Skip to content

দারসে হাদীস -১ম খন্ড _হাঃপারভিন

কবিতা ১ থেকে ১৫

পৃষ্ঠা:০১

দারস-১নিয়তের গুরুত্ব: عَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ (رض) عَلَى الْمِنْبَرِ يَقُوْلُ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ (صلعم) يَقُولُ إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ وَإِنَّمَا لِامْرِئٍ مَا نَوَى فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى دُنْيَا يُصِيبُهَا أَوْ إِلَى امْرَأَةٍ يَنْكِحُهَا فَهِجْرَتُهُ إِلَى مَا هَاجَرَ إلَيْهِ. (بخاری) অর্থ: আমীরুল মু’মিনীন হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি মিম্বারের উপর উঠে বলেছিলেন: আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বলতে শুনেছি, যাবতীয় কাজের ফলাফল নিয়তের উপর নির্ভরশীল। প্রত্যেক ব্যক্তি তাই পাবে যা সে নিয়ত করেছে। কাজেই যার হিজরত দুনিয়ার কোন স্বার্থ হাসিলের জন্য কিংবা কোন রমণীকে বিবাহ করার নিয়তে হয়েছে, তার হিজরত সে উদ্দেশ্যেই হয়েছে। (বুখারী) শব্দার্থ : عَنْ : হতে। قَالَ: তিনি বলেছেন। : নিশ্চয়ই। : لامرئ : (90) Aarone : النِّيَّاتُ : : الأَعْمَالُ মানুষের জন্য। مَا যা। نوی: সে নিয়ত করল। : অতঃপর। مَنْ: যে )ব্যক্তি)। هِجْرَتُه : তার হিজরত। كانت: ছিল। ১ঃ প্রতি, দিকে। دُنْيَا : পৃথিবী। يُصِيبُهَا: সে তা লাভ করবে। চাঁاِمر: স্ত্রী লোক। يَنْكِحُهَا : সে তাকে বিবাহ করবে। هَاجَرَ: সে হিজরত করল। مَنْ : যে ব্যক্তি। كَانَتْ : সে (স্ত্রী) ছিল। هِجْرَتَۀ : তার হিজরত। إِلَيْهِ : তার দিকে। ব্যাখ্যা: আলোচ্য হাদীসখানায় নিয়তের গুরুত্ব, আমল ও হিজরত সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। মুসলমানদের প্রত্যেকটি কাজে নিয়তের বিশুদ্ধতা

পৃষ্ঠা:০২

– থাকা অত্যাবশ্যক। প্রতিটি কর্ম আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা) সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই করা উচিত। কোন কাজে বিশুদ্ধ নিয়ত না থাকলে সে কাজ আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না। তাই আল্লাহর নিকট কোন কাজের পুরস্কার পেতে হলে প্রত্যেকটি কাজে নিয়তের বিশুদ্ধতা থাকা অপরিহার্য। এমনকি হিজরতের মত গুরুত্বপূর্ণ দীনি কাজেও নিয়তের বিশুদ্ধতা না থাকলে তা আল্লাহর নিকট গ্রহণীয় হবে না এবং তার প্রতিদান পাওয়া যাবে না। আল্লাহ তা’য়ালা কাজের সাথে বান্দার অন্তরের অবস্থাও দেখতে চান। عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ (رض) قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ (صلعم) إِنَّ اللَّهَ لَا يَنْظُرُ إِلَى صُورِكُمْ وَأَمْوَالِكُمْ وَلَكِنْ يُنْظُرُ إِلَى قُلُوْبِكُمْ وَاعْمَالِكُمْ. (مسلم) হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম (সা) বলেছেন: “আল্লাহ তা’য়ালা তোমাদের সৌন্দর্য ও সম্পদের দিকে লক্ষ্য করেন না, বরং তোমাদের অন্তর ও কাজের দিকে লক্ষ্য করেন।” (মুসলিম) বিশুদ্ধ নিয়ত প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’য়ালা বলেনঃ “আর তাদেরকে হুকুম করা হয়েছে যে তারা যেন একনিষ্ঠ হয়ে আন্তরিকভাবে আল্লাহর দীন পালনের মাধ্যমে একমাত্র তাঁরই ইবাদত করে।” (সূরা আল-বাইয়িনাহঃ ৫) “আপনি বলুন, তোমরা তোমাদের মনের কথা গোপন রাখ অথবা প্রকাশ কর, তা সবই আল্লাহ জানেন”। (সূরা আলে-ইমরান: ২৯) মুসলিম শরীফের অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছে, “কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম এমন ব্যক্তির বিচার করা হবে, যিনি আল্লাহর পথে শহীদ হয়েছেন। তাকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে হাজির করে তার প্রতি আল্লাহ প্রদত্ত যাবতীয় নি’য়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হবে। সে ঐ সব নি’য়ামত প্রাপ্তি ও ভোগের কথা স্বীকার করবে। অতঃপর তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে তুমি আমার এসব নি’য়ামত পেয়ে কি করেছো? সে উত্তরে বলবে আমি আপনার পথে লড়াই করতে করতে শেষ পর্যন্ত শহীদ হয়েছি। আল্লাহ বলবেনঃ তুমি মিথ্যা বলেছো। তুমি বীর খ্যাতি অর্জনের

পৃষ্ঠা:০৩

জন্য লড়াই করেছো এবং সে খ্যাতি তুমি দুনিয়াতে পেয়েছো। অতঃপর তাকে উপুড় করে পা ধরে টেনে হেচড়ে দোযখে নিক্ষেপ করার হুকুম দেয়া হবে এবং এভাবে সে দোযখে নিক্ষিপ্ত হবে। এরপর আল্লাহর দরবারে এমন এক ব্যক্তিকে হাজির করা হবে যে দীনের জ্ঞান অর্জন করেছে, দীনের জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছে এবং আল-কুরআন পড়েছে। তাকে তার প্রতি প্রদত্ত নি’য়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হবে। সে ঐ সব নিয়ামত প্রাপ্তি ও ভোগের কথা স্বীকার করবে। অতঃপর তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, তুমি আমার এসব নি’য়ামত পেয়ে কি করেছো? সে বলবে আমি দীনি ইল্ম অর্জন করেছি, তা অপরকে শিক্ষা দিয়েছি এবং আপনার সন্তুষ্টির জন্য আল-কুরআন পড়েছি। আল্লাহ বলবেন তুমি মিথ্যা বলেছো। তুমি আলেম। খ্যাতি লাভের জন্য ইল্‌ল্ম অর্জন করেছো। তুমি কারীরূপে খ্যাত হওয়ার জন্য আল-কুরআন পড়েছো। সে খ্যাতি তুমি দুনিয়াতে পেয়েছো। তারপর ফয়সালা দেয়া হবে, অতঃপর তাকে উপুড় করে পা ধরে টেনে হেচড়ে দোযখে নিক্ষেপ করার হুকুম দেয়া হবে এবং এভাবেই সে দোযখে নিক্ষিপ্ত হবে। এরপর হাজির করা হবে এমন এক ব্যক্তিকে যাকে আল্লাহ সচ্ছলতা ও নানা রকম ধন-সম্পদ দান করেছেন। তাকে তার প্রতি প্রদত্ত নি’য়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হবে। সে ঐ সব নি’য়ামত প্রাপ্তি ও ভোগের কথা স্বীকার করবে। অতঃপর তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, তুমি আমার এসব নি’য়ামত পেয়ে কি করেছো? সে বলবে আমি আপনার পছন্দনীয় সব খাতেই আমার সম্পদ খরচ করেছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছো। তুমি দাতারূপে খ্যাতি লাভের জন্যেই দান করেছো। তারপর ফয়সালা দেয়া হবে। অতঃপর তাকে উপুড় করে পা ধরে টেনে হেচড়ে দোযখে নিক্ষেপ করা হবে এবং এভাবেই সে দোযখে নিক্ষিপ্ত হবে। (মুসলিম) কাজেই বুঝা গেল যারা দুনিয়ার স্বার্থ লাভের নিয়তে কাজ করবে তারা দুনিয়াই লাভ করবে আর যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কাজ করবে তারা দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতে সাফল্য লাভ করবে।

পৃষ্ঠা:০৪

গ্রন্থ পরিচিতিঃ সহীহ আল-বুখারী।: হাদীস বিশারদগণ হিজরী তৃতীয় শতাব্দীর প্রথমার্ধে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের বিক্ষিপ্ত হাদীসসমূহ ‘মুসনাদ’ আকারে লিপিবদ্ধ করেন। পরবর্তীকালে মুহাদ্দিসগণ যাচাই-বাছাই করে (সহীহ) বিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থ লিখার কাজে হাত দেন। এর ফলশ্রুতিতে হিজরী তৃতীয় শতাব্দীর মাঝামাঝি ও শেষার্ধে বিশ্ব বিখ্যাত ‘সিহাহ সিত্তা’ বা ছয়খানি বিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থ জগতবাসীর কাছে উপস্থাপন করা হয়। এ গ্রন্থগুলোর মধ্যে সর্বাপেক্ষা অধিক বিশুদ্ধতম অমর হাদীস গ্রন্থ হচ্ছে ‘সহীহুল বুখারী’। ইমাম বুখারী (র) এ গ্রন্থের প্রণেতা। তাঁর পূর্ণ নাম হলো মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল ইবনে ইবরাহীম ইবনে মুগীরা ইবনে বারদিযবাহ আল-যু’ফী আল-বুখারী। তিনি ১৯৪ হিজরী ১৩ই শাওয়াল বুখারা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন। অতি অল্প বয়সে পবিত্র কুরআনকে মুখস্থ করেন। তিনি হাফিযে হাদীস ছিলেন। তিনি নিজেই বলেন: ‘তিন লক্ষ’ হাদীস তাঁর মুখস্থ ছিল। তাছাড়া তিনি ছয় লক্ষ হাদীস থেকে যাচাই-বাছাই করে ১৬ বছরে এ গ্রন্থখানি সংকলন করেন। যার মধ্যে ৭,৩৯৭ তাকরারসহ ও তাকরার ছাড়া ২,৫১৩টি হাদীস স্থান পেয়েছে। হাদীস সংকলনের পূর্বে ইমাম বুখারী (র) গোসল করে দু’রাকাত সালাত আদায় করে ইসতিখারা করার পর এক একটি হাদীস লিপিবদ্ধ করেছেন। সকল মুহাদ্দিসগণের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত মতে, সকল হাদীস গ্রন্থের মধ্যে বুখারী শরীফের মর্যাদা সবচেয়ে বেশী। তাই বলা হয়ঃ اصَحُ الْكُتُبِ بَعْدَ كِتَابِ اللَّهِ تَحْتَ السَّمَاءِ صَحِيحُ الْبُخَارِي. “আল্লাহর কিতাবের পর আসমানের নিচে সর্বাধিক সহীহ গ্রন্থ হচ্ছে সহীহুল বুখারী।” (মুকাদ্দামা ফতহুল বারী ওয়া উমদাতুল কারী) ইমাম বুখারী (র) সহজ-সরল, বিনয়ী, দয়ালু উন্নত চারিত্রিক গুণসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি নিজেই বলেন, “আমি জীবনে কোন দিন কারো

পৃষ্ঠা:০৫

কোন গীবত করিনি।” এই মহা মনীষী ২৫৬ হিজরী ১লা শাওয়াল ঈদুল ফিতর ভোর রাতে ইনতিকাল করেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। রাবী পরিচিতি: হযরত উমর (রা)। মূল নামঃ উমর। উপনাম: আবু হাফস। উপাধি: আল-ফারুক। পিতার নাম: খাত্তাব। মাতার নাম: হানতামা বিনতে হাশেম ইবনে মুগিরা। জন্মগ্রহণ: হযরত উমর (রা) হিজরতের ৪০ বছর পূর্বে রাসূল (সা)-এর জন্মের ১৩ বছর পর ৫৮৩ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক জীবন: প্রাথমিক জীবনে হযরত উমর (রা) পিতা-মাতার আদরে লালিত-পালিত হন। পিতার উট চরাতে সাহায্য করেন। যৌবনের প্রারম্ভে যুদ্ধবিদ্যা, কুস্তি, বক্তৃতা এবং নসবনামা শিক্ষা লাভ করে আত্ম-প্রত্যয়ী যুবক হিসাবে বেড়ে ওঠেন। ইসলাম গ্রহণ: তিনি নবুওয়াতের ৬ষ্ঠ সালে ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বে ৩৯ জন পুরুষ ইসলাম গ্রহণ করায় তাকে নিয়ে ৪০ জন পূর্ণ হয়। অতঃপর প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের কাজ শুরু হয়। রাসূল (সা) তাঁকে ফারুক উপাধিতে ভূষিত করেন। (উসদুল গাবা) খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণঃ হযরত আবু বকর (রা)-এর ইনতিকালের পর হিজরী ১৩ সালের ২৩ জমাদিউল উখরা মোতাবেক ২৪শে আগষ্ট ৬৩৪ সালে খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর খিলাফত কাল ছিল ১০ বছর ৬ মাস। তাঁর শাসনামলে সর্বাধিক রাজ্য জয় হয়। বিজিত রাজ্যের সংখ্যা ছিল ১০৩৬। তিনি সর্বপ্রথম হিজরী সন প্রবর্তন করেন। সামরিক কেন্দ্রসমূহ প্রতিষ্ঠা, কাজীর পদ সৃষ্টি ও বিধর্মীদের অধিকার সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। মূল কথা তিনিই ইসলামী রাষ্ট্র বাস্তব ভিত্তির উপর স্থাপিত করেন। (তাবাকাতে ইবনে সা’দ) হাদীস বর্ণনার সংখ্যাঃ তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ৫৩৯ খানা। বুখারী শরীফে এককভাবে ৯ খানা ও মুসলিম শরীফে এককভাবে ১৫ খানা। উভয় গ্রন্থে সর্বমোট ২৪ খানা হাদীস সন্নিবেশিত হয়েছে। তিনি বিপুল সংখ্যক

পৃষ্ঠা:০৬

হাদীস সংগ্রহ করেন ও লিপিবদ্ধ করে রাজ্যের বিভিন্ন শাসকদের নিকট প্রেরণ করেন। জনসাধারণকে হাদীস শিক্ষা দানের জন্য তিনি বড় বড় সাহাবীদেরকে বিভিন্ন রাজ্যে পাঠান। সেখানে তারা হাদীসের প্রশিক্ষণ দেন ও হাদীস শাস্ত্রের বিজ্ঞ বিজ্ঞ মুহাদ্দিস তৈরী করেন। ইমাম যাত্রী বলেন, “হাদীস, রিওয়ায়াতের ব্যাপারে তিনি মুহাদ্দিসগণের জন্য মজবুত নীতিমালা প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন।” রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যস্ত থাকায় তাঁর হাদীস বর্ণনার সংখ্যা কম। তাছাড়া তিনি হাদীস সংকলনের ক্ষেত্রে এ আশংকায় জড়িত হয়ে পড়েন যে সুসংঘবদ্ধ ও সংকলিত হাদীস গ্রন্থ জনসাধারণের হাতে পৌঁছলে তারা কুরআনের তুলনায় হাদীসকে বেশী গুরুত্ব দিয়ে বসতে পারে। শাহাদাত লাভঃ হিজরী ২৩ সালের ২৪শে জিলহাজ্জ বুধবার মসজিদে নববীতে নামাযের ইমামতি করার সময় মুগীরা বিন শু’বার দাস আবু লু’লু’ বিষাক্ত তরবারি দ্বারা আঘাত করলে আহত অবস্থায় তিন দিন অতিবাহিত করার পর ২৭শে জিলহাজ্জ শনিবার শাহাদাত লাভ করেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন) মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। (তাবাকাতে ইবনে সা’দ) হাদীসের পটভূমিঃ এ হাদীসের একটি ঐতিহাসিক প্রসঙ্গ ও উপলক্ষ্য রয়েছে। তা হলো, আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা) নবুওয়াত প্রাপ্তির পর মক্কার লোকদেরকে দীনে হকের প্রতি আহ্বান করলে কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠি সে কাজে বাধা দেয়। আল্লাহর বাণী তথা দীনে হকের দাওয়াত গণ-মানুষের কর্ণ কুহরে পৌঁছে দেয়ার জন্য রাসূলে করীম (সা) তাঁর সঙ্গী-সাথীদেরকে নিয়ে মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেন এবং অন্যান্য সকল মুসলমানকে চতুর্দিক থেকে হিজরত করে মদীনায় উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দেন। তখন নিষ্ঠাবান সকল মুসলমানগণ হিজরত করে মদীনায় হাজির হন। তাদের মধ্যে উম্মে কায়েস বা কায়েলা নামের একজন মহিলা ছিলেন। একজন পুরুষ উক্ত মহিলাকে বিবাহ করার জন্য মদীনায় হিজরত করেন।

পৃষ্ঠা:০৭ 

কিন্তু হিজরতের ব্যাপারে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ পালন ও সাওয়াব লাভ করার দিকে তার বিন্দুমাত্র লক্ষ্য ছিল না। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টির জন্য হিজরত না করায় তাঁর হিজরত গ্রহণযোগ্য হয়নি। অনুরূপভাবে প্রত্যেক কাজে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টির নিয়ত না থাকলে তা আল্লাহর কাছে গৃহীত হবে না। তাই হিজরতের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ ও কষ্টকর আমলের মধ্যেও যদি নিয়তের বিশুদ্ধতা না পাওয়া যায় তাহলে তাতেও কোন প্রতিদান পাওয়ার আশা করা যায় না। হাদীসে উল্লেখিত মহিলার পরিচয়ঃ যাকে বিবাহ করার উদ্দেশ্যে এক ব্যক্তি মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেছিলেন, তার নাম হলো- কায়েলা, তার উপনাম উম্মে কায়েস, আর যে পুরুষ লোকটি তাকে বিবাহ করার উদ্দেশ্যে হিজরত করেছিলেন তার নাম জানা যায় নাই। তবে তাকে মুহাজিরে উম্মে কায়েস বলা হত। সম্ভবতঃ একজন সাহাবীর পরিচয়ের সাথে তার কাজের মিল না থাকায় তার নাম উল্লেখ করা হয় নাই। (উমদাতুল কারী) হাদীসটির গুরুত্ব: ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় নিয়তের গুরুত্ব অপরিসীম। নিয়তের এ হাদীসখানা ইসলামের একটি মূল ফর্মূলা হিসেবে গণ্য। এতে অল্প শব্দে অধিক অর্থ নিহিত রয়েছে। কারো কারো মতে ইসলাম সম্পর্কিত ইলমে এর গুরুত্ব এক-তৃতীয়াংশ। আল্লামা ইমাম খাত্তাবী (র) বলেন, সকল কাজের পরিশুদ্ধতা ও তার ফলাফল লাভ নিয়ত অনুযায়ী হয়। কেননা নিয়তই মানুষের কাজের দিক নির্ণয় করে। বিশুদ্ধ ছয়খানা হাদীসের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হাদীস গ্রন্থ বুখারী শরীফের সর্ব প্রথমে ইমাম বুখারী (র) নিয়তের হাদীসখানা উপস্থাপন করেছেন। আল্লামা বদরুদ্দিন আইনী (র) বলেন, ইমাম মালেকের মুওয়াত্তা ব্যতীত অন্যান্য সকল হাদীস গ্রন্থে নিয়তের এ হাদীসটি উদ্ধৃত হয়েছে। হযরত উমর (রা) তাঁর প্রত্যেক ভাষণের সূচনাতে এ হাদীসখানা পাঠ করে নিয়তের বিশুদ্ধতার কথা স্মরণ করিয়ে দিতেন।

পৃষ্ঠা:০৮

নিয়তের অর্থ: নিয়তের আভিধানিক অর্থ- القصدُ والإزادَةُ ইচ্ছা, স্পৃহা, মনের দৃঢ় সংকল্প ইত্যাদি। শরীয়াতের দৃষ্টিতে- আল্লাহ তা’য়ালার সন্তোষ লাভ ও তাঁর আদেশ পালনের উদ্দেশ্যে কোন কাজ করার দিকে হৃদয় মনের লক্ষ্য আরোপ ও উদ্যোগকে নিয়ত বলে। ফতহুর রব্বানী গ্রন্থকার বলেনঃ تَوَجَّهُ الْقَلْبِ جَهَةَ الْفِعْلِ ابْتِغَاءَ وَجْهِ اللَّهِ تَعَالَى وَامْتِتَالاً لأَمْرِهِ. “আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ ও তাঁর আদেশ পালনার্থে কোন কাজের দিকে মনের ঐকান্তিক আগ্রহ ও অভিপ্রায় প্রয়োগ করা।” (ফতহুর রব্বানী ২য় খণ্ড পৃ. ১৭) আল্লামা ইমাম খাত্তাবী (র) বলেনঃ هُوَ قَصْدُكَ الشيء بقلبك وتحرى الطلب منك. “মনে কোন কাজ করার সদিচ্ছা পোষণ করা এবং উহা বাস্তবায়নের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করাকে নিয়ত বলা হয়।” নূরুল ইযা গ্রন্থকার বলেন: النيةُ هُوَ قَصْدُ الْقَلْبِ عَلَى الْفِعْل. “কাজের উপর মনের ইচ্ছা পোষণ করাকে নিয়ত বলা হয়।” প্রত্যেকটি কাজের শুরুতেই নিয়ত করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ক্ষেত্রে আল্লামা ইমাম বায়যাবী (র) তাঁর মতামত নিম্নের ভাষায় ব্যক্ত করেনঃ إِنْبِعَاتُ الْقَلْبِ نَحْوَ مَا يَرَاهُ مُوَافِقًا لِغَرْضِ مِّنْ جَلْبٍ نَفْعٍ أَوْ دَفْعِ ضَرَرِ حالاً أو مالاً. “বর্তমান কিংবা ভবিষ্যতের কোন উপকার লাভ বা কোন ক্ষতি প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে অনুকূল কাজ করার জন্যে মনের উদ্যোগ ও উদ্বোধনকেই নিয়ত বলে।” (উমদাতুল কারী ১ম খণ্ড ৬৩ পৃঃ) মোটকথা কোন কাজের পিছনে যে উদ্দেশ্য মানব মনে ক্রিয়াশীল থাকে, চাই তা ভাল কাজ হউক কিংবা মন্দ কাজ, তাকেই ‘নিয়ত’ নামে অভিহিত করা হয়।

পৃষ্ঠা:০৯

ইবাদতমূলক কাজে নিয়তের গুরুত্ব ইবাদত বুনিয়াদী পর্যায়ে দু’প্রকার। যথা-

১। মাকসুদা বা মূল ইবাদত;

২। গায়রে মাকসুদা বা সহায়ক ইবাদত।

১। ইবাদতে মাকসুদা যে ইবাদতের দ্বারা সওয়াব পাওয়ার সাথে সাথে দায়িত্ব মুক্তির উদ্দেশ্যও নিহিত থাকে তাকে ইবাদতে মাকসুদা বা মূল ইবাদত বলে। যেমন- নামায, রোযা, হজ্জ ইত্যাদি।

২। ইবাদতে গায়রে মাকসুদা যে ইবাদত মূল ইবাদতের সহায়ক। যে ইবাদত দায়িত্ব মুক্তির উদ্দেশ্যে করা হয় না বরং উহা মাকসুদা বা মূল ইবাদতের সহায়ক বা মাধ্যম হিসেবে পরিগণিত হয়। যেমন- অযু, তায়াম্মুম। ইহা সরাসরি ইবাদত নয় বরং সালাত উহার উপর নির্ভরশীল। আর নামাযের জন্য উহা সহায়ক বা মাধ্যমও বটে।

ইমামদের মতভেদ: ইমাম শাফি’ঈ, মালেক ও আহমদ (র) প্রমুখ মনীষীগণ বলেন, ইবাদতে মাকসুদা বা গায়রে মাকসুদা যে ধরনের ইবাদতই হোক না কেন, উহার বিশুদ্ধতার জন্য নিয়ত করা পূর্বশর্ত। আল্লাহর বাণী: مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ. وما أمروا إلا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ “আর তাদেরকে হুকুম করা হয়েছে যে তারা যেন একনিষ্ঠ হয়ে আন্তরিকভাবে আল্লাহর দীন পালনের মাধ্যমে একমাত্র তারই ইবাদত করে।” (সূরা আল-বাইয়িনা: ৫) আল্লাহ তা’য়ালা কুরআনে নিয়তের বিশুদ্ধতার কথা উল্লেখ করে বলেন: إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا وَاصْلَحُوا وَاعْتَصَمُوا بِاللَّهِ وَاخْلَصُوا دِينَهُمْ لِلَّهِ. “তবে তাদের মধ্যে যারা তওবা করবে ও নিজেদের কার্যাবলী সংশোধন করে নিবে ও আল্লাহর রজ্জু শক্ত করে ধারণ করবে এবং একমাত্র আল্লাহর জন্যই নিজেদের দীনকে খালেস করে নিবে।” (সুরা আন-নিসাঃ ১৪৬)

পৃষ্ঠা:১০

إِنَّمَا صِحْةُ الْأَعْمَالَ بِالنِّيَّاتِ. আমল ও ইবাদতের বিশুদ্ধতা একনিষ্ঠভাবে নিয়তের উপরই নির্ভরশীল।” ” হানাফী ইমামগণ বলেন, ইবাদতে সাওয়াব প্রাপ্তি নিয়তের উপর নির্ভরশীল। তাদের মতে বর্ণিত হাদীসে । শব্দের পরে ثواب শব্দটি উহ্য রয়েছে। মূল বাক্য ছিল এরূপ: إِنَّمَا ثَوَابُ الْأَعْمَالَ بِالنَّيَّاتِ “ইবাদতের সওয়াবের প্রাপ্তি নিয়তের উপর নির্ভরশীল।” গায়েরে মাকসুদা দুরস্ত হওয়ার জন্য নিয়তের প্রয়োজন নেই। কেননা, উহা নিয়ত ব্যতিরেকেই শুদ্ধ হয়ে যাবে, কিন্তু সওয়াব পাওয়া যাবে না। নিয়ত ও ইরাদার মধ্যে পার্থক্য কোন কাজের পিছনে যে উদ্দেশ্য মানব মনে ক্রিয়শীল থাকে, চাই তা ভাল হোক বা মন্দ হোক তাকেই নিয়ত বলা হয়। আর শুধু কাজের উদ্যোগ গ্রহণ করার নাম হলো ইরাদা। হিজরত অর্থ হিজরত অর্থ- ত্যাগ করা, সম্পর্কচ্ছেদ করা, ছেড়ে দেয়া, কোন জিনিস ত্যাগ করা, এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলে যাওয়া ইত্যাদি। (আল-ওয়াসীত: ২/৯৭৩) শরীয়তের পরিভাষায়-নিজের জন্মভূমি পরিত্যাগ করে দীন ও ঈমান রক্ষার নিমিত্তে ‘দারুল হরব’ থেকে ‘দারুল ইসলামে’ প্রস্থান করাকে শরীয়তে হিজরত বলে। ইবনে হাজার আসকালানির (র) মতে, “আল্লাহ যা নিষেধ করেছেন তা পরিত্যাগ করাকে হিজরত বলে।” একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে ‘দারুল হরব’ থেকে ‘দারুল ইসলামে’ প্রস্থান করাকে হিজরত বলে। যেমন- নবী করীম (সা) ও সাহাবায়ে কিরাম (রা) দীন ও ইসলামের নিরাপত্তার উদ্দেশ্যে মক্কাভূমি (দারুল হরব) পরিত্যাগ করে মদীনা (দারুল ইসলাম) চলে গিয়েছিলেন।

পৃষ্ঠা:১১

সুতরাং সে চলে যাওয়াকে হিজরত নামে অভিহিত করা হয়। তাছাড়া শরীয়তের নিষিদ্ধ কাজসমূহকে পরিত্যাগ করাকেও হিজরত বলে। হিজরতের বিধানঃ হিজরতের বিধান পরিবেশ পরিস্থিতির আলোকে কিয়ামত পর্যন্ত জারী থাকবে। এ বিধানটির উপর মুসলমানদের বহুবিদ কল্যাণ নিহিত আছে। এ দিকে লক্ষ্য রেখেই মহানবী (সা) নিম্নের হাদীসখানা বর্ণনা করেছেন:  لا تنقَطِعُ الْهَجْرَةُ حَتَّى لا تَنْقَطِعَ التَّوْبَةُ وَتَنْقَطِعُ التَّوْبَةُ حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَغْرِبِهَا. “তওবা করার অবকাশ থাকা পর্যন্ত হিজরতের ধারা বা সিলসিলা বন্ধ হবে না। আর তওবার অবকাশও বন্ধ হবে না পশ্চিম দিকে সূর্য উদিত না হওয়া পর্যন্ত।” (আবু দাউদ) গোটা বিশ্বের যে কোন স্থানে যে কোন সময় দীন ও ঈমান হিফাযত করার জন্য হিজরতের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে। বর্তমান বিশ্বে যেভাবে মুসলমানদের উপর দেশে দেশে নির্যাতন চলছে তাতে হিজরত করার অপরিহার্যতা আরো ব্যাপক করে তোলে। এমনকি কোন স্থানে বা দেশে অন্ততঃ নিজের ব্যক্তিগত জীবনে ইসলামী বিধি-বিধান পালন করা অসম্ভব হয়ে পড়লে, তখন নিরাপদ স্থানে হিজরত করার বিধান আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে। (লোমাআত)

শিক্ষা

১। সকল কাজের ফলাফল নিয়তের উপর নির্ভরশীল।

২। মুসলমানদের সকল কাজের পূর্বে নিয়তকে বিশুদ্ধ করে নেয়া উচিত।

৩। দীন ও ঈমানের হিফাযতের জন্য প্রয়োজনে হিজরত করতে হবে।

৪। সকল কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হওয়া অপরিহার্য।

৫। শরীয়ত বিরোধী কোন কাজ ভাল নিয়তেও করা জায়েয নয়।

পৃষ্ঠা:১২

দারস-২ইল্ম অন্বেষণকারীর মর্যাদা: عَنْ أَبِي الدَّرْدَاءِ (رض) قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ (صلعم) مَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَطْلُبُ فِيْهِ عِلْمًا سَهْلَ اللَّهُ لَهُ طَرِيقًا إِلَى الْجِنَّةِ، وَإِنَّ الْمَلَائِكَةَ لَتَضَعُ اجْنِحَتَهَا رِضَى لِطَالِبِ الْعِلْمِ وَإِنَّ الْعِلْمَ لَيَسْتَغْفِرُ لَهُ مَنْ فِي السَّمَوَاتِ وَمَنْ فِي الْأَرْضِ حَتَّى الْحِيْتَانُ فِي الْمَاءِ وَفَضْلُ الْعَالِمِ عَلَى الْعَابِدِ كفَضْلُ الْقَمَرِ لَيْلَةَ الْبَدْرِ عَلَى سَائِرِ الْكَوَاكِبِ وَإِنَّ الْعُلَمَاءَ وَرَثَةُ الْأَنْبِيَاءِ وَإِنَّ الأَنْبِيَاء عَلَيْهِمُ السَّلامُ لَمْ يُورَثُوا دِينَارًا وَلَا دِرْهَمَا وَإِنَّمَا وَرَدُّوا الْعِلْمَ فَمَنْ أَخَذَهُ أَخَذَ بِحَظ وافر. (ترمذی) অর্থঃ হযরত আবু দারদা (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: যে ব্যক্তি ইলম অর্জন করার উদ্দেশ্যে পথ চলবে, আল্লাহ তা’য়ালা তার বেহেশতের পথ সহজ ও সুগম করে দেবেন। আর ফেরেশতাগণ ইল্ম অর্জনকারীর সন্তুষ্টির জন্য নিজের পাখা বিছিয়ে দেয়। আলিম ব্যক্তির জন্য আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে যা কিছু আছে সকলেই মাগফিরাতের দু’আ করে, এমনকি পানির ভিতরের মাছও। আর আবিদের উপর আলিম ব্যক্তির মর্যাদা হচ্ছে সমগ্র তারকারাজীর উপর পূর্ণিমা রাত্রের চাঁদের যে মর্যাদা। অবশ্য আলিমগণ নবীদের উত্তরাধিকারী। আর নবীগণ তাঁদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে দিরহাম ও দীনার রেখে যাননি; তবে তাদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে ইল্ম রেখে গেছেন। কাজেই যে ব্যক্তি তা আহরণ করল সে ব্যক্তি বিপুল অংশ লাভ করল। (তিরমিযী) শব্দার্থ : গ্রা: পথ চলবে। طريق : পথ। علم : বিদ্যা । سهل : সহজ করে দেবেন। ১: তার জন্য। لتضع : বিছিয়ে দেয়। اجْنِحَتَهَا : তাদের

পৃষ্ঠা:১৩

পাখা। لطالب : : رضی : অনুসন্ধানকারীর জন্য। الْعِلْمُ বিদ্যা। لَيَسْتَغْفِرُ لَه : তাদের মাগফিরাতের জন্য। السفواتِ : আকাশসমূহ। الْأَرْض : পৃথিবী। الحيتان : মাছসমূহ। فِي الْمَاء : পানির মধ্যে। وفَضْلُ الْعَالِمِ : আলিমের ফযীলত। على العايد: ইবাদতকারীর উপর। کفضل : যেমন মর্যাদা। لَيْلَةُ الْبَدْرٍ : القَمَرُ : পূর্ণিমার রাত : سَائِرَ : সকল : الكَوَاكِبُ : তারকারাজী : لَمْ يُوَرْتُوا : উত্তরাধিকারী রাখেন নাই। بینارٌ : দীনার। برهم : দিরহাম। آخذ: গ্রহণ করল। يحظ : অংশ। وافر : লাভ করা। ব্যাখ্যা : আলোচ্য হাদীসখানায় ইল্‌ল্ম অন্বেষণকারীর মর্যাদা প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। এখানে তিনটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথমতঃ ইল্ম অন্বেষণ করার উদ্দেশ্যে যে পথ চলবে, তাকে আল্লাহ জান্নাতে গমনের পথ সুগম করে দেবেন। কেননা জান্নাতে যেতে হলে নেক আমল করতে হবে। আর নেক আমল করার জন্য ইল্ম অর্জন করা জরুরী। দ্বিতীয়তঃ ইল্ম অন্বেষণকারীগণ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ইল্ম শিক্ষার জন্য বের হয়, তাই তাদের মর্যাদায় ফেরেশতাগণ তাদের পাখা বিস্তার করে দেন। অর্থাৎ ইল্‌ল্ম অন্বেষণকারীর সাহায্যে এগিয়ে আসেন। তৃতীয়তঃ ইল্ম অন্বেষণকারীর জন্য পানির মাছ পর্যন্ত দু’আ করতে থাকে এবং সকলেই তার মাগফিরাত কামনা করে। অপর হাদীসে উল্লেখ আছে, “যারা মানুষকে ভাল কথা শিক্ষা দেয় তাদের জন্য আল্লাহ তাঁর ফেরেশতাকুল এবং আসমান ও যমীনের অধিবাসীরা এমনকি পিপিলিকাসমূহ তাদের গর্তে, মৎসসমূহ পানিতে দু’আ করতে থাকে।” কারণ ইলম নূর বিশেষ। ইহা যেমন আলিম ব্যক্তিকে আলোকিত করে তেমনি ইহা অপরকেও জ্যোতির্ময় করে তুলে উপকৃত করে থাকে। হাদীসের শেষ পর্যায়ও তিনটি বিষয় আলোচনা করা হয়েছে। প্রথমতঃ আবিদের তুলনায় আলিমের মর্যাদা বেশী। যেহেতু আলিম ব্যক্তি ইস্মের দ্বারা সঠিকভাবে নিজে ইবাদত করতে পারে এবং অন্যকে নেক

পৃষ্ঠা:১৪

আমলের জন্য সাহায্য করতে পারে। তাই লক্ষ তারকায় যে আলো দান করতে পারে তার চেয়ে শুধু পূর্ণিমার রাতে চন্দ্র অধিক আলো বিস্তার করতে পারে। তাই বলা হয়েছে আবিদের তুলনায় আলিমের মর্যাদা অনেক বেশী। অপর হাদীসে উল্লেখ আছে, রাসূল (সা) বলেনঃ “আবিদের উপর আলিমের মর্যাদা ততবেশী যেমন আমার মর্যাদা তোমাদের একজন সাধারণ ব্যক্তির উপর যত বেশী।” তিরমিযী) দ্বিতীয়তঃ দীনি ইল্ম শিক্ষাকারী এবং শিক্ষাদানকারী আলিমগণই নবীগণের উত্তরাধিকারী। নবীগণের অবর্তমানে আলিমগণই হচ্ছে ইল্ম প্রচার ও প্রতিষ্ঠার দায়িত্বশীল। নবীগণের রেখে যাওয়া দীন প্রচার ও প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব আলিমগণের। দীনি ইল্ম অর্জন করা নবুওয়তী কাজের সহযোগিতা করার নামান্তর। এ দায়িত্ব পালন করার কারণেই তারা জান্নাতে নবীগণের নিকটবর্তী স্থানে অবস্থান করার সৌভাগ্য লাভ করবেন। عَنِ الْحَسَنِ مُرْسَلاً قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ (صلعم) مَنْ جَاءَ الْمَوْتُ وَهُوَ يَطلُبُ الْعِلْمَ لِيُحِيَى بِهِ الْإِسْلامَ فَبَيْنَهُ وَبَيْنَ النَّبِيِّينَ دَرَجَةٌ وَاحِدَةٌ فِي الجنة (دارمی) অর্থ: হযরত হাসান বসরী (র) হতে মুরসাল হিসেবে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ যে ব্যক্তির মৃত্যু এসে পৌঁছবে এ অবস্থায় যে, যখন সে ইসলামকে যিন্দা করার উদ্দেশ্যে ইল্ম অন্বেষণে ব্যস্ত ছিল, তার মধ্যে এবং নবীগণের মধ্যে জান্নাতে মাত্র একটি স্তরের পার্থক্য থাকবে। (দারেমী) তৃতীয়তঃ আলিমগণ ধন-সম্পত্তির দিক দিয়ে নবীগণের উত্তরাধিকারী হন না বরং ইল্মের দিক দিয়ে। আর এ কারণেই আলিমগণের উচ্চ মর্যাদা। ইহা হচ্ছে ইল্মে শরীয়ত ও উহার পরিপূরক ইল্ম এবং উহার সাহায্যকারী ইল্ম। যে ব্যক্তি নবীদের পরিত্যক্ত ইল্ম লাভ করে, সে-ই পূর্ণমাত্রায় অংশ লাভ করে থাকে, আর সে প্রকৃত ভাগ্যবান। আর যে ব্যক্তি ইল্ম থেকে বঞ্চিত, সে প্রকৃত কল্যাণ থেকে বঞ্চিত।

পৃষ্ঠা:১৫

গ্রন্থ পরিচিতিঃ জামে আত-তিরমিযী। আলোচ্য হাদীসখানা জগৎ বিখ্যাত ছয়খানি হাদীস গ্রন্থের অন্যতম বিশুদ্ধ ও জনপ্রিয় হাদীস গ্রন্থ তিরমিযী শরীফ থেকে নেয়া হয়েছে। এ গ্রন্থের প্রণেতা হলেন মুহাম্মদ বিন ঈসা। পূর্ণ নাম আল-ইমামুল হাফিয আবু ঈসা মুহাম্মদ ইবনে ঈসা ইবনে সওরাতা ইবনে মূসা আত-তিরমিযী। তিনি জীহুন নদীর তীরে তিরমীয নামক প্রাচীন শহরে ২০৯ হিজরী সনে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকালে তিনি কুরআন হিফ্য করেন। শৈশবে তিনি হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহের জন্য মুসলিম জাহানের বিখ্যাত হাদীসের কেন্দ্রসমূহে বছরের পর বছরের পরিভ্রমণ করেন। বিশেষ করে কুফা, বসরা, খুরাসান, ইরাক ও হিজাযের বড় বড় মুহাদ্দিসগণের কাছ থেকে হাদীস শ্রবণ ও সংগ্রহ করেন। ইমাম তিরমিযী তীক্ষ্ণ স্মরণ শক্তির অধিকারী ছিলেন। একবার শোনার পর তিনি বহু সংখ্যক হাদীস মুখস্থ করতে সমর্থ হতেন। তিনি জনৈক মুহাদ্দিসের বর্ণিত কয়েকখানি হাদীস শুনেছেন কিন্তু তার সাথে তাঁর কোন দিন সাক্ষাৎ হয়নি। একবার হজ্জে যাওয়ার পথে তার সাথে সাক্ষাৎ হয়। তিনি তার থেকে হাদীস শুনার বাসনা প্রকাশ করেন। মুহাদ্দিস পথিমধ্যেই তা মুখস্থ পাঠ করেন। ইমাম তিরমিযী উক্ত হাদীসসমূহ মুখস্থ করে ফেলেন এবং পাঠ করে শুনান। এ অবস্থা দেখে তার স্মরণ শক্তি পরীক্ষা করার জন্য আরও চল্লিশটি হাদীস শুনান যা ইমাম তিরমিযী আর কোন দিন শুনেন নাই। তিনি উহা শুনার সাথে সাথে মুখস্থ করে নিলেন এবং তাকে শুনিয়ে দিলেন। তাতে কোন একটি শব্দও ভুল হয় নাই। (মুকাদ্দামাহ তরজমানুস সুন্নাহ ১ম খণ্ড পৃঃ ২৬১) তিনি ইমাম বুখারীর স্নেহভাজন ছাত্র ছিলেন। হাদীস প্রণয়নে তিনি ভাষার পাণ্ডিত্য, সংকলনের কলাকৌশল, মাসয়ালা-মাসায়েলের বিন্যাসে এক অভিনব পদ্ধতি প্রয়োগ করেন, যাকে মুহাদ্দিসীনদের পরিভাষায় জামে বলে। ইনতিকাল: হাদীসের এই মহান খাদেম তিরমীয শহরে ২৭৯ হিজরী সনে ৭০ বছর বয়সে ইনতিকাল করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাহি রাজি’উন। (আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া খণ্ড: ১১ পৃ: ২২)

কবিতা ১৬ থেকে ৩০

পৃষ্ঠা:১৬

রাবী পরিচিতি: হযরত আবু দারদা (রা)। নাম: উয়ায়মার অথবা আ’মের। কুনিয়াতঃ আবু দারদা (রা)। উপাধিঃ হাকিমুল উম্মাহ। পিতার নামঃ আবদুল্লাহ। মাতার নামঃ মাহাব্বা বা ওয়াকিদা। দারদা তাঁর এক মেয়ের নাম। এ জন্যই তিনি আবু দারদা নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। আবু দারদা (রা) মদীনায় খাযরাজ গোত্রের বানুল হারিছ খান্দানে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বয়সে রাসূল (সা)-এর ছোট ছিলেন। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে বাণিজ্যকে তিনি পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। তাঁর বংশ তালিকা হলঃ উমায়মার বিন যায়েদ বিন কায়েস বিন আইশা বিন উমাইয়া বিন মালিক বিন আদী বিন কা’ব ইবনুল খাযরাজ। ইসলাম গ্রহণ ও অন্যান্য ঘটনাবলী: আবু দারদা (রা) দ্বিতীয় হিজরী বদর যুদ্ধের দিন অথবা ওর অব্যবহিত পরে ইসলাম গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য খাযরাজ বংশের আনসারী সাহাবী তাঁর পরিবারের মধ্যে সকলের পরে ইসলাম গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে উহুদ যুদ্ধসহ সকল যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেন। উহুদ যুদ্ধে তাঁর অসীম বীরত্ব দেখে রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন- نعم الفارس عويمر উয়ায়মার কত উত্তম অশ্বারোহী!

কর্মজীবনঃ সিরিয়ার রাজধানী দামিশকের জামে মসজিদে সর্বপ্রথম তিনি পবিত্র কুরআন শিক্ষাদান আরম্ভ করেন। ইনতিকালের পূর্ব পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্বে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। তৃতীয় খলীফা উসমান (রা)-এর খিলাফতকালে তাঁকে দামিশকের বিচারক পদে নিযুক্ত করা হয়েছিল। অবশ্য কেউ কেউ বলেন তিনি এ দায়িত্ব উমর (রা)-এর সময় পেয়েছিলেন। শামের গভর্ণর মু’য়াবিয়া (রা) তাঁকে অত্যধিক সম্মান করতেন। এমনকি তিনি কোথাও গমন করলে আবু দারদা (রা)-কে নিজের স্থলাভিষিক্ত রেখে যেতেন। মু’য়াবিয়া (রা) তাঁকে দামিশকের বিচারক নিযুক্ত করেছিলেন।

পৃষ্ঠা:১৭

রিওয়ায়াত: আবু দারদা সর্বমোট ১৭৯টি হাদীস বর্ণনা করেছেন। তন্মধ্যে ইমাম বুখারী (র) ১৩টি এবং ইমাম মুসলিম (র) ৯টি হাদীস তাঁদের স্বস্ব হাদীস গ্রন্থে স্থান দিয়েছেন। তাঁর সবগুলো হাদীস একত্রে “খাইরুল মাওয়ারীছ” গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়েছে। তাঁর নিকট থেকে যারা হাদীস বর্ণনা করেছেন, তাঁদের মধ্যে আনাস বিন মালেক (রা), ফুযালা বিন উবায়েদ, আবু উমামা, আবদুল্লাহ বিন উমর, ইবনে আব্বাস প্রমুখ রাবীগণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

স্বভাব চরিত্রঃ আবু দরদা (রা) ছিলেন উত্তম চরিত্রের অধিকারী। বহু গুণাবলীর সমন্বয় তাঁর মধ্যে ঘটেছিল। তিনি ছিলেন নীতিবান, সচ্চরিত্র, দয়ালু, অতিথিপরায়ণ, পরোপকারী, সত্যভাষী অনাড়ম্বর জীবনের অধিকারী এবং ধর্মের ব্যাপারে কঠোর ও আপোষহীন ফিতনা-ফাসাদ হতে সর্বদা তিনি দূরে থাকতেন। সুফীবাদীগণ তাঁকে ‘আসহাফুস সুফ্ফার’ অন্তর্ভুক্ত করেন। আবু দারদা (রা) বলতেন: “আল্লাহ তা’য়ালার দীদারের জন্য আমি মৃত্যুকে ভালবাসি”। বিনয় লাভের জন্য দারিদ্র্যতাকে ভালবাসি এবং পাপ মোচনের জন্য রোগকে ভালবাসি। উল্লেখ্য আবু দারদা (রা) ছিলেন একজন অন্যতম ফিকাহবিদ, জ্ঞানী ও সুকৌশলী সাহাবী। (আসমাউর রিজাল) ওফাত: তিনি (৩২ হিজরী) মোতাবেক ৬৫২ সালে ৯ই নভেম্বর দামিশকে ইনতিকাল করেন। ইল্মের অর্থ, গুরুত্ব ও মর্যাদা

ইল্ম অর্থ : ইল্ম (1) আরবী শব্দ। এর বহুবচন হচ্ছে )عُلُوْمٌ( ‘উলুমুন’। যা ‘আলামাত’ )غلامت( হতে নির্গত। আর আলামত অর্থ )২১) কোন বিষয়ের প্রতি প্রত্যক্ষ বুঝানো এবং )إشارة( কোন জিনিসের দিকে ইংগিত। ইল্ম অর্থ জ্ঞান, বিদ্যা ও বিশ্বাস। কোন জিনিসকে উহার তথ্য সহকারে অনুধাবন করার নামই ইল্ম। এখানে ইল্ম অর্থ হচ্ছে ওহীলব্ধ জ্ঞান, যা মানুষের অন্তরে তাওহীদের প্রেরণা জাগায়

পৃষ্ঠা:১৮

এবং খোদাভীতির সঞ্চার করে। ইল্ম মানুষ বিবেক-বুদ্ধি দ্বারা আবিষ্কার করতে পারে না। তাওহীদকে মেনে নেওয়া এবং আল্লাহকে ভয় করা ইল্মের বিশেষ গুণ। কুরআনে ইল্ম শব্দের ব্যবহারঃ আল-কুরআনে ব্যাপকভাবে ইল্ম শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। ইল্‌ম ১০৫ বার; ক্রিয়ার বিভিন্ন পদে ৪২৪ বার: আল্লাম ৪ বার; আলীম ১৬১ বার; আলিম একবচনে ১৩ বার এবং বহু বচনে ৭ বার; আলাম ৪৯ বার; মালুম একবচনে ১১ বার এবং বহুবচনে ২ বার ব্যবহৃত হয়েছে। (কুরআনের পরিভাষা: ২২৫ পৃ.) ইসলামী শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যঃ ইসলামী শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য চারটি। যথা:

১. মনুষ্যত্বের বিকাশ সাধন

২. মহান সৃষ্টিকর্তার সাথে সম্পর্ক স্থাপন

৩. আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা

৪. সুখী সমৃদ্ধ জীবন লাভ।

১. মনুষ্যত্বের বিকাশ সাধনঃ মুসলিম সমাজে মনুষ্যত্বের বিকাশ সাধনের স্থান সর্বোচ্চে। আল্লাহ তা’য়ালা যে সৎ গুণাবলী দিয়ে মানব সন্তানকে সৃষ্টি করেছেন, সে গুণাবলী শিক্ষার মাধ্যমে জাগ্রত করে জাতিকে সৎ, যোগ্য ও আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলে মনুষ্যত্বের বিকাশ সাধন।

২. মহান সৃষ্টিকর্তার সাথে সম্পর্ক স্থাপনঃ মহান আল্লাহ তা’য়ালা মানুষের সৃষ্টিকর্তা। মানুষকে তিনি আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্ক হলো মানুষ আল্লাহর বান্দা আর তিনিই মানুষের সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা ও রক্ষাকর্তা। আর জ্ঞান ছাড়া এ উপলব্ধি সম্ভব নয়। জ্ঞানীরাই আল্লাহর সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে ও তাকে বেশী ভয়ও করে। কুরআনের ঘোষণা:স إِنَّمَا يَخْشَى اللَّهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ.

পৃষ্ঠা:১৯

“বান্দাগণের মধ্যে কেবলমাত্র ইল্‌ম-সম্পন্ন লোকেরাই আল্লাহকে অধিক ভয় করে।” (সূরা আল-ফাতির : ২৮) ৩. আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা: আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা করা ও ইল্ম অনুযায়ী আমল করা কর্তব্য। যে ব্যক্তি ইল্ম অনুয়ায়ী আমল করে না তাকে রাসূল (সা) বোঝা বহনে অক্ষম ব্যক্তির সাথে তুলনা করেছেন। তাই ইসলামী শিক্ষা অর্জন করলে তা আমল করা বা বাস্তবায়ন করা ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা ছাড়া আদৌ সম্ভব নয়। আর এ কারণেই ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা অপরিহার্য। রাসূল (সা) ইলমের বাস্তব আমলের জন্যই ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের সংগ্রাম করেছেন। ৪. সুখী সমৃদ্ধ জীবন লাভ: মানুষ সামাজিক জীব। সমাজ জীবনে সকলেই সুখী-সমৃদ্ধ জীবন লাভ করতে চায়। ইল্ম বা বিদ্যা এ সুন্দর জীবনের নিশ্চয়তা দিতে পরে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের দ্বারাই আল্লাহর অফুরন্ত নি’য়ামত কাজে লাগিয়ে মানুষের কল্যাণ সাধন করা যায়। শরীয়তসম্মত সকল উন্নতির পথই মানুষের জন্য উন্মুক্ত। ইলম অর্জনের গুরুত্ব

১. মানব কল্যাণ সাধনঃ বর্তমান যুগ বিজ্ঞানের যুগ। জ্ঞান মানুষকে বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষ সাধন করতে ও উন্নতির দ্বার প্রান্তে পৌছে অসাধ্যকে সাধন করতে সাহায্য করেছে। তাই আজ মাটির মানুষ মহাকাশ ভ্রমণ করছে। বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কারের ফলে বিশ্ব জগত আজ মানুষের হাতের মুঠোয়। মানুষের জীবনে নিয়ে এসেছে সমৃদ্ধি, বিশ্ব ব্যাপি এ সব ইল্‌ম বা বিদ্যার বদৌলতেই। ইসলাম এ কারণেই ইল্ম অর্জনের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছে সর্বাধিক।

২. চরিত্র গঠন : চরিত্রই মানব জীবনের বড় সম্পদ। উত্তম চরিত্র গঠন করতে হলে মানুষকে নৈতিক চরিত্রের গুণাবলী অর্জন করতে হয়। এ ক্ষেত্রে ইসলামী জ্ঞানার্জন অপরিহার্য। জ্ঞান না থাকলে মানুষ যেমন নিজকে জানতে পারে না, তেমনি মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকেও জানতে পারে না। আত্মিক ও আধ্যাত্মিক জীবনের সার্বিক উন্নতি, অগ্রগতি সাধনের জন্য জ্ঞানার্জনের কোন বিকল্প নেই।

পৃষ্ঠা:২০

৩. মর্যাদা বৃদ্ধি : যারা জানে এবং যারা জানে না তারা কখনও এক হতে পারে না। যারা জ্ঞানী ব্যক্তি তারাই সত্য-অসত্য ও ন্যায়-অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে। কিন্তু যারা জ্ঞানহীন তারা ন্যায়-অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। ফলে নানা পাপ-পংকিলতায় সমাজকে কলুষিত করে তোলে। এ সকল লোকদেরকে পশুর চেয়ে অধম বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অপর দিকে জ্ঞানী ব্যক্তিকে নবীদের উত্তারাধিকারী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে জ্ঞানীদের বিশেষ মর্যাদার কথা ঘোষণা করা হয়েছেঃ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ. “তারাই মর্যাদাসম্পন্ন যারা জ্ঞান প্রাপ্ত হয়েছে।” (সূরা আল-মুজাদালা: ১১) দেশের নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব শিক্ষিত মানুষেরাই করে থাকে। আর শিক্ষা নিয়ে মানুষ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, দার্শনিক, রাজনীতিবিদ ও অর্থনীতিবিদ হয়ে থাকে। এসব মানুষের মর্যাদা শিক্ষার কারণেই। কাজেই শিক্ষাই মানুষের মর্যাদা বৃদ্ধি করে থাকে। ইল্ম অর্জন করা ফরষঃ ইল্ম ব্যতীত আল্লাহর সঠিক পরিচয় অর্জন করা যায় না। মানুষের মানবীয় গুণাবলীর বিকাশ ইল্ম দ্বারাই ঘটে। তাই ইসলাম নারী-পুরুষ সকলের উপর সমভাবে ইলম অর্জন করা ফরয করে দিয়েছেন। রাসূল (সা) বলেনঃ عَنْ أَنَس (رض) قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ (صلعم) طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةً عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ وَمُسْلِمَةٍ. (ابن ماجه)

অর্থঃ হযরত আনাস (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: জ্ঞানার্জন করা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর উপর ফরয। (ইবনে মাযা) আল্লাহর নিকট ইল্মের মর্যাদাঃ দীনি জ্ঞান না থাকলে যথাযথভাবে নামায, রোযা, হজ্জ ও জিহাদের মত গুরুত্বপূর্ণ কোন ইবাদতই করা যায় না। সকল ইবাদতের জন্যই ইলম অর্জন করা অপরিহার্য। তাই ইলম অর্জনের মর্যাদা এত বেশী।

পৃষ্ঠা:২১

عَنِ ابْنِ عَبَّاس (رض) قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ (صلعم) طَلَبُ الْعِلْمِ افْضَلُ عِنْدَ اللَّهِ مِنَ الصَّلُوةِ وَالصِّيَامِ وَالْحَجِّ وَالْجِهَادِ فِي سَبِيلِ اللَّهِ عَزَّ وجل للديلمي في مسند الفردوس)  অর্থ: হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: মহান আল্লাহর নিকট নামায, রোযা, হজ্জ ও আল্লাহর পথে জিহাদের চেয়ে জ্ঞানার্জন হচ্ছে অধিক উত্তম। (দায়েলামী) দীনি ইলম অর্জন করা কল্যাণকর: আল্লাহ যার কল্যাণ চান তাকে সঠিক দীনি জ্ঞান, গবেষণা, অনুভূতি ও সূক্ষ্মদর্শিতা দ্বারা অনুগৃহীত করেন। (صلعم) مَنْ يُرِدِ اللَّهُ بِهِ خَيْرًا عَنْ مُعَاوِيَةَ (رض) قَالَ قَالَ . رَسُولُ اللهِ يفقهه في الدين. (بخاری، مسلم) অর্থঃ হযরত মুয়াবিয়া (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: আল্লাহ যার কল্যাণ চান তাকে দীনের ইল্ম (তত্ত্বজ্ঞান) দান করেন। (বুখারী, মুসলিম) আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য শিক্ষা গ্রহণ: ‘ইল্মে দীন’ ওহীলব্ধ জ্ঞান। ইহা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য শিক্ষা করতে হবে। পার্থিব স্বার্থে যে ইলম শিক্ষা গ্রহণ করবে সে শাস্তিযোগ্য অপরাধে অপরাধী হবে। কিয়ামতের দিন শাস্তিস্বরূপ জান্নাতে প্রবেশ করা তো দূরের কথা, জান্নাতের সুঘ্রাণ পাওয়া যায় এতটুকু কাছেও যাওয়া যাবে না। عَنْ أَبِي هَرَيْرَةَ (رض) قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ (صلعم) مَنْ تَعَلَّمَ عِلْمًا مِمَّا يَبْتَغِي بِهِ وَجْهَ اللَّهِ لَا يَتَعَلَّمُهُ إِلَّا لِيُصِيبَ بِهِ عَرَضًا مِنَ الدُّنْيَا لَمْ يَجِدُ عَرفَ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يَعْنِي رِيحَهَا. (احمد، ترمذی، ابن ماجه) অর্থঃ আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের উদ্দেশ্যে ইল্ম অর্জন করবে,

পৃষ্ঠা:২২

সে আল্লাহর সন্তুষ্টি পাবে। পক্ষান্তরে যে দুনিয়ার কোন সম্পদ লাভের উদ্দেশ্যে ইল্ম অর্জন করবে, সে কিয়ামতের দিন বেহেশতের গন্ধও লাভ করতে পারবে না। (আহমদ, আবু দাউদ, ইবনে মাজা)। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট ইল্মের মর্যাদাঃ ইল্ম চর্চার মাধ্যমেই আল্লাহর দীন কিয়ামত পর্যন্ত জারি থাকবে। এ কারণেই ইলম অর্জন করার তাকিদ দেয়া হয়েছে: “একদা রাসূলুল্লাহ (সা) মসজিদে নববীতে এসে দু’টি দল দেখতে পেলেন। (এক দল লোক ইল্ম চর্চায় লিপ্ত। অপর দল যিকির ও দু’আয় মশগুল) তিনি বলেন, উভয় দলই ভাল কাজে লিপ্ত। যারা আল্লাহর যিকির ও দু’আয় মশগুল আল্লাহ ইচ্ছা করলে তদেরকে কাঙ্খিত বস্তু দিতেও পারেন, নাও দিতে পারেন। আর দ্বিতীয় দলটি ইলম চর্চা করছে এবং অজ্ঞ লোকদেরকে তা’লীম দিচ্ছে। সুতরাং এ দলটিই উত্তম। কেননা, আমাকেও শিক্ষক করে পাঠানো হয়েছে। এ বলে রাসূলুল্লাহ (সা) দ্বিতীয় দলটির সাথে বসে গেলেন।” (দারেমী) ইলমের এত মর্যাদা কেন: ইসলামের গভীর জ্ঞানে পারদর্শী একজন আলিম, যাকে ফিক্‌হ শাস্ত্রের পরিভাষায় ফকীহ্ বলা হয়। তার মর্যাদা এক হাজার আবিদ ব্যক্তির চেয়ে বেশী। কারণ, শয়তান দীনি জ্ঞানহীন এক হাজার আবিদ ব্যক্তিকে ধোঁকায় ফেলে সহজেই গোমরাহ করতে পারে। কিন্তু ইসলামের গভীর জ্ঞানে পারদর্শী একজন আলিম ব্যক্তিকে সে সহজে গোমরাহ করতে পারে না। فقيه واحد أَشَدُّ عَلَى الشَّيْطَانِ مِنْ أَلْفِ عايد. (ترمذی، ابن ماجه) “একজন ফকীহ (বিজ্ঞ আলিম) ব্যক্তি শয়তানের বিপক্ষে এক হাজার আবিদ (সাধক) অপেক্ষাও কঠোর।” (তিরমিযী, ইবনে মাজা) ইল্‌ল্ম অন্বেষণকারী আল্লাহর পথে অবস্থান করেনঃ ইল্ম অন্বেষণকারী আল্লাহর পথে অবস্থান করেন। ‘ইল্ম’ অন্বেষণকারী মূলতঃ একজন মুজাহিদ। প্রথমতঃ জিহাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর যমীনে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা করা ও রক্ষা করা। আর ইলম অর্জনের উদ্দেশ্য হচ্ছে দীনকে যিন্দা করা ও জাহিলিয়াতের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করা। এজন্য একজন

পৃষ্ঠা:২৩

মুজাহিদ যেভাবে জিহাদের ময়দানে কষ্ট-ক্লেশ করতে হয়, সেভাবে একজন তালবে ইল্মকেও কষ্ট স্বীকার করে ইল্ম অর্জন করতে হয়। দ্বিতীয়তঃ মুজাহিদ ব্যক্তিকে জিহাদের ময়দানে শত্রুর মোকাবেলা করে নিজকে টিকে থাকতে হয়, আর তালবে ইলমকে নিজের নফস ও শয়তানের মুকাবিলা করতে হয়। তাই ইল্ম অন্বেষণকারীকে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারী মুজাহিদের সাথে তুলনা করা হয়েছেঃ عَنْ أَنَسِ (رض) قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ (صلعم) مَنْ خَرَجَ فِي طَلَبِ الْعِلْمِ فَهُوَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ حَتَّى يَرْجِعَ. (ترمذی، دارمی) অর্থ: হযরত আনাস (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: যে ব্যক্তি দীনি ইল্ম অন্বেষণে (নিজ ঘর হতে) বের হয়েছে, যে পর্যন্ত না সে (নিজ ঘরে) প্রত্যাবর্তন করবে সে পর্যন্ত আল্লাহর রাস্তায় থাকবে। (তিরমিযী, দারেমী) ইলম অর্জন করা সদকায়ে জারিয়া 1 عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ (رض) قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ (صلعم) إِذَا مَاتَ الْإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلَّا مِنْ ثَلاثَةٍ إِلَّا مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ اوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ. (مسلم)

অর্থঃ আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: মানুষ যখন মারা যায়, তখন তার যাবতীয় আমলও বন্ধ হয়ে যায়। অবশ্য তখনও তিন প্রকার আমলের সওয়াব অব্যাহতভাবে পেতে থাকে : (১) সদাকায়ে জারিয়া। (২) এমন ইল্ম যার ফায়দা সুদূর প্রসারী হয় এবং (৩) এমন সু-সন্তান, যারা তার জন্য দু’আ করে। (মুসলিম) মানুষ মৃত্যুবরণ করলে তার সকল আমল বন্ধ হয়ে যায় কিন্তু তিনটি আমলের সওয়াব অব্যাহতভাবে পেতে থাকে। যথা:

১. সদকায়ে জারিয়া : যেমন- রাস্তা-ঘাট তৈরী, সাঁকো-পুল, মসজিদ-

পৃষ্ঠা:২৪

মাদ্রাসা নির্মাণ ও অন্যান্য জনকল্যাণমূলক কাজ যা দীর্ঘ দিন যাবত মানুষ ও প্রাণীকুলের উপকারে আসে।

২. উপকারী ইল্মঃ এমন ইল্ম যার ফায়দা সুদূরপ্রসারী হয়। যেমন- দীনি পুস্তক রচনা করা যা পাঠ করলে মানুষ হিদায়াত পায় ও অজ্ঞতার অন্ধকার হতে মুক্তি লাভ করতে পারে।

৩. সু-সন্তানঃ এমন সু-সন্তান, পিতা-মাতা যাদেরকে আদব-কায়দা শিক্ষা দিয়ে উত্তম চরিত্রে চরিত্রবানরূপে গড়ে তুলেছে। এ সকল সন্তান পিতা- মাতার খিদমত করবে এরং মুত্যুর পরে তাদের জন্য দু’আ করবে। কেননা, তাদের দু’আ কবুল করা হয়। ইল্‌ম গোপন করা পাপের কাজঃ ইল্ম গোপন করা পাপের কাজ। কোন আলিম ব্যক্তি শরীয়তের কোন বিষয় জিজ্ঞাসিত হলে সে বিষয় সম্পর্কে ইল্ম থাকা সত্ত্বেও যদি তা না বলে দেন, তাহলে সে ইল্ম গোপনের অপরাধে অপরাধী হবেন এবং কিয়ামতের দিন কঠোর শাস্তির সম্মুখীন হবেন। عَنْ أَبِي هَرَيْرَةَ (رض) قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ (صلعم) مَنْ سُبُلَ عَنْ عِلْمٍ عِلْمِهِ ثُمَّ كَتَمَهُ الْحِمَ يَوْمَ الْقِيمَةِ بِلِجَامٍ مِّنَ النَّارِ. (احمد، ابو داود) অর্থঃ আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: যে ব্যক্তি তার জানা ইলম সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হয়েছে, অতঃপর সে উহা গোপন রেখেছে। কিয়ামতের দিন তাকে আগুনের লাগাম পরিয়ে দেয়া হবে। (আহমদ, আবু দাউদ) ইলম চর্চা করা রাত জেগে ইবাদতের চেয়ে উত্তমঃ ইল্ম চর্চা করা রাত জেগে ইবাদতের চেয়ে উত্তম। রাতের সামান্য সময় ইল্মে দীনের পারস্পারিক আলোচনা করা সারা রাত জেগে ইবাদত করা অপেক্ষা উত্তম। এর মাধ্যমে ইলম অর্জনের গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়।

পৃষ্ঠা:২৫

عَنِ ابْنِ عَبَّاس (رض) قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللَّهِ (صلعم) تَدَارُسُ الْعِلْمِ ساعة من اللَّيْلِ خَيْرٌ مِّنْ إِحْيَائِهَا. (دارمی) অর্থ: হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন: রাতের কিছু সময় ইল্মে দীনের পারস্পারিক আলোচনা করা সারা রাত জেগে ইবাদত করা অপেক্ষা উত্তম। (দারেমী) দীনি ইল্ম সংরক্ষণের গুরুত্বঃ ‘ইল্ম’ অর্জনের পর তা শিক্ষা দেয়া ওয়াজিব। ইল্ম শিক্ষার উদ্দেশ্যই হচ্ছে দীনের দিকে মানুষকে আহ্বান করা। কেউ যদি তা না করে তাহলে সে তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করলো না। রাসূলূল্লাহর বাণী শোনা, তা হুবহু স্মরণে রাখা এবং তা অপরের নিকট পৌছানোর প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। মানুষ মরণশীল, অপরের কাছে ইল্ম না পৌঁছানো হলে একদিন আলিম ব্যক্তিদের মৃত্যুর কারণে ইল্মেরও অপমৃত্যু ঘটে যাবে, তখন সমগ্র দুনিয়া মূর্খতার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে পড়বে এবং মানুষ আল্লাহর দীন থেকে দূরে সরে যাবে। এ কারণেই ইলমে দীন প্রচার ও প্রতিষ্ঠার তাকীদ করা হয়েছে। যাতে করে কিয়ামত পর্যন্ত নবীর বাণী অক্ষুণ্ণ থাকে। যারা এ খেদমতে নিয়োজিত থাকবেন, তাদের জন্য নবী (সা) বিষেশভাবে দু’আ করেছেন। عَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ (رض) قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ (صلعم) يَقُولُ نَضْرَ اللَّهُ إِمْرَأَ سَمِعَ مِنَّا شَيْئًا فَبَلِّغَهُ كَمَا سَمِعَهُ فَرُبِّ مُبَلِّغ أَوْعَى لَهُ مِنْ سَامِعِ. (ترمذی، ابن ماجه অর্থ : হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন: আল্লাহ তা’য়ালা সে ব্যক্তির মুখ উজ্জ্বল করুন, যে আমার কোন হাদীস শুনেছে, সেভাবেই তা অপরের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। কেননা অনেক সময় যাকে পৌঁছানো হয়, সে ব্যক্তি শ্রোতা অপেক্ষা অধিক রক্ষণাবেক্ষণকারী বা জ্ঞানী হয়ে থাকে। (তিরমিযী, ইবনে মাজা)

পৃষ্ঠা:২৬

শিক্ষা

১। ইল্ম অর্জন করার সম্মান ও মর্যাদা অত্যধিক।

২। ইল্ম অর্জনের উদ্দেশ্যে যে পথ চলবে আল্লাহ তার জান্নাতের পথ সুগম ও সহজ করে দেবেন।

৩। ইল্ম অন্বেষণকারীর জন্য ফেরেশতাগণ পাখা বিস্তার করে দেন।

৪। ইল্ম অন্বেষণকারীর জন্য সৃষ্টি জগতের সকলেই দু’আ করে, এমনকি পানির মাছ পর্যন্ত।

৫। সাধারণ মানুষের মধ্যে আলিম ব্যক্তির মর্যাদা সমগ্র তারকার তুলনায় পূর্ণিমা রাতের চাঁদের ন্যায়।

৬। আলিমগণই হচ্ছেন নবীগণের উত্তরাধিকারী।

পৃষ্ঠা:২৭

দারস-৩ তাওহীদ: وَعَنْ سُفْيَانَ بْنَ عَبْدِ اللَّهِ التَّقْفِي (رض) قَالَ قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ قُلْ لي فِي الْإِسْلَامِ قَوْلاً لَا أَسْأَلُ عَنْهُ أَحَدًا بَعْدَكَ وَفِي رِوَايَةٍ غَيْرَكَ قَالَ قُلْ آمَنْتُ بِاللَّهِ ثُمَّ اسْتَقِمْ. (مسلم)

অর্থঃ হযরত সুফিয়ান বিন আবদুল্লাহ সাকাফী (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন: একদা আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! (সা) আপনি আমাকে ইসলাম সম্পর্কে এমন একটি (চূড়ান্ত) কথা বলে দিন, যে সম্পর্কে আপনার পরে আর কারও নিকট জিজ্ঞাসা করব না। অর্থাৎ জিজ্ঞাসার কোন প্রয়োজন দেখা দেবে না। উত্তরে রাসূল (সা) বললেনঃ “তুমি বল! আমি (এক) আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলাম। অতঃপর এই কথা ও বিশ্বাসের উপর অটল অবিচল থাকো। (মুসলিম) শব্দার্থ : ل তুমি বল। قلت: আমি বললাম। : আমার জন্য। الإِسْلامُ : ইসলাম। قَوْلاً : বাক্য, বাণী। ১: আমি জিজ্ঞাসা করি। أَحَدًا : কাউকে, একজনকে। ১: আপনার পরে। টা: আমি ঈমান স্থাপন করলাম। إستقم : অবিচল থাক।  ব্যাখ্যাঃ তাওহীদের মূল বক্তব্য হচ্ছে এক আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই, এ কথায় বিশ্বাস স্থাপন করা ও সে বিশ্বাস অনুযায়ী বাস্তব জীবনে সকল কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা। কোন অবস্থায় তাওহীদের এ মূল বক্তব্য থেকে দূরে সরে যাওয়ার অর্থ হল ঈমান পরিত্যাগ করা। মৌখিক স্বীকৃতি, অন্তরের বিশ্বাস ও তদনুযায়ী আমলের নামই ঈমান। এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআনের ঘোষণা হচ্ছেঃ إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا.

পৃষ্ঠা:২৮

“যারা বলেছে আমাদের রব আল্লাহ! অতঃপর আজীবন সে কথার উপর অবিচল রয়েছে।” (সূরা আহকাফ: ১৩) তাই কুরআন ও হাদীসের ভাষ্যানুযায়ী ঈমানের উপর অবিচল থাকার নামই হচ্ছে ‘ইস্তিকামাত’। এর সাধারণ অর্থ হলো যা যেভাবে যে পরিমাণ দরকার ঠিক সেভাবেই হওয়া, করা। ইসলামের মূল দাবীও তাই। এতে ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয়দিক বিদ্যমান রয়েছে। ইতিবাচক কোন একটি বিধানও জীবন থেকে বাদ পড়লে যেমন ‘ইস্তিকামাত’ বহাল থাকে না। তেমনিভাবে জীবনে নেতিবাচক কোন একটি কাজ করলেও আর ‘ইস্তি কামাত’ অক্ষত থাকে না। ‘ইস্তিকামাত’ অর্থ স্থিতিশীল থাকা, প্রতিষ্ঠিত থাকা। সর্বাবস্থায় আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আদর্শের উপর অবিচল বা প্রতিষ্ঠিত থাকাকে শরীয়তের ভাষায় ইস্তিকামাত বলে।    امنت بالله এর মধ্যে তাওহীদ রয়েছে আর ثُمَّ اسْتَقم  কেননা এর মধ্যে যাবতীয় ইবাদত অন্ত র্ভুক্ত। হাদীসে অল্প কথায় ব্যাপক অর্থের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। আরবী ভাষায় ইহাকে جامع الكلام বলা হয়। আমাদের ঈমানের দাবী অনুযায়ী আল্লাহর সকল হুকুম আহকাম মেনে চলতে হবে। তবেই কেবল জান্নাত লাভ করা সম্ভব হবে। যা অপর এক হাদীসে সুন্দরভাবে বর্ণনা করা হয়েছে عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ (رض) قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ (صلعم) مَا مِنْ عَبْدٍ قَالَ لَا

إلَهَ إِلَّا اللهُ ثُمَّ مَاتَ عَلَى ذَالِكَ إِلَّا دَخَلَ الْجَنَّةَ. (مسلم) হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (সা) বলেছেন, “কোন ব্যক্তি যদি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর ঘোষণা দেয় এবং এরই উপর মৃত্যুবরণ করে, তবে অবশ্যই সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” (মুসলিম) গ্রন্থ পরিচিতি: সহীহ আল-মুসলিম। আলোচ্য হাদীসখানা সহীহ মুসলিম থেকে নেয়া হয়েছে। এ গ্রন্থের প্রণেতা হলেন ইমাম মুসলিম (র), যার পূর্ণ নাম আবুল হোসাইন মুসলিম বিন হাজ্জাজ আল কুশাইরী আন-নিশাপুরী। তিনি খুরাসানের প্রসিদ্ধ শহর

পৃষ্ঠা:২৯

নিশাপুরে ২০৪ হিজরী ২৪শে রজব জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবকাল থেকেই তিনি হাদীস শিক্ষায় আত্মনিয়োগ করেন। ২১৮ হিজরীতে ১৪ বছর বয়সে হাদীস সংগ্রহের জন্য তিনি হিজায, ইরাক, মিশর, বাগদাদ, সিরিয়া ইত্যাদি মুসলিম জাহানের ইল্ম শিক্ষার কেন্দ্রভূমিসমূহে ভ্রমণ করেন। তিনি সে কালের জ্ঞানসাগর ও যুগ শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ইমাম বুখারীর সান্নিধ্য লাভ করেন। ইমাম মুসলিম (র) সরাসরি ওস্তাদগণের থেকে শ্রুত তিন লক্ষ হাদীস হতে যাচাই-বাছাই করে (তাহযীবুল আসমা ১০ম খণ্ড) দীর্ঘ ১৫ বছর সাধনা ও গবেষণা করে এ শ্রেষ্ঠ গ্রন্থখানি সংকলন করেন। এতে তাকরারসহ হাদীস সংখ্যা ১২,০০০। তাকরার বাদে হাদীস সংখ্যা ৪,০০০ মাত্র। (তাদরীবুর রাবী) সমসাময়িক মুহাদ্দিসগণ এ গ্রন্থকে বিশুদ্ধ ও অমূল্য সম্পদ বলে উল্লেখ করেছেন। আজ প্রায় বার শত বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও সহীহ মুসলিমের সমমানের কোন গ্রন্থ রচিত হয়নি। হাফিয মুসলিম ইবনে কুরতুবী (র) বলেনঃ لَمْ يَضَعُ أَحَدٌ فِي الْإِسْلَامِ مِثْلَهُ. “ইসলামে এরূপ আর একখানি গ্রন্থ আর কেউই রচনা করতে পারে নাই।” (মুকাদ্দামা ফতহুল বারী ২য় অধ্যায়) এ গ্রন্থের বিশুদ্ধতা প্রসঙ্গে ইমাম মুসলিম নিজেই মন্তব্য করেন: “মুহাদ্দিসগণ যদি দু’শত বছর পর্যন্তও হাদীস লিখতে থাকেন, তবুও তাদেরকে এ সনদযুক্ত বিশুদ্ধ হাদীসের উপর নির্ভর করতে হবে।” (আল-মুকাদ্দামা আলাল মুসলিম, নববী) ইনতিকাল: এ মহা-মনীষী ২৬১ হিজরী সনে ৫৭ বৎসর বয়সে নিশাপুরে ইনতিকাল করেন। (আল-হাদীসু ওয়াল মুহাদ্দীসুন ৩৫৭ পৃঃ) রাবী পরিচিতিঃ সুফিয়ান ইবনে আবদুল্লাহ ইব্‌ন সাকাফী (রা)। সুফিয়ান ইবনে আবদুল্লাহ ইব্‌ন সাকাফী (রা) হুনায়েন যুদ্ধের পরে ইসলাম গ্রহণ করেন। হুনায়েনের যুদ্ধে তিনি কাফির বাহিনীর সাথে ইসলামের বিরুদ্ধে তার ভাই উছমানসহ অংশ গ্রহণ করেন। এ যুদ্ধে তার ভাই মুসলিম বাহিনীর হাতে নিহত হন। সুফিয়ান ভাইয়ের শোকে উদ্‌ভ্রান্ত ও

পৃষ্ঠা:৩০

নিরাশ হয়ে পড়েন। তিনি তার যুদ্ধে সঙ্গী আবু সুওয়াদকে বললেন, আর বেঁচে থেকে লাভ কি? মুসলমানেরা আমার ভাই উছমানকে হত্যা করেছে, আমিও মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে নিহত হব। একথা শুনে মুসলমানদের থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য তার সঙ্গী সুকৌশলে তাকে যুদ্ধের ময়দান থেকে বাহিরে নিয়ে গেল। এতে উভয়ই প্রাণে রক্ষা পেল। হুনায়েনের যুদ্ধে মুসলমানদের হাতে কাফির বাহিনীর অনেক লোক বন্দী হল। কাফিরেরা যুদ্ধের পরে বন্দীদের মুক্তির জন্য একটি প্রতিনিধি দলকে রাসূলের দরবারে পাঠালেন। সে দলে সৌভাগ্যক্রমে সুফিয়ান ইবনে আবদুল্লাহও ছিলেন। সে প্রতিনিধি দলটি রাসূলের দরবারে গিয়ে ইসলামের সুমহান আদর্শে আকৃষ্ট হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। তখন সুফিয়ান ইবনে আবদুল্লাহ আল্লাহর রাসূল (সা)-কে লক্ষ্য করে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! (সা) আপনি আমাকে ইসলাম সম্পর্কে এমন একটি (চূড়ান্ত) কথা বলে দিন, (যা আমি আঁকড়ে ধরবো) এ সম্পর্কে আপনার পরে আর কারও নিকট জিজ্ঞাসা করব না। উত্তরে রাসূল (সা) বললেন: “তুমি বল! আমি (এক) আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলাম। অতঃপর এই কথা ও বিশ্বাসের উপর অটল অবিচল থাকো। (মুসলিম, আবু দাউদ, নাসায়ী। তাহযীবুল আসমা ১ম খণ্ড পৃঃ ২২৩। ইবনে সা’য়াদ আত- তাবাকাত ৫ম খণ্ড পৃঃ ৫১৪। উসদুল গাবা ২য় খণ্ড পৃঃ ৩২০) তাওহীদের সংজ্ঞা: তাওহীদ )تَوْجِيدٌ( আরবী শব্দ। এর অর্থ হলো- একত্ববাদ, একক করা, এক জানা, শরীক না করা। (মুখতারুছ ছিহাহ পৃঃ ২৯৬) কাউকে একক বলে স্বীকার করা। )توجیّد( শব্দটি (১৯) থেকে নির্গত। এর অর্থ হলো একক হওয়া। মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা এক ও অদ্বিতীয়। এ বিশ্বাসের নামই তাওহীদ। ইসলামী শরীয়াতের পরিভাষায়- একমাত্র আল্লাহ তা’য়ালাকে সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, ইবাদত ও আনুগত্য পাওয়ার একমাত্র যোগ্য সত্তা হিসেবে বিশ্বাস করাকে তাওহীদ বলে।

কবিতা ৩১ থেকে ৪৫

পৃষ্ঠা:৩১

তাওহীদের সংজ্ঞা প্রদান করতে গিয়ে শাইখ আবদুর রহমান বিন নাসের আল-সাদী বলেন: “তাওহীদে মুতলাক বা নিরংকুশ তাওহীদ হচ্ছে, আল্লাহ তা’য়ালাকে সিফাতে কামেল বা পূর্ণাঙ্গ গুণাবলীতে একক বলে জানা এবং মানা। আজমত জালালাত বা শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্বের গুণে তিনি যে একক, দৃঢ়তার সাথে তার ঘোষণা দেওয়া এবং ইবাদতের মাধ্যমে তাঁর একত্বের প্রমাণ দান করা।” ইমাম আবু জাফর আত-তাহাভী (র) বলেনঃ তাওহীদ হলো এ বিশ্বাস করা যে, আল্লাহ এক, তাঁর কোন শরীক নেই। কোন কিছুই তাঁর সমকক্ষ নয়। কোন শক্তিই তাঁকে অক্ষম করতে পারবে না। আর তিনি ছাড়া কোন ইলাহ বা মাবুদ নেই। (আক্বীদাহ তাহাভীয়াহ পৃঃ ১৭/১৮) সা’দ উদ্দীন তাফতাজানী (র) বলেনঃ তাওহীদ বা একত্ববাদের আসল কথা হলো দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করা যে, উলুহিয়্যাত ও ইবাদতে আল্লাহর সাথে কোন শরীক নেই। উলুহিয়্যাত ও ইবাদত তার জন্যই খাস। (শরহুল মাকাছিদ-৪/৩৯)

‘তাওহীদ’-এর প্রকারভেদ: তাওহীদ বা আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস তিন ভাগে বিভক্ত। যথা:

১. রবুবিয়্যাত বা বিশ্ব প্রতিপালক হিসেবে আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস।

২. আল্লাহর নামসমূহ ও গুণাবলীতে একত্ববাদে বিশ্বাস।

৩. ইলাহ, মা’বুদ বা উপাস্য হিসেবে আল্লাহর একত্ববাদ।

তাওহীদী আকীদার বিভিন্ন স্তর

  1. التَّوْحِيدُ فِي الذَّاتِ )আল্লাহর মূল সত্তার একত্ব ও অবিভাজ্যতা): এর তাৎপর্য হলো, আল্লাহ এক ও একক। তাঁর কোন শরীক নেই। তিনি অকল্পনীয়, তাঁর মহান সত্তা অখণ্ড ও অবিভাজ্য। তিনি সৃষ্টিলোকের অন্যান্য বস্তুসমূহের ন্যায় বিভিন্ন উপাদান ও সংমিশ্রণে সৃষ্টি নন। আল-কুরআনে তাঁর পরিচয় এভাবে তুলে ধরা হয়েছেঃ “আল্লাহ নিজেই সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, তিনি ছাড়া কোন ‘ইলাহ’ নেই। এ সাক্ষ্য ফেরেশতাগণ ও বিবেকবান

পৃষ্ঠা:৩২

জ্ঞানীগণও দিয়েছেন সুবিচার নীতির উপর অবিচল থেকে। কেননা, তিনি ছাড়া প্রকৃত ইলাহ কেউ হতে পারে না।, তিনি সর্বজয়ী মহা বিজ্ঞানী।” (সূরা আলে-ইমরান: ১৮) আল-কুরআনের অন্যান্য আয়াতেও একই বর্ণনা পাওয়া যায়। যথা:الله “আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই।” (সূরা মুহাম্মদ: ১৯)هُوَ “তিনি আল্লাহ যিনি ছাড়া কেহ ইলাহ নেই।”

(সূরা হাশর: ২২) .لا إله إلا أنت سبحانك “হে আল্লাহ! তুমি ভিন্ন কেউ ইলাহ নেই, তুমি পরম পবিত্র।” (সূরা আম্বিয়া: ৮৭) فَاتَّقُوْنَ “আমি ভিন্ন কেউ ইলাহ নেই, অতএব আমাকে ভয় কর।” (সূরা নাহল: ২২)

  1. التَّوْجِيْدُ فِي الصِّفَاتِ )গুণাবলীর দিক দিয়ে আল্লাহর অনন্যতা( : আল্লাহ তাঁর গুণাবলীতে অতুলনীয়, অনুপম। তাঁর সত্তা, গুণ, মর্যাদা তথা সর্ববিষয় এমন, যার সাথে অন্য কারো তুলনা হয় না। ليس كمثله شيء. “তাঁর মত কিছুই নেই।” (সূরা আশ-শূরাঃ ১১) وَاللَّهُ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى فَادْعُوهُ بِهَا. “আল্লাহর রয়েছে সুন্দরতম নামসমূহ, সুতরাং তোমরা তাঁকে সে নামে ডাকো।” (সূরা আল-আরাফ: ১৮০)
  1. التَّوْحِيدُ فِي الْأَفْعَالِ )কার্যাবলীর ক্ষেত্রে আল্লাহর একক ও নিরংকুশ কর্তৃত্ব): আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর মূল সত্তায় যেমন একক; তেমনি তাঁর কার্যাবলীতেও একক। قُلِ اللَّهُ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ وَهُوَ الْوَاحِدُ الْقَهَّارُ “বলো! আল্লাহই সব জিনিসের স্রষ্টা। তিনি এক, দুর্দান্ত প্রতাপশালী।

(সূরা আর-রা’দঃ ১৬)

পৃষ্ঠা:৩৩

আল্লাহ ছাড়া কেউ সৃষ্টিকতৃা হতে পারে নাلْ مِنْ خَالِقَ غَيْرُ اللَّهِ. وَالْأَمْرُ “জেনে রাখ, সৃষ্টি যার কর্তৃত্ব তাঁর। (সূরা আরাফ: ৫৪( 8. التَّوْحِيدُ فِي الْعِبَادَةِ )ইবাদতে তাওহীদ): সকল প্রকার ইবাদতের একচ্ছত্র মালিক হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ তা’য়ালা। এতে তিনি ছাড়া আর কারোই বিন্দুমাত্র অধিকার নেই। দু’টি কারণে নিষ্ঠার সাথে ইবাদত করা যায়। যার একটি হচ্ছে- সকল প্রকার দোষ-ত্রুটি মুক্ত পূর্ণত্বের অধিকারী পূতঃপবিত্র ও অসীম। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে- তিনি হবেন মানুষের মা’বুদ ও স্রষ্টা। উভয় দিক দিয়েই ইবাদতের একমাত্র মালিক তিনিই। .لَا إِلَهَ إِلَّا أَنَّا فَاعْبُدُونِ “আমি ছাড়া কেউ মা’বুদ নেই, অতএব তোমরা কেবল আমারই ইবাদত কর।” (সূরা আম্বিয়া: ২৫) ৫. تَوْحِيدٌ فِي الربوبية রবুবিয়্যাতে তাওহীদ (প্রভুত্বে একক আধিপত্য(: মানুষের রব একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। তিনি সারা জাহানের রব, পালনকর্তা, ব্যবস্থাপক, পরিচালক ও নিয়ন্ত্রক। সমগ্র সৃষ্টি জগৎ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আল্লাহ হলেন একমাত্র রব বা প্রতিপালক। তিনি অগণিত নিয়ামতরাজির মাধ্যমে নিখিল সৃষ্টি জগতকে প্রতিপালন করছেন। এ আকীদা পোষণের নামই হচ্ছে রবুবিয়্যাতের তাওহীদ। قُلْ اغَيْرَ اللَّهِ ابْغِي رَبًّا وَهُوَ رَبُّ كُلِّ شَيْءٍ. “বলুন! আমি কি আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে রবরূপে মেনে নেব? অথচ তিনিই তো সকলের রব।” (সূরা আন’আম: ১৬

৫)التَّوْحِيدُ فِي الولاية কর্তৃত্ব করার ক্ষেত্রে আল্লাহর একত্ব) : কর্তৃত্ব করার নিরংকুশ ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর। সার্বভৌম (sovereignty) ক্ষমতার মালিক তিনিই। তাঁর কর্তৃত্বে কারো কোন অংশিদারিত্ব নেই। তাঁরই বিধান মতে মানুষ শুধুমাত্র জীবন ও জগৎ পরিচালনা করবে। কর্তৃত্ব করার ক্ষেত্রে আল্লাহর একত্ব (ব্যবস্থাপনা) দু’ভাগে বিভক্তঃ

পৃষ্ঠা:৩৪

প্রথমতঃ প্রাকৃতিক কর্তৃত্ব (ব্যবস্থাপনা) অর্থাৎ সৃষ্টির লালন-পালন, রক্ষণা-বেক্ষণ, ক্রম-বৃদ্ধি ইত্যাদি ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা সবকিছুই আল্লাহ করেন। দ্বিতীয়তঃ জীবন বিধান তথা আইন প্রণয়নের ব্যবস্থাপনায় একত্ব ও নিরংকুশ কর্তৃত্ব একমাত্র আল্লাহ তা’য়ালার। আইনদাতা, বিধানদাতা আল্লাহ। ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্র সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য যে নির্ভেজাল আইনের প্রয়োজন, তা দেয়ার ব্যাপারে আল্লাহর কর্তৃত্ব ও অধিকার একান্ত ভাবে স্বীকৃত। এ পর্যায়ে তাওহীদী আকীদার তিনটি দিক রয়েছে:

ক. নির্দেশদাতা হিসেবে আল্লাহর কর্তৃত্ব হুকুম বা নির্দেশ দান করার অধিকার কারো নেই। আল্লাহই কেবল মাত্র সকল ক্ষেত্রে হুকুম বা নির্দেশ করতে পারেন। তাঁর নির্দেশ ছাড়া অন্য কারো নির্দেশ পালন করা যাবে না। لله “শাসন কর্তৃত্ব করার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর।” .إلا له الخلق والأمر “জেনে রাখ, সৃষ্টি যার হুকুম চলবে (কর্তৃত্ব) তাঁর।” (সূরা আল-আরাফ: ৫৪)

খ. আনুগত্যে তাওহীদ সকল প্রকার আনুগত্য পাওয়ার অধিকার একমাত্র আল্লাহ তা’য়ালার। এতে সামান্যতম কারো কোন অধিকার নেই। কখনো কারো বিন্দুমাত্র অধীনতা স্বীকার করা যাবে না। কুরআনে যেখানে যেখানে অন্যের আনুগত্যের নির্দেশ করা হয়েছে তা করা যাবে, কেননা তা শুধু স্বয়ং আল্লাহর আনুগত্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই করা হয়। যেমনঃ مَنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ الله. “যে রাসূলের আনুগত্য করল সে আল্লাহর আনুগত্য করল।” (সূরা নিসাঃ ৮০) আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর আনুগত্য করার সাথে সাথে তাঁর রাসূলের আনুগত্য করার আদেশ করেছেন, তা কেবল তারই আনুগত্য বাস্তবায়নের জন্য। قلْ أَطِيعُوا الله وَالرَّسُول. “হে নবী! বলুন আনুগত্য কর আল্লাহর ও তাঁর রাসূলের।” (সূরা আলে ইমরান: ৩২)

পৃষ্ঠা:৩৫

গ. আইন প্রণয়নের অধিকারে আল্লাহর একত্ব আইন প্রণয়নের নিরংকুশ অধিকার একান্তভাবে আল্লাহরই জন্য নির্দিষ্ট। মানুষের আইন প্রণয়নের অধিকার নেই। আর না আছে মানব রচিত বিধান দ্বারা শাসনকার্য পরিচালনা করার অধিকার। সার্বভৌমত্বের মালিক যিনি আইন রচনা করার অধিকার কেবল তাঁরই। যারা আল্লাহর আইন ব্যতীত মানব রচিত আইনে শাসন কার্য পরিচালনা করে তারা হলো তাগুত। কুরআনে তাগুতী আইন অমান্য করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং আল্লাহর আইন অনুসরণ করা ফরয করা হয়েছে। সৃষ্টি যার আইন চলবে একমাত্র তাঁর। মানব রচিত কোন মতবাদ প্রচার করা ও প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শামিল থাকা কুফরি। পবিত্র কুরআনে আল্লাহর আইন অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়ে বলা হয়েছেঃ ثُمَّ جَعَلْنَاكَ عَلَى شَرِيعَةٍ مِّنَ الْأَمْرِ فَاتَّبِعْهَا. “অতঃপর আমরা তোমাকে জীবন যাপনের একটা সুদৃঢ় পথে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছি। অতএব তুমি তা অনুসরণ করে চল।” (সূরা জাসিয়া: ১৮) তাওহীদে বিশ্বাসের গুরুত্ব ও প্রভাব তাওহীদে বিশ্বাসের গুরুত্ব অপরিসীম। এটি ঈমানের প্রথম কথা। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের মূল হলো তাওহীদ। ইসলামের সকল শিক্ষাই তাওহীদে বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত। নিম্নে তাওহীদে বিশ্বাসের গুরুত্বসমূহ তুলে ধরা হলো।

১. ঈমানের প্রথম স্তর তাওহীদ ও মুসলমান হওয়ার প্রথম শর্ত হলো আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা। আর ঈমানের প্রথম শর্ত হলো তাওহীদ বা আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস।

২. ইসলামের মূল ভিত্তি হলো তাওহীদ: তাওহীদ ইসলামের মূল ভিত্তি। আল্লাহকে একমাত্র ইবাদতের মূল ভিত্তি হিসেবে মেনে না নিলে ইসলামের অস্তিত্বই থাকে না। অন্যন্য সকল প্রকার ইবাদত মূল্যহীন হয়ে পড়ে।

৩. ঈমানী শক্তির উৎস তাওহীদ: তাওহীদ মু’মিনদের সকল শক্তির উৎস।

পৃষ্ঠা:৩৬

তাওহীদে বিশ্বাসী মানুষ দুনিয়ার কোন শক্তিকে ভয় করে না। তাদের নিকট মাথা নত করে না। ঈমানের শক্তিতে বলিয়ান থাকে।

৪. ঐক্য সৃষ্টিতে তাওহীদঃ তাওহীদে বিশ্বাস পারস্পরিক বিভেদ দূর করে সকলের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি করে।

৫. বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের মাধ্যম তাওহীদঃ বিশ্বের সকল মুসলমান এক আল্লাহতে বিশ্বাসী হওয়ায় সকলের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব গড়ে উঠে।

৬. সৎকর্মের অনুপ্রেরণা তাওহীদ: আল্লাহর একত্ববাদ মু’মিন জীবনে

সৎকর্ম প্রেরণার একমাত্র উৎস। তাওহীদে বিশ্বাসীকে কেউই তার সংকল্প থেকে বিচ্যুত করতে পারে না।

৭. আত্মসচেতনতা সৃষ্টিতে তাওহীদঃ তাওহীদ মানুষের আত্মসচেতনতা ও আত্মমর্যাদাবোধ জাগিয়ে তোলে। এতে মানুষের মধ্যে উদার দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টি হয়। নিজের পরিচয় উপলব্ধি করতে পারে এবং আত্মমর্যাদা বোধ রক্ষায় সচেষ্ট হয়।

৮. স্বার্থপরতা দূরীকরণে তাওহীদঃ তাওহীদে বিশ্বাসী মানুষ আল্লাহর উপর নির্ভরশীল ও তাঁর প্রেমে অধিক বিভোর থাকায় দুনিয়ার লোভ-লালসা ও স্বার্থপরতা থেকে দূরে থাকে।

শিক্ষা

১। তাওহীদে বিশ্বাস করা ফরয।

২। তাওহীদের উপর অবিচল থাকতে হবে।

৩। তাওহীদের দাবী অনুয়ায়ী চলতে হবে।

৪। তাওহীদের বিপরীত কোন কাজ করা যাবে না।

৫। তাওহীদের বিপরীত চললে জাহান্নামে যেতে হবে।

৬। তাওহীদের বিশ্বাসের বিপরীত কোন কাজ করা শিরক।

পৃষ্ঠা:৩৭

দারস-৪ রিসালাত: عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ (رض) قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ (صلعم) وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ (صلعم) بِيَدِهِ لَا يَسْمَعُ بِي أَحَدٌ مِنْ هَذِهِ الْأُمَّةِ يَهُودِي وَلَا نَصْرَانِي ثُمْ يَمُوتُ وَلَمْ يُؤْمِنُ بِالَّذِي أُرْسِلْتُ بِهِ إِلَّا كَانَ مِنْ أَصْحَابِ النَّارِ. (مسلم) অর্থঃ হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (সা) বলেছেন: সেই মহান সত্তার শপথ, যাঁর (কুদরতী) হাতে (আমি) মুহাম্মদের প্রাণ। এ উম্মাতের (মানব জাতির) যে কেউই হোক না কেন? চাই সে ইয়াহুদী হোক কিংবা নাসারা হোক। আমার (নবুওয়াতের) কথা শুনবে অথচ আমি যা নিয়ে প্রেরিত হয়েছি, তার প্রতি ঈমান গ্রহণ না করেই মৃত্যুবরণ করবে, সে নিশ্চিত জাহান্নামী হবে। (মুসলিম) শব্দার্থ: : শপথ। نفس : আত্মা, প্রাণ। لا يسمع : সে গুনতেছে না। يموت : : نصراني : يهودي | احد মৃত্যুবরণ করে। لَمْ يُؤْمِنُ : সে বিশ্বাস করল না। از  : আমি প্রেরিত হয়েছি। أَصْحَابُ: সাথী, সঙ্গী, সহচরগণ, ভক্তবৃন্দ। الأمة: দল, গোষ্ঠী। كان: সে হয়, সে ছিল। : আগুন।

ব্যাখ্যাঃ ইয়াহুদী ও নাসারা প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র নবীর উম্মত। আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের উপর কিতাব অবতীর্ণ করা হয়েছিল এবং উহার বিধি- বিধানও তাদের উপর প্রয়োগ করা হয়েছিল। হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর নবুওয়াত প্রাপ্তির পর পূর্বেকার সকল দীন বাতিল বা মানসূখ হয়ে গিয়েছে। যদিও নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্ব পর্যন্ত তাদের পূর্ববর্তী কিতাবের অনুসরণ করা বৈধ ছিল। মহানবী (সা) দীনকে পূর্ণতা দান করার জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন। কাজেই তিনি যে দীনে হক (ইসলাম) সহকারে এসেছেন সে

পৃষ্ঠা:৩৮

রিসালাতের প্রতি ঈমান আনয়ন করা ও তা অনুসরণ করা সকলের জন্য ফরয। এ প্রসঙ্গে রাসূল (সা) বলেনঃ “সেই মহান সত্তার শপথ, যার হাতে (আমি) মুহাম্মদের প্রাণ! এ সময় যদি মূসা আলাইহিস সালামও তোমাদের নিকট আত্মপ্রকাশ করতেন এবং তোমরা আমাকে পরিত্যাগ করে তাঁর অনুসরণ করতে, তবে তোমরা সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যেতে। এমনকি তিনি আমার অনুসারী হতেন। অপর বর্ণনায় আছে, “আমার আনুগত্য ছাড়া তাঁর কোন উপায় থাকতো না।” (মিশকাত পৃঃ ৩২) সুতরাং যারা তাঁর দীনকে মেনে তা অনুসরণ করবে সে জান্নাতের অধিকারী হবে, আর যে তা প্রত্যাখ্যান করবে সে জাহান্নামের অধিবাসী হবে। চাই সে ইয়াহুদী হোক বা নাসারা হোক। অপর এক হাদীসে বর্ণিত আছেঃ لا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ إِلَّا نَفْسُ مُسْلِمَةٌ. “মুসলিম ব্যতীত অন্য কোন লোক জান্নাতে প্রবেশ করবে না।”

গ্রন্থ পরিচিতিঃ সহীহ আল-মুসলিম-এর পরিচিতি ৩নং হাদীসে আলোচনা করা হয়েছে। রাবী পরিচিত: হযরত আবু হুরায়রা (রা)। নামঃ উল্লেখিত হাদীসখানা হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। তাঁর নাম সম্পর্কে প্রায় ৩৫টি অভিমত পাওয়া যায়। বিশুদ্ধতম অভিমত হচ্ছে ইসলাম গ্রহণের পূর্বে তাঁর নাম ছিল- ১. আবদুশ শামছ, ২. আবদু আমর, ৩. আবদুল ওয়্যা ইত্যাদি। ইসলাম গ্রহণ করার পর তাঁর নাম- ১. আবদুল্লাহ ইবনে সাখর ২. আবদুর রহমান ইবনে সাখর ৩. ওমায়ের ইবনে আমের। উপনামঃ আবু হুরায়রা। পিতার নামঃ সাথর। মাতার নামঃ উন্মিয়া বিনতে সাফীহ অথবা মাইমুনা। আবু হুরায়রা নামে প্রসিদ্ধির কারণ: আবু অর্থ-পিতা, হুরায়রা অর্থ-

পৃষ্ঠা:৩৯

বিড়াল ছানা। এ হিসেবে আবু হুরায়রা অর্থ হয় বিড়ালের মালিক বা পিতা। একদা হযরত আবু হুরায়রা (রা) তাঁর জামার আস্তিনের নিচে একটি বিড়াল ছানা নিয়ে রাসূলের দরবারে হাজির হন। হঠাৎ বিড়ালটি সকলের সামনে বেরিয়ে পড়ে। তখন রাসূল (সা) রসিকতার সাথে বলে উঠলেন: “ی هريرة” “হে বিড়ালের পিতা? তখন থেকেই তিনি নিজের জন্য এ নামটি পছন্দ করে নেন এবং এ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। ইসলাম গ্রহণ: হযরত আবু হুরায়রা (রা) ৭ম হিজরী মোতাবেক ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে খায়বার যুদ্ধের পূর্বে ইসলামগ্রহণ করেন। প্রখ্যাত সাহাবী তুফায়িল বিন আমর আদ-দাওসীর হাতে ইসলামে দীক্ষিত হন। রাসূল (সা)-এর সাহচর্য তিনি ইসলাম গ্রহণের পর ইলম অর্জনের তীব্র আকাঙ্খা নিয়ে রাসূল (সা)-এর সাহচর্যে আসেন। রাসূল (সা) যখন যেদিকে যেতেন তিনিও সেদিকে যেতেন। এভাবে সার্বক্ষণিক সাহচর্য লাভ ও খেদমতের মাধ্যমে তিনি অধিক হাদীস চর্চার সৌভাগ্য লাভ করেন। রাসূল (সা)-এর দু’আ: হাদীস বর্ণনার প্রাথমিক অবস্থায় তিনি তাঁর স্মৃতিতে সব কিছু ধারণ করে রাখতে পারতেন না। রাসূল (সা)-কে একথা বলার পর তিনি তাকে তার ‘চাদর বিছিয়ে রাখার’ কথা বলেন, অতঃপর তাতে দু’আ করলেন। এ বরকতের ধারায় তিনি এমন তীক্ষ্ণ মেধা ও স্মৃতি শক্তির অধিকারী হলেন যে, তিনি যা শুনতেন তা আর কোন দিন ভুলতেন না। হাদীসে তাঁর অবদানঃ হযরত আবু হুরায়রা (রা) হাদীসের প্রচার ও প্রসারে বিরাট অবদান রেখেছেন। তিনি সর্বাপেক্ষা অধিক সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ৫৩৭৪টি। তন্মধ্যে বুখারী ও মুসলিম শরীফে ৮২২টি ও এককভাবে বুখারীতে ৪০৪টি এবং মুসলিম শরীফে ৪১৮টি হাদীস স্থান পেয়েছে। ইনতিকাল: হাদীসে নববীর এই মহান খাদেম ৭৮ বছর বয়সে মদীনার অদূরে ‘কাসবা’ নামক স্থানে ইনতিকাল করেন।

পৃষ্ঠা:৪০

রিসালাত অর্থ: রিসালাত )رِسَالَ( আরবী শব্দ। এটা رَسُوْلُ শব্দের ক্রিয়ামূল। রিসালাত হল রাসূলের পদবী। আর “রাসূল” অর্থ- প্রেরিত। এ দিক দিয়ে রাসূল শব্দ আরবী ভাষায় দূত, বাণীবাহক, সংবাদদাতা বা সংবাদবাহক, Messenger ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়। রাসূল ফেরেশতা হতে পারে এবং মানুষও হতে পারে। ফেরেশতা যখন রাসূল হয় তখন তার অর্থ হয় আল্লাহর নির্দেশ ও বাণী বহনকারী। মানুষ যখন রাসূল হয় তখন তার অর্থ হয় আল্লাহর বার্তা ও বিধানপ্রাপ্ত ব্যক্তি যিনি তা প্রচার করেন ও বাস্তবায়িত করেন। (কুরআনের পরিভাষা: ২২) আল্লামা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (র) বলেন: “রাসূল )رَسُوْل( শব্দের অর্থ ‘প্রেরিত’। এ দৃষ্টিতে আরবী ভাষায় দূত, বাণীবাহক, সংবাদদাতা বা সংবাদবাহক ইত্যাদি অর্থ বোঝাবার জন্য এ শব্দের ব্যবহার হয়। পবিত্র কুরআনে এ শব্দটি সে সকল ফেরেশতাদের বোঝানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে, যারা আল্লাহর নিকট থেকে বিশেষ কাজ সম্পাদনের উদ্দেশ্যে প্রেরিত হয়ে থাকেন এবং তাদেরকেও যাদের আল্লাহ তা’য়ালা বিশ্ব মানবের নিকট পয়গাম পৌঁছিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে মনোনীত করে পাঠিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে “রিসালাত” একবচনে ৩ বার এবং বহুবচনে ৭ বার এসেছে। (আল-মিসবাহুল মুনীর: ২২৯) ডঃ ইব্রাহীম আনীস বলেনঃ “রাসূল আল্লাহর পক্ষ থেকে যা প্রচারের জন্য আদিষ্ট হয়েছেন, তাই রিসালাত।” আল্লামা আমীমুল ইহসান বলেন: “কোন ব্যক্তি অপর ব্যক্তির নিকট সংবাদ পৌঁছিয়ে দেয়া হলো রিসালাত।” ইসলামী শরীআতের পরিভাষায়, আল্লাহ তা’য়ালার পক্ষ থেকে পৃথিবীর মানুষের কাছে তাঁর বার্তা বা আদেশ-নিষেধ পৌছিয়ে দেয়াকে রিসালাত বলে। রিসালাতে বিশ্বাসের গুরুত্বঃ ইসলামে রিসালাতের গুরুত্ব অপরিসীম। নিম্নে এর গুরুত্ব তুলে ধরা হলো:

পৃষ্ঠা:৪১

১. ইসলামের মূলভিত্তিঃ তাওহীদের মত রিসালাতও ইসলামের মূল ভিত্তি। রিসালাতে বিশ্বাস করা ঈমানের অঙ্গ। তাওহীদে বিশ্বাস করা যেমন জরুরী, রিসালাতে বিশ্বাস করাও তেমনি জরুরী।

২. স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে সেতু বন্ধনঃ রিসালাতের মাধ্যমে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে সেতু বন্ধন তৈরি হয়েছে। মানুষ রিসালাতের মাধ্যমেই আল্লাহর পরিচয় লাভ করতে পেরেছে। অন্যথায় আল্লাহর পরিচয় লাভ করা মানুষের পক্ষে কঠিন হত।

৩. ঈমানের অপরিহার্য অঙ্গ: রিসালাতে বিশ্বাস করা ঈমানের অপরিহার্য

গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। রিসালাতকে অস্বীকার করা হলে আল্লাহর বাণীকে অস্বীকার করা হয়, আর আল্লাহর বাণীকে অস্বীকার করা হলে আল্লাহকে অস্বীকার করা হয়।

৪. জান্নাত লাভের মাধ্যমঃ রিসালাত জান্নাত লাভের মাধ্যম। রিসালাতের পথ অনুসরণ করে ইবাদত না করলে পরকালে জান্নাত লাভ করা যাবে না।

৫. নৈতিকতা শিক্ষাঃ রিসালাত মানুষের উপর মানুষের কর্তৃত্ব এবং সকল প্রকার শোষণ ও যুলুমের অবসান ঘটিয়ে ইনসাফ ও নৈতিকতা শিক্ষা দেয়।

নবী ও রাসূল প্রেরণের উদ্দেশ্য রিসালাত মহান রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে মানব জাতির জন্য এক বিশেষ রহমত। রিসালাত ব্যতীত মানুষ তাঁর সঠিক পথের সন্ধান পেত না। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো: ১. মানুষের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনেঃ দুনিয়ায় মানুষের জীবন যাপনের জন্য যা কিছু প্রয়োজন আল্লাহ তা’য়ালা সে সকল জিনিসের ব্যবস্থা করেছেন। তা ব্যবহার করে কিভাবে সাফল্য লাভ করতে পারে তার সঠিক দিক নির্দেশনার প্রয়োজনেই আল্লাহ তা’য়ালা নবী ও রাসূলগণকে প্রেরণ করেছেন। “আর আমি এ নবীদেরকে জননেতা বানিয়েছি, তাঁরা আমার নির্দেশ অনুযায়ী হিদায়াত প্রদান করে। আর তাঁদের প্রতি আমার বিপুল কল্যাণময় কার্যাবলী সম্পাদন, সালাত কায়েম করার, যাকাত আদায় ও

পৃষ্ঠা:৪২

বণ্টনের নির্দেশ ওহীর মাধ্যমে পাঠিয়েছি। বস্তুত এরা সকলেই ছিল আমার প্রতি কৃতজ্ঞ বান্দা।” (সূরা আম্বিয়া: ৭৩) ২. আল্লাহর দাসত্বের প্রতি আহ্বান: আল্লাহ তা’য়ালা একমাত্র তাঁর দাসত্ব করার আহ্বান জানানোর জন্যই যুগে যুগে অগণিত নবী ও রাসূল প্রেরণ করেছিলেন। وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَّسُولٍ إِلَّا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا انَا فَاعْبُدُونَ. “তোমার পূর্বে আমরা যে রাসূলই পাঠিয়েছি, তাকে আমরা ওহীর মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছি যে, আমি ছাড়া ‘ইলাহ’ নেই। অতএব কেবল আমারই দাসত্ব কর।” (সূরা আম্বিয়া: ২৫) ৩. পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান পৌঁছে দেয়া: মানুষের নিকট আল্লাহ তা’য়ালার আদেশ-নিষেধ সম্বলিত পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান পৌঁছে দেয়ার মহান দায়িত্ব পালনের জন্য তিনি নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। তাঁরা তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছেন। কারণ এ বিষয়ে ছিল কঠোর তাকিদ। يا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغ مَا أُنزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَّمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلِّغْتَ رِسَالَتَه. “হে রাসূল! তোমার নিকট তোমার রব এর পক্ষ থেকে যা কিছু নাযিল হয়েছে, তা যথাযথভাবে পৌঁছিয়ে দাও। যদি তা না কর, তাহলে তুমি রিসালাতের দায়িত্ব পালন করলে না।” (সূরা মায়িদা: ৬৭) ৪. আলোকোজ্জ্বল পথের সন্ধান : পথহারা মানুষদেরকে সিরাতুল মুস্তাকিমের পথে চির সত্য ও আলোকোজ্জ্বল পথের সন্ধান দিতে নবী- রাসূলদেরকে পাঠিয়েছেন। كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ لِتُخْرِجَ النَّاسَ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ “এই কিতাব তোমার প্রতি আমরা নাযিল করেছি এজন্য যেন- তুমি

পৃষ্ঠা:৪৩

 মানুষকে পুঞ্জীভূত অন্ধকার থেকে বের করে আলোর পথে নিয়ে আসতে পার।” (সূরা ইবরাহীমঃ ১) ৫. অনুসরণীয় আদর্শরূপে: নবী-রাসূলগণ ছিলেন বিশ্ব মানবতার অনুসরণীয় আদর্শ নেতা ও পথ প্রদর্শক। তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে যে বাণী নিয়ে এসেছেন তা তাদের বাস্তব জীবনে অনুসরণ করে দেখিয়েছেন। তারা বিবেক-বুদ্ধির দিক দিয়ে ছিলেন পরিপূর্ণ এবং চরিত্রের দিক দিয়ে ছিলেন পবিত্রতম। لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أَسْوَةٌ حَسَنَةٌ. “নিঃসন্দেহে রাসূলের মধ্যে তোমাদের জন্য অতীব উত্তম আদর্শ রয়েছে।” (সূরা আহযাবঃ ২১) ৬. পরকালীন জীবন সম্পর্কে অবহিত করণার্থে: মানুষের দুনিয়ার জীবনই শেষ নয়, মৃত্যুর পরে তাকে আবার অনিবার্যরূপে পুনরুত্থিত হতে হবে এবং সকল কাজের ভাল-মন্দের জবাবদিহী করতে হবে। নবী-রাসূলগণ পরকালীন জীবন সম্পর্কে অবহিত করণার্থে প্রেরিত হয়েছেন। الَمْ يَأْتِكُمْ رَسُلٌ مِّنْكُمْ يَقْصُونَ عَلَيْكُمْ آيَاتِي وَيُنْذِرُونَكُمْ لِقَاءَ يَوْمِكُمْ هُدًا. “তোমাদের নিকট কি তোমাদের মধ্য থেকে রাসূলগণ আসেনি? যারা তোমাদের নিকট আমার আয়াত বর্ণনা করেছেন ও আজকের দিনের ব্যাপারে তোমাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছেন।” (সূরা আন’আমঃ ১৩১) ৭. আইন প্রণেতা ও ব্যাখ্যাদাতা হিসেবেঃ রাসূলগণই মানব রচিত আইনের পরিবর্তে আল্লাহর আইন মানব সমাজে চালু করেন এবং তার ব্যাখ্যা প্রদান করেন ও প্রয়োগ পদ্ধতি শিক্ষা দেন। চিরস্থায়ী সুখ-শান্তির জন্য আল্লাহর আইনের কোন বিকল্প নাই। তাই আল্লাহর দূরদর্শী আইন মানব সমাজে প্রয়োগের জন্য নবী-রাসূলের প্রেরণ আবশ্যক ছিল। ৮. দীনে হককে বিজয়ী করণার্থে: নবী-রাসূলগণের প্রেরণের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর মনোনীত একমাত্র জীবন বিধান ইসলামকে অন্যান্য সকল মতাদর্শের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান ও বিজয়ী করা।

পৃষ্ঠা:৪৪

هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّين كله. “তিনি আল্লাহ যিনি তাঁর রাসূলকে হিদায়াত ও সত্য (দীন) জীবন ব্যবস্থা সহকারে পাঠিয়েছেন, যেন তিনি এ দীনকে অন্য সব বাতিল ব্যবস্থা সমূহের উপর বিজয়ী করেন।” (সূরা আত-তওবা: ৩৩, সূরা আস-সফ: ৯) নবী-রাসূলগণের গুণাবলী নবী-রাসূলগণ ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানী, বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ। নিষ্পাপ ও নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী। লোভ-লালসা, পাপ-পঙ্কিলতা, ক্লেদ ও ক্রোধ কখনো তাদেরকে স্পর্শ করতে পারেনি। আমাদের প্রিয় নবী (সা) ছিলেন আদর্শের মূর্ত প্রতীক। মক্কার কাফিররা তাঁকে অনেক প্রলোভনের মাধ্যমে আদর্শচ্যুত করতে চেয়েছিল। নবী করীম (সা) তাদেরকে বলে দিয়েছিলেন, “আমার এক হাতে চন্দ্র আর অন্য হাতে সূর্য এনে দিলেও আমি সত্য প্রচারে পিছপা হবো না।” হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর বৈশিষ্ট্য আল্লাহ তা’য়ালা পৃথিবীতে যুগে যুগে যত নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন তাদের মধ্যে হযরত মুহাম্মদ (সা) ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী। আল্লাহ তা’য়ালা তাঁকে সারা বিশ্বের রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছেন। সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানী কিতাব পবিত্র কুরআন তাঁর উপর নায়িল করেছেন। তার পরে কোন নবী আসেননি আর কিয়ামত পর্যন্ত কোন নবী আসবেন না। খাতমুন নবুওয়াত খাতমুন শব্দের অর্থ সমাপ্তি। খাতমুন নুবুওয়াত অর্থ নবুওয়াতের সমাপ্তি। মানব জাতির হিদায়াতের জন্য যত নবী-রাসূল দুনিয়াতে আগমন করেছেন তাঁর মধ্যে হযরত মুহাম্মদ (সা) ছিলেন সর্বশেষ নবী। তার পরে আর কোন নবী আসবেন না। কেননা তাঁর মাধ্যমেই নবুওয়াতের সমাপ্তি ঘটেছে। মহানবী (সা) বলেন: أنا خَاتَمُ النَّبِيِّينَ لَا نَبِي بَعْدِي.

পৃষ্ঠা:৪৫

“আমি শেষ নবী, আমার পরে আর কোন নবী নেই।” (বুখারী, মুসলিম) মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর পরে আর কোন নবী আসবেন না এ প্রসঙ্গে আল্লাহর বাণী:مَا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَا أَحَدٍ مِّنْ رِّجَالِكُمْ وَلَكِنْ رَّسُولَ اللَّهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ. “মুহাম্মদ তোমাদের পুরুষদের মাঝে কারোরই পিতা ছিলো না। বরং সে আল্লাহর রাসূল এবং নবীগণের সমাপ্তিকারী। (সূরা আল-আহযাব: ৪০) হযরত ইবনে মাসউদ (রা) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন: وَلَكِنَّ نَبِيًّا خَتَمُ النَّبِيِّينَ. “পরন্ত তিনি নবী, যিনি সকল নবীকে সমাপ্ত করেছেন।” (তাফসীরে তাবারীঃ ২২তম ১২ পৃঃ) অপর এক হাদীসে রাসূল (সা) বলেনঃ “আমি ও আমার পূর্ববর্তী নবীগণের দৃষ্টান্ত হলো এই যে, এক ব্যক্তি একটি দালান তৈরী করলো এবং খুব সুন্দর ও শোভনীয় করে সেটা সজ্জিত করলো। কিন্তু তার এক কোণে একটি ইটের স্থান শূন্য ছিল। দালানটির চতুর্দিকে মানুষ ঘুরে ঘুরে তার সৌন্দর্য দেখে বিস্ময় প্রকাশ করছিল এবং বলছিল এ স্থানে একটি ইট রাখা হয়নি কেন? কাজেই আমি সেই ইট এবং “أنا خاتم النبين” আমিই শেষ নবী।” (সহীহ আল-বুখারী)

শিক্ষা

১. মুহাম্মদ (সা)-এর রিসালাতের প্রতি বিশ্বাস করা ফরয।

২. মুহাম্মদ (সা)-এর আগমণের পর সকল ধর্ম বাতিল হয়ে গেছে।

৩. রিসালাতে বিশ্বাস করা ঈমানের অঙ্গ।

৪. রিসালাতকে অস্বীকার করা কুফরী।

৫. রিসালাতের অনুসরণ করা কর্তব্য।

কবিতা ৪৬ থেকে ৬০

পৃষ্ঠা:৪৬

দারস-৫ আখিরাত: عَن ابْنِ مَسْعُودٍ (رض) عَن النَّبِيِّ (صلعم) قَالَ لَا تَزُولُ قَدَمَا ابْن أَدَمَ حَتَّى يُسْتَلْ عَنْ خَمْسٍ عَنْ عُمْرِهِ فِيْمَا أَفْنَاهُ وَعَنْ شَبَابِهِ فِيْمَا أَبْلَاهُ وعن ماله من أين اكتسبه وفيما أنفقه ومَا عَمَلَ فِيمَا عَلِمَ. (ترمذی) অর্থঃ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) রাসূল (সা) থেকে বর্ণনা করেছেন। রাসূল (সা) বলেছেনঃ (কিয়ামতের দিন) আদম সন্তানের পা (স্বস্থান থেকে) একটুও নড়াতে পারবে না যতক্ষণ না পাচঁটি ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে।

১. তার জীবন কালটা কি কাজে শেষ করেছে;

২. তার যৌবনকাল কি কাজে নিয়োজিত রেখেছে;

৩. তার ধন-সম্পদ কোন উৎস থেকে উপার্জন করেছে;

৪. কোন কাজে তা ব্যয় করেছে এবং

৫. সে অর্জিত জ্ঞানানুযায়ী কতটা আমল করেছে। (তিরমিযী)

শব্দার্থ : ال সে বলল। ১০ট১ঃ তুমি নড়াতে পারবে না। ১১: দু’পা। يُسْئل: জিজ্ঞাসিত হবে। خَفْسٌ : পাঁচ : عُمره : তার জীবনকাল। اهত্রা: ব্যয় করা, শেষ করা। شَبَابُ: যৌবনকাল। ১: তার। لاهড়া: নিয়োজিত রাখা। এট: তার সম্পদ। مِن থেকে, হতে। این : কোথায়। اكتسبه : উহা উপার্জন করেছে। الفقه: উহা ব্যয় করেছে। عمل : আমল করেছে। علم : সে জেনেছে।

ব্যাখ্যা : আলোচ্য হাদীসখানায় পরকালের জবাবদিহিতা সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। ইহজগৎ মানুষের কর্মক্ষেত্র। এখানে মানুষ যে আমল করবে

পৃষ্ঠা:৪৭

পর জগতে তার ফল ভোগ করবে। দুনিয়ার সকল কাজের হিসাব আখিরাতে মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে দিতে হবে। হিসাব দিতে হবে জীবন, যৌবন, আয়-ব্যয়, জ্ঞানার্জন ও আমলের। মোটকথা পার্থিব জগতের ভাল-মন্দ সকল কাজের হিসাবই দিতে হবে। বিশেষ করে হাদীসে উল্লেখিত পাঁচটি প্রশ্নের জবাব না দেয়া পর্যন্ত কোন আদম সন্তানের পা সামনে এক কদমও অগ্রসর করতে পারবেন না। কাজেই আমাদের সকলকে পরকালে জবাবদিহী করার মানসিকতা নিয়ে কাজ করা একান্ত প্রয়োজন। গ্রন্থ পরিচিতিঃ জামে আত-তিরমিযী। গ্রন্থ পরিচিতি ২নং দারসে উল্লেখ করা হয়েছে। রাবী পরিচিতিঃ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) নামঃ হযরত আবদুল্লাহ। পিতার নামঃ মাসউদ। উপনামঃ আবু আবদুর রহমান আল-হুযালী। বৈবাহিক জীবনঃ তিনি ছাকীফা গোত্রের আবদুল্লাহ ইবনে মু’য়াবিয়ার কন্যা যয়নবকে বিবাহ করেন। তাঁর তিন পুত্র ও এক কন্যা ছিল।

ইসলাম গ্রহণ : মহানবী (সা) দারুল আরকামে প্রবেশের পূর্বেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। (মুস্তাদরাকে হাকিম) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) নবুওয়াতের প্রাথমিক অবস্থায় ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তিনি নিজেই বলতেন আমি ৬ষ্ঠতম মুসলিম হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছি। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক তাঁকে ৩৩তম এবং সিয়ারে আলামুনুবালা গ্রন্থে ১৭তম মুসলিম বলে উল্লেখ করেছেন।

সাহচর্য লাভঃ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) সর্বদা রাসূলে করীম (সা)-এর খিদমতে নিয়োজিত থাকতেন ও সফর সঙ্গী হতেন। তিনি হুযূর (সা)-এর অযুর পানি, মিসওয়াক ও জুতা মোবারক বহন করতেন। হিজরত: ইসলাম গ্রহণের পর তিনি প্রকাশ্যভাবে মক্কায় কুরআন তিলাওয়াত শুরু করেন। ফলে তিনি কাফিরদের অত্যাচারের শিকার হন।

পৃষ্ঠা:৪৮

এক পর্যায়ে কুরাইশদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মক্কা থেকে আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। রাসূল (সা) মদীনায় হিজরত করলে তিনি আবিসিনিয়া থেকে মদীনায় হিজরত করেন। জিহাদে যোগদানঃ তিনি সকল জিহাদে অংশগ্রহণ করে ইসলামের দুশমনদের সাথে প্রকাশ্যে মোকাবেলা করেন এবং বীরত্বের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হন। হুনায়েনের যুদ্ধে তিনি শত্রুর বিরুদ্ধে সাহসিকতার সাথে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনঃ ৬৪০ খ্রিঃ মোতাবেক ২০ হিজরী কুফায় কাজী নিযুক্ত হন। একই সাথে বাইতুল মাল, ধর্মীয় শিক্ষা ও মন্ত্রিত্বের দায়িত্বও পালন করেন। চারিত্রিক গুণাবলী: তিনি উন্নত চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। সততা, ন্যায়-নিষ্ঠা, দক্ষতা ও বিচক্ষণতার এক জীবন্ত আঁকর ছিলেন। জীবনের সকল ক্ষেত্রে চুপ থাকা ও পরামর্শের ক্ষেত্রে রাসূল (সা)-এর নীতি অনুসরণ করতেন।

হাদীস বর্ণনায় তাঁর অবদানঃ হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি রাসূল (সা)-এর সঙ্গী হওয়া ও খিদমত করার সুবাদে অনেক হাদীস বর্ণনা করার সুযোগ পেয়েছেন। রাসূল (সা) তাঁর অনেক গোপন কথাও তাঁকে বলতেন। তাঁর থেকে চার খলীফাসহ অসংখ্য সাহাবী ও তাবিয়ী হাদীস বর্ণনা করেছেন। তিনি ছিলেন সাহাবীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ফকীহ। তাঁর বর্ণিত হাদীস সংখ্যা ৮৪৮টি। ৬৪/৬৮টি বুখারী শরীফে ও মুসলিম শরীফে যৌথভাবে বর্ণিত আছে। ইনতিকাল: তিনি ৩৩ হিজরীর ৯ই রমযান ৬০ বছর বয়সে মদীনায় ইনতিকাল করেন। হযরত ওসমান (রা) তাঁর জানাযার নামাযে ইমামতি করেন ও জান্নাতুল বাকীতে দাফন করেন।

পাঁচটি বিষয়ের তাৎপর্য আল্লাহ তা’য়ালা মানব জাতিকে যে সকল নি’য়ামতরাজি দান করেছেন তাঁর মধ্যে হাদীসে উল্লেখিত পাঁচটি জিনিস মৌলিক ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। আখিরাতে এ সকল নি’য়ামতের হিসাব পুঙ্খানপুঙ্খভাবে দিতে হবে।

পৃষ্ঠা:৪৯

১. জীবনকাল: মানুষের জীবন হল অমূল্য সম্পদ। আল্লাহ তা’য়ালা মানুষকে এ সম্পদ দান করেছেন তাঁর হুকুম পালন করার জন্য। কাজেই এ জীবন আল্লাহর মর্জিমত পরিচালনা করা উচিৎ। হেলায়-খেলায় জীবনকাল অতিবাহিত করলে চলবে না। মৃত্যু আসার পূর্বে জীবনের গুরুত্ব অনুধাবন করা প্রয়োজন।

২. যৌবনকাল: মানুষের দীর্ঘ জীবনের যৌবনকাল একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ সময় মানুষ যৌবনের তাড়নায় যা ইচ্ছা তাই করার ক্ষমতা রাখে। যারা বুদ্ধিমান তারা আল্লাহর হুকুম মত তাদের যৌবনকাল পরিচালনা করে থাকেন। সকলেরই বার্ধক্য আসার পূর্বে যৌবন কালের গুরুত্ব দেয়া উচিত।

৩. আয়ের উৎসঃ আল্লাহ তা’য়ালা মানুষকে হালাল পথে সম্পদ উপার্জনের আদেশ করেছেন এবং হারাম পথে সম্পদ উপার্জন করতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু অনেক সময় মানুষ লোভাতুর হয়ে হালাল-হারামের তোয়াক্কা না করে যা পায় তা লুফে নেয়। এটা কোন সঠিক পথ নয়। এ সম্পর্কে তাকে আল্লাহর নিকট কঠোর জবাবদিহি করতে হবে।

৪. ব্যয়ের খাতঃ মানুষের নিকট সম্পদ হল আল্লাহর দেয়া আমানত। সম্পদের প্রকৃত মালিক হল আল্লাহ তা’য়ালা। আল্লাহ যাকে যখন যে সম্পদ দান করেন তার পূর্ণ হিফাযত করা তার নৈতিক দায়িত্ব। আর এ দায়িত্ব পালন করার অর্থ হল তাঁর নির্দেশমত অর্থ ব্যয় করা। মনে রাখতে হবে কোন পথে সে অর্থ উপার্জন করেছে এবং কোন পথে তা ব্যয় করেছে সে সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে।

৫. জ্ঞানানুযায়ী আমলঃ জ্ঞানার্জন করা ফরয। আর জ্ঞানানুযায়ী আমল করাও ফরয। মানুষ জ্ঞানার্জনের ব্যাপারে উদাসীন বটে কিন্তু তার চেয়েও বেশী দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো জ্ঞানানুযায়ী আমলের ক্ষেত্রে। কমসংখ্যক লোকই আছেন যারা জ্ঞানানুযায়ী আমল করে থাকেন। কাজেই জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রেও আমাদের এ উপলব্ধি থাকা প্রয়োজন যে, এ বিষয়েও আমাদেরকে আল্লাহর নিকট জবাবদিহি করতে হবে।

পৃষ্ঠা:৫০

আখিরাত

আখিরাত অর্থ: আখিরাত শব্দটি আরবী (১) শব্দ থেকে উদ্ভূত। এর অর্থ- শেষ, পরে, পরবর্তী, শেষ পরিণতি, শেষ ফল, পরজীবন, পরকাল, কিয়ামত, দ্বিতীয় আলম ইত্যাদি। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায়, মৃত্যুর পর হতে মানুষের যে অনন্ত জীবনকাল আরম্ভ হয়, তাকে আখিরাত বলে। পার্থিব জীবনের পর যে অনন্ত জীবনকাল তাই কুরআনের পরিভাষায় আখিরাত। মৃত্যু পরবর্তী অনন্ত জীবনস্থলকে দারুল আখিরাত বলা হয়। (কুরআন পরিচিতি পৃঃ ৬৭) কুরআনে আখিরাত শব্দের ব্যবহার কুরআনে ৪৯ বার দুনিয়া ও আখিরাত একত্রে ব্যবহৃত হয়েছে এবং স্বতন্ত্রভাবে আখিরাত ও ইয়াওমুল আখিরাত ৯৪ বার ব্যবহৃত হয়েছে। (কুরআনের পরিভাষা: ২৮)

ইহকালই মানব জীবনের শেষ পরিণতি নয়। মৃত্যুর পরেও মানুষের জন্য রয়েছে এক অনন্ত জীবন। সেখানে মানুষকে তার পার্থিব জীবনের ভাল ও মন্দ কাজের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব দিতে হবে। কঠিন বিচারের পরই জান্নাত বা জাহান্নামরূপে তার যথাযথ ফল ভোগ করতে হবে। এটাই হল আখিরাত। তাই জাহান্নামের আযাব থেকে জান্নাতের চিরসুখ ও অনাবিল শান্তি লাভের মধ্যেই জীবনের প্রকৃত সাফল্য নিহিত। আল্লাহ তা’য়ালা এ সম্পর্কে বলেন: وَإِنَّ الدَّارَ الآخِرَةَ لَهِيَ الْحَيْوَانُ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ. “নিশ্চয়ই পরকালীন জীবনই হল প্রকৃত জীবন। যদি তারা জানত!” (সূরা আনকাবৃত: ৬৪) পরকালই হচ্ছে মানুষের প্রকৃত মর্যাদার কেন্দ্রস্থল। সেখানেই তা নিরূপণ হবে। وللآخِرَةُ أَكْبَرُ دَرَجَاتٍ وَأَكْبَرُ تَفْضِيلاً.

পৃষ্ঠা:৫১

“নিশ্চয়ই পরকালই হচ্ছে সম্মান ও মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ।’ (সূরা বনী ইসরাঈল: ২১) وَلَدَارُ الْآخِرَةِ خَيْرٌ وَلَنِعْمَ دَارُ الْمُتَّقِينَ. “আখিরাতের আবাসই উত্তম এবং তা খোদাভীরুদের জন্য কতই না সুন্দর আবাস!” (সূরা আন-নহল: ৩০) মহান আল্লাহ তা’য়ালা মানব জাতিকে এ পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে। এ পৃথিবীকে তিনি অসংখ্য লোভ, লালসা, আকর্ষণ ও চাকচিক্যময় করে সাজিয়েছেন। যাতে মু’মিন বান্দাগণ দুনিয়ার ক্ষণিকের জীবনে বন্ধুর পথ পরিক্রমা পাড়ি দিয়ে আখিরাতের অফুরন্ত নি’য়ামত ও অনাবিল শান্তিময় জগতে পৌঁছতে পারে। কুরআনে বর্ণিত হয়েছেঃ “হে আমার সম্প্রদায়! দুনিয়ার জীবন হচ্ছে সামান্য। আর আখিরাত হল চিরস্থায়ী চিরন্তন আবাস।” (সূরা আল-মু’মিন: ৩৯) وَالْآخِرَةُ خَيْرٌ وَابْقَى. “আর আখিরাত হল উত্তম ও চিরস্থায়ী শাশ্বত।” (সূরা আল-আ’লা : ১৭) وَالْآخِرَةُ خَيْرٌ لَكَ مِنَ الْأُولى. “আর আখিরাত হবে তোমার জন্য দুনিয়া থেকে উত্তম।” (সূরা আদ-দুহা: ৪)

আখিরাতের পর্যায়সমূহ

আখিরাতের দু’টি পর্যায় রয়েছে। যথাঃ (১) আলমে বারযাখ (২) আলমে হাশর। (১) আলমে বারযাখ: বারযাখ শব্দের অর্থ পর্দা, অন্তরায়, ব্যবধান ইত্যাদি। (আল-ওয়াসীত ১/৪৯) মৃত্যু হতে কিয়ামত পর্যন্ত লোক চক্ষুর অন্তরালের সময়কে বারযাখ বা মধ্যবর্তী জগত বলে। মানুষের মৃত্যুর পরবর্তী জীবন হল কবর। আর কবর থেকেই শুরু হয় পার্থিব জীবনের হিসাব নিকাশের ধারা। পাপী বান্দারা কৃতকর্মের ফল আযাব ও শাস্তি ভোগ করবে এবং খোদাভীরু ঈমানদার বান্দারা বেহেশতের নাজ-নি’য়ামত ভোগ করবে। মানুষের মৃত্যুর পর থেকে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত আলমে বারযাখের ব্যাপ্তি।

পৃষ্ঠা:৫২

وَمِنْ وَرَائِهِمْ بَرْزَخٌ إِلَى يَوْمِ يُبْعَثُونَ. “আর তাদের পশ্চাতে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত বিস্তৃত এক মধ্যবর্তী জীবন রয়েছে।” (সূরা মু’মিনুন: ১০০) (২) আলমে হাশর: আলমে হাশর হলো সমবেত হওয়ার জগৎ। যেখানে মানব ও জ্বীন জাতিকে তাদের হিসাব-নিকাশের জন্য উপস্থিত করা হবে। আল্লাহ তা’য়ালার নির্দেশে হযরত ইসরাফিল (আ) কর্তৃক শিংগায় প্রথমবার ফুৎকারে মহাপ্রলয় অনুষ্ঠিত হবে। দ্বিতীয়বার ফুৎকারে সৃষ্ট জীব কবর থেকে পুনরুত্থিত হয়ে দলে দলে একটি ময়দানে এসে সমবেত হবে। ونُفِخَ فِي الصُّورِ فَإِذَا هُمْ مِّنَ الْأَجْدَاثِ إِلَى رَبِّهِمْ يَفْسِلُونَ – قَالُوا يا ويلنا من بعثنا من مرقدنا. “এবং শিংগায় ফুঁক দেওয়া হবে, তখনই তারা কবর থেকে তাদের পালনকর্তার দিকে ছুটে চলবে। তারা বলবে হায়! আমাদের দুর্ভোগ, কে আমাদেরকে নিদ্রাস্থল থেকে উত্থিত করলো? (সূরা ইয়াসিন: ৫১-৫২) لين متُمْ أَوْ قُتِلْتُمْ لَا إِلَى اللَّهِ تُحْشَرُونَ “তোমরা মৃত্যুবরণ করো কিংবা নিহত হও, আল্লাহর কাছে তোমাদের একত্র করা হবেই।” (সূরা আলে-ইমরান: ১৫৮) অতঃপর প্রত্যেকেরই আমল নামা উপস্থিত করা হবে ও বিচারকার্য শুরু হবে। হিসাব-নিকাশের পর যার নেকের পাল্লা ভারী হবে সে হবে জান্নাতী আর বেঈমান, কাফির, মুশরিক ও অপরাধীদের জন্য ঠিকানা হবে জাহান্নাম, যাদের গুনাহের পাল্লা ভারী হবে। জান্নাত আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বিশ্বাসী বান্দাদের জন্য জান্নাতে অফুরন্ত ও অতুলনীয় নি’য়ামতরাজির ব্যবস্থা করে রেখেছেন। সেখানের সুখ-শান্তি ও আরাম-আয়েশ কল্পনাতীত। আর এর নামই হচ্ছে জান্নাত। দুনিয়ার মানুষ জান্নাতের সুসজ্জিত এ সকল নি’য়ামত রাজির কল্পনাও করতে পারে না। হাদীসে কুদসীতে যেভাবে বর্ণনা এসেছে তা নিম্নে উল্লেখ করা হলঃ

পৃষ্ঠা:৫৩

قَالَ اللهُ تَعَالَى أَعِدَّتْ لِعِبَادِي الصَّالِحِينَ مَا لَا عَيْنُ رَاتٌ وَلَا أَذُنٌ سَمِعَتْ وَلَا خَطَرَ عَلَى قَلْبِ بَشَرٍ. “মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেন: আমার সৎকর্মশীল বান্দাদের জন্য এমন পুরস্কার প্রস্তুত রয়েছে, যা কোন চক্ষু দেখেনি, কোন কর্ণ শোনেনি এবং কোন মানব হৃদয় কল্পনা করেনি।” (বুখারী, মুসলিম)

জাহান্নাম

জাহান্নামের বর্ণনা অভাবনীয় এবং অকল্পনীয় বিভীষিকাময় ও লোমহর্ষক। যার পরিবেশ অত্যন্ত নাজুক। “জাহান্নামের আগুন পৃথিবীর আগুন অপেক্ষা ৭০ গুন অধিক তাপযুক্ত।” (বুখারী, মুসলিম) রাসূল (সা) আরও বলেনঃ “জাহান্নামের অগ্নির একবিন্দু পরিমাণ যদি সূর্যোদয়ের স্থানে স্থাপন করা হয়, তার উত্তাপে দুনিয়ার যাবতীয় বস্তু পুড়ে ভগ্ন হয়ে যাবে।” জাহান্নামীদের খাদ্য হবে কণ্টকবিশিষ্ট তিক্ত খাবার যার সামান্যতম অংশ পৃথিবীর সকল খাদ্য ও পানীয়কে তিক্ততায় পূর্ণ করে দিতে সক্ষম। পানীয় হিসেবে প্রথম পরিবেশন করা হবে (গিসলীন) ক্ষতস্থানের নিঃসৃত স্রাব। এ সকল বর্ণনা শুনামাত্র প্রত্যেক সচেতন ব্যক্তির গা শিউরে উঠে, লোমকূপগুলো খাড়া হয়ে যায়।

আখিরাতে বিশ্বাসের আবশ্যকতা পার্থিব জীবনে মানুষের কৃতকর্মের যথার্থ ফল ভোগ করার জন্য একটি অনন্ত জীবন প্রয়োজন। আর সেটাই হচ্ছে আখিরাত। আখিরাত বা পরকালের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা প্রত্যেক মুসলমানের একান্ত কর্তব্য। এটা ইসলামী আকীদার মৌলিক বিশ্বাস। পার্থিব জীবন হচ্ছে পরকালের ক্ষেত্রস্বরূপ। বান্দা দুনিয়াতে যেমন কাজ করবে পরকালে সে তেমন ফল ভোগ করবে। পরকালে প্রত্যেকটি ভাল কাজের জন্য পুরস্কার ও প্রত্যেকটি মন্দ কাজের জন্য শাস্তি দেওয়া হবে। যারা আখিরাতে বিশ্বাস করে না এবং সৎ কাজ করে না, তারা আলমে বারযাখ তথা কবরে ও পরকালে

পৃষ্ঠা:৫৪

জাহান্নামের অবর্ণনীয় শাস্তি ভোগ করবে। পবিত্র হাদীসে কবরের আযাবের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। কবরের আযাব সত্য এতে সন্দেহ করার কোন কারণ নেই। পবিত্র কুরআনে কবরের ও পরকালে জাহান্নামের আযাবের কথা ঘোষণা করা হয়েছে: سَنُعَذِّبُهُمْ مَرَّتَيْنِ ثُمَّ يُرَدُّونَ إِلَى أَشَدَّ الْعَذَابِ. “আমি অতি শীঘ্র তাদের দু’বার শান্তি দিব। অতঃপর তাদেরকে ভয়াবহ বিভীষিকাময় শান্তির দিকে নিয়ে যাওয়া হবে।”

শিক্ষা

১। আখিরাতে বিশ্বাস স্থাপন করা সকলের উপর ফরয।

২। সকল কাজে আখিরাতে জবাবদিহিতার মানসিকতা থাকতে হবে।

৩। জীবনকাল আল্লাহর হুকুম মোতাবেক পরিচালনা করতে হবে।

৪। যৌবনের শক্তি সামর্থ্য আল্লাহর দ্বীনের পথে ব্যয় করতে হবে।

৫। ধন-সম্পদ আল্লাহর নির্দেশিত পথে ব্যয় করতে হবে।

৬। উপার্জিত ধন-সম্পদ আল্লাহর নির্ধারিত পথে আয় করতে হবে।

৭। জ্ঞানার্জন করতে হবে এবং তদানুযায়ী আমল করতে হবে।

পৃষ্ঠা:৫৫

দারস-৬ সালাত: عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ (رض) قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ (صلعم) أَرَأَيْتُمْ لَوْ أَنْ تَهْرًا بِبَابِ أَحَدِكُمْ يَغْتَسِلُ فِيْهِ كُلِّ يَوْمٍ خَمْسًا هَلْ يَبْقَى مِنْ دَرَنِهِ شَيْئً قَالُوا لَا يَبْقَى مِنْ دَرَنِهِ شَيْ قَالَ فَذَالِكَ مَثَلُ الصَّلَوَاتِ الْخَمْسِ يَمْحُوا اللَّهِ بِهِنَّ الْخَطَايَا. (متفق عليه) অর্থঃ হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (সা) বলেছেন: তোমাদের কারো বাড়ীর সামনে যদি একটা পানির ফোয়ারা (খাল-বিল, পুকুর, প্রবাহমান নদী) থাকে এবং সে তাতে দৈনিক পাঁচবার গোসল করে; তবে তার শরীরে কোন ময়লা অবশিষ্ট থাকতে পারে কি? সাহাবাগণ বললেন: না, তার শরীরে কোন ময়লা থাকতে পারে না। রাসূল (সা) বললেনঃ এই হচ্ছে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের দৃষ্টান্ত, এর সাহায্যে আল্লাহ তা’য়ালা (নামাযীর) যাবতীয় গুনাহ-খাতা মাফ করে দেন। (বুখারী, মুসলিম) শব্দার্থ : ازاینم : তোমরা কি দেখেছো? তোমরা কি মনে করো? তোমাদের ধারণা কি? ঃ নদী-নালা, খাল-ঝর্ণা, স্রোতস্বিনী। بَابُ : দরজা, দ্বার, প্রবেশ পথ। يَغْتَسِل সে গোসল করে, সে পানি দ্বারা শরীর ধৌত করে। يبقى : অবশিষ্ট থাকে, বাকী থাকে। دَرن: ময়লা । يَمْحُوا : মুছে ফেলে, মিটিয়ে ফেলে। الخطَائِ: গুনাহসমূহ, ত্রুটিসমূহ, অপরাধসমূহ। ব্যাখ্যাঃ ঈমানের পর ইসলামের প্রধান স্তম্ভ ও শ্রেষ্ঠ ইবাদত হলো নামায। ঈমানের বহিঃপ্রকাশের জন্য ইসলামের অপর চারটি রুকনের মধ্যে নামাযই

পৃষ্ঠা:৫৬

সার্বজনীন। আল্লাহ তা’য়ালা মুসলিম জাতিকে মানব জাতির নেতৃত্ব দানের জন্য মনোনীত করেছেন। আর নামাযই মুসলমানদের নেতৃত্বের অবকাঠামো রচনায় এবং সংরক্ষণে প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে। যারা সমাজের নেতৃত্ব দিবেন তাদের যেমন সৎ ও পরিছন্ন থাকতে হয়, তেমনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাযও নামাযীকে গুনাহ থেকে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করে তোলে। আল্লামা ইবনুল আরাবী বলেন: “আলোচ্য হাদীসে উপমার অর্থ হলো ব্যক্তি যেভাবে কাপড়ে ও দেহে প্রকাশ্য ময়লা দ্বারা ময়লাযুক্ত হয় আর পানি তাকে কাপড় ও দেহের ময়লা থেকে পাক-সাফ করে দেয়, তদ্রূপ পাঁচ ওয়াক্ত নামায নামাযীকে গুনাহের ময়লা হতে পবিত্র ও মুক্ত করে দেয়। এমনকি পরে আর কোন গুনাহ থাকে না। এ হাদীসে ছগীরা গুনাহের তুলনা করা হয়েছে দেহের প্রকাশ্য ময়লার সাথে। আর কবীরা গুনাহের তুলনা করা হয়েছে আভ্যন্তরীণ ময়লার ও দোষ-ত্রুটির সাথে। তাই গোসল যেভাবে প্রকাশ্য ময়লা দূর করে তদ্রুপ নামাযও ছগীরা তথা প্রকাশ্য ময়লাতুল্য গুনাহকে মাফ করিয়ে দেবে। আর এ নেক কাজের সাথে তওবা পাওয়া গেলে ছগীরা ও কবীরা উভয় গুনাহ মাফ হবে। গুনাহ না থাকলে তার উচ্চ মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। গ্রন্থ পরিচিতি: আলোচ্য হাদীসখানা বুখারী ও মুসলিম শরীফ থেকে চয়ন করা হয়েছে। গ্রন্থ পরিচিতি ১নং ও ৩নং দারসে আলোচনা করা হয়েছে। রাবী পরিচিতি: হযরত আবু হুরায়রা (রা)-এর পরিচয় ৪নং দারসে বর্ণনা করা হয়েছে। হাদীসের গুরুত্ব মহানবী (সা) আলোচ্য হাদীসখানায় একটি চমৎকার দৃষ্টান্তের মাধ্যমে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করার গুরুত্ব ও উপকারিতা তুলে ধরেছেন। সত্যিকার অর্থেই যদি কারো বাড়ীর আঙ্গিনায় পুকুর বা নদী-নালা থাকে আর সে তাতে দৈনিক পাঁচবার গোসল করে তা হলে তার শরীরের ময়লা থাকতে পারে না। এমনিভাবে কেউ যদি পাঁচবার মনের সকল কুটিলতা দূর করে একাগ্রচিত্তে সালাত আদায় করে তাহলে তার পাপ পঙ্কিলতা দূরীভূত হয়ে সে হতে পারে একজন নিষ্কলুষ মানুষ।

পৃষ্ঠা:৫৭

إن الصلوة تَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَر. “নিশ্চয়ই সালাত (মানুষকে) অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে।” (সূরা আনকাবৃত: ৪৫) ফোয়ারা ও নদী-নালায় যেমনি আপনা-আপনি স্রোত আসতে থাকে তেমনি ঈমানদার ব্যক্তির নিকটও পাঁচ ওয়াক্ত সালাত উপস্থিত হয়। বাড়ীর সামনের ফোয়ারা থেকে গোসল করে কেহ যদি দেহের মলিনতা বিদূরিত করতে না চায় তা হলে শরীরের ময়লা আপনা-আপনি দূরীভূত হবে না। অনুরূপভাবে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত সমাগত হওয়া সত্ত্বেও সঠিকভাবে সালাত আদায় করে নিজকে পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত করতে উদ্যোগী না হলে পাপ-পঙ্কিলতাও তার থেকে বিদূরিত হবে না।  “সালাতসমূহ বান্দাকে পাপের মলিনতা থেকে পবিত্র করে দেয়, শেষ পর্যন্ত এ সালাত কোন গুনাহই অবশিষ্ট রাখে না। বরং সব কিছু দূর করে দেয়, বিলীন করে দেয়।” (উমদাতুল কারী: ৫ম খণ্ড ১২ পৃঃ)

সালাত শব্দের অর্থ ও গুরুত্ব

সালাত আরবী শব্দ। ফার্সি ভাষায় একে নামায বলে। এর প্রসিদ্ধ চারটি শাব্দিক অর্থ আছে। যথাঃ (১) প্রার্থনা; (২) অনুগ্রহঃ (৩) পবিত্রতা বর্ণনা করা; (৪) ক্ষমা প্রার্থনা করা ইত্যাদি। আভিধানিক অর্থ: আগুনে পুড়ে বাঁশ বা কাঠ নরম করে সোজা করাকে অভিধানে ‘সালাত’ বলে। সালাতের আরো কতিপয় অর্থ রয়েছে। যেমন- দু’আ, রহমত, বরকত, তা’যীম; ইয়াহুদীদের উপাসনালয়কে সালাত বলা হয়। (কুরআনের পরিভাষা ১২৩) শরীআতের পরিভাষায় সালাতের অর্থ: নির্দিষ্ট সময় নির্ধারিত নিয়মে বিশেষ ইবাদতকে সালাত বলে। মি’রাজের রাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামায উম্মতে মুহাম্মাদীর উপর ফরয করা হয়েছে। সালাতের গুরুত্ব ইসলাম পাঁচটি মূল ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। সালাত হলো তার দ্বিতীয় ভিত্তি। ঈমানের পরই সালাতের স্থান। সালাত সর্বশ্রেষ্ঠ ফরয ইবাদত।

পৃষ্ঠা:৫৮

ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় সালাতের গুরুত্ব অপরিসীম। কুরআন ও হাদীসের আলোকে সালাতের ধর্মীয় গুরুত্ব নিম্নে তুলে ধরা হলো: ১. নামায আল্লাহর প্রভুত্ব কায়েম করার প্রশিক্ষণ: মানব জীবনের প্রত্যেকটি মুহূর্তেই আল্লাহর আনুগত্য স্বীকার করে চলতে হবে এবং আল্লাহর আইন বিরোধী যা কিছু আছে তা একেবারেই অস্বীকার করতে হবে। সালাত মানুষকে আল্লাহর প্রভুত্ব কায়েম ও তাঁর আনুগত্য করার অনুভূতি জাগ্রত করে তোলে। ২. নামায সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদতঃ আল্লাহ তা’য়ালার নিকট সকল ইবাদতের মধ্যে সালাতই হলো সর্বোত্তম ইবাদত। মানুষ সালাতের মাধ্যমেই বিশ্ব স্রষ্টা ও পালনকর্তা আল্লাহ পাকের আনুগত্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে এবং তাঁর আইন কানুন মেনে চলার সংকল্প প্রকাশ করে থাকে। এ জন্য মহানবী (সা) বলেনঃ وَاعْلَمُوا أَنْ أَفْضَلَ أَعْمَالَكُمُ الصَّلوةَ. “জেনে রাখো নামাযই তোমাদের সর্বোত্তম ইবাদত।” ৩. আল্লাহর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সৃষ্টির মাধ্যম: সালাতের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে বান্দার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং বান্দা সর্বাধিক আল্লাহর নিকটবর্তী হয় এবং সান্নিধ্য লাভ করে। الصَّلُوةُ مِعْرَاجُ الْمُؤْمِنِينَ. “সালাত মু’মিনের মি’রাজস্বরূপ।” ৪. সালাত জান্নাত লাভের উপায়ঃ সালাত হলো জান্নাত লাভের উপায়। মহানবী (সা) সালাত সম্পর্কে একটি হাদীসে বলেছেন: “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস থেকে বর্ণিত। তিনি নবী করীম (সা) থেকে বর্ণনা করেছেন, একদা তিনি সালাতের প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করে বলেন: যে লোক এ সালাত সঠিকভাবে ও যথাযথ নিয়মে আদায় করতে থাকবে তাদের জন্য কিয়ামতের দিন একটি নূর, অকাট্য দলীল এবং পূর্ণ মুক্তি নির্দিষ্ট হবে। পক্ষান্তরে যে লোক সালাত সঠিকভাবে আদায় করবে না তার জন্য নূর, অকাট্য দলীল এবং মুক্তি কিছুই হবে না, বরং কিয়ামতের

পৃষ্ঠা:৫৯

দিন তার পরিণতি হবে কারন, ফিরাউন, হামান ও উবাই ইবনে খালফ-এর মত। (আহমদ, দারেমী, বায়হাকী) “সালাত জান্নাতের চাবিকাঠি।” (মুসনাদে আহমদ)( الصلوة চাবি ছাড়া যেমন ঘরের তালা খোলা যায় না; তেমনি সালাত ছাড়া বেহেশতের দরজা খোলা যাবে না। ৫. সালাত আল্লাহকে স্মরণের উত্তম মাধ্যমঃ সালাত হলো মহান আল্লাহ তা’য়ালাকে স্মরণ করার সর্বোত্তম পন্থা। যে যত বেশী সালাত আদায় করে, সে ব্যক্তি ততোধিক আল্লাহকে স্মরণ করে। اقم الصلوة لذكرى. ” আমার স্মরণার্থে সালাত কায়েম কর।” (সূরা ত্ব-হাঃ ১৪) ৬. মু’মিন ও কাফিরের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ঃ সালাত মু’মিন ও কাফিরের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করে। بَيْنَ الْعَبْدِ وَبَيْنَ الْكُفْرِ تَرْكُ الصَّلوة. “মুসলিম ও কাফির ব্যক্তির মধ্যে পার্থক্য হলো সালাত তরক করা।” (মুসলিম) কাফিরেরা সালাত তরক করে আর মুসলমানগণ সালাত কায়েম করে। সালাত হলো ঈমানের বাহ্যিক প্রমাণ। যে সঠিকভাবে সালাত আদায় করে সে মু’মিন। আর যে সালাত সঠিকভাবে আদায় করে না সে মু’মিন হতে পারে না। ৭. সালাতই সাফল্যের চাবিকাঠিঃ সালাত আদায়ের মধ্যেই রয়েছে মানব জীবনের চরম সাফল্য। এতে রয়েছে ব্যক্তিগত জীবন, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের শৃঙ্খলা বিধানের নৈতিক শিক্ষা। আর এর মাধ্যমেই দুনিয়ার কল্যাণ ও পরকালের সাফল্য অর্জন করা যায়। قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ هُمْ فِي صَلَاتِهِمْ خَاشِعُونَ “যে সকল মু’মিন সালাতে বিনয়াবনত তাদের জীবন সাফল্যমণ্ডিত।” (সূরা আল-মু’মিনুনঃ ১-২)

পৃষ্ঠা:৬০

মহানবী (সা) বলেন: ঠিক মত পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায়কারীকে আল্লাহ পাঁচটি পুরস্কার দান করবেন। যথাঃ

১. জীবিকার কষ্ট দূর করবেন;

২. কবরের আযাব থেকে মুক্তি দেবেন;

৩. ডান হাতে আমলনামা দেবেন;

৪. পুলসিরাত বিজলীর ন্যায় পার করাবেন;

৫. বিনা হিসাবে বেহেশতে প্রবেশ করাবেন।

৮. জাহান্নাম থেকে মুক্তির উপায়ঃ সালাত মানুষকে পরকালে জাহান্নাম থেকে মুক্তিদান করবে। যারা সালাত ত্যাগ করবে তারা জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ পাবে না। কিয়ামতের দিন ফেরেশতাগণ জাহান্নামবাসীদেরকে জিজ্ঞাসা করবেন, কোন বস্তু তোমাদেরকে জাহান্নামে নিয়ে এলো? অর্থাৎ কেন তোমরা জাহান্নামের অধিবাসী হলে? ফেরেশতাগণের প্রশ্নের জবাবে জাহান্নামবাসীরা বলবেঃ

لَمْ تَكُ مِنَ الْمُصَلِّينَ.

“আমরা সালাত আদায়কারী ছিলাম না।” (সূরা মুদ্দাসসিরঃ ৪৩)

জাহান্নামবাসীদের জাহান্নামে যাওয়ার অন্যান্য কারণসমূহের মধ্যে সালাত পরিত্যাগ করা অন্যতম প্রধান কারণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই আমাদেরকে সালাত আদায় করার ব্যাপারে যত্নবান হতে হবে।

শিক্ষা

১। সালাত আদায় করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরয়।

২। সালাত মানুষের বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ পবিত্রতা দান করে।

৩। সালাত অশ্লীল ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত রাখে।

৪। প্রবাহমান স্রোতের ন্যায় নামাযের ওয়াক্ত সমাগত হয়।

৫। পানি ময়লা দূর করে আর সালাত মানুষের পাপরাশি মোচন করে।

কবিতা ৬১ থেকে ৭৫

পৃষ্ঠা:৬১

দারস-৭ সাওম: عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ (رض) قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ (صلعم) أَتَاكُمْ رَمَضَانُ شهرٌ مُبَارَكٌ فَرَضَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ عَلَيْكُمْ صِيَامَهُ تُفْتَحُ فِيْهِ أَبْوَابُ السَّمَاءِ وَتُغْلَقُ فِيهِ أَبْوَابُ الْجَحِيمِ وَتُغْلَقُ فِيهِ مَرَدَةُ الشَّيَاطِينِ لِلَّهِ فِيهِ لَيْلَةً خَيْرٌ مِّنْ أَلْفِ شَهْرٍ مَنْ حَرمَ خَيْرَهَا فَقَدْ حَرَّمَ (نسائی) مسند احمد، بیهقی) অর্থ: হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: তোমাদের সামনে রমযান মাস সমুপস্থিত। উহা এক বরকতময় মাস। আল্লাহ তা’য়ালা এ মাসে তোমাদের প্রতি রোযা ফরয করেছেন। এ মাসে আকাশের দরজাসমূহ উন্মুক্ত হয়ে যায়, জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং বড় বড় শয়তানগুলো আটক করে রাখা হয়। এ মাসে একটি রাত আছে, যা হাজার মাসের চেয়ে অধিক উত্তম। যে লোক এ রাতের মহাকল্যাণ লাভ করা থেকে বঞ্চিত থাকল, সে সত্যিই বঞ্চিত ব্যক্তি। (নাসায়ী, মুসনাদে আহমদ, বায়হাকী)

শব্দার্থ:: হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। آتَاكُمْ: তোমাদের কাছে সমুপস্থিত। رمضان: রমযান মাস। شهر : বরকতময় মাস। فرض الله : আল্লাহ ফরয করেছেন। عَلَيْكُمْ : তোমাদের উপর। صيانة : উহার (রমযানের) রোযা। تُفتح : উন্মুক্ত হয়ে যায়, খোলা হয়। أبواب السَّمَاء : আকাশের দরজাসমূহ। تُخْلَق: বন্ধ করে দেয়া হয়। أبوَابُ الْجَحِيمِ : জাহান্নামের দরজাসমূহ। مَرْدَةُ বড় বড়, সেরা। الشَّيَاطِين : শয়তানগুলো। : আল্লাহর জন্য। فيه:

পৃষ্ঠা:৬২

এর মধ্যে। لَيْلَةُ : রাত। خَيْرُ : উত্তম। مِنْ : হতেالف : হাজার। مَنْ : যে ব্যক্তি। خرم : বঞ্চিত হলো। خيرها: উহার কল্যাণ। فقد حرم: সত্যই বঞ্চিত হলো। গ্রন্থ পরিচিতি: আলোচ্য হাদীসখানা নাসায়ী, মুসনাদে আহমদ, বায়হাকী তিনটি হাদীস গ্রন্থে একই সনদে বর্ণিত হয়েছে। এখানে ‘নাসায়ী শরীফ’ ও ‘বায়হাকী শরীফের’ সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা হল। সুনান আন-নাসায়ী ছয়খানা প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থের অন্যতম সহীহ হাদীস গ্রন্থ। ইহা ইমাম নাসায়ী (র) সংকলন করেন। তাঁর পূর্ণ নাম আবু আবদুর রহমান আহমদ ইবনে শুয়াইব ইবনে আলী ইবনে বাহর ইবনে মান্নান ইবনে দীনার আন-নাসায়ী। খোরাসানের অন্তর্গত ‘নাসা’ নামক স্থানে ২১৫ হিজরী সনে জন্মগ্রহণ করেন। (ইবনে কাসীর ১১ খণ্ড ৩২ পৃঃ তাযকিরাতুল হুফফায় ২ খণ্ড: ১৫) তিনি ১৫ বছর বয়সে দেশ-বিদেশে সফর করে হাদীস সংগ্রহ করেন। তিনি মিশরে গিয়ে অনেক দিন অবস্থান করেন এবং কয়েকখানি কিতাব প্রণয়ন করেন। তিনি অত্যন্ত প্রখর মেধাশক্তিসম্পন্ন ছিলেন। তিনি চারজন প্রসিদ্ধ হাফিযে হাদীসের অন্যতম। সুনান আন-নাসায়ীর প্রথমে ‘সুনানুল কুবরা’ নামে একখানা হাদীস গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। এ সংকলনে সহীহ ও গায়রে সহীহ উভয় প্রকারের হাদীস সন্নিবেশিত হয়েছিল। পরে তিনি যাচাই বাছাই করে শুধুমাত্র সহীহ হাদীসের একটি সংকলন তৈরী করেন। এর নাম দেন ‘আসসুনানুস সুগরা’। এর অপর নাম হলো, ‘আল মুজতাবা’ বা সঞ্চয়িতা। সুনান আন-নাসায়ী দ্বারা ‘আল মুজতাবা’ কিতাবটিকেই বুঝানো হয়। এ হাদীস গ্রন্থে ৪৪৮২টি হাদীস স্থান পেয়েছে। হাদীসগুলোকে ১৫টি শিরোনামায় এবং ১৭৪৪টি অধ্যায়ে বিভক্ত করা হয়েছে। এ মহামনীষী ৩০৩ হিজরীতে ৮৯ বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন। তাঁকে সাফা ও মারওয়ার মধ্যবর্তী স্থানে দাফন করা হয়। (তাযকিরাতুল হুফ্ফায)

পৃষ্ঠা:৬৩

বায়হাকী শরীফ: ইমাম আহমদ ইবনে হুসাইন আল-বায়হাকী। (মৃঃ ৪৫৮ হিঃ) এ গ্রন্থখানা সংকলন করেছেন। এতে প্রয়োজনীয় সকল হাদীস সন্নিবেশিত হয়েছে। এর পূর্ণ নাম আস-সুনানুল কুবরা। মুসনাদে আহমদ এর পরিচিতি ১২নং দারসে উল্লেখ করা হয়েছে। রাবী পরিচিতি: হযরত আবু হুরায়রা (রা)-এর জীবন পরিচিতি ৪নং ব্যাখ্যা: আলোচ্য হাদীসখানায় রমযান মাসের মর্যাদা ও মাহাত্ম্যের কথা দারসে আলোচনা করা হয়েছে। তুলে ধরা হয়েছে। রমযান মাস একটি ‘বরকতপূর্ণ’ মাস। এ মাসে রোযাকে ফরয করা হয়েছে। এ মাসে বান্দা অধিক ক্ষুৎ-পিপাসায় কষ্ট করে বলেই অধিক কল্যাণ ও রহমত নাযিল করা হয়। এ মাসে আকাশের দরজাসমূহ খোলা থাকে যাতে বান্দা তার আবেদন নিবেদন অনায়াসে পৌঁছাতে পারে ও আল্লাহ তা’য়ালার অজস্র কল্যাণ লাভে নিজেকে ধন্য করতে পারে। বড় বড় শয়তান ও দুষ্ট প্রকৃতির জ্বিনদেরকে বন্দী করে তাদের পথভ্রষ্টকরণ কর্মসূচি দুর্বল করা হয়। যাতে করে নিষ্ঠাবান রোযাদার মু’মিন বান্দারা শয়তানের প্রতারণায় না পড়ে। (ইবনে হাজার আল-আসকলানী) এ মাসে এমন একটি বরকময় রাত রয়েছে যে রাত হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। এ রাতেই আল্লাহর নিকট থেকে অধিক রহমত বর্ষিত হয়। যে ব্যক্তি এ রাতের অফুরন্ত কল্যাণ লাভ থেকে বঞ্চিত হবে সে বাস্তবিকপক্ষেই বঞ্চিত। তার মত হতভাগ্য আর কেউ হতে পারে না। কাজেই সকলকে রমযান মাসে অধিক কল্যাণ লাভের চেষ্টা করা উচিৎ। সাওম অর্থ: বিরত থাকা, কঠোর সাধনা, অবিরাম প্রচেষ্টা, আত্মসংযম ইত্যাদি। যাবতীয় কাজ ও কথা থেকে বিরত থাকাকে অভিধানে সাওম বলে। (আল-মিসবাহুল মুনীর: ৩৫২) শরীআতের পরিভাষায়-সুবহি সাদিক থকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের নিয়তে পানাহার ও স্ত্রী গমন থেকে বিরত থাকাকে সাওম বলে। আল্লামা জুরযানী (র) বলেনঃ هو الإمساك عن الأكل والشرب وَالْجَمَاعِ مِنَ الصُّبْحِ إِلَى الْمَغْرِبِ مَعَ النية.

পৃষ্ঠা:৬৪

“নিয়ত সহকারে সুবহে সাদিক থেকে মাগরিব পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রী গমন থেকে দূরে থাকাকে সাওম বলে।” মু’জামুল ওয়াসীত গ্রন্থকার বলেন: هُوَ إِمْسَاكَ عَنِ الطَّعَامِ وَالشَّرَابِ مِنْ طُلُوعِ الْفَجْرِ إِلَى غُرُوبِ الشَّمْسِ مع النية. “নিয়ত সহকারে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকাকে সাওম বলে।” সাওম ফরয হওয়ার সময়কালঃ ‘সাওম’ দ্বিতীয় হিজরীর শাবান মাসে ফরয হয়। রমযানের রোয়া ফরয হওয়ার পূর্বে ‘আশূরার’ রোযা ফরয ছিল। হিজরতের পর ‘আইয়ামুল বিষ’-এর রোযা ফরয করা হয়েছে। এরপর রমযান মাসের রোযা ফরয করা হয়েছে এবং ‘আশূরার’ ‘আইয়ামুল বিয়ের’ রোযা মানসূখ হয়ে গেছে। এটি এখন সুন্নতরূপে পরিগণিত। সাওম ফরয হওয়ার উদ্দেশ্য তাকওয়া, খোদাভীতি, খোদাপ্রেমের গুণ ও বৈশিষ্ট্য অর্জন করাই রোযার প্রকৃত উদ্দেশ্য। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন: يأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ. “হে ঈমানদারগণ, তোমাদের জন্য রোযা ফরয করা হয়েছে, যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর। আশা করা যায় যে, তোমাদের মধ্যে তাকওয়ার গুণ ও বৈশিষ্ট্য জাগ্রত হবে।” (সূরা বাকারা: ১৮৩) সাওমের তাৎপর্য প্রকৃতপক্ষে রোযা নামাযের নিকটতম ইবাদত। নামাযের মাধ্যমে মানব জীবনে যে প্রভাব ও চেতনার সৃষ্টি হয় সেগুলোকে অধিকতর জীবন্ত ও সতেজ করে তোলাই রোযার কাজ। নামাযের মতো রোযাও সকল নবীর

পৃষ্ঠা:৬৫

শরীয়তে ফরয ছিল। আবহমানকাল ধরে সকল নবীর উম্মতগণ রোযা পালন করে আসছিলেন। অবশ্য রোযার হুকুম-আহকাম, সংখ্যা ও সময়ের ব্যাপারে বিভিন্ন নবীগণের শরীয়তে পার্থক্য বিদ্যমান ছিল। রোযা এমন একটি ইবাদত যে, এর মাধ্যমে সকল আসমানী কিতাবের অনুসারীগণ তাকওয়ার গুণ অর্জনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন। রোযা এমনি এক ইবাদত যার মাধ্যমে রোযাদার ব্যক্তি ক্ষুৎ-পিপাসায় অতিকষ্ট পেলেও আল্লাহর ভয়ে গোপনে কিছু গ্রহণ করে না। ক্রোধান্বিত হলেও সে ক্রোধ সংবরণ করে ও লোভ-লালসার নিয়ন্ত্রণ করে এবং মিথ্যা, প্রবঞ্চণা, পরনিন্দা প্রভৃতি পাপ হতে সে নিজকে বিরত রাখে। সারা দিন রোযা রেখে রাত্রি জাগরণ করে কুরআন তিলাওয়াত ও নফল ইবাদত করে আত্মিক উন্নতি সাধন করার অভ্যাস গড়ে তোলে। অতঃপর বছরের এগার মাসের জন্য তাকে জীবনের কর্মক্ষেত্রে মুক্ত হয়ে কাজ কর্মের ভিতর দিয়ে তাকওয়ার ভিত্তিতে আল্লাহর হুকুমের অনুসরণ করে জীবনকে ধন্য করতে হয়। রোযার ফযীলত সকল ইবাদতের মধ্যে রোযার ফযীলত অনেক বেশী। এ ইবাদতের সমতুল্য কোন ইবাদত নেই। এ প্রসঙ্গে মহানবী (সা) বলেনঃ عَلَيْكَ بِالصُّوْمِ فَإِنَّهُ لَا مِثْلَ لَهُ. “তুমি রোযা রাখ, রোযা সমতুল্য কোন ইবাদত নেই।” (নাসায়ী) রোযার ফযীলত সম্পর্কে কয়েকখানা হাদীস নিম্নে পেশ করা হলো: “আদম (আ) সন্তানের প্রতিটি নেক কাজের জন্য ১০ থেকে ৭শ গুণ পর্যন্ত সওয়াব নির্ধারিত রয়েছে। কিন্তু আল্লাহ বলেন, রোযা এর ব্যতিক্রম। সে একমাত্র আমার জন্য রোযা রেখেছে এবং আমিই নিজ হাতে এর পুরস্কার দেবো। রোযাদারের রয়েছে ২টি আনন্দ। একটা হচ্ছে ইফতারের সময় এবং অন্যটি হচ্ছে আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের সময়। আল্লাহর কাছে রোযাদারের মুখের দুর্গন্ধ মেক আম্বরের সুঘ্রাণের চেয়েও উত্তম।”

পৃষ্ঠা:৬৬

১. রোষা কিয়ামতের কঠিন দিনে বান্দার জন্য সুপারিশ করবে।

২. রোযাদারের সম্মানে বেহেশতের ‘রাইয়ান’ নামক একটি বিশেষ দরজা খোলা হবে। এ দরজা দিয়ে তারা বেহেশতে প্রবেশ করবে।

৩. রোযাদারের ইফতার না করা পর্যন্ত ফেরেশতারা তার জন্য গুনাহ মাফের দো’আ করতে থাকে।

৪. ইফতারের সময় রোযাদারের অন্তত একটি দু’আ কবুল করা হয়।

৫. তারাবীর নামাযে অধিক সওয়াব লাভ করা যায়।

৬. এ মাসে নফল ইবাদত ফরযের সমান এবং ১টি ফরয ইবাদত অন্য মাসের ৭০টি ফরযের সওয়াবের সমান।

৭. রমযান মাসে এমন একটি রাত রয়েছে- যে রাতে ইবাদত করলে হাজার মাসের অধিক সওয়াব পাওয়া যায়।

৮. রোযাদারের জন্য সমুদ্রের মাছ পর্যন্ত দু’আ করতে থাকে, এমনকি ইফতারের সময় পর্যন্ত।

৯. প্রতিদিন জান্নাতকে রোযাদারের জন্য সুসজ্জিত করা হয়। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, আমার নেক বান্দারা দুনিয়ার দুঃখ-কষ্ট পশ্চাতে রেখে অতি শীঘ্রই আমার কাছে আসবে।

১০. অপর হাদীসে বলা হয়েছে, ‘রমযান মাসে যে ব্যক্তি কোন রোযাদারকে ইফতার করাবে, তার এ কাজ তার গুনাহ মাফ এবং জাহান্নামের আগুন থেকে তাকে বাঁচাবার কারণ হবে। এ রোযাদারের রোযা রাখায় যত সওয়াব হবে তাতে তারও ঠিক ততখানি সওয়াব হবে। তাতে রোযাদারের সওয়াব একটুকুও কম হবে না।’

রোযার ধর্মীয় গুরুত্ব

১. ইবাদতের অনুভূতি সৃষ্টি: রোযার মাধ্যমে মানুষ নিজের ইচ্ছাকে কার্যকরভাবে সমর্পণ করে। এক মাস ধরে অবিরাম রোযার দ্বারা তাকওয়ার বৈশিষ্ট্য সৃষ্টির মাধ্যমে আল্লাহর ভয়ে শরীয়তের নিষিদ্ধ কাজ পরিত্যাগ করে তাঁর হুকুম পালনের নৈতিক শিক্ষা লাভ করে।

পৃষ্ঠা:৬৭

২. আল্লাহর হুকুমের আনুগত্য শিক্ষাঃ রোযার মাসে নিষিদ্ধ সামগ্রীর ভোগ- বিলাস ও পানাহার হতে বিরত থেকে দিনের বেলা বৈধ কাজগুলোকেও তার হুকুমে সাময়িকভাবে পরিত্যাগ করে আনুগত্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে স্বীয় প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ রাখার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে।

৩. খোদাভীতি সৃষ্টি করে: ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় আল্লাহকে ভয় করা, তাঁর আদেশ মেনে চলা এবং তাঁর নিষেধ থেকে দূরে থাকার নামই তাকওয়া। আর আল্লাহ রোষাকে ফরয করেছেন এ গুণ সৃষ্টির জন্য।

৪. চরিত্র গঠন: রোযা হচ্ছে মানুষের চরিত্র গঠনের উত্তম মাধ্যম। রোযা রাখার ইচ্ছা করার সাথে সাথে মানুষের মন হতে পাপাচার, স্বেচ্ছাচারিতা, মিথ্যাচার, অসৎ কার্য ও ঝগড়া করার মানসিকতা দূর হয়ে যায়।

৫. আত্মসংযমের মহান শিক্ষাঃ রমাযান মাস আত্মসংযমের মাস। রোযা রাখার মাধ্যমে আত্মসংযম, আত্ম-নিয়ন্ত্রণ, আত্মশুদ্ধি এবং আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধিত হয়।

৬. রোযা একটি নীরব ইবাদতঃ ‘রোযা’ একটি নীরব ইবাদত। আল্লাহ ও রোযাদার ছাড়া কেউই জানতে পারে না প্রকৃতপক্ষে সে রোযাদার কি না। অপর দিকে খানাপিনা পরিত্যাগ করা আল্লাহর গুণাবলীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাই এর প্রতিদানও আল্লাহ তা’য়ালা নিজ হাতে দিবেন। الصوم لي وانا اجزى به. “রোযা আমারই জন্য, আমিই এর প্রতিদান দিব।” (বুখারী, মুসলিম) রোযার সামাজিক গুরুত্ব

১. উন্নত সামাজিক চরিত্র অর্জনঃ রমযান মাসে একই সাথে সকলে রোযা রেখে পাপ কাজ থেকে বিরত থাকার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে সমাজ থেকে অন্যায়-অত্যাচার, জুলুম-নির্যাতন, শোষণ ও প্রতারণা চিরতরে বিদূরিত করতে পারেন।

২. সমাজে তাকওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। রমযান মাস তাকওয়া ও কল্যাণের মাস, এ মাসে মানুষ পাপ থেকে দূরে থেকে ভাল কাজের

পৃষ্ঠা:৬৮

সহযোগিতা করে। ফলে সমাজের সমগ্র পরিবেশকে নেকি ও পরহেযগারীর ভাবধারায় উজ্জ্বল করে তোলে। এভাবে চারিদিকে নেকি ও তাকওয়ার একটি মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

৩. সামাজিক ঐক্য সৃষ্টিঃ রমযান মাসকে রোযা রাখার জন্য ফরয করার কারণে সকল মানুষ একই সময় রোযা রাখে এবং একই সময় ইফতার করে। ফলে ব্যক্তিগত এ ইবাদতটি সামগ্রীক ইবাদতে পরিণত হয়ে যায়। আর রোযা সম্মিলিতভাবে পালনের মধ্যে একটি সামাজিক ঐক্য গড়ে উঠে।

৪. সামাজিক সহমর্মিতা ও দায়িত্ববোধ জাগ্রত করেঃ রোযার বিধান ধনী- গরীবকে একই কাতারে নিয়ে আসে। সমাজের সম্পদশালী লোকেরা নিজেরা ক্ষুৎ-পিপাসায় অসহায় মানুষের দুঃখ দুর্দশা সত্যিকার অর্থে উপলব্ধি করতে পারে। ফলে তাদের দারিদ্রদ্র্য বিমোচনের জন্য দায়িত্বানুভূতি জাগ্রত হয়।

৫. উত্তম সমাজ গঠনঃ রোযা মানুষের চরিত্র উন্নত করে। চরিত্রবান তথা খোদাভীরু ও সৎ লোক ছাড়া উত্তম সমাজ গঠন করা সম্ভব নয়। অসৎ ও চরিত্রহীন লোকেরা আজ সমাজকে সর্বনাশ করেছে। তাই তাকওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করে উন্নত সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের জন্য রোযাদার খোদাভীরু লোকদের নেতৃত্ব কায়েম করতে হবে। রোযার অর্থনৈতিক গুরুত্ব রোযার শেষে ফিতরা প্রদান করে রোযাদার এক দিকে রোযাকে পবিত্র করে, অন্য দিকে সমাজের দরিদ্র সম্প্রদায়কে অর্থ সাহায্য করে। এ প্রসঙ্গে হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেনঃ “সাদাকাতুল ফিতরকে রোযাদারের বেহুদা কথা ও কাজ এবং গুনাহ থেকে পবিত্র করা এবং নিঃস্ব-অসহায় মিসকীনের উদ্দেশ্যে অপরিহার্য করেছে। যে ব্যক্তি ঈদের নামাযের আগে তা আদায় করে, সেটি আল্লাহর কাছে কবুল হবে। আর যে ব্যক্তি তা ঈদের নামাযের পর আদায় করে তা অন্যান্য সাধারণ দান সদকার মত বিঘোষিত হবে। (আবু দাউদ, ইবনে মাজা, হাকেম)

পৃষ্ঠা:৬৯

রোযার সময় দানে সওয়াব বেশী হয় বলে ধনী ব্যক্তিগণ এ মাসে বেশী বেশী দান করেন। যাদের উপর যাকাত ওয়াজিব তারাও এ মাসে যাকাত গরীবদের মধ্যে বণ্টন করে থাকেন। মহামান্বিত বরকতময় রাত্রি কদর শব্দের দুইটি অর্থ আছে। একটি হচ্ছে, ভাগ্য বা তাকদীর। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ কুরআন মজীদে বলেছেন: إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِينَ – فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ امر حكيم. ‘আমরা এই কুরআনকে এক বরকতময় ও মর্যাদাসম্পন্ন রাত্রে নাযিল করেছি। কারণ আমরা লোকরদেরকে সতর্ক করতে চেয়েছিলাম। এই রাতে সকল বিজ্ঞ ও হিকমতপূর্ণ বিষয়ের ফয়সালা করা হয়।’ (সূরা আদ- দুখান: ৩-৪) এই আয়াতে রাত বলতে কদরের রাত বুঝানো হয়েছে এবং তাতে আগামী ১ বছরের অধিক রিযিক এবং হায়াত ও মৃত্যুসহ সকল কিছুর ফয়সালা ও পরিকল্পনা ফেরেশতাদেরকে জানিয়ে দিয়ে মানুষের ভাগ্য ও তাকদীর সম্পর্কে বার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের বিস্তারিত দায়িত্ব অর্পণ করার কথা বলা হয়েছে। ২য় অর্থ হচ্ছে, মর্যাদা ও সম্মানের রাত্রি। এই রাতের ইবাদতের সওয়াব ও পুরস্কার অনেক বেশী। এই রাত্রের ইবাদতকে হাজার মাসের চাইতেও উত্তম বলা হয়েছে। হাজার মাস হচ্ছে প্রায় ৮৩ বছর ১০ দিনের সমান। কি সৌভাগ্যের বিষয় যে এক রাত একজন মানুষের গোটা জীবনের সমান! অর্থাৎ একজন লোক বড় জোর ৮০/৯০ বছর জীবন লাভ করতে পারে। কদরের এক রাতের ইবাদত তার গোটা যিন্দেগীর ইবাদতের সমান। তাই এ রাতের ব্যাপারে অত্যধিক গুরুত্বারোপ প্রয়োজন। আল্লাহ বলেন, ‘আমরা কদরের রাতে এই কুরআনকে নাযিল করেছি। তুমি

পৃষ্ঠা:৭০

কি জান কদরের রাত কি? কদরের রাত হাজার মাসের চাইতে উত্তম। এই রাতে আল্লাহর হুকুমে ফেরেশতা ও জিবরীল দুনিয়ার সকল কল্যাণকর জিনিস নিয়ে অবতীর্ণ হয় এবং সূর্যোদয়ের আগ পর্যন্ত সারা রাতব্যাপী শান্তি ও রহমত বিদ্যমান থাকে।’ (সূরা কদর) রাসূলুল্লাহ (সা) আগের উম্মাহর এক ব্যক্তি সম্পর্কে জানতে পারেন যে, সে এক হাজার বছর পর্যন্ত আল্লাহর রাস্তায় তলোয়ার দিয়ে যুদ্ধ করেছে। তিনি নিজ উম্মাহর বয়সের স্বল্পতা অনুভব করায় আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে এই সূরাটি নাফিল হয়। এখানে কদরের রাতকে হাজার মাসের ইবাদতের চাইতেও উত্তম বলা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আল্লাহ ‘হাজার’ শব্দটিকে কেন নির্দিষ্ট করলেন? এটা দ্বারা কি হুবহু হাজার মাস বুঝানো হয়েছে, না তা কোন প্রতীকী শব্দ। এর জওয়াবে বলা যায়, এটি প্রতীকী শব্দ। আল্লাহ আরব জাতির জ্ঞানের পরিধি মোতাবেক বক্তব্য পেশ করেছেন। আরবরা ‘হজার’কে সর্বশেষ ও সর্বাধিক সংখ্যা মনে করতো। তারা বর্তমান যুগের মিলিয়ন ও বিলিয়নের সাথে পরিচিত ছিল না। তাই তারা ‘হাজার’ সংখ্যাকে শীর্ষ সংখ্যা বিবেচনা করতো। এই প্রেক্ষিতে, আয়াতের অর্থ হলো, কদরের রাত সংখ্যার মাপকাঠিতে সর্বোচ্চ সংখ্যার চাইতেও অধিক। তাহলে, এর সঠিক অর্থ দাঁড়ায়, কদরের রাত সকল সময় ও কাল থেকে উত্তম এবং সেই সময় বা কাল যত দীর্ঘই হোক না কেন। আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ ‘কদরের রাতে পৃথিবীতে ফেরেশতার সংখ্যা পাথর কণার চাইতেও বেশী হয়ে থাকে। ফলে যমীনে শয়তানের রাজত্ব বাতিল হয়ে যায় এবং সেই রাতে লোকেরা শয়তানের ক্ষতি থেকে নিরাপদ থাকে।’ কদরের রাতে কুরআন নাযিল হয়েছে। কিন্তু এ সূরায় এটি বছরের কোন মাসে তা বলা হয়নি। এটি কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেন: রমযান মাসেই কুরআন নাযিল করা হয়েছে, তাতে রয়েছে মানুষের হিদায়াত এবং এর সুস্পষ্ট দলিল প্রমাণ। এটি হচ্ছে সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্যকারী। (সূরা আল-বাকারা : ১৮৪)

পৃষ্ঠা:৭১

মহিমান্বিত কদর রাতের ফযীলত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ مَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيْمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ. ‘যে কদরের রাত্রে ঈমান ও সওয়াবের নিয়তে নামায পড়ে, তার অতীতের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়।’ (বুখারী, মুসলিম) অন্য বর্ণনায় আছে, ‘ভবিষ্যতের সকল গুনাহও মাফ করে দেয়া হয়।’ উবাদাহ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ مَنْ قَامَهَا ابْتِغَاءَهَا ثُمَّ وَقَعَتْ لَهُ غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ وَمَا تَأَخَّرَ. ‘যে কদরের রাত্রের অন্বেষণে সেই রাতে নামায পড়ে এবং তা পেয়ে যায়, তার অতীতের ও ভবিষ্যতের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়।’ (নাসায়ী) হযরত আয়েশা (রা) বলেন: ‘রমযানের শেষ দশক শুরু হলে রাসূলুল্লাহ (সা) কদরের রাত লাভের উদ্দেশ্যে পূর্ণ প্রস্তুতি নিতেন, রাত্রি জাগরণ করতেন এবং নিজ পরিবারকে জাগাতেন।’ (বুখারী, মুসলিম) অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি স্ত্রীদের থেকে দূরে থাকতেন। আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিতঃ রাসূলুল্লাহ (সা) রমযানের শেষ দশকে এত বেশী পরিশ্রম ও ইবাদত করতেন যা অন্য সময় করতেন না। তিনি রমযানের শেষ দশকে এমন কিছু নেক কাজের জন্য নির্দিষ্ট করতেন যা মাসের অবশিষ্টাংশের জন্য করতেন না। এর মধ্যে রাত্রি জাগরণ অন্যতম।’ (মুসলিম) আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত: ‘রাসূলুল্লাহ (সা) ২০ রযমান পর্যন্ত রাত্রে নামায ও ঘুমকে একত্রিত করতেন। কিন্তু রমযানের শেষ দশকে তিনি পূর্ণ প্রস্তুতি নিতেন এবং নিজ স্ত্রীদের থেকে দূরে থাকতেন। (মুসনাদে আহমদ) অন্য দিকে, তিনি রমযানের শেষ দশকে ঘুমাতেন না। কঠোর ও লাগাতার ইবাদতে মশগুল থাকতেন। হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত: রমযানের শেষ দশকে রাসূলুল্লাহ (সা) বিছানা উঠিয়ে ফেলতেন, নিজ স্ত্রীদের থেকে

পৃষ্ঠা:৭২

দূরে থাকতেন এবং ভোর রাত্রে সেহরীর সময় সন্ধ্যাবেলার খাবার খেতেন। (তাবারানী) উপরোক্ত বর্ণনাগুলো দ্বারা যে জিনিসটি প্রমাণিত হয় সেটা হচ্ছে, কদরের রাত লাভ করার জন্য তিনি কঠোর পরিশ্রম করেছেন এবং এক মিনিট সময়ও যেন নষ্ট না হয় সে ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন। মহাকল্যাণময় কদরের রাতের করণীয় কদরের রাত্রের মর্যাদা লাভের উদ্দেশ্যে নির্ধারিত ফরয ও ওয়াজিবগুলো পালন করতে হবে এবং অন্যান্য সুন্নত, নফল ও মুস্তাহাব কাজগুলো আদায় করতে হবে। এর মধ্যে মাগরিব ও এশার নামায জামায়াতে আদায় করতে হবে এবং তারাবী, তাহাজ্জুদ, বিতর, কুরআন তিলাওয়াত, আল্লাহর যিকির, তাওবা ইসতিগফার ও দু’আ করতে হবে। আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করতে হবে এবং পূর্ণ ইখলাস ও আন্তরিকতার সাথে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ইবাদত করতে হবে। এ প্রসঙ্গে হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: مَنْ صَلَّى الْعِشَاءُ الْآخِرَةِ فِي جَمَاعَةٍ فِي رَمَضَانَ فَقَدْ أَدْرَكَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ. ‘যে রমযানে এশার নামায জামায়াত সহকারে আদায় করে সে কদরের রাতের ফযীলত লাভ করে।’ (আবুশ শেখ ইসপাহানী) আমাদের পরিবার-পরিজনকেও রাত্রে জাগাতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সা) রমযানের শেষ দশকে নিজ পরিবারকে জাগাতেন। তিনি নামায পড়ার জন্য হযরত আলী (রা) এবং ফাতেমা (রা)-কে জাগাতেন যেন তারাও ইবাদত করে। তিনি তাহাজ্জুদ শেষে বিতর পড়ার আগে আয়েশা (রা)- কেও জাগাতেন। আরেক মুরসাল হাদীসে এসেছে, আবু জাফর মুহাম্মদ বিন আলী বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: ‘কোন সুস্থ মুসলমানের কাছে রমযান উপস্থিত হলে সে যদি রোযা রাখে, রাত্রের এক অংশে নামায পড়ে, নিজ চোখ অবনত রাখে, হাত পা ও লজ্জাস্থানের হিফাযত করে, জামায়াত সহকারে

পৃষ্ঠা:৭৩

নামায পড়ে এবং জুম’আর নামাযে তাড়াতাড়ি হাযির হয়, তাহলে সে রমযানের রোযা রেখেছে, পূর্ণ পারিশ্রমিক পেয়েছে, কদরের রাত পেয়েছে এবং আল্লাহর পুরস্কার লাভ করে ধন্য হয়েছে। অবশ্য হারাম ও নিষিদ্ধ কাজ থেকে অবশ্যই দূরে থাকতে হবে। এ প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: ‘আল্লাহ কদরের রাত্রে উম্মতে মুহাম্মদীর দিকে তাকান এবং তাদেরকে ক্ষমা ও দয়া করেন। তবে চার ব্যক্তি এ দয়ার আওতায় পড়ে না।

১. মদ পানকারী, ২. মাতা-পিতার সাথে সম্পর্ক ছিন্নকারী, ৩. হিংসুক- নিন্দুক এবং ৪. আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী। শরীয়তসম্মত ওজর আপত্তির কারণে যারা কদরের রাতে ইবাদত করতে পারেনি, তারাও সওয়াব পাবে বলে আল্লামা দাহ্হাক মন্তব্য করেছেন। তিনি যে সকল মহিলার হায়েয নেফাস হয়েছে কিংবা মুসাফির অথবা যে ব্যক্তি ঘুম থেকে জাগতে পারেনি তাদের সওয়াবের ব্যাপারে বলেন, আল্লাহ যাদের আমল কবুল করেন, তাদেরকে কদর রাত থেকে তাদের অংশ দান করবেন। আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: ‘রমযানে এমন এক রাত আছে যার ইবাদত হাজার মাসের ইবাদত অপেক্ষা উত্তম। যে এই রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়েছে সে অবশ্য বঞ্চিতের কাতারে আছে।’ (নাসায়ী ও মুসনাদ) সহীহ হাদীসে বর্ণিত, কদরের রাত্রে কি দু’আ পড়া উচিত এ মর্মে আয়েশা (রা)-এর এক প্রশ্নের জওয়াবে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, এই দু’আ পড়ঃ اللَّهُمَّ إِنَّكَ عَفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَلَى. ‘হে আল্লাহ! তুমি ক্ষমাশীল, ক্ষমাকে পছন্দ কর। সুতরাং আমাকে ক্ষমা ও মাফ করে দাও।’

পৃষ্ঠা:৭৪

শিক্ষা

১। রমযান মাসে রোযাকে ফরয করা হয়েছে।

২। রমযান মাস অত্যন্ত বরকতময় মাস।

৩। সকলকে এ মাসের কল্যাণ লাভের চেষ্টা করা উচিত।

৪। রমযান মাসে শয়তানকে বন্দী রাখা হয় যাতে ধোঁকা দিতে না পারে।

৫। বান্দাগণের অধিক কল্যাণে আসমানের দরজাসমূহ খোলা হয়।

৬। এ মাসে এমন একটি রাত রয়েছে যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম।

এ রাতটিকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করে যাপন করা উচিত।

পৃষ্ঠা:৭৫

দারস-৮ হজ্জ عن ابن عباس (رض) قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ (صلعم) مَنْ أَرَادَ الْحَجِّ فَلْيَتَعَجَّلْ فَإِنَّهُ قَدْ يَعْرِضُ الْمَرِيضِ وَفَضْلِ الرَّاحِلَةُ وَتَعْرِضُ الْحَاجَةُ. (ابن ماجه) অর্থ : হযরত ইবনে আব্বাস (রা) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, হজ্জের ইচ্ছা পোষণকারী যেন তাড়াতাড়ি তা সমাপণ করে ফেলে। কেননা সে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে, তার উট হারিয়ে যেতে পারে বা তার ইচ্ছা বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে। (ইবনে মাজাহ) শব্দার্থ : )عن ابن عباس (رض : হযরত ইবনে আব্বাস (রা) হতে বর্ণিত। قال: তিনি বলেন। )صلعم( : قَالَ رَسُولُ الله রাসূল (সা) বলেন। : যে ব্যক্তি। : ইচ্ছ করে । : الحَج : সে যেন তাড়াতাড়ি করে। فإنه: কেননা সে। قد يمرض : সে অসুস্থ হতে পারে। الْمَرِيضُ : রোগী। فضل: হারিয়ে যেতে পারে। الرَّاحِلَة উট, বাহন। تعرض : সে বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে। الْحَاجَةُ ইচ্ছা, প্রয়োজন।ব্যাখ্যাঃ হজ্জ ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ। এটা আদায় করা সামর্থ্যবানদের জন্য ফরয। কোন ব্যক্তির উপর হজ্জ ফরয হওয়ার সাথে সাথেই তা আদায় করা উত্তম। পরবর্তী বছর করবে এই আশায় হজ্জ বাকী রাখলে তার ভাগ্যে হজ্জ করার সুযোগ নাও হতে পারে। কারণ ঐ ব্যক্তি অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে অথবা তার যাতায়াতের বাহন বা খরচ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এমনকি সে পরবর্তী বছর বেঁচে থাকবে কিনা তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। তাই আলোচ্য হাদীসে রাসূলে পাক (সা) হজ্জ ফরয হওয়ার সাথে সাথেই তা

কবিতা ৭৬ থেকে ৯০

পৃষ্ঠা:৭৬

আদায় করার তাকীদ করেছেন। কেননা কোন ব্যক্তির উপর হজ্জ ফরয হওয়ার পর গাফলতীর কারণে তা আদায় না করলে কঠিন গুনাহগার হবে। গ্রন্থ পরিচিতি: আলোচ্য হাদীসখানা ইবনে মাজাহ শরীফ থেকে নেয়া হয়েছে। ইহার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি নিম্নে তুলে ধরা হল। সুনান ইবনে মাজাহ সিহাহ সিত্তার ষষ্ঠতম গ্রন্থ। ইমাম ইবনে মাজাহ অপরিসীম সাধনা করে এ গ্রন্থ সংকলন করেন। তাঁর নাম আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইয়াযীদ। তিনি ২০৯ হিজরীতে ইসলামের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও হাদীস চর্চার অন্যতম কেন্দ্রস্থল কাজভীন শহরে জন্মগ্রহণ করেন। (মু’জামুল বুলদান, পৃঃ ৮২)

তিনি অসাধারণ মেধার অধিকারী ছিলেন। মক্কা, মদীনা, মিশর, সিরিয়া, নিশাপুরসহ পৃথিবীর অনেক দেশে ভ্রমণ করে লক্ষ লক্ষ হাদীস সংগ্রহ করেন এবং এর থেকে যাচাই-বাছাই করে প্রায় চার হাজার হাদীসের এ অমর গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। যার মধ্যে ৩২টি পরিচ্ছেদ ও পনেরশত অধ্যায় আছে। হাফিয ইবনে হাজার (র) বলেনঃ “ইহা অত্যন্ত কল্যাণপ্রদ গ্রন্থ, ফিকাহর দৃষ্টিতে উহার অধ্যায়সমূহ খুবই সুন্দর ও মজবুত করে সাজানো হয়েছে।” হাফিয ইবনে হাজার আসকালানী (র) বলেন: “ইমাম ইবনে হাজার সুনান কিতাবখানা অত্যন্ত ব্যাপক হাদীস সমন্বিত এবং উত্তম। এ মহামনীষী ২৭৩ হিজরীতে ৬৪ বছর বয়সে ইনতিকাল করেন। (তাহযীবুত তাহযীব)

রাবী পরিচিতিঃ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা)। নামঃ আবদুল্লাহ। উপনামঃ আবুল আব্বাস। উপাধি: হিবরুল উম্মাহ। পিতার নাম: আব্বাস। মাতার নাম: উম্মুল ফাদল লুবাবাহ বিনতে হারেছ। তিনি কুরাইশ বংশের হাশেমী শাখার সন্তান। রাসূল (সা)-এর চাচাতো ভাই এবং উম্মুল মু’মিনীন হযরত মায়মূনা (রা) তাঁর আপন খালা। এ দিক দিয়ে রাসূল (সা) তাঁর খালু হতেন। এই সুবাদে তিনি খালার ঘরে অবস্থান করতেন। (আবু দাউদ, কিতাবুস-সালাত) আর রাসূল (সা)-এর রাত্রিকালীন ইবাদত তিনি স্বচক্ষে দেখতেন। একদা তাহাজ্জুদের নামাযের জন্য অযুর পানি এগিয়ে দেন। রাসূল (সা) তাঁর খেদমতে খুশি হয়ে দু’আ করলেনঃ

পৃষ্ঠা:৭৭

اللهُمْ فَقَهْهُ فِي الدِّينِ وَعَلِّمُهُ التَّاوِيلَ. “হে আল্লাহ তুমি ইবনে আব্বাসকে ইলমে ফিকাহ এবং ইলমে তাফসীরের অগাধ জ্ঞান দান কর।” (ইসাবা ৩য় খণ্ড, পৃঃ ৩২৩) এ দু’আর ফলে তিনি কুরআন-হাদীসে বিশেষ পারদর্শী হন। লোকেরা তাঁকে ‘হিবরুল উম্মাহ’ জাতির জ্ঞান সমুদ্র বলে জানতেন। আবদুল্লাহ নামক চারজন বিশিষ্ট সাহাবীর অন্যতম তিনি। (আল-আকমাল আসমাউর রিজাল লি সাহেবিল মিশকাত: পৃঃ ২০) জন্মঃ রাসূল (সা)-এর তিন বছর পূর্বে তিনি ‘শি’য়াবে’ আবু তালীবে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মাতা লুবাবাহ বিনতে হারেছ হিজরতের পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেন বলে তাকে ছোট বেলার সাহাবী হিসেবে গণ্য করা হয়।

তিনি গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। হযরত ওমর ও ওসমান (রা) তাঁর থেকে পরামর্শ গ্রহণ করতেন। তিনি ‘রইসুল মুফাসসিরিন’। তাঁর সংকলিত তাফসীর গ্রন্থের নাম তাফসীরে ইবনে আব্বাস। হযরত আলী (রা)-এর শাসনামলে তিনি বসরার গভর্ণর ছিলেন। তাঁর বর্ণিত হাদীস সংখ্যাঃ তিনি সর্বাধিক হাদীস বর্ণনাকারীদের অন্যতম। আল্লামা আইনীর মতে, তাঁর বর্ণিত হাদীস সংখ্যা ১৬৬০টি। বুখারী মুসলিমে যৌথভাবে ৯৫টি, এককভাবে বুখারীতে ১২০টি এবং মুসলিম শরীফে ৪৯টি হাদীসের উল্লেখ রয়েছে। (উমদাতুল কারী ১ম খণ্ড পৃঃ ৮০) ইতিকাল: তিনি শেষ জীবনে দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে ফেলেন। তাঁর মৃত্যু সন নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তিনি ৭০/৭১ হিজরী সনে ৭০/৭১ বছর বয়সে তায়েফে ইনতিকাল করেন। তাঁর নামাযে জানাযায় ইমামতি করেন সেকালের সেরা মুহাদ্দিস মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়া। তিনি উপস্থিত জনগণের উদ্দেশ্যে বলেনঃ حِيرُ هَذِهِ الْأُمَّةِ. مَاتَ وَاللَّهِ الْيَوْمَ حِبْرُ “আল্লাহর শপথ! আজ এ জাতির জ্ঞানসমুদ্র ইহধাম ত্যাগ করল।”

পৃষ্ঠা:৭৮

হজ্জ কখন ফরয হয়? হজ্জ ৯ম হিজরীতে ফরয হয়। হজ্জ ফরয হওয়ার শর্ত

১ম শর্তঃ মুসলমান হওয়া। কাফিরের উপর হজ্জ ফরয নয়।

২য় শর্ত: স্বাধীন হওয়া। দাসের উপর হজ্জ ফরয নয়।

৩য় শর্ত: আকেল (বুদ্ধিমান)-এর উপর হজ্জ ফরয। পাগল এবং জ্ঞানহীন

ব্যক্তির উপর হজ্জ ফরয নয়।

৪র্থ শর্ত: বয়োপ্রাপ্তের উপর হজ্জ ফরয। অপ্রাপ্ত বয়স্কের উপর ফরয নয়।

৫ম শর্তঃ সুস্থ ব্যক্তির উপর ফরয। অসুস্থ ব্যক্তির উপর ফরয নয়।

৬ষ্ঠ শর্তঃ যে ব্যক্তি (মক্কা পর্যন্ত) যাতায়াত ও অন্যান্য খরচের সামর্থ্য রাখে এবং হজ্জ হতে প্রত্যাবর্তন না করা পর্যন্ত তার পরিবারবর্গের যাবতীয় খরচ মিটানোর সামর্থ্য রাখে।

৭ম শর্ত: রাস্তায় বিপদাপদের ভয় থাকলে হজ্জ ফরয হবে না।

৮ম শর্ত: স্ত্রীলোকের সাথে তার স্বামী বা মুহরিম লোক না থাকলে হজ্জ করতে যাবে না।

হজ্জের ধর্মীয় গুরুত্ব ও তাৎপর্যঃ হজ্জ ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের অন্যতম শুভ। প্রত্যেক ধনী ও সম্পদশালী মুসলিম ব্যক্তির উপর জীবনে একবার হজ্জ পালন করা ফরয। এর অস্বীকারকারী কাফির। ইহা একাধারে দৈহিক, আত্মিক ও আর্থিক ইবাদত বিধায় এর ধর্মীয় গুরুত্ব অপরিসীম। কুরআনের বাণীঃ وَلِلَّهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلًا وَمَنْ كَفَرَ فَإِنَّ اللَّهَ غَنِي عَنِ الْعَلَمِينَ. “মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কা’বা গৃহে হজ্জ পালন করা ঐ সমস্ত মানুষের কর্তব্য যারা কা’বা গৃহ পর্যন্ত যেতে সমর্থ রাখে। আর যারা এ

পৃষ্ঠা:৭৯

নির্দেশ অমান্য করে কুফুরী করবে তার জেনে রাখা উচিত যে, আল্লাহ সৃষ্টি জগতের কারো মুখাপেক্ষী নন।” (সূরা আল-ইমরান: ৯৭) অপর এক আয়াতে বলা হয়েছেঃ وَاتِمُوا الْحَجَّ وَالْعُمْرَةَ لِلَّهِ. “আর তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ্জ ও ওমরা পরিপূর্ণভাবে পালন কর।” (সূরা আল-বাকারা: ১৯৬)

১. ঈমানের পরিপূর্ণতা ও দৃঢ়তা লাভঃ হজ্জ পালনের মাধ্যমে ঈমানের পরিপূর্ণতা ও দৃঢ়তা লাভ করা সম্ভব। হজ্জে গমনের মাধ্যমে কা’বা গৃহের সৃষ্টি রহস্য, জম-জম কূপ, হাজরে আসওয়াদ ও কুরআন অবতীর্ণের স্থান ইত্যাদি ঐতিহাসিক নিদর্শনাবলী অবলোকনের দ্বারা স্বাভাবিকভাবেই ঈমানের দৃঢ়তা বৃদ্ধি পায়।

২. গুনাহ মাফের উপায়: কা’বা শরীফ বিশ্বের সকল মুসলমানদের নিকট শ্রেষ্ঠতম ইবাদত গৃহ। এখানে হজ্জ পালনের মাধ্যমে মানুষের গুনাহসমূহ মাফ হয়ে যায়, ফলে হজ্জ পালনকারী নিষ্কলুষ জীবনের অধিকারী হয়। রাসূলের বাণী: “যে ব্যক্তি এ ঘরে (কা’বায়) হজ্জ করতে এলো এবং কোন প্রকার অন্যায় কাজ করলো না কিংবা কোন অশ্লীল কথা বললো না, সে এমন (পবিত্র) হয়ে প্রত্যাবর্তন করলো, যেমন তার মা তাকে নিষ্পাপরূপে ভূমিষ্ঠ করেছিলো। (বুখারী, মুসলিম)

৩. হজ্জ আল্লাহর স্মরণ: আল্লাহ তা’য়ালার ইবাদত ও স্মরণ করার জন্য দুনিয়াতে সর্বপ্রথম হযরত আদম (আ) কা’বা গৃহ নির্মাণ করেন। কাজেই এ গৃহ দর্শনের সাথে সাথেই মু’মিন বান্দাদের অন্তরে আল্লাহর স্মরণ জাগ্রত হয়।

৪. পরকালের স্মরণঃ হজ্জের ইহরামের মাধ্যমে সুন্দর পোশাক পরিত্যাগ করে সাদা-কাপড় পরিধান করে নগ্ন পদ ও শূন্য মস্তিষ্ক নিজের সকল আমিত্বকে এক আল্লাহর খুশির জন্য বিসর্জন দিয়ে লক্ষ লক্ষ হাজী আরাফার ময়দানে সমবেত হয়ে মুক্তির আশায় আল্লাহর দরবারে ধরণা দেয়, যাতে হাশরের ময়দানের কথা স্মরণ হয়।

পৃষ্ঠা:৮০

৫. আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায়ঃ দুনিয়ার সব কিছুর মায়া মমতা ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর গৃহে যখন হজ্জ পালন করার উদ্দেশ্যে সমবেত হয় তখন বান্দা আল্লাহর নিকটবর্তী হয়।

৬. আল্লাহর গভীর ভালবাসার প্রমাণ: জীবন ও সম্পদের মায়া ত্যাগ করে আরবের মরু সাহারায় পবিত্র কা’বায় হজ্জব্রত পালনের উদ্দেশ্যে হাজির হয়ে বাক্য উচ্চারণ করা, لبيك اللهم لبيك “প্রভু আমি (তোমার দরবারে( হাজির। একমাত্র আল্লাহর গভীর ভালবাসারই প্রমাণ বহন করে।

সামাজিক গুরুত্ব

হজ্জের সামাজিক গুরুত্ব অপরিসীম। নিম্নে তা আলোচনা করা হল:

১. মুসলিম জাহানের মহাসম্মেলনঃ প্রতি বছর মুসলিম জাহানের একটি মহাসম্মেলন হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। বর্তমান ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ দুনিয়ায় মুসলিম জাহানের ঐক্য সংস্থাপনের জন্য এ সম্মেলনের গুরুত্ব অনেক বেশী। হজ্জ সে দাবী পূরণ করে।

২. বিশ্ব মুসলিমের ঐক্যঃ হজ্জ বিশ্ব মুসলিমের ঐক্যের প্রতীক। সারা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মুসলিমগণ হজ্জ উপলক্ষে একত্রিত হওয়ার মাধ্যমে বিশ্ব মুসলিমের সুদৃঢ় ঐক্য গড়ে উঠে।

৩. ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি করে: বিশ্বের নানা দেশের নানা বর্ণের মানুষ একত্রিত হয়। এ সুযোগে পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে উঠে, ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি করে, সম্প্রীতি ও ভালাবাসা বৃদ্ধি পায়।

৪. ভাবের আদান-প্রদানের মহা সুযোগঃ হজ্জের মৌসুমে সকল মুসলিম দেশের নেতৃস্থানীয় লোকদের একত্রিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। সে সুযোগে এক দেশের সাথে অন্য দেশের সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা ও করণীয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সক্ষম হয়।

৫. উন্নত চরিত্র গঠন করে: হজ্জ উন্নত চরিত্র গঠনের সোপান। হজ্জের মাধ্যমে হাজীগণ আল্লাহর দরবারে কৃত অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন ও ভবিষ্যতে কোন অপরাধ করবেন না বলে ওয়াদা করেন। এর মধ্য দিয়ে তাদের চরিত্র উন্নত হয় এবং উন্নত সমাজ গড়ে উঠার পথ একধাপ এগিয়ে যায়।

পৃষ্ঠা:৮১

৬. সামাজিক সাম্য সৃষ্টি হয়ঃ হজ্জের সময় ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র, আমীর- ফকির সকলে একই পোশাকে একইবেশে একত্রিত হয়ে এ প্রমাণই দেয় যে, সৃষ্টির মধ্যে কোন বৈষম্য নেই, সবাই সমান। এতে বিশ্ব সাম্য গড়ে উঠে। বর্তমান দুনিয়ায় দেশে দেশে যে দ্বন্দ্ব সে ক্ষেত্রে সামাজিক সাম্য ও বিশ্ব সাম্যে হজ্জের গুরুত্ব অপরিসীম। হজ্জের অর্থনৈতিক গুরুত্ব হজ্জ মৌসুমে মুসলিম দেশসমূহে ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গতিবেগ সঞ্চারিত হয়। হজ্জ যাত্রীগণ যখন হজ্জব্রত পালনের উদ্দেশ্যে। নিয়ত করেন তখন মানুষের সকল পাওনা পুংখানুপুংখরূপে পরিশোধ করে আসেন। অপর দিকে মক্কায় গমনের প্রাক্কালে নিজ নিজ দেশের সরকার বিভিন্ন ধরনের ভাতা ও অন্যান্য কর আরোপ করে থাকে তা যথা নিয়মে আদায় করতে হয়। হজ্জযাত্রীগণ যখন সৌদি আরবে পৌঁছেন তখন তাদেরকে ভাড়া বাড়ীতে উঠতে হয় এবং ভাড়া পরিশোধ করতে হয়। সেখানে খাওয়াসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র ক্রয় করতে হয়। অপর দিকে সারা বিশ্ব থেকে কুরবানীর পশুসহ অন্যান্য সামগ্রী হজ্জ উপলক্ষে সৌদি আরবে সরবরাহ করে থাকে। হাজীগণ কুরবানীর জন্য পশু ক্রয় করেন ও দেশে ফেরার সময় আত্মীয়-স্বজনের জন্য অন্যান্য সামগ্রী ক্রয় করে উপঢৌকন নিয়ে আসেন। এ সকল কাজে যে অর্থ ব্যয় হয় তা দেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিরাট প্রভাব ফেলে। তাতে মূলতঃ মুসলিম বিশ্বের সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পায়।

শিক্ষা

১। সামর্থ্যবান ব্যক্তির উপর হজ্জ ফরয।

২। হজ্জ ফরয হলে যথাশীঘ্র আদায় করা উচিত।

৩। বিলম্ব করলে বাধাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

৪। ফরয হজ্জ আদায় না করলে গুনাহগার হবে।

৫। সুস্থাবস্থায় হজ্জ পালন করা উত্তম।

পৃষ্ঠা:৮২

দারস-৯ যাকাত: ! عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ (رض) قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ (صلعم) مَنْ آتَاهُ اللَّهُ مَالاً فَلَمْ يُؤدِّ زَكُوتَهُ مُثْلَ لَهُ مَالُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ شُجَاعًا أَقْرَعُ لَهُ زَبِيبَتَانِ يُطَوِّقُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ثُمَّ يَأْخُذُ بِلِرَمَتَيْهِ يَعْنِي شَدْقَيْهِ ثُمَّ يَقُولُ أَنَا مَالُكَ انا كنزك (بخاری، نسائی)

অর্থঃ হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (সা) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছ থেকে ধন-সম্পদ পেয়েছে কিন্তু সে উহার যাকাত আদায় করেনি, কিয়ামতের দিন ঐ ধন-সম্পদ এমন বিষধর সাপে পরিণত হবে, যার মাথার উপর থাকবে দু’টি কালো দাগ। এ সাপ সে ব্যক্তির গলায় পেচিয়ে দেয়া হবে। অতঃপর সাপ উক্ত ব্যক্তির গলায় ঝুলে তার দু’গালে কামড়াতে থাকবে। আর বলবে আমি তোমার মাল, আমি তোমার সঞ্চিত সম্পদ। (বুখারী, নাসায়ী) শব্দার্থ : هريرة عن ابي : হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। قال : তিনি বলেন। )قَالَ رَسُوْلُ الله (ص : রাসূল (সা) বলেন : منْ  مالاً الله : আল্লাহ যাকে ধন-সম্পদ দিয়েছেন। فلم يؤد زَكوتَهُ : কিন্তু সে উহার যাকাত আদায় করেনি। مثل له ناله : তার মাল তার জন্যে পরিণত হবে। يَوْمَ الْقِيَامَة : কিয়ামতের দিন। شُجَاعًا أَقْرَعُ : বিষধর সাপ। له : তার। زبيبتان : দু’টি কালো দাগ। يُطوقه: তার গলায় ঝুলে থাকবে। ثُمَّ : অতঃপর। يَأْخُذُ : কামড়াবে, ধরবে। بلهزمتيه : তার দু’গালের সাথে। يعنى : অর্থাৎ । شدقيه : তার দু’চোয়াল। يقول: সে বলবে। : আমি। ত: তোমার মাল। كَنْزُكَ : তোমার সঞ্চিত সম্পদ।

পৃষ্ঠা:৮৩

ব্যাখ্যাঃ যাকাত ইসলামের অন্যতম মৌলিক ইবাদত। ধনী ব্যক্তিদের উপর নিজের ও পরিবারের অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন ব্যতীত উদ্বৃত্ত সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ গরীব-মিসকীন ও অভাবী লোকদের মধ্যে বণ্টন করা ফরয। কেউ যদি এ ফরয আদায় না করে তার শান্তি কি হবে? আলোচ্য হাদীসে সে পরিণতি সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে সম্পদের যাকাত আদায় করা হবে না, কিয়ামতের দিন ঐ ধন-সম্পদ এমন বিষধর সাপে পরিণত হবে, যার মাথার উপর থাকবে দু’টি কালো দাগ। এ সাপ সে ব্যক্তির গলায় পেচিয়ে দেয়া হবে। অতঃপর সাপ উক্ত ব্যক্তির গলায় ঝুলে তার দু’গালে কামড়াতে থাকবে, আর বলবে আমি তোমার মাল, আমি তোমার সঞ্চিত সম্পদ। মহান আল্লাহ বলেনঃ وَالَّذِينَ يَكْبَزُونَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنْفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ اللَّهِ لَا فَبَشِّرُهُمْ بعذاب اليم.

“যারা সোনা এবং রূপা সঞ্চয় করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে খরচ করে না, তাদেরকে কঠিন শাস্তির সুসংবাদ দাও।” (সূরা আত-তওবা: ৩৪) অন্য আয়াতে বলা হয়েছেঃ “সেদিন জাহান্নামের আগুনে তাদের সঞ্চিত সম্পদ উত্তপ্ত করা হবে এবং তার দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্ব ও পৃষ্ঠদেশকে দগ্ধ করা হবে এবং সেদিন বলা হবে, এগুলো সে সম্পদ যা তুমি নিজেদের জন্য জমা করে রেখেছিলে। সুতরাং এখন সঞ্চিত সম্পদের স্বাদ-আস্বাদন কর। (সূরা আত-তওবা: ৩৫) বৈষয়িক শান্তি সম্পর্কে মহানবী (সা) বলেন: “যেসব লোক যাকাত আদায় করতে অস্বীকার করবে, আল্লাহ তা’য়ালা তাদেরকে কঠিন ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষে নিমজ্জিত করবেন। অপর এক হাদীসে বলা হয়েছে: যে জাতি যাকাত দেয় না, তাদের উপর বৃষ্টিপাত বন্ধ করে দেয়া হয়।” (মুজমাউল জাওয়ায়েদ) গ্রন্থ পরিচিতি: আলোচ্য হাদীসখানা বুখারী ও নাসায়ী শরীফে যৌথভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। বুখারী শরীফের পরিচিতি ১নং দারসে আলোচনা করা

পৃষ্ঠা:৮৪

হয়েছে। নাসায়ী শরীফের সংক্ষিপ্ত পরিচয় ৭নং দারসে উল্লেখ করা হয়েছে। রাবী পরিচিতি: হযরত আবু হুরায়রা (রা)-এর পরিচয় ৪নং দারসে আলোচনা করা হয়েছে। আভিধানিক অর্থঃ যাকাতের অভিধানিক অর্থ- পবিত্র, বৃদ্ধি, বিশুদ্ধ, প্রশংসা ইত্যাদি। (আল-ওয়াসীত ১/৩৯৬) প্রখ্যাত অভিধান গ্রন্থ ‘লিসানুল আরব’-এ যাকাতের অর্থ লিখেছেন: – الطهارة – وَالثَّمَاءُ – وَالْبَرَكَةُ – وَالْمَدْحُ অর্থাৎ পবিত্রতা, ক্রমবৃদ্ধি, আধিক্য ও প্রশংসা। যাকাতের পারিভাষিক অর্থ: আল্লাহ তা’য়ালার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে বিনা স্বার্থে শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত মালের একাংশ গরীব, মিসকীন ও অভাবী লোকদের মধ্যে বণ্টন করাকে যাকাত বলে। (দুররুল মুখতার)

শরীয়তের নির্ধারিত শর্তানুযায়ী নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে সম্পদের দেয় অংশকে পরিভাষিক অর্থে যাকাত বলে। (আল-ওয়াসীত ১/৩৯৬) আল্লামা আইনী বলেন: “নিসাব পরিমাণ মাল পূর্ণ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরে তার থেকে নির্ধারিত অংশ বনু হাশেম ব্যতীত দরিদ্রকে প্রদান। করাকে যাকাত বলে।” ইসলামী অর্থনীতির পরিভাষায় যাকাতের অর্থ হলো “ঋণ ও যাবতীয় প্রয়োজন নির্বাহের পর নিসাব পরিমাণ অর্থ কারো নিকট পূর্ণ এক বছর যাবত সঞ্চিত থাকলে তার চল্লিশ ভাগের একভাগ আল্লাহর নির্দেশিত পথে ব্যয় করা। কুরআনে যাকাত শব্দের ব্যবহার আল-কুরআনে যাকাত শব্দের ব্যবহার স্বতন্ত্রভাবে ৭ বার এসেছে। ‘সালাত কায়েম কর ও যাকাত দাও’ একথা একত্রে ২৫ বার এসেছে। (কুরআনের পরিভাষা: ১২৯)

পৃষ্ঠা:৮৫

যাকাত কখন ফরয হয়ঃ যাকাত কখন ফরয হয়েছে তা নিয়ে মতভেদ আছে। ইবনে খুজাইমার (র) মতেঃ হিজরতের পূর্বে মক্কায় যাকাত ফরয হয়। অধিকাংশ আলেমদের মতে মদীনায় হিজরতের পর যাকাত ফরয হয়েছে। তারিখে ইসলামীর গ্রন্থকারের মতে, ১ম হিজরীতে। ইমাম নববীর মতে, ২য় হিজরীতে। ইবনুল আছীরের মতে, ৯ম হিজরীতে যাকাত ফরয হয়। যাকাতের ধর্মীয় গুরুত্ব ও তাৎপর্য যাকাত ইসলামের পাঁচটি ভিত্তির অন্যতম ভিত্তি। যাকাত দেয়া ফরয। আল-কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে ঈমানের পরে যে দু’টি নেক আমলের কথা বার বার বলা হয়েছে তার একটি হল নামায অপরটি হলো যাকাত।

১. যাকাত দীনের স্তম্ভঃ নামায প্রকৃতপক্ষে মানুষকে আল্লাহর বান্দারূপে তৈরি করে তাঁর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে। আর যাকাত সমাজের অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করে। নামায মানুষের মধ্যে আল্লাহর আনুগত্য ও ভয়ের স্থায়ী অভ্যাস গড়ে তোলে। যাকাত দানের ফলে যাকাতদাতার আত্মত্যাগ ও স্বার্থ ত্যাগের পবিত্র ভাবধারা তাঁদের মন মেজাজে দৃঢ়মূল হয়ে যায়। দুনিয়ার দ্রব্য-সামগ্রী ও সুখ-সম্পদের লিঙ্গা কমে যায় এবং আল্লাহর সন্তোষ পাওয়ার আকাঙ্খা বৃদ্ধি পায়। (তাফহীম) সালাত ও যাকাত একত্রেই ফরয করা হয়েছে। আল্লাহর বাণীঃ “যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে, নামায কায়েম করেছে ও যাকাত আদায় করেছে, তাদের জন্য তাদের প্রভুর কাছে রয়েছে বিরাট প্রতিদান।” (সূরা আল-বাকারা: ২৭৭)। অপর এক আয়াতে বলা হয়েছে: وَاقِيمُوا الصَّلوةَ وَأَتُوا الزكوة. “তোমরা নামায কায়েম কর, যাকাত আদায় কর।” (সূরা আল-বাকারা: ৪৩)

এ কারণে ইবনে যায়েদ বলেন: افْتَرَضَتِ الصَّلوةُ وَالزَّكُوةُ جَمِيعًا لَّمْ يُفْرَقْ بَيْنَهُما. “নামায ও যাকাত একত্রে ফরয হয়েছে এবং এ দু’য়ের মাঝে কোনরূপ পার্থক্য করা হয়নি।”

পৃষ্ঠা:৮৬

২. যাকাত সকল নবীর দীনে ফরষ ছিল: মানব জাতির হিদায়াতের জন্য আল্লাহ যুগে যুগে যত নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন তাঁদের প্রত্যেকের সময় যাকাত কোন না কোনভাবে ফরয ছিল। আল্লাহ তা’য়ালায় বিশ্বাসী কোন জাতিকে এ দু’টি ইবাদত থেকে কখনই নিষ্কৃতি দেয়া হয়নি। আল- কুরআনে হযরত ইবরাহীম (আ) ও তাঁর বংশের অন্যান্য নবীগণকে সালাত ও যাকাত আদায়ের তাকীদ দিয়ে বলেন: “আমি তাঁদেরকে নেতা করলাম। তাঁরা আমার নির্দেশ অনুসারে পথ প্রদর্শন করতেন। আমি তাঁদের প্রতি ওহী নাযিল করলাম সৎকর্ম করার, নামায কায়েম করার এবং যাকাত আদায় করার। তাঁরা আমার ইবাদত করত ও হুকুম পালন করত।” (সূরা আম্বিয়া ঃ ৭৩) হযরত ইসমাঈল (আ) সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ “তিনি তাঁর লোকদেরকে নামায এবং যাকাত আদায় করার নির্দেশ দিতেন এবং তিনি তাঁর পালনকর্তার নিকট পছন্দনীয় ছিলেন।” (সূরা মারইয়াম ৪ ৫৫) হযরত ঈসা (আ)-কে যাকাত আদায় করার নির্দেশ প্রাপ্তির পর বলেন: “আল্লাহ আমাকে মহান করেছেন, যত দিন আমি জীবিত থাকব ততদিন নামায ও যাকাত আদায় করার জন্য আমাকে নির্দেশ করেছেন।”

৩. যাকাত দান নয়, গরীবের অধিকারঃ যাকাত ধনীদের পক্ষ থেকে গরীবের জন্যে কোন দান বা করুণা নয়। অধিকার। কেউ যাকাত প্রদান করার সময় ইহা আল্লাহ প্রদত্ত গরীবের একথা ধারণা করার কোন কারণ নেই যে, যাকাত দিয়ে সে অন্যের প্রতি মেহেরবানী করেছেন; তেমনিভাবে যিনি যাকাত গ্রহণ করার হকদার, তিনিও একথা মনে করার কোন কারণ নেই যে, যাকাতদাতা যাকাত দান করে তাকে করুণা করেছেন বরং তার মনোবল এরূপ থাকা চাই যে, আমার অধিকার আমাকে দিয়েছেন মাত্র। و فِي أَمْوَالِهِمْ حَقٌّ لِّلسَّائِلِ وَالْمَحْرُومِ. “তাদের সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে।” (সূরা যারিয়াত: ১৯)

৪. যাকাত হলো সম্পদের শোকর আদায়: প্রকৃত সম্পদের মালিক আল্লাহ। তিনি যাকে ইচ্ছা সম্পদ দান করেন আর যাকে ইচ্ছা দান করেন

পৃষ্ঠা:৮৭

না। যাকে এ সম্পদ দান করা হয় তার নিকট এ সম্পদ আমানতস্বরূপ। আর এ আমানতের শোকর আদায় হলো সম্পদের প্রকৃত মালিকের মর্জি মোতাবেক ব্যয় করা। ! مَا تُنْفِقُونَ إِلَّا ابْتِغَاءَ وَجْهِ اللَّهِ.

“তোমরা তোমাদের ধন-সম্পদ একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে ব্যয় কর।” (সূরা আল-বাকারাঃ ২৭২)  যে বেশী শোকর আদায় করবে আল্লাহ তাকে সম্পদ বৃদ্ধি করে দেবেন।  لَئِن شَكَرْتُمْ لا زيدَنَّكُمْ.

“যদি তোমরা শোকর আদায় কর, আমি তোমাদেরকে অধিক পুরস্কার দান করব।” (সূরা ইবরাহীমঃ ৭)

৫. যাকাত আল্লাহ প্রেমের বাস্তব পরীক্ষা: ‘যাকাত’ আদায় ফরয করে আল্লাহ তা’য়ালা প্রত্যেক ঈমানদার ব্যক্তিকে এক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন করেছেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর হুকুম মোতাবেক নিজের প্রয়োজনাতিরিক্ত সম্পদ থেকে যাকাত আদায় করে সে প্রকৃত ঈমানের পরিচয় দিয়ে থাকেন। আর যে ব্যক্তি যাকাত আদায় করে না প্রকৃতপক্ষে সে আল্লাহর হুকুম মানে না, যদিও সে নামায, রোযা তথা দৈহিক ইবাদতে নিজকে নিয়োজিত রাখুক না কেন। এ কারণে তার নামাযও কবুল করা হবে না। এ প্রসঙ্গে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বলেনঃ أمِرْتُمْ بِإِقَامَةِ الصَّلوةِ وَإِيتَاءِ الزَّكُوةِ وَمَنْ لَمْ يُرْكَ فَلَا صَلَوٰةَ لَهُ. “তোমাদেরকে নামায কায়েম ও যাকাত আদায় করার জন্য আদেশ দেয়া হয়েছে। কেউ যাকাত না দিলে তার নামায কবুল হবে না।” (তাফসীরে তাবারী ১৪ : ১৫৩ পৃঃ)

৬. হিদায়াত ও রহমতের অধিকারী হওয়া: যারা যাকাত আদায় করবে তারা আল্লাহর হিদায়াত ও রহমতের অধিকারী হবে। “যারা সালাত কায়েম করে, যাকাত আদায় করে এবং আখিরাতের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখে, এসব লোক তাদের রবের পক্ষ থেকে হিদায়াতের পথে রয়েছে এবং এরাই সফলকাম। (সূরা লোকমান: ৪-৫)

পৃষ্ঠা:৮৮

৭. যাকাত-আদায়ে সম্পদ বৃদ্ধি পায়: যাকাত আদায়ে সম্পদ কমে না বরং বৃদ্ধি পায় وَمَا آتَيْتُمْ مِّنْ زَكُوةٍ تُرِيدُونَ وَجْهَ اللَّهِ فَأُوْلَئِكَ هُمُ الْمُضْعِفُونَ “আর আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য তোমরা যে যাকাত দাও, মূলতঃ এ যাকাত দানকারীরাই তাদের অর্থ বৃদ্ধি করে।” (সূরা আররূম: ৩৯)

৮. যাকাত না দেয়ার পরিণতি: যাদের উপর যাকাত ফরয হয়, তারা যদি তা যথাযথ নিয়মে আদায় না করে, তাহলে আল্লাহ তা’য়ালা দুনিয়া ও পরকালে তাদেরকে কঠোর শাস্তিতে নিপতিত করবেন।

(ক) পরকালীন শান্তি “যারা স্বর্ণ এবং রৌপ্য সঞ্চয় করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে খরচ করে না, তদেরকে কঠিন শাস্তির সুসংবাদ দাও।” (সূরা আত-তাওবা: ৩৪) “সে দিন জাহান্নামের আগুনে তা (সঞ্চিত সম্পদ) উত্তপ্ত করা হবে এবং তার দ্বারা তাদের ললাটে, পার্শ্ব ও পৃষ্ঠদেশকে দগ্ধ করা হবে এবং (সে দিন বলা হবে) এগুলো (সে সম্পদ) যা তোমরা নিজেদের জন্যে জমা রেখেছিলে, সুতরাং এখন সঞ্চিত সম্পদের আস্বাদ গ্রহণ কর।” (সূরা আত-তাওবা: ৩৫)

(খ) বৈষয়িক শান্তি যারা যাকাত আদায় করবে না, তাদের পরকালীন শাস্তির সাথে সাথে বৈষয়িক শান্তির ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে হযরত আয়েশা (রা) বলেন: “আমি রাসূল (সা)-কে বলতে শুনেছি, যে সম্পদের সাথে যাকাতের সংমিশ্রণ ঘটে তা সম্পদকে ধ্বংস করে দেয়।” (মিশকাত) ولا مَنْعَ فِي الزَّكُوةِ إِلَّا حُبِسَ عَنْهُمُ الْمَطَرُ. “যে জাতি যাকাত দেয় না, তাদের উপর বৃষ্টিপাত বন্ধ করে দেয়া হয়।” “হুল ও জলভাগে যে ধন-সম্পদ নষ্ট হয় তা শুধু যাকাত বন্ধ করার দরুন।” (মুজমাউল জাওয়ায়েদ)

পৃষ্ঠা:৮৯

(গ) যাকাত না দেয়ার শরয়ী শাস্তি যে ব্যক্তি যাকাত আদায় করতে অস্বীকার করবে তার থেকে শক্তি প্রয়োগ করে অর্ধেক সম্পত্তি গ্রহণ করা যাবে। ইহা হচ্ছে যাকাত না দেয়ার শরয়ী শান্তি। মহানবী (সা) বলেনঃ “কেউ যদি আল্লাহর পুরস্কারের আশায় যাকাত দেয়, তাহলে তাকে পুরস্কৃত করা হবে। কিন্তু যে যাকাত দিতে অস্বীকার করবে, তার কাছ থেকে শক্তি প্রয়োগ করে যাকাত আদায় করতে হবে এবং আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী তার অর্ধেক সম্পত্তিও নিয়ে নেয়া হবে।” (আহমাদ, নাসায়ী ও বায়হাকী) যাকাতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্বইসলাম মানবতার ধর্ম। মানবতার সেবা ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যই যাকাতের বিধানকে ফরয করা হয়েছে। সম্পদ যাতে সমাজের কতিপয় লোকদের মাঝে কুক্ষিগত হয়ে না থাকে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন: كي لا يَكُونَ دُولَةً بَيْنَ الْأَغْنِيَاءِ مِنْكُمْ. “তোমাদের মধ্যকার গুটি কয়েকের নিকট যেন সম্পদ কুক্ষিগত না থাকে।” (সূরা হাশর: ৭)

১. যাকাত সামাজিক কল্যাণ সাধন করেঃ যাকাত সমাজের জনহিতকর ও সমাজ কল্যাণমূলক কাজ করে সমাজে আর্তমানবতার সেবা করে।

২. যাকাত ইসলামী অর্থনীতির মূল ভিত্তিঃ যাকাত ইসলামী অর্থনীতির মূলভিত্তি। যাকাত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সুদৃঢ় করে।

৩. যাকাত নৈতিক চরিত্রের উন্নয়ন সাধন করে: যাকাত ব্যবস্থা মানুষের নৈতিক চরিত্রের উন্নয়ন সাধন করে। মানুষের স্বভাব জাত ধর্ম হলো সে বেশী বেশী পেতে চায়। যাকাত আদায় করার মাধ্যমে যাকাতদাতার স্বার্থ ত্যাগ ও কার্পণ্যতা দূর করে নৈতিক চরিত্রের উন্নয়নে বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

৪. যাকাত সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করে: যাকাত হচ্ছে অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তার প্রধান ভিত্তি। রাসূল (সা)

পৃষ্ঠা:৯০

যাকাত ব্যবস্থা কায়েমের মাধ্যমে সমাজ থেকে দারিদ্র্যতা দূর করতে সক্ষম হয়েছেন।

৫. যাকাত সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করে: রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো সকল অবৈধ উপার্জন বন্ধ করে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আর যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা যায়।

৬. অর্থনৈতিক বৈষম্যজনিত বিদ্রোহের সম্ভাবনা থাকে নাঃ যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে নিজের সম্পদে অপরের হক আছে বলে স্বীকার করায় সে হক আদায় করতে সক্ষম হয়। ফলে এতে ধনী-গরীবের দূরত্ব কমে যায়। তখন আর ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যের কারণে অর্থনৈতিক বিদ্রোহের সম্ভাবনা থাকে না।

৮. যাকাত পরস্পরের মধ্যে সম্প্রীতি সৃষ্টি করে: যাকাত আদায় করার মাধ্যমে যাকাতদাতা ও গ্রহীতার মধ্যে দূরত্ব কমে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সহানুভূতি সৃষ্টি হয়।

৯. যাকাত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে: সম্পদের প্রতি বছর যাকাত দিতে হয় বলে ধনীলোক তার সম্পদকে বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি আনয়নের চেষ্টা অব্যাহত রাখে। যদি তা না করে, যাকাত দিতে দিতে একদিন সম্পদ নিঃশেষ হয়ে যাবে। রাসূল (সা) এ ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছেন, “তোমাদের সম্পদগুলো যাকাত যেন খেয়ে না ফেলে।”

১০. যাকাত অর্থনীতিতে স্থায়িত্ব বিধান করেঃ যাকাত দানে সম্পদ বৃদ্ধি পায়, স্থায়িত্ব লাভ করে ও ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়। যাকাত সঠিকভাবে আদায় না করলে সম্পদ ধ্বংস হয়ে যায়। যাকাত আদায়ের ব্যবস্থাপনা: যাকাতভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থা চালু করা ইসলামী সরকারের অন্যতম দায়িত্ব। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করা হয়েছে: الَّذِينَ إِن مكنهم فِي الْأَرْضِ أَقاموا الصلوة وآتوا الزكوة وأمرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ

কবিতা ৯১ থেকে ১০৫

পৃষ্ঠা:৯১

“যখন আমরা তাদেরকে ক্ষমতা দান করি তখন তারা সালাত কায়েম করে, যাকাত আদায় করে, সৎ কাজের আদেশ এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করে।” (সূরা আল-হাজ্জঃ ৪১) যাকাত সংগ্রহ করা ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্বঃ সমগ্র দেশের যাকাত ইসলামী রাষ্ট্র তার কর্মচারীর মাধ্যমে আদায়ের ব্যবস্থা করবে ও হকদারদের মধ্যে তা বিতরণ করবে। কোন ব্যক্তির এ অধিকার থাকবে না যে, সে ইসলামী হুকুমাতের নিকট যাকাত দিতে অস্বীকার করবে। কেউ যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যাকাত আদায় করে সে পুরস্কার পাবে আর যে যাকাত দিতে অস্বীকার করবে, সরকার তার কাছ থেকে শক্তি প্রয়োগ করে যাকাত আদায় করবে। যাকাত ফরযের হিকমত বা রহস্য ইসলামী শরীয়তের যে কোন বিধান প্রবর্তনের পিছনে কোন না কোন হিকমত বা রহস্য নিহিত রয়েছে। যাকাতের বিধানের মধ্যে কতিপয় রহস্য নিহিত আছে। নিম্নে তা পেশ করা গেল।

১. যাকাত সমাজ থেকে দারিদ্রদ্র্যতা দূর করে।

২. অভাব মুক্ত ইসলামী সমাজ গঠন করে।

৩. রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক ভারসাম্যতা রক্ষা করে।

৪. যাকাতদাতার আধ্যাত্মিক পবিত্রতা অর্জিত হয়।

৫. যাকাতের মাধ্যমে সমাজে সম্পদের প্রবৃদ্ধি ঘটে।

৬. যাকাত সম্পদের পবিত্রতা বিধান করে।

৭. যাকাত ধনী-দরিদ্রের মধ্যে সম্প্রীতি সৃষ্টি করে।

৮. যাকাত মানুষের মধ্যে সম্পদ ব্যয় করার অভ্যাস সৃষ্টি করে।

৯. বিত্তশালীর মধ্যে সামাজিক দায়িত্ববোধ জাগ্রত করে।

১০. যাকাতদাতার সামাজিক মর্যাদা সৃষ্টি হয়।

১১. যাকাতদাতার লোভ-লালসা সংবরণ করে।

১২. আল্লাহর নি’য়ামতের শোকরিয়া আদায় হয়।

পৃষ্ঠা:৯২

১৩. সম্পদে আল্লাহর একচ্ছত্র মালিকানা স্বীকার করা হয়।

১৪. যাকাত মানুষের অন্তরে খোদাভীতি সৃষ্টি করে।

১৫. যাকাত ধনবানকে অহংকারমুক্ত রাখে।

১৬. আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালের মুক্তির পথ উন্মুক্ত করে।

শিক্ষা

১। ধনীদের সম্পদে যাকাত ফরয করা হয়েছে।

২। যাকাত আদায় না করলে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে।

৩। শ’রয়ী বিধান মোতাবেক যাকাত আদায় করতে হবে।

পৃষ্ঠা:৯৩

দারস-১০ দাওয়াত: عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ (رض) أَنَّ رَسُولَ اللهِ (صلعم) قَالَ مَنْ دَعَا إِلَى هُدًى كَانَ لَهُ مِنَ الْأَجْرِ مِثْلُ أَجُورٍ مَنْ تَبِعَهُ لَا يَنْقُصُ ذَالِكَ مِنْ أُجُورِهِمْ شَيْئًا وَمَنْ دَعَا إِلَى ضَلَالَةٍ كَانَ عَلَيْهِ مِنَ الْإِثْمِ أَيَّامُ مَنْ تَبِعَهُ لَا يَنْقُصُ ذالِك مِنْ أَيَّامِهِمْ شَيْئًا. (مسلم)

অর্থ : হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। রাসূল (সা) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি সত্যের দিকে ডাকে তার জন্য সত্যের অনুসারীদের বিনিময়ের সমান বিনিময় রয়েছে। এতে তাদের বিনিময় কিছু কম হবে না। আর যে ভ্রান্ত পথের দিকে আহ্বান করে, তার জন্য উক্ত পথের অনুসারীদের সমান পাপ হতে থাকবে। এদের মধ্যে তাদের অনুসারীদের পাপ কিছু মাত্র কম হবে না। (মুসলিম)

শব্দার্থ: )عن ابي هريرة (رض: হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। )أن رسول الله (صلعم : নিশ্চয় রাসূল (সা)। قال: তিনি বলেন। من: যে ব্যক্তি। ১: আহ্বান করে। : দিকে। هدى : সত্য পথ। كان : ছিল। : তার জন্য। بن: হতে। الأجْرُ : প্রতিদান। مثل : পরিমাণ। أجور : প্রতিদানসমূহ। : যে ব্যক্তি। تبعه : তার অনুসরণ করে। لا ينقص : কম হবে না। ذاك: ইহা : أجورهم তার প্রতিদান। يْئً বস্তু। ومن: এবং যে ব্যক্তি। ৬১: আহ্বান করে। إلى : দিকে। ضلالة : ভ্ৰান্ত পথ। كان : ছিল। عَلَيْهِ : তার দিকে। بن الإثم : গুনাহ হতে। آثام: গুনাহসমূহ (বহুবচন)। ان  অনুসরণ করে। لا ينقص : কম হবে না। ذالك : ইহা من شَيْئًا : তার গুনাহ থেকে কোন বস্তু।

পৃষ্ঠা:৯৪

ব্যাখ্যাঃ আলোচ্য হাদীসখানায় সত্যের প্রতি আহ্বানের প্রতিদানের কথা তুলে ধরা হয়েছে। সত্য পথের দিকে মানুষকে যে ডাকবে সে ঐ পরিমাণ সওয়াব পাবে, সত্য পথে আহ্বানের কারণে তার আহ্বানকৃত ব্যক্তি যে পরিমাণ সৎ কাজ করবে। এতে ঐ ব্যক্তির সওয়াব কোন অংশে কম হবে না যে সত্য পথের অনুসারী হবে। অপর এক হাদীসে কথাটি এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। مَنْ دَلْ عَلَى خَيْرٍ فَلَهُ أَجْرٍ فَاعِلِهِ. “যে ব্যক্তি সৎ পথ দেখাবে তার জন্য প্রতিদান রয়েছে সে ব্যক্তির মত, যে সৎকাজটি করল।” (মুসলিম শরীফে, আবু মাসউদ ওকবা ইবনে ওমর (রা) হতে বর্ণিত) হিদায়াতের প্রতি আহ্বান এর অর্থ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা)-এর পথে, কুরআনের পথে আহ্বান। এটা সত্যের পথ, সঠিক পথ। এপথ ছাড়া অন্য পথে ডাকার কোন অধিকার কারও নেই। আর যে ব্যক্তি ভ্রান্ত পথে মানুষকে ডাকবে সে ঠিক ঐ পরিমাণ পাপ কাজের গুনাহগার হবে, ভ্রান্ত পথে আহ্বানের কারণে তার আহ্বানকৃত ব্যক্তি যে পরিমাণ পাপ কাজ করবে। ভ্রান্ত পথ অর্থ ইসলামী আদর্শ বিরোধী পথ। যে মানুষকে ভ্রান্ত পথে ডাকে সে জাহান্নামের অধিবাসী। مَنْ دَعَا بِدَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ فَهُوَ مِنْ جُنَّيْ جَهَنَّمَ وَإِنْ صَامَ وَصَلَّى وَزَعَمَ أَنَّهُ مُسْلِمٌ. “যে ব্যক্তি জাহিলিয়াতের (ইসলামী আদর্শ বিরোধী) নিয়ম-নীতির দিকে আহ্বান জানায়, সে জাহান্নামী হবে। যদিও সে রোযা রাখে, নামায পড়ে এবং নিজকে মুসলিম বলে দাবী করে।” (মুসনাদে আহমদ, তিরমিযী, হযরত হারেসুল আশয়ারী (রা) হতে বর্ণিত) গ্রন্থ পরিচিতি: আলোচ্য হাদীসখানা মুসলিম শরীফ থেকে নেয়া হয়েছে। এ গ্রন্থের পরিচয় ৩নং দারসে উল্লেখ করা হয়েছে।

পৃষ্ঠা:৯৫

রাবী পরিচিতিঃ এ হাদীসখানা হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। হযরত আবু হুরায়রা (রা)-এর পরিচয় ৪নং দারসে আলোচনা করা হয়েছে।

৬. দাওয়াত অর্থঃ ‘দাওয়াত’ )دعوة( আরবী শব্দ। এর মূল ধাতু )دعا(- এর অর্থ হচ্ছে ডাকা, আহ্বান করা, আমন্ত্রণ জানানো। আর পারিভাষিক অর্থে আল্লাহর দীনের পথে আহ্বান করাকে দাওয়াত বলে। দাওয়াতের লক্ষ্যঃ দাওয়াতের লক্ষ্য হলো প্রত্যেক বনী আদমের কাছে আল্লাহর বাণী পৌঁছে দেওয়া। যাতে মানুষ আল্লাহর হুকুম পালনে এগিয়ে আসতে পারে। দাওয়াতের উদ্দেশ্যঃ দাওয়াতে হকের উদ্দেশ্য “আল্লাহর বান্দাদের জীবন ও কার্যক্রম সংশোধন করা।” (সূরা আবাসা টীকা, ২. তাফহীমুল কুরআন)

দাওয়াতের মূলনীতি: দাওয়াতের মূলনীতি দু’টি। যথাঃ

১. হিকমত;

২. উপদেশ। (তাফসীরে রুহুল-মা’আনী)

দাওয়াত দেয়ার পদ্ধতিঃ বর্তমান যুগের চাহিদা মোতাবেক প্রযুক্তিগত বিষয় বিবেচনা করে বিভিন্ন উপায়, উপকরণ ও পদ্ধতির মাধ্যমে দাওয়াতের কাজ করা যেতে পারে। দাওয়াতে দীনের কাজ প্রধানতঃ তিন ভাবে করা যায়। যথাঃ

১. দীনি উপদেশের মাধ্যমে;

২. ইসলামী বই-পুস্তক রচনা ও প্রচারের মাধ্যমে;

৩. শিক্ষাদানের মাধ্যমে।

১. দীনি উপদেশের মাধ্যমে

ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে উপদেশের মাধ্যমে দীনের দাওয়াত দেয়া প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর উপর ফরয। এ কাজ না করলে ব্যক্তি নিজে ব্যক্তিগতভাবে ও সমাজের লোকেরা সমষ্টিগতভাবে দায়ী থাকবেন। এ পর্যায়ে দাওয়াতকে দু’ভাগ করা যায়। যথা:

ক. ব্যক্তিগত দাওয়াত, খ. সমষ্টিগত দাওয়াত।

পৃষ্ঠা:৯৬

দাওয়াতদাতার গুণাবলী: আল্লাহর মনোনীত দীনকে প্রতিষ্ঠার জন্য দুনিয়াতে অসংখ্য নবী-রাসূল এসেছেন। দুনিয়াতে যত নবী-রাসূল এসেছেন তাদের সকলকেই দীনের এ কঠিন দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। ইহা একটি মহান ও পবিত্র দায়িত্ব। কাজেই এ দায়িত্ব পালন করতে হলে তাদেরকে বেশ কিছু গুণ অর্জন করতে হয়। নিম্নে তা উল্লেখ করা গেল।

১. ইলমের অধিকারী হওয়াঃ ব্যক্তি যে মহাসত্যের প্রতি মানুষকে আহ্বান করবেন, সে সম্পর্কে তার পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকতে হবে। যেহেতু তিনি আল্লাহর দীনের প্রতি মানুষকে আহ্বান করবেন তাই তাকে কুরআন হাদীস গভীরভাবে অধ্যয়ন করে আল্লাহর দীন সম্পর্কে জানতে হবে এবং সমকালীন বিশ্বের অন্যান্য বিষয় সম্পর্কেও সম্যক ধারণা রাখতে হবে।

আল্লাহর বাণী: “তাদের প্রত্যেক গোত্র থেকে একদল লোক দীন ও জ্ঞান- বিজ্ঞান সম্পর্কে জানার জন্য কেন বের হয় না, যাতে করে তারা নিজ নিজ গোত্রে ফিরে এসে সতর্ক করতে পারে, তখন সম্ভবত তাদের গোত্রের লোকেরা সাবধান হতে পারবে।” (সূরা আত-তওবা: ১২২)

২. ইল্ম অনুযায়ী আমল করাঃ দাওয়াত দানকারী যে মহাসত্যের প্রতি মানুষকে আহ্বান করবেন সে আদর্শ অবশ্যই তাকে গ্রহণ করতে হবে। ব্যক্তিগত জীবনের সকল কাজ-কর্ম, লেন-দেন ইত্যাদির মাধ্যমে সে আদর্শের বাস্তব নমুনা পেশ করতে হবে। নিজের জীবনে আমল না করে অপরকে সে বিষয়ে উপদেশ দেয়ার কোন নৈতিক অধিকার থাকতে পারে না এবং তা ফলপ্রসূ হতে পারে না। আল্লাহর বাণী: اتَأْمُرُونَ النَّاسَ بِالْبِرِّ وَتَنْسَوْنَ انْفُسَكُمْ وَانْتُمْ تَتْلُونَ الْكِتَابَ. “তোমরা মানুষকে সৎকাজের আদেশ কর আর নিজেরা তা ভুলে থাক। অথচ তোমরা কিতাবও পাঠ কর।” (সূরা বাকারা: ৪৪) لمَ تَقُولُونَ مَا لَا تَفْعَلُونَ. كَبُرَ مَقْتًا عِنْدَ اللَّهِ أَنْ تَقُولُوا مَا لَا تَفْعَلُونَ. “তোমরা এমন কথা কেন বল? (অপরকে উপদেশ দাও) যা তোমরা করো

পৃষ্ঠা:৯৭

না। এটা আল্লাহর নিকট বড়ই ঘৃণার বিষয় যে, তোমরা যা বলবে তা করবে না।” (সূরা আস-সফ: ২-৩)

৩. সবর বা ধৈর্যশীল হওয়াঃ দীনি দাওয়াতের জন্য সবরের প্রয়োজন। যুগে যুগে যারাই এ কাজ করেছে তাদের উপরই অত্যাচার ও নির্যাতন নেমে এসেছে। সবর ছাড়া এ পথে টিকে থাকা যায় না। আল্লাহর বাণী: يأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اصْبِرُوا وَصَابِرُوا. “হে ঈমানদারগণ! তোমরা সবর কর এবং সবরের প্রতিযোগিতা কর।” (সূরা আলে-ইমরান: ২০০) فَاصْبِرْ صَبْرًا جَمِيلا. “অতএব (হে মুহাম্মদ) সবর করো, সবরে জামীল।” (সূরা আল-মারানিজ: ৫)

৪. স্পষ্টভাষী হওয়াঃ দাওয়াত দাতাকে স্পষ্টভাষী হতে হবে। যাতে তার বক্তব্য সকলে অনায়াসে বুঝতে পারে। ভাষার মার-প্যাচ পরিহার করতে হবে। সাবলীল ভাষায় বক্তব্য পেশ করতে হবে। ভালভাবে বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য আল্লাহর কাছে দু’আ করতে হবে।

৫. কৌশল ও যুক্তি প্রয়োগ করা: মানুষের নিকট দীনের দাওয়াত দিতে হবে উত্তম পদ্ধতিতে। বর্তমান বিজ্ঞানের যুগে কোন অযৌক্তিক উপস্থাপনা দীনি কাজকেই শুধু ক্ষতিগ্রস্থ করে না বরং মানুষকে আল্লাহর দীন থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। তাই দাওয়াত হতে হবে সত্য, যেখানে যুক্তির প্রাধান্য থাকবে বেশী। আর ভাষা হবে হৃদয়গ্রাহী। আল্লাহর বাণী: ادع إلى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هي احسن. “তোমার প্রতিপালকের দিকে আহ্বান কর বুদ্ধিমত্তা ও উত্তম উপদেশের মাধ্যমে এবং তাদের নিকট উন্নত যুক্তি পেশ কর।” (সূরা নহল: ১২৫)

৬. শ্রোতার বুদ্ধিমত্তার প্রতি দৃষ্টি রাখা: দাওয়াতদাতার বক্তব্য উপস্থাপনের সময় শ্রোতাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বিবেচনা করে বক্তব্য পেশ করতে

পৃষ্ঠা:৯৮

হবে। সাধারণ লোকদের সমাবেশে সুধী সমাবেশের যোগ্য বক্তৃতা যেমন উলুবনে মুক্তা ছড়ানো, তেমনি সুধী সমাবেশে জ্ঞান গাম্ভীর্যহীন হালকা বক্তব্য দাওয়াতের মূল উদ্দেশ্য ব্যর্থ করবে। সুতরাং প্রচারকার্য আরম্ভ করার আগে দাওয়াতদাতাকে শ্রোতাদের বুদ্ধিমত্তার মাত্রা অবশ্যই বিবেচনায় আনতে হবে। হাদীস শরীফে বর্ণিত আছেঃ وَاضِعُ الْعِلْمَ عِنْدَ غَيْرِ أَهْلِهِ كَمُقَادِ الْخَتَارِيرِ الْجَوَاهِرَ وَاللُّؤْلُؤُ وَالذَّهَبَ. “অপাত্রে জ্ঞান দান করা শুকরের গলায় মনিহার পদ্মানোর শামিল।” (ইবনে মাজাহ)

৭. বল প্রয়োগে বিরত থাকাঃ কোন অবস্থাতেই শ্রোতাদের ওপর বল প্রয়োগ করে দীনি দাওয়াত কবুল করার চাপ সৃষ্টি ইসলামসম্মত কোন কাজ নয়। বল প্রয়োগ বলতে শুধু দৈহিক শক্তিই বুঝায় না। বরং প্রতিকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে অথবা কৌশলে দূরাবস্থায় ফেলে ধর্মান্তর করা?ও বল প্রয়োগের পর্যায়ে পড়ে। ইহা কোন স্থায়ী ফল বয়ে আনে না। ইসলাম মানুষের মনকে জয় করেই মনের গহীনে স্থান করে নিতে চায় যেখান। থেকে কোন দিন ইসলাম দূরীভূত হবে না। এ প্রসঙ্গে কুরআনের বাণী: لا إكراه في الدين. “দীনের ব্যাপারে জোর-জবরদস্তি নেই।” (সূরা আল-বাকারা: ২(৫৬)

৮. পরিবেশ-পরিস্থিতি বুঝে দাওয়াত দেয়া: দাওয়াতদাতাকে অবশ্যই পরিবেশ-পরিস্থিতি ও শ্রোতার মনোভাবের প্রতি লক্ষ্য রেখে দাওয়াত দিতে হবে। শ্রোতার অমনোযোগী অবস্থায়, অসময়ে, দীর্ঘ সময়াক্ষেপণ করে ও বিরূপ পরিবেশে দাওয়াত পেশ করলে তা ফলপ্রসূ হয় না।

৯. মূল বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া: দাওয়াতের মূল টার্গেট হবে এক আল্লাহর প্রতি আহ্বান। পুরোপুরি যুক্তি সংগত ও বাস্তব সত্যভিত্তিক কথা বলা। (সূরা ফাতিরের বিষয় বস্তু তাফহীম) এ লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজনে সমসাময়িক অবস্থা তুলে ধরা যেতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনায় আনতে হবে এবং তা ১১৪ দারসে হাদীস

পৃষ্ঠা:৯৯

পুনরাবৃত্তি করতে হবে। রাসূল (সা) তাঁর ভাষণে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে তিনবার উচ্চারণ করতেন। দাওয়াত দানের পন্থা এক ব্যক্তি যেমন একজনকেও দাওয়াত দিতে পারেন, তেমনি একাধিক ব্যক্তিকেও দাওয়াত দিতে পারেন। সমষ্টিগতভাবে একাধিক ব্যক্তি এক ব্যক্তির কাছেও দাওয়াত পেশ করতে পারেন, তেমনিভাবে একাধিক ব্যক্তির কাছেও দাওয়াত পেশ করতে পারেন। এক্ষেত্রে বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করা যায়। যথা:

১. গণপ্রচার মাধ্যম ব্যবহার: বর্তমান বিজ্ঞানের চরম উন্নতির যুগে দীনের

প্রচার ও প্রসারের জন্যে বেতার, টেলিভিশন, ভিডিও, অডিও, সিডি ও সিনেমাসহ প্রভৃতি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গণপ্রচার মাধ্যম ব্যবহার করে ব্যাপকভাবে কাজ করা যায়। এ পদ্ধতি জনগণের হৃদয়গ্রাহী ও খুবই আকর্ষণীয় হয়।

ক. ওয়াজ-মাহফিল ও সভা সমিতির মাধ্যমেঃ মসজিদ-মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন স্থানে ওয়ায-মাহফিল ও সভা সমিতির মাধ্যমে ব্যাপক দাওয়াতে দীনের কাজ করা যায়।

খ. সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমেঃ ইসলামের বিভিন্ন বিষয় ও বিভাগের উপর সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও সমকালীন মুসলিম বিশ্ব পরিস্থিতি তুলে ধরে বক্তব্য প্রদান করলে উচ্চ শিক্ষিত জ্ঞানী-গুণী লোকদেরকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করা যেতে পারে।

গ. পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকী প্রকাশের মাধ্যমেঃ পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকী প্রকাশের মাধ্যমে ইসলামের সুমহান আদর্শ জনগণের সম্মুখে উপস্থাপন করা। এতে সহজে দীনের দাওয়াত মানুষের কাছে পৌঁছানো যায় ও দ্রুত ইসলামের প্রসার ঘটে।

ঘ. সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান: অপসংস্কৃতি রোধকল্পে সুস্থ ও ইসলামী সংস্কৃতি চালু করার লক্ষ্যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দারসে হাদীস ১১৫

পৃষ্ঠা:১০০

মাধ্যমে ব্যাপকভাবে দীনের কাজ করা যায়। এতে অনায়াসে মানুষ দীনের প্রতি আকৃষ্ট হয়।

২. ইসলামী বই-পুস্তক রচনা ও প্রচারের মাধ্যমে : কুরআনের

তাফসীর, হাদীসের অনুবাদ, ইসলামের বিভিন্ন বিষয়াদির উপর সহজ ও সরল ভাষায় ইসলামী বই-পুস্তক রচনা ও প্রচারের মাধ্যমে দাওয়াতে দীনের ব্যাপক কাজ করা যায়। ইহা উত্তম ও স্থায়ী পদ্ধতি। এ লক্ষ্য বাস্ত। বায়নের জন্য নিম্নের পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন:

ক. ব্যক্তিগতভাবে বই সঙ্গে রাখা ও অপরকে পড়ানো।

খ. ইসলামী পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা।

গ. বই বিক্রয় কেন্দ্র গড়ে তোলা।

ঘ. ব্যক্তিগতভাবে বই বিক্রয় করা।

শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমেঃ শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা ছাড়া জাতির কোন উন্নতি নাই। যে জাতি নৈতিক দিক দিয়ে যত উন্নত তারাই প্রকৃতপক্ষে শক্তিশালী। মুসলমানেরা একদিন সারা দুনিয়ায় নেতৃত্ব করেছে নৈতিকতার বলেই। তাই জাতিকে নৈতিক বলে বলিয়ান করতে হলে শিক্ষা ব্যবস্থার আদর্শিক পরিবর্তন ছাড়া কোন বিকল্প নেই। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য দেশের সকল স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও ইউনিভার্সিটিসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে। তবেই কেবল সৎ, যোগ্য ও আদর্শ নাগরিক সৃষ্টি করা সম্ভব হবে।

শিক্ষা

১। আল্লাহর দিকে দাওয়াত দান করা ফরয।

২। হিকমতের সাথে দাওয়াতী কাজ করা উচিত।

৩। যে সৎ পথের দিকে আহ্বান করবে, সে অবশ্যই তার প্রতিদান পাবে।

৪। যে অসৎ পথে আহ্বান করবে, সে অবশ্যই তার শাস্তি ভোগ করবে।

৫। যে ব্যক্তির কারণে মানুষ গোমরাহ হবে, সে তার জন্য দায়ী থাকবে।

১১৬ দারসে হাদীস

পৃষ্ঠা:১০১

দারস-১১ ইসলামী আন্দোলন: عَنْ حُذَيْفَةَ (رض) أَنَّ النَّبِيُّ (صلعم) قَالَ وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَتَأْمُرُنَ بِالْمَعْرُوفِ وَلَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ أَوْ لَيُؤْشِكَنَّ اللَّهُ أَنْ يُبْعَثَ عَلَيْكُمْ عَذَابًا  مِّنْ عِنْدِهِ ثُمَّ لَتَدْعُنْهُ فَلَا يُسْتَجَابُ لَكُمْ. (ترمذی) অর্থঃ হযরত হুযাইফা (রা) হতে বর্ণিত। নবী করীম (সা) ইরশাদ করেছেনঃ আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, যার নিয়ন্ত্রণে আমার জীবন। অবশ্যই তোমরা সৎ কাজের নির্দেশ দিবে এবং অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে লোককে বিরত রাখবে। নতুবা তোমাদের ওপর শীঘ্রই আল্লাহ আযাব নাযিল করে শাস্তি দিবেন। অতঃপর তোমরা তা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য দু’আ করতে থাকবে কিন্তু তোমাদের দু’আ কবুল হবে না। (তিরমিযী)

শব্দার্থ: )عَنْ حُذَيْفَةَ (رض : হযরত হুযাইফা (রা) হতে বর্ণিত। ان )النبي (صلعم : নবী করীম (সা) থেকে। الَ তিনি বলেন। وَالَّذِي : সে সত্তার শপথ। نبی : আমার জীবন। بی: যার হাতে। لَتَأْمُرُن : তোমরা অবশ্যই আদেশ করবে। المعروف: সৎ কাজ : وَلَتَنْهَوُنُ : অবশ্যই নিষেধ করবে। الْمُكْرُ : অন্যায় কাজ। لَيُؤْشِكَنْ : তিনি অবশ্যই শাস্তি দিবেন। أَنْ يَبْعَثَ : তিনি পাঠাবেন। عَلَيْكُمْ: তোমাদের উপর। عَذَابًا : শান্তি, আযাব। مِنْ : হতে। عنده : তার নিকট থেকে। ثم : অতঃপর تَدْعُون : তোমরা দু’আ করবে। لا يُسْتَجابُ : সাড়া দেয়া হবে না, কবুল করা হবে না। لكم: তোমাদের।

ব্যাখ্যা: অত্র হাদীসখানায় ইসলামী আন্দোলনের গুরুত্ব তথা ন্যায় বা ভাল কাজের আদেশ এবং অন্যায় ও পাপ কাজের প্রতিরোধ করার তাকিদ

পৃষ্ঠা:১০২

প্রদান করা হয়েছে। ইসলামের সুমহান আদর্শের ভিত্তিতে কোন সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করতে হলে সেখানে সর্বপ্রথম মানুষের মন-মগজে ইসলামের সঠিক ধারণা সৃষ্টি করার লক্ষ্যে ইসলামী আন্দোলনের সূচনা করতে হবে। আর এটা হলো মু’মিন জীবনের মিশন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন: “তোমরাই সর্বোত্তম দল, তোমাদেরকে মানুষের হিদায়াত ও সংস্কারের জন্য কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত করা হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের আদেশ দিবে এবং অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখবে।” এ দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হলে আল্লাহ তা’য়ালা আযাব নাযিল করে তোমাদের শান্তি দেবেন। সে সময় যদি দু’আ করা হয় সে দু’আ আল্লাহর কাছে গ্রহণ যোগ্য হবে না। তাতে আযাব থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না। গ্রন্থ পরিচিতি: আলোচ্য হাদীসখানা তিরমিযী শরীফ থেকে নেয়া হয়েছে। এ গ্রন্থের পরিচিতি ২নং দারসে উল্লেখ করা হয়েছে।

রাবী পরিচিতি; নামঃ হুযাইফা (রা)। উপনাম: আবু আবদুল্লাহ। উপাধী: সীররুন্নবী। পিতার নামঃ হুসাইল জন্মস্থান: ইয়ামেনে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ইয়ামেনের অধিবাসী ছিলেন। এ কারণে তাঁকে আল-ইয়ামেনী বলা হয়। তাই হুযাইফা (রা) হুযাইফা ইবনু হুসাইল থেকে হুযাইফা ইবনুল ইয়ামেনী নামে বেশী প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। পিতা ও পুত্র উভয়েই একত্রে ইয়ামেন থেকে মদীনায় আগমন করে রাসূল (সা)-এর কাছে ইসলাম গ্রহণ করেন। অনেক সাহাবী ও তাবেয়ী তাঁর কাছ থকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। বিশেষত্বঃ হযরত হুযাইফা (রা)-কে সীররুন্নবী বলা হয়। কারণ, তিনি নবী করীম (সা)-এর গোপন তথ্যের আধার ছিলেন। রাসূল (সা) সকল গোপন কথা তাঁর কাছে ব্যক্ত করতেন। মৃত্যুঃ তিনি ৩৫ হিজরীতে মাদায়েন শহরে মৃত্যুবরণ করেন। সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়। কারো কারো মতে, তিনি হযরত ওসমান (রা)-এর শাহাদাতের ৪০ দিন পর ৩৬ হিজরীতে ইনতিকাল করেন।

১১৮ দারসে হাদীস

পৃষ্ঠা:১০৩

ইসলামী আন্দোলন: আল্লাহর যমীনে আল্লাহর দীন বিজয়ী করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টাকে ইসলামী আন্দোলন বলে। আল-কুরআনের পরিভাষায় ইহাকে الجهاد الله আল্লাহর পথে জিহাদ বলে। জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহর কাজকে ৫ ভাগে ভাগ করা হয়েছে, যার সমষ্টির নাম ইসলামী আন্দোলন। যথাঃ

১. দাওয়াত ইলাল্লাহ;

২. শাহাদাত আলান্নাস;

৩. কিতাল ফী সাবীলিল্লাহ;

৪. ইকামতে দীন;

৫. আব্রু বিল মা’রূফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার।

ইসলামী আন্দোলন করার নির্দেশ

ইসলামী আন্দোলন করা ফরয। যুগে যুগে আল্লাহ তা’য়ালা নবী ও রাসূলগণকে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন তাঁর দীনকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে। সমাজে কোন না কোন ব্যবস্থা চালু থাকেই। কোন নবী সমাজের সে ব্যবস্থার পরিবর্তন করে যখনই সেখানে দীন প্রতিষ্ঠার আহ্বান করেছেন, তখনই কায়েমী স্বার্থবাদীদের সাথে সংঘর্ষ হয়েছে। আল-কুরআন থেকে জানা যায় চার শ্রেণীর কায়েমী স্বার্থবাদী মানুষ আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার কাজে বাধা দিয়েছে। তাদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় নিম্নে তুলে ধরা হলো: এক. শাসক শ্রেণী (তাগুত) যুগে যুগে নবীগণ এসে যখনই আল্লাহর দীনের দাওয়াত দিয়েছেন তখনই দেশের শাসক গোষ্ঠী এদের ক্ষমতা, প্রভুত্ব হারাবার ভয়ে সর্বশক্তি নিয়োগ করে নবীদের কাজকে বাধা দিয়েছে। কারণ, নবীর দাওয়াতের মাধ্যমে আল্লাহর প্রভুত্ব আল্লাহর আইন ও নবীর নেতৃত্বের ঘোষণা ছিল, যা তাদের পক্ষে গ্রহণ করা সহজ ছিল না। এসব শাসকগোষ্ঠী পৃথিবীর রঙ্গ মঞ্চে বিভিন্ন দেশে আবির্ভূত হয়েছে বিভিন্ন নামে বিভিন্ন চরিত্রে। কখনও রাজা- বাদশার নামে, কখনও ডিক্টেটরের নামে, কখনও রাষ্ট্রপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, আবার কখনও সমাজতন্ত্রের লেবাস পরে সর্বহারাদের ত্রাণকর্তা হয়ে।

দারসে হাদীস ১১৯

পৃষ্ঠা:১০৪

দুই. সমাজপতি (মালা): সমাজপতিরা কোন সাম্রাজ্যের অধীনে শাসকের দেয়া সুযোগ সুবিধা ভোগ করত, তারা নিজেদের সুবিধা লাভের জন্য শাসকদের প্রতি ছিল অন্ধ। তারা মনে করতো, এ শাসকেরা যতোদিন আছে আমরাও ততোদিন আছি। তারা এ সুযোগ-সুবিধা হারাতে রাজী ছিল না। অন্য দিকে অনেক সমাজপতিরা নিজেদের এলাকা নিজেরাই শাসন করত। এরা ছিল শাসনের ক্ষেত্রে স্বাধীন। উভয় প্রকার সমাজপতিরা নিজেদের ক্ষমতা হারাবার ভয়ে নবীদের দাওয়াতে বাধা দিয়েছে তাদের কায়েমী স্বার্থের জন্য।

তিন. ধনীক শ্রেণী (মুতরাফীন): অর্থনৈতিক শোষকের দল, অর্থ উপার্জনের জন্য সমাজটাকে তারা একটি ক্ষেত্র হিসেবে গ্রহণ করে। সমাজের মানুষকে শোষণ করে নিজেরাও অর্থের পাহাড় গড়ে তুলে সমাজের সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে, আর শাসকদেরকে সম্পদের অংশ দিয়ে নিজেদের অবৈধ উপার্জনের হাজার পথ খুলে নেয়। সুদী কারবার, ধোঁকা, ভেজাল, ওজনে কম, শ্রমিক ঠকানো, নারীদেহকে ব্যবসার বস্তু বানানো এবং মদ, নৃত্য, জুয়া, কালোবাজারী, ফটকাবাজারী তাদের কাজের ক্ষেত্র। কখনও তারা বেনিয়ার নামে, কখনও জমিদার, মিল মালিক, কখনও পুঁজিবাদী বা সমাজতন্ত্রের নামে আত্মপ্রকাশ করে এবং অর্থের বলে রাষ্ট্র নায়কদেরকে প্রভাবিত করে। এরা নবীদের দাওয়াতকে রুখে দাঁড়িয়েছে এবং বিদ্রোহী দলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে অর্থের ভাণ্ডার খুলে দিয়েছে নবীদের কাজ বন্ধ করার জন্য। কারণ, নবীদের দাওয়াত তাদের অবৈধ অর্থ উপার্জনের সকল পথ বন্ধ করে দেয় এবং অবৈধ সম্পদের মালিকানা অস্বীকার করে।চার. ধর্মীয় পণ্ডিত-পুরোহিত (আব্বার ও রুহবান)

আল্লাহর দীন সম্পর্কে মানুষের মধ্যে ছিল অজ্ঞতা। এ অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে পুরোহিতরা নিজেদের মনগড়া কিছু আচার-অনুষ্ঠানকে ধর্মের নামে চালিয়ে দিয়ে পরকালের মুক্তির গ্যারান্টি দিয়ে অর্থ উপার্জনের পথকে খোলাসা করে নেয়। বিনা পুঁজির এ ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবার ভয়ে তারা

১২০ দারসে হাদ্দীস

পৃষ্ঠা:১০৫

নবীগণের বিরোধিতা ও ছলচাতুরীর আশ্রয় গ্রহণ করে। অথচ তারা নবীদেরকে সেভাবে চিনতো যেভাবে তাদের নিজ সন্তানকে চিনতো। তবুও তারা তাদের স্বার্থের কারণে দীনের বিরোধিতা করেছে। সর্বশক্তি দিয়ে আল্লাহর দীনের কাজকে বাধা দিয়েছে। আর এ কারণেই আল্লাহর নবীগণ সুসংগঠিতভাবে দীনি আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। আজকের দিনেও পৃথিবীর প্রান্তরে প্রান্তরে যারাই আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন গড়ে তুলছেন তাদের সাথে উপরোল্লেখিত চার শ্রেণী মানুষের সাথে দ্বন্দ্ব চলছে। আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর বাণীকে চিরদিন সমুন্নত রেখেছেন এবং ভবিষ্যতে রাখবেন। وَجَعَلَ كَلِمَةَ الَّذِينَ كَفَرُوا السُّفْلَى وَكَلِمَةُ اللَّهِ هِيَ الْعُلْيَا. “কাফিরদের কথাকে নীচু করে দিলেন। আর আল্লাহর কথাকে সমুন্নত করলেন।” (সূরা আত-তওবা: ৪০) আল্লাহ তা’য়ালা ইসলামী আন্দোলন করার নির্দেশ দিয়ে বলেনঃ كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِتَالُ وَهُوَ كُرْهُ لَكُمْ. “জিহাদ (ইসলামী আন্দোলন) তোমাদের উপর ফরয করা হয়েছে, যদিও তা তোমাদের নিকট অসহ্য মনে হচ্ছে।” (সূরা আল-বাকারাঃ ২১৬) ! وَجَاهِدُوا فِي اللهِ حَقَّ جِهَادِه. “আল্লাহর পথে জিহাদ কর, যেমন জিহাদ করা উচিত।” (সূরা হজ্জঃ ৭৮) الَّذِينَ آمَنُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالَّذِينَ كَفَرُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ الطَّاغُوتِ. “ঈমানদারগণ আল্লাহর পথে লড়াই করে। আর কাফিরেরা লড়াই করে তাগুতের পথে।” (সূরা আন-নিসাঃ ৭৬) ইসলামী আন্দোলনের লক্ষ্য ইসলামী আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হল আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধান রাসূলের (সা) পন্থায় মানব সমাজে কায়েম করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। দারসে হাদীস ১২১

কবিতা ১০৬ থেকে ১২০

পৃষ্ঠা:১০৬

قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَلَمِينَ. “বল, আমার নামায, আমার কুরবানী (যাবতীয় ইবাদত) আমার জীবন ও মৃত্যু সব কিছুই সারা জাহানের রব আল্লাহর জন্য।” (সূরা আন’আম: ১৬৩) وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يُشْرِى نَفْسَهُ ابْتِغَاءَ مَرْضَاتِ اللَّهِ وَاللَّهُ رَءُوفٌ بِالْعِبَادِ. “অপর দিকে মানুষের মধ্যে এমন লোক রয়েছে যারা কেবল আল্লাহ তা’য়ালার সন্তোষ লাভের জন্যই নিজের জীবন উৎসর্গ করে। বস্তুতঃ আল্লাহ এসব বান্দাহর প্রতি খুবই অনুগ্রহশীল। (সূরা আল-বাকারা: ২০৭) ইসলামী আন্দোলনের স্তর মু’মিনের সামনে শরীয়ত বিরোধী কোন কাজ হতে দেখলে সে অবশ্যই তা প্রতিহত করার চেষ্টা করবে। অন্যায় প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ করা প্রত্যেক যুগে প্রত্যেকটি ঈমানদার ব্যক্তির উপর ফরয। আর এ দায়িত্ব পালন করতে হলে শক্তির প্রয়োজন। আর শক্তি, ইসলামী আন্দোলনের মাধ্যমেই তা সম্ভব। মানুষকে ইসলামী আন্দোলনের পথে সুকৌশলে আনার প্রচেষ্টা চালাতে হয়, যা কুরআন হাদীসে বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। রাসূল (সা) বলেনঃ مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكِرًا فَلْيُغَيِّرَهُ بِيَدِهِ فَإِنْ لَّمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ فَإِنْ لَّمْ يستطِعْ فَبِقَلْبِهِ ذَالِكَ أَضْعَفُ الْإِيْمَانِ. “তোমাদের কেউ যদি অন্যায় কাজ দেখে, অবশ্যই তা হাত (শক্তি প্রয়োগ করে) দ্বারা প্রতিহত করার চেষ্টা করবে। যদি সে শক্তি না থাকে তাহলে মুখে প্রতিবাদ করবে, যদি সে শক্তিও না থাকে তাহলে অন্তরে তা পরিবর্তন করার পরিকল্পনা করবে। আর এ ধরনের পরিকল্পনা করাই হলো ঈমানের সর্বনিম্ন ও দুর্বলতম স্তর।” (মুসলিম, হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) হতে বর্ণিত)। অপর হাদীসে বর্ণিত হয়েছেঃ جَاهِدُوا الْمُشْرِكِينَ بِأَمْوَالِكُمْ وَانْفُسِكُمْ وَالْسِنَتِكُمْ.

১২২ দারসে হাদীস

পৃষ্ঠা:১০৭

“জিহাদ কর মুশরিকদের বিরুদ্ধে তোমাদের জান, মাল ও মুখের প্রতিবাদ দ্বারা।” (আবু দাউদ, হযরত আনাস (রা) হতে বর্ণিত)। ইসলামী আন্দোলনের সুফল আল্লাহ তা’য়ালার প্রতি ঈমান গ্রহণ করার পর জিহাদ করলে চারটি সুফল পাওয়া যাবে।

১. জাহান্নামের আযাব থেকে নাযাত;

২. গুনাহ মাফ;

৩. জান্নাত দান;

৪. ইসলামী রাষ্ট্র দান।

এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’য়ালা বলেনঃ “হে বিশ্বাসীগণ! আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি ব্যবসার কথা বলে দিব না, যা তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি থেকে মুক্তি দিবে? তা এই যে, তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং আল্লাহর পথে নিজেদের ধন- সম্পদ ও জীবনপণ করে জিহাদ করবে। এটা তোমাদের জন্য খুবই উত্তম; যদি তোমরা বোঝ।

তাহলে তিনি তোমাদের পাপ ক্ষমা করে দিবেন এবং এমন জান্নাতে দাখিল করবেন, যার পাদদেশে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত এবং বসবাসের জন্য উত্তম আবাস-গৃহ থাকবে, এটা মহাসাফল্য এবং আর একটা অনুগ্রহ দিবেন, যা তোমরা পছন্দ কর। আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য এবং আসন্ন বিজয় (রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা), আর হে নবী, আপনি মু’মিনদেরকে এ সংবাদ দান করুন। (সূরা আস-সফ: ১০-১৩)

ইসলামী আন্দোলনের সময় দান করার প্রসঙ্গে রাসূল (সা) বলেনঃ خَيْرٌ مِّنَ الدُّنْيَا وَمَا فِيهَا. لغَدَوَةً فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَوْ رَاحَةً . “আল্লাহর পথে একটা সকাল ও একটা বিকাল ব্যয় করা দুনিয়া ও এর মধ্যে সমস্ত সম্পদ ব্যয় করা অপেক্ষা উত্তম।” (বুখারী, হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা) হতে বর্ণিত)

দারসে হাদীস  ১২৩

পৃষ্ঠা:১০৮

ইসলামী আন্দোলন না করার পরিণতি: ইসলামী আন্দোলন করা সব ফরযের বড় ফরয। এ ফরযীয়াতের দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হলে বা ছেড়ে দিলে এর শাস্তিও হবে বড়। আল্লাহর বাণী: إلَّا تَنْفِرُوا يُعَذِّبْكُمْ عَذَابًا أَلِيمًا وَيَسْتَبْدِلْ قَوْمًا غَيْرَكُمْ وَلَا تَضُرُّوهُ شَيْئًا وَاللَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِير. “তোমরা যদি জিহাদে (ইসলামী আন্দোলনে) বেরিয়ে না পড়, তাহলে তোমাদেরকে কঠোর শাস্তি দেয়া হবে এবং তোমাদের পরিবর্তে তিনি অন্য জাতিকে স্থলাভিষিক্ত করে দেবেন আর তোমরা আল্লাহর কোন ক্ষতি করতে পারবে না। তিনি সব বিষয় শক্তি রাখেন। (সূরা আত-তওবা: ৩৯) “পিছনে থেকে যাওয়া লোকেরা আল্লাহর রাসূল (সা) থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বসে থাকতে পেরে আনন্দ লাভ করেছে, আর জান ও মালের দ্বারা আল্লাহর রাহে জিহাদ করতে অপছন্দ করেছে এবং বলেছে, এ গরমের মধ্যে অভিযানে বের হয়ো না। তাদেরকে বলে দাও, উত্তাপে জাহান্নামের আগুন প্রচণ্ডতম। যদি তাদের বিবেচনাশক্তি থাকতো! (সূরা আত-তাওবা: ৮১) منْ مَاتَ وَلَمْ يَغْزُوا وَلَمْ يُحَدِّثُ بِه نَفْسَهُ مَاتَ عَلَى شُعْبَةٍ مِّنَ النِّفَاقِ “যে ব্যক্তি জিহাদে (ইসলামী আন্দোলনে) শরীক হলো না, কিংবা জিহাদের (ইসলামী আন্দোলনে) চিন্তা-ভাবনাও করল না; আর এ অবস্থায় সে মৃত্যুবরণ করল, সে যেন মুনাফিকের মৃত্যুবরণ করল।” (মুসলিম)

শিক্ষা

১। ইসলামী আন্দোলন করা সব ফরযের সেরা ফরয।

২। এ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে।

৩। সৎ কাজের আদেশ, অসৎ কাজের নিষেধ না করলে দু’আ কবুল হয় না।

৪। ইসলামী আন্দোলনের মুজাহিদকে আল্লাহ জান্নাতে দাখিল করবেন, তাদের গুনাহ মাফ করে দেবেন এবং জাহান্নাম থেকে রক্ষা করবেন।

১২৪ দারসে হাদীস

পৃষ্ঠা:১০৯

দারস-১২ সংগঠন: عَنِ الْحَارِثِ الأَشْعَرِى (رض) قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ (صلعم) أَمْرُكُمْ بِخَمْسٍ وَفِي رِوَايَةٍ أَنَا أَمُرُكُمْ بِخَمْسِ وَاللَّهُ أَمَرَنِى بِهِنَّ بِالْجَمَاعَةِ والسمع والطَّاعَةِ وَالهَجْرَةِ وَالْجِهَادِ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَإِنَّهُ مَنْ خَرَجَ مِنَ الْجَمَاعَةِ قَدْرَ شِبْرٍ فَقَدْ خَلَعَ رِيقَة الْإِسْلَامِ مِنْ عُنُقِهِ إِلَّا أَنْ يُرَاجِعُ وَمَنْ دَعَا بِدَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ فَهُوَ مِنْ جُنَّيْ جَهَنَّمَ وَإِنْ صَامَ وَصَلَّى وَزَعِمَ أَنَّهُ مسلم (مسند احمد، ترمذی)

অর্থ: হযরত হারিসুল আশয়ারী (রা) হতে বর্ণিত। নবী করীম (সা) ইরশাদ করেছেন: আমি তোমাদেরকে পাঁচটি বিষয়ে নির্দেশ দিচ্ছি, (অপর বর্ণনায় আছে আমার আল্লাহ আমাকে এ পাঁচটি বিষয় আদেশ দিয়েছেন) (১) জামায়াতবদ্ধ হবে; (২) নেতার কথা মন দিয়ে শুনবে; (৩) তার আদেশ মেনে চলবে; (৪) আল্লাহর অপছন্দনীয় কাজ বর্জন করে চলবে; (৫) আল্লাহর পথে জিহাদ করবে। যে ব্যক্তি ইসলামী সংগঠন ত্যাগ করে এক বিঘত দূরে সরে গেল, সে তার নিজ গর্দান থেকে ইসলামের রশি খুলে ফেলল, তবে সে যদি সংগঠনে পূনরায় প্রত্যাবর্তন করে তো স্বতন্ত্র কথা। আর যে ব্যক্তি জাহিলিয়াতের নিয়ম নীতির দিকে (মানুষকে) আহ্বান জানায় সে জাহান্নামী। যদিও সে রোযা রাখে, নামায আদায় করে এবং নিজেকে মুসলিম বলে দাবী করে। (মুসনাদে আহমদ, তিরমিযী)

শব্দার্থ : أَمرُكُمْ : আমি তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছি। يخفس : পাঁচটি বিষয়। السمع : নির্দেশ শুনা : الطَّاعَةُ : আনুগত্য। الهجرة হিজরত। من : যে। خرج : সে বের হয়ে গেল। مِنَ الجَمَاعَةِ : জামায়াত

দারসে হাদীস ১২৫

পৃষ্ঠা:১১০

হতে। قدر شبر : এক বিঘত। فقدْ خلع: সে খুলে ফেললো। ربقة الإسلام : ইসলামের রশি। أنْ يُرَاجِعَ : مَنْ عُنُقِم : যদি ফিরে আসে। من ذغا : যে ডাকবে। دعوى الجاهلية জাহেলী মতবাদের দিকে। এفه : তবে সে। بن جلن جهنم: জাহান্নামের ইন্ধন হবে। إن صام : যদিও রোযা রাখে। صلى: নামায পড়ে। زعم : ধারণা করে। نه مُسْلِم নিশ্চয়ই সে মুসলমান।

ব্যাখ্যা: আলোচ্য হাদীসখানায় ইসলামী জীবন ধারার পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের নির্দেশ দেয়া হয়েছে যা ব্যতীত আল্লাহর দীন পরিপূর্ণভাবে কায়েম করা সম্ভব নয়। যে সমাজে আল্লাহর দীন কায়েম নাই সে সমাজে ইসলামের সকল বিধি-বিধান মেনে চলা যায় না। আর আল্লাহর দীন কায়েমের জন্যও তা রক্ষা করার জন্য জামায়াতবন্ধ হতে হয়। জামায়াতবদ্ধ হলেই তখন নেতৃত্ব ও আনুগত্যের প্রশ্ন আসে। কোন কোন সময় জিহাদ ও হিজরতের প্রয়োজনীয়তাও দেখা দেয়। একজন মু’মিন হাদীসের আলোকে নিজের জীবন গঠন না করে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার অস্তিত্বই কল্পনা করতে পারে না। আর যে ব্যক্তি ইসলামী সংগঠন ছেড়ে দূরে চলে গেল, সে যেন তার গর্দান থেকে ইসলামের রজ্জুকে খুলে ফেলল। আর যে ব্যক্তি জাহিলিয়াতের কোন নিয়ম-নীতির দিকে মানুষকে আহবান করে, সে যেন জাহান্নামে যাওয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করে। তাই আমাদেরকে হাদীসের গুরুত্ব উপলব্ধি করে উল্লেখিত নির্দেশসমূহ মেনে চলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

গ্রন্থ পরিচিতি: আলোচ্য হাদীসখানা মুসনাদে আহমদ ও তিরমিযী শরীফ থেকে চয়ন করা হয়েছে। মুসনাদে আহমদ গ্রন্থের পরিচিতি নিম্নে তুলে ধরা হল:

মুসনাদে আহমদ হিজরী তৃতীয় শতকের এক অতুলনীয় হাদীস গ্রন্থ। মুসলমানদের ব্যবহারিক জীবনের প্রয়োজনীয় হাদীস এ বিরাট গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। (ফতহুর রব্বানীঃ ১ম খণ্ড পৃঃ ৯ ম)

১২৬ দারসে হাদীস

পৃষ্ঠা:১১১

এ গ্রন্থ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র) সংকলন করেন। তিনি বাগদাদে ১৬৪ হিজরী সনে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি হাদীস অধ্যয়নের শুরু থেকেই মুখস্থ করার সাথে সাথে লিখার কাজেও মনোনিবেশ করেন। তখন তাঁর বয়স ছিল ১৬ বছর। (মুকাদ্দামা মুসনাদ হায়াতে আহমদ ইবনে হাম্বল) তাঁর জীবনের লক্ষ্য ছিল সকল সহীহ হাদীস সংগ্রহ করা। এ লক্ষ্যে তিনি জীবনভর হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনের কাজ করেছিলেন। তিনি সর্বমোট ৭ লক্ষ ৫০ হাজার হাদীস সংগ্রহ করে, তার যাচাই বাছাই করে ৩০ হাজারের কিছু বেশী হাদীস মুসনাদে সন্নিবেশিত করেন। পরবর্তীকালে তাঁর পুত্রের আরো এক হাজার হাদীস সংযোজনের ফলে চল্লিশ হাজার হাদীসে উন্নীত হয়। (আল-হিত্তা ফী যিকরিস সিহাহ সিত্তা পূঃ ১১১) ইমাম আহমদ একজন বিজ্ঞ মুহাদ্দিস, ফকীহ ও মুজতাহিদ ছিলেন। মুতাযিলাদের ভ্রান্ত মতবাদকে অস্বীকার করার কারণে খলীফার কারাগারে বহুবিধ নির্যাতনের পর ২৪১ হিজরী সনে ৭৭ বছর বয়সে ইহধাম ত্যাগ করেন। বাগদাদ নক্ষত্রেই তাঁকে সমাহিত করা হয়। (আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া ১১ খণ্ড গৃঃ ৩৩৫) তিরমিযী শরীফ হাদ্দীস গ্রন্থের পরিচিতি ২নং দারসে তুলে ধরা হয়েছে।

রাবী পরিচিতি নামঃ হারিস; পিতা: হারিস। এ হাদীসখানা হারিস বিন হারিস (রা) বর্ণনা করেছেন। তিনি আয়ারী গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। কর্মজীবন: হারিস বিন হারিস (রা) সিরিয়ার মুহাদ্দিসগণের অন্যতম মুহাদ্দিস ছিলেন। তাই তাঁকে সিরিয়ার মুহাদ্দিসগণের মধ্যে গণ্য করা হয়। তাঁর থেকে আবু সালাম হাবশী এবং অন্যান্য রাবীগণ হাদীস বর্ণনা করেন। তিনি আজীবন হাদীস চর্চায় নিজেকে নিয়োজিত রাখেন।

দারসে হাদীস ১২৭

পৃষ্ঠা:১১২

সংগঠন শব্দের অর্থ: সংগঠন আরবী শব্দ )تنظیم( থেকে উদ্ভূত। ইংরেজী প্রতিশব্দ হচ্ছে Organization, সংঘবদ্ধকরণ। বিশেষ অর্থ দলবদ্ধ বা সংঘবদ্ধ জীবন। ইসলামী জীবনাদর্শ বাস্তবায়নের জন্য দলবদ্ধভাবে কাজ করতে হয়। মানুষ সামাজিক জীব। তাকে সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে হয়। তাই একাকী দীনের সকল হুকুম পালন করা যায় না। এ কারণেই সংগঠন গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। কেননা, ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করতে হলে ইসলামী সংগঠন গড়ে তোলা অপরিহার্য। সংগঠনই দাওয়াত সম্প্রসারণ ও জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে এবং ইসলাম বিরোধী শক্তির মোকাবেলা করতে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়। এ জন্যই মহান রাব্বুল আলামীন সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا. ১। “তোমরা সংঘবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধর, পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।” (সূরা আলে-ইমরানঃ ১০৩) وَمَنْ يَعْتَصِمْ بِاللَّهِ فَقَدْ هُدِى إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ

২। “আর যে ব্যক্তি আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করবে, সে নিশ্চয়ই সত্য ও সঠিক পথে প্রদর্শিত হবে।” (সূরা আলে-ইমরান: ১০১) وَإِنَّ هَذِهِ أُمْتُكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَأَنَا رَبُّكُمْ فَاتَّقُونِ ৩। “তোমরা মূলতঃ একই দলভুক্ত, আর আমি তোমাদের প্রভু। সুতরাং তোমরা আমাকে ভয় করে চল। (সূরা মুমিনুন: ৫২) فَاقِيمُوا الصَّلوةَ وَأتُوا الزَّكُوةَ وَاعْتَصِمُوا بِاللَّهِ.

৪। “অতএব নামায কায়েম কর, যাকাত দাও এবং আল্লাহকে (রজ্জুকে) শক্তভাবে ধারণ কর।” (সূরা হজ্জঃ ৭৮) إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيْلِهِ صَفًّا كَأَنَّهُمْ بُنْيَانٌ مُرْصُوصٌ

১২৮ দারসে হাদীস

পৃষ্ঠা:১১৩

৫। “আল্লাহ তা’য়ালা তো সেসব লোকদেরকে ভালবাসেন যারা তাঁর পথে এমনভাবে কাতার বন্দী হয়ে লড়াই করে যেন তারা সীসাঢালা প্রাচীর।” (সূরা আস-সফ: ৪)

৬। “তোমরা সেসব লোকদের মত হয়ো না যারা বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে গেছে এবং স্পষ্ট ও প্রকাশ্য নির্দেশ পাওয়ার পরও মতবিরোধে লিপ্ত হয়ে রয়েছে, তাদের জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে।” (সূরা আলে-ইমরান: ১০৫)

৭। “যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে এবং তাঁর দীনকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করবে, আল্লাহ তাদেরকে স্বীয় রহমত ও অনুগ্রহের মধ্যে প্রবেশ করাবেন এবং তাদের সঠিক পথের সন্ধান দেবেন।” (সূরা আন-নিসা: ১৭৫)

৮। “তবে যারা তওবা করবে এবং নিজেদেরকে সংশোধন করে নেবে ও আল্লাহর রজ্জুকে শক্ত করে ধারণ করবে এবং একমাত্র আল্লাহর জন্যই নিজেদের দীনকে খালেস করে নেবে, এমন লোকই মুমিনদের সঙ্গী হবে। আল্লাহ তা’য়ালা অবশ্যই মুমিনদেরকে বিরাট পুরস্কার দান করবেন।” (সূরা আন-নিসা : ১৪৬) সংগঠন সম্পর্কে আরেকটি হাদীসে বলা হয়েছে, مَنْ فَارَقَ الْجَمَاعَةَ شِبْرًا فَقَدْ خَلَعَ رِبْقَةُ الْإِسْلَامِ مِنْ عُنُقِهِ. “যে ব্যক্তি জামায়াত ত্যাগ করে এক বিঘত পরিমাণ দূরে সরে গেল, সে যেন ইসলামের রজ্জু হতে তার গর্দানকে আলাদা করে নিল।” (আবু দাউদ) নেতার আদেশ মন দিয়ে শোনা: দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে নেতার কথা মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করা। নেতার আদেশ মনোযোগ দিয়ে শোনার তাকিদ করা হয়েছে। নেতার আদেশ মনোযোগ দিয়ে না শুনলে তার আনুগত্য করা যায় না। নবী করীম (সা) যখন কোন আলোচনা করতেন তখন ইয়াহুদীরা শোনার সময় না বোঝার ভান করে নবীজিকে লক্ষ্য করে বলে উঠত ن অর্থাৎ আমাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করুন। এ কথার প্রেক্ষিতে আল্লাহ তা’য়ালা মু’মিনদেরকে লক্ষ্য করে ইরশাদ করেন:

দারসে হাদীস ১২৯

পৃষ্ঠা:১১৪

يا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَقُولُوا رَاعِنَا وَقُولُوا انْظُرْنَا وَاسْمَعُوا. “হে ঈমানদারগণ! তোমরা (রাসূলকে সম্বোধন করে) “রায়িনা” বলো না। তোমরা বরং ‘উনযুরনা’ বলো এবং (তাঁর কথা মনোযোগ দিয়ে) শোন। (সূরা আল-বাকারা : ১০৪) নেতা যতক্ষণ পর্যন্ত ভাল কাজের আদেশ করবে ততক্ষণ পর্যন্ত তার আনুগত্য করা ফরয। السَّمْعُ وَالطَّاعَةُ عَلَى الْمَرْءِ الْمُسْلِمِ فِيْمَا أَحَبُّ وَكَرِهَ مَا لَمْ يُؤْمَرُ بمعصية فإذا أمر بمعصية فلا سمع ولا طاعة. “নেতা যে পর্যন্ত কোন পাপকার্যের আদেশ না করবে সে পর্যন্ত তার আদেশ শোনা ও মেনে নেয়া প্রত্যেকটি মুসলমানের জন্য ফরয, তা তার পছন্দ হোক বা না হোক। হ্যাঁ সে যদি কোন পাপকার্যের আদেশ করে তাহলে তার আদেশ শোনা বা আনুগত্য করা যাবে না।” (বুখারী, মুসলিম) অপর এক হাদীসে সুখ-দুঃখের ও খুশি-অখুশির মুহূর্তেও নেতার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনার কথা বলা হয়েছে। بَايَعْنَا رَسُولَ اللَّهِ (صلعم) عَلَى السَّمْعِ وَالطَّاعَةِ فِي الْعُسْرِ وَالْيُسْرِ وَالْمُنْشِطِ وَالْمُنْكَرة. “আমরা রাসূল (সা)-এর নিকট বাইয়াত গ্রহণ করেছিলাম নেতার আদেশ মনোযোগ দিয়ে শোনার, তা দুঃখের সময় হোক আর সুখের সময় হোক। খুশির মুহূর্তে হোক আর অখুশির মুহূর্তে হোক। (বুখারী, মুসলিম) নেতার আদেশ মেনে চলা তৃতীয় কাজ হচ্ছে নেতার আনুগত্য করা। নেতার আনুগত্য ছাড়া জামায়াতী যেন্দেগীর সুফল লাভ করা যায় না। সর্বাবস্থায় নেতার আনুগত্য করতে হবে। নেতার আনুগত্য করা ফরয। কুরআন ও হাদীসে এর গুরুত্ব অপরিসীম। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেন:

১৩০ দারসে হাদীস

পৃষ্ঠা:১১৫

يَأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُوْلَ وَأَوْلِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ “হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসূলের আনুগত্য কর এবং তোমাদের নেতার আনুগত্য কর।” (সূরা আন-নিসা : ৫৯) وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَالرَّسُوْلَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ.“এবং আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য কর, যাতে তোমাদের প্রতি দয়া করা যায়।” (সূরা আলে-ইমরানঃ ১৩২) রাসূলের বাণী: রাসূল (সা) বলেন: “যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করল সে আল্লাহর আনুগত্য করল, আর যে ব্যক্তি আমার হুকুম অমান্য করল সে আল্লাহরই হুকুম অমান্য করল। যারা আমীরের আনুগত্য করল তারা আমার আনুগত্য করল। আর যারা আমীরের আদেশ অমান্য করল সে প্রকৃতপক্ষে আমারই আদেশ অমান্য করল।” (বুখারী, মুসলিম) مَنْ خَلَعَ يَدًا مِّنْ طَاعَةِ لَقِيَ اللَّهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ لَا حُجَّةً لَهُ وَمَنْ مَاتَ وَلَيْسَ فِي عُنُقِهِ بَيْعَةً مَاتَ مَيْتَةُ جَاهِلِيَّةً. “যে ব্যক্তি আনুগত্যের বন্ধন থেকে হাত খুলে নেয়, সে কিয়ামতের দিন আল্লাহর সম্মুখে এমন অবস্থায় উপস্থিত হবে যে, আত্মপক্ষ সমর্থনে তার বলার কিছুই থাকবে না। আর যে ব্যক্তি বাইয়াত ছাড়া মৃত্যুবরণ করবে। তার মৃত্যু হবে জাহিলিয়াতের মৃত্যু।” (মুসলিম) ন্যায় কাজের আনুগত্য করতে হবে অন্যায় ও পাপকার্যে আনুগত্য করা যাবে না। আনুগত্যের জন্য এটাই হলো শর্ত لا طَاعَةً فِي مَعْصِيَّةٍ إِنَّمَا الطَّاعَةُ فِي الْمَعْرُوفِ. “পাপকার্যে কোন আনুগত্য নেই, আনুগত্য শুধুমাত্র ভাল কাজের।” (বুখারী) হিজরত চতুর্থ কাজ হচ্ছে হিজরত করা। হিজরত অর্থ- ত্যাগ করা, সম্পর্কচ্ছেদ করা, কোন জিনিস বা স্থান ত্যাগ করা।

দারসে হাদীস ১৩১

পৃষ্ঠা:১১৬

শরীয়তের পরিভাষায়- একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে “দারুল হরব” থেকে “দারুল ইসলামে” প্রস্থান করাকে হিজরত বলে। যেমন- নবী করীম (সা) ও সাহাবায়ে কিরাম (রা) দীন ও ইসলামের নিরাপত্তার জন্য মক্কাভূমি (দারুল হরব) পরিত্যাগ করে মদীনা (দারুল ইসলাম) চলে গিয়েছিলেন, সুতরাং সে চলে যাওয়াকে হিজরত নামে অভিহিত করা হয়। তাছাড়া শরীয়তের নিষিদ্ধ কাজসমূহকে পরিত্যাগ করাকেও হিজরত বলে। নবী করীম (সা) বলেছেন: أن تَهْجُرَ مَا كره رَبِّك. এ হাদীসে উপরোক্ত দু’টি অর্থই গ্রহণীয়। হিজরত সম্পর্কে আল্লাহর বাণী: الَّذِينَ آمَنُوا وَهَاجَرُوا وَجَهَدُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ أَعْظَمُ درجةً عِنْدَ اللَّهِ، وَأُولَئِكَ هُمُ الْفَائِزُونَ. “যারা ঈমান আনে, হিজরত করে এবং নিজ নিজ জান-মাল দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করে তারা আল্লাহর কাছে মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ, আর তারাই সফলকাম”। (সূরা আত-তওবা: ২০) “যারা হিজরত করেছে, নিজ নিজ ঘরবাড়ী থেকে বিতাড়িত হয়েছে, আমার পথে নির্যাতিত হয়েছে, যুদ্ধ করেছে এবং প্রাণ দিয়েছে, আমি তাদের মন্দ কাজগুলো অবশ্যই দূর করে দেব এবং অবশ্যই তাদেরকে জান্নাতে দাখিল করাবো, যার পাদদেশে প্রবাহিত ঝর্ণাসমূহ। এ হলো আল্লাহর তরফ থেকে পুরস্কার। আর উত্তম পুরস্কার তো আল্লাহরই কাছে”। (দূর আলে-ইমরানঃ ১৯৫)

আল্লাহর পথে জিহাদ  পঞ্চম কাজ হচ্ছে জিহাদ করা। জিহাদ হলো কোন নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করে প্রচেষ্টা চালানো। জিহাদ শব্দের অর্থঃ জিহাদ )جهاد( আরবী শব্দ ১ থেকে উদ্ভূত। এর আভিধানিক অর্থ- সর্বাত্মক প্রচেষ্টা, কঠোর পরিশ্রম, চূড়ান্ত সাধনা ইত্যাদি।

১৩২ দারসে হাদীস

পৃষ্ঠা:১১৭

পারিভাষিক অর্থ: আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে আল্লাহর দীনকে আল্লাহর যমীনে প্রতিষ্ঠা করার নিমিত্তে বিভিন্ন উপায়ে প্রচেষ্টা চালানোকে জিহাদ বলে। জিহাদ সম্পর্কে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন: كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِتَالُ وَهُوَ كُرْهُ لَكُمْ. “জিহাদ তোমাদের উপর ফরয করা হয়েছে, যদিও তা তোমাদের নিকট অসহ্য মনে হচ্ছে।” (সূরা আল-বাকারা: ২১৬) وَجَاهِدُوا فِي اللَّهِ حَقَّ جِهَادِهِ. “আল্লাহর পথে জিহাদ কর, যেভাবে জিহাদ করা উচিত।” (সূরা হজ্জঃ ৭৮) الَّذِينَ آمَنُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالَّذِينَ كَفَرُوا يُقَاتِلُونَ فِي سبِيلِ الطَّاغُوتِ. “ঈমানদারগণ আল্লাহর পথে লড়াই করে। আর কাফিরেরা লড়াই করে তাগুতের পথে।” (সূরা আন-নিসাঃ ৭৬) আল্লাহর রাসূল (সা) বলেন مَنْ مَاتَ وَلَمْ يَغْزُو وَلَمْ يُحَدِّثُ بِهِ نَفْسَهُ مَاتَ عَلَى شُعْبَةٍ مِّنَ التَّفَاقِ. “যে ব্যক্তি জিহাদে শরীক হলো না, কিংবা জিহাদের চিন্তা-ভাবনাও করল না; আর এ অবস্থায় সে মৃত্যু বরণ করল, সে যেন মুনাফিকের মৃত্যুবরণ করল।” (মুসলিম) হাদীসের শেষের দিকে জামায়াত ত্যাগ করার পরিণতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। জামায়াতে যিন্দেগী যাপন ছাড়া একা একা ইসলামী জীবন বিধান অনুসরণ করা যায় না। কেউ যদি জামায়াত পরিত্যাগ করে একা চলো নীতি অনুসরণ করে তার অর্থই হলো ইসলাম ছেড়ে দূরে সরে যাওয়া। কেউ যদি ইসলামী জীবন বিধান ছাড়া অন্য কোন মতাদর্শের দিকে মানুষকে আহ্বান করে, তাহলে সে ব্যক্তি হবে জাহান্নামী; যদিও সে রোযা

দারসে হাদীস ১৩৩

পৃষ্ঠা:১১৮

রাখে, নামায পড়ে ও নিজেকে মুসলিম বলে দাবী করে। কেননা ইসলাম বিরোধী কোন মতবাদের প্রচার করা মুসলমানদের জন্য জায়েয নাই।

শিক্ষা

১। জামায়াতী যিন্দেগী যাপন করা ফরয।

২। ইসলামী জামায়াতের নেতার আদেশ মন দিয়ে শোনা কর্তব্য।

৩। ইসলামী জামায়াতের নেতার আদেশ মেনে চলতে হবে।

৪। আল্লাহর অপছন্দনীয় কাজ বর্জন করতে হবে।

৫। আল্লাহর পথে জিহাদ করতে হবে।

৬। কখনো জামায়াত বা সংগঠন পরিত্যাগ করা যাবে না।

৭। ইসলাম ছাড়া অন্য কোন মত বা পথের দিকে যারা মানুষকে আহ্বান জানায়, তারা জাহান্নামী।

পৃষ্ঠা:১১৯

দারস-১৩বাইয়াত: عَنْ عَبْدِ اللَّهِ ابْنِ عُمَرَ (رض) عَنِ النَّبِيِّ (صلعم) قَالَ مَنْ مَاتَ وَلَيْسَ فِي عُنُقِهِ بَيْعَةً مَاتَ مَيْتَةً جَاهِلِيَّةً. (مسلم)

অর্থ : হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা) রাসূল (সা) থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি বাইয়াতের বন্ধন ছাড়াই মারা গেল সে জাহিলিয়াতের মৃত্যুবরণ করল। (মুসলিম) ! عَنْ عَبْدِ اللَّهِ ابْنِ عُمَرَ (رض) يَقُولُ كُنَّا إِذَا بَايَعْنَا رَسُولَ اللَّهِ (صلعم) عَلَى السَّمْعِ والطَّاعَةِ يَقُولُ لَنَا فِيْمَا اسْتَطَعْتُمْ. (مسلم)

অর্থঃ আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা যখন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট শ্রবণ করা ও আনুগত্য করার উপর বাইয়াত গ্রহণ করতাম, তখন তিনি আমাদের বলতেন: তোমাদের শক্তি-সামর্থ্য অনুযায়ী উক্ত বাইয়াতের উপর আমল করা ফরয়। (মুসলিম)

শব্দার্থ: عن ابن عُمَرَ: হযরত (আবদুল্লাহ) ইবনে উমার (রা) থেকে বর্ণিত। عن النبي : নবী করীম (সা) থেকে বর্ণনা করেন। ১ট: তিনি বলেছেন। من مات : যে ব্যক্তি মারা গেল। وَلَيْسَ فِي عُنُقِه : অথচ তার ঘাড়ে নেই। بيعة : বন্ধন, বাইয়াত। ঃ সে মৃত্যুবরণ করলো। فيئة جاهلية : জাহিলিয়াতের মৃত্যু। يَقُوْلُ : সে বলে। كُنَّا إِذَا بَايَعْنَا : আমরা যখন বাইয়াত (শপথ) করতাম। والطاعة 199 : على السمع و আনুগত্য করার উপর। يَقُوْلُ لَنَ : তিনি আমাদেরকে বলতেন। فيما اسْتَطَعْتُم : তোমাদের শক্তি সামর্থ্যানুযায়ী বাইয়াতের উপর আমল কর।

দারসে হাদীস ১৩৫

পৃষ্ঠা:১২০

ব্যাখ্যাঃ বাইয়াত গ্রহণ করা ফরয। যদি কোন ব্যক্তি বাইয়াত গ্রহণ করা ছাড়া মৃত্যুবরণ করে তবে তার মৃত্যু হবে জাহিলিয়াতের মৃত্যু। ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় বাইয়াতের গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহ তা’য়ালা মু’মিনদের থেকে বাইয়াত গ্রহণ করেছেন রাসূল (সা)-এর মাধ্যমে। যারা বাইয়াত গ্রহণ করবে না তাদের সম্পর্কে শান্তির কঠোর বাণী উচ্চারণ করা হয়েছে। দ্বিতীয় হাদীসে বলা হয়েছে, “রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কাছে সাহাবীগণ বাইয়াত গ্রহণ করতেন, শ্রবণ করা ও আনুগত্য করার উপর। সে সময় তিনি তাদেরকে লক্ষ্য করে বলতেন: তোমরা আমার কথা পূর্ণ মনোযোগ সহকারে শুনবে। আমি যা করার আদেশ করবো তা করার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করবে। এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ সংশয় বা গাফলতী করবে না। প্রতিটি ক্ষেত্রে আমার আনুগত্য করবে।” অর্থাৎ আমার সাথে যে বাইয়াত গ্রহণ করেছো সে বাইয়াতের আলোকে সাধ্যমত যিন্দেগী পরিচালনা করা ফরয। গ্রন্থ পরিচিতিঃ উল্লেখিত হাদীস দু’টি মুসলিম শরীফ থেকে চয়ন করা হয়েছে। গ্রন্থ পরিচিতি পূর্বে ৩নং দারসে দেয়া হয়েছে। রাবী পরিচিতি: হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা)-এর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।

নাম: আবদুল্লাহ। উপনামঃ আবু আবদুর রহমান। পিতার নামঃ উমার বিন খাত্তাব। মাতার নাম: যয়নব বিনতে মাফ্টন। জন্ম: নবুওয়াতের দ্বিতীয় বছর মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। হিজরতঃ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা) ১১ বছর বয়সে স্বীয় পিতার সাথে নবুওয়াতের ১৩তম বছরে মদীনায় হিজরত করেন।

জিহাদে অংশগ্রহণ

বয়সের স্বল্পতার কারণে তিনি বদর ও উহুদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। (তাবাকতে ইবনে সা’দ ৪র্থ খণ্ড) খন্দকের যুদ্ধসহ পরবর্তী সকল যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি বাইয়াতে রিদওয়ানে উপস্থিত ছিলেন ও বিদায় হজ্জে রাসূলের সফর সঙ্গী ছিলেন।

১৩৬ দারসে হাদীস

কবিতা ১২১ থেকে ১৩৫

পৃষ্ঠা:১২১

হাদীস বর্ণনায় তাঁর অবদান: হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) রাসূলুল্লাহ (সা)-এর দরবারে ছোট সাহাবী ছিলেন। রাসূলের সান্নিধ্যে বেশী সময় থাকার সুযোগ পাওয়ায় তিনি বেশী হাদীস বর্ণনা করতে সমর্থ হয়েছেন। ইল্মে ফিহে তাঁর অসাধারণ জ্ঞান ছিল। জনসাধারণ তাঁর ইলমে ফিকহের মাধ্যমে অনেক উপকৃত হয়েছেন। তিনি সর্বাধিক হাদীস বর্ণনাকারীর অন্যতম। আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী বলেন, “হযরত আবু হুরায়রার (রা) পরে সাহাবীদের মধ্যে তিনিই সর্বাধিক হাদীস বর্ণনাকারী। (উমদাতুল কারী শরহে বুখারী ১ম খণ্ড ১১২ পৃঃ)

বর্ণিত হাদীস সংখ্যা: তাঁর বর্ণিত হাদীস সংখ্যা ১৬৩০। তার মধ্যে ১৭৩টি বুখারী ও মুসলিম শরীফে স্থান পেয়েছে। এতদ্ব্যতীত বুখারী শরীফে ৮১টি ও মুসলিম শরীফে ৩১টি হাদীস এককভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। (উমদাতুল কারী শরহে বুখারী ১ম খণ্ড ১১২ পৃঃ) ইনতিকাল: হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা) জনসাধারণের সুপ্রিয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। এ কারণে হাজ্জাজ তাঁর সাথে শত্রুতা পোষণ করত। উমাইয়া খলীফা আবদুল মালেকের শাসনামলে হজ্জ থেকে ফেরার পথে হাজ্জাজের পরামর্শে তার জনৈক সিপাহী আবদুল্লাহ ইবনে উমারের পায়ে বর্শা ঢুকিয়ে দিলে উক্ত আঘাতে রক্তক্ষরণজনিত কারণে হিজরী ৭৩/৭৪ সালে ৮৩/৮৪ বছর বয়সে মক্কায় ইনতিকাল করেন। (উসদুল গাবা)

বাইয়াত অর্থ, গুরুত্ব ও পদ্ধতি: বাইয়াত (২) আরবী শব্দ। যা بيع শব্দ থেকে নির্গত। بيعة-এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ক্রয়-বিক্রয়, লেন-দেন, চুক্তি, আনুগত্যের শপথ, অঙ্গীকার; নেতৃত্ব মেনে নেয়া ইত্যাদি। শরীয়তের পরিভাষায় আল্লাহ তা’য়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে নিজের জীবন ও সম্পদকে ইসলামী সংগঠনের দায়িত্বশীলের নিকট আনুগত্যের

দারসে হাদীস ১৩৭

পৃষ্ঠা:১২২

শপথের মাধ্যমে আল্লাহর পথে সপে দেয়ার ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতির নাম বাইয়াত।

বাইয়াতের গুরুত্ব: ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় বাইয়াতের গুরুত্ব। অপরিসীম। বাইয়াত গ্রহণ করা এবং বাইয়াতের ওপর মজবুতভাবে টিকে থাকতে পারলেই কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা সম্ভব। তাই আল্লাহ তা’য়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে নিজের জান ও মালকে ইসলামী সংগঠনের নেতা বা দায়িত্বশীলের নিকট আনুগত্যের শপথের মাধ্যমে আল্লাহর পথে সপে দেয়ার ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতির নাম বাইয়াত। জান-মালের প্রকৃত মালিক আল্লাহ। মু’মিনদের নিকট ইহা আমানতস্বরূপ। যখন এ জান ও মাল প্রকৃত মালিক ফেরত চাইবেন তখন সন্তুষ্টচিত্তে তা ফেরত দিতে বাধ্য থাকতে হবে।

আল্লাহ তা’য়ালা নিজে এসে মু’মিনদের জান-মাল গ্রহণ করবেন না। তিনি তাঁর প্রতিনিধির মাধ্যমে তা গ্রহণ করেন। এ প্রতিনিধি হলেন যুগে যুগে নবী ও রাসূলগণ। আমাদের সর্বশেষ রাসূল হলেন প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা)। এর পরে আর কোন নবী বা রাসূল আসবেন না। তাই আমাদেরকে নির্বাচিত প্রতিনিধি তথা ইসলামী সংগঠনের নেতার নিকট বাইয়াত গ্রহণ করতে হবে। ইসলামী সংগঠনের নেতার মাধ্যমে বাইয়াত গ্রহণ করা ফরয। বাইয়াতের মাধ্যমে যে কথার স্বীকৃতি দেয়া হয় তা হলোঃ

১. জান-মাল আল্লাহর পথে ব্যয় করার অঙ্গীকার;

২. আল্লাহর বিধান পালন করার অঙ্গীকার;

৩. নেতার আনুগত্য করার অঙ্গীকার।

এতদ্ব্যতীত অন্য কোন পন্থায় মুক্তির আশা করা বিভ্রান্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। বাইয়াতের গুরুত্ব কুরআন-হাদীসের আলোকে নিম্নে আলোচনা করা হলো:

সর্বপ্রথম বাইয়াত বা চুক্তি মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ এ পৃথিবীতে আগত এবং অনাগত সকল আদম

১৩৮ দারসে হাদীস

পৃষ্ঠা:১২৩

সন্তানের কাছ থেকে আলমে আরওয়াহ বা রূহের জগতে বাইয়াত গ্রহণ করেছেন, যা পবিত্র কুরআনে সবিস্তারে বর্ণনা করা হয়েছে। “আর (হে নবী) লোকদেরকে সে সময়ের কথা স্মরণ করিয়ে দাও যখন তোমার প্রভু বনি আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাদের বংশধরকে বের করেছিলেন এবং তাদেরকে তাদের নিজেদের ওপর সাক্ষী বানিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেনঃ আমি কি তোমাদের প্রভু নই? তারা জবাব দিয়েছিল: হাঁ, অবশ্যই আপনি আমাদের প্রভু। আমরা এ কথায় সাক্ষ্য দিচ্ছি। এটা আমি এজন্যে করেছিলাম যে, তোমরা কিয়ামতের দিন যেন এ কথা বলতে না পারো: আমরা তো এ কথা জানতাম না। অথবা এ কথা বলতে না পারো : শিরকের সূচনা আমাদের বাপ দাদারা আমাদের পূর্বে করেছিলেন আর আমরা পরে তাদের বংশে জন্মেছি। অতঃপর আপনি কি আমাদেরকে এমন ভুলের জন্যে পাকড়াও করছেন যা বিভ্রান্ত লোকেরা করেছিল।” (সূরা আল-আরাফ: ১৭২-১৭৩) সৃষ্টির আদি যুগে আদমের সকল বংশধরদের নিকট থেকে যে উদ্দেশ্যে বাইয়াত বা স্বীকৃতি গ্রহণ করা হয়েছিল তা হলো- মানুষ পৃথিবীতে এসে যেন আল্লাহকে ভুলে না যায়, আবার শয়তানের ধোঁকায় পড়ে আল্লাহকে ভুলে যেয়ে বিভ্রান্তিতে নিমজ্জিত হয়ে সে দায়ভার আল্লাহর উপর চাপিয়ে না দেয়। আর এ কথাও বলতে না পারে যে, আল্লাহ তা’য়ালা তো আমাদের থেকে সত্য পথে চলার কোন বাইয়াত বা শপথ গ্রহণ করেননি। এখন কথা হলো যে, মানুষের চেতনা ও স্মৃতিতে ঐ বাইয়াত বা স্বীকৃতির চিহ্ন তরতাজা নেই কেন, এর জবাবে বলবো যে, স্মৃতি ও চেতনায় এর চিহ্ন তাজা রাখা হয়নি ঠিকই কিন্তু অবচেতন মনে (Sub-conscious mind) ও অনুভূতিতে তা অবশ্যই সংরক্ষিত আছে। এই বাইয়াত বা চুক্তিকে জীবন্ত ও তরতাজা রাখার জন্যই আল্লাহ তা’য়ালা যুগে যুগে নবী ও রাসূল প্রেরণ করেছেন। নবীগণও মোমেনদের কাছ থেকে আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক সত্য পথে চলার বাইয়াত গ্রহণ করেছেন। (সীরাতে সরওয়ারে আলম, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী। পৃঃ ২১)

দারসে হাদীস ১৩৯

পৃষ্ঠা:১২৪

দ্বিতীয় বাইয়াত বা চুক্তিঃ পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’য়ালা বলেনঃ إِنَّ اللَّهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ. “নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনদের কাছ থেকে তাদের জান ও মাল খরিদ করে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়ে।” (সূরা আত-তওবা: ১১১)

এ আয়াতের মাধ্যমে আমরা বাইয়াতের পরিপূর্ণ মর্ম উপলব্ধি করতে পারি। মানুষ সর্বপ্রথম চুক্তিতে স্বীকার করেছিল যে, হে আল্লাহ, তুমিই আমাদের প্রভু। আমরা তোমার দাস বা বান্দা। দাস মনিবের হুকুম ছাড়া এক পা-ও অগ্রসর হওয়ার ক্ষমতা রাখে না। তাঁর দেয়া জীবন ও সম্পদ একমাত্র তাঁর নির্দেশিত পথে ব্যয় করে তাঁর দাসত্ব করতে হবে। তাহলেই কেবল আমাদের বাইয়াত বা চুক্তি ঠিক থাকবে এবং আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর ওয়াদা মোতাবেক জান্নাত দান করবেন। বাইয়াতের দিকে নবীগণের আহ্বান: যুগে যুগে যত নবী-রাসূল এসেছেন তাঁরা সকলেই মহান আল্লাহর সাথে মানুষের বাইয়াতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তাদের আহ্বান ছিলো: يقَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِّنْ إِلَهِ غَيْرُهُ.

“হে দেশবাসী, একমাত্র আল্লাহর দাসত্ব কর। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন হুকুমকর্তা নেই।” (সূরা আল-আরাফ: ৫৯) নবীগণের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঈমানদার ব্যক্তিগণ যুগে যুগে তাদের হাতে এক আল্লাহর দাসত্ব করার বাইয়াত গ্রহণ করেছেন। হযরত ইয়াকুব (আ) মৃত্যুর সময় তাঁর সন্তানদের থেকে স্বীকৃতি আদায় করেছেন এই বলে যে, “তোমরা আমার পরে কার ইবাদত করবে? তখন তাঁর সন্তানেরা বলেছিলেন, আমাদের প্রভু আল্লাহ এবং আপনার ও আপনার পূর্বপুরুষ ইবরাহীম, ইসমাঈল ও ইসহাকের প্রভুর ইবাদত করবো। হযরত ঈসা (আ) হাওয়ারীগণের থেকে স্বীকৃতি বা বাইয়াত গ্রহণ করেছেন এই বলে, কে আছে আল্লাহর পথে আমার সাহায্যকারী? হাওয়ারীগণ বলেছিলেন, আমরা আল্লাহর সাহায্যকারী। (সূরা আস-সফ: ১৪)

পৃষ্ঠা:১২৫

মহানবী (সা)-এর বাইয়াত গ্রহণ: বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা) মু’মিন পুরুষ ও নারীদের থেকে বাইয়াত গ্রহণ করেছেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’য়ালা ঘোষণা করেন: “নিশ্চয়ই আল্লাহ মু’মিনদের জান ও মাল জান্নাতের বিনিময়ে খরিদ করে নিয়েছেন, তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে মরে ও মারে। তাদের প্রতি (জান্নাতের ওয়াদা) আল্লাহর যিম্মায় একটি পাকা-পোখত ওয়াদা তাওরাত, ইনজিল ও কুরআনে আছে। (সূরা আত-তওবা: ১১১) “হে নবী, ঈমানদার নারীগণ! যখন আপনার কাছে এসে আনুগত্যের শপথ করে যে, আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করবে না, ব্যভিচার করবে না, তাদের সন্তানদেরকে হত্যা করবে না, মিথ্যা অপবাদ আরোপ করবে না এবং ভাল কাজে আপনার অবাধ্যতা করবে না, তখন তাদের বাইয়াত গ্রহণ করুন এবং তাদের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করুন। নিঃসন্দেহে আল্লাহ মহা-ক্ষমাশীল অতি দয়ালু।” (সূরা আল-মুমতাহিনা : ১২) সাহাবাগণ আল্লাহর দীনের জন্য রাসূল (সা)-এর নিকট জান-মাল কোরবান করার শপথ নিয়েছিলেন, এটাও আল্লাহর নিকট বাইয়াত বলেই গণ্য। “হে রাসূল! যেসব লোক আপনার নিকট বাইয়াত করেছিল তারা মূলতঃ আল্লাহর নিকট বাইয়াত করেছিল। তাদের হাতের উপরে আল্লাহর কুদরাতের হাত ছিল।” (সূরা আল-ফাতাহঃ ১০) হযরত উবাদা বিন সামিত (রা) বলেন: “আমরা রাসূল (সা)-এর নিকট বাইয়াত গ্রহণ করতাম, শ্রবণ ও আনুগত্যের ব্যাপারে এবং এটা স্বাভাবিক অবস্থায়, কঠিন অবস্থায়, আগ্রহ ও অনাগ্রহ সর্বাবস্থায়ই প্রযোজ্য। আমরা আরো বাইয়াত গ্রহণ করেছি যে, আমরা কোন ব্যাপারে দায়িত্বশীলদের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হবো না এবং সর্বাবস্থায় সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবো। এ ব্যাপারে কোন তিরস্কারকারীর তিরস্কারের পরোয়া করবো না। (নাসায়ী)

রাষ্ট্রপ্রধানের নিকট বাইয়াত গ্রহণ: রাসূল (সা)-এর ইনতিকালের পর হযরত আবু বকর (রা) মুসলিম জাহানের রাষ্ট্রপ্রধান হন। রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার পর তিনি বাইয়াত গ্রহণ

দারসে হাদীস ১৪১

পৃষ্ঠা:১২৬

করলেন তাঁর আনুগত্য করার। আমীরুল মু’মিনীন হযরত আবু বকর (রা) রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করে জাতির উদ্দেশ্যে প্রথম ভাষণে বলেনঃ “যতদিন আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে চলি, তোমরা ততদিন আমার আনুগত্য করে চলবে। আমি যদি আল্লাহর ও তাঁর রাসূলের নাফরমানি করি, তাহলে আমার আনুগত্য করতে তোমরা বাধ্য থাকবে না।” (কানযুল উম্মাল)

বর্তমান যুগে বাইয়াত গ্রহণ: আমাদের সকলের মনের মাঝে প্রশ্ন দেখা দেয় যে, বর্তমান যুগে আমরা কার কাছে বা কার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করবো। রূহের জগতে আল্লাহর সাথে যে বাইয়াত গ্রহণ অনুষ্ঠান হয়েছিল তা স্মরণ করানোর জন্যেই আল্লাহ পাক যুগে যুগে নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। যাতে মানুষ সে বাইয়াত অনুযায়ী চলতে পারে। সকল নবী-রাসূল যেভাবে বাইয়াত গ্রহণ করেছেন, শেষ নবী মুহাম্মদ (সা)-ও সেভাবে মু’মিনদের থেকে বাইয়াত গ্রহণ করেছেন। আর রাসূলের অবর্তমানে বাইয়াত গ্রহণ করতে হবে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধানের হাতে। আর ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত না থাকলে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সংগ্রামরত ইসলামী দলের নেতার নিকট। একাধিক দল থাকলে তুলনামূলকভাবে উন্নত দলে শামিল থাকতে হবে ও সে দলের নেতার নিকটই বাইয়াত গ্রহণ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে রাসূল (সা) বলেনঃ “প্রত্যেক মুসলমানের উপর (নেতার নির্দেশ) শ্রবণ করা ও আনুগত্য করা অবশ্য কর্তব্য, চাই তা তার পছন্দ হোক বা অপছন্দ হোক, যতক্ষণ পর্যন্ত না পাপাচারের আদেশ দেয়া হয়। পাপাচারের কোন আদেশ দেয়া হলে তা শ্রবণ করা ও তার আনুগত্য করার কোন অবকাশ নেই।” (বুখারী ও মুসলিম) রাসূল (সা) আরো বলেনঃ “সুদিনে ও দুর্দিনে, সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টিতে এবং তোমাদের অধিকার খর্ব হওয়ার ক্ষেত্রেও (নেতার নির্দেশ) শ্রবণ করা ও আনুগত্য করা তোমার জন্য অপরিহার্য। রাসূলের আদর্শের পতাকাবাহী

১৪২ দারসে হাদীস

পৃষ্ঠা:১২৭

দল, যারা জীবনের সকল ক্ষেত্রে কুরআন-হাদীস বাস্তবায়ন করতে চায়, যারা আল্লাহর যমীনে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে রত, কেবল সে দলের নেতার নিকট বাইয়াত গ্রহণ করতে হবে। এ ছাড়া কোন ব্যক্তি বা দল যারা আল্লাহর দীন সামগ্রীকভাবে কায়েম করার প্রচেষ্টায় শামিল নয়, তাদের নিকট বাইয়াত গ্রহণ করা উচিত নয়।

বাইয়াত গ্রহণের পদ্ধতি: বাইয়াত গ্রহণ করতে হবে রাসূলের দেখানো পদ্ধতি অনুযায়ী। রাসূল (সা) পুরুষদের হাতে হাত রেখে বাইয়াত গ্রহণ করতেন। নারীগণ রাসূলের হাতে হাত রেখে কোনদিন বাইয়াত গ্রহণ করেননি। সহীহ বুখারীতে বাইয়াত সম্পর্কে এক হাদীসে হযরত আয়েশা (রা) বলেনঃ “মহিলাদের এই বাইয়াত কেবল কথাবার্তার মাধ্যমে হয়েছে, হাতের ওপর হাত রেখে হয়নি, যা পুরুষের ক্ষেত্রে হতো। বস্তুত রাসূল (সা)-এর হাত কখনো কোন গায়েরে মুহরিম নারীর হাত স্পর্শ করেনি।” (তাফসীরে মাযহারী)

অতএব আমাদের দেশে কোন কোন ভণ্ড ও বিদআতী ব্যক্তি ইসলামের নামে নারীদেরকে হাতে হাত রেখে বাইয়াত গ্রহণের প্রথা চালু করেছে, যা সম্পূর্ণ হারাম।

শিক্ষা

১। ইসলামী সংগঠনের নেতার নিকট বাইয়াত গ্রহণ করা ফরয।

২। বাইয়াত গ্রহণ না করলে ঈমানের দাবী পূরণ হবে না।

৩। বাইয়াত হবে দীন কায়েমের লক্ষ্যে শ্রবণ ও আনুগত্যের।

৪। কোন স্বার্থের বিনিময়ে বাইয়াত গ্রহণ জায়েয নাই।

৫। কোন বিদআতীর নিকট বাইয়াত গ্রহণ জায়েয নয়।

৬। মুমিন হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য এবং ঈমানের সাথে মৃত্যুবরণের জন্যই ইসলামী রাষ্ট্রপ্রধানের বা ইসলামী সংগঠনের নেতার নিকট বাইয়াত গ্রহণ করতে হবে।

দারসে হাদীস ১৪৩

পৃষ্ঠা:১২৮

দারস-১৪ পরামর্শ: عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ (رض) قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ (صلعم) إِذَا كَانَ أَمْرَانُكُمْ خيارَكُمْ وَاغْنِيَانُكُمْ سُمَحَانُكُمْ وَأَمُورُكُمْ شُورَى بَيْنَكُمْ فَظَهْرُ الْأَرْضِ خَيْرٌ لكُمْ مِنْ بَطْنِهَا وَإِذَا كَانَ أَمْرَانُكُمْ شِرَارَكُمْ وَ اغْنِيَانُكُمْ بُخَلاتُكُمْ وَ أَمُورُكُمْ إِلَى نِسَائِكُمْ فَبَطْنُ الْأَرْضِ خَيْرٌ لَكُمْ مِنْ ظَهْرِهَا. (ترمذی)

অর্থঃ হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (সা) বলেছেন : যখন তোমাদের নেতাগণ হবেন ভাল মানুষ, ধনী ব্যক্তিগণ হবেন দানশীল এবং তোমাদের কার্যক্রম চলবে পরামর্শের ভিত্তিতে, তখন মাটির উপরের ভাগ মাটির নীচের ভাগ থেকে হবে উত্তম। আর যখন তোমাদের নেতারা হবে খারাপ লোক, ধনীরা হবে কৃপণ এবং নেতৃত্ব যাবে নারীদের হাতে, তখন পৃথিবীর উপরের অংশের চেয়ে নীচের অংশ হবে উত্তম। (তিরমিযী)

শব্দার্থ : أَمَرَاتُكُمْ : তোমাদের নেতাগণ। اغتيائكم : তোমাদের ধনীগণ। سُحَاتُكُمْ : তোমাদের দানশীল ব্যক্তি। أَمُورَكُمْ: তোমাদের কার্যক্রম চলবে। شورای : পরামর্শ। بَيْنَكُمْ : তোমাদের মধ্যে। ظهر الأرْض : মাটির উপরিভাগ। خَيْرٌ : উত্তম। منْ بَطْنِها: মাটির নীচের অংশ। شراركُمْ : তোমাদের খারাপ ব্যক্তিরা। يُخلاكُمْ: তোমাদের কৃপণ ব্যক্তিরা। الكم: তোমাদের নারীরা। بطن الأرض: যমীনের নীচের ভাগ। ظهرها : উহার (যমীনের) উপরের ভাগ।

ব্যাখ্যা: আলোচ্য হাদীসখানায় শান্তির সমাজ ব্যবস্থা বিনির্মাণের উপাদানের কথা আলোচনা করা হয়েছে। হাদীসে তিনটি ইতিবাচক (সৎ)

১৪৪ দারসে হাদীস

পৃষ্ঠা:১২৯

গুণাবলী উল্লেখ করা হয়েছে। যথা: ১. খোদাভীরু নেতৃত্ব; ২. ধনীলোক গরীবের বন্ধু; ৩. সামগ্রিক কার্যক্রম পরামর্শের ভিত্তিতে হবে এবং তিনটি নেতিবাচক (অসৎ) গুণাবলী। যথা: ১. অসৎ শাসক বা নেতা; ২. কৃপণ ধনীলোক; ৩. নারীদের নেতৃত্ব।

সমাজকে শান্তিময় ও নিরাপত্তাপূর্ণ করে গড়ে তুলতে হলে কমপক্ষে হাদীসে বর্ণিত দিক নির্দেশনাগুলো মেনে চলতে হবে। সমাজ সংস্কারক ও শাসকবর্গের অর্জন করতে হবে এসব গুরুত্বপূর্ণ গুণাবলী। শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবে সৎ ও যোগ্য ব্যক্তি। ধনী ব্যক্তিগণ হবেন দানশীল। সকল কাজ সম্পাদিত হবে পরামর্শের ভিত্তিতে। যতদিন পর্যন্ত এ গুণগুলো সমাজের নেতা ও শাসকবর্গের মধ্যে বিদ্যমান থাকবে ততদিন পর্যন্ত প্রকৃত শান্তি বিরাজ করবে। আসমান হতে কল্যাণ ও বরকত বর্ষিত হবে। যমীন তার সকল উর্বর শক্তি দিয়ে প্রচুর শস্য ও ফসল উৎপাদন করবে।

মোটকথা ফলে-ফুলে সুশোভিত হয়ে পৃথিবী বেহেশতে পরিণত হবে। মানুষ এ পৃথিবী ছেড়ে যেতে চাইবে না। পক্ষান্তরে যখন তোমাদের শাসনকর্তা হবে মন্দ ব্যক্তিরা, ধনী ব্যক্তিরা হবে কৃপণ, দেশের নেতৃত্ব যাবে নারীদের হাতে তখন এ সমস্ত ব্যক্তিরা যেমন খুশী তেমনভাবে রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনা করবে, তখন আল্লাহর রহমত থেকে ভূ-পৃষ্ঠ বঞ্চিত হবে। পৃথিবীতে খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, রাহাজানীসহ এমন সব অশান্তি দেখা দিবে যাতে অতিষ্ঠ হয়ে মানুষ বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যুকে কামনা করবে অর্থাৎ পৃথিবীর উপরিভাগে থাকতে না চেয়ে মাটির নীচে লুকিয়ে থাকা পছন্দ করবে। (রূহুল-মা’আনী)

গ্রন্থ পরিচিতি: আলোচ্য হাদীসখানা তিরমিযী শরীফ থেকে চয়ন করা হয়েছে। যাকে জামে তিরমিযী বলা হয়। জগৎ বিখ্যাত ছয়খানি বিশুদ্ধতম হাদীস গ্রন্থের অন্যতম। এ গ্রন্থখানি রচনা করেছেন হযরত ইমাম তিরমিযী। তাঁর পূর্ণ নাম আল-ইমামুল হাফেজ আবু ঈসা মুহাম্মদ ইবনে ঈসা ইবনে সওরাতা আত্-তিরমিযী। এর মধ্যে ব্যবহারিক প্রয়োজনসম্পন্ন হাদীস সন্নিবেশিত হয়েছে সবচেয়ে বেশী। (কাশফুজ জুনুন পৃঃ ২৮৮) এ গ্রন্থটির বিস্তারিত পরিচিতি ২নং দারসে উল্লেখ করা হয়েছে।

দারসে হাদীস ১৪৫

পৃষ্ঠা:১৩০

রাবী পরিচিতি: হযরত আবু হুরায়রা (রা)-এর পরিচয় ৪নং দারসে তুলে ধরা হয়েছে।

পরামর্শের গুরুত্ব: ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় পরামর্শের গুরুত্ব অপরিসীম। ইসলাম সমাজের লোকদের জন্য নিজেদের পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সকল ক্ষেত্রে যাবতীয় কাজ কর্ম সম্পাদনে ও যাবতীয় সমস্যার সমাধানে পারস্পরিক পরামর্শ করাকে বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে। পরামর্শ সম্পর্কে আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন: وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِينَ. “কাজে-কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করুন। অতঃপর যখন কোন কাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলেন, তখন আল্লাহ তা’য়ালার উপর ভরসা করুন। আল্লাহ তা’য়ালা তাওয়াক্কুলকারীদের ভালবাসেন।” (সূরা আলে-ইমরান: ১৫৯)

“তারা পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করে।” (সূরা আশ-শূরা: ৩৮) এ আয়াত দু’টোতে সমাজ সংস্কারক ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনা রয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যদি চাইতেন, তাহলে তাঁর রাসূলকে প্রতিটি কাজের ব্যাপারে ওহীর মাধ্যমে বলে দিতে পারতেন। পরামর্শের কোন প্রয়োজনীয়তা অবশিষ্ট রাখতেন না। কিন্তু বিশ্বনবীর মাধ্যমে পরামর্শের রীতি প্রচলন করার মাঝেই নিহিত ছিল মুসলিম উম্মার কল্যাণ ও মঙ্গল। কাজেই আল্লাহ বহু বিষয় এমন রেখে দিলেন, যাতে সরাসরি কোন ওহী নাযিল হয়নি বরং সেগুলোর ব্যাপারে রাসূলে করীম (সা)-কে পরামর্শ করে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করলে তিনি (আল্লাহ) খুশী হন। ইমাম জাসাস আহকামুল কুরআনে বলেন, এ আয়াত থেকে পরামর্শের গুরুত্ব ফুটে উঠেছে। এতে আমাদের প্রতি পরামর্শ সাপেক্ষ কাজে তাড়াহুড়া না করা, নিজস্ব মতকে

১৪৬ দারসে হাদ্দীস

পৃষ্ঠা:১৩১

প্রাধান্য দিয়ে কাজ না করার এবং জ্ঞানী ও সুধীবর্গের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ রয়েছে। এর গুরুত্ব উপলব্ধি করেই হযরত উমার (রা) বলেনঃ لا خلافة إلا عَنْ مَشورة.

“পরামর্শকরণ ব্যতীত খেলাফত হতে পারে না।” (কানযুল উম্মাল) আল্লাহর রাসূল (সা) বলেন: “তোমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হলে তোমাদের জীবন মৃত্যুর তুলনায় শ্রেয়।” (তিরমিযী)

পরামর্শ করার গুরুত্বের কারণ: পরামর্শের গুরুত্বের কারণ প্রধানত তিনটি। যথাঃ

ক. দুই বা ততোধিক ব্যক্তির স্বার্থের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি সম্পর্কে পরামর্শ করা ইনসাফের দাবী।

খ. নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য যেন স্বেচ্ছাচারি মনোভাব, অপরের অধিকার হরণ অথবা তাদেরকে হেয় জ্ঞান করা না হয়।

গ. যে সকল বিষয়াদি অপরের স্বার্থের সাথে জড়িত তার ফয়সালা করা কঠিন কাজ। এর জন্য আল্লাহর নিকট জবাবদিহি করতে হবে।

পরামর্শের প্রকৃতি

১। স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতামত প্রদানের ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীন হতে হবে।

২। জনগণের মতামতের ভিত্তিতে নেতা নির্বাচিত হতে হবে।

৩। জনগণের আস্থাভাজন ব্যক্তিদেরকে শূরার সদস্য নিয়োগ করতে হবে।

৪। শূরার সদস্যগণ নিজেদের জ্ঞান ও ঈমানের ভিত্তিতে পরামর্শ দিবেন।

৫। ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে নেয়া সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া সকলের জন্য ফরয।

রাসূলের যুগে পরামর্শ সভা: রাসূল (সা) সাহাবায়ে কিরামের সাথে পরামর্শ করে গুরুত্বপূর্ণ কাজ সমাধা করতেন। কখনো কখনো প্রজ্ঞাবান সাহাবীদের সাথে পরামর্শের ভিত্তিতে

দারসে হাদীস ১৪৭

পৃষ্ঠা:১৩২

অধিকাংশ কাজ করতেন। প্রয়োজনের তাকীদে অনেক সময় ছোট বড় সকলের সাথে পরামর্শ করতেন। মদীনায় হিজরত করার ব্যাপারে আকাবার শপথের সময় মদীনার সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করেন এবং আল্লাহর প্রত্যাদেশ প্রাপ্তির পর তা বাস্তবায়ন করেন। মদীনায় গিয়ে কাফেরদের সাথে প্রথম প্রকাশ্য যুদ্ধ হয় বদরের ময়দানে। এ যুদ্ধে তিনি সাহাবীদের পরামর্শ গ্রহণ করেন। তিনি পরামর্শের ভিত্তিতে মদিনার বাহিরে গিয়ে উহুদের যুদ্ধও পরিচালনা করেন। এ ক্ষেত্রে তিনি যুবকদের মতামতের প্রাধান্য দেন। খন্দকের ময়দানেও সাহাবীদের পরামর্শের ভিত্তিতে হযরত সালমান ফারসির প্রস্তাব মতে পরিখা খনন করেন। এতেই বুঝা যায় পরামর্শের গুরুত্ব কত বেশী। হযরত রাসূলে করীম (সা) অনেক সময় শায়খাইন অর্থাৎ হযরত আবু বকর (রা) ও হযরত ওমর (রা)-এর মতকে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাহাবীদের মতের উপরে প্রাধান্য দান করতেন। (মা’আরিফুল কুরআন, মুফতি মুহাম্মদ শফি র.)

খিলাফতে রাশেদার যুগে

খুলাফায়ে রাশেদীনের সকল খলীফাগণ জনগণের পরামর্শের ভিত্তিতে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁরা সকলেই খেলাফতের সকল কাজ পরামর্শের ভিত্তিতেই পরিচালনা করতেন। এ কারণেই খেলাফতে রাশেদার সময় প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিদের সমন্বয়ে মজলিস-ই-শূরা গঠিত হয়েছিল। হযরত আবু বকর (রা) সকল কাজে পরামর্শের ক্ষেত্রে হযরত ওমর, ওসমান ও আলী (রা)-কে গুরুত্ব দিতেন। হযরত ওমর (রা) কোন কোন সময় বয়স্ক সাহাবীদের ছাড়াও হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের কথাকে প্রাধান্য দিতেন। (আল-আকমাল ফি আসমায়ির রিজাল লি সহেবিল মিশকাত পৃঃ ২০)

পরামর্শের পন্থা

খতীব বাগদাদী হযরত আলী (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, আমি রাসূল (সা)-কে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার অবর্তমানে আমরা যদি এমন কোন ব্যাপারের সম্মুখীন হই, যাতে কুরআনে কোন ফয়সালা নেই এবং আপনার পক্ষ থেকেও কোন ফয়সালা না পাই, তবে আমরা সে

১৪৮ দারসে হাদীস

পৃষ্ঠা:১৩৩

ব্যাপারে কি করব? রাসূল (সা) জবাবে বললেন, এর জন্য উম্মতের ইবাদতকারীগণকে একত্রিত করবে এবং পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে কর্তব্য স্থির করবে; কারো একক মতে ফয়সালা করবে না। আর এ কারণেই প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় মজলিস-ই-শূরা গঠনের। মজলিস-ই-শূরা: মজলিস অর্থ সভা, সমিতি, পরিষদ, সংস্থা ইত্যাদি। শূরা অর্থ-পরামর্শ। মজলিস-ই-শূরা মানে পরামর্শ পরিষদ বা জাতীয় সংসদ। মজলিস-ই-শূরা দু’প্রকার। যথাঃ

১। মজলিস-ই-আম বা সাধারণ পরিষদ।

২। মজলিস-ই-খাস বা উচ্চ পরিষদ।

সাধারণ পরিষদ অধিকাংশ জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে গঠিত হয়। আর উচ্চ পরিষদ প্রজ্ঞাবান লোকদের দ্বারা গঠিত। কাদের নিয়ে মজলিস-ই-শূরা গঠিত হবে

ইসলামী রাষ্ট্র বা ইসলামী সংগঠনের প্রধানকে পরামর্শ দান ও সার্বিক কাজ-কর্মে সাহায্য করার জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে মজলিস-ই শূরা গঠন করা অপরিহার্য। তাদেরকে সুস্থ বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন, আদর্শবান, জনদরদী এবং খোদাভীরু, আমানতদার, সুবিচারক ও নিঃস্বার্থবাদী মানুষ হতে হবে। কাজেই দায়িত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ববান লোক নিয়োগ করা জরুরী। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর রাসূল (সা) বলেনঃ “লোকদের ইমাম বা নেতা হবে সে ব্যক্তি, যে তাদের মধ্যে কুরআনের জ্ঞান সবচেয়ে বেশী রাখে, এ ব্যাপারে যদি সকলে সমান হয়, তাহলে হাদীস সম্পর্কে অধিক জ্ঞানী ব্যক্তি ইমাম হবে, যদি এ বিষয়ও সকলে সমান হয় তবে তাদের মধ্যে যে সকল লোক আগে হিজরত করেছে। এ ক্ষেত্রে সমান হলে বয়সে প্রবীণ ব্যক্তি ইমামতি করবে। কোন ব্যক্তি যেন অপর ব্যক্তির প্রভাবাধীন এলাকায় ইমামতি না করে এবং তার বাড়ীতে তার অনুমতি ব্যতীত তার জন্য নির্দিষ্ট আসনে না বসে। (মুসলিম, মুসনাদে আহমদ)

এতে বুঝা গেল-

১। তাঁর রাষ্ট্রপ্রধানকে নামাযের ইমামতি করার যোগ্যতাসম্পন্ন হতে হবে।

দারসে হাদীস ১৪৯

পৃষ্ঠা:১৩৪

২। তাঁর কুরআনের জ্ঞান থাকতে হবে।

৩। তাঁর সুন্নাহ তথা ইসলামের পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকতে হবে।

৪। হিজরতে অগ্রগামী অর্থাৎ নির্দেশ পালনে অগ্রসর হতে হবে।

৫। বয়সে প্রবীণ হতে হবে।

রাষ্ট্রপ্রধান এবং সংগঠন প্রধান কাদের থেকে পরামর্শ গ্রহণ করবে, সে সম্পর্কে বলা হয়েছে। পরামর্শ করতে হবে খোদাভীরু, সৎ, যোগ্য ও প্রজ্ঞাবান (ইল্ম ও আমলের দিক দিয়ে যারা অগ্রগামী) ব্যক্তিদের সাথে অন্যথায় সুফলের চেয়ে ক্ষতি হবে বেশী। (রূহুল মা’আনী) ইসলামী শাস্ত্রবিদ, আবিদ মুমিনদেরকে নিয়ে গঠিত মজলিস-ই শূরার সম্মুখে পেশ করে তাদের পরামর্শ গ্রহণ করবে। কিন্তু নিজের মতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিয়ে কোন কাজ করবে না। (তিবরানী)

মজলিস-ই-শূরার সদস্যদের দায়িত্ব

মজলিস-ই-শূরার সদস্যদের অনেক দায়িত্ব কর্তব্য রয়েছে। অন্তত আল্লাহর আইনকে সামনে রেখে নিম্নের এ দু’টো মূলনীতি তাদের গ্রহণ করতে হবে।

১। কল্যাণময় কাজের পরামর্শ দেয়া।

২। গুনাহ ও অকল্যাণকর কাজে সিদ্ধান্ত দেয়া থেকে বিরত রাখা।

পরামর্শের সুফল

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সা) বলেনঃ “যে ব্যক্তি কোন কাজের ইচ্ছা করে তাতে পরামর্শ গ্রহণ করে, আল্লাহ তা’য়ালা তাকে সঠিক বিষয়ের দিকে হিদায়াত দান করবেন। অর্থাৎ যে কাজের পরিণতি তার জন্যে মঙ্গলজনক ও উত্তম, সে কাজের দিকে তার মনের গতি ফিরিয়ে দেবেন।” (বায়হাকী) ইমাম বুখারী এমনি ধরনের এক হাদীস আদাবুল মুফরাদে হযরত হাসান (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন। যখন কোন সম্প্রদায় পরামর্শক্রমে কাজ

১৫০ দারসে হাদীস

পৃষ্ঠা:১৩৫

করে তখন তাদেরকে অবশ্যই সঠিক পথ নির্দেশনা দান করা হয়। (মা’আরিফুল কুরআন) রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারাদিতে পরামর্শ করা ওয়াজিব। -আল্লামা ইবনে কাসীর (র) “রাসূল (সা) বলেন: “আল্লাহ যখন কোন শাসক থেকে ভাল ও কল্যাণের ইচ্ছা পোষণ করে, তখন তার জন্য কোন সত্যের পরামর্শ দানকারী নিযুক্ত করেন। আমীর কোন বিষয় ভুলে গেলে সে তাকে তা স্মরণ করিয়ে দেয় এবং যেসব বিষয় রাষ্ট্রপ্রধানের মনে থাকে সে ব্যাপারে তাকে সাহায্য- সহযোগিতা করে। আল্লাহ যদি রাষ্ট্রপ্রধানের দ্বারা ভাল ছাড়া অন্য কিছুর ইচ্ছা করেন তাহলে তার জন্য খারাপ পরামর্শদাতা নিযুক্ত করে দেন। আমীর কোন বিষয় ভুলে গেলে তাকে স্মরণ করিয়ে দেয় না। আর যদি স্মরণ থাকে, তাহলেও কোনরূপ সাহায্য করে না।” (আবু দাউদ) অপর এক হাদীসে বলা হয়েছে: مَا خَابَ مَنِ اسْتَخَرَ وَلَا نَدِمَ مَنِ اسْتَشَارَ وَلَا عَالَ مَنِ اقْتَصَدَ. “যে (কোন কাজে) ইসতিখারা করলো, সে ব্যর্থ হবে না; যে পরামর্শ করলো, সে লজ্জিত হবে না; আর যে মধ্যপন্থা অবলম্বন করলো, সে দারিদ্র্যে নিমজ্জিত হবে না।” (আল-মু’জামুস ছগীর)

আলোচনা ও পরামর্শ করাকে ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য একটি মৌলিক বিষয় হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এমনকি রাষ্ট্রপ্রধান যদি কোন সময় পরামর্শের ঊর্ধ্বে চলে যায় কিংবা এমন ধরনের লোকের সাথে পরামর্শে প্রবৃত্ত হয়, যারা শরীয়তের দৃষ্টিতে পরামর্শের যোগ্য নয়, তবে তাকে অপসারিত করা অপরিহার্য। রাসূল (সা) বলেন: আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্য পরামর্শের কোন প্রয়োজন নেই, কিন্তু আল্লাহ তা’য়ালা এ পরামর্শকে আমার উম্মতের জন্য ‘রহমত’ সাব্যস্ত করেছেন। (বয়ানুল কুরআন) নেতার সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার: পরামর্শ গ্রহণের পর আমীর বা নেতার সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার থাকবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর বাণী:

দারসে হাদীস ১৫১

কবিতা ১৩৬ থেকে ১৪৫

পৃষ্ঠা:১৩৬

 الله. إِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى  “পরামর্শ করার পর আপনি যখন কোন একটি দিক সাব্যস্ত করেন, সে মতে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন, তখন আল্লাহর উপর ভরসা করুন।” (সূরা আলে-ইমরানঃ ১৫৯) এ আয়াতে عزمت : শব্দে عَزّمٌ: অর্থাৎ নির্দেশ বাস্তবায়নে দৃঢ়সংকল্প হওয়াকে শুধু মাত্র মহানবী (সা)-এর প্রতি সম্বন্ধ যুক্ত করা হয়েছে। عزمتُم বলা হয়নি। যাতে সংকল্প ও তা বাস্তবায়নে সাহাবায়ে কিরামের সংযুক্তি তাও বুঝা যেতে পারত। এ ইংগিতের দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, পরামর্শ করে নেয়ার পর বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমীর বা নেতা যা করবেন তাই হবে গ্রহণযোগ্য। কোন কোন সময় হযরত উমর (রা) যুক্তি প্রমাণের ভিত্তিতে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের অভিমতকে প্রাধান্য দিতেন এবং সে মতেই সিদ্ধান্ত নিতেন। অথচ পরামর্শ সভায় অধিকাংশ সময় এমন সব মনীষী উপস্থিত থাকতেন, যারা ইবনে আব্বাসের তুলনায় বয়স, জ্ঞান ও সংখ্যার দিক দিয়ে ছিলেন গরিষ্ঠ।

শিক্ষা

১। আল্লাহর আইন ও সৎ লোকের নেতৃত্ব কায়েম করা ফরয।

২। ধনী ব্যক্তিদেরকে দানের জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

৩। সকল কাজ সমাধা করতে হবে পরামর্শের ভিত্তিতে।

৪। পরামর্শের ভিত্তিতে গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অটল থাকতে হবে, শিথিলতা প্রদর্শন করা যাবে না।

পৃষ্ঠা:১৩৭

দারস-১৫

দারস-১৫ নেতা নির্বাচন: عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ ابْنِ سَمُرَةَ (رض) قَالَ قَالَ لِي رَسُولُ اللَّهِ (صلعم) لا تسئل الإمارة فَإِنَّكَ إِنْ أُعْطِيتَهَا عَنْ مُسْئَلَةٍ وَكُلَتْ إِلَيْهَا وَإِنْ أَعْطِيتَهَا عَنْ غَيْرِ مسئلةٍ أُعِنْتَ عَلَيْهَا. (بخاری، مسلم)

অর্থঃ হযরত আবদুর রহমান ইবনে সামুরা (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (সা) আমাকে বললেনঃ তুমি নেতৃত্বের পদপ্রার্থী হবে না। কারণ, তুমি যদি তা চেয়ে নাও তবে তোমাকে ঐ পদের বোঝা দেয়া হবে (দায়িত্ব পালনে তুমি আল্লাহর সাহায্যপ্রাপ্ত হবে না)। আর যদি প্রার্থনা ছাড়াই তোমাকে ঐ পদ দেয়া হয়, তবে তুমি ঐ পদের দায়িত্ব পালনে (আল্লাহর) সাহায্যপ্রাপ্ত হবে। (বুখারী, মুসলিম) শব্দার্থ:  عَنْ عَبد الرحمن ابن سمرة (رض)  হযরত আবদুর রহমান ইবনে সামুরা (রা) হতে বর্ণিত। قال: সে বলল। بی: আমাকে। لا تَسْئل : তুমি চেয়ে নেবে না। الإنارة: নেতৃত্ব। فَإِنَّكَ أَعْطِيْتَهَا : নিশ্চয়ই তোমাকে উহা দেয়া হবে। عن مسئلة: তুমি চাওয়ার কারণে। إلَيْهَا : তোমাকে ঐ পদের বোঝা চাপানো হবে। عَنْ غَيْرِ مَسْتَلَةٍ : প্রার্থনা ব্যতীত। أعنت عَلَيْهَا: তাতে তুমি আল্লাহর সাহায্যপ্রাপ্ত হবে।

ব্যাখ্যাঃ ইসলামী রাষ্ট্রে কোন পদে প্রার্থী হওয়া বা নিজকে প্রার্থীরূপে দাঁড় করানোর অধিকার ইসলাম কাউকে দেয়নি। কারণ নেতৃত্ব চেয়ে নেওয়ার মত খারাপ প্রবণতা লোভ থেকে সৃষ্টি হয়। লোড মানুষকে ধ্বংস করে দেয়। এজন্যেই রাসূল (সা) বলেছেন, নেতৃত্ব চেয়ে নিলে তাতে আল্লাহর রহমত ও সাহায্য পাওয়া যায় না। আর আল্লাহর রহমত ও সাহায্য ছাড়া কোন কাজ সুচারুরূপে আঞ্জাম দেওয়া মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। সাধারণ

দারসে হাদীস ১৫৩

পৃষ্ঠা:১৩৮

কাজের চেয়ে নেতৃত্বের দায়িত্ব বেশী কঠিন। প্রার্থনা ব্যতীত যে নেতৃত্ব লাভ হয়, তাতে আল্লাহর রহমত থাকে। সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে আল্লাহ তা’য়ালা এই নেতাকে সাহায্য করেন, ফলে সহজেই তিনি নিজের দায়িত্ব পালন করতে পারেন। আল্লাহর রাসূল (সা) পদপ্রার্থীদেরকে কোন পদের উপযুক্ত মনে করতেন না এবং তাদেরকে সে পদে অধিষ্ঠিত করতেন না। এ সত্যতা আমরা নাসায়ী শরীফের একটি হাদীসে দেখতে পাই যা হযরত আবু মূসা আশয়ারী (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূল (সা)-এর নিকট আগমন করি, আমার সাথে আশয়ারী গোত্রের দু’ব্যক্তি ছিলেন। তারা রাসূলের (সা)-এর নিকট রাষ্ট্রীয় পদে চাকুরী প্রার্থনা করেন, কিন্তু রাসূল (সা) তাদেরকে বলে দেন, যারা নিজেরা রাষ্ট্রীয় পদের নেতৃত্ব চায় তাদেরকে আমরা নেতৃত্ব দেই না বা নেতৃত্ব লাভে সাহায্যও করি না। অতঃপর রাসূল (সা) আমাকে ইয়ামেনে গভর্নর করে পাঠালেন। অপর আর একটি হাদীসে রাসূল (সা) বলেনঃ مِنْ خَيْرٍ (صلعم) تجدون رَسُولُ الله عنْ أَبِي هُرَيْرَةَ (رض) قَالَ قَالَ ) الناسِ أَشَدُّهُمْ كَرَاهِيَةً لِهَذَا الْأَمْرِ حَتَّى يقع فيه. (بخاری، مسلم) “হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। রাসূল (সা) বলেছেনঃ “যারা পদকে ভীষণভাবে অপছন্দ করে। অতঃপর যখন তাতে সংশ্লিষ্ট হয়, তখন তোমরা তাদেরকে সর্বোত্তম লোক হিসেবে পাবে।” (বুখারী, মুসলিম)

গ্রন্থ পরিচিতি: আলোচ্য হাদীসখানা বুখারী ও মুসলিম শরীফ থেকে চয়ন করা হয়েছে এবং উভয় কিতাবের বর্ণনা যথাক্রমে ১নং ও ৩নং দারসে দেয়া হয়েছে।

রাবী পরিচিতি: হযরত আবদুর রহমান ইবনে সামুরা (রা)। নামঃ আবদুর রহমান। পিতার নাম: সামুরা। নসবনামাঃ আবদুর রহমান ইবনে সামুরা ইবনে হাবীব ইবনে আবদে শামস ইবনে আবদে মানাফ ইবনে কুসাই। কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন রাসূলের বংশধর। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে

১৫৪ দারসে হাদীস

পৃষ্ঠা:১৩৯

তার নাম ছিল আবদুল কাবা। ইসলাম গ্রহণের পর রাসূল (সা) তার নাম রাখেন আবদুর রহমান। তিনি ছিলেন একজন আরব সেনাপতি। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা ও প্রসারে তাঁর বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হন। খলীফা উসমানের (রা) খিলাফতকালের পরবর্তী বছরগুলোতে সিজিস্তানে সর্বপ্রথম সেনাপতিরূপে নিযুক্ত হন। তিনি দক্ষতার সাথে যারাজ ও যামীন-ই দাওয়ার জয় করেন এবং কিরমান এর শাসনকর্তার সাথে সন্ধি স্থাপন করেন। পরবর্তীতে তাঁকে সিজিস্তানের শাসনভার অর্পণ করা হয়। আমীর মু’য়াবিয়া (রা) যিয়াদকে বসরার ওয়ালী নিযুক্ত করার পর আবদুর রহমান ইবনে সামুরাকে ক্ষমতা থেকে অপসারিত করেন। তিনি ফিরে আসেন এবং ৬৭০ সালে বসরায় ইনতিকাল করেন। পরবর্তীকালে তার বংশধরগণ বসরায় একটি শক্তিশালী ও প্রভাবশালী গোত্রের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। (আল-বালাযুরী ফুতহুল বুলদান) ইসলামের দৃষ্টিতে নেতৃত্বের পরিবর্তন প্রত্যেক মুসলিম জনগোষ্ঠির ওপর তাদের নেতা বা রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন করা ফরয। এ প্রসঙ্গে ইমাম জুরযানী বলেন: أَنْ نَصَبَ الْإِمَامِ مِنْ أَتِم مَصَالِحِ الْمُسْلِمِينَ وَاعْظَمِ مَقَاصِدِ الدِّينِ. “ইমাম বা রাষ্ট্রপ্রধান নিয়োগ মুসলমানদের কল্যাণ সাধনের পূর্ণতম ব্যবস্থা এবং দীন ইসলামের সর্বোচ্চ লক্ষ্যে সর্বাধিক মাত্রায় বাস্তবায়ন।” আকাইদে নাসাফী গ্রন্থকার বলেন:

“মুসলিম জনগোষ্ঠির জন্য একজন ইমাম অবশ্যই থাকতে হবে। ইহা অপরিহার্য। তিনি আইন কানুনসমূহ কার্যকর করবেন, শরীয়ত নির্দিষ্ট হদ জারি করবেন, বিপদ-আপদের সকল দিক বন্ধ করবেন, বহিঃশত্রুর আক্রমণ বন্ধের লক্ষ্যে সেনাবাহিনীকে সুসজ্জিত ও সদা প্রস্তুত করে রাখবেন। যাকাত গ্রহণ ও বণ্টন করবেন, বিদ্রোহী, দুষ্কৃতিকারী, চোর, ঘুষখোর, সন্ত্রাসী ও ডাকাত-ছিনতাইকারীদের কঠিন শাসন ও দমন করবেন। জুম’আ ও ঈদের সালাতসমূহ কায়েম করবেন, লোকদের ঝগড়া-

দারসে হাদীস ১৫৫

পৃষ্ঠা:১৪০

বিবাদ মীমাংসা করবেন। মানুষের অধিকার প্রমাণের জন্য (বিচার ব্যবস্থা চালু করবেন) সাক্ষ্য গ্রহণ করবেন। অভিভাবকহীন দুর্বল, অক্ষম বালক- বালিকাদের বিবাহের ব্যবস্থা করবেন। জাতীয় সম্পদ জনগণের মধ্যে বন্টন করে দেবেন। (আকাঈদে নাসাফী: ৩৩৮ পৃঃ)অসৎ নেতৃত্ব পরিবর্তনের উদ্দেশ্য হচ্ছে খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা। আর খিলাফত প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর দীনকে প্রতিষ্ঠা করা। هي خلافَةُ الرَّسُولِ فِي إِقَامَةِ الدِّين.

“নেতৃত্ব হলো দীনকে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে রাসূল (সা)-এর উত্তরাধিকারিত্ব।” (কিতাবুল মাওয়াকিফ)

আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা, উহার প্রচার ও প্রসার এবং মানবতার কল্যাণ সাধনের জন্য সমাজে সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য। তাই সমাজের লোকদেরকে সুসংগঠিত হয়ে অসৎ ও খোদা বিমুখ লোকদের নেতৃত্বকে উৎখাত করে সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল স্তরে ঈমানদার, খোদাভীরু ও যোগ্য লোকদের হাতে সে নেতৃত্ব তুলে দিতে হবে। যখন সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে তখন তোমাদেরকে আল্লাহর দীনের উপর অটল থাকতে হবে। আল্লাহর বাণী: فَاصْبِرْ لِحُكْمِ رَبِّكَ وَلَا تُطِعْ مِنْهُمْ إِنَّمَا أَوْكَفُورًا. “অতঃপর তোমার প্রভুর হুকুম, নির্দেশ ও কর্তৃত্বের উপর অটল, অবিচল হয়ে থাকো, আর তাদের কোন এক একজন পাপিষ্ঠ অবিশ্বাসীর আনুগত্যও করো না। (সূরা-আদ-দাহার: ২৪) إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمْنَتِ إِلَى أَهْلِهَا.

“হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় আমানত উপযুক্ত ব্যক্তিদের হাতে অর্পণ করার নির্দেশ দিচ্ছেন।” (সূরা-আন নিসা: ৫৮) এ আয়াতের তাফসীরে মুফতী মুহাম্মদ শফী (র) বলেনঃ রাষ্ট্রীয় যত পদ ও মর্যাদা আছে, সবই আল্লাহর আমানত। এসব পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরা

১৫৬ দারসে হাদীস

পৃষ্ঠা:১৪১

আমানতদার। রাষ্ট্রীয় পদে নিয়োগের জন্যে যোগ্য ব্যক্তির সন্ধান করা অবশ্য কর্তব্য। রাষ্ট্রীয় পদের সাথে জনগণের অধিকার জড়িত, তাই সেটাও আমানতের অন্তর্ভুক্ত। এসব আমানতের অধিকারী সেসব লোক যারা নিজেদের যোগ্যতা, দক্ষতা ও সমর্থনের দিক থেকে সর্বোত্তম, আর বিশ্বস্ততা ও রাষ্ট্রীয় আমানত রক্ষার দিক থেকে অগ্রগণ্য। এদের ছাড়া কাউকে রাষ্ট্রীয় আমানত অর্পণ করা হলে আমানতের মর্যাদা রক্ষিত হবে না।” (শরীয়তের দৃষ্টিতে ভোট)

আল্লামা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (র) বলেনঃ “বনি ঈসরাঈল সম্প্রদায়ের একটি বড় অপরাধ ছিল তারা তাদের পতনের যুগে দায়িত্বপূর্ণ পদ অযোগ্য, অসৎ, সংকীর্ণমনা, দুশ্চরিত্র, দুর্নীতিপরায়ণ, খিয়ানতকারী ও ব্যভিচারী লোকদের হাতে অর্পণ করেছিল। আর এসব অসৎ নেতৃত্বের কারণে গোটা জাতি অনাচারে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল। (সংক্ষিপ্ত) অথচ আল্লাহর আদেশ হচ্ছে, “এমন লোকের (নেতৃত্ব) আনুগত্য করো না যার অন্তরকে আমি আমার স্মরণ থেকে গাফিল করে দিয়েছি, যে নিজের প্রবৃত্তির দাসত্ব করে এবং যার কার্যক্রম উগ্র ও উদাসীন।” (সূরা আল-কাহাফ ২৮)

এ আলোচনা দ্বারা বুঝা গেল যে, যোগ্য লোকদেরকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করা ফরয। আর এ জন্যই অসৎ নেতৃত্ব উৎখাত করে, সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শামিল হওয়া অপরিহার্য।

অনৈসলামিক রাষ্ট্রে নেতা নির্বাচন যেখানে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত নেই সেখানে কোন ইসলামী দল দেশের সাধারণ নির্বাচনে প্রার্থী দাঁড় করিয়ে ভোট প্রার্থনা করলে তা জায়েয। কারণ, ইহা জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহর অংশ বিশেষ। আল্লাহর দীন কায়েমের জন্য যখন যে পদ্ধতি অবলম্বন করা প্রয়োজন তা শরীয়তের সীমার মধ্যে থেকে করলে তাতে কোন দোষ নেই। তাছাড়া জনগণের সামনে না আসলে কি করে সৎ ও অসৎ নেতৃত্বের পার্থক্য বুঝতে পারবে।

দারসে হাদীস ১৫৭

পৃষ্ঠা:১৪২

আল্লাহর বাণীঃ “হে ঈমানদারগণ! তোমরা সুবিচার প্রতিষ্ঠার পক্ষে শক্ত হয়ে দাড়াও, আল্লাহর জন্য সাক্ষ্যদাতা হয়ে দাড়াও।” (সূরা-নিসা: ১৩৫) “হযরত ইউসুফ (আ) বললেন, আমাকে দেশের যাবতীয় ধন-সম্পদের উপর দায়িত্বশীল বানিয়ে দাও, আমি অধিক সংরক্ষণকারী ও বিষয়টি সম্পর্কে আমি অধিক অবহিত। (সূরা ইউসুফ: ৫৫) ইহা এক প্রকার জিহাদ যাকে ভোটের জিহাদ বা ভোট যুদ্ধ বলে। এ জিহাদে প্রার্থী হয়ে এবং ভোট দিয়ে দায়িত্ব পালন করতে হবে। যার উদ্দেশ্য হবে- مَنْ قَاتَلَ لِتَكُونَ كَلِمَةَ اللَّهِ هِيَ الْعُلْيَا فَهُوَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ. “যে আল্লাহর বাণীকে সমুন্নত করার জন্য লড়াই করে সে-ই আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে।” (বুখারী) কুরআন হাদীসের এ আলোচনা থেকে বুঝা যায় আল্লাহর বাণীকে সমুন্নত রাখার জন্যই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়া একান্ত জরুরী। রাসূল (সা) মদীনায় রাষ্ট্র প্রধান হওয়ায় এবং দেশের সকল কর্তৃত্ব তাঁর হাতে থাকায় আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা করা সহজ হয়। আর খুলাফায়ে রাশেদাও তাঁর পদাংক অনুসরণ করেন।

নির্বাচনে অংশ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা: যে কোন মুসলিম অধ্যুষিত দেশে দেশ পরিচালনা কিংবা আইন প্রবর্তনের জন্যে নির্বাচনের মাধ্যমে যদি তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় তা হলে আল্লাহ তা’য়ালার আইন বাস্তবায়ন ও রাসূল (সা)-এর আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য এবং সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে যোগ্য, সৎ, খোদাভীরু ও আমানতদার লোকদেরকে নির্বাচিত করার জন্য ঐ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা প্রত্যেক মুসলমানের ঈমানী, সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ব। যদিও বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতি ইসলাম সম্মত নয় তথাপি মুসলিম রাষ্ট্রে ইসলামী মূল্যবোধের ভিত্তিতে নির্বাচন পদ্ধতিকে অন্তর্বর্তীকালীন বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করা ছাড়া উপায় নাই। (শরীয়তের দৃষ্টিতে ভোট, মুফতী মুহাম্মদ শফী র.)

১৫৮ দারসে হাদীস

পৃষ্ঠা:১৪৩

ইসলামী দলে নেতা নির্বাচন: ইসলামী রাষ্ট্রের কোন পদে প্রার্থী হওয়া বা নিজেকে প্রার্থীরূপে দাঁড় করানোর অধিকার কারো নেই। সেভাবেই ইসলামী দলেও কোন পদের জন্য প্রার্থী হওয়া যায় না। কিন্তু পদের জন্য অন্য কোন ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করা জায়েয। তাতে নিজের লোভের কোন প্রকাশ থাকে না। ব্যক্তির নিজের প্রার্থী হওয়ার অর্থ হলো নিজেকে বড় মনে করা, যা ইসলামে না জায়েয। কিন্তু দলের পক্ষ হতে ইসলামী সংগঠনের নেতাকে ঐ গঠনতন্ত্র অনুসারে দলের কর্মীগণ স্বাধীনভাবে নির্বাচন করেন। নির্বাচিত হওয়ার পর সে দায়িত্ব পালন করা ফরয। ইসলামী দল কোন ব্যক্তিকে যোগ্য হিসেবে নির্বাচন অথবা মনোনীত করলে সে ক্ষেত্রে তার আপত্তি করার কোন সুযোগ থাকবে না এবং দুর্বলতাও প্রদর্শন করা যাবে না। তখন দলের দায়িত্ব পালন করা অপরিহার্য। ইসলামী নেতৃত্ব কোন পদের নাম নয়, ইহা দায়িত্বের নাম। কাজেই দায়িত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ববান লোক নিয়োগ করা জরুরী। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর রাসূল (সা) বলেনঃ “লোকদের ইমাম বা নেতা হবেন সে ব্যক্তি, যে তাদের মধ্যে কুরআনের জ্ঞান সবচেয়ে বেশী রাখেন, এ ব্যাপারে যদি সকলে সমান হয়, তাহলে হাদীস সম্পর্কে অধিক জ্ঞানী ব্যক্তি ইমাম হবেন, যদি এ বিষয়েও সকলে সমান হয় তবে তাদের মধ্যে যে সকলের আগে হিজরত করেছেন। এ ক্ষেত্রে সমান হলে বয়সে প্রবীণ ব্যক্তি ইমামতি করবেন। কোন ব্যক্তি যেন অপর ব্যক্তির প্রভাবাধীন এলাকায় ইমামতি না করে এবং তার বাড়ীতে তার অনুমতি ব্যতীত তার জন্য নির্দিষ্ট আসনে না বসে। (মুসলিম, মুসনাদে আহমদ) বুঝা গেল রাষ্ট্র প্রধানকে-

১। নামাযের ইমামতি করার যোগ্যতা থাকতে হবে।

২। কুরআনের জ্ঞান থাকতে হবে।

৩। সুন্নাহ তথা ইসলামের পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকতে হবে।

৪। হিজরতে অগ্রগামী অর্থাৎ নির্দেশ পালনে অগ্রসর হতে হবে।

৫। বয়সে প্রবীণ হতে হবে।

দারসে হাদীস ৫ ১৫৯

পৃষ্ঠা:১৪৪

শরীয়তে নামায ও রাষ্ট্রীয় ইমামতিতে একই গুণাবলী নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। নামাযের ইমামতি রাষ্ট্রীয় ইমামতির প্রশিক্ষণ দেয়। এ কারণেই ইসলামী সংগঠন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদে নির্বাচনের জন্যে নিম্নের গুণাবলীকে প্রাধান্য দেয়।

১. দীনি ইল্ম অর্থাৎ সর্বাধিক জ্ঞানী ব্যক্তি। যার ইসলামী সংগঠন পরিচালনার যথেষ্ট জ্ঞান থাকবে।

২. খোদাভীরু অর্থাৎ তাকওয়াবান। যিনি সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর আনুগত্য করে চলেন।

৩. রাসূলের আনুগত্য অর্থাৎ সুন্নাহ মোতাবেক সার্বিক কাজ পরিচালনা করবেন।

৪. আমানতদার অর্থাৎ যিনি হবেন সকল কাজের ও সম্পদের আমানত রক্ষায় সচেষ্ট ব্যক্তি।

৫. উন্নত আমল অর্থাৎ তাঁর আমল-আখলাক হবে সবচেয়ে উন্নত ও অনুসরণীয়।

৬. অনড় মনোবল অর্থাৎ কাপুরুষ, ভীরু নয়; অনড় মনোবলের অধিকারী।

৭. কর্মে দৃঢ়তা অর্থাৎ যার কর্মে দৃঢ়তা আছে, যিনি অস্থিরতা ও হীনমন্যতায় ভোগেন না।

তাছাড়া যিনি সাহসী, পরিশ্রমী, ইনসাফগার, ধৈর্যশীল, পরামর্শ গ্রহণের ও জবাবদিহিতার মানসিকতাসম্পন্ন, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, বিশ্লেষণ শক্তি, উদ্ভাবন শক্তি, প্রশস্ত চিত্ততা, সুন্দর ব্যবহার, মেজাজের ভারসাম্য, সাংগঠনিক প্রজ্ঞা ও সাংগঠনিক শৃংখলা বিধানের যোগ্যতা রাখেন।

শিক্ষা

১। ইসলামী রাষ্ট্র বা দলে পদ প্রার্থী হওয়া যায় না।

২। কোন পদের জন্য লালায়িত হওয়া উক্ত পদের জন্য অযোগ্যতার শামিল।

৩। কোন পদ জবর দখল করলে তাতে আল্লাহর সাহায্য পাওয়া যাবে না।

৪। জনগণের পক্ষ থেকে কোন দায়িত্ব অর্পিত হলে তা পালন করা কর্তব্য।

৫। না চেয়ে দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হলে তার জন্য আল্লাহর সাহায্য পাওয়া যাবে।

Home
E-Show
Live TV
Namaz
Blood
Job