পূনরাবৃত্তি করা সত্ত্বেও তা পুরানো মনে হয় না। ৪. কুরআন পাঠের জন্য প্রতি অক্ষরে দশটা নেকি পাওয়া যাবে। ৫. আমাদেরকে বেশী বেশী কুরআন অধ্যয়ন করতে হবে।
পৃষ্ঠা:২৯
দারস-৩:সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ
عَنْ أَبِي سَعِيدِنِ الْخُدْرِيِّ (رض) عَنْ رَسُولِ اللَّهِ (صلعم) قَالَ مَنْ رَايَ مِنكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيْرُهُ بِيَدِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ ذَالِكَ أَضْعَفُ الْإِيْمَانُ. رَوَاهُ مُسْلِمٌ) অর্থঃ হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) হতে বর্ণিত। তিনি রাসূল (সা) হতে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূল (সা) বলেছেনঃ তোমাদের কেউ যদি অন্যায় কাজ দেখে, অবশ্যই তা হাত দ্বারা প্রতিহত করার চেষ্টা করবে। যদি সে শক্তি না থাকে তাহলে মুখে প্রতিবাদ করবে, যদি সে শক্তিও না থাকে তাহলে অন্তরে তা প্রতিরোধ করার পরিকল্পনা করবে। আর এ ধরনের পরিকল্পনা করাই হল ঈমানের সর্বনিম্ন ও দুর্বলতম স্তর। (মুসলিম)শব্দার্থ : من: যে ব্যক্তি। ائ দেখে। مِنْكُمْ : তোমাদের মধ্যে কেউ। منكرًا : গর্হিত কাজ | فليغيره: অতঃপর উহা প্রতিরোধ করে, পরিবর্তন করে। بیده : তার হাত দিয়ে। لَّمْ يَسْتَطِعْ : শক্তি না থাকে। فيلِسَانِه অতঃপর তার জিহ্বা দ্বারা। فيقليه: অতঃপর অন্তর দ্বারা (ঘৃণা করবে)। ذالك : এটা, ইহা । أضعف : অধিক দুর্বল। الإيمان : ঈমান। ব্যাখ্যাঃ মু’মিন ব্যক্তির সামনে শরী’আত বিরোধী কোন কাজ হতে দেখলে সে অবশ্যই তা প্রতিহত করার চেষ্টা করবে। সর্বকালে ও সর্বযুগে এর গুরুত্ব অপরিসীম। যদিও এর ধরন, পদ্ধতি ও কৌশল অবস্থা ও পরিবেশের কারণে ভিন্ন হয়ে থাকে। আল্লাহর বাণী: وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةً يُدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عن المنكر وأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ.
পৃষ্ঠা:৩০
“তোমাদের মধ্যে এমন কিছু লোক অবশ্যই থাকতে হবে, যারা (মানুষকে) কল্যাণের দিকে ডাকবে, সৎকাজের নির্দেশ দিবে এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখবে। যারা একাজ করবে তারা কৃতকার্য হবে।” (সূরা আলে- ইমরানঃ ১০৪) كنتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَامُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ. “তোমরাই সর্বোত্তম জাতি, তোমাদেরকে মানুষের কল্যাণের জন্য কর্মক্ষেত্রে আনয়ন করা হয়েছে, তোমরা সৎকাজের আদেশ করবে এবং মন্দ কাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখবে। (সূরা আলে-ইমরানঃ ১১০) وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ يَامُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَر. “মু’মিন পুরুষ ও মু’মিন মহিলাগণ পরস্পরের বন্ধু ও সাথী। তারা (মানুষকে) ভাল কাজের নির্দেশ দেয় এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে।” (সূরা আত-তাওবা: ৭১) অন্যায় প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ করা প্রত্যেক যুগে প্রত্যেকটি ঈমানদার ব্যক্তির উপর ফরয। আর এ দায়িত্ব পালন করতে হলে শক্তির প্রয়োজন। আর এ শক্তি ইসলামী আন্দোলনের মাধ্যমেই অর্জন করা সম্ভব। রাসূল (সা) অসত্য ও গর্হিত কাজের প্রতিবাদ করার কয়েকটি পর্যায় এখানে তুলে ধরেছেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার পদ্ধতি তিনটি। যথাঃ ১. প্রথমে সে হাত দ্বারা তথা শক্তি প্রয়োগ করে তা প্রতিহত করবে। সরাসরি হস্তক্ষেপ করে শরী’আত বিরোধী কার্যকলাপ বানচাল করে দেবে। ২. শক্তি প্রয়োগ করার ক্ষমতা না থাকলে মৌখিক বক্তব্য দ্বারা তা প্রতিহত করবে। যারা অন্যায় কাজ করে তাদেরকে উপদেশ, বক্তৃতা, বিবৃতি ও লিখনির মাধ্যমে তা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করবে। ৩. যদি সে শক্তি না থাকে তাহলে অন্তরে তা পরিবর্তন করার পরিকল্পনা করবে। আর এ ধরনের চিন্তা-ভাবনা না থাকলে বুঝতে হবে তার মধ্যে ঈমানের জ্যোতি নেই।
পৃষ্ঠা ৩১ থেকে ৪৫
পৃষ্ঠা:৩১
হাদীসে বর্ণিত আছে, হযরত আনাস (রা) রাসূল (সা) থেকে বর্ণনা করেন: جَاهِدُوا الْمُشْرِكِينَ بِأَمْوَالِكُمْ وَانْفُسِكُمْ وَالْسِنَتِكُمْ. :”জিহাদ কর মুশরিকদের বিরুদ্ধে তোমাদের জান, মাল ও মুখের প্রতিবাদ দ্বারা।” (আবু দাউদ) গ্রন্থ পরিচিতিঃ সহীহ আল-মুসলিম-এর পরিচিতি ১নং দারসে দেখুন।
রাবী পরিচিতি:নাম: সা’দ, পিতার নামঃ মালেক, মাতার নাম: আনীসা বিনতে আবিল হারিস। তিনি একজন আনসার সাহাবী ছিলেন। তাঁর পূর্ব পুরুষ খুদরা ইবনে আওফের নামানুসারে তাকে খুদরী নামে অভিহিত করা হয়। জন্মগ্রহণ: হিজরতের ১০ বছর পূর্বে আবু সাঈদ খুদরী (রা) আরবে জন্মগ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণ: ৬২২ খ্রিঃ তাঁর পিতা-মাতা দু’জনই ইসলাম গ্রহণ করেন। তখন তিনি ছোট ছিলেন। বাল্যকাল থেকে তিনি ইসলামী পরিবেশে গড়ে ওঠেন। জিহাদে অংশগ্রহণ: বয়স কম থাকায় ইসলামের প্রথম যুদ্ধ বদর ও দ্বিতীয় যুদ্ধ ওহুদে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। বনী মুস্তালিকের যুদ্ধ থেকে তিনি পরবর্তী ১২টি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। কোন কোন সারিয়ার তিনি দলপতি ছিলেন। তিনি ৬০ হিজরীতে আবদুল্লাহ বিন যোবায়েরের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। ৬৩ হিজরীতে তিনি ইয়াযীদ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বন্দী হন। হাদীস শাস্ত্রে তাঁর অবদানঃ তিনি ছিলেন হাফেযে কুরআন ও হাফেযে হাদীস। তিনি সবার কাছে জ্ঞানী-গুণী হিসাবে পরিচিত। ফকীহ এবং মুহাদ্দিস হিসাবে তিনি সুখ্যাতি অর্জণ করেন। সর্বাধিক হাদীস বর্ণনাকারীদের মধ্যে তিনি অন্যতম। তার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ১১৭০টি। তন্মধ্যে বুখারী শরীফে এককভাবে ১৬টি ও মুসলিম শরীফে
পৃষ্ঠা:৩২
৫২টি হাদীস স্থান পায়। ওহুদ যুদ্ধে তাঁর পিতা কাফেরদের হাতে শাহাদাত বরণ করলে অসহায় অবস্থায় রাসূলের নিকট সাহায্য প্রার্থী হলে তিনি বলেনঃ “যে ধন-সম্পদ চায় আল্লাহ তাকে তা দান করেন। আর আল্লাহর নিকট যে ক্ষমা প্রত্যাশা করে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন।” (উসদুল গাবা ২য় খণ্ড ২৮৯ পৃঃ) ইনতিকাল: তিনি ৭০ হিজরী জুমার দিন মদিনায় ইনতিকাল করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। জান্নাতুল বাকীতে তাঁকে সমাহিত করা হয়। সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ না করার পরিণতি সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করা সব ফরযের বড় ফরয। এ ফরযীয়াতের দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হলে বা ছেড়ে দিলে এর শাস্তিও হবে বড়। আল্লাহর বাণী: إلا تَنْفِرُوا يُعَذِّبْكُمْ عَذَابًا أَلِيمًا وَيَسْتَبْدِلْ قَوْمًا غَيْرَكُمْ وَلَا تَضُرُّوهُ شَيْئًا وَاللَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ “তোমরা যদি জিহাদে (সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের জন্য) বেরিয়ে না পড় তা হলে তোমাদেরকে কঠোর শাস্তি দেয়া হবে এবং তোমাদের পরিবর্তে অন্য জাতিকে প্রতিষ্ঠিত করে দেবেন আর তোমরা আল্লাহর কোন ক্ষতি করতে পারবে না। তিনি সব বিষয় শক্তি রাখেন। (সূরা আত-তাওবা: ৩৯) “পিছনে থেকে যাওয়া লোকেরা আল্লাহর রাসূল (সা) থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বসে থাকতে পেরে আনন্দ লাভ করেছে, আর জান ও মালের দ্বারা আল্লাহর রাহে জিহাদ করতে অপছন্দ করেছে এবং বলেছে, এ গরমের মধ্যে অভিযানে বের হয়ো না। তাদেরকে বলে দাও, উত্তাপে জাহান্নামের আগুন প্রচন্ডতম। যদি তাদের বিবেচনাশক্তি থাকতো। (সূরা আত-তাওবা: ৮১) مَنْ مَاتَ وَلَمْ يَغْزُوا وَلَمْ يُحَدِّثُ بِهِ نَفْسَهُ مَاتَ عَلَى شُعْبَةٍ مِّنَ التَّفَاقِ. “যে ব্যক্তি জিহাদে (সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ) শরীক
পৃষ্ঠা:৩৩
হলো না, কিংবা জিহাদের (সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ) চিন্তা-ভাবনাও করল না; আর এ অবস্থায় সে মৃত্যু বশ করল, সে যেন মুনাফিকের মৃত্যু বরণ করল।” (মুসলিম) দু’আ কবুল হয় নাঃ প্রথমত সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ না করলে দু’আ কবুল হয় না। নিম্নের হাদীস দ্বারা তা প্রমাণিত হয়। عَنْ حُذَيْفَةَ (رض) أن النَّبِيُّ (صلعم) قَالَ وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَتَأْمُرُنَ بالْمَعْرُوْفِ وَلَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ أَوْ لَيُؤْشَكَنَّ اللَّهُ أَنْ يُبْعَثُ عَلَيْكُمْ عَذَابًا مِّنْ عِنْدِهِ ثُمَّ لَتَدْعُنْهُ وَلَا يُسْتَجَابُ لَكُمْ. (ترمذی) হযরত হুযাইফা (রা) হতে বর্ণিত। নবী করীম (সা) ইরশাদ করেছেন: আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, যার নিয়ন্ত্রণে আমার জীবন। অবশ্যই তোমরা সৎ কাজের নির্দেশ দিবে এবং অন্যার ও পাপ কাজ হতে লোকদেরকে বিরত রাখবে। নতুবা তোমাদের ওপর শীঘ্রই আল্লাহ আযাব নাযিল করে শাস্তি দিবেন। অতঃপর তোমরা তা হতে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য দু’আ করতে থাকবে কিন্তু তোমাদের দু’আ কবুল হবে না। (তিরমিযী) মুনাফিক অবস্থায় মৃত্যু হয়ঃ সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ না করলে মুনাফিক অবস্থায় মৃত্যু হবে। عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ (رض) قَالَ قَالَ رَسُول الله (صلعم) مَنْ مَاتَ وَلَمْ يَغْزُو، وَلَمْ يُحَدِّثُ بِهِ نَفْسُهُ، مَاتَ عَلَى شُعْبَةٍ مِّنَ النِّفاق. (مسلم) ابو داؤد، نسائی) হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: যে ব্যক্তি ইসলামের জন্য কোন সংগ্রাম (সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ) করেনি এবং সংগ্রাম করার কোন ইচ্ছাও পোষণ করেনি, এরূপ অবস্থায় মৃত্যু বরণ করলে, সে মুনাফিক অবস্থায় মৃত্যু বরণ করল। (মুসলিম, আবু দাউদ, নাসাঈ)
পৃষ্ঠা:৩৪
আযাব চাপিয়ে দেয়া হয়ঃ সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ না করলে আযাব চাপিয়ে দেয়া হয়। عَنْ جَرِيرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ (رض) قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ (صلعم) يَقُولُ ما مِنْ رَجُلٍ يَكُونُ فِي قَوْمٍ يُعْمَلُ فِيهِمْ بِالْمَعَاصِي يَقْدِرُونَ عَلَى ان يُغَيرُوا عَلَيْهِ وَلَا يُغَيِّرُونَ إِلَّا أَصَابَهُمُ اللَّهُ مِنْهُمْ بِعِقَابِ قَبْلَ أن يموتُوا. (ابو داؤد) হযরত জারীর ইবনে আবদুল্লাহ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহকে (সা) একথা বলতে শুনেছি যে, যে জাতির মধ্যে কোন এক ব্যক্তি পাপ কাজ করার জন্য লিপ্ত হয়, আর সে জাতির লোকেরা শক্তি থাকা সত্ত্বেও সে পাপ কাজ হতে বিরত রাখে না, আল্লাহ সে জাতির উপর মৃত্যুর পূর্বেই এক ভয়াবহ আযাব চাপিয়ে দেন। (আবু দাউদ) আমি রাসূল (সা)-কে বলতে শুনেছিঃ “লোকেরা যখন দেখলো, অত্যাচারী অত্যাচার করছে, এরপর তারা এর প্রতিরোধ করলো না, এরূপ লোকদের উপর আল্লাহ অচিরেই মহামারী আকারে শাস্তি পাঠাবেন।” (আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ) পাপের আযাব সকলকেই ভোগ করতে হয়ঃ সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ না করলে, পাপের আযাব সকলকেই ভোগ করতে হয়। عَنْ عَدِي بْن عَلَى الْكِنْدِي قَالَ حَدَّثَنَا مَوْلَى لَنَا أَنَّهُ سَمِعَ جَدَى يَقُولُ سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ (صلعم) يَقُولُ إِنَّ اللَّهَ لَا يُعَذِّبُ الْعَامَّةِ بِعَمَل خَاصَّةٍ حَتَّى يَرُوا الْمُنْكَرَ بَيْنَ ظَهْرًا فِيهِمْ وَهُمْ قَادِرُونَ عَلَى أَنْ يُنْكِرُوا فَلا يَنكِرُوا فَإِذَا فَعَلُوا ذَالِكَ عَذَبَ اللهُ العامة والخاصة. (شرح السنة) হযরত আদী ইবনে আলী আলকেন্দী হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, আমাদের এক মুক্ত কৃতদাস আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন যে, সে আমার দাদাকে
পৃষ্ঠা:৩৫
একথা বলতে শুনেছেন যে, আমি নবী করিম (সা)-কে বলতে শুনেছিঃ আল্লাহ কখনো বিশেষ লোকদের (পাপ) কাজের জন্য সাধারণ মানুষের উপর আযাব পাঠান না। কিন্তু যদি (সাধারণ লোক) তাদের সামনে প্রকাশ্যভাবে পাপ কাজ হতে দেখে, আর তা বন্ধ করার শক্তি থাকা সত্ত্বেও যদি বন্ধ না করে কিংবা প্রতিবাদ না করে, তাহলে তখনই আল্লাহ পাক সাধারণ লোক ও বিশেষ লোক সকলকে একই আযাবে নিপতিত করেন। (শরহে সুন্নাহ)সাধারণতঃ সমাজে দুই শ্রেণীর লোকের বাস। এক শ্রেণীর লোকের বিদ্যা- বুদ্ধি, অর্থ-সম্পদ ও রাজনৈতিক শক্তির প্রভাব বেশী। অপর শ্রেণী সাধারণ জনগণ। তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি সকল ক্ষেত্রে কম। প্রথম শ্রেণীর লোকজনই বেশী পাপাচারে লিপ্ত থাকে। আর এ কারণে তাদেরকেই তার আযাব ভোগ করতে হয়। কিন্তু যদি সে পাপ কার্য তাদের গণ্ডির সীমার বাইরে চলে আসে এবং প্রকাশ হতে থাকে সেখানে সাধারণ জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে তার প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। যদি তা না করে তা হলে সকলকেই আযাবে নিপতিত হতে হবে। পরকালীন শান্তি: সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ না করলে, পরকালে কঠিন আযাব ভোগ করতে হবে। হযরত উসামা ইবনে যায়িদ ইবনে হারিসা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূল (সা)-কে বলতে শুনেছি: কিয়ামতের দিন এক ব্যক্তিকে এনে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। ফলে তার নাড়ি-ভুঁড়ি বেরিয়ে আসবে। সে এটা নিয়ে এমনভাবে ঘুরতে থাকবে যেভাবে গাঁধা চাক্কীর মধ্যে ঘুরতে থাকে। জাহান্নামীরা তার চারপাশে সমবেত হয়ে জিজ্ঞেস করবে, হে অমুক। তোমার এ অবস্থা কেন? তুমি কি সৎ কাজের আদেশ দিতে না এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখতে না? সে বলবে, হ্যাঁ আমি সৎকাজের আদেশ দিতাম, কিন্তু আমি নিজে তা করতাম না, আমি অন্যদের খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে বলতাম, অথচ আমি নিজেই তা করতাম। (বুখারী-মুসলিম)
পৃষ্ঠা:৩৬
অন্যায় প্রতিরোধে সকলেরই কল্যাণ নিহিতঃ সৎ কাজের আদেশ ও অন্যায় প্রতিরোধে সকলেরই কল্যাণ নিহিত। এ সম্পর্কে রাসূল (সা)-এর হাদীস উল্লেখ করা হলো।عَنِ النُّعْمَانِ بْن بَشِيرٍ (رض) قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ (صلعم) مَثَلُ الْمُدْهِنِ بَعْضُهُمْ والواقع فيها مثل : الله والواقع فِي اعْلاهَا فَكَانَ الَّذِي فِي أَسْفَلِهَا يَمُرُّ بِالْمَاءِ عَلَى الَّذِينَ فِي أَعْلَاهَا فَتَأَدُّوا بِهِ فَأَخَذَ فَأْسًا فَجَعَلَ يَنْقُرُ اسْفَلَ السَّفِينَةِ فَأَتَوْهُ فَقَالُوا مَالَكَ تَأَذَّبْتُمْ بِي وَلَا يُدْلِى مِنَ الْمَاءِ فَإِنْ أَخَذُوا عَلَى يَدَيْهِ انْجَوْهُ وَنَجوا انْفُسَهُمْ وَإِنْ تَرَكُوهُ أَهْلِكُوا وَأَهْلِكُوا أَنْفُسَهُمْ (بخاری) হযরত নু’মান ইবনে বশির (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: আল্লাহর প্রতিষ্ঠিত আইন-সীমা সম্পর্কে উদারনীতি পোষণকারী এবং উহার লংঘনকারী লোকদের দৃষ্টান্ত হচ্ছে সে যাত্রী সাধারণের ন্যায়, যারা একটি নৌকায় সাওয়ার হওয়ার জন্য লটারী ধরেছে এবং তার ফলাফল অনুযায়ী কিছু লোক উহার উপরিভাগে আরোহন করে, আর কিছু লোক আরোহন করে উহার নীচের তলায়। নীচের দিকে যারা থাকে তারা পানি নিয়ে উপরিভাগে উপবিষ্ট লোকদের কাছ থেকে যাতায়াত করত। ইহাতে উপরিভাগের লোকেরা বড়ই কষ্ট অনুভব করত। এ অবস্থা দেখে নীচের তলার এক ব্যক্তি কুঠার হাতে নিয়ে নৌকার তলায় ছিদ্র করতে উদ্যত হল। এ সময় উপরের তলার লোক তার নিকট আসল এবং জিজ্ঞেস করল তুমি ইহা কি করছ? সে উত্তর দিল: তোমরা আমার যাতায়াতের দ্বারা কষ্ট অনুভব কর, অথচ পানি আমার না হলে চলে না। এ অবস্থায় উপরিভাগের লোকেরা যদি তার হাত ধরে, তাহলে তারা তাকে বাঁচাতে পারল এবং নিজেরাও বাঁচতে পারল। আর যদি তাকে এরূপ অবস্থায়ই ছেড়ে দেয়া হয় তাহলে, সে নিজেও ধ্বংস হবে এবং অন্য লোকদেরকে ধ্বংস করে ছাড়বে। (বুখারী)
পৃষ্ঠা:৩৭
ন্যায় কাজের আদেশ ও অন্যায় প্রতিরোধের সুফলঃ সৎ কাজের আদেশ ও অন্যায় প্রতিরোধ- সকলের জন্যই সুফল বয়ে আনে। এ পরিণাম সম্পর্কে রাসূল (সা)-এর হাদীস: ! عَنْ أَبِي أَمَامَةَ (رض) قَالَ خَرَجْنَا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ (صلعم) فِي سَرِيَّةٍ فَمَرَّ رَجُلٌ بِغَارِ فِيْهِ شَيْ مِنْ مَاءٍ وبَقْل فَحَدَثَ نَفْسُهُ بِأَنْ يُقِيمَ فِيهِ وَيَتَخَلَّى مِنَ الدُّنْيَا فَاسْأَدْنَ رَسُولَ اللهِ (صلعم) فِي ذَالِكَ فَقَالَ رَسُولُ الله (صلعم) إني لَمْ أبْعَثَ بِالْيَهُودِيَّةِ وَلا بِالنَّصْرَانِيَّةِ وَلَكِنِّي بُعِثْتُ بالْحَنَفِيَّةِ السَّمَحَةِ وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لَغَدَوَةٌ أَوْ رَوْحَةٌ فِي سَبِيلِ اللَّهِ خَيْرٌ مِّنَ الدُّنْيَا وَمَا فِيْهَا وَلَمَقَامُ أَحَدِكُمْ فِي الصَّفْ خَيْرٌ مِّنْ صَلَوتِهِ ستين سنة. (مسند احمد) হযরত আবু উমামা (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা একদা কোন এক যুদ্ধে যাত্রাকালে নবী করীম (সা)-এর সাথে বের হলাম। তখন আমাদের মধ্য হতে এক ব্যক্তি এমন একটি পর্বত গুহায় যেয়ে উপস্থিত হয়, সেখানে কিছু পরিমাণ পানি ও শাক-সবজি ছিল। তা দেখে সে ব্যক্তির মনে সেখানেই থেকে যাওয়ার ও দুনিয়ার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার ইচ্ছা জাগে। পরবর্তীতে এ সম্পর্কে সে নবী পাক (সা)-এর নিকট অনুমতি চাইলে তিনি উত্তরে বললেনঃ জেনে রাখ, আমি ইয়াহুদী ও খৃষ্টানী মতবাদসহ দুনিয়ায় প্রেরিত হই নাই; বরং আমি সত্য, সহজ ও সঠিক জীবনাদর্শ নিয়ে প্রেরিত হয়েছি। যে মহান সত্তার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ নিবদ্ধ তাঁর শপথ করে বলি, সকালবেলা কিংবা সন্ধ্যাবেলা আল্লাহর দীন প্রচার ও প্রতিষ্ঠার কাজে বের হওয়া সমগ্র দুনিয়া এবং তার মধ্যে যা কিছু আছে তার চেয়ে উত্তম। উপরন্তু এ কাতারে তোমাদের কারো দণ্ডায়মান হওয়া তার ঘাট বৎসরের নফল নামায অপেক্ষা কল্যাণকর। (মুসনাদে আহমদ) প্রচলিত আইন হাতে তুলে নেয়া যাবে না সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ না করলে, পাপের আযাব ভোগ করতে হবে একথা সত্য; তাই বলে কারো হাতে প্রচলিত আইন
পৃষ্ঠা:৩৮
তুলে নিতে পারবে না। কারণ তাতে সমাজে অরাজকতা ও অশান্তি তথা ফিৎনা-ফাসাদ দেখা দিবে। প্রথমে সে হাত দ্বারা তথা শক্তি প্রয়োগ করে তা প্রতিহত করবে। সরাসরি হস্তক্ষেপ করে শরী’আত বিরোধী কার্যকলাপ বানচাল করে দেবে। এখানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অর্জনের পরই এ পদ্ধতি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রয়োগ করা হবে। তবে যুক্তিসংগতভাবে ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে তাতে কোন দোষ নেই। আর কোথাও ব্যক্তি ও সমাজের পক্ষ থেকে কোন শক্তি প্রয়োগের কারণে কোন ফিৎনা-ফাসাদ দেখা দিলে তার বিরুদ্ধে সরকার জনগণের স্বার্থে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। সমাজে কোন ফিৎনা-ফাসাদ সৃষ্টি হোক এ ধরনের অনুমোদন ইসলাম কাউকে কখনো দেয়নি। এ প্রসঙ্গে রাসূল (সা) এর হাদীস। উম্মুল মু’মিনীন হযরত উম্মে সালামা (রা) থেকে বর্ণিত। নবী করীম (সা) বলেছেন: “তোমাদের উপর এমন কিছু শাসক নিযুক্ত করা হবে। তোমরা তাদের কিছু কার্যকলাপ (ইসলামী শরীয়তসম্মত হওয়ার কারণে) পছন্দ করবে আর কিছু কার্যকলাপ তোমরা (শরীয়ত বিরোধী হওয়ার কারণে) অপছন্দ করবে। এরূপ অবস্থায় যে ব্যক্তি এগুলোকে খারাপ জানবে সে দায়মুক্ত। আর যে ব্যক্তি এর প্রতিবাদ করবে সে নিরাপদ। কিন্তু যে তাদের এরূপ কাজের প্রতি সন্তোষ প্রকাশ করবে এবং তার অনুসরণ করবে (তারা দায়মুক্ত নয়)। সাহাবায়ে কেরামগণ বললেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমরা কি তাদের (এরূপ স্বৈরাচারী শাসকদের) বিরুদ্ধে লড়বো না? তিনি বললেন: না, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তোমাদের মধ্যে নামায কায়েম করবে ততক্ষণ পর্যন্ত নয়।” (মুসলিম)
শিক্ষা ১. অন্যায় কাজ দেখলে শক্তি প্রয়োগ করে প্রতিহত করার চেষ্টা করবে। ২. শক্তি না থাকলে মুখে প্রতিবাদ করবে। ৩. যদি সে শক্তি না থাকে তাহলে অন্তরে তা পরিবর্তন করার পরিকল্পনা করবে। ৪. এ ধরনের পনিকল্পনা করাই হল ঈমানের সর্ব নিম্ন ও দুর্বলতম স্তর। ৫. সমাজ থেকে অন্যায় কাজের মূলোৎপাটনে আমাদের ভূমিকা রাখতে হবে।
পৃষ্ঠা:৩৯
দারস-৪: জিহাদ
عَنْ عُبَادَةَ بْنِ الصَّامِتِ (رض) قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ (صعلم) جَاهِدُوا النَّاسَ فِي اللَّهِ تَبَارَكَ وَتَعَالَى الْقَرِيبَ وَالْبَعِيدَ وَلَا تَبَالُّوا فِي اللَّهِ لَوْمَةَ لائِمٍ وَاقِيمُوا حُدُودَ اللَّهِ فِي الْحَضَرِ وَالسَّفَرِ وَجَاهِدُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَإِنَّ الْجِهَادَ بَابٌ مِّنْ أَبْوَابِ الْجَنَّةِ عَظِيمُ يُنْحِيُّ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى بِهِ مِنَ الْغَمِّ وَالْهَمْ. (مسند احمد، بيهقى) অর্থঃ হযরত উবাদা ইবনুস সামিত (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (সা) বলেছেনঃ তোমরা সকলে মহিমান্বিত ও অতিশয় উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিকটবর্তী ও দূরবর্তী লোকদের সাথে জিহাদ কর এবং আল্লাহর ব্যাপারে তোমরা কোন উৎপীড়কের উৎপীড়নের বিন্দুমাত্র ভয় করো না। তোমরা দেশে বিদেশে যখন যেখানেই থাক, আল্লাহর আইন ও বিধানকে কার্যকর করে তোল। তোমরা অবশ্যই আল্লাহর পথে জিহাদ করবে। কেননা জিহাদ হচ্ছে জান্নাতের অসংখ্য দরজার মধ্যে অতি বড় দরজা। এ দ্বারপথের সাহায্যেই আল্লাহ তা’য়ালা (জিহাদকারী লোকদেরকে) সকল প্রকার চিন্তা-ভাবনা ও ভয়ভীতি হতে নাজাত দান করবেন। (মুসনাদে আহমদ, বায়হাকী)
শব্দার্থ : : عن عبادة بن الصامت (رض) হযরত উবাইদা ইবনে সামিত )রা) হতে বর্ণিত। )قَالَ رَسُوْلَ الله (صعلم : রাসূল (সা) বলেন। جاهدوا : তোমরা জিহাদ কর। الناس: মানুষ। في الله : আল্লাহর পথে। تَبارك : অতীব বরকতময়। تعالٰی: অতিশয় উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন। القريب : নিকটবর্তী। وَالْبَعِيدُ : দূরবর্তী : وَلَا تَبَالُوا : তোমরা ভয় করো
পৃষ্ঠা:৪০
না, বিচলিত হয়ো না। لَوْمَةً : নিন্দা, উৎপীড়ন। ائم নিন্দুক, উৎপীড়ক। وأقيموا : তোমরা কার্যকর কর। حدود الله: আল্লাহর দণ্ড বিধি। الحضرُ : মুকিম, দেশে। السفر এবং বিদেশে, সফরে। فی الله : আল্লাহর রাস্তায়। فإن: কেননা। الجهاد: জিহাদ, আপ্রাণ চেষ্টা। بَاب : দরজা। من : হতে। أبواب : দরজাসমূহ। الجنة: জান্নাত, বেহেশত। عظیم : অতিবড়। يُنجى : নাজাত দেবে, মুক্তি দেবে। ২: এর দ্বারা। الغم : চিন্তা ভাবনা। টা: ভয়ভীতি।
ব্যাখ্যাঃ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে আল্লাহর দীনকে আল্লাহর যমীনে প্রতিষ্ঠা করার নিমিত্তে বিভিন্ন উপায়ে প্রচেষ্টা চালানোকে জিহাদ বলে। ইসলামী জীবন ব্যবস্থাকে সুপ্রতিষ্ঠিত রাখতে এবং সমাজ-সভ্যতাকে স্থির ও বিকারমুক্ত রাখতে জিহাদের গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা দীনের মূল হলো ইসলাম, খুঁটি হলো নামায এবং তাঁর সর্বোচ্চ চূড়া জিহাদ। (আহমদ, তিরমিযী, ইবনে মাযা)
কাজেই দীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার কাজে খোদাদ্রোহী শক্তির বাধা আসাটাই স্বাভাবিক। সে বাধা মোকাবেলা করে সামনে অগ্রসর হওয়ার জন্যই জিহাদ অপরিহার্য। তাই সকলকে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিকটবর্তী ও দূরবর্তী লোকদের সাথে জিহাদ করতে হবে। প্রয়োজন অনুসারে নিকটে আর দূরে যেখান থেকেই জিহাদের ডাক আসুক সেখানে হাজির হতে হবে। কোন অজুহাত দাঁড় করানো যাবে না। সব কিছুকে আল্লাহর উদ্দেশ্যেই সহ্য করতে হবে। গ্রন্থ পরিচিতিঃ মুসনাদে আহমদ ও বায়হাকী হাদীস গ্রন্থ থেকে এই হাদীসটি চয়ন করা হয়েছে। মুসনাদে আহমদ গ্রন্থের পরিচিতি নিম্নে উল্লেখ করা হলোঃ মুসনাদে আহমদ হিজরী তৃতীয় শতকের এক অতুলনীয় হাদীস গ্রন্থ। মুসলমানদের ব্যবহারিক জীবনের প্রয়োজনীয় হাদীস এ বিরাট গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। (ফতহুর রব্বানীঃ ১ম খণ্ড পৃঃ ৯ ম) এ গ্রন্থ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র) সংকলন করেন। তিনি বাগদাদে ১৬৪ হিজরী সনে জন্মগ্রহণ করেন।
পৃষ্ঠা:৪১
তিনি হাদীস অধ্যয়নের শুরু থেকেই মুখস্থ করার সাথে সাথে লিখার কাজেও মনোনিবেশ করেন। তখন তাঁর বয়স ছিল ১৬ বছর। (মুকাদ্দামা মুসনাদ হায়াতে আহমদ ইবনে হাম্বল) তাঁর জীবনের লক্ষ্য ছিল সকল সহীহ হাদীস সংগ্রহ করা। এ লক্ষ্যে তিনি জীবনভর হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনের কাজ করেছিলেন। তিনি সর্বমোট ৭ লক্ষ ৫০ হাজার হাদীস সংগ্রহ করে, তার যাচাই বাছাই করে ৩০ হাজারের কিছু বেশী হাদীস মুসনাদে সন্নিবেশিত করেন। পরবর্তীকালে তাঁর পুত্রের আরো এক হাজার হাদীস সংযোজনের ফলে চল্লিশ হাজার হাদীসে উন্নীত হয়। (আল-হিত্তা ফী যিকরিস সিহাহ সিত্তা পূঃ ১১১) ইমাম আহমদ একজন বিজ্ঞ মুহাদ্দিস, ফকীহ ও মুজতাহিদ ছিলেন। মুতাযিলাদের ভ্রান্ত মতবাদকে অস্বীকার করার কারণে খলীফার কারাগারে বহুবিধ নির্যাতনের পর ২৪১ হিজরী সনে ৭৭ বছর বয়সে ইহধাম ত্যাগ করেন। বাগদাদ নগরেই তাঁকে সমাহিত করা হয়। (আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া ১১ খণ্ড পূঃ ৩৩৫) বায়হাকী শরীফের পরিচিতি নিম্নে তুলে ধরা হল। বায়হাকী শরীফ: ইমাম আহমদ ইবনে হুসাইন আল-বায়হাকী (মৃঃ ৪৫৮ হিঃ) এ গ্রন্থখানা সংকলন করেছেন। এতে প্রয়োজনীয় সকল হাদীস সন্নিবেশিত হয়েছে। এর পূর্ণ নাম আস-সুনানুল কুবরা।
রাবী পরিচিতিঃ নাম: উবাদা। উপনাম: আবদুল ওয়ালিদ। পিতার নাম: সামিত। মাতার নামঃ কুররাতুল আইন বিনতে উবায়দা। জন্মঃ তিনি হিজরতের ৩৮ বছর পূর্বে মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একজন আনসার সাহাবী ছিলেন। বংশধারা ঃ উবাদা ইবনে সামিত ইবনে কায়েস ইবনে আসরাম মদীনার অধিবাসী খাযরাজ বংশের লোক। জীবনের নানা তথ্যাবলীঃ মদীনা থেকে রাসূলের (সা) সাথে যে সব প্রতিনিধি মক্কায় এসে আকাবার প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বাইয়াত গ্রহণ
পৃষ্ঠা:৪২
করেছেন তাতে তিনি শরীক ছিলেন। বদরসহ সকল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে আল্লাহর রাসূলের (সা) সাথে ইসলামের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হন। হযরত আবু বকর (রা)-এর শাসনামলে তিনি সিরিয়ার অভিযানসমূহে অংশগ্রহণ করেন। সেখানে তিনি কাজী পদ অলংকৃত করেন এবং শিক্ষাদানের দায়িত্ব পালন করেন। হযরত উমর ফারুক (রা)-এর শাসনামলে তিনি মিশর বিজয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ফিলিস্তিনের প্রথম এবং প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হন। তিনি মিসরের গভর্ণরও ছিলেন। হাদীস শাস্ত্রে তাঁর অবদানঃ তিনি নবী করীম (সা) থেকে সর্বমোট ১৮১ খানা হাদীস বর্ণনা করেন। তন্মধ্যে ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম (র) ৬ খানা, ইমাম বুখারী (র) এককভাবে ২ খানা ও ইমাম মুসলিম (র) এককভাবে ২ খানা হাদীস নিজ নিজ হাদীস গ্রন্থ বুখারী ও মুসলিম শরীফে উল্লেখ করেছেন। তাঁর নিকট থেকে সাহাবায়ে কিরামের এক জামায়াত ও তাবিয়ীদের এক জামায়াত লোক হাদীস বর্ণনা করেছেন। (কিতাবুল জরাহ ও তাদিল ৬ খণ্ড পৃঃ ৯৪) ইনতিকাল: তিনি হিজরী ৩৪ সালে ৭২ বৎসর বয়সে ফিলিস্তিনের আর-রামাল্লা নামক শহরে ইনতিকাল করেন। বাইতুল মুকাদ্দিসে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
জিহাদ অর্থ আভিধানিক অর্থ: জিহাদ )جهاد( শব্দটি – جهد শব্দ থেকে নির্গত। এর – আভিধানিক অর্থ কোন উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা, কঠোর পরিশ্রম, চূড়ান্ত সাধনা, সর্বশক্তি নিয়োগ করা, সংগ্রাম করা ইত্যাদি। আল্লামা রাগিব ইস্পাহানী তাঁর ‘মুফরাদাত’ গ্রন্থে জিহাদ শব্দের অর্থ লিখেছেন: مُحَاوَلَةُ الْقُوَّةِ لِدَفْعِ الْعَدُو. “শত্রু দমনের লক্ষ্যে শক্তি নিয়োগ।” কুরআনের পরিভাষায়: وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِيْنَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا.
পৃষ্ঠা:৪৩
“আর যেসব লোক আমাদের ব্যাপারে সাধনা করেছে, আমরা নিশ্চয়ই তাদের দেখাব আমাদের পথ।” (সূরা আনকাবৃত: ৬৯) وَجَاهِدْهُمْ بِهِ جِهَادًا كَبِيرًا. “আর জিহাদ করো তাদের সাথে এ কুরআন দ্বারা বড় রকমের জিহাদ।” (সূরা ফুরকান: ৫২) শরীয়তের পরিভাষায়- আল্লাহর দীনকে বিজয়ী ও সুপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে সর্বপ্রকার প্রতিকূল শক্তির বিরুদ্ধে জীবন-সম্পদ, বুদ্ধি-জ্ঞান, শক্তি-সামর্থ্য উৎসর্গ করে সর্বাত্মক ও চূড়ান্ত সংগ্রাম করার নামই জিহাদ। ইমাম বালাজুরী বলেছেন: জিহাদ অর্থ আল্লাহর পথে যুদ্ধ করা। আর জিহাদ শব্দটি مجاهده থেকে গৃহীত। যার অর্থ, দীন কায়েমের উদ্দেশ্যে (পরস্পর) যুদ্ধ করা। এটি হচ্ছে ছোট জিহাদ। আর জিহাদে আকবার বা বড় জিহাদ হচ্ছে নফসের সাথে জিহাদ করা।
জিহাদের প্রকারভেদ
জিহাদকে প্রথমত দু’শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। যথা: ক. যাহিরী বা প্রকাশ্য জিহাদ এবং খ. বাতিনী বা অপ্রকাশ্য জিহাদ। ক. যাহিরী বা প্রকাশ্য জিহাদ: কাফির, মুশরিক, তাগুত তথা ইসলামের চরম শত্রু খোদাদ্রোহী নাস্তিক্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিরোধিতা ও প্রতিকূল পরিবেশের মোকাবিলা করে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজের জান-মাল উৎসর্গ করাই হলো যাহিরী জিহাদ বা প্রকাশ্য সংগ্রাম। وَجَاهِدُوا فِي اللهِ حَقَّ جَهَادِهِ.
“আল্লাহর পথে জিহাদ কর, যেভাবে জিহাদ করা উচিত।” (সূরা হজ: ৭৮) খ. বাতিনী বা অপ্রকাশ্য জিহাদ: মানুষের চরম দুশমন শয়তান ও নফসে আম্মারা বা কু-প্রবৃত্তি। কু-প্রবৃত্তি তথা কাম-ক্রোধ, লোভ, মোহ ইত্যাদি
পৃষ্ঠা:৪৪
মানুষকে সুপথ থেকে কুপথে পরিচালিত করে। ঈমান ও ইসলামের সুন্দর ও সুপথ থেকে গোমরাহী ও খোদাদ্রোহী পথে নিয়ে যায়। মানুষের এ অপ্রকাশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে সর্বদা লড়াই করতে হয় বলে একে বাতিনী জিহাদ বলে। ইসলামের পরিভাষায় এ জিহাদকে জিহাদে আকবার বলে। একবার একদল মুজাহিদ জিহাদের ময়দান থেকে মদিনায় প্রত্যাবর্তন করলে রাসূল (সা) তাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন: “তোমরা ছোট জিহাদ থেকে বড় জিহাদের দিকে পদার্পণ করলে। জিজ্ঞেস করা হলোঃ হে আল্লাহর রাসূল! বড় জিহাদ কি? মহানবী (সা) বললেন: নফস বা কু-প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ হলো বড় জিহাদ।” (বায়হাকী)
الْمُجَاهِدُ مَنْ جَاهَدَ لِنَفْسِيهِ. প্রকৃত মুজাহিদ ঐ ব্যক্তি যে নিজের নফসের সাথে জিহাদ করে।” ” ক. যাহিরী বা প্রকাশ্য জিহাদকে আবার চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে। নিম্নে তা উল্লেখ করা হলো। ক. ব্যক্তিগত কর্তব্য পালনে জিহাদ; খ. কায়িক জিহাদ; গ. আর্থিক জিহাদ; ঘ. বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদ। ক. ব্যক্তিগত কর্তব্য পালনে জিহাদ: ইসলাম মানুষের উপর ব্যক্তিগত ও সামাজিক যে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়েছে প্রতিকূল অবস্থায় সে সকল দায়িত্ব ব্যক্তি সত্তা বজায় রেখে সঠিকভাবে পালন করাও জিহাদের অন্তর্ভুক্ত। এ প্রকারের জিহাদকে মানব জীবনের প্রাথমিক জিহাদ বলা হয়। খ. কায়িক জিহাদ: খোদাদ্রোহী ও ইসলাম বিরোধী সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য দৈহিকভাবে অংশগ্রহণ করাই হলো কায়িক জিহাদ। وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ و يَكُونَ الدِّينُ كله لِلَّهِ. “ফিতনা নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত এবং আল্লাহর দীন পূর্ণাঙ্গভাবে প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম কর।” (সূরা আনফালঃ ৩৯)
পৃষ্ঠা:৪৫
فَاقْتُلُوا الْمُشْرِكِينَ حَيْثُ وَجَدْتُمُوهُمْ. “যেখানে পাও মুশরিকদের বিরুদ্ধে লড়াই কর।” كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِتَالُ وَهُوَ كُرْهُ لَكُمْ. “জিহাদ তোমাদের উপর ফরয করা হয়েছে, যদিও তা তোমাদের জন্য কষ্টকর হোক না কেন।” (সূরা আল-বাকারাঃ ২১৬) الَّذِينَ آمَنُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالَّذِينَ كَفَرُوا يُقَاتِلُونَ فِي سبيل الطاغوت. “ঈমানদারগণ আল্লাহর পথে লড়াই করে। আর কাফিরেরা লড়াই করে তাগুতের পথে।” (সূরা আন-নিসাঃ ৭৬) গ. আর্থিক জিহাদ: আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ধন-সম্পদ ব্যয় করা
অপরিহার্য। অর্থ ব্যয় করা ছাড়া কোন কাজই সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা যায় না। যখনই ধন সম্পদ ব্যয় করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় তখনই প্রয়োজন মাফিক ব্যয় করা উচিত। কখনো কখনো এর প্রয়োজনীয়তা অধিক পরিমাণে দেখা দেয়। তখন অকাতরে অর্থ ব্যয় করাই হলো আর্থিক জিহাদ। انْفِرُوا خِفَافًا وَثِقَالاً وَجَاهِدُوا بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ. “যুদ্ধের উপকরণ তোমাদের অল্প হোক কিংবা অধিক হোক তোমরা সংগ্রামে বের হও এবং তোমাদের ধন-সম্পদ ও জীবন বিলিয়ে দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ কর।” (সূরা আত তওবা: ৪১)ঘ. বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদ: ইসলামের দুশমনেরা যুগে যুগে শুধু সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমেই ইসলামের অগ্রযাত্রাকে রোধ করার অপপ্রয়াস চালায়নি; বুদ্ধিভিত্তিক আগ্রাসনের মাধ্যমেও ইসলামের অগ্রযাত্রা রোধ করার প্রচেষ্টা চালিয়েছে। তাই এ আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও মুসলমানদেরকে বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রাম করতে হয়। এজন্য বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে, লিখনীর দ্বারা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চায়, অর্থনৈতিক দিক দিয়ে, রাজনৈতিকভাবে, দর্শন
পৃষ্ঠা ৪৬ থেকে ৬০
পৃষ্ঠা:৪৬
ও সাহিত্য রচনায়, তথ্য ও প্রচারসহ, জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল ক্ষেত্রে মুসলমানদের দক্ষতা অর্জন করে অপসংস্কৃতির দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতে হবে। আল্লাহর রাসূল (সা) বলেন: منْ مَاتَ وَلَمْ يَغْزُو وَلَمْ يُحَدِّثُ بِهِ نَفْسَهُ مَاتَ عَلَى شُعْبَةٍ مِّنَ النِّفَاقِ. “যে ব্যক্তি জিহাদে শরীক হলো না, কিংবা জিহাদের চিন্তা-ভাবনাও করল না; আর এ অবস্থায় সে মৃত্যুবরণ করল, সে যেন মুনাফিকের মৃত্যুবরণ করল।” (মুসলিম)
জিহাদের গুরুত্ব
ইসলামী জীবন ব্যবস্থাকে সুপ্রতিষ্ঠিত রাখতে এবং সামাজিক সভ্যতাকে স্থির ও বিকারমুক্ত রাখতে তথা মুসলমানদের জীবন, সম্পদ, স্বাধীনতা রক্ষা, নিপীড়িত ও নির্যাতিত মানুষের মুক্তি এবং সর্বোপরি আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার জন্য জিহাদের গুরুত্ব অপরিসীম। নিম্নে কুরআন হাদীসের আলোকে জিহাদের গুরুত্ব তুলে ধরা হলোঃ ১. আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠায় ঃ ইসলাম হচ্ছে আল্লাহ প্রদত্ত একমাত্র পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। মানব রচিত সকল মতবাদের উপর এ জীবন ব্যবস্থাকে বিজয়ী করার জন্য আল্লাহ তা’য়ালা যুগে যুগে অগণিত নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। আজ নবী-রাসূলগণের অবর্তমানে এ দায়িত্ব সকলের উপর অর্পিত হয়েছে। তাই আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যাবতীয় বাধা ও প্রতিকূল অবস্থার মুকাবিলায় জিহাদ করা সকলের উপর ফরয। এ জিহাদে আত্মনিয়োগ করা প্রত্যেকটি মুসলমানের ঈমানী দায়িত্ব। ইসলামের দুশমনেরা কোন যুগেই এ আন্দোলন নির্বিঘ্নে চলতে দেয়নি। সব সময়ই বাধা দিয়েছে। আল্লাহ তা’য়ালা এ বাধা দূরীকরণ ও কুফরী শক্তির মূলোৎপাটনের জন্যই জিহাদের নির্দেশ দিয়েছেন। كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِتَالُ. “জিহাদ তোমাদের প্রতি ফরয করা হয়েছে।” (সূরা বাকারাঃ ২১৬) রাসূল (সা) বলেন: مَنْ قَاتَلَ لِتَكُونَ كَلِمَةُ اللَّهِ هِيَ الْعُلِيَا فَهُوَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ.
পৃষ্ঠা:৪৭
“যে ব্যক্তি আল্লাহর বাণীকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার জন্য জিহাদে লিপ্ত হয় সে আল্লাহর পথেই আছে।” (বুখারী)
২. নিরাপত্তা বিধানে। মুসলামনদের জীবন-সম্পদ ও স্বাধীনতার উপর ইসলামের শত্রুরা আক্রমণ করলে তা প্রতিহত করা এবং দীনের কাজে বাধা সৃষ্টি করলে তা অপসারণের জন্য জিহাদ করা ফরয। দেশের মাটি ও মানুষের নিরাপত্তা বিধান করতে না পারলে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যেমন অসম্ভব তেমনি আল্লাহর দীন রক্ষা করাও অসম্ভব। তাই আল্লাহ তা’য়ালা ইসলামের দুশমনদের প্রতি কঠোর থাকার নির্দেশ দিয়ে বলেন: يَأَيُّهَا النَّبِيُّ جَاهِدِ الْكُفَّارَ وَالْمُنْفِقِينَ وَاغْلُظْ عَلَيْهِمْ.
“হে নবী আপনি কাফির ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করুন এবং তাদের ব্যাপারে বজ্রকঠোর হোন।” (সূরা আত-তওবা: ৭৩) ৩. মানবতা রক্ষায় ইসলাম মানবতার ধর্ম। ইসলাম সকল মানুষের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করে। আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করে বিশ্বের বুকে আইনের শাসন কায়েম করে সকল প্রকার শোষণ, যুলুম- নির্যাতন, ফেতনা-ফাসাদ ও অশান্তির অবসান ঘটানো ইসলামের লক্ষ্য। আর এ জন্য জিহাদের অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য। وَمَا لَكُمْ لَا تُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالْمُسْتَضْعَفِينَ مِنَ الرِّجَالِ وَالنِّسَاءِ وَالْوِلْدَانِ الَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا أَخْرِجْنَا مِنْ هَذِهِ الْقَرْيَةِ الظَّالِمِ أَهْلُهَا. وَاجْعَلْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ وَلِيًّا وَاجْعَلْ لَّنَا مِنْ لَّدُنْكَ نَصِيرًا. “তোমাদের কি হলো যে, তোমরা সংগ্রাম করবে না আল্লাহর পথে। অসহায় নর-নারী এবং শিশুদের পক্ষে? যারা ফরিয়াদ করে বলছে, হে আমাদের প্রতিপালক! এ যালিম অধ্যুষিত এলাকা থেকে আমাদেরকে অন্যত্র নিয়ে যাও এবং আমাদের জন্য তোমার পক্ষ থেকে অভিভাবক ও সাহায্যকারী পাঠাও। (সূরা আন-নিসা: ৭৫) ৪. স্বাধীনতা রক্ষায়ঃ বহিঃশত্রুর আক্রমণ হতে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও দেশের প্রতি ইঞ্চি জমিকে মুক্ত ও স্বাধীন রাখার জন্য প্রত্যেকটি মুসলমান নর-নারীর উপর জিহাদে অবতীর্ণ হওয়া ফরয।
পৃষ্ঠা:৪৮
وَاعِدُوا لَهُمْ مَا اسْتَطَعْتُمْ مِنْ قُوَّةٍ وَمِنْ رَبَاطِ الْخَيْلِ تُرْهِبُونَ بِهِ عَدُوٌّ اللَّهِ وَعَدُوكُمْ “হে মুসলিমগণ, তোমরা তোমাদের শত্রুদের মুকাবিলার জন্য যথাসাধ্য শক্তি সঞ্চয় (প্রস্তুতি গ্রহণ) করো এবং যুদ্ধোপযোগী ঘোড়া প্রস্তুত রাখো যাতে আল্লাহর ও তোমাদের শত্রুদের শংকিত ও সন্ত্রস্ত রাখতে পারো।” (সূরা আনফালঃ ৬০) ৫. উচ্চ মর্যাদা লাভেঃ ইসলামে জিহাদকারীদের মর্যাদা অনেক বেশী। যারা আল্লাহর পথে জিহাদ করে শহীদ হয় অথবা গাজী হয়ে জিহাদের ময়দান থেকে ফিরে আসে তাদের মর্যাদা অতি উচ্চে।
আল্লাহর বাণী: وَلَا تَقُولُوا لِمَنْ يُقْتَلُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَمْوَاتٌ. “আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তাদেরকে মৃত বলো না।” (সূন্ন বাকারাঃ ১৫৪) অপর এক আয়াতে বলা হয়েছেঃ “যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় আল্লাহ কখনো তাদের আমলসমূহ বিনষ্ট করবেন না। তিনি তাদের পথ দেখাবেন এবং সুসংহত করে দেবেন। সেই জান্নাতে তাদের দাখিল করবেন, যার সম্পর্কে পূর্বে তাদের অবহিত করেছেন। (সূরা মুহাম্মদঃ ৪-৬) ৬. আল্লাহ্র ভালবাসা লাভেঃ আল্লাহর পথে যারা জিহাদ করেন আল্লাহ তা’য়ালা তাদেরকে বেশী ভালবাসেন। আল্লাহর বাণীঃ بنيان مرصوص. الدِّينَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِهِ صَفًّا كَأَنَّهُمْ : الله يُحِبُّ إن الله “আল্লাহ তো ভালবাসেন সেই লোকদেরকে যারা তার পথে এমনভাবে কাতারবন্দী হয়ে লড়াই করে যেন তারা সীসাঢালা প্রাচীর।” (সূরা ছফ: ৪)
৭. চির সুখের জান্নাত লাভে যারা আল্লাহ পথে জিহাদ করে আল্লাহ তা’য়ালা তাদের পাপরাশি ক্ষমা করে দিয়ে চির সুখের জান্নাত দান করবেন। يَغْفِرْلَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَيُدْخِلْكُمْ جَنَّتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَرُ.
পৃষ্ঠা:৪৯
“আল্লাহ তোমাদর (জিহাদকারীদের) গুনাহ-খাতা মাফ করে দেবেন এবং তোমাদেরকে এমন সব বাগ-বাগিচায় প্রবেশ করাবেন যে সবের নিচে ঝর্ণাধারা সদা প্রবাহিত।” (সূরা ছফঃ ১২) জিহাদ কাদের বিরুদ্ধে: অনেকেই মনে করেন রাসূলের যুগে জিহাদ করেছেন ‘কাফিরদের বিরুদ্ধে, এখন আমরা সকলেই মুসলমান, এখন কার বিরুদ্ধে জিহাদ করব। মনে রাখতে হবে ইসলাম বিরোধী শক্তি সব সময়ই ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে, যারাই যখন ইসলাম প্রচার, প্রসার ও প্রতিষ্ঠার কাজে বাধা প্রদান করবে তখনই তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে হবে। চাই সে কাফির, মুনাফিক, মুশরিক ও নামধারী মুসলমান যেই হোক না কেন। নিম্নে কুরআন হাদীসের আলোকে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা পেশ করা হল: ১. কাফির ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে: কাফির ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার নির্দেশ দেয়া হয়েছেঃ يأَيُّهَا النَّبِيُّ جَاهِدِ الْكُفَّارَ وَالْمُنفِقِينَ وَاغْلُظ : عَلَيْهِمْ. “হে নবী আপনি কাফির ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করুন এবং তাদের ব্যাপারে বজ্রকঠোর হন।” (সূরা তওবা: ৭৩) ২. যুলুমের বিরুদ্ধে জিহাদ: যালিমের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে হবে যদি সে মুসলমান হয় তবুও। ! إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الظَّلِمِينَ. “নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’য়ালা অত্যাচারীকে পছন্দ করেন না।” “যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হলো তাদেরকে, যাদের বিরুদ্ধে কাফেররা যুদ্ধ করে, কারণ তাদের প্রতি যুলুম করা হয়েছে। আল্লাহ তাদের সাহায্য করতে সক্ষম। যাদের ঘর-বাড়ী থেকে অন্যায়ভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে, শুধু এ অপরাধে যে, তারা বলে ‘আল্লাহ আমাদের রব’।” (সূরা হজ: ৩৯, ৪০)
পৃষ্ঠা:৫০
৩. আক্রমণের জবাবে পাল্টা আক্রমণ: দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে কেউ হুমকি সৃষ্টি করলে এবং কোন বহিঃশত্রু আক্রমণ করলে, আক্রমণের জবাবে পাল্টা আক্রমণ করতে হবে। وَقَاتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ الَّذِينَ يُقَاتِلُوْنَكُمْ وَلَا تَعْتَدُوا إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْمُعْتَدِينَ. “যুদ্ধ কর আল্লাহ পথে তাদের বিরুদ্ধে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং তোমরা সীমালংঘন করো না। আল্লাহ সীমালংঘনকারীদেরকে ভালবাসেন না।” (সূরা বাকারা: ১৯০)
৪. হারানো ভূখণ্ড পুনরুদ্ধারঃ মুসলমানদের বাড়ী ঘর বা দেশ থেকে যদি কোন সময় বহিষ্কার করা হয়, তা হলে শক্তি সঞ্চয় করে তা পুনরুদ্ধার করার জন্য জিহাদ করা ফরয। وَاقْتُلُوهُمْ حَيْثُ ثَقِفْتُمُوهُمْ وَاخْرِجُوهُمْ مِّنْ حَيْثُ اخْرَجُوكُمْ وَالْفِتْنَةُ اشَدُّ مِنَ الْقَتْل “তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর যেখানেই তাদের সাথে মুকাবিলা করা হয়। তাদেরকে বহিষ্কার কর সেখান থেকে, তারা যেখান থেকে তোমাদেরকে বহিষ্কার করেছে। কেননা ফেতনা সৃষ্টি করা মানুষ হত্যা করার চেয়ে জঘন্যতম অপরাধ।” (সূরা বাকারা: ১৯১)
৫. চুক্তি ভঙ্গ ও বিশ্বাসঘাতকতাঃ যাদের সাথে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে চুক্তি হয় এ চুক্তি রক্ষা করা সকলেরই কর্তব্য। চুক্তি ভঙ্গ করলে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। الا تُقَاتِلُونَ قَوْمًا نُكَنُوا إِيْمَانَهُمْ وَهَمُوا بِإِخْرَاجِ الرَّسُولِ وَهُمْ يَدَعُوكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ. “কেন তোমরা যুদ্ধ করো না সে সব জাতির বিরুদ্ধে, যারা চুক্তি ভঙ্গ করেছে, রাসূলকে বহিষ্কার করার উদ্যোগ নিয়েছে এবং নিজেরাই প্রথম আক্রমণের সূচনা করেছে। (সূরা তওবা: ১৩)
পৃষ্ঠা:৫১
৬.নির্যাতিত মুসলমানদের সাহায্যঃ নির্যাতিত মানুষের সাহায্যার্থে জিহাদ।
وَمَا لَكُمْ لَا تُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالْمُسْتَضْعَفِينَ مِنَ الرِّجَالِ وَالنِّسَاءِ وَالْوِلْدَانِ الَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا أَخْرِجْنَا مِنْ هَذِهِ الْقَرْيَةِ الظَّالِمِ أَهْلُهَا. وَاجْعَلْ لَّنَا مِنْ لَّدُنْكَ وَلِيًّا وَاجْعَلْ لَّنَا مِنْ لَّدُنْكَ نَصِيرًا. “তোমাদের কি হলো যে, তোমরা সংগ্রাম করবে না আল্লাহর পথে। অসহায় নর-নারী এবং শিশুদের পক্ষে? যারা ফরিয়াদ করে বলছে, হে আমাদের প্রতিপালক! এ যালিম অধ্যুষিত এলাকা থেকে আমাদেরকে অন্যত্র নিয়ে যাও এবং আমাদের জন্য তোমার পক্ষ থেকে অভিভাবক ও সাহায্যকারী পাঠাও। (সূরা আন-নিসাঃ ৭৫)
৭. আল্লাহর বিধানের সংরক্ষণঃ
আল্লাহর বিধানের সংরক্ষণের জন্য জিহাদ করা অপরিহার্য। যারা আল্লাহর সীমালংঘন করে, হারামকে হালাল মনে করে ও দীনে হকের বিরোধিতা করে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে হবে। قَاتِلُوا الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَلَا بِالْيَوْمِ الْآخِرِ وَلَا يُحَرِّمُونَ مَا حَرَّمَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَلَا يَدِينُونَ دِينَ الْحَقِّ. “তোমরা যুদ্ধ কর ঐ সব লোকদের বিরুদ্ধে, যারা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে না, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা) যা হারাম করেছেন, তা হারাম করে না এবং গ্রহণ করে না সত্য দীনকে।” (সূরা তওবা: ২৯) ১. দেশের আভ্যন্তরীণ শত্রু নিশ্চিহ্ন করাঃ যারা দেশের অভ্যন্তরে বসে সকল সুযোগ গ্রহণ করে দেশ ও দেশের মাটির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শত্রুর সকল ষড়যন্ত্রের মূলোৎপাটন করা সকলের কর্তব্য। لَئِنْ لَّمْ يَنْتَهِ الْمُنَافِقُونَ وَالَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ مُرَضٌ وَالْمُرْحِفُونَ فِي الْمَدِينَةِ لَنُغْرِيَنَّكَ بِهِمْ.
পৃষ্ঠা:৫২
“মুনাফিক এবং যাদের মনে রোগ রয়েছে আর মদীনায় গুজব রটনাকারীরা যদি এ সব কাজ হতে বিরত না হয়, তাহলে আমরা তাদের উপর আপনাকে চড়াও করে দিব। (সূরা আহযাবঃ ৬০)
শিক্ষা ১। জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহর কাজ অব্যাহতভাবে করা ফরয ২। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিকটবর্তী ও দূরবর্তী লোকদের সাথে জিহাদ করতে হবে। ৩। আল্লাহর পথে জিহাদের ব্যাপারে কোন উৎপীড়কের উৎপীড়নের বিন্দুমাত্র ভয় করা যাবে না। ৪। মুকীম ও মুসাফির সর্বাবস্থায় আল্লাহর আইন ও দণ্ড বিধানকে কার্যকর করতে হবে। ৫। আল্লাহর পথে জিহাদকারীর জন্য জান্নাতে উচ্চ মর্যাদা নির্ধারিত। ৬। জিহাদকারী লোকদেরকে সকল প্রকার চিন্তা-ভাবনা ও ভয়ভীতি হতে নাজাত দান করবেন।
পৃষ্ঠা:৫৩
দারস-৫: শহীদের মর্যাদা
عن انس (رض) أن النبي (صلعم) قَالَ : مَا أَحَدٌ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ يُحِبُّ ان يَرْجِعَ إلَى الدُّنْيَا وَإِنَّ لَهُ مَا عَلَى الْأَرْضِ مِنْ شَيْءٍ ، إِلَّا الشَّهِيدَ فَإِنَّهُ يَتَمَنَّى أَنْ يُرْجِعَ إِلَى الدُّنْيَا فَيُقْتَلُ عَشْرَ مَرَّاتٍ، لِمَا يَرَى مِنَ الْكَرَامَةِ، وَفِي رِوَايَةٍ، لِمَا يَرَى مِنْ فضل الشَّهَادَة (بحاری، مسلم، ترمذی)
অর্থঃ হযরত আনাস (রা) হতে বর্ণিত। রাসূল (সা) ইরশাদ করেছেন: কোন বেহেশতবাসীকে যদি দুনিয়ার সকল সম্পদ দেয়া হয়, তথাপি সে পৃথিবীতে ফিরে যাওয়া পছন্দ করবে না। একমাত্র শহীদ ব্যক্তিই এর ব্যতিক্রম। সে কামনা করবে, দুনিয়াতে পুনরায় তাকে পাঠানো হোক এবং আর দশ বার সে শাহাদাত লাভ করে আসুক। শাহাদাতের মর্যাদা ও সম্মান সে (নিচ চোখে) দেখবে, তার কারণেই সে এরূপ আকাঙ্খা করবে। (বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী)
শব্দার্থ: عن انس (رض:হযরত আনাস (রা) হতে বর্ণিত। يُحِبُّ পছন্দ করে। يرجع: ফিরে যাবে। يُثنى: আকাঙ্খা করবে। فيُقتل : অতঃপর শহীদ হবে। عشر مرات : দশ বার। يرى : দেখবে। الكرامة: মর্যাদা। فضل : ফযীলত।
ব্যাখ্যাঃ যে ব্যক্তি ভাল কাজ করে দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়, সে আল্লাহর কাছে এমন আরাম আয়েসের জীবন লাভ করে যে, তারপর এ দুনিয়ায় ফিরে আসার কোন আকাংখাই সে করে না। কারণ সারা জীবনের কষ্টের সুখ জান্নাত সামান্য সময়ের জন্য কেউ ত্যাগ করতে চাইবে না। কিন্তু শহীদগণ এর ব্যতিক্রম। তারা আকাংখা করবে আবার যেন তাদেরকে দুনিয়ায় পাঠানো হয় এবং আল্লাহর পথে জীবন দিতে গিয়ে যে ধরনের
পৃষ্ঠা:৫৪
আনন্দ, উৎফুল্লতা ও উন্মাদনায় তারা পাগল হয়ে গিয়েছিল আবার যেন সেই অভিনব আস্বাদনের সাগরে তারা ডুব দিতে পারে। তাছাড়া শহীদগণ শাহাদাতের মর্যাদা ও সম্মান অন্যদের তুলনায় কত বেশী তা নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করবেন। অপর দিকে মৃত্যু যন্ত্রনা না থাকার কারণে শহীদগণ বার বার শাহাদাত লাভ করার আকাঙ্খা করবেন। সাধারণ মানুষের মৃত্যু যন্ত্রণার তুলনায় শহীদের কোন মৃত্যু যন্ত্রণা নেই। শহীদগণ শাহাদাতের সময় কতটুকু ব্যাথ্যা অনুভব করবেন তা নিম্নের হাদীসের মাধ্যমে বুঝা যায়। عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ (رض) قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ (صلعم) مَا يَجِدُ الشَّهِيدُ مِنْ مَنَ الْقَتْلِ إِلَّا كَمَا يَجِدُ أَحَدُكُمْ مِنْ مَسَّ الْقَرْصَةِ. (ترمذى، نسائی، ابن ماجه ابن حبان হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: শহীদ তার নিহত হওয়ার সময় কাউকে চিমটি কাটলে যতটুকু ব্যাথ্যা পায়, তার চেয়ে বেশী ব্যাথ্যা পায় না। (তিরমিযী, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ, ইবনে হাব্বান) গ্রন্থ পরিচিতিঃ দারসে উল্লেখিত পবিত্র হাদীস খানা তিনটি সহীহ হাদীস গ্রন্থ বুখারী, মুসলিম ও তিরমিযি শরীফে যৌথভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। নিম্নে গ্রন্থ তিনটির পরিচয় তুলে ধরা হলোঃ
সহীহ আল-বুখারী
হাদীস বিশারদগণ হিজরী তৃতীয় শতাব্দীর প্রথমার্ধে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের বিক্ষিপ্ত হাদীসসমূহ ‘মুসনাদ’ আকারে লিপিবদ্ধ করেন। পরবর্তীকালে মুহাদ্দিসগণ যাচাই-বাছাই করে (সহীহ) বিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থ লিখার কাজে হাত দেন। এর ফলশ্রুতিতে হিজরী তৃতীয় শতাব্দীর মাঝামাঝি ও শেষার্থে বিশ্ব বিখ্যাত ‘সীহাহ সিত্তা’ বা ছয়খানি বিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থ জগতবাসীর কাছে উপস্থাপন করা হয়। এ গ্রন্থগুলোর মধ্যে সর্বাপেক্ষা অধিক বিশুদ্ধতম
পৃষ্ঠা:৫৫
অমর হাদীস গ্রন্থ হচ্ছে ‘সহীহুল বুখারী’। ইমাম বুখারী (র) এ গ্রন্থের প্রণেতা। তাঁর পূর্ণ নাম হলো মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল ইবনে ইব্রাহীম ইবনে মুগীরা ইবনে বারদিযবাহ আল-যু’ফী আল-বুখারী। তিনি ১৯৪ হিজরী ১৩ই শাওয়াল বুখারা নগরীতে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন। অতি অল্প বয়সে পবিত্র কুরআনকে মুখস্থ করেন। তিনি হাফিযে হাদীস ছিলেন। তিনি নিজেই বলেন: ‘তিন লক্ষ’ হাদীস তাঁর মুখস্থ ছিল। তাছাড়া তিনি ছয় লক্ষ হাদীস থেকে যাচাই-বাছাই করে ১৬ বছরে এ গ্রন্থখানি সংকলন করেন। যার মধ্যে ৭,৩৯৭ তাকরারসহ ও তাকরার ছাড়া ২,৫১৩টি হাদীস স্থান পেয়েছে। হাদীস সংকলনের পূর্বে ইমাম বুখারী (র) গোসল করে দু’রাকাত সালাত আদায় করে ইসতিখারা করার পর এক একটি হাদীস লিপিবদ্ধ করেছেন। সকল মুহাদ্দিসগণের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত মতে, সকল হাদীস গ্রন্থের মধ্যে বুখারী শরীফের মর্যাদা সব চেয়ে বেশী। তাই বলা হয়ঃ أَصَحُ الْكُتُبِ بَعْدَ كِتَابِ اللَّهِ تَحْتَ السَّمَاءِ صَحِيحُ الْبُخَارِيُّ. “আল্লাহর কিতাবের পর আসমানের নিচে সর্বাধিক সহীহ্ গ্রন্থ হচ্ছে সহীহুল বুখারী।” (মুকাদ্দামা ফতহুল বারী ওয়া উমদাতুল কারী) ইমাম বুখারী (র) সহজ-সরল, বিনয়ী, দয়ালু উন্নত চারিত্রিক গুণসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি নিজেই বলেন: “আমি জীবনে কোন দিন কারো কোন গীবত করিনি।” এই মহা মনীষী ২৫৬ হিজরী ১লা শাওয়াল ঈদুল ফিতর ভোর রাতে ইনতেকাল করেন। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। সহীহ্ আল-মুসলিম এ গ্রন্থের পরিচিতি ১ নং দারসে দেখুন।
জামে আত-তিরমিযী
এ গ্রন্থের প্রণেতা হলেন মুহাম্মদ বিন ঈসা। পূর্ণ নাম আল-ইমামুল হাফেয আবু ঈসা মুহাম্মদ ইবনে ঈসা ইবনে সওরাতা ইবনে মুসা আত-তিরমিযী। তিনি জীহুন নদীর তীরে তিরমীয নামক প্রাচীন শহরে ২০৯ হিজরী সনে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকালে তিনি কুরআন হিফয করেন। শৈশবে তিনি
পৃষ্ঠা:৫৬
হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহের জন্য মুসলিম জাহানের বিখ্যাত হাদীসের কেন্দ্রসমূহে বৎসরের পর বৎসর পরিভ্রমণ করেন। বিশেষ করে কুফা, বসরা, খুরাসান, ইরাক ও হিজাজের বড় বড় মুহাদ্দিসগণের কাছ থেকে হাদীস শ্রবণ ও সংগ্রহ করেন। ইমাম তিরমিযী তীক্ষ্ণ স্মরণ শক্তির অধিকারী ছিলেন। একবার শোনার পর তিনি বহু সংখ্যক হাদীস মুখস্থ করতে সমর্থ হতেন। তিনি জনৈক মুহাদ্দিসের বর্ণিত কয়েক খানি হাদীস শুনেছেন কিন্তু তাঁর সাথে তাঁর কোন দিন সাক্ষাত হয়নি। একবার হজ্জে যাওয়ার পথে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ হয়। তিনি তাঁর থেকে হাদীস শুনার আগ্রহ প্রকাশ করেন। মুহাদ্দিস পথিমধ্যেই তা মুখস্থ পাঠ করেন। ইমাম তিরমিযী উক্ত হাদীসসমূহ মুখস্থ করে ফেলেন এবং পাঠ করে শুনান। এ অবস্থা দেখে তাঁর স্মরণ শক্তি পরীক্ষা করার জন্য আরও চল্লিশটি হাদীস শুনান যা ইমাম তিরমিযী আর কোন দিন শুনেন নাই। তিনি উহা শুনার সাথে সাথে মুখস্থ করে নিলেন এবং তাঁকে শুনিয়ে দিলেন। তাতে কোন একটি শব্দও ভুল হয় নাই। (মুকাদ্দামাহ তরজমানুস সুন্নাহ ১ম খণ্ড পৃঃ ২৬১) তিনি ইমাম বুখারীর স্নেহভাজন ছাত্র ছিলেন। হাদীস প্রণয়নে তিনি ভাষার পাণ্ডিত্য, সংকলনের কলাকৌশল, মাসয়ালা-মাসায়েলের বিন্যাসে এক অভিনব পদ্ধতি প্রয়োগ করেন। যাকে মুহাদ্দিসীনদের পরিভাষায় জামে বলে। ইনতিকাল: হাদীসের এই মহান খাদেম তিরমিয শহরে ২৭৯ হিজরী সনে ৭০ বৎসর বয়সে ইনতিকাল করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজেউন। (আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া খণ্ডঃ ১১ পৃঃ ২২) রাবী পরিচিতিঃ হযরত আনাস (রা)-এর পরিচিতি ৭নং দারসে উল্লেখ করা হয়েছে।
শাহাদাত অর্থ : شهادة আরবী শব্দ شهید থেকে এর উৎপত্তি। অভিধানে শাহাদাত অর্থ সাক্ষ্য প্রদান, সংবাদ দান, শপথ করা, স্বীকার করা, উপস্থিত হওয়া, প্রত্যক্ষ করা ইত্যাদি। (আল-ওয়াসীত)
পরিভাষায় শহীদ হলো, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে দীনকে বিজয়ী ও সমুন্নত রাখতে আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করে নিহত হয়, তাকে শহীদ বলে।
পৃষ্ঠা:৫৭
الشَّهِيدُ : الْقَتِيْلُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ تَعَالَى শহীদ হলো, যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার পথে নিহত হয়। (মুখতারুছ ছিহাহ) الشَّهِيدُ : قَتِيلٌ فِي سَبِيلِ اللَّهِ.
শহীদ হলো, যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে নিহত হয়। (মাওরিদ) শহীদের সংজ্ঞা: শহীদ শব্দের আসল অর্থ হচ্ছে সাক্ষী। শহীদ বলতে এমন ব্যক্তি বুঝায় যে নিজের জীবনের সমগ্র কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তার ঈমানের সত্যতার সাক্ষ্য প্রদান করেন। আল্লাহর পথে লড়াই করে প্রাণ উৎসর্গকারীকেও এ কারণেই শহীদ বলা হয় যে, সে প্রাণ উৎসর্গ করে একথা প্রমাণ করে দেয় যে, সে যে জিনিসের উপর ঈমান এনেছিল তাকে যথার্থই সাচ্চা দিলে সত্য মনে করতো এবং তা তার কাছে এত বেশী প্রিয় ছিল যে, তার জন্য নিজের প্রাণ অকাতরে বিলিয়ে দিতেও দ্বিধা করেননি। আবার এমন ধরনের সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তিদেরকেও শহীদ বলা হয় যারা এতই নির্ভরযোগ্য হয় যে, তারা কোন বিষয়ে সাক্ষ্য দিলে তাকে নির্দ্বিধায় সত্য ও সঠিক বলে স্বীকার করে নেয়া হয়। (তাফহীমুল কুরআন, সূরা
আন-নিসা: টীকা ৯৯)
শাহাদাতের প্রকারভেদঃ
শাহাদাত তিন প্রকার। যথা:
১. মৌখিক শাহাদাত;
২. আমলী শাহাদাত;
৩. শত্রুর আঘাতে শাহাদাত।
১. মৌখিক শাহাদাতঃ আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধানই সত্য। এই জীবন বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক সকল বিধানই মিথ্যা। মুখের ভাষায় এই কর্তব্য পালনের নামই মৌখিক শাহাদাত।
২. আমলী শাহাদাতঃ যিনি আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধানকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন ও সে বিধান মোতাবেক নিজের জীবন পরিচালনা করেন। বাস্তব জীবনে এই আমলের নামই আমলী শাহাদাত।
পৃষ্ঠা:৫৮
৩. শত্রুর আঘাতে শাহাদাতঃ ইসলাম বিরোধী শত্রুর আঘাতে আল্লাহর পথে নিহত হওয়াকেও শাহাদাত বলে। ইসলামের দষ্টিতে শহীদের প্রকারভেদ: ইসলামের দষ্টিতে শহীদ দু’প্রকার। যথাঃ ক. শহীদে হাকিকী; খ. শহীদে হুকমী। ক. শহীদে হাকিকীঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে আল্লাহর দীনকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে ইসলাম বিরোধীদের সাথে যুদ্ধ করে শাহাদাত বরণ করেন তিনি শহীদে হাকিকীর মর্যাদা লাভ করে থাকেন। যথাঃ বদর, ওহুদ ও খন্দক ইত্যাদি যুদ্ধে যারা ইসলামের দুশমনদের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে গিয়ে যে সকল সাহাবী শহীদ হয়েছেন, তাঁরা শহীদে হাকিকীর মর্যাদা লাভ করেছেন। খ. শহীদে হুকমী: যারা অত্যাচারিত হয়ে অথবা কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন তারা শহীদে হুকমীর মর্যাদা লাভ করেন। যেমন: ঝড়, বন্যা, মহামারী, নৌযান ডুবি, পানিতে ডুবি, অগ্নি দগ্ধ হয়ে অথবা যানবাহনে পিষ্ট হয়ে মৃতুবরণ করলেও সে শহীদের মর্যাদা লাভ করবে। শহীদ হওয়ার শর্তঃ আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হওয়ার শর্ত তিনটি। যথা: ১. আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি খাঁটি ও মজবুত ঈমান রেখে যুদ্ধ করতে হবে। ২. একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য যুদ্ধ করতে হবে। ৩. আল্লাহর দীনকে সমুন্নত রাখার জন্য যুদ্ধ করতে হবে। আল-কুরআনে এর ব্যবহারঃ আল-কুরআনে শাহাদাত শব্দটি একবচনে ২৩ বার; বহুবচনে ৩ বার; শাহেদ শব্দটি একবচনে ৭ বার; বহুবচনে ৯ বার; শুদ ৩ বার; আশহাদ ৩ বার; শহীদ একবচনে ৩৫ বার: দ্বিবচনে ১ বার: বহুবচনে ২০ বার এবং ক্রিয়ার বিভিন্ন পদে ৫৩ বার ব্যবহৃত হয়েছে।
পৃষ্ঠা:৫৯
মানুষ কেন আল্লাহর পথে শহীদ হয়
(ক) হক বাতিলের দ্বন্দ্বের কারণে: সমাজের সকল প্রকার ফেতনা-ফাসাদ, অত্যাচার-নির্যাতন, শোষণ, পাপাচার অসামাজিক কাজ বন্ধ করে দেয়ার দায়িত্ব মু’মিনদের। আর অনৈসলামিক নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক শক্তি এসব অন্যায় কাজ সমাজে চালু করে। তাই এসব অন্যায় কাজ বন্ধ করতে হলে যে শক্তির প্রয়োজন, তাকেই বলে রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় শক্তি। রাষ্ট্রীয় শক্তি মু’মিনদের নিকট না থাকলে কোন অপরাধ বন্ধ করা সম্ভব হবে না। অথচ আল্লাহর নির্দেশ হচ্ছে: “তোমরা তাদের সাথে লড়াই কর যে পর্যন্ত ফেতনার অবসান না হয় এবং আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হয়।” (সূরা আল- বাকারা: ১৯৩) “তাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাক যতক্ষণ না ভ্রান্তি শেষ হয় এবং আল্লাহর সকল বিধান প্রতিষ্ঠিত হয়।” (সূরা আল-আনফালঃ ৩৯) উল্লেখিত আয়াতে মহান আল্লাহ শক্তি দিয়ে ফেতনা বন্ধ করে আল্লাহর বিধান কায়েম করার নির্দেশ দিয়েছেন। অতএব রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যতীত সমাজের সকল ফেতনা ও অন্যায় বন্ধ করা সম্ভব নয়। আর যখনই ঈমানদারগণ রাজনৈতিক শক্তি অর্জন তথা ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের জন্য নেতৃত্ব পরিবর্তনের চেষ্টা করে তখনই হক-বাতিলের দ্বন্দ্ব অপরিহার্য হয়ে পড়ে। তাই যুগে যুগে বাতিলের সাথে সংঘর্ষ-সংয়াত চলে আসছে। হক-বাতিলের এ দ্বন্দ্বে হকের পথে ঈমানদার ব্যক্তিদের জীবন দিতে হয়। আর এ কারণেই ঈমানদার ব্যক্তিকে শহীদ হতে হয়। (খ) আল্লাহর ওপর ঈমান আনার কারণে: “তাদের (ঈমানদারদের) থেকে তারা কেবল একটি কারণেই প্রতিশোধ নিয়েছে। আর তা হচ্ছে, তারা সে মহান পরাক্রমশালী আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছিল। যিনি স্বপ্রসংশিত, যিনি আকাশ ও পৃথিবীর সাম্রাজ্যের অধিকারী।” (সূরা আল-বুরুজ: ৯) (গ) ঈমানের দাবীতে কে সত্যঃ ঈমানের দাবীতে কে সত্য তা পরীক্ষা করার জন্য ও উচ্চ মর্যাদা দানের জন্য আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর প্রিয় বান্দাদের থেকে কাউকে কাউকে শহীদ হিসেবে গ্রহণ করেন। “তোমাদের উপর কঠিন অবস্থা এজন্য চাপানো হয়েছে যে, আল্লাহ তা’য়ালা
পৃষ্ঠা:৬০
এভাবে জেনে নিতে চান তোমাদের মধ্যে কারা সাচ্চা ঈমানদার এবং এ জন্য যে, তিনি তোমাদের থেকে কিছু শহীদ হিসেবে গ্রহণ করতে চান।” (সূরা আলে ইমরান: ১৪০)
শহীদের মর্যাদা
ইসলামে জিহাদকারীদের মর্যাদা অনেক বেশী। যারা আল্লাহর পথে জিহাদ করে শহীদ হয় অথবা গাজী হয়ে জিহাদের ময়দান থেকে ফিরে আসে তাদের জন্য রয়েছে অতি উচ্চ মর্যাদা। কুরআন ও হাদীসের আলোকে নিম্নে তা তুলে ধরা হল। ক. অমরত্ব লাভঃ যারা আল্লাহর পথে শহীদ হন তারা অমর। তাদেরকে মৃত বলা নিষেধ। এমনকি এ ধারণা করাও উচিত নয়। এ সম্পর্কে আল্লাহর বাণী: وَلَا تَقُولُوا لِمَنْ يُقْتَلُ فِي سَبِيلِ اللهِ أَمْوَاتُ، بَلْ أَحْيَاءُ وَلَكِنْ لا تَشْعُرُونَ. “আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়, তাদেরকে মৃত বলো না। প্রকৃতপক্ষে তারা জীবিত। কিন্তু তাদের জীবন সম্পর্কে তোমরা অনুভব করতে পার না” (সূরা আল-বাকারা: ১৫৪) وَلَا تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ قُتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَمْوَاتًا بَلْ أَحْيَاءٌ عِنْدَ رَبِّهِمْ يُرْزَقُونَ “আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে, তাদের মৃত মনে করো না। প্রকৃতপক্ষে তারা জীবিত। আল্লাহর নিকট থেকে তারা জীবিকা পাচ্ছে।” (সূরা আলে ইমরান: ১৬৯) . وَمَنْ “আর যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে লড়াই করে নিহত হয় কিংবা বিজয়ী হয় আমি তাকে বিরাট প্রতিদান দেবো।” (সূরা আন-নিসাঃ ৭৪) والشُّهَدَاء عِنْدَ رَبِّهِمْ لَهُمْ أَجْرُهُمْ وَنُوْرُهُمْ. “শহীদদের জন্য তাদের রবের নিকট রয়েছে তাদের প্রতিফল এবং তাদের নূর।” (সূরা আল-হাদীদঃ ১৯)
পৃষ্ঠা ৬১ থেকে ৭৫
পৃষ্ঠা:৬১
فَا الَّذِينَ هَاجَرُوا وَأَخْرِجُوا مِنْ دِيَارِهِمْ وَادُّوا فِي سَبِيلِي وَقُتَلُوا وَقُتِلُوا لَأُكَفِّرَنْ عَنْهُمْ سَيَاتِهِمْ وَلَأُدْخِلَنَّهُمْ جَنَّتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الأَنْهَارُ ، ثَوَابًا مِّنْ عِنْدِ اللَّهِ ، وَاللَّهُ عِنْدَهُ حُسْنُ الثَّوَابِ. “যারা আল্লাহর জন্য হিজরত করেছে, নিজেদের ঘরবাড়ী থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে, নির্যাতিত হয়েছে এবং আমারই পথে জিহাদ করেছে এবং নিহত (শহীদ) হয়েছে, তাদের সকল অপরাধই আমরা ক্ষমা করে দিব এবং তাদেরকে আমরা জান্নাত দান করব যার নীচ দিয়ে প্রবাহমান রয়েছে বিপুল ঝর্ণাধারা। আল্লাহর নিকট তাদের জন্য ছওয়াব রয়েছে। আর উত্তম ছওয়াব তো কেবল আল্লাহর নিকট পাওয়া যাবে।” (সূরা আলে ইমরান : ১৯৫) اتَقْتُلُونَ رَجُلًا أَنْ يَقُولَ رَبِّيَ اللَّهُ. “তোমরা কি একজন লোককে শুধু এ কারণে হত্যা করবে যে, সে বলছেঃ আল্লাহ আমার রব?” (সূরা আল-মু’মিন: ২৮) عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ (رض) أَنَّ رَسُولَ اللهِ (صلعم) قَالَ: إِنَّ فِي الْجَنَّةِ مِائَةَ دَرَجَةٍ أَعَدَّهَا اللَّهُ لِلْمُجَاهِدِيْنَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ مَا بَيْنَ الدَّرَجَتَيْنِ كمَا بَيْنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ. (بخاری)
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। রাসূল (সা) বলেছেন: বেহেশতে একশোটি উচ্চ স্তর রয়েছে, যা আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর পথে জিহাদকারীদের জন্য নির্দিষ্ট করে রেখেছেন। এর একটি থেকে আর একটির ব্যবধান আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যকার ব্যবধানের সমান। (বুখারী) খ. জান্নাতে ঘুরে বেড়াবার অধিকার: একমাত্র শহীদগণই আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ ও জান্নাতে ঘুরে বেড়াবার অধিকার পাবে। শহীদগণের আত্মা সবুজ পাখীর পেটের মধ্যে অবস্থান করবে, যারা জান্নাতের যেখানে ইচ্ছা সেখানে যেতে পারবে ও উঁচু উঁচু গাছের ফল খেয়ে বেড়াবে। عَنْ كَعْبِ بْنِ مَالِكِ (رض) أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ (صلعم) قَالَ: إِنْ أَرْوَاحَ
পৃষ্ঠা:৬২
الشُّهَدَاءِ فِي أَجْوَافَ طَيْرٍ خَضْرٍ تَعَلَّقُ مِنْ أَمْرِ الْجَنَّةِ، أَوْ شَجَرٍ الجنة. (ترمذی) হযরত কা’ব ইবনে মালেক (রা) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ শহীদগণের আত্মা এক শ্রেণীর সবুজ পাখীর পেটের মধ্যে অবস্থান করবে, যারা জান্নাতের উঁচু উঁচু গাছের ফল খেয়ে বেড়াবে। (তিরমিযী) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা) বলেছেন: যখন তোমাদের ভাইয়েরা শহীদ হয়, তখন আল্লাহ তা’য়ালা তাদের আত্মাগুলোকে এক ধরনের সবুজ পাখির পেটের ভেতরে ঢুকিয়ে দেন, যারা বেহেশতের ঝর্ণাগুলোতে ঘুরে ঘুরে তার ফলমূল খায় এবং আরশের ছায়ায় বহুসংখ্যক ঝুলন্ত প্রদীপের কাছে গিয়ে অবস্থান করে। এভাবে যখন তারা পানাহার ও ঘুমানোর স্বাদ ও আনন্দে বিভোর হয়ে যায়, তখন বলে দুনিয়ায় অবস্থানকারী আমাদের ভাইদেরকে কে জানাবে, আমরা বেহেশতে জীবিত আছি এবং খাদ্যদ্রব্য পাচ্ছি, যাতে তারা জিহাদে শৈথিল্য না দেখায় এবং যুদ্ধে কাপুরুষতা না দেখায়। আল্লাহ তা’য়ালা তাদেরকে বলেন: আমিই তাদেরকে তোমাদের পক্ষ থেকে এ খবর জানাচ্ছি। এরপরই সূরা আলে-ইমরান ১৬৯নং আয়াত নাযিল করেন: “যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে, তাদেরকে মৃত বলো না, বরং তারা জীবিত, তাদের প্রতিপালকের কাছে জীবিকা পাচ্ছে। (আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব ২য় খণ্ড: ১২৯)গ. শহীদদের জন্য রয়েছে উত্তম ঘরঃ সামুরা (রা) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: আজ রাতে (স্বপ্নে) আমি দেখতে পেলাম, দু’জন লোক আমার নিকট আসল এবং আমাকে নিয়ে গাছে উঠল। অতঃপর তারা আমাকে এমন একটি সুন্দর ও উত্তম ঘরে প্রবেশ করিয়ে দিল, যার চেয়ে সুন্দর ঘর আমি কখনও দেখিনি। অতঃপর তারা উভয়ে আমাকে বলল: এ ঘরটি হলো শহীদদের ঘর। (বুখারী) আনাস ইবনে মালেক (রা) হতে বর্ণিত। (মুতার যুদ্ধে সেনাদল পাঠানোর পর একদিন) রাসূলুল্লাহ (সা) খুতবা দিতে দিতে বললেন: যায়েদ পতাকা
পৃষ্ঠা:৬৩
ধারণ করলো, কিন্তু নিহত হল। তারপর জাফর পতাকা ধারণ করলো, সেও নিহত হল। অতঃপর আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা পতাকা ধারণ করলো, সেও নিহত হল। অবশেষে খালেদ ইবনে ওয়ালিদকে কেউ নেতা মনোনীত ছাড়াই সে পতাকা ধারণ করলো এবং বিজয় সাধন করলো। নবী করীম (সা) আরো বললেন, তারা শাহাদাতের মর্যাদা লাভ না করে এ সময় আমাদের মাঝে থাকলে তা আমাদের জন্য আনন্দদায়ক হত না। (বুখারী) ঘ. সুপারিশ করার অধিকার লাভ: কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা’য়ালা শহীদগণকে শুপারিশ করার অধিকার দিবেন। এ প্রসঙ্গে রাসূল (সা) এর হাদীস: عَنْ أَبِي الدَّرْدَاءِ (رض) قَالَ : سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ (صلعم) يَقُولُ : الشهيدُ يَشْفَعُ فِي سَبْعِينَ مِنْ أهل بيته (ابو داؤد، حبان) হযরত আবু দারদা (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা) কে বলতে শুনেছি, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: শহীদ ব্যক্তিকে তার পরিবারের সত্তর জনের জন্য সুপারিশ করার অনুমতি দেয়া হবে। (আবু দাউদ, ইবনে হাব্বান) কিয়ামতের দিন আল্লাহ যাদেরকে সুপারিশ অনুমতি দিবেন তিনি ব্যতিত কেহই সুপারিশ করতে পারবেন না। আর শহীদদের জন্য আল্লাহ তা’য়ালা নিজ পরিবারের সত্তর জনের জন্য সুপারিশ করার অনুমতি দেবেন। জিহাদের সাথে অন্যান্য ইবাদত করা: মুজাহিদগণ আল্লাহর পথে সংগ্রামের সাথে সাথে যদি অর্থ ব্যয়, নফল নামায, রোযা ও যিকর ইত্যাদি নেক কাজ ও ইবাদতে মশগুল থাকে আল্লাহ তা’য়ালা তার প্রতিটি কাজের সওয়াব সাতশত গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে দেন। عَنْ سَهْلِ بْنِ مُعَادٍ (رض) عَنْ أَبِيهِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ قَالَ رَسُوْلُ الله (صلعم) إِنَّ الصلوة والصِّيَامَ وَالذِّكْرَ يُضَاعَفُ عَلَى النُّفَقَةِ فِي سبيل بسبعمائة ضعف (ابو داؤد)
পৃষ্ঠা:৬৪
হযরত সাহল বিন মু’য়ায (রা) হতে বর্ণিত। রাসূল (সা) বলেছেন: আল্লাহর পথে ব্যয়ের সাথে সাথে যদি নামায রোযা ও যিকর করা হয়, তবে তার সওয়াব সাতশতগুণ বেড়ে যায়। (আবু দাউদ) ৪. শহীদগণকে অভ্যর্থনা জানানো হবেঃ শাহাদাতের সৌভাগ্য লাভ করার সাথে সাথেই শহীদ ব্যক্তিকে জান্নাতের সুবসংবাদ দেয়া হবে। যখনই মৃত্যুর দরজা পার হয়ে তিনি অন্য জগতে পৌঁছে যাবেন; ফিরেশতারা সেখানে তাঁকে অভ্যর্থনা জানানার জন্য উপস্থিত থাকবেন এবং এ মর্মে সুসংবাদ দিয়ে দিবেন যে, সুসজ্জিত বেহেশত তাঁর অপেক্ষায় রয়েছে। قيلَ ادْخُلِ الْجَنَّةَ، قَالَ يَلَيْتَ قَوْمِي يَعْلَمُونَ ، بِمَا غَفَرَ لِي رَبِّي وَجَعَلَنِي مِنَ الْمُكْرَمِينَ. (শহীদ হওয়ার পর তাকে) বলা হলঃ প্রবেশ কর জান্নাতে, সে বলল: হায় আমার জাতির লোকেরা যদি (আমার মর্যাদা সম্পর্কে) জানতে পারতো। আমার রব কোন জিনিসের বদৌলতে আমাকে মাগফিরাত করেছেন এবং আমাকে মর্যাদাশালী লোকদের অর্ন্তভুক্ত করেছেন। (সূরা ইয়াসিনঃ ২৬, ২৭) হযরত জাবির (রা) হতে বর্ণিত। এক ব্যক্তি বললঃ হে আল্লাহর রাসূল। যদি আমি শহীদ হয়ে যাই, তাহলে আমার স্থান কোথায়? তিনি জবাব দিলেন, তোমার স্থান হবে জান্নাতে। (এ কথা শুনে) ঐ ব্যক্তি নিজের হাতে যে খেজুর ছিল, সেগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিলেন, তারপর জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়লেন এবং শেষ পর্যন্ত শহীদ হয়ে গেলেন। (মুসলিম) বারা ইবনে আযেব (রা) থেকে বর্ণিত। নবী করীম (সা) এর নিকট এক ব্যক্তি অস্ত্র সজ্জিত হয়ে এসে বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমি প্রথমে জিহাদ করব, না ইসলাম গ্রহণ করব? জবাব দিলেন প্রথমে ইসলাম গ্রহণ কর, তারপর জিহাদ কর। লোকটি ইসলাম গ্রহণ করল তারপর জিহাদে লিপ্ত হলো এবং শহীদ হয়ে গেল। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন: এ ব্যক্তি সামান্য আমল করল কিন্তু বিপুল প্রতিদান লাভ করল। (বুখারী, মুসলিম)
পৃষ্ঠা:৬৫
হযরত উবাদা ইবনে সামেত (রা) হতে বর্ণিত। রাসূল (সা) বলেছেন: আল্লাহর কাছে শহীদের সাতটি পুরস্কার। যথাঃ ১. প্রথম বার রক্তপাত হওয়া মাত্রই তাঁর গুনাহ মাফ করা হবে; ২. তাঁকে বেহেশতের নির্ধারিত আসন দেখানো হবে এবং তাঁকে ঈমানের পোশাক পরানো হবে; ৩. তাঁকে কবর আযাব থেকে মুক্তি দেয়া হবে; ৪. কিয়ামতের আতংক থেকে নিরাপদ রাখা হবে; ৫. তাঁর মাথায় সম্মানজনক মুকুট পরানো হবে, যা সারা পৃথিবীর যাবতীয় সম্পদ থেকে মূল্যবান ইয়াকুত দ্বারা তৈরী। ৬. তাঁকে বেহেশতের বাহাত্তর জন হুরের সাথে বিয়ে দেয়া হবে। এবং ৭. তাঁর আপনজনদের থেকে সত্তর জন সম্পর্কে সুপারিশ করার সুযোগ পাবে।
আল্লাহ শহীদদের কুরবানী নিষ্ফল হতে দেন না
আল্লাহর পথে কারো নিহত হওয়ার অর্থ এই নয় যে, কেউ নিহত হলেই তার ব্যক্তিগত সব আমল বরবাদ হয়ে গেল। কেউ যদি একথা মনে করে থাকে যে, শহীদদের ত্যাগ ও কুরবানী তাদের নিজেদের জন্য কোন উপকারে আসেনি বরং যারা এ পৃথিবীতে জীবিত থাকলো তারাই কেবল মাত্র লাভবান হলো ও কল্যাণ লাভ করলো তাহলে ভুল হবে। প্রকৃত সত্য হলো যারা শাহাদাত লাভ করলো তাদের নিজেদের জন্যও এটি লোকসানের নয়, লাভের বাণিজ্য। পবিত্র কুরআনের নিম্নের আয়াত একথারই প্রমাণ বহন করে। وَالَّذِينَ قُتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَلَنْ يُضِلُّ أَعْمَالَهُمْ، سَيَهْدِيهِمْ وَيُصْلِحُ بَالَهُمْ، وَيُدْخِلُهُمُ الْجَنَّةَ عَرْفَهَا لَهُمْ. “যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় আল্লাহ কখনো তাদের আমলসমূহ বিনষ্ট করবেন না। তিনি তাদের পথ দেখাবেন এবং সুসংহত করে দেবেন। সেই জান্নাতে তাদের দাখিল করবেন, যার সম্পর্কে পূর্বে তাদের অবহিত করেছেন।” (সূরা মুহাম্মদঃ ৪-৬)
পৃষ্ঠা:৬৬
শহীদগণের কবর আযাব হয় নাঃ আল্লাহর হুকুম না মেনে দুনিয়ায় মানুষ নানা প্রকার অন্যায়-অপরাধ করে। আর এ কারণে পাপীদের কবরে নানা রকমের আযাব হবে। কিন্তু শহীদগণের বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাঁরা শহীদ হওয়ার সাথে সাথেই তাঁদের প্রভুর সান্নিধ্য লাভ করে থাকে। তাই তাঁদের কবর আযাব হয় না। عَنْ رَاشد بن سعد (رض) عَنْ رَجُلٍ مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ (صلعم) أَن رَجُلاً قَالَ : يَا رَسُولَ اللَّهِ مَا بَالُ الْمُؤْمِنِينَ يُفْتَنُونَ فِي قُبُورِهِمْ إِلَّا الشَّهِيدُ؟ قال : كفى ببارقة السيوف على رأسه فتنة. (رواه النسائي) হযরত রাশেদ বিন সা’দ (রা) থেকে বর্ণিত। এক ব্যক্তি বললোঃ হে রাসূল! মু’মিনদের কি হলো? তাদের সবারই কবরে কিছু না কিছু কষ্ট হয়। কিন্তু শহীদের কিছুই হয় না। রাসূল (সা) বললেনঃ তার মাথার ওপর যখন তরবারী ঝলসে উঠেছিল, তখন যে কষ্ট পেয়েছিল, সেটাই তার জন্য যথেষ্ট। (নাসায়ী)
নিহত ব্যক্তি তিন প্রকার
হযরত উৎঘা বিন আবু আস-সুল্লামী (রা) হতে বর্ণিত। তিনি রাসূলের সাহাবী ছিলেন। তিনি বলেন, রাসূল (সা) বলেছেন: নিহতরা তিন রকমের (১) খাঁটি ঈমানদার ব্যক্তি, যে নিজের জান ও মাল দিয়ে সংগ্রাম করে এবং সংগ্রাম করতে করতে নিহত হয়। এ ব্যক্তি হচ্ছে শহীদ। তার বক্ষকে ঈমানের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে। সে আল্লাহর জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাঁর আরশের ছায়ায় অবস্থান করবে। নবীগণ শুধু নব্যুয়তের স্তর ছাড়া আর কোন দিক দিয়েই তাঁর চেয়ে শ্রেষ্ঠ নন। (২) সে ব্যক্তি, যে নিজের গুনাহর কারণে নিজকে নিয়ে ভীষণ ভীত ও উদ্বিগ্ন। সে আল্লাহর পথে জান ও মাল দিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে নিহত হয়। তার শাহাদাত তাঁর সমস্ত গুনাহ মোচন করে দেবে। তরবারী পাপ মোচনকারী। সে যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা করবে বেহেশতে
পৃষ্ঠা:৬৭
প্রবেশ করবে। বেহেশতের আটটা ও দোযখের সাতটা দরজা। একটা অপরটার চেয়ে উত্তম। (৩) সেই মুনাফেক, যে নিজের জান-মাল দিয়ে সংগ্রাম করতে করতে নিহত হয়। সে দোজখবাসী হবে। তরবারী মুনাফেকীর বিলোপ ঘটায় না। (আহমদ, তিবরানী, ইবনে হাব্বান) প্রথমতঃ খাঁটি ঈমানদার ব্যক্তি, যারা অনায়াসে জান্নাত লাভ করবে। দ্বিতীয়তঃ গুনাহর কারণে ভীষণ ভীত ও উদ্বিগ্ন ব্যক্তি, আল্লাহর পথে সংগ্রামে লিপ্ত থাকায় তাদের গুনাহ মাফ করা হবে। এ কারণে তারাও জান্নাত লাভ করবে।। তৃতীয়তঃ মুনাফেক ব্যক্তি, এরা মুনাফেকীর কারণে জান্নাত লাভ করতে পারবে না। যদিও এরা জান-মাল দিয়ে আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে থাকুক না কেন।
শহীদ ব্যক্তিরা তিন রকমের
হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: শহীদ ব্যক্তিরা তিন রকমের। প্রথমতঃ যে ব্যক্তি নিজের জান-মাল দিয়ে আল্লাহর পথে বের হয়, কিন্তু সে লড়াই করতে চায় না। সে চায় মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে। এ পথে চেষ্টা সাধনা করতে গিয়ে যদি সে মারা যায় বা নিহত হয়, তবে তার সকল গুনাহ মাফ করা হবে, তাকে কবর আযাব থেকে পরিত্রাণ দেয়া হবে। কিয়ামতের ভয়াবহ আতংক থেকে তাকে নিরাপদ রাখা হবে, বেহেশতে অনুপম সুন্দরী হুরদের সাথে তার বিয়ে দেয়া হবে। তাকে পরম সম্মানের পোশাক পরিধান করানো হবে, তার মাথায় সম্মানজনক ও অনন্তকাল স্থায়ী মুকুট পরানো হবে। দ্বিতীয়তঃ এ শ্রেণী হলো এমন লোক, যে জান ও মাল নিয়ে একনিষ্ঠভাবে বের হয়, শত্রুকে হত্যা করতে চায়; কিন্তু নিজে নিহত হতে চায় না। সে যদি মারা যায় বা নিহত হয় তবে সে আল্লাহর তা’য়ালার সামনে হযরত ইবরাহীমের সাথে পাশাপাশি আসনে বসবে।
পৃষ্ঠা:৬৮
তৃতীয়তঃ যে ব্যক্তি নিজের জান ও মালসহ আন্তরিকতার সাথে আল্লাহর পথে বের হয়, সে হত্যাও করতে চায় এবং নিজে নিহত হতেও কোন আপত্তি নেই। সে যদি মারা যায় বা নিহত হয় তবে সে কিয়ামতের দিন নিজের তরবারী ঘাড়ে ঝুলিয়ে সবাইকে দেখাতে দেখাতে আসবে। লোকেরা ভীড় জমায়ে থাকবে। সে বলবে আমাদের জন্য জায়গা করে দাও। আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমাদের রক্ত অর্থ ব্যয় করে এসেছি। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন: আল্লাহর শপথ, তারা যদি একথা হযরত ইবরাহীম (আ)-কে অথবা অন্য কোন নবীকেও বলতো, তবে তারা পথ ছেড়ে দিতেন। কেননা, তাদের কত গুরুত্ব ও অধিকার, তা তিনি দেখবেন। অবশেষে তারা আল্লাহর আরশের নিচে আলোর মিম্বারে বসবেন। সেখানে বসে তারা কিভাবে বিচারকার্য সমাধা করা হয় তা প্রত্যক্ষ করবেন। তারা মৃত্যুর কষ্ট অনুভব করবে না, কবরে কোন আযাব ভোগ করবে না। চিৎকারের আওয়াজ শুনে তারা পেরেশান হবে না। হিসেব-নিকেশের জন্য তারা দুশ্চিন্তায় ভুগবে না। দাঁড়িপাল্লা এবং পুলসিরাত নিয়েও তারা ভাবনায় পড়বে না, তারা বিচারকার্য দেখবে। তারা যা চাবে তা পাবে; যার জন্য সুপারিশ করতে চাবে, করতে পারবে। বেহেশতে তারা যা পছন্দ করবে তা পাবে এবং বেহেশতে যেখানে তাঁরা অবস্থান করতে চাবে তা পারবে। (বাযযার, বায়হাকী) আল্লাহর পথে শাহাদাত কামনার ফযীলতঃ যে ব্যক্তি সাচ্চা দিলে শাহাদাত লাভের জন্য আশা-পোষণ করে, আর তার জীবনে কোন দিন জিহাদের পরিবেশ সৃষ্টি না হয় এবং জিহাদের ময়দানে যাওয়ার কোন প্রয়োজনীয়তা দেখা না দেয় তাহেলও সে শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করবে।
عَنْ سَهْلِ بْنِ حُنَيْفٍ (رض) أَنْ رَسُولَ اللَّهِ (صلعم) قَالَ : مَنْ سَأَلَ اللَّهَ الشَّهَادَةَ بِصِدْقٍ بَلْغَهُ اللَّهُ مَنَازِلَ الشُّهَدَاءِ، وَإِنْ مَاتَ عَلَى فِرَاشِهِ.
(مسلم، ابو داود، نساهی، ابن ماجه
পৃষ্ঠা:৬৯
হযরত সাহল বিন হুনাইফ (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আন্তরিকতার সাথে আল্লাহর কাছে শাহাদাত কামনা করবে, সে বিছানায় মৃত্যু বরণ করলেও আল্লাহ তাকে শহীদের মর্যাদা দান করবেন। (মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী ও ইবনে মাজাহ) আনাস (রা) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: যে ব্যক্তি সাচ্চা দিলে শাহাদাত লাভের জন্য দো’য়া করে, সে শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করবে। যদিও সে শহীদ না হয়ে থাকে। (মুসলিম) আল্লাহর পথে জিহাদ না করার অশুভ পরিণতিঃ যার অন্তরে জিহাদের। কোন চিন্তা-ভাবনাই থাকবে না সে মুনাফেক হয়ে মারা যাবে। আল্লাহর পথে জিহাদ না করার অশুভ পরিণতি সম্পর্কে হাদীসে বলা হয়েছে।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ (رض) قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ (صلعم) مَنْ مَاتَ وَلَمْ يَغْزُ، وَلَمْ
يُحدث به نفسه، مَاتَ عَلَى شُعْبَةٍ من النفاق (مسلم، ابو داؤد، نسائی) হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: যে ব্যক্তি ইসলামের জন্য কোন সংগ্রাম করেনি এবং সংগ্রাম করার কোন ইচ্ছাও পোষণ করেনি, এরূপ অবস্থায় মৃত্যু বরণ করল, সে মুনাফিক অবস্থায় মৃত্যু বরণ করল। (মুসলিম, আবু দাউদ, নাসাঈ)
শিক্ষা ১. সকল মুসলমানের অন্তরে শাহাদাতের তাম্না থাকা উচিত। ২. শহীদের মর্যাদা ও সম্মান অনেক বেশী। ৩. শহীদগণ শাহাদাতের মর্যাদা ও সম্মান নিজ চোখে দেখতে পাবে। ৪. শহীদগণ বার বার শাহাদাতের জন্য পুনরায় পৃথিবীতে আসার আকাঙ্খা করবে। ৫. শহীদগণ জান্নাতে উচ্চ মর্যাদা লাভ করবে।
পৃষ্ঠা:৭০
দারস-৬:ইন্ল্ফাক ফী সাবীলিল্লাহ
عن أبي هُرَيْرَةَ (رض) قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ (صلعم) قَالَ اللهُ تَعَالَى
انفق يا ابن ادم انفق عَلَيْكَ. (متفق عليه) অর্থঃ হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (সা) বলেছেন, আল্লাহ তা’য়ালা মানব সন্তানকে লক্ষ্য করে বলেনঃ তুমি খরচ কর, তোমার জন্যও খরচ করা হবে। (বুখারী ও মুসলিম)
শব্দার্থ: )عن أبي هريرة (رض : হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। قال : তিনি বলেন। )رَسُول الله (صلعم : আল্লাহর রাসূল (সা)। قال
الله تعالى : আল্লাহ তা’য়ালা বলেন। টা: তুমি খরচ কর। یا : হে ابن
ادم : আদম সন্তান। أنفق: খরচ করা হবে। عَلَيْك: তোমার উপর। ব্যাখ্যাঃ আলোচ্য হাদীসখানায় ইনফাক ফী সাবীলিল্লাহর গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহর দীনের পথে খরচ করা প্রসঙ্গে আল্লাহর কথা রাসূল (সা) বলেছেন, যাকে হাদীসে কুদসী বলে। আল্লাহ পাক মানব সন্তানকে লক্ষ্য করে বলেন: তুমি খরচ কর, তোমার জন্যও খরচ করা হবে। অর্থাৎ আল্লাহর পথে খরচ করলে তার প্রতিদান ইহকাল পরকালে পাওয়া যাবে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’য়ালা বলেনঃ
وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ خَيْرٍ يُوَفَّ إِلَيْكُمْ وَأَنْتُمْ لَا تُظْلَمُونَ “তোমরা তোমাদের সম্পদ থেকে যা কিছু খরচ করে থাক তার যথার্থ প্রতিদান তোমাদেরকে দেয়া হবে। তোমাদের উপর কোনরূপ অবিচার করা হবে না।” (সূরা আল-বাকারা: ২৭২) অপর এক আয়াতে বলা হয়েছে, “যারা আল্লাহর পথে মাল খরচ করে খোটা দেয় না এবং কষ্ট দেয় না, তাদের রবের নিকট তাদের জন্য যথার্থ
পৃষ্ঠা:৭১
প্রতিদান রয়েছে, তাদের কোন চিন্তা ও ভয়ের কারণ নাই।” (সূরা আল- বাকারা: ২৬২ আর এ প্রতিদান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বহু গুনে বাড়িয়ে দেবেন। এ প্রসঙ্গে রাসূল (সা) বলেনঃ عَنْ أَبِي يَحْيِي خَرِيْمٍ ابْنِ فَاتِكَ (رض) قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ (صلعم) منْ انْفَقَ نَفقَةٌ فِي سَبِيلِ اللهِ كُتب له سبع مائة ضعف. (ترمذی)
“হযরত আবু ইয়াহইয়া খারীম ইবনে ফাতিক (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (সা) বলেছেন: যে আল্লাহর পথে একটি জিনিস দান করলো, তার জন্যে সাত শত গুন সাওয়াব লেখা হবে। (তিরমিযী) অপর এক হাদীসে বলা হয়েছে: যে আল্লাহর পথে খরচ করে সে আল্লাহ, জান্নাত ও মানুষের নিকটতম ব্যক্তি। عن أبي هُرَيْرَةَ (رض) قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ (صلعم) النَّخِي قَرِيبٌ مِّنَ الله وَقَريبٌ مِّنَ الْجَنَّةِ قَريبٌ مِّنَ النَّاسِ بَعِيدٌ مِّنَ النَّارِ وَالْبَخِيلُ بَعِيدٌ منَ اللهِ بَعِيدٌ مِّنَ الْجَنَّةِ بَعِيدٌ مِّنَ النَّاسِ قَرِيبٌ مِّنَ النَّارِ وَالْجَاهِلُ سَنِي أَحَبُّ إِلَى اللهِ مِنْ عَابِدٍ بَخِيل. (ترمذی) “হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (সা) বলেছেন: দানকারী আল্লাহর নিকটতম, বেহেশতের নিকটতম এবং মানুষেরও নিকটতম। আর দূরে থাকে দোযখ থেকে। পক্ষান্তরে কৃপণ ব্যক্তি অবস্থান করে আল্লাহ থেকে দূরে, বেহেশত থেকে দূরে, মানুষ থেকে দূরে, দোযখের নিকটে। অবশ্যই একজন জাহেল দাতা একজন বখিল আবেদের তুলনায় আল্লাহর কাছে অধিকতর প্রিয়।” (তিরমিযী) গ্রন্থ পরিচিতি: আলোচ্য হাদীসখানা বুখারী ও মুসলিম শরীফে যৌথভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। যে হাদীস ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম (র) একই রাবী থেকে স্ব স্ব হাদীস গ্রন্থে সংকলন করেছেন তাকে মুত্তাফাকুন আলাইহি
পৃষ্ঠা:৭২
বলে। বুখারী পরিচিতি ৫নং দারসে এবং মুসলিম শরীফের গ্রন্থ পরিচিতি ১নং দারসে আলোচনা করা হয়েছে। রাবী পরিচিতি: হযরত আবু হুরায়রা (রা)-এর পরিচিতি ১নং দারসে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইনফাক শব্দের অর্থ
ইনফাক শব্দটির মূল ধাতু نفق-এর অর্থ সুড়ঙ্গ। যার এক দিক দিয়ে প্রবেশ করে অন্য আর একদিক দিয়ে বের হয়ে যায়। এ দিক দিয়ে অর্থ দাঁড়ায় মু’মিনদের জীবনে এক দিক দিয়ে বৈধ পন্থায় অর্থ আসবে অপর দিক দিয়ে বৈধ পন্থায় ব্যয় হবে। ফী সাবীলিল্লাহ অর্থ আল্লাহর পথে। ইকামতে দীনের প্রয়োজন পূরণ, এর উপায়-উপকরণ সংগ্রহ ও এ মহান কাজটি পরিচালনার জন্য সর্বাত্মক সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্যে সম্পদ খরচ করা। অতএব আল্লাহর দীনকে বিজয়ী করার জন্য যে অর্থ-সম্পদ প্রয়োজন তার জন্য একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে খরচ করাকেই ইনফাক ফী সাবীলিল্লাহ বলে।
ইনফাক ফী সাবীলিল্লাহ বলতে কি বুঝায়
ব্যাপক অর্থে নিজের ও নিজের পরিবার-পরিজনদের বৈধ প্রয়োজন পূর্ণ করা, আত্মীয়, প্রতিবেশী ও অভাবীকে সাহায্য করা, জনকল্যাণমূলক কাজে অংশ গ্রহণ করা এবং আল্লাহর কালেমা বুলন্দ করার জন্য আর্থিক ত্যাগ স্বীকার করাকে ইনফাক ফী সাবীলিল্লাহ বলা হয়। (সূরা আল-হজ্জঃ আয়াত-৩৫, তাফহীম, ঢাকা-৬৬) আল্লাহর পথে খরচ করার নির্দেশ আল্লাহর পথে খরচ করার জন্য পবিত্র কুরআনে নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ বলেনঃ يأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا انْفِقُوا مِمَّا رَزَقْنَكُمْ مِّنْ قَبْلِ أَنْ يَّاتِي يَوْمٌ لا بَيْعٌ فِيهِ وَلا خُلةٌ ولا شَفَاعَةٌ.
পৃষ্ঠা:৭৩
“হে মু’মিনগণ! তোমরা খরচ কর, আমি যা তোমাদেরকে দিয়েছি তা থেকে সেদিন আসার পূর্বেই যেদিন বেচাকেনা, কোন বন্ধুত্ব এবং কোন সুপারিশ চলবে না। (সূরা আল-বাকারাঃ ২৫৪)
আল্লাহর পথে খরচ ও জিহাদের সম্পর্ক
আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করার অর্থ হচ্ছে বিশেষত আল্লাহর দীন কায়েমের জন্য যে অর্থ প্রয়োজন সে অর্থ ব্যয় করা। আল্লাহর দীন কায়েমের প্রচেষ্টা করা যেমন ফরয; তেমনিভাবে আল্লাহর এ কাজে প্রয়োজন মোতাবেক অর্থ ব্যয় করাও ফরয। মানুষের শরীরের রক্তের সাথে দেহের সম্পর্ক যেমন জিহাদের সাথে অর্থের সম্পর্ক তেমন। গাড়ীর তৈল ছাড়া যেমন গাড়ী চলে না তেমনি অর্থ ছাড়া জিহাদ চলে না। এ কারণেই মহান আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র কুরআনে জিহাদের সাথে সাথে সম্পদ ব্যয় করার কথা উল্লেখ করেছেন। وَتُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللهِ بِأَمْوَالِكُمْ وَانْفُسِكُمْ طَ ذَالِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِنْ كُنتُمْ تَعْلَمُونَ “জিহাদ কর আল্লাহর পথে তোমাদের মাল ও জান দিয়ে। এটা তোমাদের জন্য কল্যাণকর যদি তোমরা বুঝতে পার।” (সূরা আস-সফ: ১১)
আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম
দীনের পথে খরচ করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়। এ প্রসঙ্গে কুরআনের বাণী: وَيَتَّخِذُ مَا يُنْفِقُ قُربت عِنْدَ اللهِ وَصَلَوتِ الرَّسُول. “আর যা কিছু খরচ করে, উহাকে আল্লাহর নৈকট্য লাভের এবং রাসূলের দিক হতে রহমতের দু’আ লাভের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে।” (সূরা আত-তওবা: ৯৯) আল্লাহর ভালবাসা লাভ “আল্লাহ তা’য়ালার মহব্বতে স্বীয় আত্মীয় স্বজন, ইয়াতীম-মিসকীন,
পৃষ্ঠা:৭৪
পথিক, মুসাফির ও সাহায্যপ্রার্থীদের জন্য ধন-সম্পদ দান করবে, আর মানুষের গোলামী থেকে ভৃত্যদের মুক্তির জন্য ধন-সম্পদ ব্যয় করবে।” (সূরা আল-বাকারাঃ ১৭৭)
আল্লাহর পথে খরচে লাভ
আল্লাহর পথে খরচ করলে আল্লাহ তা’য়ালা সম্পদে বরকত দান করেন এবং পরকালে তাদেরকে সফলতা দান করবেন। আল্লাহর বাণীঃ “ব্যয় করতে থাক, তোমাদের জন্য তা কল্যাণকর বৈ কিছু নয়। যারা স্বীয় আত্মাকে কৃপণতা ও সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত রেখেছে, তারাই সাফল্য লাভ করতে পারবে।” (সূরা আত-তাগাবুন: ১৬) “যারা নিজেদের ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তাদের খরচের দৃষ্টান্ত এই যেমন একটি বীজ বপন করা হল এবং তা হতে সাতটি ছড়া বের হল আর প্রত্যেকটি ছড়ায় একশতটি ‘দানা’ রয়েছে। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে বহু গুনে বৃদ্ধি করে দেন। আল্লাহ প্রশস্তকারী এবং মহাজ্ঞানী। তিনি যাকে চান তার কাজে এভাবেই প্রাচুর্য দান করেন। তিনি উদার হস্ত বটে এবং সবকিছু জানেন।” (সূরা আল-বাকারা: ২৬১) “রাসূল (সা) বলেনঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখে এবং তাঁর অঙ্গীকার সত্য জেনে আল্লাহর পথে একটি ঘোড়া নিয়োজিত রাখে, তার পরিতৃপ্তি হয়ে খাওয়া, পান করা এবং তার পায়খানা-পেশাব কিয়ামতের দিন ওজন দেয়া হবে।” (বুখারী) لَن تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ. :”তোমরা কিছুতেই কল্যাণ লাভ করতে পারবে না, যে পর্যন্ত না তোমাদের প্রিয় বস্তুগুলোকে আল্লাহর পথে ব্যয় করবে। (সূরা আলে-ইমরানঃ ৯২) আল্লাহর পথে খরচ না করার পরিণতিঃ সম্পদের প্রকৃত মালিক আল্লাহ। মানুষ সম্পদের আমানতদার। প্রকৃত মালিকের মর্জি মোতাবেক এ অর্থ ব্যয় করতে হবে। অন্যথায় কঠিন শাস্তির কথা উল্লেখ করে আল্লাহ বলেনঃ
পৃষ্ঠা:৭৫
وَالَّذِينَ يَكْبَزُونَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنْفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَبَشِّرْهُمْ بعذاب اليم. “যারা স্বর্ণ-রৌপ্য জমা করে রাখে এবং তা থেকে আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদেরকে কষ্টদায়ক শাস্তির সু-সংবাদ জানিয়ে দাও।” (সূরা আত-তওবা: ৩৪) অপর আর এক আয়াতে বলা হয়েছে: “আর যারা ধন-সম্পদ জমা করে রাখে এবং বারবার গণনা করে। সে ধারণা করে যে, এই সম্পদ তাকে চিরস্থায়ী করে রাখবে। কখনোই নয় বরং তাকে অবশ্যই হুমাযায় (জাহান্নামে) নিক্ষেপ করা হবে। (সূরা আল হুমাযা: ৪) “যারা আল্লাহ প্রদত্ত ধন-সম্পদের বেলায় কৃপণতা প্রদর্শন করে তারা যেন এ ভুলের মধ্যে নিপতিত না থাকে যে, তা তাদের জন্যে মঙ্গলজনক, বরং তা তাদের জন্যে খুবই অকল্যাণকর। যে সম্পদের বেলায় তারা কৃপণতা অবলম্বন করে, সে সম্পদ কিয়ামতের দিন তাদের গলায় পরিয়ে দেয়া হবে।” (সূরা আলে-ইমরান : ১৮) আল্লাহর রাসূল (সা) বলেনঃ “যখনই আল্লাহর বান্দারা প্রত্যুষে শয্যা ত্যাগ করে, তখনই দু’জন ফেরেশতা অবতীর্ণ হয়। তন্মধ্যে একজন বলতে থাকেন, হে আল্লাহ! তুমি দাতা ব্যক্তিকে প্রতিদান দাও। অন্যজন বলতে থাকেন, হে আল্লাহ! কৃপণ ব্যক্তিকে ধ্বংস কর। (বুখারী-মুসলিম)
শিক্ষা
১। ইকামতে দীনের জন্য অর্থ ব্যয় করা ফরয। ২। আল্লাহ দীনের পথে অর্থ ব্যয়ের পূর্ণ প্রতিদান দেবেন।
৩। আল্লাহর পথে সাধ্যমত অর্থ ব্যয় করতে হবে। ৪। আল্লাহর পথে খরচ করা আসলে খরচ নয়, এটি উত্তম বিনিয়োগ।
পৃষ্ঠা ৭৬ থেকে ৯০
পৃষ্ঠা:৭৬
দারস-৭:ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের অগ্নিপরীক্ষা
عن انس (رض) قَالَ قَالَ النبي (صلعم) إِنْ عِظَمَ الْجَزَاءِ مَعَ عِظَم الْبَلَاءِ وَإِنَّ اللَّهَ تَعَالَى إِذَا أَحَبِّ قَوْمًا إِبْتَلَهُمْ فَمَنْ رَضِيَ فَلَهُ الرِّضَى وَمَنْ سخط فَلَهُ السخط (ترمذی) অর্থ: হযরত আনাস (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (সা) বলেছেন: বিপদ ও পরীক্ষা যত কঠিন হবে তার প্রতিদানও তত মূল্যবান (এ শর্তে যে মানুষ বিপদে ধৈর্যহারা হয়ে হক পথ হতে যেন পালিয়ে না যায়)। আর আল্লাহ যখন কোন জাতিকে ভালবাসেন তখন অধিক যাচাই ও সংশোধনের জন্যে তাদেরকে বিপদ ও পরীক্ষার সম্মুখীন করেন। অতঃপর যারা আল্লাহর সিদ্ধান্তকে খুশি মনে মেনে নেয় এবং ধৈর্যধারণ করে, আল্লাহ তাদের উপর সন্তুষ্ট হন। আর এ বিপদ ও পরীক্ষায় যারা আল্লাহর উপর অসন্তুষ্ট হয় আল্লাহও তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হন। (তিরমিযী)
শব্দার্থ : عظم : মূল্যবান, الجَزَاء : প্রতিদান, مع: সাথে, البلاء পরীক্ষা, احب : অধিক ভালবাসেন, ৩৬: সম্প্রদায়, জাতি, إبتلهم: তাদেরকে পরীক্ষায় ফেলেন فمَن : যে ব্যক্তি رضی : খুশি মনে মেনে নেয়, ত্রু: তার জন্য الرضى : সন্তুষ্টি, خط: অসন্তুষ্ট হয়, المخط : অসন্তুষ্টি। ব্যাখ্যা: আলোচ্য হাদীসখানায় ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের অগ্নি পরীক্ষার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। যুগে যুগে আল্লাহর দীনের পথের পথিকদেরকে বিপদাপদ ও পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছে। ঈমানদার ব্যক্তিদের বিপদ ও পরীক্ষা যত কঠিন হয় তার প্রতিদানও তত মূল্যবান হয়। আর আল্লাহ যখন কোন জাতিকে ভালবাসেন তখন অধিক যাচাই ও
পৃষ্ঠা:৭৭
সংশোধনের জন্যে তাদেরকে বিপদ ও পরীক্ষার সম্মুখীন করেন। বিপদ দেখলেই এ কথা চিন্তা করার কোন সুযোগ নেই যে কোন ক্ষতির জন্য তাকে বিপদ দিয়েছেন। হতে পারে ঐ বিপদের মধ্যেই তার কল্যাণ নিহিত আছে। অতঃপর যারা আল্লাহর সিদ্ধান্তকে খুশি মনে মেনে নেয় এবং ধৈর্যধারণ করে, আল্লাহ তাদের উপর সন্তুষ্ট হন। আর এ বিপদ ও পরীক্ষায় যারা আল্লাহর উপর অসন্তুষ্ট হয়, আল্লাহও তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হন। যখন যারা বিপদে ধৈর্যধারণ করতে সক্ষম হয়েছে, তখন তারাই কামিয়াব হয়েছেন। يَأْتِي عَلَى النَّاسِ زَمَنُ الصَّابِرِ فِيهِمْ عَلَى دِينِهِ كَالْقَابِضِ عَلَى الْجَمْرِ মানুষের উপর এমন একটি যুগ আসবে যখন দীনদারদের জন্য দীনের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা জ্বলন্ত আঙ্গার হাতে রাখার মতো কঠিন হবে। (তিরমিযী) হযরত খাব্বাব ইবনে আরাত (রা) বলেন, একদা আমরা নবী করীম (সা) এর নিকট (আমাদের দুঃখ-দুর্দশা ও অত্যাচার-নির্যাতন সম্পর্কে) অভিযোগ করলাম। তখন তিনি তাঁর চাঁদরটিকে বালিশ বানিয়ে কাবা ঘরের ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। আমরা তাকে বললাম, আপনি কি আমাদের জন্য আল্লাহর নিকট সাহায্য চান না? আপনি কি আল্লাহর নিকট আমাদের জন্য দু’আ করেন না? তখন তিনি বললেন, (তোমাদের উপর আর কিইবা দুঃখ নির্যাতন এসেছে) তোমাদের পূর্বকার ঈমানদার লোকদের অবস্থা ছিল এই যে, তাদের কারো জন্য গর্ত খোড়া হতো এবং সে গর্তের মধ্যে তার শরীরের অর্ধাংশ পুঁতে তাকে দাঁড় করিয়ে রাখা হতো। অতঃপর করাত এনে তার মাথার উপর স্থাপন করা হতো এবং তাকে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলা হতো। কিন্তু এ অমানসিক নির্যাতন তাকে তার দীন থেকে ফিরাতে পারতো না। কারো শরীরে লোহার চিরুণী দিয়ে আঁচড়িয়ে হাড় থেকে মাংস এবং স্নায়ু তুলে ফেলা হতো। কিন্তু এতেও তাকে তার দীন থেকে ফিরাতে পারতো না। আল্লাহর শপথ, এ দীন অবশ্যই পূর্ণতা লাভ করবে। তখন যে কোন উদ্ভারোহী সানা থেকে হাযারামাউত পর্যন্ত দীর্ঘ পথ নিরাপদে সফর
পৃষ্ঠা:৭৮
করবে। এ দীর্ঘ সফরে সে আল্লাহ ছাড়া আর কাউকেও ভয় করবে না এবং মেষ পালের ব্যাপারে নেকড়ে ছাড়া অন্য কারো ভয় করবে না। কিন্তু তোমরা খুবই তাড়াহুড়া করছো। (বুখারী) গ্রন্থ পরিচিতিঃ জামে আত-তিরমিযী। আলোচ্য হাদীসখানা জগৎ বিখ্যাত অন্যতম হাদীস গ্রন্থ জামে আত- তিরমিযী থেকে চয়ন করা হয়েছে। জামে আত-তিরমিযীর বর্ণনা ৫নং দারসে আলোচনা করা হয়েছে। রাবী পরিচিতিঃ নাম: আনাস। উপনামঃ আবু হামযা, আবু উমাইয়া, আবু উমামা, আবু উমায়মা। উপাধিঃ খাদেমুর রাসূল (সা)। পিতার নামঃ মালেক। মাতার নামঃ উম্মে সুলাইম বিনতে মেলহান। বাল্যজীবন: হযরত আনাস (রা) ছোট বেলা তাঁর মাতা-পিতার সান্নিধ্যে অতিবাহিত করেন। দশ বছর বয়সে তাঁর মাতা তাকে রাসূলের খিদমতে রেখে যান। তিনি পরবর্তী দশ বছর রাসূলের খিদমত করার সুযোগ পান। এত দীর্ঘ দিন পর্যন্ত আর কারো পক্ষে রাসূল (সা)-এর খিদমত করা সম্ভব হয়নি। জিহাদে অংশগ্রহণঃ হযরত আনাস (রা) বয়সের স্বল্পতার কারণে বদর ও ওহুদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। খায়বারসহ সকল অভিযানে তিনি অংশগ্রহণ করেন এবং বীরত্বের পরিচয় দেন। ইসলামের প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর (রা)-এর সময় তিনি বাহরাইনের আমেল ও গভর্ণর নিযুক্ত হন। হযরত ওমর (রা)-এর খিলাফতকালে বসরার মুফতি নিযুক্ত হন। সেখানে তিনি জনসাধারণকে ইলমে হাদীস ও ফিক্হ শাস্ত্রের তা’লীম দিতেন।হাদীস শাস্ত্রে তাঁর অবদান ও হযরত আনাস (রা) আজীবন হাদীসের খিদমত করেছেন। আল্লামা আইনী বলেন: তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা (১২৮৬) এক হাজার দু’শ ছিয়াশি খানা। বুখারী ও মুসলিম শরীফে যৌথভাবে ১৬৮টি হাদীস উল্লেখ রয়েছে।
পৃষ্ঠা:৭৯
রাসুলের দু’আ: হযরত আনাস (রা)-এর মাতা উম্মে সুলাইম রাসূলে করীম (সা)-এর নিকট ছেলের ধন-সম্পদ, সন্তানাদি, দীর্ঘ হায়াত ও জ্ঞান- বুদ্ধির জন্য দু’আ করতে বললে তিনি দু’আ করেন। আল্লাহ তা’য়ালা এ দু’আর বরকতে তাঁকে দীর্ঘ হায়াত, বহু সম্পদের মালিক ও দু’কন্যাসহ ১০০ সন্তানের জনক করেছিলেন। ইনতিকাল: এই প্রবীনতম সাহাবী বসরায় ১১০ বছর বয়সে ইনতিকাল করেন। তিনি সমসাময়িক সময় সব চেয়ে বড় জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর থেকে ইমাম যুহরী, কাতাদা, ইসহাক প্রমুখ মনীষীগণ হাদীস বর্ণনা করেছেন। হক বাতিলের চিরন্তন দ্বন্দ্বঃ আল্লাহর বাণী ও বিধান প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রত্যেক জাতির নিকট নবী প্রেরণ করা হয়েছে। নবীগণ এসে তাদের জাতির লোকদেরকে দাওয়াত দিয়েছেন, মানুষের সৃষ্টিকর্তা, প্রভু, মালিক ও শাসক একমাত্র আল্লাহ। আসমান ও যমীনের রাজত্ব কেবল মাত্র মহান আল্লাহর। সৃষ্টির সকলেই তাঁর বিধান মেনে চলছে। হে মানব জাতি! তোমরাও তাঁরই বিধান মেনে চল। জীবনের সকল ক্ষেত্র থেকে মানুষের মনগড়া আইন পরিত্যাগ কর। যখনই নবীগণ এ দাওয়াত পেশ করেছেন তখনই কায়েমী স্বার্থবাদী চার শ্রেণীর লোকেরা এ দাওয়াতকে অস্বীকার করেছে। তারা বুঝতে পেরেছে যে, এ দাওয়াতের মধ্যে তাদের নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব, প্রভুত্ব ও সকল ক্ষমতা হারানোর আহ্বান রয়েছে। এক. শাসক শ্রেণী (তাগুত)ঃ যুগে যুগে যখনই নবী-রাসূলগণ দীনের দাওয়াত দিয়েছেন, তখনই শাসক শ্রেণী (তাগুতী শক্তি) ক্ষমতা ও প্রভুত্ব হারাবার ভয়ে নবীগণের কাজে বাধা দিয়েছে। দুই. সমাজপতি (মালা): সমাজপতিরা প্রতিষ্ঠিত শাসকের দেয়া সুযোগ সুবিধা ভোগ করত, তারা নিজেদের সুবিধা লাভের জন্য শাসকদের প্রতি ছিল অন্ধ। তারা মনে করত, যত দিন তাদের শাসক আছে ততদিন পর্যন্ত তারা আছে। তারা শাসকদের দেয়া সুযোগ-সুবিধা হারানোর ভয়ে নবীদের বিরোধিতা করত।
পৃষ্ঠা:৮০
তিন. ধনিক শ্রেণী (মুতরাফীন): অর্থনৈতিক শোষকের দল। সমাজের মানুষকে শোষণ করে নিজেরা অর্থের পাহাড় গড়ে তোলে সমাজের সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত। তারা এ সুযোগ হারাবার ভয়ে নবীদের সাথে দুশমনী করত। চার, ধর্মীয় পণ্ডিত ও পীর পুরোহিতঃ (আহবার ও রুহবার) আল্লাহর দীন সম্পর্কে মানুষের মধ্যে ছিল অজ্ঞতা। এ অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে পুরোহিতরা নিজেদের মনগড়া কিছু আচার অনুষ্ঠানকে ধর্মের নামে চালিয়ে দিয়ে পরকালের মুক্তির গ্যারান্টি দিয়ে অর্থ উপার্জনের পথকে খোলাসা করে নেয়। বিনা পুঁজিতে এ ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবার ভয়ে তারা নবীগণের বিরোধিতা ও ছলচাতুরীর আশ্রয় গ্রহণ করে। অথচ তারা নবীদেরকে সেভাবে চিনত যেভাবে তাদের নিজ সন্তানকে চিনত।
নবীদের সাথে শাসকদের দ্বন্দ্ব
হক ও বাতিলের দ্বন্দ্ব মানব সৃষ্টির প্রথম দিক থেকে চলে আসছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে। কারণ, শয়তান মানুষকে প্রতারণা করার অনুমতি লাভ করেছে শেষ দিন পর্যন্ত। হকপন্থীদের নেতৃত্ব দিয়েছেন আল্লাহর নবীগণ আর বাতিলপন্থীদের নেতৃত্ব দিয়েছে সমকালীন শাসক শ্রেণী, সমাজপতি ও ধনিক শ্রেণীর শোষকগোষ্ঠী। তাই আল্লাহর নবীদের সাথে যাদের দ্বন্দ্ব হয়েছিল, তাদের একটি তালিকা নিম্নে দেয়া হলঃ এক. হযরত নূহ (আ)-এর সাথে সমাজপতিদের সাথে সংঘর্ষ হয়েছিল। পবিত্র কুরআনে নয় জন সমাজপতির কথা উল্লেখ আছে। তারা হযরত নূহ (আ)-কে পাথর মেরে হত্যা করার ভয় দেখায়। দুই. হযরত ইব্রাহীম (আ)-এর সাথে বাদশাহ নমরুদের দ্বন্দ্ব হয়। হযরত ইব্রাহীম (আ)-কে হত্যা করার জন্য প্রজ্জ্বলিত অগ্নি কুণ্ডে নিক্ষেপ করে। তিন. হযরত সালেহ (আ)-এর সাথে কাওমে সামুদের সমাজপতিদের সংঘর্ষ হয়। চার. হযরত হুদ (আ)-এর সাথে কাওমে আ’দের সমাজপতিদের সাথে দ্বন্দ্ব ও মতবিরোধ হয়।
পৃষ্ঠা:৮১
পাঁচ. হযরত শোয়ায়েব (আ)-এর সাথে আহলে মাদায়েনের সমাজপতিদের সাথে বিরোধ হয়। ছয়. হযরত লুতের সাথে কাওমে লুতের সমাজপতিদের সাথে দ্বন্দ্ব ও মতবিরোধ হয়। সাত, হযরত মূসা (আ)-এর সাথে মিশরের বাদশাহ ফেরাউনের সংঘর্ষ ও মত বিরোধ হয়। আট, হানানী নবীর সাথে রাজা আসার দ্বন্দ্ব হয় এবং আল্লাহর নবীকে জেলখানায় পাঠায়। নয়, হযরত ইলিয়াস (আ)-এর সাথে বাদশাহ আবীয়ারের দ্বন্দ্ব হয় এবং আল্লাহর নবীকে হত্যা করার নির্দেশ দেয়। দশ, হযরত দাউদ (আ)-এর সাথে অত্যাচারী বাদশাহ জালুতের যুদ্ধ হয়। এগার, হযরত মিকাইয়া নবীর সাথে বাদশাহ আয়ু যাবেরের দ্বন্দ্ব হয় এবং নবীকে জেলে বন্দী করে। বার, হযরত যাকারিয়া (আ)-এর সাথে ইউওয়াস বাদশাহর দ্বন্দ্ব হয় ও নবীকে হত্যা করে। তের, হযরত ইয়াহইয়া (আ)-এর সাথে বাদশা হীরো দেশের দ্বন্দ্ব হয় এবং আল্লাহর নবীকে হত্যা করে। চৌদ্দ, হযরত ঈসা (আ)-এর সাথে রোমীয় শাসক পীলাতীন এর সাথে মতবিরোধ হয় এবং আল্লাহর নবীকে হত্যা করার নির্দেশ দেয়। পনের, শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর সাথে মক্কার সমাজপতি, পারাস্য ও রোমান সাম্রাজ্যের সাথে দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধ হয়। আল্লাহর নবী দশ বছরে ১১০টি যুদ্ধ করেন আল্লাহর দুশমনদের সাথে। (নবীদের রাজনীতি, পৃঃ ১৯৭) যুগে যুগে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদেরকে আল্লাহ তা’য়ালা পরীক্ষা করেছেন। আর এ সকল পরীক্ষা নিয়েছেন সে সকল মর্দে মুজাহিদদের থেকে যাদেরকে আল্লাহ তা’য়ালা তার দীন প্রতিষ্ঠার অন্দোলনের জন্য পছন্দ করেছেন। এতে তারা সফলকাম হয়েছেন জান-মাল কুরবানীর মাধ্যমে।
পৃষ্ঠা:৮২
ক. নফসের কুরবানী আল্লাহর বাণী:
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يُشْرِى نَفْسَهُ ابْتِغَاءَ مَرْضَاتِ اللَّهِ وَاللَّهُ رَءُوفٌ بِالْعِبَادِ. “অপর দিকে মানুষের মধ্যে এমন লোকও রয়েছে, যে কেবল মাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যই প্রাণ উৎসর্গ করে, বস্তুতঃ আল্লাহ এই সব বান্দাহর প্রতি খুবই অনুগ্রহশীল।” (সূরা বাকারা: ২০৭)
খ. সম্পদের কুরবানী
الَّذِينَ يُنْفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ فِي سَبِيلِ اللهِ ثُمَّ لَا يُتْبِعُونَ مَا انْفَقُوا مَنَّا وَلَا ادى لَهُمْ أَجْرُهُمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَاهُمْ يَحْزَنُونَ.
“যারা আল্লাহর পথে মাল খরচ করে, অতঃপর এ কারণে খোটা দেয় না এবং কষ্ট দেয় না, তাদের রবের নিকট তাদের জন্য যথার্থ প্রতিদান রয়েছে, তাদের কোন চিন্তা ও ভয়ের কারণ নেই।” (সূরা বাকারাঃ ২৬২)
পরীক্ষার কারণ
ক. ঈমানের দাবীতে কে সত্যবাদী
ঈমানের দাবীতে কে সত্যবাদী কে মিথ্যাবাদী তা যাচাই করার জন্য আল্লাহ তা’য়ালা পরীক্ষা করেন। আল্লাহর বাণী:
احسِبَ النَّاسُ أَنْ يُتْرَكُوا أَنْ يَقُولُوا آمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُونَ، وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللَّهُ الَّذِينَ صَدَقُوا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَذِبِينَ.
“মানুষেরা কি মনে করেছে যে, আমরা ঈমান এনেছি একথা বললেই তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে। আর তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না? অথচ আমি তাদের পূর্ববর্তীদেরকে পরীক্ষা করেছি। ঈমানের দাবীতে কারা
পৃষ্ঠা:৮৩
সত্যবাদী কারা মিথ্যাবাদী, আল্লাহ অবশ্যই তা জেনে নিবেন।” (সূরা আল-আনকাবুত : ২-৩)
খ. জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহর কাজে কে সুদৃঢ়
আল্লাহর বাণী:
وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ حَتَّى تَعْلَمَ الْمُجْهِدِينَ مِنْكُمْ وَالصَّبِرِينَ وَنَبْلُوا اخْبَارَكُمْ. “আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষার সম্মুখীন করব। যেন আমি তোমাদের অবস্থা যাচাই করতে পারি এবং তোমাদের মধ্যে মুজাহিদ ও নিজ স্থানে অবিচল কে তা জানতে পারি।” (সূরা মুহাম্মদ: ৩১) গ. আল্লাহ, রাসুল ও মুমিনদেরকে কে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেন
আল্লাহর বাণী: ام حَسِبْتُمْ أَنْ تُتْرَكُوا وَلَمَّا يَعْلَمُ اللهُ الَّذِينَ جَهَدُوا مِنْكُمْ وَلَمْ يَتَّخِذُوا مِنْ دُونِ اللَّهِ وَلَا رَسُولِهِ وَلَا الْمُؤْمِنِينَ وَلِيجَةٌ.
“তোমরা কি মনে কর, তোমাদেরকে আল্লাহ এমনি ছেড়ে দেবেন? অথচ তোমাদের মধ্যে কে জিহাদ করেছে আর আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও মুমিন লোকদের ছেড়ে অন্য কাউকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেনি, তা এখনও আল্লাহ তা’য়ালা পরীক্ষা করে দেখেনি।” (সূরা তওবা: ১৬) ঘ. আমলের দিক দিয়ে কে সর্বোত্তম “তিনি-ই মৃত্যু ও জীবন উদ্ভাবন করেছেন, যেন তোমাদেরকে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন যে, তোমাদের মধ্যে আমলের দিক দিয়ে সর্বোত্তম ব্যক্তি কে?” (সূরা মুলকঃ ২)৫. কে জিহাদকারী ও সবর অবলম্বনকারী
“তোমারা কি ভেবেছো যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে, অথচ আল্লাহ এ বিষয় এখনো দেখেননি যে, তোমাদের কারা জিহাদে আত্মনিয়োগ করে এবং সবর অবলম্বন করে।” (সূরা আলে-ইমরানঃ ১৪২)
পৃষ্ঠা:৮৪
চ. কে দুনিয়াকে প্রাধান্য দেয়, কে পরকালকে প্রাধান্য দেয় “মানুষের জন্য মনঃপুত জিনিস নারী, সন্তান, স্বর্ণ-রৌপ্যের স্তূপ, বাছাই করা ঘোড়া, গৃহপালিত পশু ও কৃষি জমি বড়ই আনন্দদায়ক ও লালসার বস্তু বানিয়ে দেয়া হয়েছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এগুলো দুনিয়ার সাময়িক ও ক্ষণস্থায়ী জীবনের সামগ্রী মাত্র। মূলতঃ ভাল আশ্রয় তো আল্লাহর নিকটই রয়েছে।” (সূরা আল-ইমরানঃ ১৪)
শিক্ষা ১। ঈমানদারগণকে আল্লাহ তা’য়ালা বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করেন। ২। বিপদ ও পরীক্ষা যত কঠিন হবে, তার প্রতিদানও তত বেশী হবে। ৩। আল্লাহ যখন কোন জাতিকে ভালবাসেন তখন অধিক পরীক্ষা করেন। ৪। অধিক সংশোধনের জন্যে আল্লাহ মানুষকে বিপদের সম্মুখীন করেন। ৫। বিপদে যারা ধৈর্যধারণ করে, আল্লাহ তাদের উপর সন্তুষ্ট হন। ৬। বিপদ ও পরীক্ষায় যারা আল্লাহর উপর অসন্তুষ্ট হয় আল্লাহও তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হন।
পৃষ্ঠা:৮৫
দারস-৮:অন্যকে অগ্রাধিকার প্রদান ও সহমর্মিতা
عنْ أَبِي سَعِيدِنِ الْخُدْرِي قَالَ بَيْنَمَا نَحْنُ فِي سَفَرٍ مَعَ النَّبِيِّ (صلعم) إِذْ جَاءَ رَجُلٌ عَلى راجلةٍ لَهُ فَجَعَل يَصْرِفُ بَصَرَهُ يَمِينَا وَشِمَالاً فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ (صلعم) مَنْ كَانَ مَعَهُ فَضْلُ ظُهْرٍ فَلْيَعُدْ بِهِ عَلَى مَنْ لا ظَهَرَ لَهُ وَمَنْ كَانَ لَهُ فَضْلُ مِنْ زَادٍ فَلْيَعُدْ بِهِ عَلَى مَنْ لَا زَادَ لَهُ فَذَكَرَ مِنْ أَصْنَافِ الْمَالَ ما ذكر حَتَّى رَأَيْنَا أَنَّهُ لا حق لا حَدٍ مِّنا في فضل (مسلم)
অর্থঃ আবু সাঈদ আল-খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমরা নবী করীম (সা)-এর সাথে এক সফরে ছিলাম। তখন একটি লোক তার সাওয়ারীতে চড়ে এসে ডানে এবং বামে তাকাতে লাগল। রাসূল (সা) বললেন: যার কাছে অতিরিক্ত সাওয়ারী রয়েছে, সে যেন তা এমন লোককে দান করে যার সাওয়ারী নেই। যার কাছে অতিরিক্ত রসদ আছে, সে যেন তা এমন লোককে দান করে যার নিকট কোন রসদ নেই। এভাবে তিনি বিভিন্ন মালের নামোল্লেখ করলেন। তাতে আমাদের মনে হলো যে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত জিনিস রাখার অধিকার আমাদের কারো নেই। (মুসলিম)
শব্দার্থ: قال : তিনি বললেন, ত: আমাদের মধ্যে, نَحْنُ : আমরা, سفر : ভ্রমণ, جاء : সে আসলো, راجلة: সাওয়ারী, فجعل সে ফিরতে লাগলো, بصره : তার দৃষ্টি يمينًا : ডানে, شمالاً : বামে, من معه : যার কাছে আছে, فضل ظهر: অতিরিক্ত সাওয়ারী, فليعد : সে যেন দিয়ে দেয়, من لا ظهر لَهُ : যার সাওয়ারী নেই, ১ঃ রসদ,
পৃষ্ঠা:৮৬
فذكر : অতঃপর তিনি উল্লেখ করলেন, مِنْ أَصْنَافِ الْمَال : বিভিন্ন ধরনের মাল, حتى رأينا : এমনকি আমাদের মনে হলো,لاحق لأحد من : আমাদের কোন অধিক নেই, في فضل : অতিরিক্ত সম্পদে। গ্রন্থ পরিচিতি: সহীহ মুসলিমের পরিচিতি ১নং দারসে উল্লেখ করা হয়েছে। রাবী পরিচিতি: নাম: সা’দ। পিতার নামঃ মালেক। মাতার নামঃ আনীসা বিনতে আবিল হারিস।। তিনি একজন আনসার সাহাবী ছিলেন। তাঁর পূর্ব পুরুষ খুদরা ইবনে আওফের নামানুসারে তাকে খুদরী নামে অভিহিত করা হয়। জন্মগ্রহণ: হিজরতের ১০ বছর পূর্বে আবু সাঈদ খুদরী (রা) আরবে জন্মগ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণ: ৬২২ খ্রিঃ তাঁর পিতা-মাতা দু’জনই ইসলাম গ্রহণ করেন। তখন তিনি ছোট ছিলেন। বাল্যকাল থেকে তিনি ইসলামী পরিবেশে গড়ে ওঠেন। জিহাদে অংশগ্রহণ: বয়স কম থাকায় ইসলামের প্রথম যুদ্ধ বদর ও দ্বিতীয় যুদ্ধ ওহুদে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। বনী মুস্তালিকের যুদ্ধ থেকে তিনি পরবর্তী ১২টি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। কোন কোন সারিয়ার তিনি দলপতি ছিলেন। তিনি ৬০ হিজরীতে আবদুল্লাহ বিন যোবায়েরের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। ৬৩ হিজরীতে তিনি ইয়াযীদ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বন্দী হন। হাদীস শাস্ত্রে তাঁর অবদানঃ তিনি ছিলেন হাফেযে কুরআন ও হাফেযে হাদীস। তিনি সবার কাছে জ্ঞানী-গুণী হিসেবে পরিচিত। ফকীহ এবং মুহাদ্দিস সুখ্যাতি। সর্বাধিক হাদীস বর্ণনাকারীদের মধ্যে তিনি অন্যতম। তার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ১১৭০টি। তন্মধ্যে বুখারী শরীফে এককভাবে ১৬টি ও মুসলিম শরীফে ৫২টি হাদীস স্থান পায়। ওহুদ যুদ্ধে তাঁর পিতা কাফেরদের হাতে শাহাদাত বরণ করলে অসহায় অবস্থায় রাসূলের নিকট
পৃষ্ঠা:৮৭
সাহায্য প্রার্থী হলে তিনি বলেনঃ “যে ধন-সম্পদ চায় আল্লাহ তাকে তা দান করেন। আর আল্লাহর নিকট যে ক্ষমা প্রত্যাশা করে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন।” (উসদুল গাবা ২য় খণ্ড ২৮৯ পৃঃ) ইনতিকাল ঃ তিনি ৭০ হিজরী জুমার দিন মদিনায় ইনতিকাল করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। জান্নাতুল বাকীতে তাঁকে সমাহিত করা হয়। ব্যাখ্যাঃ আলোচ্য হাদীসখানায় প্রয়োজনাতিরিক্ত জিনিস-পত্র অপরকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে দান করার তাকীদ করা হয়েছে। কোন এক সফরে রাসূল (সা) দেখলেন কারো কারো প্রয়োজনাতিরিক্ত সাওয়ারী ও রসদ- পত্র রয়েছে অথচ কোন কোন ব্যক্তির নিজের প্রয়োজনীয় সাওয়ারী ও রসদ-পত্র নেই। তাই তিনি সাওয়ারী ও প্রত্যেকটি রসদ-পত্রের নাম নিয়ে বললেন: অপরকে তোমাদের যার যা আছে তা দিয়ে সহযোগিতা কর। নির্দেশ মোতাবেক সাহাবাগণ তাদের সাওয়ারী ও রসদ-পত্র যাদের নাই তাদেরকে দান করলেন। সহযোগিতা ও সহমর্মিতার গুরুত্বঃ ইসলাম এমনই একটি জীবন ব্যবস্থা যেখানে সর্বক্ষেত্রে সহযোগিতা ও সহমর্মিতার তাকীদ রয়েছে। দীন প্রচার ও প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যারা ভূমিকা রাখবেন তাদেরকে একে অপরকে সাহায্য- সহযোগিতা ও সহমর্মিতার হাতকে সম্প্রসারণ করতে হবে। আমরা দেখি হিজরতের পর আনসারগণ মুহাজিরদের জন্য তাদের সব কিছু দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন। “আনসারগণ নিজেদের উপর মুহাজিরগণকে অগ্রাধিকার দিতেন। নিজেদের প্রয়োজন মিটানোর আগে তাঁেেদর প্রয়োজন মেটাতেন; যদিও নিজেরাও অভাবগ্রস্ত ও দারিদ্রদ্র্য-পীড়িত ছিলেন।” সেভাবেই প্রয়োজনীয় অর্থ-সম্পদ অন্যের সাহায্যে দান করা ও সর্বক্ষেত্রে অপরকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিৎ। ত্যাগ স্বীকার: ইসলামে ত্যাগের মর্যাদা ভোগের উপরে। ইসলাম সর্বক্ষেত্রে ত্যাগের শিক্ষা দিয়েছে। আল্লাহর বাণী: وَيُؤْثِرُونَ عَلَى أَنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ
পৃষ্ঠা:৮৮
“আর তারা নিজেদের উপর অন্যদের অগ্রাধিকার দেয়, যদিও তারা নিজেরা অভুক্ত থাকে।” (সূরা হাশবঃ ৯) “একদা এক ব্যক্তি রাসূল (সা)-এর নিকট এসে বললেন, আমি ভীষণ ক্ষুধার্ত। নবী করীম (সা) তাঁর একজন স্ত্রীর নিকট লোক পাঠালেন। তাঁর স্ত্রী বললেন, শপথ সেই সত্তার, যিনি আপনাকে সত্যসহ পাঠালেন। আমার নিকট পানি ছাড়া আর কিছুই নেই। আর এক স্ত্রীর কাছে পাঠালে তিনিও অনুরূপ জওয়াব দিলেন, এমনকি একে একে সবাই একই রকম জওয়াব দিলেন। বললেন, শপথ সেই সত্তার যিনি আপনাকে সত্যসহ পাঠিয়েছেন। আমার কাছে পানি ছাড়া আর কিছুই নেই। নবী করীম (সা) সাহাবীদের বলেন: আজ রাতে কে এই লোকের মেহমানদারি করবে? এক আনসারী বললেন, আমি হে আল্লাহর রাসূল। তিনি তাকে সাথে নিয়ে নিজের ঘরে গেলেন এবং স্ত্রীকে বললেন, রাসূল (সা)-এর মেহমানের যথাযথ খাতির-সমাদর করো। আরেক রেওয়ায়াতে আছে: আনসারী তার স্ত্রীকে বললেন, তোমার কাছে (খাবার) কিছু আছে কি? তিনি বললেন, বাচ্চাদের খাবার ছাড়া আর কিছু নেই। আনসারী বললেন, বাচ্চাদের কিছু একটা দিয়ে ভুলিয়ে রাখ এবং ওরা সন্ধ্যার খানা চাইলে ওদের ঘুম পাড়িয়ে দিয়ো। আমাদের মেহমান (ও খানা) যখন এসে যাবে, তখন বাতি নিভিয়ে দিও, আর তাকে এটাই বোঝাবে যে, আমরাও খানা খাচ্ছি। তারা সবাই বসে গেলেন। এদিকে মেহমান খানা খেলেন এবং তারা উভয়ে সারারাত উপোস কাটিয়ে দিলেন। পরদিন প্রত্যুষে তিনি নবী (সা)-এর কাছে গেলেন। তখন তিনি বললেন: এ রাতে মেহমানের সাথে তোমরা যে আচরণ করেছো, তাতে আল্লাহ সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। (বুখারী-মুসলিম)
সহমর্মিতা: সকল মানুষের প্রতি সকল কাজে সহমর্মিতা থাকা প্রয়োজন। যদি খাদ্য কম থাকে তাহলে তা ভাগাভাগি করে খাওয়া উচিত। রাসূল (সা) বলেন: “দু’জনের খাদ্য তিনজনের জন্য যথেষ্ট হতে পারে, তিনজনের খাবার চারজনের জন্য যথেষ্ট হতে পারে।” (বুখারী-মুসলিম)
পৃষ্ঠা:৮৯
অপর বর্ণনায় আছে: “একজনের খাবার দু’জনের জন্য যথেষ্ট, দু’জনের খাবার চারজনের জন্য যথেষ্ট এবং চারজনের খাবার আটজনের জন্য যথেষ্ট হতে পারে।” (মুসলিম) শিক্ষা ১। সকল ক্ষেত্রে অপরকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। ২। প্রয়োজনাতিরিক্ত জিনিস অপরকে দেয়ার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। ৩। নিজে বেশী ভোগ করে অপরকে বঞ্চিত করার অধিকার কারো নেই। ৪। প্রয়োজনে কম সম্পদ সকলে সমহারে ভোগ করতে হবে। ৫। সুখে-দুঃখে সকলকে সমান ভাগিদার হতে হবে।
পৃষ্ঠা:৯০
দারস-৯:গীবত
وعن أبي هريرة (رض) أن رسول الله (صعلم) قَالَ أَتَدْرُونَ مَا الْغَيْبَةُ قَالُوا اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ قَالَ ذِكْرُكَ أَخَاكَ بِمَا يَكْرَهُ قِيلَ أَفَرَأَيْتَ إِنْ كانَ فِي أَخِي مَا أَقُولُ قَالَ إِنْ كَانَ فِيهِ مَا تَقُولُ فَقَدِ اغْتَبْتَهُ وَإِنْ لَمْ يَكُنْ فِيهِ مَا تَقُولُ فَقَدْ بَهَتُه. (مسلم) অর্থ: হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: তোমরা জান কি? গীবত কাকে বলে। সাহাবীগণ বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। তিনি বললেন, তোমার কোন (দীনি) ভাই সম্পর্কে তোমার এমন কথা বলা, যা সে অপছন্দ করে, সেটিই গীবত। তখন তাকে জিজ্ঞেস করল, (হে আল্লাহর রাসূল) আমি যে দোষের কথা বলি, তা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে, তাও কি গীবত হবে? উত্তরে তিনি বললেন, তুমি যে দোষের কথা বল, তা তোমার ভাইয়ের মধ্যে থাকলে অবশ্যই তুমি তার গীবত করেছ। আর তুমি যা বলছ, তা যদি তার মধ্যে না থাকে, তবে তুমি তার এমন দোষের কথা বল, যা তার মধ্যে নেই; তাহলে তুমি তার উপর অপবাদ দিয়েছ। (মুসলিম)
শব্দার্থ:: وعن أبي هريرة: হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত, آن قَالَ : রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ندرون তোমরা কি জান? الغيبة : গীবত কাকে বলে, ডঃ তারা বললো (সাহাবাগণ( اللَّهُ اعْلَمُ : আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা) ভাল জানেন, ১ট: তিনি বললেন, ذكرك الحاك: তোমার কোন দীনি ভাই সম্পর্কে এমন কথা বলা, بما يكره : যা সে অপছন্দ করে, یل তাকে জিজ্ঞেস করা হলো,
পৃষ্ঠা ৯১ থেকে ১০৫
পৃষ্ঠা:৯১
افرایت : আপনার কি অভিমত إِنْ كَانَ فِي أَخِي : যদি তা আমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে, أَقُولُ : আমি যা বলি, قال: তিনি বললেন, ان فيه : যদি তার মধ্যে থাকে, مَا تَقول: যা তুমি বল, فقدِ اعْتَبْتُه: অবশ্যই তুমি তার গীবত করেছ وَإِنْ لَمْ يَكُنْ فِيْهِ مَا تَقُوْلُ : আর তুমি যা বলছ, তা যদি তার মধ্যে না থাকে, فقد بهنه: তবে তুমি তার উপর অপবাদ দিয়েছ। ব্যাখ্যা: আলোচ্য হাদীসখানায় গীবতের স্পষ্ট বর্ণনা দেয়া হয়েছে। অসাক্ষাতে কারো দোষ বর্ণনা করাকে গীবত বলে। কারও অনুপস্থিতিতে তার সম্পর্কে এমন দুর্নাম করা যা শুনলে সে মনে কষ্ট পায়। তার মধ্যে উক্ত দোষ-ত্রুটি থাকলে তা হবে গীবত। আর তার মধ্যে তা না থাকলে তা হবে ‘বুহতান’ বা অপবাদ। যা গীবতের চেয়েও মারাত্মক অপরাধ। ইসলামী শরী’য়তে গীবত হারাম এবং কবীরা গুনাহ। অপর এক হাদীসে গীবতকে যেনার চেয়ে ভয়ংকর বলা হয়েছে। গীবত তথা পরনিন্দা একটি মারাত্মক ব্যাধি, যা সামাজিক শান্তি বিনষ্ট করে এবং সম্প্রীতির বন্ধনকে ছিড়ে ফেলে। পরকালেও এর শাস্তি হবে কঠোর। রাসূল (সা) বলেন: “যখন আমাকে মি’রাজে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আমি এমন এক দল লোকের সামনে দিয়ে অতিক্রম করলাম, যাদের নখ দিয়ে নিজেদের মুখমণ্ডল ও বক্ষদেশ খামচাচ্ছিল। আমি বললাম, হে জিবরীল। এরা কারা? তিনি বলেন, এরা মানুষের গোশত খেত এবং তাদের মান-ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলত। (আবু দাউদ) গ্রন্থ পরিচিতিঃ সহীহ মুসলিমের পরিচিতি ১নং দারসে উল্লেখ করা হয়েছে। রাবী পরিচিতি: হযরত আবূ হুরায়রা (রা) পরিচিতি ১নং দারসে আলোচনা করা হয়েছে। গীবত অর্থ: গীবত আরবী শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ পরনিন্দা, পরোক্ষ নিন্দা, পরচর্চা করা, কুৎসা রটনা করা, পিছে পিছে সমালোচনা করা, অন্যের দোষত্রুটি প্রকাশ করা।
পৃষ্ঠা:৯২
শরীয়তের পরিভাষায়, গীবত বলতে বুঝায় কোন ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে তার সম্পর্কে এমন কথা বলা যা শুনলে সে তা অপছন্দ করবে।
গীবত সম্পর্কে বিভিন্ন মনীষীদের উক্তি:
গীবতের সংজ্ঞা হলো, তুমি তোমার ভাইয়ের কথা এমনভাবে বর্ণনা করলে যে, যদি সে কথা তার কানে পৌঁছে তবে সে তা অপছন্দ করবে। ইমাম রাগিব বলেন: “বিনা প্রয়োজনে কোন ব্যক্তির দোষ বর্ণনা করাই হলো গীবত। ইবনে আছির (র) বলেনঃ أنْ تَذْكُرَ الْإِنْسَانَ فِي غَيْبَةٍ بِسُوءٍ كَانَ فِيهِ. “কোন ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে তুমি তার বদনাম করলে যদিও সে ত্রুটি তার মধ্যে বিদ্যমান থাকে। الْغَيْبَةُ أَنْ تَذكر الحاكَ مِنْ وَرَائِهِ بِمَا فِيهِ مِنْ عُيُوبِ يَسْتُرُهَا أَوْ يَسُوءُ ذِكْرُهَا. “তোমার কোন ভাইয়ের পেছনে তার এমন দোষের কথা উল্লেখ করা, যা সে গোপন রেখেছে অথবা যার উল্লেখ সে অপছন্দ করে। (আল-মু’জামুল ওয়াসীত) আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী (র) বলেন: “গীবত হলো কোন ব্যক্তি অন্য কোন ব্যক্তির কথা শুনলে সে চিন্তাযুক্ত হবে, যদিও তা সত্য হয়। আর যদি তা মিথ্যা হয় সেটা হবে অপবাদ।” আল্লামা কিরমানী (র) বলেন: “গীবত হলো তুমি কোন ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে তার সম্পর্কে এমন কথা বললে যে কথা সে শুনলে তা অপছন্দ করবে, যদিও তা সত্য হয়।” গীবত ও বৃহতানের পার্থক্যঃ কোন ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে এমন দোষত্রুটি বর্ণনা করাকে গীবত বলে, যা শুনলে সে অসন্তুষ্ট হয়। আর কোন ব্যক্তির মধ্যে সে দোষ প্রকৃতপক্ষে নেই বা যে লোক কোন অপরাধ আদৌ
পৃষ্ঠা:৯৩
করেনি তা সে ব্যক্তি করেছে বলে প্রচার করা হলো “বুহতান”। গীবত ও বুহুতানের পার্থক্য প্রসঙ্গে মহানবী (সা)-এর একখানা হাদীস প্রণিধানযোগ্য: “এক ব্যক্তি রাসূল (সা)-কে জিজ্ঞেস করলেন গীবত কি? তখন রাসূল (সা) বললেন: এমনভাবে কথা বলবে, সে যদি তা শুনে তবে তা অপছন্দ করবে। লোকটি বললো ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার কথা যদি সত্য হয় তবুও কি গীবত হবে? তিনি জবাবে বললেন, তোমার কথা যদি ভিত্তিহীন হয় তাহলে তো তা ‘বুহতান’ অর্থাৎ মিথ্যা দোষারোপ হয়ে যাবে (যা গীবতের তুলনায় আরো অধিক অপরাধ)।” (মুয়াত্তা ইবনে মালেক)
গীবতের প্রকারভেদ
গীবত প্রথমতঃ তিন প্রকার। যথাঃ
১. মুসলমানের গীবতঃ
২. অমুসলিম নাগরিকের গীবত;
৩. যুদ্ধরত অমুসলিম শত্রুর গীবত।
দ্বিতীয় পর্যায়ের গীবত দু’প্রকার। যথাঃ
১. জীবিত ব্যক্তির গীবত;
২. মৃত ব্যক্তির গীবত।
উল্লেখিত প্রকারসমূহের বিস্তারিত বিবরণ নিম্নে তুলে ধরা হলো-
১. মুসলমানদের গীবত করা হারাম। যা অকাট্য দলীল দ্বারা প্রমাণিত। মহান আল্লাহ বলেন:
وَلَا يَغْتَبْ بَعْضُكُمْ بَعْضًا أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَنْ يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ
ميتا فكرهتموه.
“তোমাদের কেউ যেন কারো গীবত না করে। তোমাদের মধ্যে এমন কেউ আছে কি যে সে তার মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া পছন্দ করবে? বস্তুত তোমরা নিজেরাইতো একে ঘৃণা করো।” (সূরা আল-হুজুরাত: ১২)
পৃষ্ঠা:৯৪
রাসূল (সা) বলেনঃ “মুসলমানদের গীবত করো না এবং তাদের দোষ অনুসন্ধান করো না। কেননা, যে ব্যক্তি মুসলমানদের দোষ অনুসন্ধান করে, আল্লাহ তার দোষ অনুসন্ধান করেন, তাকে স্বগৃহেও লাঞ্ছিত করেন। (কুরতুবী) ২. অমুসলিম নাগরিকের গীবত যে সকল অমুসলিম নাগরিক ইসলামী রাষ্ট্রে যিম্মী হিসেবে বসবাস করে তাদের গীবত করাও ইসলামী শরী’য়তের দৃষ্টিতে হারাম। রাসূল (সা) বলেন: সাবধান! যে ব্যক্তি কোন যিম্মীর প্রতি অত্যাচার করবে, অথবা তাকে কষ্ট দেবে বা তার সম্মানহানী করবে বা তার কোন সম্পদ গ্রহণ করবে, কিয়ামতের কঠিন দিবসে আমি তার বিপক্ষে দণ্ডায়মান হবো।” (কিতাবুল খারাজ: ৮২) ৩. যুদ্ধরত অমুসলিম শত্রুর গীবত: কোন অমুসলিম যদি ইসলামী জাতি সত্তা তথা ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে সে ক্ষেত্রে অমুসলিম শত্রুর গীবত করা বৈধ। (তাফসীরে কাবীর) দ্বিতীয় পর্যায়ের গীবতসমূহের আলোচনাঃ ১. জীবিত ব্যক্তির গীবত জীবিত ব্যক্তির গীবত করা হারাম। পবিত্র কুরআন ও হাদীসে এ ব্যাপারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ২. মৃত ব্যক্তির গীবতঃ মৃত ব্যক্তিকে গালি দেয়া, তাদের অতীত জীবনের দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করা এবং গীবত করা সবই হারাম। মহানবী (সা) বলেন: إذا ماتَ أَحَدُكُمْ فَدَعُوهُ وَلَا تَقْعُوا فِيهِ. “তোমাদের কেউ মৃত্যু বরণ করলে তাকে ছেড়ে দাও এবং তার গীবত করো না।” (আবু দাউদ) গীবত একটি সমাজ বিধ্বংসী অপরাধ ও মানুষ সামাজিক জীব। এ কারণে মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করে। সমাজে সুখে শান্তিতে বাস করতে হলে, আমাদের মধ্যে কতিপয় ভাল গুণ থাকা একান্ত আবশ্যক। যেমন পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালবাসা, সহানুভূতি, উদারতা ইত্যাদি। গীবত,
পৃষ্ঠা:৯৫
পরনিন্দা, পরচর্চা, হিংসা-বিদ্বেষ ইত্যাদি নিন্দনীয় আচরণগুলো আমাদের সমাজ জীবনে শান্তি-শৃঙ্খলা মারাত্মকভাবে বিনষ্ট ও ধ্বংস করে। পরস্পরের মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টি করে। গীবতের ক্ষতিসমূহঃ ‘গীবত’ যেমনি সামাজিক সুখ-শান্তি বিনষ্ট করে, তেমনি গীবত দুনিয়া ও আখিরাতে গীবতকারীকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। গীবতের ক্ষতিসমূহ নিম্নে উল্লেখ করা হলো- ১. গীবতকারীর দু’আ আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না।
২. গীবতের কারণে গীবতকারীর আমলনামা থেকে সৎকাজের পরিমাণ কমে যাবে। যার গীবত করা হয় তার আমলনামায় সৎকাজের পরিমাণ বৃদ্ধি করে দেয়া হবে। ৩. গীবতের কারণে গুনাহর পরিামাণও বৃদ্ধি পাবে। মহানবী (সা) বলেনঃ “সাবধান! তোমরা গীবত থেকে দূরে থাক। কারণ গীবতের মধ্যে তিনটি বিপদ রয়েছে। (১) গীবতকারীর দু’আ কবুল হয় না। (২) তার সৎকাজ কবুল হয় না। এবং (৩) তার আমলনামায় পাপ বৃদ্ধি হতে থাকে। ৪. গীবতকারীর সৎকাজ কবুল হয় না: গীবতকারীর সৎকাজ বিনষ্ট হয়। রাসূল (সা) “বান্দার নেক আমল গীবতের দ্বারা যত দ্রুত নষ্ট হয় আগুনও তত দ্রুত শুকনা বস্তু ধ্বংস করতে পারে না।” ৫. গীবত দ্বারা ইবাদত নষ্ট হয়: রাসূল (সা) বলেনঃ “এমন চারটি জিনিস আছে যা দ্বারা অযু, নেক আমল ও রোযা নষ্ট হয়। তা হলো গীবত, চোগলখোরি, মিথ্যাচার এবং অন্য নারীর প্রতি দৃষ্টিপাত। এতে পাপাচারের শিকড়কে সজীব করে, যেভাবে পানি গাছের শিকড়কে সজীব করে। গীবত নিষিদ্ধ হওয়ার কারণঃ ইসলামী সমাজে গীবত নিষিদ্ধ। গীবত নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ নিম্নরূপঃ ১. গীবত দ্বারা পারস্পরিক সম্পর্ক ও ভালবাসা নষ্ট হয়। ২. সামাজিক জীবনে ঘৃণা, বিদ্বেষ ও শত্রুতার উন্মেষ ঘটে। ৩. এর ফলে অনেক রক্তপাত ও মারামারি সংঘটিত হয়।
পৃষ্ঠা:৯৬
৪. সমাজের শান্তি, শৃঙ্খলা ও ভারসাম্য বিনষ্ট হয়।
৫. জাতীয় ঐক্যে ফাটল ধরে।
৬. আল্লাহ তা’য়ালা অসন্তুষ্ট হন।
গীবত পরিহারের উপকারিতা: গীবত পরিহারকারী অনেক সম্মানের
অধিকারী হয়ে থাকেন। গীবত পরিহারের উপকারিতা অনেক। নিম্নে তা উল্লেখ করা গেল।
১. গীবত একটি জঘন্য পাপ। গীবত পরিহারকারী এ পাপ থেকে বেঁচে যায়।
২. গীবত করা যেনায় লিপ্ত হওয়ার চেয়েও জঘন্য অপরাধ। গীবত পরিহার করলে এ পাপ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে।
৩. গীবত করায় অযু, নেক আমল ও রোযা নষ্ট হয়। গীবত পরিহার করলে ইবাদত অটুট থাকে।
৪. গীবত করা হারাম। গীবত পরিহারকারী হারাম কাজ থেকে আত্মরক্ষা করতে পারে।
৫. গীবতকারী গীবত করার মাধ্যমে অপরকে আহত করে। তা পরিহার করলে অপরকে আহত করা থেকে নিজকে বিরত রাখতে পারে।
৬. গীবতকারী সমাজে অপমানিত হয়। গীবত পরিত্যাগকারী অপমানের হাত থেকে বেঁচে যায়।
৭. গীবতকারী তার আত্মাকে কলুষিত করে। গীবত পরিত্যাগকারী অন্তরাত্মাকে নির্মল ও পরিছন্ন রাখতে পারে।
৮. গীবতকারী পরকালে লাঞ্ছিত হবে। গীবত পরিহারকারী পরকালে সম্মানিত হবে।
৯. গীবতকারীকে সমাজে কেউ বিশ্বাস করে না। গীবত পরিহারকারীকে সমাজের সকলেই বিশ্বাস করে এবং সম্মান করে।
১০. গীবত করা কবীরা গুনাহ। গীবত পরিহারকারী কবীরা গুনাহ থেকে বেঁচে যায়।
১১. গীবতকারীকে সকলেই ঘৃণা করে। গীবত পরিত্যাগকারীকে সকলেই সম্মান করে।
পৃষ্ঠা:৯৭
গীবত পরিহার ইবাদতের চেয়ে উত্তমঃ সাহাবায়ে কেরাম (রা) নামায ও রোযার চেয়ে গীবত পরিত্যাগ করা অতি উত্তম মনে করতেন। কারণ নামায-রোযা পরিত্যাগ করলে শুধু মাত্র আল্লাহর হক নষ্ট হয়। আর গীবত করলে আল্লাহর নির্দেশ লংঘন করা হয় এবং বান্দার হকও খর্ব করা হয়। আল্লাহর হক নষ্ট করলে তাঁর নিকট অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলে তিনি ক্ষমা করবেন। কিন্তু গীবত এমন এক অপরাধ যার জন্য আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করলেও লাভ হবে না যদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ক্ষমা না করে। তাই বেশী ইবাদতকারী ও বেশী পাপকারীর চেয়ে পাপ পরিত্যাগকারী ও কম ইবাদতকারী উত্তম। কিমিয়ায়ে সা’আদাত গ্রন্থে ইমাম গাযযালী গীবত করার আটটি কারণ উল্লেখ করেছেন। প্রথম কারণঃ ক্রুদ্ধ হওয়া। মানুষ যখন কোন কারণে অপরের প্রতি ক্রুদ্ধ হয় তখন পশ্চাতে তার গীবত করে। দ্বিতীয় কারণ: অপরের মনতুষ্টি কামনায়। কোন ব্যক্তির গীবত করলে অন্য কেউ খুশি হবে এ জন্য অনেক সময় গীবত করে থাকে। তৃতীয় কারণঃ নিজের দোষ অপরের ঘাড়ে চাপানোর প্রবণতায় গীবত করে। চতুর্থ কারণ : আত্ম-প্রশংসার স্পৃহা। কোন মানুষ আত্ম-প্রশংসায় প্রবৃত্ত হয়ে যখন প্রশংসার উপযোগী কিছু খুঁজে না পায়, তখন অপরের গীবত করতে আরম্ভ করে। পঞ্চম কারণঃ ঈর্ষা। আল্লাহ তা’য়ালা যাদেরকে ধন-সম্পদ, বিদ্যা-বুদ্ধি দিয়েছেন, মানুষ তাদেরকে ভালবাসে ও সম্মান করে। কিন্তু ঈর্ষাপরায়ণ ও পরশ্রীকাতর লোকেরা তা সহ্য করতে পারে না। ফলে তাদের দোষ অন্বেষণে প্রবৃত্ত হয় এবং গীবত করে বেড়ায়। ষষ্ঠ কারণ: হাসি-বিদ্রূপ। অনেক সময় মানুষ কারো কার্যকলাপ নিয়ে হাসি-বিদ্রূপের মাধ্যমে গীবত করে থাকে। এতে উপহাসিত ব্যক্তি অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়। সপ্তম কারণ: অসাবধানতা। অনেক সময় মানুষ কোন ব্যক্তির দোষ-ত্রুটি দেখে তা সংশোধনের জন্য তার নাম উল্লেখ করে বর্ণনা দেয়। এ রকম ক্ষেত্রে অসাবধানতাবশতঃ গীবত হয়ে যায়।
পৃষ্ঠা:৯৮
অষ্টম কারণ : আত্মাভিমান। অনেক সময় পাপী ব্যক্তির পাপ কার্য দেখে ধার্মিক ব্যক্তিগণ তাকে সংশোধনের জন্য আত্মাভিমানে লোক সমাজে নাম উল্লেখ করে ফেলেন, যাতে গীবত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
গীবতকারীর করণীয়
ক. গীবতের অনিষ্ট সম্পর্কে অনুধাবন করা জরুরী। গীবত করার কারণে যার গীবত করা হয়েছে তার আমলনামায় গীবতকারীর পুণ্যসমূহ লিপিবদ্ধ করা হয়। ফলে গীবতকারীর আমলনামা পুণ্যহীন হয়ে পড়ে। খ. অপরের গীবত করার আগে নিজে সে দোষে দোষী কি না, সে সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। নিজের মধ্যে তা থাকলে অপরের দোষ খোঁজ করা অন্যায়। আর নিজের মধ্যে না থাকলে আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করবে এবং অপরের দোষ চর্চা করে নিজের পবিত্র চরিত্রকে কলঙ্কিত করবে না।
গীবতের হুকুমসমূহঃ ‘গীবত’ একটি জঘন্য পাপ। ‘গীবত’ যেমন সামাজিক সুখ-শান্তি বিনষ্টকারী, তেমনি ইসলামী শরী’য়তে গীবত করা হারাম। গীবতের হুকুম নিম্নে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো-
১. গীবতকারী যে জঘন্য পাপ করছে এ অনুভূতি জাগ্রত হওয়ার সাথে সাথেই আল্লাহর নিকট তওবা করবে।
২. তওবার পর এ ইরাদা করবে যে, সে কখনও এ হারাম কাজে লিপ্ত হবে না। ৩. এ অপরাধের যথাসাধ্য ক্ষতিপূরণ দেবে। ৪. মৃত ব্যক্তির গীবত করা হয়ে থাকলে, তার জন্য বেশী বেশী মাগফিরাতের দু’আ করা কর্তব্য। ৫. জীবিত ব্যক্তির গীবত করে থাকলে তার নিকট ক্ষমা চাওয়া কর্তব্য। (রুহুল মা’আনী) ৬. যার গীবত করা হয়েছে তার নিকট সংবাদ না পৌঁছলেও যার কাছে তা প্রকাশ করা হয়েছে, তাকে বলা জরুরী যে আমি ঐ কথা সঠিক বলি নাই। (বয়ানুল কুরআন) ৭. শিশু, উন্মদ এবং কাফের জিম্মীর গীবত করাও হারাম। হরবী কাফিরের গীবত করা মাকরূহ।
পৃষ্ঠা:৯৯
৮. কথার মাধ্যমে গীবত করা যেমন হারাম তেমনি ইশারা, ইংগিতে অভিনয় ও লেখনির মাধ্যমে গীবত করাও হারাম। (মা’আরেফুল কুরআন) ৯. কোন ব্যক্তি জ্ঞাতসারে ও সজ্ঞানে গীবত করাকে বৈধ মনে করলে সে কাফির হয়ে যাবে। ১০. জ্ঞাতসারে গীবত করাকে বৈধ মনে করলে তাযীরের আওতায় শাস্তিযোগ্য অপরাধী সাব্যস্ত হবে। ১১. শরী’য়তে গীবত শাস্তিযোগ্য অপরাধ, যা ইসলামী আদালত (তাযীরের আওতায়) অপরাধের আনুপাতিক হারে শাস্তি নিরূপণ করবেন। (ফতুয়ায়ে আলমগীরি) ১২. কোন লোকের উপর যেনার অপবাদ দিলে এবং চারজন গ্রহণযোগ্য সাক্ষী উপস্থিত করতে ব্যর্থ হলে তাকে ৮০ বেত্রাঘাত করতে হবে। ১৩. গীবতকারী চিরদিনের জন্য সাক্ষ্য দানে অযোগ্য ঘোষিত হবে।
গীবতের বৈধ ক্ষেত্রসমূহ
‘গীবত’ কেবল তখনই জায়েয, যখন (শরী’য়তের দৃষ্টিতে) যথার্থ উদ্দেশ্যে উহা করা জরুরী হয়ে দেখা দেবে এবং সে প্রয়োজন এছাড়া অন্য কোন পথ বা উপায় থাকবে না। (তাফহীমুল কুরআন, আল-হুজুরাত: টীকা-২৬) ইমাম নববী (র) বলেন: সৎ ও শরী’য়তসম্মত উদ্দেশ্য সাধন যদি গীবত ছাড়া সম্ভব না হয়, তাহলে এ ক্ষেত্রে গীবত করা জায়েয। ফিকাহবিদ ও হাদীস বিশারদগণ এ মূলনীতির ভিত্তিতে নিম্নের ছয় অবস্থায় গীবত করা জায়েয। ১. যালেমের বিরুদ্ধে মযলুমের অভিযোগ এমন ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের সামনে উত্থাপন করা যাদের যালেমকে দমন করার শক্তি ও কর্তৃত্ব এবং মযলুমের প্রতি ন্যায় বিচার করার ক্ষমতা আছে। ২. সংশোধনের উদ্দেশ্যে কোন ব্যক্তি, শ্রেণী বা গোষ্ঠির দোষ-ত্রুটি উল্লেখ এমনভাবে সব লোকের সামনে করা, যার বা যাদের দ্বারা তা দূর করানো সম্ভবপর হবে বলে মনে করা যাবে।
পৃষ্ঠা:১০০
৩. ফতোয়া পাওয়ার উদ্দেশ্যে কোন মুফতীর নিকট প্রকৃত ঘটনা বর্ণনা করা, যাতে কোন লোকের ভুল বা খারাপ কাজের প্রকৃত ত্রুটির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ৪. কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের দুষ্কৃতির ব্যাপারে জনগণকে সতর্ক করে দেওয়া, যেন তারা বা তাদের ক্ষতিকর কার্যকলাপ হতে রক্ষা পেতে পারে। যেমন হাদীসের বর্ণনাকারী, সাক্ষী ও গ্রন্থকারের ভুল-ত্রুটি প্রকাশ করা সর্বসম্মতভাবে জায়েযই নয়; বরং ওয়াজিব। ৫. যেসব লোক সমাজে ফিসক ফুজুরী-শরীয়তের সীমালংঘন ও পাপ প্রবণতার প্রচার করে বা বিদআত ও গুমরাহী প্রসার করে অথবা যে লোক জনগণকে বে-দীনী ও যুলুম অবিচারের ব্যাপকতায় নিমজ্জিত করতে নিযুক্ত রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য আওয়ায উত্থাপন করা এবং তাদের দোষ-ত্রুটির সমালোচনা করা সম্পূর্ণ জায়েয। ৬. কোন লোক যদি খারাপ উপনামে প্রখ্যাত হয়ে থাকে এমনভাবে যে, তাকে সে নামে ডাকা না হলে তাকে চিনতে পারা যায় না তবে তাকে সে উপনামে স্মরণ করা জায়েয। কিন্তু উহা তাকে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্য হতে পারবে না, নিছক পরিচিতি দানই হবে উহার উদ্দেশ্য। (তাফহীমুল কুরআন)
শিক্ষা ১. গীবত করা কবীরা গুনাহ। ২. গীবত করলে আমল নষ্ট হয়। ৩. গীবতে পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট হয়। ৪. গীবত চর্চায় সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। ৫. পরকালে গীবতকারীর কঠিন শাস্তি হবে।
পৃষ্ঠা:১০১
দারস-১০:অহংকার
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُودٍ (رض) عَن النَّبِيِّ (صلعم) قَالَ لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ كَانَ فِي قَلْبُهُ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ من كبْرِ فَقَالَ رَجُلٌ إِنَّ الرَّجُل يُحِبُّ أَنْ يَكُونَ ثَوْبُهُ حَسَنًا وَنَعْلُهُ حَسَنًا قَالَ إِنَّ اللَّهَ جَمِيلٌ يُحِبُّ الْجَمَالَ، الْكِبْرُ بَطَرُ الْحَقِّ وَغَمْطُ النَّاسِ. (مسلم)
অর্থঃ আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত। নবী করীম (সা) বলেন: যার অন্তরে অণু পরিমাণও অহংকার রয়েছে, সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। একজন বলল, কোন লোক তো চায় যে, তার কাপড়টা সুন্দর হোক, জুতাটা আকর্ষণীয় হোক (এটাও কি খারাপ)? তিনি বলেন: আল্লাহ নিজে সুন্দর। তিনি সৌন্দর্য পছন্দ করেন। অহংকার হল, গর্বভরে সত্যকে অস্বীকার করা এবং মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করা। (মুসলিম)
শব্দার্থ:عَنْ عَبْدِ اللهِ بْن مَسْعُودٍ (رض) হযরত আবদুল্লাহ ইবনেমাসউদ (রা) হতে বর্ণিত। )عن النبي (صلعم : নবী করীম (সা) হতে। لا يَدْخُلُ সে প্রবেশ করবে না। الجنة: বেহেশত। مَنْ كان: যে ব্যক্তি। فِي : মধ্যে। قلبه : তার অন্তরে। مثقال ذرة : অণু পরিমাণ। كبر : অহংকার। فقال: অতঃপর সে বলল। رَجُل: ব্যক্তি। يُحِبُّ: সে পছন্দ করে। أن يكون ثوبةً حَسَنًا : তার পোশাক হবে সৌন্দর্যমণ্ডিত। وتَعْلَهُ : এবং তার জুতো | حَسَنًا : সুন্দর : إن اللهَ جَمِيل : নিশ্চয়ই আল্লাহ সুন্দর। يُحِبُّ الْجَمَالَ: তিনি সুন্দরকে পছন্দ করেন। الكبرُ : অহংকার। بطر الحق : গর্বভরে সত্যকে পরিত্যাগ করা। وَغَمْطُ النَّاس : মানুষকে হেয় জ্ঞান করা।
পৃষ্ঠা:১০২
ব্যাখ্যা: আলোচ্য হাদীসখানায় অহংকার সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। অহংকার একটি নিকৃষ্ট স্বভাব। কারো মনের মধ্যে যদি বিন্দুমাত্র অহংকার থাকে তাহলে সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। মানুষ নিজকে অপর লোক অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ও উত্তম বলে মনে করলে মনের মধ্যে এক প্রকার আনন্দের হাওয়া বা গর্বিত ইমেজ উৎপন্ন হয়ে মনকে ফাঁপিয়ে তোলে। অতএব যে হাওয়া মনকে ফুলাতে থাকে তারই নাম অহংকার। মানুষের মনে যখন অহংকার রূপের এ হাওয়া প্রবেশ করে, তখন মানুষ নিজকে শ্রেষ্ঠ এবং তুলনামূলকভাবে অপরকে ক্ষুদ্র বলে বিবেচনা করতে আরম্ভ করে। (তাফহীম) অহংকারী ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষে মহান আল্লাহ তা’আলার সাথে প্রভুত্ব নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে থাকে। কেননা, বাস্তবিকপক্ষে প্রভুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের একমাত্র অধিকারী মহান আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ নয়। হাদীসে কুদসীতে বর্ণিত আছে: “মহান আল্লাহ বলেন, অহংকার আমার চাদর, যে অহংকার করে সে আমার চাদর ধরে টানাটানি করে।”
গ্রন্থ পরিচিতিঃ
সহীহ মুসলিমের পরিচিতি ১ নং দারসে উল্লেখ করা হয়েছে।
রাবী পরিচিতিঃ ২ নং দারসে দেখুন। অহংকার অর্থঃ তাকাবুর আরবী শব্দ। এর অর্থ-অহংকার বা আত্মাভিমান। শত্রুতাবশতঃ সত্য প্রত্যাখ্যান করা। আল-কুরআনে এর ব্যবহার: আল-কুরআনে متكبر একবচনে ৩ বার, বহুবচনে ৪ বার تكبير ১ বার اِسْتِكْبَارُ ২ বার مستكبر একবচনে ২ বার, বহুবচনে ৪ বার ব্যবহার করা হয়েছে। (আল-ওয়াসীত ২/৭৭২) অহংকারের লক্ষণ: অহংকারী ব্যক্তির মধ্যে নিম্নের লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়।
১. অহংকারী ব্যক্তি নিজের জন্য যা পছন্দ করে অপরের জন্য তা পছন্দ করতে পারে না। ২. লোকদের সাথে নম্র ব্যবহার করতে পারে না।
পৃষ্ঠা:১০৩
২. হিংসা-বিদ্বেষ পরিত্যাগ করতে পারে না। ৩. ক্রোধ দমন করতে পারে না। ৪. পর নিন্দা থেকে স্বীয় রসনাকে সংযত রাখতে পারে না। ৫. দুশ্চিন্তার মলিনতা, অশান্তির ধূলাবালি হতে হৃদয়-দর্পণ স্বচ্ছ ও পরিষ্কার রাখতে সক্ষম হয় না। ৬. নিজের কীর্তিকে অপরের চোখে বড় দেখাবার নিমিত্তে মিথ্যা ছলনা ও কপটতার প্রতারণা হতে আত্মরক্ষা করতে পারে না।
অহংকারের কারণ
প্রথম কারণ: বিদ্যা বুদ্ধিতে নিজকে শ্রেষ্ঠ মনে করা। বিদ্বান ব্যক্তি নিজেকে জ্ঞানে বিভূষিত দেখে অগাধ জ্ঞানের অধিকারী মনে করে আর অপরকে নির্বোধ ও তুচ্ছ জ্ঞান করে, ইহাই অহংকার। মহানবী (সা) বলেছেনঃ “নিজকে শ্রেষ্ঠ বলে ধারণা করাই বিদ্যানের জন্য এক মহাবিপদ।” দ্বিতীয় কারণ: ইবাদত ও পরহেযগারীতে নিজকে শ্রেষ্ঠ মনে করা; কোন কোন আবেদ ও পরহেযগার ব্যক্তি তার ইবাদত ও পরেহেযগারীর ব্যাপারে অন্যদের তুলনায় নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করেন। ইহা অহংকার। তৃতীয় কারণঃ কৌলিণ্য ও বংশ মর্যাদায় নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করা। অনেক ব্যক্তি নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ কুলীন অন্যদেরকে হীন বংশের লোক মনে করে। ইহা অহংকার। চতুর্থ কারণ : সৌন্দর্য, সুন্দর গঠন ও আকৃতিতে নিজকে বড় মনে করা। অপরের গঠন আকৃতি সুন্দর নয় বলে সমালোচনা করা। ইহা অহংকারের বহিঃপ্রকাশ। পঞ্চম কারণ: ধনে-জনে নিজকে শ্রেষ্ঠ মনে করা। অন্যদেরকে নিঃস্ব ভিক্ষুক মনে করা। ষষ্ঠ কারণঃ প্রভাব প্রতিপত্তি ও প্রভুত্বে নিজকে বড় মনে করা। অন্যদের এ বিষয়ে কোন স্থানই নেই বলে ধারণা করা।
পৃষ্ঠা:১০৪
অহংকার প্রকাশ পাওয়ার কারণ: উপরোল্লেখিত কারণে মানুষের অন্তরে অহংকার সৃষ্টি হয় এবং নিচে বর্ণিত দু’টি কারণে অন্তরে লুকায়িত অহংকার প্রকাশ পায়। প্রথমতঃ শত্রুতা ও ঈর্ষার কারণে অহংকার। দ্বিতীয়তঃ লোক চোখে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করার মানসিকতা। অহংকার প্রদর্শনে তিরস্কার ও নিষেধাজ্ঞা: গর্ব-অহংকার করা নিষেধ। মহান আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “পৃথিবীতে দম্ভভরে পদচারণা করো না। নিশ্চয় তুমি তো ভূপৃষ্ঠকে কখনই বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং উচ্চতায় তুমি কখনও পর্বতসম হতে পারবে না।” (সূরা বনী ইসরাঈল: ৩৭) অন্য আয়াতে বলা হয়েছে: وَلَا تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ كُلِّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ “অহংকারবশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং পৃথিবীতে গর্ব ভরে পদচারণা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা কোন দাম্ভিক অহংকারকারীকে পছন্দ করেন না। (সূরা লোকমান: ১৮) দাম্ভিকের চাল-চলনে, আদান-প্রদানে এবং কথা-বার্তায় বড় মানুষী প্রকাশ পায়। অহংকার ও দাম্ভিকতা প্রকাশ ঠিক যেন দাম্ভিকেরই অধিকার। যখন তার মন মগজে অহংকারী ভাবধারা কানায় কানায় ভরে যায় তখন অন্য লোকদেরও তা অনুভব করাতে সে চেষ্টা করে। আল্লাহ তা’আলা এ আয়াতের মাধ্যমে অহংকারী ও গর্বিত চরিত্রের লোকদের আচার-আচরণ ও সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকার তাকিদ করেছেন। আর এ হেদায়াতের দ্বারাই ইসলামী রাষ্ট্রের শাসক এবং সেনাপতিদের জীবনে অহংকার ও গর্বের নাম গন্ধও খুঁজে পাওয়া যায়নি। দ্বন্দ্ব-সংগ্রামের ময়দানেও তাঁদের অহংকারের লেশমাত্র চিহ্ন পরিলক্ষিত হত, এমনটি লক্ষ্য করা যায়নি। যখন বিজয়ীর বেশে কোন জনপদে, শহরে নগরে
পৃষ্ঠা:১০৫
প্রবেশ করতেন, সে সময়ও তাঁরা দাপট ও অহংকার প্রবণতা দেখিয়ে জনমনে ভীতির সঞ্চার করতে চেষ্টা করতেন না। (তাফহীম) অহংকার করার অধিকার কারো নেই: অহংকার করার অধিকার কারো নেই। যে অহংকার করবে সে-ই পথভ্রষ্ট হবে। আল্লাহ তা’আলা বলেন: “এখান থেকে নেমে যাও, এখানে থেকে অহংকার করবে তা হতে পারে না। তাই বের হয়ে যাও। তুমি অধম।” (সূরা আরাফ: ১৩) অন্য আয়াতে বলা হয়েছেঃ “আমি আমার নিদর্শনসমূহ থেকে তাদেরকে ফিরিয়ে রাখি, যারা পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে গর্ব করে। যদি তারা সমস্ত নিদর্শন প্রত্যক্ষ করে ফেলে, তবুও তা বিশ্বাস করবে না। আর যদি হেদায়াতের পথ দেখে, তবে সে পথ গ্রহণ করে না। অথচ গোমরাহীর পথ দেখলে তা গ্রহণ করে নেয়। এর কারণ, তারা আমার নিদর্শনসমূহকে মিথ্যা বলে মনে করছে এবং তা থেকে বে-খবর রয়ে গেছে।” (সূরা আ’রাফ: ১৪৬)
“আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে গৌরব গরিমা তো তাঁরই এবং তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” (সূরা জাসিয়া: ৩৭) আল্লাহ অহংকারীদের পছন্দ করেন নাঃ আল্লাহ তা’আলা অহংকারীদের ভালবাসেন না। তিনি বলেন: “নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাদের গোপন ও প্রকাশ্য যাবতীয় বিষয়ে অবগত। নিশ্চিতই তিনি অহংকারীদের পছন্দ করেন না।” (সূরা নাহল: ২৩) মহানবী (সা) বলেনঃ যে ব্যক্তি অহংকারবশতঃ স্বীয় পরিধেয় বস্ত্র মাটির উপর দিয়ে টেনে চলে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার প্রতি রহমতের দৃষ্টিতে তাকাবেন না। (বুখারী) অপর এক হাদীসে বলা হয়েছেঃ “যে ব্যক্তি নিজেকে বড় মনে করে গর্বভরে পথ চলে মহান প্রভু আল্লাহ তা’আলাকে তার উপর ক্রুদ্ধ দেখতে পাবে।” আল্লাহ তায়ালা বলেন: إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ كُلِّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ
পৃষ্ঠা ১০৬ থেকে ১২০
পৃষ্ঠা:১০৬
“নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না। (সূরা লোকমান: ১৮) মহানবী (সা) বলেন, আল্লাহ বলেছেনঃ “শ্রেষ্ঠত্ব আমার পোশাক এবং অহংকার আমার চাদর। যে এ দু’টো আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চায়, তাকে আমি জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো।” (মুসলিম) অহংকারীরা আল্লাহর বিধান মানে না: দাম্ভিক ও অহংকারী লোকেরা আল্লাহর বিধান মানে না। আল্লাহর বিধান মেনে চলাকে তারা অপমান মনে করে থাকে। আল্লাহ বলেনঃ “যারা নিজেদের নিকট সুস্পষ্ট কোন দলীল না থাকা সত্ত্বেও আল্লাহর আয়াত সম্পর্কে বিতর্ক করে, তাদের একাজ আল্লাহ ও মু’মিনদের কাছে খুবই অসন্তোষজনক। এভাবেই আল্লাহ প্রত্যেক অহংকারী স্বৈরাচারী ব্যক্তির অন্তরে মোহর এটে দেন। (সূরা মু’মিনঃ ৩৫)
অন্য আয়াতে ঘোষণা করা হয়েছেঃ “যারা কুফরী করে, তাদের বলা হবে তোমাদের কাছে কি আমার আয়াত পাঠ করা হয়নি? বস্তুত তোমরা অহংকার করছিলে এবং তোমরা ছিলে এক অপরাধী সম্প্রদায়।” (সূরা জাসিয়া: ৩১) এদের শাস্তি প্রসঙ্গে বলা হয়েছেঃ “যারা আমার আয়াত অস্বীকার করেছে এবং অহংকারবশে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তারাই জাহান্নামী, সেথায় তারা স্থায়ীভাবে থাকবে। (সূরা আ’রাফ: ৩৬)
অহংকারী আল্লাহর কিতাবকে অস্বীকার করে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “অতঃপর তুমি তাকে মিথ্যা বলেছিলে; অহংকার করেছিলে এবং কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছিলে। যারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে, কেয়ামতের দিন আপনি তাদের মুখ কাল দেখবেন। অহংকারীদের আবাসস্থল জাহান্নামে নয় কি?” (সূরা আল-যুমার: ৫৯-৬০) অহংকারীরা রাসূলগণকে অনুসরণ করে না: যুগে যুগে আগমনকারী অহংকারী ব্যক্তিরা রাসূলগণের অনুসরণ করাকে নিজের পক্ষে অপমানজনক মনে করেছিল। তারা মনে করত রাসূলতো আমাদের মতই মানুষ, আমরা
পৃষ্ঠা:১০৭
কেন অনুসরণ করবো। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন: “নিশ্চয়ই আমি মূসাকে কিতাব দিয়েছি এবং তার পরে পর্যায়ক্রমে রাসূলদের প্রেরণ করেছি, মারিয়ামের পুত্র ঈসাকে স্পষ্ট মু’জিযা দিয়েছি এবং জিবরাঈলকে দিয়ে তাঁকে শক্তিশালী করেছি। তবে যখনই কোন রাসূল এমন কিছু নিয়ে তোমাদের কাছে এসেছে যা তোমাদের মনঃপূত নয় তখনই তোমরা অহংকার করেছ এবং কতককে হত্যা করেছ।” (সূরা আল-বাকারা: ৮৭) অহংকারীগণ নিজ ধ্যান ধারণার উপর স্থির থাকে। নবীর কথা মেনে না নেয়া তাদের আর একটি বদাভ্যাস। মহানবী (সা)-কে লক্ষ্য করে মহান আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “অতঃপর তারা যদি অহংকার করে, অর্থাৎ তোমার কথা মেনে নেয়া নিজেদের জন্যে অপমান ও লাঞ্ছনাকর মনে করে, তবে যারা আপনার পালনকর্তার কাছে আছে, তারা দিন-রাত্রি তার পরিচয় পবিত্রতা ঘোষণা করে এবং তারা ক্লান্ত হয় না।” (সূরা হা-মীম সিজদাহঃ ৩৮) অহংকারীগণ আল্লাহর দাসত্ব থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখে: অহংকারী ও দাম্ভিকতা প্রদর্শনকারীগণ আল্লাহর দাসত্ব ও রাসূলের আনুগত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখে। অহংকারবশতঃ তারা তাঁর ইবাদত বর্জন করে। অথচ আল্লাহ সকলের ডাকেই সাড়া দিয়ে থাকেন। তিনি বলেন: وَقَالَ رَبُّكُمُ ادْعُونِي اسْتَجِبْ لَكُمْ إِنَّ الَّذِينَ يَسْتَكْبِرُونَ عَنْ عِبَادَتِي سَيَدْخُلُونَ جَهَنَّمَ دَاخِرِينَ. “তোমার পালনকর্তা বলেন, তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব। যারা গর্ব ও অহংকারে নিমজ্জিত হয়ে আমার ইবাদত করা থেকে বিমুখ থাকে তারা অতি সত্বরই লাঞ্ছিত হয়ে জাহান্নামে নিমজ্জিত হবে।” (সূরা আল-মু’মিন: ৬০) অহংকারীদের পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেন: قِيلَ ادْخُلُوا أَبْوَابَ جَهَنَّمَ خَلِدِينَ فِيهَا فَبِئْسَ مَثْوَى الْمُتَكَبِّرِينَ. “বলা হবে, তোমরা জাহান্নামের দরজা দিয়ে প্রবেশ কর, সেখানে চিরকাল
পৃষ্ঠা:১০৮
অবস্থানের জন্যে। কত নিকৃষ্ট অহংকারীদের আবাসস্থল।” (সূরা যুমার: ৭২) আল্লাহ তা’আলা আরও বলেন: “এটা এ কারণে যে, তোমরা দুনিয়াতে অন্যায়ভাবে আনন্দ উল্লাস করতে এবং এ কারণে যে, তোমরা ঔদ্ধত্য প্রকাশ করতে। প্রবেশ কর তোমরা জাহান্নামের দরজা দিয়ে সেখানে চিরকাল বসবাসের জন্য। (সূরা আল-মু’মিন: ৭৫-৭৬) অন্য আয়াতে বলা হয়েছেঃ “যেদিন কাফিরদেরকে জাহান্নামের কাছে উপস্থিত করা হবে সেদিন বলা হবে, তোমরা তোমাদের সুখ পার্থিব জীবনেই নিঃশেষ করেছ এবং সেগুলো ভোগ করেছ সুতরাং আজ তোমাদের অপমানকর আযাবের শাস্তি দেয়া হবে; কারণ, পৃথিবীতে তোমরা অন্যায়ভাবে অহংকার করতে এবং পাপাচার করতে।” (সূরা আহকাফ: ২০) অহংকারীদের কতিপয় অভ্যাস: অহংকারী ব্যক্তির মধ্যে কতিপয় খারাপ অভ্যাস পরিলক্ষিত হয়। সংক্ষেপে তা নিম্নে উল্লেখ করা হল: ১. অহংকারী ব্যক্তি সঙ্গী ছাড়া একাকী চলাফেরা করে না। ২. অহংকারী ব্যক্তি অপরের নিকট সম্মান পেতে চায়। ৩. অহংকারী ব্যক্তি অপরের সাথে সাক্ষাৎ করতে যায় না। ৪. সে দরিদ্র মানুষকে নিজের কাছে দাঁড়ানো পছন্দ করে না। ৫. অহংকারী ব্যক্তি নিজ হস্তে ঘরের ছোট-খাট কাজকর্ম করে না। ৬. অহংকারী ব্যক্তি নিজের প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্র বাজার থেকে নিজ হাতে বহন করে আনতে চায় না।
৭. অহংকারী ব্যক্তি মনোরম বেশ ভূষা প্রদর্শন করে বেড়ায়। অহংকারীদের পরিণামঃ “হিংসুক ব্যক্তি বেহেস্তে প্রবেশ করবে না।” আর অহংকারী ব্যক্তির পরিণতি একই। তাদের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেন : وخباب كل جبار عنيدক অহংকারী অবাধ্য লোক ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।” (সূরা ইবরাহীম: ১৫)
পৃষ্ঠা:১০৯
অন্য আয়াতে বলা হয়েছে: “এভাবে আল্লাহ তা’আলা প্রত্যেক অহংকারী ও গর্বিত লোকের অন্তরে মোহর মেরে দেন।” (সূরা মু’মিন: ৩৫) এ প্রসঙ্গে রাসূল (সা) বলেনঃ “যার অন্তরে সরিষা পরিমাণ অহংকার থাকে সে ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।” (মুসলিম)তিনি আরও বলেনঃ “অত্যাচারী ও অহংকারী স্বৈরাচারীদেরকে কিয়ামতের দিন পিপীলিকার আকারে আল্লাহ তা’আলার সম্মুখে উপস্থিত করা হবে। লোকেরা তাদেরকে পদতলে নিষ্পেষিত করবে এবং চার দিক থেকে তাদের প্রতি শুধু লাঞ্ছনা ও অপমানের ধিক্কার বর্ষিত হতে থাকবে।” (নাসাঈ, তিরমিযী)তাছাড়া সেদিন কাফিরদেরকে জাহান্নামের মধ্যে হাবহাব নামে একটি জঘন্য কূপে নিক্ষেপ করা হবে। জনৈক অহংকারকারী ব্যক্তির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি সম্পর্কে মহানবী (সা) বলেন: “কোন এক সময় এক ব্যক্তি গর্বভরে হেলে-দুলে চলছিল এবং নিজের পরিধেয় সুদৃশ্য পোশাকের প্রতি দৃষ্টিপাত করে আনন্দ অনুভব করছিল। আল্লাহ তা’আলা এ কারণে তাকে জমিনের ভিতর ধ্বসিয়ে দিলেন, আজ পর্যন্ত সে ব্যক্তি ক্রমশঃ নিম্ন দিকে ধ্বসে যাচ্ছে। সে মহা হিসাব দিবস পর্যন্ত মাটির অতল গহ্বরে দাবতেই থাকবে।” (কিমিয়ায়ে সাআ’দাত) মহানবী (সা) বলেনঃ “যে ব্যক্তির অন্তরে সামান্য পরিমাণও অহংকার থাকবে, আল্লাহ তাঁকে উল্টোমুখী করে দোযখে নিক্ষেপ করবেন।” (বায়হাকী) অহংকার দূর করার উপায়ঃ অহংকার আকারে যত ক্ষুদ্র হোক না কেন উহা জঘন্য পাপ; যা সৌভাগ্যের সকল পথ রূদ্ধ করে এবং বেহেশতের দ্বার বন্ধ করে দেয়। অতএব অহংকারের সকল বীজ অংকুরেই হৃদয় থেকে সমূলে উৎপাটন করা প্রত্যেক ঈমানদার ব্যক্তির একান্ত কর্তব্য। এ জন্য নিম্নের বিষয়গুলোর প্রতি নজর রাখা একান্ত কর্তব্য। প্রথমতঃ আল্লাহ তা’আলার শ্রেষ্ঠত্ব ও মহানত্ব সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যে,
পৃষ্ঠা:১১০
আল্লাহ ছাড়া কেউই অহংকার করার অধিকার রাখে না। অপরদিকে মানুষের সৃষ্টি রহস্য জানা। তাহলেই বুঝতে পারবে যে, মানুষকে আল্লাহ তা’আলা অধিক হীন ও নীচ পদার্থ দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, এতে অহংকার করার মত কিছু নেই। আল্লাহর বাণীঃ “কোন পদার্থ দ্বারা আল্লাহ তা’আলা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন (তা জান কি)? আল্লাহ তাকে এক বিন্দু শুক্র হতে সৃষ্টি করেছেন।” (আবাসা) অপর আয়াতে বলা হয়েছেঃ “মানুষের উপর কি এমন সময় আসেনি যখন সে উল্লেখযোগ্য কোন বস্তু ছিল না।” (সূরা দাহরঃ ১) অতএব মানুষ কোন অবস্থাতেই অহংকার করতে পারে না। দ্বিতীয়তঃ কাজে-কর্মে ও আচার-ব্যবহারে বিনয়ী হওয়া। আল্লাহর নবীগণ ছিলেন বিনয়ী স্বভাবের অধিকারী। নামায মানুষকে বিনয়ী করে তোলে। তাই নবী রাসূলের আদর্শ পথে ও আল্লাহর হুকুম পালনের মাধ্যমেই মানুষের স্বভাবের পরিবর্তন আসা সম্ভব। এতে মানুষ অহংকার ছেড়ে দিয়ে উত্তম চরিত্রের অধিকারী হতে পারে। তৃতীয়তঃ যে সকল কাজে মানুষের অহংকার প্রকাশিত হয় সে সকল কাজ পরিত্যাগ করে চলা একান্ত প্রয়োজন। উঠা-বসা, চলা-ফেরাসহ মানুষের যাবতীয় গতিবিধির মধ্যে অহংকারের ভাবধারা ফুটে উঠে। তাই সকল ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে যাতে করে অন্তরে কোনরূপ অহংকার সৃষ্টি না হয় এবং কাজ-কর্মে সে অহংকার প্রকাশ না পায়।
শিক্ষা ১। অহংকার আমলকে বিনষ্ট করে। ২। অহংকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না। ৩। আল্লাহ সৌন্দর্যকে পছন্দ করেন কিন্তু অহংকারকে ঘৃণা করেন। ৪। অহংকারী ব্যক্তি অপরকে হেয় জ্ঞান করে। অহংকার সামাজিক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে।
পৃষ্ঠা:১১১
দারস-১১:পাঁচটি বিষয়ের গুরুত্ব
عَنْ عَمْرُو بْن مَيْمُونَ الْأَوْدَى (رض) قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ (صلعم) لِرَجُل وَهُوَ يَعِظُهُ اعْتَنِمْ خَمْسًا قَبْلَ خَمْسٍ شَبَابَكَ قَبْلَ هَرَمِكَ وَصِحْتَكَ قَبْلَ سُقْمِكَ وَعِنَاكَ قَبْلَ فَقْرِكَ وَفَرَاغَكَ قَبْلَ شغلك وحياتك قبل موتك. (ترمذی) অর্থঃ হযরত আমর ইবনে মাইমুন (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেনঃ জনৈক ব্যক্তিকে উপদেশ দিতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, পাঁচটি বিষয়ের পূর্বে পাঁচটি বিষয়ের প্রতি (সময় থাকতেই) গুরুত্ব প্রদান কর-
১. বার্ধক্য আসার আগে যৌবনের; ২. রোগাক্রান্ত হওয়ার আগে স্বাস্থ্যের; ৩. দারিদ্র্য আসার আগে সচ্ছলতার; ৪. ব্যস্ত হয়ে যাবার আগে অবসর সময়ের; ৫. মৃত্যু আসার আগে জীবনের। (তিরমিযী)
শব্দার্থ : لرجل : এক ব্যক্তির জন্য। وَهُوَ : এবং তিনি, সে। يعظه : তাকে উপদেশ দিতে গিয়ে। اِعْتَنِم : গনীমাত মনে করো, মূল্যবান মনে করো।خَمْسًا: পাঁচটি বিষয়ের পূর্বে। شباك: তোমার যৌবন। قبل : পূর্বে। هريك : তোমার বার্ধক্য। وصحتك : তোমার সুস্থতা। قبل سقيك : তোমার অসুস্থতার পূর্বে। وغئاك : তোমার সচ্ছলতা। فقرك : তোমার দারিদ্র্যতা। وَفَرَاغَكَ: তোমার অবকাশ। شُغْلِك : তোমার ব্যস্ততা। حياتك : তোমার জীবনকাল। مؤتِك : তোমার মৃত্যু।
পৃষ্ঠা:১১২
হাদীসের গুরুত্ব: একজন মু’মিন বান্দার জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করার জন্য রাসূল (সা) জনৈক ব্যক্তিকে উপদেশ দিতে গিয়ে যে পাঁচটি বিষয়ের পূর্বে পাঁচটি বিষয়ের গুরুত্ব প্রদান করতে বলেছেন তা হলোঃ “বার্ধক্য আসার আগে যৌবনের; রোগাক্রান্ত হওয়ার আগে স্বাস্থ্যের; দারিদ্রদ্র্য আসার আগে সচ্ছলতার; ব্যস্ত হয়ে যাবার আগে অবসর সময়ের; মৃত্যু আসার আগে জীবনের। সত্যিকার অর্থে কোন ব্যক্তি এ বিষয়গুলোকে গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করতে পারলে এবং আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক পরিচালনা করলে তার ইহকালীন জীবনে কল্যাণ ও পরকালীন জীবনে মুক্তি সুনিশ্চিত। যারা এ বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিবে না এবং জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণে ব্যর্থ হবে তারা দ্রুততার সাথে কর্ম স্থির করতে ও তা সম্পাদন করতে পারবে না। ফলে ইহকালীন সাফল্য লাভ ও পরকালীন মুক্তি লাভ করা সম্ভব হবে না। গ্রন্থ পরিচিতি: আলোচ্য হাদীসখানা তিরমিযী শরীফ থেকে নেয়া হয়েছে। গ্রন্থ পরিচিতি ৫ নং দারসে উল্লেখ করা হয়েছে। রাবি পরিচিতিঃ এ হাদীসের রাবীর নাম আমর ইবনে মায়মুন আল- আওদায়ী (রা)। তিনি একজন প্রসিদ্ধ সাহাবী ছিলেন। রাসূল (সা) থেকে তিনি বেশ কিছু হাদীস বর্ণনা করেছেন।
ব্যাখ্যা ১। বার্ধক্যের পূর্বে যৌবনের গুরুত্বঃ হাদীসে বার্ধক্যের পূর্বে যৌবনকে গুরুত্ব দেয়ার কথা বলা হয়েছে। কেননা, যৌবনকালই হচ্ছে মানুষের কর্মশক্তির এক মাত্র উৎকৃষ্ট সময়। যৌবনে যা করা যায় বার্ধক্যে তা করা যায় না। যৌবন কালে মানুষের শক্তি-সাহস বেশী থাকে। তখন সে আল্লাহর পথে জীবন উৎসর্গ করতেও দ্বিধা করে না। আল্লাহর সকল হুকুম পালনে ও ইবাদতে ক্লান্ত হয় না। পক্ষান্তরে বার্ধক্যে ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে ইবাদতের সকল হক আদায় করে যথা নিয়মে তা পালন করা যায় না। যৌবনকালেই মানুষ সকল কিছু ভাঙ্গতে পারে ও গড়তে পারে। ইসলামের
পৃষ্ঠা:১১৩
প্রথম যুগে আল্লাহর নবীর সাথে যারা দীন কায়েমের আন্দোলনে শামিল হয়েছেন তারা অধিকাংশ ছিলেন যুবক। তারাই দীনের পতাকা নিয়ে সামনে অগ্রসর হয়েছেন বেশী। তারা পৃথিবীর দিকে দিকে ইসলামের পতাকা উড্ডীন করে ইতিহাস সৃষ্টি করে গিয়েছেন। এসবই তাদের যৌবনের ফসল। কাজেই আমাদেরকে বার্ধক্য আসার আগে যৌবনের গুরুত্ব দিতে হবে।
২। রোগাক্রান্ত হওয়ার আগে স্বাস্থ্যের: মানুষ কখন কিভাবে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়বে তা সে জানে না। মানুষ সাধারণতঃ রোগাক্রান্ত হলে তার কর্ম ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। কম রোগে স্বাস্থ্যের কমক্ষতি হয়। চিররোগে মানুষের জীবনী শক্তি হারিয়ে ফেলে। স্বাস্থ্য ভেঙ্গে যায়। দীনি আন্দোলনে সময় দান, আল্লাহর হুকুম পালন, ইবাদতে বেশী মনোযোগী হওয়া ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্যহীনদের সমস্যা দেখা দেয়। এজন্যে আল্লাহর রাসূল (সা) বলেছেন, “একজন সুস্থ মু’মিন একজন দুর্বল (রুগ্ন) মু’মিনের চেয়ে উত্তম।” কাজেই রোগাক্রান্ত হওয়ার আগে স্বাস্থ্যের যত্ন নেয়া শরীরের হক আদায় ও রোগাক্রান্ত হওয়ার আগে বেশী বেশী করে নেক কাজ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করা অপরিহার্য। ৩। দারিদ্র্য আসার আগে সচ্ছলতার: সচ্ছলতা মানুষের মনে আনন্দ দেয়, দারিদ্র্যতা মানুষের মনে কষ্ট দেয়। কিন্তু দারিদ্র্যতা ও সচ্ছলতায় কারো কোন হাত নেই। ইহা কেবল মাত্র বিশ্বনিয়ন্ত্রক মহান আল্লাহ তা’আলার হাতে। তিনি যাকে চান তাকে সচ্ছলতা দান করেন, যাকে ইচ্ছা করেন তাকে দারিদ্র্যতা দিয়ে পরীক্ষা করেন। আল্লাহর বাণীঃ إِنَّ رَبَّكَ يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَنْ يَشَاءُ وَيَقْدِرُ. “তোমার প্রতিপালক যাকে ইচ্ছা করেন তার রিযিক বাড়িয়ে দেন এবং যাকে ইচ্ছা করেন তার রিযিক সংকীর্ণ করে দেন।” (সূরা বনী ইসরাঈল: ৩০) অপর এক আয়াতে এর বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে: “বলুন, ইয়া আল্লাহ! তুমিই সার্বভৌম শক্তির অধিকারী। তুমি যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান কর এবং
পৃষ্ঠা:১১৪
যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজ্য ছিনিয়ে নাও এবং যাকে ইচ্ছা সম্মান দান কর আর যাকে ইচ্ছা অপমানে পতিত কর। তোমারই হাতে রয়েছে যাবতীয় কল্যাণ। নিশ্চয়ই তুমি সর্ববিষয়ে ক্ষমতাশীল। তুমি রাতকে দিনের ভিতর প্রবেশ করাও দিনকে রাতের ভিতরে প্রবেশ করিয়ে দাও। আর তুমিই জীবিতকে মৃতের ভেতর থেকে বের করে আন এবং মৃতকে জীবিতের ভেতর থেকে বের কর। আর তুমি যাকে ইচ্ছা বে-হিসাব রিযিক দান কর। (সূরা আলে-ইমরান: ২৬) অতএব আল্লাহ তা’আলা যাকে যখন যে অবস্থায় রাখেন তখন সে অবস্থায়ই তাঁর পথে অর্থ ব্যয় করে সচ্ছলতার শোকরিয়া আদায় করা প্রয়োজন। ৪. ব্যস্ত হয়ে যাবার আগে অবসর সময়েরঃ সকলকেই ব্যস্ত হয়ে যাবার আগে সঠিক সময়ে যথাযথ দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হওয়ার প্রতি গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। কোন কাজ পরে করব বলে ফেলে রাখা উচিত নয়। যারা বুদ্ধিমান লোক তারা সময় মতো সকল কাজ করেন। আজকের কাজ আগামী দিনের জন্য ফেলে রাখলে পরবর্তী কাজের সাথে তা বৃদ্ধি পেয়ে বোঝা সৃষ্টি করে, তখন আর সুচারুরূপে কোন কাজই করা যায় না। মানুষ যখন যে অবস্থায় থাকুক না কেন সে অবস্থাকেই কাজ করার অবসর সময় মনে করলেই এ সমস্যার সমাধান করা যাবে। অতএব এভাবেই আল্লাহর ইবাদতের ক্ষেত্রেও সময়ের গুরুত্ব দিতে হবে। বিশেষ করে দীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের ক্ষেত্রে অনেকে মনে করেন এ কাজটুকু শেষ করে অথবা অর্থ সম্পদ অর্জন করে বেশী বেশী সময় দান করব। ইহা যে নিতান্ত ভুল তাতে কোন সন্দেহ নেই। আজ বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে তাতে আল্লাহ না করুন হয়তো অনেকের ভাগ্যে সে সুযোগ নাও আসতে পারে। তাছাড়া মৃত্যুর জন্য তো সকলকেই প্রস্তুত থাকতে হবে। কখন কার মৃত্যুর ঘণ্টা বেজে উঠবে, কখনই বা কার কাছে আজরাঈল (আ) মুত্যুর পরোয়ানা নিয়ে সমপস্থিত হন, তা কেউ জানে না।
পৃষ্ঠা:১১৫
৫. মৃত্যু আসার আগে জীবনেরঃ মানুষ জন্মের পরে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যত দিন বেঁচে থাকেন সে সময়টুকুকে জীবন বলা হয়। যখন মৃত্যু আসে তখনই জীবনাবসান হয় ও দুনিয়া থেকে কবরের পথে পাড়ি জমাতে হয়। তাই দুনিয়া হল কাজের ক্ষেত্রস্বরূপ। এখানে যে যে কাজ করবেন সে তার ফল পরকালে ভোগ করবেন। কাজেই মৃত্যু আসার আগে জীবনের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করতে হবে ও পরকালের পাথেয় সংগ্রহ করে নিতে হবে, নচেৎ সে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কেননা, মৃত্যুর পরে মানুষ ভাল-মন্দ কোন কাজ করার সুযোগ পাবে না।
শিক্ষা ১। যৌবনের শক্তি-সামর্থ্য আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে ব্যয় করতে হবে। ২। সুস্থাবস্থায় আল্লাহর পথে বেশী সময় ব্যয় করতে হবে। ৩। অর্থ-সম্পদ দীনের পথে সাধ্যমত ব্যয় করতে হবে। ৪। অবসর সময়কে পরিকল্পিত উপায়ে দীনি কাজে লাগাতে হবে। ৫। মৃত্যু আসার পূর্বে পরকালের পাথেয় সংগ্রহ করতে হবে।
পৃষ্ঠা:১১৬
দারস-১২:ইসলামে নৈতিক চরিত্র
عَنْ جَابِرِ بْن عَبْدِ اللَّهِ (رض) أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ (صلعم) قَالَ إِنَّ مِنْ احبكُمْ إِلَى وَأَقْرَبِكُمْ مِنِّى مَجْلِسًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَحَاسِنُكُمْ اخْلَاقًا وَإِنَّ مِنْ ابْغَضِكُمْ إِلَى وَابْعَدِكُمْ مِنِّى يَوْمَ الْقِيَامَةِ التَّرْتَارُونَ وَالْمُتَشَدِّقُونَ وَالْمُتَفَيِّهِقُونَ قَالُوا يَارَسُوْلَ اللهِ قَدْ عَلِمْنَا التَّرْتَارِينَ وَالْمُتَشَدِّقِينَ فَمَا الْمُتَفَيهِقُونَ قَالَ الْمُتَكَبِّرُونَ (ترمذی) অর্থঃ হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) হতে বর্ণিত। রাসূল (সা) বলেছেন: তোমাদের মধ্যে আমার নিকট অধিক প্রিয় এবং কিয়ামতের দিন মর্যাদার দিক দিয়া অধিক নিকটবর্তী সেইসব লোক, যারা তোমাদের মধ্যে আখলাক ও নৈতিক চরিত্রের দিক দিয়ে উত্তম। পক্ষান্তরে তোমাদের মধ্যে আমার নিকট অধিকতর ঘৃণিত এবং কিয়ামতের দিন আমার নিকট হতে অধিক দূরে থাকবে সেইসব লোক, যারা দ্রুত কথা বলে, লম্বা লম্বা কথা বলে লোকদেরকে অস্থির করে তোলে এবং অহংকার পোষণ করে। সাহাবীগণ বললেনঃ তিন ধরনের লোকদের মধ্যে প্রথম দুই ধরনের লোক সম্পর্কে আমাদের জানা আছে, কিন্তু শেষোক্ত লোক কারা? নবী করীম (সা) বললেনঃ তারা হচ্ছে অহংকারী লোক। (তিরমিযী)
শব্দার্থ : عن جابر بن عبدِ اللهِ (رض) : )হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) হতে বর্ণিত। إن رسول الله (صلعم) قال : নিশ্চয়ই রাসূল (সা( বলেছেন: أحبكم: তোমাদের মধ্যে অধিক প্রিয়। إلى : আমার নিকট। وافريكم : তোমাদের মধ্যে মর্যাদার দিক দিয়া অধিক নিকটবর্তী। بنى আমার কাছে। مجلا : দল, সভা। يَوْمَ الْقِيَامَةِ : কিয়ামতের দিন।
পৃষ্ঠা:১১৭
أخلاقا : যারা তোমাদের মধ্যে নৈতিক চরিত্রের দিক দিয়ে উত্তম। أبغضكم إلى : তোমাদের মধ্যে আমার নিকট অধিকতর ঘৃণিত। بنى : আমার নিকট হতে অধিক দূরে থাকবে। الثزثارُونَ : যারা দ্রুত কথা বলে। وَالْمُتَشَدْقُونَ : যারা লম্বা লম্বা কথা বলে। وَالْمُتَفَيْهِقُونَ : যারা অহংকার পোষণ করে। الْمُتكبرون : অহংকারী লোক।
ব্যাখ্যাঃ নবী করীম (সা) ইসলামের যে সুমহান আদর্শ দুনিয়াবাসীর সামনে উপস্থাপন করেছেন তার মধ্যে ঈমানের পরেই সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। নৈতিক চরিত্রের উপর। দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণের উৎস হলো নৈতিক চরিত্র। উত্তম চরিত্রসম্পন্ন ব্যক্তিগণই কিয়ামতের দিন রাসূল (সা)- এর অধিক নিকটবর্তী হবেন এবং তার সাফায়াত লাভ করবেন। পক্ষান্তরে যাদের মধ্যে নৈতিক চরিত্র বিদ্যমান নেই, কথায় ও কাজে মানুষকে কষ্ট দেয়, দ্রুত কথা বলে, লম্বা লম্বা কথা বলে লোকদেরকে অস্থির করে তোলে এবং অহংকার পোষণ করে, তারা কিয়ামতের দিন রাসুল (সা)-এর নিকট সবচেয়ে ঘৃণিত বলে বিবেচিত হবে। শুধু আখেরাতেই নয় দুনিয়ায় চলার পথে আমরা দেখতে পাই, যারা অহংকারী আত্মাভিমানী তাদেরকে কেউ পছন্দ করে না। কিন্তু যাদের ব্যবহার সুন্দর ও অমায়িক সকল মানুষ তাদেরকে ভালবাসেন এবং তাদের জন্য দু’আ করেন। আল্লাহ সুবাহানাহু তা’আলা মানুষের সাথে সুন্দর কথা বলার জন্য কুরআনে নির্দেশ দিয়েছেনঃ وَقُولُوا لِلنَّاسِ حُسْنًا. “তোমরা মানুষের সাথে সুন্দর কথা বলো।” (সূরা আল বাকারা: ৮৩) মানুষের মধ্যে কারা বেশী ভাল এ সম্পর্কে রাসূলে পাক (সা) হাদীসে বলেনঃ عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍ (رض) قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ (صلعم) إِنَّ مِنْ خِيَارُكُمْ أَحْسَنُكُمْ اخْلاقا. (بخاری، مسلم) “তোমদের মধ্যে সব চেয়ে ভাল লোক হচ্ছে তারা যাদের চরিত্র তোমাদের সকলের চেয়ে উত্তম।” (বুখারী, মুসলিম)
পৃষ্ঠা:১১৮
গ্রন্থ পরিচিতি: আলোচ্য হাদীসখানা তিরমিযী শরীফ থেকে চয়ন করা হয়েছে। তিরমিযী শরীফের পরিচিতি ৫ নং দারসে উল্লেখ করা হয়েছে। রাবী পরিচিতি: জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) এর ডাক নাম: জাবির। পিতা: আবদুল্লাহ। কুনিয়াত: আবু আবদুল্লাহ। তিনি খ্যাতনামা সাহাবাদের একজন এবং আনসারদের মধ্যে অগ্রবর্তী মুসলমান ছিলেন। আকাবার প্রথম বাই’য়াতের এক বছর পূর্বেই তিনি ইসলামগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতাও একজন সাহাবী ছিলেন। তিনি বদর, উহুদ ও খন্দকের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। জাবির ইবনে আবদুল্লাহ বদরের যুদ্ধ এবং অন্যান্য জিহাদে নবী করীম (সা)-এর সাথে যোগদান করেন। তিনি প্রায় আঠারটি জিহাদে যোগদান করেছেন। তিনি “সিরিয়া” ও “মিসরে” গমন করেছেন। তাঁর জীবনের শেষভাগে দৃষ্টিশক্তি লোপ পেয়েছিল। ওফাত : হযরত জাবির (রা) ৭৪ হিজরীতে মদীনায় ইনতিকাল করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর। তাঁর তিরোধানের সময় আবদুল মালেক বিন মারওয়ান মদীনার মসনদে আসীন ছিলেন। এক বর্ণনানুসারে যে সকল সাহাবী মদীনায় ইনতিকাল করেছেন তাঁদের মধ্যে তিনিই ছিলেন শেষ সাহাবী। রেওয়ায়েত: সাহাবীদের মধ্যে যাঁরা অধিক সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করেছেন তিনি ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে ১৫৪০ খানি হাদীস রেওয়ায়েত করেন। যৌথভাবে বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে ৬০টি। এককভাবে বুখারী শরীফে বর্ণিত আছে ২৬টি এবং মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে ১২৬টি।
আখলাক অর্থ হাদীসে উত্তম চরিত্র বুঝানোর জন্য আখলাক শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে আখলাক শব্দটি আরবী। خلاق। শব্দটি لُق শব্দের বহু বচন। এর অর্থ স্বভাব, চরিত্র, আচরণ, ব্যবহার ইত্যাদি। আখলাক )خلاق(: সাধারণতঃ দু’প্রকার। যথাঃ )১( اخلاق حميدة )আখলাকে হামীদাহ): প্রশংসনীয় চরিত্র।
পৃষ্ঠা:১১৯
)২( اخلاق ذميمة )আখলাকে যামীমাহ)ঃ নিন্দনীয় চরিত্র।)১) আখলাকে হামীদাহ )اخلاق حميدة বা প্রশংসনীয় চরিত্র: ইসলাম যে সকল মহৎ গুণাবলী অর্জনের জন্য মানুষকে আহ্বান করেছে, সেগুলোই اخلاق حميدة আখলাকে হামীদাহ বা উত্তম চরিত্র। এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আল্লাহভীতি, সত্যবাদিতা, আল্লাহর যিকির, ধৈর্য, শোকর, আদল (ন্যায়পরায়ণতা), ইহসান, ক্ষমা, তাদাববুর (গভীর মনোযোগ), তাহাদুল (সহিষ্ণুতা) ইত্যাদি উৎকৃষ্ট সৎগুণাবলী। )২) আখলাকে যামীমাহ )اخلاق ذميمة বা নিন্দনীয় চরিত্র: যে সকল অসৎ গুণ মানুষকে হীন, নীচ, ইতর ও নিন্দনীয় করে তোলে তাকে আখলাকে যামীমাহ বলে। পরনিন্দা, ফিস্ক, পাপাচার, খিয়ানত, নিফাক, মিথ্যাচার ইত্যাদি হলো আখলাকে যামীমার বৈশিষ্ট্য। ইসলাম এ সকল অসৎ গুণাবলীর বর্জনের নির্দেশ দিয়েছে।
নৈতিক চরিত্রের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
ইসলামী শিক্ষার অন্যতম বুনিয়াদী শিক্ষা হলো মানুষের নৈতিক চরিত্র সংশোধন ও পরিমার্জন। এ মহান কাজের পরিপূর্ণতা বিধানের উদ্দেশ্যেই মহানবী (সা)-কে পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মহানবী (সা) বলেছেন: وَانْمَا بُعِثْتُ لا تِم مَكَارِمِ الأَخْلاقِ.:মহান নৈতিক গুণাবলী পরিপূর্ণ করার উদ্দেশ্যেই আমি প্রেরিত হয়েছি (বুখারী, হাকিম, বাইহাকী)বস্তুত নৈতিক চরিত্র হলো মানুষের সবচেয়ে উন্নত গুণ ও বৈশিষ্ট্য। মানব জাতির পার্থিব জীবনের যাবতীয় সুখ-শান্তি এবং নিরাপত্তা যেমন নৈতিকতার উপর নির্ভরশীল তেমনি পারলৌকিক শান্তি, নিরাপত্তা ও মুক্তি এর উপর নির্ভর করে। যে জাতির চরিত্র নেই, সে জাতির কিছুই নেই। সে জাতি দুনিয়ায় বেশী দিন টিকে থাকতে পারে না। ইসলাম নৈতিকতার যে রূপরেখা পেশ করেছে, তা বিশ্বের যে কোন জাতি বা সমাজের জন্যই একটি উত্তম আদর্শ।
পৃষ্ঠা:১২০
নৈতিক চরিত্রের গুণাবলীর গুরুত্ব
নৈতিক চরিত্রের গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিম্নে তুলে ধরা হলো: (১) মহান আল্লাহর সন্তুষ্টিঃ নৈতিক চরিত্রের উৎস হলো কুরআন ও হাদীস। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মোমেনদেরকে ডেকে বলছেন: صيغة اللَّهِ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ صِبْغَةً. “তোমরা আল্লাহর গুণ ও বৈশিষ্ট্যে গুণান্বিত হও। আল্লাহর চেয়ে উত্তম গুণের অধিকারী আর কে আছে?” (সূরা আল-বাকারাঃ ১৩৮) আল্লাহর গুণ-বৈশিষ্ট্য অর্জনের জীবন্ত দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন রাসূল পাক (সা)। কারণ স্বয়ং আল্লাহ ছিলেন রাসূলের শিক্ষক। সুদীর্ঘ ২৩ বছরে আল-কুরআন নাযিল করে আল্লাহ তাঁর রাসূলকে নৈতিক চরিত্রের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তাই বলা হয়েছে : إنَّكَ لَعَلى خُلق عظیم “নিশ্চয়ই রাসূল (সা)-এর মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ।” এ চরিত্র অর্জনের মধ্যেই রয়েছে আল্লাহর সন্তুষ্টি। এ প্রসঙ্গে রাসূলের বাণীঃ تَخَلُقُوا بِأَخْلاق الله. “তোমরা আল্লাহর চরিত্রে চরিত্রবান হও।” (২) ঈমানের পরিপূর্ণতাঃ ঈমান হলো ইসলামী জীবনের ভিত্তি মূল। ঈমান ব্যতীত সৎকাজ ও কোন ইবাদত-উপাসনা গ্রহণযোগ্য নয়। এই ঈমানের পরিপূর্ণতার জন্য ইসলামী নৈতিকতা পূর্বশর্ত। মহানবী (সা) বলেছেনঃ اكملُ الْمُؤْمِنِينِ إِيْمَانًا أَحْسَنُهُمْ خُلُقًا. “তোমাদের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ ঈমানের অধিকারী তারাই যারা নৈতিকতার বিচারে সর্বোত্তম।” (তিরমিযী) (৩) উচ্চ মর্যাদা লাভঃ ইসলামী নৈতিক চরিত্র মানুষকে যেমনিভাবে সমাজে সর্বোচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত করে, তেমনি মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নিকটও সবচেয়ে প্রিয় করে তোলে। রাসূল (সা)-এর বাণীঃ
পৃষ্ঠা ১২১ থেকে ১৩৫
পৃষ্ঠা:১২১
مَا مِن شَيْ القَلَ فِي مِيزَانِ الْعَبْدِ الْمُؤْمِن يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنْ حُسْنِ الْخُلُقِ. “কিয়ামতের দিনে উত্তম চরিত্রের তুলনায় মীযানে (পাল্লায়) ভারী জিনিস আর কিছুই হবে না।” (তিরমিযী)
নৈতিকতার শাখাসমূহঃ মানব জীবনের সহিত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সকল প্রকার কথা, কার্যাবলী, আচার-আচরণ, দায়িত্ব কর্তব্য সব কিছুই নৈতিকতার অন্তর্ভুক্ত। তবে মোটামুটি ধারণা নেয়ার জন্য বলা যায় যে, সত্যবাদিতা, আন্তরিক বিশ্বাস, মৌখিক স্বীকারোক্তি ও কাজে প্রকাশ, বদান্যতা, চারিত্রিক পবিত্রতা, সততা, আমানতদারী, লজ্জাশীলতা, দয়া, করুণা, ন্যায়-বিচার, সত্য সাক্ষ্য প্রদান, ইহসান, ওয়াদা রক্ষা, ক্ষমা, ধৈর্য ও সহনশীলতা, হৃদতা, সম্ভাব বিনয় ও নম্রতা, ত্যাগ, সংযম, মধ্যম পন্থা অবলম্বন, শান্তি প্রিয়তা, পরোপকার, সেবা শুশ্রুষা, সরলতা, উদারতা ইত্যাদি সৎগুণাবলী সম্পন্ন ব্যক্তিরাই আল্লাহর নিকট প্রিয় ও সম্মানিত।
নৈতিক চরিত্র গঠনের উপায়: শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু। সে মানুষকে চতুর্দিক থেকে আক্রমণ করে আল্লাহর নাফরমানীতে লিপ্ত করার প্রচেষ্টায় সদাসর্বদা রত থাকে। এ শয়তান থেকে মু’মিন ব্যক্তিকে আত্মরক্ষা করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা একান্ত প্রয়োজন। বিশ্ব নবী (সা) আমাদেরকে এ ব্যাপারে পথ নির্দেশনা দিয়ে বলেন: হযরত আবু যর গিফারী (রা) হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেনঃ “আমি একদিন রাসূলে করীম (সা)-এর খিদমতে হাযির হলাম। অতঃপর (হযরত আবু যর, নতুবা তাঁহার নিকট হতে হাদীসের শেষের দিকের কোন বর্ণনাকারী) একটি দীর্ঘ হাদীস বর্ণনা করেন। (এই হাদীস এখানে বর্ণনা করা হয় নাই) এই প্রসংঙ্গে হযরত আবু যর বলেন, আমি বললাম হে আল্লাহর রাসূল, আমাকে নসীহত করুন। নবী করীম (সা) বলেন, আমি তোমাকে নসীহত করছি। তুমি আল্লাহর তাওয়া অবলম্বন কর। কেননা ইহা তোমার সমস্ত কাজকে সুন্দর, সুষ্ঠ ও সৌন্দর্যমণ্ডিত করে দিবে। আবু যর বলেন: আমি আরো নসীহত করতে বললাম। তখন তিনি বলেনঃ তুমি কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করবে এবং আল্লাহকে সব সময়ই স্মরণে রাখবে। কেননা এই তিলাওয়াত ও আল্লাহর স্মরণের ফলেই আকাশ রাজ্যে তোমাদের উল্লেখ করা হবে এবং এই যমীনেও ইহা তোমার জন্য ‘নূর’ স্বরূপ করা হবে।
পৃষ্ঠা:১২২
আবু যর আবার বললেনঃ হে রাসূল। আমাকে আরো নসীহত করুন। তিনি বলেনঃ বেশীর ভাগ চুপচাপ থাকা ও যথাসম্ভব কম কথা বলার অভ্যাস কর। কেননা, এই অভ্যাস শয়তান বিতাড়নের কারণ হবে এবং দীনের ব্যাপারে ইহা তোমার সাহায্যকারী হবে। আবু যর বলেন, আমি বললাম: আমাকে আরো কিছু নসীহত করুন। বললেন বেশী হাসবে না, কেননা ইহা অন্তরকে হত্যা করে এবং মুখমণ্ডলের জ্যোতি এর কারণে বিলীন হয়ে যায়। আমি বললামঃ হযরত, আমাকে আরো উপদেশ দিন। তিনি বললেন: সব সময়ই সত্য কথা ও হক কথা বলবে লোকদের পক্ষে তাহা যতই দুঃসহ ও তিক্ত হউক না কেন। বললাম, আমাকে আরো নসীহত করুন। তিনি বললেন: আল্লাহর ব্যাপারে কোন উৎপীড়কের উৎপীড়নকে আদৌ ভয় করো না। আমি বললামঃ আমাকে আরো নসীহত করুন। তিনি বললেন: তোমার নিজের সম্পর্কে তুমি যা জান, তা যেন তোমাকে অপর লোকদের দোষত্রুটি সন্ধানের কাজ হতে বিরত রাখে। (বায়হাকী, শুআবিল ঈমান)
ইসলামী নৈতিক চরিত্রের বৈশিষ্ট্য
মু’মিন ব্যক্তির চরিত্র হবে উন্নত, পবিত্র ও মধুর। একজন মানুষের প্রাথমিক দায়িত্বই হচ্ছে ঈমান গ্রহণের পর সে ইসলামের বুনিয়াদি হুকুম আহকাম পালন করবে এবং এর দ্বারা নিজের চরিত্রকে পবিত্র ও উন্নত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। এতে তার জীবনে যদি নফল ইবাদত কমও থাকে তবুও সে উন্নত চরিত্রের বলেই আল্লাহর নিকট বেশী মর্যাদা পাবে। হযরত আয়েশা (রা) হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন: নবী করীম (সা)-কে বলতে শুনেছি যে, নিশ্চয় মু’মিন ব্যক্তি তার উত্তম চরিত্রের সাহায্যে সেই সব লোকদের ন্যায় সম্মান ও মর্যাদা লাভ করতে পারে, যারা সারা রাত্রি নফল নামায পড়ে এবং দিনের বেলা সব সময়ই রোযা রাখে। (আবু দাউদ)
ইসলামী নৈতিকতার ভিত্তি
-ইসলামী নৈতিকতার ভিত্তি হচ্ছে তাকওয়া। বর্তমান নৈতিক অবক্ষয়ের যুগে কেবলমাত্র তাকওয়াই প্রত্যেক ঈমানদার ব্যক্তিকে নৈতিক অবক্ষয় থেকে
পৃষ্ঠা:১২৩
রক্ষা করতে পারে। আর এজন্য নিম্নের হাদীসের আলোকে মু’মিনের জীবনকে সাবধানতায় অতিবাহিত করতে হবে। আতিয়া সা’দী হতে বর্ণিত হয়েছে, নবী করীম (সা) ইরশাদ করেছেনঃ “বান্দা মুত্তাকী লোকদের মধ্যে ততক্ষণ পর্যন্ত সামিল হতে পারে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে কোন দোষের কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ার আশংকায় সেই সব জিনিসও ত্যাগ না করবে, যাতে বাহ্যত কোনই দোষ নাই।” (তিরমিযী)হযরত আয়েশা (রা) হতে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলে করীম (সা) ইরশাদ করেছেন: হে আয়েশা! ছোট ছোট ও নগণ্য গুনাহ হতেও দূরে সরে থাকা বাঞ্ছনীয়। কেননা, সেই সব সম্পর্কেও আল্লাহর দরবারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। (ইবনে মাজা) সাধারণ লোকদের প্রতি দয়া-অনুগ্রহঃ নৈতিক চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সাধারণ লোকদের প্রতি দয়া-অনুগ্রহ করা। হযরত জরীর ইবনে আবদুল্লাহ হতে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলে করীম (সা) বলেছেন: “যে লোক সাধারণ মানুষের প্রতি দয়া অনুগ্রহ বোধ করে না, তার প্রতি আল্লাহ তা’আলাও একবিন্দু রহম করেন না।” (বুখারী-মুসলিম) ইসলামী চরিত্রের নমুনাঃ হযরত হুযায়ফা (রা) হতে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলে করীম (সা) বলেছেন: “তোমরা অপরকে দেখে কাজ করতে অভ্যন্ত হয়ো না- এভাবে যে, তোমরা বলবে: অপর লোক ভাল কাজ ও ভাল ব্যবহার করলে আমরাও ভাল কাজ, ভাল ব্যবহার করব, অপর লোক যদি যুলুমের নীতি গ্রহণ করে, তবে আমরাও যুলুম করতে শুরু করব। বরং তোমরা নিজেদের মনকে এ দিক দিয়ে দৃঢ় ও শক্ত করে লও যে, অপর লোকেরা যদি অনুগ্রহ ও ভাল ব্যবহার করে, তবে তোমরাও তাহা করবে, আর অপর লোকেরা খারাপ ব্যবহার বা যুলুম করলেও তোমরা যুলুম ও খারাপ কাজ কখনো করবে না।” (তিরমিযী) ইসলাম ও নৈতিক চরিত্রঃ ইসলাম কেবল উত্তম চরিত্র গ্রহণের আহ্বান জানিয়েই ক্ষান্ত হয় না, ইসলাম নৈতিক চরিত্রের বিধি-বিধান রীতি-নীতি ও মূল আদর্শ নির্ধারণ করে দেয়। আচার আচরণের খুঁটিনাটিও বলে দেয়
পৃষ্ঠা:১২৪
এবং তার উপর সুদৃঢ় ও অবিচল হয়ে থাকার জন্য উদ্বুদ্ধ করে। নৈতিক চরিত্র হারালে তার কি নির্মম পরিণতি হতে পারে তার কথা বলে মানুষকে সাবধান ও সতর্ক করে দেয়। আর উত্তম চরিত্রের কি উচ্চ মর্যাদা ও সওয়াব পেতে পারে এবং চরিত্র হারালে কি আযাব ভোগ করতে হবে তার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করে ইসলাম দিক নির্দেশনা দিয়ে থাকে। তাছাড়া দুনিয়ার সকল ধর্মেই এ ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
মন-মানসিকতা ও নৈতিক চরিত্রঃ মানব মনের গভীরতম কন্দরে একটা গোপন ও প্রবলতর শক্তি নিহিত আছে। যে শক্তি মানুষকে সৎপথ প্রদর্শন করে, বিপদে মুক্তি দেয় ন্যায়ের আদেশ এবং অন্যায় নিষেধ করে। এ শক্তি যেমন খারাপ পরিণতির জন্য মানুষকে সতর্ক করে তেমনি ভাল পরিণতিপূর্ণ কাজে মনকে উদ্বুদ্ধ করে। এ শক্তি যেমন হুকুমদাতা তেমনি কার্যনির্বাহী। নীতি বিজ্ঞানীরা এ শক্তির নাম দিয়েছেন ‘বিবেক’। কেউ কেউ বলেছেন নীতিবোধ বা চৈতন্য আর ইসলাম এর নাম দিয়েছেন মন, হৃদয়, অন্তর।
শিক্ষা১। আমাদের প্রত্যেকেরই নৈতিক চরিত্রে চরিত্রবান হওয়া উচিত। ২। নৈতিক চরিত্রের দিক দিয়ে উত্তম হলে কিয়ামতের দিন মর্যাদার দিক দিয়ে রাসূল (সা)-এর অধিক নিকটবর্তী হওয়া সম্ভব হবে। ৩। যারা দ্রুত কথা বলে, লম্বা লম্বা কথা বলে লোকদেরকে অস্থির করে তোলে এবং অহংকার পোষণ করে, তারা রাসূল (সা)-এর নিকট ঘৃণিত। ৪। অহংকার পতনের মূল, অহংকার পরিত্যাগ করে চলতে হবে। ৫। উত্তম চরিত্রের গুণাবলী অর্জন করা প্রত্যেকের কর্তব্য।
পৃষ্ঠা:১২৫
দারস-১৩: তাকওয়া
عَنْ عَطِيَّةَ السَّعْدِي (رض) قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ (صلعم) لا يَبْلُغُ الْعَبْدُ أنْ يَكُونَ مِنَ الْمُتَّقِينَ حَتَّى يَدَعَ مَالاً بَأْسَ بِهِ حَدْرًا لِّعَابِهِ بَأْسٌ. (ترمذی، ابن ماجه
অর্থ : আতীয়া আস-সাদী (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (সা) বলেছেন: কোন ব্যক্তি পাপ কাজে জড়িয়ে পড়ার ভয়ে (বাহ্যত) যে সব কাজে গুনাহ নেই (অথচ যাতে পাপ কাজে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে) তা পরিত্যাগ না করা পর্যন্ত খোদাভীরু লোকদের শ্রেণীভুক্ত হতে পারবে না। (তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ)শব্দার্থ : )عن عطية السعدي (رض : হযরত আতীয়া আস-সা’দী (রা( হতে বর্ণিত। ১: সে পৌছতে পারবে না। أَنْ হতে। مِنَ الْمُتَّقِينَ : খোদাভীরুদের অন্তর্ভুক্ত। حتّى: যতক্ষণ না। يَدَعَ : সে পরিত্যাগ করবে। ৩ঃ যা। ১ঃ না। بَأْسَ : গুনাহ । حَذَرًا : সতর্কতার সহিত। ১: যার জন্য। ৭: তার দ্বারা। ব্যাখ্যাঃ হালাল-হারামকে কুরআন ও হাদীসের দ্বারা স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রকৃত মুসলমান হতে হলে, আল্লাহ যা হালাল করেছেন তাকে হালাল এবং যা হারাম করেছেন তাকে হারাম বলে মেনে নিতে হবে। তবে স্পষ্ট হালাল ও স্পষ্ট হারামের মাঝখানে কিছু বিষয় এমন আছে যার সম্পর্কে দৃঢ়ভাবে বলা যায় না যে, তা হালাল না হারাম। এসব ক্ষেত্রে যে ব্যক্তি সাবধানতা অবলম্বন করবে এবং পাপ কাজে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় সন্দেহযুক্ত বস্তু গ্রহণ থেকে বেঁচে থাকতে পারবে সে হারাম থেকে বেঁচে
পৃষ্ঠা:১২৬
রইল, আর যে উহা গ্রহণ করবে সে হারামের মধ্যে পতিত হতে পারে। কোন রাখাল যদি নিষিদ্ধ চারণ ভূমির কিনার ঘেষে নিজের জমিতে পশু চরায় তবে তার পশুগুলো (নিষিদ্ধ) চারণ ভূমিতে ঢুকে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। সাবধান! প্রত্যেক বাদশাহের জন্যে নির্ধারিত সীমারেখা আছে। আর আল্লাহর সীমারেখা হচ্ছে তাঁর নিষিদ্ধ বিষয়সমূহের ধারে কাছেও না যাওয়া। গ্রন্থ পরিচিতি: আলোচ্য হাদীসখানা যৌথভাবে বিখ্যাত দু’খানা হাদীস গ্রন্থ তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ শরীফে বর্ণনা করা হয়েছে। তিরমিযী শরীফের পরিচিতি ৫ নং দারসে এবং ইবনে মাজা শরীফের পরিচিতি নিম্নে উল্লেখ করা হলো। সুনান ইবনে মাজাহ সিহাহ সিত্তার ষষ্ঠতম গ্রন্থ। ইমাম ইবনে মাজাহ অপরিসীম সাধনা করে এ গ্রন্থ সংকলন করেন। তাঁর নাম আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইয়াযীদ। তিনি ২০৯ হিজরীতে ইসলামের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও হাদীস চর্চার অন্যতম কেন্দ্রস্থল কাজতীন শহরে জন্মগ্রহণ করেন। (মু’জামুল বুলদান, পূঃ ৮২) তিনি অসাধারণ মেধার অধিকারী ছিলেন। মক্কা, মদীনা, মিশর, সিরিয়া, নিশাপুরসহ পৃথিবীর অনেক দেশে ভ্রমণ করে লক্ষ লক্ষ হাদীস সংগ্রহ করেন এবং এর থেকে যাচাই-বাছাই করে প্রায় চার হাজার হাদীসের এ অমর গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। যার মধ্যে ৩২টি পরিচ্ছেদ ও পনেরশত অধ্যায় আছে। হাফিয ইবনে হাজার (র) বলেনঃ “ইহা অত্যন্ত কল্যাণপ্রদ গ্রন্থ, ফিকাহর দৃষ্টিতে উহার অধ্যায়সমূহ খুবই সুন্দর ও মজবুত করে সাজানো হয়েছে।” হাফিয ইবনে হাজার আসকালানী (র) বলেন: “ইমাম ইবনে হাজার সুনান কিতাবখানা অত্যন্ত ব্যাপক হাদীস সমন্বিত এবং উত্তম। এ মহামনীষী ২৭৩ হিজরীতে ৬৪ বছর বয়সে ইনতিকাল করেন। (তাহযীবুত তাহযীব)
পৃষ্ঠা:১২৭
রাবী পরিচিতি
হযরত আতিয়া সা’দী (রা) এর ডাক নামঃ আতিয়া। পিতার নাম: উরওয়া (রা)। তাঁর পিতার নাম সম্বন্ধে কয়েকটি মত পাওয়া যায়। ১. উরওয়া; ২. সা’দ; ৩. কায়েস: ৪. আমর। ইবনে হিব্বানের দৃঢ় মতানুযায়ী আতিয়া (রা)-এর পিতার নাম উরওয়া পিতামহের নাম সা’দ। পিতামহের নামের সাথে তাঁর নাম সম্পর্কিত করে তাকে সা’দী বলা হয়। তাঁর পিতা একজন প্রখ্যাত সাহাবী ছিলেন এবং রাসূলের দরবারে তিনি তাঁর গোত্রের লোকদের বিভিন্ন প্রয়োজনে যেতেন। রাসূল (সা) থেকে তিনি বেশ কিছু হাদীস ও বর্ণনা করেন। বংশ পরিচয়ঃ তিনি সা’দ ইবনে বাকর মতান্তরে জুশাম ইবনে সা’দ গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। (উসদুল গাবা: ৩ খণ্ড, ৪১১) হযরত আতিয়া সা’দ একজন প্রসিদ্ধ সাহাবী ছিলেন। ইসলামের বিভিন্ন খেদমতের সাথে সাথে তিনি রাসূল (সা)-এর নিকট থেকে বহু হাদীস রেওয়ায়েত করেছেন। পরবর্তীকালে তাঁর থেকে তাঁর পুত্র মোহাম্মদ ও পৌত্র উরওয়া ইবনে মোহাম্মদসহ অনেকে হাদীস বর্ণনা করেন। (ইসাব: ৪৮৪) তাকওয়া আরবী শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ- ১. ভয় করা; ২. বিরত থাকা; ৩. আল্লাহভীতি; ৪. বেছে চলা; ৫. আত্মশুদ্ধি; ৬. রক্ষা করা; ৭. সতর্কতা অবলম্বন করা ইত্যাদি। (আল-ওয়াসীত) শরীয়তের পরিভাষায়-১। পরকালীন জীবনে উন্নতি সাধনকল্পে পার্থিব জগতে ক্ষতিকারক কাজ হতে বিরত থাকা। এ ধরনের গুণাবলী সম্পন্ন লোকদেরকে মুত্তাকি বলে।
২। একমাত্র আল্লাহর ভয়ে সকল প্রকার অন্যায় ও অসৎ কাজ থেকে নিজকে বিরত রেখে কুরআন সুন্নাহ মোতাবেক জীবন পরিচালনার নামই তাকওয়া।
পৃষ্ঠা:১২৮
তাকওয়া সম্পর্কে বিভিন্ন মনীষীদের অভিমত
হযরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা) বলেছেনঃ তাকওয়ার অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর আদেশের আনুগত্য করা। তাঁর নাফরমানী না করা, আল্লাহকে স্মরণ করা, তাকে ভুলে না যাওয়া এবং আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করা ও তাঁর কুফরী না করা। হযরত ওমর বিন আবদুল আযীয বলেছেন: দিনে রোযা রাখা কিংবা রাত্রে জাগরণ করা অথবা দু’টোর আংশিক আমলের নাম তাকওয়া নয়; বরং তাকওয়া হচ্ছে আল্লাহ যা ফরয করেছেন তা পালন করা এবং তিনি যা হারাম করেছেন তা থেকে দূরে থাকা। এর পর আল্লাহ যাকে কল্যাণ দান করেন সেটা এক কল্যাণের সাথে অন্য কল্যাণের সম্মিলন। প্রখ্যাত তাবেঈ তালাক বিন হাবিব বলেছেন: আল্লাহর প্রতি তাকওয়ার অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর আলোর রোশনীতে তাঁর হুকুমের আনুগত্য করা ও সওয়াবের আশা করা এবং আল্লাহর শাস্তিকে ভয় করে তাঁর নাফরমানী ত্যাগ করা। একদা কোন এক ব্যক্তি হযরত উমার (রা)-এর দরবারে হাজির হয়ে তাকওয়ার অর্থ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন: তুমি কি কোন সময় বনের কণ্টকাবৃত রাস্তা দিয়ে চলেছ? লোকটি জবাব দিলেন হ্যাঁ, তাহলে রাস্তা দিয়ে কিভাবে চলেছ? বললেন কাপড়ের আঁচল সামলিয়ে পার হয়ে যাই। হযরত উমার (রা) বলেন: বস্তুত তাকওয়ার অর্থ এটাই যে, তোমরা পার্থিব জীবন এমনভাবে অতিক্রম করবে যাতে করে জীবন পোশাকের আঁচল ও এখানকার কাঁটায় কণ্টকাকীর্ণ না হয়। আর আল্লাহর নিকট তাকওয়ার মর্যাদাই একমাত্র মৌলিক মর্যাদা। তাকওয়া বা খোদাভীতির মৌলিক বিষয় হচ্ছেঃ ১। শিরক হতে বিরত থাকার মাধ্যমে নির্দিষ্ট শাস্তি হতে আত্ম রক্ষা করা। ২। গুনাহ থেকে দূরে থাকা। ৩। এমন কাজ থেকে দূরে থাকা, যা আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল করে দেয়।
তাকওয়ার স্তর
সুফী সম্রাট হযরত ইমাম গাযযালী (র) গুণগত ও মানগত দিক দিয়ে তাকওয়াকে চারটি স্তরে বিভক্ত করেছেন। যেমনঃ
পৃষ্ঠা:১২৯
১. শরী’আত কর্তৃক নির্ধারিত হারাম থেকে বিরত থাকা। এ শ্রেণীর মুত্তাকীকে “মুমিন” বলা হয়। ২. হারাম বস্তু থেকে বিরত থাকার সাথে সাথে সন্দেহযুক্ত হালাল-রস্তু পরিত্যাগ করা। এ শ্রেণীর মুত্তাকীকে “সুলাহা” বলা হয়। ৩. হারাম ও সন্দেহযুক্ত বস্তু পরিত্যাগের পর আল্লাহর ভয়ে অপ্রয়োজনীয় হালাল বস্তু বর্জন করা। এ শ্রেণীর মুত্তাকীদেরকে “আতকিয়া” বলা হয়। ৪. হারাম, সন্দেহযুক্ত ও আল্লাহর ভয়ে প্রয়োজনীয় হালাল বস্তু বর্জনের সাথে সাথে যে সকল হালাল বস্তু আল্লাহর ইবাদতে সহায়তা করে না তা বর্জন করা। এ শ্রেণীর মুত্তাকীদেরকে “সিদ্দীকীন” বলা হয়।
তাকওয়ার মূল বৈশিষ্ট্য
তাকওয়ার মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে চয়টি। যথাঃ )১) তাকওয়ার প্রথম ও প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে تفتيش حق তথা সত্যের অনুসন্ধান। সত্য উপলব্ধি ও প্রকৃত সত্য প্রাপ্তির জন্য চিন্তা গবেষণা করা। )২) তাকওয়ার দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে قُبُول حَقٍّ তথা সত্য গ্রহণ। প্রকৃত সত্য সন্ধানের পর সত্যের উপলব্ধি ও সত্য প্রাপ্তির সাথে সাথে নির্দ্বিধায় নিঃসকোচে সত্যকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করা। )৩) তাকওয়ার তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে الإستقامة আপোষহীনভাবে সত্যের উপর সুদৃঢ় থাকা। নিষ্ঠা ও দৃঢ়তার সাথে সত্যকে গ্রহণ করে তার উপর সুপ্রতিষ্ঠিত থাকা। লোভ-লালসা ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ অথবা অত্যাচার-নির্যাতনের কারণে সত্যকে পরিহার না করা। )৪) তাকওয়ার চতুর্থ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে خَوْفُ الهَدِى তথা আল্লাহভীতি। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের লক্ষ্যে প্রতি মুহূর্তে আল্লাহর নিকট জবাবদিহিতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত হয়ে আল্লাহকে ভয় করা। )৫) তাকওয়ার পঞ্চম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে إحْسَاسُ الأمة তথা দায়িত্ব সচেতনতা। আল্লাহ প্রদত্ত দায়িত্ব সম্পর্কে সদাসচেতন ও সতর্ক থাকা।
পৃষ্ঠা:১৩০
)৬) তাকওয়ার ষষ্ঠ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে آدَائِي فَرائض তথা কর্তব্য পালন। আল্লাহ প্রদত্ত কর্তব্যসমূহ যথাযথভাবে আদায় করা।
মুত্তাকীদের পরিচয়
যারা অন্যায়, অত্যাচার ও যাবতীয় পাপকার্য হতে নিজেদের কলুষমুক্ত রাখার জন্য সদাজাগ্রত ও সতর্ক। সততা, আমানতদারী, ধৈর্য, শোকর, আদল প্রভৃতি সকল প্রকার অনুপম চারিত্রিক গুণাবলীর অধিকারী। যারা শরয়ী আহকাম সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখেন ও তদানুযায়ী আমল করেন। যারা নিজেরা সৎ কাজ করেন অন্যদেরকে সৎকাজের আদেশ দেন এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখেন। যে ব্যক্তির মধ্যে তাকওয়ার গুণাবলীর সমাহার ঘটে তাকে মুত্তাকী বলা হয়। হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত আছে, “যে ব্যক্তি শিরক, কবীরা গুনাহ ও অশ্লীল বাক্য হতে নিজেকে বিরত রাখে তাকে মুত্তাকী বলা হয়।” মহান রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে মুত্তাকীদের প্রাথমিক পরিচয় সম্পর্কে ঘোষণায় বলেনঃ الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِالْغَيْبِ وَيُقِيمُونَ الصَّلوةَ وَمِمَّا رَزَقْنَهُمْ يُنْفِقُونَ وَالَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ وَبِالْآخِرَةِ هُمْ يُوقِنُونَ. আলোচ্য আয়াতে মু’মিনদের নিম্নলিখিত গুণাবলীর কথা বলা হয়েছে:
১. গায়েব বা অদৃশ্য বিষয়াবলীর উপর বিশ্বাস স্থাপন করে। ২. নামায প্রতিষ্ঠা করে। ৩. আল্লাহ প্রদত্ত জীবিকা ও ধনসম্পদ হতে তারই নির্দেশিত পথে ব্যয় করে। ৪. মুহাম্মদ (সা)-এর প্রতি অবতীর্ণ আল-কুরআন এবং পূর্ববর্তী নবী রাসূলদের প্রতি অবতীর্ণ আসমানী কিতাবসমূহে বিশ্বাস স্থাপন করে।
৫. পরকাল সম্পর্কে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করে। সূরা বাকারার ১৭৭ নং আয়াতে আল্লাহ তা’আলা মুত্তাকীদের গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন। নিম্নে তা উল্লেখ করা হলোঃ
পৃষ্ঠা:১৩১
১. আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে।
২. পরকালের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে।
৩. ফেরেশতাগণের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে।
৪. আল্লাহর কিতাবের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে।
৫. নবী ও রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে।
৬. আল্লাহর মহব্বতে নিকটাত্মীয়কে সাহায্য করে।
৭. আল্লাহর মহব্বতে ইয়াতিমকে সাহায্য করে।
৮. আল্লাহর মহব্বতে মিসকিনকে (নিঃসম্বল) দান করে।
৯. আল্লাহর মহব্বতে পথিককে সাহায্য করে।
১০. আল্লাহর মহব্বতে সাহায্য প্রার্থীকে সাহায্য করে।
অপরাপর আয়াতেও এ ধরনের গুণাবলীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন-
১. প্রতিশ্রুতি পালন করা। (সূরা আলে ইমরান: ৭৬)
২. পরকালের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা।
৩. নিন্দনীয় কাজ থেকে বিরত থাকা এবং পুণ্যের কাজে প্রতিযোগিতা
করা। (সূরা আলে ইমরানঃ ১১৪)
৪. ক্রোধ সংবরণকারী ও মানুষের জন্য ক্ষমাশীল। (সূরা আলে-ইমরান)
৫. সচ্ছলতা ও অসচ্ছলতা উভয় অবস্থায় দান করা।
৬. চুক্তি রক্ষা করা। (সূরা তওবা: ৪)
৭. যারা পৃথিবীতে অহংকার করে না এবং বিপর্যয় সৃষ্টি করে না (কাসাস)
৮. যারা রাত্রে তাহাজ্জুদ পড়েন এবং আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
৯. যারা বঞ্চিত ও প্রার্থীকে সম্পদ দান করেন। (সূরা যারিয়া: ১৯)
তাকওয়ার গুরুত্ব ও তাৎপর্য
তাকওয়ার গুণ মানব চরিত্রের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। দুনিয়া ও আখেরাতের মূল ভিত্তি হচ্ছে তাকওয়া। আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও
পৃষ্ঠা:১৩২
রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে তাওয়ার প্রভাব অপরিসীম। আল্লাহ বলেন: “হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যেভাবে ভয় করা উচিত” (সূরা আলে ইমরানঃ ১০২)। পবিত্র কুরআন ও হাদীসের আলোকে তাকওয়ার গুরুত্ব নিম্নে আলোচনা করা হলঃ
১. ধর্মীয় জীবনে তাকওয়া
আল্লাহ তা’আলা মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদতের জন্য, আর তাকওয়া হচ্ছে সামগ্রিক ইবাদতের মূল। তাকওয়া বিহীন ইবাদত আল্লাহর নিকট গ্রহণীয় নয়। তাই দেখা যায় ধর্মীয় জীবনে তাকওয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহর বাণী:
لَنْ يُنَالَ اللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا بِمَانُهَا وَلَكِنْ يَنَالُهُ التَّقْوَى مِنْكُمْ “কুরবানির পশুর রক্ত এবং গোস্ত আল্লাহর দরবারে পৌঁছে না বরং আল্লাহর দরবারে পৌঁছে তোমাদের (অন্তরের) তাকওয়া।” (সূরা আলহাজ্জ। ৩৭)
২. ঈমানের পূর্ণতায় তাকওয়া
তাকওয়া ছাড়া ঈমানের পরিপূর্ণতা লাভ করা যায় না। যে ব্যক্তির মধ্যে তাকওয়ার গুণাবলী বিদ্যমান থাকে তাকে পার্থিব জীবনে কোন লোভ- লালসা, ভয়-ভীতি আল্লাহর নাফরমানী কাজের প্রতি আকৃষ্ট করতে পারে না। ঈমানের সাথে তাকওয়া অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাকওয়াবিহীন ঈমান অর্থহীন। তাকওয়াই ঈমানদারদের আল্লাহর পথে চলার একমাত্র সম্বল।
يأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ “হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর; যেভাবে ভয় করা উচিত এবং প্রকৃত মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না।” (সূরা আলে-ইমরানঃ ১০২)
৩. আল্লাহ তা’আলার ভালবাসা ও নৈকট্য লাভে তাকওয়া
তাকওয়ার গুণ অর্জন ছাড়া আল্লাহ তা’আলার ভালবাসা ও নৈকট্য লাভ করা যায় না। ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য ও ভালবাসা লাভ করাই
পৃষ্ঠা:১৩৩
হলো মানব জীবনের মূল উদ্দেশ্য। আর এ উদ্দেশ্য সফল করতে হলে মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে তাকওয়ার পথ অনুসরণ করতে হবে। তা হলেই আল্লাহর ভালবাসা ও নৈকট্য লাভ করা সম্ভব হবে। আল্লাহর বাণী : إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَّقِينَ.
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা মুত্তাকিদের ভালবাসেন।” (সূরা তওবা: ৪) وَاتَّقُوا اللَّهَ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ مَعَ الْمُتَّقِينَ. “এবং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আর জেনে রাখ, নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকীনদের সাথে রয়েছেন।” (সূরা আল-বাকারাঃ ১৯৪)
৪. জাহান্নাম থেকে মুক্তিতে তাকওয়া
তাকাওয়া মানব জীবনের এক মহৎ গুণ যা পরকালে জাহান্নামের ভয়াবহ কঠিন শাস্তি থেকে মুক্তি দিবে। আল্লাহর বাণী: قُلْ مَتَاعُ الدُّنْيَا قَلِيلٌ وَالْآخِرَةُ خَيْرٌ لِّمَن اتَّقَى وَلَا تُظْلَمُونَ فَتِيلًا. “হে রাসূল (সা) বলে দিন দুনিয়ার জীবন সম্পদ খুবই নগণ্য। আর পরকাল একজন খোদাভীরু ব্যক্তির জন্য অতিশয় উত্তম। আর তোমাদের প্রতি একবিন্দু পরিমাণ যুলুম করা হবে না। অর্থাৎ জাহান্নামে প্রবেশ করানো হবে না। (সূরা আন-নিসা: ৭৭) এ প্রসঙ্গে মহানবী (সা) বলেনঃ “দু’টি চক্ষুকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করতে পারবে না। একটি চক্ষু যা আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করে আর অপর চক্ষু যা আল্লাহর রাস্তায় পাহারারত থেকে রাত কাটিয়ে দেয়।” (তিরমিযী)
৫. জান্নাত লাভে তাকওয়া
দুনিয়ায় যারা প্রকাশ্য ও গোপন সকল কাজে আল্লাহকে ভয় করে চলবে তারাই তাকওয়ার অধিকারী হবে এবং পরকালে একমাত্র তারাই জান্নাত লাভ করবে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহর বাণী:
পৃষ্ঠা:১৩৪
“আর যে ব্যক্তি স্বীয় প্রতিপালকের সম্মুখে উপস্থিত হওয়ার ভয় রাখে এবং নিজকে কুপ্রবৃত্তি হতে বিরত রাখে নিশ্চয়ই জান্নাত হবে তার আবাসস্থল।” (সূরা নাযিয়াত: ৪০-৪১) إِنَّ الْمُتَّقِينَ فِي مَقَامِ أَمِينِ فِي جَنَّتٍ وَعُيُونٍ. “মুত্তাকীরা থাকবে নিরাপদ স্থানে উদ্যান ও ঝর্ণার মাঝে।” (সূরা দুখান: ৫১-৫২) إِنَّ الْمُتَّقِينَ فِي جَنَّتٍ وَنَعِيمٍ. “মুত্তাকীগণ থাকবেন জান্নাতের মধ্যে ভোগ বিলাসে।” (সূরা আত-তৃর: ১৭) إِنَّ الْمُتَّقِينَ فِي جَنَّتٍ وَعُيُون. “সেদিন মুত্তাকীগণ থাকবেন প্রস্রবণ বিশিষ্ট জান্নাতে।” (সূরা জারিয়া: ১৫) إِنَّ الْمُتَّقِينَ فِي جَنَّتِ وَنَهَرٍ. “মুত্তাকীগণ থাকবেন স্রোতস্বিনী বিধৌত জান্নাতে।” (সূরা আল-কামার: ৫৪)
৬. সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধিতে তাকওয়া মুত্তাকী ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে অন্যায়, অবিচার, পাপ-পংকিলতা থেকে নিজেকে বিরত রাখে, সেভাবে সমাজের অপরাপর মানুষকেও সৎপথে পরিচালিত করে। এতে সে আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদা লাভ করে এবং মানব সমাজেও সে সর্বাধিক সম্মানের অধিকারী হয়ে উঠে। আল্লাহর বাণী:
1 إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ اتْقَاكُمْ “তোমাদের মধ্যে তিনি আল্লাহর নিকট সর্বাপেক্ষা অধিক সম্মানিত, যিনি বেশী (আল্লাহকে ভয় করে) মুত্তাকী।” (সূরা আল-হুজুরাতঃ ১৩)
৭. সৎ ও যোগ্য লোক সৃষ্টিতে তাকওয়া তাকওয়া বা আল্লাহভীতি মানুষের মধ্যে সততা ও ন্যায়পরায়ণতা সৃষ্টি করে। আল্লাহকে ভয় করার মানসিকতা ব্যতীত সৎ ও যোগ্য এবং ন্যায় নিষ্ঠ মানুষ গড়ে তোলা সম্ভব নয়। জাতীয় উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির জন্য সৎ, যোগ্য ও ন্যায়পরায়ণ মানুষ তৈরি করার গুরুত্ব অপরিসীম।
পৃষ্ঠা:১৩৫
মানব হৃদয়ে তাকওয়া বিদ্যমান থাকলে পার্থিব কোন লোভ লালসা এবং প্রলোভনই তাকে সত্য পথ হতে বিচ্যুত করতে পারবে না। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা মানুষকে সৎ ও ন্যায়পরায়ণ হওয়ার আদেশ করেছেন। إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانُ.
“আল্লাহ তা’আলা তোমাদেরকে ন্যায় বিচার ও ইহসানের আদেশ করেছেন।” (সূরা আন-নাহল: ৯০) إِنَّ اللَّهَ مَعَ الَّذِينَ اتَّقَوْا وَالَّذِينَ هُمْ مُحْسِنُونَ.
“আল্লাহতো তাদের সংগে রয়েছেন, যারা তাকওয়া সহকারে কাজ করে এবং ইহসান অনুসারে আমল করে।” (সূরা আন-নাহল: ১২৮) ৮. সন্ত্রাস মুক্ত সমাজ বিনির্মাণে তাকওয়াসন্ত্রাস মুক্ত সমাজ ও সামাজিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাকওয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। মুত্তাকী বা আল্লাহভীরু লোকের অভাবে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে উচ্ছৃঙ্খলতা নেমে আসে, মানুষের মধ্যে অশান্তি বিরাজ করে। ফেতনা-ফাসাদ, সন্ত্রাস, রাহাজানি, খুন-খারাবি ইত্যাদি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। মানুষের জান মালের নিরাপত্তা থাকে না। এমনকি নারীরাও যালেমদের হাত থেকে রেহাই পায় না। একমাত্র তাকওয়া থাকলেই মানুষ নৈতিক চরিত্র অর্জন করে অসামাজিক কার্যকলাপ ত্যাগ করে প্রকৃত মানুষ হতে পারে। যখন সমাজের নেতৃত্ব মুত্তাকী লোকদের হাতে ন্যস্ত হবে এবং সমাজের মানুষ আল্লাহভীরু হবে তখনই সমাজ ও রাষ্ট্র সন্ত্রাস মুক্ত হবে।
৯. ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় তাকওয়া সামাজিক জীবনে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও আইনের শাসন কায়েমের ক্ষেত্রে তাকওয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহর নিকট জবাবদিহীতার ভয় না থাকলে মানুষ সকল ক্ষেত্রে ন্যায় বিচার করতে পারে না। মহান আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য বহু স্থানে তাকীদ করেছেন।
পৃষ্ঠা ১৩৬ থেকে ১৫০
পৃষ্ঠা:১৩৬
قُلْ أَمَرَ رَبِّي بِالْقِسْطِ “(হে নবী) আপনি বলুন! আমার প্রতিপালক ন্যায় বিচার করার নির্দেশ দিয়েছেন।” (সূরা আল-আরাফ : ২১) “তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করবে, তখন ন্যায়পরায়ণতার সাথে বিচার করবে। আল্লাহ তোমাদেরকে যে উপদেশ দেন তা কত উৎকৃষ্ট।” (সূরা আন-নিসা: ৫৮) তাকওয়া অবলম্বন ছাড়া ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “তোমরা ন্যায় বিচার করো। এটাই তাকওয়ার সবচেয়ে নিকটবর্তী। আর আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই তোমাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা অধিক খবর রাখেন।” (সূরা আল-মায়েদাঃ ৭) রাসূল (সা) ন্যায় বিচার করার জন্য তাকিদ করেছেন। তিনি নিজের জীবনে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করে বিশ্ববাসীর সামনে ন্যায় বিচারের অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
১০. রাজনৈতিক জীবনে তাকওয়া ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের ন্যায় রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও তাকওয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের প্রায় সব কিছুই রাষ্ট্রীয় আইন দ্বারা পরিচালিত। রাষ্ট্র পরিচালিত হয় রাজনীতি তথা রাজনৈতিক নেতাদের নেতৃত্বে। রাজনীতিবিদদের মধ্যে যদি তাকওয়া বা আল্লাহভীতি না থাকে তা হলে জনগণ রাজনৈতিক সন্ত্রাসের শিকার হয়। দেখা যায় খোদাভীতিহীন নেতারা স্বার্থ হাসিলের জন্য মিথ্যা আশ্বাস প্রলোভন ও বিপক্ষ দলের বিরুদ্ধে বিষোদগারের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্তি ও পরস্পর হিংসা হানাহানিতে উৎসাহিত করে। কোন কোন ক্ষেত্রে জান-মালের প্রতি হুমকি প্রদানের মাধ্যমে ভোট আদায় করে ক্ষমতায় আরোহণ করে। ক্ষমতায় আরোহণের পর নানাভাবে সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করে নিজেদের আখের গুছায়। এ কারণে আমাদের সমাজে যে অস্থিরতা বিরাজ করছে তা অনেকাংশে তাকওয়াবিহীন রাজনীতিবিদদের সৃষ্ট। তাকওয়া মানুষকে সহনশীলতা, পরমত সহিষ্ণুতা ও উদারতা শিক্ষা দেয়।
পৃষ্ঠা:১৩৭
রাজনৈতিক জীবনে সহনশীলতা ও উদারতার গুরুত্ব অপরিসীম। সুতরাং বলা যায় যে, রাজনৈতিক জীবনে তাকওয়ার উপস্থিতি দেশকে সকল বিপর্যয় হতে রক্ষা করতে পারে।
১১. অর্থনৈতিক জীবনে তাকওয়া মানব জীবনের সাথে অর্থনীতির সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মানুষের সম্পাদিত কর্ম ও পেশায় নৈতিকতার সুফল সুদূর প্রসারী। তাকওয়া বা আল্লাহভীতি থাকলেই মানুষের মধ্যে নৈতিকতা সৃষ্টি হতে পারে। আর নৈতিকতা প্রথমে ব্যক্তিকে এবং পরে সমাজ ও রাষ্ট্রকে উপকৃত করে। একজন সৎ ব্যবসায়ী ব্যবসার ক্ষেত্রে যেমন সাফল্য লাভ করে; তেমন তার ক্রেতাগণও ঠকবাজী থেকে রক্ষা পায়। অনুরূপভাবে শ্রমিক, রাজনীতিক, শিল্পপতি ইত্যাকার যারাই অর্থনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট আছে তাদের অন্তরে যদি তাকওয়া বা আল্লাহভীতি সদা জাগরুক থাকে তাহলে তাদের কর্ম যথাযথভাবে সম্পদিত হবে এবং এর দ্বারা সামগ্রিকভাবে জাতীয় অর্থনীতির উন্নতি ও অগ্রগতি সম্ভব হবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নৈতিকতা না থাকলে তা ব্যক্তি বা পেশার লোকদের সাময়িক প্রাচুর্য নিশ্চিত করলেও দেশের বৃহত্তর জনগণ বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হয়। ইসলাম যে শান্তিপূর্ণ উন্নতি ও ইনসাফভিত্তিক অর্থনীতিতে বিশ্বাসী তার জন্য দেশের জনগণের মধ্যে তাকওয়া বা আল্লাহভীতির সার্বক্ষণিক প্রহরা একান্ত প্রয়োজন। আমাদের বর্তমান সমাজে যে অর্থনৈতিক বৈষম্য চলছে তা একমাত্র তাকওয়াবিহীন লোকদের কারণেই সংঘটিত হচ্ছে। অতএব আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে, তাকওয়া বা আল্লাহভীতির মাধ্যমেই অর্থনৈতিক সুষম বণ্টন সম্ভব।
শিক্ষা ১. তাকওয়া অবলম্বন করা সকলেরই কর্তব্য। ২. তাকওয়া অর্জনের জন্য মুবাহ কাজকেও পরিত্যাগ করে চলতে হবে।। ৩. তাকওয়াবান লোক তৈরীর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
পৃষ্ঠা:১৩৮
দারস-১৪:ধৈর্যধারণ
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ (رض) قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ (صلعم) لَيْسَ الشَّدِيدُ بالصُّرْعَةِ إِنَّمَا الشَّدِيدُ الَّذِي يَمْلِكُ نَفْسَهُ عِنْدَ الْغَضَبِ (متفق عليه) অর্থঃ হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। নবী করীম (সা) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি খুব বেশী কুস্তিতে লড়তে পারে সে শক্তিশালী নহে; বরং যে ব্যক্তি ক্রোধের (গোম্বার) সময় নিজেকে সামলাতে পারে প্রকৃতপক্ষে সে ব্যক্তি শতিশালী। (বুখারী-মুসলিম) শব্দার্থ : ليس : নহে : الشَّدِيدُ : শক্তিশালী। بِالصَّرْعَة : কুস্তি দ্বারা। الشَّدِيدُ : প্রকৃত শক্তিশালী ঐ ব্যক্তি। “لذي যে ব্যক্তি বা যিনি। গ্রন্থ ও কাবু করতে পারে। : তার (নিজের) আত্মাকে। الغضب : ক্রোধের সময়। ব্যাখ্যা: এ হাদীসে ক্রোধ বা রাগকে দমনের নির্দেশ প্রদান করে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি রাগের সময় নিজেকে সামলাতে সক্ষম সে ব্যক্তিই প্রকৃত বাহাদুর। মূলত ক্রোধ (রাগ) দমন করা একটি কঠিন কাজ। যে ব্যক্তি (গোস্বা) নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম নয় সে নানা ধরনের বিপদ-আপদ ও ক্ষতির সম্মুখীন হবে। এ কারণে হাদীসে একজন কুস্তিগীরকে প্রকৃত শক্তিশালী না বলে যে ক্রোধ (রাগ) নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম তাকে প্রকৃত শক্তিশালী (বাহাদুর) বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। রাগের মাথায় মানুষ অনেক কিছু করে ফেলতে পারে। কারণ তখন মানুষের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। অবশ্য পরে যখন রাগ কমে যায় তখন তার ভুল-ত্রুটি বুঝতে সক্ষম হয়। অথচ রাগের বশবর্তী হয়ে সে যা করে ফেলেছে অনেক সময় তার প্রতিকার করা সম্ভব নাও হতে পারে। তাই মহানবী (সা) মানুষকে রাগ না করার
পৃষ্ঠা:১৩৯
উপদেশ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে একদা এক ব্যক্তি নবী করীম (সা)-এর কাছে নিবেদন করলেন যে, হে আল্লাহর নবী! আমাকে উপদেশ দান করুন। নবী করীম (সা) বললেনঃ তুমি রাগ করো না, লোকটি বার বার একই প্রশ্ন করছিলেন এবং নবী করীম (সা) বার বার তাকে একই উত্তর দিলেন যে, তুমি রাগ করবে না। অর্থাৎ ধৈর্যধারণ করবে। (বুখারী)
গ্রন্থ পরিচিতি
সহীহ আল বুখারীর পরিচিতি ৫ নং দারসে এবং সহীহ মুসলিমের পরিচিতি ১ নং দারসে দেখুন। রাবী পরিচিতিঃ হযরত আবু হুরায়রা (রা) পরিচিতি ১ নং দারসে দেয়া হয়েছে।
সবর অর্থ
“সবর” আরবী শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ-ধৈর্য। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায়- বিপদ-আপদ, দুঃখ-কষ্ট, রোগ-ব্যাধি, ক্ষুধা-তৃষ্ণা, অন্যায়- অত্যাচার ইত্যাদি বালা-মুসিবতে কোনরূপ বিচলিত না হয়ে, অবিচল চিত্তে সব কিছু আল্লাহর উপর ন্যস্ত করে ধৈর্যধারণ করাকে “সবর” বলে। যিনি ধৈর্যধারণ করেন তাকে সাবের বা ধৈর্যশীল বলে। ধৈর্যশীল বলতে বুঝানো হয়েছে সে ব্যক্তিকে, যে লোক নিজের নফসকে কাবু করে রাখতে পারে এবং ভাল মন্দ উভয় প্রকার অবস্থায়ই বান্দার উপযোগী আচরণ গ্রহণে অবিচল থাকে। সুখ-সাচ্ছন্দের সময় নিজের সত্তাকে ভুলে গিয়ে আল্লাহদ্রোহিতায় অভ্যস্ত হয়ে উঠবে না এবং দুঃখ দৈন্যের সময়ও হতাশ হয়ে হীন আচরণ শুরু করবেনা। এরূপ অবস্থা তার কখনও হয় না। (তাফহীমুল কুরআন) ইমাম মালেক (র) বলেনঃ ধৈর্যশীল ঐ ব্যক্তি যে দুনিয়াতে বিপদাপদ ও দুঃখ কষ্টে সবর করে। কেউ কেউ বলেন যারা পাপ কাজ থেকে সংযম অবলম্বন করে। পাপ কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখার কষ্ট সহ্যকারীকে ধৈর্যশীল বলে। (কুরতুবী) সুখ-দুঃখ মানুষের জীবনের সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। মানুষ কোন সময় রোগ, শোক, দরিদ্র বা অন্য কোন বিপদাপদের সম্মুখীন হতে পারে।
পৃষ্ঠা:১৪০
এমতাবস্থায়, তাকে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না, বরং সর্বাবস্থায় মহান আল্লাহর উপর ভরসা রেখে ধৈর্যধারণপূর্বক সকল প্রতিকূল অবস্থার মোকাবেলা করতে হবে এবং বলতে হবে- إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ. “নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্য এবং আমরা সবাই তারই সান্নিধ্যে ফিরে যাবো। (সূরা বাকারা: ১৫৬) আল্লাহ তা’আলা কোন জাতিকে ভালবাসলে বিভিন্ন বালা মুসিবত দিয়ে তাদেরকে পরীক্ষা করেন। এ পরীক্ষায় যারা ধৈর্যধারণ করে উত্তীর্ণ হয় তাদের উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছেঃ “এবং অবশ্যই আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল জানের ক্ষতি ও ফল ফসলের বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও সবরকারীদের। যখন তারা বিপদে পতিত হয়, তখন বলে নিশ্চয় আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং আমরা সবাই তাঁরই সান্নিধ্যে ফিরে যাবো। আর সে সমস্ত লোক, যাদের প্রতি আল্লাহর অফুরন্ত অনুগ্রহ রয়েছে এবং এসব লোকই হেদায়েত প্রাপ্ত। মহানবী (সা) বলেছেন: মানুষ যেসব বস্তুর ঢোক গ্রহণ করে তার মধ্যে রাগের সে ঢোকটি-ই-আল্লাহর নিকট সবচেয়ে বেশী উত্তম, যেটি আল্লাহকে সন্তুষ্ট রাখার জন্যে মানুষ গ্রহণ করে। (আহমদ)
সবরের প্রকারভেদ
কুরআন ও হাদীসের পরিভাষায় সবরের তিনটি শাখা রয়েছে। ১. নফসকে হারাম এবং না জায়েয বিষয়াদি থেকে বিরত রাখা। ২. ইবাদত ও আনুগত্যের মধ্যে সবর করা এবং ৩. যে কোন বিপদ ও সংকটে ধৈর্যধারণ করা। (মা’আরেফুল কুরআন: ৭৯) ইমাম গাযযালী (র) সবরকে পাঁচ ভাগে ভাগ করেছেন:১. আল্লাহর ইবাদতে সবর। ২. আনন্দ ও খুশির সময় সবর।৩. যুলুম ও অত্যাচারে সবর। ৪. বিপদে-আপদে সবর
পৃষ্ঠা:১৪১
৫. অন্যায় থেকে আত্মরক্ষার ক্ষেত্রে সবর। এ পাঁচটি বিষয়ের সংক্ষেপে আলোচনা নিম্নে প্রদত্ত হল:
১. আল্লাহর ইবাদতে সবর: আল্লাহ তা’আলা মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদতের জন্যে। ইবাদত এমন একটি সাধনা যা কষ্ট সাধ্য। আল্লাহর বাণী وَاسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلوةِ، وَإِنَّهَا لَكَبِيرَةُ إِلَّا عَلَى الْخَشِعِينَ
“এবং তোমরা ধৈর্যের সাথে সাহায্য প্রার্থনা কর নামাযের মাধ্যমে। অবশ্য তা (নামায) যথেষ্ট কঠিন, তবে যারা বিনয়ী (যারা আল্লাহর ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত) তাদের জন্য নয়।” (সূরা আল-বাকারাঃ ৪৫) আল্লাহর হুকুম আহকাম সঠিকভাবে পালন করতে হলে সবরের প্রয়োজন অত্যধিক। নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি ইসলামী বিধানসমূহ পালনে যেমন সবরের প্রয়োজন তেমনিভাবে দাওয়াতে দীন ও জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহর কষ্ট সহ্য করার জন্যেও সবরের ভীষণ প্রয়োজন। শত্রু কিংবা অজ্ঞ লোকেরা গালি-গালাজ ও ঠাট্টা-বিদ্রূপ করবে, সবরের সাথে এর মোকাবেলা করে হেকমতের সাথে দাওয়াত অব্যাহত রাখতে হবে। জিহাদে জান-মালের কুরবানীর জন্য সর্বাধিক সবর করতে হয়। এভাবে সকল ইবাদতেই সবরের গুরুত্ব রয়েছে। ২. আনন্দ ও খুশীর সময় সবর মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে এমনকি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে এমন অনেক সময় উপস্থিত হয় যখন কাজের সফলতার জন্যে মানুষ আনন্দ ও খুশিতে আত্মহারা হয়ে সীমালঙ্ঘন করে বসে। সে সময় ধৈর্যের সাথে আল্লাহর শোকর আদায় করতে হবে যাতে ইসলামের সীমালঙ্ঘন না হয়। ৩. যুলুম ও অত্যাচারের সময় সবরঃ মানুষের জীবনে কোন কোন সময় অত্যাচার নির্যাতন নেমে আসতে পারে। হতে পারে তা দাওয়াতে দীনের জন্য অথবা স্বার্থবাদীদের স্বার্থের ব্যাঘাতের কারণে। তবে ব্যক্তিগতভাবে প্রতিশোধ গ্রহণ করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যালিমকে ক্ষমা করে দেয়া সবরের অন্তর্ভুক্ত। তবে যুলুমের মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে সে অত্যাচার সহ্য করা উচিত নয়।
পৃষ্ঠা:১৪২
৪. বিপদে আপদে সবরঃ দুঃখ-কষ্ট, রোগ-শোক, বালা-মুসিবত ইত্যাদি সব কিছুই আল্লাহর পক্ষ থেকে মানব জাতির নিকট পরীক্ষাস্বরূপ। এসব মানব শক্তির বাহিরে। মানুষ ইচ্ছা করলেই ইহা থেকে মুক্ত থাকতে পারে না। শারীরিক মানসিক নানাভাবে বালা-মুসিবত আসতে পারে। এ সকল, অবস্থায় আল্লাহর উপর ভরসা করে সবর ইখতিয়ার করতে হবে এবং আল্লাহর কাছে এ দু’আ করতে হবে ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন’। (সূরা আল-বাকারা: ১৫৬)৫. অন্যায় থেকে আত্মরক্ষার ক্ষেত্রে সবরঃ মানুষ শয়তানের ধোঁকায় পড়ে ঝগড়া-বিবাদ, আত্মপ্রশংসা, অপরের গীবত ও খিয়ানতের মত অন্যায় করে খুবই আত্মতৃপ্তি লাভ করে থাকে এবং পাপের সাগরে হাবুডুবু খেতে থাকে। এসব পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে অত্যন্ত ক্ষতিকর। অতএব এ জঘন্য পাপ থেকে মুক্তি পেতে হলে সবরের মাধ্যমে নফসকে কুপ্রবৃত্তি ও অশ্লীল কাজ হতে বিরত রাখতে হবে।
সবরের গুরুত্ব
ধৈর্য মানব জীবনের একটি বিশেষ গুণ। ধৈর্য মানব জীবনকে সাফল্যমণ্ডিত করার ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই প্রবাদ আছে, “ধৈর্য প্রশস্ততার চাবিকাঠি”। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে শান্তি শৃঙ্খলা ও কল্যাণকর জীবন যাপনের জন্য সবরের গুরুত্ব অপরিসীম। ধৈর্যের অভাবে সমাজে ঝগড়া-বিবাদ, মারামারি ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। ফলে গোটা সমাজ ধ্বংসমুখী হয়। নিম্নে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সবরের গুরুত্ব আলোচনা করা হলো:
১. ধর্মীয় জীবনে সবরের গুরুত্বঃ ইসলামের মৌলিক বিষয়াদি পালনের ক্ষেত্রে চরম ধৈর্যের প্রয়োজন। প্রথম ঈমান আনার ক্ষেত্রে লোভ-লালসা, ভয়-ভীতি উপেক্ষা করতে হয়। ইসলামের প্রথম যুগে সাহাবায়ে কেরামগণ ঈমান আনয়নে সীমাহীন অত্যাচার নির্যাতনের সামনেও ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছিলেন। সকল প্রকার লোভ-লালসা, ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে ঈমানের উপর অটল ছিলেন। আজ বিশ্বের দেশে দেশে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার কাজ করার অপরাধে মুসলমানদের উপর অত্যাচারের ষ্টীম রোলার নেমে এসেছে।
পৃষ্ঠা:১৪৩
নামাযই ধৈর্যধারণের প্রথম স্তর। ধৈর্যের সাথে দীর্ঘক্ষণ নামাযে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। সারাদিন পানাহার বন্ধ রেখে ধৈর্যের সাথে রোযা রাখতে হয়। নিজের অক্লান্ত পরিশ্রমের ধন হতে যাকাত প্রদান এবং দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে সঞ্চিত অর্থ ব্যয় করে হজ্জ পালন ধৈর্য ব্যতিরেকে সম্ভব নয়। এজন্য বলা হয় বিপদে ধৈর্যধারণ করা ও আল্লাহর আনুগত্যে ধৈর্যধারণ করা প্রকৃত ঈমানদারের পরিচয়। রাসূলের বাণী: الصَّبْرُ نِصْفُ الْإِيمَانِ. “ধৈর্য ঈমানের অর্ধাংশ।” (আবু নাঈম) ঈমানের সাথে জীবন যাপন করতে হলে প্রয়োজন ধৈর্যের, যা জান্নাতের দিকে নিয়ে যায়।” الصَّبْرُ ثَوَابُهُ الْجَنَّةُ. “ধৈর্যের বিনিময় হলো জান্নাত।” (বায়হাকী) ধৈর্যধারণ করা খুবই কঠিন ও কষ্টসাধ্য কাজ, তবুও এতে নিহিত রয়েছে মানব জাতির অধিক কল্যাণ। আর এ গুণ অর্জনের জন্য রয়েছে বছরে এক মাস রোযা। হাদীসে বর্ণিত আছে রমযান হচ্ছে সবর ও সংযমের মাস। আর সবরের পুরস্কার হচ্ছে বেহেশত। অপর হাদীসে বলা হয়েছে, الصوم نصف الصبر. “রোযা ধৈর্যের অর্ধেক।” অপর এক হাদীসে রাসূল (সা) বলেনঃ “যে সবর করে আল্লাহ তাকে সবর করার শক্তি দান করেন। আল্লাহ তা’আলা সবরের চেয়ে অধিক উত্তম ও কল্যাণকর বস্তু আর কিছুই কাউকে দান করেননি।” (বোখারী-মুসলিম) আল্লাহ তা’আলা পরকালে সবরের অধিক পুরস্কার দান করবেনঃ إِنَّمَا يُوَفِّى الصَّابِرُونَ أَجْرَهُمْ بِغَيْرِ حِسَابٍ. “ধৈর্যধারণকারীদেরকে অগণিত পুরস্কার দেয়া হবে।” (সূরা আল-যুমার: ১০) إِنَّ اللهَ مَعَ الصَّابِرِينَ. “আল্লাহ তা’আলা ধৈর্যধারণকারীদের সাথে আছেন।” (সূরা আল-বাকারা: ১৫৩)
পৃষ্ঠা:১৪৪
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যে সকল ইবাদত ফরয তার জন্য ধৈর্যধারণ করাও ফরয। যে সকল ইবাদত সুন্নত তার জন্য ধৈর্যধারণ করাও সুন্নাত। এ ছাড়া বিপদে-আপদে ধৈর্যধারণ করা সুন্নত। শরীয়ত বিরোধী কোন কাজে ধৈর্যধারণ করা অবৈধ। ২. ব্যক্তিগত জীবনে সবরের গুরুত্বঃ মানুষের ব্যক্তিগত জীবনেও সবরের গুরুত্ব অপরিসীম। বাস্তব জীবনের প্রতিটি পদে পদে ধৈর্যের প্রয়োজন। মানুষকে ব্যক্তিগত জীবনে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত থেকে জীবিকা অর্জন করতে হয়। চাকুরী, ব্যবসা, প্রশাসন ইত্যাদি। এ সকল ক্ষেত্রে ন্যায় ও সত্যকে ধৈর্যসহকারে প্রতিষ্ঠা করা একজন মুসলমানের ঈমানী দায়িত্ব। কারণ ধৈর্যহীন ব্যক্তি লোভ-লালসার শিকার হয়ে যে কোন মুহূর্তে পাপ-পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত হতে পারে। সমাজের সকল ব্যক্তি যদি ধৈর্য অবলম্বন করে সে সমাজে অবশ্যই সুখ-শান্তি বিরাজ করবে। এ মর্মে মহান আল্লাহ বলেন: يَأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اصْبِرُوا وَصَابِرُوا وَرَابِطُوا وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ. “হে ঈমানদারগণ! তোমরা ধৈর্যধারণ কর, এবং পরস্পর ধৈর্যধারণের প্রতিযোগিতা কর এবং ধৈর্যসহকারে পরস্পরকে শক্তিশালী কর। আর আল্লাহকে ভয় কর যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।” (সূরা আলে ইমরানঃ ২০০) যার ধৈর্য বেশী তার পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে শান্তি বেশী। তিনি সকলের নিকট প্রিয় পাত্রে পরিণত হবেন। পক্ষান্তরে যার ধৈর্য কম তিনি সবার কাছে অপ্রিয়। এমনকি সে আল্লাহর কাছেও অপ্রিয়। আল্লাহ তা’আলা ধৈর্যশীলদেরকে ভালবাসেন। পবিত্র কুরআনের বাণী: وَاللهُ يُحِبُّ الصَّابِرِينَ. “আল্লাহ ধৈর্যশীলদের ভালবাসেন।” (সূরা আলে ইমরান: ১৪৬) ব্যক্তি জীবনে ধৈর্যধারণ প্রসঙ্গে মহানবী (সা) বলেনঃ “মু’মিন নর-নারী বিপদ-আপদের মাধ্যমে পরীক্ষায় পতিত হয়। কখনো সরাসরি তার উপর বিপদ আসে। কখনো তার সন্তান মারা যায়। আবার কখনো তার ধন- সম্পদ বিনষ্ট হয়। আর সে সকল মুসিবতে ধৈর্যধারণ করার ফলে তার
পৃষ্ঠা:১৪৫
কলব পরিষ্কার হতে থাকে এবং পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হতে থাকে। অবশেষে সে নিষ্পাপ আমলনামা নিয়ে আল্লাহর সাথে মিলিত। হয়।” (তিরমিযী) তাই আমরা এ কথা বলতে পারি যে ধৈর্য হচ্ছে নৈরাশ্যের উত্তম নিরাময়মূলক পোশাক। বর্তমান সমস্যা সঙ্কুল ও হতাশাগ্রস্ত বিশ্বে ধৈর্যধারণই নৈরাশ্যের একমাত্র প্রতিকার। ৩. সামাজিক জীবনে সবরের গুরুত্বঃ মানুষ সামাজিক জীব। পরস্পর মিলিত হয়ে সমাজ গঠন করে। সমাজে অবস্থানকারী ব্যক্তিদের মধ্যে স্বার্থের সংঘাত অনিবার্য। সুতরাং সুখী-সুন্দর ও কল্যাণময় সমাজ কায়েম করতে হলে সে ক্ষেত্রে ধৈর্য গুণ এক বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। সমাজে বিভিন্ন ব্যক্তির স্বার্থ সংশ্লিষ্ট দ্বন্দ্বে ধৈর্যধারণ ব্যতিরেকে সমাধান সম্ভব নয়। ধৈর্যের অভাবে সাধারণ বিষয় নিয়েও দ্বন্দ্বের কারণে সমাজে বিশৃংখলা ও হানাহানি অপরিহার্য হয়ে পড়ে। সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে ব্যক্তিকে ধৈর্যের সাথে অনেক কিছুই সহ্য করতে এবং ত্যাগ করতে হয়। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে: يَأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلُوةِ إِنَّ اللَّهَ مَعَ الصَّبِرِينَ. “হে ঈমানদারগণ! তোমরা ধৈর্য ও নামাযের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা কর; নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।” (সূরা আল- বাকারা: ১৫৩)
৪. রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনে সবরের গুরুত্বঃ সমাজ জীবনের ন্যায় রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনেও সবরের গুরুত্ব অপরিসীম। পৃথিবীর দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে স্বার্থের দ্বন্দ্বে, সাম্রাজ্যবাদী লালসায় অপরের রাজ্য গ্রাসের হীন লিন্দার কারণে অতীতে যেমন অনেক যুদ্ধ বিগ্রহ সংঘটিত হয়েছে বর্তমানেও হচ্ছে। বর্তমানে মানব সভ্যতার ইতিহাসে সমরাস্ত্র বিজ্ঞানের যে চরম উন্নতি সাধিত হয়েছে তাতে পরাশক্তিসমূহের যে কোন একজন শাসকের অধৈর্যের আঙ্গুলির টিপেই পারমাণবিক অস্ত্রের মানব বিধ্বংসী খেলা শুরু হয়ে যেতে পারে। সুতরাং রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ধৈর্যের উপর অটল থাকার প্রয়োজনীয়তা অতীতের যে কোন
পৃষ্ঠা:১৪৬
সময়ের চেয়ে বর্তমানে বেশী। সকল ধর্মে ধৈর্যের গুরুত্ব আছে বটে, তা সত্ত্বেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ধর্মীয় সংকীর্ণতা এবং অধৈর্যের কারণে সাম্প্রদায়িকতা বিদ্যমান। দেশে দেশে মুসলমানগণই সাম্প্রদায়িক যুলুমের শিকার হয় বেশী। এ ক্ষেত্রে ইসলাম ধৈর্যের সীমারেখা বেঁধে দিয়েছে, যা অতিক্রম করলে সময় ও অবস্থানের প্রেক্ষিতে জিহাদ অথবা হিজরত করার নির্দেশও রয়েছে। হতে বর্ণনা করেন: কিয়ামতের দিন ইনসাফের দাড়ি পাল্লা স্থাপন করা ৫. আল্লাহর নিকট সবরকারীর মর্যাদাঃ হযরত আনাস (রা) রাসূল (সা) হবে। দাতাগণ আগমন করলে তাদের দান খয়রাত ওজন করে উহার পূর্ণ সওয়াব দান করা হবে। এমনিভাবে নামায, হজ্জ ইত্যাদি ইবাদতকারীদের ইবাদত মেপে তাদেরকে প্রতিদান দেয়া হবে। অতঃপর বালা-মসিবতে সবরকারীরা আগমন করলে তাদের জন্য কোন ওজন ও মাফ হবে না; বরং তাদেরকে অপরিমিত ও অগণিত সওয়াব দেয়া হবে। আল্লাহর বাণী: إِنَّمَا يُوَفِّى الصَّبِرُونَ أَجْرُهُمْ بِغَيْرِ حِسَابٍ. “যারা সবরকারী তাদেরকে অগণিত প্রতিদান দেওয়া হবে।” (সূরা যুমার: ১০) এর ফলে যাদের পার্থিব জীবন সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে অতিবাহিত হয়েছে তারা কামনা প্রকাশ করবে হায়! দুনিয়াতে আমাদের দেহ কাঁচির সাহায্যে কর্তিত হলে আমরাও সবরের এমনি প্রতিদান পেতাম। (মাআরেফুল কুরআন: ১১৭৫) শিক্ষা ১। একজন মু’মিনকে ক্রোধ দমনকারী ও আত্মসংযমী হতে হবে। ২। ইসলাম ক্রোধ দমনকারীকে বাহাদুর হিসেবে মর্যাদা দেয়। ৩। আল্লাহর নিকট আত্মসংযমী ব্যক্তির মর্যাদা অধিক। ৪। আত্মসংযমী লোক দ্বারা ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের উপকার হয়। ৫। ধৈর্যহীন ক্রোধ ব্যক্তির দ্বারা সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষতি হয়।
পৃষ্ঠা:১৪৭
দারস-১৫:আরশের ছায়ায় স্থান লাভকারী
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ (رض) قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ (صلعم) سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمُ اللَّهُ فِي ظِلْهِ يَوْمَ لَا ظِلُّ إِلَّا ظِلُّهُ إِمَامٌ عَادِلٌ وَشَابٌ نَشَاءَ فِي عِبَادَةِ اللَّهِ وَرَجُلٌ قَلْبُهُ مُعَلِّقٌ بِالْمَسْجِدِ إِذا خَرَجَ مِنْهُ حَتَّى يَعُودَ إِلَيْهِ وَرَجُلان تَحَابًا فِي اللَّهِ اجْتَمَعًا عَلَيْهِ وَتَفَرَّقَا عَلَيْهِ وَرَجُلٌ ذَكَرَ اللَّهَ خَالِيًّا فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ وَرَجُلٌ دَعَتْهُ امْرَأَةٌ ذاتُ حَسَبٍ وجَمَالَ فَقَالَ إِنِّي اخَافُ اللَّهَ وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ فَأَخْفَاهَا حَتَّى لَا تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ بِيَمِينِهِ (بخاری، مسلم) অর্থ : হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। নবী করীম (সা) বলেছেন: সাত প্রকার লোককে আল্লাহ তা’আলা (কিয়ামতের দিন) তাঁর আরশের ছায়ায় স্থান দান করবেন। সেদিন আরশের ছায়া ছাড়া আর অন্য কোন ছায়া থাকবে না।১. ন্যায়পরায়ণ নেতা; ২. ঐ যুবক যে তাঁর যৌবনকাল আল্লাহর ইবাদতে কাটিয়েছে; ৩. এমন (মুসল্লি) ব্যক্তি যার অন্তকরণ মসজিদের সাথে লটকানো থাকে, একবার মসজিদ থেকে বের হলে পুনরায় প্রত্যাবর্তন না করা পর্যন্ত ব্যাকুল থাকে; ৪. এমন দু’ব্যক্তি যারা কেবল মাত্র আল্লাহর মহব্বতে পরস্পর মিলিত হয় এবং পৃথক হয়; ৫. যে ব্যক্তি নির্জনে আল্লাহর ভয়ে চোখের অশ্রু ফেলে; ৬. যে ব্যক্তিকে কোন সম্ভ্রান্ত বংশের সুন্দরী রমণী ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার আহ্বান জানায় আর ঐ ব্যক্তি শুধু আল্লাহর ভয়েই বিরত থাকে; এবং ৭. যে ব্যক্তি এত গোপনে দান করে যে তার ডান হাত কি দান করলো বাম হাতও তা জানলো না। (বুখারী, মুসলিম)
পৃষ্ঠা:১৪৮
শব্দার্থঃ سبعة : সাত। يُطِلُهُمُ اللهُ : আল্লাহ তাদেরকে ছায়া দান করবেন। في ظل : তার (আরশের) ছায়ায়। يوم لاظل: যে দিন কোন ছ।না থাকবে না। ১!: ব্যতীত। বড়: তাঁর (আরশের) ছায়إمَامُ : ন্যায়পরায়ণ নেতা। و شاب : যুবক। : অতিবাহিত করা, জন্ম, প্রবৃদ্ধি। فِي عبادة الله : আল্লাহর ইবাদতে। جُل ব্যক্তি। قلبُه : অন্তকরণ। معلق: ঝুলন্ত। بالنجد: মসজিদের সাথে। ।১!: যখন। خرج : তিনি বের হলেন। : উহা হতে। حتى : যতক্ষণ يعود : সে ফিরে আসে, সে প্রত্যাবর্তন করে। إلَيْهِ: তার দিকে। رجلان: দু’ব্যক্তি। تَحَابًا : পরস্পর ভালবাসা। في الله : আল্লাহর জন্য। اجتمعًا : পরস্পর মিলিত হয়। এঁও: পরস্পর পৃথক হয়। ذكر الله : আল্লার স্মরণে। خاليًا: নির্জন, নিরালয়। ففاضت عيناه : অতঃপর চোখের পানি ফেলে। دَعَتْه তাকে ডেকেছে। চإمرأ : স্ত্রী লোক। ذات وجمال : সম্ভ্রান্ত বংশের কোন সুন্দরী রমণী। إِنِّى أَخَافُ اللَّهِ : আমি আল্লাহকে ভয় করি। تَصَدَّقَ : দান করে। ا تَعْلَمُ১ঃ সে জানতে পারে না। যত: তার উত্তর দিক, মানে বাম হাত। مَا تُنْفِقُ : কি দান করেছে। بيمينه : তার ডান হাত দ্বারা। বিষয়বস্তু ও গুরুত্ব: আলোচ্য পবিত্র হাদীসখানায় প্রকৃত ঈমানদার ও পরহেযগার লোকদের বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যারা কিয়ামতের দিন কঠিন মুছিবতের সময় আল্লাহর আরশের নিচে ছায়া পাওয়ার গৌরব অর্জন করতে সক্ষম হবেন। এ সকল ব্যক্তিগণই সেদিন ধন্য হবেন যেদিন আল্লাহর আরশের ছায়া ছাড়া কোন ছায়া থাকবে না। ন্যায়পরায়ণ নেতা, যিনি আল্লাহর বিধান মোতাবেক নেতৃত্ব দিয়েছেন। যে যুবক যৌবনকাল আল্লাহর ইবাদতে কাটিয়েছে। যে নামাযী মসজিদে নামাযের জন্য ব্যাকুল ছিলো। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে পরস্পর মিলিত ও পৃথক হয়েছে। যে নির্জনে আল্লাহর ভয়ে কেঁদেছে। যে যুবক সুন্দরী রমণীর আহ্বানেও অন্যায় কাজে লিপ্ত হয়নি। যে অতি গোপনে দান
পৃষ্ঠা:১৪৯
করেছে যা কেউ বুঝতে পারেনি। যেহেতু এ সকল করেছে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে, এদেরকেই আল্লাহ রহমতের ছায়া দান করবেন।
গ্রন্থ পরিচিতি
সহীহ আল বুখারী ৫ নং দারসে এবং সহীহ মুসলিমের পরিচিতি ১ নং দারসে উল্লেখ করা হয়েছে। রাবী পরিচিতি: এই হাদীসের রাবী আবু হুরায়রা (রা) এর পরিচিতি ১ নং দারসে দেখুন। বিস্তারিত আলোচনা ১. ন্যায়পরায়ণ নেতা: এখানে সর্বস্তরের দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে বুঝানো হয়েছে। চাই পরিবারের, সমাজ, রাষ্ট্র অথবা কোন দলের নেতাই হোক না কেন। তাকে ন্যায়-ইনসাফের সাথেই নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব করতে হবে। কেননা এ কর্তৃত্ব সম্পর্কেও আল্লাহ রাব্বুল আলামীন জিজ্ঞাসা করবেন। এ প্রসঙ্গে রাসূলের বাণী: الا كُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ. “সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব সম্পর্কেই জিজ্ঞাসা করা হবে।” (বুখারী-মুসলিম) তাই সকল পর্যায়ে নেতৃত্বের জন্য চাই ইনসাফ কায়েম করা। ইনসাফভিত্তিক নেতৃত্ব কায়েম না করলে অধীনস্থদের মাঝে সৃষ্টি হবে ভুল বুঝাবুঝি। নেতৃত্বের প্রতি অনীহা ও আনুগত্যহীনতার কারণে সমাজ বিশৃঙ্খলা ও ধ্বংসের দিকে চলে যায়। নেতৃত্বে বিপর্যয় সৃষ্টিকারীকে আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। এ প্রসঙ্গে রাসূল (সা) বলেনঃ “যে ব্যক্তি মুসলমানের যাবতীয় ব্যাপারে দায়িত্বশীল হওয়ার পর তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে আল্লাহ তার জন্য বেহেশত হারাম করে দিবেন।” (বুখারী, মুসলিম) ২. যৌবনকাল ৪ যৌবনকাল মানুষের কর্মস্পৃহা ও কর্ম চাঞ্চল্যের সময়। হাদীসে বার্ধক্যের পূর্বে যৌবনকে গুরুত্ব দেয়ার কথা বলা হয়েছে। কেননা, যৌবনকালই হচ্ছে মানুষের কর্মশক্তির এক মাত্র উৎকৃষ্ট সময়। যৌবনে যা
পৃষ্ঠা:১৫০
করা যায় বার্ধক্যে তা করা যায় না। যৌবনকালে মানুষের শক্তি-সাহস বেশী থাকে। তখন সে আল্লাহর পথে জীবন উৎসর্গ করতেও দ্বিধা করে না। আল্লাহর সকল হুকুম পালন ও ইবাদতে ক্লান্ত হয় না। পক্ষান্তরে বার্ধক্যে ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে ইবাদতের হক আদায় করে তা পালন করা যায় না। যৌবনকালেই মানুষ ভাঙ্গতে পারে গড়তে পারে। ইসলামের প্রথম যুগে আল্লাহর নবীর সাথে যারা দীন কায়েমের আন্দোলনে শামিল হয়েছেন তারা অধিকাংশ ছিলেন যুবক। তারাই দীনের পতাকা নিয়ে সামনে অগ্রসর হয়েছেন বেশী। তারা পৃথিবীর দিকে দিকে ইসলামের পতাকা উড্ডীন করে ইতিহাস সৃষ্টি করে গিয়েছেন। এসবই তাদের যৌবনের ফসল। কাজেই আমাদেরকে বার্ধক্য আসার আগে যৌবনের গুরুত্ব দিতে হব। যৌবনের সমস্ত শক্তি সামর্থ্য আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত করতে হবে। যে কোন বিপ্লব একমাত্র যুবক শ্রেণীর দ্বারাই সংঘটিত হতে পারে। আর বার্ধক্য আসার পূর্বেই আল্লাহর ইবাদতে বেশী মনযোগী হওয়া প্রয়োজন। কেননা ঐ যুবক যে তাঁর যৌবনকাল আল্লাহর ইবাদতে কাটিয়েছে, সে আল্লাহর আরশের ছায়ায় স্থান লাভ করবে। ৩. এমন মুসল্লী যার অন্তকরণ মসজিদের সাথেঃ এমন (মুসল্লি) ব্যক্তি যার অন্তকরণ মসজিদের সাথে লটকানো থাকে, একবার মসজিদ থেকে বের হলে পুনরায় প্রত্যাবর্তন না করা পর্যন্ত ব্যাকুল থাকে। দৈনিক পাঁচবার নামাযের ওয়াক্ত মুসল্লীদের সামনে ঘুরে আসে। যারা নিয়মিতভাবে নামায আদায় করেন তারা দুনিয়ার সকল কাজকর্ম করার মধ্যেও নামাযের কথা ভুলে যান না। এক ওয়াক্ত নামায আদায় করে আর এক ওয়াক্ত নামাযের জন্য মন ব্যাকুল থাকে; কখন আর এক ওয়াক্ত নামাযের সময় হবে এবং সে নামায আদায় করতে মসজিদে হাজির হবেন। যা মূলতঃ তার অন্তর মসজিদে লটকানোর মতই।
৪. পরস্পর মিলিত হওয়া ও পৃথক হওয়াঃ মুসলমানদের প্রত্যেকটি কাজ আল্লাহর উদ্দেশ্যে এবং ঈমানের পরিপূর্ণতার জন্যই হওয়া উচিত। তাই যে ব্যক্তি কোন কিছুকে ভালবাসবে আল্লাহর জন্য এবং কোন কিছুকে পরিহার করবে তাও আল্লাহর জন্য, কেবল তখনই সে ব্যক্তি তার ঈমানকে পরিপূর্ণ
পৃষ্ঠা ১৫১ থেকে ১৬৫
পৃষ্ঠা:১৫১
করতে পারবে। তাই এমন দু’ব্যক্তি যারা কেবল মাত্র আল্লাহর মহব্বতে পরস্পর মিলিত হয় এবং পৃথক হয় তাও আল্লাহকে সন্তুষ্টির জন্য, কেবল তারাই ঈমানকে পরিপূর্ণ করে নিতে পারে। (আবু দাউদ) আল্লাহর দীনের কারণেই দীনি ভাইদেরকে মহব্বত করা ও যারা কুফরিতে লিপ্ত যাদেরকে শত চেষ্টা করেও দীনের পথে আনা যায় না তাদের থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করা প্রয়োজন। ৫. আল্লাহর ভয়ে চোখের অশ্রু ফেলাঃ যে ব্যক্তি নির্জনে আল্লাহর ভয়ে চোখের অশ্রু ফেলে আরশের নীচে ছায়া দেয়ার কথা এ হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। দু’কারণে চোখের অশ্রু ফেলে; প্রথমতঃ আল্লাহর আজমত-জালালাত বা শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্বের জন্য। দ্বিতীয়তঃ নিজের অপরাধ তথা মুক্তির জন্য। একথা চিন্তা করা যে আল্লাহ তা’আলা আমাকে আশ্রাফুল মাখলুকাত (সৃষ্টির সেরা জীব) হিসেবে সৃষ্টি করেছেন, যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ। তার হুকুম আহকাম মেনে চলা আমার একান্ত কর্তব্য। তা না হলে পরকালে আমাকে শাস্তি ভোগ করতে হবে। পরাক্রমশালী আল্লাহর ভয়ে ভীত হয়ে যে ব্যক্তি নির্জনে চোখের অশ্রু ফেলে তাকে আল্লাহ আরশের ছায়ায় স্থান দান করবেন। জাহান্নাম থেকে রক্ষা করবেন। রাসূল (সা) বলেনঃ لا يَلِجُ النَّارَ رَجُلٌ بَكَى مِنْ خَشْيَةِ اللهِ حَتَّى يَعُودَ اللَّينَ فِي الضَّرْعِ وَلَا يَجْتَمِعُ عُبَارُ فِي سَبِيلِ لِلَّهِ وَدُخَانُ جَهَنَّمَ. “যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে অশ্রুপাত করেছে তার জাহান্নামে প্রবেশ করা তেমনি অসম্ভব যেমন অসম্ভব দোহন করা দুধকে ওলানে পুনরায় প্রবেশ করানো। যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে তার পথে জিহাদ করেছে সে ব্যক্তি আর জাহান্নামের ধোঁয়া একত্র হবে না। (তিরমিযী) অপর এক হাদীসে জানা যায়, দু’ধরনের চক্ষুকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করতে পারবে না। ১. যে চক্ষু আল্লাহর ভয় অশ্রু ঝরায়, ২. ঐ চক্ষু যা আল্লাহর পথে রাত জেগে পাহারা দেয়। (বুখারী)
পৃষ্ঠা:১৫২
৬. চরিত্রের হিফাযত: মানুষ যখন যৌবন লাভ করে তখন নারী পুরুষের এবং পুরুষ নারীর সান্নিধ্য চায়। বিশেষ করে যুবক বয়সে কামনা-বাসনার স্পৃহা অতি প্রকট হয়ে দেখা দেয়। সে সময় কোন সম্ভ্রান্ত বংশের সুন্দরী রমণী যদি কোন পুরুষকে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার আহ্বান জানায় আর এ মুহূর্তে ঐ ব্যক্তি শুধু আল্লাহর ভয়েই বিরত থাকে এবং নিজের চরিত্রের হিফাযত করে তবেই সে আল্লাহর আরশের ছায়ায় স্থান লাভ করতে পারবে। আল্লাহ তা’আলা বলেন: ولا تَقْرَبُوا الزنى إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاءَ سَبِيلاً. “আর তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং অসৎ পন্থা।” (সূরা বনী ইসরাঈল: ৩২) ولا تقربوا الفواحش مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ. “লজ্জাহীনতার যত পন্থা আছে উহার নিকটেও যেয়ো না, তা প্রকাশ্যে হোক অথবা গোপনে হোক। (সূরা আল-আনআম: ১৫২) আল্লাহ তা’আলা যৌন চাহিদা পূরণ করার জন্য মেহেরবানী করে বিবাহের বৈধ পন্থা রেখেছেন। শুধুমাত্র আল্লাহর ভয় ও পরকালের জবাবদিহিতাই মানুষের চরিত্রকে হিফাযত করতে পারে। আল্লাহ বলেন: وَالَّذِينَ هُمْ لِفُرُوجِهِمْ حَفِظُونَ إِلَّا عَلَى أَزْوَاجِهِمْ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ فَإِنَّهُمْ غَيْرُ مَلُومِينَ. “এবং যারা নিজেদের যৌনাঙ্গকে সংযত রাখে। তবে তাদের স্ত্রী ও মালিকানাভুক্ত দাসীদের ক্ষেত্রে সংযত না হলে তারা তিরস্কৃত হবে না।” (সুরা আল-মুমিনুন: ৫)
৭. গোপনে দান করাঃ দান করতে আল্লাহ তা’আলা নির্দেশ দিয়েছেন। وَانْفِقُوا مِنْ مَّا رَزَقْنَكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِي أَحَدَكُمُ الْمَوْتُ. “আমি তোমাদেরকে যে রিযিক দান করেছি তা থেকে খরচ করো মৃত্যু আসার আগেই।” (সূরা আল-মুনাফিকূন: ১০)
পৃষ্ঠা:১৫৩
لَنْ تَنَالُوا الْبِرْحَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ. “তোমরা কিছুতেই প্রকৃত কল্যাণ লাভ করতে পারবে না যে পর্যন্ত তোমাদের প্রিয় বস্তুগুলোকে আল্লাহর পথে ব্যয় না করবে।” (সূরা আলে- ইমরান: ৯২) আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই দান করতে হবে। আর তা হতে হবে গোপনে যাতে দানকারীর মধ্যে লোক দেখানো কোন মনোভাব সৃষ্টি না হয়। অপর এক হাদীসে জানা যায় রাসূল (সা) বলেছেন: إِنَّ اللَّهَ لَا يَنْظُرُ إِلَى صُورِكُمْ وَأَمْوَالِكُمْ وَلَكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوْبِكُمْ وَاعْمَالِكُمْ. “আল্লাহ তোমাদের সৌন্দর্য ও সম্পদের দিকে লক্ষ্য করেন না, বরং তোমাদের অন্তকরণ ও কাজের দিকে লক্ষ্য করেন।” (মুসলিম) অতএব দান করতে হবে এত গোপনে যে, দানকারীর ডান হাত কি দান করলো তার বাম হাতও যেন তা না জানে। তাহলেই কেবল পূর্ণ সওয়াব পাওয়া যাবে। আল্লাহর আরশের ছায়াতে স্থান লাভ করা যাবে।
শিক্ষা ১. নেতৃত্ব দান করতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তাঁর রাসূলের পদাংক অনুসারে। ২. যৌবনের শক্তি সামর্থ্য দীন প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত রাখতে হবে। ৩. সামাজিকভাবে নামাযকে কায়েম করতে হবে ও নামাযের পূর্ণ পাবন্দ হতে হবে। ৪. মানুষের সাথে ভালবাসা ও শত্রুতার ভিত্তি হবে কেবল মাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি। ৫. অপরাধের জন্যে আল্লাহর নিকট অশ্রু ফেলে ক্ষমা চাইতে হবে।৬. পরিপূর্ণভাবে পর্দা প্রথা চালু ও অনুসরণ করতে হবে। ৭. নিজের সম্পদ থেকে গোপনে ও নিঃস্বার্থভাবে আল্লাহর পথে দান করতে হবে।