Skip to content

উপদেশশূলক কবিতা- আখতার হোসেন

কবিতা ০১ থেকে  ০৫ 

কবিতা:০১

রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১ – ১৯৪১)

মস্তকবিক্রয় মহাবত্ত্ববদান

কোশলনৃপতির তুলনা নাই, 

জগৎ জুড়ি যশোগাথা; 

ক্ষীণের তিনি সদা শরণ-ঠাই, 

দীনের তিনি পিতামাতা। 

সে কথা কাশীরাজ শুনিতে পেয়ে

জ্বলিয়া মরে অভিমানে

 “আমার প্রজাগণ আমার চেয়ে

 তাহারে বড়ো করি মানে!

আমার হতে যার আসন নিচে 

তাহার দান হল বেশি! 

ধর্ম দয়া মায়া সকলি মিছে, 

এ শুধু তার রেষারেষি।”

কহিলা, “সেনাপতি, 

ধরো কৃপাণ, 

সৈন্য করো সব জড়ো।

 আমার চেয়ে হবে পুণ্যবান,

 স্পর্ধা বাড়িয়াছে বড়ো।”

চলিলা কাশীরাজ যুদ্ধসাজে-

কোশলরাজ হারি রণে রাজ্য 

ছাড়ি দিয়া ক্ষুব্ধ লাজে পলায়ে 

গেল দূর বনে। 

কাশীর রাজা হাসি কহে 

তখন আপন সভাসদ-মাঝে,

 “ক্ষমতা আছে যার রাখিতে ধন

 তারেই দাতা হওয়া সাজে।”

সকলে কাঁদি বলে, “দারুণ

 রাহু এমন চাঁদেরেও হানে।

লক্ষ্মী খোঁজে শুধু বলীর

 বাহু চাহে না ধর্মের পানে।”

“আমরা হইলাম পিতৃহারা”

কাঁদিয়া কহে দশ দিক, 

“সকল জগতের বন্ধু যাঁরা

 তাঁদের শত্রুরে ধিক।”

শুনিয়া কাশীরাজ উঠিল রাগি,

“নগরে কেন এত শোক।

আমি তো আছি, 

তবু কাহার লাগি 

কাঁদিয়া মরে যত লোক।

আমার বাহুবলে হারিয়া তবু আমারে করিবে সে জয়।

 অবির শেষ নাহি রাখিবে কছু, শাপের এই মতো কয়।

মন্ত্রী, রটি দাও নগর-মাঝে, ঘোষণা করো চারি ধারে।

 যে ধরি আনি দিবে কোশলরাজে কনক শত দিব তারে।”

ফিরিয়া রাজদূত সকল বাটী রটনা করে দিন রাত; 

যে শোনে আঁখি মুদি রসনা কাটি। শিহরি কানে দেয় হাত।

রাজ্যহীন রাজা গহনে ফিরে মলিনচীর দীনবেশে পথিক 

একজন অশ্রুনীরে একদা শুধাইল এসে “কোথা গো বনবাসী, 

বনের শেষ কোশলে যাব কোন মুখে?”

শুনিয়া রাজা কছে, “অভাগা দেশ, সেথায় যাবে কোন দুখে।” 

পথিক কহে, “আমি বণিকজাতি,

ডুবিয়া গেছে মোর তরী।

এখন দ্বারে দ্বারে হস্ত পাতি

কেমনে রব প্রাণ ধরি।

করুণ্যপারাবার কোশলপতি,

শুনেছি নাম চারি ধারে,

অনাথনাথ তিনি দীনের গতি,

চলেছে দীন তারি দ্বারে।”

শুনিয়া নৃপসুত ঈষৎ হেসে

 রুধিলা নয়নের বারি, 

নীরবে ক্ষনকাল ভাবিয়া শেষে কহিলা নিশ্বাস ছাড়ি,

 “পাছ, যেথা তব বাসনা পূরে দেখায়ে দিব তারি পথ।

 এসেছ বহু দুখে অনেক দূরে, সিদ্ধ হবে মনোরথ।”

বসিয়া কাশীরাজ সভার মাঝে, দাঁড়াল জটাধারী এসে।

“হেথায় আগমন কিসের কাজে”

নৃপতি শুধাইল হেসে।

“কোশলরাজ আমি বনভবন”

কহিলা বনবাসী ধীরে-

আমার ধরা পেলে যা দিবে পণ দেহ্যে তা মোর সাথিটির।”

” উঠিল চমকিয়া সভার লোকে, নীরব হল গৃহতল,

বর্ষ-আবরিত দ্বারীর চোখে অশ্রু করে ছলছল্। 

মৌন রহি রাজা ক্ষণেকতরে হাসিয়া কহে, 

“ওহে কন্দী, মরিয়া হবে জয়ী আমার পরে এমনি করিয়াছ ফন্দি। 

তোমার সে আশায় হ্যানিব বাজ, 

জিনিব আজিকার রণে রাজ্য ফিরে দিব হে মহারাজ,

হৃদয় দিব তারি সনে।”

জীর্ণ-চীর-পরা বনবাসীরে

বসাল নৃপ রাজাসনে,

মুকুট তুলি দিল মলিন শিরে-

ধন্য কহে পুরজনে।

কবিতা:০২

অভিসার বোধিসত্ত্বারবান-রম্পলতা

সন্ন্যাসী উপগুপ্ত 

মথুরাপুরীর প্রাচীরের তলে 

একদা ছিলেন সুপ্ত। 

নগরীর দীপ নিবেছে পরনে, 

দুয়ার রুদ্ধ পৌর ভবনে, 

নিশীথের তারা শ্রাবণগগনে

 ঘন মেঘে অবলুপ্ত।

কাহার নূপুরশিঞ্জিত পদ

 সহস্য বাজিল বক্ষে

 সন্ন্যাসীবর চমকি জাগিল, 

স্বপ্নজড়িমা পলকে ভাগিল,

 রূঢ় দীপের আলোক লাগিল

 ক্ষমাসুন্দর চক্ষে।

নগরীর নটী চলে অভিসারে 

যৌবনমদে মত্তা। অঙ্গে আঁচল সুনীল বরন,

 সন্ন্যাসী-গায়ে পড়িতে চরণ খামিল বাসবদত্তা। 

রুনুঝুনু রবে বাজে আভরণ

প্রদীপ ধরিয়া হেরিল তাঁহার 

নবীন গৌরকান্তি, সৌম্য সহাস তরুণ বয়ান, 

করুশাকিরণে বিকচ নয়ান, 

শুভ্র ললাটে ইন্দু সমান ভাতিছে স্নিগ্ধ শান্তি।

কহিল রমণী ললিত কন্ঠে, নয়নে জড়িত লজ্জা,

 “ক্ষমা করো মোরে, কুমার কিশোর,

 দয়া করো যদি গৃহে চলো মোর-

এ নহে তোমার শয্যা।

” সন্ন্যাসী কহে করুণ বচনে,

 “অয়ি লাবণ্যপুজে,

 এখনো আমার সময় হয় নি, 

যেথায় চলেছ যাও তুমি ধনী-

 সময় যেদিন আসিবে আপনি

 যাইব তোমার কুঞ্জে।”

সহসা কঞ্চা তড়িৎশিখায় 

মেলিল বিপুল আসা। রমণী

 কাপিয়া উঠিল তরাসে,

 প্রলয়শঙ্খ বাজিল বাতাসে,

 আকাশে বস্তু ঘোর 

পরিহাসে হাসিল অট্টহাস্য।

বর্ষ তখনো হয় নাই শেষ,

 এসেছে চৈত্রসন্ধ্যা। 

বাতাস হয়েছে উতলা আকুল,

 পথতরুশাখে ধরেছে মুকুল, 

রাজার কাননে ফুটেছে বকুল 

পারুল রজনীগন্ধা।

অতি দূর হতে আসিছে পবনে বাঁশির মদির মল্ল।

 জনহীন পুরী, 

পুরবাসী সবে গেছে 

মধুবনে ফুল-উৎসবে- শূন্য 

নগরী নিরখি নীরবে হাসিছে পূর্ণচন্দ্র।

নির্জন পথে জোছনা-আলোতে

 সন্ন্যাসী একা যাত্রী। মাথার উপরে

 তরুবীথিকার কোকিল কুহরি উঠে বারবার,

 এতদিন পরে এসেছে কি তার

 আজি অভিসাররাত্রি?

নগর ছাড়ায়ে গেলেন দন্ডী বাহির প্রাচীরপ্রান্তে।

 দাঁড়ালেন আসি পরিখার পারে, 

আমবনের ছায়ার আঁধারে কে 

ওই রমণী পড়ে এক ধারে তাঁহার চরপোলান্তে?

নিদারুণ রোগে মারীগুটিকায় ভরে গেছে তার অঙ্গ।

রোগমসীঢালা কালী তনু তার লয়ে

 প্রজাগণে পুরপরিখার বাহিরে ফেলেছে, 

করি পরিহার বিষাক্ত তার সঙ্গ।

সন্ন্যাসী বসি আড়ষ্ট শির তুলি নিল নিজ অঙ্কে। 

ঢালি দিল জল শুষ্ক অধরে, 

মন্ত্র পড়িয়া দিল শির পরে, 

লেপি দিল দেহ আপনার 

করে শীতচন্দনপক্ষে।

করিছে মুকুল, কুজিছে কোকিল, 

যামিনী জোছনামতা।

 “কে এসেছ তুমি ওগো দয়াময়”, 

শুধাইল নারী, সন্ন্যাসী কয়- “

আজি রজনীতে হয়েছে সময়, 

এসেছি বাসবদত্তা।”

কবিতা:০৩

মূল্যপ্রাপ্তি অবদান শতক

অঘ্রানে শীতের রাতে সুদাস 

মালীর ঘরে নিষ্ঠুর শিশিরঘাতে

 পদ্মগুলি গিয়াছে মরিয়া- 

একটি ফুটেছে কী করিয়া।

 কাননের সরোবরে

তুলি লয়ে বেচিবারে

গেল সে প্রাসাদদ্বারে,

 আনন্দে পুলকাকুল 

মাগিল রাজার দরশন

হেনকালে হেরি ফুল

পথিক কহিল এক জন,

“অকালের পদু তব আমি এটি কিনি লব,

 কত মূল্য লইবে ইহার।

বুদ্ধ ভগবান আজ তাঁর পায়ে দিব উপহার।”

এসেছেন পুরমাঝ

মালী কহে, “

এক মাযা স্বর্ণ পাব মনে আশা।”

পথিক চাহিল তাহা দিতে-

হেনকালে সমারোহে বহু পূজ্য অর্থ্য

 বাহে নৃপতি বাহিরে আচম্বিতে। উচ্চারি মঙ্গলগীত

রাজেন্দ্র প্রসেনজিৎ

চলেছেন বুদ্ধ দরশনে হেরি অকালের ফুল শুধালেন,

 “কত মূল?

কিনি দিব প্রভুর চরণে।”

মালী কহে, “হে রাজন, 

কিনিছেন এই মহাশয়।

” ফর্ণমাষ্য দিয়ে পণ

কহিলা ধরণীস্বামী,

“দশ মাযা দিব আমি”

 “বিশ মাষা দিব” পান্থ কয়।

 দোঁহে কহে “দেহ্যে দেখ্যে”, 

হার নাহি মানে কেহ

মূল্য বেড়ে ওঠে ক্রমাগত।

মালী ভাবে যাঁর তরে এ দোঁহে বিবাদ 

করে তাঁরে দিলে আরো পাব কত।

কহিল সে করজোড়ে, 

“দয়া করে ক্ষমো মোরে, 

এ ফুল বেচিতে নাহি মন।”

এত বলি চুলি সে বুদ্ধদের উজলি কানন। 

যেথা রয়েছেন বসে

বসেছেন পদ্মাসনে প্রসন্ন প্রশান্ত 

মনে ক্ষুরিছে অবর পরে নিরঞ্জন

 আনন্দমুরতি। দৃষ্টি হতে শান্তি করে,

করুণার সুধাহাস্যজ্যোতি।

 সুদাস রহিল চাহি- 

নয়নে নিমেষ নাহি

মুখে তার বাক্য নাহি সরে।

সহসা ভূতলে পড়ি,

পদৃষ্টি রাখিল ধরি

বরধি অমৃতরাশি 

প্রভুর চরনপন্দ পরে।

বুদ্ধ শুধালেন হাসি,

 “কহ্যে বৎস, 

কী তব প্রার্থনা।

” ব্যাকূল সুদাস কহে, 

“প্রভু, আর কিছু নহে, 

চরণের ধূলি এক কণা।”

কবিতা:০৪

বিসর্জন

দুইটি কোলের ছেলে গেছে পর-পর 

বয়স না হতে হতে পুরা দু-বছর।

 এবার ছেলেটি তার জন্মিল যখন

 স্বামীরেও হারালো মল্লিকা।

 বন্ধুজন বুঝাইল- পূর্বজন্মে ছিল বহু পাপ, 

এ জনমে তাই হেন দারুণ সন্তাপ।

 শোকানলদগ্ধ নারী একান্ত বিনয়ে

 অজ্ঞাত জন্মের পাপ শিরে বহি লয়ে

 প্রায়শ্চিত্তে দিল মন। মন্দিরে মন্দিরে

 যেথা সেথা গ্রামে গ্রামে পূজা দিয়া ফিরে, 

বুত ধ্যান উপবাসে আঙ্গিকে তর্পণে কাটে দিন,

 ৰূপে দীপে নৈবেদ্যে চন্দনে পূজাগৃহে। 

কেশে ব্যধি রাখিল মাদুলি কুড়াইয়া শত ব্রাহ্মণের পদধূলি,

 শুনে রামায়ণ-কথা। সন্ন্যাসী-সাধুরে ঘরে আনি

 আশীর্বাদ করায় শিশুরে। বিশ্ব-মাঝে আপনারে

 রাখি সর্বনীচে সবার প্রসন্ন দৃষ্টি অভাগী মাগিছে

 আপন সন্তান লাগি। সূর্য চন্দ্র হতে পশুপক্ষী

 পতঙ্গ অবধি কোনোমতে কেহ পাছে কোনো 

অপরাধ লয় মনে, পাছে কেহ করে ক্ষোত,

 অজানা কারণে পাছে কারো লাগে বাথা- 

সকলের কাছে আকুল-বেদনা-ভরে দীন হয়ে আছে।

যখন বছর দেড় বয়স শিশুর যকৃতের

 ঘটিল বিকার, জ্বরাতুর দেহখানি শীর্ণ হয়ে আসে।

 দেবালয়ে মানিল মানত মাত্রা, 

পদামৃত লয়ে করাইল পান,

 হরিসংকীর্তন-গানে কাপিল প্রাঙ্গণ। 

ব্যাধি শান্তি নাহি মানে।। 

কাঁদিয়া শুধাল নারী, 

‘ব্রাহ্মণ ঠাকুর, 

এত দুঃখে তবু পাল নাহি হল দূর।

 দিনরাত্রি দেবতার মেনেছি দোহাই,

 দিয়েছি এত যে পূজা তবু রক্ষা নাই।

 তবু কি নেবেন তাঁরা আমার বাহারে।

 নৈবেদ্য দিলাম খেতে বেচিয়া গহনা, 

সর্বস্ব খাওয়ানু, তবু ক্ষুধা মিটিল না।’

 ব্রাহ্মণ কহিল, ‘বাছা, 

এ যে ঘোর কলি। 

অনেক করেছ বটে, 

তবু এও বলি,

 আজকাল তেমন কি ভক্তি আছে কারো?

 সত্যযুগে যা পারিত তা কি আজ পারো। 

দানবীর কর্ণ-কাছে ধর্ম যবে এদে 

পুত্রোর চাহিল খেতে ব্রাহ্মণের বেশে, 

নিজহস্তে সন্তানে কাটিল,

 তখনি সে শিশুরে ফিরিয়া পেল চক্ষের নিমিষে।

 শিবিরাজা শোনরূপী ইন্দ্রের মুখেতে আপন 

বুকের মাংস কাটি দিল খেতে, পাইল অক্ষয় দেহ।

 নিষ্ঠা এরে বলে।

 তেমন কি এ কালেতে আছে ভূমণ্ডলে।

 মনে আছে ছেলেবেলা গল্প শুনিয়াছি

 মার কাছে-তাঁদের গ্রামের কাছাকাছি

 ছিল এক বন্ধ্যা নারী, না পাইয়া পথ

 প্রথম গর্ভের ছেলে করিল মানত

 মা গঙ্গার কাছে, শেষে, পুত্রজন্ম 

পরে অভাগী বিধবা হল, গেল সে সাগরে,

 কহিল সে নিষ্ঠাভরে মা গঙ্গারে ডেকে,

 মা, তোমারি কোলে আমি দিলাম 

ছেলেকে- এত ক্ষুষ্য দেবতার? 

এত ভারে ভারে

এ মোর প্রথম পুত্র, শেষ পুত্র এই,

 এ জন্মের তরে আর পূত-আশা নেই।

যেমনি জলেতে ফেলা, 

মাতা ভাগীরথী মকরবাহিনী-রূপে

 হয়ে মূর্তিমতী শিশু লয়ে আপনার

 পদ্মকরতলে মার কোলে সমর্পিল।

 নিষ্ঠা এরে বলে।’ মল্লিকা ফিরিয়া এল নতশির করে, 

আপনারে বিভারিল-এতদিন ধরে বৃথা ব্রত করিলাম,

 বৃদ্ধা দেবার্চনা, নিষ্ঠাহীনা পাপিষ্ঠারে ফল মিলিল না।

ঘরে ফিরে এসে দেখে শিশু অচেতন অরাবেশে। 

অঙ্গ যেন অগ্নির মতন। 

ঔষধ গিলাতে যায় যত বারবার পড়ে যায়,

 কণ্ঠ দিয়া নামিল না আর।

 দন্তে দন্তে গেল আঁটি। 

বৈদ্য শির নাড়ি ধীরে ধীরে চলি গেল রোগীগৃহ ছাড়ি। 

সন্ধ্যার আঁধারে শূন্য বিধবার ঘরে একটি মলিন দীপ,

 শয়নশিয়রে একা শোকাতুরা নারী।

 শিশু একবার জ্যোতিহীন আঁখি মেলি 

যেন চারি ধার খুঁজিল কাহারে।

 নারী কাঁদিল কাতর, ‘ও মানিক, 

ওরে সোনা, এই-যে মা তোর, 

এই-যে মায়ের কোল, 

ভয় কী রে বাল।’ 

বক্ষে তারে চাপি ধরি তার

 জ্বরতাপ চাহিল কাড়িয়া 

নিতে অঙ্গে আপনার প্রাণপণে।

 সহসা বাতাসে গৃহদ্বার খুলে গেল,

 ক্ষীদ দীপ নিবিল তখনি- সহসা বাহির 

হতে কলকলধ্বনি পশিল গৃহের মাঝে। 

চমকিল নারী দাঁড়ায়ে উঠিল বেগে শয্যাতল ছাড়ি,

 কহিল, ‘মায়ের ডাক ওই শুনা যায়- ও মোর দুঃখীর ধন, 

পেয়েছি উপায়- তোর মার কোল চেয়ে

 সুশীতল কোল আছে ওরে বাছা।”

জাগিয়াছে কলরোল অদূরে জাহবীজলে, 

এসেছে জোয়ার

পূর্ণিমায়। শিশুর তাপিত দেহভার

 বক্ষে লয়ে মাতা, গেল শূন্যঘাট-পানে।

 কহিল, ‘মা, মার ব্যথা যদি বাজে প্রাণে 

তবে এ শিশুর তাপ দে গো মা, জুড়ায়ে।

 একমাত্র ধন মোর দিনু তোর পায়ে এক-মনে।

‘ এত বলি সমর্পিল জলে অচেতন শিশুটিরে 

লয়ে করতলে চক্ষু মুদি। বহুক্ষণ আঁখি মেলিল না। 

ধ্যানে নিরখিল বসি মকরবাহনা জ্যোতির্ময়ী 

মাতৃমূর্তি ক্ষুর শিশুটিরে কোলে করে এসেছেন,

 রাখি তার শিরে একটি পদ্মের দল, হাসিমুখে

 ছেলে অনিন্দিত কান্তি ধরি দেবী-কোল

 ফেলে মার কোলে আসিবারে বাড়ায়েছে কর।

 কহে দেবী, ‘রে দুঃখিনী, এই তুই ধর তোর ধন তোরে দিমু।’

 রোমাঞ্চিতকায় নয়ন মেলিয়া কহে, ‘কই মা? কোথায়।’ 

পরিপূর্ণ চন্দ্রালোকে বিহ্বলা রজনী। 

গঙ্গা বহি চলি যায় করি কলফানি। 

চীৎকারি উঠিল নারী, ‘দিবি নে ফিরায়ে?” 

মর্মরিল বনভূমি দক্ষিণের বায়ে।

কবিতা:০৫

বন্দী বীর

পঞ্চনদীর তীরে 

বেণী পাকাইয়া শিরে 

দেখিতে দেখিতে গুরুর মন্ত্রে 

জাগিয়া উঠেছে শিখ- 

  নির্মম নির্ভীক।

 হাজার কন্ঠে গুরুজীর জয় 

ধ্বনিয়া তুলেছে দিক। 

নূতন জাগিয়া শিষ নুতন

 ঊষার সূর্যের পানে

 চাহিল নিনিমিখ।

‘অলখ নিরঞ্জন’-

মহারব উঠে বন্ধন

 টুটে করে ভয়ভঞ্জন।

 বক্ষের পাশে ঘন

 উল্লাসে অসি বাজে 

কনক্ষন। পঞ্জাব আজি

 গরজি উঠিল, ‘অলখ নিরঞ্জন।’

এসেছে সে এক দিন লক্ষ

 পরানে শঙ্কা না জানে, 

না রাখে কাহারো ঋণ- 

জীবন মৃত্যু পায়ের মৃত্য,

 চিত্ত ভাবনাহীন। 

পঞ্চনদীর ঘিরি দশ তীর 

এসেছে সে এক দিন।

দিল্লিপ্রাসাদকূটে হ্যেথা 

বারবার বাদশাজাদার তন্দ্রা 

যেতেছে ছুটে। কাদের কন্ঠে

 গগন মন্ত্রে, নিবিড় নিশীথ 

টুটে- কাদের মশালে আকাশের

 ভালে আগুন উঠেছে ফুটে।

পঞ্চনদীর তীরে ভক্তদেহের

 রক্তলহরী মুক্ত হইল কি রে। 

লক্ষ বক্ষ চিরে ঝাঁকে ঝাঁকে 

প্রাণ পক্ষীসমান ছুটে যেন 

নিজ নীড়ে। বীরগণ জননীরে 

ক্রেতিলক ললাটে পরালো 

পঞ্চনদীর তীরে।

মোগল-শিখের রণে 

মরণ-আলিঙ্গনে

কণ্ঠ পাকড়ি ধরিল 

আঁকড়ি দুইজনা দুইজনে

দংশনক্ষত শোনবিহঙ্গ 

বুঝে ভুজঙ্গ-সনে। 

সেদিন কঠিন রণে ‘

জয় গুরুজীর’ হ্যকে 

শিখ বীর সুগভীর নিঃস্বনে।

 মত্ত মোগল রক্তপাগল 

‘দীন দীন’ গরজনে।

গুরুদাসপুর গড়ে বন্দা 

যখন কন্দী হইল

 তুরানি সেনার করে, 

সিংহের মতো শৃঙ্খলগত

 বাঁধি লয়ে গেল ধরে দিল্লিনগর-পরে। 

বন্দা সমরে বন্দী হইল গুরুদাসপুর গড়ে।

সম্মুখে চলে মোগল সৈনা উড়ায়ে পথের

 ধূলি ছিন্ন শিখের মুণ্ড লইয়া বর্শাফলকে তুলি।

 শিখ সাত শত চলে পশ্চাতে, বাজে শৃঙ্খলগুলি।

 রাজপথ ‘পরে লোক নাহি ধরে, বাতায়ন যায় খুলি।

 শিষ গরজায় ‘গুরুজীর জয় পরানের ভয় ভুলি। 

মোগলে ও শিখে উড়ালো আজিকে দিল্লিপথের ধূলি।

পড়ি ঘেল কাড়াকাড়ি আগে কেবা প্রাণ করিবেক 

দান তারি লাগি তাড়াতাড়ি। 

দিন গেলে প্রাতে ঘাতকের হাতে

বন্দীরা সারি সারি 

‘জয় গুরুজীর’ কহি

 শত বীর শত শির দেয় ডারি।

সপ্তাহকালে সাত শত প্রাণ

 নিঃশেষ হয়ে গেলে বন্দার 

কোলে কাজি দিল তুলি বন্দার এক ছেলে।

 কহিল, “ইহারে বধিতে হইবে নিজ হাতে

 অবহেলে।’ দিল তার কোলে ফেলে।

 কিশোর কুমার, বাঁধা বাহু তার, 

বন্দার এক ছোল।

কিছু না কহিল বাদী, বন্দা সুধীরে

 ছোটো ছেলেটিরে লইল বক্ষে টানি।

 ক্ষলকালতরে মাথার উপরে রখে দক্ষিণ পাণি, 

শুধু একবার চুম্বিল তার রাঙা উষ্ণীযখানি।

তার পরে ধীরে কটিবাস হতে ছুরিকা 

খসায়ে আনি বালকের মুখ চাহি

 ‘গুরুজীর জয়া কানে কানে কয়, 

‘রে পুত্র, ভয় নাহি।’

নবীন বদনে অভয় কিরণ জ্বলি

 উঠে উৎসাহি কিশোরকণ্ঠে 

কাঁপে সভাতল বালক উঠিল 

গাহি ‘গুরুজীর জয়। কিছু নাহি 

ভয়া বন্দার মুখ চাহি।

বন্দা তখন বামবাহুলাশ জড়াইল

 তার গলে, দক্ষিণকরে ছেলের বন্ধে

ছুরি বসাইল বলে- 

‘গুরুজীর জয়’ কহিয়া 

ব্যালক লুটালো ধরণীতলে।

সভ্য হল নিস্তব্ধ।

 কদার দেহ ছিড়িল 

ঘাতক সাঁড়াশি করিয়া দগ্ধ। 

স্থির হয়ে বীর মরিল, 

না করি’ একটি কাতর শব্দ। 

দর্শকজন মুদিল নয়ন

সভা হল নিস্তব্ধ।

কবিতা ০৬ থেকে  ১০

কবিতা:০৬

পূজারিনী

অবদানশতক

সেদিন শারদদিব্য-অবসান- 

শ্রীমতী নামে সে দাসী পুণ্যশীতল

 সলিলে নাহিয়া পুষ্পপ্রদীপ থালায় বাহিয়া,

 রাজমহিষীর চরণে চাহিয়া নীরবে দাড়াল আসি।

শিহরি সভয়ে মহিষী কহিলা, “এ কথা নাহি কি মনে, 

অজাতশত্রু করেছে রটনা, স্তূপে যে করিবে অর্থ্যরচনা

 শূলের উপরে মরিবে সেজন্য অথবা নিবদিনে?”

দেখা হতে ফিরি গেল চলি ধীরে। বহু অমিতার ঘরে। 

সমুখে রাখিয়া স্বর্ণমুকুর ব্যধিতেছিল সে দীর্ঘ চিকুর, 

আঁকিতেছিল সে যত্নে সিঁদুর সীমন্তসীমা-পরে।

শ্রীমতীরে হেরি বাকি গেল রেখা,

 কাঁপি গেল তার হাত- কহিল, “অবোধ, 

কী সাহস-বলে এনেছিস পূজা। এখনি যা চলে।

 কে কোথা দেখিবে, ঘটিবে তা হলে বিষম বিপদপাত।”

অস্তরবির রশ্মি-আভায়

খোলা জানালার ধারে কুমারী শুক্লা বসি

 একাকিনী পড়িতে নিরত কাব্যকাহিনী, 

চমকি উঠিল শুনি কিষিণী চাহিয়া দেখিল দ্বারে।

শ্রীমতীরে হেরি পুঁথি রাখি ভূমে দ্রুতপদে গেল কাছে।

 কহে সাবধানে তার কানে কানে,

 “রাজার আদেশ আজি কে না জানে, 

এমন করে কি মরণের পানে ছুটিয়া চলিতে আছে।”

দ্বার হতে দ্বারে ফিরিল শ্রীমতী লইয়া অর্ঘ্যখালি।

 “হে পুরবাসিনী” সবে ডাকি কয়,

 “হয়েছে প্রভুর পূজার সময়-” 

শুনি ঘরে ঘরে কেহ পায় তয় কেহ দেয় তারে গালি।

দিবসের শেষ আলোক মিলালো নগরসৌধ-পরে।

 পথ জনহীন আঁধারে বিলীন, 

কলকোলাহল হয়ে এল ক্ষীণ- 

আরতিঘন্টা কধ্বনিল প্রাচীন রাজদেবালয়ঘরে।

  • শারদনিশির স্বচ্ছ তিমিরে

তারা অগণ্য জ্বলে।

সিংহদুয়ারে বাজিল বিষাল 

বন্দীরা ধরে সন্ধ্যার তান,

 “মন্ত্রণাসভা হল সমাধান” 

দ্বারী ফুকারিয়া বলে।

এমন সময়ে হেরিল চমকি

 প্রাসাদে প্রহরী যত রাজার বিজন 

কানন মাকারে স্তূপপদমূলে গহন 

আঁধারে জ্বলিতেছে কেন যেন সারে 

সারে প্রদীপমালার মতো।

মুক্তকৃপাণে পুররক্ষক তখনি ছুটিয়া

 আসি শুধালো, “কে তুই ওরে দুর্মতি,

 মরিবার তরে করিস আরতি।” 

মধুর কণ্ঠে শুনিল, “শ্রীমতী, 

আমি বুদ্ধের দাসী।”

সেদিন শুভ্র পায়ালফলকে পড়িল রক্তলিখা।

 সেদিন শারদ স্বচ্ছ নিশীথে প্রাসাদকাননে নীরবে নিভৃতে

 রূপপদমূলে নিবিল চকিতে শেষ আরতির শিখা।

কবিতা:০৭

সামান্য ক্ষতি

দিব্যাবদানমালা

বাহ মাঘমাসে শীতের বাতাস, 

স্বচ্ছসলিলা বরুণা।

পুরী হতে দূরে গ্রামে নির্জনে 

শিলাময় ঘাট চম্পকবনে, 

স্নানে চলেছেন শতসঘীসনে

 কাশীর মহিষী করুণা।

সে পথ সে ঘাট আজি এ 

প্রভাতে জনহীন রাজশাসনে।

নিকাট যে ক’টি আছিল কুটির

 ছেড়ে গেছে লোক, 

তাই নদীতীর স্ত্য গতীর, 

কেবল পাখির কুজন উঠিছে কাননে।

আজি উতরোল উত্তর-বায়ে উতলা হয়েছে তটিনী।

 সোনার আলোক পড়িয়াছে জলে,

 লক্ষ মানিক বলকি আঁচলে নেচে

 চলে যেন নয়িনী। দুলকে উছলি ঢেউ ছলছলে

কলকাত্মালে লাজ দিল আজ

 নারীকন্ঠের কাকলি।

মূখলভুজের ললিত বিলাসে চঞ্চলা নদী মাতে উল্লাসে, 

আলাপে প্রলাপে হাসি-উচ্ছ্বাসে 

আকাশ উঠিল আকুলি।

স্থান সমাপন করিয়া যখন কূলে 

উঠে নারী সকলে মহিষী কহিলা, 

“উচু। শীতে মরি, সকল শরীর উঠিছে শিহরি, 

জ্বেলে দে আগুন গুলো সহচরী- 

শীত নিবারিত্ব অনলে।”

সখীগণ সবে কুড়াইতে কুল

 চলিল কুসুমকাননে। 

কৌতুকরসে পাগলপরানী

 শাখা বরি সবে করে টানাটানি,

 সহসা সবার ডাক দিয়া রানী

 কহে সহাস্য আনান

  • “গুলো, তোরা আয়। 

এই দেখা যায় কুড়ির কাহার অনুরে,

ওই ঘরে তোরা লাগাবি অনল, 

তপ্ত করিব করপদতলা, 

এত বলি রানী রঙ্গে বিভল

 হাসিয়া উঠিল মধুরে।

কহিল মালতী সকরুণ অতি,

 “এ কি পরিহাস রানীমা। 

আগুন জ্বালায়ে কেন দিবে নাশি।

 এ কুটির কোন সাধু সন্ন্যাসী কোন 

দীনজন কোন পরবাসী 

বাঁধিয়াছে নাহি জানি মা।”

রানী কহে রোষে, “

দূর করি দাও এই দীনদয়াময়ীরে।

” অতি দুর্নাম কৌতুকরত যৌবনমদে

 নিষ্ঠুর যত যুবতীরা মিলি পাথালর

 মতো আগুন লাগাল কুটিরে।

ঘন ঘোর ঘুম ঘুরিয়া 

ঘুরিয়া ফুলিয়া ফুলিয়ে উড়িল। 

দেখিতে দেখিতে হু হু হুংকারি

 ঝলকে ঝলকে উল্কা উগারি শত 

শত লোল জিহ্বা প্রসারি বছি আকাশ জুড়িল।

পাতাল গুঁড়িয়া উঠিল যেন রে জ্বালাময়ী যত নাগিনী।

 ফন্দা নাচাইয়া অশ্বরশানে মাতিয়া উঠিল 

গর্জনগানে প্রলয়মত্ত রমণীর কানে বান্ডিল দীপক-রাগিণী।

প্রভাতপাখির আনন্দগান ভয়ের বিলাপে 

ভূটিল- দলে দলে কাক করে কোলাহল,

ওই ঘরে তোরা লাগাবি অনল,

 তপ্ত করিব করপদতলা,

 এত বলি রানী রঙ্গে বিভল

 হাসিয়া উঠিল মধুরে।

কহিল মালতী সকরুণ অতি,

 “এ কি পরিহাস রানীমা। 

আগুন জ্বালায়ে কেন দিবে নাশি।

 এ কুটির কোন সাধু সন্ন্যাসী কোন 

দীনজন কোন পরবাসী বাঁধিয়াছে নাহি জানি মা।”

রানী কহে রোষে, “দূর করি দাও এই দীনদয়াময়ীরে।

” অতি দুর্নাম কৌতুকরত যৌবনমদে 

নিষ্ঠুর যত যুবতীরা মিলি পাথালর মতো 

আগুন লাগাল কুটিরে।

ঘন ঘোর ঘুম ঘুরিয়া

 ঘুরিয়া ফুলিয়া ফুলিয়ে উড়িল।

 দেখিতে দেখিতে হু হু হুংকারি

 ঝলকে ঝলকে উল্কা উগারি শত 

শত লোল জিহ্বা প্রসারি বছি আকাশ জুড়িল।

পাতাল গুঁড়িয়া উঠিল যেন রে 

জ্বালাময়ী যত নাগিনী। ফন্দা 

নাচাইয়া অশ্বরশানে মাতিয়া উঠিল

 গর্জনগানে প্রলয়মত্ত রমণীর 

কানে বান্ডিল দীপক-রাগিণী।

প্রভাতপাখির আনন্দগান ভয়ের 

বিলাপে ভূটিল- দলে দলে কাক করে কোলাহল,

দীনের কুটিরে দীনের কী 

হানি বুঝিতে নারিবে জানি তাহ্য

 জানি- বুঝার তোমারে নিদয়ে।”

রাজার আদেশে কিভরী আসি 

ভূষণ ফেলিল খুলিয়া- অরুণবরন

 অম্বরখানি। নির্মম করে খুলে দিল টানি,

 ভিখারি নারীর চীরবাস 

আনি দিল রানীদেহে তুলিয়া।

পথে লয়ে তারে কহিলেন রাজা,

 “মাগিবে দুয়ারে দুয়ারে- এক 

প্রহরের লীলায় তোমার যে-ক’টি 

কুটির হল ছারখার যতদিনে পার 

সে-কটি আবার গড়ি দিতে হবে তোমারে।

“বৎসরকাল দিলেম সময় তার 

পরে ফিরে আসিয়া সভায় দাঁড়ায়ে

 করিয়া প্রণতি সবার সমুখে জানাবে

 যুবতী হয়েছে জগতে কতটুকু ক্ষতি

 জীর্ণ কুটির নাশিয়া।”

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত [১৮৮২-১৯২২] 

কবিতা:০৮

রাজপূজা

রাজার নিদেশে শিল্পী 

রচিছে দেউল কাঞ্চীপুরে,

 পরশে তাহার শিলা পায় 

প্রাণ কাঞ্চন-প্রায় দূরে।

 মঞ্চের পরে বসি’ 

তন্ময় মূর্তি-মেখলা গড়ে, 

তার প্রতিভায় পৃথিবীর 

গায় স্বর্গের ছায়া পড়ে। 

ইন্দ্র, বরুণ, অগ্নি, ঈশান

 ররূপ ধরে ধ্যানে তার 

প্রাণের নিত ভরি’ তারি যত

 থেকতার অবতার। 

পুষ্পিয়া ওঠে কঠিন 

পাষান পরশ তাহার লভি,

শিল্পীর রাজা মুণী সুদরাজ স্ফটিক-শিলার কবি। 

অমৃতকুণ্ডে ডুবায়ে সে বুঝি ছেদনী-হাতুড়ি ধার,

 অকপেরে রূপ দেয় অনায়াসে অলখ-দেবের করে।

 তার নির্মাণ সৃজন-সমান, বিস্ময় লাগে ভারি, 

চমৎকারের মহলের চাবি জিম্মায় আছে তারি। 

শিলার স্বর্গে বসি’ মশগুল যশের মালা সে গাখে, 

শিষ্য একাকী পিছনে দাঁড়ায়ে পান বাটা লয়ে হাতে। 

আর কারো নাই প্রবেশাধিকার তার সে কমশালে, 

স্বস্তারণ্যে তপোবন রচি’ প্রাণের আরতি ঢালে। 

ছেনি দিয়ে কাটে, সারাবেলা খাটে, স্বপ্নাবিষ্ট জাগি,

 মাঝে মাঝে হাত বাড়াইয়া পিছে তাম্বুল লয় মাগি 

ফিরে তাকাবার অবসর নাই, দীর্ঘদিবস বরি 

আদরার গায়ে আদর মাখায়ে রচে স্বর্গের পরী।

 সহস্য কী করি’ হাতের হাতুড়ি ঠিকরি পড়িল নিচে, 

দোদ্রা হাতুড়ি নিতে তাড়াতাড়ি শিল্পী চাহিল পিছে।

 পিছে চেয়ে গুণী ওঠে চমকিয়া বিস্ময়ে আঁখি থির- 

তারি ডিবা হাতে কাঞ্চী-নরেশ দাঁড়ায়ে মুকুট-শির।

 “একী। মহারাজ।” কয় গুণরাজ, “অপরাধ হয় মোর,

 দিন মোরে দিন প্রভুরে কি সাজে।” রাজা কন,

 “দিন-ভোর এমনি দাঁড়ায়ে আছি ডিবা হয়ত, 

জোগায়েছি তাশূল, দেখিতে তোমার সৃজনকর্ম 

পাথার ফোটানো ফুল, তন্ময় তুমি পাও নাই টের,

 কখন এসেছি আমি, মোর ইঙ্গিতে কখন 

যে তব শিষ্য গিয়েছে নামি,’ 

কাজের ব্যাঘাত পাছে ঘটে ভেবে 

ডিবাটি লইয়া চাহি শিষ্যকৃত করেছি

 ঘুণীর হয়ে করক্ক-বাহী।” রাজার বচন 

শুনি লজ্জায় গুণী কহে জানু পাতি’ 

“মার্জনা করো দাসেরে, হে প্রভু, 

কাজের নেশায় মাতি’ অজানিতে 

আজ ঘটায়েছে দাস রাজার অমর্যাদা,

 সাজা দিন মোরে।” রাজা কন, “ক্ষুণী, 

তব গুদে আমি বাঁধা, ওঠো ঘুণরাজ। 

আমি পাই লাজ, তোমারে কী দিব সাজা,

 বিবির সৃজন-বিভূতি-ভূষিত তুমি সে প্রকৃত রাজা। 

মরণ-হরণ কীর্তি তোমার, মোর সে ক্ষণস্থায়ী,

 আমি প্রভু শুধু নিজের রাজো,

 বাহিরে প্রস্তুতা নাহি। 

রাজপূজা তব ভুবন জুড়িয়া, 

প্রভাব দুর্নিবার,

রাজাবিরাজেরও ভক্তি-অর্থো,

 গুণী, তব অধিকার।”

কিরণধন চট্টোপাধ্যায় (১৮৮৭ ১৯৩১]

কবিতা:০৯

 কৃপণের বদান্যতা

টাকার কুমির প্রেমদাস গৃহ কজুস ছিল বড়, 

ছাড়িত না সুদ একটি পয়সা যত হাতে পায়ে ধরো। 

তুলসীর মালা গলায় তাহার হরিনাম ঝোলা হাতে-

 সুদের হিসাব করিতে করিতে বেড়াত উঠানে ছাতে। 

একটি মুষ্টি ভিক্ষা চাহিলে লাঠি নিয়ে যেত তেড়ে,

 আধপেটা খেয়ে টেনা পারে, টাকা মাটিতে রাখিত গেড়ে। 

সহস্য একদা ভগবান্ কারে নিয়ে যাম কোন দিকে

– তার আজীবন সক্ষিত ধন খয়রাতে দিল লিখে। 

ডাক্তারখানা, টোল, ইস্কুল, দেউল, অতিষ-শালা, 

নির্মাণ তরে দিল সব, শুধু রেখে বোলা আর মালা।

 নামাবলি গায় কাঁথাখানি ঘাড়ে, ‘শ্রীরাধামাধব’ ব’লে, 

প্রেমদাস পুঁই গেলেন সহসা শ্রীবৃন্দাবন চলে। 

যার নাম কেহ করিত না ভয়ে কছু, পাছে হাঁড়ি ফাটে, 

শতবার তার নাম না করিয়া কারো দিন নাহি কাটে।

কবিতা:১০

শ্রী নীলরতন দাশ মহতের স্মৃতি

বকসার রণভূমিতে চলেছে সংগ্রাম ঘোরতর, 

মোগল পাঠান বীর পদভরে কাপে ভূমি থর-থর।

 হুমায়ুন রণে পরাজিত হয়ে করিলেন পলায়ন, 

মহিষী তাঁহার জয়ী শের সার হাতে বন্দিনী হন। 

নির্যাতনের শঙ্কা ও ভয় জাগে বেগমের প্রাণে, 

শের সা তাঁহারে অতি সমাদরে কহেন সসম্মানে

– “রাজ্য লইয়া মোগলের সাথে আমার বিরোধ বটে,

 মাতৃজাতির সঙ্গে আমার নাইকো বিবাদ মোটে। 

আমারে, মা। তুমি নির্ভয়ে মনে করিও পুত্রসম,

অভিলাহ তব জানালে পুরাব যতনি সাধ্য মম।”

 লভিয়া বিজয়ী বীরের মহৎ হহৃদয়ের পরিচয়- 

মোগল মহিষী হলেন মুগ্ধ বিস্মিত অতিশয়। 

শের সারে তিনি কহিলেন করি’ প্রাণের আশীর্বাদ,

“বাদশার কাছে অগ্রায় যেতে অন্তার মম সাব।

” শের সা’ তখনি পাঠালেন তার আগ্রার অভিমুখে, 

মহতের স্মৃতি চির-উজ্জ্বল রহে বেগমের বুকে।

নরেন্দ্র দেব [১৮৮৮ – ১৯৭১]

কবিতা ১১ থেকে  ১৫

কবিতা:১১

 দুঃখীরাম

গরিব চাষির ছোল, নাম দুখীরাম, 

পায়ে হেঁটে হাটে চলে, গায়ে করে ঘাম। 

একদিন দুর্ঘীরাম পথ দিয়ে যায়,

 টগবগ ধ্বনি শুনি পিছু ফিরে চাচ্ছ 

দেখে জোরে ছুটে আসে ছোকরা সওয়ার,

 আরামে ঘোড়ার পিঠে রাশ টেনে তার।

 সুখীরাম দেখে ভাবে মজা এ তো বেশ,

 ঘোড়া যদি পাই আমি ঘুরি সারাদেশ। 

বোঝা ঘাড়ে পায়ে হেঁটে হাটে আসা রোজ

 সবজি আনাজ বয়ে বাবুদের ভোজ- কে-বা কোন,

 কে-বা যায়, কে রাখে খবর! 

যেদিন যা পাই ভাবি মিলেছে জবর। 

আমি যদি কোনোদিন পাই 

লক্ষ্মীীর সোনার ঝাপিটা হাতে, 

বাজপক্ষীর মতন উড়ব 

দেখো ঘোড়ার ওপোর, 

দেখার আমার কত চাবুকের জোরও

লক্ষ্মী আকাশ-পথে যেতে যেতে,

 এই দুখীর মনের কথা শুনলেন যেই, 

ভাবলেন হলেও এ আশার অধিক, 

সৎপথে থাকে যদি ঘোড়া পাবে ঠিক।

 ঘোড়া ছুটে আসে বেগে অশ্বারোহীর 

দুধীরাম একধারে দাঁড়িয়ে অধীর ভাবে,

 না না, আর নয়, ঘোড়া তার চাই, 

এখন চিন্তা শুধু টাকা কোথা পাই। 

শুনেছে সে একমনে যা-কিছু যে চায়, 

  • বিধাতার কৃপা হলে সে নাকি তা পায়।

 মনে মনে বলে তাই: ওগো ভগবান,

আমায় একটা ঘোড়া দাও তুমি দান।

 হাটের ফিরতি পথে দেখে দুখীরাম একটি

 রেশমি ঘলি-বহু টাকা দাম, পথের ধুলোয় 

পড়ে গড়লগাড়ি খায়, দুখীরাম ভয়ে ভয়ে 

কাছে তার যায়। খলিটা কুড়িয়ে নেয় চেয়ে

 চারপাশ, ওঠে নামে বুকে তার ঘন নিশ্বাস।

 তুলে দেখে বেশ ভারী, বরাত কী জোর। 

খুলে দেখে থলি ভরা সোনার মোহর। 

আহ্লাদে আটখানা, ভাবে দুখীরাম-

 বিধাতা দিলেন তাকে ঘোড়াটার দাম।

 তারপরই মনে হল-এ তো ঠিক নয়,

 হারিয়েছে হাটে কেউ থলি নিশ্চয়। 

বেচারা হয়তো খুঁজে ফেরে চারিদিক

 এ খলিটি নেওয়া তার হবে না তো ঠিক। 

চলল খুঁজতে থলি হারিয়েছে কার? 

হেনকালে এল কানে সংবাদ তার বিদেশি

 কে বণিকের খোয়া গেছে আজ রেশমি একটি খলি, 

গায়ে কারুকাজ। সোলার মোহর ভরা।

 খোঁজ দিলে তার- মহাজন অর্ধেক দেবে উপহার।

 দুখীরাম এ খবর শুনে ছুটে যায়, 

হাটে এসে খুঁজে শেষে মহাজনে পায়।

হারা নিধি হাতে এল-খুশি মহাজন, 

কিন্তু দুখীকে দেখে চটে গেল মন।

 গরিবের ছেলে চায় মোহরের ভাগ। 

অর্ধেক দিতে হবে? শুনে ভারি রাগ।

 কী করে সে ফাঁকি দেবে আঁটে মতলব, 

গলি খুলে বলে, একী। নেই কেন সব?

 হীরের আংটি কোথা ঘলির ভিতর। 

সেটা দিলে, পাওনাটা পাবে তার পর। 

রাজার আংটি সেটি-বহু টাকা দাম, 

শুনে হায়, হতাশায় কাঁদে দূখীরাম।

বলে, তুমি দয়াময়, 

ওগো ভগবান, ভাগ্য মন্দ, 

তাই-এই অপমান মিছে 

বলে ফাঁকিবাজ চোর মহাজন। 

খলিতে যা-ছিল তার আছে সবই ধন।

সেদিন ছদ্মবেশে দেখিছেন

 হাট রাজা ও মন্ত্রী মিলে, 

ফেলি রাজপাট, একটি চাষার 

ছেলে কেঁদে কেন যায়? 

শুধালেন রাজা ডেকে-

ছেলেটি কী চায়? 

দুখী বলে জোড়হাতে, 

হুজুর। শুনুন, মহাজন

 নাম যার কত তার গুণ।

 মোহরের খলি কোথা

 হারিয়েছে ওর আমি

 সেটি খুঁজে পেয়ে বনে গেছি চোর। 

কথা ছিল উপহার দেবে অর্ধেক,

 এখন সে বলে ছিল ঘলিতে অনেক। 

রাজার আংটি ছিল খালির 

ভিতর সেটা আমি সরিয়েছি। 

এমনি ইতর। রানীর তাবিজে ছিল কত জহরত,

 সে-ও নাকি মেরে দিছি। 

নাকে কানে খৎ করব না উপকার কারো

 আমি আর, চাইনে মোহর ওর, থাক উপহার।

রাজা শুনি কহিলেন, এ যে অন্যায়।- 

এসো তুমি রাজবাড়ি আজই সন্ধ্যায়। 

এই নাও, রাখো কাছে হুকুম রাজার, 

দ্বারীকে দেখালে এটা, ছাড়া পাবে দ্বার। 

গরিব চাষার ছেলে দুখীরাম যায়, 

সন্ধ্যায় রাজবাড়ি ধুলোমাখা পায়,

 বুক করে গুরু গুরু, মনে বড় ভয়,

 রাজার বাড়িতে যাবে? কী জানি কী হয়।

 সেপাই সাস্ত্রী আর বরকন্দাজ তাদের

 পেরিয়ে যাওয়া নয় সোজা কাজ। দুর্গের 

দ্বার যেন জেলের ফাটক বেয়াদপি দেখে যদি-করবে আটক। 

সাতবার যায় দুখী, ফোর সাতবার,

পায় না সে ঢোকবার সাহসটা আর।

 জুতো নেই পায়ে তার, নেই ভালো বেশ,

 যা থাকে কপালে ভেবে ঢুকে পড়ে শেষ। 

দেখে সেই মহাজন সেথায় হাজির, 

রাজা কন, আরে এসো দুখীরাম বীর।

 মোহরের থলি যেটা পেয়েছ হঠাৎ, 

সেটা যদি নিতে চাও, কড়া করো ধাত।

 যে-ঘলিটা হারিয়েছে এই মহাজন, 

এ-ঘলি সে-থলি নয় বুঝেছি এখন, 

মোহর তো সবই এক, কেবা চেনে কার। 

সুতরাং এ খলিটা নয় জেনো তার।

 সে-খলিতে ভরা ছিল আরও বহু চিহ্ন 

রাজার আংটি, আর রানীর তাবিজ।

 11 সেসব তো একটিও এ ঘলিতে নেই,

 নিজমুখে মহাজন বলেছেন এই। 

সওদাগরের গেজে একই ধাঁজে হয়,

 কিন্তু তাবিজ নেই, অংটিও নয়, 

এ-খলি যে তাঁর নয়, এই তো প্রমাণ।

 তাহলে কী করে বলো উনি এটা পান?

কুড়িয়ে পেয়েছ পথে, তুমি যদি চাও, 

অর্ধেক নয় আর, পুরোপরি নাও।

 এই বলে মোহারর খলি তুলে নেন,

 হাসিমুখে কাছে ডেকে দুখীরামে দেন।

 জয় হোক মহারাজ। দুখী বলে যায়, 

মোহর মিলেছে তার, ঘোড়া কোথা পায়া

 ‘হরিহর ছত্তরে’ মেলা হয় জোর 

সেথা গেলে হাতি ঘোড়া মিলে যাবে ওর।

 এই শুনে সে-মেলায় এল দুখীরাম, 

ঘোড়া দেখে ভালো ভালো, যেটা বেশি দাম,

 কিনে নিয়ে এল দুখী পিঠে দিয়ে জিন, 

দুখীরাম সুখী আব্জ, দেশে সবচিন। 

ঘোড়ার পিঠেতে চড়ে ঘোরে কত দেশ,

মোহরে মিলেছে তার বাড়ি ঘর বেশ। 

সৎপথে চলে যেবা ভালো হয় তার, 

এ কথাটা দুখীরামই করেছে প্রচার।

কবিতা:১২

সেরিবা ও সেরিবান

নাম শুনে ভেবো নাকো ওরা দুটি সহোদর ভাই, 

নামটুকু ছাড়া আর দুজনার কোনো মিল নাই। 

সেরিবা ও সেরিবান একদেশে থাকে বটে ঠিক, 

ফেরি করে ঘোরে তারা পথে পথে, খুচরো বণিক। 

এ-যুগের কথা নয়, ইতিহাস অতি পুরাতন, 

যে-দেশের এ কাহিনী নেই আর সে-দেশ এখন।

সেরিবার লোভ ভারি, যোঁজে শুধু কিসে বেশি পায়।

 শেরিবান ভালো লোক-উচিত যা সেইটুকু চায়। 

একদিন দুজনাতে কেনা-বেচা করিতেছে ঘুরি। 

শহরের একদিকে ছিল এক ধনীদের পুরী। 

সে-বাড়ির কেউ আজ বেঁচে নেই, 

শুধু দুটি প্রাণী খুড়মুড়ি বুড়ি এক-পিতামহী ব’লে তাকে জানি। 

মরে গেছে ছেলে তার, মেয়ে যার-একটি কিশোরী, 

বুড়ি সেই নাতনিকে বুকে নিয়ে আছে প্রাণ ধরি।

 টাকাকড়ি নেই কিছু, রোজগার কে করিবে আর।

 ছিল ঘরে দামি যা যা, বেচে তাই চালাত সংসার। 

অবশেষে নেই আর-উপবাস ছাড়া পথ কোনো, 

একখানি ভাঙা থালা পড়েছিল অনেক পুরনো, 

সেরিব্যার ডেকে সেই থালাখানি দিয়ে বলে, 

“ভাই, কিনে নাও এইখানি, আমাদের খেতে কিছু নাই।

” নেড়েচেড়ে থালাখানা দেখে সোনা। মুখে বলে

 “ছি, ছি, এ আবার নেবে কেথো। 

ভাঙা ফুটো কেনা মিছিমিছি।” চলে গেল, 

বলে গেল “জজালে ফেলে দাও এনি।” 

মতলব ফিরে এসে কম দামে কিনে নেবে সেটা।

 বুড়ি বলে “সদাগর, কিছু দাও, চাল নেই যরোগ-

 সেরিব্য শোনে না সেটা, বলে “খামো, দেখা যাবে পরে।”

অনকাল পরে এল সেরিকান ফেরি সেধে সেথা,

 বালিকাটি ডাক দেয় “সদাগর। 

শুনে যাও হেথা। সেরিবান এল কাছে।

 ভাঙা খালা দিয়ে তাকে বুড়ি “কিছু 

এর দাম দিয়ে কিনে নাও।” 

বলে হাতজুড়ি। খালাখানি 

নেড়ে চেড়ে সেরিবান বলে, “

মাগো, এর দাম আমি কোথা পাব?

 এ খালার মূল্য যে ঢের।” বুড়ি বলে, 

“কিছু আগে বলে সেল এক সদাগর,

 এ খালার কানাকড়ি হবে নাকো বাজারেতে দর। 

তুমি বাছা যতটুকু দিতে পারো, নাও তাই দিয়ে, 

আমাদের পেটে আজ ভাত যাবে, 

সেই টাকা নিয়ে।” সেরিবান শুনে 

তাহা দিল ঢেলে খলি তার নেড়ে 

পাঁচশত কাহনের বেশি আরো যাহা ছিল কেড়ে। 

তারপর কহিল সে, “এ খালার লাখ টাকা দাম, 

বেচে আরো দিয়ে যাব। 

নহি আমি নিমক-হারাম।”

থালা নিয়ে সেরিবান যেই 

গেছে চলে কিছুদূর, 

সেরিবার গলা যেন এল কানে, 

ভারি মোটা সুর।। ডেকে বলে-“

কোথা গেলে? বুড়ি মাগ্যে। 

নিয়ে এসো খালা, নাও কিছু দুজনেতে।

 উপবাসী থাকা বড় জ্বালা।”

“মাণ করো, সে খালা যে নিয়ে গেল কিনো-বুড়ি বলে,

 “আর এক সদাগর পাঁচশত টনকার বদলে।” 

শুমে যেন সেরিবার মাথা গেল ঘুরে বো ব্যে করে।

 হায়। হায়। সব গেল। কেঁদে উঠে যায় বুঝি মরে।

 অসহায় মেয়ে পেয়ে চেয়েছিল ঠকাতে সে ছলে, 

খালাখানা গেল বলে- জ্বলে বুক হিংসা অনলে।

ছুটে যায় নদীতীরে। পারঘাটে দেখে 

খেয়াতরী মাঝপথে গেছে প্রায়।

 সেরিবান আছে খালা ধরি। 

থেকে ওঠে-“ওগো মাঝি। তরী ঘাটে ফেরাও, 

ফেরাও।” মাঝি শুনে হেসে ওঠে, বলে, “বাবু। 

জলে ঝাঁপ দাও।” সেরিবার মাঘাটার 

কেমন যে হয়ে গেল গোল, 

ঝাঁপ দিয়ে পাড়ে জলে সাঁতরায়-এমনি পাগল।

 খরস্রোতা নদী তাকে টেনে নিয়ে ডোবাল ঘূর্ণিতে,

 সেরিবার মতো যেন অতিলোভ নাহি থাকে চিতে।

প্রতারণা মহাপাপ বিশ্বাসের সুযোগ লইয়।

 নিজেরাই ঠকে তারা অপরকে ঠকাইতে গিয়া।

তারপর, শোনো বলি, সেই খালা বেচে সেরিবান,

 কোটিপতি হল যেই, এল ছুটে, পুলকিত প্রাণ,

 বুড়িদের সে-বাড়িতে, দেখে বুড়ি বেঁচে নেই আর,

 একলা কিশোরী মেয়ে শোকে কেঁদে করে হাহাকার। 

কে তাহারে দেখে শোনে? অসহায়, কেবা নেবে ভার। 

সেরিবান মেয়েটিকে বিয়ে করে পাতিল সংসার। যত

 পাড়া প্রতিবেশী দিল তারে সাধুবাদ কত। সুখী 

হল দুজনাতে দুজনার হয়ে মনোমতো।

কবিতা:১৩

দুষ্ট কুমার

বারাণসীরাজ ব্রহ্মদত্ত, 

দুষ্ট কুমার ছেলে। 

কষ্ট প্রকৃতি, সদস্বভাব,

 গালি দেয় কাছে গেলে 

॥ শিশুকাল হতে অপ্রিয় 

সবার, সবার চক্ষুশূল। 

লাথি মারে তার স্বতাবর্গে 

না-হলেও কোনো ভুল। 

ভরে শুনি তাকে সাপের 

মতন রাজ্যের যত লোক। 

নিষ্ঠুরতার সীমা নেই তার, 

মানুষ মারার ঝোঁক।। 

দুষ্ট কুমার আসিছে শুনিলে

 পালাত ছেলের দল। রাঘুসে 

ওই ছেলের জন্য সারা দেশ চঞ্চল।।

একদিন গেল দুষ্ট কুমার নদীতে

 সাঁতার দিতে। 

সঙ্গে ছুটিল বহু অনুচর 

ছেলের যত্ন নিতে। কুমার 

যখন খেলিতেছে জলে, 

উঠিল প্রলয় কড়। ঢাকিল 

আকাশ ঘন কালো মেঘে,

 হ্যকে বাজ কড় কড়।। 

অনুচরগণ কহিল ‘কুমার। 

চলুন ফিরিয়া যাই। নদীর 

গতিক ভালো নয় বড়, বন্যার ভয় পাই।।

” দুষ্ট কুমার বলে হেসে উঠে 

“আসুক বন্যা চেপে। বড় ভালো 

লাগে উত্তাল নদী নেচে যাব চলে খেপে ।।

 গুল মোরা যাই সাঁতার 

কাটিগে নদীর মধ্যিখানে। 

তীর-ঘেঁসা এই কোমর-জলে

 যে আরাম পাই না স্নানে।”

চলে গেল একা কুমার সেখানে,

 গেল না রক্ষীদল। দেখিতে 

দেখিতে প্রচণ্ড বেগে নদীতে 

নামিল ঢলঃ প্রাণভয়ে তারা 

পালাল সবাই দুষ্ট কুমারে ফেলে। 

রাজ্যে ফিরিয়া জানাল রাজারে

-বানে ভেসে গেছে ছেলে।

 সারাদ শুনে ব্যাকুল নৃপতি 

লয়ে বহু অনুচর। সেই দুর্যোগে

 নদীতীরে গিয়ে খুঁজিলেন বিস্তর।।

 খুজিলে কী হবে? বন্যার স্রোতে

 যে ছেলে গিয়েছে ভেসে। 

তাকে কি কখনো পাওয়া

 যায় ঘাটে। ফিরে গেল রাজা শেষে ।

। দুষ্ট কুমার ভাসিতে ভাসিতে

 চলেছে বন্যাস্রোতে। 

এমন সময় দেখে ভেসে 

যায় গাছ এক কোথা হতে।

 শ্রান্ত ক্লান্ত, যায় বুঝি প্রাণ,

 সারা দেহে অবসাদ। 

গাছের গুড়িটি এল যেন 

কাছে বিধির আশীর্বাদ।। 

আনন্দে তার রাখে দেহভার

 আরামে সে ভাস্য-গাছে।

 ক্রমে দুর্যোগে তিনটি সঙ্গী 

একে একে এল কাছে।

একটি সর্প, 

পূর্বজন্মে ছিলেন বণিক যিনি।

 চল্লিশকোটি স্বর্ণমুদ্রা রাখেন পুঁতিয়া তিনি। 

সেই অর্থের মায়াতে বেচারা মৃত্যুর পর

 শেষে সাপ হয়ে তাঁর সুপ্তধনের নিকটে ছিলেন এসে।

 আর একজন পুঁতিয়াছিলেন বিশ কোটি চুপে চুপে।

 তিনি সেখা মরে’ অর্থের লোভে ছিলেন মুষিক-রূপে। 

অতি বৃষ্টির মুষলধারায়, বন্যা প্লাবনে তারা। 

ভেসে চলেছিল স্রোতের টানেতে, দুজনেই গৃহহারা।

এমন সময় সেই গাছ দেখে 

এল তারা সেখা ছুটি। একবারে সাল, 

অপরপ্রান্তে ইদুর বান্ডিল উঠি।। 

তারপরে এল শুকপাখি এক, 

ঝড়ে ভেঙে গেছে বাসা। 

চারিদিকে দেখে জল থৈ থৈ ব্যচিবার নাহি আশা। 

বৃষ্টির ছাটে ঝড়ের দাপটে কেবলি ঠিকরি পড়ে। 

প্রাণভয়ে ভীত সে-ও অবশেষে সেই গাছে এসে

 চড়ের দুষ্ট কুমার এদের দেখিয়া রেগে ওঠে মনে মনে।

 কিন্তু তখন নিরুপায় তিনি, ভাসে তাই চারিজনে।

মেঘলা আকাশে সূর্য কখন দিয়াছে অন্ততলে।

 জানে না কেহই, রাত নেমে এল। 

তখনো ভাসিছে জলে।।

আঁধার ক্রমশ গাঢ় হয় দেখে কুমার কাঁদিয়া ওঠে।

 চিৎকারে তার সর্গ মুখিক শুকেরও তরা ছোটে।

উদীচা নামে ব্রহ্মেন এক ছিল সে নদীর বাঁকে। 

সন্ন্যাসব্রতী, রচি আশ্রম বিজনে একাকী থাকে। 

শুনি কুমারের কান্নার ধ্বনি উদীচা ওঠে জেগে। 

শয্যা ছাড়িয়া নদীতীর পানে ছুটিয়া এলেন বেগে।।

 বন্যার জলে কিশোর বালক গাছ ধরে ভেসে চলে।

 দেখি ব্রাহ্মণ বাঁচাইতে তারে ঝাঁপ দিয়া পড়ে জলে। 

নিমেষেই তিনি গাছের গুঁড়িটি আনিলেন তীরে টানি। 

সর্গ, মুষিক, শুক, মানুষেরে রাখিলেন ঘরে আনি। 

সবার অগ্নে সেক তাপ আর খাদ্য পানীয় দানে। 

মুমুর্ষু শুক সর্প মূষিকে বাঁচালেন তিনি প্রাণে। 

নিয়ত তাঁহার সেবা ও যত্নে সুস্থ হইল তারা। 

দুষ্ট কুমার ভাবে-“সন্ন্যাসী লোকটা কেমন যারা।

 রাজার পুত্র আমি পড়ে আছি, ইতর প্রাণীকে দয়া। 

সেরে যদি আমি বাড়ি ফিরি, ওর দফাটি করিব গয়ায়

ইতর প্রাণীরা সুস্থ দেখিয়া সন্ন্যাসী এইবার। 

কুমারের সেবা করিতে এলেন, করুণার অবতার।

 কহিলেন হাসি “সেবক তোমার এ ত্রুটির ক্ষমা মাগে।

 অল্প যাদের জীবনীশক্তি দেখেছি তাদের আগেও 

নইলে ওরা যে বাচিত না ভাই, হয়েছিল আয়ুক্ষীণ। 

তুমি আমাদেরই মানুষের ছেলে। বাচিবে দীর্ঘদিন।”

বন্যার জল শুখাইল ক্রমে, থেমে গেল বর্ষণ। 

রৌদ্র উঠেছে। মাঠে মাঠে চাষি করে ক্ষেত কর্ষণ। 

বিদায় লইল সর্ণ মুধিক, বলে গেল অনুরাগে, “বন্ধু,

 তোমার যদি কোনোদিন অর্থ কিছুতে লাগে পঞ্চাশ

 কোটি স্বর্ণমুদ্রা মোরা দিব হাতে তুলে। 

তোমার সেবা ও যত্নের কথা কখনো যাব না খুলে।” 

শুক বলে “তুমি দয়ার সাগর, অর্থ অমোর নাই। 

আমি এনে দিব খাদ্যশস্য যখন যাতটা চাইয়”

দুষ্ট কুমার মনে মনে বলে, “সাই যদি ওকে বাগে। 

জীবন্ত আমি পুঁতিব, অথবা শুলেই চড়ার আগে।”

প্রকাশ্যে বলে, “রাজ্যে মোদের কখনো আসিলে স্বামী,

 দ্বিজজনোচিত ষোড়শোপচারে পূজিব তোমারে আমি।

। আশ্রম তব লাগিয়াছে ভালো, ছিলাম পরম সুখে। 

মানুষে, মুষিকে, শুকে আর সাপে ভালোবেসে বুকে বুকে।।”

 মনে মনে বলে, “রাজ্যে পা দিলে সাজা দেব নিজ হাতে। 

রাজার ছেলেকে এক করেছিলে ইতর প্রাণীর সাথে।” 

দিন যায়। গেল বর্ষ ও দাস। উদীচ্য একদিন। 

ভাবে দেখে আসি পরীক্ষা করে। ইতর প্রাণীরা হীন।।।

 কৃতজ্ঞতা কি মনে আছে কারো? নিয়ে আসি পরিচয়।

 গিয়ে দ্যাখে, তারা যা বলে গিয়েছে কিছুই মিথ্যা নয়।

 সর্প কহিল, “নিয়ে যান প্রভু আমার তিরিশ কোটি। 

মুষিক কহিল, “নিন বিশ কোটি-চরণে দিলাম গুটি।” 

শুক বলে, “প্রভু আদেশ করুন যাই হিমগিরি-মূলে।

 সহজাত দেখা শ্রেষ্ঠ শস্য-নিয়ে আসি সব তুলে।” 

উদীচ্য বলে, “থাক থাক ভাই সংশয় করো ক্ষমা। 

রহিল ওসব তোমাদের কাছে আমারই হিসাবে জমা।”

 এই বলে যায় বারাণসী ধামে, দুষ্ট কুমার যেখা। 

রাজা হয়ে করে রাজ্য শাসন। অশান্ত প্রজা সেবা।

ব্রাহ্মন যেই রাজপ্রাসাদের দাঁড়ায়েছে দ্বারে এসে। 

কুমার তখন হস্তীপৃষ্ঠে চলেছিল রাজবেশে।। 

দূর হতে তিনি ব্রাহ্মণে চিনি কহেন পার্শ্বচরে। 

“ধরে নিয়ে যাও মারিতে মারিতে ওটাকে কয়েদ-ঘরে। 

অদৃষ্টে ওর মৃত্যুদণ্ড। শূলে দিব আমি ওকে। 

রাজার ছোলর প্রতাপটা আজ দেখে যাক নিজ চোখে।”

রাজপ্রহরীরা বাঁধি ব্রাহ্মণে করে পিঠে কশাঘাত।

 সন্ন্যাসী কিছু করে না নিষেধ বলে শুধু তুলে হাত।। 

“গাছের গুড়িতে ভাসিছে বালক, একদা বানের জলে।

 গভীর রাত্রি, কেঁদে ওঠে ভয়ে, স্রোতোবেগে ভেসে চলে। 

‘গাছ তুলে নাও, মরুক মানুষা বলেছিল সব লোকে। 

আজ বুঝিতেছি কথাটা সতং শেখা হল বড় ঠকে। 

যারা মনে করে মানুষ বন্ধু, খুঁড়িটা নেহাত বাজে। 

ভুল করে তারা, মানুষ শত্রু, গুঁড়ি লাগে বহু কাজে।

পথচারী বহু পথিক তখন হয়েছে সেখানে জড়ো।

শুধায় সকলে,

 “কহ সন্ন্যাসী বাথা কি পেয়েছ বড়গ্র

 তুমি কি রাজার করেছিলে প্রভু কছু কোনো উপকার।

” ব্রাহ্মণ তবে প্রকাশিয়া কহে বন্যার সমাচার।

 শুনি প্রজাগণ উঠিল খেপিয়া, পাপিষ্ঠ এই রাজা। 

বলে, “এসো দিই সবে মিলে ওরে এখনি কঠিন সাজা।”

 হৈ হৈ রবে আসিল ছুটিয়া হাজার হাজার লোক। 

কেহ কেটে নিল নাক কান তার, উপাড়িল কেহ চোখ।। 

ঝাঁকে ঝাঁকে তীর বেঁধে এসে শির, মারে কেহ মুদগর।

 কিছু হাতে নেই, সে-ও ছুড়ে মারে পথে খুঁজে প্রস্তর।।

 জনতার সেই নিঠুর আঘাতে মরিল দুষ্ট রাজা। 

অন্যায় যত করেছিল তার লভিল উচিত সাজা।।

 প্রজারা তখন উদীচ্যে লয়ে বসাল সিংহাসনে।

 কহিল, “তুমি হে ধৈর্যের রাজা, লও নতি শ্রীচরণে।।”

 সত্যনিষ্ঠ উদীচ্য করে প্রজারে পালন সুখে। 

রাজধর্মের গৌরব খ্যাতি প্রশংসা মুখে মুখে। 

হঠাৎ একদা মনে পড়ে গেল মুষিক ও শুক, সাপ।

 চলিলেন রাজা দেখিতে তাদের মনে কি ঢুকেছে পাপ।

 সাপ বলে, “প্রভু আসুন আসুন। নিয়ে যান সব টাকা।

” ইদুর কহিল, “আর কতকাল পাহারায় যায় রাখায়

 আপনার ধন যা আছে এখানে সব প্রভু নিয়ে যান।”

 সন্ন্যাসী হাসি কহিল, “এবার এসেছি তো নিতে দান।।

 বারানসীধামে যত দীনহীন বুভুক্ষু বিবসন। 

তাদের সবার করিব এবার দুঃখের নিরসন। 

এতকাল ধ’রে তোমরা বন্ধু যে-সোনা রেখেছ জমা।

 দারিদ্র্য আর অভাব মেটালে বিধাতার পাবে ক্ষমা।।

 অর্থ যে হয় সার্থক শুধু জগতে যোগ্য দানে।

 কত-না আঙুর কত ব্যথাতুর সান্ত্বনা পায় প্রাণে।

 কেবল শুকের শস্য এখন লাগিবে না প্রয়োজনে। 

খাদ্য-অভাব ঘটিলে রাজ্যে শুকেরে স্মরিব মনে।। 

এখন তোমরা চলো মোর সাথে, তোমাদের লয়ে যাব।

 মানুষের চেয়ে তোমরা যে ভালো, হেন সাধু কোথা পাব?”

এত বলি তিনি সবারে লইয়া ফিরিলেন বারানসী। 

শুকেরে দিলেন স্বর্ণদণ্ড, কথা কবে যেঘা বসিয়

স্ফটিক বিবর পাইল মূষিক, 

সুবর্ণগুহা সাপ। বলে ‘জয় জয়, 

উদীচা রাজ, আনন্দে দেয় লাফ।।

পশুপক্ষীরা সবার বন্ধু জেনেছিলে তুমি একা।

 ধনা আমরা পেয়েছিনু দেব দুর্দিনে তব দেখায়

কবিশেখর কালিদাস রায় [১৮৮৯-১৯৭৫] 

কবিতা:১৪

অপূর্ব প্রতিশোধ

“পুত্র, তোমার হত্যাকারীরে পাইনিকো আজো ছুঁড়ে

 আফসোস তাই জ্বলিছে সদাই তামাম কলিজা জুড়ে

 তার তাজা খুনে ওযু করে আজো নামায পড়িনি তাই, 

আত্মা তোমার ঘুরিছে ধরায়, স্বর্গে পায়নি ঠাঁই। 

বাঁচিয়া থাকার কথা নয় আর তোমারে হারায়ে, 

বাল, কেবল তোমার মুক্তির লাগি সই দুনিয়ার তাপ।”

 বলিতে বলিতে রুমালে অশ্রু মুছিলেন ইউসুফ, 

হেনকালে এক ঘটনা ঘটিল অদ্ভুত অপরূপ।

শশকের মতো হস্ত ব্যস্ত পলাতক এক ছুটে

 থরথর ভয়ে কাঁপিতে কাঁপিতে চরণে পড়িল লুটে,

 কহিল-“জনাব, রক্ষা করুন, দুশমন পিছে ধায়।

 দিন দয়া করে আপনার ঘরে আশ্রয় অভাগায়।

 হউসুফ কান “আল্লাহর ঘর, মোর ঘর কেন কহ? 

অজানা অতিথি, নির্ভয়ে তুমি তাঁর ইদগাতে রহ।”

বহুদিন পরে ঘুমাল অতিথি মধ্যলি বিছানায়, 

হেন দামি খানা-বহুকাল তার জুটেনিকো রসনায়।

সুখ-সুপ্তরে জাগাইয়া কদ শেষরাতে ইউসুফ- 

“অজানা অতিথি পালাও এবার দুনিয়া এখনো চুপ।

 লও টাকাকড়ি, দুদিনের খানা আর লও তরবারি, 

আশখানা হতে ঘোড়া বেছে নিয়ে চলে যাও তাড়াতাড়ি।”

নড়িতে চাহে না মুসাফির, বলে “বাঁচিতে চাই না আর,

 জীবন আমার সঁপিলাম, পীর, পূত পদে আপনার।

ইব্রাহিমের গুপ্তঘাতক আমি ছাড়া কেউ নয়। 

ঐ অসিয়ানা এ বুকে হানুন-সত্যের হোক জয়।”

বৃদ্ধের আঁখি বজ্রের মতো সহসা উঠিল জ্বলি

 বজ্রদীর্ণ মেঘের মতনই অশ্রুতে গেল গলি।

 কহিল বৃদ্ধ-“এতদিনে এলি, এতকাল খুঁজিলাম,

 নিজে এসে হাতে ধরা দিলি আজ। ঘাতক, 

কী তোর নাম। থাক নামে আর কী কাজ 

আমার-মাফ করিলাম তোরে, সব-সেরা ঘোড়া দিলাম, 

এখনি পালা তার পিঠে চড়ে। পাঁচগুণ টাকা নিয়ে যা

 সঙ্গে চলে যা সুদুর দেশে, মানুষের মন বড় দুর্বল, 

কাজ কি এদিকে এসে।”

তারপর চেয়ে আসমান পানে বৃদ্ধ কহিল “বাপ 

শত্রুরে ভোর তলোয়ার তলে পেয়েও করিনু মাফ।

 এতদিন পরে তোর হত্যার লইলাম প্রতিশোর, 

খুনের নেশায় আর করিব না আখেরের পথরোধ।”

কবিতা:১৫

জাফর ও বান্দা

দাতার প্রধান জাফর সদাই দান করে দীনজনে, 

তাহার সমান দাতা নেই আর এ-বারণা তার মনে। 

একদা সহসা বুস্তানে তার সাদ্য-ভ্রমণ-কালে, 

হেরে তার দাস ক্ষুধায় কাতর বসে আছে আলবালে।

 দিবস-শেষের তিনখানি রুটি প্রাপ্য আহার 

তার দিল একে একে কুকুরের মুখে-বিচিত্র ব্যবহার। 

কছিল জাফর-“ওরে ও নফর, সারাদিন উপবাসী, 

দিবস-শেষের খানা তোর, তাও কুকুরেই দিলি হাসি?” 

চমকি বান্দা জোড়হাতে কয়-“মরদ হয়েছি ভবে, 

আজিকে নসিবে না হয় রসদ, কালি পুনরায় হবে। 

খোদার এ জীবে আহার কে দিবে, ক্ষুধায় বাঁচাবে কেবা? 

মোরা যে ধরাতে এসেছি করিতে তামাম জীবের সেবা।”

 কহিল জাফর আঁখি ছলছল-“আবিসিনিয়ার দাস, 

আজিকে দেমাক করিলি চূর্ণ, ছিঁড়ে দিলি মোহলাশ।

 দিরের কলমা মোরে দিলি তুই, দোরে কোল, বুকে আয়,

তুই দানাদার, দরাজদস্ত এই দীন-দুনিয়ায়।

 দৌলতখানা খুলে দেছে যেবা, 

সাতা কই বটে তারে- সেই ভ্যার্থীবীর, 

বুকের রুবির হেলায় যে দিতে পারে। 

কার ক্রীতদাস,

 দিলাম খালাস-গোলামির অবসান, 

এই বাগিচার মালিক হইয়া দিল খুলে কর দান।”

কবিতা ১৬ থেকে  ২০

কবিতা:১৬

মাতৃভক্তি

বায়েজিদ বোস্তামি-

শৈশব হতে জননীর সেবা করিতেন দিবাযামী।

 দুপুর রাত্রে জননী জাগিয়া ডাকিলেন, ‘বাছাধন, 

বড়ই পিয়াস পানি দাও, বলি মুদিলেন দু’ময়ন।

 দেখিল বালক ঘরের কোণের কলসিতে নেই পানি। 

বহুদূর পথ করনা হইতে কলসি ভরিয়া আনি মায়ের 

তৃষ্ণা মিটাইবে বলি গভীর অন্ধক্যার ছুটিয়া বাহির 

হইল একাকী কলসি লইয়া ঘাড়ে।

জল ঢালি পিয়ালায় সুপ্তা মাতার নয়ন 

শিয়রে দাঁড়ায়ে রহিল ঠায়। ভাঙালে নিদ্রা হবে অপরাধ, 

কখন ভায়িবে নিদ, সেই ভরসায় পানি হাতে

 খাড়া রহিল সে বায়েজিদ।

পূর্বগগন ফর্সা হইল, ডাকিয়া উঠিল পাখি,

 জননী মেলিল আমি।

দেখিল শিয়রে দাঁড়ায়ে রয়েছে দশ বছরের ছেলে, 

পানি হাতে কেন, বুঝিল না মাতা প্রথম নয়ন মেলে।

সহসা পড়িল মনে, গভীর রাত্রে পিপাসার পানি চেয়েছিল বাছাবনে।

 কহিল মা, ‘মরি মরি।

বাছারে আমার, পানি হাতে করে সারা রাত্রটি বরি দাঁড়াইয়া আছ?

 ঘুমাওনি আজ?’ চোখে এল জল ভরি। 

পুত্রেরে কোলে নিয়ে মা চুমিল বার বার মুখখানি। 

কহিল জননী, ‘নয়নের মণি, সাধারণ শিশু নও,

খোদার দোয়ার বরকতে তুমি জগৎপূজ্য হও।

 পুত্র গরবে গর্বিত বুকে, খোদা, স্মরি তব নাম, 

তোমারে আমার জীবনের এই সম্বল সঁপিলাম।’

বিফল হয়নি মায়ের আশিস, হৃদয়ের প্রার্থনা,

 জগৎ-কন্দ্য জ্ঞানগুরুদের বায়েজিদ একজনা।

কবিতা:১৭

বর্বরের বিচার

১ নৃপতি সেকান্দার।

 মিশর বিজয় করিল তাহার উদ্যত তরবার। 

সভ্যদেশের উপরই তাঁহার রোখ, 

বর্বরদেশ দখলের নেই কোক, 

বর্বরদেশ দেখেননি চোখে কন্তু, 

কেবল সে দেশ দেখিবার তরে তবু,

 হয়ে কুতূহলী দক্ষিণদিকে হলেন অগ্রসর, 

সঙ্গে নিলেন জন কয় অনুচর।

পশিলেন এক নিগ্রোজাতির গ্রামে-

সর্দার তার অভ্যর্থনা করিলেন ধুমধামে।

 বসালেন তাঁরে সিংহচর্ম-সিংহাসনের পরে। 

সমাদার তাঁর করে সোনার ডুমুর আত্তর

 দিলেন শালপাতে উপহার। হাসিয়া

 সেকান্দার শুধান-“তোমরা খাও বুঝি সোনা দানা?”

সর্দার কান”আমরা খাই না, আছে শোনা, আছে জানা,

তোমরাই খাও যত সোনা পাও, নইলে জঙ্গী বেশে

এলে কেন এই জঙ্গলে ভরা দেশে?”

গ্রিকবীর কম-“শুধু তোমাদের রীতিনীতি আচরণ,

দেখিবার তরে এই দেশে আগমন।”

সর্দার কম-“যতদিন খুশি থেকে

আমরা কেমন করি আচরণ স্বচক্ষে যাও দেখে।”

হেনকালে দুইজন

একতাল সোনা সাথে কার

 এসে জানাইল নিবেদন

“হুজুর, তোমার কাছে মোদের

 একটা জরুরি নালিশ আছে।”

একজন রগে বলে- “একখানা 

জমি বেচিলাম ওরে, সে তার 

মাটির তলে একতাল সোনা 

পেয়ে গেছে তাই আমারে 

এসোছ দিতে, আমি কি তা 

পারি নিতে? জমির সঙ্গে 

জমির তলের সবি তো প্রাপ্য

 তার, ভাগ্য যা দিল ওরে, 

তাতে মোর কিসে হবে অধিকার?”

প্রতিবাদী কয়, “হুজুর, আমার 

আর্জি শুনতে হবে, জমিই 

কিনেছি সোনা তো কিনিনি, 

কিসে মোর দাবি তবে।

 ও তো জানতে না-জমিতেও

 সোনা আছে। ও-সোনা নিয়ে

 যে অপরাবী হর আমি ধর্মের কাছে।”

দুস্তরফ শুনে সদার মনে ভাবিলেন ক্ষণকাল, 

চিন্তায় তাঁর কুঞ্চিত হল ভাল। বলিলেন শেষে 

“তোমার ছেলেটি হয়েছে তো বেশ বড় তুমি

 এক কাজ করো। ওরে সে ডাগর 

মেয়েটার সাথে বিয়ে দাও ছেলেটার।

সোনার তালটা যৌতুক হোক তার।”

“তাই হোক তবে”

 বলে হাসিমুখে করে 

সেলাম হুজুরে দুই জন গেল চলে।

গর্জন করে ওঠেন সেকেন্দার। 

“বহুৎ আচ্ছা। বাহবা তোমার বিচার চমৎকার।”

সর্দার: “কী বিচার হত তোমাদের দরবারে?”

সেকেন্দার: “সোনার তালটি জমা হয়ে যেত সরকারি ভাণ্ডারে।”

সর্দার: “তাজ্জব। তাজ্জব:

ভরূপ বিচার তোমার মুলুকে সয় কি প্রজারা সব?”

সেকেন্দার: “দেশের আইন কেন মানিবে না তারা?

সভ্যদেশের এই তো মামুলি ধারা।”

সর্দার: “চন্দ্র সূর্য উঠে দেখা সুলতান? 

সে দেশের মেঘ করে কি বৃষ্টিদান।

সেকেন্দার: “বৃষ্টিও হয়, চন্দ্র সূর্য ওঠে সর্দার ভাই,

 এই প্রশ্নের অর্থ বুঝি না মোটে।”

সদার: “লতা পাতা ঘাস খেয়ে বারোমাস যেইসব জীব বাঁচে তারা কি সেখানে আছে?”

সেকেন্দার: “নিশ্চয়ই আছে, বন্য হিংস্র ছাড়া সব জীব আছে মানুষের ঘরে লালিত পালিত যারা।”

সর্দার: “বুঝেছি বুঝেছি তাদেরি জন্য দয়াময় ভগবান, চন্দ্রসূর্যে উঠান যে দেশে, করেন বৃষ্টিদান।”

কবিতা:১৮

বিশ্বাসঘাতকের দণ্ড

পাঠানবাহিনী সব দেশে লভি রণজয়-মর্যাদা রণথম্বরে প্রথম পাইল বাধা।

 সেনাপতি নসরৎ নিহত হইল যুঝিয়া কেশরিবৎ মস্তকে বহি পরাজয় অপমান, 

ধ্বজা গুটাইয়া ফিরিয়া গেলেন সেনানী উলুঘ খান।

সুলতান গণি পরাজয়ে দুর্বহ,

 এলেন নিজেই বিরাট বাহিনীসহ।

রণথম্বর কাঁপিয়া উঠিল বাহিনীর 

পদভারে প্রতি চৌহান রাজপুত বীর শান দিল তরবারে। 

মেরিল দুর্গ তিরিশ হাজার দেনা। 

হামিরদেবের মুণ্ড না লয়ে দিল্লিতে ফিরিবে না।

 দুর্গদুয়ারে হানা দিয়ে মাথা চিরে ভগ্ন মুক্তে শুণ্ড

 গুটায়ে হস্তীরা আছে ফিরে। দুর্গপ্রবেশে পথ না 

পাইয়া দিল্লির সেনাগণ অবরোধ করি ছাউনি 

ফেলিল করি তারে বেষ্টন। দুর্গবাসীর রসদ ফুরাবে, 

নয় তাহা অফুরান করি প্রতীক্ষা রয়ে গেল সুলতান।

একদা গভীর রাতে-

একখানা চিঠি আসিল তাঁহার হাতে। 

সেই চিঠিখানা পড়ি সুলতান হর্ষিত 

অন্তর উঠিলেন হাকি ‘আল্লাহো আকবর।

 প্রধানমন্ত্রী পাষণ্ড রণমল লিখেছে চিঠিতে 

“খোদাবন্দ আমি চাহি তব মঙ্গল। যদি মোরে

 এই দুর্গ করেন দান, দুর্গপ্রবেশে পথ কোথা আছে

 দিতে পারি সন্ধান। আমি আপনার সুলতানি 

মেনে লায়ে তামাম হুকুম তামিল করব করদ বান্দা হয়ে।” 

উত্তর গেল, “নিশ্চয়ই তাই হাব, জানাইয়া দাও কখন,

 কেমনে, কবে?”

রণথমবর বিজিত হয়েছে প্রতি বীর রাজপুত

 দিয়াছে জীবন, যুঝিয়াছে অদ্ভুত। চারিদিকে 

হতাহত রাজপুতনারী পেলেছে জহরব্রত। 

উৎসবময় মূলতানি দরবার। হামিরদেবের ছিন্ন 

মুণ্ড দিতে তাঁরে উপহার আনে জল্লাদ, 

দীর্ঘশ্বাস ফেলিলেন সুলতান। করজোড়ে

 সেথা ছিল খাড়া হয়ে রণমল বেইমান

চমকি উঠিল কাঁপিল তাহার বুক শুকাইয়া গেল মুখ।

সুলতান তারে কহিলেন কাছে ডাকি- “এখন তোমারে বকশিশ দিতে বাকি।

নিমকহারাম, শোন তোর দেহে আছে দোজখের মতো মন। 

নিজের জাতির নিজের প্রভুর করিলি সর্বনাশ,

আমি বিধর্মী, কেমন করিয়া করি তোরে বিশ্বাস।

 স্বার্থের তরে স্বদেশেরে যেবা সঁপিয়াছে 

পরহাতে সাজা হয় তার গজপদতলে অথবা খড়গাঘাতে।

কিসে চাস তুই মরণ-পুরস্কার তাই তোরে দেব করিব না অবিচার।”

শেখ হবিবর রহমান [১৮৯১ ১৯৬২] 

কবিতা:১৯

নবীর শিক্ষা

‘তিন দিন হতে খাইতে না পাই, 

নাই কিছু মোর ঘরে, দারা পরিবার 

বাড়িতে আমার উপোস করিয়া মারে। 

নাহি পাই কাজ তাই ত্যাজি লাজ বেড়াই ভিক্ষা করি। 

হে দয়াল নবী, দাও কিছু মোরে নহিলে পরানে মরি?

 আরবের নবী, করুণার ছবি ভিখারির পানে চাহি, 

কোমল কন্ঠে কহিলা, ‘তোমার ঘরে কি কিছুই নাহি?” 

বলিল সে, ‘আছে শুধু মোর কাছে কম্বল একখানি।

কহিলা রসুল, ‘এক্ষণি গিয়া দাও তাহা মোরে আনি।

সম্বল মোর কম্বলখানি বেচিয়া তাহার করে,

 অর্ধেক দাম দিলেন রসুল খাদ্য কেনার তরে।

 বাকি টাকা দিয়া কিনিলা কুঠার, হাতল লাগায়ে নিজে, 

কহিলেন, ‘যাও, কাঠ কেটে খাও, দেখ খোদা করে কী-যে।

সেদিন হইতে শ্রমসাধনায় ঢালিল ভিখারি প্রাণ, 

বনের কাষ্ঠ বাজারে বেচিয়া দিন করে গুজরান।

অভাব তাহার রহিল না আর, 

হইল সে সুখী ভবে,

 নবীর শিক্ষা কোরো না ভিক্ষা, 

মেহনত করো সবে।

গোলাম মোস্তফা (১৮৯৭-১৯৬৪)

কবিতা:২০

 জীবন-বিনিময়

বাদশা বাবর কাঁদিয়া ফিরিছে,

 নিদ নাহি চোখে তার পুত্র তাহার হুমায়ূন বুঝি বাঁচে না এবার আর!

 চারিধারে তার ঘনায়ে আসিছে মরণ অন্ধকার।

রাজ্যের যতো বিজ্ঞ হেকিম-কবিরাজ-দরবেশ এসেছে সবাই, 

দিতেছে বসিয়া ব্যবস্থা সবিশেষ, সেবা-যত্নের বিধি-বিধানের ত্রুটি নাছি এক লেশ। 

তবু তার সেই দুরন্ত রোগ হটিতেছে নাকো হায়,

 যত দিন যায় দুর্ভোগ তার ততই বাড়িয়া যায়- 

জীবন-প্রদীপ নিভিয়া আসিছে অন্ত রবির প্রায়।

শুধাল বাবর ব্যাকণ্ঠে ভিষকবৃন্দে ডাকি ‘বলো বলো আজি সত্য করিয়া, 

দিও নাকো মোরে ফাঁকি, এই রোগ হতে বাদশাজাদার মুক্তি মিলিবে না কিং’

নত মস্তকে রহিল সবাই, কহিল না কোনো কথা,

 মুখর হইয়া উঠিল তাদের সে নিঠুর নীরবতা শেল

 সম আসি বাবরের বুকে বিধিল কিসের ব্যথা।

হেন কালে এক দরবেশ উঠি কহিলেন ‘সুলতান,

 সবচেয়ে তব শ্রেষ্ঠ যে ধন দিতে যদি পারো দান,

 খুশি হয়ে তবে বাঁচাবে আল্লা বাদশাজাদার প্রাণ।’

শুনিয়া সে-কথা কহিল বাবর শঙ্কা নাহিকো মানি- 

‘তাই যদি হয়, প্রস্তুত আমি দিতে সেই কোরবানী, 

সবচেয়ে মোর শ্রেষ্ঠ যে-ধন জানি তাহা আমি জানি।’

এতেক বলিয়া আসন পাতিয়া নিরিবিলি গৃহতল গভীর 

বেয়ানে বসিল বাবর-শান্ত অচঞ্চল, প্রার্থনা-রত হাত দুটি ভার, 

নয়নে অশ্রুজল।

কহিল কাঁদিয়া- ‘হে দয়াল খোদা, 

হে রহিম-রহমান, 

মোর জীবনের সবচেয়ে প্রিয়

 আমারি আপন প্রাণ, 

তাই নিয়ে প্রভু পুত্রের প্রাণ 

করো মোরে প্রতিদান। 

স্বত্ত-নীরব সারা গৃহতল, 

মুখে নাহি কারো বাণী, 

গভীর রজনী, সুপ্তি-মগন

 নিখিল বিশ্ব-রানী; আকাশে

-বাতাসে ধ্বনিতেছে যেন গোপন কী কানাকানি।

সহসা বাবর ফুকারি উঠিল- ‘নাহি ভয়, 

নাহি ভয়, প্রার্থনা মোর কবুল করেছে 

আল্লা সে দয়াময়, পুত্র আমার বাঁচিয়া 

উঠিবে-মরিবে না নিশ্চয়।’

ঘুরিতে লাগিল পুলকে বাবর পুত্রের চারিপাশ

– নিরাশ হৃদয়ে সে যেন আশার দৃপ্ত জয়োল্লাস, 

তিমির রাতের তোরণে তোরণে উষার পূর্বাভাস।

সেই দিন হতে রোগ-লক্ষণ দেখা দিল বাবরের, 

হৃষ্ট-চিত্তে গ্রহণ করিল শয্যা সে মরণের- 

নূতন জীবনে হুমায়ূন ধীরে বাঁচিয়া উঠিল ফের।

মরিল বাবর-না, না, ভুল কথা, মৃত্যু কে তারে 

কয়া মরিয়া বাবর অমর হয়েছে, নাহি তার 

কোনো ক্ষয়- পিতৃস্নেহের কাছে 

হইয়াছে মরণের পরাজয়।

কবিতা ২১ থেকে  ২৫

কবিতা:২১

রাখী ভাই

বাহাদুর শাহ্ আসছে ধেয়ে করতে চিতোর জয় সঙ্গে নিয়ে বিপুল সেনাদল, 

চিতোর-রানী কর্ণবর্তীর তাই জেগেছে ভয় রাজপুতানা আতঙ্কে টলমল।

দেশ জুড়ে আজ চলেছে তাই পূজার আয়োজন,

 উঠছে তুমুল ঘণ্টা-কাঁসর-নাদ,

অসি এবং অশ্ব-পূজায় কেউ-বা নিমগন কেউ

 মাগিছে দেবার আশীর্বাদ।

কর্ণবর্তী বসে বসে ভাবছে মনে তার: নারী আমি নিতান্ত দুর্বল, 

শক্তি-সহায় না যদি পাই, উপায় নাহি আর, 

সবই হবে ব্যর্থ ও নিষ্ফল। কে আছে বীর এই ভারতে এমন মহৎপ্রাণ

 চিতোরের এই দুর্দিন-সন্ধ্যায় পার্শ্বে এসে দাঁড়ায় তাহার, 

রাখতে তাহার মান! ব্যাকুল রানী সেই সে ভাবনায়।

হঠাৎ তাহার পড়ল মনে বাদশা হুমায়ূন উদ্দার-হৃদয় 

অদ্বিতীয় বীর, বাহাদুরের চেয়ে তাহার শক্তি শতগুণ, 

রাখতে জানে মান সে রমণীর।

অনেক ভেবে অবশেষে হুমায়ূনের ঠাই লিখল 

রানী লিপি সে একখান ‘আজ হতে বীর হলে 

তুমি আমার ‘রাখী ভাই” শীঘ্র এসে বাঁচাও বোনের প্রাণ।’

দূতের হাতে দিল লিপি, আর সে রাখী তার— যাত্রাপথে বাহির হল দূত,

 উৎসাহ ও কৌতূহলের অন্ত নাহি আর- অবাক সবাই, 

ব্যাপার যে অদ্ভুতা

বাদশা তখন বাংলাদেশে ছিলেন অনেক দূর শেরের সাথে চলছে লড়াই তার,

 পাঠান বীরের দর্প এবার না যদি হয় চূর রাজ্য রাখাই হবে তাহার ভার!

এমনি কঠিন দুঃসময়ে কর্ণবতীর দূত হাজির হল হুমায়ূনের পাশ, 

লিপি দিল, আর দিল সেই রাঙা রাখীর সূত, মুখে তাহার আনন্দ-উচ্ছ্বাস।

লিপি পেয়ে আত্মহারা হুমায়ূনের প্রাণ, কী করিবে,

 ভেবেই নাহি পায়, শত্রুরে আজ ছেড়ে গেলে চরম 

অকল্যাণ কিরূপে-বা রাখীই ফিরান যায়।

একটি নারী করুণ স্বরে মাগছে শরণ তার

‘ভাই’ বলে সে করেছে আহবান, 

সে আহবানে খুলবে না কি তাহার

 হৃদয়-দ্বার সাড়া কি আজ দিবে না তার প্রাণ। 

থাকুক শত বিঘ্ন-বাধা-বাদশাহী তার যাক,

 তবু তাহার ‘বোন’কে বাঁচান চাই; 

হোক বাহাদুর স্বজাতি তার হিন্দু 

‘বোনে’র ডাক শুনবে আজি মুসলিম তার ‘ভাই’।

কান্ত করি এক নিমেষেই যুদ্ধ-অভিযান চিতোর 

পানে ছুটল হুমায়ূন, কোন অসীমের ভাক শুনে

 আজ চঞ্চল তার প্রাণ, একটি রাঙা রাখীর এত গুণ!

লোক-লঙ্কর সঙ্গে নিয়ে লড়ল এসে বীর- 

কামান-গোলা ছুটল সে প্রচুর, পড়ল লুটে হাজার 

হাজার মুসলমানের শির। বাহাদুরের দর্শ হল দূর।

ডিভোর-ভূমি মুক্ত হল অমনি হুমায়ূন চলল ছুটে

 বোনের যৌজে তার, রাজপুরীতে উঠল বেজে সুর

 সে অকরুণ- কর্ণবর্তী নাইকো বেঁচে আর।

ব্যাকুল আশায় চেয়ে চেয়ে হুমায়ূনের পথ কর্ণবতী গণছিল দিনরাত, 

অবশেষে হল যখন বিফল মনোরথ- জহর-এতে করল জীবনপাত।

গভীর ব্যথায় হুমায়ূনের স্বর সরে না আয়-

 বোনের তরে ভাই কেঁদে আজ খুন, 

এই জীবনে হল নাকো দেখা দেখো দুজনার- 

সেই বেদনায় ক্ষুব্ধ হুমায়ুন।

হেখায় ওদিক সুযোগ পেয়ে কিছুদিনের 

পর যুদ্ধ দিল শের শা’ পুনরায়, হুমায়ূনের রাজ্য

 গেল-হল দেশান্তর- একটি রাঙা রাখীর তরে হায়।

কবিতা:২২

রাখাল খলিফা

সেনাপতি বীর আবুগুবায়দা জেরুজালেমের তীরে করেছে আসিয়া শিবির সন্নিবেশ,

 অবচন্দ্র-পতাকা উড়িছে গগন-কিনারে দীরে, শল্পিত-ভীত-কম্পিত সারা দেশ।

জেরুজালেম সে তীর্থক্ষেত্র নহে শুধু নাসারার, মুসলিমও তারে সমান শ্রদ্ধা করে, 

অতীত দিনের কত-না পুণ্য স্মৃতি সুরভি-ভার বিজড়িত তার অন্তরে অন্তরে।

এমন পুণ্য তীর্থে কিরূপে যুদ্ধ হইবে তবে? যুদ্ধ করিতে চাহে না কারোই প্রাণ, 

বিনা যুদ্ধেই এই নগরীরে জয় করে নিতে হবে- আবুওবায়দা মনে মনে তাই চান।

লিখিলেন তিনি নগরপতিরে স্থির করি তাই মন-

‘নাহিকো মোদের যুদ্ধ করার সাধ, স্বেচ্ছায় যদি করেন আপনি নগর-সমর্পণ, 

ঘাটবে না তবে আর কোনো পরমাদ। ‘নতুবা মোদের বাধ্য হইয়া যুদ্ধ করিতে হবে, 

উপায় তখন রহিবে না কিছু আর, জেরুজালেমের পবিত্র বুকে রক্তের 

ঢেউ ব’বে’ নাহি লন যেন অপরাধ কিছু তার।’

শাসনকর্তা অনেক ভাবিয়া স্থির করিলেন শেষে যুদ্ধ করিলে হবে নাকো কোনো ফল,

 বিশ্ববিজয়ী আরব-বাহিনী-নন্দিত দেশে দেশে, রোধিবে তাদেরে কে আছে ধরণী-তল?

লিখিলেন তিনি উত্তরে তাই ‘শান্তিই যদি চান,

খলিফা ভ্রমর দিন তবে দরশন, তিনি এসে যদি খ্রিস্টানদেরে করেন অভয় দান,

 এ মহানগরী করিব সমর্পণ।

খবর পাঠাল আবুওবায়দা সত্বর মদিনায়, 

শুনিয়া খলিফা আমিরুল-মুমেনিন রাজি হইলেন 

নগরপতির রাখিতে অভিপ্রায় যাবার লাগিয়া স্থির করিলেন দিন।

জেরুজালেমের পথ সে ভীষণ, নাহি কোনো পারাপার, 

মাঝখানে তার মরুময় প্রান্তর, 

নিদাঘ-সূর্য আগুন জ্বালায় বুকের উপরে তার মরুসাইমুম বহে সে ভয়ঙ্কর।

সে পথ বহিয়া চলেন ওমর চড়িয়া উটের পরে সাথে নিয়ে শুধু নওকর একজন,

 বিশ্ব লুটায় চরণে যাঁহার, তাঁরি যাত্রার তরে এই সম্বল-এই দীন আয়োজন।

সুমুখে বিপুল মরু-দিগন্ত, ধু-ধু করে চারিধার, 

উট টেনে চলে তারি মাঝে নওকর, 

পথ হয়ে আসে ক্রমে বন্ধুর, 

চলা হয়ে ওঠে ভার তপ্ত বালুকা তাহে কাঁটা-কঙ্কর।

ভাবেন খলিফা- ‘আমি উটে চড়ে চলেছি পরম সুখে, 

কোন দোষে দোষী নওকর আজি মোর? 

একই আল্লার বান্দা দুজনে, হাসি-কাঁদি সুখে-দুখে, 

ব্যথা-বোধ আছে আমারি মতন ওর।

‘কেন তবে এই মিথ্যা ছলনা বাহিরে মোদের মাঝে? 

ইসলামে কোনো ভেদাভেদ কিছু নাই, 

সম অধিকার দিয়াছে সে সবে ধ্যানে-ধারণায়-কাজে, 

মুসলমান সে মুসলমানের ভাই।’

এতেক ভাবিয়া নামেন খলিফা সহসা সে মরুপথে, 

ভাগাভাগি করে উটে চড়ি এসো দুজনে এখন হতে আমি টানি দড়ি, 

তুমি এইবার চড়ো।’ কহেন-‘বন্ধু কষ্ট পেতেছ বড়?

কুণ্ঠিত-ভীত রাখাল শুনিয়া খলিফার সেই বাণী বলিল-‘তওবা! 

তা-ও কি কখনো হয়? আমি রব-চড়ে,

 খলিফা যাবেন উটের লাগাম টানি? 

জীবন থাকিতে এ কাজ কখনো নয়!’

না-ছোড় খলিফা,

 কোনো কথা তিনি তুলেন না তাঁর কানে,

 রাজি হল তাই অগত্যা নওকর;

 রাখাল চলিছে উটের পৃষ্ঠে খলিফা লাগাম টানে। 

এ মহাদৃশ্য অপূর্ব সুন্দর!

এমনি করিয়া ভাগাভাগি করে সারাপথ দুজনায় চলেন কষ্টে কোনোমতে ধীরে ধীরে,

 দিন-রজনীর চেষ্টার শেষে একদিন অবেলায় পৌঁছেন এসে জেরুজালেমের তীরে।

প্রবল প্রতাপ খলিফা আসিছে রোম-শাসকের কাছে, 

তাঁহার যোগ্য রাজ-সমাদর তরে আবুওবায়দা পূর্ব হতেই প্রস্তুত হয়ে আছে, 

নগরাধিপতি শত আয়োজন করে।

অবশেষে যবে খলিফার উট দেখা দিল প্রান্তরে,

 রোমান শাসক সভাসদ নিয়ে তার দাঁড়ালেন আসি সম্মুখে তাঁর অভিনন্দন তরে, 

নব কুতুহল মনে জাগে বারবার। এল যবে উট নগর-প্রান্তে দৃষ্টির সীমানায়, 

খলিফা তখন টানিতেছিলেন দড়ি, ভাগ্যচক্রে ছিল যার যাহা,

 খন্ডাবে কে বলো তায়।- রাখাল ছিল সে উটের পৃষ্ঠে চড়ি।

শাসনকর্তা দেখে নাই আগে খলিফারে কভু আর, 

ভাবিল খলিফা আছেন উটের ‘পরে, 

কুর্নিশ করি রাখালেরে তাই দুই হাতে বারবার নামাইয়া নিল পরম শ্রদ্ধাভরে।

হেনকালে আসি আবুওবায়দা হলেন সম্মুখীন, বলিলেন, 

‘না, না, খলিফা তো উনি নন, উনি নওকর; ইনিই হলেন আমিরুল মুমেনিন, 

খলিফা ওমর-এরি সাথে কথা কন।”

বিস্মিত আজি নগরাধিপতি, পুলকিত তার প্রাণ। 

স্বর্গের ছবি নামিল কি দুনিয়ায়?

মানবতা যেন রূপে ধরে তার নয়নে মূর্তিমান- 

হৃদয় তাহার লুটাতে চায় ও-পায়।

অমনি তখনি করিলেন তিনি নগর সমর্পণ, 

কোনো দ্বিধা তার জাগিল না হিয়া-মাঝে, 

কহিলেন তিনি খলিফারে করি মধুর সম্ভাষণ 

‘বিশ্বের রাজা তোমারেই হওয়া সাজো’

এম. আবুল হাশেম [১৮৯৮ – ১৯৮৫] 

কবিতা:২৩

পান্থ-আবাস

সন্ধ্যা-ছায়ায় উৎসব রত নৃপতি ইবরাহিম উল্লাস-ভরা কল-কোলাহল স্ফূর্তি অপরিসীম।

সুরার পেয়ালা ঘুরে ঘুরে চলে নর্তকীগন নাচে দলে দাল শিঞ্জিনী চল-চরণ যুগলে বাজে রিম রিম ঝিম। পারিষদগণ পরিহাস করি কেহ কহে রাহবা নর্তকীগণ হাসে মিটিমিটি আখি ঠারে কেহবা।

এমন সময়ে অতি বিমলিন চীর পরিহিত এক দীনহীন, বদনে দ্বিধার নাহি কোনো চিন্ উপনীত সহসা।

শান্ত সুধীরে মুক্ত করিয়া আপনার অবয়ব, নামায়ে রাখিল সম্বল তার কম্বল আদি সব।

উপহাস করি কহে কোনো জন- “

পথ ভুলে কিগো শুভ্র আগমন।” 

চারিদিকে জাগে কল-গুঞ্জন

কহিল সে জন”পথিক আমি 

গো আসিয়াছি পরবাসে রজনীর

 তরে আশ্রয় লব আজি এ পান্থাবাসে।”

কথা শুনি যত পারিষদ দল পরিহাস করি করে

 কোলাহল কেহ কহে এটা আস্ত পাগল। নর্তকী দল হাসে।

বলখ-নৃপতি কহিল তখন

“ওগো মুসাফির বর, পাছ-আবাস কোখা

 চাও তুমি কহিল পথিক “বুঝি না বারতা

 কহিছে কি সবে প্রাসাদের কথা?” 

কোলাহলপ্রিয় মুখর জনতা পরিহাস তৎপর। 

রাজপ্রাসাদের পর?”

মোসাহেব দলে খাদায়ে নরেশ কহিল শান্ত সুরে-

 “পাস্থ-আব্যস হেথা নয় গুগো ঐ যে হোথায় দূরে।”

শুনি মুসাফির শুধাল রাজায়- “

পূর্বে কি কেহ আছিল হেথায়?”

“জনক আমার” রাজা কহে তায়,

“থাকিত এ রাজপুরে।”

“তারো আগে কেহ আছিল এখানে

রাজা কহে, “ছিল ব্যাটটু,

পিতা পিতামহ চৌদ্দ পুরুষ

শোনোনি সে-কথা মোটে

পুনঃ মুসাফির শুষাল তাহায়

“এর পরে কেহ রহিবে হেথায়?

“পুত্র পৌত্র পরস্পরায় নৃপতি-কণ্ঠে ফোটে।

পরিহাস-সুরে কাঁপে ভিখারির ক্লান্ত কন্ঠখান,

 “এত আসে যায় পান্থ-আবাস নহে তবু এ স্থান।”

এত বলি তুলি লইল আবার যাহা কিছু ছিল সঙ্গে 

আতহার না-আসিতে ঘিরে সাঁকোর আঁধার হল অন্তর্ধান।

 স্তব্ব নীরব যত সভাসদ নৃপতি বাক্যহীন, 

গায়িকা-কণ্ঠে বেসুরা রাগিণী ক্রমে হয়ে এল ক্ষীণ।

হম্য, প্রাসাদ, আকাশ, বাতাস সবে যেন শুধু করে পরিহাস,

 মর্মের মাকে দীর্ঘশ্বাস বাজায় করুণ বীণ।

ধীরে সন্ধ্যার কবরী উজলি ফুটিল অযুত তারা, 

সভাসদসহ সমাসীন রাজা চিত্রাপিত পারা।

তখনো মদ মৃদুল পরনে কানে কানে ধীরে করে নিরুণ,

  • “আর কিছু নয় এ রাজভবন পাছ-আবাস ছাড়া।

কবিতা:২৪

পথের সন্ধানে

তখনো ধরণী তাজে নাই তার তমসার আবরণ, 

দ্বিব্যভরে পিক কুহরয় কন্তু অস্ফুট কুহরণ।

বলখ প্রাসাদ কুটে শুধু জেগে রয় ফুটে নৃপতির 

দুটি ব্যথিত নয়ন করুণ-কাতর কেঁদে-কেঁদে ডাকে 

বিশ্বের বিধাতায়। সদা কানে বাজে ফকিরের সেই সত্য দারুণ বাণী, 

“পান্থ-আবাস ছাড়া কিছু নয় এ বিরাট রাজধানী।” প্রভাত তারকা প্রায়,

এক যায় এক আসে এ চির পান্থারাসে পথিকে পথিকে ক্ষণিকের 

দেখা ক্ষদিকের আলাপন, কোথা তার গৃহ। কোথা পথ তার।

 -চঞ্চল হল মন।

তখনো ধরণী ত্যজে নাই তার দ্বিধাতার পিক কুহরায় কবু অস্ফুট কুহরণ।

 সহসা এহেন কালে কে যেন অন্তরালে করে বিচরণ প্রাসাদশিঘরে, 

গরজি দারুণ রোষে কহে নরপতি, “কে রে দুর্মতি?

” সুগভীর নির্ঘোষে। তমসার আবরণ,

কহিল সে-জন “

পথিক আমি গো। 

হারায়েছে মোর উট, 

সন্ধানে তার এসেছি 

হেথায় তোমার প্রাসাদ কুট।”

“মূর্খ পথিক তুমি, 

তাজিয়া চারণভূমি 

উই তোমার পাখা লয়ে কিথো

 এসেছে প্রসাচুড়ে।

 রক্ত কঠোরতা

 বস্তুত হল নৃপতি কণ্ঠসূরে।

 কহিল পথিক “হে রাজন, 

তব আশা জাগে কিগো মনে, 

প্রাসাদের এই কোদে, 

অতি ছোট হয়ে আজ 

নিখিলের অধিরাজ ধরা দিরে আসি।

 সে-ও যদি হয়, 

কেন বলো নাহি হবে উষ্ট্রের সম 

আগমন তর প্রাসাদশিখরে তবে?” 

রুদ্ধ-দুয়ার গর্ব-৩৫

চমকি উঠিল বলখের পতি ছুটিল সেদিক পানে,

 না হেরিল কিছু শুনা প্রাসাদে তবু যেন বাজে কানে 

“অতি ছোট হয়ে আজ, 

নিখিলের অধিরাজ ধরা দিবে আসি। 

সে-ও যদি হয় কেন বলো নাহি হবে

 উষ্ট্রের সম আগমন তর প্রাসাদশিখরে তবে।”

রাজ আভরণ য

স্বর্ণকিরীট নিমেষে হইল ধূলি অবলুন্ঠিত। 

দীপ্ত আলোক জ্বালা লক্ষ প্রদীপ

 মালা নিমেষে আঁধারে নিভে গেল হায়।

 ছুটে গেল মোহ ঘোর তত্ত্ব কপোলে

 বহিতে লাগিল আকুল নয়ন লোর।

অনকাল পরে রাজপ্রাসাদের তোরণ 

দুয়ার হয়ত বিমলিন বেশ দরবেশ 

এক বাহিরিল রাজপথে বদন বিষাদভরা নয়ন অনুকারা।

তখন ধরণী তাজিল সহসা তমসার আবরণ, 

দ্বিধা ত্যজি দিক কুহরি উঠিল প্রস্ফুট কুহরণ।

কবিতা:২৫

সফল তীর্থ

হজ হল সমাপন, 

হাজিরা সকলে ত্যজে একে একে। 

কাবাগৃহ প্রাঙ্গণ।

খোরাসান-পতি তবু সেই

 ঠাই রহিল বিছায়ে জীর্ণ চাটাই

 বদনে তাহার কোনো কথা নাই নয়নে

 কেবল জল, হজ হল তবু কী

 যেন না-হওয়া ব্যথিছে হৃদয়তল। 

সহসা কখন ক্লান্ত নয়নে

তন্দ্রা আসিল নামি,

 কী এক মধুর উজল 

স্বপন হেরে খোরাসান স্বামী।

রজত-শুভ্র উজল আলোক 

ছেয়েছে সকল গগন-ভূলোক 

বিমল অমিয় স্নিগ্ধ পুলক

 ছড়ায়ে জগৎ মাকে, 

পুষ্পের মালা কণ্ঠে

 দোলায়ে স্বর্গের দূত রাজে।

শোতে করতলে দীপ্ত 

কেতাব সান্ধ্যতারকা প্রায়

 কনক উজল আলোক 

হরফে কী যেন লিখিছে তায়।

সহসা আবার আসিল সেথায়

 যেমনি উজল সুরভিত কায়

 তেমনি শান্ত পীযূষধারায় অতুল

 সুষমা সার, জোছনা গঠিত মুরতি

 মধুর আর এক ফেরেশতার।

শুবাল আসিয়া-“বলো ভাই 

শুনি কারা সে ভাগ্যবান, 

এবার যাদের হজের 

তীর্থ সার্থক অভিযান।”

উত্তরে কছে-“একী অর্ঘটন 

খোরাসান হতে এল যতজন

 কারো হজ খোদা করেনি 

গ্রহণ শুধু এক দীন চাষি, 

লতেছে কেবল হজের পুদা 

কারা-ধামে নাহি আসি।” “

কেবা সেই জন?” শুবাল নরেশ

“কহ মোরে তার নাম 

গ্রন্থের শিরে দেখাল লিখিত

 “তাজির এবনে শ্যাম।” 

স্বপন হইতে চমকি উঠিল 

খোরাসানি সোলতান, নয়নে

 তাহার গলিত অশ্রু ব্যাকুল হইল প্রাণ।

ডাকি অনুচরে কছে- “ত্বরা করি করো 

আয়োজন, এই বিভাবরী না হতে প্রভাত 

তাজিব নগরী।” “কোথা যাবে?” কহে দাস,

 “খোরাসান” বলি সোলতান শুধু ত্যজিল দীর্ঘশ্বাস।

রাজপ্রাসাদের শীর্ষে শোভিল লোহিত পতাকা 

আজ বহুদিন পরে আসিছে ফিরিয়া 

খোরাসান অধিরাজ।

নহবতে বাজে মধুর বাজনা নকিব 

ফুকারি করিছে ঘোষণা, যত পুরবাসী 

যতেক ললনা রহে বাতায়ন চাহি, ব্যথিত 

নৃপতি চলে রাজপথে কিছুতে লক্ষ্য নাহি।

পথসন্ধানী চলে অনুচর পশ্চাতে নরপতি, 

সহসা কাহার কুটির দুয়ারে স্তব্ধ হইল গতি।

নোলতান ডাকে, ‘তাজির, তাজিরা। দীন

 কৃষি এক হইল হাজির সবিনয় শিরে,

 উজির নাজির মহাবিস্ময় মানি,

এ উহার পানে চাহি 

অপাঙ্গে করে শুধু কানাকানি।

 সম্রাট কছে-“প্রাণের বন্ধু কিছু কোরো না লাজ।

 কোন সে কর্মে হজের পুণ্য লভিলে কহ তো আজ।”

চকিত কৃষাণ মুখ চেয়ে রয়, নাহিকো নিমিষ,

 নাহি কথা ক যত নরনারী চোখে বিস্ময়,

 মন্ত্রমুগ্ধ মতো, 

নৃপতি তখন খুলিয়া কহিল স্বপ্নের কথা যত।

জুড়ি দুই কর কহিল তাজির ভীতিবিহবল সুরে,

 “হজের বাঞ্ছা বহুদিন রাজ্য ছিল এ হৃদয়পুরে,

 তিনটি বছর করি আয়োজন যাত্রা করিনু হেরি দিনক্ষণ, 

অস্তে নামিল ধীরে সান্ধ্য-আঁধার বীরে মছার আবরিল অবনীরে।

‘এক কৃষকের দুয়ারে যাইয়া কহিনু তাহারে ‘ভাই, 

জুৎ পিপাসায় ক্লান্ত পথিক নিশার শরণ চাই। 

লাজে ম্রিয়মাণ গৃহপতি কয়- “

মোর ঘরে যাহা আছে মহাশয় হারাম তোমার।” 

মহাবিস্ময় মানি আমি মনে মান্য কৃষক তখন কহিতে লাগিল বিনয়করুণ স্বরে;

সাতদিন আজ অনাহারী আমি শরীর শীর্ণ ক্ষীণ, 

সহ পরিজন মরণ-পাছ বার্থ উপায়হীন।

‘আজি সন্ধ্যায় ৩টিনীর জলে নিহত রাসভ ভেসে যায় চলে, 

হরষিত মনে তরে লায়ে তুলে এনেছি আলয়ে ভাই, 

রাজ্জাক বুঝি দয়া করে আজি রখতে লিখিছে তাই।

“শুনি সে বারতা নয়নে আমার ছাপিয়া আসিল লোর, 

যন্ত্রের মতো হাতে নিনু তার সঞ্চিত ধন মোর।”

“সঙ্গের সাথী ছিল মোর যারা,

 হজের যাত্রী-চলে গেল তারা আমিই 

কেবল সম্পদহারা রহিলাম একা পিছে, 

হজবঞ্চিত ব্যর্থ জীবন বহিতে কেনাল দিছে।”

না-জুরাতে তার কণ্ঠের বাণী আকুল আবেগ-

ভরে নরপতি তারে টানিয়া লইল আপন বৃক্ষ পরে।

দর্শক যত গড়ীর স্থির, নৃপতি নয়নে অশ্রু অধীর কম্পকণ্ঠে ডাকিল,

 “তাজির, প্রাণের বন্ধু তুমি, 

অন্ধকে আজ দেখায়ে দিয়েছ চরম তীর্থভূমি।”

কবিতা ২৬ থেকে  ৩০

কবিতা:২৬

শাহ শুজা কিরমানী

সঙ্গে লইয়া সেপাই সাস্ত্রী হাতিয়ার অফুরান, 

হিন্দুস্থানে চলেছেন আজি গজনীর সুলতান,

 পথে পথে কত দুর্গ ভীষণ কত মন্দিরচূড়া, 

বজ্রবাহুর পেষপে তাঁহার ধূলিতলে হ’ল গুঁড়া,

 দুর্গম গিরি কান্তার মরু অবহেলি হয়ে পার,

 পঞ্চনদীর প্রান্তরমাকে ছাউনি পড়িল তাঁর।

রটি গেল চরাচরে, দিন পরস্তো দরবেশ

 লাগি সুলতান নিজ করে বিলাবেন ধন, 

ফজর হইতে সন্ধ্যা অবধি যত ফকিরেরা 

সবে এল আর গেল দলে দলে অবিরত।

দিবসের শেষে স্নান সন্ধ্যার মৌন ছায়ার তলে, 

শ্রান্ত নরেশ ফিরিলেন সবে আপন মহল কোলে, 

উজির আসিয়া দাঁড়াল সহসা মৌন শান্ত বেশ, 

শুধাল নরেশ, “আর কেহ নাই? হয়েছে দানের শেষ?”

“বাদশাহ নামদার” বিনত কন্ঠে কহিল উজির,

 “শুধু একজন আর আছে অবশেষ মহাতপন্থী 

শাহ্ শুজা কিরমানী আসে নাই শুধু, আসিবে না কলু, 

পাঠ্যয়েছে তার বাণী।”

স্তজিত বাদশা- বদনে তাঁহার আলো আর 

ছায়া খেলে গেল সহস। ক্ষণকাল পরে ধীর গম্ভীরে 

কহিলেন ডাকি তারে, ‘করো আয়োজন, 

আমিই যাইব ফকিরের দরবারে।

জনহীন বনভূমি। বিরাট বিটপী নিথর নিবাত

 গগনপ্রান্ত চুমি, ডালে ডালে পাখি করিছে কুজন, 

তরুতলে পশু করে বিচরণ, শীতল ছায়ার মায়ায় 

গিয়াছে সারা বনভূমি ছেয়ে, শাখায় শাখায় উতলা 

বাতাস ফিরেছে পূরবী গেছে,

শাহ্ পুজা কিরমানী, সেই বনানীর গ্রাস্তে রয়েছে 

আপন কুটিরখানি।

শত অনুচর সাথে, 

সুলতান যবে দাঁড়াল আসিয়া 

আশ্রম আঙিনাতে শাবা হতে 

পাখি ভয়ে গেল উড়ে, 

হরিণশিশুরা ছুটে গেল দূরে

 চরণের তলে ঝরা পাতাগুলি 

কেঁদে গেল মর্মরি সুলতান যবে

 এল সে বিজন বনপথখানি ধরি।

শাহ শুজা কিরমানী- সুলতান 

পানে বাড়াইয়া দিল আপন শুভ্র 

পাণি, বসিবার দিল অজিন আসন 

শুধাল সাদরে কুশল বচন, কহিল তাহারে,

 “কেন আগমন গজনীর সুলতান?” 

সুলতান কছে, “নিবেদিতে চাই 

ক্ষুদ্র আমার দান।” এত বলি রাজা

 সম্মুখে তাঁর রাখিল ভূমির পরে মোহরপূর্ণ 

খালি একখানি মহাসপ্তম ভরে।

মৃদুল হাসির রেখা, সাধুর অধরে চপলার 

মতো ক্ষণতার দিল দেখা, কহিল, “বাদশা, 

অতিথি যে তুমি কারা না গ্রহণ ত্রুটি,” 

জীর্ণ তাহার ঝুলি হাতে লয়ে একটু 

শুল্ক-রুটি রাখি সম্মুখে কহিল, “বাদশা,

 নাই হেথা রাজভোগ, তবু অনুরোধ লইতে 

হইবে তুচ্ছ এ জলযোগ।”

ফকিরের দান সুলতান নিল নতশিরে দুই করে, 

পরশিয়া বুকে, পরশি নয়ান বদনে লইল পুরে, 

শুল্ক সে রুটি নীরস কঠোর, কাঁটা-সম যেন ফুঁড়ে, 

ব্যথিত করিল কোমল বদন, বিব্রত সম্রাটঈদ, 

কাষ্ঠের মতো গলাব্যকরণ হল মহাবিভ্রাট।

স্মিত হাসিমুখে দরবেশ কয়, “বাদশাহ নামদার,

 ভুবনবিজয়ী মহাবীর তুমি, তাজ্জব এ ব্যাপার,

 আমার আহার রুটি যদি তব কণ্ঠে নাহিকো সরে,

 তোমার সোনার দানাগুলি আমি গ্রাসিব কেমন করে?

ফিরে নিয়ে যাও সব, ফকিরের তরে সৃষ্ট হয়নি দুনিয়ার বৈভব।”

কবিতা:২৭

ভরসা

মুয়াজ্জিনের কণ্ঠ হাকিল উচ্চ মিনার চূড়ে, 

দূর দিগন্ত পানিত হইল সেই সুমধুর সুরে। 

যত মুসল্লি কাতারে কাতারে মসজিদ 

আঙিনাতে জামাতের লাগি জমায়েত হল ইমামের পশ্চাতে।

হেনকালে কহে খলিফা উমর “ওগো মুসলিমগণ,

 আমি যদি কহু করি হীন কাজ গার্হত আচরণ।

 কী করো তোমরা? নীরব জনতা কেহ নাহি কথা বলে,

 খলিফার বাণী প্রতিধ্বনি হয়ে লুসিয় হদতলে।

সহসা সে মূক জনতা হইতে আসির কনৎকার

 আঘাত করিল নমিত কছে মৌন স্তব্বতার।

নবীন যুবক উন্নত ভাল নয়নে বক্তি জ্বাল, 

কহে গম্ভীরে, উদ্যত অসি ধরি দৃঢ় করতলে-

“হে উমর, যদি অনাচার করো খলিফা-আসান বসি,

 প্রতিকার তার করিবে আমার অশান্ত এই অসি।”

এত বলি যুব্য দাঁড়ায়ে রহিল। 

স্ফীত উন্নত বুক, 

সমবেত জন মহাবিস্ময়ে রহিল জ্য মূক।

কহিল উমর “শাবাশ বন্ধু, 

ভরসা পেলাম দেখে হেন জনও আছে

 ফিরাতে যে পারে খলিফা বিপথে গেলে।”

কবিতা:২৮

উত্তর

পরিখার মহা রণে, 

যত মুসলিম মুজাহিদ মিলে যুঝিতেছে প্রাণপণে।

কোনোখান নিয়া একমুঠি দানা আনিবার পথ নাই, 

ভীষন-অরাতি অবরোধ করি রহিয়াছে সব ঠাঁই।

হেনক্যাল এক সাহাবি আসিয়া, 

নবীজির সম্মুখে দাড়াল সহসা সঙ্কোচত্তরা শুল্ক মলিন মুখে।

 সাঁক হয়ে এল মৌন বিশুর। 

মরুর বুকের পার বাঘার আবির কুড়াইয়া গেল দিকদিগন্ত ভরে।

খোমা শাখার ছায়া, 

খীমার সকাশে বিছাইল তার। শীর্ণ দীর্ঘ কায়া।

মোন তাহার কাছে 

শ্রান্ত করুণ আঁখি 

মেলে এক উই দাঁড়ায়ে আছে।

দিবসের কাজ শেষ হয়ে গেছে- 

আজান প্রতীক্ষায়, খোদার হাবিব 

বসিয়া আছেন শিবিরের আঙিনায়।

সহসা এ হেন কালে-

সাহাবি যে এক আসিয়া দাঁড়াল 

ক্লেশ কুঞ্চিত ভালে। নয়ন তাহার 

বসিয়া গিয়াছে গভীর কোটর তলে,

 বসন তাঁহার ভিজিয়া উঠেছে শ্রান্ত ঘর্ম জলে।

হযরত পাশে করুণ কন্ঠে করজোড় করি কয়,

 “হে রসুল, তব অনুগামী হতে এত দুখ সতে হয়।

ইসলাম যারা করেনি বরণ। তারা বৈভব স্বামী, 

খোদারে চেয়ে যে ক্ষুধায় উদরে পাথর বেধেছি আমি।”

এত বলি তার অঙ্গ হইতে বশস্ত্র লইল টানি, 

দেখাল নবীর উদরে তাহার প্রস্তর 

একখানি বস্ত্রের সাথে বাবা।

অভিযোগ তার শুনিল রসুল দিল 

না কোনোই বাধা।

তারপর ধীরে নিজ দেহ হতে বসন সরায়ে দিল, 

স্তব্ধ সাহাবি মহালজ্জায় নয়ন ফিরায়ে নিল।

অতি বিস্ময় মানি, হেরিল নবীর উদরে বন্ধ প্রস্তর দুইখানি।

রসুল তাহারে সুমধুর স্বরে কহিল আদরে,

 “ভাই, এমনি করেই সভাকে যে 

গো আপনার করা চাই।

কবিতা:২৯

বিচার

পিরিনিজ গিরিচূড়ে দাঁড়াইয়া মুসা দৃষ্টি তাঁহার ফরাসি 

দেশের প্রান্ত ছাড়ায়ে হোখা ইংলিস্তান, মাওখানে 

শুধু এতটুকু এক প্রণালীর ব্যবধান, প্রাশিয়া, 

পোলান্ড, রাশিয়া ছাড়ায়ে দৃষ্টি তাঁহার চলে, 

ভাবে মনে মনে আনিবে কেমনে ইসলামি ধ্বজাতলে। 

প্রসারিত বহু দূরে

হেনকালে আহজান দামেস্ক দূত হাতে 

দিল তাঁর খলিফার ফরমান।

খলিফার দরবার- আমির, উজির,

 সেনা-সামন্ত সমবেত চারিবার।

কে ঐ বন্দি সিংহের

 মতো সমবেত জন চাহে

 মুষলানে মহাবিস্ময়ভরে।

ও যে মহাতেজা সেনাপতি 

মুসা হিস্পানি জয়ী শের, 

তাঁরো তরে হায় হেন লাঞ্ছনা পরিহাস নসিবের।

কহেন খলিফা, “বন্দি তোমার কীর্তি-কথাও জানি,

 তবু অকুন্ঠ দণ্ড বিধানে ন্যায়বিচরের পাশি।

“হিংসার বশে তর সেনানীরে করেছিলে লাঞ্ছনা,

 ভেবেছিলে মনে তব অপরাধ দেখিবে না কোনো জনা।

 রাজপুরুষেরা দমন করিবে রাজ্যের অবিচার,

 হালে অপরাধী রাজ-প্রতিনিধি হবে নাকি প্রতিকার?

“আদেশ আমার পিঠে বাধি ভার সন্ধ্যা অবধি আজ 

পরিক্রম করো ওই ময়দানে তপ্ত বালুকা মাঝ।”

হিস্পানি জয়ী বীর খলিফার বাদী মানিয়া লইল। 

পাতিয়া নম্রশির।

কবিতা:৩০

খলিফার ফরমান

গুক্কাস সূত সাদ ইরান মুলুকে অভিযান করে পেয়ে তার সংবাদ,

 সংগ্রাম-ভীত সেনা-সামন্ত পালাইয়া যায় চলে, 

রক্ষীবিহীন রাজ্য লুটায় বিজয়ীর পদতলে।

ইরানের রাজধানী, মদাইন পুরী, 

সুন্দরী অতি নগরীর মাকে রানী।

মণি ও মানিক হুমী প্রাসাদ বিজয়ী 

বীরের চরণের তলে সব দিল উপহার।

আদেশ করিল সাদ, ফোরাতের পারে

 নির্মাণ করো নতুন রাজপ্রাসাদ। কুফা 

নগরীর পত্তন হল ইরাকের রাজধানী,

 ইরান হইতে ভারে ভারে যত। সম্পদ তার আনি।

নাগরীর মতো সাজিল নগরী বিবিধ অলঙ্কারে,

 মর্মরদয় তোরণ তাহার স্থাপিত হইল দ্বারে অতি

 অপরুপ চারু-কারু কাজ শিল্পশোভার সার,

 মুগ্ধ নয়নে দেখে সেনাপতি

অতুল সুষমা তার।

 কে আসিছে ঐ আরবি 

সোয়ার উড়য়ে পথের ধূলি। 

রাঙা উষ্ণীষ প্রান্ত তাহার 

বায়ুবেগে যায় খুলি।

মদিনার দূত আনি দিল

 হাতে খলিফার ফরমান,

“সেনাপতি তব প্রাসাদতোরণে

 করহ অগ্নি দান।

“রচেছ প্রাসাদ ইরানি ধরনে

 বিলাস-লুব্ধ মন তব আদর্শ 

আখেরের নবী, খসরু কছু তো নন।

“খলিফার তুমি প্রতিনিধি সেখা করিতে প্রজার দেবা,

 তুমি যদি থাকো রুধিয়া তোরণ তাদোর দেখিবে কেবা?

‘জ্বালাও প্রাসাদ।” 

সেনাপতি সাদ নিল সে আদেশ শিরে,

 অম্লর শিখা নিমেষে জ্বলিয়া উঠিল তোরণ ঘিরে।

কবিতা ৩১ থেকে  ৩৫

কবিতা:৩১

মায়া বসু  সম্রাট ও সন্ন্যাসী

নৃপতি বিবস্থান-

প্রজাবৎসল সংযত চেতা বড়ই ধর্মপ্রাণ।

 ঘন অরণ্যে সারাদিন ধরে মৃগয়ায় অবশেষে

 শ্রান্ত ক্লান্ত ফিরিতেছিলেন সন্ধ্যায় নিজ দেশে।

মাঝখানে তিনি শিবিকায়, 

আর সৈন্যেরা দুই দলে আগে 

পিছে তাঁর অস্ত্রশস্ত্র শিকার লইয়া চলে।

 কিছুদূর এসে পাত্রমিত্র চেয়ে দেখে বিশ্বয়ে, 

গভীর বনেতে সন্ন্যাসী এক সমাধিমগ্ন হয়ে 

মুদিত চক্ষে পথের উপরে একা বসে যোগাসনে, 

পরমারাধ্য ইষ্ট মন্ত্র জপ করে একমনে।

ত্যক্ত চিত্তে অমাত্য এক তাঁর কাছে গিয়ে কয়,

 “ধ্যান করিবার জায়গাটি বেশ পেয়েছেন মহাশয়। 

দেখুন চাহিয়া, পিছনে শিবিকা, নিজে রাজা সমাসীন,

 মাকপথ ছেড়ে সরে গিয়ে তাঁকে যাইবার পথ দিন?”

শুনে সেই কথা, চক্ষু মেলিয়া যোগীবর তাকে কয়,

 “তোমার রাজাকে বলো, 

হেথা এক মহারাজা বসে রয়।

 সহস্র কোটি জপ মোর শেষ না হবে যতক্ষণ, 

এক তিলও আমি নড়িব না জেনো, 

ছাড়িব না যোগাসন।”

শুনে তাপসের হেন নির্ভীক কথা,

 পাত্রমিত্র, রাজার মনেও জাগিল চঞ্চলতা।

 শিবিকা হইতে নামিলেন তিনি,

 বিচলিত অতিশয় “এতবড় কথা বলে যে সাধক,

 সে তো সাধারণ নয়।” 

প্রণমি তাপসে কহিলেন রাজা, 

“কে আপনি যোগীবর মুনি বলিলেন,

 “তর প্রশ্নের পরে দিব উত্তর। 

আগে বলো মোরে, তুমি কোন্ জন,

 কিবা তব পরিচয়?” বলিলেন রাজা,

 “আমি অভাজন সাধারণ নর নয়।

 রাজা বলে মোরে জানে এই দেশবাসী।” 

শুনিয়া সাধুর অধরে ফুটিল ঈষৎ মধুর হাসি।

 “রাজার উপরে মহারাজা আমি, 

এ-কথাও জেনো তুমি, 

রাজ্য আমার এ তিন ভূবন, 

এই অরণ্যভূমি।” মৃদু হেসে রাজা প্রশ্ন করেন,

 “মহারাজা যদি হন, সেনাদামস্ত অস্ত্রশস্ত্র তাহলে কোথায় কন?” 

বলিলেন যোগী শির করি উন্নত,

 “শত্রু থাকিলে সৈন্যে অপেত্র তবে প্রয়োজন হত। 

এ জগতে মোর কোনো শত্রুই নাই,

ওসব কাদেলা-যন্ত্রণা জ্বালা, কিছুই রাখিনি তাই।”

পরাজিত রাজা তবু বলিলেন,

 “কোথা তব কোষাগার। কোথায় প্রাসাদ, 

তোষাখানা আর অর্থের ভাণ্ডার? কই রাজবেশ?

 কোথায়-ব্য প্রজা? কোথায় সিংহাসন। 

কমণ্ডলু আর কৌপীনে কেন বুলি পরে বসে রন?” 

শিশুর মতন সরল হাস্যে এবার বলেন যোগী।

 “আমি সন্ন্যাসী হে মহারাজ, নহি তব সম ভোগী। 

খরচ কোথায়? কী করিব টাকা দিয়ে? 

কী করিব বলো কোষাগার আর অর্থের বোঝা বয়ে।

 প্রজাগণ মোর ছড়ায়ে রয়েছে সারাটি পৃথিবীময়, 

অরণ্যবাসী হিস্রে জীবেরা আমারে করে না ভয়।

“এই চরাচর অধিপতি আমি, এ মাটি সিংহাসন, 

এর চেয়ে দামি কোনো আসনেই নেই মোর প্রয়োজন।

 এ মরদেহের সাজসজ্জার কতটুকু দাম আছে? 

পরম রতন চিরসত্য সে লুকানো হৃদয়মাঝে। 

তুমি তো জানো না কত সম্পদে পূর্ণ এ বনতল, 

কত সেলতাহুরা, বৃক্ষ ও পাখি, কত ফুল কত ফল।

 এর চেয়ে দামি আর কিছু আছে নাকি? 

এ সাম্রাজ্য কোনোদিনও রাজ্য, আমাকে দেবে না ফাঁকি।

 “আমার রাজ্যে চির প্রশান্তি, স্থায়ী রবে চিরদিন, 

শত্রুর হাতে করসে হবে না, হবে নাকো বুলি লীন।

 তাই বলি শোনো, তুমি যদি রাজা, আমি তবে মহারাজ, 

বিলাসব্যসনে তুমি তো ব্যস্ত, ওতে মোর কোন কাজ।

“তাই বসে এই ধূলার সিংহাসনে,

 সারাদিন ধরে তাঁকেই যে আমি ডেকে যাই একমনে।

 সেই ‘একজন’ ছাড়া আমি আর শুনি নাকো কারও কথা, 

অন্য কাহারও আদেশ শুনিলে, পাই মনে বড় ব্যথা।”

সাধকের কথা শুনে শ্রদ্ধায় রাজা কর জুড়ি কন 

“অক্ষয় হোক হে প্রভু তোমার ধূলার সিংহাসন। 

নড়িতে হবে না সরিতে হবে না, থাকো তুমি অবিচল, 

পদব্রজেই আমি চলে যাব, লয়ে মোর দলবল।”

কবিতা:৩২

বেণু গঙ্গোপাধ্যায় দিগ্বিজয়

পরাক্রান্ত হোয়সলরাজ বীর সে সোমেশ্বর,

 বিঘ্নিজয়েতে বাহির হলেন পুলকিত অন্তর।

 পাণ্ডারাজ্য জয় অভিলাষ মনে,

 দক্ষ লক্ষ সৈন্য নিলেন সনে,

 চোল রাজাদের শির নত করা এমন কিছুই নয়,

 ম্যাব, কদর-এদেরে শিক্ষা দিতে হবে নিশ্চয়।

দাক্ষিণাত্যে চলিয়াছে যবে হোয়সল অভিযান,

 বিজয়ী বাহিনী বাড়য়ে চলেছে সোমেশরের মান।

 হঠাৎ ক্ষুদ্র জনপদে আসি, থামে পদাতিক, হয়, 

গজ, বাঁশি, ধনুশর হাতে কাকেরা সব অবরোধ করে পথ,

 বিজয়ী রাজ্যরে জানাইতে চাহে অকপটে জনমত।

রক্তচক্ষু সেনাপতি বলে, করসে করিব সব, 

হয় পথ ছাড়ো, নয় শুরু করো মরণ মহোৎসব।

বলিল মোড়ল, সে কেমন রাজা, 

বিনাদোষে দেয় প্রজাদের সাজা, 

শস্যক্ষেত্র মথিয়া যাহার মাতঙ্গশ্রেণী চলে,

 দুখী মানুষের দু’মুঠো আহার, তা-ও পায়ে পায়ে দলে।

হোয়সলরাজ শুনেন সে-কথা হস্তীপৃষ্ঠে থাকি, 

ত্বরা নামিলেন ভূতলে নৃপতি নত করি দু’টি আঁখি। 

জড়ায়ে ধরিয়া মোড়লে বক্ষে, বাঁধেন তাহারে নিবিড় সখ্যে,

 বলেন, সত্য বলিয়াছ ভাই, ত্রুটি আমাদের ক্ষমো,

 আজ হতে যত কৃষক হইল নৃপতির প্রিয়তম।

বিস্ময় মানে সৈন্যের দল, বিস্মিত গ্রামবাসী,

 অবনত শিরে কৃষকেরা পড়ে রাজার চরণে আসি।

 সোমেশ্বরের জয় অভিযান,

রচিল প্রীতিতে নূতন সোপান।

 হৃদয়ের দ্বারে লেখা হয়ে গেল প্রেমের দিগ্বিজয়, 

সে ছবি দেখিয়া দাক্ষিদাতা মেনেছিল বিস্ময়।

কাজী নজরুল ইসলাম [১৮৯৯-১৯৭৬] 

কবিতা:৩৩

উমর ফারুক

ইসলাম-সে তো পরশ-মানিক তারে কে পেয়েছে খুঁজি।

 পরশে তাহার সোনা হ’ল যারা তাদেরেই মোরা বুঝি। 

আজ বুঝি-কেন বলিয়াছিলেন শেষ পয়গম্বর- ‘

মোর পরে যদি নবী হ’ত কেউ, হত সে এক উমর।’

অর্ধ পৃথিবী করেছ শাসন ধূলার তথতে বসি

 খেজুরপাতার প্রাসাদ তোমার বারে বারে গেছে খসি’

 সাইমুম-ঝড়ে। পড়েছে কুটির, তুমি পড়োনিকো নুয়ে, 

ঊর্ধ্বে যারা-পড়েছে তাহারা, তুমি ছিলে খাড়া ছুঁয়ে। 

শত প্রলোভন বিলাস বাসনা ঐশ্বর্যের মদ করেছে 

সালাম দূর হাতে সব, ছুঁইতে পারেনি পদ। 

সবারে ঊর্ধ্বে তুলিয়া ধরিয়া তুমি ছিলে সব নিচে, 

বুকে করে সবে বেড়া করি পার,

 আপনি রহিলে পিছে।

হেরি পশ্যাতে চাহি

তুমি চলিয়াছ রৌদ্রদগ্ধ দূর মরুপথ 

বাহি যেরুষালেমের কিল্লা যেথায় আছে 

অবরোধ করি বীর মুসলিম সেনাদল তব বহু দিন মাস এরি’। 

দুর্গের দ্বার খুলিবে তাহারা বলেছে শত্রু শেষে- 

উমর যদি গো সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর দেয় এসে।

হায়রে, অর্ধেক ধরার মালিক আমির উল মুমেনিন

 শুনে সে-খবর একাকী উষ্ট্রে চলেছে বিরামহীন সাহরা পারায়ে। 

ঝুলিতে দুখানা শুকনো ‘খুবষ’ কটি, 

একটি মশকে একটুকু পানি খোমা দু’তিন মুঠি।

 প্রহরী-বিহীন সম্রাট চলে একা পথে উটে চড়ি চলছে 

একটি মাত্র ভৃত্য উষ্ট্রের রশি ধরি।

মরুর সূর্য উর্ধ্বে আকাশে আগুন বৃষ্টি করে, 

সে আগুন হাতে খই সম ফোটে বালুকা মরুর পরে।

কিছুদূর যেতে উউ হতে নামি কহিলেন ভৃত্যে, 

‘ভাই পেরেশান বড় হয়েছ চলিয়া। 

এইবার আমি যাই উষ্ট্রের রশি এরিয়া অগ্নে, 

তুমি উঠে বসো উটে’, 

তপ্ত বালুতে চলি যে চরণে রক্ত উঠেছে ফুটে।

নৃত্য দক্ত চুমি কাঁদিয়া কহিল, 

‘উমর, কেমনে এ আদেশ করো তুমি?

 উষ্ট্রের পিঠে আরাম করিয়া গুলাম রহিবে বসি’ 

আর হেঁটে যাবে খলিফা উমর ধরি সে উটের রশি।”

খলিফা হাসিয়া বলে, ‘তুমি জিতে গিয়ে বড় হতে চাও, 

ভাইরে, এমনি ছাল। রোজ কিয়ামতে আল্লাহ যেদিন

 কহিবে উমর। ওরে করিনি খলিফা মুসলিম জাঁহা

 তোর সুখ তরে তোরে। 

কী দিব জওয়াব, কী করিয়া মুখ দেখাব রসুলে ভাই?

 আমি তোমাদের প্রতিনিধি শুধু। 

মোর অধিকার নাই আরাম সুখের-মানুষ হইয়া

 নিতে মানুষের সেবা। ইসলাম বলে সকলে সমান, 

কে বড় ক্ষুদ্র কেবা।

ভূত্য চড়িল উটের পৃষ্ঠে উমর ধরিল রশি,

 মানুষে স্বর্গে তুলিয়া ধরিয়া ধুলায় নামিল শশী। 

জানি না, সেদিন আকাশে পুষ্প-বৃষ্টি হইল কিনা,

 কী গান গাহিল মানুষে সেদিন বন্দি বিশ্ববীদা।

 জানি না, সেদিন ফেরেস্তা তব করেছে কি না স্তর অনাগত কাল

 গেয়েছিল শুধু ‘জয় জয় হে মানব।

                   [সংক্ষেপিত]

কবিতা:৩৪

ইব্রাহিম ও কাফের

সূর্য ডুবেছে অন্তসাগরে-আরক্ত পশ্চিম, 

জলস্পর্শ করেনি এখনও-সাধক ইব্রাহিম। 

একজনও আজ অতিথি ভিখারি আসেনি গৃহের দ্বারে।

 অনাথ ফকিরে না তুমি’ তাপস খায় না যে একেবারে।

ভূতোরা সব অতিথির খোঁজে ঘুরে ঘুরে অবশেষে, 

এক অভাগায় দেখিতে পাইল, মরুপ্রান্তরে এসে। 

অশীতিবর্ষ বয়স তাহার-দুর্বল অতি দীন, কৃষ্ণ, পঙ্গু,

 গলিতদন্ত, বধির, সৃষ্টিহীন।

তিন দিন তার জুটেনি অন্ন, বেঁচে আছে জল পিয়ে,

 করি সমাদর আনে কিঙ্কর তাহারে প্রভুর গৃহে।

 সাধক তাহারে তুষিতে আহারে দিয়ে নানা উপচার,

 বহুব্যজ্ঞান শোভিত অম্ল বরিল সমুখে তার। 

মুখে গ্রাস তুলি করিল বৃদ্ধ ভোজনের উদ্যোগ, 

ঘটিল সহসা এ হেন সময়ে অপূর্ব দুর্যোগ।

‘হা হা করে উঠো কহিল গরজি তাপস “সর্বনাশ।

কী করো, কী করো, কোরো না ভোজন, রাখো গ্রাস, রাঁখো গ্রাস।

ইমান মানো না। এক পা কররে, হইয়াছ এত বুড়ো, 

জগদীশ্বরে না স্মরি পিও গিলিতে যেতেছ মূক্ত।” 

কহিল অতিথি, “মানি না ও রীতি, আগে তো বাঁচাই প্রাণ, 

অগ্নিরে পুঁজি-মানি নাকো মোরা আর কোনো ভগবান।” 

শুনিয়া তাপস কহিল কাফের, দূর হও, দূর হও, 

মোর এ গৃহে অন্নজলের তুমি অধিকারী নও।”

দৈববাণীতে হইল জানিত হেনকালে “আরে মুঢ়,

 আমি যারে নিজে সহিয়া গিয়াছি আশিটি বছর পুরে।

 খাইতে দিয়াছি, মোরাই দুনিয়ায় করিতে দিয়াছি বাস,

 একবেলা তারে সহিতে নারিলে, কাড়িলে মুখের গ্রাস। 

কাফের সে-ও তো মোর সন্তান, দেখিলে না হায় বুকে, 

হুতাশনে যেবা উপাসনা করে সে-ও যে আমারে পূজে।”

সুনির্মল বসু [১৯০২-১৯৫৭ 

কবিতা:৩৫

হবুচন্দ্রের আইন

হবুচন্দ্র রাজা বলেন গবুচরে ঢেকে “

আইন জারি করে দিও রাজ্যেতে আজ থেকে, 

মোর রাজ্যের ভিতর হোক, না বনী, হোক না গরিব, 

ভদ্র কিংবা ইতর,

কাঁদতে কেহ পারবে নাকো, 

যতই মরুক শোকে- হাসবে আমার যতেক প্রজা, 

হাসবে যত লোকে। শাস্ত্রী-সেপাই, 

প্যায়দা-পাইক ঘুরবে ছদ্মবেশে, 

কাঁদলে কেহ, আনবে বেঁষে, শাস্তি হবে শেষে।”

ভয় যদি কেউ পায় কখনো দৈতা, 

দানা, জুজুর, কিম্বা যদি পিছলে পড়ে মুণ্ডু

 ফাটিয়ে কেহ, গাড়ির তলে কারুর যদি থেতলিয়ে যায় দেহ,

 কিম্বা যদি কোনো প্রজার কানদুটি যায় কাটা, 

কিম্বা যদি পড়ে কারুর পিঠের ওপর কাঁটা; 

সত্যিকারের বিপন্ন হয় যদি, তবুও কি সবাই তারা হাসবে নিরবধি।”

বাজা বলেন-

আমার আইন সকল প্রজার মানতে হবে তবু। 

কেউ যদি হয় খুন বা জখম, হাড়িতে ঘুণ করে, 

পাঁজরা যদি কাঁকরা হয়ে মজ্জা করে পড়ে, 

ঠাগটি ভায়ে, হাতটি কাটে, ভূঁড়িটি যায় ফেঁসে, 

অন্ধকারে স্কন্ধ-কাটা ঘাড়টি ধরে ঠেসে,

 কিম্বা যদি ধড়ের থেকে মুণ্ডুটি যায় উড়ে, 

কাঁদতে কেহ পারবে নাকো বিশ্রী বিকট সুরে।

মরতে যদি হয় কখনো, মরতে হবে হেসে।”

পিটিয়ে দিল ঢ্যাড়া গধু, রাজার আদেশ পেয়ে-

 “কাঁদতে কেহ পারবে না আর, পুরুষ কিল্ডা মেয়ে।

যতই শোকের কারণ ঘটুক হাসতে হবে তবু,

 আদেশ দিলেন রাজাধিরাজ হবু রাজার আদেশ কেউ যদি যায় ভুলে,

চড়তে হবে শুলে।”

সেদিন হতে হবুর দেশে উল্টে গেল রীতি,

হররা-হাসির হট্টগোলে, অট্টহাসির অট্টরোলে,

জাগল তুফান নিতি।

হাসির যেন ঝড় বয়ে যায় রাজ্যখানি জুড়ে, 

সবাই হাসে যখন-তখন প্রাণ-কাঁপানো সুরে।

প্যায়দা পাইক ছদ্মবেশে হব্দ অবিরত, 

সবাই হাসে আশে পাশে, বিষম খেয়ে ভীষণ হাসে,

 আস্তাবলে সহিস হাসে, আস্তাকুঁড়ে মেথর, 

হাসছে যত মুমুর্ষুরা হাসপাতালের ভেতর। 

আইন জেনে সর্বনেশে ঘাটের মড়া উঠছে হেসে, 

বেতো-রোগী দেতো হাসি হাসছে বসে ঘরে, 

কাশতে গিয়ে কেশো-বুড়ো হাসতে শুরু করে।

 হাসছে দেশের ন্যাংলাফ্যাচাং হ্যাংলা হাঁদা যত, 

গোমড়া উদো-নোংরা-ছেঁপো-চ্যাংরা শত শত কেউ কাঁদে না কান্না পেলেও,

 কেউ কাঁদে না গাট্টা খেলেও, 

পাঠশালাতে বেত্র খেয়ে ছাত্রদলে হাসে,

কান্না ভুলে শিশুর দলে হাসছে অনায়াসে।

রাজা হবু বলেন আবার গরুচন্দ্রে ডাকি, “

আমার আদেশ মেনে সবাই আমায় দিলে ফাঁকি? 

রাজ্যে আমার কাদার কথা সবাই গেল ভুলে, 

কেউ গেল না শুলে?

একটা লোকও পেলাম না এইবাবে শূলে চড়াই যারে।

 নিয়ম আমার কড়া প্রতিদিনই একটি লোকের শুলেতে চাই চড়া।

 যা হোক, আজই সাঁঝের আগে শুলে দেবার তরে- 

যে করে হোক একটি মানুষ আনতে হবে বরে।”

গবুচন্দ্র বল্লে হেসে চেয়ে রাজার মুখে- 

“কাঁদতে পারে এমন মানুষ নাই যে এ মুহূকে, 

আমি না-হয় নিজেই কেঁদে আইন ভেঙে 

তবে চড়র শুলে, মহারাজের নিয়ম রক্ষা হবে। • কিন্তু একী, 

আমিও যে কাঁদতে গেছি ভুলে, কেমন করে চড়ব তবে শুলে?”

রাজা বলেন, “

তোমার মতো মূর্খ দেখি না-যে, 

কাঁদতে তুমি ভুলে গেলে এই ক’দিনের মাঝে। 

এই দ্যাখো না কাঁদে কেমন করে”- 

এই না বলে হবু রাজা কেঁদে ফেল্লেন জোরে।

মন্ত্রী গবু বল্লে তখন, “এবার তবে রাজা- 

নিজের আইন পালন করুন, গ্রহণ করুন সাজা।” 

বলেন হবু, “আমার হুকুম নড়বে না একচুল, 

আমার সাজা আমিই নেব তৈরি করো শূল।”

 কাজী কাদের নওয়াজ (১৯০৯-১৯৬৪]

কবিতা ৩৬ থেকে  ৩৯

কবিতা:৩৬

শিক্ষকের মর্যাদা

বাদশা আলমগীর:

কুমারে তাঁহার পড়াইত এক মৌলবী দিল্লির।

 একনা প্রভাতে গিয়া দেখেন বাদশা-শাহজাদা 

এক পাত্র হস্তে নিয়া ঢালিতেছে পানি গুরুর চরণে 

পুলকিত হদে আনত-নয়নে শিক্ষক শুধু নিজ হাত

 দিয়া নিজেরই পায়ের বুলি ধুয়ে মুছে সব 

সাফ করিছেন সঞ্চারি অঙ্গুলি।

শিক্ষক মৌলরী ভাবিলেন আজি নিস্তার নাহি

 যায় বুঝি তার সবি। দিল্লিপতির পুত্রের করে

 লইয়াছে জল চরণের ‘পরে, স্পর্ধার কাজ 

হেন অপরাধ কে করেছে কোনকালে।

 ভাবিতে ভাবিতে চিন্তার রেখা দেখা দিল তাঁর ভালে।

হঠাৎ কী ভাবি উঠি

কহিলেন, “আমি ভয় করি নাকো, 

যায় যাবে শির ছুটি, শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ

 সবার দিল্লির পতি সেতো কোন ছার, 

ভয় করি নাকো, ধরি নাকো ধার, মান আছে মোর বল, 

বাদশা শুধালে শাত্রের কথা শুনার অনর্গল।

যায় যাবে প্রাণ তাহে

প্রশের চেয়ে যে মান বড় আমি বোঝাব শাহানশাহে।”

তার পরদিন প্রতে বাদশার দূত

 শিক্ষকে ডেকে নিয়ে গেল কেল্লাতে।

 খাস কামরাতে যবে শিক্ষকে ডাকি বাদশা কহেন,

 “শুনুন জনাব তবে, পুত্র আমার আপনার কাছে 

সৌজন্য কি কিছু শিখিয়াছে। বরং শিখেছে বেয়াদবি 

আর গুরুজনে অবহেলা, নহিলে সেদিন দেখিলাম যাহা স্বয়ং সকাল বেলা-

শিক্ষক কন-“জাহাপনা, আমি বুঝিতে পারিনে হায়,

 কী কথা বলিতে আজিকে আমায় ডেকেছেন নিরালায়।”

বাদশা কহেন, “সেদিন প্রভাতে দেখিলাম আমি 

দাঁড়ায়ে তফাতে নিজ হাতে যবে চরণ আপনি করেন প্রক্ষালন, 

পুত্র আমার জল ঢালি শুধু ভিজাইছে ও চরণ। 

নিজ হাতখানি আপনার পায়ে বুলাইয়া সযতনে 

ধুয়ে দিল নাকো কেন সে চরণ, স্মরি ব্যথা পাই মান।”

উচ্ছ্বাস ভরে শিক্ষক আজি দাঁড়ায়ে সগৌরবে কুর্নিশ

 করি বাদশাহে তবে কাহন উচ্চরবে- “আজ হাতে 

চির-উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির, সত্যই তুমি মহান

 উদার বাদশা আলমগীর।”

ফররুখ আহমদ [১৯১৮-১৯৭৪] 

কবিতা:৩৭

নৌফেল বাদশা ও হাতেম তা’য়ীর কিস্সা

নৌফেল বাদশার হিংসুটে মন হিংসায় ছটফট করে সারাক্ষণ,

 চায় শুধু খ্যাতি-নাম দেয় ঢের দিরহাম পায় না তবু সে নাম চায় সে যেমন।

দিকে দিকে শোনে শুধু হাতেমের যশ, 

অথচ তেমন তার হয়নি বয়স,

মানুষকে ভালোবেসে খিদমত করে এসে চায় 

না সে প্রতিদান-সাধক, তাপস।

সকলেই বলে: দাতা হাতেম তা’র্থীর 

স্বভাব নম্র যেন গড়া সে মাটির, সূর্যের

 মতো দান করে যায় অফুরান্ ভালোবাসা

 ছাড়া কিছু জানে না সে ধীর। দরিয়া-নারাজ

 তার দিলটা উদার ছোট বড় সকলেরি দেয়

 অধিকার, সকলি সমান কাছে ঠোঁটে হাসি 

লেগে আছে। সকলেরে ভালোবাসে বান্দা ঘোদর।

হিংসায় নৌফেল হয় চঞ্চল, বলে, “হাতেমের 

যশ করিব বিফল, জঙ্গী ফউজ নিয়ে লড়ব সামনে

 গিয়ে দেখব বাজুতে তার কতখানি বল।”

হাতেম বলেন শুনে, “শোনো যত ভাই নামের 

গরজে আমি করি না লড়াই, আমি যদি লড়ি

 তবে দেশটা বিরান হবে, মারা যাবে বহু লোক, হাব না ভালাই।”

এই কথা ব’লে তিনি ছেড়ে গিয়ে দেশ ঘোরেন

 বিদেশে যেন রাহী দরবেশ, নৌফেল জুড়ে তম্ভ বলে,

 “সেই বদবখত কতবড় খ্যাতিমান বোঝা গেল বেশ।”

এদিকে হাতেম তাগী ঘুরে বহু পথ মানুষের কাছে পান সেরা হাজ্জৎ,

 সকলেই ভালোবাসে সকলেই কাছে আসে, ত্যাদী বলে সকলেই করে খিদমৎ।

নৌফেল শুনে ফের রাগে যে বেদম,

উজিরকে ডেকে গালি দেয় সে বিষম,

বলে ফিরে, “যত লোক

কারু দেখি নাই চোখ

বুদ্ধিতে সকলেই রীতিমতো কম।

“দান করি আমি, বাড়ে হাতেমের নাম।

হাজার দিনার দেব, লাখ দিরহাম,

হাতেমের মুণ্ডুটা

আন্ত অথবা টুটা

দিতে যদি পারে কেউ পাবে এই দাম।”

সকলেই শুনে শুধু করে “হায় হায়,”

 হাতেমের বদলায় মাথা দিতে চায়, 

নৌফেল রেগে খুন বলে, “ছাড়ো গুন গুন, 

হতেমের মাথা চাই লক্ষ টাকায়।” 

চমকায় সে-কথায় দুনিয়ার লোক, 

ছল ছল করে ওঠে সকলের চোখ, 

কেউ শুনে পায় ভয় বাড়ে কারো সংশয়, 

নিভে যায় কারো আশা-বিজুলি কলক।

এক বুড়া কাঠুরিয়া জঙ্গলে ঘর ছেলেদের 

সাথে নিয়ে যায় সে শহর,

ইনামের কথা শুনে কাঠুরের ছেলে-বউ চায় যে খবর।

স্বন্দের জাল বুনে

একদিন সেই বুড়া হল বেকারার, 

পেল না গহিন বনে পথ খুঁজে তার,

 হঠাৎ সামনে এসে দেখাল যে পথ 

হেসে শাজাদা-সূরত এক যুবা জোরওয়ার।

সান্ত্বনা দিয়ে ঢের সে নওজোয়ান 

দেখাতে সঠিক পথ হয় আগুয়ান, 

শুধায় সে ভালোবেসে কী কারণে 

কাঠুরিয়া আছে পেরেশান।

বুড়ার কুটিরে এসে

কাঠুরের বউ কয়, “শুনেছি ইনাম। 

হাতেমের মাথা দিলে লাখ দিরহাম

বৃদ্ধার কথা শুনে সেই যুবা কয়,

“হাতেম আমার নাম, নাই সংশয়,

এ মাথার দাম পেলে

যদি কিছু সুখ মেলে

কোট নাও শির তবে, নাই কোনো ভয়।”

কেঁদে কয় কাঠুরিয়া, “ভূখা ইনসান

আমার বরাতে নাই পথে পথে ঘুরি নিয়ে ভাগ্যটি বাম।” 

কোথায়-বা খুঁজে পাই

হাতে পারে কমজোর, 

নয় বে-ঈমান, 

ইনাম চাই না পেতে কেটে যাক সবরেতে

 দু’দিনের দুনিয়াটা রাতের সমান।”

 হাতেম শোনে না, বলে, “

নৌফেল শার দরবারে নিয়ে 

তবে চলো এইবার, তুমি সাথে নাহি 

গেলে যাব আমি অবহেলে সেখানেই

 পাবে তুমি ইনাম তোমার।”

নৌফেল বাদশার শাহি দরবারে বসেছে

 ওমরা ঢের কাতারে কাতারে, মাঝখানে

 মসনদ সবচেয়ে উঁচুপদ বসেছেন সুলতান 

তারি একধারে।

চলে দান খয়রাত, আচার-বিচার করে যান 

সুলতান নাই তো বিকার সবশেষে সে যুব্যকে 

কন ডেকে এক ফাঁকে “কোথা হতে এলে তুমি,

 কাজ কী তোমার?”

শাজাদা-সুরত কন, “

তুমি জেনে নাও হাতেম আমার নাম,

 ছিলাম উত্তাও, আমার মাথার দান দেবে

 যত দিরহাম। মাথা কেটে নিয়ে ভুখা বৃদ্ধকে দাও।”

হাতেমের কথা শুনে কাঁদে হাজেরান, 

তলোয়ার ছুড়ে ফেলে কাঁদে দ্বারোয়ান, 

আহাজারি আফসোস করে দিয়ে সব দোষ 

নৌফেল বাদশাকে বলে, “বে-ঈমান।”

নতমুখে নৌফেল তত্বের পর কী জানি কী 

ভাবি বসে সভার ভিতর, তাজ-তখত ছেড়ে 

উঠে তারপর যায় ছুড়ে টেনে নেয় অচেনাকে বুকের উপর।

হাতেম তায়ীর কাছে বলে সে তখন,

“মাথা দিয়ে জিতে যাবে, ভেবেছ এমন, 

তার চেয়ে নাও আজ তোমারি এ শাহি তাজ। 

করো দান অফুরান হচ্ছা যেমন।

আশরাফ সিদ্দিকী [১৯২৭]

কবিতা:৩৮

রহিম

রূপকথা নয় কোনো

ইতিহাস নয় কোনো-

একটি ছেলের মাটির ছেলের

 মাটির কাহিনী শোনো।

বোশেখের দিন শান্ত আকাশ 

রূপসা গাঁয়ের কোলে- সবুজ 

ধানের কোটি কিশলয় হিমশিম

 বায়ে দোলে। মাঠভরা ধান, 

ঘাটভরা ধান, বাটিভরা ধান হাসে- 

খোদার করুণা ধান শিষ হয়ে রূপসা 

গেরামে ভাসে। মাঠপানে চেয়ে দুখাই 

মোড়ল হুক্কা টানিছে জোরে ধূমা ঘোর 

কাশে-মনের আকাশে আশার ধূম্র ঘোরে। 

হানিফ মুনসী জোনাব মিয়াকে ডেকে কহে মিয়াভাই। 

বান্দার তরে খোদার এবার দয়ার সীমানা নাই। 

জীর্ণ কুটিরে শীর্ণ কৃষল সোনালি স্বপন আঁকে- 

সোনার ফসল দুলছে এবার রাপস্য গাঁয়ের বাঁকে।

ঈশান কোণেতে জানিল সহসা গুরু গুরু গুরু গুরু।

 বজ্র বিষাণে কাপিল ধরণী বাদল হইল শুরু।

 দৈত্যের মতো কালো কালো মেঘ

 ছুটিছে আকাশময় পাঁচ দিন যায়-বৃষ্টি 

ঘামে না-সৃষ্টি কি পাবে লয়? 

দাওয়ায় বসিয়া নিঝুম চাধি কাল যাপে 

শঙ্কায় হায়রে নসিব। মাবুদ তোমার লীলাখেলা বোঝা দায়।

কাঙ্ক্ষা ভুবন-কালস্সা আকাশ… ভেকেরা বাজায়।

 মোদের নায়ক রহিম তখন কায়ার করিয়া ফাঁক 

পাতার মাথাল মাথায় করিয়া মত্ত ধুতিয়া কাঁধে- মৎস্য

 ধরিতে জোর পায়ে চলে খলিসা কুঁড়ির বাঁধে।

ভূত পিশাচ আর দৈত্য দানবে ডরে না সে 

কন্তু জানি নয়নে তাহার সত্যের আলো বুকে কোরানের বাণী।

 সুস্থ সবল কিশোর রহিম সুগঠিত কনু মন 

লাঠিখেলাতেও তাহার লাঠিই ঘুরে চলে বন্ধন। 

ভীষণ ঝাল্টা মাথাল বাগায়ে রহিম চলেছে ধীর

বদ বম বম্ শব্দ উঠেছে কোথা 

যেন গম্ভীর শব্দ কিসের। রহিম ভাবিছে

 মনে গণে পরমাদ হায়রে কপাল। ভয়ানক

 চলে খলিস্য কুঁড়ির বাঁধ ভেঙে গেছে আজ

-দৈভোর মতো জল ছোটে কলোকল 

রাতের ভেতর ডুবে মুছে যাবে সোনালি ফসল দল।

 সোনালি ফসল-প্রাদের ফসল-খলিসা কুড়ির ধান- 

এ ধানের সনে বাঁচা মরা বাঁধা হাজারো চাষির প্রাণ। 

গতবার গেছে ঘোর অজন্ম্ম্য ফসল ওঠেনি ঘরে 

পথে পথে কত সোনার পরান অনাহারে গেছে করে।

 রহিম চলেছে পরানে তাহার শত বেদনার ঢেউ- দূরে 

দূরে গ্রাম-কাহারে ডাকিবে? শুনিবে কি ডাক কেউ?

সোনালি ফসল-প্রাণের ফসল-খলিসা কুড়ির ধান- 

এ ধানের সনে বাঁচা মরা বাঁধা হাজারো চাষির প্রাণ।

 ধানের ক্ষেতের ঘাড় খুঁজি খুঁজি তাড়িয়া বটের শাখা

– রহিম কেবল ব্যাধের মুখেতে বারে বারে দেয় ঢাকা।

 বারে বারে শুধু জঙ্গল কুড়ায়ে ছুড়ে ফেলে অবিরল শাবাশ।

 শাবাশ। ওই তো বুঝি বে থেমে গেছে কললো।

হায়রে বিধাতা। কী হ’ল আবার। আবার ছুটিছে জল- 

রহিমের মনে জেগে উঠে পুনঃ বেদনার কোলাহল। 

ঝাঁপায়ে পড়িল ।স্রাতের মুখে সে প্রাণপণে দিয়ে পিঠ- 

রুধি দিল বারা। সুদূর আকাশে তারকারা মিট মিট- 

জ্বলে জ্বলে জ্বলে নিভে গেল পুনঃ-নিভে গেল 

নিশাকর শদ শম্ শম ঝটিকা মেয়েরা ছেয়ে চলে অশ্বর।

… রহিম তখনো স্রোতের মুখেতে বুঝিতেছে অনিমেহ-

 বীরে ধীরে বীরে পাঁকের মাঝারে ডুবিতেছে তার দেহ। 

অচেনা বনের কুসুমের মতো একটি সোনার প্রাণ। 

কেউ জানিল না-কেউ দেখিল না হ’ল দেখা অবসান। 

প্রবালের মতো আপনারে তাজি একটি গাঁয়ের ছেলে- 

রূপসা গাঁয়ের মানুষের লাগি আপনারে দিল ঢেলে। 

রূপকথা নয় জানি-

ইতিহাস নয় জানি-

তবুও জানায়ো-তোমার নয়নে যদি করে থাকে পানি।

কবিতা:৩৯

চন্দনা আয়মনা

চন্দনাদের বাসা ছিল শ্যামবাজারের মোড়ে- 

আয়মনাদের বাসা ছিল ঠিক তাহারই জোড়ে। 

সকাল সাঁঝে অষ্টপ্রহর নিতুই জানালায় রাঁধতে

 শুতে এখর প্রখর সদাই দেখা যায়। সাত সকালে

 ঘুম ভাঙিয়া চন্দনা কয়: “মাগো। আয়মনা সই এখনও ঘুম। 

সকাল হল, জাগো।” ঘুম ভাজিয়া আয়মনা সই মুচকি হেসে চায়

– চন্দনা কয়: “বাপরে সখী কতই ঘুম যায়। ভুলেই গেছ আজ

-যে ভোরে মোদের পুতুল বিয়ে সকাল সকাল এসো কিন্তু 

পুতুল কনে নিয়ে।” তাক ডুমাডুম বাজনা বাজে চন্দনাদের

 ছাতে পুতুল বিয়ে শেষ হয়ে যায় বাদ্যি গানের সাথে। 

আয়মনারা মুসলমান আর চন্দনারা হিদু- এসব কথা

 কন্তু তারা ভুলেও জানেনি তো।

আয়মনা সই মাকে তাহার বলত মাসিষন সকাল সাঁঝে

 নিতুই তাহার খাবার নিমন্ত্রণ। চন্দনাও মাকে তাহার বলত

 মাসিমণি- খাবার হলেই তাহারো ডাক পড়ত তখখনি।

 আয়মনারা মুসলমান আর চন্দনারা হিদু- এসব 

কথা কহু তারা ভুলেও ভাবেনি তো।

আয়মনা আর চন্দনা সই ইস্কুলে যায়। ক্লাসে- 

রোজই তারা পড়তে বসে এ ওর পাশে পাশে। 

বড়দি কন: মেয়ে তো নয় দুইটি মাণিকজোড়- 

বাবারা কন: বৃন্দাবনের যুগল ননি চোর। 

তাপর সেই আগস্ট মাসে শহর কলিকাতা। 

দুইটি খুকি ফিরছে বাড়ি হাতে শেলেট খাতা। 

হঠাৎ কখন কাছেই কোথা “আল্লাহু আকবার”

 “বন্দে মাতরম” কানিতে কাঁপল চারিধার। 

মিষ্টি মধুর যে আজান আর বন্দে মাতরম হৃদয়

 ভরায় এ নহে সে-এ যেন সেই যম।

বিকেলবেলা দেখল সর বক্ষে লচুর ঢল। 

পথের ধারে ঘুমিয়ে আছে দুইটি শতদল।

কিসের তার, কিসের দোষে, 

এমন কচি প্রাণে বলতে পারো কেমন করে ভয়াল ছোরা হানে।

 কেমন মানুষ কেমন পরান কেমন 

তাদের আঁখি এমন বুকে হানতে ছোরা হাত কাঁপিল নাকি।

অনেক দিবস ওদের বাসার খোঁজ রাখিনি কোনো হঠাৎ 

সেদিন কলেজ স্ট্রিটে চলতে গিয়ে পুনঃ চন্দনা ও 

আয়মনাদের বাবার সনে দেখা শুকায়নিকো চোখের

 কোণে আজও অশ্রুরেখা। ওরা দুজন অশ্রুচোখে কী 

বলেছেন বলি: ‘চন্দনা ও আনুর মতো এমন ফুলের

 কলি বিনাদোষে করল যারা মায়ের বুক হীনা জীবন 

ভারে তোমরা তাদের করবে শুধু ঘৃণা।…

কিসের হাসি, কিসের খুশি, কিসের জীবন আশা- 

ভাই যদি-না ভয়ের তরে লুটায় ভালোবাসা। কিসের হাসি,

 কিসের খুশি, কিসের অহংকার- ভাই যদি-না ভয়ের তরে

 লুটায় স্নেহধ্যর। বলো-এমন কথা বলো-মায়ের মুখের কথা-

 যেই কথাতে দুলবে শুধু বনবকূলের লতা। এমন মণিমেলা 

শুধু গড়বে পরান দিয়ে পরান ভারে যেথায় সবে খেলবে পুতুল বিয়ে। 

এমন জগৎ আনবে তুমি যেথায় বারো মাস- 

পাখির মতো সকল মানুষ তুলবে কলহাস।।।

 

Home
E-Show
Live TV
Namaz
Blood
Job