রক্তের বিষ
পৃষ্ঠা ০১ থেকে ১০
পৃষ্ঠা -১
কুকুরগুলো বাইরে খ্যাঁকাচ্ছে। সে এমন চ্যাংড়ামি যে মাথা গরম হয়ে যায়।গগনচাঁদ উঠে একবার গ্যারাজঘরের বাইরে এসে দাঁড়াল। লাইটপোস্টের তলায় একটা ভিখিরি মেয়ে তার ছুটো বাচ্চাকে নিয়ে খেতে বসেছে। কাপড়ের আঁচল ফুটপাথে পেতে তার ওপর উচ্ছিষ্ট খাবার জড়ো করেছে। কুকুরগুলো চারধারে ঘিরে দাঁড়িয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে যাচ্ছে লাগাতার।গগনচাঁদ একটা ইট কুড়িয়ে নিয়ে নির্ভুল নিশানায় ছুঁড়ে কুকুরটার পাছায় লাগিয়ে দিল। কুকুরটার বীরত্ব ফুস করে উড়ে যায়, কেউ কেউ করতে করতে নেংচে সেটা পালায়। সঙ্গে আরগুলো। গগনচাঁদ ফের তার গ্যারাজঘরে এসে বসে। রাত অনেক হল। গগনচাঁদের ভাত ফুটছে, তরকারির মশলা এখনো পেশা হয়নি।মশলা পিষবার শিল-নোড়া গগনের নেই। আছে একটা হামানদিস্তা। তাইতেই সে হলুদ গুঁড়ো করে, ধনে-জিরে ছাতু করে ফেলে। একটা অসুবিধে এই যে, হামানদিস্তায় একটা বিকট টং টং শব্দ ওঠে। আশপাশের লোক বিরক্ত হয়। আর এই বিরক্তির ব্যাপারটা গগন খুব পছন্দ করে।এখন রাত দশটা বাজে। গ্রীষ্মকাল। চারপাশেই লোকজন জেগে আছে। রেডিও বাজছে, টুকরো-টাকরা কথা শোনা যাচ্ছে, কে এক কলি গান গাইল, বাসন-কোসনের শব্দও হয়। গগন ামানদিস্তা নিয়ে হলুদ গুড়ো করতে বসে। আলু ঝিঙে আর পটল কাটা আছে, ঝোলটা হলেই হয়ে যায়।
পৃষ্ঠা -২
গ্যারাজটায় গাড়ি থাকে না, গগন থাকে। গ্যারাজের ওপরে নীচু ছাদের একখানা ঘর আছে, সেটাতে বাড়িওলা নরেশ মজুমদারের অফিসঘর। কয়েকখানা দোকান আছে তার কলেজ স্ট্রীট মার্কেটে। নিজের ছেলেপুলে নেই, শালীদের দু-তিনটে বাচ্চাকে এনে পালে পোষে। তার বৌ শোভারাণী ভারী দজ্জাল মেয়েছেলে। শোভা মাঝে মাঝে ওপরের জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে বলে-শিল-নোড়া না থাকে তো-বাজারের গুঁড়ো মশলা প্যাকেটে ভরে বিক্রি, হয়, নাকি সেটা কারো চোখে পড়ে না? হাড়-হারামজাদা পাড়া-জ্বালানী গু-খেগোর ব্যাটার। সব জোটে এসে আমার কপালে!
সরাসরি কথা বন্ধ। বাড়িতে একটা মাত্র কল, বেলা ন’টা পর্যন্ত তাতে জল থাকে। জলের ভাগীদার অনেক। গ্যারাজে গগন। রাতে নরেশের কিছু কর্মচারী শোয় ওপরতলার মেজেনাইন ক্লোরে। সব মিলিয়ে পাঁচজন। ভিতর-বাড়ির আরো চার ঘর ভাড়াটের ষোলো-সতেরোজন মিলে মেলাই লোক। একটা টিপকল আছে, কিন্তু সেটা এত বেশি ঝকাং ঝকাং হয় যে বছরে ন’মাস বিকল হয়ে থাকে। জল উঠলেও বালি মেশানো ময়লা জল উঠে আসে। তাই জলের হিসেব ঐ একট। মাত্র কলে। অন্য ভাড়াটেদের অবন্ধু ঘরে ঘরে কল আছে, কিন্তু মাথা উচু কল বলে তাতে ডিমসুতোর মত জল পড়ে। উঠোনের কলে তাই হুড়োহুড়ি লেগেই থাকে। একমাত্র নরেশের ঘরেই অঢেল জল। নেয়। কিন্তু সে জল কেউ পায় না, গগনচাঁদ কিছু গম্ভীর মানুষ, উপরন্ত ব্যায়াম-শিক্ষক, তার বাপতি কিছু বড় নিজের আগে জল ভরতে দেয় না। নিজের পাম্পে সে জগ তুলে এমন কি তার কর্মচারীরাও নয়। কলেজ আর তিনটে ক্লাবের এবং ভারী। কাউকে সে নরেশ মাস আটেক আগে জলের বখেড়ায় গগনচাঁদকে বলেছিল-আপনার খুব তেল হয়েছে। তাতে গগনচাঁদ তার গলাটা এক হাতে ধরে অন্য হাতে চড়
পৃষ্ঠা -৩
তুলে বলেছিল-এক থাপ্পড়ে তিন ঘণ্টা কাঁদাব। সেই থেকে কথা বন্ধ।গগন গুঁড়োমশলা কিনতে যাবে কোন্ ছঃখে!ভেজাল আর ধুলোবালি মেশানো ঐ অখাদ্য কেউ খায়? তাছাড়া হামানদিস্তায় মশলা গুঁড়ো করলে শরীরটাকে আরো কিছু খেলানো হয়। শরীর খেলাতে গগনের ক্লান্তি নেই।গ্যারাজের দরজা মস্ত বড়। বাতাস এসে তো স্টোভে আগুনটাকে নাচায়। গগন উঠে গিয়ে টিনের পাল্লা ভেজিয়ে দিতে। যাচ্ছিল। নজরে পড়ল আকাশে মেঘ চমকাচ্ছে। গ্রীষ্মের শেষ, এবার বাদলা শুরু হবে। ঠাণ্ডা ভেজা একটা হাওয়া এল। গগন ভ্রুকু’ চকে তাকায়। অন্ত্য ঋতু ততটা নয় যতটা এই বাদলা দিনগুলো তাকে জ্বালায়। গ্যারাজের ভিত নীচু, রাস্তার সমান সমান। একটু বৃষ্টি হলেই কল কল করে ঘরে জল ঢুকে আসে। প্রায় সময়েই বিষৎ- খানেক জলে ডুবে যায় ঘরটা। সামনের নর্দমার পচা জল। সেই সঙ্গে উচ্চিংড়ে, ব্যাঙ এবং কখনো-সখনো ঢোঁড়া সাপ এসে ঘরে ঢুকে পড়ে। তা সে-সব কীটপতঙ্গ বা সরীসৃপ নিয়ে মাথা ঘামায় না গগন। ময়লা জলটাকেই তার যত ঘেন্না। ছটো কাঠের তাক করে নিয়েছে, তোরঙ্গটা তার ওপর তুলে রাখে, কেরোসিন কাঠের নড়বড়ে টেবিলে স্টোভ জ্বেলে চৌকিতে বসে সাহেবী কায়দায় রান্না করে গগন বর্ষা- কালে। সে বড় ঝঞ্ঝাট। তাই আকাশে মেঘ দেখলে গগন খুশী হয় না।এখনো হল না। কিন্তু আবার বর্ষা-বৃষ্টিকে সে ফেলতেও পারে না। এই কলকাতার শহরতলীতে বৃষ্টি যেমন তার না-পছন্দ, তেমনি আবার মুরাগাছা গাঁয়ে তার যে অল্প কিছু জমি-জিরেত আছে সেখানে বৃষ্টি না হলে মুশকিল। না হোক বছরে চল্লিশ-পঞ্চাশ মণ ধান তো হয়ই। তার কিছু গগন বেচে দেয়, আর কিছু খোরাকি বাবদ লুকিয়ে কলকাতায় নিয়ে আসে।
পৃষ্ঠা -৪
মেঘ থেকে চোখ নামিয়েই দেখতে পায় ল্যাম্পপোস্টের আলোর চৌহদ্দি ফুড়ে সুরেন খাঁড়া আসছে। সুরেন এক সময় খুব শরীর করেছিল। পেটের পেশী নাচিয়ে নাম কিনেছিল। এখন একটু মোটা হয়ে গেছে। তবু তার দশাসই চেহারাটা রাস্তায় ঘাটে মানুষ ছুপলক ফিরে দেখে। সুরেন গুণ্ডামী নষ্টামি করে না বটে, কিন্তু এ তল্লাটে সে চ্যাংড়াদের জ্যাঠামশাই গোছের লোক। লরীর ব্যবসা আছে, আবার একটা ভাতের হোটেলও চালায়।সুরেন রাস্তা থেকে গোঁত্তা-খাওয়া ঘুড়ির মত ঢুকে এল গ্যারাজের দিকে।বলল-কাল রাত থেকে লাশটা পড়ে আছে লাইন ধারে। এবার গন্ধ ছাড়বে।
গম্ভীর গগন বললছ।-ছোকরাটা কে তা এখনো পর্যন্ত বোঝা গেল না। তুমি গিয়ে দেখে এসেছ নাকি?-না। শুনেছি।ঘরে ঢুকে সুরেন চৌকির ওপর বসল। বলল- প্রথমে শুনেছিলাম খুন। গিয়ে দেখি তা নয়। কোনখানে চোট-ফোট নেই। রাতের শেষ ডাউন গাড়িটাই টক্কর দিয়ে গেছে। কচি ছেলে, সতেরো-আঠার বছর হবে বয়স। বেশ ভাল পোশাক-ঢোশাক পরা, বড় চুল, জুলপী, গোঁফ সব আছে।-হু। গগন বলল।হামানদিস্তার প্রবল শব্দ হচ্ছে। ভাত নেমে গেল, কড়া চাপিয়ে জিরে-ফোড়ন ছেড়ে দিয়েছে গগন। সঙ্গে একটা তেজপাতা। সাঁতলানো হয়ে গেলেই মশলার গুঁড়ো আর শুন দিয়ে ঝোল চাপিয়ে দেবে।সুরেন খাড়ার খুব ঘাম হচ্ছে। টেরিলিনের প্যান্ট আর শাট পরা, খুব টাইট হয়েছে শরীরে। বুকের বোতাম খুলে দিয়ে বলল- বড্ড গুমোট গেছে আজ। বৃষ্টিটা যদি হয়!
পৃষ্ঠা -৫
-হবে। গগন বলে-হলে আর তোমার কি। দোতলা হাঁকড়েছ, টঙের ওপর উঠে বসে থাকবে।সুরেন ময়লা রুমালে ঘাড়ের ঘাম মুছে ফেলল, তারপর সেটা গামছার মত ব্যবহার করতে লাগল মুখে আর হাতে। ঘষে ঘষে ঘাম মুছতে মুছতে বলে-তোমার ঘরে গরম বড় বেশী, ড্রেনের পচা গন্ধে থাক কি করে?-প্রথমে পেতাম গন্ধটা। এখন সয়ে গেছে, আর পাই না। চার সাড়ে চার বছর একটানা আছি।
-তোমার ওপরতলার নরেশ মজুমদার হারামজাদা তো আবার বাড়ি হাঁকড়াচ্ছে ঝিল রোডে। একতলা শেষ, দোতলারও ছাদ যখন- তখন ঢালাই হয়ে যাবে। একবার ধরে পড়ো না, নীচের তলাকার একখানা ঘর ভাড়া দিয়ে দেবে সস্তায়।গগন ভাতের ফ্যান-গালা সেরে ঝোলের জল ঢেলে দিল। তারপর গামছায় হাত মুছতে মুছতে বলল-তা বললে বোধ হয় দেয়। ওর বৌ শোভারাণী খুব পছন্দ করে কিনা আমাকে। একটু আগেও আমার গুষ্টির শ্রাদ্ধ করছিল।-একদিন উঠে গিয়ে ঝাপড় মারবে একটা, আর রা কাটবে না।গগন মাথা নেড়ে বলে-ফুঃ! একে মেয়েছেলে, তার ওপর বৌ মানুষ। বলে হাসে গগন। একটু গলা উঁচু করে, যেন ওপরতলায় জানান দেওয়ার জন্যই বলে-দিক না একটু গাল-মন্দ, আমার তো বেশ মিঠে লাগে। বুঝলে হে সুরেন, আদতে ও মাগী আমাকে পছন্দ করে, তাই ঝাল ঝেড়ে সেটা জানিয়ে দেয়।মেয়েমানুষের স্বভাব জান তো, যা বলবে তার উল্টোটা ভাববে। বলেই একটু উৎকর্ণ হয়ে থাকে গগন। সুরেনও ছাদের দিকে চেয়ে বসে থাকে। মুখে একটু হাসি দুজনেরই। শোভারাণীর অবশ্য কোন সাড়া পাওয়া যায় না। ওপরে কোন বাচ্চা বুঝি স্কিপিং
পৃষ্ঠা -৬
করছে, তারই ঢিপ ঢিপ শব্দ আসছে, আর মেঝেতে ঘুরন্ত দড়ির খধা লাগার শব্দ।নরেশচন্দ্র বড় চতুর বাড়িওলা। ভাড়াটে ওঠানোর দরকার পড়লেই সে অন্ত কোন বখেড়ায় না গিয়ে বৌ শোভারাণীকে টুইয়ে দেয়। শোভার মুখ হল আস্তাকুঁড়। সে তখন সেই ভাড়াটের উদ্দেশে আস্তাকুড়ের ঢাকনা খুলে আবর্জনা ঢালতে শুরু করে। সে বাক্য যে শোনে তার কান দিয়ে তপ্ত সিসে ঢালার চেয়েও বেশী কষ্ট হয়। সে বাক্য শুনলে গত জন্মের পাপ কেটে যায় বুঝি। শোভারাণী অবশ্য এমনি এমনি গাল পাড়ে না। নতুন ভাড়াটে এলেই তার ঘরদোরে আপনজনের মত যাতায়াত শুরু করে, বাটি বাটি রান্না করা খাবার পাঠায়, দায়ে-দফায় গিয়ে বুক দিয়ে পড়ে। ঐভাবেই তাদের সংসারের হাল-চাল, গুপ্ত খবর সব বের করে আনে। কোন সংসারে না ছটো চারটে গোপন ব্যাপার আছে! সেই সব খবরই গুপ্ত অস্ত্রের মত শোভার ভাঁড়ারে মসৃত থাকে। দরকার মত কিছু রং-পালিশ করে এবং আরো কিছু বানানো কথা যোগ করে শোভা দিন-রাত চেঁচায়। ভাড়াটে পালানোর পথ পায় না। গগনও শোভার দম দেখে অবাক হয়ে বলে-এ তো হামিদা বাস্তুর চেয়ে বেশী কলজের জোর দেখতে পাই!একমাত্র গগনেরই কিছু তেমন জানে না শোভা। না জানলেও আটকায় না। যেদিন নরেশকে ঝাঁকি দিয়েছিল গগন, সেদিন শোভারাণী একনাগাড়ে ঘন্টা আষ্টেক গগনের তাবৎ পরিবারের শ্রাদ্ধ করেছিল। বেশ্যার ছেলে থেকে শুরু করে যত রকম বলা যায়। গগন গায়ে মাখেনি, তবে ক্লাবের ছেলেরা পরদিন সকালে এসে বাড়ি ঘেরাও করে। ব্রজ দত্ত নামে সব চেয়ে মারকুট্টা যে চেলা আছে গগনের সে দোতলায় উঠে নরেশকে ডেকে শাসিয়ে দিয়ে যায়। মারত, কিন্তু গগন ওরকমধারা দুর্বলের গায়ে হাত তোলা পছন্দ করে না বলে মারেনি। তাতে শোভারাণীর মুখে কুলুপ পড়ে যায়। কিন্তু রাগটা
পৃষ্ঠা -৭
তো আর যায় নি। বিশেষতঃ গগন তখনো ইচ্ছেমত জল তোলে, কলে কোনদিন জল না এলে নরেশের চাকরকে ডেকে ওপরতলা থেকে বাপতি বালতি জল আনিয়ে নেয়। শোভা রাগ করে হয়তো, কিন্তু জল দিয়ে দেয়। ঝামেলা করে না।ভেবে দেখলে গগন কিছু খারাপ নেই। কেবল ঐ বর্ষাকালটাকেই যা তার ভয়।-লাশটার কথা ভাবছি, বুঝলে গগন!-কী ভাবছ?-এখনো নেয়নি। গন্ধ ছাড়বে।-নেবে’খন। সময় হলে ঠিক নেবে।-ছেলেটা এখানকার নয় বোধ হয়। সারাদিনে কম করে দু-চার শ’ লোক দেখে গেছে, কেউ চিনতে পারছে না। -এসেছিল বোধ হয় অন্ত কোথা থেকে। ক্যানিং-ট্যানিং-এর ওদিককার হতে পারে।সুরেন মাথা নেড়ে বলে-বেশ ভদ্রঘরের ছাপ আছে চেহারায়। কসরৎ করা চেহারা।গগন একটু কৌতূহলী হয়ে বলে-ভাল শরীর?-বেশ ভাল। তৈরী।-আহা! বলে শ্বাস ছেড়ে গগন বলে-অমন শরীর নষ্ট করল?সুরেন খাঁড়া বলে-তাও তো এখনো চোখে দেখোনি, আহা-উত্ত করতে লাগলে!-ওসব চোখে দেখা আমার সহ্য হয় না। অপঘাত দেখলেই মাথা বিগড়ে যায়। গত মাঘ মাসে চেতলার দিদিমাকে পোড়াতে নিয়ে গিয়েছিলাম কেওড়াতলায়। সেখানে দেখি রাজ্যের কলেজের মেয়ে হাতে বই-খাতা নিয়ে জড়ো হয়েছে। সব মালা আর ফুলের তোড়া নিয়ে এসেছে, একটা খাট ঘিরে ভিড়, শুনলাম কলেজের প্রথম বছরের মেয়ে একটা। সে দেওয়ালীর দিন সিম্বোটক ফাই-
পৃষ্ঠা -৮
বারের শাড়ি পরে বেরোতে যাচ্ছিল, আগুন লেগে তলার দিকটা পুড়ে যায়। ঐসব সিন্থেটিক কাপড়ও খুব ডেঞ্জারাস, বুঝলে সুরেন? ওতে আগুন লাগলে তেমন দাউ দাউ করে জ্বলবে না, কিন্তু ফাইবার গলে গায়ের সঙ্গে আঠার মত সেঁটে যাবে, কেউ খুলতে পারবে না। মেয়েটারও তাই হয়েছিল, কয়েক মাস হাসপাতালে থেকে শেষ পর্যন্ত মারা গেছে। ভিড়-টিড় ডিঙিয়ে উকি মেরে দেখে তাই তাজ্জব হয়ে গেলাম। ঠোঁট ছুটো একটু শুকনো বটে, কিন্তু কি মরি-মরি রূপ, কচি, ফর্সা! ঢল ঢল করছে মুখখানা। বুকের মধ্যে কেমন যে করে উঠল!সুরেন খাঁড়া বলে-ওরকম কত মরছে রোজ! গগনচাঁদ ব্যাপারটা ‘কত’-র মধ্যে ফেলতে চায় না, বলল-না হে, এ মেয়েটাকে সকলের সঙ্গে এক করবে না। কী বলব তোমাকে, বললে পাপ হবে কিনা তাও জানি না, আমার বুকে ভালবাসা জেগে উঠল। সেই মরা মেয়েটাকে দেখে ভাবলাম, ও যদি এক্ষুনি বেঁচে ওঠে তো ওকে বিয়ে করি। সেই ছেলেবেলা থেকে অপঘাতে মৃত্যুর ওপর আমার বড় রাগ। কেন যে মানুষ অপঘাতে মরে। সুরেন রুমালে ঘাড় গলা ঘষতে ঘষতে বলে-তোমার শরীরটাই হোঁৎকা, মন বড্ড নরম। মনটা আর একটু শক্ত না করলে কি টিকতে পারবে? চারদিকের এত অপঘাত, মৃত্যু, অভাব-এসব সইতে হবে না?গগনচাঁদ একটু থমকে গিয়ে বলে-তোমাদের এক এক সময়ে এক এক রকমের কথা। কখনো বলছ গগনের মন নরম, কখনো বল গগনের মেজাজটা বড় গরম। ঠিক ঠিক ঠাহর পাও না নাকি!সুরেন বলে-সে তত্ত্ব এখন থাক, আমি লাশটার কথা ভাবছি।-ভাবছ কেন?-ভাবছি ছেলেটার চেহারা দেখেই বোঝা যায় যে কসরৎ
পৃষ্ঠা -৯
করত। তুমি তো ব্যায়াম শেখাও, তা তোমার ছাত্রদের মধ্যে কেউ কিনা তা গিয়ে একবার দেখে আসবে নাকি?গগন ঝোল নামিয়ে এক ফুঁয়ে জনতা স্টোভ নিভিয়ে দিল।বলল-ও, তাই আগমন হয়েছে!-তাই।-কিন্তু ভাই, ওসব দেখলে আমার রাতের খাওয়া হবে না।-খেয়ে নিয়েই চল, আমি ততক্ষণ বসি।গগন মাথা নেড়ে বলে-তাও হয় না, খাওয়ার পর ওসব দেখলে আমার বমি হয়ে যেতে পারে।সুরেন বলে-তুমি আচ্ছা লোক হে! বলছি তো তেমন ঘেন্নার দৃশ্য কিছু নয়, কাটা-ফাটা নেই, এক চামচে রক্তও দেখলাম না কোথাও। তেমন বীভৎস কিছু হলে না হয় কথা ছিল।গগনের চেহারায় যে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস আর শান্ত দৃঢ় ভাবটা থাকে সেটা এখন আর রইল না। হঠাৎ সে ঘামছিল, অস্বস্তি বোধ করছিল।বলল-কার না কার বেওয়ারিশ লাশ! তোমার তা নিয়ে অত মাথাব্যথা কেন? ছেড়ে দাও, পুলিস যা করার করবে। সুরেন ভ্রু কুচকে গগনকে একটু দেখল। বলল-সে তো মুখ্যুও জানে। কিন্তু কথা হল, আমাদের এলাকায় ঘটনাটা ঘটে গেল। অনেকের সন্দেহ, খুন। তা সে যাই হোক, ছেলেটাকে চেনা গেলে অনেক ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে যায়। পুলিস কত কি করবে তা তো ছানি! সুরেন এ অঞ্চলের প্রধান। গগন তা জানে। সে নিজে এখানে পাঁচ-সাত বছর আছে বটে, কিন্তু তার প্রভাব-প্রতিপত্তি তেমন কিছু নয়। এক গোটা-পাঁচেক জিমনাসিয়ামের কিছু ব্যায়ামের শিক্ষান- বাঁশ আর স্থানীয় কয়েকজন তার পরিচিত লোক। সুরেনের মত সে এখানকার শিকড়গাড়া লোক নয়। সুরেনের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব
পৃষ্ঠা -১০
ভালই, কিন্তু এও জানে, সুরেনের মতে মত না দিয়ে চললে বিস্তর ঝামেলা। পুরেনের টাকার জোর আছে, দলের জোর আছে, নিজেকে সে এ অঞ্চলের রাজা ভাবে। বিপদ সেখানেই, এ অঞ্চলে যা ঘটে সব তার নিজের দায় বলে মনে করে সুরেন। ক্ষেপে গেলে সে অনেক দূর পর্যন্ত যায়।
গগন প্যান্ট পরল, জামা গায়ে গলিয়ে নিল। চপ্পল জোড়া পায়ে দিয়ে বলল-চল।-খেলে না?-না। যদি রুচি থাকে তো এসেই যা হোক ছুটো মুখে দেব। নইলে আজ আর যাওয়া হল না।ও দুই ।গতবার সন্তু একটা বেড়ালকে ফাঁসী দিয়েছিল। বেড়ালটা অব্য খুবই চোর ছিল, ছিনতাই করত, মাঝে-মধ্যে দু’একটা ডাকাতিও করেছে। যেমন সত্তর ছোট বোন দুধ খেতে পারে না, রোজ সকালে মারধোরের ভয় দেখিয়ে দুধের গ্লাস হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়, আর তখন খুব অনিচ্ছায় সন্ধর বোন টুটু এক চুমুক করে খায় আর দশ মিনিট ধরে আগড়ম-বাগড়ম বকে, খেলে, বারান্দায় গিয়ে দাড়ায়। এই করতে করতে এক ঘন্টা। ততক্ষণে তুধ ঠাণ্ডা মেরে যায়, মাছি পড়ে। বেড়ালটা এ সবই জেনে তক্কে তকে থাকত। এক সময়ে দেখা যেত, প্রায় সকালেই, সে গেলাস কাৎ করে মেঝেময় তুধ ছড়িয়ে চেটে- পুটে খেয়ে গেছে। এটা চুরি। এরকম চুরি সে হামেশাই করত, আর ছিনতাই করত আরো কৌশলে। পাড়ার বাচ্চাদের খাওয়ার সময়টা কি করে যে তার জানা থাকত কে বলবে। ঠিকঠাক খাওয়ার সময়ে হাজির থাকত সে। মুখোমুখি বসে চোখ বুজে ঘুমনোর ভান করত,
পৃষ্ঠা ১১ থেকে ২০
পৃষ্ঠা ১১
আর শুযোগ হলেই এর হাত থেকে, তার পাত থেকে মাছের টুকরো কেড়ে নিয়ে হাওয়া। ডাকাতি করত মা-মাসীদের ওপর। কেউ মাছ কুটছে, গয়লার কাছ থেকে দুধ নিঞ্চে, কি হরিণঘাটার বোতল থেকে তুধ ডেকচিতে ঢালছে, অমনি হুড় শ করে কোথেকে এসে বাঘের মাসী ঠিক বাঘের মতই অ্যাও করে উঠত। দেখা গেছে মা-মাসীর হাত থেকে মাছ কেড়ে নিতে তার বাধেনি, ছুধের ডেকচিও সে ওল্টাতে জানত মা-মাসীর হাতের নাগালে গিয়ে। ওরকম বাঁদর বেড়াল আর একটাও ছিল না। বিশাল সেই হুলোটা অবশ্য পরিপাটি দাঁতে-নখে ইজুরও মেরেছে অনেক। সিংহবাড়ির ছন্নছাড়া বাগানটায় একাধিক হেলে আর জাতি সাপ তার হাতে প্রাণ দিয়ে শহীদ হয়েছে। গায়ে ছিল অনেক আঁচড়-কামড়ের দাগ, রাস্তার কুকুরদের সঙ্গে প্রায়দিনই তার হাতাহাতি কামড়াকামড়ি ছিল। কুকুররাও, কে জানে কেন, বেশ একটু সমঝে চলত তাকে। রাস্তাঘাটে বেড়াল দেখলেই যেমন কুকুর হামলা করে, তেমন এই হুলোকে কেউ করত না। কে যেন, বোধ হয় রায়েদের বুড়ী মা-ই হবে, বেড়ালটার নাম দিয়েছিল গুণ্ডা। সেই নামই হয়ে গেল। হুলো গুণ্ডা এ পাড়ায় যথেচ্ছাচার করে বেড়াত, ঢিল খেত, লাঠির বাড়ি খেত, গাল তো খেতই।সন্তকে দু-দুটো স্কুল থেকে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে। প্রথমটায় যে স্কুলে সে পড়ত তা ছিল সাহেবী স্কুল, খুব আদবকায়দা ছিল, শৃঙ্খলা ছিল। সেখানে ভর্তি হওয়ার কিছু পরেই সন্তর বাবা অধ্যাপক নানক চৌধুরীকে ডেকে স্কুলের রেক্টর জানালেন -আপনার ছেলে মেন্টালি ডিরেঞ্জড,। আপনারা ওকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখান। আমরা আর দু মাস ট্রায়ালে রাখব, তারপর যদি ওর উন্নতি না হয় তো স্থঃখের সঙ্গে টি-সি দিতে বাধ্য হব।নানক চৌধুরী আকাশ থেকে পড়লেন। আবার পড়লেনও না। কারণ তাঁর মনে বরাবরই একটা খটকা ছিল সন্তু সম্পর্কে। বয়সের তুলনায় সন্তু কিছু বেশী নিষ্ঠুর, কখনো কখনো মার খেলে হেসে ফেলে।
পৃষ্ঠা ১২
এবং এমন সব ছুই মি করে যার কোন মানে হয় না। যেমন সে ছাদের আলসের ওপর সাজিয়ে রাখা ফুলের ভারী টবের একটা ছুটো মাঝে মাঝে ধাক্কা দিয়ে নীচের রাস্তার ওপর ফেলে দেয়। রাস্তায় হাজার লোকে চলে। একবার একটা সন্তুর বয়সী ছেলেরই মাথায় একটা টব পড়ল। সে ছেলেটা দীর্ঘদিন হাসপাতালে থেকে যখন ছাড়া পেল তখন বোধবুদ্ধিহীন জরদগব হয়ে গেছে। যেমন সে একবার সেফটি- পিন দিয়ে টিয়াপাখির একটা চোখ কানা করে দিয়েছিল। টিয়ার চিৎকারে সবাই ছুটে গিয়ে দেখে, একটা চোখ থেকে অবিরল রক্ত পড়ছে, লাল অশ্রুর মত। আর পাখিটা ডানা ঝাপটাচ্ছে আর ডাকছে। সে কি অমান্তষিক চিৎকার। খাঁচার গায়েই সেফটিপিনটা আটকে ছিল। আর একবার সে তার ছোট বোনকে বারান্দার একধারে দাঁড় করিয়ে খুব কাছ থেকে প্রচণ্ড জোরে গুলতি মারে। মরেই যেত মেয়েটা। বুকে লেগে দমবন্ধ হয়ে অজ্ঞান। হাসপাতালে গিয়ে সেই মেয়েকে ভাল করে আনতে হয়। তাই নানক চৌধুরী অবাক হলেও সামলে গেলেন। তবে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে না গিয়ে সপ্তকে বাড়ি ফিরে একনাগাড়ে মিনিট পনেরো ধরে প্রচণ্ড মারলেন।স্থ-মাস পর ঠিক কথামতই টি-সি দিয়ে দিল স্কুল। দ্বিতীয় স্কুলটি অত ভাল নয়। কিন্তু সেখানেও কিছু ডিসিপ্লিন ছিল, ছেলেদের ওপর কড়া নজর রাখা হত। দু-মাস পর সেখান থেকে চিঠি এল আপনার ছেলে পড়াশুনোয় ভাল, কিন্তু অত্যন্ত চঞ্চল, তার জন্ম আর পাঁড়টা ছেলে নষ্ট হচ্ছে।এক বছর বাদে সন্ত সেকেণ্ড হয়ে ক্লাসে উঠল। কিন্তু প্রমোশনের সঙ্গে তাকে টি-সি ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে।অগত্যা পাড়ার কাছাকাছি একটা গোয়ালমার্কা, স্কুলে ছেলেকে ভর্তি করে এবার নিশ্চিন্ত হয়েছেন নানক চৌধুরী। এই স্কুলে দুষ্ট ছেলের দঙ্গল, তার ওপর গরীব স্কুল বলে কাউকে সহজে তাড়িয়ে দেয় না। বিশেষতঃ সন্ধর বেতন সব সময়ে পরিষ্কার থাকে, এব
পৃষ্ঠা ১৩
ক্লাসে সে ফার্স্ট হয়। নানক চৌধুরীকে এখন সন্ধর ব্যাপার, নিয়ে ভাবতে হয় না, তিনি নিজের লেখাপড়ায় মগ্ন থাকেন।সন্ধ এখন ক্লাস নাইনে পড়ে। স্কুলের ফুটবল টিমে সে অপরিহার্য খেলোয়াড়। তা ছাড়া সে একটা ব্যায়ামাগারে ব্যায়াম শেখে। গগনচাঁদ শেখায়। সত্তর খুব ইচ্ছে সে ইন্স্ট্রমেন্ট নিয়ে ব্যায়াম করে। তাতে শরীরের পেশী খুব তাড়াতাড়ি বাড়ে। কিন্তু গগন যন্ত্র ছু’তেই দেয় না, বলে-ওসব করলে শরীর পাকিয়ে শক্ত জিংড়ে মেরে যাবে, বাড়বে না। গগন তাই ফ্রি-জাও করায় আর রাজ্যের যোগব্যায়াম, ব্রিদি, স্কিপিং আর দৌড়। সন্ত অবশ্য সে কথা শোনে না। ফাঁক পেলেই রিং করে, প্যারালাল বার-এ ওঠে, ওজন তোলে, স্প্রিং টানে। গগন দেখলে কাপড় মারবে, কিংবা বকবে। তাই প্রায় সময়েই রাতের দিকে জিমনাসিয়ামে যখন গগন থাকে না, দু-চারজন চাকুরে ব্যায়ামবীর এসে কসরৎ করে আর নিজেদের চেহারা আয়নায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে, তখন সন্তু এসে যন্ত্রপাতি নেড়ে ব্যায়াম করে। গুণ্ডা বেড়ালটাকে গতবার সন্তু ধরেছিল সিংহীদের বাগানে। বাগান বলতে আর কিছু নেই। কোমর-সমান উঁচু আগাছায় ভরে গেছে চারধার। একটা পাথরের ফোয়ারা ভেঙে ফেটে কাৎ হয়ে দাড়িয়ে আছে। কয়েকটা পামগাছের গায়ে বহুদূর পর্যন্ত লতা উঠেছে বেয়ে। সিংহীদের বাড়িতে কেউই থাকে না। বছর দেড়েক আগে বুড়ো নীলমাধব সিংহ মারা গেলেন। হাড়কিপটে লোক ছিলেন। অত বড় বাড়ির মালিক, তবু থাকতেন ঠিক চাকরবাকরের মত, হেঁটো ধুতি, গায়ে একটা জামা, পায়ে রবারের চটি। একটা ঢাকর ছিল, সে-ই দেখাশোনা করত। নীলমাধবের একমাত্র ছেলে বিলেতে থাকে, আর কেউ নেই। অসুখ হলে পৌকটা ডাক্তার ডাকতেন না, নিজেই হোমিওপ্যাথির বাক্স নিয়ে বসতেন। বাজার করতেন নিজের হাতে। যত সস্তা জিনিস এনে রান্না করে খেতেন।
পৃষ্ঠা ১৪
বাগানে কাশীর পেয়ারা, সফেদা, আঁশফল বা জামরুল পাড়তে বাচ্চা- কাচ্চা কেউ ঢুকলে লাঠি নিয়ে তাড়া করতেন। একটা সড়ালে কুকুর ছিল, ভারী তেজী, সেটাকেও লেলিয়ে দিতেন। নিজের ছোঁড়া জামাকাপড় সেলাই করতেন বসে বসে। একটা বুড়ো হরিণ ছিল, সেটা বাগানে দড়িবাঁধা হয়ে চরে বেড়াত। নীলমাধব পাড়ার লোকজনের সঙ্গে বড় একটা কথা বলতেন না, তবে তাঁর সঙ্গে কেউ দেখা করতে গেলে খুশী হতেন, অনেক পুরনো দিনের গল্প ফেঁদে বসতেন। এ অবশ্য নীলমাধবের পৈতৃক সম্পত্তি নয়, দূর-সম্পর্কের জ্যাঠার সম্পত্তি। নিঃসন্তান অ্যাঠা মারা গেলে দেখা যায় উইল করে তিনি নীলমাধবক্ষেই সব দিয়ে গেছেন। লোকে বলে, নীলমাধব এক তান্ত্রিকের সাহায্যে বাণ মেরে জ্যাঠাকে খুন করে সম্পত্তি পান। লোকের ধারণা, নীলমাধব তাঁর স্ত্রীকেও খুন করেছিলেন। এ সবই অবশ্য গুজব, কোন প্রমাণ নেই। তবে কথা চলে আসছে।সন্ত একবার নীলমাধবের হাতে ধরা পড়েছিল। সে বড় সাংঘাতিক ব্যাপার।চিরকালই জীবস্তু কোন কিছু দেখলেই তাকে উত্যক্ত করা সন্তর স্বভাব, সে মানুষ বা জন্ত যাই হোক। তাদের একটা চাকর ছিল মহী। লোকটা চোখে বড় কম দেখত। তার সঙ্গে রাস্তায় বেরোলেই সন্তু তাকে বরাবর-মহীল, গাড়ি আসছে এই বলে হাত ধরে রাস্তার মাঝখানে দাঁড় করিয়ে দিত। এবং মহী কয়েকবারই এরকমভাবে বিপদে পড়েছে। সন্তু তাকে বার-ছুই নালার মধ্যেও ফেলে দেয়। এরকমই ছিল তার স্বভাব। বুড়ো হরিণটাকে সে প্রায়ই ঢিল মারত। দেয়াল অনেক জায়গায় ভেঙে ফেটে গেছে। প্রায় দুপুরেই সন্তু দেয়াল টপকে আসত, বাঁধা হরিণটাকে তাক করে গুপতি মারত। তখন সিংহীদের বাগানের সিংহীদের বাগানের ঘর- উপকানো খুব সোজা। বাগানে ঘুরত-টুরত, আর হরিণটার গায়ে চমৎকার
পৃষ্ঠা ১৫
কয়েকটা দাগ ছিল, সেই দাগগুলো লক্ষ্য করে গুলতি দিয়ে নিশানা অভ্যাস করত সে। আর তার লক্ষ্য ছিল, হরিণের চমৎকার কাজল- টানা চোখ। কখনো বা গাছের মত ছুটি প্রকাণ্ড শিংকেও লক্ষ্য করে চিল মারত সে। একবার সে হরিণটাকে দড়ি টেনে নিয়ে গিয়ে বাগানের উত্তর দিকে একটা গহীন লতানে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়ে আটকে দেয়।সন্ত জানত না যে বুড়ো নীলমাধবের ঘুরবীন আছে। এবং প্রায়দিনই নীলমাধব তুরবীন দিয়ে তাকে খুঁজত। একটা দুষ্ট ছেলে যে হরিণকে ঢিল মারে সেটা তাঁর জানা ছিল। প্রিয় হরিণের গায়ে তিনি দাগ খুঁজে পেতেন।হরিণকে লতাগাছে আটকে দেওয়ার পরদিনই সন্ধ ধরা পড়ে। সন্ত রোজকার মতই দুপুরে বাগানে ঢুকেছে, পকেটে গুলতি, চোখে শুেনবৃষ্টি। চারদিক রোদে খাঁ খাঁ করছে সিংহীবাগান। হরিণ চরছে। গাছে গাছে পাখি ও পতঙ্গের ভিড়। শিরীষ গাছে একটা মৌচাক বাঁধছে মৌমাছিরা। বর্ষ। তখনো পুরোপুরি আসেনি। চারধারে একপশলা বৃষ্টির পর ভ্যাপসা গরম।সফেদা গাছটার তলায় দাঁড়িয়ে সন্তু ফল দেখছিল। খয়েরি রঙের কী ফল ফলেছে গাছে। ভারে শুয়ে আছে গাছ। হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়। ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে এক থোপা ফল ধরেও ফেলেছিল সন্তু। সেই সময়ে পায়ের শব্দ পেল, আর খুব কাছ থেকে কুকুরের ডাক। তাকিয়ে সে অবাক হয়ে গেল। তিন ধার থেকে তিনজন আসছে। এক দিক থেকে আসছে কুকুরটা, অম্ল ধার থেকে চাকর, আর ঠিক সামনে একনলা বন্দুক হাতে নীলমাধব সিংহ। একটা লাফ দিয়ে সন্তু দৌড়েছিল। পারবে কেন? মস্ত সড়ালে কুকুরটাই তাকে পেল প্রথম। পায়ের ডিমে দাঁত বসিয়ে জন্তুটা ঘাস-জঙ্গলে পেড়ে ফেলল তাকে। পা তখন রক্তে ভেসে যাচ্ছে। কুকুরটা তার বুকের ওপর খাপ পেতে আধখানা শরীরের ভার দিয়ে
পৃষ্ঠা ১৬
চেপে রেখেছে। আর ধারালো খাসের টানে কেটে যাচ্ছে সন্তর কানের চামড়া। ডলা ঘাসের অদ্ভুত গন্ধ আসছে নাকে। বুকের ওপর বন্ধুকের নল ঠেকিয়ে নীলমাধব বললেন-ওঠো। চাকরটা এসে ঘাড় চেপে ধরল। সন্তু কোন কথাই বলতে পারছিল না।বুড়ো নীলমাধব নিয়ে গেলেন সেই বিশাল বাড়ির ভিতরে। সেইখানে অত ভয়ভীতির মধ্যেও ভারি লজ্জা পেয়েছিল সন্ধ দেয়ালে দেয়ালে সব প্রকাণ্ড মেমসাহেবদের ফ্লাংটো ছবি, আর বড় বড় উঁচু টুলে ঐরকমই ঝ্যাংটো মেয়েমান্নষের পাথরের মূর্তি দেখে।সব শেষে একটা হলঘর। সেইখানে এনে দাঁড় করালেন নীলমাধব। মুখে কথা নেই। সিলিং থেকে একটা দড়ি টাঙানো, দড়ির নীচের দিকে ফাঁস, অন্ম প্রান্তটা সিলিংয়ের আংটার ভিতর দিয়ে ঘুরে এসে কাছেই ঝুলছে।নীলমাধব বললেন-তোমার ফাঁসি হবে।এই বলে নীলমাধব দড়িটা টেনে-টুনে দেখতে লাগলেন। চাকরটাকে বললেন একটা টুল আনতে। কুকুরটা আশেপাশে ঘুর ঘুর করছিল। সন্ত বুঝল এইভাবেই ফাঁসী হয়। কিছু করার নেই।গলায় সেই ফাঁস পরে টুলের ওপর ঘন্টাখানেক দাঁড়িয়ে থেকেছিল সন্ধ। চোখের পাতা ফেলেনি। অ্য প্রান্তের দড়িটা ধরে থেকে সেই এক ঘন্টা নীলমাধব বক্তৃতা করলেন। বক্তৃতাটা খুব খারাপ লাগেনি সন্তুর। নীস্মাধবের পূর্বপুরুষরা কিভাবে বাঘ ভালুক এবং মাঞ্জুষ মারতেন তারই নানা কাহিনী। শেষ দিকটায় সন্তুর হাই উঠছিল। আর তাই দেখে নীলমাধব ভারী অবাক হয়েছিলেন।যাই হোক, এক ঘণ্টা পর নীলমাধব তাকে টুল থেকে নামিয়ে একটা চাবুক দিয়ে গোটা কয় সপাং সপাং মারলেন। বললেন- ফের যদি বাগানে দেখি তো পুতে রাখব মাটির নীচে।
এই ঘটনার পর নীলমাধব বেশিদিন বাঁচেননি। তাঁর মৃত্যুর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হরিণটা মারা যায়। সড়ালে কুকুরটাকে নিয়ে
পৃষ্ঠা ১৭
কেটে পড়ে চাকরটা। কেবলমাত্র নীলমাধবের পেয়ারের হুলো বেড়ালটাই অনাথ হয়ে ঘুরে বেড়াত পাড়ায় পাড়ায়। বড়লোকের বেড়াল বলেই কি না কে জানে, তার মেজাজ অন্ত সব বেড়ালের চেয়ে অনেক কড়া ধাতের। চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, গুণ্ডামি কোনটাই আটকাত না।কে একজন রটাল, নীলমাধব মরে গিয়ে বেড়ালটায় ভর করে আছেন। বিলেত থেকে কলকাঠি নেড়ে নীলমাধবের ছেলে কি করে যেন বাড়ি বিক্রি করে দিল। শোনা যাচ্ছে, এখানে শীগগির সব বড় বড় অ্যাপার্ট মেন্ট হাউস উঠবে। তাসে উঠুক গে। গতবারের কথা বলে নিই আগে। জ্বলো গুণ্ডা বেড়ালকে সিংহীদের বাগানেই তকে তকে থেকে একদিন পাকড়াও করে সন্তু। ডাকাবুকো ছেলে। বেড়ালটার গলায় দড়ি বেঁধে সেই বাড়িটায় ঢুকে যায়। এবং খুঁজে খুঁজে ছাড়া-বাড়ির জানালা টপকে ভিতরে ঢুকতেই ফাঁসির হলঘরে আসে। সিলিং থেকে দড়ি টাঙানোর সাধ্য নেই। সে চেষ্টাও করে নি সন্তু।একটা মোটা ভারী চেয়ারে দড়িটা কপিকলের মত লাগিয়ে বেড়ালটাকে অন্ত প্রান্তে বেঁধে সে বলল-তোমার ফাঁসি হবে। বলেই দড়ি টেনে দিল।এসময়ে এক বজ্রগম্ভীর গলা বলল-না, হবে না!চমকে উঠে চারদিকে তাকিয়ে দেখল সন্ত। হাতের দড়ি সেই ফাঁকে টেনে নিয়ে গলায় দড়ি সমেত গুণ্ডা পালিয়ে যায়।কাকে দেখেছিল সন্তু তা খুবই রহস্তপ্তময়। সন্তু কিছু মনে করতে পারে না। সে চমকে উঠে চারদিকে চেয়ে দেখছিল, এসময় কে তাকে মাথার পিছন দিকে ভারী কোন কিছু দিয়ে মারে। সন্ত অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল।সন্ধ্যের পর নানক চৌধুরী এক অচেনা লোকের টেলিফোন
পৃষ্ঠা ১৮
পেয়ে সিংহীদের বাড়িতে লোকজন নিয়ে গিয়ে সন্তুকে উদ্ধার করে আনেন। এরপর দিন-সাতেক সন্তু ব্রেন-ফিবারে ভোগে। তারপর ভাল হয়ে যায়। এবং এ ঘটনার পর গুন্ডাকেও এ লোকালয়ে আর দেখা যায় নি। একটা বেড়ালের কথা কে-ই বা মনে রাখে!সন্তর কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয়, অলক্ষ্যে তার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী কেউ আছে। সিংহদের বাড়িতে যে লোকটা তাকে মেরেছিল সে বাস্তবিক তার শত্রু নাও হতে পারে। তার বাবা নানক চৌধুরী মানুষটা খুবই নির্বিকার প্রকৃতির লোক। এ ঘটনার পর নানক চৌধুরী থানা-পুলিস করে নি। ব্যাপারটাকে উপেক্ষা করেছে। সন্তকেও তেমন জিজ্ঞাসাবাদ করে নি। এমন কি কে একজন যে নিজের নাম গোপন রেখে টেলিফোন করেছিল তারও। খোঁজ করার চেষ্টা করে নি। নানক চৌধুরী লোকটা ওইরকমই, প্রচুর পৈত্রিক সম্পত্তি আর নগদ টাকা আছে। বিবাহসূত্রে শ্বশুরবাড়ির দিক থেকেও সম্পত্তি পেয়েছে, কারণ বড়লোক শ্বশুরের ছেলে ছিল না, মাত্র ছটি মেয়ে। কাজেই তাঁর মৃত্যুর পর সম্পত্তি ছুই মেয়ের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। নানক চৌধুরীর শালী, অর্থাৎ সত্তর মাসীর ছেলেপুলে নেই। বয়স অবশ্য বেশী নয়, কিন্তু ডাক্তারী পরীক্ষায় জানা গেছে তার সন্তান-সম্ভাবনা নেই। সেই শালী সপ্তকে দত্তক চেয়ে রেখেছে। সত্তর মা একমাত্র ছেলেকে বোনের কাছে দিতে রাজী হয় নি। অন্তর মাসী যদি অন্য কাউকে দত্তক না নেয় তবে তার সম্পত্তিও হয়তো একদিন সন্তই পাবে। মাসী সন্তকে বড় ভালবাসে। সস্তুও জানে, একমাত্র মাসী ছাড়া তাকে আর কেউ নিখাদ ভালবাসে না। যেমন মা-মা কোনদিন সন্তর সঙ্গে তার বোনকে কোথাও বেড়াতে পাঠায় না বা একা খেলতে দেয় না। তার সন্দেহ, সন্তু ছোট বোনকে গলা টিপে মেরে ফেলবে। বাবা সত্তর প্রতি খুবই উদাসীন। কেবল মাঝে মাঝে পেটানো ছাড়া
পৃষ্ঠা ১৯
সন্তুর অস্তিত্বই নেই তার কাছে। লোকটা সারাদিনই লেখাপড়া নিয়ে আছে। বই ছাড়া আর কিছু বোঝে না।সম্ভর সঙ্গী-সাথী প্রায় কেউই নেই। তার কারণ, প্রথমতঃ সন্ত বন্ধুবান্ধব বেশী বরদাস্ত করতে পারে না। দ্বিতীয়তঃ সে কাউকেই খুব একটা ভালবাসতে পারে না। তৃতীয়তঃ সে যে ধরনের দুষ্টুমি করে সে ধরনের ছষ্টুমি খুব খারাপ ছেলেরাও করতে সাহস পায় না। সন্তু তাই একরকম একা। দু’চারজন সঙ্গী তার কাছে আসে বটে, কিন্তু কেউই খুব ঘনিষ্ঠ নয়।
কাল সন্ধ্যেবেলা সন্ধ জিমনাসিয়াম থেকে বেরিয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছিল, সেই সময়ে কালুর সঙ্গে দেখা। কালুর বয়স বছর ষোলোর বেশী নয়। সত্তদের ইস্কুলের পড়ত, পড়া ছেড়ে দিয়ে এখন রিকশা চালায়। তবে রিকশা চালানো ছাড়া তার আরো কারবার আছে। স্টেশনে, বাজারে, লাইনের ধারে সে প্রায়ই চুরি ছিনতাই করে। কখনো ক্যানিং বা বারুইপুর থেকে চাল নিয়ে এসে কালোবাজারে বেচে। এই বয়সেই সে মদ খায় এবং খুব হুল্লোড়বাজী করে। সন্তুর সঙ্গে তার খুব একটা খাতির কখনো ছিল না। কিন্তু দেখা হলে তারা হুজনে ছজনকে ‘কি রে, কেমন আছিস’ বলে। কাল কালু একটু অন্তরকম ছিল। সন্ত ওকে দূর থেকে মুখোমুখি দেখতে পেয়েই বুঝল, কালু মদ খেয়েছে। রিকশায় প্যাডল মেরে গান গাইতে গাইতে আসছে। চোখ ছুটো চক- চকে। সন্তকে দেখেই রিকশা থামিয়ে বলল-উঠে পড়,!সন্ত ভ্রু কুঁচকে বলল-কোথায় যাব?-ওঠ না। তোকে একটা জিনিস দেখাব, এইমাত্র দেখে এলাম। কৌতূহলী সন্তু উঠে পড়ল। কালু রিকশা ঘুরিয়ে পালবাজার পার হয়ে এক জায়গায় নিয়ে গেল তাকে। রিকশার বাতিটা খুলে হাতে নিয়ে বলল-আয়।
পৃষ্ঠা ২০
তারপর খানিক দূর তারা নির্জন পথহীন জমি ভেঙে রেল লাইনে উঠে এল। সেখানে একটা পায়ে-হাঁটা রাস্তার দাগ। আর একটু দূরেই একটা ছেলে পড়ে আছে।কালু বলল-এই মার্ডারটা আমার চোখের সামনে হয়েছে।-ছেলেটা কে?-চিনি না। তবে মার্ডারটা কে করেছে তা বলতে পারি।কে?কালু খুব ওস্তাদী হেসে বলল-যে পাঁচশোটাকাদেবেতাকে বলব। তোকে বলব কেন?। তিন।সুরেন খাঁড়া আর গগনচাঁদ রেল লাইনের ওপর উঠে এল: এ জায়গাটা অন্ধকার। লোকজন এখন আর কেউ নেই। সুরেন খাঁড়া টর্চ জ্বেলে চারিদিকে ফেলে বলল-হল কি? এইখানেই তো ছিল!গগনচাঁদ ঘামছিল। অপঘাতের মড়া দেখতে তার খুবই অনিচ্ছা। বলতে কি রেলের উঁচু জমিটুকু সে প্রায় চোখ বুজেই পার হয়ে এসেছে। সুরেনের কথা শুনে চোখ খুলে বলল- নেই?-দেখছি না।এই কথা বলতেই সামনের অন্ধকার থেকে কে একজন বলল- এই তো একটু আগেই ধাঙড়রা নিয়ে গেছে, পুলিস এসেছিল। সুরেন টর্চটা ঘুরিয়ে ফেলল মুখের ওপর। লাইনের ধারে পাথরের স্তপ জড়ো করেছে কুলিরা। লাইন মেরামত হবে। সেই একটা গিট্ঠি পাথরের স্তপের ওপর কালু বসে আছে।